৩. সিতাংশু চলে যাওয়ার পর

০৫.

সিতাংশু চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ দু-হাতে মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে থাকে অদিতি। সেই বিকেল থেকে একের পর এক বিস্ফোরক ঘটনাগুলি তার শালীনতা ভদ্রতা এবং সৌজন্যের বোধগুলিকে একেবারে চুরমার করে দিয়েছে। একটু আগে যে ভাষায় সিতাংশুকে সে আক্রমণ করেছে, যেভাবে তাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে, এখন সেসব ভাবতে গিয়ে এক ধরনের গ্লানি বোধ করতে থাকে। পরক্ষণেই মনে হয়, এটা না করে তার উপায়ই বা কী ছিল? লোকজন ডেকে লোকটাকে ঘাড়ধাক্কা দিতে দিতে এবং বেদম মারতে মারতে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিলেই ভালো হত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি রয়েছে তার, একটা নামকরা কলেজের সে অধ্যাপিকা। অদিতির যা শিক্ষাদীক্ষা এবং রুচি তাতে একটা বিশেষ লেভেলের নীচে তার পক্ষে নামা অসম্ভব।

একসময় উত্তেজিত স্নায়ুগুলো জুড়িয়ে এলে আস্তে আস্তে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে বাইরের প্যাসেজে চলে আসে অদিতি। আর তখনই দেখতে পায় দশ ফুট দূরত্বে ওপরে ওঠার সিঁড়িটার মুখে দাঁড়িয়ে আছে বরুণ এবং মৃগাঙ্ক। অবশ্য রমাপ্রসাদ আশেপাশে কোথাও নেই।

সিতাংশুর সঙ্গে কথা বলার সময়ই অদিতির মনে হয়েছিল, কাছাকাছি কোথাও রয়েছে। বরুণরা। তার ধারণা যে আগাগোড়া নির্ভুল, হাতেনাতেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। সে চোখ বুজে বলে দিতে পারে, সিতাংশুর সঙ্গে তার যা যা আলোচলা হয়েছে–সবটাই বরুণরা শুনেছে। কেননা এই আলোচনার ওপর তাদের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে।

সিঁড়ির কাছে এসে বরুণ এবং মৃগাঙ্ককে ভালো করে লক্ষ করতেই চমকে ওঠে অদিতি। দুই ভাইয়ের চোখে এই মুহূর্তে ঘাতকের দৃষ্টি।

প্রথমটা ভয় পেয়ে যায় সে। পরক্ষণেই স্বয়ংক্রিয় কোনো পদ্ধতিতে নিজের মধ্যে অদম্য এক দৃঢ়তা অনুভব করে। দুই ভাইকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে। বরুণদের পার হয়ে যাবার পর, পেছনে না-ফিরেও অদিতি টের পায় ভাইদের চোখ থেকে আগুন ঝরছে।

দোতলার ল্যান্ডিং-এর কাছে আসতে দেখা গেল ওধারের বিশাল বারান্দায় মাথায় হাত দিয়ে একটা চেয়ারে ঘাড় গুঁজে বসে আছেন রমাপ্রসাদ। তাঁর পাশে হেমলতা। চিরদিনের ভীরু মাকে এই মুহূর্তে আরও শঙ্কিত এবং সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে। একটু দূরে শ্বাসরুদ্ধের মতো দাঁড়িয়ে আছে দুই বউদি-বন্দনা আর মীরা। ওদের দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে, এইমাত্র এ-বাড়িতে কোনো মারাত্মক পারিবারিক বিপর্যয় ঘটে গেছে।

ভয়ে ভয়ে হেমলতা ডাকেন, বুবু এদিকে আয়

সিঁড়ি দিয়ে তেতলার দিকে উঠতে উঠতে অদিতি বলে, শাড়ি-টাড়ি পালটে আসছি মা। নারী-জাগরণ-এর অফিসে চাঁপাকে রেখে আসার পর পোশাক-টোশাক বদলাবার সময় পাওয়া যায়নি। সারাদিনের ধুলোবালি ঘাম আর গ্যাসোলিনের ধোঁয়া-মাখা শাড়ি-ব্লাউজ গায়ে জড়িয়ে আছে। ওগুলো না-ছাড়া পর্যন্ত বিশ্রী লাগছে অদিতির।

তেতলায় উঠতেই কোত্থেকে দুর্গা ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। বলে, পিসিমা তোমাকে ডাকছে ছোটদি–

অদিতি ঠিকই করে রেখেছিল, সবার আগে মৃণালিনীর সঙ্গে দেখা করে সিতাংশুর সঙ্গে তার যা যা কথা হয়েছে, জানাবে।

সে বলে, পিসিকে বল দশ মিনিটের ভেতর আসছি।

মৃণালিনীর ডানপাশে অদিতির ঘর। সোজা সেখানে চলে আসে সে।

ঘরটার মাঝখানে সিঙ্গল-বেড খাটে ধবধবে বিছানা। একধারে জানলা ঘেঁষে লেখাপড়ার টেবিল-চেয়ার। আরেক দিকের গোটা দেয়াল জুড়ে পর পর অনেকগুলো আলমারি। সেগুলো বইয়ে-ঠাসা। আরেক দেয়ালের গায়ে নীচু নীচু র‍্যাক। সেগুলোও ভর্তি হয়ে বই উপচে পড়ছে। এমনকী মেঝেতেও প্রচুর ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ, প্যামফ্লেট ডাঁই হয়ে আছে।

আরেক দেওয়ালে ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল। জামাকাপড়ের আলমারি। অন্য সব ঘরের মতো এ-ঘরেও অ্যাটাচড বাথরুম।

আলমারি থেকে কাঁচানো শাড়ি জামা-টামা বের করে বাথরুমে ঢুকে পড়ে অদিতি। দ্রুত মুখ-টুখ ধুয়ে, পোশাক বদলে ঠিক দশ মিনিটের ভেতর মৃণালিনীর ঘরে চলে আসে।

মৃণালিনী প্রায় দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলেন। হাত বাড়িয়ে অদিতিকে তার পাশে বসিয়ে বলেন, কী কথা হল ওই বদমাসটার সঙ্গে? তাঁর চোখে মুখে কণ্ঠস্বরে অসীম ব্যগ্রতা এবং উৎকণ্ঠা, ওদের ফাঁদে পা দিসনি তো?

অদিতি হাসে, না পিসি। তারপর বাবা এবং দাদাদের ড্রইংরুম থেকে বের করে দিয়ে সিতাংশুর সঙ্গে যেসব কথাবার্তা হয়েছে, সংক্ষেপে জানিয়ে দেয়।

ঠিক বলেছিস। মৃণালিনীর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে থাকে। আমার এই অবস্থা! বিছানায় পড়ে না-থাকলে আমি নিজেই পশুটাকে যা বলার বলতাম। তোকে ওর কাছে পাঠাতাম না। তা হারে–

বলো—

তোর বাপ আর দাদারা ওদের শয়তানিটা কাঁচিয়ে দেবার পর কিছু বলেনি তোকে?

এখনও বলেনি। তবে সবাই আমার জন্যে বন্দুক শানিয়ে বসে আছে। একবার গেলেই

আমি তোর বাপ-দাদাদের হাড়ে হাড়ে চিনি। ওরা হয়তো রাগারাগি কিংবা কাকুতি-মিনতি করে এ বিয়েতে তোকে রাজি করাতে চেষ্টা করবে। কিন্তু ওদের কোনো কথা শুনবি না।

মৃণালিনী যে তার কতবড় হিতাকাঙ্ক্ষী, অদিতি নতুন করে আবার অনুভব করে। রমাপ্রসাদের স্বার্থের কারণে তার জীবন, তার ভবিষ্যৎ যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য তাঁর দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের শেষ নেই। অদিতি বলে, তুমি ভেবো না পিসি।

খাওয়া-দাওয়া তো হয়নি তোর?

না।

যা, খেয়ে আয়।

অদিতি উঠে পড়ে, জানো পিসি, আজ নারী-জাগরণ-এর কাজে একটা বস্তিতে গিয়ে দারুণ ব্যাপার ঘটে গেছে। ফিরে এসে তোমাকে বলছি।

নারী-জাগরণ-এর কাজকর্ম সম্পর্কে প্রবল উৎসাহ মৃণালিনীর। আবহমানকাল ধরে এ দেশের মেয়েরা লাঞ্ছিত হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে এখানে নারীর অসম্মান। প্রতিদিন এখানে নারীহত্যা, নারীনিগ্রহ। এইসব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করেছে নারী-জাগরণ। মৃণালিনী মনে মনে নিজেকে এই যুদ্ধের একজন সৈনিক মনে করেন। তাঁর আক্ষেপ, পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। নইলে বাকি জীবনটা নারী-জাগরণ-এর কাজেই কাটিয়ে দিতেন।

ঘর থেকে বেরুতে না পারলেও অদিতি রাত্তিরে বাড়ি ফিরলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খবর নেন মৃণালিনী। নারী-জাগরণ-এর মেম্বাররা মেয়েদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে প্রায় রোজই হয় মিছিল বার করছে, নইলে স্ট্রিট কর্নার মিটিংয়ের বক্তৃতা দিচ্ছে, কিংবা সমাজের নানা স্তরের লোকজন ডেকে এনে সেমিনার বসাচ্ছে। মিছিলে কী হল, কে কী বক্তৃতা দিল–সমস্ত কিছু না-জানা পর্যন্ত তাঁর ঘুম আসে না।

নারী-জাগরণ-এর খবর তো আছেই, তাছাড়া রাস্তায় চলতে ফিরতে অদিতি কী দেখল, কার সঙ্গে কী কথা হল, কলেজে গিয়ে কটা ক্লাস করল, ইত্যাদি ইত্যাদি সব জানা চাই মৃণালিনীর।

আসলে অদিতি আর দুর্গা ছাড়া তাঁর ঘরে এ-বাড়ির কেউ বিশেষ আসে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাথার দিকের জানলা দিয়ে আকাশের একটা টুকরো, বাড়ির সামনে ঝোঁপঝাড়ে বোঝাই খানিকটা জমি, ভাঙা গেটের বাইরে পিচের রাস্তা, রাস্তার ওধারে দু-চারটে বাড়ি-টাড়ি ছাড়া এই শহরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। এর বাইরে বিশাল পৃথিবীর সঙ্গে যে সামান্য যোগাযোগটুকু এখনও বজায় আছে তা অদিতির জন্যই। প্রতিদিন রাত্তিরে নানা মানুষ এবং অসংখ্য ঘটনার খবর এনে অদিতি পঙ্গু শরীরের ভেতরে তাঁর উন্মুখ অস্থির মনকে সতেজ করে তোলে।

মৃণালিনী বলেন, আচ্ছা, যা।

.

দোতলায় নেমে এসে অদিতি দেখতে পায় দুই বউদি, মা আর বাবা অবিকল কিছুক্ষণ আগের মতো দাঁড়িয়ে এবং বসে আছে। এবার অবশ্য দাদারাও আছে। সে যখন তেতলায় ছিল তখন বরুণরা নীচের সিঁড়ি থেকে উঠে এসেছে।

অদিতি লক্ষ করে, মা ছাড়া সবার চোখে-মুখেই অদ্ভুত এক কাঠিন্য আর নিষ্ঠুরতা ফুটে রয়েছে। বোঝা যায়, এরা তাকে সহজে ছাড়বে না। অদিতি নিজের স্নায়ুগুলোকে টান টান রেখে সতর্ক ভঙ্গিতে অপেক্ষা করতে থাকে।

আচমকা বরুণ চিৎকার করে ওঠে, আমাদের এভাবে অপমান করার মানে কী?

পালটা চেঁচিয়ে উঠতে পারত অদিতি। তা না করে খুব সংযত গলায় বলে, এই প্রশ্নটা তো আমার করার কথা।

কী বলতে চাস তুই?

বলতে চাই, একটা ডিবচ বদমাস স্কাউন্ট্রেলকে তোমরা আমার কাঁধে চাপিয়ে দেবার জন্য বাড়ির ভেতর নিয়ে এসেছ। আমাকে কোন লেভেলে নামতে চাইছ, ভালো করে ভেবে দেখেছ?

রমাপ্রসাদ এই সময় চড়া গলায় বলেন, সিতাংশু একজন রেসপেক্টবল বিজনেসম্যান। তার সম্বন্ধে ভদ্রভাবে কথা বল

মৃগাঙ্ক ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে ছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, একজ্যাক্টলি।

সোজা রমাপ্রসাদের চোখের দিকে তাকিয়ে অদিতি বলে, রেসপেক্টবল! যার দু-দুটো স্ত্রী ডিভোর্স করে চলে গেছে, একটা স্ত্রী মার্ডার হয়েছে।

মৃগাঙ্ক মাঝখান থেকে গলা চড়িয়ে বলে, কে বললে মার্ডার? হঠাৎ আগুন লেগে মারা গেছে। ইটস অ্যান অ্যাকসিডেন্ট

কোনটা অ্যাকসিডেন্ট আর কোনটা মার্ডার, সেটুকু বুঝবার মতো বয়েস এবং বিদ্যাবুদ্ধি আমার হয়েছে। কোনো সাফাই গাইবার দরকার নেই। অদিতি ঘুরে মৃগাঙ্কর দিকে তাকায়।

বরুণ ওধার থেকে বলে ওঠে, মার্ডার হলে কোর্টে কেস উঠত না? আইন ওকে ছেড়ে দিত?

অদিতি এবার বরুণের দিকে ফিরে দাঁড়ায়, টাকা থাকলে পাঁচটা খুন করেও যে পার পাওয়া যায়, তুমি কি জানো না? তীব্র বিদ্রুপে তার ঠোঁট বেঁকে যায়।

বরুণ পলকের জন্য থতিয়ে যায়। পরক্ষণেই গলার স্বর কয়েক পর্দা চড়িয়ে দেয়, আমি জানি সিতাংশু সম্পর্কে কে এই স্ক্যান্ডাল রটাচ্ছে। তাকে বাড়ি থেকে দূর করে দেব।

রমাপ্রসাদ তীব্র গলায় বলেন, সেই যে পয়তাল্লিশ বছর আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসল, তারপর থেকে সারাটা জীবন জ্বালিয়ে যাচ্ছে। এবার আমি আর বরদাস্ত করব না, সহ্যের সীমা একেবারে পার হয়ে গেছে।

মৃগাঙ্ক বলে, বাবা, পিসি এ-বাড়িতে থাকলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তুমি কিছু একটা ব্যবস্থা করো। আমাদের খাবে, আর দিন রাত আমাদেরই ক্ষতির মতলব করবে, এটা কিছুতেই হতে দেব না। একটা উইচ।

নিজের অজান্তেই অদিতির মুখ শক্ত হয়ে ওঠে। ছোটদা, সব ব্যাপারের একটা লিমিট আছে, তুমি সেটা ছাড়িয়ে গেছ। যে ভাষাটি নিজের পিসি সম্পর্কে বললে তাতে সন্দেহ হয় ভদ্রবংশে জন্মেছ কিনা। তারপরই রমাপ্রসাদের দিকে ফিরে বলতে থাকে, বাবা, পিসি আমার ওয়েল উইশার, তাই আগে থেকে ওই ডিবচ বদমাসটার সম্পর্কে ওয়ার্নিং দিয়েছে। তোমাদের একটা কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি, উইলে দাদু এ-বাড়ির একটা অংশ পিসিকে দিয়ে গেছে। তাকে তাড়াবার চেষ্টা করলে ফলাফল মারাত্মক হবে। আমি কিন্তু কাউকে ছেড়ে দেব না। বলতে বলতে মৃগাঙ্কর দিকে ফেরে সে, জীবনে নিজে কপয়সা রোজগার করেছ যে পিসিকে খাওয়াবার কথা বললে! পিসির সমস্ত খরচ আমি দিয়ে থাকি। ডোন্ট ফরগেট

শাট আপ। গলার শির ছিঁড়ে চেঁচিয়ে ওঠে মৃগাঙ্ক।

তোমার ভয়ে? অনেস্টলি যে একটা পয়সা রোজগার করতে পারেনি, গ্যাম্বলিং যার একমাত্র প্রফেশান, তার মতো ডার্টি বাজে লোকের ধমকে আমাকে চুপ করে যেতে হবে?

মৃগাঙ্ক হিতাহিত জ্ঞানশুন্যের মতো অদিতির ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে রমাপ্রসাদ বলেন, বাবলু, তুই এখান থেকে যা। যা বলার আমি বুবুকে বলছি।

তাঁর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে আর দাঁড়ায় না মৃগাঙ্ক। হিংস্র চোখে অদিতিকে দেখতে দেখতে দুমদাম পা ফেলে ওধারের একটা ঘরে গিয়ে ঢোকে।

রমাপ্রসাদ এবার তাঁর স্ট্র্যাটেজি বদলে ফেলেন। ভয় দেখিয়ে চড়া মেজাজে তাঁর এই একগুঁয়ে মেয়েটিকে কোনোভাবেই বাগ মানানো যাবে না। তাঁকে এগুতে হবে সুকৌশলে, ঠান্ডা মাথায়।

শান্ত, সস্নেহ ভঙ্গিতে রমাপ্রসাদ বলেন, রাগারাগি, হইচই করে কিছু লাভ আছে? তুই আমার কাছে এসে বস। আয়–

এটা বাবার যে একটা চতুর চাল, বুঝতে অসুবিধে হয় না অদিতির। তবু দেখাই যাক রমাপ্রসাদ তার জন্য ফাঁদটা নতুন করে কীভাবে সাজান। সে পায়ে পায়ে বাবার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে পড়ে। বলে, কী বলবে বলো–

দ্যাখ, মিনুর মতো আমরা যে তোকে ভালোবাসি, এটা নিশ্চয়ই মানিস।

অদিতি চুপ করে থাকে।

রমাপ্রসাদ আবার বলেন, মিনু তো ঘর থেকে বেরুতে পারে না। ওকে কে সিতাংশু সম্পর্কে উলটোপালটা খবর দিয়ে গেছে। তাই শুনে ও একটা খারাপ ধারণা করে নিয়েছে। আমি বলছি, সিতাংশু খুব ভালো ছেলে–জেম অফ এ বয়।

এবারও উত্তর দেয় না অদিতি।

রমাপ্রসাদ চোখের কোণ দিয়ে মেয়ের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে করতে বলেন, বিরাট কনস্ট্রাকশনের ফার্ম ওর। লাখ লাখ টাকা ইনকাম। আমি বলছি, এ বিয়ে হলে তুই সুখে থাকবি।

কিন্তু বাবা

কী?

আমি তো ওই লোকটকাকে অপমান করে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছি।

রমাপ্রাসাদ হঠাৎ আশান্বিত হয়ে ওঠেন। ভাবেন, এটা বুঝি অদিতির রাজি হওয়ার লক্ষণ। বলেন, সে জন্যে তুই ভাবিস না। আমি গিয়ে বোঝালে এ ব্যাপারটা ও আর মনে রাখবে না। তা হলে কালই ওদের বাড়ি চলে যাই?

অদিতি হাত তুলে বলে, দাঁড়াও দাঁড়াও, আরও কিছু কথা তোমার সঙ্গে বাকি আছে।

কী রে?

বড়দা ছোটদা আর তুমি, তিনজনে সিতাংশু ভৌমিকের কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা ধার নিয়েছ-এটা নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবে না।

রমাপ্রসাদ ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। বলেন, হ্যাঁ। মানে শেয়ার মার্কেটের ব্যাপারে–এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ থেমে যান।

অদিতি বলে, তুমি শেয়ার মার্কেটে ফাটকাবাজি করে আর দাদারা জুয়া রেস, এইসব করে টাকাটা উড়িয়ে দিয়েছে। আমার সঙ্গে সিতাংশু ভৌমিকের বিয়ে হলে টাকাটা আর ফেরত দিতে হবে না, কী বলে?

বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকেন রমাপ্রসাদ।

অদিতি বলতে থাকে, তার মানে, সাড়ে চার লাখ টাকায় তোমরা আমাকে একটা বজ্জাতের কাছে বেচে দিতে চাইছ।

রুদ্ধ গলায় রমাপ্রসাদ বলেন, কী যা তা বলছিস বুবু! আমি তোর বাবা

তাঁকে শেষ করতে দেয় না অদিতি। তীক্ষ্ণ গলায় বলে, এখানেই তো আমার অদ্ভুত লাগছে। তোমরা শেষ পর্যন্ত আমাকে একটা প্রপার্টি ভাবছ। টাকার বদলে আমাকে একটা বদ লোকের হাতে তুলে দিতে চাইছ। কিন্তু তা হবে না। আর

হঠাৎ ভীষণ অসুস্থবোধ করেন রমাপ্রসাদ। তাঁর হাত-পায়ের জোড় যেন আলগা হয়ে যেতে থাকে। শিথিল গলায় কোনোরকমে বলেন, আর কী?

তোমরা যদি ভেবে থাকো, তোমাদের ধার শোধ করার জন্য সিতাংশু ভৌমিককে এই বাড়ি বেচে দেবে, তা আমি কিছুতেই করতে দেব না। তোমরা জুয়া ফাটকা খেলে টাকা ওড়াবে, তার জন্যে বাকি সকলে পথে বসবে, সেটা হতে দেব না। দাদুর উইল আমি দেখেছি। এ-বাড়ি বিক্রি করা যাবে একটি মাত্র কন্ডিশানে। বিক্রির সময় এই ফ্যামিলির যারা বেঁচে থাকবে তাদের সবার কনসেন্ট না-পাওয়া গেলে কেউ বাড়ি ব্রিকি করতে পারবে না। দু-একজনের খামখেয়ালিতে পারিবারিক প্রাপার্টি নষ্ট করে অন্যদের কিছুতেই পথে বসানো চলবে না।

রমাপ্রসাদ চমকে ওঠেন। তাঁর আর্থারাইটিসের কষ্টটা হঠাৎ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সামলাতে সামলাতে কাতর গলায় বলেন, কিন্তু

কী?

বাড়িঘর বা আমাদের ধারদেনার কথা থাক। বাবা হিসেবে তোর ওপর আমার কিছু কর্তব্য তো আছে।

রমাপ্রাসাদ ঠিক কী বলতে চান, বুঝতে না পেরে অদিতি জিগ্যেস করে, কোন কর্তব্যের কথা বলছ?

রমাপ্রসাদ বলেন, তোর তো এবার বিয়ে দেওয়া দরকার।

কর্তব্যের ছদ্মবেশে রমাপ্রসাদ কী ধরনের তুখোড় চাল দিতে চাইছেন, ধরতে চেষ্টা করে অদিতি। হঠাৎ তার মনে হয়, রমাপ্রসাদ বুঝে ফেলেছেন সিতাংশুর সঙ্গে তার বিয়ে কোনোভাবেই ঘটাতে পারবেন না। তাই কি এ বাড়ি থেকে তাকে কৌশলে বার করে দিতে চাইছেন? সে এখানে থাকলে বাড়ি বিক্রির কনসেন্ট সবার কাছ থেকে সহজে আদায় করা যাবে না। অথচ এটা না বেচলে ঋণ শোধ করা অসম্ভব। ওদিকে টাকা ফেরত না পেলে সিতাংশু কিছুতেই ছাড়বে না। এতগুলো টাকা নিঃস্বার্থভাবে দান খয়রাত করার মতো মানুষ আর যে-ই হোক, সিতাংশু নয়।

সতর্কভাবে অদিতি বলে, বাবা, যে মেয়েদের পক্ষে বিয়েটা ভীষণ জরুরি, আমি কিন্তু তাদের মধ্যে পড়ি না। আমি মোটামুটি একটা চাকরি করি। আমি কারও ঘাড়ের ওপর বোঝ হয়ে নেই।

এতক্ষণ হেমলতা রমাপ্রসাদের পেছনে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটি কথাও বলেননি। এবার শ্বাসরুদ্ধের মতো বলেন, বুবু, দেশাচার বলে একটা কথা আছে, সেটা কি না মানলে চলে?

রমাপ্রসাদ তৎক্ষণাৎ সায় দেন, ঠিকই তো। মেয়েরা যতই লেখাপড়া শিখুক, যতই রোজগার করে স্বাবলম্বী হোক, তার বিয়ে না দিলে মা-বাপকে লোকের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়।

অদিতি স্থির চোখে রমাপ্রসাদকে দেখতে দেখতে বলে, কে কী বলল, সে-সব আমি গ্রাহ্য করি না। একটু থেমে আবার বলে, আচ্ছা বাবা, তোমরা কি বিয়ের নাম করে আমাকে এ বাড়ি থেকে তাড়াতে চাইছ?

কোমরে হাত চেপে দ্রুত খাড়া হয়ে বসেন রমাপ্রসাদ। বলেন, মানে?

আমি এখান থেকে চলে গেলে অন্যের ওপর প্রেসার দিয়ে বাড়ি বিক্রির কনসেন্ট আদায় করা অনেক সহজ হয়।

রমাপ্রসাদের মুখ-চোখ করুণ দেখায়। বিমর্ষ গলায় তিনি বলেন, তুই আমাকে কী ভাবিস বুবু? আমি এতটাই নীচে নেমে গেছি।

তার কথায় কতটা আন্তরিকতা এবং কতটা অভিনয়, অদিতি বুঝতে পারে না। সে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তের মতো বলে, ঠিক আছে, বাড়ি বেহাত না হলেই ভালো।

হেমলতা বলেন, কিন্তু তুই কি বিয়ে করবি না বুবু?

একটু চুপ করে থাকে অদিতি। তারপর খুব আস্তে বলে, বিয়ে করব না, এমন প্রতিজ্ঞা তো করিনি মা, নিশ্চয়ই করব। আর

আর কী?

আমার বিয়ের জন্য তোমাদের চিন্তা করতে হবে না।

আমরা চিন্তা না করলে বিয়েটা হবে কী করে?

ও ব্যাপারে আমি ভেবেছি। পরে তোমাদের জানাব।

মৃগাঙ্ক স্নায়ুগুলো টান টান করে অদিতিকে লক্ষ করছিল। এবার সে বলে, তুই কি বিকাশকে বিয়ে করবি বলে ঠিক করেছিস?

মৃগাঙ্কর দিকে মুখ ফেরায় অদিতি। শান্ত গলায় বলে, একটু ধৈর্য ধরো, পরে জানতে পারবে।

মৃগাঙ্ক অত্যন্ত বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ গলায় বলতে থাকে, নতুন করে জানাবার আর কিছু নেই। আমি সবই জানি। নিজের চোখে কতদিন দেখেছি ওই ছোকরার সঙ্গে ট্যাং ট্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। শুধু আমি একাই না, আমার বন্ধুরাও দেখে যা তা বলে।

অসহ্য রাগে মাথার ভেতর শিরা ছিঁড়ে যায় যেন অদিতির। ভাবে, চিৎকার করে উঠবে। কিন্তু প্রাণপণে নিজেকে সংযত রেখে কোনোরকম বিস্ফোরণ ঘটতে দেয় না।

মৃগাঙ্ক থামেনি, ছোকরার কোনো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। শুনেছি থাকার মধ্যে ভবানীপুরের থার্ড ক্লাস গলির ভেতর পুরোনো ভাঙাচোরা ছোট একটা বাড়ি। তা-ও একার না, ভাগের বাড়ি। এরকম একটা

অদিতি হাত তুলে মৃগাঙ্ককে থামিয়ে দেয়। গম্ভীর মুখে বলে, ছোটদা, আমি বাচ্চা মেয়ে নই। আমি কাকে বিয়ে করব, না করব, এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আর বিকাশ অত্যন্ত শিক্ষিত, একজন ভদ্রলোক। তার সম্মান রেখে কথা বলবে। সে আরও বলতে যাচ্ছিল, বিকাশ আর যাই হোক মৃগাঙ্কর মতো রেস বা জুয়ায় সর্বস্ব উড়িয়ে দেয় না। কী ভেবে শেষ পর্যন্ত আর বলে না।

মৃগাঙ্ক ভেংচে ওঠে, ভদ্রলোক। শিক্ষিত! আমি–

তাকে শেষ করতে দেন না রমাপ্রসাদ। বলেন, বাবলু, এত রাতে এরকম চেঁচামেচি আমার ভালো লাগছে না।

ঠিক আছে মৃগাঙ্ক আর দাঁড়ায় না, উত্তেজিতভাবে পা ফেলে ফেলে উত্তর দিকের একটা ঘরে গিয়ে ঢোকে।

দশ ফুট দুরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল মীরা। সে চাপা গলায় বলে, নিজের বিয়ের ব্যাপারে বাপ আর বড় ভাইদের সঙ্গে কোনো মেয়েকে এভাবে কথা বলতে আগে দেখিনি। নির্লজ্জ কোথাকার!

তীব্র মোচড়ে শরীরটা মীরার দিকে ঘুরে যায় অদিতির। ভেবেছিল, কোনো প্ররোচনাতেই সে উত্তেজিত হবে না বা ধৈর্য হারাবে না। কিন্তু এখন আর মাথাটা একেবারেই ঠান্ডা রাখা যাচ্ছে না। তীক্ষ্ণ গলায় সে বলে, তোমার চেয়েও আমি বেশি নির্লজ্জ! আমি তো বাবা আর দাদাদের সঙ্গে আলোচনা করছি। বিয়ের আগে তুমি এ-বাড়িতে কীভাবে এসে উঠেছিলে, মনে আছে?

অদিতির ইঙ্গিতটা মারাত্মক। বিয়ের আগে পেটে বাচ্চা নিয়ে মীরা যে এখানে চলে এসেছিল সেটাই নতুন করে জানিয়ে দিয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায় তার। রাগের মাথায় তার এই লেভেলে নেমে যাওয়া ঠিক হয়নি।

মীরা আকস্মিক আঘাতে প্রথমটা চমকে ওঠে। তারপর আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে প্রায় টলতে টলতে উত্তর দিকে তার ঘরে চলে যায়।

কিছুক্ষণের জন্য গোটা বাড়িটা স্তব্ধ হয়ে থাকে।

তারপর হেমলতা বলেন, অনেক রাত হল। সবাই এবার খেয়ে নেবে চলো।

বার বার ডাকা সত্ত্বেও বরুণ মৃগাঙ্ক মীরা বা বন্দনা, কেউ খেতে আসে না। মৃগাঙ্কর ছেলে চিকু আর মৃণালিনীকে সন্ধের পরই খাইয়ে দেওয়া হয়। অগত্যা রমাপ্রসাদ হেমলতা আর অদিতি দোতলার একধারে খাবারঘরে চলে যায়।

খাওয়ার ইচ্ছেটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নিঃশব্দে, পাতের ওপর ঘাড় গুঁজে রুটি তরকারি বা মাংসের নাড়াচাড়া করে এক সময় উঠে পড়ে অদিতি।

তেতলায় এসে প্রথমেই মৃণালিনীর ঘরে যায় অদিতি।

 মৃণালিনী তার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন। বলেন, নীচে এত চেঁচামেচি হচ্ছিল কেন রে?

এই মুহূর্তে একেবারেই কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না অদিতির। নেহাত মৃণালিনী তার জন্য জেগে থাকবেন, তাই আসতে হয়েছে।

অদিতি বলে, কাল শুনো পিসি। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।

অদিতির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে চেষ্টা করেন মৃণালিনী। বলেন, আচ্ছা যা, শুয়ে পড় গিয়ে। আর আমার ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যা।

অদিতি সুইচ টিপে ঘর অন্ধকার করে দেয়। তারপর বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।

.

০৬.

পরের দিন কলেজে পর পর চারটে ক্লাস ছিল অদিতির। একেকটা ক্লাসে প্রায় সত্তর-আশিজন মেয়ে। হিন্দি ফিল্মের ভিলেনের মতো গলার স্বর চড়ায় না তুললে লাস্ট বেঞ্চের ছাত্রীরা ক্লাস-লেকচার শুনতে পাবে না।

একটানা দুশো মিনিট গলায় ফেনা তুলে চেঁচিয়ে অদিতি যখন কলেজ থেকে বেরুল, চারটে বেজে গেছে। এই মুহূর্তে তার মাথা ঝিম ঝিম করছে।

অমিতাদি কাল বলে দিয়েছিলেন, আজ অবশ্যই যেন, নারী-জাগরণ-এর অফিসে একবার চলে আসে। কেন না, কাল ঢাকুরিয়ার বস্তি থেকে চাঁপাকে নিয়ে গিয়ে ওখানে রাখা হয়েছে। তার সম্বন্ধে কী করা যায়, আজ সেটা ঠিক হবে।

কলেজটা বড় রাস্তার ওপর। একটা বাস ধরে অদিতি যখন সাউথ ক্যালকাটায় নারী-জাগরণ-এর অফিসে পৌঁছোয়, সন্ধে হতে খুব দেরি নেই।

কাল বধূহত্যার প্রতিবাদে মিছিল বার করার কারণে প্রায় সব মেম্বারই হাজির ছিল। কালকের মতো অত ভিড় না থাকলেও বেশ কিছু মেম্বারকে আজও দেখা যাচ্ছে।

অমিতাদির ঘরে ঢুকতেই অদিতির চোখে পড়ে দশ-বারোজন মেম্বার এখানে রয়েছে। তাদের মধ্যে বিকাশ এবং চাঁপাকেও দেখা গেল। চাঁপা দুই হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে মেঝেতে বসে আছে।

অদিতিকে দেখে যারা বাইরে ছিল, তারাও এঘরে চলে আসে। এতজনের বসার মতো চেয়ার-টেয়ার নেই, বেশিরভাগই দাঁড়িয়ে থাকে।

অদিতি লক্ষ করে, সবার চোখে মুখেই প্রচণ্ড উত্তেজনা। তার ধারণা, সে এখানে আসার আগে মারাত্মক কিছু ঘটে গেছে।

অমিতাদি বলেন, বসো অদিতি

অমিতদির মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে ছিল কৃষ্ণা। সে উঠে গিয়ে অদিতির জন্য জায়গা করে দেয়। অদিতি বসতেই অমিতাদি বলেন, তোমার জন্যেই আমরা ওয়েট করছি। এত দেরি করলে?

অদিতি দেরিতে আসার কারণ জানিয়ে বলে, এখানে কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে–

অমিতাদি গম্ভীরমুখে বলেন, হ্যাঁ। চাঁপাকে নিয়ে খুব আনপ্লেজান্ট ব্যাপার ঘটে গেল একটু আগে।

ঘরের আবহাওয়া দেখে সেরকমই কিছু একটা মনে হচ্ছিল অদিতির। ভেতরে ভেতরে সে বেশ উৎকণ্ঠাই বোধ করে। বলে, কী হয়েছে?

নগেন নামে একটা লোক ড্রিংক করে এসে নানারকম কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে খিস্তি করছিল। লোকটার মুখ অত্যন্ত ফিলদি। যেমন তার জঘন্য ল্যাংগুয়েজ তেমনি তার চিৎকার। প্রথমে তো আমরা একেবারে স্টান্ড। পরে জানতে পারলাম, নগেন চাঁপার স্বামী। সে এসেছিল ওকে নিয়ে যেতে। আমরা অবশ্য তাড়িয়ে দিয়েছি। অমিতাদি বলতে থাকেন, সহজে কি যেতে চায়? একরকম জোরই করতে হয়েছে।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনে যাচ্ছিল অদিতি। ফুসফুসের আবদ্ধ বাতাস আস্তে-আস্তে বার করে দিয়ে সে বলে, তাড়িয়ে দিয়ে ভালোই করেছেন অমিতাদি। চাঁপাকে একবার হাতে পেলে লোকটা খুন করে ফেলবে। হি ইজ জেঞ্জারাস।

হ্যাঁ। দেখেশুনে মনে হল একটা অ্যান্টিসোশাল রাফায়েল। বলে একটু ভেবে আবার শুরু করেন অমিতাদি, নগেন আমাদের শাসিয়ে গেছে। কী বলেছে জানো?

দলবল জুটিয়ে এখানে হানা হবে। এরকম একটা জঘন্য টাইপের মাতাল, বজ্জাত এখানে এসে খিস্তিখেউড় করবে, হল্লা বাধাবে, ভাবতেই আমার বিশ্রী লাগছে। তা ছাড়া আশেপাশের লোকজন কী ভাববে বলো তো?

অদিতি বিষণ্ণ হাসে। বলে, অমিতাদি, মেয়েদের সামাজিক সম্মান আর মর্যাদা রক্ষার জন্যে আমরা রাস্তায় নেমেছি। কে কী বলল বা ভাবল তা নিয়ে মাথা ঘামালে চলে! কত ইনফ্লুয়েনশিয়াল মেম্বার রয়েছেন নারী-জাগরণ-এ। আমরা একটা বাজে লোককে শায়েস্তা করতে পারব না?

বিব্রতভাবে অমিতাদি বলেন, নিশ্চয়ই পারব। কিন্তু আমার একটা কথা ভেবে দেখো—

বলুন

এইসব অ্যান্টিসোশালদের পেছনে আমরা যদি সময় আর শক্তি ক্ষয় করে ফেলি, আসল কাজ কখন করব?

এটাই তো আসল কাজ অমিতাদি। এরকম জন্তুদের হাতেই তো বেশিরভাগ মেয়ে টরচারড হচ্ছে। এই মেয়েদের জন্যে যদি একটা আঙুলও তোলেন, নগেনের মতো বিস্টরা এখানে লাইন দিয়ে হানা দেবে। আর সেটা যদি হয়, বুঝব সঠিক কাজটাই শুরু করতে পেরেছি।

ডানদিকে একটা চেয়ারে বসে আছে এষা। তার বাঁ-হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। মেয়েটা চেইন-স্মোকার। এষার পরনে জিনস এবং ঢোলা শার্ট। ডান হাতের কবজিতে চওড়া স্টিল ব্যান্ডে চৌকো ঘড়ি। চুল ছেলেদের মতো করে ছাঁটা। এই পোশাক এবং সিগারেট বা চুলের ছাঁট পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে প্রোটেস্ট। সে এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। এবার বলে ওঠে, নারী-জাগরণ-এর একজাট কাজটা তা হলে কি এই হবে অদিতিদি?

কী?

আমরা অনবরত সোসাইটির টরচারড় মেয়েদের নিয়ে এসে শেলটার দেব, আর তাদের মাতাল স্বামীরা যখন ঝামেলা করতে আসবে তাদের টি করব?

অদিতি কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই অমিতাদি বলে ওঠেন, ও-সব পরে হবে। এখন চাঁপার প্রবলেমটা কী করে সলভ করা যায় সেটা ভাবো।

অদিতি এষার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অমিতাদিকে লক্ষ করতে থাকে।

 অমিতাদি বলে, চাঁপার ব্যাপারে একটা লিগ্যাল পয়েন্টও রয়েছে।

অদিতি জিগ্যেস করে, কী সেটা?

নগেন থানায় গিয়ে অভিযোগ করতে পারে, আমরা বে-আইনিভাবে তার স্ত্রীকে এখানে আটকে রেখেছি। তা হলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে, চিন্তা করে দেখো। কোর্ট উকিল উইটনেস–সব মিলিয়ে একটা ভীষণ কমপ্লিকেটেড ব্যাপার।

এ-দিকটা ভেবে দেখেনি অদিতি। সে একটু হকচকিয়ে যায়, পরক্ষণেই কী মনে পড়তে বলে ওঠে, চিন্তা নেই অমিতাদি, নগেন মরে গেলেও পুলিশের কাছে যাবে না।

মানে?

প্রথমত, সে হল, অ্যান্টিসোশাল, তার ওপর চাঁপা তার থার্ড ওয়াইফ। হিন্দু কোড বিল পাশ হবার পর ও কি গিয়ে বলবে, আমরা তিন নম্বর স্ত্রীকে নারী-জাগরণ গায়ের জোরে আটকে রেখেছে?

কিন্তু চাঁপা বলছিল, নগেনের পেছনে নাকি পলিটিক্যাল পার্টির লোকেরা রয়েছে। তারা এসে হাঙ্গামা করতে পারে।

আগে হাঙ্গামা করুক। তারপর দেখা যাবে। এত ভয় পেলে কোনো কাজই করা যাবে না অমিতাদি। যা চলে আসছে, মেয়েদের ওপর অত্যাচার, বধূহত্যা, পণপ্রথা, নারীর অসম্মান–এ সবই তা হলে চলুক। নারী-জাগরণ-এর তা হলে আর দরকার কী?

রমেন বাঁ-দিকে দাঁড়িয়েছিল। সে বলে, অদিতি ঠিকই বলেছে। গায়ে আঁচ লাগবে না, অথচ রাতারাতি সোশাল প্যাটার্ন পালটে যাবে, এটা হয় না অমিতাদি।

ডানদিকের শেষ মাথা থেকে হৈমন্তী বলে, আমরা কিন্তু আবার অন্যদিকে সরে যাচ্ছি। চাঁপার ব্যাপারটা ঠিক করে নেওয়া যাক।

হৈমন্তী নারী-জাগরণ-এর একজন অত্যন্ত সক্রিয় মেম্বার। নির্যাতিত মেয়েদের অসংখ্য সমস্যা, কলেজ আর ছাত্রছাত্রী নিয়ে তার জগৎ। এ-সবের বাইরে সে আর কিছু ভাবতে পারে না।

নারী-জাগরণ-এর পক্ষে থেকে একটা ত্রৈমাসিক বাই-লিংগুয়াল অর্থাৎ দ্বিভাষিক পত্রিকা বার করা হয়। দুই ভাষার একটি বাংলা, অন্যটি ইংরেজি। সমাজের নানা স্তরের মেয়েদের বিভিন্ন সমস্যা এখানে তুলে ধরা হয়। ছাপা হয় ধর্ষিতা লাঞ্ছিতা মেয়েদের ইন্টারভিউ। কাগজটির নাম নারী। এজন্য পশ্চিমবাংলা ছাড়াও দেশের বড় বড় শহরে নারীর অনেক মহিলা রিপ্রেজেন্টেটিভ রয়েছে। যদিও সম্পাদক হিসেবে এতে অমিতা সরকারের নামটা রয়েছে, আসল কাজটা করে হৈমন্তী-হৈমন্তী আচার্য। সে একটা কলেজে ফিজিক্স পড়ায়। খানিকটা রোগা হলেও, অত্যন্ত ধারালো চেহারা, চোখে বেশি পাওয়ারের চশমা।

অমিতাদি বললেন, অবস্থা এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে চাপাকে আর নগেনের কাছে পাঠানো যাবে না।

সবাই সায় দিয়ে জানায়, চাঁপাকে পাঠালে মারাত্মক ঝুঁকি নেওয়া হবে। চাঁপার যদি খারাপ কিছু হয়, আইনত না হলেও নৈতিক দিক থেকে নারী-জাগরণ-এর সভ্যরা এর জন্য ষোলআনা দায়ী থাকবে।

অমিতাদি বলেন, আমরা নাহয় চাঁপার দায়িত্ব নিলাম। একটা মানুষকে দুটো খেতে দেওয়া এমন কিছু ব্যাপার না। কিন্তু ও থাকবে কোথায়? আমাদের বেয়ারা একটামাত্র ঘরে বউ-বাচ্চা নিয়ে পেছন দিকে থাকে। চাঁপাকে সেখানে বা অফিসে রাখা সম্ভব না। একটা ইয়ং গার্ল একা অফিস বিল্ডিয়ে রাত্রিবেলা থাকবে, সেটা ঠিক না।

হৈমন্তী বলে, এতে ভীষণ রিস্কও থেকে যায়। আমরা কেউ এখানে রাত্তিরে থাকি না। চাঁপার ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে মানে কত রকমের বাজে এলিমেন্ট রয়েছে, তারা একেবারে বেপরোয়া। কে যে কী করে বসবে! হয়তো দরজা-টরজা ভেঙে ঢুকেই পড়ল। তার পরের কথা আর ভাবা যায় না। খারাপ কিছু ঘটে গেলে তার সব দায় কিন্তু এসে পড়বে আমাদের ওপর।

অমিতাদি আস্তে মাথা নাড়েন, তাহলে?

অদিতি এবার বলে, চাঁপাকে আমাদের কারও বাড়িতে আপাতত শেল্টার দিতে হবে।

অমিতাদি বলেন, আমার ফ্ল্যাটটা খুবই ছোট। আমার ভাই আর আমি থাকি। তাছাড়া রয়েছে একজন কাজের লোক। সেখানে একস্ট্রা আরেকজনকে নিয়ে গিয়ে ভীষণ অসুবিধে হবে।

কৃষ্ণা বলে, আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু পরশু কানাডা থেকে সেজদিরা এসেছে। বাড়ি একেবারে প্যাকড়। দশ বছর পর এল। ওরা মাস তিন-চারেক থাকবে। আমাদের অবস্থাটা কী, বুঝতেই পারছেন।

এরপর অন্য সবাই একে একে তাদের অসুবিধের কারণগুলি জানিয়ে দেয়।

একজন তো বলেই বসল, আমাদের বাড়িতে প্রচুর জায়গা। একজন কেন, দশজন বাড়তি লোকও থাকতে পারে। কিন্তু দ্যাট আন্টিসোশাল গুন্ডা, সে নিশ্চয়ই গিয়ে চড়াও হবে। বাবা এসব পছন্দ করবে না।

এটা ঠিক, অনেকের বাড়ি বা ফ্ল্যাটে জায়গা বেশ কম। যাদের বাড়ি বড় তারা নগেনের ভয়ে চাঁপাকে আশ্রয় দিতে চাইছে না। এ-জাতীয় সমাজবিরোধী ক্রিমিনাল টাইপের লোককে তারা এড়িয়ে চলতে চায়।

অদিতি অন্যমনস্কর মতো সবার কথা শুনছিল। শুনতে শুনতে তার চোখের সামনে অদৃশ্য সিনেমার স্ক্রিনে তাদের বাড়িটা ফুটে উঠছিল। সেখানে চাঁপার মতো পঞ্চাশজনের জায়গা হয়ে যাবে। কিন্তু বাবা মা এবং দাদারা কীভাবে চাঁপার ব্যাপারটা নেবে, ভেবে উঠতে পারছিল না অদিতি। দ্বিধার ভাবটা কাটিয়ে এক সময় মনঃস্থির করে ফেলে সে। বলে, ঠিক আছে, সবার যখন এত অসুবিধা তখন ওকে আমাদের বাড়িই নিয়ে যাচ্ছি। একটু থেমে বলে, আমি যখন চাঁপাকে বস্তি থেকে নিয়ে এসেছি তখন মরাল রেসপনসিবিলিটি আমার।

সবাই একসঙ্গে প্রায় গলা মিলিয়ে বলে, এভাবে ব্যাপারটা নিও না। রেসপনসিবিলিটি আমাদের সকলের। কিন্তু কিছু কিছু অসুবিধে তো প্রত্যেকের থাকে। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।

অদিতি উত্তর দেয় না।

 অমিতাদি আবার বলেন, চাঁপাকে মেয়েদের কোনো হোমে আপাতত রেখে দিলে কী হয়?

 অদিতি মনস্থির করে ফেলে। দৃঢ় গলায় বলে, না।

না মানে?

আমি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাই না। ওকে আজই আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। তারপর দেখা যাক, কী করা যায়–

অমিতাদি অস্বস্তি বোধ করেন। বলেন, চাঁপার ব্যাপারটা তোমাদের বাড়ির লোকেরা জানেন?

অদিতি বলে, এখনও জানে না। নিয়ে যাবার পর জানতে পারবে।

হঠাৎ এভাবে নিয়ে গেলে বলতে বলতে থেমে যান অমিতাদি। তিনি কী ইঙ্গিত দিয়েছেন, বুঝতে অসুবিধে হয় না অদিতির।

সে বলে, এ ব্যাপারে চিন্তা করবেন না অমিতাদি বলে চাঁপার দিকে চোখ ফেরায়, চল আমার সঙ্গে। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায়।

চাঁপাও হাঁটুর ফাঁক থেকে মুখ তুলে উঠে পড়েছিল। অমিতাদি বলেন, এখনই যাবে?

অদিতি মাথাটা সামান্য হেলিয়ে দেয়, হ্যাঁ।

আজ তো বস্তিতে যাওয়া হল না।

হ্যাঁ। কাল থেকে যাব।

অমিতাদি বলেন, তুমি আসার আগে একটা বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম।

অদিতি কোনো প্রশ্ন না করে অমিতাদির দিকে তাকায়।

তিনি থামেননি, তুমি বরং কিছুদিন বস্তিতে যেও না। পরশু থেকে আমরা যে সেমিনার করছি সেখানে মডারেটর হিসেবে থাকো।

অমিতাদির মনোভাব খুবই স্পষ্ট। বস্তিতে গেলে নগেন গন্ডগোল করতে পারে, সেই কারণে তিনি অদিতিকে সেখানে যেতে দিতে চান না।

পরশুদিনের সেমিনারটার কথা অদিতি জানে। দিল্লি বম্বে বাঙ্গালোর হায়দ্রাবাদ থেকে নাম-করা সোশিওলজিস্ট, ঐতিহাসিক, ইকনোমিস্ট, রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা এতে বক্তা হিসেবে যোগ দেবেন। তাছাড়া কলকাতার কয়েকজন সাংবাদিক এবং ঐতিহাসিককেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এজন্য তিনমাস আগেই একটা এয়ার-কন্ডিশনড হল ভাড়া করা হয়েছে। অবশ্য নারী-জাগরণ-এর এতে একটি পয়সাও খরচ নেই। একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি সেমিনারটা স্পনসর করছে। বড় বড় কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে শুরু করে ভালো হোটেলে বক্তাদের রাখার ব্যবস্থা, তাঁদের প্লেন ভাড়া, ইত্যাদি যাবতীয় দায়িত্ব ওই কোম্পানির।

অদিতির এ জাতীয় সেমিনার খুব একটা পছন্দ নয়। সে গ্লাস-রুটে গিয়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটা করতে চায়।

অদিতি বলে, আপনি কী ভাবছেন বুঝতে পারছি অমিতাদি। কিন্তু একটা অ্যান্টিসোশাল হুলিগানের ভয়ে যদি বস্তিতে যাওয়া বন্ধ করে দিই তার চেয়ে লজ্জার কিছু নেই। আজ আর হল না, কাল থেকে আবার বস্তিতে যাব। আপনি অন্য কারও ওপর সেমিনারের দায়িত্ব দিন। বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার যদি এখানে খুব জরুরি কাজ না থাকে, আমাদের সঙ্গে আসবে?

বিকাশ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, না, তেমন কোনো কাজ নেই। চলো–

.

রাস্তায় বেরিয়ে বিকাশ আর অদিতি পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। তাদের পিছনে চাঁপা।

অদিতি আগে কোনোদিন তাকে এভাবে ডেকে নিয়ে আসেনি। বিকাশ বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিল। সে বলে, আমাকে কিছু বলবে?

অন্যমনস্কর মতো মাথাটা সামান্য কাত করে অদিতি, হ্যাঁ।

 বলো–বিকাশ উদগ্রীব হয়ে তাকায়।

 কাল বলছিলে, তোমার ফ্ল্যাটটার পজেশান শিগগিরই পেয়ে যাবে

হ্যাঁ।

 এক উইকের মধ্যে পাওয়া কি সম্ভব?

 চেষ্টা করতে পারি। কেন বলোতো?

অদিতি বলে, মনে হচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি আমাকে একটা ডিসিশান নিতে হতে পারে।

শোনার পরও ব্যাপারটা বিকাশের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে সে। তার পরই টের পায় বুকের ভেতর হাজারটা ঘোড়া যেন ছুটে যাচ্ছে। মনে হয়, প্রবল রক্তচাপে তার হৃৎপিণ্ড যেন ফেটে যাবে। প্রবল আগ্রহে তার চোখ মুখ ঝকমক করতে থাকে। সে বলে সত্যি!

অদিতির চোখে মুখে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শান্ত নিস্পৃহ মুখে সে বলে, হ্যাঁ।

অদিতির এই একটি কথা শোনার জন্য কতদিন উন্মুখ হয়ে আছে বিকাশ। এমনকী কালও রাত্তিরে যখন অদিতিকে তাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় তখনও সে মনস্থির করে উঠতে পারেনি। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর হঠাৎ কী এমন ঘটে গেল যাতে তাকে এরকম স্পষ্ট একটি সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে?

যাই ঘটুক তা নিয়ে বিকাশের বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। অদিতি যে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে তাতেই সে খুশি।

আসলে বিকাশ যে নারী-জাগরণ-এর মেম্বার হয়েছিল তার একমাত্র কারণ অদিতি। মেয়েরা যে অনবরত লাঞ্ছিত হচ্ছে বা তাদের পুড়িয়ে মারার ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে যাচ্ছে, এসব নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায় না সে। নারীর মর্যাদা রক্ষার নৈতিক এবং সামাজিক দায় যে প্রতিটি শিক্ষিত সচেতন মানুষের থাকা উচিত, এমন কোনো বোধ তার মধ্যে বিশেষ নেই। তার লক্ষ্য শুধুই অদিতি। এতকাল পর সে তার ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার দাম পেতে চলেছে।

বিকাশ বলে, তাহলে তো

কী? নিরুৎসুক সুরে জিগ্যেস করে অদিতি।

ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে নোটিশ দিতে হয়।

 এ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।

ঠিক আছে। বিকাশ বলতে থাকে, হাউসিং বোর্ডে আমার কিছু জানাশোনা অফিসার আছে। কালই তাহলে ফ্ল্যাটটার ব্যাপারে তাদের ধরা যাক, না কী বলো

অদিতি উত্তর দেয় না। কেন না যা বলার আগেই বলে দিয়েছে। এক কথা বার বার বলা সে পছন্দ করে না।

হঠাৎ কিছু মনে পড়তে গলা অনেকটা নামিয়ে বিকাশ চাপা গলায় বলে, চাঁপাকে তো নিয়ে এলে। তার কী হবে?

হাঁটতে হাঁটতে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে বিকাশের দিকে তাকায় অদিতি। আস্তে করে বলে, কিছু একটা নিশ্চয়ই হবে।

এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে না বিকাশ।

একসময় ওরা বড় রাস্তায় চলে এল এবং কালকের মতো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল।

আধ ঘণ্টা পর অদিতিদের বাড়ির কাছে চাঁপা এবং অদিতিকে নামিয়ে দিয়ে বিকাশ ভবানীপুর চলে যায়।

.

০৭.

সামনের ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই একতলার বসার ঘরে সিতাংশু ভৌমিকের চড়া গলায় শাসানি কানে আসে।

আপনাদের একমাস সময় দিচ্ছি। এর ভেতর আমার টাকাটা শোধ করে দেবেন না। হলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

শুনতে শুনতে অদিতির হাসিই পায়। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে লোকটা আমূল বদলে গেছে এবং তার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে।

এবার দুই দাদা এবং বাবার ভীরু-মিনমিনে কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

আপনি শান্ত হোন। দয়া করে একটু ধৈর্য ধরুন। আমরা বুবুকে আরেকবার বোঝাব।

অদিতির রাগ হয় না, বরং মজাই লাগে। বাবা এবং দাদারা এখনও আশা করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে দিয়ে সিতাংশুর গলায় বরমাল্য পরাতে পারবে।

কিন্তু ফাঁপা রঙিন প্রতিশ্রুতিতে কাজ হয় না। সিতাংশু ঝানু ব্যবসাদার। লেনদেনের হিসেবটা তার কাছে পরিষ্কার। সে বলে, অদিতি যেভাবে কাল আমাকে অপমান করেছে, তারপর আর বোঝাবার দরকার নেই। আমার কথাটা মনে রাখবেন, এক মাসের মধ্যে টাকাটা ফেরত চাই।

প্যাসেজে অন্য দিনের মতো আজও টিমটিমে বালটা ওপর থেকে ঝুলছিল। সেটার তলা দিয়ে চাপাকে নিয়ে যেতে যেতে অদিতির চোখে পড়ে, বাঁ-পাশের ড্রইংরুমে সিতাংশু,

বাবা এবং দুই দাদা কালকের মতোই মুখোমুখি বসে আছে।

ওরা চারজনই ভেতর থেকে অদিতি আর চাঁপাকে দেখতে পেয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্যে সবাই চুপ করে যায় এবং তার মধ্যেই অদিতিরা সিঁড়ির কাছে চলে আসে। সেখানে কালকের মতোই দুর্গা দাঁড়িয়ে আছে। সে নিশ্চয়ই বাইরের ঘরের কথা শুনছিল।

দুর্গা তার এবং মৃণালিনীর গুপ্তচর। ভালো ট্রেনিং পেলে আরেকটি মাতাহারি হয়ে উঠতে পারত। অদিতি জানে, সে যদি এখন না-ও ফিরত সিতাংশুর আসার খবর আর বাবা-দাদাদের সঙ্গে তার কথাবার্তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেল মস্তিষ্কে নোট করে রাখত দুর্গা এবং শুতে যাবার আগে এসব জেনে যেত অদিতি।

দুর্গা বলে, সেই লোকটা আবার এসেছে ছোটদি।

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে অদিতি বলে, দেখলাম তো। তুই কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে আছিস?

তা আধঘণ্টা হবে।

বোঝা যায়, ঠিক আধ ঘণ্টা আগেই এ বাড়িতে ঢুকেছে সিতাংশু এবং সে এখান থেকে না যাওয়া পর্যন্ত দুর্গাকে নড়ানো যাবে না।

দুর্গা কথা বলতে বলতে বার বার চাঁপার দিকে তাকাচ্ছিল।

 এবার সে জিগ্যেস করে, এ কে গো ছোটদি?

 পরে শুনিস।

দোতলায় উঠতেই চোখে পড়ে, বাঁ-দিকের ঢালা বারান্দায় হেমলতা একটা জামায় বোতাম লাগাচ্ছেন। প্রায় রোজই বিকেলের পর মাকে এখানে বসে থাকতে দেখা যায়। হয় সেলাই-ফোঁড়াই কিছু করছেন, নইলে বই পড়ছেন বা চাল বাছছেন।

ছোট বউদি মীরা একধারে বসে হেমলতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আগামী শীতের কথা মাথায় রেখে একটা কার্ডিগান বুনছে।

একটু দ্বিধান্বিতভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে অদিতি। প্রথমে সে ভেবেছিল, চাঁপাকে নিয়ে সোজা তেতলায় নিজের ঘরে চলে যাবে এবং পরে এসে তার কথা সবাইকে জানাবে। কিন্তু এখন ঠিক করে ফেলে, আগেই চাঁপাকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে তার এ বাড়িতে থাকার কথা বলবে। তারপর ওপরে নিয়ে যাবে।

অদিতি চাঁপাকে বলে, এসো আমার সঙ্গে

দুজনে বারান্দায় এলে হেমলতা এবং মীরা চোখ তুলে তাকায়। মীরার মুখ মুহূর্তে থমথমে হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ এক হেঁচকায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেয় সে এবং দুমদাম পা ফেলে নিজের ঘরে গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। কাল রাতের সেই উত্তেজক ঘটনার পর মীরা তার সঙ্গে কথা বলছে না।

 হেমলতা অদিতির সঙ্গে একটি অচেনা বিবাহিত মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ঘুচ-সুতো আর জামা নীচে নামিয়ে রেখে আস্তে আস্তে বলেন, মেয়েটি কে রে?

অদিতি কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। মুখ ফেরাতেই অদিতির চোখে পড়ে, একসঙ্গে দুটো-তিনটে করে সিঁড়ি ভেঙে রুদ্ধশ্বাসে তেতলায় চলে গেল দুর্গা। একটু পরে বরুণ, মৃগাঙ্ক এবং রমাপ্রসাদ উঠে এসে সোজা দোতলায় চলে আসেন।

রমাপ্রসাদ বেশ নরম গলায় অদিতিকে বলেন, খানিকক্ষণ আগে তোকে আসতে দেখলাম। আজ তোর মুড কেমন আছে রে বুবু?

এসব কীসের ভূমিকা, মোটামুটি আন্দাজ করতে পারে অদিতি। বাবা বা দাদারা খুব সম্ভব স্ট্র্যাটেজিটা পালটে ফেলেছে। সে ভেতরে ভেতরে সতর্ক হয়ে যায়। বলে, এখনও পর্যন্ত ভালোই আছে। এরপর যদি তোমরা খারাপ করে দাও, আলাদা কথা—

তোর সঙ্গে একটা কাজের কথা ছিল বলতে বলতে হঠাৎ চাঁপার দিকে নজর চলে যায় রমাপ্রসাদের। কপালটা সমান্য কুঁচকে যায় তার। পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাঁপাকে দেখতে দেখতে বলেন, মেয়েটিকে তো চিনলাম না।

অদিতি বলে ওর নাম চাঁপা।

তা এখানে—

 আমি ওকে নিয়ে এসেছি।

 কিছুই বুঝতে পারছিলেন না রমাপ্রসাদ। রীতিমতো অবাক হয়েই জিগ্যেস করেন, হঠাৎ?

অদিতি বলে, তোমরা বসো। ওর কথা তোমাদের শোনা দরকার।

রমাপ্রসাদ বলেন, মেয়েটির কথা পরে শোনা যাবে। ও অন্য কোথাও একটু বসুক। তোর সঙ্গে আমাদের আলোচনাটা আগে সেরে নিই।

অদিতি প্রায় জেদই ধরে, না। চাঁপার ব্যাপারটা ভীষণ জরুরি। এটা ওর লাইফ অ্যান্ড ডেথের প্রশ্ন।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও রমাপ্রসাদ বলেন, ঠিক আছে, তুই যখন না-শুনিয়ে ছাড়বি না তখন বল

বারান্দার এধারে-ওধারে কয়েকটা বেতের মোড়া এবং চেয়ার-টেয়ার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সেগুলো টেনে এনে রমাপ্রসাদরা বসে পড়েন। অদিতিও বসে। কিন্তু চাঁপাকে বসতে বললেও সে একধারে দেয়ালের গায়ে সেঁটে একেবারে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

কাল নারী-জাগরণ-এর তরফ থেকে বস্তিতে সমীক্ষা চালাতে যাবার পর থেকে এখন পর্যন্ত চাঁপাকে নিয়ে যা যা ঘটেছে, সমস্ত জানিয়ে অদিতি বলে, ওকে বাড়িতে না-নিয়ে এসে আমার উপায় ছিল না বাবা। তোমরাই ভেবে দেখো, মেয়েটাকে আমরা জানোয়ারের হাতে তুলে দিতে পারি না।

ষাট-সত্তর বছরের এই পুরোনো বাড়িটা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপরেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মৃগাঙ্ক বলে, এটা কি ধর্মশালা যে তাকে শেলটার দিতে হবে?

বরুণও তীব্র গলায় বলে, সব ব্যাপারের একটা সীমা আছে। বস্তি থেকে একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে এল। এর দায়িত্ব কে নেবে?

রমাপ্রসাদ অবশ্য কিছু বলেন না। মুখচোখ দেখে টেরে পাওয়া যায়, তার আর্থারাইটিসের যন্ত্রণাটা হঠাৎ চাড়া দিয়ে উঠেছে।

চাঁপার কথা বললে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে, অদিতির সে সম্পর্কে ধারণা ছিল। সে আদৌ উত্তেজিত হয় না। অত্যন্ত শান্ত মুখে বলে, তোমাদের কাউকেই ওর দায়িত্ব নিতে হবে না। তা ছাড়া চাঁপা থাকবে আমার ঘরে। সেখান থেকে ও বেরুবে না। বাইরে যাবার দরকার হলে আমিই ওকে নিয়ে যাব। কোনোভাবেই ও কাউকে ডিসটার্ব করবে না।

বরুণ বলে, তুমি রোজগার করো, ওকে খেতে দিতে পারবে। সবই জানি। তবু ওর এ-বাড়িতে থাকা চলবে না।

মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে অদিতির, কেন? কিছুদিন আগে দিল্লি থেকে তোমার এক পাঞ্জাবি বন্ধু ফ্যামিলি নিয়ে এসে যখন দেড়মাস থেকে গেল তখন আমি তো আপত্তি করিনি।

কাদের সঙ্গে কার তুলনা করছিস। তারা বিশিষ্ট ভদ্রলোক।

 চাঁপাকে তুমি অভদ্র ধরে নিলে কী কারণে? বস্তিতে থাকে বলে?

বরুণ বলে, একজাকটলি। এদের নানারকম ঝামেলা থাকে। তা ছাড়া ওই টাইপের হুলিগান যার হাজব্যান্ড তাকে নিয়ে অনেক প্রবলেম। পরে ঝঞ্ঝাট হলে কে সে-সব সামলাবে।

অদিতি বলে, এ নিয়ে কাউকে ভাবতে হবে না।

মৃগাঙ্ক ওধার থেকে বলে, যে-ই দায়িত্ব নিক, এ-বাড়িতে ওইরকম একটা মেয়েকে থাকতে দিতে আমার অন্তত আপত্তি আছে। আই ডোন্ট লাইক ইট।

অদিতি এবার রমাপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা, তোমার কী মত?

 রমাপ্রসাদের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। তিনি কাতর গলায় বলেন, ওরা যখন চাইছে না তখন

বাবাকে দেখতে দেখতে স্তম্ভিত হয়ে যায় অদিতি। সে এম.এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, একটা বড় কলেজের নামকরা অধ্যাপিকা, তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা রয়েছে। সাংসারিক খরচের অনেকটাই সে দিয়ে থাকে। অথচ বাবার কাছে অদিতির সামাজিক দায়িত্ববোধের চেয়ে দুই জুয়াড়ি ছেলের মতামতের দাম অনেক বেশি। অদিতির মন বিষাদে ভরে যায়। সে বলে, তার মনে তোমারও আপত্তি আছে। কিন্তু তোমরা যাই ভাবো, যতদিন কিছু ব্যবস্থা নাহয় চাঁপা এখানে থাকবে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর অদিতি এভাবে শুরু করে, বাবা, আমার সঙ্গে তোমাদের কী জরুরি কথা যেন ছিল–

সুর কেটে গিয়েছিল। রমাপ্রসাদ ক্লান্ত গলায় বলেন, আজ থাক, কাল শুনিস—

আমি তা হলে এখন ওপরে যাই।

রমাপ্রসাদ উত্তর দেয় না।

অদিতি আর বসে না, চাঁপাকে নিয়ে তেতলায় চলে যায়

.

০৮.

পরদিন সকালে সবে রোদ উঠেছে, একটানা বোমার আওয়াজে অদিতিদের নিরিবিলি অভিজাত পাড়াটা হকচকিয়ে যায়। এই অঞ্চলটা কলকাতার ভেতরে থেকেও যেন কলকাতার বাইরে একটা প্রায় নির্জন দ্বীপ বা লেগুনের মতো। এখানকার চিরস্থায়ী শান্তি চুরমার করে এমন ঘটনা আর কখনও ঘটেনি।

খুব ভোরে ওঠা অদিতির বহুকালের অভ্যেস। সে যখন ওঠে, এ-বাড়ির কারোর ঘুম ভাঙে না। তেতলায় তার নিজের ঘরটিতে হিটার এবং চা তৈরির যাবতীয় সরঞ্জাম রয়েছে। মুখটুখ ধুয়ে এসে এক কাপ করে নেয় সে, তারপর টেবিলের সামনে গিয়ে বসে। এই সময়টা হয় পড়াশুনো বা লেখালেখি কিছু করে, নইলে ছাত্রছাত্রীদের খাতা দেখে।

আজ দুকাপ চা করে নিয়েছিল অদিতি। এক কাপ নিজের জন্য, দ্বিতীয় কাপটা চাঁপার।

চা খেতে খেতে অদিতি ক্লাস টেস্টের খাতা দেখছে, আর চাঁপা রাস্তার দিকের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

বাড়ির সামনে এবং পেছনে ঝুপসি গাছপালার মাথায় তুমুল হই-চই বাঁধিয়ে অগুন্তি পাখি উড়ছে। দূরের রাস্তা দিয়ে ক্কচিৎ ক্যালকাটা মিল্ক সাপ্লাইয়ের দু-একটা ভ্যান কিংবা রিকশা চলেছে। আর দেখা যাচ্ছে খবরের কাগজওলাদের। ঊর্ধ্বশ্বাসে সাইকেল ছুটিয়ে তারা এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঢুকে পড়ছে। কাগজ ফেলে দিয়ে আবার দৌড়।

এমন এক উত্তেজনাশূন্য শান্ত সকালে এইরকম একটি পাড়ায় বোমা ফাটানোর মতো মারাত্মক ব্যাপার ঘটতে পারে, এখানকার বাসিন্দাদের কাছে তা অভাবনীয়। বোমার আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে উত্তেজিত চিৎকারও ভেসে আসছে।

খাতা দেখতে দেখতে চমকে উঠে অদিতি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চাঁপার ভয়ার্ত গলা শোনা যায়, দিদি

দ্রুত ঘুরে বসতেই অদিতি দেখতে পায়, চাঁপা প্রায় কাঁপছে। সে এতই সন্ত্রস্ত যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

অদিতি জিগ্যেস করে, কী হয়েছে?

 জানলার দিকে আঙুল বাড়িয়ে শিথিল গলায় চাঁপা বলে, ওরা–ওরা এসেছে।

বোমা ফাটিয়ে হল্লা করতে করতে কারা এভাবে হানা দিতে পারে, মুহূর্তে আন্দাজ করে নেয় অদিতি। চেয়ার থেকে উঠে এক দৌড়ে রাস্তার দিকের জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। যা ভেবেছিল তা-ই। তাদের বাড়ির গেটটার ঠিক বাইরে প্রচণ্ড উত্তেজিত ভঙ্গিতে আট-দশটা চোয়াড়ে হুলিগান ধরনের লোক সমানে চেঁচাচ্ছে আর মাঝে মাঝে দু-একটা বোমা ফাটাচ্ছে। ওদের ভেতর নগেনকে দেখতে পাওয়া যায়।

একসঙ্গে চিৎকার করে তারা কী বলছে, কিছুই প্রায় বোঝা যায় না। তবে অকথ্য খিস্তিখেউড় যে দিচ্ছে, তাদের অঙ্গভঙ্গি থেকেই সেটা টের পাওয়া যায়।

নগেনরা যে এতদূরে এসে সকালবেলা চড়াও হবে, ভাবতে পারেনি অদিতি। বাড়িতে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তার একটা পরিষ্কার ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে অদিতির। প্রথমটা ভীষণ ভয় পেয়ে যায় অদিতি। পরক্ষণেই অসহ্য রাগে তার মাথায় বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। একটা অ্যান্টিসোশাল ক্রিমিনালের এত বড় সাহস যে তাদের বাড়ির সামনে এসে বোমা ফাটয়ে খিস্তি করছে।

তাদের ব্যাচমেট সৈকত আই.পি.এস হয়ে এখন লালবাজারে পোস্টেড। অদিতি ঠিক করে ফেলে এখনই তাকে ফোন করে পুলিশ পাঠাতে বলবে।

আগে এ-বাড়িতে ফোন ছিল। বিল দিতে না পারায় অনেক দিন আগেই ক্যালকাটা টেলিফোনের লোকেরা লাইন কেটে দিয়ে গেছে। পাশের বাড়িতে অবশ্য ফোন আছে। তেমন জরুরি ব্যাপার হলে ওখানে চলে যায় অদিতি। ওরা খুবই ভদ্র, আপত্তি করে না।

যেভাবে নগেনরা হামলা করছে তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে এখন যাওয়া ঠিক হবে না। পেছন দিয়ে সরু একটা প্যাসেজ রয়েছে, ওই দিক দিয়েই যাবে অদিতি।

চাঁপা বলে, কী হবে দিদি?

অদিতির মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে, কী আবার হবে! নগেনকে ঢিট করার ব্যবস্থা করছি। আমি একটা ফোন করে আসি। তুমি এঘর থেকে একেবারে বেরুবে না। একটু ভেবে বলে, ঠিক আছে, তোমাকে পিসির কাছে দিয়ে যাই। কাল রাত্তিরেই তেতলায় এসে মৃণালিনীর সঙ্গে চাঁপার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল অদিতি।

চাঁপা যেন তার কথা শুনতে পাচ্ছিল না। অপরাধীর মতো মুখ করে সে বলে, আমার জন্যে আপনি কী বিপদে পড়লেন বলুন তো। একটা কথা বলব?

কী?

আমি বরঞ্চ ওর সনগে চলেই যাই। আমার কপালে যা আছে তা-ই হোক। চাঁপার মুখ দেখে মনে হয়, তার ভেতরকার সব শক্তি এবং সাহস একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

না। প্রায় ধমকের গলায় বলে ওঠে অদিতি, এসো আমার সঙ্গে।

কিন্তু যাওয়া আর হয় না। তার আগেই চোখে পড়ে, মৃগাঙ্ক এবং বরুণ বাড়ির ভেতর থেকে ছুটতে ছুটতে গেটের দিকে যাচ্ছে। দুজনেই, বিশেষ করে করে মৃগাঙ্ক দারুণ গোঁয়ার। কলেজে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় প্রচুর মারদাঙ্গা করেছে। পুলিশে ওর নামে রিপোর্টও হয়েছিল বারকয়েক।

দুই দাদার পর রমাপ্রসাদকেও গেটের দিকে যেতে দেখা যায়। বাবার এমনিতেই শরীর ভালো না, কোমরে বহুদিনের আর্থরাইটিস, হার্টের অবস্থাও বেশ খারাপ। বিপজ্জনক কিছু একটা ঘটে যেতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে। তার আগেই লালবাজারে সৈকতকে ফোনটা করা দরকার।

অদিতি চাঁপার একটা হাত ধরে মৃণালিনীর ঘরে নিয়ে আসে। বলে, পিসি, ও তোমার কাছে রইল। আমি আসছি।

মৃণালিনী বোমার আওয়াজ এবং হল্লা শুনে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। বলেন, নীচে কী হচ্ছে রে বুবু? কারা বোমা ফাটাচ্ছে?

পরে এসে বলব। এখন দাঁড়াবার সময় নেই। একসঙ্গে দু-তিনটে করে সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে অদিতি।

পাশের বাড়ি গিয়ে একবার ডায়াল করতেই সৈকতকে পাওয়া যায়। সৈকত রীতিমতো অবাক, আরে তুমি! কতদিন পর তোমার গলা শুনলাম! ভালো আছ?

অদিতি বলে, ফিজিকালি অলরাইট। একটা বিপদে পড়ে তোমাকে ডিসটার্ব করছি ভাই-

তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে চমকে ওঠে সৈকত। সেই চমকের রেশ টেলিফোনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসে যেন, কী হয়েছে।

দলবল নিয়ে নগেন কীভাবে ঝামেলা করছে, সমস্ত জানিয়ে অদিতি বলে, কিছু একটা ব্যবস্থা করো সৈকত।

ব্যস্তভাবে সৈকত বলে, হা হা, নিশ্চয়। তুমি লাইনটা ছেড়ে দাও। আমি বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে ফোন করে দিচ্ছি। দশ মিনিটের মধ্যে পুলিশ চলে যাবে। তোমাদের বাড়ি অ্যাড্রেসটা দাও–

ঠিকানা জানিয়ে দেয়, অদিতি।

সৈকত এবার বলে, ঘণ্টাখানেক পর আবার ফোন করে কী হল, না-হল, খবরটা দিও। ডোন্ট ওরি–

ফোন নামিয়ে পাশের বাড়ি থেকে উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে নিজের বাড়ির গেটের দিকে যেতে যেতে থামকে দাঁড়ায় অদিতি।

ওখানে তুলকালাম ব্যাপার চলছে এই মুহূর্তে।

মৃগাঙ্ক নগেনের গলার কাছটা জামাসুদ্ধ চেপে ধরে চিৎকার করছে, বাস্টার্ড, তোমার চামড়া গুটিয়ে ছাড়ব। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি

নগেনের মাথাতেও খুন চেপে গেছে। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হিংস্র গলায় সে বলে, শালা! অন্যের মেয়েছেলেকে ঘরে পুরে রেখে ভদ্দরলোক সেজেছে! ভদ্রলোকের আমি–এরপর জঘন্য একটা খিস্তি করে সে।

তোমার মুখ আমি তুবড়ে দেব শুয়োরের বাচ্চা।

যা যা মাকড়া! তোর মতো তুবড়ে দেনেবালা আমি বহুত দেখেছি! নিজের ভালো চাইলে চাঁপাকে বার করে দে! নাইলে

একটা বাজে অ্যান্টিসোশাল তাকে তুই-তোকারি করছে। মাথায় রক্ত ফুটতে থাকে মৃগাঙ্কর। ঝাঁপিয়ে পড়ে নগেনের গলা টিপে ধরে সে, নইলে কী?

আবার ঝাড়া মেরে মৃগাঙ্কর হাতটা আলগা করে করে দেয় নগেন। বলে, তোমার লাইফ কিচাইন হয়ে যাবে। আমাকে তুমি চেনো না শালা!

এদিকে বরুণ চেঁচাচ্ছিল, এই জানোয়ারেরা ভাগ এখান থেকে

রমাপ্রসাদও হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো চিৎকার করছিলেন। নগেনের সঙ্গে যারা এসেছে তারাও সমানে চিৎকার এবং খিস্তি করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় বোমা ফটাচ্ছে।

এদিকে মৃগাঙ্ক আবার নগেনের দিকে দৌড়ে যায় এবং উন্মত্তের মতো তার মুখে ঘুষি চালিয়ে দেয়।

নগেনের নাক-মুখ ভেঙেচুরে রক্তাক্ত মাংসের দলা হয়ে গেল। লাট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজের রক্ত দেখে খুন চড়ে যায় তার। চোখ দুটো ঝলকে ওঠে। কোমরের কাছ থেকে লিকলিকে একটা ছোরা বের করেই মৃগাঙ্কর গায়ে বসিয়ে দেয় নগেন।

আতঙ্কে রমাপ্রসাদ, বরুণ এবং অনেকটা দূরে অদিতি চেঁচিয়ে উঠেছিল। মৃগাঙ্ক ক্ষিপ্র একটি মোচড়ে শরীরটাকে বাঁ দিকে হেলিয়ে দেয়। যদিও তার বুক ছিল নগেনের টার্গেট, সেখানে না-বসে ছোরার ফলা মৃগাঙ্কর কাঁধে গেঁথে যায় এবং গরম তাজা রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে।

মৃগাঙ্কর শরীর মুহূর্তে কুঁকড়ে যায়। ঠোঁট কামড়ে হাত দুটোয় মুঠো পাকিয়ে যন্ত্রণা সামলাতে চেষ্টা করে সে কিন্তু পারে না। এক সময় হাত-পায়ের জোর আলগা হয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে যায় সে।

হল্লা এবং বোমার আওয়াজে চারদিকের বাড়ি থেকে অনেকে বেরিয়ে এসেছিল কিন্তু ভয়ে কেউ এগুতে পারছে না। অন্যের জন্য অকারণে কে আর ঝুঁকি নিতে চায়?

বরুণ আর রমাপ্রসাদ মৃগাঙ্কর দিকে দৌড়ে যায়। অদিতি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। মৃগাঙ্কর এই পরিণতির যাবতীয় দায়িত্ব যে তারই, সেটা মেনে নিয়েই উদ্ভ্রান্তের মতো সে এগিয়ে যায়।

এদিকে ছুরি মারায় একটু থমকে গিয়েছিল নগেন। হঠাৎ অদিতিকে দেখে সে কিছু বলতে যাবে, পুলিশের একটা কালো ভ্যান কর্কশ আওয়াজ করে গেটের সামনে এসে ব্রেক কষে।

তৎক্ষণাৎ নগেন এবং তার গ্যাংটা উধাও হয়ে যায়।

ছজন আর্মড কনস্টেবল সঙ্গে করে একজন অল্পবয়সি অফিসার ভ্যান থেকে নেমে মৃগাঙ্ককে দেখতে দেখতে বলে, কে এঁকে স্ট্যাব করল?

ছুরি মারার খবর পেয়ে বাড়ি থেকে হেমলতা, মীরা এবং বন্দনা পাগলের মতো বেরিয়ে এসেছিল। তারা রক্তাক্ত বেহুশ মৃগাঙ্ককে পড়ে থাকতে দেখে বুক-ফাটা কান্না জুড়ে দেয়।

হাজার বিপদেও ধৈর্য হারায় না অদিতি। সে পুলিশ অফিসারকে একধারে ডেকে বলে, যাঁকে স্ট্যাব করা হয়েছে উনি আমার ছোটদা। পরে আপনাকে সব বলব, আপনি ছোটদাকে নিয়ে আগে কোনো হসপিটালে চলুন।

মৃগাঙ্ককে ধরাধরি করে ভ্যানে তোলা হয়। তার সঙ্গে বন্দনা, মীরা, রমাপ্রসাদ, বরুণ এবং অদিতিও ওঠে। আর হেমলতা, মীরাকে বোঝানো হয়েছিল, পরে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে, কিন্তু তাদের ভ্যান থেকে নামানো যায়নি।

হাসপাতাল পর্যন্ত সারাটা পথ হেমলতা নিঃশব্দে কেঁদে যান। কিন্তু মীরা পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদতে থাকে এবং মৃগাঙ্কর এই অবস্থার জন্য যে অদিতিই একমাত্র দায়ী, সেটা কান্না-জড়ানো ভাঙা ভাঙা গলায় একনাগাড়ে বলে যায়।

.

হাসপাতালে পৌঁছোবার পর ডাক্তারেরা এমার্জেন্সিতে ভর্তি করে নেন মৃগাঙ্ককে এবং পরীক্ষা করে জানান, প্রাণের আশঙ্কা নেই। যদিও ছুরির ফলা কাঁধের মাংসপেশীগুলোকে খুবই জখম করেছে। রক্তপাতও হয়েছে প্রচুর। অবশ্য ডাক্তারদের ধারণা, মৃগাঙ্ককে চার-পাঁচদিনের বেশি হাসপাতালে থাকতে হবে না, তার পরেই তাকে রিলিজ করে দেওয়া হবে। বাড়িতে সপ্তাহখানেক রেস্ট নিলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে সে।

অদিতিরা হাসপাতালে থাকতে থাকতেই জ্ঞান ফিরে আসে মৃগাঙ্কর এবং তাকে এমার্জেন্সি থেকে পেয়িং বেড়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

এইসব করতে করতে ঘণ্টাদুয়েক কাটে। তারপর একটা ট্যাক্সি করে মীরা আর হেমলতাকে নিয়ে বরুণ বাড়ি ফিরে যায়। রমাপ্রসাদ এবং অদিতি আদ্যোপান্ত জানিয়ে নগেনের নামে ডায়েরি করিয়ে বলে, লোকটা খুবই বিপজ্জনক।

তরুণ পুলিশ অফিসারটি বলে, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, নগেনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অ্যারেস্ট করা হবে।

অদিতি বলে, ধন্যবাদ। আপনার এখান থেকে আমি কি একটা ফোন করতে পারি?

 নিশ্চয়ই। ব্যস্তভাবে টেলিফোনটা অদিতির দিকে এগিয়ে দেয় পুলিশ অফিসার।

বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে পুলিশ অদিতিদের বাড়ি যাবার পর কী হল না হল, সব জানিয়ে দিতে বলেছিল সৈকত। সে নিশ্চয়ই উগ্রীব হয়ে আছে। ডায়াল ঘুরিয়ে লালবাজারে কানেকশান পেয়ে যায় অদিতি। লাইনের ওধার ধেকে সৈতকের গলা ভেসে আসে, হ্যালো

অদিতি বলছি।

 হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো।

 পুলিশ আসার পর এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, সব বলে গেল অদিতি।

 সৈকত বলে, আগে যে ফোন করেছিলে তখন একটা কথা মনে হয়নি

কী?

নগেন তোমাদের বাড়ির ঠিকানা পেল কোথায়?

একটু চিন্তা করে অদিতি বলে, জানি না। তবে মনে হচ্ছে, ও আরও একবার নারী-জাগরণ-এর অফিসে গিয়েছিল। ওখানে যে কাজের লোকটা থাকে তাকে ভয় দেখিয়ে ঠিকানাটা নিয়েছে। কিংবা অন্য কারও কাছ থেকেও জোগাড় করতে পারে।

সৈকত বলে, যাইহোক, লোকটা খুবই ডেসপারেট। অবশ্য ওকে অ্যারেস্ট করতে অসুবিধে হবে না। যদি দরকার হয়, পরে আমাকে ফোন কোরো।

আচ্ছা।

 খুট করে একটা শব্দ হল। সৈকত ফোন নামিয়ে রেখেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *