৩. সাজেদার বগীর দরজা সামান্য খোলা

সাজেদার বগীর দরজা সামান্য খোলা। করিডোর থেকে দেখা যাচ্ছে তিনি হেলান দিয়ে আছেন। তাঁর চোখ ভেজা। মাঝে মাঝে তিনি গায়ের পাতলা চাদর দিয়ে চোখ মুছছেন। চোখ মুছার কারণে ঠোঁটের পানের রসও মুখের নানান জায়গায় লাগছে। তাঁকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

চিত্রা করিডোর থেকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তার হাতে ছোট্ট ঠোঙায় জর্দা। ট্রেন কিছুক্ষণের জন্যে কি একটা স্টেশনে থেমেছিল। পান-সিগারেট ওয়ালার কাছ থেকে সে পাঁচ টাকার জর্দা কিনেছে। চিত্রা বগীতে ঢুকবে কি টুকবে না বুঝতে পারছিল না। মোটামুটি অপরিচিতা এক মহিলা চোখ ভাসিয়ে কাঁদছেন। এই সময় কি তাঁকে বিরক্ত করা উচিত? ব্যক্তিগত দুঃখ যাপনের সময় উপস্থিত হওয়া যায় না।

চিত্রাকে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল না। সাজেদা হাত ইশারায় তাকে ডাকলেন। চিত্রা বগীতে ঢোকামাত্র তিনি বললেন, আমার ছেলেটিকে দেখেছ?

চিত্রা বলল, জি না। আমি আপনার জন্যে জর্দা এনেছি।

সাজেদা বললেন, ফেলে দাও। আমি ঠিক করেছি জীবনে জর্দা খাব না।

চিত্রা বলল, আমি কি আপনার ছেলেকে খুঁজে বের করব?

খুঁজে বের করতে হবে না। তুমি বোস। দরজা বন্ধ করে বোস। তোমাকে আমি কিছু কথা বলব।

চিত্রা দরজা বন্ধ করে পাশে বসল। সাজেদা বললেন, আমার ছেলের চেহারা দেখে কি কেউ বলবে সে হাড় বজ্জাত? কেউ বলবে না। শান্ত শিষ্ট চেহারা! ভদ্র ব্যবহার। হাসি ছাড়া মুখে কথা নাই। তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই হেসে হেসে অনেক কথা বলেছে। বলে নাই?

জি, বলেছেন।

ম্যাজিক দেখায়েছে, তাই না?

চিত্রা বিস্মিত হয়ে বলল, না তো।

সাজেদা বললেন, গুণধর পুত্র। তার নানান গুন। তিনি একজন শখের ম্যাজিশিয়ান-টাকার ভিতর দিয়ে পেনসিল ঢুকাবে টাকা ছিড়বে না। হাতে পয়সা নিয়ে অদৃশ্য করে ফেলবে তারপর কারো নাক থেকে বের করবে। তাসের তিনটা সাহেব হয়ে যাবে তিনটা বিবি। ম্যাজিকের সব জিনিস সব সময় তার পকেটে থাকে। তোমাকে এখনো দেখায় নি?

না।

দেখাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখাবে। পয়সা বের করার কথা বলে তোমার কানে হাত দেবে। নাকে হাত দেবে। মেয়েছেলের গায়ে হাত দেয়ায় আনন্দ আছে না। মহানন্দ।

আপনি মনে হয় উনার উপর খুব রেগে আছেন।

সাজেদা কড়া গলায় বললেন, রেগে থাকব কেন? আমি তার উপর দিলখোশ। সে এখানে ঢুকলেই তাকে আমি কোলে বসিয়ে গালে চুমা দিব আর ও আমার বাবা ও আমার সোনা বলে মাথায় হাত বুলাব। সে একবার কামরায় ঢুকে দেখুক। কতবড় সাহস! আমার সঙ্গে গলা উঁচিয়ে কথা বলে। বুক ফুলিয়ে বলে, আমি কয়েকবার মদ খেয়েছি। কি বিরাট কাজ করে ফেলেছ। তোমার মা হিসেবে আমার কত গর্ব হচ্ছে। আমার সোনা মানিক মদ খায়, কি আনন্দ! এত আনন্দ আমি কোথায় রাখি। আমার সোনা মানিককে মদ খাওয়ার জন্যে সোনার মেডেল দেব। মেডেলে লেখা থাকবে মদারু শ্রেষ্ঠ।

কথাবার্তায় সাময়িক বিরতি পড়ল। সাজেদা পান সাজতে বসলেন। চিত্রার হাত থেকে জর্দার প্যাকেট নিয়ে এক গাদা জর্দা পানে ঢাললেন। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে চিত্রা বলল, রাতে আপনি কখন খাবেন? বুফে কারে খেতে হলে আগে অর্ডার দিতে হবে। ওরা তাই বলল।

সাজেদা বললেন, খাবার আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। হট পটে গরম খাবার আছে। তুমিও আমার সঙ্গে খাবে। আশহাব বাদ। মদারু ছেলের সাথে বসে আমি খাব না। মা, তুমি একটা কাজ কর–আমার মদারু পুত্রকে ডেকে আন। তুমি ওর সঙ্গে কামরায় ঢুকবে না। আমি এমন কিছু ঘটনা ঘটাব যা তোমার দেখা ঠিক হবে না। কথায় বলে সাপের পাঁচ পা দেখা—আমি মদারুটাকে সাপের পঞ্চাশ পা দেখাব।

চিত্রা বগী থেকে বের হল। করিডোরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সে রওনা হল বুফে কারের দিকে। বুফে কারে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়েছিল। অর্ডার ক্যানসেল করতে হবে। এই মহিলা তাকে না খাইয়ে ছাড়বেন না এটা বুঝা যাচ্ছে। শুধু যে খাওয়াবেন তা-না, নানান অত্যাচারও করবেন। ভালবাসা দেখাতে গিয়ে অত্যাচার।

 

রশীদ সাহেব ধাক্কার মতো খেয়েছেন। ডাক্তার ছেলেটা যে এত ওস্তাদ তিনি কল্পনাও করে নি। তাঁর মতো সজাগ চোখের একজন মানুষকে বোকা বানানো সম্পূর্ণ অসম্ভব। অথচ এই ছেলে তাই করেছে। চোখের সামনে পাঁচ টাকার একটা কয়েন অদৃশ্য করেছে। কোটের হাতায় লুকিয়ে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। কোটের হাতা সে গুটিয়ে নিয়েছে। একটা বস্তু হঠাৎ অদৃশ্য হতে পারে না। Volatile কোনো বস্তু অদৃশ্য হলে বলা যেত যে হাতের মুঠোর উত্তাপে বস্তুটা বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। পাঁচ টাকার কয়েন কোনো ভলাটাইল বস্তু না।

আশহাব বলল, স্যার, আপনার মনে হয় ম্যাজিকটা খুব পছন্দ হয়েছে।

রশীদ সাহেব বললেন, পছন্দ হবার কিছু না। এটা নতুন কেনা শার্ট না যে পছন্দ হবে। আমি বিভ্রান্ত হয়েছি। কেন বিভ্রান্ত হয়েছি এটা বের করতে হবে। আমি অল্প বুদ্ধির মানুষ না যে যাই দেখব তাতেই বিভ্রান্ত হব।

অতিবুদ্ধিমানরাই সহজে বিভ্রান্ত হয়।

Don’t talk nonsense.

আশহাব চুপ করে গেল। বৃদ্ধের হতচকিত অবস্থাটায় সে খুবই মজা পাচ্ছে। কাউকে ম্যাজিক দেখিয়ে এত আরাম এর আগে সে পায়নি।

স্যার, আরেকটা খেলা কি দেখাব? রুমালের কালার চেঞ্জ। লাল রঙের রুমাল প্রথমে হবে সবুজ তারপর শাদা।

যেটা দেখিয়েছ সেটার রহস্য আগে বের করি। সম্পূর্ণ নতুন দিক থেকে চিন্তা শুরু করেছি। এতে মনে হয় কাজ হবে।

রশীদ সাহেব গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বললেন, তোমাকে কি আরেক পেগ দেব?

দিন।

তোমার দুটা হয়েছে। এটা নিলে হবে থার্ড। মেজাজ ফুরফুরে করার জন্যে তিনটার বিকল্প হয় না। ইংরেজিতে এই কারণেই বলে থ্রি ইজ কোম্পানি।

সেটাতো মানুষের জন্যে।

মানুষের জন্যে যেটা সত্যি, হুইস্কির জন্যেও সত্যি।

আশহাব নিজের গ্লাস হাতে নিতে নিতে বলল, ম্যাজিকটার রহস্য উদ্ধারে নতুন কোন দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছেন একটু কি বলবেন?

বৃদ্ধ বললেন, অবশ্যই বলব। যখন চিন্তা শুরু করব তখন বলব। এখনো চিন্তা শুরু করিনি। এখন ব্রেইনকে রেস্ট দিচ্ছি।

কি ভাবে রেস্ট দিচ্ছেন?

সম্পূর্ণ অন্য বিষয় নিয়ে চিন্তা করছি। অন্য বিষয়টা কি জানতে চাও?

চাই।

বৃদ্ধ সিটে পা তুলে আরাম করে বসতে বসতে বললেন, এই ট্রেনের যাত্রী সংখ্যা আমার কাছে আছে। সর্বমোট যাত্রী সংখ্যা ৬২২ যোগ ১৮ যোগ ৪ যোগ ২ যোগ ৩ অর্থাৎ ৬৪৯।

আশহাব বলল, এর মধ্যে কিছু বিভিন্ন স্টেশনে নামবে, কিছু উঠবে।

তা ঠিক। তবে গড় সংখ্যা ৬৪৯।

জি।

এই যাত্রীদের মধ্যে একজন মৃত।

জি।

একজন আছে যে সবচে জ্ঞানী।

আশহাব বলল, সবচে জ্ঞানী আপনি হওয়া সম্ভব।

বৃদ্ধ বললেন, তা সম্ভব। তবে আমার চেয়েও জ্ঞানী কেউ থাকতে পারে। আমার সাফল্য বেশি, সাফল্য এবং জ্ঞান এক না।

আশহাব বলল, মানলাম।

একজনকে পাওয়া যাবে সবচে বোকা, একজন থাকবেন সবচে ধার্মিক।

এক মাওলানা সাহেব যাচ্ছেন। সারাক্ষণ তসবি টানছেন। উনি হবেন সবচে ধার্মিক।

বৃদ্ধ বললেন, মাওলানাকে আমিও দেখেছি। হ্যাঁ সে হতে পারে। একজন হবে সবচে ক্ষমতাধর।

আশহাব বলল, সেটা কে আমি জানি। এই ট্রেনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী যাচ্ছেন। তিনি সেলুন কারে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কি সবচে ক্ষমতাধর?

জি স্যার।

বৃদ্ধ বললেন, উনার নামটা জানা দরকার।

নাম দিয়ে কি করবেন?

বৃদ্ধ বলল, নাম দিয়েও একটা খেলা করা যাবে। ধরো উনার নাম যদি হয় জলিল তাহলে আমরা দেখব যাত্রীদের মধ্যে কতজন জলিল আছে। এই জলিলদের মধ্যে সামাজিক অবস্থা কার কি। তাদের জন্ম তারিখ যদি বের করা যায় তাহলে আমরা হিসাব করব একই দিনে জন্মেও সামাজিক অবস্থানে এখাকে কোথায়?

আশহাব বলল, লাভ কি?

বৃদ্ধ বললেন, লাভ লোকসান নিয়ে চিন্তা করছ কেন? আমরা কি ট্রেনে ব্যবসা করতে এসেছি? আমাদের কি ব্যালেন্স শীট তৈরি করতে হবে? তুমি চেষ্টা করে দেখতে মন্ত্রীর নামটা জোগাড় করা যায় কি-না। গ্লাসটা শেষ করে তারপর যাও! লাষ্ট একটা কি খাবে? নাম্বার ফোর।

এখনই মাথা ঘুরছে! আর খাওয়া ঠিক হবে না।

পিথাগোরাসের ধারণা, চার একটি magical number। সংখ্যার ধারায় চার হচ্ছে প্রথম সংখ্যা যার বর্গমূল হয়। বর্গমূল আবার প্রাইম নাম্বার। দিক আছে চারটা পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ।

আশহাব বলল, আপনি যে ভাবে ব্যাখ্যা করলেন তাতে চার পর্যন্ত যাওয়া যায়। চার পর্যন্ত না গেলে পিথাগোরাসের প্রতি অসম্মান করা হবে।

ঠিক বলেছ। তুমি মন্ত্রীর নাম জেনে আস। ততক্ষণ আমি তোমার ম্যাজিকের রহস্যটা চিন্তা করি। তারপর আমরা মহান পিথাগোরাসকে সম্মান দেখাব।

আশহাব কামরা থেকে বের হয়েই চিত্রার সামনে পড়ে গেল। চিত্রা বলল, আপনাকেই তো খুঁজছি।

আশহাব বলল, কেন?

আপনার মা আপনার জন্যে ব্যস্ত হয়ে আছেন।

আশহাব বলল, তাকে আরো ব্যস্ত হতে বলুন। উনি আমার জন্যে ব্যস্ত কিন্তু আমি এই মুহূর্তে অন্য কাজে ব্যস্ত।

চিত্রা বলল, অন্য কাজটা কি?

এই ট্রেনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাচ্ছেন। আমার বর্তমান মিশন তার নাম জানা।

তাঁর নাম A K K।

A K K মানে?

আবুল খায়ের খান।

উনার জন্মতারিখ জানেন?

জন্মতারিখতো জানিনা। জন্মতারিখ দিয়ে কি হবে?

উনার রাশি গণনা করব। উনি কোন রাশির জাতক, উনার শুভ সংখ্যা কি ইত্যাদি বের করা হবে।

চিত্রা বলল, আপনার কি হয়েছে একটু বলবেন? আপনার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। আপনি এলোমেলো পা ফেলছেন।

আশহাব বলল, আমার কি হয়েছে আপনি সত্যি জানতে চান?

চাই।

আশহাব বলল, তিন পেগ হুইস্কি খেয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যে আরেক পেগ খাব। তখন হবে চার পেগ। পিথাগোরাসের মতে চার একটি ম্যাজিকেল সংখ্যা। চারের বর্গমূল হল দুই। এটি একটি প্রাইম সংখ্যা। মহান অংকবিদ পিথাগোরাসের কারণেই আমাকে চার পর্যন্ত যেতে হচ্ছে। আর কিছু জানতে চান?

চিত্রা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। আশহাব বলল, আপনি কি আমার জন্যে একটা কাজ করতে পারবেন? ছোট্ট কাজ। কাজটা করলে আমার খুব উপকার হয়।

কাজটা কি?

আমার মাকে গিয়ে বলবেন যে তার গুণধর পুত্র মদ খাচ্ছে। গ্রীন লেভেল হুইস্কি। ভালো কথা, মন্ত্রীর নামটা আরেকবার বলুন। ভুলে গেছি।

আবুল খায়ের খান।

গুড।

মাওলানা সাহেবের নামটা জানতে পারলে ভাল হত। উনার নামের প্রয়োজন পড়তে পারে।

কোন মাওলানা?

আছেন একজন ৭ নাম্বার বগিতে আছেন। ধারণা করা যাচ্ছে তিনি ট্রেনের ৬৪৯ জন যাত্রীর মধ্যে সবচে ধার্মিক।

আশহাব রশীদ সাহেবের কামরায় ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে ফেলল। কামরার বাইরে হতভম্ব অবস্থায় চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে।

 

মাওলানা সাহেবের নাম আজিজুর রহমান। বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ। রোগা পাতলা চেহারা থুতনিতে সামান্য দাড়ি। মাওলানা সাহেব মনে হচ্ছে শৌখিন মানুষ। তাঁর গায়ের পাঞ্জাবীটা দামী। ফুলের নকশা কাটা। পাঞ্জাবীর উপর যে শালটা দিয়েছেন সেই শালও যথেষ্ট দামী। মাথার টুপিটা রঙিন নকশাদার।

মাওলানা স্ত্রীর সঙ্গে রাগারাগি করছেন তবে গলা নামিয়ে। রাগারাগির কারণ তাঁর স্ত্রী আফিয়া মাগরেবের নামাজ পড়ে নি।

মাওলানা বললেন, নামাজটা কেন পড়লে না একটু বলতো শুনি। তুমি জান নামাজ কাজা করতে দেখলে আমার ভাল লাগে না।

আফিয়া বলল, আমার শরীরের যে অবস্থা নিচু হতে পারি না। সেজদায় যাব কি ভাবে?

বসে বসে নামাজ পড়। তোমার এই অবস্থায় বসে নামাজ জায়েজ আছে।

আফিয়া বলল, আমার অবস্থা দেখলে আল্লাহপাক বলতেন, যা বেটি তোর নামাজ এখন মাফ।

মাওলানা স্ত্রীর বেয়াদবিতে কিছুক্ষণের জন্যে বাক্যহারা হলেন। নিজেকে সামলাতে সময় লাগল। ধর্ম কর্ম, আল্লাহপাক এই সব অতি গুরুতর বিষয় নিয়ে আফিয়ার হালকা কথাবার্তার অভ্যাস আছে। আগে অনেকবার লক্ষ্য করেছেন। অনেকবার নিষেধও করেছেন।

আফিয়া!

জি।

তুমি একটু আগে মস্তবড় একটা গুনার কাজ করেছ। তওবা কর। তওবা করার পর কাজা নামাজ পড়।

কি ভাবে তওবা করব?

আমার সঙ্গে তিনবার বল, আল্লাহুম্মাগ ফিরলি ওয়ার হামনি।

আফিয়া তিনবার বললেন।

তোমার অজু আছে না?

আছে।

জানালার সামনে বসে বসে পড়। জানালাটা পশ্চিম।

ট্রেন যখন ঘুরবে তখনতো কেবলা বদলে যাবে।

মাওলানা বিরক্ত গলায় বললেন, চলন্ত ট্রেনে নামাজে দাঁড়াবার সময় কেবলা ঠিক করে নিতে হয়। এরপরে কেবলা বদলে গেলে অসুবিধা নাই।

আফিয়া বললেন, আপনি আমার জন্যে আরেক বোতল পানি আনেন। পানি খেয়ে তারপর নামাজ পড়ব।

মাওলানা বললেন, আগের বোতলের পানিতে শেষ কর নাই অর্ধেক এখনো আছে। আফিয়া তুমি নামাজ না পড়ার বাহানা করছ। আল্লাহপাক খুবই রাগ হবেন।

আফিয়া বলল, আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি। আমি এখন নামাজ পড়লেই আল্লাহপাক রাগ হবেন। আমার পানি ভাঙছে। আপনি চিন্তায় পড়বেন বলে কিছু বলি নাই। ট্রেনেই আমার সন্তান হবে। আপনি খোঁজ নেন ট্রেনে কোনো ডাক্তার আছে কি-না।

কথা শেষ করার আগেই প্রবল ব্যাথায় আফিয়া মুখ বিকৃত করল। চাপা গলায় তার মাকে ডাকল—মা! মা গো। মাওলানা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। একি মুসিবত! আল্লাহপাকের এটা আবার কোন পরীক্ষা।

 

এই মুহূর্তে হতভম্ব অবস্থায় অন্য যে ব্যক্তি মোবাইল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তার নাম এ কে কে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল খায়ের খান। তিনি কোন দলের মন্ত্রী তা ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়োজন নেই, সব দলের মন্ত্রীই এক। তাদের মধ্যে গুণগত প্রভেদ যেমন নেই, দোষগত প্রভেদও নেই। তাঁদের সঙ্গে গ্রাম্য বাউলদের কিছু মিল আছে। বাউলরা যেমন বন্দনা না গেয়ে মূল গান গাইতে পারেন না, এরাও সে রকম নিজ নিজ নেত্রীর বন্দনা না গেয়ে কোনো কথা বলতে পারেন না।

আবুল খায়ের খান সাহেবের হাতে মোবাইল। তিনি মোবাইল বন্ধ করার পরেও মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর গলায় টক ভাব হচ্ছে। প্রচণ্ড এসিডিটি হলে এ রকম হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুক জ্বলা শুরু হবে।

মন্ত্রী মহোদয়ের বুক জ্বালা করার কারণ এসিডিটি না। তিনি এই মাত্র জেনেছেন তার মন্ত্রীত্ব নেই। আসল জায়গা থেকে খবর এখনো আসেনি। যে জায়গা থেকে এসেছে সেটাও নির্ভরযোগ্য। তিনি ইচ্ছা করলেই আরো কয়েকটা টেলিফোন করে মূল সত্যটা জানতে পারেন। এই মুহূর্তে ইচ্ছা। করছে না।

মন্ত্রী মহোদয়ের স্ত্রী সুরমা হাতে টমেটো জুস নিয়ে এগিয়ে এলেন। আহ্লাদি গলায় বললেন, এই, গান কখন শুরু হবে? যমুনা আর তার বর গান শুনতে চাচ্ছে।

যমুনা সুরমার ছোট বোন। গত সপ্তাহে সেনাকুঞ্জে তার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর তার মন্ত্রী দুলাভাই তাদের দেশের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন। আনন্দ ফুর্তি করতে করতে যাওয়া হবে ভেবেই ট্রেনে যাওয়া হচ্ছে। সেলুন কারে নানান আনন্দ ফুর্তির ব্যবস্থা। একটা ব্যান্ড দল যাচ্ছে। ব্যান্ডের নাম Hungry। ভিডিও ম্যান যাচ্ছে। তার দায়িত্ব ভিডিও করা। কোনো আনন্দ যেন বাদ না পড়ে। ঢাকা ক্লাব থেকে একজন বারটেনডার নেয়া হয়েছে যে ককটেল বানানোয় ওস্তাদ। সম্প্রতি সুরমার ককটেল আসক্তি হয়েছে। তিনি বিশেষ বিশেষ পার্টিতে ককটেলের ব্যবস্থা রাখেন। সিঙ্গাপুর থেকে ককটেল বানানোর উপর একটা বইও কিনেছেন। তাঁর ইচ্ছা আজ বই দেখে কয়েকটা আইটেম বানাবেন।

সুরমা বললেন, এই, কথা বলছ না কেন? গান কি শুরু হবে?

মন্ত্রী শুকনো গলায় বললেন, হুঁ।

তোমার শরীর খারাপ না-কি?

এসিডিটি হচ্ছে।

সুরমা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, এন্টাসিড খেয়ে এক গ্লাস ঠাণ্ডা দুধ খাও। দুধ নিয়ে এসেছি। দেব?

দাও।

একটু আগে টেলিফোন কে করেছে?

অফিস থেকে।

সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, তারা কি একটা সেকেন্ডের জন্যে তোমায় বিশ্রাম দেবে না! দিন রাত কাজ করতে হবে? মোবাইলটা অফ করে রাখতো। মন্ত্রী তো আরো আছে। একমাত্র তোমাকেই দেখলাম জীবনটা দিয়ে দিচ্ছ। নেত্রীর এত কাছের যে সালাম সাহেব সন্ধ্যার পরেইতো সে বোতল নিয়ে বসে। তখন তার টিকির দেখা পাওয়া যায় না।

মন্ত্রী বললেন, থামতো।

সুরমা বললেন, থামব কেন? সত্যি কথা বলতে আমি ভয় পাই না। আমি সালাম সাহেবের মুখের উপর এই কথা বলতে পারব। তার স্ত্রী গত এক মাসে তিনবার বিদেশ গিয়েছে। বেইজিং থেকে একটা খাট কিনে এনেছে একুশ হাজার ডলার দামে। টাকা কোত্থেকে আসে আমি জানি না? আমি চামচে দুধ খাওয়া মেয়ে না।

সুরমা টমেটো জুসের গ্লাস নিয়ে খাস কামরার দিকে রওনা হয়েছেন। যমুনা তার স্বামী ফয়সলকে নিয়ে সেই কামরাতেই আছে। দুজন হাত ধরাধরি করে বসা ছিল। সুরমাকে দেখে হাত ছেড়ে দিল। সুরমা বললেন, ফয়সল তুমি আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছ কেন বল তো? স্ত্রীর হাত ধরে বসে থাকবে না তো কার হাত ধরে বসবে। আমার মধ্যে কোনোরকম প্রিজুডিস নেই। (সুরমার পড়াশোনা ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। তার দ্রুত উন্নতি হয়েছে। কথাবার্তায় তিনি এত চমৎকার করে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন যে তাঁর শিক্ষা দিক্ষা নিয়ে বিভ্রান্ত হতে হয়। প্রিজুডিস শব্দটা গত সপ্তাহে শিখেছেন—এর অর্থ মন খোলা। যে কোনো কিছুতেই কিছু মনে করে না।) সুযোগ পেলেই সুরমা প্রিজুডিস শব্দটা ব্যবহার করেন। যাতে সড়গড় হয়ে যায়।

সুরমা বসতে বসতে বললেন, ফয়সল এক গ্লাস টমেটো জুস খাবে? খেয়ে দেখতে পার। সামান্য ভদকা দেয়া হয়েছে টমেটোর গন্ধ দূর করার জন্যে। এরা ব্লাডি মেরী না-কি-কি যেন বলে।

ফয়সল বলল, খেয়ে দেখতে পারি।

যমুনা বলল, বড়পা, ও খেলে আমাকেও একটু দিতে হবে। আমি কোনদিন ভদকা খাইনি আজ খেয়ে রাশিয়ান হয়ে যাব। আমার নাম হবে যমুনাভস্কি।

সুরমা বললেন, তুই ভদকা খাবি মানে পাগল নাকি?

এইসব বললে হবে না, আমিও এক চুমুক খাব। এক চুমুক খেলে কি হয়? আমি যমুনাভস্কি হব।

সুরমা বললেন, ঠিক আছে তোকে দেব এক গ্লাস। ঘ্যান ঘ্যান বন্ধ করে তোর দুলাভাইকে এক গ্লাস দুধ দিয়ে আয়। ওর এসিডিটি হচ্ছে। কোনো বিশ্রাম নাই কিছু নাই শুধু কাজ আর কাজ—এসিডিটিতো হবেই। একটু বেড়াতে যাচ্ছে এরমধ্যেও টেলিফোনের পর টেলিফোন।

যমুনা বলল, আপা দুলাভাইকে বল মোবাইল সেটটা জানালা দিয়ে ফেলে দিতে। ময়মনসিংহ পৌঁছে আরেকটা কিনে নেবে।

সুরমা বললেন, তুই যে কি পাগলের মতো কথা বলিস। দিনের মধ্যে দশবার প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করেন। সেট ফেলে দিলে উনার কল কে রিসিভ করবে? প্রধানমন্ত্রীর সবচে কাছের মানুষ বলতে এখন সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *