সন্ধ্যার পর ঘরটিতে আমরা তিনজন। চারপাশে অন্ধকার, ঘরের চালের ওপর। নারকেলপাতার শব্দ হচ্ছে মাঝেমাঝে, শিরশিরে বাতাস ঢুকছে কাঁঠালপাতার ভেতর দিয়ে। রওশনের আব্বা একবার উঁকি দেন; আমাকে দেখে তিনি খুশি হন, জানালাগুলো লাগাতে লাগাতে বলেন, ওদের একটু দেখিয়ে দিয়ে তো। বাইরে শীতের বাতাস, কিন্তু ভেতরে আমরা, রওশন আর আমি, উষ্ণ হয়ে আছি। আমার ডান পায়ের পাতার ওপর রওশনের বা পায়ের পাতা, রওশনের ডান পায়ের পাতার ওপর আমার বা পায়ের পাতা। মনে হচ্ছে কনকনে শীতের মধ্যে আমরা কোনো চুল্লির পাশে বসে আছি। আমরা একে অন্যের জন্যে শীতের আগুন, একজনের আগুন পোহাচ্ছি আরেকজন, আমাদের কোনো শীত লাগছে না। রওশন টেবিলের নিচ দিয়ে তার ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছে, উষ্ণ কোমল দুধের পেয়ালার মতো রওশনের হাত, আমাদের পৃথিবীতে কোনো শীত নেই।
শওকত ডান দিকের চেয়ারে চাদর গায়ে দিয়ে একটু একটু কাঁপছে; আর জানতে চাইছে, তোমাদের শীত লাগে না?
কেনো, এটা শীতকাল নাকি? আমি হাসতে হাসতে বলি।
না, এটা গরমকাল, শওকত বলে, মাহবুবের আর রওশনের জন্যে।
রওশন নিজের চাদরটা শওকতের গায়ে চাপিয়ে দিয়ে বলে, আমার গরম লাগছে, শওকত, তুমি এটিও গায়ে দাও।
শওকত রওশনের চাদরটি ফিরিয়ে দেয়, রওশন সেটি চেয়ারের পাশে রাখে, আমরা সবাই হাসতে থাকি। হারিকেনের আলোতে টেবিলের ওই পারে রওশনকে ধানখেতের ওপারে আখখেতের ওপরে শিমুল ডালের পাশে পৌষের চাঁদের মতো মনে হয়। আজ আমি আমার টেবিলে পড়তে বসি নি, আমার সামনে কোনো টেস্টপেপার নেই মেইড ইজি নেই একের ভেতরে পাঁচ নেই অভিজ্ঞ হেডমাস্টার নেই; আমার চোখের সামনে রয়েছে রওশন, যে সব বইয়ের থেকে ভালো, যার মুখে নাকে গালে চুলে ঠোঁটে আমি সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পড়ছি, সব অংকের সমাধান পাচ্ছি, পৃথিবীর সব ভাব সম্প্রসারিত দেখছি। কানের পাশ দিয়ে জুলপির মতো একগুচ্ছ চুল ঝুলে আছে রওশনের, মাঝেমাঝে রওশন আঙুলে জড়াচ্ছে ওই চুল, দাঁত দিয়ে কাটছে, তার ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে, আমার দিকে স্থির করে রাখছে তার প্রদীপের মতো চোখ দুটি, আড়িয়ল বিলের উত্তরে যেমন আকাশপ্রদীপ জ্বলে। আজ সন্ধ্যায় আমি যতো পড়ছি, যতো প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করছি, ততো আর কখনো করি নি।
রওশন বলে, রাতে তুমি দেখতে অন্য রকম।
শওকত সাথে সাথে বলে, হ্যাঁ, চাঁদের মতোন। একটু থেমে বলে, এবার তুমি বলো রওশন রাতে দেখতে কেমন, শোনার জন্যে কিন্তু ইনি পাগল হয়ে আছেন।
রওশন রেগে ওঠে, না, আমি শুনতে চাই না। রওশন একটি কাগজে কী যেনো লিখে আমার হাতে দেয়, তাতে লেখা আছে। আসলে আমি শুনতে চাই আমি রাতে দেখতে কেমন?
আমি কাগজটির উল্টো পিঠে লিখি। চাঁদের আলোর মতো।
রওশন কাগজটি পড়ে হাতে ভাঁজ করে রেখে বলে, আমার কবরে একথাটি লেখা থাকবে।
শওকত বলে, এতো শিগগিরই কবরের কথা!
আমরা সবাই চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ; যেনো কোনো প্রিয়জনের জন্যে নীরবতা পালন করি। রওশন নীরবতা থেকে উদ্ধার করে আমাদের।
রওশন বলে, তোমার চাদরটি দেখতে খুব সুন্দর, আমার গায়ে দিতে খুব ইচ্ছে করছে।
গায়ে দিয়ে দেখো না, আমি বলি, তবে চাদরটা খুব খারাপ; এবং পেছন থেকে .চাদরটি তুলে রওশনের হাতে দিই; রওশন চাঁদরের নিচে আমার হাত ধরে থাকে।
রওশন চাদরটি গায়ে জড়ায়, চাঁদরে গাল ঘষে হাত ঘষে, আর বলে, তোমার চাঁদরে মিষ্টি গন্ধ।
শওকত বলে, তিব্বত পাউডারের গন্ধ, মাহবুব তিব্বত পাউডার মাখে।
ওটা আসলে চাঁদের গন্ধ, আমি হাসতে থাকি, মাঝেমাঝে চাদর গায়ে দিয়ে আমি চাদে বেড়াতে যাই।
আমাকে নাও না কেনো? রওশন মধুর হাসিতে টেবিল ভরিয়ে দেয়।
ডানা আছে তোমার, রওশন? আমি জিজ্ঞেস করি, বলি, চাদে যেতে লাখ লাখ ডানা দরকার।
তোমার তো আছে, রওশন বলে, আমাকে তো অন্তত কয়েকটি ধার দিতে পারো। বলো দেবে? আমার চোখের হাজার হাজার মাইল ভেতরে তাকায় রওশন, তাতে আমার চোখ স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে।
আমি শুধু টেবিলের নিচে রওশনের হাত আরো কোমল আরো উষ্ণ আরো উষ্ণ আরো কোমলভাবে মুঠোর ভেতরে জড়িয়ে ধরি।
রওশনের হঠাৎ মনে হয় আমার শীত লাগছে, আমি অবাক হই; আমার শীত। লাগছিলো না, আমি তো শুকনো খড়ের মতো জ্বলছিলাম, আমার শীত লাগতে পারে না; তবে আমার শীত লাগছে কি লাগছে না এটা আমার পক্ষে বোঝ হয়তো সম্ভব নয়, বুঝতে পারে শুধু রওশন; তাই রওশন যখন বলে, তোমার শীত লাগছে, তখন সত্যিই আমার শীত লাগতে থাকে। আমি রওশনের দিকে তাকাই, রওশন বুঝতে পারে আমার শীত লাগছে।
রওশন আবার বলে, তোমার শীত লাগছে; আমার চাদরটি তুমি গায়ে দাও।
আমি একটু বিব্রত বোধ করি, শওকত অবাক হয়ে তাকায় আমাদের দিকে। রওশন। চেয়ার ছেড়ে উঠে তার চাদরটি আমার গায়ে জড়িয়ে দেয়, জড়ানোর সময় আমার গ্রীবা নরমভাবে ছোয়, তাতে আমার শরীর থেকে সব শীত দূর হয়ে যায়। এ-গ্রীবায় আর কোনো দিন শীত লাগবে না। চাদর জড়িয়ে দিয়ে রওশন চেয়ারে গিয়ে বসে টেবিলের। ওপর চিবুক ঠেকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাতে আমাকে কেমন দেখায় রওশন তা চোখ ভরে দেখছে।
শওকত বলে, এবার তুমি বলো রওশনের চাঁদরের কেমন গন্ধ।
আমি রওশনের দিকে তাকাই।
রওশন বলে, শওকত যখন জানতেই চায়, বলোই না, নইলে ও কষ্ট পাবে।
আমি বলি, রওশনের চাঁদরে চাঁদের আলোর গন্ধ।
রওশন টেবিলের নিচে তার মুঠোতে আমার মুঠো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে। চাঁদের আলোর গন্ধে আমার বুক ভরে যায়, আমার মাংসের বাগানে কোটি কোটি রজনীগন্ধা। ফুটতে থাকে।
শওকত হারিকেন নিয়ে খেলতে শুরু করেছে, আলো বাড়াচ্ছে আবার কমাচ্ছে; তাতে রওশনকে আরো সুন্দর লাগছে, মনে হচ্ছে সব আলো নিভে গেলে আরো উজ্জ্বল। হয়ে উঠবে রওশন। শওকত আলো বাড়াচ্ছে, কমাচ্ছে, খুব মজা পাচ্ছে; আলো কমাতে গিয়ে হঠাৎ হারিকেন নিভে যায়।
যাও, এবার নিজে হারিকেন ধরিয়ে আনো, রওশন বলে। শওকত দুজনের দিকে তাকিয়ে হারিকেন নিয়ে বেরিয়ে যায়।
শওকত বেরিয়ে যেতেই আস্তে রওশন বলে, এই, তুমি এদিকে আসো তো একটু।
আমি দাঁড়াই, চেয়ার পেছনের দিকে ঠেলে পা বাড়াই, কিন্তু পা বাড়াতে পারি না; রওশন না এক স্বপ্ন যেনো দু-হাতে সারা শরীরে জড়িয়ে ধরে আমাকে।
আমাকেও ধরো, রওশন আস্তে বলে; আমি জড়িয়ে ধরি রওশনকে। স্বপ্নকে এই প্রথম আমি বাহুর ভেতরে পাই।
রওশন আমার গালে গাল ঘষে, একরাশ কোমল পালকের মতো চুল আমার মুখের ওপর ছড়িয়ে দেয়, এবং তুমি কাল দুপুরেই আসবে বলেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার চেয়ারে গিয়ে বসে।
আমি, খসে-পড়া এক পালক, চেয়ারে বসি আবার, আমরা কোনো কথা বলতে পারি না; যে-অসম্ভব কোমলতার ভেতর কিছুক্ষণ আগে আমার শরীরটি গিয়ে পড়েছিলো, আমি সেখান থেকে উঠে আসতে পারি না, আমি আরো কোমলতার মধ্যে ডুবে যেতে থাকি। এত দিন ধরে যে-পৃথিবীতে বেঁচে আছি আমি, সেটিকে স্পর্শ। করতে গিয়ে আমার কঠিনতার বোধই হয়েছে সাধারণত; কোমলতা যা বোধ করেছি তা আমাকে জলের, মেঘের, তুলোর, ফুলের বোধের বেশি কোনো বোধ দেয় নি; রওশনের হাত ছোঁয়ার পর আমার ত্বক বুঝেছে আরো এক কোমলতা আছে পৃথিবীতে, কিন্তু আজ আমি পরম কোমলতাকে পাই বাহুর ভেতরে বুকের ভেতরে। আমার বুক গলে যায়, আমি এখন আর রওশনকে জড়িয়ে ধরে নেই, কিন্তু আমি আমার পাজরে তাল তাল কোমলতা বোধ করছি, রওশন যে আর আর আর আর আমার আমার আমার আমার আমার কথা লিখেছিলো, সে-দুটির কোমলতা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে, পৃথিবীর সব গন্ধরাজ সব গোলাপ সব পালক আমার বুকে জড়ো হলেও এ-কোমলতাকে পাবো না আমি। এ-কোমলতা হচ্ছে রওশন। শওকত হারিকেন নিয়ে ফিরে আসে, আলোতে আমি রওশনকে চিনতে পারি না, রওশনও হয়তো চিনতে পারে না আমাকে।
বেশ রাত হয়েছে, এবার আমি উঠি। রওশন আমার সাথে নারকেল গাছ পর্যন্ত আসে। রওশনদের চাকর বারেক, যে আমার থেকে দশ বছর বড়ো হবে, হারিকেন নিয়ে চলে আমার সাথে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্যে। আমি ডুবে আছি রওশনের বাহুর মধ্যে বুকের মধ্যে তাল তাল কোমলতার মধ্যে; আমি স্বপ্নের সবুজ ঘাসের প্রান্তরে। হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগ্ধ বালকের মতো হাঁটছি।
বারেক বলে, মাহবুব ভাই, আপনে একটা মাখনের মতন বউ পাইবেন।
আমি কোনো কথা বলি না।
বারেক আবার বলে, রওশন আফা আপনার লিগা পাগল, সারা দিন পত চাইয়া থাকে। আপনে এমুন একটা বউ পাইবেন যা দুইন্নাইতে আর অয় না।
আমি কোনো কথা বলি না, বারেককে থামিয়ে দিতেও ইচ্ছে হয় না, বরং খুব ভালো লাগে বারেকের কথা। আমি চুপ করে থাকি; নইলে, আমার ভয় হয়, বারেক হয়তো বুঝে ফেলবে যে আমি মাখনের মধ্যে ডুবে আছি।
বাসায় ফিরে ভাতে আমি রওশনের কোমলতা বোধ করি, পানি পান করতে গিয়ে পানিতে আমি বোধ করি রওশনের কোমলতা, বই খুলতে গিয়ে বোধ করি ওই। কোমলতা। আমি যদি এখন লোহা ছুঁই, যদি আমার বুকে এসে লাগে কোনো পর্বত থেকে ছুটে আসা প্রকাণ্ড পাথরখণ্ড, তাহলেও আমি কোমলতা বোধ করবো। রওশন কীভাবে উঠে এসেছে চেয়ার থেকে আমি দেখি নি, কীভাবে জড়িয়ে ধরেছে আমাকে আমি দেখি নি; আমাকে জড়িয়ে ধরার সময় তার মুখ কেমন দেখিয়েছে, ঠোঁট বেঁকেছে কেমনভাবে, তাও আমি দেখি নি; আমি আজ সন্ধ্যায় রওশনকে দেখেছি শুধু আমার ত্বক আর নাসিকা দিয়ে। কোমলতা আর সুগন্ধ আমাকে ঢেকে ফেলেছে। রওশনের মাংস থেকে যে-গন্ধ আমার ভেতরে ঢুকেছে, আমি তার পরিচয় জানি না; ওই গন্ধ হয়তো হরিণের হয়তো বকুলের হয়তো ঘাসের হয়তো আগুনের হয়তো মেঘের হয়তো জ্যোৎস্নার হয়তো রক্তের, আমি জানি না, আমি কোনো দিন জানবো না। আমি বই খুলে বসি, জানালা দিয়ে নারকেল গাছ আর আকাশের দিকে তাকাই, কুয়াশা নেমে। আসছে দেখতে পাই, আমার শরীর আমার পাঁজর তাল তাল কোমলতায় ঢেকে যেতে থাকে।
রওশন যদি বেড়াতে গিয়ে থাকে? রওশনকে কি একা বাড়িতে রেখে যাবে রওশনের মা-বাবা? কি বলে রওশন বেড়াতে না গিয়ে বাড়িতে থাকবে? সকাল থেকেই এসব প্রশ্ন। দেখা দিচ্ছে আমার মনে। পড়তে ভালো লাগছে, পড়তে পড়তে রওশনকে ভাবতে সুখ লাগছে। রওশন যদি বেড়াতে না গিয়ে থাকে, কী করছে তাহলে রওশন? বই পড়ছে? আমার কথা ভাবছে? চিঠি লিখছে? যদি বেড়াতে গিয়ে থাকে, তাহলে কী করছে? আমার কথা ভাবছে? যদি রওশন বেড়াতে গিয়ে থাকে, তাহলে রওশন কি হাঁটতে পারছে? তার পা কি নদীপারের বালুতে আটকে যাচ্ছে না? না, রওশন বেড়াতে যেতে পারে না; রওশন বলেছে সে বেড়াতে যাবে না, তাই রওশন বেড়াতে যাবে না। আমার জন্যেই যাবে না; আমি কান্দিপাড়ায় নেই, আমি যেখানে নেই রওশন সেখানে কেননা যাবে! সেখানে রওশনের কী সুখ! আজ যদি আমাদের বাড়ির সবাই বেড়াতে যেতো, তাহলে আমি কি যেতাম? যেতাম না, সামনে আমার পরীক্ষা আছে বলে? সেজন্যে নয়, আমি যেতাম না, কারণ সেখানে রওশন নেই। তবে আমি ছেলে, আর সামনে আমার পরীক্ষা, তাই আমি বেড়াতে না যেতে পারি; কিন্তু রওশন যাবে না কেনো? সে মেয়ে, সামনে তার পরীক্ষাও নেই, তাই সে কী করে বেড়াতে না গিয়ে পারবে? ইচ্ছে হচ্ছে। একবার গিয়ে দেখে আসি; কিন্তু না, দুপুরের আগে যাবো না; রওশন দুপুরে যেতে। বলেছে আমাকে, দুপুরেই যাবো; দুপুর পর্যন্ত আমি শুধু রওশনকে ভাববো, আর পড়বো, আর রওশনের তাল তাল কোমলতা অনুভব করবো।
দুপুরে বেরিয়েই ভয় পাই আমি, যদি গিয়ে দেখি রওশন নেই? তখন আমি খুব অন্ধকার বোধ করবো না? আমি কি তখন বাড়ি ফিরে আসতে পারবো? তখন আমি কি কান্দিপাড়ার দিকে হাঁটতে শুরু করবো? পথে পথে রওশনের পায়ের দাগ খুঁজতে খুঁজতে হাঁটতে থাকবো? রওশনের পায়ের দাগ খুঁজতে আমার ভালো লাগবে। গিয়ে দেখি রওশন দাঁড়িয়ে আছে বাধানো কবরের পাশে; কবরটিকে আমার গোলাপবাগান বলে মনে হয়, কেননা তার পাশে এক বিশাল গোলাপের মতো ফুটে আছে রওশন।
সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, রওশন বলে, তোমার দুপুর এতো দেরি করে হয়!
আমার ভয় হচ্ছিলো তুমি হয়তো নেই, বেড়াতে গেছে, আমি বলি, কী যে ভয় করছিলো!
না থাকলে তুমি কী করতে? রওশন হাসে। কান্দিপাড়ার দিকে হাঁটতে থাকতাম, আমি বলি।
সত্যি? রওশনের চোখে লাল লাল গোলাপ ফুটতে থাকে; বলে, আজ বেড়াতে যেতে হলে আমি পাগল হয়ে যেতাম।
কেনো? আমি জানতে চাই বা আমি জানতে চাই না।
কারণ সেখানে তুমি নেই, রওশন বলে, তুমি যেখানে নেই সেখানে কিছু নেই। বলে আজকাল আমার মনে হয়।
আজকাল তোমার এমন ভুল মনে হয় কেনো? আমি হেসে বলি।
তা তুমি বুঝবে না, রওশন অভিমান করে; এবং আমার ভালো লাগতে থাকে একথা ভেবে যে রওশনের চোখের পাতায় হয়তো অশ্রুর সৌন্দর্য দেখতে পাবো। রওশন বলে, এটা অংক নয় যে তুমি সহজে বুঝবে।
রওশন আমাকে নিয়ে রওশনদের দোতলার দিকে হাঁটতে থাকে; আর বলে, আজ দোতলাটি আমাদের।
আমরা দোতলায় ঢুকি, রওশন দরোজা বন্ধ করে দেয়; সিঁড়ি দিয়ে আমরা ওপরে। উঠি;–আমাদের একজনের হাতে আরেকজনের হাত।
আজ তোমাকে আমার ঘর দেখাবো, রওশন বলে, তোমার একটুও ভালো লাগবে না, খুব বিচ্ছিরি আমার ঘর।
তোমার ঘরে ঢুকলে আমি পাগল হয়ে যাবো, আমি বলি।
কেনো? রওশন জিজ্ঞেস করে, আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে।
আমি জানি না, বলি আমি।
তোমাকে পাগল দেখতে আমার খুব ভালো লাগবে, হাসে রওশন, তবে একেবারে পাগল হয়ে যেয়ো না।
যদি হয়ে যাই? আমি বলি।
তাহলে পাগলের বউ হয়ে আমাকে থাকতে হবে চিরকাল, রওশন আমার চোখের মণির ভেতরে তার চোখের মণি গেঁথে দিয়ে হাসে।
আমার ভেতরটা কেঁপে ওঠে-বউ! কী সুন্দর শব্দ! রওশন বউ হবে আমার, রওশন নিজে বলছে একথা! সারা পৃথিবীকে, সব চাঁদতারাগ্রহনক্ষত্রকে, চিৎকার করে শোনাতে ইচ্ছে করছে। রওশন আমার খুব কাছাকাছি, আমার মুখোমুখি; দুটি হাত সে আমার। বাহুর ওপর রেখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি বলি, আবার ওই কথাটি বলো।
রওশন মুখ উঁচু করে আমার চোখে চোখ রেখে জলের ঘূর্ণির মতো তার ঠোঁট বাঁকিয়ে বনের সবচেয়ে সুন্দর পাখিটির মতো বলে, বউ।
আমি কাপছি, আরো শুনতে ইচ্ছে করছে আমার, বলি, কার?
রওশন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমার।
আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, আমার পৃথিবী কাঁপছে, চঞ্চল হয়ে নাচছে। আমি রওশনকে খুব আস্তে জড়িয়ে ধরি, তার চুলের ঘ্রাণ নিই, রওশন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
একটি ছোট্ট খাট রওশনের, একটি টেবিল রওশনের, টেবিলে কয়েকটি বই আর পাউডার আর স্নোর কৌটো রওশনের, একটি চেয়ার রওশনের, দুটি জানালা রওশনের, আর জানালা পেরিয়ে একটি বাঁশবাগানের সবুজ দৃশ্য রওশনের। রওশন আমাকে চেয়ারে বসতে বলে, আর সে পা ঝুলিয়ে বসে খাটে।
রওশন আমার হাত দুটি তার হাতে নিয়ে আঙুল দেখতে থাকে, নখ দেখতে থাকে, এবং বলে, এ-আঙুলগুলো কখনো ভালো করে দেখতে পাই নি।
আমি হাত টেনে নিতে চাই, রওশন বলে, এ-হাত দুটি আমার, তোমাকে শুধু রাখতে দিয়েছি, তাই বেশি টানাটানি কোরো না তো বলে হাসে রওশন।
আমি বলি, তোমার নখ সুন্দর।
রওশন বলে, মিছে কথা; তোমার নখ সুন্দর। দেখি তো তোমার নখ বড়ো হয়েছে কিনা?
রওশন আমার নখ খুঁটতে থাকে, আর বলে, তুমি একটু চুপ করে বসো, আমি তোমার নখ কেটে দিই। রওশন টেবিলের ড্রয়ার থেকে ব্লেড বের করে।
তুমি সত্যিই আমার নখ কাটবে নাকি? আমি হাত টেনে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বলি।
তুমি দেখো তো আমি কী করি, রওশন আমার হাত টেনে নিয়ে খুব মসৃণভাবে নখ কাটতে থাকে। নখের টুকরোগুলো সে জমিয়ে রাখে তার বাঁ হাতে; এবং বলে, জানো। এগুলো দিয়ে আমি কী করবো?
জানি না তো, আমি বলি।
একটি ছোট্ট লাল কৌটোতে নখের টুকরোগুলো রাখতে রাখতে রওশন বলে, এগুলো আমি জমিয়ে রাখবো, মাঝেমাঝে খুলে দেখবো এগুলো তোমার নখ, দেখতে আমার ভালো লাগবে।
আমি রওশনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, আর বলি, তুমি তো আমার নখ দেখবে, কিন্তু আমি কী দেখবো?
তোমার কী দেখতে ইচ্ছে করে? রওশন জিজ্ঞেস করে।
আমার ইচ্ছে করে কৌটোয় করে তোমার আঙুল আমার ড্রয়ারে রাখি, একটি আঙুল আমাকে দেবে? আমি বলি।
রওশন দু-হাত বাড়িয়ে বলে, তোমার যেটি ইচ্ছে করে কেটে নাও; বলো, তোমার কোনটি কেটে নিতে ইচ্ছে করে?
আমি আমার মুঠোর ভেতর রওশনের আঙুলগুলো চেপে ধরে রওশনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, বলি, সবগুলো।
রওশন বলে, নাও, এগুলো তোমার।
আমি রওশনের দু-হাতের আঙুলগুলো আমার গালে ঘষতে থাকি, কপালে ঘষতে থাকি, নাকে ঘষতে থাকি।
রওশন তর্জনীর ডগা দিয়ে আমার নাক ঘষতে ঘষতে বলে, তোমার নাকে খুব মিষ্টি মিষ্টি ঘাম জমেছে।
তাতে কী হয়েছে? আমি বলি।
তোমার বউ তোমাকে খুব ভালোবাসবে, রওশন হাসে।
আমার ইচ্ছে করছে রওশনকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু আমি ধরি না; যদি রওশন কিছু মনে করে।
রওশন বলে, তোমার একগুচ্ছ চুল যদি তুমি আমাকে দিতে!
কী করবে চুল দিয়ে? আমি বলি।
মাঝেমাঝে দেখবো, মনে হবে তোমাকে দেখছি, রওশন বলে, আজকাল সারাক্ষণ তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে। একটু থেমে বলে, আমাকে সারাক্ষণ দেখার ইচ্ছে যদি কারো হতো!
একজনের হয়, আমি জানি, আমি বলি, দিনরাত দেখার ইচ্ছে হয় তার।
রওশন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, একবার শুধু তুমি তার নাম বলো, আমার কানে কানে একবার শুধু তার নাম বলো।
আমি রওশনের কানে কানে বলি, মাহবুব।
রওশন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, তার নাম দুবার বলো, তিনবার বলো, চারবার বলো, একশোবার বলো, সারাদিন বলো, সারারাত বলো, মাহবুব, মাহবুব, মাহবুব।
রওশনের চুলে ঢেকে যাচ্ছে আমার নাকমুখ, সুগন্ধে ভরে উঠছে আমার আত্মা, আমার রক্ত। আমি রওশনের মাথাটি দু-হাতে ধরে চুলের ভেতর চোখ মুখ নাক। ঢুকিয়ে দিয়ে ঘ্রাণ নিই।
তোমার চুলের সুগন্ধে আমার প্রাণ ভরে গেছে, আমি বলি।
ইচ্ছে হলে আরো ঘ্রাণ নাও, রওশন বলে।
আমি রওশনের চুলের ঘ্রাণে আমার প্রাণ আরো ভরে তুলতে থাকি। তারপর রওশনের মুখটি আমি নিই আমার অঞ্জলিতে।
রওশন, তুমি চোখ বোজো, তোমাকে আমি দেখবো, আমি বলি।
রওশন চোখ বোজে; আমি রওশনের মুখের নতুন রূপ দেখে অন্ধ হয়ে যাই। রওশন অনেকক্ষণ পর চোখ খোলে, আমার মনে হয় আমাদের গ্রামে ভোর হলো। এখন ডালে। ডালে পাখি ডেকে উঠবে, ফুল ফুটবে।
রওশন আমার নাকের নিচে আঙুল বুলোয় আর বলে, তোমার গোঁফ উঠছে, কী। নরম। একটু পরে বলে, তুমি কিন্তু গোঁফ রেখো না।
আমি জিজ্ঞেস করি, কেনো? গোঁফ আমার ভাল্লাগে না, রওশন বলে, আর হাত বুলোতে থাকে আমার মুখে, গালে, চিবুকে, গলায়।
তোমাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে, আমার গলায় হাত বুলোতে বুলোতে রওশন বলে, প্রাণভরে দেখতে ইচ্ছে করছে।
আমি তো তোমার সামনেই বসে আছি, রওশন, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না? আমি বলি।
রওশন হাসে, আর বলে, না, শুধু তোমার মুখ দেখছি, তোমাকে তো দেখতে পাচ্ছি না। তারপর বলে, আমি একটু তোমাকে দেখি?
কীভাবে তুমি দেখতে চাও? আমি বলি।
আমার ইচ্ছে করে জামা খুলে তোমাকে দেখতে, আমার খুব ইচ্ছে করে, রওশন বলে, মনে হয় জামার ভেতরে তুমি আরো সুন্দর।
আমার লজ্জা লাগবে, রওশন, আমি বলি।
কিন্তু আমার যে দেখতে ইচ্ছে করে, রওশন বলে, একটু দেখি?
দেখো, আমি বলি।
রওশন একটি একটি করে আমার জামার বোতাম খোলে, আর ডান হাত আমার বুকের ওপর বুলোতে থাকে। রওশন জামাটি খুলে নিতে পারে না, আমি মাথার ওপর। দিয়ে খুলে জামাটি রওশনের হাতে দিই। নিচে গেঞ্জিও আছে, রওশন নিজেই আস্তে। আস্তে গেঞ্জিটি খোলে। শীতকাল, কিন্তু আমার শীত লাগছে না। আমি ভুলে যাচ্ছি আমি কোথায় আছি। রওশন আস্তে আস্তে হাত বুলোতে থাকে আমার শরীরে; আমি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকি।
তোমার শরীর কী যে সুন্দর, রওশন বলে। আমি কথা বলি না।
তোমার এ-তিলটি তুমি কখনো দেখো নি, আমার পিঠের এক জায়গায় আঙুল রেখে রওশন বলে, তিলটি আমি দেখলাম। তিলটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ওই তিলটি তোমাকে দিলাম, আমি বলি।
রওশন আমার বুকে আঙুল দিয়ে একটু ঘষে, আর বলে, দেখো, কী সুন্দর লাল হয়ে উঠলো; এই লালটুকু আমার।
রওশনের মুখের দিকে আমি তাকিয়ে দেখি তার চোখ জুড়ে স্বপ্ন ভাসছে, সে হয়তো আমার শরীর দেখছে না, অন্য কিছু দেখছে, দেখতে দেখতে তারও চোখ অন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
জানো, তোমার শরীর আমি দিনের পর দিন ধরে দেখতে পারি, রওশন বলে, দেখে দেখে আমার সাধ মিটবে না।
রওশন, তুমি আর কতোক্ষণ দেখবে? আমি বলি, আমার ঘুম পাচ্ছে।
তুমি ঘুমোও আর আমি তোমাকে দেখি, রওশন বলে, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
তারপর যে আমি আর কোনোদিন ঘুমাতে পারবে না, আমি বলি।
কেনো? রওশন জানতে চায়।
আমি জানি না, আমি বলি।
রওশন আমার শরীরে হাত বুলোতে থাকে, আর বলে, কী যে সুন্দর, কী যে সুন্দর, সারাজীবন চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
আমি রওশনকে ডাকি, রওশন।
রওশন বলে, কী?
তোমাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে, আমি বলি, তোমাকে দেখতে আমার খুব ইচ্ছে করছে।
রওশন বলে, সত্যিই তুমি দেখতে চাও?
চাই, আমি বলি।
তাহলে দেখো, বলে রওশন চোখ বোজে, এবং বলে, তবে ছুঁয়ো না আমাকে।
আচ্ছা, আমি বলি।
কিন্তু আমি কী করবো বুঝতে পারি না, যেনো আমি খুব গরিব, আমার সামনে। কোনো দেবতা মণিমাণিক্যের সিন্দুক হাজির করে খুলে দেখতে বলছে, কিন্তু আমি খুলতে জানি না। আমার হাত থেকে বারবার সোনার চাবি মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, তুলতে গিয়ে আবার পড়ে যাচ্ছে; সোনার চাবি তুলতে তুলতে আমার সারা জীবন কেটে যাবে, আমি কোনো দিন সিন্দুক খুলে দেখতে পারবো না।
রওশন বলছে, তুমি দেখবে না?
দেখবো, আমি বলি।
রওশনের কামিজের পেছনে স্বপ্নের ঘোরে বারবার পথ হারিয়ে ফেলতে ফেলতে। আমি হাত বুলোই; বোতামগুলোকে একেকটি সোনার তালা মনে হয়; একটি একটি করে খুলতে চেষ্টা করি আমি, আমার আঙুল কাঁপতে থাকে, সারা শরীর কাঁপতে থাকে, রওশন চোখ বুজে আছে, একটি একটি করে সিন্দুকের সোনার তালা খুলছি আমি। আমি রওশনের কামিজ টেনে নিচের দিকে নামাই, মনে হয় হাত দিয়ে আমি মেঘ সরিয়ে দিচ্ছি, আমার হাত কাঁপতে থাকে। রওশনের ধবধবে কাঁধ থেকে আমার চোখে চাঁদের বন্যার মতো মাংসের আলো ঢুকতে থাকে। রওশন একটুও নড়ে না। আমি কামিজের মেঘ টেনে আরো নিচে নামাই; আমার চোখের সামনে দুটি চাঁদ জ্বলে ওঠে, দুটি শুভ্র পদ্ম স্থির হয়ে ফুটে ওঠে। বাঁ দিকের চাঁদটিকে একটু ছোটো মনে হয় ডান। দিকের চাঁদের থেকে। মহাকালের মুখোমুখি আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। আমার ছুঁতে ইচ্ছে করে ওই চাঁদ, ওই পদ্ম; কিন্তু রওশন ছুঁতে নিষেধ করেছে, আমি ছুঁই না; আমি শুধু অন্ধ চোখ দিয়ে যুগল চাঁদ যুগল পদ্ম দেখতে থাকি। আমার। চামড়া ফেটে শরীরের সব দিক থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরোতে চায়; পদ্মার ঢেউয়ের ওপর আমি একটি ছোট্ট নৌকো প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকি নিজেকে সমস্ত ঢেউয়ের। মধ্যে স্থির করে রাখতে।
তুমি কি আমাকে দেখছো? রওশন জিজ্ঞেস করে।
দেখছি, আমি বলি, কিন্তু মনে হচ্ছে আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
তুমি কি অন্ধ হয়ে গেছো? রওশন বলে, এবং চোখ খুলে আমার মুখের দিকে তাকায়।
আমি রওশনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
তোমার কি শুধু এটুকুই দেখতে ইচ্ছে করছে? রওশন বলে, আমার কিন্তু তোমাকে পুরোপুরি দেখতে ইচ্ছে করছে।
আমিও তোমাকে পুরোপুরি দেখতে চাই, আমি বলি।
রওশন চোখ বোজে, আমি রওশনের সালোয়ার মেঘের মতো টেনে সরিয়ে মেঝেতে রাখি। জ্যোত্সার বন্যায় খাট ভেসে যায়, ঘর ভরে যায়।
আমি চোখ বুজি, রওশন আমার লুঙ্গি সরিয়ে মেঝেতে রাখে।
আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকাই।
তুমি সুন্দর, রওশন বলে।
তুমি সুন্দর, আমি বলি।
আমরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি, কেউ কাউকে ছুঁইছি না, দেখছি একজন আরেকজনকে, দেখতে দেখতে অন্ধ হয়ে যাচ্ছি।
আমাদের শরীর নিয়ে আমরা কী করবো? আমি বলি।
আমাদের জন্যে রেখে দেবো, রওশন বলে।
সেই ভালো, আমি বলি।
রওশন বলে, তোমাকে আমার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।
একবার আমরা জড়িয়ে ধরি আমাদের? আমি বলি।
না, আজ নয়, আজ নয়, সেই একদিন, রওশন বলে।
রওশন সালোয়ারকামিজ পরতে থাকে; আমিও কাপড় পরি, এবং চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি।
চোখ খোলো, রওশন বলে।
চোখ খুলে আমি রওশনের দিকে তাকাই, রওশন হেমন্তের কাশবনে চাঁদের আলোর মতো হাসে; চাঁদের মতোই সুদূর মনে হয় রওশনকে; আমি সিঁড়ির দিকে হাঁটতে থাকি, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামি, দরোজা খুলে বাইরে বেরোই; সব কিছু আমার অচেনা লাগে। ওই নারকেল গাছ আমি আগে দেখি নি, এই মাটি আমি আগে দেখি নি, বাতাসের এমন ছোঁয়া আমি আগে পাই নি। আমি পেছনের দিকে ফিরে তাকাই একবার, দেখি। বারান্দায় রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে রওশন তাকিয়ে আছে। আমি নদীর দিকে হাঁটতে থাকি, আমি কিছু দেখতে পাই না; নদীর পারে এসে দেখি রওশনের শরীরের মতো পদ্ম বয়ে চলছে।
আমি কয়েক দিন রওশনদের বাড়ি যাচ্ছি না, তবে যাচ্ছি না আমার এমন মনে হচ্ছে না , মনে হচ্ছে আমি রওশনের সাথে দোতলায় রয়েছি, রওশন দেখছে আমাকে আমি দেখছি রওশনকে; যা তখন আমি দেখতে পাই নি এখন দেখতে পাচ্ছি, রওশনের গ্রীবার নিচের লাল তিলটিকে মনে পড়ছে, তিলটিকে একটি নাম দিতে ইচ্ছে করছে, ওর নাম লাল শুকতারা; আলতাভ দুটি বৃত্ত আমার চোখের সামনে ঘুরছে, রওশনের চাঁদের শীর্ষে গোলাপকুঁড়ি, দুটি চাঁদের শীর্ষে দুটি গোলাপকুঁড়ি, আলতাভ বৃত্ত ঘিরে আছে কুঁড়ি। দুটিকে; একখণ্ড মেঘের কথা মনে পড়ছে, হাল্কা মেঘ, আকাশের এককোণে ভিড়ে আছে; তবে আমি তাকালেই লাল রঙলাগা চাঁদ দেখছি চোখ বন্ধ করলেই লাল রঙলাগা চাঁদ দেখছি। প্রত্যেক বিকেলে বেরোই, কিছু দূর হটি রওশনদের বাড়ির দিকে, তারপর লাল রঙলাগা চাঁদ দেখতে দেখতে নদীর দিকে চলে যাই, ধানখেতের দিকে যাই, এক দিন বাজারেও গিয়ে চা খাই। শওকত আজ এসেছে, শওকত আমাকে ওদের বাড়ি যেতে বলছে না, ও ভীষণ দুষ্ট, যেতে বলবে না, কিন্তু আমাকে আজ যেতে হবে।
শওকত বাড়ি যাবে না এখন, আমাকে একলাই যেতে হবে।
বাঁধানো কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে রওশন, যেখানে রওশনকে না দেখলে আমি অন্ধকার দেখতাম। রওশন খুব গম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে আছে, এমন গম্ভীর আমি রওশনকে কখনো দেখি নি। গম্ভীরভাবেও রওশন সুন্দর।
তুমি কেমন আছো? আমি জিজ্ঞেস করি।
তুমি কেমন আছো? রওশন বলে।
আমরা দুজনে বসার ঘরে ঢুকি, আমি আমার চেয়ারটিতে বসি, এবং হাত বাড়িয়ে রওশনের হাত ধরি।
তুমি আমাকে ভুলে গেছো, রওশন বলে, আমি তোমাকে ভুলি নি।
আমিও ভুলি নি, আমি বলি।
তাহলে কেনো আসো নি? রওশন বলে।
আমি পাগল হয়ে গেছি, আমি হেসে হেসে বলি, একমাত্র পাগল পূর্ব পাকিস্থানে।
পাগল হলে তো সেদিনই আবার আসতে, রওশন এবার হাসে, আমার বুকে ঝলক দিয়ে রোদ ওঠে। রওশন আমার মুঠো ধরে জোরে টান দিয়ে বলে, পাগল হলে। সেদিনই কেনো হলে না? আমার সামনেই কেনো হলে না? পাগল হলে তোমাকে কেমন লাগে আমি দেখতাম!
তখন পাগল হলে তোমার খুব বিপদ ছিলো, লাফিয়ে হয়তো জানালা দিয়ে বাঁশঝাপের ভেতর পড়ে যেতাম, তখন তোমার অনেক কষ্ট হতো, আমি বলি।
কোনোই কষ্ট হতো না, রওশন বলে, আমিও তোমার সাথে বাঁশঝাপে লাফিয়ে পড়তাম, খুব চমৎকার হতো! সবাই এসে দেখতে আমরা দুজন ঝুলে আছি!
তারপর তুলে এনে একসাথে কবর দিতো, আমি বলি।
পাগল হলে, রওশন বলে, মানুষ নাকি বিড়বিড় করে নানা কিছু বলে, চোখের সামনে নানা কিছু দেখে; আচ্ছা, তুমি কী বলছো আর কী দেখছো?
আমি দিনরাত বলছি লাল শুকতারা, লাল শুকতারা, আর দেখছি লাল শুকতারা, আমি বলি।
লাল শুকতারা? রওশন বলে।
আমি নাম দিয়েছি, আমি বলি।
কার? রওশন জানতে চায়।
তোমার গ্রীবার নিচের লাল তিলটির, আমি বলি।
রওশন কোমলভাবে তাকায়, বলে, আর কী দেখছো?
গোলাপকুঁড়ি, আমি বলি।
রওশন আরো নিবিড়ভাবে আমার হাত ধরে আমার চোখের ভেতরে তার চোখের
সমস্ত আলো আর ছায়া স্থির করে জিজ্ঞেস করে, আর?
লাল রঙলাগা চাঁদ, আমি বলি। রওশন আরো শক্ত করে আমার মুঠো ধরে বলে, আর?
আকাশের কোণে একখণ্ড মেঘ, আমি বলি।
রওশন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমাকে ভালোবাসি, মাহবুব।
আমাদের যেনো কী হয়েছে, খুব গভীর কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে, নইলে এমন হবে কেনো, আমাদের এমন লাগবে কেনো? আগে তো আমরা হাতে হাত রেখে খুব। সুখে ছিলাম, এতো সুখে ছিলাম যা কখনো কেউ থাকে নি। কিন্তু এখন শুধু হাত ধরে কেনো সাধ মেটে না? রওশন এটাও প্রথম আবিষ্কার করে, বা রওশনই প্রথম। এ-আবিষ্কারটি প্রকাশ করে, তাই এর কৃতিত্ব তারই প্রাপ্য। আমিও যে বোধ করি নি, তা নয়; কিন্তু প্রকাশ করি নি; রওশন কী মনে করবে, এমন এক দ্বিধা আমার মনে থেকেই যায় সব সময়; কিন্তু রওশনের কোনো দ্বিধা নেই, সত্যকে সে সত্যের মতোই প্রকাশ করে-আমার কাছে। আমি কি একটু কপট? পনেরো বছরেই? পুরুষ হলে কি একটু কপট হতে হয়? দোতলার দিন আমি বুঝতে পারি নি আমাদের শরীর নিয়ে। আমরা কী করবো, যদিও আমি অনুভব করি যে আমাদের শরীর নিয়ে কিছু একটা আমাদের করার কথা। আমার অনেক ভাবনাই আজকাল আমাকে অবাক করে দিয়ে, অনেক সময় ভীত করে দিয়ে, বদলে যাচ্ছে; এক সময় আমি ভাবতাম রওশন আর। আমি চিরকাল শুধু মুখোমুখি হাত ধরে বসে থাকবো, রওশন হাসবে আমি দেখবো, আমি কথা বলবো রওশন শুনবে, আমরা আর কিছু করবো না, আমরা কখনো অসভ্য হবো না। কিন্তু আমার দিন দিন ভয় হচ্ছে আমরা হয়তো অসভ্য না হয়ে পারবো না; অন্যদের মতো আমরাও অসভ্য হয়ে যাবে। তবে অসভ্য কীভাবে হতে হয় আমি পুরোপুরি জানি না, রওশনও হয়তো জানে না; কিন্তু একদিন আমি জেনে নিশ্চয়ই ফেলবো কীভাবে সত্যিকার অসভ্য হতে হয়, রওশনও জানবে; তখন হয়তো আমাদের সব সময় অসভ্য হতে ইচ্ছে করবে। রওশনই প্রথম প্রকাশ করে যে হাত ধরে আর সাধ মিটছে, কিন্তু হাত ধরা ছাড়া আর কী করলে সাধ মিটবে, তা বুঝতে পারছে না। রওশন; এবং আমিও বুঝতে পারছি না।
জানো, রওশন খুব আস্তে বলে, শুধু হাত ধরে আর সাধ মিটছে না।
আমারও, আমি বলি, হাত ধরেও মনে হয় আমরা অনেক দূরে।
কী অবাক কাণ্ড না! রওশন বলে, একদিন তো হাত ধরেই সুখে গলে যেতাম, আর এখন মনে হয় কী যেনো চামড়ায় এসে আটকে যাচ্ছে, বেরোতে পারছে না!
শওকত এসে ঢোকে এমন সময়, আমরা বীজগণিত নিয়ে আলোচনা শুরু করি। রওশন খুব আগ্রহের সাথে বীজগণিত শিখতে থাকে। শওকত চলে যায়, আমরা আবার আমাদের বিস্ময় নিয়ে বিস্মিত হতে থাকি।
কী যে করি, কী যে করি, রওশন বলে, কী করলে যে মনে হবে তোমাকে ধরে আছি!
আমার ইচ্ছে করে, আমি বলি, আমার আর তোমার আঙুল কেটে আমার আঙুলের রগ তোমার আঙুলের রগের সাথে জোড়া দিয়ে দিই।
রওশন বলে, সেই ভালো, সেই ভালো; তাহলে আমাদের রক্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে, আমাদের সাধ মিটবে।
তবে এ-পদ্ধতি সম্ভবপর বলে মনে হয় না; আমাদের মাত্র পনেরো বছর বয়স হলেও আমরা বুঝতে পারি আঙুল আর রগ কাটাকাটি বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটাবে, রগ জোড়া দেয়ার আগেই রক্তে আর আমাদের চিঙ্কারে চারদিক ভরে উঠবে। রওশন তখন নতুন একটি পদ্ধতি প্রস্তাব করে।
রওশন বলে, একটি কাজ করতে পারি, প্রতিদিন আমরা একবার নিজেদের জড়িয়ে ধরবো।
কেউ যদি দেখে ফেলে? আমি বলি।
রওশন খুব চিন্তিত হয়, বলে, তার সম্ভাবনা আছে।
তাহলে কী করবো? আমি বলি।
খুব সাবধানে দেখেশুনে নিতে হবে, রওশন বলে, একটু জরিপ করে নিতে হবে। জরিপটা আমিই করবো।
তাহলে সুখ লাগবে না, আমি বলি।
ঠিকই, রওশন বলে, তবে যেদিন সুযোগ পাবো, সেদিন। একটু পর রওশন বলে, আচ্ছা, এর কোনো দেবতাটেবতা নেই, যে একটু সুযোগ করে দিতে পারে? না হয়। বিকেলবেলা আমরা হিন্দুই হয়ে যাবো।
একটি আছে বলে আমি শুনেছি, আমি বলি, তবে সেটা সুযোগ করে দিতে পারে, শুধু তীর ছুঁড়তে পারে।
তাই হবে, রওশন বলে, আমার শরীরে অনেক তীর ফুটছে বলে মনে হচ্ছে।
রওশন একটু জরিপ করতে যায়, আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে আলমারিটার। কোণায়; এবং ফিরে এসেই জড়িয়ে ধরে আমাকে, সাথেসাথে দূরে সরে যায়।
না, এতে মন ভরলো না, রওশন বলে।
একটু ব্যায়াম হলো, আমি বলি; আর রওশন খিলখিল করে হেসে ওঠে।
তুমি একটু ভেবো, রওশন বলে, একটি উপায় বের কোরো, এটাই আমার প্রথম বায়না তোমার কাছে।
কোনো উপায় বের করতে পারি না আমি, রওশনের প্রথম বায়নাটি আমি বোধ হয় রাখতে পারবো না; আমার শুধু মনে হতে থাকে আমাদের রক্ত আর মাংস অসভ্য হয়ে। উঠছে, খুব অসভ্য হয়ে উঠতে চাইছে। আমি ভয় পেতে থাকি আমি বোধ হয় আর রওশনের মুখের দিকে চিরকাল তাকিয়ে থাকতে পারবো না, শুধু রওশনের হাসি দেখেই আমার বুক সুখে ভরে উঠবে না; রওশনও শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আর আমার কথা শুনে শুনে সুখে ভরে উঠতে পারবে না। আমরা বদলে যাচ্ছি, আমাদের সুখ বদলে যাচ্ছে, আমাদের রক্ত বদলে যাচ্ছে, আমাদের মাংস বদলে যাচ্ছে। সুখ চিরকাল একরকম থাকে না কেনো, চিরকাল একইভাবে কেনো সুখ পাওয়া যায় না! আমাদের কি কেউ অভিশাপ দিয়েছে দেবতাটেবতা বা ফেরেশতাটেরেশতা কেউ কি আকাশ থেকে দেখতে পেয়েছে আমরা হাতে হাত রেখে খুব সুখ পাই, দেখে তাদের খুব ঈর্ষা হয়েছে; এবং অভিশাপ দিয়েছে তোমরা আর শুধু হাত ছুঁয়ে সুখ পাবে না, শুধু। মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সুখ পাবে না? আমার তাই মনে হয়; তাদের অভিশাপে। আমাদের রক্ত জ্বলছে মাংস পুড়ছে; নিজেদের পোড়া রক্তমাংসের গন্ধে আমাদের জগত ভরে উঠছে। রওশন আমাকে বলেছে তার মাংস জ্বলে, রক্ত পোড়ে; আমিও বোধ করছি আমার মাংস পোড়ে রক্ত জ্বলে। সেখান থেকে অসহ্য সুগন্ধ উঠছে। কয়েক মাস আগে আমি একটি উপন্যাস পড়েছিলাম, আমার মনে পড়ে, তাতে এক জায়গায় লেখা ছিলো, তাহারা চুম্বন করিল। পড়ে আমার রক্ত ঝনঝন করে উঠেছিলো। ঠিক রওশন ও আমার মতোই ওই উপন্যাসের নায়কনায়িকার রক্ত আর মাংস জ্বলছিলো পুড়ছিলো; চুম্বন করে তাদের শরীর ঠাণ্ডা হয়েছিলো। রওশনকে আমি সে-কথা বলি; রওশন প্রথম লজ্জা পায়, কিন্তু আমরা দুজন বুঝে উঠতে পারি না চুম্বন কীভাবে করতে হয়। আমি বলি চুম্বন গালে করতে হয়, ঠোঁট আস্তে গালে ছোঁয়ালেই চুম্বন হয়; রওশন বলে চুম্বন হাতের উল্টোপিঠে করতে হয়। আমরা কয়েক দিন ঠোঁট দিয়ে গাল আর হাত স্পর্শ। করি; প্রথম আমাদের একটু অদ্ভুত অনুভূতি হয়, কিন্তু পরে তা আর যথেষ্ট মনে হয় না; আমরা যা চাই, আমাদের রক্ত যা চায়, তা ওই চুম্বন নয়।
আমাদের শরীরের ভেতর কী আছে, আমাদের রক্তে আর মাংসে এখন কী জমছে? সুধা না বিষ? রওশন বলে তার মনে হচ্ছে তার রক্তে বিষ জমছে, তবে অন্য রকম বিষ, এমন এক ধরনের বিষ, যা খুব মধুর, যা খুব মিষ্টি, যাতে মানুষ মরে না, মানুষ পাগল হয়ে ওঠে। আমারও তাই মনে হয়। রওশনকে আমি মনে করিয়ে দিই রওশন একবার লিখেছিলো যে আমিই পান করবো তার যৌবন সুধা। রওশন বলে যখন সে লিখেছিলো তখন সে পুরোপুরি বুঝতে পারে নি সে কী লিখছে। রওশন ভুলো না আমায় নামের একটি বইতে কথাটি পেয়েছিলো, পড়ে রওশনের ভালো লেগেছিলো, রওশনের শরীর কেমন করে উঠেছিলো, অনেক দিন ধরে কথাটি রওশনের মনের ভেতরে গানের মতো বাজছিলো, আর চিঠিতে ওই কথাটি লিখে রওশন সুখ পেয়েছিলো। এখন রওশনের মনে হচ্ছে তার শরীরে সুধা জমছে, আমার মনে হচ্ছে আমার শরীরেও সুধা জমছে; একদিন আমরা ওই সুধা পান করবো। সে-একদিন কতো দূর? অনেক দূর? ততো দিন কি আমরা বাঁচবো? পিপাসায় আমরা মরে যাবো না? আমাদের বেঁচে থাকতেই হবে, আমরা প্রাণ ভরে পান করবো আমাদের সুধা। তখন আমাদের অসভ্য মনে হবে না, আমাদের সুধা তো আমাদেরই পান করতে হবে। রওশনকে আমি একটি কথা কিছুতেই বলতে পারছি না, রওশন আমাকে অসভ্য ভাববে, তাই বলতে পারছি না। আমি এক সময় নিজের শরীর থেকে মধু আহরণ করতাম, মধুর চাক ভেঙে সুখে ক্লান্তিতে ভরে যেতাম। সেভাবেই আমাদের মধু আহরণ করতে হবে, নিজের শরীর থেকে নয়, পরস্পরের শরীর থেকে; রওশনের মধুর চাক ভাঙবো আমি, আমার মধুর চাক ভাঙবে রওশন; রওশনের সুধা পান করবো আমি, আমার সুধা পান করবে রওশন। আমাদের। শরীর বেয়ে বেয়ে সুধা ঝরতে থাকবে, আমার মুখ থেকে সুধা ঝরবে, রওশনের মুখ থেকে সুধা ঝরবে; সুধায় আমাদের শরীর ভিজে যাবে, বালিশ ভিজে যাবে, বিছানা ভিজে যাবে; আমাদের শরীরের প্রতিটি ছিদ্র দিয়ে সুধা ঝরতে থাকবে। সুধা পান করতে হলে অসভ্য হতে হবে আমাদের। খুব অসভ্য, অত্যন্ত অসভ্য, জঘন্য অসভ্য হতে হবে। আমাদের। সবাই অসভ্য হয়; আদম-হাওয়াও অসভ্য হয়েছিলো। আমার আজ মনে। হচ্ছে আমি পারবো অসভ্য হতে, কিন্তু রওশন কি পারবে?
রওশনকে একদিন আমি জিজ্ঞেস করি, রওশন, তুমি কি অসভ্য হতে পারবে?
রওশন বিস্মিত হয়, অসভ্য? অসভ্য কেনো হতে হবে?
আমি বলি, এই যে হাত ছুঁয়ে আমরা আর আগের মতো সুখ পাচ্ছি না।
রওশন বলে, হ্যাঁ, পাচ্ছি না।
আমি বলি, এই যে একবার জড়িয়ে ধরে আমরা আর সুখ পাচ্ছি না।
রওশন বলে, হ্যাঁ, পাচ্ছি না।
আমি বলি, সুখ পেতে হলে আমাদের খুব অসভ্য হতে হবে।
রওশন আমার চোখে গভীরভাবে তাকায়, আস্তে বলে, খুব অসভ্য হতে পারবো আমি তোমার সাথে, তবে আজ নয়, সেই একদিন।
অনেক রাত জেগে আমি পড়তে থাকি; আমার আর কিছু পড়ার নেই, সব মুখস্থ হয়ে গেছে, তবু আমি পড়তে থাকি, চিৎকার করে পড়তে থাকি; কেননা চোখ বুজলেই আমি দেখতে পাই রওশন আর আমি অসভ্য হয়ে গেছি, মাছের মতো পারদের মতো জলের ভেতরে আমরা অসভ্য হয়ে উঠেছি, আমাদের শরীর থেকে মধু ঝরছে, সুধা ঝরছে। আমি দেখতে পাই আমরা জড়িয়ে যাচ্ছি, আমাদের পৃথক করা যাচ্ছে না, আমরা এক হয়ে যাচ্ছি, আমি হারিয়ে যাচ্ছি লাল রঙলাগা চাঁদের ভেতরে, গোলাপকুঁড়ির ভেতরে, একখণ্ড মেঘের ভেতরে। আমি আর আমাকে খুঁজে পাচ্ছি না। পারদ জলের। ভেতরে রওশনের চুল ছড়িয়ে পড়েছে, মাছের মতো আমি আটকে যাচ্ছি রওশনের চুলের জালে, শ্যাওলায়, কচুরিপানায়, শৈবালে। রওশন বলেছে সে আমার সাথে খুব অসভ্য হতে পারবে, খুব অসভ্য হতে পারবে, আমার সাথে, শুধু আমার সাথে।
প্রবেশিকা পরীক্ষাটি আমি খুবই ভালো দিই, এতো ভালো দেবো আগে ভাবি নি, রওশনের জন্যেই আমি এতো ভালো দিই-রওশন গর্ব করবে আমাকে নিয়ে। আমি ছাড়া আর গর্ব করার রওশনের কী আছে। রওশন সুন্দর, তা নিয়ে সে গর্ব করতে পারে; কিন্তু রওশন যে সুন্দর তা তো আমার গর্ব। আমি যাকে ভালোবাসি, সে সুন্দর; এটা আমার গর্ব। রওশন গর্ব করবে আমাকে নিয়ে। আট দিন পর মুনশিগঞ্জ থেকে ফিরে। বিকেলে আমি রওশনদের বাড়ি যাই। আমি অবাক হই, আর আমার খারাপ লাগে যে রওশন বাঁধানো কবরের পাশে নেই। আমি বসার ঘরে ঢুকি, কিন্তু রওশন নেই। শওকত আমাকে দেখে দৌড়ে আসে।
শওকত বলে, রওশন মারা গেছে।
আমি চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠি, কী বলছো তুমি?
শওকত হাসে, তুমি এসেছো আর রওশন এ-ঘরে নেই, এতে বুঝতে পারছো না যে রওশন মারা গেছে?
আমি বলি, সত্যি করে বলো কী হয়েছে?
রওশনের মা ঘরে ঢুকছেন দেখে আমি অবাক হই, তিনি তো কখনো এ-ঘরে আসেন না। আমি দাঁড়িয়ে সালাম দিই। তিনি আমার চুলে হাত বুলিয়ে দোয়া করেন। শওকতকে চলে যেতে বলে তিনি চেয়ারে বসেন, এবং রওশনকে ডাকেন। রওশন তাঁর ডাক শুনে এসে দাঁড়ায়।
রওশনের মা বলেন, বাবা, তুমি একবার রওশনকে দেখো।
আমি রওশনের দিকে তাকাতেই রওশন দু-হাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে ওঠে, দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
রওশনের মা বলেন, বাবা, তোমাকে ছেলের মতো পেলে আমাদের সুখের সীমা থাকতো না, রওশনেরও সুখের সীমা থাকতো না।
আমি মাথা নিচু করে কান্না চাপতে থাকি।
রওশনের মা বলেন, তা তো হওয়ার নয়, রওশন বড়ো হয়েছে, আর তোমার অনেক লেখাপড়া বাকি।
আমি কেঁদে ফেলি।
তিনি বলেন, রওশনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তুমি ওকে দোয়া কোরো।
রওশনের মাকে সালাম দিয়ে টলতে টলতে আমি বেরিয়ে আসি।