৩. শিশির-ভেজা

সকাল হইলে আমরা গাছ হইতে নামিয়া, শিশির-ভেজা তৃণক্ষেত্রের মধ্য দিয়া সমুদ্রতীরে আসিলাম, সেখানে বসিয়া বসিয়া সমুদ্রের শোভা দেখিলাম। পরে ডিঙিতে চড়িয়া বাড়ি ফিরি। আসিবার সময় নিবারণকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, সেই জিজ্ঞাসাটা আমার জীবনে একটা মস্ত বড়ো কাজ করিল। এখনও তাহা ভাবি। নিবারণকে বলিলাম–নিবারণ, আমাদের বাড়ি থেকে মগের ট্যাঁক কতদূর?

নিবারণ বলিল–কোশ খানেক।

আমি উহাকে কিছু বলি নাই, কিন্তু মনে ভাবি, এক ক্রোশ তো দূর, তবে মাঝে মাঝে একাই আসিব। সমুদ্রের এমন দৃশ্য–কোথায় পাইব এমন রূপ!

মনুর বাবা আজকাল আমার উপর খুব সন্তুষ্ট। কোথাও যাইতে-আসিতে আমার আর কোনো বাধা নাই। সেদিন ইহারা আমার মেজাজ বুঝিয়া লইয়াছেন। আমার সঙ্গে অনেক পরামর্শ করিয়াছেন, পুলিশের ভয় ক্রমেই বাড়িতেছে, সেদিন আর নাই। মনুকে লেখাপড়া শিখাইয়া আরাকানে সেগুন কাঠের ব্যাবসা করিয়া দিলে কেমন হয়। আমরা দুই ভাই সেই ব্যাবসা চালাইতে পারিব না? আমি বলিয়াছি–আমাকে ছাড়িয়া দিন, দেশের ছেলে দেশে ফিরিয়া যাই। মনুর বাবা না-ও বলেন না, হাঁ-ও বলেন না।

কিন্তু ও বিষয়ে পাকাপাকি স্থির করিল নিয়তি। তাহাই বলিতেছি। আমার সেদিনের উদারতার পুরস্কারস্বরূপ নিয়তি আমাকে হাত ধরিয়া চালাইল।

শরৎকাল তখন শেষ হইয়া আসিতেছিল। এই সময় মগের ট্যাঁকে তৃণভূমি জাগিয়া উঠে। নতুন তৃণভূমিতে হরিণের দল আসে। তাহা ছাড়া আছে সেই নীলসমুদ্রের মুক্তরূপ! একবার দুইবারে দেখায় সাধ কি মিটে!

একটি ডিঙি বাহিয়া চলিলাম–দুপুরের পর। আমি একা কখনো এ পথে আসি নাই। একটা খাঁড়ির মধ্যে ডিঙি ঢুকাইয়া ভাবিলাম সামনের খাল দিয়া বাহির হইব। অমন অনেক খাঁড়ি এদিক-ওদিকে গোলপাতার ও গরান জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে। মন অন্যমনস্ক ছিল, হঠাৎ মনে হইল এ কোথায় আসিলাম? আমার বাঁ-পাশে অগণিত হেঁতালঝোঁপ ও টাইগার ফার্নের জঙ্গল। হেঁতাল গাছ দেখিতে সরু খেজুর গাছের মতো, অমনি কাঁটাওয়ালা ঝাঁকড়ামাথা গাছ। তবে অত লম্বা বা মোটা হয় না। হেঁতাল ও টাইগার ফার্ন যেখানে থাকে, বাঘের ভয় সেখানে বেশি, তাহা জানিতাম। ডিঙি ভিড়াইবার ভরসা হয় না এমন জনহীন পাড়ে। কোথা হইতে বাঘ আসিয়া ঘাড়ে পড়িবে ঠিক কী?

অনেক দূর বাহিয়া আসিয়া দেখি মস্ত বড়ো একটি নদীর মোহানার সামনে পড়িয়াছি। এটা কোন জায়গা ঠিক বুঝিতে পারিলাম না। যদি পশোর ও শিবসার মিলনস্থল হয়, তবে তো অনেকদূর আসিয়া পড়িলাম। মগের ট্যাঁকে যাইতে হইলে বাঁ-দিকের ডাঙার কূলে যাই না কেন? তবে নিশ্চয় বাহির-সমুদ্রের মুখে পড়িব। খানিকটা গিয়া দেখি, আর একটা বড়ো নদী আসিয়া মোহানাতে পড়িতেছে। এ আবার কোন নদী?

মাথা ঠিক রাখিতে পারিলাম না তারপর হইতে। পদে পদে বিচারে ভুল হইতে লাগিল। কোথা হইতে কোথায় যাইতেছি–কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না কেন? একটা লোকও কি কোথাও নাই? হঠাৎ দেখিলাম সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে, ক্ষুধা পাইতেছে বিলক্ষণ। ফলের গাছের সন্ধানে চারিদিকে চাহিলাম। গোলগাছের ফল খাইতে ঠিক কচি তালের মতো, কিন্তু এ সময় একটাও চোখে পড়িল না। ভয় হইল, একা রাত্রে ডাঙায় নৌকা বাঁধিয়া থাকা নিরাপদ নয়, বাঘ ডিঙি হইতে আমাকে হালুম করিয়া একগাল মুড়ি-মুড়কির মতো মুখে করিয়া উধাও হইলেই মিটিয়া গেল!

অগত্যা নৌকা বাহিতে লাগিলাম। থামাইতে ভরসা হইল না। নদীরও কি শেষ নাই? রাত আন্দাজ চারিটার সময় অন্ধকারের মধ্যে দেখি আলো-জ্বলা-ঢেউ। আমার বৈঠার আলোড়নেও জলে জোনাকি জ্বলিতেছে। এইবার সমুদ্রে আসিয়া পড়িয়াছি। আমার সামনে অকূল বাহির সমুদ্র। আর আগাইবার রাস্তা নাই। ডিঙি লইয়া সমুদ্রের মধ্যে গেলেই মৃত্যু। দিক-দিশা তো এমনি হারাইয়া ফেলিয়াছি–ভালো করিয়াই হারাইব।

শেষরাত্রে চাঁদ উঠিলে দেখিলাম আমার পিছনের জঙ্গল খুব ঘন। এখানে ডিঙি বাঁধিতে ভরসা হয় না। কিন্তু উপায়ই বা কী? কী চমৎকার রূপ হইয়াছে সেই গভীর রাত্রে সেই ক্ষীণ চন্দ্রালোকিত অনন্ত সাগরের। দুই চক্ষু ভরিয়া দেখিয়াও ফুরায় না। অদ্ভুত স্থানটি বটে। পিছনের জঙ্গলে বাঘের গর্জন দু-একবার কানে গেল। ভোরের দিকে ভাটার সঙ্গে আর এক সমূহ বিপদ; ঢেউ উত্তাল হইয়া উঠিয়া কূলে যেভাবে আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল, তাহাতে ডিঙি বাঁচানো এক মহাসমস্যা। এখনি তো ঢেউয়ের আছাড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া যাইবে–ডিঙি সামলাইতে গিয়া ডুবিয়া মরিব শেষে?

ডিঙি হইতে নামিয়া ডিঙির মুখ ধরিয়া বাহির-সমুদ্রের দিকে ফিরাইলাম। একমাত্র ভরসা সমুদ্রের মধ্যে ডাঙা হইতে দূরে যাওয়া। কিন্তু সমুদ্রের মধ্যে লইয়া যাওয়া কি সোজা কথা? ভাটার টান অবশ্য খানিকটা সাহায্য করিতেছিল বটে। খানিক পরে মনে হইল সমুদ্রের নীচের কোনো সোঁতার মুখে পড়িয়া ডিঙি ক্রমাগত বাহিরের দিকেই চলিয়াছে। এ আবার আর এক বিপদ! কী করি উপায়? দু-বার নোনাজলের ঢেউ আছড়াইয়া পড়িয়াছিল ডিঙির উপর। সেঁউতি দিয়া জল সেচিতেছিলাম। ডুবো সোঁতার অস্তিত্ব এতক্ষণ বুঝিতে পারি নাই। মস্ত কী এক শুশুকের মতো সামুদ্রিক জানোয়ার আমার সামনে জলে উলট-পালট খাইয়া গেল, আমি নিরুপায় অবস্থায় বসিয়া রহিলাম। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত আছি। সমুদ্রের কূল আর দেখা যায় না। সুন্দরবনের কালো রেখা কোথায় মিশিয়া গিয়াছে। সম্মুখে অনন্ত নীল জলরাশি। কোথায় চলিয়াছি? এবার সত্যই কি এ জীবন হইতে বিদায় লইবার দিন আসিয়া গিয়াছে?

দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চলিতেছি, সূর্যের অবস্থান দেখিয়া মনে হইল। তটরেখা অদৃশ্য হইয়াছে বহুক্ষণ। দক্ষিণ-মেরুর দিকে চলিয়াছি নাকি? ক্ষুধা অপেক্ষা তৃষ্ণা বেশি কষ্ট দিতেছিল। শরীর অবসন্ন হইয়া আসিতেছে, ক্ষুধায় তত নয়–যতটা তৃষ্ণায়। সারাদিন কাটিয়া গেল। আবার সূর্যাস্ত দেখিলাম। আবার আকাশে নক্ষত্ৰ উঠিল। মাথার উপর অগণিত নক্ষত্রখচিত আকাশ, নীচে অনন্ত সমুদ্র–মরণের আগে কী রূপই অনন্ত আমার চোখের সামনে খুলিয়া দিলেন! মরিব বটে কিন্তু কাহাকে বলিয়া যাইব যে কী দেখিয়া মরিলাম।

অনেক রাত্রে কোথায় যেন বাঁ-দিকে বুম বুম করিয়া কামানের আওয়াজের মতো কানে আসিল। অন্ধকারের মধ্যে চাহিয়া দেখিলাম। কিছু বুঝিতে পারিলাম না। শেষরাত্রে খুব শীত করিতে লাগিল।

বোধ হয় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। উঠিয়া দেখি ডিঙি সমুদ্রে স্থির হইয়া আছে। সূর্য অনেক দূর উঠিয়া গিয়াছে। চারিদিকের নীল জলরাশি চিকচিক করিতেছে খর-রোদে। বেলা বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে পিপাসা বাড়িল। বিকালের দিকে মনে হইল আমার বহু দূরে ডান দিক দিয়া একখানা জাহাজ যাইতেছে। পরনের কাপড় খুলিয়া উড়াইয়া দিলাম, নাড়িতে লাগিলাম। তাহারা বুঝিতে পারিল না। অন্য দিকে চলিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।

কী কুক্ষণে কাল বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছি! মনুর জন্য বড়ো কষ্ট হইতেছিল। বার বার উহার কথা মনে হইতেছে–উহার কথা আর দুই মার কথা। বনবিবিতলার মার কথাও যে কতবার মনে হইল।

আবার রাত্রি আসিল। আবার নক্ষত্র উঠিল। সেই রাত্রে শেষে আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম কী অজ্ঞান হইলাম, জানি না। পৃথিবী ও সমুদ্র সেরাত্রে সব মুছিয়া গেল।

জ্ঞান হইলে দেখি একটা কাঠের ঘরে শুইয়া আছি–কাঠের ঘর কী কাঠের বাক্স। আমার পাশে একজন চাটগাঁয়ের মুসলমান বসিয়া। সে বলিল সেখানকার বুলিতে, আমি সারিয়াছি কিনা। আমি বলিলাম–আমি কোথায়? একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি আসিয়া আমার শিয়রে বসিল। তাহার দিকে চাহিয়া মনে হইল ইহাকে দেখিতে আমার বাবার মতো। আমার নাম জিজ্ঞাসা করিল, চাটগাঁয়ের ভাষায় আমি কেন এভাবে সমুদ্রে ভাসিতেছিলাম? সব খুলিয়া বলিলাম। চাহিয়া দেখিলাম চারিদিকে। একটি ক্ষুদ্র গ্রামের মধ্যে আমি একটা কাঠের ঘরে শুইয়া আছি মনে হইল। উহাদের জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম তাহারা চাটগাঁয়ের মুসলমান জেলে। এই গ্রাম কোনো স্থায়ী বাসিন্দার গ্রাম নয়। মাছ আর সামুদ্রিক ঝিনুক তুলিতে এখানে বৎসরে তিন মাস ইহারা আসিয়া বাস করে। ইহাদের সামপান (নৌকা) কূলের অদূরে সমুদ্রে আমার নৌকা দেখিতে পায়। তারপর এখানে আনে। আমি চার-পাঁচ দিনের মধ্যে সুস্থ হইয়া উঠিলাম। সামুদ্রিক মাছের ঝোল আর ভাত, এ ছাড়া আর কোনো খাদ্য সেখানে ছিল না। আমাকে তাহারা সঙ্গে লইয়া আর একটা দ্বীপে গেল, দ্বীপের নাম কুমড়াকাটা। সেখানে পাশাপাশি অনেকগুলি দ্বীপ আছে, সবগুলিই জনহীন, মৎস্যশিকারিরা মাঝে মাঝে বসতি স্থাপন করে আবার চলিয়া যায়। একটা দ্বীপের নাম চাঁদডুবি, একটার নাম সাহাজাদখালি। সব দ্বীপেই ভীষণ জঙ্গল। মিষ্ট জলের খাঁড়ি কেবল চাঁদডুবি ছাড়া অন্য কোনো দ্বীপে নাই বলিয়া আমরা সেখানে নৌকা লাগাইয়া মিষ্ট জলের সন্ধানে গেলাম। ডাঙায় উঠিয়া বাঁ-দিকে ছোটো একটা বালিয়াড়ি, তাহার পিছনে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের গাছ আমি চিনিলাম না, শুধু কয়েক ঝাড় মূলী বাঁশ ছাড়া। এক-জাতীয় বড়ো গাছে রাঙা ফুল ফুটিয়াছিল। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম ওই গাছের নাম ছাপলাস গাছ। জঙ্গলের মধ্যে ছাপলাস আর মূলী বাঁশই বেশি। এই দ্বীপের সমুদ্রতীরে বালুকারাশির উপর কত ঝিনুক ও শাঁখের ছড়াছড়ি, তাহার একটু দূরে ঘন সবুজ বনভূমি, লতার ঝোপে কত কী অজানা বনপুষ্প। চাঁদডুবি দ্বীপটি স্বর্গের মতো সুন্দর।

একা কতক্ষণ দ্বীপের বালির চড়ায় বসিয়া থাকি। সারাদিন এমনি বসিয়া বসিয়া নীল সমুদ্রের গান যদি শুনিতে পাই তবে কোথাও যাইতে চাই না। এমন সুন্দর নামটি কে রাখিয়াছিল এ দ্বীপের?

বনবেণুকুঞ্জের মধ্যে পাখি ডাকে। কেহ শুনিবার নাই সে-পাখির কলকূজন। যাহারা এখানে আসে, তাহারা মাছ ধরিতে ব্যস্ত। পাখির ডাক শুনিবার কান তাহাদের নাই।

বামদিকের বাঁশবনের তলা দিয়া সঁড়িপথ মিষ্ট জলের খাঁড়ির দিকে চলিয়া গিয়াছে। জেলেদের পায়ে চলার চিহ্ন এ পথের সর্বত্র। আমি সে-পথে একা অনেক দূরে চলিয়া গেলাম। ঠিক যেন সুন্দরবনের একটি অংশ, তেমনি ঘন বন, তবে কেয়া গাছ ছাড়া সুন্দরবনের পরিচিত কোনো গাছ নাই। এক জায়গায় দেখি অনেক জংলি গোঁড়া লেবুর গাছ, যেন কে লেবুর বাগান করিয়া রাখিয়াছে। সুন্দরবনেও এ লেবুর জঙ্গল অনেক জায়গায় আছে।

জল লইয়া জেলেরা চলিয়া গেল। আমি এক জায়গায় লেবুবাগানের মধ্যে একটি আশ্চর্য দ্রব্য হঠাৎ আবিষ্কার করিলাম। সেটি একটি ছোটো কামান। এই কামানের গায়ে বাংলা অক্ষরে লেখা আছে কী সব কথা, পড়িতে পারিলাম না।

একজনকে ডাকিয়া বলিলাম– শোনো—

সে ফিরিয়া আসিয়া বলিল–কী?

এটা কী?

দেখতেই পাচ্ছ কামান!

কী করে এল এখানে?

জানি নে।

জানতে ইচ্ছে করে না?

কী দরকার—

মিটিয়া গেল। ইহাদের কোনো কৌতূহল নাই কোনো বিষয়ে। আমার ইচ্ছা হইল কামানটা সঙ্গে করিয়া লইয়া যাই। কিন্তু অত ভারী জিনিস একা আমার সাধ্য নাই বহিবার। লোকটার সহিত অনিচ্ছার সহিত চলিয়া যাইতেছিলাম, এমন সময় সে এমন একটা কথা বলিল যাহাতে আমি থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেলাম। সে বলিল–শুধু কি একটা কামান দেখছ বাবু, ওই জঙ্গলের মধ্যে গড় আছে, ভেঙে পড়ে আছে মস্ত গড়!

সে কী?

গড় মানে কেল্লা। এটাকে বলে চাঁদডুবির গড়। কত আশ্চর্য জিনিস এখানে ছিল, এখনও আছে। কত লোক কত টাকা পেয়েছে এখানে। গড়ের ইটের মধ্যে আমার গাঁয়ের এক বুড়ো লোক সোনার পাত আর আকবরি আমলের সোনার টাকা পেয়ে খুব বড়ো মানুষ হয়েছিল। তবে বাবু ওতে বিপদ আছে–

কী বিপদ?

বাবু, ওতে বংশ থাকে না।

বয়ে গেল!

তুমি ছেলেমানুষ তাই এমন বলছ। বড়ো হলে আর বলবে না। তা ছাড়া—

তা ছাড়া কী?

অপদেবতার ভয়—

মানি না।

নেই বললেই সাপের বিষ চলে যায়? সন্ধ্যের পর তেষ্টায় গলা শুকিয়ে মরে গেলেও কেউ চাঁদডুবির খাঁড়িতে জল নিতে আসবে না।

বল কী?

তাই, তুমি যাকে হয় জিজ্ঞেস করে দেখো—

আমি যদি সন্ধ্যের পর এখানে থাকি?

প্রাণ একবার খোয়াতে বসেছিলে, আবার খোয়াবে। চলো, তোমাকে একটা গল্প বলব।

আমার কিন্তু ভূতের গল্প শুনিবার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখিয়াছিলাম সুন্দরবনে, এখানে শুনিয়াছি কেল্লা আছে। কাহাদের এসব জিনিস? কাহারা এখানে কেল্লা বা রাজবাড়ি বানাইয়াছিল অতীত দিনে? কাহারা এখানে তাহাদের অতীত গৌরবদিনের চিহ্ন ফেলিয়া রাখিয়া অজানা পথে চলিয়া গেল? কে তাহারা? কী দিয়া ভাত খাইত তাহারা? কী ভাষায় কথা বলিত? কী করিয়া দিন কাটাইত? কী ভাবিত মনে মনে?

এইসব কথা আমাকে এখনই কেহ বুঝাইয়া বলিতে পারে?

এই সব আমি জানিতে চাই। কোনো অপদেবতার কাহিনি নয়–যাহা সত্য ঘটিয়াছিল, তাহাই জানিতে চাই, কোনো মনগড়া ঘটনা নয়। ডিঙিতে ফিরিয়া গিয়া বুড়ো মাঝি বদরুদ্দিনকে সব কথা বলিলাম। সে কি কিছু দেখিয়াছে। এখানে আরও কোনো দ্বীপে কি এমন আছে?

বদরুদ্দিন বলিল– সুন্দরবনে এমন কোনো কোনো জায়গায় আছে। এদিকের মধ্যে চাঁদডুবিতে আছে, আর সোনার দ্বীপে আছে। ওসব সেকেলে রাজাদের কান্ড সোনার মোহর পাওয়ার কথাও সত্যি। আমি নিজে একবার একখানা সেকেলে তলোয়ার পেয়েছিলাম, তলোয়ারখানার বাঁটে কত কী কাজ করা! আমার জামাই সেখানা নিয়ে গিয়ে মহকুমার হাকিমকে দেখায়। তিনি বলেন–এখানা সেকালের দামি জিনিস–জাদুঘরে দিয়ে দাও। আমার জামাই তা দেয়নি, ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এখনও আমার বাড়িতে আছে সেখানা।

সেখান হইতে আমরা আর একটি দ্বীপের কূলে চলিয়া গেলাম। জায়গাটির নাম ইদ্রিশখালির চর। এখানে বড়ো হাঙরের ভয়। জেলেরা কেহ জলে নামিতে সাহস করে না। দিগন্তরেখায় সূর্য উঠিতে দেখিয়াছি এখানে কত দিন। সমুদ্রের বুকে সূর্যোদয় কখনো দেখি নাই–শুনিলাম এখান হইতে এ দৃশ্য যেমন দেখা যায়, এমন আর এদিকে আর কোনো দ্বীপ হইতে দেখা যায় না।

এই সূর্যোদয় দেখিতে গিয়া একদিন বিপদে পড়িয়া গেলাম।

একটা ছোটো ডিঙি করিয়া কূল হইতে কিছুদূরে গিয়াছিলাম শেষরাত্রির দিকে। বৃদ্ধ বদরুদ্দিন আমাকে বলিয়াছিল–সমুদ্রের মধ্যে খানিকটা গিয়ে সূর্যোদয় দেখো বাবু।

কী যে সে অদ্ভুত দৃশ্য। জলের উপর একস্থানে একটা সরু আগুনের রেখা দেখা দিল প্রথমে। মনে হইল জলে আগুন লাগিয়াছে। পরক্ষণেই সূর্য হঠাৎ লাফাইয়া উঠিল যেন জলরাশির মধ্য হইতে একটা আগুনের গোলার মতো। তখনও সেটাকে সূর্য বলিয়া বোধ হইতেছিল না, একটা রঙিন ফানুস যেন জলের উপর কে উড়াইয়া দিয়াছে। বদরুদ্দিন ঠিকই বলিয়াছিল, ডাঙা হইতে এ শোভা দেখা যায় না।

এই পর্যন্ত ভাবিয়াছি, হঠাৎ দেখিলাম ডিঙিখানি কূল হইতে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চলিয়াছে; ফিরাইবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু পারিলাম না। আবার কি চোরা সোঁতায় পড়িলাম? এই জিনিসটি বড়ো ভয়ের ব্যাপার এসব গভীর সমুদ্রে! মনু আমাকে অনেকবার বলিয়াছিল। বদরুদ্দিনও সেদিন বলিয়াছে। একবার নাকি উহারা এই চাঁদডুবি আর ইদ্রিশখালির মধ্যে কুমড়োবোঝাই একটা সামপান পায়। সামপানে তিনটি মৃতদেহ ছিল। দেখিয়া মনে হয়, তাহারা জল না খাইয়া মারা গিয়াছে। এ অবস্থায় লোকে সমুদ্রের জল পান করে, বেশি পরিমাণে সমুদ্রের জল পান করিলে পাগল হইয়া যায়।

বলিয়াছিলাম–পাগল হয় কেন?

তা জানি নে। মাথা খারাপ হয়ে যেতে দেখেছি বাবু।

তারপর? কোথাকার লোক ওরা?

বৰ্মাদেশের লোক বলে মনে হল। ঠিক বলতে পারব না। তারা কুমড়ো বোঝাই করে কোনো নদীপথে কিংবা দুটো দ্বীপের মাঝখানের সমুদ্রে নৌকো বাইতে বাইতে চোরা সোঁতায় পড়ে গিয়ে বার-সমুদ্রে চলে এসেছিল। তারপর যা হবার তাই হয়েছে। ওরা ডাঙার লোক ছিল নিশ্চয়, নইলে কুমড়ো আনবে কোথা থেকে? সামপানে কুমড়ো বোঝাই দিয়ে কেউ সমুদ্রে পাড়ি জমায় কি?

এইসব কথা আমার মনে পড়িল, আমি ঘর-পোড়া গোরু। এই সেদিন ডুবো সোঁতা হইতে মরিয়া যাইতে যাইতে বাঁচিয়াছি না নিজে? বদরুদ্দিন আমায় কী শিখাইবে?

যেমন একথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অমনি এক লাফ দিলাম ডিঙি হইতে। ভুলিয়া গেলাম যে সমুদ্র হাঙর-সংকুল ও অত্যন্ত বিপজ্জনক।

সাঁতরাইতে ভালোই জানিতাম, ডাঙাও খুব বেশি দূরে ছিল না। একটু হয়তো সাঁতরাইতে পারিব, ইহার বেশি হইলে আমার পক্ষে ডাঙায় উঠা সম্ভব হইবে না।

বেশ সাঁতরাইতেছি, হঠাৎ আমার নিকট হইতে হাত-ষোলো-সতেরো দূরে একটা চওড়া মাছের ডানা জলের উপর একবার ভাসিয়া পরক্ষণেই ডুবিয়া যাইতে দেখিয়া আমার হাত-পা অবশ হইয়া গেল। এ তো কোনো মাছের ডানা বলিয়া মনে হয় না। এ নিশ্চয় সামুদ্রিক হাঙরের ডানা! কামটের ডানা এত বড়ো হইবে না।

আবার সেই বড়ো ডানাটা ভাসিয়া উঠিল আমার নিকট হইতে আট-নয় হাত মাত্র দূরে। আমার মনে হইল যে করিয়াই হউক আমাকে এই ভীষণ জানোয়ারের হাত এড়াইতেই হইবে। একবার যদি ইহার হাতে পড়ি, তাহা হইলে আর রক্ষা নাই। এই সময় ডানাটা আবার ডুবিয়া গেল। এইবার বোধ হয় ইহা ভাসিয়া উঠিবে আমাকে মুখে শক্ত করিয়া কামড়াইয়া ধরিয়া। চট করিয়া বাঁ-দিকে ঘুরিয়া গেলাম এবং খুব চিৎকার করিতে লাগিলাম। এমন সময় ডানাটি ভাসিয়া উঠিল, ইতিপূর্বে এক সেকেণ্ড আগে আমি যেখানে ছিলাম সেখানে। এই সময় সেই ভীষণ-দর্শন সামুদ্রিক হাঙরের মুখটিও ভাসিয়া উঠিল, কিন্তু আমি যেদিকে আছি তাহা হইতে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। হাঙরের লক্ষ্য ভ্রষ্ট হইয়াছে বুঝিলাম। কিন্তু এইবেলা যাহা করিতে পারি, বিলম্বে আর রক্ষা নাই। সঙ্গেসঙ্গে দুই হাত্তা সাঁতার দিয়া ডাঙার দিকে আসিতে চেষ্টা করিলাম। হঠাৎ আমার হাঁটুতে কে যেন শক্ত মুগুরের এক ঘা লাগাইল, জলের মধ্যে যেন পা-খানা কাটিয়া পড়িয়া গেল মনে হইল। দাঁতে দাঁত চাপিয়া তখনো সাঁতার দিতেছি–যাক একখানা পা, ডাঙায় উঠিতে না পারিলে সমস্ত দেহখানাই যে চলিয়া যাইবে।

এই সময় একটা বড়ো ঢেউ আসিয়া আমাকে ডাঙার দিকে হাতদশেক আগাইয়া দিয়া গেল। পরক্ষণেই দেখি আমি আবার অন্য দিকে অনেক দূর চলিয়া গিয়াছি, কিন্তু ডাঙাটা আর কোনোদিকেই দেখা যায় না। অনেক কষ্টে ডাঙার দিকে যদি-বা দু-হাত আসি, আবার চার হাত জলের মধ্যে চলিয়া যাই ডুবো সোঁতার টানে। এই জন্যই আমার ডিঙি বাহির-সমুদ্রে অতটা গিয়া পড়িয়াছিল, এইবার ভালো করিয়া বুঝিলাম।

আমার চিৎকার শুনিয়া দু-তিনজন আমাদের দলের জেলে ছুটিয়া আসিয়া আমাকে জল হইতে টানিয়া তুলিল। তখন আমি এমন অবসন্ন যে উহাদের কথার জবাব পর্যন্ত দিতে পারিলাম না। তাহারা বার বার বলিতে লাগিল, খুব বাঁচিয়া গিয়াছি। সেই সমুদ্রে পড়িয়া সাঁতার দেওয়া যে কী জিনিস তাহা যে জানে না, তাহাকে বলিয়া লাভ কী?

আমি বলিলাম–জানি হে জানি। আমাকেও ছাড়েনি, হাঙরে তাড়া করেছিল। উহারা সমস্বরে বলিয়া উঠিল–কক্ষনো হয় না। রাগের সহিত বলিলাম–কী হয় না? তাহারা বলিল–কক্ষনো বাঁচতে পারে না হাঙরের মুখ থেকে– আলবৎ বেঁচেছি। আমার পাশে চার হাত তফাতে ওর ডানা লেগেছিল, ওর মুখও দেখেছি।

ডানা? হাঙরের নয়।

নিশ্চয় হাঙরের।

বদরুদ্দিন সব শুনিয়া বলিল–বাবু, ওরা ঠিক বলেছে। হাঙর ওভাবে একবার জাগবে একবার ভাসবে না–হাঁ করে তাড়া করে এসে কামড়ে ধরবে, ও হাঙর নয়।

কী তবে ওটা?

ওটা মহাশির মাছ, হাঙরের মতো দেখতে, মুখও অনেকটা হাঙরের মতো।

আমি প্রথমটা বিশ্বাস করি নাই। বদরুদ্দিন বলিল– ও মাছ তোমাকে দেখাবো, আমাদের আড়তে চলো—

কোথায়?

তার নাম কাছিমখালি। একটা ছোটো দ্বীপ।

আর কে আছে সেখানে?

কেউ না। শুধু আমরাই থাকি।

কী হয় সেখানে?

গেলেই দেখবে।

চাঁদডুবির মতো সুন্দর জায়গা?

মন্দ নয়।

একদিন কাছিমখালি দ্বীপে আমরা গিয়া নোঙর করিলাম। এখানে খড় দিয়া ইহারা ছোটো ছোটো ঘর তৈয়ারি করিয়াছে। অকূল সমুদ্রের ধারে বাঁশের লম্বা আলনা ও বন্য লতা টাঙানো আলনা। মাছের রাশি এখানে রৌদ্রে শুকাইবার জন্যই এই আলনার ব্যাপার। শুঁটকি মাছের দুর্গন্ধে সমুদ্রতীরের বাতাস ভারাক্রান্ত।

খাদ্যও এখানে শুধু মাছ ও ভাত। না ডাল, না কোনো তরকারি। বেশিদিন কাঁচা তরকারি না খাইলে নাকি একপ্রকার রোগ হয়, সেজন্য বদরুদ্দিন সেদিন আমাকে লইয়া নিকটবর্তী আর একটি দ্বীপে গেল। সেখানে বনের ছায়ায় ছায়ায় একরকম শাক গজায়, দু-জনে তাহাই তুলিয়া নৌকার খোলে জমা করিলাম। শাকগুলির পাতা অবিকল থানকুনি পাতার মতো– কিন্তু আমরুল শাকের মতো টক।

এখানে এক ব্যাপার ঘটিল।

আমি শাক তুলিতে তুলিতে চারিদিকে চাহিয়া দেখিতেছি, বদরুদ্দিন ডিঙিতে তামাক সাজিতে গিয়াছে, এমন সময় দেখি একজন বৃদ্ধ আমার দিকে আসিতেছেন। দু-মিনিটের মধ্যে বৃদ্ধটি আমার সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়া আমার দিকে অতি স্নেহপূর্ণ করুণ দৃষ্টিতে চাহিতে লাগিলেন। ঠিক যেন আমার দাদামহাশয়। একবার অতি অল্প সময়ের জন্য মনে হইল আমার সেই দাদামহাশয় আমার সন্ধানে বাহির হইয়া এখানে আসিয়া বুঝি পৌঁছিয়াছেন। আমার মন কেমন করিয়া উঠিল আমার দাদামহাশয়ের জন্য।

কিন্তু না, এই বৃদ্ধের রং আমার দাদামহাশয়ের চেয়ে সামান্য একটু কালো। সাদা দাড়িটিও বেশি লম্বা। পরনের কাপড় অতি ছিন্নভিন্ন ও মলিন। আমার দিকে খানিকটা চাহিয়া চাহিয়া বলেন–বাঙালি?

উত্তর দিলাম–আজ্ঞে হাঁ।

কোথায় বাড়ি?

অনেক দূর।

এখানে কী করে এলে?

মাছ ধরতে এসেছি কাছিমখালি। এখানে শাক তুলতে এসেছি।

হিন্দু না মুসলমান?

হিন্দু।

তোমার সঙ্গী কই?

তামাক সাজতে গিয়েছে ডিঙিতে। আপনি কে?

আমিও বাঙালি হিন্দু! আমি এখানে থাকি।

এখানে?

কেন, এ জায়গা কি খারাপ?

না, তা বলিনি। খুব চমৎকার জায়গা। কিন্তু এখানে আপনি কী করেন?

ব্যাবসা করি।

আমি অবাক হইয়া বৃদ্ধের স্নেহকোমল মুখের দিকে চাহিয়া থাকি। লোকটি পাগল নাকি? মুখ ও চোখের ভাবে কিন্তু পাগল বলিয়া তো মনে হয় না। তবে এমন আবোল-তাবোল বলিতেছেন কেন? আমার চোখের বিস্ময়ের দৃষ্টি বৃদ্ধ বুঝিতে পারিলেন! বলিলেন–বিশ্বাস হয় না?

এখানে কীসের ব্যাবসা?

এসো আমার সঙ্গে। কাউকে কিছু বোলো না। তোমার সঙ্গী কোথায়?

সে এখন আসবে না। তামাক খেয়ে নাইবে সমুদ্রে, বলে গিয়েছে।

সে হিন্দু না মুসলমান?

মুসলমান।

আমাকে খেতে দেবে সে?

খাবেন? নিশ্চয়ই। আমি নিজে আনছি।

সেজন্যে নয়, আমি সকলের হাতেই খাই। কী আছে?

চিঁড়ে খাবেন?

উঃ, কতদিন চোখে দেখিনি! কিন্তু শোনো, এখন থাক। আগে চলো আমার সঙ্গে। তোমাকে দেখাই আগে, কেউ এসে পড়বার আগে। বড় গোপন জিনিস কিনা!

আমার খানিকটা ভয় না হইল এমন নয়। অদ্ভুত-দর্শন বৃদ্ধের সঙ্গে এই সম্পূর্ণ অপরিচিত স্থানে কি আমার যাওয়া উচিত? কিন্তু ভয় বা কীসের? আমি নবীন যুবক। আমার সঙ্গে শরীরের শক্তিতে এই বৃদ্ধ কতক্ষণ যুঝিবেন?

গেলাম উহার সঙ্গে।

কিছুদূর গিয়া একটা বনের পিছনে পাতা-লতার একটি কুটির দেখিয়া আমি অবাক হইয়া গেলাম। বৃদ্ধ আমাকে কুটিরের সামনে লইয়া গেলেন। আমি বলিলাম–চারিদিকে এত কচ্ছপের খোলা কেন?

বৃদ্ধ হাসিয়া বলিলেন–ওই আমার ব্যাবসা।

কী ব্যাবসা?

কচ্ছপের খোলার।

এখানে কচ্ছপ ধরেন কী করে?

এখানকার নাম কাছিমখালির চর। এখানকার সব দ্বীপের চরে সমুদ্র থেকে বড়ো কচ্ছপ উঠে রোদ পোয়ায়, ডিমে তা দেয়। তোক তো নেই কোনো দিকে!

কী করে ধরেন?

উলটে দিলেই হল। আর নড়তে পারে না।

তারপর?

তারপর ওদের কাটি। মাংস খাই, ডিম খাই, আর কাছিমের খোলা বিক্রি করি। লোকে নৌকো করে এসে জমানো খোলা কিনে নিয়ে যায়। ওরাই চাল দিয়ে যায়। অনেক দিন আসেনি, চাল ফুরিয়ে গিয়েছে, শুধু কাছিমের মাংস খেয়ে ভালো লাগে না–তাও আজ তিন দিন একটা কাছিমও ডাঙায় ওঠেনি।

আমার সঙ্গে দেখা না হলে কী খেতেন?

কেন? ঝিনুক?

ঝিনুক!

খুব ভালো খেতে ওর শাঁসটা। তোমাকে খাওয়াব, এসো ঘরের মধ্যে এসো।

কুটিরের মধ্যে ঢুকিলাম। একটি ছিন্ন খেজুরপাতার চাটাই একপাশে পাতা, তাহার উপরে একটি ছেঁড়া বালিশ। একটি ঝকঝকে মাজা কাঁসার জামবাটি ছাড়া অন্য কোনো মূল্যবান জিনিস নাই ঘরের মধ্যে? একটি তিরধনুক ঘরের এক কোণে হেলানো। খাবার জলের জন্য একটি মাটির কলসি, তাও কানা-ভাঙা। অতি গরিব লোকের ঘরে ইহার চেয়ে অনেক বেশি জিনিস থাকে। আমি খুব অবাক হইয়া চারিদিকে দেখিতেছি দেখিয়া বৃদ্ধ বলিলেন–ভাবছ কী করে থাকি, না? তা নয় বাবা, বেশ থাকি।

সত্যি?

ঠিক তাই। খুব ভালো থাকি। কোনো মানুষ আমার নিন্দে করবে না, আমিও কারো নিন্দে করব না। মানুষ যেন কখনো মানুষের নিন্দে না করে। ওটা আমি সব চেয়ে অপছন্দ করি।

কি?

কেউ কারো নিন্দে করা। এখানে বেশ আছি।

কী করে দিন কাটান আপনি এখানে?

বৃদ্ধ হাসিয়া উঠিলেন। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দূরে সমুদ্রের নীল জলরাশির দিকে চাহিয়া চাহিয়া কী যেন ভাবিলেন। আমার সে সময় মনে হইল, ইনি অতি অদ্ভুত ব্যক্তি। হঁহার মতো মানুষ আমি এই প্রথম দেখিতেছি। হঁহার আগে যেসব মানুষ দেখিয়াছি তাহারা যে ধরনের, ইনি অন্য ধাতের মানুষ উহাদের থেকে। ইহার মতো চোখের দৃষ্টি তো কাহারও দেখি নাই এ পর্যন্ত।

আমিও কিছু না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলাম।

তিনি আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন–দিন এখানে বড়ো সুন্দর কাটে, বুঝলে? এত সুন্দর কাটে যে আমি এ জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইনে!

কী করেন সারাদিন?

সারাদিন বসে থাকি।

বসে?

ওই সমুদ্রের দিকে চেয়ে বসে!

তারপর হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন–আরে না না, তা ঠিক নয়। আমাকে তো খেতে হবে। কাছিমকে চিত করিয়ে দিয়ে তার মাংস কাটি–একটা বড়ো কাজ না? ঝিনুক কুড়োই বালুর চর থেকে। বড়ো একটা কাজ। শাঁস ছাড়াই–বড়ো একটা কাজ–কী বল?

আমিও হাসিতে লাগিলাম। না, বৃদ্ধ যেন শিশুর মতো সরল। আমার বড়ো ভালো লাগে। আমার দাদামহাশয়ের মতোই বটে। মনে হইল যেন ইনি আমার বহুদিনের পরিচিত।

উনি বললেন–তুমি ভাবছ, কেমন করে থাকেন? এ দ্বীপের রূপ দিনের মধ্যে এতবার বদলায়! যত দেখবে তত আরও দেখতে ইচ্ছে হবে। দেখে দেখে বুদ্ধি ফুরোয়। ভালো কথা, আজ সন্ধ্যের সময় সূর্য অস্ত যাওয়াটা একবার এ দ্বীপের একটা জায়গা থেকে দেখো তো! একটা গাছ আছে, তার ওপর আমি চড়ে থাকি। তোমাকেও চড়াব। দেখলে মোহিত হয়ে যাবে।

আমি দেখেছি।

কী দেখেছ?

উদয় ও অস্ত দুই-ই। আমি বার-দরিয়ায় হারিয়ে গিয়েই তো এখানে এসেছি। সে সময় নৌকায় বসে তিন দিন তিন রাত আমি দেখেছি।

তা হলে তুমি বুঝতে পারবে। সবই তো জান। এ জিনিস অনেকেই দেখতে পায় না। এমন দ্বীপ না হলে এ-রকমটি তো দেখা যায় না। দাঁড়াও, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।

বৃদ্ধ উঠিয়া গিয়া ঘরের কোণ হইতে একটা ছেঁড়া নেকড়ার পুঁটুলি আনিয়া আমার সামনে খুলিয়া বলিলেন–এই দেখো। আমি বিস্ময়ে অবাক হইয়া বৃদ্ধের মুখের দিকে চাহিলাম– এ কী! এ যে অতি সুন্দর অনেকগুলো মুক্তা। তাহাদের মধ্যে কতকগুলি আবার অত্যন্ত বড়ো বড়ো। সবসুদ্ধ গুনিয়া দেখিলাম–ছাব্বিশটা মুক্তা। পাঁচটি খুব বড়ো ও খুবই সুন্দর। আমি জীবনে কখনো এক জায়গায় এত মুক্তা দেখি নাই।

বৃদ্ধ বিজয়ীর গর্বভরে বলিলেন–সব কিন্তু ঝিনুক থেকে সংগ্রহ করেছি। শাঁস খাব বলে ঝিনুক কাটতে গিয়ে এই সব পেয়েছি।

কত দিনে?

দু-বছরে তিন বছরে।

আপনি কাছিমের খোলা বিক্রি করেন, মুক্ত বেচেন না?

না। কাউকে দেখাই না। অনেক টাকার মাল। টাকা হলে মনে অহংকার আসবে, বিলাসের ইচ্ছা আসবে–এমন সুন্দর জায়গা থেকে হবে চিরনির্বাসন।

আপনার মুক্তো কত টাকার?

বলো?

আমি ছেলেমানুষ, কী জানি বলুন!

বললে বিশ্বাস করবে?

আপনি বললে ঠিক বিশ্বাস হবে।

যদি বলি দু-লাখ টাকার ওপর?

আমি চমকিয়া উঠিলাম, দু-লাখ! আমি হাজার দুই তিনেক-এর কথা ভাবিয়াছিলাম। ধারণা আমার মাথার মধ্যেই নাই। এ কী আশ্চর্য ধরনের বৃদ্ধ তাহা জানি না। এই খেজুর-চাটাইয়ে শোন, ভাঙা কলসিতে জলপান করেন, খান কাছিমের মাংস ও ঝিনুকের শাঁস–এদিকে উঁহার ভাঙা কুঁড়েঘরে দু-লাখ টাকার মুক্তা অবহেলায় এক কোণে মাকড়সার জালে ঢাকা পড়িয়া রহিয়াছে। আমাকে নির্বাক দেখিয়া বৃদ্ধ বলিলেন–কী? বিশ্বাস হল না?

তা না, বিশ্বাস হয়েছে। আপনি অদ্ভুত লোক।

কিছু অদ্ভুত না। আমার দরকার থাকলে আজ বড়োমানুষ হতাম। শহরে বাড়ি করতাম। জুড়িগাড়ি করতাম। আমার দরকার নেই।

সংসারে আপনার কেউ নেই?

সবাই আছে।

তাদের টাকা দিয়ে দিন। তাদের দরকার আছে। কত গরিব লোক আছে, তাদের দিয়ে দিন।

তুমি এসেছ খুব ভালো। এখানে থাকো। সে মুসলমান মাঝিকে আমি বুঝিয়ে বলব। দু জনে এখানে থাকি, রাজি?

রাজি।

ঝিনুকের শাঁস খেয়ে থাকতে হবে।

আমি আপনার মুক্তো চাই না, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে, আপনার কাছে থাকব।

বৃদ্ধ বদরুদ্দিনকে আমি সব বলিলাম। অবশ্য মুক্তার কথা বাদে। সে আমাকে অনেক নিষেধ করিল। ওই বৃদ্ধ উন্মাদ, উহাকে সবাই জানে, আজ অনেকদিন ধরিয়া এই দ্বীপে আছেন একা কচ্ছপের খোলার ব্যাবসা করেন, তাহাও শোনা গিয়াছে। উহার সঙ্গে থাকিয়া কী লাভ? অবশেষে আমার দৃঢ়তা দেখিয়া চলিয়া গেল। বলিল, সে আবার আসিবে। যদি কোনো অসুবিধা হয়, সে আসিয়া লইয়া যাইবে।

সেই হইতে আমার এক নতুন জীবন আরম্ভ হইল।

দুই মাস কাটিয়া বর্ষা নামিল। এখানে বর্ষাটা বড়ো বেশি। দিনরাতের মধ্যে বিরাম নাই। বৃদ্ধকে ঘরের বাহির হইতে দিই না। জেলেদের সঙ্গে থাকিয়া মাছ ধরিবার পদ্ধতি শিখিয়াছিলাম। নানা রকমের সামুদ্রিক মাছ ধরি। ঝিনুকের শাঁস আমি বড়ো একটা খাই না। বৃদ্ধও আমার কাজে খুব সন্তুষ্ট। ভালো মাছ ধরিয়া বৃদ্ধকে রান্না করিয়া খাওয়াই। ঝিনুক কুড়াইয়া আনি। একদিন বৃদ্ধ আমাকে আরও দু-টি লুকোনো মুক্তা দেখাইলেন। মস্ত বড়ো দুইটি মুক্তা। বলিলেন–দাম জান? বলো তো? চোদ্দো হাজারের কম নয়! তুমি বিশ্বাস করো?

এসব সময় মনে হয় বৃদ্ধ বোধ হয় কিছু মাথা-খারাপ হইবেন। আমার অবিশ্বাসে কী আসে যায়? কেনই-বা উনি এত টাকা এখানে নির্জন বালুচরে পুঁতিয়া রাখিয়াছেন? জগতের কত না উপকার হইতে পারিত এ টাকার দ্বারা?

বলিলাম–দাদু আমাকে একদিন মুক্তোর ঝিনুক দেখান না?

বেশ, চিনিয়ে দেব। সবসময় কি পাওয়া যায়। কালেভদ্রে।

তবে এতগুলো কী করে পেলেন?

একদিন তোমাকে বলব।

আমি ছাড়িবার পাত্র নই। তাঁহাকে চাপিয়া ধরিলাম, না এখনি বলিতে হইবে। এতগুলি মুক্ত কীরূপে পাইলেন?

বৃদ্ধ বলিলেন–মুক্তোর ঝিনুক এখানেই পাওয়া যায়। সেইজন্যেই আমি তো বলছি, চিনিয়ে দেব।

এখুনি দিন।

এসো আমার সঙ্গে।

তারপর দ্বীপের উত্তর-পূর্ব-কোণে একটা সম্পূর্ণ নিভৃত স্থানে আমাকে লইয়া গিয়া একটা গাছের তলায় বসাইলেন। সে-স্থানে একরাশি ঝিনুক ছিল। আমায় বলিলেন–এর নীচের সমুদ্রে একটা পাহাড় আছে জলের তলায়। সেই পাহাড়ের গায়ে লেপটিয়ে থাকে যেসব ঝিনুক–সবগুলিই প্রায় মুক্তগর্ভা ঝিনুক।

সব?

এক-শোটার মধ্যে সাত-আটটা।

এই হল আপনার সব?

ওরই নাম সব। ওই বেশি। ডুব দিয়ে পাহাড়ের গা থেকে ওগুলো তুলতে হয়। হাঙরের ভয় এখানকার জলে। একটু সাবধান হতে হয়। চলো তোমায় দেখিয়ে দিই।

একটা গাছের নীচের পথ দিয়া আমরা সোজা নামিয়া আসি সমুদ্রের বালুতটে। জলে নামিয়া হঠাৎ বামদিকে এককোমর জলে দাঁড়াইয়া বৃদ্ধ বলিলেন–এসো। সোজা চলো দশ পা। তারপর ডুব দিলেই পাহাড়। আমি বৃদ্ধের কথামতো সেখানটাতে ডুব দিয়া দেখিলাম ছোটো পাথরের একটা চড়া সেখানটাতে আছে বটে। ডুব দিয়া পাথরের গা হইতে আমি আট-দশটা ঝিনুক তুলিয়া আনিলাম। উত্তেজনার মাথায় সেগুলি তখনই ভাঙিয়া ফেলিলাম ডাঙায় বসিয়া। কিছুই নাই। আমার হতাশা দেখিয়া বৃদ্ধ বলিলেন–সারাদিন তুলে যদি একটা মুক্তোও পাওয়া যায় তা হলে যথেষ্ট হয়েছে বিবেচনা করবে। এ কাজে বড়ো পরিশ্রম।

তা তো দেখছি। তাতে ভয় কী?

আমি রোজ ঝিনুক খেতাম, মুক্তো হত বাড়তি।

কত দিনে কত পেতেন? মাসে কত পেতেন?

দশ হাজার টাকার মাল।

তবে কাছিমের খোলার ব্যবসা করেন কেন?

আমি কোনো ব্যাবসাই করি না।

না?

ঠিক। সেসব তুমি ছেলেমানুষ, বুঝবে না। ভোলা দিলে চাল-ডাল পাই।

মুক্তো দিলে তো অনেক চাল-ডাল-টাকা পান।

তাহলে আমার শান্তি নষ্ট হবে, ডাকাতের হাতে প্রাণও যেতে পারে। এখন জানে সবাই গরিব মানুষ–সকলে দয়া করে। পাগল ভেবে করুণাও করে। কিন্তু আজ যদি তারা জানে। আমি মুক্তোর মালিক, এই বদরুদ্দিনের দলই আমায় খুন করবে।

সে-কথা ঠিক।

আমার দরকার নেই অর্থের। বেশ আছি।

আপনার না থাকে, দেশের বহু ভালো কাজ হয় এই অগাধ টাকায়। হাসপাতাল হয়, স্কুল হয়, গরিব ছেলেদের লেখাপড়া হয়।

সব বুঝি। সময় হলে করব একদিন।

আমি সব সহ্য করিলাম এইখানে। এই নির্জনতা, এই খাওয়ার কষ্ট, এই গাছতলায় দিন রাত্রি কাটানো। আমার অত্যন্ত ভালো লাগিল বৃদ্ধকে। কুবেরের মতো ধনী মানুষ আজ এই ব্যক্তি। কীসের আশায় এই নির্জন দ্বীপে কাছিমের মাংস আর ঝিনুকের শাঁস খাইয়া কাল কাটাইতেছেন? কতবার জিজ্ঞাসা করি, কোনো স্পষ্ট উত্তর পাই না। এমন আশ্চর্য নিস্পৃহ মন! আমাকে গোপনীয় মুক্তার ভাঁড়ার দেখাইয়া দিয়া এমন নিশ্চিন্ত থাকেন কী করিয়া। আমি চুরি করিতে পারি তো? অন্য কোথাও লুকাইয়া রাখিতে পারি। যেখানে-সেখানে এত টাকার মুক্তা ফেলিয়া রাখিয়া একবার খোঁজও করেন না।

একদিন আমি বলিলাম–আমাকে এত বিশ্বাস করলেন কী করে?

বৃদ্ধ হাসিয়া বলিলেন–কেন?

আমি মুক্তো নিতে পারি নে ভাবছেন?

নাও তো নেবে।

আপনি কিছু ভাববেন না?

কেন ভাবব, নিও।

বেশ।

সত্যি বলছি, তোমার দরকার থাকে নিও।

দাদু, আমার কিছু দরকার নেই। আপনি আমাকে নিজের কাছে রাখুন, এই আমার দরকার।

থাকবেই তো।

কিছুদিন ধরিয়া দাদুর কাছে থাকিয়া এটুকু বুঝিলাম, এমন অদ্ভুত ও অসাধারণ ধরনের লোক সদাসর্বদা দেখা যায় না। শরীরে বা মনে কোনো বিলাস নাই। অথচ মনে সর্বদা আনন্দ। এই খাইয়া ও এভাবে থাকিয়া কী করিয়া একটা লোক এত আনন্দ পাইতে পারেন, আমার মাথায় আসে না। দাদু আমাকে সারাদিন লেখাপড়া শিখাইতে লাগিলেন–মুখে মুখেই সব। সমুদ্রে জোয়ারভাটা কেন হয়, গ্রহনক্ষত্র কী, কত রকমের ঝিনুক আছে, কতগুলো সমুদ্র আছে পৃথিবীতে, পৃথিবীটাই বা কী– নিত্যনতুন শিক্ষার আনন্দে আমার মন মাতিয়া গেল। কত যত্নে কত স্নেহের সঙ্গে দাদু আমাকে সব কথা বুঝাইয়া বলেন, কত ধৈর্যের সঙ্গে বার বার বুঝাইয়া দেন। বর্ষা কাটিয়া শরৎ পড়িয়া গেল। সমুদ্র শান্ত হইল। সেদিন সমুদ্রের ধারে বসিয়া দাদু আমাকে দেশের অতীত ইতিহাস বলিতেছিলেন, আমি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া বসিলাম–দাদু, একটা কথা বলব?

কী বলো?

আপনি কোন জেলার লোক? কেন এখানে এলেন?

দাদু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সমুদ্রের দিকে চাহিলেন, বলিলেন–আমি একজন সাধারণ লোক, ব্যস!

না, ওসব শুনব না। খুলে বলুন, কেন এখানে এলেন?

আমার নাম কালীবর রায়, আমি বরিশাল কোটালিপাড়ার সিদ্ধেশ্বর তর্কাচার্যের সেজো ছেলে। আমি সংসার করিনি, বাবা আমাকে দেখে বাল্যেই নাকি বলেছিলেন–এ ছেলে সংসার করবে না। বাবা ও মায়ের মৃত্যুর পর দেশ ছেড়ে বহু তীর্থ বহু দেশ যাই। সেখান থেকে একদল মাঝির সঙ্গে এখানে এসে পড়ি ঘটনাচক্রে। বেশ লেগে গেল এর নির্জনতা আর এর চমৎকার দৃশ্য। সে তো তোমায় দেখিয়ে আসছি রোজ এত দিন ধরে। তবুও ফুরিয়ে যায় না, এমনি মজা। সেই থেকেই রয়ে গেলাম এবং আছি এবং থাকব। টাকার মালিক হয়ে আর অশান্তির সৃষ্টি করতে চাই না। বেশ সুখে আছি।

দাদুর মুখে তাঁহার জীবনের ইতিহাস শুনিয়া আমার কেবলই মনে হইতেছিল, ঝিনুকের মধ্যে বড়ো মুক্তার সন্ধান পাইয়াছি। অন্য কোনো ঐশ্বর্যে আমার দরকার কী? ইহার পদতলে বসিয়া কত শিখিতে পারি, কত জানিতে পারি। সারাজীবন ধরিয়া শিখিলেও ফুরাইবে না।

দাদু আমাকে সেই প্রথম দিনটি হইতে বড়ো স্নেহ করিতেন। কত গল্প বলিতেন, কত উপদেশ দিতেন। তাঁহার একটি অমূল্য উপদেশ–সময় কখনো নষ্ট করিতে নাই।

খুব সাধারণ কথা বলিয়া মনে হইতে পারে বটে, কিন্তু এত বড়ো উপদেশ আমার জীবনে আমি শুনি নাই।

একদিন বলিলাম–দাদু, একবার দেশে যাবার বড়ো ইচ্ছে করে, কিন্তু আপনাকে ছেড়ে যেতে মন সরে না।

যাও না, ঘুরে এসো। আমি তো এখানেই আছি। এবার বদরুদ্দিনের নৌকো এলে ওদের সঙ্গে যেও।

আবার আসব কিন্তু।

বা রে, তুমি না এলে আমারও কী কষ্ট কম হবে?

এই কথাবার্তার পর বহুদিন কোনো নৌকো আসিল না। সে বোধ হয় আমার সৌভাগ্যবশতই। অমন মহাপুরুষের সঙ্গ পাওয়া কি অতই সস্তা?

ঋতুপরিবর্তনের অপূর্ব রূপ সেবার সমুদ্রের উপর প্রত্যক্ষ করিবার সুযোগ হইল। বিরাট আকাশের রং পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিরাট সমুদ্রের রং বদলাইল। সমুদ্রও যেন আকাশের দর্পণ। আকাশে মৌসুমি হাওয়ায় ঘন বর্ষার মেঘ জমিবার সঙ্গেসঙ্গে সমুদ্রের রং ঘষা পয়সার মতো হইয়া গেল। বৃষ্টি-ঝরা ঘন বর্ষার মেঘপুঞ্জের দিকে চাহিয়া চাহিয়া দাদু সংস্কৃত কবিতা আবৃত্তি করিতেন। কোনো নাকি এক বড়ো কবি, নাম তাঁহার কালিদাস, তিনি আষাঢ় মাসের প্রথম দিবসে মেঘরাশির ছন্দ কাব্যে গাঁথিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। আমি মূর্খ, সংস্কৃত জানি না। দাদু মস্ত বড়ো পন্ডিতের সন্তান। আমাকে সুর করিয়া সংস্কৃত কবিতার ছন্দলালিত্য যখন বুঝাইতেন, পেছনে বহিত অনন্ত নীল সাগর, মাথার উপরে মেঘভারাক্রান্ত নভঃস্থল– যেন কোনো নতুন দেশের, নতুন জীবনের সন্ধান পাইলাম। এতদিনে। সমস্ত টাকাকড়ির স্বপ্ন যাহার নিকট তুচ্ছ হইয়া যায়।

বদরুদ্দিন মাঝি আসিল!

দাদু বলিলেন–কী দাদু, চললে সত্যি?

আপনি যা বলেন।

যাও, দেশ থেকে ঘুরে এসো।

ঠিক আসব।

আমার শিষ্য করে নেব তোমাকে।

আমি শুধু আপনার এখানে থাকতে চাই।

আমার কি অনিচ্ছে? দেশে অনেকদিন যাওনি, ঘুরে এসো।

যাইবার আগের দিন সন্ধ্যার সময় দাদু আমাকে সমুদ্রের ধারে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, দাদু সাবধানে থেকো। আবার এসো। একটা কথা–

কী?

কী নেবে বলো?

কী নেব?

যা ইচ্ছে, মুক্তো নিয়ে যাও।

একথা ভেবে বলব।

ভাবার কী আছে এর মধ্যে?

আপনার শিষ্য কি বৃথা হয়েছি? ভেবে দেখব, তবে বলব।

একা একা বিস্তীর্ণ বালুতটে দাঁড়াইয়া কত কী ভাবিলাম। দাদুর মুক্তা লইব। দাদু কিছুই বলিবেন না জানি, যত খুশি লইতে পারি বটে, কিন্তু বেশি টাকা হাতে পাইলে আমি শান্তি পাইব না। তবে দাদুর স্নেহের উপহারস্বরূপ, তাঁহার মলিন স্মৃতির চিহ্ন হিসেবে একটি মাত্র মুক্তা তাঁহার হাত হইতে গ্রহণ করিব।

দাদু পরদিন বলিলেন– কী নেবে?

কিছুই না, কেবল একটা মুক্তো নেব আপনার হাত থেকে।

খুব বিস্মিত হলাম। তুমি ছেলেমানুষ, এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সোজা কথা নয়। অনেক বড়ো বড়ো লোক পারে না। আশীর্বাদ করি, মানুষ হও।

মানুষ হও মানে বড়োলোক হও না তো?

টাকার বড়োলোক না,–এসো—

দাদা একটা পুঁটুলি খুলিয়া একটি মুক্তা আমার হাতে দিলেন। পুঁটুলিটি ঘরের এক কোণে অযত্নে পড়িয়াছিল। মুক্তাটি কখনো দেখি নাই, দেখিয়া চমকিয়া উঠিলাম। বলিলাম–এ দিলেন কেন?

দাদু স্নেহবিগলিত কণ্ঠে বলিলেন–আমার সাধ এটা। নিয়ে যাও—

বদরুদ্দিনের নৌকাতে উঠিবার সময় তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া মাথায় দিলাম। তাঁহার চোখে জলের মতো ও কী চিকচিক করিতেছে। অনেক দূর হইতে দেখি, তিনি ছবির মতো সমুদ্রবেলায় দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে আমাদের নৌকার দিকে চাহিয়া আছেন।

.

বাড়ি ফিরিয়া যাহা শুনিলাম তাহাতে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। মা নাই, দাদামহাশয় আছেন বটে, কিন্তু একেবারে শয্যাশায়ী, শরীর জীর্ণ-শীর্ণ, অস্থিকঙ্কালসার। আমাকে হারাইয়া দারুণ দুঃখে মৃতপ্রায়।

এই দীর্ঘ সাত বৎসরে আমার চেহারায় অনেক পরিবর্তন হইয়াছিল, তবু দেখিবামাত্র কষ্টে গাত্রোত্থান করিয়া দাদু রে আমার বলিয়া দাদামহাশয় আমাকে বুকে জড়াইয়া ধরিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, আমার প্রত্যাগমনের পর হইতে তিনি ক্রমশ সুস্থ হইয়া উঠিলেন, হাতে পায়ে বল পাইলেন।

একদিন তাঁহাকে প্রথম হইতে আমার সমস্ত ঘটনা বসিয়া বসিয়া বলিলাম! দাদুর কথা শুনিয়া দাদামহাশয় দু-হাত জোড় করিয়া বার বার তাঁহার উদ্দেশ্যে প্রণাম করিলেন।

বলিলাম–দাঁড়ান, একটা জিনিস দেখাই।

পরে মুক্তাটি বাহির করিয়া তাঁহার হাতে দিলাম। দাদামহাশয় বৈষয়িক ব্যক্তি, মুক্তা চিনিতেন। বিস্ময়ে তাঁহার চোখ বড়ো বড়ো হইয়া উঠিল। বলিলেন–এ কী, কে দিলেন, তিনি?

হ্যাঁ।

এর দাম কত তোমার আন্দাজ হয়?

জানি নে।

অন্তত বিশ হাজার টাকা। এ নিয়ে একটা ব্যাবসা করো দাদু। আমি সব ঠিক করে দেবো।

আপনি যা বলেন।

সত্যি বড়োলোকের দেখা পেয়েছিলে!

দাদামহাশয়কে ছাড়িয়া যাইতে পারিলাম না কোথাও। তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া মায়া হইত। আমাকে পুনরায় হারাইলে বৃদ্ধ এবার আর বাঁচিবেন না।

ব্যাবসা করিতেছি, উন্নতিও হইয়াছে। বৎসর খানেক কাটিয়াছে। নির্জন দ্বীপের আমার সেই দাদুকে কখনো ভুলি নাই, তাঁহার সেই ছবির মতো মূর্তিটি মনের পটে চিরদিন অক্ষয় হইয়া থাকিবে। জানি না আবার কবে দেখা হইবে!

মাঝে মাঝে রাত্রে স্বপ্নের মধ্যে দেখি তিনি বলিতেছেন–দাদু, মানুষ হও, সময় কখনো নষ্ট কোরো না–কথাটা ছোটো, কিন্তু মস্ত বড়ড়া উপদেশ জীবনের পক্ষে।

স্বপ্নের মধ্যেই বলি–আপনি আশীর্বাদ করুন।

সেই সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপটি, সেই নীল জলরাশি, সেই চিত-করানো কচ্ছপগুলো আবার যেন চোখের সামনে তখন ফুটিয়া উঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *