৩
শতাব্দীর ঊর্ধ্বে উঠে যারা কাজ করেন, তাঁদের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি, প্রতিভা এবং আবেগ তো অবশ্যই অনুমানযোগ্য, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে খুব লৌকিকভাবেই একথা মনে রাখতে হবে যে, চৈতন্য মহাপ্রভু কোনো ‘আপস্টার্ট’ ভুঁইফোঁড় মানুষ নন, বঙ্গদেশের ইতিহাস তাঁর জন্ম দিয়েছে। বঙ্গের রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি এবং সমাজ তাঁর উৎপত্তি ঘটিয়েছে আপন প্রয়োজনে, কিন্তু সেই পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনের যে আমূল রূপান্তর ঘটেছিল, সেইখানে কাজ করেছে চৈতন্যের ব্যক্তিত্ব এবং স্বাতন্ত্র। একথা একবারও বলছি না যে, চৈতন্য মহাপ্রভুই প্রথম বঙ্গদেশে হরিভক্তির সর্বাশ্লেষী মহিমার কথা বলেছেন। একথা বলছি না, কারণ নানান বিচিত্র গবেষণা তা বলে না। আমরা একথা বলতে পারি না যে, চৈতন্যই বঙ্গীয় সমাজটাকে একা হাতে সংস্কার করে দিলেন, কেন না সেই সংস্কারের উপযুক্ত বীজগুলি বিপ্রতীপভাবে এই সমাজের মধ্যেই উপ্ত ছিল। কিন্তু চৈতন্যের ক্ষমতাটা কোথায়— তিনি তাঁর সমাজের আভ্যন্তর যন্ত্রণাগুলি নিজের হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন, কিন্তু তিনি তার প্রশমন ঘটিয়েছেন শাস্ত্রপ্রবর্তিত পরিধির মধ্যে থেকেই, তাঁকে বাইরে থেকে কিছু আমদানি করতে হয়নি। রাষ্ট্রের কথাটাই আগে বলি।
চৈতন্যদেব যে সময় নবদ্বীপে জন্মেছিলেন (১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে) সে সময় বাংলায় মুসলমান রাজত্ব চলছে। বঙ্গদেশে স্বাধীন হিন্দু রাজাদের রাজত্ব লক্ষ্মণ সেনের আমলেই শেষ হয়ে যায়। লক্ষ্মণ সেনের সামরিক শক্তি যে খুব অকিঞ্চিৎকর ছিল, সে কথা অনেক পণ্ডিতই মনে করেন না, কিন্তু সে শক্তি উৎখাত করতে বিজেতা পাঠান বক্তিয়ার খিলজির সময় লাগেনি। সমসাময়িক মুসলমান গ্রন্থগুলি অনুসারে গৌড়ের রাজধানীর ওপর বক্তিয়ার খিলজির আক্রমণ ছিল এতটাই অতর্কিত যে, অন্দরমহলে খেতে বসা লক্ষ্মণ সেনকে খালি পায়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল মহলের পিছনের দরজা দিয়ে। মুসলমান আকর গ্রন্থগুলিতে লক্ষ্মণ সেনের এই কাপুরুষতার বর্ণনায় আধুনিক কিছু গবেষক অবশ্য অতিরঞ্জনের গন্ধ পেয়েছেন, সেইসব গবেষণায় লক্ষ্মণ সেনের কাপুরুষতার দায় হয়তো কিছু কম হবে, কিন্তু আশ্চর্য হল— এই বাবদে তৎকালীন অভিজাত হিন্দুসমাজের প্রতিক্রিয়া।
বস্তুত প্রতিক্রিয়া কিছু নেই। অথবা প্রতিক্রিয়া জানাতে তাঁরা ভয় পেয়েছেন। লক্ষণীয় ব্যাপার হল, রাজনৈতিক পালাবদলের যে উৎপাত সাধারণ মানুষকে সইতে হয়েছিল,তার চিহ্নমাত্র সমসাময়িক অভিজাত সাহিত্যের মধ্যে ধরা পড়েনি। চৈতন্যপূর্ব এবং চৈতন্য-পরবর্তী কালের সংস্কৃত গ্রন্থগুলি— সে ন্যায়শাস্ত্রই হোক কিংবা বেদান্তগ্রন্থ, কাব্যই হোক অথবা স্মৃতিশাস্ত্র— সেগুলি পড়লে পরে মনে হবে যেন এদেশে কিছুই হয়নি, কিছুই ঘটেনি, অথচ এই শাস্ত্রগুলি তৎকালীন ভদ্রসমাজের একমাত্র প্রতিবিম্ব। মুসলমান শাসকদের আমলে নবদ্বীপ দর্শন তথা নব্যন্যায়চর্চার প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল, অথচ সেই নবদ্বীপেরই পণ্ডিত সমাজের একটি সংস্কৃত লেখাতেও বঙ্গদেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পালাবদলের কোনো ইতিহাস বা তেমন কোনও ইঙ্গিত নেই, লেখা নেই মুসলমান রাজাদের সম্বন্ধে তাঁদের সামান্য অসহিষ্ণুতা বা সহিষ্ণুতার কথাও।
অথচ সমসাময়িক বাংলা চরিত সাহিত্য এবং মঙ্গলকাব্যগুলিতে মুসলমান রাজাদের বিচার, আচার, অত্যাচার এমনকী ভালোবাসার কথাও বেশ সুষ্ঠুভাবে ধরা আছে। আমরা কি তাহলে এই অনুমান করব যে, সমকালীন অভিজাত তথা জ্ঞানী-মানী পণ্ডিত সমাজ ছিলেন অত্যন্ত নির্বিকার— হিন্দু রাজার বদলে মুসলমান শাসক বঙ্গদেশে রাজত্ব করলে তাঁদের কিচ্ছু আসত-যেত না, অথবা পাণ্ডিত্যচর্চায় তাঁদের এমনই মোহ ছিল যে, বাহ্য রাজনৈতিক জগতে কী ঘটছে না ঘটছে— এই নিয়ে তাঁদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। বলা উচিত— আপস, অভিজাত সম্প্রদায়ের অনেকেই বেশ আপস করে চলতে জানেন। বিদ্বান বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের কাছে শাসকবর্গের ধন-মানের উপঢৌকন এমনভাবেই আসত, যাতে তাঁদের জীবনযাত্রায় কোনও বিঘ্ন ঘটত না। আর বিঘ্ন না ঘটে থাকলে ভট্টাচার্য-চক্রবর্তী, মিশ্র-আচার্যেরা— পরম সমৃদ্ধ অশ্ব-গজ-যুক্ত হই। …নবদ্বীপে আসিয়াছে এক দিগবিজয়ী। — এই বলে উদ্বাহু হতেন। এই তো সেকালের বিদ্যাসমাজের সামগ্রিক চিত্র, আর তা না হলে রূপ-সনাতনের মতো রাজমন্ত্রকে ‘দবির খাস’ বা ‘শাকর মল্লিক’ হয়ে গিয়ে মনে মানে পুড়ে মরা— এটাও অভিজাতের আশাপূরণের মন্ত্র ছিল।
আপনারা বলতে পারেন— বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে। রূপ-সনাতনের মতো বিশাল হৃদয় মানুষ, যাঁরা নাকি বৈরাগ্যের কারণে এক বৃক্ষের নীচে এক রাত্রির বেশি থাকতেন না, তাঁদের সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করাটা একেবারে চরম অসভ্যতা হয়ে যাচ্ছে। আমি বলি—রূপ-সনাতন আপনাদের কাছে যত শ্রদ্ধেয় তার চেয়ে আমার কাছে অনেক বেশি এবং সেটা মৌখিকতা নয়, সেখানে আমাদের পিতা-পিতামহের ধর্ম-মর্ম ন্যাস করা আছে। সবচেয়ে বড় কথা, রূপ-সনাতন একটা উদাসীন উদাহরণমাত্র, চৈতন্যের পরিকরদের মধ্যেই কতগুলি মানুষ দেখুন—রূপ-সনাতনের ছোট ভাই বল্লভ, চিরঞ্জীব সেন, মুকুন্দ, কেশব খান, কবিশেখর, দামোদর, যশোরাজ খান এবং আরও কত নাম বলব—এঁরা সবাই সুলতান হুসেন শাহর মন্ত্রিসভায় বা অন্যত্র রাজকার্য করতেন।
আমরা এটা বলছি না যে, এঁরা সব মুসলমান শাসকের তল্পিবাহক অঙ্গ-মর্দক ছিলেন, কিন্তু শাসকগোষ্ঠী এবং অভিজাত তথা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা, আপস না হয়ে থাকলে রাজদরবারে ‘নেটিভ’দের এত চাকরি জোটে না। বলতে পারেন হুসেন শাহ বড় ভালো শাসক ছিলেন, যার ফলে এমন দেওয়া-নেওয়া। আমরা বলব বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর চরিত্র বরাবর একই রকম হয়, সমঝোতার কারণগুলোও প্রায় একই রকম থাকে—যেমন ইংরেজ আমলে; যেমন মুঘল আমলে, তেমনই সুলতানদের আমলে। এবং সবার শেষে আছে শাসিত গোষ্ঠীর আপন চরিত্র। প্রসঙ্গত বলে ফেলাই ভালো যে, জাতীয় মনস্তত্ত্বের নিরিখে বাঙালি বড়ই নমনীয় প্রকৃতির মানুষ। মোগল সম্রাট বাবর পূর্বকথিত হুসেন শাহর ছেলে নসরৎ শাহকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের কিয়দংশের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করার স্মৃতি রোমন্থন করে বাবরনামায় লিখেছিলেন— পরিবর্তিত যে কোনো সুলতানের প্রতিই বাঙালিরা বশ্যতা স্বীকার করে। কী আমির, কী ওয়াজির, কী সৈন্যসামন্তরা কিংবা কৃষককুল—সকলেই নতুন তথা সদ্য সিংহাসনে অধিষ্ঠিত রাজার বশ্যতা স্বীকার করে।
এরপর আর কী-ই বা বলার থাকতে পারে। বাঙালির চরিত্র কেন এমন হল, তার জুতসই ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে এবং তা বিচার করার জায়গা নয় এটা। যেটা বলার দরকার, সেটা হল—চৈতন্যদেব যখন নবদ্বীপে জন্মেছেন, তখন সবেমাত্র বাংলার স্বাধীন সুলতানদের অন্যতম জালাল-উদ-দিন ফতে শাহর রাজত্বকাল শেষ হচ্ছে। প্রসিদ্ধ মাহমুদ শাহী বংশের গৌরব ফতে শাহর রাজত্বকালেই শেষ হয়ে যায়, যদিও সেই গৌরবের মধ্যে হিন্দুবিদ্বেষের কলঙ্কটুকু অবশ্যই ছিল। আধুনিক গবেষকদের বিচারণায় একথা প্রায় নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে, বিজয় গুপ্ত যে মনসামঙ্গল রচনা করেছিলেন, তা আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে নয়, তা জালাল-উদ-দিন ফতে শাহর আমলে। বিজয় গুপ্ত অবশ্য এক হুসেন শাহের উল্লেখ করেছেন পয়ারে, কিন্তু সেই হুসেন শাহ আসলে ফতে শাহ, কেন না তাঁরও জনপ্রিয় নাম ছিল হুসেন শাহ। যাঁরা এতকাল ‘ঋতু শশী বেদ শশী’-র পাঠান্তর প্রমাণ করে বিজয় গুপ্তকে আলাউদ্দিন হুসেন শাহর আমলে পাঠাতে চাইতেন, তাঁরা গবেষণার প্রমাণে এতদিনে বুঝেছেন যে, ‘ঋতু শূন্য বেদ শশী’-র পাঠটাই ঠিক। বিশেষত বিজয় গুপ্ত তাঁর ‘হাসান-হোসেন’ পালায় হিন্দু প্রজাদের ওপর মুসলমান শাসকের যে অত্যাচার বর্ণনা করেছন, তা জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল-এর বয়ানের সঙ্গে মিলে যাওয়ার ফতে শায়ের কালটা আরও সপ্রমাণ হয়ে ওঠে। অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়কে এই বিষয়ে প্রায় অকাট্য মনে হয়।
জয়ানন্দ তাঁর চৈতন্যমঙ্গলে চৈতন্যজন্মের পূর্বসময়ে নবদ্বীপে মুসলমান শাসকের অত্যাচারের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। খেয়াল করুন, চৈতন্যদেব জন্মেছেন ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে এবং আলাউদ্দিন হুসেন শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেছেন ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দের শেষে অথবা ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দের প্রথমে। ফলে এই অত্যাচার ঘটেছে মাহমুদ শাহী রাজত্বের শেষ ভাগে ফতে শাহর সময়েই। কথাটা এর আগেও আমরা জানিয়েছি—জয়ানন্দ লিখেছেন—বাসুদেব সার্বভৌম রাজভয়ে নবদ্বীপ ছেড়ে উৎকলে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেখানে উৎকলাধিপতি প্রতাপরুদ্র তাঁকে বরণ করে নিয়েছিলেন। এখানে জয়ানন্দের তথ্যে একটাই ভুল আছে এবং সেটা হল—উৎকলে তখনও প্রতাপরুদ্র রাজা হননি; তবে ওড়িশায় তখন গজপতিদের শাসনই চলছিল এবং হয়তো তাঁর বাবা পুরুষোত্তম দেবের আমলে সার্বভৌম গজপতি-রাজার প্রসাদ লাভ করে থাকবেন। জয়ানন্দের বয়ানে প্রতাপরুদ্রের নাম এসেছে চৈতন্যদেবের সঙ্গসাম্যে।
জয়ানন্দ তাঁর অসাধারণ ইতিহাসভেদী বুদ্ধিতে এটা খুব ভালো করে বুঝেছিলেন যে, বঙ্গদেশের মুসলমান রাজাদের কর্তৃত্ব অবশ্যই তাঁদের বিপরীতধর্মী হিন্দু প্রজাদের মনের মধ্যে একটা চিরন্তন সংশয়ের জন্ম দিয়েছিল এবং সেটা তিনি স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েই বলেছিলেন— ‘ব্রাহ্মণে-যবনে বাদ যুগে যুগে আছে।’ কিন্তু এ শুধু পারস্পরিক সংশয় নয়, মাঝে-মাঝে বিসংবাদ নয়, হঠাৎই এক চরম অত্যাচার নেমে এসেছিল নবদ্বীপে। জয়ানন্দ লিখেছেন—সে এক কঠিন সময় নেমে এসেছিল নবদ্বীপে এবং তা এসেছিল এক মিথ্যা গুজবকে কেন্দ্র করে। গুজবটা উঠে এসেছিল নবদ্বীপের কাছে ‘পিরল্যা’ গ্রাম থেকে। এখানে সুলতানের কাজিরা বসবাস করতেন বোধহয় এবং তাঁদের কিছু ধর্মোন্মাদনাও ছিল বোধহয়। এখান থেকেই গৌড়েশ্বর যবন রাজার কানে গুজব এসে পৌঁছল যে— গৌড়দেশে ব্রাহ্মণ রাজা হবে। এটা যে মিথ্যা রটনা এবং রটনার শক্তি অনেক সেটা জয়ানন্দ স্পষ্ট জানিয়েছেন—
গৌড়েশ্বর বিদ্যমান দিল মিথ্যাবাদ।
নবদ্বীপে বিপ্র তোমার করিল প্রসাদ।।
গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হব হেন আছে।
নিশ্চিন্তে না থাকিও প্রমাণ হব পাছে।।
এই মিথ্যাবাদ বা গুজব যে রটেছিল, তার স্পষ্ট প্রমাণ আছে। বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য-ভাগবত-এ চৈতন্য যখন সদ্যোজাত শিশু, তখন তাঁর কোষ্ঠী বিচার করে তাঁর মধ্যে ‘মহারাজ লক্ষ্মণ’ দেখতে পেলেন তাঁর মাতামহ নীলাম্বর চক্রবর্তী। তিনি তাঁর সময়ের পূর্ববাদ স্মরণ করে বললেন— গৌড়ে এক ব্রাহ্মণের রাজা হবার কথা। হয়তো ভবিষ্যতে এই কথাটাই প্রমাণ হবে এই শিশুর মাধ্যমে—
বিপ্র রাজা গৌড়ে হইবেক হেন আছে।
বিপ্র বোলে সেই বা জানিব তাহা পাছে।।
নীলাম্বর চক্রবর্তী চৈতন্যদেবের মাতামহ। একজন মাতামহ তাঁর নিজের সময়ের লোকবাদ উচ্চারণ করে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন এবং কথাটা জয়ানন্দের বয়ানের সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে। শিশু চৈতন্যের জন্মলগ্নের এই ভবিষ্যদ্বাণীতে চৈতন্যপ্রভুর কোনও ক্ষতি হয়নি, কারণ চৈতন্যভাগবত-এ ঈশ্বরসম্ভাবনায় ওই পূর্বশ্রুত লোকোক্তি উচ্চারিত হয়েছে ভবিষ্য-পাঠক মাতামহের মুখে, আর জয়ানন্দ এই লোকোক্তি এবং মিথ্যাবাদের ফলশ্রুতি দেখিয়েছেন ঐতিহাসিকতার উচ্চারণে এবং সেকথা চৈতন্যপূর্বকালের নায়কোপম কতকগুলি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের নামোল্লেখে যথেষ্ট প্রামাণিক বলে মনে হয়। বিশেষত জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলে বর্ণিত মুসলমান শাসকের অত্যাচার বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলে কথিত ‘হাসান-হোসেন’ পালার মধ্যে সমর্থিত হওয়ায় আরও নিঃসংশয় হওয়া যায় যে, নবদ্বীপে শাসকগোষ্ঠীর এই অত্যাচার ঘটেছিল জালাল-উদ-দিন ফতে শাহ ওরফে হোসেন শাহের আমলেই। অর্থাৎ এই হোসেন শাহ চৈতন্য-সমকালীন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ নন, তিনি ফতে শাহ— যাঁর রাজত্বের শেষ পর্বে চৈতন্য জন্মলাভ করেছিলেন।
বঙ্গে নব্যন্যায়চর্চার ইতিহাসে দীনেশ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন যে, একমাত্র জয়ানন্দ ছাড়া আর কেউ এমন সঠিকভাবে লেখেননি যে, প্রখর নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি চৈতন্যজন্মের পূর্বেই ‘ভট্টাচার্য-শিরোমণি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। জয়ানন্দের এই বর্ণনায় যদি ঐতিহাসিকতা থাকে, তবে চৈতন্য পূর্বকালে যে হঠাৎই একদিন মুসলমান অত্যাচার নেমে এসেছিল নবদ্বীপে সেটাই বা মিথ্যা হবে কেন! সুখময় মুখোপাধ্যায় এই অত্যাচারের উপাদান— গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজার জনশ্রুতি ব্যাখ্যা করার সময় অনুমান করেছেন যে, গৌড়বঙ্গের সারস্বত সমাজে যে বিরাট অভ্যুদয় ঘটেছিল, সেখানে ব্রাহ্মণেরাই প্রধান ভূমিকা নেওয়ায় এই জনশ্রুতির সৃষ্টি হয়েছিল। এটা ঠিকই যে বাসুদেব সার্বভৌম বা রঘুনাথ শিরোমণির ছাত্র হওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে তখন প্রচুর ব্রাহ্মণ পড়ুয়ার আগমন ঘটছিল নবদ্বীপে। লক্ষ্য করে দেখুন, চৈতন্যের সময়েও এই ছাত্রধারার প্রশমন ঘটেনি—
প্রতিদিন দশ-বিশ ব্রাহ্মণ-কুমার।
আসিয়া প্রভুর পায়ে করে নমস্কার।।
পণ্ডিত আমরা পড়িবাঙ তোমা স্থানে।
কিছু জানি হেন কৃপার করিবা আপনে।।
ভাল ভাল হাসি প্রভু বোলেন বচন।
এইমত প্রতিদিন বাড়ে শিষ্যগণ।।
নবদ্বীপে বিদ্যাচর্চার এই বাড়বাড়ন্ত এবং ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের মর্যাদার বহুশ্রুতি রাজনিযুক্ত কাজিদের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি করেছিল এবং হয়তো সেই কারণেই ফতে শাহের কাছে তারা মিথ্যাবাদ রটনা করে দেয় যে, সবাই বলছে— এবার গৌড়ের রাজা হবে এক ব্রাহ্মণ এবং তাঁর হয়ে অস্ত্র ধরবে হিন্দু প্রজারা—
নবদ্বীপে ব্রাহ্মণ অবশ্য হব রাজা।
গন্ধর্বে লিখন আছে ধনুর্ময় প্রজা।।
কথাটা মুসলমান শাসকের মনে ধরল। এর দশ বছর আগেই রাজা গণেশ বিভিন্ন মুসলমান শাসকের কম ভোগান্তি ঘটাননি। সেই দুর্দিন যদি আবার ফিরে আসে, সেই স্মৃতিতেই নদিয়া নগরীর ওপর অত্যাচার নেমে এল— নদিয়া উচ্ছন্ন করো রাজা আজ্ঞা দিল। রাজার পেয়াদারা ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের ধরে ধরে মারধর আরম্ভ করল। কেউ মারা গেল, কারও বা জাতি গেল, ধর্মান্তর গ্রহণ ছাড়া গত্যন্তর রইল না। যার গলায় পৈতে,যার কপালে বিষ্ণুর স্মারক তিলকচিহ্ন তাদের কারও ঘরদোর লুঠ হয়ে গেল, রাজবন্দি হয়েও শুধু প্রাণে বেঁচে রইলেন কেউ কেউ। মন্দির-দেউল ভাঙা পড়ল অনেক, উপড়ে ফেলা হল সাধারণ গৃহস্থ ঘরের পূজার প্রতীক তুলসী গাছ—
দেউলে দেহরা ভাঙ্গে উপাড়ে তুলসী।
প্রাণভয়ে স্থির নহে নবদ্বীপবাসী।।
জয়ানন্দের এই বিবরণের সঙ্গে বিজয় গুপ্ত বর্ণিত ‘হাসান-হোসেন’ পালার কোনো পার্থক্য নেই। হাসান হোসেন দুই ভাই, হোসেন হাটি গ্রামে ‘কাজিয়ালী’ করে। তাদের সামনে কোনও ‘হিন্দুয়ালি’ রীতিতে চলা চলবে না। হোসেনের শ্যালকের নাম ‘দুলা’, সে এমনিতে হালদার—বোধহয় অনেকগুলি হাল-লাঙলের মালিক। সে তাঁর জামাইবাবুদের চেয়েও অত্যাচারে দড়। হাসান-হোসেন যাওয়ার আগেই সে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছয় এবং যার মাথায় সে ‘তুলসীর পাত’ দেখতে পায়, তাকেই সে কাজির কাছে নিয়ে যায়। বামুনের গলায় পৈতে থাকলে, তারও রেহাই নেই, হয় সে গাছে বাঁধা অবস্থায় মার খায়, নয়তো তার পৈতে ছিঁড়ে ‘থুথু দেয় মুখে’। বিজয় গুপ্ত দুঃখ করে বলেছেন—মুসলমান শাসকের কাছে হিন্দুরা নিতান্তই ‘পর’ মানুষ, অতএব মার তো খেতেই হবে—
পরের মারিতে কিবা পরের লাগে ব্যথা।
চোপড় চাপড় মারে দেয় ঘাড়কাতা।।
মানুষজন সকলেই বিশেষত উচ্চশ্রেণির ব্রাহ্মণ-সজ্জনেরা যে এই অকথ্য অত্যাচারের ভয়ে সিঁটিয়েছিলেন, সেকথা বিজয় গুপ্তও বলেছেন জয়ানন্দের মতো করেই। ঠিক একইরকম একটা আচম্বিত রাজভয় সৃষ্টি হওয়ার পরেই বাসুদেব সার্বভৌম নবদ্বীপ ছাড়েন এবং গৌণ কারণ হিসেবে নিজ শিষ্য রঘুনাথ শিরোমণির উত্থানও হয়তো কাজ করেছে। সার্বভৌমের ভাই বিদ্যাবাচস্পতি নবদ্বীপের মানুষ হলেও তিনি গৌড়ের রাজধানীতে থাকতেন অথবা কাছেই বাস করতেন রামকেলি গ্রামে। অতএব তাঁর অত ভাবনা ছিল না। নবদ্বীপে রঘুনাথ শিরোমণি তখন সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত অতএব সর্বজনমান্যতার কারণে তাঁরও অসুবিধে হয়নি নবদ্বীপে থাকতে। বাসুদেব সার্বভৌমের আর দুই ভাই বিদ্যাবিরিঞ্চি এবং বিদ্যারণ্য নবদ্বীপেই থেকে গেছেন, হয়তো তাঁদের অন্যত্র যাওয়ার উপায় ছিল না। ঘটনা হচ্ছে—নবদ্বীপে এঁদের থেকে যাওয়া বা সার্বভৌমের প্রস্থানের খবরটা খুব বড় কথা নয়, বড় কথা হল—চৈতন্যজন্মের অব্যবহিত পূর্বকালেই নবদ্বীপে এই অত্যাচার নেমে এসেছিল এবং সেখানে প্রাণবধের কথা তেমন যুক্তিযুক্ত না হলেও জাত মেরে ধর্মান্তরিত করার ঘটনা অনেক ঘটেছিল। বিজয় গুপ্তের কাজির বয়ানও তাই—
হারামজাদা হিন্দুর হয় এত বড় প্রাণ।
আমার গ্রামেতে বেটা করে হিন্দুয়ান।।
গোটে গোটে ধরিব গিয়া যতেক ছেমরা।
এড়া রুটি খাওয়াইয়া করিব জাতিমারা।।
জালাল-উদ-দিন ফতে শাহর এই অত্যাচার অবশ্য বেশিদিন চলেনি, যেভাবেই হোক—অন্তত স্বপ্নে দেখা কোনো চণ্ডীমূর্তির ভয়ে অবশ্যই নয়—ফতে শাহ তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন নিশ্চয়। নিশ্চয় বুঝেছিলেন যে, গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হওয়ার ব্যাপারটা একেবারেই গুজব এবং তাঁর অত্যাচার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নবদ্বীপে বিদ্যাচর্চার পরিবেশও তৈরি হয়েছিল আবার এবং তা চৈতন্য মহাপ্রভুর নিজের কাল পর্যন্ত অব্যাহত থেকেছে। ফতে শাহ কিন্তু খুন হয়ে যান তাঁর বিশ্বস্ত দাসের হাতেই।
ফতে শাহর মৃত্যুর পর গৌড়ের সিংহাসন দখল নিয়েই এত ডামাডোল চলে যে, গৌড়ে বা নবদ্বীপে তেমন সমস্যা কিছু হয়নি। ফতে শাহের পর হাবশি রাজারা কেউ তিন বছর, কেউ এক বছর—এইভাবে শাসন চালান। এভাবেই চলে প্রায় ছয় বছর এবং তার পরেই গৌড়ে সুলতান হয়ে বসেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। হুসেন শাহকে ঐতিহাসিকেরা অনেকে ‘বঙ্গদেশের আকবর’ নামে চিহ্নিত করেছেন। চৈতন্যদেবের জন্মের উৎসব শেষ হতে না হতেই চারজন হাবশি রাজার রাজত্ব শেষ হয়ে যায়। চৈতন্যের আট-নয় বছর বয়স থেকেই গৌড়বঙ্গে তেমন কোনও অপশাসন তো চলেইনি বরঞ্চ এক সুস্থ রাজার শান্ত শাসনের আবহ তৈরি হয়ে গেছে।
হুসেন শাহ গৌড়বঙ্গের সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং কৌশলী সুলতান। রাজনৈতিক দিক থেকে তাঁর রাজত্বকালে অনেকটাই শান্তি নেমে আসে সমস্ত গৌড়বঙ্গে, নবদ্বীপে তো বটেই। ইসলাম ধর্মের পোষ্টা হিসেবে তিনি অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি যথেষ্ট উদার ছিলেন কিনা, অথবা তিনি তাঁর নিজস্ব ইসলামীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে রাজকার্য চালাতেন কিনা সেকথায় পরে আসছি। কিন্তু অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে, চৈতন্য যখন তাঁর বাল্য-কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে উপনীত হচ্ছেন, তখন নবদ্বীপে এমন কোনো রাজনৈতিক সমস্যা ছিল না, যাকে ‘রাজভয়’ বলা চলে। অর্থাৎ নিমাই-বিশ্বম্ভর যখন তাঁর অধ্যয়ন-অধ্যাপনার জীবন অতিবাহিত করছেন, অথবা সে জীবন ছেড়ে যখন তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন, তখন নবদ্বীপের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল অন্য ধর্মীয় অধিকারে থাকলেও তা সুস্থ ছিল। ফলত অন্য অনেক কিছুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হলেও চৈতন্যকে কোনো রাজনৈতিক চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়নি। এটা চৈতন্যের পক্ষে বাড়তি পাওনা ছিল।
রাজনীতির হানাহানি না থাকাটা পাওনা বটে, তবে সেই পাওনাটা মোটেই নিরুপদ্রব ছিল না, নিরুপাধিকও নয় মোটেই। ইতিহাস এমনই এক বস্তু যেখানে কখনও একটা ‘ফ্যাক্টর’ কাজ করে না। সমাজ, ধর্ম, ভৌগোলিক স্থিতি, মানব-তত্ত্ব সবই সেখানে এমন ইতস্তত জড়িয়ে আছে যে, অভ্যুদয়ী পুরুষকে সেখানে বড় সতর্ক হয়ে পা ফেলতে হয়। চৈতন্যের চলার পথে রাজনীতি ছাড়াও আরও সহস্র প্রতিকূলতা ছিল, সেই প্রতিকূলতাগুলিকে তাঁকে অনুকূল করে তুলতে হয়েছে আপন ব্যক্তিত্বের বিভূতিতে। চৈতন্য যেহেতু প্রধানত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবক্তা, অতএব যে সমাজ এবং ধর্মকে নিজের অনুকূল করে তুলতে হয়েছিল তাঁকে, সেই সমাজ এবং ধর্মকে নিজের কথাই আগে বলতে হবে, বস্তুত সেখানেই তাঁর সুবিধে এবং অসুবিধে দুইই লুকিয়ে আছে।
প্রথমেই একথা বলে নেওয়া ভালো যে, বঙ্গদেশে বেদ এবং ব্রাহ্মণের খুব সরল-কোমল বিচরণভূমি ছিল না কোনো কালেই। সেসব অকথা-কুকথা না হয় নাই বললাম, যখন সংস্কৃতে স্মার্ত শ্লোক বাঁধা হয়েছিল এই মর্মে যে, অঙ্গ-বঙ্গ কলিঙ্গে যদি কেউ তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্য ছাড় এমনি-এমনি যায় তবে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গৌড়বঙ্গের আর্যায়িত হবার আকাঙ্ক্ষা এবং ওদিককার কান্যকুব্জী ব্রাহ্মণদের ‘এক থেকে বহু’ হবার প্রয়োজন— এই দুয়ের সঙ্গতে বাংলায় ব্রাহ্মণদের আগমন ঘটতে থাকে। বঙ্গদেশের রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের কুলপঞ্জি ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, মহারাজ আদিশূর, যিনি অষ্টম খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে কনৌজ থেকে পাঁচজন সাগ্নিক ব্রাহ্মণ নিয়ে এসেছিলেন। অন্য মতে একাদশ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গের বর্মন রাজা শ্যামল বর্মা তাঁর শকুন-সত্র সম্পন্ন করার জন্য গুটিকতক ব্রাহ্মণ এদেশে নিয়ে এসেছিলেন এবং তাঁদের বংশধরেরাই নাকি পাশ্চাত্য বৈদিক। চৈতন্যের পিতা জগন্নাথ মিশ্রও কিন্তু সেই বৈদিক শ্রেণির ব্রাহ্মণ।
কুলপঞ্চিগুলির ঐতিহাসিকতা তেমন নেই বটে, কিন্তু এইসব কাহিনির মধ্য দিয়ে লোকস্মৃতির একটা ঐতিহাসিক ইঙ্গিত অবশ্যই পাওয়া যায়। পণ্ডিতেরা অবশ্য ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা শিলালিপি এবং তাম্রশাসনগুলি পরীক্ষা করে বলেছেন যে, বঙ্গদেশে ইতস্তত ব্রাহ্মণদের আমদানি হতে থাকে গুপ্তযুগের শেষ পর্যায় থেকে। দিনাজপুর, পুণ্ডবর্ধন, ফরিদপুর এমনকী ত্রিপুরায় পর্যন্ত নানা ব্রাহ্মণ্য যাগযজ্ঞের খবর পাওয়া যাচ্ছে, তবে ব্রাহ্মণ্য তখনও এই শ্যাম বঙ্গদেশে তত প্রসারিত এবং দৃঢ়বদ্ধ নয়। বরঞ্চ পণ্ডিত ঐতিহাসিকেরা এই কথাটাই মেনে নিয়েছেন যে, বঙ্গদেশে সেন এবং বর্মন রাজাদের ছত্রচ্ছায়াতেই ব্রাহ্মণ-স্মৃতি ও ব্যবহার-শাসন তথা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মানুশাসন সর্বব্যাপী প্রসার লাভ করে এবং মাথায় রাখুন— সেন রাজারা এবং বর্মন রাজারা ঐতিহাসিক প্রমাণেই অবাঙালি ছিলেন।
সেন-বর্মন রাজাদের আমলে এই যে বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার প্রোথিত হল, তাতে এখানে একটা নব্য অভিজাত শ্রেণি তৈরি হল বটে, কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম বা মধ্যদেশের কড়া-কঠিন বৈদিকতা পালনে তাঁরা অনেকটাই অক্ষম ছিলেন। ফলে বঙ্গদেশের ব্রাহ্মণ্যও বঙ্গদেশের জল-হাওয়া অনুযায়ী তৈরি হয়ে গেল। তাতে বৈদিক যাগযজ্ঞের চেয়েও পৌরাণিক এবং স্মার্ত অনুশাসনগুলি অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল। আমরা লক্ষ্মণ সেনের আমলেই দেখেছি যে, রাঢ়ী এবং বরেন্দ্রী ব্রাহ্মণেরা অনেকেই পশ্চিম-মধ্য ভারতের কঠিন বৈদিকতা আর বজায় রাখতে পারছেন না। বৈদিকতার এই ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়ের কারণেই ভবদেব ভট্ট, অনিরুদ্ধ ভট্ট, শূলপাণি, শ্রীনাথ আচার্য, আচার্য চূড়ামণি এবং অবশেষে রঘুনন্দনের মতো স্মার্ত পণ্ডিতের বিধান অনুশাসন বঙ্গীয় সমাজের ওপর অনেক বেশি কার্যকরী হয়ে ওঠে। স্মার্ত বিধানগুলির অনেক অংশই যেহেতু পুরাণ-বচন থেকে সংগৃহীত, ফলে পুরাণগুলি কিন্তু প্রায় বেদের মর্যাদা পেতে থাকে। অভিজাত সমাজের ওপর এই প্রক্রিয়ার প্রভাব পড়েছে দুই ভাবে।
বস্তুত পুরাণগুলির মধ্যে এক ধরণের দ্বৈতবৃত্তি আছে। স্মৃতিশাস্ত্রের অনেক বচনই যেহেতু পুরাণ থেকে নেওয়া, তাই নিয়ম-আচার-ব্রত- উপবাসের অভিযোজন পর্যবসিত হল ত্রিসন্ধ্যায় স্নান-আহ্নিক-তর্পণ এবং তিলক রচনার সংকেত চিহ্নে। এমনকী স্বয়ং মহাপ্রভু চৈতন্য যখন নবদ্বীপে অধ্যাপনায় রত, তখনও তিনি প্রিয় শিষ্যের ব্রাহ্মণ্য-আচার অতিক্রমের যে দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, তার মধ্যে সন্ধ্যা না করা এবং কপালে তিলক না থাকাটাই খুব বড়ো ত্রুটি বলে গণ্য হয়েছে। অধ্যাপনার সময় চৈতন্যের নিজের বাড়িতে কিছু অসুবিধা ছিল হয়তো, যার জন্য তিনি তাঁর বাল্যবন্ধু মুকুন্দ সঞ্জয়ের বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে বসে পড়াতেন। সেখানে একদিন এক ছাত্রের কপালে তিলক না দেখে তিনি যে বৈদিক কর্মকাণ্ডের উপদেশ দিচ্ছেন—তা সন্ধ্যা-আহ্নিক ছাড়া অগ্নিষ্টোম, অগ্নিচয়নের মতো বৈদিক ক্রিয়াকলাপের নির্দেশ করে না। মহাপ্রভু তাঁকে দেখে বলেছেন—
প্রভু বোলে—কেনে ভাই কপালে তোমার।
তিলক না দেখি কেনে কি যুক্তি ইহার।।
তিলক না থাকে যদি বিপ্রের কপালে।
সে কপাল শ্মশান-সদৃশ বেদে বলে।।
বুঝিলাম আজি তুমি নহি কর সন্ধ্যা।
আজি ভাই তোমার হইল সন্ধ্যা বন্ধ্যা।।
চল সন্ধ্যা কর গিয়া গৃহে পুনর্বার।
সন্ধ্যা করি তবে সে আসিহ পড়িবার।।
ছাত্রের প্রতি চৈতন্যের এই নির্দেশটিকে খুব একক বা একদেশীয় ঘটনা বলে না ভাবাই ভালো। পঞ্চদশ/ষোড়শ শতকে এটাই বঙ্গদেশের আসল চেহারা। একাদশ শতকে ‘বালবলভীভুজঙ্গ’ ভবদেবভট্ট যেসব স্মৃতিগ্রন্থ রচনা করছেন, তার মধ্যেই পুরাণগুলিকে তেমন আমল দেওয়া হচ্ছে না, কিন্তু বঙ্গদেশে সেন রাজবংশের উত্তরকালে মুসলমান আক্রমণের পর যখন নব্যন্যায়ের মতো নব্যস্মৃতির সূচনা হচ্ছে, তখন কিন্তু তাঁদের গ্রন্থগুলিতে বিচার্য বিষয়গুলি বৈদিক কর্মকাণ্ডের পূর্বমীমাংসাঘটিত বিষয়গুলির চেয়ে পূজা, পার্বণ, তিথিতত্ত্ব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং সেটা অবশ্যই পুরাণগুলির উত্থান সপ্রমাণ করে। আমাদের কাছে আরও আশ্চর্যের ঘটনা হল—আপনারা চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মের পূর্বসময়টুকু দেখুন। চৈতন্যের আবির্ভাব ঘটছে পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে আর বঙ্গীয় নব্যস্মৃতির জনক আচার্য শূলপাণি জন্মেছেন ওই একই শতকের প্রথম ভাগে। কিন্তু শূলপাণির বিভিন্ন রচনার তালিকা ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যাবে যে তাঁর লেখা স্মার্ত নিবন্ধের মধ্যে একদিকে যেমন তিথি, প্রায়শ্চিত্ত, শুদ্ধাচার এবং বিভিন্ন ব্রত-পার্বণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তেমনই তাঁর লেখার মধ্যে দুর্গোৎসবের বিষয়ে অন্তত দুটি গ্রন্থ পাওয়া যাচ্ছে, উপরন্তু পাওয়া যাচ্ছে কৃষ্ণের দোলযাত্রাবিবেক এবং রাসযাত্রাবিবেক।
এতদ্দ্বারা দুটি তর্ক প্রমাণিত হচ্ছে—প্রথমত, বিশাল বৈদিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে যাগযজ্ঞের বিভিন্ন কল্প, তিথি মাহাত্ম্য-ব্রতমাহাত্ম্যের মাধ্যমে প্রতিপূরিত হচ্ছে এবং তাতে শুধু অভিজাত ব্রাহ্মণসম্প্রদায়েরই পালনীয় বিধি থাকছে না, সমাজের তথাকথিত হীনাংশও কিন্তু এই সরলীকৃত ব্রাহ্মণ্য আচারের আওতায় চলে আসছে। দ্বিতীয়ত, দুর্গাপূজার পালনীয়তা প্রসঙ্গে একদিকে যেমন ব্যক্তি দেবতা হিসেবে দুর্গাদেবীর উত্থান ঘটছে, তেমনই দোলযাত্রা, রাসযাত্রা নিয়ে গ্রন্থ রচিত হওয়ায় এটাও প্রমাণিত হচ্ছে যে, চৈতন্যের পূর্বকালেই ভগবান কৃষ্ণ বঙ্গদেশের জনমানসে যথেষ্ট প্রিয়-পরিচিত দেবতা হয়ে উঠেছেন এবং এত যে তিথি, শুদ্ধি, প্রায়শ্চিত্ত অথবা এত যে ব্রত, নিয়ম, দেবতা-পূজন-বিধি—এগুলির প্রমাণ উঠে আসছে পুরাণগুলি থেকে। আর কে না জানে যে, স্ত্রী-শূদ্র এবং হীনাচার ব্রাহ্মণ, যাঁরা বেদে অধিকার পেতেন না, তাঁদের পক্ষে পুরাণগুলিই ছিল প্রধান অবলম্বন। চৈতন্য মহাপ্রভুর কাছে বেদব্রাহ্মণ্যের এই তথাকথিত অবক্ষয় অবশ্যই এক নতুন পথের সম্ভাবনা জুগিয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এটাও মনে রাখতে হবে যে, নব্য স্মৃতির সমুদয়ে বেদ এবং ব্রাহ্মণ্য ক্রমে ক্রমে পৌরাণিক ব্রত-নিয়ম-তিথি-শুদ্ধির দ্বারা প্রতিপূরিত হতে থাকলেও সমাজের অভিজাত ব্রাহ্মণ শ্রেণির কাছে অন্যতর এক প্রশস্ত পথ তখনও খোলাই ছিল এবং তা হল দার্শনিকতা। নব্যন্যায় চর্চা তো ছিলই, এবং তার সঙ্গে ছিল বৈদান্তিকতা। শঙ্করাচার্যের বেদান্ত দর্শন তখনও বঙ্গদেশের পণ্ডিতজনের মনপ্রাণ অধিকার করে আছে। পণ্ডিত-সজ্জন, অভিজাত ব্রাহ্মণেরা পাণ্ডিত্যের গর্বের সঙ্গে বৈদান্তিক ভাবনাট্যকেও খুব ভালোভাবে আত্মসাৎ করেছিলেন। নব্যন্যায়ের পণ্ডিতেরা অনেকেই ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে ব্রহ্ম-ভাবনা বা বেদান্তদর্শনকে সাধ্য বা পরম উপেয় বলে মনে করেছেন। কিন্তু এখানেও একটা দার্শনিক সুবিধে চৈতন্যের অনুকূলে কাজ করেছে। ঘটনা হচ্ছে, শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত যতই যুক্তিযুক্ত হোক, অথবা ঈশ্বর বা ভগবানের রূপ শঙ্করের কাছে যতই সোপাধিক বা মায়া মনে হোক, চৈতন্যের পূর্বেই যেহেতু রামানুজ—মধ্বাচার্যের বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলি শঙ্কর মতের বিরুদ্ধে নিজেদের দ্বৈতবাদী সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন, তাই এদেশে যাঁরা পণ্ডিত-বৈদান্তিক ছিলেন, তাঁরাও কিন্তু শঙ্করের নিরাকার নির্বিশেষ ব্রহ্মকে সাকার সবিশেষ কৃষ্ণ ভগবানের সঙ্গে একাকার করে তুলেছিলেন। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ মিলবে—সার্বভৌম ভট্টাচার্যের বয়ানে। চৈতন্যের সঙ্গে দেখা হওয়ার পূর্বকালে তিনি অবশ্যই বৈদান্তিক ছিলেন কিন্তু চৈতন্য-পূর্বকালে বাসুদেব সার্বভৌম একটি স্বরচিত টীকায় পরম ব্রহ্মকে নিরাকার বলা সত্ত্বেও সেই ব্রহ্মকে ভগবান কৃষ্ণেরই স্বরূপ বলে চিহ্নিত করছেন—অনাভাসং পরং ধাম ঘনশ্যাম মহং ভজে।
বিশিষ্ট ন্যায় গ্রন্থের মধ্যে এমন একটি শ্লোক দেখে দীনেশ ভট্টাচার্য মশায় লিখেছেন—”মহাপ্রভুর সংস্পর্শে আসার বহু পূর্বেই সার্বভৌমের হৃৎকমলে ঘনশ্যাম বিরাজমান ছিলেন, ইহা সম্পূর্ণ নূতন একটি তথ্য বটে। অনেকেই অদ্বৈত মকরন্দের টীকায় তাঁহার উৎকট অদ্বৈত মত দেখিয়া বিভ্রান্ত হইবেন; কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, বাহ্য দার্শনিক মত বুদ্ধির বিলাসের জন্য এবং সভায় পাণ্ডিত্য প্রকাশের জন্য যে ব্যক্তি অদ্বৈতমত অবলম্বন করেন, তিনিই আন্তরিক অনুষ্ঠানকালে স্বতন্ত্র হইয়া পড়েন।”
এই মন্তব্যের দুটি অংশই আমাদের কাছে জরুরি। তার মানে নবদ্বীপের অভিজাত দার্শনিক পরিমণ্ডলে শঙ্করের উৎকট অদ্বৈত মত তখনও যথেষ্ট মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু অন্যদিকে সেই অভিজাত জনের অন্তর্গত মানস-লোকে অখিলরসামৃতমূর্তি কৃষ্ণের প্রবেশও ঘটে গিয়েছিল চৈতন্যজন্মের পূর্বাহ্নেই। হয়তো এর জন্য অনেক কিছু দায়ী। বঙ্গদেশের সেন-বর্মন-চন্দ্র রাজবংশ ব্রাহ্মণ্যের অনুপন্থী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কিন্তু বৈষ্ণব ছিলেন। মনে রাখতে হবে ‘পদ্মাবতী-চরণ-চারণ-চক্রবর্তী’ সেই রাজকবির কথা, যিনি গীতগোবিন্দ রচনা করে লক্ষ্মণ সেনের সভাকবির আসনটির মর্যাদাই শুধু বাড়িয়ে দেননি, বঙ্গদেশের অভিজাত মানসে কৃষ্ণের লীলামাধুরীর বীজ বপন করে দিয়েছেন। এর সঙ্গে আছে মৈথিল বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাসের পদাবলির মাতন—যাতে এই নদনদীসংকুল শ্যাম বঙ্গদেশের অন্তরলোক ‘কালিয়া-পীরিতি’র সরসতায় সিক্ত হয়ে উঠেছিল। এইরকম একটা আবহের মধ্যে শ্রীমন্মাধবেন্দ্র পুরী তাঁর ভক্তিরস প্রোথিত করে গেছেন শান্তিপুরের প্রৌঢ় গৃহস্থ অদ্বৈত আচার্যের ঘরে—তিনি এখন নবদ্বীপে বাসা নিয়ে দশ-বিশ জন ভক্তসঙ্গী জুটিয়ে কৃষ্ণ ভক্তির প্রচার আরম্ভ করেছেন। অন্যদিকে হালিশহরের ঈশ্বরপুরী তখন গুরু মাধবেন্দ্র পুরীর বৃদ্ধাবস্থায় তাঁকে অন্তিম সেবা করে যাচ্ছেন, হয়তো সেটা পুরী-নীলাচল জগন্নাথে, নয়তো নবদ্বীপ থেকে আরও কাছে রেমুণায় ক্ষীরচোরা গোপীনাথের স্থানে।
নবদ্বীপে তখনও বিশ্বম্ভর মিশ্র অধ্যাপনা করছেন। প্রতিদিন তাঁর টোল বসে মুকুন্দ-সঞ্জয়ের বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে। পড়ানোর জন্য এতটা প্রশস্ত বড় জায়গা তিনি পেয়েছেন সম্ভবত এই কড়ারে যে, মুকুন্দ-সঞ্জয়ের ছেলে পুরুষোত্তমকে পড়িয়ে দেবেন বলে। এরই মধ্যে তাঁর বিবাহের বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু পিতৃহীন বালকের নানান কঠিন তথা অদ্ভুত আচরণে শচীমাতা এতটাই মনে মনে বিব্রত ছিলেন যে, পুত্রকে তিনি বিবাহের কথা মুখ ফুটে বলতে পারেননি। চরিতকারদের বয়ান শুনে মনে হয়—সেই যুগেও চৈতন্য তাঁর পত্নী নির্বাচন করেছিলেন নিজেই। এটাকে ভালোবাসার গান্ধর্ব-বিবাহ বলব না নিশ্চয়ই। কিন্তু গঙ্গার ঘাটে বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মী এসেছিলেন গঙ্গাস্নানে, বিশ্বম্ভর গৌরাঙ্গও সেই সময়েই তাঁর অধ্যাপনার অবসানে হয়তো স্নান করতেই এসেছিলেন সেই ঘাটে—
হেন মতে দোঁহা চিনি দোঁহা ঘরে গেলা।
কে বুঝিতে পারে গৌরসুন্দরের লীলা।।
ব্যাপারটা একদিনমাত্র ঘটেছে বলে আমাদের মনে হয় না, হয়তো কয়েকবার ঘটেছে এবং হয়তো ব্যাপারটা সেকালের দুঁদে ঘটক বনমালী আচার্যের চোখেও পড়েছে। সেই সূত্র ধরেই বনমালী একদিন শচীদেবীর ঘরে উপস্থিত হল গৌর বিশ্বম্ভরের অনুপস্থিতিতে। বনমালী ঘটক শচীদেবীর কাছে বল্লভাচার্যের কন্যা লক্ষ্মীর প্রসঙ্গ তুললে শচীদেবী কিন্তু পুত্রের কাছে মত না নিয়ে একটা কথাও বলতে রাজি হলেন না। বরঞ্চ তাকে হাঁকিয়ে দিয়ে বললেন—পিতৃহীন বালক আমার। জীউক পঢ়ুক আগে তবে কার্য আর। কথাটা শুনে মনে হয়—শ্চীর মনে আশা ছিল যে, তাঁর পুত্র আরও উচ্চশিক্ষা লাভ করবে—হয়তো সেটা ন্যায়শাস্ত্র অথবা বেদান্তদর্শন। যার ফলে বনমালী ঘটককে তিনি বলেছিলেন—আগে ছেলে বেঁচে-বর্তে থাক, আরও পড়াশুনো করুক, তবে তো বিয়ে। তা ছাড়া পুত্রের পিতৃহীনতার কথা উচ্চারণ করে হয়তো তিনি এটাও বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তাঁর ঘরে তেমন অর্থের স্বাচ্ছন্দ্যও নেই যাতে পুত্রের বিবাহ সম্পন্ন হতে পারে।
বনমালী ঘটক চলেই যাচ্ছিলেন, বিয়ে হবে না ভেবেই তার মনের সমস্ত সরসতা চলে গিয়েছিল। কিন্তু যাওয়ার পথে বিশ্বম্ভর গৌরাঙ্গের সঙ্গে তাঁর দেখা হল। বাড়িতে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় ঘটক গড়গড় করে সব বলে গেল। বিবাহের কথায় জননী যে তেমন গা করেননি, সেটাও বনমালী জানিয়ে দিল নবীন অধ্যাপককে। বিশ্বম্ভর গৌর নিজের ওপর জননীর অনন্ত স্নেহের কথা জানতেন এবং সেই কারণেই ঘরে ঢুকেই এক লহমায় তাঁর মনের গতি ঘুরিয়ে নিলেন নিজের দিকে। বললেন—বনমালী ঘটক এসেছিল, তাকে তুমি একেবারেই আমল দাওনি শুনলাম। কী ব্যাপার?
বুদ্ধিমতী জননী কোনো উত্তর দেননি। তিনি পুত্রের ইঙ্গিত বুঝেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বনমালী ঘটকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জগন্নাথ মিশ্রের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না এবং পুত্র বিশ্বম্ভর গৌরাঙ্গের আমলেও সে অবস্থার পরিবর্তন খুব ঘটেনি। বল্লভাচার্যের যে কন্যাটিকে বিশ্বম্ভরের পছন্দ হয়েছে, সে বাড়ির আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। বল্লভাচার্য ঘটককে বলতে লজ্জা পেয়েছেন, কিন্তু যৌতুকের প্রতীক হিসেবে পাঁচটি হত্তুকি ছাড়া তাঁর দেওয়ার মতো ক্ষমতা কিছু ছিল না। পরে একেবারে বিবাহ-মঙ্গলের সময় জামাতা বিশ্বম্ভরকে বরণ করার পর বল্লভাচার্য যে লক্ষ্মী কন্যাটিকে তাঁর সামনে নিয়ে এসেছিলেন সেই কন্যার রূপ দেখছি—’শেষে সর্ব অলংকারে করিয়া ভূষিত।’ বেশ বোঝা যায়—এই ‘অলংকার’ বৈবাহিক আড়ম্বরের স্তিমিত বর্ণনার মধ্যেও চৈতন্য চরিতকারের কাব্যিক অভ্যাসবশত প্রযুক্ত। আর তা না হলে এটাই বিশ্বাস করতেই হবে যে, বরপক্ষ যাতে এতটুকু যৌতুকও না চায়, তাই আগেভাগেই বল্লভাচার্য নিজের দরিদ্র অবস্থার কথা বনমালী ঘটকের মাধ্যমে শচীদেবীকে জানিয়েছিলেন। যাই হোক বিয়ে হয়ে গেল এবং পূর্ববৎ বিশ্বম্ভরের অধ্যাপনাও চলতে লাগল—সেই সাহংকার স্বভাব এবং একে-তাকে ডেকে ফাঁকি জিজ্ঞাসা করে তাঁর পাণ্ডিত্য বিপন্ন করা—
সর্বদাই পরিহাসমূর্তি বিদ্যাবলে।
সহস্র পঢ়ুয়া সঙ্গে যবে প্রভু চলে।।