রোটি আউর বেটি
মার্কস নাকি বলতেন, মানুষের ইতিহাসের পনেরো আনাই রুটি নিয়ে কামড়া-কামড়ির কাহিনী। মাখন-রুটি, মাংস-রুটি আর শুকনো খটখটে রোটির জন্য লড়াই। কলকাতার ইতিহাসও বোধহয় এর ব্যতিক্রম নয়। ভেবে দেখুন কথাটা। রুটির সঙ্গে দু’ টুকরো মাংস জুটবে বলেই না সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হয়ে ছুটে এসেছে ইংরেজরা। ফরাসি-পর্তুগিজ-ওলন্দাজরা। রুটি-মাংসের জন্যে মাংস খাওয়া-খাওয়ি করেছে এ ওর। দালাল-মুৎসুদ্দিরা রুটি-মাংসের চেয়ে মাংস-পোলাওতে অভ্যস্ত বেশি, নয়তো ফুলকো লুচি। টক-ঝাল-মিষ্টি সহযোগে নিয়মিত ছ’গণ্ডা লুচি খাওয়ার লোভে কথ্য, অকথ্য, সম্ভাব্য সকল পথে সাহেবদের পিছু ছুটেছে তারা। আর এদের পিছু পিছু ছুটেছে এ দেশের গরিব মানুষেরা—ইন্দে আর নাসিবুনের বাপ-মায়েরা। শুধু এক টুকরো রুটি, এক মুঠো ছাতু অথবা এক থালা পান্তা। পালকি বইতে অক্লেশে তারা বেহারা হয়েছে, আলো জ্বালতে ‘মশালচি’ হয়েছে, হুঁকো সাজাতে হয়েছে ‘হুকো-বরদার’। জো হুকুম, তাই, রাজা বুঝিনে, নবাব বুঝিনে, শুধু এক টুকরো রুটি চাই।
তা হলেই বুঝতে পারছেন, এমন রুটি-ময়, নানা আকারের নানা স্বাদের রুটি-কণ্টকিত ইতিহাস যে নগরীর, পলাশির মাঠে অথবা ফলতার আবর্জনাস্তূপে তার ইতিহাস সন্ধান বৃথা। আজব নগরীর যথার্থ ইতিহাস জানতে হলে ঢুকতে হবে আমাদের তার আসল কর্মকাণ্ডের পীঠস্থানে। ঢুকতে হবে গর্ভগৃহে,—হেঁসেলে। হেঁসেল মানে রসুইখানা মাত্র নয়—অন্তঃপুর। স্বভাবতই অন্তঃপুরচারিণীদের কথা বাদ দিয়ে ভাবা যায় না তার কথা। বিশেষ করে, রুটি তৈরি যখন স্পর্শাতীত ঘটনা ছিল না, তখন। মাটির মেঝেয় পা ছাড়িয়ে বসে, মোটা মোটা রুপোর বালা পরা যে কালো হাতগুলো পিদিমের আলোয় আটা মাখত, তাদের কাহিনী আমরা জানি। কারণ এরা আজও ইতিহাস নয়। জানি, ঝাড়-লণ্ঠনের নীচে দাঁড়িয়ে তাম্বুলরঞ্জিত মুখে অতিক্লেশে যাঁরা ঝি-ঠাকুরকে বলে দিতেন মেজোকর্তার লুচিতে ময়ানের পরিমাণ—কম বেশি তাদের কাহিনীও। কিন্তু সে তুলনায় জানি না—এই বিরাট দেশটাকে হাতের চেটোয় নিয়ে যারা ছোট ছেলের খেলার বলের মতো লোফালুফি করেছে যদৃচ্ছ, তাদের অন্তঃপুরের কাহিনী। উনুনে বসে রুটি না সেঁকলেও সেঁকা রুটিতে তারা বিলক্ষণ মাখন মাখিয়েছেন। আধুনিক আইন-মাফিক বা পশ্চিমি কনভেনশন অনুযায়ী কলকাতার ইতিহাসের আধাআধি তাদের প্রাপ্য না হলেও, উচিত মতো কমপক্ষে ন’ আনা সাত আনা যে হবে সেই ভাগ, এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সেই দায়ভাগ চুকিয়ে দেওয়ার বাসনাতেই আজকের এই আলোচনা। রোটির কথায় বেটির কাহিনীর অবতারণা।
ফ্রয়েড নাকি বলতেন—ক্লিওপেট্রার নাকটা আর সিকি ইঞ্চি এদিক ওদিক হলে পৃথিবীর ইতিহাসটা অন্য রকম হত। আমাদের সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য কলকাতার ইতিহাসে এমন নাসিকার আবির্ভাব ঘটেনি। যে দু’একজন ইতিহাস গড়ার রাজমিস্ত্রি না হলেও ক্রমে ক্রমে জোগানদার হয়ে উঠেছিলেন, সৌভাগ্যক্রমে তাঁরাও কলকাতার পাকা বাসিন্দা হননি। পঞ্চাশ হাজার সিক্কা টাকা জরিমানা গুনে দিয়ে ফিলিপ ফ্রান্সিস বিদায় দিতে বাধ্য হয়েছেন কলকাতার ক্লিওপেট্রাকে। নয়তো মাদাম গ্রান্ড কী করতেন কে জানে। তাঁর পরবর্তী জীবন-কাহিনীর কথা ভাবলেই মনে হয়, অনেক কিছুই সম্ভব ছিল তাঁর পক্ষে। অন্তত আর দু’চারটে লাট-বেলাটের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া অসম্ভব ছিল না। শোনা যায়, ইংল্যান্ডে তাঁর দেখা পেয়ে ডিউক অব ওয়েলিংটনও নাকি প্রীত হয়েছিলেন।
কলকাতার সৌভাগ্য, এই প্রাসাদপুরীকে চিরকালের জন্য ভাল লাগেনি লোলা মনটেজের। লোলা নাকি যা চেয়েছে এই পৃথিবীতে, তাই পেয়েছে দু’হাত ভরে। কে জানে, লোলার লালসা কলকাতাকে মুক্তি দিত কি না। সামান্য মেয়ে। মিঃ জেমসের বিবাহিতা স্ত্রী। এমিলি ইডেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সিমলায়। ইডেন তাঁর ভ্রমণ-কাহিনীতে লিখেছেন: চমৎকার মেয়ে, সব সময় আনন্দে উৎফুল্ল, নিষ্কলঙ্ক মন, দেখতেও চমৎকার। স্টারই বটে। অচিরেই মিসেস জেমস্ হয়ে গেল উদীয়মান তারকা—লোলা মনটেজ। লোলা অভিনয় করেন, নাচেন, কিন্তু কলকাতা বেশিদিন ধরে রাখতে পারল না তাঁকে। লোলা কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন আমেরিকার নেভাডার এর পল্লিতে। সেখান থেকে সানফ্রান্সিসকো। তখন তার নাম মিসেস প্যাট্রিক হাল। খবরের কাগজের রিপোর্টার মিঃ হালের স্ত্রী। চার চারটি পুরুষের বিবাহিত স্ত্রী হয়েছেন লোলা একটি জীবনে। আর মিস্ট্রেস? অগণিত মানবের। সে তালিকায় নাম আছে একাধিক বিখ্যাত সাহিত্যিক ও শিল্পীর। বাভেরিয়ায় রীতিমত একটা বিপ্লব ঘটে যায় লোলাকে কেন্দ্র করে। রাজা প্রথম লুডউইগ সিংহাসন ত্যাগ করলেন কলকাতার এই মেয়েটির জন্য। পয়সাওয়ালা এক তরুণ ইংরেজ মদ খেয়ে খেয়ে হত্যা করে ফেলেন নিজেকে। ডুয়েলে প্রাণ দিল আর দু’জন তরুণ। মাঝদরিয়া থেকে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে গেলেন অন্য এক হতভাগ্য প্রণয়ী। কলকাতার লোলা তাঁর সারাটি জীবন ইউরোপ আমেরিকার খবরের কাগজে জুড়ে রইলেন। এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকা তিন ভূখণ্ডের নায়িকা কলকাতার লোলা মনটেজ।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, যদি এমনই আরও গুটিকয়েক নক্ষত্রের উদয় হত সুতানুটি-গোবিন্দপুরের আকাশে তবে কলকাতার ইতিহাসের আজ কী চেহারা হত কে জানে। যা হোক, মাদাম গ্রান্ড বা লোলা মনটেজরা সংখ্যায় কম, তা ছাড়া তাদের কাহিনী লেখবার মানুষের অভাব নেই। লোলাকে নিয়ে কয় দশক আগে তিনশো পৃষ্ঠার জীবনী তথা সুখপাঠ্য উপন্যাস বেরিয়েছে মার্কিন মুলুকে, (The Woman in Black by Helen Holdredge) হু-হু কাটতি সে বইয়ের। তারপরও একাধিক বই। হ্যাঁ, এই দশকেও। লোলা আজও নায়িকা। যাঁরা নায়িকা নন, ফুটফুটে তারার মতো যাঁরা ফুটে ওঠেননি ইতিহাসের পাতায়, যাঁদের নোনধরা কবরে বাসি ফুলও পড়েনি কোনও দিন—কলকাতার আজব জীবনে নারী ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও পরিচয়ই ছিল না যাদের, আমার কাহিনী তাঁদের নিয়ে।
কী নাম জানি না, কাদের কন্যা তা-ও জানি না। কোম্পানি পাঠিয়েছে। বিলেত থেকে এক জাহাজ ভর্তি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভেট পাঠিয়েছে তাদের রুটিসন্ধানী তরুণদের। এক জাহাজ মেয়ে। ১৬৭০ সালের কথা। জাহাজখানা ভিড়ল এসে মাদ্রাজের উপকূলে। ক্যাপ্টেন থেকে শুরু করে সাধারণ পল্টন—দুর্গ খালি করে সবাই ঘাটে ছুটল। হই হই করে সকলকে দুর্গের ভিতরে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এল। একটা কাতর শব্দ তুলে বন্ধ হয়ে গেল লৌহকপাট। তারপর ভেতরে কী যে হল কেউ জানে না। ক’বছর পর খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, এক জাহাজ মেয়ের মধ্যে বেঁচে আছে মাত্র দু’জন। বেঁচে আছেন কোম্পানির সেবাদাসী হয়ে। বেঁচে থাকার জন্য তারা কোম্পানি থেকে নিয়মিত মাসোহারা পায়।
একশো বছর পরের ইতিহাসেও দেখি তাই। ঘাটতির অঙ্ক ক্রমেই বেড়ে চলেছে স্ত্রীলোকের দিকে। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে তখন ইংরেজ মহিলা মাত্র ৭২ জন। তাদের মধ্যে ১০ জন বিধবা আর ৭ জন অবিবাহিতা। কলকাতার অবস্থাও মাদ্রাজের মতোই। অষ্টাদশ শতকের শেষে গোটা প্রেসিডেন্সিতে ইংরেজ পুরুষ ছিল সাড়ে চার হাজার, আর মহিলা মাত্র আড়াইশো। স্বভাবতই উত্তেজিত হয়ে উঠল কোম্পানির ছোকরা পল্টনরা। আমরা সারা দেশের জন্যে রুটির লড়াই করছি এই বিদেশ বিভূঁইয়ে, আর আমাদের রুটি পাকাতে হবে কিনা নিজের হাতে। নালিশ গেল বিলেতে, কর্তৃপক্ষের কাছে। ১৬৮৮ সাল। তাঁরা আর এক জাহাজ পাঠালেন। সঙ্গে আদেশ দিয়ে দিলেন ‘এক বছর দেখো। এর মধ্যে যদি বিয়ে-শাদি করে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা না করে নেয়, তবে কোম্পানি থেকে তাঁদের পছন্দমতো এক প্রস্ত পোশাক দিয়ে যে-কোনও কাজে লাগিয়ে দিও। এক বাগিচার কাজ ছাড়া। কিন্তু খবরদার, ইংরেজ ছাড়া ওরা অন্য কাউকে যেন বিয়ে না করে।’ স্বভাবতই এ জাহাজেরও বিলি বন্দোবস্ত হয়ে গেল। আবার অর্ডার গেল বিলেতে। কিন্তু জাহাজ আর এল না। কর্তৃপক্ষ লিখলেন, আর পারিনে বাছাধনেরা। যা খরচপত্তর। বহু সম্ভ্রান্ত বংশের মহিলারাও আসতে রাজি। কিন্তু স্ব-খরচায় কেউ নয়। তাই আমরা বলি কি—ওখানেই দেখেশুনে পাত্রী সন্ধান করো না কেন। ক্যাপ্টেনদের বললেন, ছেলে ছোকরাদের যত রকমে সম্ভব উৎসাহিত করো, যেন দেশীয় মেয়েদেরই ওরা বিয়ে করে।
তা কি আর বলতে হয়, স্বয়ং চার্নক সাহেব থেকে শুরু করে বহু সাহেব রীতিমত ঘরকন্না করেছেন এদেশের স্ত্রীলোকদের নিয়ে প্রকাশ্যভাবে। শ্বেতচর্মের গর্ব বিন্দুমাত্র সংকুচিত করেনি তাঁদের। এত বড় সাহেব মার্টিন—যাঁর অর্থে কলকাতা আর লখনউ-এর লা মার্টিন বিদ্যালয়—তিনি কী করলেন শুনি? লখনউ থেকে চিঠি লিখছেন বিলেতি বন্ধুর কাছে, ‘এদেশে আছি বটে, কিন্তু কী জানো মন টেকে না। এই কৃষ্ণকায়গুলো এমন বলেই একপ্রস্ত যদৃচ্ছ গালাগালি। গালাগালি শেষ হতে না হতে সাহেবের মনে পড়ে গেল নিজ অন্দরের কথা। বললেন, ‘ও থুড়ি, বলতে ভুলেই গেছি। কৃষ্ণাঙ্গদের কথা বললাম বটে, কিন্তু এর মধ্যে তুমি আমার বাড়ির মেয়েটিকে ধোরো না। ও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, ওদের দলে পড়ে না। জানো তো, ওর গায়ের রং আমার চেয়েও ফরসা।’
শুধু মার্টিন সাহেব কেন? হায়দরাবাদের এক রেসিডেন্ট সাহেব হয়ে গেল ‘হামাতজঙ্গ”। কোম্পানির সেনাবাহিনীর ‘বকসি’ ছিল এক মুসলমান বৃদ্ধ। সাহেব বিয়ে করে বসল তার নাতনি খয়ের উন্নিসাকে। তাঁর কথা আগে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে উইলিয়াম গার্ডনারের কথা। তাঁর ঘরেও দিশি বিবি।
গার্ডনারের নজরে পড়েছিল কাম্বের পদচ্যুত নবাব-দুহিতাকে। এক দিন, দু’দিন। তৃতীয় দিনে নিজেই প্রস্তাব দিলেন নবাবের কাছে। নবাব বললেন, ‘মুসলমান হতে হবে’। সাহেব বললেন, ‘এ তো অতি সহজ প্রস্তাব। এত সহজেই রাজি হবেন তো ভাবিনি।’ মুসলমান হয়ে গেলেন তিনি। তাঁর এই রোমান্সের কাহিনীও স্থান পেয়েছে ইংরেজি সাহিত্যে। কিন্তু এরকম ঘটনা বেশি নয়। স্বাভাবিক অবস্থায় বিয়ে করতে চাইলেই বা কন্যাদান করবে কে? তা ছাড়া রোমান্স করার ক্ষমতাও সবার সমান নয়। বিশেষ করে নবাব-নন্দিনী, আমীর ওমরাহ-কন্যারা যে কী চোখে ইংরেজ পুরুষদের দেখত, তাও অজ্ঞাত ছিল না তাদের কাছে।
সুতরাং বিবাহ-সমস্যা দেখা দিল কলকাতার তথা ভারতের ইংরেজ সমাজে। ১৭৭২ সালের সেন্ট জন চার্চের ম্যারেজ-রেজিষ্ট্রির খাতাখানার দু’তিনখানা পাতা উলটে যান। দেখবেন প্রথম পাতায় মোট বিয়ে আছে ন’টি। তার মধ্যে দু’টির পাত্রী পর্তুগিজ কিংবা এতদ্দেশীয়। বাকি সাতজনের ভিতর পাঁচজন বিধবা। বিধবাদের মধ্যে একজন আছেন মেরি গ্রান্ট। ভদ্রমহিলার ওটা পঞ্চম পরিণয়। প্রথম বার বিয়ে করেছিলেন একজন ফরাসি ভাগ্যসন্ধানীকে, দ্বিতীয় বার একজন নৌ-চালককে, তৃতীয়টি মেজর এবং চতুর্থটি ক্যাপ্টেন। সর্বশেষটি জনৈক সিভিলিয়ান। ভদ্রমহিলার পদোন্নতির ধাপগুলো লক্ষণীয়।
এবার আসুন এর পরের পাতায়। এ পাতায় বিয়ে আছে মোট ১৯টি। তার মধ্যে ৯টি অসবর্ণ বিবাহ, অর্থাৎ পাত্রীরা এদেশের বামুন-কায়েত কিংবা শেখ-সৈয়দের কন্যা। অবশিষ্ট দশজন পাত্রীর মধ্যে চারজন বিধবা। তার মধ্যে একজন বিধবার আবার এটি তৃতীয় পক্ষ। পাত্রপক্ষের অবস্থাও একই রকম। এই দশজন পাত্রীর নামে নামে বর আছে মাত্র ন’জন। একজন একই পাতায় নাম উঠিয়েছে দু’বার। বাকি যারা তাদের মধ্যে তিনজনই আবার দ্বিতীয় পক্ষ। তা হলেই দেখুন, সব মিলিয়ে হিসেবটা দাঁড়ায় এমনি: একদিকে পাত্রী ১০ জন আর বর ১৪ জন। অন্যদিকে ৯ জন পুরুষের ১২ জন স্ত্রী। এ সব খবর আগেও কিছু কিছু শোনানো হয়েছে। কিন্তু অমৃতসমান সংবাদ যখন, তখন ফের শুনতে দোষ নেই।
আচ্ছা, তার পরের পাতাখানাও দেখুন। এ পাতায় বিয়ে আছে পনেরোটি। তার মধ্যে মাত্র ছ’জন করে কুমারী। এখানে একজন স্বনামধন্য ক্যাপ্টেনের নাম পাওয়া যাচ্ছে—ক্যাঃ থেলওয়েল। চার চারবার বিয়ে করেছেন ভদ্রলোক। তারপর আর এক পাতায় দেখুন, ২৩টি বিয়ের মধ্যে ৪টি অসবর্ণ, মাত্র ৫টির করে কুমারী, বাদবাকি সব বিধবা। মিসেস মেরি সেফার্ড নামে এক মহিলার নাম আছে এ পাতায়। ছয় ছয়বার প্রজাপতি ভর করেছিলেন তাঁকে। ষষ্ঠতম স্বামী যিনি অর্থাৎ মিঃ সেফার্ডের ওটা চতুর্থতম পরিণয়। ১৭৪২ সালের কলকাতার কথা, আজ হলিউড শুনলেও বোধহয় ভিরমি খাবে বিস্ময়ে।
যা হোক, উপরের বিবরণ থেকে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কলকাতার পাত্রপক্ষের অবস্থা। এ অবস্থায় আমরা, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারা যা করে থাকি, সিভিলিয়ান, মিলিটারি সাহেবরাও তাই করতেন নিশ্চয়ই। নেটিভ অ্যাস্ট্রোলজার-পামিস্টদের কাছে ছুটোছুটি করতেন আর হপ্তায় হপ্তায় বিজ্ঞাপন দিতেন কাগজে। আর হয়তো বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেন রাইটার্স বিল্ডিংস কিংবা ফোর্ট উইলিয়মের খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে। ১৮০৮ সালে রাইটার্স বিল্ডিংস থেকে এক মিঃ অ্যাটল বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন ক্যালকাটা গেজেটে—
‘A young man of genteel connexions and pleasing appearance, being desired of providing himself with an amiable partner and agreeable companion for life takes this opportunity to solicit the fair hand of a young and beautiful lady.’
তারপর নিজের গুণগ্রামের দীর্ঘ ফিরিস্তি দিয়ে মিঃ অ্যাটল শেষে রোমান্সের স্পর্শ জাগিয়ে তুলেতে চেয়েছেন বিজ্ঞাপনে—’A line to Mr Atall will meet with every possible attention and the greatest secrecy will not only be observed but Mr Atall will have the pleasure of giving due encouragement to their favour.’
রাজকর্মচারী ওরফে তৎকালের প্রায়-রাজপুত্র অ্যাটল-এর এই কাতর আবেদনে সাড়া দেওয়ার মতো রাজকন্যার অভাব ছিল না হয়তো, কিন্তু তারা যে সব সাগরপারে। সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপারে। ‘সোনার’ পুরী কলকাতার নামে সবার মন উড়ু উড়ু। কিন্তু দত্যি-দানোয় পথ ভরা। সুতরাং এ দিকে কলকাতা মরুভূমি, অন্য দিকে বিলেতে কন্যারণ্য। করিতকর্মা ছেলেরা সব বাইরে। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারা মহা ভাবিত। হবু জামাইয়ের বিষয়-আশয় ধনদৌলতের স্বপ্নে তারাও বিভোর। কোম্পানির খাতায় নাম ওঠা মাত্র, ধরে করে কিশোরী কন্যাকে তুলে দেন সিপাহির হাতে। শুভাকাঙক্ষী পাড়াপড়শিরা ছুটে এসে বলেন, ‘এ কী করেন, মিঃ অমুক।’
‘কেন? ঠিকই তো করেছি। কোম্পানির চাকরে—’
‘আসছে হপ্তায় যে ওদের জাহাজ ছাড়বে।’
‘তো ছাড়ুক, মাসে মাসে স্ত্রীর অ্যালাউন্সটা তো পাওয়া যাবে এখানে বসেই।’
‘তা ছাড়া, বিদেশ-বিভুঁই, লর্ড না করুন, বলা তো যায় না যদি একটা কিছু—’
‘তা হোক না, কত আর বয়েস মেয়ের। তা ছাড়া, ছ’মাস তো কোম্পানি থেকেই খোরপোষ পাবে তখন। জানেন তো, ‘Three hundred, dead or alive!’
গল্প নয়, ইতিহাস। আমাকে এ কাহিনীটি একটুও নড়চড় করতে হয়নি। বস্তুত এমনই তখন ইংল্যান্ডের কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতাদের আর্থিক এবং মানসিক অবস্থা। একমাত্র ভরসা তাদের গঙ্গার তীর। এই কলকাতা তখন তাদের একমাত্র আশ্বাস। কর্নেল রিচমন্ড ওয়েবের মতো গণ্যমান্য ব্যক্তিও তাঁর দুই কন্যাকে শুধু পাত্রস্থ করার উদ্দেশ্যেই নিয়ে এলেন কলকাতায়। কনিষ্ঠা সারা ওয়েবের বিয়ে হল পাটনায় পিটার মুরের সঙ্গে। জ্যেষ্ঠা এমেলিয়ার হল সিলেট খ্যাত থ্যাকারের সঙ্গে। তারই সন্তান—বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক উইলিয়ম মেকপিস্ থ্যাকারে।
দু’চারটি এমনি উৎকৃষ্ট বৈবাহিক সম্পর্কের সংবাদ পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় মেয়ে পাঠানোর হিড়িক পড়ে গেল ওদেশে। সেখানকার মেয়েরা বর ধরতে এল কলকাতায়। ক্লাইভের এক ‘কাজিন (বাংলা করলুম না, সম্পর্ক নির্ণয় বোধ হয় আরও কঠিন হয়ে উঠত তাতে) মিস্ শেলি ক্লাইভ পর্যন্ত এক চিঠিতে জনৈক বান্ধবকে লিখেছেন ‘I fear, the Colonel (Clive) will not bring me the Eastern Prince till it is too late; the bushel of Diamonds runs strangely in my head.’ তারপর আক্ষেপ করে তিনি বলছেন, ‘আহা, কাজিন না হয়ে যদি সহোদর বোন হতাম আমি কর্নেলের।’ তাঁর এই চিঠিটিকে নিয়ে আর এক কবি এক দীর্ঘ কাব্যকাহিনীই লিখে ফেলেছিলেন। আমি কবি নই, তাই ভাবানুবাদ দিচ্ছি, এবং গদ্যেই দিতে হচ্ছে তা। সেকালের সমসাময়িক কালের ইঙ্গ-ললনাদের এমন নিখুঁত চিত্র দুর্লভ। কবিতাটির সারমর্ম হচ্ছে:
‘আমি ভারত যাত্রার জন্যে তৈরি হয়েছি। সিটন এবং রামসে আমায় তুলে দিতে এসেছে। বুল বলছে, আমার ভাবনার কোনও কারণ নেই। ব্রিটিশ আদলের একটা নিম্নতম ‘প্রিমিয়াম’ নাকি ওদেশে আছেই। এমনকী এরা বলে আমার চেহারার জন্যেও ভাবনা মিথ্যে। বোম্বাইয়ের তাম্রবর্ণ সুন্দরীদের মধ্যে আমার এই আটপৌরে মুখখানাই নাকি সবচেয়ে খুশি করবে ওদের।…হাজার মানুষের ভিড়েও যারা হারিয়ে থাকে এখানে, মাদ্রাজে নেমেই নাকি তারা হয়ে দাঁড়ায় ভেনাস। সুতরাং বিদায়, আমি যাচ্ছি, আমি ‘নাবুবিনা’ হতে চলেছি। ইত্যাদি।’ তারপর আছে দুপুরে তিনি কী করবেন, সন্ধ্যায় কী কর্তব্য হবে, কত লোক তাঁর হুকুম তামিল করবে, কত লোক সেবা করবে, কী অফুরন্ত ধনরত্নের অধিকারী হবেন তিনি। হীরের তূপ হয়ে যাবে, মুক্তোর মালার পর মালা। রুপোর টি-সেট, বন্ধুর বাড়ি যাতায়াতের জন্য বেহারাসমেত পালকি, সন্ধ্যায় হাওয়া খাওয়ার জন্য জুড়ি গাড়ি!
বস্তুত প্রায় প্রতিটি ইংরেজ তরুণীর ছিল এই এক স্বপ্ন, একমাত্র সাধনা। মা-বাবা পরম যত্নে পুষে যেতেন তাদের মনের এই সাধ। শোনা যায়, তৎকালীন এদেশীয় ইংরেজ পিতামাতার কর্তব্য ছিল যেখানেই থাকুন না কেন তাঁরা, পাঁচ বছর বয়স হলে কন্যাকে পাঠিতে দিতে হবে ‘হোমে’। সৈখানে ব্রাইটন বোর্ডিং স্কুলে কিংবা অন্য কোথাও ভর্তি হবে মেয়েটি। বড় হবে মাসি, পিসির কাছে ভারতবর্ষের নীল আকাশ, রাজপুত্র, হীরে মাণিক্যের গল্প শুনে। পনেরো বছর বয়সে পিসিকে আর বলতে হবে না। নিজেই ছটফট শুরু করবে জাহাজে ওঠার জন্যে। অবশেষে সত্যিই একদিন নোঙর করবে কলকাতায়। বহু প্রসারিত হাত তাকে একসঙ্গে টেনে নেবে কাছে।
দুর্ভাগ্য, শেষ পর্যন্ত অতি অল্পজনের ভাগ্যেই জুটত কর্নেল, ক্যাপ্টেন। সৈন্যদলের সবাই আর ক্যাপ্টেন হবে কী করে? ফলে অবশেষে তাকে ঘর পাতাতে হত কোনও দূর হিল স্টেশনের ছাউনির নীচে সাব-ওলটার্নের সঙ্গে, নতুবা আবার ফিরে যেতে হত দেশে শূন্য হৃদয়ে শূন্য মনে, এক মাথা দুঃস্বপ্ন আর দুর্ভাগ্য বয়ে।
আশ্চর্য, তবুও আসত। বছর বছর এই কলকাতায় প্রতি মরসুমে এই সব স্বপ্নে-পাওয়া মেয়েদের জাহাজ ভিড়ত গঙ্গার ঘাটে। তারপর মেলা বসত অশ্বথতলায়। মাল্টায় এই কন্যাবোঝাই নৌকো, জাহাজকে বলা হত ‘ফিশিং ফ্লিট’, ‘জেলে নৌকো’। তরী থেকে কোনওমতে একবার পা তুলুক ডাঙায়, তারপর জাল ফেলো, আর ধরো। যত খুশি, যেমন খুশি। রুই-কাতলা-চিংড়ি-পুঁটি সব ভিড় করে আছে এখানে। মাদ্রাজে নাকি লটারিও হত এদের নিয়ে। কলকাতায় তা হয়নি। তবে ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে, এই মেয়েদের ভিড়ে যে কোনও মেয়ের হাত ধরে, যে কেউ নাকি বলতে পারত ‘Lady, will you walk?’ অনেকে গট গট করে উঠে আসত ঘরে, বাংলোয়। অনেকে আবার খেলা করত দক্ষ শিকারির মতো মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। কিন্তু প্রশ্ন, যার সন্ধানে এই এত দূর ধাওয়া, সেই ‘শিবের মতো স্বামী, কুবেরের মতো ধন’ শেষ পর্যন্ত মিলত ক’জনের।
এ প্রশ্ন কেউ কাউকে কোনও দিন করেনি। শুধু একটি মেয়ে এ প্রশ্ন করেছিল নিজেকে। আর সে প্রশ্নের উত্তরটিও সে শুনিয়ে গেছে কোনও এক মাসির মাধ্যমে। যাত্রার পূর্বমুহূর্তে কলকাতাগামী মাসিকে সে একখানা চিঠি লিখেছিল। খোলা মনের চিঠি গোপন ইতিহাসের একখানা খোলা পাতা। কান্নায় ভেজা, ক্লান্তিতে অবসন্ন। সে চিঠির দীর্ঘ কাহিনী এখানে অবান্তর। দু’চারটে নির্বাচিত লাইন মাত্র তুলে দিচ্ছি। এই সব হতভাগ্য মেয়েদের মনের কথা বোঝার পক্ষে এইটুকুই যথেষ্ট হবে আজকের পাঠকের কাছে।
মাসিকে সাবধান করে দিয়ে মেয়েটি বলছে: এসো না মাসি, তুমি এসো না কিছুতেই এসো না। যে ভুল আমি করেছি, প্রতি বছর আমার মতো অনেক মেয়ে যে ভুল করে থাকে, তুমি সে ভুলে পা দিও না। তার চেয়ে বরং জীবনভর একা থেকে যাও। তোমার শ্রম, তোমার বিদ্যেয় যা রোজগার করতে পারো, তাই খেয়ে থাকো। কিন্তু তবুও এদিকে এসো না। তা হলে আমার মতো অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতে হবে তোমাকেও সারা জীবন। সত্য বটে, আজ আমি বিবাহিতা। যে বস্তুটির সন্ধানে আমি পাড়ি জমিয়েছিলাম দূর কলকাতায়, সেই স্বামীলাভ আমার ঘটেছে। অর্থও জুটেছে অনেক। সম্ভবত আমার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। কিন্তু তার বদলে চিরকালের মতো হারিয়েছি আমি আমার সুখ, আমার মনের শান্তি। কেন জান? আমার স্বামী আমায় গ্রহণ করেছে তার প্রয়োজন-বস্তু হিসেবে, সাথী হিসেবে নয়। এমন ব্যবহার করে, যেন পালকি বয় যে বেয়ারাগুলো, আমিও তাদের মতোই তার কেনা বাঁদী। সুতরাং বুঝতেই পারছ। এখানে স্ত্রীর মানসিক শান্তি ফিরে পাওয়া সম্ভব একমাত্র স্বামীর বিয়োগে। অবাক হচ্ছ? কিন্তু মাসি, এই-ই সত্য আজকের ভারতে।
এর পর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। আজব নগরীর প্রথম জীবনে ইংরেজ মেয়েরা এমনি করেই এক হয়ে গিয়েছিল রুটির সঙ্গে। আজব নগরীর আজবতম সমাজে রোটি আর বেটি এক। দুই-ই খাদ্য।
এত কথা বলা হয়ে গেল, কিন্তু এক তরফের হল মাত্র। আলো-ঝলমল চৌরঙ্গি আর ট্যাঙ্ক স্কোয়ারের সংবাদ। ব্ল্যাক টাউনের সমাচার কী? যে কালের কাহিনী বললাম এখানে ব্ল্যাক টাউন তখনও অন্ধকারে। সতীদাহ বন্ধ হয়েছে ১৮২৯ সালে। ১৮২৮ সালেও কলকাতায় পুড়িয়ে মারা হয়েছে ৩০৮টি মেয়েকে। বিদ্যাসাগর সদরে রিপোর্ট করেছেন—‘বিধবাদের হবে বিয়ে—’ এ ছড়াটিও আরও অনেক পরের। সুতরাং সেন্ট জন চার্চে যখন ঘণ্টা বাজিয়ে পঞ্চমবারের মতো বিয়ে হচ্ছে বর্ষীয়সী ইংরেজ মহিলার, গঙ্গার ঘাটে তখন প্রবল হরি-সংকীর্তনের মধ্যে সানন্দে দাহ করা হচ্ছে সদ্য-বিধবা কোনও কিশোরী কিংবা তরুণীকে। ‘মরবে সতী, উড়বে ছাই, তবে তার বালাই গাই!’
সতীদাহ কলকাতায় তখন প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। সারা ব্ল্যাক টাউন চিতার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, অন্ধকার। সেই অন্ধকারে চলেছে বাবু-বিলাস, গুরু-প্রসাদী, কৌলীন্য-রক্ষা। সতীর আর্তনাদে, বিধবার কান্না, আর বারবনিতার কাতর আহ্বানে অষ্টাদশ শতকের কলকাতা প্রেতপুরী। পা যেন লজ্জায় জড়িয়ে আসে সেদিকে বাড়াতে।
আশ্চর্য। কলকাতায় অনেক বীরের স্মৃতি আছে, পদাধিকার বলে অনেকে অনেক স্মৃতি রেখে গেছেন শহরে, কিন্তু নেই একটি মেয়ের নামে প্রকাশ্য স্থানে একটি লাইনও। মূর্তি তো দূরের কথা। কবরখানা থেকে কবরখানায় ঘুরে বেরিয়েছি। বেগম জনসনের স্মৃতিস্তম্ভ আছে সেন্ট জন চার্চের কবরখানায়। পার্ক স্ট্রিটের কবরখানায় আছেন এলিজাবেথ জেন বারওয়েল ওরফে মিস স্যান্ডারসন। আছেন মিস অ্যানও। কিন্তু এঁরা কলকাতার ক’জন?
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গেছি। অনেক ছবি, অনেক দলিল, অনেক মূর্তির জাদুখানা সেটি। কিন্তু কোথাও চোখে পড়ল না মাসির কাছে লেখা সেই মেয়েটির চিঠিটি, অন্তত তার একখানা প্রতিলিপি। চোখে পড়ল না শিল্পী টিলি কেটলের আঁকা সেই ‘জেন্ট মেয়ে’র ছবিটি:
‘A Gentoo woman taking leave of her friends…before mounting her husband’s funeral pyre.’
হবসন-জবসন
সাদা কথায় ‘হবসন-জবসন’ একটি শব্দ। ইংরেজি শব্দ। আসলে ‘হবসন-জবসন’ একটি ভাষা। যদি বলেন, কী ভাষা? তবে উত্তরে বলতে হয় ‘চাউ-চাউ’ ভাষা। ‘চাউ-চাউ’-এর মতো সহজ কথাটারও যদি টীকা দরকার হয়, তবে আপনার পক্ষে এর পুরো ইতিহাসটা শোনা ভাল।
লোকে বলে, স্পেন না ইংল্যান্ডের এক বাদশা নাকি খুব উঁচুদরের ভাষাবিদ ছিলেন। তিনি বলতেন, ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলবে স্প্যানিশ ভাষায়, ভালবাসার মানুষের সঙ্গে বলবে ইতালিয়ানে, তরুণী মেয়েদের সঙ্গে ফরাসিতে এবং সৈন্যদের সঙ্গে জর্মানে। ইংরেজি বলতে হয়, বলবে রাজহংসীর সঙ্গে, কবুতরের সঙ্গে বলবে সুইডিশ, ঘোড়ার সঙ্গে হাঙ্গেরিয়ান, আর শয়তানের সঙ্গে চেক।
‘ইন্ডিস’, ‘ইন্ডুস্থান’ বা ভারতবর্ষের লোকেদের সঙ্গে কী ভাষায় বাক্যালাপ করা উচিত, মহামান্য সম্রাট তা বলেননি। ফলে, সপ্তদশ শতকে ইংরেজরা এদেশে এসে বিপাকে পড়লেন। কারণ, তাঁদের মুখে রাজহংসীর ভাষা। অথচ ‘জেন্টু’ কেন, এদেশের তরুণী মেয়েরা পর্যন্ত পর্তুগিজ ভাল বোঝে না। তবুও পর্তুগিজরা আগে এসেছে। তাদের কথা কেউ না বুঝলেও তারা ‘জেন্টুদের’ কথা বোঝে। ‘জেন্টু’ কথাটাও তাদেরই দেওয়া। পর্তুগিজ ভাষায় জেঁতিউ (Gentio) বা জেঁতিন (Gentile) মানে ‘হিদেন্’ বা বিধর্মী। তাই থেকে ক্রমে ‘জেন্টু’, অবশেষে ‘জেন্টলম্যান’ বা ভদ্রলোক, ওরফে ‘বাবু’।
ইংরেজরা তাই পর্তুগিজ ‘দো-ভাষ’ বা ‘দো-ভাষী’ ধরলেন। সাহেবরা ‘তুমি’কে ‘টুমি’ বলে। এক কানে-খাটো সাহেবের পাল্লায় পড়ে দু’দিনের মধ্যেই ‘দো-ভাষ’ তাই ‘টোপাস’ (Topass) হয়ে গেল। ‘টোপাস’ মানে ক্রমে দাঁড়াল—পর্তুগিজ। কারণ তারা দু’দেশের ভাষা জানে। ক্রমে দু’দেশের রক্ত যাদের গায়ে, তারাও ‘টোপাস’ হয়ে গেল। ‘টোপাস’ মানে এখন আর মোটেই দো-ভাষী নয়, টোপাস মানে ইউরেশিয়ান, ফিরিঙ্গি বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। দো-ভাষী থেকে দো-আঁশলা। দো-ভাষী দিয়ে কাজ চলে, কিন্তু মন ভরে না। তা ছাড়া কোম্পানি ব্যবসায়ী। দো-ভাষীর খরচ তাঁরা বাজে খরচ বলে ভাবতে শিখে গেলেন। কর্মচারীদের উপর আদেশ এল, ভাষা শেখো। তাতে মাইনে বাড়বে। বুদ্ধিমানদেরও তাই পরামর্শ। সার জন শের বললেন, নেটিভদের শ্রদ্ধা অর্জনের একমাত্র পথ, তাদের ভাষায় তাদের সঙ্গে কথা বলা। কোনওরকম বিকৃতি না করে ওরা যেমন বলে, ঠিক তেমনিই বলা।
জেন্টুদের মতো বলতে গিয়ে তাঁরা সব সময়ই ‘পুডিং’কে ‘পুটিন’ বলেন, ‘স্টু’কে বলেন ‘এসটু’ এবং ‘কাউন্সেল’কে ‘কাউন্সেলি’।
তবুও এঁরা শিখলেন। এমা রবার্টস নাকে এক মহিলা ভ্রমণকারী (এবং লেখিকাও) লিখেছেন ‘এত শিখতে যাব কোন দুঃখে—A very few words will suffice to carry a Dak traveller over India. মিস রবার্টস নাকি নিজে চারটে শব্দ জানতেন—‘ওঠাও’ (Otaw) ‘জলদি যাও’ (Jeldi Jaw) আর ‘পিনেকো পানি লাও’ (Pinnake Pannnee Low)। বেহারারা কিছু জিজ্ঞেস করা মাত্রই তিনি উত্তর দিতেন—‘দস্তুর কা মাফিক’ (Dustoor Ca Maffic) অর্থাৎ ‘চিরকাল যা করে আসছ, তাই করো।’
তাতেও কখনও কখনও বিপত্তি ঘটে। বেহারারা পায়ের সঙ্গে গলায় তাল রেখে চলে, গান গায়, এক সাহেব সেটা জানতেন না। ‘হেঁইয়ো-হো’ কানে আসতেই তিনি লাফিয়ে পড়লেন মাটিতে। ঈশ্বর জানেন, বেটাদের কী হয়েছে। আশ্চর্য এই, পালক-বেহারারা কিন্তু তখন হাসছে।
সুতরাং এমার পরামর্শে চলবে না। কোম্পানির কর্মচারীরা ভাষা শিখতে আরম্ভ করতেই বিলেতে বসে বড় কর্তারা তাদের চিঠি খুলেই বুঝতে পারলেন—এককালের পরামর্শ এখন আবার তুলে নেওয়ার দিন এসেছে। কোম্পানির পুরানো ইন্ডিয়াফেরত কর্মচারী নিজেই আঁতকে উঠলেন তাদের মিনিটস পড়ে। আরে বাপরে, এ কী ভাষা।
জুনিয়াররা পেয়ে বসল। কী বললেন স্যার? হোয়াট ইজ ‘আরে বাপ্ রে’? বুড়ো কিছুক্ষণ মাথা চুলকালেন। তারপর পুরানো একটা ফাইল টেনে বার করলেন। ফাইলটা হেস্টিংস-এর আমলের। তাতে একজন প্রত্যক্ষদর্শী নন্দকুমারের ফাঁসির বিবরণ দিয়ে লিখছেন দড়িটা তাঁর গলায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত নেটিভরা চোখে হাত দিল। আর তাদের গলা দিয়ে বের হল—একটা কাতর ধ্বনি,—‘আরে বাপ রে।’ অন্য একজন শব্দটার নোট দিচ্ছেন পাশেই:
‘If a Hindoo was to see a house on fire, to receive a smart slap on the face, break a China basin, cut his finger, see two Europeans boxing or a sparrow shot, he would call out—Ah-baup-aree or Ahi-baprehh!?
নোটে আর কতদিন চলে। ভারতীয় ভাষা কণ্টকিত চিট পড়তে পড়তে বিলাতি কর্তারা ক্রমে হাঁপিয়ে উঠলেন। শেষে আদেশ দিলেন, এসব শব্দের ব্যবহার বন্ধ করো।
বে-সরকারি ভাষাবিদেরাও তাই সমর্থন করলেন। তাঁরা বললেন—ঠিকই তো, চিট, ব্যাঙ্কশাল, গোডাউন (Godown), কম্পাউন্ড (Compound) দফতরখানা (Dufferkhana) আতর (Ottar) লেখার কি মনে হয়? বুঝতাম, এই জিনিসগুলো আমাদের নিজেদের দেশে নেই, তবে একটা কথা ছিল। বার্ক বললেন, তবুও কোম্পানির ব্যবসায়িক চিঠিপত্রে এগুলো চলতে পারে, তবে দয়া করে পার্লামেন্টের বাইরেই যেন এগুলো থাকে। আশ্চর্যের বিষয়, হেস্টিংসের বিরুদ্ধে বার্ক সাহেব নিজেই এ ভাষার সাহায্যে পেশ করেছিলেন তাঁর ‘আর্জি’। বোধ হয় ‘হবসন-জবসনের’ মর্ম তখনও তিনি ঠিক বুঝতে পারেননি।
তার প্রমাণ আজকের অক্সফোর্ড ডিকশনারি। ওতে ৯০০টি মূল ভারতীয় শব্দ আছে যা ‘হবসন-জবসন’-বংশজাত। তা ছাড়া আছে এদের কয়েক হাজার আত্মীয়স্বজন। তারা সবাই আজ ইংরেজি বলে গ্রাহ্য।
কী করে এই শব্দগুলো ‘অক্সফোর্ড ডিকশনারি’র মতো বনেদি বাড়িতে জায়গা পেল তা জানতে হলে ইংরেজের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও আর একবার ঢুকতে হয় নিজেদের দেশে।
প্রথমেই কালিকট। সপ্তদশ শতকে বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল দক্ষিণ ভারতে। কালিকট দক্ষিণের অন্যতম বন্দর। মিঃ রাইসকারি কালিকটে নামলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী লেডি মেরি ম্যাঙ্গো আর কন্যা মিস ম্যাকটডি (তিনটে নামই কিন্তু থ্যাকারের দেওয়া)।
কালিকটে নেমেই তাঁরা দেখলেন, ওখানকার জমাটি ব্যবসা হল কাপড়ের ব্যবসা। পর্তুগিজ এবং ফরাসিরা সাদা কাপড় বলতেই বুঝতেন ‘কালিকট’ বা ‘কালিকো’ (Kaliko)। মিঃ রাইসকারি সাদা লাল মানলেন না। তাঁর মিসেসের কাছে কাপড় মানেই ‘কালিকট’। ক্রমে সব ইংরেজই ‘কালিকট’ বলতে কাপড় বুঝলেন। ধীরে ধীরে ‘কালিকটের’ সীমা আরও বেড়ে গেল। সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডে চালু হল—‘কালিকো কাবার্ড’, ‘কালিকো-ম্যান্টল’ (Calico-mantle) এবং শেষ পর্যন্ত ‘কালিকো-বল’ বা কালিকো নাচ। তখনও ভারতীয় সিল্কের ব্যাপক প্রচলন হয়নি। অভিজাত মহিলারা রেশম পরেন। তাই ‘কালিকো-বল’ মানে, যে নাচের আসরে মহিলারা সুতি কাপড় পরে নাচেন। সিল্কের চলন বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, তার মানে হয়ে গেল অবশ্য ‘সস্তা নাচ’। আর ‘কালিকো-বেলি’ (Calico-bally) মানে সুন্দরী মেয়ে নয়—হোঁতকা ধুমসি তরুণী। বিলেত থেকে যেসব সাহেব আমেরিকায় গেলেন, তাঁরা সাদা কাপড়ে যে যাননি তার প্রমাণ ওদেশে ‘কালিকো’ মানে ছাপা কাপড়। আর কালিকো গার্ল মানে মোটা মেয়ে নয়, সুন্দরী মেয়ে। ওদেশের কলেজ বয়রা কোনও মেয়েকে সুন্দরী বলতে হলে নাকি বলত Oh! she is a piece of Calio! কিংবা, ডরোথি সত্যিই ‘A choice bit of Calico!’ ফরাসি দেশে আবার কালিকো মানে মদওয়ালার সহকারী।
কালিকট থেকে মিঃ রাইসকারি এলেন সুরাটে। সুরাটের জিনিসপত্তর কালিকটের মতো ভাল নয়। রাইসকারি তাই ‘সুরাট’ মানে করলেন ভেজাল, নিকৃষ্ট (Adulterated)।
সুরাট থেকে রাইসকারি-পরিবার আবার কালিকটে ফিরলেন। কালিকটই ভাল। এখানে দিব্যি বায়াদারি (Bayadere) নাচ হয়। অর্থাৎ বাইজিরা নাচে। দো-ভাষী তাঁকে বলেছে বাইজি মানে এ নাচ গার্ল। ‘বেনিয়ান কোট’ পরে রাইসকারি তাদের ‘টামাসা’ (Tamasha’) দেখেন, চুরুট ফোঁকেন। নয়তো ‘চিলাম’ (Chillum) খান। ‘হুক্কা’ তাঁর বড় ভাল লাগে। কখনও কখনও ‘পাওনও’ (Pawn) চিবান। তবে সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে এখানকার ‘টডি’ (Toddy)। এবং ‘পাঞ্চ’ (Punch)। টডি মানে তাড়ি, আর পাঞ্চ মানে—ভারতবর্ষের পাচন। পিলে জ্বরের ওষুধ নয়, উত্তেজনাবর্ধক সুরাসার।
যা হোক, রাইসকারি সাহেব অতঃপর সপরিবার বাংলায় এলেন। আপ-কানট্রির দিকে গেলেন না। কেননা রালফ্ ফিচ বহু আগেই লিখে গেছেন ওদিকে ‘গ্রেট’ মগরদের (Great Mogar) বাস। তার চেয়ে ‘বেঙ্গল’ নিশ্চয় ভাল হবে। কারণ যে-সব ‘বেঙ্গল’ তিনি দক্ষিণে দেখেছেন তাতে তাঁর মনে ওই নামের দেশটি সম্পর্কে বিপুল আগ্রহ। বলে রাখা ভাল, সাহেব দক্ষিণে ‘বেঙ্গল’ দেখেছেন শুনে ভাববেন না তিনি এত দূরদেশে বাঙালি দেখেছেন।‘বেঙ্গল’ নামে তখন বাংলার জিনিসপত্তর। এবার তিনি ‘বেঙ্গল’ বা বঙ্গভূমিতে এলেন।
কলকাতায় পা দিয়েই তিনি মনে মনে একটা সমস্যায় পড়লেন। দেশটা ঠিক কার? ‘জেন্টু’দের না ‘মুরদের’। ‘জেন্টু’ মানে তাঁর কাছে হিন্দু, ‘মুর’ মানে মুসলমান। বৈয়াকরণ হালেদ সাহেবের কাছে ছিল ‘জেন্টু’ মানে—হিন্দুস্থানিদের ভাষা, ‘মুর’ মানে উর্দু। কলকাতায় যেমন হিন্দু আছে, তেমনি আছে মুসলমানও। থাকগে, রাইসকারির তা নিয়ে ভাবনা নেই। তিনি ‘ট্যাংক স্কোয়ারে’ অর্থাৎ ডালহৌসিতে থাকবেন।
তাঁর বাড়িখানা ছোট। অদ্ভুত গড়নের। নদীপথে আসতে আসতে যেমন খড়োঘর দেখেছেন তেমনই। এ-বাড়ির নাম দিলেন তিনি বাংলো। চমৎকার বাংলো। টাটি (মাদুর) আছে, ‘খসখস’ আছে, জানালায় ‘চিক’ আছে। তা ছাড়া ‘সিরকার’ খানসামা থেকে ‘বেহারা’, ‘খিদমদগার’, ‘মলি’ (Molly), কুকুরের জন্যে ‘ডুবিয়া’ সব দিয়ে গেছে। ‘পাক্কা’ (Pucka) ব্যবস্থা।
সকালে এক প্রতিবেশী এলেন চা খেতে। খিদমদগার ‘টি-পয়’ বা চায়ের টেবিল নিয়ে যেই সেলাম করে দাঁড়াল, অমনি ভদ্রলোক চমকে উঠলেন, ‘আই সি, দ্যাট ফেলো।’ ওর কিছু জিনিসপত্তর নিয়ে সরে পড়েছিল লোকটি। মিঃ রাইসকারিকে তাই তিনি সাবধান করে দিলেন ‘ওর সম্বন্ধে হুঁশিয়ার। Because, there is no thinkana of that fellow! লোকটার কোনও ‘ঠিকানা’ নেই, মানে, লোকটা অসৎ।
ওরা বসে থাকতে থাকতেই ঝাঁটা হাতে ঝাড়ুদার এসে উপস্থিত। প্রতিবেশী বুঝিয়ে দিলেন ‘হি ইজ হালালকোর’ (Halalcore)।
বলা বাহুল্য, ঝাড়ুদার তাই শুনে তো মহাখুশি। কারণ সে জানে, হালালকোর মানে—হক ছাড়া যে নেয় না, খায় না। কেউ কেউ আবার তাকে বলে হ্যারি (Harry), তার স্ত্রীকে ‘হ্যারি-ওম্যান’। বোধ হয় ‘হরিজনের’ পূর্বাভাস।
যা হোক, প্রতিবেশী উঠলেন। কারণ, তিনিও একজন এইচ-ই-আই-সি-এস (H.E.I.C.S.) মানে ‘অনারেবল’ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সারভেন্ট। তারই পরবর্তী কালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের মেম্বর হয়েছেন। তাঁকে কাছারি (Cutcherry) যেতে হবে। নয়তো ‘বড়া সাহেব’ (Burrah Shaib) রাগ করবেন। তিনি তাঁর মহালেই (Mohal) কাছারি করেন।
মিঃ রাইসকারিও উঠে পড়লেন। তাঁকেও কাছারি যেতে হবে।
‘পিলাউ’, ‘চিকেন কারি’, ‘কেডগিরি’ ইত্যাদিতে তার মধ্যাহ্নভোজ হল। রাইসকারির বাবা এ-সবের একটি চিজও খাননি। বেঁচে থাকলে চিঠি লিখে লিখে তিনি তাঁকে সব খাওয়াতেন। বৈঠকখানার সেই বিখ্যাত ‘Bread & cheese Bungalow’র চাপাটি পর্যন্ত।
যাকগে, যা সম্ভব নয়, তা নিয়ে আর ভেবে লাভ কী। মিঃ রাইসকারি চেনাশোনা আত্মীয় বন্ধুদেরই চিঠি লিখে লিখে নামগুলো চিনিয়ে দিলেন। তারা সেগুলোকে চালু করে দিল ‘অক্সফোর্ডের’ পাতায়।
এদিকে অফিস থেকে ফিরে বিকেলে একটু ‘ভারান্ডায়’ (Verandah) বসেছেন, এমন সময় মিঃ সো অ্যান্ড সো এসে হাজির। তিনি কোম্পানির একজন ‘ক্রেনি’ (Cranny)। রাইসকারি কেরানি নন, কিন্তু ‘ব্রাদার ক্রেনিদের’ সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সত্যিই বড় ভাইয়ের মতো। তিনি ‘কমপিটিশনওয়ালা’ নন। মিঃ সো অ্যান্ড সো প্রস্তাব দিলেন—চলুন স্যার, টোলা কোম্পানিকে আজ ‘আউটক্রাই’ (Outcry) হচ্ছে, একটু দেখে আসি। সেকালে ‘আউটক্রাই’ মানে নিলাম। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। মিঃ রাইসকারি ‘কটে’ (Cot), ওরফে খাটে শরীরটা মাত্র ফেলেছেন, এমন সময় কানে এল একটা বিশ্রী কর্কশ শব্দ।
‘ইট ইজ এ ডেভিল বার্ড’ (Devil Bird), উত্তর দিলেন মিসেস কারি। ‘ডেভিল বাড’ মানে পেঁচা। ‘ছোটা সাহিবে’র নবনিযুক্তা ‘আয়া’ বলেছে—এ পাখি রাত্তিরে ডাকলে সমূহ অমঙ্গল। মিসেস কারি তাই এর নাম দিয়েছেন ‘ডেভিল বার্ড’। প্রসঙ্গত বলে রাখি ‘আয়া’ শব্দটি আইমা’ জাত। যেমন মেমসাহেবটি ‘মা মা সাহেবের’ জের। প্রথমটির জন্যে যদি মিসেস কারি দায়ী হন, তবে দ্বিতীয়টির দায় নিশ্চয় সেই আয়াটির।
এদিকে মিঃ রাইসকারি ‘ডেভিল বার্ডে’র ভাবনায় পড়লেন। কী অমঙ্গল হতে পারে তাঁর সোনার সংসারে?
কিন্তু সত্যিই পাখিটার বচন মিথ্যে হল না। এক দিন সাহেব কাছারি থেকে ফিরে শুনলেন তাঁর কন্যা মিস ম্যাকটডি একটা গ্রিফিনের (Griffin) হাত ধরে পালিয়ে গেছে। ওটা ‘গ্রিফিন’ বা ভবঘুরে হলে ক্ষতি ছিল না—কিন্তু সবাই বলে ছেলেটি নাকি ‘কৈ হ্যায়’দের (Qui hai) ছেলে। অর্থাৎ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান।
মনের দুঃখে মেম-সাহেব আর ছোটা-সাহেবকে নিয়ে মিঃ রাইসকারি বেড়াতে বের হলেন। যাওয়ার সময় বড়াসাহেব মিসেস কারিকে অভয় দিলেন, ‘কোনও ভয় নেই। I shall write perwannahs to all police darogahs of all Zillahs. ওরা পথে পথে ‘সিপয়’ রাখবে।
রাইসকারি সুন্দরবনে ‘শিকার’ (Shikar) করলেন। বনকে স্থানীয় লোকেরা বলে ‘জঙ্গল’। রাইসকারি লিখলেন, ‘জাঙ্গল’ (Jungle), ডাকাতকে ‘ডেকয়েট’ (Decoit)। ডাকাতের টীকা লিখলেন—Lottie-wallah. অবশ্য এটা লিখতেও ভুললেন না যে, ওরা ‘ঠগ’ নয়।
আর এখানে নয়। এবার দেশে ফিরতে হয়। কিন্তু মেম-সাহেবের ভীষণ ইচ্ছা, যাওয়ার আগে একবার নিজের চোখে ‘হবসন-জবসন’ দেখে যান।
অগত্যা—বাধ্য হয়ে মুর্শিদাবাদে আসতে হল। তখন মহরম। রাইসকারি মিসেসকে টেনে বার করলেন ঘর থেকে। এই তোমার ‘হবসন-জবসন’। ইচ্ছে হয় শোনো, ইচ্ছে হয় দেখো। দেখে শুনে সাধ মেটাও। মিসেস কারি অবাক হয়ে দেখলেন কতকগুলো ‘মুর’ একটি কফিন কাঁধে করে বুক থাবড়াতে থাবড়াতে চলেছে আর চিৎকার করছে—হবসন-জবসন। হবসন-জবসন। অর্থাৎ ‘হায় হাসান। হায় হোসেন।’
এই ‘হায় হাসান, হায় হোসেন’শব্দটাই ১৬১৮ সাল থেকে শুরু করে ১৮৩৩ সালের মধ্যে নানা কান ঘুরে ‘হবসন-জবসন’ এসে স্থিতি নিল। ইয়ুল সাহেব ১৮৩৩ সালে তার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অভিধানটি এ-নামে নামকরণ করে চিরস্থায়ী করে দিলেন তাকে।
যা হোক, অবশেষে রাইসকারি একখানা ‘ইন্ডিয়ানম্যান’-এ চাপলেন। এবার দেশে যেতে হয়। পকেটে তখন তার বিস্তর ‘গোল্ড মোহর’, মনে অপার শান্তি।
বিলেতে ফেরার পরে মিঃ রাইসকারি ‘লর্ড’ হলেন। কিন্তু কেউ তাঁকে লর্ড বলে না। বলে নাবব (Nabob)। ‘নাবব কারি।’ কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলে ‘মোগলকারি’। মিসেস কারি সেই দুঃখে আত্মহত্যা করলেন। মিঃ কারি বললেন—She is a ‘Sutte’ অর্থাৎ সতী। কেননা, সে স্বামীর দুঃখে মরেছে। ক্রমে স্ত্রীর শোকে ‘শহিদ’ (Shaid) হলেন মিঃ কারিও। আর তাঁদের স্মৃতি হয়ে রয়ে গেল এই একগাদা ‘চাউ-চাউ’।
‘চাউ-চাউ’ মানে—
কমলালেবু আর বাঁশের কঞ্চির তরকারি।
অথ উত্তমর্ণ অধমর্ণ কথা
সুখী কে? আমাদের শাস্ত্রে বলে—অঋণী আর অপ্রবাসী। কিন্তু কলকাতার ইতিহাসের মত ঠিক তার উল্টো। জন্ম থেকেই কলকাতা পরদেশিদের শহর। ভিনদেশিরা বরাবরই সুখী এখানে। বোধহয়, আজও। কিন্তু তার চেয়েও বেশি সুখী ঋণীরা। ঋণ না করে কলকাতায় সুখে থাকা যায় না। আর প্রবাসী না হলে ইচ্ছেমত ঋণও মেলে না। কলকাতা শহর তাই পরবাসীদের জন্য, আর অকুতোভয় ঋণীদের জন্যেই সুখের শহর।
কলকাতার বাঙালি ঋণ করতে জানে না তা নয়, বিয়ের খরচ জোগাতে তারা বসতবাটি বাঁধা দিয়েছে, কিংবা পিতৃশ্রাদ্ধ করতে গিয়ে শ্রাদ্ধ ডেকে এনেছে পরবর্তী তিন পুরুষের, এমন নজির অল্প নয় এখানে। কিন্তু এই সব অধমর্ণরা আসলে উত্তমর্ণের দলের। তারা সাধারণ বাঙালি নয়। ঘি তো পরের কথা, নুন তেলের জন্যেই রামা-শ্যামা বাঙালির ধার জোটে না এ শহরে। ইংরেজরা চালাক করে দিয়ে গেছে সেকালের উদারচরিত ঋণদাতাদের। তারা দোকানে দোকানে আজ ঝুলিয়েছে সেই ইংরেজি পদ্যটি, যার মানে: ‘আমার টাকা ছিল, বন্ধুও ছিল, বন্ধু টাকা নিল, বন্ধুও গেল, টাকাও গেল।’ এখানেই শেষ নয়। তারপর আছে: ‘আজ নগদ কাল বাকি’ আর ‘ধার চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’র লজ্জাকর রসিকতা। কলকাতার বাঙালি আজ ধার দেয় না, দিতে চায় না। কেমন যেন কিপটে হয়ে গেছে তারা।
কিন্তু আগে দিত। মুৎসুদ্দিকে, বেনিয়ান বেনিয়ানকে এবং সব ছোটরা সুযোগরা পেলেই সব বড়কে। তবে প্রতিবেশীর চেয়ে পরবাসীকে দিতেই ছিল তাদের বেশি উৎসাহ। বিদেশি এল। শহরে নামল। কীই বা চাকরি, কত আর মাইনে। কিন্তু দেশ ছেড়ে এই বিভূঁইয়ে যখন এলাম, তখন তিনখানা স্যুটে চলবে কেন? চললেই বা চালাব কেন মাত্র গুটি পাঁচ বয় আর বেয়ারায়? ‘নবাব’ হতে হবে না? নবাবের মেজাজে চলতে হবে না? নবারের মেজাজে চলতে হবে, খেতে হবে, থাকতে হবে। তারপর নাচগান জলসা আছে, জুয়া খেলা আছে। কোম্পানির কর্মচারীদের তো তাই হাতটান পড়তই তখন, মুহুর্মুহু মূলধনে টান পড়ে যেত চালু ব্যবসায়ীদেরও। কোনও প্রয়োজনের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে কি না পেয়েছে, অমনি ছুটে এসে হাজির বাঙালি সরকার বেনিয়ান। ‘সাহেব, কষ্ট যাচ্ছে? তা, নাও না আমার থেকে, যখন সময় হবে, দেবে। আমরা কি আর পর? তবে সুদ দিতে হবে। ওটা আমরা নিজের ছেলের থেকেও নিই। আসল ছাড়তে পারি, কিন্তু সুদ ছাড়তে পারি না।’ সুদের ভয়ে সাহেব ভীত নয়। তার কাছে বর্তমানটাই মুখ্য। আগামী সপ্তাহের আমোদ-আহ্লাদের প্রোগ্রামটি রক্ষা করাই তার আশু লক্ষ্য। সুতরাং সে নিঃসংকোচে নিয়ে নিল। যত খুশি। নিঃশব্দে দিয়ে দিল বাঙালি সরকার, মুৎসুদ্দি বেনিয়ান। শুভংকরীর আর্যা দিয়ে সুদ কষল মনে মনে। বাঙালির ক্ষেত্রে ভ্যালুয়েশান কষল তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির। যত দেরিতে দেয়, ততই ভাল। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়বে। দেবে না? না দিয়ে যাবে কোথায়? আইন আছে। সাহেবের আইনেই ঘায়েল করব সাহেবকে।
ঋণ দেওয়ার লোকের তখন অভাব ঘটত না। বরং কখনও কখনও অভাব ঘটে যেত নেওয়ার লোকের। চার্লস মুর তাঁর The Sheriffs of Calcutta বইতে লিখেছেন: ‘ঋণ না করলে তখনকার দিনের সায়েব-সুবাদের মোটেই ভাল লাগত না। জীবনটা মনে হত নেহাত মধ্যযুগীয়, একঘেয়ে। হাজার দশেক টাকা যে ঋণ না করেছে কলকাতায় এসে, এখানে তার আসাই বৃথা।’ দেবে কে? মুর সাহেব লিখেছেন:
‘Money was easily made, debts were easily contacted, and there seems to have been no end to the number of people willing to lend or give credit, and in such a happy state of society there were sure to be unlimited people ready to borrow and to spend.’
ঋণ না করেই বা করবে কী? কোম্পানির সংসর্গে যারা আছে, ঈশ্বর-ইচ্ছায় তাদের খাওয়া-পরার ভাবনা নেই বটে, কিন্তু শুধু খেয়ে থাকার জন্য কলকাতা নয়। ‘সুখে’ থাকতে হলে মুঠো মুঠো টাকা চাই এখানে। অব্যবসায়ী ইংরেজদের কাছে ঘুষ খাওয়া আর প্রাইভেট ট্রেডিং ছাড়া টাকা রোজগারের পথ ছিল মাত্র তিনটি। হয় চুরি ডাকাতি, নয় জাল জুয়াচুরি, নয়তো ঋণ করা। প্রথম দু’টোর ঝঞ্ঝাট ঝামেলার কথা শুনলেই বুঝতে পারেন, কেন শেষেরটি ছিল তাদের প্রিয়তম পন্থা।
ডাকাতি তখন একটা উল্লেখযোগ্য পেশা ছিল তরুণ ইউরোপিয়ানদের। দেশি ডাকাতদের সঙ্গে মিলেমিশে তারা দল করত। তারপর ওত পাতত রাতের চৌরঙ্গিতে। শুধু চৌরঙ্গি কেন, পালিয়ে থাকার মতো বনের অভাব ছিল না তখনকার কলকাতায়।
আর বন ছাড়া ডাকাতি হয় না, তাও নয়। আজকের বউবাজারের ফরডাইস লেন তখন ছিল ‘গলাকাটা গলি’। হাড়কাটা গলি, গুমখানা গলি আজও আছে কলকাতায়।
যা হোক, এমন ডাকাতও ছিল, যারা দিনে কোম্পানির কাজ করত আর রাতে করত ডাকাতি। ১৭৯১ সালের ক্যালকাটা গেজেটে একদল মিলিটারি ডাকাতের কথা পাওয়া যায়। তারা ময়দানে ডাকাতি করত।
ডাকাতি করার ঝক্কি ছিল অনেক। প্রথম বিপদ ধরা পড়ার। ধরা পড়ে গেলে এ ব্যাপারে ইংরেজের আইন বড় কড়া। এমনি একটা লোককে খুন করলে তার আইনে লেখে এক টাকা জরিমানা, কিন্তু ডাকাতি বা রাহাজানি হলে নির্ঘাত ফাঁসি। ১৭৯৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট পাঁচজন সাহেব এবং একজন বাঙালিকে ফাঁসি দিয়েছিল ডাকাতির অভিযোগে। ফাঁসিও যেমন তেমন নয়। কড়া ফাঁসি। যার বাড়িতে ডাকাতি করেছে, তার বাড়ির আশেপাশে ফাঁসি দিতে হবে। এবং যতক্ষণ না একেবারে মরে যায়, ততক্ষণ ফাঁসিতে ঝুলবে। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে তাই লিখেছিল: Every one of them be hanged by the neck until they and each and every one of them are dead.’
ফঁসি না হলে দ্বীপান্তর কিংবা বেত মারা অথবা পিলারীতে দাঁড়ানো। দ্বীপান্তর মানে, সাহেব হলে সেই ভ্যান ডায়মন্ডসল্যান্ড বা ট্যাসমানিয়া, এতদ্দেশীয় হলে আকিয়াব, মৌলমিন কিংবা প্রিন্স অব ওয়েলস দ্বীপ। কলকাতাই যদি ছাড়াতে হয়, তবে ডাকাতির ঝঞ্ঝাট কেন। বেত মারাটাও সহজ শাস্তি ভাববেন না। দশ আনা চুরির দায়ে রামজয় ঘোষকে বড়বাজারের দক্ষিণ কোণ থেকে বেত মেরে মেরে প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল উত্তর কোণে। তারপর আবার উত্তর থেকে দক্ষিণে। অবশেষে চিৎপুর ব্রিজের কাছে নিয়ে যখন ছেড়ে দেওয়া হল তাকে, তখন কলকাতার জীবনের সাধ তার মিটে গেছে চিরকালের জন্য।
অথচ ডাকাতিতে আর লাভ হয় কত? বড় রকমের ডাকাতি হল চৌরঙ্গিতে রাত দশটায়। লোমহর্ষক ব্যাপার। পালকি চড়ে যাচ্ছিলেন মি. মাসুক। তাঁকে সহসা আক্রমণ করে ডাকাতেরা গুরুতরভাবে আহত করে নিয়ে গেছে তাঁর সর্বস্ব। ‘সর্বস্ব’ বলতে কী? না তাঁর জুতোর বকলস। (Shoe-buckles)। খুব বড় রকমের ডাকাতি হল একটা কলুটোলায় চৈতন দত্তের বাড়িতে। জিনিসপত্রে এবং নগদে মিলিয়ে ডাকাতেরা যা নিয়েছে তা পরিমাণে ৬০০০ টাকা। প্রথমত মনে রাখুন, এটা দত্ত মশাইয়ের নিজের এস্টিমেট। তারপর মনে রাখবেন, খবেরর কাগজের রিপোর্ট। এ দুটো তথ্য মনে রেখে ডাকাতের হয়ে জিনিসপত্রগুলো বিক্রি করার চেষ্টা করুন। তারপর ভাগ করুন নিজেদের দলের মধ্যে। দেখুন কত করে পড়ে মাথা-পিছু। দেখবেন, কিছুই না। একটা রাইটারও তার বেশি রোজগার করে কলম পিষে।
সুতরাং চুরি ডাকাতির চেয়ে তখন লোক বেশি করত ঋণ। ১৮০২ সালে জেলের হিসাবে মোট কয়েদির সংখ্যা দেখলেই বুঝতে পারবেন, আমার অনুমান গল্প নয়। সে বছর কলকাতার জেলখানায় মোট কয়েদি ছিল ৭২ জন। তার মধ্যে ২৮ জন চোর ডাকাত আর ৪৬ জন ঋণগ্রস্ত। ডাকাতদের মধ্যে ১৩ জনই আবার ইউরোপিয়ান। ঋণের ঝামেলা অনেক কম। তাই এত ভিড়। তা ছাড়া পন্থাটি রীতিমত সম্মানজনকও। কী আর হবে। না হয় শেষ অবধি জেল হবে। এর বেশি তো আর নয়।
ঋণগ্রস্তদের জেলের জীবন যদি শোনেন তবে আপনারও ইচ্ছে হবে জেল খাটতে। স্বদেশিওয়ালারাও জেলের এত মজা লুটতে পারেনি, যত লুটেছে কলকাতার এই সব বিদেশি অধমর্ণরা। সত্যিই যেন জেলখানা ছিল ওদের শ্বশুরবাড়ি। বোধহয় ওদের জেল-জীবন দেখেশুনেই জেলখানাকে শ্বশুরবাড়ি ভেবেছিল এ দেশের লোক।
আমাদের এডিটর হিকির কথা শুনেছেন বোধহয়। ঋণের দায়ে জেল খাটতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তখন আর এক হিকি, এডিটর হিকির পক্ষের উকিল হিকি। তিনি তখনকার জেল-জীবনের একটি অতি সুন্দর বর্ণনা রেখে গেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। জেলখানা তখন লালবাজারে। ওখানেই ছিল অনেক দিন। তারপর ওটাকে উঠিয়ে আনা হয় ময়দানের এক কোণে। আজ যেখানে ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল, সেখানে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরি করার সময় ওটাকে সরিয়ে নেওয়া হয় আলিপুরে।
যাক সে কথা। এডিটর হিকির নাকি পছন্দ হত না জেলের ঘরগুলো। ছোট ছোট ঘর। তিনি তো আর চুরি-ডাকাতি করে জেলে আসেননি। তিনি কেন থাকতে যাবেন ওখানে। গরিবয়ানা মতো বাঁশ, খড় দিয়ে তিনি নিজের জন্যে তাঁবু করে নিলেন একখানা। জেলের চার দেওয়ালের মধ্যে সেই তাঁবুতে বসেই তিনি চালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর কাগজ—‘বেঙ্গল গেজেট’। সুতরাং বুঝুন এবার সেদিনের কলকাতায় অধমর্ণের স্বাধীনতা কী ছিল।
কাগজ চালানো বা নিজের ব্যবসা চালানো তো সাধারণ ব্যাপার। অনেক অসাধারণ কারবারও করতে পারতেন তখনকার দিনের ঋণীরা। হরিণবাড়ি জেলে নাকি এক স্বর্গপুরী বানিয়ে তুলেছিলেন তাঁরা। ময়দানের জেলখানাকেই বলা হত হরিণবাড়ি। কেন, সঠিক কেউ জানে না। কেউ কেউ বলতেন, ওটি ছিল সিরাজউদ্দৌলার হরিণ শিকারের স্থান। আবার কেউ কেউ বলেন, নবাবের গৃহপালিত হরিণ ইত্যাদি প্রাণীর জন্যে ওখানে বাড়ি ছিল একখানা এবং তাই থেকে পরবর্তী কালে জেল-বাড়িটার নাম হয়ে যায় হরিণবাড়ি। যা হোক, এই হরিণবাড়িতে ছিল অধমর্ণদের ভিড়। ছোট-বড় নানা আকারের অক্ষম ঋণী বিচারান্তে প্রেরিত হতেন ওখানে।
কিন্তু কে বলবে, এরা অর্থাভাবে আছে কিংবা জেলে আছে? সন্ধ্যায় ওদিকের পথচারীরা বিস্মিত চোখে চেয়ে দেখত হরিণবাড়ির ছাদে খোলা আকাশের নীচে জলসা বসেছে। উল্লসিত চিৎকার আর নেটিভ বাইজির গানের সুর ভেসে আসছে কানে। নাচ-গান হই-হল্লা। শুধু কয়েদিরা নয়, বাইরে থেকে আমন্ত্রিত হয়ে তাদের বন্ধু-বান্ধবরাও যোগ দিতেন এসব উৎসবে।
উৎসবও প্রায়ই হত, প্রায় প্রতিদিন। খাওয়া থাকার খরচা সরকারের। দৈনিক সে জন্যে বরাদ্দ করা আছে দু’ আনা, মাসে একুনে চার টাকা। এতদ্দেশীয় হলে তার অর্ধেক, দু’ টাকা। এতে চলবে কেন? কয়েদিরা তাই ঋণের দায়ে জেল খাটতে খাটতেই আবার ঋণ করত। না হয় আরও দু’ বছর থাকতে হবে এখানে। তা অসুবিধে কী? জন ম্যাকলাক্লিন নামে এক কয়েদি ছিলেন। তিনি বললেন, দেখো জেলে থেকে আমার শরীর কী হয়েছে। জেল খাটব বলে শরীর খোয়ব নাকি? ঘোড়া চাই। বাড়ি থেকে সকাল সন্ধ্যায় তাঁর ঘোড়া আসত, আর স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যে দু’ বেলা নিয়মিত সেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে চক্কর খেতেন তিনি জেলের ভিতরে। কেউ কেউ বাড়ি থেকে নিজের স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে আসতেন। একসঙ্গে থাকতেন। যাঁরা অবিবাহিত, তাঁরা নিয়ে আসতেন মিস্ট্রেস। গোপনে নয়, প্রকাশ্যে। “It was all open and unashamed and there was no pretence or disguise about the matter.” যার যা ইচ্ছে। কেউ কেউ খাবার আনাতেন বাড়ি থেকে, কেউ কেউ খাস চাকর-বাকর রাখতেন নিজেদের সঙ্গে। এসব তো আছেই, তারপর আছে “an eternal flow of brandy”। মদ, মেয়েমানুষ, ঝি-চাকর, ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজ-কর্ম কিছুই আপত্তি নেই এখানে। একটি মাত্র শর্ত, যা করবে, করতে হবে চার দেওয়ালের মধ্যে। ইংরেজের আইনকে অস্বীকার করতে পারবে না, এড়াতেও পারবে না, এড়াতে পারবে না বন্দিত্বকে।
টিপু সুলতানের ছেলে মুয়াজুদ্দিন একবার ছিলেন এই কারাবাসে। মাসে তিনশো টাকার ওপর হত শুধু তাঁর বাজার খরচ। তাঁর নিজস্ব ধোপা, নাপিত, দর্জি সব ছিল তাঁর সঙ্গে। তাঁর বিছানাটির দামই ছিল নাকি চারশো টাকার ওপর। অর্থাৎ সুলতান-পুত্র মুয়াজুদ্দিন আগে যা ছিলেন, তাই রইলেন। শুধু শ্রীরঙ্গপট্টম ছেড়ে কলকাতার হরিণবাড়িতে, এই যা।
কেরানিপুত্ররা এতটা পারতেন না। কেউ কেউ আবার হতভাগ্যও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। কিন্তু সে নেহাত ভাগ্যবিভ্রাট। ১৭৯৫ সালের হরিণবাড়ির সংবাদ। রোল্যান্ড স্কট নামে এক ভদ্রলোক ঋণের দায়ে জেলে এসেছেন। ৯০০০ সিক্কা টাকার অনাদায়ে। আঠারো বছর পরে সুপ্রিম কোর্টে মানবতার নামে তিনি কেঁদে-কেটে আবেদন পাঠালেন মুক্তির জন্যে। চল্লিশ বছরের স্কট তখন ষাট বছরের বৃদ্ধ। অমন স্বপ্নপুরীতে এমন ঘটনা তা হলে সম্ভব হল কী করে? না, আইনে।
স্কটের পাওনাদারটি ছিলেন নিশ্চয়ই কোনও জাঁদরেল লোক। নয়তো ন’ হাজার টাকার জন্যে তিনি আরও সওয়া হাজার টাকা নিশ্চয়ই খরচ করতেন না। ব্যবসায়িক বুদ্ধি তা করতে দিত না সেকালে। বলতে পারেন কী করে খরচ হল তাঁর? সে এক মজার আইনে। নিয়ম ছিল ঋণী ব্যক্তিটির বিষয়-আশয় যদি কিছু না থাকে, তবে তার জেল-খরচা জোগাতে হবে পাওনাদারকে। যত দিন পাওনাদার সেটি জুগিয়ে যাবে, তত দিনই জেলে রাখা হবে তাকে। স্কটের পাওনাদার আঠারো বছর রেখেছিলেন বেচারাকে। নিশ্চয়ই এমন পাওনাদার সেদিন কম ছিল। থাকলেও আজকের কলকাতার অধমর্ণদের কাছে, ‘গতকাল’ই স্বর্গ। বিশেষত, কখনও কখনও বাঙালি বড়মানুষেরাও নিজেদের আনন্দ-উৎসব উপলক্ষে মুক্তি দেন হতভাগ্য কয়েদিদের। দেনার দায়ে কয়েদিমুক্তি তখন শহরে ধর্মকর্মের অন্তর্গত!
বেকার জিন্দাবাদ
“মহামহিমবর শ্রীযুক্ত দর্পণ প্রকাশক মহাশয় বরাবরেষু—আমরা কয়েকজন বঙ্গদেশীয় এক বিষয়ে অপমান ও আশ্চর্য জ্ঞান করিয়া আপনাকে জানাইতেছি যে, হিন্দুস্থানে বাঙ্গালি দিগের প্রধান কর্মাদি প্রাণপণে তদ্দেশস্থ লোক কহে যে পূর্বকার বোর্ডের সাহেবদিগের নিষেধ আছে এবং উক্ত কথাও সত্য বোধ হইতেছে কেননা সাহেব লোক প্রায় বাঙ্গালি দিগের প্রধান কর্ম দেননা, যাহার দিগের দেওনে ইচ্ছাও আছে তিনিও সক্ষম হন না কারণ আপন ২ এলাকার কমিস্যনর সাহেব মঞ্জুর করেন না, কিন্তু শত ২ হিন্দুস্থানী লোক বাঙ্গলা ভাষায় ও অক্ষরে অনুভিজ্ঞ থাকাতেও অস্মদ্দেশে নানাস্থানে প্রধান ২ কর্ম করিতেছেন, বাঙ্গালি দিগের কি দুর্ভাগ্য যখন ১৮৩১ সালের কানুন পঞ্চম জারী হয় তখন বোধ হইয়াছিল যে অনেক বাঙ্গালি সদর: সুদূর হইবেক তাহাও হইল না এবং ইঙ্গরেজীতে পারগ যে বাঙ্গালি কোন সরকারী অফিসে কর্মখালি হইলে তচ্চেষ্টা করিলে যদিস্যাৎ তৎসময়ে কোন অক্ষম ফিরিঙ্গি উপস্থিত হয় তবে ঐ খ্রীস্টীয়ান ফিরিঙ্গিতে কর্ম পায় যাহা হউক রাজা ও ঈশ্বর প্রায় তুল্য এবং সর্বজীবে সমভাবে তবে হিন্দুস্থানে আমাদিগকে কি কারণে এমত অসহিষ্ণু অপমান করেন, যদি বলেন যে গবর্ণমেন্টে এমত হুকুম কদাচ দেন নাই তবে অকারণে আমাদিগের প্রতি এমত অন্যায় আচরণ কেন হয় ইত্যাদি।
নিবেদন ইতি সন ১২৪০
তারিখ ২৫শে অগ্রহায়ণ।
শ্রীকমলাপ্রসাদ রায়
শ্রীহরিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
শ্রীচন্দ্রকান্ত চট্টোপাধ্যায়
শ্রীগোবিন্দ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়
মোং কলিকাতা॥”
এই চিঠিখানা ছাপা হয়েছিল ‘সমাচার দর্পণ’ কাগজে ১৮৩৩ সালের ১৪ ডিসেম্বরে। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় একশ পঁয়ষট্টি বছর আগে। তখন কলকাতায় আজকের মতো বেকার নেই, উদ্বাস্তু নেই, কী-খাব কী-খাব কান্না নেই। তার ওপর মাত্র ক’মাস আগে পার্লামেন্টে স্থির হয়েছে বিচার বিভাগের বড় বড় পদে অতঃপর বাঙালিদের নিয়োগ করা হবে। সিদ্ধান্তমতো কাজও হয়েছে। শ্রীযুক্ত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব ‘ম্যাজিস্ট্রেট সম্ভ্রমার্থ’ বা অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হয়েছেন। শ্রীযুক্ত বাবু রসময় দত্ত, আশুতোষ দেব ওরফে ছাতুবাবু প্রমুখ বঙ্গগৌরবদের নিয়ে নতুন করে ‘গ্রান্দ জুরি’ও গঠিত হয়েছে। সুতরাং কলকাতার বাঙালির তখন সুসময়।
কারণ এর আগের চল্লিশটি বছর নাকি কোম্পানি এতদ্দেশীয় ‘গবর্ণমেন্টের কার্য স্পর্শ’ও করতে দেননি। তার আগেকার পরিস্থিতি অবশ্য ছিল সম্পূর্ণ অন্য। কোম্পানির রাজত্বের তখন সবে মাত্র শুরু। নতুন দেওয়ানি লাভ করেছেন তাঁরা। সমাচার দর্পণের মতে বাঙালিরা তখন অতি প্রিয় প্রজা। “ইঙ্গলন্ডীয়দের প্রথমাবস্থায় গবর্ণমেন্ট কর্তৃক এতদ্দেশীয় লোকদিগকে যেরূপ পরাক্রম ও বেতন প্রদত্ত হয় তাহা প্রায় অবিশ্বাস্য। দেশীয় মুখ্য শাসন কর্ম কেন্সেলি সাহেবদের হস্তে অর্পিত থাকিল বটে কিন্তু তাবৎ পরাক্রম অর্থাৎ সাধারণ ব্যক্তিদের চক্ষুর্গোচর দেদীপ্যমান যে পরাক্রম তাহা দেশীয় লোকের হস্তেই অর্পণ হইল। এবং এতদ্দেশীয় প্রধান কর্মকারক সাম্বৎসরিক নয় লক্ষ টাকার ন্যূন নহে বেতন পাইতেন অর্থাৎ এইক্ষণকার তাবৎ ভারতবর্ষের গবরণর জেনারেলের বেতনাপেক্ষা তিন গুণ অধিক।”
‘তারপর কি জানি কী হল, সহসা একদিন থেমে গেল বাঙালির ভাগ্যের রথ।’ কিন্তু তৎপর কয়েক বৎসরের মধ্যে ঐ নিয়মের সমূল পরিবর্তন হইল এবং গবর্ণমেন্ট বিরুদ্ধ পক্ষ অবলম্বন করিলেন। পূর্বে এতদ্দেশীয় লোকেদের হস্তে তাবৎ পরাক্রমই অর্পিত ছিল পবে বিশ্বাস্য ও ঝুঁকি সমুদায় কর্ম হইতে হঠাৎ এতদ্দেশীয় লোকদিগকে রহিত করিতে নিয়ম করিলেন। অসীম দান শৌন্ডতার পথ পরিত্যাগ করিয়া তাঁহারা অতি সংকুচিত কার্পণ্য বর্তাবলম্বী হইয়া সম্ভ্রম ও লাভজনক সমগ্র কর্ম হইতে দেশীয় লোকদিগকে চ্যুত করিলেন।” (সমাচার দর্পণ, সম্পাদকীয়, ২রা মার্চ, ১৮৩৩)। এই স্বর্গ-চ্যুতির দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর ছাতুবাবুরা আবার ‘গ্রান্দ জুরি’ হলেন, রাধাকান্তরা পেলেন ম্যাজিস্ট্রেট সম্ভ্রমার্থের সম্মানী পদ। সুতরাং বাঙালির তখন ভেঁপু বাজিয়ে আনন্দ করার কথা। কিন্তু তার বদলে কলকাতার নাগরিক চতুষ্টয় বসে বসে লিখলেন কান্নার চিঠি। বাঙালির চাকরি নেই। বাংলাদেশে কর্মখালি হলেও বাঙালির ভাগ্যে সে কর্ম জোটে না। হয় হিন্দুস্থানি না হয়, ফিরিঙ্গি—বাংলাদেশের চাকরি সব অবাঙালির নামে লেখা। কেন? ‘অকারণে আমাদিগের প্রতি এমত অন্যায় আচরণ কেন হয়?’
ইতিহাসের পাতার দিকে একটু নজর দিলেই দেখা যাবে এই চারজন নাগরিকের মুখে গোটা কলকাতা, সারা বাংলাদেশের বাঙালির প্রশ্ন এটি। রাধাকান্ত, দ্বারকানাথ কিংবা ছাতুবাবুরা কলকাতায় সমস্যা নয়। দু চার জন লাট পোষার ক্ষমতা তাঁদের ছিল। ছিল না ম্যাজিস্ট্রেটগিরি, দেওয়ানি, ছিল না সরকারি সম্মান। কোম্পানি ঘটা করে তাঁদের তাই দিয়েছেন মাত্র। তাতে কলকাতার বেকারের সান্ত্বনা কোথায়?
মোকাম কলকাতায় বাঙালির কোনও দিন চাকরি ছিল না, আজও নেই। কলকাতার বাঙালি চিরদিনই বেকার। তার মধ্যে চল্লিশ বছরের সুসময় বা দুঃসময়ের হিসেব যাঁরা করেন তাঁরা ‘ম্যাজিস্ট্রেট সম্ভ্রমার্থ’, এ শহরের তাঁরা মাথা বা মস্তকশোভা। কলকাতায় নিবাস হলেও এঁরা বেকার নন, এমনকী আজও না। অথচ কলকাতা চিরকালই বেকারের শহর।
কলকাতা আর বেকার—মা আর ছেলে। গাদাগাদা বেকার পেটে ধরেই মহানগরী হয়েছিল সুতানুটি-গোবিন্দপুরের আটপৌরে জননী। বেকারদের সঙ্গে কলকাতার তাই চিরকালের সম্বন্ধ। এ মহানগরীরই সন্তান তারা। অবশ্য কিছু নিজের, বাদবাকি সব পোষ্য নেওয়া। মার থেকে কখনও কখনও মাসির দরদ বেশি হয়। তাই হয়তো সুতানুটি গোবিন্দপুরের বাছাদের চেয়ে মাদ্রাজ, বিহার কিংবা কচ্ছ-কাম্বের খাতির কখনও বেশি মনে হয়। কিন্তু সে কলকাতার দোষ নয়। এ তার চিরকালের স্বভাব।
চার্নক সাহেব যখন নিমতলায় বসে হুঁকো ফুঁকছেন, সে দিনটিকে একটু স্মরণ করুন। ঘাটে বাঁধা তাঁর বিরাট বজরাখানা থেকে ভেসে আসছে পাটনাই গলার গান,—‘রামা হো’। অদূরেই পালকির হাতল ধরে দণ্ডায়মান গৌরকান্তি বেহারা চারজন—গৌড়জন নয়, ভিন্ন প্রদেশের। যার সঙ্গে বসে কথা বলছেন, তিনি আরও দূর দেশের মানুষ, আরমেনিয়ান। সুতানুটির হাড্ডিসার জোয়ান ছোকরা তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ‘প্যালা’ গানের কলি আওড়াচ্ছে আর সাহেবের তামাক খাওয়া দেখছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে এল কিন্তু ছোকরার নড়ন-চড়ন নেই। সে নিজেও জানে না যে, সে বেকার। নয়তো এতক্ষণ তামাসা দেখার সময় হত না তার।
সে খেয়াল যখন হল তখন সুতানুটি অন্ধকার করে রাত্রি নেমেছে। কলকাতার সওদাগরি জাহাজ যাচ্ছে সংবাদ পেয়ে করমণ্ডল উপকূল ছেঁকে পায়ে হেঁটে মানুষের দল জাহাজের আগেই পৌঁছে গেছে কলকাতার চাঁদপাল ঘাটে। সাহেবরা যখন আসছে, বিবিরাও তখন আসবেন। মুঘলরা জানে রাজার জাত ছেলে কোলে করে বসে থাকে না। এ কাজে তাদের লোক চাই। সুতরাং—
Sleep make baby
Sleep make……
From Kabul the Mougul woman comes
To make my master sleep.
কাবুল থেকে এল মুঘল ‘আয়া’, লখনউ থেকে মুঘল-ই বাবুর্চি, ওড়িশা থেকে শ্রমিক দল, আর দিল্লি থেকে সিপাহি। সুতানুটির ঘাট লোকে লোকারণ্য। এক-জাহাজ কাজের জন্যে তিন-জাহাজ লোক সেখানে দাঁড়িয়ে। যে দেশে মানুষ কিনতে পাওয়া যায়, সে দেশে মাইনে করা লোকের অভাব হওয়ার কথা নয়।
অগত্যা গোবিন্দপুরের ছেলেরা, পায়ে হেঁটে চলল ভাটিয়াল দিকে। কলকাতায় নোঙর করার আগেই জাহাজ ধরা চাই। কলকাতা থেকে দশ মাইল, পনেরো মাইল দক্ষিণে চলে যেত তখন তারা কাজের খোঁজে। হুঁকো-বরদার, ঘেসুড়ে কিংবা মশালচির কাজ চাই তাদের। তারও কি হাঙ্গামা কম? হোটেলে ট্যাভার্নে কান খাড়া করে ঘোরাঘুরি করতে হয়, কবে জাহাজ আসবে তার খবরের জন্য। খবরটা কোনওমতে একবার কানে এসে পৌঁছালে হয়। ভিখারি সেজে দোরে বসে থাকে। সাহেবরা রেগে আগুন হয়ে যায়। একজন লিখেছেন: ‘At the inn I was tormented to death by the inpertinent persevering of the Black people, for every one is a beggar, as long as you are reckoned a griffin or a new commer.’ সবাই ভিখারি, সকলেরই কাজ চাই, কাজ না হলে বখশিস্ চাই।
কাজ যে কেউ পেত না, তা নয়। নকু ধর পেয়েছিলেন। “ইংরেজেরা যখন দীনভাবে বণিক বৃত্তি করিতে আইসেন তখন এতদ্দেশীয় লোকেরা ইংরেজদিগের কথা বুঝিতে পারিতেন না, সেই সময়ে গঙ্গার মধ্যে ইংরেজদিগের একখানা নৌকা ডুবিয়া যায়। সে নৌকাতে লোক এবং দ্রব্যাদি যত ছিল সমস্ত ডুবিয়া গেল কেবল মহাবল একজন গোরা খালাসি ভাসিতে ভাসিতে গঙ্গার পূর্ব কূলে আসিল, নকু ধর তখন গঙ্গার কূলে বসিয়া জপ করিতেছিলেন, মৃতপ্রায় গোরাকে ভৃত্যদের দ্বারা উপরে উঠাইয়া বস্ত্র দিলেন এবং আপন বাটিতে আনিয়া চিকিৎসা করাইয়া বাঁচাইলেন, তাহাতেই ঐ গোরা বহুদিন নকু ধরের বাটিতে থাকে, এবং তাহার সহিত কথোপকথনে নকু ধর ইংরেজী ভাষার কিঞ্চিৎ শিক্ষা করেন, সেই ইংরেজীতে ইংরেজরা নকু ধরকে দোভাষী করিলেন।” (সম্বাদ ভাস্কর) রতু সরকারও প্রায় এমনই অলৌকিক কারণে ‘দোভাষী’ হয়েছিলেন।
ঈশ্বরানুগ্রহে এমনি আশ্চর্য কারণে যাঁরা অপ্রত্যাশিতভাবে চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁরা ছাড়া আর একদল চাকুরে বাঙালি ছিলেন তখনকার কলকাতায়। তাঁরা ভল্যান্টিয়ার চাকুরে, অর্থাৎ স্বেচ্ছানিযুক্ত। জনৈক ফৌজি সাহেব লিখেছেন: জাহাজখানা নোঙর করেছে কি না করেছে ক’খানা পানসি এসে লাগল তার গায়ে। সুদর্শন নেটিভরা এগিয়ে এলেন। তারপর পরিষ্কার ইংরেজিতে বলেন: মি লর্ড, ইওর বোট ইজ রেডি। বললাম য়্যু আর রং আই অ্যাম নো লর্ড, আই অ্যাম—।
—ইয়েস মি লর্ড, ফলো মি।
নৌকো গিয়ে ডাঙায় ঠেকল। হাত ধরে তিনি আমায় তীরে তুললেন। সেখানে পালকি ঘোড়া সব রেডি। তারই একটায় তিনি বসিয়ে দিলেন আমায়। তার লোকজনই মালপত্র সব বোঝাই করল। তারপর বাবু জিজ্ঞাসা করলেন—
—ক্যারিইং এ্যানি লেটার?
—নো।
—উইস টু স্টে ইন ট্যাভার্ন?
—নো।
—দেন লেট আস স্টার্ট টু ইওর কুঠি।
গাড়ি চলল। সত্যি সত্যিই একটা বিরাট বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালাম আমরা।
—মি লর্ড, দিস ইজ ইওর বাংলো।
তারপর চারপাশের লোকগুলোকে দেখিয়ে বলল—দে আর ইওর স্লেভস, ইওর সারভেন্টস। আই অ্যাম অলসো ইওর স্লেভ মি লর্ড।
তারপর বাবু ফিরিস্তি দিলেন কার কী কাজ, আর সে বাবদে কার কত মাইনে।
—কিন্তু তোমার মাইনে বাবু? সেটি তো বললে না। হাউ মাচ?
—মি লর্ড। আই নিড নো স্যাল্যারি। ওনলি দস্তুরি উইল ডু মি।
দস্তুরি মানে দালালি। সাহেব-কুঠিতে যত খরচ হবে, এ বাবু তার হিসেব রাখবেন, চাকর বাকরদের খাটাবেন। তার জন্যে তাঁর মাইনে চাই না। সাকুল্য খরচের ওপর টাকায় দু’পয়সা দস্তুরি দিলেই চলবে। তিনি সাহেব কুঠির সরকার।
এ চাকরি বাঙালির প্রায় একচেটিয়াই ছিল। কিন্তু তার ওপর কিংবা নীচের দিকে হলেই বিপদ। মুৎসুদ্দির চাকরি খুবই ভাল সন্দেহ নেই, কিন্তু তাতে অনেক টাকা চাই। ডিপজিট রাখতে হয়, কখনও কখনও সেলামিও দিতে হয়। তার ওপর ধরাধরি আছে, সই সুপারিশ আছে। শেষেরগুলোর জন্যে তবুও চেষ্টা করা চলে, কিন্তু পাঁচ লাখ টাকা সেলামি! সাধারণ বেকারের কাজ করে সোনার ঠাকুর গড়লেন, রমজান ওস্তাগর বেনিয়ান সেলাই করতে করতে বেনিয়ান হলেন। পদ্মলোচন দত্তের ভাগ্যের কথা স্বতন্ত্র। পদ্মলোচন দত্ত ছিলেন ‘মেকার’ বা ভাল লুচির কারিগর। হুতোম তাঁর কেরিয়ার সম্পর্কে লিখেছেন:
“ক্রমে অষ্টপ্রহর গরুড়ের মতো উমেদারীতে এক বৎসর হাঁটাহাঁটি ও হাজিরের পর দুই-চারখানা সই সুপারিশ হস্তগত হলো—শেষে এক সদয়হৃদয় মুচ্ছুদ্দী আপনার হাউসে ওজন-সরকারী কর্ম দিলেন…ক্রমে পদ্মলোচন দত্তের শুভাদৃষ্ট ফলতে আরম্ভ হলো, মুচ্ছুদ্দী অনুগ্রহ করে শিপ সরকারী কর্ম দিলেন। সাহেবদের সন্তুষ্ট করবার অবসর খুঁজতে লাগলেন…ক্রমে সায়েবরা পদ্মলোচনের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তার ভাল করবার চেষ্টায় রইলেন, অনুরোধ করে পদ্মলোচনকে সেই কর্মে ভর্তি কল্লেন।… ক্রমে মুচ্ছুদ্দীর সায়েবদের বড় একটা বনিবনাও না হওয়ায় মুচ্ছুদ্দী কর্ম ছেড়ে দিলেন সুতরাং সায়েবদের অনুগ্রহধর পদ্মলোচন বিনা ডিপসিটে মুচ্ছুদ্দী হলেন।”
মুৎসুদ্দির সিঁড়ি এমনই পেঁচালো। বেনিয়ানগিরি আরও কঠিন। বেনিয়ান মানে ব্যাংক। ট্যাঁকে যাদের ব্যাংক আছে তাঁরাই বেনিয়ান হতে পারেন। অন্যদের তা ভাবাও বাতুলতা।
সুতরাং কলকাতার কাজের বাজার তখন অত্যন্ত খারাপ৷ সরকারি চাকুরির কথা আগেই বলেছি। সওদাগরি আপিসের কথাও বলা হল। হেয়ার সায়েবের সুপারিশেও তখন কেরানিগিরি পাওয়া কষ্টকর।
কলকাতার সন্তানেরা তাই ব্যবসার পথ ধরলেন। কেউ ইমারতি কর্মে, কেউ বাড়ুই মিস্ত্রির কর্মে রুটি খুঁজতে বেরুলেন। কেউ নৌকো ধরলেন, কেউ বসলেন বেনিয়ান পা-জামা সেলাইয়ে, কেউ সোনারূপার কাজে। অনেকে সিদ্ধও হলেন। সুলতান আজউদ্দিন চাঁদ মিস্ত্রি রাজমিস্ত্রি থেকে রাজা হলেন, বাড়ুই মিস্ত্রির কর্মে পালেরা ঐশ্বর্যবান হলেন, শিব মিস্ত্রি সোনার কাজ করে সোনার ঠাকুর গড়লেন, রমজান ওস্তাগর বেনিয়ান সেলাই করতে করতে বেনিয়ান হলেন।
কিন্তু তাও দু’দিনের জন্যে। অচিরেই ‘বুরুস স্মাইল বরণ করি’ এসে ইমারতের দায়িত্ব নিলেন। “অভাগা বাঙালি মিস্ত্রীরা কর্ণিক ত্যাগ করিয়া পাগড়ি বান্ধিয়া ছিল, তাহা গিয়া কোদালি হস্তে লইল।” রোল্ট কোম্পানির দাপটে বাড়ুই মিস্ত্রি “রামতনু ঘোষ প্রভৃতি সকলে গজ ফেলিয়া বাইশ হাতে লইল (এবং) ইহাতে উদরান্নের অনাটন হইয়াছে।” হ্যামিলটন স্বর্ণকার সাজলেন। ফলে এদেশীয় স্বর্ণকারদের ‘ভক্ষ্যাভাব’ হল এবং “মিং গিবসন কোম্পানি প্রভৃতির আগমনে সূচী ব্যবসায়ীরা এক্ষণে সূচাগ্র ভূমিক্রয় করা দূরে থাকুক অন্নাভাবে সূচের ন্যায় শুষ্ক হইয়া গেল।”
এভাবেই বেকার বাঙালির সঙ্গে ক্রমে যুক্ত হল ব্যর্থ ব্যবসায়ী বাঙালি। ফলে কলকাতা আবার পুরো বেকার হল।
এদিকে সায়েবপাড়ার অবস্থাও গেল সম্পূর্ণ পাল্টে। আগে জাহাজ জাহাজ কাজ নিয়ে নাবতেন তাঁরা কলকাতায়। এখন তাঁরা আমদানি করেন জাহাজ ভর্তি বেকার।
রতু সরকার মশাইদের ভাত মেরে বিলেত থেকে সার্কুলার এল:
‘We are sorry to hear that we have not any one of our servants that can speak the language. We now purposely send you some youngman, which we would have instructed therin, as also to write it that we may not depend no accidentall persons.’
বিধি বাম হলেন। ‘অ্যাকসিডেন্টাল পারসনস’ বা নকু ধরেরা গেলেন খারিজ হয়ে। কোম্পানির নিজস্ব দো-ভাষী এলেন তাদের জায়গায়। এমনকী কিছুদিন বাদেই দেখা গেল ইউরোপিয়ান ভাষাবিদের প্রাচুর্য ঘটে গেছে শহরে। রতু সরকাররা কপালে হাত দিয়ে গেজেটে পড়লেন—
“A Gentleman in Search of Employment
If any single or family gentleman wishes a clerk, who understands several accounts, writes and reads English, French, Portuguese and can translate; he likewise reads Latin and speaks good Moor and Bengal Languages; he is willing to be emloyed in the settlement or go up the country or to either the Malabar and Coromandel Coasts, if a suitable salary be allowed him.’
ছয় ছয়টি ভাষায় বিশারদ কেরানির পদপ্রার্থী। তাও ভারতবর্ষের হেন জায়গা নেই, যেখানে যেতে তার আপত্তি। ‘ইয়েস’ ‘নো’ মার্কা বাঙালিবাবুর সেখানে নিজের হোম-সিটিতে আশা কোথায়?
বাঙালি তো পরে, আদুরে ফিরিঙ্গিও আর কাজ পায় না। সাহেবদের পরেই কোম্পানিতে তাদের খাতির। কিন্তু তাদের দেওয়ার মতো কেরানিগিরিও কোম্পানির আজ নেই। শুভানুধ্যায়ীরা তাই সভা বসালেন। ১৮২৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি টাউন হলে সভা হল। খবরের কাগজে তার সংবাদ বের হল:
ইউরোপীয় লোকদের হইতে এতদ্দেশীয় স্ত্রীর গর্ভে জাত লোকেরা পূর্বাবধি কেরানিগিরি প্রভৃতি লেখাপড়ার কর্মে প্রতিপালিত হইতেছিল কিন্তু দিনে ২ তাহাদের বংশ বৃদ্ধি হওয়াতে তৎকর্মে তাহাদের সকলের প্রতিপালন হওয়া কঠিন বোধ হইতেছে পরে আরও হইবেক যেহেতুক লোকবৃদ্ধ্যানুসারে কর্ম বৃদ্ধি নাই। কলিকাতাস্থ সাহেবেরা এই বিবেচনা করিয়া তাহাদের শিল্পকলা শিক্ষার্থে শিল্প বিদ্যালয় স্থাপন করিতে কল্পনা করিয়াছেন।
এই পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য চাঁদার খাতা ছাপা হল। সাহেবরাই বের হলেন খাতা হাতে। ১৫৭৫ টাকা মিলেও গেল। কিন্তু অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের চাকরি আর হল না। তারা আজও বেকার।
এমনকী, কারিগর হলেই যে রোজগার হত না তখনকার সময়ে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় নীচের বিজ্ঞাপনটি থেকে
‘Wants Employment
An European, upwards of twenty years in India, in the capacity of steward and hair-dresser, who understands watch making, can tune pianofortes etc……’
টেরিটি বাজার থেকে অ্যানা ডি সিলভা জানালেন, তিনি কোথায়ও একটু ঠাঁই চান (wants a place)। কলকাতা জোয়ান টমিকে সৈনিক থেকে ছেঁটে কবি বানিয়ে দিলে। সে এখন গড়ের মাঠে বসে গান গায়:
“I am a younger son of Mars and
Spends my time in craving
A thousand differents ways and means
To keep myself from starving.”
হাজার পথের সন্ধান করতে করতে অবশেষে বেকার মিঃ রিচার্ড নোল্যান্ড বাংলাদেশেই সন্ধান পেলেন এক নতুন আশ্চর্য সুন্দর ভূমির। কলকাতার বাঙালিরাই যেন কানে কানে বলে দিল তাঁকে—সাহেব চেষ্টা করো যদি মিলে যায়—এমন পথ আর দ্বিতীয়টি হয় না। অগত্যা রুটিরোজগারহীন সাহেব বংশপরিচয়কে মূলধন করেই আসরে নামলেন। ডাবলিনের মিঃ অ্যান নোন-এর অধস্তন পুরুষ মিঃ নোল্যান্ড বিবাহ মাধ্যমে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চান। তিনি কোনও সম্পন্ন ভদ্রলোকের কন্যার পাণিপ্রার্থী।
শেষ পর্যন্ত নোল্যান্ড ঝড়ের সমুদ্রে পেয়ে গেলেন দ্বীপের সন্ধান। তবে কলকাতায় নয়, মাদ্রাজে। কলকাতার কাগজে ছাপা হল সে শুভ সংবাদ।
“Married at Madras.
Mr Richard Nowland to Miss. Cuthbert of the same place with a fortune of 5,000 star pagodas (Rs. 30,000/=) and Mr. Cuthbert’s friendship who intends giving him the rice contract which Mr. Ferguson Lauty had.”
সুন্দরী কন্যা, তিরিশ হাজার টাকা নগদ, তদুপরি চালের কনট্রাক্ট, কলকাতার দুর্ভাগ্য, তার সন্তানদের মধ্যে নোল্যান্ডের মতো জামাতার অভাব না থাকলেও মিঃ কাথবার্টের মতো শ্বশুর অত্যন্ত কম। ফলে, আজও তার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে লাইন হয়, তিনটে পদের জন্য তিন হাজার দরখাস্ত পড়ে। উমেদারি আজও তাই এ শহরে, রীতি আজও ব্যবসা।
তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক, বেকার আছে বলেই কলকাতা আছে। ভেবে দেখুন, বেকার বাদ দিলে কলকাতা মানে দাঁড়ায় ডালহাউসির খানকয় কেরানিশালা আর বড়বাজারের গুটিকয় গুদাম। এ শহর হাড্ডিসার হয়ে যায়। ইঙ্গবঙ্গ-কলিঙ্গের কর্মহীন ছেলেগুলোই জন্ম থেকে এ শহরের মাংস মজ্জা। তারাই কলকাতার রং, কলকাতার জীবন। রোয়াকে রোয়াকে পাতাবাহার সেজে তারাই এ শহরকে সাজায়, গল্প কবিতা লিখে তারাই মজায় এ শহরকে। আলো জ্বালানো বাল্বে সোনা গলানো অ্যাসিডের ঢিল কিংবা ব্রান্ডি হুইস্কি, রাম ছাড়াও সোডার বোতলের ব্যবহার তাদের আবিষ্কার। তারা আছে বলেই বাঁদরনাচে ভিড় হয়, গণতন্ত্রের ভোট হয়, বিপ্লবের মিছিল হয়। কলকাতার বারোয়ারি তাদেরই দান, জলসা সাহিত্যসভা তাদেরই কৃতিত্ব।
এককথায় কলকাতার বৈচিত্র্যের মূলে কলকাতার বেকার। তারাই এ শহরের প্রাণ।
সুতরাং—বেকার জিন্দাবাদ।
গুপ্ত-শিক্ষক
শুনেছি, এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বাংলা রচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘শিক্ষায় গৃহশিক্ষকের দান’। বিষয়টি অভিনব। অন্তত ছাত্রদের পক্ষে। কারণ কোনও ‘সাজেশন’ বা ‘সিওর সাকসেস’-এ এর দু’চারটে রজত এবং সুবর্ণজয়ন্তী সংস্করণ রচনা বই উল্টে দেখেছি, এই মহামহিম পুরুষ তাতেও অনুপস্থিত। সুতরাং স্বভাবতই আশা করেছিলাম কোনও বুদ্ধিমান ছাত্র বা বিদুষী ছাত্রী এতে হাত দেবেন না। কিন্তু জনৈক পরীক্ষক বন্ধু সম্প্রতি সে ভুল ভেঙে দিয়েছেন আমার। তিনি গত রোববার সকালে দক্ষিণ কলকাতার একটি চায়ের দোকানে অত্যন্ত উদারতার সঙ্গে তাঁর ব্যাগস্থ খাতার বাণ্ডিল থেকে একটি খাতা আমায় দেখিয়েছেন, যার দুঃসাহসী লেখক উক্ত রচনাটিতে হাত দিতে ইতস্তত করেননি। রচনাটি খাতার উপসংহারে বা একেবারে শেষ পাতায় লিখিত। হাতের লেখার পরিণতি দেখে মনে হয়, ঘণ্টা পড়ার শেষ ক’মিনিটে লেখা। বোধহয় তার ইচ্ছে ছিল আর সব প্রশ্নের মামলা চুকিয়ে ধীরেসুস্থে এতে হাত দেবে। কিন্তু সময়াভাবে তা আর হয়নি।
যা হোক, উক্ত রচনার কপিরাইট সেই নাম-না-জানা লেখকের হলেও আমার পূর্বোল্লিখিত বন্ধুর প্রতি প্রকাশ্যে সৌজন্য স্বীকার করে আমি হুবহু সেটি উপস্থিত করছি এখানে।
সংজ্ঞা:
গৃহশিক্ষক এক ধরনের শিক্ষক। ইঁহারা কাহারও গৃহে থাকিয়া বা যাইয়া বিদ্যাশিক্ষা দেন। শিক্ষাদান ইঁহাদের কর্তব্য।
ইতিহাস:
এই দেশে গৃহশিক্ষকেরা কবে কোথা হইতে আসিয়াছেন, তাহা এখনও সঠিকভাবে নির্ধারিত হয় নাই। অনেকে অনুমান করেন—প্রাচীনকালে ঋষিগণ যখন আশ্রম হইতে বিতাড়িত হন, তখন তাঁহারা লোকালয়ে ছড়াইয়া পড়েন এবং তখন হইতেই ছাত্রগণ গুরুগৃহে যাইয়া পড়াশুনা করিবার পরিবর্তে গুরুগণ ছাত্ৰগৃহে অধিষ্ঠিত হন।
আকৃতি ও প্রকৃতি:
গৃহশিক্ষকেরা দেখিতে অন্যান্য শিক্ষকদের মতোই। সকলের চেহারা একরূপ নহে, পোশাকও বিভিন্ন। কেহ ভীষণ নোংরা জামাকাপড় পরিধান করেন, কেহ আবার খুব বাবু। অনেকে আবার প্যান্ট পরেন।
তবে প্রকৃতিতে ইঁহারা সকলেই সমান শান্ত ও বিনয়ী। স্কুল কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে এখানেই ইঁহাদের পার্থক্য।
গৃহশিক্ষক খুব উপকারী। কোনও কিছুতে ঠেকিয়া গেলে উঁহারা তাহা দেখাইয়া দেন। তাহাতে ছাত্রছাত্রীদের উপকার হয়।
অপকারিতা:
গৃহশিক্ষকের অপকারিতা এই যে, তাঁহারা অনেক দিন থাকিলে আস্কারা পাইয়া যান। তখন ইহারা ‘গার্জেন’ হইয়া উঠিতেও চেষ্টা করেন।
উপসংহার:
মোট কথা, গৃহশিক্ষক বাংলার অন্যতম কুটিরশিল্প। সরকার এবং জনসাধারণের উচিত, অবিলম্বে ইঁহাদের প্রতি সমুচিত মনোযোগ প্রদান করা।
এ রচনার দাম হিসেবে ছেলেটি কী পরিমাণ নম্বর শেষ পর্যন্ত পাবে আমি জানি না। কিন্তু লেখক, হিসাবে সে যে যারপরনাই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই আমার। বস্তুত, রচনাটি পড়া অবধি এদেশের ছাত্রদের সম্পর্কে নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠেছি আমি। সন্দেহ নেই, এমন ছেলে যদি বছরে শতকরা দুটি করেও কোনওমতে একবার বেরিয়ে আসতে পারে ইউনিভারসিটির ফোঁকর দিয়ে—তবে বাঙালির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত। পি.এস.সি.র মুখে ছাই দিয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকব আমরা।
রচনাটির মধ্যে ভাবগত বা মূলগত কোনও ত্রুটি নেই বলেই আমার ধারণা। তবে তাড়াহুড়োর জন্যেই হোক, কিংবা রেফারেন্সের অভাবেই হোক, বিষয় অনুসারে বক্তব্য একটু সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে হতে পারে অনেকের। সেটা যাতে না হয়, তাই আমার নিম্নেক্ত পাদটীকা। কষ্ট করে এগুলো জোগাড় করতে হল এজন্য, নয়তো এমন চমৎকার রচনাটি অসম্পূর্ণতার কারণে মারা যেতে পারে। তাতে আমার আপত্তি এবং দুঃখ। কারণ, প্রাইভেট টিউটার সম্পর্কে ভবিষ্যতে এর চেয়ে স্পষ্ট এবং উৎকৃষ্ট রচনা বাংলা সাহিত্যে হবে এমন আশা আমার নেই।
যা হোক, প্রসঙ্গকথা বাদ দিয়ে এবার আসল কথায় আসি। ছেলেটি প্রথমত একটু ভুল করেছে সংজ্ঞায়। অবশ্য সেটা নিতান্তই টেকনিক্যাল। তা ছাড়া এ ভুলের জন্যে দায়ী প্রশ্নকর্তা। তিনি যদি ‘গৃহশিক্ষক’ না লিখে ‘প্রাইভেট টিউটর’ লিখতেন, তবে দেখতেন এ ছেলে তার বাংলা করেছে—গুপ্ত শিক্ষক। কারণ ‘প্রাইভেট টক’যদি ‘গোপন কথা’ হয়, তবে ওর পক্ষে প্রাইভেট টিউটরকে ‘গুপ্ত শিক্ষক’ এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিকে ‘গোপনে সংঘবদ্ধ কোম্পানি’ বলাই হয় ছাত্রোচিত, তা ছাড়া প্রাইভেট টিউটরের পক্ষে এটাই সর্বোৎকৃষ্ট বাংলা। কেন, সে কথা পরে বলছি। তার আগে সংজ্ঞার কথা শেষ হোক। ছেলেটি লিখছে, শিক্ষাদান ইঁহাদের কর্তব্য। শিক্ষাদান ছাড়াও যে গুপ্ত-শিক্ষকদের অন্য কর্তব্য বা কর্মসূচি আছে, সে তা বুঝে উঠতে পারেনি। অবশ্য বুঝতে পারা উচিত ছিল। কারণ, তার চেয়ে অল্পবুদ্ধি বালক-বালিকারাও শরৎচন্দ্রের ‘বড়দি’ পড়ে কাঁদে, ‘নীলাঙ্গুরীয়’ পড়ে মজা করে। তবে, পরীক্ষার খাতায় তা না করে ইনি বুদ্ধিরই পরিচয় দিয়েছেন বলতে হবে। ইনি আরও বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন, শিক্ষককে তাঁর কর্তব্যের ফরমুলায় ফেলে দিয়ে। বাবার কর্তব্য যেমন খাওয়ানো পড়ানো, মা’র সিনেমার পয়সা জোগানো, তেমনি শিক্ষকেরও পড়ানো। সহজ যুক্তি এবং ভদ্র সিদ্ধান্ত। ছেলেটি অনায়াসে বলতে পারত, গৃহশিক্ষক এক ধরনে শ্রমজীবী কিংবা ব্যবসায়ী। তিনি অর্থের বিনিময়ে নিয়মিতভাবে অন্যের গৃহে আসার শ্রম স্বীকার করেন অথবা দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া বিদ্যা বিক্রয় করেন। কারণ, কলেজ অবধি আসতে নিঃসন্দেহে সে বারকয়েক বাবাকে দিয়ে বাজেটে শিক্ষক ঢুকিয়েছে এবং নিজের হাতে মাস্টার মশাইয়ের হাতে পয়সা তুলে দিয়েছে। তা ছাড়া বেচারা ভুলে গিয়েছে যে, ওর দিদিকে যিনি সপ্তাহে দু’দিন গান শেখাতে আসেন, তিনিও গৃহশিক্ষক বা গুপ্ত-শিক্ষক। এমনকী, মাড়োয়ারি ধনপতির অন্দরে পার্ক স্ট্রিটবাসিনী যে আধুনিকা এটিকেট শেখান তিনি এবং তার অনুপস্থিতিতে বাড়ির ছেলেমেয়েরা যে গভর্নেস ওরফে দ্রাবিড় রমণীটির তত্ত্বাবধানে থাকে, তারা সবাই গুপ্ত শিক্ষক।
সংজ্ঞায় এই ভুলের জন্যেই শিক্ষকদের আকৃতি-প্রকৃতি বর্ণনায়ও ভ্রান্তি ঘটে গেছে লেখকের। গৃহশিক্ষকেরা দেখতে অন্য শিক্ষক কেন, অন্য মানুষের মতো কিনা, তাতেই সন্দেহ আছে আমার। এক-ট্রাম মানুষ থেকে নিমেষে আমি তরুণ গানের মাস্টারটিকে বের করে দিতে পারি। ফুটফুটে চেহারা, ফিনফিনে পাঞ্জাবি (রেডিওর লিস্টে নাম থাকলে হাতাগুলো গিলে করা), হাতে পাথর বসানো ইয়া আংটি। তার সঙ্গে সহাবস্থান করছে আর একটি অকুলীন তারের আংটি। তারযন্ত্রের চাবি এটি।
সমগ্র শিক্ষককুলে সবচেয়ে বনেদি এঁরা। চলেন সাধারণত ট্যাক্সিতে, কথা বলেন গানের সুরে। গোটা শহরটাই যেন যমুনা পুলিন, কিংবা অষ্টাদশ শতকী লখনউ-এর কোনও দরবার। ট্রামে গেলে কান পাতবেন। শুনবেন—তেরো আনা কথাই তাঁদের ‘ছাত্রী’, ‘প্রোগ্রাম’ নয়তো ‘ফ্যাশনে’ ভরা। একজন গানাদারকে জানতাম আমি, তিনি গান শেখাতেন না, দেখাতেন।
ভদ্রলোক খুব ঘটা করে একদিন ছাত্রীর হাতে লাল একগাছি সুতো বাঁধলেন। দু’ বছরে সে সরু সুতো তো ছিড়লই না, বরং ক্রমে ফসকা গেরো পরিণত হল বজ্র আঁটুনিতে। সেদিনও ও বাড়িতে ঘটা করেই অনুষ্ঠান হল। প্রথমবারের মতো নিজেরাই নয়, এবার নেমন্তন্ন পেলেন আত্মীয়-বন্ধুরাও। আমিও। মাস্টার বরযাত্রীর ফর্দে ঢুকিয়েছিল আমাকে। দোষটা ওর, না ওর গানের কিংবা প্রজাপতির তা আজও ঠাহর করে উঠতে পারিনি আমি।
গানের মতো ডেলিকেট বিষয় যাঁরা শেখান, তাঁদের কথা স্বতন্ত্র—এমন ভাববার কোনও কারণ নেই। কেন, সে কথা পরে বলছি। শিক্ষকদের আকৃতি বর্ণনা আগে শেষ হোক। প্রকৃতি পর্যায়ে ওসব আলোচনা করা যাবে।
সাধারণত এ নগরের প্রাইভেট টিউটরদের টিউটরি পেশা সেকেন্ডারি, শিক্ষকতা ওঁদের প্রাইভেট বিজনেস। এমনি হয়তো আপিসে কাজ করেন। সকাল সন্ধ্যায় করেন ইনসিওরেন্সের দালালির বদলে টিউটরি। তাই অফিসফেরত প্যান্টেই দেখা যায় ওদের। স্কুল কলেজ ফেরত ছাত্রদের দেখা যায় খেলার বুট পায়ে কিংবা বই বগলে। যাঁরা প্রকৃত শিক্ষক, তাঁদের এভাবে দেখতে পাবেন না। রাজনারায়ণ বসু একজন শিক্ষক দেখেছিলেন কলকাতায়, পায়ে তাঁর ভেলভেটের জুতো, পরনে বিছাপেড়ে ঢাকাই ধুতি গায়ে বেনারসি শাল, হাতের পাঁচ আঙুলে চারটে আংটি। তার মধ্যে তিনটে হিরের।
আমি এতটা দেখিনি। তবে এক মফস্বল শহরে জনৈক গৃহশিক্ষককে দেখেছি, যিনি পাঁচ মিনিটের পথও যাতায়াত করতেন ঘোড়ার গাড়িতে। গ্লেসকিডের জুতো, সিল্কের জামা আর শান্তিপুরি ধুতি ছিল তাঁর নিত্য পোশাক। বারো ঘর পড়িয়ে যাঁরা সংসার চালান, তাঁদের এ পোশাক নেই। কারণ তাঁরা লক্ষ্মীপুজোর নিয়মে পড়ান বলেই, দক্ষিণাটাও আসে সেই হারে।
আজকের ভাগ্যবান গৃহশিক্ষক—স্কুলশিক্ষকেরা। যাঁর স্কুল যত বনেদি, তাঁর তত খাতির। খোকনদের উপস্থিত পরীক্ষাদির ঝামেলা তাতে যেমন কমে, পরবর্তীগুলোর ভবিষ্যতের ভাবনাও তত দূর হয়। ঘরে মাস্টারমশায় পুষছি যখন, তখন ভর্তির হাঙ্গামাটা আর পোয়াতে হবে না। বড় ঘরে ঠাকুর-চাকরের মতো মাস্টার পোষাও আজ তাই স্বভাব। এতে ফ্যামিলিটা যেমন একটু খোলতাই হয়, তেমনি ছেলেপুলের ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হয় না। কর্তা-গিন্নি টাকার দামে দিব্যি চুকিয়ে দিতে পারেন দায়িত্ব। তাই আমার বিজ্ঞ ভূমিকার বলেছেন—শিক্ষাদান করা শিক্ষকের কর্তব্য। বোধহয় পিতামাতার তা নয় বলেই তাঁর ধারণা।
কী করে এই ধারণা এল আমাদের সমাজে, তার একটা ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা অবশ্য তিনি করেছেন। তাঁর উল্লেখিত ‘প্রাচীনকালে’ যাওয়ার সাহস আমার নেই। কারণ আশ্রমে গিয়ে সেকেলে কিছু কিছু ছাত্র লেখাপড়ার সঙ্গে কী করত, তার কিছু কিছু সংবাদ যেমন আমরা জানি, তেমনিই জানি দ্রোণাচার্য প্রমুখ মাস্টারদের রেট কী ছিল তাও। সুতরাং লোকনিন্দার ভয়ে ওদিকে যেতে চাই না। তার চেয়ে এই কলকাতা শহরই ভাল।
কলকাতার বয়স কম। কিন্তু গৃহশিক্ষক এ শহরে তিনটে ঘর বসার পর থেকেই আছে বলে ইতিহাসের বক্তব্য। ‘আলালের ঘরের দুলালের বাবুরাম বাবু বলছেন, “দেখ মতিলালের বুদ্ধিশুদ্ধি ভাল হইয়াছে, ছেলেটিকে দেখিলে চক্ষু জুড়ায়, সম্প্রতি ইংরেজি পড়াইতে বাঞ্ছা করি—অল্পস্বল্প মাহিনাতে একজন মাস্টার দিতে পার?
বেণীরামবাবু। মাস্টার অনেক আছে, কিন্তু ২০।২৫ টাকা মাসে দিলে একজন মাঝারি গোছের লোক পাওয়া যায়।
বাবুরামবাবু। কত? ২৫ টাকা। যদি এত টাকা দিব তবে তোমার নিকট নৌকা ভাড়া করিয়া কেন এলাম?
এই বলিয়া বেণীবাবুর গায়ে হাত দিয়া তিনি হা হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন।”
কলকাতায় তখন ‘মাঝারি গোছের’ একজন মাস্টারের মাইনে মাসে ২০/২৫ টাকা। অথচ স্কুলের মাইনে বছরে দু’ টাকা। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের কোনও মাইনে ছিল না। ছিল না হিন্দু কলেজেরও। সুতরাং বেণীরামবাবু বাড়ি ফিরে ছেলের শিক্ষার ভার দিলেন বাড়ির সরকারের ওপর। “পরে বাবুরামবাবু বিবেচনা করিলেন, ব্যাকরণাদি ও কিঞ্চিৎ পারসীক শিক্ষা করান আবশ্যক। এই স্থির করিয়া বাটির পূজারী ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলেন—কেমন হে, তোমার ব্যাকরণ-ট্যাকরণ পড়া আছে?’ পূজারী ব্রাহ্মণ গণ্ডমূর্খ মনে করিল, যে চাউল কলা পাই তাতে কিছুই আঁটে না—এতদিন পরে বুঝি কিছু প্রাপ্তির পন্থা হইল। এই ভাবিয়া প্রত্যুত্তর করিল—‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ বাবুরামবাবু বলিলেন—‘তুমি অদ্যাবধি আমার পুত্রকে ব্যাকরণ শিক্ষা করাও।”
হিন্দু কলেজের পরে এমন শিক্ষকদের খাতির বেড়ে গেল আরও। কারণ তখন পড়ুয়া অনেক, শিক্ষক কম। সুতরাং পুজারি বামুন ছাড়া আর গতি কী। আজকের মতোই কলকাতার বুদ্ধিমান ব্যবসায়ীরা তখন এদের মূলধনে স্কুল খুলে বসতেন শহরে। সমসাময়িক একটি খবর শুনলেই বুঝতে পারবেন পরিস্থিতিটা।
“গুণাকরবাবু কহিলেন, এ বড় নতুন কথা কি প্রকার কহ দেখি। শুন বলি৷ একজন বিষয়ী লোক আপন বাসার এক ব্রাহ্মণকে কহিলেন, ওহে ঠাকুর, এক পরামর্শ আছে পূর্বকালে অধ্যাপক এত ছিল না বিদায়ও এত পাইতেন না, এইক্ষণে দেখিলাম বিষয়কর্মে কোন লাভ নাই যাহারা যাহারা টোল করিয়াছেন এক এক নিমন্ত্রণ হইলে দুইশ টাকা প্রধান বিদায় তাহার বিভাগ মত মধ্যম ও কনিষ্ঠও পান আর রূপা ও সোনার ঘড়া গাড়ু পাওয়া যায়, আইস আমি তোমায় এক টোল করিয়া দিই, কিন্তু যত টাকা লভ্য হইবেক তাহা সকল আমি লইব। তুমি ১০ টাকা হিসাবে মাহিয়ানা পাইবা আর বাসা খরচ ও ভাগ্যের কাপড়। উত্তর। যে আজ্ঞা আমার এই যথেষ্ট।”
ঠিক আজকের স্কুলগুলোর রীতি। লক্ষণীয় এই: মাস্টারমশায়দের সম্মতিটিও সনাতন। প্রাইভেট স্কুল এবং কোচিং হাউসের প্রতিষ্ঠাতা-কাম-সেক্রেটারি-কাম-প্রধানশিক্ষকদের সঙ্গে কখনও বখরা নিয়ে বিবাদে মাতেন না তাঁরা।
যা হোক, টোল তো হল, কিন্তু পুজারি ব্রাহ্মণ পড়ায় কী করে? তিনি “জনৈক উপযুক্ত পড়ো রাখিলেন কখন কেহ কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে ঐ পড়ো উত্তর করে এবং বাসাতে ভাইপো ভাগিনেয়কে রাখেন, লোকত জানান যে তাহারা আমার পড়ো। তাঁহারা কখন কখন একবার পুঁথি খুলিয়া বসেন এইমাত্র।”…
ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবু বিলাস’-এর মুনশি বৃত্তান্তও উল্লেখযোগ্য। “বাবুদের লেখাপড়া শিখাইবার জন্য বাড়ির কর্তা প্রথমে একজনকে ডেকে পাঠালেন। বললেন—তুমি আমার সন্তানদিগকে পারসী পড়াইবা এবং বহির্দ্বারে থাকিবা।… মায় খোরাকি তিন তঙ্কা পাইবা।”
এগুলো কলকাতার নেটিভ পাড়ার টিউটরদের সংবাদ। সাহেব পাড়ায়ও তখন বাজার ছিল তাদের। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮০০ সালে, তার আগে মুনশির খোঁজে সাহেবেরা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতেন নেটিভ পাড়ায়। ডিরেকটরদের কড়া হুকুম, নেটিভদের ভাষা শিখতে হবে। (So as to transact business with the natives.)
নিয়ম হল, যারা হিন্দুস্তানি ভাষা শিখতে পারবে তারা কুড়ি পাউন্ড গ্রাচ্যুইটি পাবে। এসব ১৬৭১ সনের কথা। কেরীর ‘কথোপকথন’-এ মুনসি নিয়োগপর্ব শোনার মতো। ‘সাহেব তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন—তুমি কোন ২ ভাষা জানহ।—সাহেব আমি তিন চারি প্রকার ভিন্ন ২ ভাষা জানি।’ এই মুনসি মাইনে চেয়েছিলেন মাসে ত্রিশ টাকা। কেরী তাঁর নিজের মুনশি রামরাম বসুকে দিতেন কিন্তু মাসে কুড়ি টাকা!
তখনকার সময়ের ছাত্রসহ জনৈক মুনসির একটা ছবি দেখেছি আমি। ছাত্র অর্থাৎ রাইটার সাহেব টেবিলের ওপর জুতোসুদ্ধ পা দুখানি তুলে কেদারায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। টেবিলে লাল জলের গ্লাস। হাতে হুকোর নল। মাথার ওপর টানা পাখা। সামনে একটা বই নিয়ে করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন মুনসি। নীচে লেখা না থাকলে ওঁকে মনে হবে খিদমদগার।
তার প্রায় একশো বছর পরে (১৭৫৫) তরুণ রাইটার ওয়ারেন হেস্টিংস-এর মুনসি নিযুক্ত হন নবকিষণ বা নবকৃষ্ণ। নবকৃষ্ণ কলকাতার সবচেয়ে সফল গৃহশিক্ষক। নিয়োগের সময় মাসে মাইনে ছিল তাঁর ষাট টাকা। বছর তিনেক কলকাতায় কাটিয়ে হেস্টিংস যখন কাশিমবাজার চললেন, তখন এখনকার বড় মানুষদের মতো মুনসি নবকৃষ্ণকেও পার্শ্বচর হিসেবে সঙ্গে নিয়ে গেলেন তিনি। কোম্পানির সঙ্গ আর কোনও দিন ছাড়েননি নবকৃষ্ণ। কিছুদিন পরে কোম্পানির রাজনৈতিক দেওয়ানের পদে নিযুক্ত হলেন তিনি। ছাত্রপ্রতিম হেস্টিংসকে এই গৃহশিক্ষক নাকি একবার ধার দিয়েছিলেন তিন লক্ষ টাকা। হেস্টিংস ধারের টাকা বড় একটা ফিরিয়ে দিতেন না। নবকৃষ্ণকেও দেননি বলে জনশ্রুতি। তাতে যে কিছু যায়-আসে না তাঁর নবকৃষ্ণ সেটা প্রমাণ করলেন তাঁর মায়ের শ্রাদ্ধ উপলক্ষে। নয় লাখ টাকা খরচ করেছিলেন তিনি সে মহোৎসবে।
তবে সাহেব-ছাত্র পড়ানোর ঝুঁকিও ছিল বিস্তর। কারণ তিনি তো শুধু পড়ুয়া নন, প্রভু। সুতরাং, কখন কোন্ মূর্তি ধারণ করবেন যিশুই জানেন। ১৮১০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষক আনন্দচন্দ্র শর্মা অভিযোগ এনেছিলেন জনৈক কেনেডি সাহেবের বিরুদ্ধে। তিনি তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন। অথচ একদিন এমন গুরুদক্ষিণা দিলেন যা অচিন্তনীয়। বেচারা গৃহশিক্ষক কাঁদো কাঁদো হয়ে লিখেছেন—“নিরপরাধ আমাকে অনেক ঘুষা ও থাবড়া এমন মারিয়াছেন যে আমি দুই দিবস শয্যাগত ছিলাম…”
কলকাতার আজকের গৃহশিক্ষকদের কাছে এ অবশ্যই স্বপ্নের মতো খবর। ছাত্রের মা বাবাকে বড়জোর ক্ষেত্রবিশেষে তারা মাইনে ছেড়ে দিতে পারে, ‘ভাল’ ছাত্রী হলে, সম্পন্ন শিক্ষক জন্মদিনে উপহারও দিতে পারেন এক আধখানা প্যাকেট, কিন্তু নগদ ধার? সে শুধু ক্ষমতার নয়, স্বপ্নেরও বাইরে। উল্টো দিকেরও একই অবস্থা। মাতৃশ্রাদ্ধের অজুহাতেও এক দুশ টাকা অ্যাডভান্স গলিয়ে আনা যায় না সেখান থেকে।
যা হোক, ক্রমে সাহেবপাড়ায় এসে হাজির হলেন সাহেব-শিক্ষকও। এখন হিন্দুস্থানি ভাষার চেয়ে ইংরেজি বেশি দরকারি ভাষা। কোম্পানি এখন ব্যবসায়ী নয়, রাজা। ইংরেজি রাজভাষা। ইংরেজেরা যে ইংরেজি জানে না তা নয়। কিন্তু জম্বুদ্বীপেও একশো দেড়শো বছরে বহু ইংরেজ জন্মে গেছে। তারা কেউ পুরো, কেউ বা আধা সাহেব। আয়ার শিক্ষাগুণে তারা দুচার কলি হিন্দুস্থানি গান আওড়াতে পারে। এদেশি গালিগালাজ, অশ্লীল বুলি সব তাদের মুখস্থ। এমনকী, মিথ্যে বলা, লোক-ঠকানো, চুরি-জোচ্চুরি সবই জানে তারা, কিন্তু ইংরেজি বিদ্যাটি বাদ দিয়ে। অথচ সরকারি বিজ্ঞাপন জানাচ্ছে—”Wanted Writers, One need not apply, whose handwriting is bad and who cannot write swift.”
সুতরাং অনেক বিলেতি গোরা মাস্টার সাজলেন। তার বর্ণনা দিয়েছেন একজন সাহেব। তিনি লিখছেন:
মাস্টার মশাই একটা সাবেকি চেয়ারে বসে আছেন। পা দুটো তাঁর ছড়ানো একটা বেতের মোড়ায়। গায়ে ঢিলে পাজামা আর বেনিয়ান। বেনিয়ানটার দুটো কাজ। গরম শরীরটাকে ঠাণ্ডা রাখা, আর সমাজে পজিশন রাখা। হাতে তাঁর বেত। এটাই তাঁর শাসনদণ্ড। এই মহামহিমের সামনে ছেলেরা টুলে বসে আছে। “They have already read three chapters of the Bible, and have got over the proper names without much spelling.”
খালি হাতের লেখায় চাকরি হয় সত্য, কিন্তু অংকও চাই কিছু। বিজ্ঞাপনে না হলেও, মার্চেন্ট হাউস-এ কাজে লাগে। সুতরাং জনৈক “W. Gaynard, Accountant, begs to inform the public that he intends to open an Academy at his house, No11 Merediths Buildings…” সেখানে তিনি দশমিক প্রথা শেখাবেন এবং ইটালিয়ান কায়দার বুককিপিং। ছেলেদের মাইনে মাসে মাত্র পঁচিশ টাকা, মেয়েদের তিরিশ টাকা।
মেয়েদের মাইনে পাঁচ টাকা বেশি কেন, সে কৈফিয়ত তিনি দেননি, কিন্তু কারণটি আমরা জানি। ওঁরা সেকালে বিশ্বাস করতেন মেয়েদের পড়ানোর পরিশ্রম বেশি। কারণ ওদের মাথায় নাকি আমাদের চেয়েও গোবর বেশি সুতরাং মাইনেও একটু বেশি।
তবে মেয়েদের পড়াতে পারলে যে অন্যদিক থেকে আনন্দ—তা প্রমাণ করলেন জনৈক জন মিচেল। তিনি বলতেন, আমি পাদরি। সবাই বললেন, পাদরি তো এখন আমাদের অনেক আছে, আপনি বরং আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়ান। ভদ্রলোক রাজি হলেন। কিন্তু সে শেয়ালের মাস্টারি। প্রথমে মিচেল ধরলেন ক্যাপ্টেন উইলিয়ম হাউ-এর মেয়েকে। তারপর ক্রমে অন্যদের। সাহেবরা চিঠি লিখলেন, ওকে শিগগির ফিরিয়ে নাও এখান থেকে। কারণ—He is guilty of many irregularities, and scandalous actions, altogether unbecoming the profession he pretends to do.”
মহা বিপদ, লোকটাকে মেরে তাড়িয়েও তো দেওয়া যায় না। একে পাদরি, তার উপর শিক্ষক। নেটিভেরা হেসে খুন হয়ে যাবে যে তা হলে।
লক্ষণীয় বিষয় এই, এদেশের অ্যাংগ্লো-ইন্ডিয়ান মেয়েরা কিন্তু তখনও পর্দানশিন।
সুতরাং আমাদের ঘরের মেয়েরা তখন দেওয়াল-নশিন। অন্দরমহলের চার দেওয়ালের বাইরে পা ফেলবার উপায় ছিল না তাদের। ফলে এই কলকাতা শহরে মেয়েদের স্কুল যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সভ্যভব্য বাবুদের অন্তরে, তা অনুমান করা কষ্টকর নয়। ঈশ্বর গুপ্ত মশায় সেদিন ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন:
“কপালে যা লেখা আছে,
তার ফল তো হবেই হবে।
(এরা) এ বি পড়ে বিবি সেজে,
বিলিতী বোল কবেই কবে।
(এরা) পর্দা তুলে ঘোমটা খুলে,
সেজেগুজে সভায় যাবে।
ড্যাম্ হিন্দুয়ানী বলে,
বিন্দু বিন্দু ব্রান্ডি খাবে।
আর কিছুদিন থাকলে বেঁচে,
সবাই দেখতে পাবেই পাবে।
(এরা) আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী,
গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।”
‘প্রভাকর’ এবং ‘চন্দ্রিকা’ কাগজ সেদিন রুচির সমস্ত প্রশ্ন ভুলে লিখতে ইতস্তত করেনি—“যদি কোন কোন বাবু আপন বিবিদিগকে গুণবতীকরণের নিমিত্ত গুরুমহাশয়ের নিকট প্রেরণ করেন, তথাপি সে সকল বাবুদিগেরও আমরা নিষেধ করিনা। বরঞ্চ আমরা এমত স্বীকার করি যে, যে পাঠশালায় ঐ বিবিরা পাঠার্থে গমন করিবেন, আমরাও রাত্রিকালে বৈকালে অবাধে প্রতিদিন বারেক দুইবার যাইয়া গুণবতীদিগের গুণের পরীক্ষা লইব।”
(২৩শে জুলাই, ১৮৩১)
এসব তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ‘সমাচার দর্পণ’ অগত্যা স্মরণ করতে বাধ্য হলেন আমাদের সনাতন প্রাইভেট টিউটরকে। তাঁরা লিখলেন: ভদ্র এবং সজ্জনদের উচিত “আপন আপন পরিজনের প্রতি কৃপাবলোকন করিয়া কোন বিদ্যাবতী স্ত্রীকে নিজ বাটীতে রাখিয়া তাহাদিগকে বিদ্যাশিক্ষা করান। যাহারা নির্ধন—তাহাদিগের যাবৎ বয়ঃস্থা না হয়—তাবৎ পাঠশালায় পাঠান যেহেতু বাল্যকালে কোনরূপ কোন বিষয়ে দোষ হইবার সম্ভাবনা নাই।”
ফলে এই ‘বিজ্ঞানে’ ভর করে গৃহশিক্ষক উঠে এলেন ঘরে। নারীমুক্তির ইতিহাসে বোধহয় অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা এটা। লোকে বলে, মেয়েদের স্বাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দান বাই-সাইকেল এবং টাইপরাইটারের। ইদানীং মোটরগাড়ি এবং টেলিফোনের। কিন্তু রসিক ঐতিহাসিকরা বলেন, কলকাতায় এই অবিস্মরণীয় ঘটনার ষোলআনা কৃতিত্ব প্রাইভেট টিউটরের বা গুপ্ত-শিক্ষকের। সাহেবপাড়া এবং বাঙালিপাড়া দু-পাড়ার মেয়েরাই তাদের মন্ত্রে শুনেছে জীবনের নতুন অর্থ। যে অর্থ স্কুল কলেজের হই-চই ভরা জীবনে নেই, নেই খুব নরম ধাঁচে লেখা হলেও ‘পোয়েটিক্যাল সিলেকশনের’ মরা পাতায়। নির্জন পড়ার ঘরে, শান্ত সন্ধ্যায়, দেড়হাত টেবিলটার ওপাশে ছাব্বিশ বছরের ব্রিলিয়ান্ট ছেলেটি আবেগমথিত অথচ টেলিপ্যাথিক কোডের মতো গলায় যখন বায়রন পড়ায়, তখনই তার অর্থ। তখন সে কবিতার স্বাদ স্বতন্ত্র। ছেলেটির দিকে তাকালে তখন মনে হবে, কোনও ইতালিয়ান রোমান্টিক, কিংবা ফরাসি বিপ্লবী। উপস্থিত যে সাধনায় সে রত, তাতে অনায়াসে শহিদ হতে পারে। একবারও কাঁদবে না, একবারও কাঁপবে না।
তবে হ্যাঁ, সাহেবপাড়ায় এসব জন মিচেলদের চেয়ে, সুন্দর সুন্দর চেহারার জোয়ান স্কেটিং টিউটররা বেশি মেয়েদের স্বাধীন করেছে বলে জনশ্রুতি। (“The skating ring emancipated them, as father could not go skating with them and there were a lot of good looking instructors. So they were able to ride away from mother and never rode back!” সেই যে সাইকেল শিখতে শিখতে মাস্টারের সঙ্গে বেরিয়ে গেল চৌরঙ্গিপাড়ার মেয়েরা, আর ফিরল না। সেই যে অংকের মাস্টারের সঙ্গে বেরিয়ে গেল বাঙালিটোলার মেয়েটি এখনও ফিরল না। আজও বছর বছর শত শত মেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ফিরছে না। তাই বলছিলাম, প্রাইভেট টিউটর মানে গৃহশিক্ষক নয়, গুপ্ত-শিক্ষক।
এবার উপসংহার। আমার ভূমিকাকার বন্ধু লিখেছেন: “গৃহশিক্ষক বাংলার অন্যতম কুটিরশিল্প।” তিনি শুধু ‘শিল্প’ বলেননি, কারণ কথাটার মধ্যে একটা ‘গৃহ’ আছে। তিনি বোধ হয় জানেন না, গৃহে গৃহে হলেও সুইজারল্যান্ডের ঘড়ি-শিল্প একটা বৃহৎ শিল্প, মাদুর বা বোতামের মতো কুটিরশিল্প নয়। আমার মনে হয়, গৃহশিক্ষকতাও তাই। এটি আমাদের দেশের, অন্তত এই কলকাতা শহরের একটি প্রধান শিল্প। অর্থাৎ ইনডাস্ট্রি। যে কোনও একদিন (রবিবার হলে তো কথাই নেই) একটা বাংলা কাগজ খুলুন, দেখবেন কলকাতা শহরের অধিকাংশ লোকই শিক্ষক। কেউ দু’বেলা আহারের পরিবর্তে ছোট ছোট ভাই বোনদের পড়াতে চান, আবার কেউ চতুর্থ বর্ষে পড়তে পড়তে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র খোঁজেন। আবার এমন বেপরোয়ারও অভাব নেই, যিনি মাসিক পঁচিশ টাকায় ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতে বা অন্য যে কোনও কাজ চান। পড়ানোটা যেন অন্য যে কোনও কাজ। যথা বাজারসরকারি, বেয়ারাগিরি, বা দোকানদারি, যা খুশি তার সঙ্গে অদল বদল করার মতোই কাজ। বস্তুত কলকাতায় সর্বশ্রেণীর বেকারদের বোধ হয় তাই ধারণা।
প্রতি বছরে গড়ে দুটি হিসেবে, দশ বছরে মোট কুড়িটি শিক্ষকের ঠেকায় পরীক্ষারূপ ভূমিকম্পে কোনওমতে টিকে রয়েছেন স্কুল ফাইন্যাল ছাত্র। নিজের অসাফল্যসূচক খবরটিকে প্রতিবারই তাঁর মনে হয় ছাপার ভুল। তিনিও পড়ুয়া খোঁজেন এ শহরে।
খোঁজাখুঁজির শেষে যে পানও, তা নিশ্চয় জানেন আপনারা। আপনার বাড়িতে ছাত্র থাকলে মাস্টারও আছে নিশ্চয়। সব বাড়িতে আছে। এ শহরে ঘরে ঘরে ছাত্র, ঘরে ঘরে শিক্ষক। গুপ্ত-শিক্ষক। এই প্রফেশনটা এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে গ্রাহ্য নয়, রেকর্ড নেই এর ইনকামট্যাক্স অফিসে, সুতরাং কত লোক এই শিল্পে নিযুক্ত, কী তাদের আয় সেটা বলতে পারব না আমি। তবে উৎপাদন, বণ্টন এবং বিলি ব্যবস্থার ব্যাপকতা দেখে অনুমান করতে পারি, এটি কলকাতার অন্যতম শিল্প। এ জি বেঙ্গল বা সিভিল সাপ্লায়ের চেয়েও বেশি শ্রমিক এখানে।
সুতরাং এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, ‘সরকার এবং জনসাধারণের উচিত এর প্রতি মনোযোগ দেওয়া।’ তবে শুনতে পাচ্ছি, সরকারি মনোযোগে গুপ্ত-শিক্ষকেরা আজ ক্ষিপ্ত। ক্রমাগত স্কুল-কলেজের নিশান নিয়ে মিছিল বার করছেন তাঁরা। দেখেশুনে মনে হয়, টিউশনি না থাকলে সভ্যতা থাকবে কি না সে বিষয়ে ওঁদের সন্দেহ। অবশ্য, নেপথ্যে রুটির সমস্যাটাও সর্বস্বীকৃত।
এককালে সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিত মশাইরাও পড়েছিলেন এমনই সমস্যায়। মেকলে যখন সংস্কৃত কলেজ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেন তখন মিছিলের এমন রেওয়াজ হয়নি। ক্ষুব্ধ পণ্ডিতমশাইরা তখন শ্লোকে প্রকাশ করেন তাঁদের ক্রোধ।
“গোল শ্রী দীর্ঘিকায়া বহু বিটপিতটে কলিকাতানগর্যাং
নিঃসঙ্গে বর্ততে সংস্কৃত পঠন গৃহাঘ্যঃ কুরঙ্গঃ কৃশঙ্গ।
হন্তুং তং ভীতচিত্তঃ বিধৃতখরসরো মেকলে-ব্যাধরাজঃ।
সাশ্রু ব্ৰতে সভো ভো উইলসন-মহাভাগ মাং রক্ষ রক্ষ॥
অর্থাৎ, ‘কলিকাতা নগরীতে গোলদীঘির বহুবিটপিশোভিত তটদেশে সংস্কৃত-পঠনগৃহ নামে একটি কুরঙ্গ নিঃসঙ্গভাবে বর্তমান রহিয়াছে। সম্প্রতি মেকলে নামক ব্যাধরাজ তীক্ষ্ণ শর ধারণ করিয়া, ভীতচিত্তে সেই কুরঙ্গকে হনন করিতে উদ্যত হইয়াছে। তাহা দেখিয়া সেই কুরঙ্গ সাশ্রু নয়নে বলিতেছে ভো ভো মহাভাগ উইলসন আমাকে রক্ষা করো, রক্ষা করো।”
পণ্ডিতমশাইরা তখন তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ টাকায় পড়াতেন। টিউশনির উপরি আয় ছিল তাঁদের অন্নাভাবের আশঙ্কা। আজকের মাস্টারমশাইদেরও আশঙ্কা তাই। স্কুল-কলেজের মাইনে তাঁদের সংসারে নিমিত্তমাত্র। আসল নির্ভর টিউশনি। সেটি যদি উঠে যায়।
ওঁদের ভাত-কাপড়ের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে ভাববার লোক অনেক আছেন। ব্যক্তিগতভাবে এঁদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি উদ্বেগহীন। কেননা, এবং জানি এঁদের সম্পর্কে ইতিহাসের রায়টিও। উইলসন সাহেব তা আমাদের শুনিয়ে গিয়েছেন। পণ্ডিতদের কাতর আহ্বানে উইলসন সংস্কৃতেই সেদিন পাঠিয়েছিলেন কলকাতার গুরুকুলের পক্ষে এই শাশ্বত বাণীটি, যার মর্মার্থ: ‘নিরন্তর বহু প্রাণীর পদাঘাতে নিষ্পিষ্ট, সূর্য কর্তৃক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সদৃশ কিরণসমূহের দ্বারা সন্তপ্ত, সতত ছাগ কর্তৃক ভক্ষিত এবং কোদাল দ্বারা পরাসৃষ্ট হইয়াও কৃশকায়া দূর্বা মরে না।’
অর্থাৎ, মাঝে মাঝে পরীক্ষার ফল দেখে গার্জেনরা বিরক্ত হবেন আপনাদের ওপর, প্রবল প্রতাপ সরকার বাহাদুর মাঝে মাঝে অগ্নিস্ফুলিঙ্গসদৃশ প্রস্তাবাদিও নেবেন আপনাদের সম্পর্কে, কখনও কখনও উত্তম স্কুল এবং স্কুলমাস্টারেরা অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের আসন গ্রাস করবেন এবং কখনও বা ছাত্রীর উত্তেজিত পিতা কোদালি হস্তে তেড়ে আসবেন আপনাদের দিকে। কিন্তু মাভৈঃ হে গুপ্ত-শিক্ষক কোনও ভয় নেই। আপনারা এ শহরের বহু আকাঙ্ক্ষিত দূর্বাদল। কলকাতার রক্তে আপনাদের জন্ম।
সিপাহি বিদ্রোহের দিনে
খুব বড় রকমের কোনও খেলা থাকলে যেমন হয়, তেমনি। অথবা, খুব বড় রকমের কোনও জনসভা। জওহরলালের মিটিং। কিংবা জ্যোতি বসুর। পিল পিল করে লোক চলেছে ময়দানের উপর দিয়ে। রাশি রাশি লোক। সব সাহেব। পুরো সাহেব, হাফ-সাহেব, বড়া সাহেব, ছোট সাহেব, মেম সাহেব, বাচ্চা সাহেব। যেখানে যত সাহেব ছিল, সব যেন ছুটছে আজ ময়দানের উপর দিয়ে। রাশি রাশি পালকি। গোরুর গাড়ি, টমটম আর ব্রাউনবেরির ভিড়। গাড়ির ব্যবস্থা যারা করতে পারেনি, পায়ে হেঁটেই চলেছে তারা। চলছে, নয়, ছুটছে। কোনও ট্রাফিক রুল নেই আজ। নেই কোনও বাঁধাধরা পথও। যার যেদিকে ইচ্ছে, যার যেদিকে সুবিধে। সবাই সমান ত্রস্ত, সকলেরই সমান তাড়াতাড়ি।
দূর থেকে দেখলে ময়দানের এই ছবিটা খুবই সুন্দর। উপভোগের, আমোদের। বিশেষ করে, একশ সওয়া শ’ বছর দূর থেকে দেখলে। কিন্তু কাছে থেকে এর চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। রীতিমতো ভয়ের, আতঙ্কের। প্রতিটি মানুষের মুখে আতঙ্কের ছায়া, উদ্বেগের চিহ্ন। ত্রস্ত পায়ে মৃত্যুভয়। জুনের আগুনে-গরমে খোলা ময়দান জুড়ে ভয়ের সে এক বীভৎস মিছিল। পম্পাই নগরীর মতো আজ যেন কলকাতার মৃত্যুদিন। কাছেই যেন আগুন উদিগরণ করছে কোনও ভিসুভিয়াস। অসহায় নরনারীর পিছনে পিছনে ক্ষুধার্ত জিহ্বা বাড়িয়ে তাড়িয়ে ফিরছে মৃত্যু। যেমন করে হোক বাঁচতে হবে এর হাত থেকে। অন্তত বাঁচবার চেষ্টা। নিজে না বাঁচি, ডরোথিকে বাঁচাতে হবে। ‘কোচম্যান, বখশিস মিলেগা, আউর জোর, আউর জোরসে—’। “আর একটুখানি চলো মাই ডিয়ার, এ ফিউ মিনিটস্ মোর।”
সাহেবের সামনেই শান্তি। আর ক’পা দূরেই ফোর্ট উইলিয়ম। পত পত করে নিশান উড়ছে তার মাথায়। ফোর্ট উইলিয়ম এখনও ইংরেজের কেল্লা। ভয়ার্ত সাহেবের অন্তরের সান্ত্বনা। ডাইনে যাচ্ছ, যাও। উপস্থিত সেখানেও শান্তি। ডাইনে ভাগীরথী। হিদেনদের ভাগীরথী আজ যেন সত্যিই হোলি মাদার। করুণাধারা। সারি সারি জাহাজ পাল তুলে দাঁড়িয়ে আছে তার কোলে। ইংরেজি জাহাজ। সারি সারি দেশি বজরা। ইংরেজের অনুগত বজরা। কলকাতার ইংরেজের আজ একমাত্র আশ্বাস এরা। এই গুটিকয় জাহাজ আর নৌকো, আর এই কেল্লা। ফোর্ট উইলিয়ম।
বাদবাকি কলকাতা আজ ইংরেজের কাছে মৃত্যুশয্যার হারকিউলিয়াম। উদ্বেগের শহর, আতঙ্কের আবাস। তার চারদিকে ঘিরে আজ ভয়। শুধু ভয় আর ভয়। ডাইনে ভয়, বাঁয়ে ভয়, পূর্বে ভয়, পশ্চিমে ভয়। রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতার মতো ধরমতলার সাহেব আজ যেদিকে ফেরে, সেইদিকেই ভয়।
কেননা, পাণ্ডেরা আসছে। মঙ্গল পাণ্ডে নয়। ওঁর তো ফাঁসি হয়ে গেছে আজ ক’মাস। ২৯ মার্চ সাহেবের বুকে রাইফেল দেগে সারা হিন্দুস্থানে আগুনের নিশানা দেখিয়েছিলেন মঙ্গল পাণ্ডে। বারাকপুরের সে ঘটনা কলকাতা জানে। কলকাতার এটাও অজানা নয় যে, এই ঔদ্ধত্যের শাস্তি হিসেবে কোর্ট মার্শাল ৮ এপ্রিল ফাঁসি-কাঠে ঝুলিয়েছে ওঁকে। মঙ্গল পাণ্ডে এখন আর জীবিত নেই। থাকতে পারেন না। এটা জুন মাস। আজ ১৪ জুন, রোববার। তবুও সকালবেলায় চার্চ ভাঙতে না ভাঙতেই শহরময় রটে গেল পাণ্ডেরা আসছে। বারাকপুর থেকে মঙ্গল পাণ্ডের সঙ্গীরা। সিপাহিরা। সুতরাং দে ছুট।
উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল কলকাতা। কেউ কেল্লার দিকে, কেউ গঙ্গার দিকে। ছুটতে ছুটতে তারা সিপাহিদের বাপান্ত করে যত, তার চেয়ে বেশি শাপান্ত করে কলকাতার সরকারকে। ক্যানিং-হ্যালিডের গভর্নমেন্টকে। কেননা, কলকাতার অধিকাংশ মানুষের মতে আজকের এই বিপর্যয়ের জন্যে দায়ী তাঁরাই। কারণ, দেখেও তাঁরা দেখেননি কোনও দিন। দিনের পর দিন সিংহাসনে বসে চোখ মেলে ঘুমিয়েছেন তাঁরা।
কলকাতার সাহেবদের তখন দুটো মন। একটা সরকারি মন, অন্যটা বে-সরকারি। প্রথমটি স্বভাবতই ক্ষমতায় বড় হলেও দলে ছোট, দ্বিতীয়টি অক্ষম হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ। দুই দলের দু’রকম ধারণা, দু’রকম চালচলন। ফেব্রুয়ারির শেষদিকে বহরমপুরে সিপাহিরা যখন নয়া কার্তুজ ব্যবহারে গররাজি হল, সরকার তখন তাদের মার্চ করিয়ে নিয়ে এলেন বারাকপুরে। এনে, অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হল ওদের। ব্যস, এখানেই শেষ হয়ে গেল সরকারি কর্তব্য। কর্তৃপক্ষের এই ভুল শুধরে দেওয়ার জন্যেই যেন মার্চে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন মঙ্গল পাণ্ডে। কিন্তু তবুও ঘুম ভাঙল না তাঁদের। অবশ্য পাণ্ডেকে ওরা ফাঁসি দিলেন, বারাকপুরের উপর খবরদারি করার জন্যে বর্মা থেকে নিয়ে এলেন ৮৪ নং ইউরোপিয়ান রেজিমেন্টটিকেও। কিন্তু ব্যবস্থা হিসেবে এটুকুই কি যথেষ্ট?
তা যে নয়, সে খবর পাওয়া গেল মে-র প্রথম দিকেই। ৩ মে লখনউ, ১০ মে মিরাট, ১১ মে দিল্লি। দেখতে দেখতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল গোটা উত্তর ভারতে। তবুও ২০ মে ক্যানিং সাহেব কলকাতা থেকে চিঠি লিখলেন দেশে: বাজারে অবশ্য গুজব এই যে, আমি নাকি হুকুম দিয়েছি, শহরের সব পুকুরে নিষিদ্ধ মাংস ফেলবার জন্যে। লোকেরা এও বলাবলি করছে যে, ইংলন্ডেশ্বরীর জন্মদিনে আমার হুকুমে কলকাতার সব খাবারের দোকান নাকি বন্ধ থাকবে। বলা বাহুল্য, এগুলো গুজব মাত্র, সুতরাং চিন্তার কোনও কারণ নেই।
২৪শে ধুমধাম করে রাজভবনে কুইন ভিক্টোরিয়ার জন্মদিন পালিত হল। সেদিন ছিল মুসলমানদের ইদ। তদুপরি মহীশূরের এক নবাবজাদার শাদির দিন। ফলে কলকাতার মানসিক পরিস্থিতি যে সে রাত্তিরে খুব সুস্থ ছিল, এমন বলা চলে না। বে-সরকারি রিপোর্ট বলে, আধাবয়েসী বাবা যখন রাজভবনে নাচে মত্ত, তখন তার দুটি সোমত্ত মেয়ে বাড়ি বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাঁদছে, এমন নাচ এবং ভোজটা হাতছাড়া হয়ে গেল বলে নয়, বাবা ফিরবার আগে যদি পাণ্ডেদের হাতে পড়তে হয়, সেই ভয়ে।
এক মহিলা নাকি সে ভয়েই অনেক বলে কয়ে দু’জন গোরা সৈনিককে রাত্তিরের জন্য পাহারায় বসিয়েছিলেন নিজের ঘরে। অবশ্য রাত্রিবেলা তিনি নাকি বিলক্ষণ বুঝেছিলেন যে, মনের পাণ্ডেরা যত ভয়ের, তার চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্কের চোখের সামনে বসা দুই দুইজন গোরা। বিশেষ করে, বাড়িটা যখন ফাঁকা এবং সৈন্য দুজন যেখানে অপরিচিত। তার উপর রাত দুটোয় যখন বাদ্য আর আকাশ-ফাটানো পটকা, তখন বাধ্য হয়েই ঠকঠক করে কাঁপতে হল গোটা কলকাতাকে।
তবুও পরের দিন রাজ-সরকারের সেক্রেটারি বিডন সাহেব লিখলেন, রাজধানী কলকাতার ছশো মাইলের মধ্যে গোলমাল কিছু নেই, সব শান্ত।
কলকাতার কাগজগুলো পড়লেও তাই মনে হবে যে কোনও বাইরের লোকের। গোটা উত্তর ভারতে ইংরেজ-রাজত্ব যখন জ্বলছে, কলকাতার ইংরেজি কাগজ তখন রেস কোর্স নিয়ে চিন্তিত। অনেকদিন ঠিকমতো জল দেওয়া হচ্ছে না মাঠটায়। কেন এমন হবে? মিউটিনি? যা ব্যবহার করছ তোমরা নেটিভ সৈন্যদের সঙ্গে, তা বিদ্রোহ করবে না তো কী? সবাইকে একই প্রার্থনা আওড়াতে হবে শুনলে ক্রমওয়েলের অনুগত সৈন্যরাও বিদ্রোহ করত নিশ্চয়। এমনি সব যুক্তি তাদের। সুতরাং, কাগজে তখন মিউটিনি সাধারণ ব্যাপার। তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি ডাক পালকি, শৌখিন থিয়েটার এবং এটিকেট কলম।
এদিকে মিউটিনি তখন দিল্লি পুড়িয়ে কানপুর ইলাহাবাদে এসে পৌঁছে গেছে। অথচ বারাকপুরে তখনও সাড়ে তিনটি নেটিভ রেজিমেন্ট, বার্মার সেই ৮৪ নং বাহিনী চলে গেছে আপ-কানট্রির দিকে। বারাকপুরের নেটিভ বাহিনী শাসনের নামে আছে ৩৫ নং ইউরোপিয়ান বাহিনীর সামান্য একটা টুকরো। সিংহল থেকে ক্যাপ্টেন মাণ্ডের ৫৩ নং পদাতিক বাহিনীটি ফোর্ট উইলিয়মে এসে পৌঁছেছে বটে, কিন্তু এ কেল্লাটিও তো একেবারে নেটিভশূন্য নয়। এখানেও রয়েছে আস্ত একটি নেটিভ রেজিমেন্ট। যদি এরা খেপে ওঠে? চিনসুরা থেকে হাইল্যান্ডারদের আনবে? কলকাতার সিবিলিয়ান সাহেব মনে মনে ভেবে দেখে স্ট্রাটেজিটা। চিনসুরা কলকাতা থেকে পঁচিশ মাইল, আর বারাকপুর মাত্র চোদ্দ মাইল।
সুতরাং ভয়ের কারণ আছে বইকি। তা ছাড়া, আরও ভাববার বিষয় আছে। শুধু সাধারণ ইংরেজ নয়, জন পিটার গ্রান্ট বাংলাদেশের সহকারী গভর্নর। তিনিও শঙ্কিত হয়ে উঠলেন তা ভেবে। ফোর্ট উইলিয়ম এবং বারাকপুরের হিসেব না হয় হল। কিন্তু গার্ডেনরিচে যে অযোধ্যার নবাবের হাজার হাজার ভূতপূর্ব সৈন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের ধরতে হবে না হিসেবে? দুই পক্ষের সত্যিকারের সামরিক শক্তির হিসেব নিতে গেলে ধরা উচিত, দমদমে সিন্ধিয়া, আর আমিরদের যে অগণিত চেলাচামুণ্ডা রয়েছে তাদেরও। তদুপরি মনে রাখতে হবে ছয় লাখ লোকের এই শহরটির অধিকাংশ মানুষই নেটিভ, ব্ল্যাকগার্ড। এবং এটাও মনে রাখা উচিত আমাদের যে, সত্যিকারের বিপদ যদি ঘটেই কিছু, তবে সে সময়ে নেটিভ-পুলিশের সাহায্য কিছু মিলবে না।
সাধারণভাবে এই যখন মনের অবস্থা, এমন সময় এল ১৪ জুনের খবর। পাণ্ডেরা খেপেছে। বারাকপুর থেকে সোজা মার্চ করে আসছে তারা কলকাতার দিকে। এদিকে গার্ডেনরিচেও নাকি শুরু হয়ে গেছে লুঠতরাজ। সুতরাং, কলকাতার এত দিনের মনের ভয় আজ ফুটে বের হল গা দিয়ে।
সরকারি কর্তারা অবশ্য ছুটলেন না। কিন্তু ভয় যে তাঁদেরও ছাড়েনি সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। সেক্রেটারিরা তখন কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে আপিস করেন। কাউন্সিলের মেম্বাররাও যেন এক একজন ভয়ের বিজ্ঞাপন। তাঁদের দরজায় দরজায় ব্যারিকেড, কোমরে পিস্তল। এবং বিছানা ছেড়ে তাঁরা নাকি তখন সোফায় ঘুমান। এমনকী হ্যালিডেদের সাহেব পর্যন্ত তখন আর বেলভেডিয়ারে থাকেন না। ক্যানিং-এর কাছাকাছি থাকবার জন্যে তিনি উঠে এসেছেন কলকাতায়। সুতরাং সাধারণ মানুষের আর দোষ কী?
তারা ছুটতে লাগল। এন্টালি, পার্কসার্কাস, খিদিরপুর, মেটেবুরুজ খালি করে গড়ের মাঠের দিকে। যারা অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন ব্যবসায়ী কিংবা হোটেলবাসী, তারাও অস্থির হয়ে উঠল। সদ্যপ্রতিষ্ঠিত প্রেসিডেন্সি কলেজের এক ইতিহাসের অধ্যাপক স্বয়ং পড়লেন ইতিহাসের একটা ওলট-পালট অধ্যায়ে। ক’মাস মাত্র আগে কলকাতায় এসেছেন ভদ্রলোক। থাকেন সস্ত্রীক হোটেলে। ইতিমধ্যেই খিদদতগারের মুখে রিপোর্ট শুনে একখানা পিস্তল কেনা হয়ে গেছে তাঁর। চোদ্দই রোববার এক বন্ধু এসে বললেন, “এখানে আর থাকা ঠিক নয়। চলো আমার সঙ্গে নদীতে। কোনও জাহাজে থাকবে। আমি ফ্যামিলি নিয়ে আপাতত সেখানেই চলেছি।”
ভদ্রলোক গেলেন না। কেননা, হোটেলে বসেই শোনা গেল, খবরটা গুজব মাত্র। বারাকপুরের সিপাইরা মতলব এঁটেছিল ঠিকই, কিন্তু তা ফাঁস হয়ে গেছে গতকালই। অর্থাৎ শনিবার। বিকেল চারটের খবরটা এসে পৌঁছল সরকারের কানে। তাঁরা পায়ের নীচে ঘাস গজাতে দেবেন কেন? সঙ্গে সঙ্গেই চিনসুরা থেকে হাইল্যান্ডারদের তাঁরা গাড়ি করে পাঠিয়ে দিলেন বারাকপুরে। অধ্যাপক বুঝলেন এজন্যেই কাল কলেজে যাওয়ার জন্যে কোনও গাড়ি পাননি তিনি। যা হোক, হাইল্যান্ডাররা এসে যথাসময়ে অস্ত্র কেড়ে নিল নেটিভদের। সুতরাং বিদ্রোহ আর হল না। যদি তা না করা হত তবে অবশ্য হত। এবং হত আজই।
অধ্যাপক খবরটা শুনে গুজবকে বিদেয় দিলেন। কিন্তু সে যত তাড়াতাড়ি ছড়ায়, তত তাড়াতাড়ি মিলিয়ে যায় না। ফলে, কলকাতার অস্থিরতা কাটল না একটুও। গড়ের মাঠের উপর দিয়ে সেই পলায়মান জনতায় তখন পুরোপুরি ভরে গেছে কেল্লা এবং নদীর সব নৌকো জাহাজ। ভরে উপচে গেছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী লিখেছেন, ফোর্ট উইলিয়মের ভিতরে এমন কোনও ফাঁকা জায়গা নেই, যেখানে আর দুটো মানুষ ধরে। যাঁরা ভেতরে জায়গা পেলেন না, তাঁরা র্যামপার্টে আস্তানা গাড়লেন। কেল্লার উঠোনটাও আজ নিরাপদ।
এদিকে শহরেও পুরোদমে চলেছে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি। শনিবার রাত্তিরে ভল্যানটিয়ার বাহিনী তৈরি হয়েছিল একটা। প্রসঙ্গত তাদের পাঁয়তারার কাহিনীটি উল্লেখযোগ্য এখানে। বিপদভজন ভল্যানটিয়াররা আজ এ শহরের একটা সনাতন সম্প্রদায়। এদের জন্ম সেই সিরাজউদ্দৌলার কলকাতা আক্রমণের সময়ে। যাঁর হাতে প্রথম এঁরা অবয়ব পেয়েছিলেন, তিনি আমাদের ডেকার্স লেনের ফিলিপ মিলনার ডেকার্স। কিছুদিন কলকাতার কালেকটার ছিলেন তিনি। তবে তার চেয়েও তাঁর বড় পরিচয় অন্য কারণে। ডেকার্স লেনে অনেক জমিজমা ছিল ভদ্রলোকের। ১৭৮৪ সালে দেশে চলে যাওয়ার সময়ে একটি অদ্ভুত শর্তে তিনি দান করে যান একজন নেটিভকে। ডেকার্স সাহেবের সেই শর্তটি আজও শোনবার মতো। বাংলা করে বললে তার মানে দাঁড়ায়: আমি পাঁচশো বছরের জন্যে আমার যাবতীয় ভূসম্পত্তি মিঃ অমুককে দিয়ে যাচ্ছি। তবে এক শর্তে। যদি কেউ দাবি করে তবে প্রতি বছর সেন্ট মাইকেলের ভোজোৎসবের দিন তাকে অবশ্যই একটি পিপুল (Pepper Corn) দিতে হবে!
ডেকার্স সাহেবের ভল্যানটিয়াররা আবার এসে দেখা দিলেন কলকাতায়। রবিবার সকাল থেকেই শুরু হল তাদের হুড়োহুড়ি দৌড়াদৌড়ি। হোটেলে দাঁড় হলেন পঞ্চাশজন। বিপদকালে এ বাড়িটা রিফিউজিদের আস্তানা হবে। হ্যামিলটনের বাড়িতেও জোর প্রস্তুতি, ওদের বোধ হয় ভল্যানটিয়ারদের উপর তেমন আস্থা ছিল না। তাই পাণ্ডে-নাশের জন্যে গামলা গামলা সিসা গালিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করলেন তাঁরা। আর গরম জল। বিক্রির জন্যে দুটো পুরনো কামান ছিল, সে দুটোতে বারুদ ভরে রাখা হল। মাঝে মাঝেই সাহসী সাহেবেবা ছাদে ওঠেন। শত্রুরা এসেছে কিনা সন্ধান নেন। কিন্তু পাণ্ডেরা আর আসে না। বেলা তখন সাড়ে চারটে, আবার হই-চই। বিদ্যুতের মতো আবার একটা আতঙ্কের শিহরন খেলে গেল কলকাতার ‘হাড়’ কাঁপিয়ে। নিশ্চয়ই কোথাও কিছু ঘটেছে। নয়তো এ সময়ে গোরা সৈন্যেরা কেল্লা থেকে এমন দল বেঁধে বেরিয়ে আসছে কেন?
সৈন্যরা কিন্তু মার্চ করতে করতে এসে থেমে পড়ল রাজভবনের সামনে। ওয়েলেসলি প্লেসে। ধীরে ধীরে তারা এগিয়ে গেল ক্যানিং বাহাদুরের গার্ডদের ছোট আবাসটির কাছে। তাদের সামনে এসে দাঁড়াল গভরনর জেনারেলের অফিসিয়াল গার্ড। হিন্দুস্থানি সৈন্যরা সামরিক কায়দায় হাতের রাইফেল নামিয়ে রাখল মাটিতে। তারপর ব্যাক মার্চ করে আবার ঢুকে গেল নিজেদের খুপরিতে। গোরা সৈন্যরা সেসব অস্ত্র গাড়ি-বোঝাই করে আবার ফিরে গেল কেল্লায়।
ঘটনা দেখে কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত হল কলকাতা। কিন্তু তবুও ভয় কাটল না তার। কারণ এখন প্রায় সন্ধ্যা। এবং সামনেই অনিশ্চিত অজ্ঞাত রাত। মাঝরাত্তির অবধি ভল্যানটিয়াররা দুই দলে ভাগ হয়ে টহল দিয়ে বেড়াল গোটা শহর। একদল চৌরঙ্গিপাড়ায়, অন্যদল নেটিভপাড়ায়। তবুও সে রাত্তিরে ঘুমাল না কেউ। ঘুমায় তার সাধ্য কী। চোখটা একটু লেগে আসছে কি না আসছে, অমনি দড়াম দড়াম আওয়াজ। রাতভর বেপরোয়া ফাঁকা আওয়াজ চালাতে লাগল শহরতলির অসহায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা। আর চলল অবলবান্ধব পটকা। অসামরিক, অসামাজিক ইউরোপিয়ানদের আজ পটকাই একমাত্র অবলম্বন। রক্ষক।
কর্নেল মেলসন নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী সে রাত্তিরের কলকাতার অবস্থা বর্ণনা করে লিখেছেন—“আধ ডজন মানুষ আজ ইচ্ছে করলেই কলকাতার বারো আনা পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে। এবং গোটা কয় লন্ডনের চোর যদি আজ থাকত এখানে, তবে চৌরঙ্গির আশপাশ থেকেই বিস্তর কামাতে পারত তারা।”
কিন্তু আমাদের সৌভাগ্যবশতই হোক আর দুর্ভাগ্যবশতই হোক, কলকাতায় তখন সব ভদ্রলোক। কী আগুনে-মানুষ হরিশ মুখার্জি, কী ঈশ্বর গুপ্ত সবাই। গুপ্তমশাই তখন কলকাতার শ্লোগান দিচ্ছেন—
“ভারতের প্রিয়পুত্র হিন্দুসমুদয়
মুক্ত মুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়।”
সুতরাং হুতোম জানাচ্ছেন—“বাঙালিরা বেগতিক দেখে গোপাল মল্লিকের বাড়িতে সভা করে সাহেবদের বুঝিয়ে দিলেন যে, যদিও একশো বছর হয়ে গেল, তবুও তাঁরা আজও সেই হতভাগা ম্যাড়া বাঙালিই আছেন। বহুদিন ব্রিটিশ সহবাসে, ব্রিটিশ শিক্ষায় ও ব্যবহারেও আমেরিকানদের মতো হতে পারেননি।”
ফলে যদিও “তারকেশ্বরের মোহন্তের রক্ষিতা, কাশীর বিশ্বেশ্বরের পাণ্ডার স্ত্রী ও কালীঘাটের বড় হালদারের বাড়ির গিন্নিরা স্বপ্ন দেখেচেন ইংরেজের রাজত্ব থাকবে না (এবং যদিও) দুই একজন ভট্চায্যি ভবিষ্যৎ পুরাণ খুলে তারই নজির দেখালেন” তবুও ১৪ জুন রোববার রাত্তির যখন ভোর হল, তখন দেখা গেল কলকাতার ইংরেজ-রাজধানী ইংরেজের হাতেই আছে। পাণ্ডেরা আসেনি। সত্যিই শনিবার নিরস্ত্র করা হয়েছে তাদের। গার্ডেনরিচেও লুঠতরাজ হয়নি কোনও। বরং অযোধ্যার ভূতপূর্ব নবাব এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রী এখন কারাগারে। সুতরাং টাউন মেজরের অনুরোধ মেনে এবার ঘরে ফেরাই ঠিক।
আবার ফোর্ট উইলিয়ম খালি করে দলে দলে লোক চলল বাড়ির দিকে। আবার রবিবার সকালের সেই বিচিত্র মিছিল। যেন খুব বড়রকমের কোনও খেলা ভেঙেছে। কিংবা মস্ত কোনও জনসভা।
কলকাতার ইংরেজ এখন সত্যিই যাকে বলে—বিজয়ী বীর। খবরের কাগজ খুলুন, দেখবেন তার ভাষা এখন বীরের ভাষা। সেই থিয়েট্রিক্যাল সমাচার আর এখন নেই সেখানে। তার বদলে প্রতিদিন পোয়েট কর্নারে বের হচ্ছে রাশি রাশি পদ্য। সেই কবিতার আগের লাইনে যদি থাকে ‘Wife and Daughter,’ তবে পরের ছত্রে তার মিল দেন কবি যে শব্দটি দিয়ে, তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে যায়—slaughter: প্রতিশোধ চাই। একটি নেটিভকেও যেন আস্ত রাখা না হয় আর। ক্যানিং বাধা দেবেন, সে তো জানা কথাই। এই মুহূর্তে ফিরিয়ে নেওয়া হোক তাঁকে।—‘উই ওয়ান্ট রিকল।’ আমরা লাটের মতো লাট চাই, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কবির প্রার্থনা:
“Baring humanity pretenders
To hell of none are we the willing senders.
But, if to Sepoys entrance must be given,
Locate them, lord, in the black-slums of Heaven.”
তা ঈশ্বরের বিচার না হয় তাঁর উপরই ছেড়ে দেওয়া হল। কিন্তু, উপস্থিত আমাদের বিচারটা চলুক তো। রানিগঞ্জ থেকে এক ভদ্রলোক খবরের কাগজে চিঠি দিয়ে জানালেন, তিনি একাজে কলকাতার সাহেবদের সাহায্য করতে প্রস্তুত। অনেক মাথা খাটিয়ে তিনি একটি দেখবার মতো ফাঁসি-কাঠ তৈরি করেছেন। তাতে একসঙ্গে যোলজন প্রমাণ সাইজের নেটিভকে একসঙ্গে ফাঁসি দেওয়া যাবে। অথচ মজা এই, তাতে কারও কোনও অসুবিধা হবে না।
ঠিক এতখানিতে অবশ্য রাজি হল না কলকাতা। তার প্রথম বিচারে, “ডাকঘরের কতকগুলি ন্যাড়ে প্যায়াদার অন্ন গেল।” এবং অযোধ্যা রোহিলাখণ্ডের ওয়াশিল চলল কলকাতার পথে পথে। গোরা সৈন্যরা পশ্চিমা কোচম্যান, সহিস, পালকি-বেহারা যাকে যেখানে পায়, তার উপরেই বীরত্ব ফলায়। একটা ছোকরা সদ্য এসেছে বিলেত থেকে নতুন রিক্রুট হয়ে। তার জবানবন্দি শুনুন
একদিন আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় সহসা দেখি দুটি হিন্দুস্থানি গাড়োয়ান গল্প করতে করতে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। ওরা কথা বলছিল মুর ভাষায়। হঠাৎ ‘কানপুর’ কথাটা কানে এল আমার। সুতরাং আর বুঝতে বাকি রইল না ওরা কী বলতে চায়। অগত্যা বাধ্য হয়েই ছুটে গিয়ে টমকে নিয়ে আসতে হল। টমও শুনল ওরা মধ্যে মধ্যে ‘কানপুর’ বলছে। সুতরাং আর যায় কোথা। দু’ ব্যাটাকেই দিলাম সাবাড় করে।
যাদের এভাবে হাতের কাছে পাওয়া গেল না, তাদেরই কি ছাড় আছে? ক্যালকাটা ক্লাবের দেওয়ালে পোড়া-কয়লায় লিখিত হল তাদের সম্পর্কে কলকাতার রায়। বিরাট প্রাচীরচিত্র কাঠকয়লার ম্যুরেল। নানাসাহেব উপুড় হয়ে পড়ে আছেন মাটিতে, আর একগাদা সাহেব কথ্য অকথ্য নানা প্রক্রিয়ায় শাস্তি দিচ্ছে তাঁকে।
থ্যাকার স্পিঙ্ক-এর পিকচার গ্যালারিটির দিকে তাকানো যায় না। প্রত্যেকটি জেনারেল-এর চক্ষু রক্তবর্ণ। ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে ক্যাপ্টেন হেজলউডকে। যেন চোখের আগুনে হিন্দুস্থানকে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবেন তিনি।
আশ্চর্য এই, কলকাতা তবুও ছাই হল না।
রুশ কর্তৃক কলকাতা আক্রমণ
১৮৯২ সালের ২৮ জুন। সেদিন রবিবার। ছুটির দিন। সুতরাং চৌরঙ্গিপাড়ায় ভোর একটু দেরিতেই হওয়ার কথা। বেলা তখন প্রায় আটটা। বিছানা ছেড়ে মিঃ টমকিন দোতলার বারান্দায় এসে বসেছেন। ৮টা খুব বেলা নয়। কিন্তু জুনের সকাল। মিঃ টমকিনের মনে হয় এই খোলা বারান্দাটাও যেন একটা কিচেন। মনে মনে কলকাতাকে বাপান্ত করে বাইরের দিকে তাকালেন তিনি। এমনভাবে তাকালেন, যেন সত্যিই গরম পড়েছে কিনা খুঁজে বের করাই তাঁর চোখ দুটোর উদ্দেশ্য। সামনেই ময়দান। ময়দানের ওপারে ফোর্ট উইলিয়মের ওপরে নোংরা একখানা রুমালের মতো গুটিয়ে আছে একটুকরো ইউনিয়ন জ্যাক। থেকে থেকে একটু কাঁপছে নিশানটা। যেন লেজ নাড়ছে ঘুমন্ত ব্রিটিশ সিংহ। মনে মনে ভীষণ চটে গেলেন ক্লাইভ স্ট্রিটের ব্যবসায়ী মিঃ টমকিন। একখানা বড়, প্রমাণ সাইজের ফ্ল্যাগও জোটাতে পারে না ওরা। বিরক্ত টমকিন ডাইনে সরিয়ে নিলেন তাঁর দৃষ্টি। এদিকেও একই অবস্থা। গভর্নর হাউসের পতাকাদণ্ডটি সম্পূর্ণ নগ্ন। একটা চিল বসে আছে তার ওপর। উঃ অসহ্য! অসহ্য গুমোটে যেন দম বন্ধ হয়ে হয়ে আসছে মিঃ টমকিনের। শরীরটাকে চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে তিনি চুরুট ধরালেন একটা। এমন সময় সহসা মিঃ জোনস এসে হাজির।
“গুড মর্নিং। টেক ইওর সিট জোনস।” টমকিন পাশের চেয়ারটা ঠেলে দিলেন জোনস-এর দিকে। জোনস শুধু প্রতিবেশী নয়, বন্ধু। দু’জনের এক অফিস, এক কারবার। অফিসটাইম অবধি রোজ সকালে দু’জনে আড্ডা দেন এখানে বসে। আড্ডাটা আরম্ভ হয় সাধারণত দিনের কাগজখানা নিয়ে। শেষ হয় রাতের গ্রোগ্রামে। মিঃ টমকিন এবং জোনস দুজনেই অবিবাহিত কিংবা বিপত্নীক, অথবা দুজনেরই স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা দেশে থাকে। মোট কথা, উপস্থিত তাঁরা একা, সিংগল।
“এনি নিউজ জোনস?” চুরুটে একটা টান দিয়ে রবিবার দিনটা আরম্ভ করলেন মিঃ টমকিন।
“নো। নেভার ইজ এনি নিউজ দেয়ার ওয়ার্থ এ কোউরি।” ঠোঁট উলটে উত্তর দিলেন মিঃ জোনস। “সেই সিমলার ‘গাপ’, সেই একস্চেঞ্জ মন্দা, আর সেই পুরানো কক অ্যান্ড বুল স্টোরি রাশিয়ানরা আসছে। দিজ পিপল, আই মিন, আওয়ার নিউজপেপারমেন” কথাটা শেষ করতে পারলেন না মিঃ জোনস। হঠাৎ ‘দুডুম দাড়াম,’ বাজি ফাটানোর আওয়াজে ছেদ পড়ল তাঁর বক্তব্যে।
পর পর আরও ক’বার দুডুম দাড়াম। একসঙ্গে চারটে কান পাতলেন দুজনে। হ্যাঁ, আওয়াজটা দক্ষিণ দিক থেকেই আসছে বটে।
“কিন্তু আজ তো গির্জের দিন। তবে এ কীসের আওয়াজ জোনস?” মিঃ টমকিন একটু চিন্তিতভাবেই জিজ্ঞেস করলেন।
জোনস উত্তর দিলেন; “আলিপুরে বুড়ো কর্নেল বোধহয় এই গরমে ছোড়াদের হাত পাকাচ্ছে। কে জানে ভলান্টিয়ারদের কীর্তিও হতে পারে।”
“বাট দিস ইজ নট ভলান্টিয়ার্স সিজন।” কই, এ সময়ে তো চাঁদা নেয় না ওরা। মিঃ টমকিনের মনে আজ এক অজানা শঙ্কা। কেন যেন ভোর থেকেই আজ মেজাজটা ভাল যাচ্ছে না ওঁর।
এমন সময় সহসা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ কানে এল। মিঃ টমকিন ব্যবসায়ী হলেও সিক্কা টাকার চেয়ে ভাল চেনেন এ আওয়াজটা। তিনি লাফিয়ে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে মিঃ জোনসও।
ওঁদের দরজার সামনে দিয়েই তিনজন ঘোড়সওয়ার চলেছে। তাদের একজন আহত। লাল ইউনিফর্মটা আরও লালে ভেজা।
“আরে, এ তো দেখছি আমাদের উইলকিনস। লাইটহর্সের সেই ছোঁড়াটা।” জোনস ছুটে নেমে এলেন নীচে। পিছনে পিছনে এলেন টমকিনও।
উইলকিনসের শিথিল হাত ততক্ষণে আলগা হয়ে ঝুলে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দেহটাও। দুজনে ধরে ঘোড়ার পিঠ থেকে তাকে নামাতে নামাতে মিঃ জোনস আর টমকিন শুনলেন সে বিড় বিড় করছে, “এনিমি ট্রুপস- রুশি রুশি।”
পরের দিন। আজ সোমবার। রবিবারের ছুটি কাটিয়ে, কলকাতার আজ কাজে লাগবার কথা। কিন্তু শহরের মুখের দিকে তাকানো যায় না আজ। কোথায় চৌরঙ্গির মিঃ টমকিন, কোথায় তাঁর বন্ধু মিঃ জোনস। কলকাতা আজ শ্মশান। চারদিকে ভাঙা দালান-কোঠা, ঘর বাড়ি। এতকাল লোকে কলকাতার রাস্তায় কুকুরটা কি গরুটা মরে পচতে দেখেছে। কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় এমন মরা মানুষের ভিড় দেখেনি কেউ। না ছাপ্পান্নর সিরাজউদ্দৌলার আক্রমণের সময়, না ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে। জুনের গরমে অলিতে গলিতে পড়ে পচছে সাদা কালো মানুষের শব। শকুনেরা পর্যন্ত নামতে সাহস পাচ্ছে না মাটিতে। কালো-মুখো কামান নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে অদ্ভুত অদ্ভুত চেহারার সৈন্য। ইয়া উঁচু উঁচু কঠোর কর্কশ তাদের চেহারা। মুখে এক মাপের লম্বা দাড়ি, কোমরে এক মাপের লম্বা তলোয়ার, গায়ে মোটা কাপড়ের ধূসর কোট।
তাদের ভারী বুটের আওয়াজে ঠক ঠক করে কাঁপছে কলকাতার বনেদি হোটেল, গ্রেট ইস্টার্ন। পাথর-বাঁধানো মেঝেটা যেন ফেটে পড়বে ওদের পায়ের চাপে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই, কী চায় ওরা, কী পেলে ঠাণ্ডা হয়ে বসবে চেয়ারে, সেটা বুঝতে পারছে না কেউ। কী হোটেলের সেক্রেটারি, কী খিদমদগার কেউ বুঝতে পারছে না ওদের বুলি। অবশ্য বোঝানোর জন্য চেষ্টায় ত্রুটি নেই ওদের। প্রত্যেকটি কথার সঙ্গে চলেছে কিল চড় লাথি ঘুষি। মুখের কথার সঙ্গে হাত পায়ের টীকা ভাষ্য। তবুও একবিন্দু বুঝতে পারছে না কেউ।
এসব কথার আসল অর্থ ঝুলছে তখন ফোর্ট উইলিয়মের মাথায়। মিঃ টমকিন বেঁচে থাকলে দেখতে পেতেন, কালকের সেই রুমালখানার জায়গায় পত পত করে উড়ছে এখন ডবল-বেড মাপের একখানা সাদা নিশান। তার মাঝে সেন্ট অ্যান্ড্রুর ক্রস আঁকা। গভর্নমেন্ট হাউসের সেই চিলটাও পালিয়ে গিয়েছে গঙ্গার ওপারে। ন্যাড়া পতাকাদণ্ডটার মাথায় একখানা নতুন নিশান। সাদা সিল্কের উপর সেন্ট অ্যান্ড্রুর ক্রস। নেটিভদের কাছে অপরিচিত হলেও সাহেবদের চিনতে কষ্ট হল না এই জয়ধ্বজাটি কাদের।
অবিশ্বাসী চোখ দুটোকে রগড়াতে রগড়াতেও যখন এই ফ্ল্যাগটাকে কিছুতেই সরানো গেল না গভর্নমেন্ট হাউসের উপর থেকে, সাহেবরা তখন বুঝতে পারলেন, তাদের কলকাতা এখন রাশিয়ার পদানত। রুশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ-শহরে। নেটিভদের মতো তারাও এখন রুশ-প্রজা।
এত বড় কেল্লা সমেত ইংরেজের এই শহরটাকে রাশিয়ানরা রাতারাতি দখল করে নিল কী করে, সেটা সঠিকভাবে বুঝতে হলে যুদ্ধবিদ্যা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জ্ঞান থাকা চাই। এবং সেই সঙ্গে চাই ডিপ্লোম্যাসি তথা কূটনীতি তথা জাতিচরিত্র সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা।
১৮৯৯ সালের কথা। সেদিন ১৫ অক্টোবর। মহামান্য রুশসম্রাট সহসা যুবরাজ য়ুরনঝভকে তলব করলেন তার ‘জারকো সেলো’ প্রাসাদে। যথাসময়ে যুবরাজ এসে অভিবাদন করলেন: “সম্রাট আমাকে তলব করেছেন?”
সম্রাট কোনও কথা বললেন না। তিনি চাবি-দেওয়া একখানা পিতলের চোঙ বাড়িয়ে দিলেন যুবরাজের দিকে, যুবরাজ নতজানু হয়ে হাত পেতে নিলেন সেটি।
গালে হাত দিয়ে জার তাঁর স্বভাবজ গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন, “য়ুরনঝভ, অত্র তোমাকে পূর্বদেশে ইংরেজদের রাজধানী কলিকাতা নগরী আক্রমণের নির্দেশ দেওয়া হল। কীভাবে তুমি এই নির্দেশ পালন করবে, তা এই কৌটোমধ্যস্থ পরিকল্পনাপাঠে জানতে পারবে। আপাতত তুমি আমুর নদীর নিম্নাঞ্চলে খাবারোভস্কার দিকে যাত্রা করো। সেখানে গর্ভনর জেনারেল খ্রফ তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁর কাছে তুমি এর চাবি পাবে।”
যুবরাজ সম্রাটকে অভিবাদন করে বিদায় নিলেন। তিনি জানতেন, সম্রাট বর্তমানে ইংরেজদের সঙ্গে প্রকাশ্যে শান্তি আলোচনা চালাচ্ছেন। কিন্তু তবুও তিনি এই গোপন অভিযান নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুললেন না। কারণ জারের ডিপ্লোম্যাসি তাঁর জানা। তিনি জানেন, শত্রুকে ধ্বংস করতে হলে সবচেয়ে সুন্দর পথ তার মনে নিশ্চিন্তির ভাব জাগিয়ে তোলা।
যা হোক, সেই রাত্তিরেই য়ুরনঝভের বাড়িতে এসে হাজির কাউন্ট ডিমিট্রি তলস্তয়। লেখক তলস্তয় নন, তাঁর জনৈক আত্মীয়। ইনি রাশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং গুপ্ত পুলিশবাহিনীর কর্তা। তিনি যুবরাজকে তিনজন লোক দিলেন। তাঁদের নাম মিঃ, এ. মিঃ বি. এবং মিঃ জেড। তলস্তয় বললেন, “বহু কষ্টে তোমার কাজের সুবিধার জন্যে এদের জোগাড় করেছি আমি। বেঙ্গলে ওরা পথপ্রদর্শকের কাজ করবে। সবচেয়ে ভাল কাজ হবে তোমার মিঃ জেডকে দিয়ে। সে নিজে বেঙ্গলের লোক। অবশ্য তিনজনের মধ্যে ওকেই পাওয়া গেছে সবচেয়ে কম দামে। বাকি দুজনের একজন খাস ইংরেজ। ন্যাচারেলি কস্টলি। অন্যজন ফিরিঙ্গি। তবে কমবেশি সবাই রুশি জানে। মিঃ জেডের তো আমাদের ডায়ালেক্ট গড় গড় মুখস্থ। কী বল জেড ভাই?”
জেড বাঙালি কায়দায় একগাল হাসলেন। কৃতার্থতার হাসি।
পরদিন ভোরে এই তিন সহকারীকে নিয়ে সেন্ট পিটর্সবুর্গ থেকে খাবারোভস্কা যাত্রা করলেন যুবরাজ য়ুরনঝভ। ওরেনবুর্গ, টেনিস্ক, ক্রাসনোইয়স্ক হয়ে মোট চার হাজার সাতচল্লিশ মাইল পেরিয়ে প্রথমে এলেন তিনি ইরখুস্টিক। স্টিমারে বৈকাল হ্রদ পার হতে হল এবার। তারপর রিলে গাড়িতে চড়ে ভার্খনি, উদিনস্ক হয়ে অবশেষে খাবারোভস্কা। আসার সঙ্গে সঙ্গে মিলে গেল সেই চাবি। কৌটো খুলেই যুবরাজ বুঝলেন, এখানে থামলে চলবে না তাঁকে। আরও এগুতে হবে। আসতে আসতে ইরখুতস্ক থেকে পুরো দু’হাজার পঁচানব্বুই মাইল এসে নিকোলাভস্ক-এ থামলেন তিনি। তাঁর জন্যে বিরাট নৌবাহিনী তখন অপেক্ষা করছে সেখানে।
রাশিয়ার শক্তিতে কোনও প্রথম শ্রেণীর নৌবাহিনী যেমন হওয়া উচিত, তেমনি বাহিনী। শিপ, ক্রুজার, টর্পেডো ইত্যাদি মিলিয়ে বিরাট বহর। সঙ্গে আছে অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রের মধ্যে ষোল ইঞ্চি ডিনামাইট-গান। দু’ হাজার গজ দূরে গোলা ছোড়া যায় এই কামানে। আর আছে বিশ্বের কাছে অজ্ঞাত ‘ক্রাপ-গান’। এর বিশেষত্বের কথা পরে বলছি। সৈন্যবাহিনীতে আছে এক স্কোয়াড্রন দক্ষ কসাক আর দু’ হাজার সাধারণ পদাতিক। পদাতিকের মধ্যে আবার রয়েছে কসাকদের দুর্ধর্ষ কারাও ব্যাটেলিয়ান। নৌবাহিনীর অধিনায়কত্ব অর্পিত হয়েছে জেনারেল কাল্পোকোস্কির ওপর। অশ্বারোহী এবং পদাতিক বাহিনী পরিচালনা করবেন যথাক্রমে জেনারেল জাগদ্কিন এবং আনুশ্চিন।
নৌবাহিনী কলকাতার দিকে যাত্রা করল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রানস্ কাস্পিয়ানের পথে রাশি রাশি রুশ সৈন্য চলল ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের দিকে। উদ্দেশ্য, বিপদের আসল পথটাকে আড়াল করে দেওয়া। যেহেতু আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে ভারতের উপর পশ্চিমের সব আক্রমণের পথ এটি, তাই ইংরেজদের কড়া নজর এদিকে। তার উপর রুশ সৈন্যের এদিকে নড়াচড়ার খবর পেলে সব শক্তি ওরা অবশ্যই জড়ো করবে এখানে। ততক্ষণে ওদিকে ওদের রাজধানী কলকাতার কেল্লা ফতে।
এত পথ ঘুরে কলকাতাকে আক্রমণের লক্ষ্য করল কেন রাশিয়ানরা, সে একটা প্রশ্ন বটে। তাদের এই ঝুঁকি নেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের গর্ব চূর্ণ করা। কলকাতা যে কোনও বিদেশি শক্তির আয়ত্তের বাইরে, এটাই ছিল ইংরেজদের ধারণা। মাঝে মাঝে তাই নিয়ে প্রকাশ্যেও গর্ব করতেন তাঁরা। দ্বিতীয়ত, তারা জানে, ভারতবর্ষের নেটিভদের কাছে ইংরেজদের যে খাতির এবং সম্মান, তার বারো আনাই নির্ভর করে কলকাতার উপর। তা ছাড়া কলকাতা ভারতবর্ষের রাজধানীও বটে। একবার এটি হস্তগত করতে পারলে ইংরেজের ইজ্জত যাবে, সেই সঙ্গে পাটকাঠির মতো ভেঙে দু’ টুকরো হয়ে যাবে তার মরাল। সুতরাং চলো কলকাতা। লক্ষণীয় বিষয় এই, প্রকাশ্যে কিন্তু রাশিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করেনি তখনও। ক্রেমলিনে জার বাহাদুর তখনও যতারীতি শান্তি আলোচনা চালাচ্ছেন ইংরেজ প্রতিনিধিদের সঙ্গে।
এদিকে তরতর করে জল কেটে এগিয়ে চলেছে রুশ নৌ-বহর। প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসাগর, তারপর বঙ্গোপসাগর—অবশেষে কলকাতা। রাস্তায় ভারতীয় জাহাজ পড়ল দু’খানা। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য জাহাজ। সে-দুটো দখল করে দলে ভিড়িয়ে নিলে ওরা। ‘জাপান’ নামে আরমেনিয়ানদের একখানা জাহাজ পালাতে চেয়েছিল। বাধ্য হয়ে ডুবিয়ে দিতে হল সেটিকে। রুশবাহিনীর স্টোরে নানা ধরনের নিশান ছিল। বঙ্গোপসাগরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারই এক-একখানা ঝুলিয়ে দেওয়া হল জাহাজের মাস্তুলে মাস্তুলে। তারপর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল যে-যার জায়গা মতো। খাস ইংরেজ গুপ্তচর যিনি ছিলেন, সুন্দরবন এলাকা তাঁর মুখস্থ। বহুদিন গাছপালা প্রজাপতি ইত্যাদি খোঁজার অছিলা করে এ-অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। সুন্দরবনে সাকুল্যে ক’টা নদী আছে, কোন নদীতে কী সাইজের জাহাজ ধরানো যেতে পারে, সব তাঁর জানা। তাঁরই নির্দেশে গোটা রুশ নৌ-বহর আত্মগোপন করে ফেলল সেখানে। সেখান থেকেই রাতের অন্ধকারে এক-জাহাজ পদাতিক সৈন্য চলে এল ডায়মন্ডহারবারের দিকে। আর এক দল ওদিকে গিয়ে দখল করে বসল সাগরদ্বীপের সিগন্যাল স্টেশনটিকে। তৃতীয় দল পায়ে হেঁটে চলল বনমালীপুর-বিষ্টুপুর হয়ে দক্ষিণ বারাসতের দিকে। তাদের নেতৃত্ব করছেন লেঃ মাউন্তিনফ। গাইড হিসেবে পথ দেখিয়ে তাঁকে নিয়ে চলেছেন সেই বাঙালি বাবু। ডায়মন্ডহারবারের গাইড ‘মিস্টার বি’। সেই ফিরিঙ্গি ভদ্রলোক। তাঁরা প্রথমেই এসে নষ্ট করে ফেললেন ডায়মন্ডহারবার এবং শিয়ালদহের মধ্যে রেল এবং তারের যোগাযোগ। রাতের অন্ধকারে পোর্ট ক্যানিং রেলপথও দখল হয়ে গেল বিনাযুদ্ধে। এবার সোজা বালিগঞ্জ স্টেশন। এদিকে মাউন্টিনফ ততক্ষণে এসে হাজির হয়েছেন বারাসত থেকে শিয়ালদহে। তখন প্রায় ভোররাত্তির। শিয়ালদহে পৌঁছেই একখানা রকেট ছেড়ে দিলেন তিনি। যাঁরা গরম দেখে ছাতে ঘুমোচ্ছিলেন, তাঁরা ভাবলেন, বোধ হয় কারও বিয়ে হচ্ছে, তারই হাউই উঠল আকাশে। কিন্তু বালিগঞ্জ থেকে জেনারেল কম্পোকোস্কি জানলেন, মাউন্টিনফ কাজ হাসিল করে ফেলেছে। ধীরে ধীরে সুন্দরবন থেকে কলকাতার দিকে আসতে আসতে মাস্তুলে বসেই দূরবিনে রকেট দেখে হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল অন্য সৈন্যাধ্যক্ষদের। সেই সঙ্গে বেড়ে গেল জাহাজের বেগও।
ভোরে তিন দিক থেকে শুরু হল কলকাতার উপর আক্রমণ। তার প্রথম শহিদ লাইট হর্স বাহিনীর সেই উইলকনিস। সকালে দলছাড়া হয়ে দক্ষিণী হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলেন বেচারা। বালিগঞ্জ থেকে আসার পথে জেনারেল কল্লোকোস্কি প্রথম বাধা পেলেন পার্ক সার্কাসে। না মার্তিন কলেজে ভল্যানটিয়ার কোর ছিল একটা। তারা এসে রুখে দাঁড়াল। কিন্তু সুশিক্ষিত রুশ বাহিনীর সামনে ছেলে-ছোকরাদের এই প্রতিরোধ তৃণের চেয়েও তুচ্ছ। কম্পাউন্ডে দুটো কামানের গোলা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রণে ভঙ্গ দিল তারা। প্রিন্সিপাল বন্দি হলেন। কল্পোকোস্কি ছিলেন রুশ সেনানায়কদের মধ্যে সবচেয়ে হিউম্যান। তিনি বললেন, “ছেলেদের কোনও দোষ নেই। তাদের ধৃষ্টতা আমি ক্ষমা করছি। কিন্তু প্রিন্সিপালের বিচার হওয়া আবশ্যক। কারণ, এই তথাকথিত প্রতিরোধের জন্য মূলত তিনিই দায়ী।”
তক্ষুনি সামরিক কায়দায় বিচার হয়ে গেল প্রিন্সিপালের। তিনি দেওয়ালের দিকে মুখ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। পিছন থেকে গুলি করা হল তাঁকে।
অতঃপর বিজয়গর্বে রুশবাহিনী চলল চৌরঙ্গির দিকে। ইতিমধ্যে উইলকিনস-এর মুখে খবর পেয়ে জায়গায় জায়গায় অবশ্য ব্যুহ রচনা করেছিলেন মিঃ টমকিনেরা। কোথাও ট্রামগাড়ি, কোথাও মাংসের দোকানের ভারী ভারী টেবিলের প্রতিরোধ।
হাস্যাস্পদ মনে হলেও এই তখন কলকাতার সম্বল। লড়াই করার লোক কোথায়। একদিকে কেল্লার উপর চলেছে নদী থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ, অন্যদিকে শিয়ালদহ থেকে ‘ক্রাপ গান’ ছুড়ছেন মাউন্টিনফ। এমন কামানের কথা স্বপ্নেও কেউ ভাবেনি কোনও দিন। পাক্কা তিন হাজার গজ তার পাল্লা। যেখানটায় টিপ করা, পড়বে এসে ঠিক সেখানে। মরতে মরতেও টমিরা সাবাস দেয় রাশিয়ানদের। মাথা বটে রাশিয়ার!
একে তিন দিক থেকে আক্রমণ, তায় এমনি নয়া নয়া হাতিয়ার। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেখা গেল, লজ্জিতভাবে দড়ি বেয়ে একটা সাদা পতাকা উঠছে ফোর্টের উপর দিকে। আত্মসমর্পণ করছে কলকাতার ইংরেজ সরকার। না করে উপায় নেই। ফোর্টে গাদা গাদা নারী আর শিশু। তাদের বাঁচাতে হবে।
যুদ্ধবিরতির আদেশ দিলেন রুশ কর্তৃপক্ষ। অবশ্য যুদ্ধটা সরকারিভাবে ঘোষিতই হয়েছে মাত্র কিছুক্ষণ আগে। রুশ বাহিনীর নিরাপদে কলকাতায় নামবার পর সাদা নিশানটা ফোর্টে স্থির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুশ সৈন্যাধ্যক্ষ ফোর্ট-কর্তৃপক্ষকে জানালেন, “আমরা অস্ত্র সংবরণ করেছি। তোমরাও তাই করো। আমাদের পরম পরাক্রমশালী রুশসম্রাট কখনও অসহায় নারী এবং শিশুদের সঙ্গে লড়াই করেন না। কেননা, সেটা অটোক্রেসি। যদি আমরা তাতে মত্ত হই, তবে ঈশ্বরের কোপে রুশ সেনাবাহিনীর মহা সর্বনাশ হবে এবং রুশ জনসাধারণেরও অমঙ্গল হবে।”
ইংরেজরা এ মহাপাতকের অংশভাগী হতে রাজি হলেন না। তাঁরা আত্মসমর্পণ করাই স্থির করলেন। জেনারেল পোর্তুলক্ষ ভেঁপু বাজিয়ে মিছিল করে চৌরঙ্গি গেট দিয়ে ঢুকলেন ফোর্টে। টাউন হল এবং হাইকোর্ট হাসপাতাল হল। বাড়ি দুটোর উপরে উড়ছে ‘জেনেভা-ক্রস’। অর্থাৎ রেডক্রস। ময়দানের পশ্চিম কোণটা হল ইংরেজদের কেওড়াতলা। কেরোসিন আর পেট্রোলে সেখানে মরা সৈনিকদের পোড়াতে লাগল জ্যান্ত সৈনিকরা। দূর থেকে তাই দেখে হাসাহাসি করতে লাগল হিন্দু-মুসলমানরা। এমন তাজ্জব ঘটনা তারা আর দেখেনি কোনও দিন।
সেদিন মাঝরাত্তিরেই বেলভেডিয়র থেকে জেনারেল কল্পোকোস্কির মুখে ঘোষিত হল মহামান্য সম্রাট জারের প্রক্লেমেশন। আজ থেকে বঙ্গদেশের সমগ্র নিম্ন অঞ্চল রুশ সাম্রাজ্যের একটা প্রদেশ বলে গণ্য হবে। এই প্রদেশের হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হল অত্র কলিকাতা নগরীতে অন্তবর্তিকালীন সামরিক শাসক নিযুক্ত হলেন জেনারেল কল্পোকোস্কি। ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে এ খবর শহরময় রটিয়ে দেওয়ার জন্যে নাচতে নাচতে চারিদিকে বেরিয়ে পড়ল ঢাকিরা।
হয়তো ভাবছেন, আজগুবি একটা গল্প ফেঁদেছি আমি। বিবরণটা সম্পূর্ণ আজগুবি হলেও পুরাকাল বিষয়ে আমাদের যা সাধারণত প্রধান নির্ভর এটিও তারই ভিত্তিতে রচিত। এর প্রতিটি কথা একটি লিখিত এবং মুদ্রিত বই থেকে নেওয়া। সেই দুর্লভ উদ্ভট কল্পনার গ্রন্থটির নাম:
The Bombardment & Capture of Fort William, Calcutta, by a Russian Fleet & Army, compiled from the Diaries of Prince Serge Woronzoff and Genl. Yagodkin, translated from the original Russian by Ivan Batiushka. প্রকাশকাল ১৮৯০। অর্থাৎ কলকাতার ‘পতনের’ দু’ বছর আগেকার রচনা।
সেদিক থেকে এই ইতিহাসটি অবশ্য ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ নয়, সম্ভাবনার প্রাক্-কথন। ইতিহাসও কখনও কখনও স্বপ্ন দেখে। কলকাতার ইতিহাসের এও সেই স্বপ্ন-দেখা। বইটির নামটিকে তাই বলতে পারেন স্বপ্নাদ্য-নাম। তবে পণ্ডিতেরা বলেন, স্বপ্ন মাত্রেরই কিছুনা কিছু বাস্তব ভিত্তি থাকে। কলকাতারও তা ছিল। ১৮৮৭ সালের ৯ জুন তারিখের ‘অমৃতবাজার’ কাগজ খুললেই দেখতে পাবেন তা। তাতে লেখা আছে, প্রায় চার-কুড়ি বছর ধরে ভারতের ইংরেজরা রুশ-আক্রমণের দুঃস্বপ্ন দেখছেন।. এই আক্রমণ থেকে কলকাতাকে রক্ষার জন্যে অনেক বিধিব্যবস্থাও সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন তাঁরা।
সমসাময়িক ইংরেজি কাগজে এবং পুঁথি-পুস্তকে রাশি রাশি সমর্থন পাবেন এ ঘটনার। ১৮৩৫ থেকে ১৯০৫ অবধি সরকারি বা বে-সরকারি ইংরেজের একমাত্র চিন্তা ছিল রাশিয়া। বেন্টিঙ্ক একবার খবর পেলেন, কুড়ি হাজার রুশ পদাতিক এবং এক লক্ষ অশ্বারোহী নাকি এগিয়ে আসছে ভারতবর্ষের দিকে। স্বদেশে এক কোটি পাউন্ড চেয়ে পাঠালেন তিনি সেই রুশ আক্রমণ ঠেকানোর খরচ বাবদ!
মিউটিনির পরে এ ভয় বেড়ে গেল আরও। জলাতংকের মতো রুশাতঙ্ক রোগে ধরল কলকাতাকে। সবাই বলে, আমাদের বসে থাকা উচিত নয়। একটা কিছু বিহিত করা আবশ্যক। কলকাতার রাজপুরুষরা হাটুরে পরামর্শে কান দিলেন না। তাঁদের নজর কলকাতা থেকে কয়েক শো মাইল দূরে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে। কলকাতায় রুশ আক্রমণ তাঁদের স্বপ্নেরও অতীত।
লাটসাহেবকে স্বপ্ন দেখানোর জন্যে তখন বের হল এক নতুন ধরনের তাবিজ। বই। কলকাতা যে সত্যিই নিরাপদ শহর নয়, সেটা প্রমাণ করাই এর উদ্দেশ্য। উপসংহারে লেখক জানিয়েছেন তিনি নিজে সামরিক বিভাগের একজন ভূতপূর্ব কর্মচারী। তাঁর লেখা অনেক দায়িত্বশীল সরকারি কর্মচারী পড়েছেন এবং তাঁরা এই বই-এর বিষয়বস্তুর সম্ভাব্যতা এবং বিবরণের টেকনিক্যাল যথার্থতা সম্পর্কে একমত। সুতরাং সাধু সাবধান।
যে কলকাতা মাটির তলায়
অবশেষে ডিরোজিওর সমাধি সংস্কৃত। সরকারি উদ্যোগে নতুন পরিচয়লিপিতে অলংকৃত। আপাতবিচারে এ-সংবাদে উত্তেজনার কোনও উপাদান নেই। আমাদের মনোরাজ্যে হেনরি লুইস ভিভিয়ান ডিরোজিওর (১৮০৯-১৮৩১) যেখানে অধিষ্ঠান সেখানে তাঁর কোনও স্মৃতিচিহ্ন ঘিরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে আগাছার বন, ভাবলে সেটা অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়। অথচ ঘটনা সেটাই। ডিরোজিওর জীবনের মতোই বেদনাদায়ক তাঁর সমাধির ইতিবৃত্ত। ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর এই প্রাণপুরুষের মৃত্যু ১৮৩১ সালের ২৬ ডিসেম্বর, সোমবার। ১৮৩২ সনের ১১ জানুয়ারি ‘সমাচার দর্পণ’-এর খবর ‘গত ৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার অপরাহ্নে মৃত ড্রজু সাহেবের স্মরণার্থ চিহ্ন স্থাপনকরণ বিষয়ে পারেস্তাল আকাদেমিতে অনেকের সমাগম হয়। তাহাতে শ্রীযুক্ত বাবু মহেশ চন্দ্র ঘোষ এই প্রস্তাব করিলেন যে, সরকারী চাঁদার দ্বারা যে মৃত ড্রজু সাহেবের বিষয়ে আমরা সকলেই এইক্ষণে খেদার্ণবে মগ্ন, তাহার চিরস্মরণার্থ চিহ্নস্বরূপ এক প্রস্তরময় কবর নির্মাণ করা যায় এবং তদুপরি তৎপ্রযুক্ত কথা-প্রবন্ধ ক্ষোধিত থাকে, তদনন্তর চাঁদা বহী সকলকে দর্শান গেল এবং সেই স্থানেই ৯০০ টাকার স্বাক্ষর হইল।’ কিন্তু ১৮৩২ সালের এপ্রিলে ‘সমাচার দর্পণ’ জানাচ্ছে ডিরোজিও-শিষ্যরা এখনও স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুলতে পারেননি। তবে তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘দর্পণ’ লিখছে: ‘যে কমিটি নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তাঁহারা চাঁদার স্বাক্ষরকারী মহাশয়দিগকে জ্ঞাপন করিয়াছেন যে, তাঁহার কবরস্তানোপরি চণ্ডালগড়ের প্রস্তর নির্মিত এক স্তম্ভ প্রস্তুত হওনার্থ বন্দোবস্ত করিয়াছেন। ঐ স্তম্ভ গ্রন্থনের ব্যয় এক হাজার পাঁচশত চব্বিশ টাকা দশ আনা আট পাই হইবে। আমরা শুনিয়া কি চমৎকৃত হইলাম যে, ১৫৫৪ টাকার চাঁদা হইয়াছে বটে, কিন্তু তন্মধ্যে কেবল ৬১৪ টাকা আদায় হইয়াছে।’ তারপর সে অঙ্ক নাকি শেষ পর্যন্ত আটশো টাকায় পৌঁছেছিল। কিন্তু সমাধি তবু গড়া সম্ভব হয়নি। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত ‘বেঙ্গল অবিচ্যুয়ারি’-র মতে কে বা কারা সমাধির জন্য তোলা অর্থ আত্মসাৎ করে। অথচ ১৮৩২ সালের ২৯ মার্চ, সমাধির ওপর কী লেখা হবে তার বয়ান পর্যন্ত ছাপা হয়ে গিয়েছিল ‘গভর্নমেন্ট গেজেট’-এ। শেষ পর্যন্ত ডিরোজিও-ভক্তদের সাধ পূর্ণ হয় দীর্ঘ আট বছর পরে। জনৈক ডিরোজিও-অনুরাগী অনেক কষ্টে ডিরোজিওর সমাধি খুঁজে বের করে তার ওপর একটি বেদি নির্মাণ করেন, সম্ভবত ১৮৯১ সালে। তিনি উকিল দুর্গামোহন দাস। দুর্গামোহনবাবু বেদির গায়ে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয়লিপিও খোদাই করিয়েছিলেন। কিন্তু কালক্রমে সেটিও জীর্ণ হয়ে যায়। ডিরোজিওর সমাধি আবার হারিয়ে যায় আগাছার বনে। নতুন করে সে সমাধি নির্মিত হয় ১৯০৯ সালে, ডিরোজিওর জন্মশতবার্ষিকীতে। সেবার উদ্যোক্তা ছিলেন খ্রিশ্চিয়ান ব্যারিয়াল বোর্ডের তদানীন্তন সেক্রেটারি মিঃ জর্জ ওকোনেল। কবরের চারপাশে তৈরি করা হয় রেলিং। রেলিং ঘিরে বাহারি গাছপালার সারি। মাঝখানে শ্বেতপাথরে খোদাই করা সংক্ষিপ্ত স্মৃতিলিপি। কিছুকাল আগে সে শিলাখণ্ডটিও অপহৃত। লুঠেরারা পাথরের লোভে আরও অনেক কবরের মতোই তছনছ করে রেখে যায় ডিরোজিওর সমাধি। তারপর ১৯৭৮-এর এপ্রিলে এই সরকারি উদ্যোগ। দক্ষিণ পার্ক স্ট্রিটের বিশাল গোরস্থানে কোথায় শায়িত ডিরোজিও, আজ আর তা খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা নেই।
কিন্তু কোথায় তাঁর গুরু ‘ধর্মতলা আকাদেমির’ স্কটিশ শিক্ষক ডেভিড ড্রামন্ড যিনি কবিতা লিখতেন ডোরিক-এ? কোথায় আছেন ‘হিন্দু কলেজের’ প্রথম হেডমাস্টার জেমস আইজাক ডি অ্যানসেল্ম, যিনি একদিন ক্রোধে অন্ধ হয়ে চতুর্থ শিক্ষক ডিরোজিওকে মারতে চেয়েছিলেন? ডিরোজিওর নতুন সমাধি উপলক্ষে অতএব মনে মনে আবার নতুন করে গোরস্থান পরিক্রমা। কলকাতার সেই বিবর্ণ, বিষাদাচ্ছন্ন অঙ্গনের দিকে পা বাড়ানো, ইতিহাস যেখানে মাটির তলায়। ‘ক্যালকাটা আন্ডারগ্রাউন্ড’ বলতেন উইলিয়ম হান্টার। তাঁর মতে মাটির ওপরে যেমন, মাটির তলায়ও তেমনই এ শহরের অনেক ইতিবৃত্ত। অনেক সাফল্য, অনেক ব্যর্থতা। অনেক গৌরব, অনেক লজ্জা। অনেক অশ্রু, অফুরন্ত দীর্ঘশ্বাস।
সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রির কথাই বলি। এ গোরস্থানের দরজা খোলা হয় ১৯৬৭ সালের ২৫ আগস্ট, একজন সামান্য কেরানিকে সমাধিস্থ করার জন্য। তারপর সবাই জানেন, ক্রমে সেখানে নানা অসামান্যের ভিড়। ডিরোজিও এখানে নিঃসঙ্গ নন। এই গোরস্থানেই শায়িত কলকাতার আর এক কবি টি ডব্লিউ স্মিথ (মৃত্যু ১৮৬৩)। সাহিত্যের সঙ্গে নানা সংসর্গ এখানকার কোনও কোনও সমাধির। কবি ল্যান্ডরের প্রেমিকা রোজ আইলমার-এর সদ্য সংস্কার করা সমাধিতে উৎকীর্ণ এখনও ল্যান্ডরের অশ্রু। ‘জুনো’ নামে একটি জাহাজডুবির নায়ক তরুণ নাবিক উইলিয়ম ম্যাকের অভিজ্ঞতা থেকেই নাকি প্রেরণা পেয়েছিলেন বায়রন ‘ডন জুয়ান’-এ জাহাজডুবির বর্ণনাকে এমন জীবন্ত করতে। তারপর দেওয়ালের এক কোণে দাঁড়িয়ে রবাট পাল্ক্-এর বালিকাবধূ লুসিয়ার সমাধি। এর সামনে দাঁড়িয়েই রাডিয়ার্ড কিপলিংয়ের কলম একদিন কল্পনায় উদ্দাম। সর্বোপরি, সব কবর ছাপিয়ে সেই সর্বোচ্চ স্মৃতিস্তম্ভটি, যার নীচে লেখা—সার উইলিয়ম জোন্স্ তৎসহ স্বরচিত কয়টি বাক্য: “…none below him but the base and unjust, none above him but the wise and virtuous.”
আরও অনেক স্বনামধন্যের শেষ ঠিকানা এখানে। ‘হিন্দু স্টুয়ার্ট’, অর্থাৎ ভারতীয় স্থাপত্যে ভাস্কর্যে অতি আগ্রহী সেই ছিটগ্রস্ত জেনারেল, যিনি নিত্য গঙ্গাস্নান করতেন, নিত্য দরিদ্রনারায়ণ সেবা করাতেন, এবং যাঁর সমাধি গড়া হয়েছিল হিন্দু মন্দিরের স্টাইলে। সে মন্দির কোনও লুব্ধ লুঠেরা লুঠ করে নিয়ে গেছে, কিন্তু কাঠামোটি এখনও আছে। আছে বারওয়েল পত্নী একদা কলকাতার বিখ্যাত সুন্দরী এলিজাবেথ জেন বারওয়েলের সমাধির ওপর গড়া বিশাল পিরামিড, আছেন বিচারপতি হাইড, স্বামী ক্লেভারিং-সহ লেডি মনসন। এবং আরও অনেকে।
তবু বিশেষ করে মন বিষাদে ভরে তোলে তুলনায় অখ্যাত কবরগুলোই। একজন দর্শক এলোপাথারি কিছু শিলালিপি উদ্ধৃত করেছেন তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ে। (‘টু মনসুনস’-থিও উইলকিনসন, লন্ডন, ১৯৭৬) : মারি হে’ডিড (১৮০৪), বয়স ১৭, মিসেস এলিজাবেথ হান্ট (১৮০৪), বয়স ১৮, মিসেস এলিজাবেথ ওলেস (১৮০৫), বয়স ১৭, মিসেস মার্গারেট গিবসন (১৮১০), বয়স ১৭, মিসেস আনা টাউনসেন্ড (১৮২২), বয়স ১৬। ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কেউ তারই মধ্যে চার-পাঁচটি সন্তানের জননী। নিমেষে দেখতে দেখতে গোটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, সাউথ পার্ক স্ট্রিটে সে ধরনের ভয়াবহ খবরও অনেক। একটি কবরকে বলা হয় ‘ব্লিডিং গ্রেড’, রক্তঝরা কবর। ১৮০৬ সালে একই বছরের মধ্যে মারা যান জনৈক ডেনিসন, তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানেরা। বছরে একদিন নাকি ওদের কবর থেকে লাল রক্ত চুঁইয়ে পড়ে। কিন্তু এখন? জানি না। সে কবর আমি কোনও দিন খুঁজে বের করার চেষ্টা করিনি।
তার চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণ করেছিল আমাকে স্যামুয়েল ওল্ডহাম সাহেব। কলকাতায় বলতে গেলে তিনিই প্রথম নামকরা মৃত্যুকারবারিও, যাকে বলে আন্ডারটেকার। এই শ্মশান- বান্ধবটিকে নিয়ে শহরে তখন ছড়ার ছড়াছড়ি। একটি ছড়া ছিল ‘In a very few days, you are released from all cares. If the Padre’s asleep, Mr. Oldham reads prayers.’ ফলাও কারবার ছিল তাঁর। গৌড় থেকে পাথর আনিয়ে তিনিই প্রথম স্থানীয় সম্পদকে এখানে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেন। সাউথ পার্ক স্ট্রিটের অনেক শিলালিপিতেই রয়েছে তাঁর স্বাক্ষর—‘S.O. fecit.’ বলা বাহুল্য, শেষ পর্যন্ত তাঁকেও একদিন আসতে হয়েছিল এখানে এই ব্যুরিয়াল গ্রাউন্ড রোড ধরে এবং কফিনবন্দি হয়ে, স্বজনবান্ধবদের কাঁধে। সেটা ১৭৮৮ সালের কথা। কিন্তু কোথায় তিনি? চারদিকে নিজের হাতে গড়া অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে ওল্ডহাম সাহেবের নিজের সমাধিটিই আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এখনও রয়েছে তাঁর সমাধিলিপি, দ্বারপালদের ঘরের দেওয়ালে।
অবশ্য কবরখানা শুধু মৃতের স্মৃতিই বহন করে না। ইতিহাসের নানা নিশানা ইতস্তত ছড়িয়ে থাকে সেখানে। নানা স্থাপত্য-নিদর্শন। ভাস্কর্যের বিবিধ নমুনা। হরফের হেরফের। পরমায়ুর পরিমাপ। মৃত্যুর হেতু। আধিব্যাধি। যুদ্ধ, মহামারি, নৌকাডুবি কিংবা নানা দুর্ঘটনার সংবাদ। জীবন এবং মৃত্যু সম্পর্কে বিশেষ কালের মানুষের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। আবছা অন্ধকারে অনেক ইতিকথা। এবং কখনও বা বিচিত্র সামাজিক প্রথা। আচার-বিচার-কেতা।
কবরখানাকে অনেকে রহস্য করে বলতেন পাদরির গুদাম। মৃত্যুসূত্রে শুধু আন্ডারটেকার নয়, যাজকেরাও দু’ পয়সা পেতেন। অষ্টাদশ শতকে কাউকে কবরস্থ করার জন্য পাদরির দক্ষিণা ২ থেকে ১০ গোল্ড মোহর। যাঁর যেমন মান-মর্যাদা, তার পরিবার-পরিজনের তেমন খরচ। মানীদের শবাধারে দেওয়া হয় বিদেশ থেকে আমদানি করা ‘কাফেন’, সাধারণের জন্য কমদামি স্বদেশি বস্ত্রখণ্ড। শ্মশানে সবাই সমান, কিন্তু তৎকালের গোরস্থানে নয়। কোম্পানির অফিসারদের জন্য স্বতন্ত্র এলাকা নির্দিষ্ট। সিভিলিয়ানদের জন্যও দুটি স্বতন্ত্র শ্ৰেণী। ‘রাইটার’ আর ফ্যাকটারই এক সারিতে শয্যা নিতে পারবেন না কিছুতেই। উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত যাঁরা, তাঁদের কবরের জন্য তখন খরচ পড়ে ৫০০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্য ৩০০ টাকা। তারপর ধর্মীয় সম্প্রদায় ভৈদাভেদ তো আছেই। পার্ক স্ট্রিট ধরে ঐতিহাসিক সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রির দিকে এগিয়ে গেলে, এই সেদিন অবধি পথের বাঁয়ে পড়ত ফ্রেঞ্চ ব্যারিয়াল গ্রাউন্ড বা তিরেত্তা গোরস্থান। ১৭৯৮ সালে এ সমাধিক্ষেত্রের উদ্বোধন কিন্তু সে ধরনের কোনও সাম্প্রদায়িক বিতর্ক-সূত্রেই।
এদোয়ার্দ তিরেত্তা ছিলেন জাতে ইতালিয়ান। ভেনিসের কাছে ঘর ছিল তাঁর। তিরেত্তা নাকি তৎকালে ক্যাসানোভার অন্যতম ইয়ার দোসর। একদিন রাজনৈতিক কারণে দেশছাড়া হলেন তিনি। ভাসতে ভাসতে কলকাতায়। কলকাতা তখন ভবঘুরে ভাগ্যান্বেষীদের কাছে স্বর্গ। তিরেত্তাকে নিরাশ হতে হল না। টাকার গাছ ঝাঁকিয়ে অনেক টাকা কুড়োলেন তিনি। সরকারি পদ পেলেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব স্ট্রিটস্ অ্যান্ড বিল্ডিংস। চিৎপুরের কাছে বাজার কিনলেন একটা। নাম দিলেন ‘তিরেত্তার বাজার। আমরা এখনও সে বাজারকে বলি টেরিটি বাজার। বিয়ে হয়েছিল তাঁর জনৈক কাউন্ট দুহিতার সঙ্গে। নাম—অ্যাঞ্জেলিকা। তিরেত্তার ভাগ্যে তখন একসঙ্গে রাজ্য আর রাজকন্যা। সে সৌভাগ্য অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দেনার দায়ে বাজার হাতছাড়া হয়ে গেল। একদিন আচমকা বিদায় নিলেন ঘরের পরী প্রিয় অ্যাঞ্জেলিকাও। সেটা ১৭৯৬ সালের কথা। অ্যাঞ্জেলিকাকে কবর দেওয়া হয়েছিল বৈঠকখানার পর্তুগিজ গোরস্থানে। কেন, কে জানে, সেখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তিরেত্তার বিরোধ বেঁধে গেল। জেদি তিরেত্তা তখনই জমি কিনলেন, পার্ক স্ট্রিটের এই প্রান্তে। তারপর কবর থেকে স্ত্রীর শব তুলে এনে শুইয়ে দিলেন নিজের জমিতে। স্ত্রী মারা গেছেন কিন্তু দু’ বছর আগে। তিরেত্তা সেদিন ঘোষণা করেছিলেন, ইউরোপের যে কোনও দেশের যে কোনও ক্যাথলিকের জন্য খোলা রইল এ গোরস্থানের দরজা। মিসেস তিরেত্তাকে ঘিরে একসময় এখানে, বলতে গেলে গোটা ইউরোপ সমবেত। এমনকী, মরিশাস দ্বীপের আগন্তুক পর্যন্ত শেষ শয্যা পেয়েছেন এখানে। আজ অবশ্য সেখানে বুলডোজারের তর্জন-গর্জন। বিশাল নতুন অট্টালিকা শেষ পর্যন্ত শান্ত করেছে সে যন্ত্রদানবকে। এখন সেখানে ঈশ্বরের আপন একর জুড়ে মানুষের নানা কাণ্ড। ইটের পরে ইট, সেখানে বাস করে মানুষ নামক কীট।
তিরেত্তার কবরখানার মতো ঔদার্য কিন্তু অন্যত্রও দেখা গেছে কখনও কখনও। পার্ক সার্কাসের একটি স্কটিশ কবরখানায় রয়েছে শার্লট নামে একটি শিশুর কবর। ১৮৩৮ সালে মাত্র তিন বছর তিন মাস তেরো দিন বয়সে মারা যায় সে। পরিচয়লিপিতে লেখা: ‘মোস্ট লাভলি অ্যান্ড বিলাভেড চাইল্ড অব চার্লস রিড অ্যান্ড বিজিজান।’ আমরা জানি, একসময়ে অসবর্ণে সাহেবদের আপত্তি ছিল না। তাই বলে, পাথর খোদাই করে এমন সাহসী ঘোষণা। ছয় বছর পরে বিজিজানকেও সমাধিস্থ করা হয় একই কবরখানায়। ভারতের নানা সমাধিক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু কিছু মানবিক দলিল আছে, সে খবর জানা ছিল। চুনারে আছে এক দেশীয় সৈনিকের কবর, যার বুকে ছেনি দিয়ে লেখা: এটি স্থাপন করেছে ‘লুসি, হিজ ওম্যান’। ইত্যাদি। দেখে ভাল লাগে, কলকাতার গোরস্থানগুলোও এ বিষয়ে একেবারে সাদা কাগজ নয়।
সর্বত্রই কিছু না কিছু দরকারি লেখাজোখা। পার্ক স্ট্রিটের ওই প্রান্তেই মিশন সিমেট্রিতে পাদরি কবর। তিনি মিশন চার্চের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলায় প্রথম প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারি। অনেক কীর্তি তাঁর। তাঁর দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহণ উপলক্ষে সমকালীনদের কত না রসিকতা। নর্থ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান, যেখানে এখন দেওয়ালের আড়ালে হাসপাতাল না বিদ্যালয়ের আয়োজন, সেখানে এই সেদিনও পরম শান্তিতে শায়িত ছিলেন কর্নেল কার্কপ্যাট্রিক। একদা হায়দরাবাদে কোম্পানির রেসিডেন্ট। খানদানি এক নবাব-দুহিতাকে বিয়ে করে খেতাব পেয়েছিলেন ‘হাসমৎ জঙ্গ’। ছিলেন রিচমন্ড থ্যাকারে। ঔপন্যাসিক থ্যাকারের বাবা। সঙ্গে কন্যা সারা। ছিলেন শ্ৰেষ্ঠীকূলচুড়ামণি জন পামার, ১৮৩০ সালে যাঁর গদিতে গণেশ উলটাবার ফলে কলকাতার নানা মহল্লায় রীতিমত ভূমিকম্প। এখানেই শেষ বিশ্রামের ঠাঁই খুঁজে পেয়েছিলেন বেগম সমরুর দীর্ঘকালের সেবায়েত এবং সহায় কর্নেল জন আলেকজান্ডার ডাইস এবং শিবপুর এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ‘গুরু জোনস’। ব্যাকরণ-বিশারদ হালেদ সাহেবের ভ্রাতুষ্পুত্র, বিচারক এবং ভাষাবিদ ন্যাথানিয়েল জন হালেদ ১৮৩৮ সালে দেহরক্ষা করার পর এই নর্থ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানেই ছিল হালেদ পরিবারের একটি নিশান। এখন বৃথাই সেখানে ‘ওল্ড ডেড’-দের খুঁজে বেড়ানো।
তারপর লোয়ার সার্কুলার রোডের বিস্তীর্ণ শ্মশান। যেন আগের মতোই এখনও জীবন্ত। এর উদ্বোধন ১৮৪০ সালে একটি শিশুকে নিয়ে। তারপর থেকে অসংখ্য মানুষের মিছিল। ডিরোজিও- র গুরুর কথা বলছিলাম। ১৮৪৩ সনে ড্রামন্ডকে সমাধিস্থ করা হয় এখানেই। আগেই বলেছি, তিনি কবি ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর পর তাঁর যাবতীয় কবিতা একসঙ্গে ছাপানো। কিন্তু সে ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে যায়। কেন না, স্কটল্যান্ডের পথে জাহাজডুবিতে চিরকালের মতো হারিয়ে যায় তাঁর পাণ্ডুলিপি। হিন্দু কলেজের প্রথম হেডমাস্টার জেমস আইজাক ডি অ্যানসেল্ম, ঐতিহাসিক ব্লকম্যান, সাঁ সুসির অভিনেত্রী মারিয়া ম্যাডলিন টেলার এবং আরও অনেকেই এখানে। যতদূর মনে পড়ে, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরও এখানেই সমাধিস্থ। সর্বোপরি আমাদের শ্রী মধুসূদন তাঁর চিরখ্যাত সমাধিলিপি ‘দাঁড়াও পথিকবর…’ বুকে নিয়ে। লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরের ভিড়ে কিন্তু এমন কবরও আছে, যা কোনও স্বনামধন্য মানুষকে ধারণ না করেও ইতিহাস-পড়ুয়ার কাছে স্মরণীয়। যতদূর মনে পড়ে, গোরস্থানের পশ্চিমদিকে ৪ নম্বর প্লটের দ্বিতীয় সারিতে কবর রয়েছে একটা। ওপরে নাম লেখা এইচ ভি বেইলি বি সি এস। এই ভদ্রলোকই নাকি কলকাতার শেষ পশ্চিমী হুঁকো-রসিক। পরিচয়লিপিতে সগর্ব ঘোষণা: ইনিই শেষ হুঁকো টেনেছিলেন বেঙ্গল ক্লাবে!
সব কবরখানাতেই রয়েছে কুড়িয়ে নেওয়ার মতো খবর। কোথাও বা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অশ্রুপাতের উপলক্ষ। যথা: ভবানীপুরের ফৌজি গোরস্থান। সেখানে শায়িত ডিকেন্সের-এর পুত্র। ভাগ্যিস ডিকেন্সের লেখা পরিচয়লিপিটুকু মূল কবরের পাথরে খোদাই করা, নইলে হয়তো সেটিও তুলে নিয়ে যেত কোনও লোভী হাত। গোটা কবরখানায় আজ লুঠেরাদের ব্যাপক দৌরাত্ম্যের চিহ্ন। বলতে গেলে প্রায় প্রতিটি কবর ক্ষতবিক্ষত। তারই মধ্যে এখনও কোনও মতে টিকে আছে ডিকেন্স-এর দ্বিতীয় পুত্র তেইশ বছরের ওয়াল্টার ল্যান্ডার ডিকেন্স, দেশে যাওয়ার পথে হঠাৎ বেচারা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন কলকাতায়। এ ছাড়াও রয়েছে মানিকতলার গোরস্থান, যেখানে ঘুমিয়ে আছেন তরু, অরু এবং তাঁদের বাবা মা ভাই। সেখানেও অশ্রু ঝরে। হয়তো ঝরবে চিরকাল।
অবশ্য চিহ্নগুলো যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায়। ইতিমধ্যেই অনেক মৃতলোকে হানা জীবিতের দল। যাঁরা বেঁচে নেই, তাঁদের চেয়ে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের দাবি নিশ্চয়ই বেশি। শহরে যখন তিলধারণের ঠাঁই নেই, তখন কী অধিকার আছে ‘ওল্ড ডেড’-দের এমন করে হাত-পা ছড়িয়ে আরামশয্যায় পড়ে থাকার। পৃথিবীর সর্বত্রই অতএব শুরু হয়েছে মৃতদের উচ্ছেদের উদ্যোগ। যুক্তি সহজ সরল: মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যু মানুষের নিয়তি। মৃতমাত্রই পবিত্র। কিন্তু মৃত্যু সমদর্শী হলেও মৃতলোকে সাম্যদর্শন অচল, মৃতমাত্রেরই অধিকার নেই চিরজীবী থাকার। সুতরাং, তাঁদের স্মারকগুলোই থাক, যাঁরা স্মরণীয় কিংবা বরণীয়। অন্য সকলকে দূর হঠাও। মনে হয়, ক্রমে এই যুক্তিই জোরালো হচ্ছে কলকাতা শহরেও। শুরু হয়েছে কবরখানাকে মাঠ করার পালা। কখনও নিঃশব্দে লোভী তস্করদের হাতে, কখনও বা পয়সার টানাটানির ওজর দেখিয়ে স্বয়ং রক্ষাকর্তাদের উদ্যোগে। কিন্তু সওয়াল একটাই, কবরই কি বাঁচিয়ে রাখা যাবে না কলকাতায়? অথচ শহরের স্বার্থেই সেটা ছিল অতিশয় জরুরি। জরুরি ইতিহাসের প্রয়োজনে। অসম্ভব না হলে বাঁচিয়ে রাখতে হবে কোনও কোনও গোরস্থান। যেমন—সাউথ পার্ক স্ট্রিট। যেমন—সেন্ট জন গির্জার প্রাঙ্গণ। সেখানেও সব হয়তো রক্ষা করা সম্ভব হবে না। ইতিমধ্যেই অনেক কবর লুপ্ত, ফলক অদৃশ্য। তবু কিছু কিছু বাঁচিয়ে রাখা দরকার। দরকার সাজিয়ে রাখা। সমাধিক্ষেত্র স্মৃতির উদ্যান হতে পারে। দু’ পাশের ছায়াতরুর মাঝখান দিয়ে স্মৃতির আঁকাবাঁকা সরণি। শ্মশান বলেই শোকবিলাসী হবেন সবাই, তার কোনও যুক্তি নেই। তাজমহলও তো সমাধিই। তবে কোনগুলো বাঁচিয়ে এবং সাজিয়ে রাখতে হবে, তা স্থির করার ভার দেশপ্রেমিক কিংবা ধর্মীয় তত্ত্বাবধায়কদের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না, মৃতকে বিচারের ভার এ নগরের ইতিহাসের জারিজুরি যাঁরা জানেন, তাঁদের ওপর ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয়। তা না হলে হয়তো দেখা যাবে, এমন অনেক চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে, যা ছিল শহরের ইতিকথায় জরুরি। ভয় হচ্ছে, হয়তো তিরেত্তা সিমেট্রি কিংবা নর্থ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানের মতো আরও কিছু কিছু গোরস্থান ইতিমধ্যেই পরিণত হয়েছে ইতিহাসের কবরে। বুলডোজার যখন নামানো হচ্ছে, তখন একবারের জন্যও কি কেউ বলবেন না—তিষ্ঠ ক্ষণকাল!
অতীতেও দেখা গেছে এই নির্বুদ্ধিতা। সবাই জানেন, সাউথ পার্ক স্ট্রিট শয্যা তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত আজকের সেন্ট জন চার্চ অঙ্গনই ছিল প্রথম যুগের ইংরেজ অভিযাত্রীদের শেষ বিশ্রামের ঠাঁই। গির্জা গড়তে গিয়ে একসময় সে এলাকা লণ্ডভণ্ড করেছেন ওঁরা নিজেরাই। তছনছ হয়ে গেছে অনেক সমাধি। এখন যা আছে, তাও অবশ্য অনেক-ই। জোব চার্নক এবং তাঁর কিছু আপনজন ছাড়াও সেখানে আছেন সার্জন হ্যামিলটন, অ্যাডমিরাল ওয়াটসন, জোসেফ টাউনসেন্ড, এবং বেগম জনসন। চারবার বিয়ে করেছিলেন বলেই বেগম জনসনকে যদি কেউ ওখান থেকে নির্বাসনে পাঠাতে চান, তবে তিনি ভুল করবেন না কি? আমাদের তো মনে হয় জেম্স রস নামে ১৭৫১ সালে মৃত ওই মার্চেন্টের কবরটিও রেখে দেওয়া ভাল। কেন না, ওঁর স্ত্রীর নামেই (Johannah Ross) গঙ্গায় রসবিবির ঘাট। স্বামীর সমাধিটিও নাকি তাঁরই গড়া।
ঠিক তেমনই, আরমানি গির্জার গোরস্থানে সেই ঐতিহাসিক কবরটিকেও কোনও অট্টালিকার তলায় কবর চাপা দেওয়ার কথা নিশ্চয়ই ভাবতে পারি না আমরা। সবাই জানেন, ইংরাজদের পদধূলি পড়ার আগে কলকাতা মরুভূমি ছিল না। আরমানি গির্জার একটি কবর জানিয়েছিল— কলকাতায় ইংরেজরাই প্রথম পরদেশি আগন্তুক নয়। বাংলায় পর্তুগিজদের মতো আরমানিরাও অগ্রপথিক। জোব চার্নক স্থায়িভাবে নোঙর করার আগে এই সুতানুটিতেই ছিল আরমেনিয়ানদের একটি আড্ডা। কিছু কিছু ইংরাজ ঐতিহাসিক অবশ্য অনেক তর্ক ফেঁদেছেন আরমেনিয়ানদের দাবি নস্যাৎ করার জন্য। অন্যরা কিন্তু সবিনয়ে মেনে নিয়েছেন দানশীল সুকিয়ার পত্নী রেজাবিবির সমাধি-ফলকটি খোদাই করা হয়েছিল চার্নক এখানে নামবার অন্তত ষাট বছর আগে। খ্রিস্টীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী সে কবর ১৬৩০ সালের। মেনে নিলাম, তবু তর্ক চলতে পারে। কিন্তু তর্কের খাতিরেও কি এটি রক্ষা করা কর্তব্য নয়? এমনকী, কাছাকাছি পড়ে থাকা সেই ফলকটিকে বাঁচিয়ে রাখার পক্ষপাতী আমরা, যাতে লেখা এমন একটি বাক্য ইংরাজি করলে যার মানে দাঁড়ায় অনেকটা এই রকম:
This is the tomb and resting place of the body of a certain unhappy and wretched clergyman, hardened in sins. কে তিনি? নামটি অবশ্য তাঁর গোপন নেই। কিন্তু কী তাঁর পাপ?
নাম ছিল তার অ্যাঞ্জেলিকা
পার্ক স্ট্রিটের এই কোণটিতে পা দিলেই আমার মনে পড়ে যায় অ্যাঞ্জেলিকার কথা। এখানেই ফুটপাতের ধারে ছোট লোহার গেটটির ওপারে শুয়ে ছিলেন তিনি নরম ঘাসের তলায়। জীবনের জন্য তাঁর দীর্ঘশ্বাস বুঝি ফেটে বের হয়েছিল ইটপাথরের নকশায়। ছিমছাম একটি স্মৃতিসৌধ। বুকে লাতিন ভাষায় শ্বেতপাথরে খোদাই করা হাহাকার। বাংলায় বললে ছত্র কয়টির অর্থ: এখানে শায়িত অ্যাঞ্জেলিকা দ্য ক্যারিয়ন তিরেত্তা। তিনি ছিলেন তারভিসিয়োর এদুয়ার্দোর প্রিয় পত্নী। ১৭৯৬ সালের ১৫ জুন মৃত্যু কেড়ে নেয় তাঁকে। তখন তাঁর বয়স আঠারো। মাত্র তিনদিন আগে উদযাপিত হয় ওঁদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী! তাঁর পবিত্র স্মৃতিতে শোকার্ত স্বামী স্থাপন করেছেন এই প্রস্তরখণ্ড।
সে পাথর আজ আর নেই। উধাও হয়ে গেছে সেই বিষন্ন বাগানটিও, যেখানে মানুষের অশ্রু ফুটে থাকত রকমারি ফুল হয়ে, এবং এক এক মরসুমে প্রকৃতি যাকে সাজাত রঙবেরঙের ফুল দিয়ে। কিছুই আর নেই এখন। সব উধাও। এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত এক স্কুলবাড়ি। চলতে চলতে কানে আসে নবীন পড়ুয়াদের কাকলি। কোনও দিন হঠাৎ হঠাৎ গাড়ির জটলা। উচ্ছৃঙ্খল হর্ন-এর অর্থহীন গলাবাজি। মা-মাসিদের ভিড়। হই হই করে বেরিয়ে আসছে কচি-কাঁচাদের দল। প্রাণের উচ্ছ্বাস। মৃত্যু নয়, জীবনের জয়গান। তবু কেন জানি না, পার্ক স্ট্রিটের এই কোণটিতে এলেই আমার মনে পড়ে যায় অষ্টাদশী অ্যাঞ্জেলিকার কথা। সেই সঙ্গে একদা ঈশ্বরের নিজস্ব ওই আধ একর জমির কথা। অ্যাঞ্জেলিকার প্রতিবেশী প্রতিবেশিনীদের কথা। কোথায় গেলেন ওঁরা? কেনই বা? অতি বৃদ্ধরা যেমন চলে যান, তেমনই অতি-মৃতরাও কি? ‘ওল্ড ডেড’ বলেই কি চোখের সামনে থেকে সরে যেতে হল এদুয়ার্দো তিরেত্তার গিন্নি আঠারো বছর বয়সের মেয়ে অ্যাঞ্জেলিকাকে?
অথচ এমনটি হওয়ার কিন্তু কথা ছিল না। স্বামী তিরেত্তা জানতেন তাঁর ভালবাসার বউকে তিনি যেখানে রেখে যাচ্ছেন, চিরকাল তিনি সেখানেই থাকবেন। এখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে তাঁর স্মৃতিসৌধ। লাতিনে লেখা ওই ফলক চিরকাল পথিককে বলে দেবে তাঁর ভালবাসার কথা। তিরেত্তা যেন সেদিন স্বপ্নে শাহজাহান। কলকাতায় তিনি অপরিচিত পুরুষ নন। তিনিই আমাদের চেনাজানা টিরেটা সাহেব। তাঁর নামেই চিৎপুরের পথের ধারে টেরিটি বাজার। অ্যাঞ্জেলিকা তাঁরই স্ত্রী। ওঁকে নিয়ে সেদিন কী কাণ্ডই না করেছিলেন শোকাহত তিরেত্তা।
তার আগে এদুয়ার্দোর কাহিনী। এদুয়ার্দো তিরেত্তা জাতিতে ইতালিয়ান। ওঁদের পারিবারিক ভদ্রাসন ছিল ভেনিস-এর কাছে তারভাসিও। তরুণ তিরেত্তা নাকি ছিলেন স্বনামধন্য কাসানোভার অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং সহচর। কীভাবে কেউ জানেন না, ভেনিস-এর তিরেত্তা একদিন ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছালেন ইংরেজের শহর কলকাতায়। জানা গেল পেশায় তিনি স্থপতি, আর্কিটেক্ট। অষ্টাদশ শতকের কলকাতা। পশ্চিমী ভাগ্যান্বেষীদের এই শহর স্বর্গ। সে স্বর্গে ঠাঁই করে নিতে কোনও অসুবিধা হল না তিরেত্তার। কোম্পানির কর্তারা তাঁকে শহরের রাস্তাঘাট এবং ঘরবাড়ি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিলেন। এদুয়ার্দো তিরেত্তা নিযুক্ত হলেন সুপরিনটেনডেন্ট অব স্ট্রিটস অ্যান্ড বিল্ডিংস। টাকার ফলন্ত, গাছের ডাল তাঁরও হাতে, ঝাঁকি দিলেই মাটিতে ঝরে পড়ে মোহর। সুতরাং দেখতে দেখতে আঙুল ফুলে কলাগাছ। এদুয়ার্দো তিরেত্তা কলকাতার অন্যতম ধনী অভিযাত্রী। ট্যাংক স্কোয়ারের অদূরে সাহেব পাড়ার উপান্তে বিরাট বাজার তাঁর। সেখানে আর সব পণ্যের চেয়েও বেশি বিক্রি হয় যত রাজ্যের পশু আর পাখি। কে না জানে, চিড়িয়ার শখ ছিল সাহেবের।
১৭৮৪ সালের ছাপা উড-এর মানচিত্রে রয়েছে তেরিত্তিবাজার। সুতরাং, ধরে নেওয়া যায় তিরেত্তা কলকাতায় এসেছেন ক’ বছর আগে। অ্যাঞ্জেলিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে ১৭৯৩ সালে, অর্থাৎ, বাজার পত্তনের বেশ ক’ বছর পরে। অ্যাঞ্জেলিকা বড় ঘরের মেয়ে। তাঁর বাবা একজন সম্রান্ত ফরাসি। তিনি ছিলেন ক্যারিয়ন-এর কাউন্ট। কাউন্ট দ্য ক্যারিয়ন নাকি দেশত্যাগী হয়েছিলেন রাজনৈতিক কারণে। মেয়ে যখন সোমত্ত বাবা নাকি তখন বেঁচে নেই। এদিকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তিরেত্তার তখন পড়ন্ত অবস্থা। ইতিমধ্যেই হাতছাড়া হয়ে গেছে তাঁর বাজার। ১৭৮৮ সালে ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ এক বিজ্ঞাপনে দেখা যায় লটারির আয়োজন চলছে, তাতে প্রথম পুরস্কার তিরেত্তার বাজার। বলা হচ্ছে, পাকা বাজার। জমির পরিমাণ নয় বিঘা আট কাঠা। পাকা বাড়ির চারদিক ঘিরে বারান্দা। বাঁধানো পথ। পাকা স্টল। আনুমানিক দাম কমপক্ষে এক লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার টাকা। বাজার থেকে মাসিক আয় গড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা। তবে ঠিকমতো দেখাশুনো করলে আয় আরও বেড়ে যাওয়ারই সম্ভাবনা। বাজারের সঙ্গে আরও কিছু কিছু সম্পত্তির খবরও ছিল। টাকার অঙ্কে তার পরিমাণ তিন লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা। তিরেত্তা কি দেউলে হয়ে গিয়েছিলেন? নাকি ছড়ানো ছিটানো সম্পত্তি গুটিয়ে আনছিলেন অন্য কোনও পরিকল্পনা মাথায় রেখে?
লটারি হয়ে ১৭৯১ সালে। বাজার জিতে নেন চার্লস ওয়েস্টন। বাজারের উল্টোদিকেই একটা বাড়িতে জন্মেছিলেন তিনি। তৎকালের বিখ্যাত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। তাঁর নামেও রাস্তা আছে কলকাতায়। তিনি এখন শায়িত পার্ক স্ট্রিটেরই প্রান্তে, সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে। অন্যান্য বিষয়-আশয় নিশ্চয় বিকিয়ে গিয়েছিল তখন। তবু, দু’বছর পরেই দেখি এদুয়ার্দো বিয়ে করে সংসার পেতেছেন অ্যাঞ্জেলিকাকে নিয়ে। সে নিশ্চয় দেউলিয়া বা ভবঘুরে ভিখারির বিয়ে নয়। কেননা, হঠাৎ সুখের দিন যখন ফুরিয়ে গেল, তিরেত্তা তখনও কিন্তু মেজাজে ভারতীয় বাদশাহদের মতো।
স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ওরা ছিলেন রোমান ক্যাথলিক। সুতরাং অ্যাঞ্জেলিকাকে প্রথম সমাহিত করা হয়েছিল বৈঠকখানায় পর্তুগিজদের গোরস্থানে। লোকে বলত, বারেত্তো বেরিয়াল গ্রাউন্ড। জোসেফ বারেত্তো-ও কলকাতায় একজন নামী বিদেশি। তাঁর নামেও রাস্তা আছে কলকাতায়, বারেত্তো লেন। বৈঠকখানার মাটির তলায়ই ঘুমিয়েছিলেন অ্যাঞ্জেলিকা, তিরেত্তার প্রাণ। কিন্তু হঠাৎ কী মাথায় এল, তিরেত্তা স্থির করলেন অ্যাঞ্জেলিকাকে তিনি ওখানে থাকতে দেবেন না। কিছুতেই অসম্মান হতে দেবেন না তাঁর প্রিয় পত্নীর। তিনি পার্ক স্ট্রিটের ধারে এক টুকরো জমি কিনে ফেললেন। সাকুল্যে আধ একর, দেড় বিঘা মাটি। তারপর বৈঠকখানার কবর খুঁড়ে অ্যাঞ্জেলিকার শবাধার এনে নামিয়ে রাখলেন নিজের জমিতে। ঠিক কী ঘটেছিল, সেটা স্পষ্ট নয়। ওয়ারেন হেস্টিংসকে এক চিঠিতে তিরেত্তা লিখেছিলেন, এ ব্যবস্থা করতে হচ্ছে আমাকে বাধ্য হয়ে, এমন এক দুঃখজনক পরিস্থিতিতে পড়ে, যা বলার মতো নয়—‘আন্ডার সারকামস্ট্যান্সেস টু পেনফুল টু রিলেট।’ অনেকের অনুমান, বৈঠকখানার গোরস্থানে তখন ঠাঁই কম, মৃতের ভিড় বেশি। হয়তো তিরেত্তা শুনেছিলেন, অ্যাঞ্জেলিকার সমাধিতেও অন্য শবাধার নামানো হতে পারে। হয়তো তা-ই করতে যাচ্ছিলেন পতুর্গিজ গোরস্থানের পরিচালকরা। ক্ষুব্ধ তিরেত্তা তাই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন অ্যাঞ্জেলিকার জন্য। স্বতন্ত্র ঘুম-ঘর সে জন্যই।
কেউ বলে এই অভাবিত কাণ্ড করেছিলেন তিনি অ্যাঞ্জেলিকা চলে যাওয়ার দু’ মাসের মধ্যে। কেউ বলেন দু’বছর পর। শিলালিপি অনুসারে অ্যাঞ্জেলিকার মৃত্যু ১৭৯৬ সালে ধরে নেওয়া ভাল, সে বছরই পার্ক স্ট্রিটের এই কোণে স্থাপিত হয়েছিল নতুন এক গোরস্থান। তার প্রায় তিন দশক আগে (১৭৬৭) রাস্তার ওপারে দুয়ার খোলা হয়েছে শহরের বৃহত্তম মৃত-উপনিবেশের। তার উলটো দিকে, রাস্তার ওপারে আর এক মৃতলোক—নর্থ পার্ক স্ট্রিট। তার একাংশের নাম মিশন সিমেট্রি। পার্ক স্ট্রিট তখন পার্ক স্ট্রিট নয়, বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড। গোরস্থানের রাস্তা ট্যাংক স্কোয়ারের কাছে ইংরাজের আদি গোরস্থানের আর ঠাঁই নেই। কাঁধে শব নিয়ে বাহকেরা তাই নিশুতি রাতে মেঠো পথ আর জলজঙ্গল পেরিয়ে হাজির হতেন এই প্রান্তে। শব নিয়ে নীরব পদযাত্রা চলত সাধারণত রাতে, মশালের আলোয় পথ খুঁজে নিয়ে। কেননা, মৃত্যু সত্য হলেও অভিযাত্রীদের মনোবল রক্ষা করার জন্য অন্ধকারের আড়াল দেওয়াই ভাল। কারণ, মুখে মুখে তখন ফেরে দুটি শব্দ—‘টু মনসুনস্’। দুই বর্ষা বই তো নয়। তারই মধ্যে নিশ্চয় শহরময় রটে গিয়েছিল এদোয়ার্দ তিরেত্তার পাগলামির খবর। অ্যাঞ্জেলিকাকে নিজের মাটিতে শুইয়ে দিয়ে তিরেত্তা ঘোষণা করলেন, এ গোরস্থানের ফটক শহরের রোমান-ক্যাথলিক এবং তাঁদের আপনজনদের জন্য খোলা রইল। অ্যাঞ্জেলিকার সমাধির ওপর স্মৃতিমন্দির গড়লেন তিনি। তারপর সাদা পাথরের ওপর লাতিনে খোদাই করালেন নিজের ভালবাসার কথা। আর তারপর? ওয়ারেন হেস্টিংসকে তিরেত্তা লিখেছিলেন, অ্যাঞ্জেলিকা একটি শিশুসন্তানকে রেখে গেছে। মনে হয়, সেকালের অসংখ্য কমবয়েসী মেয়ের মতো এই ফরাসি মেয়েটিও মারা গিয়েছিলেন মা হতে গিয়ে। তিরেত্তা লিখেছিলেন, এই শিশু অ্যাঞ্জেলিকার ভালবাসার অঙ্গীকার,—‘এ লিটল বেবি অ্যাজ এ প্লেজ অব হার ফ্রেন্ডশিপ।’ কোথায় গেল সেই শিশু, কোথায় তিরেত্তা, কেউ তা জানেন না। অনেকেরই অনুমান, তারপরই কলকাতা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন দুঃখী তিরেত্তা। কলকাতায় কোনও চিত্রগুপ্তের খাতায়, কোনও ‘পাদরি গুদামে’ অ্যাঞ্জেলিকা ছাড়া আর কোনও তিরেত্তার খবর নেই।
তিরেত্তা নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। কিন্তু পিছনে রয়ে গেল তিরেত্তা বাজার। তাঁর নামে একাধিক রাস্তা এবং এই গোরস্থান, নাম যার তিরেত্তা বেরিয়াল গ্রাউন্ড। আর রইলেন তাঁর প্রিয় অ্যাঞ্জেলিকা। স্থপতি স্বামীর ভালবাসার নিদর্শন সুন্দর একটি স্মৃতিস্তম্ভ। তার তলায় বেশিদিন নিঃসঙ্গতার মধ্যে কাটাতে হয়নি বেচারা অ্যাঞ্জেলিকাকে। পরের বছরই এলেন মার্ক মূর্তি। তার পরের বছর জেরিনো মানিনা। ওঁরাও ভেনিসের অভিযাত্রী। তারপর ক্রমে আরও। অ্যাঞ্জেলিকাকে ঘিরে পার্ক স্ট্রিটের ওই কোণে তিরেত্তার জমিতে সমবেত যেন গোটা ইউরোপ। শুধু ইউরোপ কেন, ম্যাকাও, মরিশাস— অ্যাঞ্জেলিকার দরবারে অনেকেই। তবে সবচেয়ে বেশি ভিড় করে এলেন যেন ফরাসিরা। বর্দো, ব্রেহা, নস্ত, এলবা, হেনবোঁ, নোমন্দি, পের্শ—ফ্রান্সের নানা এলাকার নানা মানুষের শেষ ঠিকানা তিরেত্তা বেরিয়াল গ্রাউন্ড। সে কারণেই এ গোরস্থানের আর এক নাম—ফ্রেঞ্চ সিমেট্রি। ইংরেজের কলকাতায় সে যেন এক টুকরো ফ্রান্স।
কলকাতার অন্য গোরস্থানগুলোতে ফরাসিরা অনুপস্থিত, এমন নয়। তা ছাড়া কলকাতার অদূরে চন্দননগর। ইংরেজ ফরাসির বিরোধ এবং প্রতিযোগিতার ইতিহাস যেমন সত্য, তেমনই সত্য এই, ব্যক্তিগতভাবে কলকাতায় অনেক ইংরেজের সঙ্গেই বন্ধুত্ব ছিল চন্দননগরের কোনও কোনও ফরাসি রাজপুরুষের। দুই সমাজের দ্বিতীয়, তৃতীয় স্তরে তো অবশ্যই। চন্দননগরের সবচেয়ে গৌরবের কাল বোধ হয় দুপ্লের আমল (১৭৩১-১৭৪১)। চন্দননগর নাকি রীতিমত দর্শনীয় শহর তখন। দু’ হাজার পাকা বাড়ি সেখানে। পার্ক, গির্জা, চওড়া রাস্তা, বিলাসী হোটেল—সব মিলিয়ে জমজমাট জনপদ। শহরের কাছেই জিরাটিতে ভার্সাইয়ের আদলে জাঁ আঁরি পিরোঁর প্রাসাদ। চন্দননগরের গভর্নর যখন মাঁসিয়ুব শেভালিয়ের (১৭৬৯-১৭৮৭) তখন সেখানে নাকি এক সন্ধ্যায় আয়োজিত হয়েছিল কলকাতা চন্দননগরের এক মিলিত মজলিসের। শত্রুতা ভুলে গিয়ে সেখানে হাজির হয়েছিলেন কলকাতার বড় সাহেবরাও। হেস্টিংস, ফ্রান্সিস, ক্লেভারিং থেকে শুরু করে কে নয়? প্রাসাদে নাকি সে রাত্রে সুন্দরীদের হাট। কলকাতা তো বটেই, চুঁচুড়া, শ্রীরামপুর—চারদিক থেকে ঝেঁটিয়ে সবাই জড়ো হয়েছিলেন জিরাটিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বিখ্যাত সুন্দরী কাত্রিন নোয়েল ওয়েবলি ওরফে মাদাম গ্রান্ড সেকালের চন্দননগরেরই মেয়ে। কোম্পানির কর্মচারী জর্জ ফ্রান্সিস গ্রান্ড-এর বিয়ে ১৭৭৭ সালে। তারপর অবশ্য ওকে নিয়ে কলকাতায় নানা কাণ্ড। কোর্ট কাছারি। অ্যাঞ্জেলিকা যদিও মাদাম গ্রান্ড-এর সমবয়সী নন, তবে ইংরাজ আর ফরাসির মধ্যে যখন সম্পর্ক বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ, তখনই কলকাতায় তাঁর বিয়ে (১৭৯৩)। তিরেত্তার সঙ্গে ওঁর বিয়ের আগের বছরই (১৭৯২) ফরাসি বিপ্লবের ভঙ্গিতে গণ-বিদ্রোহ। একজন পসারহীন আইনজীবীর নেতৃত্বে জনতা চন্দননগরের গভর্নরকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় জিরাটির প্রাসাদে। তারপর আবার তাঁকে শোভাযাত্রা করে বিজয়গর্বে ফিরিয়ে নিয়ে আসে চন্দননগরে। ফরাসি কর্তৃপক্ষ বিদ্রোহীদের দমন করেছিলেন ইংরেজদের সাহায্যে। সেই সুবাদে আবার কিছুকালের জন্য চন্দননগরে কায়েম হয় ইংরেজ আধিপত্য। তারই মধ্যে কলকাতায় ইতালিয়ান তিরেত্তা আর ফরাসি অ্যাঞ্জেলিকার বিয়ে। মৃত্যু। এবং পার্ক স্ট্রিটের এই কোণে ফরাসিদের নিয়ে দেড় বিঘা জমিতে উপনগরীর পত্তন। ফ্রেঞ্চ সিমেট্রি, আগেই বলেছি, অনেকের চোখে কলকাতায় এক টুকরো ফরাসি দেশ যেন। সমাধির বুকে-পিঠে সাঁটা অধিকাংশ লিপিগুলোই ছিল ফরাসিতে। শহরের আর কোথায় একসঙ্গে দেখা মেলে এত ফরাসি নারী পুরুষের? ১৭৯৬ থেকে ১৮৯৪ সালের মধ্যে একশো আটজন সমাধিস্থ হয়েছিলেন তিরেত্তার ফরাসি গোরস্থানে। কলকাতার অন্যান্য গোরস্থানের তুলনায় অবশ্য এখানে ভিড় কিছুটা কম। বছরে এক বা দু’জন হয়তো। অনেকের মনে হবে অনুপাতে কয়েক বিন্দু অশ্রুমাত্র। তবে মনে রাখতে হবে, এখানে ঠাঁই পেয়েছেন বিশেষ ধর্মমতের মানুষ এবং বলতে গেলে বিশেষ জাতিরও। সেদিন থেকে অ্যাঞ্জেলিকাকে নিয়ে যে মৃতের উপনগর গড়ে উঠেছিল, কলকাতার পক্ষে নিশ্চয়ই তা ছিল রীতিমত গুরুত্বপূর্ণ। ফরাসিদের ছিল চন্দননগর, কলকাতার ছিল অ্যাঞ্জেলিকা এবং তাঁর প্রতিবেশীরা।
অ্যাঞ্জেলিকাকে আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না পুরনো ঠিকানায়। চিরকালের মতো মুছে ফেলা হয়েছে তাঁর স্মৃতিসৌধ। সেইসঙ্গে বলতে গেলে চিরকালের মতো হারিয়ে গেলেন আরও একশো সাতজন। তাঁরা কারা? কী তাঁদের পরিচয়? অ্যাঞ্জেলিকা ইতিমধ্যে আমাদের চেনা মেয়ে। তাঁর দুঃখের কাহিনী আমাদের জানা। মাত্র আঠারো বছর বয়স হয়েছিল তাঁর। অচেনা এই বিদেশিনীর জন্য এদেশেও হয়তো অনেকে চোখের জল ফেলেছেন। অ্যাঞ্জেলিকা কিন্তু সেই নিষ্ঠুর কালের কাহিনী, যখন কলকাতায় এভাবে নিত্য ঝরে পড়ছেন তরুণী মায়েরা। রাস্তার ওপারে সাউথ পার্ক স্ট্রিটে হাতে নোটবুক নিয়ে উঁকি দিয়েছিলেন এক ইতিহাস-লেখক। তিনি জানিয়েছেন সাউথ পার্ক স্ট্রিটে মাটির তলায় শায়িত অগণিত বালিকাবধূ, আর শিশু।
এমন মহিলাও সেখানে আছেন—যিনি ছিলেন চৌদ্দটি সন্তানের গর্ভধারিণী। দু’জন কোলে ধরেছেন দশটি করে সন্তান। ফ্রেঞ্চ সিমেট্রিতে অ্যাঞ্জেলিকার প্রতিবেশীদের মধ্যেও ছিলেন বেশ ক’জন বালিকাবধূ। যেমন রুসাক দেলফিন মারি। বয়স ছিল তাঁর যোল। ওয়াল্টার স্কোয়ারস-এর স্ত্রী মেরি। তাঁর বয়স কুড়ি। আর একজন মিসেস ক্যারোলিন স্টুয়ার্ট। তিনি ছিলেন কলকাতার এক অ্যাসিস্টান্ট সার্জনের স্ত্রী। মেয়েটির বয়স হয়েছিল মাত্র সোল। চিকিৎসক স্বামী তবু তাঁকে বাঁচাতে পারেননি। ফ্রেঞ্চ সিমেট্রিতে অতএব অ্যাঞ্জেলিকার অনেক সমবয়সী সঙ্গিনী।
মায়েদের মতোই ঝাঁকে ঝাঁকে ঝরে পড়ত কুঁড়িও। সাউথ পার্ক স্ট্রিটের সিমেটারিতে পা দিলে চোখের জল ধরে রাখা কঠিন। রাশি রাশি কচিকাঁচা ওখানে। সেখানে একখণ্ড পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে একসঙ্গে টুইসডেন পরিবারের চারটি শিশুকে। ১৮২০ থেকে ১৮২৭ সালের মধ্যে মা-বাবার কোল ছেড়ে পালিয়ে যায় তারা। কারও বয়স এক বছর দশ মাসের বেশি নয়। ফরাসি গোরস্থানেও ছিল বেশ কিছু শিশুর কবর। তাদের অধিকাংশের বয়স এক থেকে ছয়। কারও কারও আরও কম। এক মাসে একই দিনে (১৮৩৩) বিদায় নিয়েছিল আলফ্রেড এডোয়ার্ড হোয়াইট এবং জোসেফ এডোয়ার্ড হোয়াইট নামে দুই ভাই। একজনের বয়স আট, অন্যজনের পাঁচ। দুমেব-দের এক শয্যায়ই ছিলেন মা-বাবা তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে। একটি শিলালিপিতে বলা হয়েছিল বাবার শোক সইতে না পেরে শিশুকন্যা মারা গেল ছেষট্টি দিনের মধ্যে।
অন্যদের মৃত্যুর হেতু কী। প্রাণহীন পাথর কখনও তারও উত্তর দেয় বইকি। গোরস্থানগুলো একটু খুঁটিয়ে দেখলে জানা যায়, কলকাতায় তখন মৃত্যু হানা দিয়ে ফিরছে নানা বেশে। কলেরা, বসন্ত, পাক্কা জ্বর, জলাতংক ছাড়াও ছিল ‘আরাকান ফিভার’,বর্ধমান ফিভার’। তা ছাড়া নৌকোডুবি, বজ্রাঘাত, ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়া বা দুর্ঘটনার ফলে মৃত্যু তো ছিলই। অনেক ব্যাধিই তখন রহস্যময়। ফলে চিকিৎসা অজানা। সুতরাং, সাউথ পার্ক স্ট্রিটে সমাহিত একজন সম্পর্কে বলা হয়েছে, মৃত্যুর হেতু হুঁকোর নেশা। কবি ল্যান্ডার-এর প্রেমিকা রোজ এলমার নাকি মারা গিয়েছিলেন আনারসের মতো ‘বিপজ্জনক’ ফল খেয়ে। খুঁটিয়ে দেখলে তিরেত্তা গোরস্থানেও নিশ্চয় মিলতে পারত আধিব্যাধি সম্পর্কে নানা খবর। কিন্তু সেভাবে আর দেখার সুযোগ হল কই। তার আগেই অ্যাঞ্জেলিকা এবং তাঁর প্রতিবেশী-প্রতিবেশিনীরা চলে গেলেন পুরোপুরি চোখের আড়ালে। এদেশ এবং বিদেশের ইতিহাস-সচেতন কিছু মানুষ অবশ্য শেষ চেষ্টা করেছেন তিরেত্তা গোরস্থানের স্মৃতি চির অবলুপ্তি থেকে রক্ষা করার। কিছু স্মৃতিফলক তাঁরা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন সাউথ পার্ক স্ট্রিটের ভিতরে। হাহাকারের সমুদ্রের মধ্যে আরও কিছু জমাট অশ্রুবিন্দু। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, এই ব্যবস্থা কোনও গোরস্থানের বিকল্প হতে পারে না। পঞ্চাশের দশকে নর্থ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান যখন মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়, তখনও কিছু দেওয়ালে গেঁথে রাখা হয়েছিল অশ্রু-শিলালেখগুলো। কোথায় এখন সেগুলো? উত্তর পার্ক স্ট্রিটে এখন শুধু খাড়া আছে একটি কবর। কলকাতায় প্রথম প্রোটেস্ট্যান্ট, যাজক মিশন চার্চের প্রতিষ্ঠাতা। কিয়েরনান্ডের পারিবারিক সমাধি এটি। এখনও এখানেই শায়িত তিনি। দুই পাশে তাঁর দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরে পরেই নাকি শোক ভুলতে পাদরি সাহেব নিজেকে সমর্পণ করেন, ‘এশিয়াটিকাস’-এর ভাষায়,—‘টু সিল্কেন এমব্রেসেস অব অ্যান ওপুলেন্ট বিউটি।’ নর্থ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানটি যদি অক্ষত থাকত, তবে আরও অনেক বিচিত্র চরিত্রেরই মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পেতেন একালের মানুষ। কর্নেল অ্যাকিলিস, ক্যাকপ্যাট্রিক ওরফে হায়দ্রাবাদের হাসমতজং। ঔপন্যাসিক থ্যাকারের বাবা রিচমন্ড থ্যাকারে, ওয়ারেন হেস্টিংস-এর বন্ধুতনয় একদা শহরের শ্রেষ্ঠী কুলচূড়ামণি জন পামার, বেগম সমরুর অনুচর বা সহচর জর্জ আলেকজান্ডার ডাইস—আরও কত কে। সন্ধানী কোথায় আজ খুঁজে পাবেন তাঁদের? অ্যাঞ্জেলিকা এবং তাঁর সঙ্গী ও সঙ্গিনীদের সম্পর্কেও একই কথা। অ্যাঞ্জেলিকার স্মৃতিলিপি ইতিমধ্যেই লুপ্ত। সেটি নাকি আগেই তুলে নিয়ে গেছে কে বা কারা। অন্যান্য লিপির মধ্যেও সবগুলো খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেগুলো আছে সেগুলোও অন্যত্র, আদি অবলম্বনহীন। অতএব বলা চলে—ছিন্নপত্র।
অথচ একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, গোরস্থানের স্মৃতিচিহ্নগুলো শুধু বিশেষ কালের মানবিক দলিল মাত্র নয়, বলতে গেলে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের মতো কালের ইতিহাস। মানুষের ইতিহাস। কৃতিত্ব এবং ব্যর্থতার ইতিহাস। কী নেই সেখানে? স্থাপত্যের নিদর্শন। ভাস্কর্যের নমুনা। হরফের হেরফের। যুগের বাক্ভঙ্গি। শব্দের ব্যবহার। আধিব্যাধির হদিশ। পরমায়ুর পরিমাপ। ব্যক্তি, শ্রেণী এবং সামাজিক সম্পর্কের নকশা। ঈশ্বর, এবং মৃত্যু সম্পর্কে মনোভঙ্গি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইতিহাসের নানা টুকিটাকি। সুতরাং যদি কেউ কখনও গোরস্থানগুলো সংরক্ষণের জন্য সওয়াল করেন, তবে ধরে নেওয়া ঠিক নয়, তিনি শৌখিন শোকাবিলাসী। ইতিহাস-সচেতন মানুষের কাছে কিন্তু সব স্মৃতিস্তম্ভই তাজমহল। তিরেত্তার গোরস্থানে বা ফ্রেঞ্চ সিমেট্রিতেও ছিল এমনই একশো আটটি তাজমহল। ভুল হল, কিছু কম। সন্ধানীরা বলেছেন, যদিও তিরেত্তার ইচ্ছা ছিল প্রত্যেকের জন্য পৃথক শয্যা, তবু শেষ পর্যন্ত সে রীতি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি ফ্রেঞ্চ সিমেট্রিতে। অ্যাঞ্জেলিকা অবশ্য প্রিয় স্বামীর স্মৃতি নিয়ে প্রায় দুই শতক কাটিয়েছেন নিরুপদ্রবে। কিন্তু আশেপাশে সমাধিস্থ হয়েছেন একাধিক। দুই, তিন, চার, এমন কী পাঁচজন। অবশ্য এক সঙ্গে নয়, এক সময়েও নয়। ওঁদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই গোরস্থানে এমন তেরোটি সমাধি ছিল, যেখানে নানা সময়ে ঠাঁই পেয়েছেন বত্রিশজন। তাছাড়া পুরোপুরি অনামা কবরও ছিল ছাব্বিশটি। বোঝা যায় সব মৃতের আপনজনেরা তিরেত্তার মতো সচ্ছল ছিলেন না। একদিক থেকে শ্মশানে অবশ্য সবাই সমান। কিন্তু সব ব্যাপারে নয়। চোখ মেলে তাকালে শ্রেণীভেদও চোখে পড়ে বই কি। সেটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কারণ, অষ্টাদশ শতকে কলকাতায় মৃতদেহ সমাহিত করা রীতিমত খরচের ব্যাপার। শেষকৃত্যের জন্য পাদরিকে দেয় দক্ষিণার পরিমাণ ছিল ২ থেকে ১০ গোল্ড মোহর! সুতরাং, গোরস্থানে কিছু অনামী মানুষ থাকবেন, কিছু থাকবেন স্মৃতিচিহ্নহীন। সেটা স্বাভাবিক। ইতিহাসে চিরকালই থাকেন নামহীনের দল।
অ্যাঞ্জেলিকার আশেপাশে পার্ক স্ট্রিটে তিরেত্তার গোরস্থানে ক’ বছর আগেও যাঁরা ছিলেন, সেই নামীদের দিকে একবার তাকানো যাক। কলকাতার যে কোনও গোরস্থানের মতোই এখানে শায়িত ছিলেন নানা পেশার মানুষ। তালিকায় ছিলেন একজন ফরাসি কূটনীতিক, একজন ম্যাজিস্ট্রেট, দুই জন অভিজ্ঞ ফরাসি নাবিক, ফরাসি নৌবাহিনীর একজন লেঃ কমান্ডার, একজন ফরাসি জাহাজ নির্মাতা, একজন স্থপতি, একজন গাণিতিক, একজন সংগীতশিল্পী, একজন চিকিৎসক, এবং দুইজন রুপোর কারিগর। কলকাতার রুপোর কারিগরদের তৎকালে এমনই খ্যাতি যে, এখানকার কর্মজীবন-শেষে পশ্চিমীরা যখন স্বদেশের দিকে যাত্রা করতেন, তখন অনেকেই সঙ্গে নিয়ে যেতেন কলকাতার রুপোর বাসন। কারিগররা ছিলেন নাকি অধিকাংশই ইউরোপিয়ান। কে জানে, এই ফরাসি শিল্পীদেরও হয়তো খাতির ছিল তখন। তিরেত্তার গোরস্থানে চার্লস লুই স্মলজ নামে সাঁইত্রিশ বছরের এক ফরাসি ছিলেন, পরিচয়ে যিনি একই সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার, রসায়নবিদ, গাণিতিক এবং সংগীতশিল্পী। ‘আধুনিক বাঁশি’ নাকি ইউরোপে তাঁরই অবদান। ওঁরই পাঁচ বছরের মেয়ে বাবার জন্য কাঁদতে কাঁদতে তাঁর কাছে চলে যায় ক’সপ্তাহের মধ্যে।
অ্যাঞ্জেলিকাকে নিয়েই শুরু। স্বাভাবিকভাবেই ফরাসি গোরস্থানের দুয়ারে দাঁড়ালে প্রথমেই মনে পড়ত অ্যাঞ্জেলো আর তাঁর স্মৃতিতে পাগল-প্রায় তিরেত্তার কথা। তবে অন্যরাও কি সমান আকর্ষণীয় চরিত্র নয়? সাভি পরিবারের কথাই ধরা যাক। তিরেত্তার গোরস্থানে ঘুমিয়ে ছিলেন শুধু ওই পরিবারেরই চৌদ্দজন নারী, পুরুষ, শিশু। পরিবারের আদিপুরুষ অ্যাঞ্জেলো সাভি। তিনি ফ্রান্সের এলবা প্রদেশের লোক। অভিযাত্রী বেশে ঘুরতে ঘুরতে বাংলা মুলুকে। শেষ পর্যন্ত স্থিতি হয় তাঁর যশোহরের কুলবেড়িয়ায়। সেখানে তিনি নীলকর। সাউথ পার্ক স্ট্রিটেও বেশ কয়েকজন নীলকরের সন্ধান মিলবে। ১৮১৯ থেকে ১৮৩২ সালের মধ্যে অন্তত সাতজন নীলকর সমাধিস্থ হয়েছেন সেখানে। কিছু কবরে ‘ফ্রি মার্চেন্ট’ বা স্বাধীন ব্যবসায়ীদের কথা আছে। কিন্তু একচক্কর ঘুরলেই জানা যায়, বিদেশি সওদাগরেরা তখনও চা কিংবা পাটের সন্ধান পাননি। তিরেত্তা বেরিয়াল গ্রাউন্ড বা ফ্রেঞ্চ সিমেট্রিতেও চা নেই, পাট নেই। কিন্তু রয়েছেন এক ফরাসি নীলকরের পরিবার-পরিজন। অ্যাঞ্জেলিকার মৃত্যুর একযুগ আগেই (১৭৮৪) অ্যাঞ্জেলো সাভি এদেশে রীতিমত প্রতিষ্ঠিত নীলকর। মনে হয়, তিরেত্তার গোরস্থানই ছিল এই নীলকর সাহেবের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র। সেই সেকাল থেকে একেবারে গোরস্থানের ফটক বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত (১৮৯২) পুরুষানুক্রমে সাভি-রা শায়িত ছিলেন এখানে। এমনকী, দূর কুলবেড়িয়ায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদেরও সমাধি ছিল পার্ক স্ট্রিটের এই কোণে। সাভি পরিবার কিন্তু এদেশে এবং বিদেশে সুখ্যাত এখনও। গোরস্থানের বাইরেও এখনও রীতিমত জীবন্ত ওঁরা। সাধারণত এমনটি খুব বেশি দেখা যায় না।
অ্যাঞ্জেলিকা বলতে গেলে হারিয়ে গেছেন। কিন্তু এখনও বেঁচে রয়েছেন অ্যাঞ্জেলো সাভি। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা সম্ভব করেছেন সাভি-পরিবারেরই একটি মেয়ে। তিনি অ্যাঞ্জেলো সাভির পৌত্র জন অ্যাঞ্জেলো আঁরি সাভির স্ত্রী এথেল উইনিফ্রেড। এথেল প্রসিদ্ধ লেখিকা। ই ডব্লিউ সাভি নামে তিনি নাকি ছিয়াশিখানা উপন্যাস লিখেছেন। তার মধ্যে দুটি সাভি পরিবারকে নিয়ে। একটির নাম ‘ডটার-ইন-ল’ (১৯১৩), অন্যটি ‘নাইদার ফিস নর ফ্রেশ’ (১৯২০)। প্রথমটি নাকি সাভিদের পারিবারিক কাহিনীকে কেন্দ্র করে। দ্বিতীয়টির প্রতিপাদ্য ইন্দো-ইউরোপীয় বিয়েসাদি। দুটো বইয়ের একটাও এখনও পড়ার সুযোগ পাইনি, সুতরাং হলফ করে বলতে পারছি না, অ্যাঞ্জেলিকার স্মৃতি মুছে ফেলতে গিয়ে একালের কলকাতা তার সামাজিক ইতিহাসের কোনও বর্ণাঢ্য পাতা হারাল কি না। পার্ক স্ট্রিটের ওই কোণে পা দিলে এখন শুধু অ্যাঞ্জেলিকা নয়, মনে পড়ে, অ্যাঞ্জেলোর কথাও। কেবল অ্যাঞ্জেলিকা দ্য কারিয়ন তিরেত্তা নন, এই আকাশের তলায় তিরেত্তার মাটির গভীরে ঘুমিয়ে এলবার জন অ্যাঞ্জেলো সাভির উত্তরপুরুষরাও। একজন নন, দু’জন নন, গুনলে চৌদ্দজন সাভির শেষশয্যা ছিল এখানে। ওঁদের পরিবারের বউ কি উপন্যাস লেখার ছলে বলে দিয়েছেন, এদেশের মানুষের সঙ্গে সাভিদের ছিল বড্ড বেশি মাখামাখি।
একটি তারকার গল্প
এগিয়ে চললাম। কবরের ভিড় ঠেলে যেন চলেছি। লোয়ার সার্কুলার রোডের সিমেট্রিও যেন আস্ত একখানা কবরের বন। রাশি রাশি কবর। প্রতিদিনই দু’ চারখানা করে যোগ হচ্ছে আজও। ইতিমধ্যেই খ্যাত-অখ্যাত, অজ্ঞাত-অবজ্ঞাত মানুষের রীতিমত ভিড় জমে উঠেছে এখানে। যতদূর চোখ যায় এক আকাশের নীচে একমাঠ মানুষ। কোনও মতে গা ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে আছে যেন। অত্যন্ত বিশৃংখল। কিন্তু ভাল করে তাকাতে না তাকাতেই ভদ্র হয়ে উঠল ভিড়টা। পরাজিত সৈনিকের মতো সার বেঁধে, মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ল কবরগুলো। কত কবর, কত মানুষ। দু’ চার ছত্রের লিপিতে স্নেহ-মায়া-মমতা এবং দুঃখ প্রকাশের কী আকুল চেষ্টা। যত্ন করে পড়লে তবে জানা যায়, কে কিংবা কী এরা। কী এদের নাম, কীই বা পরিচয়। পুরুষ অথবা নারী, শিশু কিংবা বয়োবৃদ্ধ। নয়তো সবাই এক—মানুষ এবং মৃত।
নামী যাঁরা, দামি পাথর তাঁদের বুকজোড়া। আজও, পঞ্চাশ কিংবা একশো বছর পরেও, বরাদ্দকৃত অর্থের বিনিময়ে মালী নিত্য ফুল জোগায় তাঁদের কবরে। গোছ গোছ রজনীগন্ধা, নয়তো কচুরিপানার ফুল। যাদের কেউ নেই, তাদের ওপরে বুনো ঘাসের জঙ্গল। উপরের হাল্কা পাথরের ভাঙা আস্তরণের নীচে হাঁ হয়ে আছে তাদের আত্মা, একটুখানি স্নেহদৃষ্টির জন্যে। গাইড তাড়া দিল—চলিয়ে, চলিয়ে।
চললাম। তবে কিনা, আমার প্রার্থিত নামটি শুনে থমকে দাঁড়াল বেচারা নিজেই। কত নাম। (আর স্বভাবতই) কী সব বিদ্ঘুটে নাম। কত মনে রাখতে পারে একজন। দু’চারজন ভাগ্যবান, যাঁদের কবরে বছরে একবারের জন্য হলেও সমাগম হয় বহুজনের, তাঁদের ওরা চেনে। নাম না জানলেও কবরটি ঠিক চিনে রাখে। কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে বলে, এটা কি? যদি না হয়, তবে ওটা, তা না হলে নিশ্চয় সেটা। এটা-ওটা-সেটার পর গোটা তিন-চারেকেও যখন হল না আমার, তখন অনন্যোপায় হয়েই—‘তব আপ দেখিয়ে’ বলে সরে পড়ল বেচারা।
ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী শুনে গম্ভীর হয়ে বললেন, একশো বছরেরও আগেকার ব্যাপার যখন, তখন বুঝতেই পারছেন একটু সময় দিতে হবে স্যার। যদি থেকে থাকে, তবে নিশ্চয়ই পাবেন। কবর না থাকলেও কোথায় ছিল, তার লোকেশনটা অন্তত—অতঃপর বাধ্য হয়ে নামতে হল নিজেকেই। আবার কবর। সেই কবরের অরণ্য। আমার ডাইনে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে—সারি সারি কবর। শত শত, হাজার হাজার কবর। তারই মধ্যে আমি খুঁজে ফিরছি একশো বছরেরও আগেকার একজন অভিনেত্রীকে।
আশ্চর্য। একশো বছর আগে এর বাড়িতে সকাল-সন্ধ্যায় নিশ্চয় ভিড় লেগে থাকত ফ্যানদের। সিভিলিয়ান-মিলিটারি কর্তা-ব্যক্তিদের পালকি আর জুড়িগাড়ির ভিড়। ৯৭ নম্বরের তালতলা বোধহয় তখন মহানগরীর তীর্থ। আর আজ? আজকের লক্ষ লক্ষ নগরবাসীর একজন লোকও সন্ধান রাখে না, কোথায় কোন নির্জনে পড়ে আছে তাঁর অবশেষ।
অবশেষে পেয়ে গেলাম। আমি যেন একেবারে ম্যাডলিনের মুখোমুখি। পাওয়ার আনন্দ বলে বোঝানো দায়। আমি সিনেমা-বিরাগী নই, তবে সিনেমা-উন্মাদও নেই। উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল-নির্বিশেষে তারকারা আমার কাছে মাটির মানুষই। কারও স্ত্রী, কন্যা অথবা বোন মাত্র। তাই তাদের তথাকথিত কোনও শখের ক্রিকেট খেলা দেখার জন্যে আমি কোনও দিন টিকিটের সারিতে দাঁড়াইনি। দূরবিন কষে দর্শনলাভের কৃতার্থ হাসি হাসিনি। গাড়ির নম্বর কিংবা বাড়ির ঠিকানার জন্যে সিনেমাপত্রের সম্পাদক সমীপে বিনীত চিঠিও লিখিনি। অথচ সেই আমিই সেদিন কোনও বিগত অভিনেত্রীর কবরকে সামনে পেয়ে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলাম।
কবর নয়তো, একখণ্ড পাথর। অত্যন্ত সাদাসিধে দীনহীন চেহারা। বহুকালের অবজ্ঞায় নিতান্ত জীর্ণ। লোয়ার সার্কুলার রোড সিমেট্রির দীনতম কবরটির সঙ্গেও বুঝি তুলনা চলে না এর। সেই শ্যাওলা-ধরা পাথরটির গায়ে অতি সংক্ষেপে এবং নীরস গদ্যে লেখা দুটো ছত্র:
“SACRED TO THE MEMORY
OF
MARIA MADELINE TYLOR
who died on 13th May, 1841 AGED 27 YEARS.”
শুধু নামটুকু। কার স্ত্রী, কার কন্যা, কী পেশা কিছু নয়। কেউ প্রয়োজন মনে করেননি সে কথা এই পাথরের টুকরোটির গায়ে লিখে রাখার। কিন্তু পরিচয়-লিপিতে সে কথা থাকলেও সন্ধানীরা জানেন এই ২৭ বছরের মেয়েটির নামে সরগরম তৎকালীন কলকাতার ইতিহাস। মারিয়া ম্যাডলিন টেলর ওরফে মাদাম দারমেনভিল তখন সারা কলকাতার প্রিয়তমা নায়িকা।
টেলরদের আদিবাস অস্ট্রেলিয়া। সিডনিতে। শোনা যায়, তাঁর কালের সবচেয়ে নামজাদা অভিনেত্রী যেমন ছিলেন তিনি, তেমনই তাঁর চেহারা, এবং অভিনয়। তদুপরি কণ্ঠস্বরেও ছিলেন তিনি অদ্বিতীয়া। সারা সিডনি শহর তাই তাঁর অভিনয়ের রাতে ভেঙে পড়ত রঙ্গমঞ্চের দরজায়।
এমনি করে কেটে গেল ছ’বছর। জনপ্রিয়তার শীর্ষে মিসেস টেলর। নাচেন, গান, অভিনয় করেন। আর হয়তো এমনি করেই চলে যেত আরও কিছুকাল, হয়তো চিরদিনই। কিন্তু তা সম্ভব হল না।
বিপত্তি বাধালেন নিজেরই স্বামী মিঃ টেলর। অপদার্থ বেকার কর্মহীন মানুষ। একমাত্র সম্পত্তি তাঁর মারিয়া। স্ত্রীর জনপ্রিয়তা আর রোজগারের ছত্রছায়ায় দিব্যি নিরুপদ্রব দিন কাটাচ্ছিলেন তিনি। তাতে এখনকার মতো তখনকার দিনেও পৌরুষ খুব বিচলিত হত এমন নয়। মিঃ টেলর অন্তত তাতে কোনও হীনম্মন্যতা অনুভব করতেন না। কিন্তু মুশকিল হল, এই ভদ্রলোক অন্য কোনও কাজ না করলেও একটি কাজ করেছিলেন। অতি যত্নে স্ত্রীকে তিনি পরিণত করেছিলেন প্রথম শ্রেণীর মদ্যপে। ফলাফল হিসেবে পরবর্তী কালে দেখা গেল, মারিয়া হারিয়েছিলেন তাঁর কোকিল-কণ্ঠ, আর মিঃ টেলর—তাঁর স্ত্রী।
স্বামীকে ত্যাগ করে নতুন কণ্ঠে ভর করলেন অথবা নতুন ভূত নিজ ঘাড়ে চাপালেন মিসেস টেলর। ভদ্রলোকের নাম ক্যাপ্টেন পিরে সারগেট বা লারগেটিভ। যথাসময়ে দু’জনে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন। আবার নতুন করে ঘর বাঁধতে উদ্যোগী হলেন মিসেস টেলর বা মিসেস লারগেটিভ। উভয়ের মতেই অতঃপর আর অস্ট্রেলিয়াবাস নিতান্ত অনুচিত। কিন্তু যাওয়াই বা যায় কোথায়? এক যাওয়া চলে পূর্বদেশে। নতুন ইংরেজ উপনিবেশ ভারতবর্ষে, কলকাতায়। সারা পশ্চিমের হতচ্ছাড়া ঘর তাড়ানোদের এর চেয়ে নির্ভরযোগ্য দেশ আর কোথায়? তা ছাড়া কলকাতার আকাশ তখনও নিঃসীম নীল। সন্ধ্যার নির্মল আকাশে দু’ একটি তারকা চোখে পড়ে বটে, কিন্তু তারা নিতান্ত অনুজ্জ্বল। ভূতপূর্ব অভিনেত্রী মিসেস লারগেটিউ তাই কলকাতার কথা পাড়লেন।
আপত্তি করলেন না পিরে লারগেটিউও। কলকাতার রূপকথা তাঁর কাছেও অবিদিত নয়। নিজ কানে তিনিও শুনেছেন, রাইটারেরা ওদেশে মুঠোমুঠো সোনা ছড়ায় দু’হাত ভরে, ফ্যাকটরেরা হিরে। এমনকী সাব-অলটার্নদের পকেটে পকেটেও নাকি রাশি রাশি কোহিনূর। সুতরাং কলকাতা যাত্রাই সিদ্ধান্ত হল। কিন্তু পাথেয়?
ক্যাপ্টেন বললেন, সে ভার আমার।
ভদ্রলোকের নামের আগে একটা ‘ক্যাপ্টেন’ পদবি থাকলেও সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কোনও যোগ ছিল না তাঁর। তিনি ছিলেন জেলে নৌ-বহরের কাপ্তেন। তাঁর অধীনে একখানা জাহাজ ছিল। গোপনে গোপনে সেটি বিক্রি করে দিলেন। তার পর তার চেয়েও গোপনে, অতি সন্তর্পণে পাড়ি জমালেন কলকাতায়।
নবদম্পতি কলকাতায় এলেন। অনাহূত হয়েই এলেন। অস্ট্রেলিয়ার স্বনামধন্যা অভিনেত্রী মিসেস টেলর আর তাঁর বর্তমান স্বামী পের লারগেটিউ। কলকাতার মাটি ছুঁতে না ছুঁতেই বড়মানুষিতে পেয়ে বসল লারগেটিউকে। তিনি ‘ব্যারন’ সাজলেন। অতঃপর তাঁর নাম হয়ে গেল হেনরি দারমেনভিল। বাড়ি নিলেন পার্ক স্ট্রিটে। একটা ফ্ল্যাট নয়, আস্ত একখানা বাড়ি।
পার্ক স্ট্রিট তখন জমজমাট। চৌরঙ্গি থিয়েটার উঠে গিয়ে নতুন থিয়েটার সাঁ সুসির উদ্বোধন হয়েছে এখানে। দেখতে শুনতে সে মঞ্চ যেমন, তেমনি তার অভিনয়-খ্যাতি। মিসেস টেলর ওরফে মাদাম দারমেনভিল সেখানে কাজ জুটিয়ে নিতে চাইলেন। স্থায়ী কাজ। প্রত্যাশা হিসেবে তাঁর পক্ষে সেটা অতিরিক্ত কিছু ছিল না। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়ালেন মিসেস লিচ। মিসেস এস্থার লিচ। লিচ সাঁ সুসির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এককালের মালিকও। সাঁ সুসির প্রাণ তিনি। আজকের সিনেমারসিকদের কাছে তিনিও অবশ্য বিগতস্মৃতি। কিন্তু তাঁর জীবনকাহিনীও কম রোমাঞ্চকর নয়। বিশেষ করে কলকাতার আদি নাট্য-আন্দোলনে এস্থার লিচ এমন একটি নাম, যাকে বাদ দিয়ে যে কোনও কাহিনীই অসমাপ্ত থেকে যেতে বাধ্য। মিসেস টেলরের কাহিনী তো বটেই।
লিচ এতদ্দেশীয় জনৈক ব্রিটিশ সৈনিককন্যা। অভিনেত্রী জীবনের শুরু তাঁর দমদমে। আর শেষ নিজহাতে গড়া সাঁ সুসির কক্ষে। তাঁর মৃত্যুকাহিনীও এক করুণ কাহিনী। অপ্রাসঙ্গিক হলেও, তার উল্লেখ বর্তমান উপাখ্যানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ হবে বলেই আমার ধারণা।
১৮৪৩ সালের ২ নভেম্বরের কথা। অর্থাৎ টেলরের মৃত্যুর দু’ বছর পরের কাহিনী। খাস বিলেত থেকে বিখ্যাত অভিনেতা জেমস ভিনিং এসেছেন কলকাতায়। সাঁ সুসিতে অভিনয় করবেন তিনি। সারা হল লোকে লোকারণ্য। নভেম্বরেও হাতে হাতে পাখার ব্যবস্থা করতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। দর্শকদের মধ্যে কলকাতার গণ্যমান্য কেউ বাদ নেই। অবশ্য সবাই ইউরোপিয়ান দর্শক।
অভিনয় চলেছে। সহসা হই-চই কাণ্ড। অভিনয় করতে করতে কখন এক সময় আগুন ধরে গেছে মিসেস লিচের পোশাকে। দাউ দাউ আগুন। দর্শকরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাঁদের চিৎকার, মিসেস লিচের আর্তনাদ, সব মিলিয়ে আনন্দ-উচ্ছল প্রেক্ষাগৃহ মুহূর্তে পরিণত হল আতংকপুরীতে। অভিনয় শেষ না হতেই ভেঙে গেল।
মিসেস লিচের পোশাকের আগুনও নিভে গেল এক সময়। কিন্তু আর জ্বালানো সম্ভব হল না তাঁর জীবনদীপ। মাত্র ক’দিনের মধ্যেই (১৮ নভেম্বর) চিরদিনের মতো বিদায় নিলেন তিনি। সাঁ সুসির পাশেই ছিল তাঁর বাড়ি। আজ সেখানে আর্চবিশপ-ভবন। আর সাঁ সুসি থিয়েটার? ভাল করে তাকিয়ে দেখবেন, আজকের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এখনও খুঁজে পাওয়া যায় তার কংকাল। অবশ্য দুটো বাড়ির গঠনগত ঐক্যের জন্যেই তা সম্ভব হচ্ছে আজও। নয়তো এস্থার লিচের মতো আজও এর স্মৃতিটুকু থেকে যেত ইতিহাসের পাতাতেই।
যা হোক, আমাদের মাদাম দারমেনভিল অতঃপর সাঁ সুসি থেকে নিরাশ হয়ে স্থির করলেন, নিজেই মঞ্চ গড়বেন। মঞ্চ না হোক, অন্তত নিজেই কোনও নাটক কোনও মঞ্চে উপস্থিত করবেন। সেই মর্মে বিজ্ঞাপনও বের হল কলকাতার ইংরেজি কাগজগুলোতে। বিজ্ঞাপিত হল টাউন হলে অভিনয় হবে। নাটকটির নাম The Taming of the Shrew৷ শেকসপিয়ারের নাটক তাতে ক্যাথারিনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন স্বয়ং মাদাম দারমেনভিল। দিন ধার্য হল ২৫ মে, ১৮৪১।
সব ঠিক। টিকিটও বিক্রি হল যথেষ্ট। কিন্তু এবার দেখা দিল আর এক দৈব দুর্বিপাক। যেদিন অভিনয় হওয়ার কথা, ঠিক তার আগের রাত্রিতে কলেরায় প্রাণ হারালেন হেনরি দারমেনভিল। মিসেস টেলারের স্বামী। বিদেশে বিভূঁয়ে একমাত্র বান্ধব স্বামীকে হারিয়ে একেবারে ভেঙে পড়লেন মিসেস টেলার।
স্বভাবতই বন্ধ হয়ে গেল প্রস্তাবিত অভিনয়। দর্শকেরা নিঃশব্দে টাউন হলের দরজা থেকে ফিরে গেল।
মাদাম দারমেনভিলকে তারিখ পরিবর্তন করতে হল। এবার দিন ধার্য হল ১৫ এপ্রিল।
১৫ এপ্রিল। সে দিন টাউন হলে তিলধারণের স্থান নেই। দর্শকদের অভিবাদন করে সামনে এসে দাঁড়ালেন অস্ট্রেলিয়াখ্যাত মিসেস টেলার। গৌরচন্দ্রিকা পাঠ করলেন। তখনকার দিনে ওটাই ছিল রীতি। গৌরচন্দ্রিকা পাঠ দর্শকদের অজানা ছিল না। অভিনয়ের অংশ হিসেবেই তাঁরা সেটুকু গ্রহণ করতেন। অত্যন্ত নিস্পৃহভাবে। কিন্তু সাধারণ স্বাভাবিক পোশাকে মাদাম দারমেনভিল যখন ‘Friends’ বলে শুরু করলেন তাঁর বক্তব্য, তখন নড়েচড়ে কান খাড়া করে বসতে হল সবাইকে। মাদাম দারমেনভিল তাঁর দীর্ঘ উপক্রমণিকায় যা বললেন, সংক্ষেপে তার মর্মার্থ:
‘হে দর্শক-বন্ধু, আমি তোমাদের স্বাগত জানাই। তোমরা এই নবাগতার দিকে দৃক্পাত করো এবং স্মরণ করো সেই দিনটির কথা, যেদিন এই দূর বিদেশে তোমরা পদার্পণ করেছিলে। আশা করি, আমার আজকের আবেদন তোমাদের কাছে ব্যর্থ হবে না, আশা করি তোমাদের প্রত্যেকের অন্তরে সমবেদনা জাগবে এই হতভাগ্য মেয়েটির জন্য। কে জানে, চিরকাল যারা সৌভাগ্যের কোলে লালিত, তাদের পক্ষে কতখানি সম্ভব দুঃখীর মর্মবেদনা অনুভব করা। তবে স্মরণ রেখো হে বন্ধু, এখন যে কথা বলছে তোমাদের কাছে, সে অভিনেত্রী নয়, নারী (The woman, not the actress speaketh now)—হায়, মুহূর্ত পরেই তাকে আবার ধারণ করতে হবে অভিনয়ের মুখোস। প্রয়োজন আমাকে বাধ্য করছে এ কর্মে। অন্তরে আমার অন্ধকার, বুকজোড়া আমার গুরুভার। তবুও একটু পরেই আমায় আনন্দ-নিবেদনের ডালা সাজিয়ে হাজির হতে হবে তোমাদের সামনে। সুতরাং আমার প্রত্যাশা—তোমরা আমার এই মানসিক অবস্থা মনে রেখে আমার আজকের দোষ-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবে।’
তারপর মিসেস টেলার দৃষ্টি ঘোরালেন মঞ্চ-সামলোচকদের দিকে। তাঁদের কাছেও আবেদন জানালেন। দীর্ঘ আকুতি-ভরা আবেদন। ‘তোমরাও আজ আমাকে বিচারকের দৃষ্টি দিয়ে দেখো না।’ Lords of the mind, to you I turn ইত্যাদি।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, নাট্য-সাংবাদিকরা একশো বছর আগেও কলকাতায় ছিলেন জনমনের প্রভু (‘Lords of the mind’)। অভিনেতা, অভিনেত্রীরা তাঁদের কাছে কাতর আবেদন জানাতেন সুবিচারের জন্যে, সহৃদয়তার জন্যে। আজকের চিত্র ও নাট্য সমালোচকরা পূর্বসূরিদের গৌরবে অবশ্যই আত্মপ্রসাদ ভোগ করতে পারেন।
যা হোক, সুঅভিনয়ের কারণেই হোক আর সেই দীর্ঘ কান্নাভেজা আবেদনের ফলেই হোক, টাউন হলে মিসেস টেলারের প্রথম রাত্রি ব্যর্থ হল না।
তারপর দ্বিতীয় অভিনয়-রজনী। এবারও টাউন হল প্রেক্ষাগৃহ। এবার মঞ্চস্থ হবে “Mischief- Making” নামে একটি গীতি-প্রধান হাসির নাটক।
২৯ এপ্রিল অভিনয় হয়ে গেল। এবারও অভূতপূর্ব সাফল্য মিসেস টেলারের।
কিন্তু দর্শকদের করতালিধ্বনির রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই ঘটে গেল আর এক দুর্ঘটনা। টাউন হল থেকে মাত্র কয়েক পা দূরে, বেঙ্গল ক্লাবে। বেঙ্গল ক্লাবের বাড়ি তখন ট্যাংক স্কোয়ার ইস্ট, অর্থাৎ লালদিঘির পুব পাড়ে।
ঘটনাটি এই: ‘মিসচিফ মেকিং’ দেখে এসে যথারীতি নিজ ঘরে ঢুকেছেন বেঙ্গল ক্লাবের জনৈক বাসিন্দা। তার কিছুক্ষণ পরেই তাঁর ঘরে গুডুম গুডুম আওয়াজ। চাকরবাকর দৌড়ে ছুটে এল। ছুটে এল অন্যান্য ঘরের লোকজন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। বিছানায় এলিয়ে পড়ে আছেন মিঃ কক্স। সামনে পিস্তল। মাথার রক্তে সারা বিছানা লাল। আত্মহত্যা করেছেন ক্যাপ্টেন হ্যামিলটন কক্স। ভদ্রলোক ছিলেন ক্যালকাটা ফায়ার ইনসিওর কোম্পানির একজন কর্মচারী। আত্মহত্যা তখনকার কলকাতায় প্রায় প্রতিদিনের ব্যাপার। সুতরাং বেঙ্গল ক্লাবের কোনও ঘরে জনৈক ক্যাপ্টেন হ্যামিলটন কক্সের আত্মহত্যা নিয়ে এতটা কানাঘুষা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হল। কারণ, ভদ্রলোক ছিলেন মিসেস টেলারের বন্ধু। স্বামীর মৃত্যুর পর মিসেস টেলারের অন্তরঙ্গতম বান্ধব এবং শোনা যায়, তাঁদের বন্ধুত্ব তখন অন্তরঙ্গতার স্তর পেরিয়ে আরও গভীরে পৌঁছেছিল। হয়তো একদিন স্বাভাবিক পরিণতিও হত এ বন্ধুত্বের। প্রকাশ্যেই হয়তো পরস্পরের হাত ধরাধরি করে বের হতে পারতেন এঁরা। কিন্তু তার আর সময় পেলেন না ভদ্রলোক।
আসলে, সেইদিনই দেশ থেকে চিঠি পেয়েছেন তিনি একখানা। তাঁর স্ত্রীর লেখা চিঠি। স্ত্রী পুত্র-কন্যাসহ জাহাজে চড়েছেন। আশা করছেন আগামী অমুক তারিখে দীর্ঘ বিচ্ছেদের অবসান ঘটবে ইত্যাদি।
সুতরাং, লোকে বলে, এক বিচ্ছেদের বেদনাকে আর এক বিচ্ছেদের মূল্যে মুছে না দিয়ে জেন্টলম্যানের মতো সব বিরহমিলনের ঊর্ধ্বে উঠে গেলেন কক্স।
আরও বহুবিধ জল্পনা-কল্পনা হল। কিন্তু আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ রহস্যাবৃতই থেকে গেল চিরকাল। যাঁরা জানতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁরাও মৌন রয়ে গেলেন। ফলে জনশ্রুতিই অদ্যাবধি ইতিহাস।
শোনা যায়, কক্স কতকগুলো চিঠি লিখে গিয়েছিলেন মরার আগে। অনেক চিঠি। প্রথমটি লেখা করোনারকে। তাঁকে তিনি অনুরোধ করেছেন, যেন ময়নাতদন্ত ইত্যাদিতে মিছিমিছি তাঁর দেহটাকে অযথা কষ্ট না দেন। আর লিখেছেন, তাঁর শেষকৃত্যে অযথা যেন ব্যয়বাহুল্য না হয়, পাকা সমাধি তাঁর চাই না। দ্বিতীয় চিঠিটি লেখা তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসককে। তাঁকে তাঁর ফি খামে ভরে দিয়ে তিনি লিখেছেন, যেন চারদিকের চাপে তিনি লিখে না দেন যে, সাময়িক মস্তিষ্কবিকৃতিই কক্সের মৃত্যুর কারণ। তৃতীয় চিঠিটি লেখা অফিসের বড়বাবুকে। তাঁকে অভয় দিয়ে তিনি লিখেছেন অফিসের চাবি এবং হিসেবপত্র সব ঠিক আছে। এ ছাড়া ‘বেঙ্গল হরকরা’র মতে কক্স সাহেব আরও একটা জিনিস লিখে রেখে গিয়েছিলেন। তা হচ্ছে একখানা প্রবন্ধ। বিষয়বস্তু: আত্মহত্যা। ওটা তাঁর ছেলেপুলেরা ছাড়া আর কেউ যেন না পড়ে, এই ছিল তাঁর কড়া আদেশ। যা হোক, চিঠির বাক্স তাঁর এখানেই নিঃশেষিত হয়ে গেল না। তারপরও বের হল আরও দু’খানা চিঠি। তাদের উপরে যথাক্রমে লেখা দু’জনের নাম। একজন মিঃ জে. এইচ. স্টকক্যুইলার, অন্যজন মাদাম দারমেনভিল ওরফে মিসেস টেলার।
স্টককুইলার তখনকার দিনের খ্যাতনামা সাংবাদিক। ‘ইংলিশম্যান’ কাগজের সম্পাদক। অভিনেতা-অভিনেত্রী মহলে বিশেষ প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ছিলেন তিনি। চৌরঙ্গি থিয়েটার এবং পরবর্তী কালের সাঁ সুসি বলতে গেলে তাঁরই কীর্তি। মিসেস লিচের প্রতিষ্ঠার পিছনেও ছিল তাঁর ঐকান্তিক উৎসাহ আর সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা। মিসেস টেলারের সঙ্গেও বিশেষ পরিচয় ছিল তাঁর। ‘মিস্চিফ-মেকিং’য়ের দর্শক হিসেবে তিনিও সে রাত্রে উপস্থিত ছিলেন টাউন হলে। কেউ কেউ নাকি অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে তাঁকে কথা বলতেও দেখেছে ক্যাপ্টেন কক্সের সঙ্গে। যা-হোক, তাঁর কাছে লেখা কক্স সাহেবের চিঠিটি কর্তৃপক্ষ প্রকাশের অনুমতি দিলেন না।
এই রহস্য আরও ঘন হয়ে উঠল দিন পনেরো পরে। একদিন ভোরবেলা শহরময় রটে গেল মিসেস টেলার মারা গেছেন। দেখতে দেখতে তাঁর ৯৭ তালতলার বাড়িতে লোক জমে উঠল।
‘আত্মহত্যা,’ নিশ্চয় তবে আত্মহত্যা, আগেই জানতাম, যে শোনে, তার মুখেই এক কথা। টেলারও আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু ডাক্তার রায় দিলে স্বাভাবিক মৃত্যু। স্বামীর মতো মাদাম দারমেনভিলও মারা গেছেন কলেরায়।
লোকে বলল, ডাক্তার মিথ্যে বলে। কেলেংকারি চাপা দিতে চায়।
হয়তো তাই। হয়তো তা নয়। তবে ১৮৪১ সালের ১৩ মে মাদাম দারমেনভিল যে লোকান্তরিত হয়েছেন, এ বিষয়ে বিতর্ক নেই।
কবরটির সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে করছিল, একবার গোপনে জিজ্ঞেস করি: বলুন না মাদাম কোনটা সত্য? লোকেদের কানাঘুষা, না, ডাক্তারের রিপোর্ট। লজ্জার কী আছে, বলুন না কাকে ধরতে চেয়েছিলেন আপনি এমনি করে—কক্সকে, না স্বামীকে? কে ডেকে নিয়ে গেল আপনাকে—মৃত স্বামী, না কক্স?
কিন্তু বলা হল না। তিন লাইনের সেই পরিচয়-লিপিটি যেন আবার পাথর ছুঁড়ে বেরিয়ে এল ওপরে। তারপর এক ধমকে থামিয়ে দিল আমার ভাবনা।
—চুপ। প্লি-জ, এখানে এসব নয়। এই পাথর যার নামে দাঁড়িয়ে আছে এখানে, সে মারিয়া ম্যাডলিন টেলার। সাতাশ বছরের একটি মেয়ে। কারও স্ত্রী নয়, কন্যা নয়, অভিনেত্রী নয়, একটি মেয়ে। একজন মানবী।