কঁহা যাতা? ইধর আও।’ এই কথার সঙ্গেই, রুহিতনের পিঠের ওপর চাপ পড়ল।
রুহিতন দাঁড়িয়ে পড়ল। তার সামনে সাধারণ ছোট দরজা। দু দিকে দেওয়াল, মাঝখান দিয়ে সরু ফালি সঁতসেঁতে ছায়াঘন পথ। মনে হয় বেশি উঁচু হলে মাথা ঠুকে যাবে। সামনে পিছনে দুজন ওয়ার্ডারের মাঝখানে রুহিতন সেই ফালি পথে ঢুকল। কিন্তু তার মনটা বিষাদে ভরে উঠল। পুরনো দিনের কথা মনে করে তার কষ্ট হয়। সে চায় না, পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। যে জীবন তার পিছনে পড়ে রয়েছে, সে জীবনের কথা সে মনে করতে চায় না। ভাবতে চায় না। অথচ আজকাল প্রায়ই পিছনের জীবনটা মনে পড়ে যায়। পিছনের জীবন আর সেখানকার মানুষ। মনে পড়লেই অদেখা শুকনো ঝোরার জলের মতো কোথায় যেন কলকলিয়ে ওঠে। এ বড় বিষাদ।
সামনের ওয়ার্ডার দাঁড়ায়। ডান দিকের দেওয়ালে একটা বন্ধ দরজা। এ দরজা লোহার গরাদের না। মোটা কাঠের পাল্লার দরজা। দরজার গায়ে বেরিয়ে রয়েছে একটা বাঁকানো লোহার শিক। সেটা ধরে নাড়া দিতেই দরজার ওপারে শব্দ বেজে উঠল। তৎক্ষণাৎ দরজার গায়ে একটি কয়েক ইঞ্চি জানালার পাল্লা খুলে গেল। দরজার ওপার থেকে দুটি চোখ উঁকি দিল। সেই চোখের সঙ্গে চোখাচোখি হল রুহিতনের আর ওয়ার্ডারদের। পাখির খাঁচার থেকেও ছোট পাল্লা বন্ধ হয়ে গেল, চোখ অদৃশ্য হল। ভিতরে চাবির গোছা বা শিকলের ঝনঝন শব্দ হল। দরজা খুলে গেল।
দরজার চৌকাঠ উঁচু সিমেন্ট জমানো। সামনের ওয়ার্ডারের পিছনে রুহিতন চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঢুকল। পিছনের ওয়ার্ডারও ভিতরে এল। দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। সামনে একটা অন্য জগৎ। জেলখানাই। তবু–
দরজার কাছ থেকে তিরিশ-চল্লিশ হাত দূরে মাথায় ছাদ ঢাকা, চারপাশে দেওয়াল ঘেরা একটা ঘরের মতো। বাঁ দিকে একটা লম্বা চালা। রুহিতন ঠিক মতো খেয়াল করে না, লম্বা আর চওড়া উঠোনে কটা গাছ ডাইনে বাঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত জায়গাটাই প্রায় ছায়া ঘেরা ঠাণ্ডা। কয়েদির পোশাক পরা কয়েকজন এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিল। উঠোনটার মাঝখানের বাঁধানো নালা দিয়ে কলকল করে পরিষ্কার জলের স্রোত বহে যাচ্ছে। রুহিতনের ডান দিকে ঘরের দরজার কাছে কয়েকজন পোশাক পরা বন্দি জোট হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কোনও কথা বলাবলি করছিল। কয়েকজন কতজন, রুহিতন ঠিক হিসাব করে দেখল না, ওয়ার্ডারও এদিকে ওদিকে দাঁড়িয়েছিল বা চলাফেরা করছিল। দরজা খোলা বন্ধের শব্দে প্রায় সকলেই রুহিতনদের দিকে তাকিয়েছিল। প্রায় সকলের চোখেই সন্দেহ আর অপরিচয়ের জিজ্ঞাসা। রুহিতন কুরমি। রুহিততন! নির্বাক আর সন্দিগ্ধ উঠোনটাকে চমকিয়ে দিয়ে একটা উল্লাসের চিৎকার বেজে উঠল।
রুহিতন দেখল চোখের পলকে একটা মূর্তি তার দিকে ছুটে এল। দু হাতে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে, আর এক বার চিৎকার করে উঠল, রুহিততন! কমরেড!…
ইতিমধ্যে রুহিতনও লোকটির মুখ দেখে নিয়েছিল। খেলু চৌধুরী। খেলু চৌধুরী ধরা পড়েছে, এ কথা সে আগেই শুনেছিল। যেমন শুনেছে দিবা বাগচিও নাকি ধরা পড়েছে। সে বিশ্বাস করেনি। খেল চৌধুরীর গ্রেপ্তারের কথা এখন আর বিশ্বাস না করে উপায় রইল না। উত্তেজনা আর উল্লাস রুহিতনের প্রাণেও কম না। এমন একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর নেতার দেখা সে বহুকাল পায়নি। এরাই তো পথ দেখিয়েছিল। এদের সঙ্গেই তো শুরু। তারপরেও অনেক এসেছে। তবু এদের সঙ্গে সম্পর্ক আলাদা। রুহিতনও খেলু চৌধুরীকে দুহাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। সে চিৎকার করে উঠল না, প্রায় গোঙানো স্বরে বলল, অই ওহে খেলুবাবু! আহ! খেলুবাবু হে!!..’
ওয়ার্ডের ভিতরে এবং বাইরে উঠোনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় সকল বন্দিই, রুহিতন আর খেলু চৌধুরীকে ঘিরে এগিয়ে এল। ওয়ার্ডারদের সবাইকে কিছুটা বিমূঢ় দেখাচ্ছিল। অবিশ্যি দু-একজনের মুখে হাসিও দেখা যাচ্ছিল। সন্দিগ্ধ চোখ গোমড়া মুখই ছিল বেশি। তাদের চোখে মুখে একটা ত্রস্ত সাবধানতা।
বন্দিদের অধিকাংশের চোখগুলোই বিস্ময়ে আরও বড় হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে সম্ভ্রম আর শ্রদ্ধা। রুহিতন খুব কাছেই শুনতে পেল, কে যেন প্রায় ফিসফিস করে বলছে, সেই রুহিতন কুরমি? নকশালবাড়ির? এই মানুষকে কোনওদিন দেখতে পাব ভাবিনি। জীবনটা সার্থক হয়ে গেল। কমরেড রুহিতন কুরমি, জিন্দাবাদ!
তৎক্ষণাৎ বেশ কয়েকটি স্বর উচ্চ রবে প্রতিধ্বনি করল, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।
হল্লাগুল্লা বন্ধ! শোর মচানা নহি চলে গা। আদেশের সুরে মোটা গম্ভীর স্বর শোনা গেল।
তার জবাবে রুখে ওঠা গলা শোনা গেল, চুপ রহে। বাধা দিলে আগুন লেগে যাবে।
সমর্থনসূচক আর কয়েকটি স্বর গর্জে উঠল, মনে রেখো কে এসেছে। এর নাম রুহিতন কুরমি। এই
শেষের কথাটা কানে যেতেই, রুহিতন খেলু চৌধুরীর ঘাড়ের কাছ থেকে মুখ তুলে, সকলের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকাল। তার হাসি হাসি অবাক চোখে জিজ্ঞাসা। মহাত্মা গান্ধী, এই একটি নামের সঙ্গে তার জীবনের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং আছে এক আশমান জমিন বিরোধ। গাঁধীবাবার নাম সে তার ছেলেবেলাতেই শুনেছে। ছবি দেখেছে। তাদের চা বাগানে কুলি ধাওড়ার ঘরের দেওয়ালে অনেকগুলো ছবির মধ্যে, একটি চশমা চোখে হাসি মুখ বুড়ো মানুষের ছবিও ছিল। বোধ হয় তার কপালে লাল বা সাদা কোনও কোঁটাও ছিল। গায়ে কোনও জামা ছিল না। মহাজন আর মুদি দোকানি চৌবের চেহারার সঙ্গে ছবিটার মোটামুটি একটা মিল ছিল। কিন্তু হাসি? হাসিটা ছিল তার ঠাকুরদার থেকেও অনেক সুন্দর। মনে হত এমনি এমনি কি আর ছবিটাকে সবাই নমস্কার করে? চৌবে চৌদ্দবার জন্মালেও এ রকম হাসতে পারবে না।
রুহিতন তার বাপ ঠাকুরদার কাছেও গাঁধীবাবার নাম শুনেছে। নামটা বলবার সময় তারা কপালে হাত ছোঁয়াত। তবু দার্জিলিং পাহাড়ের লেবং দেখবার কৌতূহলই রুহিতনের তীব্র হয়েছিল। বসন্তকালে ঘোড়দৌড় দেখার জন্য না। সে তার বাবার কাছে শুনেছিল বিপ্লবীরা বাংলার লাট বাহাদুর আনারসনকে (স্যার জন অ্যান্ডারসন—গভর্নর জেনারেল) লেবং-এ হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। রুহিতনের বয়স তখন ছিল আট বছর। দেশ ছিল পরাধীন। সারা পাহাড়, তরাই, ডুয়ার্স ঘিরে পুলিশ কিছুকাল জবর তাণ্ডব লাগিয়েছিল।
রুহিতনের মাথায় ঘটনাটা গেঁথে গিয়েছিল। কেন? এটাই তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, সে নিজেও জানে না। শত্রু নিধনঃ শ্রেয়ঃ। তার অন্তরের এই কথা সে নিজেও যথার্থ কখনও শুনতে পায়নি, কিন্তু রক্তের মধ্যে তা ক্রিয়াশীল ছিল। রুহিতন লেবং গিয়েছিল। মোটর বা রেল গাড়িতে চেপে না। চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সে, কয়েকজন বন্ধু মিলে, গায়ে কাপড় জড়িয়ে, চোর বাটো দিয়ে পাহাড়ে উঠেছিল। খেলতে খেলতে পাহাড়ে ওঠার মতো উঠে তারা লেবং গিয়েছিল। মিরিক আর জোড়বাংলো পাহাড়ের চা বাগান। দিয়ে, লেবং।
তার কয়েক বছর পরেই, দার্জিলিং হিমালয়ান রেল মজুরদের ধর্মঘট। গোটা পাহাড়ে তরাইয়ে এঞ্জিনের ধোঁয়া ওড়েনি। রেলের চাকা ঘোরেনি। মাঠে মেচির পলি ছড়াতে ছড়াতে, রুহিতনের রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল। কেন? কোম্পানির সাহেবরা, মারোয়াড়ি বিহারি মহাজনেরা, বাঙালি-রাজবংশি, নেপালি জোতদাররা ক্ষেপে উঠেছিল। গরিবদের চিরশত্রুদের পরাজয়ে বুকের রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল। নিজের এই চরিত্রটা তার অজানা ছিল। দিবাবাবুরা তখন বাগানে আর শহরে আন্দোলন করছিল। চেনা শোনা হয়নি। রেল ধর্মঘট করেছিল অন্য একটা দল। সেই সার্থক ধর্মঘট এখনও তার মস্তিষ্কে বিধে আছে। বিধে আছে, তারপরের অনেক লড়াইয়ের ঘটনা।
কিন্তু রুহিতন যে কারণে আজ একজন খুনি, লুণ্ঠনকারী অগ্নিসংযোগকারী এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী, এবং আরও অনেক অভিযোগে অভিযুক্ত সেই কারণগুলোর মধ্যেই রয়ে গিয়েছে, তার সঙ্গে গাঁধীবাবার বিরোধ। রুহিতন জানে, দুজনের মত আর পথের জন্য তারা পরস্পরের শত্রু। তবু এই ওয়ার্ডে গাঁধীবাবা ছিলেন, এই সংবাদ তার মনে কেমন একটা বিস্ময় আর চমক সৃষ্টি করল। সে শুনেছে, তিনি ইংরাজদের সঙ্গে অন্য এক রকমের লড়াই করেছিলেন, তার নাম অহিংসার রাস্তা। যার কোনও সম্যক অর্থই রুহিতনের জানা নেই। সাত বছরের জেল-জীবনে, সেও কয়েক বার অনশন করেছে। আর এই অনশনের হাতিয়ার নাকি তিনিই দিয়ে গিয়েছেন। যদিও দিবা বাগচি মাঝে মাঝে রেগে আর ঠাট্টা করে বলত, উপোস করা আবার একটা আন্দোলন নাকি? ওকে বলে মাগভাতারের ঝগড়া। ভাতারের গুঁতোয় মাগ উপোস দিয়ে পড়ে থাকে। আবার ভাতার গিয়ে তাকে খোশামুদি করে খাওয়ায়। খলে ওষুধ না মাড়লে আবার অন্য রোগে ধরবে। ও সব হল মাগভাতারি আন্দোলন।
রুহিতন প্রথমে যখন এ কথা শুনেছিল, বিশ্বাস করেছিল। দিবা বাগচি খেলু চৌধুরীদের অনশনের অভিজ্ঞতা ছিল। এখন রুহিতনের মনে সেই বিশ্বাসে তেমন জোর নেই। অনশন যে একটা হাতিয়ার এটা সে জেলের মধ্যে প্রথম জানতে পেরেছিল। প্রত্যক্ষ ফলও পেয়েছিল। রুহিতনদের মতো। মানুষদের পক্ষে জেলের মধ্যে যে কোনও মানবিক অধিকারের জন্য অনশন ছাড়া উপায় নেই। এখন তার দলের সবাই এটা মেনে নিয়েছে।
মতে ও পথে পরস্পরের শত্রু, সম্পর্কহীন গাঁধীবাবাকে রুহিতন যে কেবল কখনও চোখেই দেখেনি, তা না। অনশন ছাড়া গাঁধীবাবার সে কিছুই জানে না, কিছুই বোঝে না। তবু তিনি যে একজন খুব নাম। করা লোক ছিলেন, একজন বড় মানুষ, তাঁর ছবিই শুধু যার প্রমাণ না, অনেকটা দেওতার মতোই লোকে তার নাম করে, সব মিলিয়ে তার মনেও একটা ধারণা ছিল, তিনি একজন খুবই নামী দামি মানুষ। সে অবাক হেসে বলল, মহাতমা গাঁধীও এখানে ছিলেন?
হ্যাঁ। ওই যে, ওখানে গাছতলায় নাকি তিনি রোজ প্রার্থনা করতেন। একজন হাত তুলে দেখিয়ে বলল।
খেলু চৌধুরী বলে উঠল, আরে তাতে কী হয়েছে? রুহিতন কুরমি, তুমি আমাদের কাছে তার চেয়ে অনেক বড়।
কে একজন বলে উঠল, রুহিতন কুরমি যুগ যুগ জীও।
তৎক্ষণাৎ কয়েকটি স্বর প্রতিধ্বনি করল, রুহিতন কুরমি যুগ যুগ জীও।
একজন বাঙালি ওয়ার্ডার বলল, খেলুবাবু, কেন আপনারা এখানে এ সব করছেন। এখনই একটা গোলমাল লেগে যাবে। আপনারা ওয়ার্ডের ভেতরে কথাবার্তা বলুন। শ্লোগান দেওয়া চলবে না, জানেনই তো৷
একজন কে গর্জে উঠল, পিটিয়ে মেরে ফেললেও আমরা রুহিতন কুরমির নামে শ্লোগান দেব।
রুহিতনের নিজেরই ইচ্ছা হল, সে সবাইকে শান্ত করে। সকলের এই প্রাণের উচ্ছ্বাস তার ভাল লাগছে। কিন্তু শুধু মাত্র এইজন্যই, একটা দাঙ্গার সৃষ্টি হোক সে চায় না। নিরস্ত্র অবস্থায় পড়ে পড়ে মার খাওয়া কাকে বলে সে জানে। এইরকম একটা কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির ইচ্ছা তার হচ্ছে না। তার মনের ইচ্ছাকে খেলু চৌধুরী সমর্থন করে বলল, আচ্ছা, এখন শ্লোগান-টোগান থাক। রুহিতন ভাই এইমাত্র এসেছে, আগে তাকে আমরা রিসিভ করি। আমাদের আজ সবথেকে বড় গর্ব রুহিতন ভাইকে আমাদের মধ্যে পেয়েছি। আগে একটু খবরাখবর নেওয়া যাক।
খেলু চৌধুরীর কথা সকলেই যে মেনে নিল বোঝা গেল তাদের ঠেলাঠেলি ব্যস্ততা দেখে। সকলেই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, খেলুদা, আমাদের সঙ্গে কমরেড রুহিতন কুরমির আলাপ করিয়ে দিন।
খেলু চৌধুরী বলল, নিশ্চয়ই দেব। চলো আমরা নীচের তলার ভেতরে গিয়ে বসি।’ বলে রুহিতনের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, রুহিতন, তোমার সঙ্গে আর কিছু নেই?
রুহিতন এদিকে-ওদিকে ফিরে কারোকে যেন খুঁজে বলল, একখানা বাকসো তো ছিল।
একজন ওয়ার্ডার এগিয়ে এল। তার হাতে একটা টিনের সুটকেস। রুহিতন বলল, খেলুবাবু, মোকে তা হলে তোমাদের সাথেই রাখবে?
খেলু চৌধুরী হেসে উঠল। তার সঙ্গে প্রায় সব বন্দিরাই। খেলু চৌধুরী বলল, তা হলে আর তোমাকে এই খাতায় আনত? হুকুম আছে বলেই এখানে এনেছে। নইলে আমরা জানতেই পারতাম, তোমাকে এই জেলে আনা হয়েছে। কখন আনল তোমাকে? কোথা থেকে আনল? এখানে তোমার নামে যে কত রকমের গুজব রটনা হয়েছে।
খেলুদা।কথা শেষ হতে না হতেই কে একজন ডেকে উঠল। ধমকানো না হলেও, স্বর তর্জিত ত্রস্ত। ওয়ার্ডারদের সামনে খেলুদাকে মুখ না খুলতে বলা হচ্ছে।
রুহিতন ইতিমধ্যে বলে উঠল, মোকে তো পরশু দিন বিহানবেলা এখানে নিয়ে এসেছে।
খেলু চৌধুরী বলে উঠল, এখানে? পরশু? কোথায় রেখেছিল?’ বলে সে ওয়ার্ডারের দিকে তাকাল। যে-ওয়ার্ডারের হাতে রুহিতনের সুটকেস ছিল।
লোকটা সে কথার কোনও জবাব দিল না। তার ছোট চোখ দুটোতে এক ধরনের বিরক্তি আর অসন্তুষ্টি। বগলে লাঠি, নীচের ঠোঁট দেখে বোঝা যাচ্ছে খৈনি টিপে রেখেছে। হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, এ তা হলে কোন ওয়ার্ডে থাকবে?
রুহিতনের কথাই জিজ্ঞেস করছে। খেলু চৌধুরীর মুখ শক্ত হয়ে উঠল, বলল, তোমার ওপর কী হুকুম আছে, তাই বলো না।
ওয়ার্ডার তার ভাষায় বলল, এই খাতায় জমা করে দেবার হুকুম আছে।
তবে কোন ওয়ার্ডে থাকবে, সে কথা আবার জিজ্ঞেস করছ?’ খেলু চৌধুরী শক্ত স্বরে বলল, তোমার দেখছি গোলমাল পাকাবার মতলব রয়েছে।
ওয়ার্ডার বগল থেকে লাঠিটা হাতে নিল। অন্য একজন হিন্দিভাষী ওয়ার্ডার বলল, কোনও গোলমাল নেই খেলুবাবু। আপনাদের দোস্তকে নিয়ে ভিতরে চলে যান, কি কোথাও বসুন। আপনাদের বন্ধু বারো নম্বরেই থাকবে, এর আর বাত পুছের কী আছে?
আমাদের কিছুই নেই। একটি যুবক বন্দি বলে উঠল, সুটকেস হাতে ওয়ার্ডারের পাশ থেকে। তার ঠোঁটের কোণে ক্রুদ্ধ বাঁক, চোখ জ্বলছে। আবার বলল, আজেবাজে কথা এই ওয়ার্ডারই বলছে।
ওয়ার্ডারটি যুবকের মুখের দিকে তাকিয়েই একটু যেন সন্ত্রস্ত সাবধান হয়ে, সুটকেসটা নামিয়ে রেখে, এক পা পেছিয়ে গেল। তার লাঠি-ধরা হাত আর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। বন্দিদের অনেকের চোখই জ্বলে উঠল। ওয়ার্ডারদের পরস্পরের মধ্যেও দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল। হঠাৎ কে একজন বলে উঠল, এই ওয়ার্ডারটার মুলুকে বোধ হয় জোতদারি আছে।
কথাটা শুনেই কয়েকজন বন্দি হেসে উঠল। খেলু চৌধুরী আর রুহিতনও। খেলু চৌধুরী বলল, ঠিক আছে, এখন ছেড়ে দাও। এই ওয়ার্ডারকে আর যাতে এই খাতায় না পাঠানো হয়, আমরা সেই দাবি জানাব। সনতু, তুমি এদিকে সরে এসো৷
ওয়ার্ডারের পাশে যে যুবকটি দাঁড়িয়েছিল, তার নাম সনতু। পরিস্থিতি একটা অত্যন্ত উত্তেজনাকর থমথমে হয়ে উঠেছে তা স্পষ্ট। সাধারণ কর্মী কয়েদিরাও তাদের কাজ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সতু এবং আরও কয়েকজন তরুণ বন্দিদের শরীর মুখ-চোখের দৃষ্টি শক্ত হয়ে উঠেছিল। সনতু ইতিপূর্বে দু বার ওয়ার্ডারদের সঙ্গে হাতাহাতি করে, ডান্ডাবেড়ি পরে, নির্জন সেলে থেকেছে। ওর সম্পর্কে ওয়ার্ডাররাও সবসময়ে চকিত হয়ে থাকে। কিন্তু খেলু চৌধুরীর নির্দেশে সনতু সরে আসা মাত্রই থমথমে ভাবটা কেটে গেল। খেলু চৌধুরী রুহিতনের হাত ধরে ওয়ার্ডের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ঘরে এসো সবাই সেখানেই আলাপ পরিচয় হবে। কিন্তু সে কথা থামিয়ে বলতে বলতেই বলল, রুহিতন, তোমার গা বেশ গরম গরম। তোমার চেহারাটাও কেমন অন্য রকম দেখাচ্ছে।
কী জানি কী হয়েছে।রুহিতন উড়িয়ে দেবার মতো করে বলল, আজকাল প্রায়ই দেখি কেমন জ্বর জ্বর লাগে। গা তমতম করে, বুঝলে? আর হাতে পায়ে মুখে কী সব ঘা পাঁচড়ার মতন বেরোচ্ছে। আগের জেলের ডাক্তার কী সব মলম টলম দিত। ওতে কিছুই হয় না। ওরা কী দেয়, কী খাওয়ায় কে জানে? শরীরটা বড় বে-জুত বুঝলে খেলুবাবু? ওহ হ্যাঁ। ওটাকে কী বলে, এই জেলের মধ্যেই আছে, আন্ডার টেরাল না কী বলে?
খেলু চৌধুরী বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ আন্ডার ট্রায়াল জেল হাজত।
অই তাই হবে। রুহিতন বলল, ওখান দিয়েই পরশু বিহানে আমাকে একটা ছোট জেল বাড়ির মধ্যে নিয়ে রেখেছিল। একটা দোতলা গারদখানা।
পিছন থেকে একজন ওয়ার্ডার বলে উঠল, গোরা ডিগরি।
খেলু চৌধুরী বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি, এই জেলে ইওরোপীয়ান ওয়ার্ড আছে। তাকেই গোরা ডিগরি বলে। কোনও দিন দেখিনি। ওহ, পরশু দিন সকালে তোমাকে ওখানে তুলেছিল? আর আজ এখানে দিয়ে গেল? এই যে, রুহিতন ভাই, এই দরজা দিয়ে ঢোকো। বাঁ দিকে সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলো, আমরা ওপরে গিয়ে বসব। তার গলার স্বর শেষের দিকে বদলিয়ে গেল।
রুহিতন আর খেলু চৌধুরীর সঙ্গে সবাই ঠেলাঠেলি করে ওয়ার্ডের ভিতরে ঢুকতে চেষ্টা করল। ফলে, ওয়ার্ডের ছোট দরজার সামনে একটা বাধার সৃষ্টি হল। এক সঙ্গে দুজনের পাশাপাশি ঢোকাই। অসুবিধাজনক। রুহিতন কুরমিকে দেখে আর পেয়ে, সকলেই উত্তেজিত। তাদের সকলের কাছেই রুহিতন কুরমি একটি বিশেষ নাম। দু-তিনজন তরুণতম বন্দি, যাদের বয়স খুব বেশি হলে সতেরো-আঠারো, তারা রুহিতন আর খেলু চৌধুরীকে ডিঙিয়ে এগিয়ে গেল আর সামনে থেকে বড় বড় উৎসুক উত্তেজিত গৌরবদীপ্ত চোখে রুহিতন কুরমিকে দেখতে লাগল। দেখতে দেখতেই পিছন হেঁটে তারা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সেইভাবেই সিঁড়িতে উঠতে লাগল।
নীচের এই লম্বা ঘরটা দিনের বেলাও ছায়া ছায়া আবছা অন্ধকার মতো। মাঠের দিকে বড় বড় দরজার মতো, গরাদ বসানো কয়েকটি জানালা আছে। সেই জানালা দিয়ে কিছুটা আলো ভিতরে আসছে। তবু সে আলো লম্বা ঘরটাকে স্পষ্ট করে তুলতে পারেনি। রুহিতন সেই তরুণতম ছেলে কয়েকটির দিকে তাকাল। ওদের চোখের দৃষ্টি তার চেনা। অন্যান্য জেলে, এই রকম বয়সের ছেলেদের উত্তেজনায় জ্বলজ্বল চোখ সে দেখেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। এরা বেশির ভাগই সেই লড়াইয়ের ঘটনা শুনতে চায়। পুলিশ হঠাৎ আচমকা কেমন করে তাদের আস্তানা ঘিরে ফেলেছিল, তারপরে কী ভাবে তীর-ধনুক আর বন্দুকের গুলির লড়াই হয়েছিল এ সব কথাই এরা আগে শুনতে চায়। বুধুয়া তার বড় ছেলেটা বোধ হয় এখন এদের মতোই বড় হয়েছে। বুধুয়ার পিঠোপিঠিই করম। সেও নিশ্চয়ই এ রকমই বড় হয়ে উঠেছে। রুহিতনকে দেখলে কি তারাও এমনি করেই তাকাবে? ওদের বাবার দিকে?
আহ, লাগল নাকি রুহিতন ভাই। খেলু চৌধুরী, দোতলায় সিঁড়ির মুখে প্রথম সিঁড়ির নীচেই তাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরল।
পিছন থেকেও কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে দিল রুহিতনকে ধরবার জন্য। রুহিতন ঠিক মতো সিঁড়ির প্রথম ধাপটা দেখতে পায়নি। আসলে তার চোখ নীচের দিকে ছিল না। তার দৃষ্টি কি ওয়ার্ডের মধ্যেই ছিল? তার দৃষ্টি পৃথিবীর কোথাও ছিল না। বুধুয়া আর করমা নামে সাত বছর আগে দেখা দুটি বালকের মুখ তার চোখের সামনে ভাসছিল। যারা এখন তরুণ মূর্তি নিয়ে তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। সে বলল, না, লাগে নাই। সিঁড়িটা নজর করি নাই। ঘরটা বড় আন্ধার মতন।
কিন্তু তার মনের মধ্যে এখন একটা যন্ত্রণা-বিদ্ধ অনুতাপ। ছেলেদের কথা তার মনে পড়ে গেল কেন? আজকাল প্রায়ই এ রকম ঘটে। নতুন নতুন ভাবে বাড়ি বউ ছেলেমেয়ের কথা মনে পড়ে যায়। সে রুহিতন কুরমি। এ সব দুর্বলতা তার কেন থাকবে? জীবনের সব কিছু পণ রেখে যার লড়াই, তার কি কোনও অতীত থাকে? অথবা স্মৃতি? এমন কোনও অনিবার্যতাকে সে মেনে নিতে পারে না।
এই যে আমার সঙ্গে পা তোলো’ খেলু চৌধুরী বলল, এমন কিছু অন্ধকার তো এখানে নেই।তার চোখে বিস্ময়, ভুরু কুঁচকে পিছনে অন্যান্য বন্দিদের দিকে তাকাল।
খেলু চৌধুরীর বিস্ময় অন্যান্য বন্দিদের চোখেও ছিল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। নতুন জায়গায় এ রকম ভুল হতে পারে।
রুহিতনের চোখের সামনে সিঁড়ির ধাপগুলো এখন অনেক স্পষ্ট। কোনও দিকে বাঁক ফেরানো নেই, সোজা উঠে গিয়েছে। সে খেলু চৌধুরীর শেষ কথাটা ঠিক শুনতে পেল না। পিছনে যারা উঠছে, তাদের কথাও এখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না। খুব কাছে থেকে বললেই সে স্পষ্ট শুনতে পায়। সে সবথেকে তার কথাই ভাল শুনতে পায়, যার ঠোঁটের এবং মুখের দিকে তাকিয়ে সে কথা শোনে। এ সবের একটাই মাত্র কারণ। রুহিতন নিজে তা ভাল জানে। তার নিজের মনেই সন্দেহ জেগেছে, সে ঠিক আগের মতো আর সব কিছু কানে স্পষ্ট শুনতে পায় না। ছোটখাটো কয়েকটা ঘটনার মধ্য দিয়ে, নিজেই প্রমাণ পেয়েছে, সে আগের মতো আর কান খড়খড়ি নেই। নির্জন বনের গভীরে একটা শুকনো পাতা খসে পড়লে সে শুনতে পেত। বহু দূরের পায়ের শব্দ সে শুনতে পেত সাপের মতো, ভূমির মৃদুতম ঝংকারে। বাতাসের গায়ে, দূরান্তরের অচেনা গলার স্বর চিনতে পারত। রাত্রের পাখির মতোই সে সজাগ ছিল। ধরা পড়ার পরে, প্রথম জিজ্ঞাসাবাদের সময়েই পুলিশের এলোপাথাড়ি প্রহারে, তার একটা কানের পরদা হয়তো ছিঁড়ে গিয়েছিল। যেমন চলবার সময় তার নীচের বস্তিদেশ সবসময়েই একটু এগিয়ে থাকে। কারণ তার গুহ্যদেশের ওপরেই বাঁ দিকের হাড় চিড় খেয়ে গিয়েছে। সোজা হয়ে চলতে গেলেই চিড় খাওয়া হাড়ে চাড় পড়ে। যন্ত্রণা হয়। বস্তিদেশ সামনে এগিয়ে হাঁটলেও, যন্ত্রণা হয়। তবে অনেকটা কম। তবু এখনও সে অনেক কথা শুনতে পায়, যার শব্দ নির্জন বনে শুকনো পাতা খসে পড়ার মতোই ক্ষীণ। আবার অনেক সময় বদ্ধ কালা হয়েও যেতে পারে। বিশেষ করে যাদের কথা সে শুনতে চায় না।
ওপরের ওয়ার্ডে আলো অনেক বেশি। লোহার গরাদ লাগানো দরজার মতো বড় বড় জানালাগুলো দিয়ে মাঠটা এবং পুকুর দেখা যায়। রোদটা এখনও বাঁকা হয়ে জানালায় এসে পড়েনি। সূর্য আর একটু পুবের ঢাল ছাড়িয়ে উঠলেই পড়বে। তখন ঘরের মধ্যে আরও আলো ছড়িয়ে পড়বে। জানলাগুলো দিয়ে পুকুরের ওপারের গাছ আর অফিস ঘর, সবই দেখা যাচ্ছে। বিপরীত দিকের দেওয়ালেও একই রকম গরাদ দেওয়া বড় বড় জানালা। ওদিকটায় ওয়ার্ডের উঠোন, যে উঠোন দিয়ে রুহিতন সকলের সঙ্গে এখানে এসে উঠল। কয়েকটা গাছপালার জন্য আলো একটু কম আছে। তা হলেও দোতলায় আলো অনেক বেশি।
লম্বা ওয়ার্ডের দু দিকে বন্দিদের লোহার খাঁটিয়া সারি সারি রয়েছে। মাঝখানটা ফাঁকা। খাঁটিয়াগুলোতে কম্বল বিছানো। খেলু চৌধুরী তার নিজের খাঁটিয়ায় রুহিতনকে বসাল। একজন তরুণ বন্দি তার টিনের সুটকেসটা নীচের থেকে নিয়ে নিয়েছিল। সে জিজ্ঞেস করল, খেলুদা, কমরেড রুহিতন কুরমির সুটকেস কোথায় রাখব?
সেই জবাবের আগেই আর একজন প্রশ্ন করল, কমরেডের বিছানা কোথায় হবে?
এই ওয়ার্ডেই হবে। খেলু চৌধুরী বলল, এখানে যখন রুহিতন ভাইকে পাঠিয়েছে, একটা খাঁটিয়াও ঠিক পাঠিয়ে দেবে। তোমরা যেখানে বলবে, সেখানেই রুহিতনের খাঁটিয়া পাতা হবে। সুটকেসটা এখন যেখানে হোক এক জায়গায় রাখো।
রুহিতনের সঙ্গে বন্দিদের কৌতূহল ঝকঝকে উৎসুক চোখগুলোর দৃষ্টি মিলল। একজন বলে উঠল, আমরা তো সবাই চাইব, কমরেড রুহিতন কুরমি আমার পাশেই থাক।
কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। রুহিতন কুরমির মনটা এক ধরনের আনন্দ আর গৌরবে ভরে উঠছে। সে বলল, আমরা তো সব একসাথে থাকব। এটা আমাদের সকলের ঘর।
ঠিক ঠিক। অনেকে একসঙ্গে প্রায় উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে উঠল। ইতিমধ্যেই সবাই পাশাপাশি দুটো লোহার খাঁটিয়ায়, এ ওর ঘাড়ে পিঠে, দলা পাকিয়ে বসে গিয়েছে। সকলেই ঝুঁকে পড়েছে রুহিতনের দিকে। খেলু চৌধুরী বলল, আহ, কতকাল বাদে দেখা, বলো তো রুহিতন ভাই।
হ্যাঁ, তোমার গেরেপ্তারের ঘটনাটা আমাকে আগে বলো দেখি? রুহিতন বলল, আমি জানতাম, তুমি শনিলালের জোতঘরের উত্তরে, পদমের টঙে আছ। ঘণ্টাখানেক আগে তোমার সাথে আমার দেখা হইছিল, তাই ত? তারপর? এতদিনে কত কথা যে তোমার নামে শুনলাম। কেউ বলে, তুমি পলায়ে গেছ। কেউ বলে তুমি ধরা পড়েছ। কেউ বলে ওরা তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আবার কেউ বলে ফাঁসি দিয়েছে। একটা সাচা কথা জানার উপায় নাই। কী কপাল! তোমাকে এখানে দেখব, এক বারও কি ভেবেছি? এখন বলল তো বিত্তান্তটা শুনি?
খেলু চৌধুরী হেসে জিজ্ঞেস করল, কেন, পদম কিছু বলে নাই?
আরে হায় হায়, যত গোলমাল তো সেইখানেই।রুহিতন বলল, আধ মরা পদমকে ওরা ধরে নিয়ে এল, আমি ভাবলাম, শনিলালের ঘরের উত্তরে, পদমের জঙ্গল ঢাকা টঙেও যখন ওরা গেছে, তখন আর বোধ হয় কেউ বাকি নাই। ও দিক থেকে বন্দুকের আওয়াজ আমি পেয়েছি। পদমের মুখে শুনলাম, সন্তোষ তার চোখের সামনে ওদের গুলি খেয়ে মরেছে। আর তুমি নাকি গুলি ভরা একখানা যন্তর নিয়ে খুব লড়াই করছিলে। করতে করতে কোন দিকে গেলে, পদম আর তোমাকে দেখতে পায় নাই।
খেলু চৌধুরীর মুখ শক্ত হল। কপালে অনেকগুলো ভাঁজ পড়ল। তার মুখের হাসিটা যেন ঠিক হাসি না, রাগ আর বিদ্রুপা বলল, দেখতে পাবে কেমন করে। তখন যদি পারতাম, তোমাদের সবাইকেই বলে দিতাম, পালাও। পদমের টঙ থেকে আমি দেখেছিলাম, ওরা আমাদের কী ভাবে ঘিরে ফেলেছে। জিপ আর ট্রাক দিয়ে সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমাদের থেকে দলে ওরা অনেক বেশি ছিল, প্রত্যেকটা বন্দুকের ডগায় বেয়নেট লাগানো ছিল, রাত্রে জঙ্গলে শিকার ধরার ফ্লাশ লাইট তো এনেছিলই। জিপ আর ট্রাকের আলোয় দিনের মতো হয়ে গেছিল। সেই আলোয় দেখলাম, ওরা চারদিকে গিজগিজ করছে। তার মধ্যে জোতদার রুকনুদ্দিন চৌধুরীকে পষ্ট দেখেছি ওদের সঙ্গে, হোমরা চোমরাদের সঙ্গে কথা বলছিল। আরও কে কে ছিল, কে জানে। আমাদের আস্তানাগুলো যে ওদের নখদর্পণে ছিল, তাতে সন্দেহ নাই। লড়াই করেও ওদের সঙ্গে পারা যেত না। তা ছাড়া, তখন আমাদের অনেকেই ছিল না। সে দিন অনেকে খাসমহলে গেছিল, মনে আছে?
রুহিতন অপলক চোখে খেলু চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তার দৃষ্টি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সে খেলু চৌধুরীর মুখ দেখছিল না। তার মন জেলের মধ্যেও ছিল না। দার্জিলিং জেলার মিরিক থানার নিচুতে এক বনাঞ্চলের, সাত বছর আগের এক রাত্রে তার মন প্রাণ চলে গিয়েছিল। তবু সে খেলু চৌধুরীর জিজ্ঞাসার জবাবে তৎক্ষণাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে শব্দ করল হু হু।
আমার মনে হয়, সে খবরটাও ওদের জানা ছিল। খেলু চৌধুরী বলল, সেই জন্যই রাতারাতি আচমকা ঘিরে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমি দেখলাম, লড়তে লড়তে পালানো ছাড়া উপায় নেই। কথাটা পদমকে বলেছিলাম। ও কান দেয়নি, একেবারে ক্ষেপে গেছিল। আমি টুকারিয়াঝাড়ের জঙ্গলের দিকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। রাতটা সেখানে কাটিয়ে, পরের দিন ভোরে মেচি নদী পেরিয়ে নেপালের। মোরাং-এর পথে রওনা দিয়েছিলাম। আর ধরা পড়লাম সেখানেই।
রুহিতনের অতিকায় চোখের পাতায় পুচ্ছ বলে কিছু নেই। লাল অবাক চোখ দুটো আরও লাল হয়ে উঠল। বলল, মোরাং-এ ধরা পড়লে? নেপালের মধ্যে?
হ্যাঁ, নেপালের মধ্যে। খেলু চৌধুরী হাসল। হাসিটা বাঁকানো আগুন-টকটকে লোহার শিকের মতো। বলল, ভেবেছিলাম নেপালের ভেতরে ঢুকে গেলে সহজে ধরা পড়ব না। কয়েক দিন পরে আবার ফিরে আসব। কিন্তু মোরাং-এ গিয়ে ধরা পড়লাম। বিকালের দিকে একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ কে পেছন থেকে ডেকে উঠল, আরে, খেলুদা যে! আর পেছন ফেরার সময় পাইনি। ভাল করে দেখতেও পাইনি, কারা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর মাথায় একটা বাড়ি। কোমরে গোঁজা যন্তরটাও বের করতে পারিনি, চোখ উলটে গেছিল। একদম অজ্ঞান। তারপরে…।’ খেলু চৌধুরী কথাটা শেষ করল না।
রুহিতনের লাল চোখ দুটোতে তখনও অন্যমনস্কতা। বাকি চোখগুলো যেন এক বিস্ময়কর স্বপ্নের ঘোরে জ্বলজ্বলিয়ে জ্বলছিল। কারোর মুখে কথা ছিল না। কেবল একজন কেউ দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল, বিশ্বাসঘাতকতা!
তাতে কোনও সন্দেহ নেই। খেলু চৌধুরী বলল, তার হাসিটা এখন অনেক সহজ। বলল, রুহিতন ভাই তোমার কথা বলল। তার আগে সকলের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই। বলে সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সকলের নাম বলে গেল।
রুহিতন সকলের দিকে দেখতে লাগল। তার চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখের পাতায় পুচ্ছ না থাকায়, লাল ঘায়ের মতো দেখায়। তার ভুরুর চুলও উঠে গিয়েছে। নেই বললেই চলে। ভুরুর চামড়াও যেন ফেটে গিয়েছে। তার মাথায়ও চুল খুব কম। সাত বছর আগের সেই ঝাকড়া ঘন কালো চুল আর নেই। কিন্তু আগের মতোই তার মাথার চাঁদি বেরিয়ে অল্প চুল এখনও ঘাড় অবধি লম্বা। তার মুখের চামড়া যেন স্বাভাবিকের থেকে মোটা। সেই অনুপাতেই নাকের পাটাও ফোলা, ডগায় অনেকটা ছোট আবের মতো লাল ডুমো। নাকের মাঝখানটা হঠাৎ বসে গিয়েছে, যেন ভাঙা। দুই কানের লতিও মোটা, চার পাশের ডগাও। কিন্তু তার কানের ফুটোয় এখনও আছে সেই দুটো মোটা কাঠি পরানো। চিবুকে কপালে লাল গোল চাকা মতো ফোলা ফোলা দাগ।
রুহিতন কুরমির এই মুখ দেখলে, প্রথমেই চিনে উঠতে ধন্দ লেগে যায়। কিন্তু সব মিলিয়ে চিনে উঠতে দেরি লাগে না। তার রং খুব কালো না। যাকে বলে মাজা মাজা, সেই রকম। রংটা এখনও একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি।
নামগুলো বলা হয়ে যাবার পরেই, সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, কমরেড রুহিতন কুরমির নিজের কথা শুনব আমরা।
হ্যাঁ, এখানে কোথা থেকে তোমাকে নিয়ে এল, তাই দিয়ে শুরু করো। খেলু চৌধুরী বলল, পুরো সাত বছরের কথা শুনতে হবে তো।
রুহিতন বলল, সবই বলব। তার আগে কটা কথার জবাব দাও দেখি? একটা হল, খাটুনি থেকে তা হলে তোমাদের রেহাই?
খেলু চৌধুরী আর বাকি সবাই, গম্ভীর মুখে নিজেদের দিকে তাকাল। যেন ঠিক জবাবটা কারোই জানা নেই। শেষ পর্যন্ত খেলু চৌধুরীই বলল; কিছুই ঠিক করে বলা যায় না, বুঝলে রুহিতন ভাই। এই নিয়ে অনশন থেকে অনেক কাঠখড় পুড়েছে। আমাদের একটা দলকে অন্য জায়গায় আলাদা করে রেখেছে, এই জেলখানার মধ্যেই। তাদের খবর আমরা পাচ্ছি না। আমাদের কয়েক মাস খাটাচ্ছে না। কখন কী হুকুম হবে, কী ঘটবে, কিছু বলা যায় না।’
রুহিতন ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, তার মানে, সবখানেই এক ব্যবস্থা। আর গর্তের শিয়ালরা কী কয়? তাদের যাওয়া আসা আছে নাকি?
খেলু চৌধুরীর বদলে সুকুমার নামে একটি তরুণ জবাব দিল, এখন নেই। আগে আগে দু-চারটের যাওয়া আসা ছিল, আর আমাদের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিলেই মারামারি লেগে যেত। পরে অবিশ্যি আমরাই মার খেতাম বেশি।
খেলু চৌধুরী হেসে বলল, নিশ্চিন্ত থাকো রুহিতন ভাই, গর্তের শিয়ালরা গর্তেই আছে। জেলখানায় ওরা আর আসবে না। ওরা কাগজ ছাপিয়ে লড়াইয়ের লাইন বাতলাচ্ছে, আর ভোটের ভাগাভাগি করছে। ওরা গর্ত থেকে বেরিয়ে, খোঁয়াড়ে যাবে।
সবাই হেসে উঠল। রুহিতন বলল, বুঝলাম, লাইনে গলদ নাই। তার কথার ভঙ্গিতে আবার সবাই হেসে উঠল। সে না হেসে জিজ্ঞেস করল, আর দিবাবাবু? তার কী খবর? আমি বেহারের জেলে শুনলাম, সে নাকি ধরা পড়েছে?
সকলের চোখে মুখেই অবাক জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল। তারা রুহিতন কুরমিকে দেখল, নিজেদের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। খেলু চৌধুরী অবাক স্বরে বলল, এই তো সেদিনের কথা, দিবা বাগচি ধরা পড়ল, মারাও গেল। হার্টফেল করে নাকি মারা গেছে। তাকে আর আমাদের মতো জেল খাটতে হয়নি। শেষের দিকে তার স্বর কিছুটা নির্বিকার।
দিবাবাবু না?’ রুহিতন ফ্যাসফেসে ভাঙা আর্তস্বরে বলে উঠল। তার অতিকায় পুচ্ছহীন লাল চোখগুলো দগদগে ঘায়ের মতো দেখাল। সকলের মুখগুলো চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল। দিবা বাগচির মুখ জ্বলজ্বলিয়ে উঠল। তার সবথেকে পুরনো সংগ্রামী বন্ধু, যে তাকে প্রথম নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। নতুন জীবনের সেই স্বপ্ন কদাপি বিফল হবার না। সেই সফল স্বপ্নে, অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পায়। বোবায় কথা কয়। বন্ধ্যা নারীর সন্তান হয়। ভূমিহীনে ভূমি পায়। জনমজুরে রাজ্য চালায়!… রুহিতন কুরমির সাবালক জীবনে এই প্রথম শোকের আঘাত! সে দুই চোখ বুজল। তার বন্ধ চোখের সামনে দিবা বাগচির মুখ ভাসতে লাগল।
.
মাত্র তিন রাত্রি পোয়াবার পরের সকালে, রুহিতন কুরমি বারো নম্বর ওয়ার্ডের এক পাশে থমকিয়ে দাঁড়াল। সকালের রোদ উঠেছে তখন। ওয়ার্ডের অনেকেই নীচে গিয়েছে। জানালা দিয়ে দেখা যায়, মাঠের সবুজ ঘাসে, পুকুরের জলে, আর দূরের বড় বটগাছটার পাতায় রোদ চিকচিক করছে। জগৎ সংসারের মতো, জেলখানাও জেগে উঠেছে। তার নিজের নিয়মে, নিজের মতো। নীচের ওয়ার্ডের ডবল গরাদে রাত্রি আটটায় তালা পড়ে। তার আগে বন্দিরা উঠোনের পাশের চালায় রাত্রের খাবার খেয়ে নেয়। তাদের ভিতরে ঢুকিয়ে ওয়ার্ডের গরাদ বন্ধ হয়। তারপরে সারা রাত্র কেবল বুটের খটখট, হুইসলের শব্দ, রাত পাহারার চিঙ্কারের ধ্বনি বিলম্বিত স্বরে, এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে জেলখানা জাগতে থাকে। ওয়ার্ডের আলো নিবে যায়। বন্দিদের রাত্রের প্রাকৃতিক কাজের জন্য, সাময়িক ব্যবস্থা ওয়ার্ডের ভিতরেই থাকে। সিঁড়ির রেলিং ছাদের সিলিং-এ ঠেকানো৷ সিঁড়ির মুখেও লোহার গরাদ। বন্দিদের দোতলায় তুলে দিয়ে, সিঁড়ির গরাদেও তালা পড়ে যায়। নীচের ওয়ার্ডে কেউ থাকে না, কেবল আলো জ্বলে। রাতের পাহারার তীক্ষ্ণ চোখ সেই শূন্য ওয়ার্ডেও প্রতি বারের টহলে উঁকি মেরে যায়। ভোরবেলা গরাদ খুলে দেওয়া হয়। বন্দিরা তখন বাইরের পাইখানা আর বাথরুমে যায়।
ভোরবেলা লোহার গরাদ খুলে দেবার পরে, বন্দিরা অনেকেই নীচে চলে গিয়েছে। রুহিতন কুরমি দেখল, দুজন কয়েদি তার লোহার খাঁটিয়াটা সরিয়ে, নীচে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে ওয়ার্ডের এক পাশে পঁড়িয়েছিল। চার দিন আগে খাঁটিয়াটা এই ওয়ার্ডে তার জন্য, এই রকম দুজন কয়েদি তুলে দিয়ে গিয়েছিল। তার খাঁটিয়া সরিয়ে নেবার মুহূর্তেই, অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করেছিল। জবাব পেয়েছে, হুকুম হয়েছে।
খেলু চৌধুরীর সঙ্গে আরও কয়েকজন বন্দি অন্য এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। রুহিতন তার পুচ্ছহীন চোখের লাল দগদগে পাতা মেলে, তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দলের বন্ধুদের খাঁটিয়া সরিয়ে মাঝখান। থেকে তার খাঁটিয়া তুলে নিয়ে যাচ্ছে। রুহিতন প্রতিবাদ করতে পারছে না। তার বন্ধুরাও প্রতিবাদ করছে না। সাত বছরের জেল জীবনে এমন ঘটনা এই প্রথম। সে অবাক হতে গিয়ে রেগে উঠছে। রাগ করতে গিয়ে এক ধরনের ত্ৰাসাচ্ছন্ন বিষাদ মনের মধ্যে ফিরে আসছে। সে দেখল, খেলু চৌধুরী আর অন্যরা দেখছে, কয়েদিরা খাঁটিয়াটাকে সিঁড়ির দিকে কেমন করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রুহিতনের যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তা-ই ব্যস্ত হয়ে কয়েদি দুজনকে জিজ্ঞেস করল, ওটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
একজন কয়েদি জবাব দিল, নীচের ঘরে।
রুহিতন আবার তাকাল খেলু চৌধুরী আর অন্যান্যদের দিকে। কী করবে রুহিতন? সে কি প্রতিবাদ করবে? ঝাঁপিয়ে পড়বে কয়েদি দুটোর (জেলের পরিভাষায় ফালতু) ওপর? একলা? একলা কি প্রতিবাদ করা যায়? বন্ধুরা যেখানে নিষ্ক্রিয়, নিস্পৃহ, অনিচ্ছুক? রুহিতন কুরমির জীবনে নতুন অভিজ্ঞতা! তার প্রতি সকলের দৃষ্টির ভঙ্গি বদলিয়ে গিয়েছে। সেই উষ্ণ অভিনন্দন, উচ্ছ্বাসের উত্তেজনা আর নেই। বন্ধুদের চোখ-মুখ থেকে ঠিক কখন সেই হাসি মুছে গেল, রুহিতন মনে করতে পারছে না। কিন্তু সে খেয়াল করতে পারছে, কখন এক সময় থেকে যেন বন্ধুদের চোখ মুখ বদলিয়ে যাচ্ছিল।
এই ওয়ার্ডের প্রথম দিনের সকালেই কি? রুহিতন যখন বুকের ওপর দু হাত চেপে, নিচু আর্তস্বরে বলে উঠেছিল, অই ওহে দিবাবাবু’..সে কাঁদেনি, চোখ থেকে জল পড়েনি। কিন্তু প্রাণটা হাহাকার করে উঠেছিল। জীবনে আর কখনও কারও জন্য এমন হাহাকার করে ওঠেনি। সে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারেনি। সে কোনও কথা বলবার আগে, খেলু চৌধুরী কেমন যেন নির্বিকার স্বরে বলেছিল, দিবা বাগচির জন্য দুঃখ করে আর কী হবে?
দুঃখ মনে আসে খেলুবাবু। করতে লাগে না। রুহিতন বলেছিল।
খেলু চৌধুরী কেমন রাগ রাগ গলায় বলেছিল, অমন দুঃখেই বা লাভ কী রুহিতন ভাই? দিবা বাগচি ছিল দীনু বাগচির ছেলে, তুমি জানতে।
রুহিতন অবুঝ অবাক চোখে তাকিয়েছিল। খেলু চৌধুরীর চোখে যেন রাগ দপদপ করছিল। আরও অনেক জোড়া চোখের দৃষ্টিও সেই রকম, তার দিকে তাকিয়ে ছিল। রুহিতনের মনে সন্দেহ জেগেছিল, তার বহুকালের জগৎটার কোথায় কী সব অদল বদল হয়ে গিয়েছে। না হলে, দিবাবাবু দীনু বাগচির ছেলে, এ সম্পর্কের কথা নতুন করে শুনতে হবে কেন? দিবাবাবুর নাম মুখে নিতে, খেলুবাবুর গলায় এমন গরগরানি! দুই জনে না বড় বন্ধু ছিল? দিবাবাবু নেতা ছিল না?
খেলু চৌধুরীর বদলে, অন্য একজন বলে উঠেছিল, কমরেড রুহিতন কুরমি, দিবাকর বাগচি ছিল। একজন জঘন্য জোতদারের ছেলে। তার ছেলেমেয়ে বউ বিস্তর টাকার মালিক, তারা সুখেই আছে। দিবাকর বাগচি সর্বহারাদের নেতৃত্ব করত। এখন বলুন তো, আপনার ছেলেমেয়েরা কোন সুখে আছে? তারা কোন জোতদারের ধনে আছে?
এমন কথা শুনেও রুহিতনের মন বিরূপ হয়নি। তার বিস্ময়ও ঘোচেনি। বলেছিল, কিন্তু ভাই সাথীরা, দিবাবাবু যে মস্ত বড় জোতের মালিকের ব্যাটা, সেই কথা তো তাবৎ সংসার জানত। কিন্তু বাপের জোতের তাবৎ জমিন তো সে কোরফা রায়ত আর আধিয়ারদের বিলি বাঁটোয়ারা করে দিছিল! দ্যায় নাই?
কার জমি জোত, কে বিলি বাঁটোয়ারা করেছে?’ একজন তরুণ বিদ্রূপ করে বলে উঠেছিল, জোত জমি দীনু বাগচির। দিবাবাবু কি আধিয়ারদের লেখাপড়া করে দিয়ে গেছলো? তার বাপ তাকে সে হক করে দিয়েছিল? মুখের কথায় অমন সারা পৃথিবীটাই সর্বহারাদের দান করা যায়।
রুহিতন অবাক হয়ে বলেছিল, কমরেড, লেখাপড়া করে বিলি বাঁটোয়ারা কেমন করে হয়? দিবাবাবু মুখে বলছিল, ত তার বাপের জোত তো লড়াই করে দখল নিছিল আধিয়াররা!
তরুণ বন্দি রেগে উঠে বলেছিল, আর যেমনি লড়াইয়ে হেরে সরে পড়তে হল, অমনি আবার জোতের মালিক জোতদার। আধিয়ারদের পিটিয়ে মারা হয়েছে, আর দীনু বাগচি সুখে আছে।
সে দোষ কি দিবাবাবুর? রুহিতন বলেছিল, মরার পরে এখন তার বিচার করেন কেন?
খেলু চৌধুরী বলেছিল, তখন বিচারের কথা ওঠেনি, তাই বিচার হয়নি। আমাদের দলের ধর্ম এই, মরার পরেও কেউ রেহাই পায় না।
রুহিতনের তথাপি হতভম্ব ভাব কাটেনি। বলেছিল, খেলুবাবু, দিবাবাবুকে তুমি নেতা মেনেছিলে৷
মেনেছিলাম। খেলু চৌধুরী যেন কেঁজে বলেছিল, এখন আর মানি না। সে নিজে ছিল শ্রেণীশত্রু, তাই শেষ পর্যন্ত সে পার্টিকে ভুল পথে চালিয়েছিল।
রুহিতন মনে মনে বিভ্রান্ত হলেও স্থির বুঝেছিল তাদের সেই জগতের নানান জায়গায় ভাঙচুর ফাটল ধরেছে। নিজেদের মধ্যে ঘৃণা আর রাগ, সেই প্রথম জানতে পেরেছিল। বড় যন্ত্রণা বোধ হয়েছিল তার। শ্রেণীশত্রু কাকে বলে? কাদের? খেলুবাবুর বাবার তো অনেক চা-বাগানের মোটা শেয়ার আছে। এই সব তরুণ কমরেডদের কার কী আছে, সে জানে না। পাটিকে ভুল পথে চালানো? আগে কেউ বুঝতে পারেনি? নাকি দিবাবাবুর নেতৃত্ব সফল হয়নি বলে, আজ তার মড়া নিয়ে টানাটানি? কিন্তু প্রাণ থাকতে সে দিবা বাগচিকে শ্রেণীশত্রু ভাবতে পারবে না। সে তার ফ্যাসফেসে করুণ স্বরে বলেছিল, কিন্তু খেলুবাবু, দিবাবাবু, আমাদের নেতা ছিল। তার জন্য আমার মন চিরকাল পুড়বে হে, মিথ্যা বলব না।
খেলু চৌধুরী এক মুহূর্ত চুপ করে ছিল। সকলের দিকে তাকিয়েছিল। একটু হেসে বলেছিল, তোমাকে দোষ দেব না রুহিতন ভাই, তোমার দোষ নেই। আস্তে আস্তে তুমি বুঝতে পারবে। সময়ে সবই বুঝতে পারবে।
খেলু চৌধুরীর সব কথা রুহিতনের কানে যায়নি। দিবা বাগচির মুখই তার চোখের সামনে ভাসছিল। দিবা’বাগচির ধরা পড়া আর মৃত্যু-সংবাদ আর সব কিছুই তার মন থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকেই কি তার প্রতি সকলের চোখমুখের ভাবভঙ্গি বদলিয়ে যাচ্ছিল?
রুহিতন প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, কিন্তু আমি কোথায় যাব? কোনও সংবাদ তো পাই নাই?
খেলু চৌধুরী রুহিতনের দিকে তাকিয়ে এইবার মুখ খুলল, তুমি নীচের ওয়ার্ডে থাকবে এখন থেকে। ডাক্তার বলেছে, তোমার আলাদা থাকা দরকার।
একলা?’ রুহিতনের স্বরে ক্ষুব্ধতার মধ্যেও একটা ব্যাকুল বিষণ্ণতার সুর বেজে উঠল।
খেলু চৌধুরী বলল, হ্যাঁ, একলা।
কেন?’ রুহিতন এক রকম স্বরেই জিজ্ঞাসা করল।
খেলু চৌধুরীর ঠোঁট ছুরির মতো বেঁকে উঠল। বলল, তুমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ না নাকি? তোমার হাত পায়ের গোড়ায়, মুখে লাল চাকা চাকা দাগ কীসের? নিজের নাক মুখ দেখে বোঝ না? কিন্তু এর জন্য আমি তোমার দোষ দিই না।
দোষ? রুহিতন মনে মনে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে। তার হাতে, পায়ে মুখে শুকনো ঘায়ের কথা সে জানে। তার লাল দগদগে চোখের পাতা, নাকের ডগা ফুলে ওঠা, মাঝখানটা বসে যাওয়া, মুখের চামড়া আস্তে আস্তে মোটা হয়ে ওঠার কথা সে জানে। হাত পায়ের আঙুলের ডগাগুলোও কেমন লাল। আর ক্ষয়া ক্ষয়া। যে-জেল থেকে তাকে এই জেলে আনা হয়েছে, সেই জেলের ডাক্তার তেলের মতো যে মলম দিয়েছিল, তা-ই সে ব্যবহার করে। সে জানে, শরীর তার ভাল নেই। প্রায়ই গা গরম হয়। গলার স্বর বসে গিয়েছে। কানে ভাল শুনতে পায় না। নাক দিয়ে প্রায়ই অজান্তে সর্দি গড়িয়ে পড়ে। হাতের আঙুলগুলো সহজে সোজা হতে চায় না, বাঁকতেও চায় না। কেবল ডগাগুলো বেঁকে শক্ত হয়ে থাকে। ভাল্লুকের লোম ওঠা থাবার মতো দেখায়। কিন্তু দোষ কীসের? বন্ধুদের কাছ থেকে চলেই বা। যেতে হবে কেন? এই জেলের ডাক্তার তাকে দেখেনি, কিছু বলেনি।
রুহিতন অবাক স্বরে বলল, খেলুবাবু, আমি কোনও দোষ করি নাই। দোষ দেবেই বা কেন?
তুমি তো আর চিরকাল এই রুহিতন কুরমি ছিলে না। সেইজন্য তোমাকে দোষ দিই না।’ খেলু চৌধুরী বলল, বাপ ঠাকুর্দার রোগ পেয়েছ, না নিজেই বাধিয়েছ, তা তুমিই জানো৷ মোহন ছেত্রীর ছেলে বড়কা ছেত্রীর সঙ্গে এক সময়ে অনেক মজা ফুর্তি করেছ। মেলায় মেলায় রং পাঁচালি মানপাঁচালি গান শুনেছ, জুয়া খেলেছ। খেল নাই?
খেলেছি। রুহিতন স্খলিত অবাক স্বরে স্বীকার করে।
খেলু চৌধুরী হেসে বলল, মনে করে দেখ, তখন আরও কী কী ফুর্তি করেছ। মদ পচুই হাড়িয়া গিলেছ, আর বড়কা ছেত্রীর টাকায় লুবু খাঁকড়ির (নরম বা মেয়ে কঁকড়া) সঙ্গ করেছ। এখন সেই আঁকড়িরা সব রক্তে ফুটে উঠেছে।
অই খেলুবাবু, তুমি কাকে কী বলো হে?’ রুহিতনের স্বরে চিৎকার নেই, গর্জন নেই। বুকের ওপর দায়ের কোপ লেগে সে যেন আর্তনাদ করে ওঠে, আমি তাদের দাগ? বলে দু হাত নিজের চোখের সামনে মেলে ধরল। মনে হল, এ সবই যেন তার প্রাক্তন জীবনের বোঙার অলৌকিকতা! খেলুবাবুর এই সব কথা। তার শরীরের এই ব্যাধি। তার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল কেঁপড়ির মুখ। চুনীলাল। মৌজার এক মাঝারি জোতের মালিক শুকু পোঙানির মেয়ে চেঁপড়ি। তার মোলো বছর বয়সের বন্ধুনী ছিল।
কেন টেঁপড়ি তার বন্ধুনী হয়েছিল? মনে নেই। তার ষোলো বছর বয়সে শুকু পোঙানির জমি চাষ করত রুহিতন। তেঁপড়ির বয়স তখন কত? রুহিতনের সমবয়সি, অথবা কিছু কম। তেঁপড়ির তখন বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। সেই বয়সে না হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। কেঁপড়ি কেন চোখের তারা ঘোরাত, ঠোঁট মচকিয়ে হাসত, মাজা দুলিয়ে ফান ফান চলে যেত রুহিতনের গায়ে বাতাস লাগিয়ে, বুঝে উঠতে পারত না। বুঝে উঠতে পারলেও সাহসে কুলাত না। জোতের মালিকের বেটি! অথচ ভাল লাগত। শরীরে রক্ত টগবগিয়ে ফুটত। তেঁপড়ির বুকের দোলায় তার বুকে বাঁধা শাড়ির বন্ধন খুলে যেত। রুহিতনের বুকের ধনুক টান টান হয়ে উঠত। তেঁপড়ির সব ভাল ছিল। চলন বলন দলদলি, মিষ্টি হাসি। কিন্তু গায়ে দাদের ঘা ছিল। না থাকবার কোনও কারণ ছিল না। শুকু পোঙানির ঘরের সকলের গায়ে। দাদ ছিল। তার বলদের গায়েও ঘাও ছিল। বোধ হয় দাদেরই ঘা।
রুহিতন নিজের হাতের দিকে তাকাল। লাল ডুমো ডুমো দাগ কনুই থেকে এখানে সেখানে। হাতের পাঞ্জা লোম ওঠা ভাল্লুকের থাবার মতো, ডগাগুলো ক্ষয়া ক্ষয়া। এ সব কি তেঁপড়ির দাদের ঘায়ের দাগ? হ্যাঁ, কেঁপড়ির সঙ্গে সে জঙ্গলে গিয়ে শুয়েছিল। বড় সুখ হয়েছিল। দাদের ঘায়ের কথা মনে ছিল না। কেঁপড়ির গা থেকে, তার সারা গায়েও দাদ হয়েছিল। দাদের ঘা নেই, এমন ঘর কটা ছিল? মেলায় খাবারের থেকে দাদের মলম কম বিক্রি হত না। রুহিতন বেরুবাড়ির মেলা থেকেই দাদের মলম কিনেছিল। কিন্তু চেঁপড়ি টাকায় কেনা লুবু খাঁকড়ি ছিল না। বড়কা ছেত্রীর সঙ্গে মেলায় বাজারে ঘুরে, লুবু খাঁকড়িদের সঙ্গে শুয়ে তার এই ঘা হয়েছে?
খেলু চৌধুরী আবার বলল, কিন্তু আমি তোমাকে দোষ দিই না রুহিতন। তোমার বাপ ঠাকুর্দা ছিল চা বাগানের কুলি। তুমি একজন ভূমিহীন–।
চুপ! চুপ করো হে তুমি। রুহিতন তার বিকৃত স্বরে, দোতলার ওয়ার্ড ফাটিয়ে গর্জন করে উঠল। তার দগদগে চোখের পাতা টকটকে লাল। তার সারা গায়ে লালের আভা দপদপ করে উঠল।
খেলু চৌধুরী আর অন্যান্য বন্দিরা হতবাক স্তব্ধ। অপ্রত্যাশিত গর্জনে, তাদের চোখে বিস্মিত ত্রাস ও জিজ্ঞাসা। রুহিতন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল। কিন্তু তার দগদগে রক্তাভ দৃষ্টি এখন সিঁড়ির দিকে। তথাপি খেলু চৌধুরী এবং অন্যান্য বন্দিরা যেন আক্রমণের আশঙ্কায় শক্ত হয়ে উঠল।
রুহিতন এগিয়ে আসতে আসতে ঘরের মাঝখানে এক বার দাঁড়াল। এক বার তাকাল খেলু চৌধুরীর দিকে। তারপরে আব্বর সিঁড়ির দিকে। কয়েদিরা ইতিমধ্যে তার লোহার খাঁটিয়া সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছে। রুহিতন এগিয়ে গেল সিঁড়ির মুখে। ডান হাত দেওয়ালে স্পর্শ করে, মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে নীচে নামতে লাগল। ছেলেবেলায় শোনা মায়ের একটা গান বারে বারে মনে পড়তে লাগল। মায়ের গানের কলি সে নিজের মনে আওড়াতে লাগল:
উত্তরে উনাইল ম্যাঘ।
পচ্ছিমে বরষিল গ!
ভিজি গেল গাবানি কাপড়।
এই রকম কি জীবন? উত্তরে মেঘ ঘনায়। অথচ বর্ষায় পশ্চিমে? আর শখের রঙিন কাপড় ভিজে যায়? আগুন জ্বলছে তার বুকের মধ্যে। রাগের থেকে এ আগুনে বুকের পোড়ানি বেশি। এই আগুনে বুকের ঝোরায় জল ঝরে। তার নাক থেকে গাঢ় রস গড়িয়ে পড়ে। সে হাতের পিঠ দিয়ে মুছে নিল। সিঁড়ির নীচে থমকিয়ে দাঁড়াল।
নীচের ওয়ার্ডে মাঠের দিকে একটা জানালা বরাবর তার খাঁটিয়া পাতা হয়েছে। একজন ওয়ার্ডার তার খাঁটিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। কয়েদি দুজন দাঁড়িয়েছিল কাছেই। সবাই রুহিতনের দিকে তাকাল। রুহিতন এখনও তার মায়ের মুখ দেখতে পাচ্ছে। মায়ের গলায় সেই গান শুনতে পাচ্ছে উত্তরে উনাইল ম্যাঘ, পচ্ছিমে বরষিল গ!..
.
ওপর থেকে এর বাকসোটা এনে খাটের কাছে রাখো। ওয়ার্ডার কয়েদিদের হুকুম করল।
কয়েদিরা সিঁড়ির দিকে তাকাল, সিঁড়ির নীচে তখনও রুহিতন দাঁড়িয়ে। কয়েদিরা ভয় ভয় অবাক চোখে তার দিকে তাকাল। রুহিতন এক বার ওপরের দিকে তাকাতে গিয়েও ঘাড় তুলল না। সিঁড়ির নীচে অনেকগুলো ছায়া পড়তে দেখেই সে বুঝতে পেরেছে, খেলুবাবুরা সবাই রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ে তাকে দেখছে।
লুবু খাঁকড়ি! বড়কা ছেত্রীর টাকায়? মেলায় বাজারে ফুর্তি! কথাগুলো আবার রুহিতনের মনে পড়ল। তেঁপড়ির পরে মঙ্গলা। বাবা নিজে মঙ্গলার বাপকে পণ দিয়ে রুহিতনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের পরে মঙ্গলাকেও তেঁপড়ির কথা বলেছিল। এমনি কি আর বলেছিল? অনেকখানি ডেয়ং খেয়ে তার সুখের কথা বলেছিল। খোয়ারি কাটবার পরে মঙ্গলার কোপ টের পেয়েছিল। মঙ্গলাকে ছাড়া আর কোন মেয়েকে আগে জানত সে? হ্যাঁ, পেড়িকে কখনও ভোলেনি। মঙ্গলার সঙ্গে তার বিয়ের পর থেকেই তেঁপড়িকে আর দেখেনি। টেপড়ি ছিল রাজবংশিদের মেয়ে। মাহাতো কুরমি সাঁওতালদের সঙ্গে তাদের বিয়ে হতে পারে না। কিন্তু ও যদি মাহাতো বা সাঁওতালদের মেয়ে হত, তা হলেও রুহিতনের সঙ্গে বিয়ে হতে পারত। সে বিয়ে হত বাহা সাহা। বিধবা অথবা বিবাহিতা মেয়ে স্বামী ছেড়ে এসে আবার একজনকে বিয়ে করলে, সেই বিয়েকে বাহা সাহা বলে। রুহিতন তার মায়ের কাছে শুনেছে।
রাজবংশি ক্ষত্রিয়দের বিয়ের নিয়মকানুন জানত না সে। টেপড়ি কখনও তাকে বিয়ের কথা বলেনি। কেবল ফান ফান দৌড় দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে যেতে চাইত। তা ছাড়া ওর বাবা ছিল একজন ছোট জোতদার। রুহিতন ছিল তার কৃষি মজুর। কিন্তু তেঁপড়ি যদি মাহাতো কুরমি সাঁওতালদের মেয়ে হত, তার যদি বিয়ে না হত?
গভীর জঙ্গলের নিবিড় ছায়ায়, উদাস হাওয়ায় তেঁপড়ির পাশে শুয়ে যদি সে জিজ্ঞেস করত কেন ও শ্বশুর বাড়ি যেতে চায় না, তা হলে ও একটি গান গুনগুনিয়ে উঠত:
শোন্ বাহে দেওয়ানীর ছাওয়া।
মুই কমবকতি কপাল পোড়া ॥
শ্বশুর হয়্যা মাইর খাওয়াইলেন মোকে।
শ্বশুর হয়্যা দিলেন কন্যা
মাইরলে গোলাম দুপুরবেলা
মাইরলে গোলাম মাটিত ফ্যালেয়া ॥
সেই গুনগুনানি শুনলে মনে হত, তেঁপড়ি বনের বাতাসে গলা মিলিয়ে কাঁদছে।
রুহিতন কোনও দিকে না তাকিয়ে ওয়ার্ডের বাইরে এসে দাঁড়াল। যে সব বন্দিরা ইতিমধ্যেই নেমে এসেছিল, তারা তার দিকে তাকাল। রুহিতন কারোর দিকে তাকাল না। সে গাছের ছায়ার দিকে এগিয়ে গেল। এই মুহূর্তে সে স্থান-কাল-পাত্র বিস্মৃত। ভাবল, তেঁপড়ির সঙ্গে তা হলে তার নির বোলোক বাল্লা হত। এ সবই তার মায়ের কাছে শোনা। নির বোলোক বাপ্পা বলে সেই বিয়েকে, যে বিয়েতে মেয়ে নিজেই বরের বাড়িতে জোর করে এসে পড়ে। তেঁপড়ি তো সেই রকম ছিল, যে ছেলের ওপর জোর খাটাবে। সেই জোরের মধ্যে তেঁপড়ির প্রাণের মধু ছিল। কিন্ত পোল্পত কুরমি তখনও বেঁচে ছিল। শুকু পোঙানির জোতে দু দিন গিয়ে, টেপড়িকে দেখে ব্যাটার মতিগতি বুঝেছিল। বছর না ঘুরতেই রুহিতনের বিয়ে দিয়েছিল। কিরিন বাহা বাল্লা। সোজাসুজি বিয়ে। দেখে শুনে মানানসই মেয়ে এনেছিল। মেয়ের বাপকে ধার করে পণ দিয়েছিল। আর রুহিতনকে শুকু পোঙানির জোতের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল।
রুহিতন কি তবু টেঁপড়িকে ভুলতে পেরেছিল? কিছুদিনের জন্য একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। এইরকম মানুষের মন। মঙ্গলাকে পেয়ে সব ভুলেছিল। তেঁপড়ি এক রকম। মঙ্গলা আর এক রকম। মঙ্গলার বয়সও কিছু কম ছিল। সাদাসিধে সরল মাহাতো মেয়ে। শরীরে সেই সবে মাত্র বেড়ে ওঠার লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছিল। তেঁপড়ির মতো তার চোখের তারা ঘুরত না। মন ভোলানো হাসি শেখেনি। রুহিতন হাত ধরে টানলে ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে যেত। গায়ে দাদের গা ছিল না। বরং কালো রংটি যেন তেল চুকচুকে ছিল, এমন মিহি। চাঁদমণি মায়ের কুণ্ডের গভীর কালো জলের মতো ছিল চোখ দুটি।
হ্যাঁ, ঝোরার জলের ধারা যেখানে গভীর কূপের মতো কুণ্ডকে ভরিয়ে তোলে, তখন তার নাম হয়ে যায় মণি। সেই কুণ্ড তখন হয়ে ওঠে মাতৃকূপের প্রতীক। আর সেই প্রতীককে মানুষ পূজা করে। জলের প্রাচুর্যের প্রার্থনায়। আসলে, তরাইয়ের পানীয় জলের একটি প্রাকৃতিক আধার। গভীর জল সেখানে বারো মাস। মণি তো স্ত্রী ইন্দ্রিয়ের আর এক নাম। রুহিতনের মনে হত মঙ্গলার সেই কুণ্ডের গভীর কালো জলের মতো চোখে তার সতেরো বছরের জীবনটা ডুবে গিয়েছে। কিন্তু ডুবে কি যায়? এক বছর পরে তবে সে কেন আবার টেঁপড়ির খোঁজে গিয়েছিল? বাঘের ফেলে আসা শিকারের মতো নাকি? বাঘ যে-শিকারের কাছে আবার না গিয়ে পারে না?
না, রুহিতন টেঁপড়ির দেখা আর পায়নি। তারপরের বাকি জীবনটা শুধুই মঙ্গলা। একটা বউ। এক আধারেই সে কত রকম। একের মধ্যেই অনেক। শুধু পেড়ি কেন। এক মঙ্গলার মধ্যে সংসারের যাবৎ স্ত্রীলোকের দেখা মিলেছিল। সেটাও জীবনের এক অভিজ্ঞতা। কিন্তু লুবু খাঁকড়ি? মেলায় বাজারে ঘুরে বড়কা ছেত্রীর পয়সায় বেশ্যার সঙ্গ করে এই রোগ সে শরীরে এনেছে? ভাবতে ভাবতেই দু হাত সে চোখের সামনে তুলে ধরল। তারপরেই ঘা দগদগে লাল টকটকে চোখে পিছন ফিরে দোতলার ওয়ার্ডের দিকে তাকাল। দাঁতে দাঁত পিষে তার চোয়াল কেঁপে উঠল। খেলু চৌধুরীকে সে দোতলার ওয়ার্ডের জানলায় দেখতে পেল না।
রুহিতনের প্রাণে রাগের থেকেও যন্ত্রণা বেশি। এত কালের পুরনো লোকটা, একটা নেতা লোক, এমন করে দাগা দেয়? এত কালের চেনা সব মিথ্যা? লুবু খাঁকড়ি? বড়কা ছেত্রীর পয়সায়? হা! অই মা, তোর কথাই ঠিক! উত্তরে উনাইল ম্যাঘ, পচ্ছিমে বরষিল গ…।
সে একটা গাছের গায়ে পিঠের ভার চেপে দাঁড়াল। তার সামনে এখন কেউ নেই। একটা ভারী মোটর গাড়ির গর্জন যেন তার খুব কাছ দিয়ে শব্দ করে চলে যাচ্ছে। সে চোখ বুজল। আর তবু চোখের সামনে ভেসে উঠল রক্তহীন কাঁচা মাংসের রং। তার ওপরে নড়ে চড়ে উঠল সেই মন্থরগতি মেটে রঙের সাপটা, যার গায়ে লাল চাকা চাকা দাগ।
রুহিতন চমকিয়ে উঠে চোখ মেলে তাকাল। মনে হল সেই সাপটাই যেন তার শরীরের ভিতরে নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। এইজন্যই কি আজকাল চোখ বুজলে সে সেই কুৎসিত সাপটাকে দেখতে পায়? তার চোখের সামনে ভেসে উঠল বন্দুক হাতে বড়কার মূর্তি।
আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?’ দড়ি বাঁধা লাঠি হাতে ঝুলিয়ে একজন বাঙালি ওয়ার্ডার এসে সামনে দাঁড়াল। লোকটার চোখের দৃষ্টিতে কেমন গায়ে কাঁটা দেওয়া ভাব। কিন্তু মুখে হাসি। বলল, এখানে গান্ধীজি প্রার্থনা করতেন, যখন এই জেলে ছিলেন।
এইটা সেই জায়গা। কিন্তু সেই মানুষটির মতো কোনও প্রার্থনা রুহিতনের জানা নেই। প্রার্থনা করলে কী হয়। পরাধীনরা স্বাধীন হয়? ভুমিহীনে ভূমি পায়? জন-মজুরে রাজ্য চালায়? প্রাণের এই যে যন্ত্রণা, দুঃখে অপমানে পুড়ে যাচ্ছে, এর কি উপশম হয়? রুহিতন ওয়ার্ডারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে, পশ্চিমের দেওয়ালের ধারে, ছায়া ঘেরা জমির দিকে পা বাড়াল। ওয়ার্ডার বলে উঠল, আসুন, আপনাকে আমি ডাকতে এসেছি। ডাক্তারবাবু আপনাকে দেখতে এসেছেন, নীচের ওয়ার্ডে বসে আছেন।
রুহিতন থমকে দাঁড়াল। পিছন ফিরে ওয়ার্ডারের মুখের দিকে দেখে ওয়ার্ডের দিকে এগিয়ে গেল। খেলু চৌধুরীরাই তা হলে ডাক্তার পাঠাতে বলেছে?
.
রুহিতন ওয়ার্ডের ভিতরে পা দিয়ে দেখল, শার্ট-প্যান্টপরা অল্পবয়সি একটি কালো ছোটখাটো লোক, জানালার সামনে মাঠের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। লোহার খাটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন কয়েদি। হাসপাতালের বয়, হাতে একটা ব্যাগ। সে রুহিতনের দিকে এক বার দেখেই খাটের কাছ থেকে সরে গিয়ে জানালার সামনে লোকটির দিকে তাকাল। পিছন থেকে বাঙালি ওয়ার্ডার বলে উঠল, স্যার, এই যে ডেকে এনেছি।
জানালার সামনে শার্ট-প্যান্টপরা লোকটি তাড়াতাড়ি ফিরে দাঁড়াল। প্রথমেই রুহিতনের দিকে তাকাল। দু পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম রুহিতন কুরমি?
রুহিতন মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল। স্পষ্ট শুনতে না পেলেও সে লোকটির ঠোঁট নড়া দেখেই বুঝে নিয়েছিল। লোকটির অল্পবয়সি চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক খেলে গেল। শুধু বিস্ময় না, যেন এক ধরনের সম্ভম বা আর কিছু তার চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ল। ওর কথার স্বরেও যেন সেই ভাব, বলল, আমি এখানকার ডাক্তার। আপনাকে দেখতে এসেছি।
এই জেলে প্রথম দিন সকালে জেল সুপারের সঙ্গে যে ডাক্তার রুহিতনকে দেখতে এসেছিল এ সে ডাক্তার না। এর বয়স অনেক কম। আকারেও ছোটখাটো বলে খুব ছেলেমানুষ দেখাচ্ছে। ডাক্তার বলে মনেই হয় না। ও আবার বলল, আসুন, এই জানালার দিকে এগিয়ে এসে খাটে বসুন। এদিকে আলো বেশি আছে। দেখতে সুবিধা হবে।
রুহিতন তার বাঁয়ে সিঁড়ির দিকে এক বার দেখল। তারপর খাটের সামনে জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে বসল। ডাক্তার তার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। চোখের নজর বেশ চোখা করে খুব মনোযোগ দিয়ে রুহিতনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। কয়েক মিনিট কোনও কথা না বলে ও শুধু রুহিতনের সমস্ত শরীরটা যেন চোখ দিয়ে মেপে মেপে দেখতে লাগল। কখনও ওর ভুরু কুঁচকে উঠল। কখনও বা মুখের চামড়া টান টান হয়ে খুব গম্ভীর দেখাল। এমনকী জুতোর গোড়ালিতে ডিঙি দিয়ে রুহিতনের মাথাও দেখল।
রুহিতনের মনটা শক্ত হয়ে উঠল। এই ছোকরা ডাক্তারও নিশ্চয় খেলু চৌধুরীর মতো লুবু খাঁকড়ির কথা বলবে?
রোগ তো বেশ পুরনো। অনেক দিন ধরেই ভুগছেন, না?’ ডাক্তার জিজ্ঞেস করল।
রুহিতন ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ।
আশ্চর্য!’ ডাক্তার বলল, এর আগে যে জেলে ছিলেন, সেখানকার ডাক্তার আপনাকে দেখেনি?
রুহিতন খানিকটা নির্বিকার স্বরে বলল, দেখেছিল। এই তো হাতে পায়ে সেই ডাক্তারের দেওয়া মলম লাগিয়েছি।
ডাক্তারের তরুণ মুখ যেন রাগে আর বিরক্তিতে ভরে উঠল। ও হাত তুলে আঙুলের ইশারায় কয়েদি হসপিটাল বয়কে ডাকল। সে কাছে আসতে ওর হাত থেকে ব্যাগ নিল। ব্যাগের মুখ খুলে ভিতর থেকে বের করল লম্বা পেরেকের মতো ঝকঝকে এক টুকরো লোহা আর তুলো। জিজ্ঞেস করল, আপনার। শরীর থেকে রক্ত নিয়ে কখনও পরীক্ষা করা হয়েছে?
রুহিতন ঘাড় নেড়ে জানাল, না।
আপনার এই হাতের আঙুলগুলো এ রকম ক্ষয়ে যাচ্ছে কত দিন আগে থেকে?’ ডাক্তার জিজ্ঞেস করল।
রুহিতন লোমহীন ভুরু কুঁচকে মনে করবার চেষ্টা করল। মনে করতে না পেরে অন্যমনস্ক হয়ে উঠল। ডাক্তার সেই ছুঁচের চেয়ে মোটা আর লম্বা লোহার টুকরো দিয়ে রুহিতনের হাতের তালু আর আঙুলে স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করল, আঙুলগুলো এ রকম বেঁকেই বা যাচ্ছে কবে থেকে, মনে করতে পারেন?
রুহিতন ঘাড় নেড়ে জানাল, না।
আশ্চর্য। ডাক্তার ছেলেটি বলে উঠল, কোনও কষ্ট বা জ্বালা যন্ত্রণা কিছু হয় না?
রুহিতন ঘাড় নেড়ে বলল, জ্বালা যন্ত্রণা তেমন তো বুঝি না। মাঝে মাঝে জ্বরের মতো লাগে।
জ্বরের মতো লাগে? জ্বর না? ডাক্তার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
রুহিতন বলল, হতে পারে।
জ্বর তো আপনার এখনও রয়েছে।’ বলে ডাক্তার তার পায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর পায়ে এ রকম দু-তিনটে নখ উড়ে গেছে, ব্যথা লাগে না?
রুহিতন মাথা নেড়ে বলল, না।
ডাক্তার যেন কয়েক মুহূর্ত অবাক স্তব্ধ হয়ে রইল। রুহিতন নির্বিকারভাবে বলল, কী করে কখন হোঁচট খেয়ে নখগুলান উঠে গেছে, টেরই পাইনি।
টেরই পান নি?’ ডাক্তার সেই লোহার টুকরো দিয়ে হাতের আঙুলে টোকা মেরে জিজ্ঞেস করল, টের পাচ্ছেন?
রুহিতন যেন কিছুটা অবাক স্বরে বলল আগুন গরম ভাতে হাত দিয়েই কিছু টের পাই না, এতে আর আমার কী হবে?
ডাক্তার যেন বিস্ময়ে চমকিয়ে উঠে বলল, আগুন গরম ভাত আঙুলে টের পান না? ঠাণ্ডা জলে হাত দিলে টের পান?’
রুহিতন মাথা নেড়ে জানাল, না।
ওহ্ তা হলে তো ব্যাপার অনেক দূর গড়িয়েছে। ডাক্তার বলল। হাতের লোহার ডগা দিয়ে, রুহিতনের হাতের আঙুলে জোরে বিধিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, টের পাচ্ছেন?
রুহিতন মাথা নাড়ল, পাচ্ছে না। ডাক্তার বলল, চোখ বুজে থাকুন একটু। আর আমি যা জিজ্ঞেস করব, তার জবাব দিন।
রুহিতন সন্দিগ্ধ চোখে এক বার ডাক্তারের দিকে দেখল। তারপরে চোখ বুজল। ডাক্তার লোহার ডগা দিয়ে তার হাতে আর মুখের লাল চাকা চাকা ডুমো অংশে খোঁচা দিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথাও লাগছে? কিছু টের পাচ্ছেন?
রুহিতন মাথা নেড়ে জানাল, না।
ফুল অ্যানেসথেসিয়া!’ ডাক্তার বিড়বিড় করে বলল।
রুহিতন চোখ মেলে তাকাল। ডাক্তার তার দিকেই তাকিয়েছিল। জিজ্ঞেস করল, এই যে আপনার নাক থেকে শিনি গড়াচ্ছে, টের পাচ্ছেন না?
রুহিতন বলল, সবসময় পাই না। সে হাতের পিছন দিয়ে নাক মুছতে উদ্যত হল।
ডাক্তার তার আগেই তুলো দিয়ে নাকের গড়ানো রস মুছে নিল। ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে, তার মধ্যে তুলোটুকু জড়িয়ে রেখে দিল। রুহিতন অবাক জিজ্ঞাসু চোখে ঘটনাটা দেখল। আর ডাক্তার ছেলেটি যেন বিচলিত মুখে, বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, কোনও সন্দেহ নেই, আর কোনও সন্দেহ নেই।
এই সময়ে এক জন কয়েদি খাটের কাছে এসে দাঁড়াল। তার এক হাতে অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে মুড়ি ছোলা আর কলা। অন্য হাতে এক গেলাস চা। ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, কী চাই?
কয়েদি রুহিতনকে দেখিয়ে হিন্দিতে বলল, নাস্তা লে আয়া হোজোর।
রুহিতন ফিরে তাকাল। ডাক্তার বলল, নিন, আপনার জলখাবার এসেছে, খেয়ে নিন।
রুহিতন হাত বাড়িয়ে বাটি আর গেলাস নিল। খোলা দরজা দিয়ে তার চোখে পড়ল, উঠোনের ওপারে রান্নার চালার ভিতরে খেলু চৌধুরীর মুখ। খেলু চৌধুরী আর অন্যান্য বন্দিরা, সকলেই চালার ভিতর থেকে এ দিকেই তাকিয়ে আছে। রুহিতন মুখ ফিরিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকাল। খাটের অদূরেই একটা পুরনো টেবিল রয়েছে। রুহিতন সরে গিয়ে বাটি গেলাস সেই টেবিলের ওপরে রাখল।
ডাক্তার বলল, আপনার অসুখটা বেশ বেড়ে উঠেছে। কেন যে এত দিন আপনাকে দেখা হয়নি, জানি না। অনেক অনেক আগেই আপনাকে দেখা দরকার ছিল। ওষুধ দেওয়া দরকার ছিল। আপনার বাড়িতে এ অসুখ কারোর দেখেছেন? ছিল নাকি?
রুহিতন জোরে মাথা নেড়ে বলল, কখনও দেখি নাই।
ডাক্তার আবার জিজ্ঞেস করল, আপনার ঠাকুর্দা ঠাকুমা বাবা মা বউ বা আর কারোর?
রুহিতন আবার জোরে মাথা নেড়ে গলা চড়িয়ে বলল, না না।
ডাক্তার কিছুটা হতবাক হয়ে থমকিয়ে গেল। রুহিতনের মুখের দিকে তাকাল, আস্তে বলল, আপনি জলখাবার খেয়ে নিন।
রুহিতন এক গাল মুড়ি পুরে চায়ের গেলাসে চুমুক দিল। ডাক্তার ব্যাগটা হসপিটাল বয় কয়েদির হাতে তুলে দিল। তাকে গম্ভীর আর বিচলিত দেখাচ্ছে। রুহিতন ফ্যাসফেসে স্বরে জিজ্ঞেস করল, এটা কি খুব খারাপ ব্যামো?
ডাক্তার একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, রোগ ব্যামো সবই খারাপ। আবার ঠিকমতো চিকিৎসা করলেই ভাল হয়ে যায়। আপনার বেশ দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি আপনাকে ওষুধ দেওয়া দরকার।
কেন হয় এই ব্যায়োটা?কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে রুহিতনের নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এল। তার চোখ দুটো বড় হয়ে উঠল। আর তার অজান্তেই মুড়ি চিবোতে চিবোতে মুখের দু পাশ থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
ডাক্তার বলল, অনেক কারণেই হতে পারে। রোগটা তেমন মারাত্মক ছোঁয়াচে না। ছেলেমানুষদেরই বেশি ছোঁয়া লাগে। সেইজন্যেই আপনাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, আপনার বাবা মায়ের কারোর এই অসুখ ছিল কি না। ঠাকুর্দা ঠাকুরমার থাকলেও নাতির হতে পারে।
কিন্তু আমার বাপ ঠাকুর্দার কারোর এ ব্যামো ছিল না। রুহিতন প্রায় ভাঙা ঘড়ঘড়ে স্বরে বলল। এখনও গোরুর জাবর কাটার মতোই তার চোয়াল নড়ছে, আর চর্বিত মুড়ি তার দু ঠোঁটের কষ দিয়ে। বাইরে বেরিয়ে আসছে। সে আবার জিজ্ঞেস করল, খারাপ লোকেদের এই ব্যামো হয় নাকি?
ডাক্তার অবাক অনুসন্ধিৎসু চোখে রুহিতনের দিকে দেখল। বলল, খারাপ লোকেদের? কেন? না, অনেক নিরীহ ভাল মানুষদেরই এ রোগ হয়।
রুহিতনের আরক্ত অপলক চোখের দৃষ্টি ডাক্তারের ওপর। সে আবার মুখে মুড়ি পুরে দিল, আর চোয়াল নাড়তে লাগল। অনেকটা গোঙানো স্বরে লুবু খাঁকড়ি-বাজারের বেশ্যাদের সঙ্গ করলে এই ব্যামো হয়?
ডাক্তারের ভুরু কুঁচকে উঠল, তারপরেই হঠাৎ হেসে উঠল। বলল, ওহ্, না না, আপনি যে অসুখের কথা বলছেন, এটা তা নয়। বুঝেছি, আপনি সেইজন্যই খারাপ লোকদের কথা বলছিলেন। না না, এটা সে রকমের কোনও অসুখ নয়। এটা চামড়ার ওপরের অসুখ, তবে শরীরের হাড় অবধি ঢুকে যায়, আর অসাড় করে দেয়। যে কোনও লোকেরই এ অসুখ করতে পারে। আর ছোঁয়াচে বলে ছোটদেরই। তাড়াতাড়ি ধরে। বড়রা সাবধান হলে চট করে কিছু হয় না।
কী ব্যামো এটা?’ রুহিতন যেন ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে জিজ্ঞেস করল। তার চোয়াল নড়া মুখ আর আরক্ত চোখ দুটো অনেক বড় দেখাচ্ছে।
ডাক্তার একটু গম্ভীর হয়ে উঠল। রুহিতনের পা থেকে মাথা অবধি এক বার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, অনেক দেরি হয়ে গেছে ঠিক, কিন্তু আপনি ভাল হয়ে যাবেন। এই অসুখটাকে বলে লেপ্রসি– মানে, কুষ্ঠ।
রুহিতনের চোয়াল নড়া বন্ধ হয়ে গেল। তার মোটা ফাটা ফাটা চামড়ার মুখটা অনেকটা প্রাচীন রক্তবর্ণ মাকড়া পাথরের মতো দেখাচ্ছে। উচ্চারণ করল, কুট!
হ্যাঁ কুষ্ঠ।‘ ডাক্তার বলল, অসুখটাকে লোকে যত ভয় পায়, তেমন কিছু না। তবু লোকে ভয় পায়। আর আপনার দেরিও হয়ে গেছে। আপনাকে এখানে আর রাখা হবে না। বোধ হয় এ বেলাই অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে।
রুহিতন যেন চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, অন্য জায়গায়?
হ্যাঁ জেলের মধ্যেই আলাদা জায়গায়। ডাক্তার বলল, আর একটুও দেরি না করে আপনার চিকিৎসা শুরু করা দরকার। আমি গিয়ে ব্যবস্থা করছি। আপনি জলখাবার খেয়ে নিন। আমি চলি।
তরুণ ডাক্তারের দৃষ্টিতে এবং গলার স্বরে এখনও এক ধরনের সম্ভ্রমের সুর। এখন কিছুটা করুণ। সে হসপিটাল বয় কয়েদিকে ইশারা করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। রুহিতন ওর দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, ডাক্তার বাইরে যাওয়া মাত্রই খেলু চৌধুরী আর অন্যান্যরা ওকে ঘিরে ধরল। রুহিতন। মুখ ফিরিয়ে নিল। জানালার বাইরে তার চোখের সামনে মাঠ। কিন্তু সে কিছুই দেখছে না। তার আরক্ত অপলক দুই চোখে এক অপরিসীম আহত বিস্মিত জিজ্ঞাসা। হাত দুটো সে সামনে তুলে ধরল। তার ঠোঁট নড়ে উঠল, আর নিঃশব্দে উচ্চারণ করল, কুট কুট! আমার।…