৩. রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং

দুপুর আড়াইটে। রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং, সংক্ষেপে ‘র’-র সদর দপ্তরের মস্ত বড় কনফারেন্স রুমেও তখন বিরাজ করছিল অস্বস্তিকর নীরবতা।

‘কাদের কাজ হতে পারে ত্রিপাঠীজি? আই এস আই? এন এস আই? মোসাদ? এম আই ফাইভ? এস ভি আর? সি আই এ?’ টেবিলের একপ্রান্ত থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন ন্যাশনাল সিকিওরিটি অ্যাডভাইজর আশিস সিনহা।

টেবিলের অপরপ্রান্তে বসেছিলেন ছোটখাটো দোহারা চেহারার এক মধ্যবয়সি মানুষ। অতি সাধারণ দৈহিক গঠন, এবং সাধারণতর পোশাক পরিহিত মানুষটির সারা শরীরে দর্শনীয় শুধুমাত্র অত্যুজ্জ্বল চোখদু’টি। খর্বকায় মানুষটির সমস্ত আত্মা যেন শুধুমাত্র ওই চোখদু’টিতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছে।

ভদ্রলোকের নাম হরিশঙ্কর ত্রিপাঠী। ইনিই ‘র’-র দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সারা পৃথিবীর ইন্টেলিজেন্স মহল যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে ওঁকে ডাকে দ্য চিফ বলে।

ধীরে, অনুত্তেজিত সুরে বলতে শুরু করেন চিফ, ‘কাদের কাজ সেটা বলা মুশকিল। ইনফ্যাক্ট কাল রাতে ঠিক কী হয়েছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। প্রফেসর বোসের ওপর যে কাজের ভার দেওয়া হয়েছিল, সেটা প্রায় তিনি কমপ্লিট করে এনেছিলেন। চূড়ান্ত পরীক্ষাটা কালই করার কথা ছিল। সেই মতো আমরা ফাইনাল ‘গো অ্যাহেড’ পাঠাই ওঁর কাছে।’

‘কালকেই কেন?’ প্রশ্ন করলেন আই বি’র ডিরেক্টর দিবাকর সিং। দেশের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব আই বি-র। তা সত্ত্বেও এই টপ সিক্রেট মিশনটা র-কে দেওয়াতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ তিনি। বস্তুত ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর সিনহা, ত্রিপাঠী ওরফে দ্য চিফ, ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্ট এজেন্সির বস লেফটেন্যান্ট জেনারেল বিভোর ব্যানার্জি, ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জির প্রধান প্রফেসর নারায়ণস্বামী আর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর এর ব্যাপারে কেউই বিশেষ কিছু জানতেন না!

‘কারণ কালকেই প্রচণ্ড ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল।’ বলতে থাকেন দ্য চিফ, ‘চূড়ান্ত পরীক্ষাটা করার আইডিয়াল সময়। রাস্তায় লোকজন থাকবে না, আলো বা আওয়াজ কিছুই দূর থেকে দেখা বা শোনা যাবে না।’

‘পরীক্ষাটা কী, সে বিষয়ে কিছু জানা যাবে?’ প্রশ্ন করলেন ডিরেক্টর সিং।

‘আমি সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলছি।’ মুখ খুললেন প্রফেসর নারায়ণস্বামী। বর্ষীয়ান বিজ্ঞানীর নাম পার্টিকল ফিজিক্সে প্রথম সারির পাঁচজনের নামের মধ্যেই উচ্চারিত হয়।

‘আপনারা লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের নাম শুনেছেন? বা সার্ন বলে কিছু জানেন?’

‘শুনেছি প্রফেসর।’ শান্ত গলায় বলেন দ্য চিফ, ‘কিন্তু পুরো ব্যাপারটার বৈজ্ঞানিক খুঁটিনাটি যদি আপনি বিস্তারিতভাবে বলেন, তাহলে আমরা সবাই উপকৃত হই।’

সবাই নড়েচড়ে বসলে বলতে শুরু করলেন বয়স্ক প্রফেসরটি।

‘সার্ন একটি বৈজ্ঞানিক সংস্থা, পুরো নাম ইওরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ। সংস্থাটি তৈরি হয় উনিশশো আটানব্বই সাল নাগাদ। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহত্তম সায়েন্টিফিক প্রজেক্টটি এক্সিকিউট করা।

বৃহত্তম বলছি, কারণ প্রায় দশ হাজার বিজ্ঞানী আর ইঞ্জিনিয়ার এর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত আছেন। একটিমাত্র সায়েন্স প্রজেক্টে এতজন বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদ একসঙ্গে আর কখনও কাজ করেননি। ম্যানহাটন প্রজেক্টও এর কাছে শিশু। ভারতবর্ষেরও অনেক বৈজ্ঞানিক সংস্থা এর সঙ্গে যুক্ত, যেমন টি আই এফ আর, সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, আমি যেখানে পড়াতাম, সেই হরিশ্চন্দ্র রিসার্চ ইন্সটিটিউট ইত্যাদি।’

‘এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্যটা একটু বুঝিয়ে বলুন প্রফেসর।’ অনুরোধ করেন দ্য চিফ।

‘এই প্রজেক্টের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে পার্টিকল ফিজিক্স সংক্রান্ত বিভিন্ন থিওরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করা। তাতে করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন রহস্যের সমাধান হতে পারে। যেমন ধরুন, হিগস বোসন কণা, যাকে গড পার্টিকল বা ঈশ্বর কণা বলা হয়, তার খোঁজ পাওয়া।

সেই উদ্দেশ্যেই দু’হাজার সাল নাগাদ ফ্রান্স সুইজারল্যান্ড সীমান্তে, মাটির একশো মিটার নীচে সাতাশ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বসানো হয় পাইপের মতো একটি যন্ত্র। এটিই হল আজ অবধি পৃথিবীতে তৈরি সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী পার্টিকল কোলাইডর, যার নাম এল এইচ সি বা লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডর।’

‘তাতে লাভ?’ এবার প্রশ্ন করেন মিস্টার সিনহা, ‘মানে এত খরচাপাতি করে এইসব এক্সপেরিমেন্ট করার উদ্দেশ্যটাই বা কী?’

‘সৃষ্টির কতগুলো মূলতত্ত্ব বুঝে নেওয়ার জন্য এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে।’ সামান্য বিরক্ত শোনায় প্রফেসর নারায়ণস্বামীর কণ্ঠস্বর, ‘যেমন ধরুন, হাই এনার্জি পার্টিকলের স্বভাবচরিত্র স্ট্যান্ডার্ড মডেল দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়, নাকি তার জন্য হিগস-লেস মডেল দরকার। স্ট্রিং থিওরির এক্সট্রা ডাইমেনশনের তত্ত্বটা ভুল, না ঠিক। তারপর ধরুন, মহাবিশ্বের মাস এনার্জির পঁচানব্বই শতাংশ দখল করে রেখেছে যে ডার্ক ম্যাটার তার নেচারটাই বা কী ধরনের? চারটি মৌলিক ফোর্সের মধ্যে চতুর্থটি, মানে গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ বাকি তিনটি মৌলিক ফোর্সের তুলনায় এত মৃদু কেন? অথবা ধরুন কোয়ার্ক গ্লুওন প্লাজমার প্রপার্টি বলতে…’

‘বুঝেছি-বুঝেছি!’ প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন ডিরেক্টর সিং, ‘আর বলতে হবে না। কিন্তু এর সঙ্গে কালকের ঘটনার সম্পর্কটা কী?’

‘এই এক্সপেরিমেন্টের একটা বিশেষ দিক নিয়ে কাজ করতে সার্নের কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাদের, মানে ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জিকে। সেই উদ্দেশ্যেই নর্থ বেঙ্গলের একটা নিরালা জায়গায় এই ফেসিলিটিটা তৈরি করা হয়।’

‘কিন্তু এই এক্সপেরিমেন্টটা নিয়ে এত সিক্রেসি মেন্টেন করার কী আছে প্রফেসর? এমন সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্ট তো রোজই হাজার গণ্ডা হচ্ছে দেশে।’ বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করেন সিং।

‘তার কারণ,’ শান্তস্বরে বলে ওঠেন চিফ, ‘এক্সপেরিমেন্টটা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকী জাতীয় নিরাপত্তা ব্যাপারটাও জড়িত আছে এর সঙ্গে।

সার্নের পক্ষ থেকে অনুরোধটা সরাসরি করা হয় আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি বিষয়টার গাম্ভীর্য বিচার বিবেচনা করে এর সিকিওরিটির দায়িত্ব তুলে দেন ‘র’-র হাতে। যেহেতু এই এক্সপেরিমেন্টটার ফলাফল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী, এবং এর বিন্দুমাত্র ভুলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা, তাই যথাসম্ভব গোপনে এর ব্যবস্থা করতে হয়েছে।’

‘কীরকম ক্ষয়ক্ষতি?’ উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করেন ডিরেক্টর সিং।

‘যেমন ধরুন, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া।’ নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেন প্রফেসর নারায়ণস্বামী।

ঘরে হাজির অধিকাংশ অফিসার সম্ভবত বুঝতে পারছিলেন না, এই কথাটায় কী প্রতিক্রিয়া জানানো যায়। লেফট্যানেন্ট জেনারেল ব্যানার্জিই আগে সামলে নিলেন। তারপর গলা খাঁকড়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এই এক্সপেরিমেন্টের ফলে পৃথিবী ঠিক কীভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে একটু বিশদে জানাবেন প্লিজ? মানে নর্থ বেঙ্গলের ওই ছোট্ট ফেসিলিটিতে নিশ্চয়ই শ’খানেক অ্যাটম বম্ব তৈরি হচ্ছিল না। তাহলে কীসের জন্যে এত ভয়?’

‘ওখানে কেউ মারণাস্ত্র তৈরি করতে বসেনি জেনারেল ব্যানার্জি।’ গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন প্রফেসর নারায়ণস্বামী, ‘ওখানে প্রফেসর বোস খুবই ছোট, কিন্তু অত্যন্ত পাওয়ারফুল একটি সাইলেক্ট্রোপ্রোটন যন্ত্র নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এই যন্ত্রটি শুধুমাত্র এই গবেষণার জন্যেই তৈরি করা হয়েছে, এর আর কোনো জুড়ি নেই।’

‘তা আপনার এই সাঁইবাবা না কার যন্ত্রে এমনকী তৈরি হচ্ছিল প্রফেসর,’ বিস্মিত স্মরে প্রশ্ন করেন সিনহা সাহেব, ‘যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে?’

একটিমাত্র শব্দে উত্তর দেন বর্ষীয়ান প্রফেসর, ‘অ্যান্টিম্যাটার।’

‘অ্যান্টিম্যাটার!’ বিস্ময় ফুটে বেরোয় ব্যানার্জি’র গলায়, ‘সেটা কী জিনিস?’

‘পার্টিকল ফিজিক্সের দুনিয়ায় অ্যান্টিপার্টিকল বা অ্যান্টিম্যাটার একটি অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং বস্তু।’ প্রফেসরি ঢঙে বলতে থাকলেন নারায়ণস্বামী, ‘এর প্রতিটি অ্যাটমের ধর্ম ও চরিত্র আমাদের চেনা দুনিয়ার সমস্ত বস্তুর সম্পূর্ণ উলটো। এবং বিন্দুমাত্র ম্যাটার আর আন্টিম্যাটার পরস্পরের সংস্পর্শে এলে যে বিপুল পরিমাণ এনার্জি উৎপন্ন হয় তা কয়েকশো হিরোশিমার সমান।’

কয়েক মুহূর্তের অস্বাভাবিক নীরবতা। কেউ একজন প্রশ্ন করেন, ‘এমন ভয়ানক এক্সপেরিমেন্ট করার ভার আমাদের দেওয়াই বা হল কেন?’

‘তার কারণ প্রফেসর হিতেশরঞ্জন বসু এখনও এই দেশেই গবেষণা করেন বলে। পার্টিকল ফিজিক্সের দুনিয়ায় অ্যান্টিপার্টিকল বা আন্টিম্যাটার নিয়ে গবেষণায় হিতেশের থেকে বড় আর কোনো এক্সপার্ট এই মুহূর্তে দুনিয়ায় আর দুটি নেই।’

‘কিন্তু প্রফেসর,’ অধৈর্য কণ্ঠে বলেন সিনহা, ‘ওই এক্সপেরিমেন্টে এমন কী ঘটল যে এতগুলো লোক উধাও হয়ে গেল?’

‘সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। তবে কিছু তো একটা হয়েছে। আপনাদের গোয়েন্দারা কী বলছে চিফ?’

‘কারও কাছে কোনো খবর নেই।’ উত্তর দেন দ্য চিফ। ‘আই বি, র, ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি—এদের কারও কাছে কোনো ক্লু নেই। আজ দুপুর থেকে আমাদের ইলেকট্রনিক সারভেইলেন্স এক্সপার্টরা পাগলের মতো তন্নতন্ন করে পুরো সাউথ ইস্ট এশিয়ার সমস্ত টপ লেভেলের সিক্রেট কমিউনিকেশন ইন্টারসেপ্ট করছে। তাদের কাছ থেকেও কোত্থাও কোনো খবর নেই।’

ঘরে নৈঃশব্দ্য ঘন হয়। প্রবীণ অভিজ্ঞ আমলা শান্ত গলায় বলে চলেন।

‘বাংলাদেশ, মায়ানমার, নেপাল, ভুটান, চিন, পাকিস্তান, মায় পুরো সি আই এস কান্ট্রিগুলোতে আমাদের যত আন্ডারকভার এজেন্ট আছে তাদের অ্যাক্টিভেট করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে এখনও অবধি, মানে এই মিটিঙে ঢোকা অবধি আমি কোনো খবর পাইনি। মনে হয় না এর মধ্যে কোনো বিদেশি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির হাত আছে।’

‘তাহলে? ওখানে কী হয়েছে সেটা কী করে জানা যাবে?’ প্রশ্ন করেন ব্যানার্জি, ‘আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী?’

‘এই ব্যাপারে অনুসন্ধানের জন্যে একজনকে বিশেষভাবে সিলেক্ট করেছি।’ সামনে ঝুঁকে পড়েন দ্য চিফ, ‘তিনি হলেন প্রফেসর শঙ্কর গাঙ্গুলি।’

নামটা শুনেই প্রবল গুঞ্জন উঠল মিটিং রুমে। সবার আগে শোনা গেল প্রফেসরের বিস্মিত কণ্ঠস্বর, ‘শঙ্কর? আপনি সবকিছু জেনেশুনে ঠিকঠাক ডিসিশন নিচ্ছেন তো মিস্টার ত্রিপাঠী?’

‘আপনার কি ওঁর দক্ষতা নিয়ে সংশয় আছে প্রফেসর?’ চিফের মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।

‘না-না!’ নারায়ণস্বামী ব্যাখ্যা করেন, ‘হি ইজ ভেরি ট্যালেন্টেড নো ডাউট, কিন্তু সেইরকমই একসেন্ট্রিক, উগ্র, একগুঁয়ে, আর জেদি।’

‘কীরকম?’ কৌতূহলী শোনায় লেফটেন্যান্ট ব্যানার্জির গলা।

‘অদ্ভুত-অদ্ভুত সব থিওরি প্রপোজ করার জন্যে আমরা সবাই এমনিতেই ওকে একটু এড়িয়ে চলতাম। প্রায় বছর পাঁচেক আগে আটলান্টাতে থিওরেটিকাল ফিজিসিস্টদের নিয়ে একটা সায়েন্স কংগ্রেস হয়েছিল। সেখানে শঙ্কর টাইম ট্রাভেল নিয়ে একটি অত্যন্ত উদ্ভট পেপার প্রেজেন্ট করে বসে। সেটা এতই অবাস্তব যে শুনলে মনে হয় সায়েন্সের পেপার নয়, কোনো ফ্যান্টাসি স্টোরি।

সাড়া হলে হাসির হুল্লোড় বয়ে যায়। এম.আই.টি.-র প্রফেসর অ্যাণ্ড্রু জনস্টন ভারতীয়দের মেধা ও জাতীয় চরিত্র নিয়ে একটি অত্যন্ত আপত্তিকর উক্তি করেন। আগেই বলেছি, শঙ্কর খুবই রগচটা লোক। ওখানেই সে প্রফেসর জনস্টনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বহু কষ্টে শঙ্করের হাত থেকে প্রফেসর জনস্টনকে উদ্ধার করা হয়। সেই থেকে সায়েন্স কমিউনিটি শঙ্করকে মোটামুটি বয়কটই করে। তারপর থেকেই শঙ্কর প্রায় অদৃশ্য। তার কোনো খোঁজই পাইনি আমরা। কিন্তু আপনারা তাকে পেলেন কোথা থেকে?’

‘হাউ ট্যালেন্টড ইজ দিস জেন্টলম্যান?’ প্রশ্ন করলেন ডিরেক্টর সিং।

স্থির চোখে ডিরেক্টর সিং-এর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন নারায়ণস্বামী। তারপর শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার মতে, হাউ প্রেস্টিজিয়াস ইজ দ্য নোবেল প্রাইজ, মিস্টার সিং?’

‘হাইলি, ইফ নট মোস্ট প্রেস্টিজিয়াস।’ কাঁধ ঝাঁকালেন মিস্টার সিং, ‘এই নিয়ে কোনো সংশয় নেই।’

‘তাহলে শুনে রাখুন। আজ ভারতবর্ষ থেকে ফিজিক্সে যদি নোবেল প্রাইজ পাওয়ার অন্তত একজনও দাবিদার থাকে, তবে তার নাম শঙ্কর গাঙ্গুলি।’

সাড়া হল জুড়ে স্তব্ধতা নেমে এল।

‘কিন্তু উনি কি রাজি হবেন?’ সংশয় প্রকাশ করেনে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ব্যানার্জি।

‘হয়েছেন।’ জোর দিয়ে জানান দ্য চিফ, ‘অবশ্য না হয়ে ওঁর কোনো উপায়ও ছিল না।’

‘কেন?’ উৎসুক হন ডিরেক্টর সিং।

‘প্রফেসর হিতেশরঞ্জন বসু ছিলেন এই পৃথিবীতে শঙ্করের একমাত্র বন্ধু। ওঁদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্কও আছে। শঙ্কর বিয়ে করেছিলেন হিতেশের একমাত্র বোনকে।

শঙ্করের ছেলের বয়েস যখন তিন বা চার, তখন কোনো কারণে তাঁদের ডিভোর্স হয়ে যায়। তারপর থেকে দুই বন্ধুর মধ্যে কমপ্লিট ছাড়াছাড়ি।

লোকে বলে তার পর থেকেই নাকি শঙ্কর একটু পাগলাটে হয়ে যায়। এমনকী ছেলেকে দেখতেও আসত না নিয়মিত। তবে শঙ্করকে পাঠানোর পেছনে এর থেকেও বড় একটি কারণ আছে।’ ঠান্ডা গলায় বলেন হরিশঙ্কর ত্রিপাঠী।

‘সেটা কী?’

‘হিতেশের বোন অতি কষ্টে, অনেক অভাবের মধ্যেও ছেলেকে মানুষ করেন। শঙ্করের সেই সন্তান বড় হয়ে একজন অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিমান ফিজিসিস্ট হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার অদ্ভুত প্রতিভা পেয়েছে ছেলেটি। পদার্থ বিজ্ঞানে আশ্চর্য বুৎপত্তি নিয়ে জন্মেছে সে।

আমাদের সৌভাগ্য যে এই মুহূর্তে সে ছেলে ওই অঞ্চলে উপস্থিত রয়েছে। এই রহস্য ভেদ করতে হলে তাকে ছাড়া আমাদের চলবেই না। এই সিক্রেট মিশনে সেইই হতে পারে আমাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সহকারী।’

‘তার কী নাম, চিফ?’

‘সুজন।’ অল্প হাসলেন সেই স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষটি, ‘হিতেশের ভাগ্নে তথা শঙ্করের ছেলের নাম সুজন গাঙ্গুলি।’

*

অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল সে। নাকি ভেসে ছিল? আশেপাশের অন্ধকার এমন নিকষ কালো যে তার মাথার মধ্যে কোনো দিক, স্থান বা কালের কোনো বোধ কাজ করছিল না। এই অনন্ত অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে কেউ গেঁথে দিয়েছে তাকে।

প্রথমে সে হাত-পা নাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। কোনো সাড় পায় না। তার মনে হয়, ‘আমি আছি’ এই বোধ ছাড়া আর কিছুই বেঁচে নেই শরীরে। চোখ নেই, হাত নেই, পা নেই, মাথা নেই, শরীর নেই, কিচ্ছু নেই। সেই গাঢ়, নিঃসীম বোধশূন্যতার মধ্যে শুধু অন্ধকার প্রদীপটির মতো জেগে আছে একটি মাত্র জিনিস।

তার জাগ্রত চৈতন্য।

প্রথমে ভয় পেয়ে যায় সে। প্রবল ভয়! এ কোথায় সে? কেউ কি তাকে আটকে রেখেছে কোথাও? হাত-পা বেঁধে মাটির নীচে জীবন্ত পুঁতে দিয়ে গেছে? সে কি আর বেঁচে নেই?

প্রবল আতঙ্কে চিৎকার করে উঠতে যায় সে। কিন্তু তার গলায় কোনো শব্দ ফোটে না! চিৎকার করার সেই প্রবল ইচ্ছে যেন তার নিজের চৈতন্যের ওপরেই বিপুল সমুদ্র হয়ে আছড়ে পড়ল। মরণাপন্ন মানুষের মতো ছটফট করে উঠতে চাইল সে। প্রবল ইচ্ছেয় যেন মুচড়ে যেতে চাইল তার প্রতিটি স্নায়ু।

এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ধীরে ধীরে অবসন্ন হয়ে এল তার বোধশক্তি।

কিছুক্ষণ পর সে অনুভব করল, কিছু একটা হচ্ছে। তার সত্ত্বা যেন একটু-একটু করে প্রসারিত হচ্ছে। সেই অতলান্ত শূন্যতার মধ্যে তার বোধ আর চৈতন্য অতি ধীরে জমাট বেঁধে উঠছে, যেমনভাবে পাথরের গা বেয়ে উঠে আসে জীবন্ত জলজ শ্যাওলার ঝাঁক!

ধীরে ধীরে মনের ইচ্ছা সংহত করতে থাকে সে। নিজের সমস্ত বোধ একটিমাত্র বিন্দুতে স্থিত করার চেষ্টা করে। নিজের মগ্নচৈতন্যের গভীরে ডুব দেয় সেই যুবক।

কিছু সময় পর সে বুঝতে পারে, তার বিদেহী চৈতন্যবিন্দু ঘিরে যেন এক শরীরী বোধ গড়ে উঠছে। শরীর নেই, তবু যেন তার সত্ত্বার মধ্যে কে যেন নির্দেশ পাঠাচ্ছে যে সে এখন মুক্ত। যেই নিকষ কালো ব্যপ্তির মধ্যে সে যেন এবার নড়াচড়ার ধারণা অনুভব করে।

ধীরে ধীরে এগোবার চেষ্টা করে সে।

সেই অনন্ত অন্ধকার সমুদ্রে ভেসে বেড়ানোর পথে তার স্মৃতি জাগ্রত হয় তিল-তিল করে। একের পর এক দৃশ্য তার মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে। সেগুলো কাটা-কাটা নয়। বরং একটা দৃশ্যের সঙ্গে যেন জড়িয়ে যাচ্ছে, গলে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে আর একটা দৃশ্য। ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতির কোলাজ ভেসে বেড়াচ্ছিল তার স্মৃতির পর্দা জুড়ে।

শুয়ে ছিল সে…কে যেন হঠাৎ তার নাম ধরে ডাকল অনেক দূর থেকে… উদ্ভ্রান্তের মতো উঠে বসেছিল সে… চটিটা পায়ে গলিয়ে বাইরে আসতেই…

দৃশ্য পালটে যায়। নদীর পাশে একটা বড় বাড়ি। দূরে পাহাড়…নদীর পাড়ে কারা যেন বসে আছে… কথা বলছে… ওই তো, সে নিজেও আছে তাদের মধ্যে…

আবার পাল্টে যায় দৃশ্যপট। পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘন জঙ্গল…তার মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছে এক অশরীরী ছায়া…তাকে চেনা চেনা লাগে… পাহাড়ি রাস্তা… সাদা বাড়ি… নদীর ধারে বাড়ি…ঝরনা…

সেই অশরীরী ছায়ার পেছন পেছন এগিয়ে যাচ্ছে সে! অন্ধের মতো, উদ্ভ্রান্তের মতো সেই ছায়াকে অনুসরণ করে চলেছে… পাহাড়ের গায়ে ঘন জঙ্গল… সেই জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেছে সে!

কোথায় হারিয়ে গেছে সে? এই তো সেই বাড়ি… বাড়িটার আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে… জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি… চাতাল… চাতালের ওপর অনেক লোক.. বাড়িতে অনেক লোক…ঝড়…অনেক লোক…চাতালে…মশাল…কী যেন নেমে আসছে…দৌড়ে যাচ্ছে ও…বাড়িটা যেন হঠাৎ ধেয়ে আসা ঝড়ের মতো গিলে খেতে আসছে ওকে…

তারপর শূন্য। সব শূন্য।

নিজের মধ্যে ধ্যানমগ্ন হয় সে যুবক। চেষ্টা, আরও চেষ্টা করতে থাকে। তীব্র ইচ্ছার সঙ্গে জড়িয়ে দেয় ছোটোবেলার সমস্ত ভালোলাগার মুহূর্তগুলো।

ছ’বছর বয়েস। মা কোলে বসিয়ে ভাত খাওয়াচ্ছেন। লোডশেডিং। মৃদু স্বরে গাইছেন, ‘অশ্রুনদীর সুদূর পারে, ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে।’

প্রথম বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ। প্রথম দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘা-র ওপরে সোনা ঢেলে দিচ্ছে সূর্যের আলো।

মাধ্যমিকের রেজাল্ট। রাজ্যে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে সে। কে যেন একজন মা-কে জড়িয়ে ধরে বললেন ‘আপনি তো রত্নগর্ভা, দিদি।’ মা কিছু বলছেন না, ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। আর সে অনুভব করছে, এক সমুদ্র ভালোবাসা যেন নরম চাদরের মতো ওমে ঘিরে ধরেছে তাকে।

সেকেন্ড ইয়ার। কফি হাউস। কাজলরঙা মেয়েটি মৃদু স্বরে আবৃত্তি করছে, ‘একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে, ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী…!’

নেটের রেজাল্ট বেরোনোর দিন। মামা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছেন, ‘বাপকা বেটা সিপাহিকা ঘোড়া…আর কিছু না হোক, হতচ্ছাড়ার রক্তের গুণটা তো আছে!’

দেবাদিত্য… একসঙ্গে বাইক চালিয়ে দিঘা… রাতভর আড্ডা… জেনেভা… ফেয়ারওয়েল পার্টি… প্রফেসর কাগুয়োচি আড়ালে ডেকে বলছেন, ‘জয়েন আস ইন হার্ভার্ড, ইয়ংম্যান। এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স নিডস ইউ…!’

ঠিক এইসময়েই তার সত্ত্বার মধ্যে মৃদু, অতি মৃদু স্বরে জেগে উঠল কারও স্বর। দূর থেকে ক্ষীণ তরঙ্গ ধাক্কা দিল তার চেতনার পর্দায়, ‘সুজন! সুজন, একী? তুই…তুই এখানে?’

শোনামাত্র আরও তীব্র করল সে তার চিৎশক্তি। মনের সমস্ত জোর সংহত করে ছুড়ে দিল চিন্তাতরঙ্গ, ‘মামা, তুমি! তুমি এখানে? কোথায় আছ মামা? আমরা কোথায় আছি? তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?’

‘হা ঈশ্বর! সুজন, তুই এখানে এলি কী করে? তুই কি আছিস? বুঝতে পারছিস আমার কথা?’

‘আছি মামা। কিন্তু এ কোন জায়গা? আমরা কোথায়? চারপাশে কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন? আমার হাত-পা শরীর এসব কিছুই অনুভব করতে পারছি না কেন? কথা বলতে পারছি না কেন? আমার ভয় করছে মামা।’

‘ভয় পাস না সুজন। মাথা ঠান্ডা রাখ। কোথায় আছি সেটা নিশ্চিত হয়ে বলার মতো সময় আসেনি এখনও। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি যে তীব্র ইচ্ছাশক্তি ছাড়া এখানে কিছুই করা যায় না। মনের শক্তিকে সংহত কর সুজন। এছাড়া এখানে কমিউনিকেট করার কোনো উপায় নেই।’

‘কিন্তু মামা, এ কোন অদ্ভুত জায়গায় আছি আমরা? আমরা এখানে এলামই বা কী করে? তুমি ব্রাইটনে কয়েক মাসের জন্য পড়াতে গেছিলে না?’

‘না রে। আমি তোদের ভুল বলেছিলাম। একটা খুব সিক্রেট এক্সপেরিমেন্ট করতে এসেছিলাম এখানে। তারপর…সে এক লম্বা গল্প! কিন্তু তুই? তুই এখানে এলি কী করে?’

‘বন্ধুর সঙ্গে ছুটি কাটাতে এসে জড়িয়ে পড়েছি মামা। কিন্তু তুমি কিসের এক্সপেরিমেন্টের কথা বলছ?’

‘ক্যালিব্রেশনে একটা ছোট্ট ভুল, আর তার ফলে এক্সপেরিমেন্টটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল, ব্যস, এই অবধিই মনে আছে রে। তারপর যে কী হল, সে আমিও বুঝতে পারছি না। তবে…অনুমান করতে পারি।’

‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না মামা। কী এক্সপেরিমেন্ট? কোন অনুমানের কথা বলছ তুমি?’

‘এক্সপেরিমেন্টটার কথা তো তোকে বলতেই হবে এখন। তবে এতদিনে মনে হচ্ছে, ওই পাগলটার থিওরিই বোধহয় ঠিক।’

‘পাগল? কোন পাগল?’

‘তোর বাবা। শঙ্কর গাঙ্গুলি।’

*

শিলিগুড়ির একটা হোটেলের প্রায়ান্ধকার রুমে তিনজন অসমবয়সি মানুষ মাথা নীচু করে বসেছিলেন। তাঁদের একজন তরুণ, আরেকজন মাঝবয়েসি, শেষজন বয়সে প্রৌঢ়। ভেতরে এসি চলছিল মৃদু আওয়াজ তুলে। রাস্তার লোকজন, রিকশা, গাড়িঘোড়ার ক্ষীণ আওয়াজ বন্ধ কাচের ওপার থেকে রুমের ভেতর ভেসে আসছিল।

দেবাদিত্য আর কৃষ্ণদা যখন এখানে এসে পৌঁছয় তখন প্রায় বেলা এগারোটা। কৃষ্ণদা যেন জানতেনই যে এই প্রৌঢ় ভদ্রলোককে কোথায় পাওয়া যাবে। দেবুকে তিনিই টেনে এনেছেন সঙ্গে করে। সুজনের হারিয়ে যাওয়ার সংবাদ তিনি দিয়েছেন এইমাত্র। সেই দুঃসংবাদটাই যেন এই কোলাহলমুখরিত দুপুরের মধ্যে পাথরচাপা স্তব্ধতা হয়ে চেপে বসেছিল তিনজনের বুকে।

প্রথম প্রশ্ন করলেন প্রৌঢ় পুরুষটি, ‘একটা জলজ্যান্ত ছেলে হারিয়ে গেল? কীভাবে?’

‘জানি না আঙ্কেল।’ ভাঙা স্বরে বলে দেবাদিত্য। চোখ-মুখ বসে গেছে তার, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, বারবার শুকনো ঠোঁট চাটছে।

‘আমাদের প্ল্যান ছিল, রাতের অন্ধকারে আমরা দুজনে একবার ওই বাড়িটার কাছে যাব, যদি চুপিচুপি ঢোকা যায়।’ বলে চলে দেবাদিত্য, ‘আমাদের মনে হচ্ছিল, বাড়িটার মধ্যেই হয়তো এই রহস্যের সমাধান সূত্র আছে।

সেইমতো আমরা রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়েও পড়ি। কথা ছিল, মাঝরাতে সুজন আমাকে ডেকে দেবে, তারপর আমরা বেরোব। কিন্তু আমার ঘুম ভাঙে একেবারে সেই ভোরবেলায়। উঠে দেখি ও নেই… তারপর…’

‘আর ইউ কিডিং?’ রাগে ফেটে পড়েন প্রৌঢ়, ‘কী ভেবেছিলে, ওখানে কোনো সিকিওরিটি নেই? জায়গাটা এমনি এমনি খোলা পড়ে থাকবে, যাতে তোমরা গিয়ে রাতের বেলা ‘অ্যাডভেঞ্চার’ করবে? এত বয়েস হয়েছে, মাথায় সাধারণ বুদ্ধিটুকু অবধি নেই?’

‘না, মানে…’ আমতা-আমতা করতে থাকে দেবু, ‘আসলে ইনি বলেছিলেন যে সেই ঝড়জলের রাতে ওই বাড়িটায় যেন কী একটা…!’

‘এঁর সঙ্গে পরে কথা বলছি। তুমি বলো, তারপর তুমি কী করলে?’ কঠিন গলায় প্রশ্ন করলেন প্রৌঢ়।

একবার ঢোক গিলল দেবু, তারপর বলল, ‘আমি ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ওর বিছানা খালি। প্রথমে ভাবলাম আমাকে না ডেকে ও হয়তো একাই বেরিয়ে গেছে। কিন্তু তারপর দেখি টর্চ, কিটব্যাগ, রিস্ট ওয়াচ, স্নিকার্স সব কিছুই পড়ে আছে। শুধু ঘরে পরার হাওয়াই চপ্পলটাই নেই। হাওয়াই চপ্পল পরে তো ওর বেশি দূর যাওয়ার কথা নয়।’

‘কেউ ধরে নিয়ে যায়নি তো?’ অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করে প্রশ্নটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন প্রৌঢ় ভদ্রলোক।

‘না আঙ্কেল। তাহলে তো আমি শব্দ পেতাম। তাছাড়া চা বাগানের দুজন গার্ড বারান্দায় শোয়। তারাও কোনো আওয়াজ পায়নি। বিছানায় বা চারপাশের কোথাও ধস্তাধস্তির কোনো চিহ্ন নেই। আর কেউ ওকে খামোখা ধরে নিতে যেতে চাইবেই বা কেন?’

‘স্ট্রেঞ্জ! ছেলেটা হাওয়াই চপ্পল পরে বেরিয়ে জাস্ট হারিয়ে গেল?’

ঘটনাটা আরও বিশদে জানায় দেবু। ঘুম থেকে উঠে সুজনকে বিছানায় না দেখে খুবই আশ্চর্য হয়েছিল সে। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছিল, সুজন তাকে না জানিয়েই হয়তো ওই যন্তরমন্তরের কাছে গেছে।

সময় নষ্ট না করে তক্ষুনি-তক্ষুনি গার্ডের সাইকেল চালিয়ে বাড়িটার কাছে গেছিল সে। কিন্তু সেখানে সুজনের কোনো খোঁজ তো সে পায়ইনি, উপরন্তু সিকিউরিটি ওকে দেখামাত্র ভাগিয়ে দেয়। পুলিশে অভিযোগ জানাবে কি না ভাবতে-ভাবতে ফিরে আসার সময়ই নদীর ধারে কৃষ্ণদা’র সঙ্গে দেখা। কেষ্টদা তাকে বারণ করেন পুলিশে যেতে। তিনিই একটা গাড়ি ধরে ওকে নিয়ে চলে আসেন শিলিগুড়ির এই হোটেলে।

‘পুলিশে না যাওয়ার পরামর্শটা কি আপনি দিলেন?’ ঘরে উপস্থিত তৃতীয় জনকে প্রশ্ন করেন শঙ্কর গাঙ্গুলি।

‘হ্যাঁ।’ ছোট করে উত্তর দেন মধ্যবয়সি মানুষটি। তিনি এতক্ষণ ধরে নিবিড়ভাবে শঙ্কর গাঙ্গুলিকে লক্ষ করছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল যে আপাত কঠিন এই মানুষটি ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। তাঁর ঘনঘন আঙুল মটকানো, ছটফট করা, দরদর করে ঘামতে থাকা সেসবেরই ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

‘কেন? পুলিশে যেতে বারণ করলেন কেন?’ তীক্ষ্ন স্বরে প্রশ্ন করলেন শঙ্কর।

‘কারণটা বোধহয় আপনিও জানেন প্রফেসর সাহেব। আমার মন বলছিল, যে কারণে এই চেংমারি টি গার্ডেন বা লাল ঝামেলা বস্তি সংলগ্ন এলাকার লোকজন হঠাৎ করে হারিয়ে যাচ্ছে, আপনার ছেলের নিখোঁজ হওয়ার পেছনেও সেই একই কারণ রয়েছে। সেটা পুলিশকে জানিয়ে বিষয়টা জটিল করে তোলার বদলে সরাসরি আপনাকে জানানোই বেটার, তাই না? আপনিও তো এই প্রবলেমটাই সলভ করতে এসেছেন!’

‘আমি কী করতে এসেছি সে প্রশ্ন পরে। কিন্তু আপনি আগে আপনার পরিচয়টা খুলে বলুন তো।’ ধারালো গলায় প্রশ্ন করলেন শঙ্কর, ‘কে আপনি? আমি এখানে কী কাজে এসেছি, কোথায় উঠেছি, সেসব তথ্য এই গোটা দেশে গোনাগুনতি জনা দশেক লোক ছাড়া আর কারও জানার প্রশ্নই ওঠে না। আপনি জানলেন কী করে?’

‘কী করে জানলাম?’ মৃদু হাসলেন মানুষটি, ‘ধরে নিন যে দশজনের উল্লেখ আপনি করলেন, তাঁদের মধ্যেই একজন আমার অতি ঘনিষ্ঠ লোক। তিনি আমার শিষ্যস্থানীয়, আমাকে তিনি নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করেন। দেশের নিরাপত্তা জড়িত আছে এমন অনেক বিষয়েই আমার সঙ্গে আলোচনা করেন তিনি। সেই মানুষটিই আমাকে অনুরোধ করেছিলেন এখানে আসতে। আর… একটা অন্য কারণও আছে।’

উদভ্রান্তের মতো দু’জনের দিকে তাকায় দেবু। কোন দশজন লোকের কথা হচ্ছে এখানে? এখানে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নটাই বা উঠছে কেন? মাথাটা ঘেঁটে যাচ্ছিল তার। যেন ওর মনের প্রশ্নটাই আঁচ করে নিলেন কৃষ্ণদা। উঠে এসে সান্ত্বনার হাত রাখলেন দেবু’র পিঠে। তারপর বললেন, ‘আমি দুঃখিত দেবাদিত্য। এবার বোধহয় তোমাদের সব কথা খুলে বলার সময় এসেছে।’

বোবা হয়ে থাকে দেবু। কৃষ্ণদা বলে চলেন।

‘আমার এখানে আসা, বা তোমাদের সঙ্গে দেখা হওয়া, কিছুই আকস্মিক নয়। যন্তরমন্তরে ঝড়জলের রাতের পর থেকেই ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি খবর রাখছিল, এই এলাকায় কারা আসছে আর যাচ্ছে।

ইনফ্যাক্ট তুমি আর তোমার বন্ধু এখানে আসছ, এই খবর পাওয়ার পরেই এই পরিকল্পনার ছক কাটা হয়। তারপরেই যোগাযোগ করা হয় প্রফেসর গাঙ্গুলির সঙ্গে। আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছিল এই প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত থাকতে।’

‘কিন্তু… কিন্তু…’ তুতলিয়ে যায় দেবু, ‘এর কারণ কী? এ-সব… এসব সিক্রেট মিশন, ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি! ঠিক কী ঘটছে এখানে?’

‘আমরা যা ভাবছি তা যদি সত্যি হয় দেবাদিত্য,’ গম্ভীর স্বরে বলেন কেষ্টদা, ‘এখানে যা ঘটছে সেটা খুব সম্ভবত আজ অবধি আমাদের জানাশোনার পরিধির মধ্যে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা। এ একদিকে যেমন অতীন্দ্রিয় ও অলৌকিক, অন্যদিকে মানুষের প্রতিভার সর্বোচ্চ প্রমাণও বটে।’

‘কিন্তু আপনি এতসব জানলেন কী করে?’ সন্দেহের সুরে প্রশ্ন করলেন শঙ্কর, ‘আর আপনাকে কে বলেছিলেন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে?’

‘বললাম তো, ধরে নিন এই দেশের সবচেয়ে শক্তিমান দশজন মানুষের একজন।’ স্মিত হেসে বলেন কেষ্টদা।

‘তিনি যেই হোন, তাঁর প্রফেশনাল এথিক্সের বাইরে গিয়ে আপনাকে এই কাজে নিয়োগ করবেন এটা আমি ভাবতে পারছি না। আর সেই জন্যই আপনাকে বিশ্বাস করাটাও আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।’ চ্যালেঞ্জের সুরে বললেন শঙ্কর, ‘আপনি যে কোনো বিদেশি শক্তির এজেন্ট নন, তারই বা প্রমাণ কী?’

শান্ত হেসে শঙ্করের দিকে একবার তাকালেন কৃষ্ণদা। তারপর পকেট থেকে একটা আদ্যিকালের মোবাইল বার করে কাকে যেন কল করলেন। ওদিক থেকে সাড়া পেতেই ধীরস্থির স্বরে বললেন ‘চিফ, ডক্টর গাঙ্গুলি আমার পরিচয় চাইছেন।’

যন্ত্রটা তিনি বাড়িয়ে দিলেন শঙ্কর গাঙ্গুলির দিকে।

উত্তরোত্তর বিস্মিত হয়ে উঠছিল দেবু। সেই মালবাজারে মধ্যাহ্নভোজের সময় থেকে লোকটাকে দেখছে সে। তখন লোকটার হাবভাবে যে নিরীহ ছাপোষা বাঙালিমার্কা ছাপ ছিল, এখন তা ভোজবাজির মতোই উধাও। লোকটার স্বরে এখন এক আশ্চর্য সজীব ও স্থিরবুদ্ধি কর্তৃত্বের ব্যঞ্জনা খেলে বেড়াচ্ছিল।

মোবাইলটা নিয়ে দ্রুত ঘরের বাইরে গেলেন শঙ্কর গাঙ্গুলি। খানিকক্ষণ পরে ফিরে এলেন তিনি। তাঁকে একইসঙ্গে নিশ্চিন্ত আর উত্তেজিত লাগছিল। যন্ত্রটা ফেরত দিয়ে তিনি বললেন ‘ইওর আইডেন্টিটি ইজ প্রূভেন স্যার। এবার বলুন তো, এ ব্যাপারে আপনি কী করে জড়িয়ে পড়লেন? তার আগে আপনার পুরো পরিচয়টা দেবেন প্লিজ?’

মৃদু হাসলেন মধ্যবয়সি ভদ্রলোকটি। তারপর বললেন, ‘স্যার সম্বোধনটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল প্রফেসর গাঙ্গুলি। আমার নাম কৃষ্ণানন্দ, কৃষ্ণানন্দ মৈত্র।’ বলে একটু থামলেন ভদ্রলোক, তারপর বললেন, ‘অবশ্য পুজো-আচ্চা বা আগমপন্থী তন্ত্রসাধনা করি বলে লোকে অন্য একটা উপাধিও দিয়েছে আমাকে, আগমবাগীশ।

আমার নাম কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।’

*

‘এই সাংঘাতিক এক্সপেরিমেন্ট করতে রাজি হলে কেন মামা?’

‘লোভ রে সুজন, লোভ। বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটা চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যাওয়ার লোভ। লোভে পাপ। পাপে…’

‘আমরা কোথায় আছি মামা? আমরা কি মরে গেছি? এটা কি মৃতদের জগত?’

‘বলা মুশকিল। চেনাজানা কোনো জগৎ নয় সে তো বোঝাই যাচ্ছে। তবে ওই যে বললাম, তোর বাবার থিওরি যদি সত্যি হয় তো…’

‘আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন মামা? তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?’

‘না। শুধু ইচ্ছেশক্তির সাহায্যে তোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি। ইচ্ছেশক্তির বলেই বুঝেছিলাম, তুই এসেছিস এখানে। প্রতিটি মানুষের চিন্তাতরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সি আলাদা হয়।’

‘ইজ ইট টেলিপ্যাথি?’

‘কী করে বলি বল তো? সারা জীবন বিশ্বাস করে এলাম যে এসব টেলিপ্যাথি-ট্যাথি সব ভাঁওতা… এখন তাই দিয়ে নিজের অবস্থান কীভাবে ব্যাখ্যা করি?’

‘বাকিরা কোথায় মামা? তোমার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন?’

‘অনেক চেষ্টা করেছি, কারও সাড়া পাইনি। চল তো, একবার একসঙ্গে চেষ্টা করে দেখি। যৌথ প্রচেষ্টায় যদি কোনো ফল হয়।’

দু’জনে ধ্যানস্থ হন। অন্ধকার সমুদ্রে যেন অতি সূক্ষ্ম, অতি মৃদু কম্পন ওঠে। একটু পরে অতি ক্ষীণ সাড়া পাওয়া যায়, ‘হ্যালো, কেউ আছেন?’

সাড়া দেন হিতেশরঞ্জন, ‘কে? মেজর মাত্রে?’

‘ইয়েস!’ সেই অনন্ত অন্ধকার সমুদ্র থেকে জবাব ভেসে আসে, ‘আমরা কোথায় প্রফেসর?’

‘আই অ্যাম ট্রাইং টু ফিগার দ্যাট আউট।’

‘হোয়াই ক্যান্ট আই ফিল মাই বডি পার্টস?’

‘মনের জোর একত্রিত করুন মেজর, নিজের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করুন। এখানে যোগাযোগ করার বা নিজের অস্তিত্ব অনুভব করার ওটাই একমাত্র উপায়।’

‘ওকে। বাট দিস ইজ এক্সট্রিমলি স্কেয়ারি, আই মাস্ট সে।’

‘প্যানিকড হবেন না মেজর। এখন আমরা একটা ঘোর বিপদের মধ্যে আছি। এখান থেকে উদ্ধার পেতে গেলে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বিচলিত বা আতঙ্কিত হলেই আমাদের মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হবে। মনের জোর, ইচ্ছাশক্তি, এছাড়া আমাদের কাছে এইমুহূর্তে আর কোনো অস্ত্র নেই এই সিচুয়েশন থেকে বেরোবার।’

‘কিন্তু সিচুয়েশনটা কী সেটাই তো বুঝতে পারছি না! আমাদের টিমের বাকিরা কোথায়?’

‘আমার ভাগ্নে পাকেচক্রে এসে পড়েছে এখানে, তার সাড়া পেয়েছি। বাকিদের খুঁজে বের করার জন্যে চেষ্টা চালাচ্ছি। আপনি মনের শক্তি একত্রিত করে তাদের ডাকুন। যত বেশি মানুষ চেষ্টা করবে, ওদের খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ততই বাড়বে।’

‘কিন্তু… আমরা আসলে কোথায়?’

‘আমার ধারণা যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতে হবে যে আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি, কিন্তু অন্য ডাইমেনশনে। মানে স্পেস অ্যান্ড টাইমের অন্য মাত্রায়।’

‘হোয়াট?!’

*

পরের দিন যখন ওরা যন্তরমন্তরে পৌঁছল তখন প্রায় দুপুর। সারা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা চাপা উত্তেজনার আঁচ লাগছিল তিনজনের গায়েই। পুলিশের নিত্য টহল চলছে। প্রতিটি বাজারে বা মোড়ে কৌতূহলী মানুষের ভিড়।

নিরাপত্তার পুরু চাদরে মোড়া ল্যাবে ঢুকতে ওঁদের তিনদফা বায়োমেট্রিক টেস্টের ধাপ পেরোতে হল। সে নিয়ে চাপা স্বরে গজগজ করলেন শঙ্কর।

সিকিউরিটিকে বলে তক্ষুনি যন্তরমন্তরের মেশিনঘর খোলানো হল। ঘটঘট করে যখন মেশিনঘরের দরজা ওপরে উঠে যাচ্ছে, নিজের অজান্তেই সর্বাঙ্গ শিরশির করে উঠল দেবু’র।

কাল সকাল থেকে দুশ্চিন্তার ঠেলায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল তার। সুজনকে সে নিজের থেকে কম ভালোবাসে না। সুজনের মা, মানে কাকিমাও খুব স্নেহ করেন তাকে। অথচ প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার ওপর হতে চলল, ছেলেটার কোনো পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, রহস্যটা ক্রমেই জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার কাছে।

দরজাটা পুরো খুলে যেতে তিনজনেই হাঁ করে চেয়ে রইলেন সামনের দিকে।

মেশিনটা একটা প্রায় দেড়তলা বাড়ির সমান উঁচু। দুটো লরি পাশাপাশি রাখলে যতটা চওড়া হয় ততটাই চওড়া। প্রস্থও প্রায় ওই দুই লরির সাইজেরই, উঁকি দিয়ে দেখল দেবু।

দুজনে ভেতরে ঢুকল। কেষ্টদা বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলেন, ‘আমি এসব বুঝবো না ভাই।’

শঙ্কর গাঙ্গুলি মেশিনের গায়ে নাট-বোল্ট দিয়ে সেঁটে রাখা লেবেলটা কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন। স্বগতোক্তি করলেন, ‘ভেরি স্ট্রেঞ্জ অ্যান্ড এক্সট্রিমলি বিউটিফুল।’ তারপর পুরো মেশিনটা ঘুরে দেখলেন। তারপর অন্যদের দিকে ঘুরে বললেন, ‘এর কন্ট্রোলরুম বাড়ির দোতলায়। ওখানেই সব রিডিং পাওয়া যাবে। মেজর, এইবার এটা বন্ধ করে আমাদের ওখানে নিয়ে চলুন।’

দোতলায় কন্ট্রোলরুমের পাল্লা খুলতেই একটা বদ্ধ ভ্যাপসা গন্ধ সবার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিনজনেই মুখে রুমাল চাপা দিলেন। শুধু মেজর বক্সি, যিনি সদ্য এই ফেসিলিটির সিকিউরিটির দায়িত্ব নিয়েছেন, নিবাত নিষ্কম্প ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন।

গন্ধের ধাক্কা সামলে উঠে দেবু বুঝল, এই ঘরের প্রতিটি বর্গইঞ্চি অত্যাধুনিক যন্ত্রে ঠাসা। এদের মধ্যে বেশ কিছু যন্ত্রের বিবরণ শুধু বিভিন্ন জার্নালেই পড়েছে সে। চোখের সামনে সেসব দেখে তার গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল।

ঘরের একটা দিকের দেওয়াল পুরোটাই পুরু বুলেটপ্রূফ কাচের তৈরি। তার সামনে দাঁড়ালে মেশিনঘরের দরজাটা চোখে পড়ে। কাচের দেওয়ালের ঠিক সামনে বড় কন্ট্রোল প্যানেল। প্রথমে সেটাই মন দিয়ে দেখলেন শঙ্কর। তারপর প্রতিটা যন্ত্র দেখতে দেখতে কন্ট্রোল প্যানেলের পাশে রাখা ল্যাপটপের সামনে এলেন।

ল্যাপটপ খোলাই ছিল, যদিও হাইবারনেশনে। পাওয়ার বাটন অন করার সঙ্গে-সঙ্গে ল্যাপটপের স্ক্রিন লাফিয়ে উঠল ওঁদের সামনে। ফাঁকা বাক্সের মতো জায়গার ওপরে জ্বলজ্বল করে ওঠে দুটি শব্দ, ‘পাসওয়ার্ড প্লিজ।’

হঠাৎ থমকে গেলেন শঙ্কর। ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠলেন, ‘এ কী! এটা এখানে কেন?’

জিনিসটা নজরে পড়েছে দেবাদিত্যরও। সেও আশ্চর্য হল ওটাকে দেখে। জিনিসটা আর কিছুই না, একটা বালিঘড়ি।

‘বলতে পারব না প্রফেসর।’ এতক্ষণ পর প্রথম কথা বলেন মেজর বক্সি, ‘এ-ঘরের সবকিছু প্রফেসর বাসুর তত্ত্বাবধানে ছিল। কয়েকজন সহকারী তাঁকে সাহায্য করতেন। সেইদিনের পর থেকে তাঁদেরও কোনো খোঁজ নেই।

আমরা কোনো ঝুঁকি নিইনি, ঘরটা সিল করে রেখেছিলাম। কোনো কিছুতে হাত দিইনি। প্রতিটি যন্ত্র যেভাবে ছিল, ঠিক সেভাবেই রাখা আছে। সেদিনের পর আপনারাই প্রথম এই ঘরে ঢুকলেন।’

অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়তে-নাড়তে বিড়বিড় করেন শঙ্কর, ‘এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, তাতে কোনো পাওয়ার আউটেজ ঘটেনি? প্রতিটা যন্ত্র ঠিকঠাক রিডিং দিচ্ছে? কোনো মেজারমেন্ট ইক্যুইপমেন্টের কোনো ক্ষতিই হয়নি? স্ট্রেঞ্জ! যদি ল্যাপটপের পাসওয়ার্ডটা…’

হঠাৎ নীচু হয়ে কী যেন একটা হাতে তুলে নেন তিনি। দেবু চিনতে পারে জিনিসটাকে। যে কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার প্রতিটি খুঁটিনাটি লিখে রাখা হয় যাতে, সেই ল্যাবের লগবুকটা পড়ে ছিল নীচে। দ্রুত লগবুকের পাতা উলটে একটা পাতায় এসে উল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠেন শঙ্কর, ‘এই তো! পেয়েছি!’

দ্রুত অন্যদের দিকে ঘুরে উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠেন তিনি, ‘আপনারা আমাকে একটু একলা ছেড়ে দিন প্লিজ। আপনারা একটু এদিক-ওদিক জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখুন কোথায় কোনো ক্লু পান কি না। আমি বরং কন্ট্রোল প্যানেল অ্যাক্সেস করে বোঝার চেষ্টা করি, কী হয়েছিল সেদিন। এই রহস্যের সমাধান করতে গেলে আমাকে এই এক্সপেরিমেন্টের প্রতিটি স্টেপের ডেটাসেট চেক করতে হবে।’

ল্যাপটপের সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে কিবোর্ডের ওপর ঝুঁকে পড়েন বর্ষীয়ান পদার্থবিদ।

*

এক মৃদু অপার্থিব আলোর মধ্যে শূন্যে ভেসেছিলেন কয়েকজন। তাঁদের অনেককে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আবার অনেককে দেখা যাচ্ছিল না। কেমন যেন কম্পমান অবস্থায় ছিলেন তাঁরা। টিভির স্ক্রিন খারাপ হলে যেরকম দেখায়, সেরকম। চারদিকে শূন্যতা। তার কোনো আকার বা অবয়ব নেই। লোকগুলো শূন্যে ভেসে আছে বলাও ভুল। যেন কতগুলো চলমান অস্তিত্ব এই আদিম অতিলৌকিক আলোর মধ্যে গেঁথে আছেন। এই স্থানটির সামনে, পেছনে, উপর, নীচ, আকাশ, ভূমি কিছুই নেই।

‘এখন তাহলে আমাদের কী করণীয়, প্রফেসর বোস?’ বেশ কিছুক্ষণ পরে চিন্তাতরঙ্গ শোনা যায় একজনের, ‘কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে, তার কিছুই বুঝতে পারছি না যে আমরা। আপনি কিছু বলুন প্লিজ।’

কথাটা যিনি বললেন, তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন। শীতে, ভয়ে বা আতঙ্কের নয় এ কম্পন। বয়ে আসা বাতাসে প্রদীপের শিখা যেমন সরে যায়, তেমনই কেঁপে উঠলেন তিনি, যেন ছবিটা আবছা হয়েই উজ্জ্বল হয়ে উঠল ফের।

‘কোথায় আছি, সেটা বোধহয় বুঝতে পারছি লেফটেন্যান্ট সাওয়ন্ত। এমনকি এখানে যে কী ঘটেছে সেটা অনুমানও করতে পারি। কিন্তু…’

‘কিন্তু কী, প্রফেসর?’ শান্ত কণ্ঠে কে যেন জানতে চায়।

‘এখান থেকে উদ্ধার পাওয়া প্রায় অসম্ভব মেজর মাত্রে।’

‘অসম্ভব! মানে? আমরা কি এখানে থেকে থেকে মরে পচে ভূত হয়ে যাওয়ার জন্যে এসেছি নাকি?’ উষ্মা ফুটে ওঠে আরেকজনের তেজি গলায়।

‘মরে ভূত? না, তা অবশ্য হবেন না।’ ক্লান্ত হেসে জবাব দেন প্রফেসর, ‘এখানে মরার কোনো প্রশ্নই নেই।’

‘হোয়াই?’ প্রশ্ন আসে।

‘কারণ আমরা এখন আর মরজগতে নেই।’

‘এ আপনি কী বলছেন প্রফেসর?’ উদ্বিগ্ন গলা শোনা যায় আরেকপ্রান্ত থেকে, ‘মরজগতে নেই মানে? আমরা এই পৃথিবীতে আছি না নেই?’

‘আমার অনুমান যদি সঠিক হয়, তবে জেনে রাখুন, আমরা স্থানিক ভাবে যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি। কিন্তু সময়ের অন্য মাত্রায়।’

‘সময়ের অন্য মাত্রা মানে?’ উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত স্বরে প্রশ্ন করেন আরেকজন, ‘এসব আবার কীরকম হেঁয়ালি?’

‘যথাসম্ভব সরল করে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করছি। মন দিয়ে শুনুন।

আমরা যে এক্সপেরিমেন্টটি করছিলাম সেটি অত্যন্ত গোপনীয় এবং জটিল একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। সম্ভবত ভারতবর্ষের মাটিতে হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ছিল এটি।

আপনারা অনেকেই জানেন যে সার্ন বলে একটি ইউরোপীয় সংস্থা গত দেড় দশক ধরে পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহত্তম সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্টটি চালাচ্ছে। এই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার উদ্দেশ্য অনেক মহাজাগতিক রহস্য উন্মোচন করা। আরও ভালো করে বলতে গেলে সৃষ্টির গোড়ার কথাগুলি জানা।

সেই কাজেরই একটি খুব ছোট্ট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার দিয়ে আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছিল। যে ল্যাবরেটরিতে কাজটা করার কথা, সেটাও এই উদ্দেশ্যেই প্রায় যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে তৈরি করা হয়।

 এই পরীক্ষার ফলাফল জাতীয় সুরক্ষার পক্ষে বিপজ্জনক বিষয় হতে পারে বলে স্থানীয় বা রাজ্য পর্যায়ের কাউকেই বিশদে কিছু জানানো হয়নি, শুধু বলা হয়েছিল এর জন্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে।’

‘কাজটা আসলে কী, প্রফেসর?’ মেজর মাত্রের শান্ত স্বর সবার কাছে এসে পৌঁছয় আবার।

‘আমি থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের যে বিষয়টা নিয়ে কাজ করি সেটা হচ্ছে ম্যাটার অ্যান্টিম্যাটার সুপারসিমেট্রি।

ফিজিক্সের নিয়ম বলে, যেসব মৌলিকতম উপাদান দিয়ে এই বস্তুজগৎ তৈরি, তার ঠিক উলটো চরিত্রের মৌলিক উপাদান দিয়ে তৈরিও আরেকটি বস্তুজগৎ আছে। যেমন ধরুন আমাদের চেনাজানা জগতের সবকিছুর মৌলিক একক হল অ্যাটম বা পরমাণু। এই অ্যাটম বা পরমাণু যে মৌলিক কণা দিয়ে তৈরি, তার মধ্যে একটি হল ইলেকট্রন, এ নেগেটিভ চার্জ বহন করে। এই উলটো চরিত্রের বস্তুগুলোর যে পরমাণু, তার ইলেকট্রন পজিটিভ চার্জ বহন করে, তখন তাকে বলে পজিট্রন।

এই উল্টো চরিত্রের বস্তুগুলিকে বলে অ্যান্টিম্যাটার। আমার কাজ এই অ্যান্টিম্যাটার নিয়ে।

অ্যান্টিম্যাটারের সবচেয়ে অদ্ভুত দিক হচ্ছে যে একবার যদি এ ম্যাটারের সংস্পর্শে আসে তো একে অপরের স্পর্শমাত্রে এরা সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়। মানে বস্তুর আর কিছুই পড়ে থাকে না, পুরোটাই শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

সেই শক্তির পরিমাণ, আইনস্টাইনের বিখ্যাত ই ইকোয়ালস টু এম সি স্কোয়্যার অনুযায়ী, বিপুল এবং অভাবনীয়। এক কিলো অ্যান্টিম্যাটার আর এক কিলো ম্যাটার সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হলে যে পরিমাণ শক্তির উৎপত্তি হবে তা নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত পরমাণু বোমার প্রায় আঠেরো হাজার গুণ!’

সবাই নীরব রইলেন বলে একটু থেমে প্রফেসর বসুই ফের কথা বলতে শুরু করেন।

‘যে যন্ত্রটি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম, তার নাম সাইলেক্ট্রোপ্রোটন। শুধুমাত্র এই এক্সপেরিমেন্টটির জন্যেই যন্ত্রটি তৈরি করা, এর আর কোনো জুড়ি নেই।

এই সাইলেক্ট্রোপ্রোটন যন্ত্রে আমি দেখতে চেয়েছিলাম, ম্যাটার আর অ্যান্টিম্যাটারের মিলনে বিস্ফোরণের প্রসেসটা কন্ট্রোল করা যায় কি না। সেক্ষেত্রে ফিজিক্সের অনেকগুলো অন্ধকার দিক একসঙ্গে আলোকিত হত। শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান এনার্জি সমস্যারও সমাধান হত। কয়লা বা খনিজ তেলের ওপর কাউকে ভরসা করে থাকতে হত না। বিশাল তাপ বা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দরকার হত না। ছোট-ছোট ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন শক্তির জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা যেত।’

শান্ত স্বরে প্রশ্ন করেন মেজর মাত্রে, ‘গোলমালটা কোথায় হল প্রফেসর?’

‘সম্ভবত আমাদের ক্যালিব্রেশনে কিছু ভুল ছিল। বিস্ফোরণের প্রসেসটা স্লো করতে পেরেছিলাম, কিন্তু কন্ট্রোল করতে পারিনি।

যে পরিমাণ এনার্জি ওই ছোট পরিসরে তৈরি করেছিলাম, সেটা একইসঙ্গে স্লো আর আনকন্ট্রোল্ড হওয়ার জন্যে একটা অ্যাসিমিট্রিক স্পেসটাইম কার্ভ তৈরি হয়ে যায়। আমরা প্রসেসটাকে আরও কন্ট্রোল করতে গিয়েই সর্বনাশটা করেছি। স্পেসটাইমে একটা ফিসার তৈরি করে ফেলেছি।’

‘মানে?’ প্রশ্ন করেন একজন।

‘মানেটা বোঝানো একটু মুশকিল। একটা বিপুল বিস্ফোরণের শক্তি একটা অত্যন্ত ছোট টাইম অ্যান্ড স্পেসে আটকে পড়েছিল। সেই শক্তি বিস্ফোরণ ঘটাতে পারেনি বটে, কিন্তু সময় আর স্থানের ফেব্রিকটাকে সাময়িকভাবে ছিঁড়ে ফেলেছিল।

সময়কে যদি একটা বহমান পাথুরে স্রোত বলে ধরে নেন, তার গায়ে কিছুক্ষণের জন্য একটা গহ্বর তৈরি হয়ে গেছিল। সেটাই অন্য একটা ডাইমেনশনের সঙ্গে আমাদের চির চেনা স্পেসটাইমের মধ্যে একটা যাতায়াতের পথ খুলে দিয়েছে। সেই পথেই আমরা সদলবলে এই ডাইমেনশনে এসে পড়েছি।’

‘কিন্তু প্রফেসর,’ এতক্ষণ শান্ত থাকা গলায় একটা উদ্বেগের ভাব প্রকট হয়, ‘শুধু কি আমরাই এখানে আছি?’

‘সেই তো মুশকিল।’ অসহায় আক্ষেপের স্বর শোনা যায় প্রফেসর বাসু’র দিক থেকে, ‘সময়ের গহ্বরটা এখনও জীবন্ত। মাঝে-মাঝেই সে সক্রিয় হয়ে উঠছে। কেন হচ্ছে সেটা আমি জানি না, এরকম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যেই টের পাই যে সময়ের সেই ক্ষুধাগহ্বর নতুন শিকার ধরে এনেছে।’

‘তার মানে… রিসেন্টলি এই লাল ঝামেলা বস্তি, চেংমারি টি গার্ডেন—এ-সব জায়গা থেকে যারা হারিয়ে যাচ্ছে, তারাও কী…?’

‘হ্যাঁ সুজন, তারাও এই খপ্পরেই পড়েছে। তারাও আমাদের মতোই সময়ের গর্ভে আপাতত বন্দি। আমি… আমি সত্যিই জানি না এর থেকে মুক্তির কী উপায়।’

‘এ আপনি কী বলছেন প্রফেসর?’ ‘আমাদের এখানে কতদিন থাকতে হবে?’

অনেকগুলো আর্তস্বরের তরঙ্গ অন্ধভাবে সবার ওপর আছড়ে পড়ে। এতক্ষণ চেপে রাখা আতঙ্ক যেন পাগলের মতো বেরোতে চায় একটা রন্ধ্রপথে। এরই মধ্যে শান্ত স্বর শোনা যায় সুজনের, ‘কিন্তু মামা, তুমি এতক্ষণ যা-যা বললে, সেখান থেকেই কী একটা উপায় বের হতে পারে না?’

‘কী উপায়, সুজন?’

‘কেউ একজন যদি সেই যন্ত্রটাকে ফের চালিয়ে দুর্ঘটনার অবস্থায় নিয়ে যায়, তবে কি স্পেসটাইমে আবার ফিসার তৈরি হয়ে আমাদের ফেরত যাওয়ার পথ খুলে যেতে পারে না?’

‘সেটা যে আমার মাথাতেও আসেনি, তা নয় রে। কিন্তু কার্যত সেটা অসম্ভব।’

‘কেন? অসম্ভব কেন প্রফেসর?’

‘প্রথমত, এখানে ঠিক কী হয়েছে সেটা না জানলে, আমাদের উদ্ধার করার এই উপায়টা বাইরের কারো পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব নয়। একমাত্র অত্যন্ত প্রতিভাবান কোনো পার্টিকল ফিজিসিস্ট, যিনি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, তিনি বুঝলেও বুঝতে পারবেন।

দ্বিতীয়ত, কেউ যদি বোঝেও, তাহলে শুধুমাত্র মেশিনের পাস্ট ডেটাসেট দেখে সেইদিনের ক্যালিব্রেশনে মেশিনটাকে নিয়ে যাওয়ার মতো ক্ষুরধার বুদ্ধির কোনো বৈজ্ঞানিক প্রায় নেই বললেই চলে।

তৃতীয় কারণটাই সবচেয়ে মোক্ষম। যে মুহূর্তে মেশিন সেইদিনের অবস্থায় অপারেট করা শুরু করবে, সেই মুহূর্তে একটা গাইড পাথ তৈরি হবে।’

‘সেটা কী জিনিস প্রফেসর?’

‘ধরে নিন, সময়ের সরণি। আমাদের চেনাজানা জগতে ফিরে যাওয়ার ওটাই পথ। আমাদের একে-একে সেই পথ ধরে এই ডাইমেনশন থেকে বেরিয়ে আমাদের ডাইমেনশনে পৌঁছতে হবে।

মুশকিল হল, কোয়ান্টাম প্রোবাবিলিটি অনুসারে সেই গাইড পাথের দিকনির্দেশ ক্ষণে-ক্ষণে বদলাতে থাকে। তখন প্রতি মুহূর্তে জটিল ইকোয়েশন সলভ করতে হবে নতুন দিক খুঁজে বার করার জন্য, আর সেটা পুরোটাই করতে হবে মনে-মনে। সেই জিনিস পারেন, এমন অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান অঙ্কশাস্ত্রবিদ আমাদের মধ্যে একজনও নেই। তাছাড়া…’

‘তাছাড়া কী মামা?’ অধীর আগ্রহে প্রশ্ন করে সুজন।

‘আমাদের সবাইকে সময়ের ওপারে যেতে যতক্ষণ সময় লাগবে ততক্ষণ এই গাইড পাথ দু’প্রান্তেই খোলা থাকতে হবে। ওদিকে না হয় সে ব্যবস্থা করা যাবে, কিন্তু এই প্রান্ত খোলা রাখার একটাই উপায়—আমাদের সমবেত ইচ্ছাশক্তি! সময়ের পথ ধরে একেকজন যেই বেরিয়ে যেতে থাকবেন, তখন আমাদের সমবেত ইচ্ছাশক্তির পরিমাণ কমতে থাকবে, ফলে সেই পথ ধরে ওপারে যাওয়ার সম্ভাবনা কমতে থাকবে এক্সপোনেনশিয়াল রেটে।’

‘অর্থাৎ?’

‘অর্থাৎ যে লোকটি সবার শেষে থাকবেন, তাঁর এখানেই আটকা পড়ে থাকার সম্ভাবনা প্রায় একশো শতাংশ। এত বড় আত্মত্যাগ আমাদের মধ্যে কে করবেন? কে হবেন সেই শেষ ব্যক্তি?’

আরও নিবিড়, নিকষ অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে এল সেই আলোক শিখাগুলোর চারপাশে।

*

‘আপনার কথা যদি সব মেনেও নিই কৃষ্ণদা, কয়েকটা খটকা কিন্তু আমার মন থেকে এখনও যাচ্ছে না।’

‘সেগুলো কী দেবাদিত্য?’

দু’জনে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। পথে অনেকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন দু’জনে। কিন্তু কেউ মুখই খুলতে চায় না। পুরো এলাকাটার ওপর কে যেন একটা বোবা আতঙ্কের চাদর বিছিয়ে রেখেছে।

ডায়নার উজানে একটা শ্মশানঘাট আছে। এদিকের মদেশিয়া কুলিকামিনরা ওখানেই মৃতদেহ দাহ করে। ছাই ভাসিয়ে দেয় ডায়না নদীর জলে।

শ্মশানের কাছেই একটা পোড়ো ছাউনির নীচে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিল দু’জনে। অনেক দূরে দু’একটা লোক জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে নিয়ে ফিরছে। এখান থেকে আরেকটু গেলেই বাস রাস্তা। সেখান থেকে বাস আর ট্রেকারের আওয়াজ ভেসে আসছিল। পড়ন্ত দুপুরের নরম রোদ শান্ত ভাবে বিছিয়ে ছিল ঘাসে, জলে, বনচ্ছায়ায়।

‘আপনি তো তন্ত্রমন্ত্র, পুজো-আচ্চা নিয়ে থাকা লোক। তাহলে, গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা—এ-সবের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কীসের? তার ওপর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর নাকি আপনার পরামর্শ নিয়ে থাকেন? এটা হজম করা একটু অসুবিধাজনক নয় কি? মানে অমন হাই প্রোফাইল লোক আপনার মতো পুজো-আচ্চা করা লোকের সাহায্য নেবেন কেন?’

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকেন সেই মধ্যবয়সি পুরুষটি। দূরের পাহাড়ের দিকে একবার তাকালেন তিনি। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছিল নদীর দিক থেকে। সেদিকে মুখ করে বলতে শুরু করলেন, ‘ঠিক ধরেছ। এই খটকাটা দূর করা আমার কর্তব্য তো বটেই, কারণ এর সঙ্গে আরও একটা ছোট, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গল্প লুকিয়ে আছে, প্রায় হাজার বছরের পুরোনো গল্প।’

নড়েচড়ে বসল দেবু।

‘স্কুলে নিশ্চয়ই পড়েছো তিব্বতের ব্যাপারে। হিমালয়ের কোলে চমরী গাই, বৌদ্ধ মঠ, মানস সরোবর আর কৈলাস পর্বত নিয়ে পাহাড়ঘেরা দেশ তিব্বত। ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক কারণে ভারতের সঙ্গে তিব্বতের সম্পর্ক অনেক পুরোনো। তিব্বতের প্রধান ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধধর্ম, আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, বজ্রযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম।

তিব্বতে এই ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের প্রবেশ অনেক জটিল ইতিহাসের বিষয়। সে নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনায় যাব না। শুধু বলে রাখি, আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করে এই বাংলার হাত ধরেই। আচার্য শান্তরক্ষিত থেকে শুরু করে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, অনেক মহান ভারতীয় বৌদ্ধপণ্ডিত তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রসারে জীবনপাত করেছেন।

আজ থেকে প্রায় আটশো বছর আগে ভারতবর্ষে বৈদেশিক শক্তি হিসেবে ইসলামের আক্রমণ ঘটে। সেই অত্যাচার, খুনজখম আর লুটতরাজ ভারতীয় বৌদ্ধধর্মকে প্রায় শেষ করে দেয়। নালন্দার মতো বিশ্ববন্দিত শিক্ষালয় নির্মমভাবে ধ্বংস করা হয়। শত-শত বৌদ্ধ ভিক্ষু নিহত হন, বৌদ্ধ ভিক্ষুণীরা ধর্ষিতা হন।

যে কয়জন বৌদ্ধপণ্ডিত বেঁচে ছিলেন তাঁরা তাঁদের পুঁথিপত্র, বৌদ্ধদেবদেবীর মূর্তি ইত্যাদি নিয়ে নেপাল, কামরূপ, তিব্বত এসব যায়গায় পালিয়ে যান। সেই জন্যই বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে মুছে গেলেও আজও তিব্বতের অনেক মঠে তিব্বতিতে অনুবাদ করা ভারতীয় পুঁথি পাওয়া যায়।

আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে, উনিশশো পঞ্চাশ সাল নাগাদ চিন অতর্কিতে হামলা চালিয়ে তিব্বত দখল করে। এই নিয়ে অনেক প্রতিবাদ আন্দোলন ইত্যাদির পরে তিব্বতি জনগণের সঙ্গে চিনের একটা কাজ চালানো গোছের স্বশাসনের চুক্তি হয়। তবে চিনের সরকার তা মানতে চাননি।

ফলে চিনের তিব্বত দখলের ন’বছরের মধ্যেই তিব্বতের ধর্মগুরু দলাই লামা ভারতে পালিয়ে আসেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে দলাই লামার ভারতে পালিয়ে আসার পেছনে ভারতের তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থা আইবি’র একটা বড় ভূমিকা ছিল।

দলাই লামা যখন ভারতে চলে আসেন তখন তাঁর অনুগামীরা অনেক প্রাচীন ও গোপন পুঁথিপত্র তাঁদের সঙ্গে ভারতে নিয়ে আসেন। তাঁদেরই মধ্যে একজন, নাম লোবসাং গিয়াৎসো, দলাই লামার অগোচরে একটি অতি প্রাচীন পুঁথি আইবি’র তৎকালীন প্রধান বি এন মল্লিকের হাতে তুলে দেন।

পরের দিন সেই হতভাগ্য লামার ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া যায় পানিপথের রাস্তায়।’

এতটা বলে থামলেন কৃষ্ণানন্দ। গা’টা শিরশির করে উঠছিল দেবুর।

‘লোবসাং-এর সঙ্গে খুন হয়েছিলেন আই বি’র আরও একজন ধুরন্ধর অফিসার। ফলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পুরো ডিপার্টমেন্ট খুনিদের ধরতে লেগে পড়ে।

কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও খুনিদের ধরা যায়নি। শুধু এটুকু জানা গেছিল যে ডিপার্টমেন্টের মধ্যেই কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আই বি আরও আঁচ করেছিল যে মূল ষড়যন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশি শক্তিরও যোগাযোগ আছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তোলপাড় করে ফেলেও খুনিদের টিকিও ছোঁয়া যায়নি। যেন হাওয়ায় মিশে যায় তারা। এখনও আই বি’র সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত কেসগুলির মধ্যে এটি একটি।

বি এন মল্লিক, ওরফে ভোলানাথ মল্লিক ক্ষুরধার বুদ্ধির লোক ছিলেন। তিনি গুরুত্ব বুঝে পুঁথিটির গোপনীয়তা রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা নেন।

দলাই লামা ভারতে চলে আসার তিন বছরের মধ্যে বাষট্টি সালে চিন ভারতকে আক্রমণ করে। তালেগোলে আইবি এই পুঁথিটির কথা প্রায় ভুলেই যায়। চৌষট্টি সালে ভোলানাথ মল্লিক রিটায়ার করেন। অন্য সবকিছুর সঙ্গে এই গোপন পুঁথিটির উত্তরাধিকার অর্শায় পরের আইবি ডিরেক্টর এস পি ভার্মার ওপর। আর তার সঙ্গে মল্লিকসাহেব দিয়ে যান নিজের লেখা একটি সিল করা ডায়েরি।

ভারত-চিন যুদ্ধে নাস্তানাবুদ হয়ে ভারত সরকার আটষট্টি সাল নাগাদ বিদেশি শক্তিগুলির ওপর নজরদারি চালাবার জন্য একটি নতুন গোয়েন্দা সংস্থা তৈরি করেন, নাম রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং, সংক্ষেপে ‘র’। এর নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। আর এন কাও নামে এক প্রখর বুদ্ধিমান মানুষ আই বি’র ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন। তিনিই এই নবগঠিত সংস্থার দায়িত্ব নেন। আজ ওই সংস্থার যা সুনাম, তাতে কাও সাহেবের যথেষ্ট অবদান আছে।

আর এন কাও ‘র’-র দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আইবি-র প্রধান এস পি ভার্মা পুঁথিটি ভোলানাথ মল্লিকের সীল করা ডায়েরিসহ সযত্নে কাওয়ের হাতে তুলে দেন।

এর পর আসে একাত্তরের যুদ্ধ, ‘র’ তখন জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে ব্যস্ত। ফলে এই পুঁথিটির ব্যাপারে আর কেউ বিশেষ কৌতূহল দেখায়নি। ধীরে-ধীরে পুঁথিটির কথা প্রায় ভুলেই যায় সবাই।

কিন্তু, একরকম হঠাৎ করেই ওটা আবার ফিরে আসে আলোচনায়।

ভোলানাথ মল্লিকের নাতির ছেলে হচ্ছে অভিরূপ মল্লিক। সাতাশ-আঠাশ বছর বয়েস, শখের ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার। তার ওপর বইয়ের পোকা বললেই চলে। এই অভিরূপ মল্লিক একদিন হঠাৎ করেই তাদের বাড়ির লাইব্রেরির মধ্যে বি এন মল্লিকের লেখা অনেকগুলো ডায়েরি খুঁজে পায়।

ডায়েরিগুলো পড়ে সে ঠিক করে ‘লাইফ অফ আ স্পাই’ নামে বি এন মল্লিকের একটা জীবনী বার করবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে ডায়েরির সেটটা সম্পূর্ণ নয়। অনেক চেষ্টা করেও একটা বিশেষ বছরের ডায়েরি সে খুঁজে পায়নি। উনিশশো ষাট সালের ডায়েরি।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সে বার করে যে ডায়েরিটা আই বি’ বা র’য়ের গোপন লকারে আছে। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করার সুবাদে তার কিছু রাজনৈতিক কানেকশন ছিল। তার মাধ্যমে সে এই দুই সংস্থার দ্বারস্থ হয়। আর তখনই ডায়েরিটা আনিয়ে খুলে পড়েন ‘র’-এর বর্তমান প্রধান।

ডায়েরিটা পুরোটাই ইংরেজিতে লেখা। সাধারণ রোজনামচা, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। শুধুমাত্র শেষ চার পাতাতে একটা পুঁথির উল্লেখ আছে, যেটা এই ডায়েরিকে একটা আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। এই শেষ ক’টা পাতায় উনি লিখেছেন, দৈবাৎ এমন একটা পুঁথি তাঁর হাতে এসে পড়েছে, যা ঐতিহাসিক দিক দিয়ে প্রায় অমূল্য। সেই পুঁথি এমন একজনের লেখা, যাঁকে তিব্বতে বা নেপালে দ্বিতীয় বুদ্ধের মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে শুধু এজন্য নয়। পুঁথিটির আরও একটি বৈশিষ্ট্য আছে।

ভোলানাথ লিখেছেন, এক তিব্বতি ভাষার গবেষককে দিয়ে পুঁথিটির অনুবাদ করানো হয়। তাতেই জানা যায় যে পুঁথিতে যা লেখা আছে তা যথেষ্ট অদ্ভুত, রহস্যময়, এবং বিপজ্জনক। সেইজন্যই সেই খুন হয়ে যাওয়া লামা পুঁথিটি তিব্বতের বাইরে নিয়ে এসেও নিজের কাছে রাখা নিরাপদ বোধ করেননি। তিনি ওটা ওইজন্যই আইবি-র হাতে তুলে দিয়েছিলেন।’

এই বলে ফের থামলেন কৃষ্ণানন্দ। নির্মেঘ আকাশ জুড়ে নেমে আসছে শান্ত বিকেল, নম্র সন্ধ্যা। আকাশ জুড়ে পাখিদের ঝাঁক, তারা ফিরে যাচ্ছে নিজেদের বাসায়। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই সুজনের জন্য বুকটা হু-হু করে উঠলো দেবু’র। কে জানে ছেলেটা কী অবস্থায় আছে। কবে ফিরবে, বা আদৌ ফিরবে কি না! আর… ও যদি না ফেরে? তাহলে কাকিমার সামনে কীভাবে দাঁড়াবে দেবাদিত্য?

কৃষ্ণানন্দের কথায় সংবিৎ ফেরে তার। তিনি তখন ফের বলতে শুরু করেছেন।

‘আগেই বলেছি, জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত একজন আমার খুবই ঘনিষ্ঠ। তিনি কী করে এত ঘনিষ্ঠ হলেন, কেন তিনি জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে আমার পরামর্শ নেন সেসব বলার সময় এটা নয়। শুধু জেনে রাখো, তাঁর জীবনের এক সঙ্কটময় মুহূর্তে তিনি আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আমি তাঁকে সাহায্য করতে পেরেছিলাম। তিনি সেই পুঁথিটি পড়েন, এবং তৎক্ষনাৎ তার গুরুত্ব বুঝতে পেরে আমাকে পুঁথিটি পড়ে দেখতে বলেন।’

‘সেই পুঁথিতে কী লেখা আছে কৃষ্ণদা?’ দেবু’র গলাটা কেঁপে ওঠে, ‘এখানে যা ঘটছে তার সঙ্গে এর সম্পর্কই বা কী?’

‘সেই পুঁথিতে একজন বৌদ্ধ সাধক এক অত্যন্ত অদ্ভুত ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন।’ কৃষ্ণানন্দের চোখদুটো অদ্ভুতভাবে জ্বলজ্বল করছিল, ‘তিনি সম্ভবত এই উপমহাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ তন্ত্রবিদ। তাঁর অলৌকিক বিভূতি এখনও বহু কল্পকথার উপজীব্য বিষয়, তাঁর জীবনকাহিনিও অত্যন্ত রহস্যাবৃত এবং অতি আশ্চর্যজনক। তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রসারে সেই মানুষটির ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা আছে। শুধু বৌদ্ধ সাধকদের কাছে নয়, ইতিহাসবিদদের কাছেও তিনি একজন অসাধারণ, অসামান্য, অতিলৌকিক পুরুষ।’

‘কে তিনি?’ কৌতূহলী হয়ে পড়ে দেবু।

‘আচার্য পদ্মসম্ভব।’

দেবুর হঠাৎ শীত করে উঠল। পাহাড়ের দিক থেকে একটা ঠান্ডা হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিচ্ছিল কৃষ্ণানন্দের পোশাক। সেই হাওয়া খানিক গায়ে মেখে ফের বলতে থাকেন তিনি।

‘যদি ভোলানাথ মল্লিকের কথা সত্যি হয়, তাহলে খুব সম্ভবত পদ্মসম্ভবের নিজের হাতে লেখা একমাত্র পুঁথিটিই মল্লিকসাহেবের হস্তগত হয়েছিল। তাঁর স্বহস্তে লেখা পুঁথি পাওয়া মানে ঐতিহাসিকদের কাছে এক বিশাল ব্যাপার। টাকার অঙ্কে তার মূল্য নিরূপণ করা যায় না।

আচার্য পদ্মসম্ভব পুঁথিতে লিখেছেন, আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে তিনি একটি অভাবনীয় তন্ত্রকর্ম সমাধা করেন। আমি নিজে তন্ত্রবিদ্যায় শিক্ষিত, এ নিয়ে গবেষণাও কম করিনি। নিজের মুখে বলাটা ঠিক নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে আমার থেকে বড়ো তন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ এই দেশে আর কেউ নেই বললেই চলে। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, উনি যা লিখেছেন, তার যদি কণামাত্র সত্যি হয়, তবে আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে আচার্য পদ্মসম্ভব দেবাদিদেব মহাদেবের সাক্ষাৎ অবতার। নচেৎ সেই কর্ম সমাধা করা কোনো সাধারণ তন্ত্রবেত্তার পক্ষে অসম্ভব।’

‘সেটা কী, কৃষ্ণদা?’ নদী, আকাশ, পাহাড় জুড়ে নেমে আসা অন্ধকারে ভীত গলায় বলে ওঠে দেবাদিত্য। সেই অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করছিল সামান্য পৃথুল, খর্বকায় মানুষটির চোখ দু’খানি। কৃষ্ণানন্দ নীচু গলায় কথাগুলো বলে চলেন। দেবু’র মনে হয়, যেন শুধু সে নয়, এই পৃথিবী, এই সময় কান পেতে শুনছে এই অলৌকিক আখ্যান।

‘আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে তিনি এই অঞ্চলেই একটি ছোট বিহারে অধ্যক্ষপদে কর্মরত ছিলেন। সেই সময় তাঁর সামনে একটি ভয়াবহ অভিশপ্ত বস্তু এনে উপস্থিত করা হয়।

সেই অভিশপ্ত বস্তুটি কী, আর কীভাবেই বা সেটি তাঁর হাতে পৌঁছল, তার বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে পুঁথি নীরব। সেই মহান তন্ত্রবিদ শুধু এটুকু লিখেছেন যে সেই আভিচারিক বস্তুটির মতো মারণ ক্ষমতা তিনি ইতিপূর্বে দেখেননি। তাকে নিবৃত্ত করা সেই অসামান্য শক্তিশালী তন্ত্রসাধকের পক্ষেও অসম্ভব ছিল। ফলে, একরকম বাধ্য হয়ে তিনি একটি অতিলৌকিক কাজে ব্রতী হন।’

‘কোন কাজ?’ ফিসফিস করে প্রশ্ন করে দেবু।

‘তিনি স্বয়ং মহাকালের সঙ্গে যুদ্ধ করে কালজঠর উন্মুক্ত করেন। উন্মোচিত করেন সময়ের দ্বার।’

কথাটা বোধগম্য হতে দেবু’র একটু সময় লাগে। তারপর সে প্রশ্ন করে, ‘সময়ের দ্বার উন্মোচিত করেন মানে? সেটা কীভাবে সম্ভব?’

সামান্য হাসেন কৃষ্ণানন্দ, তারপর বলেন, ‘আজ থেকে বহু বছর আগে বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের একটি দল এক নতুন মতবাদের জন্ম দেন। তার নাম, কালচক্রযান। তাতে সময়ের গতি নিয়ন্ত্রিত করার বা রুদ্ধ করার কৌশল আবিষ্কৃত হয়। তাঁরা তাঁদের সাধনপীঠ স্থাপন করেন হিমালয়ের অতি দুর্গম অঞ্চলে, তার নাম জ্ঞানগঞ্জ। অতি রহস্যাবৃত সেই অঞ্চল, সাধারণ মানুষের অগম্য। একমাত্র গুরু যদি কৃপা করেন, তাঁর বিভূতি দান করেন, তবেই সেই গুপ্ত জ্ঞানগঞ্জ সাধারণ মানুষের গোচরে আসে। তার আরও একটা নাম আছে, তোমরা তাকে সেই নামেই চেনো। শাংগ্রি-লা বা সাম্ভালা।’

‘শাংগ্রি-লা?’ চমকে ওঠে দেবু, ‘কিন্তু এ-সবের সঙ্গে এই বিপদের কী সম্পর্ক কৃষ্ণদা?’

‘গভীর সম্পর্ক আছে।’ আশ্চর্য উজ্জ্বল চোখদুটি তুলে দেবুর দিকে তাকান কৃষ্ণানন্দ, ‘আচার্য পদ্মসম্ভব সাম্ভালার সম্রাট কালধর্মরাজ সুভদ্র’র সাক্ষাৎ শিষ্য ছিলেন। তিনি লিখেছেন, তিনি সেইদিন ঘোর সাধনসমরে বিজয়ী হন। ক্ষণকালের জন্য সময়ের গহ্বর উন্মুক্ত হয়। তার মধ্যে তিনি নিক্ষেপ করেন সেই অভিশপ্ত প্রেতবস্তুকে, রুদ্ধ করেন তার অপপ্রভাব।

কিন্তু পুঁথিটির শেষে একটি অদ্ভুত কথা লিখেছেন পদ্মসম্ভব। তিনি বলেছেন যে এই ঘটনার ঠিক দেড়হাজার বছর পর বিধির বিধানে সেই একই স্থানে সময়ের দ্বার পুনরায় উন্মুক্ত হবে। সেই অন্ধ প্রেতবস্তু তখন বেরিয়ে আসবে সেখান থেকে, শিকার করে বেড়াবে অযুত অসহায় প্রাণ। তখন তিনি থাকবেন না, এবং তিনি জানেন না তখন কী উপায়ে তাকে নিবৃত্ত করা যাবে।’

‘কিন্তু কৃষ্ণদা, এটাই যে সেই জায়গা, আপনি কী করে বুঝলেন?’ আকুল হয়ে প্রশ্ন করে দেবু, ‘আর এখনই যে সেই দেড় হাজার বছর আগে বলে যাওয়া ঘটনা ঘটছে তার নিশ্চয়তা কী?’

‘গণনা, দেবাদিত্য! গণনা!’ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ান কৃষ্ণানন্দ, ‘পদ্মসম্ভব তাঁর পুঁথিতে সঠিক স্থান নির্ণয়ের হদিশ দিয়ে গেছিলেন। আর বিবৃত করে গেছিলেন সেই রাতটির গ্রহ-নক্ষত্রের বিশদ অবস্থান।

সেই তথ্য অনুসারে আমি জেনেছি যে ঠিক এইখানেই বা এর আশেপাশেই ঘটেছিল সেই অতিজাগতিক ঘটনা। জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে আমি এও গণনা করে দেখেছি দেবাদিত্য, দেড় হাজার পর পুনরায় একত্রিত হয়েছে সেইদিনকার নক্ষত্রমণ্ডলী। আজ, এখনই সেই সময়।

আমি স্থির নিশ্চিত, আজ থেকে হাজার বছর আগে এখানেই উন্মুক্ত হয়েছিল কালজঠর। ব্যর্থ হয়নি সেই মহান পুরুষের ভবিষ্যদ্বাণী। গ্রহের ফেরে আজ আবার খুলে গেছে সময়ের দরজা। হাজার বছর পর আবার সেই প্রেতবস্তু বেরিয়েছে তার শৃঙ্খল ছিঁড়ে। সেই একের পর এক শিকার টেনে নিয়ে যাচ্ছে সময়ের গর্ভে।’

সবকিছু ধাঁধার মতো লাগছিল দেবাদিত্যের। বিজ্ঞানের ছাত্র সে। তন্ত্রমন্ত্র-তুকতাকে তার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। কিন্তু শহর থেকে এত দূরে, এই ঘোর বিপদের মধ্যে, এই তারাভরা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে বোধবুদ্ধি সব নষ্ট হয়ে গেল তার। স্খলিত স্বরে প্রশ্ন করে সে, ‘এর কোনো প্রতিকারের উপায় বলে যাননি সেই বৌদ্ধ তান্ত্রিক?’

‘বিশদে কিছুই বলে যাননি বটে, তবে পুঁথির শেষে একটি অদ্ভুত কথা লিখে গেছেন। তিনি বলেছেন যে এই ঘোর বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার একটিই মাত্র উপায় আছে।’

‘কী সেই উপায় কৃষ্ণদা?’ আকুলস্বরে প্রশ্ন করে দেবু।

উত্তর না দিয়ে দেবুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন কৃষ্ণানন্দ, তারপর হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ান। গম্ভীরমুখে বলেন, ‘তুমি যন্তরমন্তরে ফিরে যাও দেবাদিত্য, উনি তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।’

‘আপনি যাবেন না?’ অজানা ভয়ে গলাটা কেঁপে যায় দেবুর।

‘না। আমার কাজ আছে। গণনা করে দেখেছি আজই শেষ রাত। আজ রাতের মধ্যে যদি ওদের উদ্ধার করা না হয়, তাহলে চিরকালের জন্য ওরা হারিয়ে যাবে সময়ের গর্ভে। তুমি ফিরে যাও। অধ্যাপক অতি বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই কোনো উপায় বার করে রেখেছেন।’

‘আর আপনি? আপনি কিছু করবেন না? ও যে আমার ভাইয়ের মতো কৃষ্ণদা। ওর মায়ের যে ও ছাড়া আর কেউ নেই। আমি কী করে কাকিমার কাছে গিয়ে দাঁড়াবো? নিজের কাছে কী জবাব দেব?’ বলতে-বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে দেবাদিত্য। দু’দিনের সমস্ত জমানো উদ্বেগ যেন ঝরনার জল হয়ে নেমে আসছিল তার দু-চোখ বেয়ে।

দুই পা এগিয়ে দেবুকে বুকে টেনে নেন কৃষ্ণানন্দ, ‘এই ভালোবাসার খোঁজই করছিলাম দেবাদিত্য। নগণ্য মানুষ আমি, আমার ক্ষমতা অতি সামান্য। তবুও আজ রাতে আমি এই শ্মশানে সাধনায় বসব। আমার সমস্ত তন্ত্রদীক্ষা নিয়ে আরাধনা করব তাঁর।’

বলতে বলতে দু-হাত ওপরের দিকে তুলে ধরেন কৃষ্ণানন্দ, ‘এই ব্রহ্মাণ্ড যাঁর ছায়ামাত্র, আপন মায়াজালে যিনি আবৃত করে রেখেছেন এই মহাবিশ্ব, যিনি অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের ঊর্ধ্বে, আমি আজ শরণ নেব তাঁর। ভয়ের অন্তরালে তিনিই অভয়া, লয়ের মধ্যে তিনিই জয়, মরণের ভিতর তিনিই অমৃতস্বরূপা। তিনি সঙ্গে থাকতে ভয় কীসের?’

‘কে তিনি?’ সম্মোহিতের মতো প্রশ্ন করল দেবু।

‘স্বয়ং মহাকালকে যিনি পদদলিত করেন, মহাকালী।’

খানিক স্তব্ধতার পাহাড় পেরিয়ে প্রশ্ন করল দেবু, ‘আপনার দেবী কি প্রসন্ন হবেন? ওরা কি ফিরে আসবে আমাদের কাছে?’

স্মিত ম্লান মুখে সামান্য হাসলেন কৃষ্ণানন্দ, ‘সে কথা জানি না ভাই। শুধু এটুকু জানি যে ভালোবাসা ছাড়া তিনি আর কিছুই চান না। বাকি সমস্ত মন্ত্রতন্ত্র-পূজাপাঠ তাঁর কাছে অর্থহীন প্রলাপ মাত্র। একমাত্র নিষ্কাম ভক্তি, অপাপবিদ্ধ ভালোবাসাই তাঁর শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য।

বন্ধুর জন্য তোমার এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসাটুকু আজ আমি দু-হাত পেতে নিলাম দেবাদিত্য। মায়ের চরণে আজ আমি শুধু সেটুকুই অঞ্জলি দেব।’

বলে কিছুক্ষণ থামলেন কৃষ্ণানন্দ। তারপর ঘনিয়ে আসা সন্ধের দিকে চেয়ে গম্ভীরস্বরে উচ্চারণ করলেন কৃষ্ণানন্দ, ‘পদ্মসম্ভব তাঁর পুঁথির শেষে লিখে গেছেন, এই মহাসঙ্কট থেকে পরিত্রাণের একটিই মহামন্ত্র আছে। তা ছাড়া আর আর কোনও উপায় নেই।’

‘কী সেই মন্ত্র কৃষ্ণদা?’

সেই আলোকবিষন্ন সন্ধ্যায় যেন দৈববাণীর মতো ভেসে এল কৃষ্ণানন্দের কণ্ঠস্বর, ‘ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড় তন্ত্র, সবচেয়ে বড় জাদু।’

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *