রাজেশ্বর অধ্যায় এখানেই শেষ হয়েছে। খাতার লেখিকাকে কি কেউ ডেকেছিল? তার বন্ধ দরজায় কেউ করাঘাত করেছিল? নাকি তার খোলা-দরজা ঘরে, হঠাৎ কেউ এসে পড়েছিল বলে, বাক্য আর শেষ না করেই, একটা অধ্যায়ের ইতি হয়ে গিয়েছিল?
আমার কিন্তু তা মনে হয় না। খাতার লেখিকা, বিজলী চৌধুরীকে আমি যতটুকু বুঝেছি, সেই হিসেবে আমার মনে হয়, সে হঠাৎ তার উদগত কান্না রোধ করতে পারেনি। ইচ্ছে করছে–’এই ইতি থেকে আমার এই সিদ্ধান্তেই আসতে ইচ্ছে করছে। রাজেশ্বরের গালে জুতো মারা যায় না, তার এত রাগ হয়েছিল যে, সে আর নিজের কান্না রোধ করতে পারেনি। আসলে রাগটা যে তার রাগ না, তার লেখা পড়লে একটি ছেলেমানুষও সে কথা বুঝতে পারবে। রাগটা আসলে তার তীব্র অভিমান! বন্ধুর প্রতি অভিমান, কেন সে তার জীবনটাকে এভাবে নষ্ট করল।
নারী পুরুষের সম্পর্কের, যে তীব্র আবেগকে প্রেম বলা চলে, নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে তা ছিল না। সে কথা স্পষ্টতই উল্লিখিত আছে। বিজলী কখনও তার মনের কথা রাজেশ্বরকে বলেনি, রাজেশ্বর শুনতে চায়নি। এক পক্ষের মনের কথায়, কখনও প্রেম হয় না। কিন্তু বিজলী নামক দেহোপজীবিনীর মনটি কেবল কোমল ছিল না, সংসারের পথে চলতে গিয়ে আমরা যে মঙ্গল-চিন্তা বা বুদ্ধির কথা বলি, আমাদের তথাকথিত সংসারের বাইরে থেকেও, তার সে সব বোধ ছিল অনেক বেশি। কিন্তু আমার কথা থাক, আজ বিজলীর আলোর বৃত্তে ঘুরি। পাতা ওলটালাম।
দুর্গা আজ নার্সিং হোম থেকে ফিরল। খবর আগেই পেয়েছিলাম, ওর মেয়ে হয়েছে। আজ চোখে দেখলাম। বেশ সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটি হয়েছে। এ আর দেখতে হবে না, নির্ঘাত সেই গুজরাটি প্রীতমলালের মেয়ে। চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। প্রীতমলাল পাক্কা দু বছর ধরে, দুর্গার সঙ্গে আছে। দুর্গাকে সে পুরোপুরি রাখেনি। প্রীতমলালকে দুর্গার হাফ বাবু বলা যায়। সে রোজ রাত্রি এগারোটা নাগাদ আসে। রাত ভোর থেকে, সকালবেলা চান করে, জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে যায়। দুর্গার সব দায়দায়িত্ব বলতে গেলে প্রীতমলালেরই। তবে, রাত্রি এগারোটার আগে পর্যন্ত দুর্গার ব্যবসাতে সে আপত্তি করে না। লোকটি শান্তশিষ্ট, দুর্গা তার বিপরীত! দুর্গা মদ খেয়ে চেঁচাবে, খিস্তি-খেউড় করবে, এমনকী এক একদিন প্রীতমলালকে ধরে মারেও। সেই বলে না, ছ্যাঁচো কোটো মারো লাথি, লজ্জা নাইকো বেড়াল জাতির, প্রীতমলালের সেই অবস্থা। বড়বাজারে তার ব্যবসা আছে। সারা দিন কাজকর্ম সেরে সে দুর্গার কাছে আসে। কিন্তু প্রীতমলালের চড়া গলা কেউ কোনও দিন শুনতে পায়নি। দুর্গা মদ গিলে চেঁচিয়ে প্রীতমলালকে মেরে কত দিন বলেছে, গুখেকোর ব্যাটা, কেন মরতে তুই আমার গায়ের চামটি হয়ে আছিস। বেরো, আমার ঘর থেকে বেরো। দূর হয়ে যা।
প্রীতমলাল বেড়াল না, মহাদেব। মার খেয়েও, হেসে, দুর্গাকে বুকের কাছে চেপে ধরে, তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। দুর্গা শান্তও হয়, সবই ঠিক হয়ে যায়। তবে পেটে একটু বেশি মদ পড়লেই গোলমাল। গোলমালই বা কী। ও সব এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। ওটা একটা ধরন। তবে হ্যাঁ, ও সব ব্যাপারে কখনও অন্য কারোর নাক গলানো উচিত না। প্রীতমলালকে ধরে মারবার সময়, কেউ যদি কখনও থামাতে গেছে বা কিছু বলতে গেছে, তখন দুর্গার আর এক মূর্তি। বলে, কেন লো, মাগি পরভাতারি হারামজাদি। আমার ব্যাটাছেলেকে আমি যা খুশি তাই করব, তুই বলবার কে? তোকে কে সাউকারি করতে ডেকেছে? আমার লোককে আমি মেরেছি, তোর গায়ে লাগছে কেন? রং দেখাতে এসেছিস? ঘর ভাঙবি?
এ সব শোনবার পরে, আর কেউ কখনও এগোয়নি। ও যে অমন ঠাস ঠাস করে, নির্ঘাত মারতে শুনলে, খুব খারাপ লাগে। ও আবার কেমন পিরিত বাবা? নিজের নাটুয়াকে না মারলে তোমার তুষ্টি হয় না? বলেই বা কী লাভ। প্রীতমলালের মুখে তো হাসি। আবার এর উলটোও আছে। আরতিটাকে মানিক মেরে পাট পাট করে। মনে হয়, কোনও দিন মেরেই ফেলবে বুঝি। কিন্তু মানিককে ছাড়া, আরতি কিছুই জানে না। হ্যাঁ যদি বুঝতাম, মানিক তোমার রোজকার বাঁধা বাবু, তোমার দায়দায়িত্ব সব নিয়েছে, তা হলেও একটা কথা ছিল। তাও না। মানিক হল সেইরকম, ভাত দেবার নাম নেই, কিল মারার গোঁসাই। কিন্তু বললে কী হবে, রোগ তো অন্যখানে। আরতির মুখেও তো সেই এক কথা। তাকে মারছে তো কার বাপের কী? তাকে মেরে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে আসবে, তাতে অন্যের গায়ে লাগে কেন? এ সব শোনার পরে, সেখানে আর কে নাক গলাতে যাবে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার। জন্য দায় কেঁদেছে। তার চেয়ে, মেরে আর মার খেয়ে যদি শান্তিতে থাকে, তাই থাক। তবু খারাপ লাগে। আমার কখনও এ রকম হয়নি।
আজ দুর্গা যখন মেয়েটাকে বুকে নিয়ে ফিরে এল, মনটা কেমন ভার হয়ে গেল। আমার ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল। বেঁচে থাকলে এখন পাঁচ বছরের হত। তা না, কুকুরছানা নাড়ানাড়ি করে মরলাম। ছেলেটাকে আমার পেটে কে দিয়েছিল জানি। সে কথা তাকে আমি কখনও বলতে পারিনি। বলে কোনও লাভ ছিল না। বিশ্বাস করত না, হয়তো অন্য কিছু ভাবত। মা আমাকে বারবার পেট খসাবার জন্য বলেছিল। আমি শুনিনি। আমি কলকাতায় আসার পর থেকেই, একজন নিয়মিত আমার কাছে আসত। প্রায় রাত্রেই সে আমার কাছে আসত। সেই লোকটিকে আমার মা-ও বিশ্বাস করেছিল। তাই তার সঙ্গে আমাকে দু বার বাইরেও বেড়াতে যেতে দিয়েছে। এক বার নিয়ে গেছল নৈনিতাল, আর এক বার দার্জিলিং। দিব্যি তার বউ হয়ে বেড়িয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী, মনে হত, সত্যি সত্যি যদি সে আমাকে বিয়ে করে ঘরের বউ করে নিয়ে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায়?
আসলে আমি তার বউ ছিলাম না বলেই, সে আমাকে নিয়ে বেড়িয়েছিল। তার নিজের বউ হয়তো জীবনে কোনও দিন নৈনিতাল, দার্জিলিং চোখেও দেখেনি। একটা চুক্তি সকলের সঙ্গেই থাকে। বউয়ের সঙ্গেও থাকে, বেশ্যার সঙ্গেও থাকে। দুটো দু রকমের চুক্তি। বউ আর বেশ্যাতে তফাত আছে। বউ যা পছন্দ করে না, তা করতে চাইলে অনর্থহয়। বেশ্যারও পছন্দ অপছন্দ আছে। তবু বেশ্যা বলতে মানুষ অন্য কিছু বোঝে। তার কাছ থেকে সে অনেক কিছু আদায় করে নিতে চায়, নেয়ও। বেশ্যা যা কিছু দেয় টাকার দাবিতে। বউয়ের দাবি অনেক রকম। সেখানে বাঁধাবাঁধি থাকে। বেশ্যার সঙ্গে কোনও বাঁধাবাঁধি নেই। হবে না? দেব না? তা হলে চললাম। বউকে এ কথা বলা যায় না। পুরুষের কাছে, বউ পুরোটা সুখের না। পুরুষ ভাবে, বেশ্যা হল পুরোটাই সুখের। আমরা হলাম, পুরুষের কাছে খাবলা মারা সুখ। জীবনের নানান ধাক্কা, সংসার বউ ইত্যাদি নিয়ে চলতে চলতে, হাত বাড়িয়ে এক খাবলা সুখ ভোগ করে নেওয়া।
দুঃখের কী আছে। সেইজন্যই তো আছি। তুমি খাবলা মেরে সুখ নেবে, আমি খাবলা মেরে টাকা নেব। তবু তখন অবনীকে নিয়ে মনে মনে অনেক কিছু মনগড়া ভাবনা ভেবেছি। সে একটা বড় চাকরি করত, এখনও নিশ্চয়ই করে, কিন্তু সে আর আসে না। তার চাকরিটা হল, আঁকাজোকার চাকরি। অনেক দিন সে আমার ঘরে বসে, কাগজ পেনসিল বোলালেই ছবি। আগে কখনও এ রকম দেখিনি। দেখে এত ভাল লাগত, অবনীর গায়ের কাছে ঠেস দিয়ে, গালে হাত দিয়ে, অবাক হয়ে তার আঁকা দেখতাম। সে কয়েক বার আমার ছবিও এঁকেছে। কিন্তু মুখটা কখনও ঠিক আঁকতে পারেনি। চোখ মুখ নিয়ে সে কী একটা গোলমাল করে ফেলত। আমার মুখ বলে মনে হত না। দু বার সে আমার গায়ের সব জামাকাপড় খুলে নিয়ে ছবি এঁকেছে। প্রথমে আমি আপত্তি করেছিলাম। ও আবার কী কথা! ল্যাংটো করে ছবি আঁকবে? তারপর সে অনেক বার অনুনয় ও বিনয় করতে রাজি হয়েছিলাম। দেখেছি, ছবি আঁকবার সময় সে অন্য মানুষ। আমি যে একটা মেয়েমানুষ, তার সঙ্গে শুই, সে কথা যেন তখন তার মনে থাকত না। সে চোখ কুঁচকে, ঘাড় বেঁকিয়ে, দূরে গিয়ে, কাছে এসে, এমনভাবে আমাকে দেখত, যেন আমি একটা অন্য বস্তু। তাতে আমারও লজ্জাটা কেটে যেত। কিন্তু আমার সে সব ছবি একটাও আমাকে দেয়নি। অবনী নিয়ে গেছে। আমার উলঙ্গ ছবি এঁকে, সে আমাকে আলাদা করে টাকা দিত। খুশিই হতাম। পরে শুনেছি, সেই ছবি দিয়ে অবনী ব্যবসা করছে। অবনীর বন্ধুর মুখেই শুনেছি। টাকা কি আর এমনি কেউ দেয়? অবনী বলত, বিজলী, যে কোনও আর্টিস্ট তোমার শরীরের দিকে তাকালে, ছবি আঁকতে চাইবে। আর্টিস্ট যা যা চায় সব তোমার শরীরে আছে।
সে অনেক কথা বলত, আমি সব কথার মানে বুঝতাম না। আমার পেটে বাচ্চা এসেছে শুনে, অবনীর ভাল লাগেনি। সে আসা কমিয়ে দিয়েছিল। পেট একটু বড় হতে, সে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। তারপর যখন ছেলে হল, সে আবার এসেছিল। আমি তাকে বলতে পারতাম, আমার পেটের ছেলেটি তারই দেওয়া। পাছে সে ভাবে, আমি তার জন্য কিছু চেয়ে বসব, সেই জন্য বলিনি। আমি ভেবেছিলাম, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে অবনী নিজেই বুঝতে পারবে কার ছেলে। জানি না সে কোনও দিন বুঝেছিল কি না। মুখে কিছু বলেনি। ছেলে হবার পরে কয়েক বার এসেছিল, তারপরে একেবারেই আসা বন্ধ করে দিয়েছিল।
আমি যে অবনীকে ভালবেসেছিলাম বলে পেট খসাতে চাইনি, তা না। বাচ্চা যারই হোক, আমার পেটে যখন এসেছে, তাকে আমি ছাড়তে পারিনি। মনটা মানেনি। যাকে কখনও চোখে দেখিনি, তার জন্যই মনটা কেমন টনটনিয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, যে এসেছে তাকে পেট থেকে বের করে আমি দেখব। কোলে নেব। সে এক বড় সুখের চিন্তা ছিল। ছেলেটা হবার পরে, মায়ের মনটাও গলেছিল। কিন্তু কী এক সর্দিকাশি নিয়ে যে ছেলেটা জন্মেছিল, তাতেই বুকে কফ জমে ছেলেটা মারা গেল। মুখে। বলি, গেছে, আপদ গেছে। কিন্তু মনে মনে তো জানি, পোড়ানি কোথায়। ছেলেমেয়ে চায় না, এমন বেশ্যাও কম আছে। দীপালির সাত বছরের ছেলে আছে, তাকে সে বাইরে রেখে পড়ায়। শুনেছি, মিশনারিদের ইস্কুলে পড়ে। ছেলেকে সে মাঝে মাঝে দেখতে যায়। আমারটা থাকলে আমিও তাকে পড়াতাম। ছেলেবেলায় একটা ভাইয়ের জন্য মাকে কত বলেছি। তখন কি ছাই জানতাম, ইচ্ছে করলেই মা ভাই দিতে পারে না।
ওই তো শুনতে পাচ্ছি, দুর্গার মেয়েটা হ্যাঁ উঁ্যা করছে। আমার ছেলের গলার স্বরটা ছিল মোটা। তার বুকের জোর কম ছিল, সে চেঁচিয়ে কাঁদতে পারত না। না, আর এই ব্লা ব্লা শুনতে পারি না। যাই, দুর্গার মেয়েকে একটু কোলে করি গে।
বিজলীর ছেলের অধ্যায় এখানেই শেষ। বেশ বোঝা যায়, তার মাতৃহৃদয়ে স্মৃতি, ব্যথা, স্নেহ উথলে উঠেছিল। দুর্গার মেয়েকে বুকে নিয়ে, সে একটু নিজেকে ভোলাতে গিয়েছিল। খাতার পাতা যতই উলটোই, নানান ঘটনা নানা চরিত্রের সমাবেশ। তার জীবনের সবথেকে বড় ঘটনা যেটা, যা তার জীবনকে অন্য দিকে ক্রমাগত ঠেলে নিয়ে গিয়েছে, সেটা আমি খুলে ধরছি।
এখন বুঝতে পারি, বেশ্যাই হই আর যাই হই, সংসারে সব মেয়েরই চিন্তা ভাবনা বোধ হয় এক রকমেরই। কিন্তু বেশ্যাদের একেবারে বেশ্যা হওয়াই ভাল। তার মধ্যে আর আন থাকা উচিত না। থাকলেই গোলমাল। কথায় বলে, চালুনি বলে হুঁচকে, তোর গুহ্যে কেন ঘেঁদা। অন্য কত মেয়েকে নিয়ে কত কথা বলেছি, কত ভিকনেশি কেটেছি। শরৎবাবুর সেকালের ছবি দেবদাস দেখতে গিয়ে চন্দ্রমুখীকে যেমন মনে হয়েছে তার মরণদশা ধরেছে, একালেও অনেক বেশ্যার সেই মরণদশা দেখে অনেক কথা বলেছি।
সমাজ সংসারের লোক আমাদের থেকে অনেক বুদ্ধিমান। তারা সব কিছু ভেবে চিন্তে, বেশ গুছিয়ে চলতে শেখে। আর বেশ্যাবৃত্তি করতে এসে, আমাদের মনে নানান জট পাকায়। এই নয় কি যে, আমাদের বাইরের সংসারের দিকে তাকিয়ে, মনে কোনও কষ্ট বা হা-হুঁতাশ করি। কিন্তু মনে আমার খাজনা খাজনা, কে করবে আমার হরিভজনা। মুখে যাই বলি, মনে মনে মরবার বড় ইচ্ছে। কয়েক বার মরতে মরতে বেঁচে গেছি। মরি তো নির্ঘাত মরব। মরবার জন্য এক জন শ্যাম তো চাই। যোদো মোযর জন্য মরব কেন? তা ছাড়া, মন না মরতে চাইলে মরি কেমন করে। মন মরে, তাই মরতে হয়। শ্যামের জন্য যে মরছে, সেই জানে মরা কী। বুঝতে পারিনি, শ্যামের জন্য মরা কাকে বলে। তাদের পায়ে শত কোটি প্রণাম। যারা বলেছে, শ্যাম রাখি না কুল রাখি। শ্যামের জন্য শুধু মরাই যায়, আর কিছু না। তার জন্য সবই ছাড়তে হয়। ধন বলো, গর্ব বলো আর কুলই বলো, সব ছাড়তে হয়।
কথাটা বলি। কথা নাকি? মরণের কথাটা বলি। অতসী এক তলার এক ঘরে থাকে। ওর ঘরে প্রায় সন্ধেতেই এক ভদ্রলোক বহুদিন ধরে আসেন। একেবারে ফুলবাবু। কোঁচার পত্তন দেখলে বোঝা যায়, বনেদিয়ানা কাকে বলে। টকটকে ফরসা রং। গায়ে বিলিতি সেন্টের গন্ধ। বিলিতি মদ ছাড়া খান না। কলকাতার এক নামকরা পরিবারের ছেলে, বয়স চল্লিশ হবে। শুধু নামকরা বললে হয় না, এক ডাকে মনে পড়ে, এমন পরিবারের সন্তান। কিন্তু আমার যেন ভদ্রলোককে কেমন মাকাল ফল বলে মনে হত। অতসী নিজে আমাকে অনেক বার ডেকেছে। ওর বাবুর সঙ্গে, ওর ঘরে গিয়ে বসবার জন্য। আমি গেছি, হাত তুলে নমস্কার করেছি, কিন্তু কখনও বসিনি। ভদ্রলোকের নাম ত্রিভুবনরমণ। সবাই রমণবাবু বলে। রমণবাবু অনেক বার বলেছেন, একটু বসো না, তাতে তো জাত যাবে না?
আমি বলেছি, জাতে কী কথা আছে। আমাদের কাছে সব জাতই সমান। আজ বসব না, আর এক দিন বসব। এইরকম বলে চলে আসতাম। রমণবাবু বলেন, বসে এক পাত্তির খেয়ে যাও না, তাতে তো আর অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। রমণবাবু একটু ফাজিল মতন আছেন। ভারী মুখফোঁড়। মুখে কোনও কথা আটকায় না। মাঝে মাঝে সে রকম কথাও বলেন। আমি হেসে পালিয়ে এসেছি। এমন হয়েছে, সন্ধেবেলা ঘরে একলা বসে আছি, পরদাটা ফেলা আছে। রমণবাবু হঠাৎ পরদা সরিয়ে বলেছেন, আসতে পারি? আমি বলেছি আসুন। তারপরে উনি বলেছেন, বসতে পারি? আমি মাথা নেড়ে বলেছি, না দাদা।
রমণবাবুকে আমি প্রায়ই দাদা বলতাম। তা ছাড়া, আমাদের একটা নিয়ম আছে। নিজেদের জানাশোনার মধ্যে, কারোর লোককে আমরা নিজের ঘরে বসাই না। সেজন্য দাদা পাতিয়ে নিই। মরে গেলেও তাকে নিজের ঘরে বসাতে পারব না। রমণবাবুর ধারণা আমার খুব অহংকার, ভারী দেমাক। আমি হাসি, তা বললে আর কী হবে। আমার ঘরে ঢুকলে, তিনি প্রায়ই আমার বইয়ের দিকে দেখতেন। জিজ্ঞেস করতেন, কার বই তুমি সব থেকে ভালবাস? বলতাম, অনেকের। রবিঠাকুর থেকে ত্রিদিবেশ রায়। উনি বলতেন, ত্রিদিবেশের বইও তুমি পড়? ওর সঙ্গে আমার খুব পরিচয় আছে। আমি বলতাম, ত্রিদিবেশবাবু আমার প্রিয় লেখক। উনি বলতেন, বুঝেছি, ত্রিদিবেশকে বলতে হবে। আমি বলতাম, শুনে ত্রিদিবেশবাবু দুঃখ পাবেন। এ পাড়ার একজন মেয়ে তাঁর বই পড়ছে, শুনলে রেগেই যাবেন। রমণবাবু বলতেন, না, যাবে না।
আমি চুপ করে থাকতাম। ত্রিদিবেশ রায়ের মুখটি আমার সামনে ভেসে উঠত। আমি তাকে চিনি। আমার এই জীবনের আগে চিনতাম। উনি আমাকে চেনেন না, চেনবার কথাও না। উনি আমাদের সেই ছোট শহরের লোক। আমাদের পাড়ায় কাছাকাছিই থাকতেন। তখন লেখক হিসেবে নাম ডাক ছিল।
চাকরি করতেন। আমার থেকে বারো-চোদ্দো বছরের বড় হবেন। অল্পবয়সে বিয়ে করেছিলেন। দু-তিনটি ছেলেমেয়েও দেখেছিলাম। ক্লাস ফোরে পড়ার সময়, একটি মেয়েই আমাকে তাকে দেখিয়ে বলেছিল, এই ত্রিদিবেশদা। উনি গল্প লেখেন। লোকটিকে চিনতাম, নামে চিনতাম না। গল্প লেখার কথাও জানতাম না। চেহারাটি দেখে ভাল লেগেছিল। বিয়ে করেছেন, ছেলেপিলে আছে, মনেই হয়নি। বেন্দাদের থেকে বেশি বয়স মনে হয়নি। পরে তাঁর বউয়ের নাম শুনেছি, দূর্বা রায়, শহরের সভা সমিতিতে যেতেন। মেয়ে আমাদের থেকে ছোট, নাম রুণকি।
আমি বই কিনি, বই পড়ি। ত্রিদিবেশবাবুর বই পড়তে খুব ভালবাসি। বোধ হয় তাঁকে ছেলেবেলায় দেখেছি বলে, বা আমাদের শহরের লোক বলে। কিন্তু তার প্রত্যেকটা বই-ই এত ভাল লাগে কেন? সেটাও কি তাঁকে চিনি বলে? তা হতে পারে না। আসলে তিনি গুণী লেখক। আমি যে তাঁর সব লেখা বুঝি, তা বলি না, তবে অনেক বই পড়েছি, অনেক কথা জেনেছি, খুব ভাল লাগে। উনি জীবনে অনেক দেখেছেন।
তারপর থেকে, রমণবাবু আমার হাতে বই দেখলেই জিজ্ঞেস করেন, কী, ত্রিদিবেশ রায়ের বই পড়া হচ্ছে? একদিন কথায় কথায়, হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিলাম, ত্রিদিবেশবাবু এখন কলকাতায় থাকেন, না যেখানে বাড়ি সেখানেই থাকেন? রমণবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এত কথা আবার তুমি জানলে কী করে? তোমার ঘরে এসেছিল নাকি কোনও দিন?
আমি জিভ কেটে বলেছিলাম, ছি ছি, তা কেন। উনি এ সব জায়গায় আসতেই বা যাবেন কেন? রমণবাবু বলেছিলেন, ও সব সাহিত্যিকদের কথা কেউ বলতে পারে না বাপু। আমরা বলি, মেয়েদের মন বোঝা যায় না। সাহিত্যিকেরা ভাবে গড়া। ব্যাটাদের মনের হদিস পাওয়াই ভার। হয়তো কোনও লেখার মতলব নিয়ে চলে এল এ পাড়ায়।
হয়তো কথাটা একেবারে মিথ্যে না। ত্রিদিবেশ রায়ের কোনও কোনও গল্পে, আমাদের জীবনের কথাও আছে। সে সব মফস্বলের মেয়েদের নিয়ে লেখা। পড়ে মনে মনে খুব অবাক হয়েছি, কী করে এ সব জানলেন। আমি রমণবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বললেন না তো, উনি কি আগের জায়গাতেই আছেন, না কলকাতায় আছেন। রমণবাবু বলেছিলেন, ওর কোনও ঠিক নেই। ও সবখানেই আছে। আমি হেসে বলেছিলাম, সে আবার কী, সে তো একমাত্র ভগবানই থাকতে পারে। রমণবাবু বলেছিলেন, সে ব্যাটাও ভগবান। কিছুতেই তার পাত্তা পাওয়া যায় না।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছল, আপনি দূর্বা রায়কে চেনেন। রমণবাবু অবাক হয়ে বলেছিলেন, সে কী, তুমি ত্রিদিবেশের স্ত্রীর নামও জান দেখছি। আর কী জান? আমি হেসে বলেছিলাম, তাঁর মেয়ের নাম রুণকি। রমণবাবু এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন, যেন আমার বুকটা ভেদ করবেন, চোখ ফুটো করে দেবেন। বলেছিলেন, এর পরেও বলছ, ত্রিদিবেশ তোমার কাছে আসেনি? আমি বলেছিলাম, না এলে বুঝি এ সব জানা যায় না? তাঁর বিষয়ে কাগজেই তো কত বিষয় লেখা হয়। রমণবাবু আমার কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারেননি। রমণবাবু কি তার বন্ধুকেও চেনেন না! কী করে ভাবছিলেন, ত্রিদিবেশ রায় আমার কাছে এসেছেন? এলে, রমণবাবুর মতন যোগ্য সাথীর সঙ্গেই আসতেন।
আমার ঘাড়ে শয়তান চাপল অন্য এক দিন। রমণবাবু ত্রিদিবেশ বাবুর কথা বলেছিলেন। তিনি ত্রিদিবেশবাবুকে আমার কথা বলেছিলেন, ত্রিদিবেশবাবু নাকি আকাশ থেকে পড়েছিলেন। আমি বলে ফেলেছিলাম, ত্রিদিবেশবাবুকে এখানে এক দিন আনতে পারেন? রমণবাবু বলেছিলেন, পারলে? আমি হেসে বলেছিলাম, পারলে আর কী হবে। আপনাকে এক পেট খাইয়ে দেব। উনি বলেছিলেন, তা আমি চাই না। ত্রিদিবেশকে আনতে পারলে, তোমাকে আমাদের সঙ্গে বসতে হবে। আমি অবিশ্বাস করে বলেছিলাম, নমন ঘিও পুড়েছে, রাধাও নেচেছে। ওঁকে আপনি এখানে আনতে পারবেন না। রমণবাবু বলেছিলেন, সেটা আমি দেখব। তুমি তোমার কথা রাখবে তো? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ত্রিদিবেশবাবু কি মদ খান? রমণবাবু বলেছিলেন, তা মাঝে মধ্যে আমরা একসঙ্গে বসে থাকি। একদিন সন্ধেয় না হয়, এখানেই বসা যাবে। আমি ঠোঁট উলটে বলেছিলাম, চেষ্টা করে দেখুন।
অন্তত ছ মাসের মধ্যে রমণবাবু কিছুই করতে পারেননি। আমার সঙ্গে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতাম, কী দাদা, আপনার চেষ্টা চলছে। রমণবাবু বলতেন, চলছে চলবে। সাহিত্যিক তো, পাঁকাল মাছ। ব্যাটাকে ধরতে পারছি না। আমি হাসতাম। মনে মনে বলতাম, কোনও দিন পারবেন না। আমি মনে মনে বোধ হয় খুশিও হতাম। ত্রিদিবেশ রায় কখনও এইসব রমণবাবুদের মতন মানুষ না। তিনি কখনও এখানে আসতে পারেন না।
তারপরে, আজ থেকে কত দিন আগে হবে, সেই দিনটি। এক বছর দু মাস আগে। সন্ধেবেলায় গা ধুয়ে সাজগোজ করে ভাবছিলাম, গা হাত পা কেমন ঝিমঝিম করছে, একটু জিন খাই। এমন সময় অতসী এল। পরদা সরিয়ে বলল, বিজলী, তোর দাদা এক বার ডাকছে। আমি অতসীকে বললাম, আমার ভাল লাগছে না। তুই গিয়ে বল, আমার শরীরটা ভাল না। দেখিস রাগ না করেন। এমনিতেই আমাকে অহংকারী বলেন। অতসী বলল, তোকে যেতেই হবে, কী নাকি একটা বিশেষ কথা আছে। আমি বুঝলাম, কথা আর কী, ত্রিদিবেশ রায়ের কথা বলবেন। ভাবলাম, পরে এসে জিন খাব। বললাম, চল।
অতসীর সঙ্গে ওর ঘরের দরজায় গিয়েই থমকে দাঁড়ালাম। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। দেখলাম, রমণবাবু আর এক জন কে ভদ্রলোক, আর ত্রিদিবেশ রায় বসে আছেন। তিনি আমার দিকে দেখলেন, রমণবাবুকে দেখলেন, আবার আমাকে দেখলেন। মুখে একটু হাসি। কিন্তু আশ্চর্য, চেহারাটা আগের থেকে ভাল হয়েছে, বয়স কি একটুও বাড়েনি? সত্যি কি উনি এখানে এলেন? মনে হল, তাঁর আসাটা আমাকে হারিয়ে দিল? কেন এসেছেন? রমণবাবুকে জিতিয়ে দেবার জন্য?
রমণবাবু জোরে হেসে বলে উঠলেন, লাগ ভেলকি লাগ। কে দেখবে, জাদুর খেলা দেখে যাও। সকলেই হেসে উঠল। আমি চমকে গিয়ে তাড়াতাড়ি ত্রিদিবেশবাবুর দিকে তাকিয়ে হাত তুলে কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করে বললাম, নমস্কার। ত্রিদিবেশবাবুও তাড়াতাড়ি হাত তুলে অতি বিনীতভাবে নমস্কার করে বললেন, নমস্কার। আমার নাম ত্রিদিবেশ রায়। রমণবাবু বলে উঠলেন, এর নাম বিজলী চৌধুরী। ত্রিদিবেশবাবু বললেন, রমণদার মুখে আপনার নাম শুনেছি। রমণবাবু বলে উঠলেন, সত্যি করে বলো দেখি, কেবল নামই শুনেছ, নাকি আগে চোখেও দেখেছ। ত্রিদিবেশবাবু হেসে বললেন, ওকেই জিজ্ঞেস করুন, আমাকে কেন?
আমি বললাম, আপনি তো জানেন দাদা, আমি মিথ্যে কথা বলি না। রমণবাবু বলে উঠলেন, বেশ বেশ, মেনে নিলাম। এখন আমার বাজিটা মেটাও দেখি সখী। এসে চট করে বসে পড়ো। বিলিতি মদের বোতল, সোডা, গেলাস, আগেই ট্রেতে সাজানো ছিল। রমণবাবু আবার বললেন, আজ তুমিই আমাদের দেবে, আমি দেব তোমাকে।
জানি, আজ আর আমার উপায় নেই। আমি আসছি বলেই তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ছুটে গেলাম, আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বুকের মধ্যে কেমন ধকধক করছে। মনে হচ্ছে, মাথার ঠিক নেই। কোনও মানুষকে দেখে এ রকম আর হয়নি। আমি নিজের দিকে ভাল করে দেখলাম। আমার সেই ঝিমঝিমানি ভাব হঠাৎ কোথায় গেল। নিজেকে যেন কিছুতেই আমার মনের মতন দেখছি না। অথচ আমি মোটেই বেশি রং-চং মেখে সাজতে পারি না। রমণবাবুর ব্যস্ত গলা শোনা গেল, কী হল গো বিজলী, দেরি কেন! উনি দরজায় এসে পড়েছেন। রামাবতার বাইরে দাঁড়িয়েছিল। আমি ঘরের বাইরে গিয়ে বললাম, চলুন। রামাবতারকে বললাম, কেউ এলে বোলো, আমি ব্যস্ত আছি। তারপরে আবার অতসীর ঘরে গেলাম। ত্রিদিবেশবাবু অন্য লোকটির সঙ্গে কী কথা বলছিলেন। মদের বোতল তখনও ভোলা হয়নি। ত্রিদিবেশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, আসুন, বসুন। শুনে যেন আমার গায়ে কাঁটা দিল। আসুন বসুন, কাকে বলছেন? অবশ্য উনি তো আমাকে চেনেন না। আমি লজ্জায় কিছু বলতে পারলাম না। রমণবাবু বললেন, ত্রিদিবেশ তুমি বসো, বিজলীকে আমি বসাচ্ছি। আমি তাড়াতাড়ি গদির ওপরে ত্রিদিবেশবাবুর মুখোমুখি বসে পড়ে বললাম, বসেছি। আপনি বসুন। সবাই বসলেন। আমিই সকলের গেলাসে মদ ঢেলে দিলাম। রমণবাবু আমার গেলাসে ঢেলে দিলেন। তারপরে সবাই একসঙ্গে যখন গেলাস তোলা হল, রমণবাবু বললেন, কী গো বিজলী সুন্দরী, আমার চেষ্টা ফলল? আমিও হেসে বললাম, তা না হলে এখানে বসেছি কেন দাদা?
হাসি গল্প মদ, সব একসঙ্গে চলতে লাগল। গলার স্বর রমণবাবুরই বেশি। ত্রিদিবেশবাবু প্রায় কথাই বলছিলেন না, বারে বারে আমার দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন। মদ বড় পাজি জিনিস। বাতাস যেমন গায়ের কাপড় উড়িয়ে নেয়, মদ তেমনি মনের কথা মুখে টেনে আনে। আমি ত্রিদিবেশবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে আর কখনও এসেছেন? উনি হেসে বললেন, এসেছি। আমার এক সম্পাদক বন্ধুর সঙ্গে, একদিন তার বান্ধবীর বাড়িতে। কিন্তু কোন বাড়ি, তা বলতে পারব না। আমি মনে মনে ভাবলাম, শুধু এসেছিলে, নাকি আরও কিছু? সে কথা জিজ্ঞেস করা যায় না। তিনি আমাকে পালটা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমার স্ত্রী কন্যার নাম জানলেন কী করে? আমি বড় লজ্জা পেয়ে গেলাম। রমণবাবু সব কথাই বলে দিয়েছেন। সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না। বললাম, আপনার স্ত্রী-কন্যার নাম জানাটা কি খুব আশ্চর্যের? ত্রিদিবেশ রায় বলে কথা?
ত্রিদিবেশবাবু একটু ভাবলেন, হাসলেন, তারপর বললেন, তা হবে। কিন্তু রমণদা যে ভাবে বলেছিলেন, তাতে মনে হয়েছিল, আপনি আমাদের পরিবারকে চেনেন।আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না না, তা কী করে সম্ভব।তারপরে ওঁর গল্প উপন্যাস নিয়ে অনেক কথা বললাম। রমণবাবু বলে উঠলেন, এ মেয়ে যে একেবারে সরস্বতী, সব মুখস্থ করে রেখেছে। ত্রিদিবেশবাবু যেন অবাক, তবু মুখে খুশির হাসি। জানি না, তিনি আমার সম্পর্কে কী ভাবছিলেন। একসময়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখানে এসে আপনার কী মনে হচ্ছে? তিনি বললেন, ভালই তো, মন্দ কী।
যেন ঠিক মনের মতন না। তবু বলতে হয়, বললেন। কিন্তু তারপরেই উনি বললেন, আপনাকে বেশ ভাল লাগল। রমণবাবু চিৎকার করে উঠলেন, পেলে লেগে যা। সবাই হেসে উঠল। আমি ত্রিদিবেশবাবুকে বললাম, আমাকে আপনি করে বলবেন না। উনি হেসে বললেন, চেষ্টা করা যাবে। কিন্তু চেষ্টায় লাভ হল না। আমাকে তুমি করে বলতে পারলেন না। রাত্রি এগারোটা বেজে গেল। সকলেরই ওঠবার সময় হল। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি, যত বার চোখ তুলেছি, দেখেছি, ত্রিদিবেশবাবু আমাকে দেখছেন। জানি না, মনের ভুলও হতে পারে। একসময়ে একটু সুযোগ পেয়ে বললাম, একদিন নিমন্ত্রণ করলে আসবেন? উনি সহজ ভাবেই বললেন, আসতে পারি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কবে? উনি বললেন, বলুন কবে আসব? আমি বললাম, আপনার যে দিন খুশি। তবে আমাকে এখনই জানিয়ে রাখলে ভাল হয়। আমাদের ব্যাপার বোঝেন তো। উনি আমার কথা শেষ হবার আগেই বললেন আগামী শুক্রবার সন্ধেয় আসব। আমার মনে শুক্রবার সন্ধে গাঁথা হয়ে গেল।
ত্রিদিবেশ রায় সকলের সঙ্গে চলে গেলেন। রাত্রি এগারোটা বেজে গেলেও, তখনও আমার কাছে লোক এল। কিন্তু আমি বসাতে পারলাম না। কিছুতেই আর ভাল লাগল না। দরজা বন্ধ করে দিয়ে আরও মদ খেতে লাগলাম। আমার কীসের মরণ ধরেছে, কে জানে। কেবল মনে হতে লাগল, এ জীবনটা আর কাটাতে পারছি না। এই একঘেয়ে জীবন। টাকা করেছি, মফস্বলে আমাদের শহরে একটা বাড়ি কিনেছি। কলকাতায় বাড়ি কেনবার মতো টাকাও জমেছে। গহনাগাটিও মোটামুটি করেছি। আর ভাল লাগে না। রাগ হতে লাগল, কষ্ট হতে লাগল। কেবলই মনে হতে লাগল, কেন আর এ ভাবে জীবন কাটাব। আর কতকাল? ছুটি চাই, আমার ছুটি চাই।
সেই শুক্রবার এল। কটা দিন এই শুক্রবারের মুখ চেয়ে কাটিয়েছি। নিজেকে নিয়ে যে কী করব, তা যেন ঠিক করতে পারছি না। সারা দিন নিজের হাতে খাবার করেছি। রামাবতারকে দিয়ে বিলিতি মদ আনিয়েছি। সন্ধের অনেক আগেই সাজগোজ শেষ। কিন্তু কোথাও যেন একটু স্বস্তি নেই। কী করলে একটু স্বস্তি পাই, তাও বুঝি না। আর একটা ভয়, রমণবাবু যদি জানতে পারেন, তা হলে সব গোলমাল হয়ে যাবে। উনি হই-হুঁল্লোড় লাগিয়ে দেবেন। কোনও কারণে মেজাজ খারাপ থাকলে, ঢক করে খানিকটা মদ গিলে নিই। আজ সাহস পাচ্ছি না। আজকের অস্বস্তিও অন্য রকম। রামাবতারটা আমাকে কোনও দিন এ রকম অবস্থায় দেখেনি। দেখে শুনে ও কী রকম বোকা বনে যাচ্ছে।
দরজায় ঠক ঠক শব্দ হল। বুকটা ধক করে উঠল। দরজাটা ভেজিয়ে রেখেছিলাম। তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। পরিচিত মুখ, কিন্তু অন্য মুখ। সে হেসে জিজ্ঞেস করল, ব্যস্ত নাকি? বললাম, হ্যাঁ আজ পারব না। লোকটি চলে গেল। প্রায়ই আসে। নামটা মনে করতে পারলাম না। কেমন করে পারব। মনের কি কিছু আর আছে। তাকে খেয়ে বসে আছি। একটু পরেই রামাবতার ঘরে ঢুকে বলল, একজন বাবু এসেছে। আমি ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে, রজনীগন্ধার পাড় দেখেছিলাম। বললাম, আজ আমার কোনও বাবু চাই না। চলে যেতে বল। রামাবতার আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম, বললাম, আমিই দেখছি, তোকে বলতে হবে না। কিছু। দরজাটা খুলে, পরদা সরিয়েই, আমি চমকে উঠলাম। ত্রিদিবেশ রায়! কী সর্বনাশ, আর একটু হলেই ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম। যার পথ চেয়ে বসে আছি, তাকেই বিদায়? বললাম, আসুন। উনি ঢুকলেন। আমি বালিশ তাকিয়া সাজিয়ে রেখেছিলাম খাটের ওপর। বললাম, বসুন।
ত্রিদিবেশবাবু বসলেন। আমি বোতল গেলাস সোড়া ট্রেতে সাজিয়ে ওঁর সামনে রাখলাম। উনি হেসে বললেন, নিমন্ত্রণের কোনও ত্রুটি রাখেননি দেখছি। এ সব খাব, ধরেই রেখেছেন।আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, খাবেন না! উনি বললেন, আপনি দিচ্ছেন যখন, খাব নিশ্চয়ই। তবে না দিলেও ক্ষতি ছিল না। বললাম, একটু খান। আমার নিজের জন্যও নিলাম। রামাবতারকে ডেকে, খাবার গরম করে প্লেটে এনে দিতে বললাম। ওঁকে বললাম, আজ আর আপনি আমাকে আপনি করে বলতে পারবেন না।
ত্রিদিবেশবাবু হাসলেন, আচ্ছা, তুমি করেই বলব। আমি ওঁকে ছেলেবেলার ঘটনা বললাম। শুনে তিনি খুব অবাক হলেন। আমাদের পাড়াটার নাম বারে বারে জিজ্ঞেস করলেন। তারপরে বললেন হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। আমার বাবার নাম বলতেও চিনতে পারলেন, তারপরে আমার দিকে যেন নতুন চোখে তাকালেন। জানতে চাইলেন আমি কী করে এ পথে এলাম। আমি ওকে আমার জীবনের প্রথম ঘটনা বললাম, পীতুবাবুর বাগান বাড়ির কথা। শুনতে শুনতে মনে হল, উনি আর এ জগতে নেই, এ ঘরে নেই। চুপচাপ মদ খেতে লাগলেন। খাবার ছুঁলেন না৷ ওঁর চোখমুখ ক্রমাগত লাল হয়ে উঠতে লাগল। আমিও বেশ খেয়েছি। রাত্রি বারোটা বেজে গেছে। আমি বললাম, ত্রিদিবেশবাবু, খাবার গরম করে দিই, একটু খান।
ত্রিদিবেশবাবু হাতের ঘড়ি দেখে, গেলাসে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, না খাব না। আমি এবার যাব, অনেক রাত হয়েছে। ওঁকে যেন আমার ভিন্ন মানুষ মনে হল। সাহস করে যে হাত ধরব, থাকতে বলব, পারছি না। উনি খাট থেকে নেমে পকেট থেকে ব্যাগ বের করে, একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা রাখো। মনে বড় কষ্ট পেলাম, সাপের ছোবলের মতন লাগল। বললাম, আপনাকে আমি আজ নিমন্ত্রণ করেছি। উনি একটু হেসে বললেন, গণিকার নিমন্ত্রণ। নাও, রাখো। আমার কষ্টের মধ্যেই মাথায় আগুন ধরে গেল। নোটটা ওঁর হাত থেকে নিয়ে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেললাম। মেঝেয় ছড়িয়ে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে রাখলাম। আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না, আরও কী অনাসৃষ্টি করব। আমার মাথার ঠিক নেই।
ত্রিদিবেশ রায় দেখলেন, বেরিয়ে চলে গেলেন। তারপরে যা ঘটবার তাই ঘটল। আমি গেলাস বোতল চুরমার করে ভাঙতে আরম্ভ করলাম। শালা, তুমি সাহিত্যিক হয়েছ? আমাকে টাকা দেখাতে এসেছ। আবার বলে কিনা, গণিকা। সব ভেঙেচুরে ছিঁড়ে ফেলে দেব আজ। জানি না, কী করেছিলাম, আমি তখন চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কারা এসে আমাকে ধরেছিল, মাথায় জল দিয়েছিল, শুইয়ে দিয়েছিল। কেবল মনে আছে, বড় কষ্ট, বড় কান্না আমাকে যেন ছিঁড়ে ফেলতে চাইছিল।
জিনিসপত্রের বা শরীর-মনের ক্ষতি যা হবার হয়েছিল। কিন্তু জ্বালাটা ভুলতে পারছিলাম না। কয়েকটা দিন যেন সবসময়ে ভিতরে হু-হুঁ করে জ্বলছিল। রমণবাবুকে বলতে চেয়েছিলাম, আর এক বার ত্রিদিবেশ রায়কে ডেকে আনবেন। বলতে পারিনি।
মনের এমনি অবস্থায় পরের শুক্রবার সদ্য সন্ধেয় হঠাৎ ত্রিদিবেশ রায় এলেন। তখন আমি চুল। বাঁধছিলাম। হাতদুটো যেন মাথা থেকে খসে পড়ে গেল। উনি পরদা সরিয়ে বললেন, আসব? আমি নিজেই এগিয়ে গিয়ে বললাম, আসুন। নিজের আনন্দ দেখাতে সাহস পাচ্ছিলাম না, তাই হাসতে পারছিলাম না। তিনি ঢুকেই বললেন, সেদিনের ব্যবহারের জন্য সত্যি বড় দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আমি বললাম, ও কিছু না। আপনি বসুন। আমি এখুনি আসছি। বলে মীনাক্ষীর ঘরে ছুটে গেলাম। ওর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি চুল বাঁধলাম। মীনাক্ষী একটু ঠাট্টা বিদ্রূপ করল। জবাব দিতে পারলাম না। ফিরে এসে দেখি, ত্রিদিবেশবাবু একটা পত্রিকার পাতা উলটোচ্ছেন। আমার শাড়ি জামা বদলানো ছিল। মুখে কিছু মাখিনি, আর মাখবার দরকার মনে করিনি। আমি রামাবতারকে ডাকলাম। ত্রিদিবেশবাবু বললেন, আমি ওকে একটু পাঠিয়েছি। কোথায় কী জন্য, জিজ্ঞেস করলাম না, বোধ হয় সিগারেট আনতে পাঠিয়েছেন। আমি মদ আনবার জন্য ডাকছিলাম। উনি বললেন, সে দিনের ব্যাপারটা তোমাকে বলে নিই। আসলে কী জান, আমরা নিজেদের ছাড়িয়ে যেতে পারি না। মদ খেলে, মানুষের মাথায় একটা কিছু বিধে গেলে আর রক্ষে নেই। প্রথমে তোমার কথা শুনতে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেছল। তারপরে এক সময়ে নিজেকে বড় অধঃপতিত মনে হল। এই মনে হওয়াটা বড় খারাপ। সে জন্য নিজের ওপর শোধ তুলতে গিয়ে, তোমাকে কটু কথা বলে ফেললাম। অথচ যা বলেছি, তা নিজের বিশ্বাস থেকে বলিনি।
ত্রিদিবেশবাবুর কথা শুনছিলাম। কিন্তু আমার চোখের জল আটকাতে পারলাম না। মাথা নিচু করে বসে রইলাম। উনি আবার বললেন, তোমার বোধ হয় এখনও রাগ যায়নি। কথা বলতে গিয়ে গলায় কথা আটকে গেল। উনি অনায়াসে আমার চিবুকে হাত দিয়ে মুখ তুলে চমকে উঠলেন, তুমি কাঁদছ? না না, এটা ঠিক না, আমার অন্যায়– আমি কোনও রকমে বললাম, আপনি না এলে আরও কষ্ট হত। আমি চোখ মুছলাম। প্রথম থেকেই সব ভিজিয়ে দেওয়া ঠিক না। এ সময়ে রামাবতার এল। দেখলাম, তার হাতে মদের বোতল। অবাক হয়ে বললাম, এ কী, কোথা থেকে নিয়ে এলি? ত্রিদিবেশবাবু বললেন, আমি আনতে দিয়েছিলাম। এটা আমার ইচ্ছে, তুমি কিছু বলতে পারবে না। তবু আমার মনটা খচখচ করতে লাগল। উনি বললেন, আজ একটু খোশগল্প করা যাক। তবে একটা কথা আগেই বলে নি, আজ যেন তুমি নোট ছিড়ো না।
আমি বললাম, আপনি দেবেন না, তা হলেই আমি ছিঁড়ব না। উনি বললেন, তা বললে কী করে হয়? আমি কি বিনা পয়সায় কারোকে লেখা দিই? তোমার সময়েরও তো দাম আছে। কথাটা মিথ্যে না, কিন্তু ত্রিদিবেশ রায়ের কাছ থেকে আমি টাকা নেব কেমন করে? ভেবে দেখলাম না, জীবনে কথাটা আর কখনও মনে আসেনি। বরং টাকাটা নেব না কেন, এ কথাটাই মনে হয়েছে। টাকা ছাড়াও যে আমার জীবন আছে, তা কখনও মনে হয়নি। আমার ভিতরে কী একটা রোখ চেপে গেল, বললাম, নিতে পারব না। উনি বললেন, তা হলে তো আমি তোমার সময় নষ্ট করতে পারি না। আমাকে চলে যেতে হয়।
আমি চুপ করে, অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি বললেন, কী হল, কথা বলছ না যে? বললাম, কী বলব বলুন? উনি জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে আজ চলে যেতে বলছ? বললাম, আপনি যা বোঝেন।আমি অন্য দিকে চেয়ে থাকলেও বুঝতে পারলাম, তিনি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে মনে খুব ভয় পাচ্ছিলাম, সত্যি যদি উনি চলে যান? তা হলে আমি টাকা নিতে স্বীকার করব। তবু ওঁকে ছাড়তে চাই না। কিন্তু উনি আমাকে টাকা দেবেন কেন? আমার কাছে যে কারণে সবাই আসে, উনি কি সেই জন্যে এসেছেন? আমার মনে হয় না। তবে টাকা দিতে চান কেন? তিনি যখন কোনও মেয়ের সঙ্গে দেখা করেন, তাকে কি টাকা দেন? হ্যাঁ, এই সন্ধেরাত্রে আমার সময়ের দাম আছে। কিন্তু আমার তো সেটাই সব না। ওঁকে আমি সে কথা বোঝাব কেমন করে।
ত্রিদিবেশবাবু অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপরে একটু হেসে বললেন, আচ্ছা এখন এ সব কথা থাক, পরে ভেবে দেখা যাবে। আজ যখন এসেই পড়েছি, এই নিয়ে সেদিনের মতো গোলমাল করতে চাই না। আমি মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে, আর কখনও আসবেন না? উনি হেসে বললেন, সে রকম কোনও চুক্তি নেই। আমি বললাম, আপনার মতো লোকের এ রকম জায়গায় আসা চলে না। উনি মুখে হাসি রেখে বললেন, যদি লোকের অপবাদের কথা ভেবে চলে যাই, তা হলে সে অপবাদের ভয় আমি করি না। দশচক্রে ভগবান ভূত বলে, একটা কথা আছে। আমার বিরুদ্ধে কালি ছিটোবার লোকেরও অভাব নেই। তবু আমি যা, আমি তা-ই। কিন্তু সব পরিবেশ তো সকলের ভাল লাগে না।
বুঝতে পারলাম, তিনি কী বলছেন। আমাদের এই বেশ্যালয়ের পরিবেশ তার ভাল লাগে না। সে জন্য তাকে দোষ দিতে পারি না। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল, আমাকে তাঁর ভাল লাগে কি না। জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না। হয়তো উনিই সত্যি কথা বলতে পারবেন না, ছেলে ভুলোনো একটা কিছু বলবেন। তিনি আবার বললেন, বোতলের বস্তুর সদগতি করা যাক। আমার আজ একটু তাড়াও আছে। কথাটা বিশ্বাস হল না। বোধ হয় আমার সময়ের কথা ভেবেই বললেন। আমি লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি রামাবতারকে ডেকে, গেলাস আর সোডা দিতে বললাম। সেই সঙ্গে জানিয়ে দিলাম, কেউ এলে যেন বলে দেয়, আমি ব্যস্ত আছি।
তারপরে নিজের হাতে বোতল খুলে, গেলাসে ঢেলে, সোড়া মিশিয়ে আগে ওঁকে দিলাম। উনি বললেন, তুমি নেবে না? বললাম, না নিয়েই আমার ভাল লাগছে। উনি বললেন, তা হবে না। তোমাকেও একটু নিতে হবে। আমার এত লজ্জা শরম কোথায় ছিল? জানি, এ বাড়ির মেয়েরা কেউ দেখলে, এটাকে একটা আমাদের স্বভাবজাত ছলনা মনে করত। ঈশ্বর জানেন, আমি তা ভেবে বলিনি। ত্রিদিবেশবাবু আমাদের জীবনটা মোটামুটি বোধ হয় জানেন। তাই অনায়াসেই মদ খাওয়ার কথা বলতে পারলেন। বাইরের সামনে যে সব মেয়েদের সঙ্গে উনি মেশেন, তাদের কি এভাবে মদ খেতে বলতে পারেন? তাঁর সম্পর্কে সারা দেশে নানান গল্প ছড়িয়ে আছে। মেয়েদের নিয়ে, তাকে জড়িয়ে, বহু গল্প লোকে বলে। আমার ঘরেই, লোকেরা কত গল্প বলেছে। আমি তাদের সঙ্গে তর্ক করেছি, তারা খুব খারাপ খারাপ কথা ওঁর নামে বলে।
আমি আমার গেলাসে মদ ঢেলে সোড়া মেশালাম। উনি গেলাস তুলে বললেন, তোমার জীবনের মঙ্গল কামনায়। বলে উনি চুমুক দিলেন, আমি চুমুক দিতে গিয়ে, থমকে গেলাম, আমার জীবনের মঙ্গল? আমার জীবনের আর মঙ্গল বলে কী আছে? আমার জীবনে আছে কী? বেশ্যাবৃত্তির মধ্যে মঙ্গল বলে কিছু নেই। উনি বললেন, কী হল থামলে যে? আমি বললাম, আপনি মঙ্গলের কথা বললেন, তাই। আমার জীবনের মঙ্গল বলে কী থাকতে পারে? উনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, দেখ বড় বড় কথা বলে কোনও লাভ নেই। কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ। অন্তত নিজের কথা ভেবে বলতে পারি, এ জীবনে স্বস্তি আর শান্তি থাকতে পারে না। সুখ কথাটার কোনও অর্থ নেই, কে কীভাবে পায়, বলা যায় না! তুমি একটা বিশেষ নামে চিহ্নিত হয়ে গেছ। কিন্তু আমাদের সমাজটাও নিষ্কলুষ নয়। ব্যাভিচার। বলতে গেলে, সেখানেই চলছে। এখানে তো জীবন আর জীবিকার প্রশ্ন, সবটাই পরিষ্কার আর সহজ। তোমাদের অন্ন আজ আমাদের সমাজের বুকে ছিনতাই হচ্ছে। তার থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে, বহুকালের এই প্রাচীন ব্যবসার চেহারাটা বদলাতে বসেছে। আর দু-এক পুরুষ বাদে, মনে হয়, এ রকম কোনও লালবাতির এলাকা থাকবে না। তার মানে এই বলছি না, গোটা দেশটা লালবাতি এলাকা হয়ে যাবে। তবে গোটা সমাজের চেহারাটা বদলে যাবে। মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে, মূল্যবোধ বদলায়। এ কথাটা অনেকে মানতে চায় না।
আমি ওঁর কোনও কথাই প্রায় বুঝলাম না, কেবল তোমাদের অন্ন আজ তোমাদের সমাজের বুকে ছিনতাই হচ্ছে, সেটা আমিও জানি, অনেক কথা না বুঝলেও, আমি ওঁর কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুনতে লাগলাম। আমি যে কথা ভাবি, সে কথা পুরোপুরি মনে রাখতে পারি। ছেলেবেলায় ইস্কুলে মাস্টারমশাইরা আমাকে তার জন্য বাহবা দিতেন। ত্রিদিবেশবাবুর কথাগুলো বেশ মনে আছে। তিনি গেলাসে চুমুক দিয়ে বললেন, তোমার মঙ্গল কামনা করলাম, তোমার জীবনের জন্য। যে পথেই থাক তোমার শুভ হোক, এটাই চাই। কথাটা শুনে কেন জানি না, বুকের মধ্যে টনটন করতে লাগল। তারপরে এক সময়ে, কখন থেকে আমি আমার নিজের কথা বলতে আরম্ভ করেছি, মনে নেই। আমার স্থাবর অস্থাবর, যা কিছু আছে, সব তাঁকে বলে দিলাম। আমার মনের কথাও তাঁকে বললাম, আমি এখানে থাকতে চাই না। কলকাতায় কোথাও একটা বাড়ি কিনে কোনও রকমে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই। উনি সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন, সেটা কি পারবে? সব জীবনের একটা মূল আছে, তার যা কিছু, সব সেখান থেকেই বাইরে ফুটে বেরোয়। তুমি যা বলছ, সে তো যোগিনীর জীবন। তা কি তোমার পক্ষে সম্ভব? আমি জিজ্ঞেস করলাম, যোগিনীর জীবন হবে কেন?
ত্রিদিবেশ বললেন, আমি অবশ্য জানি না, তোমার আর কে আছে। তোমার মা আছেন বলেছিলে। আর কে আছেন? উনি কী বলছেন, বুঝতে পারলাম। বললাম, আর কেউ নেই। উনি বললেন, তবে? কী নিয়ে তোমার দিন কাটবে? আমার বলতে ইচ্ছা করল, আপনি যদি আমার সহায় হন, তা হলে আমার চিন্তা নেই। কিন্তু সে কথা বলা যায় না। উনি আবার বললেন, অবশ্য তোমার যদি একটা বিয়ে হয়, তা হলে সংসার জীবন নিয়ে থাকতে পার। বললাম, কে আমাকে বিয়ে করবে? উনি বললেন, তা ঠিক। আমাদের প্রগতিশীলতা আর বিপ্লব আবার অনেক প্রথা মেনে চলে। বলে। হাসলেন, আবার বললেন, বলো তো আমিই তোমার বিয়ের একটা সম্বন্ধ দেখি।
আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম। ওঁর কতখানি আমেজ লেগেছে, জানি না। আমার এর মধ্যেই বেশ আমেজ লেগে আছে। দু বার হুইস্কি নিয়েছি। পা ঝুলিয়ে বসে, আমার পায়ের পাতা টনটন করছে। বললাম, আমি একটু পা তুলে বসি। উনি শশব্যস্ত হয়ে সরে গিয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাল হয়ে বসো। আমি পা তুলে বসলাম। একটি তাকিয়া আমাদের দুজনের মাঝখানে। আমার ভিতরে তখন সেই বাসনা, কেবলই আমাকে যেন তার নিজের পথে নিয়ে চলেছে। নতুন করে জীবন তৈরি করবার জন্য, আমি যেন আমার চারপাশে নতুন ভাবে আঁটঘাট বাঁধতে সংকল্প করলাম, আমার বাকি জীবনটা, ত্রিদিবেশ রায়ের সঙ্গে মিশে যাক না কেন। তিনি কি তাঁর জীবনের ছিটেফোঁটা অংশ দিয়ে আমাকে বাঁচাতে পারেন না।
এখন আমি যে জীবন কাটাচ্ছি, আমার এই পেশায় আমি ইচ্ছে করে আসিনি। আজ যদি নিজের ইচ্ছেয়, অন্য জীবন পেতে চাই, তবে সেই চেষ্টাই কেন করি না। কিন্তু কেমন করে সেই চেষ্টা করব? নতুন জীবন বলতে, ত্রিদিবেশ রায়। আমি তার সঙ্গে আমার জীবনকে বাঁধতে চাই। অমনি মনে হচ্ছে, এ যেন বামুনের চাঁদে হাত দেওয়া। কিন্তু যারা বামন নয়, তারা কি চাঁদে হাত দিতে পারে? পারে না। চাঁদে কেউ হাত দিতে পারে না। ত্রিদিবেশ রায় যে আমার কাছে চাঁদ। কেমন করে তার জীবনে হাত দেব? দেওয়া কি যায় না? বাংলাদেশের এত বড় লেখক ত্রিদিবেশ রায়, সোনাগাছিতে, তার নিজের কথায়, একজন গণিকার ঘরে বসে আছেন, তার সঙ্গে বসে মদ খাচ্ছেন। এই তো অনেকখানি। গণিকার ঘরে বসে গণিকার বিছানায় বসে যদি মদ খেতে পারেন, তবে সেই গণিকার জীবনের সঙ্গে কি তিনি নিজেকে জড়াতে পারেন না? আমি তো তার বউ হয়ে, একসঙ্গে সংসার করতে চাই না। আমার যত টাকা আছে, সোনা আছে, সব তাকে দিয়ে দেব। দরকার হয় মফস্বল শহরে নতুন কেনা বাড়িটা বিক্রি করে দেব। তাঁর হাতে সব তুলে দেব। কী হবে আমার এই খাট আলমারি ড্রেসিং টেবিল, রেডিওগ্রাম রেকর্ড প্লেয়ার এ সব রেখে? সব বিক্রি করে দেব। সব টাকা তার হাতে তুলে দেব। তারপরে তিনি আমাকে যেভাবে রাখবেন আমি সেইভাবে থাকব। শুধু তিনি আছেন, এটুকু জানলেই আমার হবে। তিনি আমার সব। আমার সঙ্গে তাঁকে থাকতে হবে না। কিন্তু আমার সব দায় দায়িত্ব তার। তখন আমি মদ খাব না। তিনি মাঝে মধ্যে এসে আমাকে দেখেশুনে যাবেন। আমার ভাল-মন্দ বিবেচনা করবেন। এ জীবন থেকে আমি মুক্তি পাব।
ত্রিদিবেশবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এত চুপচাপ বসে কী ভাবছ?
আমি চমকে উঠলাম। নিজের কথা ভাবতে ভাবতে সব ভুলে গেছি। লজ্জা পেলাম। হেসে তাড়াতাড়ি একটা মিথ্যা বললাম, আপনার কথাটা ভাবছি।
তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কথা?
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, আপনার কথা মানে, আপনি আমার বিয়ের পাত্র দেখবেন, সেই কথাটাই ভাবছি।
তিনি হেসে উঠলেন, বললেন, কথাটা তোমার মনে ধরেছে তা হলে?
বললাম, তা বলতে পারেন। আমার যেন কেমন ঠাট্টা ঠাট্টা লাগছে। আমি জানি, পৃথিবীতে আমাকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। তিনি গম্ভীর মুখে চুপ করে, কী যে ভাবতে লাগলেন। আমি হাসতে হাসতে আমার মনের কথাটা বললাম, বিয়ে করার দরকার নেই। কেউ যদি আমাকে এক ফোঁটা ভালবাসত তা হলেই আমি বর্তে যেতাম।
কথাটা হাসতে হাসতে বললেও, বুকের মধ্যে কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ ছলছল করে উঠল। ভালবাসা কী, আমি জানি না। অথচ সেই ভালবাসা পাবার জন্যই কেমন একটা হাহাকার, বড় ক্ষুধা। আমার পোড়া কপাল। চেয়ে কি ভালবাসা পাওয়া যায়? যদি নিজের মন থেকে কেউ ভাল না বাসে।
ত্রিদিবেশবাবু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, সংসারের প্রায় সকলের প্রাণের কথাটা তুমি এখানে বসে বললে। তোমার কথা আমি বুঝি।
এই হলেন ত্রিদিবেশ রায়। লিখে যা বলেন, এখানে বসেও তাই বললেন। তাঁর লেখাতে বড় ভালবাসার ক্ষুধার কথা থাকে। তাই তার লেখা ভাল লাগে। তিনি আমার কথা বোঝেন, এই শুনে, তার দিকে আমার মন আরও বেশি করে টানছে। তিনি ছাড়া আমাকে কে বুঝবেন? কিন্তু সংসারের প্রায় সকলের প্রাণের কথা যদি আমি বলে থাকি, তিনিও কি তাদের একজন? তিনিও কি ভালবাসার কাঙাল? তা কেমন করে হয়? তাকে কত লোক ভালবাসে। কত মেয়ে ভালবাসে। তার কেন ভালবাসার ক্ষুধা থাকবে? তাও আবার ভাবি ভালবাসার ক্ষুধার কথা তিনি জানলেন কেমন করে? লেখেন কেমন করে? মিছিমিছি করে লেখেন? তবে পড়তে পড়তে, সত্যি মনে হয় কেন? নিজের ক্ষুধার কথা মনে পড়ে কেন? কিন্তু সে কথা তো তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি না। আমি তার দিকে এক বার তাকালাম। তিনি আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। আমি চোখের জল মুছিনি। অথচ লজ্জায় তখনই চোখ নামিয়ে নিলাম। স্পষ্ট দেখলাম, তার দু চোখে কেমন কষ্ট ফুটে আছে। আমার চোখ একেবারে ভেসে গেল। হঠাৎ আমার মাথায় তার হাতের ছোঁয়া পেলাম। হাজার পুরুষের ঘাঁটা আমার এই শরীর। কিন্তু এই ছোঁয়াটা একেবারে অন্য রকম। তার কথা শুনতে পেলাম, দুঃখ যন্ত্রণা অপমান কী, আমার থেকে তুমি তা বেশি জান। কেঁদো না। আমাকে যদি বিশ্বাস কর, তা হলে একটা কথা মনে রেখো, তোমার মতন জীবন না কাটিয়েও, বেশির ভাগ মানুষ তোমার মতোই দুঃখী। তোমার বিশেষত্ব এই, তোমাদের মতো মেয়েদের সকলের এই দুঃখের অনুভূতি নেই। নানান কারণেই তাদের সেই অনুভূতি নষ্ট হয়ে যায়, তোমার তা যায়নি। তবে গেলেই বোধ করি ভাল হত।
আমি নিজেকে একটু সামলে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? তিনি বললেন, তোমার দুঃখই তাতে বাড়বে। বাড়িয়ে কী লাভ। তার কথা যত শুনছি, মনে মনে কেমন একটা আশা হচ্ছে, তিনি বোধ হয় আমাকে একটু ভালবেসেছেন। তাঁর চোখের কষ্টও যেন আমাকে তাই বলল। তিনি আমার মাথা থেকে হাত নামিয়ে, ঘড়ি দেখে বললেন, অনেক রাত হয়েছে, এগারোটা বাজে। আমি এবার উঠি। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আর একটু বসুন। খাবার তো কিছুই খাওয়া হল না। বললেন, কিছু খাব না, বাড়ি গিয়ে খাব। বললাম, তা আর একটু হুইস্কি নিন। বলে আমি নিজেই ঢেলে দিলাম। সোড়া মিশিয়ে দিয়ে বললাম, এখানে আসার কথা কি বাড়িতে বলবেন? উনি হেসে বললেন, না। সবাই সব সহজ ভাবে নিতে পারে না, বাইরে থেকে তাদের যাই মনে হোক।
মনে মনে ভাবলাম, আমি যদি তাঁর বাড়িতে টেলিফোন করে জানিয়ে দিই। তিনি বেশ্যা বাড়িতে এসেছেন, এ কথা তিনি বলতে পারবেন না, অপমানে মাথা হেঁট করে থাকবেন। বললাম, যদি কখনও জানাজানি হয়? বললেন, তখন বলব। যা যা সত্যি, তাই বলব, কিন্তু সেই সত্যিটা কেউ বিশ্বাস করবে না। আমার স্ত্রী সন্তানরা করবে না, বাইরের লোকও করবে না। উনি ঠিক বলেছেন। আমি ওঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আবার আসবেন তো? বললেন, দেখি সময় সুযোগ পেলে আসব। জিজ্ঞেস করলাম, এখানে আসতে আপনার মনে কিছু হয় না? বললেন, হয়। তোমাকে আজ এসেই তো বলেছি, ইচ্ছা করলেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু নিজেকে ছাড়িয়েই আমি এখানে এসেছি। এখন আর আমার মনে কিছু হচ্ছে না। তবে এর পরে তোমার এখানে আসতে গেলেই, তোমার সময়ের কথা মনে পড়বে। বললাম আপনি কেবল সময়ের কথাই বলছেন। সেটাই কি আমাদের কাছে সব? সময়টা যেভাবে কাটে আপনি তো তা কিছুই করেননি।
কথাটা বলেই, লজ্জায় যেন মরে গেলাম। ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। উনি গেলাস তুলে চুমুক দিতে যাচ্ছিলেন, থেমে গেলেন। একটু পরে বললেন, না, তা করিনি। একটা কথা তোমাকে বলি। আমি আমার স্ত্রী ছাড়া যে অন্য স্ত্রীলোকের সঙ্গে মিশিনি, তা না। কিন্তু টাকা দিয়ে, স্ত্রী দেহ কিনে, আমি কখনও তা ভোগ করতে পারব না। ওটা দুজনের মনের আর শরীরের ব্যাপার। ওটা টাকা দিয়ে হয়তো পাওয়া যায়, সে পাওয়ায় আমার বিতৃষ্ণা। আমার মন শরীর কিছুই চায় না। বিবাহিত জীবনেও দেওয়া নেওয়া আছে তার স্বরূপ ভিন্ন। তার মানে এইনয় কি, বিবাহিত জীবনমাত্রের ওপরেই আমি শ্রদ্ধাশীল।
তিনি থামলেন। আমার মনের মধ্যে তখন এক চিন্তা। আমি তো তাঁর কাছ থেকে টাকা চাই না। তিনি চাইলেই তো আমাকে পেতে পারেন। তার মন কি আমাকে চায় না? তাঁর শরীরে কি আমার জন্য কিছুই হয় না? তবে যে সবাই আমার রূপ নিয়ে এত কথা বলে? আমার শরীরের দিকে তাকিয়ে, কত লোকের মরণ ধরে যায়। মিথ্যা বলব না, আমার নিজের মনেও একটু অহংকার আছে। আমাকে দেখে কেউ নিতান্ত বেশ্যা বলতে চায় না। সবাই বলে, আমার রূপ আর চেহারার মধ্যে একটা অন্য ছাপ আছে। অনেক সময় ভদ্র ঘরের মেয়েদের থেকে অনেক বেশি সহবত মনে হয়। সত্যি আমি শিক্ষিতা না। অনেকে মনে করে, আমি শিক্ষিতা। আমার কথাবার্তা চালচলনে সকলেই সন্তুষ্ট। আমার একটু নেকনজর পাবার জন্য কত ভদ্রলোক হা করে আছে। বড় চাকুরে, ব্যবসায়ী, এমনকী কবি সাহিত্যিকও। আসলে আমি মেয়ে, তার ওপর বেশ্যা। অনেক ছলাকলা জানি। সে সব দিয়ে কি ত্রিদিবেশ রায়কে, আমার বশে আনতে পারি না? তিনি তো নিজের মুখেই স্বীকার করলেন, অন্য মেয়েদের সঙ্গেও তিনি মিশেছেন। আমি কি তাকে আমার সঙ্গে মেশাতে পারি না?
আমি তার দিকে তাকালাম। তিনিও তাকালেন। তার চোখ মুখ লাল। মুখ ঠোঁট সবই লাল। আমি ঠোঁট টিপে হেসে, মুখ নামালাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী? আমি মাথা নেড়ে বললাম, কিছু না। আপনার কথাই ভাবছি। বলে, একটু পাশ ফেরবার ভান করে, বুকের আঁচল নামিয়ে দিলাম, আবার। যেভাবে বসে ছিলাম, সেই ভাবে বসলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, আমার কী কথা? বললাম, ওই। যে বলছিলেন, দুজনের মন আর শরীরের ব্যাপার। সেই কথা বলে তার দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার কী রকম ভয় করে উঠল। তিনি আমার আঁচল খসানো ছলনা বুঝতে পারেননি তো? আমি তাড়াতাড়ি আঁচলটা আবার বুকের ওপর টেনে দিলাম। কী করব, এ সব যে আমার এখন মজ্জাগত হয়ে গেছে। শরীর দিয়ে ছলনা আর চাতুরি। তিনি বললেন, তোমার হয়তো সে অভিজ্ঞতা কোনও দিন হয়নি। তার জন্য তোমাকে দোষ দেব না।
আমি এ কথা বৃথা যেতে দিলাম না। বললাম কেমন করে আমার সে অভিজ্ঞতা হবে? আমি চাইলেই কি সে অভিজ্ঞতা হতে পারে? তিনি একটু হেসে বললেন, তুমি চাইলে নিশ্চয়ই হতে পারত। কিন্তু তোমার জীবনে বোধ হয় সে সুযোগ কোনও দিন আসেনি। আমি তার দিকে তাকিয়ে, চোখ নামালাম। আবার তাকালাম। বললাম, সুযোগ পেলেও, আমি তা পাব কেমন করে? তিনি। বললেন, সুযোগ যদি আসে, তা হলে কেমন করে পেতে হয়, সেটা বলে দিতে হয় না। দুজনে বুঝে নেয়।
বুঝলাম, তিনি এখন আর আমার দিকে তাকিয়ে নেই। গেলাস শেষ করে বললেন, আর দেরি করব না, এবার উঠি। কিন্তু তোমার সময় এভাবে নষ্ট করতে সত্যি আমার খারাপ লাগছে। তুমি দয়া করে টাকাটা রাখো। আবার সেই টাকার কথা? তিনি বুঝি কিছুতেই আমাকে অন্য চোখে দেখতে পারছেন না? আমাকে যে একটি মেয়ে হিসাবে তার ভাল লাগেনি, তাও বুঝতে পারলাম। মনে বড় লাগল। কিন্তু কিছুই করার নেই। আমি কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম, বেশ এ টাকা দিয়ে আপনি রুণকিকে কিছু কিনে দেবেন।
বলেই দেখি ত্রিদিবেশবাবুর মুখটা আগুনের মতন জ্বলছে। তাঁর হাতে কতগুলো দশ টাকার নোট। বললেন, কী বললে? তোমাকে যে টাকা দিতে চেয়েছি, সে টাকা দিয়ে আমি আমার মেয়েকে কিছু কিনে দেব? তোমার সাহস তো কম না? বলেই নোটগুলো খাটের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে, খাট থেকে নেমে, দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজা খুলে বেরিয়ে যাবার আগে, রাগে আর ঘৃণায় আর এক বার আমার দিকে ফিরে বললেন, তুমি কী, তা ভুলে যেয়ো না। বলেই বেরিয়ে গেলেন। আমি পাথরের মতন বসে রইলাম। আর মনে মনে বলতে লাগলাম, ছি, ছি, কেন এ কথা বলতে গেলাম। কিন্তু আমি তো খারাপ ভেবে কিছু বলিনি। ওঁর রেগে যাবার একমাত্র কারণ, আমি বেশ্যা। ওর কথায় গণিকা। উনি সাহিত্যিক, উনি ভদ্রলোক। গণিকাকে দিতে চাওয়া টাকা দিয়ে নিজের মেয়েকে কেমন করে কিছু দেবেন? তবু গণিকা বলার জন্য আজ নিজেই না দুঃখ করছিলেন? ভাবতে ভাবতে মাথাটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। বোতল তুলে কাঁচা হুইস্কি গলায় ঢালতে লাগলাম, মুখে যা আসতে লাগল তাই বলতে লাগলাম, শালা সাহিত্যিকগিরি দেখাতে এসেছ? আবার নিজের মুখে বলা হল, বউ ছাড়া অন্য মেয়েদের সঙ্গে মেশো। সে সব খুব ভাল, না? ভদ্দর লোক। মুখে মারি ঝাড়ু অমন ভদ্রলোকের।
কত কী বলেছিলাম জানি না। রামাবতার এসে আমাকে থামাতে চেয়েছিল। সেই আমি প্রথম গেলাস বোতল ভেঙে চুরমার করেছিলাম। বুঝেছিলাম, অন্য মেয়েরা কখন কেন চিৎকার করে, ভাঙচুর করে। কিন্তু রাত পোহাতে অনুশোচনায় মরে গেছলাম। হায় হায় কেন মরতে আমার মুখ দিয়ে সেই কথা বেরিয়েছিল। আগেরবার টাকা ছিঁড়েছিলাম বলে রাগ করেছিলেন। এ বারে মেয়ের কথায় তাঁর লেগেছে। এর পরে আর তিনি কোনও দিনই আসবেন না। সত্যিই তো আমি ভুলোম কেমন করে, কার সঙ্গে কথা বলছি, কার মেয়ের কথা বলছি? আমি নিজের পায়ে কুড়োল মেরেছি। আমি পেয়ে হারিয়েছি। কিন্তু এই ভেবে তো সব শেষ করতে পারি না। আমার পোড়ানি ধরেছে যে। তাই যার মারফত তাকে প্রথম এখানে পেয়েছিলাম তাঁকে ধরলাম, যদি একদিন ধরে আনতে পারেন। তিনি বললেন, চেষ্টা করবেন, তবে কঠিন ব্যাপার, তাঁর দেখা পাওয়া ভার।
তবু আশায় আশায় বেশ কিছুদিন কাটালাম। তিনি এলেন না। তার টেলিফোন নম্বর জানি, তাঁর ঠিকানা জানি। সাহস পেলাম না কিছু করতে। সবাই বলল, আমার মদ খাওয়ার অবস্থা বেড়ে যাচ্ছে। নিজে বুঝতে পারলাম না। মা এলে, কথা বলতে ইচ্ছে করত না। ভাল ভাল লোকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করেছিলাম। তারপরে একদিন বিনা মেঘে জল এল। তিন মাস পরে, ত্রিদিবেশ রায় হঠাৎ একদিন এলেন, চুরচুর মাতাল। মানুষ চিনতে পারেন না। রাত্রি তখন প্রায় বারোটা। রামাবতার আমার খাবার গরম করছিল। আমিও আর লোক বসাব না বলে, মাথার চুল খুলে। আঁচড়াচ্ছিলাম, আর একটু মদ খাচ্ছিলাম। তিনি দরজা খুলে ঢুকে সারা ঘরের দিকে তাকালেন। বেশ টলছেন। চোখ টকটকে লাল। কোঁচা লুটোচ্ছে। কোথা থেকে এসেছিলেন, কে জানে। আমি চিরুনি ফেলে দিয়ে, তাড়াতাড়ি তাঁর কাছে গেলাম। তিনি বললেন, বিজলী? আমি মাথা ঝাঁকালাম। তিনি বললেন, অন্যায় ক্ষমা করো। বলেই ফিরতে গেলেন। আমি তাড়াতাড়ি তার হাত চেপে ধরলাম। বললাম, এভাবে কোথাও যাবেন না। তিনি আমার দিকে ফিরলেন, আমার গায়ে ঢলে পড়লেন। কিছু বলতে গেলেন, পারলেন না। আমি ওঁকে জড়িয়ে ধরলাম, খাটের কাছে টেনে নিয়ে বসাতেই তিনি এলিয়ে পড়লেন। আমি রামাবতারকে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার ইশারা করলাম। সে বেরিয়ে যেতেই, আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। তাড়াতাড়ি ওঁর কাছে গিয়ে, পা থেকে জুতো জোড়া খুলে, ভাল করে শুইয়ে দিলাম। তিনি যে কী বিড়বিড় করছিলেন। আমি তাঁর ওপর ঝুঁকে পড়ে, দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে চুমো খেলাম। তিনি চোখ খুললেন না, আমাকে দু হাতে জড়িয়ে টেনে নিলেন।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে তিনি কিছুই মনে করতে পারেননি। কথা শুনে বুঝেছিলাম, তিনি আমার কাছে আসবেন বলেই আসেননি। তবে স্বীকার করেছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই ড্রাইভারকে এই রাস্তায় আসতে বলেছিলেন। আর নিজে থেকেই আমার ঘরে এসেছিলেন। বলেছিলেন, মনে মনে তিনি অনেক দিনই আমার কাছে আসবার কথা ভেবেছেন, আসতে পারেননি। রুণকির কথার ব্যাপারে ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন, আবার সেই কথাই বলি, নিজেকে আমরা সব সময় ছাড়িয়ে যেতে পারি না। তুমি কী বলেছিলে বা চেয়েছিলে, তাতে আমার মেয়ের কিছুই যায় আসে না। ও সব আমার বাড়াবাড়ি। আসলে আমি আমার স্ত্রী পুত্র ছেলেমেয়েদের কাছেই বা কতটুকু পরিচিত?
তারপরের রোজ দিনের কথা যদি লিখি, সে এক মহাভারত। নতুন কথা কিছু না। আমাদের লাইনে, অনেক মেয়ের জীবনে এমন ঘটেছে। তফাত কেবল, তাদের জীবনে ত্রিদিবেশ রায় আসেননি। সেই ঘটনার পর থেকে ত্রিদিবেশ রায় প্রায়ই আমার কাছে আসতেন। যা আমি চেয়েছিলাম। ফলে যা হয়। আমার রোজ বলতে আর কিছু, কেউ ছিল না। তিনি রোজ আসতেন না, প্রায়ই আসতেন, কিন্তু আমি রোজই তার পথ চেয়ে বসে থাকতাম। ফলে, কারোকে ঘরে বসাতাম না। তিনি তাঁর সম্পাদক প্রকাশক সাহিত্যিক বন্ধুদের নিয়েও মাঝে মাঝে আসতেন। সবাই আমাকে সাবধান করেছিল, মা রাগারাগি করত, আমার ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আমি তো তখন অন্য জীবনের স্বপ্নে বিভোর।
আমার স্বপ্নের কথা তাকে বলেছিলাম। তিনি ঘোরতর আপত্তি করেছিলেন, তা কখনও সম্ভব না। তাঁর নিজের সম্মানের জন্য না, আমি নাকি নিজেই কখনও তা পারব না, এই তার বিশ্বাস। এ ব্যাপার নিয়ে, আমি ক্ষেপে যেতাম। মদ খেয়ে, চিৎকার চেঁচামেচি করে জিনিসপত্র ভেঙেচুরে, টাকা পয়সা গহনা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ডকারখানা করতাম। তবু তিনি আমাকে বোঝাবার চেষ্টা। করতেন। আমি বুঝতাম না। মাথা ঠুকে রক্ত বের করতাম, তাকে যা-তা গালাগালি করতাম। তারপর থেকে, তিনিও বদলে যেতে শুরু করেছিলেন। ক্ষেপে যেতেন, চিৎকার করতেন। হায় হায়, তখনকার সেই রাত্রিগুলোতে তার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখিনি, তাকে আমি কোথায় নামিয়েছি। তাকিয়ে দেখিনি, ত্রিদিবেশ রায়ের মূর্তি কী দাঁড়িয়েছে।
তখন কলকাতায় আর কান পাতবার উপায় নেই। সকলের কাছেই ব্যাপার জানাজানি হয়ে গেছল। কিন্তু তার জন্য, তাঁর কিছু যায় আসেনি। শেষপর্যন্ত অবশ্য তিনি নিজেই সরে গেছলেন। সর্বনাশকে তিনিই দেখতে পেয়েছিলেন, আমি না। তা না হলে, তিনি তো আমার সর্বস্ব নিয়ে চলে যেতে পারতেন। ঘটেছিলও তাই। তার চলে যাওয়ার পরে, যখন তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছি তখন একজন আমার জীবনে এসেছিল। সে বড়লোক, ভদ্রলোক, সজ্জন, দেখতেও সুন্দর। তাকে আমি আমার স্বপ্নের কথা বলেছিলাম। সে রাজি হয়েছিল। রাজি হওয়ার কারণ, তার স্ত্রীর সঙ্গে গোলমাল চলছিল। সে আমার জন্য কলকাতার ভাল জায়গায় বাড়ি কিনে আমাকে সেখানে নিয়ে গেছল। মনে করেছিলাম, যা। চেয়েছিলাম, তা পেলাম, ত্রিদিবেশ রায়ের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারলাম।
বড় ভুল বুঝেছিলাম। সেই লোকটি আমাকে ঠকায়নি, আমার পয়সাও সে নেয়নি, বরং দিয়েছে। কিন্তু তার মোহ ঘোচবার পরে, সে আমাকে ছেড়ে গেছল। আমার পক্ষে একলা সেই বাড়িতেও থাকা সম্ভব ছিল না। আবার সেই পুরনো জায়গাতেই ফিরে আসতে হল। ফিরে এলাম বটে, কিন্তু আমি আর সেই বিজলী নেই। এত দিন বোতল গেলাস আসবাবপত্র ভেঙেছি, এখন নিজেই ভেঙেচুরে গেছি। ত্রিদিবেশ রায় তাঁর নিজের জীবনে ঠিকই চলছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কী ঘটতে চলেছে। যতই ধুলা-কাদা মাখুন, সময় মতন ধুলা থেকে উঠতে পেরেছিলেন। আর আমি যেখানে, সেখান থেকেও, অন্য জায়গায় চলে গেছি।
কেউ কারোর জীবন কেড়ে নিতে পারে না। আমারটা কেউ পারে না। আমি কারোরটা পারি না। তবু তো তাকে কিছুদিনের জন্য পেয়েছিলাম। তিনি কি কখনও আমার কথা লিখবেন? কে জানে। সেই আমি নুড়ি, হরিমতী যার ভাল নাম, তার বেশ্যা নাম বিজলী। নিজের প্রথম অবস্থা থেকে, কোনও দিন কি ভেবেছিলাম, জীবনে এমন ঘটনাও ঘটবে? ভাবিনি। এখন ভাবি, আর কত দিন? আর কত দিন এ জীবন কাটাতে হবে? জানি, এখন আর নিজের ইচ্ছায় কিছু হবার নয়। যা হবার, তা এ জীবনের যে নিয়তি, সে-ই আমাকে তার পথে টেনে নিয়ে যাবে।
.
তারপরেও খাতায় আরও কিছু পাতা লেখা আছে। কিছু ঘটনা কিছু ব্যক্তির কথা। তার মধ্যে, ত্রিদিবেশ রায়ের বন্ধুদের কথাও আছে, যারা পরবর্তীকালে, বিজলীর কাছে এসেছে। কিন্তু সে সব ঘটনার রং রস ঔজ্জ্বল্য অত্যন্ত নিষ্প্রভ। স্মৃতিমন্থন ছাড়া আর কিছু না। খাতার লেখার শেষ বলে কিছু নেই। খাতা পড়ে বোঝবার উপায় নেই, খাতার লেখিকা আজ কোথায়, কী তার জীবনের পরিণতি ঘটেছে। কেবল তার জীবনে একটিই ঐতিহাসিক অধ্যায়, ত্রিদিবেশ রায়। তাকে কেউ না জানুক, ত্রিদিবেশ রায়কে দেশের লোক চেনে জানে। তিনি হয় তো জানেনও না, তাঁর কথায়, একটি গণিকা-র নিজের হাতের লেখায়, তিনি আর এক রূপে প্রতিভাত হয়ে আছেন। খাতাটি পড়ে আমার মনে হচ্ছে, এ যেন নিজের আয়নায় নিজেরই মুখ দেখা। খাতাটা পড়ে একটুকু জানলাম, কত কম জানি, কত কম দেখেছি, আর জীবনের কত যন্ত্রণা কষ্ট, আমার অজানা রয়ে গিয়েছে।