তৃতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ – রহস্যোদ্ভেদ—চমৎকার
কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়া নগেন্দ্রনাথ যমুনার নিকটে যাহা শুনিয়াছিলেন, আদ্যোপান্ত অক্ষয়কুমারকে বলিলেন। শুনিয়া অক্ষয়কুমার অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; মহোৎসাহে বলিয়া উঠিলেন, “নগেন্দ্রবাবু, এ ডিটেক্টিভ উপন্যাস লেখা নয়—হাতে-নাতে ডিটেক্টিভ হওয়া স্বতন্ত্র ব্যাপার।” নগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “কি অপরাধ করিলাম, বরং আপনাকে কত খবর আনিয়া দিলাম; আপনি ত তাহার কাছে কিছুই জানিতে পারেন নাই।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “তাহা ত আমি, বরাবরই স্বীকার করিয়া আসিতেছি। আপনারা ঔপন্যাসিক—মেয়ে মানুষ সম্বন্ধে আপনাদের খুব জোর খাটে। মিষ্ট কথায় ভুলাইতেও পারেন—দুঃখের বিষয় সে ক্ষমতা আমাদের নাই।”
“সে কথা যাক্, এখন ত স্পষ্টই বুঝিলেন যে, হুজুরীমল সম্প্রদায়ের টাকা লইয়া পলাইতেছিল, তাহাদের লোক শান্তপ্রসাদ তাহাকে খুন করিয়াছে।”
অক্ষয়কুমার উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিলেন। তাঁহার হাসি আর থামে না। দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ বিরক্ত হইয়া উঠিলেন।
অক্ষয়কুমার সহসা হাসি বন্ধ করিয়া বলিলেন, “কেমন, বলিয়াছিলাম কি না যে, হুজুরীমল যখন খুন হয়, তখন তাহার নিকটে টাকা ছিল।”
নগেন্দ্রনাথ স্বীকার করিলেন। বলিলেন, “হুজুরীমল যেভাবে যমুনাকে দিয়া টাকা বাহির করিয়া লইয়াছিল, তাহা কেহ স্বপ্নেও ভাবিতে পারে না।”
“আমি যমুনার কথা ভাবি নাই, এ কথা স্বীকার করি; কিন্তু আমি জানিতাম, সে কোনরকমে সকলের চোখে ধূলি দিয়া নিজ কাৰ্য্য সাধন করিয়াছিল।”
“নারকী নিজের স্ত্রী পরিবার ফেলিয়া, একটা কুলটা লইয়া পরের টাকা চুরি করিয়া পলাইতেছিল; আর সেই টাকা চুরি করিতে নিজের স্ত্রীর ভগ্নীর মেয়েকে নানা কথায় ভুলাইয়া লাগাইয়াছিল—এরূপ বদলোক ত দেখা যায় না।”
“অনেক আছে।”
“আপনি পুলিসে থাকেন, অনেক দেখিয়া থাকিবেন, কিন্তু আমার এই প্রথম!”
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “আপনি উপন্যাস লিখেন, আপনাদের উপন্যাসে ত অনেক উচ্চশ্রেণীর বদমাইস দেখিতে পাওয়া যায়।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সে সমস্তই কল্পনা—এখন সে কথা যাক্, এখন খুনী ধরিবার কি করিবেন?” অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “কে খুনী?”
“কেন শান্তপ্রসাদ। এ বিষয়ে কি আপনার এখনও সন্দেহ আছে?”
“শান্তপ্রসাদ বলিয়া কোন লোক জগতে নাই।”
নগেন্দ্ৰনাথ বিস্মিত হইয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিলেন। দেখিয়া অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আপনি কি এই শান্তপ্রসাদের কথা বিশ্বাস করিতেছেন?”
“অবিশ্বাসের কারণ কি? বরং এ কথাটা খুব সম্ভব বলিয়াই বোধ হইতেছে।”
“কেন?”
“প্রথমতঃ হুজুরীমলের মৃতদেহের নিকট সিঁদুরমাখা শিব পাওয়া গিয়াছে; সুতরাং সম্প্রদায়ের লোকই যে তাহাকে খুন করিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
“তার পর?”
“তার পর গুরুগোবিন্দ জানিত যে, টাকা ঠিকই আছে, কেবল এই শান্তপ্রসাদই জানিতে যে, তাহা নাই। তাহাকেই টাকা দিবার কথা। সে যখন দেখিল, হুজুরীমল টাকা লইয়া অপর স্ত্রীলোকের সহিত পলাইতেছে, তখন সে তাহাকে খুন করিয়াছিল।”
“বেশ—সে অপর স্ত্রীলোককেও খুন করে কেন?”
“ঐ রাগে।”
“আর ঐ স্ত্রীলোকটি নিতান্ত ভাল মানুষটির মত তাহার সঙ্গে খুন হইতে চলিল?”
“তা যাবে কেন?”
“আর যাবে কেন? গাড়োয়ান বলিয়াছে, স্ত্রীলোকটি পুরুষের সহিত গাড়ীতে আসিয়া চড়িয়াছিল। রঙ্গিয়া শান্তপ্রসাদের হাতে হুজুরীমলকে খুন হইতে দেখিয়া তাহার সঙ্গে নিজে খুন হইবার জন্য এরূপভাবে যাইতে পারে না।”
“এ কথা ঠিক। আপনি কি তবে মনে করেন না যে, শান্তপ্রসাদ খুন করে নাই?”
“শান্তপ্রসাদ বলিয়া কোন লোক নাই। এ কেবল হুজুরীমলের চালাকী। সরলা যমুনাকে দিয়া কাৰ্য্য হাসিল করিবার ইচ্ছায় সে তাহাকে ভয় দেখাইবার জন্য আপনাদের মত কল্পনা কারুকরীকে দিয়া শান্তপ্রসাদকে গড়িয়াছিল। তাহার আগাগোড়া সবই মিথ্যাকথা। এরূপ বদমাইস ভুলিয়াও কখনও সত্যকথা কয় না।”
“আপনার কথাই ঠিক বলিয়া বোধ হইতেছে।”
“তাহাকে যে খুন করিয়াছে, সে ধরা না পড়িলেই আমি খুসী হইতাম।”
নগেন্দ্ৰনাথ বিস্মিত হইয়া অক্ষয়কুমারের দিকে চাহিলেন। বলিলেন, “তবে কি আপনি খুনীকে ধরিতে পারিয়াছেন?”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “মশাই গো, এ উপন্যাস লেখা নয়।”
নগেন্দ্রনাথ যথার্থই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। বলিলেন, “কে খুন করিয়াছে?”
অক্ষয়কুমার অতি ধীরে ধীরে পকেট হইতে একখানি কাগজ বাহির করিলেন। নগেন্দ্রনাথ দেখিলেন, সেখানি ওয়ারেন্ট—উমিচাঁদের নামে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
উমিচাদ যে খুন করিয়াছে, ইহা নগেন্দ্রনাথ একবারও মনে করেন নাই। সে যে খুন করিতে পারে না, তাহা ‘অক্ষয়কুমারও অনেকবার বলিয়াছেন; সুতরাং আজ সহসা তাহার নামে ওয়ারেন্ট দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হইলেন। তাহার তখনও বিশ্বাস যে, উমিচাঁদ ইহার কিছুই জানে না। বলিলেন, “আপনি হঠাৎ মত পরিবর্ত্তন করিলেন কিসে? কিসে জানিলেন যে, উমিচাঁদ খুন করিয়াছে?”
অক্ষয়কুমার হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “গ্রন্থকার মহাশয়ের এ কেবল ডিটেক্টিভ উপন্যাস লেখা নয়—আমার বরাবরই উমিচাঁদের উপর নজর ছিল। আমি জানিতাম, এ খুন ঈৰ্ষাবশেই হইয়াছে; তাহাই এতদিন সন্ধান করিতেছিলাম যে, রঙ্গিয়ার কে ভালবাসার পাত্র ছিল।”
“সে সন্ধান ত অনেকদিন হইতে হইতেছিল; কিন্তু কিছুই সন্ধান হয় নাই। কেহ এ সন্ধান দিতে পারে নাই।”
“তাহাতেই বুঝা যায়, রঙ্গিয়া খুব চতুরা ছিল।”
“তাহা হইলে এখন কিরূপে জানিলেন?”
“একেই গোয়েন্দাগিরি বলে। রঙ্গিয়া কোথায় কোথায় যাইত, প্রথমে তাহারই সন্ধান করিতে আরম্ভ করি। ক্রমে জানিতে পারিলাম, সে গোপনে প্রায়ই একটা বাড়ীতে যাইত; তখন কে তাহার ভালবাসার পাত্র ছিল, তাহা জানা কি বড় কঠিন?”
“ভাল, তাহার পর কি জানিলেন?”
“তাহাও বলিতে হইবে? জানিলাম, উমিচাঁদ ও রঙ্গিয়া দুইজনে গোপনে এই বাড়ীতে প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ করিত।”
“উমিচাঁদ যে খুন করিয়াছে, তাহার প্রমাণ কি? আমি ত একটিও দেখিতে পাইতেছি না। সত্য উমিচাঁদ আর রঙ্গিয়ার মধ্যে ভালবাসা ছিল; কিন্তু রঙ্গিয়ার সঙ্গে সে-রাত্রে উমিচাঁদ ছিল, তাহার প্রমাণ কি? এ কথা রঙ্গিয়া আর হুজুরীমল বলিতে পারিত, কিন্তু তাহারা দুইজনেই ইহলোকে নাই
“এখনও কোন কোন প্রমাণের অভাব আছে, স্বীকার করি; কিন্তু উমিচাঁদ যে ভীরু, তাহাকে ভয় দেখাইলে—কেবল এই ওয়ারেন্টখানা দেখাইলে সে সব স্বীকার করিয়া ফেলিবে।”
“যদি সে এতই দুর্বল হয় যে, ভয়ে সব স্বীকার করিয়া ফেলে, তাহা হইলে তাহাতেই বুঝিতে পারা যাইতেছে, তাহার মত ভীরু এরূপভাবে দুইটা খুন করিতে পারে না।”
“ওর চেয়েও ভীরু লোকে ইহা অপেক্ষাও ভয়ানক কাজ করিয়াছে।”
“সে কিরূপে খুন করিল? আপনি এ বিষয়ে কি মনে করেন?”
“সে কোনরকমে জানিতে পারে যে, রঙ্গিয়া গোপনে রাত বারটার সময়ে রাণীর গলিতে হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করিবে—তাহার সঙ্গে পলাইবে। সে জানিত না যে, গঙ্গা নিজে না গিয়া তাহাকে নিজের কাপড় পরাইয়া হুজুরীমলের নিকটে পাঠাইয়াছিল। তাহার দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছিল যে, রঙ্গিয়াই হুজুরীমলের সঙ্গে পলাইতেছে। এরূপ অবস্থায় লোকের যাহা হয়, উমিচাদেরও তাহাই হইল। সে ক্ষোভে দ্বেষে উন্মত্তপ্রায় হইল, একখানা ছোরা সংগ্রহ করিল; আগেই গিয়া রাণীর গলিতে লুকাইয়া রহিল। তাহার পর রঙ্গিয়া হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করিল, অমনি সে গিয়া হুজুরীমলের বুকে ছোরাখানা বসাইয়া দিল। দেখিয়া রঙ্গিয়া হতজ্ঞান হইল, তখন তাহাকে সঙ্গে লইয়া উমিচাঁদ গাড়ীতে আসিয়া উঠিল। রঙ্গিয়া কলের পুতুলের মত তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিল। এরূপ অবস্থায় সে কেন—অনেকেই এইরূপ করিত। তখন উমিচাঁদের খুন চাপিয়াছে, বুকের ভিতর ঈর্ষার আগুন জ্বলিতেছে, সে যাহাকে এতদিন প্রাণ দিয়া ভালবাসিয়া আসিতেছে তাহার এই কাজ, এরূপ অবিশ্বাসিনীর দণ্ডই—মৃত্যু। ভয়ে রঙ্গিয়ার কন্ঠরোধ হইয়া গিয়াছিল; সে সত্য ব্যাপারের কিছুই উমিচাদকে বলিতে পারিল না। উমিচাদ তাহাকে গঙ্গার ধারে আনিয়া সেখানে কোন লোক নাই দেখিয়া নানা গালি দিয়া তাহার বুকে ছোরা বসাইল।
নগেন্দ্রনাথ চিন্তিতভাবে বলিলেন, “ইহা কি সম্ভব?”
“সম্ভব নহে—ঠিক। তাহার পর লাস গঙ্গার জলে ফেলিয়া দিতেছিল, এরূপ সময়ে কোন লোকের পায়ের শব্দ শুনিয়া পলাইয়াছিল। ইহা ব্যতীত এ খুনের দ্বিতীয় কারণ নাই।”
“এসকলই খুব সম্ভব বলিয়া জানিলাম, কিন্তু ইহার প্রমাণ নাই, যে প্রমাণ দিবে, সে-ও নাই। উমিচাদের সঙ্গে রঙ্গিয়ার ভালবাসা ছিল বলিয়াই যে, সে তাকে ও হুজুরীমলকে খুন করিবে এমন কি কথা! এ সমস্তই অনুমান ব্যতীত আর কিছুই নয়। তাহার পর
“তাহার পর আর কি?”
“তাহার পর আপনি সিঁদুরমাখা শিবের কথা একেবারেই ভুলিয়া যাইতেছেন। উমিচাদ পঞ্জাবের সম্প্রদায়ের কেহ নয়, সে খুন করিয়া সিঁদুরমাখা শিব লাসের নিকটে রাখিবে কেন? আরও একটা কথা হইতেছে, সে টাকা লইয়া আবার ফেরৎই বা দিবে কেন।”
অক্ষয়কুমার কোন উত্তর না দিয়া সত্বর উঠিয়া কক্ষমধ্যে চিন্তিতভাবে দ্রুতবেগে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার বহুক্ষণ এইরূপভাবে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন। ক্ষণপরে সহসা সেই চেয়ারখানা টানিয়া বসিয়া বলিলেন, “ভাবিয়া দেখিলাম, যাহা বলিলেন, তাহাও ঠিক–প্রমাণ সংগ্রহ করা কঠিন–আর সিঁদুরমাখা শিবের কথাটাও একটা কথা বটে—এই পাথুরে শিবই আমাকে পাগল করিবে দেখিতেছি। তবে ইহাও ঠিক, উমিচাদ এই খুনের বিষয় জানে, নতুবা সে শিব দেখিয়া অজ্ঞান হইবে কেন?”
“ইহার কারণ ত সে বলিয়াছে।”
“যাহা বলিয়াছে, মিথ্যাকথা; তবে তাহাকে এখানে ডাকিয়া পাঠাইয়াছি, আজ আসিলে দেখা যাক্, সে কি বলে। তাহার পেটের কথা এখনই যদি বাহির না করি, তবে আমার নাম অক্ষয়ই নয়।”
“কখন সে আসিবে?”
অক্ষয়কুমার পকেট হইতে ঘড়ী বাহির করিয়া বলিলেন, “এখনই আসিবে—ঐ বুঝি আসিয়াছে।” সত্যসত্যই উমিচাদ আসিয়াছে। ভৃত্য আসিয়া সংবাদ দিল। অক্ষয়কুমার তাহাকে সেই গৃহে আসিতে আজ্ঞা করিলেন।
আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, উমিচাদের সাহসটা বড় কম, তাহাকে দেখিলেই বোধ হইত, যেন সতত সশঙ্ক, কি যেন একটা পাপ সে করিয়াছে, কি যেন লুকাইবার চেষ্টা করিতেছে, সকলের সহিত সে ভাল করিয়া কথা কহিতে পারিত না। ক্ষণপরে উমিচাঁদ ধীরে ধীরে সশঙ্কভাবে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। অক্ষয়কুমার তাহাকে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। সে চোরের ন্যায় এক পার্শ্বে বসিল। ভীতভাবে কম্পিতকণ্ঠে বলিল, “আপনি আমাকে আসিতে লিখিয়াছিলেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “হ্যাঁ।”
“নূতন কিছু সংবাদ পাইয়াছেন?”
“হাঁ।”
“চুরি সম্বন্ধে?”
“খুন সম্বন্ধে।”
উমিচাঁদ চমকিত হইয়া বলিল, “খুন সম্বন্ধে!
অক্ষয়কুমার অতি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “হাঁ, কে খুন করিয়াছে, আমরা জানিতে পারিয়াছি।” উমিচাঁদ ভয় পাইয়া বলিল, “গুরুগোবিন্দ সিংহ।”
অক্ষয়কুমার ওয়ারেন্টখানি বাহির করিয়া উমিচাদের সম্মুখে রাখিয়া বলিলেন, “যার নামে এই ওয়ারেন্ট আছে, সেই খুন করিয়াছে।”
উমিচাদ মুহূর্ত্তের জন্য ওয়ারেন্টের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিল; তাহার আপাদমস্তক কম্পিত হইতে লাগিল। অস্পষ্টভাবে বলিল, “ওয়ারেন্ট।”
অক্ষয়কুমার স্বর উচ্চে তুলিয়া বলিলেন, “হাঁ ওয়ারেন্ট—আর তোমারই নামে।”
উমিচাদের মুখ বিবর্ণ হইল। তাহার সর্ব্বাঙ্গে স্বেদশ্রুতি হইতে লাগিল। সভয়ে বলিল, “আমার নামে! “ অক্ষয়কুমার আরও কঠোর স্বরে বলিলেন, “হাঁ, তোমার নামে—উমিচাদের নামে—তুমি তোমার মনিব হুজুরীমলকে খুন করিয়াছ—তোমার উপপত্নী রঙ্গিয়াকে খুন করিয়াছ, সেই উভয় অপরাধের ফল এ ওয়ারেন্ট।”
উমিচাঁদ কাঁপিতে কাঁপিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। কপালের ঘাম মুছিতে মুছিতে বলিল, “আমি খুন করি নাই।”
“তুমিই দুইজনকে খুন করিয়াছ—আমি এখনই তোমাকে গ্রেপ্তার করিব।”
“আমি খুন করি নাই—আমি নিৰ্দ্দোষী।” জড়িতকণ্ঠে উমিচাঁদ এই কথা বলিয়া তথা হইতে যাইতে উদ্যত হইল। অক্ষয়কুমার উঠিয়া তাহার হাত ধরিলেন। উমিচাঁদ কাতরভাবে বলিল, “আমি সব কথা বলিতেছি—আমি খুন করি নাই—আমি শপথ করিয়া বলিতেছি।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “কেবল তুমি নয়—ফাঁসী হইতে রক্ষা পাইবার জন্য অনেকেই শপথ করিয়া থাকে। বাপু, কথা কহিয়ো না, আমাদের অনেক কষ্ট দিয়াছ। এখন হাত দুইখানি একবার বাড়াইয়া দাও দেখি, বাপু।”
এই বলিয়া অক্ষয়কুমার বস্ত্রমধ্য হইতে একজোড়া হাতকড়ী বাহির করিলেন। হাতকড়ী দেখিয়া উমিচাদ বালকের ন্যায় কাঁদিয়া উঠিল। নগেন্দ্রনাথের পদতলে পড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “আপনি আমাকে রক্ষা করুন। আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি খুন করি নাই। আমি কিছুই জানি না।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি কি করিতে পারি। আমার কোন হাত নাই। যদি খুন করিয়া থাক, তাহার উপযুক্ত দণ্ড পাইবে
উমিচাঁদ তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “আমি নিদোষী—আমি খুন করি নাই।” অক্ষয়কুমার একটু নরমভাবে বলিলেন, “বেশ, ভাল কথা বাপু’ আমাকে বুঝাইয়া দাও যে তুমি নিদোষী, আমি এখনই তোমায় ছাড়িয়া দিব।”
উমিচাঁদ দুই হাতে মাথা চাপিয়া বলিল, “আমার বলিবার উপায় নাই।“
অক্ষয়কুমার ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “তবে ফাঁসী যাও।”
উমিচাঁদ তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিতে আসিল। অক্ষয়কুমার সরিয়া দাঁড়াইলেন। রুষ্টভাবে বলিলেন, “বেশী চালাকী করিয়ো না। ভাল মানুষটীর মত সব কথা খুলিয়া বল।”
নিরুপায় হইয়া উমিচাঁদ অবশেষে উঠিয়া দাঁড়াইল। দুই হাতে চোখের জল মুছিল। বলিল, “আমাকে একটু জল দিন।”
অক্ষয়কুমার নগেন্দ্রনাথকে ইঙ্গিত করিলেন। তিনি জল আনিলে উমিচাঁদ জলপান করিয়া বলিল, “আমি সত্যকথাই বলিব—সব কথা খুলিয়া বলিতেছি।”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “তোমার পক্ষে এখন তাহাই সৎ-পরামর্শ।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
উমিচাঁদ স্থির হইয়া বসিলে অক্ষয়কুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরকমে হুজুরীমলকে খুন করিয়াছিলে, তাহাই এখন খুলিয়া বল।
উমিচাঁদ মাথা নাড়িয়া বলিল, “আমি খুন করি নাই।”
“কি ভয়ানক মিথ্যাবাদী!”
“দোহাই আপনার—আমি খুন করি নাই।” আমি মিথ্যাবাদী নই, আগে সকল কথা শুনুন শুনিলে সকলই জানিতে পারিবেন।”
“বেশ ভাল কথা, বল।”
“হুজুরীমলের নিকটে কাজ করায়, আমাকে সর্ব্বদাই তাঁহার বাড়ীতে যাইতে হইত—আর আমি স্বীকার করিতেছি, রঙ্গিয়ার সঙ্গে আমার ভালবাসা হইয়াছিল।”
অক্ষয়কুমার মুখভঙ্গি করিয়া বলিলেন, “এ কথা তুমি অনুগ্রহ করিয়া না বলিলেও আমরা জানিতে পারিয়াছি।”
উমিচাঁদ বলিতে লাগিল, “আমি সত্য ভিন্ন মিথ্যা কথা বলিব না। রঙ্গিয়া হুজুরীমলের বাড়ীর সকল কথাই জানিত। তাহার কাছেই জানিতে পারি যে, হুজুরীমল বুড়ো বয়সে গঙ্গার জন্য পাগল। তাহারই কাছে শুনিলাম যে, হুজুরীমল গঙ্গাকে দশ হাজার টাকা দিবে বলিয়াছে, টাকা পাইলে গঙ্গা তাহার সহিত যাইতে স্বীকার করিয়াছে।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এসব কথাও আমরা জানি।”
উমিচাঁদ বলিল, “আমি হুজুরীমলের ভিতরের সকল কথাই জানিতাম। আমি জানিতাম, জুয়া খেলিয়া সে সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়াছে, তাহার দেউলিয়া হইবার আর বিলম্ব নাই; তাহাই ভাবিলাম, হুজুরীমল দশ হাজার টাকা কোথায় পাইবে।”
“গুরুগোবিন্দ সিংহের টাকার বিষয় কবে জানিলে?”
“শুনুন বলিতেছি, একদিন হুজুরীমল আমাকে দশ হাজার টাকার নোট দেখাইয়া সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে সকল কথা বলে। তাহারা কোনরূপে বিরক্ত হইলে যে গোপনে খুন করে, তাহাও তার মুখে শুনিয়াছিলাম।”
“এ সকল আমরা জানি। তাহার পর।”
“ললিতাপ্রসাদকে দিয়া হুজুরীমল নোট বদ্লাইয়া লয়। গুরুগোবিন্দ সিংহের কাছে তাহার নোটের সকল নম্বর ছিল, নোট হারাইলে গুরুগোবিন্দ সিং সব নোট বন্ধ করিয়া দিত, তখন আর নোট ভাঙাইবার উপায় হইবে না। এইজন্য আগে হইতে কৌশলে ললিতপ্রসাদকে দিয়া নোট ভাঙাইয়া লইয়াছিল।”
“আর একদিন তুমি এই লোককে একজন মহাত্মা মহাশয় লোক বলিয়া আমাদের নিকটে পরিচয় দিয়াছিলে।”
“রাণীর গলিতে গঙ্গা হুজুরীমলের জন্য অপেক্ষা করিবে। সেইখানে হুজুরীমল ছদ্মবেশে যাইবে, গঙ্গার হাতে দশ হাজার টাকা দিলে সে তাহার সঙ্গে সেই রাত্রেই বোম্বাই পলাইবে।”
“বেশ পাকা বন্দোবস্ত।”
‘এইরকম সব ঠিক হয়, রঙ্গিয়া আমাকে এইসব কথা বলে। আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম যে, হুজুরীমল পলাইবে।”
“গঙ্গা না গিয়া রঙ্গিয়া গেল কেন?”
“যেদিন গঙ্গার রাণীর গলিতে যাইবার কথা, সেইদিনের আগের দিন গঙ্গার ভয় হইল; সে যাইবার জন্য ইতস্ততঃ করিতে লাগিল; আবার টাকার লোভও সহজে ছাড়িতে পারে না—
“তাহা হইলে গঙ্গার হুজুরীমলের সহিত যাইবার ইচ্ছা ছিল না?”
“না, অমন বুড়োর সঙ্গে কি কেউ কখনও যায়। তাহার মতলব ছিল, দশ হাজার টাকা ঠকাইয়া লইয়া বুড়োকে তফাৎ করিয়া দিবে।”
“রতনে রতন মিলিয়াছিল, আর কি?”
“কিন্তু নিশ্চয়ই হুজুরীমলকে খুন করিবার তাহার ইচ্ছা ছিল না।’
“গঙ্গার বদলে রঙ্গিয়া যাইতে স্বীকার করিল কেন?”
উমিচাঁদ ইতস্ততঃ করিতে লাগিল দেখিয়া অক্ষয়কুমার রুষ্টভাবে বলিলেন, “বাপু, যদি বাঁচিতে চাও, কোন কথা গোপন করিয়ো না।”
উমিচাঁদ ধীরে ধীরে বলিল, “আমার জন্য।”
“তোমার জন্য! কেন?”
“সকল কথাই খুলিয়া বলিতেছি, কিছু গোপন করিব না।”
“তোমার বাঁচিবার একমাত্র উপায় এখন তাহাই।”
“সকল কথা বলিলে আমাকে রক্ষা করিবেন?”
“যদি তুমি যথার্থ খুন না করিয়া থাক, তোমার কোন ভয় নাই।”
“তবে শুনুন, আমি জানিতাম, হুজুরীমলের আর বেশী দিন নাই; আমারও আর চাকরীর বেশী দিন নাই। আমি এক পয়সাও জমাইতে পারি নাই, এই দশ হাজার টাকার কথা শুনিয়া আমার লোভ হইল; আমি ভাবিলাম, এ টাকাটা আমি যদি পাই, তবে আমি রঙ্গিয়াকে অন্য কোন দেশে লইয়া গিয়া সুখে বাকী জীবনটা কাটাইয়া দিতে পারিব।”
“তখন তুমি চোরের উপর বাটপাড়ী করিবার চেষ্টা আরম্ভ করিলে। কি আশ্চর্য্য, কয়টী কি মহাত্মা লোকেরই একত্র সমাবেশ হইয়াছিল!”
“সকল কথা শুনুন, পরে গালাগালি দিবেন।”
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
উমিচাঁদ বলিল, “রঙ্গিয়ার নিকটে শুনিলাম যে, গঙ্গা নিজে যাইতে ইতস্ততঃ করিতেছে—অথচ টাকার লোভও ছাড়িতে পারিতেছে না। আর সে রঙ্গিয়াকে বলিয়াছে, “তুই যদি আমার কাপড় পরে রাণীর গলিতে কাল রাত্রি বারটার সময়ে দেখা করিস্, তাহা হইলে তোকে খুব সন্তুষ্ট করিব। তোকে এক শত টাকা দিব। সে অন্ধকারে আমি কি তুই জানতে পারবে না, তোর হাতে দশ হাজার টাকার নোট দেবে, তুই নোট নিয়েই ছুটে পালাবি, ভয়ে সে তোকে ধরিতে পারিবে না।” রঙ্গিয়ার কাছে এই কথা শুনিয়া আমি বলিলাম, “রঙ্গিয়া, টাকাটা আমরাই পাইতে পারি। তোমায় হুজুরীমল টাকা দিলে সে টাকা গঙ্গাকে দেবার দরকার কি, আমরা টাকা নিয়ে অন্য দেশে সুখে থাকিব। হুজুরীমল নিজে পরের টাকা চুরি করিয়াছে, কিছুই প্রকাশ করিতে পারিবে না—আমাদের কেহ সন্দেহ করিবে না—আমাদের এই সুবিধা।” রঙ্গিয়া এ প্রস্তাবে খুব উৎসাহের সহিত সম্মত হইল।”
“হইবারই কথা—সব কটী সমান জুটিয়াছিল, একেবারে অষ্টবজ্র!”
“কিন্তু আমি ইতস্ততঃ করিতেছিলাম—”
“বটে, এত ধৰ্ম্মজ্ঞান!”
“এই সময়ে যমুনা টিকিট লইতে আসিল। আমার তখনই সন্দেহ হইল, টিকিট লইয়া যাইবার অনেক লোক ছিল, যমুনা কেন? সে জল খাইতে চাহিল। আমি জল আনিতে বাহিরে আসিলাম; কিন্তু সে কি করে দেখিবার জন্য দরজার ফাঁকে চোখ লাগাইয়া রহিলাম। দেখিলাম, সে সিন্দুক খুলিয়া নোটগুলি বাহির করিল। তখন আমার রাগে সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল। বুঝিলাম, ফন্দী খাটাইয়া হুজুরীমল ললিতাপ্রসাদের সম্মুখে টাকা সিন্দুকে রাখিয়াছিল, তাহার পর এই কৌশলে টাকা বাহির করিয়া লইল; বুঝিলাম, লোকে আমাকেই চোর স্থির করুক।”
“হুজুরীমলের এত বুদ্ধি থাকিতে ফেল হইল কেন?”
“জুয়াখেলায়।”
“তাহার পর বল।“
“আমি মনে মনে বলিলাম, ‘বটে? তোমার এই চালাকী, আচ্ছা থাক, কে টাকা পায় দেখ।’ আমি জল লইয়া ফিরিয়া আসিয়া যমুনাকে দিলাম—কোন কথা বলিলাম না। যমুনাও কিছু না বলিয়া টাকাগুলি লইয়া চলিয়া গেল। আমি আগে যে একটু ইতস্ততঃ করিতেছিলাম, তাহা আর করিলাম না। তখনই আমি রঙ্গিয়াকে গিয়া সকল কথা বলিলাম। সে গঙ্গার কাপড় পরিয়া রাত্রে রাণীর গলিতে হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল। সেখানে তাহার সঙ্গে হুজুরীমলের দেখা হইলে সে গঙ্গ। ভাবিয়া রঙ্গিয়ার হাতে নোটের তাড়া দিল।”
“খুনটা করিল কে?”
“তা—তা আমি জানি না।”
“রঙ্গিয়ার কথামত আমি গঙ্গার ধারে তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলাম। সে ছুটিতে ছুটিতে আমার কাছে আসিয়া আমার হাতে নোটের তাড়াটা দিল। সে ভয়ে এমনই হইয়াছিল যে, তখন আমাকে কি বলিল, আমি ভাল কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; তবে এইটুকু বুঝিলাম যে, হুজুরীমল খুন হইয়াছে।”
“কে খুন করিয়াছে, শুনিলে?”
“সে সেই কথা বলিতে যাইতেছিল, এমন সময়ে কোথা হইতে একটা লোক তাহার উপর আসিয়া পড়িল। তাহার হাতে ছোরা ঝক্ ঝক্ করিয়া উঠিল। রঙ্গিয়া ভয়ে পড়িয়া গেল। আমিও প্রাণভয়ে ছুটিলাম।”
“সে তোমার পিছনে এসেছিল?”
“বলিতে পারি না। আমি একবার ফিরিয়া দেখিয়াছিলাম। দেখিলাম, লোকটা রঙ্গিয়ার নিকট
বসিয়া তাহার কাপড় অনুসন্ধান করিতেছে—নিশ্চয়ই নোট খুঁজিতেছিল।”
“তাহার পর সে তোমার পিছনে আসিয়াছিল?”
“বলিতে পারি না, আমি ছুটিয়া একটা গলির ভিতরে যাই।”
“সে লোককে এখন দেখিলে চিনিতে পার?”
“তাহাকে ভাল করিয়া দেখি নাই; তবে তাহার লম্বা কাল দাড়ি ছিল, হয়ত ছদ্মবেশে ছিল, ঠিক বলিতে পারি না।”
“গাড়োয়ানও বলিয়াছিল, লোকটার লম্বা কাল দাড়ি ছিল। রঙ্গিয়া তাহাকে নিশ্চয় চিনিত, নতুবা সে তাহার সঙ্গে গাড়ীতে উঠিবে কেন?”
“সে আমাকে বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু বলিবার সময় পায় নাই।”
অক্ষয়কুমার এক দৃষ্টে উমিচাঁদের দিকে চাহিয়া রহিলেন। ক্ষণপরে বলিলেন, “বলি রঙ্গিয়ার আর কেহ ভালবাসার লোক ছিল কি?“
উমিচাঁদ ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিল, “নানা—না—
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “না থাকিলেই ভাল। তার পরে কি হল বল।”
উমিচাঁদ বলিল, “আর কিছুই বলিবার নাই—তবে ইহাও আমি বলিতে চাই যে, গুরুগোবিন্দ সিংহকে আমি টাকা ফেরৎ দিয়াছি।”
উভয়েই বিস্মিতভাবে বলিয়া উঠিলেন, “তুমি?”
উমিচাঁদ ধীরে ধীরে বলিল, “হাঁ।”
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “টাকা ফেরৎ দিলে কেন?”
“রঙ্গিয়া মরিয়া যাওয়ায় আমার টাকার দরকার নাই—আমি কোনরকমে নিজেকে চালাইতে পারিব; কেবল তাহারই জন্য টাকার লোভ হইয়াছিল—আমি যদি তাকে পাই, তবে একবার দেখিয়া লই।”
উমিচাঁদের চক্ষু দিয়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল। অক্ষয়কুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাহাকে দেখিয়া লইতে চাও?”
উমিচাঁদ দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করিয়া বলিলেন, “যে আমার রঙ্গিয়াকে খুন করিয়াছে।”
“কে সে মনে কর?”
“জানিতে পারিলে তাহাকে দেখিতাম।”
“কাহারও উপর সন্দেহ হয়?”
“না, তাহা হইলে তাহাকে সন্ধান করিয়া বাহির করিতাম।”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরমুখে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন উমিচাঁদবাবু, এসকল কথা পূৰ্ব্বে আমাদিগকে বল নাই কেন?”
“পাছে আপনারা আমাকে সন্দেহ করেন।”
“এমন মহা মূর্খ আর দুনিয়ায় নাই। যাহাই হউক, উপস্থিত আমি তোমার কথা বিশ্বাস করিলাম। তুমি নোটগুলি লইয়াছিলে, আবার ফেরৎ দিয়াছ—ভালই করিয়াছ। আমি এ ওয়ারেন্ট চাপিয়া রাখিলাম, তবে আমাদের কথার অবাধ্য হইলে –”
“আপনারা আমাকে যাহা বলিবেন, তাহাই করিব।”
“খুব ভাল কথা—উপস্থিত তুমি এসব কথা আর কাহাকেও বলিয়ো না।”
“কাহাকেও বলিব না।”
“তাহা হইলে এখন যাইতে পার।”
উমিচাঁদকে আর অধিক কথা বলিতে হইল না। সে তৎক্ষণাৎ সেখান হইতে পলাইল। উমিচাঁদ চলিয়া গেল। নগেন্দ্রনাথ এতক্ষণ নীরবে ছিলেন, এখন তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ যাহা বলিল, বিশ্বাস করিলেন কি?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “কতক করিয়াছি।”
“কিন্তু লোকটা যে বদমাইস, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।”
“সকলগুলিই সমান, তবে এর দুই-দুইটা খুন করিবার সাহস নাই। এখন আবার নূতন একজন খুনী বাহির হইল।”
“কে?”
“উমিচাঁদ যাহাকে দেখিয়াছিল।”
‘কে সে মনে করেন?”
“যে-ই হউক, তাহার সঙ্গে রঙ্গিয়ার পরিচয় ছিল।”
“তাহা ত নিশ্চয়—নতুবা সে তাহার সঙ্গে গাড়ীতে যাইবে কেন?”
“আপনি কাহাকে মনে করেন?”
“আমার মনে হয়, শান্তপ্রসাদ।”
“বাজে কথা—শান্তপ্রসাদ বলিয়া কেহ নাই।”
নগেন্দ্রনাথ কোন কথা কহিলেন না। অক্ষয়কুমার উঠিলেন। বলিলেন, “দেখা যাক্? কতদূর কি হয়। যেখান থেকে রওনা হওয়া গিয়াছিল, এ পৰ্য্যন্ত সেইখানেই থাকা গিয়াছে—কাজ কিছুই হয় নাই।”
অক্ষয়কুমার চলিয়া গেলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে যমুনাদাস আসিয়া উপস্থিত হইলেন। খুনের তদন্তের কতদূর কি হইল জিজ্ঞাসা করিলেন। নগেন্দ্রনাথ তাঁহাকে সকল কথা বলিলেন। শুনিয়া তিনি বলিলেন, “উমিচাঁদের কাছে টাকা আছে? বেটা চুরির জন্য নিশ্চয়ই জেলে যাইবে।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “গঙ্গা রঙ্গিয়াকে পাঠাইয়াছিল, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।”
যমুনাদাস ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, “আমি তাহাকে একথা জিজ্ঞাসা করিব। তাহার উপরে আমার বিশ্বাস আছে।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “যদি রাগ না কর, একটা কথা বলি।”
“বল না, তুমি বলিবে–তাহাতে রাগ করিব কেন?”
“সত্যকথা বলিতে কি, গঙ্গাকে আমার খুব ভাল বলিয়া বোধ হয় না।” যমুনাদাস ভ্রূকুটি করিলেন। বলিলেন, “আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিব।”
তিনি আর কোন কথা না কহিয়া চলিয়া গেলেন। নগেন্দ্রনাথ ভাবিলেন, “ভালবাসায় লোক কতদূর অন্ধ হয়, যমুনাদাসই তাহার প্রমাণ। গঙ্গার সকল বিষয় যমুনাদাস জানিতে পারিলে বুঝিতে পারে, সে কি মহাভ্রমের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। স্ত্রীলোকের চরিত্র দেবতাও বুঝিতে পারে না।”
সপ্তম পরিচ্ছেদ
দুইদিন নগেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারের আর কোন সংবাদ পাইলেন না। তৃতীয় দিবস বৈকালে একজন লোক আসিয়া বলিল যে, অক্ষয়কুমার তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ তাঁহার সহিত দেখা করিতে বলিয়াছেন। ব্যাপার কি, সে কিছুই বলিতে পারিল না। কেবল বলিল, “তিনি এখনই, আপনাকে যাইতে বলিয়াছেন।” নগেন্দ্রনাথ নিতান্ত কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া সত্বর অক্ষয়কুমারের সহিত দেখা করিতে চলিলেন। তাঁহার বাড়ীতে আসিয়া নগেন্দ্রনাথ দেখিলেন, অক্ষয়কুমার উমিচাঁদের সহিত বসিয়া আছেন। তাঁহাকে দেখিয়া অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “আপনি এ খুনের ব্যাপারে গোড়া হইতে আমার সঙ্গে আছেন; উপসংহারকালে আপনাকে বাদ দেওয়া উচিত নয়।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “ব্যাপার কি? খুনী কি ধরা পড়িয়াছে?”
“না, এখনও পড়ে নাই; তবে আর ধরা পড়িবারও বড় বেশী বিলম্ব নাই।”
“ব্যাপার যে কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”
“এই চিঠিখানা দেখুন।”
এই বলিয়া অক্ষয়কুমার একখানা পত্র তাঁহার সম্মুখে ফেলিয়া দিলেন। নগেন্দ্রনাথ দেখিলেন, পত্র উমিচাদের নামে।
অক্ষয়কুমার পত্রখানি খুলিয়া পাঠ করিলেন। পত্রের মর্ম্ম এইরূপ যে, কাল রাত্রি এগারটার সময়ে উমিচাঁদবাবু যদি বীডন গার্ডেনের পূৰ্ব্ব-দক্ষিণ কোণে আসেন, তবে রাণীর গলির খুনের সকল বিপদ্ হইতে তিনি রক্ষা পাইতে পারেন। একাকী আসা চাই। সেইখানে ঠিক সেই সময়ে একজন ভদ্রলোক আসিয়া চুরুট ধরাইবার জন্য দিয়াশলাই চাহিবেন। তাঁহার সহিত কথা কহিলেই সকল কথা জানিতে পারিবেন।
পাঠান্তে নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কে চিঠি লিখিয়াছে, জানিবার উপায় কি?”
উমিচাঁদ ব্যগ্রভাবে বলিল, “যে খুন করিয়াছে, সে-ই লিখিয়াছে।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “হাঁ আমারও বিশ্বাস, যে খুন করিয়াছে, সে-ই এ পত্র লিখিয়াছে; সে রঙ্গি য়াকে খুন করিবার সময়ে নিশ্চয়ই উমিচাঁদকে দেখিয়াছিল। উমিচাঁদ যে এই খুনের জন্য বিপদে পড়িয়াছে, তাহা আমরা ছাড়া আর কেহ জানে না; সুতরাং এই ব্যক্তিই খুনী। এখন উমিচাদের সঙ্গে টাকার বিষয়ে একটা বন্দোবস্ত করিতে চায়।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কতকটা সম্ভব বটে।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “সম্ভব নয়—ঠিক।”
নগেন্দ্রনাথ হাসিলেন। পূর্ব্বে অক্ষয়কুমার এইরূপ ‘ঠিক’ অনেকবার বলিয়াছেন এবং প্রতিবারই তাঁহাকে তাঁহার মতের পরিবর্ত্তন করিতে হইয়াছে। তাঁহাকে হাসিতে দেখিয়া অক্ষয়কুমার বলিলেন,
“এবার দেখিবেন, আমার কথাই ঠিক।”
“আপনি কি উমিচাঁদের সঙ্গে এই লোককে ধরিতে যাইবেন?”
“নিশ্চয়ই—আপনিও যাইবেন। উপসংহারকালে আপনারও থাকা চাই—আপনাকে ছাড়িব না।”
“তা ত নিশ্চয়ই যাইব। কিন্তু উপসংহার হয় কি আবার সূচনা হয়, তাহা দেখা চাই।”
উমিচাঁদ বলিল, “তাহা হইলে আমি এখন যাইতে পারি?”
অক্ষয়কুমার উত্তর করিলেন, “হাঁ, এখন যাও। রাত্রি ঠিক এগারটার সময়ে বীডন গার্ডেনের পূৰ্ব্ব-দক্ষিণ কোণে দাঁড়িয়ে থাকিয়ো—আমরা কাছেই থাকিব।”
উমিচাঁদ চলিয়া গেলে নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “ইনিও একটি প্রকাণ্ড বদমাইস।”
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “আমাদের অনেক সময়ে কাঁটা দিয়া কাঁটা তুলিতে হয়। বেটা টাকাগুলা বেশ গাফ্ করিয়াছিল, কিন্তু শেষে ফেরৎ দিয়াছে।”
“কেবল ভয়ে—বেটা একটি পুরাতন পাপী।“
“এ বেটাকে হাতে না পাইলে এই খুনীকে ধরা শক্ত হইত।”
“যাক্, এখন কে এই চিঠি লিখিয়াছে, আপনি মনে করেন?”
“যে হুজুরীমল আর রঙ্গিয়াকে খুন করিয়াছে।”
“কে সে? আপনার অনুমান কিরূপ?”
“নিশ্চয়ই আমাদের কোন পরিচিত বন্ধুকেই দেখিতে পাইব।”
“কে গুরুগোবিন্দ সিং?”
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “নগেন্দ্রনাথবাবু, আপনি কি কোনরূপেই গুরুগোবিন্দ সিংকে ছাড়িতে পারিবেন না? গুরুগোবিন্দ সিং যে খুন করে নাই, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে।”
“তবে কে আপনি মনে করেন?”
“আর কিছু মনে করিব না, তাহাতে খুবই অরুচি হইয়া গিয়াছে। আজ রাত্রেই সকল সন্দেহ ভঞ্জন হইবে।”
অষ্টম পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ একথায় সন্তুষ্ট হইলেন না। আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ রাত্রিতে খুনীই যে ধরা পড়িবে, আপনার ইহা কিরূপে বিশ্বাস হইল? যে পত্র লিখিয়াছে, সে খুনের সম্বন্ধে কোন কথা জানিতে পারে——কেবল শুনিয়াছে মাত্র—অথবা উমিচাঁদ যে খুনের সহিত জড়িত আছে, তাহা কোন গতিকে জানিতে পারিয়াছে, তাহাই তাহার নিকটে টাকা আদায় করিবার জন্য ডাকিয়াছে।”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা হইলেও হইতে পারে—কিন্তু তাহা নহে। এই ব্যাপারের ভিতরের খবর বাহিরের কোন লোক জানে না। উমিচাঁদ যে খুনের সময়ে উপস্থিত ছিল, তাহা কেবল তিনজনের জানা সম্ভব।”
“নাম করুন।”
“প্রথম রঙ্গিয়া—সে নাই। দ্বিতীয় উমিচাঁদ—সে প্রথম এ কথা আমাদের নিকট স্বীকার করিয়াছে। ইহা কখনই সম্ভব নহে যে, সে এ কথা অপর কাহারও নিকটে বলিবে। তৃতীয়—যে খুন করিয়াছিল।”
“আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা ঠিক।”
“তাহা হইলে উমিচাঁদ যে খুনের সহিত জড়িত, তাহা যে খুন করিয়াছিল, সে ব্যতীত আর দ্বিতীয় ব্যক্তির জানিবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই।”
“তাহাই যদি হয়, তবে সে উমিচাঁদকে এরূপভাবে ডাকিবে কেন?”
“টাকার লোভে। আমি আপনাকে পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, খুনী হুজুরীমলকে টাকার জন্যই খুন করিয়াছিল। কিন্তু সে খুন করিয়া টাকা পায় নাই। হুজুরীমল টাকা রঙ্গিয়ার হাতে দিয়াছিল। রঙ্গিয়া হঠাৎ হুজুরীমলকে খুন হইতে দেখিয়া হতবুদ্ধি হইয়া পড়িয়াছিল; সেইজন্য খুনীর সঙ্গে গাড়ীতে আসিয়া উঠিয়াছিল। পরে সুবিধা পাইবামাত্র ছুটিয়া পলাইয়া আসিয়া উমিচাঁদের হাতে টাকা দিয়াছিল। তখন সেই ব্যক্তি টাকা এইরূপে বে-হাত হওয়ায় উন্মত্তপ্রায় হইয়া তাহার পিছনে ছুটিতে থাকে। উমিচাঁদের সঙ্গে রঙ্গিয়াকে কথা কহিতে দেখিয়া উন্মত্তের ন্যায় তাহার বুকে ছোরা বসাইয়া দেয়। তাহার পর রঙ্গিয়ার কাপড়ের ভিতর টাকা খুঁজিতে থাকে। না পাইয়া উমিচাঁদের পিছনে ছুটিতে থাকে। তাহাকে ধরিতে পারিলে দুইটা খুনের জায়গায় তিনটা হইত। আর একটা বদমাইস পৃথিবীতে কম পড়িত।”
“কথাটা খুব সম্ভব বটে; কিন্তু এই লোকটা কে, আপনি মনে করেন?”
“আপনি কাহাকে করেন?”
“আমি ত কাহাকেও ভাবিয়া পাইতেছি না। আপনি কি কাহাকেও সন্দেহ করেন?”
“হাঁ, ললিতাপ্রসাদকে।“
নগেন্দ্রনাথ অতিশয় বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “ললিতাপ্রসাদ! তাহাকে সন্দেহ করিবার কারণ কি?”
“কারণ অনেক আছে। আমি আপনাকে বলিতেছি, আজ রাত্রে ললিতাপ্রসাদ ধরা পড়িবে—কাল সে জেলে যাইবে, এক মাসের মধ্যে তাহার ফাঁসী হইবে।”
নগেন্দ্রনাথ শিহরিয়া উঠিলেন। অক্ষয়কুমারের এসকল দেখিয়া দেখিয়া হৃদয় কঠিন হইয়া গিয়াছিল, তিনি অতি গম্ভীরভাবে এসকল আলোচনা করিতে পারিতেন। নগেন্দ্রনাথের এই প্রথম। তিনি বলিলেন, “আপনার ললিতাপ্রসাদকে সন্দেহ করিবার কারণ কি?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আমি এই ছোক্বা সম্বন্ধে কিছু সন্ধান লইয়াছি। এ যেরূপ দেখায় সেরূপ নহে—বাহিরে খুব ভাল মানুষের মত থাকে, ভিতরে ভিতরে মদ, জুয়া, মেয়েমানুষ আছে, আর দুই হাতে টাকাও উড়ায়। সম্প্রতি ইহার টাকার নিতান্ত দরকার হইয়াছিল, এরূপ অবস্থায় মানুষ সব করে।”
“কিন্তু হুজুরীমলের কাছে যে সে রাত্রে টাকা ছিল, তাহা সে কিরূপে জানিবে?”
“গঙ্গার অনুগ্রহে।”
“কেন?”
“কেন? গঙ্গার সঙ্গে তাহার গুপ্তপ্রণয় আছে। যদি গঙ্গা কাহাকেও একটু ভালবাসে, তাহা হইলে ললিতাপ্রসাদকেই বাসে। সে জানিত, ললিতাপ্রসাদ হুজুরীমলকে সে রাত্রে কি করিবে—তাহাই ভয়ে নিজে না গিয়া রঙ্গিয়াকে পাঠাইয়াছিল।”
“আপনার কথা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম।”
“স্তম্ভিত হইবার কিছুই নাই। প্রত্যহ এরূপ হইতেছে।”
নগেন্দ্রনাথের প্রকৃতই সংসারের—মানুষমাত্রেরই উপর ঘোর বীতরাগ জন্মিল। সন্ধ্যার সময়ে আসিবেন বলিয়া তিনি গৃহাভিমুখে নিতান্ত ক্ষুণ্ণ ও বিষণ্ণচিত্তে চলিলেন।
নবম পরিচ্ছেদ
অনিচ্ছাসত্ত্বেও নগেন্দ্রনাথ এই খুনের বিষয় মনে মনে আলোচনা না করিয়া থাকিতে পারিলেন না। যেদিন হইতে এই খুন হইয়াছে, সেইদিন হইতে তাঁহার আহার নিদ্রা গিয়াছে—তাঁহার লেখা পড়া বন্ধ হইয়াছে; তিনি দিন রাত্রি এই বিষয় লইয়াই আলোচনা করেন। তিনিও দুই-তিনখানা ডিটেক্টিভ উপন্যাস লিখিয়াছেন, কিন্তু এরূপ রহস্যপূর্ণ একখানাও লিখিতে পারেন নাই। তিনি ভাবিলেন, এই পৰ্য্যন্ত লিখিয়া যদি কেহ তাঁহাকে এই উপন্যাসের উপসংহার লিখিতে বলে, তাহা হইলেই চক্ষুঃস্থির। কিরূপভাবে উপসংহার করিলে ইহা হৃদয়গ্রাহী হইতে পারে, কল্পনা-রাজ্যে তেমন কিছুই খুঁজিয়া পাইলেন না। এ খুনের রহস্য যে কখন প্রকাশ পাইবে, সে বিষয়ে তিনি হতাশ হইয়াছিলেন।
অদ্য রাত্রে খুনী নিশ্চয়ই ধরা পড়িবে, অক্ষয়কুমার সে বিষয়ে নিশ্চিত হইয়াছেন; কিন্তু নগেন্দ্ৰনাথ এই কয়দিনে দেখিয়াছেন যে, তিনি খুব বিচক্ষণ ডিটেক্টিভ হইয়াও প্রতিপদে বিলক্ষণ ভুল করিয়াছেন, এ পর্যন্ত তাঁহার অনুমান একটাও সত্য হয় নাই। তিনি যখন যেটা ঠিক মনে করিয়াছেন, পরে দেখা গিয়াছে, সেটা ঠিক নহে—তাঁহার ভুল হইয়াছে।
অদ্যও তিনি বলিতেছেন যে, খুনীই উমিচাঁদকে পত্র লিখিয়াছে, খুনীই উমিচাঁদের সহিত দেখা করিতে আসিবে; কিন্তু যে দুই-দুইটা খুন করিয়া এতদিন সকলের চোখে ধূলি দিয়া নিরাপদে আছে, সে কি সহসা এমনই উন্মত্ত হইয়া উঠিল যে, উমিচাদের সহিত এরূপভাবে দেখা করিতে প্রস্তুত হইবে? তাহার কি ধরা পড়িবার ভয় নাই? টাকার লোভে উমিচাদের সঙ্গে দেখা করিতে পারে, কিন্তু উমিচাঁদ যে তাহাকে ধরাইয়া দিতে পারে, এ বিষয় কি সে একবারও মনে করে নাই? তবে ইহাও সম্ভব যে, সে ভাবিতে পারে উমিচাঁদ নিজের প্রাণের ভয়ে একথা প্রকাশ করিবে না। তাহার সহিত টাকার একটা অংশ করিয়া লইলে সে পরে নিজের রক্ষার জন্যই একথা গোপন করিবে। আর যদি ললিতাপ্রসাদই খুনী হয়, তবে সে ভাবিয়াছে, উমিচাঁদ কখনই তাহার বিরুদ্ধে যাইতে সাহস করিবে না—তাহা হইলে সে অনায়াসেই উমিচাঁদকে খুনী বলিয়া ধরাইয়া দিতে পারিবে। এ লোক যে-ই হউক, সে জানে না যে, উমিচাঁদ অনুতাপের জন্যই হউক, আর ভয়েই হউক, টাকা গুরুগোবিন্দ সিংহকে ফেরৎ দিয়াছে, তাহার নিকটে টাকা নাই। তাহার নিকটে টাকা নাই জানিলে সে কখনও তাহার সহিত এরূপভাবে দেখা করিতে চাহিত না। আর এ সমস্তই উমিচাঁদের চাতুরীও হইতে পারে। উমিচাঁদ এ পৰ্য্যন্ত যাহা বলিয়াছে, সমস্তই মিথ্যা—তাহার একটা কথাও সত্য নহে। কেবল অক্ষয়বাবুর চোখে ধূলি দেওয়াই তাহার উদ্দেশ্য। লোকটা যে ঘোরতর বদমাইস, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই, সম্ভবতঃ বেটা নিজেই বা কোন গুণ্ডা দিয়া টাকার লোভে হুজুরীমলকে খুন করিয়াছিল, কারণ সে হুজুরীমলের সকল কথাই জানিত। তাহার পর রঙ্গি য়া হুজুরীমলকে খুন হইতে দেখিয়াছিল; সে স্ত্রীলোক, পাছে কোন সময়ে এ কথা আত্মপ্রকাশ করিয়া ফেলে—সেই ভয়ে তাহাকেও খুন করিয়াছিল। আমাদের সম্মুখে সে যাহা বলিয়াছে, তাহা গল্পমাত্র—সকলই মিথ্যা। এ চিঠিও তাহারই চাতুরী, আজ যে এই রাত্রে বীডন গার্ডেনের ব্যাপার ঘটাইয়াছে, ইহাও তাহারই সৃষ্টি। অক্ষয়কুমার সুদক্ষ ডিটেটিভ হইতে পারেন, কিন্তু তিনি এ পর্য্যন্ত যে যে বিষয়ে স্থির নিশ্চিত হইয়াছেন, তাহার একটাও সত্য বলিয়া সপ্রমাণ হয় নাই। সম্ভবতঃ আজও সেইরূপ হইবে। এতদিন কাটিয়া গেল, কই তিনি এ খুনের কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না।
সমস্ত দিবস নগেন্দ্রনাথ গৃহে বসিয়া, কাজ-কৰ্ম্ম ছাড়িয়া এই খুন সম্বন্ধেই আলোচনা করিলেন; কিন্তু কোনক্রমে একটা স্থির-সিদ্ধান্তে আসিতে পারিলেন না। বলিলেন, “আজ ইহার একটা শেষ যাহা হয় কিছু হইলে আমি রক্ষা পাই। ডিটেটিভগিরির সাধ আমার একেবারে মিটিয়া গিয়াছে। ইহাপেক্ষা মনে মনে গড়িয়া লইয়া কল্পনার সাহায্যে ডিটেক্টিভ উপন্যাস লেখাই সহস্রগুণে ভাল। প্রকৃত ঘটনায় অনেক বিড়ম্বনা।”
সন্ধ্যার একটু পরেই আহারাদি শেষ করিয়া নগেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চলিলেন। তিনি উপস্থিত হইলে অক্ষয়কুমার আহারাদি করিতে গমন করিলেন।
রাত্রি দশটার সময়ে তাঁহারা উভয়ে বীডন-গার্ডেনের দিকে চলিলেন। অক্ষয়কুমার দুইজন বলবান্ কনষ্টেবল সঙ্গে লইলেন। তাঁহারা পুলিসের পোষাক না পরিয়া ভদ্রলোকের বেশ ধারণ করিয়া চলিলেন। অক্ষয়কুমার পকেটে একটা পিস্তল রাখিয়া বলিলেন, “সাবধানের বিনাশ নাই—অপঘাত মৃত্যুটা ভাল নয়।”
দশম পরিচ্ছেদ
রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটার সময়ে তাঁহারা সকলে বীড়ন-গার্ডেনের নিকটে আসিলেন। তখনও রাস্তায় বহু লোক চলাচল করিতেছে—বাগানের মধ্যেও অনেক লোক হাওয়া খাইয়া বেড়াইতেছে। এত লোকের চলাচল দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আশ্চর্য্যের বিষয় লোকটা এমন প্রকাশ্য স্থানে উমিচাঁদের সঙ্গে দেখা করিতে চাহিয়াছে।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “তাহাতেই বোঝা যায় যে, লোকটা খুব চালাক, যত প্রকাশ্য স্থান – ততই সন্দেহ কম।”
“আপনি ঠিক বলিয়াছেন।”
“প্রায়ই ঠিক বলি।”
নগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “এ পর্যন্ত যাহা কিছু বলিয়াছেন, তাহা ঠিক হয় নাই।” অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “মানুষের ভুল-ভ্রান্তি আছেই—আমাদের বন্ধুটি কই?” নগেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন্ বন্ধু?”
অক্ষয়কুমার আবার হাসিলেন। বলিলেন, “এটাও আবার বুঝাইতে হইবে? উমিচাদ—আমাদের প্রাণের বন্ধু উমিচাঁদ। তাহার মনে এমন একটা অনুতাপ উপস্থিত না হইলে আমাদের আজ খুনী ধরার কোন সম্ভাবনা ছিল না।”
“আপনি কি নিশ্চিত মনে করিতেছেন, আজ খুনীই এখানে আসিবে?”
“নিশ্চয়ই।”
তাঁহারা বাগানের পূৰ্ব্ব-দক্ষিণ কোণে আসিলেন। দেখিলেন, সেখানে তত লোক নাই—দুই- একটি লোকমাত্র সেদিকে বেড়াইতেছে।
বাগানের কোণে একখানা বেঞ্চি আছে। বেঞ্চিখানি খালি—তাহাতে কেহ বসিয়া নাই। ঐ বেঞ্চির পশ্চাতে একটা ঝোপ, ঝোপের পরেই রাস্তা, রাস্তার পর আবার একটা ঝোপ।
“এই উপযুক্ত স্থান,” বলিয়া অক্ষয়কুমার সঙ্গীদিগকে ইঙ্গিত করিলেন। ক্রমে অন্য লোকের অলক্ষ্যে তাঁহারা একে একে ঝোপের মধ্যে লুক্কায়িত হইলেন।
কিন্তু তাঁহারা দেখিলেন, তখনও উমিচাঁদ আসে নাই, প্রায় এগারটা বাজে। অক্ষয়কুমার অত্যন্ত অধীর হইয়া উঠিয়াছিলেন। এই সময়ে তাঁহারা দেখিলেন, উমিচাঁদ ধীরে ধীরে সেইদিকে আসিতেছে। যেখানে ঝোপের মধ্যে অক্ষয়কুমার প্রভৃতি লুকাইয়াছিলেন, উমিচাঁদ সেইদিকে আসিল। একবার চারিদিকে চাহিল; বোধহয়, অক্ষয়কুমারকে না দেখিয়া যেন ভীত হইল—সে চলিয়া যাইতেছিল, সহসা ঝোপের ভিতর হইতে একটা শব্দ হইল। উমিচাঁদ দাঁড়াইল। বুঝিতে পারিল, অক্ষয়কুমার নিকটেই আছেন। উমিচাঁদ সেইখানে পদচারণ করিতে লাগিল।
তাঁহারা যে নিকটেই আছেন, ইহা উমিচাঁদকে জানাইবার জন্য অক্ষয়কুমার তাহাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছিলেন, ঝোপের ভিতর একটা শব্দ হইলেই জানিবে, আমরা নিকটেই আছি।
ঝোপের ভিতর নিঃশব্দে নিশ্বাস বন্ধ করিয়া অক্ষয়কুমার প্রভৃতি বসিয়া আছেন। মশকে তাঁহাদের সৰ্ব্বাঙ্গে স্বচ্ছন্দে দংশন আরম্ভ করিয়াছে—নীরবে তাহা সহ্য করিতে হইতেছে। বাহিরে উমিচাঁদ সুখে সুশীতল বাতাসে গম্ভীরভাবে পদচারণ করিতেছে। অক্ষয়কুমার তখন আর থাকিতে পারিলেন না, অতি মৃদুস্বরে বলিলেন, “জীবনে কত দুঃখই আছে। মশায় খেয়ে ফেলিল, আর বেটা রাজপুত্রের মত তোফা বেড়াচ্ছেন—আঃ! সে বেটার যে এখনও দেখা নাই।”
এইরূপে আরও কিছুক্ষণ উত্তীর্ণ হইল। অদূরে মল্লিকদের ঘড়ীতে ঢং ঢং করিয়া এগারটা বাজিল। চমকিত হইয়া উমিচাঁদ দাঁড়াইল, চারিদিকে চাহিল। এগারটা বাজিতে শুনয়া অনেকে বাগান হইতে বাহির হইয়া যাইতে লাগিল; ক্রমে বাগানের ভিতরস্থ জনতার অনেক হ্রাস হইয়া আসিল। উমিচাঁদ চারিদিকে চাহিতে লাগিল; কিন্তু কোন লোক তাহার নিকটে আসিল না। সে কি করিবে- না-করিবে ভাবিতেছে, এই সময়ে সহসা একটী লোক ধীরে ধীরে তাহার নিকটবর্ত্তী হইল। তাহার হাতে একটী চুরুট। সে উমিচাদের নিকটস্থ হইয়া বলিল, “মহাশয়ের কাছে দিয়াশলাই আছে? চুরুটটা ধরাইয়া লইব।”
উমিচাঁদ তাহাকে দিয়াশলাই দিল। ধীরে ধীরে দিয়াশলাই জ্বলাইয়া চুরুট ধরাইতে লাগিল। সেই আলোকে উমিচাঁদ দেখিল যে, এই ভদ্রলোকের লম্বা কাল দাড়ি আছে। সে মুহূর্ত্তমাত্র খুনের রাত্রে সেই ব্যক্তিকে দেখিয়াছিল, কিন্তু সে সে দাড়ি ভুলে নাই।
তাহার হৃদয় অত্যন্ত দ্রুতবেগে স্পন্দিত হইতে লাগিল। এই লোকই তাহার চোখের উপর রঙ্গি য়াকে খুন করিয়াছিল। আজ আবার এই রাত্রে তাহারই সম্মুখে সেই খুনী দণ্ডায়মান।
একাদশ পরিচ্ছেদ
উমিচাদের গলা শুকাইয়া গিয়াছিল—তাহার মুখ হইতে কোন কথা বাহির হইল না। সেই ব্যক্তি চুরুটটী ধরাইয়া গম্ভীরভাবে টানিতে টানিতে দিয়াশলাইয়ের বাক্সটা উমিচাঁদকে ফেরৎ দিল।
সে যেন চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল। তৎপরে উমিচাঁদের দিকে চাহিয়া মৃদুস্বরে বলিল, “আমার পত্র পাইয়াছিলেন?” বলিয়া চারিদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে চাহিল।
উমিচাঁদও সেইরূপ মৃদুস্বরে বলিল, “হাঁ, সেইজন্য আসিয়াছি। আপনি আমার সঙ্গে দেখা করিতে চাহেন কেন?”
লোকটী বলিল, “বলিতেছি, আসুন, ঐ বেঞ্চিতে বসা যাক্।”
এই বলিয়া সে বেঞ্চিতে গিয়া বসিল। পরে উমিচাদকে বলিল, “বসুন।
এবার অক্ষয়কুমার প্রভৃতি ঝোপের মধ্য হইতে লোকটীর মুখ সুস্পষ্ট দেখিতে পাইলেন। কিন্তু তাহাকে যে তাঁহারা কখনও দেখিয়াছেন, তাহা বলিয়া বোধ হইল না। তবে যে কালো দাড়ির কথা গাড়োয়ান বলিয়াছিল, উমিচাঁদও দেখিয়াছিল, তাঁহারা দেখিলেন, এই লোকটার সেই রকমই লম্বা কালো দাড়ি আছে।
যাহা হউক, লোকটী বসিতে বলিলে উমিচাঁদ স্পষ্টতই নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে বসিল। তিনি লোকটীর নিকট হইতে একটু দূরে বসিলেন। একবার সভয়ে চারিদিকে চাহিল; তাহার সে সময়ের মনের অবস্থা বর্ণনা করা নিষ্প্রয়োজন। রঙ্গিয়ার খুনের রাত্রের সেই উদ্যত ছোরার কথা ঘন ঘন তাহার মনে পড়িতে লাগিল।
উমিচাঁদ অতি মৃদুস্বরে বলিল, “এখানটা বড় প্রকাশ্য স্থান নয়?”
লোকটী বলিল, “না, প্রকাশ্য স্থানই ভাল। আমরা বসিয়া কথাবার্তা কহিতেছি, ইহাতে আমাদের কে সন্দেহ করে?”
উমিচাঁদ কোন কথা কহিল না। তখন সেই ব্যক্তি বলিল, “এখন কাজের কথা হউক।”
“কি বলুন।”
“সেই টাকাগুলি আমি চাই।”
“কো–ন্—টা—কা?”
“তুমি বেশ জান। রঙ্গিয়া যে টাকা তোমাকে দিয়াছিল।”
“সে—সে—খুন হইয়াছে।”
“গোল করিয়ো না, তাহা হইলে তোমারও সেই অবস্থা হইবে—আমি টাকা চাই।”
“সে—সে—সে টাকা আমার কাছে নাই।
“চালাকী করিয়ো না। রঙ্গিয়া সে টাকা তোমায় দিয়াছিল—সে টাকা তোমার কাছে আছে—সে টাকা আমার চাই-ই।”
উমিচাঁদ সভয়ে চারিদিকে চাহিল; এবং এক মুহূর্ত্তে তাহার সর্ব্বাঙ্গ ঘৰ্ম্মাক্ত হইয়া উঠিল, এবং তাহার হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতে লাগিল। সে জড়িতকণ্ঠে বলিল, “সে টাকা—আমার কাছে- নাই।”
লোকটী দৃঢ়স্বরে কহিল, “আমার সঙ্গে বদমাইসী চলিবে না।”
এবার উমিচাঁদ সাহস করিয়া বলিল, “যদি না দিই?”
লোকটা বিকটস্বরে হাসিল। বলিল, “তাহা হইলে তুমিই খুন করিয়াছ বলিয়া সকলকে প্ৰকাশ করিয়া দিব।”
উমিচাঁদ এই কথায় কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইল। পরে বলিয়া উঠিল, “আমি খুন করিয়াছি? আমি স্বচক্ষে তোমার ছুরিতে রঙ্গিয়াকে খুন হইতে দেখিয়াছি। তুমি আমার সর্ব্বনাশ করিয়াছ।”
লোকটী পুনরপি বিকট হাসি হাসিয়া বলিল, “আমি সে কথা অস্বীকার করিতে চাহি না—প্রয়োজন হয়, আরও দুই-চারিটা করিব। যদিও আমি খুনী, তুমি আমার কি করিবে? তুমি আমাকে চেন না—জান না আমি কে; পরেও কখন জানিতে পারিবে না। ভাল চাও যদি, টাকা দাও, তা না হলে তোমাকেও খুন করিব। আমি সহজ লোক নই।”
এই সমযে ঝোপের মধ্যে শব্দ হইল। লোকটা চমকিত হইয়া বিদ্যুদ্বেগে উঠিয়া দাঁড়াইল। দেখিল, চারিজন লোক লম্ফ দিয়া নিকটস্থ হইল। উমিচাঁদ তাহাকে ধরিতে যাইতেছিল, সে তাহাকে ধাক্কা মারিয়া দূরে নিক্ষেপ করিল; কিন্তু নিজে পলাইতে পারিল না। সে পকেট হইতে ছুরি বাহির করিতেছিল। এদিকে অক্ষয়কুমার সদলে গিয়া তাহাকে আক্রমণ করিলেন। বহু আয়াসে শেষে তাহাকে বাঁধিয়া ফেলিলেন। তখন অক্ষয়কুমার বলিলেন, “নগেন্দ্রবাবু, লণ্ঠনটা খুলুন দেখি। দেখি, এ মহাপ্রভু কে?”
নগেন্দ্রনাথের কাছে পুলিস-লণ্ঠন ছিল; তিনি উহার চাকা ঘুরাইয়া লন্ঠনের আলোকে লোকটার মুখ দেখিয়া বলিলেন, “চিনি না।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এখনই চিনিবেন। না হয়ত আমার নাম অক্ষয়ই নয়।” বলিয়া তিনি সেই ব্যক্তির দাড়ি ধরিয়া সজোরে টান দিলেন। অক্ষয়কুমারের হাতে দাড়ি খুলিয়া আসিল, নগেন্দ্রনাথের লণ্ঠনের আলো তাহার মুখের উপর নিক্ষিপ্ত হইল, তখন সকলেই সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “কি সৰ্ব্বনাশ—এ কে!
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
তখন সেই ব্যক্তি বলিল, “যখন নিজ মূর্খতায় ধরা পড়িয়াছি, তখন পলাইব না; আমাকে উঠিয়া বসিতে দাও।”
দুইজন মহা বলবান্ কনষ্টেবল তাহার বুকের উপরে বসিয়াছিল। অক্ষয়কুমার স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইয়াছিলেন। নগেন্দ্রনাথ জীবনে এরূপ বিস্মিত আর কখনও হন নাই। তাঁহারা যাহাকে এক মুহূর্ত্তের জন্যও সন্দেহ করেন নাই, সেই ব্যক্তি এই ভয়াবহ দুই খুন করিয়াছে। নগেন্দ্রনাথের কন্ঠোরোধ হইয়া গিয়াছিল।
অক্ষয়কুমারের অবস্থাও প্রায় তদ্রূপ। তবে পুলিসের লোক, শীঘ্রই আত্মসংযম করিলেন। কিয়ৎক্ষণ এক দৃষ্টে লোকটার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, মহাশয়ের বিশেষ বাহাদুরী আছে, একথা এই অক্ষয়চন্দ্র দু’ হাজারবার স্বীকার করে।”
লোকটি বলিল, “টাকার লোভেই আমার এ দশা হইল, টাকার অভাবে পড়িয়াই এ কাজ করিয়াছিলাম—টাকার লোভে পড়িয়াই ধরা পড়িলাম; নতুবা আমাকে তোমরা কিছুতেই ধরিতে পারিতে না।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “কতকটা স্বীকার করি।”
ব্যাপার দেখিয়া নগেন্দ্রনাথের এতক্ষণ কথা সরে নাই। তিনি বলিলেন, “যমুনাদাস, তোমার এই কাজ!”
যমুনাদাস কেবলমাত্র বিকট হাস্য করিল। ঘৃণায় দুঃখে ক্রোধে নগেন্দ্রনাথ মুখ অন্যদিকে ফিরাইলেন। অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “এতদিনে আমি হার মানিলাম। সত্য কথা বলিতে কি, আমি কখনও তোমাকে সন্দেহ করি নাই।”
যমুনাদাস কোন কথা কহিল না; আবার সেইরূপ বিকট হাস্য করিল।
নগেন্দ্রনাথ আর ক্রোধ সম্বরণ করিতে পারিলেন না। বলিলেন, “নারকী, তোমার লজ্জা হইতেছে না, তুমি আবার হাসিতেছ।”
নগেন্দ্রনাথের রাগ দেখিয়া অক্ষয়কুমার হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “বন্ধুর এ দশা দেখিয়া রাগ করিয়া কি লাভ?”
নগেন্দ্রনাথ ক্রোধে অস্থির হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বন্ধু? ও কোনকালে আমার বন্ধু নয়—একসময়ে ছেলেবেলায় একসঙ্গে পড়িয়াছিলাম, এইমাত্র।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “যাহাই হউক, বন্ধুবর যমুনাদাস! আপনার যদি আমাদের কাছে আপন কাহিনী বলিতে আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে বলিলে বিশেষ বাধিত হইব। তবে ইহাও আপনাকে আমার পূর্ব্বেই বলা কর্ত্তব্য যে, আপনি আমার সম্মুখে এখন যাহা বলিবেন, তাহা আপনার বিরুদ্ধে যাইবে; সুতরাং বলা-না-বলা সে আপনার অভিরুচি।”
যমুনাদাস কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া বলিল, “আমি খুন করিয়াছি, কে বলিল? ভদ্রলোকের উপর এইরূপ অত্যাচার করিলে কি হয়, তাহা শীঘ্রই দেখিতে পাইবে।”
নগেন্দ্রনাথ গৰ্জ্জন করিয়া বলিলেন, “আবার মিথ্যাকথা! “
অক্ষয়কুমার তাঁহাকে নিরস্ত হইতে বলিয়া উমিচাঁদকে ধীরে ধীরে বলিলেন, “মহাশয়, একটু পূর্ব্বে আমাদের এই পাঁচ মূর্ত্তির সম্মুখে খুন স্বীকার করিয়াছেন।”
যমুনাদাস ক্রুদ্ধস্বরে বলিল, “আমি কিছুই স্বীকার করি নাই—মিথ্যা কথা। তোমরা ঘুস্ পাইবার আশায় আমার উপর এই অত্যাচার করিতেছ, ইহার প্রতিফল পাইবে।”
ক্রোধে নগেন্দ্রনাথের মুখ দিয়া বাক্যস্ফুরণ হইল না। অক্ষয়কুমার মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “তবে থানায় চলুন, দিন কত এখন মহারাণীর রাজপ্রাসাদে বাস করুন; পরে ভবিতব্য কে খণ্ডায় আপনাদের মত মহাত্মাগণের জন্যই ফাঁসী-কাষ্ঠের সৃষ্টি হইয়াছে। তবে বোধহয়, আপনার ন্যায় আর একটীও এ পর্য্যন্ত ফাঁসী যায় নাই। রাম সিং, বাবুকে বালা পরাইয়া লইয়া চল।”
রাম সিং হুকুম পাইবামাত্র যমুনাদাসের হাতে হাতকড়ী লাগাইয়া দিল। এবং দুই-একটা মধুরতর সম্পর্ক পাতাইয়া, দুই-একটা ধাক্কা দিয়া তাহাকে টানিয়া তুলিল। রাম সিং ও আর একজন পুলিস কর্ম্মচারী চাদর দিয়া যমুনাদাসের দুই বাহু বন্ধন করিয়া লইয়া চলিল। যমুনাদাস কোন কথা কহিল না।
কিয়দ্দূর আসিয়া অক্ষয়কুমার যমুনাদাসের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “যমুনাদাসবাবু, পূর্ব্বে আর কয়টা এরূপ সরাইয়াছেন?”
যমুনাদাস কোন উত্তর না দিয়া তাহার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার চাহিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইল। অক্ষয়কুমার বলিলেন, “বাপু, জেলে দু-চারবার না গেলে অমন চোখের কায়দা হয় না। মহাশয়ের কয়বার জেলের প্রতি অনুগ্রহ করা হইয়াছে? না বলেন, উত্তম। সে কার্য্য আমরা সহজেই করিতে পারিব। এটায় একটু কষ্ট দিয়াছেন, স্বীকার করি।”
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
যমুনাদাস বিচারকালে যেসকল ঘটনা প্রকাশ পাইয়াছিল, তাহাই এক্ষণে আমরা বলিব। যমুনাদাসের পিতা একজন ধনী বণিক ছিলেন। যখন যমুনাদাসের বয়স পঁচিশ বৎসর, সেই সময়ে তাহার পিতার মৃত্যু হয়। তখন হইতে যমুনাদাস কুসঙ্গে মিলিত হয়। এবং এক বৎসরের মধ্যে তাহার পিতার সমস্ত সম্পত্তি উড়াইয়া দেয়। তখন নানা জাল জুয়াচুরি করিয়া শেষে এদেশ ছাড়িয়া পলাইয়া যায়। সেই পর্য্যন্ত আর পাঁচ-ছয় বৎসর সে এদেশে আসে নাই। কেহ তাহার সংবাদ বলিতে পারিত না। নানা স্থানে নানা নাম লইয়া নানা জুয়াচুরি করিয়া বাবুগিরি চালাইত।
এইরূপে জুয়াচুরির জন্য আগ্রায় তাহার তিন মাস জেল হয়। জেল হইতে বাহির হইয়া আসিয়া সে আরও ভয়ানক হইয়া উঠিল; কিন্তু আবার ধরা পড়িল। সেইবার তাহার এক বৎসর জেল হইল। কিন্তু ইহাতেও তাহার শিক্ষা হইল না। কিছুদিন পরে সে আবার তিন বৎসরের জন্য জেলে প্রেরিত হইল।
জেল হইতে বাহির হইয়া সে লাহোরে যায়। সেখানেই সেই জুয়াচুরি। এই সময়ে লাহোরে তাহার সহিত গঙ্গার আলাপ হয়—সমানে সমানে মিলিল। গঙ্গার সহিত তাহার অবৈধ প্রণয় জন্মিল, বিবাহের কথাও হইল।
গঙ্গার মা-বাপ ছিল না। হুজুরীমলের শ্বশুর তাহাকে আশ্রয় দিয়াছিলেন। তাহার স্বভাব যে কিরূপ তাহা তিনি জানিতেন না।
যমুনাদাস পঞ্জাবে থাকিতে সিঁদুরমাখা শিবলিঙ্গের সম্প্রদায়ের কথা জানিতে পারে; দিন কয়েকের জন্য তাহাদের দলে মিশিয়া পড়ে; তাহাদের ঠকাইয়াও অনেক টাকা লইয়াছিল। এই সম্প্রদায়ের লোক যে খুন করে, এ সর্বৈব মিথ্যা—তাহারা একরূপ তান্ত্রিক প্রক্রিয়া গোপনে করিত এই মাত্র। এই সম্প্রদায়ে প্রবেশ করিয়াই এ কয়েকটা শিবলিঙ্গ সংগ্রহ করে। লোককে ভয় দেখাইয়া টাকা আদায়ের সুবিধা হয় দেখিয়া যমুনাদাসই প্রকাশ করিয়া দেয় যে, এই সম্প্রদায় যাহার উপর ক্রুদ্ধ হয়, তাহাকে গোপনে খুন করে। সে নানা কৌশলে অনেকের মনে বিশ্বাও জন্মাইয়া ছিল; পরে সিঁদুরমাখা শিবের ভয় দেখাইয়া অনেকের নিকটেই টাকা আদায় করিয়াছিল।
এইরূপ নানা জুয়াচুরি করিয়া সে চালাইতেছিল। যখন গঙ্গা হুজুরীমলের স্ত্রীর নিকট যমুনার সঙ্গে আসিল, তখন যমুনাদাসও কলিকাতায় আসিল। পাঁচ-সাত বৎসর সে এদেশে ছিল না, সুতরাং সকলেই তাহাকে একরকম ভুলিয়া গিয়াছিল। তাহার আর কোন ভয় করিবার কারণ ছিল না। এখানে আসিয়াও সে নিজের ব্যবসা ভুলিল না। গঙ্গার সাহায্যে বৃদ্ধ হুজুরীমলকে ভুলাইয়া তাহার নিকট হইতে মধ্যে মধ্যে টাকা সংগ্রহ করিত। গঙ্গা ললিতাপ্রসাদের মাথা খাইয়াও তাহার সর্ব্বনাশ করিতেছিল। তাহার নিকটেও অনেক টাকা আদায় করিতেছিল। এইরূপে উভয়ে খুব জোরে ব্যবসা চালাইতেছিল।।
এইরূপ সময়ে হুজুরীমল সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়া কি করিবে, তাহাই ভাবিতেছিল। হঠাৎ গুরুগোবিন্দ সিং আসিয়া তাহার নিকটে দশ হাজার টাকা জমা রাখিল। বৃদ্ধ লম্পট জুয়াড়ী লোভ সম্বরণ করিতে পারিল না। সেই টাকা লইয়া এদেশ হইতে পলাইবার ইচ্ছা করিল।
কিন্তু সে প্রাণ ধরিয়া গঙ্গাকে ছাড়িয়া যাইতে পারে না, সে গঙ্গাকে এ প্রস্তাব করিল। দশ হাজার টাকা দিলে গঙ্গা তাহার সহিত পলাইতে স্বীকার করিল। বলা বাহুল্য যে, পূর্ব্বে এবিষয়ে সে যমুনাদাসের সহিত পরামর্শ করিয়াছিল।
তখন হুজুরীমল টাকা হস্তগত করিবার চেষ্টায় রহিল। সে সুকৌশলে ললিতাপ্রসাদকে দিয়া নোটগুলি বদ্লাইল। তৎপরে শিব-সম্প্রদায়ের সর্ব্বপ্রকার মিথ্যা গল্প বলিয়া সরলচিত্ত যমুনাকে ভুলাইয়া তাহারই দ্বারা সিন্দুক হইতে নোট সরাইল। এদিকে সব স্থির—রেল টিকিট পর্যন্ত কেনা হইল, গঙ্গাও তাহার সহিত যাইতে সম্মত হইয়াছে, মূর্খ বৃদ্ধ হুজুরীমল বিন্দুমাত্রও বুঝিতে পারিল না যে, গঙ্গা কেবল তাহাকে ভুলাইয়া দশ হাজার টাকা হস্তগত করিবার চেষ্টায় আছে।
এই সময়ে এক মহা বিঘ্ন ঘটিল। গঙ্গা কোন কাজে কখনও ভয় করে নাই। আজ হুজুরীমলের সঙ্গে রাত্রে রাণীর গলিতে দেখা করিতে তাহার ভয় হইল। সে যাইতে অসম্মত হইল। যমুনাদাস বিপদে পড়িল।
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ
যমুনাদাস গঙ্গার সহিত গোপনে দেখা করিত। সে হুজুরীমলের সকল কথাই তাহাকে বলিয়া দিল। যমুনা গঙ্গাকে বড় বিশ্বাস করিত; তাহার নিকটে সে কোন কথা গোপন করিত না। যমুনা যে সিন্দুক হইতে টাকা আনিয়া হুজুরীমলকে দিয়াছিল, তাহাও যমুনার মুখে গঙ্গা শুনিয়াছিল। সুতরাং এমন সুবিধা আর হয় না। দশ হাজার টাকা অনায়াসেই পাওয়া যাইতে পারে। হুজুরীমলের নিকট হইতে এ টাকা ফাকী দিয়া লইলে কেহই তাহাদিগকে সন্দেহ করিতে পারিবে না।
সেইরূপই বন্দোবস্ত হইয়াছিল। গঙ্গা হুজুরীমলের সঙ্গে যাইবে বলিয়া স্বীকার করিয়াছে। রাত্রি বারটার সময়ে গঙ্গা তাহার সহিত রাণীর গলিতে গোপনে দেখা করিবে। যমুনাদাস ছদ্মবেশে নিকটে লুকাইয়া থাকিবে। হুজুরীমল তাহার হাতে টাকা দিবামাত্র যমুনাদাস হঠাৎ তাহার হাত হইতে টাকা কাড়িয়া লইবা পলাইবে। হুজুরীমল লোকলজ্জার ভয়ে, আর নিজে এইরূপভাবে ধরা পড়িবার ভয়ে কোন গোলযোগ করিতে পারিবে না। সে গঙ্গাকেও সন্দেহ করিতে পারিবে না। ভাবিবে বড়বাজারের কোন গুণ্ডা টাকা ছিনাইয়া লইয়া গিয়াছে।
সকলই এইরূপ স্থির হইয়াছিল, কিন্তু যে গঙ্গা গভীর রাত্রে গোপনে নানা স্থানে যাইত, সে আজ ভয় পাইল কেন, সে জানে না—একেবারে যাইতে তাহার সাহস হইল না। যমুনাদাস গোপনে তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলে তাহাকে গঙ্গা বলিল, “ভাই, আমার কেমন ভয় করিতেছে, আমি যাইতে পারিব না।”
গঙ্গা উপহাস করিতেছে ভাবিয়া যমুনাদাস হাসিয়া বলিল, “দশ হাজার টাকায় অনেকদিন বেশ চলিবে—কেমন গঙ্গা?”
গঙ্গা বলিল, “ঠাট্টা নয়—যথার্থই আমি যাব না; আমার কেমন ভয় করিতেছে।”
“সে কি! তোমার ভয়?”
“হাঁ, আমি যাইতে পারিব না।”
“সে কি কাজের কথা! এমন সুযোগ আর হইবে না। দশ হাজার টাকা—সহজে মিলে না।”
“না, তুমি যতই বল না কেন, আমি যাইব না।”
“সে কি! তবে উপায়! ইচ্ছা করিয়া হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলিবে; দশ হাজার টাকা আর কি’ মিলিবে?”
“ভয় নাই, আমি একটা মতলব স্থির করিয়াছি।”
“কি, শীঘ্র বল। তুমি যে আমাকে একেবারে হতাশ করিয়া দিয়াছ।”
“আমি স্থির করিয়াছি, আমার কাপড় পরাইয়া গঙ্গিয়াকে পাঠাইব। অন্ধকারে হুজুরীমল তাহাকে চিনিতে পারিবে না। আমাকে ভাবিয়া তাহার হাতে টাকা দিবে।”
“রঙ্গিয়া রাজি হইবে?”
“হাঁ, সে আমার কথা খুব শুনে—তাহাকে সব বলিয়াছি।”
“অন্য লোককে এসব কথা বলা কি ভাল হইয়াছে?”
“টাকায় অনেকের মুখ বন্ধ হয়। আমি তাহাকে পাঁচ শত টাকা দিব বলিয়াছি। দশ হাজার টাকা পাইলে পাঁচ শত দিতে আপত্তি কি? টাকা ঠিক পাওয়া যাইবে। অন্ধকারে আমার কাপড়-পরা রঙ্গি য়াকে দেখিয়া হুজুরীমল ভাবিবে আমিই গিয়াছি, কোন সন্দেহ করিবে না। টাকা তাহার হাতে দিবে। এখন তোমার কাজ তুমি কর।”
“আমি টাকা ছিনাইয়া লইয়া পলাইলে তখন ত হুজুরীমল তাহাকে চিনিতে পারিবে?”
“ক্ষতি কি, আমি তাহাকে পরে ঠিক করিয়া লইতে পারিব।”
নর-রাক্ষস যমুনাদাস হাসিয়া বলিল, “এ টাকা গেলে তাহাকে আর এদেশে আসিতে হইবে না। সে হয় দেশ ছাড়িয়া পলাইবে—নতুবা আত্মহত্যা করিবে।”
গঙ্গা হাসিয়া বলিল, “তাহাতে আমাদের ক্ষতি কি, বরং বুড়ো বাইসের উপযুক্ত সাজা হইবে।”রঙ্গিয়া যাইতে রাজি হইয়াছে ত?”
“বলিলাম কি? পাঁচশো টাকা—কম নয়। ওর মত একটা গরীবের পাঁচশো টাকার লোভ সাম্লান সহজ নয়।”
“তবে সব ঠিক?”
“সব ঠিক।”
“তুমি একখানি রত্ন, তোমায় না পাইলে আমার কি দশা হইত?”
“আবার জেলে বাস করিতে।”
যমুনাদাস ভ্রূকুটি করিল। হৃদয়ের ভাব গোপন করিয়া হাসিয়া বলিল, “তোমার মত রত্নলাভ অনেক পুণ্যের ফল।”
গঙ্গা কোন কথা না কহিয়া মুখ ফিরাইল। উভয়ে উভয়কে হৃদয়ের সহিত ঘৃণা করিত; কেবল উভয়ে উভয়ের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভালবাসার ভাণ দেখাইত মাত্ৰ।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
রাত্রি আটটার সময়ে যমুনাদাস আসিয়া রঙ্গিয়াকে সঙ্গে লইয়া কলিকাতায় আসিল। তাহারা ভাবিয়াছিল যে, রঙ্গিয়া পাঁচ শত টাকার লোভে গঙ্গার হইয়া হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করিতে যাইতেছে। তাহারা উমিচাদের ব্যাপার কিছুই জানিত না।
রঙ্গিয়া একাকিনী যাইবে মনে ভাবিয়াছিল; কিন্তু যমুনাদাস রঙ্গিয়াকে বিশ্বাস করিত না। রঙ্গিয়াকে বিশ্বাস করিবে কিরূপে? সে রঙ্গিয়াকে চোখের আড়াল হইতে দিল না।
রঙ্গিয়া বিপদে পড়িল। সে কিরূপে তাহাকে ফাঁকী দিবে তাহার হাত এড়াইয়া টাকা উমিচাঁদকে দিবে, তাহাই ভাবিতে লাগিল; মনে মনে একটা উপায়ও স্থির করিয়া ফেলিল।
এদিকে যমুনাদাস কলিকাতায় আসিয়া রঙ্গিয়াকে একটা বাড়ীতে লইয়া গেল। তথায় তাহাকে বলিল, “রঙ্গিয়া! হুজুরীমল ভাল লোক নয়—তাহার কাছে গেলে তোমার বিপদের সম্ভাবনা আছে। যদি সে কোনরূপে জানিতে পারে যে, গঙ্গা আসে নাই, অন্যকে পাঠাইয়াছে, তখন সে যে কি করিবে, তাহার ঠিকানা নাই। তোমাকে অনর্থক এত বিপদে ফেলিতে আমার ইচ্ছা নাই, তাই একটা মতলব স্থির করিয়াছি।”
রঙ্গিয়ার ভয় হইয়াছিল। সে যমুনাদাসকে ভালরূপেই জানিত—তাহার সহিত একাকী এই নির্জন বাটীতে আসিতেই তাহার ভয় হইয়াছিল; কিন্তু সে তাহার হাতে আসিয়া পড়িয়াছে। কি করে—কোন কথা কহিবার উপায় নাই। সে বুঝিয়াছিল যে, যমুনাদাস তাহাকে সন্দেহ করিয়াছে, সুতরাং এখন ইতস্ততঃ করিলে তাহার সন্দেহ আরও বাড়িবে। যমুনাদাসকে বিশ্বাস নাই—সে তাহাকে অনায়াসে খুন করিতেও পারে। সে কেবলমাত্র বলিল, “বলুন, কি করিতে হইবে।”
যমুনাদাস বলিল, “আমি মনে করিয়াছি, আমি গঙ্গার কাপড় পরিয়া মেয়ে মানুষ সাজিয়া যাইব—তোমাকে পুরুষ বেশে লইয়া যাইব।”
এই বলিয়া যমুনাদাস এক লম্বা কাল দাড়ি বাহির করিল। বলিল, “সাবধানে মার নাই; যদি কোন গোলযোগ হয়, তাহা হইলে পুলিসেও আমাদের ধরিতে পারিবে না—তুমি এই দাড়ি পরিয়া পুরুষ সাজিলে আর কেহ তোমাকে সন্দেহ করিতে পারিবে না। আমিও মেয়ে মানুষ সাজিলে পরে আমার উপরও কাহারও সন্দেহ হইবে না।”
রঙ্গিয়া যদিও এইসকল কিছুই পছন্দ করিতেছিল না; কিন্তু কি করে, উপায় নাই, সে অসম্মত হইলে যমুনাদাস তাহার উপর অত্যাচার করিবে—যমুনাদাস না পারে, এমন কাজ নাই।
সে ধীরে ধীরে বলিল, “আপনি যাহা বলিবেন, তাহাই করিব।”
যমুনাদাস হাসিয়া বলিল, “বেশ, ভাল কথা, একেই বলে লক্ষ্মী মেয়ে। প্রথমে তোমায় সাজাইয়া দিই।”
যমুনাদাস রঙ্গিয়াকে পুরুষবেশে সাজাইতে আরম্ভ করিল। তৎপরে তাহার মুখে সেই লম্বা কাল দাড়ি লাগাইয়া দিল। সে বেশে কাহারই সাধ্য ছিল না যে, রঙ্গিয়াকে চিনে?
তাহাকে সাজান শেষ হইতে যমুনাদাস গঙ্গার কাপড় পরিয়া স্ত্রীবেশ ধারণ করিল। তাহার গোঁফদাড়ি ছিল না, ছদ্মবেশেও যমুনাদাস সিদ্ধহস্ত ছিল—কয়েক মুহূর্ত্তের মধ্যেই একটী যুবতী স্ত্রীলোকে পরিণত হইল।
তখন যমুনাদাস বলিল, “তুমি অন্ধকারে লুকাইয়া থাকিয়ো, আমি হুজুরীমলের সম্মুখে যাইব। সে আমাকে টাকা দিলে তোমায় আমি দিব। তুমি টাকা লইয়া সরিয়া গিয়া অন্ধকারে লুকাইয়ো।”
ঠিক বারটার সময়ে পুরুষ-বেশে রঙ্গিয়া ও স্ত্রী-বেশে যমুনাদাস রাণীর গলিতে প্রবিষ্ট হইল। রঙ্গিয়াকে একটা পার্শ্ববর্ত্তী পোড়োবাড়ীর অন্ধকারে লুকাইয়া রাখিয়া, যমুনাদাস একটু অগ্রবৰ্ত্তী হইয়া হুজুরীমলের অপেক্ষা করিতে লাগিল।
তাহাদের অধিকক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইল না। দশ মিনিট যাইতে-না-যাইতে দরওয়ানবেশে হুজুরীমল তথায় উপস্থিত হইল। এই গলির মধ্যে সরকারী আলো ছিল—তাহাও অতি দূরে দূরে; কাজেই গলির ভিতর খুব অন্ধকার।
হুজুরীমল সভয়ে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে অগ্রসর হইতেছিল। যমুনাদাস প্রকাণ্ড অবগুন্ঠন টানিয়া অন্ধকারে দাঁড়াইয়াছিল। হুজুরীমল নিকটস্থ হইলে সে অগ্রসর হইল। সহসা অন্ধকারে তাহাকে দেখিয়া হুজুরীমল চকিতভাবে দাঁড়াইল। তৎপরে মৃদুস্বরে বলিল, “গঙ্গা, আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি আসিবে না।”
যমুনাদাস মাথা নাড়িয়া হাত বাড়াইল। হুজুরীমল তাহার আরও নিকটস্থ হইল। প্রেমভরে বলিল, “এতদিনে বুঝিলাম, তুমি যথার্থই আমাকে ভালবাস। আমি দুখানা টিকিট কিনিয়াছি, চল আর এখানে দেরী করিবার আবশ্যক নাই—এ জায়গা ভাল নয়।”
যমুনাদাস কথা না কহিয়া আবার হাত বাড়াইল। এবার হুজুরীমলের সন্দেহ হইল, তৎপরে কয়েকপদ সরিয়া দাঁড়াইল। কিয়ৎক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, “তুমি আমার সঙ্গে কথা কহিতেছ না কেন? এখানে কেহ নাই, কিসের ভয়?”
হুজুরীমল সহসা যমুনাদাসের নিকটস্থ হইল। যমুনাদাস সরিয়া দাঁড়াইবার অবসর পাইল না। তাড়াতাড়ি হুজুরীমল তাহার অবগুন্ঠন সরাইয়া দিল; তাহার বিস্ময় চরমসীমায় উঠিল। চকিতভাবে হুজুরীমল বলিল, “একি! তুমি কে?”
যমুনাদাস দেখিল যে, আর লুকাইবার উপায় নাই, হুজুরীমল তাহাকে চিনিয়া ফেলিয়াছে। পাছে সে চীৎকার করিয়া উঠে, এই ভয়ে সে তাড়াতাড়ি হুজুরীমলের গলা টিপিয়া ধরিল। পরক্ষণে উভয়েই ভূতলশায়ী হইল।
হুজুরীমল বৃদ্ধ হইলেও তাহার দেহ বেশ সবল ছিল। বৃদ্ধ প্রাণপণে আত্মরক্ষা করিতে লাগিল। যমুনাদাস দক্ষিণহস্তে হুজুরীমলের কন্ঠদেশ চাপিয়া ধরিয়া বাম হস্তে তাহার বুক-পকেট হইতে টাকা ছিনিয়া লইতে চেষ্টা পাইতে লাগিল। প্রায় পাঁচ মিনিট নিঃশব্দে উভয়ে মাটীতে পড়িয়া লুণ্ঠিত হইতে লাগিল। অবশেষে সহসা যমুনাদাস গলা ছাড়িয়া দিয়া নিমেষ মধ্যে বস্ত্ৰ মধ্য হইতে একখানা সুদীর্ঘ ছোরা বাহির করিয়া হুজুরীমলের বুকে আমূল বসাইয়া দিল। হুজুরীমলের কন্ঠ হইতে এক অব্যক্ত শব্দ নির্গত হইল, সে গড়াইয়া পড়িল। তাহার পকেট হইতে নোটের তাড়া লইয়া নিজ বস্ত্রে বাঁধিয়া যমুনাদাস উঠিয়া দাঁড়াইল। হুজুরীমল দৃঢ়রূপে যমুনাদাসের পরিহিত রঙ্গিন শাড়ীর একটা কোণ চাপিয়া ধরিয়াছিল, যমুনাদাস উঠিয়া জোর করিয়া কাপড়খানা টানিতে খানিকটা ছিঁড়িয়া হুজুরীমলের মুষ্টিমধ্যে রহিয়া গেল।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
দূর হইতে রঙ্গিয়া সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখিল। তাহার কণ্ঠরোধ হইল, এবং সে ভয়ে অত্যন্ত কাঁপিতে লাগিল। মুহূৰ্ত্ত মধ্যে যমুনাদাস তাহার নিকটে আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “আয়।” রঙ্গিয়া দেখিল, অন্ধকারে তাহার চক্ষু নক্ষত্রের ন্যায় জ্বলিতেছে, তাহার হস্ত রক্তে রঞ্জিত, সে অর্দ্ধস্ফুটস্বরে বলিল, “কি করিলে?”
রুষ্ট হইয়া গৰ্জ্জিয়া যমুনাদাস বলিল, “আয়।”
তবুও রঙ্গিয়া সেখান হইতে নড়ে না দেখিয়া যমুনাদাস তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিল। এক স্থানে একখানা ভাড়াটিয়া গাড়ী দাঁড়াইয়াছিল। উভয়ে সেই গাড়ীতে আসিয়া উঠে কোচম্যানকে হাওড়া ষ্টেশনে যাইতে বলিল। গাড়ী চলিল।
তখন যমুনাদাস রঙ্গিয়ার দাড়ি খুলিয়া লইয়া নিজে পরিল। রঙ্গিয়াকে পরিহিত কোণ-ছেঁড়া শাড়ীখানা ছাড়িয়া দিল। বলিল, “পর।” রঙ্গিয়া নীরবে পরিল। ভয়ে রঙ্গিয়ার প্রাণ উড়িয়া গিয়াছিল; সে ভয়ে একটা কথাও মুখ ফুটিয়া বলিতে সাহস করিল না।
যমুনাদাস রঙ্গিয়ার কানের কাছে মুখ লইয়া শাসাইল, কহিল, “যদি একথা কাহারও নিকট প্রকাশ কর, তবে তোমারও দশা হুজুরীমলের মত করিব।”
এই বলিয়া যমুনাদাস সেই রক্তাক্ত ছোরা তাহার বুকের নিকট ধরিল। রঙ্গিয়া ভয়ে চক্ষু মুদিত করিল—তাহার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইল।
হাওড়ায় আসিয়া যমুনাদাস কোচম্যানকে ভাড়া চুকাইয়া দিয়া রঙ্গিয়াকে বলিল, “যা, এখনই চন্দননগরে চলে যা। গঙ্গা জিজ্ঞাসা করিলে বলিস্, হুজুরীমল আসে নাই। অন্য কথা সব আমি নিজে গিয়া বলিব।”
এই বলিয়া যমুনাদাস মুহূৰ্ত্ত মধ্যে তথা হইতে অন্তর্হিত হইল।
রঙ্গিয়া মুহূর্তের জন্য কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ়া হইয়া দাঁড়াইল। যমুনাদাস চলিয়া যাওয়ায় তাহার হৃদয়ে সাহস দেখা দিল। অঞ্চল ভারী বোধ হওয়াতে হাত দিয়া দেখিল, তাহাতে কি বাঁধা আছে। সে খুলিয়া দেখিল, এক তাড়া নোট। সে তখনই বুঝিল, কাপড় বদলাইবার সময়ে যমুনাদাস তাড়াতাড়িতে নোট ভুলিয়া রাখিয়া গিয়াছে।
সে তীরবেগে কলিকাতার দিকে ছুটিল। সৌভাগ্যের বিষয় তখন পথে লোক ছিল না, নতুবা তাহাকে পাগল বলিয়া ধরিত। গঙ্গার ধারে উমিচাঁদ তাহার জন্য অপেক্ষা করিবে, এইরূপ কথা ছিল। সে হিতাহিত জ্ঞানশূন্যা হইয়া সেইদিকে চলিল।
তাহাকে ছুটিয়া আসিতে দেখিয়া উমিচাঁদ সত্বর পদে তাহার দিকে অগ্রসর হইল। সে তাহার হাতে নোটের তাড়া দিয়া বলিল, “সর্বনাশ হয়েছে—হুজুরীমল খুন! “
সহসা কে আসিয়া রঙ্গিয়াকে আক্রমণ করিল। রঙ্গিয়া পড়িয়া গেল—লোকটাও সেই সঙ্গে সঙ্গে পড়িয়া গেল। উমিচাঁদ দেখিল, এক শাণিত ছোরা শূন্যে উত্থিত হইল। সে আর কিছু দেখিল না- দেখিতে সাহস হইল না, প্রাণভয়ে ছুটিয়া মূহূৰ্ত্ত মধ্যে বহির্ভূত হইয়া গেল।
যমুনাদাস কিছুদূর গিয়াই নিজের ভ্রম বুঝিতে পারিল, সে নোটের তাড়া কাপড়ে বাঁধিয়াছিল। কাপড় যখন রঙ্গিয়াকে পরিবার জন্য দিয়াছিল, তখন তাড়াতাড়িতে সে নোট খুলিয়া লইতে ভুলিয়া গিয়াছিল। রঙ্গিয়াকে ষ্টেশন ছাড়িয়া আসিবামাত্র নোটের কথা মনে পড়িল। তখন সে উন্মত্তের ন্যায় রঙ্গি যার অনুসন্ধানে ছুটিল। যেখানে সে রঙ্গিয়াকে ছাড়িয়া আসিয়াছিল, সেখানে আসিয়া দেখিল, রঙ্গিয়া নাই। সে তাহার জন্য চারিদিকে পাগলের ন্যায় ছুটিল।
সহসা সে দেখিল, রঙ্গিয়া দূরে ছুটিয়া যাইতেছে—দেখিয়াই ছুটিল। রঙ্গিয়া উমিচাদের সহিত দেখা করিতে-না-করিতে যমুনাদাস আসিয়া তাহার উপর পড়িল।
যমুনাদাস এখন উন্মত্ত—হিতাহিত বিবেচনাশূন্য। সে উমিচাঁদকে দেখিয়া ভাবিল, রঙ্গিয়া তাহা হইলে এই লোকটাকে হুজুরীমলের খুনের কথাই বলিতেছে—সে রঙ্গিয়ার পৃষ্ঠে আমূল ছোরা বসাইল। ছোরা বক্ষঃস্থল ভেদ করিয়া বাহির হইয়া পড়িল। উমিচাঁদ একবার অব্যক্ত চীৎকার করিয়া সশঙ্কভাবে দশ হাত তফাতে হটিয়া গেল, এবং তখনই ছুটিয়া পলাইল। যমুনাদাস দ্রুত হস্তে রঙ্গি য়ার ভূলুণ্ঠিত দেহ অনুসন্ধান করিয়া নোট না পাইয়া উমিচাদের পশ্চাতে ছুটিতেছিল, কিন্তু কি ভাবিয়া দাঁড়াইল। রঙ্গিয়ার দেহ জলে ভাসাইয়া দিবার জন্য টানিয়া লইয়া চলিল। এমন সময়ে দূরে পদশব্দ শুনিয়া রঙ্গিয়াকে সেইখানে ফেলিয়া ছুটিয়া পলাইয়া গেল।
উমিচাদের সৌভাগ্য—যমুনাদাস তাহাকে চিনিতে পারে নাই। আরও সৌভাগ্য যে, সে তাহার অনুসরণ করিতে পারিল না।
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
পর দিবস প্রাতে যমুনাদাস বাড়ীর বাহির হইয়া, পুলিস এ সম্বন্ধে কি করিতেছে, তাহাই সন্ধান লইতে আরম্ভ করিল। জানিল যে, পুলিস যে লাস লইয়া গিয়াছে, এখন পৰ্য্যন্ত লাস সেনাক্ত হয় নাই। সে জানিত, কেহই তাহাকে সন্দেহ করিবে না। যে লোকটা রঙ্গিয়ার নিকট হইতে পলাইয়াছিল, সে তাহাকে দেখে নাই—দেখিলেও ভাল করিয়া দেখে নাই। বিশেষতঃ তাহাকে চিনিবার তাহার কোন সম্ভাবনা ছিল না। তাহার ছদ্মবেশ ছিল; বিশেষতঃ তাহার সেই লম্বা কালো দাড়ি। এক রাত্রে এক সময়ে দুইটা খুন করিয়া বোধহয়, যমুনাদাস ভিন্ন কেহ এরূপ নিশ্চিন্তভাবে বেড়াইতে পারিত না। তাহাকে দেখিলে কেহ বুঝিতে পারিত না যে, এই লোক এই ভয়াবহ কাণ্ড করিয়াছে।
গঙ্গাকে সকল কথা বলা যমুনাদাস নিতান্ত প্রয়োজন মনে করিল। সে জানিত, পুলিস দুই- একদিনের মধ্যেই কে খুন হইয়াছে, জানিতে পারিবে; তখন তাহারা হুজুরীমলের বাড়ী যাইবে —গঙ্গা, যমুনা প্রভৃতিকে জেরা করিবে। হুজুরীমলের স্ত্রী বা যমুনা কিছুই জানে না; রঙ্গিয়া যদিও জানিত, সে আর এ পৃথিবীতে নাই। একমাত্র গঙ্গা—তা যমুনাদাস তাহাকে বেশ জানিত যে, পুলিস সহজে তাহার নিকট হইতে কোন কথা বাহির করিতে পারিবে না; তবুও তাহাকে সাবধান করিয়া দেওয়া কৰ্ত্তব্য।
রঙ্গিয়া ও তাহার উভয়ের জন্যই গঙ্গা উদ্বিগ্ন থাকিবে, তাহার নিকটে এ ব্যাপার গোপন করা ঠিক নহে। কি জানি, যদি এ অবস্থায় সে নিজেকে সাম্লাইতে না পারিয়া কোন কথা পুলিসকে বলিয়া ফেলে? এই সকল ভাবিয়া যমুনাদাস চন্দননগরে গিয়া গোপনে গঙ্গাকে সকল কথা খুলিয়া বলিল। অন্য স্ত্রীলোক হইলে বোধহয়, ভয়েই অস্থির হইত; কিন্তু গঙ্গা পরম নিশ্চিন্ত মনে হাসিয়া বলিল, “শেষে বুড়োর এই দশা হইল?”
যমুনাদাসও গঙ্গার এই নিৰ্ম্মম ভাবে যেন কিছু লজ্জিত হইল। বলিল, “যথার্থই তাহাকে খুন করিবার ইচ্ছা ছিল না; সে আমাকে কিছুতেই ছাড়ে না—কি করি?”
গঙ্গা বলিল, “যাহা হইয়া গিয়াছে, তাহার উপায় নাই। রঙ্গিয়াকে ওরকম না করিলেই, ভাল ছিল।”
“সে সব কথা প্রকাশ করিয়া দিত। বোধহয়, যে লোকটার সঙ্গে সে কথা কহিতেছিল, তাহাকে বলিয়াছিল।”
“সে কে?”
“কেমন করিয়া জানিব? তাহাকে দেখিবার অবকাশ পাই নাই। নিশ্চয়ই রঙ্গিয়ার প্রেমাকাঙক্ষী। তাহার সঙ্গে সেই রাত্রে এইখানে দেখা করিবার নিশ্চয়ই কথা ছিল; নতুবা অত রাত্রে সে সেখানে থাকিবে কেন? আগে হইতে বন্দোবস্ত ছিল।”
“সে ত আমাকে কিছু বলে নাই।”
“আমরা ভাবিয়াছিলাম, সে পাঁচ শত টাকার লোভে এ কাজ করিতেছে তাহা নয়—সমস্ত টাকাই নিজে হাতাইবার চেষ্টায় ছিল, তাই সে সেই লোকটাকে গঙ্গার ধারে সেই সময়ে অপেক্ষা করিতে বলিয়াছিল, ভাবিয়াছিল, আমি তাহাকে দিয়া তোমার কাছে টাকা পাঠাইব। তখন আমি চলে গেলে সে ফিরিয়া আসিয়া সেই লোকটাকে টাকা দিবে।”
গঙ্গা হাসিয়া বলিল, “মোটের উপর তাহাই দাঁড়াইল, তোমার খুন করাই সার হইল।”
ক্রোধে যমুনাদাস উন্মত্তপ্রায় হইল; কিন্তু মনোভাব গোপন করিয়া বলিল, “যা হবার হইয়া গিয়াছে।”
“এখন ফাঁসী যাহাতে না যাও, তাহারই চেষ্টায় থাক।”
“এখন তুমি অনুগ্রহ করিয়া না প্রকাশ করিলে, আমাকে কেহই সন্দেহ করিতে পারিবে না।”
“আমার দ্বারা প্রকাশ হইবে না, নিশ্চিন্ত থাক।”
“তাহা আমি জানি।”
যমুনাদাস হুজুরীমলের বাড়ী প্রবেশ করিয়া দেখিয়াছিল যে, নগেন্দ্ৰনাথ বসিয়া আছেন। তাহার পর যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি।
নগেন্দ্রনাথ নিকটে খুন সম্বন্ধে পুলিস কি করিতেছে, জানিয়া একটা ফন্দী যমুনাদাসের মাথায় আসিয়া জুটিয়াছিল। ইহাদের সঙ্গে মিশিয়া পড়িতে পারিলে, পুলিসের সকল সংবাদ পাওয়া যাইতে পারিবে; সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে সেইরূপ সাবধানও হইবার সুবিধা হইবে।
খুনের সঙ্গে সঙ্গেই যমুনাদাস একটা বুদ্ধি খেলাইয়াছিল। দুই লাসের কাছেই পঞ্জাবের সম্প্রদায়ের চিহ্ন সিঁদুরমাখা শিব রাখিয়া দিয়াছিল। ভাবিয়াছিল, তাহা হইলে সন্দেহ সম্প্রদায়ের উপরেই পড়িবে। নগেন্দ্রনাথের সহিত মিলিবার আরও কারণ যে, তাহা হইলে অক্ষয়কুমারের সন্দেহ গুরুগোবিন্দ সিংহের উপর যাহাতে পড়ে, তাহারই চেষ্টা করিবে।
সে তাহাই করিতেছিল। প্রকৃতপক্ষে তাহার উপরে কাহারই সন্দেহ হয় নাই। ভগবান্ না মারিলে তাহাকে কেহই ধরিতে পারিত না। নগেন্দ্রনাথের নিকটে সে প্রথমে জানিল যে, সে রাত্রে রঙ্গিয়া যাহাকে নোট দিয়াছিল, সে উমিচাঁদ। এখনও নোট উমিচাঁদের হাতে আছে।
যমুনাদাস নোটের লোভ সম্বরণ করিতে পারিল না। উমিচাঁদকে পত্র লিখিল। সে কুক্ষণে সেই পত্র লিখিয়াছিল, নতুবা কেহই তাহাকে ধরিতে পারিত না।
ম্যাজিষ্ট্রেটের সম্মুখে এইসকল কথা প্রকাশ হইল। যমুনাদাস দুই খুনের অপরাধে সেসন সোপর্দ হইল।
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
যে কারণেই হউক, নগেন্দ্রনাথ এক্ষণে হুজুরীমলের পরিবারের একরূপ অভিভাবকরূপে পরিণত হইয়াছিলেন। তিনি এক্ষণে প্রায়ই তাঁহাদের দেখিতে যাইতেন, তিনি কোনদিন না গেলে তাঁহারা তাঁহাকে ডাকাইয়া পাঠাইতেন।
প্রকৃতপক্ষেই তাঁহাদের দেখিবার কেহ ছিল না। হুজুরীমলের স্ত্রী স্বামীর দুর্ব্যবহারের কথা শুনিয়া একেবারে মুহ্যমান হইয়া পড়িয়াছিলেন। এইসকল ঘটনায় তিনি পীড়িত হইয়া পড়িলেন।
যমুনা একাকিনী বড়ই বিপদে পড়িল। বিশেষতঃ তাহারা পঞ্জাববাসী হওয়ায় এখানে তাহাদের আত্মীয়-স্বজন কেহ ছিল না। এখন নগেন্দ্রনাথই তাঁহাদের একমাত্র সহায়।
নগেন্দ্রনাথই প্ৰাণপণে চেষ্টা করিয়া হুজুরীমলের সম্পত্তি হইতে কিছু তাহাদের জন্য রক্ষা করিতে বিশেষ চেষ্টা পাইয়াছিলেন, সফলও হইলেন। দেনার জন্য হুজুরীমলের সমস্ত সম্পত্তি বিক্ৰয় হইয়া গেল; কিন্তু নগেন্দ্রনাথের চেষ্টায় যাহা বাঁচিল, তাহাতে হুজুরীমলের স্ত্রীর ও যমুনার সুখে স্বচ্ছন্দে চলিয়া যাইতে পারিবে।
নগেন্দ্রনাথ যমুনার কোন ভাল পাত্রের সহিত বিবাহ দিবারও চেষ্টা করিতেছিলেন; গোলযোগ একরূপ মিটিয়া গেলে তাহার বিবাহ দিবেন, এইরূপ স্থির হইয়াছিল।
যমুনাদাস ধরা পড়িবার পূর্ব্বেই গঙ্গা হুজুরীমলের বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছিল। কোথায় গিয়াছিল, কিছুই বলিয়া যায় নাই। তবে নগেন্দ্রনাথ জানিতে পারিয়াছিলেন, সে ললিতাপ্রসাদের আশ্রয়েই আছে। যমুনাদাসকে হারাইয়া এক্ষণে ললিতাপ্রসাদের স্কন্ধে ভর করিয়াছিল।
যমুনাদাস সেসনে প্রেরিত হইবার কয় দিবস পরে নগেন্দ্রনাথ একদিন নিজ ঘরে বসিয়া লিখিতেছেন, এমন সময়ে তথায় অক্ষয়কুমার সহাস্যে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি বহুদিন আর এদিকে আসেন নাই। তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “গ্রন্থকার মহাশয়, আর গোয়েন্দাগিরি করিবার সখ আছে?”
নগেন্দ্রনাথও হাসিয়া বলিলেন, “আবার খুন নাকি?”
“সখ আছে কি না, তাই আগে বলুন।”
“না, মাপ করুন—একটাতেই যথেষ্ট সখ মিটিয়া গিয়াছে।”
‘একটাতেই? আর প্রত্যহ আমাদের এই কাজ করিতে হইতেছে।”
“যাহার যে কাজ, তাহার তাহাই ভাল লাগে।”
“রাণীর গলির খুনটা লইয়া একখানা উপন্যাস লিখুন—আপনার অনুগ্রহে এ অভাগার নামটাও সেই সঙ্গে অমর হইয়া যাক্।”
“উপন্যাস অপেক্ষাও ব্যাপারটা রহস্যময়। তবে—”
“তবে কি নায়িকার অভাব নাকি? সে অভাব নাই।”
“গঙ্গার মত নায়িকা আর যমুনাদাসের ন্যায় নায়ককে উপন্যাস কি ভাল দাঁড়াইবে? চরিত্রে সৌন্দৰ্য্য চাই।”
“আপনার উপন্যাসে উহারা নায়ক-নায়িকা হইলে চলিবে কেন?”
“কেন—আর কে হইবে?”
“বটে? নায়িকা যমুনা, আর নায়ক? মহাশয় স্বয়ং।“
নগেন্দ্রনাথের মুখ রক্তাভ হইয়া উঠিল। তিনি হাসিয়া বলিলেন, “আপনার ত সব সময়েই উপহাস। যমুনার বিবাহ হইতেছে।”
“কাহার সঙ্গে?”
“আমি একটি ভাল পাত্র স্থির করিয়াছি।”
“ইহারই নাম কি আপনাদের উপন্যাসের নিঃস্বার্থ প্রেম।”
“আপনার ঠাট্টার জ্বালায় আমি অস্থির।”
“তবে আর কিছু বলিব না। এ গরীবকে অমর করিতেছেন কি না, এখন তাহাই বলুন।”
“এই রাণীর গলির খুনের একখানা ডিটেটিভ উপন্যাস লিখে।”
“যথার্থই আমি এ বিষয়টা লিখিতেছি। এটা সত্য ঘটনা হইলেও উপন্যাস অপেক্ষা বিস্ময়কর।”
“সব ত এখনও শুনেন নাই।”
“আর কি আছে?”
“তাহাই বলিতে আসিয়াছি। হুজুরীমলদের গদিতে আর একটা চুরি হইয়াছে।”
“আবার চুরি! কে চুরি করিল?”
“তাহাই বাহির করিবার জন্য গোয়েন্দার প্রয়োজন। সখ থাকে ত আর একবার উঠে-পড়ে লাগুন।”
“কে চুরি করিল? কত টাকা চুরি গিয়াছে?”
“সেই দশ হাজার টাকা।”
“কিছু সন্ধান পাইলেন?”
“এবার আর আগেকার মত কষ্ট পাইতে হয় নাই।”
“তবে চোর ধরা পড়িয়াছে?”
“না, সরিয়া পড়িয়াছে।”
“কে সে? উমিচাঁদ নয় ত?”
“না, স্বয়ং ললিতাপ্রসাদ।”
“ললিতাপ্রসাদ—আশ্চর্য্য! নিজের টাকা নিজে চুরি?”
“এইরকম প্রায় হয়। আর একজন এতদিনে সত্য সত্যই সরিয়াছে।”
“সে আবার কে?
“আপনার গঙ্গা।”
অতিশয় বিস্মিত হইয়া নগেন্দ্ৰনাথ বলিলেন, “আমার গঙ্গা!“
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “এই আপনার উপন্যাসের।”
“আমাকে সকল খুলিয়া বলুন।”
“গুণবান্ ললিতাপ্রসাদের স্কন্ধে গঙ্গাদেবী বহুকাল হইতে অধিষ্ঠান করিতেছিল, বিশেষতঃ যমুনাদাস প্রবাসে গেলে পুরামাত্রায় তাহাকেই ভর করিয়াছিল।”
“তাহা ত আগেই শুনিয়াছিলাম।”
“হাঁ, আর এদেশে থাকা চলে না—ক্রমেই দেশটা অত্যধিক উষ্ণ হইয়া উঠিতেছিল, তাহাই ললিতাপ্রসাদ বাপের সিন্দুকে যাহা কিছু ছিল, লইয়া গত রাত্রে লম্বা দিয়াছে।”
“গঙ্গাও তাহা হইলে তাহার সঙ্গে গিয়াছে?”
“হাঁ, এবার সত্য সত্যই একজনের সঙ্গে গিয়াছে—ভগবান্ আমাদের মত গরীবদের ত্রাণ করিয়াছেন।”
নগেন্দ্ৰনাথ হাসিয়া বলিলেন, “কেন?”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “কেন? এ সহরে থাকিলে লক্ষ্মী আরও কত লীলা-খেলা করিতেন, আর আমাদের প্রাণান্ত হইত।”
“ললিতাপ্রসাদের বাপ কি করিতেছেন?”
“প্রথমে পুলিসে খবর দিয়াছিলেন, কিন্তু যখন তিনি শুনিলেন যে এ তাহার গুণবান্ পুত্রেরই কার্য্য, তখন মোকদ্দমা তুলিয়া লইয়াছেন, নতুবা আমাদেরই দেশ-বিদেশে ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতে হইত।”
“কোথায় গিয়াছে, কোন সন্ধান পাইলেন?”
“হুজুরীমলেরই পথানুসরণ করিয়াছেন; আমরা অনুসন্ধান করিয়া জানিয়াছি, তাহারা বোম্বের দুইখানা টিকিট কিনিয়াছে, বোম্বেবাসীদিগের উপরে মায়া হইতেছে।”
“কেন?”
“গঙ্গার মত রত্ন সাম্লান সাধারণ ব্যাপার নহে—পুলিস ত্রাহি ত্রাহি ডাক্ ছাড়িবে।” নগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “অন্ততঃ আপনার ত্রাহি ত্রাহি ডাক্ ছাড়াইয়াছিল।” অক্ষয়কুমার বলিলেন, “স্বীকার করি—দু’ হাজারবার।”
“উপন্যাসখানা লেখা হইলে সংবাদ চাই।” বলিয়া অক্ষয়কুমার হাসিতে হাসিতে উঠিয়া নগেন্দ্রনাথের করমর্দন করিয়া চলিয়া গেলেন।
নগেন্দ্রনাথ সংসারে নর-নারী কতদূর রাক্ষসভাবাপন্ন হইতে পারে, ভাবিয়া প্রাণে আঘাত পাইলেন। স্ত্রীলোকমাত্রকেই তিনি দেবী ভাবিতেন; সেই স্ত্রীলোকের মধ্যে গঙ্গার ন্যায় স্ত্রীলোক আছে দেখিয়া তাঁহার প্রাণে নিদারুণ কষ্ট হইল। তাঁহার মন সেদিন নিতান্ত বিমর্ষ হইয়া রহিল।
তিন-চারিদিন পরে একদিন অক্ষয়কুমার আবার আসিলেন, হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “উপন্যাসের উপসংহার হয় নাই ত?”
নগেন্দ্রনাথ মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “কেবল আরম্ভ করিয়াছি।”
“ভালই হয়েছে।”
“কেন?”
“লেখা শেষ হইয়া গেলে, উপসংহারটা কাটাকুটী হইত।”
“কেন, আবার কি হইয়াছে?”
“যমুনাদাস ফাঁসী-কাঠ লইল না।
নগেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “কেন?”
“এরূপ মহাপাপীকে ফাঁসী-কাঠ লইতেও নারাজ হইল।”
‘কেন, কি হইয়াছে?”
“কাল রাত্রে কলেরায় তাহার মৃত্যু হইয়াছে।”
“ভগবান্ তাহাকে নিজের দরবারে সাজা দিতে লইয়া গিয়াছেন।”
“এরূপ লোকের সেখানেও বোধহয়, উপযুক্ত দণ্ড নাই।”
রাণীর গলির খুন অবলম্বন করিয়া শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথবাবু একখানি উপন্যাস প্রকাশ করিলেন। দুইদিনের মধ্যে প্রথম সংস্করণ দুই হাজার পুস্তক নগেন্দ্রনাথের হাত হইতে ফুরাইয়া গেল। সহরের প্রধান প্রধান পুস্তক বিক্রেতাগণ যতদিন পুস্তক ছাপা চলিতেছিল, ততদিন গ্রাহকদিগের তাগীদে অস্থির হইয়া উঠিয়াছিলেন। এক্ষণে পুস্তক প্রকাশ হইবামাত্র তাঁহারা যাঁহার যত সংখ্যক আবশ্যক, লইয়া গেলেন। দুই-তিন মাসের মধ্যে সকলেরই সকল পুস্তক বিক্রয় হইয়া গেল। তখন নগেন্দ্ৰনাথবাবু অত্যন্ত উৎসাহের সহিত দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপাইতে আরম্ভ করিলেন।