৩. মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার

মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বললেন, আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন।

রহমান সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমার একটা ছেলে হারিয়ে গেছে-আমি ভয় পাব না?

এখন এগারোটা বাজে। ছেলেটাকে আপনি দু ঘন্টা আগে হারিয়েছেন। দু ঘন্টা সময় কিছুই না। আশে পাশে কোনো বন্ধুর বাড়িতে খেলতে গিয়েছে।

ও কোথাও যায় না।

কোথাও যায় না বলেই যে কোনো দিনও যাবে না, এমন তো কথা নেই!

রহমান সাহেব খুব চেষ্টা করলেন যাতে তাঁর কথাবার্তায় বিরক্তি প্রকাশ না পায়। সেই চেষ্টা সফল হল না। বিরক্তি প্রকাশ পেল। তার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।

আপনি কি একটু চা খাবেন? চা দিতে বলি?

যখন তখন চা খাবার অভ্যেস আমার নেই।

রহমান সাহেব ভাবলেন নিজের পরিচয় ভালোভাবে দেবেন। তাহলে এরা হয়তো গা-ঝাড়া দিয়ে উঠবে। এ রকম আলগা দেখাবে না। দেওয়ার মতো পরিচয় তাঁর আছে। তাঁর বাবা তিন বছরের মতো শিল্পমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন–শিল্পমন্ত্রী। তাঁর দাদা খান বাহাদুর ওয়াদুদ রহমান বৃটিশ সরকারের আমলে গণ পরিষদের সদস্য ছিলেন প্রায় এগারো বছর। এবং তার নিজেরও মন্ত্রী হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। আলাপআলোচনা হচ্ছে। তিনি নিজে তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছেন না, কারণ রাজনীতি তাঁর পছন্দের বিষয় নয়।

কমিশনার সাহেব।

জ্বি, বলুন।

আমি একটা পুরস্কার ঘোষণা করতে চাই। যে আমার ছেলের খোঁজ এনে দেবে বা ছেলেটাকে এনে দেবে তার জন্যে পুরস্কার। এই পুরস্কার আপনাদের পুলিশ বাহিনীর জন্যেও প্রযোজ্য।

আপনি মনে হচ্ছে বেশি রকম অস্থির হয়েছেন।

অস্থির হবার কারণ আছে। পুতুল কখনো একা ঘরের বাইরে যায় নি। সে অসুস্থ, হার্টের একটা জটিল ব্যাধিতে ভুগছে। আমি পুরস্কার ঘোষণা করতে চাই।

করতে চাইলে নিশ্চয়ই করবেন। কিন্তু আমার ধারণা, ছেলেটি সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে। শতকরা নবৃই ভাগ ক্ষেত্রে তাই ঘটে। রাগ করে বা নিছক এ্যাডভেঞ্চারের লোভে ছেলে ঘর থেকে বের হয়, খানিকক্ষণ হাঁটিহাঁটি করে ফিরে আসে।

আমার স্ত্রী খুব অস্থির হয়েছেন। তার ধারণা, ছেলেধরার হাতে পড়েছে।

ছেলেধরা বলে কিছু নেই। বিদেশে ছেলেমেয়ে পাচার হয় বলে যে শুনি।

ভুল শোনেন। বিদেশীরা এত ঝামেলা করে ছেলেমেয়ে নেবে না। আইনের ভেতর দিয়েই তারা বাচ্চাদের দত্তক নিতে পারে। এতিমখানা আছে, সেবা সংস্থা আছে।

রহমান সাহেব তাকিয়ে আছেন। পুলিশ কমিশনারের কোনো কথা তাঁর মাথায় ঢুকছে বলে মনে হল না। কমিশনার সাহেব সহজ গলায় বললেন, আরেকটা জিনিস দেখুন। ঢাকা শহরে বাচ্চা ছেলেমেয়ের কোনো অভাব নেই। হাজার হাজার ছেলেপুলে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ফুটপাত বা রেলস্টেশনে রাত কাটায়। ছেলেধরা বলে যদি সত্যি কিছু থেকে থাকে, তাহলে তারা এইসব ঠিকানাবিহীন বাচ্চাদের ধরবে। আপনার বাচ্চাকে ধরে ঝামেলায় পড়তে চাইবে না।

রহমান সাহেব বললেন, আমি একটা পুরস্কার ঘোষণা করতে চাই। আপনার কথা সবই শুনলাম। পুরস্কারের ব্যাপারে আমি মনস্থির করছি।

কত টাকা পুরস্কার?

বেশ বড় এ্যামাউন্ট। এক লক্ষ টাকা!

কী বলছেন আপনি!

আমার ছেলেটা অসুস্থ। ওর দ্রুত বাসায় ফেরা দরকার।

এই পুরস্কার ঘোষণা করার ফলে একটা ঝামেলা হতে পারে ছেলেটা দুষ্ট লোকের হাতে পড়তে পারে। আজ রাত দশটা পর্যন্ত আমাকে সময় দিন। রাত দশটার ভেতর ফিরে না এলে পুরস্কার ঘোষণা করবেন।

ইতিমধ্যে আপনারা কী করবেন জানতে পারি?

নিশ্চয়ই পারেন। আমরা ঢাকা শহরের যতগুলো পুলিশ ফাঁড়ি আছে সবাইকে জানাব। ওয়্যারলেসে বাইরের থানাগুলোতেও জানান হবে। শহর থেকে বেরুবার যে-সব পথ আছে–যেমন ধরুন রেলস্টেশন, বাস লঞ্চ টার্মিনাল-সেখানকার পুলিশদের সতর্ক করে দেয়া হবে। হাসপাতাল গুলোতে খোঁজ নেব।

হাসপাতালে খোঁজ ইতিমধ্যেই নেয়া হয়েছে।

তাহলে তো কাজ আপনারা অনেক দূর এগিয়েই রেখেছেন। মাইকে আপনারা বাড়ির আশে পাশে একটা ঘোষণা দিতে পারেন। মাইকের ঘোষণায় বেশ কাজ দেয়।

দুপুর সাড়ে এগারোটার দিকে রাস্তায় মাইক বের হল। ছেলে হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রচার হতে লাগল।

ভাইসব, বিশেষ ঘোষণা। একটি ছেলে হারানো গিয়াছে। তাহার বয়স এগারো। পরনে হাফ প্যান্ট এবং শার্ট। নাম পুতুল। রোগা, ফর্সা। কপালে কাটা দাগ আছে। শার্টের রঙ মেরুন। খালি পা। ভাইসব, অনুরোধ করা যাচ্ছে কেহ যদি ছেলেটির কোন সন্ধান পান…

.

জেসমিন সকাল থেকেই বারান্দায় একটি মোড়া পেতে বসে আছেন। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর কোনো বোধশক্তি নেই।

আত্মীয়-স্বজনরা সকাল থেকেই এ বাড়িতে আসছেন। তাঁদের কারো সঙ্গেই জেসমিন কোনো কথা বলছেন না। দু’-এক জন কিছু সান্ত্বনার কথা। বলতে চেয়েছিলেন, তাঁদের জেসমিন খুব ঠাণ্ডা গলায় বলেছেন, দয়া করে। আমাকে বিরক্ত করবেন না।

গাছকাটার জন্যে বজলু মিয়া দু’ জন লোককে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, তাকেও ধমক দিয়ে বিদেয় করা হয়েছে।

দুপুরের কিছু আগে নিমতলির পীর সাহেব বলে এক চ্যাংড়া ছেলেকে বাড়িতে আনা হয়েছে। এ নাকি হারানো লোক খুঁজে পাবার ব্যাপারে খুব ওস্তাদ। যে হারিয়ে গেছে তার কিছু কাপড়চোপড় শুকলেই সে নাকি অনেক কিছু বলতে পারে।

রহমান সাহেব লোকটিকে পুতুলের শার্ট দিতে বললেন। সে অনেকক্ষণ নানানভাবে শার্ট শুকল, তারপর চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে রইল–যেন ধ্যান করছে। ধ্যান ভাঙবার পর সে গম্ভীর গলায় বলল, তারে আমি দেখতেছি একটা বাসে। জানালার পাশে বসছে। তার সাথে দাড়িওয়ালা একটা বুড়া কিসিমের লোক। ছেলেটার হাতে আছে একটা কমলা। বাসটা যাইতেছে ফরিদপুরে।

রহমান সাহেব লোকটির কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করলেন না। তবু ফরিদপুরের ডিসিকে টেলিফোন করলেন। এক জন লোক পাঠালেন ফরিদপুরে।

নিমতলির পীর সাহেবকে পাঁচ শ’ টাকা দেয়া হল এবং বলা হল সত্যি সত্যি যদি পুতুলকে ফরিদপুরে পাওয়া যায় তাহলে তিনি পীর সাহেবের জন্যে নিমতলিতে একটা ছোটখাট বাড়ি বানিয়ে দেবেন।

.

পুতুল এবং অন্তু মিয়াকে একটা ঠেলাগাড়ির পেছনে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল। পুতুলের গায়ে গেঞ্জি নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুকুরে গেঞ্জিটার সলিল সমাধি ঘটেছে। মাছ মারার জন্যে গেঞ্জি ব্যবহার করা হয়েছিল। দু জন দু’দিক থেকে ধরে জালের মতো টেনেছে। দুটো দারফিনা মাছ ধরা পড়েছে। পুতুল সেই মাছ ধরা পড়ায় উত্তেজনায় এতই উত্তেজিত ছিল যে গেঞ্জি যে তলিয়ে যাচ্ছে সেটা লক্ষ করে নি। মাছ দু’টি দু’ জন ভাগ করে নিল। অন্তু মিয়া ভাগাভাগির পরপরই হঠাৎ উদার গলায় বলল, আমার লাগবে না, তুমি নিয়া যাও।

পুতুল গভীর আগ্রহে মাছ দু’টি মুঠোর মধ্যে পুরল। তখনি ধরা পড়ল, গেঞ্জি নেই। সেই গেঞ্জি খুঁজতে কত কাণ্ড! পুতুলই একবার ডুবে যায় যায় অবস্থা। মোটামতো এক মহিলা টেনে তুলেই এক চড়।

পুতুল অবাক হয়ে বলল, আপনি আমাকে মারলেন কেন?

মহিলাটি ঠোঁট উল্টে বলল, ও মা! পুলায় আবার শুদ্ধ ভাষা কয়। উঠ শুকনায়। আবার চড় খাইবি।

পুতুল উঠে পড়ল। নোংরা পানিতে দাপাদাপি করার ফল হয়েছে চমৎকার। পুতুলকে এখন আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই গায়ের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সমস্ত শরীরে কাদার আস্তরণ জলছাপের মতো ফুটে উঠেছে চুল হয়েছে এলোমেলো।

ঠেলাগাড়িতে এদের দুজনকে দেখাচ্ছে অদ্ভুত। দু’ জনের মাঝখানে ইয়েলো টাইগার’ কু কু করছে। তার নজর পুতুলের হাতের দিকে, সেখানে দুটি মরা মাছ এখনো আছে। ইয়েলো টাইগার সুযোগের সন্ধানে আছে! কখন মাছ দু’টি নিয়ে নিতে পারবে। পুতুল এই মতলব টের পেয়েছে। সে আছে খুব সাবধানে। মতিঝিল পর্যন্ত তারা নির্বিঘ্নে এল। মতিঝিল পার হবার পরই ঠেলাওয়ালা ওদের নামিয়ে দিল। মুখ বিকৃত করে বলল, যা যা নাম। মাগনা গাড়ি বহুত চাপছস।

পুতুল বলল, আপনি আমাদের তুই তুই করে বলছেন কেন? ভালোভাবে বললেই তো আমরা নেমে যাই।

চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কয় আবার। এক চড় খাবি। নাম।

পুতুল নেমে গেল। অন্তুকে একটু বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। পুতুল বলল, এখন কী করবে?

হাঁটুম।

যাবে কোথায়?

ইস্টিশনে। ইস্টিশনে আমার ভইন থাকে।

ভইন বলছ কেন? বল বোন।

ওই একই কথা। যার নাম ভইন তারই নাম বোন।

তা ঠিক।

পুতুল তুমি যাইবা আমার সাথে?

না, আমি এখন বাসায় চলে যাব। এখন না গেলে মা রাগ করবে।

ইস্টিশনে আমার ভইনরে দেখবা না?

হ্যাঁ দেখব। তার কী নাম?

তার নাম হইল গিয়া মরিয়ম।

মরিয়ম?

হঁ।

হঁ বলতে নেই। বলতে হয় হ্যাঁ।

ওই একই কথা।

দু’ জন ছোট ঘোট পা ফেলে এগুচ্ছে। পুতুল লক্ষ করল অন্তু গভীর মনোযোগর সঙ্গে রাস্তা থেকে সিগারেটের প্যাকেট কুড়িয়ে নিচ্ছে।

ওইগুলো দিয়ে তুমি কী করবে?

খেলুম।

কী খেলা?

চাড়া খেলা। সিগারেটের প্যাকেট হইল টেকা। ফাইভ ফাইভের প্যাকেট হইল পাঁচ শ’ টেকা, স্টার হইল দশ টেকা, আর বেনসন হইল হাজার টেকা।

সত্যি!

বলতে বলতেই পুতুল একটা ফাইভ ফাইভের প্যাকেট পেয়ে গেল। কী অদ্ভুত উত্তেজনা! দশ মিনিটের মধ্যে দুটো গোল্ড ফ্লেক এবং একটা স্টারের প্যাকেট পাওয়া গেল। এক-একটা খালি প্যাকেট দেখা যায় আর দু’ জন একসঙ্গে ছুটে যায়। এমন আনন্দ পুতুল এর আগে কখনো পায় নি।

প্যাকেট সংগ্রহের খেলা বেশিক্ষণ চলল না। রাখার জায়গা নেই। ইয়েলো টাইগারকেও সামলাতে হচ্ছে। অন্তু এক সময় বলল, ফালাইয়া দেই, কেমন?

কেন, ফেলবে কেন?

টেকা রাখনের জায়গা নাই, করমু কি?

এত কষ্ট করে জোগাড় করা টাকা নর্দমায় ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। উপায় নেই, টাকার পাহাড় হয়ে গেছে। ফেলতেই হবে। অন্তু অবশ্যি টাকা ফেলার ব্যাপারটাতেও একটা মজা নিয়ে এল। প্রথমে কুচি কুচি করে ছেঁড়া হয়, তারপরই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া। কে কত দূর নিতে পারে। দারুণ আনন্দের একটা খেলা।

ইয়েলো টাইগার কু কু করছে। যদিও তার কু কু করার কোনো কারণ নেই। সে বেশ আরামেই আছে। সে আছে অন্তুর প্যান্টের পকেটে, মাথাটা শুধু বের হয়েছে। অন্তু ইয়েলো টাইগারের দিকে তাকিয়ে একটা নরম গলায় বলল, কি রে ব্যাটা, ক্ষিধা লাগছে?

ইয়েলো টাইগার অবিকল মানুষের মতো মাথা নাড়ল।

বেশি ক্ষিধা?

কুঁ কুঁ কুঁ।

অন্তু গম্ভীর গলায় বলল, জন্তু-জানোয়ার যখন ছোট থাকে তখন মানুষের কথা বুঝে। বড় হইলে বুঝে না।

পুতুল বলল, কে বলল তোমাকে?

আমি জানি।

কি ভাবে জান? কে বলেছে তোমাকে?

আমি জানি।

কি ভাবে জান? কে বলেছে তোমাকে?

অন্তু সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। পুতুল আসছে তার পেছনে পেছনে। তার খিদে পেয়েছে। বেশ ভালো খিদে। এটা বেশ মজার ব্যাপার। বাসায় থাকার সময় একেবারেই খিদে লাগত না। এখন শুধু নানান ধরনের খাবারের কথা মনে হচ্ছে।

বাড়ি ফিরলে খিদের সমস্যাটি মেটে, কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না। পুতুলের শুধুই মনে হচ্ছে, বাড়ি ফিরে কাউকে পাওয়া যাবে না। বাবা গেছেন কাজে। মাও নিশ্চয়ই বাইরে। এ সময় তিনি কখনো ঘরে থাকেন না।

অন্তু বলল, তোমার ক্ষিধা লাগছে?

হঁ লেগেছে।

আমারও লাগছে। জব্বর ক্ষিধা।

অন্তুর বোন বয়সে অন্তুর দু’বছরের ছোট। তাকে তার বয়সের চেয়েও ছোট দেখায়! ওদের দেখতে পেয়েই সে ছুটে এল। পুতুলের মনে হচ্ছে, এই মেয়েটা যেন সবে মাত্র হাঁটতে শিখেছে, এক্ষণি আছাড় খেয়ে পড়বে।

মরিয়মের গায়ে একটা হলুদ রঙের ফ্রক। ফ্রকের উপর মোটা একটা খাকী রঙের স্যুয়েটার। স্যুয়েটারটা সে আজ সকাল বেলা পেয়েছে। রেলপুলিশের এক হাবিলদার দিয়েছে। এই হাবিলদারটা খুব ভালো। প্রায়ই এটা-ওটা দেয়! গত শীতে মোটা একটা কাঁথা দিয়েছিল। সেই কাঁথা বেশি দিন রাখা গেল না। এক রাতে কাঁথা গায়ে আরাম করে ঘুমুচ্ছিল, সকাল বেলা জেগে দেখে-কাঁথা নেই, কে টান দিয়ে নিয়ে গেছে। তার পাশে এক বুড়ি ঘুমুচ্ছিল। নির্ঘাৎ বুড়ির কাণ্ড!

কাঁথাটা থাকলে এই শীতটা আরাম করে পার করে দেয়া যেত। এ বছর বেশ কষ্ট হচ্ছে। তবে মরিয়মের মুখে কষ্টের কোনো ছাপ নেই। সে আনন্দে ঝলমল করছে,কারণ আজ তার খুব ভালো রোজগার হয়েছে। সে ট্রেনের যাত্রীদের কাছে পানি বিক্রি করে। এলুমিনিয়ামের একটা জগভর্তি পানি নিয়ে মিষ্টি সুরেলা গলায় চেঁচায়– পানি পানি। ঠাণ্ডা কলের পানি। গরমের দিনে তার রোজগার ভালো হয়। শীতের সময় পানি কেউ খেতে চায় না।

অন্তু বলল, বিক্রি হইছে কিছু?

মরিয়ম হেসে ফেলল। ফ্রকের পকেট থেকে একটা চকচকে দশ টাকার নোট বের করল। আজ পানি কেউ কেনে নি। কিন্তু এক ভদ্রলোক হঠাৎ টাকাটা দিয়েছেন। মরিয়ম এক কামরা থেকে আরেক কামরায় পানির জগ নিয়ে যাচ্ছে, কেউ কিনছেনা। তার এত মন খারাপ হল। পানি না কিনলে আজ তাদের দুই ভাইবোনের কিছু খাওয়া হবে না। গতরাতেও তেমন কিছু খাওয়া হয় নি। একটা পাউরুটি কিনে ভাগাভাগি করে খেয়েছে। পাউরুটিগুলো এমন জিনিস যে, খাওয়ার পরপরই খিদে লাগে। এই দিক দিয়ে চিন্তা করলে বাদাম অনেক ভালো জিনিস অনেকক্ষণ পেটে থাকে।

মরিয়ম পানির জগ হাতে ট্রেন থেকে নিচে নামল। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে আজ আর পানি বিক্রি হবে না। এক জন ভদ্রলোক প্লাট ফর্মে দাঁড়িয়ে জুতো পালিশ করাচ্ছেন! সে কৌতূহলী হয়ে জুতো পালিশ দেখতে লাগল। এই জিনিসটা দেখলে তার ভালো লাগে। ময়লা জুতো গুলো দেখতে দেখতে কেমন চকচকে হয়ে যায়। এমন কি জুতোর দিকে তাকালে আয়নায় মুখ পর্যন্ত দেখা। যে লোকটা জুতো পালিশ করাচ্ছিল তাকে খুব কৃপণ বলে মনে হল। কারণ দু’টাকার বেশি সে দিল না। জুতো পালিশওয়ালা বখশিশের জন্যে ঘ্যানঘ্যান করে একটা ধমক খেল। মরিয়ম বলল, সার দিয়ে দেন একটা টেকা, গরিব মানুষ। লোকটি বলল, এই লোক তোর কে হয়? ভাই নাকি?

না, আমার কেউ হয় না।

তুই পানি বিক্রি করিস?

হ।

শীতের দিনে পানি কেউ খায়?

না।

তাহলে পানি বিক্রি করিস কেন?

মরিয়ম কিছু বলল না। লোকটি পালিশওয়ালাকে একটা টাকা বখশিশ দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, দেখি আমাকে এক গ্লাস পানি দে। সে পানি দিল। সেই পানিতে লোকটি একটা চুমুক দিয়ে গ্লাস ফিরিয়ে দিল। এবং তাকে অবাক করে একটা চকচকে দশ টাকার নোট বের করল। এখানেই শেষ নয়, যাবার আগে তার চুলে হাত রেখে একটু আদর করল–নরম গলায় বলল, একটা চিরুনি কিনে নিস। চুল তো একেবারে কাকের বাসা হয়ে আছে।

দশ টাকায় তাদের দু’ জনের খাওয়া ভালোই হবে। ভাত, মাছ ডাল হয়ে যাবে। কিন্তু আজ সঙ্গে আরেক জনকে যে দেখা যাচ্ছে। মরিয়ম মনে মনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। অন্তু প্রায়ই এরকম একেক জন সঙ্গে নিয়ে আসে। এসে দু’-একদিন থাকে, রোজগারে ভাগ বসায়-তারপর আবার উধাও হয়ে যায়। একবার নিয়ে এসেছিল এক মহাগুণ্ডাকে, কথায় কথায় মারপিট করে মরিয়মের হাত কামড়ে ধরে রক্ত বের করে দিয়েছিল। এখনো হাতে দাগ আছে। আজকের ছেলেটা সে রকম হবে না। দেখে মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা ধরনের ছেলে।

তারা এগুচ্ছে কমলাপুর রেলস্টেশনের সামনের রেস্টুরেন্টগুলোর দিকে। সবার আগে অন্তু, তার পেছেনে পেছনে পুতুল এবং মরিয়ম। মরিয়ম কৌতূহলী চোখে পুতুলকে দেখছে, কিন্তু কিছু বলছে না। পুতুল খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে। মেয়েটাকে কেমন পাগলী পাগলী মনে হচ্ছে। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। কেমন ছটফটে চোখ। কিন্তু চেহারাটা খুব মিষ্টি। কেমন পিচুপিচ্ করে থুথু ফেলছে।

মরিয়ম হঠাৎ পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, এই স্যুয়েটারটা আমারে এক জন দিছে।

কে দিয়েছে।

এক জন হাবিলদার সাব দিছে।

বাহ্, ভালো তো?

খুব ওম আছে। ভাল জিনিস।

পুতুল অবাক হয়ে বলল, ওম কি? মরিয়ম খিলখিল করে হেসে। ফেলে বলল, ও ভাইজান এ ওম কি জানো না তুমি সত্যি জান না।

না।

হি হি হি। কেমুন কথা!

হাসছ কেন শুধু শুধু!

পুতুল খুব অবাক হল। মেয়েটা এমন কেন।

কেমুন কথা, যে জানে না। ওম হইল গিয়া গরম। নেও, গায়ে দিয়ে দেখ।

মরিয়ম স্যুয়েটার খুলে ফেলল। পুতুল বলল, না না আমি গায়ে দেব না।

আহ্‌ দেও না। দিলেই বুঝবা ওম কারে কয়।

এটা নোংরা স্যুয়েটার। আমি গায়ে দিব না।

ও ভাইজান, এ কেমুন কইরা জানি কথা কয়। হি হি হি।

অন্তু ধমক দিল, বেহুদা হাসিস না।

এ কেমুন কইরা জানি কথা কয়, ভাইজান বড় মজা লাগে।

পুতুল মেয়েটাকে আগ্রহ নিয়ে দেখছে। গোলগাল আদুরে মুখ। কী সুন্দর করেই না হাসছে।

মরিয়ম বলল,  তোমার নাম কি?

ভালো নাম জানতে চাও না ডাকনাম?

ও ভাইজান, এ কেমুন জানি ভদ্রলোকের মতো কথা কয়।

অন্তু বিরক্ত মুখে তাকিয়ে ছোট্ট একটা ধমক দিল। মরিয়ম বহু কষ্টে হাসি থামাল।

.

রেস্টুরেন্টের মালিক অন্তুকে চেনে। ওরা এসে দাঁড়ানমাত্র পরোটা ভাজি চলে এল কিছুই বলতে হল না। এমন কি কুকুরটার জন্যেও খাবার চলে এল। টিনের বাটিতে খানিকটা বাসি ভাত, মাছের কাঁটা, কয়েক টুকরা আলু। সে বোধ হয় আরো ভালো কিছু খেতে চায়। বার বার অন্তুর দিকে তাকাচ্ছে। অন্তু খানিকটা পরোটা ছিঁড়ে দিতেই সে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লেজ নাড়তে লাগল নানান ভঙ্গিতে। রেস্টুরেন্টের থলথলে ভুড়িওয়ালা মালিক একটা কালোজাম মরিয়মের প্লেটের কোণায় বসিয়ে দিয়ে গেল। এটা সে প্রায়ই করে। এই মিষ্টির জন্যে পয়সা দিতে হয় না।

মরিয়মের মুখভর্তি হাসি। মিষ্টির একটা কোণা ভেঙে সে মুখে দিল। আনন্দে তার চোখ ছোট-ঘোট হয়ে গেছে। অন্তুর মিষ্টি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। দু’টাকা করে মিষ্টি। ইচ্ছে করলে তো খাওয়া যাবে না। দুপুরে আবার খিদে পাবে, তখন কিছু একটা তো খেতে হবে। দু’টাকার বাদাম কিনে ভরপেটে পানি খেলে সারাদিন থাকা যায়। আজ বাদাম কিনতে হবে তিন টাকার। মানুষ এক জন বেশি।

মরিয়ম পুতুলের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, মিষ্টি খাইবা?

না।

খাও। নেও অর্ধেকটা খাও।

কারো খাওয়া জিনিস আমি খাই না।

খাও না ক্যান?

খেলে অসুখ হয়।

ও ভাইজান, এ কেমন জানি ভদ্দরলোকের লাহান কথা কয়। হি। হি হি।

তারা খাওয়া শেষ করে বাইরে এসে দাঁড়াল। পুতুল বলল, তোমরা এখন কি করবে?অন্তু বলল, ময়মনসিং যামু।

কীভাবে যাবে?

রেলগাড়ি আছে না? যাওয়ার কোনো অসুবিধা নাই, টিকেট লাগে। না।

আবার ঢাকা আসবে?

হঁ।

কবে আসবে?

ঠিক নাই কোনো। আইজ রাইতে আসা যায়, কাইলও আসা যায়।

মরিয়ম হাসিমুখে বলল, সব আল্লাহর ইচ্ছা। হি হি হি হি। অন্তু মরিয়মকে ধমক দিল, তাতে লাভ হল না। হাসি থামেই না। পুতুলের ইচ্ছে করছে ওদের সঙ্গে ময়মনসিং চলে যেতে। এরা যদি আজই ফেরে-তাহলে তো কোনো অসুবিধা নেই। মা-বাবা বাসায় ফেরার আগেই হয়তো সে পৌঁছে যাবে। মা-বাবা বুঝতেই পারবে না সে কোথায় ছিল সারা দিন। আর যদি বুঝতেও পারে, তাহলেও খুব অসুবিধা হবে না। মা-বাবা কেউই তার ওপর রাগ করে না। তার অসুখ তো, তাই। হয়তো খানিকক্ষণ রাগী-রাগী চোখ তাকিয়ে থেকে বলবে, আর এ রকম করবে না, বুঝলে? সে বলবে, আর করবো না মা!

রাস্তার বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশবে না।

আচ্ছা।

আজেবাজে খাবার খাবে না।

আচ্ছা।

লক্ষ্মী হয়ে থাকবে।

হু।

হুঁ আবার কেমন শব্দ। বল-লক্ষ্মী হয়ে থাকব।

লক্ষ্মী হয়ে থাকব।

বাড়ির জন্যে পুতুলের একটু যেন খারাপ লাগতে শুরু করেছে। কী হচ্ছে বাসায় এখন কে জানে। গাছগুলো হয়তো কাটা হয়ে গেছে। এ বারের বর্ষায় সে আর কদমফুল দেখবে না। কে জানে কোনো দিনই হয়তো দেখবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *