মিস বেনজির হাফসানা রুবাইয়াত বিউটি চার বছর আগে প্রথম ষোড়শী হয়; তারপর তার আর বয়স বাড়ে নি, সে স্থির ষোড়শী হয়ে আছে। গত বছর সে প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করে পরীক্ষার সময় সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, এবং এবারও অসুস্থ ও ফেল করার পর সে খোয়াব দেখতে শুরু করে। আলহজ্জ হামিদ আলি বিন শমশের সাহেব তাকে আমেরিকা পাঠাতে চেয়েছিলেন, পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স্ক একজন বিশিষ্ট শিল্পপতির সাথে বিবাহেরও ব্যবস্থা করেছিলেন, কিন্তু তার ঘোড়শী কন্যা সে-সব বাতিল করে দিয়ে শুধু খোয়াব দেখছে।
একদিন দুপুরে মিস বিউটি চিৎকার করে ওঠে, আম্মা, দেখে যাও, বোম্বে থিকা ফটোগ্রাফার কিষাণকুমার আসছে। এইবার আমার ড্রিম ফুলফিল হইলো।
মিস বিউটি তার শীততাপদমিত শয্যাকক্ষে গেঞ্জিটাকে নিচের দিকে টেনে পেছন কাঁপিয়ে ক্যাট ওয়াক করতে থাকে, কখনো নাচতে থাকে, গান গাইতে থাকে–প্যায়ার প্যায়ার প্যায়ার তনহা তনহা তনহা।
আম্মা বাসায় ছিলেন না, তাই তিনি আসেন না, পীর সাহেবের বাড়ি গেছেন তিনি; দুটি কাজের মেয়ে ভয় পেয়ে দৌড়ে আসে।
ছমিরন বলে, আফা, কী অইছে আপনের আমাগো কন; আপনে এমুন কইরা হাডাহাডি করতাছেন ক্যান?
মিস বিউটি বলে, বোম্বে থিকা ফটোগ্রাফার আসছে, এইবার আমার ড্রিম ফুলফিল হইলো। আমি মডেল হব, হিরোয়িন হব, বোম্বে যাব।
মিস বিউটি তার গেঞ্জি আরো নামিয়ে আনে, দুটি বেশ বড়ো বস্তুর অর্ধেকের বেশি দেখা যায়।
শেফালি বলে, হ আফা, মডেল অইলে আপনেরে বড়ো মানাইব, আপনের ওই দুইডা মইনশা কৈরেলার দুইডারে ছাড়াই গ্যাছে।
মিস বিউটি শেফালিকে জড়িয়ে ধরে বলে, ডারলিং, কথাটা ট্র বললি তো?
ছমিরন বলে, হ আফা, আপনের পাছাও আল্লার রহমতে বড়ো মাদুরির চাইতে, হাডনের সোম খালি ফাল ফারে।
মিস বিউটি খিলখিল করে হাসতে থাকে, আমি মাধুরী হইবো কাজল হইবো; আই অ্যাম হিরোয়িন।
মিস বিউটি ক্যাট ওয়াক করতে থাকে, নাচতে থাকে, গাইতে থাকে; একবার গাছের গুঁড়ি ভেবে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে।
ছমিরন আর শেফালি রান্নাঘরে গিয়ে একে অন্যকে বলে, দ্যাকতে মুরগির মতন, আর হে অইব মাদুরি, হে অইবো কাজল।
মোসাম্মৎ বেনজির হাফসানা রুবাইয়াত বিউটি ঘুমনাখোয়াবে দেখে ভিন্ন রকম ব্যাপার, যা জানতে আমাদের বেশ দেরি হয়; কেননা তার ওই খোয়াবটিকে চুড়ান্ত গোপনীয় বস্তু বলে অনেক দিন আটকে রাখা হয়। কিন্তু আমাদের সত্যের দেশে কিছুই গোপন থাকে না, সত্য একদিন এখানে প্রকাশ পেয়েই যায়; আমরা সত্য থেকে কখনোই বঞ্চিত হই না। মোসাম্মৎ বেনজিরের ওই সমস্যাটি শুরু থেকেই ছিলো, যেমন আছে আমাদের অধিকাংশ দ্বিতীয় লিঙ্গের, অর্থাৎ তার মাসিক নিয়মিত ছিলো না। কখনো মাসের পর মাস বন্ধ থাকতো, আবার কখনো মাসে দু-বার দেখা দিতে, কখনো গলগল করে ঝরতো, কখনো দেখা দিতে সামান্য ইঙ্গিত। একরাতে সে খোয়াব দেখে তার শরীর খুব ব্যথা করছে, মাথা ফেটে পড়ছে, তলপেট ভারি হয়ে উঠেছে; সে বুঝতে পারে তার সময় এসে গেছে, তাই সে সেনিটারি টাওয়েল খুঁজতে থাকে। কিন্তু সে দেখতে পায় গলগল করে কালচে রক্ত বেরিয়ে আসছে তার মুখ দিয়ে, নাক দিয়ে, তার সারা শরীরের লোমকূপ দিয়ে; শুধু যেখানে দিয়ে বেরোনোর কথা সে-স্থানটি থাকে ঝামাপাথরের মতো শুষ্ক। মোসাম্মৎ বেনজির হাফসানা রুবাইয়াত বিউটি ময়লা রক্তের স্রোতের নিচে হারিয়ে যেতে থাকে; সে দেখতে পায় রক্তে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে খাটপালং, বাড়িঘর, তাদের চারতলা দালান, বারিধারা, গুলশান, বনানী, বাস, ট্রাক, ঢাকা শহর, বুড়িগঙ্গা, সারাদেশ; সে চিৎকার করে, তার চিৎকার কেউ শুনতে পায় না।
শুধু আমরা নই, আমাদের নদীনালা খালবিল পুকুর জমি গরুগাভী পথঘাট নৌকো। জাল মাছ কাক চিল চড়ই টুনটুনি দোয়েল ঘরবাড়ি গাছপালা সাপ ব্যাঙ কেঁচো শেয়াল কুকর বেড়াল রিকশা লঞ্চ বাস ট্রাক পোল ব্রিজের দিকে তাকালেও মনে হয় তারা সবাই খোয়াব দেখছে। তাদের খোয়াবের কথা আমরা জানতে পারি না তারা কথা বলতে পারে না বলে; কিন্তু তাদের দিকে তাকালে মনে হয় তারা দিনরাত দুঃস্বপ্ন দেখে চলছে।
আমাদের ওই বালাসুরের পুকুরটির কথাই ধরা যাক; ওটির দিকে তাকালে মনে হয় ওটি পুকুর নয়, এটি কোনো দুঃস্বপ্নগ্রস্ত বদ্ধ পাগলের চোখ।
পুকুরটিতে অনেক বছর ধরে নতুন পানি আসে না। এক সময় ছিলো যখন বোশেখ শেষ হতে না হতে জ্যৈষ্ঠ আসতে না আসতে হালট উপচে খাল দিয়ে ধান তিল আর পাটখেতের ভেতর দিয়ে খেলার মাঠের সবুজ ঘাস কাঁপিয়ে চারদিক উথালপাথাল করে আসতো জোয়ার, থইথই করতো পুকুর, কেঁপে কেঁপে উঠতো; আজ ওই পুকুর কাঁপে না, জোয়ার আর ঢেউ কাকে বলে জানে না। পুকুর অবাক হয়ে ভাবে তার ভেতরের সেই পুঁটি নলা খলশে শিং মাগুর বাইন রয়না ভেটকি বাউশ সরপুঁটি বোয়াল কই আইর রুই কাতল গরমা ফলি চিতল গজার শোল নামের আনন্দগুলো গেলো কই? সেই কম্পনগুলো কোথায়? কোথায় সেই ঘাই ডাব লাফ? কোথায় টাকির পোনার সোনালি ঝাঁক? কোথায় শোলের পোনার লাল নৃত্য? কোথায় পানি? তার বুকে যতোটুকু পানি আছে, তা আর তার কাছে পানি মনে হয় না; মনে হয় চোখ ভরে ছড়িয়ে পড়েছে ঘোলাটে কেতুর। তার চোখ চটচট করছে, বন্ধ হয়ে আসছে; সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
পুকুরটির দিকে তাকালে বুঝতে পারি পুকুরটি জোয়ারের নতুন পানির উল্লাসের স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু জোয়ার আর আসবে না।
পুকুরটির দিকে তাকালে বুঝতে পারি পুকুরটি রুইমাছের লাল গতির স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু রুইমাছ আর আসবে না।
পুকুরটির দিকে তাকালে বুঝতে পারি পুকুরটি কেঁপে কেঁপে ওঠার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু পুকুর আর কেঁপে কেঁপে উঠবে না।
আমরা সবাই খোয়াব দেখছি, তবে এখন সবচেয়ে বেশি খোয়াব দেখছেন আমাদের রাজারা; খোয়াবে খোয়াবে তারা ঘেমে উঠছেন, খোয়াবে খোয়াবে তারা সুখে ভ’রে উঠছেন; এবং আমরা তাদের খোয়বের বিবরণ নিয়ে মেতে আছি। ঘর থেকে বেরোলেই আমরা একে অন্যকে জিজ্ঞেস করি, রাজারা আমাদের আজ কী খোয়াব দেখেছেন? আমরা তাদের খোয়াব নিয়ে দিনরাত আলোচনা করি, তাদের খোয়াবের ওপরই নির্ভর করে আমাদের জীবন, বিশেষ করে মরণ।
প্রথম আমাদের কানে আসে রাজাকার রাজবংশের অধ্যাপক আলি গোলামের খোয়াবের কথা; তাঁর জাগনাখোয়াব আর ঘুমনাখোয়ব দুটির কথাই আমরা জানতে পারি, জেনে আমরা উল্লাস আর ভয়ে কুঁকড়ে যাই।
খেজুরগাছের দেশ থেকে কিছুক্ষণ আগে তিনি এক মুরুব্বির ফোন পেয়েছেন; ফোন রাখার পরই তিনি খোয়াবটি দেখতে শুরু করেন। কয়েক রেকাত সালাতের ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু মধুর খোয়াবটি এসে তাঁকে সালাতের কথা ভুলিয়ে দেয়।
আলি গোলাম প্রথম টগবগ টগবগ টগবগ টগবগ শব্দ শুনতে পান, তারপর চিঁহিঁ চিঁহিঁ চিঁহিঁ চিঁহিঁ চিঁহিঁ শব্দ শুনতে পান, পরে তলোয়ারের ঠনঠন শব্দ শুনতে পান, আরো পরে শুনতে পান ট্রা ট্রা ট্রা ট্রা ট্রা ট্রা ট্রা ট্রা।
আলি গোলাম দেখতে পান তার অশ্বারোহীরা আসছে, সপ্তদশ নয় হাজার হাজার, আকাশ থেকে বাতাস থেকে সড়ক দিয়ে গলি দিয়ে ধানক্ষেত মাড়িয়ে অ্যাভিনিউ ভেঙেচুরে তারা চানতারা পাক ঝান্ডা উড়িয়ে আসছে; ঘোড়ার খুরের শব্দে তিনি চান-তারা চান-তারা চান-তারা আওয়াজ শুনতে পান। পথে পথে কল্লা খসে পড়ছে বিধর্মীর, কাফেরের ময়লা রক্তে মাটি কালো হয়ে যাচ্ছে, চানতারা উড়ছে গাছে গাছে বাড়ির ছাদে ছাদে; পবিত্র হচ্ছে বাঙলাস্তান। একটু পরে চোখের কেতুর মুছে দেখতে পান ওগুলো অশ্ব নয়, তার সালেহিনরা ঘোড়ায় চড়ে আসে নি, আজকাল ঘোড়া নেই, ঘোড়ায় চড়ে কিছু দখল করা যায় না, তারা আসছে জিপে, ট্রাকে, আসছে ট্যাংকে কামান দাগিয়ে। তাদের হাতে তলোযার নেই, আজকাল তলোয়ারে চলে না; তারা আসছে মেশিনগান এসএলআর হাতে, মর্টার ছুঁড়ে, বেয়নেট চার্জ করতে করতে; আর তাদের পবিত্র পায়ের নিচে আত্মসমর্পণ করছে বিধর্মীরা। দিকে দিকে আহাজারি উঠেছে, ওই আহাজারি কাফেরদের, কাফেরদের আর্তনাদ তার কানে মধুর শ্লোকের মতো লাগছে; তার সালেহিনরা ভেঙে ফেলছে কাফেরদের দুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বেলেহাজ মেয়েলোকগুলোকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পরিয়ে দিচ্ছে কাফনের মতো কালো বোরখা; তিনি দেখতে পান একটি চানতারা সিংহাসন এগিয়ে আসছে তার দিকে, তিনি গিয়ে বসছেন। চারদিকে শব্দ উঠছে জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।
আলি গোলাম উল্লাসে লাফিয়ে উঠে বলেন, দ্যাশে আর কাফের থাকিবে না, অন্য কোনো বহি থাকিবে না, আবু আলার রাষ্ট্র স্থাপিত হইল।
তার এমন উল্লাস আগে কেউ দেখে নি, তাঁকে পাহারা দেয় যে সালেহিনরা তারাও দেখে নি। তাঁর উল্লাস দেখে তারা ভয় পায়।
তারা দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করে, হে আমির, আপনি এমন করতেছেন ক্যান? আপনার মৃগীরোগটি কি আবার দ্যাখা দিয়াছে?
আলি গোলাম বলেন, মৃগীরোগ নহে, সালেহিনরা পাক ওয়াতান কায়েম করিয়াছে, তোমরা বন্দুক ফুটাও।
তারা বলে, হে আমির, আপনে খোয়াব দেখিতেছেন, কোনো পাক ওয়াতান কায়েম হয় নাই, বন্দুক ফুটাইলে আমাদের বিপদ হইবে।
আলি গোলাম বেদ্বীন বাস্তবে ফিরে এসে সালাত কায়েম করতে বসেন।
আলি গোলামের জাগনাখোয়াবের থেকে ঘুমনাখোয়াব অনেক বেশি আকর্ষণীয়; তার ওই খোয়বে আমাদের বাজার ছেয়ে গেছে, কয়েক দিন আমরা অন্য খোয়াব খরিদ না করে তাঁর ঘুমনাখোয়াব খেয়েই দিন কাটাই। ওই খোয়াবের মাজেজা আমরা বুঝতে পারি না, বোঝার আগেই আমরা ভয়ে চিৎকার করে উঠি, তারপর আবার ওই খোয়াব নিয়ে ফিসফিস করে আলাপ করি।
আলি গোলাম দুটি আতরমাখা কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে শুয়ে ছিলেন শুক্রবার রাতে, একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিলো তাঁর; কে যেনো তাকে ধমকে বলে, ঘুমাও আলি গোলাম। ধমক খেয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।
ঘুমিয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি খোয়াবটি দেখতে শুরু করেন।
আলি গোলাম দেখতে পান তিনি চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন, পরেছেন শুধু শালোয়ার, আর কিছু নেই। বুকের দিকে তাকিয়ে তার চোখে পড়ে পাকা পাকা পশমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, প্রথম বেশ মজা পান তিনি; শীত লাগে নি অথচ পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, বুকটিকে তাঁর একটি খেজুরবাগান বলে মনে হয়, কিন্তু বুকে হাত দিতেই কয়েকটি লোম তার হাতে সুচের মতো বিধে যায়। তিনি তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে আনেন। তিনি উপুড় হতে গিয়ে পারেন না, সুচের মতো পশমগুলো বিধে যেতে থাকে; তিনি আবার চিৎ হয়ে শোন। পেটটি তার জন্মসূত্রেই স্ফীত, কিন্তু পেটের দিকে তাকিয়ে দেখেন পেটটি আস্তে আস্তে ফুলে উঠছে। তিনি বেশ তাজ্জব বোধ করেন, পেট ফোলার কোনো কারণ নেই, সেই সকালে দুটি মুরগি আর দশখান রুটি ছাড়া বিশেষ কিছু তিনি আহার করেন নি। অকারণে পেট ফুলে ওঠায় পেটটিকে তিনি কমিন কমজাত বলে তিরস্কার করেন, কিন্তু পেটটি তার ফুলে উঠতেই থাকে একটু একটু করে।
আলি গোলাম কয়েকটি শ্লোক আবৃত্তি করেন, কিন্তু তাতে পেটের ফোলা থামে না, বরং ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে। তিনি দু-হাতে পেটটিকে চেপে ধরেন যাতে আর ফুলতে না পারে, কিন্তু নদীর জোয়ার কেউ চেপে দমাতে পারে না, তার পেটও বাড়তেই থাকে। একবার তিনি উঠে বাথরুমে যেতে চান, কিন্তু নিজেকে এতো ভারি লাগে যে উঠতে পারেন না; আবার চিৎ হয়ে পড়েন। এখন পেটটি বেশ উঁচু হয়েছে, মোসাম্মৎ গোলাম বিনতে মর্জিনা খাতুনের জন্মের আগে বিবির উদর দেখতে যেমন মরা ভোলা ছাগলের মতো হয়েছিলো তেমন দেখায় তার পেটটি; তিনি বলে ওঠেন, ইহা হইতে পারে না, আমি পুরুষপোলা, আমার পেট হইতে পারে না, আমি সহবত করি নাই।
আলি গোলামের পেট বাড়তে থাকে, ভেতরে একটা খচ্চরের লাশ ঢুকে গেছে বলে মনে হয় তার; তিনি দেখেন সেটি বড়ো বস্তার মতো হয়ে উঠেছে, দু-হাতে বেড় পাচ্ছেন না; চিমটি কাটতে গিয়ে দেখেন চিমটি কাটতে পারছেন না, একবার ঘুষি দিয়ে দেখেন পেটটি লোহার সিন্দুকের মতো শক্ত পেটটি খুবই ভারি হয়ে উঠেছে; এখন তার মনে হয় পেটের ভেতর কী যেনো খটখট ট্রা ট্রা ভোম ভোম করছে, খচ্চর দৌড়াইতেছে, ভেতরে বিস্ফোরণ হচ্ছে। ওই শব্দে তার পেট আর দেহ আর খাট কেঁপেকেঁপে উঠছে। এমন বিস্ফোরণ রাস্তায় হ’লে তার শান্তি লাগতো, কিন্তু পেটের ভেতর হচ্ছে বলে তিনি কষ্ট পাচ্ছেন।
পেটটি আরো ফুলছে আলি গোলামের, ফুলে ফুলে সিলিংয়ে ঠেকে গেছে, সেলিং হয়তো ভেঙে পড়বে, একবার তার মনে হলো পেটটি এক বিশাল উট হয়ে গেছে, যার আট-দশটা কুঁজ, সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে বেড়ে ঘর ভরে ফেলেছে; আলি গোলাম কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না, বিশাল পেটের নিচে তিনি মাছির মতো পড়ে আছেন। আমি কি মাছি, আমি কি তেলাপোকা, আমি কি ইন্দুর, আমি কি টিকটিকি, আমি কি মুরগির ছাও, আমি কি পোটকামাছ? এরকম ভাবনা আসে তার মাথায়, জট পাকিয়ে যায়। ভাবনাগুলো; তিনি একটি দীর্ঘ শ্লোক পড়তে চান, তবে তার মনে আসে না। আমি কাহা, নিজেকে প্রশ্ন করেন আলি গোলাম, আমি কি আছি, আমি কি ছিলাম, আমি কি থাকবো? তাঁর মনে হয় পেটের নিচে তিনি তিনশো চান্দ্র বছর ধরে চাপা পড়ে আছেন; তার পেট আরো ফুলে উঠছে, দেয়াল সিলিং ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে, পোটকামাছের ভেতর অনেকগুলো উট ঠেলাঠেলি করছে। আলি গোলাম চিৎকার করতে চান, পেটের নিচে তাঁর মুখ চাপা পড়ে আছে বলে পারেন না।
তাঁর পেট ফাটে না, অদ্ভুত পেট, ভেতরে ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হয়, তিনি ওই শব্দ শোনার চেষ্টা করেন, ঠিকমতো শুনতে পান না। তিনি ট্রাট্রাট্রাট্রা শুনতে চান, কিন্তু ঘড়ঘড় শব্দ উঠতে থাকে পেট থেকে। আলি গোলাম হঠাৎ বমি করে ফেলেন; বমি বেরোতে না পেরে পেটের নিচে মুখের ওপর ঘন হয়ে জমে থাকে। আলি গোলাম একটি পরিচিত দুর্গন্ধ পান; ওই গন্ধটিকে তাঁর অদ্ভুত মধুর লাগে। একটু পর মুক্তি ঘটতে শুরু হয় আলি গোলামের পেছনের দিক দিয়ে প্রবল বেগে শুরু হয় নিঃসরণ, প্রচণ্ড শব্দ হতে থাকে, তীব্র বেগে তরলতা উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে দিগ্বিদিক; তরল পদার্থের সাথে বেরোতে থাকে একটি দুটি তিনটি চারটি হাজার হাজার লাখ লাখ কোটি কোটি চানতারা, তিনি দেখতে পান, এতে চানতারা নেই আকাশে, চানতারায় তাঁর ঘর ভরে যেতে থাকে, তার শরীর আর মুখের ওপর দিয়ে প্লাবনের মতো প্রবাহিত হতে থাকে তরল চানতারার ঘন স্রোত; আলি গোলাম হাত দিয়ে মুঠো মুঠো চানতারার তরলতা তুলে চিৎকার করেন, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।
আলি গোলামের ঘুম ভেঙে যায়, শুনতে পান বাইরে একপাল কুকুর ডাকছে।
আলি গোলামের খোয়াব, ওই খোয়াবের ইতিবৃত্ত, অভিনবত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে যখন মশগুল ছিলাম আমরা, তখন আমাদের কাছে এসে পৌঁছে খোজারাজবংশের বাবরের খোয়াবের বিবরণ। বাবর সাহেব অনেক বছর আগে শ্রেষ্ঠ খোয়বি হিশেবে নাম করেছিলেন, তাকে আমরা খোয়াববন্ধু, খোয়াবপতি, খোয়াবশিল্পী, খোয়াবকৃষ্ণ প্রভৃতি উপাধিতে বিভূষিত করেছিলাম। তখন তিনি শক্তিশালী ছিলেন, আমাদের খোয়াববিজ্ঞানীরা তার খোয়বাবলি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন যে বিশ্বখোয়াবের ইতিহাসে খোজাবংশের বাবর শ্রেষ্ঠ খোয়াবি; পরে আবার তারাই দেখিয়েছিলেন যে তার খোয়াবগুলো খুবই নিকৃষ্ট, চামাররাও এর থেকে উৎকৃষ্ট খোয়াব দেখে, কেননা ওইগুলো খোয়াব দেখার সাতদিন আগে থেকে পুরোনো সিংগার মেশিনে পুরোনো কাপড়ে শেলাই করা, তালিমারা, জোড়া দেয়া, আঠালাগানো, জংধরা ও পচা। আজকাল তার নাম শুনলেই আমরা হাসি; তার খোয়াবের কথা শুনলে খোয়াব না শুনেই আমরা অতিশয় তৃতীয় শ্রেণীর হাসাহাসি করি।
আমাদের স্বভাবই এই; এককালে যাকে নিয়ে আমরা কাদাকাটি করতাম তাঁকে নিয়ে আজকাল আমরা হাসাহাসি করি। আজকাল যাঁদের নিয়ে আমরা কাদাকাটি করছি আগামীকাল তাঁদের নিয়েও আমরা অতিশয় চতুর্থ শ্রেণীর হাসাহাসি করবো।
খোজারাজবংশের মহাগণনেতা কারাকক্ষের এক কোণে বসে আছেন, এমন সময় খোয়াবটি এসে তাঁকে সরাসরি ধাক্কা দেয়।
কক্ষটি জুড়ে বেশ অন্ধকার, যদিও দুপুরবেলা; দেয়ালের এখান সেখান থেকে চুনকাম খসে পড়েছে, কয়েকটি মাকড়সা সিলিং থেকে সার্কাসের তরুণীদের মতো রগরগে খেলা দেখাচ্ছে, দুটি টিকটিকি হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে তার পা মাড়িয়ে চলে গেলো। একটু দূরে মিলিত হয়েছে দুটি নির্লজ্জ তেলাপোকা।
এমন সময় খোয়াবটি এসে তাকে চাষার মতো সজোরে আক্রমণ করে।
মহাগণনেতা শুনতে পান নগর জুড়ে উৎসবের শব্দ উঠছে, অজস্র বাদ্য বাজছে, লা লাখ কণ্ঠস্বর কী যেনো ধ্বনিত করছে; প্রথম তিনি বুঝতে পারেন না, পরে বুঝতে পারেন নগরের জনগণ তাঁর নাম ধরে উচ্চকণ্ঠে শ্লোগান দিচ্ছে, বাদ্য বাজিয়ে তারা শ্লোগান দিতে দিতে এদিকে আসছে; তিনি স্পষ্ট শুনতে পান তারা জেলের তালা ভাঙবো মহাগণনেতাকে আনবো, তোমার নেতা আমার নেতা মহাগণনেতা মহাগণনেতা, ফুল এনেছি তাজা বেরিয়ে আসো রাজা শ্লোগান দিতে দিতে তারা এদিকে এগিয়ে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে জনগণের বন্যার স্রোতে ভেসে যায় জেলখানা, লাখ লাখ মানুষ ঢুকে পড়ে জেলের ভেতরে। জেলের সব প্রহরী পালিয়ে বাঁচে। জনগণ তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে ঘোষণা করে ‘হে আমাদের রাজা, তুমি আমাদের চিরকালের রাজা; আমরা সব জালিমকে পুড়িয়ে মেরেছি, তোমাকে নিতে এসেছি আমাদের চিরদিনের রাজা করার জন্যে; তুমি আমাদের সম্রাট।’ তিনি দেখতে পান শহরের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীরা (বয়স ৪৫ থেকে ৫৫) চুম্বন করছে তার পদতলে; তারা বলছে, তুমি শুধু দেশের রাজা নও, আমাদের বুকেরও রাজা।
তিনি লাফিয়ে উঠতে গিয়ে দেখেন একটি টিকটিকি ঝুলছে তার কানে (স্থানটি সম্পর্কে বিভিন্নজন বিভিন্ন মত পোষণ করেন)।
রাতে তিনি দেখেন তাঁর ঘুমনাখোয়াবটি।
তিনি দেখতে পান অপরূপ অরণ্যের ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে এক অপরূপবতী নদী, সেই বনে সেই যমুনার পারে সেই ব্রজে তিনি বেড়াচ্ছেন, তাঁর বাহুতে পাঁচতারার মতো ঝলমল করছে এক অপরূপসী; তিনি যেই ঠোঁটে চুমো খেতে যাবেন, একপাল রাক্ষস হৈহৈ করে এসে জোর করে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তার অপরূপসীকে। তিনি তাদের পেছনে ছুটতে গিয়ে দেখেন দুই দিক থেকে লাঙলের মতো দাঁত উঁচিয়ে বল্পমের মতো নখ খাড়া করে কোদালের মতো ঠোঁট ঝুলিয়ে তার দিকে আসছে দুই রাক্ষসী। দূরে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি বুড়ী রাক্ষসী। তিনি দৌড়োতে গিয়ে পিছলে পড়েন; এক রাক্ষসী তাঁর দুই হাত ছিঁড়ে পান্তাভাতের সাথে মুখে গোঁজে আরেক রাক্ষসী তার দুই পা ভেঙে জর্দা বানিয়ে হাতির কানের সমান পানের সঙ্গে খায়, এক রাক্ষসী তাঁর মাথাটি খুলে নিয়ে মারবেল খেলে আরেক রাক্ষসী তার দেহটি ভেঙেচুরে ভর্তা বানিয়ে পোড়া মরিচ দিয়ে আহার করে।
রাক্ষসীরা যখন তাকে আহার করে তখনো তিনি খোয়াব দেখতে থাকেন।
মহাগণনেতার খোয়ব দুটি আলোড়ন তোলে এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে; খোয়াববিদরা বলতে থাকেন এই প্রথম তিনি মৌলিক খোয়াব দেখেছেন, এর মধ্যে কোনো ভেজাল, জোড়াতালি, পচা গন্ধ নেই।
আমরা মহাগণনেতা বাবর মুঘলের খোয়াব নিয়ে এক দিনের বেশি ব্যস্ত থাকতে পারি না, তার খোয়বে মৌলিকত্ব থাকলেও কোনো ভবিষ্যৎ নেই, আমরা গরিবেরাও এটা বুঝতে পারি, তার সবই অতীত; আমরা মৌলিক ও ভবিষ্যসম্পন্ন খোয়াবের জন্যে অধীর অপেক্ষা করতে থাকি, এবং পর দিন ভোরবেলার মধ্যেই ঝাঁকে ঝাঁকে ট্রাকে বাসে বিপুল পরিমাণ সম্ভাবনাপূর্ণ খোয়াব আমাদের হাটেবাজারে মাঠেঘাটে জমিতে বাড়িতে এসে পৌঁছোতে থাকে। সবচেয়ে মৌলিক মূল্যবান ভবিষ্যৎগর্ভ খোয়ব হচ্ছে দুই মহারানীর, কুইন ভিক্টোরিয়া ও সুলতানা রাজিয়ার–মহাদেশনেত্রী ও মহাজননেত্রীর খোয়াব, তাদের গিঁটেই বাধা আমাদের জীবন, বিশেষ করে মৃত্যু–এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, মৃত্যুই আমাদের জীবন; তাদের নখের লালের ওপর নির্ভর করে আমাদের জীবন–এটা আমাদের জন্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটাই আমাদের মৃত্যু, তাঁদের–পায়ের আঙুলের ব্যথার ওপর নির্ভর করে আমাদের মৃত্যু, তাঁদের ঘোমটার পরিধির ওপর নির্ভর করে আমাদের জমির শস্য, তাদের ঘুম থেকে জাগার ওপর নির্ভর করে আমাদের নদীর জল। তারা অবশ্য নিজেদের জন্যে খোয়াব দেখেন না, দেখেন আমাদের জন্যে; আমরা শুনতে পাই দিনরাত তারা খোয়াব দেখছেন, জাগনা আর ঘুমনাখোয়াবের তাণ্ডবে তাদের চোখ লাল নীল সবুজ বেগুনি হলদে কালো হয়ে আছে।
তাদের জাগনাভোয়াব আর ঘুমনাখোয়াবের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকছে না; যা দেখতে পারতেন তারা দুপুরবেলা তা তারা দেখছেন মধ্যরাতে; যা দেখতে পারতেন মধ্যরাতে তা দেখছেন সকাল সাড়ে সাতটায় বা দশটায় দুপুর দেড়টায় বিকেল পাঁচটায়। আমরা টের পাই তাদের ঘুম আর জেগে থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, ঘুম তাদের জন্যে জেগে থাকা আর জেগে থাকা তাদের জন্যে ঘুম। যাদের স্যান্ডেলের নিচে ভবিষ্যৎ তাদের মগজ ঘুম জানে না জাগা জানে না।
মহাদেশনেত্রী জাগনাভোয়াবে দেখেছেন–(এটা ঘুমনাখোয়ব হওয়ারই কথা, তবে ঘুম হচ্ছে না বলে জাগনাখোয়বেই তিনি দেখে ফেলেছেন, ফাইভের বইতে এমন খোয়াবের কথা তিনি হয়তো পড়েছিলেন বা দাদীর কাছে শুনেছিলেন কোনো সন্ধ্যায়, দীর্ঘকাল পরে সেটা তাঁর ভেতর থেকে সহজে জেগে উঠেছে)–আকাশে দশটি নীল আর লাল নতুন তারা উঠেছে, ধীরেধীরে সেগুলো একটি মুকুটে পরিণত হলো, অজস্র শাদা তারারা নেচে নেচে ওই মুকুট পরিয়ে দিলো তার মাথায়, আর আকাশের পশ্চিম থেকে উঠে এলো একটি সিংহাসন, তারারা তাকে সিংহাসনে বসিয়ে নত হয়ে চুম্বন করলো পদতলে।
খুবই উত্তম রাজকীয় ফিলিস্তিনি খোয়াব এটি, তাঁর রাজবংশের রাজপুত্ররা এতে গভীর ইঙ্গিত পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠলেন, আমরাও হৈচৈ শুরু করলাম। আমরা বুঝতে পারলাম হেলিকপ্টারে চড়ে আগামী বছরগুলোর বন্যা আর তুফানের সুন্দর দৃশ্যরাশি তারাই দেখবেন।
কিন্তু ঘুমনাখোয়াবে তিনি দেখলেন আকাশে বিশটি লাল আর সবুজ নতুন তারা উঠেছে, সেগুলো ধীরধীরে একটি অপূর্ব মুকুটে পরিণত হলো, অজস্র তারারা সেই তারার মুকুট তার মাথায় পরানোর জন্যে এগিয়ে আসছে, অমন সময় এক ডাইনি রাহু এসে ছোঁ মেরে সেই মুকুট নিয়ে নিজের মাথায় পরলো, তাঁর দিকে ছুঁড়ে দিলো মেঘ ঝড় অন্ধকার; তিনি অন্ধকারে চিৎকার করে উঠলেন।
খোয়াবটি কয়েক ঘণ্টা গোপন ফাইলে চেপে রাখা হয় পাথর দিয়ে, কিন্তু খোয়াবেরও নিজস্ব প্রাণশক্তি আছে বলে কেঁচোর মতো লিকলিক করে প্রকাশ পেয়ে যায়; তাঁর রাজপুত্ররা এতে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন, আমরাও উদ্বিগ্ন হই। আমরা বুঝতে পারি হেলিকপ্টারে চড়ে আগামী বছরগুলোর বন্যা আর তুফানের সুন্দর দৃশ্যরাশি অন্যরা দেখবেন।
মহাজননেত্রী জাগনাখোয়াবে দেখেছেন কোটি কোটি মানুষ মুকুট আর সিংহাসন মাথায় করে আসছে তার বাড়ির দিকে, তারা খুঁজছে তাদের প্রাণপ্রিয় রাজকন্যাকে, এবং তাঁর মাথায় পরিয়ে দিচ্ছে মুকুট, নাচতে নাচতে তাঁকে বসাচ্ছে সিংহাসনে। আমরা বুঝতে পারি আগামী বছরগুলোতে বারবার বিদেশভ্রমণে তিনি ও তাঁরাই যাবেন।
মহাজননেত্রী ওই রাতেই ঘুমনাখোয়াবে দেখেন কোটি কোটি মানুষ মুকুট আর সিংহাসন মাথায় করে আসছে তার বাড়ির দিকে, তারা খুঁজছে রাজকন্যাকে, এবং তাঁর মাথায় পরিয়ে দিচ্ছে মুকুট, এমন সময় এক ডাইনি এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় তার মুকুট ও সিংহাসন। আমরা বুঝতে পারি আগামী বছরগুলোতে বারবার বিদেশভ্রমণে অন্যরা যাবেন।
মহাদেশনেত্রী জাগনাখোয়াবে দেখেছেন ইরিক্ষেতের পর ইরিক্ষেতে (অবশ্য কোনো দিন বাস্তবে তিনি ইরিক্ষেত বা পাটক্ষেত বা কোনো ক্ষেতই দেখেন নি, তাঁর উঁচু হিলে মাটি লাগবে ব’লে, তবে দেশকে ভালোবাসেন বলে ক্ষেত জাতীয় ব্যাপারগুলোকে দেখার কাজ তিনি স্বপ্নেই সম্পন্ন করেন) সোনার গাছে হীরের পাতা আর মুক্তোর শীষ দেখা দিয়েছে। আমরা বুঝতে পারি আগামী বছরগুলোতে টেলিভিশনে আর সংবাদপত্রে দিনরাত শুধু তাকেই দেখা যাবে।
তিনি ঘুমনাখোয়াবে দেখেছেন ইরিক্ষেতের পর ইরিক্ষেতে এবং আর যতো ক্ষেত (কী কী ক্ষেত আছে সে সম্পর্কে তার ধারণা রাজকীয়ভাবে অস্পষ্ট) আছে আর শীষ আছে, তাতে পোকা লেগেছে, সব শীষ পচা পোকার মতো পড়ে আছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত (তিনি অবশ্য স্বপ্নে দেখা এলাকা সম্পর্কে নিশ্চিত নন, কেননা দেশটির পুব বা পশ্চিম উত্তর দিকে না দক্ষিণ দিকে এ সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত নন), পঙ্গপালে ঢেকে গেছে সূর্য। আমরা বুঝতে পারি আগামী বছরগুলোতে টেলিভিশনে আর সংবাদপত্রে দিনরাত অন্য একজনকেই দেখা যাবে।
মহাজননেত্রী জাগনাখোয়াবে দেখেছেন পদ্মা মেঘনা যমুনা ব্ৰহ্মপুত্ৰ কর্ণফুলি বুড়িগঙ্গা কাঁকড়া কারাঙ্গি ইছামতি মধুমতি সুরমা শীতলক্ষা গোমতি কপোতাক্ষ করতোয়া তুরাগ আরো যতো নদী আছে সব নদী দিয়ে প্রবল বেগে বইছে জলধারা, আর নদীতে পুকুরে খালে বিলে ভাসছে লাখ লাখ সোনার তরী। আমরা বুঝতে পারি আগামী বছরগুলোতে এ-বংশের রাজপুরুষেরাই পথে পথে স্থাপন করবেন ভিত্তিপ্রস্তর, উদ্বোধন করবেন সেতু সিনেমা হল মুদিদোকান।
তিনি ঘুমনাখোয়াবে দেখেছেন পদ্মা মেঘনা যমুনা ব্ৰহ্মপুত্ৰ কর্ণফুলি বুড়িগঙ্গা কাঁকড়া কারাঙ্গি ইছামতি মধুমতি সুরমা শীতলক্ষা গোমতি কপোতাক্ষ করতোয়া তুরাগ আরো যতো নদী আছে সব শুকিয়ে সাহারা হয়ে গেছে, ছাইয়ের মতো বালিতে ঢেকে গেছে সুন্দরবন থেকে সাজেক, একদা নদী পুকুর খাল বিলে পড়ে আছে তরীর অজস্র অদ্ভুত ভাঙাচোরা বিশ্লিষ্ট কঙ্কাল। আমরা বুঝতে পারি আগামী বছরগুলোতে অন্য বংশের রাজপুরুষেরাই পথে পথে স্থাপন করবেন ভিত্তিপ্রস্তর, উদ্বোধন করবেন সেতু সিনেমা হল মুদিদোকান।
মহাদেশনেত্রী জাগনাখোয়াবে দেখেছেন তিনি ফুলবনে দখিনা মলয়ে ছন্দে ছন্দে বনফুলের মতো আনন্দে দুলছেন; তার ওপর ঝরে পড়ছে শিউলি বকুল পারুল বেলি মল্লিকা। আমরা বুঝতে পারি আগামী বছরগুলোতে তার বংশের রাজপুত্ররা ব্যাংক থেকে যত খুশি ততো কোটি ডলার তুলে নিয়ে শিল্পপতি হবেন।
তিনি ঘুমনাখোয়াবে দেখেছেন তার চারদিকে আগুন লেগেছে, দাউদাউ দাবানলে কাগজের মতো পুড়ছে বন আর ফুলবন আর দোলনা। আমরা বুঝতে পারি আগামী বছরগুলোতে অন্য বংশের প্রিয়রা আর রাজপুত্ররা ব্যাংক থেকে যতো খুশি ততো কোটি ডলার তুলে নিয়ে শিল্পপতি হবেন।
মহাজননেত্রী জাগনাখোয়াবে দেখেছেন দেশের ৭২৯জন আধুনিক, উপাধুনিক, প্রাগাধুনিক, পরাধুনিক, গলাধুনিক, স্তবাধুনিক কবিয়াল.তার ও তার বংশের নামে ১২৫টি নতুন ছন্দ আবিষ্কার করে পাঁচ হাজার টন পদ্য উৎপাদন করেছেন, আরো তিন হাজার টন পাইপলাইনে রয়েছে, কয়েক দিনের মধ্যেই উৎপাদিত হয়ে গলগল করে পথে পথে ঝরে পড়বে। আমরা বুঝতে পারি আগামী বছরগুলোতে তাঁর বংশের মহারাজের নামে নামকরণ করা হবে দেশের সব পথঘাট বিমানবন্দর সেতু সারকারখানা খেলার মাঠ বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি ঘুমনাখোয়াবে দেখেছেন কবিয়ালদের পদ্যগুলো স্তব নয়, প্রচণ্ড শ্লোগান, কাঁপছে পথঘাট শহর গ্রাম দালানকোঠা গাছপালা। আমরা বুঝতে পারি আগামী বছরগুলোতে সব পথঘাট বিমানবন্দর সেতু সারকারখানা খেলার মাঠ কাঁচাবাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হবে অন্যবংশের রাজাধিরাজের নামে।
এই সব স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের মধ্যে আছেন আমাদের রাজারা, আছি আমরা; চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে খোয়াবের কলেরা।
আমরা শুনতে পাই শক্তির উৎসবাদী রাজবংশের অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু, জেনারেল কেরামতউদ্দিন, সোলায়মান হাওলাদার খুবই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন, নিশ্বাস নেয়ার, এমনকি উপপত্নীদেরও এক-আধঘণ্টা দেয়ার মতো সময় পাচ্ছেন না, সময়ের বড়োই অভাব; কিছুটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন রাজবংশটিকে গুছিয়ে আনার জন্যে তারা মহান জেনারেলকে মনে ও তার আদর্শে অবিচল আস্থা রেখে আপ্রাণ সাধনা করে চলছেন। কিছু দিন আগেও তারা রাজা ছিলেন, তারপর এমন হলো যে মনে হচ্ছিলো পাজেরো আর মার্সিডিস ফেলে পালিয়ে যেতে হবে শহর থেকে পালাতে গিয়ে মনে পড়লো পালাবেন কেনো? তারা কি জনগণের হৃদয়ের ধন ছিলেন না? কিছু দিন আগেও কি তাঁরা দশ কেজি বিশ কেজি ওজনের ফুলের মালা গলায় পরেন নি জনগণের হাত থেকে? দু-মাস আগেও কি একটা সফল, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে তারা দেশকে বাঁচান নি? তাঁরা দেশ না বাঁচালে কে বাঁচাতো? না হয় আর কোনো দল নির্বাচনে অংশ না-ই নিয়েছিলো, সেগুলো গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না বলে অমন সুন্দর নির্বাচনটিতে অংশ নেয় নি; কিন্তু তারা কি নির্বাচন করে জয়লাভ করেন নি? এখন কি জনগণ তাদের শহর থেকে বের করে দিতে চায়? জনগণকে অবশ্য বিশ্বাস করা যায় না; হারামজাদারা কখন কারে মালা দিবো, কোন নাঙ্গের লগে ঘুমাইবো, কারে সিংহাসনে বসাইবো তার ঠিক নাই। তবে আসল বদমাইশ ওই জনগণমন রাজবংশের শয়তানগুলো, জনগণ যাদের চায় না, যাদের তিনশো বছরের মধ্যেও রাজা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, কিন্তু রাজা হওয়ার জন্যে যারা কার্তিকের কুত্তার মতো পাগলা হয়ে উঠেছে, তারাই নানা মিথ্যে কথা বলে বাস্ট্রাক ভেঙে আগুন লাগিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলেছে জনগণকে। আর আছে হাড্ডিতে হাড়িতে শুয়ারের বাচ্চা আমলাগুলো;–ওইগুলোকে সকালে বিকেলে মাগরেবে এশায় এতো প্রমোশন দেয়া হলো, কোটি কোটি টাকা চুরি করার সুযোগ দেয়া হলো, পরস্পরের বউ ভাগানোর জন্যে এতো পুরস্কার দেয়া হলো, তবু বাঞ্চতগুলো রাস্তার দিকে ছুটলো, জনগণমন রাজবংশের বাঁশের কেল্লায় লাফিয়ে উঠে গলা ফুলিয়ে চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিলো। দেখে নেয়া হবে সময় এলে, একটাকেও ছাড়া হবে না।
তখন শহরের গাছপালাগুলোর ডালপালা থেকে পথে পথে পাতা ঝরে পড়ছে, অমন নিষ্ঠুর সুন্দর সময়ে শহর ছেড়ে প্রায় পালিয়ে যাওয়ার উপক্রম করেছিলেন এ-বংশের রাজপুরুষেরা, তাঁদের দুর্ধর্ষ রাজপুত্ররা–এতো ভয় তারা আর কখনো পান নি; কিন্তু পালানোর জন্যে বেরিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু, জেনারেল কেরামত, সোলায়মান হাওলাদার, বিশেষ করে অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু; এবং রুখে দাঁড়ানোর ফল পাওয়া গিয়েছিলো সঙ্গে সঙ্গে। জনগণমনের দুষ্কৃতিকারীগুলো তাদের তাড়া করে ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু যেই রুখে দাঁড়ালেন অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু, নিজেদের বাঁশের কেল্লা বানিয়ে ঘোষণা করলেন চোখের বদলে চোখ নাকের বদলে নাক ছিঁড়ে নেয়া হবে, তাদের দিকে একটুকু হাতপা বাড়ালে হাতপা গুড়ো করে দেয়া হবে, তখন থমকে দাঁড়ালো জনগণমনের দুষ্কৃতিকারীগুলো, তারা ভয়ই পেয়ে গেলো; এবং এক বিকেলে অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু নতুন করে পরিণত হলেন নায়কে।
আমরা জনগণরা কোনো দিন বুঝতেই পারি নি যে অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টুর থলথলে বুকে এতো সাহস, গলা এতো উচ্চ, কণ্ঠে এতো বজ্র। সুযোগ থাকলে নতুন কোনো দেশের তিনি জাতির পিতা হতে পারতেন; এক গর্জনে তিনি দেশছাড়া করতে পারতেন দখলদার বাহিনীকে।
অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু কেল্লায় ওঠেন প্রথম বক্তৃতা দিতে, বা তাকেই প্রথম বক্তৃতা দেয়ার জন্যে কেল্লায় ওঠানো হয়; এবং তার প্রথম কথায়ই সবাই গর্জন করে ওঠে তার সাথে, বিকেল ও সন্ধ্যে ভরে তিনি একলাই বক্তৃতা দেন। তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তার বজ্রকণ্ঠের পর আর কারো বক্তৃতা দেয়ার সাহস হয় না, দরকারও হয় না; অন্যরা শুধু তার সাথে শ্লোগান দিতে থাকেন চারপাশ কাপিয়ে, আর শহরের নানা দিক থেকে শক্তির উৎসবাদী দলের প্রজারা এসে পথের উত্তর থেকে দক্ষিণ কোণ পর্যন্ত কানায় কানায় ভরে ফেলে নিজেদের ঝকঝকে জিনিশগুলো জামার নিচে নিয়ে দৌড়ে আসতে থাকেন দলের দুর্ধর্ষ ক্যাডার বা রাজপুত্ররা, যারা দুপুরেও শহর ছেড়ে চুপচাপ পালিয়ে গিয়ে জনগণমন রাজবংশে যোগ দেয়ার কথা গভীরভাবে বিবেচনা করছিলেন। তাঁরা জানেন ক্যাডারদের কোনো দিন অমর্যাদা হয় না, ক্যাডার সর্বত্র পূজিত।
অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু প্রথম গলা খুলেই বলেন, উৎসবাদী রাজবংশের দুর্ধর্ষ বীরেরা, বুলডজারের মতো সিপাহিরা, তোমরা রুইখ্যা দারাও।
সঙ্গে সঙ্গে গর্জন করে ওঠে সবাই, আমরা রুইখ্যা দারাইছি, আমরা রুইখ্যা দারাইছি। তাদের গর্জন দশ মিনিট ধরে চলতে থাকে।
তিনি বলেন, এই দিকে অরা এক পাও বাড়াইলে তোমরা অগো হাত পাও মাথা ছাতু কইরা দিবা, মগজ ভর্তা কইর্যা দিবা, চউক্ষের বদলে চউক্ষু নিবা, নাকের বদলে নাক নিবা, অগো শহর থিকা বাইর কইর্যা দিবা।
তাঁর বক্তৃতা শুনে উত্বাদী দলের রাস্তায় নোক উপচে পড়ে, দুর্ধর্ষ ক্যাডাররা আকাশের দিকে তুবড়ি ছুঁড়তে থাকে, দূর থেকে শুনে ভয়ে আমরা জনগণরা কাঁপতে থাকি; আর এ-সংবাদ দুই মাইল দূরে জনগণমন বংশের রাস্তায় ও কেল্লায় গিয়ে পৌঁছলে জনগণমন বংশের রাজপুরুষরা ও ক্যাডাররা ডরে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। খুব ভয় পান তারা, তাই কয়েক মুহূর্ত তারা বরফের মতো জমে থাকেন, গলা দিয়ে তাদের গর্জন বেরোতে চায় না। জমাট গর্জন তাঁদের গলায় আটকে থাকে। জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশের ভয়টা, আমাদের মনে হয়, দু-রকম: প্রথম ভয়টা হচ্ছে ক্যাডারে ক্যাডারে লাগলে তারা হয়তো পেরে উঠবেন না, তাদের ক্যাডারগুলোরে ভালো করে তৈরি করা হয় নি, আর দ্বিতীয় ভয়টা হচ্ছে এ-সময় যদি কোনো গোলমাল হয়ে যায়, যদি দেশের বড়ো ক্যাডাররা নেমে পড়ে, তাহলে তাদেরও পালাতে হবে, সব মাটি হয়ে যাবে। বড়ো ক্যাডাররা নামলে তো আবার দশ বছর। সব মাটি করার জন্যে কি তারা তিন বছর ধরে এতো দামি দামি ঘাম ফেললেন? তাদের মাথার ঘামের বড়ো বড়ো ফোঁটায় শহরের পথঘাট ভিজে গেছে, তাই তারা এমন সময়ে এমন কাজ করতে পারেন না, যাতে সব কিছু বাঙলাদেশের মাটির থেকেও মাটি হয়ে যায়।
রুখে দাঁড়ানোর কয়েক দিন আগে অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু, জেনারেল কেরামতউদ্দিন, আর সোলায়মান হাওলাদারের মাথায় আরেকটি অব্যর্থ বুদ্ধিও এসেছিলো, কিন্তু সেটি তারা বাস্তবায়িত করতে পারেন নি; পারলে আর রুখে দাঁড়ানোর দরকার হতো না, তারাই এখনো থাকতেন রাজা; জনগণমনদের লেজ নামিয়ে পথ থেকে সরে যেতে হতো। আমরা মূর্খ জনগণরা রাজনীতির আর কী বুঝি? রাজনীতির রয়েছে দশ কোটি কানাগলি, পাঁচ কোটি উপগলি, সাতাশ লক্ষ ষড়যন্ত্র, বত্রিশ লক্ষ বদমাশি, আরো কতো রাজকীয় ব্যাপার; রাজকীয় কারবারে সবই সুন্দর যদি শুধু ক্ষমতা হাতের মুঠোয় থাকে। জনগণমন রাজবংশের রাজপুরুষরা যখন কেল্লা বানিয়ে রাস্তা জুড়ে গোলমাল করে চলছেন, তিন চারটা মোটাগাটা আমলা যখন কেল্লায় উঠে বড়ো বড়ো বক্তৃতা ঝাড়ছেন গণতন্ত্রের জন্যে, তখন অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু, জেনারেল কেরামতউদ্দিন, সোলায়মান হাওলাদার বুঝতে পারেন গোলমালের মূল কোনো মোটাগাটা আমলা নয়, কোনো বড়ো রাজপুরুষ নয়, মূল হচ্ছে একটি রোগাপটকা দারোয়ান। ওই দারোয়ানটাই সব নষ্টের মূল, সবচেয়ে শক্তিমান।
ওই রোগাপটকা দারোয়ানটির নাম মোঃ হামিদ মিয়া।
মোঃ হামিদ মিয়া দারোয়ান, তবে তিনি শুধু দারোয়ান নন। মোটাগাটাচ্যাপ্টা আমলাদের জন্যে দেয়াল দিয়ে ঘিরে যে একটি বিশাল প্রাসাদপল্লী বানিয়ে দেয়া হয়েছে, হামিদ মিয়া সেখানকার দারোয়ান; তবে তিনি নেতা, ওই প্রাসাদপল্লীর নিম্নবর্ণের কর্মচারীদের তিনি এক নম্বর নেতা। তিনি বিদ্রোহ করেছেন বলেই ওই প্রাসাদপল্লী ভেঙে পড়েছে, তাঁর আদেশেই নিম্নবর্ণের কর্মচারীরা গলা ধাক্কা দিয়ে প্রাসাদপল্লী থেকে বের করে দিয়েছেন শক্তির উৎসবাদী রাজবংশের রাজাদের। তিনি দেখা দিয়েছেন প্রচণ্ড শক্তিমান রূপে। মোঃ হামিদ মিয়া নিয়ন্ত্রণ করছেন প্রাসাদপল্লী, তাঁর কথায় সবাই উঠছে বসছে, এবং তিনি গিয়ে উঠেছেন জনগণমন রাজবংশের বাঁশের কেল্লায়। বাঁশের কেল্লায় দাঁড়িয়ে মোঃ হামিদ মিয়া অগ্নিগিরির মতো বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছেন, আর তাতে কেঁপে উঠছে নগর।
অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু, জেনারেল কেরামতউদ্দিন, সোলায়মান হাওলাদার খোঁজ নিতে থাকেন, বুঝতে পারেন মোঃ হামিদ মিয়াই মূল শক্তি; তাঁকে বশ করা গেলে থেমে যাবে ওই বাঁশের কেল্লার বিপ্লব।
দ্রুত পান করতে করতে তাঁরা তাঁদের কর্মপদ্ধতি স্থির করছিলেন।
অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু বলেন, হামিদ মিয়াটাই নষ্টের মূল, ওই ব্যাটাই খ্যাপাইয়া তোলছে সচিবালয়, কুত্তারবাচ্চারে আমিই ঢুকাইছিলাম।
জেনারেল কেরামতউদ্দিন বলেন, কয়টা ক্যাডার লাগাই দেই, দে উইল সলভ দি প্রব্লেম বিফোর ডন।
সোলায়মান হাওলাদার বলেন, ক্যাডাররা আরেকটা নতুন গোলমাল পাকাইয়া তোলতে পারে, ক্যাডার দিয়া কাম হবে না।
অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু বলেন, মিলিটারি অ্যাকশনে এখন হইবো না, এখন দরকার পলিটিক্যাল অ্যাকশন। হামিদ মিয়া আইজকাল একটা বড় ন্যাতা হইছে, জনগণমনআলাগো বড়ো বড়ো ন্যাতার লগে ওঠছে বসছে, তাই তারে পলিটিক্যালি ট্যাকেল করতে হইবো।
জেনারেল কেরামতউদ্দিন গেলাশটি শেষ করে আরেক গেলাশ ভরতে ভরতে জিজ্ঞেস করেন, হাউ উইল ইউ ট্যাকেল দি বাস্টার্ড?
অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু বলেন, অর লগে আইজ রাইতেই যোগাযোগ করতে হইবো, লাখ পাঁচেক ট্যাকা গছাইয়া দিতে পারলে ও চুপ কইর্যা যাইবো।
সোলায়মান হাওলাদার জিজ্ঞেস করেন, ব্যাটারে পাওন যাইব কই? অইটা তো জনগণমনআলাগো বড়ো বড়ো ন্যাতাগো পাশই ছাড়ে না।
অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু বলেন, হাওলাদার সাব, আপনে ত আর পলিটিক্সে জ্যানারেল ভাইর মতো নিউকামার না, এত বামপন্থী ডাইনপন্থী পলিটিক্স কইরাও আপনে হোল টুথটা বোঝতে পারতেছেন না।
সোলায়মান হাওলাদার গেলাশটা শূন্য করতে করতে বলেন, অধ্যক্ষ ভাইর মতন পলিটিশিয়ান আইজও হইতে পারলাম না, অধ্যক্ষ ভাই হইছেন আমাগো পলিটিক্সের প্রিন্সিপাল, পলিটিক্সের ভাইচচ্যাঞ্চেলার। এখন হোল ট্ৰথটা বুঝাইয়া বলেন।
অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু বলেন, মোঃ হামিদ মিয়া আইজকাল ক্ষমতার স্বাদ পাইছে, কেল্লায় উইঠ্যা সামনে এত মানুষ দেইখ্যা পাগল হইয়া গেছে, প্রত্যেক পলিটিশিয়ানই সামনে মানুষ দেইখ্যা পাগল হইয়া যায়। মদ খাওনের মতন লাগে। বড়ো বড়ো ন্যাতাগো লগে থাইক্যা সেও নিজেরে বড়ো ন্যাতা ভাবতেছে। আর আমার মনে হয় ওই জনগণমনআলারাও তারে ছাড়তেছে না, সে যাতে ভাইগ্যা না যায় সেই কারণে হামিদরে সব সময় পাশে পাশে রাখতেছে। তবে আইজ রাইতেই তার লগে কন্টাক্ট করতে হইবো।
মোঃ হামিদ মিয়ার সাথে কন্টাক্ট করার জন্যে অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু রাতেই জনপাঁচেক দূত নিয়োগ করেন।
অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু দক্ষ রাজপুরুষ; তিনি দূত হিশেবে কোনো পরিচিত রাজপুরুষকে পাঠান না; সাংবাদিক হিশেবে পাঠান দুজনকে, পাঠান আমলাপল্লীর দুজন নিম্নবর্ণের কর্মচারীকে, এবং আরো দু-একজনকে।
কিন্তু তারা কোথাও মোঃ হামিদ মিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন না। মোঃ হামিদ মিয়া রাতে বাসায় ফেরেন না; কেল্লার মঞ্চে তাঁকে দেখা যায়, কিন্তু তাঁর কাছে যাওয়া সম্ভব হয় না। কেল্লা থেকে নেমেই মোঃ হামিদ মিয়া জনগণমন রাজবংশের দুই রাজপুরুষের সাথে কোথায় যেনো মিলিয়ে যান।
বুদ্ধিটা কয়েক দিন আগে আসে জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশের নিজামউদ্দিন। আহমদ ও মোহাম্মদ আবদুল হাইয়ের মাথায়। মোঃ হামিদ মিয়া আমলাপল্লীতে যেদিন তোলপাড় সৃষ্টি করে ফেলেন, নিজের হাতে গ্রহণ করেন আমলাপল্লীর শাসনভার, সেদিনটিকে লাল অক্ষরে লেখা দিন হিশেবে গণ্য করেন নিজামউদ্দিন আহমদ ও মোহাম্মদ আবদুল হাই; তারা দ্রুত গিয়ে দেখা করেন মোঃ হামিদ মিয়ার সাথে, এবং তাকে এনে তোলেন তাঁদের বাঁশের কেল্লায়।
মোঃ হামিদ মিয়া বাঁশের কেল্লার মঞ্চে দাঁড়িয়ে সামনে জনসমুদ্র দেখে প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়তে চান, পরে তিনি শক্ত হন; তার মনে হয় তিনি ওই জনগণের মাথার ওপর তার পা দুটি রেখে দাঁড়িয়ে আছেন।
বক্তৃতা দিতে উঠে আরো বদলে যান মোঃ হামিদ মিয়া। তার মনে হতে থাকে তার কণ্ঠ থেকে একটির পর একটি ঠাঠা গর্জন করতে করতে গিয়ে পড়ছে বড়ো বড়ো আমগাছের ওপর, জামগাছের ওপর, ধানক্ষেতে পাটক্ষেতে; আর চারদিক দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে। তাঁর মনে হতে থাকে তিনি সাপুড়ে, সাপ খেলা দেখাচ্ছেন; তাঁর বাঁশিতে সাপের মতো দুলছে সামনের জনগণ। তাঁর মনে হতে থাকে ওগুলো মানুষ নয়, ওগুলো তাঁর হাতের পুতুল; তিনি যেভাবে আঙুল নাড়ছেন সেভাবেই নাচছে ওই পুতুলগুলো।
এক জন্মে মানুষ, আর ওই ছাগল ভেড়া গরু গাধা, বহুবার জন্ম নেয়; বাঁশের কেল্লায় মোঃ হামিদ মিয়ারও নতুন জন্ম হয়; তিনি আমলাপল্লীর নেতা থেকে জননেতা হয়ে ওঠেন।
নিজামউদ্দিন আহমদ ও মোহাম্মদ আবদুল হাই বিশাল সম্ভাবনা আর বিকট ভয় দেখতে পান মোঃ হামিদ মিয়ার মধ্যে।
বাঁশের কেল্লার সভা শেষ হলে নিজামউদ্দিন আহমদ ও মোহাম্মদ আবদুল হাই পাজেরোতে উঠিয়ে মোঃ হামিদ মিয়াকে নিয়ে আসেন গুলশানে নিজামউদ্দিন আহমদের ভবনে।
নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, ভাই হামিদ মিয়া, চল্লিশ পাঁচপল্লিশ বচ্ছর ধইরা পলিটিক্স করতেছি, পাকিস্থানিগো বকতিতা দিয়া কাঁপাই দিতাম; কিন্তু ভাই আপনের মতন বকতিতা আইজও দিতে পারি না।
মোঃ হামিদ মিয়ার পাঁজরের হাড়গুলো অনেকখানি ফুলে ওঠে, তাঁর সামনের নেতা দুটিকেও তার মনে হয় তুচ্ছ; সাজানো ড্রয়িংরুমটিকেই তাঁর মনে হয় বাঁশের কেল্লা, তাঁর গলা থেকে গলগল করে বক্তৃতা বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু হামিদ মিয়া বক্তৃতা দেন না, কথা বলেন।
মোঃ হামিদ মিয়া বলেন, বকতিতা দেওন কোনো কামই না, ছার, পান্তাভাত খাওনের মতন, আমি বকতিতা দিয়া রোডে বিল্ডিংয়ে আগুন লাগাই দিতে পারি। আপনেগো বকতিতা হুইন্যা হুইন্যাই বকতিতা শিকছি, ছার।
নিজামউদ্দিন ও আবদুল হাই টের পান লোকটি বেশ নির্বোধ অহমিকাপূর্ণ, শস্তা রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্যে সর্বাংশে উপযুক্ত; সে শক্তির উৎসবাদীদের জন্যে যেমন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে তেমনি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে তাদের জন্যেও। তাই তাকে তৃপ্ত রাখতে হবে, এবং রাখতে হবে সন্ত্রস্ত; আর রাখতে হবে পরোক্ষভাবে বন্দী। তাকে তৃপ্ত, ব্ৰস্ত, বন্দী রাখা বিশেষ কঠিন হবে না; মনে হচ্ছে সহজেই সে ফুলে ওঠে, পাজেরোতে উঠতে গৌরব বোধ করে, আর তাদের সঙ্গলাভে জাতীয় নেতার মহিমা লাভের সুখ পায়।
আবদুল হাই বলেন, হামিদ ভাই, আপনে যে কী কন; আইজ আপনের বকতিতা শুইন্যা ত মনে হইল আপনের কাছেই আমাগো শিখনের অনেক কিছু আছে; এক বকতিতায়ই ত আপনে জাতীয় ন্যাতা হইয়া গ্যাছেন, আমাগো লাগছে চল্লিশ পাঁচচল্লিশ বচ্ছ।
মোঃ হামিদ মিয়া বলেন, আইজ, ছার, গলাটায় একটু ব্যাদনা আছিলো, নাইলে আরও আগুন জ্বালাই দিতে পারতাম, আরও পোরাইতে পারতাম, কাইল সব ঠিক হইয়া যাইবো দেইখ্যেন, ছার।
নিজামউদ্দিন বলেন, আপনের ভবিষ্যৎ খুবই ভাল, হামিদ ভাই, জনন্যাতা ত আপনে হইয়াই গ্যাছেন, আমাগো দিন আইলে আপনে মন্ত্রী নাইলে হাউজ বিল্ডিংয়ের চ্যায়ারম্যান নাইলে অ্যামবাসাডারও হইতে পারেন।
হামিদ মিয়া বেশ ফুলে ওঠেন, সামনের খাবার গোগ্রাসে গিলতে থাকেন, বাঁশের কেল্লায় এই মুহূর্তেই আবার তাঁর লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে।
হামিদ মিয়া বলেন, রাজনীতি ত করি, ছার, জনগণের লিগা, মন্ত্রী আর চ্যায়ারম্যান হওনের লিগা না; তয় মন্ত্রীগো গাড়ি আর ফ্যালাগ দেইখ্যা দেইখ্যা মাঝে মইধ্যে মন্ত্রী হওনেরও মন চায়।
নিজামউদ্দিন ও আবদুল হাই এততক্ষণ পড়ছিলেন লোকটিকে, এবার তাদের পড়া শেষ হয়; শেষ পাতা পর্যন্ত পড়ে লোকটিকে তারা মুখস্থ করে ফেলেছেন; লোকটির কোনো বানান আর বাক্য তাঁদের ভুল হবে না।
আবদুল হাই বলেন, আমরা পাওয়ারে আসলে মন্ত্রী আপনে অবশ্যই হইবেন, হামিদ ভাই, তবে আপনের একটু সাবদানে থাকতে হইবো। আমরা যা খবর পাইছি, তাতে খুব চিন্তার মইধ্যে আছি, সেইজইন্যেই ত আপনেরে সাথে কইরা লইয়া আসলাম, একলা ছাইর্যা দিতে পারলাম না।
কথাটি শুনে ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠেন মোঃ হামিদ মিয়া।
মোঃ হামিদ মিয়া কেঁপে কেঁপে জিজ্ঞেস করে, ক্যান সাবদানে থাকতে হইবো, ছার, কী খবর পাইছেন, ছার?
নিজামউদ্দিন বলেন, শক্তির উৎসআলারা লোক লাগাই দিছে, আপনেরে দুনিয়া থিকা সরাই দিতে চায়।
ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন মোঃ হামিদ মিয়া।
আবদুল হাই বলেন, হামিদ ভাই, আমাগো স্পাইরা সারাদ্যাশ ভইর্যা কাম করতেছে, দ্যাশের কোন জায়গায় কোন কন্সপিরেসি হইতেছে কোন চক্রান্ত হইতেছে সব খবর আমরা পাইতেছি; আমাগো মহাজননেত্রীরে তারা যেমুন সরাই দিতে চায়, আপনেরেও সরাই দিতে চায়। আপনে অগো টার্গেট।
হামিদ মিয়া কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, আমি এখন কী করুম, ছার?
নিজামউদ্দিন বলেন, ডরাইবেন না, হামিদ মিয়া, আপনে আমার বাড়িতেই থাকবেন খাইবেন, আমাগো লগেই যাওয়া আসা করবেন, আমাগো বডিগার্ড আছে, বডিগার্ড ছাড়া আমরা বাইর হই না, আপনেও হইবেন না।
মোঃ হামিদ মিয়া বেশ নিরাপদ বোধ করেন; চারদিকে বডিগার্ড দেখার জন্যে তাকান, দেখেন কয়েকটি শক্ত পেশি দূরে বসে আছে, দেখে তিনি শান্তি পান।
আবদুল হাই বলেন, আইজ রাইতে আপনের বাসায় লোক পাঠাইয়া খবর নিমু অগো কোনো লোক আপনের বাসায় গ্যাছে কি না? গ্যালেই ব্যাপারটা ভাল কইর্যা বোঝতে পারুম, আরো সাবধান হমু।
হামিদ মিয়া বলেন, দ্যাহেন, ছার, আমি আপনেগো লগেই থাকুম, আমারে আপনেগো লগেই রাইখেন। আমার খুব ডর লাগতেছে।
নিজামউদ্দিন বলেন, তয় বকতিতা দেওনের সময় ডরাইবেন না, ভাই, কোনো ব্যাডা য্যান বোঝতে না পারে আপনে ডরাইছেন; আপনে অগোই ডর লাগাই দিবেন। ডরাইলে রাজনীতি করন যায় না, রাজনীতি করতে হয় ডর দ্যাখাইয়া। ডরাইলেই ডর।
হামিদ মিয়া বলেন, কাউলকা আমি অগো কইলজার ভিতরে ডর লাগাই দিমু। চাইরপাশ পোরাইয়া দিমু; অরা আমারে সরাই দিতে চায়, মানুষ চিনে নাই।
মোঃ হামিদ মিয়া উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, গলায় তার আগুন জ্বলতে থাকে, বস্ত্র গমগম করে উঠতে চায়, তিনি বাঁশের কেল্লার দিকে এখনই পা বাড়াতে চান।