তৃতীয় পরিচ্ছেদ – মানুষের সঙ্গে নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মানসিক ক্ষমতার তুলনা
সবচেয়ে অ-সভ্য মানুষ ও সবচেয়ে উচ্চশ্রেণির বানরদের মধ্যে মানসিক ক্ষমতার ব্যাপক পার্থক্য—নির্দিষ্ট কিছু সহজাত প্রবৃত্তি—আবেগ—অনুসন্ধিৎসা—অনুকরণ—মনোনিবেশের ক্ষমতা—স্মৃতিশক্তি—কল্পনাশক্তি যুক্তি—মস্তিষ্কের ক্রমবর্ধমান উন্নতি জন্তু-জানোয়ার কর্তৃক ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র—বিমূর্তায়ন, আত্মসচেতনা- ভাবপ্রকাশের ভাষা—সৌন্দর্যবোধ—ঈশ্বরবিশ্বাস, আধ্যাত্মিক কার্যকলাপ, কুসংস্কার।
*
আগের দুটি পরিচ্ছেদে আমরা দেখেছি মানুষের দেহে এমন কিছু স্পষ্ট চিহ্ন আছে যা থেকে সহজেই বলা যায় যে, সে নিম্নশ্রেণির কোনো জৈবিক আকার থেকে ক্রমবিকশিত হয়েছে। কিন্তু তাহলে মানসিক ক্ষমতার বিচারে মানুষের সঙ্গে বাদবাকি প্রাণীদের এত পার্থক্য কেন? আমাদের সিদ্ধান্তে কোনো ভ্রান্তি হয়নি তো? সন্দেহ নেই তাদের মধ্যে মানসিক ক্ষমতার পার্থক্য বহুবিস্তৃত। এমনকী তুলনার ক্ষেত্র যদি একটি অত্যন্ত উন্নত জাতের বনমানুষ ও সবচেয়ে অনুন্নত মানবজাতির এমন একজন সভ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় যে চারের বেশি কোনো সংখ্যা গুণতে পারে না এবং প্রায় কখনোই কোনো সাধারণ বস্তু বা নিজের আবেগকে কোনো নির্দিষ্ট কথায় ব্যক্ত করতেও পারে না—তাহলে সেখানেও দেখব যে এ দুয়ের ব্যবধান অত্যন্ত ব্যাপক। কুকুর তার আদিরূপ নেকড়ে বা শিয়ালের তুলনায় যতটা উন্নত বা সভ্য হয়ে উঠেছে, উচ্চতর শ্রেণির বানররা যদি ততটাও উন্নত বা সভ্য হয়ে উঠত, তাহলেও এই পার্থক্যের ব্যাপকতায় কোনো হেরফের ঘটত না। আমরা জানি ফুজিয়ানরা সবচেয়ে অ-সভ্য বা অনুন্নত জাতিগুলোর অন্যতম। কিন্তু এইচ. এম এস বিল্ নামক জাহাজে আমাদের সহযাত্রী তিনজন ফুজিয়ানকে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। এরা কয়েক বছর ইংল্যান্ডে বসবাস করেছিল এবং অল্প অল্প ইংরেজিও বলতে পারত। আমাদের, অর্থাৎ সভ্য মানুষদের স্বভাব ও মানসিক গুণাবলির সঙ্গে এই তিনজনের প্রচুর সাদৃশ্য ছিল। যদি মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে মানসিক ক্ষমতার ব্যাপারটি আদৌ থাকত কিংবা নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের তুলনায় মানুষের মানসিক ক্ষমতাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির হতো, তাহলে আমরা কখনো বলতে পারতাম না যে আমাদের উচ্চ পর্যায়ের গুণগুলো ক্রমবিকাশের ফল। কিন্তু এটা প্রমাণিত সত্য মানুষ ও নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মধ্যে এই ধরনের কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। আবার এটাও সত্য যে মানুষ ও বানরের মধ্যে মানসিক ক্ষমতার যতটা তফাত, তার চেয়ে ঢের বেশি তফাত অত্যন্ত নিম্নপ্রজাতির কোনো মাছ, যেমন ল্যামপ্রে বা ল্যান্সলেট ইত্যাদির সঙ্গে উচ্চজাতের বানরদের। নিম্নশ্রেণির মাছ আর উচ্চশ্রেণির বানরের মাঝামাঝি স্তরে রয়েছে বিভিন্ন মাত্রার মানসিক ক্ষমতাযুক্ত অন্য সমস্ত প্ৰাণীকূল।
কোনো বর্বর মানুষ (বর্ষীয়ান নাবিক বায়রন যেমন একজন বর্বরের কথা জানিয়েছেন, যে তার শিশুপুত্রকে এক ঝুড়ি সামুদ্রিক শজারু ফেলে দেয়ার অপরাধে পাথরে আছড়ে মেরে ফেলেছিল) এবং কোনো-একজন হাওয়ার্ড বা ক্লার্কসনের মধ্যেও নৈতিক স্বভাবের পার্থক্য খুব সামান্য নয়, ঠিক যেমন কদাচিৎ কোনো বিমূর্ত শব্দ উচ্চারণ করতে পারা বন্য লোকের সঙ্গে নিউটন বা শেপিয়ারের মননশীলতার পাথর্ক্যও সামান্য নয়। স্বভাবতই সর্বাপেক্ষা উন্নত জাতির সর্বাপেক্ষা উন্নত মানুষদের সঙ্গে নিম্নতম পর্যায়ের বন্য মানুষদের এই ধরনের তফাত কতকগুলো সূক্ষ্মতম ধাপের ভিত্তিতে সম্পর্কযুক্ত। এবং সেইজন্যেই এমনটা বলা হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে, এই পার্থক্যগুলো ক্রমশ দূর হয়ে যাবে এবং তারা পরস্পরকে আরও মেলে ধরবে।
এই পরিচ্ছেদে আমার প্রধান লক্ষ্য হলো এটা প্রমাণ করা যে মানুষ ও উন্নত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মানসিক কার্যকলাপের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। এই আলোচনার প্রত্যেকটি বিভাগকে (পরিচ্ছেদের শুরুতে যে-ভাগগুলো করা হয়েছে) নিয়ে আলাদা আলাদা প্রবন্ধ লেখা যায়, কিন্তু তবু আমি এখানে বিষয়গুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করব। যেহেতু এখনও পর্যন্ত মানসিক ক্ষমতার বিষয়ে কোনো সর্বজনগ্রাহ্য শ্রেণিবিভাজন করা যায়নি, তাই ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছনোর উদ্দেশে সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায়েই আমার বক্তব্যকে সাজাব এবং সেইসমস্ত ঘটনাগুলোকেই বেছে নেব যেগুলো আমাকে সবথেকে বেশি নাড়া দিয়েছিল। আশা করি আমার পাঠকদের মনেও এগুলো সাড়া জাগাতে সক্ষম হবে।
একই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন জীবের মধ্যে মানসিক ক্ষমতার তারতম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং তার কিছু নমুনাও আমরা পেশ করব। কিন্তু এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা অর্থহীন, কারণ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রকম পশু- পাখির সঙ্গে যুক্ত লোকজনের কাছে বারবার খোঁজখবর করে আমি জেনেছি তারা এ-ব্যাপারে সকলেই একমত যে প্রত্যেকটি মানসিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে পশুপাখিদের একের সঙ্গে অপরের প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। তাছাড়া আমার মনে হয় নিম্ন শ্রেণির প্রাণীদের মধ্যে প্রথম কীভাবে মানসিক ক্ষমতার উদ্ভব হয়েছিল, তা খুঁজতে যাওয়া প্রাণের উৎস খুঁজতে যাওয়ার মতই অর্থহীন। এ- সব সমস্যা ভবিষ্যতের জন্যই তোলা থাক—অবশ্য আগামী দিনের মানুষ আদৌ কোনোদিন এ-সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে কিনা, জানি না।
নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মতো মানুষও একই জ্ঞানেন্দ্রিয় ধারণ করে বলে তাদের মৌলিক স্বতঃস্ফূত জ্ঞানও এক হতে বাধ্য। মানুষের মধ্যে নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মতো কিছু সহজাত প্রবৃত্তির দেখা যায়, যেমন আত্মরক্ষা, যৌন আবেদন, সদ্যোজাত সন্তানের জন্য মাতার মাতৃত্ববোধ, শিশুর স্তন্যপানের ইচ্ছা ইত্যাদি। তবে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি তার পরের ধাপে থাকা প্রাণীদের থেকে কম। পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের ওরাংওটাং ও আফ্রিকার শিম্পাঞ্জিরা ঘুমোনোর জন্য গাছের ওপর ডালপালা দিয়ে পাটা (platform) তৈরি করে। যেহেতু উভয় প্রজাতি একই অভ্যাসের অনুবর্তী, তাই বলা যেতে পারে এর কারণ হচ্ছে তাদের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না এটা তাদের একই চাহিদা ও চিন্তাভাবনা করার একই রকম ক্ষমতার ফল কি না। লক্ষণীয় ব্যাপারে হলো, এই ধরনের বানররা (ওরাংওটাং, শিম্পাঞ্জি ইত্যাদি) গ্রীষ্মমণ্ডলের বিষাক্ত ফল ছোঁয় না, কিন্তু মানুষের মধ্যে এমন বোধের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আবার যখন আমাদের গৃহপালিত পশুদের সম্পূর্ণ অপরিচিত কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে চরে বেড়ানোর অবাধ সুযোগ দেয়া হয়, তখন তারা প্রায়শই ভুল করে বিষাক্ত গাছপালা খেয়ে ফেলে, কিন্তু পরে এ- বিষয়ে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে। এক্ষেত্রেও বোধহয় আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি না তারা কোন ফল খাবে আর কোনটা খাবে না, সেটা তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা নাকি উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করা। তবে, একটু পরেই আমরা দেখব যে এই বানরদের মধ্যে সাপ এবং অন্যান্য হিংস্র জন্তু-জানোয়ার সম্পর্কে একটা ভীতির ভাব থাকে, যা তাদের সহজাত। উচ্চশ্রেণির প্রাণীদের সহজাত প্রবৃত্তি নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম ও অপেক্ষাকৃত সরল প্রকৃতির। ক্যুভিয়ের-এর মতে, সহজাত প্রবৃত্তি ও মেধা পরস্পর বিপরীত। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে উচ্চশ্রেণির প্রাণীদের বুদ্ধিগত উৎকর্ষ তাদের সহজাত প্রবৃত্ত থেকেই ক্রমবিকশিত হয়েছে। কিন্তু পাউসেট তাঁর একটি চাঞ্চল্যকর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে এ-ধরনের কোনো বৈপরীত্য আদপেই সম্ভব নয়। কেননা যে- সমস্ত পোকামাকড় সবচেয়ে চমৎকার সহজাত ক্ষমতার অধিকারী, তারা সবচেয়ে বুদ্ধিমানও বটে। অন্যদিকে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বুদ্ধিসম্পন্ন মাছ বা উভচর ব্যাঙ ইত্যাদিরা জটিল সহজাত ক্ষমতার অধিকারী নয় এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এই ক্ষমতার উল্লেখযোগ্য দাবিদার বিবর (Beaver) অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আশা করি মি. মর্গ্যানের অনবদ্য রচনার সঙ্গে পরিচিত পাঠকরা এ-ব্যাপারে সহমত পোষণ করবেন।
যদিও মি. হার্বার্ট স্পেন্সার মনে করেন যে বুদ্ধিমত্তার প্রাথমিক স্তরগুলো প্রতিবর্তী ক্রিয়ার গুণন ও সংযোজন নীতির দ্বারা বিকশিত এবং যদিও অনেক প্রাথমিক সহজাত প্রবৃত্তি ধীরে ধীরে প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় পর্যবসিত হয়েছে যেগুলোকে এখন আর আলাদা করে চেনা যাবে না, যেমন বাচ্চাদের স্তন্য পানের ইচ্ছা তথাপি মনে হয় আরও জটিল সহজাত ক্রিয়াগুলো বুদ্ধিমত্তার থেকে স্বতন্ত্র কোনো উপায়েই বিকশিত হয়েছে। তবে এটা আমি মোটেই অস্বীকার করতে চাই না যে সহজাত ক্রিয়াগুলো তাদের নির্দিষ্ট অপরিশীলত চরিত্রকে পরিত্যাগ করতে পারে এবং স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হতে পারে। অন্যদিকে, কিছু বুদ্ধিগত ক্রিয়া বেশ কয়েক পুরুষ ধরে পালন করার ফলে সহজাত ক্ষমতায় উন্নীত হয় এবং বংশগত হয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সমুদ্রসংলগ্ন দ্বীপসমূহের পাখিদের মানুষকে এড়িয়ে চলার ব্যাপারটা এভাবেই রপ্ত হয়েছে। সুতরাং এই কাজগুলোকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অবনতি বলা যেতে পারে কারণ এগুলো আর যুক্তি বা অভিজ্ঞতার দ্বারা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। কিন্তু আরও জটিল সহজাত ক্রিয়াগুলোর একটি বড় অংশই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র উপায়ে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সহজ সহজাত ক্রিয়ায় ক্রমপরিবর্তিত হয়। এই ধরনের ক্রমপরিবর্তনগুলো হয়তো একইরকম অজ্ঞাত কোনো কারণে মস্তিষ্কের সেইসব অংশের ক্রিয়াবশত উৎপন্ন হয় যেগুলো শরীরের অন্যান্য অংশে সামান্য বৈসাদৃশ্য বা ভিন্ন ভিন্ন পার্থক্যের জন্য দায়ী। কিন্তু আমাদের অজ্ঞতার দরুন প্রায়শই আমরা বলে দিই যে, এই ক্রমপরিবর্তনশীল আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয় জটিলতার সহজাত প্রবৃত্তির উৎপত্তি সম্পর্কে আমরা এছাড়া অন্য কোনো সিদ্ধান্ত করতে পারি না। সন্তান উৎপাদনে অক্ষম শ্রমিক-পিঁপড়ে ও মৌমাছিদের চমৎকার সহজাত ক্ষমতার কথা চিন্তা করলে দেখা যায় যেহেতু তারা সকলেই সন্তান উৎপাদনে অপারগ, তাই তাদের সন্তানদের মধ্যে অভিজ্ঞতা ও পরিবর্তিত অভ্যাসের বংশগত প্রভাব পড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
পূর্বোল্লিখিত পোকামাকড় ও বিবরদের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি—বুদ্ধির উচ্চ মাত্রা নিঃসন্দেহে জটিল সহজাত প্রবৃত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তাদের ক্রিয়ারকলাপ (প্রথমে স্বতঃপ্রবৃত্ত শিক্ষাগ্রহণ করলেও) শীঘ্রই প্রতিবর্তী ক্রিয়ার দ্রুত ও নিশ্চিত অভ্যাসের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়। তথাপি এমনটা হয়তো অসম্ভব নয় যে সাবলীল বুদ্ধিমত্তা ও সহজাত ক্রিয়ার বিকাশের মধ্যে কিছু প্রতিবন্ধক কাজ করে, যা পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্কের কিছু বংশগত উন্নত পরিবর্তনের জন্য দায়ী। মস্তিষ্কের কার্জকম সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান সীমিত হলেও এটা বোঝা যায় যে বুদ্ধিগত ক্ষমতা যথেষ্ট উন্নত হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের নানা অংশ অবশ্যই আন্তঃযোগাযোগ রক্ষাকারী কতকগুলো জটিল মাধ্যম দ্বারা সংযুক্ত হয়, এবং তার ফলে সম্ভবত এর প্রতিটি পৃথক পৃথক অংশ কোনো নির্দিষ্ট ও বংশগত রীতি অনুযায়ী, অর্থাৎ সহজাতক্রিয়া অনুযায়ী, বিশেষ কোনো সংবেদন বা সংস্পর্শে সাড়া দিতে অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। এমনকী মনে হয় স্বল্পমাত্রার বুদ্ধির সঙ্গে নির্দিষ্ট কিন্তু বংশগত নয় এমন অভ্যাস গঠনে জোরালো প্রবণতার একটা সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, একজন বিচক্ষণ চিকিৎসক আমাকে জানিয়েছিলেন, সামান্য নির্বোধ ব্যক্তিরা যে-কোনো কাজ নিয়মমাফিক বা অভ্যাসমতো করতে ভালোবাসে এবং এ-ব্যাপারে উৎসাহ পেলে তাদের খুশির আর অন্ত থাকে না।
একটু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লেও আমাদের বর্তমান আলোচনাটা করা এই জন্যে দরকার যে, উচ্চশ্রেণির প্রাণীদের, বিশেষত মানুষের, মানসিক ক্ষমতাকে আমরা সহজেই কমিয়ে দেখতে পারি, যখন তাদের কাজকর্মগুলোকে পূর্বে- ঘটে-যাওয়া কোনো বিষয়ের স্মৃতি, দূরদৃষ্টি, যুক্তি ও কল্পনার ভিত্তিতে এবং নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের সহজাত ক্ষমতার দ্বারা সম্পাদিত একইরকম কাজের সঙ্গে তুলনা করতে বসি। একই সঙ্গে আমাদের মনে রাখা দরকার যে নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের এই কাজ সম্পাদনের ক্ষমতা একদিনে অর্জিত হয়নি, তা সম্ভব হয়েছে তাদের মস্তিষ্ক ও প্রাকৃতিক নির্বাচনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এবং তার জন্য তাদের ক্রমোত্তর বংশধরদের কোনো সচেতন বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের দরকার হয়নি। মি. ওয়ালেসের যুক্তি অনুযায়ী নিঃসন্দেহে বলা যায়—মনুষ্যকৃত বেশিরভাগ বুদ্ধিমত্তার কাজই যুক্তিনির্ভর নয়, সেখানে অনুকরণই প্রধান। কিন্তু মানুষের কাজ আর নিম্নশ্রেণির প্রাণী কর্তৃক সম্পাদিত অনেক কাজের মধ্যে এই পার্থক্য বেশ বড় রকমের। যেমন, মানুষ একবারের চেষ্টাতেই শুধুমাত্র অনুকরণের সাহায্যে পাথরের কুড়ুল বা ডোঙা তৈরি করতে পারে না, অভ্যাস বা অনুশীলনের দ্বারা তাকে নিজের কাজ আয়ত্ত করতে হয়। অন্যদিকে, প্রায় প্রথম চেষ্টাতেই জলের হাত থেকে বাঁচতে, মাটির ঢিপি বা যাতায়াতের জন্য সুড়ঙ্গ তৈরি করতে পারে বিবররা। পাখিদের চমৎকার বাসা তৈরি করা বা মাকড়সার সুন্দর জাল বোনার জন্যও পূর্ব-অভিজ্ঞতা বা অভ্যাসের দরকার হয় না, প্রথম চেষ্টাতেই এগুলো গড়তে পারে তারা।
এবার আমাদের বর্তমান আলোচনায় ফিরে আসা যাক। নিম্নশ্রেণির প্রাণীরা স্পষ্টতই মানুষের মতো সুখ-দুঃখ ও বিষাদ অনুভব করে থাকে। আমাদের শিশুদের মতো কুকুর, বেড়াল বা ভেড়ার বাচ্চারা যখন একসঙ্গে খেলা করে, তখন বোঝা যায় আনন্দের এর চেয়ে চমৎকার বহিঃপ্রকাশ আর কিছুই হতে পারে না। এমনকী পোকামাকড়েরাও এইভাবে খেলার মাধ্যমে তাদের আনন্দ প্রকাশ করে। এটা আমার কথা নয়, সুদক্ষ পর্যবেক্ষক পি. হুবার-ই তাঁর রচনার মধ্যে এই ব্যাপারটা উল্লেখ করেছেন। তিনি লক্ষ করেছেন পিঁপড়েরা একে অপরকে তাড়া করে এবং কামড়াবার ভান করে, ঠিক যেমনটা আমরা অনেক বাচ্চা কুকুরদের মধ্যে দেখে থাকি।
নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মধ্যে যে আমাদের মতো একই আবেগের দরুন উত্তেজনা দেখা দেয়, তার অসংখ্য প্রমাণ আছে এবং সেইজন্য এ-বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করে, পাঠককে আর নাই-বা বিরক্ত করলাম। ভয়ের ব্যাপারটি এদের মধ্যে আমাদের মতো একইরকমভাবে কাজ করে—মাংসপেশি কাঁপতে থাকে, বুক ধড়ফড় করে মলদ্বারের পেশি প্রসারিত হয় এবং দেহের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। তাছাড়া অধিকাংশ বন্য প্রাণীর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো ভয়জনিত সন্দেহপ্রবণতা। স্যর ই. টেনেন্ট কর্তৃক উল্লিখিত পোষা মাদি-হাতি কর্তৃক বন্য হাতিদের প্রবঞ্চণা করে ফাঁদে ফেলার ব্যাপারটা মেনে নেওয়া অসম্ভব, যদি-না আমরা এটা স্বীকার করে নিই যে হাতিটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই প্রবঞ্চনা অভ্যাস করেছে এবং কী করতে যাচ্ছে সেটা বেশ ভালোভাবেই জানা আছে তার। একই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন জীবের মধ্যে সাহসিকতা বা ভীরুতার সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ ঘটে থাকে, যেমনটি সাধারণভাবে আমরা আমাদের কুকুরদের মধ্যে দেখে থাকি। কোনো কোনো কুকুর বা ঘোড়া বেশ খিটখিটে মেজাজের ও স্বভাবতই বিষণ্ন প্রকৃতির, আবার অন্যদের মেজাজ বেশ চমৎকার। এসব গুণ বা বৈশিষ্ট্য বংশগত সূত্রেই অর্জিত হয়। অনেকেই হয়তো লক্ষ করে থাকবেন প্রাণীরা মাঝে মাঝে কেমন সাংঘাতিক রেগে গিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এ-বিষয়ে বিভিন্ন প্রাণীদের দীর্ঘবিলম্বিত ও সুচতুর প্রতিহিংসা সম্বন্ধে অনেক উপাখ্যান প্রকাশিত হয়েছে এবং সম্ভবত এগুলো সত্যিও। রেঙ্গার ও ব্রেহম[১] জানিয়েছেন, যে-সমস্ত আমেরিকান ও আফ্রিকান বানরকে তাঁরা পোষ মানাতে সমর্থ হয়েছিলেন সেগুলো একসময় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছিল। প্রাণীতত্ত্ববিদ স্যর অ্যানড স্মিথ, যিনি গবেষণাকর্মের জন্য সুপরিচিত, তিনি আমাকে তাঁর নিজের চোখে দেখা একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। ঘটনাটি ছিল এ-রকম উত্তমাশা অন্তরীপে একজন অফিসার প্রায়শই একটি বেবুনকে নানাভাবে বিরক্ত করত। কোনো- এক রবিবার চমৎকার পোশাক পরে সেই অফিসারটিকে প্যারেডের জন্য আসতে দেখেই বেবুনটি একটি গর্তের মধ্যে জল ঢেলে দ্রুত কিছুটা ঘন কাদা তৈরি করে ফেলে এবং সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় সেই কাদা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সে অফিসারটির গায়ে ছুঁড়ে মারে যা অনেক পথচারীর কাছেই মজার উপাদান হয়ে উঠেছিল। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন ধরে বেবুনটি যখনই ওই অফিসারটিকে দেখতে পেত, তখনই আনন্দে হাত-পা ছুঁড়ে উল্লাস প্রকাশ করত।
কুকুরের প্রভুভক্তি অতুলনীয়। একজন প্রাচীন লেখক বেশ সুন্দর করে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে কুকুরই একমাত্র জীব যে তার নিজের চেয়েও তোমাকেই (প্রভুকে) বেশি ভালোবাসে।’
এমনকী মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যেও কুকুর তার প্রভুর প্রতি বিশ্বস্ত থাকে। আমরা প্রত্যেকেই জানি যে বিজ্ঞানের কাজে জীবন্ত কুকুরের অঙ্গচ্ছেদ করে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এইরকম একটি পরীক্ষার সময় একটি কুকুর তার প্রচণ্ড যন্ত্রণা সত্ত্বেও সেই পরীক্ষকের হাত চেটে দিতে ভুল করেনি, তার তাই সেই পরীক্ষকের কাজটি আমাদের জ্ঞান সম্প্রসারণের জন্য যতই ন্যায়সঙ্গত বলে বিবেচিত হোক না কেন বা তাঁর হৃদয় যতই পাষাণ হোক না কেন, জীবনের অন্তিম সময়ে তিনি তাঁর এই কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে বাধ্য।
হোয়েল একটি চমৎকার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রায় সকল মানবজাতির স্ত্রীলোক ও সমস্ত জীবজগতের স্ত্রীলিঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মাতৃস্নেহের হৃদয়স্পর্শী দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করেছেন, তিনি কি সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন যে উভয় ক্ষেত্রে (মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী) এই স্নেহের মূলনীতি এক নয়?’ একটু লক্ষ করলেই আমরা দেখতে পাব মাতৃস্নেহের ব্যাপারটা কত সামান্য ঘটনার মধ্যেই মূর্ত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে রেঙ্গারকে স্মরণ করা যাক। তিনি একবার দেখেছিলেন সেবুস জাতের একটি আমেরিকান মেয়ে-বানর তার বাচ্চার গায়ে এসে বসা মাছিদের ব্যগ্রভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছে। অধ্যাপক ডুভোসেলের একটি অভিজ্ঞতার কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়। তিনি হাইলোবেস জাতের এক বানর-মাকে নদীর জল দিয়ে তার বাচ্চাদের মুখ ধুইয়ে দিতে দেখেছিলেন। সন্তানবিয়োগে বানর-মায়েদের দুঃখ এত গভীর হয় যে-অধ্যাপক ব্রেম্ উত্তর-আফ্রিকার এই ধরনের কিছু বানরকে আটকে রেখে দেখেছেন—সেই শোকে তারা মারা পর্যন্ত যায়। তাছাড়া স্ত্রী ও পুরুষ উভয় প্রকার বানরই অনাথ বানর-বাচ্চাদের ভার নেয় এবং বেশ যত্নের সঙ্গেই তাদের দেখাশোনা করে। একটি মেয়ে-বেবুনের কথা সেক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। সে এমনই উদার ছিল যে শুধুমাত্র অন্য প্রজাতির বাচ্চা-বানরদের ভারই নিত না, বরং হামেশাই কুকুর ও বিড়ালছানাও চুরি করত এবং সবসময় তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াত। অবশ্য এই বাচ্চাদের সে তার নিজের খাবারের ভাগ দিত না। বিষয়টি ব্রেহমের কাছে একটু অস্বাভাবিকই মনে হয়েছিল, কারণ তাঁর পোষা বানররা সবকিছুই (খাবার) তাদের বাচ্চাদের মধ্যে সুন্দরভাবে ভাগ করে দিত। এই বেবুনটি সম্পর্কে আরও জানা যায় যে একবার সংগৃহীত বাচ্চাদের মধ্যে একটি বেড়ালছানা তাকে নখ দিয়ে আঁচড়ে দিয়েছিল। এ-রকম আঁচড়ের জন্য প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও বেবুনটি ছিল যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। অচিরেই বেড়ালছানাটির পায়ের থাবা পরীক্ষা করে বিষয়টি বোধগম্য হতে সে দাঁত দিয়ে তার নখ কেটে সমস্যার সমাধান করেছিল।[২] চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত একজন কর্মচারীর কাছ থেকে আমি শুনেছি, একটি বুড়ি বেবুন (সি. চাকমা) রেসাস্ জাতের একটি বাচ্চা বানরের দেখাশোনা করত। কিন্তু যখন ড্রিল ও ম্যানড্রিল জাতের দুটি বাচ্চা বানরকে ওই খাঁচার মধ্যে রাখা হলো, ভারী আশ্চর্যজনক যে, রেসাস্ বাচ্চাটিকে বাদ দিয়ে পরে আসা বাচ্চা দু’টির প্রতি আগ্রহ দেখাতে শুরু করল। সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছিল ওই দুটি অন্য প্রজাতিভুক্ত হলেও তার প্রায় সমগোত্রীয়। আর সেই বাচ্চা রোটি এইভাবে স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে সবসময় মনমরা হয়ে থাকত। শোনা কথা নয়, আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি সুযোগ পেলেই সে ড্রিল ও ম্যানড্রিল প্রজাতির বাচ্চা দুটিকে বিরক্ত করত ও আক্রমণ করত এবং এর ফলে বুড়ি বেবুনটি রোসটির প্রতি তীব্র ঘৃণা ও ক্রোধ প্রকাশ করত। তাছাড়া, ব্রেহমের মতে, বানররাও তাদের প্রভুদের বহিঃশত্রুর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে থাকে। শুধু তাই-ই নয়, যে-কুকুরদের সঙ্গে তারা একত্রে থাকে (একই প্রভুর অধীনে), তাদেরকেও রক্ষা করার জন্য অন্য কুকুরদের আক্রমণ প্রতিহত করে তারা। কিন্তু আমরা এখানে সহানুভূতি ও আনুগত্যের বিষয়গুলোকেই খতিয়ে দেখতে চাইছি, তাই সেই প্রসঙ্গেই ফিরে যাওয়া যাক। এখানে ব্রেহমের ওই পোষা বানরদের কথা আবার বলতে হচ্ছে। তারা তাদের অপছন্দের কোনো বুড়ো কুকুর বা অন্যান্য প্রাণীকে নানা ফন্দিফিকিরের সাহায্যে উত্ত্যক্ত করে তুলত এবং তাতে প্রচুর মজাও পেত।
অধিকাংশ জটিলতর মানসিক আবেগ মানুষ ও উন্নত শ্রেণির জীবজন্তুদের মধ্যে একই রকম। প্রায় সকলেই জানেন একটি কুকুর কতখানি ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে যদি সে দেখে তার প্রভু অন্য কোনো প্রাণীকে আদর করছে। বানরদের মধ্যেও এই বিষয়টি লক্ষ করেছি আমি। এ থেকে বোঝা যায় জীবজন্তুরা শুধু যে অপরকে ভালোবাসে এমন নয়, অপরের ভালোবাসা পেতেও চায়। স্পষ্টতই তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আস্থাশীল। কোনো কাজের জন্য প্রভুর সম্মতি বা প্রশংসা পেতে তারা ভীষণ আগ্রহী। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলতে পারি, যখন কোনো কুকুর তার প্রভুর জন্য সামান্য একটি ঝুড়ি বয়ে আনে, তখন তাকে অত্যন্ত আত্মতুষ্ট বা গর্বিত দেখায়। আবার খাবার সম্বন্ধে কুকুরদের লজ্জা পাওয়ার বিষয়টি আমার কাছে ভয়জনিত কোনো কারণ মনে হয় না, বরং মনে হয় তা এমন-কিছু যার সঙ্গে মানুষের খাবার ভিক্ষা করার লজ্জা জড়িয়ে আছে। আমরা অনেকেই দেখেছি যে ভালো জাতের কুকুররা নেড়ি কুকুরদের বাজে রকমের ডাককে অবজ্ঞা করে। এটাকে মহানুভবতা ছাড়া আর কী কী বলা যায়! প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বানররা উপহাস একদম পছন্দ করে না। তাই মাঝে মাঝে তাদের শত্রুর উদ্দেশে কাল্পনিক আক্রমণ শানাতে দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে আমার দেখা চিড়িয়াখানার একটি বেবুনের কথা বলা যেতে পারে। তার দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত লোকটি কোনো চিঠি বা বই নিয়ে জোরে জোরে তার সামনে পড়লে সে ভীষণ রেগে যেত এবং তার রাগ এমন সাংঘাতিক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছত যে সে কামড়ে নিজের পা থেকে রক্ত বার করে ফেলত। কুকুররা প্রায়শই চমৎকার রসবোধের পরিচয় দিয়ে থাকে। একে নিছক খেলা হিসেবে দেখলে একটা ভুল হবে। কোনো ছোট দণ্ডাকার বস্তু বা ওই জাতীয় অন্য কিছু এদের একজনের কাছে ছুঁড়ে দিলে সে ওটাকে কিছু দূর অবধি নিয়ে যায়, তারপর জিনিসটা নিজের সামনে রেখে উবু হয়ে বসে। জিনিসটা নেওয়ার জন্য তার প্রভু তার কাছে না-আসা পর্যন্ত ওই অবস্থাতেই বসে থাকে সে এবং প্রভু কাছে এলেই ওটাকে নিয়ে দৌড়ে দূরে পালিয়ে যায় কুকুরটি বার বার এই একই কাজ করে চলে। আসলে এতে করে সে দারুণ মজা পায়।
এবার আমরা অধিকতর বুদ্ধিসঞ্জাত আবেগ ও কাজকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করব। উন্নত মানসিক ক্ষমতার বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় বনিয়াদ গঠনে এগুলো অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। সাধারণত জীবজন্তুরা কোনো প্রকার উত্তেজনাকে দারুণ মজার সঙ্গে গ্রহণ করে। ক্লান্তি বা অবসাদের বিষয়টিও তাদের মধ্যে যথেষ্টই চোখে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ কুকুর বা অধ্যাপক রেঙ্গারের মতানুযায়ী বানরের নাম করা যায়। আবার প্রায় সমস্ত জীবজন্তুই বিভিন্ন বিষয়ে বিস্ময় বোধ করে থাকে এবং তাদের অনেকের মধ্যে কৌতূহলস্পৃহাও বর্তমান। এই কৌতূহলস্পৃহার জন্য অনেক সময় কঠিন মূল্য দিতে হয় তাদের। যেমন, শিকারিদের নানা ছলাকলায় আকৃষ্ট হয়ে অনেক জন্তু প্রাণ পর্যন্ত হারায়। কিছু হরিণ, অপেক্ষাকৃত সতর্ক কৃষ্ণসার হরিণ এবং কয়েক প্রকার পাতিহাঁসের মধ্যে বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছি আমি। ব্রেহ্ম তাঁর পোষা বানরদের সাপ সংক্রান্ত কিছু সহজাত ভীতির তথ্য পেশ করেছেন। কিন্তু তাদের কৌতূহল এত বেশি ছিল যে মাঝে মাঝে তারা প্রায় মানুষের মতোই ভয় ভুলে সাপ-রাখা বাক্সটার ডালা তুলে দেখার চেষ্টা করত—ব্যাপারটা কী। এই ঘটনা আমাকে এতই বিস্মিত করেছিল যে আমি মৃত সাপের একটি গুটোনো চামড়া চিড়িয়াখানায় অবস্থিত বানরদের বাসগৃহে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম এবং তার ফলে সৃষ্ট উত্তেজনার ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। এদের মধ্যে সার্কোপিথেকাস প্রজাতির তিনটি বানর সবচাইতে সাবধানি ছিল। তারা বিপদ বুঝে নিজেদের খাঁচা ধরে ধাক্কা দিতে শুরু করল এবং তীক্ষ্ণ চিৎকারে অন্যদের জানিয়ে দিল—বিপদ আসছে। অন্য বানরেরা সহজেই বুঝে নিল ব্যাপারটা। শুধু কয়েকটি বাচ্চা বানর আর আনুবিস প্রজাতির একটি বয়স্ক বেবুন সাপটির প্রতি উদাসীন ছিল। এরপর আমি সেই সর্পাকৃতি চামড়াটি বড় বড় খোপগুলোর একটির মেঝেতে রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে সব বানরেরা সেটিকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াল এবং দেখতে লাগল। বেশ হাস্যকর দৃশ্য। দেখতে দেখতে তারা অত্যন্ত ভীত হয়ে উঠল। যে কাঠের বলকে তারা খেলার সামগ্রী হিসেবে জানে, ঘটনাক্রমে সেই রকম একটা বল খড়ের মধ্যে নড়ে উঠলে (বলটা খড়ে আংশিক চাপা পড়েছিল) তারা তৎক্ষণাৎ ভয়ে পিছিয়ে গেল। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, মরা মাছ, ইঁদুর, জ্যান্ত ঘুঘুপাখি বা সম্পূৰ্ণ নতুন কোনো জিনিস এসব বানরের খাঁচায় রাখলে এরা একেবারেই অন্যরকম আচরণ করে থাকে। হ্যাঁ, প্রথমটায় তারা কিছুটা ঘাবড়ে যেত বটে, কিন্তু অচিরেই কাছে গিয়ে ভালো করে ব্যাপারটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করত। এবার আমার পরীক্ষার অবশিষ্টাংশটুকু বলা যাক। এবার আর মরা সাপ বা তার চামড়া নয়, একটা জ্যান্ত সাপকে কাগজের ঠোঙায় ভরে, ঠোঙার মুখটা সামান্য মুড়ে, বড় খোপগুলোর একটাতে রেখে দিয়েছিল আমি। একটি বানর তৎক্ষণাৎ কাছে এসে ঠোঙার মুখটি সামান্য খুলে মুখ নামিয়ে দেখল এবং তৎক্ষণাৎ ছিটকে সরে গেল। পরের ঘটনা ব্রেহমের বক্তব্যের সঙ্গে মিলে গেল। একটির পর একটি বানর মাথাটা ওপরের দিকে তুলে, কাঁধের একপাশে হেলিয়ে, খাড়া করে রাখা ঠোঙার মধ্যে সেই ভয়ঙ্কর বস্তুটির দিকে এক পলকের জন্য হলেও এসে দেখতে লাগল, দেখার কৌতূহলকে কিছুতেই দমন করতে পারল না তারা। এ থেকে মনে হওয়া অসম্ভব নয় যে প্রাণীতত্ত্বগত সাদৃশ্যের ব্যাপারে বানরদের কিছু ধারণা আছে। কেননা, ব্রেহমের পোষা বানরদের মধ্যে অক্ষতিকারক টিকটিকি, গিরগিটি বা ব্যাঙ সম্পর্কে একটি আশ্চর্য সহজাত ভয় (অমূলক হলেও) লক্ষ করা গেছে। এমনকী একটি ওরাং-ওটাংও একবার একটা ঘুঘুকে প্রথমবার দেখে বেশ আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল।
মানুষ, বিশেষত বন্য বা অ-সভ্য মানুষদের মধ্যে অনুকরণ—প্রবণতা অত্যন্ত প্রবল। মস্তিষ্কের কোনো রোগ দেখা দিলে এই প্রবণতা অত্যধিক মাত্রায় বেড়ে যায়। দেখা গেছে, হেমিপ্লেজিয়া রোগগ্রস্ত কোনো কোনো ব্যক্তি বা অন্যরা মস্তিষ্কের স্নায়বিক কর্মের অবনতি হেতু প্রবল উত্তেজনার শুরুতে অসচেতনভাবে তাদের সামনে বলা প্রত্যেকটি কথা নকল করে যায়, তাদের মাতৃভাষা বা অজ্ঞাত কোনো ভাষা যে-ভাষাতেই কথা বলা হোক না কেন, অনুকরণ অব্যাহত থাকে। শুধু তাই নয়, তাদের সামনে উপস্থিত অন্যদের অঙ্গভঙ্গি বা দৈহিক সঞ্চালন নকল করতেও বাদ দেয় না তারা। ডেজর বলেছেন, কোনো জীবজন্তু স্বেচ্ছায় মানুষের কাজের নকল করে না, একমাত্র বানর ছাড়া—যারা হাস্যোদ্দীপক ব্যঙ্গকার হিসেবে সুবিদিত। জীবজন্তুরা কখনো কখনো একে অপরকে নকল করে থাকে। দেখা গেছে, কুকুরদের মধ্যে লালিত-পালিত হওয়া দু’টি নেকড়ে কুকুরের মতো ডাকতে শুরু করেছিল। কোনো কোনো সময় শিয়ালরাও কুকরের মতো ডেকে থাকে। তবে এটিকে স্বেচ্ছাকৃত অনুকরণ বলা যাবে কি না, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। আবার পাখিরা তাদের পিতা-মাতার স্বর নকল করে গাইতে শেখে। মাঝে মাঝে অন্য পাখিদেরকেও অবশ্য তারা নকল করে থাকে। তোতাপাখিরা এ-বিষয়ে খুব ওস্তাদ। তারা যে- কোনো শব্দ মাত্র কয়েকবার শুনেই নিজেদের গলায় তুলে নিতে পারে। দ্যিউরো দ্য লা ম্যাল একটি কুকুরের কথা বলেছেন। কুকুরটি এক বিড়াল- মায়ের রক্ষাণাবেক্ষণে বড় হওয়ায় তার প্রতিপালকের মতো পায়ের থাবা চাটতে এবং মুখ ও কান পরিষ্কার করতে শিখেছিল। প্রখ্যাত প্রকৃতিতত্ত্ববিদ্ আডুইন্-ও এই ব্যাপারটি প্রত্যক্ষ করেছেন। আমি নিজের এটা প্রত্যক্ষ না করলেও অন্য কিছু নির্ভরযোগ্য তথ্য হতে পেয়েছি। এগুলোর একটি এ-রকম : একটি কুকুর এক বিড়াল-মায়ের দুধ না খেলেও তার বাচ্চাদের সঙ্গে একত্রেই বড় হয়েছিল। এই কুকুরটিও পায়ের থাবা চাটতে আর মুখ ও কান পরিষ্কার করতে শিখেছিল এবং তার জীবদ্দশার তেরো বছর ধরে এই অভ্যাস সে চালিয়ে গেছে। দ্রিউরো দ্য লা ম্যালের কুকুরটি বিড়ালছানাদের কাছ থেকে অনুরূপ ভাবে শিখেছিল কীভাবে একটি বল সামনের থাবা দিয়ে গড়িয়ে নিয়ে যেতে হয় এবং কীভাবে তার ওপর উঠে দাঁড়াতে হয়। জনৈক পত্ৰলেখক আমাকে জানিয়েছেন, তাঁর বাড়িতে একটি মেয়ে-বিড়াল দুধ খাওয়ার সময় তার থাবাটা দুধের পাত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিত, কারণ তার মাথার তুলনায় মুখটা ছিল খুবই ছোট। এই বিড়ালটির একটি বাচ্চাও অচিরেই কৌশলটি আয়ত্ত করে নিয়েছিল এবং সুযোগ পেলেই অর্জিত বিদ্যাটি প্রয়োগ করত সে।
বিভিন্ন জীবজন্তুর বাচ্চাদের অনুকরণ-প্রবণতা, বিশেষ করে তাদের সহজাত বা বংশগত প্রবণতার কথা মনে রেখে বলা যায় যে তাদের বাপ-মা ই তাদেরকে এগুলো শেখায়। এই বিষয়টিকে পরিষ্কার করে বোঝা যায় যখন দেখি কোনো বিড়াল-মা তার বাচ্চাদের কাছে জ্যান্ত ইঁদুর নিয়ে যাচ্ছে। কিংবা ধরা যাক দ্যিউরো দ্য লা ম্যালের বাজপাখিদের উপর পরীক্ষিত কৌতূহলোদ্দীপক তথ্যটি। তিনি বলেছেন যে এই বাজপাখিরা তাদের বাচ্চাদের নানা কৌশল শেখাত, দূরত্ব পরিমাপের বিদ্যা শেখাত। প্রথমে তারা শূন্যে মুখ থেকে মরা ইঁদুর ও চড়ুই পাখি ছেড়ে দিয়ে ধরতে শেখাত, যদি ও বেশিরভাগ সময় বাচ্চা-বাজপাখিরা সেগুলো ধরতে ব্যর্থ হতো, এবং তারপর জ্যান্ত পাখি এনে ছেড়ে দিয়ে শিকার করতে শেখাত।
মানুষের বুদ্ধিগত বিকাশের ক্ষেত্রে ‘মনঃসংযোগ’ একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু মানুষ নয়, জীবজন্তুদের মধ্যেও এই ক্ষমতাটি স্পষ্টতই বর্তমান। ইঁদুরের গর্তের সামনে দাঁড়িয়ে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বিড়ালের প্রস্তুতি এই মনঃসংযোগেরই নিদর্শন। আবার কখনো কখনো বন্য জন্তুরা শিকারের অপেক্ষায় এমনই অভিনিবিষ্ট থাকে যে তখন তাদেরকে সহজেই বন্দী করা যায়। মি. বার্টলেট আমাকে এই বিষয়ে বানরদের বৈচিত্র্য সংক্রান্ত একটি চমৎকার তথ্য জানিয়েছেন। এক ভদ্রলোক জুলজিক্যাল সোসাইটির কাছ থেকে সাধারণ মানের বানর কিনতেন নাটকে অভিনয় করার জন্য শিক্ষা দেবেন বলে। প্রত্যেকটি বানরের জন্য পাঁচ পাউন্ড করে দাম দিতেন তিনি। একবার তিনি প্রস্তাব দেন—তিন চারটি বানরকে কয়েক দিন নিজের কাছে রেখে তাদের মধ্যে থেকে কোনো-একটিকে বেছে নেওয়ার সুযোগ তাঁকে দেয়া হলে প্রতিটি বানরের জন্য দ্বিগুণ দাম দেবেন তিনি। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কীভাবে তাঁর পক্ষে এত তাড়াতাড়ি বোঝা সম্ভব যে কোন বানরটি ভালো অভিনেতা হতে পারে, তখন জবাবে তিনি বলেছিলেন—সমস্তটাই নির্ভর করে তাদের (বানরদের) মনঃসংযোগের ক্ষমতার ওপর। ব্যাপারটা একটু খুলে বললে এ-রকম দাঁড়ায় : কোনো বানরের সঙ্গে তাঁর কথা বলা বা কোনো-কিছু ব্যাখ্যা করার সময় বানরটির দৃষ্টি দেয়ালে বসা কোনো মাছি বা অন্য কোনো বস্তুতে আকৃষ্ট হলে তিনি বুঝতেন—একে দিয়ে কিছু হবে না। এমনকী তিনি তাদের অমনোযোগিতার জন্য শাস্তি দিয়ে শোধরাতেও চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। উৎসাহিত হওয়ার বদলে আরও চুপচাপ হয়ে পড়ত তারা। অন্যদিকে, যে-সব বানর তাঁর কথা মনোযোগ সহকারে শুনত বা লক্ষ করত, তাদের সবসময়েই নানা জিনিস শেখানো যেত।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জীবজন্তুদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা স্থান সম্পর্কে চমৎকার স্মৃতিশক্তি কাজ করে। স্যার অ্যানড্রু স্মিথের কাছ থেকে আমি শুনেছি যে উত্তমাশা অন্তরীপের একটি বেবুন তাঁকে ন’ মাস পরে দেখেও চিনতে পেরেছিল এবং আনন্দ প্রকাশ করেছিল। আমার নিজের একটি কুকুর ছিল। তার স্বভাবটা ছিল বুনো, অপরিচিত কাউকে দেখলেই খেঁকিয়ে উঠত একবার একটানা পাঁচ বছর দু’দিন তার সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ থাকার পর আমি তার বাসস্থানের কাছে গিয়ে পুরনো অভ্যাসমতো চিৎকার করে তাকে ডাকলাম। তার মধ্যে উৎফুল্ল ভাব দেখা না গেলেও সে আমার পিছু পিছু চলতে শুরু করল এবং এমনভাবে আমার নির্দেশ পালন করতে লাগল যেন মাত্র আধঘণ্টার জন্য আমি তাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম। স্পষ্টতই গত পাঁচ বছর ধরে পুরনো অভ্যাসগুলো তার মনের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় রয়ে গিয়েছিল, এখন মুহূর্তের মধ্যেই তা জেগে উঠেছে। পি. হুবার স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন যে এমনকী পিঁপড়েরাও চার মাস বিচ্ছেদের পর তাদের একই সম্প্রদায়ভুক্ত সহযোগিদের চিনতে ভুল করে না। জীবজন্তুরা নিশ্চয়ই পুনরাবর্তক ঘটনাগুলোর অন্তবর্তী সময়-বিরতিকে কোনো-না-কোনোভাবে বুঝে নিতে পারে।
মানুষের অত্যন্ত উন্নত ক্ষমতাগুলোর অন্যতম হচ্ছে ‘কল্পনাশক্তি’। এর সাহায্যে সে ইচ্ছা-নিরপেক্ষভাবেই তার পূর্ববর্তী কোনো ধারণা ও ভাবনাকে সংযুক্ত করতে পারে আর এভাবেই গড়ে ওঠে উৎকৃষ্ট এবং মহান সৃষ্টিসমূহ। জাঁ পল রিশটার বলেছেন ‘একজন কবি যখন তাঁর কাব্যের মধ্যে সৃষ্ট কোনো শয়তান চরিত্র কখন হ্যাঁ অথবা না বলবে তা নিয়ে ভাবতে বসেন, তখন তাকে অর্থহীন মৃত চিন্তা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়!’ স্বপ্ন দেখার বিষয়টি থেকে মানুষের এই ক্ষমতাটির চমৎকার ধারণা পাওয়া যেতে পারে, কেননা, জাঁ পলের কথাতেই, ‘স্বপ্ন হলো কবিতার একটি স্বয়ংচালিত ক্রিয়া।’ তাই বলা যায়, কল্পনাশক্তির উদ্ভাবনী ক্ষমতা যেমন আমাদের ধারণার সংখ্যা, যথার্থ ও স্পষ্ট বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, ঠিক তেমনি নির্ভর করে অনৈচ্ছিক যোগাযোগকে গ্রহণ বা বর্জন করার বিচার ক্ষমতা ও রুচির ওপর এবং আমাদের স্বেচ্ছাকৃত ক্ষমতা দ্বারা এগুলোকে যুক্ত করার ওপরেও এই উদ্ভাবনী ক্ষমতা খানিকটা নির্ভরশীল। কুকুর, বিড়াল, ঘোড়া এবং সম্ভবত সমস্ত উন্নত শ্রেণির জীবজন্তুরা, এমনকী পাখিরাও[৩] স্বপ্ন দেখে থাকে, ঘুমোনোর সময় তাদের শারীরিক আন্দোলন ও মুখ থেকে উচ্চারিত আওয়াজই তাদের স্বপ্ন দেখার প্রমাণ দেয়। তাদের যে কিছুটা কল্পনাশক্তি আছে, তা স্বীকার করতে আমরা বাধ্য। আবার রাত্রিবেলা, বিশেষ করে চাঁদনি রাতে, কুকুরের করুণ সুরে চিৎকার করার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ কারণ আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমরা এ চিৎকারকে কুকুরের গম্ভীর ধ্বনি বলে থাকি। তা বলে সমস্ত কুকুরই যে এমন করে, তা নয়। হাইজো-র মতে, কুকুররা চাঁদের দিকে মোটেই তাকায় না, বরং তাদের দৃষ্টি নিবন্ধ থাকে দিগন্তে মেশা আকাশের কোনো-এক নির্দিষ্ট বিন্দুতে। তাছাড়াও তিনি মনে করেন, চারপাশের নানান অস্পষ্ট ছবি তাদের কল্পনাশক্তির পথ আটকে দাঁড়ায়, ফলে তাদের মনের মধ্যে নানা আজগুবি প্রতিকৃতি ভেসে ওঠে। তাই যদি হয়, তাহলে বলতে হয়, তাদের অনুভূতি অনেকটাই যুক্তিহীন।
বেশি ঝুঁকি নেওয়া হবে? হোক। তবু আমি ক্বলব মানুষের মানসিক ক্ষমতাগুলোর মধ্যে ‘যুক্তি’ বা চিন্তাভাবনার স্থান সর্বাগ্রে। এমনকি জীবজন্তুদের যুক্তিশক্তি সম্পর্কে সন্দিহান লোকজনের সংখ্যাও এখন খুবই নগণ্য। লক্ষ করার বিষয় হলো—জীবজন্তুরা চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়, যেন কিছু- একটা ভাবে তারপর মনস্থির করে আবার চলতে শুরু করে। এটা একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার যে, কোনো প্রাণীতত্ত্ববিদ যত বেশি সময় ধরে এবং ভালোভাবে একটি নির্দিষ্ট প্রাণীর আচার-আচরণ লক্ষ করবেন, তত বেশি করে তিনি তার মধ্যে যুক্তির প্রাচুর্য দেখতে পাবেন, তুলনায় অনেকরকম খুঁজে পাবেন সহজাত প্রবৃত্তির চিহ্ন।[৪] পরের পরিচ্ছেদগুলোতে আমরা দেখব অত্যন্ত নিম্নশ্রেণির কিছু প্রাণীও দৃশ্যত যুক্তিগ্রাহ্য কিছু কাজ করে থাকে। অবশ্য অস্বীকার করে লাভ নেই যে সহজাত প্রবৃত্তি এবং যুক্তিগ্রাহ্য কাজের মধ্যে ভেদরেখা টানা খুবই কষ্টসাধ্য। যেমন, ড. হেস তাঁর ‘দ্য ওপেন পোলার সি’ রচনাটিতে বার বার বলেছেন, পাতলা বরফের ওপর দিয়ে চলার সময় তাঁর কুকুরগুলো গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে স্লেজগাড়ি টানার বদলে পরস্পর দূরে সরে সরে যেত ও পৃথক হয়ে পড়ত, যাতে তাদের দৈহিক ওজন সমানভাবে বিন্যস্ত হতে পারে। এই ব্যাপারটা বেশির ভাগ সময়েই আরোহীদের কাছে একটা সতর্কীকরণ হিসেবে উপস্থিত হতো, যার ফলে তারা বুঝতে পারত এখান থেকে বরফের প্রকৃতি পাতলা, ও বিপজ্জনক। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে—এই কুকুরগুলো কি তাহলে স্ব স্ব অভিজ্ঞতা থেকে এরকম কাজ করত, নাকি তা বংশগত অভ্যাসের ফল, অর্থাৎ সহজাত প্রবৃত্তিবিশেষ? সম্ভবত তাদের মধ্যে এই ক্ষমতাটির উৎপত্তি হয়েছিল বহুদিন আগে, যখন এই অঞ্চলের অধিবাসীরা স্লেজ গাড়ি টানার কাজে তাদের প্রথম নিযুক্ত করেছিল। অথবা এমনও হতে পারে যে এস্কিমো কুকুরদের পূর্বপুরুষ, অর্থাৎ উত্তরমেরু অঞ্চলের নেকড়েরা, পাতলা বরফের ওপর বিচরণরত শিকারকে সকলে মিলে পাশাপাশি থেকে আক্রমণ না-করার অভ্যাস থেকেই এটা রপ্ত করেছিল।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত কাজগুলোকে বিচার করে আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি যে সেগুলো সহজাত প্রবৃত্তির ফল, না যুক্তিসঙ্গত কাজ, নাকি কেবলমাত্র কিছু ধারণার সমষ্টিগত ক্রিয়া। অবশ্য শেষের বিষয়টি (ধারণার সমষ্টি) যুক্তিশক্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কযুক্ত। অধ্যাপক মোবিয়াস বানমাছ সম্পর্কে একটি কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য জানিয়েছেন। একই অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে একটি বানমাছকে চওড়া কাচ দিয়ে অন্যান্য মাছেদের থেকে আলাদা করে রেখেছিলেন তিনি। দেখা গেল যে বানমাছটি অন্য পাশের মাছদের ধরবার জন্যে বারবার কাচটির গায়ে ধাক্কা মারছে এবং এত জোরে মারছে যে মাঝে মাঝে নিজেই অচেতন হয়ে পড়ছে। এইভাবে তিন মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর বানমাছটি ব্যাপারটা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে কাচের গায়ে ধাক্কা মারা বন্ধ করল। এরপর ওই কাচটিকে সরিয়ে নেওয়া হলেও সে আর আগের মতো অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যেকার মাছগুলোকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো না—অবশ্য পরে ছাড়া মাছগুলোকে গোগ্রাসেই গিলেছিল সে। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, যে আগেকার মাছগুলোকে আক্রমণ করার সঙ্গে যে সাঙ্ঘাতিক আঘাতটা মিশে ছিল, তা তার দুর্বল মস্তিষ্কের মধ্যে অত্যন্ত মারাত্মকভাবে গেঁথে গিয়েছিল। আবার যে বুনো মানুষটি কখনো সুবৃহৎ কাচের জানলা দেখেনি, সে যদি একবার ওই জানলায় ধাক্কা মারে তাহলে তার মনেও জানালা আর আঘাতের মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়ে যাবে—তবে এই রয়ে যাওয়াটা কিন্তু ঠিক বানমাছের ঘটনাটার সঙ্গে মিলবে না। সে ওই জানালার সম্বন্ধে ভাবনাচিন্তা করবে এবং ভবিষ্যতে একইরকম অবস্থার সম্মুখীন হলে সাবধানতা অবলম্বন করবে। আবার আমরা যদি বানরদের লক্ষ করি তাহলে দেখব, কখনো কখনো মাত্র একবার অনুষ্ঠিত কাজ থেকে প্রাপ্ত বাধা বা বিরক্তির ধারণাই তাদের দ্বিতীয়বার ওই কাজ করা থেকে বিরত রাখার পক্ষে যথেষ্ট। এখন যদি ধরা যায় বানর ও বানমাছের মধ্যে এই পার্থক্যের একমাত্র কারণ একজনের তুলনায় অন্যজনের মধ্যে ধারণার সংযুক্তি অনেক বেশি জোরালো ও দৃঢ়মূল (যদিও বানমাছটি প্রায়শই অনেক বেশি মারাত্মক আঘাতের সম্মুখীন হয়েছে) তাহলে আমরা কি বলতে পারি যে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে ওই একইরকম পার্থক্য থাকলে তাদের মানসিক গঠনও মূলগতভাবে পৃথক হবে?
হাউজো জানিয়েছেন, যখন তিনি টেক্সাসের বিস্তীর্ণ শুকনো সমতলভূমি হেঁটে পার হচ্ছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে থাকা কুকুর দু’টি অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে কম করে তিরিশ থেকে চল্লিশবার কোনো খাত দেখলেই জলের আশায় ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু খাতগুলোত কোনো জল ছিল না, কোনো সবুজের চিহ্ন বা আর্দ্র মাটির গন্ধ পর্যন্ত ছিল না। তাহলে কুকুরগুলোর এরকম আচরণের কারণ কী? নিশ্চয়ই তারা জানত গর্তের মধ্যেই জলের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য জীবজন্তুদের মধ্যেও এ-রকম আচরণ লক্ষ করেছেন হাউজো। আমার নিজের চোখে দেখা এবং সম্ভবত অনেকেই চিড়িয়াখানায় দেখে থাকবেন, কোনো হাতির নাগালের বাইরে মাটিতে একটি ছোট বস্তু ছুঁড়ে দিলে প্রথমেই সে তার শুঁড় দিয়ে মাটিতে হাওয়া দিতে থাকে, যাতে করে চারপাশে ছড়িয়ে পড়া বায়ুর চাপে বস্তুটি সহজেই তার নাগালের মধ্যে এসে পড়ে। প্রখ্যাত নূকুলতত্ত্ববিদ (ethnologist) মি. ওয়েস্ট্রোপ ভিয়েনায় দেখা তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা আমাকে জানিয়েছেন। অভিজ্ঞতাটি এ-রকম : একটি ভালুক তার খাঁচার দরজার কাছে অবস্থিত জলের ওপরে ভাসমান এক টুকরো রুটিকে নিজের কাছে টেনে আনার জন্য পায়ের থাবা দিয়ে জল টানছে। সুতরাং হাতি ও ভালুকের এই ধরনের কাজগুলোকে সহজাত প্রবৃত্তি বা বংশগত অভ্যাস বললে ভুল হবে, কারণ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে তাদের এই ধরনের কাজ করার কোনো দরকারই হয় না। কিন্তু একজন অ-সভ্য মানুষ ও উচ্চশ্রেণির একটি জন্তুর দ্বারা সম্পাদিত এইরকম কাজের মধ্যে তফাত কী? ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা যাক। অ-সভ্য মানুষ ও কুকুর, উভয়েই প্রায়শ কোনো নিচু জায়গায় জলের সন্ধান পেয়েছে এবং তাদের মনে জল আর নিচু জায়গা একটা অভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। একজন সুসভ্য মানুষ এ-বিষয়ে কিছু সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে, কিন্তু অ-সভ্য লোকদের সম্পর্ক জানা সমস্ত তথ্যকে বিচার করে দেখলে মনে হয় যে তাদের পক্ষে এ-রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব নয়, আর কুকুরদের পক্ষে তো আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু একজন বুনো লোক ও একটি কুকুর একইভাবে তাদের অনুসন্ধান চালায়, যদিও বার বার তাদের আশাহত হতে হয় এবং উভয়ের ক্ষেত্রেই কাজটার পিছনে কিছু যুক্তি কাজ করে, তা সে বিষয়টি সম্বন্ধে কোনো সাধারণ সিদ্ধান্ত তাদের সামনে থাক আর না-ই থাক।[৫] সুতরাং হাতি ও ভালুকের দ্বারা বাতাস বা জলের মধ্যে প্রবাহ সৃষ্টি করাও একই নিয়মের বশবর্তী। আবার একজন বুনো লোকের পক্ষে জানা বা খেয়াল করা সম্ভব নয় কোন নিয়মের দ্বারা তার আকাঙ্ক্ষিত কাজটি সম্পাদিত হচ্ছে। তথাপি তার কাজকর্ম কিছুটা স্থূল যুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যেমন নিশ্চিতভাবে একজন দার্শনিক তাঁর অবরোহমূলক সিদ্ধান্তের দীর্ঘতম বিন্যাস করে থাকেন। এটাই হলো একজন বুনো মানুষের সঙ্গে একটি জন্তুর তফাত। কারণ মানুষ পরিবেশ ও অবস্থার প্রতি মনোনিবেশ করতে পারে এবং অনেক অল্প অভিজ্ঞতা থেকেই সেগুলোর মধ্যেকার যোগসূত্রটি অনুধাবন করতে পারে। এবং এই ব্যাপারটার গুরুত্ব অপরিসীম। একসময় আমি আমার ছোট বাচ্চাটির সারাদিনে করা কাজগুলো লিখে রাখতাম। তার এগারো মাস বয়সের সময় (তখনও সে কথা বলতে শেখেনি) আমি আশ্চর্য হয়ে দেখতাম কত তাড়াতাড়ি তার মনের মধ্যে বিভিন্ন বস্তু ও শব্দের একটা পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আমার জানা সব থেকে বুদ্ধিমান কুকুরের মধ্যেও এই সম্পর্ক এত দ্রুত গড়ে ওঠে না। অবশ্য উচ্চশ্রেণির জীবজন্তুর মধ্যেও এই ক্ষমতা নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের, যেমন বানমাছ, থেকে পৃথক হয়। তাছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রেও তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে।
নিম্নশ্রেণির আমেরিকান বানরদের নিম্নোক্ত কিছু কাজের সাহায্যে বেশ স্পষ্ট করেই দেখানো যেতে পারে কীভাবে সামান্য অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও যুক্তি বা চিন্তাভাবনার তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। অত্যন্ত মনোযোগী পর্যবেক্ষক রেঙ্গার জানিয়েছেন যে প্যারাগুয়েতে থাকার সময় তিনি যখন প্রথমবার তাঁর পোষা বানরদের ডিম খেতে দিয়েছিলেন, তখন তারা মাটিতে আছড়ে সেগুলো ভেঙে ফেলেছিল। ফলে বেশিরভাগ ডিমেরই কুসুম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা ডিমের একটা প্রান্ত শক্ত কোনো-কিছুকে ঠুকে তারপর আঙ্গুল দিয়ে তার খোলা ছাড়িয়ে ফেলতে শিখেছিল। আবার ধারালো কোনো যন্ত্রে যদি একবার তাদের হাত কেটে যেত, তাহলে তারা দ্বিতীয়বার আর সেটা স্পর্শ করত না, কিংবা করলেও খুব সতর্কভাবে করত। আবার এ-ও শুনেছি যে এই বানরদের জন্যে কাগজে মোড়া চিনির ডেলা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু রেঙ্গার মাঝে মাঝে কাগজের মোড়কের মধ্যে জ্যান্ত বোলতা রেখে দিতেন, যাতে মোড়কটা তাড়াহুড়ো করে খুললেই তাদের হুলের কামড় খেতে হয়। কিন্তু এ- রকম ঘটনা একবার ঘটে যাওয়ার পর বানরগুলো সবসময় প্রথমে কানের কাছে কাগজের মোড়কটা ধরে বুঝতে চেষ্টা করত ভিতরে কিছু কিনা।[৬] এখন কুকুরদের সম্বন্ধে কিছু উদাহরণ পেশ করা যাক। মি. কলকিউহান একবার দুটো বুনো হাঁসকে ডানা-বিদ্ধ করায় তারা নদীর অপর পাড়ে গিয়ে পড়ল। তাঁর শিকারি কুকুরটি তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে সে দুটোকে একসঙ্গে নিয়ে আসতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। যদিও সে আগে কখনো পাখির ডানা মুড়িয়ে ধরতে শেখেনি, তবুও সে বুদ্ধি করে একটিকে মেরে ফেলে অন্য হাঁসটিকে নিয়ে আসার পর আবার গিয়ে মরা পাখিটিকে নিয়ে এলো। কর্নেল হাচিনসন জানিয়েছেন, একবার তিনি দুটো তিতির পাখিকে গুলোবিদ্ধ করার পর একটি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় এবং দ্বিতীয়টি জখম হয়। জখম পাখিটি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত শিকারি কুকুরের কাছে হার মানে এবং পাখিটিকে নিয়ে ফেরার সময় কুকুরটি মৃত পাখিটির সামনে এসে দাঁড়ায় : ‘সে থামল, স্পষ্টতই হতবুদ্ধি, তারপর বার দুয়েক চেষ্টা করে বুঝতে পারল এখন মরা পাখিটিকে তুলে নিলে জখম পাখিটি পালাবার সুযোগ পেয়ে যাবে। একটু ভাবল সে, তারপর মারাত্মক কামড়ে জখম পাখিটিকে হত্যা করে দুটি পাখিকেই একসঙ্গে নিয়ে ফিরল। জীবনে এই একবারই কুকুরটি স্বেচ্ছাকৃতভাবে শিকারকে আঘাত করেছিল।’ এখানে আমরা সঠিক যুক্তি-বুদ্ধির অভাব দেখতে পাচ্ছি, কারণ শিকারি কুকুরটি বুনো হাঁসের ঘটনাটির মতো প্রথমে আহত পাখিটিকে নিয়ে আসতে পারত, পরে মৃতটিকে। দুজন আলাদা আলাদা প্রত্যক্ষদর্শীর দেখা এই ঘটনা দুটিকে আমি এখানে রাখলাম, কারণ দুটি ঘটনাতেই শিকারি কুকুররা কিছুটা চিন্তা-ভাবনা করার পর তাদের বংশগত অভ্যাস বা আচরণকে (শিকারির সময় শিকারকে হত্যা না করা) লঙ্ঘন করেছে এবং প্রমাণ করেছে তাদের যুক্তি বা চিন্তাশক্তি কোনো নির্দিষ্ট অভ্যাসকে অতিক্রম করার পক্ষে যথেষ্টই শক্তিশালী।
হাম্বোল্ডের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টিতে ছেদ টানব আমি : ‘দক্ষিণ আমেরিকার খচ্চর-চালকরা বলে থাকে, ‘আমি আপনাকে চলতে-ফিরতে সবচেয়ে পারদর্শী খচ্চরটি দিচ্ছি না, কিন্তু যাকে দিচ্ছি যে চিন্তাভাবনায় সবচেয়ে তুখোড়।’ এরপর হাম্বোল্ডে লিখছেন, ‘দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপুষ্ট, বহুল- প্রচলিত এই উক্তিটি সম্ভবত দূরকল্পী দর্শনের যাবতীয় যুক্তি প্রণালির তুলনায় অনেক বেশি করে সজীব যান্ত্রিক-পদ্ধতির বিরোধিতা করে।’ তথাপি কোনো কোনো লেখক এখনও পর্যন্ত উচ্চশ্রেণির প্রাণীদের মধ্যে যুক্তিবুদ্ধির বিষয়টি অস্বীকার করেন এবং তাঁরা উপরোল্লিখিত এইসমস্ত ঘটনার এমন সব ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেন যা নিছকই কথার কথা মাত্ৰ।[৭]
দেখা যাচ্ছে মানুষ ও উচ্চশ্রেণির জন্তুদের মধ্যে, বিশেষ করে বানরদের মতো উন্নত প্রাণীদের মধ্যে, সাধারণ কিছু সহজাত প্রবৃত্তি কাজ করে। তাদের সকলের মধ্যে একই ইন্দ্রিয়ানুভূতি, স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান ও সংবেদন, একই ভাবাবেগ, অনুরাগ ও আবেগ লক্ষ করা যায়, এমনকী ঈর্ষা, সন্দেহ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কৃতজ্ঞতা, মহানুভবতা ইত্যাদির মত অত্যন্ত জটিল বিষয়ও তাদের মধ্যে বর্তমান থাকে। তারা প্রতারণা করতে শেখে ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়। কখনো-বা বিদ্রূপ করার ইচ্ছা জাগে তাদের, এমনকী চমৎকার রসবোধও থাকে, যেমন থাকে বিস্ময় বা কৌতূহলবোধ। তাছাড়া অনুকরণ, মনঃসংযোগ, কৌশল, অবলম্বন, পছন্দ, স্মৃতিশক্তি, কল্পনাশক্তি, ধারণার সংযুক্তি ও যুক্তি-বুদ্ধির একইরকম কাজগুলো করতে পারে তারা, অবশ্য তার মধ্যে কম-বেশি প্রভেদ থাকতেই পারে। একই প্রজাতির মধ্যে কেউ যেমন চূড়ান্ত নির্বোধ হয়, তেমনি অন্য একজন আবার হয়ে উঠে প্রচণ্ড বুদ্ধিমান। আবার মানসিক বিকারগ্রস্ত হওয়ায় ঘটনাও চোখে পড়ে, কিন্তু মানুষের মতো এত বেশি করে আর কারুর ক্ষেত্রে দেখা যায় না। তা সত্ত্বেও অনেক লেখক জোরের সঙ্গে বলে থাকেন মানুষ ও নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মানসিক ক্ষমতার মধ্যে একটি অনতিক্রম্য ব্যবধান রয়েছে। একসময় আমি এ-ধরনের কিছু উক্তি সংগ্রহে উদ্যোগী হয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য এতই বেশি আর সংখ্যাও এত সুপ্রচুর যে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলাম। এ-কথাটা জোর দিয়েই বলা হয় যে একমাত্র মানুষই ক্রমান্বয়ে অগ্রগতি ঘটাতে সক্ষম, অর্থাৎ কেবলমাত্র মানুষই যন্ত্রপাতি বা আগুন ব্যবহার করতে পারে, পশুদের পোষ মানাতে বা সম্পত্তি অধিকার করতে পারে। অন্য কোনো প্রাণীর বিমূর্ত বা বস্তুনিরপেক্ষ জ্ঞান নেই, সাধারণ ধারণা গঠনে তারা অক্ষম, কেবল নিজেতেই বিভোর এবং ভাবপ্রকাশের জন্য কোনো ভাষা তাদের জানা নেই। আর একমাত্র মানুষেরই আছে সৌন্দর্যবোধ, যেমন আছে খামখেয়ালিপনা, কৃতজ্ঞতাবোধ, নানা রহস্যময়তা ইত্যাদি। সর্বোপরি, মানুষ ঈশ্বরবিশ্বাসী এবং বিবেকবোধসম্পন্ন। এখানে আমি এগুলোর মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়গুলো নিয়ে দু-চার কথা না বলে পারছি না।
আর্চবিশপ সুনার অনেক আগে বলেছিলেন যে একমাত্র মানুষই ক্রমান্বয় অগ্রগতি ঘটাতে সক্ষম, অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের উন্নতি অনেক বেশি ও দ্রুত এবং তার কারণও মুখ্যত এই যে, সে কথা বলতে পারে এবং অর্জিত জ্ঞান হস্তান্তর করতে পারে। ফাঁদ -পাতা সম্পর্কে অবহিত ব্যক্তিমাত্রই জানেন বয়স্ক পশুদের তুলনায় তাদের শাবকদের ধরা অনেক সহজ, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা শত্রুর বশীভূত হয়। অন্যদিকে, বেশ কিছু বয়স্ক পশুকে একই জায়গায় একই রকম ফাঁদ পেতে ধরা সম্ভব নয় বা একই রকম বিষপ্রয়োগে হত্যা করাও অসম্ভব। তা বলে সকলেই যে বিষ খাবে বা ফাঁদে ধরা পড়বে, এমন ভাবাটাও অস্বাভাবিক। তাদের ভাই-বন্ধুদের ধরা পড়তে দেখে বা বিষের শিকার হতে দেখে তারা সতর্ক হতে শিখে যায়। উত্তর আমেরিকায় বেশ কিছুদিন ধরে লোমযুক্ত প্রাণীদের ধরার চেষ্টা চলছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সর্বসম্মত সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, এই প্রাণীদের অধিকাংশই অসম্ভব রকমের বিচক্ষণ, সতর্ক ও ধূর্ত অবশ্য এত দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে ফাঁদ-পাতার কাজটি চলে আসছে যে এসব গুণ তাদের মধ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে সঞ্চারিত হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। আমার কাছে আরও কিছু নজির আছে। প্রথম যখন কোনো অঞ্চলে টেলিগ্রাফের তার টাঙানো হতো, তখন অনেক পাখিই তারে ধাক্কা খেয়ে মারা যেত, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই তারা এই বিপদকে এড়িয়ে চলতে শিখেছিল। সম্ভবত সাথিদের মৃত্যু দেখতে দেখতেই এই শিক্ষাটা পেয়েছিল তারা।
যদি আমরা বংশপরম্পরাক্রমে পশু-পাখিদের লক্ষ করি, তাহলে এ- ব্যাপারে কোনো সন্দেহই থাকে না যে প্রথমে তারা মানুষ বা অন্যান্য শত্রুদের সম্পর্কে যতটা সতর্কতা অবলম্বন করছিল, তাতে ধীরে ধীরে আলগা দিতে শেখে। এই সতর্কতার অধিকাংশই বংশগত বা সহজাত অভ্যাসপ্রসূত হলেও, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও এর আংশিক দাবিদার। অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষক লেরয় জানিয়েছেন, যে-সমস্ত অঞ্চলে বেশি মাত্রায় শিয়াল শিকার করা হয়, সেখানে শিয়ালছানারা প্রথমবার তাদের বাসস্থানের গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় থেকেই অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করে থাকে। যে-সব অঞ্চলে শিয়াল- শিকারিদের প্রাদুর্ভাব কম, সে-সব অঞ্চলের বড় শিয়ালরাও এদের মতো এতটা সতর্ক হয় না। গৃহপালিত কুকুররা নেকড়ে বা শিয়াল থেকেই ক্রমবিবর্তিত হয়েছে। এই কুকুররা তাদের পূর্বপুরুষদের মতো ধূর্ত, সতর্ক বা সন্দেহপ্রবণ না হলেও তাদের মধ্যে কিছু নৈতিক গুণের ক্রমোন্নতি লক্ষণীয়, যেমন, অনুরাগ, বিশ্বস্ততা, ধৈর্য্য এবং হয়তো-বা সাধারণ বুদ্ধিমত্তাও। জানা গেছে, সারা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার কিছু অংশ, নিউজিল্যান্ড এবং সম্প্রতি হংকং ও চীনেও সাধারণ জাতের ইঁদুররা অন্যান্য প্রজাতি ইঁদুরদের ওপর আক্রমণ করছে এবং তাদের হঠিয়ে দিচ্ছে। শেষের এই দু’টি দৃষ্টান্তের বিবরণদাতা মি. সুইন্হো দেখিয়েছেন যে সাধারণ জাতের এই ইঁদুরদের দ্বারা বড় আকারের ইঁদুরদের (Mus coninga) হঠে যাওয়ার কারণ হচ্ছে সাধারণ ইঁদুরদের অপেক্ষাকৃত বেশি ধূর্ততা। শেষোক্ত এই বৈশিষ্ট্যটি মানুষের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তাদের সমস্ত চিন্তাভাবনার অভ্যাসগত অনুশীলনের ফল বলে অনুমান করা যেতে পারে, কেননা কম-চতুর বা স্বল্পবুদ্ধির প্রায় সমস্ত ইঁদুরই মানুষের হাতে অবিরত ধ্বংস হয়ে থাকে। তবে এটাও হতে পারে যে সাধারণ জাতের ইঁদুরদের এই সাফল্য সম্ভব হয়েছে মানুষের সংস্পর্শে আসার আগেই প্রতিবেশী অন্যান্য ইঁদুরদের তুলনায় তাদের অনেক বেশি ধূর্ততার দরুনই। কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়াই যদি এই ধারণা পোষণ করতে হয় যে, যুগের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোনো জীবজন্তুরই বুদ্ধিমত্তা বা অন্যান্য মানসিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটেনি, তাহলে এক্ষেত্রে আমাদের প্রজাতির বিবর্তন সংক্রান্ত তত্ত্বেরই শরণ নিতে হবে। কেননা, লার্টেট-এর মতে, বিভিন্ন শ্রেণিতে অবস্থিত বর্তমান স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মস্তিষ্কের আকার তাদের পূর্বপুরুষদের ত্রিস্তরবিশিষ্ট মস্তিষ্কের থেকে অনেক বড়।
হামেশাই বলা হয়ে থাকে যে মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারে না, অথচ শিম্পাঞ্জিরা অবস্থাবিশেষ দিব্যি এক ধরনের বুনো ফল (দেখতে অনেকটা আখরোট ফলের মতো) পাথর দিয়ে ভেঙে খায়। রেঙ্গার এভাবেই একটি আমেরিকান বানরকে শক্ত তালের আঁটি ভাঙতে শিখিয়েছিলেন এবং তারপর থেকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী নানারকম বাদামের খোসা ছাড়ানো এবং বাক্স খোলার জন্য পাথরের সাহায্য নিত। এমনকী তৃপ্তিদায়ক গন্ধ না পেলে সে এইভাবে ফলের নরম খোসাও ছাড়িয়ে ফেলত। আবার অন্য একটি বানরকে শেখানো হয়েছিল কীভাবে একটিমাত্র লাঠির সাহায্যে একটি বড় বাক্সের ডালা খুলতে হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো তারপর থেকে সে এই লাঠিটাকে কোনো ভারী জিনিস সরানোর জন্য ঠিক লিভারের মতো ব্যবহার করত। তাছাড়া আমি একটি বাচ্চা ওরাংওটাংকে একটা ফাটলের মধ্যে লাঠির একপ্রান্ত ঢুকিয়ে অন্যপ্রান্তে চাড় দিয়ে লাঠিটাকে লিভার-দণ্ডের মতো ব্যবহার করতে দেখেছি। আবার ভারতবর্ষের পোষমানা হাতিরা যে গাছের ডাল ভেঙে মাছ তাড়াতে পারে, সে কথাও আমাদের অজানা নয়। এমনকী একটা বুনো হাতিকেও এভাবে মাছি তাড়াতে দেখা গেছে। এবারের উদাহরণটি একটি বাচ্চা মেয়ে ওরাং-ওটাং সম্পর্কে। সে যখনই বুঝতে পারত তাকে এবার চাবুক মারা হবে, তখন তাড়াতাড়ি হাতের সামনে কম্বল বা খড় পেতে তাই দিয়েই নিজেকে ঢাকতে চেষ্টা করত। এতক্ষণ আমরা দেখলাম যে পাথর বা লাঠিকে জন্তু-জানোয়ারেরা যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে পাথর বা লাঠিকে আক্রমণ বা প্রতিরোধের অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করেছে তারা। সুবিখ্যাত পর্যটক শিম্পার বিবরণ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ব্রেম্ বলেছেন যে আবিসিনিয়াতে সি. জেলাডা প্রজাতির বেবুনরা দলে দলে পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসে শস্যক্ষেতগুলোকে লুট করবার জন্য। কখনো কখনো সি. হামাড্রিয়া নামে অন্য এক প্রজাতির বেবুনদের সঙ্গে তাদের সংঘাত বাধে, যার নিশ্চিত ফল হলো দু’পক্ষের মধ্যে জোর লড়াইয়ের সময় জেলাডা প্রজাতির বেবুনরা ওপর থেকে প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে বড় বড় পাথর গড়িয়ে দেয়, প্রতিপক্ষ হামাড্রিয়া বেবুনরা তা এড়াতে চেষ্টা করে এবং শেষমেষ দু’পক্ষই হুঙ্কার দিয়ে একে অপরের দিকে ধেয়ে যায়। কোবার্গ-গোথার ডিউকের সঙ্গে আবিসিনিয়ার মেসা গিরিপথের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আক্রমণকারী একদল বেবুনের বিরুদ্ধে ব্রেহম আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। প্রত্যুত্তরে তারা মানুষের মাথার মতো বড় বড় এত পাথর ফেলতে শুরু করেছিল যে আক্রমণকারীদের দ্রুত পিছু হটতে হয়েছিল এবং বেশ কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি চলাচলের রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। লক্ষণীয় যে উল্লিখিত বেবুনরা সম্মিলিতভাবে এই কাজটি সম্পন্ন করেছিল। মি. ওয়ালেস তিনটি ভিন্ন ঘটনায় দেখেছিলেন যে স্ত্রী ওরাং-ওটাং ও তাদের বাচ্চারা ‘প্রচণ্ড ক্রোধে ডুরিয়ান গাছের ডাল ও তার ভীষণ কণ্টকময় ফল ছুঁড়ে দিচ্ছে। এই প্রচণ্ড আক্রমণের দরুন আমরা ওই গাছের খুব কাছে যেতে পারিনি।’ তাছাড়া আমি অনেকবারই দেখেছি যদি কেউ কোনো শিম্পাঞ্জিকে বিরক্ত করে, তাহলে সে হাতের সামনে যা পায় তা-ই তার শত্রুর দিকে ছুঁড়ে মারে। এ প্রসঙ্গে উত্তমাশা অন্তরীপের সেই পূর্বোক্ত বেবুনটির কথা আর- একবার মনে করা যেতে পারে, যে তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য জল দিয়ে কাদা তৈরি করেছিল।
চিড়িয়াখানার একটি বানর তার দুর্বল দাঁতের জন্য এক টুকরো পাথর দিয়ে বাদাম ভেঙে ভেঙে খেত। সেখানকার সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা আমাকে জানিয়েছেন যে বাদাম ভাঙার পর সে পাথরটি খড়ের নিচে লুকিয়ে রাখত যাতে অন্য কোনো বানর সেটির খোঁজ না পায়। এখানে আমরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির একটা ছায়া দেখতে পাচ্ছি। অবশ্য কুকুরদের মধ্যে এই ধারণাটি হামেশাই দেখা যায়। সংগ্রহ করা মাংসের হাড় তারা সবসময় নিজের দখলে রাখতে চায়। আবার পাখিরা তাদের বাসাটিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলেই মনে করে থাকে।
ডিউক অফ আরজিল বলেছেন—কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য যন্ত্র বানানোটা মানুষের একান্তই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং তিনি মনে করেন এই ব্যাপারটা মানুষের সঙ্গে অন্যান্য জন্তুদের এক দুস্তর ব্যবধান রচনা করেছে। পার্থক্যটা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাতে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু স্যর জে. লুবকের কথার মধ্যেই আমি অধিকতর সত্য খুঁজে পাই। তাঁর মতে, আদিম মানুষ কোনো বিশেষ প্রয়োজনে চমকি পাথরের ব্যবহার করতে গিয়ে আকস্মিকভাবেই তা ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল এবং সেই ধারালো পাথরের টুকরোগুলো ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। এই ঘটনার পর কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে পাথর ভেঙে নেওয়াটা তো স্রেফ এক কদম বাড়নোর ওয়াস্তা। আর বিশেষ উদ্দেশ্যে পাথর ভাঙা শুরু হওয়ার পর, সেই ভাঙা পাথরকে ঘষে-মেজে কোনো হাতিয়ার বা যন্ত্র বানানোটাও বেশ সহজই হয়ে পড়ে। তবে নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের পাথর ঘষে-মেজে যন্ত্র তৈরি করার আগেকার সুদীর্ঘ সময়ের কথা বিচার করলে মনে হয় যে, এই শেষোক্ত ঘটনাটা ঘটাতে (অর্থাৎ ভাঙা পাথরকে ঘষে-মেজে কিছু বানাতে) বহুকাল সময় লেগেছিল মানুষের। তাছাড়া স্যর জে. লুবক মনে করেন, চমকি পাথর ভাঙার সময় আগুনের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হতো এবং সেগুলোকে ঘষে ঘষে মসৃণ করার সময় সৃষ্টি হতো প্রভূত তাপ। আর এইভাবেই হয়তো ‘আগুন জ্বালানোর দু’টি চালু পদ্ধতির সূত্রপাত হয়েছিল।’ অধিকন্তু আগ্নেগিরি অঞ্চলে আগুনের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে মানুষ অবহিত ছিল বলেই ধরে নেওয়া যায়, কেননা গরম লাভাস্রোত মাঝেমধ্যেই ছুটে যেত সবুজ বনের মধ্য দিয়ে। আবার বনমানুষেরা সম্ভবত সহজাত প্রবৃত্তির বশেই নিজেদের থাকার জন্য অস্থায়ী মাচা তৈরি করে থাকে। কিন্তু যেহেতু বহু প্রবৃত্তিই যুক্তি-নিয়ন্ত্রিত, তাই মাচা তৈরির মতো সরল প্রবৃত্তিগুলো স্বেচ্ছাকৃত ও সচেতন ক্রিয়ায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। আমরা অনেকেই জানি ওরাং-ওটাংরা রাত্রিবেলা প্যান্ডানাস গাছের পাতা দিয়ে নিজেদের ঢেকে রাখে। এ সম্বন্ধে ব্রেহমের তথ্যটি আরও চিত্তাকর্ষক। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর পোষমানা একটি বেবুন সূর্যের তাপ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মাথার ওপর একটা খড়ের চাটাই চাপিয়ে দিত! জন্তু- জানোয়ারদের এসব আচরণ আসলে স্থূল স্থাপত্য ও পোশাকের মতো কিছু সাধারণ কৃৎকৌশলের প্রাথমিক ধাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা, ভুললে চলবে না, মানুষের আদি পূর্বপুরুষদের মধ্যে থেকেই উত্থিত হয়েছে তারা
বিমূর্ত বা বস্তুনিরপেক্ষ ধারণা, সাধারণ ধ্যানধারণা, আত্ম-সচেতনতা বোধ, মানসক স্বকীয়তা
আমার পক্ষে কিংবা আমার চেয়েও জ্ঞানসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির পক্ষে বলা শক্ত যে জন্তু-জানোয়াররা ঠিক কতখানি এইসমস্ত উন্নত মানসিক ক্ষমতার অধিকারী। প্রাণীদের মনের মধ্যে কী ঘটছে তা ঠিকমতো জানা সম্ভব নয় বলেই এই সমস্যার উৎপত্তি। আবার উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর অর্থ সম্বন্ধে বিভিন্ন অভিমত থাকায় অসুবিধা বাড়ে বই কমে না। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো নিয়ে যদি কেউ বিচার করতে বসেন, তাহলে তিনি দেখতে পাবেন এগুলো মুখ্যত এই ধারণার ভিত্তিতেই লিখিত হয়েছে যে জন্তু- জানোয়ারদের মধ্যে কোনো-কিছু বিমূর্তায়ন করা বা সাধারণ ধারণা গঠনের ক্ষমতা বলতে আদৌ কিছু নেই। কিন্তু যখন কোনো কুকুর অন্য একটি কুকুরকে দূর থেকে দেখতে পায়, তখন সে তাকে একটি কুকুর বলেই মনে করে। কারণ, দূরের কুকুরটি কাছে আসার পর সে তাকে বন্ধু বলে বুঝতে পারলে তার আচার-ব্যবহারে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। অবশ্য সাম্প্রতিককালের একজন লেখক মন্তব্য করেছেন, এইসমস্ত ক্ষেত্রে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের মানসিক ক্ষমতা মূলত একই প্রকৃতির নয় বলে দাবি করাটা স্রেফ একটা অনুমান মাত্র। মানুষ তার ইন্দ্ৰিয়ানুভূত উপলব্ধিকে মানসিক ধারণার স্তরে উন্নীত করতে পারে এবং জন্তু-জানোয়াররাও তা করতে সক্ষম। আমি যখন আমার টেরিয়ার কুকুরটিকে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করি (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আমি বহুবার এমনটি করে দেখেছি), ‘আরে, ওটা গেল কোথায়?’ তৎক্ষণাৎ সে বুঝতে পারে তাকে কিছু একটু খুঁজতে হবে। প্রথমে সে চারপাশে দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নেয়, তারপর সবচেয়ে কাছের ঝোপটির মধ্যে ঢুকে কিছুক্ষণ শিকারের সন্ধান করে। কিন্তু কিছুই না পেয়ে অবশেষে সামনের গাছটির দিকে তাকিয়ে লক্ষ করে সেখানে কোনো কাঠবিড়ালী আছে কিনা। তাহলে এই কাজগুলো থেকে কি স্পষ্ট হচ্ছে না যে তার মনের মধ্যে এ-রকম একটি সাধারণ ধারণা বা কল্পনা ক্রিয়াশীল রয়েছে যে কোনো জীবজন্তুকেও খুঁজে বার করতে বা শিকার করতে হবে? অবশ্য, আমি কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাব, জীবন কী, মৃত্যু কাকে বলে এই জাতীয় চিন্ত াভাবনার অর্থে ধরলে কোনো পশুই আত্মসচেতন নয়। কিন্তু চমৎকার স্মৃতিশক্তি ও কিছু পরিমাণ কল্পনাশক্তির অধিকারী কোনো বুড়ো কুকুর (তার স্বপ্নের মধ্যে যে-ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া যায়) যে তার অতীত জীবনের বিভিন্ন শিকারের আনন্দ ও যন্ত্রণার কথা কখনো ভাবে না—সে ব্যাপারে কি নিশ্চিত হওয়া যায়? আর এটা হচ্ছে আত্মসচেতনতারই একটি রূপ। অন্যদিকে, বুখ্নার যেমন বলেছেন, কোনো অ-সভ্য অস্ট্রেলিয়াবাসীর স্ত্রী (খুবই কম কথা জানা বা চারের বেশি সংখ্যা গুণতে না পারা ও কঠিন পরিশ্রমী) কতটুকু আত্ম-সচেতনতা দেখাতে পারে বা নিজের অস্তিত্বের প্রকৃতি সম্বন্ধে কতটুকুই বা চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। তাছাড়া এটা সাধারণভাবেই স্বীকৃত যে উন্নতশ্রেণির প্রাণীদের মধ্যে স্মৃতিশক্তি, মনঃসংযোগ, ভাবনার সংযুক্তি, এমনকী কিছু পরিমাণে কল্পনাশক্তি ও যুক্তিবোধও কাজ করে। ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় থাকা উপরিউক্ত ক্ষমতাগুলো যদি বিকাশযোগ্য হয়, তাহলে জোর দিয়েই বলা যায় যে, ওইসব সরল ধরনের ক্ষমতা ক্রমোন্নতি ও সংযুক্তির সাহায্যে গড়ে-ওঠা জটিলতর ক্ষমতাসমূহ, যেমন কোনো বিষয়ের সারার্থ উপলব্ধি বা আত্মসচেতনতার উচ্চতর রূপ ইত্যাদির মতো ক্ষমতাগুলোও তাদের মধ্যে থাকাটা একান্তই স্বাভাবিক। কিন্তু এই মতবাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলা হয় যে জীবজগতের ক্রমবিকাশের ধারার ঠিক কোন সময়ে জীবজন্তুরা সারার্থ উপলব্ধি ইত্যাদি ক্ষমতার যোগ্যতা অর্জন করল? তাহলে পালটা প্রশ্ন করতে হচ্ছে, আমরা কি জানি ঠিক কত বছর বয়সের সময় আমাদের শিশুরা এই ক্ষমতার অধিকারী হয়? আমরা শুধু দেখতে পাই আমাদের শিশুদের মধ্যে এসব ক্ষমতা দারুণভাবে বেড়ে চলে।
জন্তু-জানোয়ারদের মানসিক স্বকীয়তা নিয়ে আশা করি কোনো দ্বিমত নেই। আগেই বলেছি কেবলমাত্র গলার আওয়াজ শুনে আমার কুকুরটি তার পুরনো ঘটনার অনুষঙ্গগুলো ফিরে পেত। অর্থাৎ তার মধ্যে একটি মানসিক স্বকীয়তা কাজ করত—যদিও দীর্ঘ পাঁচ বছর সময়-বিরতিতে তার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষের একাধিকবার পরিবর্তিত হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। কুকুরটি বোধহয় তার এই আচরণের সাহায্যে বিবর্তনতত্ত্ববিদদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি উপস্থাপিত বিচিত্র যুক্তিটিকেই খাড়া করে বলতে চেয়েছিল, ‘যাবতীয় মানসিক ভাব ও যাবতীয় বস্তুগত পরিবর্তনের মধ্যেও আমি টিকে আছি।…একগুচ্ছ কোষের পরিত্যক্ত শূন্য জায়গা পূরণ করতে উপস্থিত অন্য একগুচ্ছ কোষের ওপর প্রথম কোষগুচ্ছের প্রভাব থেকে যায়—এই যুক্তি সচেতনতার বিরোধী, অতএব মিথ্যাও বটে। কিন্তু বিবর্তনবাদই এই যুক্তির উদ্গাতা, কাজেই ওই মতবাদটিও ভ্রান্ত।’
ভাবপ্রকাশের ভাষা
সঙ্গতভাবেই এই বিষয়টি মানুষ ও নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মধ্যে প্রধান প্রধান পার্থক্যগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি আর্চবিশপ হোয়েটলির মতে, ‘মানুষই একমাত্র প্রাণী নয় যে তার মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষার আশ্রয় নিতে পারে বা অপরের ভাষা কম-বেশি বুঝতে পারে।’ প্যারাগুয়েতে দেখা যায়, সেবুস্ এজারে জাতের বানররা উত্তেজিত অবস্থায় অন্তত ছ’টি ভিন্ন ভিন্ন স্বরের আওয়াজ করে থাকে, যা অন্যান্য বানরদের মধ্যে একই অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। রেঙ্গাস এবং আরও অনেকেই মনে করেন, আমরা যেমন বানরদের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির অর্থ বুঝতে পারি, তারাও তেমনি আমাদেররটা আংশিক বুঝতে পারে। এ-বিষয়ে কুকুরের ডাক একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গৃহপালিত কুকুররা কম করে চার-পাঁচ রকম ভিন্ন ভিন্ন স্বরে ডাকতে পারে। কুকুরদের এইভাবে ডাকার রেওয়াজটা নতুন করে একটি কৌশল হলেও, তাদের পূর্বপুরুষরাও (নেকড়ে ও শিয়াল) নানারকম চিৎকার করে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারত। শিকারের সময় গৃহপালিত কুকুরদের গলার আওয়াজে ব্যগ্রভাব ফুটে ওঠে, শোনা যায় ক্রুদ্ধ চিৎকার, গর্গর্ আওয়াজ। আটকে রাখলে হতাশায় কেঁউ-কেঁউ করে, রাতে গম্ভীর স্বরে ঘেউ-ঘেউ করে ডাকে, আবার প্রভুর সঙ্গে বেড়াতে বেরোনোর সময় তাদের গলার স্বরে প্রকাশ পায় উল্লাস। কিন্তু কোনো দরজা বা জানালা খোলানোর মতো কোনো দাবি বা আর্জি জানানোর সময় তারা একেবারেই অন্য গলায় ডাকে। এছাড়া পশুপাখিদের ভাষা সংক্রান্ত এই বিষয়টির প্রতি গভীরভাবে অভিনিবিষ্ট হাউজো-র মতে, গৃহপালিত মোরগরা কম করে বারোটি বিশেষ স্বরে ডাকতে পারে।
তবে, ভাবকে স্পষ্টরূপে উচ্চারণ করার নিয়মিত অভ্যাস একমাত্র মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। কিন্তু নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মতো মানুষও অঙ্গভঙ্গি ও মুখের পেশি সঞ্চালন সহযোগে শব্দের সাহায্যে নিজের মনোভাব প্রকাশ করে থাকে। সরলতম ও সুস্পষ্ট অনুভূতিগুলোর ক্ষেত্রেই এই ঘটনা বেশি করে দেখা যায়, যেগুলোর সঙ্গে আমাদের উন্নততর বুদ্ধিমত্তার সম্পর্ক খুবই কম। ব্যথা, ভয়, ক্রোধ, বিস্ময় ইত্যাদির জন্য আমরা যে শব্দ এবং তার উপযোগী অঙ্গভঙ্গি করে থাকি, আদরের শিশুটির উদ্দেশ্যে জননী যে অস্পষ্ট বিড়বিড় ধ্বনির উচ্চারণ করেন, তা যে-কোনো কথার চেয়ে অনেক বেশি অর্থবহ। কিন্তু নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের থেকে মানুষের স্বতন্ত্র হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করে উচ্চারিত কথার বোধগম্যতার ওপর নির্ভরশীল নয়, কেননা কুকুররাও অনেক কথা ও শব্দ বুঝতে পারে। এ-ব্যাপারে তারা ঠিক দশ-বারো মাস বয়সী কোনো মানবশিশুর মতোই। দশ-বারো মাসের শিশুরা অনেক শব্দ ও ছোট ছোট কথা বুঝতে পারে, কিন্তু একটি কথাও বলতে পারে না। আবার শুধুমাত্র স্পষ্ট করে কথা বলার ক্ষমতাটাই আমাদের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য নয়, কারণ তোতা বা আরও কিছু পাখি এ-বিষয়ে আমাদের চমৎকার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে। এমনকী নির্দিষ্ট কোনো ধারণার সঙ্গে নির্দিষ্ট কোনো শব্দকে সংযুক্ত করার ক্ষমতার মধ্যেও আমাদের স্বাতন্ত্র্য নিহিত নেই, কারণ কথা বলতে শেখা কোনো কোনো তোতাপাখিও বস্তুর সঙ্গে শব্দকে এবং ব্যক্তির সঙ্গে ঘটনাকে নির্ভুলভাবে মেলাতে পারে।[৮] তাহলে কি নিম্নশ্রেণির প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে কোনো প্রভেদই নেই? নিশ্চয়ই আছে। প্রভেদটা হলো—মানুষ বহু ধরনের শব্দ ও ধারণাকে একসঙ্গে মেলাবার অসীম ক্ষমতা অর্জন করেছে, যা স্পষ্টতই তার উচ্চপর্যায়ের মানসিক বিকাশের ফলেই সম্ভবপর হয়েছে।
ভাষাতত্ত্বের অন্যতম প্রধান পথপ্রদর্শক হর্ন টুক্-এর মতে, চা বা কেক তৈরির মতো কথা বলাও একটি শিল্পকর্ম। অবশ্য আরাও প্রকৃষ্ট শিল্পকর্ম লিখনশৈলী। কথা বলার ভাষা কিন্তু মোটেই কোনো সহজাত ক্ষমতা নয়, কেননা প্রত্যেকটি ভাষাই শিখতে হয়। তবে অন্যান্য সাধারণ বিদ্যের সঙ্গে এর বিপুল পার্থক্য আছে, কারণ মানুষের মধ্যে কথা বলার এক সহজাত প্রবণতা কাজ করে। যেমন, আমাদের শিশুদের মুখে শোনা যায় অস্ফুট গুঞ্জন, যদিও তাদের কারোর মধ্যেই চা বা কেক তৈরি করা অথবা লেখার সহজাত প্রবণতা থাকে না। অধিকন্তু, কোনো ভাষাতত্ত্ববিদই এখন আর মনে করেন না যে কোনো ভাষা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃষ্ট হয়েছে; ধীরে ধীরে ও অসচেতনভাবে অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করেই বিকশিত হয়েছে ভাষা।[৯] পাখিদের নানারকম কিচিরমিচিরের সঙ্গে আমাদের বলা ভাষার সাদৃশ্য খুবই বেশি কেননা একই প্রজাতির সকল পাখি তাদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য একইরকম আওয়াজ করতে অভ্যস্ত হয়। আবার সমস্ত জাতের গায়ক-পাখিদের মধ্যে গান গাওয়ার ক্ষমতাটা সহজাত হলেও, সত্যিকারের গান গাওয়া বা শিস্ দিয়ে ডাকার ব্যাপারটা তারা তাদের মা-বাবা ও প্রতিপালকের কাছ থেকেই শিখে থাকে। ডেইন্স্ ব্যারিংটন প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে এই শব্দগুলো ঠিক ‘মানুষের ভাষার মতোই, অর্থাৎ পুরোপুরি সহজাত নয়।’ গান গাওয়ার প্রাথমিক চেষ্টাকে ‘একটি শিশু কর্তৃক অস্ফুট শব্দ করার চেষ্টার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।’ বাচ্চা পুরুষ-পাখিরা দশ-এগারো মাস ধরে নিয়মিত গানের অনুশীলন করে চলে, বা পাখি-ধরা ব্যাধেদের ভাষায়, “শব্দচয়ন’ করে। তাদের প্রাথমিক ষ্টো থাকে পরবর্তী সময়ের গান সম্বন্ধে কোনো ধারণা পাওয়া মুশকিল, কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আসল লক্ষ্যটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অবশেষে ‘ঘুরে-ফিরে গান শোনায়’ উড়তে না-পারা পাখিরা অন্য প্রজাতির পাখিদের গান শেখে, যেমন টাইরোলের ক্যানারি পাখিরা এবং এসব নতুন নতুন গান বাচ্চাদের শেখায়। ব্যারিংটনের মতে, একই প্রজাতির পাখিরা বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করার ফলে তাদের গান বা শিসের মধ্যে যে সামান্য স্বরগত পার্থক্য দেখা যায়, তাকে সহজেই ‘আঞ্চলিক উপভাষার’ সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের গলার স্বর বিভিন্ন জাতির মানুষদের বলা ভাষার সঙ্গে তুলনীয়। এখানে এত কিছু বিশদভাবে আলোচনা করার উদ্দেশ্য হলো এটা দেখানো যে, কোনো বিশেষ কৌশল আয়ত্ত করার সহজাত প্রবণতা মানুষের একচেটিয়া নয়।
স্পষ্ট করে কথা বলতে পারা কোনো-একটি ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে একদিকে মি. হেন্স ওয়েড, রেভারেন্ড এফ. ফ্যারার ও অধ্যাপক শিশারের অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক প্রবন্ধগুলো, এবং অন্যদিকে অধ্যাপক ম্যাক্স মুলারের বিখ্যাত বক্তৃতাগুলো পড়ার পর আমি নিঃসন্দেহে যে ভাষার উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্ন শব্দ ও অন্যান্য প্রাণীদের গলার স্বরকে নকল করে এবং সংকেত ও অঙ্গভঙ্গিসহ মানুষের সহজাত চিৎকার থেকে। হয়তো মানুষের কোনো পূর্বপুরুষ বা আদিম অবস্থার মানুষের গলা দিয়ে প্রথম সুরযুক্ত ধ্বনি অর্থাৎ গান বেরিয়ে এসেছিল, যেমন এখন আমরা দেখতে পাই গিবন জাতের বানরদের মধ্যে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই ধরনের অসংখ্য উদাহরণ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, কথা বলার ক্ষমতা বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়েছিল স্ত্রী ও পুরুষের পূর্বরাগের সময়, যেখানে কথার সাহায্যে তাদের মনের নানান আবেগ, ভালোবাসা, ঈর্ষা, প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বীদের চ্যালেঞ্জ জানানো ইত্যাদি প্রকাশ পেত। আর সেইজন্য বোধহয় স্পষ্ট করে শব্দ উচ্চারণ করার সাহায্যে গীতিময় ধ্বনির অনুকরণই মনের বিভিন্ন জটিল আবগকে প্রকাশ করার মত শব্দ সৃষ্টি করেছিল। আবার আমাদের সঙ্গে নিকট সাদৃশ্যযুক্ত বানর, জড়বুদ্ধিসম্পন্ন নির্বোধ ও অ-সভ্য বুনো জাতের লোকদের একটি জোরালো প্রবণতা হলো নকল করা। তারা যা দেখে বা শোনে, তা-ই নকল করে। অনুকরণ সম্বন্ধে ভাবতে গেলে এদিকটাই নজর দেয়া দরকার। বানররা তো আমরা যা বলি তার অনেক কথাই বুঝতে পারে এবং বনের মধ্যে কোনো বিপদ দেখা দিলে তারা তাদের প্রতিবেশীদের চিৎকার করে সংকেত দেয় সাবধান হয়ে যাওয়ার জন্য। মোরগরাও আকাশে বা মাটিতে বাজপাখি দেখলেই গলায় এক ধরনের আওয়াজ তুলে বিপদসংকেত জানাতে ভুল করে না (বানর ও মোরগের এই চিৎকার এবং তাদের অন্যান্য চিৎকারের অর্থ কুকুররাও বুঝতে পারে)।[১০] তাহলে এমনটা কি হতে পারে না যে বানরদের মতো কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী ভীতিউদ্রেককারী শিকারি জন্তুদের গোঁ-গোঁ আওয়াজ নকল করে তাদের প্রতিবেশী বানরদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করার চেষ্টা করত? এই অনুকরণই হয়তো ভাষা সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ।
গলার স্বর যত বেশি ব্যবহার হতে লাগল, ব্যবহারের বংশগত প্রভাবের দরুন স্বরযন্ত্রও ততই বেশি শক্তিশালী ও ত্রুটিমুক্ত হয়ে উঠল। এই বিষয়টি কথা বলার ক্ষমতার উপরেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ভাষার ক্রমাগত ব্যবহার ও মস্তিষ্কের বিকাশের মধ্যেকার সম্পর্কটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের কিছু পূর্বপুরুষের মানসিক ক্ষমতা সেই সময়ের যে-কোনো বানরের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত ছিল। এমনকী সেই পূর্বপুরুষরা যখন সামান্যতম কথাও বলতে শেখেনি, তখনও এই ব্যবধান কার্যকরী ছিল। কিন্তু আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে পারি যে, এই ক্ষমতার ক্রমাগত ব্যবহার ও প্রাগ্রসরতা মানুষের মনের ওপর দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, সুশৃঙ্খল চিন্তা করতে সক্ষম করে তুলেছে তার মনকে। শব্দের সাহায্য ছাড়া চিন্তার জটিল স্রোত কখনোই এগোতে পারে না, তা সেই শব্দ উচ্চারিত বা অনুচ্চারিত যা-ই হোক না কেন—ঠিক যেমন সংখ্যা বা বীজগণিতের সাহায্য ছাড়া কোনো দীর্ঘ হিসাব মেলানো সম্ভব নয়। এমনকী সাধারণ চিন্তা-প্রক্রিয়ার জন্যেও কিছু-না- কিছু শব্দের প্রয়োজন হয়। উদাহরণ হিসেবে লরা ব্রিজম্যান নামে এক দৃষ্টিহীন, মূক ও বধির মেয়ের কথা বলা যায়। ঘুমের মধ্যে সে যখন কোনো স্বপ্ন দেখত, তখন তার আঙ্গুলগুলো স্বপ্নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নড়াচড়া করত। অবশ্য কোনোরকম শব্দ বা ভাষা ছাড়াই স্পষ্টও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ধারণার দীর্ঘ পরম্পরা মনের মধ্যে বয়ে যেতে পারে, যেমনটা দেখা যায় ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখা কুকুরদের শারীরিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে। ইতিমধ্যে আমরা এটাও জেনেছি যে জন্তু-জানোয়াররা কোনো ভাষার সাহায্য ছাড়াই কিছুটা চিন্তাভাবনা করতে সক্ষম। আবার আমাদের এই উন্নত মস্তিষ্কের সঙ্গে কথা বলার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কটিকে চমৎকারভাবে দেখানো যেতে পারে মস্তিষ্কঘটিত সেইসব রোগের উদাহরণ টেনে, যেগুলোর ফলে কথা বলার ক্ষমতা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন, অন্যান্য কথা মনে পড়লেও আসল কথাটির ক্ষেত্রে স্মৃতিবিভ্রম, বা নির্দিষ্ট কিছু কথা ভুলে যাওয়া, অথবা শব্দের প্রথম অক্ষর বাদে বাকিটুকুর বিস্মরণ এবং কোনোও ব্যক্তি বা বস্তুর নামের বিস্মৃতি। [১১]
মস্তিষ্ক ও স্বরযন্ত্রের ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে এগুলোর আকৃতি ও কাজে বংশগত পরিবর্তন ঘটেছে, ঠিক যেমনটা ঘটে থাকে হাতের লেখার ক্ষেত্রে। হাতের লেখা নির্ভর করে অংশত হাতের গঠনের ওপর এবং অংশত মানসিক বিন্যাসের ওপর। বলা যেতে পারে হাতের লেখা নিশ্চিতভাবেই একটি বংশগত গুণ।
কিছু কিছু লেখক, বিশেষত অধ্যাপক ম্যাক্স মুলার, সম্প্রতি জোরের সঙ্গে বলেছেন, ভাষা-ব্যবহার বা কথা বলতে পারার ফলস্বরূপই নানা সাধারণ ধারণা গড়ে ওঠে, এবং যেহেতু জন্তু-জানোয়াররা এই ক্ষমতার অধিকারী নয়, সেহেতু মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারদের মধ্যে একটি অনতিক্রম্য দূরত্ব থেকেই যায়। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি, পশু-পাখিদের মধ্যে, অগোছালো বা প্রাথমিকভাবে হলেও, ক্ষমতাটি থাকে। আমি বুঝতে পারি না কীভাবে দশ-এগারো মাসের বাচ্চারা এবং মূক-বধিররা ‘নির্দিষ্ট কিছু শব্দের সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু সাধারণ ধারণাকে মেলাতে পারে। কিন্তু ওই ধারণাগুলো তাদের মাথার মধ্যে আগে থাকতেই গড়ে না উঠে থাকলে এ ব্যাপারটা অসম্ভব হয়ে উঠত। আরও বুদ্ধিমান প্রাণীদের সম্বন্ধে এ-কথা প্রযোজ্য। মি. লেলি স্টিফেন বলেছেন, ‘কুকুরদের মধ্যে বিড়াল বা ভেড়া সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা গড়ে ওঠে এবং একজন দার্শনিকের মতোই তারা এ-ব্যাপারের প্রয়োজনীয় শব্দগুলো বুঝতে পারে। আর এই বুঝতে পারার ক্ষমতাটা কথা বলার ক্ষমতার মতোই তাদের স্বরযন্ত্রের উন্নত অবস্থার সাক্ষ্য দেয়—যদিও এই প্রমাণটা অনেক অস্পষ্ট বা নিকৃষ্ট মানের।’
এটা বুঝতে খুব-একটা অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে কেন অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় আমাদের স্বরযন্ত্র প্রথম থেকেই এত নিখুঁত। পিঁপড়েদের ভাষা সম্বন্ধে গোটা একটি পরিচ্ছেদ জুড়ে আলোচনা করেছেন হুবার এবং সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, পিঁপড়েরা শুঁড়ের সাহায্যে খবর আদান-প্রদান করতে খুবই পারদর্শী। চেষ্টা করলে হয়তো আমাদের আঙ্গুলকে ভাবপ্রকাশের জোরালো মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেত। কারণ দেখা গেছে, কোনো জনসমাবেশের দ্রুত বক্তৃতার প্রতিটি কথাই একজন বধির ব্যক্তিকে আঙ্গুল নেড়ে নেড়ে বোঝানো যেতে পারে, যদি একটু অভ্যাস করা যায়। কিন্তু হাতকে এভাবে ব্যবহার করতে হলে অন্য কাজের ক্ষেত্রে আমিদের দারুণ অসুবিধায় পড়তে হতো। আবার যেহেতু উচ্চশ্রেণির সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আমাদের মতো একইরকমভাবে গঠিত স্বরযন্ত্র আছে এবং যেহেতু তা মনের ভাব আদান-প্রদানের কাজেই ব্যবহৃত হয়, সেহেতু ধরেই নেওয়া যায় যে যদি তাদের ভাব আদান-প্রদান সম্পর্কটি আরও উন্নত হতো তাহলে স্বরযন্ত্রের ক্ষেত্রেও আরও উন্নতি চোখে পড়ত এবং তা নিশ্চয়ই স্বরযন্ত্রের সংলগ্ন জিভ ও ঠোঁটের সাহায্যেই ঘটত।[১৩] উচ্চশ্রেণির বানররা যে কথা বলার কাজে তাদের স্বরযন্ত্রকে ব্যবহার করতে পারে না, তার মূল কারণ তাদের বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট অগ্রসর হতে পারেনি। হয়তো ক্রমাগত দীর্ঘ অনুশীলনের সাহায্যে তারা এই যন্ত্রটিতে কথা বলার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারত, যদিও বাস্তবে তা হয়নি, যেমন হয়নি কিছু পাখির ক্ষেত্রে, গান করার অনুকূল স্বরযন্ত্র থাকা সত্ত্বেও তারা কখনো গান করতে পারে না। নাইটিঙ্গেল (ইউরোপে বুলবুল পাখির মতো রাত্রে গান করা এক ধরনের পাখি) ও কাক, উভয়ের স্বরযন্ত্র একইভাবে গঠিত। কিন্তু নাইটিঙ্গেলের গলা দিয়ে সুরযুক্ত স্বরের বহিঃপ্রকাশ ঘটে আর কাকের গলায় ধ্বনিত হয় শুধুই কর্কশ কা-কা রব।[১৪] যদি জিজ্ঞেস করা হয় কেন বানররা বুদ্ধিতে মানুষের মতো উন্নত হতে পারল না। তাহলে তার উত্তরে সাধারণ কিছু যুক্তিই শুধু খাড়া করা যায়। অবশ্য এর থেকে নির্দিষ্টতর কোনো উত্তর চাওয়াটাই অযৌক্তিক। কেননা প্রত্যেকটি প্রাণী কীভাবে বিকাশের ধারাবাহিক স্তরগুলো অতিক্রম করেছে, সে ব্যাপারে আমাদের অজ্ঞতা অনস্বীকার্য।
বিভিন্ন ভাষা ও প্রজাতির উদ্ভব এবং সেইসঙ্গে উভয়েরই (ভাষা ও প্রজাতির) ক্রমান্বয় উন্নতির তথ্যাদির মধ্যে আশ্চর্যরকম সাদৃশ্য দেখা যায়।[১৫] কিন্তু খুঁজলে এ-রকম অনেক কথা বা শব্দই পাওয়া যেতে পারে, যেগুলো প্রজাতির উদ্ভবের অনেক আগে সৃষ্টি হয়েছে, কারণ, আমরা বুঝতে পারি ঠিক কীভাবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শব্দের অনুকরণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে এগুলো। আবার ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মধ্যে অদ্ভুত সাদৃশ্য থাকার কারণ হলো একই জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়া এবং এসব ভাষার গঠনগত সাদৃশ্যের পিছনেও একই কারণ কাজ করেছে। অন্যান্য জিনিসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার মধ্যেও কিছু হরফ বা ধ্বনির পরিবর্তন হয়, ব্যাপারটা ঠিক পরস্পর সম্পর্কযুক্ত কিছু বিষয়ের পরিবর্তনের মতই। ভাষা ও প্রজাতি, উভয় ক্ষেত্রেই আমরা পুনরাবৃত্ত অংশ, একনাগাড়ে দীর্ঘ অভ্যাসের ফল প্রভৃতি বিষয়ের আধিক্য দেখতে পাই। আবার উভয়ের মধ্যেই বহু লুপ্তপ্রায় অংশের উপস্থিতিও বেশি চোখে পড়ে।—am’শব্দের মধ্যে ‘m’ অক্ষরটির অর্থ হলো ‘I’ বা আমি। তাই ‘I am’ বা আমি হই বলার সময় একটা অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় শব্দ উচ্চারণ করে থাকি। শব্দের বানানেও অনেকসময় দেখা যায় কোনো কোনো অক্ষর প্রাচীন উচ্চারণের লুপ্তাংশ হিসেবে কাজ করছে। তাছাড়া সজীব প্রাণীদের মতোই ভাষাকেও নানা শ্রেণি, উপশ্রেণিতে ভাগ করা যায়। ভাষাকে সাধারণভাবে ক্রমবিবর্তনের মতানুযায়ী অথবা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সাহায্যে ভাগ করা যায়। আবার এ-ও তো সত্যি যে প্রধান প্রধান ভাষা ও উপ-ভাষাগুলো বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, ফলে অন্যান্য ভাষার ক্রমাগত বিলোপ ঘটে। স্যার সি. লাইয়েল বলেছেন, কোনো প্রজাতি যেমন একবার বিলুপ্ত হয়ে গেলে আর পুনরাবির্ভূত হতে পারে না, ঠিক তেমনি কোনো ভাষাও একবার বিলুপ্ত হয়ে গেলে আর তার পুনরাবির্ভাব ঘটে না। আবার একটি ভাষা কখনো দুটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মধ্যে পরস্পর সংযুক্তি বা মিশ্রণ ঘটতেই পারে।[১৬] প্রত্যেকটি ভাষার মধ্যেই বৈচিত্র্য রয়েছে এবং অবিরাম নতুন নতুন শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের স্মরণশক্তির ক্ষমতা সীমিত বলে এক-একটি শব্দ এক-একটি ভাষার মতোই ধীরে ধীরে লোপ পায়। এ ব্যাপারে ম্যাক্স মুলার খুব সুন্দর মন্তব্য করেছেন : ‘প্রত্যেকটি ভাষার শব্দ ও ব্যাকরণগত রূপের অভ্যন্তরে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এক নিরন্তর সংগ্রাম চলে। ফলে সবচেয়ে সেরা, সংক্ষিপ্ত ও সহজ রূপগুলোই ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ওঠে, এবং তারা এই সাফল্য লাভ করে তাদের অন্তনির্হিত গুণের দ্বারাই’। অবশ্য কিছু শব্দের টিকে থাকার জন্য এসব গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছাড়া, নতুনত্ব ও হাল-চলতি কেতার কথাও বলা যেতে পারে। কারণ মানুষের একটি বিশেষ প্রবণতাই হচ্ছে সব জিনিসকে কিছু -না-কিছু পরিবর্তন করে নেওয়া। সুতরাং অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামে ভালোলাগা, কিছু শব্দের টিকে থাকা বা সংরক্ষণকে প্রাকৃতিক নির্বাচন ছাড়া আর কি-ই বলা যায়!
অ-সভ্য জাতিগুলোর মধ্যে অত্যন্ত নিয়মিত ও বিস্ময়কর রকমের জটিল ভাষাকৃতি প্রায়শই দেখা যায়। এই ব্যাপারটাকে প্রমাণ হিসেবে খাড়া করে অনেকেই বলে থাকেন যে এই ভাষাগুলো হয় দৈব সূত্রে প্রাপ্ত, নতুবা তাদের পূর্বপুরুষদের উন্নত কলাকৌশল ও সভ্যতার ফসল। এফ. ফন শেগেল লিখেছেন : ‘বুদ্ধিগত উৎকর্ষতার একেবারে নিম্ন স্তরে থাকা ভাষাগুলোতে আমরা হামেশাই দেখে থাকি যে, সেগুলোর ব্যাকরণগত কাঠামোর কলাকৌশল অত্যন্ত উন্নত ও বিস্তারিত। বিশেষ করে বাস্কে, ল্যাপ্পোনিয়ান ও অনেক আমেরিকান ভাষা এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।’ কিন্তু কেবলমাত্র বিস্তার ও সু- বিন্যাসের ভিত্তিতে কোনো ভাষা সম্বন্ধে ধারণা করা ভুল। ভাষাতত্ত্ববিদরা এখন স্বীকার করেন যে একত্রে মিশে যাওয়ার আগে ধাতুরূপ, শব্দরূপ ইত্যাদি পৃথক পৃথক শব্দ হিসেবেই চালু ছিল। এবং যেহেতু এ-রকম শব্দগুলো ব্যক্তি ও বস্তুর মধ্যে অত্যন্ত সুস্পষ্ট সম্পর্ক প্রকাশ করে থাকে, তাই একেবারে প্রথম যুগে অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই যে এগুলোকে ব্যবহার করত, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। নিখুঁত সামঞ্জস্য প্রসঙ্গে এখানে একটি উদাহরণ দিচ্ছি, যা থেকে ভালোভাবে বোঝা যাবে কত সহজে ভুলের শিকার হয়ে থাকি আমরা। কোনো কোনো ক্রিনয়েডের (crinoid-sea-lily) দেহে প্রায় ১৫০০০০ খোলা দেখা যায়, যে-খোলাগুলো একেবারে নিখুঁত সামঞ্জস্যে সাজানো থাকে। কিন্তু কোনো প্রাণীতত্ত্ববিদই মনে করেন না যে এই ধরনের প্রাণী, তুলনামূলকভাবে কিছু কম শারীরিক অংশবিশিষ্ট (এবং সেই অংশগুলোও শরীরের দু’টি পাশ ব্যতীত আর কোথাও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়) দ্বিপার্শ্বিক প্রাণীদের চেয়ে বেশি নিখুঁত। বিভিন্ন শারীরিক অংশের পার্থক্য ও বিশেষত্বকে তিনি সঠিকভাবেই নিখুঁত সামঞ্জস্যের একটা পরীক্ষা হিসেবেই বিচার করেন। ভাষার বেলাতেও দেখা যায়, সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও জটিল ভাষাটিও কোনো অসম, সংক্ষিপ্ত ও বহু-উপাদান- মিশ্রিত ভাষাকে টপকে যেতে পারে না। এমনকী সেই ভাষাগুলোকেও নয়, যারা বিভিন্ন বিজিত, বিজয়ী বা দেশান্তরী জাতিগুলোর থেকে বহু ব্যঞ্জনাময় শব্দ বা বাক্য-গঠনের রীতি ধার করে নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগিয়েছে।
এসব সামান্য ও অসম্পূর্ণ মন্তব্য থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, অ- সভ্য জাতিসমূহের ভাষাগুলোর অত্যন্ত জটিল ও সুষম গঠনপ্রণালি এমন কোনো প্রমাণ দাখিল করে না যে কোনো বিশেষ সৃজন-প্রক্রিয়ার ফলেই এগুলোর উদ্ভব ঘটেছে। আবার, আমরা আগেই দেখেছি, স্পষ্ট করে কথা বলার বিষয়টিও নিজে থেকে এমন কোনো প্রমাণ হাজির করে না যা দিয়ে নিম্নশ্রেণির কোনো জৈবিক আকার থেকে মানুষের উদ্ভবের তত্ত্বকে অস্বীকার করা যেতে পারে।
সৌন্দর্যবোধ
বলা হয়ে থাকে যে সৌন্দর্যবোধ ব্যাপারটা মানুষের একান্তই নিজস্ব। মূল প্রসঙ্গে আসার আগে বলে নেওয়া ভালো, আমি এখানে সৌন্দর্যবোধ বলতে শুধু কিছু রং, রূপ বা শব্দ থেকে প্রাপ্ত আনন্দের কথাই বলতে চাইছি, তবে সুসভ্য লোকদের মনে এই অনুভূতিগুলো নানা জটিল ধারণা ও ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে। কোনো কোনো পুরুষ-পাখি তাদের উজ্জ্বল পেখম মেলে বা রঙের চমক লাগিয়ে তাদের সঙ্গিনীদের মনোরঞ্জন করে। আবার অন্য অনেক পাখি এই গুণে বঞ্চিত, ফলে তারা ওইসব কাজ করতে পারে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে মেয়ে-পাখিটি তার পুরুসঙ্গীর সৌন্দর্যকে প্রশংসার চোখে দেখে না। তবে সব জায়গায় মেয়েরাই এসব পালক দিয়ে নিজেদের সাজাতে ভালোবাসে, কাজেই এগুলোর সৌন্দর্যকে অস্বীকার করা যায় না। হামিং পাখির বাসা আর নিকুঞ্জ পাখির খেলার জায়গা রংবাহারি নানা জিনিস দিয়ে রুচিসম্মতভাবে সাজানো থাকে এবং এ থেকে বোঝা যায় যে তারা এই ধরনের জিনিস দেখে কিছু-না কিছু আনন্দ লাভ করে। বেশিরভাগ জীবজন্তুর ক্ষেত্রে সৌন্দর্যবোধ ব্যাপারটা বিপরীত লিঙ্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করার স্তরেই রয়ে গেছে। জোড়-বাঁধার ঋতুতে পুরুষ-পাখির মিষ্টি গান তাদের সঙ্গিনীদের প্রশংসা কুড়িয়ে নেয়। মেয়ে-পাখিরা যদি তাদের পুরুষ-সঙ্গীদের সুন্দর রং, শরীরের নানা চমৎকার আভরণ, গলার স্বরের মূল্য বুঝতে না পারত, তাহলে মেয়েদের মনোরঞ্জনের জন্যে পুরুষ-পাখিদের এত কষ্ট একেবারেই জলে যেত। কিন্তু মেয়ে-পাখিরা এ-সব বোঝে না, এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কেন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু উজ্জ্বল রঙেই তাদের দারুণ আনন্দ প্ৰকাশ পায় তা বলা সম্ভব নয়, যেমন বলা সম্ভব নয় কেন বিশেষ কিছু স্বাদ ও গন্ধ আমাদের আকৃষ্ট করে। তবু মনে হয় এর অন্যতম কারণ হচ্ছে অভ্যাস। কেননা প্রথমে যা আমাদের ঠিক ভালো লাগে না, পরে তা-ই বেশ ভালো লাগতে শুরু করে, এবং সেই অভ্যাসটা বংশগতভাবে সঞ্চারিত হয়। হেলম হোজ্ শব্দ বা আওয়াজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে (শারীরবৃত্তীয় নীতির ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি) সুরলালিত্য ও নির্দিষ্ট কিছু স্বরের ওঠা-নামা কেন আমাদের ভালো লাগে, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু কোনো শব্দ বেখাপ্পাভাবে থেকে-থেকে ঝঙ্কৃত হলে আমাদের মোটেই ভালো লাগে না—রাতে জাহাজের পাটাতনে যাঁরা দড়ি ঝাপটানোর অনিয়মিত আওয়াজ শুনেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এ-কথাটা স্বীকার করবেন। দেখার ব্যাপারেও এই একই নীতি প্রযোজ্য, কেননা চোখ সর্বদাই সামঞ্জস্যপূর্ণ বা নিয়মিত-ঘটা বস্তু-আকৃতি দেখতে ভালোবাসে। এমনকী অত্যন্ত নিকৃষ্ট বুনো লোকেরাও ব্যবহার করার সময় চোখের পক্ষে তৃপ্তিদায়ক গড়নই পছন্দ করে এবং কিছু পুরুষ-জন্তুর ক্ষেত্রেও এগুলো যৌন নির্বাচনের সাহায্যে অলঙ্কারের পদে উন্নতি হয়েছে। কোনো-কিছু দেখে বা শুনে কেন আমরা আনন্দ লাভ করি, তার কোনো কারণ দেখাতে পারি বা না-পারি, এটা কিন্তু ঠিক যে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরা একইরকম রং, মনোরম বর্ণবৈচিত্র্য, রূপ আর শব্দ দেখে বা শুনে যথেষ্ট আনন্দ পায়।
সৌন্দর্যপ্রীতি, অন্ততপক্ষে মেয়েদের সৌন্দর্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রীতি—এটা মানুষের কোনো সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নয়, কারণ ভিন্ন ভিন্ন জাতের মানুষের মধ্যে এ-ব্যাপারে রুচিগত পার্থক্য রয়েছে। এমনকী একই গোষ্ঠীর বিভিন্ন জাতির মানুষদের মধ্যেও এর বোধ সম্পূর্ণ একরকম নয়। বুনো লোকদের নানারকম বিকটদর্শন অলঙ্কার ব্যবহার ও অদ্ভুত গানের সুর পছন্দ করা থেকে বলা যেতে পারে, তাদের নান্দনিক বোধ পাখি ইত্যাদি কিছু প্রাণীর মতো ততটা উন্নত হয়নি। স্পষ্টতই কোনো জীবজন্তু রাতের তারা-ভরা আকাশে, সুন্দর নিসর্গ- দৃশ্যে কিংবা রুচিসম্পন্ন সংগীতের সুরে আগ্রহ প্রকাশ করে না। কারণ এই ধরনের উন্নত রুচির জন্যে প্রয়োজন কৃষ্টি ও জটিল চিন্তা ভাবনার সংযুক্তি, অ- সভ্য বা অশিক্ষিত লোকেদের পক্ষেও তাই এগুলোর স্বাদ নেওয়া সম্ভব নয়।
বেশ কিছু জিনিস মানুষের অগ্রগতিকে অত্যন্ত সাহায্য করেছে, যেমন কল্পনাশক্তি, বিস্ময়বোধ, কৌতুহল, সৌন্দর্যবোধ, অনুকরণ-প্রবণতা, উত্তেজনা বা নতুনত্বের প্রতি আগ্রহ ইত্যাদি। সেই সঙ্গেই দেশাচার ও প্রচলিত রীতিকে খেয়ালখুশি মতো পরিবর্তিত করতেও এগুলো সক্ষম। আমি এই বিষয়টিতে (খেয়ালখুশি মাফিক পরিবর্তন) জোর দিলাম, কারণ হালের একজন প্রবন্ধকার অদ্ভুতভাবে বলেছেন যে খামখেয়াল হচ্ছে ‘জন্তু জানোয়ার ও বুনো লোকেদের মধ্যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ও সুনির্দিষ্ট একটি পার্থক্য।’ কিন্তু কেন নানারকম পরস্পরবিরোধী প্রভাবের ফলে মানুষ খামখেয়ালি হয়ে ওঠে তার কারণ যেমন আমরা আংশিকভাবে বুঝতে পারি, তেমনি নিম্নশ্রেণির জীবজন্তুরাও তাদের ভালোবাসা, পছন্দ-অপছন্দ ও সৌন্দর্যবোধের ক্ষেত্রে খামখেয়ালিপনার পরিচয় দেয় কেন, তা-ও বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাছাড়াও তারা বোধ হয় নতুনত্ব ভালোবাসে—ভালোবাসে ব্যাপারটা নতুন বলেই।
ঈশ্বরবিশ্বাস ও ধর্মবিশ্বাস
এমন কোনো প্রমাণ জানা নেই যা থেকে বলা যায় মানুষ একেবারে আদিম অবস্থা থেকেই কোনো সর্বমঙ্গলময় ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বাস পোষণ করত। বরং, শুধুমাত্র দ্রুত গমনকারী পর্যটকদের কাছ থেকে জানা নয়, বুনো বা অ-সভ্য লোকদের সঙ্গে দীর্ঘদিন বসবাসকারী ব্যক্তিদের সাক্ষ্য থেকেও জানা গেছে যে এমন অসংখ্য জাতি ছিল বা এখনও আছে, যাদের এক বা একাধিক ঈশ্বর সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই এবং তাদের ভাষাতেও ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণাকে প্রকাশ করার মতো কোনো শব্দ নেই। অবশ্য পৃথিবীর একজন ‘সৃষ্টিকর্তা’ ও শাসনকর্তা’ আছেন কি না, সেটা সম্পূর্ণ আলাদা প্রশ্ন। চিরস্মরণীয় অনেক গুণীজনই এই ‘সৃষ্টিকর্তা ও শাসনকর্তা’ থাকার সপক্ষে তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
আবার আমরা যদি ‘ধর্ম’ অভিধাটির মধ্যে অদৃশ্য বা অপার্থিব শক্তিতে বিশ্বাসকে যোগ করি, তাহলে বিষয়টি সম্পূর্ণ অন্যরকম হতে বাধ্য। কারণ প্রায় সব জায়গায় অনুন্নত জাতির লোকজনদের মধ্যেই এই বিশ্বাসটি বহুল প্রচলিত। কী করে তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্ম নেয়, তা বুঝতেও খুব-একটা বেগ পেতে হয় না। কল্পনাশক্তি, বিস্ময়বোধ, কৌতূহল এবং চিন্তাভাবনার ক্ষমতা কিছুটা উন্নত হওয়ার পর মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তার চারপাশের ঘটনাকে বুঝতে চাইল এবং নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে অস্পষ্টভাবে চিন্তা করতেও শুরু করল। মি. ম্যালেনাম বলেছেন, ‘জীবনের ঘটনাবলি সংক্রান্ত একটা ব্যাখ্যা খাড়া করতেই হয়েছে মানুষকে। জীবন সর্বব্যাপী—এটাই ছিল সরলতম ভাবনা। এই ভাবনা অনুযায়ী এগোতে গিয়ে মানুষ প্রথমে সম্ভবত এটাই ভেবেছিল যে জীবজন্তু, গাছপালা, বিভিন্ন বস্তু, বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি (ঝড়, বৃষ্টি, খরা, বন্যা ইত্যাদি), এবং মানুষের নিজের মধ্যেকার যে-সব শক্তি তাকে কার্যে প্রণোদিত করে—সেগুলোর মধ্যে একটা বিশেষ কিছু ক্ষমতা আছে।’ মি. টাইলর বলেছেন, স্বপ্ন দেখা থেকেও মানুষের মধ্যে এসব ধারণার সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। ব্যাপারটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কারণ বন্য লোকেরা কোনটি কল্পিত এবং কোনটি বস্তুগত, এই দুই ধারণার মধ্যে তৎক্ষণাৎ তফাত করতে পারে না। স্বপ্ন দেখার সময় যখন বস্তু-আকৃতি তাদের সামনে প্রতীয়মান হয়, তখন তারা মনে করে ওগুলো কোনো দূরবর্তী স্থান থেকে এসে তাদের ওপর ভর করছে বা, ‘স্বপ্নদ্রষ্টার আত্মা বাইরে বেড়াতে যায়, তারপর আবার ফিরে আসে। তখন তার সঙ্গে থাকে এতক্ষণ সে যা দেখেছে, তার স্মৃতি।[১৭] কিন্তু যতক্ষণ না মানুষের মনের মধ্যে কল্পনাশক্তি, কৌতূহলস্পৃহা, যুক্তি সাজানোর ক্ষমতা প্রভৃতি বিষয়গুলো যথেষ্ট ভালোভাবে বিকশিত হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কেবল স্বপ্ন দেখা থেকে সে কোনো অলৌকিক শক্তি সম্বন্ধে কোনো ধারণা করতে পারে না যেমন পারে না কুকুররাও। প্রাকৃতিক বস্তু ও শক্তিগুলো অপার্থিব বা পার্থিব উপাদানের দ্বারা জীবন্ত হয়ে ওঠে—বুনো লোকেদের এই কল্পনা-প্রবণতাকে হয়তো আমার দেখা একটি ছোট ঘটনার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আমার কুকুরটি গায়ে-গতরে যেমন বড়, তেমনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন। একদিন সে বাগানের ঘাসের ওপর চুপচাপ শুয়ে ছিল। দিনটা বেশ গরম। হওয়ার দেখা নেই। হঠাৎই সামান্য দূরে একটু হাওয়া বইতে একটা খোলা ছাতা নড়ে উঠল। কেউ সেটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কুকুরটি হয়তো আদৌ সেদিকে নজর দিত না। কিন্তু যখনই সামান্য হাওয়ায় ছাতাটা নড়ছিল, তখনই কুকুরটি সাংঘাতিক রেগে গিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। আমার মনে হয় সে খুব দ্রুত আর অসচেতনভাবে ভেবে নিয়েছিল—যেহেতু ছাতাটা কেন নড়ছে বোঝা যাচ্ছে না, অতএব ওখানে নিশ্চয়ই তার অপরিচিত কিছু-একটা রয়েছে, এবং কোনো অপরিচিত ব্যক্তিরই তার সীমানায় প্রবেশ করার অধিকার নেই।
অপার্থিব শক্তির ওপর বিশ্বাস থেকে সহজেই এক বা একাধিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বাসের জন্ম হতে পারে। কারণ বুনো জাতের লোকেরা তাদের নিজেদের অনুভূত, আবেগ, প্রতিশোধস্পৃহা বা বিচারের সহজতম পদ্ধতি ও অনুরাগকে স্বাভাবিকভাবে আরোপ করত অপার্থিব শক্তির ওপর। এ- ব্যাপারে ফুজিয়ানরা একটি মাঝামাঝি অবস্থায় রয়েছে। ‘বির্’ জাহাজের চিকিৎসক মি. বাইনো একবার নমুনা হিসেবে পরীক্ষা করার জন্য কয়েকটি হংসশাবককে গুলি করে নামিয়েছিলেন। তা দেখে ইয়র্কমিনস্টর নামে একজন ফুজিয়ান, গম্ভীর স্বরে বলেছিল, ‘কী করলেন, মি. বাইনো? এক্ষুণি তুমুল বৃষ্টি শুরু হবে, সাংঘাতিক বরফ পড়বে, ঝড় উঠবে দূরন্ত।’ আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে—মানুষের খাবার যে নষ্ট করবে, তাকে শাস্তি পেতে হবে। তারপর একটা ঘটনার কথা বলেছিল সে : তার ভাই যখন একজন ‘বন্য প্রকৃতির লোককে খুন করেছিল তখন ভয়ঙ্কর ঝড় হয়েছিল, সেইসঙ্গে ছিল মুষলধারে বৃষ্টি আর অবিরাম তুষারপাত। কিন্তু এ-সব সত্ত্বেও আমরা ফুজিয়ান সমাজে এমন কোনো প্রমাণ খুঁজে পাই না, যা থেকে বলা যায় তারা আমাদের ঈশ্বরের মতো কোনো-কিছুতে বিশ্বাস করে। এমনকী তাদের মধ্যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের রীতিও চোখে পড়ে না। তাই জিমি বাটন নামে একজন ফুজিয়ান গর্বভরে বলতে পেরেছিল—তার দেশে কোনো শয়তানের (ভূত-প্ৰেত) অস্তিত্ব নেই। কথাটা উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। কেননা অ-সভ্য বুনো লোকদের মধ্যে মঙ্গলময় কিছুর তুলনায় অশুভ আত্মার প্রতি বিশ্বাস অনেক বেশি মাত্রায় চোখে পড়ে। ধর্মীয় অনুরাগ খুবই জটিল একটি অনুভূতি। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ভালোবাসা, মর্যাদাপূর্ণ এক মহান সত্ত্বার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য, নির্ভরশীলতা, ভয়, শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা, ভবিষ্যতের আশা এবং আরও নানা বিষয়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো প্রাণীর মধ্যে বুদ্ধিগত ও নৈতিক চেতনা মোটামুটি একটি উন্নত স্তরে উন্নীত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার পক্ষে এ-রকম জটিল একটি অনুভূতিতে পৌঁছনো সম্ভব নয়। তথাপি, কুকুরের মধ্যে যেন এই অনুভূতিরই খানিকটা লক্ষণ প্রকাশ পায়, যখন সে তার প্রভুর প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করে, যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পূর্ণ আনুগত্য, কিছুটা ভয় এবং অন্যান্য আরও অনেক অনুভূতি। কিছুদিন অনুপস্থিত থাকার পর কোনো কুকুর যখন আবার তার প্রভুর কাছে ফিরে আসে, তখন সে যেমন আচরণ করে বা ওই একই অবস্থায় একটি বানর যেমন আচরণ করে, তেমন আচরণ কিন্তু তারা নিজেদের স্বজাতির প্রতি করে না। স্বজাতির ক্ষেত্রে তাদের উচ্ছ্বাস কিছুটা কম থাকে এবং তাদের প্রতিটি কাজেই ফুটে ওঠে যে তারা নিজেদেরকে অন্যদের সমান বলেই মনে করছে। অধ্যাপক ব্রবাখ্ এমনকী এ-ও বলেছেন যে একটি কুকুরের কাছে তার প্রভু হচ্ছে দেবতার সমান।[১৮]
যে-সব উন্নত মানসিক গুণ প্রথমে মানুষকে অদৃশ্য ও অপার্থিব শক্তিতে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল এবং তারপর ভক্তিবস্তুবাদ, বহু-ঈশ্বরবাদ এবং অবশেষে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসকে দৃঢ় করেছিল, সেই গুণগুলোই চিন্তাভাবনার ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে নানারকম কুসংস্কার ও কু-রীতির জন্ম দিয়েছে। এদের মধ্যে কতকগুলো তো রীতিমতো ভয়ঙ্কর—রক্তপিপাসু দেবতাকে খুশি করতে নরবলি, বিষপ্রয়োগ করে বা আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে নির্দোষ ব্যক্তিদের বিচার করা, ডাইনিবিদ্যা ইত্যাদি। তবু এসব কু-সংস্কার সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা করা দরকার, কারণ তার ফলে বোঝা যায় চিন্তাভাবনা, বিজ্ঞান ও সঞ্চিত জ্ঞানের উন্নতির কাছে মানুষের ঋণ কী অপরিসীম। স্যর জে. লুবক তাঁর অভিজ্ঞতার নিরিখে বলেছেন, যথেষ্ট কমই বলা হবে যদি বলা হয় যে অজানা শয়তানের বিশ্রী ভয় অ-সভ্য জীবনের ওপর ঘন মেঘের মতো ছড়িয়ে থাকে এবং তাদের যে-কোনো সুখের মুহূর্তকে দুর্বিষহ করে তোলে।’ আমাদের উন্নত মানসিক গুণাবলির এসব দুঃখজনক ও পরোক্ষ ফলাফলকে তুলনা করা যায় নিম্নতর প্রাণীদের সহজাত প্রবৃত্তির বিভিন্ন আকস্মিক ও কদাচিৎ সংঘটিত ভুল-ভ্রান্তির সঙ্গে।
*
সূত্র
১. উল্লিখিত সমস্ত বিবৃতি এই দুই প্রাণীতত্ত্ববিদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ধৃত। দ্র., রেঙ্গারের—Naturgesch der saugethiere von paraguay’, পৃ. ৪১-৫৭, এবং ব্রেহমের ‘Thierleben’, বি. ১, পৃ. ১০-১৭।
২. একজন সমালোচক কোনোরকম যুক্তি ছাড়াই ব্রেহ্ম কর্তৃক উল্লিখিত এ-রকম কাজের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, আমাকে হেনস্থা করা। সেইজন্য আমি নিজেই পরীক্ষা করে দেখেছি, পাঁচ সপ্তাহ বয়সের কোনো বিড়ালছানার পায়ের ধারালো নখগুলো আমার দাঁত দিয়ে কাটা খুব শক্ত কোনো কাজ নয়।
৩. হাউজো বলেছেন যে তাঁর প্যারোকিট ও ক্যানারি পাখিগুলো স্বপ্ন দেখত। দ্র. ‘Faculte’s Mcstales’, tom. ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৬।
৪. মি. এল. এইচ. মর্গ্যানের ‘দ্য আমেরিকান বিবর’, ১৮৬৮, রচনাটিতে এই মন্তব্যের চমৎকার ব্যাখ্যা করা আছে। তবে আমার মনে হয় তিনি সহজাত প্রবৃত্তির ক্ষমতাকে খুবই কমিয়ে দেখছেন।
৫. অধ্যাপক হাক্সলি অত্যন্ত স্পষ্ট করে সেইসব মানসিক স্তরের ব্যাখ্যা করেছেন, যেগুলোর সাহায্যে কোনো মানুষ বা কুকুর আমার গ্রন্থে উল্লিখিত সিদ্ধান্তের সমতুল কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।
৬. মি. বেল্ট তাঁর অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক বইটিতে (দ্র. ‘দ্য ন্যাচরালিস্ট ইন নিকারাগুয়া’, ১৮৭৪, পৃ. ১১৮) একইভাবে সেবুস জাতের একটি পোষা বানরের বিভিন্ন কাজের কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে ওই বানরটির মধ্যে কিছুটা চিন্তাশক্তি ছিল।
৭. আমি দেখে খুশি হয়েছি যে মি. লেলি স্টিফেনের মতো অত্যন্ত যুক্তিবাদী একজন ব্যক্তিও মানুষের মন ও নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মনের মধ্যে কল্পিত সেই অনতিক্রম্য বাধাটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন (দ্র., ‘ডারউইনিজম অ্যান্ড ডিভাইনিটি, এসেজ অন ফ্রি থিঙ্কিং’, ১৮৭৩, পৃ. ৮০), ‘বস্তুতপক্ষে, যে-ভেদরেখাটি টানা হয়েছে, অধিবিদ্যা বিষয়ক অসংখ্য ভেদরেখার থেকে আমরা সেটিকে উন্নত কিছু বলে মনে করতে পারি না। অর্থাৎ ধরে নেওয়া হচ্ছে যে দুটি জিনিসকে দুটি পৃথক নাম দিলেই তাদের প্রকৃতিও হবে পৃথক পৃথক। কোনো ব্যক্তি যদি কখনো কুকুর পুষে থাকেন বা হাতির আচার-আচরণ সম্পর্কে পূর্ব- পরিচিত হন, তাহলে কীভাবে তিনি জন্তু-জানোয়ারদের চিন্তাশক্তি সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করেন, তা বোঝা মুশকিল।’
৮. এই বিষয়টার ওপর বেশ কিছু বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করেছি আমি। এখানে যাঁর কথা আগে বলা দরকার তিনি হলেন নৌ-সেনাধ্যক্ষ স্যর. বি. জে. সুলিভান—একজন অত্যন্ত তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষক। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর পিতৃগৃহে দীর্ঘদিনের একটি পোষা তোতাপাখি ছিল। পাখিটি বাড়ির কয়েকজনকে এবং তাঁদের পরিবারে আসা-যাওয়া আছে এ-রকম কয়েকজন ব্যক্তিকে অবিকল তাদের নামধরে ডাকত। প্রাতরাশের সময় সে প্রত্যেককে ‘সুপ্রভাত’ বলত এবং রাতে শুতে যাওয়ার সময় প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে ‘শুভরাত্রি’ উচ্চারণ করত। কখনোই তার এই অভ্যাসের ওলটপালট ঘটেনি। সুলিভানের বাবাকে ‘সুপ্রভাত’ জানানোর সময় সে আরও কয়েকটি কথা যোগ করে দিত, যা তাঁর বাবার মৃত্যুর পর আর কখনো শোনা যায়নি। একবার একটা বাইরের কুকুর খোলা জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়াতে পাখিটা তাকে খুব বকাবকি করেছিল। আর একবার অন্য একটি তোতা তার খাঁচা থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের টেবিলে রাখা রসাল আপেল খাচ্ছিল বলে সে তাকে জোর ভর্ৎসনা করেছিল যার কথাগুলো এ-রকম ‘তুমি একটা পাজি তোতা।’ তোতাপাখি সম্বন্ধে হাউজোর রচনাটিও উল্লেখযোগ্য (দ্র. ‘ফ্যাকালতে মেঁতাল’, Tom. ২য় খণ্ড, পৃ. ৩০৯। ড. এ. মশকো জানিয়েছেন, তিনি একটি স্টারলিং পাখিকে (বেগুনি বা সবুজ রঙের পালকের ওপর কালো ও বাদামি ছোপ ছোপ রংবিশিষ্ট এক ধরনের হরবোলা পাখি) জানতেন। যখন কেউ আসত তখন সে তাকে ‘সুপ্রভাত বলত এবং যাওয়ার সময় সে শুনতে পেত ‘বিদায় বন্ধু’। জার্মান ভাষায় শেখা এই অভিবাদনটি জানাতে কখনোই ভুল করত না সে।
৯. অধ্যাপক হুইট্নি লক্ষ করেছেন (দ্র. ‘ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড লিঙ্গুইটিক স্টাডিজ’, পৃ. ৩৫৭) মানুষের মধ্যে ভাব আদান-প্রদানের ইচ্ছা জীবন্ত আকারে রয়েছে এবং তার ভাষার উন্নতিতে ‘সচেতন ও অসচেতন দুভাবেই কাজ করে থাকে। আশু লক্ষ্যে পৌঁছনোর ব্যাপারে কাজ করে সচেতনভাবে, আর তার পরবর্তী ফলাফলের ক্ষেত্রে কাজ করে অসচেতনভাবে।’
১০. অধ্যাপক হাউজো এ বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর বিবরণ দিয়েছেন। দ্রঃ ‘ফ্যাকালতে, মেঁতাল দ্য অ্যানিমো’, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৮।
১১. এ বিষয়ে অনেকগুলো কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ দ্রষ্টব্য, ড. বেট্মান-এর রচনা, ‘অন অ্যাফাসিয়া’, পৃ. ২৭, ৩১, ৫৩. ১০০ ইত্যাদি।
১২. এ বিষয়ে অধ্যাপক হুইটনের মতো বিশিষ্ট একজন ভাষাতত্ত্ববিদের রায় আমার চেয়ে অনেক জোরালো। অধ্যাপক ব্লিকের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন (দ্র. ‘ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড লিঙ্গুইসটিক স্টাডিজ’, পৃ. ২৯৭), ‘যেহেতু ভাষা হলো চিন্তা-ভাবনার একান্ত জরুরি সহায়ক, চিন্তাশক্তির বিকাশে যেহেতু ভাষা অপরিহার্য, তাই তিনি সোৎসাহে বলেছেন যে ভাষা ছাড়া চিন্তা, একেবারেই অসম্ভব—অর্থা মূল ক্ষমতাটিকে তার কার্যসাধনের উপায়ের সঙ্গে এক করে দেখেছেন। একইভাবে তিনি এ-ও বলতে পারতেন যে মানুষের হাত কোনো যন্ত্র ছাড়া কাজ করতে পারে না। এ-রকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শুরু করলে অনিবার্যভাবেই তিনি অধ্যাপক মুলারের সেই ন্যাক্কারজনক কুটাভাসেই গিয়ে পৌঁছলেন, অর্থাৎ শিশুরা, মানে যারা এখনও কথা বলতে শেখেনি, তারা মনুষ্যপদবাচ্য নয়, বা মূক-বধিররা উচ্চারিত কথায় তাদের আঙুল ব্যবহার করতে না শেখা পর্যন্ত চিন্তাশক্তির অধিকারী হতে পারে না।’ অধ্যাপক মুলার তাঁর মূল সূত্রটিকে বাঁকানো হরফ দিয়ে এভাবে প্রকাশ করেছেন, ‘শব্দ ছাড়া কোনো চিন্তা হতে পারে না, আবার চিন্তা ছাড়া কোনো শব্দও থাকতে পারে না।’ (দ্র. লেকচারস অন মি. ডারউস ফিলজফি অফ ল্যাঙ্গুয়েজ’, তিন নম্বর বক্তৃতা) ‘চিন্তা’ শব্দটির কী অদ্ভুত সংজ্ঞাই না দিয়েছেন অধ্যাপক!
১৩. এ প্রসঙ্গে ড. মডস্লে-র কিছু মন্তব্য উল্লেখযোগ্য (দ্র. ‘দ্য ফিজিওলজি অ্যান্ড প্যাথোলজি অফ মাইন্ড’, পৃ. ১৯৯)।
১৪. চমৎকার পর্যবেক্ষক মি. ব্ল্যাকওয়াল জানিয়েছেন, ম্যাগপাই পাখিরা (লম্বা লেজ যুক্ত ও সাদা-কালো পালকবিশিষ্ট এক ধরনের কাক) ব্রিটেনের অধিকাংশ পাখিদের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি এক-একটি শব্দ, এমনকি ছোট ছোট বাক্য বলতে শেখে। তথাপি, এদের অভ্যাস সম্বন্ধে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালানোর পর তিনি বলেছেন, প্রকৃতির খোলমেলা পরিবেশে, থাকার সময় অনুকরণ করবার কোনোরকম অস্বাভাবিক ক্ষমতারই পরিচয় দেয় না এরা(দ্র., ‘রিসার্চেস ইন জুলজি’, পৃ. ১৫৮)।
১৫. স্যর সি. লাইয়েল কৃত প্রজাতি ও ভাষার উন্নতির মধ্যে সরস তুলনাটি এখানে উল্লেখযোগ্য (দ্র., ‘দ্য জিওলজিক্যাল এভিডেনসেস অফ দ্য অ্যান্টিকুইটি অফ ম্যান’, পরিচ্ছেদ ২৩)।
১৬. এ প্রসঙ্গে রেভারেন্ড অফ. ডব্লু. ফ্যারার-এর চিত্তাকর্ষক প্রবন্ধ ‘ফিলোলজি অ্যান্ড ডারউইনিজম’ উল্লেখযোগ্য (দ্র. ‘নেচার’, ২৪ মার্চ, ১৮৭০, পৃ. ৫২৮)।
১৭. টাইলরের গ্রন্থ (‘আর্লি হিস্ট্রি অফ ম্যানকাইন্ড, পৃ. ৬) দ্রষ্টব্য। এছাড়াও লুবকের ‘দ্য ডেভেলপমেন্ট অফ রিলিজিয়ান’ বিষয়ে তিনটি অসাধারণ পরিচ্ছেদ উল্লেখযোগ্য) মূল গ্রন্থ : “অরিজিন অফ সিভিলাইজেশন’, ১৮৭০)। একইভাবে মি. হার্বার্ট স্পেন্সার তাঁর চমৎকার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন (দ্র. ‘ফর্টনাইটলি রিভিউ’, ১লা মে, ১৮৭০, পৃ. ৫৩৫), পৃথিবীতে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের একেবারে গোড়ার কথা হলো স্বপ্ন দেখা বা ছায়ামূর্তি দেখা এবং অন্যান্য কিছু কারণ। সে নিজেকে শরীরগত ও আত্মাগত, এই দুই উপাদানের সমন্বয় হিসেবে ভাবতে শিখেছিল। আবার যেহেতু ধরে নেওয়া হয় যে আত্মা মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকে ও দারুণ শক্তিশালী, অতএব তাকে খুশি করার জন্য প্রয়োজন হলো নানরকম আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপহার প্রদান এবং সেইসঙ্গে তার সাহায্য প্রার্থনাও জরুরি হয়ে উঠল। মি. স্পেন্সার আরও দেখিয়েছেন যে পশুপাখি বা কোনো জিনিসের নামে কোনো গোষ্ঠীয় প্রতিষ্ঠান বা আদিপুরুষের মূল নাম বা ডাক নাম প্রদানের রীতি থেকে বহুদিন পরে গোষ্ঠীগুলোর প্রকৃত আদিপুরুষদের পরিচয় পাওয়া যায়। স্বভাবতই তখন এইরকম পশুপাখি বা জিনিসকে জীবিত-আত্মা হিসেবে বিশ্বাস করা হয়, মনে করা হয় তারা পবিত্র এবং দেবতা কল্পনায় পুজোও করা হয় তাদের। কিন্তু এ-সব সত্ত্বেও আমার মনে হয় যে এর আগেও একটি প্রাথমিক ও কঠিন ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে মানুষকে, যখন শক্তিমান বা গতিময় যে-কোনো জিনিসকেই কোনো-না-কোনোভাবে সজীব বলে মনে করা হতো এবং সেইসঙ্গেই মনে করা হতো যে আমাদের মতো সেগুলোরও চিন্তাশক্তি আছে।
১৮. বলা হয় যে বহুদিন আগেই বেকন এবং আঠারো শতকে কবি বার্নস এ-বিষয়ে একই ধারণা পোষণ করতেন (দ্র., ড. ডব্লিউ. ল্যান্ডার (লিন্ডসের লেখা, ‘জার্নাল অফ মেন্টাল সায়েন্স’, ১৮৭১, পৃ. ৪৩)।