৩. মহাবিস্ফোরণ

৩. মহাবিস্ফোরণ

মহাবিশ্ব আমাদের ধারণার মতো অদ্ভূত নয়, আমাদের ধারণার চেয়েও অদ্ভুত।

—জে বি এস হ্যালডন

সৃষ্টিকাহিনিতে বিশ্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভের একটি উপায় খুঁজছে মানুষ। এর মাধ্যমে আমাদের কাছে পরমের অর্গল খুলে যাবে। এটা আমাদের তথ্য জানায় এবং একই সঙ্গে আমাদের তার ভেতরে মূর্ত করে। মানুষ এটাই চায়। আত্মাও এটাই দাবি করে।

—জোসেফ ক্যাম্পবেল

.

টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ১৯৯৫ সালের ৬ মার্চ ছাপা হলো প্রকাণ্ড সর্পিল ছায়াপথ এম১০০-এর ছবি। সেটি দেখিয়ে দাবি করা হলো, ‘বিশৃঙ্খলায় পড়েছে কসমোলজি’। সত্যি সত্যিই কসমোলজি একটা গোলযোগের মধ্যে পড়েছিল সেবার। কারণ, তখন হাবল স্পেস টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া সর্বশেষ উপাত্ত থেকে দেখা গেল, সবচেয়ে বয়স্ক নক্ষত্রের চেয়ে খোদ মহাবিশ্বের বয়স কম। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে তা একেবারেই অসম্ভব। ওই উপাত্ত আরও ইঙ্গিত করল, মহাবিশ্বের বয়স ৮ বিলিয়ন থেকে ১২ বিলিয়ন বছর। অন্যদিকে অনেকের বিশ্বাস, সবচেয়ে প্রাচীন নক্ষত্রের বয়স প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর। ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার ক্রিস্টোফার ইমপে রসিকতা করে বলে বসলেন, ‘মায়ের চেয়ে নিজের বয়স কখনো বেশি হতে পারে না।’

তাই মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব বাতিলযোগ্য বলে প্রমাণের ভিত্তি হয়ে উঠল এম১০০ নামের এই একটামাত্র গ্যালাক্সি। এটা আসলে বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার সন্দেহজনক পথ। লেখাটিতে বলা হয়েছিল, এখানে যে ফাঁক আছে তার মধ্য দিয়ে ‘অনায়াসে স্টারশিপ এন্টারপ্রাইজ চালানো সম্ভব’। হাবল স্পেস টেলিস্কোপের প্রাথমিক উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে দেখা গেল, মহাবিশ্বের বয়স ১০ থেকে ২০ শতাংশের বেশি নির্ভুলভাবে গণনা করা যায়নি।

আমার মতে, মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব নিছক অনুমানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি, বরং এর ভিত্তি ভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া শত শত উপাত্ত। এসব উপাত্তের প্রতিটিই একত্রে এই একক, স্ব-সংগতিপূর্ণ তত্ত্বকে সমর্থন করে। (বিজ্ঞানে সব কটি তত্ত্ব একইভাবে সৃষ্টি হয়নি। অবশ্য যে কেউ নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টিবিষয়ক তত্ত্ব প্রস্তাব করতেই পারে। কিন্তু আমাদের সংগ্রহে এমন শত শত উপাত্ত রয়েছে, যেগুলো মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের সঙ্গে খাপ খায়। সৃষ্টিবিষয়ক নতুন তত্ত্বকে সেসব উপাত্তকে অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে। )

মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণগুলো আমাদের সামনে হাজির করেছিলেন বাঘা বাঘা তিনজন বিজ্ঞানী। নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী এই তিন বিজ্ঞানী হলেন এডুইন হাবল, জর্জ গ্যামো ও ফ্রেড হয়েল।

সম্ভ্রান্ত জ্যোতির্বিদ এডুইন হাবল

কসমোলজির তাত্ত্বিক ভিত গড়েন আলবার্ট আইনস্টাইন। সেখানে প্রায় একক ব্যক্তি হিসেবে যে মানুষটি আধুনিক পরীক্ষামূলক কসমোলজির জন্ম দেন, তিনি হলেন এডুইন হাবল। বিশ শতকে সম্ভবত তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিদ।

যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরির মার্সফিল্ডে ১৮৮৯ সালে জন্ম এডুইন হাবলের। বেশ ভদ্রগোছের গ্রাম্য বালক ছিলেন হাবল। ছেলেবেলাতেই তাঁর মনের ভেতর ছিল অনেক বড় এক স্বপ্ন। বাবা ছিলেন আইনজীবী ও ইনস্যুরেন্সের দালাল। ছেলেকেও নিজের মতো আইনে ক্যারিয়ার গড়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর। তবে জুল ভার্নের বই পড়ে রোমাঞ্চিত হতেন বালক হাবল। পুলকিত হতেন রাতের আকাশের তারা দেখে। টোয়েন্টি থাউজেন্ট লিগস আন্ডার দ্য সি এবং ফর্ম দ্য আর্থ টু দ্য মুন-এর মতো ক্ল্যাসিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনিগুলো গোগ্রাসে গিলতেন তিনি। আবার সুদক্ষ বক্সারও ছিলেন এডুইন হাবল। তাই সেখানকার প্রমোটররা চেয়েছিল তিনি যাতে পেশাদার বক্সার হন এবং ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন জ্যাক জনসনের সঙ্গে লড়েন।

অক্সফোর্ডে আইন বিষয়ে পড়ার জন্য নামকরা রোডস স্কলারশিপ জিতে নেন তিনি। সেখানে ব্রিটিশ উঁচুশ্রেণির আদবকেতা শিখতে শুরু করেন। (টুইড স্যুট পরতে, পাইপ টানতে, ব্রিটিশ উচ্চারণ রপ্ত করতে শুরু করেন তিনি। সেই সঙ্গে নিজের ডুয়েলে লড়ার ক্ষতচিহ্ন নিয়ে কথা বলতেন। গুজব আছে, এই দাগটা নাকি তাঁর নিজেরই তৈরি করা।)

তবে এসব নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না হাবল। তাঁর অনুপ্রেরণার পেছনে কোনো অপরাধমূলক ঘটনা কিংবা মামলা নয়, বরং সেটা ছিল সেই ছোটবেলা থেকে শুরু হওয়া নক্ষত্রের প্রতি তাঁর একরোখা প্রেম। তাই একসময় বেশ সাহসে ভর করে ক্যারিয়ার পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাই সব ছেড়েছুড়ে চলে গেলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন অজারভেটরির দিকে। মাউন্ট উইলসনে তখন কদিন আগে বিশ্বের সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপটি বসানো হয়েছে। তাঁর আয়নার ব্যাস ১০০ ইঞ্চি। অনেক দেরিতে ক্যারিয়ার শুরু করে তাড়াহুড়ো শুরু করলেন হাবল। হারিয়ে যাওয়া সময়গুলো পুষিয়ে নিতে চাইলেন। সেজন্য দ্রুত জ্যোতির্বিদ্যার কিছু গভীরতম ও সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি রহস্যময় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন তিনি।

১৯২০ সালের দিকে মহাবিশ্ব বেশ আরামদায়ক জায়গা ছিল বলা যায়। তখন ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হতো, গোটা মহাবিশ্বে কেবল মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথ আছে। রাতের আকাশে ছড়িয়ে থাকা অস্পষ্ট আলোকগুচ্ছের সঙ্গে ছলকে পড়ে যাওয়া দুধের বেশ মিল আছে। (গ্যালাক্সি শব্দের অর্থও গ্রিক ভাষায় আসলে ‘দুধ’।) ১৯২০ সালে হার্ভার্ডের হার্লো শ্যাপলি এবং লিক অবজারভেটরির হেবার কার্টিসের মধ্যে বড় ধরনের এক বিতর্ক বাধে। এই বিতর্ক ‘গ্রেট ডিবেট’ নামে পরিচিত। তাদের বিতর্কের বিষয় ছিল মহাবিশ্বের আকার। এতে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এবং খোদ মহাবিশ্বের আকার বেশ গুরুত্ব পায়। শ্যাপলির মনে করতেন, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি দিয়ে আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব গঠিত। অন্যদিকে কার্টিস বিশ্বাস করতেন, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি ছাড়িয়ে আরও দূরে আছে সর্পিল নেবুলা বা নীহারিকা দেখতে অদ্ভুত হলেও এই নীহারিকা পাক খাওয়া কুণ্ডলীর মতো সুন্দর। (১৭০০ সালের শুরুর দিকে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট অনুমান করেন, এই নেবুলা বা নীহারিকা হলো ‘আইল্যান্ড ইউনিভার্স’ বা মহাবিশ্বের দ্বীপের মতো।)

স্বাভাবিকভাবে সেকালের আলোচিত এই বিতর্কে একসময় জড়িয়ে পড়লেন হাবলও। এ ক্ষেত্রে একটা সমস্যা ছিল। সেটাকেই বলা যায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রধানতম সমস্যা। সেকালে নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ধারণ করাটাই ছিল জ্যোতির্বিদ্যায় অন্যতম কঠিন কাজ। দূরের কোনো উজ্জ্বল নক্ষত্রকেও মনে হতো হুবহু কাছের কোনো অনুজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো একই রকম। এই বিভ্রান্তির কারণে জ্যোতির্বিদ্যায় জন্ম নেয় বেশ কিছু বড় বড় দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক। তাই এর সমাধানের জন্য নক্ষত্রদের দূরত্ব পরিমাপে একটা ‘স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল’ (একটা আদর্শ আলোক উৎস) দরকার পড়ল হাবলের। এই আদর্শ আলোক উৎসকে মানদণ্ড ধরে দূরত্ব পরিমাপসংক্রান্ত এই সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছিলেন তিনি। স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল হলো এমন এক বস্তু, যা মহাবিশ্বের যেকোনো জায়গায় একই পরিমাণ আলো নিঃসৃত করে। (আসলে সেকালে এ ধরনের স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল খুঁজে বের করতে এবং তা পরিমাপ করতে কসমোলজিতে অসংখ্যবার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু এই স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল আসলে কতটা নির্ভরযোগ্য, তা নিয়েও জ্যোতির্বিদ্যায় বিতর্ক হয়েছিল বেশ বড় ধরনের।) কারও কাছে যদি একটা স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল থাকে, যা মহাবিশ্বে একই তীব্রতায় সুষমভাবে জ্বলতে থাকে, তাহলে যে নক্ষত্রটি সাধারণের চেয়ে চার ভাগ ক্ষীণ বা ম্লান দেখাবে, তার অবস্থান হবে পৃথিবী থেকে স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেলের দ্বিগুণ দূরত্বে।

এক রাতে সর্পিল অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার ছবি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এক ইউরেকা মুহূর্তের মুখোমুখি হন এডুইন হাবল। অ্যান্ড্রোমিডার ভেতরে তিনি একধরনের ভ্যারিয়েবল স্টার বা বিষম নক্ষত্র (যার নাম সেফিড) খুঁজে পান। বেশ আগে এ সম্পর্কে গবেষণা করেছিলেন হেনরিয়েটা লেভিট। তাই আগে থেকেই জানা ছিল, এই নক্ষত্রের আলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিতভাবে ওঠানামা করে। আর এ নক্ষত্রের একটা পুরো চক্রের সঙ্গে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতার সম্পর্ক আছে। নক্ষত্রটি যত উজ্জ্বল হয়, ততই তার পালস বা স্পন্দনের চক্রও লম্বা হয়। কাজেই সহজভাবে এই চক্রের ব্যাপ্তি মেপে এর উজ্জ্বলতা ক্যালিব্রেট বা মাপন মানদণ্ড ঠিক করা যায়। এর মাধ্যমে নির্ণয় করা যায় নক্ষত্রটির দূরত্বও। হাবল দেখতে পান, এর চক্রের সময়সীমা বা ব্যাপ্তি ৩১.৪ দিনের। বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি দেখলেন, এর দূরত্ব ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখ আলোকবর্ষ, যা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থিত। (মিল্কিওয়ের উজ্জ্বল চাকতি মাত্ৰ ১ লাখ আলোকবর্ষজুড়ে ছড়িয়ে আছে। এরপর আরেক গণনায় দেখা গেল, হাবল আসলে অ্যান্ড্রোমিডার সত্যিকার দূরত্ব কম করে ধরেছিলেন। আসলে এ গ্যালাক্সির প্রকৃত দূরত্ব প্রায় ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখ আলোকবর্ষের কাছাকাছি। )

এরপর তিনি অন্যান্য সর্পিল নেবুলায় একই ধরনের পরীক্ষা চালালেন। দেখা গেল, সেগুলোও আছে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরে। এতে তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, এসব সর্পিল নেবুলা সহজাতভাবেই গোটা দ্বীপ মহাবিশ্ব। সেখানে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি হলো মহাকাশের আরও অন্য সব ছায়াপথের মধ্যে মাত্র একটি।

মহাবিশ্বের আকার বিপুল পরিমাণ বেড়ে গেল এক ধাক্কাতেই। একটামাত্র ছায়াপথ থেকে মহাবিশ্ব হঠাৎ লাখ লাখ, হয়তো কোটি কোটি ছায়াপথের বসতিতে পরিণত হলো। এক লাখ আলোকবর্ষ থেকে এক লহমায় কোটি কোটি আলোকবর্ষজুড়ে বিস্তৃত হলো মহাবিশ্ব।

শুধু এই একটামাত্র আবিষ্কারটাই হাবলকে মহান জ্যোতির্বিদদের কাতারে একটা শক্তপোক্ত জায়গা দিতে পারত। কিন্তু এই আবিষ্কারে থেমে না থেকে আরও দূরে এগিয়ে গেলেন তিনি। শুধু গ্যালাক্সিদের দূরত্বই নির্ণয় নয়, সেগুলো কত দ্রুতবেগে চলছে, তা-ও নির্ণয় করতে চাইলেন হাবল।

ডপলার ইফেক্ট ও প্রসারণশীল মহাবিশ্ব

হাবল জানতেন, দূরের কোনো বস্তুর গতি মাপার সহজতম উপায় হলো, সেগুলো যে শব্দ বা আলো নিঃসৃত করে তা বিশ্লেষণ করা। একে বলা হয় ডপলার ইফেক্ট বা ডপলার প্রভাব। হাইওয়ে দিয়ে কোনো গাড়ি যাওয়ার সময় শব্দের সৃষ্টি হয়। তাদের গতি মাপতে ডপলার ইফেক্ট ব্যবহার করে পুলিশ। এ পদ্ধতিতে একটা যন্ত্র দিয়ে গাড়ির ওপর লেজার রশ্মির ঝলক ফেলা হয়, প্রতিফলিত হয়ে পুলিশের গাড়িতে আবারও ফিরে আসে। এই লেজার রশ্মির ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্কের শিফট বা বিচ্যুতি মেপে ওই গাড়ির গতি মাপে পুলিশ।

তেমনি কোনো নক্ষত্র যদি আপনার দিকে আসতে থাকে, তাহলে এর থেকে নিঃসৃত আলোকতরঙ্গ সংকুচিত হয়ে যাবে অ্যার্কিডিয়ন বাদ্যযন্ত্রের মতো। ফলে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পাওয়া যাবে ক্ষুদ্রতর। কোন হলুদ নক্ষত্র সে কারণে নীলচে দেখা যাবে (কারণ, নীল রং হলুদের চেয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের)। একইভাবে, কোনো নক্ষত্র আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে গেলে তার আলোকতরঙ্গ প্রসারিত হবে। ফলে তা থেকে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো পাওয়া যায়। তাই হলুদ নক্ষত্র থেকে পাওয়া যাবে কিছুটা লালচে আলো। সহজ কথায়, তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিচ্যুতি বা বিকৃতি যত বেশি হবে, নক্ষত্রের গতিবেগ ও হবে তত বেশি। কাজেই সহজ কথায়, কোনো নক্ষত্রের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিচ্যুতি (সরণ) জানতে পারলে ওই নক্ষত্রটির গতিও জানা সম্ভব।

এর আগে ১৯১২ সালে ভেস্টো স্লিপার পর্যবেক্ষণে দেখেছিলেন, ছায়াপথগুলো অনেক দ্রুতবেগে পৃথিবীর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সুতরাং মহাবিশ্ব আমাদের আগের প্রত্যাশার চেয়ে শুধু বড়ই নয়, এটা প্রসারিতও হচ্ছে অনেক দ্রুতবেগে। বাইরের ছোট ফ্ল্যাকচুয়েশনে তিনি দেখতে পান, ছায়াপথগুলো থেকে রুশিফটের চেয়ে রেডশিফট বা লোহিত বিচ্যুতি পাওয়া যাচ্ছে বেশি। কারণ, ছায়াপথগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। স্লিফারের আবিষ্কার প্রমাণ করল, মহাবিশ্ব সত্যি সত্যিই গতিশীল, কোনোভাবেই স্থিতিশীল নয়। অথচ এককালে মহাবিশ্বকে তেমনটিই ধরে নিয়েছিলেন নিউটন ও আইনস্টাইন।

কয়েক শতক ধরে বেন্টলি আর অলবার্সের প্যারাডক্স নিয়ে গবেষণা করছিলেন বিজ্ঞানীরা। তা সত্ত্বেও কেউই গুরুত্বের সঙ্গে ভাবেননি যে মহাবিশ্ব প্রসারণশীল হতে পারে। ১৯২৮ সালের কোনো একদিন উইলিয়াম ডি সিটারের সঙ্গে দেখা করতে রওনা হন হাবল। তাঁর জন্য একে গুরুত্বপূর্ণ একটা ভ্রমণ বলা যায়। ডি সিটার অনুমান করেছিলেন, যে গ্যালাক্সি যত দূরে, তার আরও দ্রুতবেগে দূরে সরে যাওয়া উচিত। এটাই হাবলকে উৎসাহিত করেছিল। একটা ফুলতে থাকা বেলুনের কথা চিন্তা করা যাক, যার গায়ে ছায়াপথ আঁকা রয়েছে। বেলুনটি যতই ফুলতে থাকবে, তার গায়ের পরস্পরের কাছাকাছি থাকা ছায়াপথগুলো আপেক্ষিকভাবে ততই ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকবে। যেগুলো যত কাছে, তারা দূরে সরে যাবে তত ধীরে ধীরে। কিন্তু যেসব ছায়াপথ দূরে দূরে, তাদের সরে যাওয়ার হার হবে তত বেশি।

হাবলকে তাঁর উপাত্তগুলোতে এই প্রভাব পরীক্ষা করে দেখার জন্য তাড়া দিলেন ডি সিটার। কারণ, এর মাধ্যমে ছায়াপথের লোহিত বিচ্যুতি বিশ্লেষণ করে এই প্রভাব পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব। ছায়াপথের লোহিত বিচ্যুতি যত বেশি, তা দূরে সরে যাবে তত দ্রুতবেগে। আবার তার দূরত্বও তত বেশি হওয়া উচিত। (আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী, ছায়াপথের লোহিত বিচ্যুতির কারণ পৃথিবী থেকে তার দ্রুতবেগে সরে যাওয়া নয়, বরং তা ওই ছায়াপথ ও পৃথিবীর মাঝখানের স্থান প্রসারণের কারণে ঘটে। দূরবর্তী ছায়াপথ থেকে আসা আলো প্রসারিত বা বিস্তৃত হয় স্থানের প্রসারণের কারণে। এর ফলে লোহিত বিচ্যুতির জন্ম। তাই একে লালচে দেখা যায়।)

হাবলের সূত্র

ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে এসে ডি সিটারের পরামর্শ মেনে চললেন হাবল। আদৌ এ ধরনের কোনো প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া যায় কি না, সেটাই খুঁজতে লাগলেন তিনি। সর্বসাকুল্যে ২৪টি ছায়াপথ বিশ্লেষণ করে তিনি দেখতে পান, কোন ছায়াপথ যত দূরে, তা পৃথিবীর কাছ থেকে তত দূরে সরে যাচ্ছে। ঠিক এমনটিই অনুমান করা হয়েছিল আইনস্টাইনের সমীকরণে। এই দুটোর অনুপাত (গতিকে দূরত্ব দিয়ে ভাগ দিলে) মোটামুটি একটা ধ্রুব রাশি পাওয়া গেল। অচিরেই রাশিটি পরিচিত হয়ে উঠল হাবলের ধ্রুবক বা H নামে। কসমোলজিতে এটা সম্ভবত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধ্রুবক। কারণ, হাবলের ধ্রুবক বলে দেয়, মহাবিশ্ব কী হারে প্রসারিত হবে।

বিজ্ঞানীরা এরপর চিন্তা করলেন, মহাবিশ্ব যদি সত্যিই প্রসারিত হয়ে থাকে, তাহলে কোনো একসময় সম্ভবত এর একটা সূচনাও ছিল। হাবল ধ্রুবকের বিপরীত রাশি আসলে মহাবিশ্বের বয়স সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দিতে পারে। বিস্ফোরণের একটা ভিডিও টেপের কথা কল্পনা করা যাক। ভিডিও টেপে আমরা দেখতে পাই, ধ্বংসাবশেষ ছিটকে বেরিয়ে আসছে বিস্ফোরণের জায়গা থেকে। এখান থেকে আমরা বিস্ফোরণের বেগ নির্ণয় করতে পারি। কিন্তু এখানে আরেকটা কাজও করা যায়। ভিডিও টেপটি পেছন দিকেও চালিয়ে দেখা যায়, যতক্ষণ না ধ্বংসাবশেষগুলো একটা একক বিন্দুতে এসে জড়ো হচ্ছে। আমরা বিস্ফোরণের বেগ জানি। তাই এই বিস্ফোরণটা কখন সংঘটিত হয়েছিল, তা-ও গণনা করে বের করে ফেলা সম্ভব।

(হাবলের মৌলিক গণনায় মহাবিশ্বের বয়স পাওয়া গেল প্রায় ১.৮ বিলিয়ন বছর। এটাই কয়েক প্রজন্মের কসমোলজিস্টদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, মহাবিশ্বের এই বয়স পৃথিবী আর নক্ষত্রের জন্য নির্ণীত সর্বসম্মত বয়সের তুলনায় অনেক কম। অনেক বছর পর জ্যোতির্বিদেরা অবশেষে বুঝতে পারেন, অ্যান্ড্রোমিডার সেফিড ভেরিয়েবল থেকে আসা আলো পরিমাপের ত্রুটির কারণে হাবল ধ্রুবকের মান গণনায় ভুল পাওয়া গেছে। আসলে হাবল ধ্রুবকের নিখুঁত মানের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞান জগতে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা গেছে ৭০ বছর ধরে। বর্তমানে সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট মানটি পাওয়া গেছে ডব্লিউএমএপি স্যাটেলাইট থেকে।)

১৯৩১ সালে মাউন্ট উইলসন মানমন্দির পরিদর্শনে যান আইনস্টাইন। সেবারই প্রথম হাবলের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। মহাবিশ্ব যে সত্যিই প্রসারিত হচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরে মহাজাগতিক ধ্রুবককে তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল বলে উল্লেখ করেন। (তবে এটা আইনস্টাইনের বড় ধরনের ভুল হলেও কসমোলজির ভিত নাড়িয়ে দেন তিনি। পরের অধ্যায়গুলোতে ডব্লিউএমএপি স্যাটেলাইটের উপাত্ত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা তা দেখতে পাব।) সেবার আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীকেও সেই বিশাল মানমন্দিরটা ঘুরিয়ে দেখানো হলো। তাকে বলা হয়েছিল, এই দানবীয় টেলিস্কোপ দিয়েই মহাবিশ্বের চূড়ান্ত আকৃতি নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। এর জবাবে মিসেস আইনস্টাইন নির্লিপ্তভাবে বললেন, ‘আমার স্বামী তো এ কাজটা একটা পুরোনো খামের পেছনে করে থাকেন।

মহাবিস্ফোরণ

অন্য আরও অনেকের মতো আইনস্টাইনের তত্ত্ব শিখেছিলেন বেলজিয়ান পাদরি জর্জেস লেমাইতারও। ফলে এ তত্ত্ব যৌক্তিকভাবে মহাবিশ্বের প্রসারণের ইঙ্গিত করে আর তাতে মহাবিশ্বের যে একটা সূচনা থাকতে পারে—সেই ধারণায় কৌতূহলী হয়ে ওঠেন তিনি। গ্যাসকে সংকুচিত করা হলে তার তাপ বেড়ে যায়। কাজেই তিনি বুঝতে পারলেন, মহাবিশ্বের শুরুতে নিশ্চয় অতি-উত্তপ্ত একটা অবস্থার মধ্যে ছিল। ১৯২৭ সালে তিনি বললেন, মহাবিশ্ব অবশ্যই শুরু হয়েছে অবিশ্বাস্য রকম তাপমাত্রা আর ঘনত্বের কোনো সুপার অ্যাটম বা অতিপরমাণু অবস্থার মাধ্যমে। এই অতিপরমাণু হঠাৎ করে বিস্ফোরিত হয়ে হাবলের প্রসারণশীল মহাবিশ্বে বিকশিত হতে শুরু করেছে। তিনি লিখলেন, “বিশ্বজগতের বিবর্তনকে সদ্য সমাপ্ত আতশবাজির প্রদর্শনীর সঙ্গে তুলনা করা যায়। সেখানে কিছু লালচে ফিতা, ছাই আর ধোঁয়া পড়ে থাকে। একেবারে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া পোড়া ছাইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা সূর্যকে ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে যেতে দেখি। পাশাপাশি বিশ্বজগতের জন্মের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া উজ্জ্বলতার কথাও স্মরণ করি।’

সময়ের একেবারে শুরুতে একটা সুপার অ্যাটমের ধারণার কথা প্রথম যে ব্যক্তি উল্লেখ করেন, তিনি অ্যাডগার অ্যালান পো। তাঁর যুক্তিটা ছিল, একটা বস্তু আরেক ধরনের বস্তুকে আকর্ষণ করে। কাজেই মহাবিশ্বের বা সময়ের একেবারে শুরুতে সেখানে নিশ্চয়ই পরমাণুদের মহাজাগতিক সংকোচনও ছিল।)

লেমাইতার বিভিন্ন পদার্থবিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দিতেন। সেখানে অন্য বিজ্ঞানীদের কাছে নিজের ধারণার কথা তুলে ধরতেন তিনি। কিন্তু তাঁরা রসিকতার সঙ্গে তাঁর কথা শুনতেন। তারপর স্বাভাবিকভাবে সেই ধারণা বাতিলও করে দিতেন। সেকালের শীর্ষস্থানীয় পদার্থবিদ আর্থার এডিংটন বলেছিলেন, ‘একজন বিজ্ঞানী হিসেবে, আমি কোনোভাবে বিশ্বাস করতে পারি না যে একটা বিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয়ে বর্তমানের অবস্থায় পৌঁছেছে…হঠাৎ শুরু হয়ে প্রকৃতির বর্তমান অবস্থায় আসার ধারণা বিরক্তিকর মনে হয়।’

কিন্তু অনেক বছর লেমাইতারের অধ্যবসায়ের কারণে আস্তে আস্তে গুঁড়িয়ে যেতে থাকে পদার্থবিদদের সমস্ত প্রতিরোধ। এরপর মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বটির গুরুত্বপূর্ণ একজন মুখপাত্র হয়ে ওঠেন এক বিজ্ঞানী। তত্ত্বটিকে জনপ্রিয়ও করে তোলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, তিনিই পরে তত্ত্বটির জন্য চমকপ্রদ সব প্রমাণও হাজির করতে শুরু করেন।

মহাজাগতিক ভাঁড় জর্জ গ্যামো

এডুইন হাবল ছিলেন মার্জিত ও সম্ভ্রান্ত জ্যোতির্বিদ। তাঁর কাজ আরও সামনে এগিয়ে নেন আরেক বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি হলেন বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো। অনেক দিক দিয়ে গ্যামো ছিলেন হাবলের ঠিক বিপরীত চরিত্রের। তিনি ছিলেন একাধারে ভাঁড় ও কার্টুনিস্ট। নিজের প্র্যাকটিক্যাল জোকসের জন্যও বিখ্যাত তিনি। আবার ২০টি বইও লেখেন। বইগুলোর বেশ কয়েকটা বয়স্ক- তরুণদের উপযোগী। বেশ কয়েক প্রজন্ম পদার্থবিদ (এর মধ্যে আমিও আছি) বেড়ে উঠেছে পদার্থবিদ্যা ও কসমোলজি নিয়ে তাঁর লেখা মজাদার আর তথ্যমূলক এসব বই পড়ে। একটা সময় বিজ্ঞানজগৎ আর সমাজে যখন আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিপ্লব ঘটাচ্ছিল, তাঁর বই তখন একাই টিকে ছিল। কারণ, টিনএজারদের জন্য এই বইগুলোই ছিল অগ্রসর বিজ্ঞানবিষয়ক একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য লেখা।

প্রায়ই দেখা যায়, নিষ্ফল আইডিয়া আর পর্বতসমান নীরস উপাত্ত নিয়ে তৃপ্ত থাকেন গৌণ বিজ্ঞানীরা। কিন্তু গ্যামো সেখানে ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম সৃজনশীল জিনিয়াস। তিনি ছিলেন বহু বিষয়ে পণ্ডিত। তাঁর মাথায় সব সময় বিভিন্ন আইডিয়া চরকির মতো ঘুরপাক খেত। সেসব আইডিয়া পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান, বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব, এমনকি ডিএনএ গবেষণারও মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ফ্রান্সিস ক্রিকের সঙ্গে ডিএনএ অণুর গুপ্তরহস্য উন্মোচন করা জেমস ওয়াটসন যে তাঁর আত্মজীবনীর শিরোনাম দিয়েছেন জিনস, গার্লস অ্যান্ড গ্যামো, সেটা হয়তো কোনো দুর্ঘটনা নয়। গ্যামোর সহকর্মী এডওয়ার্ড টেলার স্মৃতিচারণা করে বলেছেন, ‘গ্যামোর ৯০ শতাংশ তত্ত্বই ভুল হতো। অবশ্য সেটা যে ভুল তা সহজে বোঝাও যেত। কিন্তু তাতে সে কিছু মনে করত না। যেসব মানুষ তাদের উদ্ভাবন নিয়ে বিশেষ গর্ববোধ করে না, তেমনই একজন ছিল সে। গ্যামো তাঁর সর্বশেষ আইডিয়াটা সবার উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিত। তারপর একটা রসিকতায় পরিণত করত সেটাকে।’ কিন্তু তাঁর আইডিয়ার বাকি ১০ শতাংশই একসময় গোটা বৈজ্ঞানিক কাঠামোর বদলে দেয়।

গ্যামোর জন্ম রাশিয়ার ওডেসায়, ১৯০৪ সালে। তখন সমাজতান্ত্রিক উত্থান সবে শুরু হয়েছে দেশটিতে। গ্যামো সেই সময়ের কথা স্মরণ করে বলেছেন, ‘মাঝে মাঝে স্কুলের ক্লাস বাতিল করা হতো। কারণ, তখন শত্রুদের যুদ্ধজাহাজ থেকে বোমা হামলা হতো, কিংবা গ্রিক, ফ্রান্স বা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী দল শহরের রাজপথে সাদা, লাল, এমনকি রুশ বাহিনীর ওপর বেয়নেট আক্রমণ চালাত। অথবা লড়াই চলত বিভিন্ন রঙের রুশ বাহিনী একজন আরেকজনের সঙ্গে। ‘

একদিন গির্জায় এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন গ্যামো। অনুষ্ঠান শেষে গোপনে ভোজের কিছু রুটি বাসায় নিয়ে আসেন। তাঁর প্রথম জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল এ ঘটনাটাই। কমিউনিয়ন ব্রেড বা শেষ ভোজের রুটিকে প্রতীকী অর্থে যিশুখ্রিষ্টের মাংস হিসেবে উপস্থাপন করা হতো। রুটির টুকরোটা মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে তিনি দেখার চেষ্টা করেন, শেষ ভোজের ওই রুটি আর সাধারণ রুটির মধ্যে আদৌ কোনো পার্থক্য আছে কি না। শেষে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, ‘আমার ধারণা, এই পরীক্ষাটাই আমাকে বিজ্ঞানী বানিয়েছে।’

লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন তিনি। এরপর পদার্থবিদ আলেকজান্দার ফ্রিডম্যানের অধীনে গবেষণা করেছেন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। নীলস বোরের মতো অনেক বাঘা বাঘা পদার্থবিদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে সেখানে। (১৯৩২ সালে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালান তিনি। সে জন্য একটা ভেলায় চেপে ক্রিমিয়া থেকে তুরস্কে সাগরে রওনা হন। পরে ব্রাসেলসে এক পদার্থবিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দিতে এসে পালাতে সক্ষম হন তিনি। এ কারণে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।

বন্ধুদের কাছে লিমেরিক পাঠানোর জন্যও খ্যাতি ছিল গ্যামোর। সেগুলোর বেশির ভাগ কখনো ছাপার অক্ষরে দেখা যায়নি। তবে তাঁর একটি লিমেরিকে সেকালের কসমোলজিস্টদের উদ্বেগ ধরা পড়েছে। জ্যোতির্বিদ্যাগত সংখ্যাগুলোর বিশালত্বের মুখোমুখি হয়ে এবং অসীমত্বের দিকে তাকিয়ে তাদের মুখে উদ্বেগের ছায়া পড়ে। গ্যামোর একটি লিমেরিক এরকম :

দেয়ার ওয়াজ আ ইয়াং ফেলো ফর্ম ট্রিনিটি
হু টুক দ্য স্কয়ার রুট অব ইনফিনিটি
বাট দ্য নাম্বার অব ডিজিট
গেভ হিম দ্য ফিজেটস
হি ড্রপড ম্যাথ অ্যান্ড টুক দ্য ডিভিনিটি।

১৯২০ সালের দিকে রাশিয়ায় থাকা অবস্থায় রেডিওঅ্যাকটিভ ডিকে বা তেজস্ক্রিয় ক্ষয় কেন সম্ভব, সে রহস্য সমাধান করে প্রথম বড় ধরনের সাফল্য পান গ্যামো। অবশ্য এ বিষয়ে গবেষণার জন্য মাদাম কুরি এবং অন্য বিজ্ঞানীদেরও ধন্যবাদ দিতে হবে। কারণ, তাদের গবেষণার কারণে বিজ্ঞানীরা একসময় জানতে পারেন, ইউরেনিয়াম পরমাণু অস্থিতিশীল এবং তা বিকিরণ নিঃসরণ করে আলফা রশ্মিরূপে (হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াস)। তবে নিউটনের বলবিদ্যা অনুসারে, নিউক্লিয়াসকে একত্রে ধরে রাখা রহস্যময় পারমাণবিক বল এই নিঃসরণ বন্ধ করার জন্য একটা বাধা হিসেবে কাজ করার কথা। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব?

গ্যামো (এবং আর ডব্লিউ গার্নি এবং ই ইউ কনডন) বুঝতে পারলেন, তেজস্ক্রিয় ক্ষয় সম্ভব হয় কোয়ান্টাম তত্ত্বের কারণে। এ তত্ত্বের অনিশ্চয়তার নীতির অর্থ হলো, কোনো কণার নিখুঁত ভরবেগ ও অবস্থান কখনো একসঙ্গে জানা সম্ভব নয়। কাজেই সেখানে একটা টানেল বা সুড়ঙ্গ থাকার ছোট সম্ভাবনা থাকবে কিংবা তারা সরাসরি বাধা অতিক্রম করতে পারবে। (বর্তমানে টানেলিংয়ের এই ধারণা পদার্থবিজ্ঞানের মূল বিষয়। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, কৃষ্ণগহ্বর ও মহাবিস্ফোরণ ব্যাখ্যা করতে এটি ব্যবহার করা হয়। মহাবিশ্ব নিজেও হয়তো টানেলিংয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে।

তুলনা করার সুবিধার জন্য, চারদিকে উঁচু দেয়াল ঘেরা একটা জেলখানায় এক বন্দীর কথা কল্পনা করেন গ্যামো। চিরায়ত নিউটোনিয়ান বলবিদ্যায় এই জেলখানা থেকে পালানো একেবারে অসম্ভব। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বের অদ্ভুত জগতে, কখনো নিখুঁতভাবে বলা যাবে না, ওই বন্দীর অবস্থান কোথায় কিংবা তার ভরবেগই-বা কত। বন্দী যদি জেলখানার দেয়ালে মাঝে মাঝে দুম করে জোরালোভাবে আঘাত করে, তাহলে সে দেয়ালের ভেতর দিয়ে কত দিনে বেরিয়ে আসতে পারবে, তা হিসাব করে বের করা যাবে। অবশ্য আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান ও নিউটোনিয়ান বলবিদ্যা লঙ্ঘন করবে এ ঘটনা। এখানে ওই বন্দীর জেলখানার দেয়ালে বাইরের একটা দরজা খুঁজে পাওয়ার একটা সসীম ও গণনাযোগ্য সম্ভাবনা থাকে। বন্দীর মতো বড় বস্তুগুলোকে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটার জন্য হয়তো মহাবিশ্বের জীবনকালের চেয়ে বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে হবে। তবে আলফা কণা আর অন্যান্য অতিপারমাণবিক কণার ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। কারণ, দেয়ালের নিউক্লিয়াসগুলোর বিরুদ্ধে বারবার বিপুল শক্তি দিয়ে আঘাত করছে এসব কণা। অনেকে মনে করেন, এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য গ্যামোকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত ছিল।

১৯৪০ সালের দিকে গ্যামোর আগ্রহ আপেক্ষিকতা থেকে সরে যায় কসমোলজির দিকে। কারণ, একে একটা সমৃদ্ধ ও অনাবিষ্কৃত এলাকা হিসেবে মনে হলো তাঁর। তত দিনে জানা গেছে যে আকাশ কালো আর মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। গ্যামো একক এক ধারণায় প্রভাবিত হলেন। তাই কয়েক কোটি বছর আগে যে একটা মহাবিস্ফোরণ সংঘটিত হয়েছিল, সে ঘটনার কোনো প্রমাণ কিংবা ফসিলের প্রমাণ খুঁজতে শুরু করলেন তিনি। কাজটা ছিল বেশ হতাশাজনক। কারণ, আক্ষরিক অর্থে, কসমোলজি তখনো পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান নয়। মহাবিস্ফোরণ নিয়ে কোনো পরীক্ষা চালানোরও কোনো উপায়ও কারও জানা ছিল না। কসমোলজির সঙ্গে গোয়েন্দা কাহিনির বেশ মিল আছে। এটাও পরীক্ষামূলক নয়, একটা পর্যবেক্ষণমূলক বিজ্ঞান। এখানে কোনো অপরাধের ঘটনাস্থলের সূত্র বা প্রমাণের খোঁজ চালান গোয়েন্দারা। তাই এটা পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের চেয়ে একেবারেই আলাদা। কারণ, পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানে নিখুঁত পরীক্ষা চালানো হয়।

মহাবিশ্বের পারমাণবিক রান্নাঘর

বিজ্ঞানে গ্যামোর পরবর্তী বড় ধরনের অবদানটা ছিল নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার আবিষ্কার। এর মাধ্যমে মহাবিশ্বে আমরা যেসব হালকা মৌল দেখি সেগুলো তৈরি হয়েছিল। একে ‘মহাবিশ্বের প্রাগৈতিহাসিক রান্নাঘর’ বা প্রিহিস্টিরিক কিচেন অব দ্য ইউনিভার্স বলতে পছন্দ করতেন তিনি। এই রান্নাঘরেই আসলে মহাবিস্ফোরণের প্রচণ্ড তাপে মহাবিশ্বের সব কটি মৌল রান্না হয়েছিল। বর্তমানে এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় নিউক্লিওসিন্থেসিস বা পারমাণবিক সংশ্লেষণ। এই প্রক্রিয়ায় মহাবিশ্বের মৌলগুলোর আপেক্ষিক প্রাচুর্যতা গণনা করা হয়। গ্যামোর আইডিয়াটি ছিল, কোনো একটা নিরবচ্ছিন্ন চেইন ছিল, যার শুরু হয়েছিল হাইড্রোজেনের মাধ্যমে। এই চেইন বা শিকলটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে ক্রমাগত আরও কণা যোগ করে তৈরি করা সম্ভব। দিমিত্রি মেন্দেলেভের রাসায়নিক মৌলের গোটা পর্যায় সারণি মহাবিস্ফোরণের প্রচণ্ড উত্তাপ থেকে তৈরি করা যায় বলে মনে করতেন তিনি।

গ্যামো আর তাঁর ছাত্ররা যুক্তি দেখালেন, সৃষ্টির একেবারে আদিম পর্যায়ে মহাবিশ্বে প্রচণ্ড উত্তপ্ত প্রোটন ও নিউট্রন ছিল। তাই সেখানে হয়তো ফিউশন বা পরমাণু সংযোজন বিক্রিয়া সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে। এ সময় হাইড্রোজেন পরমাণু পরস্পরের সঙ্গে ফিউজ হয়ে বা জোড়া লেগে গঠিত হয় হিলিয়াম পরমাণু। হাইড্রোজেন বোমাতে কিংবা কোন নক্ষত্রের ভেতর তাপমাত্রা এতই প্রচণ্ড থাকে যে সেখানে হাইড্রোজেনের প্রোটনগুলো পরস্পরের সঙ্গে জোরালোভাবে ধাক্কা খেতে থাকে। এই ধাক্কাধাক্কি চলতে থাকে সেগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হিলিয়াম নিউক্লিও তৈরি না হওয়া পর্যন্ত। পরে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মধ্যে সংঘর্ষ বা ধাক্কাধাক্কিতে লিথিয়াম ও বেরিলিয়ামের মতো পরের ধাপের মৌলগুলো গঠিত হতে থাকে। গ্যামো অনুমান করেন, আরও বেশি বেশি পারমাণবিক কণা নিউক্লিয়াসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্রমেই তৈরি হতে থাকবে পরের উচ্চ মৌলগুলো। অন্য কথায়, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের যে শখানেক বা তারও বেশিসংখ্যক কণা আছে, সেগুলোর সবই রান্না হতে থাকবে এই আদিম অগ্নিকুণ্ডের প্রচণ্ড উত্তাপে।

প্রচলিত নিয়মে, নিজের এই উচ্চাভিলাষী কর্মসূচির বিস্তৃত রূপরেখা তৈরি করেন গ্যামো। এরপর তাঁর পিএইচডির ছাত্র রালফ আলফারকে বিস্তারিত বিষয়গুলো দিয়ে তা পূরণ করতে বললেন। গবেষণাপত্রটি লেখা শেষে নিজের স্বভাবমতো একটা প্র্যাকটিক্যাল জোকস করার লোভ সামলাতে পারলেন না তিনি। পদার্থবিদ হ্যান্স ব্যাথের অনুমতি না নিয়েই তাঁর নামটাও এই গবেষণাপত্রে যোগ করলেন। ফলে গবেষণাপত্রটি বিখ্যাত হয়ে উঠল ‘আলফা-বেটা-গামা পেপার’ নামে।

গ্যামো খুঁজে পেলেন যে হিলিয়াম তৈরির করার পক্ষে মহাবিস্ফোরণ ছিল প্রকৃতপক্ষে প্রচণ্ডভাবে অতি উত্তপ্ত। ভরের ভিত্তিতে মহাবিশ্বের ২৫ শতাংশ গড়ে উঠেছে এই মৌলটি দিয়ে। মহাবিস্ফোরণের একটা প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে শুধু বর্তমানের অসংখ্য নক্ষত্র ও ছায়াপথের দিকে তাকিয়ে। এগুলো তৈরি হয়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ হাইড্রোজেন এবং ২৫ শতাংশ হিলিয়াম দিয়ে। এ ছাড়া আরও কিছু মৌলের দেখা মেলে এখানে। (প্রিন্সটনের জ্যোতিঃপদার্থবিদ ডেভিড স্পারগেল যেমন বলেছেন, ‘প্রতিবার একটা বেলুন কিনলে এমন কিছু পরমাণু পাওয়া যাবে, যাদের বেশ কিছু তৈরি হয়েছে মহাবিস্ফোরণের পর মাত্র প্রথম কয়েক মিনিটে’।)

তবে নিজের গণনায় একটা সমস্যাও দেখতে পান গ্যামো। তাঁর তত্ত্বটি খুব হালকা মৌলের ক্ষেত্রে বেশ ভালো কাজে দেয়। কিন্তু যেসব মৌলে ৫টি আর ৮টি নিউট্রন ও প্রোটন থাকে, সেগুলো খুব অস্থিতিশীল। তাই এসব মৌল বড়সংখ্যক প্রোটন ও নিউট্রনসম্পন্ন মৌল তৈরিতে আর সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে না। ৫ আর ৮তম কণায় এই সেতু আর থাকে না। মহাবিশ্বে যেহেতু ৫ আর ৮ নিউট্রন ও প্রোটনসম্পন্ন মৌলের চেয়েও আরও ভারী মৌল দিয়ে গঠিত, তাই এতে এক মহাজাগতিক রহস্যের জন্ম নেয়। এই কর্মসূচির মাধ্যমে গ্যামো প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, মহাবিশ্বের সব কটি কণা মহাবিস্ফোরণের মুহূর্তে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ৫ কণা ও ৮ কণার গ্যাপের সমস্যাটি এক নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইল বেশ কয়েক বছর। তাতে স্রেফ মুখ থুবড়ে পড়ে তাঁর সাধের স্বপ্নটি।

মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন

ঠিক একই সময়ে আরেকটি ধারণা আসে গ্যামোর মাথায়। তিনি ভাবলেন, মহাবিস্ফোরণ যদি অবিশ্বাস্য রকম অতি উত্তপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে এই তাপের কিছু অবশিষ্টাংশ এখনো মহাবিশ্বের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা উচিত। তাই যদি হয়, তাহলে তা থেকে খোদ মহাবিস্ফোরণের ফসিল রেকর্ডও পাওয়া যাবে। তিনি ধারণা করলেন, হয়তো মহাবিস্ফোরণ এতই প্রকাণ্ড ছিল যে তার পরবর্তী প্রভাবের রেশ এখনো একটা সুষম ও অস্পষ্ট বিকিরণ হিসেবে গোটা মহাবিশ্বে ভরে আছে।

১৯৪৬ সালে গ্যামো অনুমান করেন, মহাবিস্ফোরণ শুরু হয়েছিল অতি উত্তপ্ত নিউট্রন কেন্দ্রসহ। সেকালের জন্য একে যৌক্তিক অনুমানই বলা যায়। কারণ, তখনো ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন ছাড়া আর কোনো অতিপারমাণবিক কণার কথা তেমন জানা ছিল না। এই নিউট্রন গোলকের তাপমাত্রা মাপা সম্ভব হলে তিনি বুঝতে পারতেন যে এখান থেকে নিঃসৃত বিকিরণের পরিমাণ ও প্রকৃতিটা কেমন হবে। দুই বছর পর, গ্যামো দেখালেন, এই অতি উত্তপ্ত গোলক থেকে যে বিকিরণ বেরিয়ে আসে, তা আচরণ করবে অনেকটা ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন বা কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের মতো। উত্তপ্ত বস্তু থেকে বেরিয়ে আসা খুব বিশেষ ধরনের বিকিরণ এটা। কৃষ্ণবস্তুতে পতিত সব আলো এটা শোষণ করে। তারপর বিকিরণ করে একটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপায়ে। যেমন সূর্য, গলিত লাভা, আগুনে উত্তপ্ত কয়লা ও ওভেনে উত্তপ্ত সিরামিক—সবই হলুদ-লাল রং ধারণ করে। পাশাপাশি সেগুলো থেকে নিঃসৃত হয় কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ। (কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন স্বনামধন্য পোর্সেলিন নির্মাতা থমাস ওয়েগউড, ১৭৯২ সালে। একদিন তিনি খেয়াল করেন, ওভেন বা চুল্লিতে কোনো কাঁচামাল উত্তপ্ত করা হলে, তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা রং পরিবর্তন করে। লাল থেকে হলুদ, তারপর সাদা রং।)

এ বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কোনো উত্তপ্ত বস্তুর রং জানা গেলে, তার তাপমাত্রাও মোটামুটি আন্দাজ করা সম্ভব। আবার উল্টো কথাটাও সত্য। মানে হলো, তাপমাত্রা জানা গেলে তার রং কেমন হবে, তা ধারণা করা যায়। কোনো উত্তপ্ত বস্তুর তাপমাত্রা ও তা থেকে বিকিরণের মধ্যে নিখুঁত সম্পর্কের সূত্র প্রথম আবিষ্কার করেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। সেটা ১৯০০ সালের ঘটনা। তাঁর গবেষণার ফলে জন্ম হয় কোয়ান্টাম তত্ত্বের। (আসলে এভাবে সূর্যের তাপমাত্রা নির্ণয় করতে পেরেছিলেন বিজ্ঞানীরা। সূর্য প্রধানত হলুদ আলো বিকিরণ করে। এতে দেখা গেল, তা কৃষ্ণবস্তুর তাপমাত্রা মোটামুটি ৬০০০ কেলভিনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এভাবে আমরা সূর্যের বহির্মণ্ডলের তাপমাত্রা জানতে পারি। একইভাবে লোহিত দানব নক্ষত্র বিটলজুস বা আর্দ্রার পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ৩০০০ কেলভিন। কৃষ্ণবস্তুর লাল রঙের সঙ্গে এটি সম্পর্কিত। লোহিত-তপ্ত কয়লার টুকরো থেকেও নিঃসৃত হয় এই রং।

১৯৪৮ সালে একটি গবেষণাপত্র লেখেন গ্যামো। তাতে প্রথমবারের মতো কেউ একজন দেখাল যে মহাবিস্ফোরণের বিকিরণের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। অর্থাৎ ঠিক কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের মতো। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, তার তাপমাত্রা। এরপর এই বিশেষ কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের বর্তমান তাপমাত্রা কত হতে তা পারে, তা-ও হিসাব করে বের করেন গ্যামো।

গ্যামোর গণনা সম্পূর্ণ করে এই তাপমাত্রা নির্ণয় করেন তাঁর পিএইচডির ছাত্র রালফ আলফার এবং আরেক ছাত্র রবার্ট হারমান। গ্যামো লিখলেন, ‘মহাবিশ্বের আদিম সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত জানা মান বিচার করে আমরা দেখেছি, অতিক্রান্ত এই অনন্তকালে মহাবিশ্ব অবশ্যই পরম শূন্য তাপমাত্রার ৫ ডিগ্রি ওপরে শীতল হয়ে যাবে।’

১৯৪৮ সালে আরেকটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন আলফার ও হারমান। সেখানে তাঁর যুক্তি দেখালেন, মহাবিস্ফোরণের পরের তাপমাত্রা কেন পরম শূন্যের ওপরে ৫ ডিগ্রিতে নেমে আসবে (তাদের পরিমাপ তাৎপর্যপূর্ণভাবে সঠিক মানের কাছাকাছি ছিল। এখন আমরা জানি, সঠিক তাপমাত্রা হলো পরম শূন্যের ওপরে ২.৭ ডিগ্রি)। এই বিকিরণকে তাঁরা মাইক্রোওয়েভ রেঞ্জের বলে শনাক্ত করলেন। আর এই বিকিরণ এখনো মহাবিশ্বে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা উচিত বলে অনুমান করলেন আলফার ও হারমান। মহাবিশ্বে সুষমভাবে এই বিকিরণে পরিপূর্ণ হওয়ার কথা।

(এর কারণটা হলো : মহাবিস্ফোরণের অনেক বছর পর, মহাবিশ্বের তাপমাত্রা এত উত্তপ্ত ছিল যে তখন কোনো পরমাণু গঠিত হলেই টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যেত। কাজেই ওই সময়ে অসংখ্য মুক্ত ইলেকট্রন ছিল, যারা আলোকে বিক্ষিপ্ত করতে পারত। সুতরাং মহাবিশ্ব তখন ছিল অস্পষ্ট, কোনোভাবেই স্বচ্ছ নয়। এই অতি উত্তপ্ত মহাবিশ্বের ভেতর দিয়ে কোনো আলোকরশ্মি চলাচলের চেষ্টা করলে অল্প দূরত্বে গিয়ে তা শোষিত হতো। তাতে মহাবিশ্বকে মনে হতো মেঘাচ্ছন্ন ও অন্ধকার। তবে ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পর তাপমাত্রা কমে নেমে আসে ৩০০০ ডিগ্রিতে। এই তাপমাত্রার নিচে পরমাণু আর সংঘর্ষের মুখে পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হলো না। ফলে স্থিতিশীল পরমাণু গঠিত হতে লাগল সে সময়। আবার আলোকরশ্মি তখন আর শোষিত হলো না। তাই অনেক আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দিতে লাগল এই আলো। কাজেই প্রথমবারের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠল মহাবিশ্বের শূন্যস্থান। এই বিকিরণ সৃষ্টির হওয়ার মুহূর্তে শোষিত না হওয়ার কারণে তা এখনো মহাবিশ্বের আনাচকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে।)

আলফার ও হারমান যখন মহাবিশ্বের তাপমাত্রাসংক্রান্ত তাঁদের চূড়ান্ত গণনা গ্যামোকে দেখালেন, তা দেখে বেশ হতাশ হন তিনি। গ্যামোর ধারণা ছিল, এই তাপমাত্রা এতই ঠান্ডা হবে যে, তা পরিমাপ করা চরম কঠিন হবে। বেশ কয়েক বছর পর অবশেষে গ্যামো তাদের গণনা সঠিক বলে মেনে নেন। কিন্তু এই অস্পষ্ট বিকিরণক্ষেত্র কখনো পরিমাপ করা যাবে না ভেবেও বেশ হতাশা পেয়ে বসে তাঁকে। ১৯৪০-এর দশকে যেসব যন্ত্রপাতি পাওয়া যেত, তা দিয়ে এ রকম দুর্বল প্রতিধ্বনি পরিমাপ করার আশা করা যেত না। (পরের হিসাব-নিকাশে, একটা ভুল অনুমান ব্যবহার করে গ্যামো এই বিকিরণের তাপমাত্রা ঠেলে ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত তুলে দেন। )

নিজেদের গবেষণাকে জনপ্রিয় করতে ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছু বক্তৃতার আয়োজন করেন গ্যামো আর তাঁর সহকর্মীরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণীমূলক এই ফলাফল কেউ তেমন গুরুত্বই দেয়নি তখন। আলফার বলেছিলেন, ‘এই কাজ সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে আমরা প্রচুর শক্তি খরচ করেছি। কিন্তু কেউই এসে বলেনি এই বিকিরণ পরিমাপ করা যাবে…তাই ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৫ সালের পর আমরা একপ্রকার হাল ছেড়ে দিই। ‘

অকুতোভয় গ্যামো তাঁর বইপত্র এবং লেকচারের মাধ্যমে মহাবিস্ফোরণে তত্ত্বের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। কিন্তু তা হলে কী হবে, রাগী এক প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়তেও হয়েছিল তাঁকে। অনেক দিক দিয়ে গ্যামোর সমপর্যায়ের ছিলেন সেই রাগী লোকটি। সেই লোকটি হলেন ফ্রেড হয়েল। গ্যামো যেখানে দুষ্টুমি মেশানো কৌতুক আর বুদ্ধিদীপ্ত ও রসাল উক্তি করে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন, সেখানে নির্ভেজাল মেধা ও আগ্রাসী স্পর্ধা দেখিয়ে দর্শককে অভিভূত করতেন ফ্রেড হয়েল।

একরোখা ফ্রেড হয়েল

মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা অতিক্ষুদ্র তরঙ্গের পটভূমি বিকিরণ জোগান দেয় মহাবিস্ফোরণের দ্বিতীয় আরেকটা প্রমাণ। কিন্তু যে মানুষটি শেষ পর্যন্ত নিউক্লিওসিন্থেসিসের মাধ্যমে মহাবিস্ফোরণের তৃতীয় প্রমাণটি দাখিল করেন, তিনি হলেন ফ্রেড হয়েল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, পেশাগত জীবনের প্রায় পুরোটাই তিনি ব্যয় করেছিলেন মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব বাতিল প্রমাণের চেষ্টা করে।

হয়েলের যে ব্যক্তি ইমেজ, তাতে একাডেমিক হিসেবে তিনি ছিলেন বেমানান। এই মেধাবী ও একরোখা মানুষটি মাঝে মাঝে তাঁর যুদ্ধংদেহী ভঙ্গিতে প্রচলিত জ্ঞানকে বুড়ো আঙুল দেখানোর স্পর্ধা দেখাতেন। হাবল ছিলেন চরমভাবে সম্ভ্রান্ত। অক্সফোর্ডের পণ্ডিতদের মতো আদবকেতা শেখার সাধনা করেছিলেন তিনি। অন্যদিকে গ্যামো ছিলেন আনন্দদায়ক ভাঁড় ও বহু বিষয়ে পণ্ডিত। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত ও সরস মন্তব্য, লিমেরিক ও প্রাঙ্কে শ্রোতাদের চোখ ধাঁধিয়ে যেত। অন্যদিকে হয়েলের ভঙ্গিটা ছিল বুলডগের মতো রূঢ় আর গোয়ার। আইজ্যাক নিউটনের এককালের আস্তানা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো হলরুমে অদ্ভুত রকম বেমানান মনে হতো তাঁকে।

উত্তর ইংল্যান্ডে ১৯১৫ সালে জন্মেছিলেন ফ্রেড হয়েল। এক কাপড় ব্যবসায়ীর পুত্র ছিলেন তিনি। ওই এলাকায় তখন ছিল উলশিল্পের প্রাধান্য। শৈশবেই বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়েন হয়েল। তখন তাদের গ্রামে সবে রেডিও এসেছে। স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেছেন, তাঁদের বাড়িতে রেডিও শোনার জন্য খুব আগ্রহ নিয়ে ২০ থেকে ৩০ জন মানুষ জড়ো হতো। একবার তাঁকে টেলিস্কোপ উপহার দেন তাঁর বাবা-মা। এটাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

হয়েলের যুদ্ধংদেহী ভঙ্গি শুরু হয় সেই শৈশবে। মাত্র তিন বছর বয়সে নামতা শেখায় দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। এরপর তাঁকে রোমান সংখ্যা শিখতে বলেন তাঁর এক শিক্ষক। ‘৮-এর জন্য VIII লেখার মতো মানুষ এতটা বোকা কীভাবে হতে পারে?’, তাচ্ছিল্যভরে এ কথা স্মরণ করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁকে বলা হলো, নিয়ম অনুযায়ী তাকে স্কুলে যেতেই হবে। তখন তিনি লিখলেন, “অসন্তুষ্ট হয়ে সেদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এমন একটা বিশ্বে জন্মেছি যেখানে আইন নামের এক উন্মত্ত দানবের আধিপত্য। সেটা একই সঙ্গে শক্তিশালী ও নির্বোধ।’

আরেক শিক্ষিকার কারণেও কর্তৃপক্ষের প্রতি তীব্র ঘৃণা জেঁকে বসে তার মনে। একদিন ওই শিক্ষিকা ক্লাসে বললেন, নির্দিষ্ট একটি ফুলের পাঁচটি পাপড়ি থাকে। শিক্ষিকাকে ভুল প্রমাণ করতে পরদিন হাতে করে একটা ছয় পাপড়িওয়ালা ফুল নিয়ে ক্লাসে হাজির হন। অবাধ্য ছাত্রের এ রকম ধৃষ্ট আচরণের জন্য এই শিক্ষিকা তাঁর বাঁ কানে বেশ জোরে আঘাত করেন। (এরপর থেকে হয়েল বাঁ কানে তেমন শুনতে পেতেন না।)

স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্ব

১৯৪০ সালের দিকে আলোচিত মহাবিস্ফোরণে তত্ত্ব কোনোভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি হয়েলকে। মহাবিশ্বের বয়স গণনার ক্ষেত্রে এই তত্ত্বের একটা ত্রুটি ছিল। কারণ, মহাবিশ্বের বয়স ভুল গণনা করে ১.৮ বিলিয়ন বছর নির্ধারণ করেছিলেন হাবল। এর পেছনের কারণ হলো দূরবর্তী ছায়াপথ থেকে আসা আলো পরিমাপের ত্রুটি। এদিকে ভূতত্ত্ববিদেরা দাবি করলেন, পৃথিবী আর সৌরজগতের বয়স সম্ভবত কয়েক বিলিয়ন বছর। তাহলে খোদ মহাবিশ্বের তুলনায় তার গ্রহগুলোর বয়স কি এত বেশি হতে পারে?

এই প্রেক্ষাপটে সহকর্মী থমাস গোল্ড ও হারমান বন্ডিকে সঙ্গে নিয়ে একটা প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিলেন ফ্রেড হয়েল। কিংবদন্তি আছে, তাঁদের এই তত্ত্ব, মানে স্টেডি স্টেট থিওরি বা স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্ব গড়ে তোলার পেছনে তাঁদের প্রেরণা ছিল ১৯৪৫ সালে নির্মিত ডেড অব নাইট নামের একটা হরর মুভি। এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন মাইকেল রেডগ্র্যাভ। মুভিতে বেশ কয়েকটি ভূতের গল্প ছিল। কিন্তু শেষ দৃশ্যে গোটা কাহিনি একটা স্মরণযোগ্য মোড় নিতে দেখা যায়। দেখা গেল, মুভির শেষে আবারও তা নতুন করে শুরু হয়। কাজেই মুভিটি এক অর্থে বৃত্তাকার চক্রের মতো, যার কোনো শুরু বা শেষ নেই। এটাই ওই তিন বিজ্ঞানীকে মহাবিশ্বের এমন একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করতে উৎসাহিত করেছিল, যার কোনো শুরু বা শেষ বলে কিছু নেই। (গোল্ড পরে বেশ স্পষ্টভাবে এই গল্প বলেছেন। তিনি স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘আমার মনে হয়, বেশ কয়েক মাস আগে মুভিটা দেখেছিলাম আমরা তিনজন। তারপর আমি স্টেডি স্টেট প্রস্তাব করার পর, তাদের বলেছি, ওটা কি কিছুটা ডেড অব নাইট-এর মতো মনে হচ্ছে না?’ )

এই মডেলে মহাবিশ্বের অংশগুলো আসলে প্রসারিত হতো। কিন্তু একেবারে শূন্য থেকে অনবরত তৈরি হয় নতুন পদার্থ। কাজেই মহাবিশ্বের ঘনত্ব সব সময় একই থাকে। অবশ্য পদার্থ কীভাবে শূন্য থেকে এমন রহস্যজনকভাবে তৈরি হচ্ছে, তার কোনো বিশদ ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তাঁরা। তবে সেকালে যাঁরা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন, তাঁদের কাছে শিগগিরই আকর্ষণীয় হয়ে উঠল তত্ত্বটি। একটা অগ্নিময় বিশৃঙ্খলা শূন্য থেকে হাজির হয়ে ছায়াপথগুলোকে সব দিকে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে—এই ভাবনাটাই হয়েলের কাছে ভীষণ অযৌক্তিক বলে মনে হতো। তার চেয়ে শূন্য থেকে পদার্থের সৃষ্টি পছন্দ করলেন তিনি। অন্য কথায়, এ তত্ত্বমতে, মহাবিশ্ব কালহীন, চিরন্তন। এর কোনো শেষ নেই, শুরুও নেই। মহাবিশ্ব এভাবেই চিরকাল রয়েছে।

(স্থিতিশীল মহাবিশ্ব বনাম মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের বিতর্কের সঙ্গে ভূতত্ত্ব ও অন্যান্য বিজ্ঞানের মধ্যে বিরোধের বেশ মিল ছিল। ভূতত্ত্বে ইউনিফরমিটারিয়ানিজম (অতীতে পৃথিবী ক্রমান্বয়ে তার আকার পরিবর্তন করেছে—এই বিশ্বাস) এবং ক্যাটাস্ট্রোফিজম (যা অনুমান করে যে প্রচণ্ড ধ্বংসাত্মক ঘটনার কারণে এসব পরিবর্তন হয়েছে)। ইউনিফরমিটারিয়ানিজম এখনো ভূতাত্ত্বিক এবং বাস্তুসংস্থান-সংক্রান্ত অনেক কিছু ব্যাখ্যা করলেও ধূমকেতু আর গ্রহাণুর প্রভাবকে কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। ধূমকেতু ও গ্রহাণুর কারণে গণবিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছিল পৃথিবীতে। কিংবা টেকটোনিক ড্রাফটের মাধ্যমে মহাদেশগুলোর মধ্যে শুরু হয় বিভাজন ও চলাচল।)

বিবিসি লেকচার

ভালো কোনো লড়াই থেকে কখনো ভয়ে পিছপা হতেন না হয়েল। মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে এক বিতর্কে অংশ নেওয়ার জন্য ১৯৪৯ সালে ব্রিটিশ ব্রডকাস্ট করপোরেশন বা বিবিসিতে ডাকা হলো হয়েল ও গ্যামো—দুজনকেই। এটি সম্প্রচারের সময় প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্বকে একহাত দেখে নিতে চাইলেন হয়েল। আর সেটি করতে গিয়ে একটা ইতিহাস সৃষ্টি করেন তিনি। দুর্ভাগ্যক্রমে হয়েল বলে বসলেন, ‘এসব তত্ত্ব সব এতই হাইপোথিসিসনির্ভর যে তারা দাবি করে, মহাবিশ্বে সব পদার্থ অনেক দূর অতীতের নির্দিষ্ট সময়ে একটা বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে।’ নামটি সবাই লুফে নিল। প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্বটির সবচেয়ে বড় শত্রুর কারণেই এর আনুষ্ঠানিক নাম হয়ে গেল বিগ ব্যাং। (পরে তিনি দাবি করেছেন, একে খাটো করার জন্য শব্দটি ব্যবহার করেননি। পরে স্বীকার করেন, ‘তত্ত্বটিকে খাটো করতে নামটি ব্যবহার করার কোনো কারণ ছিল না। ওটা ব্যবহার করেছিলাম যাতে সবাই গ্রহণ করে।’)

কয়েক বছর ধরে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের সমর্থকেরা নামটি পরিবর্তনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ নামের সাধারণ, প্রায় অমার্জিত দ্যোতনায় তারা অসন্তুষ্ট। আবার তত্ত্বটির সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষের দেওয়া নামও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। নামটা তথ্যগতভাবেও ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণেও বিশুদ্ধবাদীরা বিশেষভাবে বিরক্ত। প্রথমত, বিগ ব্যাং আসলে বিগ বা বড় নয় (কারণ এটা অতিক্ষুদ্র সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু থেকে উৎপত্তি হয়েছিল। এই পরম বিন্দুর আকার ছিল একটা পরমাণুর চেয়েও অনেক অনেক ছোট)। দ্বিতীয়ত সেখানেও কোনো ব্যাং বা বিস্ফোরণও ঘটেনি (কারণ, সেখানে কোনো বাতাসও ছিল না)। বিগ ব্যাং থিওরির নাম পাল্টানোর জন্য ১৯৯৩ সালের আগস্টে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে বসে স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ ম্যাগাজিন। এতে প্রায় ১৩ হাজার নামও জমা পড়ে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বিচারকেরা বিগ ব্যাংয়ের চেয়ে ভালো জুতসই কোনো নাম সেখান থেকে খুঁজে পাননি।)

গোটা প্রজন্মের মনে হয়েলের খ্যাতি সিলমোহরের মতো খোদাই হয়ে যায় বিবিসি রেডিওতে বিজ্ঞানবিষয়ক বিখ্যাত লেকচার সিরিজের কারণে। ১৯৫০ সালের দিকে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় বিজ্ঞানবিষয়ক লেকচার সম্প্রচারের পরিকল্পনা করে বিবিসি। তবে আসল অতিথি বাতিল হয়ে যাওয়ার কারণে বিকল্প আরেকজনকে খুঁজে বের করতে বাধ্য হন অনুষ্ঠানটির প্রডিউসার। এ সময় তাঁরা হয়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনিও আসতে রাজি হয়ে যান। পরে প্রডিউসার তাঁর ফাইল ঘেঁটে দেখে, সেখানে একটা নোট রাখা আছে। তার ভাষ্য, ‘এই লোকটাকে ব্যবহার করবেন না।’

দুর্ঘটনাক্রমে, আগের প্রডিউসারের এই ভয়ানক সাবধানবাণী আমলে নেয়নি বিবিসি। ফলে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে পাঁচটি সম্মোহনী লেকচার দেওয়ার সুযোগ পান হয়েল। বিবিসির এই ক্ল্যাসিক সম্প্রচার গোটা জাতিকে সম্মোহিত করে ফেলে, অনুপ্রাণিত করে পরের প্রজন্মের জ্যোতির্বিদদেরও। জ্যোতির্বিদ ওয়ালেস সার্জেন্ট তাঁর ওপর এই সম্প্রচারের প্রভাব মনে করে বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১৫, তখন আমি বিবিসিতে দ্য নেচার অব দ্য ইউনিভার্সশিরোনামে ফ্রেড হয়েলের লেকচার শুনতাম। সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা আর ঘনত্ব সম্পর্কে ধারণাটি শুনে খুবই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম সেবার। ১৫ বছর বয়েসে এ ধরনের ব্যাপারগুলোকে মনে হতো জ্ঞানের বাইরের কিছু। সেটা শুধু বিস্ময়কর কিছু সংখ্যাই ছিল না, বরং সবকিছু জানতে পারার মতো তথ্য।

নক্ষত্রে নিউক্লিওসিন্থেসিস

আর্মচেয়ারে অলসভাবে বসে বসে অনুমান করার কাজ ভীষণ অপছন্দ করতেন হয়েল। তাই শিগগিরই নিজের স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্ব পরীক্ষা করে দেখার প্রস্তুতি নিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, গ্যামো যেমনটি বিশ্বাস করতেন, মহাবিশ্বের মৌলগুলোর মহাবিস্ফোরণের ভেতর রান্না হয়নি, বরং তা ঘটেছে বিভিন্ন নক্ষত্রের ভেতর। আরও বুঝতে পারলেন, নক্ষত্রের প্রচণ্ড তাপের কারণে যদি শ খানেক বা তার বেশি রাসায়নিক মৌল রান্না হয়ে থাকে, তাহলে মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের আর কোনো দরকার পড়ে না।

নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া যে মহাবিস্ফোরণের সময় নয়, বরং নক্ষত্রের কেন্দ্রে সংঘটিত হয়েছে—তার বৈচিত্র্যময় বিশদ বিবরণ দিলেন হয়েল এবং তাঁর সহকর্মীরা। ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত প্রভাবশালী বেশ কিছু গবেষণাপত্রও ধারাবাহিকভাবে লিখলেন তাঁরা। নক্ষত্রের কেন্দ্রে হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম নিউক্লিওতে আরও আরও প্রোটন ও নিউট্রন যোগ করে আরও ভারী মৌল তৈরি করা সম্ভব, অন্তত লোহা পর্যন্ত—সেটাই এসব গবেষণাপত্রে দেখালেন এই বিজ্ঞানীরা। (পারমাণবিক ভর ৫ নম্বর পরের মৌলগুলো কীভাবে তৈরি হয়, সেই রহস্যের সমাধান হলো এভাবে। এর আগে ঠিক এখানে একসময় আটকে গিয়েছিলেন গ্যামো। জিনিয়াসের এক ধাক্কার মতো, হয়েল বুঝতে পারলেন, তিনটি হিলিয়াম নিউক্লিও দিয়ে তৈরি অস্থিতিশীল কার্বনের কোনো রূপ হয়তো এর আগে তাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। এ রকম কোনো কিছু পাওয়া গেলে, সেটা একটা সেতুর মতো আচরণ করার মতো যথেষ্ট সময় টিকে থাকবে। পাশাপাশি আরও ভারী মৌল গঠনের সুযোগ পাবে। এই অস্থিতিশীল কার্বন হয়তো নক্ষত্রের কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সময় টিকে থাকতে পারে। এভাবে সেগুলো ক্রমাগত আরও নিউট্রন ও প্রোটনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠন করবে পারমাণবিক ভর ৫ ও ৮-এর পরের মৌলগুলো। এই অস্থিতিশীল কার্বন একসময় সত্যি সত্যিই খুঁজে পাওয়া গেল। তখন চমকপ্রদভাবে প্রমাণ হয়ে গেল, নিউক্লিওসিন্থেসিস আসলে মহাবিস্ফোরণের সময় নয়, বরং নক্ষত্রের ভেতর ঘটেছে। এমনকি সে জন্য একটা বড় ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রামও তৈরি করেন হয়েল। এ প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রায় প্রথম নীতি থেকে প্রকৃতিতে মৌলগুলোর আপেক্ষিক প্রাচুর্যের পরিমাণ পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারত। )

কিন্তু নক্ষত্রের ভেতর প্রচণ্ড উত্তাপ থাকা সত্ত্বেও তা লোহার পরের ভারী মৌলগুলো রান্নার জন্য যথেষ্ট নয়। যেমন তামা, নিকেল, দস্তা ও ইউরেনিয়াম। (লোহার পরের মৌলগুলোকে ফিউজ বা জোড়া লাগাতে যে পরিমাণ শক্তির দরকার, তা সেখানে পাওয়া খুব কঠিন। এর মধ্যে রয়েছে নিউক্লিয়াসে প্রোটনের বিকর্ষণ ও বন্ধন তৈরির জন্য শক্তির অভাব।) এসব ভারী মৌলের জন্য আরও বড় ধরনের কোনো চুল্লির দরকার। অর্থাৎ ভারী কোনো নক্ষত্রের বিস্ফোরণ বা সুপারনোভার দরকার পড়ে সে জন্য। কারণ, কোনো অতিদানবীয় বা সুপারজায়ান্ট নক্ষত্র যখন ভয়ংকরভাবে চুপসে গিয়ে চূড়ান্তভাবে তীব্র মৃত্যুযন্ত্রণায় পৌঁছায়, তখন তার কেন্দ্রের তাপমাত্রা কয়েক ট্রিলিয়ন ডিগ্রিতে উঠে যায়। লোহার পরের মৌলগুলো রান্নার জন্য এই শক্তি যথেষ্ট। এর মানে হলো, লোহার পরের ভারী মৌলগুলো আসলে বিস্ফোরিত নক্ষত্র বা সুপারনোভা থেকে ছিটকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

১৯৫৭ সালে হয়েল এবং একই সঙ্গে মার্গারেট, জিওফ্রি বারবিজ ও উইলিয়াম ফাওলার গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। মহাবিশ্বের মৌলগুলোর উৎপত্তির জন্য প্রয়োজনীয় ধাপের নিখুঁত বর্ণনা এবং তাদের প্রাচুর্যের অনুমান- সংক্রান্ত বিষয়ে একে সম্ভবত সবচেয়ে চূড়ান্ত কাজ বলা যায়। তাঁদের যুক্তি এতই নিখুঁত, শক্তিশালী আর বোধগম্য ছিল যে শেষ পর্যন্ত গ্যামোও তা মেনে নিতে বাধ্য হন। তিনি স্বীকার করেন, নিউক্লিওসিন্থেসিস সম্পর্কে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য চিত্র তুলে ধরেছেন হয়েল। এরপর তিনি বাইবেলের প্রচলিত ভঙ্গিতে নিচের লেখাটি লেখেন। একেবারে শুরুতে ঈশ্বর যখন মৌল তৈরি করছিলেন :

গণনার উত্তেজনায়, তিনি পারমাণবিক ভর ৫ আর তাদের পরের মৌলদের ডাকতে ভুলে গেলেন। তাই স্বাভাবিকভাবে কোনো ভারী মৌল তখন গঠিত হলো না। ঈশ্বর হতাশ হয়ে, মহাবিশ্বের সঙ্গে আবারও যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। এরপর আবারও সবকিছু প্রথম থেকে শুরু করলেন তিনি। কিন্তু সেটা সরল হতে পারত। তাই সর্বশক্তিমান হিসেবে ভুল সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিলেন ঈশ্বর। তবে সেটা কোনো অসম্ভব উপায়ে নয়। এরপর ঈশ্বর বললেন, ‘হয়েল আসুক।’ হয়েল উদয় হলেন। হয়েলের দিকে তাকালেন ঈশ্বর…এরপর তাকে যেকোনো উপায়ে ভারী মৌল তৈরির কথা বললেন। এবার নক্ষত্রের ভেতর ভারী মৌল তৈরি এবং তারপর সেগুলো সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন হয়েল।

স্থিতিশীল মহাবিশ্বের বিপক্ষে প্রমাণ

তবে কয়েক দশক ধরে স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বের বিপক্ষে বেশ কিছু জায়গা থেকে একে একে বিভিন্ন প্রমাণ উঠে আসতে থাকে। একসময় স্রেফ একটা হেরে যাওয়া যুদ্ধে নিজেকে আবিষ্কার করে বসেন হয়েল। তাঁর তত্ত্বমতে, মহাবিশ্ব বিকশিত হয়নি, বরং এখানে অনবরত নতুন পদার্থ তৈরি হয়ে চলেছে। কাজেই সেই যুক্তিতে আদিম মহাবিশ্ব দেখতে অনেকটাই বর্তমানের মতো হওয়া উচিত। আজকের দৃশ্যমান ছায়াপথগুলো কোটি কোটি বছর আগের ছায়াপথের মতো প্রায় একই রকম হওয়ার কথা। কিন্তু কোটি কোটি বছরের মধ্যে কোনো নাটকীয় বিবর্তনের চিহ্ন দেখা গেলে প্রমাণ পাওয়া যাবে যে স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্ব ভুল।

১৯৬০ সালের দিকে বাইরের মহাকাশে প্রবল শক্তিশালী কিছু রহস্যময় উৎস খুঁজে পাওয়া গেল। এদের নাম দেওয়া হলো কোয়েসার বা কোয়েসি- স্টেলার অবজেক্ট। (নামটা এতই আকর্ষণীয় ছিল যে পরে একটা টিভি সেটের নাম দেওয়া হয় কোয়েসার।) কোয়েসার বিপুল শক্তি তৈরি করে। এর লোহিত বিচ্যুতিও অনেক বেশি। তার মানে, তাদের অবস্থান আমাদের কাছ থেকে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে। আর মহাবিশ্বের বয়স যখন খুবই কম, তখনো মহাকাশ আলোকিত করেছিল এরা (জ্যোতির্বিদেরা এখন বিশ্বাস করেন, এসব দানবীয় তরুণ ছায়াপথ কৃষ্ণগহ্বরের বিপুল শক্তি দিয়ে পরিচালিত হয়।) আমরা বর্তমানে কোনো কোয়েসার থাকার প্রমাণ দেখতে পাই না। কোটি কোটি বছরের বেশি সময় আগেই তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বানুসারে, তাদের থাকার কথা।

এটা ছিল হয়েলের তত্ত্বের আরেক সমস্যা। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গেলে মহাবিশ্বে অনেক বেশি হিলিয়াম থাকা উচিত। শিশুদের বেলুন ও গ্যাসভর্তি বিমানে এই পরিচিত গ্যাসটি দেখা যায়। হিলিয়াম আসলে পৃথিবীতে বিরল এক গ্যাস। কিন্তু হাইড্রোজেনের পর এটাই মহাবিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচুর্যময় মৌল। পৃথিবীতে এটা এত বিরল যে প্রথম হিলিয়ামের খোঁজ মিলেছিল পৃথিবীতে নয়, সেই সূর্যে। (১৮৬৮ সালে বিজ্ঞানীরা সূর্য থেকে আসা আলো প্রিজমে পাঠিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখেন। বিক্ষিপ্ত সূর্যরশ্মি ভেঙে সাধারণ রংধনুর মতো রং ও বর্ণালিরেখায় বিভক্ত হয়। কিন্তু তাতে বিজ্ঞানীরা একটা অস্পষ্ট বর্ণালি রেখাও শনাক্ত করেন। রেখাটি পাওয়া যাচ্ছিল অজানা, রহস্যময় কোনো মৌলের কারণে। তখন ভুলক্রমে ভাবা হলো, অজানা মৌলটি হয়তো কোনো ধাতু। ধাতুর নামের শেষে সাধারণত ‘ium’ যোগ করা হয়। যেমন লিথিয়াম (Lithium) ও ইউরেনিয়াম (Uranium) ধাতু। এই রহস্যময় অজানা ধাতুর নাম রাখা হয় সূর্যের গ্রিক প্রতিশব্দ হেলিয়স (Helios) থেকে ধার করে। অবশেষে ১৮৯৫ সালে পৃথিবীতে হিলিয়াম আবিষ্কৃত হয় এক ইউরেনিয়ামের খনিতে। বিজ্ঞানীরা বেশ বিব্রত হয়ে আবিষ্কার করেন যে সেটা একটা গ্যাস, মোটেও ধাতব কোনো মৌল নয়। তাই সূর্যে প্রথম আবিষ্কার করা হিলিয়াম শব্দের একটা অপপ্রয়োগ হিসেবে জন্ম নেয়।)

হয়েলের বিশ্বাসমতো আদিম মহাবিশ্বের হিলিয়াম যদি প্রধানত নক্ষত্রের মধ্যে তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে এই মৌলটি বেশ বিরল হওয়ার কথা। পাশাপাশি একে পাওয়ার কথা নক্ষত্রের কেন্দ্রেই। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের সব তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রমাণ পাওয়া গেল, হিলিয়াম আসলে প্রচুর পরিমাণে বর্তমান। মৌলটি মহাবিশ্বের মোট পরমাণুর ভরের প্রায় ২৫ শতাংশ দখল করে আছে। আসলে মহাবিশ্বের চারদিকে সুষমভাবে বিন্যস্ত হয়ে আছে এরা (যেমনটি গ্যামো বিশ্বাস করতেন)।

এখন আমরা জানি, গ্যামো ও হয়েলের কাছে নিউক্লিওসিন্থেসিস সম্পর্কে টুকরো টুকরো সত্য ছিল। গ্যামো ভাবতেন, সব রাসায়নিক মৌল হলো মহাবিস্ফোরণের ছাই বা পরিণতি। কিন্তু তার নিজের তত্ত্ব ৫-কণা ও ৮-কণার ফাঁকের মধ্যে পতনের শিকার হয়েছিল। অন্যদিকে হয়েল মনে করতেন, নক্ষত্রের মধ্যে সব কটি মৌল রান্না হয়—এটা প্রমাণ করে তিনি মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব হটিয়ে দিতে পারবেন। তখন আর মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের কোনো প্রয়োজন হবে না। কিন্তু হিলিয়ামের প্রাচুর্য ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয় তাঁর তত্ত্ব। কারণ, এখন আমরা জানি, মহাবিশ্বে হিলিয়াম প্রচুর পরিমাণে বর্তমান।

তাই সংক্ষেপে বলা যায়, আমাদের নিউক্লিওসিন্থেসিসের পরিপূরক চিত্র উপহার দিয়েছেন গ্যামো ও হয়েল। খুবই হালকা মৌলগুলো থেকে পারমাণবিক ভর ৫ ও ৮ পর্যন্ত আসলে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল। ঠিক এমনটাই বিশ্বাস করতেন গ্যামো। বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলাফলের কারণে আমরা জানি, প্রকৃতিতে দেখতে পাওয়া বেশির ভাগ ডিউটেরিয়াম, হিলিয়াম-৩, হিলিয়াম-৪ ও লিথিয়াম-৭ তৈরি হয়েছিল মহাবিস্ফোরণের সময়। কিন্তু এরপর থেকে লোহা পর্যন্ত ভারী মৌলগুলো তৈরি হয়েছিল নক্ষত্রের রান্নাঘরে, যেমনটি বিশ্বাস করতেন হয়েল। আমরা যদি লোহার পরের মৌলগুলো যোগ করি (যেমন তামা, দস্তা ও সোনা), তাহলে সেগুলো সুপারনোভা বিস্ফোরণের অতি উত্তপ্ত তাপে তৈরি হয়েছিল। এরপর মহাবিশ্বের মৌলগুলোর আপেক্ষিক পর্যাপ্ততা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার মতো একটা সম্পূর্ণ চিত্র আমাদের হাতে আসে। (বর্তমান যুগে কসমোলজির যেকোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্বকে ভয়ানক কিছু কাজ করতে হবে : মহাবিশ্বে শতাধিক মৌলের আপেক্ষিক প্রাচুর্য ও তাদের বিপুলসংখ্যক আইসোটোপের ব্যাখ্যা করতে হবে।)

নক্ষত্রের জন্ম হয় কীভাবে

নিউক্লিওসিন্থেসিস নিয়ে এই প্রচণ্ড বিতর্কের একটা উপজাত হলো, এখান থেকেই নক্ষত্রের জীবনচক্রের সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া গেল। আমাদের সূর্যের মতো সাধারণ একটা নক্ষত্র জীবন শুরু করে বিস্তৃত হাইড্রোজেন গ্যাসের বিশাল একটা বল হিসেবে। একে বলা হয় প্রোটোস্টার বা আদি নক্ষত্র। এই আদি নক্ষত্র মহাকর্ষের প্রভাবে ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে। এটি ভেঙে বা চুপসে যেতে যেতে দ্রুতগতিতে ঘুরতে শুরু করে (এতে প্রায়ই ডাবল স্টার সিস্টেম গড়ার দিকে নিয়ে যায়। সেখানে দুটো নক্ষত্র পরস্পরকে উপবৃত্তাকার পথে প্রদক্ষিণ করে। আবার নক্ষত্রটির ঘূর্ণন সমতলে এভাবে গড়ে উঠতে পারে গ্রহসমূহ।) নক্ষত্রটির কেন্দ্র একই সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, যতক্ষণ না সেটা ১০ মিলিয়ন ডিগ্রি বা তারও বেশি তাপমাত্রায় পৌঁছায়। তখন ফিউশন বিক্রিয়ায় শুরু হয় হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরির প্রক্রিয়া।

নক্ষত্র জ্বলে ওঠার পর একে বলা হয় মেইন সিকোয়েন্স স্টার। এটা প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর ধরে জ্বলতে পারে। এ সময়ে এর কেন্দ্রের হাইড্রোজেন ধীরে ধীরে হিলিয়াম হিসেবে অপচয় হতে থাকে। বর্তমানে এই প্রক্রিয়ার মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে আমাদের সূর্য। হাইড্রোজেন জ্বালানি পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়ার পর, নক্ষত্র তার হিলিয়াম পোড়াতে শুরু করে। এ সময় আমাদের নক্ষত্রটি বিপুল বেগে প্রসারিত হতে থাকবে। তার আকার বড় হয়ে চলে যাবে মঙ্গলের কক্ষপথ পর্যন্ত। এতে একটা রেড জায়ান্ট বা লোহিত দানবে পরিণত হবে সূর্য। একসময় এর কেন্দ্রের হিলিয়াম জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে, নক্ষত্রটির বাইরের স্তরটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেখানে শুধু পড়ে থাকে নক্ষত্রটির কেন্দ্র। একে বলা হয় হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেতবামন। আমাদের সূর্যের মতো ছোট নক্ষত্রগুলো নিউক্লিয়ার জ্বালানির অভাবে শ্বেতবামন নক্ষত্র হিসেবে মহাকাশে মৃত্যুবরণ করবে।

কিন্তু আমাদের সূর্যের চেয়ে ১০ থেকে ৪০ গুণ বেশি ভরের নক্ষত্রগুলোর ফিউশন প্রক্রিয়া আরও বেশ তাড়াতাড়ি ঘটে। এসব নক্ষত্র যখন রেড সুপারজায়ান্ট বা লোহিত অতিদানবে পরিণত হবে, তখন তার কেন্দ্র দ্রুতবেগে হালকা মৌলগুলোকে ফিউজ করবে। ফলে তা আচরণ করবে হাইব্রিড নক্ষত্রের মতো। অর্থাৎ একটা রেড জায়ান্টের ভেতরটা হবে একটা শ্বেতবামন নক্ষত্রের মতো। এই শ্বেতবামন নক্ষত্রে তৈরি হতে থাকবে পর্যায় সারণির হালকা মৌল থেকে লোহা পর্যন্ত মৌলগুলো। ফিউশন প্রক্রিয়ায় লোহা তৈরির পর্যায়ে এসে পৌছালে, ফিউশন প্রক্রিয়া থেকে আর কোনো শক্তি তৈরি হবে না। কাজেই কোটি কোটি বছর পর অবশেষে বন্ধ হয়ে যাবে নিউক্লিয়ার চুল্লি। এই পর্যায়ে নক্ষত্রটি হঠাৎ করে সংকুচিত হতে থাকবে এবং তাতে সৃষ্টি হবে এক বিপুল চাপ। ইলেকট্রনগুলোকে তাদের পরমাণুর নিউক্লিয়াসের দিকে আসলে ঠেলতে থাকবে এই চাপ। (এর ঘনত্ব পানির চেয়ে ৪০০ বিলিয়ন গুণ বেশি হতে পারে। ফলে তার তাপমাত্রা ঠেকবে কয়েক ট্রিলিয়ন ডিগ্রিতে। এই ক্ষুদ্র বস্তুর ভেতরে সংকুচিত মহাকর্ষীয় শক্তি বাইরের দিকে একটা সুপারনোভা বিস্ফোরিত হবে। এই প্রক্রিয়ার প্রচণ্ড তাপের কারণে আরেকবার ফিউশন শুরু হবে। এরপর তৈরি হতে থাকবে পর্যায় সারণিতে লোহার পরের মৌলগুলো।

যেমন অরিয়ন বা কালপুরুষমণ্ডলের সহজে দৃশ্যমান লোহিত অতিদানব বিটলজুস বা আর্দ্রা অস্থিতিশীল। এটা যেকোনো সময় সুপারনোভা বা অতিনবতারা হিসেবে বিস্ফোরিত হতে পারে। ফলে তার চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে বিপুল পরিমাণ গামা রশ্মি ও এক্স-রশ্মি। এ ঘটনা ঘটার সময় এই সুপারনোভাকে দেখা যাবে দিনের বেলায়ও। আবার রাতের বেলা চাঁদের আলোকেও ম্লান করে দিতে পারবে। (একসময় ভাবা হতো, সুপারনোভা থেকে বেরিয়ে আসা বিপুল পরিমাণ শক্তিই ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরদের বিলুপ্তির কারণ। প্রায় ১০ আলোকবর্ষ দূরের কোনো সুপারনোভা বিস্ফোরণও গোটা পৃথিবীর প্রাণ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সৌভাগ্যক্রমে দানবীয় নক্ষত্র স্পাইকা ও বিটলজুস আমাদের কাছ থেকে যথাক্রমে ২৬০ ও ৪৩০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। ভবিষ্যতে তারা বিস্ফোরিত হলে পৃথিবীর বড় ধরনের ক্ষতি থেকে বেশ দূরেই বলতে হবে। তবে কিছু বিজ্ঞানীর বিশ্বাস, ২ মিলিয়ন বছর আগে ১২০ আলোকবর্ষ দূরের একটা নক্ষত্রের সুপারনোভা বিস্ফোরণে সাগরের জীবজন্তুর ছোট আকারের বিলুপ্তি ঘটেছিল।)

এর মানে হচ্ছে, আমাদের সূর্য এই পৃথিবীর সত্যিকারের জন্মদাতা নয়। অবশ্য পৃথিবীর অনেক মানুষ সূর্যকে দেবতা হিসেবে মান্য করে। সূর্যই পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে বলে তাদের বিশ্বাস। কিন্তু এটা আংশিক সত্য। অবশ্য পৃথিবী আসলে সূর্য থেকেই জন্ম নিলেও (ধ্বংসাবশেষ ও ধূলিকণার উপবৃত্তাকার সমতলের অংশ হিসেবে এটি ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে সূর্যের চারপাশে ঘুরত), আমাদের সূর্য হাইড্রোজেন ফিউজ করে হিলিয়াম তৈরি করার জন্য নামমাত্র উত্তপ্ত। অর্থাৎ পৃথিবীর সত্যিকারের জন্মদাতা সূর্য আসলে কোনো অনামা, অজ্ঞাত কোনো নক্ষত্র কিংবা অনেকগুলো নক্ষত্র, যারা কোটি কোটি বছর আগেই সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হয়ে মারা গেছে। সেটাই এরপর পার্শ্ববর্তী কোনো নেবুলা বা নীহারিকায় লোহাসহ তার পরের উচ্চতর মৌলের বীজ বুনে দিয়েছিল। সেখান থেকে গড়ে উঠেছে আমাদের শরীর। আক্ষরিকভাবে, আমাদের দেহ কোটি কোটি বছর আগের মৃত নক্ষত্রের ধূলিকণা দিয়ে তৈরি।

সুপারনোভা বিস্ফোরণের পরিণতিতে, সেখানে অতিক্ষুদ্র ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকে, যাকে বলা হয় নিউট্রন স্টার। কঠিন নিউক্লিয়ার পদার্থ দিয়ে তৈরি এই বস্তুগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটান শহর বা প্রায় ২০ মাইল মতো আকারে সংকুচিত হয়। (নিউট্রন স্টারের প্রথম অনুমান করেন, সুইস জ্যোতির্বিদ ফ্রিজ জুইকি—১৯৩৩ সালে। কিন্তু এই বস্তুগুলো এতই আজগুবি বলে মনে হয়েছিল যে কয়েক দশক একে একেবারেই পাত্তাই দেননি বিজ্ঞানীরা। ) নিউট্রন স্টার অনিয়মিতভাবে বিকিরণ নিঃসরণ করে এবং দ্রুতবেগে ঘোরে। তাই এর সঙ্গে ঘূর্ণনশীল বাতিঘরের মিল দেখা যায়। ঘুরতে ঘুরতে চারদিকে বিকিরণ ছড়িয়ে দেয় নিউট্রন স্টার। পৃথিবী থেকে দেখলে নিউট্রন স্টারকে কেঁপে কেঁপে স্পন্দিত হচ্ছে (পালসেট) বলে মনে হয়। তাই একে ডাকা হয় পালসার নামে।

অতি বৃহৎ নক্ষত্র, হয়তো সূর্যের ভরের চেয়ে ৪০ গুণ বেশি ভরের নক্ষত্র, যখন ক্রমান্বয়ে সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটায়, তখন পেছনে একটা নিউট্রন স্টার রেখে যেতে পারে। তার ভর হতে পারে সূর্যের ভরের তিন গুণ। এই নিউট্রন স্টারের মহাকর্ষ এতই প্রবল হয় যে তা নিউট্রনদের বিকর্ষণ বলের বিপরীতে কাজ করে। তখন নক্ষত্রটি চূড়ান্ত সংকোচনের দিকে যায়। এরপর পরিণত হয় মহাবিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তুতে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরে। এ বিষয়ে আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে আলোচনা করব।

পাখির বিষ্ঠা ও মহাবিস্ফোরণ

হয়েলের স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেন আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন। সেটা ১৯৬৫ সালের কথা। তখন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির বেল ল্যাবরেটরিতে ২০ ফুট হল্মডেল হর্ন রেডিও টেলিস্কোপ নিয়ে কাজ করছিলেন এই দুই বিজ্ঞানী। এভাবে মহাকাশ থেকে আসা রেডিও সিগন্যাল খুঁজে দেখছিলেন তাঁরা। কিন্তু অপ্রত্যাশিত, অবাঞ্ছিত কিছু স্ট্যাটিক নয়েজ পাওয়া যাচ্ছিল। দুই বিজ্ঞানী ভাবলেন, গোলমালটা হয়তো কোনো বিচ্যুতির কারণেও হতে পারে। কারণ, সিগন্যালটা কোনো একক নক্ষত্ৰ বা ছায়াপথ থেকে আসছিল না, বরং তা সুষমভাবে সব দিক থেকে আসছিল বলে মনে হচ্ছিল। গোলমালটা কোনো ধরনের ময়লা বা আবর্জনা থেকেও আসতে পারে ভেবে রেডিও টেলিস্কোপটির বাইরের অংশ বেশ সতর্কভাবে পরিষ্কার করলেন দুই বিজ্ঞানী। পেনজিয়াস এই ময়লাকে ‘হোয়াইট কোটিং অব ডাইলেট্রিক ম্যাটেরিয়াল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন (সাধারণত এটা পাখির বিষ্ঠা হিসেবে পরিচিত)। কিন্তু দেখা গেল, এত কিছুর পরও এবার গোলমালটা আরও বেড়ে গেছে। তাঁরা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি, দুর্ঘটনাক্রমে মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের ওপর হুমড়ি খেয়েছেন। ১৯৪৮ সালে ঠিক এই পটভূমি বিকিরণের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন গ্যামোর দল।

এখন মহাজাগতিক ইতিহাসকে কিছুটা মূল নীতিমালার ওপর প্রতিষ্ঠিত এক তত্ত্ব হিসেবে পড়া যায়। কিন্তু সে সময় তিনটি দল একটা উত্তরের খোঁজে অন্ধের মতো হাতড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কেউ কারও কথা জানত না। অন্যদিকে সেই ১৯৪৮ সালে মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের পেছনের তত্ত্বটি প্রকাশ করেছিলেন গ্যামো, আলফার আর হারমান। তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণীটা ছিল, মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশনের তাপমাত্রা পরম শূন্য তাপমাত্রার ওপরে ৫ ডিগ্রির মতো হবে। তবে মহাকাশের ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন মাপার চেষ্টায় অনেক আগেই ইস্তফা দেন এই তিন বিজ্ঞানী। কারণ, তখনকার যন্ত্রপাতি এটা শনাক্ত করার মতো যথেষ্ট সূক্ষ্ম ও সংবেদী ছিল না। পেনজিয়াস আর উইলসন এই কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের দেখা পান ১৯৬৫ সালে। কিন্তু তার মমার্থ যে আসলে কী, তা জানতেন না তাঁরা দুজন। এদিকে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে রবার্ট ডিকের নেতৃত্বে তৃতীয় আরেক দল স্বাধীনভাবে গ্যামো আর তাঁর সহকর্মীদের তত্ত্বটি পুনরাবিষ্কার করেন। তারপর সক্রিয়ভাবে তন্নতন্ন করে ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের খোঁজ করতে থাকেন। কিন্তু এই পটভূমি বিকিরণ খুঁজে পাওয়ার জন্য রবার্ট ডিকের দলের যন্ত্রপাতিগুলো ছিল শোচনীয়ভাবে আদিম মানের।

অবশেষে এই কৌতুককর ঘটনার ইতি ঘটে, দুই পক্ষের কমন বন্ধু জ্যোতির্বিদ বার্নাড ব্রুকের কারণে। রবার্ট ডিকের কাজ সম্পর্কে পেনজিয়াসকে জানান তিনি। দুই দল শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ করল। তখন পেনজিয়াস আর উইলসনের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, তারা নিজেদের অজান্তে আসলে মহাবিস্ফোরণের সংকেত শনাক্ত করে ফেলেছেন। এই অবিস্মরণীয় আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৮ সালে নোবেল পুরস্কার পান পেনজিয়াস ও উইলসন।

এ ঘটনা ঘটার আগে, বিপরীত দুটি তত্ত্বের সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান দুই প্রতিপক্ষ হয়েল ও গ্যামো, ১৯৫৬ সালে একটা ক্যাডিলাকের ভেতর বসে গুরুত্বপূর্ণ এক লড়াইয়ে মেতে উঠেছিলেন। সেটাই কসমোলজির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারত। ‘আমার মনে আছে, আমাকে একটা সাদা ক্যাডিলাকে চড়িয়ে জর্জ চারদিকে ঘোরাচ্ছিল।’ হোয়েল স্মৃতিচারণা করে বলেছেন। গ্যামো তাঁর নিজের বিশ্বাসটা আবারও হয়েলের কাছে খুলে বলেন। অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের পর বেঁচে যাওয়া বিকিরণ এখনো দেখতে পাওয়ার কথা। তবে গ্যামোর সর্বশেষ হিসাব-নিকাশে এই বিকিরণের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রির মতো হওয়ার কথা। এরপর গ্যামোর কাছে বিস্ময়কর এক তথ্য ফাঁস করেন হয়েল। ১৯৪১ সালে অ্যান্ড্রু ম্যাককেলারের লেখা একটা অপরিচিত গবেষণাপত্রের কথা জানতেন হয়েল। সেখানে দেখানো হয়েছিল, মহাকাশে এই বিকিরণের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রির বেশি হতে পারে না। আরও বেশি তাপমাত্রায় নতুন ধরনের বিক্রিয়া ঘটতে পারে, তাতে মহাকাশে উত্তেজিত কার্বন-হাইড্রোজেন (CH) এবং কার্বন-নাইট্রোজেনমুক্ত (CN) মূলক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই রাসায়নিকগুলোর বর্ণালি মেপে, তখন মহাকাশের তাপমাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব। আসলে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, মহাকাশে তাঁর শনাক্ত করা CN অণুর ঘনত্ব ইঙ্গিত করে যে এই তাপমাত্রা প্রায় ২.৩ কেলভিন। অন্য কথায়, গ্যামোর কাছে অজানা হলেও এই ২.৭ কেলভিন ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন সেই ১৯৪১ সালেই পরোক্ষভাবে মাপা হয়েছিল।

হয়েল স্মৃতিচারণা করেন, ‘ক্যাডিলাকটা খুব আরামদায়ক হওয়ার কারণে হোক, কিংবা জর্জ এ তাপমাত্রা ৩ কেলভিনের ওপর চাইত আর আমার চাওয়া তাপমাত্রাটি শূন্য ডিগ্রির কারণেই হোক—আমরা তা শনাক্ত করার সুযোগ হারাই। ৯ বছর পর আবিষ্কারটা ঝুলিতে পোরেন আর্নো পেনজিয়াস আর বব উইলসন।’ গ্যামোর দল যদি সংখ্যাগত ভুল না করে আগের হিসাবমতো নিম্ন তাপমাত্রাতে বহাল থাকত, কিংবা হয়েল যদি মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে এত যুদ্ধংদেহী না হতেন, তাহলে কে জানে, ইতিহাস লেখা হতো অন্য কোনোভাবে।

মহাবিস্ফোরণের ব্যক্তিগত শোক

পেনজিয়াস ও উইলসনের মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন আবিষ্কারের কারণে নিঃসন্দেহে একটা প্রভাব ফেলে গ্যামো আর হয়েলের ক্যারিয়ারে। হয়েলের জন্য পেনজিয়াস আর উইলসনের কাজটি ছিল মৃত্যুর মতো এক অভিজ্ঞতা। অবশেষে ১৯৬৫ সালে নেচার ম্যাগাজিনে আনুষ্ঠানিকভাবে হার স্বীকার করে নেন হয়েল। তিনি উল্লেখ করেন, মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন এবং হিলিয়ামের প্রাচুর্যের কারণে তাঁর স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্ব পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাঁকে যে জিনিসটা সবচেয়ে বিব্রত করেছিল, তা ছিল স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা। ‘ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হতো যে মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বকে হত্যা করেছে। কিন্তু এ তত্ত্বটিকে আসলে হত্যা করেছে মনস্তত্ত্ব।…এখানে মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড এক গুরুত্বপূর্ণ পরিঘটনা ছিল, যা ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়নি…বেশ কয়েক বছর ধরে, এটা আমার দর্প চূর্ণ করে দিয়েছে।’ (পরে নিজেকে আগাগোড়া বদলে ফেলেন হয়েল। মহাবিশ্বের স্থিতিশীল তত্ত্ব নতুন করে ঝালাই করারও চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিটি রূপই আগের চেয়ে কম যুক্তিসংগত হয়েছিল।)

এদিকে দুর্ভাগ্যক্রমে, অগ্রগণ্যতার প্রশ্নে গ্যামোর মধ্যে বিস্বাদ ছড়িয়ে পড়ে। গ্যামো যদি মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেন, তাহলে তাঁর এবং আলফার ও হারমানের কাজের কথা পরে তেমন উল্লেখ করা হয়নি। এ ব্যাপারটা গ্যামোকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি গ্যামোকে। সদা বিনয়ী থেকে তিনি এই অনুভূতি প্রকাশ্যে প্রকাশ করতে বিরত থাকেন। কিন্তু একটা ব্যক্তিগত চিঠিতে তিনি লিখেছেন, পদার্থবিদ আর ইতিহাসবিদেরা তাদের কাজকে পুরোপুরি অবহেলা করেছে, সেটা অন্যায্য।

অবশ্য পেনজিয়াস ও উইলসনের কাজ স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বের জন্য অনেক বড় আঘাত ছিল। মহাবিস্ফোরণকে নিশ্চিতভাবে পরীক্ষামূলক ভিত্তি দিতে সহায়তা করেছিল এটাই। তবু প্রসারণশীল মহাবিশ্বের কাঠামো বুঝতে তখনো অনেক কিছু বাকি ছিল। যেমন ফ্রিডম্যানের মহাবিশ্বে এর বিবর্তন বোঝার জন্য ওমেগার মান, অর্থাৎ মহাবিশ্বের পদার্থের গড় ঘনত্ব জানতেই হতো। তবে একসময় জানা গেল, মহাবিশ্বের বেশির ভাগ অংশ আমাদের পরিচিত পরমাণু বা অণু নয়, বরং অদ্ভুত কিছু পদার্থ, যাকে বলা হয় ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু। এতে ওমেগার মান নির্ধারণ করা বেশ সমস্যাসংকুল হয়ে উঠল। এই গুপ্তবস্তু সাধারণ পদার্থকে কমিয়ে দিল ১০ শতাংশ। আবারও বলতে হয়, এই ক্ষেত্রের নেতাদের জ্যোতির্বিদ্যার বাকি অন্যান্য কমিউনিটিতে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি।

ওমেগা ও গুপ্তবস্তু

ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু কাহিনি কসমোলজির ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে অদ্ভুত এক অধ্যায়। সেই ১৯৩০-এর দশকে ক্যালটেকের খামখেয়ালি সুইস জ্যোতির্বিদ ফ্রিজ জুইকি দেখতে পান, কোমা ক্লাস্টারের ছায়াপথগুলো নিউটোনিয়ান মহাকর্ষ অনুযায়ী সঠিকভাবে চলাচল করছে না। তাঁর মনে, এসব গ্যালাক্সি এত জোরে ঘুরছে যে নিয়ম অনুযায়ী তাদের ছিটকে বাইরে চলে যাওয়া উচিত। আবার নিউটনের গতির সূত্র অনুসারে ক্লাস্টারটা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা। তিনি ভাবলেন, একটামাত্র উপায়েই কোমা ক্লাস্টারের ছিটকে যাওয়া রোধ করা সম্ভব। টেলিস্কোপে সেখানে যে পরিমাণ বস্তু দেখা যাচ্ছে, তার চেয়ে যদি কয়েক শ গুণ বেশি বস্তু থাকে, তাহলেই কেবল তারা ওভাবে একসঙ্গে থেকে যেতে পারে। সব দেখে মনে হলো, সেখানে হয়তো মহাজাগতিক দূরত্বে নিউটনের সূত্র কাজ করছে না, নয়তো সেখানে বিপুল পরিমাণ কোনো অদৃশ্য বস্তু আছে, সেগুলোই কোমা ক্লাস্টারকে একত্রে ধরে রেখেছে।

মহাবিশ্বে পদার্থের বণ্টনের ক্ষেত্রে ভয়াবহভাবে কিছু একটা ঠিক নেই—ইতিহাসে সেই ছিল প্রথম ইঙ্গিত। তবে দুর্ভাগ্য বলতে হবে, জুইকির এই পথপ্রদর্শকমূলক কাজটি প্রত্যাখ্যান বা তাচ্ছিল্য করেন সেকালের জ্যোতির্বিদেরা। অবশ্য তার পেছনে কিছু কারণও ছিল।

প্রথমত, জ্যোতির্বিদেরা কোনোভাবে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র ভুল হতে পারে। কারণ, কয়েক শতাব্দী ধরে পদার্থবিজ্ঞানে আধিপত্য ধরে রেখেছে মহাকর্ষ সূত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানে এ ধরনের সংকটের নজির এর আগেও দেখা গিয়েছিল। যেমন উনিশ শতকে ইউরেনাসের কক্ষপথ বিশ্লেষণ করার সময়, কিছু বিচ্যুতি পাওয়া গেল। আইজ্যাক নিউটনের সমীকরণ থেকে অতি সামান্য বিচ্যুতি ছিল সেটা। কাজেই অনেকে ভাবলেন, হয় নিউটন ভুল অথবা সৌরজগতে এমন কোনো গ্রহ আছে, যা আমাদের কাছে অজানা। এই অজানা গ্রহের মহাকৰ্ষই ইউরেনাসকে সবলে টানছে। পরে দ্বিতীয় অনুমানটাই সঠিক বলে প্রমাণিত হলো। ১৮৪৬ সালে প্রথম প্রচেষ্টাতেই নেপচুন নামের নতুন একটি গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেল। নিউটনের সূত্র ব্যবহার করে অনুমান করা জায়গাতেই ঠিক ঠিক খুঁজে পাওয়া গেল নতুন গ্রহটিকে।

দ্বিতীয়ত, সেকালে জুইকির ব্যক্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। জ্যোতির্বিদেরা আউটসাইডার বা বহিরাগত হিসেবে গণ্য করত তাঁকে। জুইকি বেশ কল্পনাপ্রবণ ছিলেন। কিন্তু এ কারণে জীবনে প্রায়ই হাস্যকর কিংবা তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৩৩ সালে ওয়াল্টার বাড়ের সঙ্গে সুপারনোভা নামটি উদ্ভাবন করেন তিনি। আবার সঠিকভাবে প্রায় ১৪ মাইল ব্যাসের একটা ক্ষুদ্র নিউট্রন স্টারের কথাও অনুমান করেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, সেটা সম্ভবত কোনো বিস্ফোরিত নক্ষত্রের চূড়ান্ত ধ্বংসাবশেষ। তাঁর এ ধারণাটি সেকালে সবার কাছে এতই অদ্ভুত মনে হয়েছিল যে ১৯৩৪ সালের ১৯ জানুয়ারি লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস তীব্র ব্যঙ্গ করে এক কার্টুন ছেপে বসে।

একটা ছোট ও অভিজাত জ্যোতির্বিদ দলের প্রতিও ক্ষিপ্ত ছিলেন জুইকি। তাঁর ধারণা ছিল, এই দলটিই তাঁকে স্বীকৃতি দিতে দিচ্ছে না, উল্টো তাঁর আইডিয়া চুরি করে যাচ্ছে। আবার ১০০ ও ২০০ ইঞ্চি টেলিস্কোপও ব্যবহার করতে দিচ্ছেন না তাঁরাই। (১৯৭৪ সালে মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে গ্যালাক্সির একটা তালিকা প্রকাশ করেন জুইকি। তালিকার শুরুর শিরোনাম ছিল ‘মার্কিন জ্যোতির্বিদ্যার সর্বোচ্চ পুরোহিতগণ এবং তাঁদের মোসাহেবদের জন্য স্মৃতিচিহ্ন’। এ রচনায় ক্লাবসর্বস্ব, বিকৃত অভিজাত জ্যোতির্বিদদের সমালোচনার বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছেন জুইকি। এই জ্যোতির্বিদদের মধ্যে তাঁর মতো খামখেয়ালিদের বাদ দেওয়ার প্রবণতা আছে। ‘বিশেষ করে মার্কিন জ্যোতির্বিদ্যায় আজকের মোসাহেব ও অকপট চোরদের বহিরাগত আর প্রগতিবাদীদের আবিষ্কার ও উদ্ভাবন আত্মসাৎ করার ব্যাপারে স্বাধীন বলে মনে হয়।’ তিনি লিখেছেন। তিনি এসব ব্যক্তিকে ‘স্পেরিকেল বাস্টার্ড’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, ‘যেদিক থেকেই দেখা হোক না কেন, তারা আগাগোড়া বেজন্মাই থাকে।’ নিউট্রন স্টার আবিষ্কারের জন্য যখন তাকে উপেক্ষা করে আরেকজনের হাতে নোবেল পুরস্কার তুলে দেওয়া হলো তখন স্বভাবত ক্রুদ্ধ হন তিনি।)

১৯৬২ সালে মহাজাগতিক গতিসংক্রান্ত এই কৌতূহলজনক সমস্যাটি পুনরাবিষ্কার করেন জ্যোতির্বিদ ভেরা রুবিন। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ঘূর্ণন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি একই সমস্যা খুঁজে পান। আগের মতোই জ্যোতির্বিদ সমাজ থেকে প্রত্যাখ্যাত হন তিনি। সাধারণত সূর্য থেকে কোনো নক্ষত্র যত দূরে থাকে, সেটি চলাচল করে ততই ধীরগতিতে। সূর্যের যত কাছে হয়, তার চলার গতিও তত বেশি। এ কারণে বুধ গ্রহের নাম দেওয়া হয়েছিল গতির দেবতার নামে। কারণ, গ্রহটা সূর্যের খুব কাছে। অন্যদিকে প্লুটোর গতি বুধের চেয়ে ১০ ভাগ ধীর হওয়ার কারণ হলো, সেটা সূর্য থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তবে ভেরা রুবিন আমাদের ছায়াপথের নীল নক্ষত্রগুলো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখতে পান, নক্ষত্রগুলো ছায়াপথের চারপাশে একই গতিতে ঘুরছে। ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে তাদের দূরত্ব তাদের গতির ওপর কোনো প্রভাব ফেলছে না (একে বলা হয় ফ্ল্যাট রোটেশন কার্ভ)। ফলে নিউটোনিয়ান গতিবিদ্যার বিধি লঙ্ঘিত হয়। আসলে তিনি দেখতে পান, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এতই জোরে ঘুরছে যে এর ছিটকে যাওয়া উচিত। কিন্তু ছায়াপথটি প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর ধরে বেশ স্থিতিশীল থাকতে দেখা যাচ্ছে। কাজেই এই রোটেশন কার্ভ ফ্ল্যাট কেন—সেটা একটা রহস্যই বটে। ছায়াপথটিকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে বাঁচাতে হলে বিজ্ঞানীরা যতটুকু কল্পনা করেছেন, একে তার চেয়েও অন্তত ১০ গুণ বেশি ভারী হতে হবে। তাই দেখা যাচ্ছে, মিল্কিওয়ে ছায়াপথের ৯০ শতাংশ ভর অনুপস্থিত বা কোনো অদৃশ্য রূপে রয়েছে।

ভেরা রুবিনকে উপেক্ষার আংশিক কারণ হলো তিনি নারী। বেশ বেদনার সঙ্গে তিনি স্মরণ করেছেন, তিনি সোথমোর কলেজে সায়েন্স নিয়ে পড়ার আবেদন করলেন। কথাচ্ছলে অ্যাডমিশন অফিসারকে বলেছিলেন, তিনি ছবি আঁকতে পছন্দ করেন। তখন প্রশ্নকর্তা বললেন, ‘তুমি কি মহাকাশের বস্তুগুলোর ছবি আঁকাবিষয়ক কোনো ক্যারিয়ার বেছে নেওয়ার কথা ভেবেছ নাকি?’ স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেছেন, ‘এটাই আমাদের পরিবারে অনেক দিন ট্যাগ লাইনের মতো ঝুলে ছিল। অনেক বছর যখনই কারও কিছু ভুল হতো, আমরা বলতাম, ‘তুমি কি মহাকাশের বস্তুগুলোর ছবি আঁকাবিষয়ক কোনো ক্যারিয়ারের কথা ভেবেছ নাকি?’ তাঁর হাইস্কুলের শিক্ষককে একবার তিনি বললেন, তিনি ভাসার কলেজে চান্স পেয়েছেন। শিক্ষক জবাব দিলেন, ‘যত দিন তুমি বিজ্ঞান থেকে দূরে থাকতে পারবে, তত দিন ভালো কিছু করতে পারবে।’ তিনি লিখেছেন, ‘এ ধরনের কথা শুনেও ভেঙে গুঁড়িয়ে না যাওয়ার জন্য প্রচণ্ড আত্মসম্মান লাগে।

গ্র্যাজুয়েট শেষে তিনি হার্ভার্ডে আবেদন করলে শেষ পর্যন্ত তা গৃহীত হয়। তারপরও সেখানে ভর্তি হতে পারেননি। কারণ, বিয়ে করে রসায়নবিদ স্বামীর সঙ্গে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। (পরে তিনি হাতে লেখা এক চিঠি পান। চিঠির ওপর লেখা ছিল, ‘তোমাকে ধিক্কার জানাই নারী। প্রতিবার যখনই ভালো একজনকে পাই, সে-ই চলে যায়, আর বিয়ে করে ফেলে।’) সম্প্রতি জাপানে এক জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী। ‘না কেঁদে এই কাহিনিটা দীর্ঘদিন বলতে পারিনি আমি। নিঃসন্দেহে একটা প্রজন্মের কারণে…এখনো পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।’ সেখানে তিনি স্বীকার করেছেন।

তারপরও তাঁর সতর্কমূলক গবেষণা এবং অন্যদের গবেষণার নির্ভেজাল গুরুত্বের কারণে, ধীরে ধীরে জ্যোতির্বিদ সম্প্রদায় অদৃশ্য এই ভর সমস্যার ব্যাপারটি বুঝতে শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে ১১টি সর্পিল ছায়াপথ পরীক্ষা করেন রুবিন ও তাঁর সহকর্মীরা। এদের প্রতিটি এতই জোরে ঘুরছিল যে নিউটনের সূত্র অনুযায়ী তাদের কোনোভাবে একত্রে থাকার কথা নয়। একই বছর ডাচ রেডিও জ্যোতির্বিদ আলবার্ট বসমা আরও ডজনখানেক সর্পিল ছায়াপথের পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ প্রকাশ করেন। তাদের মধ্যেও একই ধরনের ধর্ম লক্ষ করা গিয়েছিল। এটাই অবশেষে জ্যোতির্বিদ সম্প্রদায়কে বোঝাতে সক্ষম হয় যে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব সত্যি সত্যিই আছে।

এই চরম সমস্যার এ রকম সহজতম সমাধানে ধারণা করা হয়, ছায়াপথগুলো কোনো অদৃশ্য বলয় ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর এই বলয়ে পদার্থের পরিমাণ ছায়াপথের সব নক্ষত্রের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। এই সময় থেকে এই অদৃশ্য বস্তুর উপস্থিতি মাপতে কিছু সূক্ষ্ম উপায়ও আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়টা হলো, অদৃশ্য বস্তুর ভেতর দিয়ে চলমান নক্ষত্রের আলোর বক্রতা পরিমাপ। অনেকটা আপনার চশমার লেন্সের মতোই ডার্ক ম্যাটার আলোকে বাঁকিয়ে দিতে পারে (এর বিপুল ভর ও তার কারণে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় টানের জন্য এমনটি ঘটে)। সম্প্রতি হাবল স্পেস টেলিস্কোপে তোলা ছবিগুলো কম্পিউটারে বেশ সতর্কভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে। এর মাধ্যমে মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটারের বণ্টনের একটা মানচিত্র তৈরি করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা।

ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু কী দিয়ে তৈরি—তা অনুসন্ধানে এখন সবাই ভীষণভাবে হামলে পড়েছে। কয়েকজন বিজ্ঞানীর ধারণা, এটা সাধারণ পদার্থ দিয়েও হয়তো তৈরি হতে পারে। কিন্তু এখানে ব্যতিক্রম ব্যাপারটা হলো, তা হয়তো খুব অস্পষ্ট (অর্থাৎ এরা বাদামি বামন নক্ষত্র, নিউট্রন স্টার, কৃষ্ণগহ্বর ও এ রকম আরও কিছু দিয়ে তৈরি হতে পারে, যারা প্রায় অদৃশ্য)। এসব বস্তু ব্যারিয়নিক পদার্থের মতো একত্রে পিণ্ডের মতো হয়ে থাকে। মানে হলো, এসব পদার্থ আমাদের পরিচিত ব্যারিয়ন কণা (যেমন নিউট্রন ও প্রোটন) দিয়ে তৈরি হতে পারে। এদের একত্রে বলা হয় ম্যাচো বা MACHO (ম্যাসিভ কমপ্যাক্ট হ্যালো অবজেক্ট)।

অন্য কয়েকজন বিজ্ঞানীদের ধারণা, ডার্ক ম্যাটার হয়তো নিউট্রিনোর মতো খুব উত্তপ্ত নন-ব্যারিয়নিক পদার্থ (এদের বলা হয় উত্তপ্ত গুপ্তবস্তু)। নিউট্রিনো এতই জোরে ছোটে যে তারা কোনোভাবে ডার্ক ম্যাটার আর প্রকৃতিতে দেখা ছায়াপথের সঙ্গে পিণ্ড তৈরি করতে পারে না। তবু অনেকে হাল ছেড়ে দিয়ে ভাবেন, ডার্ক ম্যাটার পুরোপুরি নতুন ধরনের কোনো পদাৰ্থ দিয়ে তৈরি, যাদের বলা হয় কোল্ড ডার্ক ম্যাটার বা WIMPS (উইকলি ইন্টারঅ্যাকটিং ম্যাসিভ পার্টিকেল)। ডার্ক ম্যাটার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এরাই এখন শীর্ষে রয়েছে।

কোব স্যাটেলাইট

গ্যালিলিওর পর থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানসংক্রান্ত গবেষণার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে টেলিস্কোপ। কিন্তু সাধারণ টেলিস্কোপ ব্যবহার করে ডার্ক ম্যাটারের রহস্য সম্ভবত সমাধান করা যাবে না। জ্যোতির্বিদ্যা অনেক দূর এগিয়ে গেছে মানসম্পন্ন ভূকেন্দ্রিক আলোকবিদ্যা ব্যবহারের কারণে। ১৯৯০-এর দশকে নতুন প্রজন্মের জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত কিছু যন্ত্রপাতি বিজ্ঞানীদের হাতে আসে। এর মধ্যে আছে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, লেজার ও কম্পিউটার। এগুলোর ব্যবহারে কসমোলজির চেহারা আমূল বদলে গেছে।

এসবের মধ্যে প্রথম ফলটি ছিল কোব (COBE বা কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড এক্সপ্লোরার) স্যাটেলাইট। এটি উৎক্ষেপণ করা হয় ১৯৮৯ সালে। পেনজিয়াস ও উইলসনের মৌলিক গবেষণাটি মহাবিস্ফোরণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিছু উপাত্ত বিন্দুতে নিশ্চিত করা গেছে। কিন্তু কোব স্যাটেলাইট এমন উপাত্ত বিন্দু মাপতে সক্ষম হয়েছে, যা ১৯৪৮ সালে গ্যামো আর তাঁর সহকর্মীদের অনুমান করা ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশনের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

১৯৯০ সালে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির এক সভায় দর্শক হিসেবে উপস্থিত ১৫০০ বিজ্ঞানী হঠাৎ এক উত্তেজনায় ফেটে পড়েন। কারণ, তাঁরা দেখতে পেলেন, কোব স্যাটেলাইটের ফলাফল একটা ভিউগ্রাফে বসানো হয়েছে, যা ২.৭২৮ কেলভিন তাপমাত্রার মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের সঙ্গে একেবারে মিলে গেছে। তখন প্রচণ্ড উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ফেটে পড়েন বিজ্ঞানীরা।

প্রিন্সটনের জ্যোতির্বিদ জেরেমি পি অস্ট্রাইকার মন্তব্য করেছেন, ‘পাথরে ফসিল খুঁজে পাওয়া গেলে, সেটা প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেয়। হ্যাঁ, কোবও (মহাবিশ্বের) ফসিল খুঁজে পেয়েছে।’

তবে কোব থেকে পাওয়া ভিউগ্রাফটি কিছুটা অস্পষ্ট। যেমন বিজ্ঞানীরা কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের হটস্পট বা ফ্ল্যাকচুয়েশন বিশ্লেষণ করতে চাচ্ছিলেন। গোটা মহাকাশে এই ফ্ল্যাকচুয়েশনের মান হওয়া উচিত ১ ডিগ্রি। কিন্তু কোব স্যাটেলাইটের যন্ত্রপাতি যে ফ্ল্যাকচুয়েশন মাপতে পেরেছে তার মান ৭ বা তারও বেশি ডিগ্রি। এই যন্ত্রপাতিগুলো আসলে এই ক্ষুদ্র হটস্পটগুলো শনাক্ত করার জন্য যথেষ্ট সংবেদনশীল নয়। তাই বিজ্ঞানীরা ডব্লিউএমএপি স্যাটেলাইটের ফলাফল পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, এই শতক শুরু হওয়ার পর সেটা উৎক্ষেপণ হয়েছে। এই স্যাটেলাইট এ-জাতীয় প্রশ্ন আর রহস্যগুলোর সমাধান দিতে পারবে বলে আশা করছেন তাঁরা

তথ্যনির্দেশ

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক : জার্মান বিজ্ঞানী। তাঁকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক বলা হয়। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ-সংক্রান্ত একটি সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে ১৯০০ সালে তিনি নতুন একটি তত্ত্বের জন্ম দেন। এটিই কোয়ান্টাম তত্ত্ব।

কৃষ্ণবস্তু : কোনো বস্তু যদি তার ওপর পড়া তাপের কোনো অংশ প্রতিফলিত বা সঞ্চালিত না করে সবটুকু শোষণ করে, তাহলে সেই বস্তুটিকে বলা হয় আদর্শ কৃষ্ণবস্তু। ইংরেজিতে একে বলা হয় ব্ল্যাকবডি। ১৮৬০ সালে গুস্তাফ কার্শফ এ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। আদর্শ কৃষ্ণবস্তুকে উত্তপ্ত করা হলে তা সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ নিঃসরণ করে। কিন্তু বাস্তবে আদর্শ কৃষ্ণবস্তু পাওয়া যায় না। সূর্যও একটা কৃষ্ণবস্তু। কারণ, সূর্যও তার ওপর আপতিত সব বিকিরণ শোষণ করে। মহাবিশ্বে পরিপূর্ণ মহাবিস্ফোরণের প্রমাণসূচক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা পটভূমি বিকিরণ ও কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের সমীকরণ মেনে চলে।

কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বণ্টন ব্যাখ্যা করতে গিয়েই ১৯০০ সালে আকস্মিকভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্ম দিয়েছিলেন জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক।

আর্দ্রা : কালপুরুষমণ্ডলের উজ্জ্বলতম তারা বিটলজুস বা আর্দ্রার অপর নাম আলফা অরায়নিস। আরবি নাম বাত-আল-জাওজা থেকে বিটলজুস নামের উৎপত্তি

আইসোটোপ : একই মৌলিক পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু, যাদের পারমাণবিক সংখ্যা বা প্রোটনসংখ্যা একই, কিন্তু নিউট্রনসংখ্যা ভিন্ন, তাদের বলে আইসোটোপ বা সমস্থানিক। যেমন হাইড্রোজেনের আইসোটোপ তিনটি। সাধারণ হাইড্রোজেন বা প্রোটিয়াম, ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম। প্রোটিয়ামের নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটন থাকে, ডিউটেরিয়ামে একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন এবং ট্রিটিয়ামে একটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন থাকে।

নিউট্রন তারা : শীতল নক্ষত্র, যা একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর কিছু সময় অবশিষ্ট থাকে। একটি নক্ষত্রের কেন্দ্রে প্রধান পদার্থগুলো চুপসে ঘন ভরের নিউট্রনে পরিণত হলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়।

ডার্ক ম্যাটার : মহাবিশ্বের অদৃশ্য ও রহস্যময় একটি পদার্থ। বাংলায় একে গুপ্তবস্তু বা তমঃপদার্থও বলা হয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব মাত্র ৪ শতাংশ। আর মহাবিশ্বের বাকি ২৭ শতাংশ এই ডার্ক ম্যাটার দিয়ে গঠিত। এই পদার্থ দেখা না গেলেও এর প্রবল মহাকর্ষ বলের পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বর্ণালি : উপাদানের কম্পাঙ্ক যা একটি তরঙ্গের সৃষ্টি করে। সূর্যের দৃশ্যমান অংশের বর্ণালি মাঝেমধ্যে রংধনু হিসেবে দেখা যায়।

নিউক্লিয়াস : পরমাণুর কেন্দ্রীয় অংশ। এখানে শুধু প্রোটন ও নিউট্রন থাকে, যারা শক্তিশালী বল দ্বারা একত্র থাকে।

ডপলার প্রভাব : শব্দতরঙ্গ বা আলোতরঙ্গের উৎস কোনো পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে চলমান হলে ওই তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিচ্যুতি ঘটে।

ডিএনএ (DNA) : ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড, যা ফসফেট, একটি শর্করা ও চারটি ক্ষার (অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থায়ামিন ও সাইটোসিন) নিয়ে গঠিত। ডিএনএর দুটি সূত্রক একটি ডাবল হেলিক্স কাঠামো গঠন করে, যা দেখতে প্যাচানো সিঁড়ির মতো। কোষের সব তথ্য ডিএনএতে লিপিবদ্ধ থাকে। এ তথ্যের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। এটি বংশগতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কেলভিন (Kelvin) : তাপমাত্রার একটি স্কেল। এই স্কেলের শূন্য তাপমাত্রাকে পরম শূন্য তাপমাত্রা বলা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *