৩. মন্দিরের প্রাঙ্গণে

যাক। ওরা সবাই খিলানের তলা দিয়ে অগ্রসর হয়ে মন্দিরের মধ্যেকার প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াল। শুধু ভীষণ কাঁটাগাছ আর বেত, যা থেকে মলঙ্কা বেতের ছড়ি হয়।

সনৎ ছেলেমানুষ, ভালো বেত দেখে বলে উঠল–দাদা, একটা বেত কাটব?

ইয়ার হোসেন তাকে ধমক দিয়ে কী বলতে যাচ্ছে, এমন সময় একটি সুন্দর পাখি এসে সামনের বন্য রবারের গাছের ডাল থেকে মন্দিরের ভাঙা পাথরের কার্নিশে বসল। সবাই হাঁ করে চেয়ে রইল পাখিটার দিকে। কী সুন্দর! দীর্ঘ পুচ্ছ ঝুলে পড়েছে কার্নিশ থেকে প্রায় এক হাত–ময়ুরের পুচ্ছের মতো। হলদে ও সাদা আঁখি পালকের গায়ে–পিঠের পালকগুলো ঈষৎ বেগুনি!

ইয়ার হোসেন বললে–টিকাটুরা, যাকে সাহেব লোক বলে বার্ড অব প্যারাডাইজ–খুব সুলক্ষণ।

সনৎ বললে–বাঃ কী চমৎকার! এই সেই বিখ্যাত বার্ড অব প্যারাডাইজ! কত পড়েছি ছেলেবেলায় এদের কথা

সুশীল বললে–সুলক্ষণ কুলক্ষণ দু-রকমই দেখছি। কুমির নিলে একজনকে, আবার বার্ড অব প্যারাডাইজ দেখা গেল একটা সুলক্ষণ–

মন্দিরের বিভিন্ন কুঠরি। প্রত্যেক কুঠরির দেওয়ালে সারবন্দি খোদাই কাজ। সুশীল একখানা পাথরের ইট মনোযোগের সঙ্গে দেখলে। একজন ভারতবর্ষীয় হিন্দু রাজা সিংহাসনে উপবিষ্ট, তাঁর পাশে বোধহয় গ্রহবিপ্র পাঁজি পড়ছেন। সামনে একসার লোক মাথা নীচু করে যেন রাজাকে অভিবাদন করছে। রাজার এক হাতে একটা কী পাখি–হয় পোষা শুক, নয়তো শিকরে বাজ।

ভারত! ভারত! কত মিষ্টি নাম, কী প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অমূল্য ভান্ডার। তার নিজের দেশের মানুষ একদিন কম্পাস-ব্যারোমিটারহীন যুগে সপ্ত সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে এখানে এসে হিন্দুধর্মের নিদর্শন রেখে গিয়েছিল, তাদের হাতে-গড়া এই কীর্তির ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে গর্বে ও আনন্দে সুশীলের বুক দুলে উঠল। বীর তারা, দুর্বল হাতে অসি ও বর্শা ধরেনি, ধনুকে জ্যা রোপণ করেনি–সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে–এই অজ্ঞাত বিপদসংকুল মহাসাগর হিন্দুধর্মের জয়ধ্বজা উড়িয়ে দিগবিজয় করে নটরাজ শিবের পাষাণ-দেউল তুলেছে সপ্তসমুদ্র পারে।

পরবর্তী যুগের যারা স্মৃতিশাস্ত্রের বুলি আউড়ে টোলের ভিটেয় বাঁশবনের অন্ধকারে বসে বলে গিয়েছিল–সমুদ্রে যেও না, গেলে জাতটি একেবারে যাবে, হিন্দুত্ব একেবারে লোপ পাবে,তারা ছিল গৌরবময় যুগের বীর পূর্বপুরুষের অযোগ্য বংশধর, তাদের স্নায়ু দুর্বল, মন দুর্বল, দৃষ্টি ক্ষীণ, কল্পনা স্থবির।

তারা হিন্দু নয়–হিন্দুর কঙ্কাল।

দু-দিন ধরে ওরা বনের মধ্যে কত প্রাচীন দেওয়াল, ধ্বংসস্তূপ, দরজা, খিলান ইত্যাদি দেখে বেড়ালো। জ্যোৎস্না রাত্রি, গভীর রাত্রে যখন ওরাংওটাংয়ের ডাকে চারপাশের ঘন জঙ্গল মুখরিত হয়ে ওঠে, অজ্ঞাত নিশাচর পক্ষীর কুস্বর শোনা যায়, বন্য রবারের ডালপালায় বাদুড় ঝটাপটি করে, তখন এই প্রাচীন হিন্দু নগরীর ধ্বংসস্তূপে বসে সুশীল যেন মুহূর্তে কোন মায়ালোকে নীত হয়–অতীত শতাব্দীর হিন্দু সভ্যতার মায়ালোক–দিগবিজয়ী বীর সমুদ্রগুপ্ত কবি ও বীণ-বাজিয়ে যে মহাযুগের প্রতীক, হুনবিজেতা মহারথ স্কন্দগুপ্তের কোদন্ড টঙ্কারে যে যুগের আকাশ সন্ত্রস্ত।

সুশীল স্বপ্ন দেখে! সনৎকে বলে–বুঝলি সনৎ, জামাতুল্লাকে যথেষ্ট ধন্যবাদ যে ও আমাদের এনেছে এখানে। এসব না দেখলে ভারতবর্ষের গৌরব কিছু বুঝতাম না!

সনৎ একথায় সায় দেয়। টাকার চেয়ে এর দাম বেশি।

ইয়ার হোসেন কিন্তু এসব বোঝে না। সে দিন দিন উগ্র হয়ে উঠেছে। এই নগরীর ধ্বংসস্তূপে প্রায় দশদিন কাটল। অথচ ধনভান্ডারের নামগন্ধও নেই, সন্ধানই মেলে না। জামাতুল্লাকে একদিন স্পষ্ট শাসালে–যদি টাকাকড়ির সন্ধান না মেলে তো তাকে এই জঙ্গলে টেনে আনবার মজা সে টের পাইয়ে দেবে।

জামাতুল্লা সুশীলকে গোপনে বললে–বাবুজি, ইয়ার হোসেন বদমাইস গুণ্ডা–ও না কী গোলমাল বাধায়।

সুশীল ও সনৎ সর্বদা সজাগ হয়ে থাকে রাত্রে, কখন কী হয় বলা যায় না। ইয়ার হোসেনের সশস্ত্র অনুচরের দল দিন-দিন অসংযত হয়ে উঠছে।

একদিন জামাতুল্লা, বনের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গায় একটি বড়ো পাথরের থাম আবিষ্কার করলে। থামের মাথায় ভারতীয় পদ্ধতি অনুসারে পদ্ম তৈরি করা হয়েছে। সুশীলকে ডেকে নিয়ে গেল জামাতুল্লা, সুশীল এসব দেখে খুশি হল। সুশীল ও সনৎ দু-জনে গভীর বনের মধ্যে ঢুকে থামটা দেখতে গেল।

সেখানে গিয়েই সুশীল দেখলে থামটার সামনে আড়ভাবে পড়ে প্রকান্ড একটা পাথরের চাঙড়–যেন একখানা চৌরশ করা শানের মাঝে। সুশীল ক্যামেরা এনেছে থামটার ফোটো নেবে বলে, পাথরটা সরিয়ে না দিলে পদ্মটির ছবি নেওয়া সম্ভব না।

জামাতুল্লা বললে–পাথরখানা ধরাধরি করে এসো সরাই।

সরাতে গিয়ে পাথরখানা যেই কাত অবস্থা থেকে সোজা হয়ে পড়ল, অমনি সনৎ চিৎকার করে বললে–দেখো, দেখো–

সকলে সবিস্ময়ে দেখলে, যেখানে পাথরটা ছিল, সেখানে একটা সুড়ঙ্গ যেন মাটির নীচে নেমে গিয়েছে। জামাতুল্লা ও সুশীল সুড়ঙ্গের ধারে গিয়ে উঁকি মেরে দেখলে, সুড়ঙ্গটা হঠাৎ বেঁকে গিয়েছে, প্রথমটা সেজন্য মনে হয় গর্তটা নিতান্তই অগভীর।

সুশীল বললে–আমি নামব–

জামাতুল্লা বললে–তা কখনো করতে যাবেন না, বিপদে পড়বেন। কী আছে গর্তের মধ্যে কে জানে!

সুশীল বললে–নেমে দেখতেই হবে। আমি এখানে থাকি, তোমরা গিয়ে তাঁবু থেকে মোটা দড়ি হাত-চল্লিশ, টর্চ আর রিভলবার নিয়ে এসো। ইয়ার হোসেনকে কিছু বোলো না।

সব আনা হল। সুশীল জামাতুল্লা দু-জনে সুড়ঙ্গের মধ্যে নামলে। খানিক দূর নামলে ওরা। পাথরে বাঁধানো সিঁড়ি, পনেরো-ষোলো ধাপ নেমেই কিন্তু দু-জনে হতাশ হল দেখে, সামনে আর রাস্তা নেই। সিঁড়ি গিয়ে শেষ হয়েছে, একটা গাঁথা দেওয়ালের সামনে।

সুশীল বললে–এর মানে কী জামাতুল্লা সাহেব?

বুঝলাম না বাবুজি। যদি যেতেই দেবে না, তবে সিঁড়ি গেঁথেছে কেন?

রাত হয়ে আসছে। ওরা দু-জনে টর্চ ফেলে চারিদিক ভালো করে দেখতে লাগল। হঠাৎ সুশীল চেঁচিয়ে উঠে বললে–দেখো, দেখো! দু-জনেই অবাক হয়ে দেখলে মাথার ওপরে পাথরের গায়ে ওদের পরিচিত সেই চিহ্ন খোদা–পদ্মরাগ মণির ওপর যে-চিহ্ন খোদা ছিল। ভারতীয় স্বস্তিক চিহ্ন, প্রত্যেক বাহুর কোণে এক-এক জানোয়ারের মূর্তি–সর্প, বাজপাখি, বাঘ ও কুমির।

এই সেই আঁক-জোঁক বাবুজি! কিন্তু এর মানে কী, সিঁড়ি বন্ধ করলে কেন, বুঝলেন কিছু?

দু-জনেই হতভম্ব হয়ে গেল। সুশীল সামনে পাথরখানাতে হাত দিলে, বেশ মসৃণ; মাপ নিয়ে চৌরশ করে কেটে কে তৈরি করে রেখেছে।

কিছুই বোঝা গেল না–অবশেষে হতাশ হয়ে ওরা গর্ত থেকে উঠে পড়ে তাঁবুতে ফিরে এল সনৎকে নিয়ে। সেখানে কাউকে কিছু বললে না। পরদিন দুপুর বেলা সুশীল একা জায়গাটায় গেল। আবার সুড়ঙ্গের মধ্যে নামলে। ওর মনে একথা বিশেষভাবে জেগে ছিল, লোকে এইটুকু গর্তে ঢুকবার জন্যে এরকম সিঁড়ি গাঁথে না। এ সুড়ঙ্গ নিশ্চয় আরও অনেক বড়ো। কিন্তু তবে দশ ধাপ নেমেই পাথর দিয়ে এমন শক্ত করে বোজানো কেন?

এ গোলমেলে ব্যাপারের কোনো মীমাংসা করা যায় না দেখা যাচ্ছে। সুশীল চারিদিকে চেয়ে দেখলে মাথার ওপরে পাথরের গায়ে সেই অদ্ভুত চিহ্নটি সুস্পষ্ট খোদাই করা আছে। এ চিহ্নই বা এখানে কেন? ভালো করে চেয়ে চিহ্নটি দেখতে দেখতে ওর চোখে পড়ল, যে পাথরের গায়ে চিহ্নটি খোদাই করা তার এক কোণের দিকে আর একটা কী খোদাই করা আছে। সুড়ঙ্গের মধ্যে অন্ধকার খুব না হলেও তেমন নয়। সুশীল টর্চ ফেলে ভালো করে দেখলে–চিহ্নটি আর কিছুই নয়, ঠিক যেন একটি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ রাখবার সামান্য খোল। খোলের চারিপাশে দুটি লতার আকারের বলয় কিংবা অন্য কোনো অলংকার পরস্পর যুক্ত। সুশীল কী মনে ভেবে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের খোলে নিজের বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে দেখতে গেল।

সঙ্গেসঙ্গে সামনের পাথর যেন কলের দোরের মতো সরে একটা মানুষ যাবার মতো ফাঁক হয়ে গেল। সুশীল অবাক! এ যেন সেই আরব্য উপন্যাসের বর্ণিত আলিবাবার গুহা।

সে বিস্মিত হয়ে চেয়ে দেখলে, সিঁড়ির পর সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে। সুশীল সিঁড়ি দিয়ে নামবার আগে উঁকি মেরে চাইলে অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে। বহু যুগ আবদ্ধ দূষিত বাতাসের বিষাক্ত নিশ্বাস যেন ওর চোখে-মুখে এসে লাগল। তখন কিন্তু সুশীলের মন আনন্দে কৌতূহলে চঞ্চল হয়ে উঠেছে, বসে ভাববার সময় নেই। ও তাড়াতাড়ি কয়েক ধাপ নেমে গেল।

আবার সিঁড়ি বেঁকে গিয়েছে কিছুদূর গিয়ে। এবার আর সামনে পাথর নেই, সিঁড়ি এঁকে বেঁকে নেমে চলেছে। সুশীল একবার ভাবলে তার আর যাওয়া উচিত নয়। কতদূর সিঁড়ি নেমেছে এই ভীষণ অন্ধকূপের মধ্যে কে জানে? কিন্তু কৌতূহল সংবরণ করা ওর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ল। ও আরও অনেকখানি নীচে নেমে গিয়ে দেখলে এক জায়গায় সিঁড়ি হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। টর্চ জ্বেলে নীচের দিকে ঘুরিয়ে দেখলে, কোনো দিকে কিছুই নেই–পাথর বাঁধানো চাতাল বা মেঝের মতো তলাটা সব শেষ, আর কিছু নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে dead end ও সেখানে পৌঁছে গিয়েছে। সুশীল হতভম্ব হয়ে গেল।

যারা এ সিঁড়ি গেঁথেছিল তারা কী জন্যে এত সতর্কতার সঙ্গে এত কষ্ট করে সিঁড়ি গেঁথেছিল যদি সে সিঁড়ি কোথাও না পৌঁছে দেয়।

চাতালের দৈর্ঘ্য হাত-তিনেক, প্রস্থ হাত আড়াই। খুব একখানা বড়ো পাথরের দ্বারা যেন সমস্ত মেঝে বা চাতালটা বাঁধানো। তন্ন-তন্ন করে খুঁজে চাতালের কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। সুশীল বাধ্য হয়ে বোকা বনে উঠে চলে এসে জামাতুল্লা ও সনৎকে সব বললে, ওরা পরদিন লুকিয়ে তিনজনে সেখানে গেল, সিঁড়ি দিয়ে নামলে। সামনে সেই চাতাল। সিঁড়ির শেষ।

জামাতুল্লা বললে–এ কী তামাশা আছে বাবুজি–আমি তো বেকুব বনে গেলাম!

তিন জনে মিলে নানা ভাবে পাথরটা দেখলে, এখানে টিপলে ওখানে চাপ দিলে– হিমালয় পর্বতের মতোই অনড়। কোথাও কোনো চিহ্ন নেই পাথরের গায়ে। মিনিট কুড়ি কেটে গেল। মিনিট কুড়ি সেই অন্ধকার ভূগর্ভে কাটানো বিপজ্জনকও বটে, অস্বস্তিকরও বটে।

সুশীল বললে–ওঠো সবাই, আর না এখানে।

হঠাৎ জামাতুল্লা বলে উঠল–বাবুজি, একটা কথা আমার মনে এসেছে!

দু-জনেই বলে উঠল–কী? কী?

গাঁতি দিয়ে এই পাথরখানা খুঁড়ে তুলে দেখলে হয়। কী বলেন?

তখন ওরাও ভাবলে এই সামান্য কথাটা। যে কথা, সেই কাজ। জামাতুল্লা লুকিয়ে তাঁবু থেকে গাঁতি নিয়ে এল। পাথর খুঁড়ে শাবলের চাড় দিয়ে তুলে ফেলে যা দেখলে তাতে ওরা যেমন আশ্চর্য হল তেমনি উত্তেজিত হয়ে উঠল। আবার সিঁড়ির ধাপ। কিন্তু দশ ধাপ নেমে গিয়ে সিঁড়ি বেঁকে গেল–আবার সামনে চৌরশ পাথর দিয়ে সুড়ঙ্গ বোজানো। মাথার ওপরকার পাথরে পূর্ববৎ চিহ্ন পাওয়া গেল। বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপে আবার সে পাথর ফাঁক হল। আবার সিঁড়ি। কিন্তু কিছুদূর নেমে আবার পাথর-বাঁধানো চাতাল–আবার সেই dead end, নির্দেশহীন শূন্য।

অমানুষিক পরিশ্রম। আবার পাথর তুলে ফেলা হল–আবার সিঁড়ি। সুশীল বললে, যারা এ গোলকধাঁধা করেছিল, তারা খানিকদূর গিয়ে একবার একখানা পাথর সোজা করে পথ বুজিয়েছে, তার পরেরটা সিঁড়ির মতো পেতে বুজিয়েছে–এই এদের কৌশল, বেশ বোঝা যাচ্ছে। জামাতুল্লা ওদের সতর্ক করে দিলে–বললে–বাবুজি, অনেকটা নীচে নেমে এসেছি। খারাপ গ্যাস থাকতে পারে, দমবন্ধ হয়ে মারা যেতে পারি সবাই। তাঁবুতেও সন্দেহ করবে। চলুন আজ ফিরি।

তাঁবুতে ফেরবার পথে জামাতুল্লা বললে–বাবুজি, ইয়ার হোসেনকে এর খবর দেবেন না।

কেন?

কী জানি কী আছে ওর মধ্যে। যদি রত্নভান্ডারের সন্ধানই পাওয়া যায়, তবে ইয়ার হোসেন কী করবে বলা যায় না। ওর সঙ্গে তোক বেশি। প্রত্যেকে গুণ্ডা ও বদমাইশ। মানুষ খুন করতে ওরা এতটুকু ভাববে না। ওদের কাছে মশা টিপে মারাও যা, মানুষ মারাও তাই।

ইয়ার হোসেনের মন যথেষ্ট সন্দিগ্ধ। তাঁবুতে ফিরতে সে বললে– কোথায় ছিলে তোমরা?

সুশীল বললে–ফোটো নিচ্ছিলাম।

ইয়ার হোসেন হেসে বললে–ফোটো নিয়ে কী হবে, যার জন্যে এত কষ্ট করে আসা–তার সন্ধান করো।

ইয়ার হোসেনের জনৈক মালয় অনুচর সেদিন দুপুরে একটা পাথরের বৃষমূর্তি কুড়িয়ে পেলে গভীর বনের মধ্যে। খুব ছোটো, কিন্তু অতটুকু মূর্তির মধ্যেও শিল্পীর শিল্পকৌশলের যথেষ্ট পরিচয় বর্তমান।

রাত্রে জ্যোৎস্না উঠল।

সুশীল তাঁবু থেকে একটু দূরে একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর গিয়ে বসল। ভাবতে ভালো লাগে এই সমুদ্রমেখলা দ্বীপময় রাজ্যের অতীত গৌরবের দিনের কাহিনি। রাত্রে যামঘোষী দুন্দুভি যেন বেজে উঠল–ধারাযন্ত্রে স্নান সমাপ্ত করে, কুঙ্কুমচন্দনলিপ্ত দেহে দিগবিজয়ী নৃপতি চলেছেন অন্তপুরের অভিমুখে। বারবিলাসিনীরা তাঁকে স্নান করিয়ে দিয়েছে এইমাত্র– তারাও ফিরছে তাঁর পিছনে পিছনে, কারো হাতে রজত কলস, কারো হাতে স্ফটিক কলস…

আধো-অন্ধকারে কালো মতো কে একটা মানুষ বনের মধ্যে থেকে বার হয়ে সুশীলের দিকে ছুটে এল আততায়ীর মতো–সুশীল চমকে উঠে একখানা পাথর ছুঁড়ে মারল। মানুষটা পড়েই জানোয়ারের মতো বিকট চিৎকার করে উঠল–তারপর আবার উঠে আবার ছুটল ওর দিকে। সুশীল ছুট দিলে তাঁবুর দিকে।

ওর চিৎকার শুনে তাঁবু থেকে সনৎ বেরিয়ে এল। ধাবমান জিনিসটাকে সে গুলি করলে। সেটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে দেখা গেল একটা ওরাংওটাং।

জামাতুল্লা ও ইয়ার হোসেন দু-জনে তিরস্কার করলে সুশীলকে।

এই বনে যেখানে-সেখানে একা যাওয়া উচিত নয়, তারা কতবার বলবে একথা? কত জানা-অজানা বিপদ এখানে পদে পদে!

পরদিন ছুতো করে সুশীল ও জামাতুল্লা আবার বেরিয়ে গেল। বনের মধ্যে সেই গুহায়। সনৎকে সঙ্গে নিয়ে গেল না। কেননা সকলে গেলে সন্দেহ করবে ওরা।

আবার সেই পরিশ্রম। আরও দু-ধাপ সিঁড়ি ও দুটো চাতাল ওরা ডিঙিয়ে গেল। দিন শেষ হয়ে গেল, সেদিন আর কাজ হয় না। আবার তার পরের দিন কাজ হল শুরু। এইরকম আরও তিন-চার দিন কেটে গেল।

একদিন সনৎ বললে–দাদা, তোমরা আর সেখানে দিনকতক যেও না।

সুশীল বললে–কেন?

ইয়ার হোসেন সন্দেহ করছে। সে রোজ বলে, এরা বনের মধ্যে কী করে? এত ফোটো নেয় কীসের?

কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আর একদিনের কাজ বাকি। ওর শেষ না দেখে আমি আসতে পারছি নে।

একা যাও–দু-জনে যেও না। জোট বেঁধে গেলেই সন্দেহ করবে। হাতিয়ার নিয়ে যেও।

তুই তাঁবুতে থেকে নজর রাখিস ওদের ওপর। কাল খুব সকালে আমি বেরিয়ে যাব।

সুশীল তাই করলে। প্রায় ষাট ফুট নীচে তখন শেষ চাতাল পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। সেদিন দুপুর পর্যন্ত পরিশ্রম করে সে চাতালটা ভেঙে ফেললে।

তারপর যা দেখলে তাতে সুশীল একেবারে বিস্মিত, স্তম্ভিত ও হতভম্ভ হয়ে পড়ল।

সিঁড়ি গিয়ে শেষ হয়েছে ক্ষুদ্র একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে।

কক্ষের মধ্যে অন্ধকার সূচিভেদ্য।

টর্চের আলোয় দেখা গেল কক্ষের ঠিক মাঝখানে একটি পাষাণবেদিকার ওপর এক পাষাণ নারীমূর্তি– বিলাসবতী কোনো নর্তকী যেন নাচতে নাচতে হঠাৎ বিটঙ্কবেদিকার ওপর পুত্তলিকার মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে কী দেখে।

একী!

এর জন্যে এত পরিশ্রম করে এরা এসব কান্ড করেছে!

সুশীল আরও অগ্রসর হয়ে দেখতে গেল।

হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল। পাথরের বেদির ওপর সেই চিহ্ন আবার খোদাই করা। ঘরের মধ্যে টর্চ ঘুরিয়ে দেখলে। তাকে ঘর বলা যেতে পারে, একটা বড়ো চৌবাচ্চাও বলা যেতে পারে। স্যাঁৎসেঁতে ছাদ, স্যাঁৎসেঁতে মেঝে–পাতালপুরীর এই নিভৃত অন্ধকার গহ্বরে এ প্রস্তরময়ী নারী-মূর্তির রহস্য কে ভেদ করবে?

কিন্তু কী অদ্ভুত মূর্তি! কটিতে চন্দ্রহার, গলদেশে মুক্তামালা, প্রকোষ্ঠে মণিবলয়। চোখের চাহনি সজীব বলে ভ্রম হয়।

সেদিনও ফিরে গেল। জামাতুল্লাকে পরদিন সঙ্গে করে নিয়ে এল–তন্ন-তন্ন করে চারিদিক খুঁজে দেখলে ঘরের কোথাও কিছু নেই।

জামাতুল্লা বললে–কী মনে হয় বাবুজি?

তোমার কী মনে হয়?

এই সিঁড়ি আর চাতাল, চাতাল আর সিঁড়ি ষাট ফুট গেঁথে মাটির নীচে শেষে নাচনেওয়ালি পুতুল! ছো: বাবুজি–এর মধ্যে আর কিছু আছে।

বেশ, কী আছে, বার করো। মাথা খাটাও।

তা তো খাটাব–এদিকে ইয়ার হোসেনের দল যে খেপে উঠেছে। কাল ওরা কী বলেছে জানেন?

কীরকম?

আর দু-দিন ওরা দেখবে–তারপর বাকি এ দ্বীপ ছেড়ে চলে যাবে। তা ছাড়া আর এক ব্যাপার। আপনাকেও ওরা সন্দেহ করে। বনের মধ্যে রোজ আপনি কী করেন? আমায় প্রায়ই জিজ্ঞেস করে।

তুমি কী বল?

আমি বলি বাবুজি ফোটো তোলে, ছবি আঁকে। তাতে ওরা আপনাকে ঠাট্টা করে। ওসব মেয়েলি কাজ।

যারা এই নগর গড়েছিল, পুতুল তৈরি করেছিল, পাথরে ছবি এঁকেছিল–তারা পুরুষ মানুষ ছিল জামাতুল্লা। ইয়ার হোসেনের চেয়ে অনেক বড়ো পুরুষ ছিল–বলে দিও তাকে।

সুশীলকে রেখে জামাতুল্লা ফিরে যেতে চাইলে। নতুবা ইয়ার হোসেনের দল সন্দেহ করবে। যাবার সময় সুশীল বললে–কোনো উপায়ে এখানে একটা আলোর ব্যবস্থা করতে পার? টর্চ জ্বালিয়ে কতক্ষণ থাকা যায়? আর কিছু না থাক সাপের ভয়ও তো আছে।

জামাতুল্লা বললে–আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি লণ্ঠন নিয়ে বাবুজি। আপনি ওপরে উঠে বসুন, এ পাতালের মধ্যে একা থাকবেন না–

সুশীল বললে–না, তুমি যাও–আমি এখানেই থাকব। পকেটে একটুকরো মোমবাতি এনেছি–তাই জ্বালাব।

একটুকরো বাতি জ্বালিয়ে সুশীল ঘরটার মধ্যে বসে ভাবতে লাগল। বাইরে এত বড়ো রাজ্য যারা প্রতিষ্ঠা করেছিল, কোন জিনিস গোপন করবার জন্যে তারা এই পাতালপুরী তৈরি করেছিল, এত কষ্ট স্বীকার করে নর্তকীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে নয় নিশ্চয়ই।

হঠাৎ নর্তকী পুতুলটার দিকে ওর দৃষ্টি পড়তে ও বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কী ব্যাপার এটা?

এতক্ষণ মূর্তিটার যতখানি তার দিকে ছিল, সেটা যেন সামান্য একটু পাক খেয়ে খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

সুশীল চোখ মুছে আবার চাইলে।

হ্যাঁ, সত্যিই তাই। এই বাতিটার সামনে ছিল ওই পা-খানা–এখন পায়ের হাঁটুর পেছনের অংশ দেখা যায় কী করে? সে তো অতটুকু নড়েনি নিজে, যেখানে, সেখানেই বসে আছে।

সুশীলের ভয় হল। শ্মশানপুরীর ভূগর্ভস্থ কক্ষ, কত শতাব্দীর পুঞ্জীভূত দৈত্যদানোর দল জমা হয়ে আছে এসব জায়গায় কে বলতে পারে? কীসে মৃত্যু আর কীসে জীবন, এ বার্তা পোঁছে দেবার লোক নেই। সরে পড়াই ভালো।

এমন সময় ওপর থেকে লণ্ঠনের আলো এসে পড়ল, পায়ের শব্দ শোনা গেল। জামাতুল্লা লণ্ঠন নিয়ে ঘরের মধ্যে ওপর থেকে উঁকি মেরে বললে–বাবুজি, ঠিক আছেন?

তা আছি। ঘরের মধ্যে নামো জামাতুল্লা—

জামাতুল্লা ঘরের মেঝেতে নেমে ওর পাশে দাঁড়াল। সুশীল ওকে মূর্তির ব্যাপারটা দেখিয়ে বললে–এখন তুমি কী মনে কর?

কিছু বুঝতে পারছি নে বাবুজি-খুব তাজ্জব কথা!

তুমি থাকো এখানে–বোসো—

কিন্তু জামাতুল্লা দাঁড়াল না। দু-জনে এখানে বসে থাকলে ইয়ার হোসেনের দলের সন্দেহ ঘোরালোরকম হয়ে উঠবে, সে থাকতে পারবে না। জামাতুল্লা চলে যাবার পর সুশীল অনেকক্ষণ মূর্তিটার দিকে চেয়ে বসে রইল। মূর্তিটা এবার বেশ ঘুরে গিয়েছে, এ সম্বন্ধে আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। ওর আগের ভয়ের ভাবটা কেটে গিয়েছিল জামাতুল্লা লণ্ঠন নিয়ে আসার পর থেকে, এখন ভয়ের চেয়ে কৌতূহল বেশি!

খুব একটু একটু করে ঘুরছে, ঘূর্ণমান রঙ্গমঞ্চের মতোই, মূর্তির পদতলস্থ বিটঙ্কবেদিকা।

কেন? কী উদ্দেশ্য? অতীত শতাব্দীগুলি মূক হয়ে রইল, এর জবাব মেলে না। বেলা গড়িয়ে এল, সুশীলের হাতঘড়িতে বাজে পাঁচটা।

হঠাৎ সুশীল চেয়ে দেখলে আর একটি আশ্চর্য ব্যাপার।

নর্তকী-মূর্তির সরু সরু আঙুলগুলির মধ্যে একটা আঙুল একটি মুদ্রা রচনা করার দরুন অন্য সব আঙুল থেকে পৃথক এবং একদিকে কী যেন নির্দেশ করবার ভঙ্গিতে ছিল। এবার যেন আঙুলের ছায়া পড়েছে দেওয়ালের এক বিশেষ স্থানে।

এমন ভঙ্গিতে পড়েছে যেন মনে হয় মূর্তিটি তর্জনী-অঙ্গুলির দ্বারা ভিত্তিগাত্রের একটি স্থান নির্দেশ করছে।

তখনি একটা কথা মনে হল সুশীলের। লণ্ঠনের আলোর দ্বারা এ ছায়া তৈরি হয়েছে, না কোনো গুপ্ত ছিদ্রপথে দিবালোক প্রবেশ করেছে ঘরের মধ্যে?

তা-ই বলে মনে হয়, লণ্ঠনের আলোর কৃত্রিম ছায়া ও নয়। ও লণ্ঠনের আলো কমিয়ে দিয়ে দেখলে–তখন অস্পষ্ট আলো-অন্ধকারের মধ্যেও তর্জনীর ছায়া ভিত্তিগাত্রে পড়ে একটা স্থান যেন নির্দেশ করছে।

অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে উঠে ও জায়গাটা দেখতে গেল।

দেওয়ালের সেই জায়গা একেবারে সমতল, চিহ্নহীন–চারিপাশের অংশের সঙ্গে পৃথক করে নেওয়ার মতো কিছুই নেই সেখানে। তবুও সে নিরাশ না হয়ে দেওয়ালের সেই জায়গাটাতে হাত বুলিয়ে দেখতে গেল।

হাত দেবার সঙ্গেসঙ্গে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। ঠিক যেখানে আঙুলের অগ্রভাগ শেষ হয়েছে সেই স্থানের খানিকটা যেন বসে গেল–অর্থাৎ ঢুকে গেল ভেতরের দিকে। একটা শব্দ হল পেছনের দিকেও পেছন ফিরে চেয়ে দেখলে বিটঙ্কবেদিকার তলাটা যেন ঈষৎ ফাঁক হয়ে গিয়েছে।

ও ফিরে এসে ভালো করে লক্ষ করে দেখলে, গোলাকার বেদিকাটি তার নর্তকী-মূর্তিটাসুদ্ধ যেন একটা পাথরের ছিপি। বড়ো বোতলের মুখে যেমন কাঁচের স্টপার বা ছিপি থাকে, এ যেন পাষাণ-নির্মিত বিরাট এক স্টপার। কীসের চাড় লেগে স্টপারের মুখ ফাঁক হয়ে গিয়েছে।

ও নর্তকীমূর্তির পাদদেশে এবং গ্রীবায় দুই হাত দিয়ে মূর্তিটাকে একটু ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করতেই সেটা সবসুদ্ধ বেশ আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগল। কয়েকবার ঘোরবার পরে ক্রমেই তার তলার ফাঁক চওড়া হয়ে আসতে লাগল। কী কৌশলে প্রাচীন শিল্পী পাথরের উপরটাকে ঘূর্ণমান করে তৈরি করেছিল?

এই মূর্তিসুদ্ধ বেদিকা টেনে তোলা তার একার সাধ্যে কুলবে না। জামাতুল্লা ও সনৎ দু জনকেই আনতে হবে কোনো কৌশলে সঙ্গে করে, ইয়ার হোসেনের দলের অগোচরে।

সন্ধ্যার অন্ধকার নামবার বিলম্ব নেই। বহু দিন-রাত্রির ছায়া অতীতের এ নিস্তব্ধ কক্ষে জীবনের সুর ধ্বনিত করেনি, এখানে গভীর নিশীথ রাত্রির রহস্য হয়তো মানুষের পক্ষে খুব আনন্দদায়ক হবে না, মানুষের জগতের বাইরে এরা।

সুশীল লণ্ঠন হাতে উঠে এল আঁধার পাতালপুরীর কক্ষ থেকে। তাঁবুতে ঢোকবার পথে ইয়ার হোসেন বড়ো ছুরি দিয়ে পাখির মাংস ছাড়াচ্ছে। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে বললে–কোথায় ছিলেন?

ছবি আঁকতে, মি. হোসেন।

লণ্ঠন কেন?

পাছে রাত হয়ে যায় ফিরতে। বনের মধ্যে আলো থাকলে অনেক ভালো।

এত ছবি এঁকে কী হয় বাবু?

ভালো লাগে।

আসল ব্যাপারের কী? জামাতুল্লা আমাদের ফাঁকি দিয়েছে। আমি ওকে মজা দেখিয়ে দেব! আমরা সকলেই চেষ্টা করছি! ব্যস্ত হবেন না মি. হোসেন–

আমি আর পাঁচদিন দেখব। তারপর এখান থেকে চলে যাব–কিন্তু যাবার আগে জামাতুল্লাকে দেখিয়ে যাব সে কার সঙ্গে জুয়েচুরি করতে এসেছিল!

জামাতুল্লার কী দোষ? আপনি বরং আমাকে দোষ দিতে পারেন—

আরে আপনি তো ছবি-আঁকিয়ে পুরুষ মানুষ। এসব কাজ আপনার না।

সুশীল রাত্রে চুপি চুপি জামাতুল্লাদের নর্তকী পুতুলের ঘটনা সব বললে। ওদের দুজনকেই যেতে হবে, নতুবা ছিপি উঠবে না।

জামাতুল্লা বললে–কিন্তু আমাদের দুজনের একসঙ্গে যাওয়া সম্ভব নয় বাবুজি।

কেন?

জানেন না,–এর মধ্যে নানারকম ষড়যন্ত্র চলছে। ওরা আপনাদের চেয়ে আমাকেই দোষ দেবে বেশি। আপনাকে ওরা নিরীহ, গোবেচারি বলে ভাবে–

সেটা অন্যায়।

আপনারা ভালো মানুষ, আমার হাতের পুতুল–পুতুল যেমন নাচায়, তেমনি আপনারা আমার হাতে—

শেষের কথাটা শুনে সুশীলের আবার মনে পড়ল নর্তকীমূর্তির কথা। কাল হয়তো বেরোনো যাবে না, ইয়ার হোসেনের কড়া নজরবন্দির দরুন। আজই রাত্রে অন্য দল ঘুমোলে সেখানে গেলে ক্ষতি কী?

সনৎকে বললে–সনৎ, তৈরি হও। আজ রাত্রে হয় আমাদের জীবন, নয়তো আমাদের মরণ। পাতালপুরীর রহস্য আজ ভেদ করতেই হবে। আজ আঁধার রাত্রে চুপি চুপি বেরোবে আমার সঙ্গে–দিনের আলোয় সব ফাঁস হয়ে যাবে।

জামাতুল্লা বললে–কেউ টের না পায় বাবুজি, জুতো হাতে করে সব যাবেন কিন্তু।

আহারাদির পর্ব মিটে গেল। দাবানল জ্বলে উঠেছে আজ ওদের মনে, বনের সাময়িক দাবানলকেও ছাপিয়ে তার শিখা সমস্ত মনের আকাশ ব্যেপে বেড়ে উঠল।

দুটো রাইফেল, একটা রিভলবার, একটা শাবল, একটা গাঁতি, খনিকটা দড়ি, চার-পাঁচটা মোমবাতি, কিছু খাবার জল, এক শিশি টিংচার আইডিন, খানকতক মোটা রুটি–তিনজনের মধ্যে এগুলি ভাগ করে নিয়ে রাত একটার পরে ওরা অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে তাঁবু থেকে বেরোলো।

ইয়ার হোসেনের একজন মালয় অনুচর উলটো মুখে দাঁড়িয়ে বলো রামদাও হাতে পাহারা দিচ্ছে। অন্ধকারে এরা বুক ঘেঁষে চলে এল… সে লোকটা টের পেলে না।

সনৎ বললে–আমি সে পুতুলটা একবার দেখব–

অদ্ভুত রাত্রি! বনের মাথায় মাথায় অগণিত তারা, বহুকালের সুপ্ত নগরীর রহস্যে নিশীথ রাত্রি অন্ধকার যেন থমথম করছে, সমস্ত ধ্বংসস্তূপটি যেন মুহূর্তে শহর হয়ে উঠতে পারে– ওর অগণিত নর-নারী নিয়ে। লতাপাতা, ঝোঁপঝাঁপ, মহীরুহের দল খাড়া হয়ে সেই পরম মুহূর্তের প্রতীক্ষায় যেন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।

অন্ধকারে একটা সর-সর শব্দ হতে লাগল সামনের মাটিতে।

সকলে থমকে দাঁড়াল হঠাৎ। সনৎ ও সুশীল একসঙ্গে টর্চ টিপলে–প্রকান্ড একটা অজগর সাপ আস্তে আস্তে ওদের পাঁচ হাত তফাত দিয়ে চলে যাচ্ছে। সকলে পাথরের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল, সাপটা বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর ওরা আবার চলল।

গহ্বরের মুখ ওরা লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রেখে গিয়েছিল, তিনজনে মিলে সেগুলি সরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগল।

সনৎ বললে–এ তো বড়ো আশ্চর্য ব্যাপার দেখছি–

কিন্তু পাতালপুরীর কক্ষের সে-নর্তকীমূর্তিটি দেখে ওর মুখে কথা সরল না। শিল্পীর অদ্ভুত শিল্পকৌশলের সামনে ও যেন হতভম্ব হয়ে গেল।

সুশীল বললে–শুধু এই মূর্তিটি কিউরিও হিসেবে বিক্রি করলে দশহাজার টাকায় যেকোনো বড়ো শহরের মিউজিয়াম কিনে নেবে–তবে, আমাদের দেশে নয়–ইউরোপে।

জামাতুল্লা বললে–ধরুন বাবুজি নাচনেওয়ালি পুতুলটা সবাই মিলে–পাক খাওয়াতে হবে একে বারকয়েক এখনও।

মিনিট দুই সবাই মিলে পাক দিয়ে মূর্তিটাকে ঘোরালো যেমন স্টপার ঘোরায় বোতলের মুখে। তারপর সবাই সন্তর্পণে মূর্তিটাকে ধরে উঠিয়ে নিলে। স্টপারের মতোই সেটা খুলে এল।

সঙ্গেসঙ্গে বিটঙ্কবেদির নীচের অংশে বার হয়ে পড়ল গোলাকার একটা পাথরের চৌবাচ্চা। সুশীল উঁকি মেরে দেখে বললে–টর্চ ধরো, খুব গভীর বলে মনে হচ্ছে—

টর্চ ধরে ওরা দেখলে চৌবাচ্চা অন্তত সাত ফুট গভীর। তার তলায় কী আছে ওপর থেকে ভালো দেখা যায় না।

সনৎ বললে–আমি লাফ দিয়ে পড়ব দাদা?

জামাতুল্লা বারণ করলে। এসব পুরোনো কূপের মধ্যে বিষধর সর্প প্রায়ই বাসা বাঁধে, যাওয়া সমীচিন হবে না।

দু-একটি পাথর ছুঁড়ে মেরে ওরা দেখলে, কোনো সাড়াশব্দ এল না আধো-অন্ধকার কূপের মধ্যে থেকে। তখন জামাতুল্লাই ধুপ করে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল ওর মধ্যে।

কিছুক্ষণ তার আর কোনো সাড়া নেই।

সুশীল ও সনৎ অধীর কৌতূহলের সঙ্গে বলে উঠল–কী–কী–কী দেখলে?

তবুও জামাতুল্লার মুখে কথা নেই। সে যেন কী হাতড়ে বেড়াচ্ছে চৌবাচ্চার তলায়। একটু অদ্ভুতভাবে হাতড়াচ্ছে–একবার সামনে যাচ্ছে, আবার পিছু হঠে আসছে।

সুশীল বললে–কী হল হে? পেলে কিছু দেখতে?

জামাতুল্লা বললে–বাবুজি, এর মধ্যে কিছু নেই—

কিছু নেই?

না বাবুজি। একেবারে ফাঁকা—

তবে তুমি ওর মধ্যে কী করছ জামাতুল্লা?

এর মধ্যে একটা মজার ব্যাপার আছে। নেমে এসে দেখুন—

সুশীল ও সনৎ সন্তর্পণে একে একে পাথরের চৌবাচ্চাটির মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। জামাতুল্লা দেখালে–এই দেখুন বাবুজি, এই লাইন ধরে একেবার সামনে, একেবার পেছনে গিয়ে দেখুন–তা হলেই বুঝতে পারবেন—

সামনে-পেছনে গিয়ে কী হবে?

সুশীল লক্ষ করে দেখলে চৌবাচ্চার ডানদিকের দেওয়ালে একটা কালো রেখা আছে সেইটে ধরে যদি সামনে বা পেছনে যাওয়া যায় তবে চৌবাচ্চার তলাটা একবার নামে, একবার ওঠে। ছেলেদের see-saw খেলার তক্তাটার মতো।

সনৎ বললে–ব্যাপারটা কী?

সুশীল বললে–অর্থাৎ এটা যদি কোনোরকমে ওঠানো যায়, তবে এর মধ্যে আর কিছু রহস্য আছে। কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

জামাতুল্লা বললে–বাবু, গাঁতি দিয়ে তলা ভেঙে ফেলতে পারি তো–অন্য কোনো পথ যদি না পাওয়া যায়। কিন্তু আজ থাকলে হত না বাবুজি? বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ–সকাল হয় হয়—

হঠাৎ সুশীল চৌবাচ্চার এক জায়গায় টর্চের আলো ফেলে বলে উঠল–এই দেখো সেই চিহ্ন–

সনৎ ও জামাতুল্লা সবিস্ময়ে দেখলে, চৌবাচ্চার কালো রেখার ওপরে উত্তর দিকের

কোণে, দু-খানা পাথরের সংযোগস্থলে তাদের অতিপরিচিত সেই চিহ্নটি আঁকা।

সুশীল বললে–হদিশ পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে–

অর্থাৎ

অর্থাৎ এই চিহ্নের ওপর টিপলেই চৌবাচ্চার তলার পাথরখানা একদিকে খুব বেশি কাত হয়ে, ভেতরে কী আছে দেখিয়ে দেবে। কিন্তু আজ বড্ড বেলা হয়ে গেল। আজ থাক, চলো।

জামাতুল্লা তাতে মত দিলে। সবাই মিলে তাঁবুতে ফিরে এল যখন, তখনও ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি। ইয়ার হোসেনের মালয় ভৃত্য বলো হাতে তাঁবুর দ্বারে চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। জামাতুল্লার ইঙ্গিতে সুশীল ও সনৎ উপুড় হয়ে পড়ে বুকে হেঁটে নিজেদের তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়ল।

জামাতুল্লা বললে–ঘুমিয়ে পড়ন বাবুজিরা–কিন্তু বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমোবেন না, আমি উঠিয়ে দেব সকালেই। নইলে ওরা সন্দেহ করবে।

সুশীল বললে–আমাদের অবর্তমানে ওরা ঘরে ঢোকেনি এই রক্ষে—

সনৎ অবাক হয়ে বললে–কী করে জানলে দাদা?

দেখবে? এই দ্যাখো। তাঁবুর দোরে সাদা বালি ছড়ানো, যে-কেউ এলে পায়ের দাগ পড়ত। তা পড়েনি।

ওরা যে যার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

* * * *

সুশীলকে কে বললে–আমার সঙ্গে আয়।

গভীর অন্ধকারের মধ্যে এক দীর্ঘাকৃতি পুরুষের পিছু পিছু ও গভীর বনের কতদূর চলল। ইয়ার হোসেনের মালয় ভৃত্যগণ ঘোর তন্দ্রাভিভূত, ঊষার আলোকের ক্ষীণ আভাসও দেখা যায় না পূর্বদিগন্তে। বৃক্ষলতা স্তব্ধ, স্বপ্নঘোরে আচ্ছন্ন। সারি সারি প্রাসাদ এক দিকে, অন্য দিকে প্রশস্ত দীর্ঘিকার টলটলে নির্মল জলরাশির বুকে পদ্ম ফুল ফুটে আছে। সেই গভীর বনে, গভীর অন্ধকারের মধ্যে দেউলে দেউলে ত্রিমূর্তি মহাদেবের পূজা হচ্ছে। সুগন্ধ দীপবর্তিকার আলোকে মন্দিরাভ্যন্তর আলোকিত। প্রাসাদের বাতায়ন বলভিতে শুকসারী তন্দ্রামগ্ন।

সুশীল বললে–আমায় কোথা নিয়ে যাবেন?

সে কথা বলব না। ভয় পাবি—

তবুও শুনি, বলুন–

বহুদিনের বহু ধ্বংস, অভিশাপ, মৃত্যুর দীর্ঘশ্বাসে এ পুরীর বাতাস বিষাক্ত, এখানে প্রবেশ করবার দুঃসাহসের প্রশংসা করি। কিন্তু এর মূল্য দিতে হবে।

কী?

একজনের প্রাণ। সমুদ্রমেখলা এ দ্বীপের বহু শতাব্দীর গুপ্ত কথা ঘন বন ঢেকে রেখেছিল। ভারত মহাসমুদ্র স্বয়ং এর প্রহরী, দেখতে পাও না?

আজ্ঞে, তা দেখছি বটে।

তবে সে-রহস্য ভেদ করতে এসেছ কেন?

আপনি তো জানেন সব।

সম্রাটের ঐশ্বর্য গুপ্ত আছে এর মধ্যে। কিন্তু সে পাবে না। যে অদৃশ্য আত্মারা তা পাহারা দিচ্ছে, তারা অত্যন্ত সতর্ক, অত্যন্ত হিংসুক। কাউকে তারা নিতে দেবে না। তবে তুমি ভারতবর্ষের সন্তান, তোমাকে একেবারে বঞ্চিত করব না আমি–রহস্য নিয়ে যাও, অর্থ পাবে না। যা পাবে তা সামান্য। তারই জন্যে প্রাণ দিতে হবে।

আপনি বিহ্মমুনি?

মুখ! আমি এই নগরীর অধিদেবতা। ধ্বংসস্তূপ পাহারা দিচ্ছি শতাব্দীর পর শতাব্দী। অনেকদিন পরে তুমি ভারতবর্ষ থেকে এসেছ–আটশো বছর আগে তোমাদের সাহসী পূর্বপুরুষরা অস্ত্র হাতে এখানে এসে রাজ্যস্থাপন করেন। দুর্বল হাতে তাঁরা খড়গ ধরতেন না। তোমরা সে-দেশ থেকেই এসেছ কি? দেখলে চেনা যায় না কেন?

সেটা আমাদের অদৃষ্টের দোষ, আমাদের ভাগ্যলিপি।

তারপরেই সব অন্ধকার। সুশীল সেই অদৃষ্টপূর্ব পুরুষের সঙ্গে সেই সূচিভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে কোথায় যেন চলেছে..চলেছে…মাথার ওপর কৃষ্ণা নিশীথিনীর জ্বলজ্বলে নক্ষত্ৰভরা আকাশ।

পুরুষটি বললেন–সাহস আছে? তুমি ভারতবর্ষের সন্তান—

নিশ্চয়ই দেব।

নগরী বহুদিন মৃতা, কিন্তু বহু যুগের পুরাতন কৃষ্ণাগুরুর ধূপগন্ধে আমোদিত অরণ্যতরুর ছায়ায় ছায়ায় অজানা পথযাত্রার যেন শেষ নেই।

বিশাল পুরী, প্রেতপুরীর সমান নিস্তব্ধ। রাজপ্রাসাদের বিস্তৃত কক্ষে, দামি নীলাংশুকের আস্তরণে ঢাকা স্বর্ণ-পর্যঙ্ক কোন অপরিচিতের অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত। সুশীলের বুক গুরুগুরু করে উঠল, গৃহের রত্নপ্রস্তরের ভিত্তিতে যেন অমঙ্গলের লেখা। ভবনদর্পণে প্রতিফলিত হয়ে উঠবে এখনি যেন কোন বিভীষণা অপদেবীর বিকট মূর্তি!

পুরুষ বললেন–ওই শোনো–

সুশীল চমকে উঠল। যেন কোন নারীকন্ঠের শোকার্ত চিৎকারে নিশীথ নগরীর নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল। সে-নারীর কণ্ঠস্বরকে সে চেনে। অত্যন্ত পরিচিত কণ্ঠস্বর! খুব নিকট আত্মীয়ার বিলাপধ্বনি। সুশীলের বুক কেঁপে উঠল। ঠিক সেইসময় বাইরে থেকে কে ডাকলে–বাবুজি–বাবুজি–

তার ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা ঘামে ভেসে গিয়েছে। জামাতুল্লা বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকছে। দিনের আলো ফুটছে তাঁবুর বাইরে।

জামাতুল্লা বললে–উঠুন বাবুজি।

সুশীল বিমূঢ়ের মতো বললে–কেন?

ভোর হয়েছে। ইয়ার হোসেনের লোক এখনো ওঠেনি–আমাদের কেউ কোনো সন্দেহ না করে। সনৎবাবুকে ওঠাই—

একটু বেলা হলে ইয়ার হোসেন উঠে ওদের ডাকলে। বললে–পরশু এখান থেকে তাঁবু ওঠাতে হবে। জাঙ্কওয়ালা চীনেম্যান আমার নিজের লোক। ও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আর থাকতে চাইছে না। এখানে আপনারা এলেন ফোটো তুলতে আর ছবি আঁকতে এত পয়সা খরচ এর জন্যে করিনি।

সুশীল বললে–যা ভালো বোঝেন মি. হোসেন।

সনৎ বললে–তাহলে দাদা, আমাদের সেই কাজটা এই দু-দিনের মধ্যে সারতে হবে। ইয়ার হোসেন সন্দেহের সুরে বললে–কী কাজ?

সুশীল বললে–বনের মধ্যের একটা মন্দিরের গায়ে পাথরের ছবি আছে, সেটা আমি আঁকছি। সনৎ ফোটো নিচ্ছে তার।

ইয়ার হোসেন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে বললে–ওই করতেই আপনারা এসেছিলেন আর কী! করুন যা হয় এই দু-দিন।

সনৎ বললে–তাহলে চলো দাদা আমরা সকাল সকাল খেয়ে রওনা হই।

ইয়ার হোসেনের অনুমতি পেয়ে ওদের সাহস বেড়ে গেল। দিন দুপুরেই ওরা দুজন রওনা হয়ে গেল–শাবল, গাঁতি, টর্চ ওরা কিছুই আনেনি, সিঁড়ির মুখের প্রথম ধাপে রেখে এসেছে। শুধু ক্যামেরা আর রিভলবার হাতে বেরিয়ে গেল।

জামাতুল্লা গোপনে বললে–আমি কোন ছুতোয় এরপরে যাব। একসঙ্গে সকলে গেলে চালাক ইয়ার হোসেন সন্দেহ করবে। আজ কাজ শেষ করতে হবে মনে থাকে যেন, হয় এসপার নয়তো ওসপার। আর সময় পাব না।

সনৎ বললে–মনে থাকে যেন একথা। আজ আর ফিরব না শেষ না দেখে।

সুশীলের বুকের মধ্যে যেন কেমন করে উঠল সনতের কথায়। সনতের মুখের দিকে ও চাইলে। কেন সনৎ হঠাৎ এ কথা বললে?

আবার সেই অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে রহস্যময় গহ্বরে সুশীল ও সনৎ এসে দাঁড়াল। আসবার সময় সিঁড়ির প্রথম ধাপ থেকে ওরা গাঁতি ও টর্চ নিয়ে এসেছে। পাথরে নর্তকীমূর্তি দেওয়ালের গায়ে এক জায়গায় কাত করে রাখা হয়েছে। যেন জীবন্তপুরী দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। সুশীল সে-দিকে চেয়ে বললে–আর কিছু না পাই, এই পুতুলটা নিয়ে যাব। সব খরচ উঠে এসেও অনেক টাকা লাভ থাকবে–শুধু ওটা বিক্রি করলে।

তারপর দু-জনে নীচের পাথরের চৌবাচ্চাটাতে নামল।

সনৎ বললে–উত্তর কোণের গায়ে চিহ্নটা দেখতে পাচ্ছ দাদা!

-–এখন কিছু কোরো না, জামাতুল্লাকে আসতে দাও।

সনৎ ছেলেমানুষ, সে সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল। বাংলা দেশের পাড়াগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করে একদিন যে জীবনে এমন একটা রহস্যসংকুল পথযাত্রায় বেরিয়ে পড়বে, কবে সে একথা ভেবেছিল? সুশীল কিন্তু বসে বসে অন্য কথা ভাবছিল।

গত রাত্রের স্বপ্নের কথা তার স্পষ্ট মনে নেই, আবছাভাবে যতটুকু মনে আছে, সে যেন গতরাত্রে এক অদ্ভুত রহস্যপুরীর পথে পথে কার সঙ্গে অনির্দেশ যাত্রায় বার হয়েছিল, কত কথা যেন সে বলেছিল, সব কথা মনে হয় না। তবুও যেন কী এক অমঙ্গলের বার্তা সে জানিয়ে দিয়ে গিয়েছে, কী সে বার্তা, কার সে অমঙ্গল কিছুই স্পষ্ট মনে নেই–অথচ সুশীলের মন ভার ভার, আর যেন তার উৎসাহ নেই। এ কাজে ফিরবার পথও তো নেই।

ওপরের ঘর থেকে জামাতুল্লা উঁকি মেরে বললে–সব ঠিক।

এসেছ?

হাঁ বাবুজি। অনেকটা দড়ি এনেছি লুকিয়ে–

নেমে পড়ো।

আপনার ক্যামেরা এনেছেন?

কেন বল তো?

ইয়ার হোসেনকে ফাঁকি দিতে হলে ক্যামেরাতে ফোটো তুলে নিয়ে যেতে হবে—

সব ঠিক আছে।

জামাতুল্লা ওদের সঙ্গে এসে যোগ দেবার অল্পক্ষণ পরেই সনৎ হঠাৎ কী ভেবে দেওয়ালের উত্তর কোণের সে চিহ্নটা চেপে ধরলে এবং সঙ্গেসঙ্গে পাথরের চৌবাচ্চার তলা একদিকে কাত হয়ে উঠতেই ফাঁক দিয়ে সনৎ নীচের দিকে অতলস্পর্শ অন্ধকারে লাফিয়ে পড়ল।

সুশীল ও জামাতুল্লা দু-জনেই চমকে চিৎকার করে উঠল। অমন অতর্কিতভাবে সনৎ লাফ মারতে গেল কেন, ওরা ভেবে পেল না।

কিন্তু লাফ মারলে কোথায়।

জামাতুল্লা সভয়ে বললে–সর্বনাশ হয়ে গেল বাবুজি। তারপর ওরা দুজনেই কিছু না ভেবেই পাথরের চৌবাচ্চার তলার ফাঁক দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ল।

ওরা ঘোর অন্ধকারের মধ্যে নিজেদের দেখতে পেলে।

সনৎ অন্ধকারের ভেতর থেকেই বলে উঠল–দাদা, টর্চ জ্বালো আগে, জায়গাটা কীরকম দেখতে হবে—

ওরা টর্চ জ্বেলে চারিদিক দেখে অবাক হয়ে গেল। ওরা একটা গোলাকার ঘরের মধ্যে নিজেদের দেখতে পেলে–ঘরের দু-কোণে দুটো বড়ো পয়োনালির মতো কেন রয়েছে ওরা বুঝতে পারলে না। ছাদের যে জায়গায় কড়িকাঠের অগ্রভাগ দেওয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবার কথা, সেখানে দুটো বড়ো বড়ো পাথরের গাঁথুনি পয়োনালি, একটা এদিকে, আর একটা ওদিকে। সমস্ত ঘরটায় জলের দাগ, মেঝে ভয়ানক ভিজে ও স্যাঁৎসেঁতে, যেন কিছুক্ষণ আগে ও ঘরে অনেকখানি জল ছিল।

জামাতুল্লা বললে–এ ঘরে এত জল আসে কোথা থেকে বাবুজি?

সুশীল কিছু বলতে পারলে না; প্রকান্ড ঘর, অন্ধকারের মধ্যে ঘরের কোথায় কী আছে ভালো বোঝা যায় না।

সনৎ বললে–ঘরের কোণগুলো অন্ধকার দেখাচ্ছে, ওদিকে কী আছে দেখা যাক–

টর্চ ধরে তিন জনে ঘরের একদিকের কোণে গিয়ে দেখে অবাক চোখে চেয়ে রইল।

ঘরের কোণে বড়ো বড়ো তামার জালা বা ঘড়ার মতো জিনিস, একটার ওপর আর একটা বসানো, ঘরের ছাদ পর্যন্ত উঁচু। সে-দিকের দেওয়ালের গা দেখা যায় না– সমস্ত দেওয়াল ঘেঁসে সেই ধরনের রাশি রাশি তামার জালা–ওরা এতক্ষণ ভালো করে দেখেনি, সেই তামার জালার রাশিই অন্ধকারে দেওয়ালের মতো দেখাচ্ছিল।

জামাতুল্লা বললে–এগুলো কী বাবুজি?

সুশীল বললে–আমার মনে হয় এটাই ধনভান্ডার।

সনৎ বললে–আমরা ঠিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি—

জামাতুল্লা হঠাৎ অন্য দেওয়ালের দিকে গিয়ে বললে–এই দেখুন বাবুজি–

সে-দিকে দেওয়ালের গায়ে বড়ো বড়ো কুলুঙ্গির মতো অসংখ্য গর্ত। প্রত্যেকটার মধ্যে ছোটো-বড়ো কৌটোর মতো কী সব জিনিস।

সুশীল বললে–যাতে-তাতে হাত দিও না; এসব পাতাল-ঘরে সাপ থাকা বিচিত্র নয়। এই ঘোর অন্ধকারে পাতালপুরী বিষাক্ত সাপের রাজ্য হওয়াই বেশি সম্ভব।

কিন্তু চারিদিকে ভালো করে টর্চ ফেলে দেখেও সাপের সন্ধান পাওয়া গেল না।

সনৎ ও জামাতুল্লা কুলুঙ্গি থেকে একটা কৌটো বার করে দেখলে। ভেতরে যা আছে তা দেখে ওরা খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল না। এ কী সম্ভব, এত বড়ো একটা প্রাচীন সাম্রাজ্যের গুপ্ত ধনভান্ডারে এত কান্ড করে পাতালের মধ্যে ঘর খুঁড়ে তাতে পুরোনো হরতুকি রাখা হবে?

ওদের হতভম্ব চেহারা দেখে সুশীল বললে–কী ওর মধ্যে?

সনৎ বললে–পুরোনো হরতুকি দাদা—

দূর পাগল–হরতুকি কী রে?

এই দেখো—

সুশীল গোল গোল ছোটো ফলের মতো জিনিস হাতে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে বললে–আমি জানিনে এ কী জিনিস, কিন্তু যখন এত যত্ন করে একে রাখা হয়েছে, তখন এর দাম আছে। থলের মধ্যে নাও দু-এক বাক্স–

সব কৌটোগুলোর মধ্যে সেই পুরোনো হরতুকি!

ওরা দস্তুরমতো হতাশ হয়ে পড়ল। এত কষ্ট করে পুরোনো হরতুকি সংগ্রহ করতে ওরা এতদূর আসেনি।

হঠাৎ সুশীল বলে উঠল–আমার একটা কথা মনে হয়েছে—

সনৎ বললে–কী দাদা?

এ জিনিস যাই হোক, এ-ই ছিল পুরোনো সাম্রাজ্যের প্রচলিত মুদ্রাকারেন্সি–এই আমার স্থির বিশ্বাস। সঙ্গে নাও কিছু পুরোনো হরতুকি–

জামাতুল্লা অনেক কৌশল করে একটা তামার জালা পাড়লে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তার ঢাকনি খোলা গেল না। জামাতুল্লা বিরক্ত হয়ে বললে–এ কি রিবিট করে এঁটে দেওয়া বাবুজি? এ খোলবার হদিশ পাচ্ছি নে যে–

টানাটানি করতে গিয়ে একটা ঢাকনি খটাং করে খুলে গেল।

সনৎ বললে–দেখো ওর মধ্যে থেকে আবার পুরোনো আমলকি না বার হয় দাদা—

কিন্তু জালাটা উপুড় করে ঢাললে তার মধ্যে থেকে বেরোলো রাশি রাশি নানা রং-বেরঙের পাথর। দামি জিনিস বলে মনে হয় না। সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলে যেকোনো নদীর ধারে এমনি নুড়ি অনেক পাওয়া যায়।

জামাতুল্লা বললে–তোবা! তোবা! এসব কী চিজ বাবুজি?

কতকগুলো কৌটোর মধ্যে শনের মতো সাদা জিনিসের গুলির মতো। মনে হয় বহুকাল আগে শনের নুড়িগুলিতে কোনো গন্ধদ্রব্য মাখানো ছিল–এখনও তার খুব মৃদু সুগন্ধ শনের নুড়িগুলোর গায়ে মাখানো।

সনৎ বললে–দাদা, ওটা তাদের ওষুধ-বিষুদ রাখার ভাঁড়ার ছিল না তো?

জামাতুল্লা বললে–কী দাওয়াই আছে এর মধ্যে বাবুজি?

তা তুমি আমি কী জানি? প্রাচীন যুগের লোকের কত অদ্ভুত ধারণা ছিল। হয়তো তাদের বিশ্বাস ছিল এই সবই অমর হওয়ার ওষুধ।

হঠাৎ সুশীল একটা জালার মুখ খুলে বলে উঠল–দেখি, বোধহয় টাকা! জালা উপুড় করলে তার মধ্যে থেকে পড়ল একরাশ বড়ো বড়ো চাকতি, বড়ো বড়ো মেডেলের আকারের, প্রায় সিকি ইঞ্চি পুরু।

সুশীল একখানা চাকতি হাতে করে বললে–সোনা বলে মনে হয় না?

জামাতুল্লা বললে–আলবৎ সোনা–তবে টাকা বা মোহর নয়।

সুশীল বললে–কোনোরকম ছাপ নেই। মুদ্রা করবার জন্যে এগুলো তৈরি করা হয়েছিল–কিন্তু তারপর ছাপ এতে মারা হয়নি। এ অনেক আছে–

সনৎ বললে–সবরকম কিছু কিছু নাও দাদা—

জামাতুল্লা বললে–এ যদি সোনা হয়–এই এক জালার মধ্যেই লাখ টাকার সোনা—

সুশীল আর একটা জালা পেড়ে ঢাকনি খুলে উপুড় করে ঢাললে। তার মধ্যেও অবিকল অমনি ধাতব চাকতি একই আকারের, একই মাপের।

জামাতুল্লা বললে–শোভানাল্লা! দু-লাখ হল–যদি আমরা দেখি সব জালাতেই এ-রকম–

এই সময় সুশীল প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল–শিগগির এদিকে এসো—

ওরা গিয়ে দেখলে অন্ধকার ঘরের কোণে কতকগুলো মানুষের হাড়গোড়–ভালো করে টর্চ ফেলে দেখা গেল, দুটো নরকঙ্কাল!

সেই সূচিভেদ্য অন্ধকার পাতালপুরীর মধ্যে নরকঙ্কালদুটো যেন ওদের সমস্ত আশা ও চেষ্টাকে দাঁত বার করে উপহাস করছে। কাল রাত্রে স্বপ্নের কথা ওর মনে এল, মৃত্যুর চেয়ে মহারহস্য জগতে কী আছে? মূঢ় লোকে চারিপাশে মৃত্যু অহরহ দেখছে, অথচ ভাবে না কী গভীর রহস্যপুরীর দ্বারপালস্বরূপ ইহলোক ও পরলোকের পথে মৃত্যু আছে দাঁড়িয়ে।…

নরকঙ্কালটি কী কথা না জানি বলত যদি এরা এদের মরণের ইতিহাস ব্যক্ত করতে পারত? সে হয়তো দুর্নিবার লোভ ও নৃশংস অর্থলিপ্সার ইতিহাস, হয়তো তা রক্তপাতের ইতিহাস, জীবন-মরণ নিয়ে খেলার ইতিহাস, ভাই হয়ে ভায়ের বুকে ছুরি বসানোর ইতিহাস…

জামাতুল্লা কঙ্কালগুলো সরিয়ে রাখতে গিয়ে বললে–হাড় ভেঙে যাচ্ছে বাবুজি বহুৎ পুরোনো আমলের হাড়গোড় এসব। কমসে কম এক-শো-দেড়-শো বছরের পুরোনো–কিন্তু দেখুন বাবুজি মজা, হাড়ের গায়ে এসব কী?

ওরা হাতে করে নিয়ে দেখলে।

প্রায় এক ইঞ্চি করে লবণের স্তর শক্ত হয়ে জমাট বেঁধে আছে কঙ্কালের ওপরে। সুশীল ভালো করে টর্চের আলো ফেলে বললে–চোখের কোটরগুলো নুনে বুজোনো–দেখো চেয়ে!

এর যে কী কারণ ওরা কিছুই ঠিক করতে পারলে না।

অন্ধকার পাতালপুরীর শহরে ওদের হাড়ে নুন মাখাতে এসেছিল কে?

সে-সময়ে সনৎ বললে–দেখো দাদা, দেখো জামাতুল্লা সাহেব–এটা কীসের দাগ?

ওরা পিছন ফিরে চেয়ে দেখলে সনৎ টর্চ ফেলে দেওয়ালের গায়ের একটা সাদা রেখার দিকে চেয়ে কথা বলছে। রেখাটা লম্বা অবস্থায় দেওয়ালের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত টানা।

জামাতুল্লা বললে–এ দাগ নোনা জলের দাগ–খুব টাটকা দাগ।

সুশীল ও সনৎ হতভম্ব হয়ে বললে–তার মানে? জল আসবে কোথা থেকে?

জামাতুল্লা বললে–বড় অন্ধকার জায়গা, ভালো করে কিছুই তো মালুম পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু একবার ভালো করে ঘরের চারিধারে দেখা দরকার। অজানা জায়গায় সাবধান থাকাই ভালো। এত স্যাঁৎসেঁতে কেন ঘরটা, আমি অনেকক্ষণ থেকে তাই ভাবছি।

জামাতুল্লা ও সনৎ হাতড়ে হাতড়ে সোনার চাকতি বের করে থলের মধ্যে একরাশ পুরে ফেলল–পাথরের নুড়িও কিছু নিলে–বলা যায় না যদি এগুলি কোনো দামি পাথর হয়ে পড়ে! বলা যায় কী! সনৎ ছেলেমানুষ, সে এত সোনার চাকতি দেখে কেমন দিশেহারা হয়ে গেল–উন্মত্তের মতো আঁজলা ভরে চাকতি সংগ্রহ করে তার তামার জালার মধ্যে থেকে, আর থলের ভেতর পুরে নেয়। যেন এ আরব্য উপন্যাসের একটা গল্প–কিংবা রূপকথার মায়াপুরী–পাতালপুরীর ধনভান্ডার! বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায় বেলা দশটা থেকে বিকেল ছ-টা এস্তেক কলম পিষে সাঁইত্রিশ টাকা ন-আনা রোজগার করতে হয় সারা মাসে। সেই হল। রূঢ় বাস্তব পৃথিবী–মানুষকে ঘা দিয়ে শক্ত করে দেয়। আর এখানে কী, না–হাতের আঁজলা ভরে যত ইচ্ছে সোনা নিয়ে যাও, হীরে নিয়ে যাও–এ আলাদা জগৎ–পৃথিবীর অর্থনৈতিক আইনকানুনের বাইরে।

বহু প্রাচীনকালের মৃত সভ্যতা এখানে প্রাচীন দিনের সমস্ত বর্বর প্রাচুর্য ও আদিম অর্থনীতি নিয়ে সমাধিগর্ভে বিস্মৃতির ঘুমে অচেতন–এ দিন বাতিল হয়ে গিয়েছে, এ সমাজ বাতিল হয়ে গিয়েছে–একে অন্ধকার গহ্বর থেকে টেনে দিনের আলোয় তুলে বিংশ শতাব্দীর জগতে আর অর্থনৈতিক বিভ্রাট ঘটিও না।…

হঠাৎ কীসের শব্দে সুশীলের চিন্তার জাল ছিন্ন হল–বিরাট, উন্মত্ত, প্রচন্ড শব্দ–যেন সমগ্র নায়াগ্রা জলপ্রপাত ভেঙে ছুটে আসছে কোথা থেকে–কিংবা শিবের জটা থেকে যেন গঙ্গা ভীম ভৈরব বেগে ইন্দ্রের ঐরাবতকে ভাসিয়ে মর্ত্যে অবতরণ করছেন।

জামাতুল্লার চিৎকার শোনা গেল সেই প্রলয়ের শব্দের মধ্যে–জল! জল! পালান–ওপরে উঠুন–

জামাতুল্লার কথা শেষ না হতে সুশীলের হাঁটু ছাপিয়ে কোমর পর্যন্ত জল উঠল– কোমর থেকে বুক লক্ষ করে দ্রুতগতিতে ওঠবার সঙ্গেসঙ্গে জামাতুল্লা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে– ওই দেখুন বাবু!

সুশীল সবিস্ময়ে ও সভয়ে চেয়ে দেখলে ঘরের ছাদের কাছাকাছি সেই দুটো পয়োনালা দিয়ে ভীষণ তোড়ে জল এসে পড়ছে ঘরের মধ্যে। চক্ষের নিমেষে ওরা ইঁদুর-কলে আটকা পড়ে জলে ডুবে দম বন্ধ হয়ে মরবে!… কিন্তু উঠবে কোথায়! উঠবে কীসের সাহায্যে? এ ঘরে সিঁড়ি নেই আগেই দেখে এসেছে।

সুশীল চিৎকার করে বললে–সনৎ–সনৎ ওপরে ওঠ–শিগগির—

সনৎ বললে–দাদা! তুমি আমার হাত ধরো–হাত ধরো–

তারপর হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল–পুরোনো রাজাদের পোষ-মানা বেতাল যেন কোথায় হা হা করে বিকট অট্টহাস্য করে উঠল–সম্মুখে মৃত্যু! উদ্ধার নেই!

এ জলে সাঁতার দেওয়া যাবে না সুশীল জানে–এ মরণের ইঁদুরকল। বুক ছাপিয়ে জল তখন উঠে প্রায় নাকে ঠেকে-ঠেকে–

কে যেন অন্ধকারের মধ্যে চেঁচিয়ে উঠল–দাদা-দাদা–আমার হাত ধরো–দাদা–

একজোড়া শক্ত বলিষ্ঠ হাত ওকে ওপরের দিকে তুললে টেনে। ঘন অন্ধকার। টর্চ কোথায় গিয়েছে সেই উন্মত্ত জলরাশির মধ্যে। সুশীলের প্রায় জ্ঞান নেই। সে ডাকছে–কে? সনৎ?

কোনো উত্তর নেই। কেউ কাছে নেই।

সুশীলের ভয় হল। সে চেঁচিয়ে ডাকলে–সনৎ! জামাতুল্লা!

তার পায়ের তলায় উন্মত্ত গর্জনে যেন একটা পাহাড়ের মাথার হ্রদ খসে পড়েছে। উত্তর দেয় না কেউ-না সনৎ, না জামাতুল্লা।

প্রায় দশ মিনিট পরে জামাতুল্লা বললে–বাবু, জলদি আমার হাত পাকড়ান–

কেন?

পাকড়ান হাত–উপরে উঠব–সাবধান!

সনৎ, সনৎ কোথায়? তাকে রেখে এলে উপরে!

জলদি হাত পাকড়ান–হুঁ—

কত যুগ ধরে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে সে ওঠা প্রলয়ের অন্ধকারের মধ্য দিয়ে– তারপর কতক্ষণ পরে পৃথিবীর ওপর এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচা পাতালপুরীর গহ্বর থেকে! বনের মধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার যেন ঘনিয়ে এসেছে। সুশীল ব্যথভাবে বললে–সনৎ কই? তাকে কোথায়

জামাতুল্লা বিষাদ-মাখানো গম্ভীরসুরে বললে–সনবাবু নেই–আমাদের ভাগ্য বাবুজি—

সুশীল বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে বললে–নেই মানে?

সনবাবু তো পাতালপুরী থেকে ওঠেননি–তাঁকে খুঁজে পাইনি। আপনাকে তুলে ওপরে রেখে তাঁকে খুঁজতে যাব এমন সময় ঘরের মেঝে দুলে উঠে এঁটে গেল। তিনি থেকে গেলেন তলায়–আমরা রয়ে গেলাম ওপরে। তাঁকে খুঁজে পাই কোথায়?

সে কী! তবে চলে গিয়ে খুঁজে আনি!

জামাতুল্লা বিষাদের হাসি হেসে বললে–বাবুজির মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, এখন কিছু বুঝবেন না। একটু ঠাণ্ডা হোন, সব বলছি। সনৎবাবুকে যদি পাওয়া যেত তবে আমি তাঁকে ছেড়ে আসতাম না।

কেন? সনৎ কোথায়? হ্যাঁরে, আমি তোকে ছেড়ে বাড়ি গিয়ে মার কাছে, খুড়িমার কাছে কী জবাব দেব?–কেন তুমি তাকে পাতালে ফেলে এলে?

জামাতুল্লা নিজের কপালে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললে–নসীব, বাবুজি–

উদভ্রান্ত সুশীলের বিহ্বল মস্তিষ্কে ব্যাপারটা তখনও ঢোকেনি। জলের মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে দম বন্ধ হয়ে সনৎ ওপরে উঠবার চেষ্টা করেও উঠতে পারেনি। অন্ধকারের মধ্যে জামাতুল্লাও ওকে খুঁজে পায়নি। ওরই হাত ধরে টেনে তুলবার পরে ঘরের মেঝে এঁটে গিয়ে রত্নভান্ডারের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ওই ঘরে ছাদ পর্যন্ত জল ভরতি হয়ে গিয়েছে এতক্ষণ–সেখানে মানুষ কতক্ষণ থাকতে পারে?

সুশীল ক্রমে সব বুঝলে ওপরে উঠে এসে মাথায় ঠাণ্ডা হাওয়া লাগানোর পরে। একটা গভীর শোক ও হতাশায় সে একেবারে ডুবে যেত হয়তো, কিন্তু ঘটনাবলির অদ্ভুতত্ত্বে সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ল। কোথায় অন্ধকার পাতালপুরীতে পুরাকালের ধনভান্ডার, সে ধনভান্ডার অসাধারণ উপায়ে সুরক্ষিত … এমন কৌশলে, যা একালে হঠাৎ কেউ মাথায় আনতেই পারত না!

জামাতুল্লা বললে–পানি দেখে তখনি আমার সন্দেহ হয়েছে। আমি ভাবছি, এত নোনা পানি কেন ঘরের মধ্যে।

সুশীল বললে–আমাদের তখনই বোঝা উচিত ছিল জামাতুল্লা। তাহলে সনৎ আজ এভাবে–

তখন কী করে জানব বাবুজি? ওই নালিদুটো গাঁথা আছে–ও দিয়ে জোয়ারের সময় সমুদুরের নোনা পানি ঢোকে–দিনে একবার রাতে একবার। আমার কী মনে হয় জানেন বাবুজি, ওই দুটো নালি এমন ফন্দি করে গাঁথা হয়েছিল যে–

সুশীল বললে–আমার আর একটা কথা মনে হয়েছে জান? ওই দুটো নরকঙ্কাল যা দেখলে, আমাদেরই মতো দুটো লোক কোনোকালে ওই ঘরে ধনরত্ন চুরি করতে গিয়ে সমুদ্রের নোনা জলে হাবুডুবু খেয়ে ডুবে মরেছে। মুখের মতো ঢুকেছে, জানত না। যেমন আমরা–সনৎ যেমন–

কী জানত না?

যে স্বয়ং ভারত মহাসমুদ্র প্রাচীন চম্পারাজ্যের রত্নভান্ডারের অদৃশ্য প্রহরী। কেউ কোনোদিন সে-ভান্ডার থেকে কিছু নিতে পারবে না, মানমন্দিরের রত্নশৈল তার একখানি সামান্য নুড়িও হারাবে না। সুশীল বললে–কিন্তু জল যায় কোথায় জামাতুল্লা? এত জল? আমার কী মনে হয় জান—

আমারও তা মনে হয়েছে। ওই ঘরের নীচে আর একটা ঘর আছে, সেটা আসল ধনভান্ডার। বেশি জল বাধলে ঘরের মেঝে একদিকে ঢাল হয়ে পড়ে জলের চাপে–সব জল ওপরের ঘর থেকে নীচের ঘরে চলে যায়।

সুশীল বললে–স্টিম পাম্প আনলেও তার জল শুকোনো যাবে না, কারণ–তাহলে গোটা ভারত মহাসাগরকেই স্টিম পাম্প দিয়ে তুলে ফেলতে হয়–ওর পেছনে রয়েছে গোটা ভারত সমুদ্র। সে জামাতুল্লার দিকে চেয়ে বিষাদের সুরে বললে–এই হল তোমার আসল বিহ্মমুনি সমুদ্র, বুঝলে জামাতুল্লা?

ওরা সেই বনের গভীরতম প্রদেশের একটা পুরোনো মন্দির দেখলে। মন্দিরের মধ্যে এক বিরাট দেবমূর্তি, সুশীলের মনে হল, সম্ভবত বিষ্ণুমূর্তি।

যুগযুগান্ত কেটে গেছে, মাথার ওপরকার আকাশে শত অরণ্যময়ূরীদের নর্তন শেষ হয়ে আবার শুরু হয়েছে, রক্তাশোকতরুর তলে কত সুখসুষুপ্ত হংসমিথুনের নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে– সাম্রাজ্যের গৌরবের দিনে ঘৃতপক্ক অমৃতচরুর চারু গন্ধে মন্দিরের অভ্যন্তর কতদিন হয়েছে আমোদিত–কত উত্থান, কত পতনের মধ্যে দেবতা অবিচল দৃষ্টিতে বহুদূর অনন্তের দিকে চেয়ে আছেন, মুখে সুকুমার সব্যঙ্গ মৃদু চাপা হাসি–নিরুপাধি চেতনা যেন পাষাণে লীন, আত্মস্থ।

সুশীল সসম্ভ্রমে প্রণাম করল-দেবতা, সনৎ ছেলেমানুষ–ওকে তোমার পায়ে রেখে গেলুম–ক্ষমা করো তুমি ওকে!

* * * *

সুশীল কলকাতায় ফিরেছে।

কারণ যা ঘটে গেল, তার পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। ইয়ার হোসেন সন্দেহ করেনি। সনৎ একটা কূপের মধ্যে পড়ে মরে গিয়েছে শুনে ইয়ার হোসেন খুঁজে দেখবার আগ্রহও প্রকাশ করেনি। চীনা মাঝি জাঙ্ক নিয়ে এসেছিল–তারই জাঙ্কে সবাই ফিরল সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুর থেকে অস্ট্রেলিয়ান মেলবোট ধরে কলম্বো।

কলম্বোর এক জহুরির দোকানে জামাতুল্লা সেই হরতুকির মতো জিনিস দেখাতেই বললে –এ খুব দামি জিনিস, ফসিল অ্যাম্বার–বহুকালের অ্যাম্বার কোনো জায়গায় চাপা পড়ে ছিল।

দু-খানা পাথর দেখে বললে–আনকাট এমারেল্ড, খুব ভালো ওয়াটারের জিনিস হবে কাটলে। আন্নামালাইয়ের জহুরিরা এমারেল্ড কাটে, সেখানে গিয়ে কাটিয়ে নেবেন। দামে বিকোবে।

সবশুদ্ধ পাওয়া গেল প্রায় সত্তর হাজার টাকা। ইয়ার হোসেনকে ফাঁকি না দিয়ে ওরা তাকে তার ন্যায্য প্রাপ্য দশ হাজার টাকা পাঠালে–সেই মাদ্রাজি বিধবাকে পাঠালে বিশ হাজার–বাকি টাকা তিন ভাগ হল জামাতুল্লা, সনতের মা ও সুশীলের মধ্যে।

টাকার দিক থেকে এমন কিছু নয়, অভিজ্ঞতার দিক থেকে অনেকখানি। কত রাত্রে গ্রামের বাড়িতে নিশ্চিন্ত আরাম-শয়নে শুয়ে ওর মনে জাগে মহাসমুদ্র-পারের সেই প্রাচীন হিন্দুরাজ্যের অরণ্যাবৃত ধ্বংসস্তূপ … সেই প্রশান্ত ও রহস্যময় বিষ্ণুমূর্তি … হতভাগ্য সনতের শোচনীয় পরিণাম … অরণ্য মধ্যবর্তী তাঁবুতে সে-রাত্রির সেই অদ্ভুত স্বপ্ন। জীবনের গভীর রহস্যের কথা ভেবে তখন সে অবাক হয়ে যায়।

জামাতুল্লা নিজের ভাগের টাকা নিয়ে কোথায় চলে গেল, তার সঙ্গে আর সুশীলের দেখা হয়নি।

2 Comments
Collapse Comments

আমার পাঠিত উপন্যাস গুলোর মধ‍্য অন‍্যতম।

সনৎ এর মৃত্যু তে কষ্ট পেলাম ।।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *