আস্তে আস্তে উদিতের আর খারাপ লাগল না। ভাবল, তবু যা হোক, একেবারে মুখ বুজে যেতে হবে না। ওর সঙ্গে অবিশ্যি দু-তিনটি বই রয়েছে পড়বার জন্য। সব মিলিয়ে এখন পরিবারটিকে ওর ভালই লাগল। রায়গিন্নি খুবই কম কথা বলেন। রায়মশাই একটু বেশি, বোধ হয় এভাবেই ভারসাম্য রক্ষিত হয়।
কৃষ্ণা শ্যামবর্ণের ওপর, রোগা ছিপছিপে ভাবের। মাথায় বেশ বড় চুল আছে। বড় বড় চোখ দুটো উজ্জ্বল, কিন্তু শান্ত। তার ভাবভঙ্গিও শান্ত। মীনা সেই তুলনায়, একটু চঞ্চল, গায়ের রং ফরসা, চোখ তেমন বড় নয়, কিন্তু চাহনিতে একটা হাসির ছটায়, দেখতে ভালই লাগে। বারো বছরের হেনা লাজুক, ঠাণ্ডা, কিন্তু বড় হয়ে উঠছে, সে ভাবটা ওর শরীরে, চোখেমুখে সবখানে ছড়িয়ে আছে যেন। যদিও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বিশেষ বনিবনা হচ্ছে না। ইতিমধ্যে কয়েকবার, কোনও কিছু নিয়ে, হাত টানাটানি এবং ছোটখাটো গুঁতোগাতা হয়ে গিয়েছে।
রায়মশাইয়ের কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল, উদিতের বাবার সঙ্গে, তাঁর পরিচয় অনেক দিনের। পরিচয়টা এখানে নয়, পাবনাতে থাকতেই। রায়মশাইরাও পাবনার আদি বাসিন্দা। দেশ বিভাগের পরে সকলেই উত্তরবঙ্গের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। রায়মশাইয়ের কথা থেকে আরও জানা গেল, উদিতদের যে চা বাগানে শেয়ার আছে, ওঁরও সেখানে শেয়ার আছে, এবং এক সময়ে উদিতের বাবা এবং তিনি একসঙ্গে পরামর্শ করেই, শেয়ার কিনেছিলেন। রায়মশাই বললেন, ভাগ্য ভাল সে সময়ে কষ্টে ছিষ্টে কোনওরকমে শেয়ার কেনা হয়েছিল। তা না হলে এত দিনে সে টাকাও খরচ হয়ে যেত, কাজে কিছুই হত না। এখন তো তবু চায়ের দৌলতে, বছরে যাই হোক কিছু ঘরে আসে।
রায়মশাইয়ের কথা শুনে, উদিতের বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ওর বাবাও মাঝে মাঝে রায়মশাইয়ের মতো শেয়ারের কথা বলেন। পাবনা থেকে সব বিক্রি করে দিয়ে যখন জলপাইগুড়িতে এসে আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল, তখনই শেয়ার কেনা হয়েছিল। অবিশ্যি তার জন্যও নাকি অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল, এবং জলপাইগুড়ির চা জগতের একজন ক্ষমতাবান বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ধরেই, শেয়ার পাওয়া সম্ভব হয়েছিল! উদিত শুনেছে, সেই বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে, ওদের কিঞ্চিৎ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। উদিত জানে, ওর বাবাকে সেই শেয়ারের ওপর নির্ভর করেইএক সময়ে সমস্ত সংসার এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালাতে হয়েছে। রায়মশাইয়ের কথায় বাবার কথারই প্রতিধ্বনি। এমনি নানান কথাবার্তার মধ্যে আবার বন্যা প্রসঙ্গ এল। রায়মশাই বললেন, থেকে যাবার উপায় নেই, কৃষ্ণার একটা বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে কিনা।
কৃষ্ণা লজ্জা পেয়ে হেসে, মীনাকে বলল, দেখছিস, বাবা ঠিক গল্প করবেনই।
উদিত মুচকে হাসল। রায়মশাই সেদিকে কান না দিয়ে বললেন, তোমার কী মনে হয় উদিত, গঙ্গা পর্যন্ত নিশ্চয় পার হওয়া যাবে!
উদিত বলল, আমার তো তাই মনে হয়।
মীনা বলে উঠল, বলা যায় না। কী একটা নদীর নাম করে যেন লিখছে কাগজে, কাটিহারের ওদিকে অবস্থা খুব সুবিধার না।
উদিত বলল, আমি ব্যাপারটা এত তলিয়ে ভাবিইনি। দাদাও নিশ্চয় ভাবেনি, তা হলে বোধ হয় আমাকে আসতে দিত না।
মীনা এ সময়ে উদিতের দিকে তাকিয়েছিল। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল, আর উদিতের মনে হল, মেয়েটা ওকে ভীরু যাদুগোপাল ভাবছে বোধ হয়। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি লেগে রয়েছে যেন।
রায়মশাই বললেন, তা বটে, তোমার তো আর জরুরি দরকার কিছু নেই। দুটো দিন দেখে বেরোলেই ভাল করতে।
উদিত বলল, আমার কী ভাবনা বলুন। যে কোনও অবস্থাতেই আমি ঠিক চলে যেতে পারব। বান বন্যাকে আমার তেমন ভয় নেই। আপনাদেরই হবে মুশকিল
উদিত কথাটা শেষ না করে, কৃষ্ণা মীনাদের দিকে এক বার তাকাল। রায়মশাইয়ের মুখে উদ্বেগ যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। বললেন, সেই তো ভাবছি বাবা।
মীনা উদিতের দিকে চেয়ে বলে উঠল, মুশকিল আসানের জন্য আপনিই তো আছেন।
উদিত অবাক হয়ে মীনার দিকে তাকাল। কৃষ্ণাকে হেসে উঠতে দেখে, ও হাসল। রায়মশাইও হাসলেন এবং একটা আশা নিয়ে উদিতের দিকে তাকালেন।
উদিত বলল, তা সেরকম বিপদআপদ ঘটলে কি আর ছেড়ে যেতে পারব।
রায়মশাই খানিকটা খুশি ও কৃতজ্ঞতায় হেঁ হেঁ করে হেসে উঠে বললেন, তা তো বটেই বাবা, তা তো বটেই। আমাদের বিপদ হলে কি আর তুমি ছেড়ে যেতে পারবে?
কৃষ্ণা মীনা দুজনেই উদিতের দিকে তাকিয়েছিল। চোখাচোখি হতে মীনা যেন একটু লজ্জা পেল, ঠোঁট টিপে হাসল। বাইরে এখন বৃষ্টি নেই বটে, আকাশ মেঘলা। মাঠ ঘাট জলে থইথই করছে। বর্ষার সময়, এরকম থাকেই। তবু এ বছর বৃষ্টির যেন বাড়াবাড়ি।
উদিত কয়েকবার উঠে গিয়ে, দরজার কাছে আড়ালে সিগারেট খেয়ে এল।
উদিত বুঝতে পারছিল, মীনা ওর সঙ্গে একটু গল্প করতে চাইছে। উদিত যত বার দরজার কাছে উঠে গিয়ে সিগারেট খেল, প্রায় প্রতি বারেই মীনাও, একটা না একটা অছিলা করে উঠে এসেছে। প্রথম এক বার কথা না বলে, হেসে চলে গিয়েছে। উদিতের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে গেলেই মীনার চোখে একটু রং ধরে যায়। উদিত নিজেকে বিদ্রূপ করেই একটু হাসল। মীনা নিশ্চয়ই, এইটুকু সময়ের মধ্যে, ওর প্রেমে পড়ে যায়নি। আসলে মীনা কৌতুকপ্রিয়। একটু কথাবার্তা গল্প করতে ভালবাসে।
একবার মীনা বাথরুম থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছিল। উদিতের দিকে চোখ পড়তে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, খুব ফ্যাসাদে পড়ে গেছেন, না?
উদিত প্রথমে মীনার কথাটা ঠিক ধরতে পারেনি। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ফ্যাসাদে পড়ব কেন?
মীনা বলল, এই বারে বারে দরজার কাছে উঠে এসে সিগারেট খেতে হচ্ছে।
উদিত হাসল, বলল, এতে আর ফ্যাসাদের কী আছে। এ সব আমার অভ্যাস আছে।
মীনা ঠোঁট টিপে হেসে, চোখে ঝিলিক দিয়ে বলল, তবু অসুবিধে তো। বারে বারে দরজার কাছে উঠে আসতে হচ্ছে।
উদিত বলল, তা গুরুজনের সামনে যখন খেতে পারব না, তখন আর অসুবিধের কথা মনে রাখলে চলবে কেন।
মীনা বলল, এদিকে নেশা সামলানো দায়।
উদিত হেসে বলল, বোঝেন তো সবই।
মীনা যেন চলে যাবে এভাবে ঘুরতে গিয়ে, আবার উদিতের দিকে ফিরে তাকাল। বলল, দেখুন আরও কত ফ্যাসাদ আপনার কপালে আছে।
উদিত বলল, ফ্যাসাদ বলে মনে করলেই ফ্যাসাদ। আমি সে রকম কিছু মনে করছি না।
মীনার চোখের ছটার মধ্যেও একটু কৃতজ্ঞতার আভাস দেখা দিল। বলল, তা হলে আপনার দেখা পাওয়াটা সত্যি ভাগ্য বলে মানতে হবে।
বাইরে থেকে জলো হাওয়ার ঝাপটা আসছে। উদিত একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, কোনওরকম ফ্যাসাদে যে পড়তেই হবে, তা ভাবছেন কেন? দেখবেন হয়তো, শেষ পর্যন্ত বেশ ভালভাবেই পৌঁছে গেছেন।
মীনা ঘাড় নেড়ে বলল, কাগজে যা পড়ে দেখেছি তাতে আমার মনটা কেমন যেন খচ খচ করছে। একটা নদীর অবস্থাও কাগজে ভাল লেখেনি।
মীনার চোখে একটু দুশ্চিন্তার ছায়া। উদিত বলল, এত জেনেশুনে, বেরোলেন কেন?
মুহূর্তেই মীনার চোখ আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল, শুনলেন না, দিদির একটা বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয়ে গেছে?
উদিত বলে ফেলল, বিয়েটার সম্বন্ধ কি আর দুদিন দেরি হলে, ভেঙে যেত?
মীনা বলল, তাও যেতে পারে। আপনি ও সব বুঝবেন না।
উদিত মীনার দিকে তাকাল। মীনা হাসল। বলল, মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ কিনা। ছেলেদের মর্জি মাফিক চলতে হয়। তা না হলেই ভেঙে যায়।
উদিত কোনও কথা বলল না। এ সব ব্যাপার ও বোঝে না, মীনা সত্যি বলেছে। তথাপি, মীনার কথায় যেন উদিতকেও একটু খোঁচা দেবার চেষ্টা আছে। উদিত ছেলে বলেই বোধ হয়।
মীনা আবার বলল, আর বাবার অবস্থা দেখেছেন তো। না এসে আমাদের উপায় ছিল না। কিন্তু।
কথাটা শেষ না করে, মীনা সকৌতুকে ভুরু বাঁকিয়ে উদিতের দিকে তাকাল। উদিতও তাকাল। মীনা বলল, কিন্তু আপনি কেন এই দুর্যোগ মাথায় করে বেরিয়েছেন? আপনারও সেরকম কিছু ব্যাপার নাকি?
উদিত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, সেরকম কিছু ব্যাপার মানে?
মীনা কথা না বলে হাসল। উদিত মীনার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত ভাবল। ওর মুখেও একটু বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। মীনার বক্তব্য বুঝতে ওর অসুবিধে হয়নি। বলল, বিয়ে করতে যাচ্ছি কিনা বলছেন?
মীনা কথা না বলে, উদিতের চোখের দিকে তাকাল। ওর ঠোঁটে টেপা হাসি। উদিত বলল, ধরেছেন ঠিকই, তবে বিয়ে নয়, তার চেয়ে বড়, চাকরির জন্য যাচ্ছি।
মীনা ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল, বিয়ের থেকে চাকরিটা বড় বুঝি?
উদিত বলল, অন্তত ছেলেদের বেলায়। বেকার ছেলের বিয়ে হয় না।
মীনা মেনে নিয়ে বলল, তা ঠিক।
তারপরে চলে যেতে উদ্যত হয়ে বলল, আবার যখন সিগারেট খেতে আসবেন, তখন আসব। এখন যাচ্ছি।
মীনা জবাবের প্রত্যাশা না করেই চলে গেল। উদিত হাসল। মীনাকে ওর বেশ ভালই লাগছে। সহজেই কথা বলতে পারে হাসতেও পারে। মনের ভিতরে কোনও রকম প্যাঁচ পয়জার নেই। মীনার কথা ভাবতে ভাবতে, রেখার কথা মনে পড়ে গেল। রেখাও প্রথম থেকে, এমনি অনায়াসেই সেই উদিতের সঙ্গে মিশেছিল। তবে মীনা আর রেখার মধ্যে তফাতও আছে। মীনা অল্প আলাপেই বন্ধুর মতো হয়ে উঠতে চাইছে। যেন কয়েক ঘণ্টার পরিচয় নয়, তার চেয়ে বেশি। রেখা যে ওর সঙ্গে অনায়াসে মিশেছিল, তার সঙ্গে কোথায় যেন একটু অন্যরকম ভাব মিশেছিল। উদিত জানে না, সেটাকে মুগ্ধতাবোধ বলে কি না। তবে বউদির ঠাট্টার কথাগুলো, সবই কি নিছক ঠাট্টা ছিল? দিদির এই বেকার দেবরের প্রতি, রেখার মন কি, মনে মনে একটু সীমা ছাড়িয়ে যায়নি। হয়তো সেই সীমা ছাড়িয়ে যাওয়াটা তেমন দৃষ্টিকটু বা সমস্যা হয়ে ওঠেনি।
উদিত প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। যেমন একদিন রেখা বাইরে বেরিয়ে বলেছিল, খুব মুশকিলে পড়ে গেছি।
উদিত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কী মুশকিলে পড়লে?
উদিত দেখেছিল, কথাটার জবাব দিতে, রেখার যেন লজ্জা করছে। ঠোঁট টিপে হেসেছিল, মাথা নিচু করেছিল, আবার উদিতের দিকে তাকিয়েছিল। বলেছিল, এই রোজ রোজ আপনার সঙ্গে বেড়াতে বেরুনো।
উদিত বলেছিল, আমার সঙ্গে কোথায়। আমিই তো তোমার সঙ্গে বেড়াতে বেরোই।
রেখা বলেছিল, একই কথা।
উদিত বুঝতে পারেনি। জিজ্ঞেস করেছিল, মুশকিল কেন?
রেখা বলেছিল, মুশকিল না? বিকেল হতে না হতেই রোজ বেরিয়ে পড়ি।
উদিত রেখার মেয়েলি সংকোচ এবং লজ্জার কথা বুঝতে পারেনি। মনে করেছিল, বেড়াতে বেরোতে বুঝি রেখার অনিচ্ছা। সরলভাবেই বলেছিল, তা হলে না বেরোলেই হয়।
রেখা উদিতের চোখের দিকে অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকিয়েছিল। বলেছিল, আপনি কিছু বুঝতে পারেন না। আমার ভীষণ লজ্জা করে।
তারপরেও উদিত জিজ্ঞেস করেছিল, কেন?
রেখা সোজা কথা এড়িয়ে গিয়ে, ঠোঁট উলটে বলেছিল, কী জানি।
দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়েছিল। উদিত ঠিক কিছু বুঝতে না পেরে, চুপ করে ছিল। রেখাই আবার বলেছিল, সারাদিন মনে হয়, কখন বিকেল হবে। বাড়ির লোকেরাও বুঝতে পারে।
উদিত বলেছিল, আমিও তো সারাদিন বিকেলের পথ চেয়ে বসে থাকি, কখন তুমি আসবে, কখন একটু বাড়ি থেকে বেরোব।
রেখা আর কিছু বলেনি, কেবল উদিতের মুখের দিকে চেয়ে হেসেছিল। তারপরেই ওরা অন্য কথায় চলে গিয়েছিল। রেখা যেন মনে মনে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল, কবে উদিতের একটা চাকরি হবে। প্রায়ই বলত, চাকরিটা হচ্ছে না কেন?
উদিত বলত, দাদা জানে। আমার তো কিছু করার নেই। যা করছে, সবই দাদা করছে।
রেখা হেসে বলত, আমার উপায় থাকলে, আপনাকে একটা চাকরি দিয়ে দিতাম।
উদিতও হেসে বলত, আমিও বেঁচে যেতাম।
রেখার মুখ হঠাৎ হঠাৎ শুকিয়ে উঠত। বলত, এর পরে কোন দিন শুনব, আপনি কলকাতা থেকে চলে যাবেন।
তা চাকরি না পেলে তো চলে যেতেই হবে। দাদার ঘাড়ে আর কত দিন চেপে থাকব।
রেখার কথা আঁকাবাঁকা। ও বলে উঠত, আপনার সঙ্গে আর না মেশাই ভাল। উদিত বুঝতে না পেরে বলত, কেন, আমি কী করেছি।
কী আবার। কিছুই না। কলকাতায় এলেন, আমি নিয়ে বেড়ালাম, তারপরে একদিন চলে যাবেন।
রেখার স্বরে কিছু ছিল, উদিত হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারেনি। ও রেখার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল। তারপরে বলেছিল, সেভাবে চলে যেতে আমারও কষ্ট হবে।
রেখা যেন অবাক হয়ে উদিতের দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ যেন একটু লজ্জাও পেয়েছিল। কেবল জিজ্ঞেস করেছিল, সত্যি?
উদিত বলেছিল, নিশ্চয়ই।
উদিত রেখার কথা থেকে অনুমান করে নিয়েছিল, ও কলকাতা ছেড়ে চলে গেলে, রেখার খারাপ লাগবে। তাই ও নিজের কষ্টের কথা বলেছিল। সেই শেষ পর্যন্ত কলকাতা ছেড়ে ওকে চলে যেতেই হচ্ছে।
রেখার অবর্তমানে যখন ওর কথাগুলো ভেবেছে, তখন মনে হয়েছে, বউদির ঠাট্টাগুলো নিতান্ত ঠাট্টা না। রেখা যেন ক্রমেই একটু অন্যরকম হয়ে উঠছিল। উদিতের নিজেরও কি সেইরকম কিছু হয়েছিল। বুঝতে পারে না। তবে রেখাকে ওর ভাল লেগেছিল। সারাদিনে এক বার রেখার দেখা না পেলে, ওর দিনটা যেন পূর্ণ হয়ে উঠত না। রেখাকে দেখলেই ওর চোখমুখ ঝলকে উঠত। কিন্তু একলা একলা চিন্তা ভাবনার বেশির ভাগটাই ওর চাকরির ব্যাপারটা জুড়ে থাকত। রেখা ছিল, সারাদিনের মুক্তি।
নিজের কাছে কিছু গোপনীয়তা নেই এখন উদিত নিজেকে স্পষ্টই জিজ্ঞেস করতে পারছে, রেখাকে কি কখনও বিয়ে করার কথা ভেবেছে? না, এ কথা ওর কখনও মনে হয়নি। রেখার সঙ্গে ও সহজ আর সরলভাবে মিশেছে। প্রেম বলতে যা বোঝায়, তা কখনও ওর মনে আসেনি। কিন্তু আরও দু-একটি ঘটনা মনে পড়লে, রেখাকে একটু অন্যরকম মনে হয়।
বউদির ইচ্ছাতেই, একদিন উদিত, বউদির সঙ্গে দুপুরের শোতে সিনেমা দেখতে চলে গিয়েছিল। রেখা এসে অপেক্ষা করেনি, শুনেই চলে গিয়েছিল। তারপরে আর দুদিন আসেনি। তখন রেখাদের বাড়িটা উদিতের চেনা হয়ে গিয়েছিল। বউদি ওকে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিল। রেখাকে সেরকম গম্ভীর আর কখনও দেখা যায়নি। যেন উদিতের সঙ্গে কথা বলতেই চাইছিল না। তারপরে যখন বাড়ির বাইরে প্রথম কথা বলেছিল, জিজ্ঞেস করেছিল, আমাকে আগের দিন জানাতে কী হয়েছিল যে, আপনি দিদির সঙ্গে ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখতে যাবেন।
উদিত অসহায় বিস্ময়ে বলেছিল, আগের দিন কোনও কথা না হলে বলব কী করে। বউদি খেয়ে উঠে হঠাৎ বলল, সিনেমায় যাবে।
রেখা যেন অভিমানহত গলায় বলে উঠেছিল, আর অমনি আপনি চলে গেলেন।
উদিত কী জবাব দেবে, বুঝতে পারেনি। রেখা আবার বলেছিল, আর আমি যে আপনার জন্য আসব, সে কথা ভুলেই গেছলেন।
কথাটা সত্যি। রেখা যে বিকেলে আসবে, সিনেমা যাবার সময়ে, সে কথা ওর মনে ছিল না। বলেছিল, বউদি এমন তাড়া লাগাল। সব থেকে ভাল হত, আপনাকেও বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গেলে।
রেখা কথা না বলে, উদিতের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। যতক্ষণ রেখা হাসেনি, ততক্ষণ উদিতের খুব খারাপ লেগেছিল। রেখাকে গম্ভীর দেখতে মোটেই ভাল লাগে না। পরে বউদি তার বোনকে হেসে বলেছিল, আমি না হয় আমার দেওরকে নিয়ে এক দিন সিনেমায় গেছি। তা বলে তুই বেচারিকে দু দিন বাড়িতে বসিয়ে রাখলি কেন?
রেখাও হাসতে হাসতেই বলেছিল, আমিই বা কেন খালি বাড়ি ঢুরে যাব?
বউদি তেমনি হেসেই বলেছিল, তোর অবস্থাটা দেখলাম।
রেখা তাতেও বিচলিত হয়নি। বলেছিল, দ্যাখোগে। ওরকম হলে, সকলেরই রাগ হয়ে যায়।
উদিত আর একটা সিগারেট ধরাল। বড় করে একটা নিশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল, হয়তো এরকমই হয়। কিন্তু রেখা বেশ ভাল মেয়ে। আসবার সময় রেখা যথেষ্ট হাসি খুশি থাকবার চেষ্টা করেছে। চাকরি পেলে, জলপাইগুড়িতে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করতেও বলেছে। তবে হাসিখুশির আড়ালেও, ওর মুখে একটা বিষণ্ণতা দেখা গিয়েছে। এক বার উদিতকে একলা পেয়ে, হাসতে হাসতেই বলেছিল, দেখলেন তো, বলেছিলাম আপনার সঙ্গে না মেশাই ভাল।
উদিতও হেসে বলেছিল, ইচ্ছে করে তো আর যাচ্ছি না। আপনাদের কলকাতায় একটা চাকরি হল না তো কী করব।
রেখা ঘাড় নেড়ে বলেছিল, তা জানি না। মোটের ওপর আপনার সঙ্গে মেশা ঠিক হয়নি।
বলে রেখা সামনে থেকে চলে গিয়েছিল।
উদিত জানে, ওর চলে আসায় রেখা একজন বন্ধুকে হারাল। তার বেশি কিছু না। এটাকে নিশ্চয়ই প্রেম বলা যায় না। উদিতের সেরকম মনোভাব কখনও আসেনি।