ভারতে পদার্পণ
গোড়া থেকেই কোম্পানির ডিরেক্টররা ‘দি গ্র্যান্ড মোগুল’-এর দরবারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বুঝেছিল। ব্যাবসা ও ব্যাবসার পরিকাঠামো সুরক্ষিত করা যে শুধু অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হবে না, সেই উপলব্ধি তাদের ছিল। ভারতে প্রথমাগত ডাচরা সামরিক উপায়ে এবং দরকার মতো ঘুষ দিয়ে নিজেদের জন্যে জায়গা তৈরি করে নেয়। ইংরেজরা প্রায় একই ভাবে শুরু করলেও আরও সাফল্যের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা অর্থাৎ কূটনৈতিক মাধ্যমের ব্যবহার করতে পেরেছিল।
জন মিল্ডেনহল ও উইলিয়াম হকিন্স
কোম্পানি প্রতিষ্ঠার এক বছর আগে ইংল্যান্ডের দরবার থেকে জন মিল্ডেনহল নামে এক ব্যবসায়ীকে আগ্রায় পাঠানো হয়, ব্যাবসার অনুমতি চেয়ে আবেদন জানাবার জন্যে। মিল্ডেনহল মধ্যপ্রাচ্যের রাস্তা দিয়ে ভারতে এসে পৌঁছলেন ১৬০৩ সালে। তাঁকে সম্রাট আকবরের দরবারে অভ্যর্থনা জানানো হল, কিন্তু ব্যাবসার লাইসেন্স নামে যে কাগজটা তিনি পেলেন সেটা একেবারেই অকাজের। আকবরের দরবারে পর্তুগিজ ও জেসুইট পাদরিরা তখন প্রভাবশালী, তাদের চক্রান্তে মিল্ডেনহল বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না। লাভ হল এই যে মিল্ডেনহল ফারসি শিখে ফেললেন, ও ১৬০৮ সালে ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তনের পরে ফারসি জানার সুবাদে তাঁকে লেভান্ট কোম্পানির ইরান-শাখার কর্মাধ্যক্ষ করে দেওয়া হল। তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলি নিশ্চিন্তে কাটেনি। কয়েক বছর লেভান্ট কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেলে কোম্পানি ধরে নিল মিল্ডেনহল ইরানের গুপ্তচর। এই সময়ের মধ্যে তিনি এক ইরানি মেয়েকে বিয়ে করলেন, তাঁদের দুটি সন্তান হয়। বেশ কয়েক বছর বাদে কোম্পানির লোকজন যখন তাঁর সন্ধান পায় তখন মিল্ডেনহল পাঞ্জাবে, কী করছেন কেউ জানে না। তাঁর মৃত্যু হয় আজমীড়ে। মৃত্যুর আগে এক ফরাসি যুবককে তাঁর এস্টেটের অছি ঘোষণা করেন, এই যুবক তাঁর মেয়েকে বিয়ে করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মৃত্যুর পরেই হবু জামাই মিল্ডেনহলের সমস্ত কাগজপত্র ও হিসেবের বই পুড়িয়ে ফেলেন, ফলে এতগুলো বছর ভদ্রলোকের ঠিক কীভাবে কাটে, এবং ইনি সত্যিই গুপ্তচর ছিলেন কি না জানার উপায় রইল না। তবে ইনিই ভারতে ইংল্যান্ডের প্রথম রাষ্ট্রদূত।
১৬০৮ সালের আগস্ট মাসে এক নৌবহর সুরাটে পৌঁছল, ক্যাপ্টেন বিখ্যাত জাহাজি উইলিয়াম হকিন্স। ইনি সম্ভবত সেই হকিন্স যিনি ১৫৭৭ সালে কিশোর বয়েসে ড্রেকের সঙ্গে আটলান্টিক অভিযানে গিয়েছিলেন। সুরাট অভিযানের লক্ষ্য মোগল নবাব বা প্রদেশশাসকের কাছ থেকে ব্যাবসার অনুমতি নেওয়া। শাসক মকররব খাঁ দিলেন একটা কাগজ ধরিয়ে, কিন্তু দেখা গেল যে সেই পরোয়ানা সুরাট শহরের বাইরে বিশেষ কাজ করে না। ততদিনে দরবারের আমির-ওমরাদের উপহার দিতে দিতে হকিন্সের পকেট ফাঁকা। মরিয়া হয়ে হকিন্স ঠিক করলেন আগ্রা যাবেন। একদল পাঠান ঘোড়সওয়ার জড়ো করে নিজে এক আফগান রাজপুরুষের মতো সাজপোশাক পরে হকিন্স বেরিয়ে পড়লেন।
১৬০৯ সালে হকিন্সের দল আগ্রায় পৌঁছল। দলের অজান্তে সম্রাট জাহাঙ্গির এঁদের অগ্রগতির খোঁজখবর রাখছিলেন। আগ্রায় পৌঁছে খুব তাড়াতাড়ি হকিন্স সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি পেয়ে গেলেন, এবং সেই সাক্ষাৎকার দারুণ সাফল্য পেল। সম্রাট ধৈর্যের সঙ্গে হকিন্সের আর্জি শুনলেন, ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের চিঠির অনুবাদ শুনলেন, আগ্রহের সঙ্গে উপহার গ্রহণ করলেন, তাঁর অতিথির সুন্দর চেহারার তারিফ করলেন, এবং উচ্ছ্বসিত হলেন যখন দেখা গেল হকিন্স ও জাহাঙ্গির দু’জনেই অল্পবিস্তর আরবি ভাষা জানেন। এর পরে দু’জনে দোভাষী ছাড়াই কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন। ইংরেজদের দেওয়া হল সুরাটে কারখানা গড়বার অনুমতি। কিন্তু ততক্ষণে নতুন বন্ধুর প্রতি সম্রাটের স্নেহ লাইসেন্সের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে। সম্রাট হকিন্সকে ৪০০ ঘোড়ার মনসবদার খেতাব দিলেন, এবং একটি আর্মেনিয়ান মেয়ের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থাও হয়ে গেল।
সম্রাটের প্রতি হকিন্সের অনুরাগ অবশ্য বেশি দূর গড়ায়নি। আগ্রায় বাস করার সময়ে হকিন্স উপরওয়ালাদের যে সব চিঠিপত্র পাঠান তাতে জাহাঙ্গির একজন মদ্যপ, অস্থিরচরিত্র ও কখনও কখনও অত্যন্ত হিংস্রপ্রকৃতির মানুষ হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। সম্ভবত জাহাঙ্গির এই চিঠির কথা জানতেন। হয়তো মকররব খাঁ ও পর্তুগিজরা ইংরেজদের সম্বন্ধে তাঁর মন বিষিয়ে দিয়েছিল। যে কারণেই হোক, হকিন্সের প্রতি তাঁর স্নেহ যেমন হঠাৎ তৈরি হয়েছিল তেমনই হঠাৎ উবে গেল। হকিন্স তাড়াতাড়ি আগ্রার পাট গুটিয়ে সুরাটে ফিরলেন। যদিও তাঁকে ১৬১১ সালে ব্যান্টামে চলে যেতে হয়। সুরাটে কারখানা একটা তৈরি হল ঠিকই। অবশ্য নামেমাত্র।
কোম্পানির তরফে আরও একটা দৌত্য ঘটনাক্রমে বানচাল হয়ে যায়। হেনরি মিডলটনের অধিনায়কত্বে কোম্পানির ষষ্ঠ অভিযানের আসল উদ্দেশ্য ছিল অটোমানদের শাসিত এডেন বন্দরে ও আশেপাশের অঞ্চলে ইংরেজদের জন্যে জায়গা তৈরি করা। কিন্তু আলাপ-আলোচনা ভাল করে শুরু হওয়ার আগেই যুদ্ধ বেধে যায় ও এডেনের আগা মিডলটনকে বন্দি করেন। মিডলটন পালিয়ে এলেন ভারতে। সুরাট ও দাভোল বন্দরে বাস করে স্বাস্থ্য উদ্ধারের চেষ্টায় রত হলেন। কিন্তু তিনি এই অঞ্চলে বাস করায় পর্তুগিজরা বিরক্তি প্রকাশ করে। তার থেকে মনে হয় মিডলটনও হয়তো স্থানীয় শাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। যদিও সেই যোগাযোগের ফল কিছু হয়নি। তাঁর মনে তখন প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে। লোকজন সংগ্রহ করে মিডলটন চললেন এডেন অভিমুখে আগাকে শিক্ষা দেবার জন্যে। তাঁর দলের মধ্যেই বিদ্রোহ বেধে যাওয়ায় সেই প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। মিডলটন তখন ব্যান্টামে গেলেন হকিন্সকে দলে টানার জন্যে। ফেরত পথে মহামারীতে তাঁর লোকজন অনেকে মারা যায়। হকিন্সও মারা গেলেন। ১৬১১ সালে মিডলটনের মৃত্যু হয়। একের পর এক দুর্ভাগ্য তাঁর মন ভেঙে দিয়েছিল।
হকিন্সের আগ্রাওয়ালি আর্মেনিয়ান স্ত্রী ইংল্যান্ডে ফিরে এসে আবার বিয়ে করেন। এবারেও এক জাহাজিকে, সম্ভবত গ্যাব্রিয়েল টাওয়ার্সনকে। এই টাওয়ার্সনকে ১৬২৩ সালে ডাচরা আম্বৈনায় হত্যা করে (সে প্রসঙ্গ পরে আসছে)। মহিলার খবর শেষ পাওয়া যায় সুরাট থেকে, তিনি বারবার ফ্যামিলি পেনশনের আর্জি জানিয়ে কোম্পানির অফিসারদের হয়রানি করছেন।
টমাস বেস্ট ও নিকোলাস ডাউন্টন
আরও দুটো সুরাট যাত্রা থেকে ইংরেজদের কিছুটা সুবিধা হয়। কোম্পানির দশম অভিযানের ক্যাপ্টেন টমাস বেস্ট ছিলেন চল্লিশ বছর বয়স্ক জাহাজি। রাশিয়া এবং লেভান্টে জাহাজ চালানোয় অভিজ্ঞ। ১৬১১ সালে দশম অভিযান যাত্রা করে। সুরাটের বাইরে নোঙর নামিয়ে তিন সপ্তাহ কাটাবার পর এক শক্তিশালী পর্তুগিজ বহর এদের আক্রমণ করে। পরপর দুটো যুদ্ধে বেস্ট জয়ী হওয়ার পরে ইংরেজদের সুরাটে নেমে ব্যাবসা করার অধিকার সরকারিভাবে মেনে নেওয়া হল।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটে ১৬১৪ সালে। নিকোলাস ডাউন্টন, যিনি দূরদৃষ্ট ষষ্ঠ অভিযানেও প্রধান ছিলেন, সুরাটে ইংরেজ ব্যাবসার ভিত্তি দৃঢ় করবার জন্যে একটা যাত্রার ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হলেন। সুরাটের কাছে পৌঁছতেই গোয়ার শাসক জেরোনিমো দে আজেভেডো নৌবহর নিয়ে এসে হাজির হলেন ইংরেজ তাড়াতে। ইংরেজদের লোকবল ছিল শত্রুপক্ষের তুলনায় অনেক কম, কিন্তু ইংরেজদের কামানের নিশানা আরও অব্যর্থ। নিজের দলের শ’পাঁচেক সৈন্য মারা যাবার পরে (ইংরেজদের দলে পাঁচ জন মারা যায়), ডন জেরোনিমো রণে ভঙ্গ দিয়ে গোয়া ফিরে গেলেন। মোটামুটি এই যুদ্ধের পরেই ভারতের পশ্চিম উপকূলে পর্তুগিজ অধিকার দ্রুত কমে যেতে থাকে। ইতিমধ্যেই পর্তুগিজদের সঙ্গে মোগল দরবারের মনোমালিন্য বাড়ছিল, ফলে তীরে বসে যারা যুদ্ধ দেখছিল তারা ডাউন্টনের জয় স্বাগত জানাল। নিয়মমাফিক ডাউন্টন আগ্রা থেকে অনুমতিপত্র পেয়ে গেলেন, কিন্তু তাঁর নিজের স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল। ডাউন্টন কিছু দিন পরেই ব্যান্টামে মারা যান।
১৬১২ সাল নাগাদ কয়েক জন ইংরেজ সুরাটে একটা খুবই ছোট আড়তের দেখাশোনা করত। টমাস কেরিজ ছিলেন এই দলের প্রধান। কেরিজের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি ইংরেজদের আমদানি তরোয়ালের ফলা, ছুরি, ব্রডক্লথ, সিসা ও পারদ সুরাটে ভালই বিক্রি হত। অন্যদিকে কেরিজ ও তাঁর দলবল কিনছিলেন নীল, ভেষজ গাছগাছড়া, সুতো এবং সাদা সুতির কাপড় যাকে ‘ক্যালিকো’ নামে উল্লেখ করা হত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে যা প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হত। কেরিজ উপরওয়ালাদের জানালেন ভারতের রাজাদের উপহার দেওয়ার জন্যে কয়েকটা ইংরেজ বুলডগ পাঠাতে। আরও আগে, ১৬০৯ কী ১৬১০ সালে, এই দলেরই অল্ডওয়ার্থ নামে এক কর্মচারী সুরাট থেকে আহমেদাবাদ যান, ভারুচ (বোরোচ) ও বরোদা (বোথ্রা) পেরিয়ে। পথে নানান জায়গায় ক্যালিকো কাপড় ও নীল উৎপাদন হচ্ছে ইনি দেখেছিলেন। কিন্তু সেই ক্যালিকো ও নীল নিয়মিত অনেক পরিমাণে সংগ্রহ করতে হলে দরকার আগ্রায় একটা কায়েমি দূতাবাস, সুরাটে জোরালো নৌবহর, এবং প্রচুর কাঁচা টাকা। ইংল্যান্ডের ব্রডক্লথ এখানে বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না। এই পূর্বশর্তগুলির দ্বিতীয়টা বেস্ট এবং ডাউন্টন কিছুটা তৈরি করে দিয়ে যান। তৃতীয় শর্ত মেটাতে ইউরোপিয়ানদের বেশ হয়রান হতে হয়, তবে স্প্যানিশ রুপোর আমদানি বাড়লে সমস্যার পাকাপাকি সমাধান হয় (সপ্তম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)।
আর প্রথম শর্তটা? এই কয় বছরে সুরাটের টিম বুঝে গিয়েছিল যে আগ্ৰা থেকে প্রাপ্ত পরোয়ানার বাস্তব মূল্য সুরাটে খুব বেশি কিছু নয়। প্রত্যেকবার সুরাট থেকে ইংরেজ নৌজাহাজ নোঙর তুললেই স্থানীয় মাতব্বররা ব্যাবসার রাস্তায় নানারকম বাধানিষেধ নিয়ে আসে, টাকাপয়সা ও দামি উপহার দিলে তার কিছুটা শিথিল করা হয়। এই পরিস্থিতিতে বেস্ট আর ডাউন্টন সমুদ্রে ইংরেজদের আধিপত্য প্রমাণ করে দিলেন। এই প্রমাণের দাম ছিল। মোগলদের নিজেদের নৌবল বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। কাজেই পর্তুগিজদের সমঝে চলতে হত। পর্তুগিজরা যুদ্ধে হারতে দরবারে ইংরেজদের মান বেড়ে গেল।
মোগল দরবারে সম্মানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্যে জমি তৈরি করে দিয়েছে জাহাজি ক্যাপ্টেনরা। কিন্তু কূটনৈতিক কাজ জাহাজিদের দিয়ে হবে না। ইংরেজ রাজদরবার ও মোগল দরবারের মধ্যে যদি সাক্ষাৎ সম্বন্ধ গড়ে তুলতে হয়, তা হলে দরকার এমন একজন ব্যক্তির যে নিজে পাকা রাজনীতিক। এই দায়িত্ব দেওয়া হল টমাস রো-কে।
টমাস রো
রো-র (১৫৮১-১৬৪৪) জন্ম এসেক্সের এক জমিদার পরিবারে। অক্সফোর্ড থেকে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করে (১২ বছর বয়েসে!) পাঁচ বছর কাটে মিডল টেম্পল-এ, ভাবী রাজকর্মচারীদের শিক্ষানবিশি প্রতিষ্ঠানে। রো দরবারের চাকরি নিলেন ২০ বছর বয়েসে। কর্মজগতে দ্রুত উন্নতি হয়, এবং কয়েকটা খুবই চ্যালেঞ্জিং কাজের দায়িত্ব রো-কে নিতে হয়। যেমন আন্ডিজের দুর্ভেদ্য জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া সোনার শহর এল ডোরাডোর সন্ধান, বা রাজকুমারী এলিজাবেথের নড়বড়ে আর্থিক অবস্থা সামলানো। ১৬১৪ সালের অক্টোবর মাসে যখন রাজা রো-কে আমন্ত্রণ জানালেন দূত হয়ে ভারতে যাবার জন্যে, রো বিনা দ্বিধায় রাজি হলেন। কাজটা এল ডোরাডো খোঁজার মতোই কঠিন।
রো-র দৌত্য শেষ হতে চার বছর সময় লাগে। এই চার বছরে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গিরের ছাউনি অনুসরণ করে আজমীড় থেকে মান্ডু ঘুরে বেড়ালেন। কখনও রাজার সঙ্গে দোস্তি আবার কখনও মনোমালিন্য। এই ওঠাপড়ার একটা কারণ ইংরেজদের দেওয়া উপহার নিয়ে জাহাঙ্গির একটু খুঁতখুঁতে ছিলেন। ম্যাস্টিফ বা গ্রেহাউন্ড জাতীয় শিকারি কুকুর এবং লাল মদ পেলে খুশি হতেন। কিন্তু এগুলি ভারতে বসে থাকা ইংরেজদের কাছে সহজলভ্য নয়। একবার একটা দেওয়াল-ঘেরা উঠোনে জাহাঙ্গির লড়াইয়ের আয়োজন করলেন বিলিতি কুকুরের সঙ্গে দেশি হাতির। কুকুরগুলি এমন তেজের সঙ্গে হাতিটাকে আক্রমণ করল যে রাজা খুশি হয়ে হুকুম দিলেন যে কুকুরদের রুপোর চামচে খাওয়ানো হবে এবং খাওয়ার সময় একদল চাকর পাখা নিয়ে তাদের বাতাস করবে। কিন্তু উপহারসামগ্রী বলতে সাধারণত যে সব জিনিস ইংরেজরা সঙ্গে নিয়ে ঘুরত, কাপড়, ছবি, বা বাক্স, এসব দেখলে জাহাঙ্গির বিরক্ত হতেন। রো-র উদ্যোগ জটিল হয়ে যায় আর এক কারণে। রাজকুমার খুররম (পরে শাহজাহান) ইংরেজদের সাহায্য করার ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী আসফ খানও দ্বিধায় ছিলেন। রাজার সঙ্গে কথাবার্তা বলা আর এক বিড়ম্বনা। রো লাতিনে তাঁর বক্তব্য জানাতেন একজন পর্তুগিজ জেসুইট পাদরিকে, পাদরি সেই লাতিন ফারসিতে অনুবাদ করে দিতেন, দুটো ভাষার কোনওটাই এই দু’জন সংলাপীদের মাতৃভাষা নয়। এদিকে ডাচদের মসুলিপতনমে একটা আড়ত তখন কাজ করছে, তারা প্রাণপণে ইংরেজদের কাজেকর্মে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে।
রো যে তাঁর উদ্যোগে সফল হলেন তার একটা বড় কারণ পূর্বসূরিদের থেকে তিনি একেবারেই আলাদা। রো নাবিক নন, বণিক নন, রাজকর্মচারী। চেহারায়, আচার-ব্যবহারে, শিক্ষাদীক্ষায় সেই তফাতটা স্পষ্ট। শান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে খুররমের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে, এবং একটু একটু করে জাহাঙ্গির ও আসফ খানের বিশ্বাস অর্জন করে রো একটা পরোয়ানা বার করতে সক্ষম হলেন। আপাতদৃষ্টিতে রো বেস্ট বা ডাউন্টন-আদি পূর্বসূরিদের থেকে খুব বেশি হয়তো কিছু পেলেন না। এ রকম ব্যাবসার লাইসেন্স মোগল দরবার থেকে ইংরেজরা আগেও পেয়েছে। রো-র উদ্দেশ্য অবশ্য একটু অন্যরকম ছিল। ইনি চেয়েছিলেন শুধু সাদামাটা ব্যাবসার অনুমতিপত্র নয়, একটা বিশদ দলিল বা চুক্তি, যাতে সম্রাটের তরফ থেকে এবং ইংরেজদের তরফ থেকে কতগুলি ব্যাপারে দায়বদ্ধতার উল্লেখ থাকবে। যে দলিলে জাহাঙ্গির তাঁর মোহর লাগালেন সেটা হয়তো রো-র মনের মতো হয়নি। তবু এটাই প্রথম বাণিজ্যিক চুক্তি যেখানে ভারতের একজন রাজার নাম রইল। এই চুক্তি বলা যেতে পারে দুই দেশের রাজার মধ্যে চুক্তি, একতরফা ব্যাবসার সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা নয়। সে অর্থে এর ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট।
বন্ধু না শত্রু?
১৬১০ সালে ডাচ ও ইংরেজ দুই দলই ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যে নিজেদের ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। দুই দলের হাতেই অস্ত্র, দুই-ই মশলার ব্যবসায়ে যুক্ত, দুই দলকেই পর্তুগিজদের সঙ্গে বিরোধিতা করে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে হয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে সম্পর্ক কী রকম? এদের মধ্যে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার সঙ্গে সঙ্গে ছোটখাটো গন্ডগোল লাগার সম্ভাবনা ক্রমেই বেড়েছে। তবু এরা যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি, সেই সংযমের পিছনে দুটো কারণ ছিল। এক, সরাসরি যুদ্ধ বাধলে পর্তুগিজদের লাভ, যেটা কেউ-ই চায়নি। দুই, সামরিক শক্তি এত সমান সমান যে দুই দলের মনেই ভয় ছিল প্রত্যক্ষ সংগ্রামে কেউ জিতবে না, বরং দুই-ই শেষ হয়ে যাবে। দুই কোম্পানির ব্যাবসার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি এত কাছাকাছি যে ১৬১৫ সালে ডাচ তরফ থেকে প্রস্তাব আসে একত্রীকরণের। ইংরেজরা রাজি হয়নি, খোঁজখবর করে দেখা গেল ডাচ ব্যাবসাপাতি সবই প্রচুর ধারের উপর চলে। তবে মারপিট ও হুমকি দেওয়ার ঘটনা ষোড়শ শতাব্দীতে আকছার ঘটত। রো-র দৌত্য শেষ হওয়ার সময়ে ডাচরা জাভায় এবং মশলার বাজারে আধিপত্য রেখেছে। ইউরোপে মোটামুটি বন্ধুত্ব থাকলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ডাচ জাহাজ ইংরেজ জাহাজকে ভয় দেখিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করত।
পরবর্তী সাত-আট বছর এই ভাবে ইউরোপে সতর্ক বন্ধুত্ব রক্ষা হয়। ১৬২৩ সালে হঠাৎই একটা সংকটের সূত্রপাত হল। আম্বৈনা গ্রামে ইংরেজ কোম্পানির এজেন্ট পূর্বোল্লিখিত টাওয়ার্সন, আরও নয় জন ইংরেজ ও কয়েক জন জাপানি নাবিককে তড়িঘড়ি বিচারের পরে ডাচরা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা ডাচ ঘাঁটি দখল করার চেষ্টা করেছিল। সেই অভিযোগ সত্যি কি না তা নির্ধারণ করা যায় না। সম্ভবত ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতাই একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সে যাই হোক, ইংল্যান্ডে এই ঘটনাকে ‘আম্বৈনার গণহত্যা’ নাম দেওয়া হল। আম্বৈনা ডাচদের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হয়ে রইল। দুই দল এর পরে সন্ধি করে, অনেকটা পর্তুগিজদের ভয় থেকে। তবে পারস্পরিক বিশ্বাস কখনই গড়ে ওঠেনি। ডাচ গভর্নর-জেনারেল এক চিঠিতে শেয়ারহোল্ডারদের বোঝালেন, ‘একটি ঝগড়াটে স্ত্রী আমাদের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে।’
ইরান অভিযান
পর্তুগিজ-ইংরেজ বিরোধ চরমে ওঠে ইরানের উপকূলে ব্যাবসার অধিকার নিয়ে। পারসিয়ান গাল্ফের মুখে অবস্থিত হরমুজ বন্দর বহুদিন থেকেই পশ্চিম এশিয়ার প্রধান ব্যাবসার কেন্দ্র। এই বন্দরে মধ্য এশিয়া থেকে উটের কাফিলা এসে বাণিজ্যের পণ্য পৌঁছে দিত, জাহাজে সেই মাল উঠত এই বন্দরেই। এই ভাবে ইরানের রেশম যেত ইউরোপে, আর মধ্য এশিয়া থেকে যুদ্ধের জন্যে উপযোগী ঘোড়া যেত জাহাজে চেপে ভারতে। বলা যায় ইরান ত্রিকোণ লেনদেনের একটা কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল— পারস্যের ঘোড়া নিয়ে এসে ভারত থেকে কাপড় কেনা সম্ভব, আবার সেই কাপড় দিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে মশলা। অসুবিধা একটাই, হরমুজ ও গাল্ফ যদিও পারস্যের সাম্রাজ্যভুক্ত, এই অঞ্চলের উপকূলে পর্তুগিজদের একচ্ছত্র আধিপত্য।
ইরানে ঢোকার রাস্তা তৈরি করতে ইংরেজরা প্রথমে কূটনীতির আশ্রয় নেয়। রবার্ট শার্লে নামে এক প্রতিনিধিকে পাঠানো হল শাহ আব্বাসের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে। শার্লে সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক, অভিজ্ঞ জাহাজি, এবং এই দায়িত্ব পাওয়ার সময়ে পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানীতেই বাস করছেন, একজন সারকাশিয়ান (ককেসাস পর্বতমালার সন্নিহিত অঞ্চল) মহিলাকে বিয়ে করে। ১৬০৮ সালে শার্লেকে শাহ আব্বাস নিযুক্ত করলেন ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের দরবারে ইরানের দূত হিসেবে। সেখানে ইনি পারসিক রাজপুরুষের মতো পোশাক-পাগড়ি পরে সারকাশিয়ান স্ত্রীর হাত ধরে উপস্থিত হয়ে রাজসভায় হইহই বাধিয়ে দিলেন। ১৬১৫ সালে এঁকে পর্তুগাল ও স্পেনেও আলাপ-আলোচনার জন্যে পাঠানো হয়। এই দুই তরফের দৌত্য শার্লে কতটা সফল ভাবে সংঘটিত করতে পেরেছেন আমরা জানি না। এইটুকু জানি যে ১৬২০ সালে ইরানের শাহ হঠাৎ শার্লেকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন সম্ভবত গুপ্তচর সন্দেহে। শার্লে এর অল্প পরে মারা যান।
ভারতে রো যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, পারস্যে সেই ভূমিকা পালন করলেন দু’বছর পরে কোম্পানির কর্মচারী এডওয়ার্ড কনক। কনক দরবারে ভাল ব্যবহার পেলেন, ব্যাবসার লাইসেন্সের ব্যবস্থা হয়ে গেল, এবং প্রচুর মদ সহযোগে নতুন চুক্তি সেলিব্রেট করা হল। এমনকী শাহ কনকের সঙ্গে আলাদা করে চুক্তি করলেন ৩০০০ বেল রেশম প্রত্যেক বছর শাহের নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হবে। আগাগোড়াই শাহের একটা আশা ছিল যে এই বন্ধুত্ব জোরদার করলে পর্তুগিজদের হরমুজ অঞ্চল থেকে তাড়ানোর একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ১৬২০ সালের ডিসেম্বরে যুগ্ম ফ্রন্ট সত্যিই তৈরি হল। লিসবন থেকে রুই ফ্রের দে আন্দ্রাদের নেতৃত্বে নৌবহর পাঠানো হল গাল্ফে, সুরাট থেকে অ্যান্ড্রু শিলিং জাহাজ সাজিয়ে বেরিয়ে এলেন। পরবর্তী রক্তাক্ত অধ্যায়ে শিলিং মারা যান। যুদ্ধ হল প্রায় সমান সমান, কিন্তু ফ্রের দে আন্দ্রাদ হরমুজ সমর্পণ করতে বাধ্য হলেন (১৬২১)।
এর পরে কোম্পানির পক্ষে ত্রিকোণ লেনদেন শুরু করার পথে কোনও বাধা রইল না। হরমুজ (ঘোড়া), সুরাট (সুতির কাপড়) ও ব্যান্টাম (মশলা) একসূত্রে গাঁথা হল। এখনও মশলাই কোম্পানির প্রধান ব্যাবসা ও লক্ষ্যবস্তু, তবে ভারতের ব্যাবসা ক্রমবর্ধমান।
১৬৪০ সাল পর্যন্ত ভারতের ব্যাবসা সুরাটের অধীনে চলেছিল। সুরাটে মোগল সম্রাটের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক খুব নিশ্চিন্ত ছিল না। দুই ব্যক্তি, উইলিয়াম মেথল্ড ও জন ওয়েডেল, ভারতের পশ্চিম উপকূলে কোম্পানির ব্যাবসাকে স্থিতিশীল করার ব্যাপারে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। মেথল্ড ছিলেন সুরাটের প্রথম ‘প্রেসিডেন্ট’, ইনি যখন দায়িত্ব নিতে এই অঞ্চলে এসে পৌঁছন তখন এই অঞ্চল দুর্ভিক্ষ ও জলদস্যুদের উৎপাতে জর্জরিত। এর কিছু দিন আগে কালিকটের জামোরিন বা সামুদ্রী রাজার সঙ্গে কোম্পানির একটা চুক্তি হয়েছে। কোম্পানি কেরালার পাহাড়ে উৎপন্ন মশলা কিনবে, আর উপকূলে যৌথ অভিযান চালিয়ে পর্তুগিজ জাহাজিদের হয়রানি করা হবে। কিন্তু কেরালার উপকূলে কোম্পানির প্রতিনিধিরা ঘুরে বেড়ালে মালাবারের দস্যুদের শিকার হবার বিপদ বেড়ে যায়। মেথল্ড জলদস্যুদের দমনে খুব একটা সফল হননি। কিন্তু এই সমস্যার সমাধানের একমাত্র উপায় যে নিজেদের জন্যে একটা বন্দর তৈরি করা, সেই ধারণাটা উপরওয়ালাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
ওয়েডেল সুরাট-ইরান যোগাযোগ বাড়াতে সাহায্য করেন। ওয়েডেল একজন পাকা জাহাজি ও হরমুজ দখল যুদ্ধের একজন হিরো, কাজেই কোম্পানি তাঁর উপরে বেশ কয়েকটা মালজাহাজ তথা নৌবহরের দায়িত্ব দিয়ে এশিয়ায় পাঠায়। ১৬৩০-এর শেষের দিকে অবশ্য ওয়েডেল ব্যক্তিগত ব্যাবসার অভিযোগে কোম্পানির কাজ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন।
১৬৪০-এর দশক থেকে ত্রিকোণ লেনদেন চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। ইরানে অসুস্থ হয়ে বেশ কয়েক জন ইংরেজ মারা যায়। ডাচদের ফন্দিও ইংরেজদের বেশ অসুবিধায় ফেলে। ইস্ফাহানের এজেন্ট উইলিয়াম গিবসন মারা গেলে তাঁর হিসেবের খাতা পরীক্ষা করে দেখা গেল ইনি দীর্ঘদিন ডাচদের মাল সরবরাহ করেছেন। বিশ্বাসঘাতকতা এবং ব্যক্তিগত ব্যাবসা, দুটো অপরাধেই ইনি অপরাধী। ইরানের দুর্গম অঞ্চলে আর্মেনিয়ান বণিকরা প্রধান। কোন দল সামুদ্রিক ব্যাবসায় সফল হবে সেটা অনেকটা নির্ভর করে কাদের সঙ্গে আর্মেনিয়ানদের বেশি বন্ধুত্ব তার উপরে। এই ব্যাপারে ইংরেজদের থেকে ডাচদের সাফল্য কিছুটা বেশি। ইংলিশ সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধ (১৬৪২-৫১) রেশমের বাজারে মন্দা এনে দেয়। রেশম ছিল তখন ইরান থেকে ইংল্যান্ডে সবথেকে বড় আমদানি। ইরানে ব্যাবসা বাড়ানোর পথে এত রকম বাধা। এর অর্থ ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় মধ্যে ব্যাবসায় বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ইরানের জিনিসের উপরে নির্ভর করা চলবে না। এশিয়ার বাজারে স্প্যানিশ রুপোর গুরুত্ব এই সময় থেকে বাড়তে থাকে।
অন্তর্দ্বন্দ্ব
ব্যক্তিগত ব্যাবসার কারণে ওয়েডেলের অপযশ একটা ক্রমবর্ধমান সমস্যার চিহ্ন। প্রথম দিন থেকেই কোম্পানি করিতকর্মা ও ব্যক্তিত্বশালী লোকদের বিদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ করতে চেয়েছে। কিন্তু যে যত করিতকর্মা সেও ততই সাফল্যের সঙ্গে নিজের আখের গোছাবার চেষ্টা করেছে। অর্থাৎ দক্ষ লোক দিয়ে কাজ চালাতে গেলেই কোম্পানির একচেটিয়া কর্তৃত্বে অল্পবিস্তর আঘাত আসবে। প্রথম তিরিশ বছরে সমস্যাটা বেড়েই গেছে। বেশির ভাগ পদস্থ কর্মচারী তাদের ইন্ডেনচার বা চুক্তি শেষ করে দেশে ফিরে আসেনি, ব্যক্তিগত ব্যাবসায় পুরোদমে লেগে গেছে। এ ছাড়াও কিছু ব্যবসায়ী, যাদের ভলান্টেয়ারি নাম দেওয়া হয়েছিল, দরবারে কিছু টাকা দিয়ে পূর্বসমুদ্রে ব্যাবসা করার অনুমতি জোগাড় করে নিত। প্রায় দেউলে প্রথম চার্লস ঘরোয়া যুদ্ধ চালাবার জন্যে এ ধরনের সুবিধা বিক্রি করার ব্যাপারে দ্বিধা করতেন না।
বিদ্রোহীদের দমন করতে না পেরে কোম্পানি আপসের রাস্তা ধরল। ব্যক্তিগত ব্যাবসা আইনসংগত বলে মেনে নেওয়া হবে যদি তা কোম্পানির জন্যে সংরক্ষিত কতগুলি পণ্য বাদ দিয়ে হয়, আর যদি ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী কোম্পানির কাছ থেকে একটা লাইসেন্স নেয়। এ ছাড়াও, উপকূল অঞ্চলে বন্দর থেকে বন্দরে যে ব্যাবসা সেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে কোম্পানি কোনও কড়াকড়ি করেনি।
১৬৩৫ সালে লন্ডনের প্রমুখ রেশম-লিনেনের কারবারি উইলিয়াম কোর্টেন ও দরবারের একজন পদস্থ অফিসার এন্ডিমিয়ন পোর্টার রাজার কাছে আর্জি জানালেন একটা নতুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খুলবার অনুমতি চেয়ে। নতুন কোম্পানি সরাসরি পুরনো কোম্পানির চার্টারের নিয়ম ভাঙবে না। তারা ব্যাবসা করবে এমন অঞ্চলে যেখানে পুরনো কোম্পানির যাতায়াত কম, যেমন মালাবার, গোয়া, চিন ও জাপান। অস্ট্রেলিয়া ও মাদাগাস্কারে উপনিবেশ তৈরি করার পরিকল্পনাও পেশ করা হয়। নতুন পার্টনারশিপ রাজার অনুমতি পেল, সঙ্গে সোনা-রুপো রপ্তানি করার লাইসেন্স। সবকিছুর পিছনে অর্থবল পল পিন্ডার, ব্যাঙ্কার। বলাই বাহুল্য, পুরনো কোম্পানির ডিরেক্টররা খুব রেগে গেল, কিন্তু রাজার হুকুম কে অমান্য করবে? ১২০,০০০ পাউন্ড পরিমাণ বিপুল মূলধন নিয়ে নতুন কোম্পানি প্ৰথম অভিযানের আয়োজন করল, অধিনায়ক সেই জন ওয়েডেল।
এই অভিযানের সদস্য ছিলেন পিটার মান্ডি, যাঁর ভ্রমণকাহিনি থেকে আমরা ওয়েডেল সম্বন্ধে ও চিন সহ পূর্ব এশিয়ার কতগুলি জায়গা সম্বন্ধে অনেক কিছু তথ্য পাই। প্রথম অভিযান যায় ক্যান্টনে। দস্যুদের আক্রমণে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলেও এই অভিযান থেকে যা ইংল্যান্ডে ফিরে আসে তার পরিমাণ কম নয়, এবং পুরনো কোম্পানিকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তা ছাড়া এই প্রথম ইংরেজদের পা পড়ল চিনের উপকূলে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। কোর্টেন অবশ্য এই সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। পরের অভিযান যায় গোয়ায় ও মসুলিপতনমে। ফেরার পথে ওয়েডেল নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। একজন ‘প্রত্যক্ষদর্শীর’ সাক্ষ্য অনুযায়ী ওয়েডেল নিমন্ত্রণ পেয়ে একটা ডাচ জাহাজে ভোজ খেতে গিয়েছিলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর তাঁকে ঠেলে জাহাজ থেকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। ডাচদের এ রকম কোনও মতলব থাকতেই পারে। তবে নিরুদ্দেশের আর একটা ব্যাখ্যা ছিল। ১৬৩৯ সালের শীতকালে উত্তমাশা অন্তরীপের কাছে একটা জাহাজডুবি হয়। হয়তো ওয়েডেল তখনই মারা যান।
এই ঘটনার পর থেকেই নতুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাগ্য খারাপ হতে থাকে। কোর্টেনের ছেলে, তাঁর নামও উইলিয়াম, কোম্পানির ভার নিলেন বটে, কিন্তু তাঁর নিজের আর্থিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ। রাজার কাছ থেকে কিছু সাহায্য পাওয়ার পরেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। নতুন কোম্পানির পতনের আসল কারণ অবশ্য ডিরেক্টরদের দেউলে হয়ে যাওয়ার ঘটনা নয়, পুরনো কোম্পানির জোরদার বাধা সৃষ্টি। কোর্টেন পার্লামেন্টে আর্জি জানিয়ে সুবিধা করতে পারলেন না। ১৬৪৩ সালে নতুন কোম্পানির কতগুলি জাহাজ মালাক্কা প্রণালীর কাছে ডাচরা দখল করে নিল। কোর্টেন পাওনাদারদের এড়াতে ইটালি পালিয়ে গেলেন, সেখানে নিঃস্ব অবস্থায় ১৬৫৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। ততদিনে নতুন কোম্পানির অবশিষ্ট সম্পদ পুরনো কোম্পানির হাতে চলে এসেছে।