৩. ব্যাকরণের প্রকার ও শাখা

তৃতীয় অধ্যায় – ১. ব্যাকরণের প্রকার ও শাখা

কোন ভাষার উপাদান সমগ্রভাবে বিচার ও বিশ্লেষণ যে বিদ্যার বিষয় তাহাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে। ব্যাকরণের আলোচনা তিন-ভাবে হয়। সেইমতো শব্দবিদ্যায় বা ভাষাবিজ্ঞানে ব্যাকরণও তিন-প্রকার— (১) বর্ণনামূলক ব্যাকরণ (Descriptive Grammar), (২) ঐতিহাসিক ব্যাকরণ (Historical Grammar) এবং (৩) তৌলন বা তুলনামূলক ব্যাকরণ (Comparative Grammar)। কোন নির্দিষ্ট কালসীমার মধ্যে অবস্থিত কোন ভাষার বিচার বিশ্লেষণ ও আলোচনা বর্ণনামূলক ব্যাকরণের বিষয়। যেমন, এখনকার দিনে কথ্য অথবা লেখ্য বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ। ঐতিহাসিক ব্যাকরণে কোন ভাষার কালগত ধারাবাহিক রূপান্তরের অর্থাৎ পরপর অবস্থার একত্র আলোচনা থাকে। যেমন, সেই বাঙ্গালা ব্যাকরণ যাহাতে ধারাবাহিক ও সমগ্র দৃষ্টিতে প্রাচীনকালের বাঙ্গালা এবং আধুনিক কালের বাঙ্গালা ভাষার আলোচনা আছে। তুলনামূলক বাঙ্গালা ব্যাকরণে ঐতিহাসিক ব্যাকরণই আরও পিছনে অনুসরণ করিয়া হিন্দী গুজরাটী মারাঠী প্রভৃতি সমগোষ্ঠীর ও সমান-অবস্থার ভাষার সঙ্গে তুলনা করিয়া বাঙ্গালা ভাষার বিশ্লেষণ থাকে। অর্থাৎ বাঙ্গালা ভাষার তুলনামূলক ব্যাকরণে বাঙ্গালার সঙ্গে অসমিয়া ওড়িয়া হিন্দী মারাঠী গুজরাটী প্রভৃতি সম্পর্কিত সমসাময়িক ভাষাগুলির তুলনা-আলোচনা থাকিবে।

বর্ণনামূলক ব্যাকরণের সঙ্গে বর্ণনামূলক ভাষা বিশ্লেষণের (Descriptive Linguistics) পার্থক্য জানা আবশ্যক। বর্ণনামূলক ব্যাকরণে ঐতিহাসিক ব্যাকরণের সম্পর্ক সম্পূর্ণ এড়ানো হয় না। কিন্তু বর্ণনামূলক ভাষাবিশ্লেষণে সে ভাষার অতীত ইতিহাস লইয়া কোনরূপ আলোচনা থাকে না, এখানে শুধু তাৎকালিক চলিত ভাষার গঠনরীতি বিশ্লেষণ করা হয়। যেমন বাঙ্গালার বর্ণনামূলক ব্যাকরণে ‘করিল’ ‘করিব’ ‘করিতে’—এই সাধুভাষার পদগুলি যথাক্রমে [কর্‌+ইল] [কর্‌+ইব) [কর্‌+ইত+এ] এইভাবে ধাতু-প্রত্যয় বিভক্তি বিশ্লিষ্ট করিয়া দেখানো হয়। বর্ণনামূলক ভাষাবিশ্লেষণের পদগুলি যথাক্রমে [করি+ল] [করি+ব] [করি+তে]—এইভাবে বিশ্লিষ্ট হয়।

যে ভাষার কোন পুরানো নিদর্শন নাই এবং যে ভাষা কখনও লিপিবদ্ধ হয় নাই সে ভাষা শীঘ্র ও সহজে ব্যবহারে আনিবার জন্যই বর্ণনামূলক ভাষা বিশ্লেষণের বিশেষ উপযোগিতা।

ভাষাবিজ্ঞান-অনুসারে ব্যাকরণের আলোচনার চারটি প্রধান বিষয়— (১) ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics), ধ্বনিবিচার (Phonemics) ও ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology); () রূপবিচার (Morphology); (৩) পদবিধি বা বাক্যরীতি (Syntax) এবং (৪) শব্দার্থতত্ত্ব (Semantics)। শব্দার্থতত্ত্বের বিষয় অর্থপরিবর্তনের ইতিহাস। পদতত্ত্বের বিষয় বাক্যে পদের প্রয়োগ। রূপতত্ত্বের বিষয় পদের গঠনপ্রণালীর বিশ্লেষণ। সংস্কৃত প্রভৃতি প্রাচীন ভাষার ব্যাকরণে রূপতত্ত্বের প্রাধান্য, আর বাঙ্গালা ইংরেজী প্রভৃতি আধুনিক ভাষার ব্যাকরণে পদতত্ত্বের গুরুত্ব বেশি। প্রাচীন বিভক্তিগুলি লুপ্ত হওয়ার ফলে আধুনিক ভাষায় পদপ্রয়োগের ও পদবিন্যাসের গুরুত্ব সমধিক। আধুনিক ভাষায় ইডিয়ামের প্রাচুর্যে ভাবপ্রকাশশক্তি খুব বাড়িতেছে।

কোন ভাষায় যে ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহৃত হয় তাহার উচ্চারণের শারীর-বিশ্লেষণ (অর্থাৎ বাগ্‌যন্ত্রের ও শ্রবণযন্ত্রের ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ) ও তদনুসারে উচ্চারিত ও শ্রুত ধ্বনির প্রকৃতিবিচার ও শ্রেণীবিভাগ ধ্বনিবিজ্ঞানের বিষয়। কোন একটি বিশেষ ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিসমষ্টির ব্যবহারিক বিচারবিশ্লেষণ ধ্বনিবিচারের আলোচ্য। কোন একটি বিশেষ ভাষায় কালে কালে যে ধ্বনি-পরিবর্তন ঘটিয়া আসিয়াছে তাহার ধারাবাহিক আলোচনা ধ্বনিতত্ত্বের বিষয়। বাঙ্গালা এ-কারের উচ্চারণ-প্রক্রিয়া-নিৰ্ণয় ধ্বনিবিজ্ঞানের বিষয়; সংস্কৃত হইতে প্রাকৃতের ও তাহা হইতে পুরানো বাঙ্গালার মধ্য দিয়া আধুনিক বাঙ্গালা পর্যন্ত এ-কারের ইতিহাস আলোচনা বাঙ্গালা ধ্বনিতত্ত্বের বিষয়॥

২. ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিবিচার

এখন দেখা যাক ধ্বনির উৎপত্তি কি করিয়া হয়।

ফুসফুসের চাপে প্রেরিত নিঃশ্বাসবায়ু শ্বাসনালীদ্বয়ের (Trachea) মধ্য দিয়া কণ্ঠনালীতে (Larynx) মিলিত হয়, এবং তথা হইতে কণ্ঠ ও মুখবিবর অথবা কণ্ঠ ও নাসিকা পথে নির্গত হয়। যদি সচেষ্ট পেশীসঞ্চালনের দ্বারা এই নিঃশ্বাসবায়ু কণ্ঠনালী হইতে ওষ্ঠ পর্যন্ত স্থানমধ্যে কোথাও কোন রকম বাধা পায়, তবেই তাহা ধ্বনি বা স্বন (Speech-sound বা Phone) রূপে প্রকাশ পায়। বাধার স্থান ও বাধার প্রকার এবং পরিমাণ অনুসারে ধ্বনির প্রকারভেদ হয়।

ধ্বনিবিচারে প্রত্যেক উচ্চারিত ধ্বনির একটি করিয়া স্বতন্ত্র রূপ। কিন্তু প্রায় সব ভাষাতেই দেখা যায় যে-কোন একটি ধ্বনি বিশেষ অবস্থায়, অর্থাৎ অপর কোন ধ্বনির সান্নিধ্যের জন্য, একটু যেন অন্যরকম বোধ হয়। এই প্রায়সমরূপ ধ্বনিগুলির একটি যদি অপরটির স্থানে, অর্থপরিবর্তন ব্যতিরেকে, উচ্চারিত না হয় তবে সেগুলির প্রত্যেকটিকে বলে পূরক-স্বন (Allophone), এবং মূল ধ্বনিটিকে বলে ধ্বনিতা বা স্বনিম (Phoneme)। (ধ্বনি বলিলেও কোন দোষ নাই। আমরা ধ্বনিই বলিব।) যেমন বাঙ্গালায় (উল্‌টা) আর (আল্‌তা)। এই দুই শব্দের ল-কার উচ্চারণে ঠিক এক রকম নয়। ট-কারের নৈকট্যের জন্য ‘উল্‌টা’র ল-কারের উচ্চারণে জিহ্বা একটু বেশি বক্রাকার হয়। তাই দুইটি শব্দের ল-কার পরস্পর পূরক-স্বন। সুতরাং বাঙ্গালা ভাষার ল-কার এমন একটি ধ্বনি যাহার দুইটি পূরক-স্বন আছে। তেমনি ইংরেজীতে ক-কার এমন একটি ধ্বনি যাহার পূরক-স্বন স্পষ্ট বোঝা যায়। স্বরধ্বনির আগে উচ্চারিত হইলে (k) ধ্বনির শেষে একটু যেন হ-কারের রেশ লাগে কিন্তু অন্যত্র তেমন নয়।

বর্ণনামূলক ভাষাবিশ্লেষণে পূরক-স্বনের আলোচনা একটু গভীরভাবে করা হয়। দুই বা ততোধিক সমতুল্য ধ্বনি যদি প্রত্যেকটি বিশেষ বিশেষ সংস্থানে ব্যবহৃত হয় এবং একটির সংস্থানে অন্য কোনটি কদাপি শোনা না যায় তবে সে ব্যাপারকে বলে প্রতিযোগী ব্যবহার (Complementary Distribution)। যেমন বাঙ্গালায় স-কার ও শকার ধ্বনি সমতুল্য। প্রথমটি ত-কার ও র-কারের অব্যবহিত পূর্বেই ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয়টি তাহা ছাড়া সর্বত্র। শ্রী [sri], ‘স্ত্রী’ [stri], ‘আস্‌তে’ [āste]; কিন্তু ‘কষ্ট’ [kośto], ‘বাস্‌ক’ [bāśko] ‘আসি’ ‘আশী’ [āśi]। সুতরাং বাঙ্গালায় [s] আর [ś] ধ্বনি দুইটির প্রতিযোগী ব্যবহার।

কোন ভাষার দুই বা ততোধিক ধ্বনির প্রতিযোগী ব্যবহার থাকিলে সে ধ্বনিগুলির প্রত্যেকটিকে বলা হয় পূরক-স্বন (Allophone) এবং ধ্বনিগুলিকে সমষ্টিগতভাবে বলা হয় ধ্বনিতা বা স্বনিম (Phoneme)। কোন পূরক-স্বন না থাকিলে একটি ধ্বনি একাকীই ধ্বনিতা। যেমন বাঙ্গালা ভাষায় দুই একটি বাদে সব ধ্বনি॥

৩. বর্ণ ও বর্ণমালা

ধ্বনির স্বরূপনির্ণয় ও শ্রেণীবিভাগ করিবার পূর্বে প্রচলিত বর্ণমালাসমূহের অসম্পূর্ণতার কথা বলা আবশ্যক। কোন ভাষাতেই প্রাচীন কাল হইতে আগত বর্ণমালা পরবর্তী কালেও সেই ভাষার সকল ধ্বনি প্রকাশ করিবার পক্ষে একদা উপযুক্ত থাকিলেও এখন সর্বদা নয়। ভাষায় ধ্বনিপরিবর্তন হয়, কিন্তু বর্ণমালার পরিবর্তন প্রায় কিছুই হয় না। বর্ণমালার ব্যবহারে প্রায় সকল ভাষা, যাহাতে সাহিত্যসৃষ্টি হইয়াছে, অল্প বিস্তর রক্ষণশীল। ফলে হয় কি এক ধ্বনির জন্য একাধিক বর্ণ অর্থাৎ লিপি-অক্ষর (Letter) ব্যবহৃত হয় এবং এক লিপি-অক্ষরের দ্বারা একাধিক ধ্বনি জ্ঞাপিত হয়। বাঙ্গালা লিপি ব্রাহ্মী লিপি হইতে জাত। তাহার রূপ বদলাইয়াছে, কিন্তু মূল্য বদলায় নাই। ব্রাহ্মী অক্ষর সংস্কৃতের ও প্রাচীন প্রাকৃতের ধ্বনির যথাযথ প্রতীক ছিল। বাঙ্গালায় অক্ষরগুলির কালক্রমিক রূপ বদলাইয়াছে, কিন্তু মূল্য পূর্ববৎ রহিয়াছে। অধিকাংশ অক্ষরের বেলায় সংস্কৃত ধ্বনির মূল্য বাঙ্গালায় বদলায় নাই, এবং সেখানে কোন গোলমাল নাই। কিন্তু কোন কোন অক্ষরের ধ্বনিমূল্য এখন লুপ্ত। যেমন < য, ণ >৷ এখানে অক্ষর দুইটি বাঙ্গালায় নেহাত অতিরিক্ত। কোন কোন অক্ষরের ধ্বনিমূল্য বাঙ্গালায় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বজায় আছে, অন্যত্র বদলাইয়াছে। যেমন (স)। এখানে অক্ষরটি আংশিক ভাবে অতিরিক্ত। বাঙ্গালায় কয়েকটি নূতন ধ্বনির সৃষ্টি হইয়াছে। সে ধ্বনি সংস্কৃতে নাই সুতরাং বাঙ্গালায় তাহার স্বতন্ত্র লিপি-অক্ষরও নাই।

সংস্কৃত ভাষার ধ্বনি প্রকাশের উপযোগী বর্ণমালা বাঙ্গালায় পৌঁছিতে গিয়া কিছু কিছু ধ্বনিপরিবর্তনের চাপ পাইয়াছে। কিন্তু সে-পরিবর্তন অনুযায়ী বাঙ্গালা লিপির সংশোধন-সংযোজন হয় নাই। বাঙ্গালায় প্রচুর সংস্কৃত শব্দ আছে, এবং বাঙ্গালা লিপিতে সংস্কৃত পুঁথি অপর্যাপ্ত পরিমাণে লেখা হইয়া আসিয়াছে। তাই সংস্কৃতের খাতিরে বাঙ্গালা লিপিতে এমন কয়েকটি অক্ষর রহিয়া গিয়াছে যাহার অনুরূপ ধ্বনি বহুকাল পূর্বেই ভাষা হইতে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। যেমন < ণ, য, ব > ইত্যাদি। বাঙ্গালা এ-কার অক্ষরের দ্বারা অন্তত তিনটি পৃথক্ ধ্বনি প্রকাশিত হয়— (১) পশ্চিমবঙ্গের উচ্চারণে [দেশ, এই] ইত্যাদি শব্দের এ-কার ধ্বনি, (২) পশ্চিমবঙ্গের উচ্চারণে [এক, এত] ইত্যাদি শব্দের এ-কার ধ্বনি, এবং (৩) পূর্ববঙ্গের উচ্চারণে [দেশ, খেত] ইত্যাদি শব্দের এ-কার ধ্বনি। পশ্চিমবঙ্গের উচ্চারণে [অমুক] শব্দের অ-কার এবং [ওল] শব্দের ও-কার একই ধ্বনি, অথচ দুইটি পৃথক্‌ অক্ষরে লেখা হইয়া থাকে। [সবিশেষ] এই সংস্কৃত শব্দের বাঙ্গালা উচ্চারণে স-কার, শ-কার এবং ষ-কার এই তিন বর্ণের কোন পার্থক্য নাই।

বাঙ্গালার তুলনায় ইংরেজীতে অক্ষর ও ধ্বনির মধ্যে বৈষম্য আরো বেশি প্রকট। উদাহরণ নিষ্পয়োজন।

ধ্বনিবিজ্ঞানের আলোচনার এবং বিদেশি ভাষা-শিক্ষার সুবিধার জন্য প্রচলিত বর্ণমালার অসম্পূর্ণতা নিরাকরণ করিয়া এক নূতন বর্ণমালা পরিকল্পিত হইয়াছে। ইহাতে যে-কোন ভাষার যে-কোন ধ্বনি ঠিকমত প্রকাশ করা যায়। ইহাকে সর্বজনীন ধ্বনিমূলক লিপিমালা (International Phonetic Alphabet) বলে॥

৪. ধ্বনির শ্রেণীবিভাগ

ধ্বনিবিভাগ মোটামুটি দুই প্রকারে করা যায়। প্রথম প্রকারে ধ্বনিগুলিকে দুইটি প্রধান শ্রেণীতে ফেলা হয়— অঘোষ (Unvoiced, Voiceless বা Breathed) এবং সঘোষ বা ঘোষবৎ (Voiced)।

কণ্ঠনালীর মধ্যে গলগণ্ডের ঠিক পিছনে সামনাসামনি দুইটি পাতলা শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি আছে। এই দুইটিকে বলে কণ্ঠতন্ত্রী (Vocal Chords বা Lips)। অঘোষ ধ্বনি উচ্চারণ করিবার সময় কণ্ঠতন্ত্রী শ্লথ থাকে। তখন কণ্ঠনালীর মধ্য দিয়া শ্বাসবায়ু অবাধে বাহির হইয়া যায়। কিন্তু ঘোষবৎ ধ্বনি উচ্চারণ করিবার সময় কণ্ঠতন্ত্রী প্রসারিত হইয়া কণ্ঠনালীতে শ্বাসবায়ু বাহির হইবার পথ রুদ্ধ করে। অবরুদ্ধ বায়ুপ্রবাহ তখন সে বাধা ঠেলিয়া নির্গত হয়, এবং তাহাতে কণ্ঠতন্ত্রীর অনুরণন উঠিয়া শ্বাসবায়ুতে তরঙ্গ তোলে, অর্থাৎ একরকম সুর লাগে, যাহাকে বলে ঘোষ (Voice)। ঘোষ থাকে বলিয়াই দ্বিতীয় শ্রেণীর ধ্বনিগুলিকে বলা হয় সঘোষ বা ঘোষবৎ (Voiced)।

অঘোষ ধ্বনি হইল—ব্যঞ্জন বর্গের প্রথম দ্বিতীয় ধ্বনি অর্থাৎ [ক, খ; চ, ছ; ট, ঠ; ত, থ; প, ফ] এবং [শ, ষ, স] ও বিসর্গ। ঘোষবৎ ধ্বনি হইল— বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ধ্বনি অর্থাৎ [গ, ঘ, ঙ, জ, ঝ, ঞ; ড, ঢ, ণ; দ, ধ, ন; ব, ভ, ম], [য, র, ল, ব, হ], এবং সমস্ত স্বরধ্বনি।

স্বরধ্বনি মাত্রেই ঘোষবৎ, এমন নয়। কোন কোন ভাষায় একরকম অঘোষ স্বরধ্বনি (Whispered vowel) শোনা যায়। ফিসফিস করিয়া কথা বলিলে যে স্বরধ্বনি শুনি তাহা প্রায়ই অঘোষ। তবে অঘোষ স্বরধ্বনি আসলে ব্যঞ্জনধ্বনিরই সামিল। কেন না এ ধ্বনির উচ্চারণে শ্বাসবায়ু বহির্গমনে ঈষৎ বাধা পায়। (পরে ব্যঞ্জনধ্বনির আলোচনায় দ্রষ্টব্য)।

ধ্বনির দ্বিতীয় প্রকার শ্রেণীবিভাগ হইতেছে—স্বর ও ব্যঞ্জন। এই দুই শ্রেণীর ধ্বনির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে।

যে-ধ্বনির উচ্চারণে নিঃশ্বাসবায়ু মুখবিবরে কোথাও কোনরকম বাধা পায় না তাহাকে স্বরধ্বনি (Vowel) বলে। সমগ্র জিহ্বার অথবা জিহ্বাংশের অবস্থান ও সেইসঙ্গে ওষ্ঠাধরের আকুঞ্চন-প্রসারণের দ্বারা মুখবিবরের আয়তনের যে পরিবর্তন হয় তাহারই উপর স্বরধ্বনির স্বরূপ নির্ভর করে। সেই আয়তনই স্বরধ্বনিকে বিশিষ্ট রূপ দান করে।

মুখবিবরের আয়তন-পরিবর্তন, যাহার উপর স্বরধ্বনি ও তাহার প্রকারভেদ নির্ভর করে, তাহা তিন উপায়ে সাধিত হয়। (১) জিহ্বাকে সম্মুখভাগে প্রসারিত, পশ্চাদ্‌ভাগে আকৃষ্ট, ঊর্ধ্বে উত্তোলিত কিংবা নিম্নে অবস্থাপিত করিয়া, (২) নীচের চোয়ালকে উঠাইয়া, নামাইয়া, এবং/অথবা (৩) ওষ্ঠদ্বয়কে কুঞ্চিত ও প্রসারিত করিয়া।

মুখবিবরের মধ্যে যে-কোন স্থানে কোনরকমে অথবা পেশী-আকুঞ্চনের ফলে শ্বাসবায়ু নির্গমনে বাধার সৃষ্টি হইলে ব্যঞ্জনধ্বনি (Consonant) হয়। বাধার স্থানের এবং প্রকারের উপর ব্যঞ্জনধ্বনির স্বরূপ নির্ভর করে। কণ্ঠনালীর উর্ধ্বভাগ, তালুর পশ্চাদভাগ, তালুর মধ্যভাগ, তালুর সম্মুখভাগ, উপর দন্তমূল, উপর দন্ত, এবং ওষ্ঠদ্বয়—এইগুলিকে বলে উচ্চারণস্থান (Place of Articulation)। এইসব স্থানের অধিকাংশই জিহ্বাংশ সংলগ্ন অথবা সন্নিকৃষ্ট থাকিয়া শ্বাসবায়ু নির্গমনে বাধা সৃষ্টি করে। এই বাধা নিরোধের প্রকার দুইরকম—সম্পূর্ণ অথবা আংশিক। উচ্চারণস্থানে জিহ্বা সংলগ্ন থাকিলে নিঃশ্বাসবায়ুর নির্গমন একেবারে রুদ্ধ হয়। জিহ্বা অপসারিত হইলেই ধ্বনিটি উচ্চারিত হইয়া যায়। এই হইল সম্পূর্ণ নিরোধ (Complete Closure)। আর জিহ্বা উচ্চারণস্থানের সন্নিকৃষ্ট থাকিয়া নিঃশ্বাসবায়ু নির্গমন পথ কিঞ্চিৎ রুদ্ধ করিলে হয় আংশিক নিরোধ (Partial Closure)। যেমন, কে, গ, ট, দ] ইত্যাদিতে সম্পূর্ণ নিরোধ; [র, ল, স, শ] ইত্যাদিতে আংশিক নিরোধ।

বর্ণনামূলক ভাষাবিশ্লেষণে তৃতীয় এক দৃষ্টিতে ধ্বনির শ্রেণীবিভাগ করা হয়। যে ধ্বনির উচ্চারণে মুখপ্রযত্নের পরম্পরা থাকে, সুতরাং যাহা বিশ্লিষ্ট করা যায়, তাহাকে বলা হয় বিভাজ্য ধ্বনি (Segmental Phoneme)। যে ধ্বনির উচ্চারণে মুখপ্রযত্নের বহুতা আছে কিন্তু তাহা পরম্পরায় বিশ্লেষণ করা যায় না তাহাকে বলে অবিভাজ্য ধ্বনি (Supra-segmental Phoneme)। অবিভাজ্য ধ্বনি বলিতে ঠিক যে কোন একটি বা একাধিক ধ্বনি বোঝায় তাহা নহে, কোন ধ্বনির বিশিষ্ট “রঙ” ও বোঝায়: যেমন স্বরধ্বনির দীর্ঘতা ও অনুনাসিকতা। বর্ণনামূলক ভাষাবিশ্লেষণে দীর্ঘত্ব (Length), অনুনাসিকতা (Nasalization), অবকাশ (Juncture) এবং ঝোঁক বা সুর (Accent) বিশিষ্ট ধ্বনি (Phoneme) বলিয়া স্বীকৃত। যেহেতু ঝোঁক বা সুরের, অনুনাসিকতার এবং দীর্ঘত্বের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি পদের অর্থ বদলাইয়া দেয় সেই হেতু এই ব্যাপারগুলি ধ্বনি (Phoneme)। ঝোঁকের অনুনাসিকের ও অবকাশের উদাহরণ পরে দ্রষ্টব্য। দীর্ঘত্বের উদাহরণ যেমন সংস্কৃতে—‘কিল’ (অব্যয়), ‘কীল’ (বিশেষ্য, অর্থ, গোঁজ); বাঙ্গালায়—‘কি’ (প্রশ্নে—‘সে কি ভাত খাবে?)’ কী (=কোন্‌ বস্তু—‘সে ভাত খাবে না। তো কী খাবে?’)॥

৫. স্বরধ্বনি

জিহ্বার অবস্থান এবং মুখগহ্বরের আকৃতি লক্ষ্য করিয়া এই আটটি মৌলিক স্বরধ্বনি (Cardinal Vowels) নির্দিষ্ট হইয়াছে—[ই, এ, এ’, আ আ’, অ°, ও, উ (i, e, ɛ, a, a, o o, u)]। মনে রাখিতে হইবে যে মৌলিক স্বরধ্বনি বিশেষ কোন ভাষায় বা ভাষাসমূহে ব্যবহৃত ধ্বনি নয়। এইগুলি হইল সব ভাষার স্বরধ্বনি চিনিবার মান বা নিদর্শন (standard)।

(১) ই, এ, এ’, আ’,] এবং (২) [আ, অ°, ও, উ]—এই দুই গুচ্ছ ধ্বনির উচ্চারণের সময়ে জিহ্বা (অর্থাৎ জিহ্বার যথাক্রমে অগ্র ও পশ্চাৎ অংশ) সম্মুখদিকে প্রসারিত এবং পশ্চাদ্‌ভাগে আকৃষ্ট হয়। সেই জন্য ধ্বনিগুলিকে যথাক্রমে সম্মুখ (Front) এবং পশ্চাৎ (Back) স্বরধ্বনি বলা হয়।

[ই] ধ্বনিতে জিহ্বার সম্মুখভাগ প্রসারিত হয় এবং বায়ুপ্রবাহের নির্গমনে কোন বাধা না দিয়া যথাসম্ভব ঊর্ধ্বে অবস্থিত থাকে। [এ, এ’] ধ্বনিতে জিহ্বার সম্মুখভাগের উচ্চতা পর-পর কম থাকে, আর (আ’) ধ্বনিতে জিহ্বার সম্মুখভাগ সর্বাপেক্ষা নিম্ন উচ্চতায় থাকে। [আ, অ°, ও, উ] ধ্বনিগুলিতে জিহ্বার পশ্চাদ্‌ভাগ আকৃষ্ট হয়। [আ’, আ] ধ্বনিতে জিহ্বার উচ্চতা সর্বাপেক্ষা অল্প থাকে, তাহার পর ক্রমশ বাড়িয়া [ই, উ] ধ্বনিতে সর্বাধিক উচ্চতা পায়।

মৌলিক স্বরধ্বনি চিত্র

মৌলিক স্বরধ্বনি চিত্র

[ই, এ, এ’, আ’ আ]— এই পাঁচটি ধ্বনির উচ্চারণের সময়ে ওষ্ঠদ্বয় কমবেশি প্রসারিত থাকে বলিয়া এইগুলিকে প্রসারিত (Retracted) স্বরধ্বনি বলা হয়। [অ°, ও, উ,]—এই তিনটি ধ্বনির উচ্চারণকালে ওষ্ঠদ্বয় কুঞ্চিত হয় বলিয়া এগুলিকে কুঞ্চিত (Rounded) স্বরধ্বনি বলা হয়।

[ই, উ] ধ্বনি দুইটির উচ্চারণকালে মুখবিবর সংবৃত অর্থাৎ সংকুচিত থাকে বলিয়া এই দুই ধ্বনিকে সংবৃত (Closed) স্বরধ্বনি বলে। [আ’, আ]– এই দুই ধ্বনির উচ্চারণকালে মুখবিবর বিবৃত অর্থাৎ বিশেষ প্রসারিত থাকে বলিয়া এই দুইটিকে বিবৃত (Open) স্বরধ্বনি বলে। [এ, ও] ধ্বনি দুইটির উচ্চারণের সময়ে মুখবিবর প্রায়-সংবৃত থাকে বলিয়া এই দুইটিকে অর্ধসংবৃত (Half-closed) স্বরধ্বনি বলে। [এ’, অ°]— এই দুই ধ্বনির উচ্চারণকালে মুখবিবর প্রায়-বিবৃত হয় বলিয়া এই দুইটিকে অর্ধবিবৃত (Half-open) স্বরধ্বনি বলা হয়।

মৌলিক স্বরধ্বনির তুলনায় বাঙ্গালার স্বরধ্বনির উচ্চারণস্থান নীচের চিত্রে বন্ধনী মধ্যে দেখানো গেল।

[আ হ্রস্ব] [আ দীর্ঘ] [আঁ]

[আ হ্রস্ব] [আ দীর্ঘ] [আঁ]

উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ু নাসাবিবরে প্রবেশ করিয়া অনুরণিত হইলে অনুনাসিক স্বরধ্বনি (Nasalized Vowel) উৎপন্ন হয়। নাসাবিবরে নিঃশ্বাসবায়ুর অনুরণনকে বলে অনুনাসিকতা (Nasalization)।

একটিমাত্র স্বরধ্বনি উচ্চারণে যে প্রযত্ন লাগে তাহার মধ্যে দুইটি স্বরধ্বনি উচ্চারিত হইয়া গেলে, অর্থাৎ জিহ্বা এক স্বরধ্বনি উচ্চারণে প্রবৃত্ত হইয়া অপর একটি স্বরধ্বনি উচ্চারণে নিবৃত্ত হইলে, দ্বিস্বরধ্বনি (Diphthong) হয়। দ্বিস্বর-ধ্বনির শেষের অংশ সাধারণত [ই] অথবা [উ]। বাঙ্গালায় দুইটি মাত্র দ্বিস্বর-ধ্বনি[ঐ, ঔ]॥

৬. ব্যঞ্জনধ্বনি

উচ্চারণস্থান (Place of Articulation) অনুসারে ব্যঞ্জনধ্বনি প্রকারভেদ বাগ্‌যন্ত্রের রেখাচিত্র দিয়া দেখানো যাইতেছে।

(ক) ওষ্ঠ্য (Labial): উচ্চারণকালে ওষ্ঠ অধরকে স্পর্শ করিলে ধ্বনিকে বলে বিশুদ্ধ ওষ্ঠ্য (Bilabial)। আর উপরের দাঁত অধর স্পর্শ করিলে দন্তৌষ্ঠ্য (Labiodental) বা (Dentilabial)। বিশুদ্ধ ওষ্ঠ্য—আমাদের প-বর্গের ধ্বনি; দন্তৌষ্ঠ্য—ইংরেজী [f, v]।

(খ) জিহ্বাশিখরীয় (Apical): উচ্চারণকালে জিহ্বাশিখর উপরের দাঁত স্পর্শ করিলে দন্ত্য (Dental)। উপরের দন্তমূল (alveolae) স্পর্শ করিলে দন্তমূলীয় (Alveolar)। পিছনের দিকে বাঁকিয়া তালু স্পর্শ করিলে মূর্ধন্য বা প্রতিবেষ্টিত (Retroflex)। দন্ত্য—আমাদের [ত, থ, দ, ধ], সংস্কৃত [স], ইংরেজী [θ] [δ]। দন্তমূলীয়—আমাদের [ন, র, ল, ব], ইংরেজী [t, d, n, r, s, z]। মূর্ধন্য—আমাদের [ট, ঠ, ড, ণ৪’, ড়, ঢ়]।

(গ) অগ্রজিহ্বা (Frontal): উচ্চারণকালে জিহ্বার অগ্রভাগ দন্তমূল ও তালুর সংলগ্ন অংশ স্পর্শ করিলে তালুদন্তমূলীয় (Alveopalatal), আর তালুর সম্মুখ অংশ স্পর্শ করিলে অগ্রতালব্য (Prepalatal)। তালুদন্তমূলীয় ইংরেজী— [চ, জ], আমাদের [ষ, শ], অগ্রতালব্য সংস্কৃত [ঞ]।

(ঘ) পশ্চজিহ্ব্য (Postpalatal বা Dorsal): উচ্চারণকালে জিহ্বার পশ্চাৎভাগ তালুর পশ্চাৎ অংশ স্পর্শ করিলে তালব্য (Palatal), তালুর নীচের অংশ (velum) স্পর্শ করিলে কণ্ঠ্য (Velar) আর অলিজিহ্বা অথবা তাহার সংলগ্ন স্থান স্পর্শ করিলে কণ্ঠমূলীয় (Uvul̄ ar)। তালব্য— [য়]। কণ্ঠ্য— আমাদের [ক, গ, ঙ]। কণ্ঠমূলীয়—আরবী [q]।

(ঙ) কণ্ঠনালীয় (Laryngeal , ও Glottal): উচ্চারণকালে কণ্ঠনালীর পেশী-আকুঞ্চনের দ্বারা বাধা সৃষ্টি হইলে কণ্ঠনালীয় ধ্বনি উচ্চরিত হয়। যেমন আমাদের [ঃ(বিসর্গ), হ], ইংরেজী [h], আরবী আলিফ্‌ হাম্‌জা।

শ্বাসবায়ুর নির্গমনে বাধার প্রকৃতি (Nature of Obstruction) অনুসারে ধ্বনির প্রকৃতিভেদ হয়। শ্বাসবায়ু সম্পূর্ণভাবে বাধা পাইলে সৃষ্ট (Plosive, Occlusive বা Stop)। আংশিকভাবে বাধা পাইলে উষ্ম (Fricative বা Spirant)। নাসায় অথবা মুখগহ্বরে রণিত বা প্রতিধ্বনিত হইয়া, নাসাপথে, মুখপথে, অথবা যুগপৎ নাসা এবং মুখ উভয় পথে শ্বাসবায়ু নির্গত হইলে রণিত (Resonant)। স্পৃষ্ট— [ক, গ, ত, দ, প, ব (বর্গীয়)]; উষ্ম— [শ, স, f, θ, δ, z,]; রণিত— [ন, ম, ঙ, ঞ]।

ওষ্ঠের আকৃতি ও জিহ্বার অবস্থান অনুসারে উষ্মধ্বনির দুইপ্রকার রূপ। ওষ্ঠ ও জিহ্বা ঈষৎ প্রসৃত হইলে [হ, f, θ, δ, z,] প্রভৃতি প্রশস্ত (Slit) উষ্মধ্বনি উচ্চারিত হয়। জিহ্বা নালীর মতো আকূঞ্চিত হইলে সংকীর্ণ (Groove) উষ্মধ্বনি [শ স z, ź] ইত্যাদি।

কোন ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে যদি কণ্ঠনালীর পেশী আকুঞ্চিত হইয়া যুগপৎ অতিরিক্ত বাধা সৃষ্টি করে তবে— যেমন [খ, ঘ, থ, ধ, ফ, ভ] ইত্যাদি— মহাপ্রাণ (Aspirate) ধ্বনি উৎপন্ন হয়। স্পৃষ্ট ও উষ্মবর্ণ যুগপৎ উচ্চারিত হইলে (অর্থাৎ যুগপৎ দুইটি উচ্চারণস্থান থাকিলে) অথবা স্পৃষ্ট বর্ণের উচ্চারণে বাধার অপসারণ দ্রুত না ঘটিলে (অর্থাৎ বাধার গোড়ায় পৃষ্ঠ এবং শেষে উষ্মধ্বনির মতো উচ্চারণ হইলে) বলে ঘৃষ্ট (Affricatc) ধ্বনি। যেমন [চ, জ, c, j]।

ল-কার উচ্চারণ করিবার সময় বায়ুপ্রবাহ জিহ্বার পার্শ্বদেশ ঘেঁষিয়া বহির্গত হয় বলিয়া এই ধ্বনিকে পার্শ্বিক (Lateral) ব্যঞ্জন বলা হয়। র-কার উচ্চারণের সময় জিহ্বার অগ্রভাগ (অথবা তালুর নিম্নাংশ) কম বেশি কম্পিত হয় বলিয়া ইহাকে কম্পিত (Trilled) ব্যঞ্জন বলে। ড-কার ও ঢ়-কার উচ্চারণের কালে জিহ্বার তলদেশ দিয়া দন্তমূল তাড়না করা হয় বলিয়া এই ধ্বনিকে তাড়িত (Flapped) ব্যঞ্জন বলা হয়॥

৭. অর্ধব্যঞ্জন ও অধস্বর

স্পৃষ্ট ব্যঞ্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হইতেছে নাসিক্য (Nasal) ধ্বনি— বর্গের পঞ্চম বর্ণ। শ্বাসবায়ু শুধু মুখ দিয়া বাহির না হইয়া নাসারন্ধ্রে ধ্বনিত হইয়া যুগপৎ মুখ ও নাসাপথে নির্গত হইলে নাসিক্যধ্বনির উদ্ভব হয়।

ল-কার, র-কার, ন-কার এবং ম-কার এই চারিটি ধ্বনি স্বয়ং অথবা স্বরধ্বনির মতো ব্যঞ্জনধ্বনির বাহক হইয়া অক্ষর (syllable) সৃষ্টি করিতে পারে। তখন, ইহারা স্বরধ্বনির কাজ করে বলিয়া এগুলিকে অর্ধব্যঞ্জন (Sonant) বলে। সংস্কৃত ঋ-কার ও ৯-কার অর্ধব্যঞ্জন! ইংরেজীতে button (=bΛtn) এবং chasm (=kazm) শব্দে অর্ধব্যঞ্জন (ন্·, ম্‌·,) ধ্বনি শোনা যায়।

ই-কার এবং উ-কার এই দুই স্বরধ্বনি উচ্চারণ করিবার সময় যদি জিহ্বাগ্র অধিক উচ্চ অথবা ওষ্ঠদ্বয় অধিক সঙ্কীর্ণ হইয়া বায়ুপথ আংশিকভাবে রুদ্ধ করে এবং ধ্বনি ঈষৎ উষ্ম হইয়া যায়, তখন ধ্বনি দুইটিকে অর্ধস্বর (Semivowel) বলে। যেমন, যে, (অন্তঃস্থ) ব্‌]॥

৮. দ্বিব্যঞ্জন-ধ্বনি

একটিমাত্র ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণকাল-মধ্যে একসঙ্গে দুইটি ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারিত হইয়া গেলে বলে দ্বিব্যঞ্জন-ধ্বনি। দ্বিব্যঞ্জন-ধ্বনি সাধারণত দুই প্রকার,—মহাপ্রাণ (Aspirate) এবং ঘৃষ্ট (Affricate)। স্পৃষ্ট ব্যঞ্জন এবং হ-কার যুগপৎ উচ্চারিত হইলে মহাপ্রাণ ধ্বনির উদ্ভব হয়। বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধ্বনি মহাপ্রাণ; খ=ক্+হ, ভ=ব্‌+হ ইত্যাদি। স্পৃষ্ট ব্যঞ্জন এবং উষ্মধ্বনি যুগপৎ উচ্চারিত হইলে ঘৃষ্ট ধ্বনির উৎপত্তি হয়। স্পৃষ্ট প্রথমাংশ অনুসারে ঘৃষ্টধ্বনির নাম হয়। যেমন তালব্য ঘৃষ্ট (Palatal Affricate) বাঙ্গালা (ও নব্য-আর্য) চ (=ক্‌শ), জ (=গজ্‌); দন্তমূলীয় ঘৃষ্ট (Alveolar Affricate) ইংরেজী চ (ts), জ (dz); দন্ত্য ঘৃষ্ট (Dental Affricate) কোন কোন নব্য-আর্য ভাষায় চ [ =ৎস,], জ [দজ·]॥

৯ অক্ষর ও মাত্রা

শব্দ অক্ষরের সমষ্টি। কোন পদ উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ু মাঝে মাঝে মন্দীভূত হয়। অর্থাৎ উচ্চারণপ্রবাহ যেন একটু শ্লথ হয়। এক ছেদ হইতে আর এক ছেদ পর্যন্ত ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিই অক্ষর (Syllable)। শুদ্ধ স্বরধ্বনি, অর্ধব্যঞ্জনধ্বনি, অগ্রে অথবা পশ্চাৎ অথবা অগ্রপশ্চাৎ ব্যঞ্জনযুক্ত স্বরধ্বনি, কিংবা অগ্রে ব্যঞ্জনযুক্ত স্বরধ্বনি (অথবা অর্ধব্যঞ্জনধ্বনি) লইয়া অক্ষর। স্বরধ্বনিতে এবং অর্ধব্যঞ্জনধ্বনিতে ধ্বনির গাঢ়তা ফুটিয়া উঠে এবং তাহার পরই ধ্বনিপ্রবাহের বেগ যেন একটু কমিয়া আসে। সেইখানেই অক্ষরের সমাপ্তি। শব্দে স্বরধ্বনি এবং অর্ধব্যঞ্জনধ্বনি গুণিয়া অক্ষরসংখ্যা নির্ণীত হয়। ‘হরি’ দুই অক্ষর। ‘রাম’ সংস্কৃত উচ্চারণে দুই অক্ষর (রা-ম], বাঙ্গালা উচ্চারণে এক অক্ষর [রাম্]। অক্ষর দুই প্রকার। স্বরধ্বনিতে অক্ষর শেষ হইলে হয় বিবৃত (Open), আর ব্যঞ্জন অথবা অর্ধব্যঞ্জনধ্বনিতে শেষ হইলে হয় সংবৃত (Close) [হরি] শব্দে দুই অক্ষরই বিবৃত। বাঙ্গালা উচ্চারণে [রাম] শব্দে এক অক্ষর, সংবৃত। [ভক্ত=ভক্‌ত] শব্দে দুই অক্ষর প্রথমটি সংবৃত, দ্বিতীয়টি বিবৃত।

অক্ষরের উচ্চারণমানের একককে বলে মাত্রা (Mora)। বিবৃত অক্ষরে হ্রস্ব স্বরধ্বনি থাকিলে তাহা এক মাত্রা, আর বিবৃত অক্ষরে দীর্ঘস্বরধ্বনি থাকিলে এবং সংবৃত অক্ষরে সর্বদা দুই মাত্রা। যেমন, [হরি] শব্দের দুই অক্ষরে একমাত্রা করিয়া মোট দুই মাত্রা। [ভক্ত] শব্দের দুই অক্ষরে দুই এবং এক একুনে তিন মাত্রা। সংস্কৃতে ‘বিকৃত’ [বি-কৃ-ত] তিন অক্ষরে এক এক এক করিয়া তিন মাত্রা, বাঙ্গালায় [বিক্‌-রি-ত] দুই এক এক করিয়া চার মাত্রা বাঙ্গালা বর্ণমালায় [আ, ঈ, উ] দীর্ঘ স্বরধ্বনিরূপে চিহ্নিত হইলেও উচ্চারণে এইগুলি প্রায়ই হ্রস্বই। যেমন [করিয়া], এখানে শেষ অক্ষরে ‘আ’ সত্ত্বেও ইহা হ্রস্ব বলিয়া মোট মাত্ৰাসংখ্যা এখানে তিন। তেমনি অনেক সময়ে বর্ণমালার হ্রস্বস্বর ভাষায় দীর্ঘ উচ্চারিত হয়, তখন এগুলি দুইমাত্রা। যেমন, [সে কি খাবে?]—প্রশ্ন, খাবে কি খাবে না—এখানে ‘কি’ একমাত্রা কিন্তু [সে কি খাবে?]—প্রশ্ন, খাদ্যবস্তু সম্বন্ধে—এখানে স্বর দীর্ঘ, সুতরাং দুইমাত্রা। সংস্কৃতে আ, ঈ, উ, এ, ও—সর্বদা দীর্ঘ স্বরধ্বনি, সুতরাং দ্বিমাত্রিক কিন্তু বাঙ্গালা উচ্চারণে এগুলি সাধারণত বিবৃত অক্ষরে হ্রস্ব। যেমন, [একদা, লোকে]—হ্রস্ব, [এক, ওল]—দীর্ঘ। এই কারণে, একই শব্দের সংস্কৃত ও বাঙ্গালা উচ্চারণে মাত্ৰাসংখ্যার পার্থক্য হইতে পারে। যেমন, “জনগণমনঅধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা”,—এখানে উচ্চারণ সম্পূর্ণ সংস্কৃতের মতো, সুতরাং মোট মাত্ৰাসংখ্যা আটাশ। বাঙ্গালা রীতিতে পড়িতে হয় (জন্‌গন্‌মন্ অধিনায়ক্‌ জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা], তখন মাত্রাসংখ্যা দাঁড়ায়—দীর্ঘ-স্বরগুলি হ্রস্ব হওয়াতে—তেইশ।

আধুনিক বাঙ্গালা ভাষার, বিশেষ করিয়া পশ্চিমবঙ্গের কথ্যভাষার, এক প্রধান বিশেষত্ব হইল দ্বিমাত্রিকতা (Bimorism)। অর্থাৎ বহ্বক্ষর শব্দে ধ্বনিসংখ্যা যতই হোক না কেন উচ্চারণে শব্দটি দুইটি মাত্রায় অথবা দুই মাত্রার গুচ্ছে আসিয়া দাঁড়ায়। যেমন, দেবতা—দেব্‌—তা, আকাশ—আ-কাশ্‌, পরিণাম—পরি+ণাম্‌, অপরাজিতা—অপ-রা+জিতা, ইত্যাদি।

সমাসবদ্ধ শব্দে অথবা দুইটি শব্দের ঘনিষ্ট সংযোগে এবং একত্র-উচ্চারণে শব্দদ্বয়ের শেষ ও প্রথম ধ্বনির মধ্যে যে শ্বাসের অবকাশ থাকা উচিত তাহা অনেক সময় এত ক্ষীণ হয় যে কানে ধরাই পড়ে না। ধ্বনিদ্বয়-মধ্যবর্তী এবং প্রায় অশ্রুত এমন সংহিতা-অবকাশকে সন্ধান (Juncture) বলা হয়। সমাসবদ্ধ শব্দটি বিশিষ্ট অর্থ প্রাপ্ত হইলে সন্ধান বিলুপ্ত হয়। যেমন ‘মাথাঘষা’ (সুগন্ধ মশলা বিশেষ): ‘মাথা-ঘষা’; ‘ফুলবড়ি’: ‘ফুল-বাড়ি’। সন্ধানের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি এইভাবে অর্থবহ বলিয়া সন্ধানকে ধ্বনির (Phoneme) মর্যাদা দেওয়া হয়। যেমন, জা-গো (=যাও, মৃদু অনুজ্ঞা): জাগো (=জাগ্রত হও); পা-টা: পাটা; আয়-না (মৃদু অনুজ্ঞা); আয়না; কু-পিতা (=দুষ্ট পিতা): কুপিতা (=ক্রুদ্ধ স্ত্রীলোক) ইত্যাদি॥

১০. ঝোঁক ও সুর

কোন কোন ভাষার পদের মধ্যে কোন একটি নির্দিষ্ট অক্ষরে শ্বাসবায়ু একটু জোরে বাহির হয়। তাহার ফলে সেই অক্ষরটির উচ্চারণ পদের অপর অক্ষরের তুলনায় তীব্র হয়। এইরূপ উচ্চারণগত অক্ষর প্রাধান্যকে ঝোঁক, বল অথবা শ্বাসাঘাত (Stress বা Breath Accent) বলে। শ্বাসাঘাত ইংরেজী, জামান, রুশ প্রভৃতি ভাষার একটি বড় বিশেষত্ব। এইসব ভাষায় শ্বাসাঘাতের অবস্থানের উপর পদের অর্থ নির্ভর করে। যেমন, ইংরেজীতে ‘defile বিশেষ্য, défile ক্রিয়া।

ঝোঁক ছাড়াও অন্য উপায়ে পদের কোন একটি বিশেষ অক্ষর উচ্চারণে প্রাধান্য লাভ করিতে পারে। ইহাকে সুর, স্বর অথবা স্বরাঘাত (Intonation, Pitch, Tone বা Accent) বলা হয়। পদের যে অক্ষরে স্বর থাকে তাহার ঘোষ উচ্চতর গ্রামে ধ্বনিত হয়, অর্থাৎ সেই স্বরধ্বনিটুকু উচ্চারণের সময়ে কণ্ঠতন্ত্রী দ্রুততর বেগে কম্পিত হয়। চীন, সুইডেন, নরওয়ে প্রভৃতি দেশের ভাষায় ও আমাদের দেশে পাঞ্জাবীতে সুর একটি উচ্চারণগত প্রধান বিশেষত্ব।

অনেক ভাষার কোন কোন শব্দে সুরের হেরফেরে অর্থবৈলক্ষণ্য ঘটিয়া থাকে। সুরের বৈচিত্র্য অনুসারে বাঙ্গালায় [হাঁ, না], ইংরেজীতে [yes, no] নিশ্চয় সংশয় বিস্ময় বিতর্ক—এই চার বিভিন্ন ভাব জ্ঞাপন করিতে পারে। যেমন, [না] সুরবিহীন হইলে সাধারণ নিষেধাত্মক (—‘আমি ওসব কথা শুনি না’); সুরে চড়া হইলে দৃঢ় নিষেধাত্মক (—‘কতবার বলব, —না!’); সুর খাদ হইতে একটু একটু করিয়া চড়িলে সংশয় অথবা নিশ্চয়হীনতা বোঝায় (—‘তুমি বলেছ বটে কিন্তু না,—আচ্ছা ভেবে দেখব’); সুর চড়া হইতে খাদে নামিলে বিস্ময়জ্ঞাপক (—‘না !—তুমি বলছ কি?’)।

যে স্বরধ্বনিতে সুর চড়িতে থাকে সে স্বরকে বলে তারস্বর বা উদাত্ত (Acute বা Rising Tone)। প্রধান স্বরের অব্যবহিত পরবর্তী স্বরধ্বনিতে সুর ওঠা হইতে অথবা আরো একটু উঠিয়া নামিতে থাকে। তাহাকে বলে স্বরিত (Falling Tone)। যে স্বরধ্বনিতে সুর ওঠে এবং নামে তাহাকে বলে কম্প-স্বর বা স্বাধীন স্বরিত (Circumflex)। যে স্বরধ্বনিতে সুর চড়েও না নামেও না, একটানা থাকে, তাহাকে বলে খাদস্বর বা অনুদাত্ত (Unaccented বা Level Tone)। চড়া সুর একটানা হইলে বলে উঁচু টানা (Highlevel), খাদ সুর একটানা হইলে বলে নীচ টানা (Low level)।

বৈদিক ভাষায় সুর একটি বড় বিশেষত্ব ছিল। বৈদিক ভাষায় সুরের পরিবর্তনে পদের অর্থপরিবর্তন ঘটিত। যেমন ‘ব্রহ্মন্‌’—আদি স্বর উদাত্ত হইলে [র্ব্রহ্মন্] শব্দটি ক্লীবলিঙ্গ, অর্থ “প্রার্থনা, স্তব”, আর অন্ত্য স্বর উদাক্ত হইলে [র্ব্রহ্মন্‌) শব্দটি পুংলিঙ্গ, অর্থ “প্রার্থনাকারী, স্তোতা”। এইরূপ [রাজপুত্র] এই সমাসযুক্ত পদে দ্বিতীয় স্বরধ্বনি উদাত্ত হইলে [রার্জপুত্র] বহুব্রীহি সমাস (“যাহার পুত্র রাজা” অর্থাৎ “রাজার পিতা”।) এবং শেষ স্বর-ধ্বনি উদাত্ত হইলে [রাজর্পুত্র] ষষ্টি তৎপুরুষ সমাস (“রাজার পুত্র”)॥

১১. মাত্রাপূরক দীর্ঘীভবন

অনেক ভাষার ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যায় যে কালবশে উচ্চারণের প্রকৃতি কিছু কিছু বদলায়। তাহাতে ভাষায় যে সব ধ্বনি-পরিবর্তন দেখা দেয় তাহার মধ্যে একটি হইল স্বরধ্বনির হ্রস্বতা অথবা দীর্ঘতা। যুক্ত অথবা যুগ্ম ব্যঞ্জনধ্বনি একক ব্যঞ্জনধ্বনিতে পরিণত হইতে পারে। কিন্তু তাহা হইলেও সেই অক্ষরের মাত্রার পরিমাণ বদল হয় না। হ্রস্ব স্বরের পরে যুক্ত অথবা যুগ্ম ব্যঞ্জন থাকিলে সেই অক্ষর দ্বিমাত্রিক সেই যুক্ত অথবা যুগ্ম ব্যঞ্জন-ধ্বনির একটি লোপ পাইলে স্বাভাবিকভাবে অক্ষরটি হইবে একমাত্রিক। কিন্তু যেহেতু আগে অক্ষরটি দ্বিমাত্রিক ছিল সেইহেতু এখনও দ্বিমাত্রিক থাকিবে। অতএব এখানে ক্ষতিপূরণের জন্য হ্রস্ব স্বরধ্বনিটি দীর্ঘ উচ্চারিত হইবে। এইভাবে যুক্ত অথবা যুগ্ম ব্যঞ্জনধ্বনি একটিমাত্র ব্যঞ্জনধ্বনিতে পরিণত হইলে এবং তাহার ফলে অব্যবহিত পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি দীর্ঘ উচ্চারিত হইলে বলা হয় মাত্রাপূরক দীর্ঘীভবন (Compensatory Lengthening)। —সং ভক্ত, প্রা ভত্ত > বা ভাত; সং মৎস, প্রা মচ্ছ > বা মাছ; সং মিথ্যা, প্ৰা মিচ্ছা > বা মীছ (লেখা হয় ‘মিছ’); সং নষ্ট, প্রা নট্‌ঠ > বা নট (এখানে ন-কারের অ-কার দীর্ঘ); সং দুগ্ধ প্ৰা দুদ্ধ > বা দূধ (লেখা হয় ‘দুধ’); সং ব্যক্ত প্ৰা বেত্ত (এখানে একার হ্রস্ব) > বা ব্যাঁত; সং প্রা পঞ্চ > বা পাঁচ; ইত্যাদি।

অ-কারের আ-কার হওয়া মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাতে শুরু হইয়াছিল। অশোকের অনুশাসনে সং ‘বর্ষ’ পাই ‘বাস’ রূপে। আসলে এখানে দীর্ঘীভবন হইয়াছে কি না সে সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা একমত নহেন। কোন কোন পণ্ডিত বলেন যে এখানে ‘বস্‌স’ লিখিতে ‘বাস’ লেখা হইয়াছে। তবে পালিতে দীর্ঘীভবনের উদাহরণ কিছু কিছু আছে। —সং দীর্ঘ > দিগ্‌ঘ > দীঘ (তুলনীয় বাঙ্গালা দীঘি < সং দীর্ঘিকা), সং সিংহ > সীহ, ইত্যাদি। বাঙ্গালায় যেখানে অ-কার আ-কার হইয়াছে সেখানে বুঝিতে হইবে যে পরিবর্তন বেশ প্রাচীন, যেখানে তাহা হয় নাই, অর্থাৎ অ-কার দীর্ঘ অ-কার উচ্চারিত হয়, সেখানে পরিবর্তন অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন। এইভাবে দেখিলে ‘পাঁচ’ প্রাচীন, ‘পঁচিশ, পঁয়তিরিশ’ অর্বাচীন॥

মৌলিক স্বরগুলির উচ্চারণ যথাক্রমে ‘নদী দেশ (সাধুভাষায়), দেশ (পূর্ববঙ্গে কতকটা যেন ‘দ্যাশ’) কাল (পূর্ববঙ্গে), কালো, অচল (সাধারণ বাঙ্গালা [অ]), ওঃ, উট’ শব্দের মতে।

সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণে ‘সন্ধ্যক্ষর’ বলিতে গেলে ‘অক্ষর’ মানে ধ্বনি বুঝিতে হইবে।

যেমন thin, thought ইত্যাদি শব্দের আদি ব্যঞ্জন।

যেমন them, that ইত্যাদি শব্দের, আদি ব্যঞ্জন।

[ণ] ধ্বনি বাঙ্গালায় নাই, ওড়িয়া, মারাঠী প্রভৃতি কোন কোন ভারতীয় ভাষায় আছে। সংস্কৃতে তো আছেই।

পরে দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *