৩. বিভিন্ন প্রেক্ষিতে দেখা গীতা

বিভিন্ন প্রেক্ষিতে দেখা গীতা

জ্ঞানেশ্বরীজ্ঞানদেব

মাত্র ১৫ বছর বয়সে জ্ঞানদেব নামে মহারাষ্ট্রীয় এক যুবক গীতার ব্যাখ্যা করেন। জ্ঞানদেবের জন্ম ১২৭৫ খ্রিস্টাব্দে। পিতা বিটঠলপন্থ কুলকর্ণী, মাতা রুক্মিণীবাঈ।

নেবাসা গ্রামে জ্ঞানদেব ভাবার্থদীপিকা বা জ্ঞানেশ্বরী গীতা প্রণয়ন করেন ইং ১২৯০ এবং ১২১২ শকে। ১২২৮ শকে জীবন্ত সমাধি লাভ করেন।

জ্ঞানদেব ছিলেন অদ্বৈতবাদী। তাঁর দার্শনিক মত ছিল শঙ্করাচার্যের অনুরূপ। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন, এই হল অদ্বৈত মত।

তৃতীয় অধ্যায়ে জ্ঞানেশ্বরী বললেন :

সাংখ্যবাদীরা জ্ঞানমার্গ অবলম্বন করে বিহঙ্গম গতিতে মোক্ষ প্রাপ্ত হয়। কর্মযোগী কর্মমার্গ আশ্রয় করে বিহিত স্বধর্মানুষ্ঠান করতে করতে যথাসময়ে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।

জ্ঞানেশ্বরীর মতে বিহিত কর্ম না করে কেউই সিদ্ধ পুরুষের মত কর্মহীন হতে পারে না। প্রাপ্ত কর্ম ত্যাগ করে নৈষ্কর্ম্য লাভ ঘটে একথা মূর্খের মত বলা। নৈষ্কর্ম্য বাদে আস্থা থাকলে উচিত কর্ম কোনো মতেই ত্যাজ্য নয়। আপন ইচ্ছানুসারে কর্ম করলে তা সিদ্ধ হবে, ত্যাগ করলে কর্মেরও নাশ হবে একথা হলো ব্যর্থ ও স্বেচ্ছাচার- প্রণোদিত। কর্ম ত্যাগ করলেই কর্ম থেকে অব্যাহতি মেলে না। প্রকৃতির অধীন পুরুষের কর্মত্যাগ হয় না। কর্ম পরাধীন প্রকৃতির গুণানুসারেই অনুষ্ঠিত হয়। অন্য কেউ কর্ম করল কি কর্ম ত্যাগ করল এমন মনে করা বৃথা। যতক্ষণ প্রকৃতির সঙ্গ থাকে ততক্ষণ কর্মত্যাগ হয় না। লেখক তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে দৃষ্টান্ত দিয়েছেন :

রথে চড়ে যদি কেউ নিশ্চল হয়ে বসে থাকে তাহলে তাও পরতন্ত্র হয়ে থাকা হয়। অর্থাৎ রসের অধীন হয়ে রসের সঙ্গে চলতে হয়। তেমনিভাবে নিষ্কর্মা পুরুষও নিরন্তর কর্ম করে। যেমন একটি শুষ্ক পত্র নিশ্চেষ্ট হলেও বায়ু দ্বারা চালিত হয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায়। লেখক প্রদত্ত দৃষ্টান্তগুলি খুবই বাস্তবানুগ।

সূত্রাকারে লেখকের কর্মযোগ সংক্রান্ত বক্তব্য উদ্ধার করে দেওয়া গেল :

ক. জগতে নিষ্কর্মা হয়ে থাকা সম্ভব নয়।

খ. যে যে উচিত কর্ম অবসরমত প্রাপ্ত হওয়া যায় নিষ্কামভাবে সেগুলির আচরণ করা কর্তব্য।

গ. কর্ম নিজের থেকেই কর্মমোচক।

ঘ. অনুক্রমানুসারে যে স্বধর্মের আচরণ করে, সেঐ কর্মের দ্বারাই নিশ্চিত মোক্ষপ্রাপ্ত হয়।

ঙ. স্বধর্ম হল নিত্য যজ্ঞ, তাই তার আচরণে পাপের সঞ্চার হয় না।

চ. স্বধর্ম পরিত্যক্ত হলে, কুকর্মে রতি হলেই সংসারের বন্ধন এসে পড়ে।

ছ. মায়ার অধীন হলে এই সমস্ত জগৎ কর্মবন্ধনে আবদ্ধ। সেজন্য তা নিত্য যজ্ঞ থেকে বিচ্যুত।

জ. স্বধর্মের লোপ হলে সর্ব সুখের আধার ভেঙে যায়। জলচর জীব জল ছাড়লে যেমন তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হয় স্বধর্ম ভুললে জীবেরও তেমনি দশা হয়।

দৃষ্টান্ত ব্যবহারে লেখক বিশেষ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন—

১. চক্ষুষ্মান ব্যক্তি যেমন অন্ধের সঙ্গে তার আগে আগে চলে তেমনি জ্ঞানী পুরুষেরও অজ্ঞানী লোককে স্বধর্মাচরণে শিক্ষা দেওয়া উচিত।

২. সংসারের শ্রেষ্ঠ লোক যে আচরণ করে অন্য সাধারণ মানুষ তারই অনুসরণ করে।

৩. লোকসংগ্রহের জন্য কর্মমার্গের আচরণ করলে তাতে কর্মবন্ধন হয় না।

৪. গীতার বক্তব্য অনুযায়ী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শ হল—সমস্ত বিহিত কর্ম আচরণ করে আমাকে অর্পণ করবে। সকল কর্মের আমিই কর্তা। ফলপ্রাপ্তির জন্য আমি কর্ম করছি—এরূপ অভিমান কদাপি চিত্তে প্রবেশ করতে দেবে না।

চতুর্থ অধ্যায়ে লেখক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন—

ক. জ্ঞানী কে? নিজেই তার জবাবও দিয়েছেন।

যেসব কর্মে লিপ্ত থেকেও আপনাকে নিষ্কর্মা বলে দেখে কর্ম সাঙ্গ হলেও যে ফলের আশা করে না, নৈষ্কর্ম সম্বন্ধে যার এমন উত্তম জ্ঞান হয়েছে যে জগতে কর্তব্যবুদ্ধি ভিন্ন কর্ম করার অন্য কোন কারণ নেই বলে মনে করে অথচ সমস্ত ক্রিয়াকলাপ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে এমন যে জন সেই হল জ্ঞানী। লেখক দৃষ্টান্ত দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়েছেন। জলের ধারে দাঁড়িয়ে জলের মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব যে দেখে সেনিশ্চিতভাবে বুঝতে পারে যে, সেঐ প্রতিবিম্ব থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, নৌকায় চড়ে যাবার সময় যেমন তীরস্থ বৃক্ষগুলিকে বেগে চলতে দেখা যায়। কিন্তু যে সঠিক বিচার করে দেখে সেজানে বৃক্ষগুলি অচল। তেমনি সকল কর্মে লিপ্ত থেকেও যে নিশ্চিতভাবে মিথ্যা বলে জানে এবং নিজেকে নিষ্কর্মা বলে দেখে সেই জ্ঞানী।

খ. যিনি শরীর সম্বন্ধে উদাসীন, ফলভোগের কোন আশা পোষণ করেন না, সর্বদা আনন্দে মগ্ন থাকেন তিনিই জ্ঞানী। যাঁর আপন-পর ভেদ নেই, অবসরমত যা পান তাতেই সুখী থাকেন, যা দেখেন বা শোনেন নিজেও তাই হয়ে যান, যিনি আত্মানন্দের মাধুর্য নিত্য আধিকারিক প্রেমে আস্বাদন করেন, আশা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে অহংভাবে তিলাঞ্জলি প্রদান করেন তিনিই জ্ঞানী।

গ. যজ্ঞ, যজন, আহুতি, মন্ত্র ইত্যাদি সমস্তই যিনি আত্মস্বরূপ থেকে অভিন্ন বলে দেখেন তিনিই জ্ঞানী।

ঘ. যিনি অহর্নিশি যজনশীল, যিনি মানের সঙ্গে অবিদ্যাকেও গুরুবাক্যরূপ অগ্নিতে আহুতি প্রদান করেছেন তিনিই জ্ঞানী।

সাধুসেবাই জ্ঞানমন্দিরের প্রবেশদ্বার। সেবা দ্বারা জ্ঞানকে আয়ত্ত করতে হয়। গুরুর কৃপা হলে অন্তঃকরণে জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে। মোহান্ধকার দূর হয়।

যদি আকাশকে আচ্ছাদন করা যায়, পৃথিবীর ওজন যদি তৌল দন্ডে মাপা যায়, তবেই জ্ঞানের উপমা মেলা সম্ভব। জ্ঞানের সদৃশ অন্য কোন কিছু নেই। যেমন চৈতন্যের ন্যায় অন্য বস্তু কিছু নেই। জ্ঞানের পবিত্রতার তুলনা জ্ঞানেই আছে।

শূন্য গৃহ যেমন, প্রাণহীন দেহ যেমন, জ্ঞানহীন জীবনও তেমনি। লেখক দ্বাদশ অধ্যায়ে ভক্তিযোগের আলোচনা করেছেন। ঐ অধ্যায়ের সারাৎসার হল—

১. কৃষ্ণর মতে, ভক্তগণ ব্যতীত কাউকে তিনি উত্তম মনে করেন না। ভক্তরাই তাঁর ধ্যান, তারাই তাঁর নিধান। তারা তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেই তাঁর শান্তি হয়।

২. যে সন্তান মাতার গর্ভে আসে সেতার মাতার যতখানি আপনার, ভক্ত ভগবানের কাছে তেমনি প্রিয়। ভক্ত যতখানি ভগবানকে ভক্তি করে সেই পরিমাণে ভগবান তার কর্মের ভাগ বহন করেন। ভক্ত ভগবানের কলত্র। যারা ভগবানের ভক্ত সেতারা চতুষ্পদ জীব হোক বা অন্যকিছু সকলকেই ভগবান বৈকুন্ঠে বাস করার যোগ্য করে নেন।

৩. কৃষ্ণ বললেন, মন, বুদ্ধি ও চিত্ত যেন ভগবানে অর্পণ করা হয়।

৪. যোগে সমৃদ্ধ হয়ে যে নিরন্তর ভগবানে মন ও বুদ্ধি অর্পণ করে, অন্তরে ও বাহিরে উত্তমরূপে যোগসিদ্ধ হয়েও যার ভগবানের প্রতি সপ্রেম অনুরাগ সেই ভক্ত, সেই মুক্ত, সেবল্লভা আমি তার কান্ত।

গ্রন্থটির পূর্বভাষ রচনা করেছেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ। গ্রন্থটি মূলে মারাঠিতে রচিত। এর বঙ্গানুবাদ করেছেন গিরিশচন্দ্র সেন। জ্ঞানেশ্বর মহারাজ অদ্বৈত মতেই গীতার ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু তাঁর গ্রন্থ ভক্তিরসে পূর্ণ। তাঁর গ্রন্থ দ্বৈতবাদী এবং অদ্বৈতবাদী উভয় শ্রেণীর পাঠকেরই তৃপ্তিসাধনে সক্ষম। জ্ঞানদেব ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ অগ্রজ নিবৃত্তিনাথের শিষ্য। এই নিবৃত্তিনাথের কাছেই তাঁর যোগ শিক্ষা। জ্ঞানদেবের কৃতিত্ব এইখানেই যে তিনি দুর্জ্ঞেয় এবং জটিল দার্শনিক তত্ত্বগুলিকে প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করেছেন।

দি ভাগবদগীতাজন ডেভিস

John Davies-এর ‘The Bhagavad Gita’ একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। লেখকের মতে গীতা হল সংস্কৃতে রচিত দার্শনিক কাব্য : A Sanskrit philosophical poem। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে। মূলতঃ গীতার অনুবাদ। একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকায় লেখক গীতার প্রেক্ষিতটি ব্যাখ্যা করেছেন। অর্জুনের প্রশ্নোত্তরে কৃষ্ণের বক্তব্যে দার্শনিকতার সন্ধান করেছেন লেখক।

তাঁর মতে কৃষ্ণের উত্তর unfolding a philosophical system, which is a skilful union of the systems of Kapila and Patanjali, with a large admixture of the prevailing Brahmanic doctrines.

Davies মনে করেন কৃষ্ণের বক্তব্যের ভিত্তি সাংখ্য, যা পাতঞ্জলি-নির্দিষ্ট। এই মতানুসারে একজনই সর্বশক্তিমান বা Supreme Being যিনি শাশ্বত, অনন্ত সকল কিছুর উৎস, যা থেকে সবকিছুর উদ্ভব।

ভাগবদগীতায় এই Supreme Being-কে লেখক পাঁচটি রূপে বা অভিব্যক্তিতে দেখেছেন—অধ্যাত্মন (Supreme Spirit) , আধিদৈব, (Supreme Deity), অক্ষর (Indivisible), ক্ষর (Divisible), অধিযজ্ঞ (The Lord of sacrifice)।

Supreme Deity বা আধিদৈব ‘পুরুষ’ নামেও কথিত হন। পুরুষ অর্থে আত্মা এবং পুরুষ মূর্তি, এই রূপে তিনি দেবতাদের স্রষ্টা মানুষেরও স্রষ্টা।

লেখক এক্ষেত্রে কপিল পদ্ধতি থেকে গুরুতর পার্থক্য লক্ষ্য করেছেন। কারণ কপিল দৃষ্টিগ্রাহ্য জগতেই তাঁর অনুমানগুলিকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন, সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন যুক্তির সাহায্যে যা সিদ্ধান্ত করা সম্ভব তাতে। আপাতভাবে মানুষ তার নিজের সম্পর্কে ছাড়া কিছুই জানতে পারে না তা সেযতই কেন মানসিক প্রয়াস করুক, দেবতা সম্পর্কেও প্রত্যক্ষ জ্ঞান তার হয় না। কপিল পদ্ধতিতে তাই যজ্ঞ কিংবা ধর্মীয় আচারের কোন স্থান নেই। কিন্তু গীতা রচয়িতা সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন বিশেষত সর্বশক্তিমান প্রসঙ্গে। গীতার বক্তব্য এক্ষেত্রে বৈদান্তিকের কাছাকাছি। গীতার দৃষ্টিতে সর্বশক্তিমান এমনই, তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। লেখক মন্তব্য করেছেন এক্ষেত্রে :

he rose here to a height of conception far beyond the levels of his age or his race.

গীতার বক্তব্যের সঙ্গে সাংখ্য, মীমাংসা কিংবা বৈদান্তিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য লক্ষ্য করেছেন লেখক। সেপার্থক্য কী? বৈদান্তিক মতে সকল পার্থিব বস্তুর অস্তিত্ব মায়া ছাড়া কিছুই নয় কী রকম? না জলে প্রতিফলিত চাঁদের প্রতিবিম্বের মত। অন্যদিকে কপিল বললেন, প্রকৃতিই সবকিছুর পার্থিব উৎস, আত্মা শাশ্বত, গীতার মতে আত্মা অবিনশ্বর, আত্মার বয়োবৃদ্ধি ঘটে না। মৃত্যুতে আত্মার কোনো কিছু হয় না, কেবল দেহটি বিনষ্ট হয় মাত্র, আত্মা নতুন দেহে প্রবেশ করে।

অধ্যাত্মন বা Supreme Spirit সকল অস্তিত্বের উৎস তা আধ্যাত্মিক অথবা জাগতিক যাই হোক না কেন। All souls are from him, and this highest happiness is to be reabsorbed into his essence.

প্রশ্ন হল এই সর্বোচ্চ আশীর্বাদ কীভাবে লাভ করা সম্ভব? এই প্রশ্নের গীতায় প্রদত্ত উত্তরের সঙ্গে পতঞ্জলি ভাষ্যের গভীর সাযুজ্য। পতঞ্জলি বলেছেন, আত্মাকে মিলিত হতে হবে সর্বশক্তিমানের সঙ্গে আর সেটা সম্ভব কেবল ধর্মীয় সাধনায় যা নাকি সময়সাপেক্ষ। সুদীর্ঘ পদ্ধতিতে মানুষ তার বাসনাগুলিকে স্তিমিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে সক্ষম। আত্মাকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রাখা সম্ভব বহির্জগৎ থেকে। সর্বশক্তিমানের ধ্যানে তাকে ব্যাপৃত রাখা যায়। লেখক বলেছেন :

our author had evidently been trained in the school of Patanjali, or had studied his system with admiration.

গীতার বক্তব্য অনুযায়ী আত্মা অমর, যেখান থেকে তার উৎপত্তি সেখানে বিলীন হওয়াতেই তার পরিণতি। it is capable of rising to communion with God; its highest state is to enjoy that communion ; its proper destiny is to return to that eternal source from which it sprung and be lost in Him. কৃষ্ণভক্তিকেই সর্বোত্তম বলেছেন বলে লেখকের ধারণা, He contended still that mental devotion (buddhi yoga) was the best, but that devotion by work (Karma yoga) might also lead to the great blessing of nirvana.

অর্থাৎ ভক্তিযোগের পরে কর্মযোগের স্থান, লেখকের মতে। কিন্তু ‘নির্বাণ’ বৌদ্ধধর্মের কথা, গীতায় ‘নির্বাণে’র উল্লেখ কতটা সমীচীন তা ভাববার বিষয়। আসলে লেখক মুক্তি বা মোক্ষকে নির্বাণের সঙ্গে অভিন্ন করে দেখেছেন।

লেখক যোগসাধনার অধঃপতনের প্রেক্ষিতটি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন :

. . . the attempt to rise above our human nature has resulted only in failure. The Yogin, or devotee became a mere hypocrite or charlatan, leading an idle life, and supporting himself by a useless show of religious austerities or by more immoral devices. This result seems to have been manifest in our author’s time.

এখানে অবশ্য ভক্ত ও যোগীকে লেখক অভিন্নরূপে দেখলেও দুই এক নয়। দুইটির জাত এক হলেও পাঁত আলাদা। যোগী ভক্তের ওপরে। লেখক সেই সূক্ষ্মত্ব উপলব্ধি করেন নি।

লেখক কর্মযোগের ব্যাখ্যা গীতানুসারেই দিয়েছেন :

. . . all work must be done without ‘attachment’ (The sanskrit term Sanga having the same doubt meaning as this word), that is, it must be done simply as duty, without any emotion, with indifference to all attendant circumstances, and especially without any desire for reward (phala, fruit).6

অন্যত্র লেখক বলেছেন :

Works done in this spirit of absolute indifference to all external things might lead to the great blessing of nirvana ; but if done from any desire of gain, they were imperfect and could only lead to a temporary abode in one of the heavens of the gods, however good or useful they might be relatively.

এখানে বাসনাযুক্ত হয়ে কর্ম করলে যে কোনও স্বর্গলোকে ক্ষণস্থায়ী আশ্রয় লাভের কথা বলা হয়েছে গীতায় কিন্তু তার সমর্থন নেই।

গীতার বক্তব্যের সঙ্গে কপিলের বক্তব্যের পার্থক্য বোঝাতে লেখক বললেন :

when the soul has gained complete deliverance from matter, then the subtle body or linga will be absorbed forever in Prakriti. Finally, according to Kapila, all things will be absorbed into it. Only soul and unformed matter will exist. In the system of the Bhagavad Gita, all things will be absorbed into Prakriti at the end of a Kalpa, or period of creation, which is a day of Brahma, or one thousand mahayugas, . . .

গীতার ছন্দ নিয়েও লেখক আলোকপাত করেছেন স্বল্প পরিসরে। গীতার বেশির ভাগ অংশই রচিত হয়েছে অনুষ্টুপ ছন্দে, দুটি পংক্তিতে একটি শ্লোক রচিত এবং প্রতি পংক্তি ১৬টি অক্ষরযুক্ত। একমাত্র কাব্যিক অংশ রচিত হয়েছে ত্রিষ্টুভে, এর প্রতি পংক্তির অর্ধাংশ একাদশ অক্ষর সমন্বিত।

পরিশিষ্টে লেখক একটি বিতর্কের অবতারণা করেছেন গীতা খিস্টীয় প্রভাবসঞ্জাত কিনা। জার্মান অনুবাদকড. লরিনজারের (Dr. Lorinser) বক্তব্য উল্লিখিত হয়েছে, উল্লিখিত হয়েছে কে. টি. তেলাং-এর (K. T. Telang) বক্তব্যও। গীতা ও New Testament-এর মধ্যে তার সাযুজ্যও উল্লিখিত হয়েছে। লেখক নির্দিষ্টভাবে কোনো পক্ষ না নিলেও তাঁর ঝোঁকটা যে গীতা খ্রিস্ট পরবর্তীকালের রচনার দিকে, সেটি স্পষ্ট :

From a long study of the work, I infer that its author lived at near the time of Kalidas, who is supposed by professor Lassen to have lived about the middle of the 3rd century after Christ.

গ্রন্থটিতে গীতার text-এর অনুবাদ যেমন সন্নিবিষ্ট হয়েছে, তেমনি সন্নিবিষ্ট হয়েছে ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও টীকাও। আমরা লেখকের অনুবাদের পরিচয় নেব গীতার একাদশ অধ্যায়ের অনুবাদ থেকে যেখানে বিশ্বরূপ দর্শনে বিভ্রান্ত বিমূঢ় অর্জুন তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন—

God! in thy body I see all the gods,

And all the varied hosts of living things,

And sovereign Brahma on his lotus-throne

And all the Rishis and the snakes divine.

I see thee with unmumbered arms and breasts

And eyes and faces, infinite in form.

I see not either source or mean or end

Of thee, the universal Form and Lord,

Bearing thy diadem, thy club and disc.

I see the glowing as a mass of light

In every region, hard to look upon,

Bright as the blaze of burning fire and sun,

On every side and vast beyond all bound.

The undivided thou, the highest point

Of human thought, and seat supreme of all.

Eternal law’s undying Guardian thou;

The ever lasting cause thou seem’st to me.

I see not thy beginning mean, or end;

Thy strength, thy arms are infinite alike, ইত্যাদি।

কর্মযোগপ্রমথনাথ তর্কভূষণ

পন্ডিতপ্রবর প্রমথনাথ তর্কভূষণের ‘কর্মযোগ’-এর প্রকাশকাল ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ। ‘অধঃপতিত হিন্দুসমাজকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র গীতা। সনাতন হিন্দুধর্ম ও হিন্দুসমাজের স্বরূপ বুঝিবার একমাত্র সর্বপ্রধান উপায় বেদ। কিন্তু বর্তমান সময়ে, আমরা সকলে, বেদ বুঝিয়া আমাদের ধর্ম ও সমাজের স্বরূপ হৃদয়ঙ্গমপূর্বক ঐহিক ও পারলৌকিক উন্নতিসাধন করিব তাহা সম্ভবপর নহে . . .।’

গীতা তাই একমাত্র অবলম্বনীয়। কারণ দর্শিয়েছেন লেখক—

ক. বিস্তৃত গ্রন্থ নয়।

খ. সাতশত শ্লোকবিশিষ্ট।

গ. গীতার ভাষা সহজ।

ঘ. গীতার সঙ্গে কোন ধর্মের কোন প্রকার বিরোধ নেই।

ঙ. মনুষ্যজীবনের চরিতার্থতার জন্য অবশ্যজ্ঞাতব্য মহান সত্যধর্মকে গীতা সরলভাবে নির্দোষ যুক্তি দ্বারা প্রকাশ করেছে।

লেখক তুলনামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রে বলা হয়েছে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ব্যতিরেকে কোনো অবস্থাতেই কোনো ব্যক্তি কোনো কার্য করতে পারে না, গীতার সিদ্ধান্ত কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত। গীতায় প্রয়োজনীয় জ্ঞানের মূলেই কুঠারাঘাত করা হয়েছে। গীতায় বলা হয়েছে, মানুষ কলের পুতুল মাত্র। ছায়াবাজীর পুতুলের ন্যায় তার আচরণ। প্রকৃতপক্ষে মানুষ কিছুই করে না। জীবের কতৃত্ব আভিমানিক বাস্তবিক তার কতৃত্ব নেই। আমরা যা কিছু ভাবি, যা কিছু করি, প্রকৃতপক্ষে আমরা তা ভাবি না, আমরা তা করি না। করে সর্ববিশ্বোৎপাদিনী মহিয়সী প্রকৃতি। ‘সর্বাশ্চর্যময়ী ঐশী শক্তিই’।

এই সত্য উপলব্ধি হলে মানুষের কতৃত্বাভিমান মিটে যায়। পন্ডিত লেখক একটি অভিনব মন্তব্য করেছেন এবং বিতর্কও বাড়িয়েছেন। লেখকের মতে :

গীতা সতাতন ধর্মের অনুকূল সিদ্ধান্ত প্রচার করে নাই, ইহা সন্ন্যাসীর গ্রন্থ, সংসারে থাকিতে হইলে গীতার উপর নির্ভর করা উচিত নহে, গীতা সংসারের মিত্র নহে, ইহা সংসারাশ্রমের শত্রু।

কেউ বলতে পারবে না যে, সেজীবনে বিবেক ও বিলাসের বিরুদ্ধে এ জন্মে কোন কাজ করে নি :

জন্ম-জন্মান্তরের অভ্যাসজনিত সংস্কারের সাহায্যে কার্যোন্মুখ প্রকৃতির অধীনতাই জীবনের স্বভাব।

এই স্বভাব সহজে পরিবর্তিত হওয়ার নয়। এই যদি মানুষের প্রকৃতি হয় তবে সেই প্রকৃতির বিরুদ্ধে চলা মানুষের পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব। মানুষ জ্ঞানী হলেও নিজ প্রকৃতির সদৃশ চেষ্টা করে থাকে। প্রাণীনিচয় নিজ নিজ প্রকৃতিরই অনুসরণ করে।

মানুষ সংকীর্ণময় যে স্বার্থান্ধতা তারই শিকার। পরিণামে মানুষ পশুভাবাপন্ন। সমাজে সবথেকে ক্ষতির কারণ এই স্বার্থান্ধতা। এর প্রতিকার একমাত্র গীতার শিক্ষা।

লেখকের পরামর্শ :

একাত্মবাদের সূদৃঢ় ভিত্তির ওপর সংস্থাপিত গীতোক্ত কর্মযোগের ভয়হীন আশ্রয় গ্রহণ করিলে বহুকালের বিস্মৃত সেই বিশ্বব্যাপী আত্মপ্রেমের অমৃত রসাস্বাদে আমাদের সেই সর্বনাশকর ব্যক্তিগত তুচ্ছ স্বার্থাভিমানের বিষময় জ্বালা শীঘ্রই মিটিবে।

শ্রীমদভাগবদগীতাস্বামী স্বরূপানন্দ

স্বামী স্বরূপানন্দের শ্রীমদ ভাগবদগীতার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে। স্বরূপানন্দ ছিলেন অদ্বৈত আশ্রম, মায়াবতীর প্রথম সভাপতি। তিনি ছিলেন ‘প্রবুদ্ধ ভারত’-এর সম্পাদক। শ্রীমদভাগবদ গীতার রচনা শেষ হয় ১৯০১-এ। মুদ্রণের জন্য প্রেসে পান্ডুলিপিটি যায় ১৯০৩-এ। দুর্ভাগ্যবশতঃ স্বরূপানন্দ তাঁর জীবদ্দশায় নিজের গ্রন্থটি দেখে যান নি। গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে স্বরূপানন্দের গীতার আলোচনাটি মাসিক ‘প্রবুদ্ধ ভারত’-এ প্রকাশিত হয়।

লেখক ভূমিকায় বলেছেন :

. . . . like these of the Vedas, are divided into three sections, Karma (work), Upasana (devotion) and Jnana (knowledge)

‘the first six chapters explain the path of work without desire for fruits and the nature of ‘Thou’. The next six chapters deal with devotion and the nature of That. The last six describe the state of the highest knowledge and the nature of the middle term of the Mahavakya, in other words, the means of re-establishing the identity of ‘Thou’ and ‘That’.

লেখক গীতার আঠারটি অধ্যায়কে যেভাবে কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান যোগে বিন্যস্ত করেছেন, অনেকেই তা করেছেন, এই বিভাজনে নতুনত্ব কিছু নেই, কিন্তু লেখক যে ‘Thou’-এর প্রকৃতি, ‘That’-এর প্রকৃতি এবং শেষ ছ’টি অধ্যায়ে ‘Thou’ এবং ‘That’-এর প্রসঙ্গে বলেছেন—পরিচিতির পুনঃস্থাপনের মাধ্যম এই দুটির, অভিনবত্ব রয়েছে।

গীতার কেন্দ্রীয় ভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক জানালেন :

The central teaching of the Gita is the allingment of Freedom by the performance of ones. Svadharma or duty in life. Do thy duty without an eye to the results thereof.

এভাবেই একজনের চিত্তশুদ্ধি ঘটে, মোক্ষলাভের জন্য যা নাকি অপরিহার্য।

গ্রন্থটির আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে গ্রন্থটি সম্পর্কে সার্বিক মূল্যায়ন করে নেওয়া যেতে পারে। মূল শ্লোক দেবনাগরী ভাষায় উদ্ধার করে দেওয়া হয়েছে, তারপর text-এর প্রতিটি শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দসহ, প্রতিটি শব্দের অনুবাদ, সামগ্রিকভাবে প্রতিটি শ্লোকের ইংরেজি অনুবাদ এবং অভিমত প্রদত্ত হয়েছে। Index-এ প্রতিটি শ্লোকের প্রথম পংক্তিটি অধ্যায় ও শ্লোকের সংজ্ঞাসহ উপস্থাপিত।

লেখক যে মন্তব্য যুক্ত করেছেন সেগুলি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। যেমন চতুর্থ অধ্যায়ের ১৮সংখ্যক শ্লোকটির অনুবাদশেষে লেখক তাঁর মন্তব্য এই বলে যুক্ত করেছেন :

An action is an action so long as the idea of actorness of the self holds good. Directly the idea of actorness disappears, no matter what or how much is done, action has lost its nature. It has become harmless, it can no longer bind. On the other hand, how much so ever inactive an ignorant person may remain, so long as there is the idea of actorness in him he is constantly doing action. Action equals to belief in the actorness of one self and inaction reverse. He is the doer of all action. He has achieved the end of all actions, which is freedom.

কর্মই বন্ধনের কারণ, কিন্তু কি ভাবে কর্মজনিত বন্ধন দশা থেকে মুক্তি লাভ ঘটা সম্ভব, লেখক এখানে তাই ব্যক্ত করেছেন।

চতুর্থ অধ্যায়ের ২৪ সংখ্যক শ্লোকের ইংরেজি অনুবাদ শেষে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন :

How can the whole Karma of a person, engaged in work, melt away as stated here?

লেখকের বক্তব্য হল :

. . . after knowledge, his whole life becomes one act of yojna, in which the process oblation, the offering the fire, the doer of the sacrifice, the work, and the goal, are all Brahman. Since his Karma produces no other result than attainment of Brahman his Karma is said to melt away.

দ্বাদশ অধ্যায়ের ১২সংখ্যক শ্লোকের অনুবাদের পরে লেখক যে মন্তব্যটি যুক্ত করেছেন তা হল :

Renunciation of the fruit of all actions, as a means to the attainment of Bliss, is merely extolled here by the declaration of the superiority of one over another. Wherefore ? Because it constitutes a common factor which immediatily proceeds peace, both in the case of the man of wisdom who is steadily engaged in devout contemplation, and also of the ignorant one who, unable to tread the paths taught before, takes it up as the easiest means of Bliss.

তবে স্বরূপানন্দ কৃত-এমনতর মন্তব্য সীমিত ক্ষেত্রেই দৃষ্ট হয়। লেখক তুলনামূলক আলোচনার পথ ধরেন নি। এমনকি অন্যান্য তত্ত্বের সঙ্গেও গীতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন নি। অবশ্য লেখক-কৃত মন্তব্যগুলি যে সবই তাঁর স্বাধীন চিন্তাপ্রসূত তা নয়। তাঁর পূর্বসূরী আচার্যদের প্রভাব স্বরূপানন্দের মন্তব্যগুলিতে স্পষ্ট।

গ্রন্থটি মূলত তাঁদের জন্যই রচিত, যাঁরা খুব বেশি সংস্কৃত জানেন না, অবশ্যই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত। এই ধরনের পাঠক স্বরূপানন্দের ব্যাখ্যা ও অনুবাদ পাঠ করে অবশ্যম্ভাবী ভাবে মূল গীতাপাঠে উদ্বুদ্ধ হবেন বলে সঙ্গতভাবেই আশা পোষণ করা হয়েছে।

শ্রীগীতা

রামদয়াল মজুমদার

রামদয়াল মজুমদার বিরচিত শ্রীগীতার প্রকাশকাল ১৩১৬ বঙ্গাব্দ। লেখক গীতার আলোচনাকে তিনটি পৃথক পৃথক গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করেছেন। প্রথম ষটকে স্থান পেয়েছে ছয়প্রকার যোগের আলোচনা—বিষাদযোগ, সাংখ্যযোগ, কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, সন্ন্যাসযোগ ও ধ্যানযোগ। দ্বিতীয় ষটকে স্থান পেয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানযোগ, অক্ষর ব্রহ্মযোগ, রাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযোগ, বিভূতিযোগ, বিশ্বরূপ দর্শন ও ভক্তিযোগ। তৃতীয় ষটকে স্থান পেয়েছে ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগ যোগ, গুণত্রয় বিভাগ যোগ, পুরুষোত্তম যোগ, দৈবাসুর সম্পদ বিভাগ, শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগ যোগ এবং মোক্ষ-সন্ন্যাস যোগ।

আমরা, রামদয়াল মজুমদার বিস্তারিতভাবে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের যে আলোচনা করেছেন সেসম্পর্কে আলোকপাত করব। প্রথমে কর্মযোগ প্রসঙ্গ।

লেখকের মতে আত্মরক্ষাই জীবের কর্তব্য। কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন আত্মজ্ঞানের। বিনাকর্মে জ্ঞানার্জন অসম্ভব। নিষ্কাম কর্মের দ্বারা জগৎও রক্ষিত হয়, আত্মরক্ষাও হয়। নিষ্কাম কর্মের দ্বারা আত্মসংস্থ হওয়া সম্ভব। জ্ঞান ও কর্মের সহাবস্থান লেখক মানেন নি, কিন্তু স্বীকার করেছেন কর্মের পরাবস্থাই হল জ্ঞান। কর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি ঘটে। তারপর কর্মত্যাগের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন সম্পূর্ণ করতে হয়। কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে বিমল প্রীতিলাভ ঘটে। প্রীতি ঈশ্বরের প্রসন্নতার পরিচয়বাহী। কর্ম করার ফলে পাপক্ষয় হয়, চিত্তদর্পণ মলিনতামুক্ত হয়। তখনই জ্ঞানের উৎপত্তি হয়। এই সময়ে আর কর্ম বলে কিছু থাকে না। লাভ হয় নৈষ্কর্ম্য সিদ্ধি। জ্ঞানের উদয় হলে কর্মের প্রয়োজন থাকে না। কায়িক, বাচিক ও মানসিক—কর্মের তিনটি বিভাগ। নিতান্ত অজ্ঞ লোকও এই সবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো না কোনো কর্মে যুক্ত। জীবের উচিত ঈশ্বরের কতৃত্বসহ কর্ম সম্পাদন। সেক্ষেত্রে কোনো বিপদ থাকে না। কর্ম সম্পাদন করে প্রকৃতি, যা নাকি ঈশ্বরের শক্তি। ঈশ্বরের শক্তির সাহায্যেই কর্ম সম্পাদিত হয়।

রামদয়াল স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ভগবান পতঞ্জলি যাকে ‘ঈশ্বর প্রণিধানাত্মা’ বলেছেন, গীতোক্ত নিষ্কাম কর্মের সাহায্যে জ্ঞানার্জন প্রকৃতপক্ষে তাই। ইচ্ছা করলেই জ্ঞানী হওয়া যায় না, যদি না নারায়ণের আনুকূল্য থাকে। লেখক কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে দেখিয়েছেন। জ্ঞান ব্যতিরেকে মুক্তি নেই। জ্ঞানলাভের জন্য প্রয়োজন অষ্টাঙ্গ যোগ ও ভক্তিযোগ রূপ কর্ম অবলম্বন। যোগের সহায়তায় চিত্ত- শুদ্ধি ঘটে। ভক্তির মাধ্যমে চিত্ত ভগবৎরসে আপ্লুত হয়। চিত্ত যদি এই আনন্দে স্থিতিলাভ করে, তবেই তা জ্ঞানপ্রবাহে নিমজ্জিত হয়। জ্ঞানবান কাকে বলা হবে—দৃশ্য প্রপঞ্চে যিনি এক পরিপূর্ণ ব্রহ্ম বস্তুকে দেখেন তিনিই জ্ঞানবান। অন্যদিকে যিনি নাকি সকল বস্তুতে আপন ইষ্টদেবকে প্রত্যক্ষ করেন তিনি ভক্ত। লেখক মনে করেন, জ্ঞান বা ভক্তি জন্মালেই কর্ম অভ্যাস-বশবর্তী হয়ে চলে।

কর্ম ও জ্ঞান অভিন্ন নয়। যতদিন কর্ম থাকে, ততদিন জ্ঞান হয় না। কিন্তু কর্ম যখন প্রকৃতিবিমুক্ত অথচ আত্মানুসন্ধান ব্যাপৃত, তখন কর্ম জ্ঞানকারতা প্রাপ্ত হয়।

জীবাত্মা ও পরমাত্মার যে অভেদ জ্ঞান—তাই হল জ্ঞান। যিনি জ্ঞানী তিনি মনে মনে কর্ম ও কর্মফল উভয়ই ত্যাগ করেন। তিনি জানেন, আত্মা নিষ্ক্রিয়, কর্মহীন। কর্ম সম্পাদনকারীকে মনে রাখতে হয় সেআত্মা, সেপ্রকৃতি নয়। কাজেই কর্ম সেসম্পাদন করে না। কর্মযোগ যে অবিমিশ্র নয়, তার সঙ্গে ভক্তিযোগ ও জ্ঞানযোগেরও নিবিড় সম্পর্ক, ইতঃপূর্বে তার উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমে যোগী হতে হয়। যোগীর মধ্যে যে বা যিনি মদগত চিত্ত হয়ে শ্রদ্ধাসহ ঈশ্বরের ভজনা করেন, তিনি যুক্ততম। যিনি যুক্ততম, তিনিই ভক্ত। গীতায় ভগবান কৃষ্ণ যে মহৎ শিক্ষা দিয়েছেন তা হল মানুষকে কর্ম দ্বারা পাপক্ষয় করতে হবে। ভক্তিযোগের দ্বারা আনন্দভাব জাগ্রত করে তুলতে হয়। এজন্যই যোগ, ভক্তি ও জ্ঞান আমাদের সকলের সমকালে আচরণ করা কর্তব্য। যত্নসহ নিষ্কাম কর্ম করতে করতে সব কর্ম ত্যাগশেষে লাভ হয় সমাধি। সমাধিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে জ্ঞান আপনিই প্রকাশিত হয়। জ্ঞানযোগে আত্মাই যে শ্রীভগবান, এতদ সম্পর্কিত সমস্ত সংশয়ের নিরসন ঘটে। যোগের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি ঘটলেই অধিকার জন্মায় জ্ঞানে। অন্যদিকে জ্ঞানের দ্বারা সংশয় দূর করতে পারলে, স্বধর্ম পালনের মাধ্যমে নিষ্কাম কর্মের সম্পাদন করা কর্তব্য।

এবারে ভক্তিযোগের প্রসঙ্গ। ভক্তি প্রদর্শনের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে কাকে উদ্দেশ করে ভক্তি প্রদর্শিত হবে? নির্গুণ ব্রহ্মের না সগুণ ঈশ্বরের উদ্দেশে? প্রশ্ন আরও আছে—আশ্রয় করব কাকে, জ্ঞেয় ব্রহ্মকে না ধ্যেয় ঈশ্বরকে? কায়মন-বুদ্ধি দিয়ে উপাসনা করব কাকে—যিনি ইন্দ্রিয়ের অতীত না যিনি ইন্দ্রিয়গম্য তাঁকে? বলা হয়েছে যে যাকে উপাসনা করে সেতারই স্বরূপ প্রাপ্ত হয়। নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসক সদ্যোমুক্তি প্রাপ্ত হন, কিন্তু সগুণ উপাসক ক্রমে মুক্তিলাভ করেন। নিষ্কাম কর্মটি উভয়েরই কৃত্য—জ্ঞানী ও ভক্তেরও। যোগীকে ভক্ত হতে হয়। ভক্তের জন্য সগুণ ব্রহ্মের উপাসনা বা সগুণ বিশ্বরূপ উপাসনা। শেষে স্থিতি অবশ্য নির্গুণ ভাবে।

উপাসনার প্রকারভেদ নিয়ে জ্ঞানীর সঙ্গে ভক্তের পার্থক্য। জ্ঞানীর মতে নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা কঠিন এবং এটিই শ্রেষ্ঠ উপাসনা। সকলের দ্বারা এ উপাসনা সম্ভব নয়। তাই সগুণ ব্রহ্মের ধ্যান প্রয়োজন। মন্দ মধ্যম অধিকারীর জন্য সগুণ ঈশ্বর আদর্শ, উত্তমের জন্য আদর্শ নির্গুণ । কিন্তু ভক্তরা এটা মানেন না। এঁদের মতে নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা সহজ। তুলনায় কঠিন হল সাকার উপাসনা। এঁরা সাকার উপাসনাকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। গীতায় ভগবান জানিয়েছেন ভক্তগণ যদি হন তাঁর দেহ বা প্রকৃতি স্বরূপ, তবে আত্মা হলেন জ্ঞানীরা। অর্থাৎ ভক্ত ও জ্ঞানী উভয়েরই কদর ঈশ্বরের সমীপে।

ভক্ত অপরা প্রকৃতি হয়ে ভজনা করেন, জ্ঞানী অনুসন্ধান করেন সেক্ষেত্রে পরা প্রকৃতির স্বরূপ যিনি, যাঁতে অবস্থান অখন্ড চৈতন্যের, তাঁকে।

ভক্তের সঙ্গে জ্ঞানীর কোনো বিরোধ নেই। ঈশ্বরের অনুগ্রহ ভিক্ষা নিয়ে ভক্তিমার্গ। আর ভক্তি ব্যতিরেকে জ্ঞানমার্গে উপনীত হওয়া অসম্ভব।

জ্ঞানমার্গকে বাদ দিয়ে ভক্তিমার্গের আলোচনা সম্ভব নয়। কর্মযোগের সঙ্গে যেমন জ্ঞানযোগের সম্পর্ক, তেমনিই জ্ঞানযোগের সঙ্গে সম্পর্ক ভক্তিযোগেরও। জ্ঞানমার্গীরা সগুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন। রূপরস গন্ধাদি বিষয় থেকে এঁরা মনকে প্রত্যাহার করে সর্বদা প্রকৃতি থেকে পুরুষ যে পৃথক সেই বিচারে ব্যাপৃত। ভক্তদের সেক্ষেত্রে ইষ্টদেবতায় মন নিবিষ্ট রাখতে হয়। সর্বদা ভগবৎকর্ম ব্যতীত অন্য কোনো কাজ করার উপায় তাদের নেই। জ্ঞানমার্গের উপদেশ একেবারে কামনা, ভোগেচ্ছা ত্যাগ কর, ইন্দ্রিয় রোধ কর। ভক্তিমার্গের উপদেশ— একবারে সকল কামনা ত্যাগ সম্ভব না হলে শুভ কামনা কর। ভক্তিমার্গে ক্রমমুক্তির বিধান। ক্রমমুক্তি থেকেই ঘটবে সদ্যোমুক্তি। ভক্তি ব্যতিরেকে জ্ঞানলাভ অসম্ভব। আবার আত্মজ্ঞান ব্যতীত মুক্তি নেই। ভক্তি ব্যতিরেকে জ্ঞানলাভের সম্ভাবনা নেই বলে ভক্তিকেই বলা হয় মুক্তি।

শ্রীমদ্ভগবদগীতারাজেন্দ্রলাল ঘোষ

রাজেন্দ্রলাল ঘোষ বিরচিত ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’র প্রথম প্রকাশকাল ১৩৩০। গ্রন্থে রয়েছে মূল, অক্ষরার্থ, বঙ্গানুবাদ, আশ্বয়, শ্লোকার্থ, তৎসহ দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা।

গীতার শব্দসূচী, বিশদভাবে বিষয়-নির্ঘণ্ট, সমগ্র গীতা পৃথকভাবে গ্রন্থশেষে উপস্থাপিত, ন্যায়শাস্ত্রের সাধারণ ব্যবহারোপযোগী অংশ প্রায় সম্পূর্ণই প্রদত্ত হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যান্তরস্থল পৃথকভাবে নির্দেশ করা হয়েছে। ব্যাখ্যামধ্যে বক্তব্য বিষয়জ্ঞাপক শিরোনাম প্রদত্ত।

অন্বয়মুখে প্রতি শব্দের নিচে একটি সরল বঙ্গানুবাদ প্রদত্ত হয়েছে। সমগ্র গীতাটির কাব্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শ্লোকের গদ্য অনুবাদ ত’ আছেই। পয়ার ছন্দে লিখিত। দৃষ্টান্তস্বরূপ বিশ্বরূপ দর্শনের কিয়দংশ উদ্ধৃত হল (১১শ অধ্যায়)—

দেখ ওহে গুড়াকেশ! এই মোর দেহে

একত্র ভাবেতে সব বিদ্যমান রহে।।

সমুদয় চরাচর সহ এ জগত

দেখ অবস্থিত তারা এ দেহে সতত।।

আর অন্য যাহা কিছু দেখিবারে চাহ

সব বিদ্যমান মোর এ দেহে দেখহ।।

কোটি কোটি বর্ষ যদি আলোকের বেগে

কেহ কোন রূপে ধায় মনের আবেগে।।

দেখিতে—এ চরাচর বিশ্ব কোথা শেষ,

তাহলেও যার সীমা না হয় নির্দেশ।।

এহেন দর্শনযোগ্য অনন্ত জগত

চেতনাচেতন আর চরাচর ভুত।।

সাংখ্যযোগী হয় জেনো উচ্চ-অধিকারী (জ্ঞানযোগী)

কর্মযোগী তাহা হতে নিম্ন-অধিকারী।।

এর কারণও ব্যাখ্যাত হয়েছে—

শুদ্ধ চিত্ত বিনা সাংখ্যযোগ নাহি হয়

তাহে উচ্চ-অধিকারী তা দিগে কয়।।

লেখক জ্ঞান নিষ্ঠার উপায় স্বরূপ কর্ম-নিষ্ঠাকে মনে করেছেন—

কর্মযোগ সেই জ্ঞানযোগের উপায়

যোগী সেই কর্মযোগ করেন আশ্রয়।।

কর্মযোগে চিত্ত শুদ্ধ হয়, চিত্তশুদ্ধি ব্যতিরেকে সাংখ্যযোগ সিদ্ধ নয়—

জ্ঞান ভিন্ন কর্মত্যাগে জ্ঞান নাহি আসে।

লেখক বলেছেন, জ্ঞান যজ্ঞ শ্রেষ্ঠ, কেননা—

জ্ঞান হলে ‘আমি ব্রহ্ম’ এই জ্ঞান হয়

যে ব্রহ্ম নির্গুণ —আর নিষ্ক্রিয় অদ্বয়।।

তাহে সেই কতৃ ভাব নাহি থাকে আর

এজন্য কর্তব্য কিছু না থাকে তাহার।।

উপাসনা জপ তপ যত কিছু হয়

সকলি কর্মের রূপ জানিহ নিশ্চয়।।

এ সকলে দ্বৈতভাব হয় প্রয়োজন

কেবল অদ্বৈত জ্ঞানে ইহা অসাধন।।

এ কারণে জ্ঞান যজ্ঞ সর্বশ্রেষ্ঠ হয়। (পৃ-২২৪। ৪র্থ অধ্যায়)

জ্ঞান ও ভক্তির তুলনা—

জ্ঞানপথে ক্লেশ কিন্তু কিছু বেশি হয়।।

আর তাহে ভক্তিপথে যারা জ্ঞানী হন

তাঁহারা পথজ্ঞ শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হন।।

তথাপি বিশেষ এই ‘জ্ঞানী মোরে পায়’

আমিই উদ্ধারি, কিন্তু ভক্তকে নিশ্চয়,

জ্ঞান পথে বিলম্বের কোন কথা নাই

যেই হেতু জ্ঞানী হয় আমার আত্মাই।।

ভক্তিপথে মোর প্রাপ্তি অবিলম্বে হয়

তাহে জ্ঞানী হতে কিছু বিলম্বই রয়।।

জ্ঞানী জানে আমাকেই তাঁহাদের আত্মা

ভক্ত জানে আমাকেই উপাস্য দেবতা।।

জ্ঞানী উপাসনা করে অভেদ ভাবিয়া

ভক্ত তাহা করে কিছু বিশেষ মানিয়া।।

লেখকের সিদ্ধান্ত—

সত্য সত্য, জ্ঞান ভক্তি দুটি ভিন্ন পথ

কভু নয়, কিন্তু তারা শেষে জ্ঞান পথ।।

প্রথমে তাহারা ভিন্ন দুটি পথ হয়

শেষে মিলি সত্য এক জ্ঞানপথ কয়।।

তাহে এক পথ হয়, আদি অন্তে জ্ঞান,

অন্য পথে ‘আগে ভক্তি পরে হয় জ্ঞান’।।

জ্ঞান ভক্তি দুই পথ ভিন্ন ভিন্ন হয়

গন্তব্য পর্যন্ত, যারা বলে ধনঞ্জয়।।

তাহারা মহান ভ্রম করিবে নিশ্চয়।

শ্রীমদভগবদগীতা

পন্ডিত হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়

পন্ডিত হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীমদভগবদগীতার অনুবাদ, ব্যাখ্যা ইত্যাদিসহ প্রকাশ করেন ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে। মূল অন্বয়, বঙ্গানুবাদ, আধ্যাত্মিক ও সাধারণ অর্থ সন্নিবিষ্ট হয়েছে গ্রন্থটিতে। হরিমোহন গীতার ব্যাখ্যায় প্রায়শই কোরান এবং বাইবেলের প্রসঙ্গ এনেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই আধ্যাত্মিক বক্তব্যের নিরিখে গীতার সঙ্গে কোরান ও বাইবেলের সাযুজ্যের সন্ধান দিয়েছেন। লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, কর্মে কোন দোষ নেই, পরন্তু দোষের হেতু হল কর্মে আসক্তি। তাই আত্মমুক্ত হয়ে কর্ম সম্পাদনের পরামর্শ দিয়েছেন লেখক। যখন একরূপ কর্মের দ্বারা বন্ধন হয়, তখন অন্যরূপ কর্মের দ্বারা সেই বন্ধন ছিন্ন করা আবশ্যক এবং তা সম্ভবও। কর্মত্যাগ করার চিন্তা যে ভ্রমাত্মক লেখক তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। জানিয়েছেন কেন কর্মেন্দ্রিয়গুলির কার্য রোধ করে কর্মত্যাগ কখনই সম্ভব নয়।

কর্মযোগের সঙ্গে জ্ঞানযোগের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের কথা লেখকের জবানীতে স্পষ্ট। কর্মযোগ অভ্যাসের দ্বারা সময়ান্তরে জ্ঞানের অবস্থা লাভ ঘটলে আপনাতে সেই জ্ঞানের স্বরূপ দেখা সম্ভব হয়। জ্ঞানযোগেই জানা সম্ভব যে, আত্মস্থিতিসম্পন্ন পুরুষের কৃতকর্ম কদাপি বন্ধনের কারণ হয়ে ওঠে না। ভগবানের অব্যক্ত ভাব থেকে ব্যক্ত ভাবের উৎপত্তি, তাই অব্যক্ত ভাবের উপলব্ধি ব্যতিরেকে ব্যক্ত ভাবের জ্ঞানলাভ অসম্ভব। ব্যক্ত ভাবে দৃশ্যমান হয় যা তা মায়িক রূপ, মায়িক মিথ্যা জ্ঞানই সত্য বলে প্রতিভাত হয়। অপরপক্ষে অব্যক্তের জ্ঞানকে মিথ্যা বলে ধারণা তৈরি হয়।

হরিমোহনবাবু স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ভালবাসা চিরকাল থাকে না। ভালবাসার আধিক্যে জীবের ভালবাসার বস্তুতে ঘটে লয়। ভগবদ্ভক্তি কিন্তু স্বতন্ত্র। পরিণামে ভগবদ্ভক্তির বিনাশ নেই। বরং জীব এর সাহায্যে লাভ করে অনন্ত জীবন। অনির্দেশ্য পুরুষের সঙ্গ জড় জীবের পক্ষে কঠিন। কিন্তু সঙ্গ না হলে ভক্তি কীরূপে সম্ভব? লেখক তাই ভক্তি কিরূপে সম্ভব তার নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, কূটস্থপদে স্থিতি লাভ করলে সেখান থেকে এক অমানব পুরুষ জীবকে নিয়ে যান অক্ষরপদে।

হরিমোহনবাবুর ব্যাখ্যায় দেখি জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির সমন্বয়—অভ্যাসের তুলনায় জ্ঞান শ্রেষ্ঠ জ্ঞেয় বস্তুকে জানা হলে তদর্থে কর্ম করা সম্ভব হয়। তাঁতে সংযতচিত্ত হয়ে কাজ করলে তদ্ভাবাপন্ন হয়ে নিজের স্বতন্ত্র সত্তার লোপ ঘটে, আর সেই স্বতন্ত্র সত্তার লোপ ঘটলে কর্মফল ত্যাগ স্বতঃই ঘটে। আমিত্বের অবসান ঘটলে জীব অক্ষর পদে আপনিই নীত হবে।

সচিত্র গীতাউপেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য

উপেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্যের ‘সচিত্র গীতা’র প্রকাশকাল ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ। লেখকের অগ্রজ যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরবাসে দন্ডিত হলে সংসারের গুরুভার লেখকের উপরে ন্যস্ত হয়। তখন তিনি নিতান্তই বালক। কী করবেন কিছু স্থির করতে না পেরে গীতা পাঠে মনোনিবেশ করেন। শ্রীধর স্বামীর ভাবার্থ, অন্বয় ও বঙ্গানুবাদ আলোচ্য গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। ভূমিকায় লেখক আমাদের শিক্ষা মন্ত্র, ধর্ম ও কর্ম, সনাতন ধর্ম, গীতার ধর্ম, রথী ও সারথি সম্বন্ধে সাধারণভাবে আলোচনা করেছেন।

গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ বুদ্ধিযোগ ও জ্ঞানযোগের কথা বলে কর্মযোগের তুলনায় জ্ঞানযোগের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেন। অর্জুন বিভ্রান্ত হয়ে সুস্পষ্টভাবে কৃষ্ণের কাছ থেকে জানতে চান জ্ঞান না কর্ম কোন পথ অবলম্বন করে তিনি মঙ্গললাভে সমর্থ হবেন। শ্রীকৃষ্ণ স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তিনি জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগের কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেন, জ্ঞানী কর্মানুষ্ঠানকারী ব্যক্তিরা হলেন শ্রেষ্ঠ। আরও জানালেন যিনি ফলাকাঙ্খা মুক্ত হয়ে জ্ঞানেন্দ্রিয়সমূহকে সংযত করে কর্মেন্দ্রিয়গণের সহায়তায় কর্মযোগের অনুষ্ঠান করেন তাঁরাই প্রশংসার্হ।

কর্মবন্ধনের কথা বলেন সাংখ্যগণ—‘যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোন্যত্র লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ।’ ভগবানকে আরাধনারূপ কর্ম ব্যতীত অন্য কর্ম সম্পাদনে মানুষ কর্মে আবদ্ধ হয়। তাই কৃষ্ণের পরামর্শ—বিষয়াসক্তি ত্যাগ করে ভগবৎ উদ্দেশে কর্ম কর। কৃষ্ণ তত্ত্বজ্ঞানী যাঁরা, তাঁদেরও কর্ম করা উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন—

জ্ঞানযোগে কৃষ্ণের বক্তব্য আসক্তি, ভয়, ক্রোধ-বিবর্জিত ও মদগতচিত্ত হয়ে তাঁকে অবলম্বন করে অনেক ব্যক্তি জ্ঞান-তপস্যা দ্বারা পূত হয়ে তাঁর সাযুজ্য লাভ করেছে—

বীতরাগভয়ক্রোধা মন্ময়া মামুপাশ্রিতা:।

বহবো জ্ঞান তপসা পূতা মদ্ভাবমাগতা:।। ৪/১০

কৃষ্ণ বলেছেন, প্রজ্বলিত অগ্নি সব কাঠকেই ভস্মীভূত করে, অনুরূপভাবে জ্ঞানরূপ অগ্নি সমস্ত কর্মকে ভস্মীভূত করে—

যথৈধাংসি সমিদ্ধোগ্নির্ভস্মসাৎ কুরুতেএর্জুনঃ।

জ্ঞানাগ্নি সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা। ৪/৩৭

কৃষ্ণ আরও বলেছেন—ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে। ইহলোকে জ্ঞানের সমান কিছু হয় না। শুধু কি তাই—

জ্ঞানং লব্ধা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি।। ৪০

জ্ঞানলাভেই পরম শান্তিলাভ ঘটে। তবে ত’ কর্মের তুলনায় জ্ঞানই শ্রেষ্ঠতর প্রতিপন্ন হল।

ভক্তিযোগে আবার অন্য কথা। ৭ম অধ্যায়ের ১৭শ ও ৪র্থ অধ্যায়ের ৩৬শ প্রভৃতি শ্লোকে জ্ঞানীর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত। পুনরায় ৯ম অধ্যায়ের ৩১শ শ্লোকে দেখি ভক্তের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হয়েছে। দ্বাদশ অধ্যায়ে কৃষ্ণ খোলাখুলি বললেন—

ময্যাবেশ্য মনো যে মাং নিত্যযুক্তা উপাসতে।

শ্রদ্ধয়া পরয়োপেতাস্তে মে যুক্ততমা মতা:।। ২

ভগবানে মন স্থাপন করতে হবে, তাঁর প্রতি অনুরক্ত হতে হবে, পরমা ভক্তি সহকারে যিনি তাঁর উপাসনা করেন সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ যোগী।

উপেন্দ্রচন্দ্র গীতায় কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয় লক্ষ্য করেছেন। গীতায় কথিত হয়েছে, শরীর অপেক্ষা ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ, দেহ অপেক্ষা ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ, ইন্দ্রিয় অপেক্ষা মন, মন অপেক্ষা বুদ্ধি, বুদ্ধি অপেক্ষা আত্মা শ্রেষ্ঠ। মানুষকে আত্মতত্ত্ব উপলব্ধি করতে হবে। সেটা কেমনভাবে সম্ভব?

‘দেহেন্দ্রিয়-মনোবুদ্ধি যেসব বিষয় আহরণ করে, সৃষ্টি করে, সম্ভোগ করে সেসব বিষয়ই এই বিষয়ী আত্মার উপকরণ মাত্র। দেহেন্দ্রিয়-মন বুদ্ধি হইতে পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় পর্যন্ত প্রত্যেককে নিজের অধীনে রাখিয়া নিয়ন্ত্রিত করিতে একমাত্র আত্মারই নিত্য অধিকার।’ লেখকের মতে কৃষ্ণ বোঝাতে চেয়েছেন :

কর্ম করিয়া কর্মের ক্ষয় করিবে, পরে জ্ঞানাগ্নিতে সমস্ত আধার পরিশুদ্ধ করিয়া লইবে। তাহার পর ভক্তি- রসে তাহা সরস ও সজীব করিয়া তুলিবে। সাধনার এই তিনটি স্তর একে একে অতিক্রম করিতে পারিলে তখন আত্মা হইতেই উপলব্ধি হইবে—জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি এই তিন ভাবের সমন্বিত বিগ্রহ সেই চিন্ময় পুরুষ—যিনি সর্বদা চিন্ময় ধামে বাস করেন।

তাঁর বক্তব্য, গীতায় কৃষ্ণের এই পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে :

কর্ম ও জ্ঞানের ভিতর দিয়া শনৈ: শনৈ: অগ্রসর হও, দেখিবে জগৎসংসার স্থাবর জঙ্গম সব আমাতেই বিলীন হইয়াছে, আমারই দেহের প্রতি রোমকূপে সহস্র সহস্র বিশ্বব্রহ্মান্ড সংস্থাপিত। . . .আকাঙ্খা শূন্য হইয়া তুমি শুধু একবার সমস্ত আমাকে সমর্পণ কর; আমিই সব আবার তোমাকে ফিরাইয়া দিব কোটিগুণ করিয়া।. . . এই যে জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির ত্রিমার্গ—ইহাই গীতায় শ্রীভগবানের অন্যতম উক্তি।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

অতুলচন্দ্র সেন

অতুলচন্দ্র সেনের ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’ একটি স্মরণীয় কাজ। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশকাল ১৯৩৬। অতুলচন্দ্রের জন্ম ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে বাহেরক নামক গ্রামে ১৮৭৫ সালে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি দর্শন ও সংস্কৃতে অনার্স সহ বি. এ. পাস করেন। দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী তাঁর করায়ত্ত হয়। কর্মজীবনে তিনি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাসহ, কলেজে শিক্ষকতা, অধ্যক্ষতাসহ আইনী ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। ছাত্রোপযোগী বেশ কয়েকটি গ্রন্থেরও রচয়িতা তিনি। ১৯৪৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। গীতার বহু সংস্করণ থাকা সত্ত্বেও অতুলচন্দ্র আবার একটি অনুবাদে ব্রতী হলেন কেন? অতুলচন্দ্র নিজেই এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন :

গীতার যে সকল সংস্করণ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে তন্মধ্যে কতকগুলি অতি বিস্তৃত। এই সকল সংস্করণে প্রাচীন গীতাচার্যগণের কৃত ভাষ্য ও টীকা অবিকল উদ্ধৃত হইয়াছে, কিন্তু উহাদের বাংলা ব্যাখ্যা না থাকাতে সংস্কৃতানভিজ্ঞ বা অল্প সংস্কৃতজ্ঞ ব্যক্তি এ সকল সংস্কৃত টীকা হইতে বিশেষ কোনও সাহায্য পান নাই। পক্ষান্তরে কতকগুলি সংস্করণ অতি সংক্ষিপ্ত, ঐ সকল পুস্তকে মূল শ্লোক, অন্বয় ও অনুবাদ ব্যতীত আর বেশী কিছু নাই। কিন্তু শ্রীগীতা এমন গ্রন্থ নহে কেবল অনুবাদ পড়িয়াই যাহার সম্যক অর্থ পরিগ্রহ হইতে পারে।

উপরোক্ত অসুবিধার কথঞ্চিৎ নিরসনকল্পেই বর্তমান সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাতে অন্বয়ের সহিত অনুবাদ, শ্লোকের বিশদ অর্থ, প্রাচীন গীতাচার্যগণের প্রণীত ভাষ্য ও টীকা হইতে সংকলিত গীতার প্রয়োজনীয় শব্দসমূহের বাঙ্গালা অর্থ এবং পরিশেষে সরল বাঙ্গালা ভাষায় বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদত্ত হইয়াছে।

গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে ‘কর্মযোগ’ আলোচিত। অতুলচন্দ্র জানিয়েছেন, শ্রীকৃষ্ণ সংসারী মানুষদের মুক্তিলাভের জন্য দুটি যোগের কথা বলেছেন, একটি জ্ঞানযোগ, অপরটি কর্মযোগ। জ্ঞানযোগের সমর্থক সাংখ্য মতাবলম্বীরা অপরপক্ষে যোগীদের অবলম্বনীয় হল কর্মযোগ। কিন্তু আচার্য শঙ্কর এবং তাঁর অনুগামীদের মতানুসারে জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগ দুটি ভিন্ন ধারার সাধনা নয় বলে জানিয়েছেন। বলেছেন, এ দুটি হল একই সাধনার দুটি স্তর মাত্র। প্রথমে প্রয়োজন নিষ্কাম কর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি এটিই হল কর্মযোগ। চিত্তশুদ্ধি, হলে তবেই জ্ঞানলাভের অধিকার জন্মে। কর্ম ত্যাগ করে গুরুর কাছে তত্ত্বমসি প্রভৃতি বেদান্ত বাক্য শ্রবণ, সেগুলির মনন ও নিদিধ্যাসন করলে তবেই মুক্তিলাভ ঘটে। এই মতানুসারে কর্মদ্বারা মুক্তিলাভ সম্ভব নয়, কেননা কর্ম জ্ঞানের বিরোধী। জ্ঞান ও কর্ম একত্রিত হয় না। নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে জ্ঞানলাভের যোগ্যতা ঘটলেও জ্ঞানলাভ করতে প্রয়োজন কর্মত্যাগ। যতক্ষণ কর্ম ততক্ষণ জ্ঞানলাভ হয় না। আবার জ্ঞান ব্যতিরেকে মুক্তি নেই। অর্থাৎ মুক্তির জন্য কর্মত্যাগ আবশ্যক।

তৃতীয় অধ্যায়ের পঞ্চম শ্লোকের ব্যাখ্যায় আচার্য শঙ্কর প্রমুখ মনে করেছেন জ্ঞানীর কোনো কর্ম নেই। জ্ঞানীর সমস্ত কর্ম নি:শেষিত হয়। প্রকৃতির কারণে যে কর্ম সম্পাদন তা জ্ঞানীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল জ্ঞানী ব্যক্তিরও সমস্ত কর্ম নি:শেষিত হয় না। কতকগুলি কর্ম আপনা আপনিই হয় সেগুলির জন্য সচেতন প্রয়াস লাগে না। মোটের ওপর জ্ঞানী ব্যক্তিও প্রকৃতির কর্মস্রোত একেবারে বন্ধ করতে পারেন না। তবে সাধারণের সঙ্গে জ্ঞানীর পার্থক্য এইখানে যে তিনি জানেন তিনি কর্তা নন, আত্মা নির্লিপ্ত। প্রকৃতিই কর্মরত।

আট সংখ্যক শ্লোক অনুযায়ী কর্মত্যাগের তুলনায় কর্মানুষ্ঠান শ্রেয়ঃ, তবে সেকর্ম হওয়া চাই নিষ্কাম। নিষ্কাম কর্মযোগের দ্বারাই জ্ঞানলাভ হয় এবং জ্ঞান থেকেই ঘটে মুক্তিলাভ।

অতুলচন্দ্র ব্যাখ্যা করেছেন :

জ্ঞান বলিতে কর্মত্যাগ বোঝায় না, সমতা এবং ইন্দ্রিয় বিষয়ে ও কামনায় অনাসক্তিই বোঝায়।

আরও বলেছেন :

কর্মযোগের দ্বারা ভক্তিযোগ সম্পূর্ণ হয়।

অতুলচন্দ্রের মতে তৃতীয় অধ্যায়ের ৩০ সংখ্যক শ্লোকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই শ্লোকেই জ্ঞান কর্ম ও ভক্তির সমন্বয় সাধিত হয়েছে।

ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।

নিরাশীর্নির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ।। ৩০

অতুলচন্দ্রের ব্যাখ্যায় :

কর্মী যখন নিজেকে কর্মের কর্তা ও ভোক্তা মনে না করিয়া পরমেশ্বরকেই সকল কর্মের কর্তা ও ভোক্তা মনে করেন এবং নিজেকে ভৃত্যস্বরূপ মনে করিয়া ভগবানের আদেশে ও ইচ্ছায় সমস্ত কর্মানুষ্ঠান করেন, তখনই তাঁহার প্রকৃত কর্ম সমর্পণ হয়। এই কর্মার্পণ জ্ঞানীভক্ত ব্যতীত অপরে করিতে পারে না। কাজেই এই শ্লোকে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের সমন্বয় হইয়াছে।

এই ব্যাখ্যায় বিশেষভাবে লক্ষ্য করার ‘কর্ম সমর্পণ’ এই শব্দবন্ধটি অথবা ‘কর্মার্পণ’। এই প্রয়োগটি খুবই তাৎপর্যমন্ডিত এবং অতুলচন্দ্রের নিজস্ব ভাবনায় সমৃদ্ধ। বস্তুত কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি এই তিনটি ধারণার প্রতিফলনে শব্দটি বহু মাত্রিকতা লাভ করেছে।

চতুর্থ অধ্যায়ের (জ্ঞানযোগ) শেষ শ্লোকটি হল—

যোগসংন্যস্তকর্মাণং জ্ঞানসংচ্ছিন্নসংশয়ম।

আত্মবন্তং ন কর্মাণি নিবধন্তি ধনঞ্জয়।। ৪১

এই শ্লোকের ‘যোগ সংন্যস্তকর্মাণম’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যমন্ডিত। অতুলচন্দ্র ‘যোগ’ শব্দের ব্যাখ্যা করে বলেছেন :

বুদ্ধিকে কামনা বাসনা দ্বারা চালিত না করে পরমেশ্বরে স্থির করার নামই যোগ।

এই শ্লোকেও সমন্বয়ের সুর। যোগ দ্বারা সমস্ত কর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ, ‘যোগ সংন্যস্তকর্মা’ জানেন তিনি নিজে কোনো কর্মের কর্তাও নন, কর্মের ফলভোগীও নন, ভগবানের হাতের যন্ত্রস্বরূপ। তাঁর সমস্ত কর্ম ভগবানে অর্পিত।

দ্বাদশ অধ্যায়ের (ভক্তিযোগ) ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্লোকদ্বয়ের ব্যাখ্যাতেও লেখক সমন্বয়ী সুরের কথা বলেছেন।

যে তু সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্য মৎপরা:।

অনন্যেনৈব যোগেন মাং ধ্যায়ন্ত উপাসতে।। ৬

তেষামহং সমুদ্ধর্তা মৃত্যুসংসারসাগরাৎ।

ভবামি ন চিরাৎ পার্থ ময্যাবেশিতচেতসাম।। ৭

সমস্ত কর্ম যজ্ঞরূপে ভগবানকে অর্পণ করতে বলা হয়েছে। ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হবে। নিজেকে কর্মের কর্তা বা ভোক্তা মনে করা চলবে না।

অনন্যা ভক্তির দ্বারা ভগবানের সহিত যুক্ত হইয়া বিষয় হইতে চিত্তকে প্রত্যাহারপূর্বক ধ্যানস্থ হইয়া তাহার উপাসনা করিতে হইবে। এই প্রকারে ভগবানের শরণাপন্ন হইয়া একনিষ্ঠ ভক্তি, প্রেম ও কর্মযোগে যাঁহারা তাঁহার উপাসনা করেন, ভগবান প্রসন্ন হইয়া তাহাদের চিত্তে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়া তাহাদিগকে এই মৃত্যুময় সংসার-সাগর হইতে উদ্ধার করেন।

গীতার্থ-চিন্তা

চক্রধর আচার্য

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত চক্রধর আচার্য প্রণীত ‘গীতার্থ-চিন্তা’ একটি অতি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ। এতে লেখকের শুধুই বিদ্যাবত্তা বা পান্ডিত্যের পরিচয় পাই তাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যুক্তি ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গিসঞ্জাত মননশীলতা আমাদের চমৎকৃত করে, চমৎকৃত করে তাঁর বলিষ্ঠতা। চক্রধরবাবু কোনো ধানাই পানাই না করে সোচ্চার কন্ঠে জানিয়ে দিতে ভোলেন নি যে শ্রীমদ্ভগবদগীতা মোটেই মহাভারতের অংশ নয় অথবা কোনো ঐতিহাসিক বিবরণ মাত্র নয়। এটি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের context-এ রচিত কিন্তু পরবর্তীকালে। এটি একটি স্বতন্ত্র উপনিষদ। আমরা সর্বাপেক্ষা চমৎকৃত হই লেখক যেভাবে শংকর ভাষ্যকে নস্যাৎ করেছেন। দেখিয়েছেন, শংকরকৃত গীতা ভাষ্য গীতার মূল তত্ত্বের প্রতিকূল। গীতোক্ত কর্মযোগতত্ত্বকে আচার্য শংকর কর্মসন্ন্যাসমূলক অদ্বৈতবাদের অনুকূলে আনার জন্য ক্ষুরধার বুদ্ধির সহায়তায় পরিবর্তিত তথা বিকৃতি ঘটিয়েছেন। আমরা সেই আলোচনায় পরে আসছি। আপাতত কর্মযোগ সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য জেনে নেওয়া যাক।

লেখক মন্তব্য করেছেন :

. . . গীতায় উক্ত তিনপ্রকার যোগ (কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি) কথিত হইলেও একটি যোগই মুখ্যত প্রতিপাদ্য এবং তাহা কর্মযোগ।

লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে গীতায় ‘কর্ম’ শব্দটি ব্যাপকার্থে প্রযুক্ত—‘শ্রৌত ও স্মার্ত—নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য—বর্ণাশ্রমোচিত কর্মব্যতীত শরীর কর্ম ও গীতোক্ত কর্মশব্দের বাচ্য।’

লেখক দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন :

. . . কর্মত্যাগ অসম্ভব বিধায় এবং কর্ম ব্যতীত লোকসংগ্রহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় শ্রীভগবান গীতার প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত কর্ম সম্পাদনারই উপদেশ দিয়েছেন, কর্মত্যাগের উপদেশ কুত্রাপি দেন নাই। এমনকি এই বিষয়ে নিজেকেও দৃষ্টান্তরূপে উপস্থাপিত করিয়াছেন।

গীতার প্রতিপাদ্য নিয়ে পন্ডিতমহলে যে মতদ্বৈততা দেখা যায় লেখক তার কারণ নির্দেশ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন :

. . . ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রবর্তকগণ নিজ নিজ মতবাদের অনুকূল অংশগুলি উদ্ধৃত করিয়া ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ফলে কর্মযোগ শাস্ত্র কাহারও মতে জ্ঞানযোগ শাস্ত্ররূপে, কাহারও বা মতে ভক্তিযোগ শাস্ত্ররূপে ব্যাখ্যাত হইয়াছে।

এবারে দেখা যাক ভগবান শ্রীশংকরের বিরুদ্ধে লেখকের অভিযোগ কী?

. . .শ্রীভগবান যে যে স্থলে কর্মযোগের দ্বারা ভগবৎপ্রাপ্তি, বন্ধনমুক্তি প্রভৃতির উল্লেখ করিয়াছেন— শ্রীশংকর সর্বত্র ‘জ্ঞাননিষ্ঠাযোগ্যতাদ্বারেণ’, সত্ত্বশুদ্ধি জ্ঞানপ্রাপ্তি দ্বারেণ ইত্যাদি যোগ করিয়া ভগবদুক্ত কর্মযোগকে অর্থবাদরূপে সিদ্ধান্বিত করিয়াছেন। . . . একই শব্দের নানারূপ অর্থযোজনা করিয়া তিনি স্বকীয় ক্ষুরধার বুদ্ধির সাহায্যে গীতোক্ত কর্মযোগকে চিত্তশুদ্ধির উপায়রূপে ব্যাখ্যা করিয়াছেন এবং এইভাবে গীতাকে অদ্বৈত বেদান্তের অনুকূল স্মৃতিপ্রস্থান শাস্ত্ররূপে পরিণত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন।

চক্রধর আচার্য মনে করেন কর্মযোগ কখনই জ্ঞান ও ভক্তির সহায়তা ব্যতিরেকে পূর্ণতা পেতে পারে না, বরং জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়েই কর্মযোগের পরিপূর্ণতা। গীতোক্ত জ্ঞান ও ভক্তিতে কোনো বিরোধ নেই। এমনকি ভক্তিও গীতোক্ত জ্ঞানেরই অন্তর্গত এবং উভয়ই কর্মযোগের অন্তর্গত।

গীতোক্ত বুদ্ধিযোগে মূল তত্ত্বের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত লেখক যা জানিয়েছেন তা হল সমত্ব ‘সমত্বং যোগ উচ্চতে’। বিষ্ণুপুরাণে প্রহ্লাদের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে এই সমত্ব প্রসঙ্গ, ভাগবতের একাদশ স্কন্দেও কথিত হয়েছে, ‘সর্বভূতেষু যঃ, পশ্যেদ ভগবদ ভাবমাত্মনঃ। ভূতানি ভগবত্যাত্মন্যেষ ভাগবতোত্তমঃ।’ অতএব ভক্তিরও মূলকথা এই সমত্ব। লেখক গীতার কয়েকটি প্রকারে এই সমত্ব বুদ্ধির অনুসন্ধান করেছেন। যেমন ‘সুখদুঃখে সমে কৃত্বা . . . (২। ৩৮), ‘সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যো: সমো ভূত্বা (২। ৪৮);

দ্বিতীয় প্রকার অষ্টাঙ্গ যোগীর জন্য ‘সমলোষ্ট্রাশ্ম—কাঞ্চনঃ (৬। ৮), ‘সাধুষ্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধি: (৬। ৯), সর্বভূতের সঙ্গে নিজের সাম্যবুদ্ধি—‘সর্ব ভূতস্থমাত্মানম সর্বভূতানি চাত্মনি। ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।। (৬। ২৯)। এই সমত্ব বুদ্ধি পরিপক্ব হয়ে পরিণত হয় জ্ঞানে—‘বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবিহস্তিনি। শুনি চৈব শ্বপাকে চ পন্ডিতা: সমদর্শিনঃ’ (৫। ১৮)। এই সমত্ব বুদ্ধিই আন্তর যোগ, আবার গীতোক্ত কর্মকৌশলরূপ বাহ্যযোগও। অতএব লেখকের সিদ্ধান্ত এই প্রেক্ষিতে—

‘গীতোক্ত কর্ম, ভক্তি, জ্ঞান এবং অষ্টাঙ্গযোগ—এই সকলই সমত্ব বুদ্ধির উপরেই প্রতিষ্ঠিত।’

‘কর্মযোগে বিশিষ্যতে’র ব্যাখ্যায় বলা হল :

সমত্বরূপ বুদ্ধিযোগের প্রেরণায় অনুষ্ঠিত কর্মকৌশলই কর্মযোগ, . . .।

এবারে জ্ঞানযোগ প্রসঙ্গ। লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, গীতার ৭ম অধ্যায় থেকে একেবারে ১৮শ অধ্যায়ের ইতিতে শ্রীভগবান অর্জুনকে জ্ঞানেরই উপদেশ দিয়েছেন। বলেছেন, চতুর্বিধ ভক্তের মধ্যে জ্ঞানী ভক্তই শ্রেষ্ঠ। বলেছেন, ‘একমাত্র তাঁহার শরণাগত ভক্তগণই জ্ঞানলাভপূর্বক ব্রহ্ম, অধ্যাত্ম, কর্ম, অধিভূত, অধিযজ্ঞ, অধিদৈবত —এই সকলের প্রকৃত তত্ত্ব জানিতে পারেন।’

আচার্য শংকরের মতে ভক্তি ‘জ্ঞানলক্ষণা’, কিন্তু আমাদের লেখক দাবী করেছেন, ‘গীতোক্ত জ্ঞানকেই ভক্তি লক্ষণ বলা উচিত।’

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভক্তিকেই বারংবার জ্ঞানরূপে উল্লেখ করেছেন।

ভক্তি কি? চক্রধর আচার্যের ভাষায় :

ভগবদগুণকথাদি শ্রবণ ও কীর্তনের ফলে কামক্রোধভয়াদি চিত্তজ্ঞাপক ভাব উদ্দীপ্ত হয় এবং তাহার ফলে চিত্ত দ্রবীভূত হয়। সেই দ্রবীভূত চিত্তে উদ্ভূত ভগবদ-বিষয়ক যে ধারাবাহিক বৃত্তি—তাহা রাগ-স্বরূপ হউক বা দ্বেষস্বরূপ হউক—তাহারই নাম ‘ভক্তি’। সংক্ষেপে বলতে গেলে চিত্তের ভগবদাকারতাই ‘ভক্তি’।

গীতোক্ত ভক্তিযোগের সারকথা হল, লেখকের মতে :

জ্ঞানই’ ভগবৎপ্রাপ্তির প্রতি চরম হেতু . . .। ১০

অদ্বৈতবাদী বৈদান্তিকগণ কর্ম ও ভক্তিকে বর্জন করেছেন, অন্যদিকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা কর্ম ও জ্ঞানকে বর্জন করেছেন।

শ্রীমদভাগবতে বলা হয়েছে, তাবৎ কর্মাণি কুর্বীত ন নির্বিদ্যেত যাবতা। মৎকথা শ্রবণাদৌ বা শ্রদ্ধা যাবন্ন জয়াতে (১১। ২০। ৯)। আরও বলা হয়েছে, মৎকৃতে ত্যক্ত কর্মাণ স্ত্যক্ত স্বজনবান্ধবা: (৩। ২৫। ২২)। লেখক কর্ম অর্থে শ্রৌত-স্মার্ত-নিত্য নৈমিত্তিকতাকে বুঝিয়েছেন, ফলত, গীতোক্ত নিষ্কাম কর্মযোগের সঙ্গে কোনো বিরোধ দেখা যায় না। ভগবদভক্তিরও সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়।

আসলে ভক্তি কর্মযোগের প্রধান সাধন রূপ।

‘যে কৌশলে কর্ম করিলে কর্মবন্ধনজনিত পুনর্জন্ম না হয় এবং মুক্তি সুসাধ্য হয়, তিনি গীতায় সেই তত্ত্বই শিষ্য এবং সখা অর্জুনের নিকট বিবৃত করিয়াছেন। . . . তাঁহার শরণাগত হইয়া, কর্মফল তাঁহাকে নিবেদন করিয়া—তাঁহারই কর্ম করিতেছি—এই বুদ্ধিতে যে যেরূপ কর্মই করুক না কেন তাহা কখনও বন্ধনের কারণ হয় না। এইরূপ ভক্তিমান, তত্ত্বজ্ঞ কর্মযোগী যেমন শ্রীভগবানের অত্যন্ত প্রীতিভাজন হন তেমনি শ্রীভগবানও তাঁহার প্রীতিভাজন হন। এইরূপ কর্মযোগীর সর্বপ্রকার মুক্তিই করায়ত্ত হয়।’১১

দি ভাগবদগীতা

পি. লাল

ইংরেজির অধ্যাপক পি. লাল দীর্ঘদিন ধরেই গীতার অনুবাদ তথ্য ব্যাখ্যায় যুক্ত। প্রথম যখন তিনি গীতার অনুবাদ কর্মে ব্রতী হন তখন তাঁর বয়ঃসন্ধিকাল, সালটা ১৯৪৭। লেখক স্বীকার করেছেন সেসময়ে দু’একটি শ্লোকের অনুবাদে কিছুটা সফলতা হয়ত বা পেয়েছিলেন। এই প্রথম প্রয়াসটি ছিল তাঁর কাব্যিক প্রয়াস। গীতার অনুবাদ করেছিলেন কাব্যে। ১৯৫২-তে তিনি দ্বিতীয় প্রয়াস করলেন, এবারে গীতার অনুবাদ করলেন গদ্যে, পদ্যে নয়। কিন্তু লেখক অনুভব করলেন :

Prose is too thin a medium for it.

গীতা আসলে প্রশ্লোত্তরমূলক রচনা। অর্জুন প্রশ্ন করছেন, কৃষ্ণ তার জবাব দিচ্ছেন। লেখকের মতে, গীতার ভাব খুবই উচ্চাঙ্গের কিন্তু তা আন্তরিক, অত্যন্ত সিরিয়াস কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ, পবিত্র কিন্তু প্রাত্যহিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট—The tone is lofty, but intimate, highly serious, but friendly, sacred, but colloquially so.’

লেখকের সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশিত হল ১৯৬৮-তে। লেখক তাঁর অনুবাদে সচেষ্ট হয়েছেন গীতার কথোপকথনের স্পিরিটকে রক্ষা করতে। এক ধরনের নাটকীয়তা লেখকের রচনাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।

১৯৯৪ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে কি ফলের আশা ত্যাগ করে কোনো কর্ম করা সম্ভব?

. . . can the ordinary human being ever give up the fruits of action? . . . Is it reasonable is it practical to expect Arjuna, trained as a Kshatriya, expert in the arts of war, to fight without desire to win?

লেখক গীতাকে ব্যাসদেবের মহাভারতের অচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করেন। (I see the sacred text of Hinduism as an integral part of Vyasa’s epic of India; p-9)

অর্জুনের মধ্যে লেখক বিংশ শতাব্দীর অস্থিরচিত্ত নায়কের সন্ধান পেয়েছেন যিনি যৌনতৃপ্তি লাভের জন্য প্রয়াসী :

He is the only Pandava brother whose variety of erotic adventures suggests an almost restlessly twentieth century hero seeking self-fulfillment through sexual satisfaction.

কৃষ্ণ অর্জুনকে ভীত বললেও লেখক তা স্বীকারে রাজি নন, তাঁর মতে কৃষ্ণ অর্জুনকে ভীত বলে তার প্রতি অবিচার করেছেন। অর্জুন অহিংসার পক্ষাবলম্বী, কখনই তিনি ভীতু প্রকৃতির নন, বরং কৃষ্ণহত্যার স্বপক্ষে। অর্জুন লেখকের চোখে মানবতাবাদী। অপরপক্ষে কৃষ্ণ হলেন সামরিক শক্তির প্রতিভূ :

To call him a ‘coward’, as Krishna does (11 : 3), is an injustice. It requires a very special kind of courage to be ‘cowardly’ in the Arjuna manner. For Arjuna’s stands for ahimsa, Krishna recommends killing; Arjuna in the Gita is, for whatever reason, the humanist, and Krishna, for whatever reason, is the militarist

কৃষ্ণের বিশ্বরূপ প্রদর্শন লেখকের মতে যাদুশক্তির প্রদর্শন মাত্র এবং অর্জুনকে যে তিনি শেষ পর্যন্ত নিজ মতের অনুসারী হতে বাধ্য করলেন সেবিষয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন :

. . . from canto xii Arjuna accepts whatever Krishna has to offer. Brain is overpowered by bhakti — but is it ethical to silence logic with magic?

লেখক অর্জুনের পক্ষাবলম্বী। স্বভাবতঃই কৃষ্ণের বিপক্ষাচরণ করেছেন :

what I mean is that, in the twentieth century, in the contemporary world, apocalyptically threatened by the unchecked proliferation of nuclear mushrooms, Arjuna stands for the voice of invincible conscience; he is the humanist hero who has risen above the demands of military caste and convention-ridden community.

লেখক গীতার প্রতিটি অধ্যায়ের প্রারম্ভে সেই অধ্যায়ের মূল বক্তব্য সংক্ষেপে বিবৃত করেছেন, তারপর বাম- দিকে মূল সংস্কৃত শ্লোক দেবনাগরীতে প্রকাশ করেছেন, আর ডানদিকে কৃষ্ণের প্রতিটি শ্লোকের ইংরেজি অনুবাদ উপস্থাপিত করেছেন। শাস্ত্রীয় কিংবা পৌরাণিক কোনো ব্যাখ্যা অথবা তাত্ত্বিক আলোচনায় প্রবিষ্ট হননি লেখক।

কর্মযোগের মূল শ্লোকরূপে লেখক চিহ্নিত করেছেন তৃতীয় অধ্যায়ের ৩৫ সংখ্যক শ্লোকটিকে, স্বধর্মাচরণকেই লেখক গীতার অনুসরণে সর্বোত্তম বলেছেন :

At any given time a human being stands at the cross roads of four dharmas : Sva – dharma (me-ness; self-preservation), Kula-dharma (family duties; genealogical roots); juga-dharma (the spirit of the age, the nexus of the epoch; say, Marxism, Capitalism, Freudianism, Feminism in the twentieth century), and Sanatan dharma (eternal values that mankind cannot change but which persuade mankind to change itself into, hopefully a better, nobler more ‘human’ species) . . . steady yourself with yourself and choose.

লেখক কর্ম, অকর্ম, নৈষ্কর্ম্য এসবের প্রসঙ্গ আনেন নি, এমনকি ফলহীন, আসক্তিহীন কর্মের কথাও তোলেন নি।

জ্ঞানযোগের (৭ম অধ্যায়) সপ্তদশ শ্লোকটিকে লেখক মূল প্রতিপাদ্য মনে করেন :

. . . the wise is the best. The suffering person wishes to end his sorrow, the truth seeker hopes to gain enlightenment, the seeker of bliss wants salvation. All are using talent or skill as a means to an end. Only the wise man is secured in the knowledge that wisdom is an end in itself. He has seen through the myriad fruit offering seduction of Maya. He is not deceived by the dangling carrots of sex, fame, money and power; by the dazzling interplay of cause and effect. He knows that wisdom’s lamp is selfglowing self secured self-charging.

লেখকের মতে কৃষ্ণ দ্বাদশ অধ্যায়ের ত্রয়োদশ থেকে ঊনবিংশ শ্লোকে আদর্শ ভক্তের বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ করেছেন :

compassion for all creatures, absence of egotism, patience, fortitude; equanimity; freedom from jealousy, fear and worry; self-sufficiency; indifference to ups and downs; self-control, determination, decisiveness ; impartiality to freind and foe; equal mindedness in devotion praise and blame; silence, satisfaction, single-mindedness in devotion.

নর ও নারায়ণের মধ্যেকার প্রীতিঘন সম্পর্ক যখন তৈরী হয় তখন সেই প্রেক্ষিতেই নর-নারায়ণের প্রিয়তম ভক্ত হয়ে ওঠে যেমনটি অর্জুন হয়ে উঠেছিলেন অতীব প্রিয়।

পি. লাল কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ কিংবা ভক্তিযোগের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনায় যাননি। কিংবা কোন যোগটি কোনটির তুলনায় উন্নততর তাও বলেন নি। গীতার সমন্বয়ী চরিত্র সম্পর্কে তিনি নীরবতা অবলম্বন করেছেন। মূলত গীতার বক্তব্য, দেবনাগরী ভাষা যাদের আয়ত্তের বাইরে তারা যাতে তা বুঝতে পারেন সেইজন্যই তাঁর এই অনুবাদ। এইদিক দিয়ে তাঁর প্রয়াস সার্থক হয়েছে বলতে হয়।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

স্বামী জগদীশ্বরানন্দ

উদ্বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত (অষ্টম সংস্করণ ১৯৬১) জগদীশ্বরানন্দ তাঁর ভূমিকায় গীতার মহিমা, গীতার প্রাচীনত্ব, গীতার ভাষা, গীতাসাহিত্য, গীতার বাঙ্গালী টীকাকারগণ, গীতার ঐতিহাসিক সমালোচনা, গীতার শ্লোক সংখ্যা, গীতার বৈদেশিক ব্যাখ্যা, গীতার প্রচার, গীতা ও উপনিষদাবলী, গীতার উদারতা, গীতায় আত্মার অমরত্ব ইত্যাদি বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ মননশীল রচনার পর দুটি পৃথক অনুচ্ছেদে আলোচনা করেছেন ‘গীতোক্ত কর্মযোগ’ এবং ‘গীতায় যোগ চতুষ্টয়ের সমন্বয়’ প্রসঙ্গে। লেখকের মতে :

নিষ্কাম কর্মযোগই গীতার শ্রেষ্ঠ বাণী।’

আরও বলেছেন তিনি :

জগতের অন্য কোন ধর্মগ্রন্থ এত মুক্তকন্ঠে এই অদ্ভুত তত্ত্ব প্রচার করেন নাই। সচন্দন পুষ্প ভগবানের চরণে অর্পণ করিলে যেমন পূজা হয়, তেমনি স্ব স্ব কর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ করিলেও তাঁহার উপাসনা হয়। নিষ্কাম কর্মও একপ্রকার ঈশ্বরারাধনা।

এখানে প্রশ্ন? গীতায় কী ঈশ্বরে কর্ম সমর্পণের কথা বলা হয়েছে নাকি কর্মফল সমর্পণের কথা বলা হয়েছে।

গীতার ৩য় অধ্যায়ের ১৯শ সংখ্যক শ্লোকটি হল—

তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।

অসক্তো হ্যাচরণ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ।। ৩/১৯

বলা হল, ফলে অনাসক্ত হয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করলে ক্রমে ক্রমে চিত্তশুদ্ধি ও পরে জ্ঞানলাভ হয়। লেখক নিজেও শ্লোকটির ব্যাখ্যায় বলেছেন :

শ্রীভগবান অর্জুনকে বলিতেছেন—সেইহেতু সদা অনাসক্ত হইয়া কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান কর। মানুষ অনাসক্ত হইয়া কর্ম করিলে পরম পদ প্রাপ্ত হয়। এই শ্লোকে ভগবান স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, নিষ্কাম কর্মযোগ দ্বারা মুক্তিলাভ হয়।

লেখক স্বামীজীর বক্তব্য প্রসঙ্গত স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ভাবে যেখানে তিনি অনাসক্ত কর্মী তার নিষ্কাম কর্মের দ্বারা যে উচ্চাবস্থা লাভে সক্ষম তা সমর্থিত হয়েছে :

বুদ্ধদেব ধ্যানের দ্বারা ও যীশুখ্রীষ্ট প্রার্থনার দ্বারা যে আধ্যাত্মিক অবস্থা ও দিব্যভাব লাভ করিয়াছিলেন, অনাসক্ত কর্মী নিষ্কাম কর্মের দ্বারাও সেই উচ্চাবস্থা লাভ করিবেন।

লেখকের কৃতিত্ব পৃথিবীবিখ্যাত কিছু মানুষের এই নিষ্কাম কর্মযোগের প্রতি অনুরাগ ও এতদ-সম্পর্কিত তাঁদের বক্তব্যের উপস্থাপনা করে প্রমাণ করেছেন যে, এই যোগ মোটেই অবাস্তব কিংবা অপরিচিত কিছু ব্যাপার নয়। চৈনিক ঋষি লাউৎজে তাঁর ‘তাও তে-কিং’ নামীয় গ্রন্থে বলেছিলেন :

অনাসক্ত মানবই জগতে পূর্ণ স্বাধীনতা ও শান্তি উপভোগ করিতে সমর্থ। তিনি জগতে বাস করিয়াও জগদতীত হন।

Aldus Huxley তাঁর বিশ্বখ্যাত ‘Ends and Means’ নামীয় গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে গীতায় কথিত অনাসক্ত মানবকেই আদর্শ পুরুষ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে যিনি যত অনাসক্ত তিনি ততই উন্নত। ফরাসী দেশের প্রধানমন্ত্রী ক্লেম্যাত্মো বলেছিলেন—

গীতোক্ত কর্মকৌশল যদি জানিতাম তাহা হইলে আমার কর্মজীবন ধর্মজীবনে পরিণত হইত।

ব্যাধগীতা, মহাভারত প্রভৃতি থেকেও অনাসক্ত কর্মের দৃষ্টান্ত উল্লিখিত হয়েছে। লেখক শুধু গীতার সমন্বয়ী চরিত্রের কথাই বলেন নি, নিজের বক্তব্যের সমর্থনে দৃষ্টান্তেরও উল্লেখ করেছেন। যেমন জ্ঞানের দ্বারাও যে ঈশ্বর প্রাপ্তি ঘটে তার স্বপক্ষে উল্লেখ করেছেন গীতার ১২শ অধ্যায় সংশ্লিষ্ট তৃতীয় ও চতুর্থ শ্লোকে। যেখানে বলা হয়েছে—

যে ত্বমক্ষরমনির্দেশ্যমব্যক্তং পর্যুপাসতে।

সর্বত্রগমচিন্ত্যঞ্চ কূটস্থমচলং ধ্রুবম।।

সংনিয়ম্যেন্দ্রিয়গ্রামং সর্বত্র সমবুদ্ধয়ঃ।

তে প্রাপ্নুবন্তি মামেব সর্বভূতহিতে রতা:।।

যাঁরা নাকি ইন্দ্রিয়সমূহ সংযত করে, সর্বত্র সমবুদ্ধি ও সদা সর্বভূতের হিতে রত হয়ে অক্ষর, অনির্দেশ্য, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অচিন্ত্য, কূটস্থ, অচল, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁরাও আমাকেই পান। অনুরূপভাবে ভক্তিযোগেও ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে—

ভক্ত্যা ত্বনন্যয়া শক্য অহমেবংবিধোর্জুন।

জ্ঞাতুং দ্রষ্টুং চ তত্ত্বেন প্রবেষ্টুং চ পরন্তপ।। (১১শ অধ্যায়, শ্লোক-৫৪)

শ্রীভগবান কৃষ্ণের বক্তব্য হল, কেবলমাত্র অনন্যা ভক্তির দ্বারা তাঁকে স্বরূপত জানতে, প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ করতে এবং তাঁতে বিলয় রূপ মোক্ষলাভ করতে ভক্তগণ সমর্থ।

কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগের মত রাজযোগেও ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে, কিরকম?

স্পর্শান কৃত্বা বহির্বাহ্যাংশ্চক্ষুশ্চৈবান্তরে ভ্রুবো:।

প্রাণাপানৌ সমৌ কৃত্বা নাসাভ্যন্তরচারিনৌ।।

যতেন্দ্রিয়মনোবুদ্ধির্মুনির্মোক্ষপরায়ণঃ।

বিগতেচ্ছাভয়ক্রোধো যঃ সদা মুক্ত এব সঃ।।

(৫ম অধ্যায়, ২৭ ও ২৮ সংখ্যক শ্লোকদ্বয়)

বাহ্য বিষয় মন থেকে বের করে, দৃষ্টি ভ্রুযুগলের মধ্যে স্থির করে নাসিকার মধ্যে বিচরণশীল প্রাণ ও অপান বায়ুর ঊর্ধ্ব ও অধোগতি রোধ করে এবং ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি সংযমপূর্বক ইচ্ছা ভয় ও ক্রোধশূন্য হয়ে যে মুনি সর্বদা বিরাজমান, তিনি জীবন্মুক্ত।

গীতার সমন্বয়ী চরিত্রের কথা বললেও লেখক কিন্তু অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন কর্মযোগের ওপরেই। স্বভাবতঃই কর্মযোগ সম্পর্কিত তাঁর বক্তব্যও তাই বিস্তৃততর।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

স্বামী বাসুদেবানন্দ

ব্রহ্মানন্দজী মহারাজের অন্যতম শিষ্য স্বামী বাসুদেবানন্দজী বহু শ্রমে শ্রীমদ্ভগবদগীতার শাঙ্কর ভাষ্যের অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যা ও সাবলীল বিশ্লেষণ নিয়ে প্রকাশ করেছেন শ্রীমদ্ভগবদগীতা, ১৯৬৮-তে। গ্রন্থটির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যাদি হল—

ক. শ্রীমদ্ভগবদ গীতার অদ্বৈতবাদের প্রবক্তা আচার্য শঙ্কর যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তার ব্যাখ্যা এবং অনুপম বিশ্লেষণ এই গ্রন্থে লভ্য।

খ. লেখকের কৃতিত্ব শঙ্কর ভাষ্যের উল্লেখ কিংবা ব্যাখ্যাতেই তাঁর সমস্ত শ্রম নিয়োজিত হয়নি, তৎসহ অন্যান্য তত্ত্বদর্শী ভাষ্যকারদেরও বিচার-বিশ্লেষণ এবং তাঁদের মতামতের যথাযোগ্য উল্লেখ ও আলোচনাও স্থান পেয়েছে।

গ. বহু ক্ষেত্রে লেখক তাঁর নিজস্ব ভাবধারা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে কৃষ্ণ কথিত গীতার বাণীর তাৎপর্য আধুনিক যুগদর্শনের প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করেছেন।

ঘ. লেখক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের এবং শাস্ত্রের জ্ঞাতব্য তথ্যাদি, গূঢ় বিষয়গুলিকে তাঁর গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করেছেন।

ঙ. সব না হলেও কিছু কিছু শ্লোকের লেখক প্রদত্ত অভিনব ব্যাখ্যা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

চ. সুদীর্ঘ গীতা-শাঙ্কর ভাষ্যের সম্যক বিভাগ এবং উদ্দেশ্য তাৎপর্য নির্দেশসহ শিরোনামার ও অনুশিরোনামার সংযোজন আলোচ্য গ্রন্থটির মর্যাদাকে বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি করেছে।

ছ. লেখক গীতার শঙ্কর-বিরোধী প্রাচীন ও আধুনিক তাবৎ ভাষ্য ও ব্যাখ্যা যথাস্থানে উদ্ধার করে দিয়েছেন এবং যুক্তিসহ এইসব মতবাদের অযৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করেছেন এবং শঙ্কর মতের উৎকর্ষ প্রদর্শন করেছেন।

জ. শঙ্কর-বিরোধী মতগুলিকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়নি। পরন্তু কোন বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে এইসব মতবাদ সম্যকরূপে সার্থক তাও নির্দেশ করেছেন।

আলোচ্য গ্রন্থটি তিনটি খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে গীতার প্রথম অধ্যায় থেকে নবম অধ্যায় পর্যন্ত, দ্বিতীয় খন্ডে দশম অধ্যায় থেকে অষ্টাদশ অধ্যায় পর্যন্ত এবং তৃতীয় খন্ডে চারটি পরিশিষ্ট সংযোজিত। প্রথম পরিশিষ্টে বিষয় ও বিবৃতি সূচী, অর্থাৎ ভাষ্যে ভগবান শঙ্কর যেসব বিষয়ের অবতারণা করেছেন এবং গীতা ব্যাখ্যাকালে লেখক যেসব বিষয়ের আলোচনা করেছেন, বিভিন্ন বিষয়ে যেসব বিবৃতি দিয়েছেন, সেসবের সূচী লভ্য। দ্বিতীয় পরিশিষ্টে পাই ‘শব্দসূচী’, মূল গীতার শ্লোকগুলির প্রতিটি শব্দ কোন অধ্যায়ের শ্লোকে ব্যবহৃত, তার বর্ণানুক্রমিক সূচী পাই। তৃতীয় পরিশিষ্টে পাই গীতার অন্তর্গত শ্লোকসমূহের বর্ণানুক্রমিক সূচী। চতুর্থ ও শেষ পরিশিষ্টে মেলে ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা, বৌদ্ধ প্রভৃতি শাস্ত্রসমূহে ব্যক্ত বিভিন্ন মতবাদ সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞাতব্য বিষয়গুলি ও পারিভাষিক শব্দসমূহ।

গীতানুবচন

অনির্বাণ

অনির্বাণ রচনা করেছেন ‘গীতানুবচন’ তিনটি খন্ডে। ১ম খন্ডটির প্রকাশকাল ১৩৭৫, দ্বিতীয় খন্ডটির প্রকাশকাল ১৩৭৬ এবং তৃতীয় খন্ডটির প্রকাশকাল ১৩৭৭। অনির্বাণের গীতানুবচন অন্যান্য গীতা ভাষ্যের মত নয়। প্রতিটি শ্লোক ধরে ধরে লেখক ব্যাখ্যা করেন নি। প্রয়োজনীয় প্রশ্নের ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, বেদজ্ঞানের আলোকে অনির্বাণ গীতার ব্যাখ্যা করেছেন। বলা হয়েছে :

গীতার সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা অনেক আছে, কিন্তু বৈদিক ভাবনার উজ্জ্বল ছবি অনেক ক্ষেত্রেই পরিদৃষ্ট হয় না। গীতানুবচনের বৈশিষ্ট্য এইখানে।

স্বামী সত্যানন্দের মতে :

গীতানুবচনে বৈদিক চিন্তাধারার একটা সুস্পষ্ট ছবি ফুটিয়া উঠিয়াছে। গীতার মধ্যে মহাভারতের সামগ্রিক চিন্তারই পরিচয় সুপরিস্ফুট।

অনির্বাণের মতে অধ্যাত্মশাস্ত্রের মধ্যে অনুপম হল গীতা, কারণ চারিত্রধর্মে তা সমন্বয় শাস্ত্র। তাঁর মতে প্রথমে কর্ম, তারপরে জ্ঞান, অবশেষে ভক্তিতে পূর্ণতা। জীবনের সূচনা অবশ্যই কর্ম দিয়ে। লক্ষণীয় ভাবে গীতার অনুশাসনের শুরু কুরুক্ষেত্রের কর্মের সূচনায়। কর্ম করতে হবে, ধর্মের নামে কর্ম বন্ধ করা চলবে না। তবে কর্ম করতে হবে ফলাকাঙ্ক্ষাহীন হয়ে, নির্দ্বন্দ্ব হয়ে। এর থেকেই উদ্ভূত হবে জ্ঞান। তখন বোঝা যাবে জগতে যা কিছু ঘটছে সব প্রকৃতির প্রেরণাতে। তাকে এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। অন্যদিকে তাতে জড়িয়ে পড়লেও চলবে না। এই বুদ্ধি জাগলে তবেই চিত্তে জাগে প্রসন্নতা। মানুষ নিজেকে জ্ঞান করে অকর্তা বলে।

কর্মের পরে জ্ঞান। জ্ঞানে ঘটে চেতনার প্রসার। তখন প্রকৃতির কর্মের প্রেরণার পশ্চাতে ঈশ্বরের ভূমিকা অনুভূত হয়। নিজেকে মনে হয় নিমিত্ত। ঈশ্বর যদি হন যন্ত্রী তাহলে আমি হলাম যন্ত্র। এইভাবে প্রথমে কর্ম, তারপরে জ্ঞানে সমস্ত কর্মের পরিসমাপ্তি এবং শেষে ভক্তিতে এবং অর্চনা বুদ্ধিতে কর্ম করে কর্মের পূর্ণতা সাধন।

অনির্বাণের মতে ভক্তিযোগ আর জ্ঞানযোগের ভিত্তি এক। সাধনার শুরুতে দুইয়ের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করে প্রাকৃত মনের বিকল্প। শেষ পর্যন্ত এই ভেদ থাকে না, যদিও দর্শনের বিচারে জ্ঞান আর ভক্তির মধ্যে ভেদাভাসের একটা কারণ দেখানো যায়। অনির্বাণের মতে পুরুষের ধর্ম ‘স্বধা’ বা আত্মপ্রতিষ্ঠা আর তারই প্রকাশ জ্ঞানে, প্রকৃতির ধর্ম হল ‘স্বাহা’ বা আত্মসমর্পণ। এর প্রকাশ ভক্তিতে। পরমার্থ জ্ঞান আর ভক্তিতে কোনো বিরোধ নেই। আসলে শুদ্ধ জ্ঞান আর শ্রদ্ধা ভক্তি স্বরূপে গুণাতীত।

গীতা প্রবেশিকা

সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত

‘গীতা প্রবেশিকা’র রচনাকার সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত। প্রকাশকাল ১৩৭৭। লেখক বলেছেন :

যাহা গীতায় আছে ও যাহা গান্ধীজী দেখাইয়াছেন আমি তাহা কেবল সাজাইয়া দেখাইবার প্রয়াস পাইলাম।

লেখক শঙ্করাচার্যের ভাষ্যের প্রাসঙ্গিকতা যেমন প্রতিপন্ন করেছেন, তেমনি গান্ধীজীর ভাষ্যকেও মান্যতা দান করেছেন। শঙ্করাচার্যের কালে যে নিরর্থক পশুবধ করে যজ্ঞ কর্মে মানুষ শক্তি ব্যয় করত তা নিবারণের জন্যই তিনি জ্ঞানের পথের আশ্রয় গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়ে তৎকালীন সমাজকে রক্ষা করেন। অন্যদিকে বর্তমান জগতের যে চঞ্চলতা তাকে প্রশমিত করতেই গান্ধীজী গীতার আশ্রয় নিয়ে সমাজকে শান্ত ও ঈশ্বরাশ্রয়ী হয়ে কর্মানুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছেন। গান্ধীজী গীতার মধ্যে যে শক্তির উৎস খুঁজে পেয়েছিলেন এবং সেশক্তি যে ভাবে ব্যবহার করেছেন, তাঁর গীতা ভাষ্যে জগৎকে সেই শক্তির অনুকূল করার প্রয়াসী হয়েছেন।

কর্মযোগের আলোচনায় লেখক দু’একটি নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মানুষ কাজ করে প্রকৃতির প্রেরণায়। প্রাণীগণ প্রকৃতির অনুসরণ করে। মানুষের কর্তব্য হল প্রকৃতিজাত গুণকে পরিবর্তিত করে তাকে ঊর্ধ্বমুখী তথা সাত্ত্বিকতার অভিমুখী করা। মানুষের কর্তব্য হল ইন্দ্রিয়কে বশীভূত করে আত্মাকে সাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।

মানুষের ঊর্ধ্বগতির সহায়ক হয়েছে প্রকৃতিজাত আর একটি গুণ তা হল মানুষ যে বর্ণে জন্মগ্রহণ করেছে সেই বর্ণের কাজই তার সহজাত। এটি তার স্বধর্ম, বর্ণধর্ম। লেখকের মন্তব্য স্মর্তব্য :

যখন কর্ম বলিয়াই কর্ম করিতে হইবে, তখন তাহার মধ্যে ছোট বড় ভেদ থাকিতে পারে না— এই নিয়ম মানিয়া সমাজে যে যাহার জন্মগত কাজ করিয়া গেলেই স্বাভাবিক উপায়ে অনাসক্তির গোড়া পত্তন হয়। (পৃ-২৩০)

জ্ঞানযোগ্য সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য :

জ্ঞান ব্যতিরেকে মানুষ অনাসক্ত হতে পারে না। জ্ঞানাগ্নিতেই স্বার্থবোধের বিনাশ। কর্মমাত্রই জ্ঞান, জ্ঞান বিচ্যুত কর্ম অনর্থক। জ্ঞানের মাধ্যমেই কর্মের পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে। জ্ঞানের শক্তি এমনই ঞ্চে তা সমস্ত কর্মকে ভস্ম করে। ‘সমস্ত বুদ্ধি যুক্ত পুরুষের হৃদয়ের এই জ্ঞান স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দেখা দেয়।

লেখক বলেছেন :

শ্রদ্ধা ও নির্ভর— পরায়ণতা এই জ্ঞানের পৈঠা। জ্ঞান হইতে শান্তি আসে। (পৃ – ২৬৫)

ভক্তিযোগের ব্যাখ্যায় লেখক যেমন ভক্তির পরাকাষ্ঠা ব্যাখ্যা করেছেন, তেমনি সাকার সাধনার ইতিবাচকতা নিয়ে আলোকপাত করেছেন। ভক্তির পরাকাষ্ঠা হল ভক্তের ভগবানে বিলীন হওয়া এবং অস্তে এক ও অদ্বিতীয় ভগবানে আসীন থাকেন। সাকার দ্বারা এই স্থিতিতে উপনীত হওয়া যায়। নিরাকারে একেবারে সিধা পহুঁছিবার মার্গ কর্ম সাধ্য বলা হইয়াছে। (পৃ-৪২৫)

দি ভাগবদগীতা

জুয়ান মাসকারো

Juan Mascaro’-র জন্ম Majorca-তে, Cambridge-এ তিনি আধুনিক ও প্রাচ্য ভাষা অধ্যয়ন করেন— সংস্কৃত, পালি এবং সেইসঙ্গে ইংরেজিও। Oxford-এ তিনি স্পেনীয় গুহ্যতত্ত্ব নিয়ে বক্তৃতা করেন। পরে তিনি শ্রীলঙ্কায় যান। জাফনার একটি কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে বৃত হন। University of Barcelona-তে ইংরেজির অধ্যাপনা করেন। স্থায়ীভাবে বসতি করেন ইংলন্ডে। কিছু উপনিষদের অনুবাদও করেন। অনুবাদ করেন ভাগবদগীতারও। Cambridge University-তে ফিরে গিয়ে তিনি এখানে ইংরেজির Supervisor হন। বক্তৃতা করেন বাইবেলের সাহিত্যিক ও ধর্মীয় মূল্য সম্পর্কে। পালি থেকে ধম্মপদের অনুবাদ করেন। ১৯৮৭-তে তাঁর প্রয়াণ ঘটে।

বিশুদ্ধ ইংরেজিতে ভাগবদগীতার আধ্যাত্মিক বাণী প্রকাশের জন্যই তাঁর ‘The Bhagavad Gita’-র অনুবাদ। এই অনুবাদে তিনি কোনো মন্তব্য অথবা টীকা-টিপ্পনী যুক্ত করেন নি। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কিছু শব্দের প্রচলিত অনুবাদ তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন যেমন, ‘ধর্ম’ (Dharma) শব্দটি। ধর্ম বলতে তিনি রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ‘Truth of the Universe’ বা বিশ্বের সত্যকে বুঝিয়েছেন। উপনিষদে জোর দেওয়া হয়েছে ‘ব্রহ্মণ’ অথবা ‘আত্মনে’। কিন্তু গীতায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ভগবানের ওপর। লেখকও ক্ষেত্রবিশেষে ব্রহ্মণ কিংবা আত্মনের অনুবাদে ‘God’ শব্দটির ব্যবহার করেছেন।

লেখকের কৃতিত্ব তিনি গীতার মূল স্পিরিটকে অনুবাদে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছেন। অনুবাদটির প্রথম প্রকাশকাল ১৯৬২। কোনো টীকা-টিপ্পনী যোগ না করলেও একটি দীর্ঘ ভূমিকা সন্নিবিষ্ট করেছেন।

লেখক মনে করেন গীতার অর্জুন আসলে মানুষের আত্মা আর কৃষ্ণ হলেন আত্মার সারথি।

গীতার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য পাঠকের প্রয়োজন মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সবকিছু বিস্মৃত হওয়া, কিংবা মহাভারত মহাকাব্যের দুই অবিস্মরণীয় চরিত্র অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণকে মনে না রাখা। ভক্ত পাঠক গীতায় মানবাত্মার আধ্যাত্মিক সংগ্রাম লক্ষ্য করবেন। লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ের শেষে কৃষ্ণও পরামর্শ দিয়েছেন :

Be a warrior and kill desire, the powerful enemy of the soul.

আত্মার শক্তিশালী শত্রু হল বাসনা। এই বাসনা থেকে মুক্ত হতে হবে।

অজ্ঞতার কারণে জন্ম হওয়া সংশয়ের মূলোচ্ছেদ করতে হবে জ্ঞানরূপ তরবারির দ্বারা :

Kill therefore with the sword of wisdom the doubt born of ignorance that lies in thy heart!

গীতার রচনাকাল নিয়ে পন্ডিতমহলে মতবিরোধ বিদ্যমান। আমাদের লেখক মনে করেছেন গীতা বুদ্ধপূর্ব যুগের রচনা, তার কারণ :

As there are no references to Buddhism in the Gita and there are a few archaic words and expressions. . . .

লেখক ভাগবত গীতাকে আধ্যাত্মিক কবিতা রূপে দেখেছেন :

The Bhagavad Gita is, above all, a spiritual poem . . .

তাঁর পরামর্শ, যদি গীতার পুরো তাৎপর্য অনুধাবন করতে হয় তবে সামগ্রিকভাবে একে দেখতে হবে, পরিহার করতে হবে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিকে :

. . . it must be seen as a whole. An analytical approach will never reveal to us the full meaning of a poem.

লেখক ভূমিকায় একাধিকবার তুলনামূলক আলোচনায় প্রবেশ করেছেন। কখনও গীতার সর্বভূতে ঈশ্বরের অবস্থান কিংবা ঈশ্বরের সবকিছুর উপস্থিতিকে গীতার মূল ভাব বলে উল্লেখ করে এর সঙ্গে Paradiso-তে Dante যা বলেছেন তার উল্লেখ করেছেন। কর্মের ধারণা বোঝাতে লেখক হোমারের Odyssey’-র Book vi-তে উল্লিখিত Olive বৃক্ষ Nausicca-র আশ্রয়ে Odysseus-এর নিদ্রিতাবস্থা, সুশাসক Alcinous-র সুকন্যার সহচরীদের সঙ্গে নদীতে জামাকাপড় ধোওয়ার জন্য গমন-এর প্রসঙ্গ টেনেছেন। ঈশ্বরের কাছে পৌঁছাতে, তাঁর সঙ্গে যুক্ত হতে প্রার্থনা হল একটি মাধ্যম। গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের সঙ্গে লেখক st. Teresa-র শিক্ষক st. Peter of Alcantara-র বক্তব্যের সাযুজ্যের সন্ধান পেয়েছেন।

গীতায় কৃষ্ণ বললেন যা কিছু কর, খাও, দাও, প্রস্তাব কর, তা যেন আমার উদ্দেশেই করা হয়, যা কিছু ক্লেশ স্বীকার তা যেন আমারই জন্য হয় :

Whatever you do, or eat, or give, or offer in adoration, let it be an offering to me; and whatever you suffer, suffer it for me.

St. Paul Corinthian-দের কাছে একই সুরে বলেছেন :

whether therefore ye eat, or drink, or whatsoever ye do, do all to the glory of God.

কর্মযোগের কথাতে লেখক নূতন একটি বিষয়কে যুক্ত করেছেন আনন্দ, সেইসঙ্গে সৌন্দর্য, শাশ্বত সৌন্দর্যের ব্যাপারটি ত আছেই :

The poet sees things in an Eternity of beauty and joy and the actors are doing their work beautifully, in the joy of Eternity. This is the spirit of Karma in the Bhagavad Gita.

কর্মের সঙ্গে শাশ্বত আনন্দকে যুক্ত করে দেখা অভিনব। ভাগবতে সকল কর্মই তা সেযতই অকিঞ্চিৎকর হোক, একই সঙ্গে তা সুন্দর ও আনন্দময়। গীতায় কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তিযোগের প্রাধান্য। লেখকের ভাষায় জ্ঞান হল light, ভক্তি হল love এবং কর্ম হল life।

উপনিষদের কেন্দ্র হল জ্ঞান, যার সাহায্যে ব্রহ্মণে উপনীত হওয়া যায়। The Gita also places the man of Jnana, the man of light, above all men, he is in God.

লেখকের মতে :

The three manifestations of Brahman revealed in Jnana are very present in the Gita; Sat, cit, and Ananda. Being, Consciousness, and Joy.

জ্ঞান ও ভক্তির পার্থক্য করেছেন লেখক এভাবে :

whilst Jnana, the Light of God, is the highest theme in the Bhagavad Gita . . .We find that it is Bhakti, love, which is the bond of union between man and God . . . The Bhagavad Gita does not emphasize that God is reached by Jnana, because Jnana is God; but it says again and again that love is the means to reach God in whom Light and Love are one.

ভক্তি ও জ্ঞান পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত।

লেখক বললেন :

Love leads to Light! Bhakti leads to Jnana, and Jnana is the Joy of Brahman, the Joy of the infinite.

জ্ঞান ও ভক্তির পরে লেখক স্থান দিয়েছেন কর্মকে :

after Jnana and Bhakti, we have Karma.

কর্মই জীবন, তবে লেখক কর্ম বলতে পবিত্র কর্ম বা sacred work-কে বুঝিয়েছেন। লেখকের অনুবাদের কিছু পরিচয় নেওয়া যেতে পারে। গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ৩৩ থেকে ৪০ সংখ্যক শ্লোকের অনুবাদ করেছেন লেখক এভাবে—

৩৩. But Greater, than any earthly sacrifice is the sacrifice of sacred wisdom. For Wisdom is in truth the end of all holy works.

৩৪. Those who themselves have seen the Truth can be thy teachers of wisdom. Ask from them, bow unto them be thou into them a servant.

৩৫. When wisdom is thine Arjuna, never more shalt thou be in confusion for there shalt see all things in thy heart, and there shalt see thy heart in me.

৩৬. And even if those wert the greatest of sinners, with the help of the book of wisdom thou shalt cross the see of evil.

৩৭. Even as a burning fire burns all fuel into ashes, the fire of eternal wisdom burns into ashes all works.

৩৮. Because there is nothing like wisdom which can make us pure on this earth. The man who lives in self-harmony finds this truth in his soul.

৩৯. He who has faith has wisdoms, who lives in self-harmony, whose faith is his life; and he who finds wisdom, soon finds the peace supreme.

৪০. But he who has no faith and no wisdom, and whose soul is in doubt, is lost. For neither this world, nor the world to come, nor joy is ever for the man who doubts.

গীতা দর্শন

ওসো

Osho’-র গীতা দর্শনের প্রকাশকাল ১৯৭০। Osho বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। The Sunday Times (London)-এর মতে বিংশ শতাব্দীর এক সহস্র স্রষ্টাদের অন্যতম Osho, ভারতের Sunday Midday’-র মতে গান্ধী, নেহেরু কিংবা বুদ্ধের মত যে দশজন ভারতের ভাগ্য পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন Osho তাঁদেরই একজন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত পুনের International Meditation Resort’-এর আন্তর্জাতিক খ্যাতি অথবা অখ্যাতি। Osho আজ পর্যন্ত কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি, কিন্তু তিনি বক্তৃতা করেছেন অজস্র। সেই বক্তৃতা থেকেই প্রস্তুত হয়েছে তাঁর গ্রন্থগুলি, যেমন গীতা দর্শন। Osho তাঁর এই গ্রন্থে কৃষ্ণের প্রাচীন জ্ঞানকে আধুনিক ভাষায় প্রকাশ করেছেন। গীতার শ্লোকের সাহায্যে তিনি আধুনিক কালের মানুষের মনস্তত্ত্ব জগতের সন্ধান করেছেন। অর্জুনের যে সমস্যা, যে নৈরাশ্য আধুনিক কালের মানুষেরও প্রায় সেইরূপ সমস্যা ও নৈরাশ্য। তাই কৃষ্ণ অর্জুনের সমস্যা সমাধানের যে পথ নির্দেশ করেছিলেন, আধুনিক কালের মানুষের ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ গীতার অনুসরণে আমরা আমাদের আজকের দিনের সমস্যার সুরাহা করতে পারি। Osho কৃষ্ণকে দেখেছেন ‘মনস্তত্ত্বে’র জনকরূপে (The father of psychology)। তাঁর মতে কৃষ্ণ হলেন সেই ব্যক্তি :

who has understood the wavering mind, the mind which is in conflict, “……. He is the first individual who has introduced psychoanalysis and has explored the human mind.”

Osho’-র স্বাতন্ত্র্যের পরিচয়স্বরূপ গীতার যে তিনটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন তার উল্লেখ করি। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তিনি বহুদূরে থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে কী ঘটছে তা জানতে তিনি উৎসুক। ধৃতরাষ্ট্রের একশত সন্তান। Osho’-র মতে অন্ধের সন্তানদের চর্মচক্ষু থাকলেও মর্মচক্ষু ছিল না। অন্ধের সন্তানরা অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হয় না। কুরুক্ষেত্রকে বলা হয়েছে ধর্মক্ষেত্র। কিন্তু যে মুহূর্তে সেখানে অধর্মকারীরা যুদ্ধের জন্য উপস্থিত হয়েছে সেই মুহূর্তে তা পরিবর্তিত হয়েছে অধর্মক্ষেত্রে। লেখকের মতে গীতা হল : ‘Synthesis of the mind’, আর কৃষ্ণ হলেন ‘authority on Psychology’; গীতাকে লেখক অভিহিত করেন : ‘Scripture on psychology’ বলে। তাঁর মতে :

spirituality is the experience of no-mind’, কেননা যত সমস্যা সব মনকে নিয়েই—‘mind is the problem’

লেখক কর্মযোগ সম্পর্কে একটি গাণিতিক সূত্র দিয়েছেন :

‘action minus desire equals Karma Yoga’, কর্মযোগের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় লেখক বলেছেন, ‘when desire is removed from your actions, what you are left with is Karma Yoga.

লেখক বাসনা বলতে কেবল পার্থিব বাসনাকে বোঝেন নি, বাসনার নিবৃত্তি বলতে বুঝেছেন :

bring to an end of desire itself.

নিষ্কাম কর্ম কী? লেখকের ভাষায় :

to renounce something in order to achieve something else is not Nishkam Karma.

কিছু পাবার প্রত্যাশা তা ভবিষ্যতেই হোক কিংবা অন্য জগতেই হোক, এমনকি প্রতিষ্ঠিত ধর্মের ব্যুৎপত্তির অধিকারী হওয়ার যে বাসনা তাও বাসনাই। মন যে পর্যন্ত বাসনাচ্ছন্ন সেপর্যন্ত কর্মযোগের অভিজ্ঞতা অর্জন অসম্ভব :

Your mind becomes filled with desires, and such a mind can never experience Karma Yoga’; এমনকি, your renonciation is motivated by your wish to attend a certain goal and this in its turn becomes a desire.

আসলে কর্মযোগ প্রতিষ্ঠিত বাসনা শূন্যতার উপর :

Karma Yoga is the fruit of desireless action.

কৃষ্ণ যে কর্মের কথা বলেছেন তা আধুনিক মনস্তত্ত্বের বিপরীত। কৃষ্ণের মতে যে কর্ম বাসনাতাড়িত, তা মানুষকে দুঃখ ও অন্ধকারে নিয়ে যায়। নিষ্কাম কর্ম হল যে কর্মে বাসনার লেশমাত্র নেই। এই নিষ্কাম কর্মই মুক্তি আনে কিন্তু লেখক প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের অবতারণা করেছেন :

can there be an action which is unmotivated by desire?

Osho’-র মতে গভীরভাবে অনুধাবন করলে বোঝা যায় অন্তর্লীন একটা বাসনা বা উদ্দেশ্য রয়ে গেছে :

if we look deeper, for sure we will find a motive hidden behind our actions.

লেখক একটি বাস্তব দৃষ্টান্তের অবতারণা করেছেন। আমাদের সামনে দিয়ে পথ চলা এক পথিকের যদি ছাতাটা পড়ে যায়, আমরা সেটি তুলে ছাতার মালিকের হাতে দিই। এক্ষেত্রে কোনো প্রত্যাশা কাজ করে না। কিন্তু ছাতার মালিক ছাতাটি পেয়েও যদি ধন্যবাদ না জানায় আমরা ভাবি তার নিন্দনীয় আচরণের কথা। অর্থাৎ আগে থেকে কেউ ধন্যবাদ প্রাপ্তির আশা না করে ছাতাটি সংগ্রহ করে দিলেও পরবর্তীতে ধন্যবাদের প্রত্যাশা করে। অর্থাৎ ধন্যবাদ লাভের প্রত্যাশা মনের মধ্যে আগে থেকেই রয়ে গিয়েছে।

The expectation was hidden somewhere deep in your unconscious mind, waiting to emerge. Your unconscious mind was filled with expectations, although it seemed that your conscious mind did not have any expectations.

লেখকের অভিমত :

All actions are motivated by a specific desire which may be obvious or not.

পার্থক্য তাহলে কতটুকু? ‘The desire may be conscious or unconscious’, এইটুকুই।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং উদ্দেশ্যমুক্ত কর্মের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন লেখক আকবর ও তানসেনের প্রসঙ্গ টেনে। তানসেনের সঙ্গীতে মুগ্ধ আকবর যখন তানসেনের গুরু হরিদাসের সঙ্গীত শুনলেন তখন তিনি মুগ্ধ হলেন, বুঝলেন হরিদাসের অদ্বিতীয়ত্ব। আকবর জানতে চাইলেন তানসেনের সঙ্গে হরিদাসের পার্থক্য। তানসেনই জবাব দিলেন :

My master plays music, but he does not wish to attain anything by playing music,……. He has attained the truth, and he overflows with music. He has realized the truth and he is overflowing with the divine he is simply overflowing.

কিন্তু তানসেন নিজের প্রসঙ্গে কী বললেন :

I play music with a certain purpose in my mind, and I am ready to do anything in order to achieve that purpose.

তাহলে unmotivated act is the foundation of Krishna’s Nishkama Karma Yoga ‘True prayer’ ও বাসনামুক্ত। লেখক বলেছেন :

Every action becomes prayer, whenever it is unmotivated by desire.

এবং এটাই নিষ্কাম কর্ম।

কর্মযোগের মত জ্ঞানযোগের বিস্তারিত আলোচনা করেন নি লেখক। তবু সীমিত পরিসরে জ্ঞানযোগের কিঞ্চিৎ পরিচয় উপস্থাপিত করেছেন। জ্ঞানের দুটি বিভাগ—একটি objective অপরটি subjective। প্রথমটি হল বস্তু-সম্পর্কিত জ্ঞান, দ্বিতীয়টি হল আত্মসম্পর্কিত। তাই প্রথম প্রকারের জ্ঞান হল বিজ্ঞান, দ্বিতীয় প্রকারের জ্ঞান হলো সাংখ্য।

সাংখ্য কী? ‘Sankhya is the ultimate knowledge’ সাংখ্য মানে কী? না তুমি নিজেকে জান ‘You know yourself’, সাংখ্যই নিজেকে জানতে সহায়তা করে, only through Sankhya you are able to move deep within yourself and know yourself intimately. এই জ্ঞান অন্যভাবে আহরণ করা সম্ভব নয়। আত্মজ্ঞান যে বিজ্ঞান নয় লেখক তা স্পষ্ট করেই বলেছেন। Science শব্দটির অর্থও বলেছেন Knowledge অর্থ হল জানা। আমরা বলি বিজ্ঞান, বিশেষ জ্ঞান যার অর্থ শুধু জ্ঞান নয়। কিন্তু এ জ্ঞান সত্য নয় যথার্থ নয়। True knowledge is self-knowledge, এটা বিশেষ জ্ঞান specific knowledge. লেখকের মতে সাংখ্যই হল সর্বোত্তম বিজ্ঞান, ‘The ultimate knowledge’.

Osho’-র বক্তৃতাগুলি প্রাঞ্জল ভাষায় প্রদত্ত। মনে হয় আমাদের সামনে বসে কেউ বলে চলেছেন। তত্ত্বের প্রসঙ্গে লেখক আকর্ষণীয় গল্পের উল্লেখ করেছেন। গল্পের মাধ্যমেই তিনি উপস্থাপিত তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে সব ক্ষেত্রে তাঁর প্রদত্ত ব্যাখ্যা কিংবা বক্তব্য অপ্রতর্ক্য নয়।

পেরিনিয়াল সাইকোলজি অফ দি ভাগবদ গীতা

স্বামী রামা

Swami Rama-র Perennial Psychology of the Bhagavad Gita’-র প্রকাশকাল ১৯৮৫। গীতা সম্পর্কে অনেকগুলি গ্রন্থ রচিত হয়েছে, কিন্তু এই গ্রন্থটির বিশেষত্ব হল প্রাচ্যদেশীয় মনস্তত্ত্বের প্রেক্ষিতে গীতার ব্যাখ্যা দান :

The Bhagavad Gita is the fountain head of Eastern Psychology, and this commentary is designed to draw out its Psychological concepts and make them accessible to all students.

দর্শনের সঙ্গে মনস্তত্ত্বের সমন্বয় লক্ষ্য করেছেন লেখক গীতায় :

Profound psychological insights are interwined in the Bhagavad Gita with Philosophical concepts ….

লেখক বিশেষভাবে গীতায় উপস্থাপিত মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলিকে স্বতন্ত্রভাবে বেছে নিয়ে সেগুলির ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছেন।

প্রাচ্যদেশীয় দর্শন, কিংবা ধর্ম অথবা মনস্তত্ত্বের উদ্দেশ্য হল আত্মোপলব্ধি বা Self-realization, মানব- জীবনের এটাই লক্ষ্য। এই প্রসঙ্গেই লেখকের বক্তব্য, মনস্তত্ত্বের সহায়তা ব্যতিরেকে আত্মোপলব্ধি অসম্ভব, অসম্ভব মানবজীবনের লক্ষে উপনীত হওয়া। প্রসঙ্গত লেখক পাশ্চাত্যদেশীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, পার্থক্য দেখিয়েছেন প্রাচ্যদেশীয় দৃষ্টিভঙ্গির :

Western Philosophy is intellectual and deals with man’s relationship with the Universe. With the knowledge he gains, he tries to understand his status in the Universe ……. According to the Eastern system, knowing the real self is the first and foremost purpose of life.

লেখক যথার্থ ভাবেই বলেছেন, আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে এই বিশ্বের সর্বপ্রকার রহস্য এবং একজনের সঙ্গে বিশ্বের যে সম্পর্ক তা উদঘাটিত হয়। দর্শন ও ব্রহ্মবিদ্যার অভিমুখ সম্পূর্ণ বিপরীত, একটি যদি হয় তাত্ত্বিক তবে অন্যটি প্রায়োগিক। লেখকের স্পষ্ট প্রতীতী :

The Bhagavad Gita is composed of only seven hundred verses, it contains all the principles of the philosophy and psychology of the East.

গীতায় উপস্থাপিত মনস্তত্ত্বের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন লেখক এইভাবে :

The Psychology of the Bhagavad Gita leads the students first to awareness of the centre of consciousness, then to training that focuses on the understanding and mastery of one’s internal states, and lastly to the skilful and selfless performance of actions in the external world.

বর্তমান গ্রন্থটির অনন্যতা এইখানে যে শুধু গীতার বহুমুখীনতার, বিশেষত প্রায়োগিক দিকগুলিকেই বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। গ্রন্থের অনন্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে :

It does not exclusively emphasize action, devotion, or renunciation but delves into the way in which each of the paths and practices described in the Bhagavad Gita may be utilized to attain the Absolute.

লেখক কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কৌরব ও পান্ডবদের প্রতীকী রূপে দেখেছেন। কী তা?

Symbolically the armies represent the positive and negative forces functioning within the human hearts and mind.

এবারে আসি কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ প্রসঙ্গে। লেখক ‘কর্ম’ সম্পর্কে যা মনে করেন তা হল আদি ইচ্ছা, যা থেকে ক্রোধের জন্ম। লোভের, আসক্তির, বিদ্বেষের এবং অহংবোধের বাসনা থাকা মানেই ভোগান্তি। সাধারণ মানুষের ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় বাসনার দ্বারা। যিনি ইন্দ্রিয়াসক্ত, তিনি তাঁর বুদ্ধি, মন, ইন্দ্রিয়গুলিকে কাম্য বস্তুগুলির প্রতি ধাবিত করান। লেখক মনে করেন :

sense, mind and intelligence are the abodes in which the parasite desire dwells.

যদি বুদ্ধিবৃত্তি, মন কিংবা ইন্দ্রিয়সকলকে যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করা না হয় তবে :

they feed the parasite in the same way that fuel feeds the fire, desire robs, the senses, mind, and intelligence of this energy.

বাসনাকে আমরা শত্রুরূপেই দেখতে অভ্যস্ত, লেখক কিন্তু স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তার সদর্থক ভূমিকাও অনস্বীকার্য :

desire is a necessary means, when a sadhak has a burning desire to attain freedom, he learns to light the fire of knowledge. He bathes in that fire, and all his worldly desires are burnt to ashes.১০

বাসনা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে আচ্ছন্ন করে, তার মনকে নিয়ন্ত্রিত করে, নিয়ন্ত্রিত করে তার ইন্দ্রিয়কেও। তাই একজনের কর্তব্য হল বাসনাকে পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ। বাসনাই হল মানুষের প্রাথমিক শত্রু।

এবারে জ্ঞানযোগ প্রসঙ্গ। লেখক নিষ্কলুষ বুদ্ধি এবং স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান এই দুটির বিভাগ করেছেন। দুটির স্বাতন্ত্র্যও ব্যাখ্যা করেছেন লেখক :

With pure buddhi one may fathom many finer levels of consciousness, but without intuitive knowledge one cannot attain the self-illumined source of consciousness. That intuitive knowledge dawns when human endeavour is completed and exhausted.১১

স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞানের কার্যকারিতা অনেকখানি।

Intuitive knowledge has immense power to cast off all the fetters of the Sadhak, for then one’s inner strength is directly obtained from the source of all strength and knowledge.১২

সেই সূত্র বা উৎসটি কী?

That source is Atman, the pure self. As long as one remains dependent on any other source of strength-wealth, health, mind and even buddhi he remains imperfect. Perfection is attained through inner strength. There are limitations in all external strengths. If one uses all of his wealth, all his friends and those who are intellectually gifted, these will not help him to attain intuitive knowledge.১৩

সবশেষে ভক্তিযোগের প্রসঙ্গ। অনেকের ধারণা ভক্তিযোগ সব থেকে সহজ পথ। অনেকে মনে করে আবেগ- তাড়িত হল ভক্তিযোগ। ভালবাসা কিংবা প্রেমে পড়া সহজ ব্যাপার নয় মোটেই। ভক্তিযোগ, কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের মতই কঠিন। লেখকের মতে ভক্তিযোগ কঠিনতর, কারণ :

it requires single pointed devotion toward the Lord alone, with purity of mind and heart. It is a conscious dissolution of one’s individuality in the love of God.

ভক্তিযোগে মানুষ নিজেকে উজাড় করে দেয় কোনো কিছু লাভের আশা না করেই। নিছক ভাবালুতা নয় তা বরং ভক্তিযোগে প্রেমিক এবং ভালবাসার জন এক এবং অবিভাজ্য হন। এ পথে দ্বৈতের কোনো অবকাশ নেই। চমৎকারভাবে লেখক তুলনা টেনেছেন ভক্তিযোগের :

As the river meets the ocean, they become inseparably one. So it is in the path of devotion. Fortunate are those who are in love with the mighty Lord and remember His name in every breath.১৪

প্রতিটি অধ্যায়ের সব শ্লোকের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন লেখক, সন্নিবিষ্ট করেছেন ব্যাখ্যাও। অনুবাদের কিছু নিদর্শন গৃহীত হল :

i) I see you having many arms, bellies, faces, eyes, with unending forms in all directions. O Sovereign of the Universe, bearing universal forms, I see not your end, nor the middle, nor again your beginning. (chap – xi, sloke – 16)

ii) I see you bearing a crown, a mace, a discus ; you are a heap of light effulgent in all directions, very difficult to look at, immeasurable, and all around brilliant like a blazing fire and the sun. (chap – xi, sloke – 17)

iii) You are the indestructible syllable, the supreme object of knowledge; you are the transcendental repository of this universe; you are the immutable one, the guardian of eternal law (dharma). I believe you to be the eternal spirit. (chap – xi, sloke – 18)

iv) I see you without beginning, middle, or end ; of unending virility, with endless arms, with the moon and the sun for your eyes ; your face like a blazing fire that receives oblation offerings scorching this universe with your effulgence. (chap – xi, sloke – 19)

সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভগবদগীতা

জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়

মননশীল প্রাবন্ধিক জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায় ভগবদগীতার আলোচনা করেছেন সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে। প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় (১৯৯৪) লেখক সমাজবিজ্ঞানের লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন :

সমাজবিজ্ঞান ধর্ম অথবা ধর্মগ্রন্থকে কোন অলৌকিক বস্তু বলে স্বীকার করে না। পরলোকের পরিবর্তে ইহলোক নিয়ে, স্বর্গ নরকের চেয়ে পৃথিবীর সুখদুঃখ নিয়ে, পৃথিবীতে ঈশ্বরের ভূমিকার চেয়ে মানুষের ভূমিকা এবং সমাজের কাঠামোগত বিন্যাস নিয়েই সমাজবিজ্ঞান বেশী চিন্তিত। একটি বিশেষ ধর্ম অথবা ধর্মগ্রন্থ একটি দেশের আর্থ-সামাজিক বিকাশের কোন পর্যায়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলো, কে বা কারা ধর্মগ্রন্থ রচনা করেছিলেন, সমকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের জন্মলাভের কী কী সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়, ইতিহাসে তা কি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভূমিকা পালন করেছে, ইত্যাদি অনেক রকম প্রশ্ন তুলে সমাজবিজ্ঞান ধর্মের জাগতিক ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করে।

বস্তুতপক্ষে লেখকের গীতার ব্যাখ্যাতে তাঁর এই সমাজবিজ্ঞানীসুলভ অনুসন্ধিৎসারই প্রতিফলন ঘটেছে পুরো মাত্রায়। এদেশীয় অধিকাংশ ব্যাখ্যাতাদের মত ধর্মীয় অথবা দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে গীতাকে দেখেন নি। তাই গীতা ঈশ্বরের বাণী এবং এর বিষয়বস্তু ও উপস্থাপিত বিধানগুলিকে তিনি মানবজীবনের প্রশ্নাতীত আদর্শ রূপে মেনে নেন নি। সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতি অনুসরণ করে লেখক ভারতীয় ধর্মে, ইতিহাসে ও রাজনীতিতে ভগবদগীতার ভূমিকা কী সেবিষয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন। আলোচনা করেছেন গীতা রচনার ঐতিহাসিক কাল এবং রচয়িতাদের সম্ভাব্য পরিচয়, বিশ্লেষণ করেছেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট যে প্রেক্ষাপটে গীতার আত্মপ্রকাশ। তাছাড়াও লেখক সন্ধানী আলোক ফেলেছেন গীতা রচনার উদ্দেশ্যে, এতে কৃষ্ণ কতৃক ধর্ম সংস্থাপনের তাৎপর্য, তাছাড়াও ঐ ধর্মের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়োগ, ধর্মে সমর্থিত সামাজিক বিন্যাসের স্বরূপও বিশ্লেষিত হয়েছে। লেখকের কাছে মনে হয়েছে, The Gita is more a poetry than a religious book. লেখকের বর্ণনায় :

কাব্যগ্রন্থ হিসেবে ভগবদগীতা ভারতীয় সাহিত্যের এবং বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য ধ্রুপদী সম্পদ। সুললিত অনুষ্টুপ ছন্দের সুরের ঝংকারে হৃদয়-মনের অবচেতন গহনে ক্রমশ এক সম্মোহন সৃষ্টি হয়। মানবজীবনের অনিবার্য, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তার মধ্যে নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার সন্ধান এবং ধ্রুব মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অমরতার সন্ধান সাহিত্যের নিরিখে বিশ্বজনীন সংবেদনশীলতার পরিচয় বহন করে। হিংসা দ্বেষ সংঘাতে ভরা আপাত-অনিত্য সংসারের ঊর্ধ্বে অনন্ত, অসীম ও শাশ্বতের আকুতি ভগবদগীতাকে সাহিত্য-গুণে মহিমান্বিত করেছে। অর্জুন বিষাদ, সাংখ্যযোগ, কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ সংক্রান্ত প্রথম চারটি অধ্যায়, বিশ্বরূপ দর্শন ও ভক্তিযোগ সংক্রান্ত একাদশ ও দ্বাদশ অধ্যায়, আর মোক্ষযোগ বিষয়ক অষ্টাদশ অধ্যায় কাব্যগুণে বিশেষভাবে অলংকৃত। . . . সামগ্রিকভাবে কাব্যগ্রন্থ হিসেবে ভগবদগীতা যে বিশ্বমানের-সাহিত্য সৃষ্টি, সেবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। . . . পৃথিবীর সাহিত্যরসিকদের কাছে ভগবদগীতা বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে গণ্য . . .।

অন্যদিকে লেখকসচেতন, গীতার সমাদর ভারতবর্ষে প্রধানত ধর্মগ্রন্থ রূপে। অবশ্য তাই বলে তামাম ভারতবাসীর কাছে গীতা গ্রহণীয় হয়ে ওঠে নি, ধর্মগ্রন্থ রূপে গীতা শুধু হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই আদৃত। লেখকের মূল্যায়নে :

. . . ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ভগবদগীতার প্রভাব অনেক বেশী সংকীর্ণ এবং সীমিত। আবার ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গীতার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে, এর মূল বক্তব্যগুলির ভিন্ন ভিন্ন এবং পরস্পরবিরোধী অর্থ করা সম্ভব এবং ইতিহাসে বারবার করা হয়েছে। . . . ভারত-ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণী এবং গোষ্ঠীর জাগতিক প্রয়োজন এবং দার্শনিক প্রবণতা অনুযায়ী এই ধর্মগ্রন্থকে ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের বর্ণাশ্রম-ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস এবং অদ্বৈতবাদী দর্শন, বৈষ্ণব-ধর্মের বর্ণাশ্রম বিরোধিতা এবং দ্বৈতবাদী দর্শন, সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, এমনকি তান্ত্রিক দেহতত্ত্বের সমর্থনে ব্যবহার করা হয়েছে।

লেখক গীতাকে কেন্দ্র করে এত যে পরস্পরবিরোধী ভাষ্যের কথা বলেছেন, যেজন্য এর আদি অর্থ, উদ্দেশ্য সূচিত হয় নি, আমরা কিন্তু এই পরস্পরবিরোধিতার মধ্য দিয়ে গীতার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে লক্ষ্য করি। লেখকের কথামত ভারতীয় হিন্দুরা না হয় গীতাকে তাদের ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দেয়, যা অন্যরা দেয় না। অন্যদিকে কাব্য হিসেবেই গীতার গ্রহণযোগ্যতা। এখানে প্রশ্ন, বহু বিদেশীয় পন্ডিত, দার্শনিক দীর্ঘকালব্যাপী যে গীতার ভাষ্য রচনা করে এসেছেন, আলোচনা করেছেন, তা কি কেবলই তার কাব্যসৌন্দর্যের কারণে? ব্যবহারিক ধর্ম ও দর্শনরূপেও কি গীতা দেশের বাইরে ও ভিতরে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে নি? বহু অহিন্দু ভারতীয়ও কিন্তু গীতার পাঠক। গীতার আবেদন সুদূরপ্রসারী। বস্তুত গীতার এই গ্রহণযোগ্যতার মূলে রয়েছে এর নমনীয়তা। বিভিন্ন গোষ্ঠী অথবা পাঠক নিজ নিজ বিশ্বাস কিংবা মানসিকতা অনুযায়ী গীতার বক্তব্য গ্রহণ করতে পারেন, সেই অবকাশ আছে। পরিবর্তে যদি গীতার বক্তব্য অনমনীয় হত, প্রকৃতিতে rigid হত, গীতার একটিই বা দ্বিতীয় ভাষ্য রচনার অবকাশ অন্তর্হিত হত, এর গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশেই হ্রাস পেত। একমাত্র সেই অনমনীয় বক্তব্য যাঁদের মানসিকতার কাছাকাছি পৌঁছাত, একমাত্র যাঁরাই হতেন এর আস্বাদনকারী অন্যরা কেউ নয়। লেখকের মতে যেহেতু হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্যধর্মের কোনো একটি মৌলিক শাস্ত্রগ্রন্থ নেই, সেই কারণে হিন্দুধর্মের সুরক্ষার জন্য ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের মূল সামাজিক ও আধিবিদ্যক বক্তব্য ও অনুশাসনগুলিকে ধর্মগ্রন্থরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর জন্য কৃতিত্ব শংকরাচার্যের। লেখক সংক্ষেপে আলোকপাত করেছেন আমাদের স্বদেশী আন্দোলনে কিংবা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে গীতার অবিস্মরণীয় প্রভাববিস্তারের প্রসঙ্গ, গীতার কর্মযোগ, দেশনায়কদের আকৃষ্ট হওয়ার মতই বিষয়। লেখকের সুচিন্তিত অভিমত :

মুসলমানদের পক্ষে এরকম হিন্দুধর্মে ভারাক্রান্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগদান করা কার্যত অসম্ভব ছিল।

লেখক ‘হিন্দুধর্মে ভারাক্রান্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’ বলতে বুঝিয়েছেন ভগবদগীতার ধর্মযুদ্ধ ও কর্মযোগ থেকে লব্ধ সশস্ত্র বিপ্লবের অনুপ্রেরণা, সশস্ত্র কর্মযোগের দেবীরূপে কালীরূপ প্রতীককে বরণ। কিন্তু লেখকের এই মন্তব্য অপ্রতর্ক্য নয়। সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখেই অবিভক্ত ভারতবর্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতা আন্দোলনে সিংহভাগ অধিকার করেছিল। নিছক ধর্মীয় কারণে মুসলমানরা হিন্দুধর্মে ভারাক্রান্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল, এই মূল্যায়ন যুক্তিনিষ্ঠ নয়, বস্তুনিষ্ঠও নয়। বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অমানবিক শোষণ যে কেবল হিন্দুদের পক্ষেই অনিষ্টকর ছিল তা নয়, মুসলমানরাও এর খেসারৎ দিয়েছেন। প্রতিটি ক্রিয়ার একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া থাকেই, ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে এজন্যও মুসলমানদের যোগদান ছিল স্বাভাবিক ঘটনা।

প্রথম অধ্যায়ের শেষাংশে লেখকের আর একটি বক্তব্যের সমীচীনতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। লেখক বলেছেন রবীন্দ্রনাথের :

. . . তাঁর বিপুল রচনাসম্ভারের মধ্যে ভগবদগীতার উল্লেখ তুলনাক্রমে অতি অল্পই আছে।

পম্পা মজুমদার তাঁর বহু পরিশ্রমলব্ধ গবেষণায় দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের মত গীতারও অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর সুবিপুল রচনারাজিতেও প্রায় একশতবার গীতার প্রসঙ্গ এসেছে। লেখক ভগবদগীতাকে ভারতীয় তথা বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য ধ্রুপদী সম্পদ বলে অভিহিত করেছেন, অথচ তিনিই বললেন রবীন্দ্রনাথ :

প্রাচীন সাহিত্য সংক্রান্ত তাঁর রচনাগুলির মধ্যে তিনি রামায়ণ মহাভারতকে শুধুমাত্র সাহিত্যের মর্যাদা দিয়েছেন। . . . গীতাকে তিনি আদি মহাভারত রচনার পরবর্তীকালের প্রক্ষিপ্ত সংযোজন বলে মনে করতেন . . .।

রবীন্দ্রদৃষ্টিতে গীতা সাহিত্যরূপে স্বীকৃত হল না, এক্ষেত্রে যেহেতু তিনি গীতাকে মহাভারতের অপরিহার্য অঙ্গ মনে করেন নি, তা প্রক্ষিপ্ত সংযোজন মাত্র, তাই পৃথকভাবেই গীতার কাব্যত্ব স্বীকার করার অবকাশ ছিল রামায়ণ মহাভারতের মত। তবে কি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এই প্রসঙ্গে এড়িয়ে গিয়েছিল, না কি লেখকের দাবীই যুক্তিহীন যে গীতা বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ?

চতুর্থ অধ্যায়ে ‘ভগবদগীতা ও অনার্য সংস্কৃতি’ শীর্ষক আলোচনায় ব্যাপক অনার্য সংস্কৃতির মোকাবিলায় ভগবদগীতা রচিত, ভগবদগীতায় জৈনধর্ম, বিশেষত বৌদ্ধধর্মের অধিকতর প্রভাব লক্ষ্য করেছেন লেখক সঠিক- ভাবেই। দেখিয়েছেন রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় বৌদ্ধধর্মের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করাই ছিল ভগবদগীতা রচনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য, আর্যসমাজের অন্তর্গত শূদ্রশ্রেণীর অবাধ্য অংশকে আনার চেষ্টাও গীতায় সুস্পষ্ট বলে লেখকের বিশ্বাস।

আমরা এপর্যন্ত লেখকের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করি, কিন্তু তাই বলে লেখক যখন বলেন, বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম দ্বারা সমর্থিত অহিংসা নীতির বিরুদ্ধে এবং ব্রাহ্মণ্যধর্ম দ্বারা সমর্থিত যুদ্ধের এবং হিংসার সপক্ষে ধর্মতত্ত্ব গড়ে তোলাই ছিল গীতা রচনার উদ্দেশ্য, তখন মনে হয় লেখকের এই মূল্যায়ন অতি সরলীকরণের দৃষ্টান্ত। অর্জুন তথা পঞ্চপান্ডবকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় কেন? কারণ কৌরবরা পান্ডবদের প্রাপ্য রাজ্যও অন্যায়ভাবে অধিকার করে ঘোষণা করে বিনা যুদ্ধে সূচগ্র মেদিনীও তারা ছাড়বে না, এক্ষেত্রে কৌরবদের অবস্থান ও আচরণে কি বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম সমর্থিত অহিংসা নীতির প্রতিফলন লক্ষ করি, না ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে তারা বিশ্বাসী ছিল বলে প্রতিপন্ন হয়?

লেখকের আর একটি মন্তব্য স্মর্তব্য :

. . . বিপুল সংখ্যক বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী অনার্য অসুরদের বিনাশ সাধন করে ব্রাহ্মণ্যধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই যে গীতায় শ্রীভগবানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য, সেবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা অহিংস ছিলো। তাই সশস্ত্র মহাযুদ্ধে তাদের বিনাশ করবার কোন প্রাসঙ্গিকতা ছিলো না। রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে, এবং ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শ্রেণী ও উচ্চবিত্ত বৈশ্য শ্রেণীর পীড়নেই তাদের সংযত রাখা সম্ভব ছিলো। এই দমন-পীড়নের ধর্মীয় সমর্থন রচনার উদ্দেশ্যেই পল্লবিত রামায়ণ-মহাভারতের অবতার কাহিনী, মনুস্মৃতি প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্র এবং ভগবদগীতার প্রয়োজন হয়েছিলো।

অহিংস বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের যদি দমন-পীড়নেই সংযত রাখা সম্ভব ছিল তাহলে যুদ্ধের প্রয়োজন ঘটল কেন? কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হবার কারণ কী? নিছক দমন-পীড়নের উদ্দেশ্যই যদি প্রাধান্য পায় তবে সেই উদ্দেশ্য সাধনে রামায়ণ-মহাভারত রচিত হবার পরেও গীতা রচিত হওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়?

নবম পরিচ্ছেদে লেখক নিষ্কাম কর্মের আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছেন। বস্তুতপক্ষে এই পরিচ্ছেদে লেখক তাঁর স্বকীয় চিন্তাভাবনা ও মননশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। মনুস্মৃতির উল্লেখে বলেছেন, শুধু ফলের আশা করে কর্ম সম্পাদন কখনই প্রশংসনীয় নয়, কিন্তু বাস্তব সত্য হল জগতে আসক্তিহীনতার কোনো উদাহরণ দেখা যায় না। মানুষ আসক্তি ব্যতিরেকে কোনো কর্মই সম্পাদনে অক্ষম। মনুস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়ে আসক্তিহীন বা নিষ্কাম কর্মতত্ত্বের উপস্থাপন। বলা হয়েছে, ভোগের দ্বারা বাসনার নিবৃত্তি সম্ভব নয়। ভোগানন্দের তুলনায় বাসনা ত্যাগ বা বৈরাগ্যের আনন্দ অনেক গুণ বেশি। আর জ্ঞানই হল বৈরাগ্যের সোপান।

লেখক লক্ষ্য করেছেন, গীতায় দক্ষতার সঙ্গে সমন্বয় ঘটানো হয়েছে বর্ণ, ধর্মভিত্তিক স্বধর্ম—স্বকর্মের তত্ত্বের সঙ্গে আসক্তি ত্যাগের আদর্শ। লেখকের মূল্যায়ন :

সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুদের দেখে সাধারণ মানুষ যাতে কর্মত্যাগের আদর্শ গ্রহণ না করে সেজন্য অর্জুনের মাধ্যমে উচ্চবর্ণের আর্যদের সতর্ক করা হয়েছে। বৈশ্য, শূদ্র প্রভৃতি নিম্নবর্ণদের কর্মে নিযুক্ত রাখতে হলে উচ্চবর্ণদেরও উচিত স্বকর্মে নিযুক্ত থেকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

লেখক গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের এ সম্পর্কিত শ্লোক উদ্ধার করেছেন—

যদ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।

স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।। ৩/২০

শ্রেষ্ঠ মানুষদের আচরণ দেখে ইতর শ্রেণীর বা নিম্ন শ্রেণীর মানুষও তেমনটিই করে। কৃষ্ণ বলেছেন অর্জুনকে, তিনি যদি কাজ না করতেন, তবে মানুষজন তাঁর পথই অনুসরণ করত। অর্থাৎ তারাও নিষ্কর্মা হত।

পঁচিশ নম্বর শ্লোকে কথিত হয়েছে—

সক্তা: কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত।

কুর্যাদবিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোক সংগ্রহম।। ৩/২৫

আসক্তিবশত কাজ করে অবিদ্বান লোকেরা, লোকসংগ্রহে ইচ্ছুক বিদ্বান ব্যক্তির উচিত অনাসক্ত হয়ে কর্ম করা। লেখক বিদ্বান ও অবিদ্বান বলতে বুঝিয়েছেন ‘প্রভুশ্রেণী’ এবং ‘দাসশ্রেণী’কে। দাসদের শিক্ষার অধিকার ছিল না প্রভুদের মত। তাই তারা অবিদ্বান। এহেন দাসশ্রেণী :

আপাত আসক্তি নিয়ে কাজ করতো, কারণ প্রভুর নির্দেশমতো প্রাণান্তকর পরিশ্রম না করলে তাদের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। দরিদ্রের সব সময়ই প্রাণের দায়েই খাওয়া-পরায় আসক্তি থাকে, তাই তারা নিষ্কাম কর্ম করতে পারে না। কিন্তু আর্যরা একে বিদ্বান, তার উপর ঈশ্বরের বিধানে কায়িক শ্রম থেকে মুক্ত এবং প্রভুশ্রেণী। অতএব তাদের কর্ম করবার প্রয়োজন না থাকলেও ঈশ্বরের অনুকরণে কর্ম করা উচিত, নতুবা তাদের দেখে শূদ্ররাও কর্ম করতে চাইবে না, এমনকি বিদ্রোহী হবে, আর এভাবে আর্য সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।১০

গীতায় আসক্তিহীন হয়ে কর্ম করার পরামর্শ যেমন প্রদত্ত হয়েছে তেমনি অন্যদিকে আবার কর্মযোগের বিরোধিতাও করা হয়েছে। লেখক সেই স্ববিরোধিতা ধরেছেন—

দূরেণ হ্যবরং কর্ম বুদ্ধিযোগাদধনঞ্জয়

বুদ্ধৌ শরণমন্বিচ্ছ কৃপণা: ফলহেতবঃ।। ২/৪৯

এখানে বৌদ্ধধর্মের বুদ্ধি তথা জ্ঞানযোগের সমর্থন মেলে। কারণ বলা হয়েছে, কর্ম বুদ্ধিযোগের চেয়ে সুদূর নিকৃষ্ট। তাই অর্জুন যেন বুদ্ধিতে শরণ নেয়। কৃপণ বা বুদ্ধিহীন ব্যক্তিরাই কর্মফলে আসক্ত হন। কর্ম বলতে এখানে আসক্তিযুক্ত কর্ম বুঝতে হবে, নিষ্কাম কর্ম নয়। বুদ্ধিযোগের সহায়তায় আসক্তি ত্যাগ সম্ভব। এখানেই বুদ্ধি যোগের শ্রেষ্ঠত্ব। লেখক গীতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তা হল নিপুণতার সঙ্গে কর্ম করার আদর্শ গীতাতেই কথিত—‘যোগঃ কর্মসু কৌশলম’। অবশ্যই বর্ণাশ্রম ধর্মের বংশানুক্রমিক কর্মবিভাজনকে মেনে এই কর্ম সম্পাদন আবশ্যক। লেখক নিষ্কাম কর্মের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে :

সব বর্ণের মানুষই কোন ফলের আকাঙ্খা না করে এবং আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে নিজ নিজ স্থানাঙ্ক সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন না তুলে নিষ্কামভাবে প্রতিদিন সারাবেলা কাজ করে যাবে। ব্রাহ্মণ যাগ-যজ্ঞ, পুজোপার্বণ করে জীবিকা নির্বাহ করবে, ক্ষত্রিয় যুদ্ধ এবং জনসাধারণের উপর শাসন ও প্রভুত্ব করবে, বৈশ্যদের এক অংশ ব্যবসা-বাণিজ্য করবে এবং আরেক অংশ শূদ্রদের সমান হয়ে কৃষিকার্য করবে, আর শূদ্ররা শুধুমাত্র আর্যদের তিন বর্ণের নিষ্কাম পরিচর্যা করে জীবন অতিবাহিত করবে। তারা কোনো অর্থ সঞ্চয় করতে পারবে না, কর্ম পরিবর্তন করতে পারবে না, রাজশাসনে নিজ আর্থ-সামাজিক স্থানাঙ্ককে অচল থেকে নিষ্কামভাবে বংশানুক্রমে আর্যদের পরিচর্যা করে যাবে। এদিকে তারাই জনসাধারণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। . . . ব্রাহ্মণ্যধর্মের দমনপীড়ন ও শোষণমূলক অসম এবং অমানবিক আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে চিরায়ত করবার উদ্দেশ্যেই প্রাচীন ভারতে এই ধর্মের এক ঐতিহাসিক সংকটের সময়ে নিষ্কাম কর্মের তত্ত্ব রচিত হয়েছিলো।১১

লেখক শেষ পর্যন্ত মানবজীবনের লক্ষ্যরূপে জ্ঞানকে নির্দিষ্ট করেছেন। তাঁর মতে কর্ম জীবনের একটি মৌলিক চাহিদা মাত্র। জাগতিক সুরক্ষা ও সাম্য যেদিন নিশ্চিত হবে, সেদিনই মানুষ জ্ঞানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কর্মে নিরাসক্ত হতে সক্ষম হবে। এ জ্ঞান কষ্টার্জিত শিক্ষালব্ধ জ্ঞান। অতএব দারিদ্র্যপীড়িত অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত শূদ্রশ্রেণীর পক্ষে নিষ্কাম কর্মের তত্ত্ব তার স্বার্থের পরিপন্থী, তাদের ‘শ্রেণীচৈতন্যকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার আফিম মাত্র।’

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

শ্রীমৎ স্বামী সত্যানন্দদেব

শ্রীমৎ স্বামী সত্যানন্দদেব সম্পাদিত ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’র দ্বিতীয় সংস্করণটির প্রকাশকাল ১৯৯৪। নানা কারণেই গ্রন্থটির বিশেষ গুরুত্ব। গ্রন্থের টাইটেল পেজে উল্লিখিত হয়েছে :

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভাবাদর্শের আলোকে আধ্যাত্মিক ও আধুনিক যুগসম্মত বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা।

মূল text-টির সঙ্গে অন্বয়, অনুবাদ ও ব্যাখ্যা সন্নিবিষ্ট হয়েছে।

লেখক গীতায় কর্ম, যোগ, জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সমন্বয় লক্ষ্য করেছেন। গীতার শ্লোকের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাদৃশ্যমূলক মতবাদের আলোচনা করেছেন। লেখক এক্ষেত্রে অত্যন্ত বাস্তববাদীর পরিচয় দিয়েছেন। বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। তাই গীতার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে তিনি বিজ্ঞানের আধুনিকতম তত্ত্বাদিকে উপজীব্য করেছেন গীতার মর্মার্থ উদঘাটনে। শুধু বিজ্ঞানই নয়, দর্শনেরও আধুনিকতম তত্ত্বাদিকে আশ্রয় করতে দেখা গেছে। আমরা আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে কয়েকটি দৃষ্টান্তের অবতারণা করব।

ক. সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ। সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধূমেনাগ্নিরিবাবৃতা:।। ১৮/৪৮

এই শ্লোকে বর্ণাশ্রম ধর্মের সমর্থন মেলে। বর্ণাশ্রমীয় স্বভাবধর্মকে ‘সহজকর্ম’ বলা হয়েছে। লেখক এই প্রসঙ্গে পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞানের ‘habit’ বা অভ্যাস সম্পর্কিত বক্তব্যের উল্লেখ করেছেন :

Habit has an important bearing on mental economy and mental development. Habit renders movements easy and accurate.

খ. নিয়তং সঙ্গরহিতমরাগদ্বেষতঃ কৃতম

অফলপ্রেপ্সুনা কর্ম যৎ তৎ সাত্ত্বিকমুচ্যতে।। ১৮/২৩

এই শ্লোকে সাত্ত্বিক কর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে, ফলাকাঙ্খা ত্যাগ করে, অনাসক্ত হয়ে, অনুরাগ-বিদ্বেষ ভাব-বর্জিত হয়ে কর্ম সম্পাদনের কথা বর্ণিত হয়েছে। লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন সঙ্গ থেকেই আসক্তি, অনুরাগ বিরাগের জন্ম। এটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লেখক Theory of magnetic induction-এর প্রসঙ্গ এনেছেন :

কোন Powerful magnet-এর কাছে যে কোন magnetic metal-কে রেখে দিলে সেটিও magnetized হয়ে যায়। ঠিক যেমন বিষয়ের কাছে থাকলে মন, বুদ্ধি মোহগ্রস্ত হয়। বিষয়ের প্রতি আকর্ষিত হয়। আবার magnet-এর গায়ে ঘষেও metal-কে magnetized করা হয়। কিন্তু magnet powerful হলে দূর থেকেই magnetized হয়। ঠিক সেই পদ্ধতিতে সাধককেও বিশেষ প্রলোভনের বস্তু থেকে দূরে থাকতে হয়। আবার magnet থেকে metal-এর দূরত্ব যতো বাড়বে আকর্ষণ শক্তিও ততো কমবে। পরিধি ছাড়িয়ে গেলে আর চৌম্বক শক্তি কার্যকরী হয় না। সেরকম সাধককেও বিষয় থেকে দূরে দূরে থাকতে হয় যতক্ষণ না মন তৈরী হচ্ছে।

গ। সর্ব্বাস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানমপোহঞ্চ।

বেদৈশ্চ সর্ব্বেরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ বেদবিদেব চাহম।।১৫/১৫শ অধ্যায়

সকল জীবের অন্তরে হৃষীকেশরূপে অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে ভগবানের প্রাণীদের স্মৃতি ও জ্ঞান উৎপাদনে ভূমিকার কথা। আবার তাঁরই কারণে স্মৃতি ও জ্ঞানের বিলোপ সাধন ঘটে। লেখক মনোবিজ্ঞানের ‘memory’-র প্রসঙ্গ এনেছেন :

Memory is fundamental phenomenon of consciousness যাবতীয় জ্ঞানের পেছনে তিনিই স্মৃতিশক্তিরূপে বিদ্যমান, আবার জ্ঞানও তিনি। . . . জ্ঞান আদৌ সম্ভব হয় না যদি আমাদের স্মরণশক্তি না থাকে।

লেখক : Ewald Herming, Bergson প্রমুখের বক্তব্য হাজির করেছেন—

ঘ। য এবং বেত্তি পুরুষং প্রকৃতিং চ গুণৈ: সহ।

সর্বথা বর্তমানোহপি ন স ভূয়োহভিজায়তে।। ১০। ২৪

এই শ্লোকের ব্যাখ্যা করেছেন লেখক নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের atomic তত্ত্ব দিয়ে :

গীতা মতে পুরুষ দ্রষ্টা, সাক্ষী ও অনুমন্তারূপে বসে আছেন। প্রকৃতি তাঁকে ঘুরে কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রকৃতিই একরূপে জীবভূত সনাতন হয়ে সুখ দুঃখ সমন্বিত হচ্ছেন অর্থাৎ সুখ-দুঃখ ভোগ করছেন। এখন এই তত্ত্বটিকে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের atomic তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। একটি Proton-কে কেন্দ্র করে electron গুলো ঘুরছে এবং electron, proton ও neutron-এর সংখ্যা ও বিভিন্নতা অনুযায়ী সৃষ্টি হচ্ছে এক একটি matter বা বস্তু। এই proton-এর মধ্যে আছে দুটি শক্তি একটি neutron ও আর একটি positron, Neutron-টি হচ্ছে নিরপেক্ষ, নিষ্ক্রিয়, কোনরকম charge নেই অথচ সমস্ত structure-টির সাম্য নির্ভর করে এই neutron-টির ওপর। আর Positron-টি হচ্ছে Positive charge আর electron গুলি নিজস্ব orbit এবং নির্দিষ্ট গন্ডী বেঁধে ঘুরছে।

এখন এই neutron-টিই যেন পরমাত্মন, দ্রষ্টা, সাক্ষী, অনুমন্তা আর positron হচ্ছে জীবভূত সনাতন আর ঐ ঘুরন্ত electron গুলি হচ্ছে প্রকৃতি যেটি ‘সুয়তে সচরাচরম’। আর ওই যে orbit ওটি হচ্ছে জীবের সংস্কার। এখন এই neutron কেন্দ্রিক structure-টিকে ভেঙ্গে দিলে যেমন electron গুলো free হয়ে infinite গতিতে চলতে থাকে ও চলার পথে সমস্ত ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে চলে তেমনি আমাদের এই সংস্কারের গন্ডী যেটি ধারাবাহিকতার মধ্যে ঘুরে সৃষ্টি হচ্ছে, সেই গন্ডী ভেঙ্গে দিলে infinite গতিতে ছুটতে ছুটতে সংস্কার মুক্ত হয়ে অনন্ত ব্রহ্মে মিলিয়ে যায় ও আনে মুক্তি।

দৃষ্টান্ত আর বাড়িয়ে লাভ নেই। লেখক বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্বের ও তথ্যের উপস্থাপন করলেও তাঁর ঝোঁকটা বেশি দেখা গেছে মনস্তত্ত্বের উপর। আর একটি কথা। গীতার তত্ত্ব ও বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক ক্ষেত্র বিশেষে বিজ্ঞানের প্রসঙ্গকে অনাবশ্যকভাবে দীর্ঘায়িত করে প্রসঙ্গ চ্যুতি ঘটিয়েছেন। অনেক সময়ে মনে হয় বুঝিবা গীতা নয় বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ব্যাখ্যাতেই লেখক অধিকতর আগ্রহী। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাদর্শেও লেখককে গীতার সর্ব সমন্বয় মূলক আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দানে প্রয়াসী দেখা গেছে।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

গীতাপ্রেস গোরক্ষপুর থেকে প্রকাশিত। প্রথম প্রকাশকাল ১৯৯৪, অত্যন্ত জনপ্রিয়। বেশ কয়েকটি সংস্করণই তার প্রমাণ স্বল্প মূল্যের এবং ব্যবহারোপযোগী— এ দুটিই তার কারণ। অনুবাদিকা গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়। নিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রকৃতপক্ষে শ্রীমদভগবদ গীতা জ্ঞান-কর্ম-ও ভক্তির সমন্বিত প্রকাশ’। বর্তমান গ্রন্থে গীতার মূল শ্লোক এবং সেগুলির বঙ্গানুবাদ দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু জয়দয়াল গোয়েন্দকা কৃত গীতার মহিমা এবং গীতার মাহাত্ম্যও এতে বর্ণিত হয়েছে।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

সুরধূনী দেবী

সুরধূনী দেবী প্রণীত শ্রীমদ্ভগবদগীতা (১ম মহেশ সংস্করণ, ১৪০৩) ভিন্ন চরিত্রের। তান্ত্রিক দৃষ্টিতে গীতার ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয়েছে। গীতার ৩য় অধ্যায় বা কর্মযোগের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গ্রন্থকর্ত্রী বললেন, জ্ঞানযোগ এবং কর্মযোগ দুটি ভিন্ন পথ বা ধর্মাচরণ নয়, ‘উহা একই কর্ম এবং উভয় অবস্থাই তুল্য।’ জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগের ব্যাখ্যায় বলা হল :

পুস্তক পাঠে জানারূপ জ্ঞান হয় না; . . . সাংখ্যে লক্ষ্য করা রূপ (শ্বাসের গতিতে লক্ষ্য করা রূপ) প্রাণের গতির সংখ্যা করিতে করিতে ঐ গতির অতীতাবস্থায় জ্ঞানাবস্থা লাভ হইয়া সাংখ্যদিগের (যাঁহারা উক্ত সংখ্যা করেন তাঁহাদিগের) ঐ অবস্থায় মনের স্থিতি হইয়া যায়; ইহাই জ্ঞানযোগ দ্বারা সাংখ্যদিগের স্থিতি। আর কর্মযোগ দ্বারা যোগীদিগেরও এই স্থিতি; কর্ম অর্থাৎ প্রাণকর্মরূপ (প্রাণের ঊর্ধ্বাধোগতির ক্রিয়ারূপ) আত্মকর্ম; তাঁহারা যোগী, তাঁহাদের এই কর্ম করিতে করিতে কর্মের মিলনরূপ ঈড়া ও পিঙ্গলার গতি এক হইয়া সুষুম্না মার্গে লয় হইয়া কর্মের অতীতাবস্থায় মনের স্থিতি হইয়া থাকে; ইহাই কর্মযোগ দ্বারা যোগীদিগের স্থিতি।

গীতার ৫ম শ্লোকে কথিত হয়েছে—

নহি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ।

এক মুহূর্তও কারো কর্ম না করে থাকার উপায় নেই। আলোচ্য গ্রন্থে এর ব্যাখ্যা হল :

প্রকৃতির গুণসমূহ কাহাকেও স্ববশে (আত্মবশে) থাকিতে দেয় না; স্ববশ হইতে অবশ করিয়া অর্থাৎ প্রকৃতির তওদ গুণের বশীভূত করিয়া সর্বদা প্রাণের বহির্গতিরূপ কর্ম করাইয়া মনে মনে নানারূপ কর্ম করাইতেছে।

গ্রন্থকর্ত্রী কর্ম বলতে প্রাণকর্মকে বুঝিয়েছেন :

কর্ম অর্থাৎ প্রাণকর্ম, ইহার যোগ অর্থাৎ মিলন, ঈড়া পিঙ্গলার কার্য যাহা চলিযাছে ইহার বহির্মুখ গতিকে অন্তর্মুখ করিয়া ঈড়া পিঙ্গলার মিলনরূপ কর্মের মিলন অবস্থাই কর্মযোগ।

এবার জ্ঞানযোগ বলতে সুরধূনী দেবী কী বুঝিয়েছেন দেখা যাক। পূর্বেই দেখা গেছে যোগ দুইপ্রকার— কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ। সাংখ্যযোগ কর্মযোগেরই নামান্তর।

প্রাণের বহির্মুখ গতিকে অন্তর্মুখ করিয়া (বিধিপূর্বক ক্রিয়ারূপ) ঈড়া পিঙ্গলার মিলনক্রিয়ার নামই কর্মযোগ এবং ঐ কর্মদ্বারা কর্মের অতীতাবস্থা লাভ ‘আমি কে’ ইহা বিদিত হইয়া আত্মজ্ঞান প্রাপ্তিরূপ অবস্থাই জ্ঞানযোগ।

আরও বলা হয়েছে :

আপনাকে বিদিত হওয়া রূপ আত্মজ্ঞানই জ্ঞান; যোগ-চিত্তের বৃত্তিরহিত অবস্থা, অর্থাৎ বর্তমান প্রাণেরচঞ্চল গতিরহিত স্থির সাম্যাবস্থা। আপনাকে আপনি জানিয়া প্রাণের চঞ্চল গতির সাম্যভাব হইয়া আত্মা ও পরমাত্মার মিলনরূপ যে অবস্থা তাই জ্ঞানযোগ।

সবশেষে আসি ভক্তিযোগ প্রসঙ্গে। গ্রন্থকর্ত্রী ভক্তি অর্থে বুঝিয়েছেন প্রেমকে, আর যোগ বলতে বোঝাতে চেয়েছেন মিলনকে :

প্রাণরূপী আত্মাতে ভালবাসারূপ প্রেম দৃঢ়তর হইতে তাঁহাতে তন্ময় ভাবরূপে মিশিয়া যাওয়া বা মনের লয় হওয়া রূপ অবস্থাই ভক্তিযোগ।

জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির সমন্বয়ের কথা বলা হয় নি বর্তমান আলোচনা গ্রন্থে। ভক্তিই যে সর্বশ্রেষ্ঠ তাও বলা হয়নি। শুধু বলা হল কর্ম ও জ্ঞানযোগ এক আপাতপার্থক্য সত্ত্বেও আসলে অভিন্ন।

শ্রীমদভগবদগীতা (তত্ত্ব বিবেচনী)জয়দয়াল গোয়েন্দকা

জয়দয়াল গোয়েন্দকা গীতার তত্ত্ব আলোচনা করেছেন (১৯৯৬)। শ্রীমদভগবদগীতার সপ্তম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০০৯-এ। গোরক্ষপুরের গীতা থেকে গ্রন্থটি মুদ্রিত ও প্রকাশিত। ৭৭৬ পৃষ্ঠার এই বিশালাকৃতির গ্রন্থটির মূল্য মাত্র ৮০ টাকা। জয়দয়ালের ‘তত্ত্ব বিবেচনী’ নানা কারণেই উল্লেখযোগ্য। লেখক এই আলোচনায় ভক্ত ও তাত্ত্বিক উভয় সত্তার মেলবন্ধনে বিরল পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তিনি গীতাকে সর্বশাস্ত্রময়ী ও সকল শাস্ত্রের নির্যাস বলে মনে করেন। তাঁর মতে :

গীতা ভগবানের রহস্যময় প্রধান আদেশ।

গীতার তাৎপর্য লেখকের কাছে এইভাবে ধরা পড়েছে :

. . . অজ্ঞানবশতঃ সংসার-সমুদ্রে আবদ্ধ হয়ে থাকা জীবকে পরমাত্মার প্রাপ্তি করানো এবং তার জন্যে গীতা এমন পথের সন্ধান দিয়েছেন যে, যাতে মানুষ নিজের সাংসারিক কর্তব্যকর্ম ভালোভাবে সম্পাদনের দ্বারাই পরমাত্মাকে লাভ করতে পারে।

লেখকের কৃতিত্ব যে, তিনি পূর্বাপর বিরোধকে এড়িয়ে গিয়েছেন। প্রশ্লোত্তরের মধ্য দিয়ে লেখক গীতার তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। প্রশ্লোত্তরের ক্রম প্রায় সর্বত্র অর্থের ক্রমানুসারে রক্ষিত। ক্ষেত্রবিশেষে শ্লোকেরও ক্রমানুসরণ করা হয়েছে। প্রশ্লোত্তরের সময় কোথাও কোথাও অন্বয়ক্রমে মূল শ্লোকের অংশকে নিয়েই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, আবার কোথাও বা অর্থের বাক্যাংশকে নিয়েও প্রশ্ন করা হয়েছে। টীকায় লেখক মূলাপেক্ষা অধিক শব্দনিচয় যুক্ত করেছেন দ্বিবিধ কারণে—শ্লোকের ভাবকে স্পষ্টতা দিতে এবং রচনাকে আধুনিক মনের উপযোগী করতে।

গীতা এবং সাংখ্যদর্শনের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন লেখক। যেমন গীতাতে ঈশ্বরকে যে রূপে আনা হয়েছে, সাংখ্যদর্শনে সেরূপ স্বীকৃত নয়। গীতার ‘প্রকৃতি’ এবং সাংখ্যের ‘প্রকৃতি’র মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। কপিল সাংখ্যের প্রকৃতি যেখানে গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থা, সেখানে গীতার ‘প্রকৃতি’ গুণত্রয়ের কারণ। সাংখ্য প্রকৃতিকে অনাদি বলে মানে, গীতাও তাই মানে। এ পর্যন্ত দুইয়ের মিল, কিন্তু সাংখ্য প্রকৃতিকে নিত্য বলে মানলেও গীতায় প্রকৃতি অনিত্য। গীতার পুরুষ এবং সাংখ্যের পুরুষের মধ্যেও তফাৎ। কাপিল সাংখ্যে পুরুষ বহু; কিন্তু গীতার সাংখ্যে পুরুষ ‘এক’। গীতার মুক্তি এবং সাংখ্যের মুক্তিতেও পার্থক্য। সাংখ্যের মতে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিই হল মুক্তির স্বরূপ। কিন্তু গীতার মুক্তিতে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তির সঙ্গে পরমানন্দ স্বরূপ পরমাত্মার প্রাপ্তিও রয়েছে। পাতঞ্জল যোগে যোগের অর্থ ‘চিত্তবৃত্তির নিরোধ’। কিন্তু গীতায় ‘যোগ’ শব্দটি নানা অর্থে প্রযুক্ত। লেখক গীতার সমতা নিয়েও আলোকপাত করেছেন। বলেছেন সমতা ব্যতিরেকে সাধনার অসম্পূর্ণতার কথা। লেখকের ভাষায় :

জ্ঞান, কর্ম এবং ভক্তি—তিনটির পথেই সাধন রূপেও সমতার প্রয়োজন বলা হয়েছে এবং তিনটি পথেই পরমাত্মাকে যাঁরা লাভ করেছেন, তাঁদের মধ্যেও এক অসাধারণ লক্ষণরূপে যেটি বলা হয়েছে তা হল সমভাব।

লেখকের মতে :

… যিনি সর্বত্র সমদৃষ্টি রক্ষা করেন, ব্যবহারিক দৃষ্টিতে শুধুমাত্র অহং ও মমত্ব থাকলেও যিনি সবকিছুতে সমবুদ্ধি রক্ষা করেন, যাঁর সমষ্টি রূপ সমগ্র সংসারে সমভাব, তিনিই সমতাযুক্ত পুরুষ এবং তিনিই প্রকৃত সাম্যবাদী।

বলাবাহুল্য, মার্কসীয় দৃষ্টিতে যে সাম্যবাদ তার সঙ্গে এর বিরাট পার্থক্য।

লেখক সগুণ-নির্গুনের উপাসনা এবং তত্ত্ব, গীতা এবং বেদ, জীবের গতি ইত্যাদি নিয়েও সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। তবে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল ‘গীতার তাৎপর্য’ ব্যাখ্যা। লেখক বারংবার বলেছেন গীতায় কর্ম, উপাসনা এবং জ্ঞান তিনেরই বিস্তারিত আলোচনা স্থান পেয়েছে। কিন্তু অধিকারভেদে পরমাত্মা প্রাপ্তির জন্য—

দুই প্রকারের নিষ্ঠার কথা উল্লিখিত হয়েছে— জ্ঞাননিষ্ঠা বা সাংখ্যযোগ এবং যোগনিষ্ঠা বা কর্মযোগ। উপাসনা জ্ঞাননিষ্ঠা এবং যোগনিষ্ঠারই অন্তর্গত।

লেখকের ব্যাখ্যানুযায়ী :

যখন নিজেকে পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্ন মনে করে উপাসনা করা হয়, তখন তা সাংখ্যনিষ্ঠার অন্তর্গত হয়ে যায়। আর, যখন ভেদদৃষ্টিতে উপাসনা করা হয়, তখন যোগনিষ্ঠার অন্তর্গত মনে করা হয়।

এবারে কর্মযোগ এবং ভক্তিযোগ সম্পর্কে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় গ্রহণ করা যেতে পারে। শাস্ত্রবিহিত কর্ম দুইয়েই সম্ভব—জ্ঞাননিষ্ঠায় এবং যোগনিষ্ঠায়। সত্যিকথা বলতে কি, জ্ঞাননিষ্ঠার সঙ্গে যোগনিষ্ঠার কোনো বিরোধ নেই। অর্জুন কে কৃষ্ণ কখনও যোগনিষ্ঠার দৃষ্টিতে, কখনও আবার জ্ঞাননিষ্ঠার দৃষ্টিতে কর্ম সম্পাদনের পরামর্শ দিয়েছেন। এই দুইয়েরই সপক্ষে গীতার শ্লোকের উল্লেখ করা যায়, লেখক সেসব শ্লোকের উল্লেখও করেছেন। লেখক বলেছেন :

সাধক চাইলে জ্ঞাননিষ্ঠার সাহায্য ছাড়াও সরাসরি কর্মযোগের দ্বারা পরম সিদ্ধি লাভ করতে পারে অথবা কর্মযোগের দ্বারা জ্ঞাননিষ্ঠাকে লাভ করে আবার জ্ঞাননিষ্ঠার দ্বারা পরমাত্মাকে লাভ করতে পারে। দুটির মধ্যে কোন পন্থা গ্রহণ করবে, তা তার রুচির ওপর নির্ভর করে।

দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এখানে রয়ে গেছে। সাংখ্যযোগ এবং কর্মযোগ এই দুই সাধনার সম্পাদন একই সময়ে কোনো একজনের দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ—

(ক) কর্মযোগী কর্ম, কর্মফল, পরমাত্মা এবং নিজেকে ভিন্ন ভিন্ন মনে করে কর্মফল ও আসক্তি ত্যাগ করে ঈশ্বরের জন্য সমস্ত কর্ম সম্পাদন করেন। কর্মযোগী নিজেকেই কাজের কর্তা ভাবেন। কর্মযোগী পরমাত্মাকে নিজের থেকে পৃথক মনে করেন। কর্মযোগী প্রকৃতি ও প্রকৃতির সমুদয় পদার্থের সত্তায় বিশ্বাসী।

(খ) সাংখ্যযোগী মায়ার দ্বারা উৎপন্ন সকল গুণই গুণরাশিতে ব্যবহার করেন। কিংবা তাঁর ইন্দ্রিয়সমূহ ব্যবহৃত হয় ইন্দ্রিয় রাশির জন্য। ইনি কায়মনোবাক্যে সবকাজে কতৃত্বের অভিমান ত্যাগ করে পরমাত্মার স্বরূপে অভিন্নভাবে অবস্থান করেন। সাংখ্যযোগী নিজেকে কর্তা ভাবেন না। সাংখ্যযোগী সর্বদা অভেদ জ্ঞান করেন। সাংখ্যযোগী একমাত্র ব্রহ্মে বিশ্বাসী অন্য কোনো কিছুতে তাঁর বিশ্বাস নেই।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হল :

ভক্তিপ্রধান কর্মযোগ সব আশ্রমেই সম্ভব এবং শ্রীকৃষ্ণ গীতায় অর্জুনকে এই ভক্তিপ্রধান কর্মযোগেরই উপদেশ দিয়েছিলেন।

উপনিষদ রহস্য বা গীতার যৌগিক ব্যাখ্যা

বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মা

উপনিষদ রহস্য বা গীতার যৌগিক ব্যাখ্যার রচয়িতা শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মা। তিনটি খন্ডে গ্রন্থটি বিভক্ত। প্রথম খন্ডটির চতুর্থ সংস্করণের প্রকাশকাল ১৪০৫। দ্বিতীয় খন্ডটির প্রকাশকাল (৪র্থ সংস্করণ) ১৪১২ এবং তৃতীয় খন্ডটির প্রকাশকাল (৪র্থ সংস্করণ) ১৪১৫। প্রথম খন্ডে আলোচিত হয়েছে গীতার ১ম ও ২য় অধ্যায়। দ্বিতীয় খন্ডে আলোচিত হয়েছে গীতার তৃতীয়ত, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায়। তৃতীয় খন্ডে আলোচিত হয়েছে সপ্তম থেকে অষ্টাদশ অধ্যায়। লেখকের অভিনবত্ব, এই গ্রন্থে গীতার ব্যবহারিক ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে যৌগিক ব্যাখ্যাও প্রদত্ত হয়েছে। বলাবাহুল্য ব্যবহারিক ব্যাখ্যার তুলনায় যৌগিক ব্যাখ্যার পরিসর অনেকগুণ বড়। লেখকের দৃষ্টিতে গীতা আধ্যাত্মিক যোগবিজ্ঞান। তাঁর দৃষ্টিতে এটি ঐতিহাসিক আদর্শ ধর্মভাবযুক্ত ঘটনা মাত্র। লেখকের মতে, গীতার অধ্যায়গুলি সাধনার স্তর পরম্পরায় রচিত। তাঁর ভাষায় :

সাধকের হৃদয়ে ভাব ও তত্ত্বসকল পর পর যেভাবে প্রকাশ পায় অথবা প্রকাশ হওয়া সঙ্গত, সেই ধারাটি সুপরিস্ফুট করিয়া দেখাইতে গীতার অধ্যায়সকলের ক্রম সন্নিবেশ।

লেখক গীতার যৌগিক ব্যাখ্যা দানের প্রেক্ষিতটি ব্যাখ্যা করেছেন :

যোগচক্ষুষ্মান ব্যক্তি যেমন আপনার শরীরের মধ্যে সমগ্র ব্রহ্মান্ডের প্রতিবিম্ব দেখিতে পান, বস্তুতঃ বিরাটে ও দেহ-ব্রহ্মান্ডে যেমন পরিমাণগত তারতম্য ছাড়া অন্য কোন প্রভেদ নাই, তেমনই গীতাসম্বলিত কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনের ঘটনা, এবং বিরাট ব্রহ্মান্ডের মুক্তির দিকে বিরাট গতি ও জীবমাত্রের ব্যক্তিগত মুক্তিপথেসঞ্চরণ—এ তিনেও কোন প্রভেদ নাই।

লেখক কৃষ্ণকে আদর্শ পুরুষরূপে দেখেছেন, অপরপক্ষে কুরুক্ষেত্রকে দেখেছেন আদর্শ রণাঙ্গন রূপে। অর্জুন তাঁর দৃষ্টিতে ‘সাধকপ্রবর’। কৃষ্ণ বিরাট পুরুষ। কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনে তিনি এক অপূর্ব লীলা প্রদর্শন করেছেন। এই লীলাই প্রতি পরমাণুতে ব্যষ্টিভাবে এবং সমগ্র ব্রহ্মান্ডে সমষ্টিগতভাবে অভিনীত হয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে জীব মুক্তির দিকে যেমন করে অগ্রসরমান, কিংবা সমগ্র ব্রহ্মান্ড যেভাবে মুক্তির দিকে অগ্রসরমান সেই আদর্শ ছবি কৃষ্ণ কতৃক কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনে প্রদর্শিত হয়েছে। গীতার প্রচলিত ব্যাখ্যার সঙ্গে স্বভাবতঃই আলোচ্য গ্রন্থের ব্যাখ্যার গুণগত পার্থক্য বিদ্যমান। আপাদমস্তক গীতার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা পাই তিন খন্ডের গ্রন্থে। ক্ষেত্রবিশেষে লেখকের উচ্ছ্বাসপ্রাণতা প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে :

গীতা ভগবানের মুখের আশ্বাসবাণী, গীতা জগন্মাতার স্তনধারা, গীতা শ্রীকৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খনাদ, গীতা জীবের জীবনপ্রবাহের পথপ্রদর্শক, গীতা দীপ্ত আলোকশিখা, ভবার্ণবের দিক-নিদর্শন যন্ত্র।

লেখক কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ আপাতভাবে পৃথক মনে হলেও কার্যতঃ উভয়ই যে এক তা মেনে নিয়েছেন :

বুদ্ধিযোগ নামে কর্মযোগ বলিতে গিয়া জ্ঞানের কথাই বলিয়াছেন। …জ্ঞানের ভিতর কর্ম প্রবিষ্ট করাইয়া এবং কর্মের ভিতর জ্ঞানকে অন্তর্নিবিষ্ট করিয়া তিনি কৌশলে জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগ কার্যতঃ উভয়ই যে এক সেই শিক্ষার পূর্ব সূচনা করিয়াছেন। কর্মযোগকে বুদ্ধিযোগ নামে অভিহিত করিয়া আত্মার বিরাট ব্রহ্মসত্তার ধারণা করিতে উপদেশ দিয়া, ভগবান বস্তুতঃ জ্ঞান ও কর্মযোগ যে একই, যোগ অর্থে—কি জ্ঞানে, কি কর্মে আত্মস্বরূপ ভগবানে যুক্তভাবে অবস্থান করা মাত্র এবং এই জ্ঞানকর্ম সমুচ্চয় যে যোগের মুখ্য উদ্দেশ্য—বুঝাইয়াছেন।

লেখক জ্ঞান ও কর্মের পার্থক্য প্রদর্শন করতে গিয়ে বলেছেন :

… জ্ঞান ও কর্ম দুইটি বিভিন্ন শক্তি নহে। একই শক্তি যখন মাত্র অন্তঃকরণকে পরিচালিত করে এবং বাহ্য কর্মের সহায়তা না লইয়াও অনুভূতির বিকাশ করিয়া লয়, তখন উহা জ্ঞানপদবাচ্য; আবার সেই শক্তি যখন বাহ্য কারণে উদ্রিতা হইয়া বাহ্য কর্ম সাহায্য অবলম্বন করিয়া হৃদয়ে পূর্বোক্তরূপ আত্মভূতি ফুটাইয়া তোলে তখন উহা কর্ম।

লেখক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে কর্মনিষ্ঠা জ্ঞাননিষ্ঠাকে এবং জ্ঞাননিষ্ঠা কর্মনিষ্ঠাকে সাহায্য করে। পরস্পর পরস্পরের পোষণ করে।

জ্ঞানই কর্মের প্রাণ, জ্ঞানই সকল কর্মের মূল। অর্থাৎ জ্ঞানশূন্য কর্ম অসম্ভব। লেখকের পরামর্শ :

কর্মে বীতরাগ হইও না, কর্ম ও জ্ঞানের সংমিশ্রণ কর, ভক্তির প্রস্রবণ প্রবাহিত হইবে, তাহাতে ত্রিমার্গ এক মার্গে পরিণত হইবে; কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি এক হইবে; মন্ত্র, গুরু ও দেবতা এক হইবে; ক্ষর, অক্ষর, পুরুষোত্তম এক হইবে, কায়া, মন, প্রাণ এক হইবে।

জ্ঞানকে অবলম্বন করে অন্তঃকরণে যে ঘাত-প্রতিঘাত সমুত্থিত হয়, লেখক তাকেও কর্ম বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে সকল উদ্বেলনই কর্ম। এই প্রেক্ষিতে জ্ঞানও কর্ম। আবার বলা হয়েছে জ্ঞানেই কর্মের পরিসমাপ্তি। কারণ সমস্ত কাজ ফলসহ জ্ঞানেতেই পরিসমাপ্ত। জ্ঞানই এ বিশ্বের উপাদান, কর্মসকলও জ্ঞানের বিবর্তন মাত্র, তাই ব্রহ্মান্ডের এ জ্ঞানময় মূর্তি দর্শন হলে আর কর্ম উদ্ভূত হবে না। কর্মের পরিসমাপ্তি ঘটতে বাধ্য।

শুধু কর্ম ও জ্ঞানযোগের মধ্যেই নয়, সঙ্গে সঙ্গে ভক্তিযোগেরও সম্পর্কান্বিত থাকার বিষয়টিও লেখক স্বীকার করে নিয়েছেন। একাদশ অধ্যায়ের ৫৫ সংখ্যক শ্লোকটিকে উপজীব্য করে লেখকের প্রদত্ত বিশ্লেষণ হল :

… কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয় করিয়া বিশ্বরূপ দর্শন যোগের উপসংহার করিতেছেন। শারীর ও মানস, সকল ক্রিয়াতে যে ভগবৎ সংযোগ দেখে, সেযে কোনো ভাবেই হউক, ভগবানে কর্ম সমর্পণ হউক, তাঁহারই শক্তি কর্মাকারে প্রকাশ পাইতেছে, এইভাবে হউক, তাঁহার বিশ্বযজ্ঞে যোগদান করিতেছি, এইভাবে হউক, যে কোনো প্রকারে ভগবৎ-যুক্ত কর্ম করিলেই ভগবৎ কর্মকৃৎ হওয়া হইল। আর ভগবানই শ্রেয়, জীবনে চরম সার্থকতা তাঁহাকে লাভ করা, তাঁহার হইয়া যাওয়া, ভগবানই এ জগতে একমাত্র পরমাশ্রয়, এই জাতীয় জ্ঞানে ধ্রুব সম্বুদ্ধ হওয়াই মৎপরম শব্দের দ্বারা লক্ষ্য করা হইয়াছে। আর ভগবৎ ভক্তি। কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি এই তিন যাহাতে সমুচ্চিত, তাহার সর্বতোভাবে ভগবৎ সঙ্গই . . .।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

শ্রী ১০৮ স্বামী সন্তদাস বাবাজী

শ্রী ১০৮ স্বামী সন্তদাস বাবাজী সম্পাদিত ‘শ্রীমদ্ভগবদ গীতা’ (১৯৯৯)-র বেশ কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে আর এতেই প্রমাণিত হয় গ্রন্থটির জনপ্রিয়তা কতখানি। স্বামী সন্তদাস বাবাজী তাঁর দীর্ঘ উপক্রমণিকায় শ্রীমদভাগবতের ১১ স্কন্ধের ২০শ অধ্যায় থেকে যথাক্রমে ৬, ৭ এবং ৮ম শ্লোকটি উদ্ধার করে প্রতিপন্ন করতে প্রয়াসী হয়েছেন গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বিভিন্ন শ্রেণীর ভক্তের মানসিকতা ও সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষিতে জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ ও ভক্তিযোগ সংক্রান্ত উপদেশ দান করেছেন—

যোগাস্ত্রয়ো ময়া প্রোক্তা নৃণাং শ্রেয়োবিধিৎময়।

জ্ঞানং কর্ম চ ভক্তিশ্চ নোপায়োহন্যো হস্তি কুত্রচিৎ।। ৬

নির্বিণ্ণানাং জ্ঞানযোগো ন্যাসিনামিহ কর্মসু।

তেষ্বনির্বিণ্ণ চিত্তানাং কর্মযোগস্তু কামিনাম।। ৭

যদৃচ্ছয়া মৎকথাদৌ জাতশ্রদ্ধশ্চ যঃ পুমান।

ন নির্বিণ্ণো নাতিসক্তো ভক্তিযোগোএস্য সিদ্ধিদঃ।। ৮

সন্তদাস বাবাজী এই শ্লোকত্রয়ের অর্থ করে বলেছেন :

… লোকসকলের হিতার্থে জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ ও ভক্তিযোগ এই ত্রিবিধ যোগ আমি উপদেশ করিয়াছি। তন্মধ্যে যাহারা অত্যন্ত বিষয়-বৈরাগ্যযুক্ত এবং কর্মসন্ন্যাসী তাহাদের জন্য জ্ঞানযোগই প্রশস্ত, আর যাহারা কর্মে বৈরাগ্যযুক্ত নহে এবং সকাম কর্মে রত, তাহাদের জন্য কর্মযোগ শ্রেয়স্কর, আর যাহাদের সাংসারিক বিষয়ে অতিশয় বিরক্তিও নাই, অতিশয় আসক্তিও নাই এবং আমার সম্বন্ধীয় কথা প্রভৃতিতে যাহাদের স্বভাবত শ্রদ্ধা উপজাত হইয়াছে, তাহাদের পক্ষে ভক্তিযোগই উপযোগী হয়।

অর্থাৎ কিনা কর্মসন্ন্যাসী এবং বিষয়-বৈরাগ্যমুক্তদের জন্য জ্ঞানযোগ প্রশস্ত। কর্মে যারা বৈরাগ্যমুক্ত নয় শুধু তাই নয়, যারা সকাম কর্মে রত তাদের জন্য প্রশস্ত কর্মযোগ আর যাদের সাংসারিক বিষয়ে নির্লিপ্তি, আসক্তি ও অনাসক্তি দুইই অনুপস্থিত তাদের জন্য প্রশস্ত ভক্তিযোগ।

এ পর্যন্ত কোনো বিরোধ নেই, স্ববিরোধিতাও নেই। কিন্তু গীতার অন্যত্র কৃষ্ণ কখনও কর্মযোগকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দিয়েছেন, কখনও বা সেই শিরোপা পেয়েছে জ্ঞানযোগ, আবার কখনও শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপায় ভূষিত হয়েছে ভক্তিযোগ। এভাবেই গীতার ব্যাখ্যাতারাও তিনটি পর্যায়ে বিন্যস্ত হয়ে এক একটি মতবাদকে প্রাধান্য দিয়ে সেটিকেই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দিয়ে বসেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল শ্রেষ্ঠত্ব প্রাপ্তি একের অধিক হতে পারে না। হয় কর্ম, নয় জ্ঞান অথবা ভক্তি এদের একটিকেই শ্রেষ্ঠত্বের বিশেষণে বিশেষিত করা যেতে পারে। কোনমতেই তিনটি শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার হতে পারে না। মধ্যপন্থীরা বিতর্কের অবসান করতে গিয়ে এই তিনটি যোগ বা পথের সমন্বয়ের কথা বলেছেন। আমরা জানি, বৈষ্ণবতত্ত্বে যে পঞ্চরসের কথা বলা হয়েছে তাতে সূচনা শান্ত দিয়ে, তারপর দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য অতিক্রম করে পরিণতি এসেছে মধুরে। কিন্তু এক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য দাস্যে শান্ত রস অন্তর্ভুক্ত, সখ্যে শান্ত ও দাস্যরসদ্বয় অন্তর্ভুক্ত, আবার বাৎসল্য দাস্যের উপরে হলেও দাস্যকে বাদ দিয়ে তার অস্তিত্ব কল্পিত হয় নি। বরং সখ্যে রয়েছে যথাক্রমে শান্ত, দাস্য ও সখ্যরসের উপস্থিতি। শ্রেষ্ঠ মধুররস, কিন্তু তা পূর্বোক্ত চারটি রসের বাইরে নয়। মধুরে পূর্বোক্ত চারটি রসই বিদ্যমান। গীতায় যদি সেইভাবে বলা হত যে, জ্ঞানযোগে কর্মযোগও আসীন কিংবা ভক্তিযোগে কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ দুইই বিদ্যমান তবে সমস্যা থাকত না। অথবা যদি এমন বলা হত যে ভক্তের চিত্তোৎকর্ষ অনুযায়ী কর্মযোগ দিয়ে ভগবত অর্চনার সূচনা তারপর তুলনামূলক ভাবে উচ্চতর স্থানে উপনীত হয়ে জ্ঞানযোগে ঈশ্বরারাধনা, সবশেষে অন্তিম পর্বে ভক্তিযোগে উন্নীত হলেই সিদ্ধি প্রাপ্তি, সেক্ষেত্রেও সমস্যার নিরসন হত সহজেই। কিন্তু সেই সমাধানও গীতায় লভ্য নয়। এখন দেখা যাক সন্তদাস বাবাজী কিরূপে গীতার উপদেশকে দেখেছেন।

কর্মযোগের প্রেক্ষিতটি বিশদে ব্যাখ্যাত হয়েছে। বলা হয়েছে অর্জুন তীব্র বৈরাগ্যযুক্ত। আত্মীয়-পরিজনদের যুদ্ধে নিহত করা অপেক্ষা তিনি যুদ্ধ থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়ঃ জ্ঞান করেছেন। তখন কৃষ্ণ তাঁকে বোঝাতে চেয়েছেন অর্জুনের সিদ্ধান্ত কতখানি বেঠিক। বলেছেন দেহী জীব কখনও বিনাশপ্রাপ্ত হয় না। কেবল দেহেরই বিনাশ ঘটে। দ্বিতীয়ত, কৌরবপক্ষ তারা অপরের বিত্তহারী, তারা অধর্মাচারী। এই অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অন্যায় নয়, পরন্তু ক্ষত্রিয় হিসাবে অর্জুনের কর্তব্য কৌরবদের বিনাশসাধন। যদি অর্জুন সেই কর্তব্যকর্ম পালনে ব্যর্থ হন, তবে তিনি ধর্মসংগ্রাম পরিত্যাগের কারণে পাপজনক কর্মে লিপ্ত হবেন। সর্বোপরি, ফলকামনাযুক্ত কর্মই কেবল বন্ধন হয়ে দেখা দেয়, মুক্তির পথে অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। অনাসক্ত চিত্তে কর্ম সম্পাদন যোগের পর্যায়ে পড়ে। তাতে সংসারবন্ধনের শিকার হতে হয় না। অতএব অর্জুন যেন ফলাসক্তিশূন্য চিত্তে ঈশ্বর-প্রীত্যর্থ তৎপ্রচারিত শাস্ত্রবিহিত কর্ম সম্পাদনে উদ্যোগী হন। এ ত গেল গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের মর্মার্থ।

তৃতীয় অধ্যায়ে কৃষ্ণ অর্জুনের সংশয় নিরসনে প্রয়াসী। বলা হয়েছে :

মোক্ষসাধন বিষয়ে মনুষ্যমধ্যে দুইপ্রকার সাধননিষ্ঠাই বর্তমান আছে। একপ্রকার লোকের সাংখ্যমার্গীয় জ্ঞানযোগে এবং অন্য প্রকৃতির লোকের ভক্তিমার্গীয় কর্মযোগে নিষ্ঠা হয়। উভয়েরই ফল মোক্ষপ্রাপ্তি।

কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের মধ্যে সাধারণ বিষয় বা common factor হল আসক্তিহীনতা। সন্তদাস বাবাজী ব্যাখ্যা করলেন এইভাবে :

কর্মযোগী এবং জ্ঞানযোগী সন্ন্যাসী উভয়কেই কর্মে ও কর্মফলে আসক্তি পরিত্যাগ করতে হয়, আসক্তি পরিত্যাগই সন্ন্যাসেরও সার; অতএব এই বিষয়ে উভয়েই তুল্য।

পরন্তু স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে :

… জ্ঞানী সাধকের পক্ষেও কর্ম সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা অসম্ভব।

কারণ—

ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ। কার্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈগণ্যৈ।। ৩/৫

সন্ন্যাসী মানে তিনি কর্মরহিত নন, তাঁকেও কর্ম সম্পাদন করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। কর্ম- ত্যাগীর পক্ষে জীবনধারণ করাও অসম্ভব। তাছাড়া কর্ম করা আর না করার মধ্যে অবশ্যই কর্ম সম্পাদন শ্রেয়ঃ। সন্ত বাবাজী গীতার শ্লোক উদ্ধার করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন :

সাধক অবস্থায়, জ্ঞানযোগীর ত’ কথাই নাই, জ্ঞানযোগে সিদ্ধ হইয়া জ্ঞানে প্রতিষ্ঠালাভ করিলেও কর্ম একেবারে পরিত্যাগ করা যায় না।

কারণ—

সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যা: প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি।

প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি।। ৩/৩৩

অস্যার্থ—

জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত পুরুষও স্বীয় প্রকৃতির অনুরূপ কার্য করিতে বাধ্য হয়েন, কোন প্রাণীই স্বীয় প্রকৃতিকে লঙ্ঘন করিতে সমর্থ নহে।

চতুর্থ অধ্যায়ে ভগবান বলেছেন :

জ্ঞানের সদৃশ পবিত্রকারী অন্য কিছু সংসারে নাই। জ্ঞানযুক্ত পুরুষ যজ্ঞের উদ্দেশ্যে কর্ম করিয়া থাকেন। পরন্তু যজ্ঞের কর্তা, যজ্ঞার্চিত বস্তু, যাহাতে সেই সকল বস্তু অর্পণ করা যায় সেই অগ্নি এবং আহুতি দানরূপ যজ্ঞকর্ম, এতৎ সমস্তই ব্রহ্ম বলিয়া জ্ঞানী পুরুষ অবগত হয়েন। . . . কেহ বা জ্ঞানযজ্ঞের দ্বারা সমস্ত কর্ম ব্রহ্মে অর্পণ করেন, কেহ বা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা এবং প্রাণসকলের দ্বারা কৃত কর্মসকলকে আত্মাতে অর্পণ করা রূপ যজ্ঞ করেন।

দ্রব্যময় যজ্ঞের তুলনায় জ্ঞানযজ্ঞের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত। তাছাড়া অন্যান্য সকল যজ্ঞরূপ কর্মের ফল জ্ঞানোৎপাদন। জ্ঞানেই সব কর্মের অবসান। কৃষ্ণ পরামর্শ দিয়েছেন, ‘এইরূপ জ্ঞানসম্পন্ন হও, যদ্দারা আমাতে সমস্ত ভূতগ্রামকে এবং সমস্ত ভূতগ্রামে আমাকে দর্শন করতে পার।’

আসলে জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগে গুণগত কোনো পার্থক্য নেই। একটিতে স্থিত হলে অপরটির ফল প্রাপ্তিতে কোনো বাধা ঘটে না। যিনি নিষ্কাম হয়ে কর্ম করেন, যিনি বিদ্বেষমুক্ত, যাঁর অহংবোধ দূর হয়েছে তিনিও তো সন্ন্যাসীই। সন্ন্যাসের সার ফলপ্রাপ্তির ইচ্ছাত্যাগ, একথা বিস্মৃত হলে চলবে না।

কর্মযোগের সঙ্গে যেমন জ্ঞানযোগের সম্পর্ক সন্তদাস বাবাজী আলোচনা করেছেন এবং একটিকে অপরটির পরিপূরক বলে মনে করেছেন, ভক্তিযোগ সম্পর্কে কিন্তু তেমন আলোচনা তিনি করেন নি। কর্ম, জ্ঞান এদের সঙ্গে ভক্তির সম্পর্কও স্থাপিত হয় নি। অর্থাৎ গীতার সমন্বয়বাদী ভূমিকা সম্পর্কে সন্তদাস বাবাজী নীরব থেকেছেন।

সন্তদাস বাবাজীর মতে, অনন্যা ভক্তির দ্বারাই জীব ঈশ্বরকে লাভ করতে সক্ষম। সমস্ত কর্ম তাঁতেই অর্পণ করে, ভক্তিপূর্বক তাঁর উপাসনায় রত থাকলেই মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে। এমনকী কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের তুলনায় ভক্তিযোগের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়েও তাঁকে কোনো মন্তব্য করতে দেখা যায়নি।

গীতোপনিষদ

প্রভুপাদ ভক্তিবেদান্ত স্বামী

ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ যে ‘গীতোপনিষদ’ বা শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ রচনা করেছিলেন, ভক্তিচারু স্বামী তারই বঙ্গানুবাদ করেন। ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির অষ্টম সংস্করণে (২০০৬) ধৃত কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের ব্যাখ্যার পরিচয় আমরা গ্রহণ করব।

কর্মযোগের (৩য় অধ্যায়) তৃতীয় শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বললেন—

লোকোস্মিন দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানম।

জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্মযোগেন যোগিনাম।। ৩।।

কৃষ্ণ ইতিপূর্বে দুইপ্রকার নিষ্ঠার কথা বলেছেন—জ্ঞানযোগ সঞ্জাত নিষ্ঠা এবং ভক্তিযোগ সঞ্জাত নিষ্ঠা। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩৯তম শ্লোকেও বলা হয়েছে—

এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধিযো গে ত্বিমাং শৃণু।

বুদ্ধ্যা যুক্তো যয়া পার্থ কর্মবন্ধং প্রহাস্যসি।। ৩৯।।

এখানে কৃষ্ণ বলছেন তিনি সাংখ্যযোগের কথা বলেছেন, এখন তিনি ভক্তিযোগের কথা বলবেন যার দ্বারা অর্জুন কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি পেতে পারে।

সাংখ্যযোগ বলতে চেতন ও জড় প্রকৃতির বিশ্লেষণ। যারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দার্শনিক তত্ত্বের সহায়তায় জ্ঞান আহরণে উৎসাহী তাদের বিষয়কেই বলা হয় সাংখ্যযোগ। ৬১ সংখ্যক শ্লোকে ভক্তিযোগের প্রাধান্য—

তানি সর্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীৎ মৎপরঃ।

বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।। ৬১/২য় অধ্যায়

ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে কৃষ্ণের প্রতি ভক্তিপরায়ণ হয়ে তাঁর প্রতি সম্পূর্ণরূপে বশীভূত যিনি কৃষ্ণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। এখানে ব্যঞ্জনা দেওয়া হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করাই হচ্ছে বুদ্ধিযোগ কেননা তাতে দুর্দমনীয় ইন্দ্রিয়গুলি সংযত থাকে। মোটের ওপর সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগ বা বুদ্ধিযোগ আপাতভাবে দুটি পৃথক পন্থা বলে মনে হলেও একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এবারে আসা যাক কর্তব্যকর্ম বিষয়ে। কর্তব্যকর্ম না করে কেউই ক্ষণকালও তিষ্ঠতে পারে না—

ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ।

এর জন্য দায়ী জড়া প্রকৃতি।

সংসারে অনেক মিথ্যাচারী আছে। পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়কে সংযত করেও মনে মনে এরা শব্দ, রস আদি ইন্দ্রিয় বিষয়গুলি স্মরণ করে নিজেদের বিভ্রান্ত করে। প্রয়োজনে একদিকে মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করা— ‘যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতে হর্জুন’। অন্যদিকে আসক্তিরহিত হতে হবে—কর্মেন্দ্রিয়ৈ: কর্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে।। ৭ এখানে একটি সংশয়ের নিরসন ঘটানো উচিত—কোনটি ভাল—কর্ম না কর্মত্যাগ? গীতায় স্পষ্ট নির্দেশ প্রদত্ত হয়েছে—

নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ।

কর্মত্যাগের তুলনায় কর্মের অনুষ্ঠান শ্রেয়ঃ। কিন্তু কর্ম যে বন্ধনের কারণ! গীতায় সেবিষয়েও পথনির্দেশ করা হয়েছে—

যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোন্যত্র লোকোয়ং কর্মবন্ধনঃ।

যজ্ঞ বা বিষ্ণুর জন্যই কেবল কর্ম, অন্যথায় কর্ম বন্ধন হয়ে দেখা দেয়। ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে ‘পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাদের যে নিত্য সম্পর্ক রয়েছে, সেই সম্পর্কের কথা ভুলে যাবার ফলেই জীবসকল এই জড়া প্রকৃতিতে পতিত হয়ে জড় বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

যজ্ঞ সম্পাদনের সঙ্গেও ত’ প্রাপ্তির প্রসঙ্গ যুক্ত। যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে লাভ হয় ধন, ঐশ্বর্য, সন্তান ইত্যাদি। কিন্তু বিস্মৃত হলে চলবে না, ‘এই লাভগুলি যজ্ঞের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। যজ্ঞের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া। যজ্ঞপতি বিষ্ণু যখন প্রীত হন, তখন তিনি জীবকে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত করেন।’

আমরা কর্ম করব কেন? কর্ম সম্পাদন করব একটি মাত্র উদ্দেশ্যে, আর তা হল শ্রীকৃষ্ণের তুষ্টি সাধন। কর্ম করতে হবে বেদের নির্দেশানুযায়ী—

বেদের নির্দেশ অনুসারে সমস্ত কর্ম করাটাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ, তাতে কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত থাকা যায়।

সমস্ত বেদই দেবতা থেকে উদ্ভুত, ভগবানের নি:শ্বাস থেকে সৃষ্ট। ১৯ নং শ্লোকে ঘোষিত হয়েছে—

তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।

অসক্তো হ্যাচরণ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ।। ১৯

এখানে কর্মফলের প্রতি আসক্তিরহিত হয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদনের পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে। বলা হল, অনাসক্ত হয়ে কর্ম সম্পাদন করেই মানুষ লাভ করে পরতত্ত্বকে।

জনক রাজার দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। এঁরা কর্ম দ্বারাই সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছেন। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের আচরণ অনুসরণের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে, এমনকি কৃষ্ণ স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেন নি ত্রিজগতে তাঁর কিছু কর্তব্য নেই, অপ্রাপ্তিও কিছু নেই, প্রাপ্তব্যও কিছু নেই, তবু তিনি কর্মে ব্যাপৃত—

ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।

নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি।। ৩/২২

‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত ঐশ্বর্যের অধীশ্বর এবং তিনিই হচ্ছেন পরমতত্ত্ব, তাই তাঁর কোনো কর্তব্য নেই। কর্মের ফল যাদের ভোগ করতে হয়, তাদের জন্যই কর্তব্যকর্ম করার নির্দেশ দেওয়া আছে। কিন্তু এই ত্রিভুবনে যাঁর কিছুই কাম্য নেই, তাঁর কোন কর্তব্যকর্মও নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভগবান কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করেছেন, কেননা দুর্বলদের রক্ষা করা ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য।’ অর্থাৎ শাস্ত্রের বিধিনিষেধের অতীত হয়েও তিনি শাস্ত্রের নির্দেশ লঙ্ঘন করেন নি।

জ্ঞানী ও অজ্ঞানীর কর্ম সম্পাদন কখনই একরূপ হতে পারে না। অজ্ঞানরা আসক্ত হয়ে কর্ম করে— সক্তা: কর্মণ্য বিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত। কিন্তু জ্ঞানীরা কর্ম করেন অনাসক্ত চিত্তে—

কুর্যাদবিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লাকসংগ্রহম।। ২৫

তাঁদের উদ্দেশ্য হবে লোকসাধারণকে সঠিক পথে পরিচালিত করা, এজন্যই তাদের কর্ম সম্পাদন। মোহাচ্ছন্ন জীব ভাবে সকল কার্য যা নাকি তার দ্বারা সম্পাদিত হয় সেই কর্তা (doer)। মোহাচ্ছন্ন ব্যক্তি বিস্মৃত হন কৃষ্ণের সঙ্গে তার নিত্য সম্পর্কের কথা। কৃষ্ণ অর্জুনকে পরামর্শ দিলেন অধ্যাত্মচেতনা সম্পন্ন হয়ে তিনি যেন সমস্ত কর্ম তাঁকেই সমর্পণ করেন। তিনি যেন যুদ্ধ করেন মমতাশূন্য, নিষ্কাম এবং মোহশূন্য হয়ে। কর্মবন্ধন থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করে বলা হয়েছে—

যে সেমতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবা:।

শ্রদ্ধাবন্তোহনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেএপি কর্মভি:।। ৩/৩১

দেবতার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে কর্তব্যকর্মের অনুষ্ঠান করতে হবে এবং শ্রদ্ধাবান ও মাৎসর্যশূন্য হতে হবে তবেই কর্মবন্ধন মুক্তি ঘটবে।

জীবাত্মা আচ্ছন্ন থাকে কামের দ্বারা। যেমনটি দর্পণ আবৃত থাকে ময়লার দ্বারা। তাই সর্বাগ্রে কামপ্রবৃত্তিকে দমন করতে হবে। আশ্রয় নিতে হবে সদগুরুর, অনুশীলন করতে হবে কৃষ্ণভাবনার। ভক্তি বেদান্ত স্বামী চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ইন্দ্রিয় আদির কার্যকলাপের কেন্দ্র হল মন, তারপরে আসে বুদ্ধির প্রসঙ্গ :

ইন্দ্রিয় আদির সমস্ত কার্যকলাপের কেন্দ্র হচ্ছে মন, তাই মন হচ্ছে সমস্ত ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার বাসনার কেন্দ্রস্থল। . . . . বুদ্ধি হচ্ছে আত্মার সব চাইতে অন্তরঙ্গ প্রতিবেশী। এই বুদ্ধি যখন কামের দ্বারা উন্মত্ত হয়ে ওঠে, তখন সেআত্মাতে অহংকারের সঞ্চার করে, যার ফলে আত্মা জড় ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে জড়ের মাঝে তার স্বরূপ অন্বেষণ করে। জড় ইন্দ্রিয়সুখকেই প্রকৃত সুখ বলে মনে করে, আত্মা তখন তা উপভোগ করতে মত্ত হয়ে ওঠে।

শেষ পর্যন্ত গীতায় আত্মার জয়গান করা হয়েছে—

ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।

মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধে: পরতস্তু সঃ।। ৩/৪২

স্থূল জড় পদার্থ থেকে ইন্দ্রিয়াদি শ্রেয়ঃ, ইন্দ্রিয় থেকে শ্রেয়ঃ মন, মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়ঃ আর আত্মা সেই বুদ্ধির তুলনায় শ্রেয়ঃ।

এ পর্যন্ত যে আলোচনা করা হল তাতেই কি জ্ঞানযোগ অনুপস্থিত? জ্ঞান ব্যতিরেকে কি সঠিক কর্ম সম্পাদন সম্ভব?

যাই হোক, এবারে আমরা ‘জ্ঞানযোগ’ সম্পর্কে ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের ব্যাখ্যা অনুধাবন করব। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ্য ভগবদগীতা তাঁর মতে ‘পরম বিজ্ঞান’। লেখক গীতার ভক্তিপ্রণত চিত্তের ব্যাখ্যাকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানালেও ভক্তিবিমুক্ত চিত্তের ব্যক্তিকে ‘অসুর’ আখ্যায় আখ্যায়িত করেছেন এবং এদের বক্তব্যে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। ভক্তিবেদান্ত স্বামী জ্ঞানযোগের ব্যাখ্যাতেও ভক্তিযোগের দ্বারাই চালিত হয়েছেন দেখা যায়। তাঁর মতে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান। তিনিই সব কিছুর উৎস, পরমতত্ত্বের শেষ কথা। জীবের দেহান্তর ঘটে কিন্তু ভগবান যেহেতু সচ্চিদানন্দময়, তাই তাঁর দেহ অপরিবর্তনীয়। তিনি অদ্বৈত, তাঁর দেহ এবং তিনি স্বয়ং অভিন্ন। ভগবান আবির্ভূত তাঁর চিন্ময় স্বরূপে। তিনিই অতীত, তিনিই বর্তমান, আবার তিনিই ভবিষ্যতের সর্বকালীন আদিপুরুষ, সর্বপ্রাচীন পুরুষও তিনি। ভগবান সবসময় পরমতত্ত্ব। তিনি সমস্ত জীবের ঈশ্বর।

ভক্তিবেদান্ত স্বামীর মতে, যিনি ভগবানের অবতরণের তত্ত্ব উপলব্ধি করেছেন, জড়জগতের বন্ধন থেকে তিনি মুক্ত হয়েছেন ইতিমধ্যেই। দেহত্যাগের পর তিনি প্রত্যাবর্তন করেন ভগবৎধামে।

সদগুরুর অধীনে ভগবদ্ভক্তি অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ জড় বন্ধন থেকে, আসক্তি থেকে মুক্তিলাভ করে, আত্ম-উপলব্ধির পথে অবাধ গতি লাভ করে। অপ্রাকৃত জগতে ভগবান তাঁর শুদ্ধ ভক্তের ভাবনা অনুযায়ী তাঁদের সঙ্গে লিপ্ত হন ভাব-বিনিময়ে। ভজনার কোনো পথটিই পরিত্যাজ্য নয়। শ্রীকৃষ্ণ একাই পরমেশ্বর। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। অন্যান্য দেবদেবীরা এই জড়জগতের বিভিন্ন শক্তিসম্পন্ন, কেউই ভগবানের সমকক্ষ নন। বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার্চনায় লাভ হয় যা তা অনিত্য, একমাত্র নিত্য লাভ ঘটে ভগবানের সেবা আরাধনায়। প্রভুপাদ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন জড়জগতের স্রষ্টা হলেও ভগবান জড়জগতের কোনো কর্মের দ্বারাই আবদ্ধ নন। তাঁর উপদেশ হল কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভগবানের সেবা।

প্রকৃত জ্ঞানী কে? তিনিই যিনি ইন্দ্রিয়তৃপ্তি বিষয়ক বাসনা থেকে মুক্ত, নিষ্কাম। ভগবানের নিত্য দাসত্বের পরম-তত্ত্ব জ্ঞান যাঁর আয়ত্তে। বিস্মৃত হলে চলবে না যে আমরা ভগবদ্ভক্তির দ্বারা জড় চেতনাকে পরমতত্ত্বে রূপান্তরিত করতে পারি। আত্মসমর্পনও সেবার দ্বারাই পরমতত্ত্ব করায়ত্ত করা সম্ভব। জীব ভগবানের নিত্যকালের সেবক। পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়া আছে, তার মধ্যে ভক্তিযোগই শ্রেষ্ঠ। ভগবানের সান্নিধ্য লাভের প্রয়াসী হলে অবধারিতভাবে ভক্তিযোগের পন্থাই অবলম্বন করা আবশ্যক। শুদ্ধ ভক্ত সদা সর্বদা ভগবানের সেবায় নিযুক্ত। দ্বাদশ অধ্যায়ে জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের মধ্যেকার পার্থক্যটি প্রকাশিত—

ক্লেশোএধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম।

অব্যক্তা হি গতির্দু:খং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে।। ৫

ভগবানের অচিন্ত্য, অব্যক্ত ও নির্বিশেষ তত্ত্ব জানতে আগ্রহী হলেন জ্ঞানযোগী, এঁদের যে পথ অবলম্বন করে নির্বিশেষ তত্ত্ব জানার প্রয়াস তাই হল জ্ঞানযোগ। অপরদিকে যাঁরা কৃষ্ণ ভাবনাময় ভক্তিযুক্ত চিত্তে ভগবানের সেবারত, তাঁরা ভক্তিযোগী, এঁদের অবলম্বিত পথই হল ভক্তিযোগ। দুটি পন্থারই গন্তব্য এক কিন্তু পথ দুটি পৃথক। জ্ঞানযোগ ক্লেশসাধ্য, কিন্তু ভক্তিযোগ সহজ, বিশেষত দেহধারী জীবের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মধ্যেই তা পড়ে।১০

লেখক ভক্তিযোগ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন :

. . . . কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত যে মানুষ সদগুরুর দ্বারা পরিচালিত হয়ে ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করেছেন, তিনি কেবলমাত্র ভক্তিভরে ভগবানের শ্রীবিগ্রহকে প্রণাম করে, ভগবানের লীলা শ্রবণ করে এবং ভগবানকে নিবেদিত প্রসাদ গ্রহণ করে অনায়াসে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধি করতে পারেন।১১

আত্মনিবেদনের পন্থাই হল ভক্তি।

ভক্তির প্রভাবে উপলব্ধি হয় ভগবান মহান, প্রতিটি স্বতন্ত্র জীবাত্মাই হচ্ছে তাঁর অধীন। কৃষ্ণের পাদপদ্মে আশ্রয় লাভের জন্য মনকে সর্বতোভাবে কৃষ্ণে সমর্পিতপ্রাণ হতে হবে।১২ বলা হয়েছে—

শ্রেয়ো হি জ্ঞানমভ্যাসাজজ্ঞানাদ্ধ্যানং বিশিষ্যতে।

ধ্যানাৎ কর্মফলত্যাগস্ত্যাগাচ্ছান্তির নন্তরম।। ১২

ভক্তিযোগে সক্ষম না হলে পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে জ্ঞানের অনুশীলন করার। লেখক ভক্তির প্রকারভেদ নিয়েও আলোচনা করেছেন। ভক্তি দ্বিবিধ—বৈধী ভক্তি এবং প্রেম ভক্তি। বলা হয়েছে :

যাঁরা ভক্তিযোগের বিধি নিয়মগুলি আচরণ করতে অসমর্থ, তাঁদের পক্ষে জ্ঞানের অনুশীলন করাই শ্রেয়, কারণ জ্ঞানের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হতে পারেন। জ্ঞানের প্রভাবেই তাঁরা ধীরে ধীরে ধ্যানের স্তরে উন্নীত হতে পারেন এবং ধ্যানের প্রভাবে ধীরে ধীরে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে জানতে পারেন।১৩

লেখক ভক্তিযোগকে শ্রেষ্ঠতম স্তর বলে মনে করেন :

. . . . কর্মফল ত্যাগ করার ফলে জ্ঞানের স্তরে উন্নীত হওয়া যায়, তারপরে ধ্যানের স্তরে, তারপরে পরমাত্মা উপলব্ধির স্তরে। এবং সবশেষে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধির স্তরে।১৪

ভক্তিযোগের জয়গানে মুখর লেখক এরপরও বললেন :

ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করাটাই হচ্ছে পারমার্থিক উপলব্ধির সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা। . . . . আত্মা উপলব্ধির জন্য, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় লাভের জন্য ভক্তিযোগই যে পরম পন্থা, সেসম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই।১৫

দি এসেন্স অফ দি ভাগবদগীতা

স্বামী ক্রিয়ানন্দ

The Essence of the Bhagavad Gita’-র রচয়িতা স্বামী ক্রিয়ানন্দ। প্রকাশকাল ২০০৬। ক্রিয়ানন্দ গীতার সারমর্ম সম্পর্কে বলেছেন তাঁর গুরু পরমহংস যোগানন্দের ব্যাখ্যার অনুসরণে। মোট ১৮টি অধ্যায়ে গ্রন্থটি বিন্যস্ত।

লেখক কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ভিন্নতর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাঁর মতে এ যুদ্ধ আসলে রূপক। কী রকম? অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে আত্মার সাফল্যের সোপানে উত্তরণ, The war is not one of mortal, physical combat, but of courageous inner struggle towards the victory of soul principles over spiritual sloth and material ease.’ আরও স্পষ্ট করে লেখক বললেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হল মায়ার প্রভাব থেকে আত্মার মুক্ত হবার সংগ্রাম।

The war of Kurukshetra describes the soul’s final struggle to become liberated from the clutches of maya or delusion.

লেখক বিশ্বাস করেন, ঈশ্বরে উপনীত হবার কোনো প্রয়াসই ব্যর্থ হবার নয়, তাই বলে ঈশ্বরের সেবার্থে যা কিছু করা হয় তা যে অভ্রান্ত তাও নয় :

No effort on the path to God is ever wasted. This is not to say that there cannot be wrong practices in the service to God.

লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যখনই পার্থিব সুখস্বাচ্ছন্দ্যের সংস্পর্শে আসব, তখনই মনে রাখতে হবে এর তুলনায় অনেক বেশি আনন্দের কথা :

Let every worldly happiness remind you of the much greater happiness of the self.

লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন যে কর্মযোগ আসলে ধর্মযোগ, আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকর্মাদির সঙ্গেই কর্মযোগের সম্পর্ক এরই মাধ্যমে ঈশ্বরোপলব্ধি সম্ভব :

Karma Yoga, the path of spiritual action, deals with all action, and with the way to direct action towards the realization of God ….. the goal of Karma Yoga is not to please God; it is, in a true sense to please one’s self; That is to say, it is to find bliss is one’s own, divine Self.

কর্মযোগ ঈশ্বর-সন্তুষ্টির মাধ্যম নয়, আত্মসন্তুষ্টির মাধ্যম। কোন কাজ আধ্যাত্মিক, স্বভাবতই এ প্রশ্ন উঠবে, নিশ্চয়ই সব কাজ আধ্যাত্মিক নয়। লেখক উত্তর দিলেন :

that action is spiritual which minimizes one’s emphasis on the ego and on everything that feeds ego consciousness; desires attachments and every warrior in the whole army of the Kauravas.

ঈশ্বর সকল রূপের ঊর্ধ্বে, তিনি নিরাকার। একই সঙ্গে তিনি পৃথিবীতে নানা রূপ পরিগ্রহ করেন, কারণ :

He is impersonal in that He wants nothing for Himself, but in each of us He has become personal by encasing His consciousness in our forms.

লেখক আত্মসচেতনতা বিসর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু সেই আত্মসচেতনতার বিসর্জন কার কাছে? Cosmic consciousness-এর কাছে :

This method of offering ego-consciousness upto cosmic expansion comes down to the question, finally, “who am I?” “Who is this that is eating?” “Who walks when my body walks?” “Who, really, is breathing?” “Who thinks?” “Who is reaching with positive or negative feelings?”

এই হল জ্ঞানযোগের নিশানা।

যা কিছু মন্দ দেবতা তার ধ্বংস করেন, এই প্রচলিত ধারণার বিরোধিতা করেছেন লেখক। মন্দকারীকে নয়, তিনি ধ্বংস করেন মন্দকে। তাঁরই সৃষ্টি যা তাকে তিনি ধ্বংস করবেন কেমন করে? He cannot destroy Himself—is evil itself, but never the evil doer.

নিম্নস্তরের প্রয়াসকে লেখক গুরুত্ব দিয়েছেন :

Lower aims are achieved more quickly and easily than supreme devotion to God.১০

গৃহলাভে প্রত্যাশী ব্যক্তি কখনও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে বসে থাকে না, বাস্তবতার দাবীতে এজন্য যোগাযোগ করতে হয় গৃহনির্মাতার সঙ্গে, লেখক একে এক অর্থে নিম্নশ্রেণীর দেবতা বলে অভিহিত করেছেন।

জ্ঞানযোগের সহায়তায় আমরা জানতে পারি কোন কাজটি যথার্থ, কোনটিই বা অযথার্থ। যথার্থ কাজ হল সেই কাজ যা আত্মার মুক্তির সহায়ক, বিপরীতটাই মন্দ কাজ যা অহংবোধকে বৃদ্ধি করে :

Right action, spiritually speaking, is action with that attitude which leads to soul freedom. That attitude includes non-attachment to the fruits of action and acting with the consciousness that God is acting through one. Action that is inspired by His consciousness and energy, with the results given to Him without any ego involvement, a right action…. Wrong action is anything that nourishes the ego whether by contracting it in selfishness or by inflating it with pride.১১

সবশেষে আসি ভক্তিযোগ প্রসঙ্গে। ঈশ্বরাভিমুখী পথ তিনটি—ধ্যান বা ক্রিয়াযোগ, দ্বিতীয় হল সাংখ্যযোগ বা জ্ঞান যোগ, তৃতীয় হল কর্ম যোগ। তাহলে ভক্তিযোগের কোনো গুরুত্ব নেই ? লেখক বলেছেন, ভক্তি ব্যতিরেকে কোনো পথই ক্রিয়াশীল নয়। গীতায় কৃষ্ণ বারংবার ভক্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, সত্যের জন্য অন্তর্দ্বন্দ্ব হল সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যিনি যাই করুন না কেন ভক্তি-নির্ভর হতেই হবে :

whether meditating, discriminating, or acting, a devotional attidude must underline everything one does. Devotion is the bowstring that shots the arrow to its mark. Without it all spiritual effort is merely gathering good Karmas. It cannot bestow liberation.

দি ভগবদগীতা—ডকট্রিন অ্যান্ড কনটেক্সটসঅ্যাঞ্জেলিকা ম্যালিনার

Cambridge University Press থেকে প্রকাশিত Angelika Malinar-এর ‘The Bhagavadgita’-Doctrine and Contexts-এর প্রকাশকাল ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ।

ভাগবদগীতা নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, অনুবাদ ইত্যাদি হওয়া সত্ত্বেও লেখক কেন এই গ্রন্থ সম্পর্কিত আলোচনায় অনুপ্রবিষ্ট হলেন ভূমিকাতেই তার ব্যাখ্যা মেলে।

‘Some aspects and questions still need to be addressed.— কী কী তা—

ক. How are we to understand the text having been handed down as part of the Mahabharata (MBH) epic?

খ. What are the threads which connect the different ideas and levels of arguments that build up the text, and how were they twisted and woven in order to put forward philosophical and theological framework of meaning?

গ. What are the characteristic features of the theology of the BhG that explain its influence and paradigmatic role in subsequent Hindu traditions?

ঘ. Can we adduce evidence to connect the BhG to specific cultural historical contexts?

মূলতঃ লেখক এই প্রশ্নগুলিরই সমাধান খুঁজেছেন তাঁর আলোচনায়। আর এজন্য তিনি গীতার প্রতিটি অধ্যায়ের বিশ্লেষণ করেছেন, মহাভারতের সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে গীতায় ব্যক্ত তত্ত্বগুলিকে যুক্ত করে নিয়েছেন।

আমরা সেই বিস্তারিত আলোচনার প্রসঙ্গে যাব না, আমাদের লক্ষ্য লেখক কোন দৃষ্টিতে গীতার কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগকে দেখেছেন?

লেখকের মতে কর্মযোগ হল :

Self-control through action that allows one to act without experiencing any consequences.

কর্মের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ হল মূল কথা এবং যে সেকর্ম নয় সেই কর্ম যা থেকে ফলের কোনো আশা থাকবে না। লেখক এখানে ‘কর্মণ্য বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’কে অনুসরণ করেছেন। লেখকের মতে গীতায় সাংখ্যে কথিত কর্মের অর্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, ‘Sankhyistic meaning of Karman remains the basis . . . . of the BhG.’

গীতায় সাংখ্যদর্শনকে প্রতিফলিত দেখা গেছে। লেখকের মতে :

Prakriti concept of Sankhya Philosophy is used to explain why ‘doing nothing’ is an illusion.

কর্মহীনতা অবাস্তব, কর্মহীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই কারণ :

Prakriti is the cause of the visible world and activity is one of its ontological characteristics, every individual being is driven by activity, since it is a product of prakriti . . . .’

অতএব, ‘no one lives even for one moment without some act, for the three forces of nature cause every one to act, willy-nilly’

কাজ বলতে উদ্দেশ্যমূলক কর্মকে আমরা বুঝে থাকি। যদি তাই হয়, তবে মানুষ কেন কর্মহীন থাকতে পারবে না? সাংখ্য এর উত্তরে জানিয়েছে :

Thinking, feeling, eating etc., also count as Karman and have consequences, and it is not easy to rid oneself of this aspect of Karman, since the ever-active senses and cognitive faculties are difficult to control.

গীতায় যে কর্মের কথা পাই তা হল,—‘acting without attachment’। কর্মই বন্ধনের কারণ। কিন্তু নিষ্কাম কর্মবন্ধনের কারণ হয় না :

. . . only actions for the sake of sacrifice do not produce Karmic results (3.9); This world is bound by acts, except the act for the sake of sacrifice (yaj narthan). For this purpose, you must perform actions . . . (being) free from attachment.

কৃষ্ণ জানিয়েছেন, নি:শ্রেয়সে সন্ন্যাস এবং কর্মযোগ উভয়ের দ্বারাই উপনীত হওয়া সম্ভব। কিন্তু কর্মসন্ন্যাসের তুলনায় কর্মযোগ উৎকৃষ্টতর। লেখকও কর্মযোগের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল।

‘the identity of both views does not prevent from me preferring Karma Yoga.’

এবারে জ্ঞানযোগের প্রসঙ্গ। লেখক বলেছেন liberating knowledge-এর কথা। যে জ্ঞান মানুষকে physical existence-এর সীমাবদ্ধতাগুলি ধরিয়ে দেয়, যা নাকি ‘অধ্যাত্মজ্ঞান নিত্যাভ’, জ্ঞেয়কে জানতে সহায়তা করে, যা যা জানলে মানুষ অমরতার অধিকারী হয়, কৃষ্ণের ভাষায় :

‘I will now tell you, what must be known; who knows this will reach mortality’. এ হল সূচনাহীন সর্বোত্তম ব্রাহ্মণ যা নাকি বিদ্যমানও নয় আবার অবিদ্যমানও নয়, ‘neither existing nor not existing.

কর্মে বাঁধা পড়ার সম্ভাবনা, তাই কেউ কেউ বলেছেন উদ্দেশ্যহীন কর্ম সম্পাদনের কথা। কিন্তু এই ‘উদ্দেশ্যহীন কর্মের’ও (disinterested action) একটি উদ্দেশ্য থাকা বাঞ্ছনীয়। লেখকের ভাষায় :

it must be directed at something and thus connected to a referential framework of meaning that allows discriminations, the application of correct knowledge.

ভক্তিযোগ : কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন :

The one who worships me with the imperturbable Yogic practice of devotion (ভক্তিযোগেন) passes beyond these powers of nature and is ready to become brahmans. For I am the foundation of the immortal, unchanging brahman, of eternal dharma and unsurpassable happiness.

অতএব ভক্তিযোগের একাধিক গুণ। লেখকের মতে :

Yoga based on bhakti not only yields rewards similar to those of other forms of Yoga, but also leads to knowing Krishna as the beginning of that very brahman that other regard and strive for as without beginning.

তাই ভক্তিযোগে শুধু যে ব্রহ্মণে উপনীত হওয়া সম্ভব তাই নয়, তদপেক্ষা উচ্চতর পর্যায়ে কৃষ্ণে উপনীত হওয়া সম্ভব, যে কৃষ্ণ ব্রহ্মণের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠাতা শাশ্বত ধর্মের (eternal dharma)। সর্বোপরি অতুলনীয় সুখসাগরে পৌঁছনো ত আছেই।

বর্তমান লেখক কিন্তু ভক্তিযোগের ওপরেই তাঁর সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। এমনকি তিনি গীতার সমন্বয়- বাদেরও সমর্থক নন। কারণ :

This is rather a hierarchisation than a synthesis, because the other paths have different goals and therefore cannot be recommended as equally valuable.১০

অবশ্য তিনি কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগকে বাতিলও করেন নি, যদিও এই দুই পথের পথিকের লক্ষে উপনীত হতে দীর্ঘ সময় ব্যয়িত হবার সম্ভাবনা—Yet there is no need to reject them as ‘Wrong’, because they, too, help one ultimately to reach the gods, even if it takes longer.১১

সবশেষে ভক্তিযোগের পক্ষে লেখকের সমর্থনজ্ঞাপক যুক্তির পরিচয় গ্রহণ করা যেতে পারে :

the experience of liberation is modified in being directed towards a God who is both the cause of the cosmos and the highest, ever-liberated self, and who thus represents the ideal attitude towards physical existence; detachment from and therefore supremacy over the powers of nature (guna). The God not only is the ultimate goal, but also serves as a point of orientation and model of successful practice for those who practice Yoga through and with bhakti.১২

তাঁর আরও মূল্যায়ন :

In BhG 14, this type of Yoga is regarded as Yielding better results than other forms.১৩

দি উইজডম অফ দি গীতা

জে. এম. মেহেতা

J. M. Mehta’-র ‘The wisdom of the Gita’-র প্রকাশকাল ২০০৭। গ্রন্থে লেখক গীতার শ্লোক ধরে ধরে অনুবাদ করেন নি, নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয় নির্বাচন করে নিয়ে গীতার আলোকে সেগুলিকে ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন জীবনের রহস্য (The Mystery of Life), জীবনের লক্ষ্য (The goal of Life), বিপদে সাহসিকতা (Courage in Crisis), মৃত্যুভয় নয়, দুঃখ নয় (Do not fear death, Do not Grieve), সুখ এবং দুঃখ (Pleasure and pain), গীতায় যোগ (Yoga as defined in the Gita), কর্মযোগ (Path of Action), জ্ঞানযোগ (Path of Knowledge), ভক্তিযোগ (Path of Devotion), (Synthesis of Yoga) গীতার সমন্বয় বাদ ইত্যাদি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই লেখক বিষয় সম্পৃক্ত গীতার সারাৎসার ব্যক্ত করেছেন। কর্মযোগ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, সব কাজ করতে হবে ইন্দ্রিয়াসক্তি থেকে মুক্ত হয়ে। কর্মের সঙ্গে যেন আসক্তি যুক্ত না হয়, সব কর্মই সম্পাদিত হবে দেবতার উদ্দেশে, দায়বদ্ধতা থেকে, কোনো ক্ষেত্রেই কর্মের ব্যাপারে মানুষ নিজ কৃতিত্ব দাবী করবে না, বাসনাতড়িত হয়ে কর্মসম্পাদন নিষিদ্ধ। ঈশ্বরভাবনায় নিমজ্জিত থেকে সবকিছু করতে হবে। কর্ম ও জ্ঞান একত্রে থাকা চাই। জ্ঞান ব্যতিরেকে কর্ম হল অন্ধ আবার কর্ম ব্যতিরেকে জ্ঞান খঞ্জের তুল্য। কর্ম সম্পাদনে কোনো ফলের প্রতি আসক্তি থাকা চলবে না। পরিণতির কথা ভাবা চলবে না। কর্তব্য-কর্ম সম্পাদনে মানসিক প্রফুল্লতা বজায় থাকা চাই। কর্ম সম্পাদনে ব্যক্তিকে নিজের দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এর ওপর নির্ভর করেই কর্মবিশেষ নির্ধারিত হওয়া চাই।

জ্ঞানযোগের আলোচনায় লেখকের বক্তব্য :

The path of Knowledge or Gyan Yoga is the intellectual path to perfection. Spiritual vision is necessary for knowing the reality of the ‘Ultimate Truth’.

সকল বাসনার মূল হল অজ্ঞতা, অজ্ঞতাই মানুষের জীবনের বন্ধনের কারণ। যে পর্যন্ত অজ্ঞতার শিকার থাকবে মানুষ, সেপর্যন্ত তার পক্ষে আত্মার মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। তাই অজ্ঞতা দূর করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। জ্ঞানই হল অজ্ঞতা দূরীকরণের একমাত্র চাবিকাঠি। জ্ঞানের মাধ্যমেই মানুষ স্বর্গীয় অভিজ্ঞতার অধিকারী হয়। তাই মানুষকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এবং সর্ববিধ আত্মকেন্দ্রিক বাসনা থেকে মুক্ত হতে হবে। গীতা ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞানের অধিকারী হতে সহায়তা করে। জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ ব্যক্তির স্বরূপ ও তার দেহের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারে। সুখ ও দুঃখের কারণও জানা যায় জ্ঞানের সাহায্যে। আত্মার অবিনশ্বরতার জ্ঞান-লাভ ঘটে, অস্তিত্বের অর্থ উপলব্ধি হয়। The way of knowledge lies, through unflinching faith, constant devotion and worship.

ঈশ্বরলাভের পথ হল ভক্তি। ভক্তি কখনই কর্মবিমুক্ত নয়, তবে আসক্তিশূন্য হয়ে কর্ম সম্পাদন করতে হবে। ঈশ্বরের উদ্দেশে ভক্তিকে নিবেদন করতে হবে। সকলের প্রতি বন্ধুতাপূর্ণ আচরণ, দয়া এবং শত্রুতামুক্ত হতে হবে, মুক্ত হতে হবে আত্মম্ভরিতা থেকেও। ঈশ্বরে সর্বোত্তম বিশ্বাস স্থাপন করা চাই। ভক্তি হল প্রেমের পথ। ভক্তি হল ‘neither merely physical attention nor intellectual appreciation’. ভালবাসা মানে কোনো জিনিসের প্রতি নয়, উচ্চতর আদর্শের প্রতি ভালবাসা। Devotion to God is the highest and the purest form of love; ভক্তি হবে স্বতঃস্ফূর্ত, এর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের কোনো সম্পর্ক নেই, অথবা কোনো কিছুর চাহিদার সঙ্গে তা যুক্ত থাকবে না। আন্তরিকতা এবং নি:সংশয় বিশ্বাসই হল যথার্থ ভক্তির মুখ্য উপাদান। যথার্থ ভক্তির সঙ্গে প্রেমের যোগ। ভক্তের সর্ববিধ কর্ম হবে ঈশ্বরকেন্দ্রিক। তার সকল চিন্তা ঈশ্বরেই ন্যস্ত হবে। ভক্তি হল ঈশ্বরে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ।

গীতার সমন্বয়বাদ : লেখক যথার্থই মনে করেছেন কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ বা ভক্তিযোগ একের থেকে অন্যটি পৃথক নয় :

In actual practice, these paths cannot be practised in isolation, but these have to be inter-twined to achieve the final goal.

যিনি কর্মযোগে বিশ্বাসী তাঁকে কর্ম সম্পাদনে জ্ঞানের আশ্রয় নিতে হয় তা না হলে কোন কাজ ঠিক কোনটি বা ভুল বোঝা সম্ভব নয়। এছাড়া মানুষকে ভক্তিরও আশ্রয় নিতে হয়। তাহলে দাঁড়াল এই যে, a man of knowledge or devotion has to perform action, as no one can remain without action ….. action without knowledge is blind and knowledge without action is lame. Either cannot succeed without the help of the other. আন্তরিক ভক্তি আছে যার তিনি বিশুদ্ধতা লাভ করেন, লাভ করেন যথার্থ জ্ঞান, এরই ফলে তার পক্ষে সঠিক কর্ম সম্পাদন সম্ভব হয়।

Thus right knowledge, right action and true devotion cannot be separated and all these three paths have to be fused together in spiritual practice.

লেখক বারংবার ঘোষণা করেছেন :

Action, Knowledge and Devotion are blended together for the divine fulfilment of man.

লেখক যে গীতার সমন্বয়বাদ তত্ত্বের সমর্থক এর থেকেই প্রমাণিত।

পার্সোনাল একসেলেন্স থ্রু দি ভাগবদগীতা

স্বামী সুখবোধানন্দ

স্বামী সুখবোধানন্দ রচিত Personal Excellence through the Bhagavad Gita’-র প্রকাশকাল ২০০৭। গ্রন্থটির অনন্যতা হল গীতার উপদেশের যাথার্থ্য লেখক বিভিন্ন দৃষ্টান্তের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তগুলি ব্যবহারিক জীবন থেকে গৃহীত।

লেখকের মতে সমগ্র গীতায় যে শিক্ষা প্রদত্ত হয়েছে তা হল বিযুক্ত থাকা :

‘throughout the Gita the Lord says to Arjuna, be detached’.

বিযুক্ত হওয়ার মূলে রয়েছে একাত্মতাবোধ, ‘Identification expresses attachment.’ লেখক এরপর বাস্তব দৃষ্টান্তের সাহায্যে বিমুক্ত থাকার বিষয়টি বুঝিয়েছেন। একজন শল্যচিকিৎসক যখন কোনো শিশুর শল্যচিকিৎসা করেন তখন শিশুটিকে কখনই নিজের সন্তান বলে ভাবেন না, ভাবলে আর তাঁর শল্যচিকিৎসা সম্ভব হত না।

If a surgeon identifies a child as his child, it is very difficult for him to do surgery. But for the neighbour’s child he will do it. Not that he will be careless, but then he is not identified, when he is not identified, his effectiveness is enhanced.

বিযুক্ত থাকার অর্থ অসচেতন থাকা নয়, Being detached does not mean being unconcerned. লেখক খেলোয়াড়ের দৃষ্টান্ত দিয়েও ব্যাপারটি বুঝিয়েছেন। কী রকম? না খেলোয়াড় যখন খেলে তখন খেলাতেই নিবিষ্ট থাকে, দর্শকদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে মাথা ঘামায় না :

a good sportsman when playing sports, he just focuses on the game and he is not attached to the audience, whether they are clapping or not clapping.

গীতায় কর্মযোগের মূল শিক্ষা নিরাসক্ত হয়ে কর্ম সম্পাদন, লেখক সেই প্রসঙ্গেই এইসব দৃষ্টান্তের অবতারণা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, শল্য চিকিৎসক রুগীকে নিজের সন্তান বলে না মানলেও তাঁর কি লক্ষ্য থাকে না রুগীর নিরাময় কিংবা খেলোয়াড়ের উদ্দেশ্য খেলায় জয়লাভ, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন? উভয় ক্ষেত্রেই কি প্রচ্ছন্নভাবে আসক্তি যুক্ত থাকে না? রুগীর নিরাময়ের মধ্য দিয়ে চিকিৎসক প্রশংসিত হন, সুনাম অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অধিক পরিমাণে অর্থোপার্জন যুক্ত, খেলোয়াড়ের সাফল্য লাভের সঙ্গে সঙ্গে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ খেলায় অংশ- গ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত হওয়া এবং এই সুবাদে যশ ও অর্থ দুইয়েরই করায়ত্ত হওয়া।

জ্ঞানযোগ সম্পর্কেও লেখক আলোচনা-প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্তের অবতারণা করেছেন। লেখকের মতে মনকে যার সাহায্যে পরিশ্রুত করা হয় তাই হল জ্ঞানযোগ :

The process of purification of mind is called Yoga of Knowledge, Gnana Yoga.

‘Gnana means understanding, Yoga means to join’

লেখক ভক্তিযোগেরও ব্যাখ্যা করলেন। লেখক ‘understanding’-এর ব্যাখ্যা করলেন এইভাবে :

The summary of the whole Gita, which means that if you take the understanding to 100 degrees boiling point, only then it clicks. If you understand this you understand the gist of the Gita.

লেখক understanding-এর বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন নানা দৃষ্টান্তের সহায়তায়। যেমন :

If you squeeze the feats of the udder, milk will flow. Milk is in the cow. But it comes through the udder. So you should know how to milk it.

লেখকের মতে গীতা হল স্বর্গীয় মই যার মাধ্যমে আমরা পার্থিব বিষয় খেকে আধ্যাত্মিক জগতে উত্তীর্ণ হই :

Gita is like a divine ladder, which tells you climb from worldly living to divine living.

ইংরেজি knowledge এবং wisdom সমার্থক নয়। জ্ঞানযোগে wisdom-এর কথা বলা হয়েছে :

understanding has to reach peak before it becomes wisdom. Water boils at 100 degrees. If it stops at 99 degrees, the water is not going to boil. The water is hot, but it is not boiled. This is what exactly happens when your understanding has come to a level, but it has yet to reach 100 degrees, where the knowledge transforms into wisdom. …..your understanding has to come to a boiling point and then it becomes wisdom. Then your knowledge clicks. The knowledge that clicks is called wisdom.১০

লেখক বলেছেন, আমরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন আছি, ‘we are drunk with what? with an alcohol called ignorance.’১১

দৃষ্টান্ত দিলেন লেখক মদ্যপ পিতাপুত্রের। প্রতিদিন তারা মদ্যপান করতে পানশালায় যায় এবং মদ্যপানের পর একই কথোপকথন চালায়। বয়স্ক জানতে চায় কনিষ্ঠের কাছে, কোথায় তার নিবাস? কনিষ্ঠ জবাব দেয়। বয়স্ক চিৎকার করে ওঠে, আরে ঐ একই ঠিকানায় ত তার বাস। কী আশ্চর্য অথচ দুজনের দেখাসাক্ষাৎ নেই। এরপর বয়স্ক জানতে চায় কতদিন কনিষ্ঠ যে সেবাস করছে। কনিষ্ঠ জানায় গত ২৫ বৎসর। বয়স্ক বিস্মিত হন, তিনিও ২৫ বছরই রয়েছেন ওখানে। অথচ দুজনের দেখাসাক্ষাৎ হয় নি। আসলে এরা দুজন পিতাপুত্র। অত্যধিক মদ্যপানে এদের হুঁশ চলে গিয়েছে। লেখক এই দৃষ্টান্তের উল্লেখে বলেছেন :

In a drunken state, the deep connection between the father and the son is not seen by either. The lord says we are unhappy because we are also drunk. We are drunk with what? With an alcohol called ignorance.১২

অতএব এই অজ্ঞানতা দূরীকরণ আবশ্যক। এটা দূর হতে পারে কেবল জ্ঞানযোগকে আশ্রয় করলে।

গীতার অনুসরণে লেখকের বক্তব্য :

there is nothing more purifying than right understanding and if you don’t have the right understanding, your intellect is clouded with ignorance, and you live your life in delusion ….. when ignorance (অজ্ঞান) covers the intellect, your life is a deluded one (muhyanti)১৩

জ্ঞানের সাহায্যেই মানুষ বুঝতে পারে আসল সাফল্য কোনটিতে। আপাতব্যর্থতা কিংবা দুঃখবোধও জ্ঞানের কারণে সফলতার রূপ পরিগ্রহ করে। তাছাড়া :

Your success can be the greatest failure in your life. When a person who has become highly successful has to leave all his success behind at the time of death that will be the greatest failure.১৪

যে যত বেশি তথাকথিত সফল জীবনের অধিকারী মৃত্যুকালে তাকে ততখানিই ক্লেশ ভোগ করতে হয়, সব- কিছু ছেড়ে যাবার প্রেক্ষিতে। তাই বলা হল :

Your success can become the greatest failure.

লেখকের তাই পরামর্শ :

Your happiness should not be confined by failure, and your happiness should not be defined by success either.১৫

লেখক একটি সূফি গল্পের অবতারণা করে দেখিয়েছেন আমাদের মূল্যায়ন কতখানি ত্রুটিপূর্ণ, বিচ্যুতিতে ভরা। গুরুর কাছে একজন হাজির। আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা নিতে গেলে গুরু তাকে একটি পাথর দিয়ে বললেন বাজার ঘুরে তার মূল্য যাচাই করতে। হবু শিষ্য প্রথমে গেল এক সবজিবিক্রতার কাছে। সেদর হাঁকল ১ টাকা। হবু শিষ্য এরপর গেল একজন রৌপ্যকারের কাছে। সেদর হাঁকল এক হাজার টাকা। এরপর হবু শিষ্য গেল স্বর্ণকারের কাছে। সেদর বলল এক লক্ষ টাকা। হবু শিষ্য এরপর গেল মণিকারের কাছে। সেদর হাঁকল ১৫ লক্ষ টাকা। হবু শিষ্য ফিরে এল গুরুর কাছে। গুরু জানালেন প্রত্যেকেই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী দর হেঁকেছে। আসলে পাথরটির দাম ত্রিশ কোটি। অতএব জ্ঞানযোগের সহায়তায় প্রকৃত মূল্যের হদিশ পেতে হবে। আপাত অর্থে বিভ্রান্ত হলে চলবে না।

ভক্তিযোগের প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য :

Through Bhakti Yoga your mechanical emotions transform into a magnetic centre.১৬

লেখক পরামর্শ দিয়েছেন :

When you take a bath, feel the water is a divine feel the sunshine is a ‘Devata’, see the flora and fauna, and the stars in the sky as divine blessings.১৭

ভক্তিযোগ কী?

To purify your emotions through Bhakti Yoga,…emotions are extremely wonderful. But if you do not purify your emotions through Bhakti Yoga, they too can become a prison.১৮

Emotion means energy in motion.

কিন্তু এই আবেগগুলিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা আবশ্যক, উপযুক্তভাবে শিক্ষিত, নিয়ন্ত্রিত করা আবশ্যক, আর সেটা সম্ভব কেবল ভক্তিযোগের সাহায্যেই।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

স্বামী অদ্বৈতানন্দ

স্বামী অদ্বৈতানন্দের ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’র প্রকাশকাল ১৪১৬ (সপ্তম সংস্করণ)। প্রকাশক ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। গ্রন্থের প্রারম্ভে দীর্ঘ ভূমিকা সন্নিবিষ্ট। ভূমিকায় লেখক কয়েকটি বিতর্কিত বিষয়ের উত্থাপন করেছেন। যেমন, গীতা কি পৃথক রচনা না মহাভারতেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ? লেখকের সুস্পষ্ট জবাব এটি মহাভারতেরই অংশ। একটি বিতর্ক আছে যে, গীতা খ্রিষ্টের পূর্ববর্তীকালের। লেখক দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছেন যে, গীতা কখনও ভগবানের মুখ-নি:সৃত বাণী নয়, গীতার রচয়িতা মহামুনি বেদব্যাস। লেখকের আরও বক্তব্য :

গীতার ১৮টি অধ্যায়ে ১৮ প্রকার সাধনার উপদেশ দেওয়া হয়েছে . . . ।

অবশ্য কর্ম, জ্ঞান, ধ্যান ও ভক্তি এই চারটিই এদের মধ্যে প্রধান। গীতার উদ্দেশ্য সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য :

জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও সর্বস্তরে মানুষ সংগ্রামবিজয়ী হয়ে ঐহিক, পারত্রিক সর্বপ্রকার সুখ-শান্তি ও মুক্তির অধিকারী হোক—ইহাই গীতার মুখ্য নির্দেশ।

কয়েকটি অভিনব বিষয় নিয়ে লেখক আলোচনা করেছেন, বিশেষত অর্জুন কেন গীতার প্রথম শ্রোতা। তাঁর ভগবৎপ্রীতি, মাতৃভক্তি, ভ্রাতৃভক্তি, গুরুভক্তি এসব যেমন বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে, তেমনি যুধিষ্ঠিরের অযোগ্যতার কারণও বিশ্লেষিত হয়েছে। মূল text-এর অনুবাদের সঙ্গে সঙ্গে শ্লোকগুলির অন্বয় এবং ‘গীতামৃত’ নামে গীতার সবিস্তার আলোচনা স্থান পেয়েছে। লেখক স্বীকার করেছেন, গীতায় একদিকে যেমন কর্ম, জ্ঞান, ভক্তিমূলক সাধন পদ্ধতিগুলিকে স্বতন্ত্রভাবে অনুসরণ করার উপদেশ প্রদত্ত হয়েছে, তেমনি এগুলিকে একত্রে অভ্যাস করার নির্দেশও প্রদত্ত হয়েছে। গীতার সমন্বয়বাদী ভূমিকাকেই লেখক বড় করে দেখেছেন :

গীতায় আদর্শ কর্মী, আদর্শ জ্ঞানী ও আদর্শ ভক্তের উপযোগী যে সমস্ত লক্ষণসমূহ বিভিন্ন অধ্যায়ে সূচিত হয়েছে তাদের মধ্যে পার্থক্য অতি কম। এতেই বোঝা যায়, গীতা সমন্বয়মূলক মহাগ্রন্থ। কর্ম-জ্ঞান-ধ্যান-ভক্তির সমন্বয় সাধনই গীতার মূল লক্ষ্য।

শ্রীগীতা

জগদীশচন্দ্র ঘোষ

জগদীশচন্দ্রের সম্পাদিত, অনূদিত, ব্যাখ্যাত গীতাটির সর্বশেষ সংস্করণের ষষ্ঠবিংশতিতম সংস্করণ, ২০০৯ সংখ্যাতেই স্পষ্ট এটির জনপ্রিয়তা কী সুদূরপ্রসারী। গ্রন্থটি নানা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। প্রতিটি শ্লোকের শব্দে শব্দে বাংলা প্রতিশব্দ দিয়ে ভাষামুখে অন্বয় করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সংস্কৃত না জানা পাঠকের পক্ষেও গীতার শ্লোকগুলির অর্থ বোধগম্য হয়েছে। শ্লোকস্থিত দুরূহ শব্দগুলির ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয়েছে। অনুবাদ সম্ভবমত সরল, সুখবোধ্য করা হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে যেখানে পরস্পরবিরুদ্ধ বক্তব্য স্থান পেয়েছে, কিংবা আপাতবিরোধ লক্ষিত হয়েছে, সেগুলির ক্ষেত্রে লেখক সাধ্যমত সামঞ্জস্যপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেছেন। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে প্রতিপাদ্য বিষয়গুলির শ্লোকানুসরণে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ প্রাঞ্জল ভাষায় প্রদত্ত হয়েছে। লেখক তুলনামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করায় পাঠকের পক্ষে মূল শ্লোক ও সেগুলির বিভিন্ন মতের পর্যালোচনা করে নিজস্ব অভিমত গঠন করা সহজতর হয়। প্রাচীন ও আধুনিক বিভিন্ন টীকা-ভাষ্যকারদের সংক্ষিপ্ত মতামত উল্লিখিত হয়েছে। প্রাচীন উপনিষদ, কাপিল সাংখ্য, বেদান্তদর্শন, পূর্বমীমাংসা , পাতঞ্জল যোগানুশাসন, মহাভারতীয় নারায়ণীয় পর্বাধ্যায় ইত্যাদি নানা শাস্ত্রাদির স্থূল প্রতিপাদ্য বিষয় তৎসহ প্রয়োজনীয় দার্শনিক পরিভাষা ইত্যাদি উপস্থাপিত। গীতার সর্বাপেক্ষা যে গুরুত্বপর্ণ বৈশিষ্ট্য সর্বধর্মসমন্বয় প্রণালী তা ব্যাখ্যাত হয়েছে। গীতার সমন্বয়বাদ, মূল শিক্ষা, গীতার মাহাত্ম্য, গীতোক্ত ধর্মের প্রাচীন স্বরূপ, গীতা ও ভাগবত—আধুনিক বৈষ্ণব মত, গীতার শিক্ষা— সার্বভৌম ধর্মোপদেশ, গীতার সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক টীকা ভাষ্য, গীতোক্ত ধর্মের মূল কথা, বিদেশী ভাষায় গীতা, গীতোক্ত যোগসাধনা, এসব কিছুই আলোচিত হয়েছে। সর্বোপরি শ্লোকানুক্রমিক বিষয়সূচী, বিশ্লেষণ ও সার- সংক্ষেপ প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে সন্নিবিষ্ট। ভূমিকাসূচী, বিবৃতিসূচী ও বর্ণমালার ক্রমানুসারী শ্লোকসূচী পাঠকের পক্ষে নির্দিষ্ট বিষয়ের অনুসন্ধানে খুবই সহায়ক।

আমরা এবারে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ এই তিন যোগ প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য ও ব্যাখ্যার প্রসঙ্গে আসব। প্রথমেই কর্মযোগ প্রসঙ্গ। আমরা জানি সাংখ্যরা জ্ঞানযোগে আস্থাশীল, অপরপক্ষে মীমাংসকেরা কর্মযোগে বিশ্বাসী। গীতায় কর্মযোগ বিস্তারিতভাবে আলোচিত হলেও, বিস্মৃত হলে চলবে না যে মীমাংসাদর্শন অপেক্ষাকৃত- ভাবে অর্বাচীনকালের হলেও কর্মমার্গ অতি প্রাচীন। আজকের দিনে যাগযজ্ঞাদির পাট প্রায় নি:শেষিত, শ্রৌত কর্মাদির অস্তিত্ব নেই বললেই চলে, কিন্তু তথাপি বেদার্থ অনুসরণে শাস্ত্রবিহিত পঞ্চ মহাযজ্ঞ, দান-ব্রত, বর্ণাশ্রমাচার ইত্যাদি এখনও প্রচলিত রয়েছে। কর্মমার্গ এগুলিকেই ইঙ্গিত করে। মীমাংসকেরা বেদোক্ত কর্মকান্ডের যে ব্যাখ্যা করেন, তাতে যাগযজ্ঞই একমাত্র নি:শ্রেয়স, অর্থাৎ যাগযজ্ঞের মাধ্যমেই লাভ করা সম্ভব স্বর্গ ও অমৃতত্ব। বেদবিহিত কর্মকেই কেবল কর্মের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মীমাংসকেরা বলেন, জ্ঞান, ভক্তি এসব অর্থহীন, একমাত্র কর্তব্য হল কর্মসাধন। গীতায় কিন্তু ‘কর্ম’ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত, নিছক যাগযজ্ঞাদি অর্থেই তা সীমাবদ্ধ থাকে নি। জগদীশবাবু দৃষ্টান্তসহ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন :

. . . পুত্রেষ্টি যাগ; ইহার উদ্দেশ্যই পুত্রলাভ। যে পুত্রাকাঙ্ক্ষা করে না, সেউহা করিবে কেন, আর করিয়াই বা লাভ কি? বস্তুতঃ গীতায় ‘কর্ম’ শব্দ এরূপ সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয় নাই, তাহা গীতাতেই স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়।

গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৭ সংখ্যক শ্লোকটি হল—

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।

মা কর্মফলহেতুর্ভূমা তে সঙ্গোস্ত্বকর্মণি।। ৪৭

‘কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে কখনও তোমার অধিকার নাই। কর্মফল যেন তোমার কর্ম প্রবৃত্তির হেতু না হয়, কর্মত্যাগে যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়।’

কর্মবাদীরা স্বর্গাদি ফলপ্রদ কাম্য কর্মকেই একমাত্র ধর্ম বলে গ্রহণ করেছিলেন যেখানে, সেখানে জ্ঞানবাদীগণ বললেন কর্মমাত্রই তা বন্ধনের কারণ, অতএব সর্বকর্ম ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। একে বলা হয় সন্ন্যাসবাদ। জগদীশচন্দ্র বললেন—

ক. আমাদের অধিকার কেবল কর্মে।

খ. ফলে অধিকার নেই।

গ. যথাধিকার কর্ম সম্পাদন করা কর্তব্য।

ঘ. ফলাকাঙ্ক্ষা করে কখনই কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া চলবে না।

ঙ. ফলাকাঙ্ক্ষা নেই বলে যেন কর্মত্যাগে প্রবৃত্তি না হয়।

লেখক কর্মযোগের তিনটি লক্ষণকে স্পষ্ট করেছেন—

১. ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন

২. কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ এবং

৩. ঈশ্বরে সর্বকর্ম সমর্পণ

প্রশ্ন উঠবে উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে কী কোনো কর্ম সম্পাদন করা সম্ভব? আপাতভাবে মনে হবে প্রশ্নটি যথার্থ। জগদীশচন্দ্র এখানে জানিয়েছেন :

ফলাফলে উদাসীনতা ও উদ্দেশ্যহীনতা এক কথা নহে। নিষ্কাম কর্মও উদ্দেশ্যহীন নহে, লোকসংগ্রহ, ভগবানের সৃষ্টিরক্ষাই উহার উদ্দেশ্য; উহা ভগবানের কর্ম, জগৎ রক্ষার জন্য, প্রকৃতির প্রেরণায় জীবের মধ্য দিয়া হয়।

লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন :

যখন ভাগবত ইচ্ছা ও কর্মীর ইচ্ছা এক হয়, তখনই প্রকৃত নিষ্কাম কর্ম সম্ভবপর, তখন কর্তার ব্যক্তিত্ব থাকেনা।

দৃষ্টান্তরূপে জুয়াখেলা ও বালকদের খেলার পার্থক্য উপস্থাপিত হয়েছে। জুয়াখেলা উদ্দেশ্যমূলক, অংশগ্রহণকারীরা জয়-পরাজয়ের ব্যাপারে অতিমাত্রায় সচেতন থাকে, অপরপক্ষে বালকদের খেলায় জয়-পরাজয় গুরুত্বহীন, সকলে মিলে আনন্দলাভই তাদের অভিপ্রায়। অর্থাৎ বৈষয়িক কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। সেদিক থেকে তারা ফলাফলের ব্যাপারে উদাসীন।

৪৮ সংখ্যক শ্লোকে সঙ্গত্যাগের প্রসঙ্গ পাই—

যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যা ধনঞ্জয়।

সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যো: সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।।

এখানে বলা হল, যোগস্থ হয়ে ফলাসক্তি বর্জন করে সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্য জ্ঞান করে কাজ করতে হবে। এই সমত্ব বুদ্ধিই হল যোগ। তাহলে ‘যোগ’ হল সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে সমত্ব বুদ্ধি। সিদ্ধিতে হয় হর্ষ, অসিদ্ধিতে হয় বিষাদ—কর্ম করার সময় এই দুইই পরিত্যাজ্য। ‘সঙ্গ ত্যাগ’ এর অর্থ হল ‘ফলাসক্তি ত্যাগ’। কর্ম অপেক্ষা বুদ্ধিকেই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেওয়া হয়েছে গীতায়। লেখক মনে করেন, ‘বুদ্ধির উপপত্তিই গীতোক্ত কর্মতত্ত্বের মুখ্য কথা।’

কর্ম বিচারে যেন তার বাহ্য ফলকে মাপকাঠি করা না হয়, লেখক সেবিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাহলে কর্মের ভাল-মন্দের বিচার কিরূপে সম্ভব—লেখকের মতে :

কর্তা কি উদ্দেশ্যে, কিরূপ বুদ্ধিতে কার্য করেন তাহাই দেখিতে হইবে এবং তদনুসারেই কর্মের ভাল-মন্দ বিচার করিতে হইবে।

কর্মমাত্রই কী বন্ধনের কারণ? মোক্ষলাভের জন্য তবে কি কর্মত্যাগ অপরিহার্য? এ প্রশ্নের উত্তরও লেখক এড়িয়ে যান নি। বরং অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করে বলেছেন :

বন্ধনের কারণ কর্ম নহে, কামনা ফলাসক্তি বা বাসনা। কর্তার ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি যদি সমাহিত হয়, বাসনাত্মিকা বুদ্ধি যদি নিষ্কাম হইয়া শুদ্ধ হয়, সিদ্ধি অসিদ্ধিতে যদি তাহার সমত্ববোধ জন্মে, তবে তিনি যে কর্মই করুন না কেন, তাহাতে তাঁহার বন্ধন হয় না . . . যে নিষ্কাম বুদ্ধি দ্বারা কর্মের বন্ধকত্ব দূর হয় তাহাকেই গীতায় সাম্যবুদ্ধি বলা হইয়াছে এবং ইহাকেই যোগ বলা হইয়াছে। ইহা লাভ করিতে হইলে কামনা ও কতৃত্বাভিমান ত্যাগ করা চাই, ঈশ্বরার্পণ বুদ্ধিতে কর্ম করা চাই, চিত্ত একনিষ্ঠ হওয়া চাই—অর্থাৎ জ্ঞান, ভক্তি, ধ্যান সমস্তেরই ইহাতে সমাবেশ করা হইয়াছে।

গীতার তৃতীয় অধ্যায়টি ‘কর্মযোগ’, কিন্তু দ্বিতীয় অধ্যায়েই ‘কর্মযোগ’ সংক্রান্ত আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৮ সংখ্যক শ্লোকে বলা হল—

দূরেণ হ্যরবং কর্ম বুদ্ধি যোগাদ্ধনঞ্জয়।

কেবল বাহ্যকর্ম বুদ্ধিযোগ অপেক্ষা নিতান্তই নিকৃষ্ট . . .। বুদ্ধিযোগ অপেক্ষা কর্মকে নিকৃষ্ট বলা হয়েছে। সাম্যবুদ্ধির শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়েছে। বিভ্রান্ত অর্জুন জানতে চেয়েছেন কৃষ্ণের কাছে—

জ্যায়সী চেৎ কর্মণস্তে মতা বুদ্ধির্জনার্দন।

তৎ কিং কর্মণি ঘোর মাং নিয়োজামি কেশব।। ১

কর্মের তুলনায় বুদ্ধিই যদি শ্রেষ্ঠ, তবে কেশব কেন তাঁকে যুদ্ধের মত হিংসাত্মক কর্মে নিযুক্ত করেছেন। কৃষ্ণ প্রেরণা দিচ্ছেন কর্মের, কিন্তু জ্ঞানের স্বপক্ষে তাঁর উপদেশ, যে যোগ অবলম্বনপূর্বক কর্ম সম্পাদনের পরামর্শ তাঁর, তা হল বুদ্ধিযোগ।

তৃতীয় অধ্যায়ের পঞ্চম শ্লোকে কৃষ্ণ অর্জুনকে পরামর্শ দিলেন, প্রকৃতির গুণে সকলেই কর্ম সম্পাদনে বাধ্য। নিষ্কর্মা হয়ে কারো পক্ষে অবস্থান করা অসম্ভব। তাই মোক্ষলাভের অন্যতম পথ কর্মযোগ মার্গ অবলম্বনের জন্য তাঁর সুপারিশ। এখানেই কৃষ্ণ স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেন নি যে কর্মযোগ মার্গের ভিত্তিই হল সাম্যবুদ্ধি, সম্যক জ্ঞান, আর এই জ্ঞানই হল মোক্ষ। তাই কৃষ্ণের পরামর্শ—

নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ।

শরীর যাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকর্মণঃ।। ৩/৮

নিয়ত কর্ম কর, কেননা কর্মশূন্যতার তুলনায় কর্ম শ্রেয়তর। কর্ম করার সময় উপযুক্ত ব্যবস্থাদি নেওয়া চাই, সেব্যবস্থা হল—মনের দ্বারা জ্ঞানেন্দ্রিয়সকল সংযত করে অনাসক্ত হয়ে কর্মেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কর্মযোগের অনুষ্ঠান আরম্ভ করতে হবে।

কর্মবন্ধন কখন হয়? ৯সংখ্যক শ্লোকে স্পষ্টভাবে শ্রীকৃষ্ণ এই প্রসঙ্গে উত্তর দিয়েছেন—

যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোন্যত্র লোকো এয়ং কর্মবন্ধনঃ।

তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর।। ৩/৯

যজ্ঞার্থে সম্পাদিত কর্ম ব্যতীত অন্য কর্মানুষ্ঠানে কর্মবদ্ধ হতে হয়। তাই অর্জুনকে কৃষ্ণের পরামর্শ, সেযেন অনাসক্ত হয়ে কর্ম করে। ‘যজ্ঞার্থে’ বলতে এখানে কী বোঝানো হয়েছে, বোঝানো হয়েছে বিষ্ণুকে, শ্রুতিতে বিষ্ণু হলেন যজ্ঞ। শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য বলেছেন :

‘যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ’।

বেদোক্ত ক্রিয়াকলাপ নয়, কারণ সেসবও তো বন্ধনের কারণ। ঈশ্বরের উদ্দেশে, ঈশ্বরের আরাধনার জন্য বা তাঁর প্রীতি কামনার জন্য যে কর্ম তা ব্যতিরেকে অন্য সর্ববিধ কর্মই বন্ধনের কারণ।

তিলক অবশ্য ‘যজ্ঞ’ বলতে বেদোক্ত যজ্ঞাদিকেই বুঝেছেন। কিন্তু হীরেন্দ্রনাথ দত্ত আবার যজ্ঞ বলতে বুঝেছেন ত্যাগকে :

যজ্ঞের মর্মভাব ত্যাগ, অতএব যজ্ঞার্থে কর্ম করার এরূপ অর্থও অসঙ্গত নহে যে ত্যাগের ভাবে কর্মানুষ্ঠান করা। এইরূপ কর্মানুষ্ঠান যখন অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন মানব-জীবন একটি মহাযজ্ঞের আকার ধারণ করে।

গীতায় ২৭ সংখ্যক শ্লোকে কথিত হয়েছে—

প্রকৃতে: ক্রিয়মাণানি গুণৈ: কর্মাণি সর্বশঃ।

অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।। ৩/২৭

এই শ্লোকে জ্ঞানী ও অজ্ঞানের কর্মপার্থক্য স্পষ্ট করা হয়েছে। জ্ঞানী কর্ম করেন, অজ্ঞানীও কর্ম করেন। কিন্তু দুইয়ের পার্থক্য হল—অজ্ঞান ব্যক্তি ভাবে কর্ম সেই করে, জ্ঞানী মনে করেন কর্ম করেন প্রকৃতি। জগদীশচন্দ্র চমৎকারভাবে বলেছেন :

যাঁহার অহং জ্ঞান নাই, তাঁহার কর্মে আসক্তি নাই, ফলাকাঙ্খা নাই। অজ্ঞান আমিটাকে কর্মের সহিত যোগ করিয়া দেন বলিয়াই ফলাসক্ত হন। সুতরাং অজ্ঞানের কর্মভোগ, জ্ঞানীর কর্মযোগ। কর্মী হইলেই কর্মযোগী হয় না। কতৃত্বাভিমান বর্জন ব্যতীত কর্মযোগে পরিণত হয় না।

আত্মজ্ঞানী ব্যতিরেকে কতৃত্বাভিমান বর্জন অন্যের পক্ষে সম্ভব নয়। জগদীশচন্দ্র দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন গীতায় জ্ঞান-কর্ম-ভক্তির সমন্বয় সাধিত হয়েছে। ৩০ সংখ্যক শ্লোকে বলা হয়েছে—

ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।

নিরাশীনির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ।। ৩/৩০

ঈশ্বর হলেন কর্তা, তাঁর উদ্দেশেই কর্ম সম্পাদন ভৃত্যবৎ, কামনাশূন্য ও মমতাশূন্য হয়ে বিবেকবুদ্ধিসহ সমস্ত কর্ম কৃষ্ণের উদ্দেশে সমর্পণ করতে হবে। জগদীশচন্দ্র বলেন :

এই শ্লোকে (৩০) এই তিনটি লক্ষণই নির্দেশ করা হইল। যিনি সর্বকর্ম ঈশ্বরে সম্মানপূর্বক ‘আমি তাঁহার ভৃত্য স্বরূপ কর্ম করিতেছি’ এই জ্ঞানে কর্ম করেন, তিনি পরম ভক্ত, সুতরাং কর্মযোগই ভক্তিযোগ; যিনি চিত্তকে আত্মসংস্থ করিয়াছেন, ‘আমি’ ‘আমার’ জ্ঞান ত্যাগ করিতে পারিয়াছেন, তিনি পরম জ্ঞানী, সুতরাং কর্মযোগই জ্ঞানযোগ, এইরূপ ভাবে যিনি সর্বকর্ম অর্থাৎ যুদ্ধাদি লৌকিক কর্ম ও পূজার্চনা, দান-বৈদিক বা শাস্ত্রীয় কর্ম সম্পন্ন করেন, তিনিই প্রকৃত কর্মী, ইহাই কর্মযোগ; সুতরাং ইহাতে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি তিনের সমন্বয়।

জগদীশচন্দ্র সমন্বয়ের প্রসঙ্গে আরও বলেন :

জীবের অন্তর্নিহিত এই যে তিনটি শক্তি আছে, তদনুসারে সাধনের তিনটি পথের নামকরণ হইয়াছে— কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ। জীবের যে অস্ফুট সদ্ভাব উহার প্রকাশ তাহার কর্মে, সুতরাং তাহার কর্ম ঈশ্বরমুখী হইলেই উহা বিশুদ্ধ হইয়া নিষ্কাম কর্মযোগ হয়। জীবের মধ্যে যে চিদভাব উহার প্রকাশ তাহার জ্ঞানে, ভাবনায় উহা ঈশ্বরমুখী হইয়া সমত্ব প্রাপ্ত হইলেই জ্ঞানযোগ হয়। জীবের মধ্যে যে আনন্দভাব উহার প্রকাশ তাহার কামনায়, উহা ঈশ্বরমুখী হইয়া বিশুদ্ধ হইলেই প্রেমভক্তিযোগ হয়। এই তিনটি যুগপৎ অনুষ্ঠানই জীবের পূর্ণ বিকাশ, সচ্চিদানন্দের সাধর্ম্য লাভ।

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত একেই বলেছেন ‘যুক্তত্রিবেণী সঙ্গম’ :

গীতায় দেখি, কর্মবাদ, জ্ঞানবাদ ও ভক্তিবাদের অপূর্ব সামঞ্জস্য বিধান করিয়া শ্রীকৃষ্ণ এক অদ্ভুত যুক্ত ত্রিবেণী সঙ্গম রচনা করিয়াছেন, যে পুণ্যতর কল্যাণতর ত্রিবেণীতে সরস্বতীর কর্মধারা, যমুনার জ্ঞানধারা এবং গঙ্গার ভক্তিধারা সমান উজ্জ্বল, সমস্রোতে প্রবহমান।

এইবারে আসা যাক জ্ঞানযোগের প্রসঙ্গে। গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে জ্ঞানযোগের স্বপক্ষে বলা হয়েছে। কয়েকটি শ্লোক প্রথমে উদ্ধার করা গেল—

ক. শ্রেয়ান দ্রব্যময়াদ যজ্ঞাজ জ্ঞানযজ্ঞঃ পরন্তপ।

সর্বং কর্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে।। ৪/৩৩

এই শ্লোকে বলা হল দ্রব্যসাধ্য দৈবযজ্ঞাদির তুলনায় জ্ঞানযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ। দৈবযজ্ঞ, নৃযজ্ঞ, দানযজ্ঞাদির সাহায্যে স্বর্গলাভ হতে পারে, কিন্তু জ্ঞানযজ্ঞ ব্যতীত মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। সুতরাং দ্রব্যযজ্ঞ থেকে জ্ঞানযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ।

খ. তদবিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া। উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ।। ৩৪

এখানে প্রণাম দ্বারা, প্রশ্নদ্বারা, সেবাদ্বারা তত্ত্বজ্ঞ জ্ঞানীর কাছ থেকে জ্ঞানলাভের পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে।

গ. অপি চেদসি পাপেভ্যঃ সর্বেভ্যঃ পাপকৃত্তমঃ।

সর্বং জ্ঞানপ্লবেনৈব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি।। ৩৬

সকলপাপীদের থেকেও যে পাপী সেও পাপসমুদ্র জ্ঞানরূপ তরণীর দ্বারাই উত্তীর্ণ হতে সক্ষম।

ঘ. যথৈধাংসি সমিদ্ধোএগ্নির্ভস্মসাৎ কুরুতের্জুন।

জ্ঞানাগ্নি: সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা।। ৩৭

অর্জুনকে কৃষ্ণ বললেন প্রজ্বলিত অগ্নি যেমন কাষ্ঠরাশিকে ভস্মীভূত করে, জ্ঞানরূপ অগ্নিও তেমনি কর্মরাশিকে ভস্মসাৎ করে।

ঙ. ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে।

তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি।। ৩৮

ইহলোকে জ্ঞানের মত পবিত্র আর কিছু হয় না। কর্মযোগে সিদ্ধ পুরুষ কালক্রমে সেই জ্ঞান স্বীয় অন্তঃ করণে লাভ করেন।

চ শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ।

জ্ঞানং লব্ধা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি।। ৩৯

শ্রদ্ধাবান, নিরলস, জিতেন্দ্রিয় পুরুষই জ্ঞান লাভ করেন এবং জ্ঞান লাভের পর শীঘ্র পরম শান্তি প্রাপ্ত হন।

স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, নিছক কর্ম দ্বারাই মোক্ষলাভ কি সম্ভব? পরমেশ্বরের জ্ঞানের কোনো আবশ্যকতা থাকবে না? জ্ঞান ব্যতীত কি নিত্য বস্তুকে জানা সম্ভব? বৈদিক ধর্মের স্পষ্টতই দুটি বিভাগ—কর্মকান্ড ও জ্ঞানকান্ড। বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণকে নিয়ে কর্মকান্ড, আর আরণ্যক ও উপনিষদ নিয়ে জ্ঞানকান্ড। দর্শনে বলা হয়েছে পূর্ব মীমাংসা এবং উত্তর মীমাংসা। অন্যভাবে বলা যায় প্রবৃত্তিমার্গ ও নিবৃত্তিমার্গ। মহাভারতকার বললেন—

কর্মণা বধ্যতে জন্তু র্বিদ্যয়া তু প্রমুচ্যতে।

তস্মাৎ কর্ম ন কুর্বন্তি যতয়ঃ পারদর্শিনঃ।।

জীব বদ্ধদশা প্রাপ্ত হয় কর্মের কারণে, কিন্তু মুক্তি ঘটে জ্ঞানে। আর তাই তত্ত্বদর্শীরা কর্ম থেকে বিরত থাকেন।

জগদীশচন্দ্রের অভিমত ‘কর্মযোগই জ্ঞানযোগ’।১০ ব্যাখ্যায় তিনি বললেন :

যিনি চিত্তকে আত্মসংস্থ করিয়াছেন, ‘আমি’ ‘আমার’ জ্ঞান ত্যাগ করিতে পারিয়াছেন, তিনি পরম জ্ঞানী, সুতরাং কর্মযোগই জ্ঞানযোগ।১১

গীতায় কথিত হয়েছে, নিষ্কাম কর্ম বন্ধনের কারণ নয়। বন্ধনের কারণ ফলাসক্তি ও কতৃত্বাভিমান। আসক্তি ও অহংবুদ্ধি ত্যাগপূর্বক কর্ম সম্পাদন করলে বন্ধন হয় না। কিন্তু আত্মজ্ঞান ব্যতিরেকে ত অহং ত্যাগ হবার নয়। তাই জগদীশচন্দ্রের অভিমত :

কর্মযোগে সিদ্ধি লাভার্থ জ্ঞান লাভের প্রয়োজন।

আত্মজ্ঞানের উদয় হলে দেহাত্মবোধ অন্তর্হিত হয়। অতএব কর্মের সঙ্গে জ্ঞানের সংযোগ। গীতায় যে কর্মের উল্লেখ দেখি তাত একান্তভাবে জীবন্মুক্তের কর্মের। জগদীশচন্দ্রের অভিমত, ‘ইহার সহিত জ্ঞানের বিরোধ হইবে কীরূপে?’

জ্ঞানকর্মসমুচ্চয় বাদের উল্লেখে জগদীশচন্দ্র দেখিয়েছেন জ্ঞানলাভ করেও কর্মসন্ন্যাস না করেও অনাসক্ত- ভাবে লোক সংগ্রহার্থ কর্ম করাই কর্তব্য, এটাই গীতার অভিমত। গীতার প্রতিপাদ্য বৈদান্তিক কর্মযোগ। বৈদান্তিক জ্ঞানমার্গকে নস্যাৎ করে সাংখ্যকে বাতিল করে বলা হয়েছে নিষ্কাম কর্ম বা জ্ঞানযুক্ত কর্মে বন্ধন নাস্তি।

সবশেষে ভক্তিযোগের প্রসঙ্গ। গীতার ৮ম অধ্যায়ে বলা হল—

অনন্যচেতা: সততং যো মাং স্মরতি নিত্যশঃ।

তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ।। ৮/১৪

অনন্য চিত্ত হয়ে যিনি চিরদিন নিরন্তর ঈশ্বরকে স্মরণ করেন সেই নিত্যযুক্ত যোগীর পক্ষে ঈশ্বর সুখলভ্য।

২২ সংখ্যক শ্লোকে বলা হল—

পুরুষঃ স পরঃ পার্থ ভক্ত্যা লভ্যস্ত্বনন্যয়া।

যস্যান্তঃস্থানি ভূতানি যেন সর্বমিদং ততম।। ৮/২২

সকল ভূতই যাঁতে অবস্থিত, যাঁর দ্বারা এই সমস্ত জগৎ ব্যাপ্ত হয়ে আছে, সেই পরম পুরুষকে একমাত্র অনন্যা ভক্তি দ্বারাই লাভ করা সম্ভব, অন্য কিছুতে নয়।

নবম অধ্যায়ের ৩৪ সংখ্যক তথা শেষ শ্লোকে বলা হল—

মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদযাজী মাং নমস্কুরু।

মামেবৈষ্যসি যুক্তৈ বমাত্মানং মৎপরায়ণঃ।। ৩৪

সর্বদা মনকে ঈশ্বরচিন্তায় নিযুক্ত রাখা, তাঁর প্রতি ভক্তিমান হওয়া, তাঁকে পূজা করা, নমস্কার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে এভাবে ঈশ্বরপরায়ণ হয়ে তাঁতে মন সমাহিত করতে পারলেই তাঁকে লাভ করা যাবে।

১৮শ অধ্যায়ের ৫৫ সংখ্যক শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে—

ভক্ত্যা মাম ভিজানাতি যাবান যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ।

ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম।। ১৮/৫৫

যিনি পরাভক্তির দ্বারা ঈশ্বরকে স্বরূপত জানতে পারেন, তিনিই বুঝতে পারেন ঈশ্বরকে। তাঁর কত বিভাব, তাঁর সমগ্র স্বরূপ কী? এভাবে তাঁকে স্বরূপত জেনে তদনন্তর তাঁতে প্রবেশ করা যায়।

জ্ঞানবাদীদের মত, জ্ঞান ব্যতীত মুক্তি নেই, কিন্তু ভক্তিবাদীরে অভিমত, ব্রহ্মভাব লাভেই জীবের মুক্তি। এই হল জ্ঞানমার্গের চরম অবস্থা। আসলে পরম জ্ঞান ও পরাভক্তিতে কোনো বিরোধ নেই। একটি থাকলে অপরটি আসবেই। জ্ঞান থাকলে ভক্তিও থাকবে। ব্রহ্মভাব থেকেই পরাভক্তির জন্ম। ভক্তির দ্বারাই ঈশ্বরের স্বরূপ অবগত হওয়া যায়, তাতেই ভক্ত তাঁকে লাভ করেন।

প্রকৃতি মুক্ত কেউই নন। বর্ণ ধর্ম স্বভাব নিয়ত। সৃষ্টিরক্ষার্থে প্রত্যেকেরই স্বকর্মে নিরত থাকা আবশ্যক। কর্মের সঙ্গে তার ফলভোগের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। কর্মসূত্রে বারংবার জন্মগ্রহণ। তাহলে ভবচক্র থেকে মুক্তিলাভ ঘটবে কী করে? উত্তর হল কর্ম করেও কর্মবন্ধন অতিক্রম করা সম্ভব, যদি নৈষ্কর্ম্য সিদ্ধিলাভ ঘটে। আসক্তি ও ফলাকাঙ্খা ত্যাগপূর্বক কর্ম করতে হবে। নৈষ্কর্ম্য সিদ্ধি ঘটলে রাগদ্বেষ দূরীভূত হবে, ধ্যানযোগে রত থেকে ব্রহ্মভূত হওয়া সম্ভব। ব্রহ্মভাব প্রাপ্তি ঘটলে সর্বভূতে সমদর্শন ও নির্মলচিত্ত প্রসাদলাভ ঘটে। পুরুষোত্তমে পরাভক্তি জন্মায়। পরাভক্তি জন্মালে ভগবানের সমগ্র স্বরূপ যথার্থভাবে উপলব্ধ হয়, তাঁকে স্বরূপত জেনে তাঁতেই তন্ময়ত্ত প্রাপ্তি ঘটে।

শ্রীমদ্ভাগবত অভিধান

বেণীমাধব শীল

অক্ষয় লাইব্রেরী থেকে প্রকাশিত হয়েছে বৃহৎ শ্রীমদ্ভাগবত অভিধান (শ্রাবণ ১৪১৬), রচয়িতা বেণীমাধব শীল। গ্রন্থের তৃতীয় স্কন্ধভুক্ত তৃতীয় অধ্যায়ে কর্মযোগ সম্পর্কে বক্তব্য স্থান পেয়েছে। অর্জুন বিমূঢ়, কৃষ্ণের কথামত যদি কর্ম অপেক্ষা জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ, তবে কেন তিনি অর্জুনকে আয়াসসাধ্য কর্মে নিযুক্ত করতে উৎসাহী। কৃষ্ণ কখনও কর্মের প্রশংসায় মুখর, কখনও আবার জ্ঞানের, এতে অর্জুন বিভ্রান্ত, তাই তিনি কৃষ্ণের কাছ থেকে নিশ্চিতভাবে কোনো একটি পথের সম্পর্কে জানতে চান। কৃষ্ণ জানান, নিষ্ঠা দুই প্রকারের—জ্ঞানীর জ্ঞাননিষ্ঠা এবং কামীর কামনিষ্ঠা। তিনি আরও জানান যে, পুরুষ কর্ম না করলে নৈষ্কর্ম লাভ করে না। আরও বলেন যে, কারো পক্ষেই ক্ষণেকের জন্যও কর্ম না করে থাকা সম্ভব নয়। কর্ম না করা অপেক্ষা কর্ম সম্পাদনই প্রধান। কৃষ্ণ অর্জুনকে পরামর্শ দেন, তিনি যেন আসক্তিশূন্য হয়ে কর্ম করেন, কেননা তাতেই মোক্ষলাভ ঘটে। প্রসঙ্গত কৃষ্ণ জানাতে ভোলেন না যে, ত্রিলোকে তাঁর অপ্রাপ্তও কিছুই নেই, তবু তিনি শাস্ত্রোক্ত কর্ম সম্পাদন করে থাকেন। কৃষ্ণ আরও বলেন যে, প্রকৃতির গুণ দ্বারা সব কাজ সম্পন্ন হয়, কিন্তু অহঙ্কারের বশবর্তী হয়ে মানুষ নিজেকেই বিশেষ কাজের কর্তা জ্ঞান করে বসে। কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, তিনি যেন তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা সমস্ত কর্ম তাঁতে সমর্পণ করে নিষ্কাম ও মমতাশূন্য হয়ে শোক পরিত্যাগপূর্বক যুদ্ধ করেন।

গ্রন্থের চতুর্থ স্কন্ধভুক্ত চতুর্থ অধ্যায়ে জ্ঞানযোগের কথা স্থান পেয়েছে। কৃষ্ণ প্রথমেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, যেভাবেই তাঁর ভজনা করুক তিনি তাকে সেভাবেই অনুগ্রহ করে থাকেন। কৃষ্ণের মতে যিনি কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম দেখেন তিনি বুদ্ধিমান। সর্বকর্মকারী ব্যক্তিই মোক্ষযোগ্য। প্রশ্ন হল কীভাবে কর্ম সম্পাদন করা কর্তব্য। বিস্তারিতভাবে কৃষ্ণ তার কথা বলেছেন। নিষ্কাম, সংযতচিত্ত এবং সর্বপ্রকার পরিগ্রহ ত্যাগ করে কেবল শরীরের সাহায্যে কর্ম করলে পাপ হয় না। সিদ্ধি অসিদ্ধিতে সমান জ্ঞান করে কর্ম করলেও কর্মকারী বদ্ধ হন না। যজ্ঞানুষ্ঠানরত ব্যক্তির ইহলোকও নেই, পরলোকও নেই। দ্রব্যময় যজ্ঞ অপেক্ষা জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ, কেননা জ্ঞানেতেই সব কর্মের পরিসমাপ্তি। কিন্তু এ জ্ঞানলাভের জন্য দরকার প্রণিপাতের, সেবা এবং জিজ্ঞাসার। একমাত্র জ্ঞানের সাহায্যেই পাপসমুদ্র অতিক্রমণ সম্ভব। জ্ঞানরূপ অগ্নি সমুদয় কর্মকে ভস্মসাৎ করে, জ্ঞানের মত পবিত্র আর কিছুই নেই। জ্ঞানলাভ করেন যিনি শ্রদ্ধাবান এবং যিনি সংযতেন্দ্রিয়। কৃষ্ণ পরামর্শ দিয়েছেন—

তস্মাদজ্ঞানসম্ভূতং হৃদস্থং জ্ঞানাসিনাত্মনঃ।

ছিত্ত্বৈনং সংশয়ং যোগমাতিষ্ঠোত্তিষ্ঠ ভারত।। ৪২

অজ্ঞানোৎপন্ন হৃদয়ের সংশয়কে জ্ঞানরূপ খড়্গে ছেদন করে কর্মযোগে আশ্রয় গ্রহণ করার পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে। কৃষ্ণ জানিয়ে দিয়েছেন, কর্মত্যাগের তুলনায় কর্মযোগ শ্রেয়স্কর। সাংখ্য ও যোগকে এক করে দেখতে হয়।

নবম স্কন্ধার্গত দ্বাদশ অধ্যায়টিতে স্থান পেয়েছে ভক্তিযোগের কথা। কৃষ্ণ জানালেন, যাঁরা তাঁতে মন সমর্পণ করে সর্বদা সমাহিতচিত্ত হয়ে পরম শ্রদ্ধাসহ তাঁর উপাসনা করেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ যোগী। সমদৃষ্টিসম্পন্ন যিনি সর্বভূতের হিতানুষ্ঠানে নিরত ও জিতেন্দ্রিয়, তিনি কৃষ্ণকে লাভ করেন। কৃষ্ণেই মন স্থির করা চাই, তাঁতেই বুদ্ধি নিবিষ্ট করা প্রয়োজন, তাহলেই মৃত্যুর পর সেঈশ্বরেই বাস করবে। ঈশ্বরের জন্য কর্ম করলেও মোক্ষলাভ সম্ভব। অভ্যাসের তুলনায় জ্ঞান শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানের তুলনায় ধ্যান, ধ্যানের তুলনায় কর্মফল ত্যাগ শ্রেষ্ঠ, ত্যাগের মাধ্যমেই ঘটে শান্তিলাভ। সকল প্রাণীকে হতে হবে দ্বেষশূন্য, হতে হবে অহঙ্কারশূন্য, সুখে-দুঃখে সমজ্ঞানে ক্ষমাশীল, তবেই সেঈশ্বরের প্রিয় হয়। সর্বদা যিনি প্রসন্নচিত্ত, সংযতান্মা, দৃঢ়নিশ্চয়, ঈশ্বরে মন ও বুদ্ধি সমর্পণকারী, তিনিই তাঁর প্রিয়। পরশ্রীকাতরতামুক্ত হতে হবে, ভয় ও উদ্বেগ থেকেও মুক্ত হতে হবে, অনুচিত হর্ষ করা চলবে না। হতে হবে নিস্পৃহ, শুচি, অনলস ও উদাসীন, পক্ষপাতশূন্য, সকামকর্ম পরিত্যাগী। শুভাশুভ পরিত্যাগী হতে হবে, রুষ্টও হবেন না কারো প্রতি, বিদ্বেষ ভাবও পোষণ করবেন না, আকাঙ্খা করবেন না, শত্রুমিত্র সকলকে সমজ্ঞান করবেন, মানে অপমানে সমান থাকবেন, সুখে-দুঃখে সমভাববিশিষ্ট হবেন, নিন্দা ও স্তুতিকে একইভাবে গ্রহণ করবেন, যিনি স্থিরমতি ও ভক্তিমান, তিনিই ঈশ্বরের প্রিয়।

গীতার শ্লোক উদ্ধার করে লেখক জ্ঞান ও কর্মকেই অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। বলা হয়েছে, জ্ঞানীরা যেস্থান লাভ করেন, কর্মযোগীরাও তাই প্রাপ্ত হন। অজ্ঞরাই জ্ঞানযোগের সঙ্গে কর্মযোগের পার্থক্য রচনা করে। কর্ম ও জ্ঞানের অভিন্নতা সম্পর্কে বলা হলেও এদের সঙ্গে ভক্তিকে কিন্তু যুক্ত করতে দেখা যায় নি।

ভাগবদগীতা

এন. সি. পান্ডা

N.C. Panda-র Bhagavad Gita’-র প্রকাশকাল ২০০৯। গ্রন্থটি লেখক উৎসর্গ করেছেন Aldous Huxley- কে। বইটির বিশেষত্ব হল, এতে গীতার মূল শ্লোকগুলি যেমন সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে, তেমনি সেগুলিকে রোমান হরফে উপস্থাপিত করা হয়েছে। বিস্তৃত গ্রন্থপঞ্জী এবং শব্দনির্ঘণ্ট প্রদত্ত হয়েছে। গীতার মোট অধ্যায় সংখ্যা হল আঠারো। তেমনি গ্রন্থেও আঠারোটি অধ্যায়কে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়ে গীতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ের আলোচনাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। গীতার শ্লোকগুলির কোনো অনুবাদ সন্নিবিষ্ট হয়নি। কিন্তু লেখকের আলোচনায় শ্লোকগুলির অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। বিশেষ করে শ্লোক নির্বাচন করে নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি।

তৃতীয় অধ্যায় কর্মযোগ নিয়ে আলোচনাপ্রসঙ্গে লেখক প্রথমেই কর্ম ও কর্মযোগী সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করে নিতে সাহায্য করেছেন। যে কেউ নির্বিশেষে কোনো কাজে যুক্ত থাকলেই তাকে গীতার প্রেক্ষিতে কর্মযোগী বলা যাবে না। তবে কর্মযোগী কে?

Action done without attachment to the fruits thereof (nirasakta karma) is Karma Yoga. Action done as duty for the sake of duty only is Karma Yoga. Action without gainful motive and selfish interest is Karma Yoga.

অতএব A sincerely hard-working farm labourer, factory worker, business-executive, administrative officer, engineer, doctor or a politician does deserve credit for his work- culture. Still it would not be correct to say that he is a Karma-Yogi.

লেখক স্বীকার করেছেন, মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাই হল কাজ করা, ইন্দ্রিয়সুখের কারণে। কেন আমরা কাজ করি?

The acquisition of more and more wealth and power and all types of selfish interest.

সাধারণ ধারণা হল কর্মযোগ গৃহস্থদের পালনীয় আর সন্ন্যাসীদের পালনীয় জ্ঞানযোগ। কিন্তু মনে রাখতে হবে এ দুটি যোগ পরস্পরবিরুদ্ধ যেমন নয় তেমনি দুটি বিপরীত কোটিরও নয়। বরং দুইয়ের সম্পর্ক নিবিড়। তাই কৃষ্ণ বললেন বটে জ্ঞানযোগ কর্মযোগের তুলনায় শ্রেয়ঃতর, কিন্তু সেইসঙ্গে জ্ঞানযোগীদের আবার কর্ম করার পরামর্শ দিয়েছেন। এমন ধারণা আছে যে, অজ্ঞান যারা তাদের জন্য কর্মযোগ, যারা জ্ঞানী তাদের জন্যই জ্ঞানযোগ। এটা ঠিক নয়। গীতায় অনাসক্ত হয়ে কাজ করার পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে।

জ্ঞানযোগী কে? ব্রহ্মকে যিনি জানতে চান, ব্রহ্মজিজ্ঞাসু। লেখকের ভাষায় :

He realizes his non difference (identity) with Brahman / Isvara (God). অর্থাৎ জ্ঞানযোগীর সাধনা হল ‘establish his identity with God.

জ্ঞানতাপস কি করেন? চিত্তশুদ্ধি করে নেন জ্ঞানরূপ অগ্নির সাহায্যে। কর্মযোগ বন্ধনের কারণ সেই বন্ধন থেকে মুক্তি পেতেই প্রয়োজন জ্ঞানযোগের।

একজন কখনই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না যদি না সঠিক পথের সন্ধান পায়। লক্ষ্য কী? ঈশ্বরকে জানা। এজন্য প্রয়োজন আধ্যাত্মিক মইয়ের সাহায্য। ঈশ্বরে ভক্তি ব্যতিরেকে ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে না। ভক্তির প্রয়োজন সকলেরই, গৃহীরও, সন্ন্যাসীরও :

Devotion is an indispensable aid to spiritual ascension for both the householder and the sannyasi. It is also meaningful for a Jnana yogi before his final liberation (before he becomes Brahman).

ভগবদগীতার দিব্যবাণী

শশাঙ্কভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

স্বামী অভেদানন্দ প্রণীত ‘ভগবদগীতার দিব্যাবাণী’র (১ম ও ২য় খন্ড) প্রকাশকাল ২০১০। শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ লীলাপার্ষদ স্বামী অভেদানন্দ আমেরিকায় শ্রীমদ্ভগবদগীতা নিয়ে ১৯০৭ সাল থেকে যে ধারাবাহিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন ইংরেজিতে সেই বক্তৃতাগুলির বাংলা রূপান্তর স্থান পেয়েছে আলোচ্য গ্রন্থটির দুটি খন্ডে। ১ম খন্ডে আছে ৩২টি অধ্যায়, ২য় খন্ডে আছে ৩৩টি অধ্যায়। বাংলা অনুবাদের কৃতিত্ব শশাঙ্কভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

স্বামী অভেদানন্দ গীতার ব্যাখ্যায় একদিকে যেমন শঙ্কর, রামানুজ, মধ্ব, নিম্বার্ক, বল্লভ ও অন্যান্য ভাষ্যকারদের অনুসরণ করেছেন, তেমনি অন্যদিকে আবার এঁদের ব্যাখ্যা পদ্ধতিকে পুরোপুরি অনুসরণ করেন নি। বস্তুত, অভেদানন্দজীর গীতা ব্যাখ্যার মধ্যে কিছু নতুনত্ব কিছু মৌলিকত্ব হয়ে গেছে। একথা ঠিকই যে অভেদানন্দ অন্য অনেকের মত গীতার প্রতিটি অধ্যায়ের প্রতিটি শ্লোক ধরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেননি। কিন্তু তথাপি তাঁর ব্যাখ্যার গুরুত্ব তাই বলে হ্রাস পায়নি। কেননা সব শ্লোক না হোক প্রতিটি অধ্যায়ের প্রধান প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ শ্লোকগুলিকে তিনি নির্বাচন করে নিয়েছেন এবং সেগুলিকে অবলম্বন করে ধর্মতত্ত্ব, নীতি ও দর্শনের আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। প্রতিটি মানুষের মনের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলির সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং সেইসঙ্গে সমাধানও দিযেছেন। স্বামীজীর গীতা বিষয়ক বক্তৃতাগুলির প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য :

গীতার অন্তর্গত বিষয়গুলির প্রকৃত তাৎপর্য, মূল ধর্ম, দর্শন বিষয়ক চিন্তা ও ভাবরাজিকে সামনে আনা। স্বামীজী গীতাতত্ত্বের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা বিস্তৃত, যুক্তিপূর্ণ এবং বিশ্লেষণাত্মক। ক্ষেত্রবিশেষে এই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি অবশ্য এড়ানো যায়নি যেহেতু এগুলি ছিল আসলে বক্তৃতা। অভেদানন্দ তাঁর আলোচনায় ব্যাপকভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রদত্ত উপদেশাবলী ও আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্বসহ সমসাময়িক চিন্তাধারার প্রসঙ্গ এনেছেন। স্বামীজী প্রদত্ত গীতাতত্ত্বের ব্যাখ্যা যেমন বিস্তৃত, তেমনিই তা প্রভাব বিস্তারে সক্ষম।

শ্রীশ্রীমদ্ভগবদগীতা

কেদারনাথ দত্ত

বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’র ভূমিকায় বলেছেন—

পরম বৈষ্ণব ও পন্ডিত শ্রীযুক্ত বাবু কেদারনাথ দত্ত নিজকৃত অনুবাদে, অনেক সময়ে বিশ্বনাথ চক্রবর্তী প্রণীত টীকার মর্মার্থ দিয়েছেন। ইঁহাদিগের নিকট বাঙ্গালী পাঠক তজ্জন্য বিশেষ ঋণী।

এহেন কেদারনাথের জন্ম ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে নদিয়া জেলার বীরনগর গ্রামে। মৃত্যু ১৯১৪য় ৭৬ বৎসর বয়সে। বঙ্কিমচন্দ্রের বক্তব্যেই জানা গেছে কেদারনাথ ছিলেন পরম বৈষ্ণব। শতাধিক গ্রন্থের তিনি রচয়িতা। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখ্য ‘কল্যাণ কল্পতরু’, ‘শরণাগতি’, ‘জীবধর্ম’, ‘শ্রীশ্রীচৈতন্য শিক্ষামৃত’, শ্রীগৌরাঙ্গমঙ্গল স্তোত্র’, ‘দত্তকৌস্তভ’ ইত্যাদি। কেদারনাথ রচিত ইংরেজি গ্রন্থও রয়েছে। তিনি ‘সজ্জন তোষিণী’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনাও করতেন। বেশ কয়েকটি ভাষায় তাঁর ছিল ব্যুৎপত্তি যেমন, ইংরেজি, ল্যাটিন, সংস্কৃত, হিন্দী, ওড়িয়া, উর্দু, ফারসী ইত্যাদি।

কেদারনাথ শ্রীমদ্ভগবদগীতারও বঙ্গানুবাদ করেন। তাঁর মতে, গীতা শাস্ত্র সমস্ত উপনিষদের শিরোভূষণ। লেখক অবতরণিকায় কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তিযোগের বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। কর্ম তাঁর মতে চার প্রকারের—শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক। বিকর্ম, অকর্ম ও কর্মের পার্থক্য রচনা করতে গিয়ে লেখক বলেন—

১. শরীরযাত্রা নির্বাহের জন্য যে সমস্ত কার্য করা যায়, তন্মধ্যে যে সকল কর্ম জগতের অমঙ্গলজনক সেসকলকে বিকর্ম বলে।

২. মঙ্গলজনক কর্ম না করার নাম অকর্ম।

৩. যে সকল কর্ম জগন্মঙ্গলজনক সেই সকলকে কর্ম বলে।

কর্মপ্রসঙ্গে লেখকের আরও বক্তব্য :

যে কর্মে চরম উদ্দেশ্য লক্ষিত হয় নাই, সেকর্ম ভগবৎ-বহির্মুখ। তাহাকেই কর্ম বলা যায়।

লেখক স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন :

কর্ম ও জ্ঞানের সম্পর্ক বিষয়ে, তাঁর মতে বিমুক্ত কর্ম হয় না। যদিও কর্মের স্বরূপ ও জ্ঞানের স্বরূপ পৃথক।

মানবদিগের কর্ম, জড় যন্ত্রের কার্যের ন্যায় জ্ঞানশূন্য নয়। যে কর্ম মানব কতৃক কৃত হয় তাহাতে জ্ঞানের সত্তা লক্ষিত হয়। মানবের জ্ঞানালোচনাও কখন কর্মশূন্যতা লাভ করে না।

ভক্তিপ্রসঙ্গে লেখকের মন্তব্য :

বিশুদ্ধ ভক্তিই গীতা শাস্ত্রে জীবের চরম উদ্দেশ্য বলিয়া উপদিষ্ট হইয়াছে।

লেখক মনে করেন, কার্যকালে কর্ম ও জ্ঞান থেকে ভক্তিকে পৃথকরূপে নির্দেশ করা না গেলেও তাত্ত্বিক বিচারে কর্ম ও জ্ঞান থেকে ভক্তির পার্থক্য স্পষ্ট। কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি স্বভাবতঃ ভিন্ন ভিন্ন স্বরূপ। ভক্তি গূঢ় তত্ত্ব। কিন্তু জ্ঞান ও কর্মে তা জীবন স্বরূপ ও অর্থ সাধক। সেই কারণেই গীতার প্রথম ছয় অধ্যায়ে কর্মপ্রসঙ্গ, শেষ ছয় অধ্যায়ে জ্ঞানের প্রসঙ্গ, মধ্যবর্তী ছয় অধ্যায়ে ভক্তিপ্রসঙ্গকে স্থান দেওয়া হয়েছে।

লেখক প্রধানীভূতা ভক্তিকে তিনটি পর্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন—কর্ম প্রধানীভূতা, জ্ঞান প্রধানীভূতা এবং কর্মজ্ঞান প্রধানীভূতা। এই প্রেক্ষিতে যে কর্মে বা জ্ঞানে ভক্তি বৃত্তি বর্তমান তাই প্রধানীভূতা ভক্তি। যে কর্মে বা জ্ঞানে ভক্তির প্রাধান্য নেই পরন্তু কর্ম বা জ্ঞানেরই প্রভূতা, তা হল কর্ম ও জ্ঞান, তদতিরিক্ত কিছু নয়। ঐ কর্ম বা জ্ঞান, ভক্তিপদবাচ্য নয়। মোদ্দা কথা হল কেদারনাথের বিচারে ভক্তিমার্গই জীবের চরম লক্ষ্য। ভক্তিমার্গেই জীবের মুক্তি। জ্ঞান ভক্তির পোষক, ভগবৎভক্তিতেই কর্মের সাধন।

এবারে অনুবাদ প্রসঙ্গ। শ্রীমদ্ভভগবদগীতার অধিকাংশ টীকা অথবা বঙ্গানুবাদ অভেদ ব্রহ্মবাদী রচিত। বিশুদ্ধ ভগবদ্ভক্তিসম্মত টীকা বা অনুবাদ দুর্লভ। শঙ্কর ভাষ্য ও আনন্দগিরির টীকা অভেদ ব্রহ্মবাদে পূর্ণ। রামানুজ স্বামীর ভাষ্য ভক্তিসম্মত কিন্তু তার সঙ্গে গৌরাঙ্গ প্রভুর অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্বের সম্পর্ক নেই। তাই বর্তমান লেখক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী রচিত টীকার উপর নির্ভর করে গীতার অনুবাদ ও ব্যাখ্যা রচনা করেছেন। লেখক গীতার বঙ্গানুবাদকে ‘শ্রীরসিক রঞ্জন’ নামে নামাঙ্কিত করেছেন। রসিক রঞ্জন সাধু ভাষায় রচিত হলেও ভাষা সরল। নিছক আক্ষরিক অনুবাদ মাত্র নয়, ক্ষেত্রবিশেষে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-সন্নিবিষ্ট।

গীতায় সমাজদর্শন

ত্রিপুরাশংকর সেন

গীতায় স্বাস্থ্যনীতি আছে, মনস্তত্ত্ব আছে, শিক্ষা-বিজ্ঞানের সূত্র আছে, আবার সমাজদর্শনও আছে। লেখক আলোচ্য গ্রন্থে সমাজদর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ভগবদগীতার আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। গ্রন্থের মূল বক্তব্য হল নিম্নরূপ—

ক. ভারতীয় ধর্ম মানুষকে ইহকালবিমুখ করে না, এ ধর্ম স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যে সেতু রচনা করে। পৃথিবী শুধু কর্মভূমি নয়, সমরভূমিও। ক্লৈব্য ত্যাগ করে বীরের মত যুদ্ধ করতে হয়। এ যুদ্ধই হচ্ছে ধর্মযুদ্ধ। এই মহাকুরুক্ষেত্রে যখন আমাদের বুদ্ধি মোহগ্রস্ত হয়, তখন একমাত্র গীতার বাণীই আমাদের মোহ প্রবুদ্ধ করতে পারে।

খ. সংসারে দুর্বলতা বা ভীরুতার মত পাপ আর নেই। অহিংসা বা ক্ষমা পরম ধর্ম, কিন্তু দুর্বলের জন্য তা নয়।

গ. মানুষ প্রকৃতির অনুবর্তন করে কিভাবে পরম কল্যাণ লাভ করতে পারে, ভগবান সেই শিক্ষা দিয়েছেন গীতাতে।

ঘ. কৃষ্ণ গীতায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের ভেতর সমন্বয় সাধন করেছেন। মানুষের ব্যক্তিগত কল্যাণের সঙ্গে জনকল্যাণের কোনো বিরোধ নেই। পরন্তু ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিকাশের ওপরেই সমাজের বিকাশ নির্ভরশীল।

ঙ. কৃষ্ণ বলেছেন, আমরা আত্মপ্রীতি বা আত্মসুখের জন্য যেসব কাজ করি, সেসব কাজ যদি ভগবৎপ্রীতির জন্য বা লোকহিতের জন্য করা যায়, তবে তাই হয়ে ওঠে যজ্ঞ। যজ্ঞের জন্য দ্বৈত কর্ম ভিন্ন অপর কর্ম মানুষের বন্ধনের কারণ হয়।

চ. গীতায় লোকসংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। লোকসমূহকে স্বধর্মে প্রবৃত্ত করা হল লোকসংগ্রহ। লোক-সমূহের স্বেচ্ছাচারিতা বা উন্মার্গগামিতা নিবারণ করতে হবে। লোকসংগ্রহের জন্য কাজ করা চাই। কর্মের উদ্দেশ্য হবে লোকহিত। অপরের কল্যাণসাধনের ভিতর দিয়েই নিজের কল্যাণ করতে হবে।

ছ. গীতায় কর্মযোগেরই প্রাধান্য। কেউ যদি কর্মত্যাগের অধিকারী হন, তবু লোক- শিক্ষার জন্য তিনি কর্ম করবেন। প্রসঙ্গত লেখক কাণ্টের বক্তব্য এনেছেন। কাণ্ট চারিত্রনীতির যে আদর্শ স্থাপন করেছেন, তার সঙ্গে কর্মযোগের আদর্শের পার্থক্য রয়েছে। মানুষের প্রকৃতিভেদে ও অধিকার ভেদে কর্ম যে বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে, কাণ্ট তা স্বীকার করেন নি, তিনি Duty for duty’s sake-এ বিশ্বাসী ছিলেন। কাণ্ট যোগযুক্ত কর্মের কথা বলেন নি, মানুষের বিচারবুদ্ধির ওপরই ছিল তাঁর সর্বাধিক নির্ভরতা।

লোকসংগ্রহের উপায় সম্পর্কে লেখকের মত :

যাঁরা পরহিত ব্রতচারী তাঁরাই লোকসংগ্রহের অধিকারী। সকলে এই অধিকার লাভ করেন না। Totalitarian state-এ লোকসংগ্রহ সম্ভব নয়। দৃঢ়তার সঙ্গে লেখকের অভিমত ব্যক্ত হয়েছে, এখানে রাষ্ট্রের যূপকাষ্ঠে ব্যক্তির বলিদান করা হয়। মানুষের রুচিভেদ ও প্রকৃতিভেদ এই শাসন ব্যবস্থায় অস্বীকৃত। লেখক বিশ্বাস করেন, প্রত্যেকেরই পরিপূর্ণ আত্মবিকাশের জন্য চিন্তা, কর্ম ও বাক্যের স্বাধীনতা থাকা দরকার। তবে এও সত্য যে, সমাজে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ। সমষ্টিগত কল্যাণ ব্যাহত হয় এমন কোনো কাজ করার অধিকার কারো নেই।

লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ব্যষ্টির কল্যাণের সঙ্গে সমষ্টির কল্যাণের বিরোধ নেই। যে মানুষ শুধু নিজের কল্যাণ ও মুক্তির কথা চিন্তা করে সেস্বার্থপর। সমাজের প্রতি প্রত্যেকেরই কর্তব্য আছে। বিস্মৃত হলে চলবে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে ধর্ম সংস্থাপন করেছেন তার বৈশিষ্ট্য হল বৈদিক কর্মকান্ড যা প্রচলিত বর্ণাশ্রম ধর্মকে আঘাত করে নি। লোকসংগ্রহের আদর্শ কৃষ্ণ স্থাপন করেছেন। রুচিভেদে ও প্রকৃতিভেদে মানুষের উপাসনা পদ্ধতির ভিন্নতা স্বীকার করেও তিনি বলেছেন : যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাং স্তথৈব ভজাম্যহম। গীতায় কৃষ্ণ স্বধর্মের অনুসরণ করতে অর্থাৎ প্রকৃতি নির্দিষ্টকর্ম করতে বলেছেন।

কর্মযোগের দুটি সূত্রের একটি হল—স্বার্থবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে শুধু বিষ্ণুর প্রীতির জন্য কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের কর্ম করতে হবে লোকসংগ্রহ বা লোকশিক্ষার জন্য। কর্ম মাত্রই তা যে বন্ধনের কারণ নয়, সেই প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য :

অনাসক্ত হয়ে প্রতিটি করণীয় কাজ করলে কর্ম বন্ধনের কারণ হয় না, বরং সেই কর্মের দ্বারাই আমরা তত্ত্ব-জ্ঞান পেতে পারি। এইরূপ জ্ঞানই বা তত্ত্বদর্শী যেখানে সমাজ বা রাষ্ট্রের নায়ক, সেখানেই আদর্শ সমাজ বা আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।

গীতায় কৃষ্ণ তত্ত্বজ্ঞানের প্রশংসা করেছেন। তত্ত্বজ্ঞানের আলোকেই স্বধর্মের অনুসরণ করতে হবে, স্ব স্ব কর্ম নির্ণয় করতে হবে। প্রসঙ্গত সমাজদর্শনে সেই সমাজকেই আদর্শ সমাজ বলা হয়েছে যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সুযোগ পায়। লেখক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন :

ভারতের সাম্যবাদের প্রবক্তা হলেন কৃষ্ণ। কিন্তু কৃষ্ণের সাম্য ভল্টেয়ার, রুশো প্রভৃতিদের সাম্যবাদ নয়। কার্লমার্কস যে শ্রেণীহীন সমাজের কথা বলেছেন, বলেছেন সমভোগবাদের কথা, কৃষ্ণ-কথিত সাম্য তা নয়। এ সাম্যবাদের মূল কথা হল মানুষে মানুষে পার্থক্য পরিমাণগত, গুণগত নয়। লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন জৈন- দর্শনে এই সাম্যবাদ স্বীকৃত। এ সাম্যবাদ প্রত্যেক মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে মেনে নেয়।

গীতায় কৃষ্ণ নৈসর্গিক চাতুর্বর্ণ্যের কথা বলেছেন, কখন বংশগত চাতুর্বর্ণ্যের কথা বলেন নি। তপস্যার প্রভাবে শূদ্র ব্রাহ্মণ হতে পারে, আবার তপস্যার অভাবে ব্রাহ্মণ শূদ্র হয়। বর্ণাশ্রম প্রথা এখানে অপরিবর্তনশীল নয়।

লেখক সতর্ক করে দিয়েছেন, জাতিভেদ প্রথা যখন সম্পূর্ণ বংশগত হয়ে দাঁড়ায়, মানুষে মানুষে যখন কৃত্রিম ব্যবধান রচিত হয়, তখন সেটা একটা মস্ত অভিশাপ। তবে লেখক মনে করেন চাতুর্বর্ণ্য ও চতুরাশ্রমের ভেতরেই রয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতির বিশিষ্টতা।

লেখক আঙ্গিক মতবাদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। আধুনিক সমাজদর্শনে যাকে আঙ্গিক মতবাদ (Organic Theory of Society) বলা হয়, তার মূল কথা হল :

মানবদেহের সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যে সম্পর্ক, সমাজদেহের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষেরও সেই সম্পর্ক। লেখক মনে করেন, গীতায় ভগবান কৃষ্ণ এই আঙ্গিক মতবাদকে স্বীকার করেছেন, কিন্তু ব্যক্তির মহিমাকে তিনি কোথাও ক্ষুণ্ণ করেন নি। এজন্যই তিনি যাগযজ্ঞাদিকে কোথাও প্রাধান্য দেননি। বলেছেন, যাগযজ্ঞাদির দ্বারা মানুষ জীবনে পরম মঙ্গল লাভ করতে পারে না। অনলস কর্মসাধনার দ্বারাই মানুষকে পরম মঙ্গল লাভ করতে হবে।

পৃথিবীর তাবৎ সমাজবিজ্ঞানীরা ধর্ম ও ধর্ম প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, মানুষ ধর্মের বহিরঙ্গগত অনুষ্ঠানকে প্রাধান্য না দিয়ে ধর্মের অন্তর্নিহিত সত্যকে যতই উপলব্ধি করবে, ততই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভেতর ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। লেখক মনে করেন কৃষ্ণ পরিকল্পিত আদর্শ সমাজে ধর্মান্ধতার কোনো স্থান নেই। কেননা সেখানে সব মানুষই কর্মজ্ঞানের দ্বারা চালিত। ধর্মজ্ঞান বিমুক্ত সেখানে কেউ নন। অর্জুনকে কৃষ্ণ জ্ঞানের মহিমা কীর্তন করে শুনিয়েছেন—

ক. জ্ঞানলাভের ফলে মোহ নষ্ট হয়।

খ. সর্বাধিক পাপীও জ্ঞানরূপ ভেলাকে আশ্রয় করে সর্ববিধ পাপ থেকে উত্তীর্ণ হয়।

গ. পৃথিবীতে জ্ঞানের মত পবিত্র আর কিছু নেই।

ঘ. যিনি যোগসিদ্ধ, তিনি যথাকালে আপনি জ্ঞানলাভ করেন।

ঙ. যিনি শ্রদ্ধাবান একনিষ্ঠ ও ইন্দ্রিয়জয়ী শুধু তিনিই জ্ঞানলাভ করেন।

চ. যে অজ্ঞ শ্রদ্ধাহীন সংশয়াত্মা সেবিনাশপ্রাপ্ত হয়।

ছ. সংশয়ের উদ্ভব অজ্ঞানতা থেকে, তাই জ্ঞানরূপ অসির দ্বারা এই সংশয়ছেদন আবশ্যক।

জ. মানুষের পক্ষে প্রকৃতিনির্দিষ্ট কর্ম করা বা স্বধর্ম আচরণ করাই জ্ঞানলাভের উপায়।

গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে যজ্ঞের কথা উল্লিখিত। লেখকের মতে যে কর্মের দ্বারা নিজের অথবা অপরের হিত হয় তাই যজ্ঞ। তাই ভূদান, শ্রমদান, বিদ্যাদান এ সবই যজ্ঞের অন্তর্গত।

লেখক মনে করেন, ভগবান মনে করেছেন কর্মের লক্ষ্য হল জ্ঞানলাভ। কিন্তু জ্ঞানলাভের অধিকার সকলের নেই। সংসারে জ্ঞানী ব্যক্তি দুর্লভ। কিন্তু পন্ডিতম্মন্য ব্যক্তির অভাব নেই। অধীত বিষয়কে যিনি আত্মসাৎ করে চরিত্রে প্রতিফলিত করেছেন তিনিই জ্ঞানী। শ্রদ্ধাবানই জ্ঞানলাভের অধিকারী। ভগবানের মতে দৃশ্যমান জগৎটা সম্পূর্ণ সত্য। প্রত্যেককে লোককল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে অনাসক্তভাবে। কর্মযোগ ভিন্ন সন্ন্যাসলাভ কষ্ট- সাধ্য। সংসারের মানুষ যদি যোগযুক্ত হয়ে কর্ম করে, তবে সেকর্ম কখনও বন্ধনের কারণ হয় না। মানুষ সংসার ত্যাগ করতে পারে, কিন্তু ইচ্ছা করলেই কর্ম ত্যাগ করতে পারে না। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, সমাজে অভিব্যক্তি আর সমাজের অগ্রগতি অভিন্ন নয়। লেখক মনে করেন :

. . . সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিগণ যখন কোনো একটা মহান লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হবার জন্যে সচেতন- ভাবে চেষ্টা করেন, তখনই বুঝতে হবে সমাজে যথার্থ অগ্রগতি হচ্ছে।

লেখকের দৃষ্টিতে :

কৃষ্ণ শুধু একজন বরেণ্য পুরুষ বা মহামানব নন, তিনি পুরুষোত্তম বা পরিপূর্ণ মানবতার আদর্শ, তিনি ধর্মভিত্তিক অখন্ড ভারত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।

লেখক মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী :

মানুষ যেখানে সর্বপ্রকার আতিশষ্য বর্জন করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে সেখানেই সুস্থ সমাজ গড়ে ওঠে। . . . গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মধ্যপন্থার কথা বলেছেন . . . মধ্যপন্থাই মানুষের পক্ষে কল্যাণের পন্থা।

প্রসঙ্গত আমরা স্মরণ করতে পারি Aristotle আতিশয্যকে পাপ বলেছেন, মধ্যপন্থাকেই মানুষের পক্ষে কল্যাণের পথ বলেছেন।

কৃষ্ণ দার্শনিক ভিত্তির ওপর তাঁর সাম্যবাদের আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। তিনি ‘সান্ত্ববাদী’ বা শান্তিকামী হয়েও কুরুপান্ডবের যুদ্ধ বা স্বীয় বংশের ধ্বংসলীলা নিবারণ করতে পারেন নি। এ বিষয়ে লেখকের মন্তব্য :

একথাও জানতেন যে, মানুষ যে পর্যন্ত সাম্যে প্রতিষ্ঠিত বা সমদর্শী না হবে সেপর্যন্ত পৃথিবীতে শান্তি স্থাপিত হতে পারে না।

গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে কৃষ্ণ যোগের আলোচনা করলেও ক্রিয়াযোগকে প্রাধান্য দেননি। লেখকের অন্তত তাই মনে হয়েছে। আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে গেলে আমাদের যোগী হতে হবে। মনকে একটি লক্ষ্যের অভিমুখ করতে হবে। কৃষ্ণ বলেছেন :

তপস্বী অপেক্ষা যোগী শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানী অপেক্ষা যোগী শ্রেষ্ঠ, কর্মকান্ডী অপেক্ষা যোগী শ্রেষ্ঠ। অতএব হে অর্জুন, তুমি যোগী হও।

শ্রেষ্ঠ পুরুষ কে? যিনি শুধু যোগযুক্ত নন, যিনি সমদর্শী, যিনি ভগবানে মন যুক্ত রেখে, তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে ভজনা করেন অর্থাৎ লেখক কর্ম, জ্ঞান, যোগ ও ভক্তির মধ্যে সমন্বয়ের আদর্শ লক্ষ্য করেছেন।

কৃষ্ণ যে ধর্ম সংস্থাপন করেছিলেন তার মূল কথা হচ্ছে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। যে রাজা বা যে ক্ষত্রিয় এই ধর্ম পালন না করেন তিনি স্বধর্ম থেকে ভ্রষ্ট। লেখকের মতে কৃষ্ণ ‘মহাসমন্বয়াচার্য’। কৃষ্ণ যে ধর্মরাজ্য স্থাপন করেছিলেন সেখানে সকলেরই রয়েছে চিন্তার স্বাধীনতা, রয়েছে কর্মের স্বাধীনতা এমনকি রুচি অনুসারে উপাসনারও অধিকার আছে। কৃষ্ণ পরিকল্পিত রাষ্ট্রে কেউ কারো ধর্মাচরণে বাধা দেবে না। কারণ সেরাষ্ট্রে অধিকারভেদ স্বীকৃত। এই প্রেক্ষিতেই লেখকের অভিমত কৃষ্ণ পরিকল্পিত রাষ্ট্র ‘Secular State’, লেখকের ভাষায় ‘ধর্মরাষ্ট্র’ তবে এ ধর্ম কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্ম নয়। লেখকের বিশ্বাস কৃষ্ণ প্রাচীন বা তৎকালীন সমাজব্যবস্থাকে ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়ে তুলতে চাননি। তিনি বলেন নি সকল ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষ সমাজে সমান অধিকারী। বর্ণভেদই সমাজের দুর্গতির কারণ। অতএব এই ভেদকে লুপ্ত করতে হবে। কৃষ্ণ জানতেন :

ঐক্য আর একাকারত্ব এক কথা নয়। কোনো প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলাই কল্যাণকর নয়।১০

লেখকের দৃঢ় প্রতীতী শ্রীকৃষ্ণ প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে ভাঙতে আসেন নি। বরং তিনি এসেছিলেন তাকে পূর্ণতা দিতে। যীশুর বক্তব্যের সঙ্গে এখানে গভীর সাযুজ্যের সন্ধান মেলে। যীশু বলেছিলেন :

I Am not come to destroy, but to fulfil.

শিক্ষাবিজ্ঞানের প্রসঙ্গও গীতায় পাই। লেখক এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি মনে করেন কৃষ্ণ শিক্ষাবিজ্ঞানের মূল সূত্রের আবিষ্কর্তা। এযুগের পক্ষেও কৃষ্ণের শিক্ষাদর্শ অনুসরণযোগ্য। ‘স্বধর্মের আচরণই আমাদের জীবনের লক্ষ্য’।১১

সংসারে প্রত্যেক মানুষের ভিতর দেখতে পাই রুচিভেদ ও প্রকৃতিভেদ। এই দুই ভেদের কথা স্মরণে রেখেই শিক্ষা ব্যবস্থা করা উচিত১২ বলে লেখকের বক্তব্য। লেখক গীতায় আহারের প্রসঙ্গও এনেছেন। তিনি মনে করেন আহার্য সম্পর্কে কৃষ্ণ যা বলেছেন একালের বৈজ্ঞানিকদেরও তা প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু বিস্মৃত হলে চলবে না গীতায় কৃষ্ণ বিশেষ কোনো খাদ্যের উল্লেখ করেন নি। কয়েকটি নীতির উল্লেখ করেছেন মাত্র। কৃষ্ণ জানতেন দেশভেদে ঋতুভেদে পরিবেশের ভিন্নতা এমনকি বৃত্তিভেদেও আহারের তারতম্য হওয়া স্বাভাবিক।১৩ কৃষ্ণকে বড় মাপের মনস্তাত্ত্বিক বলেও মান্যতা দেওয়া হয়েছে। লেখকের বক্তব্য :

মানুষের প্রত্যেকটি কর্ম সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিতির অনুকূল হওয়া চাই, তাকে এমন কর্ম করতে হবে যাতে সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ কর্তব্যসাধনে উৎসাহিত হয়।১৪

গীতায় জীবনবাদ

ত্রিপুরাশংকর সেন

উত্তর নবাবপুর ঢাকা থেকে প্রকাশিত তিনটি স্তবকে বিন্যস্ত পুস্তিকাটি, মনস্বী লেখক গীতার অসাধারণ ব্যাখ্যা- প্রসঙ্গে বললেন :

গীতার বাণী মহা সমন্বয়ের বাণী, সাম্যের বাণী, মৈত্রীর বাণী, স্বাধীনতার বাণী। মনুষ্যত্বের যে অখন্ড আদর্শ, যে পরিপূর্ণ রূপ পার্থসারথির চোখে ধরা দিয়েছে, আমাদের দুর্বল মস্তিষ্ক তা ধারণ করতে অসমর্থ হয়েছে।

কেন জীবনবাদের আলোচনা? লেখক তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন—কারণ :

আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে দেখা দিয়েছে অবসাদ, ক্লৈব্য, জড়তা। তাই আজ গীতার জীবনবাদ সম্বন্ধে আলোচনার বিশেষ প্রয়োজন . . .।

অন্য অনেকের মত, বিশেষত কোনো কোনো পূর্বসূরীদের মত লেখক গীতার ‘সমন্বয়বাদ’ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত :

গীতার মধ্যে এই সমন্বয়ের বাণী সবিশেষ পরিস্ফুট। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শাশ্বত ধর্ম ও অধিকারবাদের, কর্মযোগ ও কর্মসন্ন্যাসের, পুরুষকার ও সমর্পণযোগের যে অপূর্ব সমন্বয় সাধন করেছেন, কোথাও তার তুলনা নেই।

গীতায় জীবনবাদ বলতে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন ব্যবহারিক জীবনের কষ্টিপাথরে গীতার মূল্য যাচাই করা। কৃষ্ণ বলেছেন গীতায়, মানুষের মত বাঁচতে চাও যদি, জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিজয়লাভ করতে চাও যদি, স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত হতে চাও যদি, তবে ‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ’, ক্লৈব্যকে আশ্রয় করো না। ‘নাত্মানমেব সাদয়েৎ’, অবসাদকে প্রশ্রয় দিয়ো না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় অর্জুনের মধ্যে এই ক্লৈব্য উপস্থিত হয়েছিল, স্বধর্ম বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন—লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন :

আমাদের ব্যষ্টিগত ও জাতীয় জীবনে যখন এই মোহ, এই জড়তা, এই অবসাদ, এই ক্লীবতা এসে উপস্থিত হয়, তখন আমরা তমোগুণকে আশ্রয় করে, সত্ত্বগুণের দোহাই দিয়ে আত্মবঞ্চনা করি, ক্ষুদ্র হৃদয়-দৌর্বল্যের অধীন হয়ে ধর্মযুদ্ধে যোগদান করতে ভীত হই—তখন আমরা দুর্বলতাকে ক্ষমা বলে ভ্রম করি, কাপুরুষতাকে বৈরাগ্য বলে ভ্রম করি, জড়তাকে সত্ত্বগুণ বলে ভ্রম করি, অবসাদকে শান্তিপ্রিয়তা বলে ভ্রম করি, আর কর্মহীনতাকে ত্যাগ বলে ভ্রম করি . . . .।

আত্মরক্ষার জন্য, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিরামহীন সংগ্রামই কৃষ্ণের যথার্থ উপাসনা, উপাসনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ব্যক্তিগত তথা জাতীয় জীবনে।

লেখক যৌথ উপাসনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সম্মিলিত কন্ঠে গীতার আবৃত্তিকে তিনি সংঘবদ্ধ উপাসনা বলেছেন।

দ্বিতীয় স্তবকে বলা হয়েছে—আধুনিক যুগের সর্ববিধ সমস্যার সমাধান গীতায় লভ্য। এককথায় গীতা হল মুশকিল আসান। নবযুগের বাণী হল স্বাধীনতা ও মানবতার বাণী। গীতা মানবতার আদর্শ প্রচার করেছে, সর্বভূতে মৈত্রীর আদর্শও প্রচার করেছে।

জাতীয় জীবনে যে দুঃখ-দৈন্য, তার কারণ ভগবানের বাণীকে আমরা সার্থক করে তুলতে পারিনি। মানুষে মানুষে কৃত্রিম ব্যবধান রয়েছে, অগণিত মানুষকে অস্পৃশ্য অশুচি করে রেখেছি, নারীকে মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি।

যুগ যুগ ধরে যে পাপ করা হয়েছে, তার প্রায়শ্চিত্ত হল সংহতি, সহযোগ ও সংগ্রহ। লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন, যারা সংহত তারা বাঁচে, আর যারা অসংহত তারা বিনাশপ্রাপ্ত হয়। স্বেচ্ছায় যারা পরস্পরের সহযোগিতা করে তারাই শ্রেয়ো লাভ করে। এ সংসারে কেউই ঘৃণ্য নয়, কেউ হেয় নয়, কেউ অস্পৃশ্য নয়—এই দৃঢ় বিশ্বাসকে জাগ্রত করে তুলতে হবে। সংগ্রহ চাই, বর্জন নয়। চাই অর্জন, অস্বীকার নয়, চাই স্বীকৃতি, অপচয় নয়, চাইসঞ্চয়। গীতায় ‘লোকসংগ্রহ’ কথাটি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থ হল লোকসকলকে স্বধর্মে প্রবর্তন, লোক- শিক্ষা, জনবল বৃদ্ধি। এই লোকসংগ্রহই জাতিকে সঞ্জীবিত করে, লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন। আপৎকালের জন্য ক্ষাত্রধর্ম পালনই একমাত্র ধর্ম। অভী: মন্ত্রই একমাত্র মন্ত্র। গীতায় ভগবান শাশ্বত ধর্ম, যুগধর্ম ও আপদ্ধর্মের বক্তা।

গ্রন্থের তৃতীয় স্তবকটি সংক্ষিপ্ততম। লেখকের সতর্কীকরণ—ধর্মকে যেন বিসর্জন না দিই। গীতায় কৃষ্ণ সর্বপ্রকার আতিশয্য বর্জন করতে বলেছেন। গীতায় আহার সম্বন্ধে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে—শারীর বিজ্ঞান ও মনস্তত্ত্বের দিক থেকে তার আলোচনা করলে কল্যাণ হবে। ব্রহ্মতত্ত্ব নয়, পরলোকতত্ত্ব নয়, আপন মহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত হতে হবে, সেজন্য চাই আত্মশক্তির শুভ উদ্বোধন।

.

জ্ঞানেশ্বরী / জ্ঞানদেব বিরচিত :

১. জ্ঞানেশ্বরী, পৃ – ৫৭

২. জ্ঞানেশ্বরী, পৃ – ৮৪

দি ভাগবদ গীতা; জন ডেভিস

১.  The Bhagavad Gita, John Davies, 1893, Introduction, p-5

২.  Ibid, p-9

৩.  Ibid, p-9

৪.  Ibid, p-10

৫.  Ibid, p-10

৬.  Ibid, p-10

৭.  Ibid, p-11

৮.  Ibid, p-15

৯.  Ibid, p-200-201

কর্মযোগ / প্রমথনাথ তর্কভূষণ :

১. কর্মযোগ, প্রমথনাথ তর্কভূষণ, পৃ – ৪

২. ঐ ঐ পৃ – ১০

৩. ঐ ঐ পৃ – ১১

৪. ঐ ঐ পৃ – ১২

৫. ঐ ঐ পৃ – ১৬

শ্রীমদভাগবদগীতা / স্বামী স্বরূপানন্দ:

১.  Shrimad – Bhagavad Gita ; Swami Swarupananda, p-i

২.  Ibid p-ii

৩.  Ibid, 4th chapter, p-106

৪.  Ibid p-109

৫.  Ibid p-283

সচিত্র গীতা / উপেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য

১. পরিশিষ্ট, গীতামৃত সার, শ্রীমদ্ভগবদ গীতা, পৃ : ৩৬০

২. ঐ ঐ ঐ পৃ : ৩৬৪ – ৩৬৫

৩. ঐ ঐ ঐ পৃ : ৩৬৫ – ৩৬৬

শ্রীমদ্ভগবদ গীতা/অতুলচন্দ্র সেন:

১. শ্রীমদ্ভগবদগীতা, অতুলচন্দ্র সেন, ৩য় সংস্করণ, জনমুত্রণ, ২০০০; পৃ – ১১

২. তদেব তৃতীয় অধ্যায় পৃ – ১২৯

৩. তদেব ঐ পৃ – ১২৯

৪. তদেব ঐ পৃ – ১৫৬

৫. তদেব চতুর্থ অধ্যায় পৃ – ২১২

৬. তদেব দ্বাদশ অধ্যায় পৃ – ৪১৮

গীতার্থ চিন্তা / চক্রধর আচার্য :

১. চক্রধর আচার্য, গীতোক্ত কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি পৃ – ৮৯

২. ঐ ঐ পৃ – ৯০

৩. ঐ ঐ পৃ – ৯৯

৪. ঐ ঐ পৃ – ৯০

৫. ঐ ঐ পৃ – ৯৪

৬. ঐ গীতার্থ চিন্তা, গীতোক্ত কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি পৃ – ৯৫

৭. ঐ ঐ পৃ – ৯৬

৮. ঐ ঐ পৃ – ৯৭

৯. ঐ ঐ পৃ – ৯৭

১০. ঐ ঐ পৃ – ১০৪

১১. ঐ ঐ পৃ – ১০৭

দি ভাগবদগীতা, পি. লাল:

১.  The Bhagavad Gita; P . Lal (1968) p-16

২.  Ibid, p-10

৩.  Ibid, p-11

৪.  Ibid, p-12

৫.  Ibid, p-12

৬.  Ibid, p-43

৭.  Ibid, p-81

৮.  Ibid, p-131

শ্রীমদ্ভগবদ গীতা / স্বামী জগদীশ্বরানন্দ

১. ভূমিকা, ৮ম সংস্করণ, ১৯৬১; পৃ – ৮৬

দি ভাগবদ গীতা; জুয়ান মাসকারো:

১.  The Bhagavad Gita; Juan Mascaro, 1962, Introduction, p-23

২.  Ibid, p-23

৩.  Ibid, p-23

৪.  Ibid, p-33

৫.  Ibid, p-33

৬.  Ibid, p-28

৭.  Ibid, p-30

৮.  Ibid, p-31

৯.  Ibid, p-31

পেরিনিয়াল সাইকোলজি অফ দি ভাগবদ গীতা / স্বামী রামা:

১.  Introduction; page-1

২.  Introduction; page-1

৩.  Introduction; page-2

৪.  Introduction; page-2

৫.  Introduction; page-6

৬.  Introduction; page-9

৭.  Introduction; page – 11

৮.  The Yoga of Action, chap iii, page-162

৯.  The Yoga of Action, chap iii, page-162

১০.  The Yoga of Action, chap iii, page-162

১১.  Knowledge of Renouncing Fruits ; Chap iv; page-198

১২.  Knowledge of Renouncing Fruits ; Chap iv; page-198

১৩.  Knowledge of Renouncing Fruits ; Chap iv; page-198-199

১৪.  The Yoga of Devotion ; Chap xii; page-364

সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভগবদ গীতা / জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়:

১. ২য় সংস্কোরণ, ১৯৯৭, পৃ – ১১

২. ঐ পৃ – ১১ – ১২

৩. ঐ ১ম পরিচ্ছেদ, ২য় নং, ১৯৯৭, পৃ – ২৫

৪. ঐ ঐ পৃ – ২৬

৫. ঐ ঐ পৃ – ২৬

৬. ঐ ৪ঠ পরিচ্ছেদ পৃ – ৬১

৭. ঐ ঐ পৃ – ৬২

৮. ঐ ভগবদগীতার ধর্ম সংস্থাপন, ৫ম পরিচ্ছেদ পৃ – ৮২

৯. ঐ ঐ নিস্কামকর্মের মাট সামাজিক তাৎপর্য, নাম পরিচ্ছেদ পৃ – ১৪৫

১০. ঐ ঐ পৃ – ১৪৫

১১. ঐ ঐ পৃ – ১৫২ – ১৫৩

শ্রীমদ্ভগবদগীতা / শ্রীমৎ স্বামী সত্যানন্দদেব :

১. অষ্টাদশোহধ্যায়, পৃ – ৭০৮

২. ঐ পৃ – ৬৮৪

৩. পঞ্চদশোহধ্যায়, পৃ – ৬০২ – ৬০৩

৪. ত্রয়োদশোহধ্যায়, পৃ – ৫৩৭ – ৫৩৮

শ্রীমদ্ভগবদগীতা / সুরধূনী দেবী:

১. ১ম মহেশ সংস্করণ, ১৪০৩, পৃ – ৭০

২. ঐ ঐ পৃ – ৬

৩. ঐ ঐ পৃ – ৬

৪. ঐ ঐ পৃ – ৬

৫. ঐ ঐ পৃ – ৬

৬. ঐ ঐ পৃ – ৬

৭. ঐ ঐ পৃ – ৬

শ্রীমদভগবদ গীতা (তত্ত্ব বিবেচনী) : জয়দয়াল গোয়েন্দকা

১. নম্র নিবেদন; পৃ – xii

২. ঐ পৃ – xiii

৩. ঐ পৃ – xxiii

৪. ঐ পৃ – xxiv

৫. ঐ পৃ – xiii

৬. ঐ পৃ – xvii

৭. ঐ পৃ – xxi

উপনিষদ রহস্য বা গীতার যৌগিক ব্যাখ্যা / বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মা :

১. শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মা, শ্রীমদ্ভগবদগীতা, ৭ম অধ্যায়, ব্রহ্মখন্ড, ৩য় খন্ড, পৃ – ৯

২. ঐ ঐ, ভূমিকা, ১ম খন্ড , (১ম ও ২য় অধ্যায় সম্বলিত)

৩. ঐ ঐ, ৩য় অধ্যায়, কর্মযোগ, পৃ : ১১-১২

৪. ঐ ঐ, ঐ ঐ পৃ – ১৫

৫. ঐ ঐ, ২য় খন্ড, জ্ঞানযোগ, পৃ – ১৭৪

৬. ঐ ঐ, ৩য় খন্ড, ১০ম অধ্যায়, পৃ – ২২৮

গীতোপনিষদ / প্রভুপাদ ভক্তিবেদান্ত স্বামী:

১. কর্মযোগ, পৃ – ২০৯, শ্লোক – ১০

২. ঐ পৃ – ২১১, পৃ – ১১

৩. ঐ পৃ – ২১৮, পৃ – ১৫

৪. ঐ পৃ – ২২৭, পৃ – ২২

৫. ঐ পৃ – ২৫১, পৃ – ৪০

৬. জ্ঞানযোগ, ৪ঠ অধ্যায় পৃ – ২৬২

৭. ঐ ঐ পৃ – ২৬৭

৮. ঐ ঐ পৃ – ২৭৮

৯. ঐ ঐ পৃ – ২৭৮

১০. ভক্তিযোগ, ১২শ অধ্যায় পৃ – ৭৭০

১১. ঐ ঐ পৃ – ৭০৮

১২. ঐ ঐ পৃ – ৭১০

১৩. ঐ ঐ পৃ – ৭১৮

১৪. ঐ ঐ পৃ – ৭১৮

১৫. ঐ ঐ পৃ – ৭২৭

দি এসেন্স অফ দি ভাগবদ গীতা, স্বামী ক্রিয়ানন্দ:

১.  The allegory of the Gita ; chap – iii; page – 12-13

২.  The allegory of the Gita ; chap – iii; page – 14

৩.  The nature of Right Action ; chap – xii; page – 79

৪.  The nature of Right Action ; chap – xii; page – 115

৫.  Why Fight ; chap – xiii; page – 128

৬.  The Supreme Science of knowing God ; chap-xvi; page -195 – 196

৭.  The Supreme Science of knowing God ; chap-xvi; page -198

৮.  The Supreme Science of knowing God ; chap-xvi; page -185

৯.  The Supreme Science of knowing God ; chap-xvi; page -187

১০.  The Supreme Science of knowing God ; chap-xvi; page -189

১১.  The Field of battle ; chap – xxvi ; page – 445

দি ভাগবদ গীতা ডকট্রিন অ্যাণ্ড কনটেকসটস, অ্যাঞ্জেলিকা ম্যালিনার:

১.  page – 81

২.  page – 80

৩.  page – 80

৪.  page – 80

৫.  page – 81

৬.  page – 109

৭.  page – 194

৮.  page – 229

৯.  page – 200

১০.  page – 201

১১.  page – 201

১২.  page – 201

১৩.  page – 201

পার্সোনাল একসেলেন্স থ্রু দি ভাগবদ গীতা / স্বামী সুখবোধানন্দ:

১.  Chapter iv; Detachment – an Inner Awakening, page-26

২.  Chapter iv; Detachment – an Inner Awakening, page-27

৩.  Chapter iv; Detachment – an Inner Awakening, page-26

৪.  Chapter iv; Detachment – an Inner Awakening, page-27

৫.  Chapter v; Commitment – the Awakening of Excellence; page-49

৬.  Chapter v; Commitment – the Awakening of Excellence; page-53

৭.  Chapter v; Commitment – the Awakening of Excellence; page-52

৮.  Chapter v; Commitment – the Awakening of Excellence; page-52

৯.  Chapter v; Commitment – the Awakening of Excellence; page-48

১০.  Chapter v; Commitment – the Awakening of Excellence; page-43

১১.  Chapter vi; The Three Realities – From Prison to Divine Presence; page-39

১২.  Chapter vi; The Three Realities – From Prison to Divine Presence; page-39

১৩.  Chapter vi; The Three Realities – From Prison to Divine Presence; page-35

১৪.  Chapter vi; The Three Realities – From Prison to Divine Presence; page-29

১৫.  Chapter vi; The Three Realities – From Prison to Divine Presence; page-30

১৬.  Chapter vii; Yoga – The dropping of Prison habits; page-57

১৭.  Chapter vii; Yoga – The dropping of Prison habits; page-57

১৮.  Chapter vi; The three realities – From Prison to Divine Presence ; page-49

শ্রীমদ্ভগবদগীতা / স্বামী অদ্বৈতানন্দ :

১. চতুর্থো অধ্যায়, শ্লোক ২৩, পৃ – ১৬৯

শ্রীগীতা / জগদীশচন্দ্র ঘোষ :

১. জগদীশচন্দ্র ঘোষ, শ্রীগীতা ; ষষ্ঠ বিংশতিতম সংস্করণ, ২০০৯, পৃ – ৫৮

২. ঐ ঐ ঐ পৃ – ৫৯

৩. ঐ ঐ ঐ পৃ – ৫৯

৪. ঐ ঐ ঐ পৃ – ৬২

৫. ঐ ঐ ঐ পৃ – ৬২

৬. ঐ ঐ ঐ পৃ – ৬৩

৭. ঐ ঐ ঐ পৃ – ১১২

৮. ঐ ঐ ঐ পৃ – ১১৭

৯. ঐ ঐ ঐ পৃ – ৫০

১০. ঐ ঐ ঐ পৃ – ১১৭

১১. ঐ ঐ ঐ পৃ – ১১৭

ভাগবদ গীতা / এন. সি. পান্ডা :

১.  Karma-yogah; page-106

২.  Karma-yogah; page-106

৩.  Karma-yogah; page-107

৪.  Jnana -Karma – SannyasaYogah; Page-129

৫.  Jnana -Karma – Sannyasa; Page-129

৬.  Bhakti Yogah, page-262

গীতায় সমাজ দর্শন / ত্রিপুরাশংকর সেন :

১. গীতায় সমাজ দর্শন, ত্রিপুরাশংকর সেন (১৩৭৫), পৃ – ১০

২. ঐ ঐ পৃ – ৫২

৩. ঐ ঐ পৃ – ৫৩

৪. ঐ ঐ পৃ – ৫৪

৫. ঐ ঐ পৃ – ৫৫

৬. ঐ ঐ পৃ – ৩০১

৭. ঐ ঐ পৃ – ৫৬

৮. ঐ ঐ পৃ – ৮৪

৯. ঐ ঐ পৃ – ৮৪

১০. ঐ ঐ পৃ – ৮৬

১১. ঐ ঐ পৃ – ৮৭

১২. ঐ ঐ পৃ – ৮৭

১৩. ঐ ঐ পৃ – ৯২

১৪. ঐ ঐ পৃ – ৯৬

গীতায় জীবনবাদ / ত্রিপুরাশংকর সেন :

১. গীতায় জীবনবাদ, ত্রিপুরাশংকর সেন, পৃ – ৪-৫

২. ঐ ঐ পৃ – ৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *