৩. বিডন স্ট্রিট

১১.

বিডন স্ট্রিট দিয়ে খানিকটা এগুতেই দেখা। মুখোমুখি।

 বোধন,নীলিমা ডাকল।

নীলিমাকে দেখেই মনে হল হাসপাতাল থেকে ফিরছে ও।

 বোধন হাসির মুখ করল। এই তো৷ ডিউটি থেকে ফিরছ?

 মাথা নাড়ল নীলিমা। এদিকে কোথায়? পথ ভুলে?

আশিসের কাছে এসেছিলাম। নেই। ওরা নাকি বাড়িসুষ্ঠু মধুপুরে বেড়াতে গিয়েছে পরশু।

 আর কাউকে পেলে না? নীলিমা ফুটপাথের দিকে আরও একটু সরে দাঁড়াল।

গজেনকে পেয়েছিলাম। ও আবার শোভাবাজার যাচ্ছে…।

নীলিমা বলল, ফিরে যাচ্ছ তা হলে?

 ভাবছিলাম। ফিরে না গিয়ে কী করব?

মাসিমারা কেমন আছে?

ওই যেমন থাকে।

মেসেমশাই? চুয়া?

চলছে সব। …তুমি কেমন আছ?

 আমারও চলছে।

নীলিমা বলল, তা এসেছ যখন চলো, আমার বাড়িতেই বসবে।

বোধন বোধ হয় এটা আশা করেনি। দেখল নীলিমাকে। তুমি সবে ডিউটি থেকে ফিরছ।

তাতে কী। …পাড়ায় এসে ফিরে যাবে, পাড়ার বদনাম। নীলিমা হাসল, আস তো না। ভুলেই গিয়েছ। চলো৷

বোধন এড়িয়ে যাবার উপায় দেখল না, ইচ্ছেও হল না। বাড়ি ফিরে গিয়েই বা কী করবে? বলল, চলো। তোমাদের এখানে লোডশেডিং হচ্ছে না?

কোথায় না হচ্ছে। তবে এখন বেশির ভাগ দিন সন্ধেবেলায় থাকে, রাত্তিরে যায়। নীলিমা হাঁটতে লাগল। বোধন পাশে পাশে।

নীলিমা থাকে প্যারি রোয়ে। বোধন বাড়ি চেনে। আসা-যাওয়া ছিল একসময়ে। নীলিমাকে কেমন যেন লাগত বোধনের। কালো রং গায়ের, গড়নে একেবারে ছিপছিপে, মুখের ধাঁচ বেশ লম্বা, বড় বড় চোখ–যেন দুটো ঝকঝকে চোখ ঠেলে নাক ছুঁয়ে ফেলছে। গালে ব্রণ, ব্রণের গর্ত। মস্ত কপাল। সমস্ত চুল একেবারে টেনে বাঁধত। কপাল তাই লম্বা দেখাত আরও। এখনও সেইভাবে চুল বাঁধে। নীলিমার চেহারায় কী আছে বোধন বুঝতে পারত না। কিন্তু আকর্ষণ অনুভব করত। ঠাট্টা করে পাড়ায় তাকে বোধনরা বলত, ব্ল্যাক বিউটি।

তুমি একেবারেই আর এদিকে আস না? নীলিমা জিজ্ঞেস করল।

খুব কম। এসে কী করব বলল! কাউকে পাব না। শুধু শুধু বাস ভাড়া খরচা করে আসা আর ফিরে যাওয়া।

নীলিমা ঘাড় বেঁকাল। তুমি যা মিথ্যেবাদী হয়েছ।

মিথ্যেবাদী! কেন?

তোমার সঙ্গে সেই যে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে একদিন দেখা হল, বললে সামনের রবিবারে আসবে। এলে?

বোধন ঘাড় চুলকে হাসল। না, সে আসেনি। নীলিমা ঠিকই বলেছে, মাস চার পাঁচ আগে একদিন দেখা হয়ে গিয়েছিল কলেজ স্ট্রিটে। বোধন ব্যাঙ্কিং পরীক্ষা দেবে বলে একটা বইয়ের খোঁজে ও পাড়ায় গিয়েছিল। ফেরার সময় দেখা। বলল, বলেছিলাম। তারপর নানা ঝাটে পড়ে গেলাম!

তোমার ঝঞ্ঝাট…কিছু করছ?

না। একেবারে বেকার।

সেই পরীক্ষার কী হল? বলছিলে যে?

 কিছু হয়নি।

বড় রাস্তা শেষ করে গলি। এ-পাড়া একদিন বোধনেরই ছিল। সবই নখদর্পণে। এখানে এলে কখনও কখনও বোধনের মনে হয়, এমন কিছু হয় না আচমকা, ম্যাজিকের মতন, বোনরা আবার এখানে ফিরে আসে।

সরু গলি। রিকশা যাচ্ছে। আলোও জ্বলছিল। খানিকটা এগিয়ে নীলিমাদের বাড়ি।

বোধন বলল, তোমার জামাইবাবুর খবর কী?

কথার জবাব দিল না নীলিমা সঙ্গে সঙ্গে। পরে বলল, কী আবার। জপতপ, তেলক কাটা, এটা ওটা সবই চলছে। আজকাল আবার মাঝে মাঝে ক্যানিংয়ের দিকে কোথায় যায়। সেখানে ওর চেলারা আশ্রম খুলে দিয়েছে। বলে নীলিমা বোধনের কনুয়ের কাছে ধরল। হাসল যেন, তোমার ভয় নেই। জামাইবাবু আজ তিন চার দিন নেই। সাধনা করতে গিয়েছে।

আরও কয়েক পা এগিয়ে নীলিমাদের বাড়ি। নীচের তলায় ভুজিঅলা গিরিধারী থাকে বউ বাচ্চা নিয়ে, তার বউ তিন মনী লাশ নিয়ে মুড়ি-ছোলা ভাজে সারাদিন, প্রচণ্ড চেঁচায়। অন্যদিকে থাকে কলমিস্ত্রি অখিল। অখিলকে লোকে বলে লাটুমিস্ত্রি। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ধেনো খায়। আর পান। পাড়ায় সন্ধেবেলায় কোনওদিন যদি দেখাও যায় তাকে–লোকটাকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখা যাবে না।

দোতলায় থাকে নীলিমারা। নামেই দোতলা। ভাঙা সিঁড়ি, কড়িবরগা ফাটা ছোট ছোট ঘর, হাত কয়েকের বারান্দা। তার একপাশে কাঠের তক্তা মেরে রান্নাঘর করা। অনেকদিন আছে নীলিমারা।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে নীলিমা প্রথমে একটা ভাঙা টিনমারা দরজা খুলল। এটা আগে ছিল না।

 বোধন হেসে বলল, গেট করেছ?

না করে উপায় কী! সারাদিন যদি কেউ না থাকে বাড়িতে তা হলে…।

নীলিমা নিজের ঘরের তালা খুলে বাতি জ্বালাল। এসো।

ভেতরে ঢুকল বোধন। জিনিসপত্রে ঠাসা। কোনওটাই বহুমূল্য নয়, হবার কথাও না। নীলিমার যাবতীয় যা কিছু সবই জড়ো হয়ে আছে। জানালাটা খুলে দি, কেমন? ঘরে একটু বাতাস ঢুকুক।

বেতের মোড়া এগিয়ে দিল নীলিমা। বসো।

শীতের ঠাণ্ডা বাতাস আসছিল ধীরে ধীরে। বাতাস বোঝা যায় না। ঠাণ্ডা বোঝা যায়।

চা খাবে না? নীলিমা বলল। খাব না কেন? বোধন ঠাট্টা করল, যা খাওয়াবে খাব। বাস ভাড়া ওসুল করতে হবে না!

তা হলে বসো! আমি কাপড়টা ছেড়ে নি। বলে কাপড়চোপড় উঠিয়ে নিয়ে নীলিমা বারান্দায় চলে গেল।

নীলিমা বোধ হয় বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কাপড় ছাড়ছিল। বারান্দা থেকেই বলল, তেলেভাজা খাবে? হাঁদুর তেলেভাজা।

সে তো রাস্তায়!

আমি নিয়ে আসব। …বাব্বা, পাড়ার পুরনো লোক, বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েছ। মান্যগণ্য অতিথি।

ঠাট্টা করছ?

নীলিমা কাপড় ছেড়ে ঘরে এল আবার। হাতে পুঁটলি করা ছাড়া কাপড়। রাখল। বলল, একটু চুপ করে বসে থাকো, আমি নীচে থেকে তেলেভাজা আর চা একসঙ্গে নিয়ে আসি। বাড়িতে আর কেন চা করি, কী বলো!

বোধন গাল চুলকে নিল। দেরি করবে?

পাঁচ দশ মিনিট। এখন সাতটাও বাজেনি। তোমার এত তাড়া কীসের। বসোনা দুটো সুখদুঃখের গল্প করি। অনেক কথা আছে।

বোধন হাসল। তা নয়। আমি বসতেই পারি। তুমি আর জিরোতে পারছ না…।

নীলিমা পয়সা নিল। তারপর ঘরের এক পাশ থেকে কলাইয়ের একটা মগ। চটি পায়ে দিয়ে চলে গেল।

বোধন বসেই থাকল। পকেটে সিগারেট নেই। থাকলে খাওয়া যেত।

.

নীলিমার কথাই ভাবছিল বোধন। এই পাড়ায় বোধনরা আসার পর থেকেই দেখছে নীলিমাকে। বোধনদের লাহাবাবুর ফ্ল্যাট বাড়িতে বাচ্চা বাচ্চা সময়বয়সী বন্ধু ছিল নীলুর। খেলতে যেত। বোধনের সমবয়সী। দিদির সঙ্গেও ভাব ছিল নীলুর। চুয়া খানিকটা ছোট বলে তেমন পাত্তা পেত না নীলুদের। নীলুর মা ছিল না, বাবা ছিল। বাবা আর দিদি। দিদি অনেক বড়। অণিমাদিই সব দেখাশোনা করত। অণিমাদির বিয়ে হল। তারপর নীলুর বাবা মারা গেল। বাবা মারা যাবার পর নীলুরা প্যারি রোয়ে চলে যায়। দিদিই মানুষ করেছে নীলুকে। দিদি বেঁচে থাকতেই নীলু নার্সিং পাশ করে ফেলেছে। দিদিও একদিন চলে গেল। এখন নীলু একা। তার জামাইবাবু একসময় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেরানিগিরি করত। সব ছেড়েছুঁড়ে এখন ধর্ম করে।

নীলুর সঙ্গে বোধনের একসময় মেলামেশা ছিল। ভাল লাগালাগির ব্যাপারও ছিল দুজনের মধ্যে। এমনকী বোধন যখন পাড়া ছেড়ে চলে গেল তখনও প্রথম প্রথম সে নীলুর টানে এখানে আসত। কলেজে পড়ার সময়ও নীলুর সঙ্গে মাখামাখি রেখেছিল। ধীরে ধীরে টান কমে গেল। তবু, নীলু অনেকটা তার ছেলেবেলার বন্ধুর মতন, আবার খানিকটা অন্যরকম।

সিঁড়িতে চটির শব্দ পাওয়া গেল, নীলু আসছে।

ঘরে এসে নীলিমা বলল, তোমার কপাল ভাল, হাঁদু সবেই কড়া থেকে আলুর চপ নামিয়েছে আমি গিয়ে হাজির। খুব গরম।

ঘরের কোণ থেকে কাচের প্লেট কাপ নিয়ে নীলিমা কুঁজোর জলে সব ধুয়ে নিল। আলুর চপ আর চা দিল বোধনকে। নিজেও নিল। নিয়ে বিছানায় বসল।

হাঁদু দারুণ তেলেভাজা করে। তেলেভাজার দোকান চালিয়ে সিঁথিতে জমি কিনেছে বলে গুজব। বোধন আরাম করে তেলেভাজা খাচ্ছিল।

নীলিমা খেতে খেতে বলল, আর কী খবর, বলো?

খবর! ..খবর আর নতুন কী থাকবে?

 তোমাদের বাড়িতে একদিন যেতে খুব ইচ্ছে করে। জায়গাটা ঠিক চিনি না!

বাসে উঠবে, চলে যাবে। কঠিন কিছু নয়!

তুমি আস না, আমি কেন যাব?

বোধন একটা চপ প্রায় শেষ করে এনে দু চুমুক চা খেল। পকেটে বাস ভাড়া থাকে না, ভাই। ঠাট্টা করে বলল, বলে হাসল।

নীলিমা বোধনকে ভরা চোখে দেখছিল। বলল, এতদিনে একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলে না?

দাও না একটা।

আমি চাকরি দেবার মালিক?

 সবাই ওই কথা বলে, নীলু। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। চাকরির বাজার তুমি জান না।

বেশ জানি, নীলিমা বলল। তার চপ খাওয়া শেষ সে একটাই নিয়েছিল। চায়ের কাপে মুখ দিল। তবু লোকে একেবারে পাচ্ছে না তাও নয়। চেষ্টা করো আদা জল খেয়ে।

বোধন হাসল। কিছু না খেয়েই করছি। তবু জুটছে না। একটু থেমে বোধন আজ আশিসের কাছে আসার আসল কারণটা বলল।

নীলিমা কিছু ভাবছিল। সামান্যক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।

বোধন ফাজলামির গলায় বলল, এবার চুরি-চামারির লাইনে নেমে যাব। বলেই নিজের হাত পা দেখল দু পলক। শরীরটাও তেমন মজবুত নয়। ল্যাকপেকে তাই না? চলবে এতে?

নীলিমা জোরে হাসল না। বলল, সাহসও নেই। চুরি গুণ্ডামিতেও সাহস লাগে।

বোধনের হঠাৎ কেমন বিনুর মার কথা মনে পড়ে গেল। বিনুর মা অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন। তাঁর গলায় হার, হাতে চুড়ি। আলমারির চাবি আলনার কাছে পড়ে। বোধন ইচ্ছে করলেই টাকা পয়সা সোদানা কিছু সরাতে পারত। পারেনি কেন? সাহসে কুলোয়নি? হয়তো তাই, কে জানে! বোধনের সেদিন আরও একটা লোভ এসেছিল বিনুর মাকে দেখতে দেখতে। ঘামে জলে ভেজা আধ খোলা জামাটা তাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছিল। কেন বিনুর মার গা বুক এখনও দেখতে ভাল। কত ভাল। কেন তার মায়ের নয়।

নীলিমা বলল, করবে চুরি? এমন আচমকা নীলিমা বলল যে বোধন শুনতে পেল না।

তাকাল বোধন।

বলছি, চুরি করবে? নীলিমা বলল।

বোধন অবাক হল। নীলিমাকে দেখছিল বোকার মতন।

 করলে বলল, ব্যবস্থা করে দেবার চেষ্টা করব। ঠাট্টা করেই বলল কিনা নীলিমা কে জানে।

নীলিমা এবার বিছানা থেকে উঠে দেরাজের কাছে চলে গেল। কিছু হাতড়াল। ফিরে এল। হাতে সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই। খাবে?

তুমি সিগারেট খাও? বোধন বিমূঢ় বোধ করছিল।

আজকাল খাই। আগে একআধটা খেতাম। এখন দিনে আটটা দশটাও খাই। নীলিমা বোধনকে একটা সিগারেট দিল।

বোধন তখনও যেন বিশ্বাস করছিল না।

 নীলিমা নিজের সিগারেট ধরিয়ে নিল। ধোঁয়াও গিলল।

বোধন কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তার বাকি চা-টুকু শেষ করল।

 তা হঠাৎ সিগারেট টানা শুরু করলে কেন? বোধন বলল।

এমনি। অনেকেই তো খায়। কম খাটুনি! ক্লান্তি লাগে। খাই। খেলে ভাল লাগে। তা ছাড়া বাড়িতে যখন থাকি একা একা, কতক্ষণ আর চুপচাপ, একেবারে একা চুপচাপ ভাল লাগে! ওই সিগারেট খাই।

তোমার জামাইবাবুর সামনে?

হ্যাঁ আড়ালে কেন খাব! জামাইবাবুর আবার নেশাভাঙ পছন্দ। নীলিমা হাসল।

বোধন দেশলাই চাইল। তুমি অনেক পালটে গিয়েছ।

বিছানায় বসল নীলিমা। পালটাব না কেন? কচি খুকি তো আর নয়। বয়েস হয়ে গিয়েছে। তোমার সমান সমান।

বোধন মুখ ভরতি করে সিগারেটের ধোঁয়া নিল। গিলে ফেলল সবটাই। আলুর চপের ঝাল, চায়ের তেতো স্বাদ সব মিলেমিশে গলা-জিব কেমন লাগছিল। দেখছিল নীলিমাকে। টান করে বাঁধা চুল, বড় বড় চোখ, গলার তলায় কি শ্বেতি ফুটছে। গায়ের আঁচল আলগা। শুধুই জামা পরে আছে নীলিমা, নীচে বোধ হয় কিছু নেই। আঁটো, ছোট বুক। নীলিমার ওই রকমই বরাবর। যাকে বাড় বলে নীলিমার কখনওই তেমন বাড়ন্ত গড়ন হল না। তবু ও চাকরি করে, খাটে, উপার্জনের পয়সায় পেট ভরায়।

কে না পালটায় গো,নীলিমা বলল, তোমরা পালটাওনি?

বোধন জবাব দিল না। দেবার দরকার করে না। তারাও পালটেছে। বাবা, মা, চুয়া–সবাই। হঠাৎ কেমন রাগ হল বোধনের। বলল, তুমি আর কী নেশা করো?

নীলিমা চোখে চোখে তাকিয়ে কেমন যেন বেঁকা করে হাসল ঠোঁটে। মদের কথা বলছ? আমাদের কেউ কেউ খায়। দুদশ ফোঁটা মদে আর কী হবে। আমিও খেয়েছি। ঘরেই থাকে, জামাইবাবুর কাছে।

বোধন বলল, দারুণ। গলার মধ্যে বিদ্রূপ ছিল। আর কিছু করো না?

দেখছিল নীলিমা বোধনকে। মুহূর্ত কয় চুপ করে থেকে বলল, আরও অনেক কিছু করি। করতে হয়। খারাপ কী। গা বাঁচিয়ে চললে আমাদের চলে না। তোমাদের ভদ্র সংসারের কত রকম দেখতে হয়…।

শুনি?

 কী?

একটা দেখার গল্প বলল, শুনি।

কেচ্ছা শুনতে চাইছ। বলল নীলিমা। অন্যমনস্ক হল সামান্য। কী হবে শুনে! নীলিমা ভাবছিল কিছু। হঠাৎ বলল, শুনবে? একটা অন্য ঘটনা বলছি শোনো, কেচ্ছার নয়। আমি হাসপাতালের চাকরি ছাড়াও মাঝে মাঝে নার্সিংহোমে গিয়ে কাজ করে আসি। বাড়তি কিছু টাকা হাতে আসে। টাকার কার না দরকার, বলো। এই পাড়ার কাছাকাছি এক নার্সিংহোমে আমি মাঝে মাঝে ঠিকে কাজ নি। একবার দিন সাতেকের কাজ নিয়েছিলাম। এক ভদ্রমহিলার মেয়েলি বড় অপারেশান। সেখানে একদিন রাত দশ সোয়া দশটা নাগাদ একটা কাণ্ড ঘটল।

বোধন সিগারেট খাচ্ছিল অলসভাবে। নীলিমা দু হাত বিছানার দুপাশে দিয়ে ঝুঁকে বসে আছে। সিগারেট শেষ।

কতকগুলো ছেলেজনা চার পাঁচ হুড়মুড় করে দোতলায় উঠে এল। ডাক্তারবাবুকে খুঁজছে। ওদের সঙ্গে আর একজন। তার মুখের ওপর একটা ছেঁড়াফাটা জামা জড়ানো, হাতে ফেট্টি। সে চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে যন্ত্রণায়, পারছে না। বন্ধুরা তাকে ধমকাচ্ছে, বারণ করছে। অত রাত্রে নার্সিংহোমে ডাক্তার কোথায় পাবে। দরকার ছাড়া কেউ আসে না। ইনচার্জের সঙ্গে কী কথা হল জানি না আমাদের কেবিনের পাশে ছেলেটাকে রেখে তার বন্ধুরা চলে গেল। তারপর সারারাত সে কী চিৎকার আর কান্না, একটা গোরু মোষ কাটলে যেমন চেঁচায় জন্তুটা সেইরকম। ইনজেকশন দিয়েও তাকে ঘুম পাড়ানো যায় না। তার কী হয়েছিল জানো? পুলিশ মারতে বোমা বাঁধছিল, ফেটে গিয়ে নাক মুখ ঝলসে পুড়ে গিয়েছে, চোখ অন্ধ। কিছু দেখতে পাচ্ছিল না বেচারি। বুঝতে পারছিল তার চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাঁদছিল, চেঁচাচ্ছিল। আর তার বন্ধুরা লুকিয়ে লুকিয়ে এসে তাকে বলে যাচ্ছিল–তুই ভাবিস না, আমরা অন্য ব্যবস্থা করছি। কোনও রকমে সহ্য কর। চেঁচামেচি করিস না। পুলিশ স্পট করে ফেলবে। তুই একটু সহ্য কর, সব ঠিক হয়ে যাবে।

বোধন নিশ্বাস বন্ধ করে শুনছিল।

ছেলেটা যতক্ষণ হুঁশে থাকত, আমার চোখ, আমার চোখ কী হল আমার, কেন আমি দেখতে পাচ্ছি না করে চেঁচাত আর কাঁদত। ছেলেটা দুদিন ওইভাবে পড়ে পড়ে কাঁদল। তারপর একদিন রাত্তিরে এসে তার বন্ধুরা ওকে নিয়ে গেল।

কী হল তারপর?

 তা জানি না। তবে পরের দিন ভোরে পাঞ্জাবি হোটেলের কাছে রাস্তায় একটা ছেলেকে গুলি খেয়ে মরে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল।

বোধন আঁতকে উঠে শব্দ করল: নোটন। তাদের পাড়ার নোটন। নোটন পাঞ্জাবি হোটেলের সামনে মরে পড়েছিল বলে সে শুনেছে। নোটন?

নীলিমা কোনও জবাব দিল না।

একেবারে চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরে বোধন বলল, নোটনকে তার দলের বন্ধুরাই মেরেছিল বলে শুনেছি। ধরা পড়ার ভয়ে।

নীলিমা চুপচাপ।

বোধনের মনে হল, সে অনেকক্ষণ বসে আছে। কটা বাজল কে জানে। কটা বাজল বলতে পারো?

সোয়া আট, সাড়ে আট হবে। ঘড়ি দেখে বলব?

না, থাক। আমি এবার উঠি।

উঠবে?

শীতকাল। রাত হচ্ছে।

 তা হলে এসো।

 বোধন উঠে দাঁড়াল। তোমার আর একটা সিগারেট নেব?

নাও না।

 বোধন সিগারেট নিল; ধরাল না! পরে রাস্তায় ধরাবে।

দরজার কাছে এসে নীলিমা বলল, ও একটা কথা তোমায় বলতে ভুলে গিয়েছি। শোভনাদিকে সেদিন দেখলাম।

দিদিকে? কোথায়?

আমাদের হাসপাতালে এসেছিল।

হাসপাতালে? কেন?

নীলিমা হাসির মুখ করল।  তুমি বুঝতে পারবে না। দায়ে পড়ে এসেছিল। মাস খানেকের প্রেগনেন্সি নিয়ে। আজকাল এক রকম যন্ত্র বেরিয়েছে। প্রথম দিকে এলে ওতে বেশি সময় লাগে না। ঘণ্টা খানেক পরেই ছাড়া পেল। ট্যাক্সি করে চলে গেল! সঙ্গে লোক ছিল।

বদ্যিনাথ?

 না বদ্যিনাথ নয়। অবাঙালি একজন। তা খুব যত্ন করে নিয়ে গেল।

দরজার মুখে দাঁড়িয়ে বোধন নীলিমার মুখ দেখল। হাত পা কাঠ। বোধন সবই বুঝতে পারছিল।

.

১২.

কলকাতায় এমন হাড়-জমানো শীত পড়বে ভাবাই যায়নি। হুট করে চলে এল। কাগজে বলছে, উত্তরে বরফ পড়ছে, শীতের ঝাঁপটা চলছে দিল্লিতে, আগ্রায়; পাটনাতেই এক দিনে তিন জন মারা গিয়েছে।

সুকুমার অঘটনের খবর পড়তে ভালবাসে। সে এই সব পড়ছিল আর বোধনকে বলছিল। বোধন বসে বসে একটা চিঠি তৈরি করছে সুকুমারের জন্যে। সুকুমার তার দোকান বাড়াবার জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছে। ব্যাঙ্কের একজন বলেছে, টাকা ধার পাইয়ে দেবে সুকুমারকে। সেই টাকার আশায় এই চিঠি। সুকুমারের কথা মতন বোধন বাবার কাছ থেকে জেনে এসেছে, কী লিখতে হবে, কেমন করে লিখতে হবে চিঠিটা। চিঠি কালই সুকুমার ব্যাঙ্কে নিয়ে যাবে। আগে চিঠি, তারপর না অন্য কাজ।

দোকানে বসেই চিঠি লেখা হচ্ছিল। এখন কদিন আলো থাকছে সন্ধেবেলায়। আজ এখন অন্তত আছে, হুস করে চলে যেতেও পারে।

বোধন চিঠি লেখা প্রায় শেষ করে এনেছিল। সুকুমার চুপচাপ বসে থেকে সকালের বাসি কাগজটাই রেডিয়োর খবর পড়ার মতন করে পড়ছিল।

শীতের জন্যে রাস্তায় লোকজন কম কম লাগছে। তবু আসা-যাওয়া রয়েছে, ট্যাক্সি ঢুকছে, রিকশা যাচ্ছে, একটা লরিও ঝরঝর করতে করতে চলে গেল।

সুকুমার বলল, বোধনা, আর একবার চা হোক কী বলিস? সুকুমারের মেজাজ খুশি থাকলে সে বোধনকে আদর করে বোধনা বলে।

বোধনের শীত করছিল। জামার তলায় গেঞ্জি নেই, পুরনো হাতকাটা এক সোয়েটার, তার ওপর জামা। জামার ওপর সুতির চাদর। মেয়েলি চাদর। মার। পা দুটো কনকন করছে।

বলল, বোধন বলল।

দোকানে কেউ নেই। সুকুমার উঠে পড়ে চা বলতে গেল।

বোধন চিঠি শেষ করতে লাগল। বাবাকে একবার দেখিয়ে নিতে হবে। ভুলভাল কী লিখছে সে জানে না।

সুকুমার ফিরে এল। নে কেক খা।

কেক?

বছরের শেষ দিন। খেয়ে নে। পরিমলের দোকানে একটাই পড়েছিল। নিয়ে নিলাম। সুকুমার আধখানা কেক বোধনের সামনে রাখল।

চিঠি শেষ করল বোধন। মাথা তুলল। শুনবে কী লিখলাম?

পড়। ইংলিশ ব্যাপার, বুঝিয়ে দিবি।

বাবাকে একবার দেখিয়ে নেব।

তা হলে আর আমায় শোনাচ্ছিস কেন? মেসোমশাই দেখে দিলেই ফাইন্যাল।

তবু একবার শোনো। তোমার জিনিস।

পড় তবে।

 চিঠি পড়ার মধ্যে দোকান থেকে কাচের গ্লাসে চা এল।

বোধন চিঠি শেষ করে বলল, ঠিক আছে?

ফার্স্ট ক্লাস। মেসোমশাইকে দেখিয়ে নিবি। …নে, চা খা।

সুকুমারের মন-মেজাজ আজ কদিন ধরেই ভাল। মা বর্ধমানে গিয়ে শান্তিতে আছে। বাড়িতে বউ আর ওরকম কানের কাছে গজগজ করছে না। তার ওপর সুকুমার ধরেই নিয়েছে, ব্যাঙ্কের টাকা সে পাবেই, পেলেই দোকানটা আরও বাড়াবে, গুছিয়ে নেবে, মালপত্র রাখবে ইলেকট্রিকের, রেডিয়ো সারাইয়ের ব্যবস্থা করবে। এসব দিয়ে দোকান বাড়ালে সেটা চলবেই। দেখতে দেখতে পাড়াটা কেমন জমজমা হয়ে গেল।

কেক চা খেতে খেতে বোধন বলল, তোমার সঙ্গে বলাইবাবুর কথা হল?

তাকাল সুকুমার বোধনের দিকে। আজই হয়েছে।

কী বলছে?

বলছে, অফিসের গণ্ডগোলটা না মিটলে কিছু করতে পারছে না।

 গৌরাঙ্গ অন্য কথা বলছে।

কী বলছে গোরা?

বলাইবাবুর পার্টনার বাগড়া দিচ্ছে।

সুকুমার জবাব দিল না। ব্যাপারটা অন্যরকম। গৌরাঙ্গ বোধনকে নিয়ে বলাইবাবুর কাছে গিয়েছিল। কথাবার্তাও বলেছেন বলাইবাবু বোধনের সঙ্গে। কিন্তু অন্য জায়গায় আটকে গিয়েছে। সুকুমার বোধনের জন্যে তদ্বির করতে গিয়ে প্রথম দিন কিছু শোনেনি, দ্বিতীয় বার যাবার পর বলাইবাবু বললেন, তোমায় আসল কথাটা বলি সুকুমার লিক করে দিয়ো না। আমার লোক চাই নিশ্চয়, কিন্তু তাকে ক্যাশ হ্যাঁন্ডেল করতে হবে। যে ছিল সে আমাদের ডুবিয়েছে। ক্যাশের ব্যাপার বুঝতেই পারছ, দশ বিশ টাকা সরিয়ে নিলেও ধরা যাবে না। রিলায়েবল লোক হওয়া দরকার। বোধনদের ফ্যামিলির যা অবস্থা শুনলাম তাতে ভরসা হচ্ছে না। অভাবে স্বভাব নষ্ট বলে যে কথা আছেউড়িয়ে দেওয়া যায় না একেবারে। তার ওপর আমি ওর বাবা সম্পর্কেও একটু খোঁজ নিলাম। লাকিলি আমার পুরনো এক বন্ধু ওই ব্যাঙ্কে কাজ করেছে। সে বলল, ভদ্রলোক ব্যাঙ্কের লোন সেকশানে কাজ করতেন। টাকা পয়সা খেতেন। আরও সব কী ব্যাপার! হি ওয়াজ সাসপেন্ডেড। কেস হয়। ভদ্রলোকের চাকরি যায়। এই ধরনের বাড়ির ছেলে ক্যাশে আনা…বুঝতেই পারছ, সাহস হচ্ছে না। আমার পার্টনার একেবারে এগেনস্টে। তবু পাড়ার ছেলে বলে আমি চেষ্টা করছি। তুমি কিছু বোলো না। বেচারির মন খারাপ হবে।

সুকুমার চটে গিয়েছিল। সামলে বলল, কাকাবাবু, বোধন খুব ভাল ছেলে। সে চুরিচামারি করার ছেলেই নয়। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন। পাড়ার যে কোনও লোককে ওর স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন।

বলাইবাবু শান্ত নম্র গলায় বললেন, আমি জানি সুকুমার। গৌরাঙ্গ ওকে এনেছে, তুমি বলছ–তার ওপর কথা থাকতে পারে না। বাপের দোষ ছেলেতে বর্তাবে যে তারও কোনও মানে নেই। কিন্তু আমার পার্টনার বেশি খুঁতখুঁতে। আমি চেষ্টা করছি। তুমি ওকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলল। পাড়ার ছেলে আমার বিবেকে লাগছে। আমি ওকে অন্য কোনওভাবে নেবার চেষ্টা করব।

সুকুমার আর কিছু বলেনি। মনে মনে বলেছিল–শালার বিবেক। বেয়াইয়ের পোঁদে তাপ্পি মেরে গাড়ি কিনেছে, শাহেনসা পার্টি।

.

বোধনকে এসব কথা বলা যায় না। বলেওনি সুকুমার। কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মেসোমশাইয়ের ব্যাপারটা শুনে তার খারাপ লেগেছে। অবশ্য বাপ হলেই কি সে ঠাকুর দেবতা হয়ে ওঠে। সুকুমারের বাবাই বা এমন কি গঙ্গাজল ছিল! এ-পাড়ায় কত চিটিংবাজ, ঘুষ খাওয়া, মালটানা বাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সুকুমার কথা ঘোরাল। নে সিগারেট খা। বলাইবাবু চেষ্টা করছেন।

বোধন কেক শেষ করেছিল। চা খেতে লাগল।

আমার কিছু হবে না, সুকুমারদা?

হবে রে বেটা, হবে। না হয়ে যাবে কোথায়? আমার হয়েছিল। বাবা ফট হয়ে যাবার পর কী লাথিঝেটা খেয়েছি রে, বোধন। কুকুর বেড়ালের মতন পাছায় লাথি খেতাম। এখন দেখ। নিজের পেট চালাবার জন্যে কার কাছে হাত পাতি? তোরও হবে আর আমার টাকা এলেই তো রেডিয়ো ডিপার্টমেন্ট করছি তোর জন্যে। নে সিগারেট খা।

বোধন সিগারেট নিল। ধরাল।

 ছকু বলছিল, বোধন বলল, ও যে মিনিবাসে খাটে সেখানে আমি খাটতে পারি।

মিনিবাস? কার মিনিবাস?

মালিকের নাম জানি না। নাগের বাজারে থাকে।

 ছ কোন রুটে খাটে?

ডানলপ ব্রিজ।

 কত কামায়?

গোটা হপ্তা খাটতে পারে না। পাঁচদিন খাটে। শ তিনেক পায়।

 ও তুই পারবি না। সুকুমার পা তুলে দিল টেবিলের ওপর, ছক্কু পারে।

এ তুমি কী কথা বলছ? ছকু বি কম পাশ।

এ কম বি কম-এ কিছু না। ছকুর চেহারা দেখেছিস! ও খাটতে পারে, ঝগড়া করতে পারে; আর বানচোত বলে হাত গুটোতে পারে। তুই পারবি না।

কেন?

কেন? সুকুমার এমনভাবে বলল, যেন এই সহজ কথাটা বোধনের মাথায় ঢুকছেনা কেন। কেন বুঝছিস না? মালিকের খেচামেচি তোর সহ্য হবে না। প্যাসেঞ্জাররা তো শালা মাল, এ বলবে ধীরে চলো ও বলবে জোরে চলো, বাসে উঠেই দশ টাকার নোট ভেড়াবে লাটের মতন, পচা নোট চালাবে। তারপর আজ পুলিশের গুতো, কাল প্যাসেঞ্জারের গুতো। টায়ার পাঞ্চার হল তো জ্যাক মারো। …তুই এসব পারবি না। তার ওপর যাদের পাল্লায় পড়বি তারা বেশির ভাগ অ্যায়সা খিস্তি খেউড় করবে তোর যেটা শুনে কান লাল হয়ে উঠবে।

বোধন রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বলল, আমি যদি কিছু না পারি বাঁচব কেন?

সুকুমার তাকাল। তাকিয়ে থাকল বোধনের দিকে। তার বড় কষ্ট হচ্ছিল। কেন যে এই ছেলেটাকে এত ভালবাসে! কে জানে! ভালবাসে, বিশ্বাস করে, প্রশংসা করে। …কত বছর আগেকার কথা, সুকুমাররা যখন বাগবাজারে থাকত, সুকুমারের বারো তেরো বয়েস তখন তার ছোট ভাই বিশু বর্ধমানের দেশের বাড়িতে পুকুরে ডুবে মারা যায়। সুকুমাররা তখন মাঝে মাঝে দেশের বাড়িতে যেত। বোধনের সঙ্গে ভাইয়ের কোনও মিল নেই। শুধু চোখ দুটোয় যেন ভীষণ মিল।

কথাটা সুকুমারের মনে হয়, কিন্তু কাউকে বলে না, মাকে নয়, বউকে নয়, বোধনকেও না। বলে না এই জন্যে যে, সেই ছোট ভাইবিশুপুকুরে ডুবে মরে যাবার একটা কারণ সুকুমার। যদি সুকুমার সাত আট বছরের বর্ষার ভরা পুকুরে সাঁতার শেখাবার বাহাদুরি না করত বিশু ডুবত না। এই আফশোস, দুঃখ, পাপ সুকুমার এখনও যেন বয়ে বেড়াচ্ছে।

মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল বলে সুকুমার উঠে পড়ল। নে নে ওঠ, দোকান বন্ধ করি।

বোধন কয়েক মুহূর্ত বসে থেকে উঠল।

 চিঠিটা নিলি?

 নিয়েছি।

 মেসোমশাইকে ভাল করে দেখে নিতে বলবি।

বোধন কথা বলল না।

সুকুমার দোকান বন্ধ করতে লাগল। বোধন হাত লাগাল।

দোকানে গোটাতিনেক তালা মারল সুকুমার। জগৎ কাল আসবে। জ্বর ছেড়ে গিয়েছে।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেঁপে উঠল বোধন। বড় শীত করছে। বাতাসটাও হাড়ে গিয়ে লাগে।

নে চল, সুকুমার পা বাড়াল।

চুপচাপ খানিকটা হেঁটে এসে সুকুমার হঠাৎ বলল, তুই একটা সিসের আংটি পর তো।

কেন? সিসের আংটি পরব কেন?

 পর। তোর মাথা ভাল থাকবে। বলে সুকুমার হাসবার চেষ্টা করল, হাসিটা ঠিক গলায় এল না।

.

১৩.

বিনুর গলা বসে গিয়েছিল। অনবরত মুখ তুলে কাশছে। এক হাতে রুমাল, অন্য হাতে কফ লজেন্স। বলল, আমি মরে গিয়েছি। বলে অস্থিরভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে ঝপ করে বসে পড়ল।

জ্বর? বোধন জিজ্ঞেস করল।

জ্বর না গলা–টনসিল। কথা শুনছ না? ঘ্যাসঘ্যাস করছে।

বোধন হাসল। বিনুর গলা বসে যাওয়া মানে আজ আর বই খোলাও হবে না। অন্য দিন তবু সামনে বই থাকে, হাতে কলম পেনসিল। আজ তাও নয়।

হাসছে কেন? বিনু বলল।

না, আজ একেবারে ছুটি কিনা তাই, বোধন মজা করে বলল।

কাল আমরা পিকনিকে গিয়েছিলাম। কাকাদের অফিসের বন্ধুরা, উইথ ফ্যামিলি। মা যায়নি, আমি গিয়েছিলাম। সারাদিন গঙ্গার কনকনে হাওয়া খেয়ে এই অবস্থা…।

বোধন বুঝতেই পারছিল। পিকনিকের কথা বিনু আগেই বলেছিল, তবে সে যাবে কি যাবেনা তখনও ঠিক করেনি। নতুন বছর পড়ে গিয়েছে, শীতের দিন–এখন তো এসব হবেই।

আমি আর তা হলে কী করব! পালাই? বোধন বলল।

পালাবে কেন, বোসো। বিনু মুখ তুলে আবার কাশল। গলা পরিষ্কারের চেষ্টা করল। করেই লজেন্স মুখে দিল।

মাসিমা কোথায়? বোধন জিজ্ঞেস করল।

 ঘরে। আসছে। …কাল তুমি আসনি তো?

না। কেন?

কাল তোমাদের পাড়ার দুটো ছেলে এসে তোমার নাম বলে মার কাছ থেকে পাঁচটা টাকা নিয়ে গেছে। বলেছে কীসের যাত্রা-ফাত্রা করবে।

আমি কাউকে পাঠাইনি। যাত্রার ব্যাপারও জানি না। আচ্ছা তো!

মা সেটা বুঝতে পেরেছে। …তোমাদের পাড়ায় কতগুলো বাজে ছেলে থাকে। …সব পাড়াতেই থাকে। এ-পাড়ার বাজে ছেলেগুলো একেবারে বাজের বাজে।

বোধন হেসে ফেলল।

বিনুর মার সাড়া পাওয়া গেল। বিনু, বোধন এসেছে?

হ্যাঁ।

আসছি।

বিনুকে আগের চেয়ে আজকাল সামান্য ভাল দেখায়। উনিশ বিশ। বাড়িতে এখন তার খুব যত্ন। বোধন ঠিক জানে না, বিনুর মুখেই শুনেছে–গত বছর তার প্লুরিসির মতন হয়েছিল, সেরে গিয়েছে– তবু এখনও ঠাণ্ডা লাগানো, ভারী কাজকর্ম করা বারণ। বিনু কিছুই করে না, হয়তো নিজের বিছানাটা পরিষ্কার করল, চা করল কিংবা ওমলেট ভাজল একটা। এমন আরামে থেকেও কেমন করে অসুখ করে মানুষের কে জানে! বিনুর কোনও অভাব নেই। না থেকেও এই শরীর স্বাস্থ্য! আশ্চর্য।

বিনুর মা ঘরে এলেন। গায়ে চাদর। পাতলা। কালো রং। মাথার খোঁপা সামান্য ওঠানো। চশমা চোখে নেই। তুমি কাল এলে না কেন?

কাল? কাল তো আমার…বোধন অবাক হচ্ছিল।

সুকুমার তোমায় কিছু বলেনি?

কই না।

আমি যে ওকে বললাম, তোমায় একবার পাঠিয়ে দিতে। বেলার দিকে ও সামনের বাড়িতে এসেছিল। দেখতে পেয়ে বললাম।

বোধন বুঝতে পারল। কাল বোধন সুকুমারদার দোকানে যায়নি। দেখাও হয়নি। বোধন কাল সারা দুপুর, বিকেলে পাড়াতে ছিল না। গৌরাঙ্গর সঙ্গে ইডেন গার্ডেনসে রঞ্জি ট্রফির খেলা দেখতে গিয়েছিল। গৌরাঙ্গই টেনে নিয়ে গিয়েছিল। গৌরাঙ্গ বেলগাছিয়ার ক্রিকেট টিমে খেলে। বোধনও একসময় পাড়ার ক্লাবে খেলত। কাল নিতান্ত শীতের দুপুর কাটাবার জন্যে, রোদ খাবার জন্যে বোধন মাঠে গিয়েছিল। ফিরেছে সন্ধে নাগাদ। বাড়ি ফিরে আর কোথাও বেরোয়নি।

আমার সঙ্গে সুকুমারদার দেখা হয়নি, বোধন বলল। কোনও দরকার ছিল?

ছিল। ..তুমি একটু বোসো। আমি হাতের কাজ সেরে আসছি।

 অনুপমা চলে গেলেন। বোধন বিনুর দিকে তাকাল, যেন জানতে চাইল, কাজটা কী?

 বিনু হাতের রুমাল নিয়ে খেলা করছিল। কেমন যেন গন্ধ এল বাতাসে। বোধন বলল, কী। লাগিয়েছ?

ইউকেলিপটাস। বেশি পড়ে গিয়েছে।

তোমার ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। বোধন হাসল, অত ইউকেলিপটাসে মাথা ধরে যাবে।

যাক গে, আমারই তো মাথা। বলে বিনু নিজের মাথায় কিল মারল ছেলেমানুষের মতন।

বোধন হাসল। কিছু বলল না। বিনু অদ্ভুত। এই মেয়ের যে কেমন করে বিয়ে হবে কে জানে! যে বিয়ে করবে তারই মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

হাসছ যে? বিনু বোধনের হাসি থেকে কিছু অনুমান করে বলল।

 এমনি।

এমনি আবার কেউ হাসে নাকি। তোমার মুখ থেকে অন্য কিছু মালুম হচ্ছে।

বোধন নিজেও মজা পেতে চাইছিল। কথাটা বলতে ইচ্ছে করছিল তার। বলবে? দরজার দিকে তাকাল। বিনুর মা কি কাছাকাছি আছেন? না বোধ হয়। গলা নামিয়ে বোধন বলল, মাথা খারাপদের বিয়ে হয় কেমন করে? মজার মুখে হাসছিল।

বিনু টেরা-টেরা চোখ করে চটপট জবাব দিল, রাজুরও তো মাথা খারাপ। আমার চেয়ে বেশি।

 দুই মাথাখারাপে তা হলে ভয়ংকর কাণ্ড হবে যে। বোধন হাসছিল।

 কাটাকাটি হয়ে যাবে। এ একেবারে মেথামেটিকস।

বোধন জোরে হেসে উঠল। বিনুও হাসছিল।

দুজনের হাসাহাসির মধ্যে অনুপমা ঘরে এলেন। দেখলেন দুজনকে। এত হাসির কী হল?

 বিনু বলল, মাথাখারাপের কথা হচ্ছিল। বোধনদা আমায় পাগল বলছে।

বোধন অপ্রস্তুত। না না, পাগল কোথায় বললাম!

বলেছ বেশ করেছ,অনুপমা বললেন, পাগল ছাড়া আবার কী! মেয়ের দিকে তাকালেন আবার চা ভিজিয়ে দিয়ে এসেছি, ঢেলে নিয়ে আসবি? বোধনের জন্যে দুটো পাঁপড় ভেজে আনিস।

বিনু আড়চোখে বোধনকে দেখল। তার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সে সবই বুঝতে পারছে। মা তাকে সরিয়ে দিচ্ছে ঘর থেকে।

বিনু উঠে গেল।

অনুপমা বসলেন। কাল তোমার জন্যে হাঁ করে বসে থাকলাম। দরকারি কথা ছিল।

বোধন বলল, আমি খবর পাইনি।

তাই তো শুনছি। অনুপমা সামান্য চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, বিনুর তো বিয়ে।

বোধন অবাক হবার ভান করল। বিনুর মুখে কী শুনেছে সে সেটা জানতে দেওয়া উচিত নয়। কী মনে করবেন বিনুর মা! বিয়ে?

এই মাঘ মাসের শেষে।

বোধন যেন কতই বোঝে মাথা চুলকে বলল, বিনু তো ছেলেমানুষ, মাসিমা। কম বয়েস।

একেবারে কম কোথায়, কুড়ি পেরিয়ে গিয়েছে। একটু থেমে আবার, আজকালকার হিসেবে একটু কম। আমাদের সময়ে এই রকমই হত। আমারও উনিশ শেষ হতে বিয়ে হয়েছিল। বিনু হয়েছে অনেক পরে, বছর তিন চার।

বোধন মার কথা ভাবল। মারও কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। মার প্রথম সন্তান দিদি। তারপর বোধন।

আমার তো ওই একটি মেয়ে, অনুপমা বললেন, ছেড়ে থাকতে কি ইচ্ছে হয়। কিন্তু কী করব বলল, বিয়ে তো দিতেই হবে রোগা-সোগা মেয়ে, রোজ শরীর খারাপ, অসুখ। আর নিজেই দেখেছ, লেখাপড়ায় ওর মন নেই। বাড়িতে বসে পড়াশোনা করবে তাও করবে না। ওকে নিয়ে আমার বড় ভাবনা। বরাবর। বিনুর বাবা চলে যাবার পর থেকে ওই মেয়ে নিয়ে আমার কেটেছে। ছেলেমেয়ের দায় বড় দায়, বোধন। সে তুমি এখন বুঝবে না। ছেলেমানুষ। পরে বুঝবে।

বোধন যেন কিছুই জানে না, বলল, কলকাতার ছেলে?

না। দিল্লির। আমাদের চেনাশোনা। বিনুর বাবারই এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলে। বন্ধুর ছেলেও বলতে পারো। ছেলেটি ভাল। বিনুকে বাচ্চা বয়েস থেকে দেখেছে। দুজনে ভাবসাব ছিল বরাবরই।

ও। আচ্ছা।

ছেলের তরফ থেকে তাড়া বেশি। ছেলের বাবার শরীর ভাল যাচ্ছে না। তিনি ব্যাপারটা ফেলে রাখতে চান না।

বোধন মাথা নাড়ল। যেন সবই বুঝতে পারছে।

অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে অনুপমা বললেন, তোমায় কটা কাজ করে দিতে হবে।

বলুন?

বিনুর কাকাকে দিয়ে কোনও কাজ হয় না। ভরসাও করা যায় না। অফিস আর অফিস থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাবে বসে তাস খেলা। কিছু বোঝে না। এক বললে আরেক করে বসবে। আমি সুকুমারকে বলেছি৷ আমায় একটা বাড়ি জোগাড় করে দিতে হবে, অন্তত চার পাঁচ দিনের জন্যে। দিল্লি থেকে ছেলের বাড়ির ছ সাতজন থাকবে এসে। তারপর ধরো বিয়ে-থার ব্যাপার। প্যান্ডেল, আলল, খাওয়া-দাওয়া বাজার ছোটাছুটি…। আমার তো সহায় বলতে কিছু নেই। তোমাকেই বলতে পারি! আর সুকুমার।

বোধন শুনল সব। বলল, আপনি ভাবছেন কেন। সুকুমারদাকে বলেছেন তো, সব হয়ে যাবে, আর আমি তো আছি।

অনুপমা যেন খুশি হলেন। আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বিনু এল। পাঁপড় ভাজা চা রাখল।

মেয়েকে দেখে অনুপমা যেন অস্বস্তি বোধ করলেন। আরও কিছু বলার আছে। বললেন, তোর কাকার খাবারটা করে রাখ না। আসার তো সময় হল।

বিনু চলে যেতে যেতে বলল, বোধনদা, যাবার আগে বলবে আমার দরকার আছে।

নাও, চা খাও, অনুপমা বললেন।

বোধন পাঁপড় ভাজা খেতে লাগল।

অন্যমনস্ক হয়ে অল্পক্ষণ বসে থাকলেন অনুপমা, তারপর বললেন, আর একটা কথা আছে, তুমি কাউকে বলবে না।

তাকাল বোধন। অবাক হচ্ছিল।

 বলবে না?

ইতস্তত করে বোধন বলল, না।

আমার কিছু সোনাদানা আছে। বিনুর জন্যে ভেঙেচুরে গড়তে দিয়েছি। …আর কিছু আছে যা আমি বেচতে চাই। গলার স্বর একেবারে নেমে গেল অনুপমার। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আমি দোকানে যাব। একা যেতে পারি না। যাওয়া উচিত নয়।

বোধন আশ্চর্য হয়ে গেল। সোনা বেচতে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান বিনুর মা। বোধন সোনাই চেনে না। তাদের বাড়িতে সোনা বলতে মার কানে কী একটা আছে একরত্তি, আর হাতের লোহাটা। মা সেই কবেকার সোনা দিয়ে বাঁধানো লোহাটা এখনও পরে আছে।

বোধন বলল, আমি তো সোনার দোকান চিনি না।

 দোকান আমি চিনি। …আমার চেনা দোকান।

 তা কাকাবাবু তো আছেন তিনি আপনার সঙ্গে…

না, অনুপমা মুখের কাছে আঙুল তুললেন, গলা আরও নামল, বিনুর কাকাকে কিছু জানাতে চাই না বলেই তোমায় বলছি। সে যেন কোনওদিন কিছু জানতে না পারে।

বোধন বোবা। কিছু বুঝছিল না। বিনুর মার চোখ সতর্ক। বোধনের দিকে তাকিয়ে আছেন।

 বেশ, যাব।

অনুপমা নিশ্বাস ফেললেন, আমি তোমায় পরে জানাব।

কথা ঘুরিয়ে নিলেন অনুপমা, অন্য কথা তুললেন। দু চারটে এলোমেলো কথা বলে উঠলেন।

বোধনের চা খাওয়া শেষ হয়েছিল।

বিনুকে ডেকে দি, তোমার সঙ্গে কী দরকার বলল…।

অনুপমা চলে গেলেন।

 বোধন বিনুর মা আর বিনুর কাকার কথা ভাবছিল। আশ্চর্য। সবই কেমন অদ্ভুত।

বিনু এল। উঠবে?

 হ্যাঁ।

চলো তবে।

সদরে এসে বিনুই দরজা খুলল। বাইরে এল। বোধনও বাইরে এসে দাঁড়াল। শীতের হাওয়া দিচ্ছে কনকনে। চারপাশে কুয়াশার মতন। ট্রেন যাচ্ছে অনেকটা তফাত থেকে, ইলেকট্রিক ইঞ্জিনের হুইসল বাজছিল।

বিনু বলল, মা আমার বিয়ের কথা বলছিল না?

 হ্যাঁ।

আর কী বলল?

আবার কী! ওই কথাই বলছিলেন।

বিনু বোধনের বুকের কাছে আঙুল দিয়ে খোঁচা মারল। আজ তোমায় একটা কথা বললাম না। আর কদিন যাক, বলব। বাইরে থেকে সব জিনিস দেখো না।

বিনু সদরের দিকে মুখ ঘোরাল আবার।

.

সুকুমারের দোকান থেকে ঘুরে বোধন বাড়ি ফিরছিল। রাত বেশি নয়। আটটা হবে। জোর শীত পড়েছে। আকাশের তলায় কুয়াশা যেন জমাট বাঁধছে। উত্তরের বাতাস দিচ্ছিল। এই ঠাণ্ডায় ঘোরাঘুরি না করে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরছিল বোধন। সুকুমারদার সঙ্গে কথা হয়েছে। বাড়ির খোঁজ পাওয়া যাবে কাল পরশু, প্যান্ডেল বাঁধার জন্যে ঘনশ্যামকে বিনুদের বাড়ি নিয়ে গেলেই হবে, ইলেকট্রিকের জন্যে সুকুমারদাই রয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা বিনুর কাকা দেখবেন। ক্যাটারিং। মোটামুটি এই। কিছুই আটকাবে না। বাকি কাজ যেটা–সেটা নিয়ে সুকুমারদার সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই। কিন্তু বোধন কিছুতেই বুঝতে পারছে না, বিনুর মা কেন সোনা-দানা বেচতে চান? নিশ্চয় টাকার জন্যে। বিয়ের খরচ মেটাবেন বিনুর মা। বিনুর কাকা তা হলে আছেন কেন? তার চেয়েও বড় কথা বিনুর মা বিনুর কাকাকে লুকিয়ে একাজ কেন করতে চান? দুজনের মধ্যে কীসের একটা ব্যাপার আছে। বোধন এতদিনে অনেকটা ধরতে পেরে গেছে ওঁদের সম্পর্কটা সোজা, সরল, স্বাভাবিক নয়।

তা থাকগে। বোধনের কী? এরকম আজকাল খুব চলে। সি ব্লকের প্রতিভা বউদিরও এইরকম। দুই মেয়ে নিয়ে থাকে, বারো চোদ্দো বয়েস, স্বামী আছে কোথাও, আসে না, যে-আসে সে অন্য লোক– প্রতিভা বউদির এক মাসতুতো ভাই, সিনেমার ক্যামেরাম্যান। আরও আছে। এই পাড়াতেই।

বিনুর বিয়েটা তা হলে ভাল মতনই হচ্ছে। তোক। বরপক্ষ আসবে দিল্লি থেকে, প্যান্ডেল বাঁধা হবে, আলো জ্বলবে, বিনু ফুল চন্দন পরে কনে সাজবে, রেকর্ডে সানাই বাজবে, আহা–দারুণ হবে। বোধনের দিদির কথা মনে পড়ল। ছেলেবেলায় পাড়ায় যখন বিয়ে হতবোধন সব সময় ভাবত, দিদির বিয়ের সময় সে একবার দেখে নেবে। মাতব্বরি কাকে বলে দেখিয়ে দেবে।

কোথায় কী ভেবেছিল, আর কী হল। দিদি পালিয়ে গেল। শুধু পালিয়েই গেল না, এখন সে অন্য রাস্তায় চলে গেছে। বদ্যিনাথ কোথায়? মারা গিয়েছে নাকি? না, দিদি বদ্যিনাথকে ছেড়ে চলে এসেছে? দিদির সেই ছেলেটারই বা কী হল? আচ্ছা, নীলু বাজে কথা বলেনি তো? বোধনকে ঘা দেবার জন্যে? না, নীলু তেমন মেয়ে নয়। কী দরকার তার মিথ্যে কথা বলে।

বোধন দিদির কথা কাউকে বলেনি। বলা যায় না। মা কিংবা বাবা একথা শুনলে কানে আঙুল দেবে। বোধনেরও কেমন কান মুখ গরম হয়ে ওঠে কথাটা মনে পড়লে। ছি ছি। ছি ছি! তার দিদি প্রস্টিটিউট। ছিছি। মাথা তোলার আর কিছু রাখল না দিদি।

হাউসিংয়ের মধ্যে ঢুকতেই স্কুটার-চাপা দুটি ছেলেকে দেখতে পেল বোধন। ফুল স্লিভ পুল ওভার। মাথায় গরম নাইট ক্যাপ। কাকে যেন খুঁজছে।

বোধনকে দেখতে পেয়ে দাড়িঅলা ছেলেটি বলল, এই যে দাদা, আমাদের একটু হেল্প করবেন?

দাঁড়াল বোধন। তাকাল।

 অৰ্চনা চৌধুরী কত নম্বর ফ্ল্যাটে থাকে? যাদের দেখতে পাচ্ছি জিজ্ঞেস করছি বলতে পারছে না?

বোধন বুঝতে পারল। চুয়াকে খুঁজছে। নিশ্চয় থিয়েটারের ছেলে। বোধন বলতে যাচ্ছিল, ডেকে দিচ্ছি, হঠাৎ কী ভেবে বলল, অর্চনা…! মানে যে থিয়েটার করে?

হ্যাঁ হ্যাঁ। রাইট।

ওই যে ওই বাঁদিকের ব্লকের সেকেন্ড এনট্রেন্স…দোতলায়।

থ্যাঙ্ক ইউ, দাদা।

বোধন ইচ্ছে করেই অন্য ফ্ল্যাটের দিকে চলে গেল। ছেলে দুটোকে সে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে গিয়েই বা কী করত! ঘরে ডেকে বসতে দিতে পারত না। বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে হত। সেটা বিশ্রী। চুয়া বুঝুক কী করবে।

মানিকদের ব্লকের দিকে সরে গিয়ে আড়ালে দাঁড়াল বোধন, ফাঁকায় নয়, এনট্রেন্সের তলায়। চুয়ার জন্যে বাড়ি বয়ে লোক আসে খুঁজতে। থিয়েটারের লোক। চুয়া কি খুব নাম করে ফেলেছে! এরা কোন ক্লাবের ছেলে? কোন অফিসের? যাক, চুয়ার কিছু একটা হল। মেয়েদের একটু আধটু গুণ থাকলে হয়ে যায় কিছু। কিন্তু ছেলে দুটোকে বলিহারি! এই শীতের মধ্যে স্কুটার চালিয়ে চুয়াকে খুঁজতে এসেছে। তা ছাড়া, দুটোই বোকা, গাধা। পাড়ায় ঢোকার মুখে তারা কি থমথমে ভাবটা বুঝতে পারেনি? রজনী ভার্সেস শান্তদের লড়াই চলছে। ও-দিককার রাস্তার বাতি-টাতি নিবোনো থাকে, দোকানপত্রও প্রায় বন্ধ হয়ে যায় রাত হলে। লোকজন ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করে। কালও বোমাবাজি করেছে দু দলে। বেপাড়ার ছেলে রাত্রে এসেছে, ফেঁসে না যায়। বোধনের উচিত ছিল সাবধান করে দেওয়া।

আরও খানিক দাঁড়িয়ে বোধন নিজের বাড়ির দিকে চলল।

মোটাসোটা ছেলেটা স্কুটার নিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে। দাড়িঅলা এইমাত্র নেমে এসে বন্ধুর কাছে দাঁড়াল।

ওরা কী বলছে বোধন শুনতে পায়নি। কাছে আসতেই আবার চোখাচোখি।

কী, দেখা হল? বোধন জিজ্ঞেস করল।

 ধ্যুৎ মশাই; কীসের দেখা! বাড়ির মধ্যে ফাটাফাটি হচ্ছে। কী চেল্লানি। দরজার কড়া নাড়ছি, শুনতেও পেল না। শেষে এক মহিলা বেরিয়ে এসে আমাকেই মারে আর কী।

অৰ্চনাকে পেলেন না?

না বাড়িতেই নেই বোধ হয়। কোথাও খেপ মারতে গিয়েছে। একটু প্রফেসন্যাল হয়ে গেলে এই সব মেয়েদের আর ধরা যায় নাকি! এই নিয়ে তিন দিন ধরার চেষ্টা করলাম। না পারি ওর ক্লাবে ধরতে, না পারি ওর শো-এর দিন ধরতে। …বাজে থার্ড ক্লাস মাল, বাজারে চলে গেল। স্কেয়ারসিটি মেকস ডিম্যান্ড। বন্যা হলে কুমডোর ফালির দাম চড়ে যায় জানেন তো, দাদা; এ হল তাই। আচ্ছা চলি, দাদা। ধন্যবাদ। চলো, নির্মল। …আগেই তোমায় বলেছিলাম ওর পিনুদাকে না ধরলে কি হবে না। যাও পিনুকে তেল মারো।

স্কুটারে স্টার্ট দিয়ে ছেলে দুটো চলে গেল। দাড়িঅলা দারুণ স্মার্ট। দাঁড়াবার সময় নাচে, কথা বলার সময় গলা ওঠায়। নাটুকে কায়দা। কিন্তু ওদের দু একটা কথা বোধনের ভাল লাগেনি। বাজে থার্ড ক্লাস মাল–মানে কী? কেন বলল কথাটা? পিনু কে? পিনু কি চুয়ার ক্লাবের কেউ? চুয়া গেলই বা কোথায়? আজ ওর বাইরে যাবার তোড়জোড় তো বোধন দেখে আসেনি। বোধ হয়, মার চেঁচামেচি শুনে অন্য কোথাও গিয়ে বসে আছে। মা একবার শুরু করলে তো থামে না, তখন বাড়িতে থাকা সত্যিই দায়। ছেলেটা বোধ হয় মার তাড়া খেয়েছে। তা খাক, কিন্তু অর্চনা চৌধুরীর মা কেমন তা জেনে গেল। ওদের বন্ধুবান্ধবদের কাছে গল্প করবে।

মার মেজাজ এখন গরম। বাড়ি না ঢুকতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এই ঠাণ্ডায় বাইরে বাইরে কোথায় ঘুরে বেড়াবে বোধন। বড় শীত করছে।

দরজা খোলাই ছিল। ভেজানো ছিল। বোধন দরজা ঠেলতেই খুলে গেল।

ঘরের ভেতর থেকে গলা শোনা যাচ্ছিল মার। বাবা সেই নিজের জায়গাটিতে টেবিলে বসে। চেয়ারের পাশে দেওয়াল ঠেস দিয়ে ক্রাচ দাঁড় করানো। বাতি জ্বলছিল আজ।

বোধন চোরের মতন নিশব্দে চটি খুলে পাশের ঘরে ঢুকে পড়বে ভাবছিল, দেখল, মা ঘর থেকে বাইরে এল, দুহাতে শাড়ি গুটিয়ে হাঁটুর ওপর তুলেছে।

একদিন এই নো-ড়া নিয়ে আমি আমার কপালে ঠুকব। ঠুকে ঠুকে মরব। আর তোমাকেও আমি রেহাই দেব না। সে-মেয়ে আমি নই। ওই নোড়া তোমার কপালেও ঠুকব।

বোধন চুপ করে দাঁড়িয়ে। মা তাকে দেখেনি। বরং বোধন দেখছে, মা কেমন করে নিজের কপালে আর বাবার কপালে নোড়া ঠুকবে তার ভঙ্গিটা মা দেখাচ্ছিল।

বাবা মুখ নিচু করে গাল চুলকোচ্ছে। ভরতি দাড়ি।

তুমি হচ্ছ পাকা শয়তান। বোবা সেজে বসে থাকো। বসে বসে শয়তানি করো।

বোধন কিছুই বুঝতে পারছিল না। কী নিয়ে আজ শুরু হয়েছে সে জানে না। অবশ্য হবার কোনও বিশেষ কারণ মার থাকে না, যে কোনও সময়ে অকারণেও শুরু হতে পারে। মার মরজি।

শিবশংকর বললেন, একেবারে নিচু গলায়, আমি কথা বলে কী করব?

কেন, তোমার মুখ নেই? খাবার সময় মুখ হাঁ করতে পারো কথা বলার সময় পারো না। ন্যাকামি!

শিবশংকর চুপ।

সুমতি স্বামীর কাছাকাছি গিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। কেন তুমি ওকে চিঠি লিখেছিলে?

কেমন যেন অসহ্য হল শিবশংকরের। বললেন, আমি তোমায় হাজার বার বলছি, চিঠি আগে আমি লিখিনি।

লেখোনি তো সে আসতে চাইছে কেন?

বোধনের বুক ধক করে উঠল। দিদি নাকি? দিদির চিঠি? বাবা কি দিদিকে চিঠি লিখেছে? কেন? ঠিকানা পেল কোত্থেকে? তা হলে দিদির সম্পর্কে নীলু যা বলেছে তা সত্যি নয়? দিদি যদি অতই খারাপ হয়ে গিয়ে থাকবে বাবা নিশ্চয় তাকে চিঠি লিখত না।

তুমি, শিবশংকর বললেন, ভেবেচিন্তে কথা বললে আমায় দোষ দিতে না। কী হয়েছে সবই তুমি জান। মাধু আমায় যে চিঠি লিখেছিল তাতে তোমারও চিঠি ছিল। সে লিখেছিল, বছর খানেক ধরে ভুগছে। ওখানকার ডাক্তার কিছু করতে পারছে না, ধরতেও পারছে না। একবার কলকাতায় এসে হাসপাতালে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে চায়। …তা তুমি আমায় বললে, জবাব লিখে দিতে। আমি লিখে দিয়েছি। এতে দোষের কী করেছি?

বাজে কথা বোলো না, একেবারে বাজে কথা বলবে না, সুমতি হাত তুলে আঙুল নাড়তে লাগলেন শাসনের ভঙ্গিতে, আমি তোমায় বলিনি তোমার ভাগ্নিকে নেমন্তন্ন করে ডেকে আনন। বলেছি?

না, তা বলোনি, তবে…

তবে-টবে নয়। আমি বলিনি, তবু তুমি সোহাগ করে ডাকতে গিয়েছ। নিজের পাছায় কাপড় নেই–শঙ্করাকে ডাকে। কেন তাকে তুমি ডাকবে?

বোধন ঘরের দিকে চলে গেল। হয়তো তাকে মা বাবা কেউ দেখেনি। যাক, দিদি নয়, মাধুদি মানে পিসিমার মেয়ে।

ঘর থেকে বোধন বাবার কথা শুনছিল।

আমি আর কী করতে পারি! তুমি তো বলে দাওনি যে আসতে বারণ করে লিখে দাও। সম্পর্কে ভাগ্নি, পুষ্প কবে মারা গিয়েছে। না লিখতে পারলাম না। লজ্জা করল।

লজ্জা করল! আহা কী আমার লজ্জা পাবার মানুষ! সুমতি স্বামীকে ভেঙিয়ে বললেন, তোমার ভাগ্নির বেলায় লজ্জা, আর নিজের মাগের বেলায় লজ্জাও নেই, মায়াও নেই। সে মরুক। মুখে রক্ত তুলে মরুক। তুমি বাঁচো। আমিও বাঁচি৷।

শিবশংকর কোনও জবাব দিলেন না।

সুমতি বোধ হয় আবার ঘরে চলে গেলেন।

বোধন এতক্ষণে ব্যাপারটা অনুমান করতে পারছিল। মাধুদি কলকাতায় আসার জন্যে বাবা-মাকে চিঠি লিখেছিল। মা বাবাকেই জবাব দিয়ে দিতে বলেছিল। বাবা বেচারি ভাগ্নিকে আসতেই লিখেছে। হয়তো সেই চিঠির জবাব এসেছে আজ। বাবা মাকে বলেছে। তারপর ওই নিয়ে বেধে গেছে।

বাবা কাজটা ভাল করেনি। নিজের ভাগ্নি ডাক্তার দেখাতে আসতে চাইলে না করা যায় না। ঠিক, বাবা সেদিক থেকে ঠিকই। কিন্তু এই বাড়িতে মাধুদি এসে কোথায় থাকবে। জায়গা নেই এক ফোঁটাও। এমন কী মাধুদিকে শুতে দেওয়াও যাবে না। রোগী লোক, সঙ্গে বাচ্চা থাকবে, আর যদি মাধুদির স্বামী থাকে তবে তো হয়েই গেল। বাবা ভুল করেছে। দোষ নেই বাবার। তবু ভুল।

আবার মার পায়ের শব্দ শুনতে পেল বোধন। মুখে কথা নেই। রান্নাঘরে গেল বোধ হয়। ডাল পোড়ার গন্ধ আসছে। সারাদিন খেটেখুটে এসে মা আর রান্নায় মন বসাতে পারে না, শরীরেও কুলোয়, তখন সেদ্ধ ডাল নামিয়ে তার মধ্যে কাঁচা লঙ্কা পিয়াজ, এক মুঠো কড়াইশুটি দিয়ে দেয়। আর বেগুনপোড়া। কিংবা আলু ফুলকপির ঘেঁট। আবার কী! এই যথেষ্ট।

বোধন আবার মার গলা পেল। রান্নাঘর থেকেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে।

 তুমি কালকেই লিখে দাও, এখানে এসে উঠতে হবে না।

একটু চুপ।

 কী সাড়া নেই যে–? আবার বোবা?

 দেব। লিখে দেব।

হ্যাঁ, তাই দেবে। …আমার নাম করে লিখবে না। তোমার নামে লিখবে।

শিবশংকরের সাড়া পাওয়া গেল না।

 বোধন এতক্ষণ ঘরে আলো জ্বালায়নি। জ্বালাবে কিনা ভাবছিল।

সুমতি আবার কথা বলছেন। রান্নাঘর থেকেই। আমি কেন তোমার ভাগ্নির দায় অদায় দেখব। আমার যখন মাথার ঘায়ে পাগল হবার জোগাড় হয়েছিল–তখন কেউ দেখেছিল আমায়। ওই তোমার বোনও কি দেখেছিল? নাকি তোমার সোহাগের ভাগ্নি একটা চিঠি লিখেছিল। …আমি কিছু ভুলিনি, সব মনে করে রেখেছি। তোমার বোন আমার সংসারে আমার গতরে বসে খেয়েছে আর ন্যাকামি করে ফিট হয়েছে। তার মার কাছে গুজগুজ করত। আমায় একটা ভাল শাড়ি পরতে দেখলে খুঁটত। আবার ঠোরও দিত কত: তুমি তো দেখতে ভাল, তাই বুঝি বাসন্তী রং পরো….আমি কি বুঝতাম না কিছু। আমি দেখতে ভাল তাতে ওর গায়ে জ্বালা ধরত। স্বার্থপর বদমায়েস, পাজির দল…।

শিবশংকর বললেন, এই একঘেয়ে পুরনো কথাগুলো কেন তুমি বলো! আমি কাল চিঠি লিখে দেব।

বাইরে এসেছেন সুমতি। হ্যাঁ দেবে। স্পষ্ট করে লিখে দেবে, আমরা কোনও ঝক্কি নিতে পারব না। এখানে জায়গা নেই।

বোধন বাতি জ্বালাল। প্যান্টটা ছাড়ছিল।

সুমতির পায়ের শব্দে মনে হল ঘরে চলে গিয়েছেন।

বোধন প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে ঘরের বাইরে এল। হাত পা ধোবে। বাথরুমে যাবার সময় দেখল, বাবা ছাদের দিকে মুখ করে অন্ধকার দেখছে। বাবার গায়ে সেই অদ্ভুত চাদর।

বাথরুমে গিয়ে বোধন হাতে মুখে জল দিল। কনকনে ঠাণ্ডা। ফিরে আসার সময় আবার বাবাকে দেখল। কাছেই কার গামছা ঝুলছে। টেনে নিয়ে মুখ মুছল। পা। ঘরে মা চুপচাপ। বাইরে বাবাও বোবা হয়ে বসে মাথার চুল ছিঁড়ছে। বাবার এই এক মুদ্রাদোষ, যখন কিছু ভাবে তখন মাথার চুল ছেড়ে বাবা কী ভাবছে বোধন অনুমান করতে পারল: চিঠির কথা, কাল আবার চিঠি লিখতে হবে মাধুদিকে, বাবার নিশ্চয় মনে লাগছে। ক্ষোভ ও দুঃখ হচ্ছে।

বোধনের মনে হল, বাবাকে কিছু বলা দরকার, যাতে ব্যাপারটা সহজ করে নিতে পারে। অক্ষমতায় দুঃখ পাবার কারণ নেই। তারা অক্ষম। নিজেরাই দুবেলা দুটো মুখে গুঁজে, কোনও রকমে মাথা বাঁচিয়ে বেঁচে আছে। এখানে আত্মীয়তা দেখাবার উপায় নেই। মা খারাপ কিছু বলেনি।

বোধন একবার মার ঘরের দরজার দিকে তাকাল, তারপর বাবার কাছাকাছি এসে নিচু গলায় বলল, আমি লিখে দেব না হয়।

শিবশংকর ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর হঠাৎ বললেন, না, আমিই লিখে দেব। পাপ যখন আমি করেছি তখন…

ব্যাপারটা তুমি বুঝছ না। একটা লোক এসে থাকা বড় কথা নয়, কিন্তু তাকে রাখা, দেখাশোনা করা…

আমি বুঝছি। তুমি আমায় বোঝাতে এসোনা। …তোমার মা শোধ নিতে চাইছে।

সুমতি একেবারে ঘরের দরজার সামনে। শুনতে পেয়েছেন।

বোধন মাকে দেখেই সরে যাবার চেষ্টা করল।

কী বললে। শোধ নিচ্ছি! …হ্যাঁ, তাই নিচ্ছি। বলতে বলতে এগিয়ে এলেন সুমতি। রাগে কাঁপছেন। চোখ খেপার মতন। জ্বালা আর ঘৃণা। গলার স্বর কর্কশ। কেন শোধ নেব না? তোমাদের সকলের ওপর আমি শোধ নেব। তোমরা ছোটলোক, ইতর, শয়তান। আমায় তোমরা কম পিষেছ? তোমার মা, তোমার বোন, তুমি–কেউ আমায় ছাড়োনি!

বোধন একটু তফাতে সরে গল। শিবশংকর ভয়ে কাঠ।

শোনো, এই আমি তোমায় বলে রাখছি বলে সুমতি যেন স্বামীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, সারাটা জীবন আমি শুধু জ্বলেছি। আমাকে তোমরা পুড়িয়েছ ছ্যাঁকা দিয়ে দিয়ে। তোমার মা বলত, আমি ছোটলোকের বাড়ি থেকে এসেছি, তোমার বোন বলত–আমার স্বভাব দোষ আছে…

থাক না, ওরা তো স্বর্গে গেছে

স্বর্গে! স্বর্গে যাবার মানুষ। নরকে গিয়েছে।

আমি তোমার কাছে মাপ চাইছি শিবশংকর জোড় হাত করলেন।

না, কীসের মাপ! তোমরা আমার হাড় মাংস রক্ত সব নিয়েছ, আমার ছেলেমেয়েকেও। একটা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেশ্যা হয়েছে, আর-একটা নেচে বেড়াচ্ছে বাইরে–সেটাও যাবে। আমি কিছু বুঝি না। আর ওই আর-এক হারামজাদা, খাচ্ছে-দাচ্ছে ডেংডেঙিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেয়েমানুষের অধম। …আমি যেদিন চিতেয় উঠব, বুঝতে পারবে। মানুষটার জন্যে এক মণ কাঠও লাগবে না। হুস হুস করে পুড়ে যাব।

মার চোখ-মুখ দেখে বোধনের ভয় করছিল। মাথায় রক্ত চড়ে মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।

.

১৪.

বিনুর মা পাঁচ ছটা একশো টাকার নোট বোধনের হাতে গুঁজে দিলেন। বোধন অবাক। কিছু বলতে যাচ্ছিল, ইশারায় বারণ করলেন বিনুর মা। ট্যাক্সি পাড়ায় ঢুকছে। একটু পরেই বাড়িতে পৌঁছে গেল। নেমে ভাড়া মিটিয়ে বিনুর মা সদরে দাঁড়ালেন। হাতে কালো ব্যাগ। পাশে বোধন! বিনুর মা বললেন, টাকাটা তোমার কাছে রেখে দাও। কখন কে কী চায় আমার বার বার টাকা বের করতে বিরক্ত লাগে। তুমিই দিয়ে দিয়ো। এতগুলো টাকা কাছে রাখতে বোধনের ভয় করছিল। যদি হারিয়ে যায়। মেরে নেয় কেউ! কিছু বলতে যাচ্ছিল বোধন, সদর খোলার শব্দ হল, বিনুর মা ফিসফিস করে বললেন, কাউকে কিছু বলতে হবে না। পরে হিসেব দিয়ো। দরজা খুলল বিনু। বিনুর মা কোলের কাছে ব্যাগ ধরে ভেতরে ঢুকলেন। বোধন জানে, ব্যাগে ন হাজারের বেশি টাকা আছে। সোনার দোকান থেকে পেয়েছেন বিনুর মা। বোধন ভেতরে পা বাড়াচ্ছিল, হঠাৎ কী জড়িয়ে গেল।

ঘুম ভেঙে গেল বোধনের। মশারির সঙ্গে পা জড়িয়ে গিয়েছে। সরু ক্যাম্প খাটের একপাশে পা ঝুলে গিয়েছে। কয়েক মুহূর্তে বোধন তেমন হুঁশ করতে পারল না। তারপর বুঝল, সে স্বপ্ন দেখছিল। তার হাতে বিনুর মা টাকা গুঁজে দেননি।

চোখ চেয়ে বোধন একবার যেন সব দেখতে চাইল। কিছুই দেখা যায় না। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। মশারির চাল ঝুলে আছে চোখের ওপর। শীত করছিল। একটা পুরনো ভুট কম্বলের তলায় ময়লা কাঁথা দিয়ে বোধন শোয়। এতে শীত যায় না। যদিও চারদিকে সব বন্ধ। উত্তরের জানলাটাও। আর এও আচ্ছা শীত চলেছে কলকাতায়। কমেই না।

বোধন একবার ভাবল, বাথরুমে যাবে। পরের মুহূর্তে ভাবল, দূর–কে আবার বাথরুমে যায়। একবার বাইরে বেরুলেই শীত গায়ের লোম খাড়া করে দেবে, মশা ঢুকবে শয়ে শয়ে। কাঁথা কম্বল আরও টেনে-টুনে বোধন আস্তে আস্তে করে পাশ ফিরল। জোরে পাশ ফিরলেই ক্যাম্প খাট উলটে যাবে।

তা স্বপ্নটা মন্দ নয়। হাতের মুঠোয় পাঁচ ছশো টাকা এলে ভালই লাগে। পরের টাকা হলেও। বোধন ইচ্ছে করলেই কিছু সরিয়ে ফেলতে পারত। পঞ্চাশ, একশো, দুশো। কে দেখতে যাচ্ছে। বিনুর মা অত দেখতে চাইবেন না। চাইলেও বোধন ম্যানেজ করতে পারত। অবশ্য সে কিছুই করত না। টাকাটা সত্যি সত্যি হাতে থাকলেও, বড় জোর দু চার প্যাকেট সিগারেট উড়ত, চা চলত। তার বেশি কিছু নয়। বিনুর মা বোধনকে বিশ্বাস করেন। যদি অবিশ্বাসের কাজ করতে হত তবে বোধন পুরো ন হাজার সাড়ে ন হাজার টাকা মারতে পারত। সোনা বিক্রির কোনও রসিদ কেউ রাখেনি। মারলে কে ধরত!

বিনুর মা বোধনের উপকার নাকি জীবনে কোনওদিন ভুলবেন না বলেছেন। বলেছেন, বিনুর বিয়েটা চুকে যেতে দাও, আমি তোমার চাকরি করিয়ে দেবই দেব। ওকে দিতেই হবে।

বিনুর ব্যাপারটা চুকে যাক। বোধনও আশা করছে, বিয়েটা হয়ে গেলে বিনুর মার ঝাট মিটে যাবে। তখন উনি মন দিতে পারবেন।

বিনু অবশ্য বেশ একটা মজার কথা বলছিল সেদিন। বিনু বলছিল: বোধনদা, তুমি বরং দিল্লিতে চলে যেয়ো। আমি! কেন? আমি রাজুকে বলে তোমার চাকরি জোগাড় করে দেব। আমাদের সঙ্গে থাকবে। শুনে বোধনের ভাল লাগলেও সে হেসে ফেলেছিল: দিল্লি গেলে আমার কেমন করে চলবে বিনু! আমার বাবা খোঁড়া, মার শরীর ভেঙে গেছে। বোনের বিয়ে হয়নি। তা ঠিক, তা ঠিক.বিনু দুঃখের মুখ করল।

কথাগুলো বোধন উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল। স্বপ্নটা দেখার কোনও মানে হয় না। বিনুর বিয়ের এখনও আট দশ দিন বাকি। বিনুর মার সঙ্গে সোনার দোকানেও যাওয়া হয়নি এখনও। আগামী পরশু যাবার কথা। শুক্রবারে। বিকেলে। শুক্রবার বিনুর কাকার ফিরতে দেরি হয় বলেই বোধ হয় মাসিমা দিনটা বেছেছেন। বোধনের কোনও অসুবিধে নেই। তার কাছে সব দিনই সমান।

একটা ব্যাপার বোধন এই কদিনে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে বিনুর মা আর বিনুর কথাবার্তা থেকে। টাকা পয়সার ব্যাপারে বিনুর কাকা কাঁচাখোলা নয়। বিনুর জন্যে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে নিজে নারাজ। বিনুর মাকেও করতে দিতে চান না। বিনুর মা কিন্তু যতটা পারেন করবেন, বিনুর কাকার টাকার মুখ চেয়ে তিনি বসে নেই, বসে থাকবেন না। তা ছাড়া বিনুর মার ইচ্ছে নয়–খাওয়া-দাওয়ার খরচটা ছাড়া বিনুর কাকার টাকায় এই বিয়ের কিছু হয়। কাকা লোকটা বোধ হয় বেশ হিসেবি। নিজের ভবিষ্যৎ ভাল বোঝেন।

পরের সংসারের হাঁড়ির সব খবর জানা সম্ভব নয়। বোধনও জানে না। তবে, দেখেশুনে তার মনে হচ্ছে, বিনুর ব্যবস্থা করে দেবার পর তার মা আর কাকায় একটা গণ্ডগোলও লেগে যেতে পারে। কিংবা চোখের সামনে থেকে মেয়ে সরে গেলে বিনুর মা আরও খোলাখুলিভাবে কাকাকে নিয়ে সংসারে থাকতে পারবে।

অন্যের কথা ভেবে আর লাভ কী! ভাঙা ঘুম আবার জোড়া লাগাবার আশায় বোধন কম্বলটা প্রায় মাথা পর্যন্ত টেনে নিল, কান ঢাকা থাকলে শীতও কম লাগে।

সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। হাউসিংও। কোথাও কিছু ডাকছে না। শব্দ হচ্ছে না। এক আধবার দূরের রেল লাইন দিয়ে গাড়ি চলে যাবার শব্দ। নিশ্চয় মালগাড়ি। এখন কোনও লোকাল ট্রেন চলে না।

ভাঙা ঘুম জোড়া লাগছিল না। মা বাবা তাদের ঘুরে ঘুমোচ্ছে। চুয়া তার ঘরে। বোধনের এই শোবার জায়গাটাতে ইঁদুর ছুটছে, আরশোলার দল বাথরুম ভরতি করে রেখেছে। এই ভাবে শুয়ে থাকতে বড় কষ্ট হয়। ক্যাম্প খাটটায় নড়াচড়ার জায়গা নেই। শুয়ে শুয়ে অনেকটা ঝুলে গিয়েছে। মাকে বলবে বোধন। আর-একটা ক্যাম্প খাট তাকে কিনতেই হবে। এভাবে শোয়া যায়! ঝোলা ক্যাম্প খাট, ছেঁড়া শক্ত বালিশ, চাদর বলতে চিট এক টুকরো কাপড়।

এক এক সময়, বোধনের মনে হয়, আকাশ থেকে ঝপ করে পড়ার মতন কিছু টাকা তাদের এই বাড়ির মধ্যে পড়ে গেলে বেশ হয়। এটা এমন কী অসম্ভব! একবার একটা লটারি লেগে গেলেই তারা লাখোপতি। প্রতি হপ্তায়, প্রতি মাসে কেউ না কেউ তো লটারির টাকা পাচ্ছেই–হয় এখানকার, না-হয় ভুটান পাঞ্জাব বিহার কোথাও না কোথাওকার। বাবা লটারির টিকিট মাঝে মাঝে আনায় নীচের তলার পালবাবুকে দিয়ে। একবার কেন একটা লাগছে না? বেশ, লটারি না লাগুক বাবা যে ক্রসওয়ার্ড করে তার একটা লেগে যাক, তাতেও তো পঁচিশ ত্রিশ হাজার।

বোধনদের কপালে একটা কিছু লাগুক। একবারের জন্যে। তাদের সারা সংসারটা এমন ভাবে গরিব, দীন, হতশ্রী হয়ে গিয়েছে যে আর পারা যাচ্ছে না। ছেঁড়াখোঁড়া তোশকের তুলোর মত সব কালচে, ময়লা। চারদিকে এই তুলো ছড়িয়ে আছে, ঘরে, বিছানায়, মেঝেতে টেবিলে রান্নাঘরে বাথরুমে এমনকী তাদের প্রত্যেকের গায়ে মাথায়। এভাবে আর বাঁচা যায় না। শরীরের রক্ত জল হয়ে গেলে যেমন সবই ফ্যাকাশে, খড়িওঠা, নিষ্প্রাণ হয়ে থাকে, এই সংসারের সবই সেই রকম– বিশ্রী, কুৎসিত, নোংরা। টাকার জন্যে যেন দেওয়ালগুলো পর্যন্ত স্যাঁতসেতে, ঠাণ্ডা, কালচে হয়ে গিয়েছে, বিছানাপত্র, দুর্গন্ধে আর উকুনে ভরেছে, ভাঁড়ার খাঁ খাঁ করছে, মেঝে মরার মতন পড়ে আছে।

টাকা টাকা করে তাদের এই ছটফটানি কবে মিটবে? এ-জীবনে, না, পরের জন্মে? নাকি কোনওদিনই মিটবে না!

বোধন আবার সোজা হয়ে শুল। ঘুম আসছে না। এখন কত রাত? দুইনা আড়াই? তিন চারও হতে পারে। কিছু বোঝা যায় না। শুধু অন্ধকার ঝুলে আছে চারপাশে।

আচ্ছা, বোধনের হঠাৎ মনে হল, এই সব ছেড়েছুঁড়ে বিনুর সঙ্গে দিল্লি চলে গেলে কেমন হয়। কিন্তু তো নিয়ে যেতেই চাইছে। দিল্লি যেমন-তেমন জায়গা নয়। রাজধানী। সেখানে সত্যি সত্যি কিছু জুটে যেতে তো পারে। তাদের এক বন্ধু ফটিক তো দিল্লি গিয়ে গুছিয়ে ফেলেছে বলে শোনা যায়।

বোধনও চলে যেতে পারত। কলকাতায় তার কিছু হবে না। কিন্তু কেমন করে যাবে? বাবা বেচারি পঙ্গু, অক্ষম অথর্ব। মা দিন দিন কেমন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। জলেভরা ফোলা শরীর, সারা গায়ে খড়ি উঠছে, সাদা নি-রক্ত চেহারা, অনবরত হাঁফায়, হাঁ করে নিশ্বাস নেয়। মার দুচোখের তলায় কালি, ঠোঁট সাদা, দাঁতের মাড়ি ভরতি রক্ত।

না, বোধন যেতে পারে না। দু দিকে দুই ফাঁসের মতন মা আর বাবা তাকে আটকে রেখেছে।

আমার যাওয়া হবে না, বিনু। এ-জন্মে নয়। বোধন মনে মনে বলল, যেন সত্যিই সে যেতে পারত বিনুর সঙ্গে কিন্তু পারল না।

.

১৫.

সকাল থেকেই চুয়াকে ব্যস্ত দেখাচ্ছিল।

এই সময়টায় তার কিছু কাজ থাকে। সকালের চা তৈরি, বিছানাপত্র ঘর পরিষ্কার, রেশনের চাল বাছা, বাজার এলে শাকসবজি ধুয়ে মার কথামতন কেটেকুটে দেওয়া–এই ধরনের টুকিটাকি কাজ। সকালে একটু বেলা করেই ওঠেন সুমতি, তারপর আর সময় থাকে না, শীতের দিন হুহু করে বেলা চলে যায়।

আজ চুয়া বাথরুমে ঢোকার মুখেই জবাকে কিছু বলল। বোধন শুনতে পায়নি।

 বাথরুম থেকে বেরিয়ে চুয়া তাড়াতাড়ি চায়ের পাট নিয়ে বসল। ওই ফাঁকে নিজের ঘরদোরও পরিষ্কার করে ফেলল যতটা পারে।

বাবাকে চা দেবার সময় চুয়া বলল, আমি কিন্তু বেরিয়ে যাব। আজ আমার দরকার।

শিবশংকর কিছু বললেন না। মেয়েকে একবার দেখলেন। চুয়া ঘরে চলে গেল।

 বোধন চা খাচ্ছিল।

শিবশংকর বললেন, কাল এদিকে গণ্ডগোল হয়েছে।

বোধন এমন বদ্ধ জায়গায় শোয় কিছু শুনতে পায়নি। বলল, কখন? কোথায়?

 তা এগারোটা সাড়ে এগারোটা হবে, শিবশংকর বললেন, প্রায় আধঘণ্টা ধরে দুমদাম হল।

বোধন জবাব দিল না। রাত্রে গুলি কিংবা বোমার আওয়াজ-টাওয়াজ এ-পাড়ায় নতুন কিছু নয়। রেল লাইন দুরে, তবে তেমন দূরে নয়। কাছাকাছি রেল ইয়ার্ডও রয়েছে। রেলের পুলিশ আর ওয়াগান ব্রেকারদের মধ্যে মাঝেসাঝে গুলি বোমার খেলা হয়। হয়তো সেই রকম কিছু।

শিবশংকর চায়ের অর্ধেক শেষ করে বিড়ি ধরালেন। জানলার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। বাইরে রোদ। আলোও পরিষ্কার। তোমার মা এমনিতেই আজকাল কম ঘুমোয় তার ওপর শব্দ-টব্দ শুনলে আর ঘুমোত পারে না।

বোধন মার ব্যাপারটা বোঝে। রাত্রে মার ভাল ঘুম হয় না। শেষরাত কিংবা ভোরের দিকে ঘুম ঘন হয়। সকালে উঠতে দেরি করে। আসলে সারাদিনের খাটুনি হুড়োহুড়ির পর মার বোধ হয় এতই অবসাদ থাকে যে চট করে ঘুম আসে না। তার ওপর নানা দুশ্চিন্তা। মাথা গরম হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে শোবার পরও মা ঘর বেরিয়ে এসে বাথরুমে গিয়ে মাথায় জল দিয়ে নেয়। শীতের দিনেও বাদ যায় না। মাথার ব্রহ্মতালুতে জল চাপড়ে চাপড়ে মা মরবে। অদ্ভুত সব অভ্যেস মার।

বোধন বলল, রেল লাইনের দিকে হতে পারে শব্দ।

 না না, অত তফাতে নয়কাছেই কোথাও।

কাছেই? তবে কি রজনী আর শান্তদের ব্যাপার? হতে পারে। রজনী আর শান্তদের রেষারেষি এমন একটা অবস্থায় পৌঁছে থেমে আছে যে শুধু একটা দেশলাইয়ের কাঠি ফেললেই হয়। কালী পুজোর সময় থেকেই এটা চলছে। রজনীরা তাদের সাম্রাজ্য বাড়িয়ে ফেলে জিজিয়া আদায় বেশি করছে শান্তরা হটে যাচ্ছে, মোটামুটি এই নিয়ে রেষারেষি। ওটা একটু চাপাচুপি ছিল, তারপর আবার লেগেছে। দু পক্ষই তৈরি। একটা ছুতো কিংবা সুযোগের অপেক্ষায় আছে। পুলিশ এখন রজনীদের যতটা পারে খাতির করে চলছে। কিন্তু শাতরাও কম যায় না, সোজাসুজি না হলেও বেঁকা রাস্তায় তারাও থানার দুচারজনকে হাত করে রেখেছে। কাজেই উভয় তরফই সেজেগুজে শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় বসে আছে। পাড়ার লোকজন এটা জানে। জানে বলে সাবধানে চলাফেরা করছে রাত্রে।

চা শেষ করে বোধন উঠে পড়ল। মা ঘুম থেকে উঠে চোখ-মুখ ধুয়ে চা না-খাওয়া পর্যন্ত তার কিছু করার নেই। মা টাকা পয়সা দিলে সে বাজারে যাবে।

চুয়া আবার কখন বাথরুমে ঢুকেছিল। ভেজা মুখ, খোলা চুল নিয়ে ঘরে চলে গেল।

আজ আবার কী আছে চুয়ার? এই সাত সকালে?

বোধন ঘরে এল। চুয়া শাড়ির শুকনো আঁচলে মুখ মুছছে ঘষে ঘষে।

 কী ব্যাপার রে? কোথাও বেরুবি? বোধন জিজ্ঞেস করল।

 হ্যাঁ। নটায় বাস।

 বাস? কোথায় যাচ্ছিস?

কেষ্টনগর। ভাড়া বাসে।

 কেষ্টনগর। সেখানে কী?

শো আছে সন্ধেবেলায়। দুপুরে পৌঁছে যেতে হবে।

 শো! মানে থিয়েটার।

 চুয়া মাথার চুল আঙুলে ছাড়িয়ে নিয়ে মোটা চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতে লাগল।

কীসের থিয়েটার? বোধন জিজ্ঞেস করল!

কল শো। আমাদের ক্লাবের নয়, আমি ক্লাব ছেড়ে দিয়েছি। যত প্যাঁচ মারামারি। টাকা দেব বলে দেয় না, দেব-দিচ্ছি করে, বড় বড় কথাই শুধু। তার চেয়ে আমার এই মধুচক্র-ই ভাল। পিনুদা টাকাপয়সা নিয়ে ছ্যাঁচড়ামি করে না।

বোধন কিছুই বুঝল না। কত টাকা দেবে তোকে?

তিরিশ।

 তিরিশ। বলিস কী রে! একবার স্টেজে নামবি, তার জন্যে তিরিশ?

একবার মানে? গানও গাইতে হবে।

বোধন নাক টানল। বোনকে ঈর্ষাও করছিল। তিরিশটা টাকা কত সহজে রোজগার করে চুয়া! তা তুই ফিরবি কেমন করে?

কী জানি। ভাড়া বাসেই ফেরার কথা। তবে বেশি রাত হয়ে গেলে আজ হয়তত ফেরাই হবে না।

বোধন অবাক হল। রাত্রে বাড়ি ফিরবে না চুয়া! আশ্চর্য। মা কি তা হলে আস্ত রাখবে। চুয়ার সাহস দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। মা ওকে আস্কারা দিচ্ছে বেশি।

সুমতির সাড়া পাওয়া গেল।

চুয়া চিরুনি মাথায় খুঁজে বেরিয়ে গেল। বোধ হয় সুমতির চা ঢেলে দিতে।

বোধন দাঁড়িয়ে থাকল ঘরে। নিজের বিছানার দিকে চুয়া কিছু দিন হল তার এক ছবি টাঙিয়েছে। ছোট ছবি। সাজগোজ করে তোলা। মাথায় ফুল। এই ছবি চুয়ার থিয়েটারের ছবি। রীতিমতো ভালই দেখায় তাকে। ..কোন সিনেমার রঙিন কাগজে একবার ছবিও বেরিয়েছিল চুয়ার। চুয়া আর একটা ছেলে একসঙ্গে আছে, অভিনয়ের ছবি, চুয়া দাদাকে দেখিয়েছিল। দারুণ, তুই তো ফেমাস হয়ে যাচ্ছিস রে? কোথায় আর। বংশীদার জন্যেই ছবি। কত হাতে পায়ে ধরতে হয় একটা ছবি বার করার জন্যে।

বোধন আগে বুঝতে না, এখন সে বুঝতে পারছে, চুয়া ধীরে ধীরে পায়ের তলায় মাটি করে নিচ্ছে। একদিন সে দাঁড়িয়ে যাবে। বোধন পারবে না।

দুঃখ এবং নিজের ওপর কেমন ঘেন্না হল বোধনের। সত্যিই সে অপদার্থ। নীলু তাকে বলেছিল, তুমি পয়সা রোজগার করতে চাও, আমি তোমায় চুরির রাস্তা শিখিয়ে দেব। …না, শেষ পর্যন্ত বোধনের বোধ হয় ওই রাস্তাতেই যেতে হবে।

চুয়া ঘরে এল। তার সময় তর তর করে চলে যাচ্ছে। বলল, কাপড়টা বদলে নিই।

 বোধন ঘর ছেড়ে চলে এল। দরজা ভেজিয়ে দিল চুয়া।

সুমতি চা খেতে বসেছেন। আলগা, এলোমেলো, মিলের শাড়ি। ময়লা। সুমতির পা দুটো ছড়ানো। শাড়িটা বোধ হয় খাটো হয়ে গিয়েছে। চোখ-মুখ ফোলা, চোখ ছলছল করছে, মুখময় অবসাদ। মাথার চুল উস্কোখুস্কো, কপালের কাছে অজস্র পাকা চুল। সুমতি এখনও হাই তুলছিলেন।

শিবশংকর মাঝে মাঝে স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছেন, কিছু যেন বলতে চান, বলতে পারছেন না। চোখ নামিয়ে নিচ্ছেন।

ছেলের দিকে তাকালেন সুমতি। রোজ রাত্তিরে এত হইহই কীসের হয়?

সুমতি এমনভাবে বললেন যেন বোধনই হইহই করে বেড়ায়।

 নিজের বাড়িতে শুয়ে রাত্তিরে চোখ বোজার উপায় নেই! কী ছোটলোকের জায়গা।

বোধন নিচু গলায় বলল, রেল লাইনের দিকে হবে বোধ হয়।

যে লাইনের দিকে হোক, আমার তাতে কী? ঘরে বাইরে কোথাও এক ফোঁটা শান্তিতে থাকার উপায় রাখল না। যত রাজ্যের গুণ্ডা বদমাশের রাজত্ব হয়ে গিয়েছে।

শিবশংকর বললেন, পুলিশ আজকাল কিছু করে না। পড়ে পড়ে ঘুমোয়।

তোমার মতন সব– সুমতি স্বামীর দিকে বিতৃষ্ণার চোখে তাকালেন, খায় দায় নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়। আবার একবার হাই তুলে চা মুখে দিলেন, বিস্বাদের মুখ করলেন, চা না গঙ্গাজল!

বোধন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। মা টাকা দিলে সে বাজারে যাবে। বাইরে যেতে পারলে রোদটাও গায়ে লাগানো যায়। সকালের দিকে এই বাড়িটা বড় ঠাণ্ডা, কনকনে। মার কিন্তু শীত নেই। গায়ে একটা সুতির চাদরও মা সকালে জড়াবে না। শিবশংকর আবার কিছু বলার চেষ্টা করেও থেমে গেলেন। একটু আগেই ধমক শুনেছেন স্ত্রীর।

নিজের হাতে না করলে কোনও জিনিস মুখে ভোলা যায় না– সুমতি বললেন, সবই দায়সারা।

বোধন বলল, আজ বাজার…

 বাজারে না গেলে গিলবে কী? যাও আমার ব্যাগটা নিয়ে এসো।

বোধন মার ব্যাগ আনতে ঘরে গেল।

ফিরে এসে দেখল, চুয়া সেজেগুজে বাইরে এসেছে। হাতে একটা মেয়েলি ব্যাগ। চুয়াকে বেশ দেখাচ্ছিল। মাথার চুল এলো। চোখে বোধ হয় কাজল দিয়েছে। মুখে পাতলা করে পাউডার মাখা। বড় বড় ফুলকাটা ছাপা শাড়ি। নাইলন নাইলন দেখাচ্ছে। গায়ে চাদর।

চুয়া পায়ের দিকের কাপড় টেনে গুছিয়ে নিল। নিয়ে সুমতির দিকে তাকাল। আমি যাচ্ছি। দেরি হয়ে গেল। বলে শিবশংকরের দিকে তাকাল। কই, দাও?

শিবশংকর কেমন জড়সড় হয়ে সংকোচের ভাব করলেন। মেয়ের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে স্ত্রীর দিকে, আবার মেয়ের দিকে তাকালেন।

চুয়া বলল, কী হল?

শিবশংকর আরও আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। অপ্রস্তুত। থুতনির কাছে দাড়ি চুলকোলেন। অস্বস্তি বোধ করছিলেন। স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তাকিয়েই আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। গলায় কেমন এক শব্দ হল চাপা।

কী, দেবে না? চুয়ার মুখ বিরক্ত হয়ে উঠল, চোখ রুক্ষ।

 আজ হল না, বিব্রত গলায় শিবশংকর বললেন।

হল না? বাঃ! চুয়ার চোখ নাক কুঁচকে, মুখ বিশ্রী হয়ে উঠল।

শিবশংকর হাতে-পায়ে ধরার মতন করে বললেন, তুই আজ চালিয়ে নে। পরে দেব…

সুমতি প্রথমে স্বামী তারপর মেয়ের দিকে তাকালেন। কী, হয়েছে কী?

 বাবা আমার টাকা নিয়েছে, বলেছিল দেব, দিচ্ছে না। চুয়া ভীষণ রেগে গিয়েছিল।

 টাকা? কেন? কীসের জন্যে? সুমতি বললেন।

আমি কেমন করে জানব। চুয়া রুক্ষভাবে বলল, আমি তখনই বললাম, দু একটা টাকা নিয়েই তুমি ফেরত দাও না কোনওদিন, দশ টাকা তুমি ফেরত দিতে পারবে না। আমি দিচ্ছিলামই না। তখন আমায় খোসামোদ করে টাকা নিল। বলল, তোর মার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে ফেরত দেব।

সুমতি স্বামীর দিকে তাকালেন। তুমি টাকা নিয়েছিলে?

 অসহায়ের মতন মাথা নাড়লেন শিবশংকর।

কেন? কীসের জন্যে তুমি ওর কাছ থেকে টাকা নিয়েছ? দশ-দশটা টাকা?

শিবশংকর চুপ। সমস্ত মুখ লজ্জায়, সংকোচে, অপমানে দীন, করুণ দেখাচ্ছিল।

সুমতির গলা ভীষণ চড়ে গিয়েছিল, মুখও লালচে। তোমার কীসের টাকার দরকার হল? নেশাভাঙের জন্যে? বেঁটা মারি তোমার অমন নেশার মুখে। বসে বসে আর কিছু করতে পারো না, শুধু নেশা? এতগুলো টাকার নেশা…

শিবশংকর কিছু বলার চেষ্টা করেও পারলেন না।

 চুয়া বলল, আমার কাছে একেবারে টাকা নেই। পরশু থেকে বলছি, আমার টাকা ফেরত দাও। রোজ বলে, কাল দেব, কাল দেব। এখন আমি কী করব? আমি বাইরে যাচ্ছি, টাকা আমার চাই।

সুমতি চিৎকার করে আবার বললেন, কেন তুমি টাকা নিয়েছিলে, বলো? বোবা হয়ে থাকবে না। বলল, কেন নিয়েছিলে?

কেন আর নেবে? চুয়া ঘেন্নার গলায় বলল, ওই যে কাগজ আনায়, ক্রস ওয়ার্ড, সেগুলো পাঠায়।

ও! ওই ছাইভস্ম। ওরা টাকা নিয়ে বসে আছে তোমার জন্যে। কী নির্লজ্জ বেহায়া তুমি? পেটে ভাত জোটে না, পেছনে কাপড় নেই, টাকা খরচা করে তুমি জুয়া খেল। ছি ছি, গলায় দড়ি তোমার।

চুয়া টাকা পাবে না বুঝে নিয়ে বিশ্রীভাবে বাবাকে বলল, আর তুমি কখনও আমার কাছে টাকা চাইবে না। মিথ্যুক কোথাকার। টাকা নেবার সময় খুকি খুকি। ফেরত দেবার সময় মাকে দেখাও। ফেরত দেবার মুরোদ নেই টাকা নাও কেন? খালি ধাপ্পাবাজি।

চুয়া রাগে ঘেন্নায় মুখ কালো করে পেছন ফিরল। আর দাঁড়াবার সময় নেই তার।

হঠাৎ, একেবারে হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেলেন সুমতি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেয়ের দিকে হাত বাড়ালেন, ধরতে গেলেন মেয়েকে। কী বললি তুই?

চুয়া মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে মুখ ঘোরাল। ঠিক বলেছি।

চলে যাচ্ছিল চুয়া সুমতি চেয়ার থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে মেয়ের চাদর ধরে ফেললেন। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। নিজের বাপকে ধাপ্পাবাজ বলিস। আজ আমি তোর মুখ ভাঙব। হারামজাদি।

চুয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্যে চাদর ধরে টানল। তারও মাথায় আগুন উঠে গেছে। ধাপ্পা মারে তো ধাপ্পাবাজ বলব না। …ছেড়ে দাও আমাকে।

নিজেকে প্রচণ্ড জোরে টান মেরে ছাড়িয়ে নিতে গেল চুয়া। তার গায়ের চাদর খুলে গেল। সুমতির হাতে থাকল চাদরটা।

চাদর টান মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে সুমতি মেয়েকে ধরতে গেলেন। তাঁর আঁচল খুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চুয়া দরজার দিকে চলে যাচ্ছিল। তার শাড়ির আঁচলটা সুমতির হাতে এসে গেল। ধরে টানতে লাগলেন।

চুয়া তার শাড়ি আর ব্যাগ বাঁচাতে বাঁচাতে বলল, ছেড়ে দাও আমায়।

ছেড়ে দেব? তোর মুখ আমি ভাঙব। সাপের পাঁচ পা দেখেছিস না? সুমতি প্রাণপণে মেয়েকে টানতে লাগলেন তার শাড়ি ধরে।

চুয়া নিজেকে ছাড়াবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। রাগে, জ্বালায় সে হিংস্র হয়ে উঠেছিল। বাঁ হাতে ব্যাগ, তবু দুহাতে শাড়ির আঁচলের বাকিটা ধরে সে টানছে। আমায় ছেড়ে দাও বলছি। শাড়ি ছিঁড়ে যাবে আমার।

ছিডুক। তোর শাড়ি আমি কুচি কুচি করে ছিঁড়ব। আগুনে দেব। তোর বড় বাড় বেড়েছে। এত বড় আস্পর্দা তোর তুই তোর বাপকে মুখ ঝামটা দিয়ে কথা বলিস। গালাগাল দিস। আজ তোরই একদিন, না আমারই একদিন।

ঝটকা মেরে শাড়ি ছাড়িয়ে নিল চুয়া। আগুনে দেবে না? একটা সুতো কিনে দিতে পার না, শাড়ি আগুনে দেবে। আমি নিজের রোজগারে এশাড়ি কিনেছি।

সুমতি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কোনও হুঁশ ছিল না। মুখ লাল। চোখ জ্বলছে ঘৃণায়, অপমানে। সমস্ত শরীর কাঁপছিল। গলার স্বর যত তীক্ষ্ণ তত কর্কশ! প্রায় লাফিয়ে পড়ার মতন করে এগিয়ে তিনি মেয়ের চুল ধরলেন মুঠো করে। তোকে আমি রোজগার দেখাচ্ছি! মেয়েকে ঠাস করে চড় মারলেন। বাইরে নেচে, ধাড়ি ধাড়ি মদ্দাগুলোর গায়ে ঢলে তুই পয়সা রোজগার করিস, তা আমি জানি না। সুমতি চুলের ঝুঁটি ধরে মেয়েকে টানতে লাগলেন। রোজগার! আবার ঠাস করে চড় মারলেন। আমাকে রোজগার দেখাতে আসিস, হারামজাদি!

চুয়া নিজেকে বাঁচাবার জন্যে মরিয়া হয়ে সুমতিকে ধাক্কা দিতে গেল। তার হাতের ব্যাগ মুখে লাগল সুমতির। সুমতি উঃকরে যন্ত্রণার শব্দ করে চোখ বুজলেন। চুল ছেড়ে দিলেন। দিয়েই পর মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা কেড়ে নিলেন। তারপর ব্যাগ দিয়ে পাগলের মতন মারতে লাগলেন মেয়েকে। চুয়াও কেমন বেপরোয়া।

চুয়ার গায়ের কাপড় খুলে মাটিতে লুটোচ্ছে, চুল পাগলের মতন, গালে দাগ বসে গেছে আঙুলের, হাতের একপাশ ছড়ে গেছে। সুমতি তখনও পাগলের মতন ব্যাগ দিয়ে মেরে যাচ্ছেন মেয়েকে।

চুয়াও হাত ছুড়ছিল। খামচা-খামচি করছিল। কাঁদছিল।

শিবশংকর চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে উঠে বার বার বলছিলেন, কী করছ, ছেড়ে দাও। সুমু ছেড়ে দাও। ছি ছি। একি কাণ্ড! মেরে ফেলবে নাকি ওকে?

বোধন কোনও পক্ষকেই ধরবার সাহস করছিল না। মাকে এসময় সামলাতে যাওয়া বিপদ। চুয়া যা বলেছে তাতে মার মাথায় আগুন জ্বলে যাওয়া অন্যায় নয়। চুয়ার একটু শিক্ষা হওয়া উচিত। সত্যি, সে বড্ড বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু মা-মেয়ের এই কুৎসিত ঝগড়া, মারপিট তার ভাল লাগছিল না। এত জোর চেঁচামেচি হচ্ছে যে ফ্ল্যাটের বাইরে হয়তো কান পাতছে কেউ কেউ!

চুয়া কাঁদছিল। কাঁদছিল আর ভাঙা কান্না জড়ানো গলায় হিংস্রের মতন যা মুখে আসে বলছিল। সে কাউকে বাদ দিচ্ছিল না। বাবাকে নয়, মাকে নয়, বোধনকেও নয়।

আমার রোজগারের পয়সা নাও, আবার আমায় লাথি মারো। ভগবান দেখছে, তোমার ওই পা খোঁড়া হবে।

তোর মতন মেয়ের রোজগারের পয়সায় আমি থুতু ফেলি। হারামজাদি।

তুমি মিথ্যুক। তুমি পয়সা নাও না?

তুই কার পয়সায় খাস? কার বাড়িতে থাকিস? কে তোকে এতকাল খাইয়ে পরিয়ে এসেছে? তোর থিয়েটারের দাদারা?

খাওয়াতে পরাতে পারবে না তো জন্ম দিয়েছিলে কেন। লাথি-ঝেটা মারার জন্যে? স্বামীভক্তি দেখাচ্ছ?

মা আচমকা চুয়ার মুখের ওপর ব্যাগ দিয়ে মারল। পর পর।

 চুয়া সামলাতে পারল না। যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল।

তুই বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। ছোটলোক, শয়তান মেয়ে কোথাকার! যা বেরিয়ে যা। যেখানে তোর জোটে সেখানে চলে যা…।

যাব। এ বাড়িতে আর থাকব না।

যা, মরগে যা– আমায় ভয় দেখাস না। একজন গিয়েছে–তুইও যা।

বোধন আর সহ্য করতে পারল না। মার হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিল। কী করছ! মেরে ফেলবে ওকে?

মরুক ও। সুমতি জোরে জোরে হাঁফ নিচ্ছিলেন। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে শ্বাস টানতে। চোখের দৃষ্টি উন্মাদের মতন। সমস্ত মুখ টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে।

চুয়ার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল। জোরেই কাঁদছিল। তার শাড়ির আধখানা মাটিতে লুটোচ্ছে, মাথার চুল এলোমেলো। জামা ছিঁড়েছে। গালে ঘাড়ে পিঠে দাগ ফুটেছে মারের।

বোধন সুমতিকে টানতে টানতে ঘরের দিকে নিয়ে চলল।

চুয়াও তার ঘরে চলে যেতে যেতে বলল, এ বাড়িতে আমি থাকব না আর। যদি থাকি আমার মরা মুখ দেখবে তোমরা।

হ্যাঁ; তাই দেখব। তুই মর।

তুমিও মরো।

 চুয়া গিয়ে দরজা বন্ধ করল বিকট শব্দ করে।

শিবশংকর পাথরের মতন দাঁড়িয়ে। তাঁর অসহায়, দীন, করুণ মুখ আরও কাতর, দগ্ধ দেখাচ্ছিল। বিহ্বল, বিমূঢ়। সমস্ত দৃশ্যটাই যেন তাঁর কাছে দুঃস্বপ্নের মতন। শূন্য, নির্বোধ দৃষ্টি। অনুশোচনায় বার বার মাথা নাড়ছিলেন।

ঘরে এনে বোধন সুমতিকে বিছানায় বসাল। জল খাবে?

 সুমতি মাথা নাড়লেন।

বোধন জল এনে দেখল, মা বিছানায় শুয়ে পড়েছে কেমন ভাবে যেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *