মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৭, ১৯৯৩
বিছানায় সে সরাসরি ঘুমিয়ে পড়ল।
আমি দীর্ঘ সময় জেগে থাকলাম। জেগে জেগে কুয়াশা, মদ, আমাদের কথোপকথনের বিষয়ে ভাবছিলাম। স্রষ্টা একই সাথে পিতা ও মাতা এই চিন্তাটা আমাকে ক্রমশই ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল। ঈশ্বর কি তাহলে সত্যিই আছেন?
একটু পরে আমি বাতি জালিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকলাম।
আমরা যখন চুপচাপ ছিলাম তখন আমি দেখছিলাম আমি তাকে কত কাছ থেকে অনুভব করছি।
আমাদের দুজনের কেউ কিছুই বলছিলাম না।
ভালোবাসা কোনো কিছু নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন পড়ে না। নিজেকে বলার জন্য ভালোবাসার নিজের ভাষা আছে।
সেই রাতে কুয়োর পাশে নির্জনতাটুকু আমার হৃদয়কে আরো কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দিয়েছিল। যাতে করে আমরা একে অপরকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারি।
আমার হৃদয় আরো কাছ থেকে শুনছিল সে কি বলছে।
ঘুমানোর আগে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমার বন্ধু যে অন্য আরেক মানুষের চর্চা করতে বলেছিল আমি সেটা করা শুরু করব।
‘আমি এই যে ঘরে শুয়ে আছি’ আমি ভাবলাম। আমার পরিচিত পরিবেশ থেকে অনেক দূরে, এবং এমন কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলছি যে বিষয়ে আমি কখনোই আগ্রহি ছিলাম না, আর আজকে ঘুমাচ্ছি এমন এক শহরে যে শহরে আমার সারা জীবনেও কোন দিন পা পড়ে নি। আমি ভান করতে পারি অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভান করতে পারি যে আমি ব্যতিক্রম। সব কিছু থেকে ব্যতিক্রম।
.
আমি তখন সেই মুহূর্তটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম।
আমি সুখি হতে চাই। আমরা ক্ষেপাটে, আরো আনন্দপূর্ণ হৈচৈ করে জীবনটা পার করতে চাই, প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে জীবনের পানীয় পান করতে চাই। আমি যা চাই তার জন্য আমি যুদ্ধ করতে সক্ষম।
এমন একটা মানুষকে ভালোবাসি যে আমাকে ভালোবাসে।
আমি অনুভব করলাম আমার অন্তর ঈশ্বর কিংবা দেবির আলোয় আলোকিত হচ্ছে যাদের উপর থেকে এক সময় আমার বিশ্বাস হারিয়ে গিয়েছিল। আর আমি আরো অনুভব করছিলাম আমার ভেতরের সেই অন্যজন আমার শরীরকে ছেড়ে ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
ভালোবাসা সব সময় নতুন। একবার, নাকি দুইবার নাকি কয়েক ডজন বার আমরা জীবনে প্রেমে পড়লাম সেটা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমরা সব সময় একদম নতুন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হই।
ভালোবাসা আমাদেরকে স্বর্গে পাঠাতে পারে আবার নরকেও পাঠাতে পারে। এটা আমাদেরকে কোথাও না কোথাও নিয়ে যাবেই। আমরা কেবল ভালোবাসাকে গ্রহণ করব। কারণ এটা আমাদের অস্তিত্বকে সদা প্রফুল্ল করে।
কোনভাবেই ভালোবাসাকে ছাড়া যাবে না।
আমরা যদি ভালোবাসাকে ছেড়ে দেই কিংবা প্রত্যাখ্যান করি তাহলে আমরা ক্ষুধায়, জীর্ণতায় মারা যাব। কারণ ভালোবাসাকে ছেড়ে দেওয়ার অর্থ হলো জীবন থেকে উৎফুল্লতাকে ত্যাগ করা।
ভালোবাসাকে আমরা যেখানেই পাব সেখানেই এটাকে গ্রহণ করতে হবে, এমনকি যদি সেটা কয়েক মুহূর্ত, ঘণ্টা, দিন কিংবা সপ্তাহের দুঃখের মুহূর্তও হয় তবুও সেটাকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না।
যেই মুহূর্ত থেকে আমরা ভালোবাসাকে খুঁজতে থাকব সেই মুহূর্ত থেকে ভালোবাসাও আমাদেরকে খুঁজতে থাকবে।
তারপর আমাদেরকে রক্ষা করবে।
.
যখন আমার ভেতরের দ্বিতীয়জন আমাকে ছেড়ে গেল তখন আমার অন্তর আমার সাথে কথা বলা শুরু করল।
হৃদয় আমাকে বলল যে বাধের মধ্যে যখন ফাটল দেখা দেয় তখন পানি সেখান থেকে ছিটকে বের হয়ে আসে, চারপাশে বাতাস বইতে থাকে। হৃদয় এখন এই জন্য খুশি সে যা কিছু বলতে চাইছে আমি তা শুনছি।
আমার হৃদয় বলল যে আমি প্রেমে পড়েছি।
আমার ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
*
আমি যখন ঘুম থেকে উঠলাম দেখলাম জানালা খোলা, আমার বন্ধু জানালা দিয়ে অনেক দূরে পাহাড়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আমি চুপচাপ তাকে দেখতে থাকলাম। প্রস্তুত ছিলাম যদি সে ফিরে তাকায় তাহলে আমি তার আগেই চোখ বন্ধ করে ফেলব।
মনে হলো আমার বন্ধু বিষয়টা বুঝতে পেরেই মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল।
‘শুভ সকাল। সে বলল।
‘শুভ সকাল। জানালাটা বন্ধ করে দাও। খুব শীত।
আমার ভেতরের দ্বিতীয়জন কোন রকম সাড়া শব্দ না করেই হাজির হলো। এটা তখনো বাতাসের গতি পাল্টানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
‘আমি পোশাক পাল্টাবো।’ আমি বললাম।
‘নিচের সিঁড়িতে তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করছি।
.
আমি উঠে দাঁড়ালাম, আমি ভেতরের দ্বিতীয়জনকে আমার চিন্তা থেকে তাড়িয়ে দিলাম। জানালাটা আবার খুলে সূর্যের আলো ভেতরে ঢুকতে দিলাম। সূর্যের আলো সব কিছুকে ধুয়ে দিচ্ছিল; বরফে আচ্ছাদিত পাহাড়ের চূড়া থেকে শুরু করে বরফের চাদরে ঢাকা শুকনো পাতা এবং নিচের নদী যেটাকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু তার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।
সূর্যের আলো আমার নগ্ন শরীরটাকে উষ্ণ করে তুলছে।
আমি যদিও তেমন শীতার্ত ছিলাম না। কারণ একটা তাপে আমি উষ্ণই ছিলাম। যেই তাপটা ছোট্ট একটা আগুনের ফুলকি থেকে শুরু হয়েছিল। তারপর সেই আগুনের ফুলকি আগুনের শিখা হয়ে গেল, আগুনের শিখা পাল্টে গেল বিশাল অগ্নিকুণ্ডে, আর অগ্নিকুণ্ড পরিণত হলো নরকে।
আমি এটা জানতাম।
আমি এটাই চেয়েছিলাম।
আমি আরো জানতাম যে এই মুহূর্ত থেকেই আমাকে স্বর্গ আর নরক, সুখ, দুঃখ আর হতাশার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে।
আমি আরো বুঝতে পেরেছিলাম যে এই মুহূর্ত থেকেই ভালোবাসা হবে আমার পথপ্রদর্শক।
সত্যি কথা হলো আমি কখনোই ভালোবাসাকে ভুলি নি। তবে ভালোবাসা সত্যিকার অর্থেই খুব জটিল।
সোরিয়াতে সেই বাড়ির স্মৃতিটুকু আমি আবার মনে করার চেষ্টা করলাম। সেখানে আমি তাকে বলেছিলাম আমার মেডেলটা খুঁজে দিতে। আমি আরো জানতাম সে কি বলতে চাইছে। কিন্তু সেটা আমি কিছুতেই শুনতে চাচ্ছিলাম না। কারণ সে এমন একটা ছেলে যে কোনো এক সময় আর সম্পদ, অভিযান, স্বপ্নের পিছু ছুটবে না। আমি এমন একটা ভালোবাসা চাই যেটা সম্ভব।
আমি উপলব্ধি করতে পারলাম ইতোপূর্বে ভালোবাসার বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না।
আমি যখন আমার বন্ধুকে সম্মেলনের কক্ষে দেখলাম আর তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম তখন আমি ভেবেছিলাম যে একজন পরিণিত মেয়ে হিসেবে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব যে তার রাজকুমারকে দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আর সে যখন শিশু বেলা নিয়ে কথা বলা শুরু করল তখন আমি শিশু কালের সেই ভীত রাজকুমারীর কণ্ঠের স্বর শুনতে পেলাম যে রাজকুমারী ভালোবাসা পেয়ে হারানোর ভয়ে ভীত ছিল।
চারদিন ধরে আমার হৃদয়ের কথাগুলোকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হৃদয়ের কণ্ঠস্বর ক্রমশই ধীরে ধীরে আরো উঁচু হয়ে উঠছিল। আমার হৃদয়ের সত্যিকার আমিকে দেখতে পেলাম। সমস্ত জায়গায় খুঁজে বেড়িয়ে অবশেষে ভালোবাসা আমাকে খুঁজে পেল। যদিও অন্তরের দ্বিতীয় জন সেই জারাগোজা থেকে আমাকে প্রতিবন্ধক তৈরি করে আসছিল।
আমি জানালার কপাট আর আমার হৃদয়ের কপাট খুলে দিলাম। সূর্যের আলো পুরো ঘরটাকে ভাসিয়ে দিল, আর ভালোবাসা আমাকে অভিভূত করে ফেলল।
*
আমরা তুষারের ভেতর দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘুড়ে বেড়ালাম।
যে গ্রামে সকালের নাস্তা করলাম সেই গ্রামের নামটা মনে করতে পারছি না। তবে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের মধ্যখানে একটা অদ্ভুত ঝর্ণার ভাস্কর্য দেখতে পেলাম, সেখানে শান্তির প্রতীক একটা ঘুঘুর প্রতিকতিকে একই সাথে একটা ধুর্ত শয়তানের প্রতিকৃতির সাথে মিশিয়ে কেমন একটা অতিপ্রাকৃতিক আকৃতি দেওয়া হয়েছে।
আমার বন্ধুটি মুচকি হেসে বলল, এটা হলো পুরুষ আর নারীর একটা প্রতিকৃতিতে মিশে যাওয়ার চিহ্ন।
‘তুমি গতকাল আমাকে যা বলেছিলে সেটা নিয়ে আমি কখনোই চিন্তা করি নি। আমি বললাম। কিন্তু এটা আমাকে কিছু একটা ভাবতে শিখিয়েছে।’
‘আর ঈশ্বরই নারী ও পুরুষকে তৈরি করেছে। কারণ এটাই হলো তার প্রতিকৃতি, পুরুষ আর নারী। সে বলল।
তার চোখে আমি নতুন একটা আলোর খেলা লক্ষ্য করলাম। সে খুব সাধারণ বিষয় নিয়েও হেসে উঠছিল।
রাস্তা দিয়ে হাটার সময় আমরা যে সব লোকদের সাথে মিলিত হচ্ছিলাম সে তাদের সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবে সাধারণ কথা বার্তায় মেতে উঠল।
তার হাসিখুশি ভাবের জন্য যারাই তার সাথে কথা বলছিল তারা সকলেই হেসে উঠল।
খুব সম্ভবত তার হৃদয় তার সাথে কথা বলেছে আর এখন সে জানে যে আমি তাকে ভালোবাসি।
‘আজকে তোমাকে খুব খুশি খুশি লাগছে। আমি বললাম।
কারণ আমি সব সময় স্বপ্ন দেখতাম যে তোমাকে নিয়ে আমি এই পাহাড়ি উপত্যকার ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। আর সূর্যের সোনালি ফলগুলো সংগ্রহ করছি।’
‘সূর্যের সোনালি ফল’ এটা কবিতার একটা লাইন অনেক অনেক বছর আগে যেটা লেখা হয়েছিল। আর আজ সে এই মুহূর্তে সেটা বলছে।
‘তোমার খুশি হওয়ার আরো একটা কারণ আছে। আমরা সেই ছোট্ট গ্রামের ভাস্কর্যটা অতিক্রম করার সময় আমি বললাম।
“কি সেটা?
‘তুমি জানো আমি এখন খুব সুখি। তোমার কারণেই আমি এখানে এসেছি, আমি এতদিন পুস্তকে যে পাহাড়ের কথা জানতাম সেটাকে ফেলে রেখে বাস্তবে এ পাহাড়ে আরোহন করছি। তুমি আমাকে সুখি করেছ। আর সুখ হলো এমন একটা জিনিস যখন এটাকে ভাগ করা হয় তখন এটা আরো দ্বিগুণ হয়ে যায়।
তুমি কি তোমার ভেতরের দ্বিতীয়জনের সাথে কথা বলেছ?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কীভাবে সেটা জানলে?’
কারণ তুমি এখন অনেক পাল্টে গেছ।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে আরো কিছুটা পথ পার হয়ে গেলাম।
তুমি কি নিয়ে ভাবছ?’ সে আমাকে জিজ্ঞেস করল।
‘আমি ভেম্পায়ার নিয়ে ভাবছি। এই অদ্ভুত প্রাণীটি নিজেকে নিজের ভেতরই বন্দি করে রেখে অস্থির হয়ে অন্যজনের সংগ খুঁজে বেড়ায়।
‘সেই জন্যই এরকম একটা কথা আছে যে সুক্ষ্ম একটা লাঠি নিয়ে ভেম্পায়ারের হৃদয়ের ভেতর দিয়ে চালিয়ে দিয়ে তাকে হত্যা করা যায়। যখন সেটা করা হয় তখন হৃদয়টা ফেটে যায় আর শয়তানের শক্তিকে ধ্বংস করে দিয়ে ভালোবাসার শক্তি মুক্ত হয়ে যায়।
‘আমি কখনোই এভাবে চিন্তা করি নি।
আমার হৃদয়টাকেও সেভাবে মুক্ত করার চিন্তা করছিলাম আমি।
সহস্রবার আমি তার হাতটাকে ধরতে চেয়েছিলাম আবার সহস্রবার সেটাকে ফিরিয়ে নিয়েছি। আমি তখনো সংশয়ে ছিলাম যে আমি তাকে ভালোবাসি এই কথাটা তাকে বলতে চাই।
আমি জানতাম না কীভাবে সেটা শুরু করতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা নদী পাহাড় নিয়ে কথা বললাম। এক ঘণ্টার জন্য একটা জঙ্গলে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে আবার পথ খুঁজেও পেলাম। আমরা সেন্ডউইচ খেলাম, গলানো বরফ খেলাম।
সূর্য যখন অস্ত যাওয়া শুরু করল আমরা সেইন্ট সেভিনে ফিরে আসলাম।
*
আমাদের পায়ের শব্দ পাথরের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছিল।
গির্জার প্রবেশ পথে ঢোকার সময় আমি পবিত্র জলে হাত ডুবিয়ে ক্রস চিহ্ন আকলাম।
আমার মনে পড়ল পানি হলো পবিত্র দেবীর চিহ্ন।
‘চলো ভেতরে যাই। সে বলল।
শূন্য অট্টালিকার অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আমরা হেঁটে চললাম। সেইন্ট সেভিন একজন সাধক মানুষ ছিলেন যিনি একদম শুরু থেকেই এখানে বাস করতেন, তাকে মূল বেদিটার নিচে সমাহিত করা হয়েছে। প্রাসাদের দেয়ালগুলোয় ফাটল দেখা দেয়াতে সেগুলোকে বেশ কয়েকবার আবার নতুন করে তৈরি করা হয়েছে।
শুলবিদ্ধ যীশুকে দেখে আমার খুব হাসি পেল। আমার মনোভাবটুকু আমার বন্ধু বুঝতে পেরে সে মাথা ঘুড়িয়ে আমার দিকে তাকাল।
‘এখানে দাঁড়াও।
আমরা তখন আমাদের মহান মাতার বেদির কাছে দাঁড়িয়ে।
‘এই ছবিটার দিকে তাকাও।’
মা মেরি তার কোলে সন্তান। শিশু যিশু আঙুল দিয়ে স্বর্গের দিকে ইশারা করছে।
‘আরো মনোযোগ দিয়ে দেখো। সে বলল।
আমি খুটে খুটে চিত্রকর্মটা দেখলাম। এর তৈলচিত্র, বাঁধাই, রঙের আয়োজন সব কিছু। কিন্তু যখন আমি যিশুর আঙুলের দিকে চোখ রাখলাম তখন বুঝতে পারলাম সে কি বোঝাতে চাইছিল।
যদিও মেরি যীশুকে তার কোলে নিয়ে রেখেছেন তবুও যিশু তখন হাতটা উপরে আকাশের দিকে তুলে কুমারী মাতাকে স্বর্গের দিকে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করছেন।
‘যেই শিল্পী এই চিত্রকর্মটা ছয়শত বছর আগে করেছিলেন তিনি জানতেন যে তাকে কি করতে হবে। আমার বন্ধু বলল।
কাঠের মেঝেতে কারো পায়ের শব্দ শোনা গেল।
একজন মহিলা ভেতরে ঢুকে মুল বেদির পায়ের কাছে একটা মোম জ্বালালো।
আমরা চুপ থেকে মহিলাকে প্রার্থনা করতে দিলাম।
মহিলাটা যখন চলে গেল সে আবার কথা বলা শুরু করল।
‘শিল্পি জানত এই মহান মাকে, দেবীকে এবং ঈশ্বরের করুণাময় চেহারাকে। তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলে যার উত্তর আমি এখনো দেই নি। তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে আমি কোত্থেকে এসব শিখেছি?
হ্যাঁ আমি তাকে এই প্রশ্নটা করেছিলাম। সে ইতোমধ্যে তার উত্তর দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও আমি তাকে কিছুই বললাম না।
‘হ্যাঁ এই চিত্রকর্মের শিল্পী যেভাবে তার কাজটা শিখেছে আমিও সেভাবে শিখেছি। আমি ভালোবাসাকে অনেক উপর থেকে গ্রহন করেছি। আমি তোমাকে যে চিঠিটা লিখেছিলাম সেই চিঠিটার কথা তোমার নিশ্চই মনে আছে। আমি একটা আশ্রমে ঢোকার কথা বলছিলাম। আমি তোমাকে যদিও কিছু বলি নি কিন্তু আমি কাজটা ঠিকই করেছিলাম। আমার বন্ধু বলল।
বিলাবোতে কনফারেন্স শুরু হওয়ার আগে তার সাথে আমার যে কথোপকথন হয়েছিল সাথে সাথেই আমার সেগুলো মনে পড়ে গেল। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। কি বলব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
‘বন্য জন্তুর মত বেশ কিছু বছর আমি এর মধ্যেই কাটিয়ে ফেলেছি। আমি কি ভাবছিলাম সেদিকে না তাকিয়েই আমার বন্ধু বলল। আমি পৃথিবীর নানা মানুষ নানা দেশ ঘুড়ে দেখেছি। পৃথিবীর চারটা পাশ থেকে আমি ঈশ্বরকে দেখেছি। অন্যান্য অনেক রমণীর প্রেমে পড়েছি আমি, নানান দেশের মানুষের সাথে নানা রকম কাজ করেছি। জীবনের রহস্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি সেই রহস্যগুলোকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চেয়েছি। আমি সব সময় এমন একটা নিদর্শনের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম যেটা আমাকে বলবে যে কেউ একজন আছে যে বিশেষ কিছু জানে।
‘আমি ভারতবর্ষে গিয়েছিলাম। মিশর গিয়েছিলাম। সেখানে আমি যাদুবিদ্যার গুরু আর ধ্যানি সাদকদের সাথে কথা বলেছি, তাদের সাথে ধ্যান করেছি। সবশেষে আমি আবিষ্কার করলাম যে আমি একটা সত্যকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। সেটা হলো যেখানে বিশ্বাস আছে সেখানেই সত্য বাস করে।
আমার বন্ধুর কথাগুলো চুপচাপ শুনে আমি ভাবলাম সে কি বলছে এসব! যেখানে বিশ্বাস আছে সেখানে সত্য বাস করে।
আমি আবারো গির্জার চারপাশটা ভালোভাবে দেখলাম।
পাথরগুলো বারবার ক্ষয়ে গেছে আর সেটাকে আবারো নতুন করে স্থাপন করা হয়েছে। কেন এমনটা করার জন্য মানুষ এত উতলা হয়েছিল। কেন মানুষ বার বার এত পরিশ্রম করে দূর্গম অঞ্চলে এই পাহাড়ি উপত্যকার ভেতর ছোট্ট এ গির্জাটাকে বার বার তৈরি করেছে?
বিশ্বাস।
বুদ্ধ সঠিক ছিলেন, হিন্দুরাও ঠিক ছিল, মুসলিমরাও ঠিক আছে, একই সাথে যিশুও ঠিক আছেন। যখনই যেখানে যেই থাকুক সে যদি বিশ্বাসের পথকে অনুসরণ করে, একনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করে তাহলে সে ঈশ্বরে বিলীন হয়ে যেতে পারবে, সমস্ত অলৌকিকতা তার কাছে ধরা দেবে। সে বলল।
‘শুধু মাত্র একটা বিষয় মনে রাখতে হবে তাহলে তোমাকে কিছু একটা পছন্দ করতে হবে। আমি ক্যাথলিক চার্চকে নির্বাচিত করেছি, কারণ আমি এর মধ্যেই বেড়ে উঠেছি, ক্যাথলিকের রহস্যময়তা আমার সাথে মিশে আছে। আমি যদি আজকে ইহুদি হয়ে জন্মগ্রহণ করতাম তাহলে জুডাইজমকে আমি পছন্দ করতাম। ঈশ্বর সব জায়গায় এক। যদিও তার হাজার হাজার নাম রয়েছে। এখন তুমি তাকে কোন নামে ডাকবে সেটা তোমার পছন্দ।
গির্জার ভেতর আবারো কারো পায়ের শব্দ শোনা গেল।
*
একজন লোক এগিয়ে আসল। সে আমাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তারপর সে ঘুড়ে গীর্জার কেন্দ্রে যে মূর্তিটা ছিল তার কাছে চলে গেল। এই লোকটা হয়ত গির্জার দায়িত্বে আছে।
আমার তখন গ্রামের অন্য প্রান্তে প্রথম যেই গির্জাটা আমরা দেখেছিলাম সেখানকার প্রহরী বুড়োটার কথা মনে পড়ল। সেই বুড়ো আমাদেরকে গির্জার ভেতর ঢুকতে দেয় নি। কিন্তু এই লোকটা এখনো কিছু বলছে না।
‘আজকে রাতে আমার একটা সভা আছে। লোকটা চলে যাওয়ার পর আমার বন্ধু বলল।
দয়া করে তুমি যা বলছিলে সেটা বলতে থাকো। কথার বিষয় পাল্টাবে না। আমি বললাম।
‘এখানকার কাছাকাছি একটা আশ্রমে আমি থাকলাম। চারবছর সেখানে আমি যতটুকু সম্ভব সমস্ত বিষয়ে পড়াশোনা করলাম। সেই সময় আমি এমন কিছু গোত্র আর বিশেষায়িত ধর্মীয় আধ্যাত্মিক নেতাদের সাথে মিশলাম যারা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা আধ্যাত্মিক ক্ষমতার একটা দরজা খোলার চেষ্টা করছিল। আমি আবিষ্কার করলাম ঈশ্বর সেই ভয়ংকর দানব নন যিনি আমাকে ছোট বেলা ভয় দেখিয়েছিলেন।
‘তুমি তাহলে বলতে চাইছ যে এই দুই হাজার বছর পর পুরোহিতরা শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে যে যিশুকে চার্চের অংশ বানানোর এটাই সেরা সময়? আমি একটু শ্লেষের সুরে বললাম।
‘তুমি হয়ত বিষয়টা ঠাট্টার সুরে নিয়েছ কিন্তু এটাই সত্যি। আমি আশ্রমের একজন বিজ্ঞ সাধকের সাথে পড়াশোনা শুরু করলাম। সে আমাকে জ্ঞান দিল যে আমাদেরকে পবিত্র ক্ষমতাকে গ্রহণ করতে হবে।
তার কথা শুনে আমি অবাক হলাম। ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখি কুমারী মাতা হাসছেন। শিশু যীশুখ্রিষ্ট তার কোলে খুব আনন্দের সাথে আছে। এই মুহূর্তে আমি এটাকে বিশ্বাস করা শুরু করলাম।
কিন্তু কিছু আগেও আমি একজন যৌক্তিক আর বাস্তববাদি মানুষ ছিলাম। আমার এই যুক্তিনির্ভর জ্ঞান আমাকে ধর্ম থেকে দূরে রেখেছিল। আমি বুঝতে পারলাম যে আমি মনে প্রাণে চাইছি আমার ছেলেবেলার বিশ্বাসটাকে ফিরিয়ে আনতে যখন আমি ফেরেস্তা আর অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতাম। কিন্তু আমি সেটাকে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না।
‘আমি যখন আমার ঘরে থাকতাম তখন আমি নিজের সাথেই কথা বলতাম। আমার বন্ধু বলতে থাকল।
‘আমি প্রার্থনা করতাম সেই পবিত্র ক্ষমতা আমাকে সাহায্য করবে। আমি আবিষ্কার করলাম যখনই আমি নিজের সাথে কথা বলতাম তখনই একটা বিজ্ঞ কণ্ঠস্বর আমাকে কিছু বলতে থাকত।
‘এটাতো আমার সাথেও ঘটছে। তার কথার মাঝে আমি বাধা দিয়ে বললাম।
আমার কথা শুনে সে কথা শেষ হওয়ার জন্য একটু অপেক্ষা করল। কিন্তু আমি আর বেশি কিছু বলতে পারলাম না।
“আমি তোমার কথা শুনছি।’ সে বলল।
একটা কিছু আমার গলার স্বর আর জিহ্বাকে আটকে ধরেছে। আমার বন্ধুটি সব কিছু কত সুন্দর করে বলে যাচ্ছে অথচ আমি ছোট্ট একটা কথা কিছুতেই গুছিয়ে বলতে পারছি না।
‘তোমার ভেতরের দ্বিতীয়জন ফিরে আসতে চায়। আমি কি ভাবছিলাম সেটা আমার বন্ধু ধারণা করে বলল।
‘দ্বিতীয়জন সব সময় অনেক ছোট কথা বলতেও ভয় পায়।
আমি তার কথা শুনে ভয় আর মনের জড়তাকে দূর করার চেষ্টা করে বললাম, হ্যাঁ। আচ্ছা ঠিক আছে আমি বলছি। কখনো কখনো যখন আমি কারো সাথে বলি, আর আমি যা বলছি সেটা নিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ি, তখন আমি নিজেকে দেখি যে আমি এমন কিছু কথা বলছি যে কথাগুলো আমি জীবনে কখনোই বলি নি। তবে এটা খুব ঘটে থাকে। অধিকাংশ সময় কথা বার্তায় আমি চুপ চাপ থেকে শোনার চেষ্টা করি। আমি সব সময় বোঝার চেষ্টা করি যে আমি কিছু একটা শিখছি।
‘আমরা নিজেরাই একটা বিস্ময়। সে বলল। বিশ্বাস সেটা বালু কণার মতো ক্ষুদ্র হলেও আমাদেরকে পাহাড়ে উঠতে সহায়তা করে। আমি এটাই শিখেছি। আর এখন আমার কথাই কখনো কখনো আমাকে অবাক করে দেয়।
যীশুর আদি শিষ্যরা ছিল জেলে, অশিক্ষিত, মূর্খ। কিন্তু তারা স্বর্গ থেকে যে আগুনের শিখা এসেছিল সেটাকে গ্রহণ করেছে। নিজেদের অজ্ঞতা নিয়ে তাদের কোনো লজ্জা ছিল না। পবিত্র অলৌকিকতার উপর তাদের বিশ্বাস ছিল।’
আমি কুমারী মার ছবির দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি তখনো হাসছেন। তার দুঃখ পাওয়ার কান্না পাওয়ার অনেক কারণ ছিল, কিন্তু তারপরেও তিনি হাসছেন।
‘তুমি কথা চালিয়ে যাও। থেমো না। আমি বললাম।
‘এইগুলোই আমার কথা। পবিত্র উপহারটা গ্রহণ করো, সেই উপহার নিজেকে আলোকিত করে তুলবে।
‘এটা ঐ দিনে কাজ করে না।’
‘তুমি কি আমার কথা বোঝ নি?’
‘আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি অন্য সব সাধারণ মানুষের মতো। আমি ভয় পাচ্ছি। এটা হয়ত তোমার জন্য কিংবা আমার প্রতিবেশিদের ক্ষেত্রে কাজ করবে কিন্তু এটা কখনোই আমার জন্য কাজ করবে না।
‘এটা যে কাউকে পাল্টে দিতে পারে- যখন থেকে তুমি দেখতে থাকবে যে আমরাও সেখানে তার মতই সন্তান।
কিন্তু তখন পর্যন্ত আমাদেরকে ভাবতে হবে যে আমরা আসলে আমাদের নিজেদের আলোর অনেক কাছে।
আমার কথার উত্তরে সে কিছু বলল না। চুপ থাকল।
‘সেই সেমিনারিদেরকে নিয়ে তোমার গল্পটা কিন্তু এখনো শেষ করো নি। আমি বললাম।
‘আমি এখনো সেখানেই আছি।
আমি কিছু বলার আগেই সে উঠে দাঁড়িয়ে গির্জার কেন্দ্রে চলে গেল।
আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম।
এই মুহূর্তে এই সব নিয়ে না ভাবলেই চলবে। ভালোবাসা আমার আত্মাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন কোনভাবেই আমি এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। এখন বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় আমার ভেতরের দ্বিতীয়জন। যার সাথে আমি সব সময় খারাপ আচরণ করেছিলা, কারণ আমি দুর্বল ছিলাম, যাকে আমি কখনোই গ্রহণ করিনি। আমি কখনোই তার চোখ দিয়ে আমার জগক্টাকে দেখতে চাই নি।
খুব সুক্ষ্ম একটা শব্দ আমার চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করল। আমার অন্তরটা লাফ দিয়ে উঠল।
শব্দটা আবারো শুনতে পেলাম, আবারো।
আমি চারপাশটা ভালোভাবে তাকানোর পর একটু দূরে একটা কাঠের সিঁড়ি দেখতে পেলাম যেটা উঁচুতে কোথাও উঠে গেছে। গির্জার বরফ সৌন্দর্যের সাথে যেটা আসলে খাপ খাচ্ছে না। সেখানে একটা বাদ্যযন্ত্রের পাশে আমার বন্ধু ছিল। সেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে। পর্যাপ্ত আলো না থাকার কারণে আমি তার মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে আমি বুঝতে পারছিলাম সে ঐ জায়গাটাতেই আছে।
আমি উঠে দাঁড়ানোর পর সে আমাকে ডাকল।
‘পিলার। সে খুব আবেগ নিয়ে আমাকে ডাকল। যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। আমি তার কথা মেনে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
‘মহান মেরি মাতা আমাকে সাহায্য করুক। আজকের দিনের জন্য এই সুরটুকু আমার প্রার্থনার অংশ হোক।
সে বাদ্যযন্ত্রটা বাজাতে শুরু করল। বাদ্যযন্ত্রের সুর আমার ভেতর আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে। সেই সুর গির্জার চারপাশের দেয়ালে, পাথরে আঘাত করে প্রতিফলিত হয়ে আসছে বারবার। আমার অন্তরকে এক ধরনের বিশ্বাস, ছবি আর আবেগ দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছিল। আমার অন্তরের সমস্ত পাপ, ক্লান্তি, গ্লানি সব কিছু যেন ধুয়ে মুছে সাফ করে দিচ্ছিল। আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে আমি এতদিন নিজেকে যতটুকু ভালো আছি মনে করতাম এখন তার চেয়ে ভালো আছি এবং আমি এখন আগে যতটুকু বিশ্বাস করতাম তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।
আমি যখন থেকে বিশ্বাস আর ধর্মের পথ ছেড়ে আসলাম তারপর থেকে এই প্রথমবারের মতো আমার হৃদয় ব্যাকুল ভাবে প্রার্থনা করতে চাইল।
আমি যদিও বসেছিলাম তারপরেও আমার আত্মা আমার সামনের পবিত্র নারী মাতার কাছে হাঁটুগেরে উবু হয়ে গেল। আমার মনে হলো ছবির সেই মেরি মাতা আমার সাথে কথা বলছে। আমি তার সমস্ত কিছু শুনতে পাচ্ছি। এক সময় আমার বন্ধুর বাজানো বাদ্যযন্ত্র থেমে গেল। সূর্য ততক্ষণে পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে সূর্য আর পাহাড় এই দুটোই যেন এক হাত দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
বাজনার এই সুরটাই ছিল আমার বন্ধুর প্রার্থনা। তার প্রার্থনা শোনা গেল।
আমি চোখ মেলে তাকিয়ে পুরো গির্জাটাকে গভীর অন্ধকারের ভেতর ডুবে যেতে দেখলাম। শুধু দেখলাম মিটিমিটি করে একটি মোমবাতি জ্বলছে। তার আলোতে মেরিমাতার চিত্রটা দেখা যাচ্ছে।
আমি আবারো পায়ের শব্দটা শুনতে পেলাম। আমি যেখানে বসেছিলাম সেটা এসে সেখানে থামল। প্রদীপের মৃদু আলোয় আমার চোখের জল চিকমিক করে উঠল। আর আমার হাসিটা যেটা মেরি মাতার হাসির চেয়ে কিছুতেই সুন্দর ছিল না সেটা দেখাল যে আমার হৃদয় এখনো বেঁচে আছে। আমার বন্ধু আমার দিকে তাকাল আমি তার দিকে তাকালাম। তাকে ধরার জন্য আমি হাত বাড়ালাম। তাকে খুঁজে পেলাম। আর এখন আমার বন্ধুর হৃদস্পন্দন অত্যন্ত দ্রুত চলছে। আমি এই নিরবতার মধ্যে তার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তখন আমার অন্তর অত্যন্ত শান্ত আর গভীর প্রশান্তিতে ডুবে আছে।
.
আমি তার হাত ধরলাম। সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমরা দুজন মেরিমাতার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না।
মনে হচ্ছিল সময় যেন থমকে আছে সেখানে। মেরিমাতা আমাদের দিকে নিচু হয়ে তাকিয়ে আছেন। হ্যাঁ তিনি বুঝতে পেরেছেন। যিনি তার হৃদয় দিয়ে ঈশ্বরের ভালোবাসাকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন।
আমি কোন কিছুই জিজ্ঞেস করতে চাইলাম না। কিছুই জিজ্ঞেস করতে আমার ইচ্ছে করছিল না।
আমাদের ভ্রমণটাকে চার্চের সেই দুপুরের মধুর সময়টা আরো অর্থবহ আর মূল্যবান করে তুলেছিল।
আমরা হাত ধরাধরি করে চার্চ থেকে বের হয়ে আমাদের ঘরে ফিরে আসলাম।
পরবর্তী নানারকম বিষয়ের কথা চিন্তা করে আমার মাথাটা ঘুড়তে থাকল।
আমি তখন থেকেই বুঝতে পারলাম যে আমরা দুজনেই একই ভাগ্য আর একই আত্মাতে মিশে যেতে চাইছি। কিন্তু সেই সেমিনারী ভাবনা আর জারাগোজায় যাওয়ার চিন্তা আমার ভাবনায় বারবার বাধ তৈরি করছিল।
আমার বুকটা কেমন মুচরে উঠল। চারপাশের বাড়িঘরগুলো আমি দেখতে থাকলাম। সেই কুয়োটার দিকে তাকালাম যেখানে আমরা গত রাতে বসে গল্প করেছিলাম।
.
ঈশ্বর, আমার বিশ্বাসকে আবারো উদ্ধার করতে চাইছি। দয়া করে আমাকে এই অভিযানের মাঝ পথে ছেড়ে যাবেন না।
আমার ভয় আর শঙ্কাগুলো এক পাশে সরিয়ে রেখে আমি প্রার্থনা করতে থাকলাম।
*
সে একটু ঘুমিয়ে নিল। কিন্তু আমি জেগে থাকলাম। জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখছিলাম।
অনেক পরে আমরা উঠে বাড়ির মালিকের সাথে খাবার খেতে গেলাম।
তারা খাবার টেবিলে আমাদের সাথে কখনোই কোনো কথা বলে না। আমার বন্ধু ঘরের চাবিটা চাইল।
‘আমরা আজকে অনেক রাত করে ফিরব। আমার বন্ধু বাড়ির মালিক মহিলটিকে বলল।
‘যুবক নিজের মতো করে সব কিছু ভোগ করো। আনন্দ করো। যতটুকু সম্ভব ছুটির দিনের সুবিধাগুলো ভোগ করে নাও।’ উত্তরে মহিলাটা বলল।
.
আমরা যখন গাড়িতে উঠছি তখন আমি বললাম, “তোমাকে আমার কিছু কথা জিজ্ঞেস করার আছে। আমি অনেক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিলাম যেন আমি এটা না বলি কিন্তু পারলাম না। আমাকে এটা জিজ্ঞেস করতেই হবে।’
‘তুমি কি আমাকে সেমিনারিয়ানের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে চাও?’ সে বলল।
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ। আমি এটা বুঝতে পারি নি। এটা যদিও তত গুরুত্বপূর্ণ না। আমি মনে মনে ভাবলাম।
‘আমি সব সময় তোমাকে ভালোবাসি। আমার বন্ধু বলল। তোমার সেই মেডেলটি আমি অত্যন্ত যত্ন করে আমার কাছে রেখে দিয়েছি। ভেবেছি কোনো একদিন আমি তোমাকে এটা দেব। এই চিন্তাটাই আমাকে সব সময় উৎসাহ জুগিয়েছে যে একদিন বলব আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি যত রাস্তাই ঘুড়ে বেড়িয়েছি সব কিছুই আবার তোমার কাছে ফিরে এসেছে। আমি তোমার কাছে যতগুলো চিঠি লিখেছিলাম আর তার উত্তরে তুমি যত চিঠি আমার কাছে পাঠিয়েছ সেই চিঠিগুলো আমি প্রতিবারই এই ভয়ে ভয়ে খুলে পাঠ করেছি যে তুমি হয়ত চিঠিতে বলবে যে তুমি অন্য কাউকে তোমার জন্য খুঁজে পেয়েছ।
তারপরই আমি আধ্যাত্মিক জীবনের ডাক পেলাম কিংবা আধ্যাত্মিক জীবনের আহ্বানে সাড়া দিলাম। এই জন্য সাড়া দিলাম যে এটা সব সময় সেই ছেলেবেলা থেকেই আমার সাথে ছিল। এটা এই জন্য ছিল যে তুমি আমার সাথে ছিলে।
এর মধ্যেই আমি আবিষ্কার করলাম যে আমার জীবনে ঈশ্বরের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি যদি অন্তরের সেই আহুতিতে সাড়া না দেই তাহলে আমি কিছুতেই সুখি হতে পারব না।’
সে একটু থামল। আমি তাকে কথা বলার জন্য চাপ দিলাম না।
বিশ মিনিট পর সে গাড়ি থামাল। আমরা গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম।
‘তুমি এখানকার আসল চেহারা দেখবে গ্রীষ্মের সময়। সে বলল।
আমি চারপাশটা তাকিয়ে দেখলাম। নির্জন রাস্তা বন্ধ দোকান।
‘ষাট লাখের বেশি মানুষ গ্রীষ্মের সময় এখানে আসে। সে বেশ আগ্রহ নিয়েই বলতে থাকল।
‘আমার কাছে এটাকে একটা ভূতের শহর মনে হচ্ছে।
আমরা একটা সেতু পার হয়ে বিশাল লোহার গেটের কাছে আসলাম। একটা অংশ খোলা ছিল। আমরা সেটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম।
‘তুমি যা বলছিলে সেটা শেষ করো।’ আমি বললাম। আমি যদিও চাইছিলাম না তাকে কোন কিছু বলার জন্য চাপ দিতে। তুমি যেই সব লোকদের সাথে মিশেছ তাদের চেহারায় খ্রীষ্টের অবয়বের বিষয়টা আমাকে বলো।
আমার কাছে মনে হলো সে এই বিষয়ে এখন কোন কথা বলতে চাচ্ছে না। হতে পারে এই ধরনের আলোচনার জন্য এটা ঠিক জায়গা কিংবা সঠিক সময় না। কিন্তু একবার যখন সে শুরু করেছে তাকে এটা শেষ করতে হবে।
আমরা বিশাল একটা রাস্তা হেঁটে পার হলাম। দুই পাশেই বরফের বিস্তীর্ণ জায়গা।
শেষ মাথায় এসে আমি বিশপের প্রধান গির্জার ছায়া দেখতে পেলাম।
কথা বলো। চুপ করে থেকো না। আমি আবারো বললাম।
‘তুমি এর মধ্যেই জানো আমি রোমান ক্যাথলিকদের বিদ্যাশ্রমে ঢুকেছিলাম। প্রথম বছর আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা যেন সকলের মানুষের প্রতি ভালোবাসায় পাল্টে যায়।
দ্বিতীয় বছর আমি উপলব্ধি করলাম যে ঈশ্বর আমার কথা শুনেছেন।
তৃতীয় বছর তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার তীব্রতা থাকার পরও আমি দেখলাম আমার ভালোবাসা দুঃখিকে সাহায্য করা, প্রার্থনা করা আর মানুষের সেবা শশ্রুষায় পাল্টে গেছে।’
‘তাহলে কেন তুমি আমাকে খুঁজে বেড়ালে? কেন আমার ভেতরে আবার সেই আগুন জালিয়ে দিলে। কেন তুমি আমাকে বাধ্য করলে দেখাতে যে আমার জীবনটা খুব ভাসাভাসা। কেন তুমি ফিরে আসলে? কেন তুমি এই গল্পটা বলার জন্য আজকের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে যখন তুমি দেখলেই যে আমি তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি? আমি খুব অস্থির হয়ে কথাগুলো বললাম।
সে সাথে সাথেই কোন উত্তর দিল না।
তারপর সে বলল, তুমি হয়ত ভাববে যে এটা একধরনের মূর্খামি।
‘আমি কখনোই সেটা ভাবতাম না। হাস্যকর কিছু হবে সেটা নিয়ে আমি মোটও চিন্তিত ছিলাম না। তুমিই আমাকে সেটা শিখিয়েছ।
‘মাস দু এক আগে আমার আশ্রমগুরু তার সাথে এক মহিলার বাড়িতে থাকতে বললেন। সেই মহিলা তার সমস্ত সম্পত্তি ক্যাথলিক সেমিনারিদের জন্য দান করে গেছে। সেই মহিলা সেইন্ট সেভিনে থাকত। আমার আশ্রমগুরুকে সেই মহিলার কি কি আসবাব ছিল তার একটা তালিকা করতে হয়েছিল।’
আমরা রাস্তার শেষ মাথায় প্রধান গির্জার কাছাকাছি চলে আসলাম।
যতই গির্জার কাছাকাছি আসছি আমার মন বলছিল যে বিষয় নিয়ে আমরা। কথা বলছি সেটা বাধা প্রাপ্ত হবে।
তাই আমি বললাম, এক মুহূর্তও থামবে না। তুমি আমাকে বলো। তুমি যা বলেছ সেটার ব্যাখ্যার প্রয়োজন।
‘আমি যখনই ঘরে ঢুকলাম তখন সেখানের সমস্ত স্মৃতি আমার মাথার ভেতর আছে। জানালাগুলো ভোলা ছিল। সূর্যের আলোতে ঘরের ভেতর বরফের কুচি আর সব কিছু চকমক করছিল। আমি ঘরের সমস্ত আসবাবপত্রের তালিকা করা শুরু করলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই আমাকে মাঝ পথে থামতে হলো।
‘আমি লক্ষ্য করলাম মৃত সেই মহিলার রুচিবোধ একদম আমার মতো। তার গানের যেই রেকর্ডগুলো ছিল সবগুলোই আমার পছন্দের তালিকায় ছিল। আমি সেগুলো শুনতাম। তার বইয়ের যে সংগ্রহ ছিল তার সবগুলোই আমি পড়েছিলাম। অবশিষ্ট বইগুলোও আমার পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। মহিলার ঘরের পরিচ্ছন্ন ভাব, চিত্রকর্মের সংগ্রহ সব কিছুই আমার মনের মতো ছিল, আমার মনে হচ্ছিল আমি এ মহিলা হলে এই সব বিষয়গুলোই আমি নিজের জন্য পছন্দ করতাম।
‘সেই দিন থেকে এ ঘরটাকে আমি কিছুতেই ভুলে থাকতে পারি না। আমি যখনই গির্জায় প্রার্থনা করতে যেতাম সেই ঘরটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত। আমি দেখতাম তোমাকে নিয়ে আমি সেই ঘরটাতে আছি। জানালা দিয়ে অনেক দূরে পাহাড়ের বরফ দেখছি। আমার মনো ছবিতে ভেসে উঠছে যে আমাদের বাচ্চারা বাড়ির চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছে, সেইন্ট সেভিনের মাঠে খেলাধুলা করছে।
আমার বন্ধুর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল আমি যদিও সেই ঘরটার কাছে কখনো ছিলাম না কিন্তু তারপরেও যেন সেই ঘরটা যেমন আছে আমিও তেমনটা দেখতে পাচ্ছি। আমি আশা করছিলাম আমাকে অবাক করার জন্য সে আর কিছু বলবে না।
কিন্তু সে তার কথা চালিয়ে গেল।
‘গত দু সপ্তাহ ধরে আমি কিছুতেই আমার হৃদয়ের দুঃখের সামনে দাঁড়াতে পারছিলাম না। আমার আশ্রমগুরুর কাছে গিয়ে আমার সাথে যা ঘটছিল তার সব কিছুই আমি তাকে বললাম। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার কথাটাও বললাম। সেই ঘরের আসবাবপত্রের তালিকা করতে গিয়ে কি অভিজ্ঞতা হলো সেটাও বললাম।
হাল্কা বৃষ্টি পড়া শুরু করল। আমি মাথাটা নিচু করে আমার কোর্টের সামনের অংশটা টেনে ধরলাম। হঠাৎ করেই গল্পের বাকি অংশটা আমার আর শুনতে ইচ্ছে করল না।
‘আমার আশ্রমগুরু বললেন ঈশ্বরকে সেবা করার অনেক পথ রয়েছে। তুমি যদি সেটাকেই তোমার ভাগ্য ধরে নাও তাহলে তারই সন্ধানে বের হয়ে পড়ো। একজন সুখী মানুষই পারে তার আশপাশের মানুষগুলোকে সুখি করতে।’
‘আমার সৌভাগ্য কি সেটাই ছিল কি না আমি জানি না। তবে আমি যখন সেমিনারিতে ঢুকলাম তখন অনেক প্রশান্তি পোলাম। আমার আশ্রমগুরুকে আমি বললাম।
আমার গুরু বললেন, তাহলে সেখানে যাও আর যদি কোন সন্দেহ থাকে তাহলে সেটাকে দূর করে আসো। হয়ত বাইরের পৃথিবীতে থেকে যাও নয়ত আবার এই সেমিনারিতেই ফিরে আসো। তবে একটা বিষয় তোমাকে মাথায় রাখতে হবে, তুমি যে স্থানটাই পছন্দ করো না কেন তোমাকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। একটা খণ্ড খণ্ড রাজত্ব কিছুতেই নিজেকে এর বিদ্রোহ থেকে রক্ষা করতে পারে না। একজন দ্বিধাবিভক্ত ব্যক্তি কিছুতেই জীবনের মহিয়ান পথে জীবনের মুখোমুখি হতে পারে না।
আমার বন্ধু কথা শেষ করে তার পকেট থেকে কিছু একটা বের করে আমার হাতে দিল।
এটা ছিল একটা চাবি।
‘আশ্রমগুরু আমাকে চাবিটা ধার দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে এই বাড়িটা বিক্রি করার জন্য তিনি কিছুদিন অপেক্ষা করবেন। আমি জানি তিনি চান আমি যেন আবার সেমিনারিতে প্রবেশ করি। আমি এটাও জানি তিনিই মাদ্রিদে এ অবস্থাটা তৈরি করেছিলেন যাতে করে আমরা একে অপরে সাক্ষাৎ করতে পারি।’
আমার হাতের চাবিটার দিকে তাকিয়ে আমি হাসলাম।
আমার অন্তরে একটা ঘণ্টা বেজেই চলছিল। স্বর্গের দরোজা যেন আমার জন্য খুলে গেছে।
আমার পাশে থেকে সে ঈশ্বরকে নানা ভাবে সেবা করে যেতে পারে।
কারণ সেই মুহূর্তটা যেন ঘটে সে জন্য আমি বারবার চেষ্টা করছিলাম। চাবিটা আমার বেগে আমি রেখে দিলাম।
*
আমাদের সামনে আবছা ভাবে গির্জাটা ফুটে উঠল।
আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই কেউ একজন আমার বন্ধুকে চিনতে পেরে তার কাছে চলে আসল। হাল্কা বৃষ্টিটা তখনো হচ্ছিল। আমি জানতাম না এটা কতক্ষণ চলবে। আমি এটাও কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না যে আমার মাত্র এক সেট কাপড় আছে। আমি কিছুতেই চাচ্ছিলাম না যে। আমার কাপড়গুলো ভিজে যাক।
আমার সমস্যাটার দিকেই আমি মনোযোগ দিয়ে রেখেছিলাম। সেই ঘর যেটা স্বর্গ আর পৃথিবীর মাঝে ঝুলে আছে, ভাগ্যের জন্য অপেক্ষা করছে সেগুলো কোনো কিছু নিয়েই আমি ভাবছিলাম না।
তার চারপাশে যে অসংখ্য লোকজন ভিড় করছিল সে তাদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল।
তারা আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল যে সে কোথায় উঠেছে। আমার বন্ধু যখন বলল যে সেইন্ট সেভিন তখন আশপাশের লোকজনের মধ্য থেকে একজন আমাদেরকে সেই সাধকের গল্প বলল যাকে সেখানে সমাহিত করা হয়েছে।
এই সাধক সেভিনই সেই প্লাজার মধ্যখানের কৃপটা আবিষ্কার করেছিল। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল ধার্মিক লোকদের জন্য একটা আশ্রম করা। তারা সকলেই গ্রামটাকে ছেড়ে ঈশ্বরের সন্ধানে পাহাড়ি এলাকায় চলে এসেছিলেন।
‘সেই লোকগুলো এখনো সেখানে আছে। একজন বলল।
আমি জানি না এই গল্পটা কতটুকু সত্য, কিংবা সেই ধার্মিকরা আসলেই সেখানে এখনো আছে কিনা।
আস্তে আস্তে লোকেরা আসতে শুরু করল। মানুষের দলগুলো সেই কৃত্রিম গুহাটার দিকে যেতে থাকল।
একজন বয়স্ক লোক আমাকে ফ্রেন্স ভাষায় কিছু একটা বলতে চাইল। সে যখন বুঝতে পারল যে আমি তার কথা বুঝতে পারছি না তখন সে ভাঙা ভাঙা স্পেনিশে আমাকে বলা শুরু করল।
‘তুমি খুবই বিশেষ একজন মানুষের সাথে আছ। যেই মানুষটা অলৌকিক অনেক কিছুই করতে পারে। সে বলল।
আমি কিছুই বললাম না। কিন্তু বিলাবোর সেই রাতটার কথা আমার মনে পড়ে গেল। সেই রাতে একজন উদ্ধত লোক আমার বন্ধুর দিকে তেড়ে আসল। সেই লোকটা তারপর কোথায় চলে গেল এই নিয়ে আমার বন্ধু আমাকে কিছুই বলে নি, আমিও তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করি নি।
এই মুহূর্তে আমি সেই মহিলার ঘরটার পরিপূণ চিত্র নিয়ে ভাবতে চাইলাম। সেই ঘরটার ভেতর কি আছে, ঘরের বইগুলো নিয়ে, এর গানের রেকর্ড, চিত্রগুলো, ঘরের আসবাবপত্র সব কিছু নিয়ে চিন্তা করতে থাকলাম।
আমরা বৃষ্টির ভেতর দিয়েই চুপচাপ হেঁটে চললাম।
অবশেষে মা মেরির ছায়া দেখা গেল।
আমি যেভাবে কল্পনা করেছিলাম হুবহু সেই রকম চিত্র। সেই বানানো গুহা, আমাদের মহান মাতার মূর্তি, কাঁচে ঢাকা ঝর্ণা যেখানে পানির অলৌকিকতা রয়েছে।
কিছু কিছু তীর্থযাত্রী প্রার্থনা করছিলেন, কেউ কেউ গুহার ভেতর চুপচাপ বসেছিলেন, তাদের চোখ বন্ধ। নদীর একটা ধারা পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছিল। নদীর পানির সেই শব্দ আমাকে আরো শান্ত করে তুলছে।
এ দৃশ্য দেখে আমি খুব দ্রুতই একটা প্রার্থনা করে ফেললাম কুমারী মাতা মেরির কাছে তিনি যেন আমাকে সাহায্য করেন। আমার অন্তর আর কোনো দুঃখ সহ্য করতে পারবে না।
.
দুঃখ যদি আসেই তাহলে সেটা যেন খুব দ্রুত চলে আসে। কারণ আমাকে একটা জীবন বেঁচে থেকেই পার করতে হবে। আমি সবচেয়ে সেরা উপায়েই বেচে থাকতে চাই। সে যদি কোন পছন্দ করে তাহলে সেটা যেন এখনই করে। তাহলে হয় আমি তাকে এখন থেকেই মনে রাখব নয়ত চিরতরে ভুলে যাব।
অপেক্ষা করা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ভুলে যাওয়াটাও বেদনাদায়ক। কিন্তু কি করব সেটা যদি না জানি তাহলে সেটা আরো বেশি পীড়াদায়ক।
.
আমার অন্তরের এক কোনায় আমি অনুভব করলাম মেরি মাতা আমার প্রার্থনা শুনেছেন।
*