বিকালের কোমল বায়ুর গায়ে হালকা দুরন্তপনা। পত্রপল্লবে মৃদু ঝাঁপটা দিয়ে দিয়ে অনন্তে মিশে যাচ্ছে। সূর্যের আলোর প্রখরতা কমে এসেছে। সবার মনে প্রশান্ত প্রশান্ত ভাব। কিন্তু আমর ইবনে আস (রা.) এর মাথায় দারুণ চিন্তা। মিশর বিজয়ের চিন্তায় তিনি বিভোর। বাইতুল মুকাদ্দাসে এসেছেন খলীফা উমর (রা.)। একটি বিষয় নিয়ে সরাসরি তাঁর সাথে আলোচনা করতে এলেন হযরত আমর ইবনে আস (রা.)। বললেন, আমি আপনার সাথে একটি জরুরী বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছি।
উমর (রা.) বললেন, কিসের আলোচনা, বলুন।
হযরত আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহর শপথ করে বলছি। আপনি রোমান সালার আতরাবুনকে এমনিভাবে চিনেন যেমনিভাবে আপনি আপনার ডান হাতকে চিনেন। আমি কখনো একথা বিশ্বাস করব না যে, আমাদের খলীফা এ আত্মঅহমিকায় বিভোর হয়ে আছেন আর ভাবছেন, রোমান সালার আত্রাবুন ভয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস ছেড়ে মিশরে চলে গেছে। আমাদের প্রত্যয় ও বিশ্বাস, আমরা স্বপ্নে বিভোর থাকি না। আর নিজেকে নিজে প্রবঞ্চিত করা মুজাহিদদের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
হযরত উমর (রা.) হযরত আমর ইবনে আস (রা.)-কে থামিয়ে দিয়ে বললেন, হে ইবনে আস! তুমি যে কথার ভূমিকা রাখছো সরাসরি তা বলে ফেলাইতো ভাল। আমি তোমার কথা মনযোগ সহকারে শুনছি।
হযরত আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমি বলতে চাচ্ছি, আরাবুনের পশ্চাদ্ভাবন করা উচিত।
উমর (রা.) বললেন, ইবনে আস! আমরা যে বিশাল বিসৃত অঞ্চল পদানত করেছি, তাকি তুমি যথেষ্ট মনে করছো না?
হযরত আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, আপনার নির্দেশ শিরধার্য। কিন্তু আমরা যদি আতরাবুনকে কোথাও দাঁড়ানোর সুযোগ দেই তাহলে নিঃসন্দেহে একদিন সে ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ বাহিনী তৈরী করে আবার আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। হিরাক্লিয়াস আর আতরাবুন এক ইবলিসের দুই নাম। আতরাবুনের মাথায় এতো কূট-কৌশল ও বুদ্ধি রয়েছে যে, সে ফিলিস্তিন ও আরবের খ্রিস্টানদের বিদ্রোহের জন্য উসকে দিতে পারে। মিসরে সে এ জন্যই গিয়েছে। তাই আমাদের উচিত, তাকে স্থির হয়ে কোথাও দাঁড়াতে না দেয়া। আপনার অনুমতি হলে আমি মিসর আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত আছি।
উমর (রা.) বললেন, হে ইবনে আস! শুধু আতাবুনের প্রতিই তোমার দৃষ্টি নিবন্ধ করো না। তুমি কি দেখছো না, আমি কিসরার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। শামেও রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। যদি আমরা আবার সুদূর মিসরে আরেকটি যুদ্ধ ফ্রন্ট খুলি তাহলে হয়তো ইরান ও রোমে আমাদের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে।
আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর সাথে হযরত আমর ইবনে আস (রা.)-এর আলোচনা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। বরং তিনি মিসরের ইতিহাস তার সামনে তুলে ধরলেন। কুরআনের যে সব আয়াতে মিসরের আলোচনা এসেছে তা পাঠ করে শুনালেন। বনী ইসরাইল আর মূসা (আ.)-এর কথাও আলোচনা করলেন। মূসা (আ.) আর ফেরআউনেরও আলোচনা করলেন। কিভাবে আল্লাহ মূসা (আ.)-এর জন্য সাগরের মাঝে পথ করে দিলেন আর ফেরআউন তাতে নিমজ্জিত হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হল। হযরত ইউসুফ (আ.)-এর কথাও আলোচনা করলেন।
আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.) নিরবে হযরত আমর ইবনে আস (রা.)-এর কথা শুনে যেতে লাগলেন। এসব কথা উমর (রা.)-এর অজানা নয়। কিন্তু তিনি হযরত আমর ইবনে আস (রা.)-কে থামিয়ে দেননি। তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন, কোন নিয়তে, কোন উদ্দেশ্যে আমর ইবনে আস (রা.) মিসর আক্রমণ করতে চাচ্ছেন। তিনি কি নিজের জন্য একটি রাজত্ব কায়েম করতে চাচ্ছেন, না এ কারণে মিসর আক্রমণ করতে চাচ্ছেন যে, মিসর ছাড়া ইসলামী খেলাফতের পরিধি অপূর্ণ থেকে যায়!
তিনি আরব বিশেষভাবে হিজাজের অধিবাসী ও মিসরের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কের কথাও আলোচনা করলেন। তিনি আরো বললেন, হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) আরবদের পূর্বপুরুষ। আর তার মাতা হাজেরা ছিলেন মিসরের অধিবাসী। হযরত ইসমাঈল (আ.) জ্বরহুম গোত্রের এক সতীসাধ্বী মেয়েকে বিয়ে করেন। তার বারটি সন্তান হয়। এ বারজনই আরবদের পূর্ব পুরুষ। সুতরাং হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর নানার বাড়ি মিশর হওয়ার কারণে মিসরের সাথে আরবদের নাড়ীর সম্পর্ক বিদ্যমান।
তিনি বললেন, মিসরকে নিয়ে রোম ও পারস্য সম্রাট যুদ্ধে নিপতিত হল। দীর্ঘ যুদ্ধের পর ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে মিসরে ইরানীরা রোমানদের পরাজিত করল এবং নয় বৎসর তারা শাসন করল।
রোমে তখন হিরাক্লিয়াসের উত্থান হল। সে ইরানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল এবং মিসর ও শামকে ইরানীদের থেকে মুক্ত করে নিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে পূর্বেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে, রোমানরা শীঘ্রই ইরানীদের উপর বিজয় লাভ করবে। প্রিয় নবীর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল।
ষষ্ঠ হিরজীতে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিয়ে বিভিন্ন দেশে দূত প্রেরণ করেন। ইরান সম্রাট, রোম সম্রাট, হীরার শাসক, গাসাসানের শাসকের সাথে মিসরের শাসক মুকাউঁকিসের নিকটও ইসলাম গ্রহণের আহবানসহ পত্র প্রেরণ করেন। হাতিব (রা.) এ পত্র নিয়ে মিসরে গিয়েছিলেন।
মিসরের বাদশাহ মুকাউঁকিস রাসূলের পত্র অত্যন্ত আদবের সাথে গ্রহণ করেছিলেন ও মনোযোগের সাথে পাঠ করেছিলেন। রাতে বাদশাহ মুকাউঁকিস হযরত হাতিব (রা.)-কে একাকী নির্জনে ডাকলেন। অত্যন্ত সম্মানের সাথে তাঁকে বসালেন। বললেন, আমাকে আপনার রাসূল সম্পর্কে কিছু বলুন। হাতিব (রা.) রাসূল (সা.)-এর গুণাবলী বর্ণনা করলেন এবং বিশ্বাসযোগ্য কিছু প্রমাণও উপস্থাপন করলেন।
সবকিছু শোনার পর মুকাউঁকিস বললেন, আমি জানি, একজন নবীর আগমনের সময় হয়ে গেছে। তবে আমার ধারণা ছিল তিনি শামে আত্মপ্রকাশ করবেন। কারণ ইতিপূর্বে প্রায় সব নবীই শামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এখন দেখছি এ নবী এক ভয়াবহ মরুর বুকে জন্মলাভ করেছেন। আমি যদি এ নবীকে গ্রহণ করে নেইও তবে মিসরীরা কিন্তু তাকে গ্রহণ করে নিবে না। শোন, এ কিন্তু তোমার ও আমার মাঝে একান্ত আলাপচারিতা। কেউ যেন তা জানতে না পারে। তবে আমার বিশ্বাস, এ দেশও তোমাদের নবীর পদানত হবে। তোমাদের নবীর অনুসারীরা মিসরে পদার্পণ করবেন। মিসর পদানত করবেন। তুমি কিন্তু মিসরবাসী কারো নিকট এ সম্পর্কে কোন আলোচনা করবে না।
সেদিন রাতে আর মুকাউঁকিসের চোখে ঘুম আসেনি। দুগ্ধফেনলিভ সুকোমল বিছানায় শুতেই তার মাথায় বিভিন্ন চিন্তা এসে ভীড় করল। বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো তাকে অস্থির করে তুলল। প্রতিশ্রত নবী সম্পর্কিত আলোচনাগুলো একে একে তার চোখের সামনে পরিস্ফুট হয়ে উঠতে লাগল।
পরদিন সকালে মিসরের বাদশাহ মুকাউঁকিস আবার হাতিব (রা.)-কে ডেকে পাঠালেন। একেবারে পাশে বসালেন এবং আরবী ভাষায় একটি চিঠি লিখে তার হাতে দিলেন। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন?
আব্দুল্লার পুত্র মুহাম্মদের প্রতি মিসরের বাদশাহ মুকাউঁকিসের সালাম। আমি আপনার পত্র পাঠ করেছি। আপনি যা কিছু তাতে লিখেছেন এবং যার দাওয়াত দিয়েছেন তা বুঝেছি। আমি জানতাম, একজন নবী সমাগত। তবে আমার ধারণা ছিল, সে নবী শামে আত্মপ্রকাশ করবেন। আমি আপনার দূতের যথাযোগ্য ইহতেরাম করেছি। আর আপনার খেদমতে দুই মিসরী যুবতী পাঠালাম। তারা মিসরের উঁচু খান্দানের মেয়ে, আর আপনার আরোহণের জন্য একটি উন্নত জাতের খচ্চর উপহার পাঠালাম।
এই দুই যুবতীর একজনের নাম মারিয়া কিবতিয়া। তাঁকে রাসূল (সা.) স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছিলেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা মিসরীদের সাথে ভাল আচরণ করবে। তোমাদের উপর তাদের দাবী আছে। তাদের সাথে তোমাদের আত্মীয়তার সম্পর্কও রয়েছে।
আমর ইবনে আস (রা.) আরো বললেন, মিসরীরা খ্রিস্টান। কিন্তু তারা একটি ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আছে। রোমান সাম্রাজ্যে এ ধরনের অনেক খ্রিস্টান উপদল রয়েছে। এরা প্রায়ই একে অপরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসও খ্রিস্টান। সে মিসরীয়দের ও অন্যান্য উপদলের ঘোর বিরোধী। সম্রাট হিরাক্লিয়াস বিভিন্ন দল উপদলের আলাদা বিভিন্ন আকীদা বিশ্বাসকে সমন্বয় করে একটি রাষ্ট্রীয় ধর্ম উদ্ভাবন করেছিল। সবাইকে সে ধর্ম মানতে বাধ্য করত। মিসরের রাজধানী ইস্কান্দারিয়ার প্রধান পুরোহিত কীরসকে এ কাজের জন্য দায়িত্ব দেয়া হল। তাকে অধিকার প্রদান করা হল, সে যে কোন প্রকারে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও খ্রিস্টানদেরকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম মানতে বাধ্য করবে।
সম্রাট হিরাক্লিয়াসের ভয়ে সকল দল উপদলের হৃদয় চুপসে গেল। তাদের আর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে মিসরীয়রা হিরাক্লিয়াসের চাপিয়ে দেয়া খ্রিস্ট ধর্মকে মেনে নিল না। কীরস তাদের উপর নির্মম নির্যাতন শুরু করল। হিংস্রতায় কীরস পশুকেও ছাড়িয়ে গেল। প্রায় দশ বৎসর যাবৎ মিসরীয়রা ধর্মের নামে নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করছে। তাদের কোন আশ্রয়দাতা ছিল না। সমবেদনা জানানোর মতও তাদের কেউ ছিল না।
আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, এই নিপীড়িত নির্যাতিত মিসরবাসীদের রক্ষার দায়িত্ব কাদের? নিশ্চয় আমাদের।
তারপর আমর ইবনে আস (রা.) মিসরের অপরিসীম ধন-সম্পদ, মহামূল্যবান পাথর, মূল্যবান ধাতুর অসংখ্য খনি ইত্যাদির সবিস্তারিত আলোচনা করলেন। বললেন, আল্লাহ্র জমীন থেকে উৎসারিত এ সকল সম্পদ রোম সম্রাটের প্রাসাদে চলে যায়। অথচ সাধারণ জনগণ ক্ষুৎপিপাসায় হাড্ডিসার হয়ে ধুকে ধুকে মরছে। শ্রমজীবীরা সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সামান্য রুটি রুজীর ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের শ্রমের সকল ফসল চলে যায় শাহী প্রাসাদে।
আমর ইবনে আস (রা.)-এর কণ্ঠ এবার আবেগাপ্লুত হয়ে উঠল। বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আমার হৃদয় বলছে, নীল নদীর দেশ মিসর আমাদের ডাকছে। আমিরুল মুমিনীন! আমি আপনাকে আমার এক ব্যক্তিগত ঘটনা শুনাতে চাই। যে বিষয়টিকে আমি আল্লাহর ইঙ্গিত মনে করি
তখন ছিল রোমানদের রাজত্ব। মিসরের শাসক ছিল তারাই। আমি ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে বাইতুল মুকাদ্দাস গেলাম। একদিন কাফেলার উট চড়ানোর দায়িত্ব আমার উপর এসে পড়ল। আমি উট নিয়ে দূরের এক চারণভূমিতে গেলাম। আমি অত্যন্ত সংক্ষেপে ঘটনাটি আপনাকে বলছি।
আমি উটগুলোকে চারণভূমিতে ছেড়ে দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে এক গাছের ছায়ায় বসে ছিলাম। তখন পাহাড়ের গা বেয়ে এক খ্রিস্টান নেমে এল। পিপাসায় প্রায় অর্ধমৃত। আমি তাকে পানি দিলাম। সে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল। তার নাম ছিল শাম্মাস। পানি পানের পর সে অদূরে এক গাছের ছায়ায় গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পরে রইল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, এক বিষাক্ত সাপ তার দিকে ছুটে যাচ্ছে। আমার হাতে ছিল তীর ধনুক। আমি সাথে সাথে তীর ছুঁড়ে মারলাম। সাপটি মরে গেল। ঘুম ভেঙ্গে শাম্মাস সব শুনে হতবাক। বিস্ময়াবিভূত। সে আমাকে তখন ছাড়ল না। সাথে করে মিসরে নিয়ে গেল। সে ছিল মিসরের রাজধানী ইস্কান্দারিয়ার অধিবাসী। রাজ পরিবারের সাথে তার গভীর সখ্যতা ছিল। তখন মিসরে এক রাজকীয় আনন্দানুষ্ঠান ছিল। শাম্মাস আমাকে সে অনুষ্ঠানে নিয়ে গেল। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে আমি দেখলাম, এক পাদ্রীর হাতে একটি স্বর্ণের বলয়। সে চোখ বন্ধ করে তা উপরে ছুঁড়ে মারছে। বলয়টি ঘুরতে ঘুরতে কারো মাথায়, পিঠে বা অন্য কোন অঙ্গে পড়ছে।
আমি শাম্মাসকে এর রহস্য জিজ্ঞেস করলাম। শাম্মাস বলল, এ ধরনের উৎসবে ঐ পাদ্রি চোখ বন্ধ করে স্বর্ণের এ বলয়টি নিক্ষেপ করে। নিক্ষিপ্ত বলয়টি যার বাহুতে গিয়ে পড়বে সেই পরবর্তীতে মিসরের বাদশাহ হবে।
আরো কয়েকবার বলয়টি নিক্ষেপ করার পর হঠাৎ তা আমার বাহুতে এসে পড়ল। সাথে সাথে সবাই হর্ষধ্বনী দিয়ে উঠল। অনেকে হাত তালি দিল। রাজপরিবারের লোকেরা আমার পরিচয় জানতে চাইলে শাম্মাস বলল, এর নাম আমর ইবনে আস। আরবের মক্কা নগরীর অধিবাসী। সাথে সাথে চারদিক থেকে ঠাট্টা মশকরা আর বিদ্রুপের আওয়াজ ভেসে আসল। বাহ্ বাহ্ দেখ, এ বামন নাকি মিসরের বাদশাহ হবে! ভারি চমৎকার কথা! সেদিন এ ধরনের অনেক বিদ্রূপ আমি শুনেছিলাম।
এ ঘটনা শোনানোর পর আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমার মাথায় কখনো এ ধরনের চিন্তা আসেনি যে, সেই বলয়টির কারণে আমি একদিন না একদিন মিসরের বাদশাহ হব। রাজত্ব তো আল্লাহর। তবে আমার ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা আমি মিসরে আল্লাহর রাজত্ব কায়েম করব। আমি এখন আপনার অনুমতির অপেক্ষায় আছি।
হযরত উমর (রা.) অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে মনোযোগ সহকারে আমর ইবনে আস (রা.)-এর কথাগুলো শুনলেন। তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন যে, মিসর বিজয়ের জন্য আমর ইবনে আস (রা.)-এর নেতৃত্বে একদল মুজাহিদ পাঠাতে হবে। কিন্তু তখনই কিছু বললেন না।
মদীনায় ফিরে এসে হযরত উসমান (রা.) ও আরো অনেকের সাথে পরামর্শ করলেন। কিন্তু কেউ মিসর আক্রমণের পক্ষে মত দিলেন না। সবাই বললেন, এতো দূরে আরেকটি বিশাল যুদ্ধের সামর্থ কি এখন আমাদের আছে!
দূরদর্শী উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)। তিনি আমর ইবনে আস (রা.)-কে নিরাশ করলেন না। তার মনোবল ভেঙে দিলেন না। তাকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় খোঁজ খবর ও তথ্য সংগ্রহের পরামর্শ দিলেন। বিভিন্নভাবে উৎসাহও প্রদান করলেন। কথার এক ফাঁকে বললেন, আচ্ছা, আমর ইবনে আস! শুনলাম মিসরের খ্রিস্টানরা নাকি এক লোমহর্ষক রেওয়াজ পালন করে আসছে। তারা বিশ্বাস করে, নীল নদী মাঝে মধ্যে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে মিসরবাসীদের নিকট ভোগ চায়। সে ভোগ হল কুমারী নারী বলীদান। আর তখন মিসরের লোকেরা একজন কুমারী নারীকে অপরূপা সাজে সুসজ্জিত করে নীল নদীতে নিক্ষেপ করে। আর তারপরই নদীতে পানি-প্রবাহ শুরু হয়। তাদের এই রেওয়াজ এমন আকার ধারণ করেছে যে, এখন তারা প্রত্যেক বৎসরই একজন কুমারী নারীকে এভাবে নদী বক্ষে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। আর তারা এটা ধর্মীয় উৎসবের ন্যায় মহাসমারোহে পালন করে।
আমর ইবনে আস (রা.) হযরত উমর (রা.)-এর কথা স্বীকার করলেন। বললেন, মানুষ সত্য ধর্মচ্যুত হলে নানা কুসংস্কারে জড়িয়ে পড়ে। বাতিল ও অবাস্তব বিষয়কে আঁকড়ে ধরে আর সত্যকে অবজ্ঞার সাথে পরিহার করে। তবে আমার বিশ্বাস, মিসরীয়রা সত্যের সন্ধান পেলে সাথে সাথে তা গ্রহণ করবে। ইসলাম গ্রহণে তারা জড়তায় ভুগবে না। ফলে তাদের কুসংস্কার আর মিথ্যা রোসম-রেওয়াজ চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে চলে যাবে।
***
আলেপ্পা নগরীর পতনের পরে সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) নগরীতে এলেন। খ্রিস্টান কবীলার সর্দারদের সাথে আলোচনা করলেন। সর্দাররা অকপটে স্বীকার করল যে, তারা মারাত্মক ভুল করেছে। সে ভুলের যথপোযুক্ত শাস্তিও তারা পেয়েছে। সর্দাররা বলল, দুই রোমান সালারের নেতৃত্বে তারা বিদ্রোহ করেছিল। তারাই তাদেরকে বিদোহে উস্কানী দিয়েছিল। ইতিপূর্বে আবু উবায়দা (রা.) শারীনার স্বামী হাদীদ ইবনে মুমিনের থেকে শুনেছে, রোমান সালার আন্তোনীস ও রূতাস খ্রিস্টান কবীলার লোকদের বিদ্রোহে উৎসাহিত করেছিল। হাদীদ আরো বলেছে, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের এক স্ত্রী ও তার এক যুবক পুত্রও পালিয়ে এসেছিল। তারাও এ বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল।
সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। পরক্ষণে উদ্বেলিত কণ্ঠে বললেন, রোমান সাম্রাজ্য ছিল এক বিশাল মহীরুহ। এখন তার নিঃশেষের সময় এসে গেছে। দেখ কিভাবে তার ডালপালাগুলো ভেঙে ভেঙে চারদিকে পড়ছে। এক রোমান সালার বিদ্রোহ করে চলে এসেছে। তার সাথে এসেছে সম্রাটের এক স্ত্রী ও তার পুত্র। তারা একটি নতুন সাম্রাজ্য গড়ার জন্য এসেছিল। তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। এভাবে রোম সাম্রাজ্যের সকল ডালপালা ভেঙে পড়বে আর পানির অভাবে তার শীকড় শুকিয়ে যাবে।
সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) কিছুদিন আলেপ্পা নগরীতে থাকার পর হিমসে চলে এলেন। তিনি শামের একেকটি অঞ্চল একেকজন সালারের দায়িত্বে অর্পণ করেছেন। তারা সেখানে প্রশাসন সুবিন্যস্ত করে সাজাচ্ছেন। জননিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। জিযিয়া সহ অন্যান্য কর আদায়ের সুব্যবস্থা করছেন। এভাবে দ্রুত শামের প্রশাসনিক কাঠামো সুশৃঙ্খল ও সুদৃঢ় ভিত্তি পায়।
আলেপ্পা ও ইন্তাকিয়ার মাঝে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মাইলের ব্যবধান। এ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মাঝে মাঝে ঝোঁপঝাড় ঘন গাছগাছালী। মাঝে মাঝে বিস্তৃত উঁচু-নীচু টিলা। কোথাও খা খা মরুভূমি। পানি আর সবুজের কোন চিহ্ন সেখানে নেই। রোম সাগরের তীরে ইন্তাকিয়া শহর। বাণিজ্যিক জাহাজগুলো এখানেই এসে নোঙর করে। মালামাল নামায়। আবার নতুন মাল বোঝাই করে বিভিন্ন বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। মিসরের ইস্কান্দারিয়া বন্দরের অনেক জাহাজ এখানে আসে। এখানের জাহাজও ইস্কন্দারিয়ায় যায়। আলেপ্পা আর ইন্তাকিয়ার মাঝের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন মুসলমানদের দখলে। এখানে দুচারটি ক্ষুদ্র কবিলা থাকলেও দূরে দূরে তাদের অবস্থান। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আলেপ্পা বিজয়ের কিছুদিন পরের ঘটনা। যারা আলেপ্পা থেকে ইন্তাকিয়ায় গিয়েছে বা ইন্তাকিয়া থেকে আলেপ্পায় এসেছে তারা বলেছে যে, শহরের বাইরে ঘন গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ে ভরা এলাকায় ডাইনী বদরূহ দিশেহারা হয়ে ঘুরছে। মাঝে মাঝে সে চিৎসার করে উঠে আর দুর্বোধ্য ভাষায় কি যেন বলে। লোকেরা তার আওয়াজ শুনে দ্রুত পালিয়ে যায়।
একদিন এক মুসাফির আলেপ্পা শহরে এসে এক সরাইখানায় উঠল। তার চেহারায় ভয়-ভীতি আর আতঙ্ক। সে স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারছে না। সরাইখানার সবাই বুঝল, লোকটি পথে ভয়ঙ্কর কিছু দেখেছে। তারা তাকে হিম্মৎ দিল। সান্ত্বনা দিল। অভয় দিল। তারপর লোকটি বলল, আমি আমার গ্রাম থেকে এক খচ্চরে চড়ে আলেপ্পায় আসছিলাম। এক ঝোঁপের পাশ দিয়ে আসার সময় একেবারে নিকট থেকে শুনতে পেলাম, কে যেন বলছে, আমি তার খুন পান করব। সে আমার খুন ঝড়িয়েছে। তারপরই আমি এক ভয়ঙ্কর চিৎকার ধ্বনি শুনতে পেলাম। সে চিৎকার নিঃসন্দেহে কোন মহিলার।
ঝোঁপঝাড় খুব ঘন ছিল। মাঝে মাঝে উঁচু উঁচু টিলাও ছিল। তাই আমি কিছুই দেখতে পাইনি। ভয়ে আমার সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠল। আমি দ্রুত খচ্চর চালিয়ে চলে আসতে চাইলাম। কিন্তু খচ্চর তো আর ঘোড়া নয়, সে ধীর লয়ে চলতে লাগল।
আমি একটি টিলার পাশ দিয়ে আসার সময় হঠাৎ দেখলাম, এক যুবতী মেয়ে পথের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। অগোছালো চুল। ভারী সুন্দরী। জায়গায় জায়গায় তার কাপড় ছিঁড়ে গেছে।
ভয়ে আতঙ্কে আমার মরণ দশা। ভাবলাম, এ বিজন প্রান্তরে এ যুবতীর তো থাকার কথা নয়। নিশ্চয় সে কোন মৃত যুবতীর বদরূহ বা কোন ডাইনী হবে। মানুষের রূপ ধরে আমার নিকট এসেছে। আমি ভয়ে খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে পড়লাম। ডাইনীর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ালাম। একেবারে বিনীত কণ্ঠে বললাম, আমি এক গরীব মুসাফির। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের খাবারের সন্ধানে ব্যস্ত থাকি। আমাকে বলুন, আমি আপনার কি খেদমত করতে পারি। দয়া করে আমার কোন ক্ষতি করবেন না।
ডাইনী কোন কথা বলল না। সে সোজা খচ্চরের নিকট গেল। খচ্চরের কাঁধের সাথে বাঁধা এক থলেতে আমার কিছু খাবার ছিল। আর একটি মসকে কিছু পানি ছিল। সে খাবারের থলে আর মশকটি নিয়ে আমার সামনে এগিয়ে এল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, হিরাক্লিয়াস কোথায়?
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম, আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে এতটুকু শুনেছি যে, মুসলমানদের সাথে পরাজিত হয়ে শাম থেকে পালিয়ে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে তা বলতে পারি না। তবে মনে হয় সে মিশর গেছে। মিশরে এখনো তার বাদশাহী আছে। ইস্কান্দারিয়াতে তার একটি প্রাসাদও আছে। হয়তো সেখানেই চলে গেছে।
ডাইনী দাঁতে দাঁত পিষে বলল, আমি তাঁর খুন পান করতে যাচ্ছি। সে আমার খুন ঝরিয়েছে। সে আমাকে হত্যা করেছে। বল্ সে কোথায় আছে? অন্যথা আমি এখনই তোর খুন পান করব।
ভয়ে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমার মাসুম সন্তানদের আপনি এতীম বানাবেন না। আমি একজন গরীব মানুষ। রাজা বাদশাদের খবর আমি কী জানব। যদি আপনি আল্লাহকে বিশ্বাস করেন তাহলে তার উসিলায় আমাকে ক্ষমা করে দিন।
তারপর আর ডাইনী কিছু বলল না। খাবারের থলে আর পানির মশক নিয়ে চলে গেল। ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি আর দেরি করলাম না। খচ্চরের উপরে লাফিয়ে উঠে চলে এলাম।
এর কিছুদিন পর ইন্তাকিয়াতে দুই মুসাফির পৌঁছল। তাদের অবস্থাও ঐ মুসাফিরেরই মত। ভয়, ভীতি আর আতঙ্কে তারা শেষ হয়ে গেছে। তারা লোকদের বলেছে, অমুক পথ দিয়ে যেন কেউ না যায়। কারণ সে পথে এক ডাইনী হন্যে হয়ে ঘুরছে। মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর চিৎকার দিচ্ছে। ডাইনী বলছে, সে হিরাক্লিয়াসের খুন পান করতে যাচ্ছে। কারণ হিরাক্লিয়াস তার খুন ঝড়িয়েছে।
বাতাসের আগে আগে এ সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বিশ্বাস করে নিয়েছে, নিশ্চয় হিরাক্লিয়াস কোন যুবতাঁকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। এটা তারই বদরূহ। তবে কেউ এমন কথা বলেনি যে সেই বদরূহ কারো কোন ক্ষতি করেছে। বা কাউকে কোন ভয় দেখিয়েছে। সে যে মুসাফিরের সামনেই আত্মপ্রকাশ করেছে তার খাবার ও পানীয় নিয়ে গেছে।
এ অঞ্চলে যে ছোট ছোট দুচারটি কবিলা বাস করে তারাও এ চিৎকারের আওয়াজ শুনেছে। কিন্তু কেউ তাকে কোন বস্তীতে প্রবেশ করতে দেখেনি। ভয়ে লোকেরা সন্ধার পর ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সে শুধু মুসাফিরদের সামনেই আত্মপ্রকাশ করেছে এবং তাদের খাবার ও পানীয় নিয়ে গেছে। যারা তাকে দেখেছে, সবাই বলেছে সে দারুণ সুন্দরী, তার মাথার চুল অবিন্যস্ত। গায়ের কামিছটি ময়লা ও শত ছিন্ন।
বিভিন্ন মুসাফিরের মুখ থেকে যা শোনা গেছে তাতে অনুমান হয়েছে যে, সে ইন্তাকিয়ার দিকে যাচ্ছে।
***
সে যাই হোক, বদরূহ হোক, ডাইনী হোক বা পাগল যুবতী হোক-ইন্তাকিয়ার আশেপাশে তার সংবাদ পৌঁছে গেছে। তারপর যখন লোকেরা শুনতে পেল যে, সে ইন্তাকিয়ার নিকটে এসে পৌঁছেছে, তখন চারদিকে ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। রাতে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মুসাফিররা তাদের যাত্রা মুলতবী করে দিল।
একদিন ইন্তাকিয়ার তিন চারজন খ্রিস্টান অধিবাসী মুসলমান সালারের নিকট গিয়ে বলল, বেশ কিছুদিন যাবৎ এক বদরূহ বা ডাইনীর কথা শহরের ঘরে ঘরে আলোচিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে মানুষ শুনতে পেয়েছে, সে নাকি শহরের অতি নিকেট এসে পৌঁছেছে। ভয়ে এখন মানুষ সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে বেরোয় না। অনেকে সফরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
সেই প্রতিনিধি দলের বর্ষিয়ান লোকটি বলল, আমরা ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি। আমরা জানি, জ্বীন, বদরূহ বা ডাইনীর সামনে মানুষ একেবারে দুর্বল। কোন মানুষ তার মুকাবিলা করতে পারে না। তবে মুসলমানদের কিছু আলেম আছেন যারা অলৌকিক শক্তি বলে তাদের বশে আনতে পারে। তাই আমরা আপনার শরণাপন্ন হলাম।
প্রতিনিধি দলের কথা শুনে সালার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর তার শির দুলে উঠল। বললেন, হ্যাঁ, তুমি সত্য বলেছো। ইসলামে এমন শক্তি রয়েছে যা জ্বীন, বদরূহ ও ডাইনীদের সহজে কাবু করতে পারে। আসল কথা হল, মুসলমানরা বিশ্বাস করে, যে মারা যায় সে আর কখনো ফিরে আসে না। আর ডাইনী নামে কোন বস্তু পৃথিবীতে নেই। ইসলাম গ্রহণ কর, তোমার মাঝেও ঐ শক্তির সৃষ্টি হবে। তুমিও তখন নির্ভয়ে দৃঢ়তার সাথে ঐ বদরূহ বা ডাইনীর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে পারবে, তুমি কে? কি তোমার পরিচয়?
প্রতিনিধি দলের কথা শুনে ও চেহারা দেখে সালার বুঝতে পারলেন, এরা এ সূক্ষ্ম বিষয়টি বুঝবে না। সহজে মেনেও নিবে না। এত গভীর জ্ঞান তাদের নেই। তাই তিনি একজন মুজাহিদ বাহিনীর সাহসী অফিসারকে ডেকে পাঠালেন। নির্দেশ দিলেন, তুমি তোমার সাথে যে কয়জন মনে চায় মুজাহিদ নিয়ে যাও এবং এই যে বদরূহ বা ডাইনী যার আলোচনা শহরে ছড়িয়ে গেছে তার রহস্য উৎঘাটিত করো।
প্রতিনিধি দলের একজন বলল, মহামান্য সালার! আপনার ধর্ম ও বিশ্বাস সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই না। এ ব্যাপারে কিছু বলার অধিকারও আমার নেই। তবে আমার একটি অনুরোধ, আপনি আপনার অধিনস্তের কোন ক্ষতি করবেন না। হতে পারে, আপনার প্রেরিত সৈন্যদের দেখে তা অদৃশ্য হয়ে যাবে। আর যদি অদৃশ্য হয়ে না যায় তাহলে নিশ্চয় আপনার লোকেরা তাকে ধরতে গেলে তাদের ভীষণ ক্ষতি হবে। তাদের নিমিষে হত্যাও করে ফেলতে পারে।
সালার তার দুর্বল বিশ্বাসের কথা শুনে নির্বাক রইল। চেহারায় নির্ভিকতার আভা ফুটিয়ে তাদের আশ্বস্ত করতে চাইল। তারপর অফিসারদের বলল, যাও যে করেই হোক তাকে খুঁজে বের কর। যদি তোমাদের দেখে পালিয়ে যায় তাহলে তো কিছু করার নেই। আর যদি তোমরা তার নাগাল পাও, তাহলে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসো।
সেনা অফিসারটি নির্ভাবনায় এ দায়িত্ব নিজ জিম্মায় নিয়ে নিল। প্রথমে সে খোঁজ খবর নিল, এ বদরূহটি কোথায় কোথায় দেখা গেছে। অনেকে তিন চার জায়গার কথা বলেছে। তবে দুজন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট জায়গার কথা বলেছে।
অফিসারটি বেশ কিছু সাহসী মুজাহিদ সাথে নিয়ে শহরের বাইরে চলে গেল। মুজাহিদদের চার পাঁচজন করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে যে সব স্থানে ঝোঁপ ঝাড় রয়েছে, টিলা রয়েছে তার চারদিকে ছড়িয়ে দিল।
সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে তার আলোক রশ্মি। ঠিক তখন মুজাহিদদের একটি দল ঝোঁপের আড়ালে চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেল। বলছে, আমি হিরাক্লিয়াসের খুন পান করতে যাচ্ছি। এ দলটি আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র দলকে তাদের কাছে ডাকল। তারা কেঁপের চারদিক ঘিরে ফেলল। সামনে অগ্রসর হতে লাগল। তাদের অধিনায়ক বলে দিল, অন্তরে আল্লাহর দৃঢ় বিশ্বাস আর কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকবে। এভাবে চারদিক থেকে মুজাহিদ বাহিনী সামনে অগ্রসর হতে লাগল। তারা বারবার সেই চিৎকার ধ্বনি শুনতে পেল। মনে হচ্ছে, সে হেঁটে হেঁটে এক দিক থেকে অন্য দিকে যাচ্ছে।
তাদের অবরোধ একেবারে ছোট হয়ে এলে তারা দর্শকদের বর্ণনা মতই এক নারীকে দেখতে পেল। নারীটি তাদের দেখে ধীরে ধীরে পিছু হটে যাচ্ছিল। মুজাহিদদের অধিনায়ক আরো অগ্রসর হয়ে চিৎকার করে বলল, খবরদার! এক কদম লড়বে না! তারপরই বর্শা উঁচু করে তুলে ধরল। বলল, তুমি জ্বীন, বদরূহ বা ডাইনী হলে অদৃশ্য হয়ে যাও। আর যদি মানুষ হও তাহলে আত্মসমর্পণ করে চলে এসো। তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করা হবে না। আমরা তোমাকে ভয় পাচ্ছি না। তুমিও আমাদের ভয় পেয়ো না।
নারী চিৎকার করে বলল, আমাকে হিরাক্লিয়াস পর্যন্ত যেতে দাও। হিরাক্লিয়াস আমার খুন ঝড়িয়েছে। আমি তার খুন পান করব।
নেতৃস্থানীয় মুজাহিদ বলল, আমরা তোমাকে হিরাক্লিয়াসের নিকট পৌঁছে দেব। তুমি জান,আমরা হিরাক্লিয়াসের দুশমন। আমরাও তাকে হত্যা করতে চাই। আমরা তোমার সাথে লোক পাঠাব। সে তোমার সাথে হিরাক্লিয়াসের নিকট যাবে, তারা তোমার ইচ্ছা পূরণে সহায়তা করবে।
মুজাহিদ অধিনায়ক ঘোড়া থেকে নামলেন, বর্শা হাতে ধীর পদবিক্ষেপে সামনে অগ্রসর হলেন। কথার তালে তালে তিনি একেবারে মেয়েটির কাছে পৌঁছে তার বাহু শক্ত করে ধরে বললেন, আমাদের সাথে এসো। আমরা তোমার ইজ্জত আবরু রক্ষা করব।
যুবতী কোন প্রতিবাদ করল না। কোন শক্তিও প্রয়োগ করল না। সুবোধের মত অধিনায়কের সাথ চলে এল। মুজাহিদ অধিনায়ক একেবারে তার ঘোড়ার নিকট চলে এল এবং যুবতাঁকে তার ঘোড়ায় বসিয়ে দিল। ঘোড়ার লাগাম ধরে চলতে লাগল। ইতিমধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল মুজাহিদ সমবেত হয়ে গেছে। তারা সারি বেঁধে অধিনায়কের পিছনে পিছনে চলছে। তারা দেখল, যুবতী অত্যন্ত সুন্দরী। অনেকে আশংকা করছিল, যে কোন মুহূর্তে সে ঘোড়ার পিঠ থেকে উধাও হয়ে যাবে। কিন্তু না, সে ঘোড়ার পিঠেই বসে রইল।
***
সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে। চারদিকে আবছা আবছা অন্ধকার ক্রমেই ঘনিভূত হতে শুরু করছে। সালারের দুশ্চিন্তা ক্রমেই উদ্বেগের আকার ধারণ করতে লাগল। নানা দুশ্চিন্তা তাকে পেয়ে বসল। ভাবছে, যদি এ কোন জ্বীন বা অন্য কিছু হয় তাহলে তো তাদের ক্ষতিও করতে পারে। আর হতে পারে এ সময় পর্যন্ত তারা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইত্যাদি নানা দুশ্চিন্তায় তিনি যখন ঝিম খেয়ে বসে আছেন, ঠিক তখন প্রহরী এসে সংবাদ দিল, প্রেরিত অফিসার এক যুবতাঁকে গ্রেফতার করে এনেছেন। সালার বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। হতবুদ্ধিতার রেশ কাটতে না কাটতেই অফিসারটি সেই যুবতাঁকে নিয়ে সালারের কক্ষে প্রবেশ করলেন।
ইতিমধ্যে শহরে এ সংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সবাই দৌড়ে এল ডাইনীকে দেখতে। সালারের কক্ষের সামনে মানুষের ভিড়। সালারকে বলা হল, লোকেরা তার কামরার সামনে ভিড় করে আছে। তারা দেখতে চায় কাকে মুজাহিদরা গ্রেফতার করে এনেছে। কেমন সেই ডাইনী। ইতিমধ্যে সালার বুঝে ফেলেছেন, ডাইনী বদরূহ বা জ্বীন কিছুই নয়, সে একজন মানুষ। এক যুবতী নারী। সালার বললেন, যে নেতৃস্থানীয় লোকেরা এ সংবাদ নিয়ে এসেছিল তাদের ডেকে এ কক্ষে নিয়ে এসো। নেতৃস্থানীয় আরো কেউ থাকলে নিয়ে এসো।
দশ বারজন নেতৃস্থানীয় লোক সালারের কামরায় প্রবেশ করল। সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যুবতীর উপর। অথচ যুবতী নির্বিকার নিশ্চুপ! পিট পিট করে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। ভাব লেশহীনভাবে বসে আছে।
সালার জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি?
যুবতী উত্তর দিল, আমার নাম ইউকেলিস।
কামরায় বসা লোকেরা কানাঘুষা করতে লাগল। একজন বলল, এতো পুরুষের নাম। এ ধরনের নাম রোমানরা রাখে।
যুবতী বলল, আমি ইউকেলিস। আর ইউকেলিস হল রোজী। ইউকেলিস জীবিত আছে আর রোজীকে হত্যা করে ফেলেছে।
সালার জিজ্ঞেস করল, রোজীকে কে হত্যা করেছে?
যুবতী উত্তরে বলল, হিরাক্লিয়াস। আমি হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করতে যাচ্ছি। আমি তার খুন পান করব। তোমাদের কেউ পারলে আমাকে ঐ পথ দেখিয়ে দাও যে পথে গেলে আমি হিরাক্লিয়াসকে পাব।
সালার জিজ্ঞেস করল, তুমি কি মৃত মানুষের রূহ, না জীবিত মানুষ?
যুবতী বলল, ইউকেলিস আমার রূহ। ইউকেলিসের রূহ আমার মাঝে নিহিত রয়েছে।
সালার জিজ্ঞেস করল, তুমি কার মেয়ে? তোমার পিতার নাম কি? কোথা থেকে এসেছো? সে আর কিছু বলতে পারল না, যা কিছু বলল তা অর্থহীন। সালার বুঝে ফেললেন, এই যুবতীর বিবেক-বুদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। উন্মাদনা তাকে আরষ্ট করে রেখেছে।
***
সালার দারুণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। যুবতী নারী, ঠিকানা বলতে পারে না। নিকটাত্মীয় কেউ নেই। তা ছাড়া এ ধরনের রোগীর কোন চিকিৎসকও তার জানা নেই। কি করা যায়। আর এ কথা তো চিন্তাও করা যায় না যে,একজন যুবতী নারীকে পাগল জেনে তাকে ঘর থেকে বের করে দিবে।
মানুষের সামনে যুবতাঁকে উপস্থিত করার কারণে শহরবাসীদের মাঝে যে ভয় ও আতঙ্ক বিরাজমান ছিল তা দূর হয়ে গেল। সবাই জানল, আসলে কোন জ্বীন, বদরূহ বা ডাইনী নয়। একজন পাগলী যুবতী এ কাণ্ড ঘটিয়েছে। যদি যুবতী তার নামধাম ও ঠিকানা বলতে পারত তাহলে সালার তাকে তার পিতামামার নিকট পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারত। এ অবস্থায় যদি মুসলমান সালার না হয়ে কোন রোমান সালার হত তাহলে উন্মাদিনী ও পাগলিনী সাব্যস্ত হওয়ার পর তাকে হত্যার নির্দেশ দিত। তারপর তার লাশ কোথাও ফেলে দিত। কিন্তু ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় কোন সালার বা অফিসারের কথা চলে না। বরং ইসলামের বিধান অনুযায়ী তাদের চলতে হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের কোন ত্রুটি প্রকাশিত হলে তাদেরও শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়।
সালার রোজীকে তার সাথে তার বাড়িতে নিয়ে গেল এবং মহিলাদের হাতে তুলে দিয়ে বললো, একে গোসল করিয়ে ভাল কাপড় পরাও এবং খেতে দাও।
সালার ফিরে এসে শহরের সমবেত লোকদের মাঝে উপস্থিত হলেন।
সালার বললেন, আপনারা শহরের গণ্যমান্য মানুষ। আপনারা আমাকে পরামর্শ দিন, আমি এখন কি করতে পারি। আমি এ যুবতী নারীকে ঘরেও রাখতে পারছি না। আবার তাকে বাইরেও বের করে দিতে পারছি না। তার দেখাশুনা ও তার ইজ্জত আব্রুর হিফাজত করা আমাদের কর্তব্য। আমি তাকে কোন মুখলিস হামদর্দ ব্যক্তির নিকট অর্পণ করতে চাচ্ছি যে তাকে তার বাড়িতে রাখবে। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। হতে পারে সে ভাল হয়ে যাবে। ভালো হয়ে উঠলে সে তার পিতামাতার নামধাম বলতে পারবে। তখন একটা ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে।
সালারের কথার পর মজলিসে নিরবতা নেমে এল। টু শব্দটি পর্যন্ত নেই। তার অর্থ কেউ এ উন্মাদিনীর দায়িত্ব নিতে রাজী নয়। সে মজলিসে সবার পিছনে তিন ব্যক্তি বসে ছিল। তারা কানাঘুষা করে কি যেন বলছে।
তাদের একজন হামদর্দীর সাথে বলল, জনাব আমীর! আমরা তিনজন মিশর থেকে এসেছি। কাজ শেষে এখন আমরা ফেরার পথে। লোকমুখে শুনতে পেলাম, এক বদরূহকে ধরে আনা হয়েছে। অনুসন্ধিৎসু মন ধরে রাখতে পারলাম না। দেখতে এলাম। বদরূহের জায়গায় এক উন্মাদিনীকে দেখতে পেলাম। আমরা নিশ্চিত এ যুবতী মুসলমান নয়। কোন খ্রিস্টান কবিলার মেয়ে। আমরা মিসরের খ্রিস্টান। যদি আপনি আমাদের বিশ্বাস করেন, তাহলে আমরা একে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারি। আমরা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। ভাল হলে তাকে তার পিতামাতার নিকট পৌঁছে দিব। আর যদি সে শাদী করতে চায় তাহলে মিশরে তার শাদীর ব্যবস্থা করব। যুবতী নারী নিয়ে চলা ভারি বিপদ জেনেও আমরা পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে বলছি, যুবতীটি খ্রিস্টান আর আমরাও খ্রিস্টান। তাই তাকে আমরা আমাদের জিম্মায় নিতে চাচ্ছি। আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা তার দেখাশোনা ও চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করব।
উপস্থিত লোকদের তিন চারজন খ্রিস্টানের কথা সমর্থন করল। অন্যরাও মৌন সমর্থন দিল। ফলে সালারও এই ফয়সালাই করলেন। যুবতাঁকে তাদের নিকট সমর্পণ করার হুকুম দিলেন।
সালার জিজ্ঞেস করলেন, তবে যদি মেয়েটি তোমাদের সাথে যেতে না চায়, তাহলে কি হবে?
লোকটি বলল, মহামান্য আমীর! মেয়ের মাথায় কোন বুদ্ধি নেই। কল্যাণ অকল্যাণ কিছুই সে বুঝে না। তার মাথায় এ কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে যে, সে হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করতে যাচ্ছে। আমি তাকে বলব, তুমি আমাদের সাথে চল, আমরা তোমাকে আমাদের সাথে রাখব। তারপর আমরা সবাই মিলে হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করব।
তার কথা শুনে সবাই প্রীত হল। বুঝল, লোকটি দারুণ বুদ্ধিমান ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন।
সালারের নির্দেশে যখন মেয়েটিকে আবার সালারের কামরায় আনা হল, তখন সে গোসল করে খেয়ে দেয়ে সুন্দর কাপড় পরিধান করে এসেছে। এবার তাকে দেখা মাত্র সবার চোখ স্থির হয়ে গেল। যেন রাজকুমারী, অপরূপ তার দেহলতা। মন কাড়া তার রূপ সুষমা। চেহারায় নিষ্পাপ ভাব প্রকট হয়ে আছে। সালার মেয়েটিকে বলল, আমি তোমার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তিনজন লোক তৈরী করেছি, এরা তোমার সাথে থাকবে এবং হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করবে।
সালারের কথা শুনে যুবতীর অবয়বে দ্বিতীয়ার চাঁদের ন্যায় ক্ষীণ সরু এক হাস্যরেখা ফুটে উঠল। খ্রিস্টান লোকটি তার সাথে মমতাভরা ভাষায় কথা বলল। যুবতী তাদের সাথে যেতে প্রস্তুত হয়ে গেল।
সালার বললেন, আজ রাতে সে আমার বাড়িতে মহিলাদের সাথে থাকবে। আগামীকাল ফজরের নামাযের পরই তাকে খ্রিস্টান লোকটির নিকট অর্পণ করা হবে। তারপর সে তাকে নিয়ে মিসর চলে যাবে।
***
ফজরের নামাযের পর সালার মসজিদে বসে কুরআন তিলাওয়াত করেন। ইশরাকের নামায শেষে বাড়িতে পৌঁছে দেখেন, খ্রিস্টান সেই তিন লোক তার অপেক্ষায় দহলিজে বসে আছে। সালার মেয়েটিকে তাদের নিকট সমর্পণ করে দিলেন। তারা তাকে নিয়ে চলে গেল। ইন্তাকিয়া থেকে ইস্কান্দারিয়া যাওয়ার পথ দুটি। স্থল পথ ও সমুদ্র পথ। তারপর দিনই ইস্কান্দারিয়ার উদ্দেশ্যে একটি জাহাজ ইন্তাকিয়া ছেড়ে চলে গেল। সে জাহাজেই তারা রোজীকে নিয়ে মিসরের উদ্দেশে রওয়ানা দিল।
রোজীর কথার মাঝে একটি প্রতিজ্ঞাই বার বার ফুটে উঠছে। সে হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করে তার খুন পান করবে। খ্রিস্টানরা তাকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দিল। তার মন মতই তার সাথে আচরণ করতে লাগল।
রোম সাগরের বুক চিরে জাহাজটি ছুটে চলছে। চারদিকে পানি আর পানি। পানির জগত। মাঝে মাঝে পাল তোলা জাহাজের সমাগম। সকালে মনে হয় পানির বুক থেকে আগুন ছড়িয়ে সূর্য আকাশে উঠে আসছে। আর সন্ধ্যায় মনে হয়, ক্লান্ত সূর্য বিষণ্ণ মুখে আবার পানির বুকেই আত্মবিসর্জন দিচ্ছে। দিগন্তের দিকে দৃষ্টি ফেললে মনে হয়, আকাশ আর পানির অপূর্ব মাখামাখি। দৃষ্টিনন্দন মিলন।
রাতে রোজী ঘুমিয়ে পড়লে খ্রিস্টান তিনজন জাহাজের ছাদে চলে যায়। গল্পগুজব করে। তারপর ঘুমায়। একদিন তাদের একজন অপরজনকে বলছে, বন্ধু হোরশীছ! আমার তো বিশ্বাস, তোমার মেয়ে এ যাত্রায় বেঁচে যাবে। মনে হয় এ মেয়েটি কুমারী।
হোরসীছ বলল, আমারও তাই মনে হয়। আমি তো নিজেকে নিরূপায় ভেবে এ মর্মান্তিক আঘাতের জন্য প্রস্তুত করে নিয়েছিলাম। মানসিক প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম যে মেয়েটিকে নীল নদে বিসর্জন দিব। খোদার খাস মেহেরবানীতে এ যুবতাঁকে পেয়ে গেলাম। যদি ধর্মীয় গুরু এ মেয়েকে কবুল করে নেন তাহলে কঠিন কষ্ট থেকে বেঁচে যাব।
অন্য সাথী বলল, তুমি বেঁচে যাবে। নিশ্চয় তুমি আল্লাহর সাহায্য পেয়েছে। তুমি বড়ই ভাগ্যবান।
রোজীকে পেয়ে হোরশীছের এক বিরাট বিপদ কেটে গেছে। এ ছিল তার এক অসহনীয় মসীবত। মুসলমানদের সালার ইন্তাকিয়ার আমীর একটুও সন্দেহ করতে পারেনি যে, এ খ্রিস্টানরা মানবতার নামে, হামদর্দীর নামে তাকে ধোঁকা দিয়ে রোজীকে নিয়ে গেল।
মিসরের খ্রিস্টানদের প্রথা ছিল, তারা প্রত্যেক বৎসর এক নির্দিষ্ট রাতে নীল নদীতে একজন কুমারী যুবতাঁকে অপরূপ সজ্জায় সজ্জিত করে নদী বক্ষে বিসর্জন দিত। পিতামাতার সন্তুষ্টচিত্তেই ধর্মীয়গুরু তা পালন করত। কখনো কোন মেয়েকে জোর জবরদস্তি করে নদী বক্ষে নিক্ষেপ করা হত না।
পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক কবিলা থেকে একজন কুমারী যুবতাঁকে বিসর্জন দেয়া হত।
এ বৎসর যে কবিলার জিম্মায় বিসর্জনের পালা পড়েছে সে কবিলায় শুধুমাত্র হোরশীছেরই একমাত্র যুবতী কুমারী মেয়ে আছে। আর কারো নেই। হয় বিয়ে হয়ে গেছে, নয়তো অল্প বয়সী। ধর্মীয়গুরু হোরশীছকে ডেকে জানিয়ে দিয়েছে, এ বৎসর তার মেয়েকে বিসর্জন দিতে হবে। হোরশীছের একমাত্র সন্তান তার এ মেয়ে। মেয়েটিকে সে হৃদয়ভরা মমতা দিয়ে বড় করে তুলেছে। এ কথা সত্য, তার অনুমতি ও সন্তুষ্টি ছাড়া মহাপাদ্রী তার মেয়েকে বিসর্জন দিতে পারবে না। তবে হোরশীছের পক্ষে মহাপাদ্রীর নির্দেশ অমান্য করাও সম্ভব নয়। এ সংবাদ শোনার পর হোরশীছের স্ত্রীর মাতম শুরু হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ। দিনরাত শুধু কান্না আর কান্না। এই সুখী পরিবারটিতে নরকের অশান্তি নেমে এল। এদিকে হোরশীরের মেয়েও আত্মবিসর্জনে নারাজ। পরিশেষে হোরশীছ সিদ্ধান্ত করল, সে গীর্জায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করবে, তার মেয়ের শাদী না হলেও সে কুমারী নয়। সে মহাপাপী। তাই তাকে নীল নদে বিসর্জন দিয়ে নীল নদের পবিত্রতা সে নষ্ট করতে পারে না।
হোরশীছ ও তার স্ত্রী-মেয়ে কঠোর ভাষায় বলে দিয়েছে, সাবধান! আমরা যা বলি তাতেই তুমি অবিচল থাকবে। এতে আমাদের পরিবারের কবিলার ইজ্জত হানী হলে তোক তাতে কোন পরোয়া নেই।
মিসরের খ্রিস্টানদের এ বিশ্বাস ছিল অমূলক। নীল নদের পানি প্রবাহের সাথে যুবতী বিসর্জনের কোন সম্পর্ক ছিল না। সম্রাট হিরাক্লিয়াস যে রাষ্ট্রীয় খ্রিস্ট ধর্মের প্রচলন করেছিল তাতে এ ধরনের যুবতী বিসর্জন ছিল মারাত্মক অপরাধ। এ অপরাধ মানব হত্যার মতই গুরুতর। তাই মিসরের খ্রিস্টানরা তাদের প্রথা দিনে পালন না করে রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি করত।
এখনো বিসর্জনের দুতিন মাস বাকি। হোরশীছ ব্যবসার উদ্দেশ্যে দুজন সাথীর সাথে ইন্তাকিয়ায় গিয়েছিল। ইন্তাকিয়ায় সব কাজকর্ম শেষ করে ফেরার পথে শুনতে পেল, নগরের আমীর এক বদরূহকে গ্রেফতার করে এনেছে। তাই সে তাকে দেখতে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।
***
হোরশীছ ব্যবসায়িক কাজ শেষ করে মিসরে ফিরে যাওয়ার জন্য জাহাজের অপেক্ষা করছে। অকস্মাৎ শুনতে পেল, ইন্তাকিয়ার শাসক এক বদরূহ প্রেতাত্মা বা ডাইনীকে গ্রেফতার করেছে। হোরশীছ তার অনুসন্ধিৎসু মনকে দমন করতে পারেনি। সাথীদের নিয়ে ইন্তাকিয়ার শাসকের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য এসেছে।
ইন্তাকিয়ার শাসক যখন জিজ্ঞেস করল, এ মেয়েটিকে কে তার বাড়িতে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে প্রস্তুত? তখন, হোরশীছের মাথায় এক নব চিন্তার স্ফুরণ ঘটল। সে ফিস্ ফিস্ করে তার সাথীদের সাথে পরামর্শ করল। সাথীরা তার মতে সায় দিল। বলল, মেয়েটিকে নিয়ে নাও। এটি দিয়ে এবার কাজ সেরে দিব। তারা মেয়েটিকে সাথে নিয়ে নিল।
সমুদ্রের বুক চিরে জাহাজটি মিসরের দিকে ছুটে চলছে। সাঁ সাঁ রব তুলে ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছে আবার দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। শীতল বাতাসে প্রচুর জলজ গন্ধ। দিনের বেলা গাং চিলগুলো জাহাজের পাশে পাশে উড়ে। বেশ কিছুক্ষণ উড়ার পর আবার হারিয়ে যায়।
ফেরার পথে একদিন রাতে হোরশীছ ও তার সাথীরা রোজীকে জাহাজের ছাদে নিয়ে গেল। তার মনকে আকৃষ্ট করার জন্য সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে তারা কথাবার্তা শুরু করল। রোজীও তাদের সাথে খোলামেলা কথাবার্তা বলছে। সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে হত্যার বিভিন্ন কৌশল নিয়েও তারা আলোচনা করল। তাদের আলোচনায় রোজী অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হল। উল্লাসে তার চেহারা চিক চিক করে উঠল।
কথার এক ফাঁকে হোরশীছ রোজীকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা রোজী, তুমি কি কুমারী?
উত্তরে রোজী বলল, হ্যাঁ। তারপরই তার কণ্ঠ একটু কঠিন শোনা গেল। বলল, মাতা মেরী যিনি হযরত ঈসা (আ)-কে জন্ম দিয়েছিলেন আমি তারই মত কুমারী। কিন্তু….. কিন্তু এ কথা কেন আমাকে জিজ্ঞেস করছো?
হোরশীছ মোলায়েম কণ্ঠে বলল, না, না। আমরা কোন সন্দেহ করছি না। তবে পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছিলাম যদি নিপীড়িত কুমারী নারী কোন জালিমকে হত্যা করে, তাহলে তার কোন পাপ হয় না। হিরাক্লিয়াসের চেয়ে জালিম শাসক এ দুনিয়ায় আর কে আছে?
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর একদিন জাহাজ মিসরের ইস্কান্দারিয়া বন্দরে এসে থামল। সে কী বিরাট বন্দর। জাহাজের পর জাহাজ বন্দরে নোঙর করে আছে। একের পর এক যাচ্ছে আবার একের পর এক আসছে। সর্বত্র হাট বাজারের মত মানুষের ভিড়। স্রোতের ন্যায় মানুষের যাত্রা প্রবাহ লেগেই আছে। মুসাফিররা একের পর এক নেমে যার যার গন্তব্যে চলে গেল। ইস্কান্দারিয়া থেকে দূরেই হোরশীছের বাড়ি। তারা একটি উট ভাড়া করে নিয়ে সন্ধ্যার পর বাড়িতে পৌঁছল।
পরদিন সকালে হোরশীছ তার সাথী দুজনকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে গেল। সে গ্রামে তাদের অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাদ্রীর গীর্জা। গীর্জার পাশেই তার আলীশান কামরা। সে কামরায় তিনি সব সময় থাকেন। তারা গিয়ে সোজা পাদ্রীর কামরায় পৌঁছল। লোকটি সাদা ধবধবে শশ্রুমণ্ডিত সুঠাম দেহের অধিকারী। চোখ দুটি ছোট ছোট, পিট পিটে। ধুরন্ধরীর গন্ধ আসে তার চোখ থেকে। পাদ্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে কুশলাদি বিনিময় করল। ইন্তাকিয়া থেকে আনা কিছু উপঢৌকন তার পদপ্রান্তে রাখল। তারপর হোরশীছ তার কণ্ঠে অত্যন্ত দৃঢ়তা ও আত্মনির্ভরশীলতা এনে বলল, বাবাজ্বী মহাশয়! আমরা যখন ইন্তাকিয়ায় ঠিক তখন আমাদের সাথে এক মিসরী খ্রিস্টান ব্যবসায়ীর সাক্ষাৎ। আমাদের পেয়ে সে দারুণ আপ্যায়ন করল। তারপর যীশুর কসম দিয়ে বলল,আমি ব্যবসায় মার খেয়েছি। এখন প্রায় নিঃস্ব অবস্থা। অন্ন সংস্থান করাই দায় হয়ে পড়েছে। দুশ্চিন্তায় আকাশ ভেঙে পড়েছে আমার মাথায়। দিশেহারা হয়ে ছুটে গেলাম গির্জায়। চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ জপতপ করলাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে গেছি স্মরণে নেই। হঠাৎ দেখলাম, যীশু আমার সামনে উপস্থিত। চারদিক আলোতে উদ্ভাসিত। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছেন। আমি ভড়কে গেলাম। তিনি আরো খানিকটা এগিয়ে এসে বললেন, শোন, হে মিশরী! তোমার ঐ কুমারী কন্যাকে নীল নদীতে উৎসর্গ কর। তোমার ব্যবসায় উন্নতি হবে। নীলের অববাহিকায় বসবাসরত লোকদের আশীর্বাদ পবে। আবার তোমার সুদিন ফিরে আসবে।
হোরশীছের সাথী দুজন তাকে সমর্থন করল। বলল, লোকটি তার কুমারী কন্যাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। বলেছে, এ বৎসরই যেন তাকে নীল নদে উৎসর্গ করা হয়।
হোরশীছের কণ্ঠ একটু দৃঢ় শোনা গেল। বলল, এ বৎসরই তাকে নীলে উৎসর্গ করতে হবে। সে একটি আমানত। কিছুতেই আমরা তার খেয়ানত করতে পারি না।
পাদ্রী দুচারটি কথা জিজ্ঞেস করার পর বলল, মেয়েটিকে আমার সামনে নিয়ে এসো।
পরদিন সকালে তারা রোজীকে পাদ্রীর নিকট নিয়ে এল। পাদ্রী আপাদমস্তক রোজীকে দেখল। তারপর জিজ্ঞেস করল। তুমি কি স্বেচ্ছায় এসেছো, না তোমাকে জোর করে আনা হয়েছে।
রোজী পাদ্রীর কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝল না। বলল, আমি ইচ্ছে করেই এসেছি। রোজী তখনো অসুস্থ। চিন্তাশক্তি তার বিকল। ভালমন্দ কিছুই সে অনুধাবন করতে পারছে না। তবে পাদ্রীর সামনে বসে সে হাসল। বুদ্ধিমানের মত দুচারটি কথা বলল। পাদ্রীর সকল সন্দেহ দূর হয়ে গেল। সে তাকে নীল নদে উৎসর্গ করার নির্দেশ দিয়ে দিল।
***
হোরশীছ ও তার স্ত্রী রোজীকে সীমাহীন আদর যত্ন করতে লাগল। তার কথার তালে তারা কথা বলে। তাকে সান্ত্বনা দেয়। প্রবোধ দেয় এবং বলে, শীঘ্রই হিরাক্লিয়াসকে হত্যার পরিকল্পনা করা হবে। তোমাকেই তাকে হত্যার দায়িত্ব দেয়া হবে। রোজীকে নীল নদে উৎসর্গের দিন এসে গেল। সন্ধ্যায় তাকে গীর্জায় নেয়া হল। আজ তাকে হোরশীছের স্ত্রী অপরূপ সাজে সজ্জিত করে দিয়েছে। মূল্যবান ঝলমলে কাপড় তার গায়ে। হোরশীছের মেয়ে সকল অলঙ্কার তাকে পরিয়ে দিয়েছে। যেন সে এক সাক্ষাৎ স্বর্গের অপ্সরী।
আজ থেকে দশ বার বৎসর পূর্বে নীল নদে কুমারী উৎসর্গ করার সময় চারদিকে ঘোষণা করা হত। দলে দলে লোক সমবেত হত। যে যুবতাঁকে উৎসর্গ করা হবে তারা তাকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করত। লাইন ধরে তার হাতে চুমু খেত। কিন্তু সম্রাট হিরাক্লিয়াস এ ধরনের উৎসর্গকে দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করেছে। তার আইনে এটা হত্যাকাণ্ড। যাকে এ ধরনের কাজের সাথে জড়িত পাওয়া যাবে তাকেই মানব হত্যার শাস্তি ভোগ করতে হবে। সম্রাটের এ নির্দেশের পর প্রকাশ্যে আর কাউকে উৎসর্গ করা হয় না। তবে গোপনে রাতের অন্ধকারে তারা এ প্রথা পালন করে থাকে।
রাতের অন্ধকারে তারা রোজীকে জনবসতি থেকে দূরে নীল নদের তীরে নিয়ে গেল। হোরশীছ তাকে বলেছে, নদীতে একটি নৌকা রাখা আছে। সে নৌকা দিয়ে তাকে ইস্কান্দারিয়া নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানেই হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করা হবে। সেখানে প্রধান পাদ্রী ছিল। কবীলার গণ্যমান্য কিছু লোকও ছিল।
পাদ্রী তার শরীরে সুগন্ধি পানি ছিটিয়ে দিল। বিড়বিড় করে কি কি সব মন্ত্র পাঠ করল। তারপর তার দুই কাঁধের উপর হাত রাখল। বিড়বিড় করে আরো কি যেন পাঠ করল। বাহু ধরে তাকে নদীর তীরে নিয়ে গেল। সেখানে তীর বেশ উঁচু ছিল। পাদ্রী পিছন দিক দিয়ে ধাক্কা মেরে রোজীকে নীল নদীর পানিতে ফেলে দিল। রোজী কোন কিছু বুঝার আগেই ঝুপ করে পানিতে পড়ে গেল।
চারদিক অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার। পাদ্রী আর উপস্থিত লোকেরা সুর দিয়ে একটি ধর্মীয় আমেজের কবিতা আবৃতি করতে করতে চলে এল। যদিও নদী অত্যন্ত গভীর কিন্তু সেদিন স্রোত তেমন প্রবল ছিল না। নদী ছিল অনেকটা শান্ত।
রোজী কবিলার সর্দারের মেয়ে। দারুণ চঞ্চল আর চটপটে। তাদের পল্লীর পাশ দিয়েই বয়ে গেছে প্রবাহমান ফুরাত নদী। রোজী তার দুতিনজন সখীকে নিয়ে প্রায়ই নদীতে নাইতে যেত। জলকেলী করত। পানি ছুড়াছুড়ি করত। সাঁতার কাটত। বয়স একটু বাড়লে রোজীর দৌরাত্মও বেড়ে গেল। সাঁতার কেটে কেটে সে মাঝ নদীতে চলে যায়। স্রোতের উল্টো দিকে সাঁতার কেটে চলতে থাকে। উঁচু তীর থেকে ঝাঁপিয়ে নদীতে পড়ে। তার এই সাঁতার দক্ষতার কারণে সখীরা তাকে হাসী বলে ডাকত।
রোজীকে নীল নদীতে নিক্ষেপ করা হলে পানিতে পড়েই তার প্রথম আত্মরক্ষার চিন্তা এল। যে করেই হোক তাকে জীবনে বাঁচতে হবে। পানিতে পড়েই সে ভেসে উঠল না। পানির নীচ দিয়ে সাঁতার কেটে কেটে সে খানিক দূর চলে গেল। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলেই সে পানির উপর ভেসে উঠল এবং নদীর অন্য পারের দিকে সাঁতার কাটতে লাগল। অন্ধকারে কেউ তাকে দেখতে পেল না। তাছাড়া তাকে নদীতে ফেলে দিয়েই সবাই সুর দিয়ে কবিতা পাঠ করতে করতে চলে এসেছে।
রোজী এক রকম ভাসতে ভাসতে নদীর অপর পারে চলে এল। অন্ধকারে সে নদীর তীরে বসে হাঁপাতে লাগল। চারদিকে সে উদ্বিগ্ন ও ভীত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। তার মনে হচ্ছে যেন সে স্বপ্নের জগত থেকে হঠাৎ জাগ্রত হয়েছে। ইতিমধ্যে তার চিন্তাশক্তি ফিরে এসেছে। সে ভেবেই পাচ্ছে না, তার শরীরে এতো মূল্যবান অলঙ্কার এলো কোত্থেকে!
সেখানে বসেই সে চিন্তা করতে লাগল, এখন তার কি হবে? সে তার বাড়ি থেকে কোথায় চলে এসেছে তা ঠিক করতে পারছে না। তবে কি এটা ফুরাত নদী। কিন্তু এমন স্থান তো সে কোথাও কখনো দেখেনি।
তার চিন্তাশক্তি আরো স্বচ্ছ, আরো পরিচ্ছন্ন হয়ে আসতে লাগল। ধীরে ধীরে তার যুদ্ধের কথা স্মরণ হল। রক্তাক্ত সে যুদ্ধ। তারপরই হঠাৎ তার মানস পটে ইউকেলিসের চেহারা ভেসে উঠল। রক্তাক্ত মুমূর্ষ ইউকেলিস। সাথে সাথে তার শরীরে কম্পন সৃষ্টি হল। তার মনে হল, শতে শতে লাশের মাঝে সে ইউকেলিসকে খুঁজছিল। তার আরো মনে এল, ইউকেলিসের লাশের পর সে ইউকেলিসের মায়ের লাশও দেখেছিল। তার মনে হল, এরপরই সে এক স্বপ্নের জগতে হারিয়ে গিয়েছিল।
প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের কারণেই রোজীর স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তবে একেবারে উন্মাদ হয়ে যায়নি। অন্ধকারের মাঝে বসে সে উন্মুক্ত নির্মল আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। ধীরে ধীরে তার স্মৃতি শক্তি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে আসতে লাগল। হিরাক্লিয়াসের কথা স্মরণ হল। সে যে হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করার জন্য বেরিয়ে ছিল তাও মনে পড়ল। মানুষ তাকে ডাইনী বা প্রেতাত্মা মনে করে ভয় করত। সে কারো সামনে এলেই সে ভয় পেত। সে মানুষের খাবার ও পানীয় নিয়ে নিত। এভাবেই সে বেশ কিছুদিন মরুভূমি আর ঝোঁপঝাড়ের মাঝে কাটিয়েছিল।
তারপর তার ঐ ব্যক্তির কথাও মনে এল, যে তাকে জাহাজে করে মিসর নিয়ে এসেছে। মনে এল তাকে দুমহিলা নতুন কাপড় পরিয়ে অলঙ্কার দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। বলা হয়েছে যে, হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইউকেলিসের খুনের প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে এই ভেবে সে আনন্দিত ও বিমুগ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে তার নিকট সবকিছুই তার মানসপটে ভেসে উঠল। সবকিছুই যেন সে বুঝতে পারল। কিন্তু তাকে কেন নদীতে ফেলে দেয়া হল এর কোন কারণ সে খুঁজে পেল না।
***
নিরব নিস্তব্ধ এই অন্ধকার রজনীতে ইউকেলিসের কথা স্মরণ হতেই অঝোর ধারায় তার চোখ দিয়ে অশ্রু নেমে এল। কিন্তু এখন তার প্রেমিক হারানোর বেদনা এমন তীব্র নয় যে, চিন্তাশক্তি বিকল হয়ে যাবে। সে এখন নিজেকে নিয়েই দারুণ চিন্তায় পড়ে গেল। একতো তার সাথে রয়েছে মূল্যবান অলঙ্কার। তার চেয়ে আরো বেশী মূল্যবান তার কুমারিত্ব।
অলঙ্কার না হয় লুকিয়ে রাখল কিন্তু নিজেকে, নিজের যৌবন আর রূপ শোভাকে কিভাবে লুকাবে! ভাবনার এক পর্যায়ে সে তার সকল অলঙ্কার খুলে ফেলল। যেন কোন ডাকাতের খপ্পরে না পরে। ভাবল, অলঙ্কারগুলো নদীতেই ফেলে দিবে। কিন্তু পরক্ষণেই বিদ্যুতের মত চমকে উঠল। ভাবল, না, এভাবে ফেলে দেয়া যায় না। বরং এগুলো দিয়ে কারো সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
অলঙ্কারগুলো কীভাবে লুকিয়ে রাখবে তা-ই ভাবছে। ঘাগড়ার মত এক প্রকার পোষাক তার গায়ে ছিল। সে জামার নিজের দিকের কিছু অংশ ছিঁড়ে তাতে অলঙ্কারগুলো বাঁধল। তারপর তা পুটলির মত বানিয়ে কাপড়ের নিচে বেঁধে নিল।
অর্ধরাত পেরিয়ে গেছে। সে অত্যন্ত ক্লান্ত। তার ভীষণ ঘুম পেয়েছে। নিকটে একটি বৃক্ষ। সে বৃক্ষের নিচে গিয়ে বসে পড়ল। তারপর ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল।
***
ঘুম ভেঙ্গে গেল। তবুও ঘুমের আবেশে চোখ দুটি তার লেগে আছে। মনে হচ্ছে, যেন তার চারপাশে কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল। দেখল, তার চারপাশে বহু মানুষ জমায়েত হয়েছে। সবার চোখে রাজ্যের বিস্ময়।
এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? এখানে কেন পড়ে আছ?
রোজী বলল, সব বলব। তবে আমাকে আগে এমন এক বাড়িতে নিয়ে চল, যেখানে মহিলা আছে। আমি প্রবঞ্চিত হয়ে এখানে এসেছি। আমি নদী থেকে উঠে এসেছি।
রোজী বুঝল, এরা শ্রমিক ও নীচু শ্রেণীর মানুষ। পাপাচারী বা বদলোক নয়। যদি তেমন লোক হত তবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু তামাশা দেখত না এখনো।
এক ব্যক্তি বলল, আমাদের বাবাজ্বী আসছেন। তিনি বলবেন, তোমাকে কোথায় নিতে হবে। তোমার ধর্ম কি?
রোজী বলল, আমি খ্রিস্টান।
সে লোকটি বলল, তাহলে ভয়ের কিছুই নেই। আমরাও সবাই খ্রিস্টান। মিসরী খ্রিস্টান।
রোজীও তাদেরকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, আমিও মিসরী খ্রিস্টান।
একটু পরেই ঘোষণার মত একটু উঁচু কণ্ঠে একজন বলল, ভাইয়েরা! সরে দাঁড়াও। সরে দাঁড়াও। বাবাজ্বী আসছেন। সাথে সাথে সবাই পিছনে সরে এসে রাস্তা করে দিল। এক বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি রোজীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার চেহারা, পোষাক, আর পদবিক্ষেপে মনে হয়, তিনি একজন উঁচু মর্যাদার লোক। রোজীকে দেখেই সে ভূত দেখার মত ভয় পেয়ে দুকদম পিছিয়ে গেল। তারপর তার চেহারার রং এমন পরিবর্তিত হয়ে গেল যা লুকাবার নয়।
বাবাজ্বী বলল, আমি তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। সেখানে আমার স্ত্রী আছে, দুমেয়ে আছে আর পুত্রবধূ আছে।
রোজী বলল, আমি এমন বাড়িতেই যেতে চাই যেখানে মহিলা আছে।
বাবাজ্বী তাকে সাথে করে নিয়ে গেল। রোজী চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখল। একদিকে নীল নদী। যার তীরে ছোট বড় নৌকা বাঁধা আছে। আরো একটু দূরে পালতোলা বেশ কিছু নৌকা নোঙর করে আছে। কিছু নৌকা থেকে লোকেরা নামছে। আবার কিছু নৌকায় লোকেরা আরোহণ করছে। রোজী বুঝল, এটা নৌঘাট। এখান থেকে নৌকায় চড়ে লোকেরা দূরে দূরে যায়।
নদী থেকে আধমাইল দূরে একটি লম্বা গ্রাম। সেখানে ছোট ছোট ঝোঁপড়ির মত বাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু ইট পাথরের নির্মিত বাড়িও আছে। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষই মৎসজীবী, জেলে বা মাঝি মাল্লা। এটা খ্রিস্টান পল্লী। ইতিমধ্যে গ্রাম থেকে নৌঘাটে মানুষের যাতায়াত শুরু হয়ে গেছে।
বাবাজ্বী গোত্রের সর্দার। মিসরী খ্রিস্টানদের নিকট সে এক উঁচু মর্যাদার ব্যক্তিত্ব। রোজীর সাথে কোন কথা না বলেই সে তাকে তার বাড়িতে নিয়ে এল এবং একটি কামরায় তাকে বসতে দিল। তারপর বাড়ির নারীদের ডেকে রোজীর নিকট থেকে সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত জানতে বললো। তারা জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে? কেন তোমার এ অবস্থা হল, তা তুমি সুস্পষ্ট করে বল।
রোজী মহিলাদের নিকট তার জীবন কাহিনী বিস্তারিত বললো। শোনাল কি মনোভাব নিয়ে সে ইন্তাকিয়ায় পৌঁছেছে। তারপর মিসরে এ স্থানে কিভাবে পৌঁছেছে।
বাবাজ্বী নিরবে সবকিছু শুনল। রোজী তার জীবনের বেদনাতুর কাহিনী শেষ করল। বাবাজ্বী তার স্ত্রীকে বলল, মেয়েটিকে গোসল করাও। নতুন কাপড় পরিয়ে দাও এবং খাবারের আয়োজন কর। তারপর সে রোজীর কাঁধে হাত রেখে নরম কণ্ঠে বলল, এ বাড়িটিকে তুমি নিজের বাড়ি মনে করবে। তোমাকে তোমার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হবে। তারপর বাবাজ্বী বাইরে চলে গেল। এবং এক ব্যক্তিকে দুতিনটি নাম বলে তাদের ডেকে আনার নির্দেশ দিল।
***
বাবাজ্বীর হাবেলী খুব শানদার ও প্রশান্ত। দেখলেই মনে হয় তিনি তার গোত্রের প্রধান সর্দার। রোজী অন্তঃপুরে চলে গেছে। বাবাজ্বী বাইরে বৈঠক খানায় বসে আছে। ইতিমধ্যে তিনি যাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন তারা এসে গেছে। অত্যন্ত গুরু গম্ভীর ভাবে বাবাজ্বী তাদের দিকে তাকালেন। তাদের একজন বিস্মিত কণ্ঠে বলল, বাবাজ্বী! শুনলাম এক যুবতাঁকে একাকী পাওয়া গেছে?
বাবাজ্বী বলল, সে এখন আমার ঘরে। সে জন্যেই তো আমি তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছি। তোমরা জান, গতরাতে নীল নদে এক যুবতাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। সে যুবতীই এই। সে মরেনি। জীবিত অবস্থায় নদী থেকে উঠে এসেছে। নীল নদ আমাদের উৎসর্গকে কবুল করেনি। আমাদের উপঢৌকন গ্রহণ করেনি। উগলিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে। নীল আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট। হয় তার প্রবাহ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে বা দুকূল ছাপিয়ে এমন বন্যা আসবে যা কেউ কখনো দেখিনি। ফলে আমাদের ফসলের জমি ভেসে যাবে। গ্রামগুলো তলিয়ে যাবে। চারদিকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে।
ভাগ্যক্রমে আমি গতকালের উৎসর্গ অনুষ্ঠানে ছিলাম। আর মেয়েটিকে দেখেছিলাম। আজ ভোরে আমি শুনতে পেলাম, এক মেয়ে নীল নদের তীরে ঘুমিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হয় সে নীল নদ থেকে উঠে এসেছে।
উপস্থিত এক ব্যক্তি বলল, এখন আমাদের কি কর্তব্য।
বাবাজ্বী বললেন, আমি কিছু বলতে পারব না। বড় পাদ্রী তা বলতে পারবেন। আমি এখন তার নিকটই যাচ্ছি। তোমাদের কেউ আমার সাথে চল। বড় পাদ্রীই সিদ্ধান্ত দিবেন, এখন আমাদের কী করতে হবে। আমরা কি পুনরায় মেয়েটিকে নীল নদে বিসর্জন দিব, না অন্য কোন মেয়েকে বিসর্জন দিতে হবে।
তবে আমার নিকট একটি বিষয় অস্পষ্ট, বিসর্জন দেয়ার সময় তার গায়ে অনেক অলঙ্কার ছিল। কিন্তু এখন তা দেখতে পাচ্ছি না কেন! হাতের আংটিটিও দেখছি না। আমি তাকে এসব কথা এ চিন্তা করে জিজ্ঞেস করিনি, যেন সে বুঝতে না পারে, আমি তাকে উৎসর্গ করার পূর্বে দেখেছি। তাহলে হয়তো সে বুঝে ফেলবে যে, তাকে আবার নীল নদে উৎসর্গ করা হবে। আর সে পালিয়ে যাবে।
বাবাজ্বী জানতেন না যে, রোজী অন্তঃপুরে তার অলঙ্কার বের করে দেখিয়েছে। আর বলেছে, যে তাকে তার পিতামাতার নিকট পৌঁছে দিবে তাকে এ অলঙ্কার দেয়া হবে।
এক ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে বাবাজ্বী বড় পাদ্রীর নিকট গেলেন। বড় পাদ্রী অন্যগ্রামে থাকেন। গ্রামটি বেশ দূরে। তারা ঘোড়া নিয়ে রওয়ানা হল। রাত্রের ক্লান্তি এখনো দূর হয়নি রোজীর শরীর থেকে। তাই গোসল করে নতুন কাপড় পরে খাবার গ্রহণ করা মাত্র তার চোখ জুড়ে নেমে এল রাজ্যের ঘুম।
***
সূর্য অস্তমিত হতে এখনো বেশ বাকি। বাবাজ্বী ফিরে এসে শুনতে পেল, রোজী এখনো বিছানায়। বাবাজ্বী তার স্ত্রীকে নির্জনে ডেকে নিয়ে বলল, বড় পাদ্রীর নির্দেশ আজ রাতেই তাকে সেই আগের স্থানে নিয়ে গিয়ে নীল নদে বিসর্জন দিতে হবে। এবার তার হাত বেঁধে বিসর্জন দিতে হবে। যেন সাঁতরে বেঁচে যেতে না পারে।
বাবাজ্বীর স্ত্রী বলল, মেয়েটির নিকট মূল্যবান বহু অলঙ্কার আছে। সে তা লুকিয়ে রেখেছিল।
বাবাজ্বী বললেন, এখনই মেয়েটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে দাও। অলঙ্কারগুলোও পরিয়ে দিবে। এখনই তাকে নিয়ে যেতে লোকেরা চলে আসবে। যাও,আর দেরি করো না।
স্ত্রী বলল, এক্ষুণি আমি তাকে তৈরী করে আনছি। আর কত ঘুমাবে। নীল নদের কোলেই সে চির শান্তির ঘুম ঘুমাবে।
একথা বলতে বলতে সে রোজীর কামরায় প্রবেশ করল। রোজী তখন সজাগ। সে কথাগুলো শুনে ফেলল।
বাবাজ্বীর স্ত্রী বৃদ্ধা। সে রোজীকে জাগ্রত করে সাজিয়ে দিতে লাগল। রোজী জিজ্ঞেস করল, তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে? উত্তরে বৃদ্ধা মহিলা এমন কিছু কথা অসতর্কভাবে বলে ফেলল যা দ্বারা রোজী বুঝে ফেলল যে, তাকে পুনরায় নীল নদে ফেলা হবে। সে বেঁকে বসল।
বাবাজ্বীকে সংবাদ দেয়া হল, রোজীকে অনেকভাবে বুঝানো হয়েছে, ফুসলানো হয়েছে। কিন্তু সে বেঁকে বসে আছে। এবার বাবাজ্বীর আশঙ্কা হতে লাগল, যদি সাম্রাজ্যের কোন অফিসার বা কর্মচারী এ সংবাদ জানতে পারে তাহলে তাদের সবাইকে গ্রেফতার করে কয়েদখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করবে।
বাবাজ্বী বয়োবৃদ্ধ। জীবনে অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছে। ষোল ঘাটের পানি খেয়েছে। তাই সে কপট স্নেহের জাল ফেলে শিকার করতে চাইল। স্নেহে গদগদ কণ্ঠে বলল, আহা, আহা, মেয়েটি আমার যদি অলঙ্কার পরতেই না চায় তাহলে তাকে কেন তোমরা বিরক্ত করছে, তার অলঙ্কার পরার প্রয়োজন নেই। ওর অলঙ্কার ওর কাছেই থাকুক।
রোজীর কণ্ঠ একটু তীক্ষ্ণ ও শ্লেষে ভরা। বলল, এ অলঙ্কার আমার নয়। এগুলো আমি আমার কাছে রাখতেও চাই না। যার অলঙ্কার তাকে তা পৌঁছে। দিন।
সূর্য তামাটে রং ছড়িয়ে পশ্চিমাকাশে অস্তমিত হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। রোজীকে বাইরে আনা হল। সারাদিনেই চারদিকে এ গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, গতকাল এক মেয়েকে নীল নদে বিসর্জন দেয়া হয়েছিল। তাকে নীল গ্রহণ করেনি। উগলে দিয়েছে। আজ আবার তাকে বিসর্জন দেয়া হবে। নীলের বক্ষে তাকে ডুবে মরতেই হবে। অন্যথায় নীল ক্ষুব্ধ হয়ে, ধ্বংসলীলা শুরু করবে।
অনুসন্ধিৎসু জনতা সন্ধ্যার আগেই জমতে শুরু করেছে। একজন দুজন করে অনেক মানুষ সমবেত হয়েছে। এ গ্রামের সবাই মিসরী খ্রিস্টান। এরাই সাম্রাজ্যের বিধান উপেক্ষা করে ধর্মের নামে এ বিসর্জন প্রথা আঁকড়ে আছে। প্রত্যেক বৎসর গোপনে তারা এ কাজ করে। তারা রোজীকে অত্যন্ত পবিত্র ও বরকতময় মনে করে দেখতে এসেছে। তারা জানে না যে, দাগাবাজী করে, প্রতারণা করে রোজীকে নীল নদে বিসর্জন দেয়া হচ্ছে। রোজীকে বাইরে আনা হলে লোকেরা তার হাত ও জামায় চুমু খেতে থাকে।
একটু দূরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা একটু উচ্চ কণ্ঠেই বলল, ঐ তো এসে গেছে। যাকে নীলের বুকে বিসর্জন দেয়া হবে সে এসে গেছে।
এ ধরনের আরো কিছু কথা রোজী নিজ কানেই শুনল। তার দৃঢ় বিশ্বাস হয়, তাকে ধোকা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যে দুব্যক্তির হাতে বাবাজ্বী রোজীকে তুলে দিতে চায় রোজী তাদের সাথে যেতে রাজি হল না। তারা রোজীর দুই বাহু ধরে জোর করে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু রোজী শক্ত হয়ে দাঁড়াল। কিছুটা টানা হেঁচড়া হল। মানুষের মাঝে শোরগোল শুরু হল। তারা হয়তো ভিন্ন কিছু চিন্তা করেছে।
বাবাজ্বী এবার হাতের লাঠি উঁচিয়ে এগিয়ে এল। সবাই নিরব হয়ে গেল। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। বাবাজ্বী নির্দেশের সুরে বলল, একে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাও, নৌকায় তুলে মাঝ দরিয়ায় নিক্ষেপ করে এসো। দেরি করো না।
রোজী অসহায়। সে বসে পড়ল। লোক দুটি তাকে দাঁড় করাতে চেষ্টা করল। কিন্তু রোজী প্রাণপণে তাদের থেকে বাঁচতে চাচ্ছে।
***