৩. বাস্তবতার নিরিখে ৯৫%

৩. বাস্তবতার নিরিখে ৯৫% 

জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়ের একটি হচ্ছে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া এবং অনুতাপের সঙ্গে উপলব্ধি করা যে, জীবনে আপনি আরও অনেক বড় হতে পারতেন, অনেক বেশি কিছু করতে পারতেন এবং আপনার অনেক বেশি কিছু থাকতে পারত।
—Robin Sharma 

প্রতিদিন আমরা ঘুম থেকে উঠি, সেই একই চিরন্তন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হই: আমজনতার স্তর (mediocrity) পেরিয়ে আমাদের পূর্ণ সম্ভাবনার জীবনযাপন করা। মানব ইতিহাসে এটা খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জ- অজুহাত কাটিয়ে উঠা, সঠিক কাজটি করা, সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় থাকা ও আমাদের কাঙ্ক্ষিত সর্বোচ্চ স্তরের জীবনযাপন করা-এই জীবনের কোনো সীমা পরিসীমা নেই, খুব কম মানুষই এই জীবনযাপন করতে পারে। 

প্রতিদিন অধিকাংশ মানুষ এই জীবনের কাছাকাছিও যেতে পারেন না। আমাদের সমাজের প্রায় ৯৫% মানুষ তাদের আকাঙ্ক্ষার তুলনায় অনেক কম প্রাপ্তির জীবনে স্থির হয়ে যায় বা থেমে যায়। তাদের জীবনে একটা অনুতাপ থাকে যে, জীবনে যদি অনেক বেশি কিছু থাকত। কিন্তু তারা কখনো বুঝতে পারেন না যে, তারা যা যা হতে চেয়েছিলেন তা হতে পারতেন, যা করতে চেয়েছিলেন তা করতে পারতেন এবং যা যা পেতে চেয়েছিলেন তা পেতে পারতেন। 

সামাজিক নিরাপত্তা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী যদি আপনি যে কোনো ১০০ মানুষের কর্মজীবনের শুরুটা দেখেন এবং অবসর জীবনে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত তাদের পরবর্তী ৪০ বছরের জীবন লক্ষ্য করেন তাহলে আপনি দেখবেন যে, তাদের মধ্যে মাত্র ১ জন সম্পদশালী, ৪ জন আর্থিকভাবে নিরাপদ, ৫ জন তখনও কাজ করতে থাকবে বাধ্য হয়ে, ৩৬ জন মৃত এবং ৫৪ জন নিঃস্ব ও যে কারণে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও সরকারের ওপর নির্ভরশীল। 

আর্থিকভাবে বলতে গেলে আমাদের মাত্র ৫% মানুষই স্বাধীন জীবনযাপনে সফল হবে এবং বাকী ৯৫% মানুষ সারা জীবন সংগ্রাম করতে থাকবে। 

সুতরাং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর আমরা খুঁজে বের করব। আমরা শুধু জীবনের সংগ্রাম করতে করতে ফুরিয়ে যাব না, যেমনটি ঘটবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ৯৫%-এর ক্ষেত্রে। আমরা এখন কী করতে পারি এটা নিশ্চিত করতে? 

আমজনতা (mediocrity) লেভেলের উর্ধে উঠা এবং ৫%-এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া 

আপনি এই বইটি পড়ছেন যার অর্থ আমার কাছে এরকম যে, আপনি আপনার জীবনের পরবর্তী স্তরের জন্যে প্রস্তুত। আপনি কখনোই ঠিক অবস্থানে নেই যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার যা আছে, আপনি যা হতে পারেন এবং আপনি যা করতে পারেন তার চেয়ে সবকিছু কম রয়েছে। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই এটা ঘটে থাকে, এই কম পাওয়া জীবনে, আমজনতার জীবনে তারা থিতু হয়ে যায়। আমজনতা স্তরের (mediocrity) উপরে উঠতে ও শীর্ষ ৫%-এর সঙ্গে থাকতে এখানে তিনটি সাধারণ অথচ সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ রয়েছে: 

ধাপ-১: স্বীকার করুন, বাস্তবতার নিরিখে ৯৫% 

আমরা অবশ্যই অনুধাবন করব ও বাস্তবতা স্বীকার করব যে, আমাদের সমাজের ৯৫% মানুষ কখনোই তাদের আকাঙ্ক্ষার জীবনটি তৈরি করে সেরকম জীবনযাপন করবে না। আমরা এই বাস্তবতা মেনে নেব যে, যদি আমরা এখন অধিকাংশ মানুষের চেয়ে ভিন্নভাবে জীবনযাপনের চিন্তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হই তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবে যাত্রা শুরু করেছি আমজনতা (mediocrity), সংগ্রাম, ব্যর্থতা ও অনুশোচনার জীবনযাপন করতে। অধিকাংশ মানুষের জীবন এমনই। উপলব্ধি করুন, যদি আমরা এখনই এ ব্যাপারে কিছু না করি এবং আমাদের সম্ভাবনার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে আমাদের পক্ষে কী করা সম্ভব তার একটা উদাহরণ সৃষ্টি না করি তাহলে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানের জীবনে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে আমাদের নিজস্ব বন্ধুমহল ও পরিবার। 

গড়পড়তা (average) হওয়া মানে এমন জীবনে থিতু হয়ে যাওয়া, যে জীবনের সবকিছু আপনার চাওয়াপাওয়ার তুলনায় প্রকৃতপক্ষে অনেক কম এবং আপনি সারা জীবন সংগ্রাম করে কাটিয়ে দিতে প্রস্তত। প্রতিদিন, অধিকাংশ মানুষ স্থির হয়ে যায় এবং অধিকাংশ মানুষ প্রায় সব স্তরেই সংগ্রাম করে যেতে থাকে। অধিকাংশ মানুষ প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠে এবং শারীরিক, মানসিক, আবেগজনিত, সম্পর্ককেন্দ্রিক ও আর্থিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে যায়। তাদের সংগ্রাম হচ্ছে সফলতা, সুখ, ভালোবাসার পূর্ণতা, স্বাস্থ্য ও আর্থিক সমৃদ্ধির সেই স্তর তৈরি করা যা তারা প্রকৃতপক্ষে আকাঙ্ক্ষা করেন। 

নীচেরগুলো ভেবে দেখুন 

শারীরিকভাবে : স্থুলতা একটা মহামারি। ক্যান্সার ও হৃদরোগ-এর মতো ভয়াবহ মারাত্মক রোগ বেড়েই চলেছে। মানুষগুলো যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তাদের শারীরিক শক্তি যে-কোনো সময়ের চেয়ে কম। কয়েক কাপ কফি কিংবা কয়েক ঘণ্টার এনার্জি ড্রিংক ছাড়া অধিকাংশ মানুষ যেন একদিনও তাদের এনার্জি ধরে রাখতে পারে না। ওই জাতীয় পণ্যের সফলতাই বলে দেয় মানুষ কতটা শারীরিক সংগ্রামের ভেতর রয়েছে। 

মানসিক ও আবেগজনিতভাবে: হতাশা, উদ্বিগ্নতা ও অন্যান্য অসংখ্য মানসিক রোগের মোকাবেলার জন্যে প্রতিদিন মানুষকে অনেক ওষুধ সেবন করতে হচ্ছে। টেলিভিশন খুললেই এরকম ওষুধের বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে। সচরাচর দেখা যাবে যে, সুন্দর চেহারার মধ্যবয়সী এক যূগল তাদের কুকুরটি সঙ্গে নিয়ে সমুদ্র তীরে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। তখন একজন মানুষ গভীর কন্ঠে খুব ভদ্রভাবে রোগের লক্ষণ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে বলতে থাকবে: “কখনো কি আপনাকে মনে হয়েছে যে আপনি ক্লান্ত, ব্যথিত, একাকী, বিষণ্ণ, স্থুল অথবা এরকম আরও কিছু যেগুলো থেকে মুক্ত থাকতে আপনি খরচ করবেন? বেশ, তাহলেই আপনি সৌভাগ্যবান, XYZ ওষুধ আপনাকে সাহায্য করবে! 

সম্পর্কের দিক থেকে : এটা সবারই জানা যে, আমেরিকাতে বিবাহবিচ্ছেদ (divorce) এখন মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, প্রতি দুটো বিয়েতে একটা করে বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, গভীর ভালোবাসায় ডুবে থাকা যুগলদের অর্ধেক যারা বন্ধু ও পরিবারবেষ্টিত এবং একে অপরের প্রতি ভালো ও মন্দ উভয় সময়েই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে, তারাও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্যে সংগ্রাম করে। বিয়ের ৩০ বছরেরও বেশি সময় পর আমার দুজন প্রিয় ব্যক্তি, আমার মা ও বাবা সম্প্রতি বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। এখন অতি সাধারণ হয়ে যাওয়া সম্পর্কজনিত এই বিচ্ছেদের কষ্টটা আমি দেখতে পাই। 

আর্থিকভাবে : ইতিহাসের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় আমেরিকার জনগণের ব্যক্তিগত দেনার পরিমাণ এখন অনেক বেশি। অধিকাংশ মানুষ ততটা আয় করতে পারছে না যতটা তারা চায়। তারা খুব বেশি খরচ করছে, যথেষ্ট সঞ্চয় করতে পারছে না এবং আর্থিকভাবে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এটা এখন গোপন কোনো বিষয় নয় যে, অধিকাংশ মানুষ তাদের সম্ভাবনার অনেক নিচের স্তরের জীবনযাপন করছে। এটা খুঁজে বের করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো কারণে অধিকাংশ মানুষ সংগ্রাম করে কিন্ত আমজনতার (mediocrity) জীবনে স্থির হয়ে যায়। 

ধাপ-২ : আমজনতা জীবনের (Mediocrity) কারণগুলো চিহ্নিত করুন 

আমরা যখন এটা মেনে নিয়েছি যে, আমাদের সমাজের ৯৫% মানুষ তাদের সামর্থের তুলনায় অনেক কম পাওয়া জীবনে স্থির হয়ে যাচ্ছে, জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই সংগ্রাম করে যাচ্ছে কিন্ত সফলতা, সুখ ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সেই স্তরের জীবনটি পাচ্ছে না— যা তারা প্রকৃতপক্ষে চেয়ে থাকে, তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে এর কারণটি খুঁজে বের করা। এরূপ জীবনযাপন থেকে নিজেকে বাঁচাতে আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে কী কারণে গড়পড়তা মানুষেরা (average person ) আমজনতার (mediocrity) জীবনযাপন করতে করতেই ফুরিয়ে যায়। 

এদেশের ৪০-৫০ বছর বয়সের গড়পড়তা (average person) মানুষ যারা আকাঙ্ক্ষার তুলনায় কমপ্রাপ্তির জীবনে স্থির হয়েছে এবং দিন কাটাচ্ছে দৈনন্দিন বিল পরিশোধ করা ও সুখী হওয়ার সংগ্রামে। তাদেরকে যদি আপনি প্রশ্ন করেন যে, এই জীবনযাপন তাদের পরিকল্পনায় ছিল কিনা, তাদের জীবনের স্বপ্ন ছিল কিনা, তাহলে উত্তর কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন? আপনি কি মনে করেণ তারা স্বপ্ন দেখেছিল এরকম একটা সংগ্রামের জীবনের? অবশ্যই না! এবং সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার। 

যখন আমাদের সমাজের ৯৫% মানুষ তাদের আকাঙ্ক্ষার জীবনযাপন করতে পারছেন না তখন আমাদেরকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে তারা জীবনে কী ভুল করেছিলেন কিংবা কোনটা সঠিক করেননি। এটা থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে যেন আমজনতার জীবনযাপন করতে করতেই জীবনটি ফুরিয়ে না যায়। 

আমরা কেউ চাই না যে, জীবনটি একটি সংগ্রামে পরিণত হোক। আমি একটি স্বাধীন জীবন চাই। ইচ্ছামত ঘুম থেকে উঠতে চাই। আমি যা চাই তা করতে চাই— যখন চাই, যার সঙ্গে চাই। প্রতি সকালে বিছানা ছেড়ে উঠে নিজের জীবনকে ভালোবাসতে চাই। আমি আমার কাজকে ভালোবাসতে চাই। যাদের সঙ্গে আমি আমার জীবন ও কাজ শেয়ার করি তাদেরকে ভালোবাসতে চাই। এটাই আমার সফলতার সংজ্ঞা। এই ধরনের জীবন এমনি এমনি সৃষ্টি হয় না। এটার জন্যে পরিকল্পনা করতে হয়। আপনার সংজ্ঞায়িত ও পরিকল্পিত অসাধারণ জীবন যদি আপনি যাপন করতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই আমজনতা জীবনের (mediocrity) মৌলিক কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে যেন আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত জীবনকে ওসবের কবল থেকে রক্ষা করতে পারেন। 

নিচের তালিকাটি হচ্ছে সেইগুলো যা আমি আমজনতা জীবন (mediocrity) ও সম্ভাবনাময় জীবনের অপূর্ণতার (unfulfilled potential ) সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক কারণ হিসেবে মনে করি। এগুলো অনবরত আপনার জীবনে খুব বড় ও গভীর প্রভাব ফেলবে। আপনি পরাজিত হবেন না কারণ আপনি সক্ষম ও সচেতন হতে পারবেন যেন ওই ব্যাপারগুলো আপনার জীবনে না ঘটতে পারে। 

Mediocrity’র কারণসমুহ (এবং তাৎক্ষণিক সমাধানগুলো) : 

অতীতমুখীতা 

মাঝারি (mediocrity) মানের জীবনের জন্যে অন্যতম যুক্তিটিকে আমি বলি অতীতমুখীতা (Rearview Mirror Syndrome (RMS))। আমাদের অবচেতন মন সব সময় একটি অতীতমুখী সীমাবদ্ধ দৃষ্টিতে সজ্জিত। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা অনবরত অতীতে প্রবেশ করি, অতীতটি নতুনভাবে সাজাই এবং সেই অতীতেই বসবাস করি। আমরা খুব ভুলভাবে বিশ্বাস করি যে, আমরা হচ্ছি তাই যা আমরা অতীতে ছিলাম। এভাবে আমরা আমাদের বর্তমানের প্রকৃত সম্ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলি এবং এটা আমরা করি আমাদের অতীতের সীমাবদ্ধতার ওপর ভিত্তি করে। 

যার ফলে আমরা কখন ঘুম থেকে উঠব, কোন লক্ষ্য নির্ধারণ করব, আমাদের জীবনে কোনটা সম্ভব বলে ধরে নেব এসব কিছু আমরা অতীত অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধ দৃষ্টিতে বিবেচনা করি। আমরা একটি সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা করি, কিন্ত এ জীবনটা এতদিন সবসময়ে যেমন ছিল তার বাইরে কীভাবে আরও অধিক সুন্দর হতে পারে তা আমরা ভাবতে পারি না। 

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়পড়তা একজন মানুষ ৫০,০০০ থেকে ৬০,০০০ চিন্তা করে। সমস্যাটি হচ্ছে, আমাদের চিন্তার ৯৫% ভাগই হচ্ছে সেইসব একই রকম ভাবনা যেগুলো নিয়ে আমরা গতকাল এবং তার আগের দিন এবং তার আগের দিন ভেবেছি। এটা কোনো বিস্ময় নয় যে অধিকাংশ মানুষ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর একই জীবনযাপন করে এবং কখনোই জীবনযাপনের মানের পরিবর্তন করে না। 

পুরনো জীর্ণ ব্যাগের মতো আমরা আমাদের মানসিক চাপ, ভয় ও দুশ্চিন্তা গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত বহন করে চলি। যখন ভালো কোনো সুযোগ এসে হাজির হয়, আমরা আমাদের অতীত সক্ষমতা দিয়ে সে সুযোগটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। “না, আমি আগে কখনোই এরকম কোনো কিছু করিনি। আমার কখনোই ওই পর্যায়ের অর্জন ছিলনা। বাস্তবিকই, বারবার আমি ব্যর্থ হয়েছি।” 

যখন কোনো প্রতিকূল অবস্থা এসে হাজির হয়, আমরা আমাদের বিশ্বস্ত অতীত অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে তা মোকাবেলার কথা চিন্তা করি। “হ্যাঁ, আমার ভাগ্যটা এরকমই। আমার ক্ষেত্রে সব সময় এরকম বাজে ব্যপারটাই ঘটে থাকে। আমি হাল ছেড়ে দেব। পরিস্থিতি খুব কঠিন হয়ে গেলে আমি সব সময় এরকমই করেছি।” 

যদি আপনি আপনার অতীতকে ঝেড়ে ফেলে সামনে যেতে চান এবং আপনার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে অতীত চিন্তায় বসবাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আপনাকে অসীম সম্ভাবনার জীবনের কল্পনায় ডুবে যেতে হবে। দৃষ্টান্তটি মেনে নিন: আমার অতীত আমার ভবিষ্যতের সমতুল্য নয়। নিজের সঙ্গে এভাবে বোঝাপড়ায় আসুন যেন আপনার আত্মবিশ্বাসে অনুপ্রেরণা জেগে ওঠে। তখন এভাবে ভাবতে পারবেন যে, আপনার জীবনে যেকোনো কিছু শুধু সম্ভবই নয়, বরং সেরকম কোনো কিছু ঘটাতে আপনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও সক্ষম। এরকম নয় যে, প্রথমেই আপনাকে এভাবে বিশ্বাস করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, সম্ভবত আপনি এটা বিশ্বাস করবেন না। আপনার কাছে এটা অস্বস্তিকর মনে হতে পারে এবং এরূপ ভাবনা থেকে আপনি দূরে থাকতে পারেন। ঠিক আছে। যেকোনো ভাবে নিজে নিজেই বারবার চেষ্টা করুন এবং এভাবে একসময় আপনার অবচেতন মন ইতিবাচক আত্ম- কথনের (self-affirmations) সঙ্গে একাকার হয়ে যাবে। (কীভাবে এটা করতে হয় তা বিস্তারিত রয়েছে ষষ্ট অধ্যায়ে : Chapter 6: The Life S.A.V.E.R.S.) 

আপনার জীবনের চাওয়ায় কোনো অপ্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতা রাখবেন না। এব্যাপারে যেভাবে চিন্তা করছেন তার চেয়ে অনেক বড় করে ভাবুন। আপনি কী চান তা আগে স্পষ্ট করুন, নিজেকে আশ্বস্ত করুন যে এটা সম্ভব। এজন্যে আপনাকে প্রতিদিন এটাতে মনোনিবেশ করতে হবে ও ইতিবাচকভাবে ভাবতে হবে। এবং তখন একটানা ছুটে চলুন আপনার লক্ষ্যের দিকে যতক্ষণ না এটা বাস্তবে পরিণত হয়। ভয়ের কিছু নেই কারণ আপনি ব্যর্থ হতে পারেন না। শিখুন, বিকশিত হোন এবং আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো অবস্থানে থাকুন। 

সব সময় স্মরণে রাখুন, আপনি এখন যে অবস্থানে রয়েছেন এটা অতীতে আপনি যা ছিলেন তারই একটা ফল। কিন্ত কোন অবস্থানে আপনি থাকবেন তা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে এখন থেকে আপনি কোন ব্যক্তিটি হওয়ার জন্যে মন স্থির করেছেন বা কোন জীবন বেছে নিয়েছেন তার ওপর। 

উদ্দেশ্যের অভাব 

আপনি যদি গড় (average) মানুষকে জিজ্ঞাসা করেন- তাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী, তারা আপনার দিকে কিছুটা হালকা রসাত্মকভাবে তাকাবে অথবা এরকম উত্তর করবে যে, “ঠিক জানি না”। কেমন হবে যদি আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করি? আপনি কেমন উত্তর করবেন? গড়পড়তার মানুষেরা ( average person ) তাদের জীবনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে বলতে পারে না। একটা বাধ্যতামূলক “কারণ” তাদেরকে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠায় এবং তারা সে অনুযায়ী কাজ করে জীবনের উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে। 

সাধারণ মানুষেরা একটা দিনকেই সারাজীবনের সব দিন মনে করেন এবং শুধু জীবনধারণ ছাড়া জীবনের বড় কোনো উদ্দেশ্য তাদের থাকে না। অধিকাংশ মানুষ শুধুমাত্র দিনটি কাটাতে মনোনিবেশ করেন, কোনো বাধাবিপত্তিতে পড়তে চান না এবং খুঁজতে থাকেন স্বল্পকালীন ও স্বল্পমেয়াদী আনন্দসমূহ। অন্যদিকে জীবনে বড় হওয়ার পথে যে কষ্ট ও অস্বস্তি থাকে তা তারা এড়িয়ে চলেন। 

জীবনের সাতটি বছর আমি সরাসরি বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমি এতটা সফল হয়েছিলাম যে, বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আমি কম্পানির অনেক রেকর্ড ভাঙতে সক্ষম হয়েছিলাম। এরূপ সফলতা সত্ত্বেও ওই সাত বছরের প্রথম ছয় বছর আমি সংগ্রাম করেছিলাম সাধারণ মানের (mediocrity) জীবন কাটিয়ে উঠতে। আমি ধারাবাহিক কোনো ফল পাচ্ছিলাম না এবং আমি একটানা আমার সর্বোচ্চ প্রাপ্তির তুলনায় অনেক কম গ্রহণ করছিলাম। অবশেষে গড়পড়তা জীবন (mediocrity) অতিক্রমের গোপন সূত্রটি পেয়ে গেলাম : উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবন যাপন করুন। 

কোম্পানিতে সুখ্যাতি পাওয়ার পর, আমার জন্যে তখন উপযুক্ত সময় ছিল আমার স্বপ্নপূরণের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া: লেখক, পেশাজীবী বক্তা কিংবা প্রশিক্ষক হওয়া। যাহোক, কম্পানিতে আমি কখনো আমার পূর্ণ সম্ভাবনার সফলতা অর্জন করতে পারিনি। আমি মধ্যমানের (mediocrity) তকমা নিয়ে প্রায় কম্পানিটি ছেড়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এটা নিশ্চিত ছিল যে, এ অবস্থায় কম্পানিটি ছেড়ে আসলে আমার পরবর্তী উদ্যোগেও এর একটা প্রভাব থাকবে যদি আমি এ অবস্থার পরিবর্তন না করি। 

ততক্ষণ পর্যন্ত, আমার জীবনে একান্ত বাধ্যকর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না যা আমাকে সকালে ঘুম থেকে উঠাবে, এমনকি আমি না উঠতে চাইলেও। কোনো কিছুতেই আমার সুস্পষ্ট, নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য ছিলনা। এমন সময় আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, পরবর্তী বারো মাসের জন্যে আমার জীবনের উদ্দেশ্য হবে: সেই ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া যে ব্যক্তিটি হওয়া আমার জন্যে প্রয়োজন। এটা প্রয়োজন সফলতা, স্বাধীনতা ও যে মানের জীবন আমি চাই সেজন্যে। আমার জীবনের অন্যান্য উদ্দেশ্যের সঙ্গে আমি আরেকটা উদ্দেশ্য একত্রিত করেছিলাম (আপনার জীবনেও একাধিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে)। এটা ছিল নিঃস্বার্থভাবে অন্যের জীবনমান উন্নয়ন করা। এজন্যে ষোলো সদস্যের একটি বিক্রয় প্রতিনিধি দলকে আমি একত্রিত করেছিলাম। প্রতি সপ্তাহে কোনো অর্থ ছাড়াই একটি কনফারেন্স প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিলাম যেন তারা সহজে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। আমি পরপর ছেচল্লিশ সপ্তাহ এটা করেছিলাম। 

আমার জীবনের দুটো উদ্দ্যেশ্যের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলাম। আমি একটানা খুব সচেতনভাবে আমার প্রতিটি উদ্দেশ্যের সঙ্গে আমার চিন্তা, কথা ও কাজ এক সুতায় বেঁধে ফেলেছিলাম। বিস্ময়করভাবে সেবছরটি আমার জন্যে শুধু সর্বোচ্চ বিক্রয়ের বছর ছিল না, আমি অন্যান্য বিক্রয় প্রতিনিধিদেরও কম্পানির পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস ভেঙে সেরা সফলতা এনে দিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। 

তাই, যে কারণে জীবন গড়পড়তা মানের (mediocrity) হয়ে যায় তা প্রতিহত করতে হলে আপনার প্রয়োজন উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবন। সে উদ্দেশ্য হতে পারে আপনার চাওয়া যে কোনো কিছু। এটা হতে পারে এমনকিছু, যা আপনাকে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেবে এবং সব সময় আপনাকে আপনার উদ্দেশ্যের সঙ্গে ধরে রাখবে। আপনার এ উদ্দেশ্য খুব বড় ও অসাধারণ হতে হবে এমন নয়। আপনি অতি সাধারণ কিছু থেকে শুরু করতে পারেন। এটা হবে আপনার উদ্দেশ্যপূর্ণ বড় এক জীবনের প্রথম পদক্ষেপ। 

এটা মনে রাখুন, আপনি যে কোনো সময় আপনার জীবনের উদ্দেশ্য পরিবর্তন করতে পারেন। বড় ও বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার জীবনের উদ্দেশ্যও পাল্টে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনাকে একটি উদ্দেশ্য বেছে নিতে হবে— যে কোনো উদ্দেশ্য এবং এখন থেকেই এটাকে কেন্দ্র করে জীবনযাপন শুরু করতে হবে। 

মনে রাখুন এমনটি নয় যে, আপনি আপনার উদ্দেশ্যটি খুঁজে বের করবেন। আপনাকে এটা তৈরি করতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কী হতে চান। Matthew Kelly তাঁর বেস্টসেলিং বই The Rhythm of Life-এ আমাদের সামনে জীবনের একটি সার্বজনীন উদ্দেশ্য আলোকপাত করেছেন, যা আমি মনে করি আমাদের সবারই বেঁচে থাকার মূল উদ্দেশ্য : আমাদের সর্বোত্তমটি হওয়া (to become the best version of ourselves )। অন্য কথায়, মনোবিশে করুন কিভাবে বিকশিত হওয়া যায় এবং কতটা সেরা আপনি হতে পারেন, অনুসন্ধান করুন আপনার স্বপ্নের এবং অন্যদেরকেও একই কাজ করতে অনুপ্রাণিত করুন। এটাই আপনার উদ্দেশ্য। 

আপনার জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভাবনা এবং তা প্রকাশ করার জন্যে এই সপ্তাহে কিছু সময় নির্ধারণ করুন। এটা লিখে সেরকম একটি জায়গায় রাখুন যেন প্রতিদিন দেখতে পারেন। আসলে, আপনি যখন Miracle Morning চর্চা করবেন তখন এটা করতে আপনি সময় পাবেন। সব সময় মনে রাখুন যে, যখন আপনি আপনার জীবনের উদ্দ্যেশ্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তা যখন আপনার সমস্যাগুলোর চেয়ে অনেক বড় কিছু, তখন আপনার সমস্যাগুলো আপেক্ষিকভাবে তাৎপর্যহীন এবং আপনি খুব সহজেই সেগুলো অতিক্রম করবেন। 

বিচ্ছিন্ন ঘটনাসমূহ 

খুব স্পষ্টভাবে বোঝা না গেলেও, সাধারণ মানের জীবনের (mediocrity) অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে বিচ্ছিন্ন কাজসমূহ (isolating incidents)। আমরা এটা করে থাকি যখন আমরা ভুল করে মনে করি যে, আমাদের প্রতিটি পছন্দ ও প্রতিটি একক কাজ যা আমরা করে থাকি তার প্রভাব শুধুমাত্র সেই সুনির্দিষ্ট বিশেষ মুহূর্তে ও পরিস্থিতিতে সীমাবদ্ধ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি ভাবতে পারেন যে, একদিন শরীরচর্চা না করা কোনো বড় বিষয় নয়, একটি প্রকল্পে বিলম্ব করাও তেমন কিছু নয়, অথবা একদিন ফাস্টফুড খাওয়াটাও কোনো ব্যাপার না কারণ আগামীকাল আপনি নতুনভাবে শুরু করবেন। আপনার এটা একটা ভুল ধারণা যে, একদিনের একটি কাজ না করা শুধুমাত্র সেই বিশেষ কাজটিকেই প্রভাবিত করে এবং পরবর্তীকালে আপনি উত্তমভাবে সবকিছু করবেন। 

আমরা অবশ্যই উপলব্ধি করব যে, আমাদের প্রতিটি পছন্দ ও কাজের এবং এমনকি চিন্তার প্রকৃত প্রভাব ও ফলাফলই একটা স্থায়ীত্ব পেয়ে যায়। কারণ প্রতিটি একক চিন্তা, পছন্দ ও কাজ নির্ধারণ করে দিচ্ছে আমরা কোন মানুষ হতে যাচ্ছি, যা অবশেষে আমাদের মান কেমন তা নির্ধারণ করবে। যেমন T. Harv Eker তাঁর বেস্টসেলিং বই Secrets of the Millionaire Mind-এ বলেছেন, “অপনি যে কোনো কাজ যেভাবে করেন, সব কাজই সেভাবে করেন।” 

সঠিক কাজটি করার পরিবর্তে সব সময় যদি আপনি সহজ কাজটি করেন তাহলে আপনি আপনার পরিচয়টি তুলে ধরছেন, সেই ধরনের একজন মানুষ হয়ে যাচ্ছেন— যে সহজ কাজটিই করে, সঠিকটি নয়। 

অন্যদিকে, যখন আপনি সঠিক কাজটি করেন এবং আপনার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে থাকেন— তখন আপনার জীবনে অসাধারণ শৃঙ্খলার উন্নয়ন ঘটে (যা অধিকাংশ মানুষের জীবনে ঘটে না)। আপনার জীবনে অসাধারণ ফলাফল সৃষ্টির জন্যে এরূপ শৃঙ্খলা প্রয়োজন। আমার প্রিয় বন্ধু Peter Voogd প্রায়ই তাঁর ক্লায়েন্টদের এই শিক্ষাটি দিয়ে থাকেন : “শৃঙ্খলা সৃষ্টি করে লাইফস্টাইল।” (“Discipline creates lifestyle.”) 

উদাহরণস্বরূপ, যখন অ্যালার্ম ঘড়ি বেজে ওঠে এবং আমরা সুজ বাটনটি চাপি (এটা সহজ কাজ), অধিকাংশ মানুষ মনে করে যে, এই কাজটা শুধুমাত্র তাদের বর্তমান সময়কে প্রভাবিত করছে। বাস্তবতাটি হচ্ছে এই যে, এ ধরনের কাজ আমাদের অবচেতন মনে একটি প্রোগ্রামিং করে ফেলছে। সেখানে এই নির্দেশনা থাকছে যে, যে কাজটি আমরা করতে চেয়েছিলাম অথচ সে পথ অনুসরণ করিনি বা কাজটা করিনি তা ঠিক আছে। (এ ব্যাপারে বিস্তারিত পরবর্তী চ্যাপ্টারে: আপনি কেন আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেছিলেন?) 

আমরা অবশ্যই আমাদের উদ্দেশ্যের বাইরে বিচ্ছিন্ন কাজ করা থেকে বিরত থাকব এবং জীবনের বড় চিত্রটি দেখা শুরু করব। এটা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করুন যে, প্রতিটি কাজ যা আমরা করি তা প্রভাবিত করে আগামী দিনের মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায়। এটা আমাদেরকে সেই জীবনটি নির্ধারণ করে দেবে অবশেষে যে জীবনটি আমরা তৈরি করে নেব ও যে জীবনযাপন করব। যখন আপনি জীবনের বড় কোনো চিত্র দেখতে পারেন আপনি তখন সময়ের প্রতি খুবই সিরিয়াস হয়ে যাবেন। অ্যালার্ম ঘড়ির সঙ্গে সঙ্গে আপনি যদি আবারও ঘুমিয়ে পড়তে প্রলুব্ধ হন, তাহলে আপনি এরকম ভাবতে শুরু করুন যে, “আমি এরকম মানুষ হতে চাইনে যার সকালে বিছানা থেকে উঠার মতো শৃঙ্খলাও নেই। আমি এক্ষুণি উঠব, কারণ আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ (সকালে ওঠা, লক্ষ্যে স্থির থাকা, আমার স্বপ্নের জীবন সৃষ্টি করা ইত্যাদি’।) 

জবাবদিহিতার অভাব 

সফলতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে একটি অকাট্য যোগসূত্র রয়েছে। বস্তুত সকল উচ্চ স্তরের সফল ব্যক্তিরা, প্রধান নির্বাহী থেকে শুরু করে পেশাজীবী ক্রীড়াবিদ, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, সবাইকেই ব্যাপক জবাবদিহিতার ভেতর থাকতে হয়। এটা তাদেরকে উৎসাহ দেয় যার ফলে তারা ব্যবস্থা নিতে ও ফলাফল বের করতে পারেন। জবাবদিহিতা না থাকলে আমরা দেখবো, ক্রীড়াবিদরা অনুশীলন এড়িয়ে চলছেন এবং প্রধান নির্বাহীরা তাদের দিন অতিবাহিত করছেন iPhone- এ বিভিন্ন মজাদার প্রোগ্রামের সঙ্গে। আমি নিশ্চিত যে অনেকেই এটা করছেন। 

জবাবদিহিতা হচ্ছে কোনো ব্যক্তির কাছে, অথবা কোনো কাজ বা ফলাফলের জন্যে দায়ী থাকার অবস্থা। যে কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছাড়া এই পৃথিবীতে অথবা আপনার জীবনে খুব সামান্য কিছুই ঘটে থাকে। বস্তুত, প্রতিটি ইতিবাচক ফলাফল যা আপনি ও আমি আমাদের জন্ম থেকে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত করতে পেরেছিলাম তার জন্যে আমাদের বড়দের (পিতামাত, শিক্ষক, বড় ভাই ইত্যাদি) সঙ্গে আমাদের জবাবদিহিতার একটা ব্যাপার ছিল। সব্জি খাওয়া হতো, হোমওয়ার্ক সম্পন্ন হতো, দাঁত ব্রাশ করা হতো, আমরা গোছল করতাম ও সঠিক সময়ে ঘুমাতে যেতাম। আমাদের পিতামাতা ও শিক্ষকদের সঙ্গে এসব ব্যাপারে যদি জবাবদিহিতার কোনো বিষয় না থাকত তাহলে আমরা হতাম অশিক্ষিত, অপুষ্ট, নিদ্রাহীন নোংরা ছোট শিশু! 

জবাবদিহিতা আমাদের জীবনে শৃঙ্খলা এনেছে। উন্নতি, অগ্রগতি এবং সেইসঙ্গে যা কিছু আমরা অর্জন করেছি তা জবাবদিহিতা ছাড়া সম্ভব ছিল না। তবে জবাবদিহিতা এমন একটা জিনিস যা আমরা কখনোই চাইনি; বরং শিশু, কিশোর ও তরুণ হিসেবে আমাদেরকে সব সময় ওটা মেনে চলতে হয়েছে। যেহেতু বয়স্করা আমাদের ওপর এটা চাপিয়ে দিতেন, আমাদের অধিকাংশ‍ই অবচেতনভাবে জবাবদিহিতার প্রতি বিরূপ ছিলাম ও এড়িয়ে চলতাম। তারপর, যখন আমাদের বয়স ১৮ হলো, আমরা যতটুকু স্বাধীনতা পেতাম সবটুকুই উপভোগ করতাম, জবাবদিহিতা এড়িয়ে চলতাম যেন ওটা ছিল প্লেগ-এর মতো একটা রোগ। এই ভাবনাটা আমাদেরকে স্থায়ীভাবে নামিয়ে দেয় আমজনতা (mediocrity) পর্যায়ে। এর ফলে অলসতা, দায়িত্বহীনতা ও সবকিছু short cut পদ্ধতিতে করার মতো ক্ষতিকারক মানসিকতা ও অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়। এগুলো সবই সফলতার অন্তরায়। 

এখন আমরা সবাই যেহেতু বড় হয়েছি এবং যথাযথ সফলতা ও পূর্ণতা অর্জনের জন্যে সংগ্রাম করছি, আমাদেরকে অবশ্যই দায়িত্ববান হতে হবে আমাদের নিজস্ব জবাবদিহিতার ব্যবস্থার জন্যে। এই ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে একজন পেশাজীবি প্রশিক্ষক, মেন্টর, এমনকি একজন ভালো বন্ধু কিংবা পরিবারের সদস্য। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, পরিসংখ্যানে দেখা যায় ৯৫% মানুষ যে কোনো বই থেকে যা শেখে তা কাজে লাগায় না। কারণ কেউ তাদেরকে এ ব্যাপারে জবাবদিহিতার ভেতর রাখে না। এ অবস্থার পরিবর্তনের একটা পথ আছে। 

[জোরালো সুপারিশ] জবাবদিহিতার একজন সঙ্গী নিন (সহযোদ্ধা)

আপনার জীবনে কখনো কি এমন কোনো দিন এসেছে যেদিন আপনি ব্যায়াম করতে কিংবা জিম-এ যেতে চেয়েছিলেন অথচ যাননি কারণ যাওয়ার ইচ্ছাটা অনুভব করেননি? নিশ্চয়, আমাদের সবার জীবনে ওরকম দিন আছে। কিন্তু কেমন হতো যদি কেউ একজন আপনার জিম-এ কিংবা ব্যায়াম করতে যাওয়াটা হিসাব রাখছে এবং প্রতিদিন এজন্যে তার সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ করতে হচ্ছে? কারো কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে এরকম হলে নিশ্চয় আপনি নিয়ম ভঙ্গ করতেন না। 

আমি আপনাকে খুব দৃঢ়ভাবে বলছি যে, এই বইটি পড়তে পড়তে একজন জবাবদিহি অংশিদারের সঙ্গে একত্রে কাজ করুন। তিনি হতে পারেন আপনার বন্ধু, সহকর্মী অথবা পরিবারের সদস্য যার সঙ্গে আপনি MiracleMorning.com পাঠানোর মাধ্যমে The Miracle Morning শেয়ার করতে পারেন যেন সে Miracle Morning “Crash Course”টি পেতে পারে (এই বইয়ের দুটো অধ্যায় এবং সেই সঙ্গে The Miracle Morning-এর ভিডিও ও অডিও প্রোগ্রাম)। এভাবে, আপনি কোনো একজনকে পাবেন যে নিজেও তার জীবনকে পরবর্তী স্তরে নেওয়ার জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আপনারা দুজন একে অপরকে সমর্থন করবেন, উৎসাহ দেবেন এবং পরস্পরের কাছে জবাবদিহি করবেন। 

এমনকি আপনি এব্যাপারে আপনার ফেসবুক ওয়ালে অহবান করে পোস্ট দিতে পারেন। ব্যাপক সহযোগিতামূলক সদস্যসমৃদ্ধ The Miracle Morning Community at www.My TMMCommunity.com.-এও আপনি এ আহবান করতে পারেন। আপনি এরকম একটি পোস্ট দিতে পারেন: “আমি এমন কাউকে খুঁজছি যে The Miracle Morning 30-day Life Transformation Challenge-এর জন্যে আমার Accountability Partner হয়ে জীবনের উন্নয়ন ঘটাতে চায়। চেক করুন www.Miracle Morning.com এবং আগ্রহী হলে আমাকে জানান।” এটা মাথায় রাখুন যে, এই ধরনের পোস্ট- এ যিনি সাড়া দেবেন তিনি সেই ধরনের ব্যক্তি যাকে আপনি আপনার সার্কেলটির জন্যে পেতে চান। আমি আপনাকে তাগিদ দেব, আপনার একজন বন্ধুকে কল, মেসেজ ও ই-মেইল করতে আপনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবেন, আপনার মিরাকল মর্নিং জার্নিতে তাদেরকে আহবান করবেন। বইটি তাদেরকে পড়তে বলবেন এবং তাদেরকে আহবান করবেন যে, The Miracle Morning 30-day Life Transformation Challenge -এ তারা যেন আপনার Accountability Partner হয়। এই বইয়ের দশম অধ্যায়ে এটা রয়েছে। অথবা The Miracle Morning Community at www.My TMMCommunity.com-এ ভিজিট করে অন্যান্য ’মিরাকল মেকার্স’দের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আপনার আদর্শ Accountability Partner পেয়ে যেতে পারেন। 

প্রভাবময় আমজনতা সঙ্গ 

গবেষণায় দেখা গেছে যে, আমরা যে পাঁচজন মানুষের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় কাটাই, তাদের গড় করলে আমাদের অবস্থান পাওয়া যায়। আপনি কাদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন সে ব্যাপারটিই হতে পারে আপনি কেমন মানুষ হয়ে উঠছেন তার একক নির্ধারণী ফ্যাক্টর। আপনার জীবনের মানও (quality of life) এভাবে নির্ধারিত হয়। যদি আপনি দুর্বল মনের অলস ও অজুহাত তৈরি করা মানুষ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন, অনিবার্যভাবে আপনি তাদের মতোই হয়ে যাবেন। ইতিবাচক ও সফল মানুষদের সঙ্গে সময় কাটান, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সফলতার অভ্যাসগুলো অনিবার্যভাবে আপনার ভেতর প্রতিফলিত হবে। আপানিও তাদের মতো হয়ে উঠবেন। 

জীবনের সব ক্ষেত্রেই এটা সত্য। সফলতা, স্বাস্থ্য, সুখ, উপার্জন যাই হোক না কেন। যদি আপনার সব বন্ধুই সুখী ও আশাবাদী মানুষ হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আপনি শুধুমাত্র তাদের সংস্পর্শে থাকার কারণেই অধিক সুখী ও আশাবাদী হয়ে উঠবেন। যদি আপনার সকল বন্ধুই সফল মানুষ হয়ে থাকে, যদি তারা বছরে কয়েক লক্ষ টাকার বেশি উপার্জন করে, সেক্ষেত্রে এমনকি অনেক কম আয় থাকা সত্ত্বেও যদি আপনি তাদের সার্কেলে প্রবেশ করেন তাহলে তাদের চিন্তাধারার সঙ্গে মিশে আপনিও উপরে উঠে যাবেন এবং সেই সঙ্গে সফলতার পথে তারা জীবনে যে অভ্যাসসমূহ গঠন করেছেন সেসবে আপনিও প্রভাবিত হয়ে যাবেন। 

অন্যদিকে, আপনি যাদের সঙ্গে উঠাবসা করেন তাদের অধিকাংশ‍ই যদি সবসময় অভিযোগ করতে থাকে এবং তারা যদি জীবনের নেতিবাচক দিক নিয়েই পড়ে থাকে, আপনিও তেমনই হয়ে যাবেন। আপনার বন্ধুরা যদি তাদের জীবনের উন্নয়নের জন্যে সংগ্রাম না করে, অথবা তারা যদি আর্থিক সংগ্রামে লিপ্ত থাকে, তাহলে তারা আপনাকে কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে কিংবা জীবনে ভালো কিছু করতে অনুপ্রাণিত করবে না। 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক মানুষ আছে যারা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু তাদের চারপাশের মানুষগুলো তাদেরকে পিছনে টেনে নিয়ে যায়। এটা বিশেষভাবে কঠিন হয়ে যায় যখন ওই মানুষগুলো আপনারই পরিবারের সদস্য। আপনাকে অবশ্যই শক্তিমান হতে হবে এবং এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, ওইসব মানুষদের সঙ্গে আপনি খুবই কম সময় কাটাবেন যারা আপনাকে নিজের সর্বোচ্চ ভালোটা হতে উৎসাহিত করে না ও চ্যালেঞ্জ নিতে বলে না। 

খুঁজে বের করুন সেই মানুষদের যারা আপনাকে বিশ্বাস করে, প্রশংসা করে এবং আপনার জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে আপনাকে সাহায্য করে। আপনি অবশ্যই এরূপ মানুষদের খুঁজে পেতে তৎপর হবেন যাদের প্রভাবে আপনার সার্কেলের উন্নয়ন ঘটবে। এসব মানুষদের ঘটনাক্রমে সামনে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এখানে কয়েকটি উপায় রয়েছে, আপনি অনুসরণ করতে পারেন: 

■ Meetup.com এর মতো অনলাইন কম্যুনিটিতে আপনি যুক্ত হতে পারেন। সেখানে আপনি সংযুক্ত হতে পারেন আপনার এলাকার সমমনা মানুষদের সঙ্গে যাদের আপনার মতো একই রকম আগ্রহ রয়েছে। আপনি বিদ্যমান কোনো Meet up group -এ যুক্ত হতে পারেন অথবা নিজেও একটা গ্রুপ তৈরি করে নিতে পারেন। 

§ যদি আপনি ব্যবসায়ী কিংবা পেশাজীবী হন এবং কোনো পণ্য বাজারজাত করেন অথবা সেবা দিয়ে থাকেন, আপনি business networking and referral marketing গ্রুপে সংযুক্ত হতে পারেন। সবচেয়ে বড় গ্রুপটি হচ্ছে BNI (www.bni.com.)। দীর্ঘদিন যাবৎ আমি BNI-এর সদস্য ছিলাম। এটা আমার ব্যবসায়ের প্রসার ঘটাতে সাহায্য করেছিল এবং আমি সব সময় অন্যদেরকে এটার জন্যে সুপারিশ করে থাকি। 

■ যদি আপনি একজন ছাত্র হয়ে থাকেন— হাইস্কুল, জুনিয়র স্কুল কিংবা প্রাথমিকের ছাত্র- আমি খুব জোরালোভাবে বলব যে আপনি Boys & Girls Clubs of America-তে যুক্ত হওয়ার চিন্তা করুন। www.bgca.org-এ তাদের স্থানীয় ৪,০০০ ক্লাব রয়েছে। সফলতার পথে যুক্ত হতে তরুণদের জন্যে এটা অন্যতম সেরা সংগঠন। তাদের মিশন হচ্ছে: সব তরুণকে সক্ষম করে তোলা যেন তারা উৎপাদনমুখী, যত্নশীল, দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারে। এই সংগঠনের প্রাক্তন ক্লাব সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন Denzel Washington, Adam Sandler, Jennifer Lopez, and Shaquille O’Neal.। সফল হওয়ার জন্যে তাদেরকে অনুসরণ করা নিশ্চয় কোনো খারাপ পদক্ষেপ নয়। 

■ যেমনটি আমি বলেছি, আমাদের রয়েছে খুবই ব্যতিক্রমী ইতিবাচক, সহযোগিতামূলক ব্যাপক সক্রিয় একটি গোষ্ঠি যেখানে আপনি www.MyTMMCommunity.com. সাইটে যুক্ত হতে পারেন। সেখানে আপনি সব ধরনের মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবেন ও নেটওয়ার্কিং করতে পারবেন। নির্বাহী কর্মকর্তা ও উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে ছাত্র ও ঘরে থাকা মায়েরা সবাই সেখানে রয়েছে। 

এটা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে “দুঃখকষ্ট সঙ্গ ভালোবাসে”। কথাটা অতিসাধারণ মানের জীবনের (mediocrity) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অন্যের ভয়, নিরাপত্তাহীনতা ও সীমাবদ্ধ বিশ্বাস যেন আপনার পক্ষে সম্ভব এমন কোনোকিছুকে সীমাবদ্ধ করতে না পারে। অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি যা আপনি করবেন তা হচ্ছে সক্রিয় ও একটানা আপনার প্রভাব সৃষ্টিকারী বৃত্তের উন্নয়ন ঘটানো। ক্রমাগত আপনার বৃত্তে সেইসব মানুষদের সংখ্যা বাড়াতে থাকবেন যাদের সংস্পর্শ আপনাকে টেনে তুলবে। সব সময় সেই মানুষদের খুঁজুন যারা আপনার জীবনের মূল্য বাড়িয়ে দেবে এবং আপনার ভিতরের সর্বোত্তমটা বের করে আনবে। এবং অবশ্যই, আপনি নিজেও অন্যের জন্যে সেই মানুষটি হোন! 

এটা অন্য আরেকটা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার একটা প্রতিশ্রুতি থাকবে যে আপনি আপনার একজন বন্ধুকে আহবান করবেন, অথবা আপনার সহকর্মী কিংবা পরিবারের সদস্যকে যিনি আপনার জবাবাদিহিতা অংশীদার বা সহযোদ্ধা (Accountability Partner) হয়ে আপনার সঙ্গে Miracle Morning অনুসরণ করবেন। আপনি সেই ব্যক্তির জীবনের মূল্য বাড়িয়ে দিতে থাকবেন তাদের আত্মউন্নয়নের স্তর বাড়াতে সহযোগিতা করার মাধ্যমে। বিনিময়ে এক সময় তারা হয়ে যাবে আপনার জন্যে খুব ভালো প্রভাবসৃষ্টিকারী সঙ্গ। 

ব্যক্তিগতগত উন্নতির অভাব 

Jim Rohn আমার জীবনে অন্যতম একজন সেরা মেন্টর। তার কাছ থেকে আমি জীবন পাল্টানো অনেক দর্শন শিখেছি। আমার মতে, এর চেয়ে বড় কোনো ধারণা নেই যে, আমাদের সফলতার স্তর খুব কমই আমাদের ব্যক্তিগত উন্নতির স্তর অতিক্রম করতে পারে, কারণ সফলতা এমন একটা জিনিস যা আমরা জীবনে উন্নতির একটা পর্যায়ে পৌঁছে তবেই তাতে আকৃষ্ট হই। অন্য কথায়, আপনার জীবনের সব ক্ষেত্রে আপনার সফলতার স্তর খুব কমই আপনার ব্যক্তিগত উন্নতির স্তর (আপনার জ্ঞান, দক্ষতা, বিশ্বাস, অভ্যাস ইত্যাদি) অতিক্রম করবে এবং সাধারণত তা সমান (parallel) হবে। 

এ সম্পর্কে আগে কিছুটা বলা হয়েছে, আমরা এখন আবার পরখ করে দেখতে পারি। যদি আপনি এবং আমরা আমাদের জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে (স্বাস্থ্য, অর্থ, সম্পর্ক, ইত্যাদি) এক থেকে দশ স্কেলে সফলতার পরিমাপ করি, আমরা সবাই চাই “Level 1(0)” সফলতা, আপনি একমত? ঠিক আছে, খুব ভালো। 

এখন সমস্যাটি হচ্ছে আমরা অধিকাংশই সেই “Level 10” স্তরে উন্নীত হওয়ার জন্যে প্রতিদিন যে পরিমাণ সময় বিনিয়োগ করা দরকার তা করছি না। সফলতার যে স্তর আমরা আকাঙ্ক্ষা করি সে স্তনে পৌঁছানোর জন্যে এবং তা ধরে রাখার জন্যে সার্বিক সক্ষমতা সৃষ্টিতে আমরা সময় ব্যয় করছি না। যার ফলে স্বাস্থ্য, সুখ, শক্তি (এনার্জি), ভালোবাসা, ব্যক্তিগত ও পেশাগত সফলতা এসব আমরা যে স্তরের চাই সে স্তরে পৌঁছাতে পারি না, আমাদেরকে সংগ্রামের পর্যায়েই থেকে যেতে হয়। 

The Miracle Morning 30-Day Life Transformation Challenge (in Chapter 10) প্রক্রিয়ায় আপনি প্রবেশ করতে পারবেন The Miracle Morning 30 – Day Life Transformation Challenge “Fast- Start Kit” -এ যেখানে আপনি পরিচালিত হবেন জ্ঞানভিত্তিক ও অবিশ্বাস্য একটি মজার প্রক্রিয়ায়। সে প্রক্রিয়ায় আপনি প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনার সফলতা মুল্যায়ন করতে পারবেন। তখন একটি উঁচু স্তরের স্বচ্ছতা ও আত্মসচেতনতা অর্জনের পর, আপনি আপনার জীবনের সব ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে “Level 10” ভিশন দেখতে সক্ষম হবেন! তারপর আপনার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্যে আপনার “Next Level” লক্ষ্যসমূহ স্থির করা সম্ভব হবে। এর ফলে আপনি তাৎক্ষণিকভাবে আপনার Level 10 ভিশনে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করতে পারবেন। 

অতি অসাধারণ জীবন যা আপনি কল্পনা করে থাকেন তা এখন আপনার সামনেই। আপনার অতীতে কী ঘটেছে তা কোনো ব্যপারই না। শুধু আপনাকে বিকশিত হয়ে সেই ব্যক্তিতে পরিণত হতে হবে যে সহজে সক্ষম হবে আপনার স্বপ্নের সেই জীবন আকর্ষণ করতে, সৃষ্টি করতে এবং যাপন করতে। 

The Miracle Morning আপনাকে সক্ষম করে তুলবে সেই Level 10 পার্সন হতে, যা হওয়া আপনার প্রয়োজন। প্রয়োজনটা এই জন্যে যে, আপনি যেন আপনার জীবনের সকল ক্ষেত্রে খুব সহজে ও একটানাভাবে Level 10 সফলতা আকৃষ্ট করতে পারেন, সৃষ্টি করতে পারেন ও ধরে রাখতে পারেন। 

সব সময় মনে রাখুন যে, যদি আমরা ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্যে সময় করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদেরকে বাধ্য হয়ে কষ্ট ও সংগ্রামের জন্যে সময় বের করতে হয়। The Miracle Morning আপনাকে অসাধারণ ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্যে সেই সময়টি দেবে। 

জোরালো তাগিদ না থাকা 

যুক্তিসঙ্গতভাবে বলা যায়, মধ্যমানের জীবনের (mediocrity ) ও সেইসঙ্গে সম্ভাবনা অপূর্ণ থেকে যাওয়ার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কারণটি হচ্ছে, নিজেদের জীবনকে উন্নত করার জন্যে কোনো তাড়া (urgency) ও সেই জাতীয় বোধ অধিকাংশ মানুষের থাকে না। এই ব্যাপারটাই আমাদের সমাজের ৯৫% মানুষকে বিরত রাখে তাদের প্রকৃত চাওয়া জীবন তৈরি করে নিয়ে সেরূপ জীবনযাপন করতে। মানব প্রকৃতি এরকম যে ’কোনো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে’ এরূপ ভাবনা চিন্তার সঙ্গে মিশে থাকে। সে চিন্তা করে যে, ‘জীবনের সবকিছু এক সময় এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে’। প্রত্যেকের জীবনে এটা কীভাবে কাজ করছে? 

এই ‘কোনো একদিন হয়ে যাবে’ মানসিকতাটা চিরস্থায়ী হয়ে যায় এবং এটা নিয়ে আসে কালক্ষেপণ, সম্ভাবনার মৃত্যু ও পরিতাপের জীবন। এ অবস্থা চলতে চলতে কোনো এক দিন ঘুম থেকে উঠে আপনি বিস্মিত হয়ে ভাবেন যে, জীবনটাকে আপনি কীভাবে অপচয় করে ফেলেছেন; কীভাবে আপনার জীবন এভাবে শেষ হয়ে গেল? কীভাবে আপনি এভাবে শেষ হলেন? 

জীবনের অন্যতম একটা কষ্টের বিষয় হচ্ছে, এরকমের একটা পরিতাপ নিয়ে জীবনযাপন করা যে, আপনার আরও অনেক কিছু থাকতে পারত, আপনি আরও অনেক বড় কিছু হতে পারতেন এবং আরও অনেক কিছু করতে পারতেন। 

এই সত্যটি মনে রাখুন : আপনার জীবনে যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানটাই (now) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আজ যে কাজটি আপনি করছেন সেই কাজটিই নির্ধারণ করে দিচ্ছে আপনি কেমন মানুষ হতে চলেছেন এবং আপনি কেমন মানুষ হচ্ছেন তা দিয়েই নির্ধারিত হবে আপনার জীবনের মান ও গন্তব্য। 

আজ যদি আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত অসাধারণ জীবনের মানুষটি হওয়ার জন্যে প্রতিশ্রুতি না করেন, সেই জীবনে উন্নীত হওয়ার জন্যে প্রচেষ্টা শুরু না করেন, তাহলে এমন কী কারণ ঘটবে যে, জন্যে আপনি আগামী কাল শুরু করবেন, অথবা পরবর্তী সপ্তাহে, পরবর্তী মাসে, কিংবা পরবর্তী বছরে? কিছুই ঘটবে না। সেজন্যে অবশ্যই আপনি সীমানা নির্ধারণ করুন; এই নির্ধারিত সময়েই আপনাকে সবকিছু সম্পন্ন করতে হবে। 

ধাপ-৩ : সীমানা নির্ধারণ করুন 

আপনি এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন, আমাদের সমাজের ৯৫% মানুষ সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। এবং তাই, যদি আমরা অধিকাংশ মানুষ থেকে ভিন্নভাবে চিন্তা ও কাজের জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হই তাহলে আমরা অধিকাংশ মানুষের মতোই সংগ্রাম করতে করতে ফুরিয়ে যাব। কেন একজন মানুষ আমজনতার জীবন (mediocrity) যাপন করে তার কারণসমূহ আপনি জানতে পেরেছেন। আপনাকে এগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে ও এড়িয়ে চলতে হবে। তৃতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে যে, আপনাকে আপনার সীমা ও সীমানা নির্ধারণ করে নিতে হবে। আজ থেকে আগামী দিনের জন্যে সাধারণ জীবনযাপন করা মানুষদের থেকে ভিন্নভাবে কী কী করতে চলেছেন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করুন 

আগামীকাল নয়, আগামী সপ্তাহে নয়, কিংবা আগামী মাসেও নয়। আপনাকে এ সিদ্ধান্তটি আজই নিতে হবে যে, আপনি সেইসব প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের জন্যে প্রস্তুত যেগুলো আপনাকে এতদিনের কাঙ্ক্ষিত জীবনযাপনে সক্ষম করে তোলার নিশ্চয়তা দেবে। আপনার ব্যক্তিগত ও পেশাগত সফলতা আগে যে পর্যায়ে কখনো ছিল না এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে আপনাকে এমন কিছু করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে, যা আপনি আগে কখনো করেননি। আপনি কি সেই প্রতিশ্রুতির জন্যে প্রস্তুত? 

যেদিন আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন, নিজের জীবনে আপনি আর সাধারণ মানের জীবন (mediocrity) মেনে নিতে প্রস্তুত নন, সেইদিনই আপনার সমগ্র জীবন পাল্টে যাবে। আপনার উপলব্ধিতে এটা আসতে হবে যে, আজই আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। আপনি সিদ্ধান্তে আসবেন যে বর্তমান সময়টি যে কোনো সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ আপনার প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত এবং কর্মসমূহ আপনাকে একটি বিশেষ মানুষে পরিণত করছে এবং এগুলোই নির্ধারণ করে দিচ্ছে আপনার ভবিষ্যৎ জীবনের মান। 

প্রত্যেকের জীবনে মধ্যম অবস্থার (mediocrity) সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে কারণ সাধারণভাবে মাঝারি মানের মানুষ (mediocre) বলতে বোঝায় সেরকম মানুষ যে সব সময় একই রকম জীবনযাপন করতে পছন্দ করে। এটা হয়ে থাকে সচেতন কিংবা অসচেতনভাবে। নিজেকে অন্য মানুষের সঙ্গে তুলনা করার সঙ্গে মধ্যমানের জীবনের (mediocrity) কোনোই সম্পর্ক নেই; এটা শুধুমাত্র একটানা শেখা, বিকশিত হওয়া ও নিজেকে উন্নত করার প্রতিশ্রুতি না থাকার পরিণতি। অন্যদিকে অসাধারণ হওয়া বলতে বোঝায় অসাধারণ সফলতা যা হচ্ছে শেখা, বিকশিত হওয়া এবং অতীতের চেয়ে প্রতিদিন একটু বেশি উন্নত হওয়া। 

আমাদের সবারই অনুতাপের একটি কষ্টের অভিজ্ঞতা আছে। এটা হচ্ছে, আমরা সবাই এরকম চিন্তা করি ও কথা বলি: জীবনে আমরা যা কিছু হয়েছি, যা কিছু করেছি এবং যা কিছু পেয়েছি তা আমাদের সামর্থ্যের তুলনায় অনেক কম। মাঝারি মানের দিনগুলো (mediocre days) সপ্তাহে পরিণত হয়। সপ্তাহগুলো মাসে পরিণত হয়। মাসগুলো অনিবার্যভাবে পরিণত হয় বছরে। এবং যদি আমরা আমাদের জীবনের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন না আনি তাহলে আমাদের আত্ম-সৃষ্ট ভাগ্যটি হবে সম্ভাবনা অপূর্ণ থাকা একটি মাঝারি মানের জীবন। প্রকৃতপক্ষে সে জীবনটি হবে প্রাপ্য অনুযায়ী আমাদের কাঙ্ক্ষিত জীবনের তুলনায় অনেক কম প্রাপ্তির। 

বাস্তবতা হচ্ছে, যদি আমরা এখন পরিবর্তিত না হই, আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসবে না। যদি আমরা উন্নত না হই, আমাদের জীবন উন্নত হবে না। এবং যদি আমরা অবিচলভাবে আত্ম-উন্নয়নে আমাদের সময় বিনিয়োগ না করি, আমাদের জীবনের উন্নয়ন হবে না। তারপরও আমরা অধিকাংশই প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠি এবং একই জায়গায় থেকে যাই। 

আমি মনে করি জীবনে আপনার চাওয়া অনেক। আপনি সত্যিই একটা অসাধারণ জীবনযাপন করতে চান। এটার মানে এমন নয় যে, ধনী কিংবা বিখ্যাত হতে চাওয়া। প্রত্যেকের স্বপ্নই আলাদা। এর মানে আপনার সংজ্ঞা অনুযায়ী যে জীবনযাপনকে অসাধারণ মনে করেন তাই। যেখানে সবকিছুতে আপনার সক্ষমতা থাকবে এবং সারা জীবনের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আপনি যাকিছু করতে চাইবেন, হতে চাইবেন এবং পেতে চাইবেন তার সবকিছুতে স্বাধীনতা থাকবে। কোনো অজুহাত থাকবে না। অনুতাপ থাকবে না। ঠিক একটা অভাবনীয়, অর্থপূর্ণ এবং উত্তেজনাপূর্ণ জীবন! 

যেমনটি আগে বলা হয়েছে, বেস্টসেলিং লেখক রবিন শর্মার মতে: “জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়ের একটি হচ্ছে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া এবং অনুতাপের সঙ্গে উপলব্ধি করা যে জীবনে আপনি আরও অনেক বড় হতে পারতেন, অনেক বেশি কিছু করতে পারতেন এবং আপনার অনেক বেশি কিছু থাকতে পারত।” এটা শুধুমাত্র আমজনতার আত্ম-আরোপিত ভাগ্য, কোনোভাবেই এটা আপনার জন্যে প্রযোজ্য হতে পারে না। আজই আপনি সামনে যাওয়ার জন্যে অপনার সীমানা নির্ধারণ করে নিতে পারেন। আপনি সিদ্ধান্তে আসতে পারেন যে, কোনো অবস্থাতেই মাঝারিমানের জীবন (mediocrity) আপনার কাছে আর এক মুহূর্তের জন্যেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আপনি আপনার ভিতরের বিশালত্ব খুঁজে পেতে পারেন। যে অসাধারণ জীবন সাত্যই আপনি আকাঙ্ক্ষা করেন, সেই জীবন তৈরি করে নিতে যে ব্যক্তিটি হওয়া প্রয়েজিন আপনি সেই জীবন বেছে নিতে পারেন। আপনার জীবন ভরে উঠতে পারে শক্তি (energy), ভালোবাসা, স্বাস্থ্য, সুখ, ও আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রাচুর্যে। এবং সেই সঙ্গে এতদিন আপনি যাকিছু পাওয়ার জন্যে, হওয়ার জন্যে এবং করার জন্যে আকাঙ্ক্ষা করেছেন সবই ভরে উঠতে পারে পূর্ণতায়। The Miracle Morning আপনাকে সেই জীবন দেবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *