৩. বাইরের জগত

         বাইরের জগত আর নিজের জগতের মাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীত আড়ালের কাজ করত, পাঁচিলের । গানের প্রতি আগ্রহ ছিল না ; গানের আবহ দিয়ে বইয়ের জটিল তত্বগুলোকে আয়ত্ব করার উপায় বের করে ফেলেছিল । কী গান, কী কথা, কার গাওয়া, তা নিয়ে ও চিন্তা করেনি । লঙ প্লেইং রেকর্ড কলের গানে চাপিয়ে মন দিত পড়ায় । রাহুলের মা জানতেন ; গান থেমে গেলে রেকর্ডের উল্টোপিঠে বা ওই পিঠেই আবার বা অন্য রেকর্ডে পিন বসিয়ে দিতেন । রবীন্দ্রনাথকে এভাবেই ব্যবহার করেছে রাহুল, চিরকাল । হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে ও, রাহুল । ওনার প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস পড়েছে বাইরের জগতের সঙ্গে আড়াল তোলার কাজে লাগাবার জন্য ।

         রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বন্ধুদের আলোচনা শুরু হলে, ও চুপ করে থেকেছে, বা ওনার গোঁফ, নখ কাটা, কোন সাবান মাখতেন, কখন চুল আঁচড়াতেন, মাঝখানের সিঁথে কাটা কবে ব্যাকব্রাশ হল, কবে নাগাদ পৈতে ফেলে দিয়েছিলেন, পৈতে হবার পর ন্যাড়া মাথায় কি দাদারা চাঁটি মারতেন, বাবা মারা যাবার পর চুল-দাড়ি কামিয়ে ন্যাড়া হয়েছিলেন তার ফোটো কোথায় পাওয়া যাবে, কোন হুইস্কি খেতে পছন্দ করতেন, ইত্যাদি নিয়ে উৎসাহ দেখিয়েছে ।

        স্নাতকোত্তরের পর রাণোর সঙ্গে আর দেখা হয়নি, ন্যাড়া-মাথা রবীন্দ্রনাথকে তাই পায়নি ও, রাহুল ।

         বলেছিল রাণো কখনও একবার, ওর পূর্বপুরুষ হলেন জং বাহাদুর কুঁঅর । কিন্তু বলেনি যে সেই জং বাহাদুর লোকটির ষড়যন্ত্রের ফলে রাজ দরবারের ছত্রিশ জন লোক খুন হয়েছিল, আর প্রধান মন্ত্রীকে খুন করে সিংহাসন দখল করে রেখেছিল তার বংশধর, মানে, রাণোর পূর্বপুরুষ । রাণোর শিরায় সেই লোকটার রক্ত, ভাবা যায়, সেই রক্তের চুমু ওর ঠোঁটের স্মৃতিতে ! তার শেষ বংশধর পালিয়ে এসেছিল  , ফিল্ড মার্শাল মোহন শমশের জং বাহাদুর রাণা নেপালের রাজাকে সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিল ভারতে । সে রাজার ছেলে রাজা হল ,খুন হল, তার ভাই রাজা হল, উৎখাত হয়ে দেশ ছেড়ে পালালো ।

         রাণো কি এখন বুড়ি ? আশি বছরের বুড়ি !

         রাহুল বলেছিল, জানি, তোমাদের নামের আগে তিনটে শ্রী বসানো হয় আর নতুন রাজার নামের আগে পাঁচটা । আমি আমার নামের ডগায় একটাও শ্রী জুড়তে দেবো না, কারণ আমি কাউকে তো খুন করিনি । এও জানি যে তোমাদের বংশে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি, সেই খুন হয়ে-যাওয়া প্রধান মন্ত্রীর স্ত্রীর অভিশাপে । কারেক্ট ?

         –হানড্রেড পার্সেন্ট । তবে, ভেবে দ্যাখো, রয়াল ব্লাডের চুমু পেলে । ওয়ান্স ইন এ লাইফটাইম অভিজ্ঞতা । রক্ত দূষিত হয়ে গিয়ে থাকবে তোমার, যতই হ্যারল্ড ল্যাসকি, বুকানিন, প্রুধঁ আর মার্কস পড়ো ।

         –আর তুমি প্লেবিয়ান । তফাত এই যে তুমি এই অভিজ্ঞতা রিপিট করার অজস্র সুযোগ পাবে ।

         –তা পাবো ; সেরকম সুযোগ পেলে নেবোও । নেপালে বা ইনডিয়ায় থাকতে চাই না ; বিদেশে চলে যেতে চাই ।

        রাণোর বাঁ গালে টোলের জন্য আকৃষ্ট হয়েছিল রাহুল । যে তরুণীদের গালে টোল পড়ে তারা ওকে আকৃষ্ট করেছে, সুশ্রী না হলেও । বাংলা গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়তে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন যিনি, স্কুলের সেই উঁচু ক্লাসের ছাত্রী, ধনী ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে সুমিতাদিরও দুই গালে টোল পড়ত । সুমিতাদির গালে যদি টোল না থাকত তাহলে কি সিরিয়াস বই পড়ার, আর লেখালিখির প্রতি আগ্রহ হতো ওর?  সুমিতাদি যে মন্দিরে গান গাইতে যেতেন, ব্রাহ্মমন্দির, তা এখন বিরাট একটা শপিং মল । নিজেকে বলতেন ব্রাহ্ম-বাঙাল-বামপন্হী-বামা ।

        –তোমার কাছে এসে তাই সবাই ব্যা-ব্যা-ব্যা-ব্যা করে ।

        –চুপ । কানমুলে ম্যা-ম্যা-ম্যা-ম্যা করাবো ।

         রাহুলের স্ত্রী, বুড়ি হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও টোল পড়ে । অনেকে সাক্ষাৎকার নিতে এসে যখন প্রশ্ন করে, কোথা থেকে প্রেরণা পেলেন, তখন বলা উচিত যে তরুণীদের গালে টোল পড়া থেকে প্রেরণা পেয়েছি । সাইক্লোনের চোখের মতো ওই টোলগুলো, পাকিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যেতে চায়, তছনছ করে দিয়ে চলে যেতে চায়, আবার প্রথম থেকে জীবন শুরু করে পরের ঘুর্ণিঝড়ের অপেক্ষায় ।  গালের টোলের কোনো ধর্ম, সম্প্রদায়, ভাষা, দেশ, জাতি হয় কি ?

         কলেজে ঢোকার পর, সুমিতাদি রাহুলকে  পথে দেখতে পেয়ে, বেবি অস্টিন গাড়ি থামিয়ে,  ওনার বাড়িতে নিয়ে

গিয়েছিলেন  । রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমমম, বোধহয় মমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । তারপর ওনার গালের টোলের আলোয় শোনালেন ওনার প্রেমিকের বিপ্লবগাথা ; সে পুং-বিপ্লবী নাকি তখন কোথাও লুকিয়ে বেড়াচ্ছে । ওনার প্রেমিক যে কে তা রাহুল তখন পর্যন্ত জানতে পারেনি , সুমিতাদির কাছে তার ফোটোও নেই ।

         সুমিতাদির বাড়ি কয়েকদিন যাবার পর উনি ওনার  বিপ্লবের স্বপ্নে টানতে চাইলেন রাহুলকে, সোভিয়েট রাষ্ট্রে

প্রকাশিত অদ্ভুতগন্ধী বই পড়তে দিয়ে। ক্রমে, লোকমুখে জেনেছিল, বিপ্লবের স্বপ্নটা ওনারই, এবং উনিই তাতে টেনে এনেছিলেন ওনার বর নামের অদৃশ্য লোকটিকে, যাকে রাহুল কখনও দেখার সুযোগ পায়নি  । রাহুলের বয়সী আরও ছেলে-মেয়ে আসত, যাদের এড়িয়ে যেত রাহুল, তারাও ওনার বিপ্লবী প্রেমিককে দ্যাখেনি কখনও ; সে যাকগে, ওর, রাহুলের, আগ্রহ তো সুমিতাদি । ওনার দেয়া বইগুলো রাহুল বাড়ি এনে পড়ত, বিভ্রান্ত হতো, কিন্তু গালের টোলের আলোর আকর্ষণে আবার গিয়ে আবার বই আনত, আরও বেশি করে বিভ্রান্ত হবার জন্য ।  

        বিপ্লব ? রাহুলের বড়-জ্যাঠামশায় একবার বলেছিলেন, যে-মেয়েরা বাপের অবাধ্য হয় তারা, আর যে-ছেলেরা মায়ের অবাধ্য হয় তারা , বড় হয়ে বিপ্লবী হয় ।

       রাহুল আর অনিকেত দু’জনেই তো কখনও বাবার আর কখনও মায়ের অবাধ্য হয়েছে । ওরা তাহলে কী ?

        কয়েকটা মোটা বই দিয়ে সুমিতাদি একবার বললেন, স্কুলে তুমি একবার একটি মেয়ের জন্য মারামারি করেছিলে, মনে আছে ? আমি তো কল্পনাও করতে পারি না তুমি মারামারি করছ, অ্যান্ড ফর এ গার্ল । এরকম ডেলিকেট চেহারা তোমার, যে মারামারি খাপ খায় না, অন্তর্মুখি তরুণ, সে কিনা মারামারি করছে । আর মারামারি করেছ কোনও মেয়ের জন্য ? কোনও যুবতী এসেছে জীবনে ?

        মারামারি করেনি রাহুল, করে ফেলেছিল , অঞ্জলি দাশ নামে একজন সহপাঠিনীর ওসকানিতে । অঞ্জলি বলেছিল, কেমন মরদ রে তুই, তোর সামনেই আমাকে টিটকিরি মারছে আর তুই রেসপণ্ড করছিস না । ইন্সট্রুমেন্ট বক্স থেকে কমপাস বের করে এগিয়ে গিয়েছিল রাহুল । তার জন্য স্কুলের অফিসরুমে, কেরানিবাবুর নির্বিকার চাউনির সামনে,  ওকে সারাদিন একঠায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল ।

         অঞ্জলি অপেক্ষা করেছিল ওর শাস্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত । তারপর নিয়ে গিয়েছিল ওদের বাড়ি । বিশাল তিনতলা বাড়ি, প্রতি বছর হলুদ চুনকাম করানো হয় । থাকেন ওর মা আর ও, ব্যাস আর কেউ নেই । অত বড় বাড়ি রাখার কী দরকার জানতে চাইলে অঞ্জলি বলেছিল, বা রে, আমার দাদুর বাড়ি, বড় হলেই বা । রাহুলের মনে হয়েছিল

যে অমন বৈভবশালী পরিবারের মেয়ে জানা থাকলে হয়ত মারামারি করত না ও । মারামারিটা তার মানে রাহুল নিজের জন্যই করেছিল, মারামারির জন্য মারামারি, উদ্দেশ্যহীন ।

         সুমিতাদি কি তা বুঝবেন ? বুঝবেন নিশ্চয়ই । কেন কিছু তরুণ সব ছেড়ে-ছুড়ে বিপ্লবী দলে নাম লেখায়, ওনার অদৃশ্য প্রেমিকের মতন !

         –না, কোনো যুবতীর জন্য করিনি । পুলিশের সঙ্গে করেছিলুম, ছাত্র আন্দোলনের সময়ে, সেই যেবার নেহেরু এসে কানপুর-ময়দানে লেকচার দিয়ে গিয়েছিলেন, অথচ আমাদের কলেজে আসা দরকার মনে করলেন না । পুলিশের গুলিতে একজন সহপাঠী মারা গিয়েছিল ।

         –জানি, কাগজে পড়েছিলাম, বলেছিলেন সুমিতাদি ।

          অঞ্জলি কোনো জিনিস ছুঁতে দেয়নি ওদের বাড়িতে । সোফার পাশের টেবিলে এমিলি ডিকিনসনের একটা বই ছিল , রাহুল হাতে তুলে নেবার আগেই চেঁচিয়ে উঠেছিল অঞ্জলি, ছুঁসনি, ছুঁসনি, বাবা যে জিনিস যেখানে যেমন রেখে গেছে তা সেরকমই থাকবে ।

          মানে ? কখন ফিরবেন তোর বাবা ?

          বাবা তো আমার যখন এক বছর বয়স তখনই মারা গিয়েছিলেন ।

          অঞ্জলির মা বললেন, হ্যাঁ বাবা, আমি কাউকে কোনো জিনিসে হাত দিতে দিইনি । ঝি-চাকররা ঝাড়পোঁছ করে যেখানকার যা সেখানেই রেখে দ্যায় ।

         রাহুল অঞ্জলিকে বলেছিল, তোর বাবা তোর গালে টোল দিয়ে যাননি কেন জানিস ? ছোঁয়া বারণ বলে ।

         অঞ্জলি যা করল তা রাহুলের জীবনে প্রথম ক্লিংগিং, স্বতঃস্ফূর্ত, সংক্রামক । বলল, জিনিস, বুঝলি, ইডিয়ট, জিনিস, যাতে প্রাণ নেই, গাড়ল, আমি তো আর জিনিস নয়, আমি রক্তমাংস দিয়ে গড়া, শোঁক, আমার নিঃশ্বাস শোঁক । 

রাহুলও রক্তমাংস দিয়ে গড়া প্রমাণ করবার জন্য জড়িয়ে নিয়ে কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়ল । মেয়েদের নিঃশ্বাস কী দিয়ে

গড়া ? বরফের মরুভূমি দিয়ে হয়তো । জামাকাপড়, আকর্ষণের অংশটুকুতে নিজেদের মেলে ধরার খাতিরে যতটুকু, খুলে ফেলল, একজন আরেকজনের । দুজনেই একে অপরের  সঙ্গে পরিচিত হল আর, এতদিন পর রাহুলের মনে হয়, তা ছিল প্রথম প্রেম, উন্মাদ, মোহময়, নেশার মতন ।

         স্কুলের পর,অঞ্জলির ঘরের ইরানি কার্পেটের ওপর শ্বাস-প্রশ্বাসের ঝড়, আর ওর মা বাড়িতে না থাকলে স্নানঘরে,

শাওয়ার চালিয়ে। অঞ্জলির ঘরে গিয়ে বিছানায় । অন্ধকারে বা আলো জ্বেলে । হাফছুটির দুপুরে বা স্কুল শেষের সন্ধ্যায় । নারী শরীরের গোপন রহস্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে রাহুল, যা তহমিনা আপা স্পষ্ট করে মেলে ধরেননি, বা যা বুঝতে পারার মতন প্রতিক্রিয়া তখনও গড়ে ওঠার বয়স হয়নি সেসময় ।

         পরস্পরের গোপন নাম হয়ে গিয়েছিল ক্লিংগার । আকর্ষণের নাম অঞ্জলি দিয়েছিল পাশাখেলা । পাশাখেলার সময়ে দ্রৌপদীর শাড়ি খুলে ফেলতে চেয়েছিল কৌরবরা আর দ্রৌপদীর তখন মাসিক, যোনিতে কানি বাঁধা ।

        মনে রাখবি, শরীরের কিছু এলাকা ছোঁয়া চলবে না ।

         নিষেধ ! এটাই বোধহয় আকর্ষণবোধের সূত্র ! ছোঁবো বললেই হয় না, রাহুলের তো সাহস চাই । ও তো ডরপোক।

         একদিন অঞ্জলি স্কুলে আসেনি বলে ফেরার পথে খোঁজ নিতে গিয়ে  ওদের বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছে রাহুল শুনল, অঞ্জলিকে নিয়ে ওর মা চলে গেছেন পণ্ডিচেরিতে । রাহুল তো জানতো ওরা বৈষ্ণব ; তারাও যায় নাকি অরবিন্দ আশ্রমে ? বৈষ্ণব !

         সুমিতাদি ব্রা্হ্ম । অঞ্জলিরা বৈষ্ণব । তহমিনা আপা  শিয়া মুসলমান । আইরিশ নানরা ক্যাথলিক খ্রিস্টান । আকর্ষণের বনেদ তো একই । জাস্ট আকর্ষণ । তার কোনো কার্যকারণ ছিল না । নাকি অভিকর্ষ ? হয়তো বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ থাকতে পারে, যেভাবে নিউটনের আপেলকে টেনেছিল অভিকর্ষ । সে অভিকর্ষ কি নিউটনের নিজস্ব ছিল না ?  কেননা আপেল তো তার আগে থেকেই পড়ত । পৃথিবীর অভিকর্ষ তো ছিল, কিন্তু নিউটন নিজের অভিকর্ষ আবিষ্কার করলেন ।

         রাহুলও নিজের অভিকর্ষ আবিষ্কার করে, আর অবাক হয় । আপেলকে চায় পৃথিবী, পৃথিবীকে চায় সূর্য, সূর্যকে চায় আগুন, আগুনকে চায় মহাশূন্য । জাস্ট চায় । একজন আরেকজনকে চায়, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই ।

         তোকে আবার কে চিঠি দিল, বলে একটা খাম রাহুলের হাতে দিয়েছিলেন রাহুলের মা, ‘দেখিস, আবার প্রেম-ট্রেম করিসনি যেন, করার হলে পরীক্ষার পর করিস’, কথা কটা বলে । 

         ডাকে অঞ্জলির চিঠি, নীল রঙের কাগজে লেখা, আঁকাবাঁকা হাতের লেখায়,  পেয়ে, রাহুল জানতে পারল যে ওদের কর্মকাণ্ড দেখে ফেলেছিলেন অঞ্জলির মা । অঞ্জলির সঙ্গে তর্কবিতর্ক ক্রমে ঝগড়ার চেহারা নিয়ে ফেলতে, উনি সেদিন সন্ধ্যাতেই ট্রেনের প্রথম শ্রেণির টিকিট কেটে রওনা  দিলেন হাওড়া । অঞ্জলি লেখেওছে, প্রথম শ্রেণি, যে শ্রেণিতে রাহুল চাপেনি কখনও । ঠাকুমাকে নিয়ে বা মা-বাবার সঙ্গে দেশের বাড়িতে গেলেও রাহুলকে থার্ড ক্লাসে চেপে যেতে হয়েছে ।

         নিজের কাঁধ, বাহু, শুঁকলেও অঞ্জলির গায়ের কোমল গন্ধ পায় রাহুল । ওদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে গেলে গাছের পাতারা হাওয়াকে বলতে থাকে এখানে হাত দেয়া নিষেধ, ওখানে মুখ দেয়া নিষেধ ।

        চিঠিটা রাখেনি ; চায়ের ঠেকে বসে,  পড়ে, চায়ের দোকানের উনোনে ফেলে দিয়েছিল ছিঁড়ে , কুটিকুটি । চিঠি জুড়ে তেতাল্লিশবার লিখেছিল “ভালোবাসি তোকে”, বারো বার লিখেছিল “তোকে ছাড়া বাঁচব না”, আর কুড়ি বার লিখেছিল “তোর জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করব” ।

        রাসবেহারির ফ্যাঁকড়া গলিতে,   এক মহিলা কবি-অধ্যাপকের বাড়ি গিয়েছিল রাহুল, এমনিই, হাটতে-হাঁটতে, হঠাৎ দেখা করার ইচ্ছা হল, তাই ; কখনও সামনা-সামনি পরিচয় হয়নি । রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমম, বোধহয় তেইশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । উনি নিচের তলায় বসিয়ে রাখলেন বেশ কিছুক্ষণ, তারপর খবর পাঠালেন, অসুস্হ, শুয়ে আছেন, রাহুল দেখা করতে পারে, তবে অবিরাম কথা বলা যাবে না ।

         আমাকে সবাই এত ভয় পায় কেন, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে ভাবছিল রাহুল । সিঁড়ির দেয়ালে ওনার বিখ্যাত বাবা-মায়ের সেপিয়া ফোটো । গিয়ে দেখল, কবি-অধ্যাপক শুয়ে আছেন । ওঃ, ভয় নয়, একটু মেক-আপ করার সময় নিয়েছেন । অসুস্হ হলেও পাটভাঙা তাঁতের শাড়িতে, কপালে টিপ, যৎসামান্য পাউডার বোলানো গাল । টিপ দেখে

ভালো লাগল । রোগিদের টিপ পরলে কত সুন্দর দেখায়, হাসপাতালগুলোয় অমন ব্যবস্হা থাকলে ভালো হতো। 

পরিবেশ পালটে যায় । পরে, একবার ও, মানব রায়, ভবদেব মিত্র আর ভবদেবের বন্ধুনি রোশনি,  কয়েক প্যাকেট টিপ কিনে আর জি কর, এস এস কে এম, মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে নার্সদের অনুরোধ করে রোগিনীদের মেরুন টিপ বিলি করেছিল । প্রায় সব রোগিনী পরে নিয়েছিল টিপ, হাসি ফুটেছিল আত্মীয়দের মুখে । নিউজপ্রিন্টের কালোবাজারি এক ট্যাবলয়েডের সাংবাদিক ঘটনাটা জানতে পেরে টিপ বিলোনোকেও ওদের আন্দোলনের কর্মকাণ্ডের

অন্তর্ভুক্ত করে রসগদ্য লিখেছিল।

         অগ্রজ মহিলা কবির কোনো অপেরা-সংলাপ মনে নেই রাহুলের, অপেরা বইয়ের নামও মনে নেই, কিন্তু ওনার চুমু-ডাক ফিকে-লাল ঠোঁট, আর টিপ-পরা সরু কপাল মনে আছে ।

         মহিলা কবির বাড়ি থেকে বেরিয়ে, কতদিন পর, গড়িয়াহাটের মোড়ে, আচমকাই অঞ্জলির সঙ্গে দেখা, স্লিভলেস লাল ব্লাউজে, কাঁথা-স্টিচ শাড়িতে, সোনালি রিস্ট ওয়াচ, কানে হিরের ফুল ঝিকমিক ।

         সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড এক পলকের জন্য থেমে গেল, আর  রক্ত চলকে উঠে এলো রাহুলের শিরা-উপশিরা বেয়ে, দ্রুত, নিঃশব্দ আওয়াজ তুলে । রাহুলের মুখ থেকে আপনা থেকেই, এত বছরের সময়ের দূরত্বকে ঝটিতি মুছে ফেলে, এই গরমশ্বাস কথাগুলো বেরোল, যা শুনে নিজেই অপ্রস্তুত বোধ করল ও, ‘কি রে ? ক্লিংগার? এখানে ? কলকাতায় থাকিস?’

         অঞ্জলি বলল, এখন আমি ক্লিংগার নই, ক্লাইম্বার । চিনতে পেরেছিস দেখছি । আঁচ করেছিলাম, নির্ঘাত এড়িয়ে যাবি, চোখ থেকে চোখ সরাচ্ছিস না দেখে বুঝতে পারলাম এখনও বাসি রহস্যে বাঁধা আছিস । কিন্তু তুই কি করছিস কলকাতায় ? তুই তো কানপুরের জুহি পরমপুরওয়া পাড়া ছেড়ে অশোকনগরের বাড়িতেই আছিস বলে শুনেছি ; সব খবর রাখি ।

         হ্যাঁ, বলল রাহুল, ফিসফিস করে, মাই গড, তোর গালে টোল পড়ছে । পারফিউম থেকেই তো বুঝতে পারছি, তুই কোথাও ক্লাইম্ব করে উঠে পড়েছিস, করকরে নোটের জগতে, আর আমি পচা-ছাতাপড়া নোটের আড়তে । অরবিন্দ আশ্রম থেকে এই মায়াবাজারে ? একটু থেমে, প্রাক-তারুণ্যের প্রাচীন ব্যর্থতাবোধ আর মনখারাপের ধুলোপড়া স্মৃতিকে সরিয়ে, হৃৎপিণ্ডকে গলা থেকে আবার বুকের ভেতরে নামিয়ে, রাহুল বলল,  তোর হাত ধরব ? আমার কবজির শিরার আওয়াজ তোকে দেখেই যে লাফিয়ে উঠল তা ফিল করতে পারবি । সিঁদুর নোয়া-টোয়া বা হুকড-অফ চিহ্ণ তো দেখছি না । ধরব ? তোর ত্বক আরও মসৃণ হয়ে গেছে ।

         অঞ্জলি রাহুলের কবজি আঁকড়ে চাপা গলায় বলল, চল, তোকে আমার টেমপোরারি আস্তানায় নিয়ে যাই, কাছেই, যাদবপুরে। আমার বর, ওই যার সঙ্গে ঘর করি আরকি, সে একজন স্মাগলার । রাহুলের উদ্বিগ্ন  অবিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে যোগ করল, সত্যি রে । ও এখন বাইরে কাজে গেছে । কাছাড় শুনেছিস ? সিলেটি ।

        স্মাগলার শব্দটা শোনামাত্র রাহুলের ভীতিময় আত্মদন্দ্ব ওকে গা-বাঁচিয়ে পরিস্হিতি যাচাই করতে নির্দেশ দিল ।

         প্রসঙ্গের বাঁকবদল ঘটিয়ে রাহুল বলল, সিলেট ? শ্রীহট্ট ? ও তো পাকিস্তানে । সিলেটিদের তো বাঙালরাও স্বীকৃতি

দ্যায় না, কালচারাল ডিফারেনসেসের জন্য । শুনেছি সিলেটিরাই একমাত্র পিওর ব্রিড বাঙালি । পেডিগ্রি বজায় আছে আজও, দেশভাগের এই কয়েক বছর পরও ।

        কাছাড়ে ওদের বাঙাল বলে না ; সেখানকার মুসলমানদের হিন্দু সিলেটিরা বলে বাঙাল । সিলেটিরা সিলেটিই, পেডিগ্রি ছাড়তে চায় না । মাটিতে পুঁটি মাছ পুঁতে রেখে বহুকাল পর তারিয়ে-তারিয়ে খায় । বিয়ে-টিয়ের রীতি-রেওয়াজ একেবারে আলাদা, বেশ ইনটারেসটিং । পাকিস্তানে ওরা সিলেটিদের বলে আবুইদ্যা, কে জানে তার কী মানে ।

         –চল, তার আগে কোথাও খেয়ে নিই । সকালে ট্রেনি হসটেলে কেবল ব্রেড-বাটার-কলা খেয়ে বেরিয়েছিলুম ।

         –আমার বাসাতেই চল না, ভাত-টাত রাঁধাই আছে । যা আছে দুজনে খেয়ে নেব । তোর কথা শুনতে পাই এর-তার মুখে । কী সব আন্দোলন-টান্দোলন করছিস । চল , শুনবো । কলকাতায় কেন ? পোস্টেড ?

         –না, ট্রেনিঙে পাঠিয়েছে অফিস ।  এর-তার ? হু আর দে ?

          –তোদেরই জ্ঞাতি-গুষ্টি, যারা তোদের হিংসে করে । অপেরা লিখিস বলেও হিংসে করে । বোধহয় তোর অপেরার  মাংসময় ডিভিনিটিকে হিংসে করে । কিসের ট্রেনিং রে ? তোর আবার ট্রেনিঙের দরকার আছে নাকি !

         –নোট পোড়াবার ট্রেনিঙ । আশ্চর্য লাগছে ? যে শোনে সে-ই অবাক হয় ।

         –টাকা পোড়াবার ? তার ট্রেনিঙের কী দরকার ? এক জায়গায় জড়ো করে পেটরল ঢালো আর আগুন ধরিয়ে

দাও ।

        –প্রতিটি নোট পোড়াবার হিসেব রাখতে হয় । পচা-গলা-ছাতাপড়ে সবুজ হয়ে-যাওয়া নোটগুলো শেষ পর্যন্ত কী হয় ভেবে দেখেছিস কখনও ?

         –না ভাবিনি । ডেসট্রয় করা হয় জানতাম ।

         –নোটের পাহাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে চাকরি করি । প্রায় পনেরো ফিট উঁচু-উঁচু পচা নোটের পাহাড় । তা থেকে

র‌্যানডাম স্যামপ্লিং করে, গুণে, তার পর বস্তায় ভরে, চুল্লিতে পোড়াতে নিয়ে যেতে হয় । বিটকেল গন্ধ, প্রথম দিকে জ্বর হতো, নাক দিয়ে জল পড়ত, গলা বন্ধ থাকতো মাঝে-মাঝে, এখন সব সয়ে গেছে ।

         –হ্যাঁ, সব সয়ে যায়, সব সয়ে যায় ।

         –জ্ঞাতিগুষ্টির কথা বলছিলিস, তারা কারা ?

         –কলকাতার, কানপুরের, গঙ্গার এপার-ওপারের । তোদের গুষ্টিটাই হিংসুটে ।

          –এটা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগে, এই যে কেউ-কেউ আমাকে হিংসে করে ; কেমন এক ধরণের স্ট্রেঞ্জ রাসায়নিক আরাম পাই । মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক ট্রাইবাল যুগে ফিরে গেছি ।

          –তা না হলে আর মানব বলেছে কেন ! মানুষ তো বেসিকালি ক্যানিবাল ।

          –আমি তো তোর ব্যাপারটা শুনতে চাই । তোর মা কোথায় ? স্মাগলার বলে অবজেকশান নেননি, সত্যিই যদি সে স্মাগলার হয় ? আমি তো বেটার অপশান ছিলুম । স্মাগলর শব্দটা ব্যবহার না করতে চাইলেও, তক্ষুনি প্রতিশব্দ না পাওয়ায়, প্রয়োগ করতে হল ওকে ।

          তখন ছিলিস না ; তখন ছিলিস  স্কুল কিড, নাইভ, ইররেসপনসিবল, কী করে কী করতে হয় তাই জানতিস না, ভুলে যাচ্ছিস কেন, থেমে-থেমে কথাগুলো বলে, একটা ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে থামতে ইশারা করে, বলল অঞ্জলি । তারপর ট্যাক্সিতে বসে, রাহুল দূরত্ব রেখে বসতে যাচ্ছিল, কাছে ঘেঁষে থপ করে বসে, পারফিউমের সুগন্ধ রাহুলের দিকে উড়িয়ে,  অঞ্জলি বলল, মা তো পণ্ডিচেরি যাবার কয়েক বছরের মাথায় মারা গিয়েছিলেন । আশ্রমই আমাকে স্কুলের শেষ ধাপ পর্যন্ত পড়িয়েছিল ; তারপর কলকাতা চলে এলাম রিসেপশানিস্টের চাকরি নিয়ে । আশ্রমে তো সায়েবে গিজগিজ, হোটেলে রিসেপশানিস্টের চাকরি পেতে অসুবিধা হয়নি, দেখতেই পাচ্ছিস আমার স্মার্টনেস । সেখানেই গেঁথে তুললাম আমার বরকে, এত টাকাকড়ির গোমর দেখাত যে না ফাঁসিয়ে থাকতে পারলাম না । পরে ক্রমেক্রমে জানলাম যে ও স্মাগলার । ভাল্লাগে না স্কাউন্ড্রেলটাকে, কিন্তু কি করি, উপায় নেই, পয়সাখরচের বদভ্যাস করে দিয়েছে ; আমার অ্যাম্বিশান ছিলই পয়সাঅলা বর । তাছাড়া, এত ব্যাপার জেনে ফেলেছি যে বেগতিক দেখলে হয়তো খুন করে ফেলে দেবে আসামের সবুজ চা-বাগানে নিয়ে গিয়ে । কিন্তু কী জানিস, ও জড়িয়ে ধরলেও আমি চোখ বুজে তখন তোর কথাই ভাবি, যেন তুই চুমু খাচ্ছিস, বুকে মুখ ঘসছিস, প্রবেশ করছিস ।

         প্রবেশ ? সেই পাশাখেলার দিনে তো প্রবেশ নট অ্যালাউড বলেছিলিস  ! ছোঁয়াও বারণ ছিল । স্মাগলারদের তো অঢেল টাকা । তাহলে যাদবপুরের রিফিউজি পাড়ায় থাকিস কেন ?

         যাদবপুরেরটা মাল রাখার জায়গা ; পুলিশ বড়ো একটা ওমুখো হয় না । তোকে সোজা আলিপুরের ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে পারতাম । কন্ঠস্বরকে, ট্যাক্সিঅলা যাতে শুনতে না পায়, ফিসফিসানিতে নামিয়ে, বলল অঞ্জলি ।

         কালো-হলুদ ট্যাক্সিটা এইটবি বাস স্ট্যাণ্ডের কাছে গতি কমাতে, অঞ্জলি ড্রাইভারকে হুকুম দিলে, এখানে থামতে হবে না, তুমি ঘুরে আলিপুরেই চলো । রাহুলের অনুসন্ধিৎসু ঘর্মাক্ত উদ্বিগ্ন মুখের পানে তাকিয়ে বলল, ‘আমি আজও তোর মুখ দেখে বলে দিতে পারি কী চলছে তোর মনের মধ্যে । তুই আমাকে দেখে একই সঙ্গে ভয় আর আনন্দের মাঝে, সত্যি আর মিথ্যের মাঝে, ভালো মেয়ে আর নষ্ট মেয়ের মাঝে, দোল খাচ্ছিস । তারপর জিগ্যেস করল, ভুরু কুঁচকে, তোর মুখ থেকে কথাগুলোর সঙ্গে কিসের যেন একটা স্ট্রেঞ্জ গন্ধ বেরোচ্ছে, কি খেয়ে বেরিয়েছিস ?

       –হ্যাশিশ । শব্দটা লিখে, স্মৃতিতে ফিরে, সত্তরোর্ধ রাহুল নিজের সম্পর্কে একটা ব্যাপার আবিষ্কার করল । কোনো মাদকই ওকে নেশার অভ্যাসে আটকাতে পারেনি । ছোটোবেলায়, ছ’সাত বছর বয়সে, পাড়ার স্হানীয় পার্বণে বা বিয়েশাদিতে তাড়ি খেয়েছে, ভালো লেগেছে, পরে বন্ধুদের সঙ্গে খেয়েছে, হিন্দি লেখকদের বাড়িতে খেয়েছে, তারপর কখন যেন আর খায়নি । ছোটোবেলায় এগারো-বারো বছর বয়সে দিশি মদ বা ঠররা বা সোমরস খেয়েছে, জিভে ভালো লাগেনি, মগজে ভালো লেগেছে, তারপরেও খেয়েছে, বন্ধুদের সঙ্গে খালাসিটোলায়, পিসতুতো দাদার সঙ্গে হাওড়া ব্রিজের তলায়, দাদা অনিকেতের সঙ্গে চাইবাসা, লাহেরিয়াসরায়, ডালটনগঞ্জ, ধানবাদ, দুমকায় মহুয়ার মদ আর ভাত পচানো

হাড়িয়া খেয়েছে, দাদার বন্ধুদের সঙ্গে খেয়েছে, ভালো লেগেছে, তারপর আর খায়নি । কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে গাঁজা ভাঙ

চরস আফিম খেয়েছে, কবিবন্ধুদের সঙ্গে খেয়েছে, হিপি-হিপিনীদের সঙ্গে ফুঁকেছে, একা ফুঁকেছে, তারপর কখন যেন আর খায়নি । চিত্রকর বন্ধুদের সঙ্গে বেনারসে, হিপি-হিপিনীদের সঙ্গে নেপালে, লাইসারজিক অ্যাসিডে চোবানো ব্লটিং পেপার, কোকেনগুঁড়ো মাখানো ব্লটিং পেপার গিলে ফেলেছে, নেশায় ডুবে থেকেছে, ভালো লেগেছে, তারপর কখন যেন আর গেলেনি । প্রথমে চারমিনার খেতো, তারপর পানামা খেতো, তারপর পাকানো রাইস পেপারে ক্যাপস্ট্যান বা উইলস

টোব্যাকো ভরে খেয়েছে, কখন যে ছেড়ে দিয়েছে, ওর মনে নেই । চুরুট ফুঁকেছে, ছেড়ে দিয়েছে । পাইপ টেনেছে, ছেড়ে দিয়েছে । পান-জর্দা খেয়েছে, ছেড়ে দিয়েছে । রাম, হুইস্কি, ভোদকা খেয়েছে, সহপাঠীদের সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে, স্ত্রীর সঙ্গে, ছেলে-মেয়ের সঙ্গে, অধস্তন অফিসারদের সঙ্গে মদ খেয়ে হুল্লোড় করেছে, তারপর ছেড়ে দিয়েছে । দেহ টলমল করেছে, কিন্তু চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পায়নি, মাতাল হয়নি, বাজে বকেনি, বা উল্টোপাল্টা আচরণ করেনি কখনও ।

         ইচ্ছে করলেই ও, রাহুল, ছেড়ে দিতে পারে, দিয়েওছে, একের পর এক, পেছনে পড়ে থেকেছে স্বজনজ্ঞাতি, শ্যাওড়াফুলির খন্ডহর, কলকাতার ফ্ল্যাট, পরিচিত মানুষ-মানুষী, মাদক, বই, বন্ধু, বন্ধুনি, আসবাবপত্র, পোশাক , কোনো কিছুতে অভ্যস্ত হয়নি ।

         যা ওকে ছাড়েনি তা হল হঠাৎ চাগিয়ে ওঠা মন-খারাপ, আচমকা উঁকি-দেয়া ব্যর্থতাবোধের গ্লানি, অকস্মাৎ মনে পড়ে-যাওয়া বিশ্বাসঘাতকতা আর নিম্নরুচির ব্যবহার, গ্রামীণ উন্নয়নের পরিকল্পনা রূপায়নে নিষ্ফলতাজনিত দুঃখ— এমন কোনো পঞ্চায়েত বা গ্রাম পায়নি যেখানে পরস্পরবিরোধী দুদল মানুষ প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে ভণ্ডুল করার জন্য সব সময় মুখিয়ে নেই—, স্বজন আর স্বজন করে নিতে-চাওয়া মানুষের থেকে বিচ্ছেদের বেদনা, সুচিকিৎসা না পাওয়ায় মায়ের মৃত্যুর দায় ।          

        –নেশা ? নেশা করিস ? ছিঃ , ওটা তো ছোটোলোকদের নেশা । তোর ছোটোবেলাকার জুহি পরমপুরওয়ার হ্যাবিট ছাড়তে পারলি না ।  ড্রিংক করলেই তো পারিস । বলল অঞ্জলি ।

        –নীলকমলের ট্যাবলয়েডের অফিসে গিয়েছিলুম, ও-ই ফুঁকতে দিল । তুই চিনবি না নীলকমলকে ; ও আমাদের ব্রাহ্ম স্কুলের প্রডাক্ট নয় ।  যদি না ফুঁকতুম তাহলে বোধহয় তোকে দেখে বিব্রত আর আড়ষ্ট বোধ করতুম । এড়িয়ে গিয়ে কেটে পড়তুম । ছোটোবেলায় কোন পাড়ায় থাকতুম জানিস তো ? ছেলেবেলার বন্ধুদের সঙ্গে এখনও দেখা হয় মাঝে-সাঝে ।

        –যত্তো সব চোর-ছ্যাঁচোড়ের পাড়া ছিল তোর সেই জুহি পরমপুরওয়া স্লাম, কানপুরের সবচেয়ে কুখ্যাত স্লাম।

        –তাহলে, ভেবে দ্যাখ, স্মাগলিং ব্যাপারটাকে খারাপ মনে হচ্ছে না তোর ; ছোটোলোকদের খারাপ মনে করছিস ।

         রাহুলের মগজে বিভিন্ন রসায়ন কাজ করছিল, যেগুলোর ভেতর প্রধান হল সুপ্ত আতঙ্ক । ও এর আগে কখনও এমন কোনো মানুষের সান্নিধ্যে আসেনি যে স্মাগলিং করে, কিংবা যার পরিবারের লোকেরা স্মাগলার । স্মাগলিং শব্দটাই ভীতিকর, যারা করে তারা আরও খতরনাক , অন্ধকার অচেনা জগতের বাসিন্দা । একজন যুবতী, যাকে ও তখনও পর্যন্ত ভুলতে পারেনি, যে গোপন হাহাকারে ওকে ফেলে উধাও হয়ে গিয়েছিল, যাকে মুছে ফেলতে পারেনি ইন্দ্রিয়গুলো

থেকে, তাকে ও আবিষ্কার করছে, হঠাৎই, সেই যুবতীরই স্বীকৃতি অনুযায়ী, সে কিনা অচেনা অন্ধকার জগতের নিবাসী । অযথা টানাহেঁচড়ায় পড়বে না তো ! পুলিশের লোকেরা নিশ্চয়ই নজর রাখে ওর বাসায় । কারা আসছে যাচ্ছে সেদিকে নজর রাখে । রাহুলের কেমন যেন শীত-শীত করতে লাগল, টের পাচ্ছিল যে ভেতর থেকে ও কাঁপছে ।

       নিজেকে অভয় দেবার জন্য অঞ্জলিকে বলল, না, ভয় পাবো কেন ? পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছে । সন্ধ্যার ফিকে আলোয় সবুজ রঙের তোশকে একজন কিশোরী । বাকিটা ফিসফিস করে, যাতে ট্যাক্সিচালক শুনতে না পায়, উদ্দীপনায় রিমঝিম, সবে উঁকি-দেয়া রোম, বুকের ওপর ঢেউ উঠতে শুরু করেছে । ভুলতে পারি না । কত দিন হয়ে গেল কিচ্ছু ভুলিনি । তোর সেই হেস্তনেস্তকারি বৈশাখী চিঠি । লজ্জা করে, বলে, তুই কমলারঙের নেটের মশারি ফেলে দিলি ; বললি বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি । শাওয়ারের ফোয়ারাকে বললি তোর তিন লক্ষ উড়ন্ত শিশু আমার কোল থেকে তোর বুকে উড়ে যাচ্ছে । তোর নাভি থেকে আলোছায়ার কাঁচা মায়াবি গন্ধ বেরুতো । আমার জিভে রয়ে গেছে তোর বুকের গমগমে স্মৃতি । এটাই প্যাশন । কাকে প্যাশন বলে জানিস না বোধহয়, যিশুখ্রিস্ট জেদ ধরেছিলেন কাঁধে করে বধ্যভূমি পর্যন্ত ক্রস বয়ে নিয়ে যাবেন, ওই জেদই প্যাশান ।

      –জেদ ? নাঃ, জেদ নয় ; যিশু তো ছিল ছুতোর, অভ্যাস ছিল । তুই কত কিলো কাঠ কাঁধে বইতে পারিস ? জিগ্যেস করল অঞ্জলি ।

       –তোকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলুম, তোর পড়ার ঘর থেকে বাথরুম পর্যন্ত, কাঁধে চাপিয়ে, ভুলে গেছিস নাকি !

রাহুলের জবাব ।    

        অঞ্জলি কথার মোড় ঘোরালো, জানিস, আমি আমার মায়ের লাভারের মেয়ে । বাবা মারা যাননি । আমার জন্মের পর কী করে জানতে পেরে সংসার ছেড়ে চলে গেছেন । আমার মনে হয় একদিন উনি হঠাৎই এসে দরোজায় উপস্হিত হবেন, স্বামী বিবেকানন্দের গেরুয়া পোশাকে ।

        –স্বামী বিবেকানন্দ ! আর কাউকে পেলি না তুলনা করার জন্য ! বলে, রাহুলের সন্দেহ হল, অঞ্জলি বোধ হয় সব কথাই বানিয়ে বলছে । যে কারণেই হোক, গুল মারছে ; বলেছিল যাদবপুর, কিন্তু চলল আলিপুর ।

        –বিবেকানন্দের ফিলোজফির জন্য বলছি না, জানিও না সেসব । প্রেম নিবেদন করার মতন পারফেক্ট পুরুষ বলে মনে হয়, যখনই ওনার ফোটো কোথাও দেখতে পাই । এসব আবার কোথাও লিখে দিসনি যেন । মঠের লোকেরা জানতে পারলে ব্রেন ওয়াশ করার ডাক দেবে ।

         –লাভার ? তিনি কে জানতে পেরেছিস ? কী করেই বা জানলি ? রাহুলের মনে হল, নিজেকে নিয়ে কল্পনার ধোঁয়া তৈরি করছে অঞ্জলি ।

         –মা নিজেই বলেছিল । তখনকার দিনের রোমান্টিক গল্পে যেমন হতো । লাভার ছিল পেইনটার, কলকাতায় থাকত, যক্ষ্মায় মারা গিয়েছিল । আমার ঘরের বাঁ-দিকের দেয়ালে যে ল্যাণ্ডস্কেপ পেইনটিং ছিল,  সেটা নাকি ওই লাভারের, মানে আমার বায়ালজিকাল বাবার । কী আশ্চর্য দ্যাখ ! বায়ালজিকাল বাবা, অথচ তাকেই ঘেন্না করি ।

         –তোর কতদিন হল বিয়ে হয়েছে ? বলে, রাহুলের কানে ফিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত টোকা দিতে লাগল । মনে করতে পারল না কোন গান ।

         –চার বছর ।

         –চার বছর হয়ে গেল, তোর তো একটা কিড হয়ে যাওয়া উচিত ছিল ।

          –না হলে আর কী করব । কতরকম ভাবে তো কতকিছু করা হল । আমার হাজবেন্ডের কিউ ক্রমোজোম থেকে বাইশ কিউ এগারো ডিলিশান আছে ।

          রাহুল বুঝতে পারল যে ও ভুল প্রসঙ্গ তুলে ফেলেছে । অঞ্জলির হাতের ওপর হাত রেখে বলল, আই স্টিল মিস ইউ । ছেড়ে দে তোর বরকে । ডিভোর্স দিয়ে দে ।

          অঞ্জলি সরাসরি রাহুলের মুখের দিকে তাকাল । চোখে চোখ । হ্যাঁ, আমিও তোকে মিস করি । লোকে বলে চোখের আড়াল হলেই ভুলে যায়, তা কিন্তু নয় । ওই বয়সের মাংসের বিস্ময় চিরকাল টিকে থাকে, তাকে কেন যে প্রেম বলা হয় তা জানি না ।

          ট্যাক্সি থেকে নেমে রাহুল বলল, আমার কাছে শিভালরি দেখাবার মতো টাকাকড়ি নেই, তুই-ই ভাড়া মেটা ।    অঞ্জলি বলল, জানি, শুনেছি, ফালতু চাকরি করিস আর পুরো মাইনে উড়িয়ে দিস বন্ধুদের নিয়ে লেখালিখির পেছনে ; এখন বুঝতে পারছি তা নয়, আসলে গাঁজা-আফিম-চরসের পেছনে । কে জানে, হয়তো রেড লাইট এরিয়াতেও যাস, যা

তোর সেক্সুয়াল অ্যাপেটাইট ওই বয়সেই ছিল, আর এখন তো ফুল ব্লাডেড স্টাড-বাইসন । অন্য চাকরি খুঁজছিস না কেন?  ছাত্র তো ভালোই ছিলিস, রেজাল্টও ভালোই করেছিলি ।

         –ঠিক জানি না, বোধহয় আমি বড়োই অলস ; কোনো অ্যাম্বিশান নেই । নিজের মগজের ভেতরে বাসা বানিয়ে বাবুই পাখির মতন কুনো। ওই যে ডাকনাম রাহু, বছরে একবার সূর্য খাই আর তাইতেই তিনশ চৌষট্টি দিন চলে যায় । কলেজে পড়াবার চাকরি পেয়েছিলুম, বাড়ির আরাম ছেড়ে যাবার মতন রেডি করতে পারলুম না নিজেকে । তুই যদি রাজি হোস তাহলে অমন কোনো চাকরি খুঁজবো ।

        –হাঃ, এককালে তো দুজনে মিলে পালাবার প্রস্তাব দিয়েছিলিস ।

        –তুইও তো তোর চিঠিতে কতকিছু লিখেছিলিস ।

        –আমি ছিলাম কচি-হরমোন-খুকি  আর তুই ছিলিস কচি-হরমোন-খোকা । দ্যাটস দ্যাট ।

         আমি এরকমই, রাহুল গোপনে নিজেকে বলছিল, এর কোনো কারণ নেই । এই যে দুপাশ দিয়ে পথ চলে যাচ্ছে, তাদের কোনো আগ্রহ তো নেই রাহুল সম্পর্কে, রাস্তার বাঁকে ভিড়, সরকার-বিরোধী মিছিলের ক্লান্ত মানুষ-মানুষী, ততোধিক ক্লান্ত তাদের কাঁধের ওপর রাখা পতাকা । সকালে ও  বিশেষ উদ্দেশে বেরিয়েছিল । এখন ট্যাক্সির ভেতরে বসে অঞ্জলির নির্দেশে যাচ্ছে কোথাও ; যাবার ছিল যাদবপুর, পরিবর্তে এখন চলেছে আলিপুর– একে কি পরিভ্রমণ বলবে ?

আকাশ মেঘলা হতে পারত । মার্চ মাস মানে তো বসন্তকাল, তার রেশ গড়ে তুলছে অঞ্জলিকে ঘিরে, ওরই কারসাজিতে

রোমাঞ্চ খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে, অথচ সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরোবার সময়ে যাবার কথা ছিল সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে এক বন্ধুর দপতরে, যে ওরই প্রবাসের কানপুর শহর থেকে এসেছে, সুকোমল রুদ্র , অপেরা-সংলাপের মুক্তাঙ্গনে নতুন ঘটনা ঘটাবার জন্য শলা-পরামর্শ করার উদ্দেশে । তার বদলে ঢুঁ মারল নীলকমলের ট্যাবলয়েডের দপতরে । অথচ স্মাগলার-বধুর সংসর্গের ভীতিময় আকর্ষণ কাটিয়ে উঠতে পারছে না ।

         সুকোমল রুদ্র সাইক্লোস্টাইল-করা বুলেটনগুলো বের করে, স্টেনসিল দিয়ে হাতে এঁকে বা লিখে । রাহুল একটা চার্ট তৈরি করে ওকে দিয়েছিল ; কবিয়ালদের বংশলতিকায় এখনকার নটদের নাম । রক্তিম চাটুজ্জের নামও ছিল বলে পুরো রামায়ণ নট্ট কোম্পানির লেঠেলরা সুকোমলকে ঘিরে ধরেছিল কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসের সামনে । চওড়াকাঁধ, কোঁকড়াচুল, কালোত্বক কাঠ-বাঙাল সুকোমল যে একাই কানপুরি রুদ্র-হুঙ্কার দিয়ে লড়তে আহ্বান জানাবে, তা ওর প্রতিপক্ষের কেউই আঁচ করেনি। সবাই কলেজ স্ট্রিট, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট ধরে দে পিট্টান । সুকোমলের সঙ্গে সেদিন কামেশ্বর চোঙদার, নবদেব সরখেল আর প্রভাস চোঙদারও ছিল ; ওরা তো সুকোমলকে ঘিরে ফেলা হচ্ছে দেখে আগেভাগেই পালিয়েছিল।

           ওল্ড কোর্ট হাউসের ট্রেনি হসটেল থেকে বেরিয়ে, ডালহাউসি স্কোয়ারে ট্রাম দেখতে পেয়ে উঠে পড়েছিল রাহুল, পরিভ্রমণ অভিযানে, চলমান ঘটমান সময়ের সঙ্গী হবার খাতিরে, একাকীত্ব উপভোগ করবে, শহুরে রোদের ফিকে অনুভব চারিয়ে দেবে অস্তিত্বে । নীলকমলের অন্ধকার দপতরের শীতশীতে চেয়ারে বসে হ্যাশিশ ফুঁকে, বাসে চাপল, আর সে বাস ওকে পৌঁছে দিল রাসবেহারি ।

             অঞ্জলিকে দেখেই মন অশান্ত হতে চাইল, শিকড় থেকে ঝাঁকিয়ে তুলতে চাইল আলস্যের নিয়মানুবর্তীকে, অপ্রত্যাশার লোভনীয় বিস্ময়কে ফাঁদ পেতে ধরে ফেলতে চাইল । ওর সেই বৈশাখী চিঠির তীব্র আঘাতের বিদায়সঙ্গীত বাজতে লাগল দপদপে রগের শিরায় ।

         ফ্ল্যাটের চাবি খুলে ভেতরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করেই অঞ্জলি পেছন ফিরে রাহুলকে জড়িয়ে, ওর  কাঁধে মাথা রেখে কেঁপে-কেঁপে ফোঁপাতে আরম্ভ করল । গালে গড়িয়ে আসা চোখের জল যদিও জিভ দিয়ে চেটে নিল রাহুল, কিন্তু ও টের পাচ্ছিল যে ভয়ে ওর হাতের চেটো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে আর সামান্য কাঁপুনি ঘটছে শরীর জুড়ে । বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই দাড়িয়েছিল দুজনে । কাঁপুনি থেমে আত্মস্হ হলে, রাহুল, মিথ্যা কথা বলার সাহস কন্ঠে এনে, যেসব কথা স্কুলের শেষ বছরে বলবে বলে নিজেকে তৈরি করেছিল, সেগুলো বলতে আরম্ভ করল,   বলল, আই স্টিল মিস ইউ, ভুলতে পারি না তোকে, তোর শ্বাসের গন্ধ ভুলতে পারি না । বলে, রাহুল নিজেকে বোঝালো, জড়াজড়ি আর চুমু সত্তেও তো ওর দেহ সাড়া দিচ্ছে না, অচেনা ভয়ে ওর যৌনতা জাগল না । এরকম কেন হচ্ছে ? কতদিন পর একজন যুবতীর তপ্ত দেহ জড়িয়ে ধরে আছে, কিন্তু ওর মনে বা দেহে, তার প্রতিক্রিয়া ঘটছে না !

         অঞ্জলিকে চিনতে না পেরে কাটিয়ে দিলেই হতো ।

        তুই আমাকে মিস করিস বা না করিস, তুই আমার লাভার হ, আমার মায়ের লাভারের মতন , কাঁধ থেকে মাথা তুলে বলল অঞ্জলি, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে । চল, চল, প্রমাণ কর যে তুই আমার লাভার হবার যোগ্য । যাদবপুরে না গিয়ে তাই এখানে এলাম । পাশাখেলি চল, আগেকার দিনের মতন, শাওয়ারের জলে, তোর তিন লক্ষ শিশু উড়ে আমার বুকে এসে বসুক, চল ।

        –স্কুলের সময়ে তুই তো লাভার হতে দিসনি, অবসাদগ্রস্ত গলায় বলল রাহুল, বলেছিলি, সবকিছু করা চলবে না, ওনলি ড্রাই লাভ ।

        –হ্যাঁ বলেছিলাম । এখন হ । এখন সবকিছু কর । আজকে থেকে যা । সারারাত মাংসামাংসি করব । জীবনের

সেই বোকা দিনগুলোয় যা পাওয়া হয়নি তা আশ মিটিয়ে পুরো করে নিতে চাই আজ ।

        –তুই ওই স্মাগলারকে ছেড়ে দে, ডিভোর্স দিয়ে দে ; আমার সঙ্গে চল । প্রস্তাবটা যে অবাস্তব, তা জেনেই বলল রাহুল । পরপর মিথ্যা বলার দরুণ বেশ হালকা লাগছিল ।

        –আর হয় না রে । একসঙ্গে শোয়া যায়, কিন্তু ঘর করা আর যায় না । স্মাগলারের সঙ্গে ঘর করা যায়, কবি-টাইপদের সঙ্গে, উচ্চাকাঙ্খাহীন পুরুষের সঙ্গে, যারা নিজের সম্পর্কেই সন্দেহে ভোগে, তাদের সঙ্গে ঘর করা যায় না, সে স্টাড-বাইসন হলেও । তাছাড়া মনের দিক থেকে আমরা অনেক দূরে চলে গেছি, নর্থ পোল সাউথ পোল । আমি তোকে সেরকমই ফ্লেশ অ্যান্ড ব্লাড চাই, যেরকম ছোটোবেলায় চাইতাম; ফ্লেশ অ্যান্ড ব্লাড, ফিলমি ভালগার প্ল্যাটনিক

প্রেম নয় । তোর সঙ্গে এখন প্রতিদিন শুতে পারি, অবাধ যৌনতার খেলা খেলতে পারি সারা ফ্ল্যাটে

দৌড়ে-লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে । কিন্তু ঘর করা সম্ভব নয় । ঘর করার ব্যাপারটা রুটিন । আর দুজন মানুষের রুটিন যদি খাপে-খাপে না মেলে তাহলে মনের ডিফারেনসেস মেটানো কঠিন ।

        অঞ্জলির বরের ড্রেসিংগাউন পরে, পারফিউম মেখে, লাঞ্চ করল রাহুল । হুইস্কি খেল দুজনে । ব্ল্যাক ডগ, নিশ্চয়ই স্মাগলিং করা হুইস্কি । তারপর বেডরুমে গিয়ে সেই যে বিছানায় আশ্রয় নিল, আচমকা একে আরেকজনকে টেনে নিয়ে আদর করল স্কুলের দিনগুলোর ঢঙে । রাহুলের দেহ তবু সাড়া দিল না ।

         –কী হয়েছে তোর ? রেসপন্ড করছিস না, একেবারে ফ্রিজিড ।

         –জানি না । রাহুল ভাবছিল মোক্ষম কথাটা বলবে, যে ,একজন মেয়ে ওর মনের মতন নয় , এই ধারণা মগজে একবার ঢুকে গেলে ও ফ্রিজিড হয়ে যায় , সেকারণে ও যৌনকর্মীদের বাড়ি যায় না। 

          অঞ্জলি ওর স্মাগলার বরের গ্রামের বাড়ি আর সেখানে সঙ্গমের আলোচনা আরম্ভ করল, রাহুলকে ঈর্ষার মাধ্যমে যদি উত্তেজিত করা যায় । ওদের বাড়িটা বাঁশের তৈরি, জমি থেকে বেশ উঁচুতে, বাঁশ পুঁতে-পুঁতে তার ওপর দুতলা টালির চালার বাড়ি । বর্ষায় বাসার তলায় জল জমে থাকে, মাছ ধরা যায়, ডিঙি করে যেতে হয় রাস্তা পর্যন্ত । পাতা বাঁশের ওপর মাদুর পেতে সঙ্গম করার সময়ে পুরো বাড়িটা সঙ্গীতময় হয়ে ওঠে, বাঁশের ক্যাঁকোর-ক্যাঁকোর শব্দে। স্মাগল-করা জিনিস লুকোবার জন্য বাঁশের দেয়ালে খোপোর গড়া আছে, পুলিশ রেইড করলেও মাল খুঁজে পাবে না, যদিও ওই গ্রামে যেতে হলে ট্রেন তারপর বাস তারপর কাঁচাপথে মোটর সাইকেল তারপর কয়েক কিলোমিটার হাঁটা, কিংবা বর্ষায় ডিঙি-নৌকো ।

          গল্প শুনতে-শুনতে রাহুল ঘুমিয়ে পড়েছিল ।

          সকালে রাহুল যখন জামা-ট্রাউজার-জুতো পরে তৈরি, অঞ্জলি বলল, তুই বেসিকালি কাওয়ার্ড, তাই  এড়িয়ে গেলি । তোর পকেটে যে কাগজটা ছিল তাতে যাদবপুরের ঠিকানা লিখে দিয়েছি ; আর এই বাড়িটা তো তুই চিনেই গেলি।  ফোন নম্বরও লিখে দিয়েছি । আমি তুললে রেসপণ্ড করিস, নয়তো করিস না । যদি তোর কাওয়ার্ডনেসকে কাবু করতে পারিস তাহলে চলে আসিস ।

       তুই চল না আমার সঙ্গে । পালিয়ে চল । আমার নাম-ধাম তো আর তোর বর জানে না । কার সঙ্গে ইলোপ করলি কি করেই বা জানবে । আমার আস্তানা থেকে ডিভোর্স নোটিস পাঠিয়ে দিস । আবার অবাস্তব প্রস্তাব দিল রাহুল । দিয়ে ভয়ও করল, কে জানে, যদি অঞ্জলি প্রস্তাবটা মেনে নিয়ে বলে ওঠে, ঠিক আছে, চল ।

       যাক, তা বলল না অঞ্জলি । বলল, তুই মাংসের সম্পর্ককে ডিবেস করে ফেলছিস । আমি তো আছিই, তোর বাড়িতে না গিয়ে অন্যের বাড়িতে আছি, তাতে কী এলো-গেলো ।

       দাঁড়া, বলে, অঞ্জলি ড্রইংরুমের একটা আলমারি থেকে রাহুলকে চামড়ার পার্স দিয়ে, যোগ করল, এই নে, তোর ট্রাউজারের পকেটে তো দেখলাম পার্সটার্স নেই, পকেটে টাকা গুঁজে রাখিস । হিসাব রাখিস কী করে ?

       –হিসাব ? আমি তো কোনোকালে কোনো কিছুর হিসেব রাখিনি । বন্ধুবান্ধবরা অভাবের কথা বললেই সাহায্য করি ; সময়কে লাগাতার খরচ করতে থাকি ।

       –এত দিনে কিছু একটা হয়ে ওঠা উচিত ছিল তোর ।

       ‘হয়ে ওঠা’ ! কতবার শুনেছে কথাটা রাহুল । এই হয়ে ওঠা ব্যাপারটা ঠিক কী, ভেবে কুলকিনারা পায়নি । মানুষ তো মানুষই , তার আবার হওয়াহয়ির কী আছে ! মানুষ কী ভাবে ধাপে ধাপে বিবর্তনের সিঁড়ি বেয়ে জেলি-প্রাণ থেকে মানুষ হল তা তো ডারউইন বলে গেছেন । তারপর আবার কী হয়ে উঠবে মানুষ ? বাইবেলের গল্প থেকে ইউরোপের লোকেরা বেরুতে পারছে না বলে আমরাও কেন আটকে পড়ব সেসব গল্পে ? বিজ্ঞান বাদ দিয়ে হয়ে ওঠার গল্প । কেউ কি অপেরা-গায়ক বা অপেরা-লেখক হয়ে ওঠে ? রবীন্দ্রনাথ কি হয়ে ওঠার কথা চিন্তা করেছিলেন ? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কি চেয়েছিলেন শব্দকোষের ভাঁড়ার আবিষ্কারক হয়ে উঠবেন ? ইউরোপ গিলিয়েছে, আরও নানা রকমের গল্পের সঙ্গে এই হয়ে ওঠার গল্প । হাতে কলম এলেই আরম্ভ হয়ে যায় হয়ে ওঠার কৌম-নিরপেক্ষ আনুই বিষাদ দুঃখ অশান্তি ।

     বিষাদ দুঃখ অশান্তি ! রাহুলের বয়স তখন কত হবে, মমমমমমমম, যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । লেক মার্কেটের সামনের হোটেল ভেঙ্কটেশ  থেকে বেরিয়ে দাদা অনিকেতের বাড়ি যাবে বলে স্ত্রী সুমনার সঙ্গে টালিগঞ্জমুখো ট্রামে চাপতে যাচ্ছিল। কলকাতার ফ্ল্যাট বেচে দেবার পর, কলকাতায় গেলে,ওই হোটেলেই উঠত সেসময়ে । রাসবিহারি

ক্রসিঙে একজন পেটমোটা মোদো-গাল প্রৌঢ় সামনে এসে বলল, ‘স্যার চিনতে পারছেন ?’ অনেককেই চিনতে পারে না

রাহুল আজকাল, এমনকি মুখ দেখে চেনা মনে হলেও,  নাম মনে পড়ে না । স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চোখে চাউনি-প্রশ্ন তুলতে, সুমনাও মাথা নাড়ল, উঁহু ।

     –স্যার, আমি অনির্বাণ মৌলিক ।

     রাহুল, তবু মনে করতে পারল না ।

      –আপনার আন্ডারে জুনিয়ার অফিসার ছিলাম, কলকাতাতেই, আপনি ইনচার্জ ছিলেন, আপনি আমার অ্যাপলিকেশান ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, মনে পড়ছে ?

      –না না, আমি কখনও কারো কোনো দরখাস্ত ছিঁড়ে ফেলে দিইনি, প্রতিটি অ্যাপলিকেশান রেকমেণ্ড করেছি, তা সে যোগ্য হোক বা না হোক ।

     –আমি অন্য অ্যাপলিকেশানের কথা বলছি স্যার । আমি গ্রেপ্তার হয়ে হাজতে একরাত ছিলাম, চাকরি নিয়ে টানাটানি হতে পারত, আপনি বাঁচিয়েছিলেন ।

     মনে পড়ল সেই যুবক অনির্বাণ মৌলিককে । বলল, কিন্তু এরকম কুৎসিত হয়ে গেলে কী করে ? তোমার তো ফিল্মস্টারের মতন চেহারা ছিল, তোমার স্মার্টনেস তোমার সহকর্মীদের ঈর্ষার কারণ ছিল । সেসব মিটে গেছে ? বললেও, ভেঙেপড়া আদল দেখে, রাহুল বুঝতে পারল যে সেই যুবকটি নিজেকে ধ্বংস করে, জন্ম দিয়েছে এই মোটা ভ্যাদকা লোকটাকে ।

     অনির্বাণ মৌলিক বিয়ে করেছিল । ছেলে হয়েছিল একটা । তারপর ওর বদলি হয়ে গেল মিজোরাম । ওর স্ত্রী যেতে চাইল না । অনির্বাণ জোরাজুরি করেনি, মিজোরামে ছেলের স্কুলের সুবিধা নেই, স্ত্রীকেও আত্মীয়স্বজনহীন একা থাকতে হবে, কেননা ওকে তো সারা রাজ্যে ট্যুর করে বেড়াতে হবে । দেড় বছর মিজোরামে কাটিয়ে, টিএ-ডিএর যথেষ্ট টাকাকড়ি জমিয়ে ফিরে এলো । ফিরে, জানতে পারল, ওর স্ত্রী প্রেগন্যান্ট । অনির্বাণ তো ওর স্ত্রীর সঙ্গে দেড় বছরের একদিনও শোয়নি, তো বউ অন্তঃস্বত্তা হল কী করে ! স্ত্রীকে অনুরোধ করল, অ্যাবর্ট করিয়ে ফেলতে । স্ত্রী রাজি না হওয়ায়, শ্বশুর-শাশুড়িকে জানালো ঘটনাটা । শ্বশুর, শাশুড়ি আর স্ত্রী ওর বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ দায়ের করল থানায় । অনির্বাণ মৌলিক গ্রেপ্তার হয়ে চালান হয়ে গেল ।

    ছাড়া পেয়ে পরের দিন একটা দরখাস্তে বিস্তারিত লিখে রাহুলের কাছে জমা দিয়েছিল । ওটা ফরোয়ার্ড করলেই যুবকটি চাকরি থেকে সাসপেন্ড হয়ে যাবে । রেস্তহীন মকদ্দমা যে কী ব্যাপার, তা ভালোই জানা ছিল রাহুলের । ফৌজদারি আদালতে দিনের পর দিন একা-একা দাগিদের মাঝে কপর্দকহীন সময় কাটানো ! অ্যাপলিকেশান ছিঁড়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিয়ে রাহুল ওকে বলল, চেপে যাও, কেস-ফেস লড়তে হয়  চুপচাপ লড়ো, কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই ; আর যদি তোমার স্ত্রীকে তুমি ওভাবেই অ্যাকসেপ্ট করে নিতে পারো, তাহলেও কাউকে কিছু বলার দরকার নেই ; পুরো ব্যাপারটা তোমার ব্যক্তিগত নির্ণয়ের ওপর নির্ভর করছে, তুমি ছাড়া আর কেউ তো কিছুই জানে না । আমিও তোমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না ; আমার কাছে ঘটনাটা ঘটেনি ।

     –আপনি যেমন বলেছিলেন, ঘটনাটা ঘটেনি, আমিও সেভাবেই অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছিলাম । কিন্তু একসঙ্গে থাকতে পারিনি, সেই থেকে আলাদা । বোঝাপড়া করে নিয়েছি । মাইনে পাই, এক তৃতীয়াংশ রেখে সবটা দিয়ে দিই, তবু আজ পর্যন্ত ছেলেদের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে দেয় নি, সামনে দাঁড়িয়ে থাকে । এই ভাবেই চলছে । মদ খাই, খালাসিটোলায় গিয়ে কাঁদি, বমি করি…

    –ডিভোর্স দিয়ে আবার বিয়ে করলে না কেন ?

    –তাহলে তো সবই জানাজানি হয়ে যেত স্যার । লোকে কী ভাবত ওর সম্পর্কে, ভেবে দেখুন, আমার কথা না হয় বাদ দিন, ছেলেগুলো বড়ো হয়ে সমাজের নোংরা লাথির মুখে পড়ত । প্রথম বাচ্চাটাও আমার নয় স্যার।

    –তুমি তো বলেছিলে..

    –বলেছিলাম ।  ডিএনএ টেস্ট করিয়ে জানতে পেরেছি । সুমনার দিকে তাকিয়ে অনির্বাণ বলল, স্যার জানেন

আমার ব্যাপারটা ।

    –অযথা টেনশান এড়াতে, ও তো অন্য কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপার সাধারণত বাড়িতে আনে না । বলল সুমনা ।

    অনির্বাণ মৌলিক টালিগঞ্জমুখো অটোয় উঠে যাবার পর, ঘটনাটা সুমনাকে জানিয়ে রাহুল  বলল, আমি এই লোকটার জীবন নষ্ট করে ফেলেছি; এর দরখাস্ত গ্রহণ করে সাসপেন্ড করে দিলে সবাই জেনে ফেলত, আর এ বাধ্য হতো

নিজের সঙ্গে নিজে লড়তে ; ফালতু পড়ে গেল এমন বউ-বাচ্চার রুলেট খেলায় যে খেলাটা প্রকৃতপক্ষে ও খেলছেই না ।

বোকার মতন কেঁদে মরছে । এ নিজেকে মেলে ধরলে প্রেমে পড়ার মতো তরুণী পেয়ে যেতো, অফিসেই ছিল কয়েকটি মেয়ে যারা এর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করত । নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা চাপিয়ে দিয়ে ধ্বংস করে ফেললুম আরেকজন  মানুষের জীবন ।

        –তুমি তো সুরিন্দরের বাবার চিঠিও ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে ; কতবার বলেছিলুম খোঁজ করো কার চিঠি, যাদের কথা উনি লিখেছেন তারা কারা, শুনলে না । চিঠি পড়েই ছিঁড়ে ফেলে দেবার এমন বদভ্যাস করে ফেলেছো যে ওর জীবনটাও নষ্ট হয়ে গেল । অনির্বাণ চলে যাবার পর বলল সুমনা ।

     রাহুলের সহকর্মী সুরিন্দর ওবেরয়ের প্রসঙ্গে কথাটা তুলেছিল সুমনা । রাহুলের বয়স তখন কত হবে, মমমমমমম, বোধহয় পঁয়ত্রিশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । অফিসে ডাকে যে চিঠিপত্র  আসে তা থেকে বাছাই করে যার চিঠি তার কাছে পৌঁছে দ্যায় পিওন । পরপর তিনদিন যে চিঠি ওর টেবিলে পিওন রেখে গেল, তাতে কেবল পদবির মিল ছিল, নামের জায়গায় কেবল শ্রীমান লেখা । ওর পদবির অন্য কেউ অফিসে নেই বলে চিঠিগুলো ওকেই পৌঁছে দিয়েছিল পিওন। 

          চিঠিতে একজন বাবা তাঁর ছেলের সংসারে কোনো গোলমাল চলছে কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন । ওর সহকর্মীদের কয়েকজনকে চিঠিগুলো পড়তে দিয়েছিল রাহুল, কিন্তু কেউই চিহ্ণিত করতে পারল না যে  প্রেরক লোকটি কে, কেননা তিনি প্রাপককে ‘বেটা’ সম্বোধন করেছিলেন আর নিজেকে ‘পিতাসমান’। চিঠিতে পিতাসমান লোকটি বেটার কাছে জানতে চেয়েছেন যে তাঁর ছেলের স্ত্রীর সঙ্গে অবনিবনার মিটমাট হয়েছে কিনা ; ছেলের বড় ছেলেকে শিখ করবে ভেবেছিল, তা করেছে কিনা ; রান্না করতে গিয়ে ওনার নাতনির হাত পুড়ে গিয়েছিল, সে কেমন আছে ;ছোটো ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করেছে কিনা, ইত্যাদি ।

         ওর, রাহুলের, অফিসের ড্রয়ার মাস তিনেকে একবার পরিষ্কার করার জন্য জমে ওঠা চিঠিগুলো ছিঁড়ে বাজে কাগজের বিনে ফেলার পর ওর নজরে পড়ল রহস্যময় চিঠিগুলোর একটা খামে পোস্টঅফিসের ছাপটা আবছাভাবে যেন হিন্দিতে ‘রোপড়’ মনে হচ্ছে।

         রোপড় ? রোপড়ের একটা গ্রামে তো ও হনিমুন করার জন্য গিয়েছিল, সহকর্মী সুরিন্দর ওবেরয়দের আখ-সর্ষে-গমের খেত-খামার ঘেরা বাড়িতে, সাটলেজ বা শতদ্রু নদীর তীরে । অপরিচিত পাঞ্জাবি গ্রামে হনিমুনের প্রস্তাবে সুমনাও রাজি হয়েছিল । দেশভাগের আগে মুসলমানদের গ্রাম ছিল ; দখল করে নেয়া বাড়িগুলোর সদর দরোজাও জানলার মাপের, হেঁট হয়ে ঢুকতে হতো, এঘর-সেঘর করতে হলেও অমনই ছোটো-ছোটো দরোজা । জানলার বদলে ছাদের কাছে ভেনটিলেটর । গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে লোটা হাতে সুমনাও কাকভোরে গিয়েছিল আখ খেতে । পরে, বেলায়, রাহুলও গিয়েছিল, উলঙ্গ হওয়া নিয়ে রাহুলের কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না, আজও নেই, কলেজ থেকে এক্সকার্সানে গিয়ে দল বেঁধে হাগতে যেতো, হাগবার সময় গালগল্প হতো, পাদবার প্রতিযোগীতা হতো ।

         সুরিন্দরদের বাড়িতে প্রতিদিন সকালে পেতলের এক ফুট উঁচু গেলাসে লস্সি, ঘিয়ে চোবানো বেসনের আর ভুট্টার আটার রুটি, পেতলের হাঁড়িতে কাঠের মুগুর দিয়ে পেষা ঘিয়ে ভাজা পালংশাক খেয়ে-খেয়ে কয়েক সপ্তাহেই চেহারার খোলতাই হয়ে গিয়েছিল ।

        সুরিন্দরকে তো চিঠিগুলো দেখিয়েছিল, কিন্তু ও বেশ হাসিমুখে বলেছিল যে ওগুলোতে তোলা প্রসঙ্গে থেকে মনে হয় অন্য কারোর।

         রোপড়ের ছাপ রয়েছে যখন, সন্দেহ থেকে বেরোতে না পেরে,  সুমনা আর রাহুল একদিন রাতে আটটা নাগাদ ঢুঁ মারল সুরিন্দরের বাড়ি । সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়েই শুনতে পেল প্রচণ্ড ঝগড়া চলছে ওর আর ওর স্ত্রীর । ফিরে যাবে কিনা, শোনা উচিত হবে কিনা, ইত্যাদি চিন্তার মাঝে দোটানায় ওরা শুনতে পেল এই কথাগুলো :

       –তোমার তো বাচ্চাদের জন্য সময় নেই ; সব সময় বাইরে থাকো, কোথায় যাও আমি জানি, ওই বয়ফ্রেন্ডের কাছে যাও দুপুরবেলা, যখন আমি অফিসে থাকি । মেয়ের ওপর রান্নার ভার দিয়ে তুমি সেজেগুজে বেরিয়ে যাও । রান্না করতে গিয়ে ওর হাত পুড়ে গেল, তবু তুমি ভ্রুক্ষেপ করলে না । দয়ামায়া খুইয়ে বসে আছো ।

      –যাই তো যাই । কেমন করে ভালো বাসতে হয় তুমি তার কিছুই জানো না । অফিস থেকে ফিরলে, অফিসের কাজ নিয়ে বসে গেলে, ব্যাস খেলে-দেলে, তারপর রুটিন মতো নিজের কর্মটি করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লে । আমার দিকে ভালো করে তাকাবারও ফুরসত নেই তোমার ; আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কেয়ার তো কোনোদিনই করলে না ।

     –বাচ্চাদের সামনে এসব আলোচনা কোরো না ।

     –মিন্টুকে শিখ করার সময়ে আমার সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন মনে করোনি । তোমার সংসারে আমার কোনো দাম আছে নাকি ? আমি কেবল জড়িয়ে ঘুমোবার পুতুল ।

     –মাইনের পুরো টাকাটা তোমার হাতে তুলে দিই ।

     –তুমি যে মাইনের টাকা দাও তা থেকে অনেক বেশি হাতখরচ খান্না আমাকে দ্যায় । তোমার সঙ্গে কেনই বা থাকবো!

    –থেকো না, কে বলেছে থাকতে ।

    –চলেই যাবো । দাঁড়াও না তোমায় দেখাচ্ছি মজা । আমি চলে গেলে তখন বুঝবে ।

         ঝগড়ার মাঝে ঢুকে পড়তে রাহুল-সুমনার মধ্যবিত্ত চেতনা বাধা দিল । সুরিন্দরের ফ্ল্যাটে না ঢুকে ফিরে গেল ওরা। রাহুল পরের দিন অফিসে গিয়ে দেখল ওর ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট সুইপাররা খালি করে দিয়েছে, নয়তো, যে চিঠিগুলো ভালো করে পড়া হয়নি, ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, ছেঁড়া টুকরোগুলো সাজিয়ে, আবার পড়ে পরিস্হিতি বোঝার চেষ্টা করত, বোঝাপড়া সম্ভব কিনা তা খতিয়ে দেখত । সুরিন্দরের বাবাকে টেলিগ্রাম করতে পারত, বা রোপড়ের গ্রামে গিয়ে নিয়ে আসতে পারত ওনাকে ।  অন্যের সংসারে মাথা গলানো অনুচিত হবে মনে করে হাত গুটিয়ে বসে রইলো ।

        দিনকতক পরে শুনলো যে সুরিন্দরের বউ ছোটো ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে একজন লোকের সঙ্গে পালিয়ে গেছে ।

       পরে , রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । রাহুলের চণ্ডীগড়ের কোয়ার্টারে মদ খাবার সান্ধ্য আড্ডায় সুরিন্দর ওবেরয় বলে ফেলল, যে ওর বউ সত্যিই একজনের সঙ্গে চলে গেছে, কোথায় গেছে জানে না, জানতে চায় না, ছোটো ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে, কেননা ওই বাচ্চাটা নিশ্চয়ই খান্নার।

        তারপর, রাহুলের বয়স যখন, মমমমমমমম, বোধহয় পঁয়তাল্লিশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, ও চলে এসেছে গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরিতে, সুরিন্দর নোট পোড়াবার স্তর থেকে ওপরে উঠে-উঠে সেই অফিসেই জাঁদরেল অফিসার হয়েছে, মুম্বাইতে রাষ্ট্রীয়স্তরের এক মিটিঙে পরস্পরের সাক্ষাৎ । সৌজন্য বিনিময়ের পর সুরিন্দর ওর অফিস কোয়ার্টারে খেতে ডাকল সুমনা-রাহুলকে । ওরা গিয়ে দ্যাখে সুরিন্দরের বউও রয়েছে । ওর বউ ফিরে এসেছে দেখে সুমনা-রাহুল ঠিকমতো সন্ধ্যাটা কাটাতে পারল না, ভেবে পেল না কী নিয়ে কথা বলবে । সুরিন্দরই বলল, ওর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে নিউইয়র্কের এক যুবকের সঙ্গে । বড় ছেলের পড়াশোনা তেমন হয়নি, নানা কারণে, তাই ভালো চাকরি পায়নি, চণ্ডিগড়ে থাকে । ছোটো ছেলের প্রসঙ্গ তুলল না ; তাকে ওরা ওর ফ্ল্যাটে দেখতেও পেল না ।

        অবসর নেবার পর একদিন হঠাৎ চণ্ডিগড় থেকে সুরিন্দরের বড় ছেলের ফোন পেয়ে জানতে পারল যে লিভারে ক্যানসার হয়েছিল সুরিন্দরের ; অপারেশন করাতে গিয়ে মারা গিয়েছে ; ও জানতে পেরেছে অন্ত্যেষ্টির পর । দিল্লিতে একা থাকত, চব্বিশ ঘণ্টার এক চাকর ছিল দেখাশোনার জন্য, গাড়ি চালাবার জন্য, সে-ই শেষকৃত্য করেছে । প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের পুরো টাকা চিকিৎসা করাতে খরচ হয়ে গেছে ।

       –মা কোথায় ?

       –মায়ের সঙ্গে ফর্মাল ডিভোর্স তো হয়নি ।

       –মুম্বাইতে তোমাদের কোয়ার্টারে ওনাকে যে দেখেছিলুম ?

       –বাবা মারা গেলে যাতে ফ্যামিলি পেনশন পান তা নিশ্চিত করতে এসেছিলেন ।

       –তোমার ছোটো ভাই কোথায় ?

       –জানি না । মা-ও কোথায় থাকে জানি না ।

      সুরিন্দর মারা যাবার পর ওর বাবার পাঠানো চিঠিগুলোর উদ্বেগের জের থেকে গেছে রাহুলের সঙ্গে, ফিকে বেদনাময় অপরাধবোধের মতন । ছিঁড়ে না ফেলে সুরিন্দরের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ওর বাবাকে বিস্তারিত জানালে উনি আর দুই পরিবারের সদস্যরা  হস্তক্ষেপ করে কিছু একটা বিহিত করতে পারতেন, সম্পর্কে ভেঙে পড়ার আগে এসে মধ্যস্হতা করতে পারতেন, ফরম্যাল ডিভোর্স করিয়ে পরিস্হিতিকে জটিলতা থেকে বাঁচাতে পারতেন। রাহুলকে অন্তত অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দিতেন ।

     সুরিন্দর কি জীবনে কিছু হয়ে উঠতে পেরেছিল ? হেরে যাওয়াটাও, বোধহয়, অনির্বাণ মৌলিকের মতনই, হয়ে

ওঠা। সুরিন্দরের বউই বা কি হয়ে উঠেছিল ? খান্না সাহেবের সঙ্গিনী ! অনির্বাণ মৌলিকের বউ কী হয়ে উঠেছিল ? গোপন প্রেমিকের মানসী ।   

      হয়ে ওঠা’ ! রাহুলের হয়ে ওঠা !

     কী ? না, নোটের মুদ্দোফরাস ! মুদ্দোফরাস হিসাবে পার্সোনালিটি নির্মাণ । শ্মশানের ডোম লাশ পোড়ায়, আর রাহুল পোড়ায় টাকার লাশ, একটা-দুটো নয় শ্মশানের চেয়ে অনেক বেশি, লক্ষ-লক্ষ, দিনের পর দিন ।

     সুযোগ পেতেই, মুদ্দোফরাসের চাকরি ছেড়ে পালিয়েছিল রাহুল । গ্রামীণ উন্নয়নের নতুন চাকরিতে, সারা ভারত চষে বেড়িয়েছে, সরকারি খরচে । তার আগে তো ও জানতোই না জোয়ার গাছ আর বাজরা গাছের তফাত, মুসুর ডাল লতা আর অড়রডাল ঝোপের তফাত, ওংগোল গরুর সঙ্গে থারাপারকর গরুর তফাত, কেন কিছু ছাগলের গলা লম্বা আবার কিছু ছাগলের গলা ব্যাপারটাই নেই, কত কি জানতো না । 

        চাকরিটার জন্য, যারা ওর ইনটারভিউ নিয়েছিল, তারা বিশেষ কিছুই জিগ্যেস করেনি । কিন্তু ও যখন উঠে থ্যাংকস জানিয়ে পেছন ফিরেছে, ইনটারভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান ওকে বললেন, মিস্টার সিংহ, ওই কোনে যে ফুলদানি রাখা রয়েছে তা থেকে ধানের শিষটা তুলে এনে আমায় দিন । শুনেই, যাতে ওর মুখ যে শুকিয়ে গেল, তা ওনারা টের না পান, রাহুল দ্রুত পেছন ফিরে, এলিমিনেশান মেথড প্রয়োগ করল । বাড়িতে সরস্বতী পুজোয় যবের শিষ দরকার হতো, সেটা ও চেনে, গমের শিষ যে যবের শিষের মতন তা ও জানে, বাদবাকি শিষের মধ্যে দুটো বটল ক্লিনারের মতন দেখতে, অতএব সেদুটো জোয়ার-বাজরা-নাচনি হবে, ঘাসের চোরকাঁটা চেনে, কাশফুল চেনে । বাঁচল যেটা, সেটাই তাহলে ধানের । শিষটা তুলে ওনাদের দেবার এক মাসের ভেতর ওর চাকরির আর পোস্টিঙের চিঠি পেয়ে গিয়েছিল ।

      পোস্টিঙের পরই, তখন রাহুলের বয়স, মমমমমমম, বোধহয় মমমম, থাকগে , সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, রাহুলকে বুন্দেলখন্ড অঞ্চল পর্যবেক্ষণ-ক্ষেত্রসমীক্ষা করে প্রতিবেদন লেখার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হল ইটাওয়া-জালাউন-ললিতপুর ইত্যাদি জেলাগুলো পরিদর্শনের জন্য । অফিসের রাজনীতির খেলায় নতুন, তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে, কৃষিজ্ঞান পরীক্ষা নেবার জন্য এবং সেই সঙ্গে অভিজ্ঞতা জড়ো করার জন্য পাঠানো হল ওকে, কেননা ওই অঞ্চলগুলোতে রাতে থাকার হোটেল, যানবাহন আর খাওয়া-দাওয়ার অভাব সহজেই কাবু করে ফ্যালে বাইরের লোকেদের।

        ওর সৌভাগ্য যে ইটাওয়ার জেলা কৃষি আধিকারিক শার্দুল মীনাকে রাহুলের কোনো শুভানুধ্যায়ী,  হবু অধস্তন অফিসার, ওর সম্পর্কে বিস্তারিত খবর পাঠিয়ে দিয়েছিল । কথা প্রসঙ্গে জানতে পারল কৃষি আধিকারিক রাহুলের স্নাতকোত্তর সহপাঠী অভিমন্যু মীনার বড় ভাই । কৃষি আধিকারিকের সরকারি বদান্যতায় জেলা সদরের আর ব্লকস্তরের অতিথিভবনগুলোয় রাতে থাকার, খাওয়ার, ব্যবস্হা হয়ে গেল । ঘোরাঘুরির সুবিধার জন্য উনি ওঁর বিভাগের বয়স্ক অভিজ্ঞ অফিসার সুগ্রিব নিমচকে সঙ্গে দিলেন । সরকারি জিপ ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে গেল রাহুল ।

        তিনদিনের ক্ষেত্রসমীক্ষায় রাহুলের কর্ডুরয় প্যান্ট  — পরে এই প্যান্ট ওর গুডলাক ট্রাউজার খেতাব পেয়েছিল –, ডোরাকাটা শার্ট, চোখের পাতা, মাথার আর ভুরুর চুল গেরুয়া ধুলোয়, এবং কাগজপত্র সংখ্যা ও তথ্যে ভরে উঠল । শুধু গেঞ্জি আর আণ্ডারওয়্যার বদলাতো, কেননা মাত্র চার দিনের ট্যুর বলে দুটো সেট শার্ট-প্যান্ট সঙ্গে নিয়েছিল ।

         অঞ্চলটা, যেখানে ওর সহকর্মীরা আসতে চায় না, ওর মনে হল বর্ণনাতীত । পথের দুধারে গভীর ও সঙ্কীর্ণ গিরিখাতের শুকনো ও বিমূর্ত ভুলভুলাইয়ার প্রায় জনহীন বিস্তার ধুলো উড়িয়ে  অধঃক্ষিপ্ত জলরাশির প্রত্যাশায় ভূতাত্বিক বৈচিত্র্যকে করে তুলেছে কূতূহলোদ্দীপক আর দূরভিসন্ধিপূর্ণ । দুপুরের আগেই দিগন্ত ঢেকে যায় গেরুয়া কুয়াশায় । এখানকার ফুল-ফল ও প্রাণীরা ছলনাময় । চারিদিকে থম মেরে মায়াময় অস্হিরতা । একটাই নদী বয়ে গেছে অঞ্চলে, যা উটের পিঠে বসে পারাপার করছে গ্রামবাসীরা ।

         চতুর্থ দিন কিছুটা যাবার পর নিমচ একটা মন্দিরের কাছে জিপগাড়ি পার্ক করতে আদেশ দিয়ে ভেতরে ঢুকতে, রাহুলও নিমচের পিছু-পিছু ঢুকে কালী মন্দির দেখে অবাক হল । সাধারণত কয়েক ঘর বাঙালি যে জায়গায় থাকে সেখানে কালী মন্দির নজরে পড়ে । নিমচকে জিগ্যেস করতে সে জানালো যে মন্দিরটা সতেরো শতকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আতেরের মহারাজা বদন সিংহ, হয়তো আপনার পূর্বপুরুষ, আপনিও তো সিংহ ! রাহুল মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল বায়বীয় আত্মীয়তা ।

         নিমচ বলল, তিনি শক্তির উপাসক ছিলেন । এখানকার শক্তি-উপাসকরা, তা সে যে জাতেরই হোক না কেন, জরুরি কাজে যাবার আগে কালীমাকে প্রণাম করে যায়, আর সফল হলে পাঁঠা বলি দেয় । হাড়িকাঠে শুকনো রক্তের দাগ দেখে বিশ্বাস হল রাহুলের । কে জানে এরা নীলকমলের গ্রামের ছিন্নমস্তার মন্দিরে মোষ বলির পর রক্তমাখা নাচ নাচে কিনা ।

         খালি-গায়ে পৈতে ঝোলানো পুরুত নিমচকে বলল, বাবাসাহেব কাছের এক গ্রামে এসেছেন । উত্তরে নিমচ বলল,

বহুদিন পর বাবাসাহেব নদীর এই পারে এলেন ।

         রাহুল গলা নামিয়ে জানতে চাইল, বাবাসাহেব কি কোনো সাধুসন্ত ?

         –জি হাঁ, পহুঁচে হুয়ে আদমি হ্যাঁয়, বলল নিমচ ।

         অভিব্যক্তিটা বেশ মনের মতন মনে হল রাহুলের, ‘পৌঁছে-যাওয়া মানুষ’ । মানুষ তো মহাশূন্যে, চাঁদে, সমুদ্রের মেঝেয়, সর্বত্র পৌঁছে গেছে । সাধুরাও মেডিটেট করে পৌঁছে যায় হয়তো অভিষ্ট্য লক্ষ্যে । ওদের আন্দোলনের এক অপেরা-গায়ক , অবিনাশ ভট্টশালি, মামলা-মকদ্দমার সময়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল । পরে রাহুল জানতে পারে যে অবিনাশ কোনো ধর্মগুরুর দর্শনে প্রভাবিত হয়ে পৌঁছে গেছে আত্ম-উত্তরণের তৃপ্তিতে । সকলেই কোথাও না কোথাও পৌঁছে যায়, রাহুলের পৌঁছোনো হয় না । যাযাবার রয়ে গেল । চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়, অথচ পৌঁছোয় না ।

          কাঁচা রাস্তায় জিপগাড়ি ছুটল, রাহুলের পোশাক ও ত্বকের রোমে ধুলোর আস্তরন সংগ্রহ করতে-করতে । কিছুটা যাবার পর লাল কাঁকরের পথের মাঝখানেই কয়েকজন গ্রামবাসী বসেছিল বলে ড্রাইভার জিপ থামাতে, তাদের একজন চালককে বলল, এই রাস্তাটা আগে গিয়ে খারাপ হয়ে গেছে, আপনারা পাশের গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে যান ।

         বাতাসকে আরও ধূসর করে সাত-আট কিলোমিটার যাবার পর রাহুল দেখল একটা বিশাল বটগাছের তলায় প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন গ্রামবাসী একজন তামাটে পেটমোটা মোড়লের সামনে বসে, সম্ভবত তার বাণী শুনছে । ‘আরে, বাবাসাহেব’ বলে, চালক সেই দিকে গাড়ি নিয়ে গিয়ে থামাল । নিমচকে নামতে দেখে রাহুলও নামল । উস্কোখুস্কো বাবরিচুল মোড়লের উর্ধাঙ্গে জামা বা গেঞ্জি নেই, কোমরে চাক-কাটা লুঙ্গি, কোঁচড়ে রাখা মুড়ি খাচ্ছে । মোড়ল বসে আছে গোবরলেপা মাটির উঁচু বেদির ওপর ।

         মোড়লের কাছে গিয়ে নিমচ হাতজোড় করতে সে ওর হাতে একমুঠো মুড়ি নিজের কোঁচড় থেকে তুলে দিল । নিমচ তা হাতে নিয়ে এক গ্রাসে খেয়ে ফেলল । রাহুলকে ইঙ্গিত করে মোড়ল নিমচকে জিগ্যেস করল, ‘সরকার বাহাদুর?’

         –জি হাঁ, নিমচের বিনয়ী প্রত্যুত্তর ।

         মোড়ল রাহুলকে ডেকে বলল, সরকার বাহাদুর, তুম ভি লো, খাও । যেখানে-সেখানে যা পাওয়া যায় তা সাধারণত খায় না রাহুল, পেট খারাপ হবার ভয়ে । ও পকেট থেকে রুমাল বের করে মুড়িগুলো বেঁধে নিল, পরে সুযোগ বুঝে ফেলে দিতে পারবে । রাহুলের আচরণে প্রীত হয়ে মোড়ল ওকে আরও কাছে ডাকল । কাছে গেলে, মাথার ওপর হাত রেখে বলল, জিতে রহো ।

         ওরা জিপগাড়িতে গিয়ে বসল । কিছুদূর যাবার পর নিমচ বলল, আপনি বুন্দেলখণ্ডের চম্বলঘাটিতে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারেন, কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করবে না, বাবার আশীর্বাদ পেলেন ।

        রাহুল জানতে চাইল, ইনি কি এখানকার ধর্মগুরু ? পোশাক দেখে তো মনে হল বয়স্ক চাষি ।

         নিমচ বলল, স্যার, উনি ডাকাত সরদার বাবা মুস্তাকিম ; সরকার ওনার মাথার দাম রেখেছে এক লক্ষ টাকা । যারা ওনার সামনে বসেছিল তারা ওনার দলের ডাকাত ।

         ভাগ্যিস গুডলাক প্যান্টটা পরে এসেছিলুম, রাহুল নিজেকে নিঃশব্দে বলে আস্বস্ত বোধ করল । কতরকমের মানুষের আশীর্বাদ যে পেয়েছে জীবনে, যাদের আশীর্বাদ পাওয়া সহজ নয় । কিছুকাল পরে কাগজে পড়েছিল, উত্তরপ্রদেশের পুলিশ  বাবা মুস্তকিমকে মেরে, রটিয়ে দিয়েছে যে ওর দলের লোকেরাই মেরেছে ওকে ; ওরা খবর পেয়েছিল যে বাবার কোঁচড়ে সবসময় শুধু মুড়ি থাকে না, তার তলায় থাকে লুকোনো টাকা । মেরে, কোঁচড়ের কয়েক লাখ টাকা মেরে দিয়ে, সরকার থেকে মুস্তকিমের মরা মাথার দামও গুনে নিয়েছে ।

          এই প্যান্টটা পরেই অতগুলো শিষ থেকে ধানের শিষ বেছে ইনটারভিউতে সফল হয়েছিল ; ওর প্রতিযোগী তো কয়েক হাজার যুবক ছিল , তাদের অনেকেরই যোগ্যতা আর পড়াশুনা ওর চেয়ে ভালো, অথচ ওকে বেছে নেয়া হল ।

         এই প্যান্টটা পরেই অঞ্জলির আলিঙ্গনে ঢুকেও বেরিয়ে আসতে পেরেছিল, নয়তো স্মাগলারের বউকে ধর্ষণ করার গ্লানিতে ভুগত সারাজীবন । স্মাগলারের বোষ্টুমি !  

         এই প্যান্টটা পরেই মুম্বাইয়ের সেনচুরি বাজারের কাছে দাউদ ইব্রাহিমের স্যাঙাতদের ফাটানো বোমা থেকে একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছিল রাহুল আর ওর স্ত্রী সুমনা ; অফিস থেকে ছেলের স্কুলে যাবার জন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়েছিল, সেনচুরি বাজার পেরোবার পরই শুনতে পেল পেছনে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ, সেই সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি । সেই বিস্ফোরণে সুমনাদের ‘লেডিজ ট্র্যাঙ্গল’ নামের গোষ্ঠী, যাতে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান মহিলারা ছিল, তা ভেঙে গিয়েছিল ।

ওদের গোষ্ঠীর সদস্যারা মুম্বাইয়ের তিনটি ধর্মস্হানে যেত প্রতি মাসে একবার । মঙ্গলবার প্রভাদেবীর সিদ্ধি বিনায়ক মন্দিরে, বুধবারে মাহিম চার্চের নোভেনায় আর শুক্রবারে ভাটার সময়ে হাজি আলির মাজারে । বিস্ফোরণের পর, যে যার আবার জন্মসূত্রে-পাওয়া নিজের-নিজের সম্প্রদায়ের খোলশে ঢুকে পড়েছিল । সুমনার বন্ধুমহলও বদলে যেতে লাগল তার পর থেকে । তারা ওকে টেনে নিয়ে গেল রামকৃষ্ণ মঠে, দীক্ষা নেবার জন্য । দীক্ষা নিয়ে, দুবছর বেশ জপ-তপ করল, তারপর ছেড়ে দিল, উড়ু-উড়ু মন আর একঘেয়ে বসে থাকার ক্লান্তিতে । ধর্ম থেকে, ততদিনে রঙিন টিভির জগতে যে বিস্তার ঘটল, তাতে রওনা দিল । কল্পনার জগতে । ধর্মের কল্পনা জগতের চেয়ে টিভির কল্পনা জগত অনেক রঙিন ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *