১১.
বাংলো থেকে ওরা সাড়ে তিনটেতে বেরিয়েছিল। এখন সাড়ে চারটে বাজে।
সকলে মাচায় বসে গেছে। ওদের বসিয়ে দিয়ে দুর্গা, গঙ্গাধর, বাইধর, জগবন্ধু–ওরা সকলে কথা বলতে বলতে বাংলোয় ফিরে গেছে। গাড়িটা রাস্তায় পার্ক করানো আছে।
রাকেশের মাচায় শ্রুতি বসেছে। অন্য মাচায় সুব্বল আর অর্জুন। শ্রুতি ফিসফিস করে বলল, কফি খাবেন?
রাকেশ বলল, না। পরে। চুপ করে বসে থাকো।
শ্রুতি রাকেশের মুখের দিকে তাকাল। রাকেশ শরীরটাকে হেলা করে চলে। কিন্তু তাকে কেমন যেন ভালো লাগে তার মনের জন্যে। অর্জুনের বুকে শুয়ে আদর খেতে খেতে কখনো যে শ্রুতির রাকেশের কথা মনে পড়ে না, তা বললে মিথ্যে বলা হয়।
রাকেশ একদৃষ্টে মড়িটির দিকে চেয়ে আছে। মাঝে মাঝে অতিধীরে চুলবুল করে মাথাটি এপাশে ওপাশে ঘোরাচ্ছে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে–ওর প্রতিটি ঘাস, পাতা, গাছকে চোখ দিয়ে ও চিরে চিরে দেখছে। সেইমুহূর্তে, সেই শীতের বনের বিধুর বিকেলে রাকেশের পাশে মাচানের ওপরে বসে ভীষণ ভালো লাগছিল শ্রুতির। অর্জুনের সঙ্গে বিয়ের পর, এত কাছে এত নিরবচ্ছিন্ন অবকাশে, এত নিবিড় নির্জনতায় শ্রুতি রাকেশের কাছে আর কখনো আসেনি। ঝুপরি ঝুপরি পাতার আড়াল দিয়ে পশ্চিমের সিঁদুরে আকাশ দেখা যাচ্ছে একচিলতে। সেই পটভূমিতে রাকেশের উদ্ধত চিবুকসমেত মুখটি দেখা যাচ্ছে। কানের কাছ অবধি টুপিটা নামানো রয়েছে। আজ রাকেশ বোধ হয় দাড়ি কামায়নি। তার গালে একটি সবুজাভা ফুটে আছে।
মাচার চারপাশ থেকে জঙ্গল ঘিরে নানারকম শব্দ উঠছে। কতরকম পাখি, কতরকম পোকা কত কী ভাষায় কথা বলছে। কী একটা পাখি টাকুর-টুসি টাকুর-টুসি করে ডেকে চলেছে। যদিও অনেক শব্দ আছে চারিদিকে, যদিও এখনও অন্ধকার হয়ে আসেনি–তবু শ্রুতির কেমন গা ছমছম করছে। মৃত মোযটাকে দেখা যাচ্ছে মাচা থেকে। মাঝে মাঝে একটি উৎকট গন্ধ আসছে। ঝরনাটি বয়ে চলেছে কুলকুল কুলকুল একটানা আওয়াজ করে।
শ্রুতি আবার রাকেশের মুখের দিকে চাইল। আজ রাকেশ নায়ক। আজ সন্ধেবেলা যে নাটক–যে একাঙ্কিকা নাটক সম্পাদিত হবে তা কেবলমাত্র দুটি পুরুষ চরিত্রের। রাকেশ আর বনের রাজা বাঘ। শ্রুতিও মঞ্চে উপস্থিত, কিন্তু তার কোনো ভূমিকা নেই। সে রাকেশের মতো শিকারি নয়, সে রাকেশের স্ত্রী নয়, জীবনসঙ্গিনী নয়, সে কেবল রাকেশকে ব্যথা দিয়েছে। কথার মারপ্যাঁচে ঠকিয়েছে–মিষ্টিমুখে দূরে রেখেছে। আর এই সরল রাকেশ তার কাছে ভীরুর মতো কেবল আঘাতের পর আঘাতই সয়েছে। তবু তাকে আরও বেশি করে ভালোবেসেছে।
কেন জানে না, সেইমুহূর্তে শ্রুতির মন কী এক বেদনায় হঠাৎ দ্রবীভূত হয়ে গেল রাকেশের প্রতি সমবেদনায় তার সমস্ত সত্তা ককিয়ে কেঁদে উঠল। তার খুব ইচ্ছে করল, যে দান সে কোনোদিন রাকেশকে দেয়নি–অথচ যে দান সে অবহেলায় ইদানীং অনুক্ষণ অর্জুনকে দিচ্ছে, সেই দান এই সুন্দর অথচ ভয়ার্ত গোধূলি বেলায় রাকেশকে দেয় অথবা নিজে তা গ্রহণ করে! ওর মনে মনে মর্মরধ্বনি উঠল।
এমন সময় রাকেশ তার দিকে চাইল। আশ্চর্য! সে চাউনিতে কোনো চাওয়া নেই–এখন রাকেশের চোখে, রাকেশের মনে, মড়িতে-ফেরা বাঘ ছাড়া আর কিছু নেই। শ্রুতি হঠাৎ কুঁকড়ে গেল। ছিঃ, সে কী করতে যাচ্ছিল! সে না মেয়ে? মেয়েরা যে বরাবর পুরুষদের হারিয়ে এসেছে, সে তো কেবল নিজে থেকে কিছু না দিয়ে। কলেজে পড়ার সময় মায়ার খেলার গান গাইত শ্রুতি–আশ মেটালে ফেরে না কেহ, আশ রাখিলে ফেরে। মনে পড়ে গেল শ্রুতির, নিজেকে ধন্যবাদ দিল নিজেকে প্রকাশ করে ফেলেনি বলে।
এই রাকেশকে শ্রুতি শ্রদ্ধা করে। শুধু রাকেশ কেন, সব পুরুষকেই করে। যে পুরুষ যথার্থ পুরুষ, সে যখন কাজ হাতে নেয় তখন তার স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা সকলকেই সে ভুলে যায়, সে তখন পার্থর মতো কেবল পাখির চোখই দেখতে পায়–সে তখন কর্তব্যে অটল, চরিত্রে দৃঢ়; কাজের পুরুষ। মেয়েরা বরাবর এই ক্ষণিক পুরুষকেই শ্রদ্ধা করে এসেছে, আর পুতুলের মতো খেলা করে এসেছে অবকাশের পুরুষকে নিয়ে, পুরুষের প্রেমিক সত্তাকে নিয়ে।
রাকেশ ফিসফিস করে শুধোল, শীত করছে?
শ্রুতি অস্ফুটে বলল, হু। হাত দুটো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
রাকেশ কথা না বলে শ্রুতির হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিল। নিজের হাতের চওড়া তেলোয় রেখে ধীরে ধীরে ঘষে ঘষে উষ্ণ করে দিল। তারপর মাথা নীচু করে শ্রুতির হাতটি নিয়ে নিজের মুখে, চোখের পাতায়, গালে বুলল, কোমল কম্বলের কোনা দিয়ে ওর হাত দুটি ঢেকে দিল। যতক্ষণ রাকেশ এই সমস্ত করছিল, শ্রুতির সমস্তক্ষণ রাকেশকে একবার আদর করতে ভীষণ ভীষণ ইচ্ছে করছিল–কিন্তু অনেক কষ্টে, অনেক কষ্টে নিজেকে নিবৃত্ত করল ও। কিন্তু ওর হাত দুটি কম্বলের নীচে ঢেকে দিয়েই রাকেশ হঠাৎ অভাবনীয় যা এতদিন এত বছরও করেনি তাই করে বসল। শ্রুতিকে বাঁ-হাতে জড়িয়ে ধরে তার গ্রীবায়, চোখে, ঠোঁটে দ্রুত চুমু খেয়ে চলল। শ্রুতির সমস্ত সত্তায় ঝরনার শব্দ বাজতে লাগল–কুলকুল কুলকুল কুলকুল কুলকুল। কী এক আশ্চর্য আবিষ্কারে শ্রুতির শীতার্ত শরীর শিরশির করে উঠল। চোখ জলে ভরে উঠল। অর্জুন তাকে কাছে টানলে, কই, তার এমন তো কখনো মনে হয়নি। এমন করে তার সমস্ত শরীর-মন ভালো লাগায়, ভালোবাসায় পরিপ্লুত হয়ে যায়নি? এমন করে কখনো তো সে এমন শিউরে শিউরে ওঠেনি? এই সামান্য দানে যদি এত ভালো লাগা তো কেন এত দিন এত বছর নিজেকে এবং রাকেশকে এমন করে বঞ্চিত করে এসেছিল ও?
ভালো লাগায় শ্রুতি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। রাকেশ ওকে শুধু বাঁ-হাত দিয়ে জড়িয়ে বসে থাকল। শ্রুতি মাথাটি এলিয়ে রইল রাকেশের বলিষ্ঠ কাঁধে।
রাকেশ ফিসফিস করে বলল, ইশ, এখনও তোমার হাত আগের মতো ঘামে?
শ্রুতি সোজা হয়ে বসে বলল, এখনও তো কত কিছুই হয় আগের মতো। সূর্য ওঠে পাখি ডাকে।
শ্রুতি বলল, ওদের মাচা থেকে আমাদের মাচা দেখা যাচ্ছে–ও যদি দেখে থাকে?
হঠাৎ রাকেশ সেদিকে তাকাল। দেখল অর্জুন একদৃষ্টে ওদের মাচার দিকেই চেয়ে আছে। কিন্তু পাতার আড়াল থাকায় খুব সম্ভব এ মাচার কিছুই ও দেখতে পাচ্ছে না। রাকেশ কোনো কথা বলল না। শ্রুতির কথার জবাবও দিল না।
কফির ফ্লাস্কটা থেকে ঢেলে কফি নিয়ে নিজে নিল এবং শ্রুতিকে দিল। তারপর শ্রুতির চোখে ঠোঁট ছোঁয়াল।
তারপর দুজনে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।
অনেকক্ষণ পর শ্রুতি বলল, বাঘ কখন আসবে?
রাকেশ বলল, জানি না। মাচায় এসে এত কথাবার্তা বলছি, বাঘ না আসার সম্ভাবনাই বেশি।
সেটা কি আমার দোষ?
রাকেশ বলল, না, আমার দোষ। সব আমার দোষ।
শ্রুতি কথা না গলে রাকেশের হাতে ওর হাতটি রাখল। স্বর্ণময়ী সন্ধ্যা সেই দুটি মহৎ মানুষের দিকে বিমুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল।
অন্য মাচায় অর্জুন পা ছড়িয়ে বসেছিল; মাঝে মাঝে ফসফস করে দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরাচ্ছিল।
সুব্বল বলল, এমন করবেন না বাবু, এমন করলে বাঘ আর আসবে না।
অর্জুন বলল, তাতে আমার কী?
সে কী বাবু? বাঘ মারতে এলেন আর বলছেন আপনার কিছু নয়?
আমি বাঘ মারতে আসিনি। আসলে, ফর দ্যাট ম্যাটার, আজকে কেউই বাঘ মারতে আসেনি।
সুব্বল জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল।
অর্জুন ভাবল, আজকে শ্রুতিকে ছেড়ে দেবে না রাকেশ রায়। শালা বাঘ-মারা শিকারি। খুব রমদা-রমদি হবে। আমার ওয়াইফকে বাঘ মারা দেখাবে তুমি! কী আর করব- ছোটোবেলা থেকে শহরের শিকারই শেষ করতে পারলাম না–জঙ্গলে আসার টাইম পেলাম কই? নইলে বাহাদুরির কী আছে? দাঁত বের করতে করতে, হ্যাঁ হ্যাঁ : করতে করতে বাঘ এল, তাকে জার্মানির তৈরি পাওয়ারফুল রাইফেল দিয়ে, মাচায় বসে অন্য লোকের স্ত্রীর বুকে হাত রেখে গুলি করে দিলাম–আর সে শালা হতভাগা গুলিখোর বাঘ মরে গেল। এতে বাহাদুরির কী আছে তা তো আমি জানি না! শালা বাঘ্বডুম্বা!
তারপর অর্জুন সুব্বলকে বলল, বাঘ্বডুম্বা কোথায় আছে জানো?
সুব্বল বলল, বাঘ আসবে না বাবু আর। আপনি এত কথা বলছেন!
অর্জুন বলল, তুমি থামো। বাঘ্বডুম্বা কোথায় জানো?
না। সেটা কি জন্তু বাবু? একরকমের বাঘ?
আরে না না, বাঘ নয়। বাঘ্বডুম্বা ভূত। বলেই কিরি কিরি কিরি কিরি ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ আওয়াজ করে উঠল আস্তে আস্তে।
সুব্বল অবাক হয়ে বলল, এই ডাক তো শুনেছি বাবু!
শুনেছ? কোথায়?
আমরা যখন বাইসন মেরে ফিরে আসছিলাম তখন।
আমরা মানে? সঙ্গে রাকেশবাবুও ছিল?
হ্যাঁ, বাবু তো ছিলই। বাবু টর্চ দিয়ে কত খুঁজলেন গাছে।
তাই বুঝি? অর্জুন মনে মনে বলল, শালা বেমালুম চেপে গেছে। শালা বাঘৃদুম্বা! নিজের পেছনে বাতি ফেলে কে আর কবে নিজেকে চিনেছে?
অর্জুন ফ্লাস্ক খুলে গেলাসে ঢালতে লাগল।
সুব্বল বলল, কী বাবু? চা?
ভাগ। চা! সান-ডাউনের পর চা খাই না আমি। হুইস্কির সঙ্গে জল মেশানো আছে। তোর রাকেশবাবুকে একটু দিয়ে আসবি নাকি?
বাবু শিকারের সময় ওসব খান না। শিকার কি খেলার জিনিস বাবু? শিকার সাধনার জিনিস।
অর্জুন বলল, যা বলেছ। সাধনা না করলে সিদ্ধিলাভ হয়?
সেই শেষকথা। তারপর অর্জুন যতক্ষণ মাচায় ছিল আর একটিও কথা বলেনি সে। খালি ধীরে ধীরে ফ্লাস্ক থেকে পানীয় ঢেলেছিল আর চুমুক দিয়েছিল।
সুব্বল দেখল সন্ধে হয়ে আসছে। এখনও বাঘ এল না। ওর টর্চের ক্ল্যাম্পটি ঠিকমতোই লাগানো আছে–রাকেশের বন্দুকে ফিট করা আছে। নিথর হয়ে বসে রইল সুব্বল। সুব্বল ভাবল, আজ আর বাঘ আসবে না।
সূর্য সবে ডুবেছে–পাখিদের সব ডাক থেমে গেছে। এমন সময় ডুঙরি পাহাড়ের দিক থেকে এসে একটা কোটরা খুব ভয় পেয়ে ডাকতে ডাকতে ঝরনাটার পাশ ঘেঁষে চলে গেল। দূরের শিমুল গাছ থেকে একটি ময়ূর হঠাৎ কেঁয়া-কেঁয়া করে উঠল।
ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। ঘন কালো অন্ধকার। শ্রুতি চারিদিকে চেয়ে দেখল। চোখ চাওয়া যায় না। অন্ধকারে চাইলে অন্ধকার চোখে থাবড়া মারে। সে অন্ধকারে চাইলে চোখ ব্যথা করে। শ্রুতি মাথা তুলে ওপরের দিকে চাইল।
ওপরে তারাভরা আকাশ। কালপুরুষ কোমরে তরোয়াল নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। সন্ধ্যাতারাটি স্নিগ্ধ সৌকুমাৰ্যে প্রসন্ন প্রদীপের মতো জ্বলছে। একমাত্র ওপরে তাকালেই আলো দেখা যায়। ভালো লাগে।
রাকেশ অনেকক্ষণ থেকে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ শুনছিল ঘাসের মধ্যে–ফিসফিসানির মতো। কিন্তু ঝরনার শব্দে ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছিল না। হঠাৎ মড়ির কাছে একটা স্পষ্টতর আওয়াজ শোনা গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে মড়ির দুর্গন্ধটি অনেক তীব্র হয়ে ছড়িয়ে গেল চারদিকে। রুদ্ধ নিশ্বাসে আরও কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল রাকেশ, তারপর বাঁ-হাতটি আলতো করে শ্রুতির গায়ে ছুঁয়ে ওকে স্থির হয়ে বসতে ইশারা করে, নিঃশব্দে রাইফেল তুলল। হালকা থার্টি-ও-সিক্স রাইফেল তুলে আন্দাজে ওইদিকে নিশানা করতে সময় লাগল না। এবং যেই মড়ির কাছের ঘাসে আবার একবার হ্যাঁচড়ানোর আওয়াজ শোনা গেল, রাকেশ ব্যারেলের সঙ্গে লাগানো ক্ল্যাম্পের সুইচটি টিপল। কিন্তু আলো যেখানে পড়ল সেখানে বাঘ কি মড়ি কিছুই দেখা গেল না। চকিতে ব্যারেলটা ঘুরিয়ে আন্দাজে মড়ি যেদিকে ছিল সেদিকে আলো ফেলতেই রাকেশের আলো একটি লক্ষমান বাঘের সোনালি ও সাদা ডোরাকাটা শরীরে পড়ল –মুহূর্তের মধ্যে রাকেশ গুলি করল। এবং বাঘটি প্রচন্ড হুয়াও আওয়াজ করে আলোর বৃত্তের বাইরে লাফিয়ে চলে গেল।
সুব্বলও দেখতে পেয়েছিল। সুব্বল নিজের আলো জ্বালেনি। কারণ একসঙ্গে দুটি আলো জ্বালালে বাঘ হয়তো দাঁড়াত না। মানে বাঘ দাঁড়াবে ভেবেছিল সুব্বল, কিন্তু বাঘটি দাঁড়াল না মোটে। সুব্বলের মনে হল, গুলিটা পেটে বা কোমরের নীচে কোথাও লেগেছে। ভালো জায়গায় লাগেনি। যে সময় গুলি হয়, সে সময় বাঘের বুক কিংবা গলা কিংবা মাথা কিছুই আলোয় দেখা যাচ্ছিল না।
গুলির আওয়াজের পর অর্জুন কথা বলল, কী হল? বাঘ মরেছে?
সুব্বল বলল, মরবে, তবে কাল এ বাঘ নিয়ে কপালে ভোগ আছে।
কেন?
বা:, এই খন্ডিয়া বাঘকে খুঁজে বের করে মারতে হবে না?
অর্জুন বলল, তাই বুঝি রেওয়াজ? খণ্ডিয়া বাঘ মানে কী? ইনজিয়োরড?
গুলি-লাগা বাঘ। খন্ডিয়া বাঘকে খুঁজে বের করে মারার সময়ই তো পরখ হয়, কে কত বড়ো শিকারি।
অর্জুন একটা হেঁচকি তুলল, বলল, রিয়্যালি? বহুত আচ্ছা।
.
১২.
ওরা খেতে বসেছিল।
স্যালাডের ডিশটি এগিয়ে দিতে দিতে শ্রুতি বলল, আমরা যে নেমে এলাম মাচা থেকে, বাঘ যদি তখন নীচে বসে থাকত?
রাকেশ বলল, হয়তো থাকতে পারত–কিন্তু আমরা যথাসম্ভব সাবধান হয়ে এবং গুলি করার প্রায় একঘণ্টা পরে নেমেছি। তবুও হয়তো থাকতে পারত।
অর্জুন বলল, স্টম্যাক শট খুব পেইনফুল, না? বাঘটার এখন নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে।
রাকেশ বলল, তা হচ্ছে। কিন্তু কী করা যাবে এল? কাল সকালেই খুঁজে বের করে আমাদের তাকে মারতে হবে।
আপনার কি মনে হয় পায়ে হেঁটে আহত বাঘ মারা ঠিক হবে, ওই লাইট রাইফেল দিয়ে? সুব্বল আমাকে বলছিল যে, তা নাকি খুব রিস্কি হবে।
রাকেশ বলল, না না। ওই রাইফেল নিয়ে যাব না। ফোর-সেভেনটি-ফাইভ নিয়েই যাব।
সে রাইফেলের তো ডানদিকের ব্যারেলই ফোটে না বলছিলেন।
ডানদিকের ব্যারেল নাই বা ফুটল, এ রাইফেলের একটা গুলিই যথেষ্ট–সে যত বড়ো বাঘই হোক না কেন। তুমি তো এসব বোঝে অর্জুন, দেখো না রাইফেলটার কিছু করতে পারো কিনা?
শ্রুতিও বলল, হ্যাঁ, দেখো না। নইলে একব্যারেল ভরসা করে অত বড়ো আহত বাঘকে মারতে যাওয়া মানে প্রাণ হাতে করে যাওয়া।
অর্জুন শ্রুতির দিকে একবার তাকাল, তারপর মাংস চিবোতে চিবোতে বলল, বলছ?
শ্রুতি বলল, হ্যাঁ, বলছি।
অর্জুন বলল, খাওয়ার পর আমাকে ও রাইফেলের স্ট্রাইকিং পিনের অ্যাকশনটা বুঝিয়ে দেবেন রাকেশদা, আমি দেখি কী করতে পারি।
রাকেশ বলল, আচ্ছা।
অর্জুনের লাল চোখ জ্বলছিল লণ্ঠনের আলোয়। অর্জুনের মাথার মধ্যেও আগুন জ্বলছিল। বাঘটার খুব লেগেছে, ভাবছিল অর্জুন। পেটে গুলি লেগেছে। অর্জুনেরও পেটে গুলি লেগেছে। আজ। পেটে গুলি খাওয়া বাঘ কাউকে ক্ষমা করে না। লণ্ঠনের আলোয় ওদের ছায়াগুলি সাদা দেওয়ালে লাফালাফি করছিল–আর অর্জুনের বাঘটির কথা মনে হচ্ছিল। বাঘটা বোধ হয় এখন কোনো ঘাসবনে, কী কোনো গুহায় এই নড়াচড়া-করা কালো ভূতুড়ে ছায়ার মতো অন্ধকারে গড়াগড়ি দিচ্ছে, রাকেশকে অভিশাপ দিচ্ছে।
শ্রুতি যে এতখানি বাড়াবাড়ি করবে বুঝতে পারেনি অর্জুন। শুধু রাকেশ নয়–শ্রুতিরও দোষ আছে। মাচায় কী ঘটেছে না ঘটেছে তা অৰ্জুন লক্ষ করেছে। এ কে সান্যাল কাউকে ক্ষমা করবে না।
খাওয়া-দাওয়ার পর রাকেশ রাইফেলটা এনে অর্জুনকে দেখিয়ে দিল কী করে ট্রিগার টানলে, স্ট্রাইকিং পিনটি গর্ত থেকে সামনে বেরিয়ে এসে কার্টিজের পেছনে স্ট্রাইক করে। অর্জুন একটি সিগারেট ধরিয়ে ভালো করে মনোযোগ সহকারে দেখে নিল, ডানদিকের পিনটা পুরোটা বাইরে আসছে না।
রাকেশ বলল, রাইফেলটা রইল। তুমি যদি কিছু করতে পারো তো দেখো, নইলে এই খাবার টেবিলেই রেখে দিয়ো, কাল সকালে আমি নিয়ে নেব। আজ আমার ভালো ঘুমের দরকার।
শ্রুতি গিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল।
সেদিন ও বড়ো সুখে ঘুমোবে বলে ঠিক করেছিল। কম্বলের নীচে শুয়ে শুয়ে সেদিন ও কোনো মিষ্টি-দুষ্টু স্বপ্ন দেখবে ভেবেছিল, এমন সময় অর্জুন ঘরে এল। ওর খাটের কাছে এল, কোনো কথা না বলে একটানে ওর গা থেকে কম্বলটি টেনে মাটিতে ফেলে দিল।
শ্রুতি রেগে বলল, এ কী অসভ্যতা? আমার শীত করছে।
অর্জুন চোখ দিয়ে শ্রুতিকে কী যেন বলল; মুখে বলল, এখানে এসো।
শ্রুতি পড়ে-যাওয়া কম্বলটি টেনে তুলতে তুলতে বলল, না, তুমি যা-ই এল, আজকে না।
অর্জুন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ আজকে–জীবনে আর কোনোদিন আসো কি না আসো, আজকে এসো; প্লিজ, আজকে এসো।
কী যেন হয়ে গেল শ্রুতির। প্রথমে অর্জুনকে একটু অস্বাভাবিক লাগল, তার পরক্ষণেই শ্রুতি কী যেন ভেবে অর্জুনের কাছে উঠে এল।
অনেকক্ষণ থেকে লণ্ঠনটা দপদপ করছিল–বোধ হয় তেল ছিল না। হঠাৎ দপ করে সেটা নিভে গেল।
অর্জুন শ্রুতিকে দেখতে পাচ্ছিল না। মাচায় বসে অন্ধকার রাতের বনকে যেমন দেখাচ্ছিল, অর্জুনের চতুর্দিকে, ঘরে তেমন অন্ধকার ছেয়ে ছিল। মানুষখেকো বাঘ কোনো মৃতদেহকে যেমন করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়, কোনো দয়া না করে, কোনো মমতো না রেখে, অর্জুনের ইচ্ছে করছিল শ্রুতিকে তেমন করে ছিঁড়ে ফেলে–শ্রুতিকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে। পেটে গুলি খাওয়া বাঘের মতো নীরব যন্ত্রণায় অর্জুন কেঁপে কেঁপে উঠছিল এবং শ্রুতির শ্রান্ত শরীরকে তার লব্ধ শিকারের মতো আক্রমণ করে আনন্দিত হচ্ছিল।
শ্রুতি চোখ বুজে ছিল। এত সুখে কোনোদিন শ্রুতি স্বপ্ন দেখেনি। তার শরীরের শাখায় কি মনের মুকুরে তখন অর্জুন একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। অর্জুনের পরশ, অর্জুনের আদর, অর্জুনের নিশ্বাস সেদিন সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে মনে হচ্ছিল শ্রুতির। শ্রুতি চোখ বুজে শুধু রাকেশকে দেখতে পাচ্ছিল অর্জুনের জায়গায়। শ্রুতি শরীর ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছিল সে-মুহূর্তে–তাই অর্জুনের আক্রমণ তাকে আক্রান্ত না করে এক পরম পবিত্র তৃপ্তির তরঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে চলল।
রাকেশ পাশ ফিরে শুয়ে ওর হাতে শ্রুতির ঘামে-ভেজা সুন্দর উষ্ণ আঙুলগুলি ঘুমের মধ্যে অনুভব করছিল। জানলার ভাঙা শার্সি দিয়ে আকাশভরা তারা রাকেশের স্বপ্নভোর মুখের দিকে চেয়েছিল। বাইরের অনাদি রাত, অশেষ মুহূর্তগুলিকে ঝরে-পড়া শিশিরের সঙ্গে একটি একটি করে গুনে চলছিল। রাকেশ পালকের গদির মতো এক সুখের স্বপ্নে ডুবুরির মতো ডুবে যাচ্ছিল।
বাঘটা ঝরনার পাশে বসেছিল–চকচক করে জল খেয়েছিল। সমস্ত গায়ে রক্ত লেগে চ্যাটচ্যাট করছিল। বাঘটা হাঁপাচ্ছিল–বাঘটার আবার পিপাসা পেল। বাঘটা আবার জল খেল। তারপর আহত শরীরটাকে টেনে টেনে কোনোরকমে ঝরনার পাশের নীচু নালায় বাঁশঝাড়ের আড়ালে একরাশ ঝরে-পড়া পাতার ওপর এসে শুয়ে পড়ল। সামনের দু-থাবার ওপরে মুখটা রেখে সামনে চেয়ে রইল–আততায়ীর আগমনের অপেক্ষায়। সেই ঘনান্ধকারেও দেখা যেতে লাগল, বাঘটার পেটটা ওঠানামা করছে। বাঘটা জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিল।
অর্জুন শ্রুতিকে ছেড়ে উঠল, একগ্লাস জল খেল কাঁচের জাগ থেকে ঢেলে। টর্চটা জ্বালল।
শ্রুতি ওর বিছানাতেই কী এক তৃপ্ত বিভাসে বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কম্বল গায়ে না দিয়েই। ওঘরে যাওয়ার সময় অর্জুন শ্রুতিকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিল, অর্জুনের মনে হল শ্রুতি মরে গেছে। টর্চটা ভালো করে ওর মুখে ফেলল। নাঃ, জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। কম্বল-ঢাকা বুক উঠছে নামছে।
অর্জুন ওঘরে গিয়ে টর্চ নিবিয়ে দিল। রাকেশের ঘরে যাওয়ার দরজাটা নিঃশব্দে খিল দিয়ে দিল। তারপর আবার টর্চ জ্বেলে ওর স্যুটকেস থেকে টুলবক্স খুলে একটি ছোটো উকো বের করল। সেটিকে নিয়ে এসে খাবার টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসল। রাইফেলটার লক খুলে, স্টক আর ব্যারেল আলাদা করে ফেলল। তারপর বাঁ-দিকের ব্যারেলের ট্রিগারটি টানল –স্ট্রাইকিং পিনটি কট শব্দ করে সামনে বেরিয়ে এল–তখন আস্তে আস্তে উকো ঘষতে লাগল অর্জুন তার ওপর। ধীরে ধীরে, ধীরে ধীরে, ধীরে ধীরে। অর্জুন একবার হাসল। দেওয়ালে তাকাল। লণ্ঠনের আলোর ছায়ায় তাকে আর তার হাতে-ধরা রাইফেলের কুঁদোটাকে ভূতের মতো মনে হচ্ছিল। অর্জুন উকোটি ঘসে চলল।
মিনিট পনেরোর মধ্যে ঘুমন্ত রাকেশের জিয়নকাঠি চুরি করে মরণকাঠি রেখে দিল অর্জুন। বাঁ-দিকের পিনটি প্রায় পুরো ঘষে ক্ষইয়ে দিয়েছে। এ রাইফেলের কোনো ব্যারেলেই আর গুলি হবে না। আপাতত পেটে গুলি খাওয়া বাঘের কাছে এই রাইফেল হাতে পৌঁছেলে– রাকেশ রায়ের বাবার আশীর্বাদ, শ্রুতির ভালোবাসা কোনো কিছুই আর তাকে বাঁচাতে পারবে না।
রাইফেলটি আবার জোড়া লাগিয়ে যথাস্থানে রেখে অর্জুন ঘর পেরিয়ে বাথরুমে গেল। বাথরুমের জানলাটা খোলা ছিল। ঝুপরি আমগাছটা দেখা যাচ্ছিল। অর্জুন বাথরুম থেকে। বেরিয়ে আসবে, এমন সময় কাছের কোনো গাছ থেকে হঠাৎ ডাকটা শুনল ও, কিরি-কিরি কিরি-কিরি-ধুপ-ধুপ-ধুপ। অর্জুন চমকে উঠল। তারপরই সেই ঘুমন্ত বাংলোয় নিশুতি রাতে খোলা জানলায় দাঁড়িয়ে অবিশ্বাসী অর্জুনের গা ছমছম করে উঠল। সে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দৌড়ে এসে শ্রুতিকে ঠেলে তুলল, বলল, নিজের খাটে যাও, এই, নিজের খাটে গিয়ে শোও।
শ্রুতি ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে উঠে বসল, ডানহাতে মাথা চুলকালো, তারপর ঘুমের ঘোরেই উঠে ওর নিজের খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে শ্রুতি মনে মনে নিরুচ্চারে বলল, আমার বিছানাটা একেবারে ঠাণ্ডা করে রেখেছ কেন? তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না অর্জুন, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না। তোমার মধ্যে আর একটুও উষ্ণতা নেই। তুমি এই বিছানার মতো শীতল হয়ে গেছ।
.
১৩.
ভোর হয়ে গেছিল।
বাঘটা সারারাত বাঁশপাতায় গড়াগড়ি দিয়েছে। সমস্ত জায়গাটা রক্তে থকথক করছে। বাঘটার চোখ লাল হয়ে গেছে–ঘোলা হয় গেছে। কোথাও কোনো নিরালা গুহায় গিয়ে একেবারে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে বাঘটার। দু-একটা করে মাছি পড়তে আরম্ভ করেছে। একটা শকুন ভোরের প্রথম আলোর সঙ্গে সঙ্গে উড়ে এসে কুচিলা গাছে বসেছিল, বসে বাঘটার দিকে তাকিয়েছিল। বাঘটা ঘৃণায় ঘোঁৎ করে উঠেছিল। বড়ো বড়ো কুৎসিত ডানা ঝটপট করে শকুনটা উড়ে গেছিল।
বাঘটা আকাশের দিকে চেয়ে ভাবছিল যে, ও আবার আসবে, নিশ্চয়ই সদলবলে আসবে।
বাঘটা যখন ছোটো ছিল তখন ওর মায়ের সঙ্গে টুকার জঙ্গলে প্রথম প্রথম শিকার করা শিখেছিল–বাঘটার সেই সময়ের কথা মনে পড়ছিল। বাঘটা গোঙাচ্ছিল যন্ত্রণায়। গতবছর কুরাপের কাছে মে মাসে এক বাঘিনির সঙ্গে পনেরো দিন একসঙ্গে ছিল বাঘটা। সেইসব জ্যোৎস্নারাতগুলির কথা মনে পড়ছিল বাঘটার। ছেলেমানুষ বাঘিনিটি বেশ দেখতে ছিল–খুব সপ্রাণ ছিল। কে জানে, তার শরীরের শরিক তার বাচ্চাদের নিয়ে সে বাঘিনি এখন কেমন আছে! সেও কোনো শিকারির গুলি খেয়েছে কি না!
বাঘটা একবার একটা ঘেয়ে লোমওঠা নুড়ো শম্বর মেরেছিল। গরমের দিনে। একটি মহুয়া গাছের নীচে। তার চলবার শক্তি ছিল না। সে বেচারি বসে বসে মহুয়া চিবোচ্ছিল, এমন সময় বাঘটি তার কাছে পৌঁছোতেই সে ধড়ফড় করে উঠে বসবার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু পড়ে গেছিল। তারপর শম্বরটার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল–বাঘটার সেই শম্বরটার মুখের কথা মনে পড়ল।
বাঘটা থাবা দিয়ে বড়ো লাল সূর্যটাকে একটা বলের মতো নামিয়ে আনতে চেষ্টা করল, কিন্তু সূর্যটা শুনল না–সে ক্রমাগত বড়ো হয়ে আকাশময় ছড়িয়ে গেল। বাঘটার আর লুকিয়ে থাকা হল না। বাঘটা জীবনে এই প্রথমবার ভয় পেল।
ভোর হয়ে গেছিল।
অর্জুন অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। শ্রুতি বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে গিয়ে নাইটি ছেড়ে শাড়ি পরে মধ্যের ঘরে এল, তারপর রাকেশের ঘরের দরজা ঠেলে ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকল। রাকেশও ঘুমিয়ে ছিল। জানলা দিয়ে আলো এসে ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছিল। রাকেশ পাশ ফিরে শুয়েছিল। রাকেশকে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল। শ্রুতি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে রাকেশের পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল।
হয়তো সেই ভোরের বাতাস কানে কানে শ্রুতির আসার খবরটা দিয়ে থাকবে–রাকেশ হঠাৎ চোখ মেলে চাইল। অনেকক্ষণ শ্রুতির চোখের দিকে চেয়ে রইল। শ্রুতি হাসল, শুয়ে শুয়েই রাকেশ শ্রুতির একটি হাত টেনে নিয়ে নিজের বুকে রাখল। তারপর চোখে ছোঁওয়াল।
শ্রুতি প্রশ্রয়ের চোখে হাসল। বলল, ওঠা হবে না?
হবে।
বাইরে অনেক বেলা, রোদ উঠে গেছে।
রাকেশ বিছানায় উঠে বসে হাত দিয়ে ঠেলে কাঁচের জানলা দুটি খুলে দিল।
বাইরে চমৎকার রোদ। বাতাসে বাঁশপাতার গন্ধ ভাসছে। কত পাখি ডাকছে।
শ্রুতি বলল, বাইরেটা কী সুন্দর লাগছে, না?
দারুণ। আমার দারুণ ভালো লাগছে আজ।
কথা না বলে শ্রুতি কিছুক্ষণ বাইরে রোদে চেয়ে রইল, তারপর বলল, এবার উঠে পড়ুন। আমি চায়ের বন্দোবস্ত করছি।
ভোর হয়ে গেছিল।
সুব্বল পাহাড়তলি থেকে প্রাতঃকৃত্য সেরে বদনা হাতে গ্রামে ফিরছিল। ঘাসে ঘাসে শিশিরবিন্দুগুলি রোদে হিরের টুকরোর মতো জ্বলছিল–ও পায়ের নীচে হাজার হিরে মাড়িয়ে গ্রামে ফিরছিল।
সুব্বলের ভালো লাগছিল। রাতে ঘরে আগুনের মালসার পাশে ওর বউয়ের গা ঘেঁষে শুয়েছিল সুব্বল।
সে বেটি কেবলই বলছে কাল থেকে, বাবু বাঘকে খন্ডিয়া করেছে, তুই কেন মরতে যাবি সে বাঘ খুঁজতে? সুব্বল ভাবল, ও বাচ্চাবিয়ানো বেটি তার কী বুঝবে। সুব্বল কী করে তাকে বোঝাবে এর মজাটা-তেড়ে আসা বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে হাঃ হাঃ করে হাসতে হাসতে শেষমুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে সে বাঘকে গুলি করে মারা যে কী আনন্দ তা ও কী করে বুঝবে? হ্যাঁ, বিপদ কি ঘটে না? মাঝে-মধ্যে ঘটে। তা ঘটুক–যেদিন ঘটবে সেদিন ঘটবে, তা বলে তার বউয়ের উটকো ঊরুতে মাথা রেখে ককিয়ে কেঁদে ঘরে মরার চেয়ে অমন করে বাইরে মরা ঢের ভালো। মেয়েমানুষের জাত, ওরা খালি কাছা ধরে টেনে রাখতে শিখেছে। পুরুষকে, ও কি বুঝবে খন্ডিয়া বাঘের হুংকারের বুক-কাঁপানো আনন্দ?
ভারি ভালো লাগছে আজ সুব্বলের।
চা-খাওয়া শেষ করে রাকেশ বলল, চলো সুব্বল। সুব্বল তৈরি হয়েই বারান্দার সিঁড়িতে বসেছিল। অর্জুন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, উইশ ইউ অল দি বেস্ট। রাইফেলটার কিছু করতে পারলাম না, স্যরি।
রাকেশ আর সুব্বল গাড়িতে গিয়ে উঠল। রাকেশ এঞ্জিন স্টার্ট করে শ্রুতিকে হাত নাড়ল। শ্রুতি বারান্দায় থামের পাশে নিথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গাড়িটা গড়িয়ে গেল–গাড়িটা যখন বাংলোর গেট অবধি পৌঁছে গেছে, তখন শ্রুতি পেছন থেকে চেঁচিয়ে ডাকল, রাকেশদা, একটু দাঁড়ান।
গাড়িটা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। শ্রুতি একদৌড়ে ঘরে গেল। দ্রুতহাতে ওর হ্যাণ্ডব্যাগ খুলল, ডাইরিটা বের করল। ডাইরির ভেতরে একটি জবাফুলের পাপড়ি রাখা ছিল–পাতার ভাঁজে –ফিনফিনে কাগজের মতো হয়ে গেছিল। ফুলটি–মায়ের আশীর্বাদি ফুল দিল্লি থেকে আসার আগে শ্রুতির মা শ্রুতিকে রাখতে দিয়েছিলেন। তাড়াতাড়ি ফুলটি নিয়ে শ্রুতি দৌড়ে বাংলোর গেট অবধি চলে গেল।
রাকেশ শুধোল, কী ব্যাপার?
শ্রুতি বলল, এই যে, এটা বুকপকেটে রাখুন।
রাকেশ কথা না বলে ফুলটি নিল, নিয়ে বুকপকেটে রাখল; তারপর গাড়ির দরজায় রাখা শ্রুতির হাতে হাত দিয়ে একটু চাপ দিল। তারপরই শ্রুতি দেখল গাড়িটা লাল ধুলো উড়িয়ে জঙ্গলের পথে মিলিয়ে গেল।
বনে-পাহাড়ে তখন বেশ রোদ উঠে গেছে। পাতায় পাতায় রোদ ঝিলমিল করছে। ধনেশ পাখিগুলো হাঁক হাঁক হুঁ হুঁক করছে পাহাড়ে। আজকের সকালের মতো সুস্থ সুন্দর সান্ত্বনার সকাল রাকেশের জীবনে বহুদিন আসেনি। তার শ্রুতি, তার চিরদিনের জন্মজন্মের শ্রুতির এতদিনে সংস্কার-মুক্তি ঘটেছে–যা হয়তো এই পরিবেশে না হলে সম্ভব ছিল না। কোনোদিন সম্ভব ছিল না। এই সকালের আকাশ-ভরা রোদের মতো শ্রুতির অস্তিত্ব আজ রাকেশের শরীরে ও মনে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। পৃথিবীকে বড়ো ভালো লাগছে–বাঁচতে খুব ইচ্ছে করছে রাকেশের। অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছে করছে।
গাড়ি ছেড়ে ওরা দুজনে নামল। সুব্বলকে ওর দোনলা চার্চিল শটগান দিয়েছে। ও নিয়েছে ফোর-সেভেনটি-ফাইভ রাইফেল। ডান ব্যারেল যখন কাজই করছে না, তখন সে ব্যারেলে আর গুলিই পুরল না। কেবল একটি গুলি রাখল বাঁ ব্যারেলে। বাঘ চার্জ করলে ভালো করে দেখেশুনে মারবে। এত বড়ো বাঘ জন্মায়নি এখনও যে এই রাইফেলের গুলি হজম করবে। তা ছাড়া সুব্বল তো সঙ্গে আছেই।
ওরা দেখতে দেখতে মাচার কাছে গিয়ে পৌঁছোল। খুব সাবধানে, খুব সন্তর্পণে। রাকেশের বেশ খিদে পেয়ে গেছে একটু হেঁটেই। শ্রুতি বলেছে, আজ ফ্রায়েড-রাইস রাঁধবে। আজ এই অর্ধসমাপ্ত কাজ ভালোভাবে শেষ করে ভালো করে রেলিশ করে খাবে। আরাম করে শ্রুতির চোখের ছায়ায় বসে খাবে।
রক্ত দেখা গেল। ঘাসে ঘাসে রক্ত শুকিয়ে আছে। পাইপটাতে শেষ দুটো বড় বড়ো টান লাগিয়ে ছাই ঝেড়ে বুকপকেটে রাখল রাকেশ। সুব্বলের কাঁধ ধরে ফিসফিস করে বলল, তুমি টিলার ওপর দিয়ে যাও, আমি নীচুতে আছি। ওপর থেকে চারদিক ভালো করে দেখতে পাবে। আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো না-দেখলেই গুলি করবে।
সুব্বল আলাদা হয়ে গিয়ে টিলায় চড়তে শুরু করল। টিলাটি ছোটো কিন্তু প্রস্থে বেশ বড়। বেশির ভাগই বাঁশ আর কুচিলার জঙ্গল-বড়ো বড়ো কালো কালো পাথর-ন্যাড়া ন্যাড়া।
এখন থেকে রাকেশ একা-একদম একা। রাকেশ রক্ত অনুসরণ করে এক-পা এক-পা এগিয়ে চলল। ও মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল যে, বাঘটা যেন বেশিদূরে না গিয়ে থাকে –তাড়াতাড়ি যেন বাঘটাকে মেরে ও ফিরে যেতে পারে শ্রুতির স্নেহচ্ছায়ায়, শ্রুতির ভালোবাসায়। এতদিন সে শুধু চেয়েছে। কালকে পাওয়ার আভাস মাত্র পেয়ে ওর মনে হচ্ছে যেন বরাবর এমনি পাওয়াতেই অভ্যস্ত ছিল। ওর অন্তরের শুকিয়ে যাওয়া ক্লান্ত কোষগুলি আবার নতুন করে ভরে উঠেছে। এখন আর নষ্ট করার মতো সময় নেই রাকেশের। এমনকী শিকার করেও নয়। এই শেষ শিকার।
বাঘটা একবার ওপরে তাকাল। রোদের তেজ বেড়েছে। বাঘটা রোদের দিকে চাইতে পারছে না। ওপরে তাকালেই শুধু হলুদ রং দেখতে পাচ্ছে বাঘটা; কানের কাছে কোনো ঝরনার শব্দের মতো শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ওর খুব পিপাসা পেয়েছে। জিভটা শুকিয়ে গেছে। কিন্তু উঠে আবার নালায় গিয়ে জল খাবার ক্ষমতোও নেই, উপায়ও নেই। বাঘটা সূর্যকে অভিশাপ দিচ্ছে–গতরাতের হঠকারিতাকে অভিশাপ দিচ্ছে। বাঘটার পেটটা উঠছে নামছে। এমন সময় সামনের শুকনো পাতা-বিছানো সঁড়িপথে বাঘটা মানুষের শব্দ শুনল।
রাকেশ সাবধানে এখোচ্ছিল। রক্তের রেখাটা বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে এঁকে-বেঁকে গেছে। এক জায়গায় অনেকখানি থকথকে রক্তে কিছু বাঘের লোম দেখতে পেল। বাঘটা এখানে নিশ্চয়ই গড়াগড়ি দিয়েছিল। রাকেশ সামনের টিলার পাশ-ঘেঁষা একটি উঁচু জায়গা দেখতে পেল। ঠিক করল ওই জায়গায় পৌঁছে ভালো করে চারদিক দেখবে–বাঘটা খুব কাছাকাছি নিশ্চয়ই আছে।
একটা নীল কাঁচপোকা গুনগুন করে বাঘটার নাকের সামনে উড়ে বেড়োচ্ছিল। বাঘটার চোখ খুলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, তবু বাঘটা দেখছিল মানুষটা এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে বাঁশঝোঁপের আড়াল দিয়ে দেখতে পাচ্ছিল। উত্তেজনায় বাঘটা জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল। নিশ্বাসের সঙ্গে দমকে দমকে টাটকা রক্ত বেরোতে লাগল। বাঘটা ঠিক করল, মানুষটা যেই সামনের ফাঁকা উঁচু জায়গাতে পৌঁছোবে-টিলাটার পাশ ঘেঁষে-অমনি তাকে গিয়ে ধরবে। বাঘটা আবার ওপরে তাকাল। আবার হলুদ রং দেখতে পেল। বাঘটা দাঁতে দাঁত চেপে মুখটা মাটির সঙ্গে লাগিয়ে ঘোলা আরক্ত চোখে সেই আগন্তুকের পথের দিকেই চেয়ে রইল।
শ্রুতি বাথরুমে স্নান করছিল। গ্রীবায় সাবান মাখতে মাখতে গুনগুন করে গান গাইছিল। বাথরুমটা নোংরা, কোথাও বসবার জায়গা নেই। শ্রুতি বাথরুমের ছায়ান্ধকারে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার মুখ দেখল। তারপর চোখে হাত ছোঁয়াল। রাকেশদা কেবলই চোখে চুমু খায়, শ্রুতির হাতটি নিয়ে তার নিজের চোখে ছোঁয়ায়। কেন? চোখে কী? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রুতি ভাবল-চোখ হৃদয়ের জানলা।
এমন সময় বাথরুমের দেওয়ালের পাশ থেকে কী যেন খুব জোরে কিরি-কিরি-কিরি-কিরি –ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ করে উঠল। শ্রুতি চমকে উঠে ভয় পেয়ে ভিজে গায়ে কেঁপে উঠল– তার সিক্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। জানলার ওপরের কাঁচ দিয়ে উঁকি মেরে দেখল–অর্জুন হি-হি করে হাসছে। অর্জুনের চোখে শ্রুতির চোখ পড়তেই অর্জুন আবার চেঁচিয়ে উঠল কিরি-কিরি-কিরি-কিরি–ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ–তারপর বলল, বাঘ্বডুম্বা।
শ্রুতি বলল, ভালো হবে না বলছি, আমাকে ভয় দেখিয়ো না। আমার ভীষণ ভয় করে। আমাকে ভয় দেখিয়ো না।
এইসব মুহূর্তে খুব বড়ো শিকারিরও ভয় করে। রাকেশ প্রায় সেই উঁচু জায়গাটায় পৌঁছে গেছে, এমন সময় অতর্কিতে ডানদিক থেকে একটি প্রচন্ড গর্জন করে বাঘটি ওর দিকে তেড়ে এল। তখনও প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে ছিল। বাঘটি আসতে পাচ্ছিল না–কোনোরকমে সামনের দু-পায়ে ভর দিয়ে পেছনের অংশটিকে টেনে এগিয়ে আসছিল–গুলিটি তলপেটে ঢুকে পেছনের একটি পা ভেঙে বেরিয়ে গেছিল। পারছিল না–তবুও তার অবনমিতো পৌরুষের শেষগর্বে সে তার আততায়ীর সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে আসছিল।
রাকেশ স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তর্জনীটি পেছনের ট্রিগারে ছুঁয়ে–সেফটি ক্যাচটি সামনে ঠেলে–বাঘটাকে আরও কাছে আসতে দিচ্ছিল। বাঘটা ওর শরীরের অক্ষমতোর লজ্জা আকাশ-কাঁপানো হুংকারে ঢেকে এগিয়ে আসছিল। ওর পিঠে সকালের রোদ শ্রুতির ভালোবাসার মতো আশ্লেষে জড়িয়ে ছিল। উষ্ণতায় রাকেশ ভরেছিল।
শ্রুতি সারাগায়ে সাবান মাখতে মাখতে ঠিক করে ফেলল, একদিন তার এই শিউলি শরীর সম্পূর্ণভাবে রাকেশদাকে দান করে দেবে। রাকেশদা কী করে তাকে আনন্দে আদর করে, তা নিজের শরীর ছেড়ে বাইরে এসে বসে বসে দেখবে। রাকেশদার সূর্যমুখী উষ্ণতাকে ও ওর যা-কিছু আছে সব দিয়ে ফুরিয়ে যাবে।
এবার রাইফেল তুলল রাকেশ। বাঘটা দশগজের মধ্যে এসে গেল। রাকেশ গুলি করল। কিন্তু বাঘটা তবুও অমনিভাবে মুহূর্তের মধ্যে এসে গেল। রাকেশ কিছু বুঝতে পারল না, গুলি হল না–গুলি হল না। ও রাইফেলের ব্যারেল দিয়ে বাঘটাকে ঠেকাবার চেষ্টা করতে গেল –কিন্তু বাঘটা ওকে ধরে ফেলল। ধরে ওর ডানকাঁধ ও গলার মাঝামাঝি জায়গায় কামড় দিয়ে রাকেশকে একঝটকায় শুইয়ে ফেলে বাঘটা পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল।
অর্জুন বিয়ারের বোতলটা খুলল–বোতলটা কাত করে গেলাসে হলুদ বুড়বুড়ি কাটা বিয়ার ঢালতে ঢালতে বলল, শালা বাঘ্বডুম্বা।
গুড়ম করে একটা শব্দ হল। রাকেশের চোখ ঘোলা হয়ে এসেছিল। ও ভালো দেখতে পাচ্ছিল না। রোদটা হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল। ও বুঝতে পারছিল ওর সমস্ত শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে–সেই ঘোলা চোখেও সুব্বলকে দেখতে পেল–সামনের টিলার ওপর বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। টিলা ও আকাশের পটভূমিতে।
গুডুম আওয়াজের পরই বাঘটা রাকেশের পাশে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। বাঘের মুখটা রাকেশের মুখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে স্থির হয়ে রইল মাটিতে। রাকেশের মনে হল বাঘটা ওকে চুমু খাবে।
রাকেশ একবার সূর্যের দিকে তাকাল–ওর খুব শীত করছিল–দেখল সমস্ত আকাশে কে যেন সবুজ, লাল, নীল, হলুদ, বেগুনে, কালো রঙের সুতো টান-টান করে তাঁতে বসিয়েছে। –শাড়ি বুনছে। রাকেশের খুব ঘুম পেতে লাগল। ওর ইচ্ছে করল বাঘটাকে কোলবালিশ করে ঘুমোয়।
রাকেশের মাথার মধ্যে কে যেন সেতারে ধুন বাজাতে লাগল, ওর মাথায় কী যেন হতে লাগল। হঠাৎ রাকেশের মনে হল, রুমনি একটি লাল ঢাকাইশাড়ি পরে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রুমনি খুব হাসছে। বিয়ের আগে ও যেমন ঝরনার মতো হাসত-হাসতে হাসতে রুমনি আবার শুকনো বাঁশপাতা মাড়িয়ে রোদ্দুরে ভেসে ভেসে ফিরে গেল। জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।
ঘুমে রাকেশের চোখ জড়িয়ে এল।
একটা করুণ কাঁচপোকা বঁই-ই বঁ-বঁ-পুঁই-ই-ই করে একবার রাকেশের আর একবার বাঘটার মুখে উড়ে উড়ে বসতে লাগল।
bujalm na ata thik ki rokom ending holo..sob kisu akebare mathar upor diye cole gelo mone hosse..rakesh morlo na beche gelo taw bujte parlam na…