৩. বাংলার লোকধর্ম

তৃতীয় অধ্যায় – বাংলার লোকধর্ম (Folk Religions in Bengal )

লোকধর্ম গবেষণা : প্রকরণ ও পদ্ধতি

লোকধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে যে গ্রন্থটির নাম করতে হয় সেটি হল অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬) প্রণীত ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় প্রথম খণ্ড ১৮৭০ ও দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বইটির শিরোনাম ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় হলেও এর বেশিরভাগ স্থান জুড়ে আছে বাংলার লোকধর্মগুলোর পরিচিতি দান। বইটি বর্ণনাত্মক হলেও এটি লোকধর্ম বিষয়ক ধারণা লাভ করার ক্ষেত্রে আদি ও প্রাথমিক ভিত্তি সম্পর্কে অবহিত করতে সমর্থ হয়।

অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায় গ্রন্থে ভারতের সমস্ত লোকসম্প্রদায়কে বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, সৌর এবং গাণপত্য— এই পাঁচ ভাগ করে আলোচনাকে বিন্যস্ত করেছেন। গ্রন্থটি দুটি খণ্ডে বিভক্ত। তাঁর মূল বর্ণনায় ১০৬টি লোকসম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এতগুলো লোকসম্প্রদায়ের বর্ণনা তাঁর পূর্বে আর কেউ করেননি।

এ গ্রন্থের প্রথম ভাগে তিনি আলোচনা করেছেন বৈষ্ণব, রামানন্দী, কবীরপন্থী, খাকী, মলুকদাসী, দাদুপন্থী, রয়দাসী, সেনপন্থী, মধুচারী, বল্লভচারী, মীরাবাই, সনকাদি, চৈতন্য, স্পষ্টদায়ক, কর্তাভজা, মারবল্লভী, সাহেবধনী, বাউল, ন্যাড়া, দরবেশ, সাঁই, আউল, সাধিনী, সহজী বা সহজিয়া, খুশি বিশ্বাসী, গৌরবাদী, বলরাম হজরতী বা বলাহাড়ি, গোবরাই, পাগলানাথী, তিলকদাসী, দর্পনারায়ণী, অতিবড়ী, রাধাবল্লভী, সখীভাবক, চরণদাসী, হরিশ্চন্দ্রী, সাধনপন্থী, চুহড়পন্থী, কুড়াপন্থী, বৈরাগী, নাগা প্রভৃতি লোকসম্প্রদায়কে নিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর নিজের সংগৃহীত তথ্যের উপর নির্ভর করেছেন, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে শীতল সিংহ, মথুরানাথ এবং উইলসনের রচনার সাহায্য গ্রহণ করেছেন।

অপেক্ষাকৃত অধিক সংখ্যক লোকসম্প্রদায়ের বর্ণনা রয়েছে দ্বিতীয় ভাগে। এই ভাগে আছে শৈব, শিবারাধনা, দশনামী, দণ্ডী, ঘরবারী দণ্ডী, কুটীচক, বৃহূদক, হংস, পরমহংস, সন্ন্যাসী, নাগা, আলেখিয়া, দমলী, অঘোরী, ঊর্ধ্ববাহু, আকাশমুখী, নখী, ঠাড়েশ্বরী, পঞ্চধনু, মৌনব্রতী, জলশস্যী, জলধারা তপস্বী, কড়া লিঙ্গী, ফরারী, গুদড়, সুখড়, রুখড়, ভূখড়, কুকড়, উখড়, অবধূতানী, ঘরবার সন্ন্যাসী, ঠিকরনাথ, স্বভঙ্গী, ত্যাগ সন্ন্যাসী, আতুর সন্ন্যাসী, মানস সন্ন্যাসী, অন্ত সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী, যোগী, কনফট্ যোগী, অরঘড় যোগী, মৎস্যেন্দ্রী, শারঙ্গীহার, ডুরীহার, ভর্তৃহরি, কাণিপাপযোগী, অঘোরপন্থী যোগী, যোগনী, সংযোগী, লিঙ্গোপাসনা, লিঙ্গায়ৎ, ভোপা, দশমনী-ভাঁট, শাক্ত, পশ্চাচারী, বীরাচারী, করারী, চলিয়াপন্থী, ভৈরবী বা ভৈরব, শীতলা-পণ্ডিত, সৌর ও গাণপত্য প্রভৃতি লোকসম্প্রদায়ের বর্ণনা। এসব লোকসম্প্রদায়ের অধিকাংশই বাংলা অঞ্চলের, আবার কিছু সম্প্রদায়ের বাস ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে। দ্বিতীয় ভাগের পরিশিষ্টে সংযোজিত হয়েছে আরো অনেক সম্প্রদায়, যেমন— নিরঞ্জনী সাধু, মানভাব, কিশোরী ভজনী, কুলি গায়েন, টহলিয়া বা নোমো বৈষ্ণব, দশামার্গী, জোগ্নি, শাঙ্খী, নরেশপন্থী, পাঙ্গুল, কেউড়দাস, ফকির, কুম্ভূপাতিয়া, খোজা প্রভৃতি। এছাড়া সাধ, প্রাণনাথি নামক দুটি উৎকৃষ্ট রচনাও সংযুক্ত আছে দ্বিতীয় খণ্ডে। লোকধর্মসম্প্রদায়ের বর্ণনা, সাধন পদ্ধতি, অনুসৃত লোকাচার, লোক-অনুষ্ঠান, গীত গান প্রভৃতি বিষয় গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত।

ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়-এর দ্বিতীয় ভাগের উপক্রমণিকায় প্রধানত ভারতীয় ষড়দর্শন, রামায়ণ, মহাভারত, বিবিধ পুরাণের আলোচনা প্রত্যক্ষ করা যায়। অক্ষয়কুমার প্রাচীন ভারতের প্রচলিত বিভিন্ন দর্শন বিশেষত ন্যায়, চার্বাক, যোগ, সাংখ্য, মায়া, পাতঞ্জল, বৈশেষিক, মীমাংসা, বেদান্ত প্রভৃতি সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন। উপাসক সম্প্রদায়সমূহ ব্যাখ্যা করার সময়ে এসব দর্শনের মূল ভাব তিনি আত্মস্থ করে সেগুলোকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর লেখাতে।

অক্ষয়কুমার এতসব ধর্মসম্প্রদায়ের বর্ণনা করলেও বাংলার সর্ববৃহৎ লোকসম্প্রদায়সমূহ ‘বাউল’, ‘মাইজভাণ্ডারী’ এবং ‘মতুয়া’ লোকসম্প্রদায় নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করেননি। এ সকল প্রধান লোকসম্প্রদায় নিয়ে তাঁর কেন এই নীরবতা তা বোধগম্য নয়। গ্রন্থটির এটি একটি বড় ত্রুটি। তবে হোরেস হেম্যান উইল্সন্ (Horace Hayman Wilson, 1786-186০) প্রণীত Sketches of the Religious Sects of the Hindus (1846) গ্রন্থটি দ্বারা অক্ষয়কুমার যথেষ্ট সহায়তা গ্রহণ করলেও তাঁর নিজগ্রন্থেও স্বকীয়তার বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯খ্রি.) রচিত বৃহৎ বঙ্গ নামে দুই খণ্ডের ইতিহাস গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে বাঙালির ধর্মীয় ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। এছাড়া ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে নীহাররঞ্জন রায় লিখিত বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব) নামক গ্রন্থটি বাঙালির সামগ্রিক ইতিহাসের আকর গ্রন্থ বলে বিবেচনা করা যায়। তবে এই দুটি গ্রন্থ কেবল ধর্মীয় বিবর্তনকে বুঝতে সহয়তা করে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত প্রবোধচন্দ্র বাগচীর বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য নামক গ্রন্থটিতে বৌদ্ধ ধর্মের বিবর্তন ও দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বাঙালির ধর্মীয় ইতিহাস বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গ্রন্থটি সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এই গ্রন্থের পরিধিও পূর্বোক্ত গ্রন্থ দুটির অনুরূপ। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ভারতীয় দর্শন গ্রন্থটি। পল্লব সেনগুপ্ত লিখিত পূজা-পার্বণের উৎসকথা (১৯৮৪) নামে ধর্মাচার নিয়ে নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণধর্মী একটি বই প্রকাশিত হয়। একই খ্রিষ্টাব্দে তৃপ্তি ব্রহ্ম রচিত লোকজীবনে বাংলার লৌকিক ধর্মসঙ্গীত ও ধর্মীয় মেলা বিষয় আরো একটি বই প্রকাশিত হয়। অতুল সুর ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে লেখেন হিন্দু সভ্যতার বুনিয়াদ। বইটিতে হিন্দু ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাস আলোচিত। মুহম্মদ এনামুল হক বাংলাদেশের সুফি ধারা বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রচনা করেন A History of Sufi-ism in Bengal (১৯৭৫)।

এছাড়া বাঙালির ধর্মীয় বিবর্তন ও বিভিন্ন লোকধর্ম সম্পর্কে ধারণা পেতে যেসব গ্রন্থ আমাদের সহায়তা দেয় তার মধ্যে উল্লেখ করা যায়, ওসমান গণী লিখিত কোরানের আলোকে ইসলাম জগৎ ও সুফীসমাজ (২০০২), সুবীরা জয়সবলা প্রণীত বৈষ্ণবধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (১৯৯৩), সুধীর চক্রবর্তীর বাংলার গৌণধর্ম সাহেবধনী ও বলাহাড়ি (২০০৩), (১৯৭৩), রমাকান্ত চক্রবর্তীর বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম (১৯৯৬), বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য লেখেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় ভক্তিরস ও অলংকারশাস্ত্র (১৯৯৩), বিরাট বৈরাগ্য প্রণীত মতুয়া সাহিত্য পরিক্রমা (১৯৯৯), নন্দদুলাল মহান্ত প্রণীত মতুয়া আন্দোলন ও দলিত জাগরণ (২০০২), স্বরূপেন্দু সরকারের শ্রীশ্রী হরিচাদের জীবনকথা (২০০৬) সুকুমার বিশ্বাসের মনোমোহন দত্ত (১৯৮৯), সেলিম জাহাঙ্গীরের মাইজভাণ্ডারি সন্দর্শন (১৯৯৯), গাউসুলআজম মাইজভাণ্ডারী শতবর্ষের আলোকে, (২০০৭), সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীর গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারীর জীবন ও কেরামত (১৯৬৭), মুহম্মদ আবুদল মান্নান চৌধুরীর মাইজভাণ্ডারী দর্শন (২০০২) ইত্যাদি।

বাউল বিষয়ক আলোচনার জন্য প্রথমে যে বইটির নাম উল্লেখ করতে হয় সেটি হল ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর বাংলার বাউল নামক গ্রন্থটি। এর পর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত উপেন্দ্রনাথ ভট্টচার্য রচিত বাংলার বাউল ও বাউল গান নামক গ্রন্থটি। এটি বাউল বিষয়ক একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ। আহমদ শরীফ লিখিত বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য (১৯৭৮) গ্রন্থটি বাঙালির মৌলধর্মকে আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। সুধীর চক্রবর্তীর গভীর নির্জন পথে (১৯৮৯), ব্রাত্য লোকায়ত লালন (১৯৯২), বাউল ফকির কথা (২০০১), আহমদ শরীফ প্রণীত বাউল তত্ত্ব, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত বাংলার বাউল-ফকির (১৯৯৯) প্রভৃতি গ্রন্থে বাউল ধর্ম ও সাধনা সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজিত হয়েছে। তবে এ সব গ্রন্থের সিংহভাগ স্থান জুড়ে আছে বর্ণনাত্মক কথকতা। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে সনৎকুমার মিত্রের সম্পাদনায় প্রকাশ পায় বাউল লালন বরীন্দ্রনাথ নামক একটি প্রবন্ধ সংকলন। এতে বাউল বিষয়ক অনেক গবেষকের নানামাত্রিক বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ স্থান পায়। এস এম লুৎফর রহমানের বাউল তত্ত্ব ও বাউল গান, বিকাশ চক্রবর্তীর বাউল জীবনের সমাজতত্ত্ব, আবুল আহসান চৌধুরী রচিত লালন সাঁই প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ (২০০৪), আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত গ্রন্থ লালন স্মারক গ্রন্থ (১৯৭৪), লালনসমগ্র (২০০৮) প্রভৃতি গ্রন্থের নাম করা চলে। বাউল সাধনা ও জীবন চর্যা নিয়ে অনেক গবেষকই তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি সহযোগে গ্রন্থ, প্রবন্ধ প্রণয়ন করেছেন। গ্রন্থগুলো কোনটি কেবল লালন নিয়ে আলোচনা করা আবার কোনটি বাউল বিষয় আলোচনা, কিন্তু সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশের লোকধর্ম ও তার প্রকার-প্রকৃতি নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ এ সব গ্রন্থগুলোতে অনুপস্থিত। আবার যে সকল গ্রন্থগুলোতে বাউল সাধনার ঐতিহাসিক দিক নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় তার সিংহভাগ গ্রন্থ কোন পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়নি। নিতান্ত লেখক-গবেষকগণ তাঁদের নিজস্ব চৈতন্য ও আগ্রহ থেকে এই সব গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন বলে মনে হয়। যেমন, এস এম লুৎফর রহমানের লালন জিজ্ঞাসা, খন্দকার রিয়াজুল হকের মরমি কবি লালন শাহ্ জীবন ও সঙ্গীত, হায়াৎ মামুদ-এর লালন সাঁই, তপন কুমার বিশ্বাসের লোককবি লালন, আনোয়ারুল করিমের বাংলাদেশের বাউল, মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন-এর লালন তত্ত্বের ভূমিকা, তৃপ্তি ব্রহ্মের লালন পরিক্রমা প্রভৃতি গ্রন্থ.

এখন বাংলাদেশে যে বাউল সম্প্রদায় দেখা যায় তারা মহাপ্রভু চৈতন্যদেবকে নিজেদের সম্প্রদায়ের আদি প্রবর্তক বলে ঘোষণা করে। বাউল সম্প্রদায়ের অপর শাখা নেড়ানেড়ী সম্প্রদায় নিত্যানন্দ প্রভুর পুত্র বীরভদ্র বা বলভদ্ৰ গোস্বামীকে নিজেদের আদি প্রবর্তক বলে পরিচয় দেয়। বঙ্গদেশে দশম শতাব্দীতে চৈতন্যদেব পাঁচ শ’ বছর পূর্বে সহজিয়া মতের প্রচারক ছিলেন নাথপন্থের চুরাশি সিদ্ধপুরুষের অন্যতম নাঢ় পণ্ডিত ও তাঁর পত্নী নাঢ়ী। এই নাঢ়া ও নাঢ়ী হতেই নেড়ানেড়ী সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও নামকরণ হয়েছে। চৈতন্যদেব ও নিত্যানন্দ অদ্বৈত আচার্যকে ‘নাড়া’ বলে সম্বোধন করতেন তা চৈতন্যভাগবতের নানা স্থানে উল্লেখ দেখা যায়। সহজিয়া বৈষ্ণবগণ বলেন, তাদের গুরু হচ্ছেন চৈতন্যদেবের ও নিত্যানন্দ অদ্বৈত আচার্যকে ‘নাড়া’ বলে সম্বোধন করতেন তা চৈতন্যভাগবতের নানা স্থানে উল্লেখ দেখা যায়। সহজিয়া বৈষ্ণবগণ বলেন, তাদের গুরু হচ্ছেন চৈতন্যদেবের পরিষদ স্বরূপ গোস্বামী। স্বরূপের শিষ্য রূপ গোস্বামী, রূপের শিষ্য দাস গোস্বামীর শিষ্য কৃষ্ণদাস কবিরাজ যিনি চৈতন্যচরিতামৃত প্রণয়ন করেন। কবিরাজ গোস্বামীর শিষ্য মুকুন্দ দাস। মুকুন্দ দাসের চার শিষ্য থেকে আউল, বাউল, শাঁই, দরবেশ এই চার শ্রেণির ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। সহজ ধর্ম ‘নবরসিকের ধর্ম’ বলে পরিচিত। এই নবরসিকের মধ্যে পঞ্চরসিকের নাম পাওয়া যায় যদুনাথ দাসের সংগৃহীত পুঁথিতে। পঞ্চরসিক হচ্ছেন বিল্বমঙ্গল, জয়দেব, চণ্ডীদাস, রায় গুণাকর ও রায় শেখর। এঁরা প্রত্যেকেই সহজসাধন করেছিলেন এবং এঁদের প্রকৃতি ছিলেন চিন্তামনি, পদ্মবতী, রজকিনী, রামী, লছিমা, দেবী ও দুর্গাদাসী। এঁদের প্রত্যেকের পরকীয়া প্রেম ছিল বিশুদ্ধ, ‘কাম গন্ধ নাহি তায়।’ ওইসব নায়িকা কিশোরী। এইরূপ বিশুদ্ধ প্রেমতত্ত্ব ও প্রেমবিলাস-প্রেমবিবর্ত চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে নির্মল রসালো বর্ণনা আছে। সেইজন্য বাউলেরা বলে ওই গ্রন্থ সহজ প্রেম-সাধনের শাস্ত্র। সহজভাবে জীবনযাপন ও ধর্মসাধন করাই বাউলদের আদর্শ বলে এঁরা নিজেদের চুলদাড়ি যথেষ্টভাবে বাড়তে দেয়, কিছুই কাটে না। এঁরা কারো উচ্ছিষ্ট লাভের ধার ধারে না।

লোকধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ

বাংলাদেশের লোকধর্মের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস হাজার বছরের। নানামুখী জনস্রোত আর নানারূপী অধ্যাত্ম চিন্তার রূপায়ণে এখানকার নিজস্ব ধর্ম ধারার বিকাশ ঘটছে। কালে কালে শ্রেণি চেতনায় ধর্মান্ধতা, ধর্ম নিয়ে উন্মত্ততা প্রভৃতি যেমন আশ্রয় করেছে তেমনি এগুলো হতে মুক্তির চেতনা সম্বলিত মতাদর্শেরও জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশের সরস মাটিতে বাঙালির হৃদয় যেমন ভাবোন্মত্ত হয়ে উঠেছে তেমনি এরা ভাবান্দোলনের মধ্যদিয়ে বৈষয়িক হিস্যা আদায় করেছে। তাই বাংলাদেশের লোকধর্মধারার উদ্ভব ও বিকাশের পর্যায়গুলোয় দেখা যায় প্রতিষ্ঠানিকতার কায়েমী রীতির বিরুদ্ধাচরণ করার প্রবণতা বিদ্যমান। এখানকার পৌত্তলিকতা, দ্বৈত-অদ্বৈতবাদ, অবতারতত্ত্ব, নির্বাণতত্ত্ব, তৌহিদবাদ, ত্রিত্ববাদ প্রভৃতি মতবাদ কোনটি এই মাটির ফসল আবার কোনটি ভিন্ন হাওয়ার প্রভাবে উৎপন্ন হয়ে এখানে এসেছে। তবে বহিরাগত ফসলের বীজ এখানে পতিত হয়ে এদেশীয় জল হাওয়ায় স্বদেশী ফলের স্বাদ নিয়ে ফসল উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। ফলে বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় মতামত, জীবনাচরণ, সংস্কার- সংস্কৃতি নানা মাত্রিকতা লাভ করেছে। কখনো কখনো এগুলোর মধ্য হতে কোনটি নিজস্ব সাংস্কৃতিক উপাদানকে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে। তারা নিজস্ব রীতি-পদ্ধতিকে গ্রন্থবন্ধ করেছে এবং সেগুলো জনসাধারণের উপর আরোপ করার চেষ্টা করেছে। তখনই উদ্ভব হয়েছে দ্বন্দ্বের। শাস্ত্রীয় শ্রেষ্ঠত্ব আর লোকসাধারণের মনন লালিত ধারণার সাথে মতাদর্শিক লড়াই চলেছে। সে লড়াইয়ের প্রধান অস্ত্র ভাষা। গাল মন্দ বা নিন্দাবাদ নয় একের পর এক যুক্তির উত্থাপন, যুক্তি খণ্ডন ও যুক্তির মোকাবেলার প্রস্তুতি ছিল এই বাহাসের কেন্দ্রনানুগ প্রত্যয়। এই প্রত্যয়ের মধ্যে আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার তাগিদ ছিল। ফলে এক সময়ের হৃত গৌরব পুরুদ্ধারের চেষ্টায় নতুন করে আবার চৈতন্যকে শান দিতে হয়েছে। কখনো মিলনে আপোসে লোকধর্মের ধারকেরা টিকে থেকেছে। কখনো আবার তথাকথিত বড় প্রতিষ্ঠানের দুর্দণ্ড প্রতাপে তারা আত্মরক্ষার্থে আত্মগোপন করেছে। কখনো আবার অন্যের চেতনার ফসলকে স্ব-ইচ্ছায় নিজের করে নিয়েছে। এমনি বহুমুখী ভাব ও কর্মযজ্ঞের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের লোকধর্মের বিকাশ ঘটেছে।

ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দিন প্রদেয় লোকধর্মের গুরুদের উল্লেখ পর্যায়ে দেখা যায় :

১. লূহি পা, লুই পা, লুয়িপা, মৎস্যেন্দ্র বা মৎস্যন্দ্রনাথ। ২. লীলাপাদ। ৩. বিরূপা। ৪. ডোম্বি হেরুক। ৫. শাবর। ৬. শরহ বা রাহুল ভদ্র। ৭. কঙ্কালি পাদ। ৮. মীনপাদ বা বজ্রপাদ। ৯. গোরক্ষ। ১০. চৌরঙ্গী। ১১. বীণাপাদ। ১২. রত্নাকর শান্তি। ১৩. তন্তিপাদ। ১৪. চর্যারু। ১৫. খড়গ্‌ পাদলছত্র, গাছাবাড়ী, সাইনামারীসহ প্রত্যন্ত গড় অঞ্চলে আজো গারো সম্প্রদায়ের সাংসারেক শাখা স্তূপবৃক্ষ ও অন্যান্য পূজার মধ্যে দিয়ে থেরো/থারো ধর্মের অবশেষ রক্ষা করে চলেছেন। সভ্য মানুষের অবহেলা ও অনাদরের মধ্য দিয়ে মানব প্রগতির একটি ধারা আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এই ধারায় প্রধান সাধক সাধিকারা হলেন : কবীরগোস্বামী, হরবালাদেবী, চরিত্র গোঁসাই, অর্জুন সাধু, উদয় মানখীন প্রমুখ গুণীজন। সাংসারেক সাধক সম্প্রদায়ের শতকরা নব্বই জনই বর্তমান খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে।

পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ ধর্মমতের নাম ক্রামা। এই ধর্মমতটির উৎপত্তি আমাদের এই বাংলাদেশে। বান্দরবান জেলার পোড়োপাড়া গ্রামের মেনলে ম্রো এই ধর্ম আনুষ্ঠাকিভাবে প্রচার শুরু করেন ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে বসবাসরত ম্রো জনগোষ্ঠীর ৫৫ জন মানুষ এই ধর্মমতে দীক্ষা গ্রহণ করেছেন। ম্রো-দের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মায়ানমারের অধিবাসী। সেখানেও ক্রামা ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের হার বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।

আমাদের দেশের অধিকাংশ গবেষকই মনে করেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের নাগপাশ থেকে মুক্ত হবার বাসনা থেকেই বৌদ্ধ, জৈন্য ইত্যাদি ধর্মের সূচনা। অর্থাৎ এগুলি হল ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিবাদী ধর্ম। কালক্রমে প্রবল প্রভাবান্বিত বৌদ্ধধর্মের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থান ঘটে। নবসৃষ্ট ব্রাহ্মণ্যধর্মের কঠোর বিধান ছিঁড়ে প্রতিবাদী বৈষ্ণবধর্মের উত্থান এবং অচিরেই সে ধর্মান্দোলন দিগভ্রষ্ট হলে সমাজের ভেতর থেকে প্রতিবাদী চেতনার অঙ্কুরে বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব ধর্মের রস সিঞ্চনে লোকধর্মগুলির উদ্ভব।

বাংলার লোকধর্মগুলির সৃষ্টি যে অন্ত্যজ সমাজের ভেতর থেকে, তাতে কোন দ্বিমত নেই। এক চৈতন্যদেবকে বাদ দিলে আশ্চর্যজনকভাবে অভিজাত সমাজের প্রায় সকল ধর্মগুরুই ব্রাহ্মণ্য মূল্যবোধের পৃষ্ঠপোষক। অন্ত্যজরাই এর ব্যতিক্রম। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। মনীষী দাদু ছিলেন চর্মকার শ্রেণির, কবীর জোলা বা তাঁতি, আসামে বৈষ্ণব আন্দোলনের প্রবক্তা শংকরদেব শূদ্র। সকলেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরোধী। যতীন সরকার তাঁর ‘বাঙালির লৌকিক ধর্মের মর্মান্বেষণ’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন :

‘আদিতে সব ধর্মই ছিল লৌকিক ধর্ম। লোকসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্নকে ধারণ করে তাদের মধ্যেই সব ধর্মের উদ্ভব ও বিস্তার। কিন্তু পরে প্রায় সব ধর্মই সাধারণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, সমাজের অধিপতি শ্রেণি ধর্মকে নিজেদের স্বার্থসাধনে নিয়োজিত করে, তৈরি হয় বিধিবদ্ধ শাস্ত্রীয় ধর্ম। কখনো-বা সরাসরি বল প্রয়োগে এবং কখনো-বা নানা ছল ও কৌশলের আশ্রয়ে লোকসাধারণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় সেই শাস্ত্রীয় ধর্ম, যাজক-পুরোহিতের দল নিয়োজিত হয় সে-ধর্মের খবরদারির দায়িত্বে। তবু, তখনও, লোকসাধারণ কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের নিজস্ব ধর্মকেই লালন করে যেতে থাকে। আকাঙ্ক্ষা করতে থাকে যে তাদের ভেতর থেকেই আবির্ভূত হবেন কোন পবিত্রাতা যিনি নিপীড়নমূলক পরধর্মের হাত থেকে তাদের রক্ষা করবেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করবেন, ধূলার পৃথিবীতেই স্বর্গরাজ্য নামিয়ে আনবেন। লোকসাধারণের সেই অভীপ্সা একসময়ে পূর্ণ হয়, তাদের ভেতরই এ রকম দরদি মানুষকে তারা পেয়ে যায়। সেই মানুষকেই তারা অবতার বা ঈশ্বর-প্রেরিত ত্রাণকর্তারূপে গ্রহণ করে, তাঁরই শিক্ষায় লৌকিক ধর্ম তখন নবতর রূপ পায়, উৎপীড়িত ও বঞ্চিত লোকজন দলে দলে সেই ধর্মের অনুসারী হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছুদিন পরই অবস্থাটি আবার উল্টে যায়, সেই নবরূপপ্রাপ্ত লৌকিক ধর্মটিকেও সমাজের উচ্চবর্গের অধিপতি শ্রেণিই অধিকার করে নেয়, একে বিধিবদ্ধ শাস্ত্রীয় ধর্মের পরিণত করে ফেলে। পৃথিবীর সব ধর্মের ইতিহাস-পরিক্রমাতেই এ-সত্যের সন্ধান মেলে’ (পৃ. ৩৪৯)।

এভাবে ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়েই বিকশিত হয়ে ওঠে লোকধর্মের অবয়ব। পরিশেষে কবি কণ্ঠে সমউচ্চারণে আমাদেরও এই প্রত্যাশা :

আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণির উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেমন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ। (আল মাহমুদ)

বিশিষ্ট কয়েকটি লোকধর্মের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

সৎসঙ্গ সম্প্রদায়

ভারতীয় সন্ত মতেরই একটি সম্প্রসারিত রূপ সৎসঙ্গ সম্প্রদায়। বাংলাদেশে এই মতের বিকাশ ও সম্প্রসারণ করেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র (১৮৮৮-১৯৬৯)। সৎসঙ্গ বলতে Holy Communion বুঝায় কিন্তু কবীরপন্থা অনুসারে এখানে সাধুসঙ্গ ও ভজন গানের অনুষ্ঠান বুঝায়। কল্পতরুবৃক্ষ ও সৎসঙ্গ সমগুণ বিশিষ্ট, কল্পতরু বৃক্ষের নিকট যেমন বাঞ্ছিত বস্তু মিলে তেমনি সৎসঙ্গ দ্বারা বাঞ্ছা পূর্ণ হয়। কাঠের সাথে বিদ্ধ হয়ে লোহা যেমন জলে ভাসতে পারে তেমনি সৎসঙ্গ দ্বারা মানুষের অসম্ভব বিষয় সম্ভবপর হয়। কয়লা যেমন আগুনের সঙ্গে মিলিত হয়ে রক্তিম বর্ণ প্রাপ্ত হয়, সৎসঙ্গও তেমনি মানুষকে ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়।

বাঁশের কাঠি লজেন্সের মধ্যে প্রবেশ করালে চিনির দামেই তা বিক্রয় হয়। পিপীলিকাও ফুলের মধ্যে লুকিয়ে রাজার মালায় প্রবেশ করে। জাগ্রত অবস্থায় পঞ্চাশ হাজার বছরের তপস্যার পুণ্য ফলের চেয়ে স্বপ্নযোগে একঘণ্টা সৎসঙ্গের মূল্য অধিকতর। স্বামী শিব দয়াল সিংহ আধুনিক সৎসঙ্গের প্রতিষ্ঠাতা। স্বামী শিবদয়াল সিংহ রাধাস্বামী মতের প্রবক্তা, তিনি শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু বিশ্বপ্রকৃতির পরিচালনার মধ্যে যে ইচ্ছাময়ের বহিঃপ্রকাশ তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বর্তমান সভ্যতা Globalization এর সভ্যতা, এর জন্য যে Universalism-এর প্রয়োজন তা’ তিনি গ্রহণ করেছিলেন এবং সকল ধর্মের প্রাণসত্তা সৎসঙ্গ তা দিয়ে তিনি জগতের সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। এই আদর্শের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পাবনার হিমাইতপুর নিবাসী ঠাকুর অনুকুলচন্দ্রকে কেন্দ্র করে জাতি, ধর্ম বর্ণ গোষ্ঠি ও সম্প্রদায়ের বিকাশ ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রত্যয়ে এক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়, পরবর্তীকালে তাঁরা সৎসঙ্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। সৎসঙ্গের মর্মানুযায়ী বুদ্ধ, ঈসা (আ.), মুহম্মদ (স.) শ্রীচৈতন্য এবং শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে কোন প্রভেদ নাই জীবোদ্ধারে তাঁরা যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন। সৎসঙ্গে ধর্ম বলতে বাঁচা বাড়ার মর্মকেই ধর্ম বলে অভিহিত করা হয়। জাগতিক ও পারমার্থিক বিকাশসহ জীব ও প্রাণির সুসামঞ্জস্য বিধানে তাঁরা নিষ্ঠাবান। সৎসঙ্গের প্রচারকদের ঋত্বিক বলা হয়। যে কেউ ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের প্রতি নিষ্ঠাযুক্ত ভক্তি রেখে ঋত্বিক হতে পারে। সৎসঙ্গের দীক্ষা হিন্দু, মুসলমান বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, নাস্তিকসহ সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত। সৎ সংযুক্তির সঙ্গে তদ্‌গতি সম্পন্ন যারা তারাই সৎসঙ্গী আর তাদের মিলন ক্ষেত্র হল সৎসঙ্গ। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন: ‘মানুষ আপন টাকা পর, যত পারিস মানুষ ধর।’

ঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের রচনাবলি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও সাবলীল এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন। প্রায় দেড়শটি গ্রন্থের গ্রন্থকার তিনি। একমাত্র সত্যানুসরণ ছাড়া বাকি গ্রন্থগুলো সবই শ্রুতি লিখনে প্রকাশিত। এসব গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে পুণ্যপুঁথি, চলারসাথী, নানা প্রসঙ্গে, কথা প্রসঙ্গে, বিবাহ বিধায়না, শিক্ষা বিধায়না, নিষ্ঠা বিধায়না, বিজ্ঞান বিধায়না, বিজ্ঞান বিভূতি, সমাজ সন্দীপনা সহ বিভিন্ন অমূল্য গ্রন্থ। আর্য কৃষ্টি সংরক্ষণ যজন, যাজন, ইষ্টভৃতির অঙ্গীকারে সৎসঙ্গের উদ্ভব।

রামবল্লভী সম্প্রদায়

রামবল্লভী সম্প্রদায় কর্তাভজা সম্প্রদায়েরই একটি স্রোতধারা, আউলচাঁদ প্রবর্তিত কর্তাভজা সম্প্রদায় অনেকাংশে গোস্বামীতন্ত্রে রূপান্তরিত হলে আউল চাঁদের সত্যস্রোতে আরেকটি ধারার সৃষ্টি হয়; তার নাম রামবল্লভী সম্প্রদায়। রামবল্লভী সম্প্রদায়ের উদ্যোগী পুরুষ হলেন কৃষ্ণ কিংকর গুণসাগর ও শ্রীনাথ মুখোপাধ্যায়। রামবল্লভ নামক এক ব্যক্তিকে এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলে মান্য করা হয়। প্রতি বৎসর শিবচতুর্দশীতে এই সম্প্রদায়ের মেলা বসে। রামবল্লভী সম্প্রদায় সকল ধর্মের প্রবর্তক ও সকল ধর্ম গ্রন্থকে শ্রদ্ধা করে। রামবল্লভী সম্প্রদায়ের প্রার্থনা সভায় যিশু খ্রিষ্ট, হজরত মুহম্মদ (সা.) ও গুরু নানকের ভোগ প্রদান করা হয়। এই সম্প্রদায়ের বিশ্বাসসূত্র নিম্নরূপ :

১. রামবল্লভী সম্প্রদায় জাতি ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমান জ্ঞান করে।

২. সকলের প্রতি বিনয় সম্মত আচরণে বিশ্বাসী।

৩. সকলের প্রতি ভালবাসা ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী।

৪. পরদ্রব্য, পরস্ত্রীর প্রতি নির্মোহ।

৫. বিভিন্ন ধর্মের উপাস্য পরমসত্তা বহু নয়, ভিন্ন নয়, জাতি ভাষা কৃষ্টিভেদে একেরই ভিন্ন ভিন্ন নাম।

বাংলাদেশের লোকায়ত মানুষের মধ্যে অদ্য বিধি বিভিন্ন নামে এই ধারার সাধনা বিদ্যমান। বাংলাদেশ বিভিন্ন আউলিয়া দরবেশ সুফি সাধক ও গুরু নানকের পবিত্র পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে, পরবর্তীকালে সুফিদের মত কুকাসন্ন্যাসীরাও সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে অশেষ অবদান রাখেন এবং পাশাপাশি খ্রিষ্টানমণ্ডলির অনেক সাধক সম্প্রদায় (যারা আউল বাউলের সমপর্যায়ের) বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত থেকেছেন এবং অদ্যাবধি রয়েছেন। সেক্ষেত্রে বৌদ্ধ বাউল বৈষ্ণব ধর্মের তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর যিশু খ্রিষ্ট, মুহম্মদ (স.), নানক প্রমুখ পুরুষোত্তমের ভাবাদর্শে একটি নতুন সম্প্রদায়ের জন্ম বাঙালির অন্তর্নিহিত, সমন্বয়ী ও প্রেমিক সত্তার বহিঃপ্রকাশ ব্যতীত আর কিছুই নয়।

অখণ্ডমণ্ডলী সম্প্রদায়

স্বামী স্বরূপানন্দকে কেন্দ্র করে অখণ্ডমণ্ডলীর উদ্ভব ও বিকাশ। এ সম্প্রদায়ের বেদ হল অখণ্ড সংহিতা। মানবজীবনে উৎকর্ষ লাভ করতে হলে ত্যাগ, আত্মনির্ভরশীলতা, ও ব্রহ্মচর্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অখণ্ডমণ্ডলী শুধু মাত্র কৌমার্যের মাধ্যমে ব্রহ্মচর্য নয়, দাম্পত্য জীবনেও ব্রহ্মচর্যের ধারা প্রবর্তন করেছেন। অখণ্ডমণ্ডলী মনে করে যে, নারী পুরুষ আধ্যাত্মিক সাধনার চড়াই এবং উত্রাইয়ে যুগল এবং পরিপূরক শক্তি। অখণ্ডমণ্ডলী মূলত একেশ্বরবাদী। বাংলাদেশে এর উদ্ভব হলেও পরিবর্তিকালে অনিবার্য কারণবশত বিহারের মানভূম জেলায় এর বিকাশ ঘটে। বাংলাদেশে ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী সহ বিভিন্ন স্থানে অখণ্ডমণ্ডলী বিদ্যমান। অযাচক ও বীর্যবানের ধর্মই হল অখণ্ডমণ্ডলী। ঢাকা অঞ্চলের শুভ্যাঢ্যা নিবাসী বীরেন্দ্র মালো নামক মল্লবর্মণ সম্প্রদায়ের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি (যিনি কিশোর সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন) এই প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। টাঙ্গাইল অঞ্চলে গোপালপুর উপজেলার ডুবাইল গ্রামের শহীদ ভূপতি মোহন সরকার এক সময় অখণ্ড মণ্ডলীর বাণী প্রচার করেছেন। কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের অন্তর্গত রহিমপুরে একটি অখণ্ডমণ্ডল আশ্রম রয়েছে। যেখানে ‘ভবান ভিক্ষাংদেহি’ তথাকথিত সন্ন্যাসীদের মূলমন্ত্র: সেখান থেকে স্বামী স্বরূপানন্দ অযাচক ও অভিক্ষার ব্রতে অখণ্ডমণ্ডলীকে প্রতিষ্ঠা করেন। স্বামী স্বরূপানন্দ বলেন, ‘নিজ নিজ ক্ষুদ্র সংসার এবং হীনস্বার্থ নিয়া যাহারা ব্যস্ত, তাহাদের সংসারও দেখিতে না দেখিতে ছিন্নমূল তরুর ন্যায় ভূতলশায়ী হইবে, স্বার্থও দুর্বৃত্ত-পীড়নে নিষ্পেষিত হইয়া মরিবে। আজ তোমরা সকলকে স্বার্থ এবং সংসার এই দুই জঞ্জালের চিন্তা হইতে মুক্ত হইবার জন্য গভীর আবেগে আবেদন জানাও। পৃথিবীর সকলের স্বার্থের মধ্য দিয়া নিজের স্বার্থকে আদায় করিতে, জগতের সকলের সংসারের সর্বাঙ্গীণ পুষ্টির ভিতর দিয়া নিজের ক্ষুদ্র সংসারের পুষ্টি আহরণ করিতে আজ তোমরা প্রত্যেককে উদ্ধুদ্ধ কর। ব্যষ্টির তৃপ্তি এবং ব্যক্তির কুশলই আজ যেন কাহারও লক্ষ্য না হয়। সমষ্টির তৃপ্তি এবং সমগ্রের কুশলের মধ্য দিয়া যেন ব্যষ্টি আজ পরিপূর্ণরূপে তৃপ্তিমান এবং অফুরন্ত কুশলের অধিকারী হইতে পারে।’ স্বামী স্বরূপানন্দ আরো বলেন, ‘ক্ষুদ্রকে যে অবহেলা করে, তার দুঃখ পদে পদে। পৃথিবীতে তোমার অবজ্ঞার পাত্র যে কেউ নেই, এই কথাটি সত্য ক’রে জানো। ছোটর ভিতরে বড়’র বীজ খুঁজে বের কর। নিম্নতম অবস্থার এবং নীচতম চরিত্রের লোকের ভিতরেও উচ্চতম অবস্থা ও চরিত্র যে বিকশিত হ’তে পারে, এই বিশ্বাসকে জাগ্রত কর, জ্বলন্ত কর। ক্ষুদ্রের ভিতরেও বৃহৎকে দেখ।’

কিশোরীভজা সম্প্রদায়

সৃষ্টির আদিম শক্তি হল চির কিশোরী, চিরচঞ্চলা কন্যাকুমারী। তাকে উপলব্ধি করেই ‘আমার উঠিতে কিশোরী বসিতে কিশোরী’ সংগীতের উদ্ভব। এই মহাজগৎ ও তার প্রাণিন সম্পদ যেন কিশোরীর ক্রীড়ার বস্তু, তাঁর অন্তর্নিহিত মাতৃত্ব ও দয়ার গুণে পৃথিবীতে আমাদের আবির্ভাব। সৃষ্ট জীবের জন্য তিনি মাতা ও কন্যাস্বরূপ। ব্যক্তি বা গুটি কয়েক মানুষের কলংকের জন্য সূর্য যেমন কলংকিত হয়না তেমনি কতিপয় দূরাচারী ব্যক্তির জন্য কোন মতবাদকে অহিতকর বলা বিধেয় নয়। মাধ্ব গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের শ্রী বিমলাপ্রসাদ সিদ্ধান্ত সরস্বতী তার বঙ্গে সামাজিকতা নামক গ্রন্থে কিশোরীভজা সম্প্রদায়কে বক্র দৃষ্টিতে দেখেছেন, এখানে তিনি অক্ষয়পন্থীদের মত কিশোরী ভজা মতের বাহ্যিক দিকটা দেখেছেন। তার মত প্রাজ্ঞজন বিষয়টি তাদের জীবনবেদ তথা চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে লক্ষ্য করলে এই মতের প্রাসঙ্গিকতা ও দার্শনিক গভীরতা উপলব্ধি করতে পারতেন। মোটকথা, অধিকারবঞ্চিত, ব্রাহ্মণ্যবাদ কর্তৃক সমাজবহিঃস্কৃত এবং তথাকথিত মাধ্ব গৌড়ীয় নিষ্কলংক দেবদূতগণ (?) কর্তৃক ধীকৃত মানুষেরা ধর্মান্তরিত না হয়ে আর্যকৃষ্টির সুউচ্চ পর্বতের শেষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁদের প্রতি বিচারবিহীন মন্তব্য ‘অমানীকে মান’ দেওয়া তত্ত্বের বৈরিতা ও ‘তৃণাদপি সুনীচেন’ আদেশের বরখেলাপ ব্যতীত আর কিছুই নয়।

কালাচাঁদ বিদ্যালংকার এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। কালাচাঁদ শুরুগৃহে অবস্থানকালে ধানভানার সময় গুরুপত্নীর গায়ে আঘাত লাগে। এর ফলে গুরুগৃহ থেকে পালিয়ে তিনি নবদ্বীপ চলে যান, সেখানে তিনি বংশরাম স্পষ্টদায়ক সহ বিভিন্ন আধ্যাত্মিক নেতার সংস্পর্শে আসেন, কর্তাভজা ও রাধাবল্লভীদের সাথে তাঁর মতাদর্শে মিল থাকায় পণ্ডিতেরা তাঁর কর্তাভজা ও রাধাবল্লভী সংশ্লিষ্টতা অনুমান করেন। মতে সহজিয়া, আচারে বৈষ্ণবরাই হয়ত কিশোরীভজা মতের প্রচারক। আদ্বিজ ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল সবার জন্যই কিশোরীভজাদের দ্বার উন্মুক্ত। তবে চক্র সাধনা অন্তরঙ্গ ভক্তদের মধ্যে সীমিত।

ঢাকা শহর ও তৎসংলগ্ন নমঃশূদ্র ও জেলে গ্রামগুলিতে অদ্যাবধি চক্র সাধনার অবশেষ বিদ্যমান রয়েছে। সাধনার ক্ষেত্রে এরা নারীকে/কুমারীকে অতিউচ্চ স্থান দেন। জেমস ওয়াইজ ও অন্যান্যদের বর্ণিত নগ্ন প্রেমলীলা কোথাও আমাদের প্রত্যক্ষ হয় নি, তবে তাঁরা প্রকৃতি ও পুরুষের আত্মিক উন্নতির জন্য পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক হিসাবে একত্রে সাধন ভজন করে থাকে। কেরানীগঞ্জ উপজেলার শুভাঢ্যা চৌকিদার হাটির সুরেন্দ্র সরকার, তোতারাম সাধু, দুখাই সাধু ও চন্দ্রবাউলের আখড়ার সেবায়েত তারাকুমার মহাশয়ের সংস্পর্শে থেকে কালাচাঁদের মত তথা কিশোরী ভজন সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। রামকৃষ্ণ মঠে প্রকাশ্য কুমারী পূজা শাস্ত্রীয় বিচারে বৈধ হলে কিশোরী ভজনের অবৈধতা সর্ব সাধারণের বোধগম্য নয়।

কর্তাভজা সম্প্রদায়

কর্তাভজা সম্প্রদায়কে অনেকে বাউল মতবাদ হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন। বাউল এবং কর্তাভজা উভয় মতবাদের মধ্যে সাদৃশ্য থাকলেও একটি আরেকটি থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে তা বলা যায় না। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উদ্ভব। এরা নিজেদের আরাধ্য দেবতার নামকে কর্তা বলে অভিহিত করে। আউল চাঁদ এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। ঘোষপাড়াকে কেন্দ্র করে এর প্রচার ও উদ্ভব। প্রতি বৎসর দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে এই সম্প্রদায়ীদের মেলা বসে।

ফকির আউল চাঁদ এর প্রতিষ্ঠাতা হলেও রামশ্রবণ পাল এর প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মানুষ যখন রসবিবর্জিত আচারের মরুবালিরাশি কিংবা মূল্যহীন শব্দের ধুম্র ধূলিতে দিকভ্রান্ত হচ্ছিল তখন জীবন সত্যের অঙ্গীকারের প্রেম ও বোধিবৃক্ষের লালনের সফল প্রয়াস ও অভিযানের মধ্য দিয়ে লোকায়ত মানব সম্প্রদায়ে এর উদ্ভব।

ব্রাহ্মসমাজের অভ্যুদয় যেমন উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের চিৎ প্রকর্ষের কারণ হয়েছিল, তেমনি নিরক্ষর তৃণমূল সহজ মানুষের সমাজে বুদ্ধির মুক্তি ও সংস্কারমুক্ত আত্মিক অনুশীলনের প্রয়োজনে লোকায়ত সমাজে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উদ্ভব ও প্রসার। মানুষ যে মানুষের পরিপূরক সত্তা এবং প্রেমের মধ্য দিয়েই মানুষ প্রজ্ঞার ধ্রুবলোকে অধিষ্ঠিত হতে পারে এবং সৃষ্টির মূল যে পরম কল্যাণ ও সুন্দর সেই ধারণা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের দান।

কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বিশ্বাসসূত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল-

১. বাণীবদ্ধ শাস্ত্র আচারের মধ্যে সত্যস্রোত আটকে থাকে না, সত্য নিত্য নতুন রূপে চির বহমান।

২. জৈবিক প্রবৃত্তিকে নির্মূল করে সাধনা নয়, প্রবৃত্তির ঊর্ধ্বমুখী ও সুসঙ্গত বিকাশের মধ্য দিয়াই অগ্রসর হতে হবে।

৩. জ্ঞানতত্ত্বের দিক থেকে তারা বাস্তববাদী, অনুমান নির্ভর নয়।

৪. বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ভেদবুদ্ধি এবং অন্ধ বিশ্বাস ও বিচারহীন আনুগত্য নাই তারা প্রতিবাদী এবং বিবেকের নিকট দায়বদ্ধ।

৫. কায়াসাধনার মাধ্যমে পরমসত্যের উপলব্ধি ঘটে, অধ্যাত্মসিদ্ধির জন্য গুরুশিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।

৬. ধর্ম বর্তমানের বিষয়; ধর্ম ইতিহাস কিংবা অনুমান নয়। জীবনের জন্যই ধর্ম। সাম্যবাদী বৌদ্ধধর্মের সকল উচ্ছেদের পর তৃণমূল মানুষের মধ্যে বৌদ্ধ আচার অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে অথবা বৌদ্ধধর্মের সাধনা প্রজাকুলের মধ্যে দীর্ঘকাল সংগোপনে সাধিত হবার পর অনুকূল পরিবেশে সুফিবাদের স্পর্শে বৈষ্ণব, আউল, কর্তাভজা নামে এরা পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে কর্তাভজাদের একটি বিরাট অংশ খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে।

কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ভগবৎ সেবার নিয়মাবলি :

১. ভক্তি প্রাণ চিত্তে সবার উদ্দেশ্য প্রণতি কর্তব্য;

২. মিথ্যা ভাষণ, উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ, অহঙ্কার হিংসা প্রভৃতি পরিতাজ্য; ৩. সত্য বাক্য, সত্য আচার ও সত্যানুষ্ঠান পরিপালনীয়;

৪. আত্ম প্রশংসা মহৎজনের নিন্দা ও বেদ শাস্ত্রের নিন্দা পরিহর্তব্য; ৫. সভা অভ্যন্তরে কাহারও প্রতি কর্কশ বা অপ্রিয় বাক্য প্রয়োগ করবে না; ৬. সভা মধ্যে পাদ প্রসারণ অবিধেয়;

৭. সেবাপরাধ না ঘটে, তদ্বিষয়ে দৃষ্টি রাখবে;

৮. শ্রদ্ধা ভক্তি সহকারে তদ্‌গত চিত্তে ভগবদ্ নিবৃত থাকবে;

৯. সর্বদা ভগবত জনের সম্মাননা করবে;

১০. নিয়ত সৎপ্রসঙ্গে চিত্ত নিবিষ্ট রাখবে;

১১. সর্বদা সর্ব বিষয়ে সতর্ক থাকা বিধেয়;

১২. আত্ম শ্লাঘা বিবাদ কলহ প্রভৃতি পরিত্যাজ্য;

১৩. কুতর্ক পরিত্যাজ্য;

১৪. শ্রদ্ধাহীন ব্যাক্তিকে নাম উপদেশ প্রদান নিষিদ্ধ;

১৫. সকলকেই তুল্য মানুষ জ্ঞান করবে;

১৬. গুরু ভজনে অবজ্ঞা পরিত্যাজ্য;

১৭. সাধু সমাজের প্রতি ভয় ও ভক্তি প্রদর্শন কর্তব্য;

১৮. বিরলে নাম স্মরণ বিধেয়;

১৯. শুক্রবারে নিরামিষ ভোজী।

পিরালী সম্প্রদায়

পীর নারায়ণ সম্প্রদায় অবৈদিক ধারণার মধ্য দিয়ে মানব মিলনের প্রয়াসী। সত্য নারায়ণ/সত্যপীর সম্প্রদায় বৌদ্ধ সাধনার ধারাবাহিক প্রকাশ ঘটে। পরম শ্রদ্ধেয় মছলন্ধী পীর মৎসেন্দ্রনাথকে অভিন্ন বলে মনে করা হয় অথবা দিনাজপুর জেলার সতিমন ডাঙ্গির সত্যমন ঠাকুররূপী ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ প্রতিমার মত অন্যান্য প্রতিমাগুলি পরবর্তীকালে সত্যপীরের/সত্যনারায়াণের রূপ লাভ করেছে কিনা তা গবেষণার বিষয়। বৌদ্ধদের পঞ্চতথাগত তান্ত্রিক বৌদ্ধযুগের অন্তিমপূর্বে লোকায়ত সমাজে পঞ্চপণ্ডিতে রূপান্তরিত হয়, এই লোকায়ত সমাজ সুফি মরমিদের সংস্পর্শে ইসলামে আত্তীকরণের সময় পঞ্চতথাগতকে পঞ্চপীর/পাঁচপীর পূজা আজো বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশের রংপুর দিনাজপুরে ও ভারতের কোচবিহার অঞ্চলে আজো পঞ্চপীর, সত্যপীর পূজা প্রচলিত রয়েছে। এক সময় মধুপুর গড় অঞ্চলে পঞ্চপীরের অনুসারীদের আখড়া বিদ্যমান ছিল। বৌদ্ধ করগুব্যূহসূত্র মতে অবলোকিতেশ্বর (পদ্মপানি) এর হৃদয় হতে নারায়ণের জন্ম— সে হিসাবে সত্যনারায়ণ সত্যপীর বৌদ্ধধর্মের প্রভাবজাত ও বৌদ্ধদের সত্যপূজার অবশেষ বটে, জৈন বৌদ্ধ যুগে তীর্থংকর ও অর্হৎ পূজার আরম্ভ অথবা সে যুগে মানুষ সাধনা বলে নরনারায়ণে পরিণত হয়। সত্যসেবা সাধনার গুণে তীর্থংকর এবং অহঙ্গণ সাধারণ মানুষের পূজা পেতে থাকেন এবং পরে তা সঙ্গত কারণে যোগী দরবেশ পীর ভক্তিতে রূপান্তরিত হয়। অনেকে পৌরাণিক অর্হৎ, নাথ যোগীকে পীরদের সাথে অভিন্ন মনে করেন। রামেশ্বরী সত্যনারায়ণ পাঁচালীতে সত্যপীরের মাহাত্ম্য নিম্নরূপ:

‘কৃষ্ণকেশী কেশব মোর নাম,
মক্কায় রহিম আমি অযোধ্যার রাম।
…. …. …. …. …. ….
ফকির হইয়া আসি তোমার কারণ,
কলিতে সম্প্রতি সত্যপীর নারায়ণ।

মতুয়া সম্প্রদায়

ইতিহাসের জটিল বিন্যাসে না ঢুকে সহজ কথায় বললে বলতে হয় গৌতমবুদ্ধ (৫৬৬-৪৮৬ খ্রিষ্টপূর্ব) থেকে শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) দেবের ঐতিহ্য-ঋদ্ধ এক বিপ্লবী ধর্ম আন্দোলন তথা সমাজ আন্দোলনের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মেছিলেন পূর্ব বাংলার ফরিদপুর জেলার সাফলিডাঙা গ্রামে ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মার্চ। বেঁচেছিলেন ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই মার্চ পর্যন্ত। তাঁর সুপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। তার প্রয়াণ তারিখ ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ তাঁদের ধর্ম সাধনার গোটা সময়টাই (১৮১২ থেকে ১৯২৭) পরাধীন দেশে, অবিভক্ত বাংলায়। তাঁদের প্রবর্তিত ধর্মমতের নাম ‘মতুয়া ধর্ম। তাঁদের ধর্ম অবিভক্ত বাংলায়। তাঁদের ধর্ম আন্দোলন, সমাজ বিপ্লব, জীবনসাধনা বিষয়ে তাঁদের লেখা কোনও গ্রন্থ নেই। যেমন ছিল না চৈতন্যদেবের। হরিচাঁদ সামান্য শিক্ষিত ছিলেন, দলিল ইত্যাদি পাঠ করতে পারতেন। তাঁর পুত্রকে বর্ণ হিন্দুদের স্কুলে পড়ার সুযোগ ছিল না বলে মক্তবে ভর্তি করেন। এখানে পড়াশুনা করার পরে অন্যত্রও পড়াশুনা করেন।

তবে তাঁদের জীবনলীলা বা কর্মসাধনা দর্শন মনন ও নির্দেশ বিধৃত আছে দুটি মহাগ্রন্থে। মতুয়া ধর্মের মানুষের শ্রেষ্ঠ শাস্ত্র সে দুটি। হরিচাঁদের জীবন কেন্দ্রে রচিত কবি তারক সরকারের শ্রীশ্রী হরি লীলামৃত এবং গুরুচাঁদের জীবন ও সংগ্রামের কথা লেখা আছে আচার্য মহানন্দ হালদারের শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত গ্রন্থে। দুটি গ্রন্থই ছন্দে বিধৃত। ভক্তদের অভিমতে যেন এ যুগের চৈতন্য চরিতামৃত।

আমরা জানি পৃথিবীর ইতিহাসে বহু যুগে বহু দেশে ধর্ম আন্দোলনের মাধ্যমে অনেক মহামনীষী করেছেন সমাজ সংস্কার এমনি সমাজ বিপ্লব। হরিচাঁদ তাঁর মতুয়া ধর্মকে বলেছিলেন, ‘সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম’। যেন সেই আদিম সাম্যবাদী যুগের মত কথা। মনু-পূর্ব ভারতে বর্ণবিভাজন ছিল কর্মভিত্তিক। জন্মভিত্তিক-গোষ্ঠীতন্ত্রবাদী ব্রাহ্মণ্য শোষণের বর্ণাশ্রম নয়। জানি না হরিচাঁদ তেমনি কোনও বিভেদ মুক্ত সনাতন ধর্মের কথা বলেছিলেন কিনা। সে যাইহোক পূর্ব বাংলার গ্রামে বসে শহরের সংযোগহীন একজন মানুষ বর্ণবাদকে অস্বীকার করলেন। তাঁর ধর্ম আন্দোলনে এল চার্বাক-বৃহস্পতি-বুদুর-উত্তরাধিকার, বস্তুবাদী চিন্তার আলোকে।

তার আগের মহাপুরুষেরা বলেছেন স্বর্গলাভ, পরকাল, পরজন্ম, মোক্ষ নির্বাণের কথা। তিনি বললেন, ‘এসব স্বর্গলোভ, পাপভয় দেখিয়ে মানুষের মানসিক শক্তিকে আচ্ছাদন করা হয়’। এ প্রসঙ্গে গুরুচাঁদ বলেন, ‘অনন্ত শক্তির কেন্দ্র মানবের মন। পাপভয়ে স্বৰ্গলোভে করে আচ্ছাদন।’ ভারতের অন্য কোনও সাধু সন্তরা স্বর্গকে লোভের বস্তু হিসেবে ঘোষণা করেছেন কিনা—আমরা জানিনা Į এই ধর্মমত তাই আমাদের ভাষায় একটি বস্তুবাদী বিপ্লবী ধর্মমত। যা অনেক ক্ষেত্রে ‘ধর্ম’ বলতে আমাদের যেসব পুরনো ধর্মীয় ধারণা আছে তাকে অতিক্রম করে যায়।

মতুয়া ধর্ম নাম কেন?— কেউ বলেন হরি নামে মাতোয়ারা। কেউ বলেন ওদের তন্ত্র-মন্ত্র বাছ-বিচার নেই, হিন্দুরীতি মানে না। জাত-পাতহীন এ ধর্মমত; যেমন বিধর্মীর মতো। তাই মতুয়া ধর্ম। কুসংস্কার মুক্ত এক সূক্ষ্ম-সনাতন ধর্ম। যাদের মূল আশ্রয় এ জীবন, পিতা-মাতা-পুত্র-কন্যা-স্ত্রী-আত্মীয়সহ এ গৃহ, গার্হস্থ্য-ধর্ম তাদের

রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে যেমন উচ্চ শ্রেণির হিন্দু ধর্মে জাগরণের সৃষ্টি হয়, তেমনি ফরিদপুরের ওড়াকান্দি গ্রামে হরিচাদ ঠাকুর ও গুরুচাদ ঠাকুরের শুভ আবির্ভাবে তফসিলী জাতি তথা নমশূদ্রসম্প্রদায়ে জাগরণের সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় সংস্কার প্রগতির পথকে যে উন্মোচিত করে তার প্রমাণ ইউরোপের প্রটেষ্ট্যান্ট আন্দোলন, চৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলন, ব্রাহ্ম সমাজ অতঃপর পূর্ববঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায় ও অন্যান্য আন্দোলন।

মতুয়া সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার আগে বাংলার কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী, নমশুদ্র, জেলে, কৈবর্ত সহ তফশীলি সম্প্রদায়ের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ এবং মানবেতর। বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্যসমাজ এই সব ব্রাত্য ও লোকায়ত সমাজের মানুষকে নিজেদের গৃহপালিত জন্তুর চেয়ে নিম্নতর ভাবতেন। আবার ব্রাহ্ম সমাজ তখনও জমিদার বাড়ির আঙ্গিনা ছেড়ে তৃণমূল মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করেনি। এমতাস্থায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে তৃণমূল মানুষের বাঁচাবাড়া অর্থাৎ আত্মবিকাশে কোন পথ খোলা ছিল না। আবার সদ্ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম অথবা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করবে তেমন মানসিক প্রস্তুতিও এদের ছিল না। উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান প্রমুখ ইংরেজ সিভিলিয়ান খ্রিষ্টধর্ম প্রচার আরম্ভ করলে নিম্নবর্গের মধ্যে যারা অধিকতর নিম্ন এবং দরিদ্রের মধ্যে যারা অধিকতর দরিদ্র এবং যাদের ধর্ম বিক্রয় করা ছাড়া আর কোন বিষয় সম্পদ ছিল না। তারা আত্মরক্ষার তাগিদে দলে দলে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। তদুপরি, জনতার উপর চলছিল হাজারও ধরনের অত্যাচার। প্রচলিত ছিল গুরুপ্রসাদী প্রথা ও সতীদাহ প্রথা।

এই অবস্থায় হরিচাদ ঠাকুরের নেতৃত্বে একটি আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন সুচিত হয়। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষ হত দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষ হরিচাঁদের ডাকে প্রবলভাবে সাড়া দেয় এবং ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়ি এক সময় এই অবহেলিত মানুষের মুক্তির কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে বঙ্গে যিশুর বিজয় যাত্রা কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এককালে বর্ণ হিন্দুরা নমশূদ্রদেরকে চণ্ডাল নামে অভিহিত করত, মতুয়া উত্থানের ফলে তদানীন্তন বিট্রিশ সরকার ব্রাহ্মণ্যবাদের আরোপিত এই উপাধি নিষিদ্ধ করে। হরিচাঁদ ঠাকুর পৃথিবীতে মহাসম্ভূতির দায়িত্ব পালন করেন। মতুয়া সম্প্রদায়ের উন্নয়নীসভা নামশূদ্রদের মধ্যে বৈষয়িক জাগরণের সূচনা করে। এ সময় সারা বাংলাদেশে ৫,০০০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। এই সমস্ত বিদ্যালয়ে মতুয়া সম্প্রদায়ের অনুসারিরা শিক্ষকতা করতেন। ধর্মদর্শনের ক্ষেত্রে মতুয়ারা বৈষ্ণব ঐতিহ্যের দাবিদার; যার উৎপত্তি সহজিয়া বৌদ্ধধর্ম থেকে। বিশ্বের যতগুলি লোক ধর্ম রয়েছে মতুয়া তার মধ্যে অন্যতম। ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য থেকে উদ্ধার, সামাজিক ন্যায় বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠা তাদের মহান ব্রত

মতুয়া শাস্ত্রে রয়েছে/নীচ হয়ে করিব নীচের উদ্ধার অতি নিম্নে না নামিলে কীসে অবতার, নীচু জনে উচ্চ হবে বুদ্ধ তপস্যায়, বুদ্ধদেব অবতার যে সময় হয়। মতুয়াদের দ্বাদশ আজ্ঞা— ১. সদা সত্য কথা বলবে; ২. পিতা মাতাকে দেবতা জ্ঞানে ভক্তি করবে; ৩. নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে; ৪. জগৎকে প্রেম করবে; ৫. সকল ধর্মে উদার থাকবে; ৬. জাতিভেদ করবে না; ৭. হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে; ৮. প্রত্যহ প্রার্থনা করবে; ৯. ঈশ্বরে আত্মদান করবে; ১০. বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না; ১১. ষড়রিপু বশে রাখবে; ১২. হাতে কাম, মুখে নাম করবে।

অধ্যাত্ম অনুশীলনের মূল কথা হল আত্মোপলব্ধির সহিত মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ এবং বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সকল সত্তার সামগ্রিক কল্যাণ। উপরিউক্ত ধারণার সঙ্গে সত্য, প্রেম ও পবিত্রতার সমন্বয়ে মতুয়াবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মতুয়াবাদের দ্বাদশ আড্ডায় শীল, সমাধি, প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটেছে এবং পুরাতন নিয়মের দশ আজ্ঞা এবং নতুন নিয়মের অষ্টকল্যাণ বাণীর সাথে এর মিল রয়েছে। মতুয়ারা বর্তমান ও জীবন্ত ধর্মে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, দণ্ডকারণ্যসহ আন্দামান দ্বীপে মতুয়া ধর্মমত প্রচলিত আছে।

মহানাম সম্প্রদায়

শ্রী জগদ্বন্ধু সুন্দর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে মুর্শিদাবাদের ভাগবতী তীরের ডাহাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তার জীবনাবসান ঘটে। জগবন্ধু সুন্দরের উপাসকরা সুন্দরকে কেন্দ্র করে এক আধ্যাত্ম অভিযাত্রা শুরু হয়। তিনি দীর্ঘদিন ধ্যানমার্গে অতিবাহিত করেন। তাঁর শিষ্য মহেন্দ্ৰজী এই সম্প্রদায় গঠনে অসামান্য অবদান করেন। এই সম্প্রদায় বৈষ্ণব বেদান্তের অনুসারী, প্রকৃতি বিবর্জিত সাধনায় বিশ্বাসী। শ্রীশ্রী জগদ্বন্ধু মোট ৮ খানি গ্রন্থ রচনা করেছেন যথা— ১. শ্ৰমতী সংকীর্তন ২. শ্রী নামকীর্তন ৩. শ্রীবিবিধ সংগীত ৪. শ্রীস্যকীর্তন ৫. শ্রীশ্রী হরিকথা ৬. চন্দ্রপাত ৭. ত্রিকাল ৮. উদ্বাবন। ড. মহানামব্রহ্মচারী এই সাধক সম্প্রদায়ের একজন তাত্ত্বিক ও দার্শনিক প্রবক্তা। ফরিদপুরে গোয়াল চামটে ‘শ্রী অঙ্গণ’ অবস্থিত। ঢাকা টিকাটুলীসহ সারাবিশ্বে এই সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শাখা রয়েছে। চন্দ্ৰপাত গ্রন্থে এই সম্প্রদায়ের বীজমন্ত্র মহানাম রয়েছে।

হরিপুরুষ জগদ্বন্ধু মহাউদ্ধারণ।
চারি হস্ত চন্দ্র পুত্র হাকীট পতন।
(প্ৰভু প্রভু হে) (অ ন ন্তা ন স্ত ময়)

বৈষ্ণব সম্প্রদায়

পরমসত্তা আনন্দময়, আনন্দ ও রস আস্বাদনের জন্য তিনি বিশ্বভুবন সৃষ্টি করেছেন। আনন্দ দিয়ে তিনি জগৎসংসার লালন করেছেন এবং মহাজগতের গতি ও সদা পরিবর্তনের মূলে যে রস ও আনন্দ বিদ্যমান তাই তিনি। ব্যক্তি তার রস বৃক্ষের রসকলি। জগতের সকল কিছুই তার রসের প্রকাশ। বিশ্বসংসার রসবৃক্ষ ব্যক্তি তাঁর ফল। মহাজাগতিক বৈচিত্র তার আনন্দের পরিপূরক সত্তা। সকল সত্তাই রসময় ও তাঁর নাম।

মধুময় জগৎ ও আনন্দময় জীবনের লক্ষ্যে বৈষ্ণব মতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ। ভাগবতের প্রতীক ও উপাখ্যানগুলি দ্বারা বৈষ্ণবমতের সারার্থ বর্ণনা করা হয়েছে। বৃন্দাবন আনন্দ ভূমির প্রতীক। এখানে তৃণ, লতা, পুষ্প, গুল্ম, পশু, পাখি, পর্বত, নদী এবং মানুষ সকলই ঈশ্বরের গৌরব এবং প্রশংসার জন্য। এখানে সকল কর্মই রস ও আনন্দের জন্য। বিষ্ণু পালনকর্তা, বৈষ্ণব পৃথিবীতে বিষ্ণুর প্রতিনিধি, শুদ্ধ বৈষ্ণবের উপস্থিতি সমতা উন্নয়ন ও ন্যায় বিচারের চেতনা জাগ্রত করে। বিষ্ণু জগতে অবতীর্ণ হন শিষ্টের লালন ও দুষ্টের বিনাশের জন্য। কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম গীতা-র লোকসংগ্রহ ও ভাগবত নির্দেশিত দারিদ্র্য বিমোচনের তত্ত্ব অস্বীকার করে। তারা জীবন ও জগত সম্পর্কে মায়াবাদী পন্থা গ্রহণ করে। ফলে অনিরূদ্ধ দেবের মত তারা বৈষ্ণব ধর্মের পূর্ণাঙ্গ মত উপস্থাপন করেন নি অথবা শিখ গুরুদের মত তারা অবিচারের বিরুদ্ধে জনতার কাতারে দাঁড়ান নি। মূলত বৈষ্ণব সম্প্রদায় ইউটোপীয় (বৈদিক) সাম্যবাদী। শ্ৰীমন্ত শঙ্করদেব, চৈতন্যদেবও সমকালে সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্যবাদী ছিলেন। বৈদিক সাম্যবাদের মূলকথা হচ্ছে—

এই বিশ্বচরাচরে যা কিছু আছে তা সবই পরমেশ্বর ভগবানের সম্পদ এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই জীবন ধারণের জন্য তিনি যেটুকু বরাদ্দ করে দিয়েছেন সেটুকুই গ্রহণ করা উচিত এবং সব কিছুই যে তার সম্পত্তি তা ভালভাবে জেনে কখনও তার অতিরিক্ত কোন কিছুর আকাঙ্খা করা উচিত নয়।

সর্বধর্ম সম্প্রদায়

আনন্দচন্দ্র নন্দী বা আনন্দ স্বামী এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। আনন্দ স্বামী ১২৩৯ বঙ্গাব্দের ১১ই বৈশাখ কুমিল্লা জেলার কালীকচ্ছ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামদুলাল নন্দী। তিনি শৈশব থেকেই কঠোর অধ্যয়নের মাধ্যমে বাংলা, ইংরেজি, আরবি, উর্দু, হিন্দি ও ফারসি ভাষায় বুৎপত্তি লাভ করেন। অল্প বয়সেই তৎকালীন কুমিল্লা জেলায় ভাষাবিদ ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে।

এক সময় আনন্দ স্বামী ব্রাহ্মসমাজের ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ পাঠ করে ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। অতঃপর আনন্দ স্বামী স্বীয় ভ্রাতা কৈলাশ চন্দ্র নন্দীর সঙ্গে ১২৭৩ বঙ্গাব্দে (পূর্ব বাংলা ব্রাহ্মসমাজ মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন) ঢাকায় ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হবার পর থেকে তিনি নিজ গ্রামে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠা করে প্রচার ও আধাত্ম সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি তার সাধনালব্ধ সত্যকে জনতার মধ্যে বিতরণে সচেষ্ট থেকেছেন। ১২৮৮ বঙ্গাব্দ হতে তাঁর ভিতর দয়াময় ভাবনা ক্রমবিকশিত হচ্ছিল এবং ১২৮৯ সনে তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হন।

বাংলার নব জাগরণের মধ্যে দিয়ে বাঙালির ভাবনার গুণাত্মক পরিবর্তন সাধিত হয়। পূর্ববর্তী ভাবনা এবং তৎকালীন ভাবনাগুলির মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও আদান প্রদানের ফলে নতুন ধর্ম মতের সৃষ্টি হয়। আনন্দ স্বামীর সর্বধর্ম সমন্বয় সেই প্রচেষ্টারই এক মহৎ অভিব্যক্তি। সাধক কবি মনোমোহন, লবচন্দ্র পাল, আফতাব উদ্দিন, মনছুর উদ্দিন সহ অসংখ্য সাধক পুরুষ এই ধারার অনুসারী। সাতমোড়া, ভোলাচং, নরসিংদী, ত্রিপুরা, গাজীপুর অঞ্চলে এই ধারার সাধকমণ্ডলী বিদ্যমান রয়েছে। আনন্দ স্বামী ১৩০৭ বঙ্গাব্দে ১১ই জ্যৈষ্ঠ মৃত্যুবরণ করেন। কালীকচ্ছ গ্রামে তাঁকে সমাহিত করা হয়। প্রকৃত তত্ত্ব, সর্বধর্ম্মগীতিকা তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। মনোমোহন দত্তের ভাষ্য অনুযায়ী স্বামীজীর মত নিম্নরূপ :

‘সর্বসামঞ্জস্য যোগে জগতের মঙ্গলের জন্য সাধনার ভাবে স্বামীজী দয়াময় নাম প্রাণের সহিত উপলব্ধি করিয়া সিদ্ধ যোগ লাভে অবতারীভাবে এই নাম সকল নামের যোগে মানুষের হৃদয়ের ভাব সামঞ্জস্য রাখিয়া প্রচার করিতে থাকেন। ধর্মের মূল বিষয় মানুষের আত্মপরিচয় ও স্বরূপ পুনরুদ্ধার। মনুষ্যত্বের বিপরীত কর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বৌদ্ধিক মুক্তির নিরলস ও নিরন্তর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মসমাজের অভ্যুদয় ঘটে। ব্রাহ্ম সমাজের চিৎপ্রকর্ষের বিদ্যুৎদূতি উচ্চকোটির মননশীল মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করলেও তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে প্রতীক প্রতিমা ও তথাকথিত গুরুতত্ত্বের বলয় থেকে বের করা সুকঠিন ও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কায়াতরু বাঙালি মনীষীদের নিকট বোধিবৃক্ষরূপে বিবেচিত। এখানেই বাংলার বোধিসত্তগণ প্রত্যেকে বুদ্ধরূপে বোধিলাভ করেছেন। বাঙালি মননের বৈশিষ্ট্য শুধু বুদ্ধি নয়। প্রেম ও সহজ সাধনা এর কর্ষণক্ষেত্র। ফলে লোকায়ত মনন ভূমিতে যৌক্তিক আলো আবহাওয়ার আবহে যে ব্রাহ্মবীজ পত্রপল্লবায়িত হয়ে ওঠে তারই পরিণাম সর্বধর্ম সমাজ। সর্বধর্ম মিশন বর্ধিষ্ণু সংগঠন। জনতার মধ্যে প্রতিনিয়ত সর্বধর্মকে জানার ইচ্ছা বাড়ছে। বাংলাদেশে সেমিটিক ধর্ম বলয়ের বাইরে সর্বধর্ম ব্যতীত অন্যকোন সংগঠনের এত প্রচার ও প্রসার নাই। সর্বধর্মের আরতির মধ্যে বিশ্বজনীনতার আভাস মিলে-

সবে বল জয় জয় দয়াময়ের জয়।
সৰ্ব্ব সিদ্ধি মহাশক্তি জগৎ লক্ষ্মীর জয়।
স্থাবর জঙ্গম আদি পশু-পক্ষীর জয়।
চেতন অচেতনাদি কীট পতঙ্গের জয়।
শিব রামকৃষ্ণ দূর্গা আল্লা করিমের জয়।

নাথ বা যোগী সম্প্রদায়

বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে যোগী সম্প্রদায়ের লোকজন বাস করে। বাংলাদেশে তিন ধরনের যোগী বাস করে যথা— ১. যোগী; ২. জাত যোগী; ৩. সন্ন্যাসী যোগী।

ব্রাহ্মণদের পরে যোগীরা স্বতন্ত্র স্বাধীন সম্প্রদায়। তাদের ধর্মীয় ও মাঙ্গলিক কাজের জন্য ব্রাহ্মণের উপর তারা নির্ভরশীল নয়। শিক্ষাদীক্ষায় যোগী সম্প্রদায় তুলনামূলকভাবে অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে অগ্রসর। যোগী সম্প্রায়ের লোকেরা নিজেদেরকে গোরক্ষনাথ, মৎস্যেন্দ্রনাথ সহ নয়নাথের অনুসারী বলে দাবি করেন। পণ্ডিতেরা মনে করেন গোরক্ষনাথ একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন। গোরক্ষনাথই নাথধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। আবার নাথধর্ম বিশ্বের প্রাচীন ধর্মগুলির মধ্যেও একটি। সে বিষয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। নাথসম্প্রদায়ের বিভিন্ন গ্রন্থাবলী পাঠ করে নয়জন নাথ ও চুরাশী জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। নয়নাথ এবং চুরাশী সিদ্ধার রচনাবলি ও সাধন প্রণালী সারা জীবনের অনুশীলনের বিষয়। শুধু সম্প্রদায় হিসাবে এত অমূল্য রত্নরাজি আর কারো নেই। অনেকে নাথধর্মকে সহজিয়া শূন্যবাদের অফসু (off shoot) বলে মনে করেন। এর পিছনে যথেষ্ঠ কারণও বিদ্যমান রয়েছে। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণের তালিকা এবং নাথ সিদ্ধাচার্যগণের তালিকার তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যায় যে ২৯ জন সিদ্ধাচার্যের নাম উভয় তালিকায় এসেছে। তবে বৌদ্ধ সহজতন্ত্র প্রভাবিত নাথধর্ম পরবর্তীকালে হিন্দু প্রাধান্যের যুগে হিন্দুধর্মে মিশে যায় এবং হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবীর মাহাত্ম্য ও নাথধর্মে স্বীকৃত হয়। তবুও কায়াসাধন এবং দেহতত্ত্বের সাধনার উপর ভিত্তি করে যে নাথধর্মের উদ্ভব তার অন্তর্নিহিত সারসত্তার কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটে নি। উপমা উপাখ্যান এবং নাথশিক্ষায় শিক্ষাউপকরণের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটলেও মূলশিক্ষা থেকে নাথধর্মের তেমন কোন বিচ্যূতি ঘটে নি। নিম্নে নয়নাথের তালিকা প্রদান করা হল—১. একনাথ; ২. আদিনাথ; ৩. মৎস্যেন্দ্রনাথ; ৪. উদয়নাথ; ৬. সত্যনাথ; ৫. দন্দনাথ; ৭. সন্তোষনাথ; ৮. কুর্মনাথ; ৯. জালন্ধর নাথ.

সুধাকর চন্দ্রিকা, বর্ণনরত্নাকর তালিকায় ৮৪ জন সিদ্ধার নাম থাকলেও উভয় তালিকাতে ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে কিংবা একই ব্যক্তির দুই নাম থাকতে পারে। বাংলা নাথ সাহিত্য রচয়িতাদের অধিকাংশই মুসলমান। বাংলায় বৈষ্ণব সাহিত্যের পরেই নাথ সাহিত্যের স্থান। মননের ধর্ম, জীবনের ধর্ম নাথ ধর্ম। মানুষই মানুষের নাথ, এই লক্ষ্যে উপনীত হবার সাধনা নাথসাধনা।

নাথধর্মের সম্প্রদায়গুলির নাম শ্রী অমৃতনাথ আশ্রমের পরম্পরা অনুযায়ী ১২টি নাথ উপ-সম্প্রদায় রয়েছে। যথা: ১. সত্যনাথ পন্থা; ২. ধর্মনাথ পন্থা; ৩. দরিয়ানাথ পন্থা; ৪. অইয়ীনাথ পন্থা; ৫. বৈরাগাকীরা পন্থা; ৬. রামকী পন্থা; ৭. কপিলানী পন্থা; ৮. গঙ্গানাথী পন্থা; ৯. মন্নাথী পন্থা; ১০. রাওয়ালকী পন্থা; ১১. পাভা পন্থা; ১২. পাগলা পন্থা।

রাজমোহন নাথের দেওয়া তথ্য মোতাবেক নাথ ধর্মের তেরটি উপ-সম্প্রদায় রয়েছে, তা নিম্নরূপ। যথা— ১. মৎস্যেন্দ্রনাথ সম্প্রদায়; ২. আদিনাথ সম্প্রদায়; ৩. মীননাথ সম্প্রদায়; ৪. গোরক্ষনাথ সম্প্রদায়; ৫. খর্পরনাথ সম্প্রদায়; ৬.

সত্ত্বাথ সম্প্রদায়; ৭. বালকনাথ সম্প্রদায়; ৮. গোলকনাথ সম্প্রদায়; ৯. বিরূপাক্ষনাথ সম্প্রদায়; ১০. ভতৃহরিনাথ সম্প্রদায়; ১১. অরিনাথ সম্প্রদায়; ১২. খেচরনাথ সম্প্রদায়; ১৩. রামচন্দ্রনাথ সম্প্রদায়।

লোকনাথপন্থী

অতি সাম্প্রতিক বাংলাদেশে লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে কেন্দ্র করে তৃণমূল মানুষের মধ্যে ভক্তিবাদের জাগরণ সৃষ্টি হয়। লোকনাথপন্থায় কোন মন্ত্রতন্ত্রের প্রয়োজন নেই। সাধক লোকনাথ তাঁর নামকেই মহামন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। অসামান্য সাধক পুরুষ লোকনাথ। তাঁর আদর্শই তার জীবন। বাক্য নয় আচরণ দিয়ে যদি কেউ মত প্রতিষ্ঠা করে থাকেন তিনিই লোকনাথ। লোকনাথ আপন সাধনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে যুক্তির চাইতে আবেগ বেশি কার্যকর বিধায় লোকনাথকে পরম ব্রহ্মের আসনে বসিয়ে একদল ভক্তের আতিশয্য দেখা যায় এবং এর দ্বারা ব্রাত্য ও লৌকিক বিশ্বাসে আরেকটি কার্যকর দেবতা সংযুক্ত করা হল।

দেবদেবীর উপাসনা দ্বারা মোক্ষলাভের বিষয়টি কতটুকু যুক্তিগ্রাহ্য তা বিতর্কের বিষয় তবে নানাবিধ পূজা অর্চনাকে করে যে মূর্তিগড়া হয় এবং পূজার উপকরণ কেনা হয়, উৎসবে মেলা বসে। ফলে সমাজের প্রত্যেক স্তরে অর্থনৈতিক সঞ্চালন ঘটে। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার বর্ণের মানুষের নিকট অর্থ পৌছে যায়। হিন্দুধর্মে পূজার অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। অতএব, শুধুমাত্র যুক্তি, থিওলজি দিয়ে মূর্তিপূজা বন্ধ করা যায় না। লোকনাথ কোন গুরুপম্পরা সৃষ্টি করে না গেলেও লোকনাথকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই একদল পাল পুরোহিত সৃষ্টি হয়েছে তাঁরা লোকনাথ মণ্ডলীর সগোত্রীয় সুহৃদ সন্ধান করে বেড়াচ্ছেন আপন বৈভবের জন্য। এমনকি আধুনিক যুগে তাবিজ কবচ মাদুলি ঝাঁড়ফুঁক দৈববাণী বলা শুরু হয়েছে, যেটি মানুষের পশ্চাৎ ভাবনাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছে।

লোকনাথের বাণী : ‘যদি আমার প্রতি কোন কৃতজ্ঞতার ভাব অনুভব করিস তো আমাকে ভিক্ষা দিস। দরিদ্র আতুর সম্বলহীন অনাথের জন্য দয়া করে যা হাতে তুলে দিবি জানবি তা একমাত্র আমিই পাব। আমি ছাড়া তো আর কেউ নেই রে’। দুঃখ-দুর্দশাক্লিষ্ট এই জগৎসংসারে সকল পতিতজনে পরিত্রাণের নির্ভরতা দিয়ে লোকনাথ বলেছেন-

‘রণে বনে জলে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে
আমাকে স্মরণ করিবে আমিই রক্ষা করিব।’

অসংখ্য ধর্মমতের মধ্যে নিমজ্জিত এই বিশ্ব মানবসমাজ। বাঙালি সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। সাধারণত ধর্মপ্রাণ মানুষ স্বধর্মে নিষ্ঠাবান। কেউ কেউ হয়ত মনে করে তাঁর অনুসৃত ধর্মটিই ঠিক। এমতাবস্থায় কোন গবেষক যদি তাঁর ধর্মের দুর্বলতা চিহ্নিত করেন সেটা স্বধর্মে নিষ্ঠাবানের জন্য স্বস্তিদায়ক ব্যাপার নয়। এই ব্রিতকর পরিস্থিতির মধ্যে কোন নতুন সন্ধিৎসার অনুগামি হওয়া কিংবা ধর্মচিন্তায় পরিবর্তন ঘটানো এবং সেই সাথে সমাজে ভিন্ন ধর্মানুসারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সুরক্ষা করা একটি কঠিন বাস্তবতা। যদিও একেশ্বরবাদী শাস্ত্রীয় মতে বহু ধর্মের অস্তিত্ব স্বীকৃত নয়। ধর্ম একটাই। স্রষ্টা একজনই। এখানে সৃষ্টি বৈচিত্র্যের মধ্যে স্রষ্টার বহুত্বের উপলব্ধি অজ্ঞতাপ্রসূত বিষয়। তারপরও পরিত্রাণ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় যেসব ধর্মমত মানবসমাজে প্রচলিত আছে তার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য উন্মোচন ধর্মগবেষকদের কাছে সহজ হলেও জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মপালনকারীর জন্য সহজ নয়। ইসলাম অনুসৃত সাধারণ ধর্মানুসারিও অসংখ্য পয়গম্বর— নবী, রসূলের সন্ধান পান। ইসলাম ধর্ম মতে, বিভিন্ন সময়ে মানব জাতিকে সতর্ক করার প্রয়োজনে পৃথিবীতে সত্তর হাজার মতান্তরে এক লাখ চব্বিশ হাজার পয়গম্বরের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের মধ্যে মাত্র ৩১৩ জন মতান্তরে ৩১৫ জন রাসূল এবং অবশিষ্ট সবাই নবী ছিলেন। নবী ও রসূলের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্যের অন্যতম হল— যেসব নবীদের কাছে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাঁরা নবী ও রাসূল— এই সমন্বিত মহিমায় অভিষিক্ত এবং অপরাপর সবাই নবী মর্যাদায় অভিষিক্ত। সনাতন ধর্মের গীতায় ঘোষিত হয়েছে দুষ্কৃতিদের শাস্তিপ্রদান এবং সাধুদের পরিত্রাণ প্রাপ্তির জন্য যুগে যুগে স্বয়ং স্রষ্টা অবতাররূপে আবির্ভূত হন। তবে তা স্বমূর্তিতে নয় (দ্র. পূ. ৩৬৮-৬৯)। নিরাকার অবয়বে তাঁরই প্রতিনিধি হয়ে সাধারণ মানুষ থেকেই নির্বাচিত হয় এই পরিত্রাণসহায়ক প্রতিনিধি। তাই বলে এঁরা নিজেরাই স্রষ্টা নন— স্রষ্টার প্রতিনিধি। আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এঁরা লোকধর্মের প্রবক্তা পুরুষ হিসেবে স্বীকৃত।

ব্রাহ্মসমাজ

হিন্দুধর্মের ভিন্ন মতাবলম্বী ব্রাহ্মসমাজ উপনিষদ থেকে ঈশ্বরের অদ্বৈতবাদ ও ইসলাম ধর্মের একেশ্বরবাদের সমন্বয়ে হিন্দুধর্মের একটি নতুন মতবাদ। পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে যারা হিন্দুধর্ম সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যমণি ছিলেন বাঙালি হিন্দু রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থার নাম ছিল ব্রাহ্মসমাজ। বৈদেকি ধর্মে মূর্তিপূজা ছিল না। বহু দেবতার পরিবর্তে এক ঈশ্বরবাদে রামমোহন রায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ব্রাহ্মরা একেশ্বরবাদী ও নিরাকার ব্রহ্মার উপাসক। রাজা রামমোহন রায় এক ঈশ্বরবাদের সমর্থনে তুহুফাউল মুয়াহিউদ্দীন (একেশ্বরবাদীদের জন্য উপহার) শীর্ষক পুস্তক রচনা করেন। তাঁর আন্দোলন জোরদার হওয়ার পূর্বেই ৫৯ বছর বয়সে তিনি লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজের আদর্শে পরিবর্তন আসে। কারণ বেদে মূর্তি ছিল না বটে কিন্তু একাধিক দেবতা যেমন— ব্রহ্ম, বিষ্ণু, শিব এর স্বীকৃতি ছিল। তাই রামমোহন রায়ের অনুসারীগণ বহু ঈশ্বরবাদের পূজায় ফিরে যান। রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে আসীন হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯০৫)। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের বিশ্বাসে বহু পরিবর্তন আনয়ন করেন। ব্রহ্মবিদ্যা প্রচারের জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন ‘তত্ত্বাবোধিনী সভা’ (১৮৩৯)। এই সভার মুখপত্রস্বরূপ ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকাও প্রকাশিত হয়।

ব্রাহ্মগণ অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাসে অবহিত হওয়ায় আগ্রহী ছিলেন। তারা অবতারবাদ প্রত্যাখ্যান করেন। তবে তারা আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। অনুশোচনা ও সৎকর্মের মাধ্যমে অমরাত্মার মুক্তিই ছিল তাদের লক্ষ্য। ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ দু’ভাগে বিভক্ত হয়। ব্রাহ্মসমাজে কেবলমাত্র নিরাকার এক ঈশ্বরের উপাসনা করা হয়। নিষিদ্ধ হয় সকল প্রকার মূর্তিপূজা। পরবর্তীকালে আদি ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুধর্মের উদার অংশে পরিণত হয়। প্রার্থনা সমাজ, আর্য সমাজ ও সর্বধর্ম সম্প্রদায়ও ব্রাহ্ম সমাজের অমৃত উৎস থেকে প্রবাহিত ধারা।

লোকধর্ম কোন অলৌকিক প্রত্যাদেশে বিশ্বাসী নয়

ধর্মচিন্তা কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে বিশ্লেষণ সাপেক্ষ বিষয় নয়। উপলব্ধি ও অনুভূতির আলোকে মানুষের অন্তরে যে-বিশ্বাসের উদ্ভব ঘটে– সেই বিশ্বাসই তাকে একটি গন্তব্যে নিয়ে যায়। কিন্তু এই গন্তব্যের যাত্রাপথে দেখা মেলে নানা নির্দেশনা। অলৌকিক প্রত্যাদেশ, অলৌকিক বাহক ও বাহন। এতে সঠিক গন্তব্য নির্ধারণে বিভ্রান্ত হয় সাধারণ মানুষ। তখন এই সাধারণ মানুষের সপক্ষে কাঙালিনী সুফিয়ার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়—

‘ঘুমাইয়া ছিলাম— ছিলাম ভালো
জাইগা দেখি বেলা নাই;
কোন্ বা পথে নিতাইগঞ্জে যাই?’

গঞ্জের পথ নির্দিষ্ট করা না-থাকলেও তাদের জীবনের আরব্ধ উপলব্ধিতে যে- জিজ্ঞাসা উচ্চারিত হয়েছে— তা মানব গন্তব্যের এক অনন্ত জিজ্ঞাসারই উদ্ভাসন। লৌকিক ধর্মদর্শনে এ জিজ্ঞাসার উত্তর এখনো অমীমাংসিত। তবে সরল মানুষের জীবন পরিক্রমায় একটি প্রচ্ছন্ন আত্মবিশ্বাস দেখা যায়। এখানে জীবন খুব একটা স্বপ্নবিলাসী নয়। প্রাকৃতিক বিধানের বাইরে ‘অলৌকিক আনন্দের ভার’ এরা বহন করে না। তাই বলা যায়— লোকধর্ম কোন অলৌকিক বাহক ও বাহনে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে না অলৌকিক প্রত্যাদেশও। সে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে সরল পথের সন্ধান করে। সে কোন কঠিন দর্শনের অনুগামী হয় না। জীবনের নানা প্রতিকুলতায় অভিজ্ঞ মানুষের বিশ্বাসেও যে-বিভ্রাট ঘটে লোকধর্মের অনুসারিদের মধ্যে এতে এত ব্রিত হতে দেখা যায় না। সহজবোধে সে যত অবিচল থাকে তা শাস্ত্রীয় ধর্মানুসারিদের মধ্যে দৃষ্টান্ত অপ্রতুল। লোকধর্মের অভিধায় একে ‘অটল রূপ’ বলা হয়েছে। আপন সত্তার আলোকে বিশুদ্ধমার্গের মহৎ সাধক যাঁরা তাঁরাই ‘অটল রূপে’ স্থিত থাকতে পারেন। এঁরা শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রলোভন মুক্ত মনের অধিকারী হন।

লোকধর্মে কৌলধর্ম বা কৌলমার্গীয় সাধনা

এক সময়ে বাংলাদেশে বৌদ্ধ মরমীবাদের সাথে শক্তি ধর্মের সংস্পর্শের ফলে একটি জনপ্রিয় ধর্ম মতের সৃষ্টি হয় যা কৌল ধর্ম নামে পরিচিত। ব্রাহ্মণ্য শক্তি ও বৌদ্ধ তন্ত্রবাদের সমন্বয়ে এক নতুন শক্তি ধারার সৃষ্টি হয়—তা হচ্ছে কৌল সম্প্রদায়। কৌল শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে বুঝা যায় যে, তাদের প্রধান মতবাদগুলি বৌদ্ধ ধর্ম থেকে এসেছে। কুল বৌদ্ধ সাধনার অঙ্গ। পঞ্চকুল ও প্রজ্ঞাশক্তির পাঁচ রূপ। তাদের নিয়ামক পঞ্চতথাগত। কুলতত্ত্ব যারা অনুসরণ করে তারাই কৌলমার্গীয়।

তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্য ও শক্তি ধর্ম এবং নববৌদ্ধধর্মের গুহ্য সাধনবাদের একত্র মিলনে শক্তিধর্মের যে সব নতুন রূপ দেখা দেয় তার মধ্যে কৌলধর্মই প্রধান। কৌলধর্মীরা মৎস্যেন্দ্রনাথকে গুরু বলে মানেন। তারা বলেন— তাদের ধর্মের মূল সূত্রগুলি গুরু সৎস্যেন্দ্রনাথকে শিক্ষা হতে পাওয়া। মৎস্যেন্দ্রনাথকে অনেকে চুরাশি সিদ্ধাচার্যের অন্যতম লুইপাদের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেন। যদি তা-ই হয় তাহলে কৌলধর্ম নববৌদ্ধ গুহ্য সাধনবাদ হতেই অদ্ভূত, একথা অস্বীকার করা যায় না। বরং বলা যায়— কুল বৌদ্ধ গুহ্য সাধনপন্থার একটি বিশেষ অঙ্গ। কুলতত্ত্ব যাঁরা মেনে চলেন তাঁরাই কৌল বা কুলপুত্র। ডোম্বী, নটী, রজকী, চণ্ডালী ও ব্রাহ্মণী এই পাঁচ রকমের কুল। এই পাঁচটি কুল প্রজ্ঞার পাঁচটি রূপ। যে পঞ্চস্কন্ধ বা পঞ্চবায়ুর সারোত্তম দ্বারা এই ভৌতিক মানবদেহ গঠিত, ব্যক্তি বিশেষের দেহে তাদের মধ্যে যে স্কন্ধটি অধিকতর সক্রিয় সেই অনুযায়ী তার কলুনির্ণীত হয় এবং তদানুযায়ী সাধনপন্থাও স্থিরীকৃত হয়। বৈষ্ণব পদকর্তা ও সাধক চণ্ডীদাসের রজকী বা রজকিনী বজ্রযান-সহজযান মতে চণ্ডীদাসের কুলেরই সূচক, আর কিছু নয়। কুলমার্গীদের মতে, কুল হচ্ছে শক্তি, কুলের বিপরীত অকুল হচ্ছে শিব এবং দেহের অভ্যন্তরে যে শক্তি কুণ্ডলাকারে সুপ্ত তিনি হচ্ছেন কুলকুণ্ডলিনী। এই কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে শিবের সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে একত্র করাই কৌলমার্গীর সাধনা।

লোকধর্মে ‘সত্যধর্ম’ ও বাউলমানসে তার প্রভাব

‘কর্তাভজাত সম্প্রদায় কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মের নামই ‘সত্যধর্ম’। বেদ-পুরাণকে পাশ কাটিয়ে, ব্রাহ্মণ নিয়ন্ত্রিত যজ্ঞাদিকে সচেতনভাবে দূরে রেখে কর্তাভজা সম্প্রদায় জীবনের জন্য সহজ যে বিধিবিধান তৈরি করে নেয় তা-ই ‘সত্যধর্ম’ বলে স্বীকৃতি লাভ করে। ‘সত্যধর্ম’ দশটি ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইহুদি ধর্মের ‘দশ আদেশ’ এর মত সত্যধর্মেও ‘দশটি কর্ম’ নিষিদ্ধ। এই দশটি কর্মকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা :

ক. কায়কর্ম

খ. মনঃকর্ম

গ. বাক্যকর্ম।

ক. কায়কর্ম তিনটি, যথা :

১. পরস্ত্রীগমন

২. পরদ্রব্যহরণ ও

৩. পরহত্যাকরণ

খ. মনঃকর্ম তিনটি, যথা :

১. পরস্ত্রী গমনের ইচ্ছা

২. পরদ্রব্য হরণের ইচ্ছা ও

৩. পরহত্যা করণের ইচ্ছা

গ. বাক্যকর্ম চারটি। যথা :

১. মিথ্যাকথন

২. কটুকথন

৩. অনর্থক বচন ও

৪. প্রলাপ ভাষণ

এই দশটি নিষিদ্ধ কর্ম পরিহার করাই হচ্ছে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ‘সত্যধর্ম’। সত্যধর্ম কেবল যে কর্তাভজা সম্পদায়ের লোকেরাই গ্রহণ করেছিল এমন নয়। বাউলেরাও এই সত্যধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। বাউলসম্রাট লালন শাহের গানেও এই সত্যধর্মের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। লালনের গানে আছে-

‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন।
সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন।।

… … …
পরের দ্রব্য, পরের নারী হরণ করো না পারে যেতে পারবে না।
যতবার করিবে হরণ ততবার হবে জনম।।

গানের এই বাণীগুলো থেকেই বুঝা যায় কর্তাভজাদের সত্যধর্ম দ্বারা লালন ব্যাপকভাবে না হলেও অল্পবিস্তর প্রভাবিত ছিলেন। কেননা সত্যধর্মের যেটা পীঠস্থান সেই ‘ঘোষপাড়ার মেলায়’ (সতীমায়ের মেলায়) মহাত্মা লালনও যাতায়াত করতেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং ‘সত্যধর্ম’ দ্বারা বাউলগণের প্রভাবিত হওয়া অমুলক নয়।

লোকধর্মে সহজযান ও সহজিয়া সাধন পদ্ধতি

বজ্রযান গুহ্য সাধনারই সূক্ষ্মতর স্তর সহজযান নামে খ্যাত। মন্ত্র-মুদ্রা-পূজা-আচার অনুষ্ঠানে বজ্রযানের সাধন মার্গ আকীর্ণ। কিন্তু সহজযানে দেবদেবীর স্বীকৃতি যেমন নেই, তেমনি নেই মন্ত্র-মুদ্রা-পূজা-আচারের বাড়াবাড়ি। সহজযানীরা বলেন, কাঠ, মাটি বা পাথরের মধ্যে দেববৌর কাছে প্রণত হওয়া পশুশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। বাহ্যানুষ্ঠানের কোন মূল্যই সহজযানীদের কাছে নেই, সহজযানীরা ব্রাহ্মণদের আচারসর্বস্ব ধর্মকর্মের নিন্দা তো করতেনই সেই সঙ্গে যেসব বৌদ্ধ মন্ত্রজপ, পূজার্চনা ও কৃচ্ছ্রসাধন করতেন তাঁদেরকেও কটু কথা বলতে ছাড়তেন না। দোহাকোষে সহজযানী সিদ্ধাচার্য বলেছেন-

“কিং তো দীবেঁ কিং তো নিবেজ্জঁ
কিং তো কিকজ্জই মন্তহ সেঁবর।
কিং তো তিথ তপোবন জাই
মোক্‌খ কি লবভই পানী হ্নাই।।

অর্থাৎ, কী (হইবে) তোর দীপে, কী (হইবে) তোর নৈবেদ্যে, কী করা হইবে তোর মন্ত্রে ও সেবায়, কী তোর (হইবে) তীর্থ তপোবনে যাইয়া। জলে নাহিলেই কি মোক্ষ লাভ হয়।

সহজযানীদের মূলস্তম্ভ ‘কায়াসাধন’ বা ‘দেহবাদ’। এদের মতে ‘শূন্যতা’ হল ‘প্রকৃতি’ আর ‘করুণা’ হল ‘পুরুষ’। শূন্যতা ও করুণা অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনে অর্থাৎ নারী ও নরের মিথুন মিলন যোগে বোধিচিত্তের যে পরমানন্দময় অবস্থার সৃষ্টি হয় তা-ই মহাসুখ। এই মহাসুখই ধ্রুবসত্য। এই ধ্রুবসত্যের উপলব্ধি ঘটলে ইন্দ্রিয়গ্রাম বিলুপ্ত হয়ে যায়। সংসারজ্ঞান তিরোহিত হয়, আত্মপরভেদ লোপ পায়, সংস্কার বিনষ্ট হয়। এটাই সহজযানীদের সহজ অবস্থা।

সমরস অর্থাৎ সামান্যভাবনা আর ‘খসম’ অর্থাৎ আকাশের মত শূন্য চিত্ত এগুলোই সহজযানের আদর্শ। সহজযানীরা বলেন— ধ্যানের মধ্যে মোক্ষ নেই, সহজ ছাড়া নির্বাণ নেই আর ‘কায়াসাধন’ ছাড়া পথ নেই। যেখানে মন-পবন সঞ্চারিত হয় না, রবিশশীর প্রবেশ নেই, সেখানেই একমাত্র বিশ্রাম। সহজের মধ্যেই পরমানন্দ। তারা আরও বলেন— আগম, বেদ-পুরাণ সবই বৃথা, নিষ্কলুষ নিস্তরঙ্গ হচ্ছে সহজের রূপ। সহজের মধ্যে পাপপুণ্যের বালাই নেই। সহজে মন নিশ্চল করে যে সমরসসিদ্ধ হয়েছে সে-ই তো একমাত্র সিদ্ধ। তাঁর জরা-মরণ দূর হয়েছে। শূন্য নিরঞ্জনই পরমসুখ, সেখানে না আছে পুণ্য- ‘সুন্ন নিরঞ্জন পরম মহাসুহ তহি পুন ন পাব’ সরহপাদ, কাহ্নপাদ প্রভৃতি আচার্যরা দোহার পর দোহায় এসব মত কীর্তন করেছেন। বৈরাগ্য তাঁরা সাধন করতেন না। তাঁরা বলতেন— বিরাগাপেক্ষা পাপ আর কিছুতে নেই, সুখ অপেক্ষা পুণ্য কিছু নেই।

মধ্যযুগে উত্তর ভারতে ও বাংলাদেশে যে মানবধর্মী মরমিয়া সাধক কবিদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস হতে আরম্ভ করে কবীর, দাদু, রজ্জব, তুলসীদাস, সুরদাস, মীরাবাঈ, তারপরে লালন, হাসন, পাঞ্জু, দুদ্দু প্রভৃতি পর্যন্ত এঁরা সকলেই ভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে একাদশ-দ্বাদশ শতকের এই সহজযানী সাধক কবিদেরই বংশধর। প্রাচীন সহজযানী সাধকেরা এবং মধ্যযুগীয় মরমিয়া সাধকেরা তাঁদের ধ্যান-ধারণাগুলি জনসাধারণের কাছে প্রচার করবার জন্য যে মাধ্যম অবলম্বন করেছিলেন তা-ও এক। সে মাধ্যম হচ্ছে গীত ও দোহার মাধ্যম।

লোকধর্মে বজ্রযান সাধন পদ্ধতি

বজ্রযান মহাযানেরই একটি পরিবর্তিত শাখা। বজ্রযানের ধ্যান-কল্পনা গভীর ও জটিল। বজ্রযানীদের মতে নির্বাণের পর তিন অবস্থা : শূন্য, বিজ্ঞান ও মহাসুখ। ভারতীয় মতে শূন্যতত্ত্বের সৃষ্টিকর্তা নাগার্জুন। (আরেকটি মতে আল খারিযমী। দ্র. এম. আকবর আলী, বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান)। নাগার্জুনের মতে, দুঃখ, কর্ম, কর্মফল, সংসার সবকিছুই শূন্য। শূন্যতার এই পরম জ্ঞানই নির্বাণ। বজ্রযানীরা এই নির্বিকল্প জ্ঞানের নামকরণ করেন নিরাত্মা। তারা বলেন, জীবের আত্মা নির্বাণ লাভ করলে এই নিরাত্মেই বিলীন হয়। নিরাত্মা কল্পিত হলেন দেবীরূপে এবং বলা হয়— বোধিচিত্ত যখন নিরাত্মার আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে নিরাত্মাতেই বিলীন হন তখনই উৎপত্তি হয় মহাসুখের। বোধিচিত্তের অর্থ হচ্ছে চিত্তের (মনের) এক বিশেষ বৃত্তি বা অবস্থা যাতে সম্যকজ্ঞান বা বোধি লাভের সংকল্প বর্তমান। বজ্রযানীরা বলেন, মৈথুন যোগে চিত্তের যে পরম-আনন্দময়, ভাব, যে এককেন্দ্রিক ধ্যান তা-ই বোধিচিত্ত। এই বোধিচিত্তই বজ্র। কারণ কঠোর যোগসাধনার ফলে ইন্দ্রিয়শক্তি সম্পূর্ণ দমিত চিত্ত বজ্রের ন্যায় দৃঢ় ও কঠিন হয়। বোধিচিত্তের বজ্রভাব লাভ হলে তবে বোধিজ্ঞান লাভ হয়। চিত্তের এই বজ্রভাবকে আশ্রয় করে সাধনার যে পথ তা-ই বজ্রযান। বজ্রযানীরা ইন্দ্রিয় শক্তি ও কামনাবাসনাকে সম্পূর্ণভাবে দমন করার পক্ষপাতী। বজ্রযানীরা বলেন, ইন্দ্রিয় দমন করতে হলে আগে সেগুলিকে জাগ্রত করতে হয়। মিথুন সেই জাগরণের উপায়। মিথুনা জাত আনন্দকে অর্থাৎ বোধিচিত্তকে স্থায়ী করা যায় মন্ত্রশক্তির সাহায্যে এবং সেই অবস্থাতেই ইন্দ্রিয়শক্তি দমন হয়। সাধকের সাধনার শক্তিতে মন্ত্র বা ধ্যান অর্থাৎ তার ধ্বনি রূপমূর্তি লাভ করে। এই রূপমূর্তিরাই বিভিন্ন দেবদেবী। মিথুনাবস্থার আনন্দোদ্ভূত বিভিন্ন দেবদেবী সাধকের মনশ্চক্ষুর সম্মুখে নিজ নিজ স্থানে এসে অধিষ্ঠিত হয় এক একটি মণ্ডল সৃষ্টি করেন। এই মণ্ডলের নিঃশব্দ ধ্যান করতে করতেই বোধিচিত্ত স্থায়ী ও স্থির হয়ে বজ্রের মত কঠিন হয় এবং ক্রমে বোধিজ্ঞান লাভ ঘটে। বলা বাহুল্য, অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই বজ্রযানের এসব সাধন-পদ্ধতি অত্যন্ত গুহ্য এবং যে ভাষায় এ শব্দে এই পদ্ধতি ব্যাখ্যাত হয় তাও গুহ্য। গুরুদীক্ষিত সাধক ছাড়া সে শব্দ ও ভাষার গূঢ়ার্থ আর কেউ বুঝতে পারেন না এবং গুরুর নির্দেশ ও উপদেশ ছাড়া আর কারো পক্ষে এই সাধন-পদ্ধতি অনুসরণ করাও প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। বজ্রযানে গুরু অপরিহার্য। বজ্রযানে প্রজ্ঞার মূল যে ‘বোধিচিত্ত’, ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রের ভাষায় তা-ই ‘শক্তি’।

লোকধর্মে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি উপেক্ষিত

বাংলাদেশে আচরিত লোকধর্মের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত নেই। এখানে শাস্ত্রীয় ধর্মানুসারিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত থেকে তাদের আপন ধর্মীয় পরিচয় উন্মোচন অনায়াসসাধ্য নয়। ফলে তারা স্বগোষ্ঠির মধ্যে সৎসঙ্গী, মতুয়া, বৈষ্ণব, নাথপন্থী প্রভৃতি স্বতন্ত্র নামে পরিচিত থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে এঁরা সনাতন ধর্মানুসারি হিন্দু হিসেবেই বিবেচ্য। এ প্রসঙ্গে লোকধর্ম গবেষক অনুপম হীরা মণ্ডল এর অভিমত হল :

সকল প্রকার রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে তারা এক একটি বড় ধর্মের ধারক হিসেবে নিজেদেরকে পরিচয় দিতে বাধ্য হয়। আবার খুব কম ধর্মানুসারীই আছে যারা নিজেদেরকে তথাকথিত বড় ধর্মের পরিচয়ে পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যেমন, মতুয়া, সৎসঙ্গী, বৈষ্ণব প্রভৃতি ধর্মানুসারীগণ নিজেদেরকে হিন্দু বা সনাতন ধর্মের বাইরে পরিচিত করে তুলতে চায় না। এরা কখনো এই সকল লোকধর্মগুলোকে সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যায়িত করে আবার কখনো বা ধর্ম হিসেবে পরিচয় দেয়। ফলে একজন মতুয়া বা সৎসঙ্গী হিন্দু হয়ে মতুয়া বা সৎসঙ্গী। আবার একজন মাইজভাণ্ডারী অনুসারী নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেওয়ার পর মাইজভাণ্ডারী হিসেবে খ্যাত। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন, লালনের ফকিরী ধর্মের অনুসারী। এঁরা নিজেদেরকে হিন্দু বা মুসলমান কোন পরিচয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে চায় না। যদিও সমাজের পরিচয়ে কেউ মুসলমান কেউ হিন্দু হিসেবে পরিচিত। (বাংলাদেশের লোকধর্ম : দর্শন ও সমাজতত্ত্ব, পৃ. ২৬)।

এই লোকধর্ম থেকেই পৃথিবীর সকল শাস্ত্রীয় ধর্মের উদ্ভব। লোকধর্মকে ফোকলোরের ভাষায় বলা হয় Folk Religion। এর একাধিক প্রতিশব্দ রয়েছে। যেমন উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে একে ‘উপাসক সম্প্রদায়’ এবং সুধীর চক্রবর্তী তাঁর বাংলার গৌণ ধর্ম সাহেবধনী ও বলাহাড়ি নামক গ্রন্থে একে ‘গৌণ ধর্ম’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রশ্ন উত্তাপন করা যায়, লোকধর্মগুলি কীভাবে শাস্ত্রীয় ধর্মে রূপান্তরিত হল? এর উত্তর অনুসন্ধানে দেখা গেছে। আদিম দর্শকে শাস্ত্রকাররা নিয়ম-রীতির পরাকাষ্ঠায় রূপ দিয়ে গ্রন্থবদ্ধ করে ধর্মানুসারীদের নিকট হাজির করে, এবং এই শাস্ত্রীয় রীতিকেই জীবন বিধান কিংবা অবশ্য পালনীয় রীতি বলে ঘোষণা দেয়। ধর্মকে যখন এরূপ শাস্ত্রবদ্ধ করে আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া-করণকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বা সেগুলো ধর্মাচারের ক্ষেত্রে আবশ্যক হয়ে ওঠে তখন একটি ধর্ম শাস্ত্রীয় ধর্মের রূপলাভ করে।

লোকধর্ম বনাম শাস্ত্রীয় ধর্ম

লোকধর্মকে মোটামুটিভাবে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সুনির্দিষ্ট আদেশ নিয়ে তাঁর প্রেরিত পুরুষ (রাসুল বা গয়গম্বর) কর্তৃক প্রচারিত ধর্ম। তৌরাত, জবুর, ইঞ্জিল ও কোরআন দ্বারা প্রচারিত ধর্ম এই পর্যায়ে পড়ে। এ সমস্ত ধর্মে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশের বাইরে যাবার শক্তি তাঁর প্রেরিত পুরুষদের নেই। কিন্তু লোকধর্মে সে সুযোগ আছে। লোকধর্ম সময়োপযোগী। তবে…শাস্ত্রীয়ধর্ম ও লোকধর্মের মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্বন্ধ সূত্র বিদ্যমান। শাস্ত্রীয়ধর্মের উদ্ভবের ভিত্তি লোকধর্ম আবার শাস্ত্রীয় ধর্মের মধ্য হতেই নতুন নতুন লোকধর্মের সৃষ্টি হয়। শাস্ত্রীয়ধর্ম আর লোকধর্মের মধ্যে বিরোধও কম নেই। এই দুটি ধর্ম ধারা যেমন একটি অপরটির উৎসমূল হিসেবে কাজ করে তেমনি দুটির মধ্যকার বিরোধও জিইয়ে রাখে।

শাস্ত্রীয় ধর্মের কাছা-কাছি, পাশাপাশি কিংবা মধ্যেই লোকধর্মের অবস্থান কিন্তু লোকধর্মের চর্চা ও লোকধর্মানুসারীদের সক্রিয়তা শাস্ত্রীয় ধর্মানুসারীদের শঙ্কিত করে তোলে। শাস্ত্রীয়ধর্ম সবসময় নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্কিত কিছু মূল নীতিতে আশ্রয় করে পরিচালিত হয়। এ সব নীতি অনুসারীদের ক্ষেত্রে অবশ্য পালনীয়। শাস্ত্রাচার কিংবা সংশ্লিষ্ট করণ-ক্রিয়া সম্পর্কে পুরোহিত, ধর্মগুরু, মৌলবী, পাদ্রী প্রমুখ নিজ নিজ ধর্মানুসারীদের সচেতন করে তোলে এবং এ সকল ধর্মাচার পালনের উৎসাহিত করে। শাস্ত্রীয় ধর্ম শাস্ত্রাচারের প্রতি অবজ্ঞা কিংবা শাস্ত্রীয় রীতি-নীতির অবমাননা সম্মিলিত জীবনের সংহতির ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে দেখে। শাস্ত্র বর্ণিত পাপ-পুণ্যের ধারণা ও ধর্মাচার পালনের ফলাফলের প্রতি অবিশ্বাস স্থাপনাকারীকে শাস্ত্রবেত্তাগণ অধার্মিক হিসেবে বিবেচিত করে। সমবেত প্রার্থনা ও তৎসংশ্লিষ্ট আনুষ্ঠানিকতা অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রতি আত্মনিবেদনে উৎসাহিত করে দশবিধ সংস্কার, ন্যায়-অন্যায় বোধ, পাপ-পুণ্যের ধারণা, ইহলৌকিক-পারলৌকিক জীবনবোধ, অতিপ্রাকৃত শক্তির স্বরূপ প্রভৃতি ব্যাখ্যা হাজির করতে এক একটি শাস্ত্রীয়ধর্মে এক বা অধিক শাস্ত্রের অবতারণা ঘটে। এ সকল শাস্ত্রের বিধানগুলো প্রায় সকল সময় আসমানী কিতাব বা অলৌকিক বাণী হিসেবে সমাজে প্রচার পায়। শাস্ত্র নিজ নিজ ধর্মানুসারীদের নিকট পূর্ণ জীবন বিধান রূপে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহন হয়ে ওঠে। শাস্ত্রীয় রীতির বাইরে কিংবা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার বাইরে স্বতন্ত্র ভাবনা ও জীবনচর্যাকে শাস্ত্রীয় ধর্ম বরাবরই অনুৎসাহিত করে। ফলে জীবন, জগৎ, ঈশ্বরের ধারণা, সৃষ্টিতত্ত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে শাস্ত্রকারদের ব্যাখ্যার সত্যাসত্য বিচার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যাকে অভ্রান্ত বলে ভাবতে শেখা এবং এ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে প্রশ্নতোলা শাস্ত্রাশ্রিত সমাজে নিন্দনীয়, কখনো কখনো দণ্ডণীয় অপরাধ বলে স্বীকৃত। পক্ষান্তরে লোকধর্ম বরাবরই শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় বিকল্প খোঁজে। সে বা তাঁরা জীবন চর্চার নয়া নয়া ব্যাখ্যা হাজির করে যা শাস্ত্রের বিকল্প হিসেবে শাস্ত্রীয় ধর্মকে প্রতিহত করে। এই নয়া ব্যাখ্যাতাগণ শাস্ত্রকার কিংবা শাস্ত্রীয় ধারক, প্রচারকদের ধর্ম নিয়ে বাহাসে আহ্বান করে। একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাহাস শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যাকে হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করায়। সময়ের বিবর্তনে কখনো কখনো কোন কোন ব্যক্তি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে স্থবিরতা থেকে মুক্তি দিয়ে স্বঘোষিত ও নয়া ব্যাখ্যা সংবলিত ধর্মধারার প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে নতুন নতুন গড়ে ওঠা ধর্মধারা ধীরে ধীরে একটি নতুন লোকধর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

শাস্ত্রীয় গ্রন্থের নিয়মনীতি অমান্যকারীকে শাস্ত্রীয়ধর্ম নিজ অনুশাসনে শাস্তি প্রয়োগ করতে, কখনো সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করে, আবার কখনো প্ৰায়শ্চিত্ত, তওবা প্রভৃতি নামক সংশোধনী আচার পালন করে, সম্প্রদায়ের সভ্য হিসেবে গ্রহণ করে। লোকধর্মের ক্ষেত্রে এ রকম বাধ্যবাধকতার মানদণ্ড ক্রিয়াশীল থাকে না। লোকধর্মের অনুসারীগণ অনেকটাই স্বাধীন চিন্তাকে উসকে দেয় বলে সম্প্রদায়ের সভ্য হিসেবে নিজের আত্মপরিচয় নির্বাচন করতে যে কোন সম্প্রদায়ভুক্ত হতে পারে। এ বিষয়ে লোকধর্ম কারো জন্য কোন শাস্তির বিধান কিংবা সংশোধনী রীতি কায়েম করে না। আবার শাস্ত্রীয়ধর্ম লোকধর্মকে প্রতিনিয়ত আত্তীকরণ করে দিতে চায়, এবং নিয়ত আক্রমণাত্মক ব্যাখ্যায় লোকধর্মের ধারকদের বিরুদ্ধে জেহাদ জিইয়ে রাখে। কখনো বা সশস্ত্র আক্রমণে পরাভূত করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে লোকধর্মের বৈশিষ্ট্য সর্বদা অহিংস। লোকধর্মের অনুসারীগণ শাস্ত্রীয়ধর্মের অনুসারীদের সশস্ত্র হয়ে মোকাবেলা করার পরিবর্তে বিপদকালীন শাস্ত্রীয় ধ্বজা ধরে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা চালায়। অথবা আত্মগোপন করে গুহ্য জীবচর্চায় নিজস্ব মত ও পথকে বাঁচিয়ে রাখে।

শাস্ত্রীয়ধর্মের পুরোহিত, প্রচারক প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রযন্ত্র ও শাসককূলের আনুকূল্যলাভের প্রত্যাশী। এই উদ্দেশ্যে শাসককূলের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে শাসন প্রদত্ত নীতি-নৈতিকতাকে সমাজে ধর্মীয় ছবকের প্রচার করে। শাসকদের ব্যাখ্যাই হয়ে ওঠে পুরোহিতের ব্যাখ্যা। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা, গণজমায়েত, প্রভৃতির মধ্যে শাসককূলের কর্মক্রিয়াকে বৈধতা দান করার প্রবণতা দেখা যায়। সমস্ত সামাজিক অসঙ্গতিকে অধ্যাত্মবাদী দৃষ্টি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা বিদ্যমান থাকে। এমনকি অধস্তনের প্রতি নিপীড়নকে দেখা হয় মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা হিসেবে। পক্ষান্তরে লোকধর্মে শাসককূলের আনুগত্য লাভের বাসনা থাকলেও সে বাসনা যতনা স্পষ্ট হয় তার চেয়ে শাসকের কেন্দ্রীয়ক্ষমতাকে মোকাবেলা করার বাসনা স্পষ্ট হয় বেশি। ফলে তোষামোদের পরিবর্তে আধিপত্যকে খর্ব করার চেষ্টার জন্য শাসককূল হতে লোকধর্মানুসারীদের প্রতিনিয়ত দূরে সরিয়ে দেয়। তবে শাসকবর্গের নৈতিকতাকে মোকাবেলা করার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের জন্য লোকধর্মানুসারীদের শাসকেরা শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন করে। কখনো কখনো লোকধর্মের প্রসারকে শাসকেরা তাদের কুক্ষিগত ক্ষমতার ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে দেখে, এবং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাকতে লোকধর্মকে বিলীন করতে সচেষ্ট হয়। শাসকবর্গের এই প্রচেষ্টায় বিরুদ্ধে লোকসাধারণের অসন্তোষ ধীরে ধীরে দানা বাঁধে। একই সমাজ, গোষ্ঠী কিংবা সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই দ্বন্দ্ব সক্রিয় থাকতে পারে। সমাজের মধ্যে বাড়তে থাকা এই দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে সামাজিক রূপান্তর কিংবা পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সেই পরিবর্তন ধর্মীয় পরিচয়ে ঘটলেও তার অধ্যাত্মচিন্তনের অভ্যন্তরে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। উদাহরণ স্বরূপ গোড়ার দিককার খ্রিষ্টধর্মের কথা বলা যায়। খ্রিষ্টধর্ম গোড়ায় ছিল উৎপীড়িত মানুষের আন্দোলন : দাস আর মুক্তিপাওয়া দাস, সর্ব-অধিকারবঞ্চিত গরিব মানুষ, রোম কর্তৃক পদানত কিংবা ছত্রভঙ্গ জাতিগুলির ধর্ম হিসেবে এটি প্রথমে উদ্ভব ঘটেছিল। এটি নির্যাতিত এবং নিগৃহীত, অনুগামীরা অবজ্ঞার পাত্র এবং বহিষ্কারক আইন কানুনের অধীন : ধর্মের, পরিবারের, মানবজাতির শত্রু হিসেবে যাবতীয় নির্যাতন সত্ত্বেও, এমনকি সেটির তাড়নায় অনুপ্রাণিত হয়ে, জয়যুক্ত হয়ে, দুর্নিবার গতিতে সামনে এগিয়ে চলে। তিন-শ’ বছর পর এটিই রোম বিশ্ব সাম্রাজ্যের স্বীকৃত রাষ্ট্রধর্ম হয়ে ওঠে। এক কালের শ্রমিক বা দাসের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে গড়ে ওঠা ধর্ম কালের বিবর্তনে শাস্ত্রীয় রূপলাভ করে।

শাস্ত্রীয় ধর্ম ও ধর্মানুসারীগণ প্রতিনিয়ত সমস্ত জনগোষ্ঠীর সংহতি স্বমতে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই চেষ্টা প্রথম শুরু করে সাধারণ মানুষের চিন্তা জাগতিক বিষয়গুলোকে নিজ নিজ ধর্মের পক্ষে নেওয়ার মাধ্যমে। এই উদ্দেশ্যে তথাকথিত কোন বড় ধর্ম বা শাস্ত্রীয়ধর্মের অনুসারীগণকে নিজ নিজ শাস্ত্রের ব্যাখ্যা ও বয়ান প্রদানের উদ্দেশ্যে যত্র তত্র ধর্মীয় সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা, মতবিনিময় সভা প্রভৃতি কর্মসূচি পালনের প্রতি প্রতিনিয়ত আগ্রহী থাকতে দেখা যায়। নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে স্বযুক্তির পক্ষে নানামুখী উদাহরণ আর বিদগ্ধতার স্বাক্ষর রাখতে চেষ্টা করে।

সাধারণ মানুষের মননগত সম্মতি আদায়ের পর শুরু হয় ধর্মীয় আচার- আচরণের পরিধির মধ্যে জীবনযাপনে অনুপ্রাণিত ও বাধ্য করা। কখনো বা এই উদ্দেশ্যে পাপ বা পরকালের শাস্তি ভোগের অবশ্যম্ভাবী পরিণতির পক্ষে বিবৃতি প্রদান করা হয়। সাধারণ ও সমাজের ব্যাপক মানুষ যখন কোন একটি ক্ষমতাবান ধর্মের প্রতি (ক্ষমতাবান ব্যক্তিগণের আচরিত ধর্ম) আনুগত্য প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করে কিংবা অস্বীকার করে তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাজানুগ্রহ লাভকারী ও শাস্ত্রীয় ধর্মের ধ্বজাধারীদের দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার হয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা এ সব ধর্ম সকল সময় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে এবং সেই ধর্মের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে বাধ্য করে। অন্যপক্ষে একটি ধর্ম লোকধর্মে রূপলাভ করে বল প্রয়োগের ক্ষমতা তথা কায়েমী স্বার্থকে অস্বীকার করে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে লোকধর্মের উদ্ভবের সাথে বঞ্চিত মানুষের হিস্যা আদায়ের উদ্দেশ্যে সংগঠিত দ্রোহ প্রদর্শন ও ক্ষমতা বলয়ে আঘাতের যোগসূত্র থাকে তবুও সে ধর্ম ততক্ষণই লোকধর্ম থাকে যতক্ষণ সেটি সর্বজনীন মাঙ্গলিক ও উদারতার বার্তা বয়ে চলে। লোকধর্মের বার্তা সর্বকালে সর্বদেশে একই রকম।

লোকধর্ম সর্বদা শাস্ত্রীয়ধর্মের চাপে অন্তর্মুখি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। শাস্ত্রীয় ধর্মের আক্রমণের স্বীকার হয়ে ক্রমান্বয়ে এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রাম্য বারোয়ারিতলা, পুরাতন মহিরুহের নিচে, খানকা, আখড়া প্রভৃতি স্থানে নিতান্তই নিভৃতে নির্জনে সাধনা চালিয়ে যায়। প্রতিনিয়ত শাস্ত্রীয় প্রতাপের রোষানলে পড়ে লোকধর্ম ধারা গুহ্য, গভীর নির্জন পথের সাধনায় পর্যবসতি হয়। তাই এ ধর্মে গুরু তাঁর শিষ্যকে সাবধান করে দেয়, ‘আপন সাধন কথা না কহিও যথা তথা’– বলে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত ও প্রচলিত অনেক নিয়ম, নীতির সাথে লোকধর্মের অনেক তত্ত্বসঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় অনেক সময় সেগুলো গুরু আর শিষ্যের মধ্যে গুরুমুখী বিদ্যা হিসেবেই অন্তরালে চর্চা হতে বাধ্য হয়। আবার রাষ্ট্র অধিকাংশ সময় এসব চেতনা ও চর্চাকে স্বীকৃতি না দেওয়ায়, লোকধর্মানুসারীদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে, রাষ্ট্র স্বীকৃত কোন শাস্ত্রীয়ধর্মের শরণাপন্ন হতে হয়। ফলে কখনো কখনো শাস্ত্রীয়ধর্মের চাপে লোকধর্ম টিকতে না পেরে, কোন কোন লোকধর্মের ক্ষীণ ধারা কালের বিবর্তনে, নতুন লোকধর্মের সূত্রের মধ্যে—রূপান্তরের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল থাকে।

শাস্ত্রীয়ধর্ম কোন না কোন লোকধর্মকে আত্তীকরণ করে উৎপত্তি লাভ করেছে। লোকধর্মের সর্বজনীন বৈশিষ্ট্যকে প্রতিনিয়ত সুযোগভোগী শ্রেণি মানুষ শাসককূলের অনুগামী করার চেষ্টায় থাকে। তারা লোকধর্মের মধ্যকার লৌকিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে অলৌকিক ঘটনাবলী বলে প্রমাণ করার প্রয়াসে নানামুখী তৎপরতা জিইয়ে রাখে। তাদের এই উদ্যোগ কখনো কখনো সমবেত হয়ে ওঠে। তাদের এই সমবেত কর্মক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে শাস্ত্র প্রণয়ন, শ্রেণি স্বার্থকে কুক্ষিগত করে রাখার প্রচেষ্টা, এবং সর্বোপরি কায়েমী স্বার্থের স্বপক্ষে সমাজস্থ মানুষের চৈতন্যের স্বীকৃতি লাভের প্রয়োজনে শাস্ত্রীয়ধর্মের প্রসার ঘটাতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। শাস্ত্রীয় ধর্মের উদ্ভবকালে লোকধর্মের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে বটে, কিন্তু কালে কালে শ্রেণিস্বার্থের সুযোগলোভী মানুষের করতলগত হয়ে নানাভাবে তার লোকচেতনা লোপ পায়। ফলে শাস্ত্রীয়ধর্ম কৌম গোষ্ঠী প্রধান, সামন্তপ্রভু কিংবা আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের পুঁজিপতি সকলেই ধর্মীয় ব্যাখ্যার মানদণ্ড নিরুপণের উদ্দেশ্যে মাথার উপর তরবারি কিংবা ত্রিশুল উঁচিয়ে ধরে।

লোকধর্মের উপাদানাগুলো একটি সমাজ, সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠীর আবহমান ঐতিহ্য হিসেবে বেঁচে থাকে। সেগুলো জাতীয় ঐতিহ্যের স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে বা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভে ব্যর্থ হলেও তা সমাজের শ্রেণি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত জীবনচর্চার অঙ্গ বা উপাদানে পরিণত হয় এটি বংশ পরম্পরায় চলে। সেগুলো দেশজ ঐতিহ্য হওয়ায় সমস্ত ধরনের আরোপিত মতবাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে। এটি ঘটে এর ধারক ও বাহকগণের আন্তঃপ্রতিষ্ঠার কিংবা আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। লোকধর্মের ধারকেরা যতটা তাদের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যাবলি বিনষ্টের আশঙ্কায় ভোগে তার চেয়ে অধিক সমন্বয় ও সহনশীলতার মধ্যদিয়ে অতিক্রান্ত হয়। পক্ষান্তরে শাস্ত্রীয়ধর্ম প্রতিনিয়ত লোকধর্মের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলো অধিকৃত করে স্বঐতিহ্য বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং প্রতিনিয়ত নিজ নিজ ধর্মের শুদ্ধতা ও অপরের দ্বারা অবমাননার আশঙ্কায় ভোগে। শাস্ত্রীয়ধর্মকে শাস্ত্রকার, প্রচারক, পুরোহিত প্রমুখ ব্যক্তি অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতায় বলপ্রয়োগে উৎসাহিত হলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সহনশীল লৌকিক ধারার জনগোষ্ঠী শাস্ত্রীয়ধর্মের ধ্বজার নিচে দাঁড়ায় বটে, কিন্তু সে তার দেশাচারকে ভুলতে পারে না। তাই দেখা যায় শাস্ত্রীয়ধর্ম প্রচারকগণ সদল চেষ্টায় লোকসাধারণকে ধর্মান্তরিত করলেও সমস্ত ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে শাস্ত্রীয় রীতির সীমার সমান্তরাল ঐতিহ্যগতভাবে লৌকিক ক্রিয়াগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়।

ধর্মকে যখন জটিল তত্ত্বানুশীলনে আবৃত করা হয় তখন প্রতিনিয়ত বিপত্তি ঘটে। ধর্ম মানব জীবনে অপরিহার্য বলেই কখনো, কখনো আপন আপন পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের নিমিত্তে, কায়েমি স্বার্থকে বলবৎ করার মানসে ধর্ম ব্যাখ্যায় নানারূপ জটিলতার আশ্রয় নেয়। তথাকথিত পণ্ডিতজনেরা নানা রকম শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা আর টিকা ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে নানা ধরনের জটিলতা দ্বারা ধর্মকে আকীর্ণ করে, ঘোরালো পথে মানব মুক্তির পথানুসন্ধান করে বিস্ময় অনুভব করে। ফলে ধর্মীয় দর্শন, চর্চা পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে। ক্রমান্বয়ে ধর্ম সাধারণ মানুষের নিকট জটিল, আর আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে অনুসারীদের বিহ্বল করে তোলে। এই বিহ্বলতা থেকে মুক্তি পেতে নানা স্থানে নানাজন নতুন-নতুন ও অপরিচিত পথে হাঁটছে। এ সকল অপরিচিত পথ ধর্মীয় সরল পথের নিশানাকে বাৎলে দিতে চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু জটিল, দুর্বোধ্য, অপরিচিত পথে পাথেয় খুঁজতে গিয়ে সাধক, ভক্ত, কর্মী মানুষের কর্মযোগে স্থবিরতা দেখা দেয়, জ্ঞানকাণ্ড হয়ে ওঠে ধোয়াচ্ছান্ন। কখনো কখনো তথাকথিত শাস্ত্রব্যাখ্যাকারীগণ শাস্ত্রকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বার্থপরায়ণতার আশ্রয় নেন, যা মূঢ়তার নামান্তর। এর ফলশ্রুতিতে তারা ধর্মানুসারীদের ভ্রান্তিবশত শাস্ত্রশাসনে রাধ্য করার চেষ্টা করে। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন-

বাহিরে দেখিতে যেমনই হউক জটিলতাই দুর্বলতা, তাহা অকৃতার্থতা; পূর্ণতাই সরলতা। ধর্ম সেই পরিপূর্ণতার, সুতরাং সরলতার, একমাত্র চরমতম আদর্শ। কিন্তু এমনি আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই ধর্মকেই মানুষ সংসারের সর্বাপেক্ষা জটিলতা দ্বারা আকীর্ণ করিয়া তুলিয়াছে। তাহা অশেষ তন্ত্রে মন্ত্রে কৃত্রিম ক্রিয়াকর্মে জটিল মতবাদে বিচিত্র কল্পনায় এমনি গহন দুর্গম হইয়া উঠিয়াছে যে, মানুষের সেই স্বকৃত অন্ধকারময় জটিলতার মধ্যে প্রত্যহ এক-একজন অধ্যবসায়ী এক এক নুতন পথ কাটিয়া নব নব সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করিতেছে। সেই ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় ও মতবাদের সংঘর্ষে জগতে বিরোধ-বিদ্বেষ অশান্তি-অমঙ্গলের আর সীমা নাই। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ধর্ম; বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ. ৩৫)।

ধর্ম জটিল হয়ে ওঠে তখনি যখন তার লোকবৈশিষ্ট্যটি লোপ পায়। ধর্মের লৌকিক বৈশিষ্ট্য হল সরলভাবে সর্বজনী আবাহন। সেখানে শ্রেণিভেদে সকলের মিলনের আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান। এই আকাঙ্ক্ষার বিলুপ্তি ঘটলেই বিরোধ বিদ্বেষ প্রকট হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মের এই লোকবৈশিষ্ট্য লোপ পেয়ে জটিল হয়ে ওঠার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন—

ইহার একমাত্র কারণ, সর্বান্তঃকরণে আমরা নিজেকে ধর্মের অনুগত না করিয়া, ধর্মকে নিজের অনুরূপ করিবার চেষ্টা করিয়াছি বলিয়া। ধর্মকে আমরা সংস্কারের অন্যান্য আবশ্যক দ্রব্যের ন্যায় নিজেদের বিশেষ ব্যবহারযোগ্য করিয়া লইবার জন্য আপন আপন পরিমাপে তাহাকে বিশেষভাবে খর্ব করিয়া লই বলিয়া (প্রাগুক্ত)।

ধর্মকে জটিল, অর্থহীন, মোহাচ্ছন্ন সৃষ্টিকারীবস্তু হিসেবে প্রতিপন্ন করা কিংবা সুবিধাভোগীদের করতলগত করে তোলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন লোককবি, গায়ক, বয়াতি, সাধক কিংবা লোকদার্শনিক। তারা সকল সময় আপন শ্রেণি মানুষের চৈতন্যকে শাস্ত্রকারের মোহাচ্ছন্নতা থেকে নিবৃত করতে প্রাণের তাগিদে চারণের ভূমিকা গ্রহণ করে। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনপদে-জনপদে ধর্মের সহজ-সরল বার্তা জ্ঞাপন করে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার মানসে শাসক-শোষকেরা যে অপকৌশলের আশ্রয় নেয় শাস্ত্রকারেরা সেই অপকৌশলকে ত্বরান্বিত করতে ধর্মকে অনেক সময় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। যখনই ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীদের এই অপচেষ্টা শুরু হয়— তখনই, বঞ্চিত জনমধ্য থেকে ধর্মদিয়েই আবার তার গতিরোধ করা হয়। ধর্মের লেবাছধারী দুর্জনেরা জনগণকে মায়া জালে আটকাতে মনোহরী প্রলোভন সংবলিত ফতোয়া প্রদান করে। লোকধর্ম দুর্জনদের এই দুর্মতিকে মোকাবেলা করে।

লোকধর্ম সমাজ বিচ্যুত কোন কল্পনার কথান্তর বা আচার নয়। সমাজবদ্ধ শ্রেণি মানুষের অধ্যাত্ম চিন্তার খোলসে বঞ্চনা আর না পাওয়ার প্রতিবাদ, আন্তঃপ্রতিষ্ঠার ফলশ্রুতি। সমাজের সুযোগভোগী মানুষের বাইরে টিকে থাকা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ভাবনায় এটি মূর্ত হয়ে ওঠে। শাসকবর্গের কবলে পড়ে ধর্ম যখন উৎপাদক শ্রেণি মানুষের পেশা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে, শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান নান্দনিকতা আর ধ্রুপদী সীমার মধ্যে আবদ্ধ হওয়ার বাসনায় উন্মুখ থাকে, ধর্মাচারী মানুষ আচারসর্বস্বতার বেড়াজালে রুদ্ধ হয়, ধর্মাচারের পুঙ্খানুপুঙ্খ পালন ক্রিয়াকে পারলৌকিক লোভ ও লাভের উপাদান বলে পরিগণিত করে এবং ধর্মাচারের নিয়ম-নিষ্ঠা যথাযথভাবে পালন না করতে পারার আশঙ্কায় ভোগে, তখন শ্রমজীবীরা তাদের মনন, চিন্তন দিয়ে মোকাবেলা করে বুদ্ধিজীবীদের। শ্রমজীবীরা তাদের শ্রম ও পেশার সাথে সঙ্গতি রেখে অধ্যাত্ম ভাবনা ও ধর্মাচারের ঐতিহ্যকে নতুনভাবে সমাজের ধর্ম জীবন্ত করে তোলে। ফলে শাসক, শাসককূলের আনুগত্যলোভী সুবিধাবাদী শ্রেণিমানুষের বিপরীতে আরো একদল গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ ধর্মানুষ্ঠানের চর্চা করে চলে, যা লোকধর্ম উদ্ভবের ও চর্চার ইতিহাসকে ত্বরান্বিত করে।

লোকধর্ম বরবারই পেশাজীবী গোষ্ঠীর পেশা নির্ভর। সেখানে তার আপন শ্রেণি বঞ্চনার ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে লালন করে। এই ধর্মীয় চর্চা ও আন্দোলন নিয়ত প্রবহমান। কালে কালে বঞ্চিত মানুষের ভাবনা ও চর্চার উপকরণ উচ্চকোটির মানুষ আত্তিকরণ করে নেয়। আর কালে কালেই সেই আত্তিকরণের পশ্চাতে সুপ্ত প্রতিবাদ বেগবান হতে থাকে। ফলে আর্থসামাজিক সুযোগের সাথেই অধ্যাত্মভাবনা নিয়ে নানামুখি তৎপরতা জিইয়ে থাকে। এই তৎপরতার মধ্যেই ব্রাত্য-বঞ্চিত- প্রান্তীয় মানুষ ধর্মীয় আন্দোলনের খোলসে হক আদায়ে সক্রিয় হয়। এ সব ধর্মীয় আন্দোলন এক একটি গোষ্ঠীর সংহতিতে লোকধর্মের প্রতিষ্ঠা করে।

লোকধর্মের উদ্ভব সমাজের একটি অনিবার্য পরিণতি। সামাজিক অসঙ্গতির মধ্যে দিনাতিপাত করতে করতে সমাজস্থ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হয়। সেই ক্ষোভ থেকেই জন্ম নেয় অসঙ্গতি মোকাবেলা ও তার থেকে পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষা। কাল ও স্থান ভেদে আকাঙ্ক্ষাগুলোর বহুমাত্রিকতা থাকে বটে, কিন্তু আকাঙ্ক্ষার উদ্ভব তাবৎ সমাজের অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। সমাজের অবিরত পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর সাথে যখন একাত্মতা পোষণ করে কোন সংস্কারক, পরিবর্তনকামী, সচেতন ও অগ্রগামী ব্যক্তি তার সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে সাধারণ মানুষকে সংঘে সংগঠিত করে, তাদের অপূর্ণ আর্থ-সামাজিক মর্যাদা ও চাহিদা পূরণের নিমিত্তে সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে নয়া সংস্থাপন ঘটানোর উদ্দেশ্যে, সমাজপতিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেয়। তখন মানুষের মধ্যে সংহতি প্রদর্শনের ক্ষেত্র নিয়ে বোঝাপড়া তৈরি হয়। সামাজিক অধিকার আদায়ের এই বোঝাপড়ার মধ্যে আন্দোলনে আবহ্বনাকারী যুগনায়ক কখনো দেবতা, ভগবান, অবতার, নবী, পয়গম্বর রূপে সমাজে পুজ্য হন। যুগনায়কদের এই আহবান যখন অধ্যাত্ম ভাবনার আচ্ছাদনে শ্রেণি মানুষের নিকট পরিণতি লাভ করে তখন সেগুলোই হয়ে ওঠে লোকধর্ম। লোকধর্ম যেমন দ্রোহ প্রসুত তেমনি দেশজ ঐতিহ্যজাত। দেশজ ঐতিহ্য নিরন্তর রূপান্তর প্রক্রিয়ায় বহমান এবং সেগুলো অধ্যাত্ম ভাবাশ্রিত হয়ে নতুন নতুন লোকধর্মের রূপ নেয়। দেখা যায় একটি জাতি বা শ্রেণি গোষ্ঠীর লোকধর্ম সেই শ্রেণির দেশজ ঐতিহ্য ধারণকরত বস্তুবাদী-বাস্তববাদী চিন্তনে প্রদ্যোতময়। তাই লোকধর্মের বিবর্তনকালীন গ্রহণ-বর্জনের টানাপোড়েন লক্ষণীয় একটি সমাজের সমাজ ভাবনা ও চর্চার মধ্যকার গ্রহণ-বর্জনের টানাপোড়েন দ্বারাই সে সমাজের লোকধর্মের স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য নিরূপিত হয়। সাধারণ মানুষের ভাবান্দোলনের সামগ্রিক এই মত্তাবস্থাই লোকচেতনার স্বাক্ষর রাখে এবং স্বকীয়তা ধারণ করে। লোকধর্মের স্বরূপ নিরুপণে ভাবান্দোলনের এই বিচিত্রতাই অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

ইহলৌকিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্বপ্নকে আশ্রয় করে লোকধর্মের উদ্ভব ঘটে। এদিক দিয়ে শাস্ত্রীয় ধর্ম তথা প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম (revealed religion) যতটা রিলিজিয়নের বিশুদ্ধ বৈশিষ্ট্যের অনুগামী ‘লোকধর্ম’ মোটেও ততটা নয়। লোকধর্মের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর পরমতসহিষ্ণুতা। লোকধর্মানুসারিদের মধ্যে ভিন্ন বিশ্বাসের প্রপ্তি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন একটি বড় গুণ। এরা শাস্ত্রীয় ধর্মানুসারিদের ন্যায় ‘শরা-বেশরা’র দ্বন্দ্বে আক্রান্ত হয় না। লোকধর্ম মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন আচার পালনের সুযোগ করে দেয়, এবং কর্মব্যস্ততার মাঝেও সহজ-স্বাভাবিকভাবে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে উৎসাহিত করে। এই উদ্দেশ্যে কোন প্রকার ধ্রুব ধারণা পোষণ করার জন্য অনুসারিদের বাধ্য করে না। ধর্মানিরপেক্ষতা লোকধর্মের আরেক মানবিক বৈশিষ্ট্য।

বাঙালির জীবনদর্শন তথা বিশ্বসমাজের জীবনদর্শন উপলব্ধিতে লোকধর্মের অন্তর্নিহিত লোকমানস এবং এর সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যায় এখন প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্বের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে পিএইচডি পর্যায়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব গবেষণা কখনো লোকসাহিত্যের (folklore) আওতাধীনে আবার কখনো সমাজবিজ্ঞানের (Sociology) পরিসরে পর্যায়ভুক্ত হয়ে আলোচিত হয়ে আসছে। মোট কথা ধর্মের সমাজবিজ্ঞান (Sociology of religion) গবেষণার লোকধর্মের দর্শন এক অপরিহার্য বিষয়। এতকাল লোকধর্মে বিশ্বাসের বিষয়গুলি লোকসাহিত্য ও লোকায়ত দর্শনের আবরণেই আলোচিত হত। বর্তমানে লোকধর্ম আলোচনার পরিধি ও এর গুরুত্ব অনেকদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে। এ বিষয়ে গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালনে হোরেস হেম্যান ইউলসনসহ আরো কতিপয় বিদেশীদের কৃতিত্ব স্মরণীয় হয়ে আছে। আর বাঙালিদের মধ্যে পথিকৃৎ গবেষক অক্ষয়কুমার দত্ত এ বিষয়ে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। অতপর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুল সুর, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, দীনেশচন্দ্র সেন, নীহাররঞ্জন রায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শক্তিনাথ ঝা, সুধীর চক্রবর্তী, আবদুল হাফিজ, মজহারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, মুহম্মদ আবূ তালিব, মোমেন চৌধুরী, ওয়াকিল আহমদ, আনোয়ারুল করীম, শামসুজ্জামান খান, শীলা বসাক, তৃপ্তি ব্রহ্ম, দুলাল চৌধুরী, বরুণকুমার চক্রবর্তী, রমাকান্ত চক্রবর্তী, আবুল আহসান চৌধুরী, মোহাম্মদ সাইদুর, যতীন সরকার, হরিশংকর জলদাস, সুবোধ চন্দ্র দাস, আবদুল ওয়াহাব, স্বরোচিষ সরকার, অনুপম হীরামণ্ডল, তপন বাগচী, সাইমন জাকারিয়া, রঞ্জনা বিশ্বাস প্রমুখ গবেষক সংশ্লিষ্ট গবেষণায় স্মরণীয়।

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

Hilden Golden and Hilda Hertz, Literary and Social Change in Underdevelopment Countries Rural Society (vol. 2০); Calcutta, 1955

Max Weber, The Sociology of Religion; Oxford, 1964 Thomas O’dea, The Sociology of Religion; London, 1966

J. Milton Yinger, The Scientific Study of Religion; Cambridge, 197০ N. J. Demerath & P. E. Hammon, Religion in Social Context; New York, 1975

H. P. Chalfant & C D. Aimer, Religion in Contemporary Society; New York, 1981

Maria Leach and Jerome fried (ed.), Standard Dictionary of Folklore, 1982

Mythology and Legend; New Yok: Harper San Francisco, 1984 Mary Ellen Brown and Buch (ed.), Encyclopedia of Folklore and literature-, Rosenberg, England Santa Barbara, California, Denver, Colorado, Exford, 1988

James A. Beckford, Social Theory and Religion; Cambridge: Cambridge University Press, 2০০3

E. Abram (ed.) The Influence of Faith: Religious Groups & U. S. Foreign policy; Lanham and Littlefield publishers, 2০০3

Pramatha Nath Bose, A History of Hindu Civilization During British Rule (vol. 1); Calcutta, 1994

David Leeming, The Oxford World Mythology; Tess Press, New York, 1995

ওয়াকিল আহমদ, বাংলা লোক-সংস্কৃতি; বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৪

আবদুল হাফিজ, লৌকিক সংস্কার ও মানবসমাজ; মুক্তধারা ঢাকা, ১৯৭৫

অক্ষয় কুমার দত্ত, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় (প্রথম খণ্ড); করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৮৯

সুবীরা জায়সবাল, বৈষ্ণব ধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ; কেপি বাগচী অ্যাণ্ড কোম্পানী, কলকাতা, ১৯৩৩

রমাকান্ত চক্রবর্তী, বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম; আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা, ১৯৯৬ অক্ষয় কুমার দত্ত, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় (দ্বিতীয় খণ্ড); করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯৯

অলোক মৈত্র, বাংলা লৌকিক ধর্মাচারের ঐতিহ্য সন্ধানে; পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০০০

ননী গোপাল গোস্বামী, চৈতন্যোত্তর যুগে গৌড়ীয় বৈষ্ণব; করুণা প্রকাশনী, কলকাতা ২০০০

নন্দদুলাল মোহান্ত, মতুয়া আন্দোলন ও দলিত জাগরণ; অন্নপূর্ণ প্ৰকাশনী, কলকাতা, ২০০‍

রমাকান্ত চক্রবর্তী, বাংলার গৌণ ধর্ম সাহেবধনী ও বলাহাড়ি; পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০০৩

মুহম্মদ আবদুল মান্নান চৌধুরী, মাইজভাণ্ডারী দর্শন, উৎপত্তি, বিকাশ ও বিশেষত্ব; মাইজভাণ্ডার শরীফ, চট্টগ্রাম ২০০৫

সৈয়দ দেলওয়ার হোসেন মাইজভাণ্ডারী, গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারীর জীবন ও কেরামত; মাইজভাণ্ডার শরীফ, চট্টগ্রাম ২০০৭

সুবোধ চন্দ্র দাস, সত্যের সাধনায় বহুমুখী স্রোতধারা; ভাওয়াল ব্রাহ্মসমাজ, বৌদ্ধপূর্ণিমা ১৪০৯ বঙ্গাব্দ

অনুপম হীরা মণ্ডল, বাংলাদেশের লোকধর্ম দর্শন ও সমাজতত্ত্ব; বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০১০

ড. সুমন সাজ্জাদ, ধর্ম নিম্নবর্ণ ঠাট্টা; অক্ষর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৩ রায় রমানন্দ, ভগবানের তত্ত্বকথা; র‍্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১৩

রঞ্জনা বিশ্বাস, বাংলার লোকধর্ম (প্রথম খণ্ড); বেহুলা বাংলা, ঢাকা, প্র. প্র. ২০২০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *