৩. বাংলার বিদ্বৎসভা ও বাঙালি বুদ্ধিজীবী

বাংলার বিদ্বৎসভা ও বাঙালি বুদ্ধিজীবী

সভা—সমিতি ও ক্লাব—সোসাইটি—অ্যাসোসিয়েশন হল এ—যুগের মানুষের সামাজিক জীবনের অন্যতম অঙ্গ। শুধু অন্যতম নয়, অপরিহার্য সহচর। আদিম মানব—সমাজেও ক্লাব সোসাইটি ও অ্যাসোসিয়েশন ছিল। কোথাও বয়স—ভেদে, কোথাও স্ত্রী—পুরুষ—ভেদে, এমনকী কোথাও কোথাও ‘স্টেটাস’ বা মর্যাদাভেদেও সেগুলি গড়ে উঠত এবং তার একটা সুনির্দিষ্ট সামাজিক কর্তব্যও ছিল। সমাজের সমগ্র গড়নের সঙ্গে তার বিরোধও ছিল কোথাও কোথাও, ‘ব্যক্তি’ ‘পরিবার’ ও ‘ক্ল্যান’ প্রত্যেকটি ইউনিটের সঙ্গে বিরোধ। সভ্যসমাজের সভা সমিতির বৈশিষ্ট্য হল তার গোষ্ঠীগত ও শ্রেণিগত স্বাতন্ত্র্য। এই জাতীয় সভা—সমিতির উৎপত্তি হয়েছে আধুনিক যুগে এবং ক্রমেই তার প্রভাব এত বেড়েছে ও বাড়ছে যে তার ঘাতপ্রতিঘাতে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের ধারা পর্যন্ত বদলে যাচ্ছে।

বিদ্বৎসভা কেবল বিদ্বৎজনের সভা হলেও, সমাজ—জীবনে তারও প্রভাব আছে। সমাজে সভা—সমিতির প্রভাব যে কত ব্যাপক ও গভীর, বিশেষ করে আধুনিক সমাজে, বিদ্বৎসভা সম্পর্কে আলোচনার আগে সে—সম্বন্ধেও অবহিত হওয়া প্রয়োজন। এই ধরনের সভা—সমিতি প্রাচীন বা মধ্যযুগে ছিল না, আধুনিক যুগে গড়ে উঠেছে। তার প্রধান কারণ, সামাজিক অধিকার বা ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে তখন বিশেষ কিছু ছিল না। তা না থাকলে সভা—সমিতির বিকাশ হতে পারে না। টলেমিদের যুগে (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দে) আলেকজানড্রিয়ার মিউজিয়ামে পণ্ডিতেরা যে বিদ্যাচর্চার জন্য মিলিত হতেন, অথবা বৌদ্ধ আচার্যরা মঠেযে সভা করতেন, তা প্রধানত রাজার আদেশে ও বিশেষ প্রয়োজনে হত, স্বাধীনভাবে হত না। মধ্যযুগের রাজসভায় কবি—পণ্ডিতদের যে সভা বসত, তা ‘রত্নসভা হলেও, আধুনিক যুগের বিদ্বৎসভা বা অন্য কোনো সভা—সমিতির সঙ্গে তার কোনো মূলগত সাদৃশ্য নেই। আধুনিক সভায় প্রত্যেক ব্যক্তি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে স্বাধীনভাবে আলাপ—আলোচনা ও ভাব—বিনিময়ের জন্য মিলিন হন। বিদ্বৎসভার বিশেষ উদ্দেশ্য হল, জ্ঞানবিদ্যার চর্চা ও আলোচনা। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে সমাজের শিক্ষিত ও বিদ্বান ব্যক্তিরা মিলিত হয়ে, স্বাধীনভাবে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করার জন্য, বিদ্যার আদান—প্রদানের জন্য, যে সভা স্থাপন করেন, তাকে বিদ্বৎসভা বলে। রাজনৈতিক সভা, বাণিজ্যিক সভা, অন্যান্য সাধারণ সভা—সমিতি বা ক্লাব—অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে তার আদর্শগত পার্থক্য আছে, কিন্তু গড়নের পার্থক্য নেই। মূলে আছে ব্যক্তিস্বাধীনতার ছাড়পত্র ও স্বীকৃতি, স্বাধীন চিন্তার ও যুক্তির স্বাধিকার। এসব আধুনিক যুগের দান।

আধুনিক যুগের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন যে সব শক্তিশালী শ্রেণির আবির্ভাব হল, তার মধ্যে মধ্যবিত্তশ্রেণি অন্যতম। সমাজে মধ্যশ্রেণি আগেও যে ছিল না তা নয়, কিন্তু তার রূপ ছিল অন্যরকম। সমাজে তার কোনো স্বাধীন গতিশীল শ্রেণিগত স্বাতন্ত্র্য ও সত্তা ছিল না। নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণি সেই স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন সত্তা নিয়ে এল। সমাজে তার প্রভাব—প্রতিপত্তি যথেষ্ট বাড়ল। রিনেসান্স ও রিফরমেশন আন্দোলনের এবং আধুনিক গণতন্ত্রের আদর্শের প্রবর্তন করলেন তাঁরা। রিনেস্যন্সের আদিকেন্দ্র ইটালিতে ‘অ্যাকাডেমি’ কয়েকটি স্থাপিত হল পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে।* ১৪৩৩ সালে অ্যান্টনিও বেক্কাদেল্লি প্রতিষ্ঠিত Accademia Pontaniana, ১৪৭৪ সালে লরেঞ্জ—প্রতিষ্ঠিত Accademia Platonica, ১৫৮২ সালে সাহিত্যের Accademia delia Crusca, ১৬০৩ সালে বিজ্ঞানের Accademia del Lincei (গ্যালিলিও এই সভার সভ্য ছিলেন), ১৬৫৭ সালে ফ্লোরেন্সের Accademia del Cimento, ১৭৫৭ সালে Reale Accademia delle Scienze ইত্যাদি তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইটালির এই সব অ্যাকাডেমির মডেলে ইয়োরোপের সর্বত্র (বলকান অঞ্চল ছাড়া) বিদ্বৎসভা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ১৬৩৫ সালে রাজকীয় পোষকতায় ফ্রান্সে Academie Francaise প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারই শাখা হিসেবে ১৬৬৩ সালে Academie des Inscriptions et Belles-lettres স্থাপিত হয়। ১৬৬৬ সালে Academie des Sciences  প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৯৩ সালে সমস্ত অ্যাকাডেমির কার্যকলাপ আইনত বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার দু—বছর পরে Institute National,* স্থাপিত হয় এবং অন্যান্য অ্যাকাডেমিগুলি তারই বিভিন্ন শাখা হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। জার্মানিতে ও ইংল্যান্ডেও এই ধরনের সোসাইটি ও অ্যাকাডেমি একসময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। নবযুগের কর্মমুখর প্রত্যেকটি শহরে ও বন্দর—নগরে সভা—সোসাইটির গুঞ্জন শোনা যায়। কলরব নয়, মৃদুগুঞ্জন।

নতুন বাণিজ্যলব্ধ মূলধনের অবাধ প্রসারের সঙ্গে নতুন শিক্ষালব্ধ চিন্তাশক্তি ও যুক্তিবাদের অবাধ অগ্রগতি হতে থাকে। নতুন সমাজে ‘Money’ ও ‘Intellect’—এর মর্যাদা প্রায় অভিন্ন হয়ে ওঠে। সেকালের কুলকৌলীন্যের বদলে নবযুগে অর্থকৌলীন্য ও বিদ্যাবুদ্ধির কৌলীন্যই সামাজিক শ্রেণিনিয়ন্তা হয়ে ওঠে। নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণির মধ্যে একটি শক্তিশালী বিদ্যাবুদ্ধিজীবীর (Intelligentsia) উপশ্রেণি গড়ে ওঠে। বিত্তের সঙ্গে বিদ্যার কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও এবং সেরকম কোনো সম্পর্ক অভিজাত বিদ্বৎজনেরা স্বীকার না করলেও, রিনেস্যান্স আন্দোলনের গোড়ার দিকে বিত্তবানদের মধ্যে অনেকে ‘ইন্টেলিজেন্সিয়ার’ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন দেখা যায়। আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সভা ও সোসাইটি প্রধানত তাঁদের উদযোগেই হতে থাকে। নতুন শিল্প—বাণিজ্যের যুগেই মধ্যবিত্তশ্রেণির বিকাশ সম্ভব হল। এই মধ্যবিত্তের বিকাশ যদি না হত, তাহলে রিনেস্যান্স বা রিফর্মেশন কোনোটাই সম্ভব হত না। ঐতিহাসিক পোলার্ড বলেছেন :

Without commerce and industry there can be no middleclass, where you had no middle class, you had no Renaissance and no Reformation.

নতুন যুগের বণিকশ্রেণির মধ্যে শিক্ষার প্রসারের ফলে, নগরে নগরে সাহিত্যসভা দর্শনসভা বিজ্ঞানসভা প্রভৃতি বিবিধ বিদ্বৎসভার প্রতিষ্ঠা হতে থাকল। বিত্তবান ও বিদ্বানরা এই সব সভায় মিলিত হয়ে নবযুগের নানা বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে লাগলেন। লাইব্রেরি ও বিতর্কসভার বিস্তার হতে লাগল। নবজাগরণ ও নতুন সংস্কার—আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠল এই সভাগুলি :

Closely connected with the growth of education and enlightement among the younger generation of merchants is the creation of Literary and Philosophical Societies in the leading mercantile towns… societies of the type became centres of reforming zeal as well as of literary and philosophic illumination.

রবার্ট ওয়েন তার আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন, যৌবনে ‘ম্যাঞ্চেস্টার সোসাইটি’র সভ্য ছিলেন তিনি এবং এই সোসাইটি কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল তাঁর পরবর্তী জীবনে। রসায়নবিদ ড্যাল্টন ও ওয়েন ছিলেন ম্যাঞ্চেস্টার সোসাইটির সদস্য। ম্যাঞ্চেস্টারের মতো লিভারপুল শহরেও অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে অনেক সোসাইটি ও অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশেও নবযুগের বিদ্যাকেন্দ্র কলকাতা শহরে অনেক অ্যাকাডেমি সোসাইটি ও সভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং কলকাতার দেখাদেখি কাছাকাছি বর্ধিষ্ণু স্থানে (যেমন, বর্ধমানে, কৃষ্ণনগরে) ক্রমে সভাস্থাপনের একটা ঢেউ এসেছিল একসময়। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সামাজিক—সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল এই সব সভা—সমিতি। প্রথমে দেখা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে এদেশের ইংরেজ শাসক—বণিকরাই উদযোগী হয়ে এই ধরনের সোসাইটি স্থাপন করতে আরম্ভ করেছিলেন। তারপর নবযুগের আদর্শ উদ্বুদ্ধ বিত্তবান ও শিক্ষিত বাঙালিরা উদ্যোগী হয়ে সভাস্থাপন করতে আরম্ভ করেন। তখন থেকেই আসল আদর্শ—সংগ্রাম শুরু হয় এবং সেই আন্দোলন কলকাতাকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে বাংলার সমাজ—জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।

পলাশির যুদ্ধের পর যে—ইংরেজরা বণিকের মানদণ্ড ছেড়ে এদেশে রাজদণ্ড ধরতে আরম্ভ করেন, তাঁরা আমাদের চেয়ে বিশেষ কোনো উন্নততর সামাজিক আদর্শের ধারক ও বাহক ছিলেন না। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংলন্ডের উচ্চশ্রেণির সঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার উচ্চশ্রেণির, শিক্ষা বা রুচির দিক দিয়ে, কোনো পার্থক্যও তেমন ছিল না। এদেশের নবাগত ইংরেজদের প্রসঙ্গে একথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। কারণ অনেকসময় আমরা এদেশে ইংরেজের আবির্ভাবটাকেই নবযুগের ও নবীন আদর্শের আবির্ভাব বলে মনে করি। তা একেবারেই সত্য নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংলন্ডে মধ্যযুগের অবসান হলেও, প্রকৃত নবযুগের সূত্রপাত হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে, শিল্পবিপ্লবের পরে। আমাদের দেশেও তখন নতুন শিক্ষিতশ্রেণির মধ্যে যুগচেতনার বিকাশ হচ্ছে। দুই দেশের নতুন বর্ধিষ্ণু শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির নবজাগ্রত চেতনার মিলন প্রায় একই সময় হয়েছে। হেস্টিংস—ক্লাইভ—কর্নওয়ালিসের যুগে ঘোড়দৌড় জুয়াখেলা মদ্যপান ডুয়েলিং ইত্যাদির রেওয়াজ ইংলন্ডের অভিজাত ও নতুন বণিকসমাজে ছিল এবং আমাদের বাংলাদেশের নতুন রাজা—মহারাজা ও দেওয়ান—বেনিয়ানের সমাজে তারই সংক্রমণ হয়েছিল। দীর্ঘকাল পর্যন্ত আভিজাত্যের উপসর্গরূপে এগুলি বাঙালি সমাজের নতুন অভিজাতশ্রেণির মধ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। ১৮৪০—এর সমাজেও বাঙালি বণিকশ্রেণির মধ্যে ঘোড়—দৌড় ও জুয়াখেলার কীরকম রেওয়াজ ছিল, সে সম্বন্ধে একজন ইংরেজ লিখে গেছেন :

The native merchants are now commonly seen, on the racecourse, booking their bets, and acting like ‘knowing ones’. This is a practice of very modern introduction, but has become so common as to be noticed even in newspaper doggerels.

লেখক তাঁর স্মৃতিকথায় একটি ছড়া উদ্ধৃত করেছেন। তার মধ্যে রাধামাধব (?) ও মতিলাল শীলের নাম আছে :

Sugar is rising

Silk is likewising

So now let us baboos the joys of sport feel;

I‘ll not a ledger look

But take my betting book;

Like Radamadub and Muttylall Seal.

আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য তাঁর ‘পুরাতন প্রসঙ্গে’ এ সম্বন্ধে অনেক কথা বলে গেছেন। তিনি বলেছেন যে ইংরেজদের দেখাদেখি বাঙালিরা তখন আলাদা রেসকোর্স করেছিলেন। উত্তর—কলকাতায় পোস্তার রাজাদের বাগানে ঘোড়দৌড় হত। অনুষ্ঠানের কোনো ত্রুটি ছিল না। Starter ছিল, Jockey ছিল,  Booking Betting সবই ছিল। ছাতুবাবুর দৌহিত্র শরৎবাবু, লাটুবাবুর পোষ্যপুত্র মন্মথবাবু, হাঠখোলার দত্তবাবুরা ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া আনতেন। শরৎবাবু নিজে Jockey ও হতেন। শীতকালে ছাতুবাবুদের মাঠে বুলবুলির লড়াই হত। অনেক তাঁবু পড়ত মাঠে। পোস্তার রাজা নরসিংহ ও ছাতুবাবু প্রত্যেকে দেড়শো করে বুলবুলি আনতেন। লড়াইয়ে হেরে গেলে বুলবুলিরা উড়ে যেত এবং বিজয়ীদলের লোকেরা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠত ‘বো মারা’ বলে। দুপুরবেলা, বেলা এগারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত বুলবুলির লড়াই হত। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংলন্ডেও তাই হত। ট্রেভেলিয়ান মুরগির লড়াই সম্বন্ধে লিখেছেন :

At cock-fighting all classes shricked their bets round the little amphitheatre–এবং ঘোড়দৌড় সম্বন্ধে বলেছেন——Horseracing presented much the same spectacle in a more open arena।১০

দুই দেশের মধ্যেই মধ্যযুগের এই বিকৃত কালচারের লেনদেন হয়েছিল প্রথম যুগে এবং আমাদের দেশের নতুন ধনিকসমাজে তার জের ছিল অনেকদিন পর্যন্ত। ধনিকরা যা আভিজাত্যের লক্ষণ বলে মনে করতেন, আসলে তা আপজাত্যের লক্ষণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ওদেশের মতো এদেশের ধনিকদের মধ্যে ও অনেকে প্রত্যক্ষভাবে সমাজসংস্কারাদি আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। সভা—সমিতি, সোসাইটি অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠায় তাঁরা কম উদযোগী ছিলেন না। রক্ষণশীল সভা নয় শুধু (‘ধর্মসভা’ যেমন), প্রগতিশীল সভাতেও ধনিকদের একাংশ যোগ দিয়েছিলেন। ‘আত্মীয় সভা’, ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’ (Society for the Acquisition of General Knowledge), ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ প্রভৃতির প্রতিষ্ঠায় ও পরিচালনায় তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। সকলে সব সময় ঘোড়দৌড়, বুলবুলির লড়াই আর শখের থিয়েটারের মধ্যে ডুবে থাকেননি। তা ছাড়া, এইসব বিদ্বৎসভার প্রভাবে, শিক্ষার ক্রমবিস্তারের ফলে, শহরের নতুন আভিজাত—শ্রেণির বংশধরেরা ক্রমে পূর্বপুরুষদের নবাবি কালচারের মোহ থেকে কিছুটা মুক্ত হয়ে উঠেছিলেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে, প্রধানত কলকাতা শহরে, সভা—সমিতির যে বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য দেখা যায়, তা সত্যই বিস্ময়কর।* কেবল এই সব সভা—সমিতির বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে নবযুগের বাংলার একখানি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করা যেতে পারে। সুতরাং সমস্ত সভার বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয় এখানে। সকল প্রকারের সভাও আমার আলোচ্য নয়। ধর্মসভা, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সভার কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করলেও, বিদ্বৎসভাই আমার প্রধান আলোচ্য বিষয়। বিদ্বৎসভায় ধর্ম রাজনীতি অর্থনীতি বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হতে পারে, হয়েছেও, কিন্তু তা হলেও অন্যান্য সভার উদ্দেশ্যের সঙ্গে তার পার্থক্য আছে। ইংরেজিতে Learned Society বলতে যা বোঝায়, তার চেয়ে আরও ব্যাপক অর্থে আমি ‘বিদ্বৎসভা’ কথাটি ব্যবহার করেছি। অবশ্য সম্প্রতি Learned Society কথাটিও অন্যান্য দেশে অনেক ব্যাপক ও ‘পপুলার’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক যুগের বিদ্বৎসভা, সেকালের অ্যাকাডেমির সংকীর্ণতা কাটিয়ে অনেক বেশি উদার হয়ে উঠছে। জ্ঞানবিজ্ঞান, শিক্ষা—সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার জন্য শিক্ষিত বাঙালিদের যে—কোনো সভাকে আমি ‘বিদ্বৎসভা’ বলে গণ্য করেছি। ঊনবিংশ শতাব্দীকে দুটি পর্বে ভাগ করে (১৮০০—১৮৫০ এবং ১৮৫০—এর পর), প্রত্যেক পর্বের প্রধান সভাগুলির বিবরণ দিয়ে, বাংলার সমাজসংস্কৃতির নতুন গতিধারার উপর তার প্রভাব বিচার করাই আমার লক্ষ্য। আলোচনার সুবিধার জন্য প্রথম পর্বকে দুটি ‘যুগে’ ভাগ করেছি—একটি রামমোহন—ডিরোজিওর যুগ, আর একটি ইয়ং বেঙ্গলের যুগ।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে বা ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে প্রধানত ইংরেজরা উদযোগী হয়ে যেসব বিদ্বৎসভা স্থাপন করেছিলেন, সে সম্বন্ধে এখানে আলোচনা করব না, কারণ তখন বাঙালি সমাজের সঙ্গে তার বিশেষ কোনো যোগাযোগ ছিল না। এইসব সভার মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য—’এসিয়াটিক সোসাইটি’। সুপণ্ডিত স্যার উইলিয়াম জোনসের উদযোগে ১৭৮৪ সালে এসিয়াটিক সোসাইটি স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রথম যে সভা হয় (১৫ জানুয়ারি, ১৭৮৪), তাতে—

Thirty gentlemen attended and they represented the elite of the European community in Calcutta at the time.

এই সভায় জোনস সাহেব তাঁর ভাষণে বলেন—

Whether you will enrol as members any number of learned Natives you will hereafter decide.

১৮২৯ সালের ৭ জানুয়ারির এক সভায় (অর্থাৎ সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছর পরে) উইলসন সাহেব সর্বপ্রথম কয়েকজন এদেশীয় লোকের নাম প্রস্তাব করেন, সোসাইটির সদস্যপদের জন্য, এবং তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হয়।১১ এদিকে ১৮২৯ সালের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালিরা নিজেরাই উদযোগী হয়ে অনেক সভাসমিতি ও শিক্ষা—প্রতিষ্ঠান স্থাপনে অংশ গ্রহণ করেন। রামমোহন রায়ের ‘আত্মীয় সভা’, ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’, ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’ ‘হিন্দু কলেজ’, ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’, ‘সংস্কৃত কলেজ’ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যানুরাগী ইংরেজ ও বাঙালি উভয়েই উদযোগী হয়ে এইসব সভা সোসাইটি ও শিক্ষায়তন স্থাপন করেন। তারপর ‘এসিয়াটিক সোসাইটির’ সঙ্গে বাঙালি শিক্ষিত সমাজের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তার আগে হয়নি।

আত্মীয়সভা

বাঙালীর উদযোগে প্রতিষ্ঠিত সভা—সমিতির মধ্যে সর্বপ্রথম নাম করতে হয়, ১৮১৫ সালে স্থাপিত, রামমোহন রায়ের ‘আত্মীয় সভা’র। প্রথম রামমোহনের মানিকতলার বাড়িতে আত্মীয় সভার অধিবেশন হত, পরে তাঁর সিমলের বাড়িতে সভা স্থানান্তরিত হয়। প্রধানত ধর্মসংস্কারের আদর্শ নিয়ে এই সভা স্থাপিত হলেও পরবর্তীকালের ‘ইউনিটেরিয়ান সোসাইটি’ (সেপ্টেম্বর ১৮২১) অথবা ‘ব্রাহ্মসমাজের’ (আগস্ট ১৮২৮) সঙ্গে ‘আত্মীয় সভার’ পার্থক্য আছে। আত্মীয় সভা কেবল ধর্মোপাসনার সভা ছিল না। যদিও সভার সাপ্তাহিক অধিবেশনে বেদপাঠ হত, ব্রহ্মসংগীত হত, তাহলেও কেবল তাতেই সভার কাজ শেষ হত না। আত্মীয় সভার বৈঠকের বিচ্ছিন্ন বিবরণ, যা প্রাচীন সংবাদপত্রাদিতে পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় যে সভার অধিবেশন কেবল রামমোহনের গৃহেই হত যে তা নয়, যোগদানকারী সদস্যদের গৃহেও মধ্যে মধ্যে হত। অধিবেশনে কেবল বেদপাঠ ও ব্রহ্মসংগীত হত না, নানারকম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে আলোচনাও হত। ইংরেজি ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ পত্রিকা থেকে আত্মীয় সভার বৈঠকের মাত্র একটি বিবরণ এখানে উদ্ধৃত করছি। বৈঠকটি ১৮১৯ সালের ৯ মে, রবিবার ব্রজমোহন মজুমদারের গৃহে হয়েছিল। ১৮ মে, ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ পত্রে এই সভার বিবরণ প্রকাশিত হয় এই মর্মে :

At the meeting in question, it is said, the absurdity of the prevailing rules respecting the intercourse of several castes with each other, and of the restrictions on diet etc. was freely discussed, and generally admitted–the necessity of an infant widow passing her life in a state of celibacy–the practice of Polygamy and of suffering widows to burn with the, corpse of their husbands, were condemned– as well as all the superstitious ceremonies in use amongst idolaters..–Calcutta Journal, vol. 3. Tuesday, May 18, 1819, No. 89 (Italics  বর্তমান লেখকের)।

এই একটি বিবরণ থেকে ‘আত্মীয় সভা’ যে কী ধরনের সভা ছিল, তা পরিষ্কার বোঝা যায়। যে সভায় নানাবিষয় ‘was freely discussed’, সে সভা কেবল উপাসনা সভা ছিল না, পরিপূর্ণ আলোচনা সভা ছিল (আধুনিক অর্থে)। আলোচ্য বিষয়গুলির বৈচিত্র্য ও সামাজিক গুরুত্ব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা উচিত। জাতিভেদ সমস্যা, নিষিদ্ধ খাদ্যসমস্যা, বালবিধবাদের সমস্যা, বহুবিবাহের সমস্যা, সতীদাহ—সহমরণের সমস্যা, পৌত্তলিকতার সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আত্মীয় সভার অধিবেশনে স্বাধীনভাবে আলাপ—আলোচনা হত। যদি আত্মীয় সভার অধিবেশনের কোনো মুদ্রিত Proceedings পাওয়া যেত, তাহলে আমরা দেখতে পেতাম, ‘ইয়ং বেঙ্গল’ যুগের ভিতর দিয়ে একেবারে বিদ্যাসাগর যুগের প্রান্ত পর্যন্ত, বাংলার সামাজিক আন্দোলনের ধারা যে পথে পরিচালিত হয়েছে, যেন তার একটা মোটামুটি খসড়া রামমোহনের ‘আত্মীয় সভার’ অধিবেশনেই রচিত হয়েছিল। নবযুগের বাংলার সামাজিক ইতিহাসে ‘আত্মীয় সভা’র ভূমিকা এই কারণে উপেক্ষণীয় নয়।

আত্মীয় সভার সভ্যদের কথাও এখানে উল্লেখ করা উচিত। সভ্যরা সকলেই রামমোহনের আদর্শ সঙ্গী ও বন্ধু ছিলেন। সংস্কার—আন্দোলনের সময় কেউ—কেউ ভয়ে তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করলেও, অধিকাংশই তাঁর অনুরাগী সহচর ছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুত্র গোপীমোহন ঠাকুর, তাঁর পুত্র প্রসন্নকুমার ঠাকুর, তেলিনীপাড়ার জমিদার অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, টাকীর জমিদার কালীনাথ রায়, রাজনারায়ণ বসুর পিতা নন্দকিশোর বসু, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা ও রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজেন্দ্রলাল মিত্রের পিতামহ বৃন্দাবন মিত্র, ভূকৈলাসের (খিদিরপুর) রাজা কালীশঙ্কর ঘোষাল, জাষ্টিস অনুকূলচন্দ্রের পিতামহ রাজা বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, আন্দুল রাজবংশের রাজা কাশীনাথ প্রমুখ আরও অনেকে। ইয়োরোপে নবযুগের আবির্ভাবের প্রথম পর্বে, প্রগতিশীল ভাবধারার মুখপাত্ররূপে নতুন বিত্তবানশ্রেণির সঙ্গে উদীয়মান বুদ্ধিজীবীশ্রেণির যে ঐতিহাসিক মিলন হয়েছিল, বিত্ত ও বিদ্যার যে সমন্বয় ঘটেছিল, বাংলার নবযুগের ইতিহাসেও কিছুটা তাই হয়েছিল দেখা যায়। বাঙালি বিত্তবানেরা বিদ্বৎজনদের সঙ্গে প্রথম একত্র মিলিত হয়েছিলেন আত্মীয় সভায়। বিত্তের সঙ্গে বিদ্যার শ্রেণিগত বিচ্ছেদ তখনও ঘটেনি। সমাজবিজ্ঞানী কার্ল ম্যানহাইম (Karl Mannheim) নতুন ধনিকশ্রেণির এই সাংস্কৃতিক ভূমিকা সম্বন্ধে বলেছেন—‘‘…it is essential to note how with the rise of modern capitalism, the wealthy merchant and banking families play their part in cultural life.’’১২

‘হিন্দুকলেজ’ স্থাপিত হয় ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি, সোমবার। ‘আত্মীয় সভা’ কেন্দ্র করে যে সামাজিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর তাতে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হল। শিক্ষালয়ের সংস্কার ও নতুন শিক্ষার উপযোগী পাঠ্যপুস্তকাদি রচনার জন্য ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ (জুলাই, ১৮১৭) ও ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’ (সেপ্টেম্বর, ১৮১৮) স্থাপিত হল। বাঙালি ও ইংরেজরা একত্রে উদযোগী হয়ে এইসব সোসাইটি ও মহাবিদ্যালয় স্থাপন করলেন। শিক্ষার প্রসার হতে লাগল। নতুন শিক্ষার, নতুন শিক্ষিতশ্রেণির সংখ্যাও বাড়তে লাগল। সভা—সমিতি ও সোসাইটিও এই সময় স্থাপিত হল অনেক। ক্রমে শিক্ষিতশ্রেণির মন সভা—সমিতি—সচেতন হয়ে উঠলো। প্রধানত ইংরেজদের উদযোগে এইসময় (১৮১৮—২৮) যেসব সভা—সোসাইটি স্থাপিত হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—Literary Society, Oriental Literary Society, Phrenological Society, Agricultural and Horticultural Society, Commercial and Patriotic Association (১৮২৮ সালে স্থাপিত হয়, রামমোহন রায় এই অ্যাসোসিয়েশনের ট্রেজারার ছিলেন), Ladies Society (১৮২৮ সালে স্থাপিত হয়—রাজা বৈদ্যনাথ রায় ও কাশীনাথ মল্লিক এই সভা প্রতিষ্ঠায় উদযোগী ছিলেন ইংরেজদের সঙ্গে), Calcutta Medical and Physical Society ইত্যাদি। বাঙালিদের উদযোগে প্রতিষ্ঠিত এই সময়কার সভা—সমিতির মধ্যে প্রধান হল ‘গৌড়ীয় সমাজ’।

‘গৌড়ীয় সমাজ’ স্থাপিত হয় ১৮২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সেকালের প্রতিপত্তিশালী বাঙালিদের মধ্যে অনেকে উদযোগী হয়ে ‘এতদ্দেশীয় লোকেদের বিদ্যানুশীলন ও জ্ঞানোপার্জনার্থে’ এই সমাজ স্থাপন করেন। হিন্দুকলেজে সভা—স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রথম যে সভা হয়, তাতে দেখা যায় যে রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল উভয়দলের লোক যোগদান করেছিলেন। রামমোহনের দলভুক্ত দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রভৃতি অনেকে ছিলেন, আবার ওদিকে রাধাকান্ত দেব, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামদুলাল দে, কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন, এঁরাও ছিলেন। এই বিচিত্র সমাবেশের কারণ হল, ১৮২৩ সালে রামমোহনের আন্দোলন সমাজে এমন কিছু তরঙ্গবিক্ষোভের সৃষ্টি করেনি, যার ফলে সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিতশ্রেণির মধ্যে প্রত্যক্ষ দলাদলির উৎপত্তি হতে পারে। ১৮২৯ সালে বেন্টিঙ্ক যখন সতীদাহ ও সহমরণ বিধিবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করেন এবং ১৮৩০ সালে সনাতনপন্থীরা যখন ধর্মরক্ষার্থে ‘ধর্মসভা’ স্থাপন করেন, মতামতের সংঘাত ও দলাদলি তখন থেকে তীব্রভাবে আরম্ভ হয়। তার আগে, বিশেষ করে গৌড়ীয় সমাজের প্রতিষ্ঠার সময়, বাঙালি সমাজে প্রাচীনপন্থী মধ্যপন্থী এবং উদার প্রগতিপন্থী, মোটামুটি এই তিন দলের লোক থাকলেও, তাঁদের মত ও পথ নিয়ে সংঘর্ষ আরম্ভ হয়নি। গৌড়ীয় সমাজে তাই সকলের সমাবেশ সম্ভব হয়েছিল। সভা স্থাপনের সময় উদযোগীর মধ্যে যে আলাপ—আলোচনা হয়, তা লক্ষ্য করার মতো। রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আমাদের দেশে সভা—সমিতি সেরকম স্থায়ী হয় না, তার কারণ কী? তাই নিয়ে অনেকে আলোচনা করেন। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, সভা স্থাপন করে আমরা যে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হবার ও আলাপ আলোচনা করার সুযোগ পেলাম, তাতে যে কতটা আমরা সুখী হয়েছি তা বিবেচনা করা দরকার। রামজয় তর্কালঙ্কার বলেন, সত্যিই এখানে আমরা আজ এমন সব লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছি, যাঁদের সঙ্গে হয়ত একবছর কি ছ—মাসের মধ্যেও একবার দেখা হয় না। কাশীনাথ মল্লিক সভার এই প্রয়োজনের কথা স্বীকার করেন। রসময় দত্ত বলেন, সভায় যদি বিদ্যা বিষয়ে আলোচনা হয়, তাহলে আমি এর মধ্যে আছি, আর যদি রাজসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে, কি ধর্মশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা হয়, তাহলে আমি নেই। এইরকম সব আলোচনা চলতে থাকে।১৩ ‘আত্মীয় সভা’র মতো ‘গৌড়ীয় সমাজে’র অধিবেশনও মধ্যে মধ্যে সভ্যদের বাড়িতে হত। গৌড়ীয় সমাজের সভ্যদের মধ্যে যে—কোনো আদর্শগত ঐক্য ছিল না, তা বেশ বোঝা যায়। কিন্তু তা না থাকলেও, বিদ্বৎসভার সভ্যদের যে উদারতা থাকার প্রয়োজন, তা তাঁদের প্রত্যেকেরই ছিল। সমাজের উন্নতি করা যায় কী করে, তাই নিয়ে সকলে স্বাধীনভাবে আলোচনা করতেন। সভ্যরা রচনাও পাঠ করতেন, রচিত গ্রন্থের অংশ পর্যন্ত পাঠ করে শোনাতেন। গৌড়ীয় সমাজ কতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল সঠিক বলা যায় না। প্রবীণদের সভার বদলে যখন নবীনদের সভাস্থাপনের যুগ এল, তখন বিদ্বৎসভার রূপও বদলে গেল।

অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন

এর মধ্যে হিন্দুকলেজের বয়স দশ বছরের বেশি হয়ে গেছে। হিন্দু বিত্তবান পরিবারের সন্তানেরা অনেকে মহাবিদ্যালয়ে নতুন উচ্চশিক্ষা পেয়ে, বাল্যকাল থেকে যৌবনকালে পদার্পণ করেছেন। বেকন লক হিউম রুশো, টম পেইন প্রমুখ মনীষীদের চিন্তাধারার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয়েছে। নবযুগের আদর্শগুরু তাঁরা, কেবল ইংলন্ডের বা ইয়োরোপের নয়, সমগ্র বিশ্বের। হাতে—লেখা পুথিতে তাঁদের বাণী আর পুরোহিতযাজকের কুক্ষিগত হয়ে নেই, মুদ্রিত গ্রন্থাকারে সেই বাণী দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিম থেকে পূর্বেও ছড়িয়ে পড়েছে, বাংলাদেশের কলকাতা শহরে পর্যন্ত। বাংলার নতুন শিক্ষিত যুবকরা সেই বাণী শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। Age of Reason-এর অভ্যুদয় হয়েছে। কুসংস্কারের মেঘাচ্ছন্ন মধ্যযুগের আকাশে প্রথম ঊষার আলোকরেখা দেখা দিয়েছে। বিজ্ঞানের আলো, যুক্তির আলো। মানুষের মনে নতুন প্রশ্ন, নতুন মূল্যবোধের বিকাশ হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড মার্টিন নবযুগের মানুষের এই অনুভূতি ও মনোভাব সম্বন্ধে বলেছেন :১৪

Men felt that they had at last attained their majority in matters economic, political and intellectual. The new conditions of life brought with them new attitudes, new valuations.

‘ইয়ং বেঙ্গল’ ও হিন্দুকলেজের তরুণ ছাত্রদের সম্বন্ধেও এই কথা বলা যায়। সমস্ত রকমের বন্ধন ও কর্তৃত্ব থেকে তাঁরাও মুক্তি চেয়েছিলেন। স্থবির ও প্রবীণেরা যখন রক্তচক্ষু মেলে সেই বন্ধন আরোপ করতে চেয়েছেন, তখন তাঁদের ‘assertive self-consciousness’ তা প্রত্যাখ্যান করে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। যাঁরা বেকন পড়েছেন, লক পড়েছেন, হিউম পড়েছেন, তাঁরা কর্তৃত্ব মানবেন না, শাস্ত্রের বিধান প্রশ্নাতীত বলে স্বীকার করবেন না। তাঁরা কেবল সংশয় প্রকাশ করবেন, প্রশ্ন করবেন, যুক্তির অবতারণা করবেন। হিন্দুকলেজের ছাত্ররা তাই করতেন :১৫

The young men brought up in the Hindu College began to study the works of Bacon, of Locke; of Berkley, of Hume, of Reid, and of Douglas Stewart. A through revolution took place in their ideas…They began to reasons, to question,to doubt.

ডিরোজিও ছিলেন হিন্দুকলেজের শিক্ষক। তিনি নিজে ছিলেন কলকাতার ‘ধর্মতলা অ্যাকাডেমি’র ছাত্র এবং সেখানে তাঁর শিক্ষক ছিলেন কড়া প্রকৃতির কুঁজো স্কচম্যান ডেভিড ড্রামন্ড। অভিভাবকেরা ড্রামন্ডের কাছে ছেলেদের শিক্ষার জন্য পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারতেন না। দার্শনিক হিউমের শিষ্য ড্রামন্ড ছিলেন সর্ববিষয়ে ঘোর সংশয়বাদী এবং শাণিত যুক্তি ও স্বাধীন চিন্তার নির্ভীক সমর্থক।১৬ গুরু ড্রামন্ডের সুযোগ্য শিষ্য তৈরি হয়েছিলেন ডিরোজিও। চোদ্দোবছর বয়সে অ্যাকাডেমির শিক্ষা শেষ করে তিনি কিছুদিন বাইরে চাকরি করেন। তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভা ছিল অসাধারণ এবং তরুণ বয়সেই কাব্য ও অন্যান্য রচনার মধ্যে তার পরিচয়ও তিনি দিয়েছিলেন। পোর্তুগিজ পরিবারের সন্তান হয়েও এদেশকে তিনি স্বদেশ ও মাতৃভূমি বলে মনে করতেন। এদেশে তিনিই বোধহয় প্রথম দেশাত্মক কবিতা লেখেন। ১৮২৬ সালে, মাত্র সতেরো বছর বয়সে, তিনি হিন্দুকলেজের চতুর্থ শিক্ষকদের পদে নিযুক্ত হন। গরানহাটায় (চিৎপুরে) হিন্দুকলেজের প্রতিষ্ঠা হয় যখন, তখন আটবছরের বালক ডিরোজিও ধর্মতলা অ্যাকাডেমির ছাত্র। তখন কে জানত, এই ডিরোজিওই আর আট নয় বছরের মধ্যে হিন্দুকলেজের শিক্ষক হবেন এবং সেখানে তাঁর ছাত্রদের মনোজগতে এক প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করবেন।

তাই করেছিলেন ডিরোজিও। উচ্চশ্রেণির ছাত্রদের মধ্যে অনেকে তাঁর সমবয়স্ক ছিলেন। ভাবী ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের নেতৃস্থানীয় সকলেই প্রায় তাঁর কাছে শিক্ষা পেয়েছেন। রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ শিকদার, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, সকলে তাঁর ছাত্র ছিলেন। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, হরচন্দ্র ঘোষ, এঁরাও ডিরোজিওর অধ্যাপনাকালে হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন। কারণ, ১৮২৬ সালে ডিরোজিও হিন্দুকলেজের শিক্ষকরূপে যোগ দেন এবং ১৮২৮ সালে কৃষ্ণমোহন ছিলেন প্রথম শ্রেণির ছাত্র, রসিককৃষ্ণ দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। একজন তরুণ শিক্ষককে ঘিরে তরুণ ছাত্রদের এরকম সমাবেশ সাধারণত ঘটে না। কেবল পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষকরূপে নয়, নবযুগের আদর্শ শিক্ষকরূপে ডিরোজিও নব্যবঙ্গের তরুণ ছাত্রদের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন। মনীষী বেকন ছিলেন তাঁর আদর্শ। শিক্ষার পদ্ধতিও ছিল তাঁর অভিনব। প্রত্যেক প্রশ্নের ও বিষয়ের সপক্ষে ও বিপক্ষে সমস্ত বক্তব্যটিকে পেশ করে তিনি ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তার সুযোগ দিতেন এবং তার ভিতর থেকে আসল বৈজ্ঞানিক যুক্তির পথটি তাদের সন্ধান করে নিতে সাহায্য করতেন। ক্লাসের মধ্যে এক বিচিত্র রোমান্টিক পরিবেশের সৃষ্টি হত এবং ছাত্রদের কাছে ডিরোজিও যেন তার নায়ক হতেন। মুগ্ধ হয়ে ছাত্ররা তাঁর কথা শুনত। ডিরোজিওর এই ক্লাস সম্বন্ধে রেভারেন্ড লালবিহারী দে বলেছেন :১৭

…it was…more like the Academus of Plato, or the Lyceum of Aristotle.

বিদ্যালয়ের ক্লাস বিতর্কসভায় পরিণত করা সম্ভব নয়, কিন্তু শিক্ষক ডিরোজিও এমনভাবে শিক্ষা দিতেন এবং ছাত্ররা তাতে এমনভাবে উদ্বুদ্ধ হত যে, শিক্ষক—ছাত্র সকলের মন বিতর্কের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। শেষপর্যন্ত এই বিতর্ক ও আলোচনা সভা হত ডিরোজিওর বাড়ির বৈঠকখানায়। সভার নাম হল ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন (Academic Association) মনে হয়,১৯২৭—২৮ সাল থেকেই এই অ্যাকাডেমির নিয়মিত অধিবেশন আরম্ভ হয়। ডিরোজিওর বৈঠকখানা থেকে এই বিদ্বৎসভা পরে শ্রীকৃষ্ণ সিংহের মানিকতলার বাগানবাড়িতে (যেখানে ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়) স্থানান্তরিত হয়। এই অ্যাকাডেমি ও তার অধিবেশন সম্বন্ধে রেভারেন্ড লালবিহারী দে লিখেছেন :১৮

Derozio’s drawing-room proving too confined a place for these discussions, the young men got up, about the year 1828, a debating society, which they called the Academic Association, or the Academy. In this grove of Academus– and the debating society had a garden attached to it, it being held on the premises now occupied by the Ward’s Institution– did the choice spirits of Young Calcutta hold worth, week after week, on the social, moral and religious questions of the day. The general tone of the discussions was a decided revolt against existing religious institutions… The young lions of the Academy roared out, week after week, ‘Down with Hinduism! Down with Orthodoxy!…’

‘পার্থিনন’ (The Parthenon) নামে সভার মুখপত্র প্রকাশিত হল, কিন্তু হিন্দুকলেজের কর্তৃপক্ষ অল্পদিনের মধ্যেই পত্রিকাখানি হুমকি দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। সভার কাজ তাতে বন্ধ হল না। কেবল অ্যাকাডেমিতে নয়, ডিরোজিও অন্যান্য শিক্ষায়তনের ছাত্রদের সভায় (যেমন পটলডাঙার হেয়ার সাহেবের স্কুলে) বক্তৃতা দিতে লাগলেন। ডিরোজিও ও তাঁর অ্যাকাডেমির আকর্ষণ তরুণদের কাছে বাড়তে লাগল। কলকাতা শহরের শিক্ষিত তরুণরা ডিরোজিও ও তাঁর অ্যাকাডেমির সংস্পর্শে আসার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠলেন। তাঁদের জ্ঞান, বিচারবুদ্ধি ও প্রতিভার উন্মেষ হতে লাগল অ্যাকাডেমির উদার পরিবেশে। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ সকলেই এই অ্যাকাডেমির সভাতেই বক্তৃতা দিতে শিখলেন এবং বক্তা হয়ে উঠলেন। কৃষ্ণমোহন সম্বন্ধে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়েট’ পত্রিকা লিখলেন :

Krisna Mohan was the readiest and most effective speaker, unaffected in manner, calm and unimpassioned, though sometimes bursting into vehemence.

কৃষ্ণমোহন ডিরোজিওর খুব প্রিয়ও ছিলেন।১৯ অ্যাকাডেমির বিতর্ক—সভায় রামগোপাল ঘোষের বাগ্মিতার বিকাশ হয়েছিল কিভাবে, সে সম্বন্ধে অমৃতলাল বসু লিখেছেন :২০

It is said that this debating club was to him what the Oxford Club had been to many an English orator. Ramgopal continued to shine as a speaker at the Academic. He was an eloquent speaker, but not so close a reasoner as his colleague Babu Russick Krishna Mullick.

মানিকতলার বাগানবাড়িতে তরুণদের এই বিদ্বৎসভায় প্রবীণ ও বিচক্ষণেরাও যোগদান করার লোভ সম্বরণ করতে পারতেন না। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি এডওয়ার্ড রায়ান, ডেভিড হেয়ার, ডেপুটি—গবর্নর বার্ড সাহেব, প্রায়ই যেতেন অ্যাকাডেমির অধিবেশনে। অ্যাকাডেমির তরুণ সভ্যদের মুখে—মুখে হিউম বেকন লক—এর বাণী শোনা যেত।

পরবর্তীকালের কোনো—কোনো সভার মুদ্রিত বিবরণী যেমন পাওয়া যায়, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের সেরকম কিছু পাওয়া যায় না। পরে যেমন সমসাময়িক পত্রিকায় এইসব সভা ও সোসাইটির অধিবেশনের বিবরণ মধ্যে মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, অ্যাকাডেমির সেরকম কেনো বিবরণ বোধহয় প্রকাশিত হয়নি। অনেক অনুসন্ধান করেও, যা পাওয়া যায় এরকম কোনো সেকালের পত্রিকাতে আমি কোনো বিবরণ পাইনি। যদি পাওয়া যেত, তাহলে ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের উন্মেষপর্বের ইতিহাস আমরা আরও সবিস্তারে জানতে পারতাম। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনই ছিল ইয়ং বেঙ্গলের আসল ট্রেনিং স্কুল। আধুনিক যুগের বাংলার ইতিহাসে তাই অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের গুরুত্ব আছে।

বাংলার নব্যশিক্ষিত তরুণ বিদ্রোহীরা যখন মানিকতলার বাগানবাড়িতে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠকে নানারকম সমস্যা নিয়ে তর্কবিতর্ক করছিলেন, তখন বাইরের জনসমাজে তাই নিয়ে মৃদুগুঞ্জন হলেও, বিশেষ কলরবের সৃষ্টি হয়নি। বিদ্বৎসভার নিরিবিলি পরিবেশে ইয়ং বেঙ্গল দলের তরুণদের বাকযুদ্ধ অব্যাহত ধারায় চলছিল। এমন সময় বাইরের নিস্তরঙ্গ সমাজের বুকে হঠাৎ যেন আন্দোলনের ঢেউ বয়ে গেল। বেন্টিঙ্ক সতীদাহপ্রথা আইনবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করলেন (১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর)। বিধর্মীর বিধান বানচাল করবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে প্রতিপক্ষরা মাসখানেকের মধ্যে ‘ধর্মসভা’ নামে এক সভা গঠন করলেন (১৭ জানুয়ারি, ১৮৩০)। মাস ছয়েকের মধ্যে পাদ্রি আলেকজান্ডার ডাফ সস্ত্রীক কলকাতায় পৌঁছলেন (২৭ মে, ১৮৩০)। উদ্দেশ্য খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার প্রসারের পথ পরিষ্কার করা। কলকাতায় পৌঁছেই তিনি মিশনারিসুলভ উদ্যমে কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর হলেন। ডাফ সাহেব কলকাতায় পৌঁছবার ছ—মাস পরে রামমোহন রায় বিলাত যাত্রা করলেন (১৯ নভেম্বর, ১৮৩০)। তার প্রায় একমাসের মধ্যে ইয়ং বেঙ্গলের আদর্শগুরু ডিরোজিওর অকালমৃত্যু হল (২৬ ডিসেম্বর, ১৮৩১)। রামমোহন ও বিদ্রোহী তরুণদের মন্ত্রদাতা ডিরোজিও, বাংলার সমাজ—জীবনের এমনই এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে কর্মক্ষেত্র থেকে বিদায় নিলেন যে, অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁদের উত্তরাধিকার বহন করার সমস্ত দায়িত্ব পড়ল নবীনদের উপর। নবীনরা সেই গুরুদায়িত্ব বহন করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলেন। সংগ্রাম ও প্রস্তুতি একসঙ্গেই চলতে লাগল। এই প্রস্তুতির পর্বে বাংলাদেশে সভাসমিতির বিকাশ হল অনেক। তার মধ্যে বিদ্বৎসভাই বেশি। কেবল বিদ্বৎসভাকেন্দ্রিক সংগ্রামের এই রূপ বিশেষ লক্ষণীয়।

ইংলন্ডের ব্রিস্টল শহরে, ১৮৩৩ সালে (২৭ সেপ্টেম্বর) রামমোহনের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুতে আধুনিক বাংলার ইতিহাসে একটি পর্বাস্তর হয় বলা যায়। প্রবাসে থাকলেও, বাংলার অগ্রগামী দলের আন্দোলনের পশ্চাতে তাঁর কোনো প্রভাব ছিল না, এমন কথা বলা যায় না। ১৮২৯—৩০ থেকে ১৮৩৩ সালের মধ্যে এমন কতকগুলি ঘটনা ঘটে যায়, যার প্রভাব বাংলার সমাজজীবনে গভীর ও দূরপ্রসারী। ক্রমায়াত ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে বাইরের সমাজপ্রাঙ্গণ কলরবমুখর হয়ে ওঠে। এক নতুন কলরব, প্রাণহীন স্থিতিশীল সমাজে যা শোনা যায় না কখনো। বন্ধ ডোবার পাড়ে তরঙ্গ প্রতিহত হয় না। সমাজের মধ্যে যখন প্রবল স্রোত বইতে থাকে, তখন তার তরঙ্গের আঘাতে তীরে ভাঙন ধরে। সমস্যার পর সমস্যা, সুপ্ত লোকচেতনাকে খানিকটা জাগিয়ে তোলে। জাগ্রত চেতনার বিস্ময়ের সাময়িক ঘোর যখন কেটে যায়, তখন সমস্যার মুখোমুখি সে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। সকলে এক দিকে বা এক ভঙ্গিতে দাঁড়ায় না। কেউ দাঁড়ায় সামনে, কেউ পিছনে, কেউ পাশে। নানা মত ও নানা পথের চাপে বিদীর্ণ হয়ে যায় সমাজ। দ্বন্দ্ব ও বিরোধের ভিতর দিয়ে নতুন পথে তৈরি করে এগিয়ে চলে মানুষ। সমাজজীবনের নির্জন নিস্তব্ধ অঙ্গন এই ধরনের ঐতিহাসিক সংঘাতকালে রণাঙ্গণে পরিণত হয়। আলাপ—আলোচনা, তর্ক—বিতর্ক, বিচার—বিশ্লেষণ, আলোড়ন—আন্দোলনের মধ্যে সমাজের এই নতুন প্রাণচাঞ্চল্য আত্মপ্রকাশ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে (১৮২৫—৫০) বাংলার সমাজ—জীবনে এই বৈশিষ্ট্যই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। তখন সভাসমিতিরও বিকাশ হয়েছিল যথেষ্ট। রামমোহন ও ডিরোজিওর অভাবে নবীনেরা প্রায় অভিভাবকহীন অবস্থায় আন্দোলন চালিয়েছিলেন। প্রাচীনদের দলে সমাজের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি এবং তাঁদের আর্থিক ও সামাজিক প্রতিপত্তিও খুব সংহত ছিল। নবীন ও প্রাচীনের দ্বন্দ্বে, নবীনরা সবদিক দিয়েই খুব দুর্বল ছিলেন। তার উপর তাঁদের কোনো প্রবীণ পরিচালক বা পরামর্শদাতা কেউ ছিলেন না। সুতরাং একত্রে দলবেঁধে মিলেমিশে, সভাসমিতি গঠন করে, তাঁরা কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছিলেন। বিশেষ কোনো ‘যুগ’ হিসেবে আখ্যা দিতে হলে এইসময়টাকে ‘ইয়ং বেঙ্গলের যুগ’ বলতে হয়। এই যুগের সভাসমিতির শুধু সংখ্যা নয়, বৈচিত্র্যও উল্লেখযোগ্য। বৈচিত্র্যের মধ্যে একটি ঐক্য ছিল, সভা—গঠনের উদ্দেশ্যের ঐক্য। স্বাধীন চিন্তা, অবাধ আলোচনা ও মেলামেশার আদর্শ নিয়েই সমস্ত সভাসমিতি গড়ে উঠেছিল। কলকাতা শহরকেন্দ্রিক নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্তদের ও বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক সংস্কারসংগ্রাম প্রধানত সভাসমিতির তর্কবিতর্কের রূপ ধারণ করেছিল।

সামাজিক সংঘাতের তীব্রতার মধ্যেই সভাসমিতির বিকাশ হয়। এটা আধুনিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য দেশের ইতিহাসেও তাই দেখা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে, এ যুগের সভাসমিতি বা ক্লাব—সোসাইটি বলতে যা বোঝায়, তার বিকাশ হয়নি। ইতালীয় রিনেস্যান্সের ‘হিউম্যানিস্টিক অ্যাকাডেমি’—গুলির আদর্শে ইয়োরোপ সোসাইটি ও অ্যাকাডেমির কিছু কিছু বিকাশ হয়েছিল বটে, কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে সম্মিলিতভাবে স্বাধীন চিন্তা ও আলোচনার জন্য সভাসমিতির প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ তেমন তৈরি হয়নি। সামাজিক ইতিহাসের বিশেষজ্ঞরাও এ কথা স্বীকার করেন :২১

–the world had not known until the eighteenth century any societies organised for collective thinking and discussion. There had been religious sects, guilds of merchants and artisans, colleges of doctors and parliaments of lawyears; but there had never been–anything like societies, let alone a whole network of societies, for the avowed purpose of collective thinking and talking.

সভা সমিতি সোসাইটি—‘for the avowed purpose of collective thinking and talking’—একমাত্র সমস্যাসংকুল সংঘাতমুখর সমাজেই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে ও তাগিদে গড়ে উঠতে পারে। অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজবিপ্লব (আমেরিকান ও ফরাসি) মানুষের চিরন্তন একমুখী চিন্তাধারাকে বহুমুখী করে তোলে। অনেক প্রশ্ন, অনেক সমস্যা ও সংশয় মানুষের মনে জাগে, যার সদুত্তর ও সমাধান সে চায়। তার ফলে আলাপ—আলোচনা ও তর্কবিতর্কের প্রয়োজন হয় সম্মিলিতভাবে। এই সামাজিক প্রয়োজন থেকেই সভা—সোসাইটির বিকাশ হয়। এই সমস্ত সভা—সোসাইটির মূলনীতি হল স্বাধীন চিন্তা (Freedom of Thought), অবাধ আত্মপ্রকাশের (Freedom of Expression) ও পরস্পর—মিলনের  (Freedom of Association) অধিকার। নবযুগের গণতান্ত্রিক আদর্শের তিনটি প্রধান স্তম্ভ, মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে যার অস্তিত্ব ছিল না। এই সময় ইউরোপে Freethinker-দের আন্দোলনও আরম্ভ হয়। নবযুগের আলোকপন্থীদের লক্ষ্য করে ভলতেয়ার উপদেশ দিতেন—সুহৃদগোষ্ঠী ও চক্র গঠন করে একত্রে মেলামেশা করতে, একত্রে আহারবিহার করতে, একত্রে আলাপ—আলোচনা করতে, সভা করতে। এই আদর্শের প্রেরণায় ফ্রান্সে সভা সোসাইটির বিকাশ হয়েছিল প্রচুর। হবস তাঁর Leviathan গ্রন্থে ‘Captivity of Understanding’—এর কথা বলেন এবং স্পিনোজা মানুষের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ও মতামত প্রকাশ করার স্বাভাবিক অধিকার নিয়ে বহু দার্শনিক আলোচনা করেন। লক ও হিউমের রচনাও মানুষের চিন্তাবিপ্লবের পথ পরিষ্কার করে দেয়। তা ছাড়া Rights of Man এবং The Age of Reason-এর লেখক টম পেইন (Tom Paine) নবযুগের নবীন সমাজের চিন্তাধারায় এইসময় গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে ভলতেয়ার হিউম লক, টম পেইন প্রমুখ নবযুগের চিন্তানায়কদের রচনাবলি গ্রন্থাকারে কলকাতার বন্দরে আমদানি হতে থাকে। বিদেশি মদ ও শৌখিন জিনিসপত্তরের সঙ্গে এইসব গ্রন্থের কথা কলকাতার ব্যবসায়ীরা তখনকার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করতেন। Calcutta Chronicle, Calcutta Gazette, Morning Post প্রভৃতি কলকাতার ইংরেজি পত্রিকায় এরকম অনেক বইয়ের বার্তা প্রচারিত হত। এই বিজ্ঞাপনগুলি থেকে সামাজিক ইতিহাসের অনেক মূল্যবান উপকরণ পাওয়া যায়। বোঝা যায়, বিদেশ থেকে কেবল যে পোর্ট—ওয়াইন, জিন, ক্ল্যারেট, ব্র্যান্ডি, আসত তা নয়, তার চেয়ে আরও অনেকগুণ বেশি উত্তেজক পদার্থ আসত—যেমন ভলতেয়ারের গ্রন্থাবলি, হিউমের গ্রন্থাবলি, টম পেইনের গ্রন্থাবলি ইত্যাদি। অবশ্য বই ও ব্র্যান্ডির সামাজিক ভূমিকা তখন প্রায় একই ছিল বাংলার নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে।

একহাতে ব্র্যান্ডি, আর এক হাতে বই নিয়ে ইয়ং বেঙ্গল দল চিন্তাবিপ্লবের উদযোগ করেছিলেন। তাঁদের ব্র্যান্ডিপ্রীতির কথা অনেকে বলে গেছেন, কিন্তু নবযুগের চিন্তানায়কের প্রচারিত আদর্শের প্রতি অনুরাগের কথা তেমনভাবে কেউ বলেননি। এই আদর্শ আধুনিক যুগের মুদ্রিত বইয়ের মারফত সমাজে প্রচারিত হয়। বাংলাদেশেও হয়েছে। কীভাবে হয়েছে তার একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। টম পেইনের গ্রন্থাবলি প্রচুর সংখ্যায় আমদানি হয়েছে। দৃষ্টান্তটি পাদরি ডাফ সাহেব উল্লেখ করেছেন। ইয়ং বেঙ্গলের আদর্শগুরুদের প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন :২২

Their great authorities…. were Hume’s Essays and Paine’s Age of Reason. With copies of the latter, in particular, they were abundantly supplied… It was some wretched bookseller in the United States of America who–basely taking advantage of the reported infidel leanings of a new race of men in the East and apparently regarding no God but his silver dollars, despatched to Calcutta a cargo of that most malignant and pestiferous of all antichristian publications. From one ship a thousand copies were landed, and at first were sold at the cheap rate of one rupee per copy, but such was the demand that the price soon rose, and after a few months, it was actually quintupled. Besides the separate copies of the Age of Reason,  there was also a cheap American edition, in one thick vol. 8vo, of all Paine’s works including the Rights of Man, and other minor pieces, political and theological.

১৮৩০—৩১ সালের কথা বলেছেন ডাফ সাহেব। পাদরি সাহেবের পক্ষে টম পেইনের বইকে ‘malignant’ ও ‘pestiferous’ বলা খুবই স্বাভাবিক। জাহাজ—বোঝাই টম পেইনের বই এল এবং কয়েকদিনের মধ্যেই তা হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেল। এই একটিমাত্র ঘটনা থেকে নব্যবঙ্গের নবীন বিদ্বৎসমাজের মানসিক অবস্থার একটা পরিচয় পাওয়া যায়। সেটা হল, তাঁদের সমাজসংস্কার—সংগ্রাম প্রধানত ছিল বিদেশি গ্রন্থপ্রণোদিত।

নতুন মানবাধিকার ও অবাধ চিন্তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইয়ং বেঙ্গল প্রাচীনপন্থীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। সংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার হল তাঁদের দুটি। একটি হল পত্রিকা, আর একটি বিদ্বৎসভা, বিতর্কসভা প্রভৃতি বিভিন্ন সভা—সোসাইটি। দুইটি নতুন হাতিয়ার, প্রেসও নতুন, সোসাইটিও নতুন। প্রাচীনপন্থীরাও এই একই হাতিয়ার নিয়ে নামলেন, কিন্তু তাঁদের সুবিধা ছিল অনেক। প্রথমত ধনিকদের আর্থিক পোষকতা ছিল, দ্বিতীয়ত কুসংস্কারের ভূতপ্রেত লেলিয়ে দেবার সুযোগ ছিল এবং সনাতন ধর্মের দোহাই তো ছিলই। ইয়ং বেঙ্গলের প্রধান সম্বল ছিল ‘যুক্তি’। তাঁরা ছিলেন Age of Reason-এর প্রতিনিধি। পত্রিকা ও সভা—সোসাইটির মাধ্যমে তাঁরা সেই যুক্তির অভিযান আরম্ভ করলেন। বাড়াবাড়ি বা আতিশয্য প্রকাশ তাঁরা যথেষ্ট করেছেন। পার্থিনন, হেসপারাস, ইস্ট ইন্ডিয়ান, রিফর্মার, এনকোয়ারার, জ্ঞানান্বেষণ প্রভৃতি কয়েকটি ভালো—ভালো পত্রিকা এইসময় প্রকাশিত হল। ধর্মসভার পান্ডারা তাঁদের পত্রিকাদি মারফত হিন্দুকলেজের শিক্ষাদীক্ষা ও খ্রিস্টধর্মের প্রচারের বিরুদ্ধে নানারকম অভিযোগ করতে লাগলেন। হিন্দুকলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার বিরুদ্ধে চিঠিপত্র ও বিভিন্ন সংবাদপত্রে (সমাচার—চন্দ্রিকা, সংবাদ প্রভাকর, সমাচার দর্পণ ইত্যাদি) প্রকাশিত হতে থাকল।

কেবল পত্রিকার মাধ্যমে ইয়ং বেঙ্গল দল আন্দোলন করেননি। ‘পত্রিকা’ ছিল তাঁদের প্রথম হাতিয়ার। দ্বিতীয় হাতিয়ার ছিল ‘সভাসমিতি’। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন কতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল, সঠিক জানা যায় না। তবে অ্যাকাডেমি ছাড়াও এইসময় আরও অনেক সভা—সোসাইটির বিকাশ হয়েছিল। কী পরিমাণ বিকাশ হয়েছিল, রেভারেন্ড লালবিহারী দে তাঁর ডাফ সাহেবের জীবনচরিতে এবং ডাফ নিজে তা লিখে গিয়েছেন। রেভারেন্ড দে লিখেছেন :২৩

Debating Societies were multiplied, in which bigotry, high-handed tyranny, superstition and Hindu orthodoxy was denounced in no measured terms.

ডাফ সাহেব বিশদভাবে এই সমস্ত সভাসমিতি সম্বন্ধে লিখেছেন : তিনি বলেছেন যে, এর আগে সভা—সোসাইটি ছিল, কিন্তু খুব বেশি ছিল না। তার মধ্যে অধিকাংশ সভা ইংরেজরাই উদযোগী হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ আদর্শসংঘাতের এই নতুন পরিবেশে সভাসমিতির দ্রুত বিকাশ হতে থাকল এবং তার সংখ্যা অনেক বাড়ল। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এই সমস্ত সভার বৈঠক হত কলকাতায়। এক—একজন একাধিক সভায় যোগ দিতেন ও সদস্য হতেন। আলাপ—আলোচনা, তর্কবিতর্ক যেন একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়াল।* এমন কোনো বিষয় ছিল না যা নিয়ে আলোচনা বা তর্ক হত না। বিষয়—বৈচিত্র্যের যেন শেষ ছিল না মনে হয়। ডাফ সাহেব লিখেছেন :২৪

New Societies started up with the utmost rapidity in every part of the native city. There was not an evening in the week, on which one, two or more of these were not held; and each individual was generally enrolled a member of several. Indeed, the spirit of discussion became a perfect mania; and its manifestation, both in frequency and variety, was carried to a prodigious excess.

সভা—সোসাইটিতে মিলিত হয়ে, নানা বিষয়ে স্বাধীনভাবে আলোচনা ও তর্কাতর্কি করার মনোভাব একসময় প্রায় ‘ম্যানিয়া’ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশে, ১৮২৯—৩০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে। (অবশ্য শতাধিক বছর পরেও বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের সেই ‘ম্যানিয়া’ আজও ঠিক রয়েছে, বরং আরও বেশি প্রবল হয়েছে বলা চলে)। ১৯৩০ সালে জনৈক ‘হিন্দুকালেজচ্ছাত্রস্য পিতুঃ’ কলেজের ছেলেদের শিক্ষা ও ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের চিঠিতে এই বলে অভিযোগ করেছিলেন :২৫

প্রায় সকল ছেলেগুলি একগুঁয়ে অবশ্য অধৈর্য এবং অনেক বিষয় বিপরীত ইহারা স্থানে ২ সভা করিয়াছে তাহাতে আচার ব্যবহার ও রাজনিয়মের বিবেচনা করে এই সকল দেখিয়া পুত্রের কালেজে যাওয়া রহিতকরণের চেষ্টা করিলাম কিন্তু ছেলে কালেজ ছাড়িতে চাহে না পরে মাসিক বন্ধ করিলাম এইক্ষণে ছেলে লইয়া যে উৎপাতগ্রস্ত হইয়াছি যদি আবশ্যক হয় পশ্চাৎ লিখিয়া জানাইব…।

পরিষ্কার বোঝা যায়, ছেলেরা যে স্থানে—স্থানে সভা করেছে এবং সেইসব সভায় সামাজিক আচার—ব্যবহার, এমনকী রাজনিয়মের বা রাজনীতিরও আলোচনা করছে, এতেই ‘ছাত্রস্য পিতুঃ’ বেশ বিচলিত হয়েছেন। তিনি ছেলেকে কলেজ ছাড়াতে চেয়েছেন, ছেলে ছাড়েনি। মাসিক টাকাও বন্ধ করেছেন, কিন্তু তাতেও ‘উৎপাতগ্রস্ত’ হয়েছেন। অথচ এরকম অবস্থার মাত্র বছর ছয় অগেও, ইংরেজি সংবাদপত্রে এই জাতীয় সভা—সোসাইটি স্থাপনের আবশ্যকতার কথা লেখা হত। Bengal Hurkaru পত্রে ১৮২৪ সালে জনৈক লেখক সভা—সোসাইটি স্থাপনের উপযোগিতা সম্বন্ধে আলোচনা করেন। তার উত্তরে ‘Medicus’ নাম দিয়ে আর একজন লেখেন :২৬

A correspondent in your paper…called the attention of the public, to the formation of debating society in Calcutta, by which I conceive he means and Institution, where men may unbend their minds, discuss and express their sentiments freely and fearlessly, on every subject connected with general knowledge, both political and Scientific…. In Countries whose Government are different from this, such institutions flourish and to the credit of such, it may be said, that through their medium, Political Economy and Science have been greatly promoted.

‘মেডিকাস’—এর যুক্তি একেবারে বাতিল করা যায় না। ১৮২৪ থেকে ১৮৩০ সাল, মাত্র ছ—বছরের মধ্যে, দেশের সামাজিক অবস্থার যে খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, সভা—সোসাইটির অভাবনীয় সংখ্যাবৃদ্ধি থেকেই তা বোঝা যায়। তার ফলে যে রাজনীতি সমাজনীতি অর্থনীতি ও বিবিধ জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার কিছুটা প্রসার হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ছাত্রদের পিতারা সেইজন্য এইসব সভা—সমিতির সংখ্যাবৃদ্ধিতে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন।

এই সমস্ত সভা ও সোসাইটি কীভাবে পরিচালিত হত, সকলেরই তা জানবার কৌতূহল হবে, কিন্তু সে সম্বন্ধে কোনো নির্ভরযোগ্য বিবরণ বিশেষ পাওয়া যায় না। এ—সম্বন্ধে ডাফ সাহেব যা লিখে গেছেন, তা অনেকটা নির্ভরযোগ্য, কারণ তিনি নিজে একাধিক সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং অনেক সভায় যোগদান করতেন :

At one or other of these societics I felt it to be at once a duty and a privilege constantly to attend.

তাঁর বিবরণ থেকে যেটুকু জানা যায়, তার মর্ম এই :

সভার সদস্যরা যখন বক্তৃতা দিতেন তখন ইংরেজ লেখকদের প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁরা নিজেদের মতামত জোরালো করে শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরতেন। আলোচ্য বিষয় ঐতিহাসিক হলে রবার্টসন ও গিবন উদ্ধৃত করা হত। রাজনৈতিক বিষয় হলে অ্যাডাম স্মিথ ও জেরিমি বেন্থাম, বৈজ্ঞানিক বিষয় হলে নিউটন ও ডেভি, ধর্মবিষয় হলে হিউম ও টম পেইন, দার্শনিক বিষয় হলে লক, রীড, স্টিউয়ার্ট ও ব্রাউন প্রমুখের রচনা থেকে প্রচুর পরিমাণে আবৃত্তি করা হত। বক্তৃতাটিকে সাহিত্যিক মাধুর্যে জীবন্ত করে তোলার জন্য ইংরেজ কবি ও সাহিত্যিকদের রচনা থেকে ভালো—ভালো অংশ তাঁরা উদ্ধৃত করতেন। তার মধ্যে ওয়াল্টার স্কট ও বায়রণ থেকেই বেশি বলা হত, মধ্যে মধ্যে রবার্ট বার্নসের কাব্যাংশও আবৃত্তি করতে শোনা যেত। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল, আলোচনার অবাধ স্বাধীনতা—

But the most striking feature in the whole was the freedom with which all the subjects were discussed.

আলোচনার অবাধ স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সোসাইটির অধিবেশনের যে পরিচয় দিয়েছেন ডাফ সাহেব, তা সম্পূর্ণ উদ্ধৃতির যোগ্য। উদ্ধৃতিটি অনেক বড় হবে বলে বাংলায় তাঁর বক্তব্যের সারটুকু উল্লেখ করছি।২৭ সাধারণত বিদ্বৎসভা ও বিতর্কসভার বৈঠকে যা দেখা যায়, তাতে আলোচ্য বিষয়ের পক্ষে এক দল বলেন এবং বিপক্ষে আর এক দল বলেন। বিদ্বৎসভার ঠিক এ রকম কোনো বাঁধাধরা নিয়ম না থাকলেও, বিতর্কসভা এই নিয়মেই পরিচালিত হয়। ইয়ং—বেঙ্গলের যুগে বিদ্বৎসভা ও বিতর্কসভার মধ্যে ‘ফর্মাল’ ভেদ বিশেষ ছিল না। কারণ সব সভাই প্রায় আলাপ—আলোচনা তর্কবিতর্কের জন্য গঠিত হয়েছিল, প্রকৃত সামাজিক সংগ্রামের জন্য নয়। এই আলোচনা প্রবণতাই ছিল তখনকার সভার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিতর্কসভায় পূর্বপক্ষ ও প্রতিপক্ষের দল পূর্বনির্দিষ্ট থাকাই রীতিসংগত। কিন্তু ডাফ সাহেব বলেছেন, তখনকার সভায় তা থাকত না। সভার পরিচালকরা বলতেন যে তাতে আলোচনা যান্ত্রিক ‘ফর্মাল’ আলোচনা হয়, কার কি বিশ্বাস ও ধারণা তা জানা যায় না, কেবল পরীক্ষার্থী ছাত্রদের মতো মৌখিক প্রবন্ধ—প্রতিযোগিতা হয়। সে রকম আলোচনায় এই জাতীয় সভা স্থাপনের আসল উদ্দেশ্যই অনেকটা ব্যর্থ হয়। সুতরাং এইসব সভায় কোনো পূর্বনির্দিষ্ট পূর্বপক্ষ ও প্রতিপক্ষ থাকতেন না। সকলে মিলিত হবার পর যখন সভার কাজ আরম্ভ হত, তখন স্বাধীনভাবে যাঁর যে পক্ষে ইচ্ছা আলোচনা করতে পারতন। তাতে হয়তো এক পক্ষেই পর পর ছ সাত জন বক্তা বলে গেলেন এমনও হত—

All were, therefore, left alike free in their choice; hence it not infrequently happened, that more than half-a-dozen followed in succession on the same side.

সভ্যবৃন্দের বলা শেষ হয়ে গেলে, উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে যদি কেউ ওই বিষয় সম্বন্ধে কিছু বলতে চাইতেন, তাঁকে তা বলবার সুযোগ দেওয়া হত। সমস্ত আলাপ—আলোচনার মধ্যে পরস্পরের মতামতের প্রতি এমন একটা সংযত শ্রদ্ধার ভাব প্রকাশ পেত, যা সত্যই প্রশংসনীয়। যাঁদের ধৈর্য সংযম শৃঙ্খলাবোধ ইত্যাদির অভাব সম্বন্ধে প্রাচীনদের অভিযোগের অন্ত ছিল না, তাঁরা যে সভা—সোসাইটিতে মিলিত হয়ে কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্ককালে এ রকম উদারতা ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতেন, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। বোঝা যায়, সমাজ—সংস্কারের নীতি বা পদ্ধতির দিক দিয়ে তাঁরা অধৈর্য অদূরদর্শিতা ও অসংযমের পরিচয় দিলেও, ব্যক্তিগত চরিত্রের বনিয়াদ তাঁদের দৃঢ় ছিল। তা না হলে, তাঁদের সভাসমিতির পরিচালনায় এই শৃঙ্খলাবোধের পরিচয় পাওয়া যেত না।

সভা—সোসাইটির বৈচিত্র্য

১৮৩০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে, এই সামাজিক আলোড়নের ফলে, কলকাতা শহরে অনেক সভাসমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের সংখ্যা ও বৈচিত্র্যের বিস্তৃত বিবরণ অনাবশ্যক। সমসাময়িক পত্রিকাগুলি তন্ন তন্ন করে খুঁজলে সভা—সমিতির সুদীর্ঘ একটি তালিকাও তৈরি করা যেতে পারে। সভা—স্থাপন করা যখন তরুণ বাংলার প্রায় বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন স্বল্পকালস্থায়ী সভাও অনেক গড়ে উঠেছিল। পত্রিকার পৃষ্ঠায় তাদের অনেকগুলির দু—এক লাইন ‘নোটিস’ ছাড়া আর কোনো পরিচয় কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তার মধ্যে কয়েকটি সভা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিল এবং কিছুকাল স্থায়ীও হয়েছিল। যেমন :

বঙ্গহিত সভা সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা

অ্যাংলো—ইন্ডিয়ান হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন জ্ঞানচন্দ্রোদয় সভা

জ্ঞানসন্দীপন সভা সোসাইটি ফর দি অ্যাকুইজিশন

 অফ্ জেনারেল নলেজ

ডিবেটিং ক্লাব তত্ত্ববোধিনী সভা

বঙ্গরঞ্জিনী সভা মেকানিক্স ইনস্টিটিউট

বিজ্ঞানদায়িনী সভা টিচার্স সোসাইটি

ডিরোজিওর অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন তরুণ ছাত্রমহলে সভাস্থাপনের প্রেরণা সঞ্চার করে। ১৮৩০ সালেই ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন’ স্থাপিত হয়। ৯ সেপ্টেম্বরের (১৮৩০) ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রে এই সভার যে বিবরণ প্রকাশিত হয়, তা থেকে জানা যায় যে তার কিছুদিন আগে এই সভার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সিমলায় রামমোহন রায়ের অ্যাংলো—হিন্দু স্কুলের ছাত্ররা, হিন্দুকলেজের ছাত্ররা এবং হেয়ার সাহেবের পটলডাঙা স্কুলের ছাত্ররা একসঙ্গে মিলিত হয়ে এই সভা স্থাপন করেন। রামমোহন রায় তখনো বিলাত যাত্রা করেননি, কলকাতাতেই ছিলেন। এই সভা—স্থাপনের ব্যাপারে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন কিনা বলা যায় না। সভার নির্দিষ্ট নিয়মাবলি দেখে মনে হয়, হয়তো তিনি পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সভায় কেবল নানাবিধ জ্ঞানবিজ্ঞান ও বিদ্যার চর্চা করার স্বাধীনতা ছিল, কিন্তু ধর্মবিষয়ে কোনোরকম আলোচনা করা নিষেধ ছিল। ডিরোজিওর অ্যাকাডেমির আলোচনায়, অথবা ডাফ হিল প্রভৃতি পাদরিদের ধর্মপ্রচারে তখন যে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল সমাজে, রামমোহন রায় তার প্রতি খুব যে প্রসন্ন ছিলেন তা মনে হয় না। তাই কেবল বিদ্যানুশীলনের উদ্দেশ্যে এই সভাস্থাপনে তাঁর খানিকটা সহানুভূতি ছিল বলে মনে হয়। প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বুধবারে এই সভার অধিবেশন হত।২৮ ‘জ্ঞানসন্দীপন সভা’ স্থাপিত হয় পাথুরিয়াঘাটার উমানন্দ ঠাকুরের বাড়িতে, ১৮৩০ সালে। এই সভারও নিয়ম ছিল, ধর্মবিষয়ে আলোচনা করা চলবে না, কেবল বিদ্যাবিষয়ে চলবে। এই সময় চোরাবাগানের লক্ষ্মীনারায়ণ দত্তের বাড়িতে ‘ডিবেটিং ক্লাব’ নামে এক সভা স্থাপিত হয়। ‘ইংলন্ডীয় বিদ্যা’ যাতে সভ্যবৃন্দের মধ্যে বিশেষরূপে বৃদ্ধি হয়, এই ছিল ক্লাবের উদ্দেশ্য। রামমোহন রায়ের সিমলার স্কুলে, ১৮৩২ সালের শেষ দিকে, ‘সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা’ স্থাপিত হয়। সভাস্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাভাষার বিশেষ অনুশীলন করা। অধিকাংশ সভাসমিতিতে শিক্ষিত যুবকরা তখন ইংরেজিতে বক্তৃতা ও আলোচনা করতেন। বাংলাভাষা অনেকটা উপেক্ষিত হত। তরুণ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের এই বিজাতীয় মনোভাব দূর করবার জন্য এই সভাটি স্থাপিত হয়। সভার সভাপতি ছিলেন রামমোহন রায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ রায় এবং সম্পাদক ছিলেন তাঁর সতীর্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।২৯

এ রকম আরও অনেক সভাসমিতি এই সময় স্থাপিত হয়। উদ্দেশ্য ও নিয়মকানুন সকলের যে এক ছিল তা নয়। তবে যার যে উদ্দেশ্য বা নিয়মই থাক না কেন, এই প্রয়োজন সকলেই সমানভাবে বোধ করতেন। সেটি হল বিদ্যানুশীলনের প্রয়োজন। এদিক থেকে বিচার করলে, এই সময়কার দুটি সভা আধুনিক যুগের বাংলার ইতিহাসে স্থায়ী আসন অধিকার করে আছে মনে হয়। একটি ‘Society for the Acquisition of General Knowledge’—বাংলার ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’ বলে পরিচিত, আর একটি তত্ত্ববোধিনী সভা’।

পাশ্চাত্য বিদ্বৎসভার প্রভাব

এদেশের বিদ্বৎসভা স্থাপনের মূলে যে পাশ্চাত্য সভা—সোসাইটির প্রেরণা ছিল অনেকটা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ‘ইয়ং বেঙ্গলে’র যুগে এই প্রেরণা আরও বেশি প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হয়েছে মনে হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যে ইংলন্ডে প্রচুর সোসাইটি ও অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠে। সেগুলির প্রধান লক্ষ্য ছিল, সাধারণ অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে নতুন জ্ঞান বিতরণ করা। এই সব সোসাইটির মধ্যে ‘মেকানিকস ইনস্টিটিউটে’র নাম করতে হয়। ইংলন্ডের অনেক জায়গায় এই ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া অন্যান্য যেসব সোসাইটি এই সময় স্থাপিত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—‘Society for the Propagation of Christian Knowledge’ (S.P.C.K.) ‘Society for the Diffusion of Useful Knowledge’ (S.P.V.K.), ‘Society for the Diffusion of Political Knowledge’ (S.D.P.K.)  ইত্যাদি। ইংলণ্ডের সামাজিক জীবনে প্রত্যেকটি সভা রীতিমতো প্রভাব বিস্তার করেছিল। আমাদের দেশে বিদ্বৎসভার ও অন্যান্য সভার নামকরণে পর্যন্ত পাশ্চাত্য সভার প্রভাব দেখা যায়। ‘মেকানিকস ইনস্টিটিউট’ এদেশেও স্থাপিত হয়েছিল। S.D.U.K. ও S.D.P.K.—র সঙ্গে এদেশের ‘Society for the Acquisition of General Knowledge’ (S.A.G.K.)-এর সাদৃশ্যও লক্ষণীয়। ‘Diffusion’ ও ‘Acquisition’—এর মধ্যে পার্থক্য অনেক। সে পার্থক্য ইংলন্ড ও বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থার পার্থক্যের সঙ্গে তুলনীয়। ইংলন্ডের কাছে তখন বড় প্রশ্ন ‘Diffusion’—এর, আমাদের দেশের বিদ্বৎসমাজের সমস্যা হল ‘Acquisition’—এর। কিন্তু উল্লেখযোগ্য এই যে, প্রায় একই সময়ে দুই দেশেই এই জাতীয় সভা সোসাইটি স্থাপিত হয়।*

সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা

‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’ স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রথমে কয়েকজন উদযোগী মিলে একটি ম্যানিফেস্টো ছাপিয়ে প্রচার করেন। প্রচারপত্রে পাঁচজনের স্বাক্ষর ছিল দেখা যায়—তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, তারাচাঁদ চক্রবর্তী ও রাজকৃষ্ণ দে। ১৮৪০—৪২ সালে প্রকাশিত সভার ‘ট্র্যানজ্যাকশন’—এর গোড়ায় প্রচারপত্রটি সম্পূর্ণ মুদ্রিত হয়। ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে নয় শুধু, অন্যান্য দিক থেকেও এই প্রচারপত্রটি খুব মূল্যবান।*

প্রচারপত্রের মধ্যে কয়েকটি বিষয় লক্ষ করা যায়। প্রথমত, ১৮৩৮ সালে স্বাক্ষরকারীরা যখনই এই সভা—স্থাপনের উদ্দেশ্যে পত্রটি প্রচার করেন তখন, তাঁরা বলেছেন, সুপরিচিত একটিও বিতর্কসভা বা বিদ্বৎসভা ছিল না। যা দু—একটি ছিল, তাও তখন প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, ডাফ সাহেবের কলকাতায় আসার পর, বিশেষ করে ডিরোজিওর মৃত্যুর পর, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তার আগেই হয়তো তার কার্যকলাপ ঝিমিয়ে পড়েছিল। তারপরে আর কোনো ভালো বিদ্বৎসভা গড়ে ওঠেনি। তার কারণ, সামাজিক অবস্থার অতিদ্রুত পট—পরিবর্তন। বাইরের সামাজিক অবস্থায় দ্রুত পরিবর্তনের ফলে যখন চারিদিকে তীব্র কোলাহলের সৃষ্টি হয়, তা যত সীমাবদ্ধ স্তরে হোক, তখন বিদ্বৎজনেরাও অব্যবস্থিতচিত্ত হয়ে থাকেন। ছোট ছোট বৈঠকী দল তখন অনেক গজিয়ে উঠলেও বেশ বড় কোনো স্থায়ী বিদ্বৎসভা স্থাপনের সুযোগ হয় না। ১৮৩০—৩১ সালে বাংলাদেশে ঠিক এই অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছিল। ডাফ সাহেব এই সময়ে যে ধরনের সভার প্রাচুর্যের কথা বলেছেন, তার অধিকাংশই ছোট ছোট বৈঠকী সভা, বড় কোনো বিদ্বৎসভা নয়। পাঁচ—ছ বছরের মধ্যে অবস্থা অনেকটা শান্ত হবার পর, সকলে মিলিত হয়ে বেশ বড় স্থায়ী বিদ্বৎসভা স্থাপনের প্রয়োজন অনুভব করেন। ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’, ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ ইত্যাদি তখন প্রতিষ্ঠিত হয়। তার আগে হয়নি, কারণ হবার মতো অনুকূল পরিবেশ ছিল না।

প্রচারপত্রের দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয় হল, সুস্থির বিদ্যাচর্চা ও গভীর জ্ঞানার্জনের সংকল্প। উদ্যমীদের মধ্যে অনেকে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। প্রতিভার উন্মেষপর্বে তখন তাঁদের বিদ্যালোচনায় চপলতা ও তরলতার ভাগ ছিল বেশি। আট—নয় বছরের মধ্যে তাঁদেরও অনেক মানসিক পরিবর্তন হয়েছে, বিচারবুদ্ধি পরিণত হয়েছে, দৃষ্টিও গভীর হয়েছে। এখন আর তাঁরা বিদ্বৎসভায় চাপল্যের বা তারল্যের পরিচয় দিতে চান না। ভাসা—ভাসা জ্ঞানে আর তাঁরা সন্তুষ্ট নন। প্রত্যেক বিষয়ের গভীরে তাঁরা প্রবেশ করতে চান। প্রকাশ্যে এ কথা প্রচারপত্রে তাঁরা ঘোষণা করেছেন। শুধু তাই নয়, আত্মসংযম ও শৃঙ্খলাবোধ সম্বন্ধেও তাঁরা অনেক বেশি সচেতন হয়েছেন। যদি কোনো সভ্য তাঁর পূর্বনির্দিষ্ট দিনে সভায় যোগদান না করেন এবং তাঁর প্রতিশ্রুত বক্তৃতাটি না দেন বা রচনাটি না পাঠ করেন, তাহলে সভার সম্মতিক্রমে তাঁকে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা যেতে পারে। বিদ্বৎসভার এ রকম কঠোর বিধান বিস্ময়কর মনে হয়। কিন্তু প্রথম পর্বের অতিরিক্ত উচ্ছৃঙ্খলতার কথা ভাবলে, পরবর্তীকালের এই কঠোর শৃঙ্খলার ইঙ্গিত অনেকটা স্বাভাবিকও বলা যেতে পারে।

তৃতীয় লক্ষণীয় বিষয় হল—কেবল পাশ্চাত্য বা সাধারণ বিদ্যাচর্চার মধ্যে তারা আর সীমাবদ্ধ থাকতে চান না। স্থানীয় বিষয় নিয়েও (‘‘matters of local interest’’) তাঁরা পড়াশুনা ও আলোচনা করতে চান, কেবল বিদেশের নয়, নিজের দেশেরও। জ্ঞানোপার্জিকা সভায় এ দেশের পুরাণ ইতিহাস ভূগোল ইত্যাদি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। ১৮২৮—২৯ থেকে ১৮৩৮—৩৯ সাল, মাত্র এই দশ বছরের মধ্যে এদেশীয় বিদ্বৎসভায় যে দেশে খানিকটা আদর্শগত পরিবর্তন হয়েছিল, জ্ঞানোপার্জিকা সভার ‘ম্যানিফেস্টো’ তার ঐতিহাসিক প্রমাণ।

১৮৩৮ সালে এই সভা স্থাপিত হয়। সভার সভাপতি ছিলেন তারাচাঁদ চক্রবর্তী, সহকারী সভাপতি রামগোপাল ঘোষ ও কালাচাঁদ শেঠ, সম্পাদক রামতনু লাহিড়ী ও প্যারীচাঁদ মিত্র, পরিচালকমণ্ডলীতে ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিকলাল সেন, মাধব মল্লিক প্রভৃতি। সাধারণ সভ্যরূপে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই সভার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সভায় সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করবার অধিকার ছিল সকলের, বিশেষ বিষয়ে কোনো নিষেধ ছিল না। সাহিত্য বিজ্ঞান ইতিহাস ভূগোল রাজনীতি অর্থনীতি সমাজবিজ্ঞান দর্শন, সব বিষয় নিয়ে এই সভায় নিয়মিত আলোচনা হত। সাধারণত সংস্কৃতকলেজেই সভার মাসিক অধিবেশন হত বলে মনে হয়। বাংলার নবীন বিদ্বৎসমাজের প্রায় সকলেই এই সভার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ইংরেজদের মধ্যেও অনেকে এই সভার অধিবেশনে যোগদান করতেন। সেই সময় যতগুলি বিদ্বৎসভা স্থাপিত হয়েছিল, তার মধ্যে এই সভাটিকে বিদেশিরাও একবাক্যে প্রশংসা করে গেছেন। কিন্তু কোনোদিক থেকেই এই সভা বিদেশিদের মুখাপেক্ষী ছিল না। বরং সভার অধিবেশনে মধ্যে মধ্যে যেভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় আলোচনা হত, তাতে কলকাতার ইংরেজসমাজ সভার প্রতি খুব প্রীত ছিলেন না। তবু আদর্শ বিদ্বৎসভার সমস্ত গুণ এই সভার ছিল বলেই তাঁরা প্রশংসা না করে পারেননি। কলকাতার তদানীন্তন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট জর্জ জনসন লিখেছেন : ‘‘One of the most meritorious of the native association is the Society for the Acquisition of General Knowledge.’’৩০

এই সভার Transactions ও Proceedings-ও মধ্যে মধ্যে প্রকাশিত হত। অন্তত তিন খণ্ড Transactions প্রকাশিত হয়েছিল বলে মনে হয়, কারণ ১৮৪৩ সালের ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রের একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায়—‘‘3rd Volume of the transactions of the Society for the Acquisition of General Knowledge, shortly to be published and all volumes to be had of Messrs. P.S.D.’ Rozaroi & Co.’’৩১

এই মুদ্রিত বিবরণীগুলি থেকে সভার আলোচ্য বিষয়, আলোচনার স্ট্যান্ডার্ড ও অন্যান্য কার্যকলাপ সম্বন্ধে অনেক মূল্যবান কথা জানা যায়। ‘জ্ঞানান্বেষণ’ থেকে উদ্ধৃত ”সমাচার দর্পণের” একটি বিবরণে দেখা যায়, প্রথম বর্ষের একটি অধিবেশনে (১৬ মে, ১৮৩৮) কৃষ্ণমোহন পুরাণপাঠের সার্থকতা সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন এবং সেদিন ”অতিশয় দুর্যোগ ও মেঘগর্জন হওয়াতে ঐ পাদরিবাবুর বক্তৃতা শ্রবণে শতাধিক মনুষ্য আগমন করিয়াছিলেন।”৩২ সভার কার্যকলাপ পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য পরিচালকরা বিশেষ উৎসুক ছিলন না। ১৮৪৩ সালে ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রে সভার যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রকাশিত হয়, তাতে প্রথমেই এই কথা তাঁরা উল্লেখ করেছেন : ‘‘Although this Society has existed for several years, its members are so modest and have so studiously resisted publicity as to be hardly known that the Society does exist.’’৩৩ হরকরাপত্রের এই বিবরণ থেকে আরও জানা যায় যে, সভ্যরা নিজেদের খুশি ও সামর্থ্য অনুযায়ী, যে—কোনো বিষয় নিয়ে স্বাধীনভাবে আলোচনা করতেন এবং কেবল ইংরেজিভাষার মাধ্যমে নয়, বাংলাভাষাতেও তাঁরা প্রবন্ধ রচনা করে পাঠ করতে পারতেন। ১৮৪৩ সালে সভার সভ্যসংখ্যা ছিল প্রায় ২০০ জন। এই সভ্যসংখ্যা থেকে ‘জ্ঞানোপার্জিকা সভার’ ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্বন্ধে ধারণা করা যায়।

নব্যবঙ্গের মুখপাত্ররা সকলেই প্রায় এই সভার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। প্রত্যেক বিষয় নিয়ে তাঁরা সভায় আলোচনা করতেন, এবং কেবল দর্শন বিজ্ঞান সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হত না, রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও আলোচনা হত। আলোচনাকালে ব্রিটিশ নীতির সমালোচনাও তাঁরা মধ্যে মধ্যে নম্রভাবে করতেন। একবার একটি অধিবেশনে এইরকম আলোচনার সময় খুব গন্ডগোল হয়। এই অধিবেশনের বিস্তৃত বিবরণ ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রে প্রকাশিত হয়।৩৪ সংক্ষেপে ঘটনাটি উল্লেখ করছি।

১৮৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংস্কৃতকলেজে সভার একটি অধিবেশন হয়। সভার সভাপতি তারাচাঁদ চক্রবর্তী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন ও আর একজন ইংরেজ দর্শক সভায় উপস্থিত ছিলেন। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ছিলেন বক্তা এবং বক্তব্য বিষয় ছিল : ‘‘On the present State of the East Indian Company’s Criminal Judicature, and Police, under the Bengal Presidency’’ বক্তৃতা—প্রসঙ্গে দক্ষিণারঞ্জন কোম্পানির কর্মচারীদের ক্ষমতার অপব্যবহার, পুলিশের অসাধুতা ও অকর্মণ্যতা এবং ব্রিটিশের এদেশে আসার অভিসন্ধি সম্বন্ধে জোরালো ভাষায় মন্তব্য করেন। মন্তব্য শুনে রিচার্ডসন সাহেব ক্রুদ্ধ হয়ে বক্তৃতার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলেন :

To stand up in a hall which the government had erected and in the heart of the city which was the focus of enlightenment, and there to denounce, as oppressors and robbers, the men who governed the country, did in his opinion, amount to treason… The College would never have been in existence, but for the solicitude the Government felt in the mental improvement of the natives of India. He could not permit it, therefore, to be converted into a den of treason, and must close the doors against all such meetings.

রিচার্ডসনের এই অসৌজন্য—প্রকাশে বিচলিত হয়ে, সভাপতি তারাচাঁদ চক্রবর্তী (হিন্দুকলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র) চেয়ার ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ান এবং বলেন :

Captain Richardson, with due respect I beg to say that I cannot allow you to preceed any longer in this course of conduct towards our Society, and on behalf of my friend Baboo Dukhin. I must say that your remarks are anything but becoming. I am bound also to add that I consider your conduct as an insult to the society and that if you do not retract what you have said and make due apology, we shall represent the matter to the Committee of the Hindoo College, and if necessary to the Government itself. We have obtained the use of this public hall, by leave applied for and received from the Committee, and not through your personal favour. You are only a visitor on this occasion, and possess no right to interrupt a member of this society in the utterance of his opinions. I hope that Captain Richardson will see the propriety of offering an apology to my friend, the writer of the essay any to the meeting.

এর পর দক্ষিণারঞ্জন তাঁর প্রবন্ধটি পাঠ করেন। রিচার্ডসন পরে অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করে তার মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চান। জ্ঞানোপার্জিকা সভা যে কেবল এদেশে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারে সাহায্য করেছিল তা নয়, বাঙালি শিক্ষিতসমাজে স্বাদেশিকতাবোধও প্রথম জাগিয়েছিল। দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে জর্জ টমসন এদেশে আসার পর, এই সভার সভ্যবৃন্দের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও আলাপ—আলোচনা হয়।* তাঁরই উদযোগে সভার সভ্যবৃন্দ ১৮৪৩ সালে Bengal British India Society স্থাপন করেন। এই জ্ঞানোপার্জিকা সভার সভ্যদের মধ্যেই অনেকে তত্ত্ববোধিনী সভা’র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। গোড়া থেকেই তত্ত্ববোধিনী সভার সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা

বাংলা ভাষায় সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের অনুশীলন ও আলোচনার জন্য বিদ্যালয়ের ছাত্ররা, উনিশ শতকের প্রথম পাদে, খানিকটা তৎপর হন। এই তৎপরতা ও উৎসাহ তিরিশের দশক থেকে প্রকাশ পেতে থাকে। ১৮৩২ সালের ৩০ ডিসেম্বর রামমোহন রায়ের অ্যাংলো—হিন্দু স্কুলে ‘সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা’ স্থাপিত হয়। সভা প্রতিষ্ঠায় যাঁরা উদযোগী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (তখন হিন্দু কলেজের ছাত্র, রামমোহনের স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র) এবং রমাপ্রসাদ রায় (রামমোহনের কনিষ্ঠ পুত্র)। এই সভাটিকে পুরোপুরি ছাত্রদের একটি বিদ্বৎসভা বলা যায়। সভার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রমাপ্রসাদ রায় (তখন হিন্দু কলেজের ছাত্র) সভাপতিত্ব করেন।

অনুষ্ঠানে একজন ছাত্রবক্তা বলেন : ”এই মহানগরে বঙ্গভাষার আলোচনার্থ আমরা এক সভা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম ইহাতে আমাদের অনুমান হয় যে এই সভার প্রভাবে মঙ্গল হইবেক।” বাংলা ভাষাতেই সভার সমস্ত কাজকর্ম সম্পন্ন হবে এ বিষয়ে সকলে সম্মত হন। কিন্তু এই সভার পরবর্তী কার্যকলাপের কোনো বিস্তারিত বিবরণ বিশেষ পাওয়া যায় না।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা

এই সভা ঠিক কোন সময় স্থাপিত হয় সঠিক জানা যায় না। মনে হয় ১৮৩৫ সালে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সরকারি নীতি ঘোষিত হবার পরে এই সভা স্থাপিত হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলন ও উন্নতি সাধন করা ছিল এই সভার উদ্দেশ্য। সভার সভাপতি ছিলেন পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ, যিনি পরে ‘সম্বাদ ভাস্কর’ পত্রিকার সম্পাদক ও পরিচালক হন। সভার সম্পাদক ছিলেন পণ্ডিত দুর্গাপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদক), হরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (‘সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়’ পত্রিকার সম্পাদক), প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামলোচন ঘোষ, কালীনাথ রায়, প্যারীমোহন বসু প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সাহিত্যিকরা এই সভার সদস্য ছিলেন।

১৮৩৬ সালের ৮ ডিসেম্বর সভার একটি অধিবেশনের সংবাদ পাওয়া যায়। সভায় যখন ‘দুঃখ থেকে সুখ অথবা সুখ থেকে দুঃখের উৎপত্তি’—এই বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব হয়, তখন রামলোচন ঘোষ এই বলে আপত্তি করেন যে এই প্রসঙ্গ আলোচনাকালে ধর্মপ্রসঙ্গ উঠবে এবং ‘ধর্ম’ যেহেতু এই সভার আলোচনার নিয়মবহির্ভূত বিষয় সুতরাং এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে না। পরে তিনি বলেন, ”নীতি এবং রাজকার্য্যাদি সংক্রান্ত বিষয় যাহাতে আমারদিগের ইষ্টানিষ্টের সম্পর্ক আছে তাহা বিবেচনা করিলে দেশের অনেক উপকার হইবে।” এই প্রস্তাব সভায় সকলের সম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সভার অন্যতম সদস্য কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এ বিষয়ে তাঁর ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় (২ মার্চ, ১৮৫২) লেখেন :

”রাজকীয় বিষয়ের বিবেচনার জন্য অপর যে একটা সভা হইয়াছিল তন্মধ্যে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে প্রথমা বলিতে হইবেক, ঐ সভায় মহাত্মা রায়, কালীনাথ চৌধুরী, বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর, মুন্সি আমীর প্রভৃতি অনেক ব্যক্তিরা রাজকীয় বিষয়ের বিবেচনা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, নিষ্কর ভূমির কর গ্রহণ বিষয়ক প্রস্তাবের অতি সুচারু বিচার হয়, জিলা নদীয়ার বর্ত্তমান প্রধান সদর আমীন শ্রীযুত রায় রামলোচন ঘোষ বাহাদুর গবর্ণমেণ্টের পক্ষ হইয়া অনেক প্রকার বিতর্ক উপস্থিত করিলে মহাশয়ের প্রভাকর পত্রে তাহার সুচারু বিচার হইয়াছিল ঐ সময়ে সম্বাদ ভাস্কর পত্রের জন্মগ্রহণও হয় নাই। কিন্তু কেবল একতার অভাবে ঐ সভার উচ্ছেদ হইয়াছে, রায় কালীনাথ চৌধুরী প্রভৃতি মহাশয়েরা ব্রহ্মসভা পক্ষে থাকাতে ধর্ম্মসভার লোকেরা তাহাতে সংযুক্ত হয়েন নাই, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার পতন কারণ স্মরণ হইলে আমারদিগের অন্তরে কেবল আক্ষেপ তরঙ্গ বৃদ্ধি হয়।”

তত্ত্ববোধিনী সভা

‘জ্ঞানোপার্জিকা সভা’ প্রতিষ্ঠার বছর দেড়েকের মধ্যে ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ দ্বারকানাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮৩৯, ৬ অক্টোবর)। প্রথমে নাম ছিল ‘তত্ত্বরঞ্জিনী সভা’, পরে পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের পরামর্শে ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ নাম হয়।৩৫ সভার প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেবেন্দ্রনাথের ভাষায়, এই সভার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল : ”আমাদিগের সমুদায় শাস্ত্রের নিগূঢ় তত্ত্ব ও বেদান্ত প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার”। কিন্তু কেবল ধর্ম—প্রচারের দিক থেকে বিচার করলে তত্ত্ববোধিনী সভার প্রতি কিছুটা অবিচার করা হবে। ধর্মপ্রচারের দিক থেকেও পূর্বেকার সনাতনপন্থীদের ‘ধর্মসভা’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’র মধ্যে মূলগত পার্থক্য ছিল। ১৮৩০ সাল থেকে বাংলার সামাজিক জীবনে যে পরিবর্তন হতে থাকে, ইংরেজিশিক্ষিত বাঙালির নৈতিক জীবনে যে ভাঙন ধরে, রামমোহন রায় জীবিত থাকলে হয়তো তার অসংযত উদ্দামতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার দিকটাকে কিছুটা সংযত করার চেষ্টা করতেন। যে সমস্যা সবচেয়ে ভয়াবহরূপে প্রকট হয়ে উঠলো, তা হল কৃষ্ণমোহনের মতো বাংলার প্রতিভাবান যুবকদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাগ্রহণের সমস্যা। তখন বৈদান্তিক ব্রহ্মবিদ্যা প্রচারের জন্য তত্ত্ববোধিনী সভা’র মতো নতুন কোনো সভা স্থাপনের কথা রামমোহনও ভাবতে বাধ্য হতেন। তাঁর অভাবে, তাঁর উত্তরাধিকারী দেবেন্দ্রনাথ গুরুর অসমাপ্ত কর্তব্য সাধনের পথে অগ্রসর হন। এ ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হল, ডাফ হিল প্রমুখ পাদরিদের ইংরেজশিক্ষিত বাঙালিসমাজে খ্রিস্টানধর্মের প্রচারের অবাধ অগ্রগতির পথ প্রতিরোধ করা। ধর্মসভার মতো ‘গুড়ুম সভা’ স্থাপন করে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এই দিক দিয়ে, ধর্মের ক্ষেত্রেও তত্ত্ববোধিনী সভা সেই সময় বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।

শুধু ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে নয়, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সভার দান সমসাময়িক যে—কোনো বিদ্বৎসভার তুলনায় বেশি ছাড়া কম নয়। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন :৩৬

The Tattwabodhini Sabha  used to hold weekly and monthly meetings. Papers were read and discussed at the weekly meetings and divine service used to be hold once a month. The Sabha  commenced it career with only ten young men as its members. But so great were the energy and enthusiasm with which its proceedings were conducted that the the course of two years the number of members rose to 500…

আরও কয়েক বছরের মধ্যে তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্যসংখ্যা প্রায় আটশত পর্যন্ত হয়। ইংরেজশিক্ষিত বাঙালি বিদ্বৎসমাজের অধিকাংশই তখন এই সভার সভ্য হন। সভার মুখপত্র ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ সাহিত্য ইতিহাস রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি ধর্ম দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত আলোচনার প্রবর্তন করে বাংলা সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে নতুন পথ প্রদর্শন করে। অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতো পুরুষদের সাহিত্যক্ষেত্রে অভ্যুদয় হয় এই পত্রিকার পৃষ্ঠায়।

কয়েক বছরের মধ্যে তত্ত্ববোধিনী সভার দ্রুত প্রসার ও উন্নতি হয়। এ সম্পর্কে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ লেখেন (১৭৬৭ শকাব্দ) :৩৭

তত্ত্ববোধিনী সভার জন্মাবস্থার সহিত বর্ত্তমান অবস্থার তুলনা দ্বারা তাহার উন্নতি আলোচনা করিলে অবশ্য অত্যন্ত আহ্লাদে মগ্ন হইতে হয়। প্রথম কালে দশজন মাত্র সভ্য দ্বারা উহার সংস্থাপন হয়। এইক্ষণে পাঁচশত অপেক্ষা অধিক সভ্য উৎসাহের সহিত ইহাকে আশ্রয় দিতেছেন; তৎকালে মাসে দশমুদ্রা একত্র হওয়া দুষ্কর ছিল। এইক্ষণে প্রতি মাসে প্রায় চারিশত টাকা সংগৃহীত হইতেছে এবং আয় ক্রমশ বৃদ্ধি হইতেছে; তৎকালে সভার অভিপ্রেত ব্রহ্মোপাসনার প্রচারের জন্য প্রধান প্রধান সমুদায় উপায়ের অভাব ছিল, এইক্ষণে তজ্জন্য জ্ঞানজনক নানা বিষয়ে পরিপূর্ণ এই পত্রিকা মাসে মাসে প্রকাশ হইতেছে….প্রথমতঃ কলিকাতা নগরে শ্রীযুক্ত দ্বারকানাথ ঠাকুর মহাশয়ের বাটীতে ১৭৬১ শকের ২১শে আশ্বিন দিবসে এই সভা প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং কিয়দ্দিবস তৎকালের যৎকিঞ্চিৎ কর্ম্ম সেই স্থানেই সুসম্পন্ন হইয়াছিল। পরন্তু কার্যের কিঞ্চিৎ বাহুল্য দ্বারা স্থানের সঙ্কীর্ণতা প্রযুক্ত সভার কার্য্যালয় ১৭৬২ শকের অগ্রহায়ণ মাসে ষষ্টিমুদ্রা মাসিক বেতনে কলিকাতার শিমুলিয়াস্থিত শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের গৃহে পরিচালিত হয়। সেখানে তৎকালে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার কর্ম্ম এবং সভার অন্যান্য তাবৎ কার্য্য একত্র নির্ব্বাহ হইত। তদনন্তর তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা কলিকাতা হইতে বংশবাটী গ্রামে অন্তর হইবার নিশ্চয় হওয়াতে পাঠশালার ব্যয় এবং সেই বৃহৎ বাটীর বেতন একত্রে নির্ব্বাহ করিতে অসমর্থ প্রযুক্ত সে বাটী পরিত্যাগ করিয়া অধ্যক্ষেরা সভার ক্ষুদ্র কার্য্যালয় ১৭৬৪ শকের অগ্রহায়ণ মাসে কলিকাতার জোড়াসাঁকোস্থিত ব্রাহ্মসমাজের গৃহে স্থাপন করিলেন। পরন্তু অল্প দিবস পরেই সভার অবস্থা সুন্দররূপে পরিবর্ত্তন হইল, সভ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি হইল, মুদ্রাযন্ত্র স্থাপনের কল্পনা হইল, বহু কর্ম্মচারী অবশ্যক হইল; সুতরাং ক্ষুদ্র ব্রাহ্মসমাজ গৃহের এক ক্ষুদ্রাংশ দীর্ঘ প্রস্ত পঞ্চ হস্ত স্থানে এই সমুদয় ব্যাপার সম্পোষ্য হইবার আর কি সম্ভাবনা থাকিল? অতএব ১৭৬৫ শকের আষাঢ় মাসে সেখানে হইতে হেদুয়া পুষ্করিণীর দক্ষিণ অঞ্চলে এক প্রশস্ত গৃহে সভার কার্য্যালয় আনীত হইল।৩৮

সভার কাজকর্মের ক্রমিক প্রসারের ফলে স্থানসংকট দেখা দেয়। স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়ালে সভার কাজ সুসম্পাদন করা সম্ভব হয় না। তাই সভ্যদের কাছে এককালীন দানের জন্য পত্রিকা মারফত আবেদন করা হয়, যাতে সভায় একটি নিজস্ব গৃহ নির্মাণ করা যায়—

মাসিক দান নহে, বার্ষিক দানও নহে, চিরকালের নিমিত্তে একবার মাত্র কিঞ্চিৎ দান করিলে যখন এরূপ মহোপকার হয়, তখন তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্য হইয়া কি তাহাতে কুণ্ঠিত হইতে পারেন? তত্ত্ববোধিনী সভার অতি দরিদ্র সভ্যও যিনি তিনি আপনার ভরণপোষণের দৈনিক ব্যয়কে সংক্ষেপ করিয়াও ইহার আনুকূল্য করিতে কি কৃপণ হইতে পারেন?

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মধ্যে তত্ত্ববোধিনী সভার মতো আর কোনো সভা বাংলার বিদ্বৎসমাজে এত ব্যাপকভাবে বিস্তার করতে পারেনি। তার প্রধান কারণ, অ্যাকাডেমিক এসোসিয়েশন, এমনকী সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভার যেটুকু ত্রুটি ছিল, তত্ত্ববোধিনী সভা সেই ত্রুটিটুকু পূরণ করে দিয়েছিল। সেই ত্রুটি হল, দেশীয় সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্য (?) ঐতিহ্যের উপর পাদপ্রতিষ্ঠার অভাব। পাশ্চাত্য বিদ্যাকে সাদর অভিনন্দন জানিয়েও, তত্ত্ববোধিনী সভা দেশীয় ঐতিহ্যের যা কিছু মহান তাকে অস্বীকার করেনি। কোনো সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সংকীর্ণতা তার বিশেষ ছিল না। ধর্মের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে যে—কোনো স্থায়ী সংস্কার কিছু করা যায় না, অথচ তার কালসঞ্চিত কুসংস্কারগুলোকে ছেঁটে ফেলে দিয়ে যে মুক্ত মনের অঙ্গনে তাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, এ সত্য কেউ কেউ কিছুটা উপলব্ধি করেছিলেন। পরবর্তীকালে নোঙরহীন আদর্শবাদীদের দিগভ্রান্তির মধ্যে তত্ত্ববোধিনী সভা এই দিক—নির্ণয়ে খানিকটা সাহায্য করেছিল। পূর্বেকার সমস্ত প্রগতিশীল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সভার যা কিছু ভালো তার অনেকটা গ্রহণ করে এবং যা কিছু মন্দ তার অনেকটা বর্জন করে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্থের শেষদিক থেকে তত্ত্ববোধিনী সভা নবযুগের বাংলার বিদ্বৎসমাজকে একটা আদর্শসমন্বয়ের পথের সন্ধান করতে প্রেরণা দিয়েছিল। তারপর থেকে সভা—সমিতির ইতিহাসের এক নতুন পর্বের সূচনা হল।

বিদ্বৎসভার তৃতীয় যুগটিকে বাংলাদেশে ‘বিদ্যাসাগরের যুগ’ বলা যায়। এই যুগটি ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদ জুড়ে (১৮৫০—৭৫) বিস্তৃত। এই যুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সর্বাধিক প্রভাবশালী নেতা হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলার বিদ্বৎসভার ক্ষেত্র এই সময় আরও প্রসারিত হল। তার কারণ, শিক্ষিত বাঙালি বিদ্বৎজনের সংখ্যা এই সময়ের মধ্যে অনেক বাড়ল। বিদ্বৎসভায় মিলিত হয়ে, সমাজ শিক্ষা ও সংস্কৃতির নানা সমস্যা নিয়ে আলাপ—আলোচনা করবার জন্য তাঁরা অনেক বেশি উৎসাহী হলেন। পাশ্চাত্ত্য ভাবধারারও দ্রুত আমদানি হতে থাকল। ইংরেজ ও শিক্ষিত বাঙালি, উভয়েরই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হল। শতাব্দীর প্রথমার্ধের ঘাত—প্রতিঘাতের পর, উচ্ছ্বাসের আবেগাতিশয্য প্রশমিত হয়ে, সামাজিক জীবনে সবেমাত্র সমীকরণপর্বের সূচনা হল বলা চলে। তৃতীয় যুগের বিদ্বৎসভাগুলি এই সমীকরণ ও আত্মীকরণের পথ কিছুটা প্রস্তুত করে দিল।

সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে, এর মধ্যে, বিদ্বৎসভার প্রকৃতিরও পরিবর্তন হল। প্রথম যুগের ‘আত্মীয় সভা’, ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ ছিল কতকটা ঘরোয়া বৈঠকের মতো। দ্বিতীয় যুগের ‘সোসাইটি ফর দি অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজ’ বা ‘তত্ত্ববোধিনী—সভা’ আর ঘরোয়া বৈঠক ঠিক রইল না, তার কর্মক্ষেত্র কিছুটা বিস্তৃত হল। সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা দীর্ঘকাল স্থায়ী না হলেও, ইয়ং বেঙ্গলের যুগে জ্ঞানবিদ্যার প্রেরণার ক্ষেত্রে, জ্ঞানান্বেষণের ক্ষেত্রে, তার দান স্মরণীয়। তত্ত্ববোধিনী সভার কাজ বিদ্যাসাগরযুগে আরও বাড়ল। বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজেও তার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট হলেন। কিন্তু নতুন যেসব বিদ্বৎসভা তৃতীয় যুগে প্রতিষ্ঠিত হল, তার স্বরূপই অনেকটা বদলে গেল। সমাজ—জীবনের গতিধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জনে জ্ঞানতপস্যা করলে, বিদ্বৎসভা যে প্রাণহীন স্কলাষ্টিক অ্যাকাডেমিতে পরিণত হয়, এবং শেষপর্যন্ত দেশের বিদ্বৎজনের বৃহদংশের সঙ্গে তার কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্কও থাকে না, এ দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে বিরল নয়। উনিশ শতকে বাংলাদেশে যেসব বিদ্বৎসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার অধিকাংশই সংকীর্ণ গোষ্ঠীবদ্ধ অ্যাকাডেমিতে পরিণত হয়েছিল। প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয়, প্রত্যেক যুগের বিদ্বৎসভার ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। সেগুলি দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, এ দেশের বিদ্বৎসমাজ প্রধানত এই সব সভার ভিতর দিয়ে আত্মমর্যাদা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন এবং নিজেদের জ্ঞানবিদ্যাকে সমাজ ও দেশের একটা সীমাবদ্ধ স্তরে মানসিক কর্ষণের কাজে নিয়োগ করবার সুযোগ পেয়েছিলেন।

ছোট ছোট সভাসমিতি আলোচনাচক্র এই সময় অনেক বেশি গড়ে উঠেছিল। সমাজ—জীবনে তাদের প্রভাব উপেক্ষণীয় নয়। সামান্য হলেও যে কয়েকটি বিদ্বৎসভা, ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদে, শিক্ষিত বাঙালিরা জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল, তার মধ্যে প্রধান এইগুলি—

বঙ্গ ভাষানুবাদক সমাজ (১৮৫০)

বেথুন সোসাইটি (১৮৫১)

বিদ্যোৎসাহিনী সভা (১৮৫৩)

সুহৃদ্ সমিতি (১৮৫৪)

ফ্যামিলি লিটারারি ক্লাব (১৮৫৭)

বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভা (১৮৬৭)

এ ছাড়া, পূর্বে স্থাপিত হলেও, ‘তত্ত্ববোধিনী সভার’ প্রতিপত্তি এই সময় বেতন ক্ষুণ্ণ হয়নি। বাংলার বিশিষ্ট বিদ্বৎজনেরা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে সাহিত্য শিক্ষা ও সমাজ জীবনকে তাঁদের আকাঙ্ক্ষিত পথে পরিচালিত করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।

বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ

এই বিদ্বৎসভা স্থাপিত হয় ১৮৫০ সালে ডিসেম্বর মাসে। ১৪ ও ২৮ ডিসেম্বর (১৮৫০) ‘সত্যপ্রদীপ’ পত্রিকায় এই সভা স্থাপনের বিবরণ অনুষ্ঠানপত্রাদিসহ প্রকাশিত হয়। অনুষ্ঠানপত্রে এই সভার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে বলা হয় :

”ট্রাস্ট সোসাইটি কিম্বা খৃষ্টান নলেজ সোসাইটি কি স্কুল বুক সোসাইটি অথবা আসিয়াটিক সোসাইটি চতুষ্টয় সভার সাহেবরা সভার নিয়মমতে সর্বসাধারণের পাঠ্য উত্তম যে সকল পুস্তক প্রকাশ করিতে পারেন না তাহা উক্ত কমিটির সাহেবেরা প্রকাশ করিবেন।”

এখানে ‘সাহেবেরা’ কথাটি লক্ষণীয়। এই উক্তির কারণ হল, সভার প্রথম চোদ্দোজন সদস্যের মধ্যে এগার জন ছিলেন ইংরেজ, বাকি তিনজন ছিলেন বাঙালি—দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রসময় দত্ত এবং উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। সাহেবদের মধ্যে ছিলেন বেথুন, হজসন প্রাট, মেরিডিথ টাউনশেন্ড, মার্শম্যান, সিটন—কার, হেনরি উডরো প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিরা। কিন্তু সভার ঘোষিত উদ্দেশ্য যে কতদূর সফল করতে পারে না পারে তা সভার এই সাংগঠনিক রূপ দেখেই অনেকটা বোঝা যায়।

সভার কার্যকলাপের মধ্যে প্রধান হল বিলাতের পেনি ম্যাগাজিনের আদর্শে, রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদনায়, ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ বাংলা মাসিক পত্র প্রকাশ (অক্টোবর ১৮৫১)। এরপর ‘বিবিধার্থে’র প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেলে, (১৮৬১), ১৮৬৩ সালের রাজেন্দ্রলালের সম্পাদনাতেই ‘রহস্য সন্দর্ভ’ নামে ‘বিবিধার্থের’ অনুরূপ আর একখানি সচিত্র বাংলা মাসিকপত্র প্রকাশিত হয়।

বাংলা ভাষায় সাধারণের জ্ঞানের জন্য বই প্রকাশের যে পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য সভার ছিল তা অনেকটাই ব্যর্থ হয়। এ বিষয়ে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লেখেন (২৭ চৈত্র ১২৬৬ সন) :

ভদ্রলোকের ও বালকবালিকাদের পাঠোপযোগী সুপ্রণালীসিদ্ধ গ্রন্থ প্রচারই বঙ্গভাষানুবাদক সমাজের প্রধান উদ্দেশ্য। যদি এরূপ উদ্দেশ্যই হয় তবে সামাজিকদের এতদ্বিষয়ে গুটিকত উপদেশ লওয়া কর্ত্তব্য। সমাজ সংস্থাপনাবধি সামাজিকেরা যতগুলি গ্রন্থ ও পুস্তক প্রচার করিয়াছেন, তাহার অধিকাংশই নিষ্প্রয়োজন ও অকিঞ্চিৎকর হইয়াছে। আপনার দোষগুণ আপনার হৃদয়ঙ্গম হয় না। এ নিমিত্তে বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ তাহা বুঝিতে পারেন নাই।*

বেথুন সোসাইটি

১৮৫১ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘বেথুন সোসাইটি’ স্থাপিত হয়। ১১ ডিসেম্বর ডক্টর মুয়াট মেডিকাল কলেজে স্থানীয় শিক্ষিত ভদ্রলোকদের একটি সভা ডাকেন এবং সেই সভায় একটি নতুন বিদ্বৎসভা স্থাপনের আবশ্যকতার কথা প্রস্তাব করেন এসিয়াটিক সোসাইটি ও অন্যান্য সোসাইটির কথা উল্লেখ করে তিনি এ বিষয়ে আলোচনা করেন এবং প্রসঙ্গত বলেন যে, শিক্ষিত বাঙালিরা যাতে পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করবার সুযোগ পান, তার জন্য এই জাতীয় বিদ্বৎসভা আরও বেশি স্থাপন করা উচিত (‘‘…pointed out the great necessity of devising some means of bringing the educated natives more into personal contact with each other…’’)! এই সভায় মুয়াট আরও একটি কথা বলেন যা প্রণিধানযোগ্য। ইংলন্ড স্কটল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বিদ্বৎসভার ভূমিকার কথা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন যে এ দেশের সমাজের গড়নই এমন বাঁধাধরা, সামাজিক প্রথার বন্ধন এত কঠোর যে পরিবার ও ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক—স্থাপনের সুযোগ এখানে অনেক সীমাবদ্ধ। এ দেশের সুস্থ সামাজিক জীবনযাত্রার জন্যও তাই বিদ্বৎসভার প্রয়োজন বেশি (‘‘how much more such means of mental improvement and intellectual recreation were needed in this country, where, from the very constitution of native society and the social customs of the people, even the private relations of individuals and families were necessarily much restricted’’)।

মেডিকেল কলেজের আলোচনাসভায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডক্টর গুডিভ চক্রবর্তী, ডক্টর স্প্রেঙ্গার রেভারেন্ড লঙ প্রভৃতি যোগ দেন। সভাতে স্থির হয় যে সাহিত্য ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত নানা বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি বিদ্বৎসভা স্থাপন করা প্রয়োজন (‘‘A Society be established for the consideration and discussion of questions connected with Literature and Science’’)। এর কিছুদিন আগে বেথুন সাহেবের মৃত্যু হয় (১২ আগস্ট ১৮৫১)। স্ত্রীশিক্ষা প্রভৃতি এ দেশের নানাপ্রকার সমাজকল্যাণকর কাজে বেথুন সাহেবের দানের কথা স্মরণ করে, নতুন সভার নাম রাখা হয় ‘বেথুন সোসাইটি’।

সোসাইটির উদ্যোক্তা সভ্যদের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালিদের সংখ্যা ছিল বেশি। শিক্ষিত সমাজে যাঁরা লব্ধপ্রতিষ্ঠ ছিলেন তাঁদের সঙ্গে বিদ্যোৎসাহী ইংরেজ পাদরি ও রাজকর্মচারীরাও যোগ দিয়েছিলেন। সোসাইটির রিপোর্টে এই উদ্যোক্তাদের নাম দেওয়া হয়েছে।

জে. এফ. মুয়াট হরমোহন চ্যাটার্জি

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জগদীশনাথ রায়

রেভারেন্ড জেমস লঙ নবীনচন্দ্র মিত্র

মেজর জে.টি.মার্শাল জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর

রেভারেন্ড কে. এম. ব্যানার্জি প্যারীচরণ সরকার

ডক্টর স্প্রেঙ্গার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

ডক্টর গুডিভ চক্রবর্তী প্যারীচাঁদ মিত্র

এল. চ্যাট রসিকলাল সেন

বাবু রামগোপাল ঘোষ প্রসন্নকুমার মিত্র

রাধানাথ শিকদার গোপালচন্দ্র দত্ত

রামচন্দ্র মিত্র হরিচন্দ্র দত্ত

কৈলাসচন্দ্র বসু দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জি

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন বেথুন সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় উদযোগী হয়েছিলেন তখন তার আদর্শগত রূপেরও যে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল তা বোঝা যায়। সংযম ও সমন্বয়—সাধন ছিল সভার অন্যতম নীতি। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ইয়ং বেঙ্গলের প্রতিনিধিরাও ছিলেন এবং মুয়াট ও পাদ্রি লঙের মতো বিদেশি বিদ্যোৎসাহীরাও ছিলেন। শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত বাঙালি সমাজের অগ্রগণ্যদের মধ্যে সকলেই যে বেথুন সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, বা তার প্রতিষ্ঠা ও সমৃদ্ধির জন্য উদযোগী হয়েছিলেন, তা নয়। রাধাকান্ত দেব এই সোসাইটির প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহী হননি, পরে অবশ্য সভ্য হয়েছিলেন। ধর্মসভার আদর্শে যাঁদের মানসিক ও বৃদ্ধিবৃত্তি লালিত হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে অনেকেই বেথুন সোসাইটির সংস্পর্শে আসেননি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল যাঁরা সংস্পর্শে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে মুসলমান বিদ্বৎসমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিও ছিলেন। মৌলবি আব্দুল লতিফ খাঁ তাঁদের অন্যতম। বেথুন সোসাইটির আগে আর কোনো বিদ্বৎসভায় মুসলমানরা এ রকম সক্রিয়ভাবে যোগদান করেছিলেন কিনা সন্দেহ।

সোসাইটির নিয়মাবলি যা রচিত হয়েছিল, তার মধ্যে নীতি—নির্দেশক পঞ্চম নিয়মটি হল :

Discourses (written or verbal) in English, Bengali or Urdu, on Literary or Scientific subjects, may be delivered at the Society’s Meetings, but none treating of religion or politics shall be admissible.

সোসাইটির অধিবেশনে সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ে, ইংরেজি বাংলা বা উর্দু ভাষায়, লিখিত বা মৌখিক ভাষণ দেওয়া যাবে, কিন্তু ধর্ম বা রাজনীতি বিষয়ে কোনো আলোচনা নিষিদ্ধ।

প্রথম দিকে সোসাইটির উদ্যোক্তারা ধর্ম ও রাজনীতিকে সাহিত্য—বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করতে চাননি এবং এসব বিষয়ে কোনো আলোচনার প্রয়োজনবোধ করেননি। তার কারণ, তাঁরা মনে করেছিলেন ধর্ম ও রাজনীতি আলোচনায় তাঁদের আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে এবং অকারণে সভ্যদের মধ্যে বিদ্বেষভাব জাগিয়ে তোলা হবে। ইংরেজি বাংলা উর্দু তিনটি ভাষাতেই সভ্যদের আলোচনার অধিকার ছিল। উর্দুর উল্লেখ থেকেই বোঝা যায়, বেথুন সোসাইটির আলোচনায় মুসলমানরাও যোগদান করতেন।

প্রতিষ্ঠার পর অল্পদিনের মধ্যেই সোসাইটি শিক্ষিতশ্রেণির কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে এবং ঢাকা শহরেও ‘The Branch Bethune Society of Dacca’ নামে একটি শাখা—সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম বছরে ১৮৫২ সালেই কলকাতায় সোসাইটির সভ্যসংখ্যা হয় ১৩১ জন, তার মধ্যে ১০৫ জন বাঙালি। পাঁচ—ছয় বছরের মধ্যে সভ্যসংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ বাড়ে—

 ১৮৫৩ ১৮৫৪ ১৮৫৫ ১৮৫৬ ১৮৫৭

মোট : ১৪০ জন ২২৮ জন ২৮১ জন ৩০৪ জন ৩৪৫ জন

বাঙালি : ১১৯ জন ? ? ? ?

পৃথকভাবে এদেশি ও বিদেশি সভ্যের সংখ্যা পরবর্তী রিপোর্টে উল্লিখিত না হলেও, পাঁচ বছরের মধ্যে সোসাইটির সভ্যসংখ্যা প্রায় সাড়ে—তিনশো হয়েছিল, এবং তার মধ্যে অন্তত তিনশো জন বাঙালি ছিলেন মনে হয়। শিক্ষিত বাঙালি সমাজে ‘এলিট’ (Elite) বা সম্ভ্রান্ত ও প্রতিষ্ঠিত বলে গণ্য হবার মতো ব্যক্তি ১৮৫৭ সালে এর চেয়ে খুব বেশি ছিলেন না। বেথুন সোসাইটি এই বাঙালি এলিটসমাজের সঙ্গে ইয়োরোপীয় উচ্চসমাজের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছিল। ১৮৬১ সালের রিপোর্টের ভূমিকায় বলা হয়েছে :

A Society which had succeedd in bringing together–for mutual intellectual culture and rational recreation the very elite of the educated native community and blending them in friendly union with leading members of the Civil, Military and Medical services of Government, of the Calcutta bar, of the Missionary body, and other non-official classes… (বাঁকা হরফ লেখকের)

১৮৫৯ সালে সোসাইটি প্রায় অচল হয়ে ওঠে। দেখা যায়, সভ্যদের অধিকাংশই অধিবেশনে আসেন না, এবং ১৪৫৮ টাকা তাঁদের চাঁদা বাকি পড়েছে। কোনো ভালো বিষয়ে বক্তৃতা বা প্রবন্ধ পাঠ করাও আর হয় না। সভাপতি মুয়াট ইংলন্ড যাবার পরে হজসন প্র্যাট, গুডউইন, জেমস হিউম যথাক্রমে সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হন। হিউম সাহেব ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য সভার কাজে তেমন মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। এই সময় সভায় পুরাতন সভ্যরা চিন্তা করতে থাকেন, কীভাবে তাকে পুনরুজ্জীবিত করা যায়। প্রথমত এমন একজনকে সভার প্রেসিডেন্ট করা দরকার যাঁর উপর সম্প্রদায়—নির্বিশেষে শিক্ষিত সমাজের অনেকের আস্থা ও শ্রদ্ধা আছে। পাদরি অ্যালেকজান্ডার ডাফের নাম প্রস্তাব করা হয়—

though for various reasons which it is needless now to specify, he had never joined the Society as a member.

ডাফ সাহেব প্রথম রাজি হননি। পরে তিনি রাজি হন এবং বোধ হয় তাঁর জন্যই সোসাইটির পঞ্চম নিয়মটি (পূর্বোদ্বৃত) সংশোধন করে, ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে আলোচনার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়। ১৮৫৯ সালের ১৪ জুলাইয়ের অধিবেশনে ডক্টর শেভার্স সংশোধিত নিয়মটি প্রস্তাবাকারে পেশ করেন এই মর্মে :

The grand and distinctive object of the Society being to promote among the educated natives of Bengal a taste for literary and scientific pursuits, discourses written or verbal, in English, Bengali, or Urdu, may be delivered at the Society’s meetings, on any subject which may be fairly included within the range of Literature and Science.

ধর্ম ও রাজনীতিকে বিজ্ঞান বা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত বিষয় বলে গণ্য করা যেতে পারে, এবং আলোচনাকালে সেই কথা মনে রাখলে কোনো অপ্রীতিকর ব্যাপারও না ঘটতে পারে। প্রস্তাবটি পাশ হয়ে যায় এবং নিয়মটিও গৃহীত হয়। বেথুন সোসাইটির ইতিহাসে, এর পর থেকে, দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয় বলা চলে (‘‘With the adoption of these resolutions, the Bethune Society terminated the first period of its existence, and was fairly projected upon its second.’’)।

বেথুন সোসাইটি দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়েছিল, উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত। ১৮৭০—৭১ সাল পর্যন্ত সোসাইটির কাজকর্মের বিবরণ তার Transactions এবং Proceedings-এর মধ্যে পাওয়া যায়। পরবর্তীকালের বিবরণ তৎকালের সাময়িকপত্রে ও দৈনিক সংবাদপত্রে অনেক প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেথুন সোসাইটির একটি অধিবেশনে (২৯ এপ্রিল ১৮৮১) ‘সংগীত ও ভাব’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন এবং আলোচনাকালে মধ্যে মধ্যে নিজের কণ্ঠসংগীত সভ্যবৃন্দকে শোনান। এই অনুষ্ঠানের আংশিক বিবরণ ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত (জ্যৈষ্ঠ ১২৮৮ সন)। সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়।

ইংরেজি ‘The Statement’ পত্রিকাতে বেথুন সোসাইটির অধিবেশনের খবর মধ্যে মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ২৯ মার্চ ১৮৮০ সোসাইটির একটি অধিবেশন হয় মেডিকাল কলেজ লেকচার থিয়েটার। প্রধান বক্তা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ সম্বন্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন :

I look upon the permanent Settlement as a Magna Carta. Upon the Settlement I take my stand, and with it I propose to fight, the battles of the Ryot… I have no hesitation in saying that I look upon the permanent Settlement as a great, if an unmixed blessing… The Statesmen : April 14, 1883

১৮৮৯ সালেও (৫ ডিসেম্বর) বেথুন সোসাইটির অধিবেশনে বিপিনচন্দ্র পাল ‘The Present Social Reaction; What does it mean?’ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্যার হেনরি কটন।

বেথুন সোসাইটিতে পঠিত ও আলোচিত শিক্ষাবিষয়ক কয়েকটি নির্বাচিত প্রবন্ধের তালিকা দেওয়া হল :

। ১৮৫২।

 Peary Churn Sircar : On the Education and Training of Children in Bengal.

। ১৮৫৩।

 Umesh Chandra Dutt : The present State of Education at Krishnaghur with a few short remarks on the character and social position of the educated natives of Bengal.

 Pundit Issar Chunder Vidyasagar : On the Sanscrit Language and Literature in English and Bengallee.

 Juggodishnath Roy : On Education and the Necessity of Instruction in the Vernacular Language.

 Hurro Chunder Dutt : On Bengali Life and Society.

। ১৮৫৪।

 Rev. Lal Behari Day : On Vernacular Education in Bengal.

 Nabinkisto Bose : On the School of Industrial Art.

 Chunder Sekhur Goopta : On the Power and Responsibility of knowledge with special reference to the duties the educated natives owe to their country.

। ১৮৫৬।

 Rev. Lal Behari Day. On English Education in Bengal.

 Nobin Chunder Paulit : On Hindoo Woman as a Wife and Widow.

 Tarauk Nath Dutt : On the Remarriage of Hindoo Widows in Bengal.

। ১৮৫৭।

 Koylas Chunder Bose : Hindoo Female Education how best achieved under the present circumstances of Hindoo Society.

। ১৮৫৮—৫৯।

 Dr. S.G. Chuckerburty : On Native Education.

 Horropersad Chatterjee : On the Best Mode of Instructing the Females of India.

। ১৮৫৯—৬০।

 E.B. Cowell : On the principles of Historical Evidence and the Permanent Importance of the study of History to the educated Natives of India.

 Macleod Wylie : Hannah Moore and Female Education.

। ১৮৬৫—৬৬।

 Keshub Chunder Sen : On a Visit to Madras and Bombay with Notes of differences between their customs with those of Bengal.

 Maulavi Abdul Lateef : Periodical Census.

 Mary Carpenter : The Reformatory School System and its influence on Female Criminals.

। ১৮৬৯।

 Gopal Chunder Dutt : Educated Natives, their Duties and Responsibilities.

। ১৮৮৩।

 Surendranath Banerjee : Permanent Settlement as a Magna Carta.

। ১৮৮৯।

 Bepin Chandra Pal : The Present Social Reaction; What does it mean.

সমাজবিজ্ঞানের চর্চা

সাহিত্য ও দর্শন, জনস্বাস্থ্য শিক্ষা বিজ্ঞান ও শিল্পকলা, সমাজবিজ্ঞান—এই কয়টি বিভাগ ছিল বেথুন সোসাইটিতে। বাৎসরিক অধিবেশনে প্রত্যেক বিভাগের পরিচালকদের কৃত কাজকর্ম ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা সম্বন্ধে একটি করে রিপোর্ট পেশ করতে হত। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল সমাজবিজ্ঞান বিভাগটি। ইয়োরোপেও তখন সমাজবিজ্ঞানের চর্চা সবেমাত্র শুরু হয়েছিল বলা চলে। জ্ঞানবিজ্ঞানের নতুন ‘লিবারাল’ আদর্শ যাঁরা এ দেশে বহন করে আনতেন, তাঁরাই সেদিন বাংলাদেশে অন্যান্য বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের চর্চারও প্রয়োজন আছে বুঝেছিলেন। বিদ্বৎসভার মধ্যে বাংলাদেশে আধুনিক সমাজবিজ্ঞান চর্চার প্রবর্তকের সম্মান বেথুন সোসাইটির প্রাপ্য। তার মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ও অগ্রণী হয়ে এই বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছিলেন, তিনি পাদরি লঙ সাহেব। বাংলার বিদ্যাচর্চায় পাদরি লঙের দান শিক্ষিত বাঙালি মাত্রেই স্বীকার করেন।

পাদরি লঙ সাহেব একবার তাঁর রিপোর্টে সমাজবিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষিত বাঙালির উদাসীনতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন :

One of he reasons why do little in the way of writing has hitherto been contributed to sociology by educated natives and others, may have been the system of education that has prevailed and is prevailing, which cultivates memory to the exclusion of almost every other faculty and particularly the necessary one of observation,–Report of the Sociological Section, Bethune Society, April 26, 1861.

আজও যে শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে সমাজবিজ্ঞানের সমাদর বাড়েনি, তার প্রধান কারণ, আমাদের শিক্ষার গোড়ায় গলদ আছে। পরীক্ষায় কৃতী ছাত্ররা যতটা স্মৃতিশক্তির সাধনা করেন, বিচারবিশ্লেষণে শক্তির সাধনা ততটা করেন না। শিক্ষাপদ্ধতিই এমন যে তার মধ্যে একমাত্র যান্ত্রিক স্মৃতিশক্তি ছাড়া অন্য কোনো শক্তির অনুশীলনের সুযোগ থাকে না। বিশেষ করে, পাঠ্যপুস্তকের বাইরে যে বিরাট জ্ঞানজগৎ আছে, যান্ত্রিক পরীক্ষাপ্রধান শিক্ষার ধারায় সে—সম্বন্ধে কোনো কৌতূহলও জাগে না। শিক্ষিত মন অনুসন্ধানী হয় না, বিচারমুখী হয় না, কেবল মুখস্থবিদ্যার গণ্ডির মধ্যে থেকে নিশ্চিত চাকরিগত জীবন কাটাতে চায়। সমাজবিজ্ঞানের চর্চা এইজন্য আজও আমাদের দেশে প্রচলিত হয়নি। ইতিহাস দর্শন সাহিত্য, কোনো ক্ষেত্রেই আজও আমাদের বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের স্পৃহা বাড়েনি। সর্বত্রই আমরা স্মৃতি শ্রুতি ও অলীক কল্পনার জগতে বিচরণ করতে ইচ্ছুক। তাই বাংলা সাহিত্যে থোড়বড়িখাড়া কাব্য ও গল্প—উপন্যাসের এত প্রাচুর্য এবং অন্য বিষয় অনুশীলনে বিস্ময়ক দৈন্য দেখা যায়। বাঙালির জাতীয় চরিত্রের মুকুর এই ভাবালুতাসর্বস্ব কাব্যকাহিনিসাহিত্যের (অধিকাংশই অপাঠ্য) প্রাচুর্য এবং মননশীল সাহিত্যের দৈন্য।

১৮৬১ সালে বেথুন সোসাইটির অধিবেশনে লঙ সাহেব বলেছিলেন :

The time is very favourable for sociological investigation as an educated class of natives is rapidly rising qualified not only to investigate, but also to write the results of their investigation.

লঙের আশা আজও সফল হয়নি। বেথুন সোসাইটি ও তার সমাজবিজ্ঞানবিভাগ দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি। সোসাইটি থাকাকালীন পরে একটি স্বতন্ত্র ‘সমাজবিজ্ঞান সভা’ ও স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সমাজবিজ্ঞানচর্চার উৎসাহ শিক্ষিতদের মধ্যে তেমন বাড়েনি। শ্রমবিমুখ অনুশীলনকাতর কল্পনাপ্রবণ শিক্ষিত বাঙালি আজও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান বা আলোচনার প্রতি তেমন অনুরাগী নন। গল্প ও কাহিনি শুনতেই তাঁরা বেশি ভালোবাসেন। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হল, মননশীলতার এই সুস্থ ধারাটি পর্যন্ত আজ আমাদের সাংস্কৃতিক জীবন থেকে প্রায় লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এবং তার বদলে অলস রোমান্টিক ভাবানুভাবের রোমন্থনে আমরা ক্রমেই আত্মহারা হয়ে যাচ্ছি।

বিদ্যোৎসাহিনী সভা

” ৺নন্দলাল সিংহ মহাশয়ের পুত্র শ্রীমান বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ বঙ্গভাষার অনুশীলনের জন্য এক সভা করিয়াছেন” (সংবাদ প্রভাকর, ১৪ জুন ১৮৫৩)। এই সভার নাম ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’। বেথুন সোসাইটির প্রতিপত্তির যুগেই এই সভা সিংহ মহাশয়ের গৃহে স্থাপিত হয়, প্রধানত বিদ্বৎসভাকে একটি টিপিকাল বাঙালি মজলিসে পরিণত করার জন্য। বেথুন সোসাইটির সব বাঙালি সভ্যই প্রায় বিদ্বোৎসাহিনী সভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নবীন তরুণ বিদ্যোৎসাহী যাঁরা বেথুন সোসাইটির গুরুগম্ভীর পরিবেশে খুব বেশি স্বস্তিবোধ করতেন না, তাঁরা প্রবীণদের সংসর্গে আসতে হলেও, বিদ্যোৎসাহিনী সভার ঘরোয়া পরিবেশে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এ সম্বন্ধে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য তাঁর যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন তা উপভোগ্য :

পুরাতন সাহিত্যের আলোচনা করিতে বসিলে আমরা দেখিতে পাই যে ৺কালীপ্রসন্ন সিংহের আসন খুব উচ্চে। আমার যখন ১৫/১৬ বৎসর বয়স, তখন কালীপ্রসন্ন সিংহের সহিত আমার প্রথম আলাপ হয়। প্রথম পরিচয় ঠিক কেমন করিয়া কোন সময়ে হয়, তাহা এখন আমার স্মরণ নাই। তাঁহার বাড়ীর দোতলায় একটি Debating Club ছিল, আমি সেই সভার সভ্য হইয়াছিলাম। সেই স্থানে কৃষ্ণদাস পালের সহিত আমার প্রথম পরিচয় হয়। এখনও আমার বেশ মনে আছে, যেদিন কৃষ্ণদাস পাল Commerce সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা করেন, ইংরাজীতে তাঁহার সেই বক্তৃতা শুনিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম। তখন যদিও আমি ছেলেমানুষ, ইংরাজি বক্তৃতার ভাবটা সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিতাম কিনা সন্দেহ, তথাপি মনে হইল যে. এই লোকটি একদিন বড়লোক হইতে পারিবে। আমিও প্রবন্ধ পাঠ করিতাম, কিন্তু বাঙ্গালায়। আমি ছেলেমানুষ বলিয়াই হৌক, বা আর কোনও কারণেই হৌক, প্রবন্ধগুলির জন্য আমি প্রশংসা পাইতাম। একদিন আমার একটি প্রবন্ধের আলোচনা হইতেছিল—কি বিষয়ে সে প্রবন্ধ রচিত হইয়াছিল, এখন আমার স্মরণ নাই, বোধ হয় বিধবাবিবাহের উপর—এমন সময় একজন সভ্য বলিয়া উঠিলেন, ‘ছেলেমানুষের প্রশংসা করে রাত কাটান যাবে না কি?’ কালী সিংহ সভার নাম দিয়েছিলেন ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’, দুষ্ট লোকে তাহার নামকরণ করিল ‘মদ্যোৎসাহিনী সভা’। তিনি সভার patron গোছ ছিলেন।—মধ্যে মধ্যে সভাদিগের ভোজনাদির ব্যবস্থা হইত, আমি কিন্তু কখনও আহারাদিতে যোগদান করি নাই।—(পুরাতন প্রসঙ্গ, প্রথম পর্যায়, ৮৪—৮৫)।

কৃষ্ণকমলের মতো তখনকার তরুণ বিদ্যোৎসাহীরা কালীপ্রসন্ন সিংহের সভায় গিয়ে যতটা স্বচ্ছন্দে আলাপ—আলোচনায় যোগদান করতে পারতেন, বেথুন সোসাইটিতে তা পারতেন না। তার প্রধান কারণ বেথুন সোসাইটিতে ইংরেজদের সংখ্যাধিক্য না থাকলেও তাঁদের প্রভাব—প্রতিপত্তি যথেষ্ট ছিল। সভার কাজকর্ম পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে পরিচালিত হত। তার শৃঙ্খলা ও সংযত পরিবেশ বাঙালিদের কাছে খুব আকর্ষণের বিষয় ছিল না। তাই বেথুন সোসাইটির খাঁটি বাঙালি সংস্করণ হয়েছিল বিদ্যোৎসাহিনী সভা। একটু ঢিলেঢালা ঘরোয়া মজলিসি পরিবেশ না হলে বাঙালিদের বিদ্বৎসভা বা সাহিত্যসভা জমতে চায় না। সেই পরিবেশটি সিংহ মহাশয় তাঁর সভায় সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর আর্থিক সামর্থ্যও ছিল এবং প্রধানত তাঁর পোষকতাতেই সভা চলত। পরিবেশটা পুরো সামন্ততান্ত্রিক।

সাহিত্য বিজ্ঞান ইতিহাস দর্শন ইত্যাদি নানাবিষয়ে সভার আলোচনা হত। ইংরেজি ও বাংলা, দুই ভাষাতেই আলোচনা হত, কিন্তু বাংলা ভাষায় আলোচনার দিকেই ঝোঁক ছিল বেশি। সভার পক্ষ থেকে মধ্যে মধ্যে কৃতী সাহিত্যিকদের সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও পাদরি লঙ সাহেবকে বিদ্যোৎসাহিনী সভা এই সময় সংবর্ধনা জানান। সুলিখিত প্রবন্ধের জন্য সভার তরফ থেকে দু—তিনশো টাকা পুরস্কার দেওয়া হত। ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’ নামে সভার একটি মুখপত্রও কিছুদিনের জন্য প্রকাশিত হয়েছিল। সভায় মধ্যে মধ্যে সংগীতের আসর বসত, নাটকেরও অভিনয় হত। ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ’ নামে, সভার অঙ্গ হিসেবে, ১৮৫৬ সালে একটি পৃথক রঙ্গালয়ও কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা রঙ্গালয়ে ও বাংলা নাটক অভিনয়ের প্রচলনে এই রঙ্গমঞ্চের বিশেষ দান আছে।

ধনীব্যক্তির গৃহে সভা হত, তার সঙ্গে সংগীত ও নাটকাভিনয়ও হত এবং মধ্যে মধ্যে ভোজনাদিরও ব্যবস্থা হত। সভা তখনকার বাঙালি সুধীজনদের সমাগমে বেশ জমে উঠত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও এই সভায় মধ্যে মধ্যে যেতেন। বড়লোকের বাড়ির এরকম মজলিসি সভ্যকে অনেকে ‘বিদ্যোৎসাহিনী’ না বলে ‘মদ্যোৎসাহিনী’ সভা বলতেন। কিন্তু বিদ্যোৎসাহিনী সভা যে মজলিসি আড্ডার মধ্যেও বাইরের সমাজজীবনের ধারার সঙ্গে কিঞ্চিৎ যোগ রেখে চলত, তারও দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। বাংলার সমাজ—জীবনে তখন একদিকে বিদ্যাসাগর মহাশয় কর্ণধার। তাঁর সামাজিক আন্দোলনের প্রভাব বিদ্বৎসভার উপরেও পড়েছে। বেথুন সোসাইটি, বিদ্যোৎসাহিনী সভা, কেউ সামাজিক জীবনের ঘাতপ্রতিঘাত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেনি। বিদ্যোৎসাহিনী সভা নানাভাবে এই আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছে। বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সময় এই সভার সভ্যরা অগ্রণী হয়ে কৌন্সিলে দরখাস্ত পাঠান। বিবাহ বিধিবদ্ধ হবার পরে, কালীপ্রসন্ন সিংহ সংবাদপত্রে ঘোষণা করেন যে, বিধবাবিবাহ করতে যাঁরা ইচ্ছুক হবেন, তাঁদের প্রত্যেককে সভার পক্ষ থেকে এক হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। অবশ্য কোনো বিদ্বৎসভার পক্ষে এই ধরনের পুরস্কারাদি দিয়ে উৎসাহিত করা, যথেষ্ট আর্থিক পোষকতা ভিন্ন সম্ভব নয়। বিদ্যোৎসাহিনী সভার সেই পোষকতার অভাব ছিল না। না থাকলেও, এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, তখনকার সম্ভ্রান্ত বাঙালি সমাজে এ রকম অনেক ধনী ব্যক্তি ছিলেন যাঁরা এই ধরনের সভার পৃষ্ঠপোষক হতে পারতেন এবং সেই সভার মারফত শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজের জন্য কিছু কাজ করতে পারতেন। তা না করে, অধিকাংশ বাঙালি ধনীরা তখন অর্থের অপব্যয় করেছেন নানাভাবে।

সুহৃদ্ সমিতি

‘সুহৃদ সমিতির’ নামের আগে ‘সমাজোন্নতিবিধায়িনী’ কথাটি আছে। প্রধানত সমাজসংস্কারের প্রয়োজনবোধ থেকেই এই সমিতি স্থাপিত হয়। সুতরাং ‘সুহৃদ সমিতিকে’ ঠিক বিদ্বৎসভা বলা যায় কিনা তাই নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে। ঠিকভাবে বিচার করতে গেলে তা বলা যায় না। ১৮৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর কাশীপুরে কিশোরীচাঁদ মিত্রের দমদম রোডস্থ বাসভবনে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে যে সভা ডাকা হয়, তাতে কিশোরীচাঁদ তাঁর ভাষণে, সমাজসংস্কারের আবশ্যকতার কথা খুব জোর দিয়ে বলেন। তিনি এমন কথাও বলেন যে, কেবল প্রবন্ধ রচনা করে এবং বক্তৃতা দিয়ে কাজ হবে না। প্রাচীন ও নবীন বাঙালি সকলে মিলেমিশে একযোগে সমাজের উন্নতিবিধানের চেষ্টা করতে হবে।

সভায় হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রস্তাব করেন এবং যাদবচন্দ্র মিত্র সমর্থন করেন যে, সমিতির সভ্যরা প্রত্যেকে সামাজিক উন্নতির পরিপন্থী কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন এবং নিজেরা এমন কোনো কাজ করবেন না যা যুক্তি সত্য সুনীতি ও উদারতার বিরোধী। কিশোরীচাঁদ মিত্র প্রস্তাব করেন এবং অক্ষয়কুমার দত্ত সমর্থন করেন যে, স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তন, বিধবা—পুনর্বিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহবর্জন ও বহুবিবাহনিরোধের ব্যাপারে সমিতির সভ্যরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সাহায্য করবেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রস্তাব করেন এবং কিশোরীচাঁদ মিত্র সমর্থন করেন যে, হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহের বিধিগত বাধা দূর করবার জন্য ব্যবস্থাপক সভায় আবেদন করা হক এবং স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য নগরের উপকণ্ঠে বালিকা—বিদ্যালয় স্থাপন করা হক।৩৯

এই সকল প্রস্তাব থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, সুহৃদ সমিতি প্রধানত সামাজিক সভা রূপেই স্থাপিত হয়েছিল, বিদ্বৎসভা রূপে নয়। কোনো বিষয় নিয়ে বিদ্বৎসভার মতো আলোচনা বা প্রবন্ধ পাঠ করা যে সুহৃদ সমিতিতে হত না তা নয়, কিন্তু সামাজিক সুনীতি ও সত্যাচরণের আদর্শ প্রচার করাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। এক কথায় বলা যায়, বিদ্যাসাগর যুগের বিদ্বৎসভার সঙ্গে সামাজিক সভার খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। নতুন জ্ঞানবিদ্যার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামাজিক উন্নতি ও কল্যাণের অনুভূতি তখন প্রায় এক হয়ে মিশে গিয়েছিল। অবশ্য সেটা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের সমাজের উন্নতি ও কল্যাণ।৪০

ফ্যামিলি লিটারারি ক্লাব

সাধারণত মেডিক্যাল কলেজের লেকচার থিয়েটারে বেথুন সোসাইটির অধিবেশন হত এবং তার পরিবেশ ছিল পাশ্চাত্য সভার মতো নীতিদুরস্থ। ডক্টর মুয়াট থেকে রেভারেন্ড ডাফ পর্যন্ত যাঁরা সভার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছেন, তাঁদের ব্যক্তিত্বের প্রভাবও ছিল যথেষ্ট। ঠিক ঘরোয়া বৈঠকের অন্তরঙ্গতা সোসাইটির অধিবেশনে স্বভাবতই দুর্লভ ছিল। এই অভাব পূরণের জন্য সোসাইটির সভ্যরা অন্যান্য আরও অনেক সভা স্থাপন করেছেন, যেখানে আরও বেশি অন্তরঙ্গভাবে মিলিত হয়ে আলোচনা করবার সুযোগ পাওয়া যায়। কালীপ্রসন্ন সিংহ যেমন এই সময় ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ স্থাপন করেছিলেন, তেমনি প্রধানত রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদযোগে ১৮৫৭ সালের মে মাসে ‘ফ্যামিলি লিটারারি ক্লাব’ স্থাপিত হয়েছিল। বেথুন সোসাইটি থাকা সত্ত্বেও কেন তাঁরা এই সভা স্থাপনের আবশ্যকতা বোধ করেছিলেন, তা তার নাম দেখেই বোঝা যায়। ‘ফ্যামিলি’ ও ‘ক্লাব’ এই কথা দুটির মধ্যেই তা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। যে—কোনো বিদ্যোৎসাহী এই ক্লাবের সভ্য হতে পারতেন এবং শহরের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের বাড়িতে চক্রাকারে ক্লাবের বৈঠক বসত। আলোচনায় বিষয়বস্তুর গুরুত্ব একই ছিল। যেসব বিষয় নিয়ে বেথুন সোসাইটিতে আলোচনা হত, ফ্যামিলি লিটারারি ক্লাবেও প্রায় সেই সব বিষয় নিয়ে বৈঠক বসত। রীতিমতো বিতর্কও হত। ক্লাবে ইংরেজরাও যোগ দিতেন। স্যার রিচার্ড টেম্পল, রেভারেন্ড ডল, রেভারেন্ড মুলেনস, ব্যারিস্টার উড প্রমুখ বিদ্যোৎসাহীরা এই ক্লাবের অনুরাগী সভ্য ছিলেন। কেবল পরিবেশের পার্থক্য ছাড়া বেথুন সোসাইটির সঙ্গে লিটারারি ক্লাবের বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না।

চৈতন্য লাইব্রেরি

(নাম ‘লাইব্রেরি’ হলেও ‘চৈতন্য লাইব্রেরি’ কলকাতার একটি বিশিষ্ট সাহিত্য—সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠাতা হলেন আহিরীটোলার সুবর্ণবণিক পরিবারের গৌরহরি সেন। গৌরহরি, কলকাতার সম্ভ্রান্তশালী সুবর্ণবণিক পরিবারের আরও অনেকের মতো, বিদ্যোৎসাহী ছিলেন এবং সাহিত্য—সংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল, তিনি নিজে সাহিত্যচর্চাও করতেন। ১৮৮৯ খ্রীস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে ৮৩ নং বিডন স্ট্রিটে গঙ্গানারায়ণ দত্ত প্রদত্ত একখানি ঘরে চৈতন্য লাইব্রেরি প্রথম স্থাপিত হয়। এই বছরেই মার্চ মাসে সাহিত্যসভা খোলা হয়। ১৮৯১ খ্রীস্টাব্দে শোভাবাজারের বিনয়কৃষ্ণ দেব মহাশয়ের উদযোগে, ১৮৬০ সালের ২১নং আইন অনুসারে লাইব্রেরি রেজিস্ট্রি করা হয়। ‘বাংলায় ইহাই প্রথম রেজিস্ট্রিযুক্ত লাইব্রেরি’ (চৈতন্য লাইব্রেরির তৃতীয় বার্ষিক রিপোর্ট, পৃষ্ঠা ৪)।

লাইব্রেরির আলোচনা—সভায় যে—সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হত, তার খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায় প্রথম বর্ষের সভার বিবরণ থেকে :

বিষয় : বক্তা :

ডি.জি.রসেটি নলিনীকান্ত মুখোপাধ্যায়

মুসলিম ভারত হবিবর রহমন

দিল্লী ও আগ্রা রেভারেন্ড এ.টমরী

কবিতা হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

বর্তমান স্ত্রীশিক্ষা নলিনীকান্ত মুখোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ দত্ত

জর্জ ওয়াশিংটন কুঞ্জবিহারী দত্ত

আমাদের সমাজে সতীশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য

পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব

দ্বিতীয় বছরে লাইব্রেরির কার্যনির্বাহক—সমিতিতে আশুতোষ চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহকারী সভাপতি মনোনীত হন। চৈতন্য লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা বিকাশ সম্বন্ধে গৌরহরি সেন তাঁর ‘চৈতন্য লাইব্রেরি সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ’ পুস্তিকায় লিখেছেন :

পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে কম্বুলিটোলা লাইব্রেরীর খুব নামডাক ছিল। কেশব একাডেমির ছাত্র ৺গুরুচরণ চৌধুরী ও তাঁহার দাদা ৺তীর্থনাথ ঐ লাইব্রেরীর প্রধান পাণ্ডা ছিলেন। কয়েক বৎসর হইল ঐ লাইব্রেরী রিপোর্ট বাগবাজার লাইব্রেরীর সহিত মিশিয়া গিয়াছে। কম্বুলিটোলা লাইব্রেরীর রিপোর্ট পড়িয়া এবং গুরুচরণের সহিত মেলামেশা করিয়া আমার লাইব্রেরীর নেশা ধরে। ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দে আমি কম্বুলিটোলা লাইব্রেরীর সভ্য ছিলাম। ১৮৮৮ খ্রীস্টাব্দে ৺কুঞ্জবিহারী দত্তকে ঐ লাইব্রেরীতে ভর্ত্তি করাই। কুঞ্জর তখন গাড়িঘোড়া ছিল না। বর্ষাকালে কম্বুলিটোলা যাইতে কষ্ট হওয়াতে, তাহার বিডন ষ্ট্রিট অঞ্চলে একটা লাইব্রেরী করিতে সাধ হয়। কুঞ্জর দ্বিতীয় ভ্রাতা ৺নিতাইচাঁদ খুব উৎসাহী ছিল। আমাদের কথাবার্তা শুনিয়া, তাহারও লাইব্রেরীর সম্বন্ধে বাতিক জন্মে। দুই একদিনের মধ্যে নিতাই—এর গৃহশিক্ষক ৺হরলাল শেঠ ও আমাদের প্রতিবেশী ৺রঙ্গলাল বসাক আমাদের দলভুক্ত হইলেন।…

নিতাই তাহার দাদার, মাস্টারের, রঙ্গর ও আমার খানকতক বই লইয়া একটা আলমারিতে পুরিল। প্রথম মাসে দত্ত মহাশয়ের প্রদত্ত টাকায় খানকতক বাংলা পুস্তক কেনা হইল। একদিন ভূপেন (এখন বাবুডাঙ্গা নিবাসী) আসিলে, তাহার নিকট খান ছয়—সাত বই পাওয়া গেল। কিন্তু দুই মাসের চেষ্টায় কিছুতেই একটা আলমারি ভরিল না। কুঞ্জর শ্বশুর মহাশয় প্রত্যহ ‘Indian Mirror’ পাঠাইয়া দিতেন। প্রতি সপ্তাহে ‘বঙ্গ বাসী’ ও ‘সঞ্জীবনী’ কেনা হইত।

পাদরি টমরি সাহেব তখন বিডন ষ্ট্রিটের ৩২/৬ বাটীতে থাকিতেন। তাঁহাকে একদিন পাকড়াও করিয়া আনিলাম। তিনি পৌনে এক আলমারি পুস্তক, তিনখানি কাগজ ও আধ ডজনের কম সভ্য দেখিয়া খুব হাসিলেন।… আমি নাম দিয়াছিলেন Beadon Square Literary Club। দত্ত মহাশয় বলিলেন,—’অ্যাঁ, ঠাকুরদের নাম দাওনি’। অনেক তর্কাতর্কির পর Chaitanya Library and Beadon Square Literary Club এই নাম স্থির হইল। আমরা ১৮৮৯ সালের ১ জানুয়ারী সাইন বোর্ড লাগাইব স্থির করিয়াছিলাম। দত্ত মহাশয় পাঁজি দেখিয়া বলিলেন, দিনটা খারাপ; সুতরাং সরস্বতী পূজা (৫ই ফেব্রুয়ারী) পর্য্যন্ত দিন পিছাইতে হইল। চৈতন্য নাম শুনিয়া কেহ কেহ টিকি লাইব্রেরী বলিয়া ঠাট্টা করিত। ছেলেদের কাণ্ড বলিয়া পাড়ার বয়স্ক লোকরা প্রথম প্রথম আমল দিতেন না। একদিন রাত তিনটায় উঠিয়া, নিতাই, রঙ্গ ও আমি বিডন ষ্ট্রিট, কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রিট ও কলেজ ষ্ট্রিটের দুই ধার লাইব্রেরীর Prospectus মারিয়া দিলাম।

দশ টাকায় স্থায়ী সভ্য এবং দুই আনা চাঁদার সাধারণ সভ্য জোগাড় করিতেও প্রথম প্রথম বেগ পাইতে হইত। বুঝিলাম একটু হৈ চৈ না করিলে চলিবে না। ব্যারিষ্টার এ চৌধুরী মহাশয় (এখন সার আশুতোষ চৌধুরী) তখন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দক্ষিণে থাকিতেন। তাঁহার কাছে যাওয়া আসা করিয়া, ১৮৯০ সালের প্রারম্ভে লাইব্রেরীর প্রথম বার্ষিক অধিবেশনের জন্য ‘Literature and the Calcutta University’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ আদায় করিলাম। আমার সধ্যায়ী পাথুরে ঘাটার ৺নগেন্দ্রনাথ চৌধুরী, হাইকোর্টের জজ নরিস সাহেবকে সভাপতি জোগাড় করিল। কলিকাতার দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রে চৌধুরী সাহেবের প্রবন্ধ আলোচনা বাহির হইল। চৈতন্য লাইব্রেরীর নাম দেশময় ছড়াইয়া পড়িল।

১৮৯১ সালে রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেবের ব্যয়ে লাইব্রেরী রেজিস্টারি করা হয়।…

গত উনিশ বৎসরে লাইব্রেরীর সর্ব্ব—প্রধান মুরুব্বি কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটি। ইহাদের নিকট প্রায় নয় হাজার টাকা পাওয়া গিয়াছে। ৩নং ওয়ার্ডের কমিশনার ৺কালীচরণ পালিত মহাশয় আমাকে Municipal Grant সম্বন্ধে প্রথম সন্ধান দেন।

চৌত্রিশ বৎসর লাইব্রেরী চালাইয়া যথেষ্ট আনন্দ ও হাড়ে হাড়ে আক্কেল পাইয়াছি। ভারত গভর্নমেন্টের ল মেম্বর, মিলিটারী মেম্বর, হোম মেম্বর, ফিন্যান্স মেম্বর এবং বঙ্গদেশের গভর্ণর, লেফটেন্যান্ট গভর্ণর, চিপ জাষ্টিস প্রমুখ উচ্চ পদস্থ রাজ—কর্ম্মচারী, বঙ্কিমচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, প্রমুখ সাহিত্যিক দিকপাল; সার রাজেন্দ্রনাথ, সার কৈলাস, সার দেবপ্রসাদ, সার আশুতোষ চৌধুরী প্রমুখ দেশের জননায়কগণ, সকলেই আমার আহ্বানে চৈতন্য লাইব্রেরীর অধিবেশনে সভাপতি বা বক্তা হিসাবে যোগদান করিয়াছেন। চৌত্রিশ বৎসরে যাহা কিছু ছাপা হইয়াছে—পুস্তকের তালিকা, বাৎসরিক বিবরণী, সভার চিঠি, নিয়মাবলী—সমস্তই আমার লেখা। এই সকল কার্য্যে শ্রম আছে, দায়িত্ব আছে, আনন্দও আছে। মিউনিসিপ্যাল কমিশনারের কাছে হাঁটাহাঁটি করিয়া গ্রান্টকে বাৎসরিক আড়াই শত হইতে ক্রমে ক্রমে সাড়ে—ছয় শত টাকায় তুলিয়া মনটা বেশ প্রফুল্ল হইত।

১৯১২ হইতে ১৯১৫ সালের মধ্যে হাড়ে হাড়ে আক্কেল পাইয়াছিলাম। যে সকল কারণে কম্বুলিটোলা লাইব্রেরী, সাবিত্রী লাইব্রেরী, ক্যালকাটা রিডিং রূমস, সিকদারবাগান বান্ধব লাইব্রেরী, মিনার্ভা লাইব্রেরী প্রভৃতি পাঠাগারগুলি লোপ পাইয়াছে, চৈতন্য লাইব্রেরীতে ঐ চার বৎসরে তাহার সব চিহ্ন দেখা দিয়াছিল। লাইব্রেরীয়ান পুস্তক ক্রয়, তালিকা প্রস্তুত, পুস্তক আদানপ্রদানের হিসাব সব বিষয়েই উদাসীন, ট্রেজারার তিন মাসে এক দিনও আসিয়া জমা খরচের সন্ধান লইতেন না; সেক্রেটারীকে চিঠিপত্র লিখিতে বা সভা—সমিতি করিতে বলিলে তাঁহার চক্ষু আকাশে উঠিত। পাছে হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গে তাহা চাপা দিবার জন্য আমাকে তখন চার গুণ খাটিতে হইত। বেহারা না আসিলে ঝাঁট দিতে ও আলো জ্বালিতে হইত। চার বৎসর পরে এই ভাষায় বন্ধুদের নিকট ধন্যবাদ পাইয়াছিলাম,—’ওর আফিস নেই, দোকান নেই, পরিবার নেই, ছেলে—মেয়ে নেই, ও খাটবে না ত কি? ওর ভাত হজম হবে কি করে।’

চৈতন্য লাইব্রেরীর ক্রমিক অবনতি সম্বন্ধে গৌরহরি যা লিখেছেন, তা বাংলা দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বাঙালি মধ্যবিত্তের, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের, চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দল—পাকিয়ে দলাদলি করা এবং দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য প্রতিষ্ঠানের অধোগতির পথ সুগম করা। বাংলার স্যাঁতসেঁতে মাটিতে সবকিছুই যেমন পচে যায়, তেমনি সমস্ত উদ্যমও ব্যর্থ হয়। যেমন সামাজিক ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, তেমনি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, সর্বত্রই এই একই অধোগতির ইতিহাস। প্রথম পর্বে গেঁজিয়াওঠা উচ্ছ্বাস, দ্বিতীয় পর্বে কিঞ্চিৎ থিতোনা, তৃতীয় পর্বে পতন।

বড়বাজার গার্হস্থ্য সাহিত্য—সমাজ

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ১২৬৪ সনে) প্রসাদদাস মল্লিক জোড়াসাঁকোর একজন শিক্ষিত সুবর্ণবণিক বন্ধুর সহযোগে ‘বড়বাজার গার্হস্থ্য সাহিত্য—সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই বন্ধুর নাম গোষ্ঠবিহারী মল্লিক, কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের বাঙালি পাড়ার রতন সরকার গার্ডেন ষ্ট্রিটের অধিবাসী ছিলেন তিনি। এই সাহিত্যসমাজের সম্পাদক ছিলেন প্রসাদদাস এবং সহকারী সম্পাদক ছিলেন গোষ্ঠবিহারী। দেশের শিক্ষিত সুধী সমাজে এই বিদ্বৎসভায় বেশ ব্যাপক প্রভাব ছিল। সভার বাৎসরিক অধিবেশন মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হত এবং প্রায় চার—পাঁচশো লোকের সমাগম হত। মাসিক অধিবেশনে বিভিন্ন বিষয়ে ইংরেজি ও বাংলায় প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা করা হত। নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রবন্ধ রচনার জন্য পুরস্কারও দেওয়া হত এবং প্রবন্ধগুলি পুস্তকাকারে ছেপে পাঠকদের বিতরণ করারও ব্যবস্থা ছিল।

এই সাহিত্য—সমাজ থেকে মধ্যে—মধ্যে বিশিষ্ট গুণী ব্যক্তিদের অভিনন্দিত করারও প্রথা ছিল। ১৮৭২ সালে প্রসিদ্ধ পণ্ডিত—মিশনারি রেভারেন্ড জেমস লং সাহেবকে বিলাত যাত্রাকালে এই সভা থেকে একটি অভিনন্দন—পত্র দেওয়া হয়। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত দীর্ঘ ন—বছর লং সাহেব এই সাহিত্য—সমাজের সভাপতি ছিলেন। লং সাহেবকে প্রদত্ত অভিনন্দনপত্র এবং তাঁর উত্তর উদ্ধৃত করা হল :*

লং সাহেবকে প্রদত্ত অভিনন্দনপত্র

To the Rev. James Long.

Rev. and Dear Sir,

We, the members of the Family Literary Club desire to convey to you this humble expression of our heartfelt sorrow at the prospect of your departure from India, and of the deep sense of obligation which our countrymen in general and this Society in particular entertain for the benefits you philanthropic labours have conferred upon them.

You will remember that in the year 1859, when our Society was yet in its infrancy, you kindly accepted the office of our President. We thankfully cherish the recollection of the zeal, earnestness, and assiduity, with which you promoted its welfare and advancement. You worked with us Sir, in the strong consciousness and hope that it might, in the Providence of God, materially help the cause of native enlightenment. Although your departure for Europe in 1863 necessitated a temporary severance of our connection with you, we have always had signal proofs of the deep interest you take in our efforts to repair the breach which separates the European and native by bringing them together in social and intellectual fellowship. The ready condescension with which you have always come forward to direct our faltering steps and strengthen us with your words of encouragement has commanded our heartfellt gratitude.

It is difficult, Sir, to estimate the amount of good you have conferred on this country by lending your powerful air towards the improvement of our vernacular literature. Your intimate knowledge of the Bengali language, your lifelong labours to raise its status, your admirable and exhaustive collection of proverbs spoken by the ryots and women of Bengal, embodying their wisdom and practical good sense, have brought before the European world a knowledge of our inner life which the most elaborate work on India would fail to convey. We humbly prey to the Divine Disposer of Events to raise up men like yourself to continue the work of native enlightenment after your simple and unostentatious fashion…

We remember the days of agitation when the wrongs inflicted on the dumb ryots by the Indigo planters roused your benevolent heart and led you, at immense personal sacrifice, to wield your powerful pen against the oppressor and whatever may have been the judgement of a frail earthly tribunal on a matter, we firmly believe that, in addition to the blessings of thousands that were ready to perish the consciousness of having performed a duty and a strong faith that your conduct was approved before the throne of the Eternal, proved a most powerful solace in your numerous earthly tribulations.

And now, Sir, we bid you a hearty farewell let us hope only for a time. May the Almighty Father of us all restory your health and strength to enable you to return to out shores and to promote the welfare of our countrymen, to which your have devoted the best years of your life.

We remain

Rev. and Dear Sir,

Your most obedient servants

Prosad Doss Mullick, Aushoo Toss Dhur,

Hurry Mohun Chatterjee, Gosto Behary Mullick,

Behary Lall Dhur, Govinchand Addy,

Bollai Chand Mullick, Brojo Lall Dutt,

 and Serveral others

Calcutta, March 20, 1871.

অভিনন্দনপত্রের উত্তরে লং সাহেব বলেন :

To

Baboo Prosad Doss Mullick,

Honorary Secretary, Family Literary Club.

My dear Prosad Baboo,

I regret that press of engagement (at leave for Bombay tomorrow) prevents my replying more at large to your address, which interested me very much, showing that there are men among the educated classes who sympathise with my humble efforts to do something to raise the masses of their countrymen through the potent agencies of vernacular education and security of tenure to the ryot.

Your Society has been always peculiary interesting to me as your conducted the proceedings in the native language as well as the language of the foreigners. The Bengali Language is now attaining the strength of a giant in its capabilities of expressing all ideas which it can do by its connection with the Sanscrit.

Social questions– and not mere literary ones, have also come in for their due share in your attention. You have here a boundless field before you in the Bengali people, who well deserve a study.

The position of your Society in Burrabazar has often reminded me, in threading of the adage, ‘One-half the world does not know the other lives.’ The Burra-bazar and Mugul part of Calcutta are quite a terra incognita to the other part, and I hope your Society will pursue its inquiries into the curious social life of the Marwaris, Jews, and Muguls, that inhabit the far-famed Burrabazar.

I am delighted at reveiving an address from some of your in that expressive language both musical in its tone and expressive in its ideas.

A change is coming over Bengal : The Bengali language is happily dropping the old Sanscrit style, and assuming a nervous idiomatic form. I trust my Bengali friends are learning to be not merely kotah but also kurmo men, of deeds and not mere words.

If my health allow, it will afford me much pleasure to return to this country, but time carries us away. May we all, as we are approachng another world, feel that our relations to God are of superior importance–that the concern of a future state ought to be our chief care.

Yours sincerely,

J. Long.

রেভারেন্ড লং সাহেবের উত্তরের মধ্যে সমাজবিজ্ঞানের অনুশীলনের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহে প্রকাশ পেয়েছে। প্রসঙ্গত কলকাতার ‘বড়বাজার’ অঞ্চলের সমীক্ষার কথা তিনি যেভাবে উল্লেখ করেছেন তা থেকেই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। দুঃখের বিষয়, বড়বাজার অঞ্চল নিয়ে এই ধরনের সমীক্ষা আজ পর্যন্ত (১৯৭৮) হয়নি।

আলোচনা—সভায় বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য

বেথুন সোসাইটি, বিদ্যোৎসাহিনী সভা, সুহৃদ সমিতি, ফ্যামিলি লিটারারি ক্লাব প্রভৃতি বিদ্বৎসভায় আলোচ্য বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য ছিল। কোনো বিষয় সম্বন্ধে কোনো গোঁড়ামি ছিল না। ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আলোচনা বেথুন সোসাইটিতে প্রথমদিকে নিষিদ্ধ ছিল বলে, হিন্দু ব্রাহ্ম ও খ্রীস্টান সভ্যরা সকলেই খানিকটা অসুবিধা বোধ করতেন মনে হয়। ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতি বর্জিত হওয়ার জন্য, সামাজিক সাহিত্যিক দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়েই বেথুন সোসাইটিতে আলোচনা হত বেশি। সোসাইটির ‘ট্রানজ্যাকশনসে’ প্রকাশিত আলোচ্য বিষয়ের তালিকা থেকেই তা বোঝা যায়। ১৮৫২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ১৮৫৯ সালের মে মাসের মধ্যে যে সব বিষয় গঠিত ও আলোচিত হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখ্য কয়েকটির তালিকা দিচ্ছি :

সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

সংস্কৃত কাব্য রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা কাব্য হরচন্দ্র দত্ত

ইউরোপীয় ও হিন্দু নাটক কৈলাসচন্দ্র বসু

বাংলার শিশুপালন ও শিশুশিক্ষা প্যারীচরণ সরকার

বাংলার কৃষির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রামশঙ্কর সেন

বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ এইচ উড্রো

কলেজীয় শিক্ষায় বিজ্ঞান ও সাহিত্যের স্থান প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী

কৃষ্ণনগরে শিক্ষার বর্তমান অবস্থা ও শিক্ষিত

ব্যক্তিদের চরিত্র ও সামাজিক জীবন উমেশচন্দ্র দত্ত

বাংলা শিক্ষাব্যবস্থা ও মাতৃভাষায়

শিক্ষার সমস্যা জগদীশনাথ রায়

বাঙালী সমাজ ও জীবন হরচন্দ্র দত্ত

সংগীত প্রসঙ্গে কিরপ্যাট্রিক

বাংলার নারীসমাজ কৈলাসচন্দ্র বসু

বাংলায় ইংরেজী শিক্ষা রেভারেন্ড লালবিহারী দে

বাংলায় হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহসমস্যা তারকনাথ দত্ত

সভায় পঠিত বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সমাজ ও শিক্ষা সম্বন্ধে আলোচনার প্রাধান্য ছিল বেথুন সোসাইটিতে এবং অধিকাংশ আলোচনাই বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে করা হত। কাব্য দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তত্ত্বপ্রধান আলোচনাও যথেষ্ট হয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে বিষয়বস্তুর এই বৈশিষ্ট্যটাই বড় হয়ে ফুটে ওঠে। বাংলার সমাজ—জীবনে, বিদ্যাসাগরযুগে, সমাজ ও শিক্ষার সমস্যাই ছিল প্রধান। তখন কার বিদ্বৎসভায় এই সমস্যাগুলিই তাই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। সমাজ—জীবনের সঙ্গে তখন বাঙালি বিদ্বৎসমাজের কতটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল এবং তাঁরা তাদের সামাজিক কর্তব্য সম্বন্ধে কত সচেতন ছিলেন, বিদ্বৎসভার এই ইতিহাস থেকে তা সঠিক বোঝা না গেলেও, খানিকটা অনুমান করা যায়।

বেথুন সোসাইটিতে ধর্মালোচনার স্বাধীনতা না থাকার জন্য, হিন্দু ব্রাহ্ম ও খ্রিস্টান সভ্যরা, তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেও, আরও নতুন ছোট ছোট বিদ্বৎসভা গড়ে তোলেন। তার মধ্যে বিদ্যোৎসাহিনী সভা ও ফ্যামিলি লিটারারি ক্লাব অন্যতম। অন্য দিকে তত্ত্ববোধিনী সভা তো ছিলই। এই সব সভায় ধর্মের কোনো গোঁড়ামি ছিল না, ধর্মতত্ত্ব নিয়ে অবাধ আলোচনা হত। তা হলেও এই সব সভার বৈঠকেও প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে দেশের সামাজিক সমস্যা। ফ্যামিলি লিটারারি ক্লাবে বাল্যবিবাহ স্ত্রীশিক্ষা বহুবিবাহ ইত্যাদি সম্বন্ধেও আলোচনা হয়। বিদ্যোৎসাহিনী সভা ও সুহৃদ সমিতি তো প্রত্যক্ষভাবেই সমাজসংস্কার আন্দোলনে সহায়তা করে।

বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভা

বিদ্যাসাগর—যুগের বিদ্বৎসভার এই সামাজিক চেতনার ভিতর থেকেই বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভার প্রতিষ্ঠার আভাস পাওয়া যায়। বেথুন সোসাইটিতেই যে একটি সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ছিল, সে কথা আগে বলেছি। রেভারেন্ড লঙ সাহেব সমাজবিজ্ঞানের চর্চা সম্বন্ধে বাংলার বিদ্বৎজনদের অনুপ্রাণিত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। পরে স্বতন্ত্রভাবে যখন ‘বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভা’ ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তখনো লঙ সাহেব তার একজন অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন।

মেরি কার্পেন্টার এদেশে এসে একটি স্বতন্ত্র সমাজবিজ্ঞান সভা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করেন। স্থানীয় বিদেশি ও এদেশি সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত ব্যক্তিদের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে আলোচনাও করেন। ১৮৬৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর এসিয়াটিক সোসাইটিতে একটি সভা হয়। তাতে কুমারী কার্পেন্টার ব্রিটেনের ‘National Association of the Promotion of Social Science in Great Britain’–এর শাখা—প্রতিষ্ঠানরূপে বাংলাদেশে একটি সমাজবিজ্ঞান সভা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবটি বিবেচনা করে সভা সম্বন্ধে প্রাথমিক খসড়া—পরিকল্পনা রচনা করবার জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিতে ছিলেন—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রেভারেন্ড লঙ, জাস্টিস নর্মান, জাস্টিস ফিয়ার, জাস্টিস সীটনকার, ই.সি. বেইলি, আর্থার গ্রোট, অ্যাটকিনসন, ফার্কুয়ার, ম্যাকেনজি, ক্ষেত্রমোহন চ্যাটার্জি, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামচন্দ্র মিত্র, কেশবচন্দ্র সেন, মনোমোহন ঘোষ ও রাজেন্দ্রলাল মিত্র। কমিটি ব্রিটেনের সমাজবিজ্ঞান সভার শাখা হিসেবে এদেশে কোনো সভা স্থাপন করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং Bengal Social Science Association নামে একটি স্বতন্ত্র সভা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। ১৮৬৭ সালের ২২ জানুয়ারি মেটকাফ হলের সাধারণ সভায় প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভার লক্ষ্য সম্বন্ধে প্রস্পেক্টস—এ বলা হয় :

The object of the Association is to promote the development of social progress in the Presidency of Bengal, by uniting Europeans and Natives of all classes, in the collection, arrangement and classification of facts, bearing on the social, intellectual and moral condition of the people.

সভার কাজ চারটি বিভাগে ভাগ করা হয় : ১ আইন ২. শিক্ষা ৩. স্বাস্থ্য ৪. অর্থনীতি ও বাণিজ্য। প্রত্যেক বিভাগে কী কী বিষয়ে অনুসন্ধান করা যেতে পারে তাই নিয়ে সিলেবাসের মতো একটি করে ‘সার্কুলার’ তৈরি করে সভ্যদের বিতরণ করা হয়। এই বিভাগীয় সার্কুলারগুলি থেকে অনুসন্ধানযোগ্য কয়েকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করছি:

আইন—বিভাগ

ট্রাস্ট ইত্যাদি সম্বন্ধে বর্তমান হিন্দু ও মুসলমান আইন পর্যালোচনা করা, তার ফলাফল বিচার করা এবং তা কাম্য কী বিবেচনা করা।

‘বেনামী রীতি সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা।

পঞ্চায়েত প্রথা, তার বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব। বিবাদ—নিষ্পত্তির ব্যাপারে তার আবশ্যকতা কী?

বিচারালায়ে উৎকোচ গ্রহণের দুর্নীতির অনুসন্ধান—তার কারণ কী? প্রভাব কতদূর? দুর্নীতি দমনের পন্থা কী?

অপরাধ সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করা—অপরাধ কারা করে, অপরাধীরা কোনো বিশেষ জাতির লোক কি না? তা যদি হয়, তাহলে সেই জাতির স্বভাব, অভ্যাস, আর্থিক অবস্থা কী রকম? কী কারণে অপরাধ করে তারা? তার জন্য দারিদ্র্য কতটা দায়ী? মাদক—নেশা ইত্যাদি কুঅভ্যাসই বা কতটা দায়ী? আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান—আইন করে আত্মহত্যা বন্ধ করা সম্ভব কি না?

শিক্ষা—বিভাগ

গত অর্ধশতাব্দীতে বাংলাদেশে শিক্ষার বিস্তার—হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে শিক্ষার ফলাফল কী? নিম্নবঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার না হবার কারণ কী?

প্রত্যেক জেলার শিক্ষার অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা—কোন কোন শ্রেণির মধ্যে কতটা শিক্ষার বিস্তার হয়েছে? কৃষকদের মধ্যে কারিগরদের মধ্যে, ভৃত্যদের মধ্যে?

বিদ্যালয়ের মাধ্যমে কৃষির উন্নতি করা সম্ভব কি না—হলে কতটা সম্ভব হতে পারে?

স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার—হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কতদূর হয়েছে? বিস্তারের পথে বাধা কী? বাধা দূর করার উপায় কী?

প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানের সুবিধার জন্য এক—একটি বিষয়ে কর্মীদের জন্য প্রশ্নমালা তৈরি করে দেওয়া হত। ‘স্ত্রীশিক্ষা’ সম্বন্ধে এই ধরনের একটি প্রশ্নমালার পরিচয় দিচ্ছি :

১. জেলায় ক—টি বিদ্যালয় আছে বালিকাদের জন্য? শুধু বালিকাদের জন্য, না বালক—বালিকা উভয়েরই জন্য?

২. ছাত্রীসংখ্যা কত? দৈনিক ক—জন করে গড়ে উপস্থিত থাকে?

৩. বিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে জাতিগত বাধা আছে কিনা?

৪. ক’বছর বয়সে সাধারণত বালিকাদের স্কুলে ভরতির করানো হয়, এবং ক’বছর বয়সে স্কুল ছাড়িয়ে নেওয়া হয়?

৫. স্কুল ছাড়ার প্রধান কারণ কী?

৬. স্কুলের পাঠ্য কী?

৭. বিধবা, না বিবাহিতা স্ত্রীলোক, শিক্ষকতার পক্ষে কাদের ভালো মনে হয়?

৮. হিন্দুদের পারিবারিক জীবনের গড়ন স্ত্রীশিক্ষার অন্তরায় কি না? তরুণ স্বামীরা তাঁদের নববিবাহিতা তরুণী স্ত্রীদের শিক্ষার ব্যাপারে কোনো সাহায্য করেন কি না—করলে, কতটা করেন? ইত্যাদি।

বিভাগীয় বিষয়ের সার্কুলার এবং প্রত্যেক বিষয়ের প্রশ্নমালা দেখলে বোঝা যায়, যতদূর সম্ভব বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতেই প্রত্যেক বিষয় সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা হত। বাংলার বিদ্বৎসমাজের মধ্যে শুধু সমাজবোধ জাগানো নয়, সামাজিক জীবন ও তার সমস্যা সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক বিচারবুদ্ধির বিকাশেও বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভার বিশেষ দান আছে।৪১

রামমোহনের যুগ থেকে বিদ্যাসাগরের যুগ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিদ্বৎসভার মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলি ফুটে উঠেছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ পাদ থেকে ধীরে ধীরে সেগুলি লোপ পেতে থাকে। সেই বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে উল্লেখ্য হল—আলোচনার স্বাধীনতা, মতামতের উদারতা, পারস্পরিক মিলন ও ভাববিনিময়, সমাজচেতনা, বিদ্বৎসমাজের সামাজিক দায়িত্ববোধ, নবীন বিদ্যোৎসাহীদের প্রেরণাদান ইত্যাদি। যদিও বাঙালি হিন্দু ব্রাহ্ম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে সামাজিক ব্যাপারে তখন মতবিরোধ যথেষ্ট তীব্র ছিল, নবীন ও প্রাচীনদের মধ্যে পথের ব্যবধানও ছিল বিস্তর। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিদ্বৎসভার আসরে সকলের মিলনের পথে তেমন অনতিক্রম্য কোনো অন্তরায় ছিল না। আজকের রাজনৈতিক সংঘাতের তীব্রতার যুগে যে দুর্লঙ্ঘ্যপ্রায় বাধার সৃষ্টি হয়েছে, সেদিন সে—বাধার সৃষ্টি হয়নি। সাধারণভাবে আজ প্রায় সকল শ্রেণির সভা—সমিতির চরিত্রই বদলে গেছে। রাজনৈতিক চেতনার প্রভাব সর্বত্র সমান স্পষ্ট না হলেও, তা থেকে একেবারে মুক্ত থাকা সম্ভব কি না সন্দেহ। বিদ্বৎসভার ক্ষেত্রেও এই প্রভাব অল্পবিস্তর দেখা যায়। রাজনৈতিক সমস্যা ছাড়াও, সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনের সমস্যাও আজ আগেকার তুলনায় অনেক বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের ভাব—বিনিময়ের স্বাভাবিক সামাজিক ইচ্ছা—বাসনা পর্যন্ত স্তিমিত হয়ে আসছে মনে হয়। মানবোচিত সাধারণ উদারতাবোধটুকুও যেন আমরা হারিয়ে ফেলছি। এ হল ধনতান্ত্রিক যুগের অব্যর্থ অভিশাপ। বেশ বোঝা যায় যে আজ এই পরিবেশে, বিদ্বৎসভার মুক্ত অঙ্গনে, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে, বিদ্বৎজনদের পক্ষে উনিশশতকী কায়দায় মিলিত হওয়া খুবই কঠিন। তাই সেকালের মতো কোনো বিদ্বৎসভা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার কথা চিন্তা করা আজ আর সম্ভব নয়। কিন্তু একালের উপযোগী কোনো বিদ্বৎসভা আজও গড়ে উঠেছে বলে, অথবা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে হয় না। অথচ মানুষের জীবনের সামনে আজ এত জিজ্ঞাসা, এত সমস্যা এসে ভিড় করেছে যে বিদ্বৎজনদের পক্ষে বিচ্ছিন্নভাবে তার উত্তর বা সমাধানের নির্দেশ দেওয়াও সম্ভব নয়। বিদ্বৎজনদের ঐতিহাসিক ভূমিকারই আজ বৈপ্লবিক রূপান্তর হয়ে গিয়েছে। যে তথাকথিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য মানবতন্ত্র ও যুক্তিবাদের বাতি জ্বালিয়ে মানুষ মধ্যযুগের অন্ধকার গহ্বর থেকে আধুনিক ধনতান্ত্রিক যুগের তথাকথিত আলোকরাজ্যে প্রবেশ করেছিল, সেই যুগ এবং ধনতন্ত্রের সেই চেহারাও আজ নেই। আজ তাই উনিশ শতকের বিদ্বৎসমাজ বিদ্বৎসভা কোনোটারই পুনরুজ্জীবনের কথা ভাবা যায় না।

রচনাকাল : ১৩৬২ সন

। Lowie, Robert H. : Primitive Society, N.Y: Liveright, 1947. p. 10-11

। Encyclopaedia of Social Sciences (1951), vol. 6, ‘Family.’

। Pollard, A. F. : Factors in Modern History  (London, 1932)

। Encyclo. Soc. Sc. Vol. 9, ‘Learned Societies’

। Martin, A. V. : Sociology of the Renaissance London, 1945p. 27-64

। Pollard, A.F. op. cit. 3rd ch.

। পৃষ্ঠা ৫৯—এর ইংরেজি উদ্ধৃতি Johnson’s England :  An Account of the Life and Manners of his Age; ed, by, A.S. Turberville Oxford, 1933; vol. 1; 210-11

। Trevelyan, G. M. English Social History (London, 1948); 290-328

। Jhomson, G. D. : Stranger in India etc, London: Henry Colburn, 1843, p. 67-68

১০। Trevelyan, G. M: op. cit.

১১। Centenary Review of Asiatic Society of Bengal, `1784–1883, pt.I.

১২। Mannheim Karl : Man and Society London, 1940. p 84

১৩। সমাচার দর্পণ ৮ মার্চ ১৮২৩। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ”সংবাদপত্রে সেকালের কথা,” ১ম খণ্ড, ৯—১০ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।

১৪। Martin, A V op. cit, p. 39-40

১৫। Dey, Rev. Lal Behari : Recollections of Alexander Duff, London: Nelson, 1879, p. 28

১৬। Edwards, Thomas : Henry Derozio, Calcutta:Newman, 1884, p. 1-9

১৭। Dey, Lalbehari, op. cit. p. 29

১৮। ibid.

১৯। Bengal Past and Present, vols. 36 (Part II), 37 (Parts I & II), Rev. Krishna Mohan Banerjee by Harihar Das.

২০। Speeches of Babu Ram Gopal Ghose, with a Biographical Sketch Calcutta: Valmiki Press, 1885-1874, p. VII.

২১। Encyclopaedia of Social Sciences, (1951), vol. 6, ‘Free-thinkers’ by Robert Eisler, এ ছাড়া J.B. Bury লিখিত A History of Freedom of Thoughts (London, 1913) দ্রষ্টব্য।

২২। Duff, Rev. A. : India and India Missions (Edn. 1879) p. 640

২৩। Rev. L.B. Day : op. cit.

২৪। Duff, A. ; ibid.

২৫। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩২।

২৬। Bengal Hurkaru, November 22, 1824.

২৭। Duff, A. ; op. cit.

২৮। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ২য় খণ্ড, ১২১—১২৯’সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা থেকে কয়েকটি সভা—সমিতির বিবরণ সংকলন করা হয়েছে।

২৯। J. K. Majumdar : Raja Rammohun Roy and Progressive Movements in India, p. 271-74

৩০। Jhonson, J. W.: The Stranger in India, Calcutta: Art Press, 1941, p. 153

৩১। Bengal Hurkaru, February, 1843.

৩২। ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে ‘সংবাদপত্রের সেকালের কথায়’ ২য় খণ্ড, ১২৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।

৩৩। Bengal Hurkaru,  January 16, 1843

৩৪। Bengal Hurkaru, February 13, 1843. ”বেঙ্গল হরকরা” পত্রের ১৮৪৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সভার বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশিত হয়। দক্ষিণারঞ্জনের সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়, ১৮৪৩ সালের ২ ও ৩ মার্চ।

৩৫। ”তত্ত্ববোধিনী সভার” বিবরণ দেবেন্দ্রনাথের ”আত্মজীবনী, ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ”বাঙ্গালার ইতিহাস” (৩য় ভাগ), রাজনারায়ণ বসুর ”আত্মচরিত”, শিবনাথ শাস্ত্রীর History of the Brahmo Samaj (Vol.1) প্রভৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায়।

৩৬। Sastri, Sivnath : History of the Brahmo Samaj, vol. I, Calcutta: R. Chatterjee, 1919, p. 86-88

৩৭। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ১ ফাল্গুন ১৭৬৭ শক।

৩৮। The Proceeding of the Bethune Society (1859-60, 1860-61) Calcutta, 1862.

 The Proceedings and Transactions of the Bethume Society (Nov. 10. 1859– April 20, 1869), Calcutta, 1870.

৩৯। সুহৃদ সমিতির বিবরণ প্রাচীন পত্রিকাদি ছাড়া, মন্মথনাথ ঘোষের ”কর্মবীর কিশোরীচাঁদ” গ্রন্থে (ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ, ৯৯—১১১ পৃষ্ঠা) আছে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন জীবনচরিতেও কিছু কিছু বিবরণ পাওয়া যায়।

৪০। ”ফ্যামিলি লিটারারি ক্লাব” সম্বন্ধে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনী প্রসঙ্গে হরিহর দাস আলোচনা করেছেন—Bengal Past and Present, Vol. 38, Part I (July-September 1929)। ক্লাবের বাৎসরিক রিপোর্টও প্রকাশিত হত।

৪১। Transactions of the Bengal Social Science Association; 1867-1872.

* অ্যান্টনিও বেকাদেল্লি (১৩৯৪—১৪৭১) বিখ্যাত ইতালির কবি ১৪৪৩ সালে Accademia Pontaniana প্রতিষ্ঠা করেন। অ্যাকাডেমিয়া প্লেটোনিকা কসিমো দ্য মেদিচি (১৩৮৯—১৪৬৪) ১৪৩৮—৩৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। লরেজ্ঞে দ্য মেদিচি (১৪৪৯—১৪৯২) ছিলেন পৃষ্ঠপোষক।

Accademia delia Crusca, ইতালি ভাষার বিশেষত্ব বজায় রাখার জন্য ১৫৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬১২ সালে ইতালি ভাষার প্রথম অভিধান প্রকাশ করে। ১৬০৩ সালে ফেদারিকো সেসি (১৫৮৫—১৬৩০) Accademia del Lincei  বিজ্ঞান বিষয়ে চর্চার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভায় ২৫ এপ্রিল ১৬১১ গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪—১৬৪২) সদস্য হন।

* Institute de France ২৫ অক্টোবর ১৭৯৫ ফরাসি সরকার ভাষা, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সংগীত, স্থাপত্যবিদ্যা, মানবিক বিদ্যা বিষয় নিয়ে চর্চার জন্য প্রতিষ্ঠা করে।

* বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর গুরু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রসঙ্গে কৌতুক করে বলেছেন, সৌভাগ্যক্রমে তিনি আজিকার দিনে বাঁচিয়া নাই : তাহা হইলে সভার জ্বালায় ব্যতিব্যস্ত হইতেন। রামরঙ্গিনী শ্যামতরঙ্গিনী, নববাহিনী, ভবদাহিনী প্রভৃতি সভার জ্বালায়, তিনি কলিকাতা ছাড়িতেন সন্দেহ নাই। কলিকাতা ছাড়িলেও নিষ্কৃতি পাইতেন, এমন নহে। গ্রামে গেলে দেখিতেন… সভা সকল সভ্য সংগ্রহের জন্য আকুল হইয়া বেড়াইতেছেন।’—বঙ্কিম রচনাবলী, বিবিধ খণ্ড, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতাসংগ্রহ, ভূমিকা। ১২৯২

* সম্প্রতি বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের ‘সেমিনারে’র বাতিকের মতো।

* ইংলন্ডের এই সব সভ্য সোসাইটির বিবরণ Dr. R.K. Webb—এর The British Working Class Reader, 1790–1848–Literacy and Social Tension নামক গ্রন্থে বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। ব্রিটিশ মিউজিয়ম ও ইংলন্ডের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে রক্ষিত, এই সব সোসাইটি বহু অপ্রকাশিত মুদ্রিত ও অমুদ্রিত বিবরণ থেকে ডক্টর ওয়েব এই ইতিহাস রচনা করেছেন। পূর্বে যাঁরা করেছেন, তাঁদের বিবরণ বিশদও সম্পূর্ণ নয়। যেমন S.D.U.K. সম্বন্ধে ডক্টর ওয়েব লিখেছেন—‘‘There is, for example a pretty extravagant passage in G.D.H. Cole and Raymond Postage. The Common People (London, 1947). pp. 810-11. The only large-scale attempt at an assesment of the Society’s work is an unsatisfactory and unpublished dissertation in the University of London : M.C. Grobel. ‘The Society for the Diffusion of Useful knowledge, 1826-46.’ (p.176, Note 13.)

* এই অধ্যায়ের শেষে জ্ঞানোপার্জিকা সভার প্রচারপত্রটি মুদ্রিত হয়েছে।

* জর্জ টমসন এই সময় ‘জ্ঞানোপার্জিকা সভা’ ও ‘মেকানিকস ইনস্টিটিউটে’ অনেক বক্তৃতা দেন। ১৮৪৩ সালে Bengal Hurkaru ও The Bengal Spectator পত্রে তাঁর অনেক বক্তৃতা প্রকাশিত হয়। পরে গ্রন্থাকারেও কিছু বক্তৃতা সংকলিত হয়।

* বিনয় ঘোষ : সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭১—৭৩

* The Fifteenth Anniversary Report of the Family Literary Club pp. 27-29.

পরিশিষ্ট

সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভার প্রচারপত্র

COUNTRYMEN,––Though humiliating be the confession, yet we cannot, for a moment. deny the truth of the remark so often made by many able and intelligent Europeans, who are, by no means, inimical to the cause of native improvement, that in no one department of learning are our acquirements otherwise than extremely superficial. We need only examine ourselves in order to be convinced of the justice of the remark. After the ground-work of our mental improvement has been laid in the School, (and a school tution seldom does more) we enter into the world and never think of building a solid superstructure. The fate of our Debating Associations, most of which are now extinct, while not one is in a flourishing condition, as well as the puerile character of the native productions that appear in the periodical publications are lamentable proofs of this sad neglect. If a tree is to be known by its fruits, where, with but one or two solitary exceptions, are the fruits to which we can point with pride and satisfaction, as manifesting any degree of intellectual energy or extent of learning? We have ever sincerely regretted the want of an institution which should be the means of promoting frequent mutual intercourse among the educated Hindus, and of exciting an emulation for mental excellence. There is at present no occasion whereby we are ever called upon to congregate on an extensive scale for the purpose of mutual improvement, and whence we may receive an impetus for applying ourselves to useful studies. Is it then not desirable unite in such a laudable pursuit, by which the bonds of fellowship may be strengthened, the acquisition of knowledge promoted, and the sphere of our usefulness intended?

With a view therefore to create in ourselves a determined and well regulated love of study,  which will lead us to dive deeper than the mere surface learning, and enable us to acquire a respectable knowledge on matters of general and more especially, of local interest, we have thought it expedient to invite you to meet, in order to consider the proposal of establishing an institution which, in our humble opinion, is eminently calculated not only to effect this great end but likely to promote mutual good feeling and union–an object of no less importance. We cannot, of course, within the limits of circular, give a detailed account of the plan we propose to lay before you, but allow us to state the following brief outline.

Such members of the proposed Society, as may be willing, should undertake to deliver at its meetings, written or verbal discourses, on subjects studied to their respective tastes at such times as may be previously fixed by them with a view to their convenience, and to the degree of research and attention which the subjects may require, and, if they should fail without satisfactory reasons, to fulfil their pledges, they will be liable to pay a pecuniary fine. The purpose of this circular is to call a general meeting to consider the propriety of establishing the purposed institution, and to arrange the details.

It is at this general meeting, Gentlemen, that we most earnestly solicit your attendance. You must be well aware that the success of a public object, like the one we propose, must depend on the degree of cordial co-operation we may receive from the members of our community. We cannot believe that in such a cause, coldness will be manifested by any person that entertains the least regard for his own improvement. or breathes any love for his own country, and we flatter ourselves with the hope, that we shall meet with your heart support in a proposal. which none can look upon with ‘indifference, unless lost to all sense of duty, or sunk in apathy Those who may, from circumstances, be unable to take an active share in our proceedings, can at least countenance the object by their presence, for which they may be assured of our thanks.

We have, through the kindness of Baboo Ramcomul Sen, Secretary to the Sanscrit College, obtained permission to use the Sanscrit College Hall for our meeting, where precisely at 7 O’clock P.M. on Monday, the 12th March next, we earnestly entreat and hope, that every one of you, Gentlemen, will have the godness to try your best to be present.

Calcutta, February 20, 1838

 TARINEY CHURN BANERJEE

 RAMGOPAL GHOSE

 RAMTONOO LAHIRY

 TARA CHAND CHUKERBUTTEE

 RAJKRISHNA DAY

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *