যদিও বহু জিনিসেই টান পড়তে শুরু করেছে।
কালি এনেছিলাম জাহাজ থেকে। সেটা এখন শেষ। জল মিশিয়ে বাড়াতে শুরু করেছিলাম আধাআধি সময় থেকে। ফের জুল, ফের জ্বল, চলেছিল এইভাবেই। ইদানীং এমনই দাঁড়িয়েছে তার রং তাতে সাদা কাগজে লিখলে কোনো কিছু আর বোঝা যায় না। সব সাদা। ফলে লেখা বন্ধ করতে হয়েছে। সেটা আমার অত্যন্ত বেদনাদায়ক। লিখে প্রকাশ করতে পারতাম এতাবৎ মনের নানান অবস্থার কথা। এখন শুধু ভাবনা। আর নিজের সঙ্গে অনবরত কথা বলা। এইভাবেই নিজেকে এখন প্রকাশ করতে শুরু করেছি।
ভাবতে ভাবতে নানান কথাই মনে পড়ে। মিল পাই অনেক কিছুর। যেমন বাবার আদেশ অগ্রাহ্য করে আমার সেই হল–এ পলায়ন। তারিখটা স্পষ্ট মনে আছে। একই তারিখে জলদস্যুদের হাতে আমি পড়েছিলাম। দুয়ের মধ্যে আশ্চর্য মিল।
প্রথম জাহাজ ডুবির পর যেদিন ইয়ারমাউথে গিয়ে উঠলাম, সেটাও সেই একই তারিখ। অবাক কাণ্ড, যেদিন পালালাম জলদস্যুদের কবল থেকে হিসেব করে দেখেছি সেটাও সেই একই তারিখ।
আমার জন্মও ঐ দিন অর্থাৎ ৩০শে সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় বার ঝড় ঝাঁপটার তাড়নায় সঙ্গী সাখীদের হারিয়ে যেদিন এই দ্বীপে এসে উঠলাম, সেটাও ঐ ৩০ তারিখ। অদ্ভুত এক সামঞ্জস্য আছে এই ঘটনালোর মধ্যে। একথা এতদিন আমার মনে উদয় হয় নি। আজই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম। বিস্কুটও সব ফুরিয়ে গেছে। বলব কি সে যেন আমার জীবনের এক চরম সংকটের মুহূর্ত। শেষ হবার অনেক আগে থেকেই আমি হিসেব নিকেশ করে খরচ করতে শুরু করেছি। একটা মাত্র বিস্কুট সারাদিনে একবার। তা-ও কি থাকে। একবছর এইভাবে চালাতে চালাতে দেখি সঞ্চয় শেষ। এদিকে চাষবাসেও তখন তেমন সুবিধে করে উঠতে পারি নি। চলল সেইভাবে আরো একটা বছর। তারপর ফসল ঘরে তুললাম। সে আনন্দ আমার! এই একটা বছর তো বলতে গেলে শুধু মাংসের উপরই চালাতে হল।
পোশাকেরও চরম দুরবস্থা। কটা চেক কাটা জামা শুধু আছে–জাহাজে একটা বাক্সের মধ্যে পেয়েছিলাম। আর সব ছিন্ন ভিন্ন। এগুলো আর ভয়ে পরি না। খালি গায়েই থাকি। মাঝে মাঝে মনে হয়, কী আর দরকার আমার পোশাকে, একলা তো মানুষ। যদি নগ্ন অবস্থায় ঘোরাফেরা করি কে আর আমাকে দেখতে আসছে। সেইভাবে কদিন চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু পারি নি। রোদের যা তাত! পিঠ যেন একটু পরে পুড়তে শুরু করে।
পিঠের চামড়া দু চার জায়গায় ঝলসে গেছে। তখন ঠিক করেছি, খালি গায়ে আর থাকব না, যেমন তেমন হোক, একটা জামা গায়ে রাখতেই হবে। তাতে রোদের তাপ থেকে অব্যহতি তো পাবই উপরন্তু হাওয়া চলাচল করে শরীর জুড়িয়ে রাখবে। একটা টুপিরও দরকার। খালি মাথায় থাকলে দেখি একটু পরেই মাথা ধরে যায়। এটা কদিন ধরে খুব টের পাচ্ছি। কিন্তু করব কী-টুপি যে আমার নেই।
তখন শুরু হল ভাবনা। ছিল যে ছেঁড়া খোঁড়া কাপড় চোপড়, বসলাম তাই নিয়ে। জ্যাকেটও একটা বানাতে হবে। তাতে জামাটা রক্ষা পাবে। তা সে যা সেলাইয়ের হাত আমার!শেষাবধি যা তৈরি হল তাকে বাস্তব অর্থে জ্যাকেট কিছুতেই বলা যায় না। কিন্তু তকিমাকার একটা জিনিস। হোক গে। আমার তাতে কী যায় আসে! দেখতে তো আর কেউ আসছে না। কাজ চললেই হল।
টুপির প্রয়োজনটা মেটালাম একটু অন্যভাবে। জীবজন্তু এতাবৎ যত মেরেছি চামড়া তো ফেলি নি একটারও, শুকিয়ে রেখেছি রোদে। সে একেবারে খটখটে শুকনো যাকে বলে। ভাঁজ করতে গেলে মড়মড় করে আওয়াজ হয়তো তাই দিয়েই বানাতে বসলাম টুপি। হল কিন্তু ভারি চমৎকার। মস্ত বিশাল তার আকৃতি। লোমের দিকটা উপরে। তাতে বৃষ্টি ভিজলে কোনোক্রমে জল দাঁড়াবার উপায় নেই, পিছলে পড়ে যেতে সময় লাগবে না। মোটমাট খুশি আমি আমার নিজের কাজে। শেষে আত্মবিশ্বাস এমনই বাড়ল, চামড়া দিয়েই বানিয়ে ফেললাম একটা ছোটো মাপের কোট আর পরনের একজোড়া সরু পা প্যান্ট। গোড়ায় ভেবেছিলাম খুব গরম হবে। পরার কিছুক্ষণের মধ্যেই না খুলে পারব না। পরে দেখি রোদের অপে শরীর এতে ঠাণ্ডাই থাকে। সে ভারি আরাম। রোদ বৃষ্টি দুয়ের হাত থেকেই যাকে বলে পরিপূর্ণ অব্যাহতি।
এবার বসলাম একটা ছাতি বানাতে। ছাতির খুব দরকার। টুপি পরলে মাথায় রোদ লাগে না ঠিকই, কিন্তু সে হাঁটাচলা করার সময়। এক জায়গায় বসে কাজ করতে করতে তাপে মাথা গরম হয়ে যায়। তাছাড়া বৃষ্টির হাত থেকে শরীর সম্পূর্ণ বাঁচাতে ছাতি একটা অত্যন্ত দরকার। এটার কিছু কিছু কাজ আমি জানি। দেখেছি তো ব্রাজিলে। রোদের তাপ সেখানেও কিছু কম নয়। ছাতি সেখানে প্রায় সকলের সঙ্গেই থাকে। এখানে গরম আরো বেশি। তা দু দুটো বরবাদ করে তিন নম্বরটা মোটামুটি প্রয়োজন মাফিক তৈরি হল। তা-ও আবার ঝঞ্ঝাট–তাকে পারা যায় না বন্ধ করতে। এমন ছাতি নিয়ে কি আর যত্রতত্র যাওয়া যায়। শেষে অনেক হিসেব নিকেশ করে অনেক কারিগরি বিদ্যে খাঁটিয়ে সেরকমও একটা বানাতে পারলাম। ছাউনিতে সেই জন্তুর ছাল। তার উপরটায় লোম, ফলে বৃষ্টি এলে চালের উপর থেকে জল পড়ার মতো সব জলই পড়ে যায়। তখন ভারি খুশি আমার। যেখানে যেতাম ভাঁজ করে ছাতিটা নিয়ে যেতাম বগলের নিচে। বলতে গেলে কালে দিনে আমার বাহন হয়ে দাঁড়াল।
এবং এইভাবেই এই দ্বীপে আমি বেঁচে বর্তে আছি। পাঠক বুঝতে পারছেন কত সুখী আমি, কত তৃপ্ত। এর পিছনে আগাগোড়াই তো ঈশ্বরের দয়া। শুধু কথা বলার লোক পাই না এই যা দুঃখ। তা ও জয় করি ভাবনা দিয়ে। নেই তো কী, আমি নিজেই তো আছি। এই তো মন আমার। এর সঙ্গেই নয় কথা বলি।
তখন সেইভাবে নিজেই প্রশ্ন করি নিজেকে। নিজেই দিই জবাব। কথায় কথায় এসে পড়ে ঈশ্বরের কথা। অমনি মন আমার প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। একাগ্রচিত্তে তাঁকে স্মরণ করতে শুরু করি।
এর পর পাঁচটা বছর বলতে গেলে নিরুত্তাপ নিরুদ্বিগ্ন দিনযাপন। অদ্ভুত অপ্রাকৃত আর কিছু ঘটে নি বা ঘটবার সুযোগও হয় নি। অর্থাৎ নৈমিত্তিক যে সব কাজ আমি করি তাই নিয়েই নিজেকে রাখি ব্যস্ত। যেমন ধরুন সকালে বন্দুক কাঁধে বেরিয়ে পড়া, কি অবসর সময়ে চাষবাসের কাজ–সেখানে জমি তৈরি থেকে শুরু করে বীজ বোনা, ফসল ফলানো, ফসল কাটা, ফসল ঝাড়া বাছা–সব কিছুই আছে মোটের উপর গতানুগতিক যাকে বলে। ব্যতিক্রম হিসেবে সেই ডোঙা তৈরি আর তাকে জলে ভাসাবার অনন্ত প্রচেষ্টা। ডোঙা যে তৈরি করেছি সে কথা তো আগেই আপনাদের জানিয়েছি। জল অব্দি নিয়ে যাওয়ার যাবৎ প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হল তখন মরিয়া হয়ে খাল কাটতেই শুরু করলাম। ঠিক খাল বলা যায় না, নালা আর কি। দু ফুটের মতো প্রশস্ত, চার ফুট গভীর। দৈর্ঘ্যে ধরুন প্রায় আট মাইল। একে বোধহয় অসাধ্য সাধনই বলা উচিত। গোড়ায় ডোঙা তৈরির পর নানারকম কসরৎ করেও যখন পরলাম না তাকে জলের কাছে নিয়ে যেতে, তখন হতাশ হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু হাল ছাড়ি নি। জেদ চেপে গিয়েছিল। তাই দুটি বছর একটানা খাটুনির পর নালার জল ঢুকিয়ে যখন তাকে সত্যি সত্যি ভাসাতে ভাসাত জলে এনে নামালাম–সে কী আনন্দ আমার, কী খুশি।
আর অবাকও। এত ছোটো আমার নাও! এত সুত্ব! বুঝি নি তো এতদিন। জলের বিশালতার মধ্যে পড়ে তার ক্ষুদ্রত্ব নজরে পড়েছে। একে নিয়ে কীভাবে বেরব আমি সমুদ্র যাত্রায়! আগে ভাগেই তো আর নদী পার হয়ে ওপাশের জমিতে উঠছি না, আগে ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে চারপাশ। কী আছে না আছে সেটা বাইরে থেকে আগে জরিপ করার প্রশ্ন। তারপর তো গিয়ে ওঠা। কিন্তু প্রায় চল্লিশ মাইলের মতো পথ টহল দেওয়া এইটুকু ডিঙিতে কি সম্ভব।
তখন ছোট্ট একটা মাস্তুল খাটালাম। তাতে জুড়ে দিলাম পাল। এখানে আছে তো মজুত আমার কাছে। জাহাজ থেকে আনার পর থেকে তাবু তৈরি ছাড়া তো অন্য কোনো কাজে লাগে নি। পাল খাঁটিয়ে তবে খানিকটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
কটা ছোটো খাটো বাক্সও বানালাম। দেরাজের মতো। তাতে থাকবে আমার প্রয়োজনীয় নানান সামগ্রী। খাদ্য দ্রব্য থেকে শুরু করে বন্দুক, গোলা বারুদ- সব। এগুলোকে জলের বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচিয়ে শুকনো রাখাটাই সবচেয়ে বেশি দরকার। বন্দুক রাখার জন্যে অবশ্য আলাদা একটা জায়গা করলাম। খোলের খানিকটা চেরা মতো। ঠিক বন্দুকের মাপে মাপে তৈরি। সেভানে ঢুকিয়ে সামনে কাঠের ফালি দরজাটা আটকে দিলে সাধ্য কি জল ঢোকে।
ছাতাটাকেও খুলে মাস্তুলের সঙ্গে আটকে দিলাম। ভালোই হল। ছায়া পাব সর্বদা। রোদের তাপ যে ইদানীং একদম সহ্য করতে পারি না। মোটমাট সব রকম ভাবেই আমি এখন প্রস্তুত। এবার পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন। ভেসে পড়লাম একদিন ঈশ্বরের নাম করে। কিন্তু সে এমন দূরে নয়। কাছেই। আসলে আমার দরকার ডোঙা কেমন চলে সেটা একটু খতিয়ে দেখা। ফিরে এলাম কুলের কাছে। তারপর থেকে রোজই একটু একটু করে এগোই। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে এই নতুন কাজটাও ঢুকে গেছে। কদিন পরে মনে হল–তাইত, ঘুরে দেখে আসি না একদিন নিজের সাম্রাজ্যটা। কখনো তো একনাগড়ে পুরোটা দেখা হয় নি। তখন দু ডজন মতো রুটি নিলাম সাথে আমারই নিজের হাতে তৈরি, এক কলসী চাল ভাজা নিলাম,এটা খাই খুব, আমার খুব ভালো লাগে। আর এক বোতল পানীয়, আধখানা ছাগলের প্রমাণ মাংস, কিছু বারুদ, দুটো বাড়তি চামড়ার কোট –রাত্রে গায়ে দিয়ে ঘুমোবার জন্যে দরকার হবে। ব্যাস। আর কী। এবার রওনা হলেই হয়।
নভেম্বর মাসের সেটা দু তারিখ। দ্বীপে আসার ছ বছর পর। এই ছ বছর সময়কে আপনারা বলতে পারেন নির্বাসন বা বন্দীত্ব। আমি বলি আমার রাজ্য শাসনের ছ বছর। সে যাই হোক, ভেসে পড়লাম। দ্বীপ তো বড় নয় তেমন, ঘুরে দেখতে বেশি দিন লাগল না।। পুব প্রান্ত ধরেই চলেছি। খানিকটা এগিয়ে দেখি দ্বীপের পাহাড়টা সিধে নেমে এসেছে। সমুদ্রে, কিছুটা অংশ ভাসমান, কিছুটা জলে ডোবা। এগিয়ে গেছে অনেকটা দূর। তা প্রায় ক্রোশ খানেক তো বটেই। মাঝে খানিকটা আবার বালির চড়া মতো। তারপর ফের পাহাড়। বেশ উঁচু। তারই পায়ের নিচ দিয়ে চলে গেছে সমুদ্র। তখন সেই বালির চড়ায় নোঙর ফেললাম।
নোঙর অর্থে সত্যি সত্যি যেমনটি দেখা যায় সচরাচর তা নয়। লোহার একটা চাই। তার সঙ্গে ভারী কয়েকটুকরো পাথর বাধা। লোহাটুক আমি জাহাজ থেকে নিয়ে এসেছিলাম। আর পাথর তো দ্বীপে কিছু কমতি নেই। দুয়ে মিলে নোঙর।
তারপর বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অঞ্চলটা ভালো ভাবে জরিপ করে দেখতে।
উঠলাম গিয়ে সেই পাহাড়ের মাথায়। দেখা যায় অনেক দূর অব্দি। পাহাড়ের এদিকে স্রোত প্রবল। চলেছে পুবের দিকে। অনেকক্ষণ ধরে স্রোতের গতি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করলাম। কেননা ফিরে যদি আসি এই পথ ধরে তবে এই স্রোতের টানে আমাকেও পড়তে হবে। সেক্ষেত্রে ডোঙা বেতাল হয়ে সমুদ্রের দিকে চলে যাবার আশঙ্কা। দ্বীপে ফিরে আসা তখন মুশকিল। তবে বিস্তার হিসেব করে দেখলাম সমুদ্রের দিকে যাবার সম্ভাবনা কম। প্রথম স্রোতের ধাক্কায় যদিও বা খানিকটা চলে যাই। বাতাসে ঘূর্ণির টান আছে। তাতে ডোঙা আমার ফের কূলের দিকেই ফিরে আসবে।
তবু দুদিন সেখানেই নোঙর করে অপেক্ষা করতে হল। বাতাস উঠেছে। দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে ছুটে আসছে ঝড়ের বেগে। এ অবস্থায় ভেসে পড়ার ঝঞ্জাট অনেক। পারব না বাতাস কাটিয়ে পার হয়ে যেতে। এবং একটু বেচাল হলে সঙ্গে সঙ্গে ডোঙা উলটে যাবারই সম্ভাবনা।
তিন দিনের দিন দেখি শান্ত ভাব। সমুদ্র প্রায় স্থির। নোঙর তুলে রওনা দিলাম। বলব কি, দাঁড় বাইতে না বাইতে দেখি এক দমকে ডোঙা চলে গেল অনেকটা দূর। জল সেখানে রীতিমতো গভীর। আমি তো থ। নির্ঘাৎ কোনো চোরা স্রোতের মুখে পড়েছি, তাকে এড়ানো আমার সাধ্যের বাইরে। হায় হায়, এখন উপায়! যত বাই দাঁড়, মৃত কুলের দিকে ফিরে আসার চেষ্টা করি-সব ব্যর্থ। পারি না এতটুকু এগোতে। বরং সরতে সরতে গভীর সমুদ্রের দিকেই এগিয়ে চলেছি। সে অবস্থায় আমার তো মৃত্যু অনিবার্য। হাজার হাজার মাইল ব্যাপী সমুদ্র। জানি না কোথায় পাব ফুলের রেখা। ডুবে মরার ভয় নেই। কেননা সমুদ্র দর্পণের মতো শান্ত। ভয় অনাহারে মরার। কি আছে আমার সঙ্গে খাদ্য। মাত্র কয়েকটা রুটি, চাল ভাজা, এক কলসী জল আর একটা কাছিম। এটা সাম্প্রতিক সংযোজন। নোঙর করে থাকা কালীন হাতের গোড়ায় পেয়ে তুলে নিয়েছি নৌকোয়। এমন একটা বড় নয়। এই সামান্য রসদ নিয়ে যদি ভেসে পড়ি তবে তাতে কদনি চলবে আমার।
তখন কী আক্ষেপ আমার! নিজের প্রতি নিজেরই কী প্রচণ্ড ক্রোধ! হায় হায় কত অবিবেচক আমি! ঈশ্বরের দেওয়া সুখের আশ্রয়-আমি অবহেলা করে খুঁজতে চলেছিলাম নতুন দেশ। দেশই তো বলব, না কি দ্বীপ! সব রইল পিছনে পড়ে। আমার ঘর, বাড়ি, আমার চাষের জমি, গুহা, গৃহপালিত পশু-এখন সামনে শুধু অনিশ্চিত আর অজানা। দ্বীপটাকে আমি যে ভালবেসে ফেলে ছিলাম। ছ ছটা বছর যে কাটিয়েছি ওখানে। ঐ তো এখন আমার স্বদেশ। সব ফেলে কেন যে বেরিয়েছিলাম রাজ্য জয়ের আশায়। ঈশ্বরের দানে অর্থাৎ আমি সন্তুষ্ট হতে পারি নি। ভিতরে ভিতরে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিল অসন্তোষ। আমি পাপী। আমার তো শাস্তিই প্রাপ্য।
মোটমাট তখন আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। আর কী লাভ চেষ্টা করে। পাল, তখন গোটানো। খোলা থাকলে হয়ত আরো কত দূরে চলে যেতাম তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে তখন আমি হাত গুটিয়ে বসে আছি। বেলা তখন প্রায় দুপুর। মধ্য গগনে সূর্য। একটু একটু করে পশ্চিমের দিকে হেলতে শুরু করেছে। হঠাৎ বলব কী, যেন দক্ষিণ পুব দিক থেকে এক দমক বাতাস এসে আমার মুখে চোখে ঝাঁপটা মারল। আমি তো থ! একি ঈশ্বরেরই আরেক করুণা! নাকি আমার মনের ভুল। তখন উঠে দাঁড়ালাম দেখি সত্যি সত্যিই হাওয়া। রীতিমতো জোরে জোরে বইতে শুরু করেছে। অমনি পাল খাটালাম। হাতে নিলাম দাঁড়। শেষ চেষ্টা এবার করতে হবে। যেমন করে পারি কুলে পৌঁছতেই হবে।
চলেছি পুর মুখো। স্রোত তেমন নেই, হাওয়াই ঠেলে নিয়ে চলেছে আমায়। খানিক দূর এগিয়ে দেখি পাহাড়ের একটা অংশ জলে প্রায় ডোবা। তার উপর দিয়ে তরতরিয়ে বয়ে চলেছে জলরাশি। বলতে গেলে প্রচণ্ড বেগ সেই জলের। দুমুখে ভাগ হয়ে ভেঙে পড়ছে দুদিকে। একটা চলেছে দক্ষিণের দিকে। আরেকটা উত্তর মুখে। আর সেখানে ভীষশ ঘূর্ণি। ঘুরতে ঘুরতে প্রবল তোড়ে জল চলেছে এগিয়ে ।
আমার অবস্থাটা একবার চিন্তা করুন। মই বেয়ে উঠছিল একটা মানুষ। সরে গেছে মইটা পায়ের নিচ থেকে, অনিবার্য তার পতন এবং মৃত্যু এহেন অবস্থায় সে আকস্মিক ভাবে রক্ষা পেল। কিংবা ধরুন ডাকাতের হাতে পড়েছে একজন। খুন করবে তাকে তার–সে যে কোনো কারণেই হোক, নিস্তার পেল আমি যেন সেই রকমই একজন। কোন অজানা অনিশ্চিতের পানে একটু আগে চলেছিলাম ভাসতে ভাসতে, এখন ফিরে এলাম। আমার আর দুশ্চিন্তার তেমন কোনো কারণ নেই। কী যে আনন্দ সেই মুহূর্তে! পাল তুলে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলেছে ডোঙা। মৃদু মন্দ বাতাস। আর তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়া স্রোত। আমি কূলের দিকেই ফিরে চলেছি।
তবে যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম ঠিক সেই দিকে নয়। সেটা পুব। চলেছি কোনাকুনি। প্রায় সেখান থেকে মাইল পাঁচেক দূর দিয়ে। উত্তর মুখো। কল এখনো অনেক
তবু চেষ্টার তো কামাই নেই। লক্ষ্য কিন্তু সেই পাহাড়ে ফিরে যাবার দিকে। দাঁড় বাইছি সমানে। একটু পরে দেখি সব নিরর্থক। সাধ্যের বাইরে আমার। কুল থেকে এখন প্রায় ক্রোশ খানেক দূরে। অবাক কাণ্ড। দুদিকে বয়ে চলেছে দুই ভিন্ন মুখী স্রোত। একটা দক্ষিণে একটা উত্তরে। মাঝখানে খানিকটা অঞ্চল স্রোতহীন। নিস্তরঙ্গ স্থির দর্পণের মতো। বইছে মৃদুমন্দ বায়ু। পালে লাগছে তার ঝাঁপট। দুহাতে টেনে চলেছি দাঁড়। ডোঙা সেই তরঙ্গহীন জলের উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে।
বেলা তখন প্রায় চারটে। দেখি মাইলখানেক দূর যদিও তখন কুল, সেই পাহাড়ের একটা অংশ জলের নিচে ডোবা অবস্থায় এদিকেও এগিয়ে এসেছে। তার ধারে ধারে অসংখ্য ঘূর্ণি প্রবাহ। আর স্রোত। একটু এগিয়ে জলের উপর মাথা তোলা পাহাড়। হাঁটতে হাঁটতে সেখান থেকে স্বচ্ছন্দে ডাঙায় গিয়ে ওঠা যায়। ডোঙা এনে তারই গায়ে ভেড়ালাম। তারপর নেমে পড়লাম এক লাফে।
অমনি হাঁটু গেড়ে ঈশ্বরের প্রার্থনা। এটা আমার প্রথম কাজ। তাঁরই দয়ায় আমি জীবন ফিরে পেলাম। আমি ঘোর পাপীপ্রভু আর কোনোদিন আমি এমন অপরাধ করব না। তোমার পবিত্র দান অগ্রাহ্য করে হাত বাড়াব না অনিশ্চিতের পানে। দয়া কর প্রভু, দয়া
তারপর ডোঙাটাকে বেঁধে ফেললাম মস্ত একখণ্ড পাথরের সাথে। শরীর আর যেন বয় না। অসীম ক্লান্তি গেছে সারাদিন। এবার চাই বিশ্রাম। আর ঘুম।
ডোঙার মধ্যেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
উঠে দেখি সকাল। ঝকমক করছে রোদ। আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি। শুধু মনের গভীরে বাড়ি ফিরে যাবার একটা প্রচণ্ড অগিদ। বাড়ি অর্থে আমার সেই অস্তানা। কিন্তু যাব কীভাবে? আবার যে স্রোতের মুখে ভেসে পড়ব তাতে ভয়। ফের যদি যাই অজানার দিকে ভেসে! যদি স্রোত ফের আমাকে টেনে নিয়ে যায়! হেঁটে কুলে গিয়ে ওঠার যে কথাটা ভেবেছিলাম সম্ভব হবে, তাও দেখছি এখন আর সম্ভব নয়। এগিয়ে পাহাড়টা পুরোপুরি জলের নিচে। সেখানে ভীষণ স্রোত। এ অবস্থায় ডোঙা নিয়েই আমাকে যেতে হবে। সেটা একমাত্র পশ্চিম কল ধরেই সম্ভব। কূলের ধারে ধারে বেয়ে যাব ডোঙা, তাতে জলের তোড়ে ভেসে যাবার কোনো আশঙ্কা নেই। যেতে হবে অবিশ্যি বেশ খানিকটা দূর। তা হোক। তবু নিরাপদ তো।
এগোলাম সেই ভাবেই। পথে পড়ল একটা ছোট্ট নদীর মুখ! সেখানে গবগবিয়ে জল টুকছে ভিতর দিকে। পেরিয়ে গেলাম। দেখি ভারি চমৎকার একটা খাজ মতো। সেখানে ঢেউ মোটে নেই। ডোঙা স্বচ্ছন্দে রাখা যেতে পারে। যেন ছোটোখাটো একা পোতাশ্রয়। সেখানে ডোঙা ঢুকিয়ে বেঁধে রাখলাম। উঠলাম ডাঙায়। নিশ্চিন্ত এখন। হাঁটতে হাঁটতে চললাম বাড়ির দিকে।
রোদ ততক্ষণে চড়েছে। ভীষণ তাপ। ছাতি আর বন্দুক তো আমার সারাক্ষণের সঙ্গী। খুলে ফেললাম ছাতি। আরো খানিকটা এগিয়ে সামনে পড়ল সেই টঙ। আমার নিরালা বিশ্রামের কুঞ্জ। যেমনটি ফেলে রেখে গিয়েছিলাম সেইরকমই আছে। আর এমনই কাণ্ড, দেখামাত্র এমন ক্লান্তি এসে ভিড় করল শরীরে, এমনই ঘুম ঘুম ভাব! সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গা ঢেলে দিলাম বিছানায়। তারপর ঘুম।
আচমকাই ভেঙে গেল ঘুম। বলব কী সে যা বিস্ময় আমার, যা চমক। আমার অবস্থায় পড়লে জানি না আপনারাও কতটা অবাক হতেন। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি কে যেন ডাকছে আমার নাম ধরে–রবিন, রবিন ক্রুশো, তুমি কোথায়? কোথায় ছিলে এতদিন? রবিন..
ঘুমের যেটুকু চটক ছিল শরীরে মুহূর্তে তো সবই উধাও। আমি থ। কে ডাকে এমন করে আমাকে এখানে!–রবিন, রবিন ক্রুশো, তুমি কোথায়? কোথায় ছিলে এতদিন?…সমানে ডেকে চলেছে আর একটু একটু করে জন্ম নিচ্ছে আমার মধ্যে ভয়। এ আবার কী ধরনের বিপদ রে বাপু! কে আবার এল আমার সুখের ঘরে আগুন জ্বালাতে। মোটমাট হতবিহ্বল আমি। সেই অবস্থাতেই ঘাড় তুলে চুপি চুপি উঁকি দিলাম। দেখি পোল। আমার সেই কাকাতুয়া। আমার বিছানার সামনে পায়ের কাছে বসে ঘাড় তুলে সমানে বলে যাচ্ছে একই কথা। আমারই শেখানো বুলি সব। আর গলা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আড় চোখে আমাকে দেখছে।
তবু ধাতস্থ হতে অনেকখানি সময় লাগল। মানুষ নয় এ যে আমারই কাকাতুয়া এটা আমার কাছে বিরাট সান্ত্বনার ব্যাপার। কিন্তু এল কী করে এতখানি পথ? ওর তো থাকার কথা গুহারই আশে পাশে। কেমন করে খুঁজতে খুঁজতে এতদূর এল! পোল্ই তো না অন্য কোনো কাকাতুয়া? তখন ডাকলাম নাম ধরে। কাছে এ গুটি গুটি উঠে বসল আমার হাতের উপর। তখন ফের সেই ডাক–রবিন, রবিন ক্রুশো, তুমি কোথায়? কোথায় ছিলে এতদিন?
তখন বুকে জড়িয়ে ধরে খুব একচোট আদর করলাম।
ফিরে এলাম বাড়িতে। কদিন ধরে কোনো কাজেই মন বসাতে পারি না। ঘুরে ফিরে কেবল মনে পড়ে সমুদ্রযাত্রার কথা। তার বিপদ, তার আতঙ্ক। তোলপাড় করে বেড়ায় তাই সর্বদা। আর এমন কাজ ভুলেও নয়। ভাবতেও শরীর আমার হিম হয়ে আসে। হাত পা যেন সেঁধিয়ে যায় পেটের ভিতর। এই সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ঈশ্বরের দেওয়া এই এত কিছু–সব ছেড়ে ছুঁড়ে আমি অবোধ ভেসে পড়েছিলাম কিনা অজানার টানে। ডেঙাটা পড়ে আছে এখনো একই অবস্থায়। থাক। আমার কথা ভাবতে পারছি না। ফের যদি সেইভাবে ভেসে যাই। দরকার কী আমার আর ডোঙায়। এই তো বেশ আছি।
একটা বছর বলতে গেলে ঠায় বসা। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে যে ভাবে মানুষ কাটায় দিন। দৈনন্দিন খাদ্য অন্বেষণে টহলদারী, ফসল ফলাবার প্রয়োজনীয় কাজ, রান্নাবান্না–এই শুধু আমার কাজ। এর বাইরে বলতে গেলে কোনো পরিশ্রমের কাজই করি না।
বসে বসেই কাজের যন্ত্রপাতি নিয়ে খুটখাট করি। এটা ওটা বানাবার চেষ্টা করি। দেখি কদিনের মধ্যেই দুটো ব্যাপারে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছি। এক হল কাঠের জিনিস তৈরির কাজ, আরেকটা মাটির বাসন বানাবার কৌশল।
মাটি দিয়ে এখন আমি সবই প্রায় বানাতে পারি। কুমোরের চাকা বানিয়ে নিয়েছি একটা। কাঠ দিয়ে। তাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তৈরি করি যাবতীয় জিনিস। অনেক সোজা এখন কলসী কি হাঁড়ি কি অন্য কিছু তৈরি করা। তামাক খাওয়ার একটা ইকোও বানিয়েছি। পাইপ যাকে বলে। তৈরি করতে সে যা নাকাল। কিছুতে পারি না গোছ করে আনতে। শেষে তৈরি যখন হল সে যা আনন্দ! পুড়িয়ে নিলাম আগুনে। আর চিন্তা কীসের। দিব্যি তামাক পুরে খোশ মেজাজে টানি। তা এরকম পাইপ জাহাজেও ছিল অনেকগুলো। ইচ্ছে করেই আনি নি। তখন তো জানতাম না দ্বীপে এত অজস্র তামাক গাছ আছে। মোটমাট এতদিন পরে নেশা করার একটা উপায় হল।
বুড়ি বোনার কাজেও বেশ পারদর্শিতা অর্জন করলাম। ঝুড়ি তো নিজের গরজেই বুনতে হয়। লাগে যে কাজে। এটা রাখা ওটা রাখা–দিনে দিনে জিনিস যে ক্রমশই বাড়ছে। বুনিও নানার আকৃতির। তাতে হাতল লাগাই। বয়ে নিয়ে যাবার যাবার তাতে সুবিধা হয়। ছাতি আর বন্দুক বাদে দৈনন্দিন টহলে আমার বেরোবার সময় এরকম একটা বুড়িও থাকে এখন আমার সঙ্গে। হয়ত ছাগল মারলাম একটা। তাকে অমনি বুলিয়ে ফেললাম কোনো গাছের ডালে। ছাল ছাড়ালাম। মাংস কেটে ঝুড়িতে রাখলাম। নিয়ে এলাম বাড়িতে। তাতে অতবড় গোটা ছাগলটা বয়ে নিয়ে আসার পরিশ্রম থেকে অব্যাহতি। কাছিম ধরলে আরো সুবিধে। গোটা কাছিমটা আর বাড়ি অব্দি বয়ে আনতে হয় না। কেটেকুটে ডিম কটা বের করে নিই, সঙ্গে দু-এক টুকরো মাংস। বাকিটা দিই ফেলে। ঝুড়িতে করে নিয়ে আসি। মোটামুটি খাটুনি আগের চেয়ে অনেক কম।
বারুদ কিন্তু কমতে শুরু করেছে। কতদিন আর চলে। সব জিনিসেরই শেষ বলে একটা কথা আছে। আর এ এমনই এক পদার্থ। যা আমি দ্বীপে মাথা খুঁড়ে মরলেও পাব না। তখন উপায়! যদি বারুদ না থাকে তবে কী করে মারব ছাগল? কী করে খাদ্য সংগ্রহ করব? অর্থাৎ বিকল্প ব্যবস্থা আমাকে ঠিক করে নিতে হচ্ছে। যদি এখন থেকেই শুরু করি পশুপালন। পশু খামার বলতে যা বোঝায় আর কি। একটা দুটো নয়, চাই আমার অগণিত অর্থাৎ ছেলে, তার ছেলে, তার ছেলে এইভাবে ক্রমশ বংশ বৃদ্ধি হবে। আমারও চিরদিনের মতো সমস্যা মিটবে।
এখানে আসার বছর তিনেকের মাথায় এরকম একটা প্রচেষ্টা নিয়েছিলাম। একটা বাচ্চা এনে পুষেছিলাম। মাদী। দেখতে দেখতে চোখের সামনেই বেশ বড় সড় হয়ে উঠল। তা একটা মদ্দা যে চাই। নইলে বংশ বৃদ্ধি যে হবে না। কিন্তু সে আর জোটানো সম্ভব হল না। আমারই চোখের সামনে সে বুড়ি হল। কতবার ভেবেছি লাভ কী একে বাঁচিয়ে রেখে, মেরে ফেললেই তো সব চুকে যায়। পারি নি মারতে। হাত আমার ওঠে নি। শত হলেও মায়া যে। শেষে এই গত বছর মরল নিজে থেকেই।
অর্থাৎ ওভাবে হবে না। নতুন পন্থা আবিষ্কার করতে হবে। দেখতে দেখতে দশটা বছর পার হল। এগার বছর চলেছে এখন। বারুদ বলতে গেলে তলানিতে এসে ঠেকেছে। নতুন প আবিষ্কার না করলে আমার সমূহ বিপদ। শেষে ভেবেচিন্তে ফাঁদ পাতব বলে ঠিক করলাম।
ফাঁদে ধরা পড়লে সুবিধে এই জ্যান্তই পাব শিকার। হাতে পায়ে একটু হয়ত চোট খাবে। সেটা এমন কিছু নয়। মোটমাট চাই আমার মাদী মন্দা দুরকমই ছাগল। তখন গর্ত খোঁড়া শুরু করলাম।
সে মস্ত বড় বড় গর্ত। ওরা যেখানে ঘাস টা খেতে আসে তারই আশেপাশে। উপরে লতাপাতা দিয়ে বুজিয়ে দিলাম। যব গাছের ডগা ওঁদের খুবই প্রিয় খাদ্য। দিলাম তার কিছু বিছিয়ে। তা কদিনে দেখি গাছ টাছ সব উধাও। কখন এসে কায়দা করে খেয়ে গেছে। কিন্তু গর্তে পড়ে নি। তখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা ছাড়া আর কী উপায় থাকতে পারে! শেষে ফল পাওয়া গেল। দেখি দুটো গর্তে ধরা পড়েছে মোট চারটে ছাগল। একটা রাম পাঠা। সেটা পড়েছে একটা গর্তে। আরেকটায় সর্বমোট তিনটে বাচ্চা। তার মধ্যে দুটো মাদী আর একটা মদ্দা।
বাপরে বাপ, পাঁঠামশায়ের সে কী তেজ। উঠতে তো পারে না, আমাকে উঁকি মারতে দেখে সে যা তর্জন গর্জন। শিং উঁচিয়ে পারলে যেন তখনি পুঁতিয়ে পেট ফুটো করে দেয়। তা সব জারিজুরি পারি আমি এক নিমেষে বন্ধ করে দিতে। একটি মাত্র গুলিই তার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু তা তো আমার মনোবাসনা নয়। আমি চাই জ্যান্ত ধরে নিয়ে যেতে। কিন্তু একে নিয়ে গিয়েই বা কী লাভ। যদি এই ভাবে আমাকে সদা সর্বদা আক্রমণ করার চেষ্টা করে, কী করে একে আমি পোষ মানাব। তখন ভিতরে খানিকটা মাটি ফেলে দিলাম। সেই মাটির উপর ভর দিয়ে উঠে গর্তের বাইরে বেরিয়ে সে যা দৌড় তার! দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য অবস্থা বলতে যা বোঝায়। বেদম ভয় পেয়ে গেছে। একটু পরে দেখি জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল।
চোর পালালে মানুষের যেমন বুদ্ধি বাড়ে, আমারও তখন ঠিক সেই অবস্থা। সে কী হয় হতাশ আমার! ধরা পড়ল ফাঁদে আর আমি ভালোমানুষ করে ছেড়ে দিলাম! মানত না কি পোষ! আলাৎ মানত। সিংহকে মানায় না পোষ! সে ক্ষেত্রে চারদিন স্রেফ তাকে কুটোটুকু না খেতে দিয়ে ঐ ভাবে গর্তে ফেলে রাখ। চারদিন পরে যখন ক্ষিধেয় তেষ্টায় প্রাণ যায় যায় হাল হবে তখন দিতে হবে খাবার। তা-ও পেট-পোরা নয়, একটুখানি । সেই সাথে এক আঁজলা জ্বল। এইভাবে দু চারদিন করলে, পোষ না মেনে উপায় কী!
দড়িদড়া বেঁধে তিনটে বাচ্চাকে টানতে টানতে বাড়িতে নিয়ে এলাম।
প্রথম প্রথম সে তো নাজেহাল অবস্থা আমার। যা দিই খেতে কিছুই খায় না। তখন বুদ্ধি করে কয়েক মুঠো যব ছড়িয়ে দিলাম। অমনি এগিয়ে এসে খেতে শুরু করল। মিষ্টি যে খুব খেতে! পোষ মানল একটু একটু করে। আমার তো মনে সর্বদা ভয়, পাচ্ছে জংলীদের দলে গিয়ে ভেড়ে। গেল না কেউ। ছেড়ে দিলেও দেখি নিশ্চন্তে তাবুর আশে পাশেই ঘুরে বেড়ায়। ধীরে ধীরে বড় সড় হল। তারপর আর কী–একের পর এক সন্তান প্রসব! দেখতে দেখতে ছোটো খাটো খামার হয়ে উঠল আমার তাবু।
তখন প্রমাদ গণলাম। আর তো এভাবে রাখা যায় না। এবার একটা পাকাঁপোক্ত ব্যবস্থা করা দরকার। কোনোক্রমেই এদের জংলীগুলোর ধারে কাছে ভিড়তে দেওয়া ঠিক হবে না। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে আমাকে খামার বানাতে হবে। চারপাশে দেব বেড়া। আর জন্যে চাই মোটামুটি সমতল একখণ্ড জমি। সেখানে প্রচুর ঘাস থাকবে। আর ঝোঁপঝাড় জাতীয় বিস্তর গাছ। খাদ্য তো দিতে হবে নিয়মিত। প্রাকৃতিক খাদ্যের উপর যতটা নির্ভর করা যায় ততই মঙ্গল। আর ঘর তুলে দিতে হবে একধারে। রোদ বাড়লে সেই ঘরে গিয়ে থাকবে।
আপনারা হয়ত ভাবছেন, এ আর এমন কী। সারা দ্বীপটি তো আমারই দখলে। যে কোনো একটা জায়গায় ওদের খামার করে দিলেই হল। কিন্তু সে যে কী ঝকমারি আমি বলে বোঝাতে পারব না। জমি বিস্তর অস্বীকার করি না। তাতে ঘাসও অঢেল, আর আছে ঝোঁপ আর প্রয়োজনীয় জল সরবরাহের জন্যে ছোটো নালা। কিন্তু ঘর যে আমাকে বানাতে হবে। চারপাশে তুলতে হবে পাচিল। হাত তো মোটে দুখানা। যে হারে এদের সন্তান সন্ততি জমাতে শুরু করেছে তাতে দুইমাইল কেন, দশ মাইল এলাকা নিলেও আমার মনে হয় ভবিষ্যতে জায়গা কম পড়বে। এবং এর চারদিকে মাটি গেথে পাচিল তোলা–এ কি এক দু দিনের কাজ।
অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম বেশি বড় না করে দেড়শ গজ লম্বা একশ গজ চওড়া এক ফালি জমি আপাতত ঘিরে নেই। তাতে সবাই এটে যাবে। পরে যেমন যেমন বাড়ছে আমিও দেয়াল গাথতে গাথতে এগিয়ে যাব।
সময় লাগল মোট তিন মাস। তবু বলব কাজ আমার নিপুণ। স্বচ্ছন্দে ঘুর ফিরে বেড়ায় সবাই। ঘাসপাতা খায়। মাঝে মাঝে ছড়িয়ে দিই দু দশ মুঠো যব বা ধান। গলার দড়ি সবার খুলে দিয়েছি। সে যা অপূর্ব লাগে দেখতে। আমি যখন যবের ঝুড়ি নিয়ে ভিতরে ঢুকি ঋক বেঁধে আমার চতুর্দিকে এসে ভিড় করে। অবোধ শিশুর মতো ব্যা ব্যা করে ডেকে আমাকে খাবার দেবার আবেদন জানায়।
তা দুবছরে তিনজন থেকে বেড়ে হল তেতাল্লিশ জন। অর্থাৎ জীবিত এখন এরাই। মাঝে যে কত মেরে খেয়েছি তার তো সীমা সংখ্যা নেই। সব মিলে ষাট পঁয়ষট্টি তো হবেই।
আরেক কাণ্ডও শুরু করেছি ইদানীং। এটা বলতে পারা যায় আমার খাদ্য সংক্রান্ত বিষয়ে নবতম সংযোজন। দুধ দোয়াই। সব মিলিয়ে গ্যালন দুই তো হয়ই। আমার একার তুলনায় বলা যায় অঢেল। এত দুধ তো আর খাওয়া যায় না। তাই পনীর বানাই আর মাখন। সে মহা ঝকমারি প্রথম প্রথম। কিছুতে পারি না সঠিক জিনিসটি তৈরি করতে। নষ্ট হয়ে যায় সব। শেষে পারলাম। কাজ করতে করতেই যে শেখে মানুষ। আমার আর চিন্তা কীসের!
আর ঘুরে ফিরে মনে পড়ে ঈশ্বরের করুণার কথা। দুহাতে ঢেলে দিয়েছেন তিনি সব কিছু। এই বিশাল পৃথিবীর খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব তার। চতুর্দিকে তার নজর। চরম দুঃখকে তিনি করে তোলেন অনন্ত সুখ। নির্জনতার মধ্যেও যুগিয়ে দেন বহু আনন্দ। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন ক্ষুধার্ত মানুষকে। এর কি কোনো তুলনা আছে!
খেতে যখন বসি, পরিবার পরিজন সমেত সে এক দেখবার মতো দৃশ্য। রাজা আমি, আমি সম্রাট। এই বিশাল সাম্রাজ্য আমার পদতলে। এখানকার যাবতীয় জীবের জন্ম মৃত্যু আমার করায়ত্ত। তা বলে কাউকে আমি অসুখী বা অতৃপ্ত করে রাখি নি। মুক্তভাবে বিচরণের অধিকার দিয়েছি। আমার রাজ্যে সর্বদা শান্তি বিরাজমান। প্রজায় প্রজায় কখনো কোনো বৈরীতার খবর আমার কানে আসে নি।
খাবার সময় সেটা বলতে গেলে চোখের গোড়াতেই প্রত্যক্ষ করি। পোল আমার সবচেয়ে প্রিয়। সে আমার টেবিলের একধারে বসে থাকে। বেশির ভাগ দিনই আমার ডান দিকে যেন প্রভুর খাদ্যাখাদ্য তদারকের দায়িত্ব তারই। পায়ের কাছে বসে থাকে আমার কুকুর। বুড়ো হয়েছে ইদানীং, গায়ের লোম প্রায় সবই উঠে গেছে। ওর বংশ বৃদ্ধি হয় এমন কোনো জীব আমি সারা দ্বীপে খুঁজে পাই নি। আর থাকে দুটো বিড়াল। টেবিলের দু ধারে দুজন। সবাইকে কিছু না কিছু খেতে দিই। এটা তাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার বাইরে উপরি পাওনা। সকলেই যথেষ্ট সন্তোষ বোধ করে।
বিড়াল দুটোর ব্যাপারে কিছু বলে নিই এই ফাঁকে। জাহাজ থেকে নিয়ে এসেছিলাম যাদের তারা এই দুজন নয়। তাদের মৃত্যু হয়েছে। তাবুর অনতিদূরে আমি নিজের হাতে তাদের সমাধিস্থ করেছি। এরা তাদেরই বংশধর। দ্বীপে বিড়াল আছে সেকথা আগেই বলেছি। প্রথম দিকে অবস্থা এমনই দাঁড়াল, পিলপিল করে পঙ্গপালের মতো বাড়তে লাগল বিড়ালের সংখ্যা। আমি তো ঝালাপালা প্রায়। শেষে কটাকে তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হলাম। যায় কি আর তাতে! দেখি রাত্রে এসে এটা ওটা খাবার চুরি করে নিয়ে যায়। শেষে মারলাম কটাকে গুলি করে। তাতে ভয় পেয়ে বাকিরা পালিয়ে গেল। পরে দেখি এই দুটো এসে ফের ঠাই নিয়েছে। তা এদের আমি আর তাড়াবার চেষ্টা করি নি।
বলতে গেলে আছি বেশ, তবু ঐ যে বলে এক ছটফটানি আমার। ভিতরে ভিতরে অশাস্তি ভাব। মন যে কিছুতেই থিতু হতে চায় না। ডোঙাটার কথা বারবার মনে পড়ে। তাইত, অত কষ্ট করে অত খেটেখুটে বানালাম –সে কি অমনি ফেলে রাখার জন্যে। তা-ও অত দূরে। ইচ্ছে হয় যাই একবার পাহাড়ের মাথায়। দেখি কেমন চলছে স্রোত, কী তার গতি প্রকৃতি। স্রোত সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হলে ডোঙা স্বচ্ছন্দে ধারে কাছে এনে বেঁধে রাখা। যাবে। তাতে কোথাও যাই কি না যাই এই মুহূর্তে সেটা বড় কথা নয়, অন্তত চোখের গোড়ায় তো রইল জিনিসটা। পরে সময় সুযোগ বুঝে খানিকটা বেড়িয়ে আসতেও পারব।
অনেক দিন ধরে যাব কি যাব না, যাব কি যাব না করতে করতে শেষে একদিন মরিয়ার মতো বেরিয়ে পড়লাম। বলা বাহুল্য পদব্রজে। যাব অনেকটা পথ পেরিয়ে পাহাড়ের মাথায়। সে যা সাজ পোশাক আমার! পোশাকের যা বাহার! মাঝে মাঝে নিজেই তো নিজেকে আমি জরিপ করি আয়নায় বা নদীর স্বচ্ছ জলে। হাসি পায়। মনে মনে ভাবি, যদি এই চেহারায় এই পোশাকে ইয়র্কশায়ারের রাস্তা দিয়ে আমি হাঁটতাম তবে কী দৃশ্যই না হত! ভিড় জমে যেত আমার পিছনে। সব মিলিয়ে বর্ণনাটা এই রকম।
মাথায় আমার পেল্লাই এক টুপি। ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি। তার অদ্ভুত চেহারা। পিছনে আবার স্কুল কল করে মস্ত এক ফালি চামড়া। সেটা দিয়ে আমি পিঠ ঢেকে রাখি। রোদ তো খুব। তাছাড়া বৃষ্টিরও কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। যখন তখন ঝরঝর করে খানিকটা ঝরিয়ে দিলেই হল। আমার আবার বৃষ্টি একদম সহ্য হয় না। শরীর খারাপ হয়।
গায়েও ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি একটা জ্যাকেট। তার প্রায় হাঁটু অব্দি বলি। আর পরনে ঘোড়সওয়ারের যেমন চুপ্ত পাৎলুন থাকে, আমারও ঠিক তাই। সেটাও ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি। উপরে তার লোম। লোমশ পালুন। সে এক বিস্ময় বটে। মোজাটোজার বালাই নেই। জুতোও নেই। অর্থাৎ জুতো অর্থে আপনারা যা বোঝেন সেরকম কিছু নয়। চামড়া দিয়ে তৈরি একটা আচ্ছাদনী মতে। তাতে দুটো পা-ই ঢাকা পড়ে। মোটমাট আমার টুপি বা জ্যাকেট বা পালুন সব কিছুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই জুতো জোড়া তৈরী।
কোমরে বেল্টও আছে। ভাববেন না সেটা আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি। একটু চওড়া। তাকে কটিবন্ধনী হিসেবেই আমি ব্যবহার করি। পুরনো দিনের রাজা রাজড়া বা যোদ্ধারা যেমন করত। তবে হ্যাঁ, তাদের কটিবন্ধনীতে ঝোলানো থাকত তলোয়ার, আমারটায় থাকে কুড়ুল আর একখানা করাত। দুটো দুদিকে। আরো একটা বেল্ট আছে। সেটা কম চওড়া। গলায় পরা থাকে। তাতে ঝোলানো থাকে আমার পাইপ আমার তামাক এবং আর এক ধারে একটা খাপে বারুদ। পিঠে থাকে ছোট্ট একটা বুড়ি। সেটাও এই বোল্টের সঙ্গে বাধা। তাতে থাকে আমার কন্দুক-হাতিটা ধাঁধা থাকে আর একদিকে। তার এমনই কায়দা, হাওয়া বাতাস তেমন জোরদার না থাকলে সাধারণ ভাবে তাকে খুলে রাখা যায়। আমার আলাদা করে হাত দিয়ে ধরবার প্রয়োজন পড়ে না। নতুন করে ছাতির বর্ণনা এখানে আর দিলাম না। আগেই বলেছি একবার। গায়ের রঙের কথা একটু বলি। বিশেষ করে মুখের রঙ। সে ভারি বিচিত্র। মা কালো আর বাপ ফর্সা হলে তার ছেলেমেয়ের সচরাচর যে রঙ হয়, না কালো না সাদা–দুয়ের অদ্ভুত সক্ষয়। আর হবে না কেন, ন ডিগ্রী দ্রাঘিমা রেখায় অবস্থিত আমার রাজ্য। রোদ তো এখানে কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। আর তেমনই দাড়ির ঘটা। বাড়তে বাড়তে একবার প্রায় ফুট খানেক হয়েছিল। প্রথম দিকে খেয়াল করি নি। পরে খেয়াল হতে আমি তো থ। অমনি কাচি আর ক্ষুর নিয়ে বসে গেলাম। জাহাজ থেকে এনেছিলাম সাথে করে। তা তেমন তো অভ্যেস নেই। হল আধ খ্যাচড়া কিম্ভুতকিমাকার ক্ষেরী। টিবুকের কাছে খানিকটা বইল, আর মোচটা আমি ইচ্ছে করেই কামালাম না, কিছুটা হেঁটে রেখে দিলাম। অনেকটা তুর্কিদের মতো। চিবুকের কাছের অংশটা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়ুক, তাতে আমার কোনো চিন্তা নেই। আরো খানিকটা বাড়লে নয় ওতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখব আমার টুপি। আর সেই অবস্থায় যদি গিয়ে পড়ি ইংল্যান্ডের কোনো অঞ্চলে তবে ঘটনাটা কী দাঁড়াবে আমি ভেবেও কোনো কুল পাই না।
তবে এখানে বেপরোয়া। কীসের চিন্তা আমার! কে-ই বা আসবে দেখতে! আমার যেমন ইচ্ছে তেমন করব, যেমন ইচ্ছে নিজেকে সাজাব। আমি কি কারুর ধার ধারি না কি বলবে তাই নিয়ে এতটুকু লজ্জা পাই! এ তো আমারই সাম্রাজ্য। একপাল জীবজন্তু পাখি আমার প্রজা। কোনো প্রজারই এমন সাহস নেই যে রাজাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে, মজা করে।
চলেছি এই পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে হাঁটতে হাঁটতে। অনেক দূরের পথ। পাঁচ ছ দিন তো এরই মধ্যে বলতে গেলে পার হয়ে গেল। গোড়ায় সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটেছি। লক্ষ্য সেই যেখানে ডোঙা বেঁধে রেখে গিয়েছিলাম সেই জায়গাটা। কাছেই সেই জলে ডোবা পাহাড়। এক অংশ তার উঁচু। তা পৌঁছে দেখি, জল ডিঙিয়ে সেই পাহাড়ের টঙে গিয়ে চড়বার আর দরকার নেই। কাছে পিঠে তুমি বেশ উঁচু। বলতে গেলে পাহাড়ের মাথারই প্রায় সমান সমান। উঠলাম সেখানে। সবই নজরে পড়ছে। ঐ তো আমার ভোঙা। আর ঐ সেই বিপজ্জনক এলাকা। সেই মহামারী স্রোত সেখানে কেবল ঘুরপাক খায় আর নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে নৌকো পাঠিয়ে দেয় দূর সমুদ্রের পানে। এখন সবই শান্ত। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। নেই কোনো স্রোত, কি ঘূর্ণি, কি হাওয়া। যেন শান্তু একফালি দর্পণ। এখনি গিয়ে ডোঙায় উঠে বসতে ভারি ইচ্ছে হচ্ছে।
দমিয়ে রাখলাম ইচ্ছে। আরো পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে। এখানে দু একদিন থাকতে হবে। দেখতে হবে সবকিছু। সেই ভাবেই মন ঠিক করলাম। দেখি চমকদার সব ব্যাপার। স্রোত যা আসে সব পশ্চিম দিক থেকে। গিয়ে মেশে এক নদীর সঙ্গে। নদীটা বিশাল। হাওয়ার গতিও পশ্চিম থেকে উত্তর মুখী। সব মিলে ধাক্কা খায় সেই পাহাড়ের গায়ে। তখন ওঠে বিপরীত মুখী স্রোত। তারই দমকে নৌকো যায় দূর সাগরের দিকে ভেসে। সান্ধ অব্দি বসে বসে এই সবই দেখলাম। বাতাস আর স্রোতের মরণ খেলা শুরু হয় বেলা বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে। সন্ধে লাগতে সব আবার শান্ত। তখন বাতাসের তাড়না নেই। স্রোতহীন নির্মল নিস্তরঙ্গ জল। এবং এটাই আমার পক্ষে ডোঙা নিয়ে ভেঙ্গে পড়ার উপযুক্ত সময়।
পরের দিনও একই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলাম। নিপুণ মাঝি হতে গেলে স্রোত তো চিনতেই হবে। মনের দিক থেকে আমি এবার আমার সিদ্ধান্তে স্থির নিশ্চিত। কিন্তু ভয় যে খুব! যখনই ভাবি যাই, এবার গিয়ে ডোঙায় উঠে বসি–অমনি ভয়ে সারা শরীর পিটিয়ে আসে। সেই বিপদের কথা মনে হয়। কাটা দেয় প্রতিটি লোম কুপে। কিছুতে আর পা উঠতে চায় না। যদি ফের হয় সেই একই অবস্থা! তখন অনেক ভেবেচিন্তে নতুন এক সিদ্ধান্ত নিলাম। থাক এটা এখানে যেমন আছে। আমি বরং আরেকটা ডোঙা বানিয়ে নেব।
কিন্তু বানাব বললেই তো আর হয় না, তার জন্যে সময় দরকার। অত সময় আমি পাই কোথায়। আমার যে এখন অগাধ কাজ। যেমন ধরুন, দু দুটো ক্ষেত আমার। একটা গুহার কাছে। গায়ে গায়ে লাগানো বলা যায়। গুহাও তো আর সে গুহা নেই। তাকে বড় করেছি। একটার পর একটা ঘর এখন গুহার ভিতর। ঢুকবার বেরবার দু দুটো দরজা। একটা ঘর তার মধ্যে সবচেয়ে শুকনো। সেখানে আমি দরকারী সব জিনিস রাখি। যেমন বীজ এবং শস্য। অগুণতি ঝুড়িতে থরে থরে সাজানো শুধু ধান আর যবের দানা। এগুলো নষ্ট স্বার বা পচে যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রয়োজন মতো দৈনন্দিন খাদ্য শস্য আমি ঐ ঘর থেকেই নিয়ে আসি।
ক্ষেতের ব্যাপারে যা বলছিলাম। সে ভারি চমৎকার এখন। সব কিছুই সুশৃঙখল। বেড়া। দিয়েছিলাম চারপাশে গাছের ডাল দিয়ে। কিছু কিছু তার মধ্যে গুল্ম জাতীয় গাছ। সেগুলো এখন বেশ বড় বড় হয়েছে। সে আবরণ ভেদ করে বাইরের কোনো জীবের ভিতরে ঢোকার সম্ভাবনা নেই। নিজের ইচ্ছেমতো জমিতে চাষ করি। যে বছর কম শস্য পাই, তার পরের বছর প্রয়োজন মতো খানিকটা জমি বাড়িয়ে নিই। তাতে আগের বছরের ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।
আর একটা ক্ষেত একটু দূরে। আমার সেই টঙের কাছে। এটাকে আমি বলি বাগানবাড়ি। ক্ষেত এখানে প্রধানত ফলের। আঙুরই বেশি। প্রয়োজন মতো শস্যের চাষও হয়। তবে সে কদাচিৎ। গাছ গাছালিতে ঘেরা সে এক অপরূপ শান্তির পীঠস্থান। সব গাছই এখন বেশ বিশাল বিশাল হয়ে উঠেছে। ডালপাতায় মাচার ঘর এখন চারধারে ঢাকা। আর যা মিষ্টি ছায়া! সিঁড়ি বেয়ে উঠে বিছানায় গা ঢেলে দিতে পারলে সে এক স্বর্গীয় শাস্তি। একটা আরাম কেদারাও বানিয়েছি। ছাগলের চামড়া আর লোম দিয়ে। বসলে শরীর প্রায় আধখানা ডুবে যায়। মাঝে মাঝে সেখানে বসে দূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিতে কড় অপূর্ব লাগে।
এরই লাগোয়া আমার পশু খামার। হয়ত একটু বাড়িয়ে বলা হল, কেননা অত বিচিত্র ধরনের পশু আমার নেই। না গরু না মোষ। থাকার মধ্যে শুধু একপাল ছাগল। চারধারে মাটির দেয়াল। তুলতে আমাকে রীতিমতো পরিশ্রম করতে হয়েছে। বাইরে থেকে দু একটা ঢুকলে বরং আমার লাভ, কিন্তু বেরিয়ে গেলে যে ক্ষতি। কেমন করে সে ক্ষতি আমি পূরণ করব! তাই তো দেয়াল। তাই তো অক্লান্ত পরিশ্রম। দেয়ালের বাইরে আবার গুম জাতীয় গাছের টানা বেড়া। তাতে সুরক্ষার ব্যাপারটা জোরদারই হয়েছে বলা যায়। আরেকটা বৃষ্টির মাত্র অপেক্ষা। কোপগুলো বেড়ে এমন হবে যে আমি চির নিশ্চিন্ত হতে পারব।
অর্থাৎ আপনি যে কলবেন আমি কুড়ে, আমি শুয়ে বসে দিন কাটাই, মোটেও তা নয়। রীতিমতো খাটতে হয় আমাকে। যাকে বলে গাধার খাটুনি! পশুপালন থেকে শুরু করে তাদের দুধ দোওয়া, সেই দুধে ছানা পনীর মাখন তৈরি, তারা যাতে বেঁচে বর্তে সুস্থ শরীরে বহাল থাকে সেদিকে নজর রাখা–এ কি চাট্টিখানি কাজ।
কতদিন থাকতে হবে এখানে তার তো কোনো ঠিক নেই। সে বিশ বছর হতে পারে, চল্লিশ বছরও হতে পারে। চল্লিশ এই কারণে বলছি কেননা মোটামুটি ধরে নিয়েছি আমার আয়ু খুব বেশি হলে আর চল্লিশ বছর। সেই সময় সীমার জন্যে প্রয়োজনীয় রসদের সরবরাহ আমাকে তো অব্যাহত রাখতেই হবে। এছাড়া আর উপায় কী।
আঙুরের চাষটাও উল্লেখের দাবী রাখে। বলতে দ্বিধা নেই আমি অন্য সব চাষের চেয়ে এদিকে একটু বেশিই নজর দিয়ে থাকি। কিসমিস আমার অতি প্রিয় খাদ্য। মুখরোচক তো বটেই, শরীরে বল সঞ্চয়ের প্রয়োজনেও এর অবদান কম নয়। দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার মধ্যে কিসমিস আমার বিলাসের পর্যায়ে পড়ে।
এই সব কাজের সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে নতুন আরেকটি কাজ। প্রায়ই একবার করে ডোঙাটা গিয়ে দেখে আসা। আছে যে সেই অবস্থায় এটাই আমার কাছে সান্ত্বনা, এমন নয় যে সব মালপত্র আমি তোড়া থেকে নিয়ে এসেছি বা নিয়ে আসার কোনোরকম ইচ্ছে আমার আছে। ডোঙা নিয়ে ফের ভেসে পড়ার সঙ্কল্প বর্তমানে ত্যাগই করেছি। অবশ্য ভয়টাও একটু একটু করে মন থেকে মুছে যেতে শুরু করেছে। দ্বীপের কোনো ব্যাপারেই ইদানীং আমি আর ভয় পাই না। এমনকি ভূমিকম্প হলে ফের যে পাথর পাহাড়ের মাথা থেকে গড়িয়ে নামতে পারে তা নিয়েও বিন্দুমাত্র চিন্তিত বা ভীত আমি নই। এখন জীবনের ধারা আমার সম্পূর্ণ পালটে গেছে। এটা আমি নিজেও স্পষ্ট টের পাই।
জানি না হয়ত এই গতিতেই চলত আমার জীবন। এই যেমন গড়িয়ে গড়িয়ে চলা হয়ত এই নিয়েই আমি বেঁচে থাকতাম। কোনো ব্যতয় হত না কোনোখানে। এতটুক বিভ্রান্তি বা অস্বস্তি বোধ করতাম না। যদি না ভারি অদ্ভুত ভারি অবাক একটা ঘটনা ঘটত।
ঘটনাটা তবে গোড়া থেকেই বলি।
একদিন দুপুরবেলা। আমি চলেছি ডোঙা দেখতে। যেমন মাঝে মাঝে যাই। হঠাৎ দেখি কূলের কাছে বালিয়াড়ির উপর মানুষের পায়ের ছাপ। একটা নয়, অনেকগুলো। আমি তো থ। হঠাৎ সামনে বাজ পড়লে মানুষ যেরকম চমকে যায়, অবাক হয়, আমি ঠিক তাই। মানুষ! অর পায়ের ছাপ। আমি ভুল দেখছি না তো চোখে। চকিতে চারদিকে চোখ বোলালাম। কই কেউ তো নেই আশে পাশে! এগিয়ে গেলাম। মানুষের অবস্থিতির অন্য কোনো নজিরও নেই। আবার দেখলাম ছাপগুলো। না, অন্য কারো নয়, মানুষেরই। গোড়ালি, পায়ের চেটো, আঙুল সব নিপুণভাবে কেটে বসেছে বালির উপর। কিন্তু এখানে এ ছাপ কেমন করে এল! বুকে তখন রীতিমতো ঝড় বইতে শুরু করেছে। ঢিপঢিপুনির শব্দ বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছি। এত্ত শঙ্কিত ভয়ার্ত আমার চোখমুখ। কত কীই না ভাবলাম! যেন ছবির মতো এক একটা চিন্তা। মনে উদয় দিয়েই সঙ্গে সঙ্গে যায় আবার শূন্যে বিলীন হয়ে। তবু ভয় মোটে কমে না। সে যা অবস্থা! এক পা দু পা করে আমি আতঙ্কে অমনি পিছু হটতে শুরু করেছি। তারপর তো দুই। সব অগ্রাহ্য করে স্কুল গাছপালা ভেদ করে শুধু দৌড় আর দৌড়। আর মাঝে মধ্যেই থমকে পড়ি। পিছন দিকে দেখি। কেউ তাড়া করছে না তো! যেতে যেতে প্রতিটি ঝোঁপঝাড় তন্ন তন্ন করে খুঁজি। আমার জন্যে কেউ ওত পেতে নেই তো। ভয়। আর আতঙ্ক। আর ত্রাস। আমি বলতে গেলে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য।
বাড়িতে ঢুকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। কীভাবে ঢুকেছিলাম ভিতরে সে আর এখন মনে নেই। মই বেয়ে উঠেছিলাম না কি এক লাফে দেয়াল ডিঙিয়ে পড়েছিলাম এধারে কিছুই এখন আর স্মরণ করতে পারি না। শুধু এটুকু মনে আছে ভীষণ ভয় আমার আষ্ঠেপৃষ্ঠে। তাড়া খাওয়া হরিণের মতো অবস্থা। কিংবা ভীতু খরগোশের মতো। যে কোনো ভাবে চাইছি নিজেকে আড়াল করতে। সেই ভয়ের হাত থেকে অব্যাহতি পেতে।
তবুও কি ভয় কাটে! ভয়ের ধর্মই যে এই। ঢুকল একবার মনে তো সহসা যাবে না। সারারাত আমি নির্ঘুম। চোখের পাতা মোটে পারিনা এক করতে। কেবলই ঘুরে ফিরে পায়ের ছাপ কটা মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। আর নানারকম কল্পনা করতে শুরু করি। আচ্ছা, কে ঐ পায়ের অধিকারী? কী করে সে এখানে এল? কেনই বা এল? সে কি নরখাদক? জানতে পেরেছে কোনোভাবে আমি এখানে আছি? এখনো কি লুকিয়ে আছে এই দ্বীপে? কোথায়? আমি দেখা পেলাম না কেন? তবে কি মানুষ নয় সে, আত্মা? কোনো পিশাচ বা ঐ জাতীয় কিছু? পিশাচেরা শুনি যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো রকম আকার ধারণ করতে পারে। তবে কি আমাকে তার উপস্থিতি সম্বন্ধে সজাগ করার জন্যেই রেখে গেল পায়ের ছাপ? জানে আমি ঐখান দিয়ে ডোঙা দেখতে যাই। তাই কি বিশেষ করে ওখানকার বালিতেই ছাপ রেখে যাওয়া। কিন্তু জল বাড়লে ঐ ছাপ তো মুছে যেতেও পারত। কিংবা হাওয়া উঠলে বালি যেত উড়ে। ছাপ তছনছ হয়ে যেত। সেক্ষেত্রে এটা শয়তানের অভিসন্ধিমূলক প্রচেষ্টা বলে ভাবতে অসুবিধে হয়। তবে কার ছাপ। সত্যি সত্যি কি কোনো মানুষের?
এরকম রাশি রাশি অগুণতি চিন্তা। অনর্গল। ভাবতে তো আর কোনো বাধা হয় না। শুরু করলে ঘোতের মতো একের পর এক ভাবনা আসতে শুরু করে। শেষ হয় অজ্ঞাত অপরিচিত কোনো মানুষে। সেই বর্বর মানুষ। নরখাদক। থাকে ঐ ওধারের দ্বীপে। আমি যেখানে যাব বলে ডোঙায় চেপে রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু অতখানি পথ পার হয়ে এখানে এসে ওঠা তো চাট্টিখানি কথা নয়। পারল কীভাবে! নিশ্চয়ই বাতাসের গতি প্রকৃতি আমার চেয়ে অনেক ভালো বোঝে। সত্নও চেনে আমার চেয়ে ভালো। তাই পেরেছে স্বচ্ছন্দে চলে আসতে। আমি পারি নি।
তবে পারি নি যে সেটা আমার পক্ষে মঙ্গল। এখন বুঝতে পারি। সে-ও ঈশ্বরেরই দয়া। গেলে ওদের হাতে পড়ে আর কি রক্ষা থাকত! সে সম্ভাবনা এখনো কম। কেননা ওরা যদি আমার হদিশ পেয়ে থাকে, তবে ফের আসবে। ডোঙাটা হয়ত দেখতে পেয়েছে। সেক্ষেত্রে এর পর আর একলা একজন আসবে না, আসবে দলবল সমেত। আমাকে ধরে নিয়ে যাবে । তারপর বলি। আমার জীবন শেষ। আমার ক্ষেত দেবে ধ্বংস করে। আমার ছাগল নিয়ে যাবে। যদি সে অবস্থায় কোনোভাবে আমি আত্মরক্ষা করতে পারি, তবে তা-ও মরারই দাখিল । থাকবে না ফসল, থাকবে না ছাগলের পাল–আমি কি খেয়ে কীভাবে বেঁচে থাকব।
অবাক কাণ্ড, ভয়ের তাড়ায় মন থেকে মুছে গেল আমার ধর্মচিন্তা। ঈধরে আর কোনো আস্থাই যেন নেই। এই যে, এত কিছু দিয়েছেন তিনি আমায় জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলবার জন্যে নানানভাবে সাহায্য করেছেন-কেবলই মনে হয়, আর বোধহয় এসব রক্ষা করতে পারব না। আমার পক্ষে তো সম্ভব নয়ই, হয়ত ঈশ্বরের পক্ষেও । আর ধিক্কার জন্মায় মনে অনবরত। নিজের উপর। জীবনটাকে এতদিন সহজ সরল ভাবেই নিয়েছি। তার মধ্যে যে জটিলতা আসতে পারে, আসতে পারে নানান দুঃখ, কখনো বারেকের জন্যে ভুল করেও ভাবি নি। তবে কি আর যেটুকু দরকার শুধু সেটুকু শস্য চাষ করতাম! জমিয়ে রাখতাম গোলা ভরা ধান, বসে তাই খেতাম। আমাকে আর এই ভয়ের মধ্যে তাহলে অন্নচিন্তায় বাইরে বেরতে হত না কিংবা না খেয়ে মরতেও হত না।
অদ্ভুত ব্যাপার–মানুষের জীবনের এই আশ্চর্য গতিপ্রকৃতি। দেখি আর বারে বারে নতুন করে অবাক হই। আজ যা মানুষ ভালবাসে কাল তাকেই দেয় দুপায়ে ঠেলে। আজ যা চায় কাল তাকেও করে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান। নিজেকে দিয়েই তো সব মিলিয়ে নিতে পারছি। সভ্য জগৎকে এখন আমি সত্যি সত্যি ভয় পাই। অর্থাৎ এই আমি যখন প্রথম এলাম এই দ্বীপে, চারপাশে অগাধ জলরাশি আর ঘন অরণ্য–আমি ভীষণ একা কী বিশ্রীই না লাগত! নির্জনতা কী প্রচণ্ড ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরত আমায় আর এতদিন পর,–মানুষের পায়ের ছাপ দেখে আমি চমকে উঠি। ভয়ে আতঙ্কে হাত পা সেঁধিয়ে যায় বুকের ভিতর। জ্যান্তু মানুষ তো দূরের কথা, জানি না হয় তো তার ছায়া দেখলেও আমি সন্ত্রাসে স্থবির হয়ে যাব।
সে যে কত চিন্তা মনের গভীরে, কত জল্পনা কল্পনা! বিয়ের প্রথম ধাক্কাটা ততদিন সামলে উঠতে পেরেছি। তবু ঈশ্বরে বিশ্বাস আর কোনো ভাবেই আসে না। আসবে কী করে, আমি যে শেষের প্রহর গুনতে শুরু করেছি ততক্ষণে। আর কি নিস্তার আছে আমার! এই তো শেষ। এ-ও এক ধরনের শাস্তি। ঈশ্বরের দেওয়া দানে পারি নি সন্তুষ্ট হতে। অপরাধ করেছি। আগ বাড়িয়ে দেখতে গিয়েছিলাম নতুন সাম্রাজ্য। এ তারই প্রতিফল। যিনি দেন, তারই তো আছে শাস্তি দানের অধিকার। এ শাস্তি আমাকে মাথা পেতে গ্রহণ করতে হবে।
পরক্ষণেই নতুন এক চিন্তা উদয় হল মনে। তাইত, শাস্তি পাব নয় ধরেই নিলাম, নয় মৃত্যুই হবে তার শেষ পরিণতি। কিন্তু তাই বলে এখন থেকে জীবনের সব আশা ভরসা ত্যাগ করব, এ তো হয় না। তাহলে তো জীবন যাবে স্থবির হয়ে। আশাহীন ভাবে কি বেঁচে থাকা যায়। আমার কাজ হবে দৈনন্দিন অভ্যাসের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করা। ঈশ্বরের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা। তারই মধ্য দিয়ে আগামীতে যে পরিণতি আসে তিলে তিলে সেই দিকে এগিয়ে যাওয়া।
এই চিন্তাই তোলপাড় করে তুলল মন। দিনের পর দিন মাসের পর মাস শয়নে স্বপনে জাগরণে আমার এই একই চিন্তা। ভাবতে ভাবতে হঠাৎই একদিন সকাল বেলা–বিদ্যৎচমকের মতো মনে ভেসে উঠল বাইবেলের সেই অনবদ্য নির্দেশ–বিপদের দিনে আমায় স্মরণ করো, আমি তোমার ত্রাতা, তুমি গৌরোববিত করবে আমাকে।
বলব কী, যেন এক ঝলক মিঠে বাতাস, অপরূপ তার আমেজ, অদ্য তার স্নিগ্ধতা। হৃদয় মন যেন জুড়িয়ে দিল আমার। আমি বিছানা ছেড়ে এক লাফে উঠে বসলাম। আহ, শান্তি! শরীরে যেন অদ্ভুত এক ক্ষমতা পাচ্ছি। অমনি তড়িঘড়ি প্রার্থনায় বসলাম। হে বিধাতা, আমায় ক্ষমা কর। আমি পাপী। আমি অপরাধী। বাইবেল খুললাম। চোখে পড়ল সেই আশ্চর্য নির্দেশ : ঈশ্বরে আস্থা স্থাপন কর। হৃদয় প্রফুল্ল কর। তোমার মনে তিনিই যোগাবেন শক্তি। ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখ। …. সে যে কী শান্তি কী সান্ত্বনা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। সব প্রশ্নের জবাব আমি পেয়ে গেছি। আমার মনে আর কোনো জিজ্ঞাসা নেই। বই নামিয়ে রাখলাম। হৃদয় যেন আনন্দে ভরে উঠেছে।
পাঠক, বুঝতে পারছেন, নতুন উদ্যমে নতুন উৎসাহে আমি আবার শুরু করেছি আমার জীবনযাত্রা। সব আবার আগের মতো। পায়ের ছাপের একটা যুক্তিও নিজের মনে খাড়া করেছি। হয়ত আমারই পায়ের ছাপ। সেই যেদিন ডোঙায় চেপে গিয়েছিলাম সেদিনই হয়ত পড়েছে বালির উপর। বাকিগুলো গেছে জলের ঝাঁপটে মুছে। কোনোভাবে কয়েকটা হয়ত রক্ষা পেয়েছে। ভেবে অব্দি সে কী আনন্দ আমার! কোনো পালটা যুক্তিই আর মনে স্থান পায় না। নিজেকে নিজেই করি উপহাস। নিজেকে বোকা ঠাওরাই। বোকা ছাড়া আর কী! নইলে এমন তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে এত জল ঘোলা করি।
মোটমাট সাহস আমার একটু একটু করে ফিরে আসছে। একটু একটু করে আমি আবার বাড়ির সীমানা ছেড়ে বেরতে শুরু করেছি। তিন দিন তিন রাত তো বলতে গেলে বিছানা ছেড়ে না ওঠা। এদিকে ঘরে খাবারের টান। থাকার মধ্যে আছে শুধু একটু জল আর কটা যবের মণ্ড বিশেষ। দুধ নেই। তিনদিন ধরে দোয়াই না এক ফোঁটা, থাকবে কীভাবে! আর সে বেচারিদেরও তো কষ্টের সীমা পরিসীমা নেই। নির্ঘাৎ প্রচণ্ড বেদনা হচ্ছে বটে। বলা যায় না, হয়ত কারো কারো দুধ এর মধ্যে শুকিয়ে গেছে।
তখন বেরলাম চৌহদ্দি ছেড়ে। দেয়াল ডিঙিয়ে ফের নামলাম এধারে। নতুন লাগছে সব কিছু। গেলাম হাঁটতে হাঁটতে আমার বাগান বাড়িতে। তারই পাশে কিনা ছাগলের খোয়াড়। দুধ দোয়ালাম। ভয় কিন্তু একেবারে কাটে নি। হাঁটি কয়েক পা, বারবার পিছন ফিরে তাকাই। আসছে না তো কেউ পিছন পিছন! কোথাও নেই তো লুকিয়ে চুরিয়ে! পাতা পড়ার শব্দ হলে অব্দি চমকে উঠি। দু একবার তো দুধের বালতি ফেলে পালাব কি পালাব না সে চিন্তাও এল। মোটমাট আতঙ্কের ভাবটা এখনো পুরোপুরি যায় নি।
তবে দু চার দিন চলাফেরা করতে করতে সাহস আরো খনিকটা বাড়ল। কোনো কিছুই যে চোখে পড়ে না। আমার যাবৎ জল্পনা কল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। তখন সাহস করে একদিন সেই ছাপটা যেখানে দেখেছিলাম সেখানে গেলাম। নিজের পা ফেলে মাপলাম সেই ছাপ। মিলল না। আমার চেয়ে বেশ বড় সেই পা। দ্বিতীয়ত অনেক ভাবনা চিন্তা করেও আমি যে ডোঙা নিয়ে ঐখানে গিয়েছিলাম, এটা কিছুতেই যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে মেলাতে পারলাম না। তাহলে! বুকটা অমনি থর থর করে কেঁপে উঠল। মেরুদণ্ড বেয়ে বয়ে গেল একটা শীতল স্রোত। সে যে কী ভয় কী আতঙ্ক! দিঘিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটালাম আমি মরিয়ার মতো। দুটি আর বারবার পিছন ফিরে তাকাই। আসছে না তো কেউ পিছন পিছন। আমাকে ধরবে না তো!
জীবনের এও এক বিচিত্র রূপ। ভয় যখন আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে চারদিক থেকে কী অদ্ভুত যে হয়ে যায় মানুষ! নিজের কাছে নিজেই তখন সে হাস্যাস্পদ। কোনো যুক্তিবুদ্ধির তখন আর স্থান নেই। আর আত্মরক্ষার সে কী অদম্য চেষ্টা! সব ছাপিয়ে জন্ম নেয় এক নিদারুণ হতাশা। তাই তো, কী লাভ আমার এই ঘরদোর আগলে রেখে। কী প্রয়োজন! সব ভেঙেচুরে তছনছ করে দিলেই বা অসুবিধে কী। দেব সব ছাগল ছেড়ে। দেয়াল ভেঙে ফেলব। শস্যক্ষেত নিজের হাতে দেব লণ্ডভণ্ড করে। যাতে এ দ্বীপে আমার অবস্থিতি ওরা কোনোভাবে না টের পায়। বাগান বাড়ির ঐ মাচান–এটাও ফেলব ভেঙে মোটমাট এখানে মনুষ্য বসতির যে সব লক্ষণ আমি তিল তিল করে নিজের হাতে গড়ে তুলেছি তার আর কিছুমাত্র অবশেষ রাখব না।
এসব অবশ্য প্রথম রাতের ভাবনা। রাত বলব না, বলতে গেলে সারাদিন সারারাত। ঘুম কি আর আসে! পারি কি দুদণ্ড থিতু হয়ে বসতে! ভয়ের এটাই তো বৈশিষ্ট্য। ঘটনার চেয়ে হাজারগুণ বড় হয়ে মনের আনাচে কানাচে বাসা বাঁধে। আতঙ্কে থম করে রাখে প্রতিটি স্নায়ু। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে কেটে যায় প্রহরের পর প্রহর। হায়রে, পেতাম যদি একজন অন্তত সঙ্গী! যদি তার সাথে আলোচনা করতে পারতাম। কিংবা স্থির হয়ে বসে কাঁদতে পারতাম ঘন্টার পর ঘন্টা, বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাতে পারতাম–তবে হয়ত লাঘব হত আমার ভয়ের বোঝা। হয়ত কিছুটা সানাও পেতাম। কিন্তু কোথায় কে! চারদিকে শুধু ভয় আর ভয়। তবে কি আমি পাগল হয়ে যাক!
ভোরের দিকে নিজের অজানতেই কখন ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর ঘুম। ক্লান্ত তো ভীষণ। তদুপরি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। উঠলাম যখন ঘুম ভেঙে, তখন বেশ বেলা। ভালো লাগছে বেশ। শরীর মন বেশ ঝর ঝরে। ভয়ের সেই প্রথম ধাক্কাটা নেই। এখন যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে ব্যাপারটা নিজের মনেই বিশ্লষণ করতে পারছি। ভাবতে বসলাম ফের আগাগোড়া। একটা কথা ঠিক যে যারই পায়ের ছাপ পড়ুক না কেন, সে দ্বীপের অধিবাসী নয়। কেননা দ্বীপ আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি, মনুষ্যবসতির কোনো নিদর্শন আমার নজরে পড়ে নি। তবে সে নির্ঘাৎ আগন্তুক। ডোঙায় চেপে বা ভেলায় করে এসেছিল এই দ্বীপে। হয়ত স্বেচ্ছায়, নয়ত বাতাসের তাড়নায়। বাতাস পড়তে ফের নিজের বাসস্থানের দিকে ফিরে গেছে।
মোটমাট একটা কথা আমি হলফ করে বলতে পারি, আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানুষ এই দ্বীপে থাকে না। বা এই দীর্ঘ পনের বছরে একটি দিনের তরেও কোনো মানুষকে আমি এই দ্বীপমুখো হতে দেখি নি।
বর্বর বা নরখাদকের কথা যদি মন থেকে মুহূর্তের জন্যে মুছে ফেলি, তবে দ্বিতীয় সম্ভাবনা বলতে প্রথমেই মনে পড়ে সভ্য কোনো মানুষের কথা। ধরে নিতে পারি আমারই মতো হয়ত তারা পড়েছিল কোনো দুর্ভাগ্যের কবলে। তবে রক্ষা পেয়েছে এটা স্পষ্টত বুঝতে পারা যায়। স্রোতের তাড়নায় হয়ত তরী ভেড়াতে বাধ্য হয়েছিল এই দ্বীপে। ছিল খানিকটা সময়। রাত্রে ভাটার টানে আবার যাত্রা করেছে গন্তব্যের দিকে।
এটা নিছকই কই কল্পনার পর্যায়ে পড়ে। জোর করে সানা পাবার একটা চেষ্টা। ঘুরে ফিরে বারবার মাথায় আসে বর্বর নরখাদকের কথা। আর ততোই ভয়ে বুক আমার দুরু দুরু করে ওঠে।
আর কেবল গাল পাড়ি নিজেকে। নিজের কাজ নিয়ে নিজেরই অনুতাপ হয়। কেন বানাতে গেলাম গুহার আরেকটা দরজা! কী দরকার ছিল আমার। এতে করে গুহাটা যে নিছক গুহা নয়, মনুষ্যবসতি–এটা তো যে করুর চোখে ধরা পড়বে। তার উপর বোঝার উপর শাকের আঁটি তুলেছি টানা একটা দেয়াল। মানুষ ছাড়া কেউ কি পারে এমন দেয়াল তুলতে?–এ তো একটা শিশুও বুঝতে পারবে। তাহলে উপায়। এখন এই মুহূর্তে আত্মগোপন করার ব্যাপারটাই প্রধান। দেয়াল সমতে গুহাটাকে আড়াল করতে হবে। লোক চক্ষুর আড়ালে আনতে হবে। তার জন্যে গাছ বসাতে হবে দেয়ালের বাইরের দিকে অর্ধবৃত্তাকারে। বড় হবে সেই গাছ। ঢেকে ফেলবে চারদিক। ভিতরে দেয়াল আছে কি না বাইরে থেকে সেটা কারুর মালুম হবে না।
বসালাম গাছ। দেয়ালটাকেও সঙ্গে সঙ্গে আরো মজবুত করলাম। কাঠকুটো যেখানে যা ছিল সব এনে গেঁথে দিলাম ভিতরের দিক থেকে দেয়ালের গায়ে। আর সাতটা ফুটো করলাম। হাত ঢোকানো যায় এরকম এক একটা ফুটো। জায়গায় জায়গায় আরো মাটি চাপালাম। হল সব মিলিয়ে প্রায় দশ ফুটের মতো পুরু। আর সেই সাতটা ফুটো। নজর রাখা যায় চুতর্দিকে তারই ব্যবস্থা। প্রয়োজন বোধে ফুটোর মধ্যে বন্দুক ঢুকিয়ে গুলি ছুঁড়তে পারব। সাতটা গুলি পর পর ছুঁড়তে আমার সময় লাগবে মোট দুমিনিট। মোটের উপর আপাতত আমি নিজেকে নিরাপদ বলতে পারি। আর কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। অন্তত ভিতরে যতক্ষণ আছি ততক্ষণ তো নয়ই।
দুবছরেই গাছ হল বেশ বড় বড়। খুব ঘন ঘন করে বসানো তো। তার ডালপালা ছড়িয়ে সে এক কুঞ্জ বিশেষ। দূর থেকে দেখলে চেনার উপায় নেই যে এরই আড়ালে আছে কোনো দেয়াল, তার ভিতরে গুহা, সেখানে কোনো মানুষ থাকে এবং তার উপর ইচ্ছে খুশি যে কোনো রকম আক্রমণ চালানো যেতে পারে। মই বানালাম আরো একটা। সেটা পাহাড়ের দিকে রাখলাম অর্থাৎ প্রয়োজন বোধে এদিকে দিয়েও আমি বেরুতে বা ভিতরে ঢুকতে পারব।
অর্থাৎ মানুষের বুদ্ধিতে যতখানি কুলোয়, আমার পক্ষে এই পরিবেশে যা যা করা সম্ভব– নিজেকে রক্ষার প্রয়োজনে সবই করলাম। এছাড়া অন্য কিছু আর আপাতত মাথায় খেলছে না। চিন্তা এখন শুধু আমার ছাগলের পাল নিয়ে।
ছেড়ে দেবার চিন্তা বাতুলতা। ছাড়লে আমারই বিপদ। গোলা বারুদ যে পরিমাণে কমতে শুরু করেছে তাতে আগামী দিনে হাতের কাছে খাদ্য মজুত না থাকলে আমি হয়ত না খেতে পেয়েই মারা যাব। তাছাড়া দুধের যোগানটাও কিছু কম ব্যাপার নয়। সে ক্ষেত্রে কী করণীয়?
অনেক ভাবনা চিন্তা করে দেখলাম, দু’টো মাত্র উপায় আছে ছাগলের পাল রক্ষা করার। এক, যদি আমি মাটির নিচে একটা গুহা মতো করি, সেখানে রাত্রে ঢুকিয়ে দিই পুরো দলটাকে, ভোর হলে যদি আবার বের করে এনে খোয়াড়ে ছেড়ে দিই–তবে ওরা নিরাপদে থাকবে। না খেয়ে মরবে না এবং সর্বোপরি রাতে কারুর চোখে ওদের অস্তিত্ব প্রকাশ পাবে না। দ্বিতীয় পন্থা হল, যদি এক জায়গায় সবাইকে না রেখে দুটো কি তিনটে দলে ভাগ করি এবং এক একটা দলের জন্যে আলাদা আলাদা জায়গা ঠিক করি। এতে সুবিধে এই, চট করে ওরা যে গৃহপালিত জীব এটা ধরা পড়বে না এবং আমারও মাটির নিচে গোপন আস্তানা খোঁড়ার প্রয়োজন হবে না।
দ্বিতীয়টাই প্রথমটার তুলনায় মনঃপূত হল বেশি। তখন লেগে গেলাম জায়গা খোঁজার কাজে। একটা পাওয়া গেল। দুপাশে গাছের আড়াল, মাঝখানে খানিকটা চত্বর মতো। তাতে সবুজ কচি ঘাস। প্রায় তিন একর পরিমাণ বিচরণের জমি। আমার কাজের পক্ষেও এটা যথেষ্ট সুবিধাজনক। বেড়া দিতে বা ঘিরতে বিশেষ একটা পরিশ্রম লাগবে না। বলতে গেলে সব দিক থেকেই আর মনের মতো।
কাজে লেগে গেলাম পরদিনই। মোট সময় লাগল একমাস। চারধারে বেড়া বাধা শেষ। কেড়ার ধারে ধারে বসিয়ে দিয়েছি গুলম জাতীয় গাছ। তারপর কটা মাদী আরা দুটো মন্দাকে এনে ছেড়ে দিলাম চত্বরে। আগের মতো তেজ তো আর নেই। অনেকটা পোষ মানা গোছের ভাব এখন। জোর জবরদস্তি তেমন আর ফলাতে চায় না। দেখি মূল দল থেকে আলাদা হয়েও বেশ স্বচ্ছন্দেই আছে। ব্যস, আমারও স্বস্তি।
জানি না আপনারা ব্যাপারটাকে কী চোখে দেখছেন। এই যে এত পরিশ্রম, এত দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা–সব কিছুর মূলে কিন্তু বালির উপর সেই পায়ের ছাপ। না দেখলে এত খাটাখাটুনির কোনো প্রয়োজনই হত না। এ যেন অজানা অলীকের পানে মোহগ্রস্তের মতো ছুটে যাওয়া। শুধু ছাপ, মালিককে এই দুবছরের মধ্যে বারেকের তরেও দেখতে পেলাম না। জানি না কেমন তার আকৃতি প্রকৃতি। তবে সে যে মনুষ্য, এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সভ্য হতে পারে, কিব্রা অসভ্য। দুটোই আমার কাছে সমান ত্রাসের ব্যাপার। মোটমাট মানুষের সান্নিধ্য এখন আমি এড়াতে চাই। তাদের ছায়া দেখলেও জানি না হয়ত আৎকে উঠব। ঈশ্বরের কাছে দিবানিশি এই প্রার্থনা জানাই প্রভু, আর যাকেই হাজির কর তুমি এই দ্বীপে, সে যেন মানুষ না হয়। অসভ্য বর্বর তো নয়ই, এমন কি সভ্য মানুষও এই আমার জীবনের সর্বশেষ কামনা। তবে এই শাস্তির আলয়ে অশান্তির ছায়া ঘনাবে। তোমাকে নিভৃতে ডাকার কাজে ছেদ পড়বে। আমি চাই না সে কাজে কেউ বিঘ্ন ঘটাক। চাই না কেউ আমার এই সাম্রাজ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসুক।
কিন্তু এ প্রসঙ্গ এখন থাক। কাজের কথা বলি। আমার ছাগলের পালের মধ্যে এক দলকে করেছি নিরাপদ, আরো একদলের নিরাপত্তার ব্যাপার আছে। তারই খোঁজে কদিন সারা দ্বীপ তোলপাড় করে বেড়ালাম। মোটমাট থাকতে পারে ওরা নিরাপদে, এমন একটা চমৎকার জায়গা আমার চাই। একদিন, ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পৌঁছেছি পশ্চিম প্রান্তে, আনমনা তাকিয়েছি সমুদ্রের দিকে ওমা, দেখি একটা নৌকা! খুব দূরে ঠিকই, তবু চোখে যেন মুহূর্তের জন্যে ধরা পড়ল! নাকি আমার দেখারই ভুল! দূরবীন তো আর সঙ্গে নিয়ে বেড়াই না, গুহায় বাক্সের মধ্যে সযত্নে মজুত আছে। মোট দুটো। সেই নিয়ে এসেছিলাম জাহাজ থেকে। এত আফসোস হল! ইস, যদি থাকত এখন একটা সাথে! ভাবলাম, যাই ছুটে গিয়ে নিয়ে আসি। কিন্তু সে কি আর একটু দূর। ফিরে আসতে আসতে দিন ফুরিয়ে সন্ধের ঘোর নামবে। তখন তাড়াতাড়ি কাছের একটা টিলার মাথায় চড়লাম। কই, কিছুতো নেই! সুনসান চারধার! তবে কি আমার মনের ভুল। ভারি দুশ্চিন্তা নিয়ে নেমে এলাম উপর থেকে। ঠিক করলাম, এবার থেকে দূরবীন সঙ্গে না নিয়ে আমি এক কদমও বাড়াব
এবং মোটামুটি এতদিন পরে আমি পায়ের ছাপের একটা যুক্তি খাড়া করতে পারছি। দৃষ্টি বিভ্রমের ব্যাপার নয়, বারেকের জন্যে হলেও আমি যা দেখেছি সেটা নৌকো। স্বভাবতই নৌকোর চালক নরখাদক বর্বর। সঙ্গে নির্ঘাৎ কোনো বন্দী। অর্থাৎ আমারই মতো কোনো হতভাগ্য, ভুল করে বা অন্য কোনো কারণে হয়ত বা ওদিকের দ্বীপে জাহাজ ভিড়িয়েছিল। নেমেছে ভাঙায়। অমনি ধরা পড়েছে ওদের হাতে। নৌকোয় করে বদীকে নিয়ে মহা খুশিতে ওরা রওনা দিয়েছে এই দ্বীপের দিকে। জানে তো এখানে মানুষজন থাকে না। তারপর আর কি? বন্দীকে হত্যা। তারপর মহানন্দে হৈ চৈ করে নরমাংসের ভোজ!
এটা যে অলীক কল্পনা নয়, তার প্রমাণ একটু পরেই পেলাম। এই অংশে আগে আমি কখনো আসি নি। পাহাড় থেকে নেমে কূলের দিকে এগোতে গিয়ে হঠাৎ দেখি, এক গাদা নরখুলি, হাত পা আর ধড়ের কঙ্কাল, পাশে একটা জায়গায় আগুন জ্বালাবার চিহ্ন, বালি খুঁড়ে সেখানটায় ছোটো একটা উনুন মতো করা হয়েছে। অর্থাৎ রান্নাবান্না হয়েছে এখানে বসেই। কঙ্কাল কটা ফেলে রেখে গেছে।
দেখে আমার তো প্রথম অবস্থায় ভিরমি খাবর যোগাড়! অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি তো তাকিয়েই আছি। এই বিপদের হাতে আমিও যে পড়তে পারি যে কোনো মুহূর্তে, আমারও যে একই দশা হতে পারে–এ চিন্তাটুকও তখন আর মাথায় নেই। কী নৃশংস এই নরখাদকের দল! পারে এইভাবে রক্তমাংসের একটা জ্যান্ত মানুষকে কেটে কুটে খেতে। শুনেছি এদের সম্বন্ধে বিস্তর, কিন্তু সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা বলেতে গেলে এই প্রথম হল। সংবিত ফিরে আসতে সে কী ঘেন্না আমার শরীরে, কী গা গুলানো ভাব! বমি পাচ্ছে। এখুনি যেন কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। গায়ে পায়ে এতটুকু যেন জোর নেই। নিজের অজান্তেই সকালের খাওয়া যাবতীয় খাবার হড়হড়িয়ে উঠে এল গলা দিয়ে। উঃ, সে যা অবস্থা! বেশ কয়েকবার ওয়াক উঠল। শেষে শুধু জল বেরয় মুখ দিয়ে। পেটে আর তো কিছু নেই। তখন স্বস্তি বোধ করলাম অনেকটা। সুস্থ লাগছে। হাত পায়ের কাপুনিও কমেছে। কিন্তু আর না। এবার পালাতে হবে এখান থেকে। পারছি না সহ্য করতে এই দৃশ্য। তখন প্রাণপণে চোখ সরিয়ে নিয়ে পিছু ফিরলাম এবং কোনোদিকে দৃকপাত না করে বনবাদাড় ভেঙে দে ছুট।
বেশ খানিকটা এসে দাঁড়ালাম এক চমক। তখনো কেমন যেন নেশালাগা ঘোর ঘোর ভাব। দেখি কড়কড় করছে চোখ। জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। অর্থাৎ কান্না। নিজের অজান্তেই কখন যেন কাঁদতে শুরু করেছি। আকাশের দিকে মুখ তুললাম, ঈশ্বরকে ডাকলাম প্রভু, আমায় রক্ষা কর, আমি পাপী। বুঝতে পারি না তোমার মহিমা। তাই তোমাকে বারে বারে দোষ দিই। তুমি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছ। এ আমার পরম আশীর্বাদ। আমি ধন্য। আমায় ক্ষমা কর।
আহ, অনেকটা হালকা লাগছে। চোখের জল মুছলাম। ফিরে গেলাম নিজের বাড়িতে। ভয়ের বোধটা এখন বলতে গেলে নেই। আসলে এই যে দ্বীপে আসে ওরা কখনো সখনো, সেটা দ্বীপে কি পাওয়া যায় তার খোঁজে নয়, লোকচক্ষুর আড়ালে এই নীরব নির্জনে বসে এদের পৈশাচিক প্রবৃত্ত চরিতার্থ করতে। যতদূর অনুমান কুল ছেড়ে ওরা ডাঙায় অব্দি ওঠে না। জানে তো উঠে কোনো লাভ নেই। এখানে তো আর কিছু মিলবে না। অহেতুক তাই আর পরিশ্রম কেন। তাইতো এই দীর্ঘ আঠার বছর ঐ কটা পায়ের ছাপ ছাড়া আর একটা ছাপও আমার নজরে পড়ল না। পড়ুক না পড়ুক আমারই বা কীসের অত মাথাব্যথা! আমি তো আর স্বেচ্ছায় ধরা দিতে আগ্রহী নই। আসুক ওরা, যা খুশি তাই করুক, আমি যেমন আছি থাকব। ওদের চোখের আড়ালে, নিজেকে যতদূর সম্ভব লুকিয়ে রেখে। অত দুর্ভাবনা করে আমার লাভ কী!
কিন্তু পারা যায় কি তবু? চিন্তা করা যত সোজা সেটাকে কার্যে পরিণত করা যে ততটাই কঠিন। ভাবি মনে আর স্থান দেব না ভয় বা আতঙ্ক, ভিতরে বোধটা স্থায়ী ভাবে থেকে যায়। তাই নিয়ে সদা সর্বদা বিশ্রী এক মনের ভাব। কিছুটা বিষণ, কিছুটা বা ভয়ার্ত। দুয়ে মিলে অদ্ভুত এক থমথমে পরিবেশ। ঘুরি ফিরি বেড়াই,–সব নিজের পরিচিত সীমার মধ্যে। দূরে কোথাও যাই না। খুব বেশি হলে মাচান অব্দি আমার দৌড়। ছাগল যেখানে সে অব্দি যেতে ভয় লাগে। ডোঙা দেখতেও যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। সেটাকে কখনো নিয়ে আসব যে দ্বীপের এই ধারে–সে চিন্তা ইদানীং মন থেকে বিসর্জনই দিয়েছি বলা যায়। এইভাবেই কেটে যায় দুটি বছর।
তা বলতে গেলে নির্বিঘ্নেই কাটল। আগের মতোই গতানুগতিক জীবন, শুধু একটু অধিক মাত্রায় সতর্ক এই যা। চোখ কান আগের চেয়ে একটু বেশি খোলা রাখি। সন্দেহজনক কোনো কিছু দেখলেই থমকে যাই। খতিয়ে দেখি জিনিসটা কী। নিশ্চিন্ত হলে তবে এগোই। নতুবা নয়। মোটমাট ধরা আমি কিছুতেই দেব না। পারবে না কেউ আমাকে অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে কাবু করতে। কাঁধে আমার সর্বদা সজাগ বন্দুক। হিসেব করে বারুদ বা টোটা ব্যবহারের দরকার তো আর এখন নেই। খাদ্য আমার যথেষ্ট পরিমাণে মজুত। এক পাল ছাগল রয়েছে খামারে। তাদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। নতুন ছাগল ধরবার প্রয়োজন হলে এখন আর গুলিগোলা ব্যবহার করি না, স্রেফ ফাঁদ পেতে একটার পর একটাকে ঘায়েল করি। তা হিসেব করে দেখলাম, গত দুবছরে একটি বারের জন্যেও আমি গুলি ছুড়ি নি বা ছুড়বার প্রয়োজন বোধ করি নি। তবু বেরলে সঙ্গে কিন্তু বন্দুক আমার নিত্য সহচর। তিনটে পিস্তলও থাকে। দুটো তো বটেই। কোমরের বেল্টের সঙ্গে গাথা বলতে গেলে। তলোয়ারও আছে। সেটা বেল্টের সঙ্গে বাঁধা। কিন্তু ঐ এক ঝামেলা–খাপ নেই তরবারির। সেক্ষেত্রে খোলাই থাকে। সেই অবস্থাতেই আমি ভাঙডেঙিয়ে ঘুরে বেড়াই।
অর্থাৎ সব মিলিয়ে এই আমার বর্তমান জীবন। এর সঙ্গে পুরানো অবস্থাটাকে মেলাতে বসলে মাঝে মাঝে একটু দুঃখ হয়। পুরানো দিনগুলোতে ছিল অপূর্ব এক শাস্তির ভাব, যাকে বলে নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ জীবন। সেই শান্তি ইদানীং বিপর্যস্ত হয়েছে। তার বদলে ভয়। তুলনামূলকভাবে এখন আমি বরং খানিকটা দুঃখের মধ্যেই আছি। তুলনা এইভাবেই হয় কিনা। একের সঙ্গে অপরকে মানুষ তুলনা করে। নিজের অবস্থার সঙ্গে আরেকজনের অবস্থাকে খতিয়ে দেখে। তবেই না কোনটা ভালো কোনটা মন্দ টের পায়। আমিই বা এর ব্যতিক্রম হই কীভাবে। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখি ইদানীং আগের মতো অতটা অভাববোধ আর আমার নেই। আগে সেই যেমন দরকার লাগত এটা ওটা নানান জিনিস–সেই দরকার থেকে জন্ম নিত নানান উদ্ভাবনী কৌশল–সব গেছে বর্তমানে স্তব্ধ হয়ে। এটা ভালো এটা মন্দ–এই নিয়ে বাছাবাছিও দেখি ইদানীং বন্ধ হয়ে গেছে। অস্পেতেই এখন যথেষ্ট সন্তুষ্ট বোধ করে থাকি। যেমন মাঝখানে ভেবেছিলাম যব থেকে হালকা এক ধরনের পানীয় মদ বানাব। আগের অবস্থায় থাকলে হয়ত এতদিন বানিয়েও ফেলতাম। কিন্তু এখন আর ঐ সব ঝঞ্ঝাটে মাথা গলাতে ইচ্ছে করে না। ঢাল নেই তলোয়ার নেই কীসের অত সখ রে বাপু! তার চেয়ে করব না ভাবলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
এই হল বর্তমানে আমার মনের অবস্থা। ঘুরে ফিরে একটাই চিন্তা কেবল এখন কী করে কী কৌশলে যদি আসে দুবৃর্ত শয়তানের দল, তাদের মোকাবিলা করব। আমার অনুমান যদি নির্ভুল হয় তবে এই দ্বীপে নিয়ে আসে তারা বন্দীকে। কেটেকুটে খায়। আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান কীভাবে রক্ষা করব সেই বন্দী জীবন। তাকে বাঁচাব। সঙ্গে সঙ্গে দুর্বত্তদেরও ঘায়েল করার ব্যাপার আছে। হত্যা করব তাদের। কিংবা এমন ভয় ধরিয়ে দে যাতে আর এই দ্বীপে আসার সাহস না পায়। কিন্তু সে কি আমার একলার পক্ষে সম্ভব? আমি একা মানুষ–আর ওরা যদি সংখ্যায় হয় বিশ বাইশ জন! তিরিশও হতে পারে। সঙ্গে নির্ঘাৎ থাকবে অস্ত্রশস্ত্র। তীর ধনুক বা বল্লম কি বর্শা। সেক্ষেত্রে আমি কি পারব বন্দুক নিয়ে ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে?
আচ্ছা যদি গর্ত খুঁড়ি একটা কেমন হয়? সেই যেখানটায় আগুন জ্বেলেছিল। তার মধ্যে বারুদ রেখে দেব অনেকটা। প্রায় পাঁচ ছ পাউন্ড ওজনের। ওরা যেই ফের এসে আগুন জ্বলবে অমনি বারুদে ধরে যাবে আগুন, আর সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ–ফলে কেউ আর বাঁচবে না।
আপাতদৃষ্টিতে পরিকল্পনা হিসেবে চমৎকার, কিন্তু দু একটি অসুবিধের জায়গাও আছে। প্রথমত অতটা বারুদ নষ্ট করতে আমার ইচ্ছে নেই, মনের দিক থেকে তেমন সায় পাই না। সঞ্চয় বলতে আছে আর মাত্র এক পিপে। ফুরোতে কতক্ষণ? দ্বিতীয়ত আগুনের কাছাকাছি যে বসবেই ওরা তার কোনো স্থিরতা নেই। দূরেও বসতে পারে। সেক্ষেত্র বিস্ফোরণের আঁচ তাদের লাগবে না। হয়ত শব্দ হবে, কানের পাশ দিয়ে দুমদাম করে বেরিয়ে যাবে কটা আগুনের স্ফুলিংগ, তাতে ভয় পাবে তারা, কিন্তু প্রাণে মরবে না।
এবং সে অবস্থায় আমাকে পালটা কোনো রাস্তা ভাবতেই হচ্ছে। আচ্ছা যদি অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি এদের উপর! তিনটে বন্দুক তো আমার আছে। তিনটেতেই থাকবে দুটো করে টোটা ভরা, ওরা হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠবে, অমনি রৈ রৈ চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ব ওদের মাঝখানে। তারপর আর কি দেদার গুলি। এক এক গুলিতে জোড়ায় জোড়ায় তো পারবই ঘায়েল করতে। এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। বন্দুক ছাড়াও সঙ্গে থাকবে পিস্তল, আর তরবারি। যদি মোট থাকে কুড়িজন,-কুড়িটাকেই আমি খতম করব। করবই। সে মনোবল আমার আছে। তবে আর কি, সেইভাবেই নিজের মনকে প্রস্তুত
ক হপ্তা ধরে এই নিয়ে চলল ভাবনার খেয়া। শয়নে স্বপনে জাগরণে এই আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। কীভাবে মহড়া নেব, কীভাবে বন্দুক চালাব, পিস্তলটা থাকবে কোথায়–এই সব নিয়ে কেবলই নানান ফন্দি আঁটি। শেষে এমনই অবস্থা ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখতে লাগলাম মারপিটের।
জায়গাটাও দেখে এলাম অনেক বার। কোথায় লুকিয়ে থাকব আমি, কোথায় বসলে ওরা আমাকে দেখতে পাবে না কিন্তু আমি নজর রাখতে পারব ওদের প্রতিটি গতিবিধির
শুরু করেছে। বদলে জন্ম নিচ্ছে ঘৃণা। আর বিদ্বেষ। অদেখা অজানা সেই বিশ ত্রিশ জন বর্বর শয়তান নরখাদকের উপর বিদ্বেষ।
যেখানে লুকোব সেটা পাহাড়ের ঢালে একটা মস্ত গাছের কোটর। প্রতিটি কার্যবিধি আমি নিখুঁত ভাবে ঠিক করে ফেলেছি। বসে থাকব সেই কোটরে, ওরা নৌকোয় চেপে আসবে, নামবে তীরে–আমি সব দেখতে পাব। তারপর হয়ত বন্দীকে হত্যা করার প্রস্তুতি নেবে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার লুকায়িত জায়গা থেকে ছুড়ব গুলি। পর পর কয়েকবার। একের পর এক শয়তান পড়বে মাটিতে লুটিয়ে। ব্যস আমার উদ্দেশ্য সার্থক।
কিন্তু হ্যাঁ, যদি কোনোক্রমে নিশানা ব্যর্থ হয়।
সেটাও ভেবে রেখেছি একই সঙ্গে। কী করব তখন সেটাও ঠিক। যাতে না হয় সেজন্যে বন্দুকে ভরা থাকবে অতিরিক্ত টোটা। ছররা যাকে বলে। একবার ঘোড়া টিপলে একসাথে ছুটে যাবে অনেকগুলো গুলি। একটা না একটা লাগবেই নির্ঘাৎ। মুরগি মারার সময় আমি যে ছররা ব্যবহার করে থাকি। তদুপরি পিস্তল তো সঙ্গে রয়েছেই। তাতে থাকবে চারটে করে টোটা। বন্দকে কাজ না হলে পিস্তল চালাব।
এবং এখন শুধু প্রতীক্ষার পালা। রণকৌশল আমি ঠিক করে ফেলেছি, বলতে গেলে প্রতিটি ইঞ্চি মেপে নির্ভুল। তত্ত্বের দিক থেকে এতটুকু তুটি কোথাও নেই। এখন শুধু তাদের আসার অপেক্ষা। আসে কিনা দেখার জন্যে রোজ পাহাড়ের মাথায় গিয়ে উঠি। আমারই বাড়ির গা ঘেঁসে যে পাহাড়টা। দূরবীন দিয়ে চতুর্দিকে নজর বোলাই। কই, পড়ে না তো কিছু চোখে। নৌকো তো দূরের কথা, একটা ভেলা অব্দি দূর থেকে এদিকে ভেসে আসতে দেখি না। অথচ তিন তিনটে মাস প্রতিদিন আমার পর্যবেক্ষণের কামাই নেই। তিন মাইল চড়াই ভেঙে পাহাড়ের মাথায় ওঠা। ফের খানিকক্ষণ কাটিয়ে ড্যাঙডেঙিয়ে নেমে আসা। ফল প্রতিদিনই শূন্য। দেখা পাই না জনমনিয্যির।
তবে সে জন্যে আমার কোনো হতাশা নেই। ক্ষিপ্ত যে এখন আমি। আর ভিতরে ভিতরে দারুণ রাগ। বিশ হোক আর ত্রিশ হোক যতজন খুশি আসুক–আমি খুন করবই করব। এটা আমার সংকল্প। নরহত্যার বদলা আমি নেই। একদিন এই মনোভাব নিয়ে পাহাড়ে উঠছি চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখার জন্যে, হঠাৎ একটা অদ্ভুত চিন্তা মনে উদয় হল। আচ্ছা, এই আমি যা করব বলে ঠিক করেছি–এটা ঠিক তো, না ভুল? ঈশ্বর যদি নিয়ন্তা হন এই বিশ্বপৃথিবীর, তবে এই যে নরহত্যা ওরা করে, এই যে পাপ-এর বিরুদ্ধে তিনি কোনো পন্থা গ্রহণ করেন না কেন? পাপীকে শাস্তি দেওয়াই তো ঈশ্বরের কাজ। ওরা কি শাস্তি পায় এই অন্যায়ের জন্যে?
এ যে অদ্ভুত এক আত্মদর্শন। সঙ্গে সঙ্গে এতদিনের সমস্ত প্রচেষ্টা আমার, সমস্ত চিন্তা সমস্ত উদ্যোগ–সব যেন অর্থহীন বলে মনে হতে লাগল। আশ্চর্য, এ প্রশ্ন আমি এতদিন খতিয়ে দেখি নি কেন! এই যে হত্যা ওরা করে–এমনও তো হতে পারে, পাপ বা অন্যায় ভেবে ওরা করে না। এটা ওদের প্রথা। বন্দীকে হত্যা করতে হয় এটা রেওয়াজ, তাই হত্যা করে। একে তো পাপ বলতে পারি না। কোনো দিক থেকেই এটা অন্যায় নয়। তবে কেন অনর্থক আমি ওদের বিরুদ্ধে রাগে বিদ্বেশে নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারছি?
পাহাড়ের মাথা অব্দি ওঠা আর হল না, মাঝপথে দাঁড়িয়েই এই সব নিয়ে ভাবতে লাগলাম। এই যে দীর্ঘ তিনমাস ধরে একের পর এক চিন্তা আমি করেছি, বিদ্বেষ বিরোধে পূর্ণ করেছি আমার হৃদয়ের পাত্র–সেটা এখন মনে হচ্ছে সর্বৈব ভুল। ভাবছি ওদের আমি হত্যাকারী, আসলে ওরা তা নয়। বন্দী হত্যা যদি অপরাধ বলে ধরি, তবে ইংরেজরা তো অনেক বেশি অপরাধী। যুদ্ধে বন্দীদের তারা ধরে জেলে ভরে, আজীবন রাখে কারাবাসে, সেখানেই মৃত্যু হয়। এছাড়া যুদ্ধে যে অগণিত হত্যা হয়, মৃত্যু হয়–তারও মূলে তো তারাই। সেটাই বা কি কম অপরাধ।
একটু ঘুরিয়ে চিন্তা করলে যা ওরা করছে–সে যত নৃশংসই হোক না কেন, তাতে আমার কী-ই বা আসে যায়? এরকম কত ঘটনাই তো ঘটে পৃথিবীতে। নানান দেশে। স্পেনীয়রা শুনি দেবদেবীর নামে বন্দী জীবন উৎসর্গ করে। নিষ্ঠুরভাবে তাদের প্রাণ বলি দেয়। কত অত্যচারই তো করল তারা। আমেরিকায় কত হত্যাই না করল। লক্ষ লক্ষ আমেরিকার আদিবাসীকে প্রাণ দিতে হল। এ ব্যাপার নিয়ে যখন কোনো বিবৃতি শুনি, তাতে তো অপরাধ বা অন্যায়ের লেশমাত্র থাকে না, এটাকে প্রচার করা হয় জীবনের এক স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে। সারা ইউরোপের মানুষ একে ন্যায় এবং সত্য বলেই মনে করে। এমনকি দেবদেবীর নামে অপরকে নিষ্ঠুরভাবে উৎসর্গ করাকেও। কই, তার জন্যে তো আমি কখনো রুখে যাই না। নৃশংস নিষ্ঠুর বর্বর আচরণ বলে কখনো ঝাঁপিয়ে পড়ি না। তবে এই ঘটনা নিয়েই বা আমার এত মাথাব্যথা কীসের?
মোটমাট আমার এতদিনের যাবতীয় প্রস্তুতি, যাবতীয় উদ্যম সব স্তব্ধ করে দিল এই চিন্তা। বলতে গেলে বিরাট একটা যতিচিহ্ন। থমকে গেলাম। নেমে এলাম পাহাড়ের উপর থেকে। আর ভাবব না এসব। অনর্থক কারুর উপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে মুখিয়ে যাব না। কী দরকার জবরদস্তি ওদের মধ্যে গিয়ে পড়ার? যদি ওরা আমাকে আক্রমণ করে তখন নয় অন্য কথা। কিন্তু যতক্ষণ করছে না, আমার করণীয় কী থাকতে পারে।
সে যেন এক নতুন উপলব্বি আমার। নতুন ভবে আগাগোড়া সব কিছু বুঝবার ভাববার চেষ্টা করা। কত ত্রুটি যে ছিল আমার পরিকল্পনায়। এতদিন ঘোরের মধ্যে ছিলাম, তাই বুঝতে পারি নি। যেমন, হুড়মুড় করে হয়ত গিয়ে পড়লাম ওদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে। ডাইনে বয়ে বন্দুক চালালাম। মরল অনেকে। হয়ত একজন কোনোভাবে ত্রাণ পেল। নৌকো বেয়ে অসীম ক্ষিপ্রতায় ফিরে গেল নিজের দেশে। সেখানে গিয়ে সব কথা বলল, নিয়ে এল হাজার হাজার মানুষ আমার উপর বদলা তুলবার জন্যে। তখন কি আর তিনটে বন্দুক আর তিনটে পিস্তল নিয়ে পারব আমি ওদের সাথে মহড়া দিতে। সেক্ষেত্রে নিজের ধ্বংস অনিবার্য।
অর্থাৎ কৌশলের দিক থেকে হোক কি নীতির দিক থেকে তোক কোনো ভাবেই ওদের বিরুদ্ধাচরণ করা আমার ঠিক না। তাতে নিজেরই ক্ষতি। আমার একমাত্র কাজ হবে এখন নিজেকে ওদের চোখের আড়ালে লুকিয়ে রাখা। সেই সাথে আমি যে এখানে আছি সেটা ওদের কোনো ভাবে বুঝতে না দেওয়া।
এর বাইরে অন্য কিছু করার অধিকার আমার নেই। এটা আমি ধর্মের নিরিখ থেকে বলছি। খোদার উপর খোদকারী করা কি মানুষের সাজে! এই তো ঈশ্বরের সাজানো বাগান। এই বিশ্ব দুনিয়া। সেখানে যে যার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে সে নিজের নিজের নিয়মে। ঈশ্বরের সমর্থন আছে বলেই না সেভাবে সাজাতে পারি। আমি কে এমন ক্ষমতাধর যে সব নিয়ম তছনছ করে নিয়ন্ত্রনের অধিকার আমি নিজের হাতে তুলে নেব?
এত শান্তি পেলাম মনে, এত নিশ্চিন্তু–সে আর বলা নয়। বুক যেন হালকা আমার। হৃদয় যেন পবিত্র। কী পাপই না করতে চলেছিলাম অমি। নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনছিলাম। ঈশ্বরের অনুগ্রহেই না এবারও ত্রাণ পেলাম!–হে ঈশ্বর, আমি তোমাকে আর কীভাবে ধন্যবাদ জানাব! আমি অবোধ, আমি দুর্মতি। তুমি বারেবারে আমাকে আলোর দিশা দাও। আমি অজ্ঞান, তাই আমি বারবার ভুল করি।
পরের একটা বছর এইভাবেই কাটালাম। নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ জীবন। কোনো তাপ নেই, উত্তাপ নেই। শুধু সতর্কতা ভীষণ। অহেতুক নিজেকে জড়াব না কোনো ঝামেলায় এটাই আমার জীবনের মূলমন্ত্র। আমি যে এই দ্বীপের বাসিন্দা এটা কোনো ভাবে কাউকে বুঝতে বা জানতে দেব না। যত্রতত্র সেই কারণে আর যাই না। উঠি না পাহাড়ের মাথায়। ডোঙাটা যেখানে নোঙর করা ছিল সেখান থেকে দড়ি বেঁধে গুণ টেনে নিয়ে এলাম পুবের তুলে। তোলা ছিল পাল, সেটা নামিয়ে দিলাম। নিয়ে এলাম বাড়িতে। ডোঙায় বাকি যে সব জিনিস রেখেছিলাম সব একে একে বাড়িতে এনে তুললাম। ডোঙাটা রাখলাম পাহাড়ে ঘেরা এক বাড়ির মধ্যে। মোটমাট কেউ যদি দেখে ভুলেও বুঝতে পারবে না এটা এই দ্বীপেরই কারুর হাতে তৈরি। ধরে নেবে ভাসতে ভাসতে এসেছে হয়ত সমুদ্রের স্রোতে, কোনো রকমে খাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বাস্ এছাড়া অন্য কিছু বুঝবার বা ভাবার কোনো উপকরণ তাদের চোখে পড়বে না।
নিজের গতিবিধিও এখন যারপরনাই নিয়ন্ত্রিত। বাইরে বড় একটা যাই না। নিজের সীমানার মধ্যেই থাকি। কাজের মধ্যে প্রধান এখন দুধ দোয়ানো। তিনটে তো খোয়াড় মোট আমার। তাতে অগুণতি ছাগল। নিয়ে আসি দুধ। নিজের রান্নাবান্না করি। আর ভাবি এটা ওটা আকাশ পাতাল। ঈশ্বরের অসীম দয়া ভাই না আমি বেঁচে আছি। যদি আমার অনুমান নির্ভুল হয় তবে এই দীর্ঘ বিশ বছরে ওরা অজস্রবার এসেছে এই দ্বীপে। সেই বর্বর নরখাদকের দল। সংখ্যায় কখনো বিশ কখনো ত্রিশ। এতদিন তো চলাফেরার আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যেখানে খুশি যেতাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম দ্বীপের প্রতিটি অংশ। সম্বল বলতে হাতে শুধু একটা বন্দুক। তাতে আবার পাখি মারার টোটা ভরা। যদি সেই অবস্থায় দেখে ফেলত ওরা। যদি উন্মাদের মতো আমাকে ধরবে বলে পিছনে ধেয়ে আসত। পারতাম আমি নিজেকে রক্ষা করতে। ওদের চেয়ে কি জোরে আমি ছুটতে পারি!
শিউরে উঠি নিজের মনেই। মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল হিমস্রোত বয়ে যায়। প্রত্যক্ষ করি কল্পনার দৃষ্টিতে তার পরের ঘটনাবলী। নিষ্ঠুর নির্দয় ভাবে ওরা আমাকে হত্যা করছে, তারপর পরম উল্লাসে কেটে কেটে খাচ্ছে আমার গায়ের মাংস। সে যে কী বীভৎস, ভাবতে বসলে আর বড় নিঃসঙ্গ বোধ হয়। কত একলা আমি এই দ্বীপে, কত অসহায়। এমন কেউ নেই যে আমাকে এই সব বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। তখন কান্না পায়। তখন দুঃখে বুক ভেঙে যাবার দাখিল হয়। ঈশ্বরের নাম তখন জপ করি মনে মনে। হে ঈশ্বর, এই নিঃসঙ্গতায় তুমিই আমার একমাত্র পরিত্রাতা। তখন মনে একটু জোর আসে।
এ এক অদ্ভুত নিয়ম। আশ্চর্য আমাদের এই জীবন, ততধিক আশ্চর্য জীবনের এইসব অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। যেন অমোঘ কোনো নির্দেশ। মানুষ পড়ে বিপদের মুখে, হয়ত এমনই সে বিপদ তার করবার মতো কোনো কিছুই আর নেই। জানে না কোন দিকে কোন্ পথে এগোবে বা কীভাবে ত্রাণ পাবে। সেক্ষেত্রে অন্ধকারে আলোক বর্তিকার মতো পথ দেখায় তাকে এই অদৃশ্য নির্দেশ। সেই পথে এগিয়ে সে বিপদ থেকে ত্রাণ পায়। আমারও জীবন জুড়ে এই অলৌকিক নির্দেশের ছলাকলা। বারে বারে পথ যায় ভুল হয়ে, বারে বারে বেঠিক হয়ে যায় লক্ষ্য, কী করব হাজার চেষ্টা করেও ঠিক করে উঠতে পারি না, তখন অলৌকিক অদৃশ্য নির্দেশ আমাকে পথ দেখায়। সঙ্কট থেকে ত্রাণ পেয়ে আমি নতুন জীবন নতুন উপলদ্ধি লাভ করি।
পরেও বহুবার জীবনের নানান ক্ষেত্রে আমি এই সত্য যাচাই করে দেখেছি। একভাবে এগোতে এগোতে পেয়েছি এই নির্দেশের হাতছানি, অমনি থমকে দাঁড়িয়ে গোটা ব্যাপারটা নতুন করে ভেবেছি, পেয়েছি নতুন পথের দিশা। পুরানো পথ ত্যাগ করে আমি সেই নতুন পথে পা বাড়িয়েছি।
এর অসংখ্য উদাহরণ আমার এই দ্বীপবাসের জীবনে মজুত আছে। পাঠক ইতোমধ্যেই কিছু কিছু নজির পেয়েছেন। আরো পাবেন। সময়ে সব উদাহরণই আমি হাজির করব।
মোটমাট অদ্ভুত এক অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে চলছে আমার জীবন। আমার সব হিসেব বদলে গেছ। কত কী বের করতাম মাথা খাঁটিয়ে, সে সব এখন বন্ধ। উদ্বেগে ছেয়ে থাকে সারাক্ষণ আমার মন। কত কিছু যে বাদ দিয়েছি। নিরাপত্তার প্রশ্নটা যে এখন সর্বপ্রধান। সেই ভয়ে আগুন জ্বালি না। তৈরি করি না আর বাসন। যদি গলগলিয়ে ওঠে ধোয়া। ধোয়ার কুণ্ডলী অনেক দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়। তাতে আমি যে আছি এখানে সেটা অনেকেই অনুমান করতে পারবে। বিশেষ করে যদি নরখাদকদের চোখে পড়ে। তাই গুলিও ছুড়ি না। শব্দ সহজেই জানান দেয় মানুষের অস্তিত্ব। কাটি না গাছ। তাতে কুড়লে গাছের গায়ে ঘা লেগে শব্দ উঠবে। তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে বাতাসে ছড়িয়ে যাবে সেই শব্দ। যদি শুনতে পায় ওরা।
একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
অগুন না জ্বেলে তো আর উপায় নেই। রান্নার প্রয়োজনে জ্বলতেই হবে। তাই নিরিবিলি একটা জায়গা দেখে অনেক ভেবেচিন্তে কাটতে গেছি কাঠ, সামনে পাহাড়ে ছোটো একটা গুহা, কাঠ ইদানীং আমি আর জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করি না, পুড়িয়ে কাঠকয়লা বানাই, তাই দিয়ে রান্নার কাজ করি। গুহাটা মোটের উপর আমার পক্ষে আদর্শ। কাঠ পোড়াব এই গুহার মধ্যে, সেক্ষেত্রে গলগলিয়ে ধোঁয়া ওঠার ব্যাপার নেই। কাঠ কেটে জড় করে ভাবলাম যাই একবার, সর্বপ্রথম গুহাটা সরেজমিনে পরীক্ষা করে আসি।
ঢুকে দেখি বেশ বড়সড় মাপের। মুখটা উঁচু প্রায় সাত ফুট, আমার মতো দুজন মানুষ পাশাপাশি হেঁটে স্বচ্ছন্দে গুহায় প্রবেশ করতে পারে। দৈর্ঘ্যে খুব একটা মস্ত নয়। ঠিক কতটা এই মুহূর্তে বলা যায় না। আর ভারি অন্ধকার ভিতরে। চোখে কিছুই ঠাওর হয় না।
আরো ক পা এগোলাম।
ওমা, দেখি অদ্ভুত এক ব্যাপার–দুটো চোখ, এতক্ষণ কোথায় ছিল জানি না, হঠাৎ যেন অন্ধকারের বুক চিরে আমার দিকে কটমট করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
বুক তো আমার শুকিয়ে কাঠ। পা আর চলে না। বাস প্রায় বন্ধ। না পারি এগোতে না পারি পিছোতে। এ আবার কী ধরনের জন্তু রে বাপু! হিংস্র কি? ঝাঁপ দেবে এখুনি আমাকে লক্ষ্য করে? অন্ধকারে চোখের অধিকারী যে কে মানুষ না কোনো জন্তু নাকি অপদেবতা–কিছুই তো মালুম হয় না।
আরো খানিকক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর সংবিত ফিরে পেলাম। ধাতস্থ হলাম খানিকটা। আর নিজেকে নিজেই সে কী গালমন্দ! কী কটু কথার চোট! বিশটা বছর না রয়েছি আমি এই দ্বীপে? আমি এমনই আহাম্মক এটাকে হিংস্র কোনো জন্তু ভেবে ভয় পাচ্ছি? কিন্তু নডে না কেন এতটুকু? আসলে কী এর পরিচয়?
অমনি এক ছুটে বাইরে গেলাম, জালালাম একখণ্ড কাঠ, নিয়ে ঢুকলাম ভিতরে, ভীষণ উত্তেজনা তখন আমার, তিন কদমও এগোই নি, হঠাৎ শুনি মানুষের গলায় গভীর এক ঘাস ফেলার শব্দ। তারপর ককানি। যেন ভীষণ দুর্বল কেউ ককিয়ে ককিয়ে নিজের শরীরের কষ্ট প্রকাশ করছে। পাঠক, ভেবে দেখুন আমার অবস্থা। একটু আগের মনের জোর আমার মুহূর্তে চুপসে গেল বেলুনের মতো। ভীষণ ঘাবড়ে গেছি আমি। মাথায় টুপি পরা, নয়ত হাত দিলে টের পেতাম চুল আমার দাঁড়িয়ে গেছে। কুলকুল করে ঘাম ঝরছে সারা শরীর বেয়ে। আমার বুদ্ধি বলতে তখন আর কিছু নেই। মূক স্তব্ধ নিশ্চল আমি। কী করা উচিত কিছুই ঠিক করতে পারছি না।
তখন ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল–এগোও! অমনি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। আলো পড়েছে গুহার চতুর্দিকে। দেখি পায়ের কাছে শোয়া এক বিশালাকৃতি পাঠা। থুতনিতে মস্ত লম্বা দাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। মুমূর্ষ। হয়ত শোয়াই ছিল। আমাকে ঢুকতে দেখে প্রাণভয়ে উঠে পঁড়িয়েছিল বারেকের জন্যে, আমি বেরুতে ফের শুয়ে পড়েছে।
পা দিয়ে ঠেলা দিলাম, নড়ল না। আমার ইচ্ছে যেভাবে হোক একে বাইরে বরে করে দেওয়া। মরতে হলে বাইরে কোথায়ও গিয়ে মরুক। কিন্তু শক্তি আর নেই শরীরে। তুলবার চেষ্টা করলাম। অন্তত তুলে যদি বাইরে কোথায় রেখে আসা যায়। অসম্ভব ভারী। অগত্যা চেষ্টা ত্যাগ করতে হল। থাকুক না এখানে, মন্দ কী! মরব বললেই তো আর কেউ মরে না। সেক্ষেত্রে মরতে এখনো কয়েকটা দিন লাগবে। ইতোমধ্যে আমারই মতো হঠাৎ ঢেকে যদি কোনো নরখাদক এই গুহায় কোনো কিছুর সন্ধানে, আমারই মতো নির্ঘাৎ সে-ও চোখ দেখে ভয় পাবে।
বিস্ময় পর্ব আপাতত খতম, এবার গুহা দেখার পালা। দেখছি তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ছোট্ট পরিসর। বার ফুটের মতো চওড়া ভিতরটা, তবে আকৃতি যে সবদিকে সমান তা নয়। এবড়ো থেবড়ো ভাব। অবিশ্যি সমতল। শেষ মাথায় এগিয়ে দেখি সরু একটা সুড়ঙ্গ মতো। সেই সুড়ঙ্গ ধরেও বেশ খানিকটা এগোনো যায়। কিন্তু মাথা তুলে হাঁটা অসম্ভব। সুড়ঙ্গ পথে যেতে গেলে হামাগুড়ি দিতে হবে। ভয় কী আমার। হাতে তো রয়েছে জ্বলন্ত মশালরূপী কাঠ। হামাগুড়ি দিয়ে চললাম এগিয়ে। দেখি বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। তখন ক্ষান্ত হলাম। থাক আজ আর নয়। কাল আবার এসে বাকিটা দেখে যাব। তখন সঙ্গে আনব মোমবাতি। যা কিছু নতুন আবিষ্কার কালকেই হবে।
পরদিন যথারীতি এলাম দুটা মোমবাতি নিয়ে। এ আমার নিজেরই হাতে তৈরি। ছাগলের চর্বি দিয়ে আজকাল আমি ভারি চমৎকার মোমবাতি বানানো রপ্ত করেছি।
একটা পাত্রে রেখে দুটা জ্বালিয়ে দিলাম একসাথে। ঢুকলাম গুহায়। সেই সুড়ঙ্গ। চলেছি হামাগুড়ি দিয়ে। একপা দুপা করে একটানা প্রায় দশগজ। সে যে কী সাহস তখন আমার! ভয়ডর সব তুচ্ছ। দেখি একটু একটু করে মাথার উপরে ছাদটা উঁচু হচ্ছে। আরো খানিকটা এগোতে পুরোপুরি উঁচু। দাঁড়ানো যায় সোজা হয়ে। আর কী বাহার সেই গুহার । আলো হাতে ঢোকা মাত্র আলোয় আলোয় দশদিক আলোময়। ছাদ থেকে দেয়াল থেকে চুতর্দিক থেকে যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে আলো। সে প্রায় কুড়ি ফুটের মতো চওড়া আর লম্বা একটা অংশ। কাঁচের মতো ঝিকমিক করছে তাতে অসংখ্য পাথর। জানি না হীরে কি সোনা কিনা। তবে মূল্যবান যে কোনো ধাতু, এটুকু বুঝতে আমার কোনো অসুবিধে হল না।
আমি তো আনন্দে আত্মহারা। মূল্যবান ধাতু দেখে নয়, এমন একটা অদ্ভুত গুহার অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পেরে। সব দিক থেকে নিরাপদ। আত্মরক্ষার আশ্চর্য সুন্দর জায়গা। এতটুক সঁৎসেঁতে কি ভেজা ভাব নেই। মেঝে সমতল। কোনো বিছে বা ঐ জাতীয় বিষধর কোনো প্রাণীও নেই। এরকমই তো একটা জায়গা খুঁজছিলাম আমি মনে প্রাণে। দরকারী জিনিসপত্র এখানে এনে জমা করে রাখতে পারব। যেমন আমার বারুদ এবং প্রয়োজনীয় কিছু খাদ্য শস্য। নিজেও প্রয়োজন বোধে আত্মগোপন করে থাকতে পারব। আসুক না হাজারে হাজারে নরখাদক শয়তান। আমার নাগাল পেলে তো!
শুরু হল বারুদ এবং শস্য এনে রাখার কাজ। সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় সেই যে বারুদ বোঝাই পিপেটা পেয়েছিলাম সেটা এবার খুললাম। দেখি জল ভিতরে ঢুকেছে, তবে তাতে ক্ষতির পরিমাণ সামান্যই। চার পাশে খানিকটা বারুদ জল লেগে জমে শুকনো খটখটে হয়ে গেছে। যেন নারকোলের খোসা। ভিতরের বেশির ভাগটাই ব্যবহারযোগ্য পরিমাণে প্রায় ষাট পাউন্ড ওজনের তো হবেই। সীসের পাতটাও নিয়ে রাখলাম একধারে। এটা আরো বেশি দরকারী। পিটিয়ে পিটিয়ে আমি ছোটো ছোটো ছররা বানাই।
এদিকে পাঠাটা মরেছে; টানতে টানতে নিয়ে এলাম তাকে বহুকষ্টে বাইরে। মস্ত একটা গর্ত খুঁড়লাম। সমাধি দিলাম। পচন ধরেছে শরীরে। ইস, সে যা দুর্গন্ধ।
তেইশ বছর হল এই দ্বীপে। তেইশ টা বছর। বেশ সুখেই ছিলাম। মাঝখান থেকে হিসেবে সব গোলমাল করে দিল নরখাদকের দল। তাইতো এত ঝঞ্ঝাট। সব সময় একটা হ্রাসের ভাব। মনের গভীরে আতঙ্ক। এটুকু বাদ দিলে আমার চেয়ে সুখী মানুষ আর পৃথিবীতে কে আছে। পোলকে শিখিয়েছি আরো কত কথা। আমার সঙ্গে দিব্যি এখন কথা বলে। সে আমার পরম সান্ত্বনা। বেশ লাগে শুনতে। জানি না কতদিন আর শুনতে পাব। জীবের জন্ম যেমন আছে মৃত্যুও আছে। কবে মরে যাবে পটাং করে তা কি জানি? তবে ব্রাজিলে, শুনেছি কাকাতুয়া নাকি একশ বছর অব্দি বাঁচে। সেক্ষেত্রে আমিই আগে মরব, ও বেঁচে থাকবে। আর ঘুরে ঘুরে বেড়াবে দ্বীপে আর ডাকবে : রবিন ক্রুশো, রবিন ক্রুশো, তুমি কোথায়? এদিকে এস …..? নিল সে ডাক। শুনবে না তো কেউ। কে মরতে আসবে এই দ্বীপে! বিশেষ করে আমাদের দেশের কেউ! তবে বুঝবে তার ইংরিজি কথার মানে। আর কেউ শুনলে মানে বুঝবে না, ভাববে হয়ত কোনো প্রেত কি পিশাচ–এখানে মরে ভূত হয়েছে, ডেকে বেড়াচ্ছে উমাদের মতো সারাক্ষণ।
কুকুরের সঙ্গলাভ বঞ্চিত হয়েছি দশ বছর আগে। ষোল বছরের আয়ু। বুড়ো হয়েছিল, স্বাভাবিক কারণেই মারা গেছে। বিড়ালের কথা তো আগেই বলেছি। একের পর এক সে যা বাচ্চা দেবর ধুম! একপালকে তো মেরে ফেলতে বাধ্য হলাম। ভয় পেয়ে পালাল বাকি কটা। আমার সেই গোড়ার দিকের মাদী দুটো দেখি তাও আসে মাঝে মাঝে। চোরের মতো। এসে খাবার দাবার সব চুরি করে খেয়ে চলে যায়। শেষে এমন ভয় দেখালাম! তারপর থেকে আর আসে না। মিশেছে জঙ্গলে গিয়ে হয়ত জাতভাইদের সঙ্গে। আমার চোখে কখনো পড়ে না।
দুটো ছাগল ছানা পুষেছি। এটা সাম্প্রতিক ঘটনা। ভারি ভালো লাগে আমার ওদের হাবভাব। গোড়ার দিকে একটু দূরত্ব ছিল। এখন ভেঙে গেছে সে প্রাচীর। আশেপাশেই সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে। হাত থেকে খাবার খায়। এরা বড় হলে ফের আমি দুটো ছানা পুষব।
বলতে ভুলে গেছি আরো দুটো কাকাতুয়া পুষেছি। কথা বলতে তারাও শিখেছে। কিন্তু পোলের মতো নয়। পোল আমার পরম প্রিয়। এদের যে শেখাব মন দিয়ে, আরো উন্নত করব সে ইচ্ছেও এখন আর নেই।
দুটো মুরগি আছে পোষা। সামুদ্রিক মুরগি। একদিন ফাঁদ পেতে ধরে এনেছিলাম। তারপর ডানা দিয়েছি হেঁটে। দেয়ালের পাশে ঝোঁপ মতো একটা গাছ সেখানেই বাসা বেঁধে থাকে। আর সারাদিন ঘুরঘুর করে বেড়ায় আমার জমির সীমানার মধ্যে। বেশ লাগে। আমি মুগ্ধ চোখে ওদের হাবভাব লক্ষ করি।
এবং এই সব নিয়ে এতদিন বেশ সুখেই ছিলাম। সুখে থাকারই যে কথা। মাঝখান থেকে নরখাদকের দল দিল ব তোলপাড় করে। আমার সুখ এখন দুঃখে পরিণত হতে চলেছে।
কী জানি, সভ্য সমাজে তো থাকি না, হয়ত সেখানকার নিয়ম কানুন একটু অন্যরকম। তবে আমার মনে হয় সুখ আর দুঃখের ব্যাপারে চির সত্য এই একটিই। জীবনের নিয়মটাই এই মাপের। সুখ থাকবে, স্থায়ী হবে, তাকে ছাপিয়ে আসবে দুঃখ। চাকার মতো এর আবর্তন। এটা আমার জীবনে যেমন, সভ্য সমাজেও হয়ত তেমনই। দুয়ের বিশেষ একটা ফারাক নেই।
ঘটনার বিবরণীতে আবার ফিরে আসি।
এটা ডিসেম্বর। তেইশ বছর এই ক দিন আগে পূর্ণ হল। এখন সূর্যের দক্ষিণায়ন। হিম হিম ভাব। তাকে শীত বলা চলে না। এখন চাষের সময়। মাঠে আমাকে কাজ করতে যেতেই হয়। একদিন ভোর সকালে উঠে গেছি মাঠে। দেখি দূরে কুলের কাছে জ্বলছে আগুন, গলগলিয়ে উঠছে ধোয়া। আমি যেখানে সেখান থেকে মোটে মাইল দুই তফাৎ। আমি তো থ। একপাল নরখাদককে এই এতদূর থেকেও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এত কাছে। এ দিকটায় তো ওরা আসে না। কিন্তু আজ যে এল।
খুব ভয় পেয়ে গেছি। ঝোঁপের আড়ালে আমার তো হাত পা বলতে গেলে স্থবির। নড়াচড়া করারও যেন ক্ষমতা নেই। পরছি না আড়াল থেকে বেরতে কি অন্য কোথাও যেতে। মহা মুশকিল। দু মাইল তো মাটে দুর–যদি হাঁটতে হাঁটতে ঘুরতে ঘুরতে কোনো কারণে চলে আসে এদিকে! আমার ক্ষেতখামার দেখতে পায়! তবে তো চিত্তির : ক্ষেত আছে মানুষ নেই তা কি হয়! নির্ঘাৎ ধরে নেবে ওরা আমার অস্তিত্বের কথা। তখন। তল্লাসী চালাবে। ধরে ফেলবে অমাকে। তারপর আর কী বন্দী এবং হত্যা!
মরিয়ার মতো তখন মাটির সঙ্গে গা মিশিয়ে পিছু হটতে হটতে দেয়ালের কাছ বরাবর গিয়ে মইটাকে আঁকড়ে ধরলাম। উঠলাম বেয়ে একলাফে। মই তুলে ভিতর দিকে বসিয়ে নামলাম। সরিয়ে নিলাম মই। ব্যস, আপাতত নিশ্চিন্ত।
কিন্তু পুরোপুরি তো নয়। আক্রমণ ওরা যে কোনো মুহূর্তে করতে পারে। আত্মরক্ষার ব্যবস্থা আমাকে চটপট করে ফেলতে হবে। বন্দুকগুলো তাই গিয়ে নামিয়ে আনলাম। আর পিস্তল। সাজালাম দেয়ালের উপর পাশাপাশি তলোয়ার রাখলাম হাতের গোড়ায়। আসুক দেখি, কার ক্ষমতা আছে আমার সঙ্গে যুঝুক!
বসে আছি সেই ভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দেখি কেউ আর আসে না। দেয়ালের এপাশে তো আমি কিছু যে দেখব দূরে সে সুযোগ নেই। তখন মই বেয়ে গুটি গুটি উঠে উঁকি দিলাম। চটপট শুয়ে পড়লাম দেয়ালের উপর সটান। চোখে লাগালাম দূরবীন। হা, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এবার। সংখ্যায় মোট ওরা নজন। উদোম ন্যাংটা। বসে আছে আগুনের চারপাশে গোল হয়ে। আগুন পোয়াচ্ছে কি? কেন পোয়াবে? শীত তো নেই, উলটো গরমই বলা যায়। অর্থাৎ শিকারের হাড় মাংস এখন আলাদা করা হচ্ছে। যাকে বলে কাটাকুটি। তাই চুপচাপ। আগুনে পুড়িয়ে যখন খাবে, তখন হয়ত উদ্দাম নৃতে মেতে উঠবে।
সঙ্গে দুটো শাম্পান। টেনে তুলে নিয়েছে ডাঙায়। জোয়ার তখন। তাই হয়ত এই কায়দা। হয়ত অপেক্ষায় আছে কখন ভাটা পড়বে। তখন ফিরে যাবে।
আমার কি আর নড়া চড়ার অবকাশ আছে। ঠায় দূরবীন লাগিয়ে শুয়ে আছি একভাবে। আর মনে একের পর এক দুশ্চিন্তা। যদি হুট করে চলে আসে এদিকে। যদি আমার আস্তানা দেখতে পায়! যদি বন্দী করে। নয় এ যাত্রা এল না, যদি আমার অজ্ঞাতসারে পরের যাত্রায় এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। মোটমাট ভয়ে আতঙ্কে আমি বলতে গেলে সিটিয়ে গেছি।
আরো অনেকক্ষণ পরে ভাটা পড়তে উঠল তারা, শাম্পান টেনে জলে নামাল। ফিরে গেল বাইতে বাইতে। যাত্রা শুরুর আগে ঘন্টা খানেক ধরে আগুন ঘিরে সে কী নাচের ঘটা। কত রকম তার অঙ্গভঙ্গি। দূরবীনে যতটা ধরা পড়ল আমার মনে ত্রাস সঞ্চার করতে তাই যথেষ্ট। সবাই উদোম। তবে সবাই পুরুষ না তার মধ্যে কোনো নারী আছে–সেটা আমি এত দূর থেকে বুঝতে পারলাম না।
অমনি বন্দুক কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম চটপট। সঙ্গে দুটো পিস্তল আর সেই তলোয়ার। উঠলাম পাহাড়ের মাথায়। সে প্রায় দু ঘণ্টা একনাগাড়ে হাঁটা। ভিতরে ভিতরে ভীষণ উত্তেজিত আমি। এধার থেকে আরো তিনটে শাম্পান ভেসেছে জলে। মোট পাঁচ। চলেছে সবাই অসীম বেগে কূলের দিকে।
ভেবে দেখুন আমার অবস্থা। আতঙ্কে ব্রাসে ভয়ে আমি তো বলতে গেলে মূক। হতবিহব্বল অবস্থা আমার। হাঁটতে হাঁটতে তখন কুলের দিকে গেলাম। হাড়ে মাংসে রক্তে
সে একেবারে ছড়াছড়ি অবস্থা। কী যে নিষ্করুণ নিষ্ঠুর সেই দৃশ্য। বমি পাচ্ছে আমার। সারা পেট তোলপাড় করে গলার কাছে এসে বলা হয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে। গুড়গুড় করে বেরিয়ে এল অনেকখানি। তখন একটু নিশ্চিন্ত লাগল।
মোটমাট দ্বীপে যে ওরা প্রায় আসে এটা ঘটনা। যে কোনো অংশে আসে। আমার অজ্ঞাতসারে। এতদিন দেখি নি নিজের চোখে তাই ভাবতাম শুধু পশ্চিম দিকেই আসে। এটা ওদের নিষ্ঠুর লালসা চরিতার্থ করার জায়গা। আমারও জীবন এবার থেকে ওদের হাতরে মুঠোয়। অর্থাৎ শাস্তি আমার সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত।
এবং এ অবস্থায় হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। অবিবেচনার কাজও বটে। ঘুরেফিরে আবার সেই পুরানো চিন্তাটা মাথায় উদয় হচ্ছে। খুন করতে হবে এবার, খুন। নিষ্ঠুরতার বদলা খুন করেই নিতে হবে। ঝাঁপিয়ে পড়বে কখন কোন মুহূর্তে আমার উপর তা তো জানি না। প্রস্তুত থাকতে হবে। যদি আসে দু দল–এক এক দলে থাকে দশজন কি এক ডজন করে নরখাদক–আমি ছাড়ব না তাদের। অন্তত একদলকে ঘায়েল করব। বাকিরা তখন যাবে পালিয়ে। ফের কখনো না কখনো আসবে। তখন মারব তাদের। তারপর ফের আরেকদল। তারাও পার পাবে না আমার হাত থেকে। এইভাবে একের পর এক ধ্বংসলীলায় আমি মেতে উঠব। অর্থাৎ আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুত। কৌশলগত ভাবেও। ভারি উদ্বেগ আমার মনে। তবু বাঁচতে হবে এটা বড় কথা। আত্মরক্ষা করতে হবে। তাতে যদি একের পর এক খুনের রক্তে আমাকে হাত রাঙাতে হয়, তাও সই। মোটকথা ধরা আমি কিছুতেই সহজে দেব না। বেরব না তেমন। আমার সৌভাগ্য সময় সুযোগ বুঝে এক পাল ছাগল পুষেছিলাম। এই অসময়ে তারা যোগাবে আমার খাদ্য। কতদিন যে তাদের উপর নির্ভর করে চালাতে হবে তা তো জানি না। আগুন একবার জ্বাললে নিভতে সময় লাগে। এক দলকে মারলে বাকি যে দল ফিরে যাবে তারা হয়ত পরের বার নিয়ে আসবে দুশ নৌকো বোঝাই নরখাদক যোদ্ধা। তখন কি আর যুদ্ধ আমি এড়াতে পারব।
এই ভাবেই কাটল আরো পনেরটা মাস। উদ্বেগই সার, কাউকে আর একটি দিনের তরেও দ্বীপের ত্রিসীমানায় দেখতে পেলাম না। তারপর মে মাস সেটা। হঠাৎ দেখি একদিন…. কিন্তু থাক। সে কথা মুহূর্তে নয়। তার আগে আমার মনের অবস্থাটা একটু বিশদ করে ব্যক্ত করি।
এই পনেরটা মাস বলতে গেলে একটি দিনও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি নি। সে যে কী অস্বস্তি! চোখ বুঝলেই চোখের পাতায় ভেসে ওঠে যুদ্ধের দৃশ্য। হয়ত ঝিম এসেছে একটু অমনি দেখতে লাগলাম নানান স্বপ্ন। প্রতিটির মাঝেই হত্যা আর হত্যা। একের পর এক আমি বর্বর হতাভিযানে মেতে উঠেছি। আর কী রক্ত! তখন ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ। ব্যস, ঘুমেরও অমনি ছুটি। সারা রাত আমাকে জেগেই কাটাতে হয়।
এরই মধ্যে একদিন ঘটল একটা অন্যরকম ঘটনা।
ষোলই মে। সকাল থেকে ভীষণ ঝড় আর বৃষ্টি। বিশ্রী আবহাওয়া বলতে যা বোঝায়। সারা দিনে আমি আর গুহা ছেড়ে বেরই নি। দেখতে দেখতে চোখের সামনে সন্ধ্যা হল রাত ঘনাল। আমি প্রতিদিনকার প্রথা মতো বাইবেল খুলে রেখেছি বাতির সামনে। হঠাৎ আকাশ ফাটিয়ে গুড়ুম করে একটা কন্দুকের আওয়াজ। মেঘ ডাকা নয় এ আমার বুঝতে অসুবিধে হয় নি। কিন্তু এখানে কে করবে আমি ছাড়া বন্দুকের আওয়াজ।
অবাক হয়েছি নানান ভাবে নানান কারণে এই দ্বীপে আসা ইস্তক। কিন্তু এভাবে অবাক কখনো হই নি। বিচিত্র কাণ্ড তো!- কে আবার এল এই বিজ্ঞান বিভুয়ে? নাকি সমুদ্রের বুকেই আওয়াজটা হল। দশদিক নির্জন বলে বাজল এসে আমার কানে?
তড়িঘড়ি মই বেয়ে পাহাড়ে উঠলাম। ঘাবড়ে গেছি ভীষণ–নয়ত উঠতে গিয়ে দু-দুবার এমন পিছলে পড়ব কেন? তা হাকড় পাকড় করে ছুটতে ছুটতে উঠলাম তো গিয়ে মাথায়। ওঠা মাত্র আরেকটা আওয়াজ আর সঙ্গে বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো রোশনাই। উখুন শব্দের উৎপত্তি কোথায় সেটা আন্দাজ করা গেল। সমুদ্রের দিক থেকে আসছে এবং জাহাজ থেকে। হয়ত পড়েছে ঝড়ের মুখে মহা বিপদে, বন্দুক ছুঁড়ে নিজেদের অবস্থার কথা জানান দিচ্ছে। এটা প্রথা আমি জানি। কিন্তু কী করতে পারি? সাহায্য করার কি কোনো সাজ সরঞ্জাম আমার আছে? তবে একটা কথা আমি সাহায্য করতে না পারলেও ওরা হতে পারে আমাকে সাহায্য করতে। অবশ্যই নিজেরা যদি নিরাপদে থাকে। সেক্ষেত্রে আমার অস্তিত্ব ওদের জানানো উচিত। তাই তড়িঘড়ি কাঠকুটো সংগ্রহ করে সেই পাহাড়ের মাথাতেই জ্বলালাম এক মস্ত আগুন। ভেজাকাঠ, সেটা আমার পক্ষে মঙ্গলই বলা চলে। গলগলিয়ে উঠতে লাগল ধোয়া। আমি জানি, আগুন নজরে না পড়ুক, ধোয়া বহুদূর থেকে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে জাহাজ যদি সত্যি সত্যি আশে পাশে কোথাও থেকে থাকে, তবে ধোয়া ঠিকই ওদের নজরে পড়বে। তখন আরো একবার বন্দুকের আওয়াজ ভেসে এল। আমি দ্বিগুণ উৎসাহে আরো কাঠকুটো জড় করে আগুনে ফেললাম। কিন্তু সেই শেষ। তারপর থেকে সারারাত বলতে গেলে কাটল সেই পাহাড়ের মাথায় নির্ঘুম–জাহাজের টিকিরও দেখা মিলল না।
বসে রইলাম ঠায়।
ভোর হতে দেখি ঝলমলে রোদ। নীল নিমেৰ্ঘ আকাশ। কুয়াশার লেশমাত্র কোথাও নেই। তখন চারদিকে নজর ঘোরাতে গিয়ে দেখি–এমা, ঐ যে কী একটা যেন কুলের কাছে ভাসছে! দূরবীন তুললাম চোখের গোড়ায়। কী যে ওটা কিছুতেই মালুম হয় না। পালও হতে পারে আবার অন্য কিছুও হতে পারে। তবে একটা ব্যাপার অনুমান করতে পারহি-জাহাজই হোক আর নৌকোই হোক হয়ত নোঙর করে আছে ধারে কাছে কোথাও। দূরবীন চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি অংশ দেখতে শুরু করলাম। দেখি জলের নিচে সেই যে ডুব পাহাড়–সেখানে গোত্তা খেয়ে পড়ে আছে একটা জাহাজ। তার প্রায় ভগ্নদশা। তোলপাড় হয়ে গেছে তার সারা শরীর। আহারে বেচারিরা! কোথায় ভাবছিলাম আমার হবে সাহায্য, এখন দেখি সম্পূর্ণ উলটো ব্যাপার।
হয়ত এমন হতে পারে–আমার আগুনের ধোয়া ওরা দেখতে পেয়েছে। অমনি তড়িঘড়ি বিপদের হাত থেকে উদ্ধার পাবে বলে জাহাজের নৌকোয় চেপে আসছিল এই দ্বীপের দিকে পথে বাতাসের তাড়নায় নৌকো সমুদ্রে উলটে যায়। কিংবা এমনও হতে পারে–হয়ত উলটায় নি, ওরা গিয়ে ভিড়েছে সেই নরখাদকের দেশে। ইতোমধ্যে সবাইকে বন্দী করে পিশাচের দল বোধহয় মারশোল্লাসে মেতে উঠেছে।
আরো একটা সম্ভাবনা আছে। হয়ত এ জাহাজটা বিপদে পড়েছে, কিন্তু সঙ্গী ছিল আর একটা জাহাজ। তাদের কিছু হয় নি। বিপদ থেকে তারাই হয়ত নাবিকদল সহ জাহাজের অন্যান্য সকলকে উদ্ধার করেছে। এতক্ষণে নিরাপদ কোনো দূরত্বে পৌঁছে গেছে। সেক্ষেত্রে আমার নিজেকে উদ্ধার করার সম্ভাবনা দূর অস্ত।
গেলাম হাঁটতে হাঁটতে ডুবো পাহাড়ের দিকে। কুলের কাছ বরাবর হতে দেখি একটি মৃতদেহ। বয়েস কম। পরনে নীল রঙের সুতির জামা আর পাৎলুন। পায়ে জুতো মোজা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে বালিতে মুখ গুঁজে। জামার পকেটে তামাক খাওয়ার একটা পাইপ, কিছু টাকা আর কিছু খুচরা পয়সা। এ থেকে কি আর কোনো পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রথম দর্শনেই মনটা দুঃখে ভরে উঠল। তবে হয়ত আমার অনুমান ঠিক নয়। হয়ত বঁচে নি কেউ জাহাজের। আমাদেরই মতো অবস্থা। জাহাজের কাছে গিয়ে যে দেখব সে সুযোগও নেই। সেই ভীষণ স্রোত আর অতি বিপজ্জনক সে অঞ্চল। বরং এই ফাঁকে ডোঙাটা ব্যবহার করি। উদ্ধার করা যদি সম্ভব হয় কাউকে করব। নয়ত যা পাই জাহাজ থেকে দরকারী জিনিস নিয়ে আসব।
অমনি ফিরে গেলাম গুহায়। যাত্রার আয়োজন করতে হবে। নিলাম রুটি, এক কলসী পানীয় জল, কম্পাস, এক বোতল মদ, এক ঝুড়ি কিসমিস ব্যস, আর কিছু নেবার দরকার নেই। ডোঙাটা অর্ধেক ডুবিয়ে রেখেছিলাম নিরাপত্তার প্রয়োজনে জলের নিচে। জল তুলে ভেঁকে ফেলতে ভেসে উঠল ফের জলের উপর। মুছে নিলাম। মালপত্র রাখলাম জড় করে। কী মনে হতে চালও নিলাম খানিকটা। ছাতি আর বন্দুক তো আছেই। আমার নিত্য সহচর। মোটমাট সব দিক থেকেই নিশ্চিন্ত। এবার ঈশ্বরের নাম স্মরণ করে রওনা দিলেই হয়।
ভাসল ডোঙা জলে। কুলের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে চলে এলাম ডুবোপাহাড়ের কাছ বরাবর। এবার যেতে হবে জাহাজের কাছে। কিন্তু ভয় খুব। সেই বিপজ্জনক স্রোত। যদি ফের ভেসে যাই মাঝ দরিয়ায়। আগের সেই অবস্থার কথা স্মরণ করে বুকে ইতোমধ্যেই হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছে। স্রোত তো বরং ভালো, যদি ওঠে ঝোড়ো বাতাস! তবে কি আর পারব আগের বারের মতো ফিরে আসতে।
ছোটো একটা খাড়িতে ডোঙা ঢুকিয়ে ভাবতে বসলাম। এখন শুধু প্রতীক্ষা। যে ভাবে স্রোত বইছে হু হু বেগে, তাতে স্রোত ডিঙিয়ে যাবার চেষ্টা করাও বাতুলতা। এখন আবার জোয়ারের সময়। বাড়ছে জল। কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না। উপায় বের করতে হবেই। কিন্তু কী সেই উপায়?
তখন নামলাম। হাঁটতে হাঁটতে ডুবো পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে গেলাম শেষ মাথায়। দেখি স্রোত আসলে দ্বিমুখী। উত্তর থেকে আসছে জোয়ারের জল, আর দক্ষিণ থেকে স্রোত। অর্থাৎ যদি আমি দক্ষিণের স্রোতে ভেসে যাই জাহাজের দিকে ফিরে আসার সময় উত্তরের স্রোত আমাকে সাহায্য করবে।
কিন্তু আজ আর নয়। বেলা প্রায় শেষ। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। উঠলাম পরদিন ভোর সকালে। স্রোত এসময় তেমন তীব্র হয় না। ভেসে পড়লাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কসরৎ করতে হল খানিকটা। একটু পরেই পৌঁছে গেলাম জাহাজের কাছে।
সে যা অবস্থা জাহাজের। স্পেনের জাহাজ নির্মাণ কৌশল দেখলেই সেটা অনুমান করা যায়। গোত্তা খেয়ে এসে পড়েছে পাহাড়ের একটা ফাটলের মাঝখানে, চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে সামনের দিকটা। সে যেন লণ্ডভণ্ড ভাব। মাস্তুল নেই, হাল ভাঙা, পাটাতন পুরোপুরি জলমগ্ন মানুষের গন্ধ পেয়েই হোক বা অন্য যে কোনো কারণে হোক, একটা কুকুর দেখি বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। আমাকে দেখে সে কী হাক ডাক! একলাফে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। আহারে বেচারা! কতদিন যে আছে অনাহারে! আমার ডোঙায় এসে উঠল। দিলাম কটা রুটি। চোখের নিমেষে শেষ। জল দিলাম এক পাত্র, খেল গপগপ করে। যেন কুকুর নয়, একটা ক্ষুধার্ত নেকড়ে। সেই রকমই ভাব। ওকে ডোঙায় সেই অবস্থায় রেখে আমি জাহাজে এসে উঠলাম।
জীবনের সাড়া শব্দ নেই। জল ঠেলতে ঠেলতে চলেছি এগিয়ে। দেখি রান্নাঘরের সামনে দুটি মৃতদেহ। ফুলে গেছে, দুজনের হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা। এরা পাঁচক। হয়ত জল ঢুকছে দেখে দুজনে দিশা ঠিক করতে না পেরে বেঁধে ফেলেছিল হাত, হয়ত বন্ধু ছিল দুজন, একসাথে মরবে সংকল্প করেছিল। একসাথেই মরেছে। এগিয়ে গেলাম। মস্ত একটা পেটি, তাতে থরে থরে মদের বোতল। ভীষণ ভারী। কটা প্যাটারাও নজরে পড়ল। নাবিকদের জিনিসপত্ররাখার বাক্স। দুটো দেখলাম মোটের উপর হালকা। তুলে এনে রাখলাম ডোঙায়।
মনটা ভারি খারাপ লাগছে। পারলাম না এতটুকু সাহায্য করতে। বিপদে পড়েছিল এরা। পেল না ত্রাণ। আর যা ভগ্নদশা জাহাজের! সেটাও আমার মন খারাপের অন্যতম কারণ। সামনের দিকটা ঐভাবে না ভেঙে যদি অন্য কোনো রকম জখম হত-যদি ভাঙত মাল কি হাল কিংবা পাটাতন–একবার নয় জোড়াতালি দিয়ে চেষ্টা করতাম ভেসে পড়ার। জাহাজে আসার সেটাও একটা প্রধান কারণ। চাই যে আমি এখান থেকে এবার সরে পড়তে। এটা আমার ঐকান্তিক বাসনা। যত দ্রুত মুক্তি পাওয়া যায় ততই মঙ্গল। নরখাদকের হাতে প্রাণ দেবার চাইতে তো ভালো। ভেসে পড়তাম সাগরে। যেখানে খুশি নিয়ে যাক হাওয়া, স্রোত তোলপাড় করুক, চাই কি ডুবে যাই অতলান্ত জলে আমার হৃক্ষেপ মাত্র নেই। আর ভালো লাগছে না এই একক জীবন। আমি এবার মুক্তি চাই।
একটা ছোটো পেটি পেলাম মদের বোতলের। সেটা নিলাম। কটা বন্দুকও রয়েছে। একটা ঘরে। নিলাম বন্দুক। শুকনো বারুদ রয়েছে যৎসামান্য–চার পাউন্ড মাত্র ওজন। নিলাম। একটা বেলচা পেলাম, আর একটা চিমটে। দুটো পেতলের কেতলিও রয়েছে, ফেলে রেখে লাভ কী। জল গরম করতে বা দুধ জ্বাল দিতে আমার তো কেতলির খুব দরকার। নিলাম। আর দেখি চকোলেট বানাবার তামার একটা ডেকচি মতো। সেটাও সঙ্গে নিলাম।
মোটমাট সব মিলিয়ে এই। আর কুকুর। তার কথা তো আগেই বলেছি। আর নেবার মতো কিছু নেই জাহাজে। সন্ধের ঘোর লেগেছে তখন। স্রোতের টানও কম। ভাসিয়ে দিলাম ডোঙা। দ্বীপে ফিরে এলাম যখন, প্রায় মাঝরাত। আর ভারি ক্লান্ত আমি। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
সে রাতে আর গেলাম না গুহায়। ভোঙাতেই থাকব। মালপত্র পুরানো গুহাতে নিয়ে যাব না। এটা আমি আগেই ঠিক করে রেখেছি। নতুন আবিষ্কার করেছি সেই যে অদ্ভুত গুহা রাখব সব সেখানে উঁই করে। এগুলো আমার অভাবের দিনের সঞ্চয়। শুধু একটা কেটলি ব্যবহার করা যেতে পারে। আর প্যাটরায় যদি কিছু পোশাক থাকে তার দু একটা। সেই মন নিয়েই পরদিন ভোরে ডোঙা নিয়ে এলাম নতুন গুহার কাছে। মাল তুললাম। দেখে মনে হয় না পানীয় হিসেবে খুব একটা ভালো। তবু মদ তো। সময়ে যথেষ্ট কাজ দেয়। দেখি ছোট্ট একটা কাগজের প্যাকেট, তাতে বোতলে বোতলে ভরা খনিজ জল। ভীষণ উপকারী। এতে নানান অসুখ সারে। আর একটা মোড়কে কিছু মেঠাই। এত সুন্দর করে বঁধা যে ভিতরে এক ফোঁটা জল ঢুকতে পারে নি। খেলাম দুটো। আহ কী অপূর্ব যে খেতে!
আরো কটা মোড়ক আছে, কিন্তু তার অবস্থা শোচনীয়। জল ঢুকেছে ভিতরে। ফেলে দিলাম। বেশ কয়েকটা জামাও আছে। আর বিস্তর রুমাল। দুটোই আমার কাছে লোভনীয়। গরমের দিনে এমন ঘাম হয় চোখে মুখে, ন্যাকড়ার অভাবে পারি না মুছতে। এখন থেকে রুমাল ব্যবহার করব। আর পাঠক তো জানেনই, জামা পরার পাট আমার কবে চুকে গেছে। ছাগলের চমড়াই এখন আমার একমাত্র পরিধেয়। সুতরাং জামায় যে লোভ পড়বে এতে আর আশ্চর্য কি। দেখি উপরের দিকে একটা গোপন খোপ। তাতে বিস্তর নোট–প্রায় এগারশর মতো আর ছটা সোনার গিনি, সোনার পাতও আছে সামান্য। সব মিলে ওজন প্রায় এক পাউন্ডের মতো।
দ্বিতীয় প্যাঁটরাতে বেশির ভাগই পোশাক আশাক। তবে খুব একটা দামী নয়। আর দেখি কিছু বারুদ। দুটো মোট প্যাকেট। এটা নির্ঘাৎ কোনো শিকারির বাক্স। এবারকার অভিযানে প্রাপ্য বলতে এই। আমার প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। আপনারা হয়ত প্রসঙ্গক্রমে সোনা বা অর্থের কথা বলবেন। কিন্তু সত্যি বলতে কি সোনা আর আমার পায়ের নিচের ধুলোর মধ্যে আমি কোনো তফাৎ দেখতে পাই না। কি লাভ আমার সোনা দিয়ে। আমি কি গয়না গাটি গড়াব না বিক্রী করে রাজা বাদশার মতো ধনী হব? কার কাছে করব বিক্রী? তবে হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি–জুতো পেয়েছি মোট চার জোড়া। এটা আমার কাছে একটা বিরাট ব্যাপার। দু জোড়া পেয়েছি দ্বিতীয় প্যটায়, আর দু জোড়া খুলে নিয়েছি সেই হাত বাধা দুই মৃতের পা থেকে। আমার খুব কাজে লাগবে। খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের যা দূরবস্থা। তবে এই যা জুতা–খুব একটা টেকসই হবে বলে মনে হয় না। রবারের তৈরি। তবু যাহোক, কিছুদিন তো পায়ের একটু আরাম
তাই বলে টাকা বা সোনা কিন্তু ফেললাম না বা অবহেলা ভরে যত্রতত্র রেখে দিলাম না। নিয়ে গেলাম সাথে করে আমি যে গুহায় থাকি সেখানে, আগেকার জাহাজ থেকে আনা টাকাকড়ি যেখানে মজুত রেখেছিলাম তারই সাথে রেখে দিলাম গোছ করে। তা সব মিলিয়ে নেহাৎ কম নয়। কাজে লাগতে পারে হয়ত কখনো। যদি ইংল্যান্ডে যাবার সুযোগ পাই, অর্থাৎ যদি পারি কোনোক্রমে কোনো জাহাজের সঙ্গে বন্দোবস্ত করতে, তবে পারানির কড়ি হিসেবেও তো কিছু দিতে লাগবে।
অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিশেষ করে ছেলে ছোঁকড়াদের–যাদের কম বয়েস, যাদের রক্ত চঞ্চল–দেখুন, ভাই, আপনারা অসহিষ্ণু হবেন না। ঈশ্বরের দেওয়া যে দান তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চেষ্টা করুন। তবে শান্তি পাবেন। আখেরে মেওয়া ফলবে।
এবার বৃটনায় ফিরে আসি।
মার্চ মাস সেটা। আমার দ্বীপে অবস্থানের চব্বিশ বছর। আস্তানা থেকে বিশেষ একটা বেরই না। দরকার পড়ে না তাই। মোটামুটি শরীরের দিক থেকে সুস্থই আছি। খাওয়া ঘুম বিশ্রাম কোনো কিছুরই অভাব নেই। উছুটে চিন্তাও আছে মাথায় প্রচুর। রাত হয়েছে। ঘুমোব বলে শুয়েছি এসে বিছানায়। সেদিন অদ্ভুত কাণ্ড–ঘুম আর কিছুতেই আসে না।
একের পর এক চিন্তায় তোলপাড় হচ্ছে মন। জানি না কেন মনে পড়ছে নিজের জীবনের পুরানো দিনের কথা। সেই আমার ছেলেবেলা, বাবার উপদেশ অগ্রাহ্য করে ভেসে পড়া, তারপর দুর্ভোগ, ফের অভিযান ছবির মতো একটার পর একটা ভেসে উঠছে আমার মনের পর্দায়। দ্বীপে আসা ইস্তক প্রতিটি খুটিনাটি ঘটনাও মনে পড়ছে। বেশ তো চলছিল জীবন প্রবাহ হঠাৎ যে কেন চোখে পড়ল পায়ের ছাপ। সেই থেকে তো গোটা ছবিটাই পালটে গেল। তবে না নরখাদক সম্বন্ধে ধারণা জন্মাল। আগেও হয়ত এসেছে অনেকবার, আমার চোখে পড়ে নি। বা কোনো নজিরও দেখতে পাই নি। হয়ত দীর্ঘকাল ধরে আসা যাওয়া চলছে। হিংস্র নিষ্ঠুর লালসা চরিতার্থ করার এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কোথায় আছে। হয়ত কখনো শয়ে শয়ে এসেছে দল বেঁধে। আমার অজ্ঞাতসারে। এলেই বা কী আসে যায়। আমাকে ব্যতিব্যস্ত না করলেই হল! আমি তো আর উপযাচক হয়ে ওদের সঙ্গে লড়াই করতে যাচ্ছি না। তাতে লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি। কী দরকার বাপু খাল কেটে কুমীর ডেকে আনার!
প্রায় দুঘন্টা ধরে সমানে এইসব তালগোল চিন্তা। মাথা গরম হয়ে গেছে তখন আমার। সারা শরীরের রক্ত যেন উঠে এসেছে মাথায়। খুব ক্লান্ত লাগছে। ভাবনা চিন্তাতেও ক্লান্তি আসে না কি? বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত ভাব তখন আমার। চোখের পাতা আপনা আপনি বুজে এল। কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না। স্বপ্ন দেখলাম। যেন বেরিয়েছি আমি রোজকার নিয়ম মতো বন্দুক কাঁধে সকালবেলা। হঠাৎ কূলের দিকে দৃষ্টি যেতে দেখি দু দুটো নৌকা। এগারজন মোট তাতে নামল তারা। সঙ্গে এক বন্দী। সেও তাদেরই মতো একজন। তাকে এনেছে খাবে বলে। তাকেও নৌকা থেকে নামানো হল কুলে। মূহুর্তে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে সে যা তাজ্জব ব্যাপার! বন্দী তো পড়ি কি মরি করে লাগিয়েছে বাই বাই ছুট। আসছে আমারই আস্তানার দিকে। এসে ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আমি তো সবই দেখতে পাচ্ছি। তখন বেরুলাম আমার গোপন জায়গা থেকে। দেখা দিলাম। হাসলাম মুচকি মুচকি। তখন আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল, হাত জোড় করে আমাকে ইঙ্গিতে অনুরোধ করল তার জীবন রক্ষা করতে। আমি তখন ইশারায় মইটা দেখিয়ে দিলাম। উঠে এল তরতরিয়ে। ব্যস, তারপর আর কি, সে থেকে সে আমারই সাথে আমার অনুগত সহচরের মতো। আমার আনন্দ আর দেখে কে। আর আমার কীসের চিন্তা। খুঁজছিলাম বহুদিন ধরে এরকমই একজন সহচর। এরই সাহায্যে এবার এখান থেকে পালাব। মুক্তি পাব। মুক্তির আনন্দে সে এমনই টালমাটাল অবস্থা যে এক ঝটকায় ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখি ঘুরঘুটি অন্ধকার। আমি বিছানায় শোয়া। ঘামছি দরদর করে। কোথায় আমার সেই সহচর! তখন দুঃখে হতাশায় সে যা মনের অবস্থা আমার।
সে যাই হোক চেতনে হোক বা অবচেতনে হোক, ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত এক শিক্ষা লাভ হল। এখান থেকে পালাবার জন্যে যে আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি, সেটা আমার একলার চেষ্টায় সম্ভব হবে না। আর একটা লোক অন্তত চাই। বিশেষত বর্বর সম্প্রদায়ের। সমুদ্রের হালচাল আমার চেয়ে ওরা ঢের ঢের ভালো বোঝে। জায়গাটাও পরিচিত। কিন্তু সে না হয় পরের কথা। আগে লোকটাকে জোটাই কী করে?
ভেবে দেখলাম, একটি মাত্র উপায় আছে এবং এক্ষেত্রে নরখাদকের দল আমার ভরসা। ওরা দ্বীপে আসবে বন্দী নিয়ে। সেই সুযোগে আমি ওদের সব কটাকে মারব। শুধু বন্দীকে রাখব অক্ষত। সেই হবে আমার সহচর। কিন্তু ভাবনা যত সোজা কাজটা কি তত সোজা? যদি একচুল হিসেবে গোলমাল হয়ে যায়। তাছাড়া ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্নটাও আছে। আমি যে ওদের মারব, ওরা তো আমার সাথে কোনো অন্যায় আচরণ করে নি। সেক্ষেত্রে ঈশ্বরের নির্দেশের বাইরে হবে সেই কাজ। হোক, তবুও মারব। এছাড়া আমার আর উপায় নেই। একটু ঘুরিয়ে চিন্তা করলে এও তো প্রয়োজনে হত্যা। আমার পালানো দরকার তাই প্রাণ হরণ। তাতে পাপ কোথায়! বরং আমি যে একজন মৃত্যু পথযাত্রী বন্দীকে রক্ষা করছি সেটা তো আমার অশেষ পুণ্য। পূণ্যের ভাগটাই এক্ষেত্রে বেশি। সুতরাং এই নিয়ে আর দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না।
মোটামুটি মনস্থির করার পর কৌশলের প্রশ্নটা মাথায় এল। অর্থাৎ কী কৌশলে আমি ওদের হত্যা করব। বিস্তর ভেবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলাম যে এই মুহূর্তে সেটা ভাববার চেষ্টাও বৃথা। কেননা কখন কী অবস্থায় থাকবে ওরা সেটা তো আগে থেকে আমার জানা নেই। তাই আগে ভাগে কোনো ফন্দী বার করবারও কোনো অর্থ হয় না। বরং আসুক আাগে, তখন নয় হিসেব নিকেশ করে দেখা যাবে কোন উপায়টা কার্যকরী এবং সেই মতো ব্যবস্থাই গ্রহণ করব।
ডোঙা নিয়ে ফিরে এলাম সেই গোপন বন্দরে। অর্থাৎ পাহাড়ের সেই খাজ। লুকিয়ে ফেললাম আগের মতো। অর্ধেক জল বোঝাই অবস্থায় ডুবে রইল জলের মধ্যে। বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। তারপর ফিরে এলাম নিজের আস্তানায়। দেখি সব রয়েছে আগের মতো। হাত দেয় নি কেউ বা ফেলে নি কি ছড়ায় নি। সেটা সুখের কথা। অর্থাৎ আমার আস্তানা কোনো ভিন্ মানুষের চোখে ধরা পড়ে নি। এদিকে মনটাও বেশ প্রফুল্ল। তবু যাহোক নতুন একজন সাথী তো পেয়েছি–সেই কুকুর। পাহারাদারীর কাজটা ওর ধ্যমেও চলবে। বিশেষ করে নরখাদকের দল কাছাকছি এলে হাঁকডাক করে জানান দেবে। খানিকটা নিশ্চিন্ত বলা যায়।
কেটে গেল এইভাবে আরো দুটিবছর। আর এই দু বছরে কত যে পরিকল্পনা আমার মাথাটাই যে গোলমেলে। সুযোগ পেলেই এটা ওটা ভাবতে শুরু করে। অন্তুত শ খানেক মতলব এল এই দ্বীপ থেকে পালাবার। শ খানেকই বাতিল হল। একবার ভাবলাম, লেগে পড়ি ঐ ভাঙা জাহাজ সারাবার কাজে। যন্ত্রপাতি সাজিয়ে তৈরি অব্দি হলাম। শেষে নিরর্থক প্রচেষ্টা এই ভেবে যাওয়া আর হয়ে উঠল না।
বলতে পারেন এ আমার স্বভাবের অদ্ভুত এক বৈশিষ্ট্য। কিছুতে পারি না সুস্থির হয়ে নিজের অবস্থার মধ্যে তুময় থাকতে। ছোটোবেলা থেকে উড়উড় যে মন। তাই না জীবনে কত কষ্ট পেলাম। শুনতাম যদি বাবার আদেশ! বা ব্রাজিলে যদি সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে নিজের ক্ষেত খামার নিয়ে বেঁচে বর্তে খাবার চেষ্টা করতাম। কত টাকার মালিক হতাম এত দিনে, কত সম্মান কত যশ। সব গেল তছনছ হয়ে। আবার এই যে এখানে রয়েছি মোটের উপর সুস্থ ভাবে, এটাও আজকাল আর ভালোলাগে না। কেবল উড়ুউড়ু করে মন। তাই না যত অশান্তি!