২১. বর্তমান সময়
তৃতীয় দিন
এক অদ্ভুত ইন্টারভিউ
সিএমওর সাথে মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভারতে টাইটান ফার্মাসিউটিক্যালসের হেডকোয়ার্টারের চওড়া লবিটাকে খুঁটে খুঁটে দেখছে রাধা। ইচ্ছে করেই কয়েক ফুট দূরে আরেকটা চামড়ার সোফায় বসে থাকা ইমরানের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। দুজনে একই সময়ে পৌঁছালেও এসেছে ভিন্ন ভিন্ন গাড়িতে। আইবির এক ফিল্ড এজেন্ট রাধাকে এখানে দিয়ে গেছে; আবার ফিরিয়েও নিয়ে যাবে।
দালানটা গুড়গাঁওয়ের বেশির ভাগ কর্পোরেট অফিসের মতই সাদামাটা ছয়তলা একটা স্টিল আর গ্লাসের তৈরি কাঠামো। তবে অন্দর মহলে মার্বেলের মেঝে, রিসেপশনে গ্রানাইট কাউন্টার আর লবির একেবারে মাঝখানে একটা ঝরনা থাকায় ব্যবসার সমৃদ্ধি পরিষ্কার ফুটে উঠেছে।
বসার একটু পরেই এগিয়ে এলো মরচে রঙা চুল আর লম্বা, কৃশকায় এক লোক। পরনে ল্যাবরেটরি কোর্ট আর হাবভাবে কর্তৃত্ব দেখে বোঝা গেল যে ডা. বরুণ সাক্সেনা। মুগ্ধ হয়ে গেল রাধা। ভদ্রলোক নিজে এসে লবিতে ওর সাথে দেখা করে উপরে নিয়ে যাবেন এতটা আশাও করেনি। কিন্তু তারপরই তাকে জানানো হল যে রাধা একজন জার্নালিস্ট আর মেডিকেল ফ্যাসিলিটির অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে কাভার করতে এসেছে। বুঝতে পারল কোম্পানি প্রেসকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। শোনার সাথে সাথেই কেমন ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে কনফার্ম করে দিলেন।
“হ্যালো সিমা” রাধার ভুয়া নাম ধরে অভিবাদন জানাল রোগা লোকটা। তবে চেহারা দেখে বোঝা গেল যে জোর করে হাসছে। তার মানে এই মিটিং নিয়ে তেমন খুশি না; অথচ হাতে কোনো অপশনও নেই। “আমি ডা. বরুণ সাক্সেনা।”
পাল্টা সম্ভাষণ জানিয়ে রাধা বলল, “এত শর্ট নোটিসে আমার সাথে মিটিং করতে রাজি হয়েছেন তাই ধন্যবাদ। আগামীকালকেই এ সংবাদটা ছাপতে চাইছি। তাই যদি আরো কিছু জানা যায়।”
সুযোগটা লুফে নিল সাক্সেনা। “ওহ, আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে এখানে আর বেশি কিছু বলার নেই। আপনি যা যা জানতে চান বলতে আমার আপত্তি নেই; তবে মনে হয় না তেমন কোনো চটকদার কিছু পাবেন।” পরিবেশকে হালকা করার জন্য হাসার চেষ্টা করে বলল, “চলুন উপরে গিয়ে কথা বলি?”
রাধা মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই দুজন চুপচাপ পাঁচতলায় উঠে এলো। মিটিং রুমে বসার পর সাক্সেনা কফির অর্ডার দিতেই সোজা পয়েন্টে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিল রাধা।
“পূর্ব-দিল্লিতে আপনার ফ্যাসিলিটিতে অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে বেশ কিছু গুজব শোনা যাচ্ছে তাই ভাবলাম সত্য খবরটা আপনার কাছেই পাওয়া যাবে।”
“ওহ অবশ্যই, কেন নয়।” দাঁত দেখিয়ে হাসার চেষ্টা করল সাক্সেনা, সেটাই বরঞ্চ ভালো হবে। এবার বলুন আপনি কী শুনেছেন?”
“ওয়েল” রাধা এমনভাবে থেমে গেল যেন নিজের কথাগুলো সাজিয়ে “ নিচ্ছে, “শুনেছি কয়েকটা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নাকি ডিসিজি আই অ্যাপ্রুভ করেনি। ভয়ংকর মাইক্রোবস নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা হচ্ছিল।”
নার্ভাস ভঙ্গিতে হেসে ফেলল সাক্সেনা। মনে হচ্ছে এ প্রশ্নটারই আশঙ্কা করছিল। “আপনি যাই শুনে থাকুন না কেন তা পুরোপুরি মিথ্যা। ফ্যাসিলিটি টাইটান যে সমস্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করছিল তার সবটুকুই বোর্ড জানে। জিসিজি আইও অ্যাপ্রুভ করেছে। আপনি চাইলে আমার বক্তব্যের স্বপক্ষে পেপারসও দেখাতে পারি। আর প্রাণঘাতী মাইক্রোবসের তো প্রশ্নই উঠে না। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এভাবে কাজ করে না। আর টাইটানের নীতিবোধ নিয়ে আমরা গর্বিত। একজন ভাইরোলজিস্ট হিসেবে এসব হাবিজাবি আমার অজানা থাকার কথা নয়। কিছু হলে আমি ঠিকই টের পেতাম।
“আর ফ্যাসিলিটিতে যে মৃতদেহগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো? এ ব্যাপারে আপনার মত কী?” রাধা জানে যে ইমরান মৃতদেহের কথা এখনো সর্বসাধারণকে জানাননি। কেননা তাহলে গণমাধ্যমের নজরে পড়বে আর তদন্ত বানচাল হবে। তাই সাক্সেনাও নিশ্চয় অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে।
সত্যিই তাই, লোকটা যেন আকাশ থেকে পড়ল। বোঝা গেল যে এ প্রশ্ন আসতে পারে ভাবতেই পারেনি। চোখ সরু করে জানাল, “এটা আপনি কোথা থেকে শুনলেন? এটা একেবারেই সত্য নয়। আগুনে কেউ নিহত হয়নি। প্রপার্টি আর ইকুপমেন্টের ক্ষতি হলেও হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাধা, “ডা, সাক্সেনা আপনি নিশ্চয় জানেন আমাদের মানে জার্নালিস্টদের সোর্সের কোনো অভাব নেই। এমনকি পুলিশেও লোক আছে। আমি যা শুনেছি তার সাথে আপনার কথা মিলছে না। সোর্স অনুযায়ী, দমকল কর্মীরা পৌঁছানোর পর বিল্ডিংয়ে কাউকেই দেখতে পায়নি। স্টাফ, ল্যাব টেকনিশিয়ান, রিসার্চার কেউ ছিল না। সবাই যেন হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কেবল গোপন বেজমেন্টের বাইরে থেকে তালা দেয়া হাইটেক সেলে মৃতদেহগুলো পড়ে ছিল। আমি এও শুনেছি যে বেচারা লোকগুলোকে গুলি করে মারা হয়েছে। তাদের মৃত্যুর কারণ অগ্নিকাণ্ড নয়। আমার মনে হয় আপনার এই কথাটা অন্ত ত সত্যি যে, আগুনে কেউ মারা যায়নি।
সাক্সেনার কাঁধ ঝুলে পড়ল। চেহারাতেও অসন্তুষ্টি। তবে ক্ষণিকের মাঝেই আবার নিজেকে সামলে নিল। তার মানে, হয় সে মিথ্যে বলায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত নয়ত এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে পটু।
“ওকে ফাইন” রাধার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল ডা. সাক্সেনা, “আমি তো ভেবেছিলাম যে এই ব্যাপারে কেউ কিছু জানেনা। দুঃখিত যে আপনাকে মিথ্যে বলেছি। তবে আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে এ ধরনের পরিস্থিতি আমাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য কতটা নাজুক।” মাথা নেড়ে আরো জানাল, “ওইসব মৃতদেহ সেখানে কিভাবে কিংবা কেন এলো সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। বিশ্বাস করুন টাইটানের মূল্যবোধ আর ন্যায়নীতি বেশ কড়া। আমাদের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান কার্ট ওয়ালেস শুধু ইউএসে নয় বরঞ্চ সারা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ব্যক্তি। এটা বলছি না যে আমরা সুবোধ। আমাদেরও ভুল হয়। তবে এ ঘটনাটা তো কোনো ভুল নয়। আমাদের ধারণা, ফ্যাসিলিটির মালিক সুমন পাওয়া কোনো এক ধরনের গোপন অপারেশন পরিচালনা করছিল। যদি জানতে চান কেন, তাহলে বলব উনার সাথে কথা বললেই ভালো হবে। তবে পুলিশ যদি খুঁজে পায়, তবে আপনার সোর্স নিশ্চয় এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে।” শেষ লাইনটা বেশ জোর দিয়ে বলল ডাক্তার।
তার মানে পাওয়ার মৃতদেহের কথা এখনো জানেনা। থাক, রাধাও কিছু বলবে না বলেই ঠিক করল।
“কিন্তু সেন্টারে তো একমাত্র টাইটানের ট্রায়ালই চলছিল।” রাধা এখনো হাল ছাড়েনি।
“ওহ, ইয়েস। অবশ্যই। সেটা তো আমি অস্বীকার করছি না।”
“ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে এরকম একটা ফ্যাসিলিটিতে আপনার সেলের কি দরকার ছিল?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাক্সেনা জানাল, “আপনি শুধু শুধু নোংরা খোঁজার চেষ্টা করছেন। যেমনটা আমি বলেছি এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলোও অন্য সব ট্রায়ালের মতই। ল্যাবে আর্য তার রিসার্চ করছিল। তারা এই ফ্যাসিলিটির মালিক। যখন আমরা প্রতিনিধি পাঠিয়ে এই রিসার্চের স্পন্সর হবার জন্যে সম্মতি দিতে ফ্যাসিলিটি চেক করেছিলাম, তখন তো গোপন বেজমেন্ট সম্পর্কে জানতামই না। কেউ সাইট ইন্সপেকশনে গেলে নিশ্চয়ই গুপ্ত রুম খুঁজে বেড়ায় না। আপনি তাই ভুল লোকটাকে ভুল প্রশ্ন করছেন। আমি আবারো বলছি পাওয়াকে জিজ্ঞেস করুন। সেই এসব কাদা ঘাটছিল, টাইটান নয়। ফ্যাসিলিটিতে যা আবিষ্কার করেছেন তা দেখে আপনার মত আমরাও স্তম্ভিত।”
“আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার হল” রাধা যেন সাক্সেনার কথা শুনতেই পায়নি, “ফ্যাসিলিটির কেবল তিনটা তুলাই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। কাকতালীয়ভাবে এসব তলাতে কেবল ফ্যাসিলিটির সমস্ত মেডিকেল রেকর্ডস আর আইটি সেন্টার ছিল। শুধু এ ফ্লোরগুলোই পুড়ে গেল, ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত না? নিশ্চিতভাবেই কেউ ইচ্ছে করে ফ্যাসিলিটির ট্রায়ালের সমস্ত রেকর্ড আর ডাটা নষ্ট করার চেষ্টা করেছে।”
“আমার উত্তর এবারও একই।” খানিকটা কাট কাট স্বরে জানাল সাক্সেনা, “এই অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কে কিংবা কী দায়ী সে সম্পর্কে আমাদের কোনো আইডিয়াই নেই। তদন্ত শুরু হয়েছে। তাই সন্দেহাতীতভাবেই শেষ হলে আরো অনেক কিছু জানা যাবে। যা করার আছে তা হল অপেক্ষা। আর আমাদের অপিনিওন হল এর জন্য মি. পাওয়াই দায়ী।”
মাথা নাড়ল রাধা। সময় হয়েছে কান ধরে টানার “আমি তো এও শুনেছি যে ফ্যাসিলিটিতে প্রাপ্ত মৃতদেহগুলো এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াম আর ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। যদি এর জন্য মি. পাওয়াকেই দায়ী করা হয় তাহলে তিনি আপনার অজ্ঞাতে কিভাবে আপনারই মেডিকেল সেন্টারে একশরও বেশি লোকের উপর দুটো নতুন ধরনের মাইক্রোবস প্রয়োগ করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছিল?”
এবার সাক্সেনার চেহারা কঠোর হয়ে গেল, বোঝা গেল যে আঘাতটা জায়গামত, লেগেছে। আপনার সোর্স সম্পর্কে আমার সত্যিই জানতে ইচ্ছে করছে। এবারে আর কষ্ট করে হাসার কোনো চেষ্টাই করল না। আপনি অনেক কিছুই জানেন দেখছি। টাইটানের বিরুদ্ধে এতসব জটিল অভিযোগ করছেন যার কোনো প্রমাণই নেই। দুভার্গ্য হল এই বেদনাদায়ক ঘটনা আমাদের নিয়ন্ত্রণহীনতাকেই তুলে ধরেছে। সেন্টারের স্টাফেরা কেবল তাদের দায়িত্ব পালন করছিল। বিভিন্ন টেস্ট করা, স্যাম্পল নেয়া এসবের মাধ্যমে বিশ্বাস করেছিল যে তারা বৈধ। আমরা আমাদের ইন্টারনাল সিস্টেম চেক করব। আর এটাও চেষ্টা থাকবে যেন এ ধরনের ঘটনা পুনরায় না ঘটে। এ ব্যাপারে আমি নিজে আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।”
খানিকটা ঝুঁকে সামনে আসতেই দেখা গেল পাথরের মত চেহারা ক্রোধে কালো হয়ে গেছে। “আর আমি এটাও জানি যে আপনি এই গল্প লিখবেন না সীমা। কেন জানেন?”
রাধা কিছুই বলল না। লোকটার গলার স্বরে কিছু একটা আছে। ও কী একটু বেশিই বলে ফেলেছে নাকি?
“কারণ” সাক্সেনা আবার শুরু করল, “আপনার হাতে কোনো প্রমাণই নেই। টাইটানকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে যদি এসব যথেচ্ছাচার লিখেন তাহলে আপনার সংবাদপত্রের ভরাডুবির ব্যবস্থা আমরাই করব। আর আমি শিওর আপনার এডিটর এতটা রিস্ক নেবেন না।”
এবারে রাধা জানাল, “আর যদি আমরা প্রমাণ খুঁজে পাই তো?” ভয়ে বুক দুরু দুরু কাঁপতে থাকলেও একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সি এম ওর দিকে।
মুখ বাঁকা করে হেসে ফেলল সাক্সেনা, “আপনি পাবেন না। আর আমি তো বলব যে সে চেষ্টাও করবেন না। কেননা তাতে সমূহ বিপদ হতে পারে।”
“মনে হচ্ছে আপনি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন ডা. সাক্সেনা?” নিজেকে সামলাতে যুদ্ধ করছে রাধা। হালকাভাবে কেঁপে উঠল নিচের ঠোঁট।
সাথে সাথে বদলে গেল সাক্সেনার গলা। আবারো পরে নিল হাসি-খুশি থাকার মুখোশ। “ওহ, না, আরে কি বলেন।” জোর করে হেসে জানাল, “আমি তো শুধু বলতে চাইছি যে, আমাদের প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে যদি কেউ অবৈধ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়ে থাকে আর এতদিন ধরে, সেটা লুকিয়ে রাখতেও সমর্থ হয় তাহলে নিশ্চয় নিজেদের প্ল্যান বাঁচাতে যে কোনো কিছু করতেও পিছপা হবে না। তাদের সিক্রেট খোঁজার জন্য আশপাশে ছোঁক ছোঁক করা রিপোর্টারকেও নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা কইবে না।” উঠে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দিল যে মিটিং খতম হয়ে গেছে। “আপনি একজন নাইস ইয়াং লেডি। তাই আপনার কিছু থোক তা চাইছি না। সো, প্লিজ সাবধানে থাকবেন।”
বোবার মত করে মাথা নাড়ল রাধা। যা শুনেছে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। তাড়াতাড়ি সাক্সেনার সাথে হাত মিলিয়ে বাইরে চলে এলো।
মেয়েটা চলে যাবার পর নিজের চেয়ারে বসে খানিক সিলিঙের লাইট পরীক্ষা করল সাক্সেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইল ফোনে একটা নাম্বার ডায়াল করে জানাল, “সাক্সেনা বলছি। কয়েকটা ব্যাপার জানানোর আছে।”
.
২২. দ্য সিক্রেট জার্নাল
“শিওর” গলা পরিষ্কার করে বলল বিজয়, “দেখা যাক কী হয়। বেশ রহস্যময় একটা ব্যাপার। ইউমিনেস সম্পর্কে একেকটা সোর্স একেকটা কথা বলছে। তবে সবকিছু মিলিয়ে আমি যেটা বুঝতে পারছি তা হল তিনি ছিলেন আলেকজান্ডারের একজন জেনারেল আর তার মৃত্যুর পর গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ইউমিনেসকেও বন্দী করা হয়। এছাড়া পৌত্রের জন্য মেসিডোনিয়ান সিংহাসন পুনরুদ্ধারের কাজে অলিম্পিয়াসকেও সাহায্য করেছিলেন; যদিও এই কারণেই জীবন হারিয়েছেন। আরেকটা ব্যাপার স্পষ্ট যে তিনি বেশ জ্ঞানী ছিলেন আর এশিয়া অভিযানের সময় আলেকজান্ডারের রয়্যাল ডায়েরিও লিখে গেছেন।”
“রিসার্চ করার তেমন একটা সময় না পেলেও ক্যালিসথিনস আর ইউমিনেস সম্পর্কে এতকিছু জেনেছ সেটাই তো কত?” খুশি হল এলিস। “আলেকজান্ডারের পিতা দ্বিতীয় ফিলিপের সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেছেন ইউমিনেস। আর ফিলিপের মৃত্যুর পর হয়ে উঠেন আলেকজান্ডারের চিফ সেক্রেটারি। এছাড়া অন্যতম জেনারেল তো ছিলেনই। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তার জেনারেলরা। বেশির ভাগ সোর্স ইউমিনেসকে স্বীকৃতি দিলেও ভাগ্য তার সহায় হয়নি। কাহিনিটা বেশ বড় হলেও খুব দ্রুত যতটা পারি সংক্ষেপে বলছি। আলেকজান্ডারের পর নির্বাচিত উত্তরাধিকার পারডিকাসের বিরুদ্ধে যেসব জেনারেল বিদ্রোহ করেছিল তাদের সাথে মৃত্যুবরণ করার কথা থাকলেও একবার ফাঁকি দিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন ইউমিনেস। কিন্তু মৃত্যু তাকে আলেকজান্ডারের আরেক জেনারেল অ্যান্টিগোনাসের কাছে তাড়া করে নিয়ে যায়। তবে অ্যান্টিগোনাসকে হারিয়ে দিলেও ইউমিনেসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তারই কিছু প্রাদেশিক কর্মকর্তা। এরপর অ্যান্টিগোনাসের হাতে খুন হন। সময় ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। তবে কথিত আছে যে, অ্যান্টিগোনাসের সাথে যুদ্ধের আগেই নিজের সমস্ত ডকুমেন্টস আর জার্নালস নষ্ট করে গেছেন। তাই কোনো ঐতিহাসিক রেকর্ডেই এই সিক্রেট জার্নালের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।”
“তোমার ধারণা এটা নকল?” খানিকটা উন্মা নিয়ে জানতে চাইল বিজয়। বন্ধুর গলার স্বরে রাগের আভাস পেয়ে ভ্রু তুলে তাকাল কলিন।
জার্নালটা হাতে নিয়ে মন দিয়ে পড়ছে এলিস। মনে হয় বাকি দুজনের কাণ্ড খেয়ালই করেনি। “হুম, সে রকমত মনে হচ্ছে না। অনেকটা যেন নিজেকেই শোনাল। তারপর বলল, “অনুবাদকের সূচনা অনুযায়ী, লরেন্স ফুলার ১৯৫৪ সালে মিসরীয় এক অ্যান্টিক ডিলারের কাছে খুব ভালো অবস্থায় আছে এমন এক সেট প্যাপিরাস ডকুমেন্টস পেয়ে যান। সে সময়ে তার দল কায়রোর কাছাকাছি এক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজের সাথে জড়িত ছিল। এর সাথে ফুলার আরো কিছু নোটস আর টীকা যোগ করে গেছেন। কিন্তু এই জার্নাল মিশরে কেন আর কিভাবে গেল সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ইউমিনেস তো আজকের দিনের ইরানে মারা গেছেন।” চোখ তুলে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, “তুমি এটা কোথায় পেয়েছ?”।
বিজয় খুলে বলল কেমন করে মাত্র গতকালকেই সে আর রাধা মিলে জার্নালটাকে খুঁজে বের করেছে। আমার বাবা-মা দুজনেই ইতিহাসবিদ ছিলেন, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে কাজ করতেন।”
“চমৎকার” বিড়বিড় করে আবার জার্নালে মনোযোগ দিল এলিস, “মনে হচ্ছে প্যাপিরাস ডকুমেন্টসগুলো ঠিকঠাক থাকলেও কিছু কিছু অংশ মিসিং হয়েছে। ফুলার যেই হোক না কেন যথাসাধ্য চেষ্টা করে হারানো অর্থ বসিয়ে অনুবাদ করে গেলেও মিসিং শব্দগুলো ছাড়া পড়তে একটু কষ্টই হচ্ছে।”
“তোমার বাবা-মা কিভাবে এই জার্নাল পেলেন সেটাই তো আমার মাথায় আসছে না” উচ্চস্বরে জানাল কলিন, “উনারা নিশ্চয়ই এই ফুলার লোকটাকে চিনতেন।”
কাঁধ ঝাঁকাল বিজয়, “আমি আসলে অনেক ছোট ছিলাম” স্বীকার করে জানাল, “আর দুভার্গ্যক্রমে সে সময় তাদের কাজের প্রতি এতটা আগ্রহীও ছিলাম না। তাই ওদের বন্ধু কারা কিংবা তাদের মাঝে ফুলারও ছিলেন কিনা সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই। ইস, কোনোভাবে যদি জানতাম। উনার সাথে তাহলে যোগাযোগ করে বাবা-মা সম্পর্কেও কথা বলা যেত।” ধরে এলো ছেলেটার গলা।
“ওকে, এক্ষুনি আমি পুরো জার্নালটা পড়ে দেখতে চাই” ঘোষণা করল এলিস। উত্তেজনা লুকিয়ে রাখতে পারছে না। আমাকে শুধু সারাংশটা বলো।”
“ফুলারের লেখানুযায়ী জার্নালটা দুভাগে বিভক্ত আর সাথে একটা চিঠিও আছে।” শুরু করল বিজয়। “ক্যালিসথিনসের অংশটা মনে হচ্ছে ক্যালিসথিনস নিজেই লিখে গেছেন। আর তারপর ইউমিনেস তার দ্য ডিডস অব আলেকজান্ডারের সাথে এটাকে জুড়ে দিয়েছেন। ক্যালিসথিনসের দাবি সগডিয়ান পাথর অভিযানের সময় আলেকজান্ডার তাকে একটা সিক্রেট মিশনে পাঠিয়েছিলেন। এর কাহিনির অনেকটুকুই হারিয়ে গেছে। কারণ জার্নালের ওই অংশটার বেশ ক্ষতি হয়েছিল। তাই মিশনের উদ্দেশ্যটা তেমন স্পষ্ট না। তবে অবাক ব্যাপার হচ্ছে তিনি ব্যাকট্রিয়ার জঙ্গলে ঘুরে গাছ আর পাতা পরীক্ষা করতেন; যেটার কোনো ব্যাখ্যাই পাওয়া যায়নি।”
“তাই নাকি?” এলিসেরও খটকা লাগছে ব্যাপারটা নিয়ে।
“এই গল্পে এটুকুই আছে। এরপর মিশন সম্পন্ন করে ক্যালিসথিনস ফিরে এলে পর আলেকজান্ডার তাকে অত্যন্ত কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন।”
“আর তার কিছুদিন পরেই আবার খুন করে ফেলেছেন।” মিটিমিটি হাসছে কলিন। “মিডতে দেখি ক্ষণে ক্ষণে বদলাতো।”
“জার্নালে কি লেখা আছে যে ব্যাকট্রিয়াতে ক্যালিসথিনস আসলে কী খুঁজে পেয়েছিলেন?” মৃদু স্বরে জানতে চাইলেন ডা. শুক্লা। এতক্ষণ চুপচাপ বসে অন্যদের কথা শুনছিলেন আর আইভরি কিউবটা পরীক্ষা করেছেন।
নিজের নোটের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল বিজয়। “ফুলারের অনুবাদে এ সম্পর্কে কিছুই নেই। হয়ত অরিজিন্যাল প্যাপিরাস ডকুমেন্টে ছিল। তবে সে অংশটা তো ড্যামেজ হয়ে গেছে।”
“এটা সত্যি হলেও হতে পারে” মন্তব্য করল এলিস। “কারণ, আলেকজান্ডারের এশিয়া অভিযানের সময় ক্যালিসথিনস অনেক ধরনের সায়েন্টিফিক মিশনেও গিয়েছিলেন। তবে এ ব্যাপারে আর কিছু নেই কেন সেটাই বিস্ময়কর। কী মনে হয়, উনি ব্যাকট্রিয়ার জঙ্গলে কী করছিলেন?”
“ইউমিনেসের গল্পটা আরো মজার। শোনার জন্য সবাই তৈরি তো?” চকচক করে উঠল বিজয়ের চোখ। “ইউমিনেসের দাবি, আলেকজান্ডার তাকে তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া ছয়টা পদ্যের একটা পার্চমেন্ট দিয়েছিলেন। যেটা নাকি “দেবতাদের সিক্রেট” খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। ইউমিনেস সিক্রেটের কথা বলে না গেলেও এটা লিখেছেন যে পার্চমেন্টের নির্দেশ অনুযায়ী নাকি সিক্রেট অবস্থানে যেতে আলেকজান্ডারকে সাহায্য করেছে। দুজনে এক রাতে ছোট একটা চামড়ার পাউচ নিয়ে সেনাবাহিনিকে রেখে বের হয়ে পড়েন। তবে ব্যাগের ভেতরকার জিনিস ইউমিনেসকে দেখতে দেয়া হয়নি। পাঁচ মাথাঅলা সাপের মত দেখতে একটা পাথরের অভ্যন্তরে সিক্রেট লোকেশনটা খুঁজেও পান। তারপর ইউমিনেসকে রেখে আলেকজান্ডার কিছুক্ষণের জন্য ভেতরে যান। ফিরে আসার পর দেখা যায় তার দেহবর্ম আর ব্রেস্টপ্লেট ভেজা। যেন এতক্ষণ পুলে ভিজেছেন। সে রাতে কী ঘটেছে ইউমিনেস না জানলেও পরে বলতেন যে আলেকজান্ডার সত্যিই দেবতাদের সিক্রেট খুঁজে পেয়েছিলেন আর তারপর থেকে তিনি নিজেই এক দেবতা হয়ে যান।”
বিজয়ের কথা শেষ হবার সাথে সাথে নিশ্চুপ হয়ে গেল চারপাশ।
“এই কাহিনিটা” অবশেষে কথা বলল এলিস, “আলেকজান্ডার যে নিজেকে দেবতা দাবি করে উপাসনার ঘোষণা দিয়েছিলেন তার সাথে মিলে গেলেও কিছুটা আবার আলেকজান্ডার যে রোমান্স করেছেন সে গল্পের সাথেও খাপ খায়।”
“এগুলো সম্পর্কে আমিও শুনেছি।” বলে উঠল কলিন। “গ্রিক ইতিহাস যে একেবারে জানি না তা না। আলেকজান্ডারের গল্পগুলোর কালেকশনের একটা না?”
“ওয়েল, আমি এটাকে গ্রিক ইতিহাস বলব না, কলিন” হেসে ফেলল এলিস। “অজ্ঞাত একজন গ্রিক লেখক দ্য গ্রিক আলেকজান্ডার রোমান্স লিখে গেছেন। যাকে আজকাল ফুসিডো-ক্যালিসথিনস নামে ডাকা হয়। এর তিনটা ভার্সন আছে। প্রতিটাই অন্যদের চেয়ে আরো বেশি আকষর্ণীয় এবং একেবারে প্রথম পান্ডুলিপির তারিখ তৃতীয় শতকের। এখানে আলেকজান্ডার সম্পর্কে এত চমৎকার সব গল্প আছে যে কী বলব। তবে ইতিহাসের চেয়ে কল্পনাই বেশি।”
দাঁত বের করে হাসি দেখিয়ে দিল কলিন, “আরে বাবা আমিও তো তাই বলছি। সত্যিই।”
তবে বিজয়ের কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেছে এলিস। “আলেকজান্ডারের একটাই ইচ্ছে ছিল; দুনিয়া জয় করা। ইতিহাসে যে কথা বার বার লেখা হয়েছে। এখনো যেন মাথায় ঢুকছে না, “আর যদি এটা ধরেও নেই যে তিনি কোনো রহস্যময় এক ‘দেবতাদের সিক্রেট জানার অভিযানে গিয়েছিলেন কই ইউমিনেস তো মূল্যবান কিছু পাবার কথা লিখে যাননি। শুধু এটুকুই যে আলেকজান্ডার ফিরে আসার পর দেখা যায় তার দেহবর্ম ভেজা।”
“হয়ত দেবতাদের সুইমিং পুল পেয়ে গেছেন” কলিনের হাসি আর থামেই না, “সেটাও তো বেশ দামি তাই না?”
চোখ মুখ শক্ত করে তাকাল এলিস। “দ্যাটস ফানি, কলিন। কিন্তু সিরিয়াসলি এ কাহিনি তো আলেকজান্ডারের রোমান্সকেও ছাড়িয়ে গেছে। রোমান্সের সব ক্ষেত্রেই আলেকজান্ডারকে ঈশ্বর হিসেবে আঁকা হয়েছে। এ কারণেই হয়ত ইউমিনেস অফিসিয়াল রেকর্ডে এ জাতীয় কিছু লিখে যাননি সত্যের চেয়ে কল্পনাই বেশি শোনাবে।”
খুক খুক করে কাশি দিয়ে বিজয়ের দিকে তাকালেন ডা. শুক্লা, “ইউমিনেস ছয়টা পদ্য সম্পর্কে কিছু বলে গেছেন?” নরম স্বরে জানতে চাইলেন প্রাজ্ঞ ভাষাবিদ।
“আমি তো ভেবেছি এ ব্যাপারে কারো আগ্রহই নেই।” এমনভাবে বলল বিজয় যেন মহার্ঘ্য কিছু উন্মোচন করতে যাচ্ছে। “উনি জার্নালে সবকটি পদ্য রেকর্ড করে গেছেন আর ফুলারও দয়াপরবশ হয়ে প্রতিটা অনুবাদ করেছেন। কয়েকটা শব্দ মিসিঙ হলেও সারমর্ম বুঝতে অসুবিধা হবে না। আমি বলছি।”
নোটবুকের পাতা উল্টে পড়তে শুরু করল বিজয়।
.
২৩. আবছায়া এক হুমকি
এক দৃষ্টে ক্রিশ্চিয়ান ভ্যান কুকের দিকে তাকিয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটের বেডরুমে পার্সোনাল ওয়ার্কস্টেশনে বসে আছে কুপার। এইমাত্র মিশনের প্রগ্রেস সম্পর্কে সব জানিয়ে শেষ করেছে। ভ্যান কুক কেবল মাঝে মাঝে মাথা নেড়েছে। বোঝা গেল যে শেষ করার জন্য তাড়া দিচ্ছে।
তবে এলিসের সাথে আর কারা আছে শোনার সাথে সাথে বদলে গেল অস্ট্রিয়ান বিজনেসম্যানের চেহারা। স্থান-কাল ভুলে ঈগলের মত তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া শ্যেন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল কুপারের দিকে।
“আমি ওই নামগুলো চিনি।” ধারালো কণ্ঠে জানাল ভ্যান ক্লক। গত বছর অর্ডারের সমস্ত প্ল্যান বানচাল করে দেয়া নামগুলো এত সহজে ভোলার কথা নয়। আরেকটু হলেই হাতে এসে যেত দুই হাজার বছর ধরে গোপনে থাকা মহাভারতের সিক্রেট। “একেকটা একেবারে বিষ ফোঁড়া। ওদের কারণেই অর্ডারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকেও হারিয়েছি।” দ্রুত কুপারকে সবকিছু খুলে বলল।
“তাহলে সরিয়ে দিলেই তো হয়।” অর্ডার এদেরকে এত সহজে ছেড়ে দিয়েছে দেখে তো কুপার যারপরনাই বিস্মিত। ওদের জীবিত থাকাটা তো
অর্ডারের কাজের সাথে খাপ খায় না। “বেঁচে থাকবে না, মানে প্রত্যক্ষদর্শীও নেই।” এটাই তো অর্ডারের গাইডিং প্রিন্সিপ্যাল। অর্ডারের সাথে জড়িত সকলেই এই নীতি মেনে চলে। এর বাইরে যাবার সাধ্য কারো নেই। এই কেসের ক্ষেত্রে কেন উল্টোটা হল কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
ভ্যান কুক বুঝতে পারলো যে কুপার ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। লোকটা অর্ডারের সত্যিকারের কোনো সদস্য ছিল না; ছিল এক কর্মচারী মাত্র। “অর্ডারের জন্ম কখন, বয়স কত সেটাও বোধহয় কারো মনে নেই। সেই ইতিহাসের শুরু থেকেই আছে। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা মেটাবার কোনো স্থান নয় অর্ডার। অর্ডারের অস্তিত্বের কারণও সবার অজানা। কেবল এর সদস্যরাই জানে। তবে আমরা যে কী করতে পারি তাও একেবারে অজানা নয়। আর এটা সম্ভব হয়েছে আড়ালে থেকে অপারেশন চালানো; রাজনীতিকে ব্যবহার করা; একইভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতি আর যুদ্ধকেও কাজে লাগানোর মাধ্যমে। যদি আমাদের গত বছরের মিশনটা সফল হত তাহলে দুনিয়াকে শাসন করার জন্য মারণাস্ত্র হাতে এসে যেত। কিন্তু তখনো বাইরের দুনিয়ায় আমাদের উদ্দেশ্য। সাধনের জন্য সন্ত্রাসীদের সাথে হাত মেলাতে হয়েছে। অন্তরালে থেকে গোপনে রশি টেনে ঘটনা ঘটানোই আমাদের কাজ। তাই, যদি এই লোকগুলোর পিছু নিতাম তাহলে ইউ এস আর ইন্ডিয়ার সরকার কানেকশনটা টের পেয়ে যেত। অথচ মিশনে আমাদের সদস্যদের মৃত্যুর সাথে সবাই ধরে নিল যে কেস। সেখানেই সমাধা হয়ে গেছে। ফলে আমরাও স্বাধীন হয়ে গেলাম। অন্যান্য মিশন নিয়ে মাথা ঘামাতেও কোনো কষ্ট হল না। এখন যেমন তুমি একটার দায়িত্ব পেয়েছ।”
“তবে সমস্যাটা মনে হচ্ছে শেষ হয়নি।” চিন্তিত ভঙ্গিতে চিবুক ঘষলো কুপার। “ইন্ডিয়ান গোয়েন্দাবাহিনি জড়িয়ে পড়ায় কাজ আদায় করাটা কঠিন হবে।”
“গত বছর আর এ বছরের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে কুপার।” হালকাভাবে হাসল ভ্যান কুক, “এই বছর আমাদের মিশন সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। আর আমাদের সাথে এসবের কানেকশনও কেউ বের করতে পারবে না। বিশেষ করে তুমি যখন চার্জে আছো। আমি তোমাকে চিনি। নিজের ট্র্যাক তুমি কাভার করো। এদের কোনো গুরুত্বই নেই। আর কোপ দেয়ারও যথেষ্ট কারণ আছে। তাই তোমার পথে যেই আসুক না কেন তাকে নিয়ে কী করবে সেটা ভাবার অধিকারও তোমার। কেউ বেঁচে থাকবে না। মানে প্রত্যক্ষদর্শীও নেই। নিয়মটা তো তুমিও জানো।”
কুপার মাথা নাড়তেই লাইন কেটে গেল।
বেডরুমের দরজায় নক শুনে তাকাতেই দেখা গেল কৃষাণ। বেশ অস্থির। দেখাচ্ছে।
“কোনো সমস্যা?” জানতে চাইল কুপার।
“আইবি অফিসার আর রাধা শুক্লা দুজনেই টাইটান ফার্মাসিউটিক্যালসে গেছে।”
এক দৌড়ে স্যুইটের লিভিং রুমে চলে এলো কুপার, “নাহ, এটা কিছুতেই হতে পারে না।”
দুটা লাল আলো জ্বলছে নিভছে এরকম একটা মনিটরের দিকে ইশারা করল কৃষাণ, “এটা টাইটান, আর ওই যে দুটো টার্গেট।”
নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না কুপার। ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স কী ওদের প্ল্যানটা ধরে ফেলল নাকি? সেটা কিভাবে সম্ভব? কেউইতো জানে না। এমনকি কুপার নিজেও পুরো ডিটেইলস জানে না। শুধু এটুকু জানে যে পঁচিশ বছর আগে শুরু হয়েছিল এ মিশন। তাকে ব্রিফ করা হয় স্ট্যাভরসকে নিয়ে অলিম্পিয়াসের সমাধি খোঁড়ার জন্য। এও জানানো হয় যে সমাধি থেকে কী আনতে হবে। একবার সেই নির্দিষ্ট বস্তুটা হাতে এলে কী করতে হবে তাও স্পষ্ট ছিল। এর বেশি আর কিছুই জানে না।
তাহলে আইবি এমন কী জানে যেটা সে জানেনা?
যাই হোক, ওকে ওর কাজ করতে হবে। সাথে সাথে তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। সবার আগে একটা ফোন করতে হবে। আর তারপর টার্গেটেরা খতম। এরা সত্যের বড় বেশি কাছে চলে গেছে।
এতটা তো সে হতে দিতে পারে না।
.
২৪. এ মিসিং লিঙ্ক
একে একে ছয়টা পদ্যই পড়ে ফেলল বিজয়। মাঝে মাঝে কেবল মিসিং শব্দগুলোর সময় একটু করে থামতে হল।
“নাম্বার ওয়ান” শুরু করল বিজয়’ “এটাই মনে হচ্ছে পুরোপুরি অক্ষত আছে।”
পদ্য-১
তারপর…ধোঁকাবাজির জন্মস্থান
প্রতিশোধের শপথ নিয়ে মৃত্যুর জন্ম
সর্বশক্তিমান এক রাজা
অভিযাত্রিগণ…গড়িয়ে দাও খুঁটি!
আর…ভাগ্য তোমায় পথ দেখবে!
“নাম্বার টু-তে অনেক শব্দই নেই” পড়ার আগে বলে নিল বিজয়।
পদ্য-২
“ওপারে…দ্রুতবহতা…চক্ষু
লবণহীন সমুদ্রের …পাশে
তিনজন ভ্রাতা…
তীরের ফলার ন্যায়…রাস্তা
পাতালের …প্রবেশপথ
সর্পের সিল…
আর পাবে…সন্ধান।
“নাম্বার-খ্রি:
আর…সেই…পাথর
তুলে ফেলো…আর…ছাল
প্রথমটি…আর ফল
গাঢ় রঙ্গা…সাদা…খোসা
আর…অথবা…মসৃণ পরবর্তী …
… সেই ফল
সাবধান…স্পর্শে…জ্বলবে।
“নাম্বার ফোর”:
তারপর প্রবেশ করো…সেই পথে…
উপত্যকায়…পূর্বে…
বেছে নাও…মনে রাখবে
তুমি…যেখানে ঘুমায় অ্যাপোলো।
“নাম্বার-ফাইভ”:
কিনারের…উপরে…
যেখানে…আর রাত্রি…মেশে
…পোসিডনের সম্পদ
…সর্পের কাছে…
পাঁচ…দেবদূত
সেই প্রবেশপথ…দেবে…জীবন।
“নাম্বার-সিক্স”:
মনে রাখবে…সাহস…আর
অবহেলায়…হবে ধ্বংস
একত্রে …সমস্ত কিছু
সুরক্ষা দেয়…স্থির দৃষ্টি
অবজ্ঞায়…
হারাবে…সবচেয়ে মূল্যবান উপহার।
চোখ তুলে তাকাল বিজয়। নিস্তব্ধ হয়ে আছে সকলে।
“তার মানে আলেকজান্ডারের পার্চমেন্ট আর তার মায়ের সমাধিতে পাওয়া এলিসের আইভরি কিউবটার মধ্যে কানেকশন আছে।” সবার আগে নিজের মতামত দিল কলিন। “একেবারে প্রথমটা ছাড়া আর সবকটিই তো কিউবের সাথে মিলে যাচ্ছে। কয়েকটা শব্দ মিসিং থাকলেও বুঝতে কোনো কষ্টই হচ্ছে না।”
ডা. শুক্লাও মাথা নাড়লেন। “আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল যে এরকমই হবে”, স্বীকার করে জানালেন, “তুমি যখন ব্যাকট্রিয়ার জঙ্গলে ক্যালিসথিনসের মিশনের কথা বললে তখনই আমার পাতা, গাছের ছালসহ বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া পদ্যটার কথাই মনে হয়েছে। আর যখন পাঁচ মাথাঅলা সাপের কাছে আলেকজান্ডারের অনুসন্ধান শেষ হবার কথা শুনলাম তখন তো পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি। একটা পদ্যে কিন্তু সেই প্রবেশদ্বারের রক্ষক হিসেবে পাঁচ মাথাঅলা সাপের কথা লেখা আছে। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না আমার ভাবনার আদৌ কোনো সত্যতা আছে কিনা।
“দিস ইজ ইন্টারেস্টিং” ধীরে ধীরে বলে উঠল এলিস। মনে হচ্ছে বেশ চিন্তা করে তারপর কথা বলছে, “কিউবটাতে প্রাচীন ভারতীয় ভাষায় ভারতীয় দেবতাদের কথাই লেখা হয়েছে। অন্যদিকে আলেকজান্ডারের কাছে যে পার্চমেন্ট ছিল সেখানে ভারতীয় দেবতা গ্রিক দেবতাতে পরিণত হয়েছে। অ্যাপোলো হল সূর্য। পোসিডন শিব। আর কেবল দেবতারাই নয়, পাতাল হল নরক। পার্চমেন্টটা সম্ভবত গ্রিকে লেখা। তার মানে কিউবটা আসলে ভারতে তৈরি হয়েছিল। তারপর কেউ এটাকে গ্রিকে অনুবাদ করেছে। ফলে অরিজিন্যাল সংস্কৃত পদ্যের চেয়ে আরো সহজতর হওয়ায় আলেকজান্ডারের বুঝতে কোনো অসুবিধাই হয়নি।”
“এতে করে আরো একগাদা প্রশ্নের উদয় হল” স্বীকার করল বিজয়। “যেমন ধরো কিউবটা এলো কোথা থেকে? আর সংস্কৃতকে ঘিকেই বা কে অনুবাদ করল? আরো আছে, পার্চমেন্ট অনুসরণ করে কিসের সন্ধানে গিয়েছিলেন তিনি? নিশ্চয় এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে আলেকজান্ডার গ্রিস থেকে ভারতে চলে এসেছেন। ইউমিনেসের মতে দেবতাদের সিক্রেট অনুসন্ধানই ছিল এর উদ্দেশ্য। কিন্তু তাতে কিছুই তো খোলাসা হল না।”
“আচ্ছা চিঠিটা কোথায়?” বিজয়ের কাছে জানতে চাইল এলিস। “তুমি না বলেছিলে জার্নালের সাথে একটা চিঠিও আছে?”
মাথা নেড়ে বিজয় জানাল, “ফুলারের মতে চিঠিটা অনেকটা জার্নালের কাভার লেটারের মত। অলিম্পিয়াসকে উদ্দেশ্য করে ইউমিনেস লিখে গেছেন। ফুলারের বিশ্বাস ইউমিনেস জার্নালসহ এই চিঠিটা অলিম্পিয়াসের কাছে পাঠিয়েছিলেন। হয়ত নিজের মৃত্যুর কয়েকদিন আগে?”
ভ্রু-কুঁচকে ফেলল এলিস, “ইউমিনেস ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৃত্যুবরণ করেছেন। অলিম্পিয়াসও তাই। হয়ত চিঠিটা কখনোই পান নি। তাই সম্ভবত ফুলারের ধারণাই সত্যি। আর তারপর কোনো একভাবে সমস্ত ডকুমেন্টস মিশরে পৌঁছে গেছে।” কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানাল, “এসবই অনুমান। কোনো প্রমাণ নেই হাতে।”
হেসে ফেলল বিজয়। এলিসের অ্যার্কিওলজিস্ট সত্তাটা বেরিয়ে এসেছে। কোনো ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কিংবা প্রমাণ ব্যতীত কেবল ঐতিহাসিক রেকর্ড দেখেই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে নারাজ।
“যাই হোক” বিজয় বলল, “চিঠিটা অলিম্পিয়াসকে জানিয়েছে যে ইন্দুস ভূমিতে আলেকজান্ডারের মিশন সফল হয়েছে। আরও লেখা আছে যে রানির নির্দেশ মতন আলেকজান্ডারকে দেয়া ধাতব গোলাকার পাতটাকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। আলেকজান্ডারের স্বর্গীয় পিতা জিউসের বেদির নিচে। ব্যাবিলনে ফিরে যাবার আগে হাইফাঁসিস নদী তীরে আলেকজান্ডার যে বারোটা বেদি নির্মাণ করিয়েছিলেন এটা তাদেরই একটা। দেবতাদের সিক্রেট খুঁজে পাবার জন্য ধাতব পাতটা যে অন্যতম চাবিকাঠি ইউমিনেস সেটাও বারে বারে লিখে গেছেন।”
“তার মানে তোমার ধারণা ধাতব পাতটাকে দেখতে পেলে কিউবের পদ্যগুলোর মমার্থ বোঝা যেত?” বন্ধুর চিন্তার ধারা অনুমান করল কলিন।
“সেটার সম্ভাবনা কিন্তু আছে।” একমত হলেন ডা. শুক্লা। “রাধা যেমনটা বলেছিল কিউবের পদ্যগুলোর কোনো অর্থই বোঝা যাবে না; যদি না রেফারেন্স পয়েন্টটা জানা যায়। আর যদি সত্যিই কোনো মূল্যবান চাবি হয় তাহলে তো পুঁতে ফেলার জন্য অলিম্পিয়াসের কথায় যুক্তি আছে। নিজ পুত্রকে উপহার দেবার পর নিশ্চয় অন্যকারো হাতে পড়ক দেবতাদের এই সিক্রেস্ট, সেটা কাম্য নয়।”
“কিন্তু এখনো আমার মাথায় আসছে না যে অলিম্পিয়াস এই কিউব আর ধাতব পাতটা কোথায় পেয়েছেন?” এলিস কিছুতেই ধোঁয়াশা কাটাতে পারছে না। “উনাকে কে এসব দিয়েছিল? কেন? সমাধিতে একসাথে ধাতব পাওয়া গেলেই বেশি ভাল হত। তাহলে এখন চোখে দেখে পরীক্ষা করা যেত যে আদৌ কিউব আর এটার মাঝে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা।”
এলিসের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে ফেলল বিজয়। ও এখনো ওদের জন্য অনেক সারপ্রাইজ লুকিয়ে রেখেছে। জার্নালের রেফারেন্স পাওয়া ফাইলের বাক্সের গায়ে চাপড় মেরে বলে উঠল, “তোমাদেরকে একটা ফাইলের কথা জানিয়েছিলাম না যেখানে জার্নালের কথা পেয়েছি? এটাই সেটা। কোনো এক কারণে আমার বাবা সারা বিশ্বব্যাপী হওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজগুলোর একগাদা ডকুমেন্টস আর নিউজ পেপার আর্টিকেল সংগ্রহ করে গেছেন। কেন করেছেন সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই। কিন্তু যখন জানালটা পড়েছি, তখনই ফাইলের একটা নিউজ পেপারের কথা মনে পড়েছে।”
ফাইলের বেশ কয়েকটা পাতা উল্টে কাঙ্ক্ষিত আর্টিকেলটা বের করে আনল বিজয়। ১৯৮৫ সালের একটা নিউজ আইটেম। পড়ব? তোমরা শুনবে?”
অন্যেরা একযোগে মাথা নেড়ে অপেক্ষা করল বিজয়ের জন্য। “দ্য গ্রেট আলেকজান্ডার নির্মিত বেদির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে” আর্টিকেলের হেডলাইন পড়ে বাকিটা শোনাল, “ইস উপত্যকার ধ্বংসাবশেষের জন্য ভূমি খনন করতে গিয়ে হোশিয়ারপুর জেলার দাশুয়া শহরে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অসংখ্য বিশালাকার কাঠামোর কাদা-মাটি দিয়ে তৈরি ইটের ভিত্তি খুঁজে পেয়েছেন। ফাউন্ডেশন অনুযায়ী প্রতিটা কাঠামো অন্তত ১৭ মিটার চওড়া। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা দেশে ফেরার দীর্ঘ ভ্রমণ শুরু করার আগে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বীজ (Beas) নদী তীরে যে বারোটা বেদি নির্মাণ করেছিলেন এগুলো তারই ধ্বংসাবশেষ। দুহাজার বছর ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এসব বেদিতে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর চারশ বছর পরেও ভারতীয় রাজারা উপাসনা করতেন।”
চোখ তুলে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এবারে এটা শোন। বেদিগুলো পরীক্ষা করে দেখার সময় একটা ভিত্তিপ্রস্তরের নিচে অজ্ঞাত এক কৃষ্ণরঙা ধাতু দিয়ে তৈরি গোলাকার ছোট্ট একটা পাত পাওয়া গেছে। প্রকৃতপক্ষে গ্রিক না হওয়ায় প্লেটটির উৎস নিয়ে রহস্য রয়ে গেছে। এ আবিষ্কার সম্পর্কে পুরো দল মুখ না খুললেও এটুকু জানিয়েছে যে অত্যন্ত প্রাচীন আমলের এই ধাতব পাত আলেকজান্ডারেরও বহু আগের কোনো এক সময়ের হতে পারে। এটির গায়ে খোদাই করা রহস্যময় চিহ্নগুলো হায়ারোগ্লিফিক কিংবা এ জাতীয় চিত্রসদৃশ লেখা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। পরীক্ষা নিরীক্ষা আর সংরক্ষণের জন্য পাতটাকে নিউ দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।”
হেসে ফেললেন ডা. শুক্লা। বুঝতে পেরেছেন বিজয় এরপর কী বলতে পারে। তার মানে তোমার ধারণা ইউমিনেস উনার চিঠিতে এই পাতটার কথাই লিখে গেছেন?”
“রাইট” টেবিলের উপর ফাইলটাকে রেখে দিল বিজয়। “আমার মনে হয় না এতে তেমন কোনো ভুল আছে। প্রথমত, পাতটা আলেকজান্ডারের চেয়েও বয়সে প্রাচীন। দ্বিতীয়ত, সেটা তাহলে আলেকজান্ডারের নির্মিত বেদির নিচে কিভাবে গেল? যদি না আলেকজান্ডার নিজে সেখানে না রাখেন? ইউমিনেস নিজেই তো বলে গেছেন যে আলেকজান্ডার তা করেছিলেন।”
“তোমার যুক্তিতে এখনো অনেক ফাঁক-ফোকড় আছে বিজয়” কপালে ভাঁজ ফেলে জানাল এলিস, “সবচেয়ে জরুরি কথা হচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিকের ধারণা যে
ধ্বংসাবশেষগুলো আলেকজান্ডারের নির্মিত বেদির হতে পারে। আরো একবার বলছি তাদের কাছেও জোরালো কোনো প্রমাণ নেই। যদি এগুলো এমনই কোনো ধ্বংসাবশেষ হয় যার সাথে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের কোনো সম্পর্কই নেই?”
ভ্রু-কুটি করলেন ডা. শুক্লা, “১৯৮৫ সালে পাতটা আবিষ্কার হয়েছে? কই আমি তো কখনো ন্যাশনাল মিউজিয়ামে তা দেখিনি।”
“তাহলে একবার মিউজিয়ামে ফোন করে জিজ্ঞেস করলে হয় না?” পরামর্শ দিল কলিন। “হয়ত পাবলিক ডিসপ্লেতে রাখা হয়নি। অনেক জাদুঘরই তাদের বেজমেন্টে কার্টন আর ক্রেট ভর্তি জিনিসপত্র রেখে দেয়। কায়রো মিউজিয়ামও এরকম করে; আমি জানি। সাধারণত এ ধরনের নিদর্শন সাধারণ জনগণকে দেখতে দেয়া হয় না। তবে এলিস নিজে একজন অ্যার্কিওলজিস্ট। হয়ত ও বলতে পারে যে গবেষণার জন্য একবার দেখতে চায়।”
মাথা নেড়ে এলিস জানাল, “শিওর। এ পাতের সাথে কিউবের সম্পর্ক আছে কি নেই সেটা জানার জন্য আমার অসম্ভব কৌতূহল হচ্ছে। তাছাড়া জার্নালের কথাগুলো সত্যি, নাকি আলেকজান্ডারকে নিয়ে রচিত আরেকটা কল্পকাহিনি তাও জানা হয়ে যাবে।”
“তাহলে তো চেষ্টা করে দেখতেই হচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্কের উপর নিজের মোবাইল ফোন আনতে গেল বিজয়। “হয়ত এ ব্যাপারে আমি একটু সাহায্য করতে পারি” বললেন ডা. শুক্লা, “ন্যাশনাল মিউজিয়ামে আমার এক কিউরেটর বন্ধু ছিল। ও হয়ত আমাদের জন্য কিছু করতে পারবে।” বিজয়কে নাম্বার দিয়ে দিলেন।
তারপর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডা. শুক্লার বন্ধুর সাথে কথা বলে আর্কিওলজির কিউরেটরের নাম্বার নিয়ে মিউজিয়ামে গিয়ে পাতটাকে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করে ফেলল বিজয়।
কান থেকে ফোন নামাতেই চোখ ভরে উঠল খুশিতে, “দেখা যাক, আমাদের ধারণা কতটা মেলে। তাছাড়া কিউবের ধাঁধার সমাধান করারও কোনো উপায় নেই। আলেকজান্ডারের মাই বা কিভাবে পেলেন সেটাও জানি না। কিন্তু এলিস যেটা বলল যে প্রাচীন এক রহস্যের প্রতিটা অংশকে জোড়া লাগানোটা সত্যিই আনন্দের হবে। একই সাথে জার্নালের গল্পের নির্ভুলতাও প্রমাণিত হবে।”
“মনে রেখো, তুমি কিন্তু বলেছ যে আমরা কিউবের ধাঁধার মীমাংসা করব “ জোর দিল কলিন, “শেষবার কয়েকটা পদ্যের মর্মোদ্ধার করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের সাথে লড়েছি। আরেকটু হলেই স্বর্গবাসী হতে হতো। এবারের আলোচনাটাও মজার হলেও এখানেই এটাকে শেষ করো। মেটাল প্লেটটাকে দেখব। তখনই জানা যাবে ইউমিনেস জোচ্চুরি করেছে কিনা, তারপর ব্যস সব খতম।”
হেসে ফেলল বিজয়, “শিওর, তোমার সাথে আমিও একমত। এবার আমি আর কোনো জেদ করব না। এই কিউবটার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্কই নেই। তাই এটার সিক্রেট যাই হোক না কেন, সারাজীবন লুকিয়ে থাকলেই ভালো।”
তখন বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না যে ওর কথা কতটা ভুল প্রমাণিত হবে।
.
২৫. শয়তানের নকশা
“ওরা বাইরে যাচ্ছে” রিপোর্ট করল কৃষাণ।
স্ক্রিনে ফুটে উঠা একগাদা বিন্দুর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে কুপার। “ওরা দুর্গের বাইরে যাচ্ছে, গুড।” এটার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। দুর্গের বাইরে গেলেই হতচ্ছাড়াগুলো নাজুক হয়ে পড়বে।
“নজর রাখো আর আমাকে জানাবে সবকিছু।”
এরপর পাশে দাঁড়ানো ছয় ফুট লম্বা, ঢেউ খেলানো সোনালি চুল আর অত্যুজ্জ্বল নীল চোখের পেশিবহুল তরুণের দিকে তাকাল। মাত্র এক বছর আগেই তার কিলার গ্রুপে যোগ দিয়েছে রাইলি; কিন্তু ছেলেটার খুন করার দক্ষতা দেখে কুপার মুগ্ধ, ঠাণ্ডা মাথায় একেবারে সূক্ষ্ম কাজ। কুপারের মত নয়; রাইলি তার ছুরি, দড়ি আর শূন্য হাতদুটোই বেশি পছন্দ করে। “মারার সময় আমার টার্গেটদেরকে ফিল করতে পছন্দ করি; মৃত্যুর সাথে সাথে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া শরীর, শেষ দীর্ঘশ্বাস-ওহ, আমার যে কেমন লাগে না।” অস্ত্রে কেন অভক্তি জিজ্ঞেস করায় একবার কুপারকে বলেছিল রাইলি।
এ কারণে অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে শারীরিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য কসরৎও অর্জন করতে হয়েছে। কেননা একেবারে কাছ থেকে খুন করার সময় ভিকটিমের চেয়ে তোমাকেই বেশি শক্তিশালী হতে হবে। নচেৎ তুমি সফল হবে না।
এই জিনিসটাই রাইলি অত্যন্ত ঘৃণা করে। অথচ মাত্র দু’রাত আগেই গ্রিসে তাকে একই রাতে দুবার অস্ত্র চালাতে হয়েছে। ওর উপর দায়িত্ব ছিল কুপার আর স্ট্যাভরসের খোঁড়া সমাধিটাকে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়া। অথচ হঠাৎ করে যেন কোথা থেকে উদয় হয় সেই মেয়ে অ্যার্কিওলজিস্ট। তেমন বাধ্য হয়ে ওর পালানো ঠেকাতে গুলি ছুঁড়তে হয়। কিন্তু অস্ত্র হিসেবে বন্দুক তেমন পছন্দ না করাতে টার্গেট নিচ্ছিদ্র হয়নি। আবারো হাইওয়ের উপর সেই মেয়েটার সাথে এনকাউন্টারে যেতে হয়। আরো একবার জেদের বশে গুলি ছুঁড়তে হয়। কারণ মেয়েটা ওর ল্যান্ড করা হেলিকপ্টার সরিয়ে চলে গেছে, বেঁচে গেছে শয়তানিটা। আর, দেশ ছেড়ে এখানে এসে লুকিয়েছে। যাক এবারে হাতে পাওয়া গেছে।
“আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা হ্যাঁন্ডেল করতে চাই” রাইলিকে জানাল কুপার। খুঁজে বের করে যে তারা কী জানে। তারপর সবাইকে খতম করতে হবে। যদি ওরা দিল্লির দিকে যায়; তাহলে এক্ষুনি বেরিয়ে ওখানকার দলের সাথে যোগাযোগ করো।”
মাথা নাড়ল রাইলি, এবার সে রাতের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার সুযোগ পাওয়া গেল। বহু হিসাব নিকাশ করা বাকি আছে। “শিওর। কোনো সমস্যাই হবে না। আপনি কি অন্য দুজনকে দেখবেন?” টেক্সাসে অনেক দিন কাটানোয় কণ্ঠস্বরে দক্ষিণি টান।
মাথা নেড়ে কুপার জানাল, “মেয়েটাকে জীবিত ধরে আনতে হবে। ওর ব্যবস্থা করার আকে কতটুকু কী জানে তাও দেখতে হবে।” আরেকটা স্ক্রিনের লাল ফুটকির দিকে ইশারা করে বলল, “তবে তার আগে অন্য টার্গেটকেও দেখতে হবে।” রাইলির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, “তোমাকেই পাঠাতাম তবে এক্ষেত্রে লং ডিসট্যান্স উইপন লাগবে।”
“চিয়ারস” খলবল করে উঠল রাইলি।
স্যুইট থেকে বেরিয়ে এলিভেটরে চড়ে বসল কুপার। সব প্ল্যান মত এগোলে মিশনের এই অংশ আজ রাতেই পূর্ণ হয়ে যাবে। আর যেমনটা সব সময়েই ঘটে কোনো প্রত্যক্ষদর্শীও থাকবে না।
.
২৬. নিউ দিল্লি
সন্ধ্যার ব্যস্ত ট্রাফিকের জন্য রাধা বেশ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। টাইটান ফার্মাসিউটিক্যালসের অফিস থেকে বের হয়ে ইমরানকে কয়েকবার ফোন করার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি। উনি টাইটানের সিইওর সাথে মিটিংয়ে ব্যস্ত ভেবে এরপর বিজয়কে ফোন করেছে।
জার্নালের কথা জানিয়ে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে যাচ্ছে বলে রাধাকে ইনফর্ম করল বিজয়; এও জানাল যে, “তোমার বাবাকে কাজ শেষ হলে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসব।” তাই সোজা বাসায় গিয়ে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল রাধা। সিক্রেট জার্নাল, ধাতব পাত আর আইভরি কিউবের সাথে এর সম্ভাব্য সম্পর্কের কথা শুনে সে নিজেও বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে মিউজিয়ামে কী ঘটে জানার জন্য।
সাউথ দিল্লিতে সাদা দেয়াল ঘেরা একটা বাংলোর গেইটের বাইরে গাড়ি পার্ক করল। এখানেই থাকে পিতা-কন্যা। ঘরে ঢোকার সময় আরেকবার ইমরানকে চেষ্টা করতেই এবারে উনি ফোন ধরলেন।
“সরি” ইমরান জানালেন, “আমার মিটিং শুরুই হয়েছে দেরিতে আর তারপর বারে বারে সিইওর ফোন আসায় শেষ হতেও সময় লেগেছে। আমিও ভাবছিলাম যে এক্ষুনিই তোমাকে ফোন দেবো। মিটিং কেমন হল?”
সাক্সেনার সাথে কী কী কথা হল সব খুলে বলল রাধা।
“হুমমম। তুমি আরেকটু হলেই থলের বিড়াল বের করে দিচ্ছিলে। আমার মনে হয় তাহলে সাক্সেনাকে চোখে চোখে রাখতে হবে। আরো অনেক কিছুই জানা যাবে বোধহয়।” নিজের মিটিং সম্পর্কে এরপর জানিয়ে বললেন, “রিপোর্ট করার মতন বিশেষ কিছু না। সাক্সেনা যা বলেছে প্রায়ই সেই কথাগুলোই শুনেছি। শুধু এর গলাটা বেশ সংযত আর কম হুমকির মনে হয়েছে। আমাকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে রেকর্ডও দেখতে দেবে বলে জানিয়েছে। এ ব্যাপারটা অবশ্য বেশ মজার লেগেছে। যদি গোপন করার কিছু থাকত, তাহলে নিশ্চয় এত সহজে অভ্যন্তরীণ রেকর্ড নিয়ে কথা বলত না। প্যাটারসনকে বলে ইউএসে ওদের বাকি কাগজপত্র চেক করাতে হবে।” কেটে দিলেন ইমরান।
রাধা ভেবে দেখল যে কেল্লায় ফেরার আগে অন্যদেরকে কিছু খাওয়াতে তো হবেই। জোনগড় এখান থেকে অনেক দূর। যেতে যেতে ক্ষিধের চোটেই মরে যাবে সকলে। কিন্তু তাড়াতাড়ি ডিনার বানাবার আগে চট করে একটু গোসল করে নিলে কেমন হয়?
যেই ভাবা সেই কাজ। শাওয়ার সেরে, কাপড় বদলে রান্না শুরু করল রাধা। শেষ করার পর ঘড়ির দিকে তাকাল; রাত সাড়ে আটটা। বাকিরা এখনো বাইরে কী করছে? জাদুঘরে কি সত্যিই আকষর্ণীয় কিছু পেয়ে গেল নাকি? মনে হল একবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে; তারপর আবার ভাবল না থাক; বিজয় যেহেতু ফোন করছে না তার মানে কোনো না কোনো কারণ নিশ্চয়ই আছে।
টিভির সুইচ অন করে তাই একের পর এক চ্যানেল পাল্টাতে লাগল। ওরা ফিরে এলে সবকিছু একসাথে শুনবে।
.
খতম
প্যাটারসনের ফোনটা কেটে দিয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইমরান। টাস্ক ফোর্স লিডারের সাথে তাঁর প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই ঝামেলা লেগে গেছে। সবসময় যুক্তি মেনে চলা, খুঁতখুঁতে স্বভাবের প্যাটারসনের সাথে কাজ করা বেশ দুরূহ ব্যাপার। অন্যদিকে তারকা খ্যাতি নিয়ে আইপিএস ছেড়ে আসা ইমরান। আইবি’তেও বেশির ভাগ সময়ে নিজের মত করেই কাজ করেন। আর তা না। হলে নিয়ম ভঙ্গ করে হলেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল ঠিকই আদায় করে ছাড়েন। যে কোনো ব্যক্তি কিংবা পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার তার ক্ষমতা আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের শক্তি এ পর্যন্ত উপরঅলার সমীহই জাগিয়েছে কেবল। তাই নিজের কাজ আর অনুমানশক্তি নিয়ে কখনো কোথাও কৈফিয়ত দিতে হয়নি।
কিন্তু প্যাটারসন একেবারে আলাদা। সবসময় ফ্যাক্টস চায়। আর টাইটান কড়কড়া প্রমাণ। টাইটান ফার্মার কেউই যে মেডিকেল ফ্যাসিলিটির ঘটনার সাথে জড়িত আছে, ইমরানের সেই ধারণাকেও এক কথায় খারিজ করে দিল।
“আপনার বক্তব্যে তো নজর দেবার মতন বিশেষ কিছুই পেলাম না।” টাইটান সিএমওর সাথে রাধা আর সিইওর সাথে তার নিজের মিটিংয়ের কথা জানাতেই তেতে উঠলো প্যাটারসন। “আমি কার্ট ওয়ালেসের সাথে কথা বলেছি। ভদ্রলোক শুধু যে পুরো সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিয়েছে তা নয় বরঞ্চ ভারত কিংবা ইউএসে তার ম্যানেজমেন্ট টিম থেকে কেউ যে এতে জড়িত নয় তার স্বপক্ষেও জোরালো যুক্তি দেখিয়েছে। এটা তো লোকাল অপারেশন হিসেবেই মনে হচ্ছে না। কোনো গ্লোবাল টেররিস্ট সংস্থার ফান্ডও থাকতে পারে। তাই আমার পরামর্শ হচ্ছে টাইটানকে ধাওয়া বাদ দিয়ে এসবের পেছনকার মাস্টারমাইন্ডকে খুঁজে বের করুন।”
ইমরান একবার ভেবেছিলেন যে হঠাৎ করে এলিসের ভারতে আসা আর কার্ট ওয়ালেসের সাথে তার কানেকশনকে বায়ো-টেররিজমের অ্যাংগেলে দেখার কথা জানাবেন কিনা। তবে প্যাটারসনের অবজ্ঞা পেয়ে সেই ইচ্ছেটাই উঠে গেল। তাছাড়া এলিসের সাথে কথা বলার পর মনে হয়েছে যে নাহ মেয়েটা সত্য কথাই বলছে। গ্রিসে তার অভিজ্ঞতা আর এখানকার ঘটনার মাঝে আসলে কোনো মিল নেই; যদিও ওয়ালেস উভয় ক্ষেত্রেই কমন ফ্যাক্টর।
সেই সাথে মনে পড়ে গেল এলিস স্ট্যাভরস আর পিটারের ছবি দিয়েছে। ছবিগুলো নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ডাটাবেইজ ঘাটাঘাটি করতেই বাজিমাৎ করে দিলেন।
তাড়াতাড়ি বিজয়ের নাম্বারে ফোন করে জানিয়ে দিলেন সবকিছু।
গাড়ি নিয়ে চলে এলেন নিজের বাসায়। চৌকষ গার্ড স্যালুট করতেই ইমরানও উত্তরে হাসলেন। একেবারেই সামান্য বেতন দেয়া এ কনস্টেবলদেরকে কেউ ধন্যবাদ না দিলেও তাদের কাজটা বেশ কঠিন। তিনি নিজে অনেক সিনিয়র পুলিশ অফিসারকে দেখেছেন চলার পথে ওদের দিকে না তাকিয়ে অগ্রাহ্য করতে। তবে ইমরানের ধাঁচ তা নয়। মানুষ হিসেবে অন্তত আরেকজন মানুষের দিকে তাকিয়ে হাসা, কাজের জন্য ধন্যবাদ দেয়াই তো মনুষত্বের পরিচয়।
নিজের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে পৌঁছে তাই ড্রাইভারকেও হাসিমুখে বিদায় দিলেন ইমরান। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে লিফটে চড়ে সিক্সথ ফ্লোরে উঠে এলেন ইমরান। লিফট থেকে নামার সাথে সাথে কেন যেন কাঁপতে লাগল ল্যান্ডিংয়ের সিলিং লাইট। মেইনটেন্যান্সের জন্য কমপ্লেইন করার কথা ভাবতে ভাবতে খুলে ফেললেন ঘরের দরজা।
গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছে লিভিং রুম। লাইট অন করেই জানালার কাছে। এগিয়ে গেলেন। বিরক্ত চোখে দেখলেন রাস্তার ওপারে নির্মাণাধীন টাওয়ারের কুৎসিত দৃশ্য। পাঁচটা ফ্লোর সম্পূর্ণ হয়ে গেল, তার অ্যাপার্টমেন্ট সোজাসুজি ছয় নম্বর ফ্লোরটায় এখনো কাজ চলছে। প্রথম দিকে তেমন আমল না দিলেও এখন প্রায় প্রতিদিনই শ্রমিকদেরকে দেখে।
ব্যাপারটা ডেইলি রুটিনের মত হয়ে গেছে। হাউজকিপার কাজ সেরে পর্দা মেলে দিয়ে চলে যায়। আর ইমরান বাসায় ফিরে টাওয়ারের দৃশ্য ঢাকতে আবার টেনে দেয়।
রুমে ঢোকার সাথে সাথে বিপ বিপ করে উঠল ব্ল্যাকবেরি। বেডরুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ফোনের স্ক্রিন দেখে তো চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগাড়।
এই মাত্র পাওয়া টেক্সট মেসেজটা দেখে রীতিমত চমকে উঠলেন। এমনকি পর্দা টানার কথাও ভুলে গেলেন। তাই সিক্সথ ফ্লোরে ছায়ার মধ্যে উঠে দাঁড়ানো লোকটাকেও দেখতে পেলেন না।
বেডরুম থেকে মাত্র দুকদম দূরে থাকতেই ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল জানালার কাঁচ। হুশহুশ শব্দ করে কিছু একটা উড়ে এলো রুমে।
সহজাত বোধ আর ট্রেনিংয়ের কল্যাণে সাথে সাথে বুঝে গেলেন কী হচ্ছে। অ্যাপার্টমেন্টের দরজা আর তার মাঝখানে পড়েছে খোলা একটা রকেট প্রপেলড বোমা।
বাম দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেডরুমে ঢুকে গেলেন ইমরান। প্রচন্ড শব্দে লিভিং রুমের ফ্লোরে বিস্ফোরিত হল রকেট বোমা। থরথর করে কেঁপে উঠল পুরো অ্যাপার্টমেন্ট।
বেডরুমের দেয়াল বেশিরভাগ ধাক্কা সামলে নিলেও ব্লাস্টের সাথে সাথে মেঝেতে শুয়ে পড়ায় বুকে তীব্র ব্যথা পেলেন ইমরান। মেঝেতেও ছড়িয়ে পড়ল রক্ত।
রক্ত! তার মানে উনি আঘাত পেয়েছেন। কী দিয়ে কিছুই বুঝতে পারছেন না। এ্যাপনেল, ফ্লাইং গ্লাস? যাই হোক না কেন ক্ষতটা গুরুতর। মারাত্মকভাবেই জখম হয়েছে।
চোখের সামনে মুছে গেল সবকিছু।
প্রাণহীন অসাড় হাত থেকে মাত্র তিন ফুট দূরেই পড়ে আছে ব্ল্যাকবেরি ফোন। স্ক্রিনের মেসেজটা এখনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে: “কুপার আজই ইমিগ্রেশন পার হয়ে এসেছে।”
.
২৭. জাদুঘরে কাটানো রাত
ফোন কেটে দিয়ে বাকিদের দিকে তাকাল বিজয়। “ইমরান ফোন করেছিলেন।” এলিসের পাঠানো ছবিগুলো চেক করে দেখেছেন। ম্যাচ পাওয়া গেছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল ডাটাবেজে পিটারও আছে। “দ্য রিপার” নামে ডাকে সবাই। আসল নাম পিটার কুপার আর গত ত্রিশ বছর ধরে অসংখ্য খুন করেছে। স্নাইপার আর টেলিস্কোপিক সাইট লাগানো বন্দুকে পারদর্শী পিটার এ পর্যন্ত একটাও টার্গেট মিস করেনি। একুশটা দেশ ওকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। তোমার খনন কাজের সাথে তাহলে কিভাবে জড়ালো?”
“আমি জানি না” কেঁপে উঠল এলিসের গলা, “সে তো…শুধু…ওখানে। স্ট্যাভরসের সাথে ছিল। দুজনেই এ প্রোগ্রামের কো-ডিরেক্টর। ওয়ালেস ট্রাস্ট ওদেরকে নিয়োগ দিয়েছে। স্ট্যাভস অ্যার্কিওলজিস্ট। আর পিটার ফিনান্সিয়াল ও লিয়াজো কর্মকর্তা। আর্কিওলজিস্ট কিংবা খনন কাজ সম্পর্কে কিছুই জানত না। ওর সম্পর্কে কেবল এটুকুই শুনেছি। আর কোনো প্রশ্নও করিনি। অলিম্পিয়াসের সম্ভাব্য সমাধি নিয়ে এতটাই উত্তেজিত ছিলাম যে অন্য কোনো কিছু ভাবিও নি। আর স্ট্যাভরস সম্পর্কে কিছু বলেন নি?”
মাথা নাড়ল বিজয়। “না। কোনো ডাটাবেজ লিস্টেই নেই। তার মানে অবশ্য এই না যে সে সুবোধ। ইন্টারপোল কিংবা অন্য কোনো এজেন্সিতে নেই এই যা।”
“চিন্তা করোনা।” মেয়েটা ভয় পাচ্ছে বুঝতে পেরে সাহস দিতে চাইল কলিন, “তুমি তো কুপারকে গ্রিসেই ছেড়ে এসেছ। ভারত পর্যন্ত তোমাকে ট্রেস করার কোনো উপায় নেই। তুমি যে এখানে আসবে সেটা সে কিভাবে জানবে? আর যদি জানেও তাহলেও জোনগড় মানচিত্রে এতটা দূরে যে স্থানীয়রাই ঠিকমত চেনে না।”
“কিন্তু আমরা তো এখন জোনগড়ে নেই।” হঠাৎ করেই কেল্লার আরাম আয়েশ আর নিরাপত্তার কথা মনে করল এলিস। বিশেষ করে স্পেশাল সিকিউরিটি সিস্টেম আছে। এখানে ওর কাছে মরতে এসেছি।”
“কলিন যেভাবে বলল কুপার তোমাকে ইন্ডিয়া আর জোনগড়ে ট্রাক করলেও আজই যে দিল্লি এসেছ সেটাই বা কিভাবে জানবে?” হেসে ফেলল বিজয়। “জানি গ্রিসে তোমার সাথে কী কী হয়েছে। তবে সে সবই অতীত। আর ইমরান ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অথরিটিকেও অ্যালার্ট করে দিয়েছেন। কুপারের সত্যিকারের পরিচয় জানার পরপরই ব্যবস্থা নিয়েছেন। যদি কুপার ইন্ডিয়াতে আসেও আমরা ঠিকই জানতে পারব। যদি প্রয়োজন পড়ে ইমরান তোমাকে আইবির সেফ হাউজে নিয়ে যাবেন বলেছেন। সুতরাং তোমার কোনো ভয় নেই। ঠিক আছে? আর আমরা তো সাথে আছি।”
সকলে মিলে মিউজিয়ামে পৌঁছে গেল। ভিজিটরস আওয়ার শেষ হওয়াতে মেইন গেইট লকড। তাড়াতাড়ি কিউরেটরকে ফোন করে দিল বিজয়। ভদ্রলোক ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তাই ফোনের সাথে সাথে গার্ড পাঠিয়ে দিলেন। গাড়ি ভেতরে ঢোকার পর আবার তালা লাগিয়ে দিল গার্ড।
“ওয়াও, দেখো দেখো!” চত্বরের বিশাল মূর্তিটা দেখে অবাক হয়ে গেল কলিন, “বেশ প্রাচীন, তাই না!”
বিজয় গাড়ি পার্ক করতেই সবাই নেমে এলো। গার্ড এসে জানাল যে সে ই তাদেরকে কিউরেটরের কাছে নিয়ে যাবে।
বিল্ডিংয়ের ভেতরের দিকের দেয়ালের সাথে হেলান দেয়া গার্নার থেকে আনা দ্য গ্রেট অশোকের ঈডিক্টের রেপ্লিকা পার হয়ে মূল দালানে ঢুকতে হয়। চারপাশে বেশ খোলামেলা আবহাওয়া।
ফার্স্ট ফ্লোরে কিউরেটরের অফিস। ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক।
“ডা. শুক্লা” এগিয়ে এসে শুক্লার সাথে করমর্দন করলেন। “আমি রাজিব সাহু, আর্কিওলজির কিউরেটর এবং কালেকশন কীপার। আপনি আসাতে সত্যিই বেশ ভাল লাগছে।” এরপর এলিসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আর আপনি নিশ্চয় মিস টার্নার?” হাত মিলিয়ে জানাল, “দেখা হয়ে ভাল লাগল। বলুন আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?”
বিজয়ের দিকে তাকিয়ে ঘোঁৎ করে উঠল কলিন, “তার মানে আমরা বডিগার্ডস?”
দাঁত বের করে অট্টহাসি দিল বিজয়। তারপর সাহুর কাছে দুজনের পরিচয়। দিল।
“ওহ্, হ্যাঁ, আমাদের তো কথা হয়েছে ফোনে।” বিজয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেও কলিনের সাথে কোনো কথা বললেন না।
দ্বিধায় পড়ে গেল এলিস। “মানে…আমি ১৯৮৫ সালে দোশুয়ার কাছে। আবিষ্কৃত পাতটা দেখতে চাই। যেটাকে মনে করা হয় গ্রিসে ফেরার আগে বীজ নদীর তীরে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বেদি নির্মাণ করে সমাধিস্থ করে গেছেন।”
“অবশ্যই, অবশ্যই।” মুখে বললেও একটুও নড়ল না সাহু। “এটা সম্পর্কে আপনার এত আগ্রহ কেন তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। জানেন নিশ্চয়ই পাবলিকের জন্য এটা উন্মুক্ত নয়।”
“আমরা কিন্তু কথা বলেছিলাম মিঃ সাহু” বাধা দিল বিজয়। “ডা. দত্তই বলেছেন আপনাকে জানাতে। তখন তো আপনি রাজি হয়েছিলেন।”
“আমি কেবল ভিজিটরস আওয়ারের শেষে মিউজিয়ামে ঢুকতে দিতে রাজি হয়েছি।” এখনো নজর শুধু এলিসের উপর, “যেটা আসলে সরকারের নিয়ম বিরুদ্ধ। কিন্তু আমি মানা করিনি। আমি শুধু মিস টার্নারের আগ্রহটাই জানতে চাইছি। উনি পাবলিক ডিসপ্লের বাইরে থাকা একটা আর্টিফ্যাক্ট দেখতে চাইছেন। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, যে কেউ এসে নিজেকে অ্যার্কিওলজিস্ট দাবি করার সাথে সাথে আমি অনুমতি দিতে পারি না। এমনকি ডা, দত্ত পাঠালেও আমার কিছু করার নেই।”
আগ্রহ নিয়ে আবারো এলিসের দিকে তাকালেন, কিউরেটর।
“আমি একজন অ্যার্কিওলজিস্ট।” খানিকটা উত্তপ্ত হয়েই জানালো এলিস, “এ ব্যাপারে আপনি সন্দেহ করছেন? ইন্টারনেটে আমাকে সার্চ দিন। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাস আমার পছন্দের বিষয়। বিশেষ করে হেলেনিস্টিক পিরিয়ড। শুনেছি যে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সাথে জড়িত একটা নিদর্শন আছে আপনার কাছে; তাই দেখতে এসেছি।”
“আপনার সাথে নিশ্চয় কোনো আইডেন্টিফিকেশন আছে?” এলিসের কথা যেন শুনতেই পাননি এমনভাবে বললেন কিউরেটর, “যেমন ধরুন আইডি কার্ড? আপনার স্বপক্ষে প্রমাণ দেয় এমন কিছু?”
রাগে লাল হয়ে গেল এলিসের গাল। তারপরেও ব্যাগ হাতড়ে গ্রিসে জয়েন্ট মিশনের আইডি কার্ড বের করে সাহুর হাতে দিল। খানিকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে আবার এলিসকে ফিরিয়ে দিলেন কিউরেটর।
“এবারে আপনি ধাতব প্লেটটা দেখতে পারেন।” পকেট থেকে সিংগল একটা চাবি বের করে জানালেন, “চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি। সেকেন্ড ফ্লোরে স্টোর করে রাখা হয়েছে।” অন্যদের দিকে তাকিয়ে খানিকটা অসন্তুষ্টের ভঙ্গিতে জানালেন, “সবাই কী আপনার সাথেই যাবে?”
“হ্যাঁ।” দৃঢ় স্বরে উত্তর দিল এলিস, “থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”
“ফলো মি” আদেশ দিয়েই হাঁটতে শুরু করলেন কিউরেটর। সিঁড়ি বেয়ে পার হলেন আর্মস অ্যান্ড আর্মার গ্যালারি। এ কক্ষের সর্বত্র কাঁচের কেসে থরে থরে সাজানো
তলোয়ার, বর্শা আর সব ধরনের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় অস্ত্র। গ্যালারির শেষ মাথায় প্রাইভেট লেখা একটা দরজা। তালা খুললেন সাহু।
সবার মনের মাঝে একটাই চিন্তা; না জানি কী দেখতে পাবে!
.
২৮. এক নতুন রহস্য
রুমটা পুরোপুরি অন্ধকার। মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট ব্যবহার করে লাইটের সুইচ অন করল বিজয়। সিলিংয়ের বা চিরে দিল আঁধার। বিস্ময়ে মুখে হাত চাপা দিল এলিস।
সারি সারি তাক ভর্তি বিভিন্ন ধরন আর গড়নের ট্যাবলেট। এমন সব ভাষায় লেখা যার একটাও চেনে না। বুঝতে পারল এ কক্ষ ইতিহাসের এক গুপ্ত ভান্ডার।
ডা. শুক্লারও প্রায় একই অবস্থা। এমনভাবে চারপাশে তাকাচ্ছে যেন তিনি একটা ছোট্ট বাচ্চা; যাকে খেলনার দোকানে ছেড়ে দেয়া হয়েছে আর কোন খেলনাটা নেবে সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছে ছোট্ট মানুষটা।
“আমরা যে পাতটা খুঁজছি সেটা কোনটা?” উঁচু গলায় বলে উঠল বিজয়।
“এটা।” কালো রঙের ছোট গোলাকার একটা প্লেট নিয়ে বাকিদেরকে দেখালেন ডা. শুক্লা। ট্যাবলেটের একপাশে খোদাই করা ছয়টা চিহ্নও দেখা যাচ্ছে।
সবাই হা করে তাকিয়ে রইল ট্যাবলেটের দিকে। ছয়টা চিহ্নের কোন অর্থই বুঝতে পারছে না।
ঘড়ির দিকে তাকাবার ভান করলেন সাহু। “আমি আপনাদেরকে পনের মিনিটের বেশি দিতে পারব না। প্লিজ শেষ করে তালা লাগিয়ে যাবেন। আমি অফিসেই থাকব।” আর একটাও কথা না বলে গটগট করে হেঁটে সিঁড়ির কাছে চলে গেলেন কিউরেটর।
এখনো সবাই একদৃষ্টে সিলগুলোই দেখছে।
“তো?” স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে এলিস জানতে চাইল, “কোনো ধারণা?”
মাথা নাড়লেন ডা. শুক্লা। “কিউবের সাথে কানেকশন আছে এমন কিছুই তো দেখছি না। বোধহয় আমার অনুমান ভুল হয়েছে।” বিব্রত ভঙ্গিতে হেসে ফেললেন, “যাই হোক আশা করা খারাপ না। তবে সত্যি হলে ব্যাপারটা বেশি ভালো হত।”
“আমিও কিছু দেখতে পাচ্ছি না। এই ট্যাবলেটটার আসলে কোনো মানে নেই।” একমত হল বিজয়।
“ওকে, তাহলে চলো বেরিয়ে যাই। রাধার রান্না খেতে হবে তো।” সাগ্রহে হাত ঘষল কলিন।
“দাঁড়াও, কয়েকটা ছবি তুলে নেই।” মোবাইল ফোন বের করে দ্রুত কয়েকটা ছবি তুলে নিল বিজয়।
এরপর রুমে তালা দিয়ে গ্যালারি পার হয়ে এলো। আধো অন্ধকারেও সাজিয়ে রাখা অস্ত্রগুলো দেখতে বেশ ভয়ংকর লাগছে। যুদ্ধের সময় না জানি কতটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করত এগুলো।
করিড়োর ধরে সিঁড়ির দিকে যেতেই হঠাৎ করে কানে এল কারো আর্তচিৎকার। ঠিক কিউরেটরের অফিস থেকেই এসেছে শব্দটা। কেউ একজন প্রচন্ড ব্যথায় কাতড়াচ্ছে। তীব্র আক্রোশ নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে আরেকজন।
.
সমস্যার পর সমস্যা
অফিসের দিকে হাঁটতে গিয়েও সাহুর মনটা কেন যেন খচখচ করে উঠল। আজ সময়মত চলে যাবার কথা থাকলেও দত্তের অপ্রত্যাশিত ফোনটা সব ভন্ডুল করে দিল। দত্তের অনুরোধ উপেক্ষাও করতে পারলেন না। বিশেষ করে বারবার জানিয়েছেন যে খুব বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু একজন আমেরিকান অ্যার্কিওলজিস্ট প্রায় তিন দশক আগে আবিষ্কত একটা অখ্যাত ধাতব পাত নিয়ে কেন এত আগ্রহ দেখাচ্ছে সেটাই তো মাথায় আসছে না। আলেকজান্ডারের বেদিগুলো আবিষ্কার হওয়ার পর সেসময়ে বেশ শোরগোল হলেও আদৌ এগুলো সেই বিখ্যাত স্থাপনা কিনা তা কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। দ্রুত আবার ব্যাপারটা সবাই ভুলে গেছে। আর আলেকজান্ডারের বেদিগুলোও এখন পর্যন্ত বলতে গেলে অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। মিডিয়াও এ গল্পে আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় তখন থেকেই উপর তলায় নির্জীবের মতন পড়ে আছে বেচারা ধাতব প্লেট। মেয়েটা যে কিভাবে এটা জানল সেটা সম্পর্কেও উনার কোনো আইডিয়া নেই। শুধু দত্ত সাহেব ফোন করে জানালেন যে ওর পুরনো বন্ধু ডা. শুক্লা আসতে চায়।
নিজের অফিসে ঢুকেই আবার থেমে গেলেন সাহু। রুমে অজানা দুজন লোক। তবে যদি মেঝেতে গলা কাটা অবস্থায় রক্তের মধ্যে ডুবে থাকা মৃত গার্ডকে হিসাবে ধরেন তাহলে থ্রি।
সাহুর চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে সোনালি চুলের লম্বা এক তরুণ সাহুরই টিবক্স থেকে টিস্যু নিয়ে মুছছে বিশাল আর কুৎসিত দর্শন বোয়ি ছোরা। অন্যজন পিস্তল হাতে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সাহু খেয়াল করে দেখলেন যে গানম্যানের চোখ, মাথা, নাক, হাত মুখোশে ঢাকা থাকলেও বোঝা যাচ্ছে যে সে ককেশীয়।
সাথে সাথে দৌড়ানোর জন্য ঘুরলেও পালাতে পারলেন না সাহু। সাৎ করে দরজার সামনে চলে এলো গানম্যান। ফাঁদে আটকা পড়ে গেছেন।
কোমরে বাঁধা খাপের ভেতর ছুরি ঢুকিয়ে মোবাইল ফোনের দিকে তাকাল রাইলি, “রাজিব সাহু, কিউরেটর অব অ্যার্কিওলজিস্ট” ফোন দেখে লাইনগুলো পড়ে আবার রেখে দিয়ে জানাল, “তোমার ভিজিটররা কোথায়?”
একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সাহু। এতটাই অবাক হয়ে গেছেন যে কথা বলাও ভুলে গেলেন। কে এই লোক? মিউজিয়ামে ঢুকে গার্ডকে খুন করে এখন। আবার ট্যাবলেট রুমে রেখে আসা লোকগুলোর কথা জানতে চাইছে।
অবশেষে গলায় স্বর ফুটিয়ে কোনো মতে বললেন, “উপর তলাতে তোতলাতে তোতলাতে বুড়ো আঙুল দিয়ে দেখালেন সেকেন্ড ফ্লোর।
মাথা নাড়ল রাইলি, “একটু বসা যাক, ঠিক আছে?” তোমার ভিজিটরদের খবর নেয়ার আগে তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।”
কৃষাণ চারজন টার্গেটের গুড়গাঁও হয়ে দিল্লি আসার রিপোর্ট করার পরে হোটেল থেকে বেরিয়ে দিল্লির দলের সাথে দেখা করেছে রাইলি। এরপর ন্যাশনাল মিউজিয়ামের কথা শুনে বুঝতে পারল টার্গেট দল এমনি এমনিই এখানে বেড়াতে আসেনি। নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে। কুপারকে ফোন করতেই, টার্গেটদের পিছু নিয়ে খুন করার আগে সম্ভব হলে মিউজিয়ামে আসার উদ্দেশ্যও জেনে নিতে বললো।
আর এ কাজের জন্য কিউরেটরের চেয়ে যোগ্যতর আর কেউ নেই।
“তো” সাহু নিজের ডেস্কে বসতেই রাইলি বলল, “তোমার ভিজিটররা কী দেখতে চেয়েছে বলো।”
চোখ বড় বড় করে রাইলিকে দেখছেন সাহু; শরীরের প্রতিটি রোমকূপ থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে আতঙ্ক। কিউরেটরের অবস্থা দেখে হেসে ফেলল রাইলি। ভয়ে লোকটার দিশেহারা অবস্থা। আর খতম করার আগে টার্গেটের এরকম গন্ধটাই রাইলির পছন্দ। অন্য কোনো আবেগীয় সম্পর্কই তাকে এতটা আনন্দ দিতে পারে না।
“তাদের একজন আর্কিওলজিস্ট” বিড়বিড় করে জানালেন সাহু।
“আমেরিকান মেয়েটা। এটা আমি আগে থেকেই জানি।” কঠোর হয়ে উঠল রাইলির গলা। ক্রমেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। “যা জানি না এরকম কিছু বলল। ওরা কেন এসেছে?”
গানম্যানকে ইশারা করতেই সাহুর পাশে চলে এলো। কব্জি ধরে ডেস্কের উপর হাত নিয়ে তালু চেপে ধরতেই আঙুলগুলো ছড়িয়ে পড়ল। খাপ থেকে ছুরি বের করে কিউরেটরের হাতের উপর ঘোরাতে লাগল রাইলি। অবশেষে একটা জায়গা পছন্দ করে এক ফালি মাংস কেটে দিতেই ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত।
সাহুর আর্তচিৎকার পৌঁছে গেল খালি করিডোর বেয়ে মিউজিয়ামের গ্যালারি অব্দি। সহ্যের অতীত সেই যন্ত্রণা। আরেকটা জায়গা বেছে নিয়ে আরেকটু মাংস কেটে ফেলল রাইলি।
কিউরেটরের গলা ভেঙে গেল চিৎকারের চোটে। “এবার, আরেকবার বলছি” নিচু কিন্তু ভয়ংকর স্বরে জানতে চাইল রাইলি, “অ্যার্কিওলজিস্ট তোমার কাছে কী চেয়েছে? সে কেন এসেছে এই মিউজিয়োমে?”
.
২৯. কী ঘটেছে বুঝে ফেলা
“এটা তো সাহুর গলা!” বলে উঠল বিজয়। “তোমরা তালা লাগাও ততক্ষণে আমি দেখে আসি কী হয়েছে।”
লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি পার হয়ে করিডোর ধরে সাহুর অফিসের দিকে দৌড় দিল বিজয়। কিন্তু অফিসের কাছাকাছি যেতেই কিউরেটরের আর্তনাদ ছাপিয়ে শোনা গেল নিচু স্বরের ভয়ংকর সব শব্দ, “এবার, আরেকবার বলছি, অ্যার্কিওলজিস্ট তোমার কাছে কী চেয়েছে? সে কেন এসেছে এই মিউজিয়ামে?”
মাঝ পথেই থেমে গেল বিজয়। ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হবার জোগাড়। কেউ নিশ্চয় এলিসের কথা জানতে চাইছে। তার মানে এলিস যে এই মিউজিয়ামে এসেছে তাও জানে লোকটা। কুপার নাকি? সেটাই বা কিভাবে সম্ভব? ইমরানকে
জানিয়ে কুপারের তো ইমিগ্রেশনের চৌহদ্দি পেরোবারই কথা না।
মনের মাঝে টিকটিক করে উঠল দুঃশ্চিন্তার কাঁটা। অন্যদেরকে সাবধান করতে হবে।
.
সত্য উদঘাটন
বাইরের করিডোরে কারো দৌড়ানোর শব্দ শুনেই গানম্যানকে ইশারা করল রাইলি। ছুটে বের হয়ে গেল লোকটা। আবার কিউরেটরের দিকে মনোযোগ দিল রাইলি।
“আয়্যাম ওয়েটিং।” খালি হাত দিয়ে ধরে রেখেছে কিউরেটরের অক্ষত হাত। যেকোনো মুহূর্তেই ছুরি চালানোর জন্য প্রস্তুত। রক্তে ভেসে গেছে পুরো ডেস্ক।
“দ্য মেটাল প্লেট” কান্না মেশানো কণ্ঠে বিড়বিড় করে উঠলেন সাহু; প্রাণপণে চেষ্টা করছেন লোকটার হাত থেকে ভালো হাতটাকে ছাড়াতে। “আলেকজান্ডারের বেদির ফাউন্ডেশনের নিচে যেটা পাওয়া গিয়েছিল!”
খবরটা যেন রাইলির কানের মধ্যে হুল ফোঁটালো। অপছন্দের বলে ইতিহাস আর আর্কিওলজিস্ট সম্পর্কে তেমন কিছু না জানলেও, এটা জানে যে এই মিশন গ্রিক ইতিহাসের সাথে জড়িত। আর গ্রিসে তো সমাধিটা নিজের চোখেই দেখেছে। উড়িয়ে দেয়ার সময় ডিগিং হাটের ক্যাম্পে আর্টিফ্যাক্টগুলোও দেখেছে। তার মানে হচ্ছে যে এই ধাতব পাতটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
“গার্ড নয়। করিডোরে তেমন আলো না থাকায় চেহারাও ভালো করে দেখিনি।” কিউরেটর অফিস থেকে বাইরে গিয়ে রিপোর্ট করল গানম্যান। “উপরের দিকে উঠে গেছে। তাহলে টার্গেট গ্রুপই হবে। আমি অন্যদেরকে ডেকে পিছু নিচ্ছি।” রাইলির ইয়ারপিসে জানিয়ে দিল লোকটা।
“ঠিক আছে।” আবার কিউরেটরের দিকে তাকাল রাইলি, “ওরা এখন কোথায়? মেটাল প্লেটটা কোথায়?”
এতক্ষণে সাহুর সমস্ত শক্তি শেষ। রাইলিকে তাই গড়গড় করে সবকিছুই বলে দিলেন।
“সেকেন্ড ফ্লোর। আর্মস অ্যান্ড আর্মার রুম” নিজের লোকদেরকে আদেশ দিল রাইলি। “খেদিয়ে সোজা একজায়গায় জড়ো করবে। আমি মিনিটখানেকের ভেতরে উপরে আসছি। দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার আগে কথা বলতে চাই।”
.
ডিফেন্স
একেকবারে দুটো করে সিঁড়ি পার হয়ে উপরে উঠে এলো বিজয়। অন্যরা ততক্ষণে অর্ধেক নেমে এসেছে। “ব্যাক-আপ!” হাঁপাতে হাঁপাতে কোনো মতে জানাল, “আমাদেরকে আবার উপরে যেতে হবে। এরপর এলিসের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওরা জেনে গেছে যে তুমি এখানে।”
অন্য কোনো প্রশ্ন করারও সময় নেই। বিজয়েরর কণ্ঠস্বরের মরিয়াভাবেই সবাই যা বোঝার বুঝে নিয়ে আবার উপরে উঠে গেল।
এই ফাঁকে প্ল্যান করে ফেলল বিজয়। সেকেন্ড ফ্লোরের গ্যালারিতে ঢুকতেই সবাইকে দ্রুত বুঝিয়ে বলে দিল যে কী করতে হবে। “জানি না ওরা কতজন এসেছে।” ফিসফিসিয়ে জানাল, “এটাও জানি না যে নিচে নামার আর অন্য কোনো পথ আছে কিনা। মেইন সিঁড়ি দিয়ে তো নামাই যাবে না, ওরা পিছু নেবে। আর লোকগুলো যে সশস্ত্র তা তো বলাই বাহুল্য। তাই আমাদেরকে এটাই করতে হবে। ডিসপ্লে থেকে যার যেটা খুশি অস্ত্র তুলে নাও। নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য কিছু তো করতে হবে।”
“বেটা, ওদের সাথে কি আমরা পারব?” মোলায়েম স্বরে জানালেন ডা. শুক্লা, “ওদের হাতে পিস্তল আছে। এর বিরুদ্ধে তরবারি আর বর্শা কোনো কাজেই আসবে না।”
হাতে অস্ত্র নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকে মাথা নাড়ল বিজয়। “বলছি না যে আমরা লড়ব। অস্ত্রগুলো কেবল সতর্কতাস্বরূপ এনেছি। জানি ওদের সাথে লড়তে যাওয়া কেবল বোকামিই হবে। তবে কিছু একটা অন্তত সাথে রাখা ভালো। এখন কী করতে হবে বলছি। এটাই একমাত্র সুযোগ।” প্ল্যানটা খুলে বলতেই অন্যরা সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়ল।
করিডোরে লাইন করে রাখা মূর্তিগুলো থেকে ছোট্ট একটা পাথরের ভাস্কর্য তুলে নিল বিজয় আর কলিন। এটা দিয়েই বাড়ি মেরে কাঁচ ভেঙে ডিসপ্লে করা অস্ত্রগুলো থেকে যার যার পছন্দ মত তুলে নিল।
১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে তৈরি নাদির শাহের ব্যবহৃত খোদাইকৃত যুদ্ধ কুঠার তুলে নিলেন ডা. শুক্লা। চওড়া মাত্র ৫২ সেন্টিমিটার। তাছাড়া ওজনও খুব বেশি নয়। তাই ওনার পক্ষে হাতে নিতে কোনো সমস্যাই হল না।
কলিন পছন্দ করল টিপু সুলতানের তরবারি। আর বিজয় তুলে নিল আঠারো’শ শতকে কাশ্মির থেকে আসা গদা।
“নিজের মতই সবচেয়ে বড় আর ভারী অস্ত্রটা নিয়ে নিলে”, বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসি দিল কলিন। এরকম কঠিন পরিস্থিতিতেও ওর ঠাট্টার কারণে হালকা হয়ে গেল পরিবেশ, “কিন্তু যখন প্রয়োজন হবে মাথার উপর নিয়ে ঘোরাতে পারবে তো?”
“আশা করো যেন তার দরকারই না হয়”, ধীর স্থিরভাবে উত্তর দিল বিজয়, “এলিস তুমি কী নেবে?”।
ভীত চোখে চারপাশে তাকাচ্ছে মেয়েটা; জানে হাতে সময় বেশি নেই। কোনটা যে হাতে নেবে সেটাও বুঝতে পারছে না। গ্রিসের কথা মনে পড়তেই আতঙ্কে হাত-পা অবশ হবার যোগাড়। ওর অবস্থা দেখে এগিয়ে এল বিজয়। তুলে নিল ষোড়শ শতকে রাজপুত কাঠ আর আইভরি দিয়ে তৈরি একটা বর্শা। ৩৮.৫ সেন্টিমিটার হওয়াতে বহন করতেও সুবিধা হবে। এলিসও মনে মনে আশা করল যেন ব্যবহার করতে না হয় এ বর্শা।
বিজয়ের প্ল্যান মোতাবেক সবাই যার যার অস্ত্র হাতে পজিশন নিয়ে নিল। এ অবস্থাতে হাতে খুব বেশি অপশন না থাকলেও এটুকুই আশা যে প্ল্যানটা কাজ করবে।
.
৩০. সব ঠিকঠাক মত হবে তো?
সেকেন্ড ফ্লোরে যাবার সিঁড়ির নিচে এসে একসাথে জড়ো হল তিনজন গানম্যান। গ্রাউন্ড ফ্লোরে মিউজিয়ামের মেইন লবির দুটো করিডোরে গার্ড দিচ্ছে দুজন; যেন কেউই ভেতরে কিংবা বাইরে যেতে না পারে।
কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ হতেই ঝট করে সবাই উপরের দিকে তাকাল।
প্রথম গানম্যান সিঁড়ির দিকে ইশারা করতেই নিঃশব্দে উঠে গেল তিনজন।
কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই আবার নিশ্চুপ হয়ে গেল সেকেন্ড ফ্লোর। চারপাশে ঝাপসা আলো। করিডোরে বাতি নেভানো থাকলেও গ্যালারি থেকে খানিকটা আলো আসছে।
আশেপাশে তাকিয়ে মিউজিয়ামের সাইন খুঁজলো; যেন আর্মস আর আমার গ্যালারিটা চেনা সহজ হয়। এরপরই সিঁড়ির কাছে দেয়ালের গায়ে লাগানো ফ্লোর প্ল্যান দেখে ইশারা করল তিনজনের একজন। মাথা নেড়ে ফ্ল্যাশলাইট তুলে নিল প্রথম গানম্যান। আর কোনো উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়েই টার্গেটদের চোখে পড়ার রিস্কটা নিতে হল। তবে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেছে, যাদের সাথে লড়তে এসেছে তারা বেশ স্মার্ট। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে।
ম্যাপে দেখা গ্যালারি খুঁজে বের করে বাকি দুজনকে ইশারা দিল। হঠাৎ করেই কী মনে হতে সশস্ত্র হবারও সিগন্যাল দিল। কিছুই বলা যায় না; যে কোনো কিছুই ঘটতে পারে। যদিও রাইলি বলেছে এরা নাকি সব সাধারণ মানুষ। অথচ এমন অনেকের কথা শুনেছে যারা শত্রুকে তুচ্ছ জ্ঞান করায় প্রাণ পর্যন্ত হারিয়েছে। নিজেও সেই দলে ভেড়ার কোনো ইচ্ছেই নেই তার।
যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে গ্যালারির প্রবেশ দ্বার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। খোলা দরজার ওপাশে নিকষ কালো রাত।
করিডোরের সুইচ খোঁজার জন্য ইশারা দিল প্রথম গানম্যান। তিনজন মিলে ছড়িয়ে দেয়াল ধরে খোঁজা শুরু করল।
“পেয়ে গেছি”, গলার সাথে লাগানো মাইক্রোফোন সামান্য কম্পন থেকেই বুঝতে পারে; তাই নিশ্চুপ মিউজিয়ামে তার ফিসফিসানি একটুও শোনা গেল না।
সুইচ টিপতেই আলোয় ভেসে গেল পুরো করিডোের। খানিকক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে গেল তিনজন।
স্কি-মাস্কের নিচে কঠোর হয়ে গেল লিড গানম্যানের চেহারা। করিডোরের আলো অন্ধকার গ্যালারিতে পৌঁছালেও এরকম উজ্জ্বল আলো থেকে নিকষ কালো গ্যালারিতে ঢোকাটা তাদের জন্য সুখকর হবে না। কিন্তু তারা নিরুপায়।
তাই আস্তে আস্তে আগে বাড়লো তিনজন।
.
কুকুর-বিড়াল খেলা
বাইরের বাতি জ্বলতে দেখেই শক্ত হয়ে গেল বিজয়। ভেবেছিল বুঝি ভেতরে এত অন্ধকার দেখে গানম্যানেরা ঢুকবে না। তার মানে যতক্ষণ সুইচ খুঁজবে সে সময়ের ভেতরেই যা করার করতে হবে।
নিঃশব্দে দরজার কাছে এসে পড়ল একটা ছায়া। একেবারে ট্রেইনড় কিলারস, মনে মনে ভাবল বিজয়। এদের দক্ষতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
একের পর এক এসে পড়ল তিনটা ছায়া। পরস্পরের সাথে একেবারে মিশে গেল; তবে তাদের মালিকদেরকে এখনো চোখে পড়ছে না।
এবার কী তাহলে? অন্যদের কী অবস্থা তা চেক করার কোনো উপায় নেই। কেবল সেকেন্ড গোনা ছাড়া! আশা করছে যেভাবে প্ল্যান করেছে সব সেভাবেই এগোবে।
.
প্রায় কাছে…
ইয়ারপিসে গানম্যানের কণ্ঠস্বর শুনে মাথা নাড়ল রাইলি। সাহুর পায়ে জোর একটা লাথি দিয়ে বলল, “আমার সাথে চললা; উপরে কাজ আছে।”
রক্তাক্ত কিউরেটরকে প্রায় টেনে-হিঁচড়ে সিঁড়ি দিয়ে তুলে চেষ্টা করল গ্যালারিতে যেতে। যেন পালানোর আগেই টার্গেটদের ঘাড় চেপে ধরা যায়।
.
ভণ্ডুল হয়ে গেল সবকিছু!
দেয়ালের গায়ে পড়া ছায়াদের দেখে তিক্ত হয়ে গেল বিজয়ের চেহারা। এতক্ষণে প্ল্যান মোতাবেক তার দলের সবাই বাইরে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু গানম্যানদেরকেও যে বাইরে বেরোতে দেখা যাবে সেটা তার মাথায় ছিল না। বাইরে কিংবা সিঁড়িতে আরো কেউ আছে কিনা সেটাও জানে না। কিন্তু এটাই একমাত্র সুযোগ।
১২৮
অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। কিন্তু দরজায় তো আর কোনো ছায়া পড়ছে না। আরেকটা ব্যাপার হল তার দলের দুজন বের হয়ে গেলেও গানম্যান কিন্তু পিছু নেয়নি। কোথাও কোনো গন্ডগোল হচ্ছে। আর তখনই জ্বলে উঠল গ্যালারির লাইট। উজ্জ্বল আলোতে চোখ পিটপিট করল বিজয়। না জানি কী হচ্ছে বাইরে।