০৩. ফ্রেডরিক হয়েলের বোয়িং ৭৪৭ ফ্যালাসি
সরল, সাধারণ জ্ঞান দিয়ে বিচার করি বলে ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই। কোনো ঈশ্বরেই।
–চার্লি চ্যাপলিন
ছবি। পেজ ১৩০
চিত্র : ফ্রেডরিক হয়েল (১৯১৫-২০০১)
ফ্রেডরিক হয়েল (১৯১৫-২০০১) ছিলেন বিগত শতকের এক নামকরা জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী। আজকে যে আমরা মহাবিস্ফোরণ বা বিগব্যাং তত্বের কথা শুনি, সেই ‘বিগব্যাং’ শব্দটি তার কাছ থেকেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের একটা রেডিও প্রোগ্রামে, যদিও বিগব্যাং শব্দটি তিনি তখন উচ্চারণ করেছিলেন অনেকটাই সমালোচনা আর শ্লেষের সুরে। শ্লেষ থাকার কারণ, সেসময় বিগব্যাং-এর সাথে সমানে পাল্লা দিচ্ছিল। হয়েলেরই নিজস্ব একটি তত্ব; যাকে বিজ্ঞানীরা ডাকতেন স্থিতিশীল অবস্থা তত্ব (Steady State Theory) নামে। ১৯৬৪ সালে আর্নো পেনজ্যিাস এবং রবার্ট উইলসন মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিকিরণ[১০০] খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত কিন্তু পৃথিবীর বহু নামকরা পদার্থবিজ্ঞানীই স্থিতিশীল অবস্থা তত্ত্বের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। ফ্রেডরিক হয়েল ছিলেন সেই স্থিতিশীল তত্ত্বের মূল প্রবক্তা, যদিও তার এই বিখ্যাত তত্বের সাথে জড়িত ছিলেন আরও কয়েকজন নামকরা পদার্থবিদ-হারমান বন্দি, থমাস গোল্ড এবং পরবর্তীকালে এক ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকর। স্থিতিশীল তত্ব ছাড়াও স্টেলার নিউক্লিওসিন্থেসিসসহ জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক কিছুতেই ফ্রেডরিক হয়েলের অবদান ছিল। জীবনের শেষ বয়সে তিনি তার ছেলের সাথে মিলে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখায়ও হাত দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানে তার সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি ‘স্যার’ উপাধি পেয়েছিলেন, পুরস্কার পেয়েছিলেন রয়েল এস্ট্রোনোমিকাল সোসাইটি থেকেও, এছাড়া আরও অন্যান্য ছোটখাটো পুরস্কার তো আছেই। কাজেই ফ্রেডরিক হয়েলের সুনাম কম ছিল না তার সময়ে।
ছবি। পেজ ১৩১
চিত্র : আর্কিওপটেরিক্স (১৪৭৭) : বার্লিন স্পেসিমেন
কিন্তু বড় বিজ্ঞানী হলে কী হবে তিনি বিভিন্ন জায়গায় নিজের মতামত দিতে পছন্দ করতেন। এমনি একটা ঘটনা ঘটেছিল যখন বিজ্ঞানীরা বিগত শতকের মাঝামাঝি সময়ে বেশ ক’টি ডায়নোসর এবং পাখির মধ্যবর্তী জীবাশ্ম আর্কিওপটেরিক্সের ফসিল খুঁজে পাচ্ছিলেন। হয়েল হঠাৎ করেই বলে বসলেন আর্কিওপটেরিক্সের ফসিলগুলো নাকি সব জালিয়াতি। অথচ, আর্কিওপটেরিক্স কিন্তু বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন কিছু ছিল না সেসময়। আর্কিওপটেরিক্সের প্রথম পালকের ফসিল খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বহু আগেই-সেই ১৮৬০ সালে। এমনকি ডারউইন তার অরিজিন অব স্পিশিজ গ্রন্থের চতুর্থ সংস্করণে আর্কিওপটেরিক্সের উল্লেখও করেছিলেন। ডারউইনের সমসাময়িক বিজ্ঞানী টিএইচ হাক্সলি তখনই মন্তব্য করেছিলেন যে, হাবভাবে মনে হচ্ছে আধুনিক পাখিগুলো সব থেরোপড ডাইনোসর থেকেই এসেছে; আর আর্কিওপটেরিক্সের মতো ফসিলগুলো এই যুক্তির পেছনে জোরালো প্রমাণ হিসেবে হাজির হয়েছে[১০১]। তারপর ১৮৬১ সালের দিকে জার্মানির ল্যাংগেনালথিমে[১০২] পাওয়া গেল আর্কিওপটেরিক্সের পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল। একই পরিক্রমায় ১৮৭৭ সালে ক্লমেনবার্গে[১০৩], ১৮৫৫ সালে রিডিনবার্গে, ১৯৫৪ সালে ল্যাংগেনালথিমে[১০৪], ১৯৫১ সালে ওয়ার্কারসজেলে, ১৯৬০ সালে জার্মানির ইৎসচাটে, ১৯৯১ সালে ল্যাংগেনালথিমে, ২০০৫ এবং ২০০৬ এ জার্মানিতে আর্কিওপটেরিক্সের বিভিন্ন ফসিল উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আর জীববিজ্ঞানীরা কষ্ট করে ফসিল পেলে কী হবে, বিজ্ঞানী হয়েল তার সহকর্মী গণিতবিদ চন্দ্র বিক্রমসিংহের সাথে মিলে হঠাৎ করেই ১৯৮৫ সালে তুমুল শোরগোল শুরু করলেন এই বলে যে, আর্কিওপটেরিক্সের ফসিলগুলো সব নাকি বানোয়াটা তাঁরা বললেন, ফসিলগুলো নাকি এত চমৎকারভাবে সংরক্ষিত থাকার কথা না, মধ্যবর্তী স্তরে নিশ্চয় আধুনিক পাখির পালক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, ইত্যাদি। ব্রিটিশ ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘরের বিজ্ঞানীরা হয়েলের প্রতিটি সন্দেহ
পরীক্ষা করে দেখলেন, এবং তাঁদের পরীক্ষায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো ফসিলগুলো আর্কিওপটেরিক্সেরই। এমনি একটি পরীক্ষায় অ্যালেন চ্যারিগসহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা স্ল্যাবের কিনারাগুলোর মাপ নিয়ে দেখালেন আর্কিওপটেরিক্সের দুটি পাললিক শিলাস্তরের স্ল্যাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে একে অপরের স্তরে খাপ থেমে যায়, ফলে মধ্যবর্তী স্তরে আধুনিক পাখির পালক থাকার ব্যাপার এখানে নেই। তাদের সম্পূর্ণ পরীক্ষার ফলাফল সায়েন্স জার্নালের ১৯৪৬ সালের ২৩২ সংখ্যায় ‘আর্কিওপটেরিক্স কোনো জোচ্চুরি নয়’ শিরোনামে প্রকাশিত হ্যাঁ[১০৫] হয়েল যখন ফসিলের সত্যতা নিয়ে শোরগোল করছিলেন, ঠিক সেসময়ই জার্মানির সোলনহফেনে ১৯৮৭ সালে আরেকটি আর্কিওপটেরিক্সের ফসিল পাওয়া যায়, আর বিজ্ঞানীরা সবাই মিলে পুরো প্রক্রিয়াটিকে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে অবলোকন করার সুযোগ পান। কীভাবে পাখির পালকের ছাপ পাললিক শিলায় পড়ে, কীভাবে শিলাস্তরে চিড় ধরে সবকিছুই বিজ্ঞানীরা আরও একবার ভালোমতো যাচাই করার সুযোগ পেযে যান। দেখা গেল আর্কিওপটেরিক্সের এই সোলনহফেন নমুনাটিও অন্যগুলোর মতোই একই ফলাফল নিয়ে আসলো। এই আবিষ্কারের ব্যাপারটিও সায়েন্স জার্নালে আর্কিওপটেরিক্সের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে আবির্ভূত হলো![১০৬] আর আর্কিওপটেরিক্স নিয়ে হয়েলের যাবতীয় ‘কন্সপিরেসি তত্বের সমাধি রচনা করল।
আসলে অধ্যাপক হয়েল পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে সুপরিচিত হলেও জীববিজ্ঞান কিংবা প্রত্নতত্ত্বের খুঁটিনাটি বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন না; সত্যি বলতে কী বিবর্তন কিংবা পাললিক শিলায় কীভাবে ফসিল সংগৃহীত হয়, কীভাবে পালকের ছাপ স্ল্যাবে পড়ে এগুলো নিয়ে পরিষ্কার জ্ঞান হয়েলের ছিল না। কিন্তু সেই অপরিচ্ছন্ন জ্ঞান নিয়ে, তর্ক করে ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন পোড় খাওয়া জীববিজ্ঞানীদের কষ্টার্জিত সাক্ষ্য প্রমাণগুলোকে। অল্পবিদ্যা কীভাবে ভয়ংকর হয়ে ওঠে শেষপর্যন্ত নিজেকেই থেলো করে তোলে, হয়েলের দৃষ্টান্তই তার বড় প্রমাণ। এ প্রসঙ্গে টিম বেরা তার ইভল্যুশন অ্যান্ড দ্য মিথ অব ক্রিযেশনিজম : আ বেসিক গাইড টু দ্য ফেক্টস্ ইন দি ইভল্যুশন ডিবেট’ বইয়ে খুব স্পষ্টভাবেই বলেন[১০৭]:
একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলা দরকার যে, হয়েল এবং বিক্রমসিংহ-এদের কারোই জীববিজ্ঞান এবং জীবাশ্মবিদ্যা বিষয়ে কোনো প্রথাগত জ্ঞান ছিল না, এবং তারা প্রাকৃতিক নির্বাচনের খুঁটিনাটি নিয়েও সম্যকভাবে অবগত ছিলেন না। ফলে তারা বিবর্তন-বিরোধী নানা চিন্তাভাবনা দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এ সমস্ত অভিযোগ, তা যতই সারশূন্য আর মেধাশূন্য হোক না কেন, একটা সময় সৃষ্টিবাদীদের এক ধরনের স্বস্তি দিয়েছিল …। হয়েলের উদ্দেশ্য ঠিক স্পষ্ট ছিল না, কিন্তু তিনি একটি মুহূর্তের জন্যও নিজের বিশেষজ্ঞীয় ক্ষেত্রের মতো কোনো প্রভাবশালী চ্যালেঞ্জ এখানে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এধরনের দাবি প্রমাণ করে, একজন। বিজ্ঞানী কেমন থেলো হয়ে যেতে পারেন যখন তিনি এমন বিষয়ে অভিমত জানাতে শুরু করেন যেখানে তিনি বিশেষজ্ঞ নন।
অধ্যাপক টিম বেরার কথায় অত্যুক্তি নেই। হয়েলের অভিযোগ কিংবা বিশ্লেষণগুলোতে কোনো সারবত্তা না থাকলেও সৃষ্টিবাদীদের জন্য সেগুলো তখন ভালোই রসদ যুগিযেছিল। ধর্মবাদী সাইটগুলো বুঝে না বুঝে হয়েলের ভুল অভিযোগগুলোই পুনরাবৃত্ত করে চললো (এবং কিছু ক্ষেত্রে এখনও চলছে)। তারা খোঁজ করে দেখারও চেষ্টা করেন নি যে, হয়েলের ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘরের বিজ্ঞানীরা (যারা এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান রাখেন) ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিলেন সেসময়ই।
হয়েল শুধু আর্কিওপটেরিক্স নিয়েই জল ঘোলা করেন নি, করেছিলেন আরও একটা বড় ব্যাপারে, যেটা নিয়ে সৃষ্টিবাদীরা এখনও যারপরনাই উচ্ছ্বসিত হয়েল তার ‘নিজস্ব গণনা থেকে একসময় সিদ্ধান্তে চলে এসেছিলেন যে, সরল অবস্থা থেকে উচ্চতর জটিল জীবের উদ্ভব অনেকটা নাকি টর্নেডোর ঝড়ে জাইয়ার্ডে পড়ে থাকা লোহার জঞ্জালের স্থূপ থেকে এক লহমায় বোয়িং ৭৪৭ বিমান তৈরি হয়ে যাওয়ার মতো অবাস্তব!
ছবি। পেজ ১৩৬
চিত্র : হয়েল ধারণা করেছিলেন যে, সরল অবস্থা থেকে উচ্চতর জটিল জীবের উদ্ভব অনেকটা নাকি টর্নেডোর ঝড়ে জাঙ্কইয়ার্ডের সৃপ থেকে বোয়িং ৭৪৭ বিমান তৈরি হয়ে যাওয়ার মতো অসম্ভাব্য কিছু!
মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, এই ‘জঞ্জাল থেকে বোয়িং ৭৪৭ বিমান তৈরি হওয়ার উপমা হয়েল কোনো বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে লেখেন নি। তবে শোনা যায় তিনি ১৯৮২ সালের একটি সেমিনারে প্রাণের রাসায়নিক উৎপত্তি তত্বের বিপরীতে তার প্যান্সপারমিয়া তত্ত্বের সপক্ষে একথা বলেছিলেন। ইস্টের সাথে বোয়িং ৭৪৭-এর তুলনা করার কারণ হিসেবে বলেছিলেন দুটোরই নাকি সমান সংখ্যক প্রত্যঙ্গ, এবং জটিলতার স্তরেও বেশ মিল আছে[১-৮]। যাহোক ফ্রেড হয়েলের এই যুক্তিমালা’ পরবর্তীকালে তার একটি বই ‘দ্য ইন্টেলিজেন্ট ইউনিভার্স’ (১৯৮৩)–এ সন্নিবেশিত হয়েছিল এভাবে[১০৯]–
ধরা যাক, একটি জাঙ্কইয়ার্ডে বোয়িং ৭৪৭ বিমানের সকল অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হঠাৎ একটি ঘূর্ণিঝড় (whirlwind) এসে জাঙ্কইয়ার্ডের ওপর দিয়ে বয়ে চলে গেল। সেই ঘূর্ণিঝড়ে পুরো বোয়িং ৭৪৭ তৈরি হয়ে উড়ার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় চলে আসার সম্ভাবনা বা চান্স কতটুকু?
তারপর থেকেই সৃষ্টিতাত্ত্বিকেরা সব জায়গায় হয়েলের উপমাকে বিবর্তনের বিরুদ্ধে এক মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন।
শোনা যায় হয়েল ব্যক্তিগত জীবনে নাস্তিক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সরল অবস্থা থেকে উচ্চতর জীবের উৎপত্তির সম্ভাবনা গণনা করতে গিয়ে দেখেন সেটার চান্স এতই কম (১০০০০০ ভাগের ১ ভাগ) যে, তাতে নাকি তার ‘নাস্তিকতার বিশ্বাস টলে গিযেছিল’ এবং হয়েল ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন, এবং সেসময়ই তিনি ঘর্ণিঝডে বোয়িং ৭৪৭ তৈরি হওয়ার উপমা এনে দেখানোর চেষ্টা করেন যে, সরল অবস্থা থেকে জটিল জীবের উদ্ভব নাকি প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার, ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ নাকি লাগবেই। এই গুজবের পেছনে আমরা কোনো সত্যতা খুঁজে না পেলেও (যদিও ব্যাপারটা সত্য হলেও খুব বেশি অবাক হব না) সম্প্রতি বইপত্র ঘাঁটার। ফলে একটা মজার জিনিস বেরিয়ে এসেছে। হলে কিন্তু কোনো সৃষ্টিবাদী বা ক্রিযেশনিস্ট ছিলেন না। বরং তার অনেক প্রবন্ধ এবং বইপত্রেই তিনি বিবর্তন তত্ত্বের ওপর প্রগাঢ় আস্থা ব্যক্ত করেছেন। যেমন, তার ‘অরিজিন অব লাইফ ইন দ্য ইউনিভার্স’ বইয়ে তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলেন[১১০]–
We are inescapably the result of a long heritage of learning, adaptation, mutation and evolution, the product of a history which predates our birth as a biological species and stretches back over many thousand millennia…. Darwin’s theory, which is now accepted without dissent, is the cornerstone of modern biology. Our own links with the simplest forms of microbial life are well-nigh proven.
এমনকি তার জীবনের একেবারে শেষ দিককার বইগুলোতেও তিনি সৃষ্টিবাদকে প্রত্যাখ্যান করে লিখেছিলেন যে, কোনো প্রকৃত বিজ্ঞানী সৃষ্টিবাদে বিশ্বাস করতে পারেন না[১১১]। তারপরেও সৃষ্টিবাদীরা আর ধর্মবাদীরা হয়েলের বোয়িং ৭৪৭ উপমা নিয়ে যারপরনাই উচ্ছ্বসিত। এ যেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ তাদের কাছে। জাকির নায়েক, হারুন ইয়াহ্যিারা তো আছেই, আমরা শুনেছি সম্প্রতি বাংলাদেশের কিছু ধর্মীয় সংগঠন নাকি তাদের মুখপত্রে আর লিফলেটে ‘সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে হয়েলের যুক্তিমালা ব্যবহার করা শুরু করেছে। বোঝা যাচ্ছে কেবল কোরআন হাদিস। কিংবা অনুরূপ ধর্মগ্রন্থের আয়াতের বিভিন্ন ব্যাখ্যা আর অপব্যাখ্যা হাজির করে আর কাজ চলছে না, তাদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে বিবর্তন-বিশ্বাসী এবং সম্ভবত পাঁড় নাস্তিক হয়েলের উপমার কাছে। প্যালের ঘড়ির মৃত্যু নেই’ ঠিক তেমনই হয়ত বলা যেতে পারে ‘হয়েলের বোয়িং বিমানের মৃত্যু নেই! প্যালের ঘড়ি আর হয়েলের বোয়িং যেন পরস্পরের পরিপূরক; তামাক আর ফিল্টার দুজনে দুজনার!
এ অধ্যায়টি অবশ্য হয়েল আস্তিক নাকি নাস্তিক, সৃষ্টিবাদী না অসৃষ্টিবাদী তা নিয়ে বিতর্ক করার জন্য নয়, বরং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার আর্গুমেন্টগুলোকে যাচাই করে দেখা যে সত্যিই হয়েলের বোয়িং উপমা বিবর্তনের বিরুদ্ধে কোনো শক্তিশালী যুক্তি হিসেবে গ্রহণীয় হতে পারে কিনা। তবে তা যাচাই করার আগে একটি ব্যাপার পরিষ্কার বোধহয় করে নেওয়া দরকার যে, আধুনিক বিশ্বের প্রায় সকল জীববিজ্ঞানীরাই হয়েলের এই বোয়িং উপমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন[১১২]। তারা মনে করেন হয়েলের এই বোয়িং ৭৪৭ উপমা বিবর্তনের সাথে তুলনীয় হতে পারে না। কারণ–
১. বিবর্তন টর্নেডো বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। এটা এমন কোনো প্রক্রিয়া নয়, যেটাকে কেবল চান্স দিয়ে পরিমাপ এবং ব্যাখ্যা করতে হবে।
২. টর্নেডো দিয়ে চূড়ান্ত কোনোকিছু তৈরি করার চেষ্টা আসলে একধাপে ঘটা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনোকিছু বানানোর চেষ্টা। আর অন্যদিকে বিবর্তন ঘটে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বহু ধাপে পরিমিত ভিন্নতার মধ্য দিয়ে ক্রমবর্ধমান নির্বাচন (Cumulative Selection)-এর মাধ্যমে।
৩. প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন সরঞ্জাম (যেমন জাঙ্কইয়ার্ডে রাখা বিমানের বিভিন্ন অংশ) জোড়া লাগার মাধ্যমে কিন্তু বিবর্তন ঘটে না। বিবর্তন ঘটে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবে শুধু বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো দীর্ঘ সময় ধরে পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত হওয়ার মাধ্যমে।
৪. বোয়িং বিমানের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত দ্রব্য থাকে স্থির। আর বোয়িং বিমান বানানোর পেছনে থাকে নকশাকারীর একটি চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। অপরদিকে বিবর্তন কিন্তু কোনো ভবিষ্যতের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য মাথায় রেখে কাজ করে না, চূড়ান্ত লক্ষ্যের ব্যাপারে থাকে একেবারেই উদাসীন।
প্রথম দুটো পয়েন্ট আরেকটু বিস্তৃত করা যাক। অনেকেই ভেবে থাকেন প্রাথমিকভাবে মিউটেশনের ফলে বিভিন্ন প্রকরণের অভদ্য যেহেতু ইতস্তত : বিক্ষিপ্তভাবে (randomly) ঘটে থাকে, বিবর্তন বোধহয় কেবল চান্সের থেলা। আসলে কিন্তু তা নয় মোটেই। বিবর্তনের পেছনে মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন। প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যাপারটা কিন্তু কোনো চান্স নয়। প্রাথমিক পরিব্যক্তিগুলো র্যান্ডম হতে পারে, কিন্তু তারপর বৈশিষ্ট্যগুলো ন্যাচারাল সিলেকশনের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটি ‘র্যান্ডম’ নয়, বরং ‘ডিটারমিনিস্টিক’, কারণ তা নির্ভর করে বিদ্যমান উপযুক্ত পরিবেশ এবং সে পরিবেশে অনুকূল কোন বৈশিষ্ট্যের টিকে থাকার ওপর। সেজন্যই বিবর্তন কেবল চান্সের খেলা নয়।[১১৩] পরিব্যক্তিগুলো র্যান্ডম হওয়ার পরেও কীভাবে তা বিবর্তনকে একটি নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তা জানতে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘If Mutation is Random, Why Does Evolution Occur at all? প্রবন্ধটি পড়া যেতে পারে। প্রবন্ধটিতে দুটি চমৎকার উদাহরণ হাজির করে বুঝানো হয়েছে- Mutation was random, but selection provided a direction to the evolution.’
ছবি। পেজ ১৪১
চিত্র : চোখের বিবর্তন : চোখের মতো একটি জটিল প্রত্যঙ্গ সহজেই আলোর প্রতি সংবেদনশীল খুব সরল স্নায়বিক কোষ বিশিষ্ট ‘আই-স্পট’ থেকে বিভিন্ন ধাপে ধাপে পরিমিত ভিন্নতার মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হতে পারে। যখনই এধরনের কোনো পরিবর্তন-যা কিছুটা হলেও বাড়তি সুবিধা প্রদান করে, তা ধীরে ধীরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জনপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে আমাদের চোখের অভ্যুদয় এবং বিকাশের ব্যাপারটা আরও বিস্তৃতভাবে চিন্তা করা যেতে পারে। আজকে আমরা চোখের যে পূর্ণাঙ্গ গঠন দেখে বিস্মিত হই, তা কিন্তু একদিনে তৈরি হয় নি, বরং বহুকাল ধরে ক্রমান্বয়ে ঘটতে থাকা ছোট ছোট পরিবর্তনের ফল হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। খুব সম্ভবত আলোর প্রতি সংবেদনশীল এক ধরনের স্নায়বিক কোষ থেকে প্রথম চোখের বিকাশ শুরু হয়। তারপর হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত হতে হতে আজকে তারা এই রূপ গ্রহণ করেছে। কতগুলো সংবেদনশীল কোষকে কাপের মতো অবতলে যদি ঠিকমতো সাজানো যায় তাহলে যে নতুন একটি আদি চোখের উদ্ভব হয় তার পক্ষে আলোর দিক নির্ণয় করা সম্ভব হয়ে ওঠে। এখন যদি কাপটির ধারগুলো কোনোভাবে বন্ধ করা যায়, তাহলে আধুনিক পিন হোল ক্যামেরার মতো চোখের উৎপত্তি ঘটবে।
তারপরে এক সময় গতি নির্ধারণ করতে পারে এমন একটি অক্ষিপট বা রং বুঝতে পারে এমন কোণের মতো অংশ বিকাশ লাভ করে, তাহলে উন্নত একটি চোখের উৎপত্তি হবে। এরপর যদি বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইরিস ডায়াফ্রামের উৎপত্তি ঘটে তাহলে চোখের ভেতরে কতখানি আলো ঢুকবে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। হবে। এরপর আস্তে আস্তে যদি লেন্সের উদ্ভব ঘটে তা তাকে আলোর সমন্বয় এবং ফোকাস করতে সহায়তা করবে, আর এর ফলে চোখের উপযোগিতা আরও বাড়বে।
ছবি। পেজ ১৪২
চিত্র : প্রকৃতিতে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের চোখ খুব সরল ধরনের চোখ থেকে শুরু করে জটিল চোখের অস্তিত্ব এই প্রকৃতিতেই আছে, আর তা সবই তৈরি হয়েছে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায়[১১৪]
এভাবেই সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবে উপযোগিতা নির্ধারণ করে চোখের ক্রমান্বযিক পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা এখনও আমাদের চারপাশে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত বিভিন্ন ধাপের চোখের অস্তিত্ব দেখতে পাই, অনেক আদিম প্রাণীর মধ্যে এখনও বিভিন্ন রকমের এবং স্তরের আদি-চোখের অস্তিত্ব দেখা যায়।
কিছু এককোষী জীবে একটা আলোক-সংবেদনশীল জায়গা আছে যা দিয়ে সে আলোর দিক সম্পর্কে খুব সামান্যই ধারণা করতে পারে, আবার কিছু কৃমির মধ্যে এই আলোক-সংবেদনশীল কোষগুলো একটি ছোট অবতল কাপের মধ্যে বসানো থাকে যা দিয়ে সে আরেকটু ভালোভাবে দিক নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। সমতলের উপর বসানো নামমাত্র আলোক সংবেদনশীলতা থেকে শুরু করে পিনহোল ক্যামেরা সদৃশ চোখ কিংবা মেরুদণ্ডী প্রাণীদের অত্যন্ত উন্নত চোখ পর্যন্ত সব ধাপের চোখই দেখা যায় আমাদের চারপাশে (অন্ধ গুহা মাছ মেক্সিকান টেট্রা থেকে শুরু করে নটিলাস, প্লানারিয়াম, অ্যান্টার্কটিক ক্রিল, মৌমাছি, মানুষের চোখ ইত্যাদি), এবং তা দিয়েই বিবর্তন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর ব্যাখ্যা করা সম্ভব। বিবর্তন প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে ক্রমবর্ধমান নির্বাচনের মাধ্যমে না ঘটলে আমরা প্রকৃতিতে এত বিভিন্ন ধরনের চোখের অস্তিত্ব পেতাম না। সম্প্রতি সুইডিশ অধ্যাপক ড্যান এরিক নিলসন এবং পেলগার তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে[১১৫] বের করে দেখিয়েছেন যে, আদি সমতল পিগমেন্টেড আলোক সংবেদনশীল সেল থেকে শুরু করে প্রায় ২০০০ ধাপের মধ্যে পরে তা মানুষের চোখের মতো জটিল যন্ত্রে পরিবর্তিত হতে পারে। তাদের করা সিমুলেশনের সচিত্র ফলাফল নিচে দেওয়া হলো–
ছবি। পেজ ১৪৪
চিত্র : অধ্যাপক ড্যান এরিক নিলসন এবং পেলগারের সিমুলেশনের ফলাফল, তারা দেখিয়েছেন আদি সমতল আলোক সংবেদনশীল সেল থেকে শুরু করে ৪০০ ধাপ পরে তা রেটিনাল পিটের আকার ধারণ করে, ১০০০ ধাপ পরে তা আকার নেয় পিনহোল ক্যামেরার মতো আকৃতির, আর প্রায় ২০০০ ধাপ পরে অক্টোপাসের মতো জটিল চোখের উদ্ভব ঘটে। জীববিজ্ঞানী মার্ক রিডলির সাইটে ব্যাপারটি এনিমেশনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
এবার হয়েলের সম্ভাবনার মারপ্যাঁচ নিয়ে একটু গভীরে আলোচনা যাক হয়েলের এই জঞ্জাল থেকে বোয়িং উপমা খুব মৌলিক কিছু নয়। অসীম বানর তত্ব (Infinite monkey theorem) নামে একটি ব্যাপার দর্শনের আঙ্গিনায় প্রচলিত ছিলই। হলে সেটাকে বোয়িং এর আলোকে কোষীয় প্রাণবিজ্ঞানের আঙ্গিনায় ব্যবহার করতে চেযেছেন। মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে নামের বইয়ে এই অসীম বানর তত্ব নিয়ে ছোট করে লিখা হয়েছিলো[১১৬]। পাঠকের সামনে সেটি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন বোধ করছি।
অসীম বানর তত্ব হচ্ছে এমন একটা ধারণা যেখানে মনে করা হয় যে, অফুরন্ত সময় দেওয়া হলে আপাত দৃষ্টিতে প্রায় অসম্ভব সমস্ত ব্যাপারও ঘটে যেতে পারে সম্ভাবনার নিয়মেই। যেমন, একটা বানরকে যদি টাইপরাইটারের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়, তবে তার অন্ধভাবে টাইপিং করা থেকে শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটও বেরিয়ে আসতে পারে, যদি বানরটিকে অফুরন্ত সময় দেওয়া হয় টাইপিং চালিয়ে যাওয়ার জন্য। হয়েল এই বানরের বিক্ষিপ্তভাবে টাইপ করে হ্যামলেট লেখার উপমাকেই প্রাকৃতিক উপায়ে জটিল জীবজগৎ তৈরির ব্যাখ্যায় নিয়ে গেছেন, কেবল পার্থক্য এই যে, তিনি শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটের বদলে ব্যবহার করেছেন বোয়িং ৭৪৭।
হয়েলের ধারণা সত্য হলে সরল অবস্থায় প্রাকৃতিকভাবে জটিল জীবজগতের উদ্ভব অনেকটা হঠাৎ লটারি জিতে কোটিপতি হওয়ার মতোই একটা ব্যাপার হবে। কম সম্ভাবনার ঘটনা যে ঘটে না তা নয়। অহরহই তো ঘটছে। ভূমিকম্পে বাড়ি-ঘর ধ্বসে পড়ার পরও অনেক সময়ই দেখা গেছে ঘটনাক্রমে ভগ্নস্তূপের নিচে কেউ বেঁচে আছেন। এই যে হাইতিতে বিশাল ভূমিকম্প হলো কিছুদিন আগে, প্রায় পনেরো দিন, এমনকি একটি ক্ষেত্রে ২৭ দিন পরেও জীবন্ত অবস্থায় এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়েছে[১১৭]। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ভবন ধ্বসের ১৭ দিন পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে রেশমাকে জীবিত উদ্ধারের ঘটনা বিশ্বজুড়ে বিস্ময় ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল (যদিও ঘটনাটি সাজানো নাটক’ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে)। নিউইয়র্ক টাইমস-এ একবার এক মহিলাকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল যিনি দু দুবার নিউজার্সি লটারির টিকেট জিতেছিলেন। তারা সম্ভাবনা হিসাব করে দেখেছিলেন ১৭ ট্রিলিয়নে ১L এত কম সম্ভাবনার ব্যাপারও ঘটছে। কাজেই সম্ভাবনার নিরিখেই প্রাণের উৎপত্তি এবং সর্বোপরি জটিল জীবজগতের উদ্ভব যত কম সম্ভাবনার ঘটনাই হোক না কেন, ঘটতে পারে। সম্ভাবনা নিয়ে যে অনেক ধরনের চালাকি করা সম্ভব সেটা পাঠকরা আগের অধ্যায়ের অসম্ভাব্যতা অংশে দেখেছেন।
প্রাণের আবির্ভাব ও বিবর্তনের পেছনে জীববিজ্ঞানীদের কাছে কেবল সম্ভাবনার মারপ্যাঁচ থেকেও ভালো উত্তর রয়েছে। আর সেই উত্তরটি হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন আর পূর্বেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন কোনো চান্সের খেলা নয়। এটি একটি নন র্যান্ডম ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়া। সেজন্যই ব্লাইন্ড ওযাচমেকার গ্রন্থে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স পরিষ্কারভাবেই বলেছেন[১১৮]–
প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা ডারউইনীয় বিবর্তনকে এলোমেলো (random) মনে করা শুধু ভুলই নয়, চূড়ান্ত বিচারে অসত্য। এটা সত্যের পুরোপুরি বিপরীত। চান্স’ ডারউইনীয় রেসিপিতে খুব ছোট একটা উপাদান, কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বড় উপাদানটির নাম ক্রমবর্ধমান নির্বাচন যেটা একেবারেই নন-র্যান্ডম।
এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমাদের গ্যালাক্সিতে ১০১১ টি তারা আর ১০৬০ টি ইলেকট্রন আছে। ঘটনাক্রমে এ ইলেকট্রনগুলো একত্রিত হয়ে আমাদের গ্যালাক্সি, কোটি কোটি তারা, আমাদের পৃথিবী এবং শেষ পর্যন্ত এই একটি মাত্র গ্রহে উপযুক্ত পরিবেশে প্রথম জীবকোষটি গঠনের সম্ভাবনা কত? আমাদের গ্যালাক্সি এবং পৃথিবীর যে ব্যস, তা কি ওই সম্ভাবনা সফল করার জন্য যথেষ্ট? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। কারণ এই সম্ভাবনা মাপতে গেলে যে হাজারটা চলক নিয়ে কাজ করতে হয়, তার অনেকগুলো সম্বন্ধে। আমরা এখনও অনেক কিছু ঠিকমতো জানি না। তারপরেও এটা নিদ্বিধায় বলা যায় যে, হয়েলের মতো শুধু চান্স দিয়ে পরিমাপ করে একধাপী সমাধান হাজির করলে সেটার সম্ভাবনা এতই কম বেরুবে যে ‘জঞ্জাল থেকে বোয়িং হওয়ার মতোই শোনাবে; কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনকে গোনায় ধরলে আর সেটা মনে হবে না। বিজ্ঞানী কেযুরেন্স-স্মিথ এমনই একটি কৃত্রিম উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি আমাদের বুঝিয়েছিলেন ১৯৭০ সালেই। তিনি বলেছেন, ধরা যাক একটা বানরকে জঙ্গল থেকে ধরে নিয়ে এসে টাইপরাইটারের সামনে বসিয়ে দেওয়া হলো। তারপর তার সামনে ডারউইনের ‘প্রজাতির উৎপত্তি’ নামক বইটি খুলে এর প্রথম বাক্যটি টাইপ করতে দেওয়া হলো। বাক্যটি এরকম
When on board HMS Beagle, as a naturalist, I was much struck with certain facts in the distribution of the inhabitants of South America, and in the geological relations of the present to the past inhabitants of that continent.
এই লাইনটিতে ১৮২টি অক্ষর আছে। বানরটিকে বলা হলো এই লাইনটিকে সঠিকভাবে কাগজে ফুটিয়ে তুলতে। এখন বানর যেহেতু অষ্কর চিনে না, সেহেতু সে টাইপরাইটারের চাবি অন্ধভাবে টিপে যাবে। টিপতে টিপতে ঘটনাক্রমে একটি শব্দ সঠিকভাবে টাইপ হতেও পারে। কিন্তু শুধু সবগুলো শব্দ সঠিকভাবে টাইপ নয়, এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। এখন এই বানরটির বাক্যটি সঠিকভাবে টাইপ করার সম্ভাবনা কত? কত বছরের মধ্যে অন্তত একবার হলেও বানরটি সঠিকভাবে বাক্যটি টাইপ করতে পারবে? সম্ভাবনার নিরিখে একটু বিচার-বিশ্লেষণ করা যাক।
ছবি। পেজ ১৪৮
চিত্র : অনেকে ভাবেন, একটা বানরকে যদি টাইপরাইটারের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়, তবে তার অন্ধভাবে টাইপিং করা থেকে শেক্সপিপিয়রের হ্যামলেট বেরিয়ে আসলে আসতেও পারে, যদি বানরটিকে অফুরন্ত সময় দেওয়া হয় টাইপিং চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
মনে করা যাক যে, টাইপরাইটারটিতে ৩০টি অক্ষর আছে এবং বানরটি প্রতি মিনিটে ৬০টি অক্ষর টাইপ করতে পারে। শব্দের মধ্যে ফাঁক-ফোকরগুলো আর বড় হাত ছোট হাতের অক্ষরের পার্থক্য এই গণনায় না আনলেও, দেখা গেছে পুরো বাক্যটি সঠিকভাবে টাইপ করতে সময় লাগবে ১০৮০ বছর, মানে প্রায় অনন্তকাল! কিন্তু যদি এমন হয় যে, একটি সঠিক শব্দ লেখা হওয়ার সাথে সাথে সেটিকে আলাদা করে রাখা হয়, আর বাকি অক্ষরগুলো থেকে আবার নির্বাচন করা হয় বানরের সেই অন্ধ টাইপিং-এর মাধ্যমে, তবে কিন্তু সময় অনেক কম লাকবে, তারপরও ১৭০ বছরের কম নয়। কিন্তু যদি এই নির্বাচন শব্দের উপর না হয়ে অক্ষরের ওপর হয়ে থাকে (অর্থাৎ, সঠিক অক্ষরটি টাইপ হওয়ার সাথে সাথে এটিকে আলাদা করে রেখে দেওয়া হয়); তবে কিন্তু সময় লাগবে মাত্র ১ ঘণ্টা, ৩৩ মিনিট, ৩০ সেকেন্ড।
কাজেই উপরের উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, প্রাকৃতিক নির্বাচনকে গোনায় ধরলে ব্যাপারগুলো আর ‘অসম্ভব’ থাকে না, বরং অনেক সহজ হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে পরীক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ তারপরেও ওপরের উদাহরণটির কিছু ত্রুটি আছে। একে তো এধরনের প্রোগ্রাম খুব সরল, তার উপর সঠিক বাক্য বা অক্ষর নির্বাচিত হওয়ার সাথে সাথে সেটিকে আলাদা করে রাখার ব্যাপারটা কিন্তু সেইভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে প্রকাশ করে না। প্রাকৃতিক নির্বাচন জিনিসটি তাহলে কী? আগের অধ্যায়ে আমরা প্রাকৃতিক নির্বাচন জিনিসটার একটা বিস্তৃত ব্যাখ্যা পেয়েছি। বেছে নিয়েছিলাম নিচের তিনটা ধাপকে[১১৯]–
১. জনপুঞ্জের অধিবাসীরা নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে (জীববিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন রেপ্লিকেশন)।
২. প্রতিলিপি করতে গিয়ে দেখা যায় প্রতিলিপিগুলো নিখুঁত হয় না, অনেক ভুলত্রুটি ভাল হয়ে যায় (জীববিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘মিউটেশন বা পরিব্যক্তি)।
৩. এই ভুল কারণে প্রজন্মে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের তারতম্য ঘটে (জীববিজ্ঞানীরা বলেন ‘ভ্যারিয়েশন’ বা প্রকরণ)।
কাজেই প্রতিলিপি, পরিব্যক্তি এবং প্রকরণের সমন্বয়ে যে নির্বাচন প্রক্রিয়া জীবজগতের জনপুঞ্জে যে পরিবর্তনের জন্য দায়ী তাকেই আমরা প্রাকৃতিক নির্বাচন নামে অভিহিত করব। এই ধরনের প্রাকৃতিক নির্বাচনকে গোনা ধরলে আমাদের উপরের সমস্যাটা কীভাবে সমাধান করতে হবে? করতে হবে মিউটেশন এবং রেপ্লিকেশনের ব্যাপারটা মাথায় রেখে এবং সেখান থেকে শুরু করে।
বিক্ষিপ্ত পরিব্যক্তি (random mutation) এবং প্রতিলিপির (replication) ব্যাপারটা মাথায় রেখে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স নিজ হাতে আশির দশকে একটি প্রোগ্রাম লেখেন, প্রথমে জি ডালিউ বেসিক ভাষায়, এবং পরে প্যাস্কেলে, যেটাকে এখন অভিহিত করা হয় Weasel Program নামে, সেটি পরে তিনি প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত ব্লাইন্ড ওযাচমেকার’ বইয়ে। বানর দিয়ে পুরো হ্যামলেট না লিখে তিনি হ্যামলেট এবং পলোনিয়াসের মধ্যকার কথোপকথনের একটি উদ্ধৃতি METHINKS IT IS LIKE A WEASEL সিমুলেশনের জন্য তার প্রোগ্রামে ব্যবহার করেন। তবে তিনি অন্ধভাবে টাইপরাইটার বা কিবোর্ড চালনাকারী কোনো বানর খুঁজে পান নি, তার বদলে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তার এগারো মাস বয়সী কন্যাকে কম্পিউটারের কিবোর্ডের সামনে বসিয়ে দিয়ে। তার কন্যা কম্পিউটারের কিবোর্ডে হাত রেখে টাইপ করেছিল নিচের অর্থহীন কিছু অক্ষরমালা–
WDLTMNLT DTJBKWIRZREZLMQCO P
এই অক্ষরমালাকেই তিনি প্রতি জেনারেশন বা প্রজন্মে প্রতিলিপি করতে দেন ডকিন্স। যেহেতু তিনি জানতেন জীবজগতে প্রতিলিপিগুলো নিখুঁত হয় না, অনেক ভুল হয়ে যায় (অর্থাৎ মিউটেশন ঘটে), ডকিন্সও প্রতিলিপিতে কিছু ভুল হওয়ার সুযোগ করে দেন তার সিমুলেশনে, ফলে প্রতি প্রজন্মে একটি বা দুটি অক্ষর পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকতো। তিনি এভাবে সিমুলেশন করে এগিয়ে গিয়ে অনেকটা এধরনের ফলাফল পেলেন
প্রজন্ম ০১: WDLTMNLT DTJBKWIRZREZLMQCO P
…
প্রজন্ম ০২ : WDLTMNLT DTJBSWIRZREZLMQCO P
…
প্রজন্ম ১০: MDLDMNLS ITJISWHRZREZ MECS P
…
প্রজন্ম ২০ : MELDINLS IT ISWPRKE Z WECSEL
…
প্রজন্ম ৩০: METHINGS IT ISWLIKE B WECSEL
…
প্রজন্ম ৪০ : METHINKS IT IS LIKE I WEASEL
…
প্রজন্ম ৪৩ : METHINKS IT IS LIKE A WEASEL
অর্থাৎ একেবারেই অর্থহীন কিছু অক্ষরমালা থেকে ৪৩ প্রজন্ম পরে তিনি METHINKS IT IS LIKE A WEASEL-এর মতো অর্থপূর্ণ বাক্যাংশ গঠিত হতে দেখলেন। ডকিন্স তার ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার বইয়ে বলেছেন, তিনি যখন প্রথমে বেসিক ভাষায় প্রোগ্রামটি লিখে লাঞ্চের জন্য আধা ঘন্টা বাইরে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে দেখেন এর মধ্যেই METHINKS IT IS LIKE A WEASEL বেরিয়ে গিয়েছিল। পরে তিনি একই প্রোগ্রাম, প্যাস্কাল ব্যবহার করে লিখেছিলেন এবং তাতে সময় লেগেছিল মাত্র ১১ সেকেন্ড ইন্টারনেটে ইউটিউবে ডকিন্সের সিমুলেশন সংক্রান্ত কিছু ভিডিও রাখা আছে।[১২০] সেগুলো থেকে ডকিন্সের সিমুলেশন সম্বন্ধে পাঠকেরা কিছুটা ধারণা পেতে পারেন। এছাড়া, ১৯৮৪ সালের দিকে গ্লেনডেল কলেজের রিচার্ড হার্ডিসন একই ধরনের স্বতন্ত্র একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করে তাতে দেখান যে এভাবে র্যান্ডম মিউটেশন বা পরিব্যক্তি ঘটতে দিয়ে’ শেক্সপিয়ারের গোটা হ্যামলেট নাটিকাটি সাড়ে চার দিনে একেবারে অগোছালো অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ সঠিকভাবে পুনর্বিন্যস্ত করা সম্ভব।[১২১]
তারপরেও ডকিন্সের সিমুলেশনেরও কিছু সমালোচনা আছে। তার প্রোগ্রামও সরলতার দোষে দুষ্ট। এছাড়া তার প্রোগ্রাম একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যকে (longterm goal) সামনে রেখে চালিত (এ ক্ষেত্রে অভীষ্ট লক্ষ্যটি ডকিন্সই নির্বাচন করেছিলেন-METHINKS IT IS LIKE A WEASEL)। বিবর্তন কিন্তু এধরনের কোনো সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগোয় না। তিনি নিজেই ‘ব্লাইন্ড ওযাচমেকার’ বইয়ে তার প্রোগ্রামের এই সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছিলেন এভাবে
Although the monkey/Shakespeare model is useful for explaining the distinction between single-step selection and cumulative selection, it is misleading in important ways. One of these is that, in each generation of selective ‘breeding’, the mutant ‘progeny’ phrases were judged according to the criterion of resemblance to a distant ideal target, the phrase METHINKS IT IS LIKE A WEASEL. Life isn’t like that. Evolution has no long-term goal. There is no long-distance target, no final perfection to serve as a criterion for selection, although human vanity cherishes the absurd notion that our species is the final goal of evolution. In real life, the criterion for selection is always short-term, either simple survival or, more generally, reproductive success.
অবশ্য ডকিন্সের এই উইসেল প্রোগ্রাম এই অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি দেখালেন পরিব্যক্তি এবং প্রতিলিপির প্রভাবে ঘটা ক্রমবর্ধমান নির্বাচনের মাধ্যমে আপাত অসম্ভব বলে মনে হওয়া ঘটনাও স্বাভাবিক নিয়মে ঘটতে পারে। সেজন্যই তিনি তার বইয়ে বলেন
ক্রমবর্ধমান নির্বাচন জীবনের অস্তিত্বের সমস্ত আধুনিক ব্যাখ্যার চাবিকাঠি। এটা এক বিনি সূতার মালা গ্রন্থিত করে চলে খুব সৌভাগ্য প্রসূত ঘটনা (বিক্ষিপ্ত পরিব্যক্তি) গুলোকে অবিক্ষিপ্ত এক অনুক্রমে; ফলে অনুক্রমের শেষে এসে আমরা যখন চূডান্ত কাঠামোর দিকে তাকাই তখন আমাদের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রম তৈরি হয়; আমরা ভাবি এধরনের কাঠামো তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা এতই কম যে, চান্সের মাধ্যমে এমনই একটি কাঠামো তৈরিতে যে সময় লাগবে-তার তুলনায় সমগ্র মহাবিশ্বের ব্যসও খুব নগণ্য।
ডকিন্স পরে তার প্রোগ্রামটিকে আরও উন্নত করেন, এবং METHINKS IT IS LIKE A WEASEL বাদ দিয়ে কোনো সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ছাড়াই সিমুলেশন ঘটান। গাছের থেকে যেমন শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে, ঠিক সেভাবেই ‘জিন নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনকে কম্পিউটারে চালিত করে সরল অবস্থা থেকে মাকড়সা কিংবা অক্টোপাস সদৃশ জটিল জীবজগতের কাঠামো তৈরি করে দেখান, তার সেই প্রোগ্রামের নাম দেন ‘বায়োমর্ফ’[১২২]।
ডকিন্স তার পরবর্তী বই ‘ক্লাইম্বিং মাউন্টেন্ট ইম্প্রোবেবল’-এ অন্য প্রোগ্রামারদের লেখা আরও কিছু জটিল প্রোগ্রামের উল্লেখ করেন বিবর্তনের বাস্তবসম্মত মডেল তুলে ধরতে। এ ধরনের বহু মডেল ইন্টারনেটের বিজ্ঞানের ওপর গবেষণালব্ধ বিভিন্ন ওয়েবসাইটেও পাওয়া যাবে।[১২৩] সম্প্রতি স্কেপ্টিকাল এনকুইরার পত্রিকায় গবেষক ডেভ থমাস তার ‘War of Weasels : An Evolutionary Algorithm Beats Intelligent Design’ প্রবন্ধে একটি আকর্ষণীয় বিষয়ের অবতারণা করেন।[১২৪] তিনি দেখিয়েছেন যে, ইন্টারনেটে কম্পিউটার প্রোগ্রামের একটি প্রতিযোগিতা হয়েছিল যেখানে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের অ্যালগোরিদমের সাথে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল বিবর্তনীয় অ্যালগোরিদমের ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের সমর্থক সালভেদর কর্ডোভাসহ অনেকেই বিবর্তনকে পরাজিত করতে তাদের শক্তিশালী অ্যালগোরিদম হাজির করেছিলেন। কিন্তু তারপরেও তাদের বিবর্তনীয় জেনেটিক অ্যালগোরিদমের কাছে শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ডেভ থমাস তার প্রবন্ধে তাই পরিষ্কার করেই বলেন–
The results were stunning: The official representative of intelligent design community was outperformed by evolutionary algorithm, thus learning Orgel’s Second Law-’Evolution is smarter than you are’-the hard way.
এ গাণিতিক সিমুলেশনের সবগুলোই আমাদের খুব পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছে যে নন-র্যান্ডম প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবে জটিল জীবজগতের উদ্ভব ঘটতে পারে, কোনো ধরনের কল্পিত শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই। মূলত অধ্যাপক হয়েল প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যাপারটা ঠিকমতো বোঝেননি বলেই তিনি জটিল জীবজগতের উদ্ভবকে কেবল চান্স দিয়ে পরিমাপ করতে চেযেছিলেন এবং একে বোয়িং ৭৪৭ উপমার সাথে তুলনা করে ফেলেছিলেন। এমনকি হয়েলের চান্সের গণনাও সম্প্রতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। যেমন, টক অরিজিন সাইটে ড. ইয়ান appare Lies, Damned Lies, Statistics, and Probability of Abiogenesis Calculations প্রবন্ধে[১২৫] হয়েলের অজৈবজনি। (Abiogenesis) সংক্রান্ত গণনার নানা ভুলভ্রান্তির প্রতি নির্দেশ করেছেন। একটি ভ্রান্তি এই যে, হয়েল সম্ভাবনা পরিমাপের সময় প্রতিটি ঘটনাকে একটির পরে একটি এভাবে সিরিজ বা অনুক্রম আকারে সাজিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃতির সিমুলেশনগুলো এভাবে সিরিজ আকারে ঘটে নি, অনেকগুলোই ঘটেছে সমান্তরালভাবে। ফলে সময় লেগেছে অনেক কম। আপনার চার জন বন্ধুকে চারটি মুদ্রা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঝোঁকমুক্তভাবে নিক্ষেপের সুযোগ করে দিলে-চারটি HHHH পেতে যে সময় লাগবে, সেই একই কাজ পেতে আপনার ষোল জন বন্ধুকে লাগিয়ে দিলে অনেক তাড়াতাডিই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল (অর্থাৎ চারটি HHHH) বেরিয়ে আসবে। ঠিক একইভাবে, একটি বানর দিয়ে পুরো হ্যামলেট পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম মনে হলেও, যদি এক লক্ষ বানরকে একই কাজে লাগিয়ে দেওয়া যায়, তবে আর সেরকম অসম্ভব কিছু মনে হবে না। ইয়ান মাসগ্রেভ তার প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, যদি এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সম্ভাবনার কোনো কিছু। ঘটিযে দেখাতে চান তা হলে চীনের জনসংখ্যার মতো চলক নিযুক্ত করে দিন। আর ডকিন্সের মতো ইয়ান মাসগ্রেভও মনে করেন, সৃষ্টিবাদীদের বোয়িং উপমার সাথে বিবর্তনবাদের পার্থক্য মূলত এই জায়গাটিতেই।
ছবি। পেজ ১৫৬
চিত্র : অধ্যাপক হয়েল ভেবেছিলেন কতগুলো রাসায়নিক পদার্থ মিলেমিশে হঠাৎ করেই ব্যাকটেরিয়ার মতো জটিল জীবের অভ্যুদয় হওয়াটাই অজৈবজনি (Abiogenesis), কিন্তু সত্যিকার অজৈবজনি কখনোই একধাপে ঘটে না, বরং এটি বিভিন্ন ছোট ছোট ধাপের সম্মিলিত প্রক্রিয়ার ফসল।
‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ বইয়ে অজৈবজনি তথা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রাণের উদ্ভবের পেছনে বিভিন্ন ধাপগুলো বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। প্রথম জৈবকোষ কেবল চান্সের মাধ্যমে তৈরি হয় নি। প্রথম জৈবকোষ তৈরি হয়েছে ধাপে ধাপে। বিজ্ঞানী ওপারিন[১২৬] আর হালডেন[১২৭] তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, সাড়ে চারশো কোটি বছর আগেকার পৃথিবী কিন্তু কোনো দিক দিয়েই আজকের পৃথিবীর মতো ছিল না। তাঁদের মতে, আদিম বিজারকীয় পরিবেশে একসময় এসব গ্যাসের ওপর উচ্চশক্তির বিকিরণের প্রভাবে নানা ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থের উদ্ভব হয়। এগুলো পরবর্তীকালে নিজেদের মধ্যে বিক্রিয়ার মাধ্যমে আরও জটিল জৈব পদার্থ উৎপন্ন করে। এগুলো থেকেই পরবর্তীকালে ঝিল্লি তৈরি হয়। ঝিল্লিবদ্ধ এসব জৈব পদার্থ বা প্রোটিনয়েড ক্রমে ক্রমে এনজাইম ধারণ করতে থাকে আর বিপাক ক্রিয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। এটি একসময় এর মধ্যকার বংশগতির সংকেত দিয়ে নিজের প্রতিকৃতি তৈরি করতে ও বা পরিব্যক্তি বা মিউটেশন ঘটাতে সক্ষম হয়। এভাবেই এক পর্যায়ে তৈরি হয় প্রথম আদি ও সরল জীবনের। ওপারিন এবং হালডেন তত্ত্বের বহু স্তরই পরবর্তী গবেষকদের পরীক্ষালব্ধ গবেষণায় (Urey-Miller, 1953[১২৮], 1959[১২৯] Fox 1960[১৩০]; Fox and Dose 1977[১৩১], Cairn Smith 1945[১৩২], de Duve 1995[১৩৩], Russell and Hall 1997[১৩৪]; Wächtershäuser 2000[১৩৫], Smith et al. 1999[১৩৬], Huber et al. 2003[১৩৭] সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আদি জীবকোষ তৈরির পেছনে যে ধাপগুলোকে ইতোমধ্যেই শনাক্ত করেছেন সেগুলো হলো—
ধাপ-১ : জৈব যৌগের উৎপত্তি
হাইড্রোকার্বন উৎপাদন (মুক্ত পরমাণুগুচ্ছ CH এবং CH)-এর বিক্রিয়া, বাষ্পের সাথে মেটালিক কার্বাইডের বিক্রিয়া)
হাইড্রোকার্বনের অক্সি ও হাইড্রক্সি-উপজাতের উৎপাদন (বাষ্প ও হাইড্রোকার্বনের বিক্রিয়ায় এলডিহাইড, কিটোন উৎপাদন)
কার্বোহাইড্রেট উৎপাদন (গড়ুকোজ, ফুকটোজ আর ঘনীভবনের ফলে চিনি, স্টার্চ, গ্লাইকোজেন) ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলের উৎপত্তি (ফ্যাট বা চর্বির ঘনীভবন)। অ্যামাইনো এসিড গঠন (হাইড্রোকার্বন, অ্যামোনিয়া আর পানির বিক্রিয়া)
ধাপ-২ : জটিল জৈব অণুর উৎপত্তি (পলিমার গঠন)
• প্রোটিনযেড মাইক্রোস্ফিয়ার
• কো-অ্যাসারভেট
ধাপ-৩ : পলিনিউক্লিটোইড বা নিউক্লিক এসিড গঠন
ধাপ-৪ : নিউক্লিযোগ্রোটিন গঠন
ধাপ-৫: আদি কোষ বা ইউবায়োন্ট গঠন (কো-অ্যাসারভেটের ভেতরে নিউক্লিযোপ্রোটিন আর অন্যান্য অণু একত্রিত হয়ে লিপোপ্রোটিন ঝিল্লি দিয়ে আবদ্ধ প্রথম কোষ; প্রথম জীবন)
ধাপ-৬ : শক্তির উৎস ও সরববাহ (শক্তির সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেওয়ায়, প্রকৃতিতে টিকে রইল তারাই যারা প্রোটিনকে এনজাইমে রূপান্তরিত করে সরল উপাদান থেকে জটিল বস্তু তৈরি করতে পারত, আর সেসব দ্রব্য থেকে শক্তি নির্গত করতে পারত)।
ধাপ-৭ : অক্সিজেন বিপ্লব (অক্সিজেনহীন বিজারকীয় আবহাওয়া অক্সিজেনম জারকীয় আবহাওয়ায় রূপান্তরিত হলো-আজ থেকে দু’শ কোটি বছর আগে)
ধাপ-৮ : প্রকৃত কোষী জীবের উৎপত্তি (প্রোক্যারিওট থেকে ইউক্যারিওট)
ধাপ-৯ : জৈব-বিবর্তন বা বায়োজেনেসিস (জীব থেকে জীবে বিবর্তন)।
এরপরেও বলতে দ্বিধা নেই যে, বিজ্ঞানীরা এখনও এমন কোনো জীবকোষ ল্যাবরেটরিতে তৈরি করতে পারেন নি যা ফ্লাস্কের গা বেয়ে নেমে এসে আমাদের চমকে দেবে। এর একটি প্রধান কারণ ‘সম্য’। জীবকোষ তৈরির পেছনে পৃথিবীতে বিবর্তন প্রক্রিয়া চলেছে কোটি কোটি বছর ধরে। আর এই কোটি বছরে পৃথিবীর আবহাওয়াও বদলেছে বিস্তর। যেমন, আদিম পরিবেশে মুক্ত-অক্সিজেন ছিল না, অক্সিজেনহীন বিজারকীয় আবহাওয়া অক্সিজেনম জারকীয় আবহমণ্ডলে রূপান্তরিত হয় আজ থেকে দুই বিলিয়ন বছর আগে। আবার বর্তমান বিশ্বের বায়ুমণ্ডলে আদিম পরিবেশের মতো মিথেন ও অ্যামোনিয়া নেই, তার জায়গায় আছে জলীয় বাষ্প, কার্বন-ডাই অক্সাইড, আণবিক নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন ও প্রচুর আণবিক অক্সিজেন। এই কোটি বছরের সম্য-প্রসার আবহমণ্ডলের পরিবর্তনকে ল্যাবরেটরির ফ্লাস্কে বেঁধে রাখা যায় না। কিন্তু ফ্লাস্কে বিবর্তনের সিমুলেশন না করলেও কৃত্রিম উপায়ে প্রাণ তৈরিতে ঠিকই সফল হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি ক্রেগ ভেন্টর ভার সিনথেটিক লাইফের গবেষণা থেকে প্রথম কৃত্রিম জীবকোষ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন[১৩৮]। তিনি প্রাথমিকভাবে ইস্ট থেকে ক্রোমোজোমের বিভিন্ন উপাত্ত সংগ্রহ করেন, কিন্তু ক্রোমোজোমের পূর্ণাঙ্গ রূপটি কম্পিউটারে সিমুলেশন করে বানানো Mycoplasma mycoides নামের একটি ব্যাকটেরিয়ার জিনোমের অনুকরণে। তারা এটি বানানোর জন্য তৈরি করেন এক বিশেষ ধরনের সফটওয্যার। এই সফটওয়্যারের সাহায্যেই তৈরি করা হয় কৃত্রিম ক্রোমোজোম এবং তাতে সংযুক্ত করা হয় কিছু জলছাপ (এটি আসলে ইমেইল আইডি, ভেন্টরদের দলের সদস্যদের নাম এবং কিছু বাড়তি তথ্য)। এভাবে বানানো ক্রোমোজোমটি পরে পুনঃ স্থাপিত হয় Mycoplasma capricolum নামের একটি সরল ব্যাকটেরিয়ার কোষে, যার মধ্যেকার ক্রোমোজোম আগেই সরিয়ে ফেলা হয়। এভাবেই তৈরি হয় প্রথম কৃত্রিম ব্যাকটেরিয়া নামে কৃত্রিম হলেও আচরণে এটি অবিকল মূল ব্যাকটেরিয়ার (Mycoplasma mycoides) মতোই। শুধু তাই নয়, তাদের তৈরি এই কৃত্রিম ব্যাকটেরিয়াটি স্বাভাবিকভাবে বংশবিস্তারও করছে। সংক্ষেপে এই পদ্ধতিকেই বলা হচ্ছে সিনথেটিক প্রক্রিয়ায় জীবনের বিকাশ ঘটানোর সুদূরপ্রসারী প্রক্রিয়া। এভাবে উপাত্ত সাজিয়ে সরল জীবনের ভিত্তি গড়ে ফেলেছেন তিনি, তৈরি করে ফেলেছেন প্রথম কৃত্রিম জীবনের। তিনি নিজেই বলছেন, এই পদ্ধতিতে এমন একটি ব্যাকটেরিয়া তিনি বানিয়েছেন যার অভিভাবক প্রকৃতিতে পাওয়া যাবে না, কারণ অভিভাবক রয়েছে কম্পিউটারে। প্রাণের উদ্ভব যদি এতই অসম্ভাব্য একটি ব্যাপার হতো, তবে বিজ্ঞানীদের এই ধরনের গবেষণাগুলো কখনোই সফলতার মুখ দেখতো না। এ ছাড়া এর আগের অধ্যায়ে আমরা বেশ কিছু পরিচিত স্বতঃ সংগঠনের উদাহরণের সাথেও পরিচিত হয়েছিলাম। বহু গবেষকই মনে করেন স্বতঃ সংগঠন ব্যাপারটি প্রকৃতির অনিবার্য বাস্তবতা হলে সেলফ সাসটেইনিং বিক্রিয়ায় নেটওয়ার্ক উৎপন্ন হওয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভাবেই প্রথম প্রাণের উদ্ভব ঘটা সম্ভব।[১৩৯]
সব মিলিয়ে হয়েলের জঞ্জাল থেকে বোয়িং উপমা জীববিজ্ঞানে বহু আগেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। খ্যাতনামা জীববিজ্ঞানী জন মায়নার্ড স্মিথ তো স্পষ্ট করেই বলেন, ‘কোনো জীববিজ্ঞানীই হয়েলের মতো চিন্তা করেন না যে, জটিল কাঠামো জঞ্জাল থেকে বোয়িং-এর মতো এক ধাপে হুট করে তৈরি হয়’[১৪০] হয়েলের এই বোয়িং উপমার সমালোচনা সময়ে সময়ে করেছেন স্ট্রাহেলার, ম্যাক্লিভার, কাউফম্যান, দ্য দ্যুভে, পিটার স্কেলটন, রুডলগ রাফ, পেনক, ম্যাট ইং এবং ড্যানিয়েল ডেনেটসহ বহু বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকই। মূলত হয়েলের এই অপরিণামদর্শী উপমাকে এখন অবহিত করা হয়ে থাকে হয়েলের হেত্বাভাস (Hoyel’s fallacy) হিসেবে[১৪১]। রিচার্ড ডকিন্স তার ‘গড ডিলুশন’ বইয়ে রসিকতা করে বলেন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা জটিল জীবজগতের উদ্ভবের তাও একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাই। কিন্তু ঈশ্বর নামে সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান এক জটিল সম্বা হুট করে কোথা থেকে উদ্ভূত হলো, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই আমরা কোথাও পাই না, কখনও পাবও না। তাই ঈশ্বরই হচ্ছেন হয়েলের ‘আল্টিমেট বোয়িং ৭৪৭,[১৪২]