প্রান্তিক সোম টেবিল ছেড়ে অস্থির হয়ে উঠে পড়ল। লেখা আসছে না। কতদিন থেকেই আসছে না। প্রদোষ আর নন্দিতার জীবনে অশুভ গ্রহের ছায়াপাত প্রান্তিক সোমকেও বিপর্যস্ত করছে।
না, এই অবস্থাটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না প্রান্তিক। কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছে না, প্রদোষ আর নন্দিতা চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
নন্দিতার সেই সংসারটি, যার কেন্দ্রবিন্দুটিতে নন্দিতা ছিল স্থির, উজ্জ্বল দীপ্তিময়ী, যেখানে গিয়ে দাঁড়ালেই যেন হৃদয়ের আশ্রয় মিলত, একটি নির্মল কল্যাণের স্পর্শ পাওয়া যেত, সেখানে আর নন্দিতাকে দেখা যাবে না কোনোদিন। নন্দিতা নিজেকে সেখান থেকে উপড়ে নিয়ে যে একটা ভয়াবহ গহুর সৃষ্টি করে দিয়ে এসেছে, সেটাই শুধু চিরদিন হাঁ করে গ্রাস করতে আসবে তার সংসারের অতিথিদের, বন্ধুদের।
কেন, নন্দিতা এই ভয়াবহতার নায়িকা হয়েই বা থাকবে কেন? প্রদোষ উচ্ছন্নে গেছে বলে সে-ও যাবে উচ্ছন্নে?
প্রান্তিক যেন ক্রমশ নন্দিতার ওপরই ক্রুদ্ধ হচ্ছে। যেন নন্দিতা ইচ্ছে করলেই এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। আর সে ইচ্ছে নন্দিতার করাই উচিত। শুভবুদ্ধিকে ঠেলে রেখে অশুভ বুদ্ধির বশে চলবে কেন নন্দিতা?
প্রান্তিক সোম অতএব নন্দিতা ভৌমিকের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করতে আসে। কারণ নন্দিতাও তার বন্ধু। বন্ধুর বৌ হবার আগে থেকে বন্ধু।
প্রন্তিক সোমই ওদের বিবাহের ঘটক, বিবাহের সাক্ষী। বিয়ের পর দুজনের ঘর সাজিয়ে দিয়েছিল প্রান্তিক সোমই, তাদের সন্তানলাভে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে গেলে ঢাক পিটিয়ে বেড়িয়েছে।
আর প্রান্তিক সোমই সে ছেলেকে লায়েক করে তোলায় সক্রিয় সাহায্য করেছে।
ওদের সুখ যেন প্রান্তিকেরও সুখ, ওদের প্রেম যেন প্রান্তিকেরই গৌরব। অন্য অন্য বন্ধুদের কাছে কত সময়েই প্রান্তিক তার বন্ধু-দম্পতির নিটুট নির্ভেজাল প্রেমের উদাহরণ দেখিয়েছে, সে গৌরব-মন্দির সহসা ধূলিসাৎ হয়ে গেল প্রান্তিকের।
তাই প্রান্তিক এক বন্ধুর কাছে আবেদন করে ব্যর্থ হয়ে আর-এক বন্ধুর শুভবুদ্ধির দরজায় আবেদন করতে আসে। আধুনিক লেখক হয়েও তার যুক্তিটা সেকেলে। নইলে বলে কিনা—বুঝলাম তো সবই, কিন্তু মনে রাখতে হবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে–তুমি হচ্ছ মা।
নন্দিতা ওর এই সেকেলে ভাবপ্রবণতাকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে বলে, রাখ তোমার ওই পচা কথা, ওই মিথ্যে সেন্টিমেন্টের বেড়ি পায়ে পরিয়ে রেখে চিরটাকাল তোমরা মেয়েদের নিরুপায় করে রেখেছে। এই কেস-এর ব্যাপারে তুমি যদি কোনো সাহায্য করতে পার তো এসো এখানে, নচেৎ তোমার সেই শয়তান বন্ধুর কাছে বসে বসে সিগারেট ওড়াওগে। বলছ কি করে যে, এরপরে আবার আমি ওর ঘরে ফিরে যাব, আবার ওর স্ত্রীর পরিচয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াব!
প্রান্তিক ম্লান হাসে। বলে, এর চেয়ে অনেক বেশি নারকীয় পুরুষের স্ত্রীর পরিচয় নিয়েও অনেক মেয়েকে ঘুরে বেড়াতে হয়, নন্দিতা!
হ্যাঁ, কখনও বলে মিসেস ভৌমিক, কখনও বলে নন্দিতা। আজ ইচ্ছে করে নন্দিতাটাই ব্যবহার করছে। কল্যাণকামী বড়ো ভাইয়ের গলায় কথা বলছে। সেই গলাতেই বলে, এর থেকে অনেক বেশি নারকীয় পুরুষের স্ত্রীর পরিচয় নিয়েও অনেক মেয়েকে ঘুরে বেড়াতে হয় নন্দিতা! কারণ মেয়েরা স্বভাবতই ক্ষমাশীল।
ওর ওই নতুন প্রেমের নায়িকার চুনকালি-মাখা মুখটা একবার দেখুক ও।
চুনকালি?
প্রান্তিক বিষণ্ণ হাসি হাসে, তুমি কি জান নন্দিতা, কতটা চুনকালির সঞ্চয় থাকলে তবে এদের মতো চরিত্রের মুখে চুনকালি মাখানো যায়? দেখবে তোমার এই আত্মসম্মান তখন আত্মহত্যার পথ খুঁজতে চাইবে।
ওঃ তোমার মতে আইনটা কেউ কাজে লাগাচ্ছে না?
লাগাবে না কেন, লাগাচ্ছে। হয়তো অনেকেরই অন্য প্রয়োজন আছে। কিন্তু তুমি নন্দিতা, তুমি কি আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে?
রক্ষে কর! জীবনে আমার ঘেন্না ধরে গেছে।
তবে? তবে শুধু আপাতত সেপারেশনটাই থাক না! তাতে অন্তত–
নন্দিতা রূঢ় গলায় বলে, ওঃ, তুমি বুঝি ওর চর হয়ে এসেছ? অথবা ওর উকিল? যাতে ওর সব দিক রক্ষে হয়, সামাজিক প্রতিষ্ঠাটি অক্ষুণ্ণ থাকে, অথচ নতুন প্রেমের পানসিটিও ভাসে, তার ব্যবস্থাতেই? আমি ওর প্রতিষ্ঠা ঘোচাব, এই হচ্ছে আমার শেষ কথা।
তা শেষ কথার পরও অনেক কথা বলে প্রান্তিক, অনেক শুভ প্রেরণা দিতে চেষ্টা করে। ছেলের মুখ চাইতে বলে, মা-বাপের মুখ চাইতে বলে, কিন্তু নন্দিতাকে সংকল্প থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না।
নন্দিতা বলে, একদিনে অসহিষ্ণু হইনি প্রান্তিক, একদিনে এ সঙ্কল্প করিনি। ধৈর্যের শেষ সীমায় পোঁছে তবেই—ও যদি সাধারণ চরিত্রচ্যুত লোকের মতো লুকোচুরি করত, আমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলত অথবা ধরা পড়ে গেলে ঘটনাটাকে অস্বীকার করত আমি হয়তো ক্ষমা করতে পারতাম। সেখানে দুর্বলচিত্ত পুরুষের বাঁদরামি বলে উড়িয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু ও তা করেনি। ও দিনের পর দিন আমার মুখের ওপর বলেছে, তোমাতে আমার আর রুচি নেই। বলেছে, আমাকে তুমি রেহাই দাও। দেব রেহাই! তবে ওর ইচ্ছেমতো ওর সংসারের গিন্নি সেজে বাঁদীগিরি করে নয়।
তবু প্রান্তিক ক্ষমার কথাই তোলে। বলে, মেয়েরা ক্ষমাপরায়ণা।
সে তোমার উপন্যাসের মহৎ নায়িকারা প্রান্তিক, রক্তমাংসের মানুষ মেয়েরা নয়। ক্ষমা? ক্ষমা মানুষ কাকে করে? অনুতপ্তকে, ক্ষমাপ্রার্থীকে। বল তাই কিনা? একটা নির্লজ্জ জানোয়ারকে ক্ষমা করতে যাব আমি?
কিন্তু চিরদিন সে জানোয়ার ছিল না, নন্দিতা! আজ শুধু সাময়িক একটা বিভ্রান্তি তাকে এমন করে তুলেছে!
থাম, তোমার ও-কথা বিশ্বাস করি না আমি। এখন বুঝছি চিরকাল ও আমায় ঠকিয়েছে। হা এই চিন্তাতেই ক্ষেপে গেছে নন্দিতা। চিরকাল ঠকিয়েছে! আমায় সরল পেয়ে ধাপ্পা দিয়ে দিয়ে চালিয়েছে, আর আমি চোখে মায়ার কাজল পরে বসে বসে ঠকেছি। ছি ছি! আবার আমি সেই ভুলের সুখকে বুকে ভরতে যাব? গলায় দিতে দড়ি জুটবে না আমার।
প্রান্তিক ক্ষুব্ধ গলায় বলে, তোমার এটা ভুল ধারণা, নন্দিতা! আমি বলছি এটা সাময়িক। বলতে পার এ একটা ব্যাধির মতো অকস্মাৎ এসে পড়েছে। তুমি তোমার স্বামীর সেই ব্যাধির কালে চিকিৎসার চেষ্টা না-করে তাকে ত্যাগ করে চলে এসেছ, চিরদিনের মতো ত্যাগ করতে চাইছ।
কী করব বল? নন্দিতা কঠিন গলায় বলে, আমি পাপিয়সী। আমি তোমার ওই কুৎসিত ব্যাধিগ্রস্ত বন্ধুকে নার্সিং করে সারিয়ে তুলতে অক্ষমতা জ্ঞাপন করছি। তবে উদাহরণটা যুক্তি নয় প্রান্তিক, আত্মপ্রবঞ্চনাটা সত্য নয়। বল তো তুমি এক্ষেত্রে তোমার গল্পের নায়িকাকে দিয়ে কী করাতে? এই অপমান-শয্যাতেই ফেলে রাখতে তাকে? আর গালভরা গলায় উপদেশ দিতে, সকলের ওপর তুমি মা! বলতে—তোমার স্বামীর হঠাৎ একটি ছোঁয়াচে অসুখ ধরেছে, তুমি তাকে নার্সিং করে সারিয়ে তোলো?..বল? বল শীগগির বলতে পারবে না, উত্তর নেই।
প্রান্তিক আরও ক্ষুব্ধ গলায় বলে, জীবনকে গল্পের নায়িকার ছাঁচে ফেলতে যাওয়ায় সুখ নেই, নন্দিতা! তোমরা দীর্ঘ ষোলোটা বছর পরস্পরের সুখে-দুঃখে জড়িত হয়ে যে ঘরটা গড়ে তুলেছ, এক মুহূর্তের অসহিষ্ণুতায় সে ঘরটা ভেঙে গুঁড়ো করবে?
ঘর? নন্দিতাও এবার একটা ক্ষুব্ধ হাসি হাসে। নিজে ভেঙে গুঁড়ো করছি না প্রান্তিক, ভেঙে ধ্বসে পড়ছে দেখে ছাদ-চাপা পড়ে সমাধি হবার পরিণাম এড়াতে পালিয়ে এসেছি। ঘর? ঘরের মূল্য তোমরা কতটুকু বোঝ? ঘর মেয়েদের জীবনের কতখানি তা জান?…বই লেখ বলেই সব বুঝে ফেলেছ তা ভেব না। তবু সেই ঘর যখন কোনো মেয়ে স্বেচ্ছায় ছেড়ে আসে, জেনো অনেক দুঃখেই আসে। তবু এও জেনো, ঘর যতই মূল্যবান হোক, আত্মসম্মানের থেকে বড়ো নয়। যদি তোমার মহৎ নায়িকারা তাকে সে প্রাধান্য দেন তো বুঝব হয় তাদের আত্মসম্মানবোধই নেই, নয় তাদের ওই ইট-কাঠের ঘরটার ওপরই নির্লজ্জ লোভ। তুমি আর আমায় সুবুদ্ধি দিতে এস না প্রান্তিক, কে আমি করবই। ওকে আমি কোর্টে দাঁড় করাবই।
প্রান্তিক হার মেনে ফিরে গেল। শিখা তো আগেই হার মেনেছিল। তবু সুমতি দিতে আসবার লোক আরও ছিল বৈ কি! নন্দিতা একটা বড়ো সংসারের মেয়ে তো বটে।
নন্দিতার দিদি এল গোড়ায়, বলল, তিলকে তাল করিসনে নন্দি, ইচ্ছে করে লোক হাসাসনি। প্রদোষের অধঃপতনে যদি বা লোকের তোর ওপরে সহানুভূতি আসছিল, তোর এই মামলা করার কেলেঙ্কারীতে সে সহানুভূতি ঘুচবে।
লোকের সহানুভূতি? নন্দিতা ব্যঙ্গ হাসি হাসল, জিনিসটা একদম অসার দিদি, কিছুমাত্র ফুভ্যালু নেই।
তা যাক, মা-বাবার মুখটার দিকেও চাইবি না? একবার তো বিয়ের সময় যথেষ্ট মুখ পুড়িয়েছিলি, আবার সেই সাধের বিয়ের কেচ্ছা-কাহিনি নিয়ে
নন্দিতা গম্ভীর হয়। নন্দিতা সেই গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলে, দেখ দিদি, মুখ যদি তারা পুড়ছে কল্পনা করেই পোড়ার জ্বালা অনুভব করেন, আমার কি করবার আছে? ছেলেমেয়েরা বড়ো হলে যে তারা আর তাদের শিশুটি থাকে না, পুরো একটা মানুষ হয়ে ওঠে, তাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, সমস্যা-প্রতিকার তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়, এগুলো মা-বাবারা ভুলে যান বলেই এত জ্বালা। আমার ভালোবাসাকে তাঁরা সমর্থন করেননি, বিয়ের সময় অকারণ প্রতিকূলতা করে অনেক কষ্ট দিয়েছেন আমায়, তারপর শুধু শুধুই কতকাল নির্লিপ্ত থেকেছেন, ঠেলে রেখেছেন, সে তো তোমার অজানা নয়! বলতে গেলে তোমার চেষ্টাতেই আবার তারা আমাকে মেয়ে বলে স্বীকার করেছিলেন, নচেৎ হয়তো করতেন না। এখনও আমার জীবনের এই সমস্যার দিকে তারা সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন না। জামাইকে নিন্দেমন্দ করলেও, তার দোষটাকে ক্ষমার অযোগ্য বলে মনে করছেন না, ভাবছেন আমিই অসহিষ্ণু। আমিই বা তবে তাঁদের মুখের কথা ভাবতে যাব কেন?
দিদি হতাশ হয়ে বলেন, তবে আর কি বলব। তবে টুবলুর কথাটাও একবার ভাবলে পারতিস!
ভেবেছি।
নন্দিতা তীব্র গলায় বলে, তার সম্পর্কে বেশি ভাবনা না-করলেও চলবে। সে ঠিকই সাপের তেলে সলুই হচ্ছে। সেও তার বাপের মতো আমায় আসে ধমকাতে, চুপ করাতে।
তা তোরা রাতদুপুরে পাড়া জানিয়ে ঝগড়া করবি—সে ছেলেমানুষ, মা ছাড়া জানত না—
দিদি থাম। ভয়ানক মাথা ধরেছে। মোটেই আর সে ছেলেমানুষ নেই। আমার জন্যে তার কিছুই এসে যাবে না। বাপের পয়সা আছে, চাকর-বাকর আছে, ইচ্ছে হলে বোর্ডিংয়ে পাঠাবে, দু-দিন বাদে বিলেত পাঠাবে, মিটে যাবে সমস্যা।
তাহলে বলতে হবে তোর সেই মাতৃস্নেহটাও মিথ্যে ছিল।
নন্দিতা মুখটা অন্যদিকে ফেরায়। নন্দিতা ঘাড় ফিরিয়ে বলে, তাই ছিল তাহলে। তবে—এটা জেনো, আমার কাছে স্নেহ প্রেম সব কিছুর বড়ো আমি যে একটা মানুষ, সেই চেতনাটুকু।
অতএব লড়াই বাধে।
একদিন মা এসে মাথার দিব্যি দিয়ে যান, বাপ এসে অভিসম্পাত, তবু বাধে।
পিসি-মাসি দাদা-বৌদি এবং আরও অনেকেই আসেন, শেষ অবধি রাগ করে ফিরে যান। কারণ নন্দিতা আপন সংকল্পে অটল।
শিখার বাড়িতেই রয়ে গেছে নন্দিতা, তাই শিখা আর সাহস করে বেশি কিছু বলে না, কি জানি বন্ধু যদি আহত হয়। যদি বলে আমাকে ভারস্বরূপ লাগছে বলেই বুঝি সেই নোংরা লোকটার সঙ্গে মিটমাট করতে বলছ?
আসল কথা নিয়তি। ওর বাড়া অমোঘ, ওর বাড়া অনিবার্য আর কি আছে? নন্দিতার এই নিয়তি, তাকে রোধ করবে এ সাধ্য কি নন্দিতার আছে? নেই।
তাই নন্দিতা অসাধ্য সাধন করে বেড়ায়! নন্দিতা উকিলবাড়ির মাটি নেয়, নন্দিতা পড়ে পড়েই বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন মুখস্থ করে ফেলতে বসে।
কিন্তু জায়গায় জায়গায় খটকা লাগছে। নিজের দিকে যেন উপকরণ কম। উকিল বলছে, শুধু স্বামী অনাসক্ত, অথবা আপনার প্রতি উদাসী, এটুকুতে কাজ হবে না। সলিড় কিছু চাই। প্রমাণ করতে হবে মিস্টার ভৌমিক চরিত্রহীন।
প্রমাণ!
নন্দিতা ঝঙ্কার দিয়ে বলে, তার গতিবিধিই তার প্রমাণ।
ওতে হয় না। উকিল কুটিল হাসি হাসেন, আরও কিছু দরকার।
অতএব সেই দরকারি বস্তুটা নির্মাণ করতে বসেন উকিলবাবু। নন্দিতাকে বাঁশ-দড়ি খড় মাটির জোগান দিতে হয়।
মিছে কথা? কে বলেছে মিছে কথা? নন্দিতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে এইটুকুই হয়তো বানানো, তাছাড়া? তবু খারাপ লাগে বৈকি! নিজেকেই যেন ক্লেদাক্ত মনে হয়, অশুচি মনে হয়। কিন্তু উপায় কি? নাচতে নেমে. তো ঘোমটা চলে না। প্রত্যক্ষদর্শীর মহিমা নিতে হলে যা মুখস্থ করবার, করতে হবে বৈকি। দিনরাত্তিরের চিন্তাতেই তাই লেগে থাকে একটা ক্লেদাক্ত অনুভূতি।
বিশ্বাস হয় না, কিছুদিন আগেও এই নন্দিতা প্রত্যেকটি বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর ঘট সামনে দিয়ে ধূপ-ধুনো ফুলচন্দন দিয়ে পুজো করতে বসত। বিশ্বাস হয় না, পাজী দেখে নীলষষ্ঠী মহাষ্টমীর দিন বরের কাছে বায়না করত—গাড়িটাকে চালিয়ে একটু এগিয়ে নিয়ে চল দিকিনি, একটু বড়ো গঙ্গায় স্নান করে আসি। এখানের ঘাটে যা কাদা, নামতে ইচ্ছা করে না।
আর এও বিশ্বাস হয় না, রান্নার বই দেখে দেখে নতুন রান্না করে স্বামী-পুরকে খাওয়ানোর জন্যে দুপুরের বিশ্রামের হাতছানিকে আমল দিত না।
এ যেন আর এক নন্দিতা। লজ্জা-সরম বিবর্জিত, শালীনতা-অশালীনতা বিসর্জিত একটা প্রতিহিংসা-সাধনের যান্ত্রিক মূর্তি।