৩. পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যা

তৃতীয় অধ্যায় – পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যা

পাশ্চাত্য দর্শনে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তবে, এই আলোচনা প্রাচীন ও মধ্যযুগের চেয়ে আধুনিক যুগে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে। সম্ভবত এ কারণে ৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দের গ্রিক দার্শনিক থেলিসের হাতে পাশ্চাত্য দর্শনের জন্ম হলেও পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে জ্ঞানবিদ্যাগত প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য একশ বছর, সোফিস্টদের সময় পর্যন্ত, অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রাক-সোফিস্ট যুগের দার্শনিক আলোচনা ছিল প্রধানত বিশ্বতাত্ত্বিক। প্রাক-সোফিস্ট দার্শনিকগণ জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা না করেই ধরে নিয়েছিলেন যে, মানুষ বিশ্বপ্রকৃতিকে জানতে পারে। তাঁরা জ্ঞানের সম্ভাব্যতার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন নি। এজন্য হিরাক্লিটাস ও পারমেনাইডিস প্রমুখ দার্শনিক জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনা না করেই যথাক্রমে ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করে বিচারবিযুক্তভাবে তাঁদের দার্শনিক মত প্রকাশ করেন। ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সোফিস্টগণই প্রথম জ্ঞানের সম্ভাব্যতার ব্যাপারে সন্দেহের সূচনা করেন। তাঁরাই প্রথম প্রশ্ন তোলেন, আমরা প্রকৃতি সম্পর্কে যে জ্ঞান পাই তার কতটুকু ব্যক্তিনিরপেক্ষ এবং কতটুকু আমাদের মনের ধারণা।[১] অবশ্য পাশ্চাত্য দর্শনে যথার্থ অর্থে জ্ঞানবিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয় প্লেটোর হাতে। কারণ, তিনিই প্রথম জ্ঞানবিদ্যার মূল প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। প্রথম অধ্যায়ে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার সময় একথা বলা হয়েছে যে, ভারতীয় দর্শনের নয়টি দার্শনিক সম্প্রদায়ই জ্ঞানবিদ্যা নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন যা পাশ্চাত্য দর্শনে দেখা যায় না। সুতরাং বলা যায়, জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় ভারতীয় দর্শনে পাশ্চাত্য দর্শনের চেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হিসেবে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য তা হলো, প্রায় সকল ভারতীয় দার্শনিকই মানবজীবনকে দুঃখের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য মোক্ষ বা মুক্তিলাভের পথ অনুসন্ধানের লক্ষ্যে দর্শনচর্চা করেছেন। তাই ভারতীয় প্রতিটি দার্শনিক সম্প্রদায় তাঁদের দার্শনিক মত নিজেদের জীবনে অনুশীলন করেছেন। একথাও বলা যায় যে, প্রায় সবকটি দার্শনিক মতই তাঁদের অনুসারী দার্শনিকদের ধর্মীয় মতের সাথে অনেকটা অভিন্ন হয়ে গেছে।

ভারতীয় দর্শনের প্রায় সবগুলো দার্শনিক গোষ্ঠীই এ ব্যাপারে একমত যে, অজ্ঞানতাই হলো দুঃখ বা বন্ধনের কারণ। অজ্ঞানতার হাত থেকে মুক্তির জন্য যথার্থ জ্ঞানলাভের উপায় তথা প্রমাণতত্ত্বের আলোচনা আবশ্যক। এসব কারণে ভারতীয় দার্শনকে প্রধানত জীবনদর্শন বলা যায়, মূলত জীবন সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানের লক্ষ্যে জ্ঞানবিদ্যার তথা প্রমাণতত্ত্বের আলোচনা এই দর্শনে একটি অপরিহার্য বিষয়। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনের উদ্ভবের পেছনে জীবন সমস্যার সমাধানের চেয়ে বিশ্ব প্রকৃতিকে জানার প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আগ্রহই বেশি। তাই বলা চলে বিশ্বতাত্ত্বিক প্রশ্ন থেকেই পাশ্চাত্য দর্শনের জন্ম।

সুতরাং জীবন সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে নয় বরং মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞানস্পৃহার পরিতৃপ্তি লাভের উদ্দেশ্যে পাশ্চাত্য দর্শনে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার সূত্রপাত। ভারতীয় দর্শনের মতো পাশ্চাত্য দার্শনিকদের সকলে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনাকে সাধারণ বা আবশ্যিক বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন নি। বরং যুগ ও কালের প্রেক্ষিতে যে দার্শনিক যে বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন সে বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রাক-সোফিস্ট যুগে পাশ্চাত্য দর্শনে জ্ঞানবিদ্যাগত প্রশ্নের উৎপত্তি না হওয়ার মূলে এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করেছে।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের অনেক দার্শনিক জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় গুরুত্ব আরোপ করে থাকলেও আধুনিক যুগে এসেই পাশ্চাত্য দর্শনে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা সবিশেষ গুরুত্ব পায় এবং আধুনিক দর্শন যথার্থ অর্থে জ্ঞানবিদ্যাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। পাশ্চাত্য দর্শনের সকল দার্শনিক ভারতীয় দার্শনিকদের মতো জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় মনোযোগ দেননি। তবুও ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলোর ক্রমবিন্যাসের ক্ষেত্রে যে সমস্যাটি দেখা যায় পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় সে সমস্যা অনুপস্থিত। দর্শনের ইতিহাসে প্রাথমিককাল থেকেই ইউরোপে একের পর এক দার্শনিকের আবির্ভাব হয়েছে এবং তাঁরা তাঁদের মতবাদ প্রচার করেছেন। এসব মতবাদকে কালের ক্রম অনুসারে সাজিয়ে একটি গোষ্ঠীর মতবাদ অন্য গোষ্ঠীকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে, অথবা দার্শনিক চিন্তাধারায় এসব মতবাদ বিভিন্ন সময়ে সাধারণভাবে কী পরিবর্তন সাধন করেছে তা পর্যালোচনা করা সম্ভব। তাই বর্তমান অধ্যায়ের আলোচনায় ‘ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যা’ অধ্যায়ের আলোচনা পদ্ধতি অনুসরণ না করে পৃথক পদ্ধতি অনুসরণ করা হলো।

পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাস বিস্তৃত। তাই আলোচনার পরিসরকে সীমাবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে যে সব দার্শনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন সে সব দার্শনিকের মতবাদ আলোচনা করা হলো। ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় যেমন প্রধানত প্ৰমাণতত্ত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তেমনি এই অধ্যায়েও জ্ঞানোৎপত্তিসংক্রান্ত মতবাদকে প্রাধান্য দেওয়া হলো। মূলত প্লেটো-এরিস্টটলের হাতে জ্ঞানবিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার সূত্রপাত। তবে সোফিস্ট দার্শনিকগণ প্রথম জ্ঞানবিদ্যাগত প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তাই সোফিস্টদের জ্ঞানবিদ্যা দিয়েই আলোচনার সূত্রপাত হলো। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে হিউমের স্থান নির্ণয় করার জন্য বর্তমান অধ্যায়ের পরিকল্পনা। তাই সোফিস্টদের জ্ঞানবিদ্যা থেকে শুরু করে হিউম পূর্ববর্তী আধুনিক ব্রিটিশ দার্শনিক জর্জ বার্কলের জ্ঞানবিদ্যা পর্যন্ত প্রধান প্রধান দার্শনিকদের মতামত এই অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। আলোচনার সুবিধার জন্য এই অধ্যায়কে ইতিহাসের ধারায় প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক এ তিনটি যুগে বিভক্ত করে আলোচনা করা গেল।

প্রাচীন যুগ

সোফিস্টদের আগে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে জ্ঞানবিদ্যাগত প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। সোফিস্টরাই প্রথম জ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। এতে জ্ঞানবিদ্যাগত আলোচনার সূত্রপাত হয়। তাই এখানে সোফিস্টদের জ্ঞানবিদ্যা থেকে শুরু করে প্রাচীন যুগের প্রখ্যাত দার্শনিকবৃন্দ অর্থাৎ সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল এবং এরিস্টটল পরবর্তী জ্ঞানবিদ্যাগত ধারা আলোচনা করা গেল।

সোফিস্টদের জ্ঞানবিদ্যা

সোফিস্টদের দর্শন মূলত সোফিস্ট-পূর্ববর্তী দার্শনিকদের বিশ্বতাত্ত্বিক ও প্রকৃতিবাদী দর্শনের কূটাভাষমূলক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ। সম্ভবত গ্রিক প্রকৃতিবাদী দার্শনিকদের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে মতবৈচিত্র্যের কারণেই সোফিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গি জ্ঞানবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়।[৩] তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মানুষের চিন্তাবৃত্তির সীমাবদ্ধতার কারণেই তাঁদের পূর্বসূরিগণ সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে একমত হতে পারেননি। তাই, বিশ্বতাত্ত্বিক প্রশ্নের যথার্থ ও সর্বজনস্বীকৃতি উত্তর খোঁজার আগে জ্ঞানবিদ্যাগত প্রশ্নের প্রতি নজর দেওয়াকে তাঁরা প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন।

সোফিস্টদের মতে, জানার পদ্ধতির ক্ষেত্রে মানুষের মন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জ্ঞান, জ্ঞাতা নামক বিশেষ ব্যক্তির উপর নির্ভর করে এবং জ্ঞাতার কাছে যা সত্য বলে মনে হয় তাই সত্য। ব্যক্তিনিরপেক্ষ কোনো সত্যের অস্তিত্ব সোফিস্টগণ অস্বীকার করেন। তাঁদের মতে, সমস্ত জ্ঞানই ব্যক্তিসাপেক্ষ। বিখ্যাত সোফিস্ট দার্শনিক প্রোটাগোরাস (আনু. ৪৮০- ৪১০ খ্রি.পূ.) এর প্রসিদ্ধ উক্তি—মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি। এ উক্তির মধ্যে দিয়ে জ্ঞানবিদ্যাগত ব্যক্তিসাপেক্ষ জ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়। এতে সত্যতার সর্বজনীনতা অস্বীকৃত হয় এবং ব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানোৎপত্তির একমাত্র উপায় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে, তিনি ব্যক্তি মানুষের সাধারণ জ্ঞানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, একজন পাণ্ডুগ্রস্থ রোগীর দৃষ্টির চেয়ে একজন স্বাভাবিক মানুষের দৃষ্টি বেশি নির্ভরযোগ্য। প্রোটাগোরাসের জ্ঞানবিদ্যাগত এই ঘোষণা পূর্ববর্তী প্রকৃতিবাদী দার্শনিকদের মতবিরোধের সমাধান সম্ভব করে তোলে। অর্থাৎ তাঁদের সকলের মতই সত্য বলে স্বীকৃত হয়। কারণ, সত্যতা ব্যক্তিসাপেক্ষ বিষয়। তবে, কোনো কোনো দার্শনিকের মতবাদ অন্যান্য দার্শনিকের মতের চেয়ে বেশি স্বাভাবিক বলে তা বেশি নির্ভরযোগ্য।

প্রোটাগোরাসের পরবর্তী সোফিস্ট দার্শনিক জর্জিয়াস প্রোটাগোরাসের জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদকে চরম রূপ দেন। তিনি বিখ্যাত তিনটি উক্তির মাধ্যমে নঞর্থক জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদের সূচনা করেন।o এ উক্তি তিনটি হলো, অস্তিত্বশীল বলে কোনো কিছু নেই, এ ধরনের কিছু থেকে থাকলেও তাকে জানা যায় না, এবং জানা গেলেও এর জ্ঞান অন্যের মধ্যে সংক্রমণ করা যায় না। জর্জিয়াসের মতের জন্য সোফিস্ট জ্ঞানতত্ত্বকে নঞর্থক ও সংশয়বাদী জ্ঞানতত্ত্ব লা হয়।

এককথায়, পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে প্রাচীন যুগে সোফিস্টগণই প্রথম জ্ঞানবিদ্যাগত প্রশ্নের সূচনা করেন। তাঁরা জ্ঞানের সর্বজনীনতা অস্বীকার করে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে ব্যক্তিসাপেক্ষ মতবাদ প্রচার করেন। জ্ঞান বলতে সোফিস্টরা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষকেই বোঝান। তারা জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার ভূমিকা অস্বীকার করেন। ইন্দ্রিয়ানুভূতি যেহেতু ব্যক্তিভেদে ভিন্ন সেহেতু বস্তুর যথার্থ স্বরূপ জানা যায় না। সর্বজনীন জ্ঞান নেই। জ্ঞানমাত্রই আপেক্ষিক। সোফিস্টদের এই মতবাদ অভিজ্ঞতাবাদ থেকে সংশয়বাদ পর্যন্ত বিস্তারলাভ করে। সত্যতার মানদণ্ড হিসেবে সোফিস্টরা প্রায়োগিক কার্যকারিতাকেই সমর্থন করেন। ব্যক্তিমানুষের সাধারণ জীবনে যে জ্ঞান ফলপ্রসূ সে জ্ঞানই সত্য। তাঁদের সত্যতার মানদণ্ড বিশ শতকের প্রয়োগবাদীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

সুতরাং দেখা যায়, সোফিস্টগণ পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে প্রথম জ্ঞানবিদ্যাগত প্রশ্নের উত্থাপন করেন এবং জ্ঞানকে ব্যক্তির ইন্দ্রিয়নির্ভর আপেক্ষিক বিষয়ে পরিণত করে অভিজ্ঞতাবাদের বীজ বপন করেন। তবে সর্বজনীন জ্ঞানকে অস্বীকার এবং বস্তুর যথার্থ জ্ঞান অর্জনকে অসম্ভব হিসেবে ঘোষণা করায় সোফিস্টদের জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদ নঞর্থক ধারার দিকে প্রবাহিত হয় এবং নঞর্থক সংশয়বাদে রূপ নেয়। তবে একথা বলা যায় যে, প্রাচীন যুগে সোফিস্টগণ জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতাবাদী ধারার ভিত্তি স্থাপন করেন আধুনিক যুগের ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী লক, বার্কলে ও হিউমের জ্ঞানবিদ্যায় সে ধারার অনুরণন শোনা যায়। সোফিস্টদের কাছে যে অভিজ্ঞতাবাদের ব্যাখ্যা ছিল অসম্পূর্ণ এবং যা নঞর্থক সংশয়বাদের দিকে মোড় নিয়েছিল হিউমের হাতে সে অভিজ্ঞতাবাদই পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যাত হয় এবং নঞর্থক সংশয়বাদ গঠনমূলক সংশয়বাদে রূপ নেয়।

সক্রেটিসের জ্ঞানবিদ্যা

পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় সোফিস্টদের পরে প্রখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস (৪৬৯-৩৯৯ খ্রি.পূ.) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সক্রেটিস সোফিস্টদের অভিজ্ঞতাবাদী এবং আপেক্ষিকতাবাদী জ্ঞানবিদ্যার বিরোধিতা করে জ্ঞানের জন্য প্রজ্ঞার ভূমিকার স্বীকৃতি দেন এবং জ্ঞানের সর্বজনীনতার গোড়াপত্তন করেন। মূলত সোফিস্টদের মতবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সক্রেটিসের জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদের সূচনা হয়। সক্রেটিসের দর্শন মূলত নীতিতত্ত্বমূলক। সক্রেটিস মনে করতেন মানুষের চরিত্রের উৎকর্ষ জ্ঞানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই সক্রেটিসের নীতিতত্ত্ব তাঁর জ্ঞানবিদ্যার উপর নির্ভরশীল ছিল। তিনি তাঁর নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবেই জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদ প্রচার করেন।

সোফিস্টদের বিষয়ীগত জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ ও আপেক্ষিকতাবাদ তাঁদের নীতিত্ত্বকেও বিষয়ীগত ও আপেক্ষিক করে তোলে। তাঁদের জ্ঞানবিদ্যাগত সংশয়বাদ নীতিবিদ্যাগত সংশয়বাদে রূপ নেয়। সোফিস্টদের প্রচারিত ব্যক্তিসাপেক্ষ নৈতিকতার মানদণ্ড গ্রিক নগররাষ্ট্র ও সর্বজনীন নৈতিকতার ভিত্তিকে দুর্বল করে। ফলে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের পর্যায়ে নেমে যায়। সক্রেটিসের মূল সমস্যা ছিল গ্রিক নগররাষ্ট্রের মানুষের নৈতিক চরিত্র উন্নত করার পথ নির্দেশ করা। তাই তিনি সর্বজনীন নৈতিক আদর্শের ভিত্তিরূপ সোফিস্টদের ব্যক্তিসাপেক্ষ জ্ঞানবিদ্যাগত আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তিনিরপেক্ষ বা সর্বজনীন জ্ঞানবিদ্যাগত আদর্শের প্রচারে সচেষ্ট হন।

অভিজ্ঞতাবাদী সোফিস্টগণ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষকেই জ্ঞানের যথার্থ উৎস হিসেবে অভিহিত করে সবকিছুকে বিষয়ীগত বলেন। তাঁরা জগতের শুভ-অশুভ, ন্যায়-অন্যায় সবকিছুকে ব্যক্তি মানুষের সৃষ্টি বলে ঘোষণা করেন। বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা নয় বরং সংবেদন, কামনা, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ ইত্যাদিকে মানুষের আসল রূপ হিসেবে অভিহিত করায় তাঁদের কাছে সবকিছু আপেক্ষিক বিষয়ে পরিণত হয়। সক্রেটিস এক্ষেত্রে সোফিস্টদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি ধারণাকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ‘ধারণা’ বলতে তিনি মূলত সাধারণ বা সর্বজনীন ধারণাকে বুঝিয়েছেন। সাধারণ ধারণা বা সম্প্রত্যয় প্রজ্ঞার সাহায্যে গঠিত হয়। অভিজ্ঞতার সাহায্যে নয়। তাই তাঁর মতে, সার্বভৌম বা সার্বিক প্রজ্ঞাই জ্ঞানের যথার্থ উৎস। প্রজ্ঞার কল্যাণেই মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব। সুতরাং প্রজ্ঞার সাহায্যে জ্ঞানের প্রমাণ ও যথার্থতা যাচাই করতে হবে। তিনি সর্বজনীন জ্ঞানকে সার্থক জ্ঞান বলে মনে করেন। এরূপ জ্ঞান ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ভিন্ন নয় বরং সর্বজনীন, এবং সকল সংশয়ের ঊর্ধ্বে।

সোফিস্টগণ যেখানে অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করে সর্বজনীন এবং অপরিবর্তনীয় জ্ঞানের অস্তিত্ব অস্বীকার করে সংশয়বাদ প্রবর্তন করেন, সক্রেটিস সেখানে সর্বজনস্বীকৃত অপরিবর্তনীয় সাধারণ ধারণাকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করে বুদ্ধিবাদের প্রবর্তন করেন। এতে জ্ঞান সংশয়বাদের হাত থেকে রক্ষা পায়। সোফিস্টদের দ্বারা প্রবর্তিত জ্ঞানের ব্যক্তিসাপেক্ষ মানদণ্ড সক্রেটিসের হাতে এসে ব্যক্তিনিরপেক্ষ মানদণ্ডে রূপলাভ করে। তৎকালীন এথেন্সের সামাজিক ও নৈতিক বিশৃঙ্খলা নিরসনের লক্ষ্যে সক্রেটিস সকলের জন্য একই রকম নৈতিক মানদণ্ড নির্মাণে আগ্রহী ছিলেন। মূলত ব্যবহারিক নৈতিকতার ব্যক্তিনিরপেক্ষ মানদণ্ড নির্মাণ ছিল তাঁর লক্ষ্য। এর উপায় হিসেবে তিনি জ্ঞানের ব্যক্তিনিরপেক্ষ মানদণ্ডের কথা বলেছেন। তাই তিনি জ্ঞানের খাতিরে জ্ঞান নয় বরং ন্যায় ও সুনীতি পরিচালিত যথার্থ জীবনযাপনের ব্যবহারিক প্রয়োজনেই জ্ঞানের অনুসন্ধান করেন। তিনি তাঁর ব্যবহারিক নীতিবিদ্যাকে জ্ঞানবিদ্যার উপর নির্ভরশীল করে জ্ঞানকে সদগুণ বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতে, এই জ্ঞান হলো সর্বজনস্বীকৃত অপরিবর্তনীয় অপরিহার্য সার্বিক জ্ঞান।

এককথায়, সক্রেটিস সোফিস্টদের অভিজ্ঞতাবাদ ও নঞর্থক সংশয়বাদী মতবাদের বিরুদ্ধাচরণ করে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার ভূমিকাকে প্রাধান্য দেন। এতে জ্ঞানবিদ্যার একটি নতুন ধারা, তথা বিশুদ্ধ বুদ্ধিবাদী ধারার প্রবর্তন হয়। এর ফলে সোফিস্টদের নঞর্থক সংশয়বাদের হাত থেকে জ্ঞানবিদ্যা মুক্তি পায়। এছাড়া, সক্রেটিস সর্বজনস্বীকৃত সম্প্ৰত্যয়কে যথার্থ জ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করে সত্তার যথার্থ জ্ঞানলাভ সম্ভব বলে ঘোষণা করায় পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে আদি যুগ থেকেই একটি গঠনমূলক ধারা জন্মলাভ করে। এই ধারা পরবর্তীকালে এরিস্টটল থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় দার্শনিকদের চিন্তার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আধুনিক যুগের দার্শনিকদের জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এই জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারা বুদ্ধিবাদী, এবং প্রধানত তা ভাববাদী তত্ত্ববিদ্যার সঙ্গে সঙ্গতিপূৰ্ণ

প্লেটোর জ্ঞানবিদ্যা

সোফিস্ট ও সক্রেটিসের জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদের উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার প্রারম্ভিক যুগে সোফিস্টগণ যে অভিজ্ঞতাবাদী ও নঞর্থক সংশয়বাদী ধারার সূচনা করেন সক্রেটিস সে ধারার স্থলে জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার ভূমিকার স্বীকৃতি দিয়ে একটি নতুন ধারা প্রবর্তন করেন যাতে বুদ্ধিবাদের প্রবর্তন হয়। সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো সোফিস্টদের মতবাদ খণ্ডন করে সক্রেটিস প্রবর্তিত জ্ঞানবিদ্যাগত ধারাকে সমর্থন করে তাঁর মতবাদ দেন।

প্লেটোর জ্ঞানবিদ্যা তাঁর কোনো একটি বিশেষ ডায়ালগ-এ সুস্পষ্টভাবে আলোচিত হয়নি। বরং বিভিন্ন ডায়ালগ-এ প্রসঙ্গক্রমে আলোচিত হয়েছে। তাঁর জ্ঞানবিদ্যার দুটি দিক। নঞর্থক ও সদর্থক। নঞর্থক দিকটিতে তিনি মূলত সোফিস্টদের অভিজ্ঞতাবাদী তথা সংশয়বাদী জ্ঞানবিদ্যার সমালোচনা করেন। সদর্থক দিকে তিনি জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কে নিজস্ব মতবাদ প্রদান করেন। প্লেটো তাঁর থিয়াটিটাস নামক গ্রন্থে জ্ঞান সম্পর্কিত জটিল ধ্যান ধারণা ব্যক্ত করেন।[৬] তবে এ আলোচনা মূলত নঞর্থক। এতে সোফিস্টদের অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদকে খণ্ডন করা হয়েছে। থিয়াটিটাস-এর পূর্ববর্তী বিখ্যাত রচনা রিপাবলিক-এ তিনি তাঁর জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কিত সদর্থক মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। সুতরাং বলা যায়, প্লেটো জ্ঞান সম্পর্কে তাঁর নঞর্থক মতবাদের আগেই সদর্থক মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ জ্ঞানের প্রকৃতি কী—এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই তিনি অন্যান্য জ্ঞান সম্পর্কিত মতবাদের সমালোচনা করেন। এ

প্লেটোর দর্শনে প্রাক-প্লেটো গ্রিক দর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট। আয়োনিয় দার্শনিক হিরাক্লিটাসের মতে, জগৎ পরিবর্তনশীল। প্লেটো এ মত গ্রহণ করেন। তবে তিনি একে শুধু দৃশ্যমান জগতের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখায় প্রয়াসী ছিলেন। এলিয়াটিক দার্শনিকদের মত হলো, সত্তার জগৎ অপরিবর্তনশীল। এই মতকেও প্লেটো গ্রহণ করেন। পারমেনাইডিসের অপরিবর্তনশীল সত্তার ধারণাকে তিনি শাশ্বত ধারণার জগতে প্রতিস্থাপিত করেন। পরমাণুবাদীদের সঙ্গে একমত হয়ে তিনি বলেন যে, জগৎ বৈচিত্র্যময়। কিন্তু পরমাণুর বহুত্বকে তিনি ধারণা বা আকারের বহুত্ব দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেন। অ্যানাক্সোগোরাসের সঙ্গে একমত পোষণ করে প্লেটো মনকে জগতের একটি শক্তিশালী উপাদান বলে স্বীকার করেন। এছাড়া, সমসাময়িক গ্রিক দার্শনিকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তিনি যথার্থ সত্তাকে বৌদ্ধিক বলে মত প্রকাশ করেন। জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে প্লেটো তাঁর পূর্ববর্তী সোফিস্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে একমত যে, ইন্দ্ৰিয় অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান সংশয়াত্মক। আবার সক্রেটিসের সঙ্গে একমত হয়ে তিনি বলেন, যথার্থ জ্ঞান একমাত্র প্রত্যয় বা ধারণার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। এ কারণে পাশ্চাত্য দর্শনের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ফ্রাংক থিলি প্লেটোর দর্শনকে তাঁর পূর্ববর্তী গ্রিক দর্শনের পরিপক্ব ফল বলে আখ্যায়িত করেন।

প্লেটোর দর্শনে, এমনকি তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদে, তাঁর সময়ের বিদ্যমান সামাজিক অবস্থার প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়। প্লেটোর শিক্ষাগুরু সক্রেটিসের সময়েই এথেন্সের গণতন্ত্রের মহান নায়ক পেরিক্লেশ-এর মৃত্যু হয়। এই সময়ে এথেন্সের গণতন্ত্রে অবক্ষয়ের সূচনা। সোফিস্ট দার্শনিকগণ তা থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকবেলা করেন। কিন্তু সোফিস্টদের ব্যক্তিসাপেক্ষ পরিবর্তনশীল জ্ঞানবিদ্যাগত ও নৈতিক মানদণ্ড এথেন্সের জন্য কোনো সর্বজনীন স্থিতিশীল আদর্শ স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। তাই সক্রেটিস সোফিস্টদের ব্যক্তিসাপেক্ষ জ্ঞানবিদ্যাগত ও নৈতিক মানদণ্ডের সমালোচনা করে ব্যক্তিনিরপেক্ষ সর্বজনীন জ্ঞানবিদ্যাগত ও নৈতিক মানদণ্ড প্রচার করেন। কিন্তু আজীবন নৈতিকতা ও জ্ঞানের অনুশীলনকারী এই অবিস্মরণীয় পণ্ডিতকে এথেন্সের তথাকথিত বিচার ব্যবস্থা মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। প্লেটোর উপর তাঁর শিক্ষাগুরু সক্রেটিসের শিক্ষা ও জীবনাবসানের গভীর প্রভাব পড়ে।

প্লেটো যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তাঁর জন্মভূমি এথেন্স প্রতিবেশী রাষ্ট্র স্পার্টার বিরুদ্ধে দীর্ঘকালীন যুদ্ধের পর পরাভূত, এবং জাতীয় সংকটের সম্মুখীন। এই পরাজয়ের কারণ ছিল এথেন্সের তথাকথিত গণতন্ত্র। অচিরেই এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন ঘটে এবং ক্রমান্বয়ে আরো দুটি সরকার পরিবর্তিত হয়। কিন্তু এথেন্সের সামাজিক রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকটের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। এসব সরকারের হাতেই সক্রেটিসকে নির্যাতিত হতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করতে হয়। প্লেটো এই অবস্থা থেকে স্থায়ী মুক্তির লক্ষ্যে এথেন্সের জন্য একটি আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিকল্পনা করেন। এতে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার থাকবে রাষ্ট্রের জ্ঞানী ব্যক্তির হাতে এবং এটি হবে একটি সুশৃঙ্খল নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা প্রদানকারী ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র। এজন্যই তিনি তাঁর শিক্ষাগুরু সক্রেটিসের সঙ্গে একমত ঘোষণা করে, সোফিস্টদের ব্যক্তিভিত্তিক ন্যায়পরায়ণতার সমালোচনা করেন। তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে সর্বজনীন ন্যায়পরায়ণতার মানদণ্ড সমর্থন করেন। প্লেটোর জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদেও তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের সর্বজনীনতার মূল আদর্শের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি রাষ্ট্রের মতো জ্ঞানের ক্ষেত্রেও সর্বজনীনতার আদর্শকে সমর্থন করে ব্যক্তিভিত্তিক অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদকে অযথার্থ বলেন। সুতরাং একথা বলা যায়, প্লেটোর জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদে তাঁর শিক্ষাগুরু সক্রেটিসের মতবাদের প্রভাব এবং তৎকালীন এথেন্সের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবস্থার প্রতিক্রিয়া ছিল স্পষ্ট।

প্লেটোর মতে, কোনো কিছুকে জ্ঞান হতে হলে তা অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে। সোফিস্টগণ অভিজ্ঞতাকেই জ্ঞানোৎপত্তির মাধ্যম হিসেবে অভিহিত করে সর্বজনীন ও নিশ্চিত জ্ঞানকে অসম্ভব বলেন। ফলে সংশয়বাদের বীজ বপন করা হয়। কিন্তু প্লেটোর মতে, যেহেতু গণিতে নিশ্চিত জ্ঞান পাওয়া যায় সেহেতু নিশ্চিত জ্ঞান সম্ভব। সুতরাং সংশয়বাদীদের যুক্তি ভ্রান্ত। তবে অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চিত জ্ঞান পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে তিনি দুটি যুক্তির উল্লেখ করেন। প্রথমত, অভিজ্ঞতা কখনও নিশ্চিত জ্ঞান দিতে পারে না, এবং দ্বিতীয়ত, গাণিতিক উক্তিতে যে জ্ঞান প্রকাশ করা হয় তা অভিজ্ঞতাজাত বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞান নয়।[১০] সুতরাং প্লেটোর মতে, মানুষের মনই হলো জ্ঞানের অবস্থানকেন্দ্র। মানুষের দেহ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শুধু বিভ্রান্তিকর ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা উৎপন্ন করে।

প্লেটো জগৎকে দুই ভাগে ভাগ করেন। ধারণার জগৎ বা বৌদ্ধিক জগৎ, এবং অবভাসের জগৎ বা বাস্তব জগৎ।[১১] ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার বিষয়বস্তু হিসেবে যেমন বাস্তব জগৎ অস্তিত্বশীল তেমনি মানসিক অভিজ্ঞতার বিষয়বস্তু হিসেবে ধারণার জগৎ অস্তিত্বশীল। তাঁর মতে, ধারণার জগৎই যথার্থ সত্য বা সত্তার জগৎ। এই জগৎকে আকারের (form) জগৎও বলা হয়। মন বিশুদ্ধ বুদ্ধির মাধ্যমে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে আকারের জগতের জ্ঞান পায়। তাই যথার্থ জ্ঞানের বিষয়বস্তু হলো আকার, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নয়। বুদ্ধি হলো মনের সেই বৃত্তির নাম যার সাহায্যে মন আকারের জগতের জ্ঞান পেতে পারে। সুতরাং ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা শুধু বাস্তব জগতের জ্ঞান পায় যা অনিশ্চিত। কিন্তু বুদ্ধি আকার বা ধারণার জ্ঞান পায় যা নিশ্চিত। আকার শাশ্বত ও অপরিবর্তনশীল বলেই তা নিশ্চিত।

উল্লেখ্য যে, প্লেটো আকার বা ধারণা বলতে বস্তুগত সার্বিক ধারণা বা আকারকে বুঝিয়েছেন। এই ধারণা বা আকার এক নয়, বরং বহু। তা বিমূর্ত এবং বিশেষ থেকে স্বতন্ত্র হয়ে মন-নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল। আকার বা ধারণা মানসিকও নয়, জড়ীয়ও নয়। তবে বাস্তব। আকার ও বিশেষের মধ্যে সম্পর্ক হলো অনুকরণ ও অংশ গ্রহণের সম্পর্ক। প্রতিটি বিশেষই তার অনুরূপ আকার বা ধারণায় অংশগ্রহণকারী।[১২] প্লেটোর এই মতবাদকেই ধারণাবাদ বা আকারবাদ বলা হয়। এ মতবাদই তাঁর জ্ঞানবিদ্যার মূলসূত্র। তিনি তাঁর এই মতবাদের মাধ্যমে সোফিস্টদের অভিজ্ঞতানির্ভর সংশয়বাদী জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদের হাত থেকে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যাকে রক্ষা করেন এবং পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে বুদ্ধিবাদী ধারার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনিই প্রথম দার্শনিক যিনি দর্শনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অভিমত বা বিশ্বাসকে জ্ঞান থেকে পৃথক করেন এবং একথা বলেন যে, অভিমত বা বিশ্বাস ইন্দ্রিয় নির্ভর। তাই তা পরিবর্তনশীল এবং আপেক্ষিক। কিন্তু জ্ঞান বুদ্ধিনির্ভর। তাই জ্ঞান নিশ্চিত।[১৩]

অবশ্য একথা সত্য যে, প্লেটো তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদের জন্য সক্রেটিসসহ অন্যান্য পূর্ববর্তী দার্শনিকের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। কারণ, প্লেটোর ধারণা সম্পর্কিত মতবাদের উপর তাঁর পূর্ববর্তী তিনটি উৎসের প্রভাব দেখা যায়। এলিয়াটিক দার্শনিকদের কাছ থেকে তিনি পরমসত্তার ধারণা, হিরাক্লিটাসের কাছ থেকে পরিবর্তনের ধারণা, যা তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের উপর আরোপ করেন, এবং সক্রেটিসের কাছ থেকে প্রত্যয় বা ধারণা সম্পর্কিত মতবাদের ধারণা গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়। এসত্ত্বেও ফ্রাংক থিলির মতে, প্লেটোর ধারণা মতবাদ হলো তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক দার্শনিক কৃতিত্ব। তাঁর মতে, যদিও পিথাগোরিয়ানদের সংখ্যামরমীবাদ, পারমেনাইডিসের শাশ্বত সত্তা, হিরাক্লিটীয় জ্ঞানজ-মতবাদ, অ্যানাক্সোগোরাসের গুণগত পরমাণুবাদ, এবং সর্বোপরি, সক্রেটিসের ধারণা বা প্রত্যয় সম্পর্কিত মতবাদ দ্বারা প্লেটোর ধারণা মতবাদের পথ নির্মিত হয়েছিল তবুও সার্বিকতা সম্পর্কিত মতবাদকে পরিপূর্ণ আধিবিদ্যক মর্যাদা দেওয়ার সমস্ত কৃতিত্বই প্লেটোর প্রাপ্য।[১৪]

প্লেটোর জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদ দ্বারা পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার ক্ষেত্রে যে দুটি নতুন বিষয়ের দিক নির্দেশ করা হয় তার প্রথমটি হলো, জ্ঞানের পরিচিতি দান। অর্থাৎ জ্ঞান থেকে অভিমত বা বিশ্বাসকে আলাদা করে অপরিবর্তনশীল আকারের জগতের বিষয়রূপে, শুধুমাত্র নিশ্চিত ও সন্দেহাতীত অবধারণ বা উক্তির মধ্যে জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করা। দ্বিতীয়টি হলো, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা শুধু অভিমত বা বিশ্বাসের উৎস হতে পারে, যথার্থ জ্ঞান দিতে পারে না, এই ঘোষণা দেওয়া।[১৫] এই ঘোষণার ফলেই জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা সংশয়বাদের হাত থেকে রক্ষা পায়। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার প্লেটো পরবর্তী বুদ্ধিবাদী ধারা প্লেটোর এ দুটি বিষয় দ্বারা কোনো না কোনো অর্থে প্রভাবিত হয়েছে। আকারকে জানার জন্য মনের যে বৃত্তিকে প্লেটো বুদ্ধি বলেছেন সকল বুদ্ধিবাদী দার্শনিকই একে স্বীকার করে নিয়েছেন। অন্যদিকে, অভিজ্ঞতাবাদী ধারা সব সময়ই প্লেটোর এ দুটি বিষয়ের বিরোধিতা করেছে। বিশেষত, প্লেটোর বুদ্ধি নামক বৃত্তিকে অভিজ্ঞতাবাদীরা সর্বোতভাবে বর্জন করেছেন।

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, প্লেটোই প্রথম দার্শনিক যিনি পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে জ্ঞানকে প্রথম নিশ্চিতির বিষয় হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি একথা স্পষ্টভাবে স্বীকার করেন যে, মানুষ গণিতের জ্ঞানের মতো নিশ্চিত ও সর্বজনস্বীকৃত জ্ঞান পেতে পারে। জ্ঞান ও অভিমত বা বিশ্বাসের মধ্যে তিনিই প্রথম সুস্পষ্ট পার্থক্য করেন এবং জ্ঞানকে নিশ্চিতির বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রথম বারের মতো জ্ঞানের নির্দিষ্ট পরিচিতি দান করেন। এর ফলে যথার্থ ও অযথার্থ জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যকরণ সম্ভব হয়। এছাড়া, তিনিই প্রথম দার্শনিক যিনি ইন্দ্রিয় দ্বারা যথার্থ জ্ঞান পাওয়া যায় না একথা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন এবং বিশুদ্ধ বুদ্ধিকে যথার্থ জ্ঞানোৎপত্তির একমাত্র মাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত করার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে বুদ্ধিবাদের প্রবর্তন করেন।

এরিস্টটলের জ্ঞানবিদ্যা

প্লেটোর জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কে উপর্যুক্ত আলোচনায় দেখা যায়, প্লেটো তাঁর পূর্ববর্তী সোফিস্টদের জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার বিরোধিতা করে তাঁর গুরু সক্রেটিসের জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার অনুসরণ করেন। এর ফলে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে বুদ্ধিবাদী ও ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি স্থাপিত হয়। প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রি.পূ.) তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদ দিতে গিয়ে প্লেটো দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি মূলত প্লেটোর প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিবাদ ও ভাববাদের ত্রুটি নিরসন করে তাঁর মতবাদকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হন। এরিস্টটল তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদে অনেক ক্ষেত্রেই প্লেটোর সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।

প্লেটোর মতোই এরিস্টটল মনে করেন, আমরা বিশেষ বস্তু সম্পর্কে যা জানি তা বিশেষের মধ্যেই আমরা সার্বিককে জানি। অন্তঃস্যূত।[১৬]

জ্ঞান হলো সার্বিক বা আকারের জ্ঞান। সার্বিকের দৃষ্টান্ত হিসেবে জানি। তবে এরিস্টটলের সার্বিক বিশেষের মধ্যেই সার্বিকের জ্ঞানকে যথার্থ বলার পরও এরিস্টটল প্লেটোর ধারণা বা আকারবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর মতে, প্লেটোর আকার বা ধারণাবাদে জাতি বা সার্বিক এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় বা বিশেষের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে এদের সম্বন্ধ বোধগম্য হয় নি। প্লেটো ধারণা বা আকারকে ব্যক্তি বা বিশেষের অতিবর্তী বিমূর্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বিশেষকে আকারের ছায়ামাত্র বলেছেন। কিন্তু এরিস্টটল জাতিকে ব্যক্তির মধ্যে অন্তঃস্যূত বা মূর্ত সত্তা বলে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ বিশেষের মধ্যেই আকার বা সর্বজনীন অন্তর্নিহিত আছে।

প্লেটো আকার বা ধারণার জগতের যথার্থতা প্রচার করতে গিয়ে দৃশ্যমান বা পরিবর্তনশীল জগৎকে অবভাস বা অযথার্থ বলে উল্লেখ করেন। তিনি পরিবর্তনের জগতের জ্ঞানকে অভিমত বা অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান এবং আকারের জ্ঞানকে ধারণাপ্রসূত জ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতে, প্রথম প্রকার জ্ঞান অযথার্থ এবং দ্বিতীয় প্রকার জ্ঞান যথার্থ। কিন্তু এরিস্টটল অভিমত বা অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান এবং ধারণা বা বুদ্ধিপ্রসূত জ্ঞানের এই পার্থক্য স্বীকার করেন না। তিনি অভিমত বা পরিবর্তনশীল জগতের অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞানের তাৎপর্য স্বীকার করে প্লেটোর একদেশদর্শিতার প্রতিবাদ করেন। তাঁর মতে, এ পরিবর্তনশীল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ থেকেই সার্বিকের ধারণাকে খুঁজে পেতে হবে। অর্থাৎ প্লেটো যেখানে অভিজ্ঞতাপ্রসূত জগতের জ্ঞানকে ধারণার জগতের ছায়া মনে করেছেন এরিস্টটল সেখানে অভিজ্ঞতার জগতের মধ্যে সার্বিকের জগৎ অন্তঃস্যূত বলেছেন। তাই প্লেটো অভিজ্ঞতাকে বর্জন করে আকার বা ধারণাকে গ্রহণ করলেও এরিস্টটল আকারের বা সার্বিকের জন্য অভিজ্ঞতার জগতের গুরুত্ব স্বীকার করেন। এছাড়া তিনি প্লেটোর মতের বিরোধিতা করে তথ্যসমৃদ্ধ অভিজ্ঞতাকেও জ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি দেন।[১৭]

এরিস্টটল মানুষের দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানপদবাচ্য বিষয়গুলোকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেন। একটি হলো তত্ত্বগত বিজ্ঞান, অন্যটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান। তাঁর মতে, তত্ত্বগত বিজ্ঞানের জ্ঞান আবশ্যিকভাবে মানুষের কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিরপেক্ষভাবে সত্য। তত্ত্বগত বিজ্ঞানের সত্য উক্তি সব সময়ই সত্য। তত্ত্বগত বিজ্ঞানের জ্ঞানকে এরিস্টটল নিশ্চিত ও স্বপ্রমাণিত নিয়মাবলি থেকে অনুসৃত বলে মনে করেন। এই জ্ঞানকে জানার জন্য কেউ সত্যিকার অর্থে আগ্রহী হলে এবং যথার্থ পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করলে তার পক্ষে নিশ্চিত জ্ঞান সম্ভব। ফলে প্লেটোর মতো এরিস্টটলও পূর্ণ সংশয়বাদকে প্রত্যাখ্যান করেন। এরিস্টটলের কাছে ব্যবহারিক বিজ্ঞান হলো মানুষের অভিজ্ঞতার ফসল। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এবং অন্যান্য মানুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের মধ্যে থেকে যে সাধারণ নিয়মাবলি পাওয়া যায় তা ব্যবহারিক বিজ্ঞানের জ্ঞান।[১৭]

এরিস্টটলের তত্ত্বগত বিজ্ঞানের জ্ঞানের সীমার সাথে প্লেটো নির্দেশিত নিশ্চিত জ্ঞানের সীমার সাদৃশ্য বিদ্যমান। কিন্তু এরিস্টটলের ব্যবহারিক বিজ্ঞানের জ্ঞানকে প্লেটো যথার্থ জ্ঞান বলে স্বীকৃতি দেননি। ফলে এরিস্টটলের হাতে প্লেটোর জ্ঞানের সীমা বিস্তৃতিলাভ করে এবং ব্যবহারিক বিজ্ঞানগুলোও যথার্থ জ্ঞান পদবাচ্য হয়। বর্তমান কালে জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, নীতিবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং সাহিত্য সমালোচনা বলতে যা বোঝানো হয় তা এরিস্টটলের ব্যবহারিক বিজ্ঞানপ্রসূত জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। এরিস্টটলই প্রথম মানুষের জ্ঞানের এই ব্যবহারিক শাখাগুলোকে বিজ্ঞান, বিশেষত যথার্থ জ্ঞানের বিষয়, হিসেবে মূল্যায়িত করেন। জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে এটা তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান। এর ফলেই অধিবিদ্যার সাথে অভিজ্ঞতালব্ধ বিজ্ঞান তথা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের জ্ঞানকেও যথার্থ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ বিষয়টি জ্ঞানের সীমা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে প্লেটোর সাথে এরিস্টটলের পার্থক্য সূচিত করে। প্লেটো যেখানে নিশ্চিত জ্ঞানের বিষয়কে আবশ্যিকভাবেই অপরিবর্তনশীল বলে মনে করেন এরিস্টটল সেখানে ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে জ্ঞানের আওতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন। এর ফলে পরিবর্তনশীল বিষয়ের নিশ্চিত জ্ঞান পাওয়া সম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়।

প্লেটোর সঙ্গে এরিস্টটলের যে পার্থক্যটি উল্লেখযোগ্য তা হলো, প্লেটোর জ্ঞানবিদ্যায় ধারণা বাস্তব জগতের বা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের বস্তুর সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়াই অস্তিত্বশীল। কিন্তু এরিস্টটলের জ্ঞানবিদ্যায় আকার বা ধারণা বাস্তব জগতের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়া অস্তিত্বশীল নয়। তাই এরিস্টটলের মতে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশেষ বিষয়ই একমাত্র অস্তিত্বশীল হয় এবং মানুষের সকল জ্ঞানই ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার বিষয়। অর্থাৎ মানুষের জ্ঞান এরিস্টটল যাকে মুখ্য দ্রব্য (Primary Substance) বলেছেন তার উপর নির্ভরশীল। কারণ, মুখ্য দ্রব্যগুলোই একমাত্র অস্তিত্বশীল এবং এগুলো অস্তিত্বশীল না হলে অন্য কিছুই অস্তিত্বশীল হতে পারত না।

এরিস্টটল প্লেটোর সঙ্গে ভিন্নমত, এমনকি বিপরীত মত প্রকাশ করে পরিবর্তনশীল বাস্তব জগতের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুকে জ্ঞানের বিষয় হিসেবে গণ্য করেন। তবে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাই যে জ্ঞান পদবাচ্য নয় এ ব্যাপারে তিনি প্লেটোর সাথে একমত। তিনি জ্ঞানকে একটি ক্ষমতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। এই ক্ষমতা দ্বারা মানুষ কোনো কিছু উপলব্ধি করে এবং কোনো বস্তু কেন এ বস্তু তা ব্যাখ্যা করে। অর্থাৎ তাঁর মতে, কোনো বস্তুর নিজের সম্পর্কিত জ্ঞানকে ঐ বস্তুর জ্ঞান বলা যায় না, বরং বস্তুটির কারণ, নিয়ম ইত্যাদি যে সব বিষয় বস্তুটিকে এই বস্তুতে পরিণত করেছে সে সব বিষয়ের জ্ঞানই হলো এই বস্তুর জ্ঞান।[১৮] তাই কোনো কিছু সম্পর্কে জ্ঞান পেতে হলে তাকে জাতি বা কারণ ও উপজাতির অন্তর্ভুক্ত করে দেখতে হবে যে এর আবশ্যিক উপাদান বা বিভেদক লক্ষণ কী?১৯] এভাবে জাতির বা কারণের অন্তর্ভুক্ত করে কোনো বিশেষ বস্তুর সারসত্তা বা বিভেদক লক্ষণ খুঁজে বের করার অর্থ হলো আদি কারণ থেকে বস্তুটির যে সারসত্তা নির্দেশিত হয় তা প্রতিপাদন করা। এরিস্টটলের মতে, এটাই বিজ্ঞানের কাজ। আদি কারণকে একমাত্র বুদ্ধির মাধ্যমে জানা যায় বলে এরিস্টটল মনে করেন।[২০] এ কারণেই তিনি বুদ্ধিবাদী।

সুতরাং এরিস্টটলীয় মতবাদ অনুসারে যদিও বিশেষ বা স্বতন্ত্র বস্তু, বা মুখ্য দ্রব্যই একমাত্র অস্তিত্বশীল তবুও জ্ঞান বলতে এসব স্বতন্ত্র মুখ্য দ্রব্যের জ্ঞান বোঝায় না। বরং জ্ঞান হলো এদের সে সব আবশ্যিক গুণাবলির জ্ঞান যা একটি বিশেষ বস্তুকে অন্য বিশেষ বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত করে। প্লেটোর ধারণাবাদের সমস্যা ছিল ধারণা বা আকার হিসেবে ‘লাল’ কীভাবে বিভিন্ন বিশিষ্ট লাল রং-ধারী বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত হবে তা নির্ণয় করা। এরিস্টটলের হাতে এই সমস্যার সমাধান হয়। কারণ, এরিস্টটল বিভিন্ন বিশিষ্ট, লাল বস্তুর মধ্যে থেকেই ‘লাল’–এর আকার বা সার্বিক ধারণা বা সারসত্তাকে গঠন করেন।

এছাড়া, প্লেটো সকল প্রকার পরিবর্তনকে জ্ঞানের জগতের বহির্ভূত রেখেছিলেন। এরিস্টটলের মতে, ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য জগতের বস্তুগুলো পরিবর্তিত হলেও এদের মধ্যে একটি অপরিবর্তনীয় বিষয় আছে যা হলো এর বিভেদক লক্ষণ বা সারসত্তা। এই সারসত্তাই হলো বস্তুগুলোর আকার, এবং আকারই জ্ঞানের বিষয়বস্তু। বস্তুর বাহ্যিক যে পরিবর্তন ঘটে তা হলো বস্তুর অবান্তর লক্ষণের পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের মধ্যেও বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞানের বিষয়বস্তু অর্থাৎ বিভেদক লক্ষণ বা আবশ্যিক গুণাবলি বা সারসত্তা অপরিবর্তনশীল। এভাবে এরিস্টটল একদিকে যেমন প্লেটো দ্বারা বর্জিত ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার বিষয়কে জ্ঞানের রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন অন্যদিকে তেমনি প্লেটোর সঙ্গে একমত হয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর জ্ঞানকে যথার্থ জ্ঞান না বলে এদের আবশ্যিক গুণ বা আকারের জ্ঞানকে যথার্থ জ্ঞান বলেন। আকারই হলো সার্বিক। এরিস্টলের সার্বিকের সাথে আকারগত দিক থেকে প্লেটোর ধারণা বা আকারে মিল লক্ষণীয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, এরিস্টটলের হাতেই যুক্তিবিদ্যার জন্ম। বিভেদক লক্ষণ, অবান্তর লক্ষণ, ইত্যাদি যুক্তিবিদ্যার ধারণা। এরিস্টটল যুক্তিবিদ্যার ধারণা দ্বারা তত্ত্ববিদ্যাকে ব্যাখ্যা করেছেন।

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, এরিস্টটল প্লেটোর দ্বারা নির্দেশিত জ্ঞানের সীমাকে ধারণার জগৎ থেকে বিশেষ বস্তুর জগতে নিয়ে আসেন এবং জ্ঞানের জন্য বিশেষ বস্তুর ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতাকে আবশ্যিক বলে ঘোষণা করেন। বিশেষ বস্তুর সারসত্তা বা বিভেদক লক্ষণ থেকেই বিশেষ বস্তুর আকার পাওয়া যায়। এই আকার যে আদি কারণ থেকে নিসৃত হয় সে কারণই হলো বিশেষ বস্তুর মূল নীতিমালা এবং মূল নীতিমালার জ্ঞানই যথার্থ জ্ঞান। বিশেষ বস্তুর জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পাওয়া গেলেও বিশেষ বস্তুর সারসত্তা বা আদি কারণ বা মূল নীতিমালার জ্ঞান পাওয়া যায় বুদ্ধির মাধ্যমে। এরিস্টটল বুদ্ধিকে যথার্থ জ্ঞানের উপায় বলে সক্রেটিস ও প্লেটো নির্দেশিত বুদ্ধিবাদী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আবার আকার বা সার্বিককে যথার্থ জ্ঞানের বিষয়বস্তু বলায় তিনি প্লেটোর মতোই ভাববাদী। সুতরাং বলা যায়, এরিস্টটল প্লেটো প্রদত্ত জ্ঞানের সীমাকে ধারণার জগৎ থেকে বাস্তব জগৎ পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। অন্যদিকে তিনি জ্ঞানবিদ্যার মূলনীতিতে প্লেটোর সাথে একমত হয়ে, আরো বিশেষভাবে বললে প্লেটোর মতের সংশোধন করে, ভাববাদী ও বুদ্ধিবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদই প্রচার করেন।

এরিস্টটল-পরবর্তী জ্ঞানবিদ্যা

সোফিস্টদের থেকে শুরু করে এরিস্টটল পর্যন্ত পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসের উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানের একমাত্র উপায় হিসেবে ধরে নিয়েই সোফিস্টগণ পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে জ্ঞানবিদ্যাগত আলোচনার সূত্রপাত করেন। তাঁদের কাছে জ্ঞান ছিল আপেক্ষিক বিষয়। তাঁরা সর্বজনীন জ্ঞানের অস্তিত্ব স্বীকার করেন নি। তাঁদের জ্ঞানতাত্ত্বিক আপেক্ষিকতাবাদ শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে, তাঁরা বস্তুর যথার্থ জ্ঞান পাওয়া সম্ভব নয় বলে মত প্রকাশ করেন। তাঁদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অভিজ্ঞতাবাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে নঞর্থক সংশয়বাদে পরিণত হয়। এর ফলে জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে একটি নঞর্থক ভাবধারার সূচনা হয়। কিন্তু সোফিস্ট-পরবর্তী দার্শনিক সক্রেটিস নৈতিক অবক্ষয়গ্রস্ত গ্রিসে সর্বজনীন নৈতিকতার মানদণ্ড নির্ধারণের লক্ষ্যে সোফিস্টদের আপেক্ষিকতাবাদী এবং অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যার বিরোধিতা করে জ্ঞানের জন্য প্রজ্ঞার ভূমিকা স্বীকার করেন। ফলে জ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বজনীনতাবাদী ও বুদ্ধিবাদী ধারার গোড়াপত্তন হয়। এই ধারা প্লেটো ও এরিস্টটল কর্তৃক অনুসৃত ও পরিশোধিত হয়ে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবাদ নামে একটি গঠনমূলক ধারার জন্ম দেয়।

এরিস্টটলের পরবর্তীকালে দুজন সমসাময়িক দার্শনিক প্রাচীন গ্রিক দর্শনে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁরা হলেন এপিকিউরীয় দার্শনিক আন্দোলনের প্রবক্তা এপিকিউরিয়াস (৩৪১-২৭০ খ্রি.পূ.) এবং স্টোয়িক দার্শনিক জেনো (৩৩৬-৩৬৪ খ্রি.পূ.)। তাঁরা সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটলের মতো প্রধানত নীতিবিদ্যার সাথে সম্পর্কিত করে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা করেন। অর্থাৎ নৈতিকতার যৌক্তিক ভিত্তি আবিষ্কারের লক্ষ্যে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা করেন। স্টোয়িকগণ দর্শনকে এমন একটি জমি হিসেবে আখ্যায়িত করেন যার বেড়া হলো জ্ঞানবিদ্যা বা যুক্তিবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা যার ভূমি এবং নীতিবিদ্যা যার ফল।[২১] এই দুজন দার্শনিকই জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে সোফিস্টদের প্রবর্তিত ধারাকে অনুসরণ করেন এবং সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটলীয় ধারার বিরোধিতা করেন। সোফিস্টদের মতো এপিকিউরিয়াসও সংবেদনকেই একমাত্র জ্ঞানের উৎস হিসেবে অভিহিত করে অভিজ্ঞতাবাদী ধারার অনুসরণ করেন। তবে, সোফিস্টদের চেয়ে এপিকিউরীয় দার্শনিকগণ বিজ্ঞানের প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন।[২২] কারণ, এ সময়ে বিজ্ঞান ও গণিতের ক্ষেত্রে গ্রিক চিন্তাবিদগণ সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করেন। এপিকিউরীয়দের অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাকে তথা জ্ঞানের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ নির্ভরতাকে তৎকালীন আলেকজান্দ্রিয়ার বিজ্ঞানের সাফল্যের প্রভাব হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।

উল্লেখ্য যে, এপিকিউরিয়াস জ্ঞানের ক্ষেত্রে সোফিস্টদের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেও তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদে সোফিস্টদের নঞর্থক সংশয়বাদের ইঙ্গিত ছিল না। কারণ, তিনি বিশেষ মূর্ত বস্তুকেই একমাত্র বাস্তব সত্তা বলেন এবং বিশেষ বস্তুর সংবেদনকে যথার্থ জ্ঞান বলে অভিহিত করেন। শুধু তাই নয়, তিনি সংবেদনকে জ্ঞান ও সত্যতার মানদণ্ড হিসেবে ও স্বীকৃতি দেন। তাঁর মতে, আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তাই সত্য। ভ্রান্তি বা অধ্যাস ইন্দ্রিয়ের ত্রুটি নয় বরং সংবেদনের ভুল ব্যাখ্যামাত্র। এছাড়া, তিনি পর্যবেক্ষণের পুনরাবৃত্তি এবং অপরের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে নিজের পর্যবেক্ষণের তুলনা করে ভ্রান্ত অবধারণকে শুদ্ধ করে নেওয়া যায় বলেও মত প্রকাশ করেন।

এপিকিউরিয়াসের অভিজ্ঞতাবাদের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলা যায়, সোফিস্টগণ পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার সূত্রপাত করার সাথে সাথে অভিজ্ঞতাবাদের বীজ বপন করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদ নঞর্থক সংশয়বাদে পর্যবসিত হয়। সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটল মূলত এই ধারারই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বুদ্ধিবাদী মতবাদ গড়ে তোলেন। কিন্তু এপিকিউরিয়াসই প্রথম ধ্বংসমূলক অভিজ্ঞতাবাদী এই ধারাকে গঠনমূলক খাতে প্রবাহিত করে অভিজ্ঞতাবাদের সুসঙ্গত ব্যাখ্যা দেন। অভিজ্ঞতাবাদের ক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকার জন্য ঐতিহাসিক ফ্রাংক থিলি এপিকিউরিয়াসকে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে অভিজ্ঞতাবাদের প্রবর্তক হিসেবে অভিহিত করেন।[২৩] এছাড়া, এপিকিউরিয়াস সম্পর্কে এ কথাও বলা হয় যে, প্রাচীন জগতে অভিজ্ঞতাবাদী বলে কেউ থেকে থাকলে তিনি হলেন প্রখ্যাত গ্রিক পরমাণুবাদী এপিকিউরিয়াস।[২৪]

স্টোয়িক দার্শনিক জেনো এপিকিউরিয়াসকে সমর্থন করে অভিজ্ঞতাবাদের আরো সুসঙ্গত ব্যাখ্যা দেন। জন্মের সময় মন ‘টেবুলে রাসা’ অর্থাৎ সাদা কাগজের মতো থাকে এই তথ্য তিনিই আবিষ্কার করেন। এই ধারণাকে আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জন লক সরাসরি গ্রহণ করেছেন। এছাড়া, যখন তিনি ইন্দ্রিয়ছাপ এবং ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে স্মৃতি প্রতিরূপ গঠিত হওয়ার মাধ্যমে জ্ঞান গঠনের পদ্ধতির কথা বলেন তখন হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের জ্ঞান গঠন প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সর্বোপরি, অভিজ্ঞতাবাদের প্রতিনিধিত্ব করলেও জেনো বুদ্ধির উপাদানকে একেবারে বর্জন করেন নি। বরং আংশিকভাবে এরিস্টটলীয় ধারায় প্রভাবিত হয়ে জ্ঞানের জন্য অভিজ্ঞতালব্ধ উপাদানগুলো থেকে সক্রিয় চিন্তাপদ্ধতির দ্বারা সার্বিক ধারণা গঠনের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ আমাদের জ্ঞানের মূল উপাদান প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে বাহ্যজগত থেকেই সংগৃহীত হয়। কিন্তু এসব উপাদান মনের বা প্রজ্ঞার সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া যথার্থ জ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে না। জার্মান দার্শনিক কান্ট বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদকে সমন্বিত করে আধুনিক যুগে যে যুগান্তকারী বিচারবাদী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন তার উপর স্টোয়িকদের উপরিলিখিত প্ৰজ্ঞাস্বীকৃত অভিজ্ঞতাবাদের প্রভাব স্পষ্ট।

এ পর্যন্ত আলোচনা থেকে প্রাচীন গ্রিক জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে সোফিস্ট- এপিকিউরিয়াস-জেনো সমর্থিত অভিজ্ঞতাবাদী এবং সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটল সমর্থিত বুদ্ধিবাদী, এই দুটি মূল ধারা পরিলক্ষিত হয়। এ দুটি ধারার পাশাপাশি সংশয়বাদ নামক অন্য একটি জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার অস্তিত্বও প্রাচীন পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে দেখা যায়। নিম্নে এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া গেল।

সক্রেটিস এবং সক্রেটিস-উত্তর যেসব দার্শনিক সোফিস্টদের সংশয়বাদী আক্রমণ থেকে জ্ঞানের ও সত্যের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে রক্ষা করেছিলেন তাঁদের দার্শনিক অনুসন্ধানের মূলে যে বিশ্বাস ক্রিয়াশীল ছিল তা হলো, মানুষের বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার সত্য আবিষ্কারের ক্ষমতা রয়েছে। মূলত এই দৃষ্টিভঙ্গিই জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে বিচারবিযুক্তবাদকে প্রতিষ্ঠিত করে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে এপিকিউরীয় ও স্টোয়িক নীতিপ্রধান দর্শনের পাশাপাশি যে নতুন জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদের উৎপত্তি হয় তা-ই জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে সংশয়বাদ নামে পরিচিত। এ মতবাদের মূলকথা ছিল পরম জ্ঞানের ভিত্তিকে অস্বীকার করা। নৈতিক পরমতার বিরুদ্ধেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ সংশয়বাদের উদ্ভব হয়।

অবশ্য এর একটি সামাজিক কারণও ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধের ফলস্বরূপ গ্রিস স্বাধীনতা হারায়। গ্রিক রাষ্ট্রগুলোর অন্তর্ঘাতী যুদ্ধ ও দাস মালিকদের বিশ্বাসঘাতকতা ছিল এই পরাধীনতার কারণ। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রোম মাকিদোনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। গ্রিসদেরকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে এই আশ্বাস দিয়ে রোম এই যুদ্ধে গ্রিসের সাহায্য নেয়। কিন্তু যুদ্ধে জয়ের পর রোম অঙ্গীকার ভঙ্গ করে গ্রিসের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে। বিজিত দেশ রোম ধ্বংসলীলা ও দাসতন্ত্রের তাণ্ডব চালায়। এহেন সামাজিক অবস্থায় প্রচলিত নৈতিকতার উপর থেকে মানুষ আস্থা হারায় এবং তথাকথিত সর্বজনীন নৈতিক আদর্শ সম্পর্কে সংশয়ের উদ্ভব হয়। ফলত, নৈতিকতা ও জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে সংশয়বাদের জন্ম হয়।

গ্রিক সংশয়বাদকে তিনটি পৃথক পর্বে ভাগ করা যায়।[২৫] প্রথম পর্বের উল্লেখযোগ্য সংশয়বাদী পাইরো (৩৬৫-২৭০ খ্রি.পূ.) এবং টাইমন (৩২০–২৩০ খ্রি.পূ.)। প্রধানত নৈতিক অনপেক্ষতার বিরুদ্ধেই ছিল এই সময়ের দার্শনিকদের সংগ্রাম। এপিকিউরিয়ানদের সুখবাদের সমর্থক পাইরো তাঁর পূর্ববর্তী পারমেনাইডিস, সোফিস্ট ও সক্রেটিস প্রমুখ দার্শনিকদের সংশয়াত্মক মত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জ্ঞান ও সত্তার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করে তত্ত্ববিদ্যা ও জ্ঞানবিদ্যা উভয় ক্ষেত্রে সংশয়বাদী মতবাদ প্রদান করেন। তাঁর শিষ্য টাইমনও পাইরোকে সমর্থন করে অনপেক্ষ সত্যকে অস্বীকার করেন। পাইরো প্রতিষ্ঠিত চরম সংশয়বাদ পরবর্তীকালে পাইরোবাদ নামে অভিহিত হয়। ‘পাইরোবাদ’ শব্দটিকে সংশয়বাদের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করতেও দেখা যায়।

টাইমনের পরে প্লেটোর একাডেমীর নেতাদের হাতে গ্রিক সংশয়বাদের দ্বিতীয় পর্ব বিকশিত হয়। এই পর্বের সংশয়বাদ একাডেমিক সংশয়বাদ নামে খ্যাত। এ সময়কার প্রধান দার্শনিক হিসেবে আর্কোসিলাস (৩১৫-২৪১ খ্রি.পূ.) ও কার্নিয়াডিসের (২১৩-১২৯ খ্রি.পূ.) নাম উল্লেখযোগ্য। এসব দার্শনিক প্রধানত স্টোয়িকদের আক্রমণ করেন এবং সম্ভাব্যতার ধারণাকে একটি মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। আরকোসিলাস সুনিশ্চিত জ্ঞানলাভ অসম্ভব বলে মনে করেন। তাঁর মতে, সত্য ও মিথ্যাজ্ঞানের পার্থক্যকরণের সুনর্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নাই। সুতরাং সম্ভাব্যতাই জ্ঞানের ক্ষেত্রে একমাত্র আশ্রয়। তাঁর অনুসারী কার্নিয়াডিসও আরকোসিলাসকে সমর্থন করেন।

খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল প্রাচীন বিশ্বের বিজ্ঞানের উন্নতির শীর্ষদেশ স্পর্শ করে। এ সময়ে সংশয়বাদের অন্য একটি ধারা আলেকজান্দ্রিয়া নগরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর গুরুত্বারোপ এই সংশয়বাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এনেসিডেমাস (সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক) ও সেক্সটাস এম্পিরিকাস (২৩০ খ্রি.) ছিলেন এই ধারার অন্যতম দার্শনিক।

এনেসিডেমাসের মতে, ইন্দ্রিয় সংবেদন এবং নৈতিক ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতা স্থান, কাল, পাত্রভেদে ভিন্ন, অর্থাৎ আপেক্ষিক। সুতরাং জ্ঞানের কোনো সর্বজনীন মানদণ্ড সম্ভব নয়। তিনিই প্রথম কার্যকারণ সম্পর্ককে সন্দেহ করেন। তাঁর মতে, আধুনিক সংশয়বাদী হিউমের মতের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এনেসিডেমাসের অনুসারী সেক্সটাস্ এম্পিরিকাস ছিলেন গ্রিক সংশয়বাদের সর্বশেষ দার্শনিক। তিনি এনেসিডেমাসের মতের উন্নয়ন সাধন করে আরো হ অনুমানের সার্বিক সিদ্ধান্তের সত্যতায় সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং সকল সার্বিক নিয়ম ও সিদ্ধান্তকে আপেক্ষিক বলেন। দেশ, কাল, এমনকি গণিত ও নীতিশাস্ত্র তার কাছে আপেক্ষিক বলে পরিগণিত হয়। তবে এ দুজন দার্শনিকই চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রায়োগিক নিয়মাবলির মতো জীবনের প্রায়োগিক নিয়মাবলি থেকে পাওয়া কাণ্ডজ্ঞানের মাধ্যমে জীবন পরিচালনার এবং সামাজিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার পরামর্শ দেন। সেক্সটাস্ এম্পিরিকাসের পর সংশয়বাদের আর কোনো প্রখ্যাত চিন্তাবিদের উন্মেষ ঘটেনি, এবং সংশয়বাদের প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পায়। মধ্যযুগে ধর্মীয় প্রাধিকারবাদের প্রভাবে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে সংশয়বাদের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না।

পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার প্রাচীন যুগ সম্পর্কিত উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, এই যুগে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে মূলত তিনটি ধারার উৎপত্তি হয়। এ তিনটি ধারা হলো অভিজ্ঞতাবাদ, বুদ্ধিবাদ ও সংশয়বাদ। সোফিস্ট দার্শনিকদের হাতে পাশ্চাত্য দর্শনের প্রাচীন যুগে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার সূত্রপাত। তখন জ্ঞানবিদ্যা ছিল অভিজ্ঞতাবাদী। সোফিস্টদের অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যা জ্ঞানবিদ্যাগত আপেক্ষিকতাবাদের জন্ম দেয় এবং শেষ পর্যন্ত সোফিস্টগণ যথার্থ জ্ঞান সম্ভব নয়—একথা বলে তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদকে নঞর্থক ধারার সংশয়বাদের দিকে নিয়ে যান। এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে সর্বজনীনতাবাদী মানদণ্ড সরবরাহ করার প্রয়াস লক্ষিত হয়। এ লক্ষ্যে সক্রেটিস ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার পরিবর্তে প্রজ্ঞাকে প্রাধান্য দিয়ে বুদ্ধিবাদী ধারার সূচনা করেন। এই ধারা সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো এবং প্লেটোর শিষ্য এরিস্টটল কর্তৃক সংশোধিত ও পরিশোধিত হয়ে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে বুদ্ধিবাদ প্রতিষ্ঠা করে। এতদ্‌সত্ত্বেও সোফিস্টদের অভিজ্ঞতাবাদী ধারা লয়প্রাপ্ত হয়না। এরিস্টটলের পরবর্তীকালে এপিকিউরীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা এপিকিউরিয়াস এবং স্টোয়িক দার্শনিক জেনো সোফিস্টদের অভিজ্ঞতাবাদী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁরা এই ধারাকে নঞর্থক সংশয়বাদের হাত থেকে রক্ষা করে গঠনমূলক খাতে প্রবাহিত করেন। এর ফলে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ প্রতিষ্ঠা পায়

অভিজ্ঞতাবাদী ও বুদ্ধিবাদী এই দুটি ধারার পাশাপাশি আরো যে একটি শক্তিশালী ধারা পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যায় প্রতিষ্ঠালাভ করে তা হলো সংশয়বাদ। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে পাইরোর হাতে এই ধারার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং তিনটি ভিন্নমুখী দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রবাহিত হয়ে এই ধারা খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে সেক্স্টাস এম্পিরিকাসের চিন্তায় পরিণতি লাভ করে।

পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে প্রাচীন যুগে গড়ে ওঠা অভিজ্ঞতাবাদী, বুদ্ধিবাদী ও সংশয়বাদী জ্ঞানবিদ্যার তিনটি ধারাই পরবর্তীকালের দার্শনিকদের চিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। প্রাচীন যুগের পাশ্চাত্য দর্শনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল মুক্তবুদ্ধির আলোকে দর্শনচর্চা করা। জ্ঞানবিদ্যাসহ দর্শনের বিভিন্ন শাখায় দার্শনিকগণ যে অবদান রেখেছেন স্বাধীন বা মুক্তচিন্তাই ছিল তার ভিত্তি। মধ্যযুগের দার্শনিক চিন্তা ছিল ধর্মীয় প্রাধিকারবাদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই সময়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চার সুযোগ ছিল না। দার্শনিকগণ খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্বের আলোকে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ব্যাখ্যা করেন। ফলে মুক্তবুদ্ধির স্থলে প্রত্যাদেশই মধ্যযুগীয় দার্শনিক চিন্তার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তাই এই যুগে যথার্থ অর্থে জ্ঞানবিদ্যার চর্চা ছিল না বললেই চলে। তবে এ সময়ে প্রাধিকারবাদ বা প্রত্যাদেশের আলোকে জ্ঞানচর্চা করা হয়েছে। এতে প্রথম দিকে প্রত্যাদেশ নিয়ন্ত্রিত বুদ্ধিবাদ এবং শেষদিকে অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদের প্রতিফলন দেখা যায়। মধ্যযুগে সংশয়বাদী জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখা যায় না।

রেনেসাঁর মাধ্যমে আধুনিক যুগে মধ্যযুগীয় প্রাধিকারবাদের অবসান ঘটলে আবারো দর্শনে মুক্তবুদ্ধির চর্চা প্রাধান্য পায়। তখন জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে মূলত অভিজ্ঞতাবাদী, বুদ্ধিবাদী ও সংশয়বাদী, এই তিনটি ধারার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক যুগে ব্রিটিশ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন, জন লক, জর্জ বার্কলে ও ডেভিড হিউম অভিজ্ঞতাবাদের এবং ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত, বেনেডিক্টো স্পিনোজা এবং জার্মান দার্শনিক লাইবনিজ বুদ্ধিবাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। এছাড়া, আধুনিক বুদ্ধিবাদের জনক দেকার্ত প্রারম্ভিক সংশয়বাদ দিয়ে তাঁর দর্শন শুরু করেন, এবং বৃটিশ অভিজ্ঞতাবাদী ডেভিড হিউম তাঁর পূর্বসূরি জন লক ও জর্জ বার্কলে সমর্থিত অভিজ্ঞতাবাদকে সঙ্গতিপূর্ণ করতে গিয়ে চূড়ান্ত সংশয়বাদের জন্ম দেন। আমরা মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় উপরিলিখিত ধারাগুলোর প্রভাব লক্ষ করবো।

মধ্যযুগ

প্রাচীন যুগের পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কে উপর্যুক্ত আলোচনায় দেখা যায়, প্রাচীন যুগে দার্শনিকগণ মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তার আলোকে জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদের আলোচনা করেছেন এবং এর ফল হিসেবে সংবেদননির্ভর অভিজ্ঞতাবাদ, প্রজ্ঞানির্ভর বুদ্ধিবাদ এবং এর পাশাপাশি সংশয়বাদী জ্ঞানবিদ্যাগত ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মধ্যযুগে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দর্শনের আলোচনা শুরু হয়। এই সময়ের দর্শন মূল খ্রিষ্টীয় দর্শন। এ সময় পাশ্চাত্য দর্শনকে প্রধানত খ্রিষ্টধর্মের বাহন বা ব্যাখ্যাকারী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তখন দার্শনিকগণ ক্যাথলিক ধর্মের আচার অনুষ্ঠানকে সুদৃঢ় করার জন্য প্রমাণ উপস্থাপনের লক্ষ্যে দর্শনচর্চা করেন। প্রাচীন যুগে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা তথা বিচারমূলক ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, তথা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ, এককথায় অভিজ্ঞতা ও বিচারবুদ্ধির যে চর্চা ছিল মধ্যযুগের ধর্মীয় প্রাধিকারবাদের প্রভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়। তখন জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার উপর প্রত্যাদেশ ও বিশ্বাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্ব প্রভাবিত মধ্যযুগীয় দর্শনে জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কে যে মূল কথাটি আলোচিত হয়েছে তা হলো, যথার্থ জ্ঞান বলতে একমাত্র ঈশ্বর ও আত্মার জ্ঞানকে বোঝায়। যুক্তিবিদ্যা, অধিবিদ্যা, নীতিবিদ্যাসহ জ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলো যতটুকু ঈশ্বরের জ্ঞান দিতে পারে ততটুকুই মূল্যবান।

খ্রিষ্টীয় দর্শনের শুরু হয় খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে। তখন থেকে শুরু করে নবম শতক পর্যন্ত মধ্যযুগীয় দর্শনে যে ভাবধারা ছিল তাকে প্রাচীন যাজকদের যুগ বলা হয়। সেন্ট অগাস্টিন (৩৫৪-৪৩০ খ্রি.) ছিলেন এ যুগের অন্যতম প্রতিনিধি। খ্রিষ্টীয় নবম শতক থেকে শুরু করে পনেরো শতক পর্যন্ত বিস্তৃত যুগকে বলা হয় স্কলাস্টিক যুগ। সেন্ট থমাস একুইনাস (১২২৫–১২৭৪ খ্রি.) এ যুগের অন্যতম প্রতিনিধি। এ দুজন বিখ্যাত দার্শনিকের জ্ঞানবিদ্যা এখানে আলোচনা করা গেল।

সেন্ট অগাস্টিনের জ্ঞানবিদ্যা

অগাস্টিন জ্ঞান বলতে ঈশ্বরের জ্ঞানকে বোঝান। তিনি ঈশ্বরের জ্ঞানকেই একমাত্র সম্ভাব্য জ্ঞান বলে মনে করেন। On The Trinity গ্রন্থে তিনি জ্ঞানবিদ্যার মূলসূত্র প্রকাশ করে বলেন, এমনভাবে বোঝ যাতে তুমি বিশ্বাস করতে পারো এবং এমনভাবে বিশ্বাস কর যাতে তুমি বুঝতে পারো। তাঁর মতে, কিছু জিনিসকে আমরা বিশ্বাস করি না যতক্ষণ এগুলোকে বুঝতে পারি না। আবার অন্য কিছু জিনিসকে আমরা বুঝতে পারি না যতক্ষণ আমরা এগুলোকে বিশ্বাস করতে পারি না।[২৬] এভাবে অগাস্টিন বিশ্বাসের জন্য বোধ ও বোধের জন্য বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তার নীতিকে সমর্থন করেন। এতে বুদ্ধি ও বিশ্বাসের মধ্যে দ্বৈতবাদকে অস্বীকার করা হয়। বুদ্ধিই প্রথম সিদ্ধান্ত নেবে যে, প্রত্যাদেশ সত্যিকার অর্থে ঘটেছে কি না। যদি বুদ্ধি প্রত্যাদেশ ঘটেছে বলে সমর্থন করে তবেই প্রত্যাদেশ বিশ্বস্ত ও বিশ্বাসযোগ্য। একমাত্র এই অবস্থায় প্রত্যাদেশকে বিশ্বাস করা হবে এবং বুদ্ধিই তা বোঝার জন্য ব্যাখ্যা করবে। এই মূলসূত্রের সাহায্যে অগাস্টিন বুদ্ধিকে বিশ্বাসের সাথে অভিন্ন করে বুদ্ধিবাদের সমর্থন করেন। তবে তাঁর মতে, আমরা সবকিছু বিশ্বাস বা বুদ্ধি দ্বারা বুঝতে পারবো এমন কোনো কথা নাই। এ জন্যই তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি চার্চের উপর নির্ভর করতে বলেন।

সুতরাং দেখা যায়, অগাস্টিন জ্ঞানের জন্য বুদ্ধি ও বিশ্বাস উভয়ের প্রয়োজন বোধ করেন। যা বিশ্বাস করা হয় তাকে বোঝার জন্য বুদ্ধি দরকার। অন্যদিকে, বুদ্ধি যা বোঝে তাকে বিশ্বাস করার জন্য বিশ্বাস থাকা দরকার। তবে তিনি বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিসহ সকলপ্রকার বুদ্ধিকে ঈশ্বরের, অন্যকথায় ঈশ্বরের প্রতিনিধি চার্চের উপর নির্ভরশীল বলে মনে করেন। এর ফলে জ্ঞানবিদ্যায় সোফিস্টদের প্রবর্তিত ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার গুরুত্ব হ্রাস পায়। এছাড়া, প্লেটো-এরিস্টটল প্রবর্তিত বুদ্ধিবাদ ঈশ্বরের প্রত্যাদেশের দ্বারা পরিশোধিত হয়ে ঈশ্বরের ধারণার সাথে একাত্ম হয়ে মিশে যায়। এ কারণে সেন্ট অগাস্টিনকে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবাদী বলা যায়। তবে তিনি প্রাচীন যুগের পাশ্চাত্য দার্শনিক তথা সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটলের মতো মুক্তবুদ্ধি তথা স্বাধীন বিচার বিবেচনানির্ভর বুদ্ধিবাদের প্রতিনিধিত্ব করেন নি, বরং এর পরিবর্তে প্রত্যাদেশনির্ভর বুদ্ধিবাদের প্রবর্তন করেন।

সেন্ট থমাস একুইনাসের জ্ঞানবিদ্যা

সেন্ট অগাস্টিনের মৃত্যুর পর দীর্ঘ বারশ বছর ধরে রাজনৈতিক কারণে পশ্চিম ইউরোপ অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। এই সময় চার্চই ছিল একটি স্থায়ী ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান। তখনকার ইউরোপে চার্চীয় কর্তৃপক্ষই ছিল প্রাচীন জ্ঞান সংরক্ষণ ও নতুন জ্ঞান অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার একমাত্র ধারক ও বাহক। দীর্ঘদিন ধরে চার্চের এই ভূমিকার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ইউরোপে যে ধর্মকেন্দ্রিক বিশ্বাস ও যুক্তি প্রভাবিত মিশ্র দর্শনচর্চার সূচনা হয় তাকে স্কলাস্টিক দর্শন বলা হয়। এই দর্শনও ধর্মযাজক ও সন্ন্যাসীদের দর্শন। প্রত্যাদেশের উপরই এই দর্শনের প্রতিষ্ঠা। তবে খ্রিষ্টীয় ধর্মমতকে অভ্রান্ত মনে করলেও যুক্তির সাহায্যে ধর্মমতকে ব্যাখ্যার চেষ্টা স্কলাস্টিক দার্শনিকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বাধীন বা মৌলিক চিন্তার স্থান এতে প্রাচীন যুগের মতো ছিল না। ঈশ্বর, পরলোক, মানুষের অমরতা—এসব অতীন্দ্রিয় বিষয়ই এই দর্শনের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল। গির্জাই মানুষের জীবন ও চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করত। বস্তুর উৎপত্তি বা স্বরূপ ব্যাখ্যায় আপ্তবাক্যের উপরই নির্ভর করা হত। সেন্ট আসেম (১০৬৩–১১০৯ খ্রি.) এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা এবং সেন্ট থমাস একুইনাসের হাতে এই দর্শনের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়।

একুইনাস সেন্ট অগাস্টিনের, এমনকি আসেমের সাথে দ্বিমত পোষণ করে প্রজ্ঞা ও বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন। তিনি দর্শনকে যুক্তি বা প্রজ্ঞার বিষয় এবং ধর্মকে বিশ্বাসের বিষয় বলে মনে করেন। তবে দর্শন ও ধর্মের মধ্যে কোনো বিরোধ তিনি স্বীকার করেন নি। বরং তাঁর মতে, এদের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বাসের মাধ্যমে পাওয়া সত্যকে প্রজ্ঞার আলোকে বোঝা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে তিনি এরিস্টটল দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হন। এরিস্টটলের মতো তিনিও মনে করেন যে, ধারণাগত জ্ঞানই যথার্থ জ্ঞান। কিন্তু এর ভিত্তি হলো ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ। আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদী জন লক-এর মতে, বুদ্ধিতে এমন কিছু নাই যা পূর্বে অভিজ্ঞতায় ছিল না। একুইনাসের জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদে এই মতের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনিও এ কথা বলেন যে, বুদ্ধির মধ্যে এমন কোনো ধারণা নাই যা প্রথমে সংবেদনের মধ্যে ছিল না।[২৭]

একুইনাসের মতে, সংবেদন, সক্রিয় বুদ্ধি এবং সম্ভাব্য বুদ্ধি ইত্যাদি বৃত্তি আত্মার আছে এবং যথার্থ জ্ঞানমাত্রই এসব বৃত্তির মিশ্রিত ক্রিয়ার ফলশ্রুতি। ইন্দ্রিয় সংবেদনের মাধ্যমেই আত্মা প্রথম বাহ্য বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত হয় এবং বিশেষ বস্তুর আকার বা অনুলিপি গ্রহণ করে। সংবেদনের সাহায্যে বিশেষ বস্তুর এই অনুলিপি বা উপকরণ লাভ করা যায়। সক্রিয় বুদ্ধি এর মধ্যে থেকে অভিন্ন আবশ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে পৃথক করে এতে বিশেষ বস্তুর একটি বুদ্ধিগ্রাহ্য অনুলিপি, তাঁর ভাষায়, “বুদ্ধিগ্রাহ্য উপজাতি” তৈরি হয়। এই বুদ্ধিগ্রাহ্য উপজাতির মাধ্যমেই সম্ভাব্য বুদ্ধি বস্তুর সার্বিক ধারণাকে জানে। এই সার্বিক ধারণাই হলো যথার্থ জ্ঞান। সুতরাং অভিজ্ঞতা হলো জ্ঞানের প্রাথমিক স্তর। অভিজ্ঞতার সাহায্যে যেমন আমরা বস্তু সম্পর্কে বিশেষ বিশেষ সংবেদন লাভ করি তেমনি সক্রিয় বুদ্ধির সাহায্যে আমরা জগতের পরাতাত্ত্বিক গঠন সম্পর্কে অবহিত হই। পরবর্তীকালে আধুনিক জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের দর্শনে এই ধারণার উন্নততর রূপ পাওয়া যায়।

উপরের আলোচনা থেকে এটা মনে হয় যে, একুইনাস জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে সেন্ট অগাস্টিন ও সেন্ট আসেম-এর জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদের চেয়ে এরিস্টটলীয় মতবাদ দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়ে প্রত্যাদেশ বা বিশ্বাসের পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর মতে, যথার্থ জ্ঞানের ভিত্তি হলো অভিজ্ঞতা। যার ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ হয় তাকেই আমরা জানতে পারি। এ অভিজ্ঞতালব্ধ উপাদান থেকে সারসত্তা নিয়েই বুদ্ধি জ্ঞানের উচ্চতর পর্যায় গঠন করে। সারসত্তার জ্ঞান হলো সত্তা বা তত্ত্ববিদ্যার জ্ঞান। সুতরাং দেখা যায়, একুইনাস জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা উভয়ের ভূমিকা স্বীকার করেছেন। তবে বুদ্ধির ভূমিকাকে অস্বীকার না করলেও প্লেটোর মতো অভিজ্ঞতাপূর্ব কোনো আন্তর্ধারণার অস্তিত্ব তিনি স্বীকার করেন নি। বরং এরিস্টটলের মতো ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বা অভিজ্ঞতাকেই যথার্থ জ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদী জন লক এবং বিচারবাদী কান্টের জ্ঞানবিদ্যার উপর একুইনাসের জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যদিও লকের মতো একুইনাস তাঁর মতবাদকে বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেন নি তবুও তাকে অভিজ্ঞতাবাদী আখ্যায়িত করা যায়। কারণ, জ্ঞানের সকল উপকরণ চূড়ান্ত অর্থে অভিজ্ঞতা থেকে আসে, অন্য কোনো উৎস থেকে নয়—একথা তিনিই ঘোষণা করেছেন। এটাই অভিজ্ঞতাবাদের সারকথা। এরিস্টটলের মতো সার্বিক ও বিশেষ উভয়ের জ্ঞানকে স্বীকৃতি দিয়ে, বিশেষের ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার উপর সার্বিকের জ্ঞানকে নির্ভরশীল করে, একুইনাস জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে এরিস্টটল প্রভাবিত মতবাদ প্রদান করেন। তাই ত্রয়োদশ শতকে একুইনাসের আবির্ভাবকে জ্ঞানরাজ্যে এরিস্টলের পুনরাবির্ভাব হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।[২৯]

মধ্যযুগীয় পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যা বিষয়ে উপরের আলোচনা থেকে এ সময়ের জ্ঞানবিদ্যাগত আলোচনায় দুটি স্বতন্ত্র ধারার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। একটি হলো প্রত্যাদেশ নির্ভর বুদ্ধিবাদী ধারা, অন্যটি প্রজ্ঞাস্বীকৃত অভিজ্ঞতাবাদী দ্বারা। মধ্যযুগের প্রথমাংশের অর্থাৎ প্রাচীন যাজকদের যুগের প্রতিনিধি সেন্ট অগাস্টিন ছিলেন বিশুদ্ধভাবে প্রত্যাদেশের উপর নির্ভরশীল বুদ্ধিবাদী ধারার সমর্থক। তিনি প্রত্যাদেশ ও বুদ্ধিকে অভিন্ন হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। তাই, যদিও তাঁকে মধ্যযুগের বুদ্ধিবাদী বলা যায় তবুও তিনি যে বুদ্ধির চর্চা করেছেন তা প্লেটো-এরিস্টটল নির্দেশিত স্বাধীন বিচারবুদ্ধি বা মুক্তবুদ্ধি নয়, বরং প্রত্যাদেশনির্ভর বুদ্ধি।

অন্যদিকে, মধ্যযুগের দ্বিতীয়াংশের অর্থাৎ স্কলাষ্টিক দর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক সেন্ট থমাস একুইনাস এরিস্টটল দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি প্রত্যাদেশ বা গির্জাকে সবকিছুর মানদণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং ধারণাগত জ্ঞানকেই যথার্থ জ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন। তা সত্ত্বেও জ্ঞানের প্রাথমিক উপাদানগুলো আহরণের জন্য তিনি ব্যক্তির ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল হয়ে একথা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, অভিজ্ঞতায় যা পাওযা যায় না তা বুদ্ধিতে থাকতে পারে না। তবে অভিজ্ঞতাই চূড়ান্ত জ্ঞান নয়, বরং অভিজ্ঞতার উপাদানে সমৃদ্ধ ধারণাগত জ্ঞানই যথার্থ জ্ঞান পদবাচ্য। তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত বুদ্ধিস্বীকৃত অভিজ্ঞতাবাদে আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদী জন লক ও বিচারবাদী ইমানুয়েল কান্টের মতবাদের পূর্বাভাস পাওয়া যায়।

উল্লেখ্য যে, মধ্যযুগীয় প্রত্যাদেশনির্ভর দার্শনিক আলোচনায় বুদ্ধিবাদী এবং অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদও প্রত্যাদেশের হাত থেকে মুক্তি পায় নি। পরবর্তীকালে, আধুনিক যুগের জ্ঞানোৎপত্তি সম্পর্কিত মতবাদসমূহ আলোচনা করার সময় আমরা দেখবো যে, রেনেসাঁর মাধ্যমে আধুনিক যুগের সূচনা হলে সে যুগের বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন বিচার-বিবেচনা, যুক্তি, মুক্তচিন্তা এবং বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

আধুনিক যুগ

মধ্যযুগের পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কে উপর্যুক্ত আলোচনায় দেখা যায়, মধ্যযুগে যদিও প্রাচীন যুগের মতো বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী ধারা প্রবাহিত ছিল তবুও এ দুটি ধারা স্বাধীন চিন্তা তথা মুক্তবুদ্ধির উপর নির্ভরশীল ছিল না। বরং তা ছিল প্রত্যাদেশনির্ভর। যথার্থ জ্ঞানকে তখন খ্রিষ্টান ধর্ম বা চার্চের মানদণ্ডে মূল্যায়ন করা হতো। চৌদ্ধ শতকের শেষভাগে রেনেসাঁ এবং সপ্তদশ শতকে বিজ্ঞান বিপ্লবের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় ধর্মপ্রভাবিত চিন্তাধারার হাত থেকে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা মুক্তিলাভ করে। দর্শন এর মধ্যে অন্যতম। অতিপ্রাকৃত বিষয়াদির পরিবর্তে প্রকৃতিকে এবং প্রকৃতির বিভিন্ন সমস্যার সমাধানকে জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ধর্মীয় প্রাধিকারবাদের পরিবর্তে মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন বিচারবুদ্ধি জ্ঞানচর্চার, বিশেষত দর্শনচর্চার, মূল ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করে।

এ সময়ে জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯ খ্রি.), কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩ খ্রি.), কেপলার (১৫৭১–১৬৩০ খ্রি.), গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২ খ্রি.), নিউটন (১৫৪২-১৭২৭ খ্রি.) প্রমুখ বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কার সম্ভব করেন। এর ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রচলিত মতের চেয়ে ব্যক্তির পর্যবেক্ষণ তথা অভিজ্ঞতাভিত্তিক আবিষ্কারের প্রাধান্য ঘোষিত হয়। বিজ্ঞানে তখন বিশুদ্ধ আরোহাত্মক পদ্ধতির ব্যবহার জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিজ্ঞানের এই নবজাগরণ দর্শনকেও প্রভাবিত করে। বিজ্ঞান বিপ্লবের ফলে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের যথেষ্ট উন্নতি ও সাফল্য অর্জিত হলে প্রাকৃতিক সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনা বিজ্ঞানের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, দর্শন কেন্দ্রীভূত হয় প্রধানত মানুষের জ্ঞান সম্পর্কিত অর্থাৎ জ্ঞানবিদ্যাগত আলোচনায়। তাই পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে আধুনিক যুগের দর্শন মূলত জ্ঞানবিদ্যাকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে।

আধুনিক যুগের জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদের ধারা আলোচনায় প্রাচীন যুগের অভিজ্ঞতাবাদ, বুদ্ধিবাদ ও সংশয়বাদ—এই তিনটি ধারার প্রভাব লক্ষ করা যায়। তবে প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকে এ যুগের স্বাতন্ত্র্য হলো বিজ্ঞানমনস্কতা। বিজ্ঞানে আরোহ পদ্ধতি সফল পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় দার্শনিকগণও তাঁদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আরোহ পদ্ধতি তথা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণকে দর্শনের পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করতে প্রয়াসী হন। সপ্তদশ শতকের আগে প্রখ্যাত দার্শনিকগণ যেখানে বুদ্ধিবাদী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন সেখানে সপ্তদশ শতক থেকে অধিকাংশ প্রখ্যাত দার্শনিকই অভিজ্ঞতাবাদী ধারার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সপ্তদশ শতকের পূর্বে দর্শনের টেস্ট কেস বা দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা হিসেবে গাণিতিক বা ধর্মীয় পদ্ধতিকে গ্রহণ করা হতো। কিন্তু সপ্তদশ শতক থেকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে দর্শনের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়।[৩০] গাণিতিক বা ধর্মীয় পদ্ধতিকে টেস্ট কেস হিসেবে গ্রহণ করলে যে কোনো দার্শনিক চিন্তাই চূড়ান্ত পরিণতিতে বুদ্ধিবাদী হতে বাধ্য। কিন্তু সপ্তদশ শতক থেকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দর্শনের দৃষ্টান্ত হিসেবে গৃহীত হওয়ায় দর্শনে পর্যবেক্ষণ তথা অভিজ্ঞতা গুরুত্ব পায়। ফলে, এ সময়ের জ্ঞানবিদ্যা প্রধানত অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যায় পরিণত হয়। এই ধারার সফল প্রতিনিধি ইংলন্ডের দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন, জন লক, জর্জ বার্কলে ও ডেভিড হিউম তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে হলেও পর্যবেক্ষণ অর্থাৎ অভিজ্ঞতাভিত্তিক পদ্ধতির ব্যবহার দেখা যায়।

অন্যদিকে, এর পাশাপাশি অন্য একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানবিদ্যাগত ধারাও আধুনিক যুগে গড়ে ওঠে। এর মধ্যে প্রাচীন যুগের সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটল নির্দেশিত বুদ্ধিবাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তবে এ যুগের বুদ্ধিবাদী জ্ঞানবিদ্যার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, সুস্পষ্টভাবে অবরোহাত্মক পদ্ধতির ব্যবহার। আধুনিক যুগের বুদ্ধিবাদীরা অভিজ্ঞতাবাদীদের ব্যবহৃত আরোহাত্মক পদ্ধতির বিরোধিতা করে বিশুদ্ধ অবরোহাত্মক পদ্ধতির ব্যবহার করেন। তাঁদের পদ্ধতির উপর মধ্যযুগীয় প্রাধিকারবাদের আংশিক প্রভাব এবং আধুনিক যুগের গণিতের উন্নতির প্রভাব লক্ষিত হয়।

আমরা এখানে অভিজ্ঞতাবাদী ধারার প্রতিনিধি বেকন, লক ও বার্কলের জ্ঞানবিদ্যা এবং বুদ্ধিবাদী ধারার অন্যতম প্রতিনিধি দেকার্তের জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদের আলোচনা করবো।

বেকনের জ্ঞানবিদ্যা

মধ্যযুগীয় স্কলাস্টিক দর্শনের অবসান ঘটিয়ে সংস্কারধর্মী ও বাস্তববাদী মতবাদ প্রচারের মাধ্যমে যেসব চিন্তাবিদ আধুনিক চিন্তার প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি ও প্রশংসা অর্জন করেছেন ব্রিটিশ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬ খ্রি.) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ইংলন্ডে দর্শনের পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে তাঁর নাম ওতপ্রতোভাবে জড়িত। রেনেসাঁর প্রভাবে মধ্যযুগীয় নির্বিচার বিশ্বাসের স্থলে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা জ্ঞানানুশীলনের যে নতুন প্রেরণা ও প্রচেষ্টার সূত্রপাত ঘটে বেকন ছিলেন এর মূর্ত প্রতীক।[৩১]

সপ্তদশ শতকে নিউটনের Principia গ্রন্থ ঘটনার কারণ নির্ণয়ের জন্য দার্শনিক অনুধ্যান বর্জন করে অভিজ্ঞতাভিত্তিক পর্যবেক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। নিউটন এ পদ্ধতিকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিষয়ীনিরপেক্ষ পদ্ধতি বলে মনে করতেন।[৩২] বৈজ্ঞানিক অবধারণের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা এবং অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যায় এর ব্যবহার ফান্সিস বেকনের কৃতিত্ব। তিনি দর্শনকে ধর্মতত্ত্ব থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রাখতে বলেন। তবে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন এবং বলেন যে, যুক্তি দ্বারাই এর অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। অতীতের বিজ্ঞান ও দর্শনের নিষ্ফলতার কারণ হিসেবে তিনি যথার্থ পদ্ধতির অভাবকে দায়ী করেন।[৩৩] তিনি জ্ঞানানুশীলনের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। এই পদ্ধতি হলো আরোহ পদ্ধতি। বেকনের কাছে জ্ঞানের উদ্দেশ্য তাত্ত্বিক নয়, প্রায়োগিক। অর্থাৎ প্রকৃতির উপর মানুষের আধিপত্য বিস্তারই জ্ঞানের উদ্দেশ্য।

বেকন তাঁর বিখ্যাত Advancement of Learning গ্রন্থে জ্ঞানকে শক্তি বলেছেন।[৩৪] এই শক্তি অর্জনের জন্য, অর্থাৎ ভ্রান্তিবর্জিত যথার্থ জ্ঞান অর্জনের জন্য চার প্রকার পূর্বসংস্কার বর্জন করা প্রয়োজন। তা হলো, মানবীয় পূর্বসংস্কার, অর্থাৎ স্বভাবগত বদ্ধমূল প্রত্যক্ষ ও চিন্তার অভ্যাস, ব্যক্তিগত পূর্বসংস্কার, অর্থাৎ ব্যক্তির চরিত্র ও শিক্ষার পরিবেশজাত সংস্কার, জনশ্রুতিমূলক পূর্বসংস্কার, অর্থাৎ ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারজাত সংস্কার, এবং পরিকল্পিত পূর্বসংস্কার, অর্থাৎ ঐতিহ্যগত বিশ্বাস ও প্রাধিকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্যজনিত সংস্কার। তাঁর মতে, এসব পূর্বসংস্কার ভ্রান্তির কারণ হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞানার্জনের জন্য দরকার যথার্থ বা সংস্কারমুক্ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, তথা বিশুদ্ধ আরোহাত্মক পদ্ধতির সহায়তা। বেকন এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যাকে বন্ধ্যা বলেছেন। কারণ এরিস্টটলের সহানুমানিক যুক্তিবিদ্যা অবরোহ পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে এসব পূর্বসংস্কারে আক্রান্ত হয়েছে। অবরোহ পদ্ধতির বিরুদ্ধাচরণ করে, আরোহ পদ্ধতির প্রাধান্য ঘোষণা করে, আধুনিক যুগের পরে যে বিজ্ঞানমনস্ক দীর্ঘ দার্শনিক ধারার সূচনা হয় বেকন সে ধারার প্রথম দার্শনিক।[৩৫] তিনি যথার্থ আরোহ পদ্ধতিকে পূর্ণগণনামূলক আরোহ থেকে পৃথক করেন এবং পূর্ণগণনামূলক আরোহকে রূপক কাহিনী হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

বেকনের মতে, পৃথিবীর প্রতিটি ঘটনার একটি করে মূল নিয়ম বা কারণ রয়েছে। কারণ আবিষ্কার করতে পারলেই ঘটনার স্বরূপ আবিষ্কার করা যায়। এভাবে, বিশেষ ঘটনার সাথে পরিচিত হয়ে আমাদের এমন একটি সাধারণ নিয়ম আবিষ্কারের চেষ্টা করতে হবে যার কারণে ঘটনাটি ঘটেছে। ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করে এ থেকে সাধারণ নিয়ম আবিষ্কার করা আরোহ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য। পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ এ পদ্ধতির মূল ভিত্তি। বেকনের দ্বারা ব্যবহার্য পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণভিত্তিক আরোহাত্মক পদ্ধতি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতিকে দর্শনের পদ্ধতি হিসেবে আত্মীকরণের ইঙ্গিত প্রদান করে।

বেকন জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রেও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির লালন করেন। তাঁর মতে, প্রত্যাদেশ ব্যতীত আমাদের সকল জ্ঞানই সংবেদন থেকে আসে। তিনি এরিস্টটলের মতো শুধু বিশেষ বস্তুরই অস্তিত্ব আছে বলে মনে করেন। মন বা বুদ্ধি ইন্দ্রিয় দ্বারা পরিশোধিত বিশেষ বস্তুর উপর কাজ করে। জ্ঞান যেমন পরীক্ষামূলক তেমনি বৌদ্ধিক। কিন্তু বুদ্ধির নিজস্ব কোনো সত্য নাই। অভিজ্ঞতা থেকেই বুদ্ধি তার সত্যগুলোকে সংগ্রহ করে। উল্লেখ্য যে, বেকন সকল জ্ঞানকে প্রাথমিকভাবে অভিজ্ঞতা নির্ভর মনে করে সকল প্রকার আন্তর্ধারণার অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও চিন্তার মতো অভিজ্ঞতা-পূর্ব মানসিক বৃত্তির অস্তিত্ব স্বীকার করেন।[৩৬]

বেকনের জ্ঞানবিদ্যাসংক্রান্ত উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, রেনেসাঁ যুগের প্রথম উল্লেখযোগ্য দার্শনিক হিসেবে তিনি জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রাচীন যুগের সোফিস্ট- এপিকিউরিয়াস-জেনো এবং মধ্যযুগের সেন্ট থমাস একুইনাস প্রবর্তিত অভিজ্ঞতাবাদী ধারারই প্রতিনিধিত্ব করেন। তবে দার্শনিক আলোচনা, বিশেষত জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে কোনো পদ্ধতির ব্যবহার বেকনের কৃতিত্ব। আরো বিশেষভাবে বললে দর্শনের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক প্রায়োগিক আরোহাত্মক পদ্ধতির প্রয়োগ বেকনের উল্লেখযোগ্য অবদান।

একথা ঠিক যে, বেকনের হাতে অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদ সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। তাঁর ব্যবহৃত আরোহাত্মক পদ্ধতিও ছিল পূর্বসংস্কারের মতো। পদ্ধতিটিকে যথেষ্ট বিচার ব্যাখ্যা না করেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন। তবুও দর্শনের ক্ষেত্রে বেকনকর্তৃক আরোহ বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগই দর্শন ও বিজ্ঞানকে কাছাকাছি আসার পথ প্রশস্ত করে এবং পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দর্শনচর্চার নবযুগের সূচনা হয়। দার্শনিক আলোচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ যে সম্ভব একথা সম্ভবত বেকনই প্রথম সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন। দর্শনের পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিই দর্শনকে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় প্রাধিকারবাদের দীর্ঘ রাজত্বের বিস্তৃত প্রভাব কাটিয়ে ওঠতে প্রেরণা জোগায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি রেনেসাঁ তথা আধুনিক যুগের শুরুতে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ প্রচারে অনুপ্রাণিত করে। এর মাধ্যমে বেকন যে বিষয়টির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তা হলো, অভিজ্ঞতাবাদের মাধ্যমে সার্বিক জ্ঞান পেতে হলে আরোহ পদ্ধতির বিকল্প নাই। পরবর্তী যে সব অভিজ্ঞতাবাদী অভিজ্ঞতা দ্বারা সার্বিক জ্ঞান পাওয়া যায় না বলে মত প্রকাশ করেন তাঁরা মূলত বেকনের গৃহীত পদ্ধতিকেই সমালোচনা করেছেন। অর্থাৎ তাঁরা এই পদ্ধতিকে পূর্বসংস্কার বা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেননি। আধুনিক দর্শনের ইতিহাসে বেকনের দর্শন সামগ্রিক বিচারে সন্তোষজনক নয়। তবু আধুনিক আরোহ পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাতা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির যৌক্তিক শৃঙ্খলাবদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার পথ নির্দেশক হিসেবে বেকনের গুরুত্ব দর্শনের ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করে আছে।[৩৭]

দেকার্তের জ্ঞানবিদ্যা

বেকনের জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মধ্যযুগীয় প্রাধিকারবাদের প্রাধান্য থেকে মুক্ত করে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি, তথা আরোহ পদ্ধতির প্রবর্তনের মাধ্যমে বেকন আধুনিক যুগে অভিজ্ঞতাবাদের ভিত্তি স্থাপন করেন। বেকন পরবর্তী ফরাসি দার্শনিকের নাম রেনে দেকার্ত (১৫৯৬–১৬৫০ খ্রি.)। দেকার্ত জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। দেকার্ত বেকনের অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির বিরোধিতা করেন। তিনি প্রাচীন যুগের সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটলীয় এবং মধ্যযুগের অগাস্টিনীয় জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার আধুনিক যুগের প্রতিনিধি।

বেকনের আরোহ পদ্ধতির বিরোধিতা করে জ্ঞানের জন্য অবরোহ তথা গাণিতিক পদ্ধতির কথা বলে দেকার্ত আধুনিক দর্শনে বুদ্ধিবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত ধারা প্রবর্তন করেন। Meditations নামক গ্রন্থে দেকার্তের জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা পাওয়া যায়। স্কলাস্টিক যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যার উপর দেকার্তের ব্যাপক পড়াশুনা ছিল। অন্যদিকে নতুন যুগের প্রেরণায় তিনি তখনকার বিজ্ঞানে, বিশেষ করে গণিতে, বিশেষ ব্যুৎপত্তিলাভ করেন। এছাড়া, লিওনার্দো ও বেকনের মতো নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সম্ভাবনাও তিনি দেখতে পান। এসব কারণে দেকার্ত দর্শনে এমন নিশ্চিত ও স্বতঃপ্রতীত জ্ঞান আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেন যাকে সকল মানুষ যুক্তিতর্ক ও বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারে। তাঁর এই চিন্তার উপর অধিবিদ্যা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে, নিশ্চিত জ্ঞানের পদ্ধতি হিসেবে যখন তিনি গণিতকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন তখন তাঁর দর্শনের উপর তৎকালীন গণিতের উন্নতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। দেকার্ত প্লেটোর মতো জ্ঞানকে নিশ্চয়তার জগতে সীমাবদ্ধ করেন। গণিতে স্বতঃসিদ্ধের মাধ্যমে নিশ্চিত জ্ঞান পাওয়া যায়। এজন্য তিনি বেকন প্রমুখ ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী নির্দেশিত আরোহাত্মক পদ্ধতিকে বর্জন করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে গাণিতিক বা অবরোহ পদ্ধতিকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। অভিজ্ঞতাবাদ নির্দেশিত, গণিত বিবর্জিত আরোহ পদ্ধতি নিশ্চিত ও স্বতঃপ্রমাণিত জ্ঞান দিতে পারে না বলেই তাঁর ধারণা।

সম্ভবত অধিবিদ্যাপ্রীতির কারণেই দেকার্ত জ্ঞানের রাজ্যকে প্লেটোর মতো নিশ্চয়তার জগতে সীমাবদ্ধ রাখেন। নিশ্চয়তা দিতে পারে না বলে তিনি ইন্দ্রিয় সংবেদন থেকে জ্ঞানোৎপত্তিসংক্রান্ত সকল অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ বর্জন করেন। এছাড়া, তিনি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনেও আগ্রহী ছিলেন। কারণ, বিশেষ বিশেষ বিজ্ঞানগুলো সাধারণ বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল, সাধারণ বিজ্ঞানের সূত্রগুলো বিশেষ বিশেষ বিজ্ঞানের জগতেও সত্য।

প্লেটো ও এরিস্টটলের সঙ্গে দেকার্তের যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষিত হয়। এই পার্থক্যগুলো তাঁকে একজন স্বতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকের মর্যাদা দিয়েছে। প্লেটো ও এরিস্টটলের সঙ্গে দেকার্তের মূল পার্থক্য হলো, পূর্বোক্তরা যেখানে মানুষ জাতি কী জানতে পারে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন, দেকার্ত সেখানে খুঁজেছেন একজন মানুষ অর্থাৎ ব্যক্তিমানুষ কী জানতে পারে, এর উত্তর। মূলত তিনি ব্যক্তি হিসেবে একজন মানুষের চিন্তার উপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন।[৩৮] এই দৃষ্টিভঙ্গি রেনেসাঁর ফসল এবং আধুনিক দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

প্লেটো ও এরিস্টটলের সঙ্গে দেকার্তের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, প্লেটো ও এরিস্টটল ধরে নিয়েছিলেন যে, জ্ঞান আছে। তাই জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁরা সন্দেহাতীত জ্ঞান নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু দেকার্ত তাঁর আলোচনায় জ্ঞান যে আছে একথা প্রথমেই প্রমাণ করতে চান। তিনি জ্ঞান আছে বলে ধরে নেননি। এজন্য তিনি সংশয় পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করেন, যাকে প্রারম্ভিক বা পদ্ধতিগত সংশয়বাদ বলা হয়, এবং অনুধ্যানের মাধ্যমে জ্ঞানবিদ্যার সিদ্ধান্তগুলোকে নিশ্চিত বলে প্রমাণ করেন। তাঁর এই প্রমাণ ও প্রমাণ পদ্ধতিতে যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে। এ সত্ত্বেও স্বীকার করতেই হয় যে, বেকন প্রমুখ দার্শনিক যেমন বিজ্ঞানে ব্যবহৃত আরোহ বা পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিকে বিনা বিচারে গ্রহণ করেছিলেন দেকার্ত তেমন করে তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত সিদ্ধান্তকে বিনা বিচারে গ্রহণ করেননি। তিনি ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে এগুলোকে যাচাই করেছেন। ব্যক্তিমানুষের বিচারবুদ্ধির উপর গুরুত্ব প্রদানই রেনেসাঁ তথা আধুনিক দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্য। দেকার্ত তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত সিদ্ধান্ত প্রণয়নে প্রারম্ভিক বা পদ্ধতিগত সংশয়বাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি ব্যক্তি হিসেবে একজন মানুষের চিন্তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে ব্যক্তিমানুষের মুক্তবুদ্ধির প্রাধান্য ঘোষণা করেন। তাই সময়ের দিক থেকে বেকনের উত্তরসূরি হওয়া এবং জ্ঞানবিদ্যাগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মুক্তবুদ্ধির উপর দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁকে আধুনিক দর্শনের জনক বলে অভিহিত করা হয়।

দেকার্ত গণিতের প্রভাবেই জ্ঞানের জগতে সর্বজনস্বীকৃত যুক্তিগ্রাহ্য নিশ্চিত সত্য আবিষ্কারে প্রয়াসী ছিলেন। কারণ, তিনি মনে করতেন এতে জ্ঞানের রাজ্যে এমন একটি নিশ্চিত ভিত্তি স্থাপিত হবে যা গণিতের জ্ঞানের মতো সন্দেহাতীত ও ভ্রান্তিমুক্ত, এবং যার ফলে দর্শনের সকল প্রকার বিতর্কের অবসান ঘটবে। তাই তিনি প্রচলিত সকল মতবাদকে সন্দেহ করে সকল প্রকার পূর্বসংস্কারের হাত থেকে মুক্ত হতে চান। তিনি জ্ঞানরাজ্যে এমন সার্বিক স্বতঃসিদ্ধ সত্য খুঁজে বের করতে প্রয়াসী হন যা থেকে অন্যান্য সকল জ্ঞান গাণিতিক বা অবরোহ পদ্ধতিতে নিঃসৃত হবে। তিনি তা আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন বলেও দাবি করেন। এই নিশ্চিত সত্যের ধারণা থেকে দেকার্ত এমন এক দর্শনের উন্নয়ন ঘটান যা বহু গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক এবং ধর্মীয় উক্তিকে নিঃসন্দিগ্ধ সত্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তিনি জ্ঞান ও সত্যের যে মানদণ্ড আবিষ্কার করেন তা হলো, স্পষ্টতা ও স্বতঃপ্রতীতি। যে জ্ঞান জ্ঞাতার কাছে স্পষ্ট ও স্বতঃপ্রতীত সে জ্ঞানই যথার্থ জ্ঞান। তাঁর আবিষ্কৃত জ্ঞানের এই মানদণ্ডের ক্ষেত্রেও একমাত্র ব্যক্তির বিচারবুদ্ধিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এই স্পষ্টতা ও স্বতঃপ্রতীতি ইউক্লিডের জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধের মতো জ্ঞানের অবরোহ পদ্ধতির ক্ষেত্রে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে কাজ করে।

দেকার্তের মতে, মানুষের মনে তিন প্রকার ধারণা আছে। আন্তর বা সহজাত, আগন্তুক ও কৃত্রিম। সহজাত ধারণাগুলো অভিজ্ঞতাপূর্ব। আগন্তুক ধারণাগুলো অভিজ্ঞতাজাত। এগুলো পরিবর্তনশীল ও ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। আর কৃত্রিম ধারণা হলো একাধিক আগন্তুক ধারণার সমষ্টি। এগুলো অবাস্তব। তাই আগন্তুক ও কৃত্রিম ধারণা যথার্থ জ্ঞান দিতে পারে না। পক্ষান্তরে, সহজাত ধারণা বুদ্ধিভিত্তিক, জন্মগত প্রবণতাসদৃশ। তাই সহজাত ধারণা জ্ঞানের সাধারণ ও সর্বজনীন সূত্র সরবরাহ করে। এই ধারণাই একমাত্র স্পষ্ট ও স্বতঃপ্রতীত। ঈশ্বর, নিত্যতা, অসীমতা, দ্রব্য ইত্যাদি হলো সহজাত ধারণাজাত জ্ঞান বা যথার্থ জ্ঞান। এসব জ্ঞান থেকে অবরোহাত্মক পদ্ধতিতে অন্যসব বিশেষ বস্তুর জ্ঞান আসে। এভাবে বেকনের আরোহ পদ্ধতির বিরোধিতা করে, অভিজ্ঞতাপূর্ব সহজাত ধারণাকে জ্ঞানের স্বতঃসিদ্ধ বা মূল উৎস হিসেবে বর্ণনা করে, এবং অবরোহ পদ্ধতিকে সমর্থন করে দেকার্ত আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যায় বুদ্ধিবাদের ভিত্তি স্থাপন করেন। তবে পদ্ধতিগত সংশয়বাদের আশ্রয় নিয়েও বুদ্ধিকে নিশ্চিত জ্ঞান উৎপাদনের উপায় বলে স্বীকার করায় তাঁকে বিচারবিযুক্তবাদী হিসেবে অভিহিত করা হয়।[৪০]

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, আধুনিক ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত মূলত প্রাচীনকালের সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল প্রবর্তিত এবং মধ্যযুগে অগাস্টিন সমর্থিত জ্ঞানবিদ্যাগত বুদ্ধিবাদী ধারাকে আধুনিক যুগমানসে তথা ব্যক্তির স্বাধীন বিচারবুদ্ধির আলোকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তিনি প্লেটোর মতোই জ্ঞানকে নিশ্চয়তার জগতে সীমাবদ্ধ রেখে, অবরোহ বা গাণিতিক পদ্ধতিকে জ্ঞানের একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁর মতে একমাত্র সহজাত ধারণাই যথার্থ জ্ঞান পদবাচ্য। এতে প্রাচীন যুগের সোফিস্ট, এপিকিউরিয়াস ও জেনো, মধ্যযুগের একুইনাস, এবং আধুনিক যুগের বেকন সমর্থিত ধারার সঙ্গে বিরুদ্ধমত পোষণ করা হয়। এর ফলে আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে বুদ্ধিবাদের প্রবর্তন হয়।

দেকার্ত তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য পদ্ধতিগত সংশয়ের আশ্রয় নেন। এছাড়া, জ্ঞানের পদ্ধতি আবিষ্কারে তিনি বিশুদ্ধভাবে মুক্তবুদ্ধির অর্থাৎ ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির প্রাধান্য ঘোষণা করেন যা তাঁর আগে কেউ করেন নি। মূলত এই দৃষ্টিভঙ্গিই আধুনিক যুগের জ্ঞানচর্চার যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি। তাই তাঁকে আধুনিক দর্শনের জনক বলে অভিহিত করাকে বার্ট্রান্ড রাসেল যথার্থ বলে মন্তব্য করেন।[৪১] অন্যদিকে, জাতি বা শ্রেণি হিসেবে নয় বরং ব্যক্তি হিসেবে মানুষের উপর গুরুত্ব প্রদান করে তিনি জ্ঞানবিদ্যাগত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে বুদ্ধিবাদী হওয়া সত্ত্বেও প্লেটো থেকে তাঁর পার্থক্য সূচিত হয়। রবার্ট এ্যাকারম্যান মনে করেন এই কৃতিত্বের কারণেই তাঁকে আধুনিক দর্শনের জনক হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়।[৪২] বস্তুতপক্ষে তিনি শুধু আধুনিক দর্শনেরই জনক নন বরং আধুনিক জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে বুদ্ধিবাদেরও জনক। তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, এমনকি তাঁর আলোচনার ধরনও কান্ট পর্যন্ত পরবর্তী সকল বুদ্ধিবাদী দার্শনিকের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীকালে হল্যান্ডের বুদ্ধিবাদী স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭ খ্রি.) এবং জার্মান বুদ্ধিবাদী লাইবনিজ (১৬৪৬-১৭৪৬ খ্রি.) মূলত দেকার্তের বুদ্ধিবাদী ধারাকেই অনুসরণ করেন।

লকের জ্ঞানবিদ্যা

রেনেসাঁ পরবর্তী জ্ঞানবিদ্যার ঐতিহাসিক ধারার আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, এ সময়ে বিজ্ঞানের মতো দর্শনের জগতেও পদ্ধতি নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছে। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার যথার্থ প্রতিনিধি বেকন ও দেকার্ত যথাক্রমে আরোহাত্মক এবং অবরোহাত্মক পদ্ধতিকে দর্শনের জন্য যথার্থ পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করে অভিজ্ঞতাবাদী ও বুদ্ধিবাদী মতবাদ দিয়েছেন। বেকনের পদ্ধতিতে যেমন তৎকালীন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির প্রভাব লক্ষিত হয় তেমনি দেকার্তের পদ্ধতিতে তৎকালীন গণিতের উন্নতির প্রভাব পড়ে। সতেরো শতকের শেষদিকে দর্শনের ক্ষেত্রে এ ধরনের পদ্ধতি নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখা যায়। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে অধ্যয়নের আগে মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে অধ্যয়নের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তখন এ সত্য উপলব্ধি করা হয় যে, বেকন আরোহ পদ্ধতিকে বিনা বিচারে দর্শনের পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আবার দেকার্তও তাঁর সংশয় পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষের জ্ঞানের সীমা, বিস্তৃতি ইত্যাদি জ্ঞানবিদ্যাগত বিষয় সম্পর্কে বিচারমূলক অনুসন্ধান করেননি। তাঁদের উভয়ই পূর্বসংস্কার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। বেকন যেমন আক্রান্ত হয়েছেন বিজ্ঞানের ব্যক্তিনিরপেক্ষতার পূর্বসংস্কার দ্বারা দেকার্ত তেমনি আক্রান্ত হয়েছেন আন্তর্ধারণার পূর্বসংস্কার দ্বারা। তাই এসময়ে দর্শনে পূর্বসংস্কারের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে মানবপ্রকৃতি অধ্যয়ন বা জ্ঞানবিদ্যাগত প্রশ্নাবলির যথার্থ অধ্যয়নের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আধুনিক দর্শনে এ যুগকে মুক্ত জ্ঞানালোকের যুগ বলে। মানুষের জ্ঞানের সীমা নির্ধারণই এ যুগের চিন্তাবিদদের প্রধান লক্ষ্য। ১৬৯০ সালে জন লক (১৬৩২-১৭০৪ খ্রি.) এর Essay Concerning Human Understanding প্রকাশিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে এ যুগের সূচনা হয়। ১৭৮৯ সালে কান্টের Critique of Pure Reason প্রকাশের মধ্যে দিয়ে এর অবসান ঘটে।[৪৩] এতে ইংল্যান্ডে যে উদার মতবাদের প্রতিষ্ঠা হয় তার ফলেই ইংল্যান্ড উৎপীড়িত ও বিতাড়িত ধর্মীয় শরণার্থী এবং দার্শনিক সংশয়বাদীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত হয়। এছাড়া, এই কারণেই ইংল্যান্ডে লকের মতো বাস্তববাদী দার্শনিকের পর বার্কলের মতো উগ্র ভাববাদী, এবং এরপর হিউমের মতো সংশয়বাদী দার্শনিকের উদ্ভব ঘটে। উল্লেখ্য যে, উপর্যুক্ত তিনজন দার্শনিক অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ পোষণ করেন। তবে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁরা সকলেই অভিজ্ঞতাবাদকে সমর্থন করেন। এদেরকে নিয়ে আধুনিক ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদের গৌরবময় ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। জন লক এই ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তাই লককে ইংল্যান্ডের ১৬৮৮ সালের বিপ্লবের সবচেয়ে প্রগতিশীল ও সফল প্রচারক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।[৪৪] রাজনীতি ও দর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাবের জন্য তাঁকে ইংল্যান্ডে দার্শনিক উদারতাবাদ ও জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও অভিহিত করা হয়।[৪৫]

লক তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে দেকার্তের আন্তর্ধারণাকে খণ্ডন করে বুদ্ধিবাদের অসারতা প্রমাণ করেন। তিনি ধারণাগুলোর মধ্যে সংযোগ অর্থাৎ মিল বা অমিলকেই জ্ঞান বলে অভিহিত করেন।[৪৬] স্টোয়িক দার্শনিক জেনোর মতো লকও জন্মের সময় মন টেবুলে-রাসা বা অলিখিত সাদা কাগজের মতো থাকে বলে মনে করেন। এতে কোনো প্রকার ধারণা থাকে না। অভিজ্ঞতার সাহায্যে জ্ঞানের উপাদানস্বরূপ বাহ্য বস্তুর ধারণা নিষ্ক্রিয় মনে আসে। অভিজ্ঞতা বলতে লক বাহ্য বা মানস প্রত্যক্ষণকে বোঝান। তাই লক প্রত্যক্ষণকেই জ্ঞানের প্রথম পদক্ষেপ বা প্রথম স্তর এবং জ্ঞানের সমস্ত উপাদানের একমাত্র পথ বলেছেন। প্লেটো তাঁর Theatetus গ্রন্থে প্রত্যক্ষণের সাথে জ্ঞানের অভিন্নতা সম্পর্কিত মতকে খণ্ডন করেন। দেকার্ত, লাইবনিজ প্রমুখ দার্শনিক এই মতবাদের উপর গুরুত্ব প্রদান করেন। লক প্রথম প্রত্যক্ষণকে জ্ঞানের একমাত্র উৎস বলায় তাঁর মতবাদকে একটি নতুন ও বিপ্লবাত্মক মতবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।[৪৭] মনের প্রাথমিক ক্ষমতা হলো সংবেদন ও অন্তদর্শনজাত ধারণাকে গ্রহণ করা। ধারণা বলতে তিনি মন যাকে সরাসরি অনুভব করে অর্থাৎ প্রত্যক্ষণ, চিন্তা ও বুদ্ধির সাক্ষাৎ বিষয়বস্তুকে বোঝান।[৪৮] লকের মতে, বস্তুর ধারণা বস্তুর অনুরূপ। ধারণার উৎপত্তির কারণ হিসেবে তিনি মনের নয়, বরং জড় বস্তুর বস্তুনিষ্ঠতা ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ ধারণার উৎপত্তির জন্য মনকে জড়ের উপর নির্ভর করতে হয়। এজন্য তাঁকে আধুনিক জড়বাদের অগ্রদূতও বলা হয়।

লক ধারণাকে দুভাগে ভাগ করেন। সরল ও যৌগিক। সরল ধারণা বলতে তিনি বস্তুর সংবেদন ও অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিচ্ছিন্ন ধারণাকে বুঝান। মন নিষ্ক্রিয়ভাবে এগুলোকে গ্রহণ করে। এগুলো মনে আসার পর মন সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং এসব সরল ধারণার সাদৃশ্য ও বৈষম্য লক্ষ করে বিশেষ ধারণা থেকে সার্বিকীকরণের মাধ্যমে সার্বিক ধারণা গঠন করে। তাই লকের সুবিখ্যাত উক্তি, বুদ্ধিতে এমন কিছু নাই যা পূর্বে অভিজ্ঞতায় ছিল না। এভাবে তিনি দেখান যে, আরোহ পদ্ধতিতে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞানোৎপত্তি ঘটে। অবশ্য নিষ্ক্রিয় মন সক্রিয় হয়ে কীভাবে সার্বিক ধারণা গঠন করে এ সম্পর্কে লক বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি পরবর্তীকালে কান্টের বিচারবাদে ক্যাটাগরি ও দেশকালের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যার প্রয়াস লক্ষিত হয়।

জ্ঞানের সীমা সম্পর্কে লকের মত হলো, যেহেতু ধারণার মধ্যে মিল ও অমিল প্রত্যক্ষ করাই জ্ঞান সেহেতু অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণার আলোকে বস্তুকে যতটুকু জানা যায় ততটুকুর জ্ঞানই পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ জ্ঞানের সীমা আছে। জ্ঞানের যথার্থতা সম্পর্কে তাঁর মত হলো, অভিজ্ঞতা জ্ঞানকে যতটুকু প্রমাণ করতে পারে জ্ঞান ততটুকুই প্রতিপাদনযোগ্য বা যথার্থ অর্থাৎ বস্তু ও ধারণার মিল থাকলেই জ্ঞান যথার্থ, মিল না থাকলে জ্ঞান অযথার্থ। উল্লেখ্য যে, দেকার্ত আন্তর্ধারণাকে স্বতঃসিদ্ধ ঘোষণা করে জ্ঞানের সীমাকে অসীম করেছিলেন। এতে সবকিছুরই জ্ঞান পাওয়া সম্ভব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু লক তাঁর পূর্বোক্ত Essay গ্রন্থের প্রথম পুস্তকে আন্তর্ধারণাকে খণ্ডন করেন এবং ধারণার মধ্যে মিল ও অমিল প্রত্যক্ষ করাকে জ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি সংবেদনলব্ধ সরল ধারণার মধ্যে জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করার মাধ্যমে প্রথম বারের মতো জ্ঞানের সীমার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এটি জ্ঞানের সীমা নির্দেশের ক্ষেত্রে লকের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। পরবর্তীকালে হিউম জ্ঞান আদৌ সম্ভব কি না বলে যে মৌলিক প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন লকই তার পটভূমি তৈরি করেন।[৪৯] তিনি জ্ঞানের সীমাকে ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতার উপর নির্ভরশীল বলায় সংশয়বাদের পথ প্রশস্ত হয়। হিউমের দর্শনে লকের এই দিকটির প্রভাব দেখা যায়।

লক জ্ঞানকে অভিজ্ঞতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করলেও তিনি সংশয়বাদী নন। কারণ তিনি দ্রব্য, ঈশ্বর, কার্যকারণ ইত্যাদিকে স্বীকার করেন। তাঁর মতে, বস্তুর যে ক্ষমতা আমাদের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি করে তা হলো বস্তুর গুণ। এই গুণ দুই প্রকার। মুখ্য বা বস্তুনির্ভর গুণ, যেমন, বিস্তৃতি, ওজন, গতি ইত্যাদি। গৌণ বা মননির্ভর গুণ। যেমন, রং, স্বাদ, গন্ধ ইত্যাদি। লকের গৌণ গুণের ধারণার উপর আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাব লক্ষ করা যায়। লকের মতে, মুখ্য ও গৌণ গুণের আধার হলো দ্রব্য। দ্রব্য জড়ীয় ও আধ্যাত্মিক দুই প্রকার এরা অজ্ঞেয়। এছাড়া, লক ত্রিবিধ জ্ঞানের কথা বলেন।[৫০] যথা, (ক) স্বজ্ঞামূলক, অর্থাৎ মন ধারণার সাহায্য ছাড়া সরাসরি দুটো ধারণার মিল অমিল প্রত্যক্ষ করে যে জ্ঞান লাভ করে। (খ) প্রমাণমূলক, অর্থাৎ ধারণার সাহায্যে যে জ্ঞান লাভ হয়। যেমন, ঈশ্বরের জ্ঞান। এবং (গ) সংবেদনমূলক বা অভিজ্ঞজাত। লকের মতে স্বজ্ঞামূলক ও প্রমাণমূলক জ্ঞানই নিশ্চিত। সংবেদনমূল জ্ঞান হলো সম্ভাব্য। সকল জ্ঞানই প্রাথমিকভাবে সংবেদন থেকে আসে—একথা বলায় তাঁকে অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু অভিজ্ঞতাজাত নয় এমন প্রমাণমূলক জ্ঞানকে নিশ্চিত বলে স্বীকার করায়, এবং আধ্যাত্মিক দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করায় অনেকে তাঁকে সীমিত অর্থে অভিজ্ঞতাবাদী বলে মনে করেন।[৫১]

মূলত লকের মতবাদের কূটাভাস ছিল বহির্জগৎ সম্পর্কিত জ্ঞান নিয়ে। ধারণার মধ্যে মিল ও অমিল লক্ষ করাই যদি জ্ঞান হয় তবে আমরা অন্য মানুষের বা বাহ্য জগতের অস্তিত্বের জ্ঞান পেতে পারি না। কারণ, অস্তিত্ব মনের ধারণা নয়। সুতরাং জ্ঞান কেবল জ্ঞাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বাহ্য জগতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। লক মূলত এই কূটাভাসের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উপর্যুক্ত তিনপ্রকার জ্ঞানের কথা বলেন। কিন্তু লকের এই মত তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী পূর্ববর্তী মতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সংবেদনের কারণ আছে এবং এই কারণগুলো সংবেদনের অনুরূপ—লকের এই মত অভিজ্ঞতাবাদী নয়, বরং অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ। এই অসঙ্গতির হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যই লক জ্ঞানের যথার্থতাকে ধারণা ও বস্তুর সঙ্গতির উপর নির্ভরশীল করে তোলেন, এবং সকল প্রকার ধারণা বস্তুর অনুরূপ বলে মত প্রকাশ করেন।[৫২] রাসেল অভিজ্ঞতাবাদের এই অসঙ্গতিকে একটি বড় সমস্যা বলে মনে করেন। হিউম এই সমস্যা সমাধান করতে গিয়েই সংবেদনের বাহ্য কারণ অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই মত তাঁর অভিজ্ঞতাবাদের মূলসূত্র ‘ইন্দ্রিয়ছাপ’ ছাড়া কোনো ধারণার অস্তিত্ব নেই—এই মতের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। কারণ, ‘ইন্দ্রিয়ছাপ’ শব্দটি বাহ্য কারণ নির্দেশ করে। সুতরাং হিউম লক সম্পাদিত কূটাভাস থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা করে নিজেই আবার কূটাভাস সৃষ্টি করেছেন।[৫৩]

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, লকের মতবাদ যদিও ত্রুটিমুক্ত ছিল না তবুও তিনি প্রাচীন যুগের সোফিস্ট-এপিকিউরিয়াস-জেনো, মধ্যযুগের সেন্ট থমাস একুইনাস এবং আধুনিক যুগের বেকন প্রবর্তিত অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি আধুনিক প্লেটোনিক ধারার প্রভাবে প্রভাবিত বুদ্ধিবাদী দেকার্তের সহজাত ধারণাকে খণ্ডন করে বুদ্ধিবাদের ভিত দুর্বল করেন এবং অভিজ্ঞতালব্ধ সংবেদনের মধ্যে জ্ঞানের সীমা নির্দেশ করেন। এদুটো বিষয়ই অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারায় তাঁর নবতর সংযোজন। বেকন জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ করেন। তবে এ পদ্ধতিকে তিনি বিচারবিযুক্তভাবে গ্রহণ করেন। বেকনের এ ত্রুটি থেকে লক দর্শনকে মুক্ত করেন। তাই একথা বলা হয় যে, লকের অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদই প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি যথার্থ অর্থে সুবিচার করে। তিনি দেকার্তের আন্তর্ধারণা খণ্ডন করে প্রমাণ করেন যে, সাধারণের জ্ঞানের মধ্যেও আন্তর্ধারণাকে সন্দেহ করার পর্যাপ্ত ভিত্তি রয়েছে। এছাড়া, তিনি এও দেখান যে, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানই বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের জন্য আবশ্যিক। তাই ইন্দ্ৰিয় অভিজ্ঞতাই বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের আবশ্যিক ভিত্তি।[৫৪] তাঁর পরবর্তী ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী জর্জ বার্কলে লকের মতবাদ থেকে দ্রব্যের অজ্ঞেয়তা ও বাহ্য বস্তুর জ্ঞান সম্পর্কিত সমস্যা দূরীকরণের প্রয়াস নেন। ফলে লকের জড়বাদী জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ বার্কলের হাতে ভাববাদে পরিগণিত হয়। অবশ্য এরও পরবর্তীকালে ডেভিড হিউম এই উভয় দার্শনিকের দ্বারা সম্পাদিত অভিজ্ঞতাবাদের সমস্যা সমাধান করেন। হিউমের হাতে অভিজ্ঞতাবাদ সঙ্গতিপূর্ণ পরিণতি লাভ করে এবং সংশয়বাদে পর্যবসিত হয়।

বার্কলের জ্ঞানবিদ্যা

জন লক দেকার্তের আন্তর্ধারণ খণ্ডন করে অভিজ্ঞতাবাদের ভিত্তি স্থাপন করেন। বার্কলে লকের বিমূর্ত ধারণা অস্বীকার করে লকের অভিজ্ঞতাবাদের অগ্রগতি সাধন করেন। তবে তিনি সংবেদন ও অন্তর্দর্শনকে জ্ঞানের একমাত্র প্রাথমিক উপাদান হিসেবে আখ্যায়িত করেও এসবের কারণ হিসেবে অধ্যাত্ম দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। ফলে অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদে অসঙ্গতি ঘটে। এছাড়া, তিনি অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য বস্তুকে বস্তুর ধারণার অনুরূপ বলেছেন। অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে একথা তিনি বলতে পারেন না। কারণ, অভিজ্ঞতা দ্বারা তিনি কেবল বস্তুর ধারণাকে অভিজ্ঞতায় পান, বস্তুকে পান না। লক-পরবর্তী ব্রিটিশ দার্শনিক জর্জ বার্কলে (১৬৮৫–১৭৫৩ খ্রি.) লকের দ্বারা সম্পাদিত ত্রুটি নিরসন করে অভিজ্ঞতাবাদকে যৌক্তিক ও সুসংহত রূপ দেবার চেষ্টা করেন।

বার্কলের দার্শনিক আলোচনার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে লকের অভিজ্ঞতাবাদ থেকে অভিজ্ঞতা বহির্ভূত জড় দ্রব্যের অস্তিত্ব বর্জন করা, এবং অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে লকের স্বীকৃত জড়বাদী মতবাদ বর্জন করে ঈশ্বরের একছত্র অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করা। লক বাহ্য জগতের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করায় তাঁর মতবাদে জড়বাদ, নাস্তিকতাবাদ, সংশয়বাদ ও ধর্মহীনতার বীজ নিহিত ছিল। বিশপ বার্কলে এসব বীজ উৎপাটনে প্রয়াসী হন। বার্কলের অধিবিদ্যাগত উদ্দেশ্য তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত লক্ষ্য সাধনে বাধার সৃষ্টি করে। অর্থাৎ তাঁর অভিজ্ঞতাবাদকে অসঙ্গতিপূর্ণ করে। A Treatise Concerning the Principles of Human Knowledge 4 Three Dialogue Between Hylas and Philonous গ্রন্থদ্বয়ে বার্কলের জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদ পাওয়া যায়। বার্কলে তাঁর জ্ঞান বিষয়ক মতবাদে লকের যে সব বিষয়ের সমালোচনা করেন সেগুলো হলো : (১) সার্বিক ও বিমূর্ত ধারণার অস্তিত্ব, লক যাকে বিশেষ ধারণা থেকে গঠন করেন; (২) ধারণার মূলে জড়ীয় সত্তার অস্তিত্বের পূর্বধারণা; (৩) দ্রব্যের ধারণা; এবং (৪) মুখ্য ও গৌণ গুণের পার্থক্য।

বার্কলের মতে, লক বাহ্য জগতের মনোনিরপেক্ষ অস্তিত্ব স্বীকার করে তাঁর অভিজ্ঞতাবাদকে অসঙ্গতিপূর্ণ করেছেন। এই স্বীকৃতির কারণ হলো, মনের বিমূর্ত ধারণা গঠনের ক্ষমতাকে স্বীকার করা। কিন্তু অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস—লকের এই মতকে মেনে নিলে বিমূর্ত বা সার্বিক ধারণার জ্ঞানকে স্বীকার করা যায় না। কারণ, এর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অভিজ্ঞতায় আমরা যা পাই তা হলো সাদা, কালো, লাল রং, এবং এসব রং-সম্পন্ন বিশেষ বস্তু। আমরা যেমন সাদাত্ব, কালোত্ব, লালত্বকে অভিজ্ঞতায় পাই না তেমনি বিশেষ বস্তুর সার্বিক অস্তিত্বও অভিজ্ঞতায় পাই না। তাই তিনি সার্বিক ধারণা সম্ভব নয় বলে মত প্রকাশ করেন।[৫৬] যেসব শব্দ দ্বারা বিমূর্ত ধারণা প্রকাশ করা হয় তা শুধু এক একটি নাম। এই নামের অনুরূপ কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নাই। সার্বিক ধারণাকে নাম হিসেবে আখ্যায়িত করে বার্কলে যে মতবাদ দেন তাকে ‘নামবাদ’ বলা হয়।[৫৭] যেহেতু অভিজ্ঞতায় পাই না বলে কোনো প্রকার সার্বিক ধারণার অস্তিত্ব নাই সেহেতু বাহ্য বস্তুর প্রত্যক্ষ নিরপেক্ষ অস্তিত্বও স্বীকার্য নয়। ঠিক একই কারণে লকের মুখ্য ও গৌণ গুণের ভিত্তি হিসেবে অজ্ঞেয় দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করাও যুক্তিহীন বলে বার্কলে মনে করেন।[৫৮]

লক মুখ্য ও গৌণ গুণের পার্থক্য করে বলেছিলেন, মুখ্য গুণ বস্তুগত এবং গৌণ গুণ মনোগত। কিন্তু বার্কলে এই পার্থক্য অস্বীকার করে বলেন, এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ, মুখ্য গুণগুলোও গৌণ গুণের মতোই ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ নির্ভর ও ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। এগুলোকে গৌণ গুণ থেকে আলাদা করে প্রত্যক্ষ করা যায় না। সুতরাং উভয়ই প্রত্যক্ষ নির্ভর। আর যা কিছু প্রত্যক্ষ নির্ভর তা-ই, বার্কলের মতে, মনের ধারণা। এভাবে বার্কলে লকের দুই প্রকার গুণের পার্থক্য অস্বীকার করে লক যাকে ‘গুণ’ বলেছিলেন তাকে ‘ধারণা’য় রূপান্তরিত করেন। তাঁর মতে, আমরা যাকে জড় বলে থাকি তা আসলে কতিপয় ইন্দ্ৰিয়লব্ধ গুণের সমষ্টি। এসব গুণের সবই মানসিক অবস্থা বা ধারণামাত্র।[৫৯] লক বস্তুর ধারণাকে বস্তুর অনুরূপ বলেছিলেন। বার্কলের মতে, অনুরূপ মানেই অভিন্ন। বস্তুই ধারণা। বস্তুই যেহেতু ধারণা আর ধারণাই যেহেতু প্রত্যক্ষিত হয় সেহেতু বার্কলের সিদ্ধান্ত হলো, জড় জগৎ বা বহির্জগৎ বলে কোনো জগতের অস্তিত্ব নেই। যা কিছু আছে সবই আমাদের মনের ধারণা হিসেবে আছে। সুতরাং একমাত্র মনের ধারণাই অস্তিত্বশীল। যা প্রত্যক্ষিত হয় তাই মনের ধারণা। এজন্য লক যেখানে বলেছিলেন, বুদ্ধিতে এমন কিছু নাই যা পূর্বে অভিজ্ঞতায় ছিল না, সেখানে বার্কলের সিদ্ধান্ত হলো, অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর। এটাই তাঁর মতবাদের সারসংক্ষেপ।[৬০]

বার্কলের এই সিদ্ধান্তের দুটি দিক। প্রথমত, প্রত্যক্ষ ছাড়া কোনো কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা জ্ঞান পাই না। এই দিকটির জন্য তিনি লকের চেয়ে পরিশোধিত অভিজ্ঞতাবাদী। দ্বিতীয়ত, বস্তুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষের উপর নির্ভর করে। এই দিকটির জন্য তাঁর হাতে লকের জড়বাদ ভাববাদে রূপ নেয়। তিনি অভিজ্ঞতাবাদী ভাববাদী, ব্যক্তিগত ভাববাদী, আত্মগত ভাববাদী ইত্যাদি নামে খ্যাত হন। অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর, বার্কলের এই সিদ্ধান্তের ফলে জ্ঞানবিদ্যায় সংশয়বাদের ভিত ভেঙে পড়ে। কারণ, এতে সংবেদনগুলো বাহ্য কোনো বস্তুর প্রতিনিধিত্ব করছে কি-না এ প্রশ্নের অবকাশ থাকে না। জ্ঞান সম্ভব বলে বিবেচিত হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি জ্ঞানের নিশ্চয়তাও দান করে। কারণ, ধারণা ও বস্তু অভিন্ন বলে ভ্রান্ত জ্ঞানের সম্ভাবনা থাকে না। এছাড়া, এই মত সাধারণ জ্ঞানকেও সমর্থন করে।

এ সব বার্কলের মতবাদের সদর্থক দিক। এসব থাকা সত্ত্বেও বার্কলের মতবাদ আত্মবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত। কারণ, তিনি অস্তিত্বকে প্রত্যক্ষনির্ভর বলেছেন। এ থেকে মুক্তি পাবার জন্য বার্কলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে আমাদের প্রত্যক্ষকে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষের একটা অংশ হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁর মতে, আমরা যখন কোনো বস্তু প্ৰত্যক্ষ করি তখন ঈশ্বরের প্রত্যক্ষের অংশ হিসেবেই তা প্রত্যক্ষ করি, এবং আমরা যখন কোনো বস্তুকে প্রত্যক্ষ না করি তখনও সার্বিক প্রত্যক্ষণকর্তা ঈশ্বরের প্রত্যক্ষের বিষয় হিসেবে বিষয়টি অস্তিত্বশীল থাকে। এভাবে বার্কলে ঈশ্বরের ধারণা ধার করে এনে আত্মবাদের অভিযোগ থেকে তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী ভাববাদকে রক্ষা করার প্রয়াস পেয়েছেন।[৬১]

লক ধারণার উৎপত্তির ক্ষেত্রে মনের ক্ষমতাকে অস্বীকার করেছিলেন। তাই বাহ্য বস্তুর অজ্ঞেয় অস্তিত্ব স্বীকার করে মুখ্য ও গৌণ গুণাবলির কারণ নির্দেশ করেন। বার্কলে লকের প্রথমোক্ত কথাটি স্বীকার করেন, অথচ বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। ফলে তাঁকে নতুন করে মনের ধারণার কারণ নির্দেশ করতে হয়। বার্কলের মতে, এর কারণ জড় দ্রব্য নয়, বরং অদৈহিক সক্রিয় দ্রব্য বা ভাব। এই ভাব হলো একটি সরল অবিভক্ত সক্রিয় সত্তা। এই সক্রিয় সত্তাই অসীম বুদ্ধিময় সত্তা বা ঈশ্বর। তাঁর মতে, আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা যা কিছু শুনি, দেখি, অনুভব করি, তার সবকিছুই ঈশ্বরের শক্তির কার্য বা ফল।[৬২] ঈশ্বরের দেওয়া ধারণাবলির সুসংহত সমষ্টিকেই আমরা প্রকৃতি বলি। যে নিয়মানুবর্তিতা ও পরম্পরার মাধ্যমে ঈশ্বর অসীম মনে সংবেদন সৃষ্টি করেন তাকে প্রাকৃতিক নিয়ম বলা হয়। প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে ঈশ্বরের অভিব্যক্তি জানাই দর্শনের লক্ষ্য।

এই আলোচনা থেকে দেখা যায়, জন লক সমর্থিত অভিজ্ঞতাবাদী ধারার প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে জর্জ বার্কলে লকের অভিজ্ঞতাবাদের দোষত্রুটি সংশোধনের প্রয়াস গ্রহণ করেন। এর ফলে সংবেদনের কারণরূপ বাহ্যজগতের জ্ঞান পাওয়াসংক্রান্ত যে কূটাভাস জন লক সম্পাদন করেছিলেন তা দূরীভূত হয়েছে। অজ্ঞেয় ও অভিজ্ঞতালব্ধ নয় এমন জড়দ্রব্যের ধারণা অনাবশ্যক বলে বর্জিত হয়েছে, এবং জ্ঞানবিদ্যা থেকে সংশয়বাদের বীজ তিরোহিত হয়ে নিশ্চিত জ্ঞান সম্ভব বলে ঘোষিত হয়েছে। অন্যদিকে অভিজ্ঞতাবাদ আত্মগত ভাববাদের কবলে পড়ে অসঙ্গতির মুখোমুখি হয়েছে। লকের জড় ও অধ্যাত্ম দ্রব্যের স্থলে বার্কলের অধ্যাত্ম দ্রব্য সর্বগ্রাসী ভূমিকা পালন করেছে যা অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। লক যেমন জড় দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করে অভিজ্ঞতাবাদকে অতিক্রম করেন, বার্কলে তেমন অধ্যাত্ম দ্রব্যের সর্বময়তা ঘোষণা করে অভিজ্ঞতাবাদকে অতিক্রম করে যান। পরবর্তীকালে বার্ট্রান্ড রাসেলের নিরপেক্ষ একত্ববাদ দ্বারা, ধারণাই বস্তু অর্থাৎ বস্তু ও ধারণা অভিন্ন—বার্কলের এই মতকে খণ্ডন করা হয়।

সুতরাং দেখা যায়, লক ও বার্কলে উভয়ই অভিজ্ঞতাবাদের সাথে বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কিত ধারণার সামঞ্জস্য ব্যাখ্যার চেষ্টা করতে গিয়ে অভিজ্ঞতাবাদের ত্রুটি সম্পাদন করেছেন। লকের মতবাদে যদিও সংশয়বাদের বীজ নিহিত ছিল তবুও তিনি বেকন নির্দেশিত আরোহ পদ্ধতিতে সার্বিক ধারণার অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। বার্কলে সরাসরি নিশ্চিত জ্ঞানকে স্বীকার করেছেন। এতে সংশয়বাদের হাত থেকে অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাকে রক্ষার প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছে। তাঁদের দর্শনে অভিজ্ঞতাবাদের যে অসঙ্গতি ঘটেছে এর কারণ মূলত এই প্রচেষ্টার মধ্যেই নিহিত। আলোচনার অগ্রগতিতে আমরা দেখবো যে, ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদের অন্যতম প্রতিনিধি ডেভিড হিউম এ সমস্যাটি নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন।

পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার আধুনিক যুগ সম্পর্কিত আলোচনা থেকে মূলত দুটি ধারা লক্ষ করা যায়। একটি অভিজ্ঞতাবাদ, অন্যটি বুদ্ধিবাদ। প্রাচীন যুগে সোফিস্টদের হাতে সৃষ্ট অভিজ্ঞতাবাদী ধারা এপিকিউরিয়াস ও জেনোর চিন্তায় লালিত ও পরিশোধিত হয়ে মধ্যযুগের সেন্ট থমাস একুইনাসের চিন্তার মধ্যে দিয়ে আধুনিক যুগে বেকনের হাতে পৌঁছায়। বেকন রেনেসাঁ-উত্তর বিজ্ঞানের প্রভাবে এই অভিজ্ঞতাবাদকে আরোহ পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত করে যৌক্তিক ভিত্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে সতেরো শতকের ব্রিটিশ দার্শনিক লক ও বার্কলে এই অভিজ্ঞতাবাদী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। তবে তাঁরা দর্শনের ক্ষেত্রে বেকনের মতো পদ্ধতি নির্মাণের বিরোধিতা করেন। তাঁরা কোনো পদ্ধতিকে পূর্বস্বীকৃত হিসেবে ধরে না নিয়ে মুক্তভাবে বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে জ্ঞানবিদ্যাগত আলোচনায় প্রয়াসী হন। এরপরে ডেভিড হিউম এই ধারার সমর্থন ও পরিশোধন করে প্রমাণ করেন যে, আরোহাত্মক পদ্ধতি একটি সম্ভাব্য পদ্ধতি, নিশ্চিত নয়। তাঁর এই ব্যাখ্যা বিশ শতকের আপেক্ষিকতাবাদী পদার্থ বিজ্ঞানের তত্ত্বে সমর্থিত হয়।

অন্যদিকে, আধুনিক দর্শনে আরেকটি জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এ ধারাটি মূলত প্রাচীন যুগে এরিস্টটলের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, প্লেটো ও সক্রেটিস প্রমুখ দার্শনিক সমর্থিত ও পরিশোধিত হয়ে মধ্যযুগে সেন্ট অগাস্টিনের মাধ্যমে আধুনিক ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তের কাছে পৌঁছায়। দেকার্ত গণিতের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বুদ্ধিবাদী এ ধারাটিকে অবরোহ পদ্ধতির উপর স্থাপন করেন। তিনি সহজাত ধারণার কথা বলে বুদ্ধিবাদকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস নেন। পরবর্তীকালে স্পিনোজা ও লাইবনিজ এ ধারাকেই আরো পরিশোধিত করেন। উল্লেখ্য যে, পরবর্তী আধুনিক জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী পরস্পর বিরুদ্ধ ধারা দুটিকে সমন্বিত করে বিচারবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে এ দুটি ধারার প্রভাব বিশ শতকের দর্শনেও প্রতীয়মান হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আধুনিক যুগে রেনেসাঁ ও বিজ্ঞানের উন্নতির প্রভাবে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায়, প্রাচীন যুগের মতোই, ব্যক্তির স্বাধীন বিচারবুদ্ধি প্রাধান্য পায় এবং জ্ঞানবিদ্যা মধ্যযুগীয় প্রত্যাদেশনির্ভরতা থেকে মুক্ত হয়। জ্ঞানবিদ্যার এ বিজ্ঞান প্রভাবিত মুক্তবুদ্ধির ধারা আজ পর্যন্ত তার আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।

নির্যাস

এ অধ্যায়ে পাশ্চাত্য দর্শনের প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের জ্ঞানবিদ্যার ধারা আলোচনা করা হয়েছে। প্রাচীন যুগে সোফিস্ট, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, এপিকিউরিয়াস, জেনো ও সংশয়বাদী জ্ঞানবিদ্যা, মধ্যযুগে সেন্ট অগাস্টিন ও সেন্ট থমাস একুইনাসের জ্ঞানবিদ্যা, এবং আধুনিক যুগে বেকন, দেকার্ত, লক ও বার্কলের জ্ঞানবিদ্যা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। এর ফলে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার নিম্নোক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো লক্ষিত হয়।

(১) পাশ্চাত্য দর্শনের সকল দার্শনিক জ্ঞানবিদ্যার আলোচনাকে সাধারণ আলোচ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন নি। বরং জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার সূত্রপাতের জন্য পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসকে একশত বছর, অর্থাৎ সোফিস্টদের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রাক- সোফিস্ট যুগে পাশ্চাত্য দর্শনের আলোচনা ছিল মূলত বিশ্বতাত্ত্বিক। এক্ষেত্রে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যা থেকে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার পার্থক্য স্পষ্ট। ভারতীয় দর্শনের প্রচলিত নয়টি সম্প্রদায়ই সাধারণভাবে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার উপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এ পার্থক্যের কারণ সম্ভবত এই যে, প্রধানত জীবন সমস্যার সমাধানকল্পে ভারতীয় দর্শনের জন্ম হলেও বিশ্বতাত্ত্বিক প্রশ্ন থেকেই পাশ্চাত্য দর্শনের জন্ম। ভারতীয় দার্শনিকেরা জীবন সমস্যার সমাধানের জন্য যথার্থ জ্ঞান পাবার উপায় সম্পর্কে আলোচনা অর্থাৎ জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা করেছেন। কিন্তু পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ বিশ্বতাত্ত্বিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কিত আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন। সম্ভবত ভারতীয় দর্শনের মতো পাশ্চাত্য দর্শনে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা আবশ্যিক বিষয় হিসেবে গৃহীত না হওয়ার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

(২) পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনাকারী সকল দার্শনিকই জ্ঞানোৎপত্তির উপায় সম্পর্কিত আলোচনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁরা জ্ঞানের সীমা, সম্ভাবনা, সত্যতার মানদণ্ড ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করলেও জ্ঞানোৎপত্তির উপায় সম্পর্কিত আলোচনা ছিল মুখ্য বিষয়। এই বৈশিষ্ট্যের সাথে ভারতীয় দার্শনিকদের প্রমাণতত্ত্ব সম্পর্কিত আলোচনার মিল লক্ষিত হয়। ভারতীয় দর্শনের সকল সম্প্রদায় জ্ঞানবিদ্যাগত আলোচনায়, মূলত প্ৰমাণতত্ত্ব তথা জ্ঞানোৎপত্তিসংক্রান্ত মতবাদের আলোচনার উপরই প্রাধান্য দিয়েছেন।

(৩) প্রাচীন যুগে সোফিস্টদের হাতে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার সূচনা হলেও প্রাচীন, মধ্য, এমনকি আধুনিক যুগে বার্কলে পর্যন্ত কোনো দার্শনিকই জ্ঞান বলতে কী বোঝায় তার সুস্পষ্ট উত্তর দেননি। অর্থাৎ জ্ঞানের স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দান করেননি। প্রাচীন যুগে প্লেটো জ্ঞানকে নিশ্চিতির বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করে পরিবর্তনশীল বিষয় বা অভিমত থেকে আলাদা করেন। এতে জ্ঞানের পরিচিতি দানের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে একে জ্ঞানের যথার্থ সংজ্ঞা বলা যায় না। এই দুর্বলতার কারণেই পরবর্তী আধুনিক জার্মান দার্শনিক কান্ট তাঁর পূর্ববর্তী জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসকে বিচারবিযুক্তবাদের ইতিহাস হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি জ্ঞানের সংজ্ঞা দিয়ে অভিজ্ঞতাপূর্ব সংশ্লেষক অবধারণকে জ্ঞান বলেন। এক্ষেত্রে ভারতীয় দার্শনিকদের সঙ্গে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের অমিল লক্ষণীয়। ভারতীয় দার্শনিকদের সকলেই প্রথম যথার্থ জ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। অতপর যথার্থ জ্ঞান পাবার উপায়, তথা প্রমাণতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু পাশ্চাত্য দার্শনিকদের আলোচনা অনেকটা বিপরীত দিক থেকে প্রবাহিত।

(৪) পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার তিন যুগের দার্শনিকদের জ্ঞানোৎপত্তিসংক্রান্ত মতবাদের আলোচনায় প্রধানত দুটি ধারা লক্ষিত হয়। এই দুটি ধারা হলো অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদ মূলত সোফিস্টদের অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদ থেকেই পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার জন্ম। কিন্তু সোফিস্টদের অভিজ্ঞতাবাদ নঞর্থক সংশয়বাদের দিকে মোড় নেয়। এরিস্টটল পরবর্তী দার্শনিক এপিকিউরিয়াস, জেনো প্রমুখ এই ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সোফিস্টদের অভিজ্ঞতাবাদের নঞর্থক সংশয়বাদী ধারাকে সদর্থক দিকে প্রবাহিত করেন। মধ্যযুগে প্রাচীন যুগের মতো মুক্তবুদ্ধির মাধ্যমে জ্ঞানবিদ্যার চর্চা ছিল না। তবুও মধ্যযুগের শেষাংশে সেন্ট থমাস একুইনাস সোফিস্ট-এপিকিউরিয়াস-জেনো সমর্থিত এই ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। আধুনিক যুগের শুরুতে বেকনের হাতে এই ধারা আবারো নতুনভাবে আলোচিত হয়। বেকন অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যার পদ্ধতি হিসেবে বিজ্ঞানে ব্যবহৃত আরোহ পদ্ধতিকে যুক্ত করেন। পরবর্তীকালে লক ও বার্কলের হাতে এ দুটি ধারা আরো সংশোধিত হয়ে হিউমের হাতে চূড়ান্ত রূপলাভ করে। তিনি আরোহাত্মক পদ্ধতির পরিবর্তে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন এবং তাঁর মতবাদেই অভিজ্ঞতাবাদের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে সংশয়বাদের উদ্ভব হয়। তবে তাঁর সংশয়বাদ, সোফিস্টদের মতো, জ্ঞানকে অসম্ভব বলেনি, বরং জ্ঞানকে সম্ভাব্য বলে সংশয়বাদকে গঠনমূলক ও জীবনোপযোগী করেছে।

অন্যদিকে, সোফিস্ট অভিজ্ঞতাবাদের নঞর্থক সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিক্রিয়া হিসেবে জ্ঞানের সর্বজনীন মানদণ্ড আবিষ্কারের লক্ষ্যে প্রাচীন যুগে সক্রেটিস বুদ্ধিবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার ভিত্তি স্থাপন করেন। এই ধারা প্লেটো ও এরিস্টটলের চিন্তাধারার মধ্যে দিয়ে সংশোধিত আকারে প্রবাহিত হয়। মধ্যযুগে সেন্ট অগাস্টিন এই ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। তবে তিনি প্রত্যাদেশ ও বুদ্ধিকে একীভূত করায় তাঁর মতবাদকে প্রত্যাদেশ-প্রভাবিত বুদ্ধিবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। আধুনিক যুগে ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত এবং তাঁর অনুসারী স্পিনোজা ও লাইবনিজ এ ধারারই সফল প্রতিনিধি। দেকার্ত বুদ্ধিবাদকে অবরোহ পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত করে সহজাত ধারণার কথা বলে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বুদ্ধিবাদী ধারাকে সংশোধিত করেন এবং দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করেন।

সোফিস্ট-এপিকিউরিয়াস-জেনো-একুইনাস-বেকন-লক-বার্কলে দ্বারা সমর্থিত অভিজ্ঞতাবাদী এবং সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটল-অগাস্টিন-দেকার্ত-স্পিনোজা-লাইবনিজ দ্বারা সমর্থিত বুদ্ধিবাদী ধারা ছাড়াও পাশ্চাত্য দর্শনে সংশয়বাদ নামক একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। তবে একথা ঠিক যে, অভিজ্ঞতাবাদী ও বুদ্ধিবাদী ধারাই পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে মূল ধারা হিসেবে পরিচিত। এক্ষেত্রে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার সাথে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ধারার সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষিত হয়। ভারতীয় দর্শনে একমাত্র চার্বাক ছাড়া অন্য সবকটি সম্প্রদায় প্রত্যক্ষ ও অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করায় তাঁদের কোনোটিকে বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতাবাদী বা বিশুদ্ধ বুদ্ধিবাদী হিসেবে অভিহিত করা যায় না। একমাত্র চার্বাক দার্শনিকগণই বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতাবাদী।

(৫) পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যায় জ্ঞানের প্রামাণ্যের বিষয়টি একটি সাধারণ বিষয় হিসেবে আলোচিত হয়নি। অর্থাৎ সকল দার্শনিক আবশ্যিকভাবে প্রামাণ্যের বিষয়ে আলোচনা করেননি। এক্ষেত্রে ভারতীয় দার্শনিকদের সঙ্গে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের প্রভেদ লক্ষ করা যায়। ভারতীয় দর্শনের সকল দার্শনিকই জ্ঞানের প্রামাণ্যের বিষয়টিকে সাধারণ ও আবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে আলোচনা করেছেন। এর কারণ সম্ভবত এই যে, পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ জ্ঞান বলতে কেবল যথার্থ জ্ঞানকে বুঝিয়েছেন। ভ্রান্ত জ্ঞানকে তাঁরা জ্ঞান পদবাচ্য মনে করেননি। তাই জ্ঞানের প্রামাণ্যের আলোচনা তাঁদের কাছে অত্যাবশ্যকীয় মনে হয়নি। কারণ, প্রামাণ্য দ্বারা ভ্রান্ত জ্ঞান থেকে যথার্থ জ্ঞানকে আলাদা করা হয়। কিন্তু ভারতীয় দর্শনে জ্ঞান বলতে যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা এবং অযথার্থ জ্ঞান বা অপ্রমা উভয়কে বোঝানো হয়েছে। তাই যথার্থ জ্ঞান থেকে ভ্রান্ত জ্ঞানকে আলাদা করার জন্য জ্ঞানের প্রামাণ্যের বিষয়টি অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে সকল ভারতীয় দার্শনিকের দ্বারা আলোচিত হয়েছে। এজন্যই বিশিষ্ট ভারতীয় পণ্ডিত শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী জ্ঞানের প্রামাণ্যের প্রশ্নটিকে ইউরোপীয় দর্শনের সমস্যা না বলে ভারতীয় দর্শনের সমস্যা বলেছেন।[৬৩]

(৬) পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় যে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে তা হলো, জ্ঞানবিদ্যার ঐতিহাসিক ধারার কালিক অগ্রগতির সাথে জ্ঞানবিদ্যার বিশেষ ধারার আলোচনাও পরিশোধিত, সংশোধিত ও পরিমার্জিত হয়েছে। যেমন, সোফিস্টদের অভিজ্ঞতাবাদের তুলনায় এপিকিউরিয়াসের অভিজ্ঞতাবাদ বেশি ব্যাখ্যাত হয়েছে, এবং এসব মতবাদের তুলনায় আধুনিক দার্শনিক লক ও বার্কলের অভিজ্ঞতাবাদ অধিকতর পরিশোধিত পরিমার্জিত ও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। বুদ্ধিবাদী ধারার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একথাও বলা যায় যে, পাশ্চাত্য দর্শনের আধুনিক যুগেই জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা অধিকতর গুরুত্ব বহন করে এবং এই সময়ের দর্শন মূলত জ্ঞানবিদ্যাকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে, যা এর পূর্বে দেখা যায়নি। তবে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় মধ্যযুগে একটি নিম্নগামী ধারা পরিলক্ষিত হয়। মধ্যযুগে সমস্ত দর্শনচর্চা ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হলে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় মুক্তবুদ্ধির প্রয়োগ ব্যাহত হয়। ফলে এই সময়ে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা বিচারবিযুক্ত অবস্থার দিকে মোড় নেয়।

ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার এই ক্রমপরিশোধনের ধারাটি অনুপস্থিত। ভারতীয় দর্শনের সবকটি দার্শনিক সম্প্রদায়ই সমান গুরুত্বসহ জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা করেছেন। তবে তাঁদের আলোচনাপদ্ধতি ছিল দ্বান্দ্বিক। অর্থাৎ পূর্বপক্ষ, পূর্বপক্ষ-খণ্ডন, উত্তরপক্ষ। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় এই পদ্ধতি সর্বক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে উপস্থিত নয়।

একথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মূলত হিউমের জ্ঞানবিদ্যার প্রেক্ষাপট হিসেবে এ অধ্যায়ে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা করা হয়েছে। এ কারণে এখানে হিউম পূর্ববর্তী দার্শনিক জন লক পর্যন্ত জ্ঞানবিদ্যার আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখা হলো। আলোচনার অগ্রগতিতে হিউমের জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখবো যে, হিউম প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের অভিজ্ঞতাবাদী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদী লক ও বার্কলের অভিজ্ঞতাবাদ থেকে অসঙ্গতিমূলক উপাদান বর্জন করে অভিজ্ঞতাবাদকে সঙ্গতিপূর্ণ করেন। ফলে তিনি আত্মা, দ্রব্য, কার্যকারণ ইত্যাদি সকলপ্রকার অভিজ্ঞতা বহির্ভূত ধারণার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন এবং অভিজ্ঞতাবাদকে সংশয়বাদে পরিণত করেন। তাঁর মতে, এটাই অভিজ্ঞতাবাদের সঙ্গতিপূর্ণ পরিণতি। তাঁর এই সংশয়বাদ, তাঁর মতে, নঞর্থক নয় বরং সদর্থক। একজন যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদীর পক্ষে এই মত সমর্থন করা ছাড়া কোনো বিকল্পও নাই। তিনি তাঁর সংশয়বাদের নাম দিয়েছেন একাডেমিক সংশয়বাদ। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা হিউমের অভিজ্ঞতাবাদ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে হিউমের স্থান নির্ণয় করতে প্রয়াসী হবো।

তথ্যপঞ্জি

১. Paul Edwards (ed.): The Encyclopedia of Philosophy, New York. Macmillan Publishing Co. Inc. and The Free Press, 1972, Vol. 1, পৃ. ৯।

২. Robert Ackermann : Theories of Knowledge, Bombay, Tata McGraw-Hill Publishing Co. Ltd., “Introduction” দ্রষ্টব্য। এছাড়া Paul Edwards (ed.): The Encyclopedia of Philosophy, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯ তে প্লেটোকে “real originator of episte mology” বলা হয়েছে।

৩. F. Thilly : A History of Philosophy, Allahabad, Central Book Depot, 1978, পূ.

৪. জর্জিয়াস তাঁর On Nature or Nonexistent গ্রন্থে এই তিনটি উক্তি করেন।

৬. R. Ackermann : Theories, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১

৭. নীরদবরণ চক্রবর্তী : পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস, কলিকাতা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৮৮, পৃ. ১০।

৮. F. Thilly : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১।

৯. R. Ackermann : Theories, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫।

১০. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬।

১১. সরদার ফজলুল করিম (অনু.) : প্লেটোর রিপাবলিক, ঢাকা, বর্ণমিছিল, ১৯৭৪, ৬ষ্ঠ পুস্তক, ১৮ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

১২. F. Thilly : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৮১-৮২

১৩. সরদার ফজলুল করিম (অনু.) : প্লেটোর রিপাবলিক, পূর্বোক্ত, ৫ম পুস্তক, ১৫] অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

১৪. F. Thilly : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৮১।

১৫. R. Ackermann : Theories, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪।

১৬. Paul Edwards (ed.) : Encyclopedia., পূর্বোক্ত, পৃ. ১২।

১৭. R. Ackermann : Theories, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৭।

১৮. পূর্বোক্ত, পৃ. ৭২।

১৯. এরিস্টটল দর্শনের ক্ষেত্রে প্রথম যুক্তিবিদ্যার আলোচনার সূত্রপাত করেন। তিনি পাঁচ প্রকার বিধেয়কের কথা বলেন। সেগুলো হলো সংজ্ঞা, জাতি, বিভেদক লক্ষণ, উপলক্ষণ ও অবান্তর লক্ষণ। বিভেদক লক্ষণই হলো বিশেষ বস্তুর সারসত্তা। অর্থাৎ একই জাতির অন্তর্ভুক্ত কোনো একটি বিশেষ শ্রেণি বা উপজাতির অনিবার্য ও সাধারণ গুণ। বিভেদক লক্ষণের জ্ঞান ও জাতির জ্ঞান পেলেই বস্তুর যথার্থ জ্ঞান পাওয়া যায়। বস্তুর মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটে তা হলো বস্তুর অবান্তর লক্ষণের পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের মধ্যেও বস্তুর বিভেদক লক্ষণ বা সারসত্তা অপরিবর্তিত থাকে। পরিবর্তনশীল বস্তুর ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই সারসত্তার জ্ঞান পাওয়া যায়।

২০. Paul Edwards (ed.) : Encyclopedia., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩।

২১. F. Thilly : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩১।

২২. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩২।

২৩. পূর্বোক্ত।

২৪. Paul Edwards (ed.) : Encyclopedia., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩।

২৫. আমিনুল ইসলাম : প্রাচীন ও মধ্যযুগের, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫৭।

২৬. F. Thilly : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৮।

২৭. পূর্বোক্ত, পৃ. ২২৮।

২৯. পূর্বোক্ত।

30. R. Ackermann : Theories. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩।

৩১. আমিনুল ইসলাম : আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৪, পৃ. ৭৪।

32. R. Ackermann : Theories, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪০ দ্রষ্টব্য।

33. F. Thilly : History, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৮৭।

38. B. Russell : History of Western Philosophy, London, George Allen and Unwin Ltd. 1961, পৃ. ৫২৭।

৩৫. পূর্বোক্ত।

36. F. Thilly : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯২।

37. B. Russell : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ১০১।

৩৮. R. Ackermann : Theories, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০১।

40. F. Thilly : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১৪।

41. B. Russell : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৪২।

42. R. Ackermann : Theories, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০১!

83. W. K. Wright : A History of Modern Philosophy, New York, The Macmillan Co. 1965, পৃ. ১৩৯।

৪৪. ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে রাজা দ্বিতীয় চার্লস সিংহাসনারোহণ করেন। তাঁর সময়ে ও তাঁর পরবর্তীকালে তাঁর ভ্রাতা দ্বিতীয় জেমস রাজা হলে স্বৈরতন্ত্র চরম আকার ধারণ করে এবং সমগ্র ইংল্যান্ডকে বাহুবলের সাহায্যে ক্যাথলিকবাদে পরিণত করার প্রয়াস চালানো হয়। এই স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্তির জন্য হুইগ ও টোরি নেতৃবৃন্দ সম্মিলিতভাবে উইলিয়াম অব অরেঞ্জকে আহ্বান জানান।[১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে যুবরাজ উইলিয়াম ইংল্যান্ডে পদার্পণ করলে পার্লামেন্ট, গির্জা, সৈন্যবাহিনী, সকলে তাঁকে ত্রাণকর্তা হিসেবে বরণ করেন এবং রাজা দ্বিতীয় জেমস পলায়ন করেন। এই রক্তপাতহীন বিপ্লবের পটভূমিতেই জন লক তাঁর, Essay গ্রন্থ রচনা করেন এবং মুক্ত জ্ঞানালোকের যুগের সূচনা হয়। 45. B. Russell : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৮৪।

46. John Locke : Essay Concerning Human Understanding, ed. by A. Seth, Oxford, Pringle Pattison, 1924, Book IV, Chap. I.

47. B. Russell : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৯০।

48. John Locke : Essay, পূর্বোক্ত, Book II, Chap. VIII.

49. C. R. Morris: Locke, Barkeley and Hume, London, Oxford University Press, 1963, পৃ. ২১-২২।

50. John Locke : Essay., পূর্বোক্ত, Book IV. Chap. III.

৫১. Paul Edwards (ed.) : Encyclopedia, Vol. 1-2, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০২।

52. B. Russell : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৯১।

৫৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৯১-৫৯২।

54. R. Ackermann : Theories, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪১-১৪২।

৫৬. R. Ackermann : Theories, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫২।

57. W. K. Wright : A History., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৭] এবং R. Ackermann, Theories. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫৯-৬০।

৫৮. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৬ এবং F. Thilly : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫৯-৬০।

৫৯. আমিনুল ইসলাম : আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৯।

60. R. Ackermann : Theories. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৯।

61. G. A. Johnston : Development of Berkeley’s Philosophy, New york. Macmillan Publishing Co., Inc, and The Free Press, 1923, পৃ. ২০৫।

62. G. Berkeley : A Treastise Concerning Principles of Human Knowledge, London, Everman’s Library, 1910. CXLVIII.

৬৩. শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী : বেদান্ত দর্শন—অদ্বৈত বেদান্ত, কলিকাতা, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪৯, পৃ. ৩১৮।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *