৩. পলিটিক্স
অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স একাধারে আগ্রহোর্দীপক ও গুরুত্বপূর্ণ। আগ্রহোদ্দীপক এই অর্থে যে, তাতে তার যুগের শিক্ষিত গ্রিকদের সাধারণ সংস্কারগুলোর পরিচয় পাওয়া যায়; আর গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত প্রভাব বজায় ছিল এমন অনেক তত্ত্বের একটি উৎস তার এই গ্রন্থ। আজকের দিনে কোনো রাষ্ট্রনেতার ব্যবহারিক কাজে লাগবে এমন বেশি কিছু এই গ্রন্থে আছে বলে আমার মনে হয় না, কিন্তু হেলেনিক জগতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-বিরোধগুলোতে আলো ফেলে এমন বিষয় এতে প্রভূত পরিমাণে রয়েছে। অ- হেলেনিক রাষ্ট্রগুলোর শাসনপদ্ধতি সম্বন্ধে বেশি কিছু এতে পাওয়া যায় না। সত্য যে, মিসর, ব্যাবিলন, পারস্য ও কার্থেজ সম্পর্কে পরোক্ষ কিছু উল্লেখ পাওা যায়; কিন্তু সেগুলোও, শুধু কার্থেজ সম্পর্কিতগুলো ছাড়া, গতানুগতিক। আলেকজান্ডারের কোনো উল্লেখ নেই, এমনকি পৃথিবীতে তিনি যে পরিপূর্ণ রূপান্তর সাধন করছিলেন তারও অস্পষ্টতম উল্লেখ পর্যন্ত নেই। পুরো আলোচনাটি নগররাষ্ট্রগুলো সম্পর্কে নগররাষ্ট্রগুলো যে একসময় সেকেলে হয়ে যেতে পারে এ ব্যাপারে কোনো পূর্বদৃষ্টিও এতে পাওয়া যায় না। নানা স্বাধীন নগরীতে বিভক্ত ছিল বলে গ্রিস ছিল রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক গবেষণাগার। কিন্তু অ্যারিস্টটলের সময় থেকে মধ্যযুগে ইতালীয় নগরীগুলোর উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো কিছুরই অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অনেক দিক থেকে, যে অভিজ্ঞতার প্রতি অ্যারিস্টটল মনোযোগ আকর্ষণ করেন তা বইটি লেখার পরের পনের শত বছরের যেকোনো সময়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়ে অধিকতর প্রাসঙ্গিক।
আকস্মিক অনেকগুলো সুখকর মন্তব্য আছে বইটিতে। রাজনৈতিক তত্ত্ব আলোচনা শুরু করার আগে সেগুলোর কিছু কিছু উল্লেখ করা যায়। বলা হচ্ছে, ইউরিপিডিস যখন মেসিডোনের রাজা আর্কিলাউসের দরবারে ছিলেন, তখন জনৈক ডিকামনিকাস অভিযোগ করেন যে ইউরিপিডিসের মুখে দুর্গন্ধ। ইউরিপিডিস তাতে ক্ষিপ্ত হন, রাজা রাগ প্রশমনের জন্য ইউরিপিডিসকে অনুমতি দেন ডিকামনিকাসকে চাবুক মারার, তিনি চাবুক মারেন। তার পর থেকে বহু দিন সুযোগের অপেক্ষায় থাকার পর ডিকামনিকাস রাজাকে হত্যা করার এক সফল ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেন; কিন্তু ইউরিপিডিস আর তত দিনে বেঁচে নেই। বলা হচ্ছে, সন্তান ধারণ করতে হবে শীতকালে, যখন বাতাস থাকে উত্তরে। বলা হচ্ছে, খুব সযত্নে অভদ্র কথা এড়িয়ে চলতে হবে, কারণ লজ্জাজনক কথা থেকে লজ্জাকর কাজের জন্ম হয়। আরো বলা হচ্ছে, অশ্লীল কথা বা আচরণ কখনো বরদাশত করা হবে না, শুধু মন্দিরে ছাড়া, কারণ মন্দিরে আইনত সব ধরনের বাজে কথা, এমনকি অশ্লীল কৌতুকও অনুমোদনযোগ্য। অতি অল্প বয়সে বিয়ে করা উচিত নয়, কারণ তাহলে সন্তান দুর্বল হবে এবং কন্যা সন্তানের জন্ম হবে, স্ত্রীরা খেয়ালি ও অসতী হবে এবং স্বামীদের দৈহিক বিকাশ ব্যাহত হবে। পুরুষের জন্য বিবাহের উপযুক্ত বয়স ৩৭ বছর, মেয়েদের ১৮। আমরা জানি থেলিসকে দারিদ্র্যের জন্য বিদ্রূপ করা হলে তিনি দফায় দফায় সব জলপাই মাড়াইকল কিনে নিয়েছিলেন এবং সময়মতো সেগুলো ব্যবহারের ওপর একচেটিয়া ভাড়া ধার্য করেছিলেন। তিনি এ রকম করেছিলেন এটা দেখাবার জন্য যে, দার্শনিকরা ইচ্ছে করলে টাকা বানাতে পারে। আর যদি তারা গরিব থেকে যায়, তার অর্থ এই নয় যে তাদের ধনী হবার সাধ্য বা বুদ্ধি নেই, বরং সম্পদের চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের চিন্তা করবার আছে। এই সব কথা এসে গেল কথায় কথায়। এখন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আসা যাক।
গ্রন্থটি (পলিটিক্স) শুরু হয়েছে রাষ্ট্রের গুরুত্ব নির্দেশের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্র হলো সর্বোচ্চ ধরনের এক মানবসংগঠন। তার লক্ষ্য সর্বোচ্চ মঙ্গলসাধন। সময়ের বিচারে, প্রথমে আসে পরিবার পরিবার গঠিত হয় পুরুষ ও নারী, মালিক ও দাস-এই দুই মৌলিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। উভয় সম্পর্কই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক। কতকগুলো পরিবার মিলিত হয়ে গঠন করে একটি গ্রাম, কতকগুলো গ্রাম মিলে হয় রাষ্ট্র, এখানে শর্ত হবে যে এইসবের সমষ্টি এমন বৃহৎ হবে যাতে তা স্বনির্ভর হয়। সময়ের বিচারে রাষ্ট্র পরিবারের পরবর্তী হলেও স্বভাবের দিক থেকে রাষ্ট্র পরিবারের পূর্ববর্তী, এমনকি তা ব্যক্তিরও আগে। কারণ, প্রত্যেকটি জিনিস পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হলে যা দাঁড়ায় তাকে আমরা বলি তার প্রকৃতি। এবং মানব সমাজ পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হলে হয় রাষ্ট্র; আর সমগ্র হলো অংশের অগ্রবর্তী। ধারণাটি একটি দেহাংশের ধারণার মতো : বলা হচ্ছে, একটি দেহের সঙ্গে সংযুক্ত একটি হাত আর হাত থাকে না যদি দেহটি ধ্বংস হয়ে যায়। এ কথার নিহিতার্থ হলো এই যে, একটি হাত সংজ্ঞায়িত হবে তার কাজ দ্বারা। হাতের কাজ হলো কোনো কিছু ধরা, এ কাজ একটি হাত কেবল তখনই করতে পারে যখন তা একটি দেহের সঙ্গে যুক্ত থাকে। একইভাবে একজন ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত একটি রাষ্ট্রের অংশ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সে তার উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে না। অ্যারিস্টটল বলছেন, যিনি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন তিনি মঙ্গলকর্তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কারণ আইন ছাড়া মানুষ পশুরও অধম আর আইনের অস্তি ত্ব নির্ভর করে রাষ্ট্রের ওপরে। রাষ্ট্র নেহায়েত বিনিময়ের এবং অপরাধ দমনের জন্য একটি সমাজ নয় : রাষ্ট্রের লক্ষ্য মঙ্গলময় জীবন…আর রাষ্ট্র হচ্ছে কয়েকটি গ্রামের ও কয়েকটি পরিবারের সম্মিলনে একটি উৎকৃষ্ট ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন, যার দ্বারা আমরা বুঝি একটি সুখী ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন।…একটি রাষ্ট্রীয় সমাজ টিকে থাকে শুধু সঙ্গ ও সখ্যের স্বার্থে নয়, মহৎ কাজকর্মের স্বার্থে।
একটি রাষ্ট্র গঠিত হয় কয়েকটি গৃহস্থালি দ্বারা, আর প্রত্যেকটি গৃহস্থালি হলো একটি করে পরিবার, তাই রাজনীতির আলোচনা আরম্ভ করতে হয় পরিবার নিয়ে। এই আলোচনার বড় অংশ দাসপ্রথার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট-কারণ প্রাচীন গ্রিসে দাসদের পরিবারের অংশ হিসেবে ধরা হতো। দাসপ্রথা সুবিধাজনক এবং আইনানুগ, তবে একজন দাস স্বভাবগতভাবে তার মালিকের চেয়ে হীন। জন্ম থেকেই কিছু মানুষ শাসন করার জন্য আর কিছু মানুষ শাসিত হবার জন্য আলাদাভাবে চিহ্নিত। প্রাকৃতিকভাবে যে লোকের ওপর নিজের অধিকার নেই বরং অন্যের অধিকার আছে, স্বভাবগতভাবে সে একজন দাস। দাসরা গ্রিক হবে না বরং এমন একটি জাতের মধ্য থেকে হবে যাদের তেজস্বিতা কম। পোষা জীবজন্তু মানুষের দ্বারা শাসিত হলে তাদের উন্নতি ঘটে; একইভাবে স্বভাবগতভাবে হীন লোকেরা তাদের চেয়ে শ্রেয় ব্যক্তিদের দ্বারা শাসিত হলে উন্নতি করে। প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, যুদ্ধবন্দিদের দাস বানানোর রীতি ন্যায্য কি না। যে ক্ষমতা মানুষকে যুদ্ধে বিজয়ী করে তা একটি শ্ৰেয় গুণ বলে বিবেচিত, কিন্তু ব্যাপারটা সবসময় এ রকম নয়। যুদ্ধ তখনই ন্যায্য যখন তা করা হয় এমন লোকদের বিরুদ্ধে যারা প্রকৃতির ইচ্ছায় অন্যদের দ্বারা শাসিত হবার জন্য নির্দিষ্ট কিন্তু অধীনতা স্বীকার করে না। এ রকম থেকে (অ্যারিস্টটলের পাঠ থেকে) মনে হয় যে বিজিতদের মধ্য থেকে দাস বানানো বৈধ। যেকোনো যুদ্ধজয়ীর পক্ষেই এই যুক্তি দেওয়াই যথেষ্ট। কারণ কোনো জাতিই মানবে না যে প্রকৃতির ইচ্ছা যে তারা অন্যদের দ্বারা শাসিত হোক। সে ক্ষেত্রে প্রকৃতির ইচ্ছার একমাত্র প্রমাণ বেরিয়ে আসবে যুদ্ধের ফলাফল থেকে। অতএব, প্রত্যেকটি যুদ্ধে বিজয়ীপক্ষ ন্যায্য, পরাজিত পক্ষ অন্যায্য। বেশ সন্তোষজনক! এরপর এসেছে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে একটি আলোচনা, যা পণ্ডিতদের তর্ক বিতর্কে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। একটি বস্তুর দুই ধরনের ব্যবহার থাকে, একটি সঠিক ব্যবহার আর একটি হলো ভুল ব্যবহার, বা অপব্যবহার। দৃষ্টান্তস্বরূপ, একটি জুতো পায়ে দেওয়া যায় আর বিনিময় করা যায়। জুতো পায়ে দেওয়া হলো জুতোর সঠিক ব্যবহার আর তা বিনিময় করা হলো বেঠিক ব্যবহার। এ থেকে মুচি সম্বন্ধে হীন ধারণা পোষণ করা হচ্ছে, কারণ সে জীবিকার জন্য জুতো বিক্রি (বিনিময়) করতে বাধ্য। বলা হচ্ছে, খুচরো ব্যবসা সম্পদ লাভের কলাকৌশলের স্বাভাবিক অংশ নয়। সম্পদ অর্জনের স্বাভাবিক উপায় হলো গার্হস্থ্য ও জমির দক্ষ ব্যবস্থাপনা। এই উপায়ে যে সম্পদ অর্জিত হতে পারে তার একটি সীমা আছে, কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা অর্জিত সম্পদের সীমা নেই। ব্যবসার কারবার টাকার সঙ্গে, কিন্তু সম্পদ মানে মুদ্রা অর্জন নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে আগত অর্থ সঙ্গতভাবে ঘৃণিত। কারণ তা স্বাভাবিক নয়। বলা হচ্ছে, সবচেয়ে ঘৃণ্য পন্থা হলো সুদের কারবার, সবচেয়ে সঙ্গত কারণেই। সুদখোরি অর্থের স্বাভাবিক বস্তু থেকে লাভ এনে দেয় না, খোদ অর্থ থেকেই লাভ নিয়ে আসে। কারণ অর্থের ব্যবহার বিনিময়ে, সুদ থেকে অর্থের বৃদ্ধির জন্য অর্থ নয়…সম্পদ অর্জনের সব পন্থার মধ্যে সুদখোরি হলো সবচেয়ে অস্বাভাবিক।
এ রকম অনুশাসন থেকে যা বেরিয়ে আসে তা পাঠ করা যেতে পারে Tawney এর Religion and the Rise of Capitalism গ্রন্থে। তবে তার ইতিহাসবিষয়ক বক্তব নির্ভরযোগ্য হলেও তার মন্তব্যে এমন একটি কিছুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব আছে, যা প্রাক পুঁজিবাদী।
লাভের শর্তে টাকা ধার দেওয়াই সুদখোরি, এখনকার মতো শুধু অতি উচ্চ হারে টাকা ধার দেওয়া নয়। গ্রিক যুগ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত মানব সমাজ, বা মানব সমাজের অর্থনৈতিকভাবে উন্নততর অংশ বিভক্ত ঋণগ্রহীতা আর ঋণদাতা-এই দুই ভাগে। ঋণগ্রহীতারা সুদের বিপক্ষে আর ঋণদাতারা সুদের পক্ষে। অধিকাংশ সময়ে জমির মালিকরা ছিল ঋণগ্রহীতা, আর সদাগরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত লোকেরা ছিল ঋণদাতা। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দার্শনিকদের অভিমতগুলো তাদের নিজ নিজ শ্রেণির আর্থিক স্বার্থের সঙ্গে মিলেছে। গ্রিক দার্শনিকরা হয় ভূ-মালিক শ্রেণির ছিলেন অথবা তারা ওই শ্রেণির অধীনে চাকরি করতেন। সুতরাং তারা সুদ অনুমোদন করতেন না। মধ্যযুগের দার্শনিকরা ছিলেন চার্চের লোক, আর চার্চের সম্পত্তি ছিল প্রধানত জমি। তাই তারা অ্যারিস্টটলের মত উল্টাবার কোনো কারণ দেখেননি। সুদখোরির বিরুদ্ধে তাদের আপত্তি আরো জোরদার হয় ইহুদি বিদ্বেষীদের দ্বারা, কারণ সিংহভাগ তরল পুঁজি ছিল ইহুদিদের হাতে।
খ্রিস্টান যাজক সম্প্রদায় ও ব্যারন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঝগড়া ছিল, কখনো কখনো তা তীব্র রূপ নিত। কিন্তু যে ইহুদি খারাপ ফসলের মৌসুম কাটিয়ে উঠতে তাদেরকে টাকা ধার দেয় তার বিরুদ্ধে তারা একজোট হতে পারে। এবং তারা মনে করে ইহুদিটির মিতব্যয়িতার জন্য কিছু পুরস্কার প্রাপ্য।
রিফরমেশনের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিস্থিতি বদলে যায়। সবচেয়ে আন্তরিক প্রটেস্টান্টদের অনেকেই ছিলেন ব্যবসায়ী, যাদের জন্য সুদে টাকা ধার দেওয়া ছিল অত্যন্ত জরুরি। ফলে, প্রথমে ক্যালভিন এবং তারপরে অন্যান্য প্রটেস্টান্ট ধর্মবেত্তাগণ সুদ অনুমোদন করেন। অবশেষে ক্যাথলিক চার্চ এই দৃষ্টান্ত অনুসরণে বাধ্য হয়, কারণ পুরোনো বিধি-নিষেধ নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাচ্ছিল না। দাশর্কনিকরা যখন থেকে আর যাজক রইলেন না এবং সেই হেতু ভূমির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক টুটে গেল তখন থেকে তারা সুদের পক্ষপাতী হলেন। এ সময় তাদের জীবিকা আহরিত হতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিনিয়োগ থেকে। প্রত্যেকটি ধাপে আর্থিকভাবে সুবিধাজনক দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর পেছনে তাত্ত্বিক যুক্তির সমর্থন ছিল।
বিভিন্ন দিক থেকে অ্যারিস্টটল প্লেটোর ইউটোপিয়ার সমালোচনা করেছেন। প্রথমেই আছে খুবই আগ্রহোদ্দীপক মন্তব্য, প্লেটোর ইউটোপিয়া রাষ্ট্রকে অতিরিক্ত ঐক্য দিয়েছে; এই ঐক্য এতটাই বেশি যে, তাতে রাষ্ট্র যেন একজন ব্যক্তিতে পরিণত হবে। এর পরে এসেছে পরিবার বিলোপের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অ্যারিস্টটলের যুক্তি, যা স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেক পাঠকের মনে আসে। পুত্র হতে পারে এমন বয়সী সবাইকে শুধু পুত্র নাম দিয়ে প্লেটো মনে করেছেন যে এর ফলে একজন পুরুষ মানুষ তার পুত্রবয়সী সব ছেলের প্রতিই পুত্রবৎ অনুভূতি অর্জন করবে এবং একইভাবে পিতা সম্পর্কেও পিতাবয়সী সবার প্রতি পিতৃবৎ অনুভূতি লাভ করবে। উল্টো দিকে, অ্যারিস্টটল বলছেন, সর্বোচ্চসংখ্যক লোকের কাছে যা সাধারণ, তা কোনো যত্নই পাবে না। পুত্ররা যদি অনেক পিতার সাধারণ পুত্র হয় তাহলে তারা গড়পড়তাই অবহেলিত হবে; অ্যারিস্টটলের মতে প্লেটোর উল্লিখিত পুত্র হওয়ার চেয়ে বাস্তবে কাজিন হওয়া শ্রেয়। অ্যারিস্টটল মনে করেন, প্লেটোর পরিকল্পনা স্নেহ-ভালোবাসাকে। জলো করে ফেলবে। তারপরে আছে এক অদ্ভুত যুক্তি : যেহেতু ব্যভিচার থেকে বিরত থাকা একটি সদগুণ অতএব এমন ধরনের সমাজব্যবস্থা কায়েম করা পরিতাপের বিষয় হবে যেখানে এই সদগুণের অধিকারী হবার বা তার উল্টো পাপ করার সুযোগ কারো। থাকবে না। তারপর প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যদি মেয়েরা হয় সাধারণ, তাহলে গৃহস্থালির তদারকি করবে কে? Architecture and the Social System শিরোনামে একবার আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সেখানে আমি বলেছি, যারা সাম্যবাদের সঙ্গে পরিবার বিলোপ করার ব্যাপারটি যুক্ত করেন তারা সবাইই বিপুলসংখ্যক বারোয়ারি বাড়ি, বারোয়ারি রন্ধনশালা, খাবার ঘর, শিশু প্রতিপালনের ঘর ইত্যাদির পক্ষে বলেন। এই ব্যবস্থাকে কৌমার্যব্রতহীন আশ্রম-জীবন হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। প্লেটোর। পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য, কিন্তু তা করা নিশ্চয়ই তার অন্যান্য প্রস্তাবিত বিষয়গুলোর চেয়ে অধিকতর অসম্ভব নয়।
প্লেটোর সাম্যবাদ অ্যারিস্টটলের কাছে বিরক্তিকর। অ্যারিস্টটল বলছেন, প্লেটোর সাম্যবাদী ব্যবস্থায় অলস লোকদের বিরুদ্ধে ক্রোধ সৃষ্টি হবে; একসঙ্গে ভ্রমণে বেরুলে ভ্রমণসঙ্গীদের মধ্যে সাধারণত যে ধরনের ঝগড়া-মনোমালিন্য হয় সে ধরনের ঝগড়াঝাটির বিরুদ্ধেও প্লেটোর সাম্যবাদী সমাজে রাগ দেখা দেবে। ভালো হয় যদি প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজে মন দেয়। সম্পত্তি হওয়া উচিত ব্যক্তিগত, কিন্তু জনগণকে এমনভাবে পরোপকারে দীক্ষিত করে তুলতে হবে যেন তারা নিজেদের সম্পত্তি ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারে সম্মত হয়। পরের উপকার করা এবসং উদারতা হলো সদগুণ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছাড়া এ দুটি সদগুণ সম্ভব নয়। অবশেষে বলা হচ্ছে, যদি প্লেটোর পরিকল্পনাগুলো উত্তম হতো, তাহলে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তা বাস্তবায়নের চিন্তা আগেই করত। আমি প্লেটোর সঙ্গে একমত নই, আর তা প্লেটোর বিরুদ্ধে অ্যারিস্টটলের যুক্তির কারণেই।
দাস প্রথার ব্যাপারে আমরা দেখেছি, অ্যারিস্টটল সমতায় বিশ্বাসী নন। দাস ও নারীদের অধীনতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, সব নাগরিক রাজনৈতিকভাবে সমান হবে কি না। অ্যারিস্টটল বলছেন, কিছু লোক মনে করে সব নাগরিক রাজনৈতিকভাবে সমান হওয়া বাঞ্ছনীয় এই কারণে যে, সব ধরনে বিপ্লব সংঘটিত হয় সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে। অ্যারিস্টটল এই যুক্তি বাতিল করেছেন। তিনি মনে করেন, বড় বড় অপরাধ সংঘটিত হয় অভাবের কারণে নয়, বরং প্রাচুর্যের কারণে। তার মতে, শীত থেকে বাঁচবার জন্যে কোনো মানুষ স্বৈরাচারী হয় না। একটি সরকার তখনই ভালো সরকার হয় যখন তার লক্ষ্য হয় পুরো জনগোষ্ঠীর মঙ্গলসাধন আর খারাপ সরকার সেই সরকার যে শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবে। ভালো সরকার তিন ধরনের; যথা-রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং সাংবিধানিক সরকার (বা রাষ্ট্রসমাজ-Polity)। খারাপ সরকার তিন ধরনের; যথা-স্বৈরতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র এবং গণতন্ত্র। এসবের মাঝামাঝি আরো অনেক মিশ্র ধরনের শাসনপদ্ধতি আছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখানে ভালো সরকার ও মন্দ সরকার সংজ্ঞায়িত হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের নৈতিক বৈশিষ্ট্যাবলি দ্বারা, সরকারের গঠন কী রকম তার দ্বারা নয়। তবে কথাটি আংশিকভাবে সত্য। অভিজাততন্ত্র হলো সদগুণসম্পন্ন লোকদের শাসন, গোষ্ঠীতন্ত্র ধনিক গোষ্ঠীর শাসন, কিন্তু অ্যারিস্টটল তো সদগুণ এবং ধন-সম্পদকে খুব সমার্থক মনে করেন না। স্বর্ণময় মধ্যপন্থার নীতি অনুসারে তিনি মনে করেন, সদগুণের সঙ্গে একটি ন্যায়সঙ্গত পর্যাপ্ততা সংশ্লিষ্ট। বলা হচ্ছে : বৈষয়িক মালামালের সাহায্যে মানবজাতি সদগুণ অর্জন করে না বা তা রক্ষা করে না; বরং সদগুণ ও সুখের সাহায্যেই মানুষ বৈষয়িক সম্পদ লাভ করে। কারো বৈষয়িক সম্পদে আনন্দ বা সদগুণ বা উভয়ই আছে কি না তা প্রায়ই বেশি করে দেখা যায় সেইসব মানুষের মধ্যে যারা মনের দিক থেকে চরিত্রগতভাবে বেশ সংস্কৃতিবান, যারা বৈষয়িক সম্পদ ভোগ করে পরিমিতভাবে। যারা অর্থহীনভাবে মাত্রাতিরিক্ত ধন-সম্পদের অধিকারী কিন্তু উচ্চতর গুণাবলিতে যাদের ঘাটতি আছে তাদের মধ্যে ব্যাপারটা ততটা দেখা যায় না। তাহলে সর্বোত্তমদের শাসন (অভিজাততন্ত্র) এবং সবচেয়ে সম্পদশালীদের শাসনের (গোষ্ঠীতন্ত্র-oligarchy) মধ্যে একটি পার্থক্য আছে, কারণ সর্বোত্তমরা কেবল পরিমিত ধন-সম্পদের অধিকারী। গণতন্ত্র এবং পোলিটির মধ্যেও একটি পার্থক্য আছে; শাসনপদ্ধতির মধ্যে যে নৈতিক পার্থক্যের কথা অ্যারিস্টটল বলছেন তা ছাড়াও পোলিটির মধ্যে কিছু গোষ্ঠীতান্ত্রিক উপাদান থেকে যায়। তবে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যকার পার্থক্য শুধুই নৈতিক। অ্যারিস্টটল গোষ্ঠীতন্ত্র ও গণতন্ত্রের পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে শাসকদের অর্থনৈতিক অবস্থানের ওপরে জোর দিয়েছেন। গোষ্ঠীতন্ত্রে ধনিকরা গরিবদের স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে শাসন করে; আর গণতন্ত্রে ক্ষমতা থাকে অভাবী লোকদের হাতে, তারা ধনীদের স্বার্থ অগ্রাহ্য করে। রাজতন্ত্র অভিজাততন্ত্রের চেয়ে ভালো, অভিজাততন্ত্র পোলিটির চেয়ে ভালো। কিন্তু সর্বোত্তমদের পচন হলো সবচেয়ে খারাপ, তাই স্বৈরতন্ত্র গোষ্ঠীতন্ত্রের চেয়ে খারাপ আর গোষ্ঠীতন্ত্র গণতন্ত্রের চেয়ে খারাপ। এইভাবে অ্যারিস্টটল গণতন্ত্রের পক্ষে একটি সীমিত কৈফিয়তে পৌঁছেন। যেহেতু অধিকাংশ বাস্তব শাসনপদ্ধতিই খারাপ তাই তাদের মধ্যে গণতন্ত্র সবচেয়ে ভালো।
গ্রিকদের গণতন্ত্রের ধারণা অনেক দিক থেকে আমাদের গণতন্ত্রের ধারণার চেয়ে বেশি চরম ছিল। উদাহরণস্বরূপ, অ্যারিস্টটল বলছেন, বিচারকদের নির্বাচিত করা হলো গোষ্ঠীতান্ত্রিক ব্যাপার, আর জনগণের দ্বারা তাদের নিয়োগ করা হলো গণতান্ত্রিক। চরম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলোতে নাগরিকদের পরিষদ ছিল আইনের উপরে, সেই পরিষদ স্বাধীনভাবে প্রত্যেক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিত। এথেনীয় আদালতগুলো জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত বিরাটসংখ্যক নাগরিকদের দ্বারা গঠিত ছিল। এসব আদালতে কোনো আইনজ্ঞ থাকত না; তারা অবশ্যই বাগ্মিতা বা দলীয় সহানুভূতি দ্বারা প্রভাবিত হতো। গণতন্ত্রের সমালোচনা যখন করা হয়, তখন বুঝতে হবে যে এই রকম ব্যাপারগুলোকেই বোঝানো হচ্ছে।
পলিটিক্স-এ বিপ্লবের কারণ সম্বন্ধে লম্বা একটি আলোচনা আছে। গ্রিসে বেশ ঘন ঘন বিপ্লব হতো, যেমনটি লাতিন আমেরিকায় হতো। সে কারণে তার এ ব্যাপারে প্রচুর অভিজ্ঞতা ছিল, যা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। বিপ্লবের প্রধান কারণটি ছিল গোষ্ঠীতন্ত্রী ও গণতন্ত্রীদের মধ্যকার বিরোধ। অ্যারিস্টটল বলছেন, গণতন্ত্র গড়ে ওঠে এই বিশ্বাস থেকে যে, যেসব মানুষ সমানভাবে স্বাধীন, সব দিক থেকেই তাদের সমান হওয়া উচিত। আর গোষ্ঠীতন্ত্র গড়ে ওঠে এই বাস্তবতা থেকে যে, যেসব মানুষ কিছু কিছু ব্যাপারে বড় তারা অতিরিক্ত দাবি করে। উভয়েরই একধরনের বিচার আছে, কিন্তু তা সর্বোত্তম ধরনের নয়। অতএব, শাসনব্যবস্থায় তাদের অংশীদারিত্ব যখন তাদের পূর্বপরিকল্পিত ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে মেলে না, তখন উভয় পক্ষই বিপ্লবের ডাক দেয়। গোষ্ঠীতন্ত্রের চেয়ে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোতে বিপ্লবের ঝোঁক কম হয়। কারণ গোষ্ঠীতন্ত্রীরা একে অপরকে পরিত্যাগ করতে পারে। মনে হয় গোষ্ঠীতন্ত্রীরা তেজস্বী লোক ছিল। বলা হয়েছে কিছু কিছু নগরীতে তারা এরকম শপথ নিত : আমি জনগণের শত্রু হব এবং তাদের বিরুদ্ধে সাধ্যমতো সব ধরনের ক্ষতিকারক পন্থা খুঁজব। আজকের দিনে প্রতিক্রিয়াশীলরা এ রকম অকপট নয়।
বিপ্লব ঠেকানোর জন্য যে তিনটি জিনিসের দরকার সেগুলো হলো শিক্ষায় সরকারি প্রচারণা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা-এমনকি ছোটখাটো ব্যাপারেও এবং আইন ও শাসন পরিচালনায় ন্যায়বিচার। অর্থাৎ নিজ নিজ অংশের আনুপাতিক সমতা এবং প্রত্যেক মানুষের নিজ অধিকার ভোগ। মনে হয় অ্যারিস্টটল কখনো আনুপাতিক সমতার জটিলতা উপলব্ধি করতে পারেননি। তা যদি হয় সত্যিকারের ন্যায়বিচার তাহলে অনুপাত বলতে যা বোঝানো হয়েছে তা অবশ্যই সদগুণের অনুপাত। কিন্তু সদগুণ পরিমাপ করা হয় কঠিন এবং তা দলীয় বিতর্কের বিষয়। রাজনৈতিক রীতিতে, তাই সদগুণ পরিমাপ করা হয় উপার্জন দ্বারা। অভিজাততন্ত্র এবং গোষ্ঠীতন্ত্রের মধ্যে অ্যারিস্টটল যে পার্থক্য করতে চান, তা সম্ভব কেবল সেখানেই, যেখানে একটি খুব সুপ্রতিষ্ঠিত বংশানুক্রমিক কুলীন সম্প্রদায় আছে। এমন পরিস্থিতিতে অভিজাত নয় এমন একটি বিরাট ধনিক শ্রেণি তৈরি হবার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে ক্ষমতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে, কারণ তা না হলে তারা বিপ্লব করতে পারে। যেখানে একমাত্র জমিই সম্পদের উৎস, সেখানে ছাড়া বংশানুক্রমিক অভিজাততন্ত্র দীর্ঘ সময় তাদের ক্ষমতা বজায় রাখতে পারে না। সব সামাজিক অসমতা শেষ পর্যন্ত উপার্জনের অসমতা। এটি গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তির অংশ : সম্পদ ছাড়া অন্য যেকোনো গুণের ভিত্তিতে একটি সমানুপাতিক ন্যায়বিচার লাভ করার চেষ্টা নিশ্চিতভাবে বিফল হবে। গোষ্ঠীতন্ত্রের রক্ষকরা দাবি করে যে উপার্জন সদগুণের সমানুপাতিক। এক। ধর্মোপদেশক বলেছিলেন, তিনি কখনো একজন ন্যায়নিষ্ঠ মানুষকে তার পেটের ভাত ভিক্ষে করতে দেখেননি। আর অ্যারিস্টটল মনে করেন, ভালো লোক তার জন্য যথাযথ উপার্জন করে-খুব বেশি নয়, খুব কমও নয়। কিন্তু এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভট। সম্পূর্ণ সমতা ছাড়া প্রত্যেক ধরনের ন্যায়বিচার থেকে বাস্তবে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য মেলে যা একেবারেই সদগুণ থেকে ভিন্ন এবং সে কারণে তা নিন্দনীয়।
গ্রন্থটিতে স্বৈরতন্ত্র সম্পর্কে একটি আগ্রহোদ্দীপক অংশ আছে। একজন স্বৈরশাসকের আকাক্ষা ধন-সম্পদ, আর একজন রাজা চান সম্মান। স্বৈরশাসকের রক্ষীরা ভাড়াটে সৈনিক, অন্যদিকে রাজার রক্ষীরা হলো নাগরিক। অধিকাংশ স্বৈরশাসক গলাবাজ, তারা ক্ষমতা অর্জন করে বিশিষ্ট লোকজনদের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। শ্লেষপূর্ণ ম্যাকিয়াভেলীয় সুরে অ্যারিস্টটল বোঝাচ্ছেন, ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে একজন স্বৈরশাসককে কী করতে হবে। অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন যেকোনো ব্যক্তির উত্থান ঠেকাতে হবে, সে জন্য দণ্ড প্রদান বা দরকার হলে গুপ্তহত্যার আশ্রয় নিতে হবে। সমবেতভাবে খাদ্য গ্রহণ, সমিতি এবং শত্রুতাবোধ তৈরি করতে পারে এমন শিক্ষা নিষিদ্ধ করতে হবে। কোনো সাহিত্যিক সভা-সমাবেশ বা আলোচনা সভা হতে দেওয়া যাবে না। এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে লোকজন পরস্পরকে ভালোভাবে না জানতে পারে এবং স্বৈরশাসক তাদেরকে প্রকাশ্যে তার ফটকগুলোতে বাস করতে বাধ্য করবে। সিরাকুজের মহিলা গোয়েন্দাদের মতো গুপ্তচর নিয়োগ করতে হবে। লোকদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ লাগিয়ে দিতে হবে এবং প্রজাদের দারিদ্র্য আরো বাড়াতে হবে। বিশাল বিশাল কর্মযজ্ঞে লোকজনকে ব্যস্ত রাখতে হবে, যেমনটি মিসরের রাজা পিরামিড তৈরির জন্য করেছিল। নারী ও দাসদেরকে গোপন সংবাদদাতা হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তাদেরকে ক্ষমতা দিতে হবে। প্রজারা যাতে করার কিছু পায় সে। জন্য এবং সর্বদাই যেন তারা একজন নেতার অভাব বোধ করে সে জন্য স্বৈরশাসককে যুদ্ধ বাধাতে হবে।
ভেবে বিষণ্ণ বোধ হচ্ছে যে অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স গ্রন্থের পুরোটার মধ্যে এই একটি পরিচ্ছেদ আজকের দিনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। শেষে অ্যারিস্টটল বলছেন, একজন স্বৈরশাসকের পক্ষে বিরাট গর্হিত কোনো অন্যায় নেই। অবশ্য তিনি বলছেন, স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখার আরো একটি পদ্ধতি আছে, তা হলো মিতাচার এবং ধর্মের লেবাস পরা। এ দুয়ের মধ্যে কোনটা বেশি সফল প্রমাণিত হতে পারে সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত তিনি দেননি। অন্য দেশ জয় করা রাষ্ট্রের শেষ লক্ষ্য নয়-এ কথা প্রমাণের জন্য একটি লম্বা যুক্তি দেওয়া হয়েছে। দেখানো হয়েছে অনেক জাতি সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। সত্য যে একটি ব্যতিক্রম আছে, তা হলো স্বভাবগত দাসদেরকে জয় করা সঠিক এবং ন্যায্য। অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিতে এটা বর্বরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ন্যায্যতা দান করে। কিন্তু গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে নয়, কারণ কোনো গ্রিক স্বভাবগত দাস নয়। মোদ্দাকথা, যুদ্ধ হলো কেবল একটি উপায়, লক্ষ্য নয়। আগ্রাসন সম্ভব নয় এ রকম বিচ্ছিন্ন কোনো নগরী সুখী হতে পারে, বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রগুলোর নিষ্ক্রিয় হবার প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সক্রিয়, যদিও তাদের পক্ষে আর কোনো কিছু জয় করবার নেই। সুতরাং একটি রাষ্ট্র যে সুখের অন্বেষণ করবে তা যুদ্ধ নয়, বরং শান্তির ক্রিয়াকর্ম, যদিও কখনো কখনো যুদ্ধ সেই সুখের জন্য একটি দরকারি উপায় হতে পারে।
এ থেকে একটি প্রশ্ন এসে পড়ে : একটি রাষ্ট্র কত বড় হওয়া উচিত? বলা হয়েছে, বড় নগরীগুলো কখনো ভালোভাবে শাসন করা যায় না, কারণ একটি বিশাল জনগোষ্ঠী সুশৃঙ্খল হতে পারে না। একটি রাষ্ট্রের আকার এমন হওয়া উচিত যাতে তা মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে। কিন্তু সাংবিধানিক উপায়ে শাসন পরিচালনা করতে অসুবিধা হতে পারে এতটা বড় হওয়া চলবে না। রাষ্ট্রের আকার এমনভাবে সীমিত থাকা উচিত যাতে করে নাগরিকরা পরস্পরের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে পারে, তানা হলে নির্বাচনকালে বা মামলা মোকদ্দমায় তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। রাষ্ট্রের ভূখণ্ডটি এমন ছোট হতে হবে যাতে একটি পাহাড়চূড়া থেকে পুরো ভূখণ্ডটি দেখা যায়। একদিকে বলা হচ্ছে রাষ্ট্র হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, আবার অন্যদিকে বলা হচ্ছে তার। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য থাকবে। এ দুটো দাবি পরস্পর অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়।
যেসব মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য দৈহিক পরিশ্রম করে তারা নাগরিকত্ব পাবে। নাগরিকদের উচিত নয় কারিগর বা ব্যবসায়ীর জীবনযাপন করা, কেননা এ ধরনের জীবন লজ্জাকর ও সদগুণের পক্ষে ক্ষতিকর। কৃষকের কর্ম করাও তাদের উচিত নয়, কেননা তাহলে তাদের অবকাশ মিলবে না, কিন্তু অবকাশ অবশ্যপ্রয়োজন। নাগরিকদের নিজস্ব সম্পত্তি থাকা উচিত কিন্তু কৃষিজীবীরা হবে ভিন্ন জাতের দাস। বলা হয়েছে, উত্তরাঞ্চলের জাতিগুলো প্রাণবন্ত ও সাহসী আর দক্ষিণের জাতিগুলো বুদ্ধিমান। তাই দাসদের নিতে হবে দক্ষিণের জাতিগুলো থেকে, কারণ দাসরা সাহসী হলে মুশকিল। কেবল গ্রিকরাই একই সঙ্গে প্রাণবন্ত, সাহসী ও বুদ্ধিমান; কোনো বর্বরের চেয়ে গ্রিকদের ভালোভাবে শাসন করা যায়। আর গ্রিকরা ঐক্যবদ্ধ হলে সারা বিশ্বে রাজত্ব করতে পারবে। অ্যারিস্টটলের আলোচনার এই পর্যায়ে যে কেউ আলেকজান্ডারের উল্লেখ প্রত্যাশা করতে পারে, কিন্তু সে রকম কোনো উল্লেখ নেই।
রাষ্ট্রের আকারের ব্যাপারে আধুনিক উদারপন্থীদের অনেকে যে ভুল করেছেন, অ্যারিস্টটলও, ভিন্ন এক মাপদণ্ড থেকে সে ভুল করেছেন। যুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করার সামর্থ্য একটি রাষ্ট্রের অবশ্যই থাকতে হবে। এমনকি যদি কোনো উদার সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে হয়, তবে সে ক্ষেত্রেও অনায়াসে রাষ্ট্রকে আত্মরক্ষা করতে হবে। এটি করার জন্য রাষ্ট্রের আকার কত বড় হবে তা নির্ভর করবে যুদ্ধের কলা-কৌশল ও শিল্পের ওপর।
অ্যারিস্টটলের যুগে নগররাষ্ট্র সেকেলে হয়ে পড়েছিল, কারণ মেসিডোনিয়ার বিরুদ্ধে তা নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। মেসিডোনিয়াসহ সামগ্রিকভাবে গ্রিস আমাদের কালে অচল, এই অর্থে, সাম্প্রতিককালের ঘটনাবলি যা প্রমাণ করেছে। কোনো উঁচু জায়গা থেকে পুরোটা দেখা যায় এমন একটি শহরের সম্পূর্ণ স্বনির্ভরতার পক্ষে কথা বলা যেমন বৃথা, তেমনি আজকের দিনে, গ্রিস বা অন্য যেকোনো ছোট দেশের জন্য পূর্ণ স্বনির্ভরতার পক্ষে কথা বলা নিষ্ফল। নিজ শক্তি ও চেষ্টার দ্বারা বহিঃশক্তির সব আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে এমন যথেষ্ট শক্তিধর কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রজোট ছাড়া প্রকৃত অর্থে কেউ স্বাধীন ও স্বনির্ভর হতে পারে না। আমেরিকা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে একসঙ্গে জুড়লে যা দাঁড়াবে তার চেয়ে ক্ষুদ্র কোনো কিছুই এই প্রয়োজন মেটাতে পারবে না, এমনকি সেটাও অতি ক্ষুদ্র একটি শক্তি হবে।
যে রূপে গ্রন্থটি (পলিটিক্স) আমরা পেয়েছি, তা অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়। শিক্ষা সম্বন্ধে একটি আলোচনার মধ্য দিয়ে গ্রন্থটি শেষ হয়েছে। শিক্ষা কেবল সেসব শিশুর জন্য যারা নাগরিক হতে যাচ্ছে। দাসদেরকে রান্নাবান্নার মতো কিছু দরকারি কলা কৌশল শেখানো যেতে পারে, কিন্তু সেসব শিক্ষার অংশ নয়। শাসনপদ্ধতির ছাঁচের উপযোগী করে নাগরিককে গড়ে তুলতে হবে। তাই, নগরে নগরে এই ছাঁচগুলো মধ্যে পার্থক্য থাকবে, গোষ্ঠীতান্ত্রিক নগররাষ্ট্রের ছাঁচ হবে এক রকম, গণতান্ত্রিক নগররাষ্ট্রের হবে আর এক রকম। এই আলোচনায় অ্যারিস্টটল ধরে নেন যে, রাজনৈতিক ক্ষমতায় সব নাগরিকের ভাগ থাকবে। শিশুরা তা-ই শিখবে, যা তাদের জন্য উপকারী, তারা অশালীনতা শিখবে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, এমন কোনো বিদ্যা বা পটুতা তাদের শেখানো উচিত নয় যা তাদের দেহের স্বাভাবিকতা নষ্ট করে বা যার দ্বারা অর্থ উপার্জনে সক্ষম হয়। তারা পরিমিত খেলাধুলা করবে, কিন্তু এমন মাত্রায় নয় যাতে করে তারা পেশাগত দক্ষতা অর্জন করে। যেসব বালক অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য প্রশিক্ষণ নেয় তাদের স্বাস্থ্যগত ভোগান্তি হয়। বাস্তবে দেখা গেছে, বালক হিসেবে যারা বিজয়ী হয় তারা পুরুষ হিসেবে বিজয়ী হয় খুব কদাচিৎ। শিশুরা ছবি আঁকা শিখবে, যেন তারা মানুষের শারীরিক অবয়বের সৌন্দর্য উপভোগ করতে শেখে। নৈতিক ধ্যান-ধারণা প্রকাশ করে এমন ধরনের চিত্রকর্ম ও স্থাপত্যশিল্প উপলব্ধি ও উপভোগ করার শিক্ষা তাদেরকে দিতে হবে। তারা গান গাওয়া ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখতে পারে, যথেষ্ট মাত্রায়ই পারে, যেন তারা বিচার-বুদ্ধিসহ সঙ্গীত উপভোগ করতে সক্ষম হয়; কিন্তু তার বেশি নয়, এত দূর পর্যন্ত শেখা উচিত নয় যাতে তারা দক্ষ শিল্পী হয়ে ওঠে। কেননা কোনো মুক্ত মানুষ কেবল মাতাল হলেই গান গায় বা বাজায়। শিশুরা অবশ্যই পড়তে ও লিখতে শিখবে, পড়া ও লেখার ব্যবহারিক উপযোগিতা থাকা সত্ত্বেও এ দুটো কলা তাদের শেখা উচিত। কিন্তু শিক্ষার উদ্দেশ্য উপযোগ নয়, সদগুণ। সদগুণ বলতে অ্যারিস্টটল যা বোঝাতে চেয়েছেন তা তিনি বলেছেন তার এথিক্স গ্রন্থে। এথিক্স গ্রন্থের উল্লেখ পলিটিক্স-এ বারবার এসেছে।
পলিটিক্স গ্রন্থে অ্যারিস্টটলের মৌলিক অনুমানগুলো যেকোনো আধুনিক লেখকের অনুমানগুলো থেকে খুবই ভিন্ন। অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো সংস্কৃতিবান ভদ্রলোক তৈরি করা। এই ভদ্রলোকেরা এমন মানুষ যাদের মধ্যে অভিজাত মানসিকতার সঙ্গে জানার আগ্রহ ও শিল্পকলার প্রতি অনুরাগের মিলন ঘটবে। পেরিক্লিসের এথেন্সে এই মিলন সর্বোচ্চ উৎকর্ষতা পেয়েছিল। তবে তা ছিল অবস্থাপন্ন লোকদের মধ্যে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে নয়। পেরিক্লিসের জীবনের শেষ সময়ে তা নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে। সাধারণ জনগোষ্ঠী, যাদের কোনো সংস্কৃতি ছিল না, পেরিক্লিসের বন্ধুদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। পেরিক্লিসের বন্ধুরা প্রতারণা, হত্যা, অবৈধ। উৎপীড়ন এবং নানা রকম অভদ্রজনোচিত পন্থায় ধনিক গোষ্ঠীর স্বার্থ-সুবিধাদি রক্ষায় ধাবিত হয়েছিল। সক্রেটিসের মৃত্যুর পর এথেনীয় গণতন্ত্রের গোঁড়ামি হ্রাস পায়। এথেন্স প্রাচীন সংস্কৃতির কেন্দ্ররূপে থেকে যায় বটে কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে যায় অন্যত্র। প্রাচীন যুগের পরবর্তীকাল জুড়ে ক্ষমতা ও সংস্কৃতি বরাবরই আলাদা ছিল : ক্ষমতা ছিল উগ্র সৈনিকদের হাতে আর সংস্কৃতি ছিল ক্ষমতাহীন গ্রিকদের হাতে, প্রায়ই দাসদের হাতে। রোমের সুসময়ের প্রসঙ্গে বললে, এ অবস্থা ছিল আংশিক সত্য, কিন্তু সিসেরোর পূর্বে মারকাস অরেলিয়াসের পরে তা ছিল প্রবলভাবে সত্য। বর্বরদের আগ্রাসনের পর ভদ্রলোকেরা হলো উত্তরের বর্বর, আর সংস্কৃতিবানরা হলো দক্ষিণের সূক্ষ্ম পুরোহিত। কমবেশি এই অবস্থা চলতে থাকল রেনেসাঁ পর্যন্ত, যখন ইতালি সংস্কৃতিবান হয়ে উঠতে শুরু করে। রেনেসাঁর পর থেকে সংস্কৃতিবান ভদ্রলোকদের শাসনের গ্রিক ধারণাটি ক্রমে ব্যাপক হয়ে ওঠে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে তা তার চূড়ায় পৌঁছে।
এই অবস্থার পরিসমাপ্তির পেছনে কাজ করেছে নানা শক্তি। প্রথমে, ফরাসি বিপ্লবে এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলিতে মূর্ত হয়ে ওঠা গণতন্ত্র। পেরিক্লিসের যুগের পর যেমনটি হয়েছে, সংস্কৃতিবান ভদ্রলোকদের আপন স্বার্থ-সুবিধাদি রক্ষা করতে হয়েছে জনসাধারণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এবং এই প্রক্রিয়ায় তা করতে গিয়ে তারা ভদ্রলোকও থাকতে পারেনি, সংস্কৃতিবানও থাকতে পারেনি। দ্বিতীয় কারণ ছিল প্রথাগত সংস্কৃতি থেকে খুবই ভিন্ন রকমের বৈজ্ঞানিক কলা-কৌশলসমৃদ্ধ শিল্পতন্ত্রের উত্থান। তৃতীয় কারণ গণশিক্ষা, যা পড়ার ও লেখার ক্ষমতা দান করেছে, কিন্তু সংস্কৃতি দান করেনি। গণশিক্ষা থেকে নতুন একধরনের গলাবাজ রাজনীতিক এক নতুন কিসিমের প্রচারণার চর্চায় সক্ষম হয়ে ওঠে, যা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাগুলোতে দেখা যায়। অতএব, ভালো ও মন্দ উভয়ের জন্যই সংস্কৃতিবান ভদ্রলোকের দিন গত হয়েছে।