পরিষদ ভবনে পৌঁছে তোপের মুখে পড়লাম যেন। সামনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার। পাশে কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। প্রধানমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠলেন। বললেন, পরিষদে আপনার বিরুদ্ধে মোসন আনব। আপনি আমাদের সদস্যদের পরিষদ ভবনে আসতে বাধা দিচ্ছেন। আমি শুধু লতিফ বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। প্রকৃত চিত্র হচ্ছে–আমি না থাকলে আজ লোকটি রাজপথে নির্ঘাত মারা পড়ত।
আমি প্রধানমন্ত্রীকে পাস কাটিয়ে গেলাম। পরিষদ ভবনে মওলানা ভাসানীকে পেলাম না। শেখ সাহেবকে বললাম। তিনি মিছিল নিয়ে আমার সঙ্গে এলেন। সেদিন দেখেছিলাম মিছিল নিয়ন্ত্রণের অটুট ক্ষমতা। তিনি আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের উত্তরের রাজপথে এসে জনতাকে ধমক দিলেন। বললেন, তোমাদের পরিষদ সদস্যদের আক্রমণ করতে কে বলেছে? কে বলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাড়িতে ঢিল মারতে? জনতা টু শব্দটি না করে আস্তে আস্তে সরে গেল। আর ইতোমধ্যে ড. মযহারুল হকের বাসা থেকে আমার কাছে একটি স্লিপ এলো৷ পি লিখেছেন হাশেম উদ্দীন আহমদ। তিনি লিখেছেন, তার কাপড়ের অবস্থা বেহাল। বাড়ি থেকে নতুন কাপড় না এলে পরিষদে যাওয়া সম্ভব হবে না। আমি স্লিপটি শেখ সাহেবের হাতে দিলাম। তিনি হেসে শ্লিপটি হাতে নিলেন। আমি জানতাম, এ মানুষটিই এ কাজটি করতে পারবেন এবং করবেন।
হরতালের পরে রাতে শুনলাম গভর্নর এ কে ফজলুল হক আবু হোসেন সরকারের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন এবং আওয়ামী লীগকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলেছেন। মনে হলো আমার ছাত্রলীগ ছাড়বার পালা এল। কারণ প্রদেশে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা। ছাত্রলীগের পক্ষে এই মন্ত্রিসভার বিরোধিতা করা সহজ হবে না। আর আমার পক্ষে আওয়ামী লীগকে অন্ধ সমর্থন দেওয়া সম্ভব হবে না।
সেই সময়টা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তখন আত্মীয়স্বজন কারো সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল না। ১৯৫৪ সালের পর আমার আর বাড়ি যাওয়া হয়নি। চিঠিপত্রও বন্ধ। আমার সঙ্গে কারো খবর রাখাও বিপজ্জনক। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি যে কত বিপজ্জনক তা তখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তখন আমার সঙ্গে মতানৈক্য দেখা দিচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১২ সেপ্টেম্বর চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পদত্যাগ করেন। ৮০ জনের পার্লামেন্টে মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন। এ সময় তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ৮ সেপ্টেম্বরে রাজবন্দি মুক্তি।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা ওয়াদা ছিল। ওই ওয়াদায় বলা হয়েছিল জননিরাপত্তা আইন বাতিল করা হবে এবং রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান তাঁর মন্ত্রিসভার সকল সদস্য নিয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে যান। ৫৯ জন রাজবন্দিকে মুক্তি দেন। ইতিহাসে এ ছিল একটি অনন্য ঘটনা। পৃথিবীর কোনো সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে জননিরাপত্তা আইন বাতিল হয়নি। এভাবে মুক্ত হয়নি কোনো দেশের রাজবন্দিরা। কেন্দ্রে তখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হননি।
প্রশ্ন উঠেছিল জননিরাপত্তা আইন না থাকলে দেশ চলবে কী করে? তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট বিরোধী সরকার। সুতরাং পাকিস্তানে কমিউনিস্টদের আটক করার জন্যে একটি আইন প্রয়োগ করা হবেই। পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানেরই অঙ্গ। সুতরাং কেন্দ্রীয় সরকার নতুন করে জননিরাপত্তা আইন জারি করলে পূর্ব পাকিস্তানেও তা প্রযোজ্য হবে। তবে জননিরাপত্তা আইন না থাকলে কী অবস্থার সৃষ্টি হয় পরবর্তীকালে সে নজির পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ সরকারই দেখিয়েছে। এই আওয়ামী লীগ সরকারই শেষ পর্যন্ত ৭ জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করেছিল চোরাচালানীর অভিযোগে। আওয়ামী লীগের এ কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো তখন সহজ ছিল না। ইত্তেফাকের পাতায় পাতায় তখন কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে ঝড় বইত। ইত্তেফাকের মালিক সম্পাদক মরহুম তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) তখন ইচ্ছামতো কমিউনিস্টদের গালি দিতেন।
এ সময় একটি ভিন্ন কারণে আমি মওলানা ভাসানীর কাছাকাছি আসি। একদিন সন্ধ্যা রাতে হলে ফিরে দেখি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও মোহাম্মদ তোয়াহা আমার জন্যে আমার পাশের কক্ষে অপেক্ষা করছেন। আমি খানিকটা বিস্মিত হলাম। তাঁরা বললেন, বিশেষ কারণে তারা আমার কাছে এসেছেন। কারণটি হচ্ছে মওলানা সাহেবের প্রথম পুত্র আবু নাসের খান ভাসানী অর্থাৎ বাবুকে পড়াতে হবে। বাবু প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী। ছাত্র তেমন ভালো নয়। আমার উপায় ছিল না তাদের ফিরিয়ে দেবার। তবে বলেছিলাম আমি কিন্তু বিনা বেতনে পড়াব না এবং টাকা নিয়েই বাবুকে পড়াতাম। বাবু আমার কাছে এসেই পড়ত। বাবু দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল।
তখনও আমি ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক। তখন পিরোজপুর ও ভোলায় দুটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানী এ দুটি জেলায় সফর করবেন। আমি এককালে বরিশালের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। আমাকে তার সফরসঙ্গী হতে হলো। এই সফরে গিয়ে আমি মওলানা ভাসানীর একটি বিশিষ্ট রূপের সন্ধান পেলাম। তার সঙ্গে আমার শুরু হলো বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক। আমরা একটি বিশেষ লঞ্চে করে বরিশাল যাত্রা করেছিলাম। যাওয়ার পথে বিভিন্ন স্টেশনে লঞ্চটি থামতো। মওলানা সাহেব সব স্টেশনেই ভাষণ দিতেন। তার প্রথম স্টেশনের ভাষণকে কেন্দ্র করেই আমার সঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। তিনি তাঁর ভাষণে বললেন-”দুনিয়ার সকল সম্পদ শতকরা পাঁচ জনের হাতে জমা হইয়াছে। দুনিয়ায় শতকরা ৯৫ ভাগ মজলুম। ১৯৬০ সালের মধ্যে তামাম দুনিয়া হইতে সাম্রাজ্যবাদ নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে। দেশে দেশে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হইবে।…’
মওলানা সাহেবের ভাষণের পর লঞ্চ ছেড়ে দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মওলানা সাহেব, এ তথ্য আপনি কোথা থেকে পেলেন? এ তথ্য সঠিক নয়। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬০ সাল। মাত্র ৪ বছর। এ ৪ বছরের মধ্যে দুনিয়া থেকে সাম্রাজ্যবাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। এ তথ্যটি আপনি বেভানের কাছ থেকে পেয়েছেন। বেভান ব্রিটিশ শ্রমিক দলের বামপন্থী অংশের নেতা। শুনেছিলাম মওলানা সাহেব লন্ডনে থাকাকালীন বেভানের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। বেভানের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে পাকিস্তানের জন্ম এবং কাশ্মীর নিয়ে। আমার ধারণা হয়েছিল মওলানা সাহেব হয়তো তার কাছে এমন একটা কিছু শুনেছেন।
মওলানা সাহেব আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। এমনিতেই তিনি আমার আচরণে খুশি নন। আমি তাঁকে হুজুর বলে সম্বোধন করি না। এটি তিনি লক্ষ করেছেন।
তবে মওলানা সাহেবের জবাবের জন্যে আমাকে অপেক্ষা করতে হলো না। লঞ্চ আর একটি স্টেশনে পৌঁছাল। সেই স্টেশনেও মওলানা সাহেবকে ভাষণ দিতে হলো। শ্রোতা অধিকাংশ মুসল্লি। মওলানা সাহেব এবার আর সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি উল্লেখ করলেন না। তিনি কোরান থেকে দুটি সুরার উদ্ধৃতি দিলেন। খলিফা হারুন-অর রশিদের শাসন আমলের কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন, ইসলামের বিধান হচ্ছে দুনিয়ার সকল মানুষ দুনিয়ার সকল সম্পদের অংশীদার। ইসলাম সাম্যের ধর্ম। ইসলাম হচ্ছে অসাম্যের বিরুদ্ধে জেহাদ।
এমনি করে ভোলার বিভিন্ন জনসভায় তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন। উপস্থিত জনসভায় তিনি ভাষণ দিলেন। উপস্থিত জনতার মনমেজাজ পরিচ্ছদ লক্ষ রেখেই তাঁকে বক্তৃতা করতে দেখলাম। কোথাও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের কথা বললেন। কোথাও বললেন ইসলামের সাম্যের কথা। আরো লক্ষ করলাম, সব সভায় তিনি একক বক্তা হতে চান। তারপরে কেউ বক্তৃতা দিতে পারে না। তার দীর্ঘ ভাষণের পর তিনি জিজ্ঞেস করেন–আদৌ কোনো বক্তা আছে কিনা। নিজে নিজেই বলেন, আর কোনো বক্তা নেই। কাজেই প্রস্তাব পাঠ শুরু করেন। চোখের সামনে কোনো কাগজ ছাড়াই তিনি স্কুল, কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, সড়ক-সেতুগুলো দাবি করেন এবং এক সময় বলেন, এখানেই শেষ।
আমার জীবনে এ ধরনের সমাবেশের অভিজ্ঞতা আদৌ ছিল না। কখনো লক্ষ করিনি নেতাদের এ ধরনের বৈশ্যতা। কেউ যেন মওলানা সাহেবের সামনে কথা বলতে পারে না। তিনি হঠাৎ সবাইকে ধমক দেন। কারো যুক্তি বেশিক্ষণ শুনতে চান না। নিজেই শুরু এবং শেষ করেন। তাঁর সঙ্গে বৈঠক করতে গেলে হতে হয় নির্বাক শ্রোতা। প্রতিবাদ করা যেত না। আমার সঙ্গে এমন ঘটনাই ঘটেছিল।
আমরা উপনির্বাচনের সফরে বেরিয়েছিলাম। কথা ছিল ভোলা ও পিরোজপুর দু’টি এলাকাতেই জনসভায় ভাষণ দেয়া হবে। কিন্তু ভোলা সফর শেষে তিনি বললেন, তিনি এখন ঢাকায় ফিরবেন। কাগমারী যাবেন। আমি বললাম, তা হবে না। তিনি বললেন, বেশি বাড়াবাড়ি করো না। বরিশালে খবর দিয়ে দাও, ওরা যেনো স্টিমারে টিকেট কেনে। আমি আগামীকালই স্টিমারে ঢাকা যাব।
উপায় নেই। আমরা বিশেষ লঞ্চে বরিশাল ফিরলাম। পিরোজপুরে আর জনসভা হলো না। স্টিমারের প্রথম শ্রেণিতে আমাদের আশ্রয় হলো। তখন বরিশাল থেকে স্টিমার নারায়ণগঞ্জ আসত। ঢাকা পর্যন্ত আসত না।
স্টিমার নারায়ণগঞ্জে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা হেলে পড়ে পশ্চিমে। মওলানা সাহেব দেরি করেই ঘুম থেকে উঠলেন। বললাম, নাস্তার কথা। তিনি প্রথম রাজি হলেন না। বেশ কিছু পরে বললেন, নাস্তার অর্ডার দাও। নাস্তা এলো। প্রথম শ্রেণির দামি নাস্তা দেখে তিনি বলেন, এ নাস্তার অনেক দাম। পয়সা সৃষ্ট করা যাবে না। আর আপনি এ নাস্তাই আনতে বলেছেন। তিনি কিছুটা খেলেন। বাকিটা কর্মচারীদের দিয়ে দিলেন। নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে বললেন, আমি চাষাড়ায় ওসমান আলীর বাড়িতে থাকব। তুমি ঢাকা যাও। মুজিব আর মাহমুদ আলীকে খবর দাও আমার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে দেখা করতে। মাহমুদ আলী তখন গণতন্ত্রী দলের নেতা। গণতন্ত্রী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। কোয়ালিশন সরকারে আছে। আমার মনে হলো, মওলানা সাহেব উপনির্বাচন নিয়ে দুজনের সঙ্গেই আলোচনা করতে চান।
আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা ফিরলাম। সকলকে খবর দিলাম। পরদিন ভোরে ইত্তেফাকে দেখলাম, অসুস্থ মওলানা ভাসানীর কাগমারী গমন। আর আমি ঢাকায় পৌঁছে আর এক সঙ্কটের মুখোমুখি হলাম। শুনলাম মিসরের বিরুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্স হামলা চালিয়েছে। প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র জনতা পুরানা পল্টনের মোড়ে ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের ভবন পুড়িয়ে দেয়।
ইংরেজ ও ফরাসি মিসর হামলার কারণ ছিল সুয়েজ খাল। একশ’ তিন মাইল দীর্ঘ সুয়েজ খাল ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে আরব সাগরকে যুক্ত করেছে। এ খাল কাটা না হলে নৌপথে ইউরোপ থেকে এশিয়ায় আসতে হতো উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে। প্রয়োজন হতো মাসের পর মাস। সুয়েজ খাল খননের ফলে পাশ্চাত্যের উপনিবেশ শক্তিবর্গের প্রাচ্যে শাসন ও শোষণের পথ আরো সহজ হয়। খালটি খনন করে ফরাসি নাগরিক ফার্ডিন্যান্স দ্য লেসেপস ১৮৫৯-১৮৬৯ সালে। এক সময় ব্রিটিশ ও ফরাসি সরকার মিসরের কাছ থেকে এক কোম্পানির শেয়ার কিনে কোম্পানির মালিক হয়। মিসরের নাসের ক্ষমতায় আসার পর নীল নদের ওপর বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা করে। এ বাঁধ আসোয়ান বাঁধ নামে পরিচিত। এ বাঁধে পাশ্চাত্যের শক্তিবর্গ অর্থ সাহায্য দিতে রাজি না হওয়ায় প্রেসিডেন্ট নাসের ১৯৫৬ সালের জুন মাসে সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেন। এ জাতীয়করণের তিন মাস পর ব্রিটিশ ও ফ্রান্স ৩০ অক্টোবরে মিসরে হামলা চালায়। সারা পৃথিবীতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধমকে ইঙ্গ-ফ্রান্স সরকারকে নতিস্বীকার করতে হয়। ঢাকাতে ভস্মীভূত হয় ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের ভবন। নতুন সঙ্কট দেখা দেয় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতিতে। প্রশ্ন ওঠে পাশ্চাত্য ঘেঁষা শহীদ সোহরাওয়ার্দী কোন দিকে যাবেন?
সুয়েজ সংঘর্ষ শুরু হলো ২৯ অক্টোবর। কলম্বো শক্তিসমূহ ১২ নভেম্বর নয়াদিল্লিতে বৈঠক আহ্বান করল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজি হলেন না এই বৈঠকে যেতে। পরিবর্তে তিনি প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জাকে নিয়ে তেহরান চলে গেলেন বাগদাদ চুক্তির বৈঠকে যোগ দিতে। বাগদাদ চুক্তি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিরোধী সামরিক জোট।
মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসের বাগদাদ চুক্তির তীব্র বিরোধী ছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হলো মিসর। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মিসর সফরে যেতে চাইলে নাসের প্রত্যাখ্যান করল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকিতে সুয়েজে যুদ্ধ বিরতি হলো। সিদ্ধান্ত হলো সুয়েজে খবরদারি করবে জাতিসংঘ বাহিনী। পাকিস্তান এ বাহিনীতে সৈন্য দিতে চাইলে মিসর আপত্তি জানায়। অর্থাৎ সুয়েজ সঙ্কট শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানকে রাজনৈতিকভাবে একঘরে করল মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে। তবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সমর্থন জানায়নি মিসরের প্রশ্নে। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান ও মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়েছিলেন–মিসরের পক্ষে। পূর্ব পাকিস্তানে মিসর দিবস পালিত হয়েছিল। এ দিবস পালনে আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান একমত না হলেও বিরোধিতা করেননি।
আওয়ামী লীগ পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন হলেও এ সংগঠনের মূল শক্তি ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এই পূর্ব পাকিস্তানে ছিল একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্য। আবার বিভিন্ন বামপন্থী দল প্রকাশ্যে কাজ করতে না পেরে আওয়ামী লীগের আশ্রয় নিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছিল সকল ধরনের যুদ্ধচুক্তি বিরোধী এবং প্রতিবাদ জানিয়েছিল পাক মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া প্রতিরক্ষা চুক্তির। অথচ আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পাশ্চাত্য ঘেঁষা এবং এই চুক্তির সমর্থক। ফলে সঙ্কট অনিবার্য হয়ে উঠল।
আমি এ সফরে বিপদে পড়লাম ভিন্ন দিক থেকে। দীর্ঘদিন পর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৫৪ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি কামরুজ্জামান পদত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন তাঁরা এ পদে আছেন। এ নিয়ে বিক্ষোভ আছে ছাত্রদের মধ্যে। তাই সিদ্ধান্ত হলো ১৯৫৮ সালের প্রথম দিকে সম্মেলন হবে। সম্মেলনের নাম উঠতেই প্রশ্ন উঠল, পরবর্তী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কে হবে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রস্তাব এল মোমিন তালুকদার সভাপতি থাকবেন না। সভাপতি হবেন এম এ আউয়াল, সাধারণ সম্পাদক হবে নির্মল সেন। অনেক আলোচনার পর এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো।
কিন্তু সম্মেলনের পূর্ব মুহূর্তে সবকিছু পাল্টে গেল। প্রস্তাব এল, এবার পূর্বের কমিটি বহাল থাকবে। শুধু নির্মল সেন দফতর সম্পাদক থেকে সহ সভাপতি হবে। সভাপতি মোমিন তালুকদার মাত্র ক’মাস পরে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তাঁর আসন শূন্য হলে নির্মল সেন সভাপতি হবেন।
আমি এ জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। জানতামও নাম। সম্মেলনে এ প্রস্তাব উঠলে আমি বিরোধিতা করলাম। প্রতিবাদে নয়টি জেলার প্রতিনিধিরা সম্মেলন ত্যাগ করল। তাদের সন্তুষ্ট করার জন্যে সঙ্গে সঙ্গে একটি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নিখিল পাকিস্তান কো-অর্ডিনেটিং কমিটি গঠন করা হলো। আমাকে তার সদস্য করা হলো। আমি চলে এলাম। প্রকৃতপক্ষে সেদিন আমার সঙ্গে ছাত্রলীগের সম্পর্ক ছিন্ন হলো। আর আমার পক্ষে ছাত্রলীগে থাকাও সম্ভব ছিল না। কারণ শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হবার পর আমাদের দল অর্থাৎ আরএসপি’র বৈঠক বসেছিল কুমিল্লায়। কুমিল্লা বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল–আমাকে ছাত্রলীগ ছাড়তে হবে। ছাত্রলীগ অন্ধভাবে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি সমর্থন করছে। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের লেজুড় হয়ে গেছে। সময় সুযোগ বুঝে ছাত্রলীগ ছাড়তে হবে। আমি ছাত্রলীগ থেকে চলে এলাম। তবে প্রকাশ্যে কোনো ঘোষণা দিলাম না। তাই মাঝে মাঝে ছাত্রলীগ নেতারা আমার কাছে আসতেন আলোচনার জন্যে। আমি জানতাম আমি চলে আসায় ছাত্রলীগকে বিপদে পড়তে হবে। অসম্মানজনকভাবে এম এ আউয়ালকে চলে যেতে হবে ছাত্রলীগ থেকে। কারণ সব হিসাব, সংগঠনের যোগাযোগ আমার সঙ্গে। আমি না থাকলে সে থাকতে পারবে না। নতুন ছেলেরা সব হিসাব চাইবে। তাই আউয়াল প্রায়ই আসত আলোচনার জন্যে। এখানে বলা প্রয়োজন, আমি যখন ছাত্রলীগে যোগ দিই তখন সারাদেশে ছাত্রলীগের মাত্র তিনটি জেলায় সক্রিয় কমিটি ছিল। আমি চলে আসার আগে দেশের ১৭ জেলায়ই সক্রিয় কমিটি গঠিত হয়।
কিন্তু ছাত্রলীগে আমার আর ফেরা হলো না। ইতোমধ্যে একদিন প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় এলেন। তিনি সলিমুল্লাহ হল প্রাঙ্গণে ভাষণ দিলেন তাঁর পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে। এ ভাষণে তিনি উল্লেখ করলেন তাঁর বিখ্যাত জিরো– শূন্য তত্ত্ব। তিনি বললেন, পাকিস্তানের মতো ছোট রাষ্ট্রগুলো কতগুলো গণিতের শূন্য-এর মতো। এর বাঁ দিকে যে কোনো অংক বসালেই তার অর্থ হয়। যেমন একটি শূন্যের বাঁয়ে এক বসলে ১০ হয়। অন্যথায় শূন্য হয়ে যায়। এই এক অংকটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ব্যতীত আমরা শূন্য থেকে যাবে এবং এই অংকেই তিনি বাগদাদ চুক্তি, পাক মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং সিটো চুক্তির সমর্থক। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এ ভাষণে পাণ্ডিত্য থাকলেও গ্রহণযোগ্য হলো না সাধারণ ছাত্র সমাজের কাছে। ওই সভায় আমি যাইনি। শুধুমাত্র আমাকে ঢাকা হলে বসে অনেক কথা শুনতে হলো। সকলেই জিজ্ঞাসা করতে শুরু করল–আর কতদিন ছাত্রলীগে থাকবেন?
তবে এর পরেও ঘটনার বাকি ছিল। একদিন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এম এ বারী এ টি আমার রুমে এলেন। আমাকে বললেন, আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় সমাবেশ ডেকেছে ফজলুল হক হল, এসএম হল, ইকবাল হলের ছাত্র সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্টরা। আলোচনার বিষয়বস্তু মওলানা ভাসানীর কথিত বক্তব্য। এই ছাত্র নেতারা নাকি কাগমারীতে মাওলানা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন ইউরোপ সফর শেষে মাওলানা সাহেব মাত্র দেশে ফিরেছেন, তাই নাকি ছাত্র নেতাদের তাঁর কাছে যাওয়া। আলোচনাকালে মওলানা সাহেব নাকি ছাত্রনেতাদের কাছে ব্রিটিশ শ্রমিক দলের বামপন্থী নেতা বেভানের একটি বক্তব্যের উল্লেখ করেছিলেন। ঘটনটি নিম্নরূপ
মওলানা সাহেব আলোচনাকালে বেভানের কাছে কাশ্মীর সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের মতামত জানতে চান। বেভান নাকি বলেছিলেন, মওলানা, কাশ্মীর দিয়ে কী হবে, তোমরা পাকিস্তান চেয়ে ভুল করেছ।
মওলানা সাহেবের কাছে এই কথা শুনে ছাত্রনেতারা মওলানা ভাসানীকে জিজ্ঞাসা করেন, বেভান এ কথা বলার পর আপনি কী বললেন? মওলানা সাহেব নাকি জবাবে বলেছিলেন, আমার কী বলার আছে। বেভান ঠিকই তো বলেছে।
মওলানা সাহেবের কথায় ছাত্রনেতারা ক্ষুব্ধ হয়। তারা ঢাকায় এসে প্রচার শুরু করে যে, মওলানা ভাসানী পাকিস্তান বিদ্বেষী, ভারতীয় এজেন্ট। সুতরাং তার বিরুদ্ধে সভা সমাবেশের সিদ্ধান্ত হয়। মওলানা সাহেব তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি।
বারী সাহেব বললেন, কাল আমতলার সমাবেশে মারামারি হবে। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর অবস্থান দুই মেরুতে। তাই মওলানা ভাসানীকে হেনস্তা করা প্রয়োজন। নইলে এই তুচ্ছ ঘটনার জন্যে মওলানা সাহেবের কথিত উক্তির প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ ডাকার কোনো কারণ ছিল না।
আমার কাছে ঘটনাটি স্পষ্ট হয়ে এল। বুঝতে কষ্ট হলো না যে, ছাত্রলীগের শহীদ সোহরাওয়ার্দী পন্থীরাই এ কাজটি করেছে। সংঘর্ষ অনিবার্য। কিন্তু আমি কী করবো। ছাত্রলীগ প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। আর সপ্তাহখানেক ধরে জ্বরে ভুগছি। আমাকে দেখার আমি ব্যতীত কেউ নেই। ইতোমধ্যে আমাকে শুনতে হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি এবং পরবর্তীকালে ন্যাপ নেতাদের হস্তক্ষেপে আমি ছাত্রলীগের সম্পাদক হতে পারিনি। তাদের বক্তব্য, নির্মল সেন হিন্দু। তাই দেশের সবচে’ বড় ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নেতা হিন্দু হলে কাশ্মীর এবং অন্যান্য প্রশ্নে নাকি অসুবিধা হবে। এ যুক্তি দিয়েছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের ভেতরের এবং বাইরের বামপন্থী নেতারা। ডানপন্থীরা নন। এবার আবার সেই ডানপন্থী-বামপন্থীদের সংঘর্ষের মোকাবেলায় আমাকে নামতে হবে। তাই জ্বর নিয়ে একটি আলোয়ান গায়ে দিয়ে হাজির হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়। তখনো সমাবেশ শুরু হবার অনেক দেরি। মনে হলো ‘দু’পক্ষের কাছে আমিই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি।
আমতলায় পৌঁছে ছাত্রলীগের কোনো বড় নেতার সাক্ষাৎ পেলাম না। দেখা হলো সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপি সামসুল হক, ফজলুল হক হলের ভিপি আব্দুল মতিন ও ইকবাল হলের ভিপি দেওয়ান সফিউল আলমের সঙ্গে। দেওয়ান সফিউল কুমিল্লা কলেজে পড়বার সময় আমাদের দল আরএসপি’র সংস্পর্শে এসেছিল। এদের সকলের সঙ্গে কথা বললাম। স্থির হলো কোনো উস্কানিমূলক বক্তব্য নয়। কাশ্মীরের দাবিতে যাদের যা খুশি বলতে পারে।
ঘণ্টাখানেক পর সমাবেশ শুরু হলো। লক্ষ করলাম মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের অনেকে ছাত্র সমাবেশে এসেছে। মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগ বরাবর দুর্বল। সভার শুরুতে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন সামসুল হক। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি কারো নাম উল্লেখ না করে বললেন, পাকিস্তানে কোনো মীর জাফরকে সহ্য করা হবে না। সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র কালিদাস বৈদ্য স্লোগান দিলেন–মওলানা ভাসানী জিন্দাবাদ। প্রতিপক্ষ স্লোগান দিলো–শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ–হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। সেকালে মারামারিতে বোমা-রাইফেল, পিস্তল ছিল না। তাই সংঘর্ষ হাতাহাতিতে সীমাবদ্ধ থাকল। দীর্ঘক্ষণ সংঘর্ষ চলার পর দোতলা থেকে অর্থনীতি বিভাগের ড. নূরুল হুদা ও ইংরেজির টার্নার নিচে নেমে এলেন। তাঁদের উপস্থিতিতে সবাই শান্ত হয়ে গেল।
সে সময়ের একটি ঘটনা আজও মনে পড়ছে। ছাত্রলীগের সদস্যরা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের ভারতীয় দালাল মনে করত। তাই ওই দিন ছাত্রলীগের এক সদস্য ছাত্র ইউনিয়নের এক সদস্যকে কান ধরে বলতে বাধ্য করছিল–কাশ্মীর পাকিস্তানে চাই। দৃশ্যত সংঘর্ষে ছাত্রলীগ জিতেছিল। বিকেলের দিকে আমতলায় দাঁড়িয়ে ছিল বাংলার ছাত্র সুনীল মুখোপাধ্যায় (পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)। আমি তখন ক্লান্ত। আলোয়ান ছিঁড়ে গেছে সংঘর্ষ ঠেকাতে। সুনীল বাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম–এরপর কী হবে বলুন? তিনি হেসে বললেন, আমতলায় কোনোদিন সিরাজদ্দৌলা জিততে পারে না। এরপর ছাত্রলীগে ফেরার কথা আর ভাবতে পারছিলাম না।
এরপর আর এক বিপদ এগিয়ে এল আমার জন্যে। পূর্ব পাকিস্তানে তখন আওয়ামী কংগ্রেসে কোয়ালিশন সরকার। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান এবং অর্থমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সিদ্ধান্ত নতুন গোলযোগের সূত্রপাত করে।
১৯১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি হল ছিল। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল), জগন্নাথ হল এবং ছাত্রলীগের জন্যে চামেলী হল (বর্তমানে রোকেয়া হল)। সলিমুল্লাহ হল ও ফজলুল হক হল মুসলমান ছাত্রদের জন্যে। জগন্নাথ হল হিন্দু ছাত্রদের জন্যে এবং ঢাকা হল ছিল সকল সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জন্যে নির্দিষ্ট। তবে ঢাকা হলে কোনোদিন মুসলিম ছাত্র ভর্তি না থাকায় (শুধুমাত্র ড. শহীদুল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ শফিউল্লাহ কিছুদিনের জন্যে এ হলের ছাত্র হয়ে সলিমুল্লাহ হলে চলে যায়) ঢাকা হল শেষ পর্যন্ত অমুসলমান ছাত্রদের হলে পরিণত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর হিন্দু ছাত্র সংখ্যা হ্রাস পায়–এ সময় পাকিস্তান সরকার জগন্নাথ হলের উত্তরের বাড়িতে পোস্টমাস্টার জেনারেলের অফিস স্থাপন করে। দক্ষিণ বাড়িতে স্থাপিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার অফিস-জগন্নাথ হল মিলনায়তন পরিণত হয় পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে। জগন্নাথ হলের হিন্দু ছাত্রদের পাঠানো হয় ঢাকা হলে। ঢাকা হল পরিণত হয়। ঢাকা জগন্নাথ হলে। অমুসলমান ছাত্রসংখ্যা আরো হ্রাস পেলে ঢাকা হলের পূর্বের এলাকা দিয়ে দেয়া হলো ফজলুল হক হলকে। ফলে তখন নাম হয় ফজলুল হক হল এক্সটেনশন।
১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন যে জগন্নাথ হলকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে শুধুমাত্র উত্তর বাড়ি নিয়ে। দক্ষিণ বাড়িতে রেজিস্ট্রার অফিস থাকবে। তবে নতুন রেজিস্ট্রার ভবন নির্মিত হলে ঐ বাড়িও ছেড়ে দেয়া হবে। ঢাকা হলকে মুসলিম হলে পরিণত করা হবে। জগন্নাথ হলকে অমুসলমান ছাত্রদের ছাত্রাবাসে পরিণত করা হবে। ঢাকা হল মুসলিম হলে আর অমুসলমান ছাত্রদের চলে যেতে হবে জগন্নাথ হলে।
ঢাকা হলের ছাত্ররা এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জেনকিনস। ঢাকা হলের একদল প্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি জানালেন, তিনি নিজে খ্রিস্টান, তিনি সংখ্যালঘু ছাত্রদের সুবিধা-অসুবিধা জানেন। তাঁর ধারণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যালঘু ছাত্রদের সংখ্যা আর বৃদ্ধি পাবে না। অথচ মুসলিম ছাত্র সংখ্যা বাড়ছে–তাই অমুসলিম ছাত্রদের জগন্নাথ হলে যাওয়া উচিত। এ সময় গেলে তাদের অনেক সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে। এ সিদ্ধান্তে রাজি হলে তারা অনেক ভালো করবে। ঢাকা হলের ছাত্রদের বক্তব্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি কোনো পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে সম্প্রদায় ভিত্তিতে আনা চলবে না। সকল হল সকল সম্প্রদায়ের জন্যে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। কোনো সম্প্রদায়ের জন্যে বিশেষ হল থাকতে পারে না। সকল হল হবে কসমোপলিটন। এ দাবি না মানা হলে ঢাকা হল যেমন আছে তেমন থাকবে। ড, জেনকিনস একমত হলেন না। তবে চলে যাবার পূর্বে ঢাকা হলকে মুসলিম হল করার পরিবর্তে কসমোপলিটন হল করার সিদ্ধান্ত দিয়ে গেলেন। তবে জগন্নাথ হল অমুসলমান ছাত্রদের হলে পরিণত করার সিদ্ধান্ত বহাল থাকল।
ড. জেনকিনস চলে যাবার পর ভাইস চ্যান্সেলর হলেন। বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম। ইব্রাহিম সাহেবের সঙ্গে তৎকালীন রেজিস্ট্রার হাদি তালুকদারের সুসম্পর্ক ছিল না। আমরা ইতিমধ্যে হল সম্পর্কে ইব্রাহিম সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, ঢাকা হলের ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করেই পরবর্তীকালে সকল সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু ইব্রাহিম সাহেব চিকিৎসার জন্যে লন্ডন গেলে রেজিস্ট্রার হাদি তালুকদার এক অদ্ভুত নির্দেশ জারি করলেন ঢাকা হলের ছাত্রদের ওপর। যতদূর মনে আছে জুন মাসের শেষের দিকে এক নির্দেশ জারি করে বললেন, ঢাকা হলের সকল হিন্দু ছাত্রদের ১ জুলাইয়ের মধ্যে জগন্নাথ হলে চলে যেতে হবে। ঢাকা হল কসমোপলিটন হল। এ হলে সকল সম্প্রদায়ের ছাত্রদের থাকবার অধিকার আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো ক্ষমতা নেই কাউকে নির্দেশ দিয়ে হল থেকে তাড়াবার। দ্বিতীয়ত জগন্নাথ হল তখন বাসযোগ্য ছিল না। দীর্ঘদিন পিএমজি থাকায় কোনো মেরামত হয়নি। পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, জল নেই, ক্যান্টিন নেই, কমনরুম নেই, প্রভোস্ট অফিস নেই। একটি ছাত্রাবাসের জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু নেই। একমাত্র লোভনীয় হচ্ছে প্রতিজন ছাত্রের জন্যে এক আসনের একটি কক্ষ। সর্বশেষ কথা হচ্ছে–ভাইস চ্যান্সেলর কথা দিয়েছিলেন, আলোচনার মাধ্যমেই সকল সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু সবকিছুই হলো একতরফা। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কেউই ঐ তারিখে ঢাকা হল ত্যাগ করব না।
আমরা সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। ভাইস চ্যান্সেলর ফিরে এলেন। তিনি বললেন, সকলকে জগন্নাথ হলে যেতে হবে না, যাদের খুশি তারা যাবে। আমরা বললাম, তাও হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হলকে ঢাকা হলের মতো কসমোপলিটন হল করতে হবে। আমরা সকল হলে থাকব। নইলে যে কোনোদিন যে কোনো হল থেকে আমাদের তাড়ানো হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের কথা মানলেন না। মাঝখানে একদিন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য অগ্নিযুগের অন্যতম বিপ্লবী রাজশাহীর প্রভাস লাহিড়ী আমাকে ডাকলেন। বললেন, তুমি নাকি ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার এসএন মিত্রের সঙ্গে দেখা করেছ। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান এ অভিযোগ করেছেন। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমি ভারতীয় হাইকমিশনের কাউকে চিনতাম না। শুধু জানতাম আমার সম্পর্কে তাদের ধারণা অনুকূল নয়। পরদিন ভোরে ইত্তেফাকে এ সম্পর্কে রাজনৈতিক মঞ্চে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার লিস্ট বের হলো। তিনি সরাসরি লিখলেন-একজন সংখ্যালঘু বিপ্লবী ছাত্রনেতা ঢাকা হল-জগন্নাথ হল নিয়ে ভারতীয় কূটনীতিকের সঙ্গে আলোচনা করেছে। তারপর যা লিখবার সবই লেখা হয়েছিল ইত্তেফাকের পাতায়। শুধুমাত্র আমার প্রতিবাদ পত্রটি ছাপা হয়নি।
এভাবে চারিদিকে প্রচারণা করে ঢাকা হলের ছাত্রদের চরমপথ গ্রহণে বাধ্য করা হলো। এসময় অনশন ধর্মঘট করতে বাধ্য হলাম। সিদ্ধান্ত হলো প্রথম দিন ছ’জন ছাত্র অনশনে যাবে। এরা দুর্বল হলে তরল জাতীয় কিছু গ্রহণ করবে। দ্বিতীয় দিন আমি অনশনে যোগ দেব। আমার অনশন হবে একান্তই কোনো কিছু না খেয়ে।
এ ধরনের অনশন করার অভ্যাস আমার হয়েছিল জেলখানায়। ১৯৪৮ ৪৯-৫০ সালে ঢাকা জেলে চারবার অনশন করেছিলাম। ৬ দিন, ২৪ দিন, ৪০ দিন এবং ৫০ দিন। অনশনের ফলে অসুস্থ হয়েছিলাম, যে অসুখের ঐতিহ্য বহন করে জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। তাই ১৯৫৭ সালে অনশনে যাওয়া আমার পক্ষে কঠিন ছিল না। আর আমাকে বারণ করারও কেউ ছিল না। ১৯৪৮ সালে মা পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলেন। গোপালগঞ্জের গ্রামে বাবা আছেন। দু’কাকা আছেন টুঙ্গিপাড়ায়। জেলে থাকতে থাকতে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর। আর তারা কোনোদিনই আমার কোনো সিদ্ধান্তে বাধা দেননি।
প্রথমদিকে ৬ জন ছাত্র অনশন শুরু করে। দ্বিতীয় দিনে আমাকে নিয়ে ৭ জন। চারদিকে একটি থমথমে ভাব। ঢাকা হলের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে ভয় পাচ্ছে। একটি দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সর্বত্রই যেন একটা সাম্প্রদায়িক মনোভাব। মনে হয় ঢাকা হলের সংখ্যালঘু ছাত্ররা একটা অন্যায় কাজ করছে। ঢাকা হলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান তিন সম্প্রদায়ের ছাত্র থাকলেও চিহ্নিত হচ্ছে হিন্দু হল বলে। সুতরাং হিন্দু হলের ছাত্রদের আন্দোলন নিশ্চয়ই হবে সাম্প্রদায়িক। প্রকৃতপক্ষে তল্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন একটি বিবৃতি দেয়া ছাড়া কোনো ছাত্র সংগঠনই আমাদের আন্দোলনের পক্ষে এগিয়ে আসেনি। তারা বিক্ষুব্ধ। কারণ আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায় এবং আমি ছাত্রলীগের সদস্য হয়েও ঐ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছি।
অনশনের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যাবেলায় ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি ইব্রাহিম আমাদের দেখতে এলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সকল হলের প্রভোস্ট। প্রভোস্টদের মধ্যে ছিলেন ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব। তিনি ঢাকা হলের ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট ছিলেন। নতুন পরিস্থিতিতে তিনি জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট নিযুক্ত হয়েছেন। নতুন পদ পেয়ে তিনি খুশি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বোঝাতে চাচ্ছিলেন, ঢাকা হল মুসলিম হল হয়ে যাক। জগন্নাথ হলকে অমুসলমানদের হল হিসেবে চালু করা হোক। একটু দেনদরবার করতে পারলে এ পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু ছাত্ররা অনেক সুযোগ-সুবিধা পাবে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু ছাত্রদের সংখ্যা আর বৃদ্ধি পাবে না। এবার সুযোগ হারালে সংখ্যালঘু ছাত্ররা আর কোনদিন সুযোগ-সুবিধা পাবে না। ড, গোবিন্দ দেবের মতে আমরা একমত হতে পারিনি। তিনি আমাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে জগন্নাথ হলের দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তিনি তখন আমাদের কাছে ছিলেন অসহায়। তাই ভাইস চ্যান্সেলর আমাদের কক্ষে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম, ড, গোবিন্দ দেব থাকলে আপনাদের সঙ্গে কোনো কথা হবে না। তাঁকে চলে যেতে হবে। তিনি অসম্মানিত হলে আমরা দায়ী থাকব না। ড. গোবিন্দ দেব হতচকিত হয়ে গেলেন এবং কক্ষ ছেড়ে বের হয়ে গেলেন।
ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে ছিলেন ঢাকা হলের নবনিযুক্ত প্রভোস্ট এম এন কিউ জুলফিকার আলি। বছর খানেক আগে তিনি ঢাকা হলে প্রভোস্ট হয়েছেন। কিন্তু আমরা তাঁকে কোনোদিন হলে ঢুকতে দিইনি। আমি বললাম, জুলফিকার আলি সাহেবকে আমরা হলের প্রভোস্ট মানি না। তিনিও কক্ষে থাকলে কোনো আলোচনা হবে না। তাকেও চলে যেতে হবে। তিনিও চলে গেলেন।
এবার আলোচনা শুরু হলো। বিচারপতি ইব্রাহিম বললেন, Best of the things will be done for the minority students. তাঁর কথাগুলো এখনও আমার কানে ভাসছে। তিনি বললেন, তোমরা অনশন করছ। আমরা তোমাদের সব দাবি মেনে নেব। তোমরা অনশন প্রত্যাহার করো। আলোচনায় আমাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন ঢাকা জগন্নাথ হল সভাপতি তরুণ সেন। সাধারণ সম্পাদক শিশির দাস, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার এককালীন প্রধান দেবপ্রিয় বড়ুয়া এবং পদার্থবিদ্যা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. অজয় রায়।
বিচারপতি ইব্রাহিমকে আমি বললাম, স্যার, আমার একটি কথার জবাব দিতে হবে। ঢাকা হল কসমোপলিটন হল। এ হলে সকল সম্প্রদায়ের ছাত্রদের থাকার অধিকার আছে। আপনারা কোন যুক্তিতে এ হলের হিন্দু ছাত্রদের বাধ্যতামূলকভাবে জগন্নাথ হলে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন? আমি ঢাকা হলে থাকব কি-না সে সিদ্ধান্ত আমি নেব। আমার ওপর কোনো অধিকার আপনাদের নেই।
বিচারপতি ইব্রাহিম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। পরে বললেন, এ নির্দেশটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এবার তোমরা যারা খুশি এখানে থাকবে এবং যারা খুশি জগন্নাথ হলে যাবে। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই। আমি প্রবাসে থাকাকালীন এ নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। এ নির্দেশ আর কার্যকর নয়। আমি বললাম, আমাদের মূল দাবি হচ্ছে ঢাকা হলের মতো সব হলকে কসমোপলিটন করতে হবে। সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে কোনো হল থাকতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্যে সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে কোনো ছাত্রী নিবাস নেই। তাই ছাত্রদের ক্ষেত্রেও এ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাই আমাদের দাবি স্ট্যাচুট পরিবর্তন করে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে মুসলিম শব্দটি তুলে দেয়া হোক। সকল সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জন্যে এই হল দুটির দুয়ার খুলে দেয়া হোক।
বিচারপতি ইব্রাহিম বললেন, কোনো হলের স্ট্যাচুট পরিবর্তন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এতে অনেক ঝামেলা হবে। আমি বললাম–স্যার আপনার কথা সত্য নয়। ইচ্ছা হলেই আপনারা স্ট্যাচুট পাল্টাতে পারেন। আপনারা জগন্নাথ হলের স্ট্যাচুট পাল্টিয়েছেন। স্ট্যাচুট অনুযায়ী জগন্নাথ হল শুধুমাত্র হিন্দু ছাত্রদের জন্যে সংরক্ষিত ছিল। স্ট্যাচুট পাল্টে আপনারা জগন্নাথ হলকে অমুসলমান হলে পরিণত করেছেন। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জগন্নাথ হলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান তিন সম্প্রদায়ের ছাত্ররাই থাকতে পারবে। তাই জগন্নাথ হলের স্ট্যাচুট পাল্টানো গেলে সলিমুল্লাহ হল ও ফজলুল হক হলের স্ট্যাচুট কেন পাল্টানো যাবে না?
ইব্রাহিম সাহেব চুপ করে গেলেন। বললেন, তুমি এত কথা জানলে কী করে। বললাম, স্যার, আপনাদের লাল বইটা দেখেছি। আপনাদের লাল বই আমাদের দেখা নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদেরও উপায় ছিল না। তাছাড়া আমাদের ভিন্ন যুক্তি আছে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সম্পর্কে। পাকিস্তানের সংবিধানে আছে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি সাহায্য পেলে সেই প্রতিষ্ঠানে কোনো সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীকে প্রবেশে বাধা দেয়া যাবে না। সকল সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীকে থাকবার এবং পড়বার সুযোগ দিতে হবে। ইকবাল হলে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ১২ লাখ টাকা সাহায্য দিয়েছে। তাই ইকবাল হলের দুয়ার আমাদের জন্যে খুলে দিতে হবে। এর পরেও কথা আছে। জগন্নাথ হল এখনও মানুষের বাসোপযোগী নয়। জগন্নাথ হল এ মুহূর্তে কতগুলো পায়রার খোপের সমষ্টি। ওই হলে ছাত্রদের যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
এরপরে আর আলোচনা জমল না। ভাইস চ্যান্সেলর নীরব হয়ে গেলেন। বিদায় নেবার পূর্বে আবার অনশন প্রত্যাহারের আবেদন জানালেন। অনশনের তৃতীয় দিনে অর্থমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর এলেন। তিনি খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করলেন। বললেন–ঠিক আছে অনশন যখন শুরু করেছেন চালিয়ে যান। দেখি কতদূর কী করা যায়। কিছুক্ষণ পর দেখা করতে এলেন আর একজন মন্ত্রী-কংগ্রেসের শরৎ মজুমদার। তিনিও সমর্থন জানিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে এলেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ফণীভূষণ মজুমদার। তাকে খুব চিন্তিত মনে হলো। তিনি বললেন, কী করবে? তোমার বাড়ি থেকে তোমার অবস্থা জানতে চেয়েছে। আমি বললাম, ভাববার কিছু নেই। বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম করে দিন।
অনশনের চতুর্থ দিনে হাওয়া পরিবর্তন হতে শুরু হলো। আমাকে জানানো হলো ঢাকার আদিবাসীদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি ইব্রাহিমের সঙ্গে দেখা করেছে। তারা নাকি বলেছে দেশের হিন্দুরা তো এমনিতেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে। বাকি আছে টাকা হলে শ’তিনেক ছাত্র। এদের সমস্যা তাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হোক। এক বন্ধু এসে জানিয়ে গেল ঢাকা হলের অনশন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক যুগান্তরে সম্পাদকীয় বেরিয়েছে। বলা হয়েছে, এই অনশন নিয়ে অপ্রীতিকর কিছু ঘটলে পশ্চিমবাংলায় তার প্রতিক্রিয়া হবে। সন্ধ্যার দিকে সেকালের সমাজতন্ত্রী দলের নেতা অধ্যাপক পুলিন দে এলেন। তিনি বললেন–নারায়ণগঞ্জের হিন্দু ব্যবসায়ীরা একটি ভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁদের প্রস্তাব হচ্ছে–তারা টাকা দিয়ে পুরো ঢাকা হল কিনে ফেলবে। হলটি হিন্দু ছাত্রদের জন্যেই থাকবে। অথবা হলের মাঝখানে একটি দেয়াল দেয়া হবে। পশ্চিম দিকে থাকবে অমুসলমান ছাত্ররা। পূর্ব দিকে থাকবে ফজলুল হক হল এক্সেটেনশন। যেমন আছে তেমন।
পুলিন বাবুর প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম না। বললাম, সংগ্রাম আমাদেরই করতে দিন। কারো সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন নেই। আমি তখন বিব্রত বোধ করছিলাম চারদিক থেকে। চারিদিকে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ। ঢাকা হলের ছাত্ররা ক্লাসে যাচ্ছে না। শুনেছি মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানের বাসভবনে। ছাত্রলীগ নেতাদের বৈঠক হয়েছে। সে বৈঠকের ফলাফল একান্তই আমাদের বিপক্ষে। আমি কাউকে কিছু বলতে পারছিলাম না। ভয় পাচ্ছিলাম। আমার কথা শুনলেই সবাই আরো ভয় পেয়ে যাবে। সকলের মন ভেঙে যাবে। আমার এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা প্রচার করছে নির্মল সেনও সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে। সেও হিন্দু ছাত্রদের জন্য অনশন শুরু করেছে। বড় বড় কথা বললেও নির্মল সেনও শেষ পর্যন্ত হিন্দু।
এ পরিস্থিতি আমাকে বারবার মোকাবেলা করতে হয়েছে। আমি যখন অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্যে সংগ্রাম করেছি তখন এ প্রশ্ন ওঠেনি। আমি ন্যাশনাল মেডিক্যাল ছাত্রদের জন্যে সংগ্রাম করেছি। তল্কালীন এলএমএফ ছাত্রদের দাবির সমর্থনে অনশন করতে ময়মনসিংহ গিয়েছি। রাজশাহীতে গিয়েছি। তখনও প্রশ্ন ওঠেনি। আমার অসুবিধা ছিল আমাদের দল আরএসপি’র এককালে পূর্ব পাকিস্তানে বড় সংগঠন থাকলেও দেশ বিভাগের পরে প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। ছাত্রফ্রন্টে আমার সহযোগি ছিল ছাত্রলীগ। সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে তারা সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। ছাত্র ইউনিয়ন কথাবার্তায়, চলনে-বলনে অসাম্প্রদায়িক হলেও সামনাসামনি প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে অবস্থান নিতে পারত না। তাদের ছিল নিদারুণ দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব। তাই তকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলি আক্কাস আমাকে প্রতিদিন এসে খবর দিলেও প্রকাশ্যে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি ছাত্র ইউনিয়ন। ফলে সে সময় আমাকে বড্ড নিঃসঙ্গ মনে হতো। বলার মতো একটি মানুষ আমি খুঁজে পাইনি। এর মধ্যে অনশনের ৫ম দিনে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল।
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। পদাধিকার বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। অনশনের ৫ম দিনে তিনি আমাদের দেখতে এলেন। শেরেবাংলা ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী। তাই কথায় কথায় বলতেন–আমি তোমাদের সব দাবি মেনে নিচ্ছি। তোমরা অনশন বন্ধ করো। শেরেবাংলার সঙ্গে তখন অসংখ্য তোক ঢাকা হলে। লোকে লোকারণ্য। আমি শেরেবাংলাকে বললাম, আমি আপনাকে শৈশব থেকে চিনি। শ্রদ্ধা করি। কিন্তু বিশ্বাস করি না। আমি জানি একথা আপনি রাখতে পারবেন না। আমার কথায় সবাই যেন চমকে উঠলেন। কেউ কোনো কথা বললেন না। শেরেবাংলা সদলবলে ঢাকা হল থেকে সলিমুল্লাহ হলে চলে গেলেন। পরে শুনলাম তিনি সলিমুল্লাহ হলে এক ছাত্রসভা করেছেন। আমার আচরণের কথা বলেছেন। ছাত্ররা নাকি বলেছে-সলিমুল্লাহ হলের স্ট্যাচুট পরিবর্তন হবে একমাত্র রক্তের বিনিময়ে। অর্থাৎ অবস্থা আরো ঘোলাটে হয়ে উঠল।
সন্ধ্যার সময় ভাইস চ্যান্সেলর অফিস থেকে এক ভভদ্রলোক এসে আরেক খবর দিয়ে গেলেন। খবরটি হচ্ছে আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তারেরা নাকি রিপোর্ট দিয়েছে আমার শরীর ভেঙে যাচ্ছে। তাই ভাইস চ্যান্সেলর একাডেমিক কাউন্সিলের সভা ডেকেছিলেন। একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যরা নাকি একবাক্যে বলেছেন, তাঁদের করার কিছু নেই। আর আমার সম্পর্কে বলেছেনLet him die peacefully. এ খবর কতটুকু সত্য আমি কোনোদিন যাচাই করার চেষ্টা করিনি। তবে আমাকে নিয়ে যে ইব্রাহিম সাহেব চিন্তিত ছিলেন তা আমি বিশ্বাস করি। তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিন ধরে।
অনশনের ৬ষ্ঠ দিনে তেমন কিছু ঘটল না। চারিদিকে চুপচাপ। মনোরঞ্জন বাবু ও শরৎ বাবু এসে আমাদের দেখে গেলেন। কোনো মহলে কোনো উচ্চবাক্য নেই। অনশনের ৭ম দিনের সন্ধ্যাবেলা দলবল নিয়ে উপস্থিত হলেন বিচারপতি ইব্রাহিম। তাঁর কাছে নাকি খবর গেছে আমার অবস্থা ভালো নয়। চিকিৎসকরা আমার দায়িত্ব নিতে রাজি নন। কক্ষে ঢুকেই ভাইস চ্যান্সেলর বললেন, নির্মল, বলো তো আমি কে? আমি বললাম, আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ভাইস চ্যান্সেলর মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তিনি বললেন, তুমি কি আমাকে শ্রদ্ধা করো? আমি বললাম, করি। বিচারপতি ইব্রাহিম বললেন, তাহলে আমার নির্দেশ, আজকে তুমি কোনো কথা বলতে পারবে না। আমি বললাম, তা হতে পারে না।
ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম আঁটঘাট বেঁধেই এসেছিলেন। তিনি শুনেছিলেন আমার অবস্থা খারাপ। ডাক্তাররা কোনো দায়িত্ব নেবে না। আমার হাসি পাচ্ছিল। কারণ ৭ দিনের অনশনে আমার কিছুই হয় না। ১৯৪৯ সালে ঢাকা জেলে শুধু জল খেয়ে ১১ দিন ছিলাম। অনশন আমার কোনোদিনই কষ্টকর মনে হয়নি। মনোবল থাকলে অনশনে কিছুই হয় না। তাই ডাক্তারের রিপোর্ট সত্ত্বেও আমি আদৌ শঙ্কিত ছিলাম না। ভাইস চ্যান্সেলর ইব্রাহিম বললেন, নির্মল, আমি ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নির্দেশ দিচ্ছি আজ তুমি কোনো কথা বলতে পারবে না। তুমি অসুস্থ। আমি বললাম, আপনার নির্দেশ আমাদের স্বার্থের বাইরে যাচ্ছে। আমাকে কথা বলতে হবেই। আমার কথার প্রতিবাদ করলেন সকল প্রভোস্ট একযোগে। তারা বললেন, তুমি বলছো তুমি ভাইস চ্যান্সেলরকে সম্মান করো। তাই তার নির্দেশ তোমাকে মানতে হবে। নইলে ভাইস চ্যান্সেলরকে অসম্মান করা হবে। আমার ঢাকা হলের বন্ধুরা আমাকে চুপ থাকতে বলল। এবার কথা শুরু করলেন ভাইস চ্যান্সেলর মোহাম্মদ ইব্রাহিম।
ভাইস চ্যান্সেলর বললেন, সেই আগের একই কথা–সংখ্যালঘু ছাত্রদের জন্যে সবকিছু করা হবে। তোমরা অনশন প্রত্যাহার করো। আমি বললাম, এমন কথায় কিছু হবে না। ভাইস চ্যান্সেলর আমাকে আবার চুপ থাকার কথা বললেন। তিনি বললেন, তোমাদের সকলকে জগন্নাথ হলে যেতে হবে না। যাদের খুশি তারা জগন্নাথ হলে যাবে। যারা ঢাকা হলে থাকতে চায় তারা ঢাকা হলেই থাকবে। জগন্নাথ হল সংস্কার করা হবে। জল, আলো, ক্যান্টিন কমনরুমের ব্যবস্থা করা হবে। আমি কথা দিচ্ছি, আমি ভাইস চ্যান্সেলর থাকলে ইকবাল হল কসমোপলিটন হল হবে। জগন্নাথ হলের রেজিস্ট্রার অফিস ও মিলনায়তন তোমরা একদিন পাবে।
আমি লক্ষ করলাম, আমাদের ঢাকা হলের ছাত্র বন্ধুরা অনেক নমনীয়। তারা অনশন অব্যাহত রাখতে সাহস পাচ্ছিল না। সকলেই অনশন ভাঙতে নিমরাজি। ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে সকল হলের প্রভোস্টরা প্রতিশ্রুতি দেয়ায় অনশন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হলো। আমি কিছুই করলাম না। ভাইস চ্যান্সেলর বললেন, তুই কাল সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে যাবি। আমি বললাম, আমার সময় হবে না। আমি আগামীকাল কুমিল্লা যাবো। কুমিল্লায় আমার দলের বৈঠক আছে। অনশন প্রত্যাহারের পর অর্থমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর এলেন। তিনি অনশন প্রত্যাহারের কথা জানতেন না। বললেন, এত তাড়াতাড়ি অনশন প্রত্যাহার করলেন কেন? আমরা তো আলোচনা শুরু করেছিলাম। আমার কথার কিছু ছিল না। আমি পরের দিন ঐ শরীর নিয়েই ট্রেনে কুমিল্লা চলে গেলাম। দু’দিন পরে ঢাকা ফিরলাম।
ঢাকা এসে দেখি পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিয়েছে। ঢাকা হলের ছাত্ররা এক নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, জগন্নাথ হলকে সংখ্যালঘু হল হিসেবে ঘোষণা করা হোক। ঐ হলটিতে শুধুমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্ররাই থাকবে। তাদের আশঙ্কা হচ্ছে–জগন্নাথ হল অমুসলমান কসমোপলিটন থাকলে একদিন ভবিষ্যতে আবার হয়তো নতুন দাবি উঠবে। মুসলমান ছাত্ররা বলবে ঐ হলকে কসমোপলিটন করা হোক। সকল ছাত্রকে ঐ হলে থাকতে দিতে হবে।
আমি বললাম, এ সিদ্ধান্তে আমি একমত নই। কোনো সংখ্যালঘু হল করা যাবে না। আমাদের মূল দাবি ছিল সকল হলকে কসমোপলিটন করা। আবার এখন আমরা দাবি করছি জগন্নাথ হলকে সংখ্যালঘু হল করার। এ দাবি মূল দাবির সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমার সকল বন্ধু খুশি না হলেও আমার প্রস্তাব সবাই মেনে নিল।
সন্ধ্যার দিকে ভাইস চ্যান্সেলর আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি একটি নতুন প্রস্তাব দিলেন। তিনি বললেন, নির্মল, তোর সেদিনের কথায় আমি বিবেকের দংশন অনুভব করেছি। আমরা জগন্নাথ হলের স্ট্যাচুট পরিবর্তন করেছি। অথচ এসএম হলের স্ট্যাচুট পরির্বন করতে পারছি না। এই বৈপরীত্য চলতে পারে না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি জগন্নাথ হলের স্ট্যাচুট আবার পাল্টে দেব। জগন্নাথ হল আবার হিন্দু ছাত্রদের হল হবে। আমি বললাম, স্যার, এ প্রস্তাব আমি মানব না। আমরা সকল হলকে কসমোপলিটন করার কথা বলেছি। জগন্নাথ হলকে নতুন করে হিন্দু হল বানাতে চাই না। তিনি বললেন, নির্মল তুই বুঝবার চেষ্টা কর। এদেশে হিন্দু ছাত্রদের সংখ্যা কোনোদিন বৃদ্ধি পাবে না। জগন্নাথ হলের সিট খালি থাকবে। মুসলমান ছাত্ররা দাবি তুলবে আমরা ঐ সিটে থাকব। একদিন দেখবি এসএম হলের ছাত্ররা জগন্নাথ হল দখল নিয়ে গেছে। ওরা বলবে, শুধুমাত্র অমুসলমান ছাত্রদের জন্যে নয়, সকল সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জন্যে জগন্নাথ হলের দুয়ার মুক্ত থাক। বিচারপতি ইব্রাহিম জোর দিয়ে বললেন–আমি এ পথ বন্ধ করে দিয়ে যেতে চাই। তুই রাজি হয়ে যা। আমি বললাম, কিছুতেই রাজি হব না। এবার তিনি আমাকে সরাসরি একটা প্রশ্ন করলেন। জিজ্ঞেস করলেন-তুই কি পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু ছাত্রদের প্রতিনিধি? আমি বললাম না। আমি শুধু ঢাকা হলের ছাত্রদের প্রতিনিধি।
বিচারপতি ইব্রাহিম এরপর তেমন কোনো কথা বললেন না। শুধু বললেন, ঠিকমতো তোর কথা ভেবে দেখব। বললেন, তোর একটা কাজ আছে। আগামীকাল ভোরে ঢাকা হলের প্রতিনিধিরা জগন্নাথ হলে যাবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীরা থাকবে। সব মাপজোক করবে। কক্ষগুলোতে বাতাস ঢুকবার জন্যে দেয়াল কেটে ঘুলঘুলি করা হবে। কোথায় কমনরুম ক্যান্টিন হবে তাও ঠিক করা হবে। আমি বললাম, দক্ষিণের রেজিস্ট্রি অফিস ও এসেম্বলি অফিস কী হবে। তিনি বললেন, কালক্রমে হলগুলো তোরা পেয়ে যাবি।
পরদিন সবাই মিলে জগন্নাথ হলে গেলাম। প্রকৌশলীরা এলেন। সব মাপজোক শুরু হলো। জগন্নাথ হলে খাওয়া আর ঢাকা হলে থাকার পালা। এ ব্যাপারে ভাগাভাগি হয়ে গেল। আমরা ৭০ থেকে ৭৫ জন ছাত্র ঢাকা হলে থেকে গেলাম। বাদ বাকি সকলেই চলে গেল জগন্নাথ হলে। এ ব্যাপারেও কৌশল গ্রহণ করলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নতুন যারা ভর্তি হতে এসেছিল সেই সংখ্যালঘু ছাত্রদের ঢাকা হলে ভর্তির ফরম দেয়া হলো না। প্রায় সকলকেই বাধ্য করা হলো জগন্নাথ হল থেকে ভর্তির ফরম কিনতে।
সেদিন আমার এবং আমাদের এ সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা এ নিয়ে পরবর্তীকালে প্রশ্ন উঠেছিল। জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের প্রথম অভিষেক অনুষ্ঠানে আমি তিরস্কৃত হয়েছিলাম বিপ্লবী ছাত্রনেতা বলে। বলা হয়েছিল আমি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেছিলাম। আমি ভিন্ন অবস্থান নিলে সংখ্যালঘু ছাত্ররা অনেক কিছু পেত। আমার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জগন্নাথ হলের একটি বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ঐ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছিলেন হলের প্রভোস্ট ড. গোবিন্দ দেব। প্রধান অতিথি ছিলেন সামরিক শাসনের ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি হামিদুর রহমান। আমি তখন ঢাকা হলের ছাত্র। এই বিচারপতি হামিদুর রহমানের আমলেই আমাকে ২৪ ঘণ্টার নোটিসে ঢাকা হল ছাড়তে বলা হয়েছিল। আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছিল কলাভবনে। অজুহাত, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র সুতরাং আমাকে কার্জন হলের চৌহদ্দিতেই থাকতে হবে। এভাবে জগন্নাথ হলের ইতিহাসের প্রথম পর্ব শেষ হলো। পরবর্তীকালে ঢাকা হলে অমুসলমান ছাত্রদের জন্যে দিনগুলো ছিল নিদারুন দুঃখজনক। সে কাহিনী পরে বলছি।
ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগে নতুন সঙ্কট দেখা দিল পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সকল ধরনের সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে। প্রথম থেকে আওয়ামী লীগ বাগদাদ চুক্তি ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার চুক্তির (সিটো) বিরোধী। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতানৈক্য ছিল। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবার পূর্বে এ নিয়ে সংকট দেখা দেয়নি। সংকট দেখা দিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবার পর।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সুয়েজনীতি সকল মহলে তীব্রভাবে সমালোচিত হলো। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় এসে ১৯৫৬ সালের ৯ ডিসেম্বর সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে এক ভাষণ দিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই সামরিক চুক্তির সমর্থন করলেন। এ পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করলেন। কাউন্সিল পূর্ববর্তী ওয়ার্কিং কমিটির সভা বসল ৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারিতে। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করা গেল, এই কমিটির বৈঠকে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে একটি অভিনব প্রস্তাব গৃহীত হলো। প্রস্তাবে বলা হলো কাউন্সিলে সামরিক চুক্তি সম্পর্কে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে না। প্রস্তাবের পক্ষে ৩৫ ভোট এবং বিপক্ষে ১ ভোট পড়লো। এই ভোটটি দিয়েছিলেন অলি আহাদ, যিনি পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।
তবুও গণ্ডগোল দেখা দিল পরবর্তী সময়ে কাগমারীতে আফ্রো-এশিয়া সাংস্কৃতিক সম্মেলন নিয়ে। আফ্রো-এশিয়া সাংস্কৃতিক সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন মওলানা ভাসানী।
এই সম্মেলনে তিনি ভারত এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তখন কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে। আর তখনই কাগমারী সম্মেলনে এসেছিলেন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক হুমায়ুন কবির, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, সুফিয়া ওয়াদিয়া, পরোধ স্যানাল, রাধা রাণী দেবী প্রমুখ। কাগমারী সম্মেলন উপলক্ষে মহাত্মা গান্ধী, কায়েদে আযম, আব্রাহাম লিংকন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, তিতুমীর, হাকিম আজমল খান, লেনিন, শেক্সপিয়রসহ অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিদের নামে তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল।
এই তোরণ নির্মাণের ফলে মওলানা ভাসানীকে ভারতীয় এজেন্ট বলে আখ্যায়িত করা হয়। মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে দৈনিক ইত্তেফাক বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করে। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগে ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। তবে এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় ছিল যে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সামরিক চুক্তির বিরোধিতা করলেও ওয়ার্কিং কমিটিতে সে প্রস্তাব কোনোদিনও গৃহীত হতো না। মওলানা ভাসানী সামরিক চুক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন। কিন্তু বৈঠকে কোনো প্রস্তাব উত্থাপিত হতো না। অধিকাংশ সভায় তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে নিজের ভাষণের পর বৈঠক ত্যাগ করতেন। ফলে তার সমর্থকরা কোনোদিনই বৈঠকে এ ধরনের প্রস্তাব মানতেই সাহস পেতেন না। শেষ পর্যন্ত শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমান যে ধরনের প্রস্তাব চাইতেন সে ধরনের প্রস্তাবই গৃহীত হতো। এবারও কাগমারী সম্মেলনে তাই ঘটল। আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কোনো প্রস্তাব গৃহীত হলো না। কোন্দল চূড়ান্ত রূপ নিলো আফ্রো-এশিয়া সাংস্কৃতিক সম্মেলন নিয়ে। কাগমারী সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ১৬ মার্চ লিখিতভাবে পদত্যাগ করলেন।
আওয়ামী লীগ থেকে মওলানা ভাসানীর পদতাগপত্র দেবার পর শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ একশ্রেণির আওয়ামী লীগ নেতার ধারণা হলো যে এর পেছনে আওয়ামী লীগের একশ্রেণির অনুপ্রবেশকারী বামপন্থী নেতারা দায়ী। এঁদের অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আছে এবং এদের নেতৃত্ব করছেন সংগঠনের সম্পাদক অলি আহাদ। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসল ৩০ মার্চ। অলি আহাদের বিরুদ্ধে সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হলো। প্রথম বৈঠকে সভাপতিত্ব করলেন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান। এ অধিবেশনে অলি আহাদ পাল্টা অভিযোগ আনেন মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করার জন্যে। পরে বৈঠক মুলতুবি হয়ে যায়। বিকালের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মনসুর আহমেদ। তিনি নিজে প্রস্তাব উত্থাপন করে অলি আহাদকে বরখাস্ত করেন। এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আব্দুস সামাদ আজাদসহ ৯ জন সদস্য পদত্যাগ করেন। উপস্থিত ৩০ জন সদস্যের মধ্যে ১৪ জন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন।
মওলানা ভাসানী তখন ফতুল্লা ঘাটে নৌকায় অবস্থান করছিলেন। অলি আহাদসহ বিক্ষুব্ধ সদস্যগণ মওলানা সাহেবের কাছে গিয়ে ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডেকে সমস্যা মোকাবেলার আহ্বান জানান। মওলানা সাহেব তাতে রাজি হলেন না। তিনি ৩১ মার্চ রোববার নারায়ণগঞ্জে জনসভা করার নির্দেশ দেন। ১৮ ও ১৯ মে বগুড়ায় কৃষক সম্মেলন আহ্বান করেন। খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১ জুন থেকে ৭ জুন পর্যন্ত আত্মশুদ্ধির জন্যে অনশন পালনের সিদ্ধান্ত নেন। মওলানা ভাসানী ১ জুন অনশন শুরু করলে ৩ জুন আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসে। এবার তিন বছরের জন্যে অলি আহাদকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। পদত্যাগী ৯৯ জন সদস্যের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে নতুন ৯ জন কো-অপট করা হয়।
মওলানা সাহেব জানান, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আলোচনা হলেই তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের প্রশ্ন উঠতে পারে-এই পটভূমিতে ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকার পিকচার প্যালেসে (পাকিস্তান সিনেমা হল) আওয়ামী লীগের কাউন্সিল আহ্বান করা হয়। কাউন্সিলের আলোচ্য বিষয় অলি আহাদকে বহিষ্কার, সামরিক চুক্তি, পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, খাদ্যশস্য মূল্যবৃদ্ধি তথা মওলানা ভাসানীর অনশন।
এবারও সেই এক ঘটনা ঘটল। মওলানা সাহেব অধিবেশনের প্রথমে নিজস্ব বক্তব্য দিয়ে হল ত্যাগ করেন। সম্মেলনে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতিসহ সবকিছু গৃহীত হয়। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের সদস্যরা মওলানা ভাসানীর সমর্থকদের ওপরে হামলা চালায়। মারামারির পর বরিশাল ছাত্রলীগের কতিপয় সদস্য ঢাকা হলে আমার কক্ষে আসে এবং বীরবিক্রমে তাদের ভূমিকা বর্ণনা করতে থাকে। আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, এবার আওয়ামী লীগ দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ১৪ জুন বিকালে পল্টন ময়দানে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তান শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে।
এরপর আমাদের পক্ষে ছাত্রলীগে থাকা আদৌ সম্ভব হলো না। আমি এনায়েত উল্লাহ খান, আহমেদ হুমায়ুন, নূরুল হক চৌধুরী (মেহেদী), আব্দুল হালিম, আনিসুর রহমান, জহিরুল ইসলামসহ ছ’টি জেলার ৬৮ জন নেতা ও কর্মী ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করি। ফরিদপুর এবং ময়মনসিংহ শাখা ছাত্রলীগ অবলুপ্ত হয়ে যায়।
এরপরে মওলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগে থাকা আর সম্ভব ছিল না। তিনি ১৩ ও ১৬ জুন দু’দিনব্যাপী ঢাকায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের এক বৈঠক ডাকেন। এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ২৫ ও ২৬ জুলাই ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ মওলানা ভাসানী এবার পাকিস্তানভিত্তিক নতুন দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেবেন। মওলানা ভাসানীর সিদ্ধান্ত সেদিন আমাকে কৌতূহলী করেছিল, বিস্মিত করেনি।
আমি লক্ষ্য করছিলাম, দেশে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হতে যাচ্ছে। এ দলের প্রধান বক্তব্য হবে–সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অর্থাৎ পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ভাগ হচ্ছে। এমন ঘটনা পৃথিবীতে কমই ঘটেছে। এ কথা সত্য, সেকালের আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগ ভাঙনের বিরুদ্ধে ছিল–কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তাদের অনুসৃত নীতি এই ভাঙনের অন্যতম কারণ ছিল।
পৃথিবীর দেশে দেশে রুশপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো এ নীতি অনুসরণ করেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চরম বৈরী সম্পর্ক ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে। পাশ্চাত্য শিবিরের উভয় পক্ষই তখন নিজের প্রভাব বলয় বিস্তারে ব্যস্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র বিশ্বে তার প্রভাব বিস্তারের জন্যে আগ্রাসী অভিযান শুরু করেছিল। বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি শ্লোগান দিচ্ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন ছিল কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর প্রধান কর্মসূচি। এই ঢাকার বুকে দেখা গেছে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব, ফস্টার যালেস ঢাকা সফরে এলে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছিল।
স্বাধীন নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি নিঃসন্দেহে সমর্থনযোগ্য। কিন্তু শুধুমাত্র পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে একটি দল ভাঙা বা নতুন দল গড়া অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নকে অন্ধভাবে অনুসরণের ফল। কারণ একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি সে দেশের অভ্যন্তরের অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতেই নির্ধারিত হয়। শুধুমাত্র পররাষ্ট্রনীতি কোনো দেশের বা সরকারের প্রগতিশীলতার মাপকাঠি নয়। সেকালে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি তার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির প্রেক্ষিতেই নির্ধারিত হয়েছিল। জন্মলগ্নেই ভারত কিছুটা শিল্পোন্নত ছিল। ভারতে প্রভাবশালী পুঁজিপতি ছিল। মার্কিন বা সোভিয়েত শিবিরে না গিয়ে মাঝখানে থেকে দরকষাকষি করাই ছিল তার পক্ষে লাভজনক। এই দরকষাকষির শক্তি পাকিস্তানের ছিল না। আবার পররাষ্ট্রনীতি জোটনিরপেক্ষ হলেই যে প্রগতিশীল হয় না, তার প্রমাণ মিসর। বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মিসর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে সমর্থন করেছে। আবার চরম নির্যাতন করেছে নিজের দেশের কমিউনিস্টদের। ভারত জোটনিরপেক্ষ হলেও চীনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ডেকে এনেছে। সুতরাং জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করলেই কোনো সরকার বা দল প্রগতিশীল হবে এ কথা বলার অবকাশ নেই। তাই শুধু জোটনিরপেক্ষ নীতির ওপর ভিত্তি করে কোনো রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা একান্তই অবৈজ্ঞানিক। কারণ প্রতিটি দল একটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। সেই শ্রেণির স্বার্থ ভিত্তি করেই দলের নীতি নির্ধারিত হয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি অর্থাৎ ন্যাপ নামে যে সংগঠনটি মওলানা ভাসানী যাদের নিয়ে গঠন করলেন তাদের শ্রেণি চরিত্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের শ্রেণি চরিত্রের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। ন্যাপে এসেছিলেন পাঞ্জাবের জননেতা মিঞা ইফতেখার উদ্দিন আহমদ, সিন্ধুর জিএম সৈয়দ, বেলুচিস্তানের আব্দুস সামাদ, সীমান্ত গান্ধী আবদুল গাফফার খান। শ্রেণি চরিত্রের দিক থেকে এদের মধ্যে অধিকাংশই সামন্তবাদী ধ্যানধারণারই মানুষ। ব্যক্তিগত জীবনেও এঁরা একান্তভাবেই জমিদার শ্রেণির অর্থাৎ মওলানা ভাসানী যে দলটি গড়েছিলেন সে দলটি আদৌ শ্রেণি চরিত্রের বিষয়ে আওয়ামী লীগ থেকে পৃথক ছিল না। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে আওয়ামী লীগের এই বিভাজন ছিল অবৈজ্ঞানিক ও অনভিপ্রেত এবং রুশপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক নীতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। আমার ধারণা মস্কোর নেতারা তখনো এ ব্যাপারে তত সতর্ক ছিলেন না। ১৯৫৩ সালে স্টালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতে অনেক পরিবর্তন হচ্ছিল। সেই পরিবর্তনের হাওয়া পূর্ব পাকিস্তান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। পৌঁছালে হয়তো বা সেদিন আওয়ামী লীগ শ্রেণিচরিত্রের প্রশ্ন বিবেচনা না করে শুধুমাত্র পররাষ্ট্রনীতিকে কেন্দ্র করে নতুন দল গঠন করত না। এটি যে সঠিক ছিল না তা প্রমাণিত হয়েছে পরবর্তীকালে। যতদিন সোভিয়েত পররাষ্ট্রনীতির প্রয়োজন ছিল ততদিন পর্যন্ত ন্যাপ সজীব এবং সচল ছিল। পরবর্তীকালে অধিকাংশ ন্যাপ নেতা আওয়ামী লীগে ফিরে গিয়েছিলেন এবং এক সময় এই ন্যাপ নেতারা কাগজপত্রে এবং দলিলে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বাকশাল গঠন করেছিলেন। অথচ এঁরাই ১৯৫৭ সালে শেখ সাহেবকে সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলে আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাপ গঠন করেন। আমার ধারণা, সেকালে আওয়ামী লীগে ভাঙন এবং ন্যাপ গঠনের জন্যে দায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির অন্ধ অনুসরণ এবং এ কাজটি করেছেন কমিউনিস্ট পার্টির বন্ধুরা।
তবে ১৯৫৭ সালের ২৫-২৬ জুলাইয়ের একটি ভিন্ন কাহিনীও আছে। সেদিন ন্যাপের সম্মেলন এবং জনসভায় আওয়ামী লীগের গুণ্ডামি ছিল অবিস্মরণীয়। সেদিন পল্টন ময়দানে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্মানিত নেতাদের ওপর গুণ্ডারা হামলা করেছিল। পণ্ড করতে চেয়েছিল রূপমহল হলে তাদের সম্মেলন। আওয়ামী লীগের সে আচরণ ছিল অশোভন, বর্বর এবং ধৃষ্টতাপূর্ণ আর দৈনিক ইত্তেফাক সেদিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে Nehru Aided Party বলে অভিহিত করেছিল।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনের আগে মওলানা ভাসানী আমাকে ডেকেছিলেন। বললেন, আমি নতুন দল গঠন করছি। আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিচ্ছি। তোমরা ছাত্রলীগ ছেড়ে দিয়েছ–আমার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান যাবে। দেখা যাক সারা পাকিস্তানব্যাপী কোনো সংগঠন গড়ে তোলা যায় কি না।
মওলানা সাহেবের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ব্যারিস্টার শওকত আলীদের সদরঘাটের বাসায়। মওলানা সাহেব খুব আন্তরিক হলেও বোঝাতে পারলাম না যে এটা হবার নয়। কমিউনিস্ট পার্টি কিছুতেই আমাকে এ ধরনের কোনো সুবিধা দেবে না। কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য অনুযায়ী আমি ট্রটস্কিপন্থী। তারাই একমাত্র সাচ্চা কমিউনিস্ট। অন্যান্য সকলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল। আর দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে শতকরা প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ জন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যই ট্রটস্কির কোনো মূল গ্রন্থ পড়েনি। দলীয় প্রচার পুস্তিকা পড়ে এবং নেতাদের কাছে শুনে ট্রটস্কির মুণ্ডপাত করছে। আমি আদৌ ট্রটস্কিপন্থী নই। আমাদের দল সেকালের আরএসপি (বর্তমানে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল) লেনিনপন্থা অনুসারী ট্রটস্কি বা স্টালিনকে সঠিক বলে মনে করে না। তবে রুশ বিপ্লবের নেতা হিসেবে সকলকেই সম্মান দেয়।
এছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমাদের সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল, ভিন্ন। কোনো দলে অনুপ্রবেশের নীতি নিয়ে। ব্রিটিশ ভারতেও কমিউনিস্ট পার্টি মনে করতো অন্য দলে নিজেদের সদস্যদের ঢুকিয়ে তাদের নীতি পরিবর্তন করা যায় বা সীমিত ক্ষেত্রে হলেও ভিন্ন দলের নীতি নিয়ন্ত্রিত করা যায়। এই বিশ্বাস থেকেই তারা ব্রিটিশ ভারতে নিজেদের সদস্যদের মুসলিম লীগে ঢুকিয়েছে মুসলিম লীগের নেতৃত্ব দান বা নীতি নিয়ন্ত্রণের আশায়। শেষ পর্যন্ত কোনোটাই হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির সেই সদস্যই হারিয়ে গেছে। একই বিশ্বাস থেকে এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপে ঢুকেছে। ন্যাপের নেতৃত্ব করেছে। শেষ পর্যন্ত আর কমিউনিস্ট পার্টিতে ফিরে আসেনি। যদিও এ ধরনের নীতি গ্রহণের ব্যাপারে আর একটি বিবেচনাও কাজ করেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকা এবং নিষিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কায় কমিউনিস্ট পার্টি এ নীতি গ্রহণ করেছিল।
আমাদের এ ব্যাপারে একেবারে বিপরীত নীতি ছিল। আমাদের দল কোনো দিন ভিন্ন দলের ছায়ায় কাজ করেনি। ভিন্ন ফ্রন্টে ভিন্ন দলের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করলেও দলের প্রশ্নে কোনো ভেজাল নীতি ছিল না। তাই কাগমারী সম্মেলনে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও দল হিসেবে আমরা যাইনি। আমাদের প্রবীণ নেতা প্রখ্যাত অতীন্দ্রমোহন রায় কাগমারী সম্মেলনে গিয়েছিলেন। তখনো মওলানা ভাসানী তাকে একসঙ্গে রাজনীতি করার কথা বলেছিলেন। অতীনদা বলেছিলেন, অন্য দলে ঢুকে নিজের দলের আদর্শ বাস্তবায়ন করা যায় না। সুতরাং রাজনীতি ও কৌশলের দিক থেকে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমাদের মৌলিক পার্থক্য ছিল।
জানতাম যে ন্যাপ গঠনের পর নতুন কোনো ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠিত হোক এটা কমিউনিস্ট পার্টি চাইবে না এবং সে সংগঠনে আমার যাওয়াই সম্ভব হবে না। বাস্তবে তাই হয়েছিল। মওলানা ভাসানীর প্রচেষ্টা সফল হয়নি। আমারও পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
তবে ন্যাপ গঠনের পর বিপদ এল অন্যদিকে থেকে। পূর্ব পাকিস্তানে তখন আতাউর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী কংগ্রেস কোয়ালিশন সরকার। বিরোধী দলে আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক পার্টি এবং নেজামে ইসলাম। এ পরস্থিতিতে ন্যাপ যে দিকে ভোট দেবে সে সরকারই একমাত্র টিকে থাকবে। কারণ আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত অনেক পরিষদ সদস্যই তখন ন্যাপে যোগদান করেছে। অপরদিকে কেন্দ্রে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্ব তখন টালমাটাল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাশ্চাত্য ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে তখন পাশ্চাত্য জগতে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলেন। কথা হচ্ছে ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনে ভয় ছিল পাকিস্তানের সামরিক বেসামরিক আমলাদের। ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচন তাদের আরো শঙ্কিত করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে মুসলিম লীগ উচ্ছেদ হয়ে গেছে।
আমলাদের ভয় হচ্ছে সাধারণ নির্বাচন হলে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। আমলাদের হাতের পাঁচ মুসলিম লীগ এবং ইস্কান্দার মীর্জার হাতে গড়া রিপাবলিকান পার্টি নির্বাচনে লাপাত্তা হয়ে যেতে পারে। তাই মীর্জার নেতৃত্বে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হলো শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে। ৮০ সদস্যের সংসদে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন ১২ সদস্যের নেতা। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন রিপাবলিকান পার্টির সমর্থনে। ইস্কান্দার মীর্জার ইঙ্গিতে একদিন সুপ্রভাতে রিপাবলিকান পার্টি শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করল। অধিকাংশ সদস্যের সমর্থন নেই এই অজুহাতে প্রেসিডেন্ট মির্জা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পদত্যাগের অনুরোধ জানালেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজি হলেন না। তিনি মির্জাকে জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকার পরামর্শ দিলেন। প্রেসিডেন্ট মির্জা রাজি হলেন না। পদচ্যুত হবার অপমানজনক পরিস্থিতি এড়াবার জন্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করলেন।
পূর্ব পাকিস্তানে তখন আওয়ামী লীগের মধ্যেই চরম কোন্দল। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। অবশেষে শেখ সাহেবকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়। তাঁকে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয় এবং বিদেশে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁকে সফর করতে দিতে অসম্মতি প্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে রওনা হন। কিন্তু ইতোমধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। শেখ সাহেবকেও ফিরে আসতে হয়।
এসময় আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারে তুমুল কোন্দল দেখা দেয়। এই সুযোগ গ্রহণ করে কৃষক শ্রমিক পার্টি। বিভক্ত কৃষক শ্রমিক পার্টি আবু হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান বুঝতে পারেন, যে কোনো সময় তাঁর মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হতে পারে। তিনি গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন মুলতুবি করার আহ্বান জানান। তাঁর কথা না শুনে ৩০ মার্চ গভর্নর তাঁকে পদচ্যুত করেন। নতুন মুখ্যমন্ত্রী হন আবু হোসেন সরকার। আবু হোসেন সরকারের অনুরোধে ঐদিনই পরিষদের অধিবেশন মুলতুবি হয়। কেন্দ্রে তখন প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নুন। তাঁর সঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে ফিরোজ খান নুন গভর্নর ফজলুল হককে ৩১ মার্চ অপসারণ করেন। ১ এপ্রিল আতাউর রহমান আবারও মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে চরম অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।
১৮ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। পরিষদে ন্যাপের সদস্য সংখ্যা ৩৩। ন্যাপ ভোটাভুটিতে নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবার ফলে আতাউর রহমান সরকারের পতন ঘটে ১৯ জুন। নতুন মুখ্যমন্ত্রী হন আবু হোসেন সরকার। ২২ জুন আবু হোসেন সরকার অনাস্থা ভোটে পরাজিত হন। ২৫ জুন পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট শাসন প্রবর্তিত হয়। এই রাজনৈতিক উত্থান-পতনের জন্যে মূলত দায়ী ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। তারা কখনো আওয়ামী লীগ আবার কখনো কৃষক শ্রমিক পার্টিতে ভোট দিয়ে এক অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাবার জন্যেই শেষ পর্যন্ত একটির পর একটি মন্ত্রিসভার পতন ঘটে।
পূর্ব পাকিস্তানে এই প্রেসিডেন্ট শাসনও দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। শহীদ সোহরাওয়াদী পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে সমঝোতা করতে থাকেন। তাঁর প্রধান দাবি ছিল ১৯৫৯ সালে সাধারণ নির্বাচন দিতে হবে। এই শর্তে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ফিরোজ খান নুনকে সমর্থন দিতে রাজি হন এবং এই ভিত্তিতেই ফিরোজ খান নুন পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট শাসন প্রত্যাহার করেন। ২২ জুলাই পুনরায় আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর প্রাদেশিক অধিবেশন বসে। তখন পরিষদের স্পিকার ছিলেন জনাব আবুল হাশিম। আবুল হাশিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। সরকার পক্ষ থেকে স্পিকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
নতুন স্পিকার নির্বাচিত হন ডেপুটি স্পিকার জনাব শাহেদ আলী। শাহেদ আলীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পরিষদে তুমুল হাঙ্গামা হয়। হাঙ্গামায় আহত হয়ে শাহেদ আলী ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এই পরিবেশে কেন্দ্রীয় সরকার আর একটি চাল দিলেন। এবার বলা হলো। আওয়ামী লীগকে কেন্দ্রীয় সরকারে অংশ নিতে হবে। সিদ্ধান্ত হলো আওয়ামী লীগের দু-একজন সদস্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগদান করবে। অনেকেই সম্মত হলো না। বলা হলো ১৯৫৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সারা পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন হবে। শেষ পর্যন্ত ২ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কতিপয় সদস্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। দফতর বণ্টনের ব্যাপারে অসভ্রষ্ট হওয়ায় ৭ অক্টোবর তাঁরা পদত্যাগ করেন। ওই দিনই ইস্কান্দার মীর্জা তাঁর বাসভবনে একটি পার্টির ব্যবস্থা করেন। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরাসহ সকলেই এই পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন। পার্টি শেষে সকলেই যে যার বাসায় ফিরে যান। আর ওই রাত্রিতেই প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা সারা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ এবং মন্ত্রিসভা বাতিল করেন। সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করেন। সংবিধান রহিত করেন। প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক শাসক নিয়োগ করেন। আমি তখন ঢাকা হলে। ঢাকা হলেও তখন এক অস্থির পরিস্থিতি।
ইতোমধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে আমার রাজনৈতিক জীবন ও ঢাকা হলের জীবনে। আমি, এনায়েতুল্লাহ খান, আহমেদ হুমায়ুন, আব্দুল হালিম, কাজী বারী প্রমুখ ছাত্রলীগ ছেড়ে দিলাম। আমি ব্যতীত অন্যান্য সকলে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। তাদেরকে কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্রলীগে কাজ করতে বলেছিল। কমিউনিস্ট পার্টির ধারণা ছিল তারা ছাত্রলীগে ঢুকে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করবে। এটা নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনেও ঘটেছিল। এককালে ছাত্র ফেডারেশনেও ঘটেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি ও জয়প্রকাশ নারায়ণের কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির দ্বন্দ্ব ছিল। আর অপ্রত্যাশিত হলেও সত্য যে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি অর্থাৎ সিএসপির ছাত্রফ্রন্টের নেতা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির অমিয় দাশগুপ্ত। তবে কমিউনিস্ট পার্টির এই অন্যের দল দখলের নীতি তেমন কাজে আসেনি। কমিউনিস্ট পার্টিকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হারিয়ে।
আমাদের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটি হলো না। মাত্র একটি জেলার ক্ষেত্রে আমাদের আশাভঙ্গ হলো। কুমিল্লার তাহেরুদ্দীন ঠাকুরকে আমরা কমিউনিস্ট পার্টি ঘেঁষা মনে করতাম। তিনি আমাদের সঙ্গেই চলতেন। কিন্তু দেখা গেল যে ছাত্রলীগ ছাড়বার সময় আমাদের সঙ্গে এলেন না। যদিও পরবর্তীকালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেলে ঢাকা হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। এনায়েতুল্লাহ খান হয়েছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। এ সংসদের অন্যতম সদস্য ছিলেন শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সিদ্দিকুর রহমান, ওয়ার্কার্স পার্টির হায়দার আকবর খান রননা, প্রয়াত নাট্যজন আবদুল্লাহ আল মামুন।
এনায়েতউল্লাহ খান, আহমেদ হুমায়ুন, আব্দুল হালিম, আজিজুর রহমান, জহিরুল ইসলাম এবং কাজী বারীর সিদ্ধান্ত ছিল ছাত্র ইউনিয়নে যাবার। তবে তাদের সকলেরই ইচ্ছা ছিল আমরা সকলে যেন এক সঙ্গেই ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিই। আমার দলেরও সিদ্ধান্ত ছিল ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেবার। তাই ঠিক হলো ছাত্র ইউনিয়নেই যোগ দিতে হবে।
কিন্তু কীভাবে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেয়া যাবে? ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে তখন ভিন্নভাবে দেখা হলো। ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা মুকুল সেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি তাঁদের কয়েকজন সদস্য নিয়ে আমার কাছে একদিন ঢাকা হলে এলেন–আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে ছাত্র ইউনিয়নে যোগদানে আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁর কথা হলো, আপনি ছাত্রলীগের একজন নেতা ছিলেন। আর পাঁচজনের মতো আপনি আমাদের সদস্যপদ গোপনে নেবেন তা হতে পারে না। আর আপনি যদি কোনো পদে যেতে চান তাও বলুন।
সে ছিল আমার পক্ষে এক বিড়ম্বনা। আমি ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ছিলাম। সভাপতি আব্দুল মোমিন তালুকদার এবং সম্পাদক এম এ আওয়ালের সঙ্গে আমার এমন সমঝোতা ছিল যে, এককভাবে আমি কোনো কিছু করলে তাঁরা কিছু বলতেন না। প্রকৃতপক্ষে ছাত্রলীগের সকল খবরই আমার কাছে থাকত। তাই ছাত্র ইউনিয়নে কোন পদে যাবো এ নিয়ে আমার কোনোদিন চিন্তা-ভাবনা ছিল না। এটাও জানা ছিল, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত ছাত্র ইউনিয়নে আমার অবাধ বিচরণ সম্ভব হবে না। কারণ এ ধরনের রাজনৈতিক উদারতা ঐ দলটির কোনোদিন পরিলক্ষিত হয়নি প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রশ্নে। এছাড়া সেখানে বামপন্থী রাজনীতিতে আমাদের দল আরএসপির তেমন কোনো প্রভাব না থাকলেও কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা জানতেন আরএসপির একটি বিকল্প বক্তব্য আছে মার্কসবাদ-লেলিনবাদ সম্পর্কে। স্টালিনকে তারা সঠিক বলে মনে করে না এবং এও মনে করে যে ক্রুশ্চেভের সহাবস্থানের নীতি স্টালিনের আমলেই শুরু হয়েছিল।
সুতরাং মুকুল সেনের সকল সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমাকে ছাত্র ইউনিয়নে নেয়া সহজ হলো না। ব্যাপারটা খুবই বিস্ময়কর নয় কি? একজন ছাত্র, একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে অন্য একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবে, তাকে নিতে হলে প্রতিষ্ঠানের কাউন্সিল ডাকতে হবে।
আমার ক্ষেত্রে তাই-ই হয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ কাউন্সিল ডাকায় অধিবেশন বসলো বার লাইব্রেরি হলে। আমাকে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যপদ দেয়া নিয়ে একমাত্র বরিশাল জেলা থেকে আপত্তি এল। অবস্থান এমন দাঁড়ালো, তারা নোট অব ডিসেন্ট দেবে। কাউন্সিলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নের লেখা। আমার লেখা চিঠি পেশ করা হলো।
বলা হলো নির্মল সেনের জন্যে ঐক্য হয়নি। তাই তাকে ছাত্র ইউনিয়নে নেয়া যাবে না। সম্মেলনের সভাপতি ড, আলমগীর বললেন, এ চিঠি ছাত্রলীগ সম্পাদক এম এ আউয়ালের পক্ষ নিতে নির্মল সেন লিখেছেন, তাই এ আপত্তি গ্রাহ্য নয়।
এ সময় আমার খুব খারাপ লাগছিল। বললাম, আমি কিছু বলব। বাধা দিলেন আজিজুর রহমান খান। তখন তিনি ফজলুল হক হলের ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট, পরবর্তীকালে অর্থনীতিবিদ এ আর খান নামে পরিচিত। আজিজ আমাদের সঙ্গেই ছাত্রলীগ ছেড়েছিলেন। আজিজ বললেন, আমরা বিবৃতি দেব। আপনি আমাদের সঙ্গে এসেছেন। আমরাই আপনাকে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য পদ দেব।
ইতোমধ্যে আমাকে নিয়ে বক্তৃতা শুরু হয়েছে কাউন্সিলে। এ সময় কক্ষে ভাষণ দিলেন বগুড়ার সাদেক আলী আহমদ ও দুর্গাদাস মুখার্জী। পুরো এক ঘন্টা বক্তৃতা দিলেন আজিজুর রহমান খান। আমার মনে হয়েছিল লেডি ম্যাকবেথের মৃত্যুর পর ম্যাকবেথের বলা কথা শুনছি। আজিজের বক্তৃতার পর কাউন্সিলে ভোট হলো। আমার বিরুদ্ধে দুটি ভোট পড়ল। এ দুটি ভোটই বরিশালের।
কাউন্সিলে আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচন করা হলো। পরবর্তী দিন কমিটি নির্বাচিত হবে। তখন ছাত্র ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রে এমন বিধি ছিল। কাউন্সিলে পুরো কমিটি নয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হবে। এ সদস্যরাই পরবর্তীকালে সভাপতি, সম্পাদক নির্বাচন করবে।
পরদিন এই সভাপতি সম্পাদক নির্বাচন নিয়ে দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। যারা আমার ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যপদ দেয়া ঠেকাতে পারেনি তারা। সারা রাত তৎপর ছিল। মুখে মুখে রটে গিয়েছিল আমাকে নাকি সহসভাপতি করা হবে। খুলনার গাজী শহীদুল্লাহ এবং গাজী লুৎফর রহমান বলল, আমাদের পক্ষে আপনাকে আর সমর্থন করা সম্ভব হবে না। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ভিন্ন নির্দেশ এসেছে। কিন্তু জহিরুল ইসলামসহ অনেকে কমিউনিস্ট পার্টির লোক হলেও এ নির্দেশ মানতে রাজি ছিল না। জহির ছিল ঢাকা হলে আমার রুমমেট এবং আমার সঙ্গে ছাত্রলীগ ছেড়েছিল। এ ধরনের আমার অনেক সমর্থক ছিল যারা প্রকৃতপক্ষে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রফ্রন্টের লোক ছিল।
এ পরিস্থিতিতে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের বৈঠক বসল। যতদূর মনে আছে ড, আলমগীরই সভাপতি হলেন। সাধারণ সম্পাদক হলেন সাইফুদ্দিন আহমদ, দপ্তরবিহীন সম্পাদক হলেন আহমেদ হুমায়ূন। প্রশ্ন দেখা দিল আমার নাম সহসভাপতি হিসেবে উত্থাপিত হওয়ায়। প্রস্তাব উত্থাপন করলেন জহিরুল ইসলাম। উপর থেকে ভিন্ন প্রস্তাব এল। কিন্তু কোনো পক্ষই ভোটে যেতে রাজি নন। এক সময় জহির ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে পদত্যাগের কথা বললেন। আমি এ পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। এতদিন বাইরে থেকে ছাত্র ইউনিয়নের কথা শুনে একটি ধারণা জন্মেছিল এ সংগঠনটি ঐক্য চায় না। আমার ঘটনাতেই তা প্রমাণিত। প্রকৃত পরিস্থিতি তেমন নয়। তাই বৈঠকে আমি এক সময় বললাম আমি প্রার্থী হচ্ছি না। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবেই আমি কাজ করব। গণ্ডগোল মিটে গেল। এবারের জন্যে যবনিকাপাত হলো। পরবর্তীকালে খবর হচ্ছে আমি ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসেবেই জেলে গিয়েছিলাম। জেল থেকে এসে দেখি ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন হচ্ছে। কিন্তু সে সম্মেলনে আমাকে ডাকা হলো না। সে ঘটনা আরো পরে।
এদিকে ঢাকা হলে এখন ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইছেন না অমুসলমান ছাত্ররা ঢাকা হলে থাক। তাই প্রতিদিন গণ্ডগোল সৃষ্টি করা হতো ঢাকা হলে। ঢাকা হল কসমোপলিটন হল হলেও মুসলমান ও অমুসলমান ছাত্রদের জন্যে পৃথক রান্নার ব্যবস্থা ছিল। হলের কিছু কর্মকর্তার প্ররোচনায় কতিপয় মুসলিম ছাত্র প্রায় দিনই অমুসলমান ছাত্রদের খাবার খেয়ে ফেলত, হামলা চালাতো এদের রান্নাঘরে। এ ছাত্ররা ছিল মুখ্যত ন্যাশনাল ছাত্র ফেডারেশন এনএসএফ-এর অনুসারী। এ পরিস্থিতিতে অমুসলমান ছাত্ররা জগন্নাথ হলে যাওয়া শুরু করল।
নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো সরস্বতী পূজা নিয়ে। কসমোপলিটন হলে হিন্দু ছাত্ররা সরস্বতী পূজা করতে চায়নি। আমি বললাম, এটা সঠিক নয়। আপনারা সরস্বতী পূজা করলে মুসলিম ছাত্ররা যদি গরু কোরবানি দেয় এ হলে থাকবেন আপনারা। ওদের গরু কোরবানিও আপনাদের পূজার মতো। আমি তাদের, বোঝাতে পারলাম না। সাড়ম্বরে সরস্বতী পূজা হলো ঢাকা হলে এবং পরবর্তীকালে মুসলমান ছাত্ররা ঈদুল আজহায় গরু কোরবানি দিল। কী এক করুণ অবস্থা। হলের একশ্রেণির কর্মকর্তা এ কাজে ইন্ধন যোগালেন। যিনি প্রত্যক্ষ সব কিছু করলেন তিনি হলের অন্যতম হাউস টিউটর মীর ফখরুজ্জামান। মিষ্টভাষী এবং সদালাপী এই মানুষটি যে কি করতে পারেন তা সেদিন হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম। আবার দৃঢ়তাও খুঁজে পেয়েছিলাম অন্যান্য কর্মকর্তার মধ্যে।
ঢাকা হলে (আজকের শহীদুল্লাহ হল) আমার কক্ষ নম্বর তখন ১০৬। এ কক্ষে আমি, জহিরুল ইসলাম (এককালের সরকারি কর্মকর্তা এখন অনিয়মিত কলাম লেখক) ও আহমদ হোসেন (যুগ্ম সচিব হিসেবে অবসর নিয়েছেন)। আমাদের সঙ্গে ছিলেন হিমাংশুরঞ্জন দত্ত (অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব)। হিমাংশু দত্ত চলে গেছেন জগন্নাথ হলে। আমাদের কক্ষে এসেছেন প্রয়াত শান্তিরঞ্জন কর্মকার (বাংলাদেশ ব্যাংকের এককালীন কর্মকর্তা)।
সেদিন ঈদুল আজহা। আমাদের মন ভালো না। হলে গরু জবাই হয়েছে। না খেয়ে অমুসলমান ছাত্ররা হল ছেড়ে চলে গেছে। ক্ষুব্ধ জহিরুল চলে গেছে বাইরে। আহমেদ হোসেন বললেন, আমাদেরও হলে খেয়ে কাজ নেই। চলুন হোটেলে খেয়ে আসি। স্টেডিয়ামের সামনে মোটামুটি অভিজাত হোটেল লা সানি। আমরা দু’জন সেখানে খেয়ে হলে ফিরে এলাম।
হলে ফিরে দেখি আমার টেবিলে পরিপাটি করে খাবার সাজানো। এমনিতেই আমি ডাইনিং হলে খেতাম না। আমার হলে ফেরার সময়ের ঠিক ছিল না। তাই আমার খাবার টেবিলেই ঢাকা থাকল। তবে এমনটি করে পরিপাটি করে সাজানো নয়। ঢাকনি খুলে খাবার দেখারও প্রবৃত্তি হলো না। সারাটা দিন হলে শুয়ে থাকলাম। রাত বারোটার দিকে আমাকে জানানো হলো হাউস টিউটর ফখরুজ্জামান সাহেব আমাকে ডেকেছেন। তিনি আমাকে সাধারণত গভীর রাতেই ডাকতেন। হাউস টিউটরের কোয়ার্টারে আমাকে যেতে হলো। ঢুকতেই প্রশ্ন করলেন, দুপুরে খেয়েছি কিনা। বললেন, তোমার খাবারও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কোনো অসুবিধা হয়নি তো। আমি বললাম, স্যার আমাকে খাইয়ে কী হবে? ঈদ তো আনন্দের। গরুর পরবর্তে খাসি জবাই করলে সবাই মিলে খাওয়া যেতো। আমার কোনো ব্যাপারে আপত্তি নেই। কিন্তু যাদের আপত্তি তারা তো কেউ হলে খেল না। আমাকে এখন গভীর রাতে ডেকে কোনো লাভ আছে কি?
মীর ফখরুজ্জামান সাহেব একটু সরে বসলেন। মনে হলো তিনি ভয় পেয়েছেন। জানতে চাচ্ছেন আমি কোনো গণ্ডগোল করবো কিনা। তাই হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, নির্মল তুমি কী করে চলো। শুনেছি তোমার কেউ নেই। শুধু রাজনীতি করো। আমি বললাম–স্যার, টিউশনি করি। ছাত্র পড়িয়েই চলে যায়। কারো অধীনে কোনো কিছু করা আমার ধাতে সয় না।
নির্মল তোমাকে আমি সাহায্য করতে পারি। ভালো টিউশনি দিতে পারি। তুমি নেবে? গভীর রাতে হাউস টিউটরের এ কথা শুনে মনে হলো কর্তৃপক্ষ এবার আমাকে কিনতে চাচ্ছে। আমি বললাম-স্যার, জেলে যেতে না হলে
আর নিয়মিত পড়ার সুযোগ পেলে আমিও হয়তো এতোদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতাম। আমাকে আপনার সাহায্য করতে হবে না। আমি নিজেই চলতে পারব। আমাকে যেতে দিন। বিদায় নিয়ে কাউকে কিছু না বলে শুয়ে পড়লাম।
কিন্তু হল কর্তৃপক্ষকে এড়ানো গেলো না। ভোরবেলা দেখি প্রভোস্ট এস এন কিউ জুলফিকার আলী সাহেব আমার কক্ষে হাজির। বললেন, কেমন আছেন? খুব স্নেহের কণ্ঠে বললেন, এমনি করে কি দিন চলবে? আপনি আজ দুপুরের দিকে আমার বাসায় যাবেন।
প্রভোস্টের বাসা ১০ ফুলার রোড। আজকে সেখানে সায়েন্স এনেক্স। এককালে নির্মিত হয়েছিল ব্রিটিশ ধাচে। পূর্ববঙ্গ আসাম প্রদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এ ভবনগুলো হস্তান্তরিত করা হয়। ভাবছিলাম প্রভোস্টের বাসায় যাব কিনা। কারণ এর মধ্যে আরো কিছু ঘটনা ঘটে গেছে।
একদিন সকালের দিকে আমাকে হাউস টিউটরের কক্ষে ডাকা হলো। কক্ষে ঢুকে দেখি চারজন হাউস টিউটরই বসে আছেন। এ চারজন হচ্ছেন ড. সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক মুনীম, মুকলেসুর রহমান এবং মীর ফখরুজ্জামান। ড. ইসলাম বললেন, তুমি কি জবাব দিতে পার তোমাকে হল থেকে বহিষ্কার করার হবে না কেন? তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে গতকাল রাত বারোটার পর তোমার কক্ষে গান হয়েছে। এটা হলের শৃঙ্খলা বিরোধী।
প্রশ্ন শুনে আমি কিছুটা অবাক হলাম। কারণ ওই গানের কথা আমি জানতাম না। পরে শুনেছি সত্য সত্যই আমার কক্ষে সে রাতে গান হয়েছিল। গান গেয়েছিলেন সুরেশ বাবু। বাড়ি নড়াইল কি মাগুরা। ইতিহাসের ছাত্র। তিনি স্বভাব গায়ক। শেষ বর্ষের পরীক্ষা হয়ে গেছে। হল ছেড়ে যাবেন। তাই মনে হয় সকলকে গান শুনিয়েছিলেন। সকলে তাঁকে ডাকত সুরেশদা। সুরেশদা আমার কক্ষে গান গেয়েছিলেন আমার অনুপস্থিতিতে। বুঝলাম আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ খুঁজে না পেয়ে এ অভিযোগ আনা হয়েছে।
আমি বললাম, রাত বারোটার পর কোনো কক্ষে গান গাওয়া অপরাধ তা আমি জানতাম না। আপনারা আমাদের কোনো নিয়ম জানাননি। আমরা ড, গোবিন্দ দেবের অধীনে ছিলাম। তিনি কোনোদিন এ সম্পর্কে কিছু জানাননি। আপনারা এ হলে নতুন। আপনারাও জানাননি। তাই আমার অপরাধ কোথায়? আমার কথা শুনে সকলে নীরব হলেন। শুধুমাত্র মুনীম সাহেব বিড়বিড় করে বলতে থাকরেন–হি ইজ টু মাচ ইনটেলিজেন্ট-ইউ ক্যান নট ক্যাচ হিম।
মীর ফখরুজ্জামান এবার মুখ খুললেন। তিনি বললেন, তুমি প্রতিদিন গভীর রাতে হলে আস। তুমি জানো না যে, রাত ন’টার পূর্বেই হলে আসতে হবে। এ অপরাধে তোমাকে বহিষ্কার করা যায়, তা কি তুমি জানো?
প্রকৃতপক্ষে আমি রাত এগারোটা, বারোটা, একটা, দু’টায়ও ফিরতাম। তবু আমি প্রশ্ন করলাম–স্যার, এর কি প্রমাণ আছে? কেউ কি সাক্ষ্য দেবে? বা আপনাদের গেটের বইয়ে এ ধরনের কোনো কিছু লেখা আছে কি?
এবারও হাউজ টিউটরেরা চুপ করে গেলেন। একই কথা বিড়বিড় করে বললেন মুনীম সাহেব। আমি চুপ করে বসে থাকলাম।
এবার মোক্ষম অস্ত্রটি ছাড়লেন ড. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বললেন, তুমি এখন হলের নিয়মিত ছাত্র নও। তুমি হলে আছ কী করে? আমি বললাম, স্যার যদি পাল্টা প্রশ্ন করি–আমি হলের ছাত্র না হলেও হলে আপনারা রাখছেন কী করে? আমার খাওয়ার টাকা নিচ্ছে কী করে? আমার নামে কক্ষ বরাদ্দ হয়েছে কী করে?
এবারও তারা চুপ করে গেলেন, মুনীম সাহেব এবার জোরে বললেন, ইউ ক্যান নট ক্যাচ হিম। ড. ইসলাম বললেন, তুমি যাও। তবে সকাল থেকে রাত ৯টার মধ্যে হলে ফিরবে এবং গেটে বইয়ে স্বাক্ষর করবে।
এখানে একটি ভিন্ন কাহিনী আছে। আমার রাজনৈতিক কারণে ১৯৫৭ সালে পরীক্ষা দেয়া হয়নি। পরীক্ষা দিতে হবে ১৯৫৮ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি চেয়ে আবেদন জানিয়েছি। সেই আবেদনপত্র কিছুতেই প্রভোস্ট অফিস রেজিস্ট্রি অফিসে পাঠাচ্ছে না। আর আমাকেও কিছু বলতে পারছে না। থাকতে দিতে হচ্ছে হলে।
আমি কক্ষে চলে গেলাম। পরদিন রাত ৯টায় ফিরলাম হলে। গেটে দারোয়ান প্রমোদ বলল বইয়ে স্বাক্ষর দিন। বইয়ে স্বাক্ষর দিলাম। সময়ের জায়গায় লিখলাম, রাত তিনটা। প্রমোদ বলল, একি করছেন? আমি বললাম, দেখো না কী হয়? পরপর সাতদিন এভাবে স্বাক্ষর করায় একদিন প্রমোদ বলল–স্যার বলেছেন, আপনাকে বইয়ে সই না দিতে।
পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিল হলের হিন্দু কর্মচারিরা কালীপূজা করায়। ঢাকা হল কসমোপলিটন হল। সকলেরই সকল ধর্ম পালনের অধিকার আছে। তাই হাউস টিউটর ড. সিরাজুল ইসলাম তাদের পূজার অনুমতি দিয়েছিলেন। ফলে তাকে শোকজ করা হয়। ড, ইসলামকে চলে যেতে হয় ঢাকা হল থেকে। যাবার আগে তিনি আমাকে ডাকলেন। বললেন, নির্মল, সতর্ক থেকো। তোমার সম্পর্কে একটি চিঠি আছে আমার কাছে। চিঠিটা লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে লেখা হয়েছে–আউট এ কেস এগেনস্ট হিম অ্যান্ড এক্সপেল হিম ফ্রম দি হল (তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আনো এবং তাকে হল থেকে বহিষ্কার করো)। হল থেকে বহিষ্কার করার অর্থ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার। ছাত্রজীবন শেষ।
এ পরিস্থিতিতে ঈদুল আজহা আসে। ঢাকা হলে গরু কোরবানি হয়। অমুসলমান ছাত্ররা হল ছেড়ে যায়। আমাকে সাহায্য করার প্রস্তাব দেন হল কর্তৃপক্ষ। প্রভোস্ট হলে এসে আমন্ত্রণ জানান তাঁর কোয়ার্টারে।
হাউস টিউটর ড. সিরাজুল ইসলাম হল থেকে চলে গেলেন। আমাকে বলে গেলেন সতর্ক থাকতে। যেহেতু তার কাছে চিঠি আছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
আমি তখন সকল দিক থেকে বিপর্যস্ত। প্রভোস্ট জুলফিকার আলী সাহেবের দুকন্যা, এক পুত্র পড়াবার দায়িত্ব নিয়েছি। অথচ তার সঙ্গে আমার বনিবনা হচ্ছে না। তিনি আমাকে হলে রাখছেন। কিন্তু ভর্তি হবার জন্যে আমার ফাইল পাঠাচ্ছেন না কোথাও।
রাজনীতির দিক থেকে তখন প্রায় একাকী। দলের অবস্থানটি আশানুরূপ নয়। কমিউনিস্ট পার্টিকে আগেই অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তারা কেউ ন্যাপে, কেউ আওয়ামী লীগে ঢুকে কাজ করছে। আমাদের দলের ব্যাপারে ভিন্ন মত। কোনো দলে ঢুকে নিজস্ব রাজনীতি করা যায় না। অন্যের রাজনীতিই করতে হয় অথচ প্রকাশ্যে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল (রিভল্যুশনারি সোসালিস্ট পার্টি অর্থাৎ আরএসপি) করার পরিবেশ তখন ছিল না। এ নিয়ে দলের মধ্যে মতানৈক্য আছে। নিতাই গাঙ্গুলির মতে, প্রকাশ্যে নামা উচিত। দলের অধিকাংশ সদস্যের ভিন্নমত। ১৯৫৩ সালে গঠিত দলের কেন্দ্রীয় কমিটি কাজ করছে না। এবিএম মুসা রাজনীতিতে নেই। রুহুল আমিন কায়সার অসুস্থ। মাত্র কিছুদিন আগে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বর্ষিয়ান নেতা অতীন্দ্রমোহন রায় কুমিল্লায় আছেন। এককালে ডাকসাইটে শ্রমিক নেতা নেপাল নাহা নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে কুমিল্লায় শিক্ষকতা করছেন। বরিশালের সুধীর সেন কখন জেলে যান আর কখন মুক্তি পান তার হিসাব রাখা কঠিন। জিয়াউল হক রইসউদ্দিন নোয়াখালিতে আছেন। রাজনীতির সঙ্গে তার তেমন সম্পর্ক নেই।
বেশ কিছুদিন আগে রুহুল আমিন কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করি যে তিনি অসুস্থ। আমার রুমমেট হিমাংশুরঞ্জন দত্ত। তাঁর বাবা হাজীগঞ্জের নরেন্দ্রনাথ দত্ত ডাক্তার ছিলেন। পরবর্তীকালে একাত্তর সনে তাঁকে খুন করা হয়। আমি যাচ্ছিলাম চাঁদপুরে ছাত্রলীগ সম্মেলনে। হিমাংশু বলেছিল আমাদের বাসা হাজীগঞ্জে, যাবেন? বলেছিলাম যাব। আমি বললাম, দেখুন আমি কথা দিলে কথা রাখি। আমি গেলে বিপদে পড়বেন না তো।
হিমাংশু আশা করেনি। তবুও হাজীগঞ্জে রেল স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল। সেখানে ট্রেনেই চাঁদপুর হয়ে মানুষ হাজীগঞ্জ যেত। হাজীগঞ্জ গিয়ে বিপদে পড়ে গেলাম। আমি কোনোদিন প্রকৃতপক্ষে কোনো সংসারে মানুষ হইনি। শৈশবে বাবা মারা গেছেন। বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পড়েছি। কলেজে পড়তে গিয়ে বাড়ি যাওয়া হয়নি। জেলে চলে গেছি। মা, ভাই-বোন কারো সঙ্গে তেমন কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাঁরা ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন। মার সঙ্গে শেষ দেখা ১৯৪৮ সালে। ১৯৫৭ সালে হিমাংশু বাবুর মায়ের সঙ্গে দেখা। তিনি প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী খেতে ভালোবাসো?
আমি বললাম, জানি না। কারণ এ প্রশ্ন আমাকে কোনোদিন কেউ জিজ্ঞাসা করেনি। খানিকটা অবাক হলেন তিনি। বললেন–তোমার মা কোথায়?
– পশ্চিমবঙ্গে।
– কতদিন দেখা হয় না?
– ন’বছর।
এবার তিনি রেগে গেলেন। বললেন, তুমি আমার বাড়ি থেকে চলে যাও। এ কেমন ছেলে তুমি, নিজের মায়ের সঙ্গে দেখা করো না?
আমি বিব্রত বোধ করলাম। বললাম, আপনি আমাকে পাসপোর্ট দেবেন? গত ৮ বছরের সাড়ে চার বছর জেলে ছিলাম। দু’বছর ছিলাম খুনের মামলার আসামী হয়ে আত্মগোপন করে। কার খবর রাখব, বলুন।
এবার তিনি যেন শান্ত হয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথায় যাবে? আমি বললাম, বিকালে আপনাদের মসজিদ প্রাঙ্গণে জনসভা আছে যুক্ত নির্বাচনের দাবিতে। আমি এবং মহিউদ্দিন আহমদ বক্তা। বক্তৃতার পর রাতেই রামগঞ্জ থানার পানিওলা যাব। সেখানে আমার বন্ধু রুহুল আমিন কায়সার প্রধান শিক্ষক একটি স্কুলের।
হিমাংশু বাবুর মা বললেন, তুমি এখন বারান্দায় শুয়ে থাকবে। বিকেলে জনসভায় যাবে। সন্ধ্যার আগে ফিরে আসবে। আমরা নৌকা করে দেব। ভোরবেলা পানিওয়ালা যাবে।
বিকালে জনসভা শেষ হতে সন্ধ্যা ছাড়িয়ে গেল। দেখলাম ছোট্ট একটি মেয়ে হারিকেন হাতে আমাকে খুঁজছে। মেয়েটির বয়স সাত-আট বছর হবে। হিমাংশু বাবুর ছোট বোন দীপু। আমার বিলম্ব দেখে তাঁর মা পাঠিয়েছেন আমাকে খুঁজতে।
সকালে নৌকায় হাজীগঞ্জ ছেড়ে গেলাম। হাজীগঞ্জ থেকে নৌকায় পানিওয়ালা। আজ মনে হয় কল্পনা করাও যায় না। বাঁধে বাঁধে এখন জমি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। কোথাও জল নেই নৌকা চলার মতো।
পানিওয়ালা পৌঁছে আমার আক্কেল গুড়ুম। শুনলাম প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন কায়সার ১২ দিন যাবৎ অসুস্থ। প্রবল জ্বর। আমাকে ঢাকায় খবর দেয়া হয়েছে। তাদের ধারণা, খবর পেয়েই আমি ওখানে গিয়েছি। তাই আমার পানিওয়ালা থাকা হলো না। পানিওয়ালা থেকে নৌকায় মেহের কালীবাড়ি (বর্তমানে মেহের) রেল স্টেশন। মেহের থেকে লাকসাম। লাকসাম থেকে রাতে ঢাকা পৌঁছে রুহুল আমিন সাহেবকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে।
এ পরিস্থিতিতে আমাকে ঢাকা হল নিয়ে অনশন করতে হয়েছে। দলের নির্দেশে ছাত্রলীগ ছেড়ে ছাত্র ইউনিয়নে আসতে হয়েছে। অপরদিকে সামরিক শাসন জারি হয়েছে। হাজার হাজার নেতা কর্মী গ্রেফতার হয়ে যাচ্ছে। আমিও বা কতদিন বাইরে থাকব তার নিশ্চয়তা নেই। বুঝতে পারলাম আমার ঢাকা হলে থাকাও সম্ভব হবে না।
ড. ইসলাম যাবার পর একদিন হাউস টিউটর আমাকে ডাকলেন। বললেন, তুমি ভর্তি হতে পারছ না। তাই তোমার হলের আসন বাতিল করা হলো। আমি বললাম, স্যার এটা কী করেছেন? আপনারা আমার ভর্তির আবেদনপত্র আদৌ রেজিস্ট্রার অফিসে পাঠালেন না। ফলে আমার ভর্তির কোনো সুরাহা হলো না। দেশে সামরিক আইন। আমি কোথায় যাব? হলের বাইরে গেলে গ্রেফতার হয়ে যাব। আপনারা নির্দেশ দিলেও আমি যাব না।
ড, জামান বললেন, তোমাকে যেতে হবে না। তুমি তোমার কক্ষে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে থাকবে। তুমি হলেই টাকা দিয়ে খাবে। তোমাকে ডিস্টার্ব করা হবে না। জানি না, প্রভোস্টের বাসায় শিক্ষকতা করতাম বলে এ সুবিধা দেয়া হলো কিনা। পরদিন আমি প্রভোস্টের কক্ষে ঢুকে বললাম, আমাকে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দিন। তিনি আমতা আমতা করলেন। কোনো জবাব দিলেন না।
আমি বুঝলাম আমার ঢাকা হলে থাকা হবে না। পরীক্ষার অনুমতি পাব। অবশেষে জেলে যেতে হবেই। জেলে গেলে বিজ্ঞান পড়া হবে না। তাই একদিন ঢাকেশ্বরী এলাকায় সিটি নাইট কলেজে গেলাম। অধ্যক্ষকে বললাম, আমি বিএ ক্লাসে ভর্তি হব। আমার বিষয় হবে অর্থনীতি ও দর্শন। এককালে রসায়নেও অনার্স-এর ছাত্র ছিলাম। তারপর ছাত্র হলাম পাস কোর্সে পদার্থ, রসায়ন এবং গণিত নিয়ে। এবার আর বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞান আমাকে জেলখানায় অনেক জ্বালা দিয়েছে। জেলের বাইরে নিয়মিত ক্লাস করতে পারিনি। পরীক্ষা দেয়া হয়নি। এবার বিএ ক্লাসের ছাত্র হলাম, হল কর্তৃপক্ষ জানলেন না। ২/১ জন বাদে কোনো বন্ধু জানল না। জানতে পারল না সরকারি গোয়েন্দা বিভাগ। তবে বিএ ক্লাসে ভর্তি হলেও সিটি নাইট কলেজে আমি কোনোদিন ক্লাস করিনি।
এ পরিস্থিতিতে এগিয়ে এল ১৯৫৯ সাল। সামরিক আইনের কবলে পাকিস্তান। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে ডাকসু–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন। আমার জন্যে আর এক পরীক্ষা। আর এক বিপদ।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়েছে। দেশে সংবিধান, পার্লামেন্ট বাতিল হয়েছে। সামরিক আইন জারি করে ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আইয়ুব খান এসেছেন। স্টেডিয়ামে হাজার হাজার মানুষ তাকে স্বাগত জানিয়েছে।
মাত্র ৪ বছর। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করেছিল। সে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নূরুঙ্গ আমিন, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খানের কাছে। সেদিন ঢাকায় হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল। মাত্র চার বছরে সব কিছু উল্টে গেল।
কিন্তু কেন? এর একটি স্বাভাবিক জবাব দেয়া যায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ভোট ছিল নেতিবাচক অর্থাৎ আমরা মুসলিম লীগকে চাই না। এ কথা সত্যি যে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবি ছিল। এ দাবিকে কেন্দ্র করে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে গিয়েছিল। সে দাবি বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রতিশ্রুতি যুজফ্রন্ট নেতারা দিয়েছিলেন। তবুও যুক্তফ্রন্টের নেতাদের আচরণ প্রথম থেকে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।
যুক্তফ্রন্টের প্রধান তিন নেতা ছিলেন–(১) শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, (২) মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও (৩) শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই তিন নেতার মধ্যে পার্থক্য ছিল একান্তই স্পষ্ট। নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে এঁরা একমত হতে পারেননি। এমনকি শেষ পর্যন্ত এক আসনে দুই প্রার্থীও থেমে গেছে। এছাড়াও যুফ্রন্টের শরিক দল ছিল নেজামে ইসলামী ও গণতন্ত্রী দল। রাজনীতির ব্যাখ্যায় একটি জগাখিচুড়ি। এ যুক্তফ্রন্ট প্রথম দিকে আওয়ামী মুসলিম লীগ বা কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি)-ও চায়নি। এ যুক্তফ্রন্টের উদ্যোক্তা ছিল পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। অর্থাৎ দেশের যুব ও ছাত্র সমাজ। বার বার নেতারা দ্বিমত পোষণ করেছেন। মনে হয়েছে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাচ্ছে। আর বারবার ছাত্ররা মিছিল করেছে। নেতাদের ঘেরাও করেছে। এদের কথা, ঐক্যবদ্ধ না হলে মুসলিম লীগকে হারানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত ভাঙা যুক্তফ্রন্ট একসঙ্গে নির্বাচন করেছে। কেএসপি বলেছে গণতন্ত্রী দল কমিউনিস্টদের। কমিউনিস্টদের ভারসাম্য বিধান করে নিতে হয়েছে ইসলামপন্থী মওলানা আতাহার আলীর দল নেজামে ইসলামকে। অর্থাৎ যুক্তফ্রন্ট ছিল একটি অপূর্ব রাজনৈতিক জোড়াতালি। এই যুক্তফ্রন্টের প্রশ্নে আমাদের দল আরএসপি একমত ছিল না। আমরা বলেছিলাম এ ঐক্য টিকবে না। শেষ পর্যন্ত হতাশা সৃষ্টি করবে এবং আরএসপি ওই নির্বাচনে প্রার্থী দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। মওলানা ভাসানী এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুরোধে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করা হয়। আমরা একমত না হলেও যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করেছি। সারাদেশে তখন যুক্তফ্রন্টের নামে জোয়ার আর এই নির্বাচনেই প্রথম নৌকা প্রতীক নির্বাচনের রাজনীতিতে আসে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা। নৌকা প্রতীক নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ২৩৭ আসনের মধ্যে ২২৭ আসনে জয়লাভ করল। সেদিন ঢাকায় ছিল মিছিল আর মিছিল।
কিন্তু সে যুক্তফ্রন্ট টিকল না। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের পরাজয় স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার এবং বেসামরিক ও সামরিক আমলারা। তাদের ধারণা পূর্ববাংলার সবকিছু হয়েছে কমিউনিস্টদের প্ররোচনায়। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ছিল তখন কমিউনিস্টবিরোধী জোটে। এ জোটের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাই পূর্ববাংলার নির্বাচনের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন–এ নির্বাচনের কোনো প্রভাব পাকিস্তানের রাজনীতিতে পড়বে না।
তাই তারা প্রথম থেকেই চেষ্টা করছিল যুক্তফ্রন্টকে ভাঙতে। আর এ সুযোগ দিয়েছিল যুক্তফ্রন্ট নেতারা। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলেও যুক্তফ্রন্ট একটি ঐক্যবদ্ধ মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারল না। প্রথমে কেএসপির তিনজন সদস্য নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। এপ্রিলে সকলকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের পরপরই কর্ণফুলি পেপার মিল ও আদমজী জুট মিলে বাঙালি-বিহারী দাঙ্গার অজুহাতে পূর্ববাংলার মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে প্রেসিডেন্ট শাসন জারি করা হলো। শেরেবাংলা ফজলুল হককে দেশদ্রোহী ঘোষণা করা হলো। তাঁকে নজরবন্দি করা হলো। শেখ মুজিবুর রহমানসহ হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হলো।
এ রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মাঝখানে ষড়যন্ত্রকারীরা জিতে গেল। যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেল। কখনো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা, আবার কখনো কেএসপির নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। নিজের দলকে তোয়াক্কা না করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভার আইনমন্ত্রী হলেন। পূর্ববাংলার স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে সংখ্যাসাম্য ও দুইউনিট মেনে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার চেষ্টা করলেন। অপরদিকে দেশদ্রোহী নজরবন্দি শেরেবাংলা একে ফজলুল হক–যারা তাঁকে নিগৃহীত করেছিল, সেই মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। পরে একসময় গভর্নর হলেন পূর্ববাংলার।
অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেলেন এই নেতারা। মানুষের তখন চরম ঘৃণা এই নেতাদের বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদে ডেপুটি স্পিকার নিহত হলেন। তারপর এলো সামরিক শাসন। সামরিক শাসক এলেন ত্রাতারূপে। তাই ১৯৫৮ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে জেনারেল আইয়ুবের সংবর্ধনা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। ছিল রাজনীতিকদের চরম পরাজয়ের স্বাক্ষর।
১৯৫৪ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। এরপর ছিল সাধারণ নির্বাচন। পড়াশুনা ব্যাহত হলো। আমরা ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুল হকের কাছে গেলাম। অনুরোধ জানালাম এবার যেন হঠাৎ করে কোনো কঠিন প্রশ্ন করা না হয়। আমরা চাই না ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থীরা গোলযোগ করুক। কারণ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এমন একটা কিছু ঘটতে পারে। তিনি রাজি হলেন। কথা দিলেন তিনি সতর্কতা অবলম্বন করবেন।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাজটি হলো উল্টো। ইংরেজিতে একটি রচনা এলো, রচনার নাম হলো-এ জব। ড. হক স্কাউটের কর্মসূচির অঙ্গ মনে করে তিনি এ কাজটি করেছেন। অথচ গ্রামবাংলার ছাত্র এমন কি অধিকাংশ শিক্ষকও এ ধরনের রচনার খবর রাখেন না। সুতরাং আবার ড. হক সাহেবের কাছে যেতে হলো। তিনি আশ্বাস দিলেন, উত্তরপত্র নিরীক্ষণের সময় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সে সময় পাক-মার্কিন সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। তাই আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রিত হয়ে আসত। আমরা প্রতিবাদ করলাম। আবার ড. হকের কাছে গেলাম। তিনি উচ্চকণ্ঠে হাসলেন। বললেন, বলেন কী এতে অসুবিধা কোথায়? তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রিত বইয়ের একটি কপি হাতে নিয়ে বললেন, দেখুন এ বই কত শক্ত। এ বই টানলেও ঘেঁড়ে না। আমরা বললাম, শক্ত বই নয়। পড়ার যোগ্য দেশে মুদ্রিত বই চাই। পরবর্তীকালে এ নিয়ে তুমুল আন্দোলন হওয়ায় বাধ্য হয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হয়।
এরপর বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে এলেন ড. কুদরত-ই খুদা। তিনি আবার বাংলায় কথা বলতে চাইতেন না। তখন চারিদিকে দাবি উঠেছে বাংলা ভাষায় সকল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে। এমনকি গণিতের প্রশ্নও বাংলায় হতে হবে। সেদিন আমি একাই বোর্ড অফিসে গেলাম। ঢুকতেই ড, খুদা বললেন, হোয়াট হ্যাঁজ ব্রট ইউ টু মি? আমি চুপ করে থাকলাম। বললাম, বাংলায় বলুন। তিনি বললেন, কী চাই? আমি বললাম, ছাত্রদের দাবি, গণিতের প্রশ্ন বাংলায় করতে হবে। মনে হলো, উনি আমাকে স্কুলের ছাত্র মনে করেছেন। আবার তিনি ইংরেজিতে বললেন, ডু ইউ নো হোয়াট ইজ এ রাইট অ্যাঙ্গেল? তুমি কি জানো সমকোণ কাকে বলে? গো, রিড অ্যান্ড সিট ফর একজামিনেশন।
আমার ইচ্ছে হচ্ছিল চিৎকার করি। আমি বললাম, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, স্কুলে পড়ি না। স্কুলের ছাত্র পড়াই। তবে আপনাকে বলে যাই, গণিতের প্রশ্নপত্র বাংলায় হবেই। আর বিড়বিড় করে বললাম, ব্যাটা ইংরেজি ছাড়া কথা বলে না।
ঢাকা হলে ফিরে নবকুমার স্কুলের একজন ছাত্র এবং কামরুন্নেসা স্কুলের এক ছাত্রীকে বললাম, পরদিন মিছিল নিয়ে আসতে। মিছিল আসবে শিক্ষামন্ত্রীর বাসভবনের সামনে। শিক্ষামন্ত্রী আশরাফউদ্দীন চৌধুরী। এককালে ফরোয়ার্ড ব্লক করতেন। নেতাজী সুভাষ বসুর আমলে বাংলা কংগ্রেসের সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীকালে নেজামে ইসলামে যোগ দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন নেজামে ইসলামের কোটায়।
পরদিন মিছিল এল। শিক্ষামন্ত্রী নিজ ভবন থেকে বের হয়ে এলেন। ছাত্রছাত্রীদের আশ্বাস দিলেন, গণিতের প্রশ্নপত্র বাংলায় হবে। বছরখানেক পরের কথা। ১৫৭ নবাবপুর রোডের ছাত্রলীগ অফিসে বসে আছি। একজন ছাত্র এলো। সে ম্যাট্রিক এক বিষয়ে ফেল করেছে। তখন নিয়ম ছিল ম্যাট্রিকে এক বিষয়ে ফেল করলে স্যাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা দিতে পারবে। তার অভিযোগ হলো-সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষার জন্যে এক বছর বসে থাকতে হলে একটি বছর নষ্ট হয়। তাই তার প্রস্তাব, তিন মাসের মধ্যে এ পরীক্ষা নিতে হবে। আবার ড, খুদার দফতরে গেলাম। তিনি এবার হেসে বাংলায় কথা বললেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার আরজি কী? আমি আমার কথা বললাম। ড, খুদা বললেন–আমরাও একথা ভাবছি। তুমি যেতে পার।
তবে ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে মনে হয়েছে আমাদের আন্দোলনের সবচে’ ন্যক্কারজনক দিক ছিল পরীক্ষার তারিখ পাল্টানোর দাবি।
১৯৫৬ সাল। আওয়ামী লীগ-কংগ্রেস কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায়। প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান। প্রধানমন্ত্রী একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সভায় এসেছিলেন। ছাত্ররা তাঁর কাছে আবেদন জানালে ডিগ্রি পরীক্ষার তারিখ সরিয়ে দিতে তিনি রাজি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল একমত হয়নি।
ডিসেম্বর মাসে আবারো একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান আসলেন। আবারো তাঁর কাছে অনুরোধ জানানো হয় পরীক্ষার তারিখ পিছাতে। কিন্তু এবার তিনি রাজি হলেন না। এক সময় বললেন, প্রয়োজন হলে আমার মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে। তবুও পরীক্ষা পিছাবার দাবি মানবে না।
ছাত্রদের বক্তব্য ছিল–বিএ পরীক্ষা মার্চ মাসে অথচ একখানা পাঠ্যপুস্তক তখনও প্রকাশিত হয়নি। আমার যতদূর মনে আছে বইটির নাম ‘সিলভার স্কুল। এছাড়া বিএসসির ছাত্রদেরও অনেক দাবি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মনোভাব হলো এভাবেও পরীক্ষা হয়।
এবার তা হলো না। প্রধানমন্ত্রী কার্জন হল থেকে চলে গেলেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি ইব্রাহিমের বাসার সামনে অবস্থান ধর্মঘট করলাম।
রাত বাড়তে থাকল। রাত ১২টার দিকে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমানের ১ নম্বর গাড়িটি ভাইস চ্যান্সেলরের কম্পাউন্ডে ঢুকল। প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করলেন ইব্রাহিম সাহেবের সঙ্গে। ইব্রাহিম সাহেব আইন ক্লাসে আতাউর রহমান সাহেবের শিক্ষক ছিলেন। যতদূর শুনেছি প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, স্যার পরীক্ষার তারিখ পিছিয়ে দিলে ভালো হয় না কি? এটা আমার অনুরোধ। ইব্রাহিম সাহেব বলেছিলেন-প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুরোধ হয় না; প্রকৃতপক্ষে নির্দেশ। আমি কাল একাডেমিক কাউন্সিলের সভা ডাকব।
এ ঘটনার পর আমরা অবস্থান ধর্মঘট প্রত্যাহার করি। পরদিন একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠক। পরীক্ষার তারিখ পিছিয়ে গেল। বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ফজলুল হক হলের প্রভোস্ট অর্থনীতির শিক্ষক ড. মযহারুল হক।
কিন্তু এ আগুন থামল না। পরবর্তী বছর পরীক্ষার তারিখ পেছানোর দাবিতে অনশন ধর্মঘট শুরু করল জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা। নেতৃত্ব ছাত্রলীগের। আমি সম্পাদক আউয়ালকে বললাম-আমি জগন্নাথ কলেজে যাব এবং এই অনশনের বিরুদ্ধে অনশন করব। শেষ পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে গিয়ে সকলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি মীমাংসায় পৌঁছাই। সেবার আর পরীক্ষার তারিখ পেছানো হয়নি। আমরা ধারণা পরীক্ষায় তারিখ পেছালে খুব একটা লাভ হয় না। শুধুমাত্র বিপদে পড়ে গরিব পিতামাতার সন্তানেরা। এদের কথা কেউ ভাবে না।
এ সময় আর একটি অবাঞ্ছিত কাজের সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়ি। দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম লীগ শাসনকালে ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে অনেক কলেজে আমলাদের অধ্যক্ষ করে পাঠানো হয়েছিল। এসময় কয়েকজন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। তাই বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ, দৌলতপুর ব্রজলাল একাডেমী, রংপুর কারমাইকেল কলেজ, চাঁদপুর কলেজ, যশোর কলেজসহ আরো কয়েকটি কলেজের অধ্যক্ষকে সরানোর আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। তবে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাধ্যতামূলকভাবে বরখাস্ত করলে ২০ ঘণ্টার মধ্যে তাকে পুনর্বহাল করেছিলাম। সেকালে প্রয়োজনে অনেক সমালোচনা সহ্য করেছি। কিন্তু কেউ বুঝতে চাননি, আমাদের অধ্যক্ষ সাহেবেরা কেমন আমলা মনোভাবাপন্ন হয়ে গিয়েছিলেন।
তখন আন্তর্জাতিক ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল কমিউনিস্ট প্রভাবিত আন্তর্জাতিক ছাত্র ইউনিয়ন (আইইউএস)। তবুও ছাত্র ইউনিয়ন নয়। পূর্ববাংলায় আমাদের সঙ্গে প্রথম সম্পর্ক স্থাপিত হয় আইইউএস-এর। যক্ষ্মা রোগীদের জন্যে আইইউএস-এর একটি হাসপাতাল ছিল বেইজিংয়ের কাছে বাঙাচু-তে। এ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে আমরা গাইবান্ধার নির্মলেন্দু মজুমদারকে পাঠিয়েছিলাম। চেকোশ্লোভাকিয়ায় স্কলারশিপ পেয়েছিল নূরুল হক বাচ্চু (পরবর্তীকালে সিনেমা পরিচালক)। কিন্তু পাকিস্তান সরকার পাসপোর্ট না দেয়ায় তার যাওয়া হয়নি। সেকালে ছাত্রলীগের বন্ধুরা অনেকেই এ খবর রাখতেন না। এ কালের সদস্যরাও জানে না।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। সরকারি আমলা এবং শিল্পপতিরা এ অভ্যুত্থান মেনে নেয়। কিন্তু কেন?
আমার মনে হয়, ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে একটি বুর্জোয়া বিপ্লব হয়েছিল। অর্থাৎ পুঁজিবাদীরা ক্ষমতা দখল করেছিল।
লক্ষণীয়, মুসলিম লীগকে ইস্পাহানি দাউদ-আদমজীসহ এক শ্রেণির শিল্পপতি সমর্থন করলেও সঠিক অর্থে মুসলিম লীগ একটি প্রকৃত পুঁজিপতিদের রাজনৈতিক দল ছিল না। এ দল খান সাহেব, খান বাহাদুর, উকিল মোক্তারদের সংগঠন ছিল। অর্থাৎ বিক্ষুব্ধ উঠতি মুসলিম মধ্যবিত্তরা ছিল এ দলের নেতৃত্বে। তাও আবার পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে তফাৎ ছিল। মুসলিম লীগের পেছনে কলকাতাভিত্তিক মুসিলম শিল্পপতিরা থাকলেও দেশভাগের সময় কলকাতা ভারতে চলে গেল। বোম্বাই, ভারতভিত্তিক মুসলিম শিল্পপতিরা বরাবরই জানত, পাকিস্তান সৃষ্টি হলে তারা ভারতেই পড়বে। তাই দেশ বিভাগের পর দেখা গেল পূর্ববাংলার মুসলিম লীগের নেতৃত্বে এসেছে উকিল-মোক্তার, ছোট জমিদার-জোতদারসহ এক শ্রেণির নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী। আর পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশে ক্ষমতায় এলো যারা এককালে রাজনৈতিকভাবে মুসলিম লীগ বিরোধী এবং মুখ্যত জমিদার-জায়গিরদার। ব্রিটিশ ভারতের সেই অংশ নিয়েই পাকিস্তান গড়ে উঠল–যেখানে কোনো শিল্প-কলকারখানা ছিল না, ছিল না সংগঠিত পুঁজিপতি শ্রেণি। ফলে দেশভাগ হওয়ার পর মুসলিম লীগকে কেন্দ্র করেই একটি পুঁজিপতি শ্রেণি গড়ে উঠবার সম্ভাবনা দেখা দিল।
কিন্তু মুসলিম লীগ সে ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল না। উকিল মোক্তার জমিদার-জায়গিরদারদের একমাত্র বাসনা ছিল ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা। নিজের জন্যে ক্ষমতা দখল করা। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রথম দিকে এদের জনপ্রিয়তা ছিল। তাই দেখা গেল নিজের জনপ্রিয়তা এবং দলবাজি সম্বল করে এরা ক্ষমতা দখল করছে এবং মন্ত্রিসভা ভাঙছে আর গড়ছে। দেশে কোনো ধরনের শিল্পায়ন হচ্ছে না। তাই এই শিল্পায়নের জন্যেই পুঁজিপতিদের নিজস্ব রাজনীতি বেছে নিতে হয়।
পাকিস্তানের প্রথম দিকেই প্রথম সারির দু’নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী মারা যান। ক্ষমতা চলে যায় গোলাম মোহাম্মদের নেতৃত্বে আমলাদের হাতে। কারণ, সমগ্র পাকিস্তানে গ্রহণযোগ্য কোনো নেতা তখন ছিল না। অপরদিকে কমিউনিস্টবিরোধী জোটে পাকিস্তান ছিল বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং ঘাটি। পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি ছিল। এ সূত্রে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মার্কিন সরকারের সরাসরি সম্পর্ক ছিল। এ প্রেক্ষিতে সামরিক-বেসামরিক আমলারা সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, তাদেরই একদিন ক্ষমতা দখল করতে হবে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সালে জেনারেল আইয়ুব একটি সংবিধান রচনা করেন পাকিস্তানের জন্যে। তখন জেনারেল আইয়ুব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রধান। রাজনীতির ব্যাপারে তাঁর নাক গলাবার কথা নয়।
১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ববাংলার নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে। এ রাজনীতি মুখ্যত মার্কিনবিরোধী। তবে এদের অন্যতম নেতা মার্কিনপন্থী শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কেন্দ্রের পাকিস্তান সরকারকে এ বাস্তবতা মেনে নিতে হয়। পূর্ববাংলার যুজফ্রন্টকে ভেঙে দিতে হয়। পূর্ববাংলার যুক্তফ্রন্টকে ভেঙে দিতে না পারলে সামরিক অভ্যুত্থান পূর্ববাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। অপরদিকে পূর্ববাংলায় যুক্তফ্রন্ট জিতে যাওয়ায় পাকিস্তান রাজনীতিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একটি নতুন অবস্থান সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে না পারলে কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না। অভ্যুত্থানও সম্ভব নয়।
পাকিস্তান রাজনীতির ব্যাখ্যা এ রকম সাজালে পরবর্তী চিত্র অনুধাবন করা সহজ হবে। এ পটভূমিতে পূর্ববাংলায় ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতৃত্ব বদলের প্রতিযোগিতায় যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। প্রধানমন্ত্রীত্বের টোপ দিয়ে কেন্দ্রে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে আইনমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় পাকিস্তানের আমলা প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংখ্যা সাম্যের নামে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেড়ে নেয়া হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী সহযোগিতা না করলে সাংবিধানিকভাবে পূর্ববাংলাকে বঞ্চিত করা সহজ হতো না।
সংবিধান পাস হবার পর পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলারা শেষ খেলা শুরু করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ৮০ জনের সংসদে ১২ জন সদস্যের নেতা শহীদ সোহরাওয়াদী ছিলেন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার ওপর নির্ভরশীল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী চাইলেন ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন দিয়ে একটি রাজনৈতিক সরকার গঠন করতে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজি হলো না। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংগঠন থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানে তার তেমন সংগঠন বা সমর্থক ছিল না। তাদের আশঙ্কা ছিল সারা পাকিস্তানের নির্বাচন হলে মার্কিন বিরোধী শক্তি জয়লাভ করবে। তাই মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্যে আমলাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের নতুন পুঁজিপতি শ্রেণি এবং মার্কিন সাহায্য নির্ভর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আমলা যৌথভাবে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। তারপর একের পর এক প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত এবং বরখাস্ত হন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি হয়। আর সামরিক শাসনকালেই পাকিস্তানে প্রথম ভূমি সংস্কারের কর্মসূচি নেয়া হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বুর্জোয়া ধারার কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। গমের বিনিময়ে কাজ কর্মসূচি শুরু হয়। সারাদেশে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ বাজার অর্থনীতির কাঠামোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এবং আইয়ুব খানই প্রথম পরিবার আইন প্রণয়নের সাহস করেন। এ প্রেক্ষিতে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান ছিল এক ধরনের আমলা পুঁজিপতিদের ক্ষমতা দখল।
১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। ১৯৫৯ সালে ডাকসু নির্বাচন এগিয়ে আসে। একদিকে ছাত্র ইউনিয়ন অপরদিকে ছাত্রলীগ, ছাত্রশক্তি এবং এনএসএফ। সেবার ভিপি হওয়ার কথা ঢাকা হল থেকে জিএস অর্থাৎ সাধারণ সম্পাদক এসএম হল থেকে। আমাদের ভিপি প্রার্থী এনায়েতুল্লাহ খান। ছাত্রলীগের ভিপি আবুল হোসেন (তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে বিএনপিতে যোগ দিয়ে এমপি হয়েছিলেন)।
ডাকসুর সদস্য সংখ্যা ১৬। হিসেব করে দেখা গেল আমরা ছাত্র ইউনিয়ন-৮ প্রতিপক্ষও ৮। প্রতিপক্ষের আটজনের মধ্যে ছিল নোয়াখালীর আবদুল মালেক। তিনি এককালে নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল। মালেক সাহেব পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকে চাকরি করতেন। আমি আর অজিত তাঁর সঙ্গে আলাপ করলাম। সিদ্ধান্ত হলো আমাদের পক্ষে আট ভোট পড়লে তিনি আমাদের ভোট দেবেন। সুতরাং বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম।
আমার ওপর বিপদ এল ভিন্ন দিক থেকে। আমাকে প্রভোস্ট বাসায় ডাকলেন। কিছুদিন ধরে শুনছিলাম ভাইস চ্যান্সেলর আমার খোঁজ করছেন এবং আমাকে হল থেকে বের করার কথা বলছেন। তখন ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন বিচারপতি হামিদুর রহমান। প্রভোস্ট বললেন, আপনি এনায়েতুল্লাহ খানকে সমর্থন করতে পারবেন না। আপনি সমর্থন প্রত্যাহার করলে এনায়েতুল্লাহ জিততে পারবে না। আমি বললাম, তা হয় না। আর আপনার কথা আমার শোনারও কোনো প্রয়োজন নেই। প্রভোস্ট বললেন, আপনার ভালোর জন্যে বলছি। আমার কথা না শুনলে আপনার বিপদ হতে পারে।
আমি জানতাম প্রভোস্টের কথা না রাখলে হয়তো হল থেকে আমাকে বের করে দেয়া হবে। আমি বললাম, এনায়েতুল্লাহ আমাদের প্রার্থী। তাকে পাস করাতেই হবে।
প্রভোস্ট-এর বাসা থেকে হলে ফিরলাম। দেখলাম হলের গেট একটি নোটিস টাঙানো আছে। লেখা ২৪ ঘন্টার মধ্যে নির্মল সেনকেহল ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে।
নোটিস দেখে আমি রুমে চলে গেলাম। কাউকে কোনো কথা বললাম না। চুপচাপ শুয়ে থাকলাম। রাত ১২টার দিকে হাউস টিউটর ড. কামরুজ্জামান আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, তুমি নোটিস দেখেছ? আমি বললাম, দেখেছি। হাউস টিউটর বললেন, তোমাকে কাল হল ছেড়ে দিতে হবে। আমি বললাম, আমার পক্ষে হল ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সামনে ডাকসু নির্বাচন। নির্বাচন শেষ হোক-দেখা যাবে। ড. জামান তেমন কিছু বললেন না। তারপর একদিন নির্বাচন এলো। আমরা আমাদের পক্ষের সদস্যদের জগন্নান্ধ হলে থাকবার ব্যবস্থা করলাম। পুরের দিকে জহিরুল ইসলাম (বর্তমানে অনিয়মিত কলামিস্ট) ছুটে এলো আমার কাছে। বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাদের একজন সদস্যকে কিডন্যাপ করেছে। যিনি কিডন্যাপ হয়েছিলেন তখন তিনি সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। আর যারা কিডন্যাপ করেছিল তারাও আজ অচেনা নয়। ফলে নির্বাচনে আমাদের পক্ষে ৭ ও বিরুদ্ধে ৮ ভোট হলো। আমরা প্রতিবাদ জানালাম। নির্বাচন স্থগিত রাখতে বললাম। বিচারপতি হামিদুর রহমান কোনো কথাই শুনলেন না। পরবর্তীকালে এই কিডন্যাপ নিয়ে আমরা দেন-দরবার করেছিলাম। তখন এককালের পুলিশের ডিআইজি আবদুল্লাহ সাহেব আইনের ছাত্র ছিলেন। তিনি বললেন, বৃথা আপনারা এ নিয়ে হইচই করছেন। কারণ সিদ্ধান্ত নিয়েই আপনাদের হারানো হয়েছে। সকল মহল না জানলে সামরিক শাসন আমলে ডাকসুর একজন সদস্য কিডন্যাপ হওয়া আদৌ সম্ভব কি?
ডাকসু নির্বাচনে হেরে গেলাম। এবার বিপদ ঘনিয়ে এলো। বুঝলাম ঢাকা হলে থাকা আর সম্ভব হবে না। এমন কি ঢাকায় থাকাও আর সম্ভব হবে না। ঢাকা হলের বাইরে গেলে গ্রেফতার অনিবার্য। দেশে রাজনীতি নেই বললেই চলে। সর্বত্রই গ্রেফতারের ভয়।
সামরিক শাসন জারি হবার পর আমি এবং আমার রুমমেট আহম্মদ হোসেন হেঁটে হেঁটে সেগুনবাগিচা গিয়েছিলাম। সেগুনবাগিচায় শেখ মুজিবুর রহমান থাকতেন। জানতাম তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি তখন মন্ত্রিত্ব ছেড়ে চা বোর্ডের সভাপতি। সেগুনবাগিচায় গিয়ে দেখলাম এই বাসা থেকে শেখ সাহেবের পরিবার-পরিজনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সকলেরই এক কথা–এ সময় রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। গ্রেফতার হলে কেউ খোঁজ নেবে না।
সত্যি সত্যি সঙ্গে তখন কেউ নেই। মাত্র বছরখানেক আগের কথা। ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলাম ছাত্রলীগ থেকে। ছাত্র ইউনিয়নের পুরুষ নেতৃত্বের একাংশ প্রবল বিরোধিতা করেছিল। আমাকে কিছুতেই গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে না দেবার জন্যে জোট বেঁধেছিল। দেশে সামরিক শাসন জারি হবার পর তারা কেউ নেই। ডাকসু নির্বাচনে দাঁড়ালেন এনায়েতুল্লাহ খান। তিনি এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে ছাত্রলীগ থেকে। ডাকসু নির্বাচনের জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করলাম আমি জহিরুল ইসলাম ও আজিজুর রহমান খান। আমরা সকলেই এসেছিলাম ছাত্রলীগ থেকে। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন সালউদ্দিন আহমদ (অধ্যাপক সাদউদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন ৯০ দশকে)। অন্যতম নেতা ছিলেন কাজী জাফর আহমদ। কেউই এলেন না এ নির্বাচনের সময় সামনা-সামনি, একমাত্র আমানুল্লাহ ব্যতীত।
নিজের দলে প্রায় এক অবস্থা। নিতাই গাঙ্গুলি আবারো ঢাকেশ্বরী মিলের চাকরি ফিরে পেয়েছেন। রুহুল আমিন কায়সার আবার অসুস্থ হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে। ১৯৫৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে কিছুদিন থাকার পর তিনি
কিছুটা সুস্থ হন। তারপর চলে যান ভাইয়ের কাছে চুয়াডাঙ্গা। ভাই রেলে চাকরি করতেন। থাকতেন চুয়াডাঙ্গা। তখন ঢাকা থেকে সরসারি চুয়াডাঙ্গা যাওয়া যেত না। নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টিমারে গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে চুয়াডাঙ্গা। আজকের দৌলতদিয়া ঘাটে বা গোয়ালন্দে সেদিনের গোয়ালন্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না। দৌলতদিয়া এখন নদী গর্ভে। আজকের গোয়ালন্দ বন্দরেই সেকালে স্টিমার ভিড়ত।
রুহুল আমিন কায়সারকে চুয়াডাঙ্গা পৌঁছে দিয়ে এসে ভাবলাম হয়তো সুস্থ থাকবেন কিছুদিন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে যক্ষ্মায় ভুগছেন। বারবার হাসপাতালে যাচ্ছেন আর আসছেন। কিন্তু আমার প্রত্যাশা সঠিক হলো না। রুহুল আমিন সাহেব চুয়াডাঙ্গা থাকলেন না। একটু সুস্থ হয়েই প্রধান শিক্ষকের চাকরি নিয়ে চলে গেলেন বরিশালের গৌরনদী। আমি কিছুই জানতাম না।
১৯৫৮ সালের প্রথম দিকে হঠাৎ একদিন এসে হাজির হলেন ঢাকা হলে। রুহুল আমিন কায়সার আবার অসুস্থ। কিন্তু কী করব? কোথায় রাখা যাবে? মিটফোর্ড হাসপাতালে কোনো সিট নেই। চিকিৎসক ড. নূরুল ইসলাম রোগী দেখে বললেন, এ মানুষ বেঁচে আছে কী করে। একটি লাংগস নেই। অপরটির এক-তৃতীয়াংশ চলে গেছে। ইনজেকশন দিলে ৬ ডিগ্রি জ্বর ওঠে। অনেক কষ্টে তাকে ভর্তি করা হলো বেআইনিভাবে, সাধারণ রোগী ওয়ার্ডে চারিদিকে কাপড় ঘিরে দিয়ে। কিছুদিন পরে টিবি ওয়ার্ডে সিট পেয়েছিলেন। সে সিটে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কালীদাস চক্রবর্তী। কালীদাস চক্রবর্তী মারা যাওয়ায় সে সিট রুহুল আমিন কায়সারকে বরাদ্দ করা হয়।
কিন্তু যক্ষ্মা রোগীর ওষুধ কে জোগাবে? এতো পয়সা কোথা থেকে আসবে? আমার টিউশনি জুটছে না। জুটছে না, ঠিক নয়। থাকছে না। কারণ কারো সঙ্গে আমার বনছে না। একটি টিউশনি পেলাম পুরানা পল্টনের জামায়াতখানার পেছনে। ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের ছাত্র-ছাত্রী। সে পরিবারটি বিরাট ব্যবসার মালিক। একদিন অনুপস্থিত হওয়ায় জিজ্ঞাসা করেছিল : Why did you not come yesterday? আমি জবাব দিলাম, I will not come from tomonow. কারণ আমার টিউশনির শর্ত ছিল আমি সপ্তাহে সাতদিন আসতে পারি কিন্তু একদিন না এলে আমাকে জিজ্ঞাসা করা যাবে না, আমি কেন আসিনি। কারণ আমি কারো পিতার কোম্পানিতে চাকরি করি না।
আমার ছাত্র-ছাত্রীরা ভড়কে গেল। তাদের মা এলেন। বললেন, এমন আর হবে না। আমি বললাম, আপনারা ভবিষ্যতে কোনোদিন বিপদে পড়লে আমার কাছে আসবেন। আমি সাহায্য করব। সত্যি সত্যি বছরখানেক বাদে এক মাসের জন্যে তাদের আবার পড়াতে গিয়েছিলাম। তবে ওরা বড় হিসেবি। প্রথমবার ২৭ দিন টিউশনি করার পর ছেড়ে দিলাম ওরা আমাকে ঠিক ২৭ দিনের টাকা হিসাব করে দিয়েছিল। দ্বিতীয়বার পড়িয়েছিলাম ৩৬ দিন। এবার তারা গুণে গুণে ৩৬ দিনের টাকা দিয়েছিল। ঢাকা হলে এসে এবার ৩৬ দিনের টাকা নিয়ে পুরানা পল্টনে ওদের বাসায় গেলাম। ওদের মাকে ডাকলাম। বললাম, দেখুন ব্যবসা করেন ভালো কথা। এমন ব্যবসা করলে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে পারবেন না। ওরা ব্যবসায়ী হবে, মানুষ হবে না। আমি ৩০ দিনের টাকা পেলেই ৩৬ দিন পড়াতাম। মাস শেষ হবার পর ৬ দিনের জন্যে কোনো টাকা নিতাম না। এই বলে ৬ দিনের টাকা দিয়ে চলে এলাম। ওরা ছিল এককালে ঢাকার অভিজাত লাসানি হোটেলের মালিক। বায়তুল মোকাররমের হোভা দোকানের মালিক। দেশ স্বাধীন হবার পর ওদের খোঁজ করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম ওদের কর্মচারিরাই ওদের সকল দোকানের মালিক হয়ে বসেছে। কর্মচারিরা অবশ্যই জন্মসূত্রে বাঙালি।
এমনি করেই আর এক টিউশনি ছাড়তে হলো। মতিঝিল কলোনিতে দুজন ছাত্রী পড়াতে হবে। টাকার বড় অভাব। ত্রিশ দিন পড়ালে ত্রিশ টাকা। হলের চার্জ ৩২ টাকা। তারপর অন্যান্য খরচ। প্রথমদিন পড়াতে গিয়ে দেখলাম অনেক খাবার ব্যবস্থা। বললাম, খাবার কম দিয়ে বেশি টাকা দিলে সুবিধা হয়। আর প্রতিদিন এ ধরনের খেতে হলে খাবার পাটটা এখানেই শেষ করতে হয়। টিউশনি বাড়ির লোক রাজি হলো না। এক, দুই, তিনদিন দেখলাম। তারপর বললাম, আমি ৩০ দিনের পর আর পড়াব না। ছাত্রীরা কাঁদল। আমার মনে হচ্ছিল টিউটর বলে যেন সবাই করুণা করে। ত্রিশ দিনের ত্রিশ টাকা নিয়ে চলে এলাম। এরপর একেবারে বেকার।
এবার এগিয়ে এলেন ক্ষিতীশ দা। ক্ষিতীশ চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সেকালে স্টেডিয়ামের মতো কিছু ছিল না। পশ্চিম দিকে কিছু কক্ষ ছিল। ওই মাঠ দিয়ে হাঁটতে গেলে একটি পরিচিত লোক চিৎকার করে উঠতেন খাঁটি ঢাকার আদি ভাষায়। ক্ষিতীশ দা ডাকছেন। ক্ষিতীশ দা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পোর্টসের সঙ্গে আছেন। কী তার পদ, কী তার পরিচয় জানি না। এককালে ঢাকা হলের ছাত্র ছিলেন। খেলাধুলার ক্ষেত্রে সকলের দাদা। ক্ষিতীশ দার এলাকায় গেলে চা খেতে হবে। গল্প শুনতে হবে। পাকিস্তানের বাঘা বাঘা সকল সিএসপি আমলারা তাঁর হাতে গড়া। সকল এলাকায় তাঁর যাতায়াত। মনে হতো জন্মসূত্রে ক্ষিতীশ দা হয়তো ঢাকার কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে ছিলেন। একদিন ডেকে বললেন, কেমন আছ? বললাম ভালো নেই। টিউশনি প্রয়োজন। ক্ষিতীশ দা চমকে দিয়ে অট্টহাসি করে উঠলেন। বললেন চিঠি দিচ্ছি, এখন যাও। আমি ফোন করে দেব। এক সম্ভ্রান্ত মানুষের বাড়িতে পড়াবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালের সেরা ছাত্র। এ কালের সেরা আমলা। ১৯৪৯ সালের ব্যাচের সিএসপি। সত্যি সত্যি বেইলি রোডের বাড়িতে ঢুকে বুঝলাম অন্তত একজন শিক্ষিত লোকের বাড়িতে এসেছি। তার বাড়ির বসবার রুমে ফ্রিজ বা আলমারি ভর্তি কাপ, গ্লাস, প্লেটের ভিড় নেই। শুনেছি, তিনি বলে রেখেছেন ছাত্র জীবনে নিজে টিউশনি করেছি। টিউশনিতে মর্যাদা নেই। তাই টিচার এলে দূরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বাজাবে। একটি পরিবেশ সৃষ্টি করবে পড়াবার। কোনোদিন যেন অনুভব করতে না পারেন যে তিনি এখানে বহিরাগত এবং শিক্ষক। কথাগুলো বলেছিলেন গৃহকত্রী। ১৯৫৮ সালের ৮ অক্টোবর ভোর বেলা ওই গৃহকত্রী এসে বলেন–স্যার, আজ আপনার পড়াতে হবে না-সাহেব বলেছেন, আপনি হয়তো জানেন না যে কাল রাতে দেশে সামরিক আইন জারি হয়েছে। আপনি হলে চলে যান।
কোনো কথা না বলে সেদিন চলে এসেছিলাম। ভোর বেলা কাগজে দেখেছি। হলেও রেডিও ছিল না বা রেডিও শুনবার তেমন অভ্যাসও ছিল না। কিন্তু সে বাসায়ও আমার পড়ানো হলো না। তবে ছাত্রটি ভালো ছিল যাকে ইরেজিতে বলে Exeptionally Brilliant. আমিই একমাত্র তাকে পড়তে বসাতে পেরেছিলাম। আমি বললাম, ঠিক সাতটায় আমি আসব। সে বলত ঠিক ঠিক সাতটায় এসে পড়ব আমি। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের ফোর্থ স্ট্যান্ডার্ডের ছাত্র। প্রতিদিন ঠিক সাতটায় য়ার খুলে দেখত আমি দাঁড়িয়ে।
এভাবে একদিন পড়াতে গিয়ে দেখলাম আমার ছাত্র ও তার ছোট ভাই কাঁদছে। কাঁদার কারণ বাবা-মা তাদের বাসায় রেখে সিনেমায় গিয়েছেন। আমি আর সেদিন পড়ালাম না। পরদিন পড়াতে গিয়ে ছাত্রদের মাকে ডেকে বললাম–আমি আর পড়াব না। তিনি অবাক হলেন। বললেন, কেন? আমি বললাম, দেখুন আমার ছাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে দু’ঘন্টা আমার কাছে থাকে। বাকি ২২ ঘন্টা আপনাদের কাছে। দুঘন্টা করে আমার কাছে রেখে ২২ ঘণ্টার ক্ষতি আমি পুষিয়ে দিতে পারব না। ছেলে দু’টি কাল কাঁদছিল। আমার করার কিছু ছিল না। আপনারা সিনেমায় গিয়েছেন। ওরা পড়েনি। ভদ্রমহিলা এক অদ্ভুত বিষয় নিয়ে থাকিয়ে থাকলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি আমার সীমানা লজ্জন করছি। এসব ব্যাপারে নাক গলানো আমার কথা নয়। তাই তিনি অত্যন্ত ভদ্র এবং তার সঙ্গে আমার কথা মেনে নিলেন। আমি চলে এলাম। দীর্ঘদিন জেল থেকে আসার পর একটি ফোন এসেছিল আর এক বন্ধুর মারফত। অনুরোধ জানানো হয়েছিল, আপনার ছাত্র ম্যাট্রিক দিচ্ছে, একবার আসবেন। আমি জবাব দিয়েছিলামনা।
অর্থাৎ শেষ টিউশনি চলে গেল। বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। সারাজনম কাকাদের ওপর জুলুম করেছি। তারা কোনোক্রমে গ্রামে আছেন। মা-ভাইবোন সকলে কলকাতা। মাঝে মাঝে চিঠি আসে। আমার চিঠি লেখা হয় না। মা অনেকটা নিশ্চিত হন আমি জেলে গেলে। কারণ অন্তত একটি ঠিকানা তাদের তখন জানা থাকে।
আবার ক্ষিতীশ দা’র শরণাপন্ন হলাম। এবার টিউশনি জুটল অ্যাডভোকেট জেনারেল বিএ সিদ্দিকীর বাসায়। মাহুতটুলীতে বাসা। সপ্তাহে ৬ দিন ঢাকা হল থেকে হেঁটে যেতে হয়। আর এ সময় রুহুল আমিন সাহেব এসে ঢাকায় উপস্থিত হলেন। নিজে বাঁচতে হবে, তাকে বাঁচাতে হবে। আত্মীয়-স্বজন বারবার এসেছেন। আমি তাদের ফিরিয়ে দিয়েছি। কারণ যে মানুষটি দলের জন্যে জীবন দিতে বসেছে, সারা জীবন নিজের পরিবার থেকে নিয়েছেন অথচ কিছু দিতে পারেননি। তাঁর বিপদে তাঁকে আবার সংসারে ঠেলে দেবার মতো অরাজনৈতিক, কিছু হতে পারে আমি কোনোদিন তা মনে করিনি।
রহুল আমিন কায়সারকে মিটফোর্ডে ভর্তি করলাম। আবার নিজের কক্ষে উঠলাম ঢাকা হলে। দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিরাতে হাউজ টিউটর ডেকে পাঠাতেন। বলতেন, তুমি না গেলে আমাদের চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। প্রতিদিন ভাইস চ্যান্সেলর হামিদুর রহমান তোমার খোঁজ নিচ্ছেন। আমি বললাম, কোথায় যাব বলুন। কোথাও বাসা পাওয়া যায় না। আর বাইরে গেলেই গ্রেফতার। এবার শেষ প্রস্তাব দিলেন হল কর্তৃপক্ষ। ঢাকা হলের দক্ষিণের রেললাইন পার হয়ে নিমতলা। নিমতলাতে একটি হোটেল ডি-লাক্স। ওই হোটেলে তুমি থাকলে তোমার খাবার আমরা ঢাকা হল থেকে পাঠাব। হোটেল ডি-লাক্স-এ তখন আমার ঢাকা হলের বন্ধু অজয় রায় থাকতেন। তিনি পদার্থবিদ্যায় এমএসসি পাস করে থিসিস করছেন। তার কক্ষেই একটি সিট পেলাম। মাসিক ভাড়া ৩০টাকা। আমার ভাড়া পাঠাবেন হল কর্তৃপক্ষ।
শেষ পর্যন্ত ঢাকা হল ছাড়তে হলো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে ছাড়লেন না। একদিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে ঢুকতেই প্রয়াগ ছুটে এল। দূরে দাঁড়ানো ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক এটিএম মেহেদী। মেহেদী এনএসএফ নেতা মহসিনের সঙ্গে কথা বলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমতলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে এনএসএফের আক্তার আহাদ এবং ছাত্র ইউনিয়নের আমানউল্লাহ। প্রয়াগ ডাকসুর কর্মচারী। প্রয়াগ বলল, আপনি এখুনি এখান থেকে চলে যান। আপনাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। আপনার পক্ষে কথা বলছেন মেহেদী সাহেব ও আমানউল্লাহ সাহেব। যে কোনো সময় বিপদ ঘটে যেতে পারে। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। পালিয়ে গিয়ে লাভ নেই। সব কিছু সামনাসামনি মোকাবেলা করা ভালো।
এর মধ্যে আমানউল্লাহ সাহেব আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন, চলুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যাই। গুলিস্তান গিয়ে চা খাব। বুঝলাম, আমানউল্লাহ সাহেব আমাকে নিরাপদ এলাকায় নিয়ে যেতে চাইছেন। তার সঙ্গে গুলিস্তান গেলাম। চা খাওয়া হলো না। নিমতলা হোটেলে ফিরে এলাম।
পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম। মধুর ক্যান্টিনে আহমেদুরের সঙ্গে দেখা হলো। আহমেদুর রহমান দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারি সম্পাদক। ভিমরুল ছদ্মনামে উপসম্পাদকীয় লেখেন। আমাকে বললেন, বাঁচবেন কী করে। এভাবে তো বাঁচা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্ষেপে গেছে। পুলিশ অপ্রসন্ন। একটি মাত্র টিউশনি। কেউই প্রকাশ্যে রাজনীতি করছে না। এভাবে চললে গ্রেফতার হয়ে যাবেন। কোথাও একটা চাকরি নিন। আহমেদুর রহমানকে আমরা অনেকেই ‘মামু’ বলে ডাকতাম। বললাম, মামু, আমি কারো অধীনে চাকরি করব না। আমার টিউশনি করাই ভালো। যেদিন খুশি যাব। যখন খুশি ছেড়ে দেব। মামু বললেন, আমি ইত্তেফাকে কথা বলেছি। ইত্তেফাকের সহকারি সম্পাদক আপনার বন্ধু এমএ আউয়াল। সে আপনাকে ইত্তেফাকে চাকরি দিতে রাজি। আপনি সহকারি সম্পাদক হিসেবেই ইত্তেফাকে যোগ দেবেন। আমি রাজি হলাম না। আহমেদুর রহমান ক্ষুণ্ণ হলেন।
কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয় ঢুকতেই প্রোক্টর নুরুল মোমেন সাহেব ডাকলেন। বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে। দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। মধুর ক্যান্টিনে তখন অনেক ছাত্রের ভিড়। আমতলায়ও তখন অনেক ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। নুরুল মোমেন সাহেব বললেন, তুমি কিছু মনে করো না। তোমার ভালোর জন্যেই একথা বলছি। ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি হামিদুর রহমান তোমার সম্পর্কে একটি নির্দেশ পাঠিয়েছেন। কলাভবনে তোমার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তুমি মধুর ক্যান্টিন বা আমতলায় আসতে পারবে না। তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র। তোমাকে কার্জন হল এলাকায় থাকতে হবে। আমি বললাম, আমি তাহলে কোথায় যাব? আমাকে ঢাকা হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এখন কলাভবনে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো। আমার তো চা খাবার জায়গাটুকুও রইল না। এ নির্দেশ আমি মানব না। আর এ নির্দেশ আমি না মানলে আপনারা কী করতে পারেন তাও আমি দেখতে চাই।
নুরুল মোমেন সাহেব আমার কথায় কিছুটা বিমর্ষ হলেন। বললেন, আমার করার কিছু নেই। আমি তোমাকে ভাইস চ্যান্সেলরের নির্দেশ জানালাম। তুমি কলাভবনে ঢুকলে আমি হয়তো খেয়াল করব না। কিন্তু তোমাকে নজর রাখবার জন্যে বহু লোক এই কলাভবনে আছে। তাদের তুমি এড়াতে পারবে না।
খানিকটা দমে গেলাম। তখুনি কলাভবন ছেড়ে গেলাম না। মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে বসলাম। কয়েকজন মুখ চেনা লোকও আমার সঙ্গে মধুর। ক্যান্টিনে ঢুকল। ওদের মধ্যে একজন আমার বড় চেনা। তিনি ডাকসুর সদস্য। আমাদের বিপরীত প্যানেল থেকে নির্বাচিত। যতদূর বুঝেছি তিনিই উদ্যোগ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে এ নির্দেশটি করিয়েছেন। নুরুল মোমেন সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি ছায়ার মতো পেছনে পেছনে ঘুরেছেন।
দীর্ঘদিন পর তিনি কথায় কথায় তাঁর কৃতকর্মের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট এবং রাজাকার হিসেবে জেলও খেটেছেন। মধুর ক্যান্টিনে ঢুকতেই দেখি আহমেদুর রহমান বসে আছেন। তাঁকে ঘটনা খুলে বললাম। তিনি বললেন, আজই আমার সঙ্গে ইত্তেফাকে চলুন। আজই আপনাকে সম্পাদকীয় লিখতে হবে। এভাবে জেলের বাইরে থাকতে পারবেন না। তাঁর কথামতো সেদিন ইত্তেফাকে গেলাম। সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সঙ্গে দেখা হলো। বললেন, যা খুশি একটা সম্পাদকীয় লিখে যাও। সংস্কৃতির ওপর একটা সম্পাদকীয় লিখে হোটেলে চলে গেলাম।
১৯৫৯ সাল, সেপ্টেম্বর মাস। আনুষ্ঠানিকভাবে আমার সাংবাদিকতা শুরু। এর আগে বরিশালে ব্রজমোহন কলেজে পড়বার সময় কলকাতায় সাপ্তাহিক গণবার্তায় লিখেছি। সাপ্তাহিক যুগবাণীতে দীর্ঘদিন সম্পাদকীয় লিখেছি। তবে কারও বেতনভুক্ত কর্মচারি ছিলাম না। ইত্তেফাকেই আমার অর্থের বিনিময়ে সাংবাদিকতা শুরু। তবে ইত্তেফাকে ঢুকে বুঝলাম, শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার ঠেকানো যাবে না।
আমি ইত্তেফাকে ঢুকবার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া গ্রেফতার হয়ে গেলেন। তখন তিনি মোসাফির নামে রাজনৈতিক মঞ্চে লিখতেন। পাকিস্তান সরকার ইত্তেফাককে বরদাস্ত করতে পারত না। দেশে মানিক মিয়ার রাজনৈতিক মঞ্চ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। এই মঞ্চের জন্যেই ইত্তেফাকের কাটতি বেশি ছিল এবং রাজনৈতিক মঞ্চে লেখার জন্যেই মানিক মিয়াকে জেলে যেতে হয়েছিল।
সম্পাদক সাহেব গ্রেফতার হবার পরে আর একটি ঘটনা ঘটল। আমি সচিবালয়ের সামনের রাস্তা দিয়ে পুরানা পল্টন মোড় থেকে প্রেস ক্লাবের দিকে যাচ্ছিলাম। ডানপাশে তখন ঢাকা জেলা গোয়েন্দা অফিস ছিল। একজন অফিসার বের হয়ে এলেন। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি পথ ঘাটে বিরক্ত করতে অভ্যস্ত। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা নাকি নতুন রাজনীতি শুরু করবেন। এবার হবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। আপনারা এনএসএফ-এর সঙ্গে এক হয়ে রাজনীতি করবেন। আমার মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল।
আমরা তখন এনএসএফকে সামরিক বাহিনীর দালাল বলতাম। বললাম, পায়ের স্যান্ডেল দেখেছেন। আর একবার এ কথা উচ্চারণ করলে স্যান্ডেল খুলে লাগিয়ে দেব। ওই রাস্তা দিয়ে তখন ইত্তেফাকের ফটোগ্রাফার মিজানুর রহমান সাইকেলে যাচ্ছিলেন। তাঁকে ডেকে বললাম, মিজানুর দাঁড়াও। শোন এ ব্যাটা বলছে কী! আর একবার উচ্চারণ করলে কিন্তু বিপদ হবে। মিজান আমাকে থামাল। গোয়েন্দা বিভাগের ভভদ্রলোক চলে গেলেন। ইত্তেফাকে দিন মন্দ কাটছিল না। সামরিক আইনের কড়াকড়ি। সম্পাদক জেলে। আমাদের লিখতে হতো সচেতন হয়ে। তখন সরাসরি কিছু লেখা যেত না। সবই লেখা হতো ইঙ্গিত এবং ইশারায়। এর মধ্যে আবার সামরিক আইনের ৫২ ধারা আছে। এ ধারার জন্যে ইশারায় ইঙ্গিতে কিছু বলা যাবে না। তবুও ইত্তেফাকে উপসম্পাদকীয় কলামে আমরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখতাম। মানুষ তখন সরকারবিরোধী লেখা চাইত। তবে মনে আছে একদিন আমি বৃষ্টি নিয়ে একটি সম্পাদকীয় লিখছিলাম। লিখেছিলাম, সেই যে শ্রাবণের শেষে মেয়েকে পরের বাড়ি পাঠিয়েছিলাম ভরা বৃষ্টির সময় তখন কি কেউ জানত যে ওই মেয়ে কলকাতার শাড়ি পরে বাড়ি ফিরে আবার একদিন কাঁদতে বসবে। সম্পাদক সাহেব খুব খুশি হলেন জেলখানায়।
মরহুম আহমেদুর রহমান তার মিঠেকড়া কলামে আফ্রিকার কোনো দেশের সামরিক শাসনের তীব্র সমালোচনা করে লিখতেন ল্যাতিন আমেরিকার গণতন্ত্রের ওপর, এমেলার বিরুদ্ধে। মানুষ উৎসাহিত হতো। গোগ্রাসে গিলত। সামরিক আমলে ঢাকায় বস্তি উচ্ছেদ আরম্ভ হলো। আমি লিখলাম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হচ্ছিল বর্ধমানের মহারাজাদের বসতবাড়িতে। ফলে হাজার হাজার পায়রা বাস্তুচ্যুত হয়। এই পায়রা বাস্তুচ্যুত হওয়া ভিত্তি করেই চলে এলাম ঢাকায় বস্তি উচ্ছেদের ঘটনায়। মনে হয় তখনি আমরা অনেকে খুঁচিয়ে লিখতে শিখেছিলাম বা শুরু করেছিলাম। সে অবরুদ্ধ হাতের লেখা। লেখা যায় না, লেখার নিয়ম নেই। লেখা শাস্তিযোগ্য, তবুও লিখতে হবে। পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে হবে। সে অভ্যাস সহজে যায় না। স্পষ্ট না লিখে ইশারায় ইঙ্গিতে লিখেছি। তবে ঘুরিয়ে লিখলেও কিছুদিন ইত্তেফাকে ভালো ছিলাম।
তাও কাঁটায় কাঁটায় ত্রিশ দিন। ২৪ সেপ্টেম্বর ইত্তেফাকে লেখা দিয়েছিলাম। ২৪ অক্টোবর কথায় কথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ঢুকেছিলাম। সকাল দশটা থেকে প্রায় রাত আটটা পর্যন্ত গল্প করেছি। চা পেয়েছি। প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম যে কলাভবনে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ। এক সময় মধুদাকে চিৎকার করে বললাম, মধুদা এক কাপ চা। মধুদা বললেন, ৯৯ কাপের দাম দিয়ে যান। কারণ আসুন আর না আসুন ৯ কাপের হিসাব খাতায় লেখা থাকবেই আপনার নামে। মধুদা শুধু আমাদের চা খাওয়াতেন না। চোখে চোখে রাখতেন। হোটেলে ফিরতে রাত হলো।
ভোর ৪টার দিকে ঘুম ভেঙে গেল টর্চের আলোয়। আমার পাশের খাটে অজয় রায়। পাশের কক্ষে রফিকুল্লাহ চৌধুরী। আমি চিৎকার করে উঠলাম, কোন শূকরের বাচ্চা টর্চ ফোকাস করছে। বাইরের দিক থেকে একটি গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো, নির্মল বাবু আপনার মেজাজ কি কোনোদিন ঠাণ্ডা হবে না। দুয়ার খুলুন। দুয়াল খুলে দেখলাম রমনার ওসি। সঙ্গে বেশ ক’জন পুলিশ। বললেন, চলুন। সূর্যের আলো ফুটবার পূর্বে হোটেল ডি-লাক্স থেকে বের হলাম। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন অজয় রায়, রফিকুল্লাহ চৌধুরী ও হোটেলের অন্যান্য বন্ধুরা। সামনে এগিয়ে দেখি পূর্বের সেই আইবির ভভদ্রলোক। যার সঙ্গে তর্ক হয়েছিল কদিন আগে। জিজ্ঞাসা করলাম, কবে বের হব। ভভদ্রলোক হেসে জবাব দিলেন, যদি কোনোদিন পাকিস্তানে গণতন্ত্র আসে–আপনি মুক্তি পাবেন শেষ ব্যাচে। তোপখানা রোডে তখন ঢাকা জেলার গোয়েন্দা অফিস। গোয়েন্দা অফিসে পৌঁছে দেখি তকালীন ন্যাপ নেতা (বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা) মহিউদ্দিন আহমদ বসে আছেন। বসে আছেন নারায়ণগঞ্জের ন্যাপ নেতা শফিক খান ও হাসান জামিল। বুঝলাম, আমি একা নই। সারা দেশে সেদিন অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী গ্রেফতার হয়েছে। শুনতে পেলাম–সরকারের ধারণা ২৭ অক্টোবর নাকি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের একটা কিছু করার কথা ছিল। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়েছিল ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর। প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ইস্কান্দার মীর্জা। ২৭ অক্টোবর বন্দুকের মুখে তাকে সরিয়ে দেয় সামরিক জান্তা। আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৫৯ সালের ২৭ অক্টোবর ছিল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের এক বছর। গোয়েন্দা বাহিনীর ধারণা ছিল। এই দিন হয়তো আমরা গোলমাল করবো।
কিন্তু এ ধরনের কোনো চিন্তা আমার মাথায় ছিল না। ন্যাপ এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিনা তাও জানি না। ছাত্রদের মধ্যে তেমন কোনো উদ্যোগ বা আয়োজন দেখিনি। এ ধরনের কোনো চিন্তা থাকলে আমি জানতাম। আজো আমার মাথায় আসছে না, কেন এ ধরনের ধারণা সেদিন গোয়েন্দা বাহিনীর হয়েছিল।
গোয়েন্দা অফিসে আমাকে জেরা শুরু করলেন জনাব মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর পিতা। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে গ্রেফতার করলেন কোন ভিত্তিতে? এ পর্যন্ত কোনো ছাত্রনেতাই গ্রেফতার হয়নি। তাহলে আমাকে ধরা হলো কেন? তিনি বললেন, আমরা অমুসলমান ছাত্রনেতাদের তালিকা প্রণয়ন করেছিলাম। এ তালিকায় ছিল মুকুল সেন, চিত্ত ভট্টাচার্য্য, সত্য ভট্টাচার্য্য এবং স্বদেশ বসু। তারা সকলেই জগন্নাথ হলের ছাত্র। একমাত্র আপনিই ঢাকা হলের ছাত্র। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল মুকুল সেন ভারতে চলে গেছেন। চিত্ত বাবু, সত্য বাবু গভীরভাবে পড়াশুনা কছে। স্বদেশ বসু রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। সুতরাং বাকি থাকলেন আপনি এবং আপনাকেই গ্রেফতার করতে হলো।
আমি বললাম, দেখুন আপনাদের একটা ভুল হচ্ছে। আমি কিন্তু এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নই। ইন্সপেক্টর চৌধুরী চমকে উঠলেন। বললেন, মানে? আমি বললাম, মানে হচ্ছে–আমি জানতাম, সামরিক শাসনে আমি গ্রেফতার হবই। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র; জেলে গিয়ে পরীক্ষা দিতে পারব না। তাই বেশ কিছুদিন আগে আমি ঢাকা সিটি নাইট কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। আমি চাই এ কথাগুলো আপনি আপনার রিপোর্টে লিখুন। সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানুক। ফলে আমার পরীক্ষার অনুমতি পাওয়া সুবিধা হবে।
এবার মহিউদ্দিন চৌধুরী ভিন্ন কথা শুরু করলেন। তিনি জানতে চাইলেন আমার মা কোথায়? আমি বললাম, পশ্চিমবঙ্গে। এবার তিনি বললেন, তাহলে আপনি এদেশে কেন আছেন? আমি বললাম, আপনার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, আপনার মা দেশ ছেড়ে কেন গেলেন। অথচ উল্টো আপনি জানতে চাইলেন আমি কেন এদেশে আছি। তাহলে তো আমিও আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি আপনি কেন পাকিস্তানে আছেন?
পাশে শফি খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন আরেকজন ইন্সপেক্টর। এবার তিনি কথা বললেন। বললেন, চৌধুরী সাহেব, আপনি কি বাতাসে বড় হয়েছেন? ১২ বছর আগে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে। ১২ বছর পর আপনি নির্মল সেনকে জিজ্ঞাসা করছেন উনি পাকিস্তানে আছেন কেন।
কথায় কথায় বেলা হয়ে গেল। গোয়েন্দা অফিসেই খাবার ব্যবস্থা হলো। বিকালের দিকে আমাদের ঢাকা জেলে পাঠানো হলো। জেলে বিভিন্ন ধরনের বন্দিদের বিভিন্ন বিভাগ আছে। আমরা সিকিউরিটি আইন অর্থাৎ নিরাপত্তা আইনে আটক আছি বলে আমাদের বিভাগের নাম সিকিউরিটি বিভাগ। এই সিকিউরিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানে এর আগে সাড়ে ৪ বছর আমি ঢাকা ছেলে ছিলাম। আমাদের বিভাগে একজন জমাদার ছিল। জমাদারের নাম নজির আহমেদ। নজির আহমেদের বাড়ি ভারতের বিহারে। কিন্তু দেখতে পাঞ্জাবিদের মতো। সব সময় হাসিখুশি। কিন্তু সরকারের প্রিয়পাত্র। তার কাছ থেকে কোনো খবরই পাওয়া মুশকিল।
ঢাকা জেলে ঢুকতেই জমাদার নজির আহমেদের সঙ্গে দেখা। হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, আবার আইলেন? এবার কোথায় থাকবেন। আমি বললাম, পুরানা জায়গায় থাকব। অর্থাৎ পুরানো হাজতে। ঢাকা জেলে ঢুকতে বাঁ দিকে পুরানো হাজত। এক নাগাড়ে চার বছর ছিলাম এই পুরানো হাজতে। এই পুরানো হাজতে এককালে ছিলেন আন্দামান ফেরত আগ্নিযুগের বিপ্লবীরা। ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করার আগে তাদের যুক্তি দিয়ে দেয়।
জেলে ঢুকে রাজবন্দিদের কষ্ট অনেকটা কমেছে। ব্রিটিশ আমলে রাজবন্দিদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হতো। ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ সরকার সে সুবিধা বাতিল করে দেয়। এর বিরুদ্ধে রাজবন্দিরা দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে। ১৯৫৬ সালে আবু হোসেন সরকারের আমলে তল্কালীন অর্থমন্ত্রী প্রভাস লাহিড়ীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সুপারিশে স্টেট প্রিজনার রুলস ১৯৫৬ প্রণীত হয়। রাজবন্দিদের গ্রেড ওয়ান, গ্রেড-টুতে বিভক্ত করা হয়। সাধারণ কয়েদিদের থেকে একটু ভদ্রভাবে রাখার চেষ্টা করা হয়। তাই জেল গেটে গিয়েই বুঝলাম জেলে থাকা খুব একটা অসুবিধা হবে না। আমরা গ্রেড ওয়ান রাজবন্দি হিসেবেই জেলখানায় ঢুকলাম। পুরান হাজতে গিয়ে দেখি ইতোমধ্যে অনেক রাজবন্দি সারাদেশে থেকে এনে সেখানে জড়ো করা হয়েছে। সেখানে আছেন শহিদুল্লাহ কায়সার। তিনিও রাজবন্দি। তবে তার বিরুদ্ধে মামলাও আছে আওয়ামী লীগ আমলের। আছেন বরিশালের হীরণ ভট্টাচার্য। সাংবাদিক আলী আকসাদ এবং দিনাজপুরের গুরুদাস তালুকদারসহ অনেকে। বলা হতো গুরুদাস তালুকদারের বক্তৃতা দিতে কোনোদিন মাইকের প্রয়োজন হতো না। তার গলাই ছিল মাইক।
গুরু দা তেভাগা আন্দোলনের নেতা ছিলেন। ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ করার আগে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প এড়িয়ে একটি অগ্নিগর্ভ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল কৃষকেরা। প্রাণ দিয়েছিল অকাতরে। নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু এ আন্দোলন সামনে এগিয়ে নিতে সেদিন ব্যর্থ হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি। ব্রিটিশ, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ এক জোট হয়েছিল এই আন্দোলন দমন করতে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িক রূপ নিতে, পারে, এ আশঙ্কায় মাঝপথে আন্দোলন বন্ধ করে দেয়। সেই আন্দোলনের এক অদ্ভুত মানুষ গুরু দা। গুরুদাস তালুকদার।
বেলা বাড়তে থাকলে আমরা প্রতীক্ষায় থাকি যদি কোনো চিঠি আসে। জেলখানায় চিঠি হচ্ছে বাইরের খবর। একখানা চিঠির জন্যে মানুষের কতো প্রত্যাশা। কিন্তু গুরু দা’র কোনো চিঠি আসত না। বলতাম গুরু দা, কোনো চিঠি নেই আপনার? গুরু দা বলতেন–পাগল, চিঠি লিখবে কে? বাবা ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন রাজনীতি করি বলে। পোষ্যপুত্র নিয়ে সকল সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন। বাবা ত্যাজ্যপুত্র করার পর কলকাতায় আসি। কলকাতায় ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুলে এলএমএফ পড়তাম। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসি। একবার যক্ষ্মা হলে রিলিফের জন্যে দিনাজপুরে যাই। আর দিনাজপুর থেকে ফেরা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আমার বাড়ি রংপুর। বাবা জমিদার। বাবা জীবিত থাকা পর্যন্ত আর রংপুর যাইনি। মা জীবিত থাকা পর্যন্ত দিনাজপুর এসে দেখা করতেন। পড়ার খরচ দিতেন এক জেঠতুতো বোন। মাঝে মাঝে চিঠি লিখত। সে মারা গেছে। এখন কে আমাকে চিঠি লিখবে?
গুরু দার কথা শুনতে শুনতে মনে হতো এ কোন রূপকথার কাহিনী। এ কোন আত্মত্যাগ। জেলখানায় গুরু দা’র কোনো চিঠি আসত না। চিঠি লিখবার কেউ নেই বলে। আমার অজস্র চিঠি আসত। চিঠি লিখবার লোক আছে। আজকের প্রজন্মকে এ কাহিনী শুনাতে গেলে বলবে–গল্প। বলবে, এ ত্যাগের কোনো মানে হয় না। আজকের সমাজে এমন লোকের অভাব আছে যারা এটুকু বলবে যে, এ লোকগুলো না জন্মালে, এভাবে সব কিছু না ছাড়লে তোমাদের এমন একটি দেশ হতো না।
এর মধ্যে দীর্ঘদিন পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে মা’র একখানা চিঠি এল। এবার তাঁরা নিশ্চিত যে, তার ছেলের একটা ঠিকানা পাওয়া গেছে। বেশ কিছুদিন হয়তো চিঠি লেখা যাবে না। মা লিখেছেন, “দেখিতে দেখিতে ১২ বছর হইয়া গেল, তোমার সঙ্গে দেখা নাই। কোথায় থাকো, কেমন থাকো জানিতে ইচ্ছা হয়। মা’র সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১৯ এপ্রিল। জেলখানায় মা’র চিঠি এল ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে। বরিশালে গ্রেফতার হয়েছিলাম ১৯৪৮ সালেরর ২০ আগস্ট। বিএসসি ফাইনাল পরীক্ষার মাত্র ৮ দিন পূর্বে। পরীক্ষা দেবার অনুমতি মিলেছিল। জেলখানায় পড়ার বই ছিল না। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির পর স্বস্তি ছিল না। নিজেই জানতাম না কী হতে যাচ্ছে। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, দেশ ভাগ হবে আমার লাশের ওপর দিয়ে। মওলানা আজাদ বলেছিলেন, পাকিস্তান মানব না। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, কাটছাঁট পাকিস্তান মানব না। পাকিস্তান চাই-বাংলা পাঞ্জাব ভাগ করা চলবে না। কারো কথা সত্য হলো না। জিতে গেলে ব্রিটিশ সরকার। জওহরলাল নেহেরু, বল্লভভাই প্যাটেল, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী ভারতে ব্রিটেনের শেষ বড় লাট লর্ড মাউন্ড ব্যাটেনের কথা শুনলেন। ভারতবর্ষ বিভক্ত হলো। পাকিস্তান এবং ভারত হলো। বাংলা, পাঞ্জাব ভাগ হলো। কেউ জানতে চাইল না এই ভাগাভাগির ফলে সাধারণ মানুষের কী হবে। আমি নতুন প্রজন্মকে অনুরোধ জানাবো-ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়ন। জানার চেষ্টা করুন ব্রিটিশ বেনিয়াদের চরিত্র। জানুন, এই উপমহাদেশের ষড়যন্ত্রকারী নেতৃত্বের চরিত্র। এই ভাগাভাগির ফলে পাকিস্তানের করাচি আজ ৮০ লাখ ভারতীয় মোহাজেরের শহর। প্রতিদিন মারামারি ও দাঙ্গা করে বেঁচে থাকতে হয়। ঢাকার জেনেভা ক্যাম্পে মানুষ নামক এক ধরনের প্রাণী জীবনধারণ করছে। এদের জন্ম বাংলাদেশে। এদের পিতা-পিতামহ জন্মেছিল ভারতে। এরা দেশ বিভাগের শিকার। বাংলাদেশে অবাঙালি। এখন পাকিস্তানের নাগরিক। পাকিস্তান সরকার বলে দিয়েছে তাদের তারা নেবে না। কোথায় যাবে তারা, কী হবে তাদের পরিচয়? বেনাপোল থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিমে যান, দেখবেন স্টেশনে স্টেশনে অসংখ্য মানুষের ভিড়। রেললাইন ধরে পাঞ্জাব-পাকিস্তান সীমান্ত পর্যন্ত যান–অন্তত একজন মানুষ পাবেন, ওদের পরিচয় এককালের এই পাকিস্তানের হিন্দু। জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে খাঁটি অবাঙালি হয়ে গেছে অনেকে বসনে, ভাষায়।
পূর্বে মিয়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া যান। এবার যেতে হবে পতিতালয়ে। এই পতিতালয়ে যারা আজকে আছে তাদের পূর্বপুরুষ অনেকেই এসেছিল ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় একহাত থেকে আর এক হাত হয়ে। উপমহাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর ভারত-পাকিস্তান সরকারের যৌথ কমিশনের হিসাবে দেশ ভাগের সময় উপমহাদেশের ৬ লাখ তরুণী এবং মহিলা পণ্য হয়ে এসেছিল এ দেশগুলোর পতিতালয়ে। আর এদের জীবনের বিনিময়ে যারা নেতা হয়েছিলেন, সরকার গঠন করেছিলেন তাদের সমাধি আছে নয়াদিল্লি আর করাচিতে। এখনো এ সকল সমাধিতে হাজার হাজার দর্শনার্থী আসে প্রতিদিন। কেউ খবর রাখে না এই ভাগাভাগির ফলে কোটি কোটি মানুষের দুর্ভোগের ইতিহাস।
এ পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালে ঢাকা জেলে এসেছিলাম। মনে ভয় ছিল। পাকিস্তানের প্রথম যুগ। সবকিছু দেখা হয় সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে। সর্বত্রই সন্দেহ-সংশয়।
সেবার ঢাকা জেলে এসে প্রথম সবকিছু গোছানো পেয়েছিলাম। অসংখ্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ইতোমধ্যে জেলে এসে গেছেন। ঢাকা জেলে আছেন ঢাকার রণেশ দাশগুপ্ত, ধরণী রায়, বরিশালের নটু ব্যানার্জি আর কংগ্রেস নেতা হরিগঙ্গা বসাক। হরিগঙ্গা বসাকের ঢাকা জেলে মৃত্যু হয় ভুল চিকিৎসার জন্যে। হরিগঙ্গা বসাকের বাড়ি ঢাকার বনগ্রাম লেনে। রাজনীতি করতেন ত্রিপুরার আগরতলায়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় তিনি ত্রিপুরাকে ভারতে নেবার জন্যে তদ্বির করেছিলেন। সে জন্যে রাগ ছিল পাকিস্তান সরকারের। তাই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরই তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তিনি ১৯৪৮ সালে জুলাই মাসে ঢাকায় এলেই গ্রেফতার হয়ে যান। তখন ভারত-পাকিস্তান পাসপোর্ট চালু হয়নি। ইচ্ছে হলেই যাতায়াত করা যেত। হরিগঙ্গা বসাক অসুস্থ মাকে দেখতে এসে জেলে গেলেন। আর জেলেই তার মৃত্যু হলো। কেউ আগরতলা গেলে দেখবেন একটি সড়কের নাম হরিগঙ্গা বসাক সড়ক।
১৯৪৮ সালে ঢাকা জেলে এসে প্রথমে ভয় করলেও পরে মানিয়ে নিয়েছিলাম। আর আমাদের মতো কম বয়সের কেউ জেলে না থাকায় আবার সহানুভূতি পেয়েছি সকল মহল থেকে।
তবে ঢাকা জেলে এসে বুঝেছিলাম, পাকিস্তান সরকার কাকে বলে এবং কী তার প্রকৃত চরিত্র। তখন কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ছিল সরকারকে এ মুহূর্তে আঘাত করে ফেলে দেবার নীতি। সুতরাং অনশন গণ্ডগোল জেলে প্রতিদিন লেগেই ছিল এবং এর মধ্যে পাকিস্তান সরকার রাজবন্দিদের দেয়া ব্রিটিশ আমলের সকল সুযোগ-সুবিধা বাতিল করে দেয়। রাজবন্দিদের পরিণত করা হয় সাধারণ কয়েদিতে। এ পরিস্থিতিতে ঢাকা জেলে ১৯৪৮-৪৯-৫০ সালে মোট ১২৭ দিন অনশন করেছিল রাজবন্দিরা।
এই পরিস্থিতিতে ১৯৫২ সালের অক্টোবরে আমি মুক্তি পাই। তারপর ১৯৫৪ সালে বরিশালে খুনের মামলার আসামী। ১৯৫৬ সালে মামলা প্রত্যাহার। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক আইন। ১৯৫৯ সালের অক্টোবরে আবার ঢাকা জেলে।
এবার খুব খারাপ লাগছিল না। ঢাকায় রাজনীতি করি। দীর্ঘদিন ছাত্রলীগ করেছি। ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়েছি। আওয়ামী লীগের ভাঙন দেখেছি। ন্যাপ গঠন করেছি। এবার জেলখানায় এসে দেখি অসংখ্য ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জেলে। তারা চেনা। তাই ভিন্ন পরিবেশ।
১৯৪৮ সালে জেলখানায় ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সে যুগের জঙ্গি নীতি। যে কোনো প্রকারে তোক জেলখানায় গোলযোগ করা। তাদের তত্ত্ব ছিল জেলখানায় গোলযোগ হলে বাইরের জনতা উত্তেজিত এবং সংগঠিত হবে। সরকার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠবে। সরকারের পতন ঘটবে।
এবারের চিত্র একেবারে ভিন্ন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পরাজিত হয়েছে। যুক্তফ্রন্টের নামে আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতন্ত্রী দল মন্ত্রিত্ব করেছে। আওয়ামী লীগ ভেঙেছে, গণতন্ত্রী দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একাংশ মিলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ জন্ম নিয়েছে। এ ন্যাপ প্রাদেশিক পরিষদে কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো কৃষক শ্রমিক পার্টিকে সমর্থন দিয়েছে। ফলে মন্ত্রিসভার ভাঙন-গড়ন হয়েছে। দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। আর এক পর্যায়ে সামরিক বাহিনী পাকিস্তানে ক্ষমতা দখল করেছে।
প্রশ্ন আসতে পারে এ জন্যে দায়ী কে? এ অবস্থায় ন্যাপের দায়িত্ব কতটুকু? ন্যাপ বললে কমিউনিস্ট পার্টিকে বাদ দেয়া যায় না। কারণ ন্যাপ গঠনের আগে ও পরে কমিউনিস্ট পার্টি সঙ্গে ছিল। আর ন্যাপের নেতা ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এ হচ্ছে ন্যাপের প্রথম যুগ।
একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল চিঙ্কারে। ঘুম ভেঙে দেখলাম ন্যাপের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। একপক্ষ বলছেন ন্যাপ গঠন ভুল ছিল। আমাদের আওয়ামী লীগে থাকাই উচিত ছিল। আর একপক্ষ বলছেন-ন্যাপ গঠন ঠিক ছিল। কিন্তু গণতন্ত্রী দলের সম্পাদক সিলেটের মাহমুদ আলীকে ন্যাপের সম্পাদক করা ঠিক হয়নি। আমি বিতর্কে যোগ না দিয়ে জোরে হেসে উঠলাম। সবাই বললেন, হাসছেন কেন? আমি বললাম-দেখুন, একটা কিছু ভুল হয়েছে, নইলে দেশ সামরিক শাসন জারি হবে কেন? আর আপনারা যারা কমিউনিস্ট পার্টি করেন বা সমর্থক আপনাদের গোপন সংগঠন করাই ভালো। আওয়ামী লীগ বা ন্যাপে ঢুকে এ সকল দলকে দখল করবেন বা এ সংগঠনকে আপনার মতো চালাবেন–এ তত্ত্ব সঠিক নয়। এতে আদর্শগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। নিজের দল থাকে না। ঢাকা জেলে এককালের জাদরেল কমিউনিস্ট শামসুদ্দীন আহমদ আমার সঙ্গে ছিলেন। মুসলিম লীগ দখলের জন্যে তাঁকে আপনারা মুসলিম লীগে ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ রাজনীতিতে গুরুত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর আপনাদের ভাষায় তিনি নাকি পাকিস্তানের গোয়েন্দা হয়ে গেছেন। তিনি জেলে এলেন। তার ওপর আপনাদের এতো অবিশ্বাস যে, তিনি দিন-রাত আমার কাছেই থাকতেন আর দুঃখের কথা বলতেন। তাই রাত দুপুরে এ নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। ভুল সবাই মিলে না করলে কি সাধের পাকিস্তানে এমনি করে বারবার গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়!
এবারের জেলখানায় অনেক প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতাই ছিলেন। জীবন সায়াহ্নে শুনছি তাদের খেদোক্তি। দলে একের পর ভুল সিদ্ধান্তের ফলে তারা বারবার জেলে এসেছেন। অনেক কমিউনিস্ট নেতাই পাকিস্তান সৃষ্টির পর বছরের পর বছর জেলে থেকেছেন। আপনজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। ঘর ভেঙেছে। কিন্তু রাজনীতি এগোয়নি। দুপুরের স্নানের সময় আমি ব্রিটিশ আমলের দেশাত্মবোধক গান গাইতাম। তখন পাশে এসে দাঁড়াতেন বরিশালের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হিরণ ভট্টাচার্য। কলেজের এককালীন নামকরা ছাত্র। আত্মীয় বলতে এদেশে কেউ নেই। আত্মীয় হচ্ছে একমাত্র রাজনীতি। সে রাজনীতি বিপর্যস্ত। আমার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি গান শুনতেন। চোখ থেকে তখন টপটপ করে জল পড়ত।
আমাদের সঙ্গে ছিলেন বগুড়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সুবোধ লাহিড়ী। এককালে অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। এক সময় আরএসপি করেছেন। পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে এসেছেন। জীবন মধ্যাহ্ন পার হয়েছে। দেশে সামরিক শাসন। কেউ জানে না কবে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে। কবে আমরা মুক্তি পাব। সুবোধ বাবু মাঝে মাঝে গল্প বানাতেন। বলতেন, ঢাকা জেলের গেটের সামনে একটি বাদাম গাছ আছে। এই বাদাম গাছে একটি ডাইনি বসে আছে। যে বা যারা জেলখানা থেকে বের হয়, ডাইনি তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সবাই জেলখানার কথা ভুলে যায়। সুবোধ বাবু এ। কথা বলেছিলেন বড় দুঃখে। সে এক অদ্ভুত ঐতিহ্য। জেলখানায় থাকাকালীন সকলেই সকলের বন্ধু থাকে। জেল থেকে মুক্তি পাবার সময় প্রতিশ্রুতি দেয় যে, জেলের বাইরে গিয়ে সকলকে মনে রাখবে। সকলকে সম্মান করবে। কিন্তু দু’একজন ব্যতিক্রম ছাড়া বন্ধুদের কেউ কখনো মনে রাখে না। তখন ঢাকা জেলের সুপারিন্টেভেট ছিলেন নিয়ামত উল্লাহ। তার বড় ভাই রহমত উল্লাহ ১৯৫০ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। দায়ী ছিলেন সে সময় দাঙ্গার জন্যে। কিন্তু নিয়ামত উল্লাহ ছিলেন ভিন্ন মানুষ। তার ভয়ে জেলখানায় বাঘ-মোষে একসঙ্গে পানি খেত। তিনি জেলখানায় ঢুকলে জেলখানা ভিন্ন রূপ ধরত।
এক কথায় নিয়ামত উল্লাহ কঠিন লোক ছিলেন। তিনি জেলখানায় ঢুকলে জেলে পাতাটিও নড়ত না। গাছ থেকে একটি পাতা ঝরলে পর্যন্ত জেল পুলিশ কুড়িয়ে পকেটে রাখত। এই নিয়ামত উল্লাহর সঙ্গে যে কোনো কারণেই হোক আমার একটি ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সস্তায় বুধবার তিনি আমাদের ওয়ার্ডে আসতেন। দেখতেন আমরা কেমন আছি। একদিন আমি বললাম, আপনার জেলখানায় এসে বিপদে পড়ে গেছি। তিনি বললেন কেন? আমি বললাম, বাইরে থাকতে জানতাম দুধের মধ্যে জল দেয়। জেলখানায় দেখছি জলের মধ্যে দুধ দেয়া হয়। আমি একসময় রসায়নে অনার্সের ছাত্র ছিলাম। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না জলের মধ্যে দুধ দিয়ে সাদা করা হয় কী করে। জেলখানায় তো দুধের বর্ণ সাদাই দেখছি।
নিয়ামত উল্লাহ সাহেব হেসে ফেললেন। আমি একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলাম। আমার প্রয়োজন ছিল ভিন্ন ধরনের। ১৯৫২ সালে ঢাকা জেল থেকে মুক্তি পাবার সময় আমি এক ফুটফুটে বিহারী ছেলেকে দেখে গিয়েছিলাম। ছেলেটির নাম রহিম। তখন জেলখানায় অসংখ্য অবাঙালি সিপাহী ছিল। মাত্র দু’জন ছিল পাঞ্জাবের অধিবাসী। আর সবার বাড়ি বিহার এবং উত্তর প্রদেশে। বিহারের ইয়াকুব মিয়া, উত্তর প্রদেশের মাহমুদ হাদিস, উড়িষ্যার রমজান আমার কাছে দুঃখের কথা বলত। ওরা দেশ ছেড়ে এসেছে। দেশের কথা ভুলতে পারেনি। দেশ ছাড়তে গিয়ে সব হারিয়েছে। পাঞ্জাবি আলী মহাম্মদ খান এবং গোলাম খানের প্রায় স্থায়ী ডিউটি ছিল আমাদের ওয়ার্ডে। এরা ব্রিটিশ আমলের সিপাই। গোলাম খান ৮ ঘণ্টা হেঁটে হেঁটে ডিউটি করত। কখনোই বসত না। আলী মহাম্মদ খান তত কঠিন ছিল না।
১৯৫৯ সালে জেলে গিয়ে এদের খোঁজ করলাম। আলী মহম্মদ খান অবসর নিয়ে দেশে চলে গেছে। গোলাম খান কোনোক্রমে চাকরিতে আছে। বৃদ্ধ ইয়াকুব ও রমজান মিয়া এখনও ডিউটিতে এলে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে। হাদিস জমাদার হয়ে গেছে। মাহমুদ অন্য জেলে চলে গেছে। রহিম ঢাকা জেলেই আছে। একদিন সন্ধ্যার পর রহিমের সঙ্গে আমাদের দেখা। রাতের ডিউটিতে রহিম আমাদের ওয়ার্ডে এসেছিল। সে আমাকে চিনতে পেরেছে। আমি জানালার পাশে বসে পড়ছিলাম। রহিম বলল, বাবু সাব আবার জেলে এলে। তুমি বারবার কেন জেলে আস? আমি বললাম, তুমি দেশ ছেড়েছ কেন? পাকিস্তানে তুমি কী করবে। লেখাপড়া করেছে কতদূর।
রহিম ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৫০ সালে সে বিহার থেকে ঢাকা এসেছে। আত্মীয় স্বজন অনেকেই দেশে রয়ে গেছে। তার ইচ্ছা আছে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবার। আমি বললাম, তুমি পড়তে চাও? আরবি, উর্দু ছাড়া সব বিষয় আমি তোমাকে পড়াব। তুমি বড় জমাদারকে বলো। তোমাকে যেন স্থায়ীভাবে আমাদের এখানে ডিউটি দেয়।
কিন্তু ব্যাপারটি সহজ ছিল না। আমরা রাজবন্দি। রাজবন্দির ওয়ার্ডে কাউকে স্থায়ী ডিউটি দেবার নিয়ম নেই। খুব বিশ্বস্ত হলে ভিন্ন কথা। অন্যথায় রাজবন্দিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে এবং তাদের মারফত রাজবন্দির বাইরে খবর আদান প্রদান করতে পারে। তাই ব্যাপারটি সহজ ছিল না। সে প্রেক্ষিতে সুপারিন্টেনডেন্টের সঙ্গে আমার কথা বলার প্রয়োজন ছিল এবং সেদিন সুপারিন্টেনডেন্ট নিয়ামত উল্লাহ দ্বিমত করলেন না। কিন্তু আমাকে জানানো হলো রহিম আমাদের ওয়ার্ডেই ডিউটি করবে, তবে স্থায়ীভাবে নয়। মাঝে মাঝে তাকে পাল্টিয়ে দেয়া হবে।
সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। জেলখানায় যারা যায়, সবাই মুক্তি চায়। জেলে যারা থাকে বা চাকরি করে তারাও চায় আমরা যেন মুক্তি পাই। কিন্তু আমার মুক্তির কথা শুনলে রহিম বিষণ্ণ হয়ে যেতে।
এছাড়া মাঝখানে আমার মুক্তির কথাও বারবার আলোচিত হতো। আমার আগে ইত্তেফাকের সম্পাদক মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া গ্রেফতার হয়েছিলেন। তিনিও ঢাকা জেলে ছিলেন। আমি জেলে আসার পর তিনি মুক্তি পান। অনেকেই প্রত্যাশা করেছিল আমি হয়তো শিগগিরই মুক্তি পেয়ে যাব। বাইরে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের সঙ্গে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি ছিলেন মোহাম্মদ আজফর। আমার গ্রেফতারের খবর পেয়ে মোদাব্বের সাহেব আজফরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমাকে কেন গ্রেফতার করা হলো। আজফর বলেছিলেন, এ ব্যাপারে সব দায়িত্ব ব্যুরো অব ন্যাশনাল রি-কনস্ট্রাকশন অর্থাৎ বিএনআর-এর প্রধান কাজী আনোয়ারুল হক-এর।
এই বিএনআর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। এই সংগঠনের দায়িত্ব ছিল বুদ্ধিজীবীদের কেনাবেচা করার। এরা দেশের প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের টাকা দিত। তাদের রচনা প্রকাশ করত। এসব রচনায় পাকিস্তান সরকারের প্রশংসা করা হতো। বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হতো শিক্ষিত মহলকে। এই সংগঠনটি তাদের এই সাহিত্যকর্মের আড়ালে গোয়েন্দাবৃত্তি করত। এদের গোয়েন্দারা ছাত্র, শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক মহলের খবরাখবর রাখত। এই সংগঠনের সুপারিশের ভিত্তিতেই কেউ গ্রেফতার হতো। কারো সরকারি চাকরি হতো। আবার কাউকে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হতো। এককালে এই সংস্থার প্রধান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসান জামান এবং অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। চিফ সেক্রেটারি আজফারের কথা শুনে কিছুটা বিষ্মিত হলেন মোদাব্বের সাহেব। তিনি জানতেন না যে বিএনআর গোয়েন্দা বৃত্তিও করে। তবুও তিনি কাজী আনোয়ারুল হককে জানিয়েছিলেন। তিনি বললেন, নির্মল সেন বড্ড দুর্বিনীত। সে কাউকে মানে না। রাস্তাঘাটে সবাইকে গালি দেয়। এ মুহূর্তে তাকে মুক্তি দেয়া সম্ভব নয়। বেশ কিছুদিন ধরে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলমাল করছে। তাকে ঢাকা হল থেকে ২৪ ঘণ্টার নোটিসে বের করে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবুও সে কোনো কিছু মানতে চাইছে না।
এ খবর জেলখানায় পৌঁছলে বুঝলাম আমি তাড়াতাড়ি মুক্তি পাচ্ছি না। বাইরে তখন সরকার মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচন করার উদ্যোগ নিচ্ছে। অনেকে বলল মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচন হয়ে গেলে হয়তো আমাদের মুক্তি দেয়া হতে পারে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখলাম, বিপরীত ঘটনাই ঘটেছে। একের পর এক রাজনীতিক নেতা ও কর্মীদের গ্রেফতার করে জেলখানায় পাঠানো হচ্ছে। তবুও আমার একটা ক্ষীণ আশা ছিল। আমি সাংবাদিক হিসেবে গ্রেফতার হয়েছি। সাংবাদিক ইউনিয়ন নিশ্চয়ই আমার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করবে।
এবার আমার মাথায় একটা নতুন বুদ্ধি খেলল। আমি জেলে যাবার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পরিবর্তিত হয়েছেন। ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি ইব্রাহিম আইয়ুব খান সরকারের আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন। আমি জেলখানা থেকে তাঁকে চিঠি লিখলাম। চিঠিতে বললাম, আপনি ভাইস চ্যান্সেলর থাকাকালীন আমি ঢাকা হলের ছাত্র ছিলাম। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের সকল ছাত্রাবাসকে ধর্মনিরপেক্ষ অর্থাৎ কসমোপলিটন করার দাবিতে অনশন করেছিলাম। আপনি কথা দিয়েছিলেন আমি অনশন ভাঙলে এই দাবিটি অন্তত আপনি পূরণ করবেন। আপনি বলেছিলেন ইকবাল হল অর্থাৎ আজকের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলকে আপনি কসমোপলিটন করবেনই। আপনি এখন আইনমন্ত্রী। আপনি আপনার কথা রাখলে বাধিত হব।
আমার চিঠি পৌঁছেছিল কি না জানি না। তবে সে চিঠির জবাব আমার কাছে কোনোদিন পৌঁছেনি আর আইয়ুব খানের আমলে কোনো হলই কসমোপলিটন হয়নি।
তবে এবার বিপদ দেখা দিল আমার বিএ পরীক্ষা নিয়ে। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই দীর্ঘদিন ধরে। দলের অন্যতম নেতা রুহুল আমিন কায়সার দীর্ঘদিন যাবত মিটফোর্ড হাসপাতালে। তিনি যক্ষ্মায় ভুগছেন। অনেক কষ্ট করে হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করিয়েছিলাম। কথা ছিল ২৫ অক্টোবর হাসপাতাল থেকে তিনি মুক্তি পাবেন। সব ব্যবস্থা হয়েছিল। ২৪ অক্টোবর তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছি। কিন্তু ওই রাতেই আমি গ্রেফতার হয়ে গেছি। ওই রাতে গ্রেফতার হয়ে যাবার পর শুনেছি দীর্ঘদিন রুহুল আমিন কায়সারকে হাসপাতালেই থাকতে হয়েছে। পরবর্তীকালে আরেক নেতা কমরেড সিদ্দিকুর রহমান তখন বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল ঢুকেছেন। নিতাই গাঙ্গুলীর ওপর তখন পুলিশের কড়া নজর। অর্থাৎ আমি জেলে যাওয়ায় আমার মা যেমন নিশ্চিত হয়েছিলেন আমার ঠিকানা সম্পর্কে, আমার বন্ধুরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিলেন সবকিছু সম্পর্কে।
এ সময় একজনমাত্র মানুষ আমার সঙ্গী দীর্ঘদিনের বন্ধু বিএসসি ক্লাসের সতীর্থ আমার নিমতলী ডি-লাক্স হোটেলের রুমমেট তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার গবেষক অজয় রায়। তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো। প্রায় প্রতিদিন তিনি ঢাকা জেলে আমার জন্যে কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা পৌঁছে দিতেন। সিটি নাইট কলেজে গিয়ে আমার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমার বিএ পরীক্ষার অনুমতি আদায় করেছেন। সে অজয় রায় পরবর্তীকালে ড. অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। এককালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সম্পাদক। বেশ কিছুদিন হলো তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন। এক কথায় বলা যায়, অজয় রায় না থাকলে আমার জেলখানা থেকে বিএ পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হতো না।
কিন্তু সব কিছুরই একটা সীমা আছে। অজয় রায় আমার জন্যে কতটুকু পারেন! আমি বই কোথায় পাব? এক সময় রসায়নে অনার্সের ছাত্র ছিলাম। পরে পদার্থ, রসায়ন ও গণিত নিয়ে বিএসসি পাস কোর্সের ছাত্র হলাম। রাজনৈতিক বিপত্তির জন্যে সব ছাড়তে হলো। এবার আমি বিএ’র ছাত্র। আমার পরীক্ষার বিষয় হচ্ছে–ইংরেজি, বাংলা, অর্থনীতি ও দর্শন।
ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে দু’জন বিকম পরীক্ষার্থী ঢাকায় এলেন। তাঁরা হচ্ছেন জনাব নূরুল ইসলাম ও সাইফুদ্দীন আহমেদ খান। তাঁরা আসায় আমার বেশ সুবিধা হলো। ওদের কাছে কিছু অর্থনীতির বই ছিল, কিন্তু বাংলা, ইংরেজি, দর্শনের বই কোথায় পাব? টাকাও বা কোথা থেকে জুটবে? জেলে যাবার আগে তৎকালীন অ্যাডভোকেট জেনারেল মরহুম বিএ সিদ্দিকীর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে পড়াতাম। তিনি আমার গ্রেফতারের খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে মাইনের টাকা জেলগেটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বই-এর জন্যে খবর দিয়েছিলাম মোদাব্বের সাহেবকে। তিনি বই কিনে সরাসরি নিজেই গোয়েন্দা বিভাগের দফতরে চলে যান এবং অর্থনীতির একটি বই জেলখানায় পাঠিয়ে দেন।
এদিকে তখন বাইরে তেমন আন্দোলন নেই। একদিন আমাকে জেল অফিসে ডাকা হলো। বলা হলো গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। জেল অফিসে ঢুকে আমি চমকে গেলাম। দেখলাম, আমার অতি চেনা এক মানুষ সেখানে বসে আছেন। বহুদিন ধরে তাঁর সঙ্গে মধুর ক্যান্টিনে গল্প করেছি। চা খেয়েছি। তিমি আমাকে দেখে হাসলেন। বললেন, নির্মল বাবু নিশ্চয়ই বিষ্মিত হয়েছেন। আপনি জানতেন আমি আইন বিভাগের ছাত্র। রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করি, একথা সত্য। তবে প্রধানত আমি গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারি। আপনার ওপর নজর রাখার জন্যেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। আমার মতো অনেক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি আমার বিস্ময় কাটতে না কাটতেই একটি ভিন্ন প্রশ্ন করলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ছাত্রলীগ ছাড়লেন কেন? কথা ছিল আপনি সম্পাদক এবং এমএ আউয়াল সভাপতি হবেন। সে প্রস্তাব পরে পাল্টে গেল দেশের বামপন্থীদের চাপে। তারা কেউ আপনাকে পছন্দ করল না। পরে কথা হলো মমিন তালুকদার সভাপতি হবেন। আপনি সহসভাপতি এবং এমএ আউয়াল সম্পাদক হবেন। আপনি সে প্রস্তাব মানলেন না। সে প্রস্তাব মানলে আপনি ছাত্রলীগের একচ্ছত্র নেতা হতেন।
আমি বিস্মিত হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। বললাম, এ ধারণা আপনি কেন করছেন? তিনি বললেন, দেশে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর মমিন তালুকদার কিংবা আউয়াল সাহেব নিশ্চয়ই নেতৃত্বে থাকতেন না। আপনি ছাত্রলীগকে চিনতেন। এ সংগঠনে কিছু বোহিমিয়ান সংগ্রামী কর্মী আছে। এই পুরো সংগঠন নিয়ে আপনি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারতেন। এ সংগঠনের সংগ্রামী ভূমিকা আপনার অন্তত অনুধাবন করা উচিত ছিল। কারণ দীর্ঘদিন এদের সঙ্গে আপনি ছিলেন এবং নেতৃত্বেই ছিলেন। আপনার সম্পর্কে তাদের কোনো প্রশ্নই ছিল না।
আমি বললাম, দেখুন আজকে ১৯৫৯ সালে একথা যেমন সত্য মনে হচ্ছে, ১৯৫৭ সালে তেমন অনুভূতি আমার ছিল না। নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। আমি নিশ্চিত দাবি করতে পারি, তখন আমি না থাকলে ছাত্র ইউনিয়নের এ প্রবল জোয়ারের যুগে ছাত্রলীগকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হতো। ছাত্রলীগে আমিই একমাত্র ছিলাম অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিপন্থী রাজনীতির প্রতীক। আমার সঙ্গে একমাত্র ছিল কমিউনিস্ট পার্টির ময়মনসিংহের কাজী আব্দুল বারী। তবে ইচ্ছা থাকলেও আমার ছাত্রলীগে থাকার উপায় ছিল না। শহীদ সোহরাওয়াদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবার পর আওয়ামী লীগ একটি কমিউনিস্টবিরোধী সংগঠনে পরিণত হয়। ছাত্রলীগও আওয়ামী লীগকে অন্ধ অনুকরণ করতে শুরু করে। আমাদের দল অর্থাৎ আরএসপি সিদ্ধান্ত নেয় যে, ছাত্রলীগ ছাড়তে হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলেই আমার ছাত্রলীগে থাকা সম্ভব হয়নি। এবার তিনি প্রশ্ন তুললেন ময়মনসিংহের কাজী আব্দুল বারী সম্পর্কে। কাজী আব্দুল বারী পূর্ব পাকস্তিান ছাত্রলীগ ময়মনসিংহ শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মূলত কমিউনিস্ট পার্টির লোক। ময়মনসিংহে ছাত্রলীগ কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রদের দখলে থাকায় পৃথক। ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করা হয়নি। কাজী বারী তাদেরই নেতা ছিল। আমরা একসঙ্গে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছিলাম। ১৯৫৪ সালে একটি সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করেছিল। মুসিলম লীগ পরাজিত হয়েছিল। জেলখানা থেকে সকল রাজবন্দি মুক্তিলাভ করেছিল। অনেকের ধারণা ছিল শিগগিরই হয়তো আর জেলে আসতে হবে না। আমি খুনের মামলার আসামী হয়ে ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। সে মামলায় আমি প্রথম দুদিন ব্যতীত কোনোদিন হাজির হইনি। ১৯৫৪ সালের মামলা ১৯৬৫ সালে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ভেবেছি এভাবে নির্বিঘ্নে হয়তো কিছুদিন কাটানো যাবে।
কিন্তু হলো না। যুজফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া হলো। যুফ্রন্টে কোন্দল হলো। সমগ্র পাকিস্তানের রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। সামরিক বেসামরিক আমলারা ক্ষমতা দখল করল। দেশে সামরিক শাসন জারি হলো ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর। আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো গ্রেফতার। আমাদের মুক্ত থাকার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।