৩
বিকেলে আমি পরান মাস্টারের কথা ভুলে গিয়েছিলাম, রাতে মনে পড়ল যে, সে কী একটা শোনাবার জন্যে আমার কাছে আসতে চেয়েছিল, সত্যি সে পাগল এবং ওটা পাগলের কথা মনে করে আমি ঘুমোতে গেলাম। রাতে স্বপ্ন দেখলাম পরান মাস্টারকে। কাঁচা জিগার ডাল ভেঙে সড়ক দিয়ে ধাওয়া করে যাচ্ছে সে, আর পুরো জলেশ্বরীর সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে; দৃশ্যটা আমি দেখছি অনেক ওপর থেকে, শূন্যে ভাসমান অবস্থায়, কোনো বিমান থেকে নয়, বিমান তো সচল, আমি যেন স্থির একটি পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে নিচের এই কাণ্ড কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ করছি।
পরান মাস্টার হঠাৎ সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে আমাকে বলল, ওখানে কী করছিস? নেমে আয়, নেমে আয়।
পরদিন, সারাদিনেও পরান মাস্টার এল না। আমি যে তার অপেক্ষায় ছিলাম, তা নয়, অনেক দিন পরে দেশে ফিরেছি— একজন যাকে সুস্থ বলে জানতাম তাকে পাগল দেখলাম, পল্লীর পরিকল্পনায় পাগলের উপস্থিতি তো আমরা জন্মসূত্রেই মেনে নিয়েছি; অতএব আমার কোনো বিশেষ কারণ নেই যে পরান মাস্টারকে নিয়ে ভাবব। তবে, গত রাতে ঐ স্বপ্নটা দেখে সামান্য কৌতুকবোধ করেছিলাম ভোর বেলায়; সারাদিনে আজ পরান মাস্টারের কথা মনে পড়ে থাকে তো, ঐ পর্যন্তই।
সকালে সাইকেল নিয়ে গোরস্তানে গেলাম, বাবার কবর জেয়ারত করলাম, কবরে বহু দিনের আগাছা, লোক ডেকে পরিষ্কার করালাম, আমার ছোট ভাইয়ের বৌ নানা রকম মাছ রান্না করেছিল, খেয়ে দেয়ে দুপুরে লম্বা ঘুম দিয়ে বিকেল করলাম, সন্ধে বেলায় নদীর পাড় দিয়ে খানিক হেঁটে এসে সিনেমা হলের সমুখে দাঁড়ালাম, পুরনো কয়েক জনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, হলের ম্যানেজারি করছেন এখন বুড়ো মনসুর ভাই, তিনি পেটপুরে পুরি আর জিলিপি খাওয়ালেন, বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে নটা হয়ে গেল। পল্লীতে রাত সাড়ে নটা অনেক রাত।
এই এত রাত্তিরে পরান মাস্টার এসে উপস্থিত।
আমাকে খেতে দেবার আয়োজন করছিল বৌমা, সে হাত গুটিয়ে বিশেষ বিরক্ত হয়ে বলল, পাগল আর আসবার সময় পেল না।
বারান্দায় ভাঙা হেলনা বেঞ্চে সটান বসেছিল পরান মাস্টার, ভেতর থেকে আমি এসে দাঁড়াতেই আমার হাত টেনে পাশে বসিয়ে প্রশ্ন করল, তুই যে লন্ডনে ছিলি, স্পেসশীপ দেখেছিস?
আমি আরো একবার আকাশ থেকে পড়লাম। স্পেসশীপ? নভোযান? মহাশূন্যে নভোচারীরা যায় যে যানে করে? ব্যাডমিন্টনের কর্কের মতো দেখতে?
অবাক হয়েছি এতটা যে, আবার না শোনা পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছি না ঠিক শুনেছি। বললাম, কী দেখেছি বললেন?
স্পেসশীপ, স্পেসশীপ। নিতান্ত বিরক্ত হয়ে পরান মাস্টার বলল, যেন সাইকেল টাইকেল জাতীয় সাধারণ একটা বস্তু আমি চিনতে পারছি না।
ও স্পেসশীপ? আমি নকল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, না দেখি নি তো।
দেখিস নি? বড় হতাশ হলো সে।
তবে ছবিতে দেখেছি।
ছবিতে? ছবি আর আসল কি এক কথা? আসল সে একেবারে আলাদা জিনিস। কথাটা বলে আড়চোখে আমাকে একবার দেখে নিয়ে পরান মাস্টার হাতের লাঠি দিয়ে মাটিতে আঁকি বুকি দিতে লাগল।
কেন? হঠাৎ স্পেসশীপের কথা জিগ্যেস করছেন কেন, পরান ভাই?
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পরান মাস্টার আমাকেই একটা প্রশ্ন করল। তুই বিশ্বাস করিস যে, স্পেসশীপে করে পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাশূন্যে যাওয়া যায়?
বাহ, বিশ্বাস না করবার কী আছে? আমেরিকা, রাশিয়া হরদম লোক পাঠাচ্ছে স্পেসশীপে করে। বিনা মানুষে স্পেসশীপ তো মঙ্গল গ্রহ, শনি গ্রহ ছাড়িয়ে টাড়িয়ে এখন সৌরজগৎ ছেড়ে অজানা অসীমের দিকে যাত্রা করেছে। স্বয়ং মানুষ স্পেসশীপে করে চাঁদে নেমেছে সকলেই জানে; ঢাকায় টেলিভিশনে ছবি পর্যন্ত দেখিয়েছে, জ্যান্ত ছবি, চাঁদের বুকে মানুষ নামছে।
হু। চিন্তিত স্বরে অনুনাসিক ধ্বনি করে পান মাস্টার কিছুক্ষণ মূর্তির মতে। বসে রইল। আমি নির্ঘাত এক পাগলের পাল্লায় পড়েছি, এবং বেশ বৈজ্ঞানিক পাগল, নভোযান আর মহাশূন্য ছাড়া দুশ্চিন্তা নেই।
মুখ তুলে পরান মাস্টার বলল, তুই শুনে অবাক হবি, অন্য কথা দূরে থাক, অন্য সৌরজগত তো পরের কথা, মানুষ যে চাঁদে নেমেছে এটাই জলেশ্বরীর কেউ বিশ্বাস করে না।
আমি মৃদু হাসলাম। এবং চমকে উঠলাম। গতরাতের স্বপ্নের কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেছে আমার। অদ্ভুত যোগাযোগ তো! স্বপ্নে দেখলাম আমি নভোচারীর মতো আকাশে, নিচে পরান মাস্টার আমাকে নেমে আসতে বলছে, আর আজ এই রাতের প্রথম প্রহরে পরান মাস্টার আমাকে মহাশূন্য বিষয়ে প্রশ্ন করছে?
পরান মাস্টার বলল, তুই অনেক লেখাপড়া করেছিস, বিলেত আমেরিকা ঘুরেছিস, তুই যত সহজে বিশ্বাস করেছিস, জলেশ্বরীর কারো পক্ষে বিশ্বাস করাটা তত সহজ না। এখানে কুতুব শাহের মাজারের খাদিম, তিনি এক হ্যান্ডবিল ছেপে বিলি করেছিলেন সেই চাঁদে মানুষ নামবার সময়।
কীসের হ্যান্ডবিল?
মহামুর্খের প্রলাপ। খাদিম সাহেবের কথা হচ্ছে, ঐ যে চাঁদে নামবার ছবি দেখান হয়েছে, ওটা আসলে সাহারা মরুভূমিতে তোলা ছবি, সাহেবরা গোপনে কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের এই ভাওতা দিয়েছে।
আমার মনে পড়ে যায়; আমি বললাম, হাঁ, ঢাকাতেও তখন কেউ কেউ ওরকম একটা কথা বলেছিল বটে; বলেছিল, যে চাঁদ নবীজীর আঙুলের ইশারায় দুটুকরো হয়ে গিয়েছিল, সেই চাঁদে মানুষ নামতে পারে না।
খি খি করে কিছুক্ষণ হাসল পরান মাস্টার; সে হাসির প্রসঙ্গ সঠিক বোঝা গেল না; এবং আমি পাগল সাব্যস্ত করে সে হাসিকে আমল দিলাম না। অচিরে পরান মাস্টার প্রশ্ন করল, তুই তো অনেক জানিস, এটা জানিস তো, যে এই পৃথিবী ছাড়াও আরো অনেক পৃথিবী আছে?
হাঁ, আছে, আছে বৈকি।
সেইসব পৃথিবীর সূর্য আলাদা, আবহাওয়া আলাদা, সেখানে আমাদের মতো প্রাণী আছে? মানুষের মতো বুদ্ধিমান জীব আছে তুই জানিস?
হেসে উঠে বললাম, আচ্ছা পরান ভাই এ সব আমি কি চোখে দেখে এসেছি যে আপনাকে বলতে পারব? বিলেত তো আর বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড নয় যে, বিলেত ফেরত বলেই ব্রহ্মাণ্ডের চোখে দেখা হাল তোমাকে দিতে পারব?
পরান মাস্টার ক্ষেপে গিয়ে বলল, তুই জানিস কি না, তাই জিগ্যেস করছি। আমি তো জানিই তুই সেখানে যাস নি, তুই কেন— এ পৃথিবীর কেউই সেখানে আজ পর্যন্ত যায় নি, এক আমি ছাড়া।
আপনারা শুনলেন? অন্য কোনো সূর্যের অন্য কোনো পৃথিবীতে নাকি এই মাটির পৃথিবী থেকে এ পর্যন্ত একমাত্র তিনিই গিয়েছেন; এবং সেখান থেকে যে তিনি ফিরেও এসেছেন তার প্রমাণ তো জ্বলজ্যান্ত আমার সমুখেই এখন বসে আছেন। আপনাদের মনে পড়বে যে, এর আগে তার কথা শুনে আমি বার দুয়েক আকাশ থেকে
পড়েছিলাম, বারবার তো আর পড়া যায় না? অতএব, আমি এ বার মাটির ওপরেই রয়ে গেলাম। পরান মাস্টার যেন জলেশ্বরী থেকে ঢাকা যাবার কথা বলেছে, আমি সেই রকম জ্ঞানে তার বক্তব্যটি গ্রহণ করলাম।
বললাম, কবে গিয়েছিলেন, পরান ভাই?
হবে, সব হবে, সব বলব। তোকে বলব বলেই তো এসেছি। আমি জানি তুই অন্তত বিশ্বাস করবি! গোড়াতেই তোকে যদি পেতাম, ফিরে আসবার পরপরই, তাহলে এই সারা টাউনের মুর্খগুলোর থোতা মুখ ভোতা করে দিতে পারতাম দুজনে মিলে। আমাকে একা পেয়ে পাগল টাগল যা খুশি এত দিন বলেছে, জানিস?
তাই নাকি?
হাঁ, সেইজন্যেই তো পুরোটা আর ওদের বলা হয় নি, অর্ধেকের একটু বেশি বলা হয়েছিল, তাতেই আমাকে পাগল বলেছে, পুরোটা বললে তো ওরা নিজেরাই পাগল হয়ে যেত।
তাহলে পুরোটা না বলে ভালোই করেছেন, পরান ভাই। এতগুলো মানুষকে পাগল বানানো কি আপনার উচিত হতো?
হুঁ, মন্দ বলিস নি।
পরান মাস্টার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। এর ভেতরে বৌমা একবার লোক পাঠাল আমার খোঁজ নিতে। ‘একটু পরে আসছি’ বলে তাকে বিদায় করলাম। পরান মাস্টারের জন্য আমার খুব মায়া করছে এখন, কী করে তাকে বলি যে, আপনি এখন যান? তার চোখ দিয়েই বা হঠাৎ ঝরঝর করে পানি পড়ছে কেন, তাও বুঝতে পারলাম না; নিঃশব্দে চোখ মুছছে, আবার চোখ ভরে উঠছে তার। আমি পরান মাস্টারের কাঁধে হাত রাখলাম।
পরান ভাই, ও পরান ভাই, কী হলো? আহা, পাগল বললেই তো আর আপনি পাগল হয়ে গেলেন না, যে কাঁদছেন।
আমি কি আর আমার জন্য কাঁদছি রে?
কার জন্যে সে কাঁদছে, আর জিগ্যেস করতে সাহস হলো না, আমি তার কাঁধে হাত রেখেই বসে রইলাম।
অচিরেই পরান মাস্টার আবার আমাকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা তুই এসব বিশ্বাস করিস তো? আপনার যাওয়ার ব্যাপারটা তো?
না, না। জিগ্যেস করছি, তুই অন্য সূর্যের অন্য কোনো গ্রহে আমাদেরই মতো অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব আছে বলে বিশ্বাস করিস তো?
আমার নিজেরই কেমন সন্দেহ হয়, আমিই পাগল হয়ে যাচ্ছি কি না? পরান মাস্টার এত ঘুছিয়ে, পরিষ্কার করে অমন দীর্ঘ প্রশ্নটি করতে পারল, তাকে আমি পাগল মনে করি কী করে, যদি আমি নিজে পাগল না হই?
নাহ, মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে।
আমি বললাম, হাঁ, আমি বিশ্বাস করি।
কেন করিস?
বৈজ্ঞানিকরা বলেন, তাই বিশ্বাস করি।
বৈজ্ঞানিকরা বললেই তুই বিশ্বাস করবি?
তাদের বহু কথাই তো চোখে না দেখে, হাতে কলমে প্রমাণ না পেয়েও আমরা বিশ্বাস করি। তারা বলেন, এত বড় ব্রহ্মাণ্ডের কোটি কোটি সূর্য আছে, আমরা দূর থেকে যাদের তারা বলে জানি, সেইসব সূর্যের ভেতরে একমাত্র আমাদের সূর্যেরই গ্রহণ আছে, আর আমাদের সূর্যেরই একটা গ্রহ এই পৃথিবীতে মানুষ নামে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে, এটা হতে পারে না; মানুষ যদি তা মনে করে, তা হলে বুঝতে হবে মানুষ নিতান্ত কুয়োর ব্যাঙ ছাড়া আর কিছুই নয়, কুয়োর বাইরে পৃথিবী আছে, বা আর কোনো ব্যাঙ আছে সে ভাবতে পারে না। বৈজ্ঞানিকেরা বলেন, অন্তত কয়েক কোটি সূর্যের নিজস্ব গ্রহ আছে, আর তার ভেতর এমন লাখ লাখ গ্রহ অবশ্যই আছে যেখানে প্রাণের বিকাশ হবার মতো পরিস্থিতি আছে, আসলে, সেখানে প্রাণী আছে, কোনো কোনো গ্রহের প্রাণী আমাদের চেয়েও অনেক উন্নত, অনেক অগ্রসর।
ভেতর থেকে বৌমা লণ্ঠন পাঠায়, সে ধরেই নিয়েছে যে আমার উঠতে দেরি হবে, অতএব আমাকে অন্ধকারে থাকতে দেওয়াটা তার পক্ষে বেয়াদবি হয়ে যাচ্ছে। লণ্ঠনের সঙ্গে চা-ও এসে যায়।
লণ্ঠনের আলোয় দেখতে পেলাম, পরান মাস্টার খুব প্রশংসা নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
সুড়ৎ করে চায়ে চুমুক দিয়ে পরান মাস্টার বলল, দ্যাখ, লেখাপড়ার গুণটা তুই দ্যাখ। যে কথা তুই গড়গড় করে বলে গেলি, পড়েছিস বলেই না বলতে পারলি? এখানে সব ছোড়া সারাদিন টি-টি করে বেড়াবে, চায়ের দোকানে আড্ডা মারবে আর প্রেম করে বেড়াবে, পড়াশোনা করবার, দুনিয়ার খোঁজ খবর নেবার সময় আছে তাদের?
প্রসঙ্গটি দুনিয়ার নয়, দুনিয়ার একেবারে বাইরের, এমনকি অনেকের কাছে সুস্থ মস্তিষ্কেরও বাইরের ব্যাপার। আমি চুপ করে রইলাম।
পরান মাস্টার নতুন একটি প্রশ্ন এবার করে বসল।
আচ্ছা, তুই কি বিশ্বাস করিস যে, অন্য সূর্যের কোনো গ্রহ থেকে অন্য জাতের সেইসব বুদ্ধিমান প্রাণী, তুই বললি যাদের অনেকেই আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত, তারা স্পেসশীপ নিয়ে আমাদের পৃথিবীতে এসেছে?
কে বলবে, পাগলের সঙ্গে আলাপ করছি? রীতিমতো নভোবিজ্ঞান নিয়ে কথা হচ্ছে আমাদের। আমিও কখন ভুলে গেছি, প্রথম দিনকার সেই পাগলের সঙ্গে পাগল সেজে কথা চালিয়ে যাবার ব্যাপারটা।
আমি বললাম, সত্যি কথা বলব, পরান ভাই? আমার কখনো বিশ্বাস হয়, কখনো হয় না। আমার কথার শেষভাগটুকু দূর দূর করে উড়িয়ে দিয়ে পরান মাস্টার বলল, বিশ্বাস না হবার কথাটা ছেড়ে দে; আমার কথাটা যখন শুনবি তখন আর দোমনা থাকবে না তোর। তুই শুধু বল বিশ্বাস যদি করিস তো কেন করিস?
কী উত্তর দেব মাথার ভেতরে হাতড়াতে থাকি আমি।
বিলেতে প্রচুর বই বেরিয়েছে এ বিষয়ে, তার খানকতক আমি পড়েছি; প্রথম একখানা বই পড়ে নেশা লেগে যায়, খুঁজে খুঁজে আরো কয়েকখানা যোগাড় করেছিলাম, আমার মনে পড়ে গেল।
সবগুলো বই বাইবেল থেকে কিছু কিছু বর্ণনার উদ্ধৃতি দেয়; প্রাচীন কিছু গাথা ও পুরাণ কথা তুলে ধরে; অতীতকালের কিছু নকশা, স্তম্ভ, নির্মাণ ইত্যাদির ফটো ছেপে দেয় এবং বলতে চায় এসবের ভেতরেই প্রমাণ লুকিয়ে আছে যে, একদা এই পৃথিবীতে অন্য সূর্যের অন্য গ্রহের উন্নত প্রাণীরা এসেছিল।
আমার এখন মৃদু বিস্ময় হলো এই ভেবে যে, জলেশ্বরীর মতো সুদূর মফস্বলের একজন ইস্কুল শিক্ষক কী করে ঐ বইগুলো পেল? আর যদিও তা পেয়ে থাকে, তার সামান্য ইংরেজি বিদ্যায় বইগুলোর মর্মোদ্ধার করল কীভাবে।
আমি ‘জিগ্যেসই করে ফেললাম, আপনি এত কথা জানলেন কী করে?
পরান মাস্টার স্মিত হেসে উঠল এবং আমি মনে মনে বললাম- এই সেরেছে, এটা কি প্রশ্ন করলাম? এক্ষুণি তো উত্তর হবে যে, বললাম না তোকে, আমি গিয়েছিলাম, সেই নতুন গ্রহে, সেখানে শুনে এসেছি।
না, পরান মাস্টার নির্মল হেসে উত্তর দিল, বিলেতে গিয়েছিস, ইংরেজি কেতাব পড়েছিস, আর আমাদের একেবারে গেঁয়ো ঠাউরে বসে আছিস, না? তোর ঐ সায়েবদেরই লেখা বই বাংলাতেও এখন পাওয়া যায়, কষ্ট করে পড়লেই জানা যায়। সব শুনলে বুঝবি। ভাষাটাও কোনো ব্যাপারে নয়। ভাষা তো মানুষেরই তৈরি একটা জিনিস। ওটা কোনো বাধাই নয়। তবে আমি বই পড়ে শুধু নয়, অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি। শেষ বাক্যটি পরান মাস্টার হাসি মুছে ফেলে গম্ভীর গলায় উচ্চারণ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
অতএব আমাকে তার প্রশ্নের উত্তর এখন দিতেই হয়। আমি বললাম, বিশ্বাস এই জন্যে করি পরান ভাই যে, কোথায় যেন পড়েছিলাম, খুব বড় একজন লেখকের কথা, কথাটা এই— মানুষ যা কল্পনা করে তা যত অসম্ভবই মনে হোক না কেন সম্ভবপরতা ছাড়িয়ে কিন্তু মানুষ কিছুই কল্পনা করতে পারে না। মানুষের কল্পনা আজ সত্য না হলেও কাল হবেই হবে, কিম্বা অতীতে তা সত্য হয়েছে আমরা ভুলে গেছি।
পরান মাস্টার আমার হাতে চাপড় দিয়ে বলল, তোকে আমি দেখেই বুঝেছি, আমার কথা তোর বিশ্বাস হবেই হবে, সেই জন্যে তো ইস্টিশানে দেখেই হাত ধরে টান দিয়েছিলাম রে। তোকে আমি সব বলছি। ওদের যেটুকু বলি নি, তাও বলছি। একেবারে গোড়া থেকে না বললে তুই বুঝতে পারবি না।
এখুনি শুরু হবে নাকি পাগলের পাঁচালি? এ তো ভালো বিপদে পড়া গেল। ওদিকে ভেতরে আমার ভাত নিয়ে বসে আছে বৌমা, ছেলেমানুষ, তার কষ্ট হচ্ছে। আমি বড় চঞ্চল হয়ে পড়লাম। বোধহয় সেটা টের পেয়েই পরান মাস্টার এখন আমার হাঁটুর ওপর নিজের দুহাত চেপে ধরে ঘুরে বসল, যেন আর উঠে যেতে না পারি। তারপর হঠাৎ গলা নামিয়ে ফিসফিস করে পরান মাস্টার বলল, আমার বীথিপৃ যাওয়ার শুরু কীভাবে শোন। শব্দটা ঠিক ধরতে না পেরে আমি প্রতিধ্বনি করলাম, বীথিপৃ?
ওহো, তোর তো এখনো জানবার কথা নয়। আমি যে গ্রহে গিয়েছিলাম, তার নামই বীথিপ্। নুভা নামে এক সূর্য, তারই একটি গ্রহ। সে এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড। কৃষ্ণপক্ষের রাত। সারা দুনিয়ার এত সভ্য দেশ থাকতে এই বাংলাদেশে, আর এই বাংলাদেশেও এত জায়গা থাকতে এই জলেশ্বরীতে, তাও আমার মতো পুওরেস্ট অব দি পুওর এক ইস্কুল টিচারের ভাঙা বাড়ির পেছনে বীথিপ্ স্পেসশীপ নিয়ে ষ্যনুম এসে নেমেছে।
ষ্যনুম?
আমার হাঁটুতে চাপড় দিয়ে পরান মাস্টার বলল, বীথিপৃর অধিবাসী। ওদের ঐ নাম। এত প্রশ্ন করিস না। চুপচাপ শুনে যা।