৩. নেশায় দম দিয়ে

যদু নেশায় দম দিয়ে দোহনে লেগে পড়েছিল। গ্রামের দুই ঘর থেকে চাল ডাল তেল নুন দিয়ে গিয়েছিল। বাথানের ড্যারা তাদের মাঠে। মাঠে সার হবে। সূর্যাস্তের আগেই দোহন শেষ হয়েছিল। দুধ সব পাটুলিতেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকার নামবার আগেই প্রাণীদের পায়ে পায়ে দড়ি বাঁধা সারা। রান্না চেপেছিল। কৃষ্ণপক্ষের কালো রাত্রের আকাশ ভরা তারা। গ্রাম থেকে ভেসে আসছিল খোল করতালের সঙ্গে নামগান। কাঠের আগুন আর একটা হ্যারিকেনের আলোয় চারজন তাস খেলছিল।

যদু গাছতলা থেকে সরে, একটা চট পেতে শুয়ে ছিল। সে ওঠেনি, ভাত খায়নি। শ্রীবাস ধমক দেওয়ায়, আধ সের মতো কাঁচা দুধ খেয়েছিল। গদাধর হেসেছিল, এক বেলা আমার শউড় বাড়িতে খেয়ে, গোটাদিনের খিদে মিটে গেছে? মাদবের বউ কী খাইয়েচে র‍্যা তোকে?

যদু সে কথার কোনও জবাব দেয়নি। জটা এসে বলেছিল, চল যদু, জামালপুরে ঘুরে আসি।

জটার মতলব খারাপ ছিল। ও জামালপুরের বাউরিপাড়ায় যেতে চেয়েছিল। চোলাই মদ খাবার ধান্দা। ফাউ হিসেবে বাউরি শুণ্ডিনীর সঙ্গে একটু হাসি মশকরা। যদু যায়নি। ও দ্রব্যে কোনওদিনই ওর টান ছিল না। জটাও একলা যায়নি। বাঁকাকে ডেকেছিল। বাঁকাও যায়নি।

পরের দিন ভোরবেলা দোহন পর্বের পর, প্রাণীদের নিয়ে চার জন বাথান নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। তিনজন গিয়েছিল দুধ নিয়ে পাটুলিতে। যাবার আগে সবাই পান্তাভাতে কাঁচা দুধ মেখে খেয়েছিল। পান্তা হোক আর গরম ভাত হোক গোপজনেরা দুধ পেলে আর কিছু চায় না। দুধ তাদের ধন-রত্ন। দুধের রং গন্ধ তাদের ক্ষুধা বাড়ায়। কাঁচা হোক, জ্বাল দেওয়া হোক, দুধ হলেই হল। শ্রীবাস যদুকে বাথানে যেতে দেয়নি। পেট খারাপ মহিষীকে বিশেষভাবে দেখাশোনার জন্য বলে গিয়েছিল। বাথান নিয়ে বেরিয়ে এক-আধদিন দুপুরে রান্না খাওয়া হয়। আগেরদিন বড়গাছি থেকে বাথান দুপুরে নিমদেয় এসে ড্যারা করেছিল। সেদিন আর দূরান্তরের মাঠে প্রাণীদের খাওয়াতে নিয়ে যাবার দরকার ছিল না। সেইজন্য দুপুরে রান্না হয়েছিল। বাথানে রান্না চাপে রোজ বিকালে দোহন পর্বের শেষে, সন্ধ্যারাত্রে।

মহিষীটা ছাড়া ছিল। যদু দেখেছিল, প্রায় সারা রাত মহিষী নেদেছে। সুদেব ঘোষ, মাঝবয়সি, শক্ত শরীর মানুষ। ছিট-গঙ্গার ধার থেকে ফিরেছিল। ড্যারার দেখাশোনা, উনোন সাজানো, কাঠ পাতা জোগাড় করা তার কাজ। একটা চোখ খারাপ, একেবারে দেখতে পায় না। চল্লিশ প্রাণীর মালিক। গদাধরও যায়নি। দরকার ছিল না। তারা একঘর থেকেই পাঁচ জন গিয়েছিল। ভোরবেলা তামাক খাওয়া সেরে, গদাধর দক্ষিণের মাঠে যাবার আগে, মহিষীর দিকে এক বার দেখেছিল। সুদেব প্রাকৃতিক কাজ সেরে, ছিট-গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে এসেছিল। শুকনো কাপড় পরে, ভেজা কাপড় গামছা নিংড়ে মাটিতেই ছড়িয়ে দিয়েছিল। কাপড়ের ওপর একটা মাটির ঢ্যালা রেখে গিয়েছিল। বাতাসে উড়ে না যায়। যদুর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ভোর হতে না হতেই, মহিষীকে মাছি ঘেঁকে ধরেছিল। যদু মহিষীর গলার ঘন্টা বাধা দড়ি ধরে কিছুটা দক্ষিণে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। দুর্গন্ধ পাতলা মল ছড়িয়েছিল খানিকটা জায়গা জুড়ে। যদুর টানে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়েছিল। বড় জিভ বের করে, যদুর বুকের কাছে চেটেছিল। যদু মহিষীর মুখে গলায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল, হ্যাঁ সোনা মা, কষ্ট হচ্ছে, বুঝতে পাইরচি। ক্যানে এ ব্যামো হল, কে জানে।

মনে ল্যায়, গঙ্গা পেরোবার সময়ই কিছু মুখে ঢুকেছিল।সুদেব বলেছিল, পথে আইসতে খারাপ ঘাস খেলে, ও একলা খেত না। তা’লে আরও পেরানিদের পেট খারাপ কইরত। বাড়িতে থাইকতে কিছু হয় নাই ত? নজর রেখেছিলে?

যদু বলেছিল, আইসবার দিন ভোরবেলাও দোয়ান হইয়েছিল। পাতলা নাদলে, কারুর না কারুর নজরে পইড়ত। তবে কী জানি, বলা ত যায় না। ক্যানে না, সোঁতের জল পেরবার সোময়, কেউ ত কিছু খায় না। এক যদি কোনও কিছুর মড়ার মাংস ভেসে এইসে। সোঁতের মুখে, মুখে ঢুকে গিয়ে থাকে। তাও ও সব জিনিস এরা মুখে নেয় না। মাছ মাংসের আঁশটে পচা গন্ধ ওদের সয় না। জলে মুখ বন্ধ কইরে রাখে। যদু গাছতলায় গিয়েছিল। একটা বালতিতে জল ছিল। এক বস্তা কাটা খড়, খোল মেশানো ছিল। সঙ্গে রাখতে হয়। কখন কোন প্রাণীর জন্য দরকার পড়ে, বলা যায় না। যদু সেই বস্তার ভিতর থেকেই দড়িতে বাঁধা এক গোছ লুড়া বের করেছিল। বালতি, ঘটি আর একমুঠো লুড়া নিয়ে মহিষীর কাছে গিয়েছিল। ঘটিতে জল তুলে, লুড়া ভিজিয়ে মহিষীর মলদ্বার, পাছা মুছিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছিল, শালা মাছিগুলান রাক্ষস। পোঙা মুখটা হেজে গেচে দেইখচি।

খোন্দ হয় নাই ত যদু?’ সুদেব জিজ্ঞেস করেছিল।

মাঝবয়সি লোকটার কথা শুনে যদুর মেজাজ খারাপ হয়েছিল, দেইখচ পাতলা নাইদচে, পেট খারাপ হইয়েছে। এর মধ্যে খোন্দ দেইখলে কোতায়?

কথা ঠিক। খোন্দ হলে পেট ফুলত। পেকে ওঠবার মুখে বেশি মুসুরের ডাল খেয়ে ফেললে, খোন্দ হয়। পেট ফোলে। তখন প্রাণীর বাঁচার আশা কম থাকে। পেটে বেজায় বায়ু জন্মে, বুকের কাছে খিল ধরে দম আটকে যায়। শেষ চেষ্টা হিসাবে, বিদে কাটি দিয়ে তখন তলপেটের কাছে খানিকটা জায়গা কেটে দিতে হয়। দিলে বায়ু বেরিয়ে যায়। সুদেব ঘোষের মতো মাঝবয়সি নোক খোন্দের লক্ষণ বোঝে না।

যদু ভেজা লুড়া ঝাপটা দিয়ে জল ছাড়িয়ে নিয়েছিল। মহিষীর সারা গা মাথা মুখ মুছিয়ে দিয়েছিল। মহিষী লাল চোখ মেলে যদুর দিকে তাকিয়েছিল। দুর্বলের চোখে, কষ্টের দৃষ্টি। যদু মহিষীর চোখ, নাকের ভিতর পরিষ্কার করে দিয়েছিল। কানের ভিতরের চামড়া ঘষে দিয়েছিল। মহিষী নিজের বাছুরের মতো যদুর গা চেটে দিয়ে, বড় নিশ্বাস ফেলেছিল। যদু বলেছিল, হঁ হঁ বুঝেছি গো, কষ্ট হচ্ছে।’

ঠিক সেই সময়েই মহিষীর সারা গা কেঁপে উঠেছিল। গলায় একটা লম্বা দমবন্ধ শব্দ করেছিল আঁক করে। সুদেব বলেছিল, যদু, দ্যাখ ত, পেটের ভেতর থেকে কী বেরিয়ে আইসচে যেন?

যদু ঝটিতি পিছনে এসে দেখেছিল। মহিষীর পাতলা মলের সঙ্গে, পেটের নাড়ি বেরিয়ে এসেছিল। গদাধর এসে তখন পঁড়িয়েছিল। যদুর চোখে উদ্বেগ আশঙ্কা ফুটে উঠেছিল, কী বোঝ ঠাকুদ্দা?’

দুদিনে এত বাড়াবাড়ি হল ক্যানে?’ গদাধরের কপালে ভাঁজ পড়েছিল। চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া। সূর্যোদয়ের রোদ ভরা পুবের আকাশের দিকে তাকিয়েছিল, কেউ কিছু খাইয়ে টাইয়ে দেছে নাকি?

সুদেব বলেছিল, তা দিতে পারে। শত্তুরের অভাব নাই। মইষীর মরা পালানের চেহারাও কী ভরাট। দেইখলে নজর লাইগতে পারে। রোজা ওঝা ডাইকবা খুড়ো?

সুদেব এক চোখে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে মহিষীর দিকে তাকিয়েছিল। যদুর ভাল লাগেনি। মনে মনে বলেছিল, শালা এক চখো, নজর লাইগলে তোমারই লেইগেচে। গদাধরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কেমন বোঝ ঠাকুদ্দা? শান্তি শাকের শরবত গেলাতে হবে কি?

লক্ষণ ত সেই রকমই দেইখছি। গদাধর মহিষীর দিকে তাকিয়েছিল, জামালপুরে একজন ভাল মুসলমান ওজা আছে। তাকে একটা খবর পাঠাতে পাইরলে।

যদু বালতি ঘটি হাতে তুলে নিয়েছিল, ওজা রোজা পরে ডাইকলেও হবে। আমি যাই শান্তি শাকের ব্যাওস্তা দেখি। নিমদের মুদি দোকানে চিটে গুড় মিলবে।

আ, ওই শোন যদু, এত তড়িক-ঘড়িক করিস না। গদাধর যদুর পিছনে পিছনে গিয়েছিল, মাঠ বাদাড় খুইরে, মুখ ধুইয়ে আগে কিছু খা।

যদু তা জানত। সেইজন্যেই ওর তাড়া। বোঁচকার ভিতর থেকে বিড়ির কৌটা দেশলাই বের করেছিল। কৌটা থেকে একটা বিড়ি নিয়ে, দেশলাই হাতে দক্ষিণের বাঁদাড়ে গিয়েছিল। ওই দিকে একটা এঁদো পড়া জলাশয়ও ছিল। নিমদেয় এলে ওই বাদাড় আর জলাশয়েই সবাই প্রাকৃতিক কাজ সারতে যায়। রাত্রে যায় না। কিছু দূর গিয়েই যদু বিড়ি ধরিয়েছিল। বাঁদাড়ের জঙ্গলে জলাশয়ে প্রাকৃতিক কাজ সেরে, একটা বাবলা গাছের কচি ডাল ভেঙে নিয়েছিল সে। কাটা আর পাতা খসিয়ে, দাঁতন কাটি করে চিবোতে চিবোতে ফিরেছিল। দেখেছিল, ঠাকুদ্দা হুঁকা টানছে। মহাদেব ঘোষ এসেছিল। দুজনে বসে কথা বলছিল। মহাদেবকে দেখেই, উমির মুখ মনে পড়েছিল। ভোররাত্রে ঘুম ভেঙেই, হাতে তেলজল মেখে, দোহনে লেগে পড়েছিল। জীবনের গতিক কেমন, বোঝা যায় না। রাত্রে সকলের কাছ থেকে সরে, চট পেতে শুয়েছিল। সারা আকাশে ছড়ানো ছিটানো কত কত তারা। সব তারাগুলোতেই যেন উমির মুখ হাসছিল। উমির চোখ ঝিলিক দিচ্ছিল। বাতাস বইছিল ঝিরঝির। কুউ না, অন্য কোনও স্বরে পাখির ডাক ভেসে আসছিল। প্রাণীরা সব চুপচাপ থাকলেও, থেকে থেকেই তাদের গলার ঘণ্টা বেজে উঠছিল। আর এক একটা ভেড়া মাঝে মাঝে ডেকে উঠছিল। হয়তো দুরে শেয়ালের চোখ জ্বলে উঠতে দেখেছিল। গোবাঘ আজকাল বড় একটা দেখা যায় না। শীতকালের বাথানে হায়নার উপদ্রব বেশি। শিয়াল সবখানেই আছে। ওদের লক্ষ্য ভেড়াদের দিকে।

যদু জানত, কেউ না কেউ লাঠি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শিয়ালের জন্য ভেড়াদের পাহারা দিতে হয়। উনোনে সারা রাত্রি আগুন জ্বলে। ভেড়াদের রাখা হয় নিজেদের সব থেকে কাছে। মানুষ না দেখতে পেলেও, ভেড়ারা শিয়ালের অস্তিত্ব টের পায়। ওদের গায়ের চামড়া কেঁপে ওঠে। ভিতু ভেড়া অনেক সময় যেন দুঃস্বপ্নও দেখে। সারা রাত্রিই ওরা মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে। ওরা কেউ ডেকে উঠলেই, কোনও গোরু মহিষ সাড়া দেবেই। তখন মানুষের হাক শোনা যায়, হ হেই হেই, কোন শালা র‍্যা।’…

যদুর কানে সেই সব ডাক হক ভেসে আসছিল। কিন্তু কোনও ধ্যান ছিল না। ও দেখছিল, ছুঁয়ে ছড়ানো ঝরা শিউলির মতো আকাশ ভরা তারাগুলোকে। সব তারাতেই উমির মুখ। উমির চোখ। একেবারে বেদাগি প্রাণে সেই প্রথম দাগ লেগেছিল। মাত্র এক বেলার ঘটনা। মনে হয়েছিল, সে যেন কতকালের ঘটনা। বড় উচাটন মন। ভারী অসহায় উতলতা। কেমন একটা অবাক করা কষ্ট। যদু ছটফট করেনি। নিথর শুয়ে ছিল। ঘুম ছিল না চোখে। পশ্চিমের কত দূরেই তা ছিল সেই মেয়ে? অথচ তাকে দেখতে হচ্ছিল দূরের আকাশের তারায়। তবু সুপ্তি এসেছিল। আকাশ এসেছিল নেমে। উমি-মুখ তারাগুলো ছুঁয়েছিল ওর মুখে, চোখের পাতায়, সমস্ত শরীরে।

ভোর রাত্রে ঘুম ভেঙেছিল। দোহন পর্বের সাড়া শব্দে ঝটিতি উঠে বসেছিল। চট গুটিয়ে তুলে, কাজে লেগে গিয়েছিল। উমিকে মনে পড়ছিল না। অথচ কাজের মধ্যে কোথায় একটা আড়ষ্টতা মনের গভীরে বিধেছিল। কোথায় যেন কষ্ট খচখচ করছিল। কাজের ব্যস্ততায় খচখচানির কারণ বুঝতে পারছিল না। দোহন পর্বের পরে বাথান বেরিয়ে পড়েছিল। অসুস্থ মহিষীর জন্য যদুর দুশ্চিন্তা হয়েছিল। মহিষীর ভাবনা বাহির-মন জুড়ে ছিল। বাহির-মন ভিতরের মনের দরজা আগলে ছিল। দক্ষিণের বাদাড় থেকে ফিরে, মহাদেব ঘোষকে দেখামাত্র, উমি এসে দাঁড়িয়েছিল চোখের সামনে। তাই, কথা এই, জীবনের গতিক কেমন বোঝা যায় না।

গদাধর যদুকে দেখে হেসেছিল। আঁ, তাই ত বলি মা’দেব, কী সোমপরশ্য খাওয়ালে হে আমার লাতিকে, আত্তিরে আর খেতে চায়নি?

আ! আর লজ্জা দিয়ো না গো পিসে। মহাদেব লজ্জা পেয়ে হেসেছিল যদুর দিকে তাকিয়ে, ওকে কি সোমপরশ্য খাওয়ান বলে? চাডডি ডাল ভাত ছাড়া কিছু তো খাওয়ান হয়নি তোমার নাতিকে। হবেই বা কেমন কইরে, বল? ভোজ দেবার মতন রান্নাবান্না ত হয় নাই। কাত্তিকের মা যদুকে নাইতে দেখে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গেচিল।

গদাধর হুঁকাটা বাড়িয়ে দিয়েছিল মহাদেবের দিকে, তা কী জানি। শালা বলে আত্তিরে আর খিদে নাই। বাপ খানিকটে দুধ গিলিয়ে দেচে। তা বল, ওক্কুরদাদা কেমন আচে। ঘরের সবাই ভাল ত?

সোমপর্শ হল, বিশেষ করে নানা ব্যঞ্জনে পেট ভরে খাওয়া। হাঁ, যদুর কাছে কাল দুপুরের খাওয়া সোমপর্শ ছিল বটে। তবে সেটা পেটে খাওয়া না। মনের সোমপর্শ। রাত্রে আর খেতে ইচ্ছে হয়নি। মহাদেব অনায়াসেই গদাধরের সামনে হুঁকা টেনেছিল। একটা বয়স এলে, তখন আর সম্পর্ক দিয়ে ফারাক করা যায় না। যদু বাবলা কাঠি দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে দুজনের কাছে এগিয়ে গিয়েছিল, ঠাকুদ্দা, আমি শান্তি শাগের খোঁজে যাচ্ছি।

অ্যাঁ?’ গদাধর যদুর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল, হাত মুখ ধোয়া মোছা নাই, কাল আত্তিরে সেই খানিকটে দুধ গিলেচিস। মুখ ধুইয়ে দুটো পান্তা খেইয়ে শান্তি শাগের খোঁজে যা।

মহাদেব বলেছিল, হ্যাঁ, যদুর মুকে কাল শুইনছিলাম বটে, একটা মইষীর পেট খারাপ হইয়েচে। তা শান্তি শাক খাওয়াবার মতন বাড়াবাড়ি নাকি?

তা বাড়াবাড়িই দেইখচি। গদাধর বলেছিল, বড়গাছি থেকে আইসবার সোময় কাল থেইকেই চখে পইড়েছিল, মইষী খোঁড়াইচ্চে। এত হঠাৎ কইরে ত এতটা বাড়াবাড়ি হবার কতা লয়। লজর লাইগতেই পারে। ওই ত দেখ না ক্যানে, দু দিনেই মেয়ের এত বড় গতর কেমন কাহিল হইয়ে পইড়েচে। একটু ধরন নাই, ওলাই ঠাগরানের কুলজর লেইগেছে যেন।

মহাদেব হুঁকা থেকে মুখ তুলে উদ্বিগ্ন চোখে, দূরে মইষীকে দেখেছিল, হ্যাঁ, তাই তো দেইখচি পিসে।’

কথাটা মিথ্যে ছিল না। কলেরার মতোই, মহিষী অসারে কালো জলের মতো মলত্যাগ করছিল। যদু জিজ্ঞেস করেছিল মহাদেবকে, এখেনে শান্তি শাগ কোতায় মিলতে পারে খুড়?

শান্তি শাগ–! মহাদেব চিন্তিত মুখে, হুঁকায় দুবার টান দিয়েছিল, হ্যাঁ মিলবে। তুমি আমাদের ছিট-গঙ্গার নাবাল জমিতে খুঁইজলে পাবে। বোশেখ মাস, এ সোময় শাগ পাতার অভাব। পেলে ওখেনেই পাবে। দক্ষিণের মাঠে শুকনো পুকুরটার আশেপাশেও খুঁইজে দেইখতে পার।

গদাধর বলেছিল, জামালপুরে একজন ভাল রোজা আছে–মুসলমান।

 হ্যাঁ, পাঁচু শেখ। মহাদেব বলেছিল, ওর মন্তর জলের খুব নাম আছে।

যদু ওঝার কথা শুনে বিরক্ত হয়েছিল। প্রাণী অঝোর ধারায় নেদে যাচ্ছে, কোথায় তাড়াতাড়ি ওষুধ দেবে। তা না, ওঝার কথা ভাবা হচ্ছিল। ওষুধ পড়ুক, তারপর ওঝাকে ডেকো। যদু দাঁতে দাঁতন কাটি চিবোতে চিবোতে পশ্চিমে হাঁটা দিয়েছিল। গদাধর হেঁকে উঠেছিল, অ র‍্যা, অই যদু, এখনই শান্তি শাগের খোঁজে যাচ্ছিস নাকি? মুখ ধুয়ে খেয়ে যা।

এইসে খাব। যদু মুখ না ফিরিয়ে বলেছিল।

গদাধর রুষ্ট চোখে তাকিয়েছিল, এ শালা আবার পেরানিদের কষ্ট দেইখতে পারে না। আরে, পেরানিদের জান মানুষের থেনে শক্ত। এত ছটফট কইরলে হয়? সেই কাল দুকুরে তোমাদের ঘরে ভাত খেইয়েছে। পেটে আর ভাত পড়ে নাই৷ কেউ বাকি নাই, সবাই খেইয়েচে, আমি আর যদু বাকি। একসঙ্গে খাব। তা দেইখলে ত, যেন শালার সোহাগি বউয়ের ব্যানো হইয়েচে। কোন তন জ্ঞান নেই।

যদু ঠাকুরদার কথা শোনার জন্য দাঁড়ায়নি। তবে হ্যাঁ, তল জ্ঞান ছিল না। মহিষী ওর সোহাগি বউ ছিল না। তবে মনে বড় উদ্বেগ ছিল। বউ না থোক, উমির জন্যও মন বড় উচাটন ছিল। মহাদেবকে দেখা মাত্রই উমির মুখ ভেসে উঠেছিল। গতকাল ঢল খাওয়া বেলায় সেই শেষ দেখা, রোজ আইসতে হবে কিন্তু। পিতামহর শ্বশুরবাড়ি। যত দূরের হোক, কুটুম তো বটে। কুটুমবাড়িতে কি রোজ যাওয়া যায়? যায় না। ওদিকে মহাদেব ঘোষের মুখে সংবাদ, ছিট-গঙ্গার নাবালে শান্তি শাক মিলতে পারে। উদ্বেগ আবেগ, দুইয়ে মিলে, যদু তখন এক বর্গা-গতিবৃষ। ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা কি মনে থাকে। ছোট রে যদু। শান্তি শাক খুঁজতে গিয়ে, সেই মেয়ের সঙ্গে কি এক বারটি দেখা হবে না?

যদু জলের ধারে গিয়ে, আগে দাঁত মেজে মুখ ধুয়েছিল। তারপর শান্তি শাকের সন্ধান, ছিট-গঙ্গার দক্ষিণ তীর ঘেঁষে। মহাদেব ঘোষের বাড়ি দক্ষিণ তীরে। সে মেয়ে কি ঘাটে আসবে? কিন্তু যদুর তো শান্তি শাক খোঁজাটা অছিলা ছিল না। শান্তি শাক খুঁজতে খুঁজতে ও মহাদেব ঘোষের ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকবে না। ও শাকের সন্ধান পেলে, তুলতে তুলতে চলে যাবে। যখন মহাদেব ঘোষের ঘাটে পৌঁছুবে, তখন যদি সে আসে, তবে দেখতে পাবে। না হলে, যদু চলে যাবে। কম শাক তো না। অন্তত শাক নিংড়ে দু সের রস হওয়া চাই। তা না হলে মহিষীর ব্যাধি সারবে না।

কিন্তু শান্তি শাক কোথায়। যদুর তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নাবাল থেকে উঁচুতে ফিরছিল। জলের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে, এক পা এক পা করে চলছিল। পুনর্ণবা বিস্তর। কোথাও কলমির দাম। ব্রাহ্মী শাকও চোখে পড়ছিল। বিষকাটারির ঝাড়, ছাগলবটির লতা সামান্য। দেখতে দেখতে গৃহস্থের বাড়ির এলাকা এসে পড়েছিল। সাত সকালের ঘাট। বউঝিদের বাসন মাজা, গা ধোয়া স্নানের সেটাও একটা সময়। আর গৃহস্থের ঘাটের সীমানাতেই প্রথম শান্তি শাক চোখে পড়েছিল। বেশি না, সামান্য। যদু তুলে নিয়েছিল। আশা হয়েছিল, পাবে। পেয়েও ছিল। কোথাও বেশি না। অল্প স্বল্প। তবু তো মিলেছিল। ঘাটের মেয়ে পুরুষরা তাকিয়ে দেখছিল। অচেনা জোয়ান পুরুষ। বউ মেয়েরা ঝটিতি ঘোমটা টেনে, নিজেদের সাব্যস্ত করতে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়ছিল। পুরুষদের জিজ্ঞাসা, কী কুড়োচ্চ?

শান্তি শাগ। যদু সব ঘাটেই পুরুষদের জিজ্ঞাসার জবাব দিচ্ছিল, একটা মইষীর ব্যামো হইয়েছে, শাগের রস খাওয়াতে হবে। সেই সঙ্গেই জিজ্ঞাসা, অ, তোমরাই বুঝি বাথান নিয়ে এসেচ?

ঘাট এলেই, যদু নাবাল ছেড়ে ওপরে উঠছিল। বউ ঝিদের যেন পরপুরুষ দেখে লজ্জায় পড়তে হয়। ওপরে না উঠলে জলে নামতে হত। সব ঘাটেই যে লোক ছিল, এমন না। ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস চরছিল জলে ডাঙায়। জায়গায় জায়গায় শাক মিলছিল। লজ্জাবতী লতাগুলোর শরীর মোটে লজ্জাবতী না। কাঁটা আছে গায়ে। ছিল না চোরকাঁটা। যদু মহাদেব ঘোষের ঘাটে পৌঁছে দেখেছিল এক পাল হাঁস। মানুষ এক জনও না। আব্বা মানুষ দেখে, হাঁসগুলোর কিছু জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাকিরা ডাঙার উঁচুতে উঠে গিয়েছিল প্যাক প্যাক ডেকে। না, কেউ দেখতে আসেনি, হাঁসগুলো কেন ডাকছে। শূন্য। ঘাটের পৈঠার কাছে, স্থির স্বচ্ছ জলে, ছোট ছোট মাছ খেলা করছিল। জলের ধারের ডাঙায় গুগলি শামুকের মরা খোল। যদু শাক খোঁজার ফাঁকে, ওপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। বাড়ির ভিতর থেকে ঘাটে। আসার রাস্তা নেই। বাড়ির বাইরে এসে, ঘাটে নামার পথ। ভিতর বাহির করবার জন্য, বেশি দরজা পথ রাখতে নেই। একটাই যথেষ্ট। জলাশয়ের সঙ্গে ভেতর বাড়ির যোগাযোগ রাখতে গেলে, আর একটা ঢোকবার পথ করতে হত। রাত বিরেতে, কে কখন সেই দরজা দিয়ে ঢুকবে, কে বলতে পারে।

যদু দাঁড়াবে না। শাক খোঁজার অছিলায়ও না। তবু সেই শূন্য ঘাট থেকে নড়তে সময় লেগেছিল। মন বেড়ির বন্ধন। না, কারোর গলাও শোনা যায়নি। যদু চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বুকে নিশ্বাস আটকে ছিল। রোজ আসতে হবে বলেছিল। এসেছিলাম তো। তুমি কোথায়? ঘরকন্নার কাজে ব্যস্ত? থাকো, আমি যাই। আটকে পড়া নিশ্বাস, আটকেই ছিল। যদু শান্তি শাক খুঁজে পেতে, তুলে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল।

বেলা বাড়ছিল। বৈশাখের রোদ বেঁজে উঠছিল। সাঁকোর কাছে গিয়ে, একটা জায়গায় অনেকটা জুড়ে ছিল শান্তি শাক। জয় গিরিগোবর্ধন। এমন আরও জুগিয়ে দাও। ওপর দিয়ে লোক যাতায়াত করছিল। বাঁশের সাঁকো। জোড়া বাঁশের সাঁকোর সঙ্গে, জলে পোঁতা খুঁটির গায়ে, ধরে যাবার বাঁশ বাঁধা। মাঝে মাঝে জলের মাঝখানে বড় ঘঁকা জাল পাতা। নৌকা দু-একটা পারাপার করছিল। পাড়ে যেখানেই ঝোঁপ বেশি, সেখানেই লাল পাছা কালো বুলবুলি। শিস দিচ্ছিল।

যদু থেমেছিল প্রায় জামালপুরের সীমানায়। সেখানেই ছিট-গঙ্গার শেষ। গামছা খুলে দেখেছিল। শাক যা জোগাড় হয়েছিল, নিংড়োলে এক সের রস হবার মতোও না। ওপরে উঠে, একটা গাছতলার ছায়ায় দাঁড়িয়ে, কোমর থেকে বিড়ির কৌটো দেশলাই বের করে, বিড়ি ধরিয়েছিল। মহাদেব ঘোষের ঘাট সেখান থেকে দেখা যায় না। সে বাড়ির বাসন মাজা, বাসি কাপড় কাঁচা বুঝি আরও ভোরেই হয়ে গিয়েছিল?

যদু পশ্চিম পাড়ের বাঁকে তাকিয়েছিল। গাছতলায় হাওয়া। ছায়া থেকে রোদে গেলেই, জ্বালা। তবু যদু পশ্চিম পাড়ে গিয়েছিল। অল্প-স্বল্প শাক মিলেছিল। উত্তরের বাঁকে গিয়ে, হঠাৎ যেন শান্তি শাকের চাষ দেখেছিল। বিস্তর শাক। যদু সেই মুহূর্তে সব ভুলে গিয়েছিল। ক্ষুধার্ত গোরুর মতো দু হাতে মুড়িয়ে, গামছা ভরেছিল। ছোট ছেলে মেয়ে কয়েকটা কাছে এসে দেখেছিল। জিজ্ঞেসও করেছিল, ওগুলান কী তুইলচ? খাবে নাকি?

হ্যাঁ। যদুর তখন হাসবার সময় ছিল না।

বাছুরের মতো ছেলেমেয়েগুলো হেসে গড়াগড়ি দিয়েছিল। যদুর গামছা তখন ভরে উঠেছিল। তা হোক। দু সের রস পাবার মতো শাক পাওয়া কম কথা না। ও বাঁক ফিরে, উত্তরের জলের ধার ঘেঁষে শাক খুঁজেছিল। পেয়েওছিল। দু নম্বর সাঁকোর নীচে আবার শান্তি শাকের ঝাড় পেয়েছিল। যখন মনে। হয়েছিল, দু সের রস হবার মতো শাক জুটেছে, সূর্য তখন প্রায় মাথার ওপরে। ওর ছায়া, ছোট হয়ে পায়ের কাছে। দক্ষিণের ডাঙায় তাকিয়েছিল। একেবারে মহাদেব ঘোষের ঘাটের মুখোমুখি। না, কেউ ছিল না। ঘাট শূন্য। নৌকা একটা বাঁধা উত্তরের ঘাটে। জনা কয়েক এসে উঠেছিল নৌকায়। ওপারে যাবে। যদু অনুমতি নিয়ে নৌকায় উঠেছিল। পারানির পয়সা লাগে না। গাঁয়ের মানুষদের সকলের পারাপারের নৌকা। ওপারে গিয়ে নৌকা লগি পুঁতে বেঁধে দিয়েছিল। আবার যারা উত্তরের ডাঙায় যাবে, তারা নিজেরাই চালিয়ে নিয়ে যাবে।

যদু দক্ষিণের ডাঙায় উঠে, পশ্চিমে ফিরেছিল। চিটে গুড়ের দরকার। পয়সা নিয়ে বেরোয়নি। তবু দোকানে জিজ্ঞেস করে যেতে চেয়েছিল, চিটেগুড় আছে কি না। যাবার পথের ধারেই মহাদেব ঘোষের বাড়ি। সে কি দরজার কাছে থাকবে? দেখতে পাবে?

পায়নি। মই-ঝাঁপ ফেলা। কঁপের সামনে মাটির দেওয়াল। ভিতর বাড়ি দেখা যায় না। না যাবারই কথা। আবরু তো রাখতেই হয়। না হলে বাড়ির ভিতর বাহির একাকার। কেউ সেখানে ছিল না। থাকে নাকি? তুমি কি জানিয়ে গিয়েছিলে? না। কিন্তু সে যে রোজ আসতে বলেছিল? তা কি হয়? যদু শূন্য দরজার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। চওড়া মাটির রাস্তা। বৈশাখে ধুলা উড়িয়ে যাচ্ছিল গোরু মহিষের গাড়ি। দু পাশে ঘর দরজা, ডোবা পুকুর বাঁশঝাড়। দোকান সেই জামালপুরের উত্তরের বাঁকে, একটু পশ্চিমের ভিতরে। চিটে গুড়? কতখানি চাই? পাঁচ সের? হবে। যদু দোকানিকে বলেছিল, ঘুরে আইসতেছি, রেইখে দিও। মইষীর ব্যামো, শান্তি শাগের শরবত খাওয়াতে হবে।

দোকানির কাছ থেকে ভরসা পেয়ে, যদু বাথানের ড্যারায় ফিরেছিল। না, ফেরবার সময়ও সেই বাড়ির কারোর মুখ দেখতে পায়নি। গদাধর পথ চেয়ে বসে ছিল, পেইয়েচিস?

যদু গামছা বাঁধা বোঁচকা দেখিয়েছিল, চিটেগুড়ের খোঁজও পেইয়েচি। পয়সাকড়ি কিছু নিয়ে যাই নাই। তোমার কাছে আছে ত?’

থাইকলই বা। গদাধরের স্বরে উত্তাপ ছিল, তা তুই কি এখনই গুড় কিনতে যাবি নাকি? তোর জন্যে আমিও খাই নাই। এত বেলায় এখন আর না নেইয়ে ধুইয়ে খেইতে পারব না। শাগের বোঝা রাখ। একটু জিরো। একসঙ্গে নেইয়ে এইসে খাব। তারপরে যা করবার কইরবি।

যদুর মনটা খারাপ হয়েছিল, তা তুমি খেইয়ে নিলে না ক্যানে?

 তুই বা নিস নাই ক্যানে?’ গদাধর বেঁজে উঠেছিল, শালা, আমি কি আর তোর মতন জোয়ান আছি? খিদে পেইলে থাইকতে পারি না, জানিস না? তুই সেই কাল থেনে খেইলি না, আমি বা খাই কী কইরে? শালা, তোমার বিবেচনা নাই?

যদু শাকের বোঝা গাছতলায় সাবধানে রেখে, গদাধরের গা ঘেঁষে বসেছিল। হেসেছিল, গদাধরের হাঁটুতে হাত রেখেছিল, লাও, দু ঘা মার।’

শালা। গদাধর যদুর মুখের দিকে তাকিয়েছিল, অদুরে তেতে পুইড়ে, মুখটা পুইড়ে এইসেছিস। তা এত শুকনো দেইখচি ক্যানে র‍্যা তোর মুখটা? মইষীটার জন্যে মন খুব খারাপ হইয়েছে?

যদু দূরে মহিষীর দিকে তাকিয়েছিল, হ্যাঁ। ক্যানে, তোমার হয় নাই? তোমাকে কি লতুন দেইখচি? তুমি হলে যা কইরতে, আমি তাই কইরেচি।

কিন্তু যদু, তোর চখ মুখের ভাব অন্য রকম দেইখচি। গদাধরের সজাগ চোখে অনুসন্ধিৎসু জিজ্ঞাসা।

মা’দেব বইলে গেল।

যদু চমকে উঠে জিজ্ঞেস করেছিল, কী বইলে গেল?

খারাপ কিছু না। গদাধর হেসেছিল, মা’দেব বইলছিল, পিসে, তোমার লাতি তোমার মতন হইয়েচে, জীবের দুঃখু দেইখতে পারে না। কিন্তু তা বইলচি না যদু। তোর এত মন কেমন করার কী হইয়েছে? গোবন্ধন সহায়, মইষী বাঁইচবে। এত কষ্ট ধান্দা কইরে শান্তি শাগ জোগাড় কইরে এইনেচিস। পেরানিদের জান আমাদের থেকে শক্ত। সোময় যায় নাই। তা তোর যেন পেরানিদের মতন কষ্ট দেইখচি, অ্যাঁ? অবোলা জীবের মতন?

তা যদুর মনের অবস্থা এক রকম অবোলা জীবের মতোই ছিল। কেবল দু চোখ তুলে তাকিয়ে থাকা। কারোকে কিছু বলতে পারছিল না। পুরুষ মানুষ তুই। বুক ফাটলেও রা কাড়তে পারছিলি না। বলেছিলি, চল তবে, নেইয়ে আসি। খেইয়ে চিটে গুড় আইনতে যাব।

সুদেবকে সতর্ক করে দিয়ে পিতামহ পৌত্র ছিট-গঙ্গায় স্নান করে এসেছিল। মাটির বড় হাঁড়ি থেকে এক পাতে পান্তা ভাতে দুধ ঢেলে খেতে খেতে ঠাকুরদা বলেছিল,’মা’দেবের সঙ্গে তোর দেখা হয় নাই?

না ত? যদু অবাক চোখে গদাধরের দিকে তাকিয়েছিল।

গদাধর ভাত চিবোতে চিবোতে বলেছিল, না হবারই কথা। তুই আইসবার একটু আগে সে এখান। থেনে গেচে। বইলল, যদুর সঙ্গে দেখা হইয়ে যেইতে পারে। তাকে আমি চিটে গুড়ের পয়সা দিয়ে দেচি। সে গুড় কিনে তাদের ঘরে রাইখবে। বাঁকা আর তোর বাবা ড্যারায় ফিরতে দেরি কইরবে না। দুধ বেচে, বাথানের সঙ্গে যাবে। সঙ্গে ফিরবে না, আগে আগে চইলে আইসবে–বিকাল লাগাদ। আমি একটু ওক্কুরদাদার সঙ্গে কথা বইলব। তুই শান্তি শাগের শরবত বানাবি। লিয়ে এইসে ড্যারায় খাওয়াবি।

যদুর বুকে তখন মহাবন্যার ঢেউ। মহাদেব ঘোষের বাড়িতে শাক ঘেঁচে, নিংড়ে রস করে, চিটে গুড়ের শরবত বানাবে? কী কথা! দুধপান্তা গলা দিয়ে নামতে চাইছিল না। অই হে ঠাকুদ্দা! উমির বাবা! তোমরা কি অন্তর্যামী নাকি? এমন না যে, উমি তার বাবার কানে মন্ত্রণা দিয়েছিল। পিসের সঙ্গে শালার ছেলের পরামর্শ। যদুর হয়ে কি কোনও অদৃশ্য শক্তি এমন যোগাযোগ ঘটিয়েছিল?

কী হল, খা?’ গদাধর বলেছিল।

 যদুর তনজ্ঞান ছিল না। খেতে পারছিল না। আবার যখন আরম্ভ করেছিল, সপাস গিলতে আরম্ভ করেছিল। গদাধর ভুরু কুঁচকে হেসেছিল, শালা, আমার ভাগটাও মারবি নাকি?

আ! কী লজ্জা কী লজ্জা। যদু মাতালের মতো হেসে উঠেছিল। গদাধর তবু ভুরু কুঁচকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়েছিল, শালার যেন ঘোর লেইগেচে। মইষীর জন্য মরে যাচ্ছে।’

তা একেবারে মিথ্যা ছিল না। এক মহিষীর ব্যানোর চিন্তা ছিল। আর এক জনও তো কিশোরী মহিষী বটে। কাঁড়াটার ঘোর লেগেছিল তার জন্যেই। খাওয়া সেরে, যদু আর এক বার মহিষীর পাছা মলদ্বার পরিষ্কার করে দিয়েছিল। সুদেবকে ড্যারার উপর নজর রাখতে বলেছিল। তারপরে শান্তি শাক নিয়ে মহাদেব ঘোষের বাড়ি। সেখানে তখনও দুপুরের রান্না খাওয়া চোকেনি। উমির গায়ে খয়েরি ডোরা শাড়ি। মাথায় ভেজা চুল। উঠোনের দড়িতে ভেজা শাড়ি মেলে দিচ্ছিল। যদুকে দেখেই, ধনুক ভুরুর নীচে কালো চোখের তীরে ঝিলিক দিয়েছিল। যথার্থই শাড়ির আঁচল সদ্যোস্নাত বুকে অসাব্যস্ত ছিল। বাড়ির ভিতরে লজ্জার অবকাশ ছিল না। যদুকে দেখেই ফরসা মুখে ছটা লেগেছিল। ঠোঁটের কোণে হাসি। তাড়াতাড়ি ভাল করে গায়ে শাড়ি জড়িয়েছিল।

মহাদেব দাওয়া থেকে নেমে এসেছিল, এইস পিসে। তোমার সুমুদ্দি আমার উপর ভারী ক্ষেইপে গেছে।’

ক্যানে?’ গদাধর দক্ষিণের দাওয়ার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, তোমার উপর ক্ষেইপল ক্যানে?

 মহাদেব বলেছিল, তোমাকে খেইতে বলি নাই।

 অইগো ওক্কুরদাদা, কেমন আছ?’ গদাধর দক্ষিণের দাওয়ায় উঠে, অক্রূর ঘোষের কাছে গিয়ে বসেছিল, ছেলের উপর আগ কইরেচ ক্যানে? বুড়া ভগ্নিপিতকে সোমপরশ্য কইরে খাওয়াবে?’

দুজনের মধ্যে অনেক কথা শুরু হয়েছিল। মহাদেব উমাকে ডেকে বলেছিল, অ উমি, যদুকে শান্তি শাগের রস করার বাওস্তা টাওস্তা কইরে দে।

উমি তখন ঘরের মধ্যে। কোনও জবাব শোনা যায়নি। মহাদেব যদুকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি ক্ষেত্তরের দোকানে গেছিলে, চিটে গুড়ের কথা বইলতে?

হা। যদু জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছিল।

মহাদেব বলেছিল, ক্ষেত্তর তাই বইললে, ডাগর জোয়ান একজন গুড়ের কথা বইলেচে। তাকে বইলাম, সে আমাদের কুটুম, দিসারা থেকে বাথান নিয়ে এসেছে। আমি এইনে রেইখেচি। আগে রস কর, তা’পরে গুড় বের কইরে দেবে।

উমি একটা অ্যালুমিনিয়ামের টোলটাল খাওয়া বড় হাঁড়ি আর বোয়া গামছা নিয়ে পুবের ঘর থেকে বেরিয়েছিল। কোনও দিকে না তাকিয়ে উত্তরের পিছনে গিয়েছিল। মহাদেব জিজ্ঞেস করেছিল, ওদিকে কোতায় যাচ্ছিস? পশ্চিমের ছায়ায় দিলে পারতিস।

গোয়ালের ওখানেও গাম্বিলের ছায়া আছে। উমি দক্ষিণমুখো ঘরের পিছনে, আড়ালে গিয়েছিল।

ভবতারণ আর কার্তিককে দেখা যাচ্ছিল না। অনন্ত পুবের নারকেল গাছের নীচে বসে পাটের দড়ি পাকাচ্ছিল। কানে তার পোড়া বিড়ি গোঁজা। যদুর দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। ভবতারণের স্ত্রী ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে নাইয়ে বাড়ি ঢুকেছিল। গতকালের থেকে অনেক আগবেলায় যদু এসেছিল। রান্নাঘরে কার্তিকের বউয়ের সঙ্গে যদুর চোখাচোখি হয়েছিল। দুধেল শ্যামা গাভীর মতো বউ হেসে, ঘোমটা টেনে মুখ আড়াল করেছিল। সোজা হাসি না। একটু বাঁকা। ভুরুতে যেন কেমন ইশারা। কেন?

ওখেনে জল রেখে এইসেছি। উমি উঠোনের ওপর দিয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে বলেছিল, শিল নোড়া লাইগবে কি?

মহাদেব যদুর দিকে তাকিয়েছিল। যদু বলেছিল, হামদিস্তে হলে ভাল হয়। না থাইকলে–।

 আছে। রান্নাঘর থেকে উমির গলা শোনা গিয়েছিল।

যদু দেখেছিল, রান্নাঘরের ভিতরে কার্তিকের বউ উমির হাঁটুর কাছে একটা চাপড় মেরেছিল। কার্তিকের বউ বসে ছিল। কোলে তার ছেলে হাত-পা ছুড়ছিল। উমি কার্তিকের বউয়ের কাঁধে চিমটি কেটেছিল। কার্তিকের বউ মুখ বিকৃতি করেছিল। যেন কত যন্ত্রণা পেয়েছে। ঠোঁট ফুলিয়ে, ভুরু কুঁচকে যদুর দিকে তাকিয়েছিল। নিঃশব্দ নালিশ ছিল তার চোখে। যদুকে নালিশ কেন? ও কি উমিকে ধমক দেবে? সেই রকমই যেন। ননদ ভাজে কী খেলা চলছিল? উমি রান্নাঘরে মায়ের সঙ্গে কী কথা সব। বলছিল। যদু উত্তরের আড়ালে গিয়েছিল, শাকের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে। সঙ্গে মহাদেব। যদু দেখেছিল, গাম্বিল গাছের গোড়া ঘেঁষে, পুরনো অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির মুখে, মাড় ছাড়ানো নতুন গামছা। মাটির হাঁড়িতে জল। পাশে একটি শাড়ির রঙিন পাড় ঘেঁড়া সুতোয় কাজ করা চটের আসন পাতা। কয়েক হাত দূরেই একটি গোরু বাঁধা গোয়ালে। ছিট-গঙ্গা দেখা যাচ্ছিল। মাঝখানের জলে একটা পানকৌড়ি। নাবালের ঝোঁপঝাড়ে বুলবুলি শিস দিচ্ছিল। গাম্বিলের ছায়া ঝোপে চড়ুইয়ের ঝাঁক। তাদের সমবেত ডাকে যেন যাত্রার দলের সখীদের পায়ের ঘুঙুরের ঝংকার বাজছিল।

যদু শাকের বোঝা নামিয়েছিল। উমি লোহার হামানদিস্তা বসিয়ে দিয়েছিল পাতা আসনের সামনে। সে দিনও মেয়ের ভেজা চুল থেকে টুপিয়ে পড়ছিল জলের কণা। যদুর দিকে এক বার মাত্র তাকিয়েছিল। চোখের কালো জোড়া তীরে ঝিলিক। ওই তীরে যদুর মন প্রাণ বেঁধা ছিল। সে একটুও দাঁড়ায়নি। চলে গিয়েছিল। মহাদেব জিজ্ঞেস করেছিল, আর কিছু লাইগবে?’

না। আমি বসে যাই। যদু গায়ের জামাটা খুলে ফেলেছিল। পোঁটলায় রাখা দলা মোচড়া জামা। পকেটে বিড়ির কৌটা দেশলাইয়ের শব্দ হয়েছিল।

মহাদেব চলে যাবার আগে বলেছিল, তুমি তালে কাজ কর, আমি যাই।

আজ্ঞা। যদু জামাটা পাকিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিল গাম্বিলের নিচু ডালে। তাকিয়েছিল উঠোনের দিকে। উঠোন দেখা যায়নি। যদু শাকের বোঝা গামছা খুলে, কাজে লেগেছিল। মাড় ছাড়ানো গামছাটা এক বার হাত দিয়ে টিপে দেখেছিল। গন্ধ শুঁকেছিল। কোনও কটু গন্ধ ছিল না। পরিচ্ছন্ন। জলের হাঁড়িতে হাত ডুবিয়ে গণ্ডুষ ভরে জল নিয়ে শাকে জলের আছড়া দিয়েছিল। গোছা তুলে হামানদিস্তায় ভরে আলতো করে হেঁচতে আরম্ভ করেছিল। মাঝে মাঝে জলের ছিটা আর আলতো হেঁচা। তারপর হাঁড়ির মুখের গামছায় হেঁচা শাক তুলে, মুড়িয়ে নিংড়ে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে রস ঢেলেছিল।

এক প্রস্ত শেষ হবার আগেই, কাচের চুড়ির ঝনাৎকার। যদু চোখ তুলে দেখেছিল, সামনে উমি। হাতে ওর কলকে বসানো হুঁকা। মাথার চুল মোছা, খোলা। যদু কথা বলবে কী? নিজের প্রাণ দেখছিল কালো স্থির বিদ্ধ জোড়া তীরে। নাকছাবিতে ঝিলিক। ঠোঁটের কোণে হাসি। স্বর ছিল নিচু, শান্তি শাগ তোলবার সোময় দেইখতে পাই নাই ক্যানে?

আমারও তো সেই কথা। যদু যেন অনেক চেষ্টায় বলেছিল। সম্মোহিতের মতো তাকিয়েছিল উমির টানটান কালো স্থির চোখে।

উমির নিচু স্বরে কথা, একটা হাঁক দিতে কী হইয়েছিল?

সাহস পাই নাই। যদুর দু হাতে মোড়ানো গামছা। বুকের মধ্যে তোলপাড় করছিল।

উমি চোখ বড় করেছিল, ভারী মদ্দ! চখে কী হইয়েছে?

যদু গামছা সুদ্ধ হাত চোখে তুলতে যাচ্ছিল, জানি না ত। কী হইয়েছে?

জানি না, তুমি বোঝগা। উমি নীচের ঠোঁট কামড়ে, হাসি চেপেছিল। কিন্তু শরীর কেঁপেছিল, নাও হুঁকা ধর। আড়ালে এনে বসিয়েচি বলে, এতক্ষণ থাকা যায় না। ধর, চখ সরাও। ওই চখ দেইখলি শরীলে কেমন করে।

যদু ডান হাতে ভেজা শাকের গামছা ধরে, বাঁ হাত কেখে নিয়েছিল হাঁড়ির কানায়। তারপরে বাড়িয়ে দিয়েছিল। হুঁকা নিয়েছিল উমির হাত থেকে, আমারও ত করে। ক্যানে বল ত?

জানি না। উমি ফিরতে উদ্যত হয়ে, খোলা চুলে ঝাপটা দিয়ে, ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়েছিল, গঙ্গার ধ্যেরে ভূত, আমার ঘাড় মইটকে দিয়ে। তারপরেই নাক কুঁচকে, জিব দেখিয়ে চলে গিয়েছিল।

কী কথা। আমি তোমার ঘাড় মটকেছি? না, তুমি? মটকানো ঘাড় নিয়ে ওই রকম জিভ ভ্যাংচানো যায়? যদুর বুকে তোলপাড়। অথচ যেন তীরে খাওয়া শরীর অসার। শাকের গামছা শিথিল হাত থেকে হাঁড়ির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। আচমকা ঘোর কেটেছিল। হুঁকায় জোরে জোরে টান দিয়েছিল। না, না, তামাকে তৃষ্ণা ছিল না। তৃষ্ণা চোখে। তবু যদুর চোখকে দোষ দাও। নিজের চোখ দেখতে পাও না। সব কেড়ে নিয়ে, গরিবটাকে ভ্যাংচাও। আর ওই রকম ভ্যাংচানো। জাওলা মাছটাকে ছাই মেখে, বঁটি পেতে বসে, কেবল আছাড় মারো। মারো, মারেও যে সুখ, আগে যদু জানত না। একটা নিশ্বাস ফেলে কাজে হাত লাগিয়েছিল।

ঘড়ির বেলা সাড়ে বারোটায় রস করতে বসা। তিন ঘণ্টা সময় লেগেছিল রস করতে। ইতিমধ্যে গুঁড়োগাড়াগুলো যদুকে ঘিরে বসেছিল। উমির মা খুড়ি শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। কার্তিক অনন্ত ঘুরে গিয়েছিল। কার্তিকের বউও এক বার এসেছিল। তার আঁচল ধরে পিছনে উমি। কার্তিকের বউ হেসে বলেছিল, রস নিংড়োবার হাত বড় পাকা।

শাক নিংড়ে রস বের করবে, তার আবার কাঁচা পাকা কী আছে? তারপরেই কপট ঝামটা দিয়ে উঠেছিল, ইস ঠাকুরঝি, আমাকে ক্যানে মারছ? যাও, গামছায় গিয়ে সেঁদোও, তোমাকেও নিংড়ে রস বের কইরবে?’

যদু কার্তিকের বউয়ের কথা বোঝেনি। তবে বুঝেছিল, কথা সহজ ছিল না। উমি বলেছিল, আমার সইবে না। তুমি গিয়ে সেঁদোও।

ক্যানে, আমি সেঁদোব ক্যানে?’ কার্তিকের বউ বলেছিল, আমাকে নিংড়োবার জন্যে তোমার দাদা আছে না?

উমি গুপ করে একটা কিল মেরেছিল বউদির পিঠে। মুখ লাল করে পালিয়ে গিয়েছিল। না, মেয়েদের কথার ঘোরপ্যাঁচ বোঝেনি যদু। কিন্তু অবুঝ কথাগুলো বুকের তোলপাড় বাড়িয়ে দিচ্ছিল। ও রস করে, হাঁড়িতে হাত বুলিয়ে ওজন অনুমান করেছিল। দু সেরের মতো হয়েছিল। কাঁচা রসের গন্ধ। ছাড়ছিল। উঠোনে এসেছিল হাঁড়ি নিয়ে। বড় একটা টিন চেয়ে রেখেছিল আগেই। বিশ সেরি তেলের খালি ধোয়া টিন। মহাদেব চিটে গুড়ের পাত্র বের করে দিয়েছিল। উমি কলসি ভরে জল এনেছিল। সবাই দাঁড়িয়ে যদুর ওষুধি শরবত বানানো দেখেছিল। উমি টিনের মধ্যে জল ঢেলে দিয়েছিল। প্রায় অর্ধেক টিন ভরেছিল। যদু সেই জলে চিটে গুড় ফেলে, দু হাতে চটকেছিল। চটকে মাড়িয়ে, জলের সঙ্গে এক করেছিল। শান্তি শাকের রস ঢেলেছিল টিনে। অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে গামছা পেতে, টিনের সবখানি শরবত ঘেঁকে ঢেলেছিল। গদাধর এগিয়ে এসে উঁকি দিয়ে বলেছিল, হা, পরিমাণ দশ-এগার সের হইয়েছে।

বৈশাখের পোড়া আকাশের পশ্চিমে বেলা ঢলে গিয়েছিল। হাঁড়ির মুখে গামছা জড়িয়ে বেঁধে যদু মাথায় নিয়েছিল। গদাধর তখন অক্রূরের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল। উমির মা বলেছিল, তুই কোথায় যাবি?

মহাদেবের হাতে ছিল সোয়া হাত লম্বা বাঁশের নল। উমি আর ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল, উমি যেতে চাইছে? তা চলুক। ভাইবোনগুলান যাচ্চে। কোনদিন দেখে নাই, দেইখবে। আমি সঙ্গে কইরে নিয়ে আইসব।’

কথা শুনতে যতটুকু সময়। মেয়ে বাথানের ড্যারায়ও পা বাড়িয়েছিল। যদু সকলের আগে, হাঁড়ি মাথায় এগিয়েছিল। বাঁকা শ্রীবাস আর সুদেব বাথান ড্যারায় রান্নার আয়োজন করছিল। দূরের উত্তরে, ধুলা উড়তে দেখা গিয়েছিল, তার সঙ্গে মৃদু টুংটুং শব্দ। বাথান দিয়ে আসছিল। যদু হাঁড়ি নামিয়েছিল মহিষীর সামনে গিয়ে। অবস্থা আরও খারাপ হয়েছিল। মলদ্বারে বেরিয়ে-পড়া নাড়ির গায়ে রক্ত লেগেছিল। শ্রীবাস আর বাঁকা এগিয়ে গিয়েছিল। যদুর তখন নজর করে দেখবার সময় ছিল না, উমি কোথায়। মহিষীকে ঘিরে সবাই দূরে দাঁড়িয়েছিল। যদু মহিষীর গায়ে হাত বুলিয়ে মাথার শিং জোড়া চেপে ধরেছিল। শ্রীবাস মহিষীর সামনের পা জোড়া চাপ দিয়ে, মুড়ে দিয়েছিল। মহিষী বসে পড়েছিল। গদাধরও হাত লাগিয়েছিল। মহিষীকে কাত করে শোয়ানো হয়েছিল। বাঁকা মহিষীর চার পা। দড়ি দিয়ে বেঁধেছিল। মহিষী ফোঁস ফোঁস করছিল। লাল চোখে ভয়ের দৃষ্টি। গলায় শব্দ করেছিল, আঁ…।

হা, ভয় নাই মা, কেউ তোকে মাইরবে না। গদাধর মহাদেবের দিকে ফিরেছিল, চোঙাটা ছিবাসকে দাও।

যদুর চোখে মুখে উত্তেজনা। শ্রীবাস মহিষীর মুখ ফাঁক করে, বাঁশের নল খানিকটা ভিতরে ঢুকিয়েছিল। কিন্তু নলটা সে অনড় রাখতে পারছিল না। যদু খেঁকিয়ে উঠেছিল, নিকুচি কইরেচে নল ধরার। টিনের চোঙটা ধইরবে কে? আমার বাপ?’

ছেলের ধমক খেয়ে শ্রীবাস বিব্রত হয়েছিল। গদাধর তাড়াতাড়ি টিনের ফুদিল এনে বাঁশের নলে বসিয়ে দিয়েছিল, না, তোর বাপ লয় র‍্যা শালা, বাপের বাপ ধইরবে।’

উমির খিলখিল হাসি কানে এসেছিল। যদু মুখ তুলে তাকায়নি। শরবতের হাঁড়ি তুলে, সাবধানে ফুদিলের মুখে ঢেলেছিল। মহিষীর গলা দিয়ে শরবত ভিতরে যাচ্ছিল। থেমে থেমে ঢেলেছিল, মহিষীর টাগরায় না আটকায়। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ে যেন শরবত নষ্ট না হয়। বাঁকা মহিষীর শিং জোড়া চেপে ধরেছিল।

মানুষের ওষুধ খাওয়ানো না। মহিষীর ওষুধ। ওজনে এগারো সের প্রায়। খাওয়াতে খাওয়াতে, পশ্চিমের লাল আকাশ, পোড়া লোহার মতো রং হয়েছিল। সন্ধ্যা নেমেছিল। বাথান ফিরে এসেছিল। তাদের হাঁকডাকে, ঘণ্টার শব্দে ধুলা ওড়ানো মাঠ মুখরিত হয়ে উঠেছিল। ঝটিতি সবাই বাছুরগুলোকে সরিয়ে নিয়ে বেঁধে, দোহন শুরু করেছিল। মহিষীর কাছে তখন যদু গদাধর আর মহাদেব। বাকিরা দোহনের কাজে লেগে গিয়েছিল। উমি, ওর ভাইবোনগুলো তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। উমি দেখছিল যদুকে, যদু মহিষীর পায়ের বাঁধন খুলে দিয়েছিল। সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। লুড়া ভিজিয়ে পাছা মলদ্বার মুছিয়ে দিয়েছিল। মহিষী তখন উঠে দাঁড়ায়নি। কাত হয়ে শুয়েছিল। যদু বলেছিল, ঠাকুদ্দা, যাই, আমি এবার একটা ডুব দিয়ে আসি। গা জ্বালা কইরচে।

চল, আমরাও যাই। মহাদেব বলেছিল, গা জ্বালা কইরবে বইকী। খাটনিও কম না।

নেমে আসা সন্ধ্যার ছায়ায় উমি তাকিয়েছিল যদুর দিকে। ছেউটি মেয়েটির চোখে গভীর আবেগ ফুটেছিল। বোধ হয় যদুর জ্বালা জুড়াতে মন করছিল।

যদুর তখন বিড়ির নেশা পেয়েছিল। জামার কথা মনে পড়েছিল। মনে পড়েছিল, গাম্বিল গাছের ডালে জামা রেখেছিল। জামার পকেটে বিড়ির কৌটা দেশলাই ছিল। পা বাড়িয়েই থমকে দাঁড়িয়েছিল, ওই যাহ, জামাটা ফেইলে এইসেচি গাম্বিলের ডালে।

এই যে আমার হাতে। উমি এগিয়ে গিয়ে জামাটা যদুর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, আমার খ্যাল ছিল।

যদু উমির মুখের দিকে তাকিয়েছিল। সন্ধ্যার ছায়া গাঢ়তর হচ্ছিল। ফরসা মেয়ের মুখ, আবছা মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো দেখাচ্ছিল। কালো ধনুক ভুরুর নীচে, টানা কালো চোখে তখন ঝিলিক ছিল না। স্থির তারায় আবেগ। মহাদেব বলেছিল, এ আঁধারে জামা নিয়ে নাইতে যাবে?

না-ওই হ্যাঁ। যদু মহাদেবের দিকে তাকিয়ে, হেঁটেছিল। মন তখন উমির কাছে। কথার তাগবাগ ছিল না, পাড়ে রেইখে ডুব দেব। ঠিক নজর কইরে নিয়ে আইসব।

উমির হাতের চুড়ি বেজেছিল। চুড়ির মতোই হাসিও, জামার পকেটে বস্তু আছে।

মহাদেব কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে গলা খাকারি দিয়েছিল, গরমের সোময়, জলের ধারে বেশিক্ষণ বইসতে যেয়ো না।

মহাদেব আগে আগে হাঁটছিল। উমির কথা সে অব্যর্থ বুঝেছিল, জামার পকেটে বিড়ি দেশলাই আছে। উমির ভাইবোনগুলো আরও আগে। পিছনে যদু। যদুর পিছনে উমি। একটু ভয় নেই? মহাদেব আরও জোরে পা চালিয়েছিল, তাড়াতাড়ি আয় উমি, নইলে তোর মা আমাকে গাল পাইড়বে।’

মাঠ ছেড়ে সবাই ছিট-গঙ্গার ধারে চওড়া রাস্তায় পড়েছিল। যদুর মনে হয়েছিল, হঠাৎ বাতাস ওর কানে কানে ফিসফিস করেছিল, কাল বাবার বার। জামালপুরে বুড়া বাবার থানে যাব সকালে। আইসতে হবে।

যদু পাশ ফেরার আগেই, উমির আঁচল ওর গায়ে লেগেছিল, উমি প্রায় দৌড়ে মহাদেবের পাশে গিয়েছিল। যদু দেখেছিল, উমির পিছনে ঘাড়ের ওপর, সন্ধ্যার আবছায়ায় খোঁপা চিকচিক করছিল। ছিট গঙ্গার ধারে মহাদেব দাঁড়িয়েছিল, চলি যদু। পরে সাক্ষেৎ হবে।

আজ্ঞা। যদু দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

উমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েছিল, বুড়া রাজা মইষীকে ভাল কইরে দেবে।

যদু সকলের ছায়াগুলো দেখেছিল। আকাশে তারা ফুটছিল একটা একটা করে। ছায়াগুলো মিলিয়ে গিয়েছিল পশ্চিমে। ও জামার পকেট থেকে বিড়ি দেশলাই বের করেছিল। বিড়ি ধরিয়ে জলের দিকে তাকিয়েছিল। বাথানের প্রাণীদের ডাক আর ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছিল।

দোহন পর্ব শেষ। গাই বাছুরের ডাকাডাকি। নিস্তরঙ্গ জলে তারারা নিজেদের মুখ দেখছিল। মহাদেবের সময়ের কথা মনে ছিল। গরমের সময়, সেই সন্ধ্যারাত্রের বাতাসে সাপ বেরোবার সম্ভাবনা ছিল। বিশেষ জলের ধারে ঠাণ্ডা জায়গায়। আর বাতাসের চুপি চুপি কথা, কাল বাবার বার। জামালপুরের বুড়াবাবার থানে যাবে। হ্যাঁ, পরের দিন সোমবার ছিল। ওই দিনে, গোরু বাছুর বেচাকেনা নিষেধ। কিন্তু বিদেশিকে তুমি এমনি করে ডাকো কেন? তোমার কী হয়েছে? যদু বুঝতে পারে না। কেবল বুঝতে পারে, তুমি সেই যে গতকাল জল থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলে, সেই থেকে তোমার হাতে যদুর প্রাণ। তুমি ডাকলে যদু না গিয়ে থাকবে কেমন করে?

জামা পাড়ের ওপর রেখে, যদু জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। স্থির জলে তারারা খান খান হয়ে গিয়েছিল। ডুব দিয়ে উঠে আসার সময় দেখেছিল, জটা দাঁড়িয়ে আছে, বেশ আচিস র‍্যা যদু। কুটুম বাড়িতে খাচ্চিস, সোমপরশ্য, অ্যাঁ? যাবি নাকি জামালপুরে? সেই বেলের হাটের ওদিকে বাথান লিয়ে গেচিলাম। গা হাত পায়ের জাম ছাড়িয়ে আসি। যাবি নাকি?

না, তুই যা। যদু বাথানের ড্যারায় পা বাড়িয়েছিল।

ড্যারায় তখন বড় বড় টিনের পাত্রে দুধের বাঁক কাঁধে তিনজন বেরিয়ে গিয়েছিল। উনোনে জ্বলছিল কাঠের আগুন। ঠাকুদ্দা গান ধরেছিল, অ হে, কী নিদ্দয় হেদয় তোমার!/এখ্যে গেলে বেন্দাবনে/ বইলেছিলে কোন পেরাণে/ আবার আইসব কদমতলে যমুনাধার/ অহে..।’

.

সারা রাত্রিই কি যদু সেই বাতাসের ফিসফিস শুনতে পেয়েছিল, কাল বাবার বার। জামালপুরে বুড়োবাবার থানে যাব সকালে। আইসতে হবে।’…ভোর রাত্রে ঘুম ভেঙেছিল। দোহন পটের আগে ও মহিষীর কাছে গিয়েছিল। দেখেছিল ঠাকুদ্দা মহিষীর কাছে বসে আছে। বলেছিল, অবস্তা ভাল। নাদার ধরন হইয়েচে একটু। অল্প কইরে পাতলা খোলচুনি খাওয়াতে হবে। আমি দেইখচি, তুই দুইতে যা।

দোহন পর্ব শেষ করেই, সবাই প্রাকৃতিক কাজ সেরে, দুধ পান্তা খেয়েছিল। বাছুররা ছাড়া পেয়ে, মায়েদের কাছে ফিরেছিল। প্রাণীদের পায়ের বাঁধন খোলা হয়েছিল। বাথান বেরোবার আগে প্রাণীরা এমন হাক ডাক করে, যেন তাদেরই তাড়া বেশি। বাঁকা আর যদুদের দুটো বা ডাকতে আরম্ভ করেছিল। গতকাল থেকেই বাথানের সঙ্গ নিয়েছিল এক কালো রং বিশাল ষণ্ড। বলদগুলো দূর থেকেই ষণ্ড দেখে ফোঁস ফোঁস করছিল। ভয় পাচ্ছিল। হঠাৎ হঠাৎ গাভির ঘাড়ে চেপে উঠছিল। গাভি নির্বিকার। বকনার পিছনে ষণ্ড দেখলে কি বলদের পুরুষত্ব জেগে ওঠে? কী করেই বা জাগবে। ওদের পুরুষত্ব তো কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আসলে প্রাণীদের আচরণ সবসময় বোঝা যায় না। না হলে গাই গোরুই বা কেন ষণ্ডের মতো গাই গোরুর ঘাড়ে চাপতে যায়।

শ্রীবাস বাঁকা সহদেব ঘোষ বাঁক কাঁধে দুধের পাত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। পুবের আকাশ লাল করে সূর্য উঠেছিল। শ্রীবাস যাবার আগে যদুকে ড্যারায় থাকতে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিল। হীরা তোপা বাথানের সঙ্গে গিয়েছিল। জটা আর পরেশও গিয়েছিল। যদু জানত, জটা ফিরেছিল শেষ রাত্রে। বাথানে ওর বাপ খুড়া জ্যাঠা কেউ ছিল না। থাকলেও জটাকে রোখা দায়। গোরু যদি এক বার বিষ্ঠাখোর হয়, তাকে রোখা কঠিন। কিন্তু যদু, তুই কীসের ফেরে পড়েছিলি?

শত শত ঘণ্টার শব্দ তুলে, ধুলা উড়িয়ে বাথান বেরিয়ে পড়েছিল। পালদের মুনিষরা গোবর কুড়োতে এসেছিল। ড্যারা তাদের মাঠে, গোবর তাদের পাওয়ানা। দু দিনের চাল ডালও দিয়েছিল যদুদের। যদু মুখ ধুয়ে ঠাকুদ্দার সঙ্গে দুধ পান্তা খেয়েছিল। খেতে খেতে বলেছিল, আজ বাবার বার।

তা কী?’ গদাধর জিজ্ঞেস করেছিল।

যদু হেসেছিল, কিছু না। ভাইবচি এক বার জামালপুরে বাবার থানে যাব। মইষী ভাল আছে। ফিরে এইসে কাঠ পাতা কুড়োতে যাব। জল তুলব।

বড় যে ধমমে মতি দেইখচি?’ গদাধর ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল, তোর একটা কী হইয়েচে। কী হইয়েচে বল দিনি?’

যদু খাওয়া শেষ করে উঠে পড়েছিল, কী আবার হবে?

গদাধর যদুর দিকে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়েছিল। যদু হাত মুখ ধুয়ে, কাঁধের ওপর জামাটা ফেলে চলে গিয়েছিল। একেবারে সোজা জামালপুরে। সোমবার বলেই একটু ভিড় হয়েছিল। যদুর অচেনা জায়গা না। গোটা চারেক পাঁঠা এনেছিল মানতকারীরা। প্রতি সোমবারেই দু-চারটি বলি হয়। বৈশাখের পূর্ণিমাতে বুড়োরাজের রক্ত খাওয়া দেখতে হয়। হাজার বলিতেও তার তৃষ্ণা মেটে না। যদুরা পূর্ণিমার পরে কৃষ্ণপক্ষে নিমদহে এসেছিল।

খড়ের চাল মাটির ঘরে, বুড়োরাজের বিগ্রহ। পাথরের আকৃতি শিবলিঙ্গের মতো না। বড়, গোল একটা পাথরের চ্যাংড়া, গায়ে ছেনি হাতুড়ির কাজ। মাঝখানটা খোদল। যদু দেখেছিল আগেই। সেবাইত ব্রাহ্মণদের পাকা দোতলা দালান কোঠাবাড়ি ছাড়িয়ে, খড়ের চালের নাটমন্দিরের কাছে এগিয়ে গিয়েছিল। পূজা শুরু হয়নি তখনও। মন্দিরের সামনে যূপকাষ্ঠের চারপাশে গোবর দিয়ে নিকোনো হয়েছিল। বাঁ দিকে গাছতলায় বলির পাঁঠাগুলো বাঁধা ছিল। যদু বলি দেখতে পারে না।

এইসেচ!’ উমির স্বরে যেন নিশির ডাক বেজেছিল।

যদু চমকে পিছন ফিরে তাকিয়েছিল। দেখেছিল, উমি একলা। লাল পাড় শাড়ি, লাল জামা গায়ে। মুখে কি সে কিছু মেখেছিল? হিমানি পাউডার? আঁচড়ানো খোলা চুল পিঠে ছড়ানো। বেদেনি আর সবুজ রঙের কাচের চুড়ি দু হাতে। গলায় একটি রুপোর সরু হার। কপালে দোকান থেকে কেনা। আলগা লাল টিপ। চোখে সরু করে কাজল টানা। টানা চোখ যেন আরও টানা দেখাচ্ছিল। পায়ে সকালে পরা টাটকা আলতা। যদু চোখ ফিরাতে পারছিল না।

এইস’ উমি মাথা ঝাঁকিয়ে ডেকেছিল।

নিশির ডাক। নিশি পাওয়া ঘোরে সেই মেয়ের সঙ্গে গিয়েছিল। কোথায় যাবে, সঙ্গে কেউ আছে কি না, জিজ্ঞাসা মনে ছিল। মুখ ফুটে বেরোয়নি। দক্ষিণে গিয়ে, পশ্চিমে বাঁক নেবার সময়ে, উমির স্বরে কেমন চাপা আবেগ, মা আর নক্কী আইসবে সেই দুকুরে, পূজার সোময়ে। আমি নেয়ে ধুয়ে আগে চলে এইসেছি। বইলেচি, জামালপুরে সইয়ের বাড়ি যাচ্ছি।’

যদুকে সইয়ের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল নাকি? যদু কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারেনি। স্থান কাল জ্ঞান ছিল না। লোকলজ্জা ভয় হারিয়ে ছিল। বৈশাখের সকাল রোদে তেতে উঠেছিল। মাঝে মাঝে ঝটকা বাতাসে ধুলা উড়ছিল। উমি কোন পথে, কোথা দিয়ে গিয়েছিল এক নিরালা দিঘির ধারে। বৈশাখের খরা টানে দিঘির জল কম। চার দিকে, চারটি ঘাটই ভাঙাচোরা। চারপাশে জঙ্গল আর পোডড়া জমি। উমি চলতে চলতে, যদুর গা ঘেঁষে এসেছিল। মিষ্টি একটা গন্ধ লেগেছিল যদুর ঘ্রাণে। বুলবুলিরা শিস দিচ্ছিল। ডাক পাখি ডাকছিল।

উমি বাবলা আঁসশ্যাওড়ার জঙ্গলে ঢুকেছিল। যদুর জামা তখনও কাঁধে ঝোলানো। জঙ্গলের মধ্যে মাঝে মাঝে বড় শাল তাল মাথা তুলেছিল। জঙ্গল পেরিয়ে, ধু ধু মাঠ। উমি থেমেছিল। মাথার ওপরে। একটা মস্ত অর্জুন গাছের ছায়া। উমি যদুর দিকে তাকিয়েছিল। ছেউটি মেয়েটিকে তখন বড় যুবতীর মতো দেখাচ্ছিল। তার কালো চোখের তারায় ঝিলিক ছিল না। যেন ভরা বর্ষার কালো দিঘিতে, মেঘ ভাঙা রোদের ছটা। বড় গভীর। আবেগ ভরা। চোখা নাকের রন্ধ্র কঁপছিল। কপালে চিবুকে নাকের ডগায় ঘামের বিন্দু। দাঁড়িয়েছিল একেবারে যদুর বুক ঘেঁষে। কী কর মেয়ে? বৃষের বুকে তোলপাড় রক্ত। নিশ্বাস পড়তে চাইছিল না। মাথার চুলের কালো কণাগুলো বাতাসে যেন ফোঁস ফোঁস করছিল। উমির সেই নিশি-পাওয়া স্বরে, সেই নিঝুম বন মাঠের সীমানায়, একটি শব্দ উচ্চারিত হয়েছিল, কী?

কী?’ যদু যেন ভিন্ন সুরে উমির শব্দের প্রতিধ্বনি করেছিল।

উমি সেই নিরালায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিল, জান না?’

যদু নির্বাক ঘাড় নেড়েছিল। উমির স্বরে সেই ফিসফিস, তবে এলে ক্যানে?

 তুমি ডাইকলে যে?’ যদুর গলা যেন দূর থেকে ভেসে এসেছিল।

উমি হেসেছিল। মুখে লাল ছটা। ভাল লাগে না?

যদুর বুকে ঢাকের দগর বেজেছিল। রক্ত দাপাদাপি করছিল। উমির চোখ থেকে দৃষ্টি এক বার নেমেছিল, সদ্যোন্নত বুকে। আবার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। জবাব দিতে পারছিল না। কী জবাব দেবে, জানত না। জোয়ান ঘামছিল, নাকের পাটা ফুলে উঠছিল। উমির কাচের চুড়ি পরা বাঁ হাত, যদুর ঘন শ্যাম বুকে ঠেকেছিল। যদু চোখ নামিয়ে সেই হাত দেখেছিল। আর ওর বড় ডান হাত দিয়ে, সেই হাতের ওপর চেপে ধরেছিল। উমির চোখ হঠাৎ টলটলিয়ে উঠেছিল। স্বরে ওর কান্না, বুড়োরাজ জানে,আমার কী হইয়েচে।

উমির মাথা যদুর বুকে ঠেকেছিল। যদু বাঁ হাত দিয়ে সেই মাথা ওর প্রকাণ্ড বুকে চেপে ধরেছিল। উমি কান্না জড়ানো ফিসফিস স্বরে বলেছিল, আমার মনে কোন পাপ নাই। সেই দু বছর আগে এইসেছিলে, কতটুনি মেয়ে তখন আমি। সেই থেকে কেবল তোমার মুখ মনে পড়ে। ক্যানে?

উমি যদুর গা থেকে যেন গলে মাটিতে পড়েছিল আস্তে আস্তে। বসেছিল যদুর পায়ের কাছে। দু হাত যদুর হাঁটুর ওপরে। যদুর তখন ভিতরের তোলপাড়, দরজা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল। ও বসে, দু হাতে উমিকে বুকের কাছে টেনে নিয়েছিল। উমির সকল লজ্জা ভেঙে গিয়েছিল। দু হাত দিয়ে যদুর গলা জড়িয়ে ধরেছিল, তোমাকে সেইদিন জলে দেইখলাম, ভেইসে গেলাম তোমার কাছে। দূর থেকে দেইখেই চিনতে পেরেছিলাম, আর মনটা কেমন করে উইঠেছিল। ক্যানে গো?

আমার মনও যে কেমন কইরচে। ক্যানে?’ যদুর গাঢ় স্বর ভাঙা ভাঙা শোনাচ্ছিল, সেই যে তুমি ডেইকে নিয়ে গেলে, তা’পর থেনে আর কোথাও যেইতে পাইরচি না।

উমি যদুর বিশাল শরীরে যেন নিজেকে দলামোচড়া করছিল, আমি সারা দিন ঘরের কাজ করি, মন পইড়ে থাকে তোমার কাছে। আমার কোন লাজ লজ্জা নাই।

উমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। মনে তার একটা অপরাধ বোধ বিধেছিল। সংসারের নিয়ম নীতি সে লঙঘন করেছিল। মনের গভীরে, মেয়ের সেই অজ্ঞাত অনুভব, আমার বাবা মা এত্ত ভালবাসে। কিন্তু তোমার কাছে ক্যানে মন পইড়ে থাকে?

উমি, আমারও সেই কথা। যদুর হাত উমির কোমরে, আমার কেবল মনে হয়, ক্যানে তুমি আমাকে ডেইকেছিলে?

যদুর কোলে উমি, মাথা বুকে। মুখ তুলে তাকিয়েছিল। কাজল ধোয়া চোখের জল গালে, তুমি যে অনেক আগে আমাকে ডেইকেছিলে, জান না?

যদু মাথা নেড়েছিল, জানে না। দেখেছিল আঁচল খসা ছেউটির সদ্যোন্নত বুক ঢাকা লাল জামা।

উমি হেসেছিল। হাত চাপা দিয়েছিল যদুর চোখে। আলতো করে দাঁত বসিয়েছিল যদুর শক্ত বুকে। বাতাস উঠেছিল প্রবল। বন মাথা নাচিয়ে, ঝাপটায় শব্দ তুলেছিল হা হা। ঘূর্ণি বাতাসে শুকনো পাতা উড়েছিল পাগলা নাচের ছন্দে। বৃষ উন্মত্ত হয়েছিল। শ্যাম ঘন রং পুরুষ, কিশোরী গৌরী, ঘাসে মাটিতে শুকনো পাতায় জড়াজড়ি গড়াগড়ি দিয়েছিল। দিঘি জঙ্গল মাঠও যেন নিশি পাওয়া ঘোরে তাকিয়েছিল দুজনের দিকে। দুজনে হেসেছিল। প্রকৃতি স্বয়ং সেই হাসিতে যেন মুগ্ধ মত্ত হয়েছিল।

উমি আবার কেঁদেছিল। যদু উমির বুকে হাত রেখেছিল, দিসারার গোপ যদু, নিমদের উমির কাছে বন্ধক থাইকল।

তাই যদি, ও নিমদের মেয়ে অনেক আগে বন্ধকি হইয়েচে। চোখের জলে, হাসির কিরণ ছিল উমির মুখে, তোমার অনেক সুদ পাওয়ানা হইয়েছে।’

যদু ছেউটি গৌরীর চুল ঘাড় গলা শুঁকেছিল, আদায় কইরব।

দুজনে যখন ফেরবার জন্য উঠেছিল, উমির খোলা চুলে, শাড়ি জামায় শুকনো ঘাস পাতা ভরা। যদু একটি একটি করে সব তুলে, ঝেড়ে পরিষ্কার করে দিয়েছিল। উমি নিজের শাড়ি চুল বিন্যস্ত করেছিল। খোয়া গিয়েছিল কপালের টিপ। ভেঙেছিল কয়েকটা কাচের চুড়ি। ফেরার পথে বলেছিল, তুমি আজ আর বাবার থানে যেইও না। পরশু আমি বেলের হাটে মামার বাড়ি যাব। তুমি বাথান নিয়ে বেরিয়ে দাশু ঘোষের বাড়ি যেইও। তোমার জন্যই মামাঘর যাব। যাবে তো?

যাব। বন্ধকি না আমি?’ যদু সুখে হেসেছিল।

দিঘি ছাড়িয়ে উমি বলেছিল, যে পথ দিয়ে এইসেছি, তুমি সেই পথে যাও। আমি অন্য পথ দিয়ে সইয়ের বাড়ি যাব।’

যদু যেন পথহারা গোরুর মতো বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়েছিল। উমি হেসেছিল, কী কইরব বল। নুকোচুরি কইরতে আমার মন চায় না। বাড়িতে কারুকে কোনও দিন মিছা কথা বলি নাই। এখন বইলতে হচ্ছে।

উমির হাসি মুখে, চোখের কোণ দুটি আবার জলে চিকচিক করে উঠেছিল। প্রাণ একখানে, মন অন্যখানে। ছেউটির প্রেম। কিশোরীর ছলনা। তবু যদু বলেছিল, কিন্তু কাঁদ ক্যানে। তুমি যে বইললে, বুড়োরাজ সব জানে।

মিছে বইলচি নাকি?’ কালো ধনুক ভুরু কুঁচকে উমি তাকিয়েছিল। আবার হেসেছিল, বাবা মাকে মিছে বইললে কষ্ট হয় না? তবু বইলব, বুড়োরাজকে সব বইলব। যাচ্ছি।’

উমি অন্য দিকে মোড় নিয়েছিল। যদু দিশাহারা বৃষের মতো তাকিয়েছিল। উমি ফিরে দাঁড়িয়েছিল, যাবে না?

যেতে হবে। যদুর বলতে নিশ্বাস আটকাচ্ছিল।

উমির চোখের কালো তীরে ঝিলিক দিয়েছিল, গঙ্গার ধ্যেরে ভূত!

বলেই ছুট দিয়েছিল। যদু উমিকে বাঁশগাছের আড়ালে হারিয়ে যেতে দেখেছিল। মনে মনে নিজেও বলেছিল, গঙ্গার ধ্যেরে ভূত! তারপরে নিজেই হেসে উঠে, জোরে হাঁটা দিয়েছিল। বৈশাখের খর রোদ। পথে দুই জন তোক আর গোরুর গাড়ির আসা যাওয়া। পাগল না হলে কেউ হঠাৎ ওই রকম গেয়ে উঠত না, অ র‍্যা কালা, তোরে মজালে কোন কড়ে নারী।/এ কি র‍্যা শমন জারি/উকিল মোক্তার ম্যাজিস্টর সবাই নারী/ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কালা, পায়ে তোর পীরিত বেড়ি।’

পথচারীর একজন হেসে বলেছিল, গরম নেইগেচে। যদু কোনও জবাব দেয়নি। ড্যারায় ফিরে গিয়েছিল। বিকালে সূর্যাস্তের আকাশে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা কালো মহিষ বাছুরের মাথা ক্রমে। বড় হয়ে উঠছিল। বাথান ফিরে আসছিল ধুলা উড়িয়ে, ঘণ্টার শব্দে। যদু মহিষীকে খাবার খাওয়াচ্ছিল। গদাধর আকাশের সেই কালো মহিষ কঁড়ার শরীর বাড়তে দেখে, হেঁকেছিল, ঝড় উইঠবে মনে হচ্চে রে যদু।

ভেড়ার পাল তখন ড্যারার মাঠে এসে পড়েছিল। কালো কড়া মহিষের গায়ে বিজলি হেনেছিল। গাছপালা থমকে গিয়েছিল। বাথানের প্রাণীরা ডাকতে আরম্ভ করেছিল। যদু জিজ্ঞেস করেছিল, ভেড়াগুলান লিয়ে পালেদের বাড়ি চইলে যাব?

ঝড় আইসবে। সহদেব চিৎকার করে ছুটে এসেছিল। যদু হীরা তোপাকে ডেকেছিল। শ্রীবাস হেঁকেছিল, ভেড়াগুলানকে লিয়ে কারুর বাড়ি চইলে যা।’

ভেড়ার দল দিশেহারা উদ্বিগ্ন চোখে ডাকতে আরম্ভ করেছিল। ওরা জল বৃষ্টি সইতে পারে না। আকাশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে যেন হাজারটা মহিষ কাঁড়া দৌড়ে ধেয়ে আসছিল। বিজলি চমকাচ্ছিল ঘন ঘন। বাজের ডাকে রুদ্রের হুংকার। ভেড়ার সংখ্যা প্রায় সত্তর। যদু লাঠি হাতে ভেড়াদের পথ দেখিয়ে ছুটেছিল। দলের দু পাশে পিছনে তোপা আর হীরা। যদু সামনের দিকে। ছিট-গঙ্গার ধারে পৌঁছোতেই, আকাশ থেকে যেন হাজার কাঁড়া মহিষ ভয়ংকর হাঁক দিয়ে, বাতাসের ঝাপটায় ছুটে এসেছিল। ছিট-গঙ্গার স্থির জলে ঢেউ দিয়েছিল। ধুলা উড়েছিল অন্ধকার করে। যদু চিৎকার করে। বলেছিল, পালেদের বাড়িত যাওয়া হবে না। কার্ত্তিকদাদাদের বাড়ি ঢুকব।’

বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছিল বড় বড় ফোঁটায়। গাছপালার মুণ্ডুগুলো ধরে যেন কেউ নুইয়ে মুচড়ে দিচ্ছিল। ঘন ঘন বিদ্যুৎ হানা বাজের ডাক ধরণী কাঁপাচ্ছিল। কাক পক্ষীরা ঝড়ের ঝাপটায় আৰ্তরব করছিল। মহাদেব ঘোষের দরজায় পৌঁছবার মুহূর্তে, ঝড়ের তাণ্ডবের সঙ্গে, হাজার তীরের মতো বৃষ্টি বিদ্ধ করেছিল। যদু মই-ঝাঁপ তুলে ধরতেই মেষগুলো ডাকতে ডাকতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। দাওয়ার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ঢুকে মা বাচ্চারা সব ডাকতে আরম্ভ করেছিল। অক্রূর ঘোষ চিৎকার করে উঠেছিল, অই র‍্যা দ্যাখ কাদের ভেড়ার পাল বাড়ির মধ্যে ঢুইকা পইড়েচে।

কেবল অক্রূর ঘোষ না। বাড়ির সবাই ঘরের ভিতর থেকে চিৎকার করছিল। যদু উমির মায়ের গলা শুনতে পেয়েছিল, এ গুলান এল কোথা থেকে?

আমাদের বাথানের ভেড়া।যদু চিৎকার করে বলেছিল, পালেদের বাড়িতক আর যেতে পাইরলাম না গো খুড়ি।’ও পুবের ঘরের দাওয়ায় উঠেছিল।

ভেড়ারা দুটি ঘরের দাওয়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। খড়ের চাল অনেক নামানো। তবু বৃষ্টির ছাট আসছিল। মাটির দেওয়াল খড়ের চাল ঝড়ে কাঁপছিল। চারপাশের গাছগুলোর ঠোকাঠুকি ঝাপটায়, দুরন্ত শব্দ হচ্ছিল। পুবের ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিল উমি। তোপা আর হীরা দক্ষিণের দাওয়ায় উঠেছিল। অক্রূর ঘোষের চিৎকার ক্ষীণ শোনাচ্ছিল, ওই গো, তোমরা আমাকে কেউ একটু ধর।

তোপা, হীরা, দাদুকে ধর। যদু চিৎকার করেছিল।

উমির হাতে শাঁখ ছিল। ও শাঁখ বাজিয়েছিল ঘন ঘন। ওর মা একটা পিড়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল উঠোনের জলে। অন্ধকার ঘন হয়ে আসছিল। ঝড়ের প্রচণ্ড দাপটে, খড়ের চাল মচমচ করে উঠেছিল। ঘরের ভিতর কিছু ভারী জিনিস পড়ার শব্দ হয়েছিল। মুহুর্মুহু বিজলির হানা, বাজের রুদ্র হুংকার ফেটে পড়ছিল। ঘরের ভিতর দু-তিনজন ছোট ছেলেমেয়ে একসঙ্গে কেঁদে উঠেছিল। কার্তিকের বউয়ের আর্তস্বর শোনা গিয়েছিল, মা গো, চাল কাঁইপচে, খড় উড়ে গিয়ে ঘরে জল ঢুইকচে।

উমি শাঁখ বাজাচ্ছিল, যদুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছিল। যদুর চোখে জিজ্ঞাসা। উমির মুখ থেকে চোখ সরিয়ে, ওর মায়ের দিকে তাকিয়েছিল, খুড়ি, কিছু কইরতে হবে?

কী কইরবে বাবা তুমি?’ উৎকণ্ঠিত আর্তস্বরে বলেছিল উমির মা, চাল উড়িয়ে নিয়ে গেলে, অন্য ঘরে যেতেই হবে। মরাই দুটো ভেঙে পইড়ল কি না কে জানে? একটা পুরুষ ছেলে ঘরে নেই।’

যদু দাওয়া থেকে নিচু হয়ে ধানের মরাইয়ের দিকে দেখেছিল। শাল কাঠের খুঁটির ওপরে, বাঁশের তৈরি শক্ত মরাই। ঘরের মতোই মাথায় খড় দিয়ে চারচালা বানানো। বিজলি হানা ঝলকে দেখা গিয়েছিল, মরাইয়ের মাথা কাঁপছে। বৃষ্টির ঝাপটায়, তেল সিদুরে আঁকা স্বস্তিক চিহ্ন গলে পড়ছিল। দক্ষিণ থেকে উঠোনের জল ঢল খেয়ে যাচ্ছিল উত্তরে। আলকাতরা মাখানো শালের খুঁটি দেখতে দেখতে ডুবে যাচ্ছিল। যদু অনুমান করতে পারছিল না, মরাই দুটো মুখ থুবড়ে পড়বে কি না?

উমির শঙ্খধ্বনি থামছিল না। ওর মা চিৎকার করছিল, অই গো পবন দো, তোমাকে পিঁড়ে পেইতে দিয়েচি। শান্ত হয়ে বস।

সেই মুহূর্তেই অশান্ত ক্রুদ্ধ পবন দেবতার উগ্র ঝাপটায় কোথায় মট করে প্রচণ্ড শব্দ হয়েছিল। উমির শঙ্খধ্বনি থেমে গিয়েছিল। যদু ভেবেছিল ঘরের দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। চকিতে এক বার ঘরের দিকে তাকিয়েছিল। দেওয়াল ভেঙে পড়েনি। তোপার চিৎকার ভেসে এসেছিল, পেছুনকার গাছ ভেইঙে পইড়েছে।’

যদু নিচু হয়ে উত্তরে দেখেছিল। গাম্বিল গাছের মুণ্ডু নেই। একটা ছোটখাটো ডাল মরাইয়ের চারচালা মাথায় পড়ে ছিল। গাম্বিল গাছের পাশেই গোয়াল। যদুর বুকটা ধ্বক করে উঠেছিল। গোয়ালের চালা ভেঙে, গোরু বাছুর বলদ কয়টি চাপা পড়েনি তো? ও দাওয়া থেকে নীচে লাফিয়ে পড়েছিল। উমি পিছন থেকে চিৎকার করে উঠেছিল, কোথায় যাও?

যদু জবাব না দিয়ে, দক্ষিণের ঘরের পিছনে গিয়েছিল। গাম্বিলের বিরাট মুণ্ডু গোয়ালের সামনে পড়েছিল। বাছুর বলদগুলো আর্তস্বরে ডাকছিল। যদু তাদের দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু টের পাচ্ছিল, ওরা খুঁটির দড়ি ছিঁড়ে পালাতে চাইছে। ঘর ভেঙে পড়ার ভয় প্রাণীদের। যদু হাঁক দিয়েছিল, হ হহ, সাইমলে থাক গো মা ব্যাটারা। মানুষের উপস্থিতি আর আওয়াজ দরকার। প্রাণীরা ভরসা পায়। যদু গাম্বিলের মুণ্ডু টেনে ধরে, গোয়ালের অবরোধ সরাতে চেষ্টা করেছিল।

কী কইরচ গো তুমি? উমি যদুর গায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল।

যদু কোনও জবাব না দিয়ে, গাম্বিলের ভারী মুণ্ডুর ডাল ধরে সবলে হ্যাঁচকা টেনেছিল। সেই মুহূর্তেই বিজলি হেনেছিল। কড়াৎ বাজ। ঝলকে উঠেছিল তীক্ষ্ণ আলোর ঝলক। উমি যদুকে ধরে, চোখ বুজে আঁতকে চিৎকার করেছিল, মইরলাম।

ঘরে যাও গা। যদু হেঁকেছিল। গোয়ালের সামনে থেকে গাম্বিলের মুণ্ডু সরিয়েছিল। বৃষ্টিতে সারা শরীর ধুয়ে যাচ্ছিল। ও গোয়ালের মধ্যে ঢুকেছিল।

উমিও গোয়ালের মধ্যে ঢুকেছিল। সকালের সেই শাড়ি জামা, ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপটে গিয়েছিল। যদু প্রাণীদের গায়ে হাত দিয়েছিল। তারা শান্ত হয়েছিল। ডাগর কালো চোখে ভরসা নিয়ে তাকিয়েছিল যদুর দিকে। উমির তখন জ্ঞান ছিল না। যদুকে জড়িয়ে ধরেছিল। যদু উমির দিকে। তাকিয়েছিল। উমি কাঁদছিল, বুড়োরাজ তোমাকে পাঠিয়েছে।

উমির মায়ের চিৎকার ভেসে এসেছিল, চাল উড়ে যাচ্ছে।

যদু উমিকে হাত ধরে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। বুকের কাছে নিমেষের জন্য চেপে ধরে ছেড়ে দিয়েছিল। ছুটে গিয়েছিল পুবের দাওয়ায়। উঠোনে জলের তোড়, ছিট-গঙ্গার দিকে ঢলে নামছিল। যদু ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখেছিল, পশ্চিমের চালের খড় কেউ যেন একটা খাবলা দিয়ে তিন-চার হাত তুলে নিয়েছে। ঘর জলে ভেসে যাচ্ছে। বউ ঝি ছোটরা সব সেই ঘরে। কার্তিকের বউ শিশু কোলে ঘরের এক কোণে। উমির মা ভয়ার্ত চোখে চালের দিকে তাকিয়ে ছিল। যদু জিজ্ঞেস করেছিল, খড়ের গাদা কোথায়?

পচ্চিমের পোড়োয়।উমির মা উৎকণ্ঠিত কান্নার স্বরে বলেছিল, কিন্তু তুমি যেইও না বাবা, মাথার ওপরে গাছ ভেইঙে পইড়বে।

যদু ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। উমি তখন দাওয়ায় এসে উঠেছিল। যদু ঘরের পিছনে গিয়ে, ঝাপিয়ে পড়েছিল খড়ের গাদায়। উঠতে গিয়ে, ভেজা খড়ে পা পিছলে যাচ্ছিল। তবু উঠেছিল। খড়ের আঁটি তুলে নিয়ে, চালের শূন্য জায়গায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল। মাথার ওপরে কাটাল গাছের ডাল ওর মাথায় ঝাপটা মারছিল। বৃষ্টির ধারা কমে এসেছিল। ঝড়ের বেগ কমেছিল। যদু খড়ের গাদা থেকে নেমে, পুবের ঘরে গিয়েছিল। ফাঁকা চাল ঢাকা পড়েছিল। উমির খুড়ি একটা লম্প জ্বালিয়েছিল।

উমির মা কেঁদে উঠে যদুর হাত ধরেছিল, বাবা তুমি বাঁচিয়েচ।’

সবাই যদুর দিকে তাকিয়েছিল। উমি জানত না, কেন ওর চোখ দিয়ে অবিরল জল গড়াচ্ছিল। যদু বলেছিল, খুড়ি, মরাইয়ের ক্ষতি হয় নাই। গোরু বাছুর বলদ বেঁইচে আছে, গোয়ালের চাল বেঁইচে গেচে।ও বাইরে বেরিয়েছিল। ভেড়াদের গায়ে গায়ে হাত দিয়েছিল, হীরা তোপা, সব ঠিক আছে?

হ্যাঁ। দাদুকে ঘরের মধ্যে থুইয়েচি। হীরার গলা শোনা গিয়েছিল।

অন্ধকার নেমেছিল। কাঁড়া মহিষের দল দুরান্তের চকে গিয়েছিল। ঝড় থেমেছিল। বৃষ্টি ধরে এসেছিল। ভেড়ারা ডাক থামিয়েছিল। যদুর গায়ে ভেজা স্পর্শ লেগেছিল। অন্ধকারে উমি আবার ওর গায়ের কাছে। যদু বৃষের মতো ওর চুলে ঘাড়ে কপালে লেহন করেছিল, আমি ড্যারায় যাই।

উমি যদুর হাত চেপে ধরেছিল। মহাদেবের উৎকণ্ঠিত গলা শোনা গিয়েছিল উঠোনে, কার্তিকের মা!’

উমি যদুর হাত ছেড়ে দিয়ে সরে গিয়েছিল। যদু দাওয়া থেকে নেমেছিল, হীরা তোপা, তোরা বৃষ্টি ধরলেই ভেড়াদের নিয়ে আসিস। আমি ডেরায় যাচ্ছি।’

তুমি যদু?’ মহাদেবের স্বরে বিস্ময়। যদু বলেছিল, আজ্ঞা। আমাদের ভেড়ার পাল তোমার দাওয়ায় ঠাই নিয়েচে খুড়ো। উমির মা লক্ষ হাতে দাওয়ায় এসেছিল, ওগো, তুমি এইসেচ? কোতায় ছিলে? ছেলেরা কোথায়? … যদু বেরিয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টিও ধরে এসেছিল। মেঘ ডাকছিল গম্ভীর দীর্ঘ স্বরে। সে এখন শান্ত। আর ভয় নেই। ড্যারায় তখন দুধ দোহন শুরু হয়ে গিয়েছিল। যদুও দোহনে লেগে গিয়েছিল।

.

 রাত্রে আকাশে তারা ছিল না। আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল। মাঝে মাঝেই মেঘ ডাকছিল। যদুর চোখে ঘুম ছিল না। ভেজা মাটিতে দুটো চট বিছিয়ে শুয়েছিল। চোখ বোজা প্রাণীরা মেঘ ডাকলেই চোখ তাকাচ্ছিল। আর একসঙ্গে শত শত চোখ স্নিগ্ধ নীল আলোর মতো জ্বলে উঠছিল। আবার নিভে যাচ্ছিল। যদু নিজের মুখে বুকে হাত দিচ্ছিল। উমির ছোঁয়া লেগেছিল সারা গায়ে। উমিকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছিল নিজের গায়ে।

শেষ রাত্রের দিকে বাতাস বহেছিল। আকাশে তারা জেগেছিল। দোহন পর্ব শেষ হতে হতেই, পুবের আকাশ লাল করে, সূর্যোদয় হয়েছিল। মহিষী সুস্থ হয়ে উঠেছিল। যদু বাথান নিয়ে বেরিয়েছিল। তোপা আর সহদেব গদাধরের সঙ্গে ড্যারায় ছিল। যদু বৃষ্টি ভেজা মাঠের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিল, দু দিনের মধ্যেই মাঠের আলে ঘাস গজাবে।

যদু পরের দিনও বাথানের সঙ্গে গিয়েছিল। নিজেই বলেছিল, বাথান লিয়ে আজ বেলেরহাটে যাব।’ কিন্তু মনে সংশয় ছিল, উমি মামার বাড়ি গিয়েছে তো? গতকাল এক বারও দেখা হয়নি। বাথান চরাতে চরাতে বেলেরহাট পৌঁছেছিল দুপুরে। বিশাল মাঠের অনেক জায়গাতেই সবুজের ছিট ছিল। যদু একাকে গ্রামে চলে গিয়েছিল। গ্রামবাসীদের কাছে দাশু ঘোষের বাড়ির সন্ধান করেছিল। বাড়ি অবধি। পৌঁছাতে হয়নি। উমি নিজেই পথে বেরিয়ে এসেছিল। যদুকে মামার বাড়ি নিয়ে যায়নি প্রথমে। নিয়ে গিয়েছিল, এক ভাঙা বাড়ির জঙ্গলের পোড়োয়। বলেছিল, যদুর প্রশংসায় ওদের বাড়ির সবাই পঞ্চমুখ। উমির সঙ্গে বিয়ের কথাও উঠেছিল। উমির মা তুলেছিল। বাবা খুড়ো দাদারা সবাই এক কথায় নাকচ করে দিয়েছিল। চাষবাস নেই, বছরে ছ-সাত মাস বাথান নিয়ে ঘোরে। দুধ বেচে খায়। যত গোনই থাকুক, পথে ঘোরা গোপদের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায় না। কী করবে? উমি তো সেই এগারো বছর বয়সেই প্রাণে মরেছে। এখন যদু তাকে শরীরে– সে আর বাঁচতে চায় না। যদুর বুকে পড়ে উমি কেঁদেছিল।

যদুর চোখের সামনে মহাদেব ঘোষের মরাই দুটো ভেসে উঠেছিল। তোমরা ধান বেচে খাও। ঘরে চাল কর, বছর ভরে খাও। বাথান নিয়ে ঘোরা গোপের ছেলেকে মেয়ে দিতে ইজ্জতে লাগে। যদুর রাগ হয়েছিল, মুখ শক্ত করে বলেছিল, মেয়ে তুইলে লিয়ে যাব গা। কিন্তু জানত, তা সম্ভব না। উমি বলেছিল, তুমি আইবুড়ো মেয়েকে কলঙ্ক দাও। যদু অবাক হয়ে উমির কথা শুনেছিল। অবিবাহিতা মেয়ে গর্ভবতী হতে চেয়েছিল। সেও তো গোপকন্যা। গোপের আদিম রক্ত তার শরীরে। যদুর বাবা মাকে মনে পড়েছিল। ঘরে আসবার আগেই বউ গর্ভবতী? তা হয় না। তবে কী হবে? দুটি কাঁচা প্রাণ, অসহায় আকুল চোখে পরস্পরের দিকে তাকিয়েছিল। আদর সোহাগ সুখে, বারে বারে ব্যথা বিধেছিল। দিসারার গোপ যুবা, কেন বাথান নিয়ে নিমদহে এলে? কেন দেখা দিলে। মারো হে, উমিকে শেষ কর। যদুর সেই শক্তি ছিল না। বরং শক্তি ছিল, মেয়েকে তুলে নিয়ে চলে যাবে। দুই বন্দি অসহায় চোখে তাকিয়েছিল। পথ হাতড়েছিল অন্ধকারে। পথের দিশা তখন মেলেনি।

উমি যদুকে নিয়ে মামার বাড়ি গিয়েছিল। জানত না, দাশু ঘোষ স্বয়ং ওদের ভাঙা বাড়ির নির্জন পোড়ো থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিল। মামি শক্ত মুখে জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় ছিলি এতক্ষণ উমি? বাথান চরিয়ে বেড়াচ্ছিলি? উমির হাতের মুড়ি বাতাসা না নিয়ে যদু ফিরে এসেছিল।

তিন দিন পরে, দোহন পর্ব সারা হয়েছিল। শ্রীবাস যদুকে বাথানে যেতে বারণ করেছিল। শ্রীবাস নিজেও দুধ বিক্রি করতে বা বাথান নিয়ে যায়নি। সবাই বাথান নিয়ে চলে গিয়েছিল। ড্যারায় ছিল শ্রীবাস গদাধর আর যদু। যদু মাঠের পশ্চিমে একলা বসে ছিল। বেলেরহাট থেকে ফেরার পরে, উমিকে আর দেখতে পায়নি। ওদের বাড়ি যাওয়ার কোনও আছিলা পায়নি। ও দেখছিল, মহাদেব ঘোষ তার দুই ছেলেকে নিয়ে ড্যারার দিকে আসছে। হাতে তাদের লাঠি। ঠিক সেই মুহূর্তেই বাঁশের লাঠির প্রচণ্ড ঘা পড়েছিল যদুর পিঠে। যদু চমকে পিছন ফিরে দেখেছিল, বাবা শ্রীবাসের উগ্র মূর্তি। ও উঠে দাঁড়াবার আগেই, শ্রীবাস আবার ঠাস করে লাঠি মেরেছিল যদুর কোমরে, শোরের বাচ্চা, ষাঁড়বিত্তি ধইরেচিস? আত্মকুটুমের ঘরের মেয়েকে বেইজ্জত?

শ্রীবাস অন্ধের মতো উপর্যুপরি যদুর সর্বাঙ্গে লাঠি চালিয়েছিল। ইতিমধ্যে মহাদেব, কার্তিক আর অনন্ত এসে দাঁড়িয়েছিল। তাদের মুখ শক্ত। শক্ত হাতে শক্ত লাঠি। গদাধরও এসে দাঁড়িয়েছিল। যদু মুহূর্তের মধ্যেই ঘটনা বুঝে নিয়েছিল। এক বার চোখ জ্বলে উঠেছিল। শ্রীবাসের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নেবে ভেবেছিল। নেয়নি। দু হাতে মাথা চেপে ধরে, উপুড় হয়ে বসে পড়েছিল। শ্রীবাস পিটিয়েই চলেছিল। মহাদেব ঘোষ পর্যন্ত আর থাকতে পারেনি। শ্রীবাসের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়েছিল। খুন কইর না হে ছিবাস, ছেইড়ে দাও। আমরা বাপ ব্যাটারাও এইসেছিলাম, এক মতলবেই। এখন ভেবে দেইখচি, নিজেদের আত্মকুটুমের মধ্যে ব্যাপার, গাঁয়ে পাঁচ কান না হওয়াই ভাল।

যদুর পক্ষে সম্ভব ছিল না উঠে বসবে। ও আস্তে আস্তে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিল। সারা হাতে কাঁধে পিঠে কালশিরার দাগ ফুটে উঠেছিল। শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। ও উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিল। গদাধর যদুর কাছে গিয়ে বসেছিল, ছিবাস তুই মাইরলি, লইলে নিমদেতে আজ অক্তগঙ্গা বইত।

পিসে কি আমাদের সঙ্গে লইড়তে? মহাদেবের স্বরে যুগপৎ বিস্ময় ও ব্যঙ্গ।

গদাধর বলেছিল, তা লইড়তাম বইকী মা’দেব। আমার লাতিকে আমি চিনি। এক হাতে তালি বাজে না। তোমার মেয়ে কি ধোয়া তুলসীপাতা?’

না পিসে, মেয়েকে তার মা পিটিয়ে পাট পাট কইরেচে।মহাদেব বলেছিল, তোমার এই লাতিকে আমাদের সার ভাল লেইগেছিল। মেয়ের মা নিজেই বইলেচে, সে তোমার লাতির কোন দোষ দেইখতে পায় নাই। তোমাকে আর ছিবাসকে সবই বইলেচি। বেলেরহাট থেকে আমার নিজের শালা এইসে সব বইলে গেছে। তা আমাদের আঁতে লাগবে না?’

গদাধর নিষ্ঠুর হেসে বলেছিল, আঁতের কতা বইল না হে মা’দেব, ইজ্জতের কতা বল। ইজ্জত আমাদেরো আচে। তোমরা যদি আমার লাতির গায়ে হাত দিতে, গদাধর ঘোষ চুপ কইরে বইসে থাইকত না। তুমি গোপ আমিও গোপ, মনে এখ্য। তবে হ্যাঁ, আত্মকুটুমের ব্যাপার। ছিবাস নিজের ছেলেকে মেইরেচে, তোমাদের সামনে মেইরেচে আমার যদুকে। ছিবাসকে কাইদতে হবে, এই বইলে দিলাম। আর একটা কথাই বইলব মাদেব, তোমার পিসির কথা আজ বড় মনে পইড়চে।

গদাধর যদুর পিঠে হাত দিয়েছিল। যদুর সারা শরীরের যন্ত্রণা থেকেও বেশি যন্ত্রণা হচ্ছিল, উমির মার খাওয়ার কথা শুনে। ওর চোখ ফেটে জল আসছিল। উমির মুখ মনে পড়ছিল। সংসার এই রকম। সংসার কোনওকালে কোনও যদু উমির কথা জানতে চায় না। সে তার নিয়মে চলে। ও কোনও রকমে মুখ তুলে মহাদেবকে বলেছিল, খুড়ো, খুড়িকে বইল, মেয়েকে যেন আর না মারে। দোষ সব আমার।

কার্তিক আর অনন্ত চলে গিয়েছিল। মহাদেব নিজে ড্যারার বালতি থেকে ঠাণ্ডা জল এনে যদুর পিঠে ছিটিয়ে দিয়েছিল। কালশিটে দাগের ওপর জল দিয়ে ডলে দিয়েছিল। শ্রীবাস দক্ষিণের মাঠে চলে গিয়েছিল। গদাধর মিথ্যা বলেনি। তার দু চোখে জল জমেছিল, অথচ দাতে দাঁত পিষছিল।

পরের দিন দোহন পর্বের পরে, নিমদহ থেকে ড্যারা তুলে বাথান মেড়তলায় যাত্রা করেছিল। যদুর গায়ে জ্বর, ব্যথা। ও সারা গায়ে কাঁথা জড়িয়ে বাথানের সঙ্গ নিয়েছিল। ও, গদাধর, শ্রীবাস ছাড়া আর কেউ ঘটনা জানতে পারেনি। প্রাণীদের গলার ঘণ্টার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, বাঁকা চিৎকার করে গান ধরেছিল, অ রে অ বাথানের রাখাল/তোর সামনে ধু ধু জাঙ্গাল/ জাঙ্গাল জাঙ্গাল চলবে রাখাল।

ভাবিস ক্যানে ঘরের কথা/ঘর গেরস্তি রইচে যেথা/সোহাগি মুখ মনে কইরে/ক্যানে রে মন উথাল-পাতাল। হাঁ, বাঁকা আগের ফাল্গুনে বিয়ে করেছিল। যদু এক বার পশ্চিমে গ্রামের ছিট গঙ্গার কূলের দিকে তাকিয়েছিল।…