৩. নির্বাসিত পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার

৩. নির্বাসিত পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার

(১)

১৮২৯—এর কলকাতা। জমিয়ে শীত পড়েছে। জানুয়ারি মাসে তখন শীত পড়ত বটে কলকাতায়। সাহেবদেরও না কি শীত করত! সেই শীতের মধ্যে যত সকালে সম্ভব কলেজে চলে আসে এক বারো বছরের ছেলে। তার নাম মদনমোহন। সে দ্বিতীয়বার ভর্তি হয়েছে সংস্কৃত কলেজে। কলকাতার বিখ্যাত সংস্কৃত কলেজ।

কেন সে অত সকালে কলেজে আসে। সে এক বন্ধু পেয়েছে কলেজে। একমাত্র তারই সঙ্গে কথা বলা যায়, তাকেই ভালবাসা যায়। এমনই তার মেধার উজ্জ্বলতা। মদনমোহনের থেকে দু—বছরের ছোট সে। কিন্তু দশ বছর বয়েসেই সে ভর্তি হতে পেরেছে মদনমোহনের ক্লাসে। তার নাম ঈশ্বর।

মদন আর ঈশ্বর, দুজনেই গরিব ঘরের ছেলে। দুজনেরই একমাত্র সম্বল মেধা। দুজনেই বৃত্তি পেয়ে ভর্তি হতে পেরেছে সংস্কৃত কলেজে। নিজেদের টাকাপয়সা খরচ করে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে লেখাপড়া করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। বৃত্তি তাদের পেতেই হবে। তা—ই তারা যত ঘন বন্ধু, তারা পরস্পরের ততটাই তীব্র প্রতিযোগী। কোনও পরীক্ষায় মদন প্রথম হয় তো কোনও পরীক্ষায় ঈশ্বর প্রথম। একজন দশ বছর বয়েসে কলেজের ছাত্র। অন্যজনের বয়েস বারো। দুজনে সতীর্থ! মেধা মুছে দিয়েছে বয়েসের পার্থক্য!

মদন খুব ভালোবাসে ঈশ্বরকে। লেখাপড়ার প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও সে ভালোবাসে। মদন স্বভাবে বড় মধুর। তার মধ্যে কোনও কাঠিন্য নেই। মিষ্টি হাসিটি তার ঠোঁটে লেগেই আছে। সে যে কবি, তার সঙ্গে মিশলেই বোঝা যায়।

ঈশ্বরের ধাতে কাব্য নেই। কল্পনা তার বিচরণভূমি নয়। তার স্বভাবে আবেগের ওপর বুদ্ধির স্থান। কাব্যের চেয়ে ব্যাকরণের দিকেই তার বেশি ঝোঁক। কিন্তু তার মনের অনেক গভীরে একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে। মদন যা পারে সে পারে না। মদন কবি। সংস্কৃতেও কবিতা লিখতে পারে। ঈশ্বর কিন্তু কিছুতেই ব্যাকরণ আর বিশ্লেষণের বাইরে বেরতে পারে না। ঈশ্বরের মনে হয়, মদন হল পাখির মতো, তার ডানা আছে, হঠাৎ হঠাৎ সে আকাশে উড়ে যায়। তখন ঈশ্বর তার বন্ধুর নাগাল পায় না। অনেক নীচে একা পড়ে থাকে সে। তার ঈর্ষা হয়—মদনকে।

তিন বছর একই ক্লাসে লেখাপড়া করে মদন আর ঈশ্বর উঠল সাহিত্যের ক্লাসে। এতদিন তো তারা পড়েছে মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ। এবার কাব্য। আর এইখানেই মদনমোহন, মাত্র পনেরো বছর বয়েসে, জ্বলে উঠল নিজের প্রতিভায়। এমন সুললিত ও প্রাঞ্জল সংস্কৃত কী করে অনর্গল ঝরে পড়ছে মদনের কলম থেকে! অধ্যাপকেরা মুগ্ধ।

জয়গোপাল তর্কালঙ্কার সেই সময় সাহিত্যের অধ্যাপক। কলকাতার বিখ্যাত অধ্যাপকদের একজন তিনি। তিনি এতই মুগ্ধ মদনের সংস্কৃত পড়ে যে, সারাক্ষণ শুধু মদন আর মদন। এমন ছাত্র তিনি নাকি সারা জীবনে আর একটিও পাননি! জয়গোপাল তর্কালঙ্কার পরিষ্কারই বলে দিলেন মদন সম্পর্কে তাঁর মতামত : মদন বিশুদ্ধ কবি। কবি ছাড়া এমন লেখা কেউই লিখতে পারে না।

সাহিত্যের ক্লাস থেকে মদন আর ঈশ্বর দুজনেই নক্ষত্রের উজ্জ্বলতায় উত্তীর্ণ হল ‘অলংকার’—এর ক্লাসে। মদনের সঙ্গে ঈশ্বরের তফাৎটা আরও যেন স্পষ্ট হয়ে পড়ল। সেই সময় সংস্কৃত কলেজে ‘অলংকার’—এর অধ্যাপক মহাপণ্ডিত প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ (১৮০৬—১৮৬৭)। তর্কবাগীশ সংস্কৃত কলেজে পড়িয়েছেন ১৮৩২ থেকে ১৮৬৪ পর্যন্ত। মদন হয়ে উঠল প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের প্রিয়তম ছাত্র। তার একটা বড় কারণ, প্রেমচাঁদ নিজেও যে কবি। প্রেমচাঁদ নিজেকে দেখতে পান তাঁর প্রিয়তম ছাত্র মদনের মধ্যে! তাঁর মুখেও সর্বদা মদন মদন। আহা! এমন ছাত্র পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। রোজ রোজ তো মদনের মতো ছাত্র অধ্যাপকদের ভাগ্যে জোটে না।

সেই সময় স্মৃতিশাস্ত্রের মহাপণ্ডিত সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক হরনাথ তর্কভূষণ মদনের প্রতিভায় মুগ্ধ। হরনাথ তর্কভূষণ সংস্কৃত কলেজে পড়িয়েছেন বিশ বছর, ১৮২৪ থেকে ১৮৪৪। মদন ও ঈশ্বর দুজনেই তাঁর ছাত্র। তিনি একই সঙ্গে পড়িয়েছেন ব্যাকরণ ও স্মৃতিশাস্ত্র। হরনাথ তর্কভূষণও মদনমোহনের ভাষা ও পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হলেন। হরনাথ বুঝলেন মদনের পাণ্ডিত্য নদীর বহতার মতো। স্বাভাবিক। কোনও কচকচানি নেই। মধুর স্রোতের মতো মদনের ভাবনার ভাষা।

সংস্কৃত কলেজে ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপক আরও এক মহাপণ্ডিত নিমাইচন্দ্র শিরোমণি। মদন তাঁরও প্রিয় ছাত্র। কিন্তু ১৮৪০—এ হঠাৎ মারা গেলেন নিমাইচন্দ্র। তাঁর জায়গায় ন্যায়শাস্ত্র পড়াতে এলেন আর এক মেধা—উজ্জ্বল বাঙালি, জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন। এবং দীর্ঘ তিরিশ বছর সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করলেন তিনি। তিনি নিজে ছিলেন সংস্কৃতে শ্লোকরচনায় বিশেষ পারদর্শী। মদনের কাব্য প্রতিভা, মুগ্ধ করল তাঁকেও।

ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপক, মদন ও ঈশ্বরের শিক্ষক, জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন এক সময়ে কলকাতা কাঁপিয়ে ছিলেন। মুখে মুখে উচ্চচারিত হত তাঁর নাম। আজ বাঙালি তাঁকে সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। তাঁর কথা জানাবার লোভ তাই সামলাতে পারছি না:

১৮৭২—এর ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকায় তাঁর কথা লেখা হয়েছিল তাঁর প্রয়াণের পরেই হুবহু এই ভাষায়—

‘ইঁহার সমান নৈয়ায়িক বাঙ্গালাদেশে নাই বলিলে অত্যুক্তি হয় না। আমাদের দেশের নৈয়ায়িকেরা সচরাচর কাজ চালানো মত দুই একখান গ্রন্থ পড়িয়া, দুই চারটা ফাঁকি শিখিয়া কেবল টিকি নাড়িয়া ‘অবচ্ছেদাবচ্ছেদক’ করিয়া বেড়ান। কিন্তু তর্কপঞ্চানন মহাশয়ের ন্যায়শাস্ত্রে প্রকৃত গভীর বিদ্যা ছিল। তাঁহার নিকট যাঁহারা পড়িতেন তাঁহারা সকলেই তাঁহার গভীর বিদ্যা ও পরিষ্কার বিচারশক্তি দেখিয়া আশ্চর্য হইতেন।’

মদনমোহন তাঁর শিক্ষক জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননের কাছ থেকে যে গুণটি আহরণ করেছিলেন, তা হল :

‘এত বিদ্যা থাকিয়াও তারা লোক দেখান ছিল না। বৃথা আস্ফালন তিনি কখনো করিতেন না। কোনও প্রশ্ন হইলে, অতি ধীর, প্রশান্ত, ও গম্ভীরভাবে ফল কথাগুলি বলিয়া দিতেন।’

আগেই বলেছি, প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ তাঁর ছাত্র মদনমোহনের কবি—প্রতিভায় মুগ্ধ। বিস্মিতও কম নন তিনি। এমন কবি—ছাত্র তিনি জীবনে এই প্রথম পেয়েছেন। মদনকে তিনি পড়ান ‘অলংকার’ শাস্ত্র। মদন এবং ঈশ্বর, দুজনেই তাঁর ছাত্র। ক্লাসে ওরা পাশাপাশিই বসে। কিন্তু অধ্যাপক প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের মনে হয়, মদনমোহনের মধ্যে যেন ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে ওঠে এক অন্য আলো। কখনও সেই আলো গভীরতর রসবোধের। কখনও সেই আলো একেবারে নিজস্ব মধুর প্রকাশভঙ্গির।

মদনমোহনের বয়েস ঠিক সতেরো। ঠিক সেই সময় তার মধ্যে যেন ঘটল এক আকস্মিক বিস্ফোরণ। আর সেই বিস্ফোরণের ফল এল প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের হাতে।

প্রেমচাঁদ পড়লেন বাংলাভাষায় লেখা এক মধুর কাব্য। নাম ‘রসতরঙ্গিণী’। সার্থক নাম বটে কাব্যের। রসে যে উপচে পড়ছে। কিন্তু শৃঙ্গাররস। কাব্যটিতে আদিরসের এই প্রাবল্যে কিঞ্চিৎ মজাই পেলেন প্রেমচাঁদ।

কিন্তু ‘রসতরঙ্গিণী’—র লেখক কে? যিনিই লেখক হন, প্রেমচাঁদের বুঝতে বাকি নেই যে, ‘রসতরঙ্গিণী’ আসলে কয়েকটি আদিরসাত্মক সংস্কৃত কবিতার বাংলা অনুবাদ। কিন্তু লেখককে চিনতে পারলেন না প্রেমচাঁদ। তাঁর খটকা লাগল। তিনি বেশ বুঝলেন, এই বাংলা কবিতা মদনমোহন ছাড়া আর কারও পক্ষেই লেখা সম্ভব নয়। রসতরঙ্গিণী—তে আদি রসের বাড়াবাড়ি। তা—ই মদন নিজের নামে বইটি প্রকাশ করেনি—নিশ্চিত প্রেমচাঁদ। তিনি তাঁর ছাত্রের ভাষা চেনেন। সেই কাব্যের কয়েক লাইন মদনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ক্লাসের মধ্যেই একদিন আবৃত্তি করলেন প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ :

বরং দিবস ভালো নিশা যেন হয় না।

অথবা নিশাই ভালো দিন যেন রয় না।

কিংবা এই উভয় সখি! প্রাণে আর সয় না।

প্রিয় বিনে আর মনে কিছু ভালো লয় না।।

মদন মাথা হেঁট করে বসে থাকে। লজ্জায় তার কান দুটো রাঙা হয়ে ওঠে। প্রেমচাঁদ মিঠে মিঠে হাসেন। ঈশ্বরের প্রখর বুদ্ধি। ব্যাপারটা সে বুঝতে পারে। এই বাংলা কবিতা মদন লিখেছে। তার ভেতরটা ‘ছিঃ’ বলে চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু তারপরেই তার মনে হয়, সে—ও কেন এমন লিখতে পারে না?

এরপর আর এক মজার ঘটনা। মদন হারিয়ে দিতে চায় কবি ভারতচন্দ্রকে। সে বিদ্যাসুন্দর—এর চেয়েও উৎকৃষ্ট কাব্য লিখতে চায়। লিখেও ফেলল। প্রকাশিত হল তার ‘বাসবদত্তা’। সুবন্ধু—রচিত সংস্কৃত গদ্যকাব্য ‘বাসবদত্তা’ অবলম্বনে তরুণ মদনমোহন লিখে ফেলল তার বাসবদত্তা। তারপর সে নিজেই তুলনা করল ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর—এর সঙ্গে। এবং নিজেই স্বীকার করল ভারতচন্দ্রকে সে হারাতে পারেনি। তাই নিজের কাছে প্রতিশ্রুত হল মদনমোহন, আর কাব্য লিখব না।

এরপর মদনমোহন যুবক। তিনি ও ঈশ্বর একই সঙ্গে স্মৃতিশাস্ত্রের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জজপণ্ডিতের সার্টিফিকেট পেলেন। একশো একুশটি প্রশ্নের মধ্যে মদনমোহন উত্তর লিখতে পেরেছিলেন আটচল্লিশটি প্রশ্নের। তার বেশি উত্তর দেয়া অন্য কারোর পক্ষেই সম্ভব হয়নি। ১৮৪২ সালে মদনমোহনের স্বর্ণালি ছাত্রজীবন শেষ হল। প্রথমেই তিনি কলিকাতা বঙ্গ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।

কলিকাতা বঙ্গ বিদ্যালয়, সেটা আবার কোথায়? এই বঙ্গ বিদ্যালয়ই হল হিন্দু কলেজ পাঠশালা। হিন্দু কলেজে তো শুধুই পড়ানো হত ইংরেজিতে। সন্তুষ্ট হতে পারেননি রামমোহন ও দ্বারকানাথ। প্রতিষ্ঠিত হল কলিকাতা বঙ্গ বিদ্যালয়। ১৮৪০ সালের ১৮ জানুয়ারি। হিন্দু কলেজের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে মেশানো হল সংস্কৃত ভাষা ও ধর্মশাস্ত্রের অধ্যয়ন। হিন্দু কলেজেরই অধীনে চালু হল নতুন পাঠশালা। ১৮৪২—এ এই নতুন বিদ্যালয়ে চাকরি করতে এলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। শুরু হল এক নতুন যাত্রা। যে—যাত্রার শেষটি বড় করুণ!

১৮৪৬—এর ১৩ এপ্রিল। মারা গেলেন মহাপণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। তিনি তখন সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক। ঈশ্বর ও মদন দুজনেই তাঁর ছাত্র।

এই বছরেই পয়লা জানুয়ারি স্থাপিত হয়েছে কৃষ্ণনগর কলেজ। প্রথম প্রিন্সিপাল ক্যাপ্টেন ডেভিড রিচার্ডসন। কলেজের সূচনা থেকেই সেখানে সাহিত্য পড়াচ্ছেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। কলকাতার সংস্কৃত কলেজে কে পূর্ণ করবেন সদ্য প্রয়াত জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের আসন?

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক। তিনি ডাক দিলেন বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে পূর্ণ করতে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের আসন। উনতিরিশ বছরের পণ্ডিতপ্রবর মদনমোহন উত্তর দিলেন কৃষ্ণনগর থেকে, এখুনি পারছিনা বন্ধু, নতুন চাকরি, হুট করে ছেড়ে দিলে যে দেখান হবে দায়িত্ববোধের অভাব। বিদ্যাসাগর বললেন, আসতে তোমাকে হবেই মদন। তবে যতদিন আসতে না পার, আমিই কোনওরকমে চালিয়ে নিচ্ছি। মনে রেখো, জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের পদে আর কেউ বসবে না, তুমি ছাড়া।

দু—মাস পরে, ১৮৪৬—এর ২৭ জুন সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা শুরু করলেন মদনমোহন। বন্ধু এবং সংস্কৃত কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ঈশ্বরের ডাকে তিনি ছেড়ে দিলেন কৃষ্ণনগর কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদ। এবং কলকাতায় এসেই জয় করলেন ছাত্রদের মন। একেবারে নতুন স্টাইলের অধ্যাপনা। কলকাতায় এমন অধ্যাপনার ধরন তো চালু নেই। ছাত্রেরা অবাক। এবং তারা মদনমোহনকে ভয় পায় না। ভালোবাসে। কেমন এই নতুন স্টাইলের পড়ানো?

মদনমোহন ছাত্রদের সঙ্গে গল্প করেন। সেই গল্প থেকে ঝরে পড়ে সাহিত্যরস। সময়—সময় শৃঙ্গাররসেরও আভাস থাকে বইকি। মদনমোহন বেড়াতে নিয়ে যান ছাত্রদের। সাহিত্যের বাগানে বেড়াতে নিয়ে যান তিনি। সেই বাগানে কত ফুল, কত লতাপাতা, কত সুবাস, কত উতল হাওয়া। নবীন অধ্যাপক মদনমোহনের এই রসলীলায় মেতে ওঠে ছাত্রেরা। অধ্যাপনার এই নতুন শৈলী চেনা নিয়মের ধার ধারে না। মদনমোহনের রোম্যান্টিক মনের বেপরোয়া প্রকাশ ঘটে তাঁর অধ্যাপনায়। অধ্যাপক হিসেবে মদনমোহনের প্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মনে খিঁচ ধরে। ছড়িয়ে পড়ে ঈর্ষার গুমো আঁচ। নিয়মভাঙা অধ্যাপনার এই আধুনিক স্টাইল ভালোলাগে না বিদ্যাসাগরের। কিন্তু বন্ধুকে সরাসরি কিছু বলেন না তিনি। কলকাতায় এসে প্রথম কদিন তো ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়িতেই উঠেছিলেন মদনমোহন। দিনরাত বন্ধুর সঙ্গেই মদনমোহন আলোচনা করেছিলেন, কী পড়াবেন। ঈশ্বরের মনে পড়ে, বন্ধুকে কত আগ্রহে তিনি শুধু কী পড়াতে হবে তা—ই বুঝিয়ে দেননি, কেমনভাবে পড়াতে হবে তা—ও তো বলে দিয়েছিলেন। সেই রীতি সংস্কৃত কলেজের ঐতিহ্যের কথা মনে রেখেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু মদন এ কী করছে? সংস্কৃত কলেজের যে বদনাম হবে!

একদিন ঘটল এক ঘটনা। পাড়ার কিছু লোকজন এল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে। কী ব্যাপার? অবাক বিদ্যাসাগর। একটি অভিযোগ নিয়ে এসেছি, বলল তারা। অভিযোগ! আরও বিস্মিত বিদ্যাসাগর। বলুন, কী আপনাদের নালিশ। একজন এগিয়ে এসে বলল, সংস্কৃত কলেজের পাশেই আমাদের বাড়ি। কলেজ ঘরের একটি জানলা দিয়ে আমাদের বাড়ির ছাদ দেখা যায়। আমাদের বাড়ির মেয়েরা ছাদে উঠতে পারে না।

—কেন? ছাদে উঠতে পারে না কেন? জিগ্যেস করলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

—তার কারণ, আপনার কলেজের একটা ক্লাসরুম থেকে ছাত্রেরা ছাদে আমাদের মেয়েদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আপনি এই অন্যায়ের বিহিত করুন বিদ্যাসাগর মশাই।

রাগে রাঙা হয়ে উঠল বিদ্যাসাগরের মুখ। কার ক্লাস থেকে দেখা যায় পাশের বাড়ির ছাদ?

কার আবার? মদনমোহনের। মনে মনে গর্জে উঠলেন বিদ্যাসাগর। ছুটে গেলেন মদনমোহনের ক্লাসে। আর গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। মদনমোহন হাসছে আর তার সঙ্গে ছাত্রেরাও বেশ মজায় আছে।

মদনমোহন বিদ্যাসাগরকে দেখতে পাননি। তিনি নিজের মনে পড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু এ কেমন অধ্যাপনা! মদন যে রসে টইটম্বুর। আর সেই রস ভাগ করে নিচ্ছে ছাত্রদের সঙ্গে। ছাত্ররা যেন রসে ভাসছে—সাহিত্যের রস। ব্যাকরণের দিকে কোনও মন নেই মদনের।

অগ্নিশর্মা বিদ্যাসাগর ঢুকে পড়লেন মদনমোহনের ক্লাসে, দাঁড়ালেন গিয়ে তাঁর সামনে। ছাত্রেরা ভয়ে শিঁটিয়ে। রসভঙ্গ হল মুহূর্তে। মদনমোহন নীরবে মুখ তুলে তাকালেন।

—একী কথা শুনছি মদন? বিদ্যাসাগরের কণ্ঠে ক্রোধ।

—কী কথা শুনে তুমি ছুটে এসেছ ঈশ্বর?

—তোমার ছাত্রদের বিরুদ্ধে আমার কাছে অভিযোগ এসেছে।

—কী অভিযোগ এল আমার ছাত্রদের বিরুদ্ধে? অন্যায় যদি কিছু হয়ে থাকে, বন্ধু, শাস্তি দাও আমাকে। আমার ছাত্রদের তো কোনও দোষ দেখিনা আমি।

—শোনো মদন, অভিযোগটি গুরুতর। তোমার ছাত্রদের জ্বালায় পাশের বাড়ির মহিলারা ছাদে উঠতে পারেন না।

—এই অভিযোগের অর্থ? মদনমোহনের কণ্ঠে শিশুর সারল্য।

—তুমি বুঝতে পারলে না? তোমার ছাত্ররা জানলা দিয়ে মহিলাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। অর্থাৎ তাদের ওপর তোমার কোনও শাসন ও নিয়ন্ত্রণ নেই।

ক্লাসের মধ্যে যেন বাজ পড়ল। মদনমোহন তাকালেন ছাত্রদের দিকে। এতটুকু রাগ নেই তাঁর চোখে। সেখানে শুধু স্নেহ, মায়া, মমতা। এবং তারমধ্যেই ঝিলিক মারছে মদনমোহনের বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকবোধ।

বিদ্যাসাগর নীরব। তিনি অপেক্ষা করছেন মদনমোহনের জবাবের জন্য। ছাত্রদের সামনেই অপমানিত অধ্যাপক কী বলবেন এবার?

হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন মদনমোহন। বিদ্যাসাগরের মনে হল মদন সংস্কৃত কলেজের ঐতিহ্যের থোড়াই কেয়ার করে। তারপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শুনতে পেলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মধুর কণ্ঠস্বর—

—শোনো ঈশ্বর, বসন্তকাল, পড়ানো হচ্ছে স্বয়ং কালিদাসের ‘মেঘদূত’, পড়াচ্ছেন স্বয়ং মদন। সুতরাং ছাত্রদের মন যদি একটু ব্যাকুল, সামান্য চঞ্চল হয়ে ওঠে, তাতে তেমন দোষের কী হল?

এই উত্তর আশা করেননি বিদ্যাসাগর। তিনি দেখলেন, ছাত্ররা বেশ মজা পেয়েছে। তারা যেন হাসি চাপতে পারছে না। অপমানিত বোধ করলেন বিদ্যাসাগর। রাগের আগুন ছড়িয়ে পড়ল তাঁর সারা শরীরে। সেই রাগে ঈর্ষাও মিশে গেল। তিনি চটির শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলেন। পরের দিন মদনমোহন ক্লাসে এসে দেখেন বসন্তের আকাশ—বাতাস সেই ক্লাসরুমে আর কোনওদিন ঢুকবে না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মিস্ত্রি ডেকে জানলার সমস্ত খড়খড়ি স্ক্রু দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে জানলাটিকেও চিরদিনের মতো এঁটে দিয়েছেন! বসন্তের আপদ বিদায় হয়েছে!

কিছুদিন আগেও তো ছিল বিদ্যাসাগরের সঙ্গে মদনমোহনের ভারি মধুর সম্পর্ক। মদনমোহনের স্ত্রী নৃত্যকালী বিদ্যাসাগরকে ঠাকুরপো ডাকেন। বিদ্যাসাগর নৃত্যকালীকে ডাকেন বউদি। বউদির সঙ্গে ঈশ্বরের মিষ্টি সম্পর্ক। একদিন দুপুরবেলা ঘটল মজার ঘটনা।

খুব খিদে পেয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। তিনি হাঁটতে—হাঁটতে চলে এলেন বন্ধু মদনের বাড়ি। বন্ধু বাড়ি নেই। দেখলেন তাঁর বউদিটি একা বসে ভাত খাচ্ছেন। বললেন, বউদি বড্ড খিদে পেয়েছে। কী খাব?

—কেন, এই তো ভাত। খাও না। নিজের ভাতের থালাটিই নৃত্যকালী এগিয়ে দিলেন ঠাকুরপো ঈশ্বরের দিকে।

ঈশ্বর বেশ গদগদ। বউদির এঁটো থালা থেকেই পাশে বসে ভাত খেতে লাগলেন তিনি। খাচ্ছেন আর দুজনে মশগুল হয়ে গল্প করছেন। নৃত্যকালী বেশিরভাগ বাঙালি মেয়েদের মতো নয়। বেশ কথা বলে। জড়তা নেই। ভালোলাগে ঈশ্বরের এমন বউদিটিকে।

এমন সময় মদনমোহন হঠাৎ বাড়ি ফিরলেন। তিনি যে এই সময় হঠাৎ বাড়ি ফিরবেন, নৃত্যকালী ভাবতে পারেননি। তিনি খাওয়া থামিয়ে দেন। যেন কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত। ঈশ্বরও কী বলবেন, বুঝতে পারেন না।

কিন্তু রসিকচূড়ামণি মদনমোহনের রসবোধের অভাব ঘটেনা। তিনি হাসতে—হাসতে বলেন, এ কী বিদ্যাসাগর, সব মহাপ্রসাদ তুমি সাবাড় করে দিলে, আমি খাব কী?

নৃত্যকালী দেখেন, পাতে তখন আর সত্যিই বিশেষ কিছু নেই। তবু বলেন, যা আছে তাই খাও। এঁটো থালাটি স্বামীর হাতে তুলে দেন তিনি।

মদনমোহন মহা খুশিতে সেই খালি থালা চাটতে থাকেন।

(২)

পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল

কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।

রাখাল গোরুর পাল লয়ে যায় মাঠে।

শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।।

কলকাতার ভোরবেলায় তখনও পাখির ডাক শোনা যেত বলেই তো মনে পড়ে। কিন্তু কোথায় বাগান যে ফুলফোটা দেখব, কোথায় মাঠ যে দেখব রাখাল যাচ্ছে গরু চরাতে?

কিন্তু এই লাইনগুলো দুলে দুলে পড়তে—পড়তে চোখের সামনে ফুল ফুটতো, মাঠ গজাতো, রাখাল গরু চরাতো! তবে কার যে লেখা এই কবিতা, কেউ তা তো বলেনি আমাকে।

দু—একজনের মুখে শুনেছিলুম, বিদ্যেসাগর মশাই কী সুন্দর লিখেছেন, বাচ্চচাদের জন্যে কত ভাবতেন!

সে ছিল ১৯৪৭—এর ঘটনা। কেউ বলেননি, কবিতাটি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের!

তখন থেকেই মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে ধীরে ধীরে ভুলেছে বাঙালি। আজ তিনি বঙ্গজীবন থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন!

আজকের বাঙালি ছেলেমেয়েরা কি মদনমোহনের অসামান্য বই ‘শিশুশিক্ষা’ পড়ে? কোনও বাবা—মা কি আজকের বাচ্চচাকে পড়ে শোনান বাংলা ভাষার প্রথম প্রাইমার ‘শিশুশিক্ষা’ থেকে চিরদিনের কয়েকটি লাইন—

সুশীল ও সুবোধ বালক সর্বদা লেখাপড়া করে। সারাদিন খেলা করিয়া বেড়ায় না। পাঠের সময় সে যেমন পাঠ বলিতে পারে আর কেহই তেমন পারে না।

শিশুশিক্ষাতেই আছে মদনমোহনের অক্ষয় উপদেশ। সেই সঙ্গে বর্ণমালা শেখানোর অতুলনীয় রীতি :

 ক : কটু বাক্য নাহি কবে।

 খ : কুকাজে অখ্যাতি হবে।

 দ : বিদ্যাধন আছে যার।

 ধ : সকলি সুসাধ্য তার।

কী এমন করলেন মদনমোহন তাঁর ‘শিশুশিক্ষা’য় যা বৈপ্লবিক?

এ—প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন প্রবোধচন্দ্র সেন : তিনি মধ্যযুগীয় মানসিকতার অর্থাৎ চিরন্তন গতানুগতিকতার স্থলে আনলেন দেশকাল পাত্রবিচারে যুক্তি প্রয়োগের আদর্শ। প্রথার বদলে বিচার, রীতির বদলে নীতি।

কিন্তু আজ হঠাৎ মদনমোহনের প্রসঙ্গ কেন? কজন বাঙালি তাঁকে আজ জানেন, চেনেন? কে তিনি?

তিনি সত্যিই হয়তো কেউ নন। কারণ, আজ পর্যন্ত তাঁর কোনও ছবি পাইনি আমরা। ভূতের ছবিও কেউ কেউ না কি তুলেছেন। কিন্তু এক বিপুল পণ্ডিত, অপূর্ব বাঙালি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের কেউ কখনও কোনও ছবি আঁকেননি পর্যন্ত। হয়তো স্বভাবতই প্রচার বিমুখ তিনি, ধরা দিতে চাননি কোনও ছবিতে।

তবু তাঁর প্রসঙ্গে আজ দু—এক কথা না বলে পারছি না একটিই কারণে, এই ঠিক দুশো বছরের পুরনো বাঙালিকে হয়তো এখনও কেউ কেউ ভালোবাসি।

মদনমোহন চট্টোপাধ্যায় জন্মেছিলেন দুশো বছর আগে, ১৮১৭—র ৩ জানুয়ারি নদিয়ার বিল্বগ্রামে। এই বছর ৩ জানুয়ারি তাঁর বয়েস দুশো হল। অথচ কলকাতায় তাঁকে নিয়ে কোনও সাড়াশব্দ নেই।

আমরা এত সংস্কৃতিসচেতন, ঐতিহ্যগর্বী, অতীত—অহংকারী, আর আমাদের এই বর্ণময় প্রজ্ঞাবান অধিবিদ্য মনীষিকেই ভুলে গেলুম?

যাঁর ছবি নেই তাঁর ফ্রেম নেই। যাঁর ফ্রেম নেই তাঁর ফুল নেই। নেই কোনও জন্মদিন, স্মৃতিচারণ, প্রণতি! প্রশংসা!

কিন্তু তবু তো ছিলেন তিনি। এবং তাঁর যুগান্তকারী সব অবদান সত্ত্বেও জীবনকালেই তিনি নির্বাসিত, পরাজিত, নিরুদ্দেশ।

কিন্তু আজও তিনি স্মরণযোগ্য। দাবি করেন আমাদের প্রণাম ও ঋণাঞ্জলি। তাঁর মনস্বিতা আজও জানায় বিস্ময়। তাঁর আধুনিকতা আজও চমকে দেয় আমাদের। এই রসিক মানুষটিকে আমরা ভালো না বেসেও তো পারি না। এই বাঙালির জীবনগল্প আজও শোনবার মতো!

মদনমোহনের লেখাপড়া দিয়েই এই গল্প শুরু করা যাক। ১৮২৯ সালের কলকাতা। মদনমোহনের বয়েস বারো। নদিয়ার বিল্বগ্রামের ছেলে তিনি। কিন্তু লেখাপড়ার জন্যে তিনি সেই নবজাগরণের কলকাতায়।

বছর বারোর মদনমোহন কী পড়ছে? সে তো ভর্তি হয়েছে সংস্কৃত কলেজে। সে সংস্কৃতব্যাকরণ জলের মতো তরল করে গিলে ফেলছে। আশ্চর্য ক্ষমতা তার। সে যেন প্রাচীন তপোবনের সন্তান। কথা বলতে পারে সংস্কৃতে।

চার বছরের মধ্যে সংস্কৃতব্যাকরণ নিংড়ে নিয়ে সে সরাসরি চলে গেল সংস্কৃতসাহিত্য শ্রেণিতে। দু—বছরে তাও শেষ। ষোল বছরের মদনমোহন ভর্তি হল সংস্কৃতের অলংকার শ্রেণিতে। তারপর ১৮৩৫ থেকে ৩৭ : মদনমোহন শেষ করল জ্যোতিষবিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্র। এবং ১৮৪০ : তেইশ বছরের মদনমোহন স্মৃতিশাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত!

এবার আর এক মজার গল্প : একই ক্লাসে মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পড়ছে আর এক রত্ন। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। একজন পরে হলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। অন্যজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সত্যিই কি বন্ধুত্ব হয়েছিল এই দুই মহাপণ্ডিতের? সে আর এক কাহিনি।

মদনমোহনের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের মূল পার্থক্য হল, একজন কবি ও রোম্যান্টিক। অন্যজন প্রজ্ঞার সঙ্গে মিশিয়েছেন বাস্তববোধ। শিক্ষার সঙ্গে বাণিজ্য।

বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন, দু—জনেই একেবারে ছোটবেলা থেকে সতীর্থ বটে, একসঙ্গে কাজও করছেন, কিন্তু ঠিক তেমন বন্ধুত্ব হল না একটিই কারণে। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এবং আরও মারাত্মক ব্যাপার, সেই পিছিয়ে পড়াটা শিক্ষার ক্ষেত্রে!

নিজের এই উপায়হীন অনগ্রসর নিজেই সহ্য করতে পারেননি বিদ্যাসাগর। এবং রাগ ও ঈর্ষা গিয়ে পড়ল মদনমোহনের ওপর।

১৮৪৯ সালে প্রকাশিত হয় মদনমোহনের শিশুশিক্ষা—র প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। পরের বছরেই বেরল তৃতীয় ভাগ। এবং বেরিয়েই সুপারহিট!

তার কারণ, মদনমোহনের লেখার মাধুর্য। তাঁর ভাবনার নতুনত্ব। তিনি ‘শিশুশিক্ষা’—র ভূমিকায় এই অভিনবত্বের পরিচয় দিলেন অকপটে :

কেবল মনোরঞ্জনের নিমিত্ত শিশুগণের উন্মেষোম্মুখ নির্মল চিত্তে কোনো প্রকার কুসংস্কার সঞ্চারিত করা আমাদিগের অভিপ্রেত নহে। এ নিমিত্ত, হংসীর স্বর্ণডিম্ব প্রসব, শৃগাল ও সারসের পরস্পর পরিহাস নিমন্ত্রণ, ব্যাঘ্রের গৃহদ্বারে পাকস্থলী ও কাষ্ঠভার দর্শনে ভয়ে বলীবর্দের পলায়ন, পুরস্কার লোভে বক কর্তৃক বৃকের কণ্ঠবিদ্ধ অস্থিখণ্ড বহিষ্করণ, ধূর্ত শৃগালের কপট স্তবে মুগ্ধ হইয়া কাকের স্বীয় মধুর স্বর পরিচয় দান প্রভৃতি অসম্বন্ধ অবাস্তবিক বিষয় সকল প্রস্তাবিত না করিয়া সুসম্বন্ধ নীতিগর্ভ আখ্যান সকল সম্বন্ধ করা গেল।

কী চমৎকার বাংলা। পড়লেও আহ্লাদ হয়। আর কী বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এক সংস্কৃত পণ্ডিতের! নেকড়ে বাঘের বদলে বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ ‘বৃক!’ আহা! শেষ লাইনে ‘আখ্যান সকল সম্বন্ধ করা গেল’— মিল্টন যেমন ল্যাটিন মেশাতেন ইংরেজিতে কত সহজে, এও তেমনি বাংলারূপী সংস্কৃত! ‘সম্বন্ধ’—অনেকগুলি নবীন আখ্যানকে অমোঘ বিবাহসূত্রে জুড়ে দেওয়ার এই প্রতিভাস এক কথায় অপূর্ব!

এইখানে আসল খবরটা বলি—মদনমোহন যখন বিপ্লব ঘটালেন তাঁর ‘শিশুশিক্ষা’—র তিনটি ভাগে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখনও ‘বর্ণপরিচয়’, ‘কথামালার’ কথা ভাবতে পর্যন্ত পারেননি! তিনি ‘বর্ণপরিচয়’ নিয়ে অবতীর্ণ হলেন ছ’বছর পরে। ততোদিন মদনমোহন একাই ছয় মেরেছেন!

আরও এক ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের চেয়ে এগিয়ে মদনমোহন। মদনমোহনের দুই মেয়ে। ভুবনমালা আর কুন্দমালা। রূপকথার নাম। পণ্ডিতের মেয়ে নয়, যেন দুই রাজকন্যে।

১৮৪৯ সালের ৭ মে জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (বিটন) যেই খুললেন ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’ অমনি ভুবনমালা—কুন্দমালাকে সেখানে পাঠালেন মদনমোহন।

ছি ছি! ম্লেচ্ছদের স্কুলে হিন্দু পণ্ডিতের কন্যা! ঢি—ঢি পড়ে গেল শহরে। নিন্দা রটল বেথুনের। মদনমোহন তাঁর ‘স্ত্রীশিক্ষা’ প্রবন্ধে প্রবল সাহসে প্রতিবাদী আগুন ছড়ালেন:

অনারেবল বিটন মহাশয় যে আমাদিগের কন্যাসন্তানদের শিক্ষার্থে প্রতি মাসে সাত আট শত টাকা ব্যয় করিয়া উৎকৃষ্ট বিদ্যামন্দির নির্মাণ করিয়া দিতেছেন, ইহা একবারও বিবেচনা করিলেন না, কেবল অহরক ঐ মহানুভবের নিন্দাবাদ, অকীর্তি রচনা ও মিথ্যাকলঙ্ক জল্পনা করিয়া আপন আপন ইংরাজি বিদ্যার পরিচয় দিলেন। কী লজ্জার কথা! কী লজ্জার কথা!

মদনমোহন তর্কালঙ্কার তিনভাবে পাশে দাঁড়ালেন বেথুন সাহেবের। এক, দুই মেয়েকে পাঠালেন তাঁর স্কুলে—সে—যুগে এটা যে কতবড় ঐতিহাসিক বিপ্লব আজ আর তা ভাবা যায় না। দুই, বিনা বেতনে সেই স্কুলে নিজে পড়াতে লাগলেন। তিন, নারীশিক্ষার উৎসাহেই তিনি লিখলেন তাঁর ‘শিশুশিক্ষা’।

‘শিশুশিক্ষা’—র প্রথম ভাগের উৎসর্গ পত্রটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য নতুন করে বাঙালিকে ভাবতেই হবে :

মহামহিম মান্যকর শ্রীযুক্ত জে.ই.ডি.বিটন

ভারতবর্ষীয় রাজসমাজসদস্য

শিক্ষাসমাজাধিপতি

মহাশয়েষু।

কোথায় তখন বিদ্যাসাগরমশাই?

অথচ এই ‘পায়োনিয়র’, এই পথ—প্রবর্তক পারলেন না ‘যুগনায়ক’ হতে। তাঁকে যেতে হল নির্বাসনে। মরতে হল, নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ, ভগ্নহৃদয়! কেন? সে—প্রশ্নের উত্তরের শেষে কি দাঁড়িয়ে নেই তাঁরই ছেলেবেলার বন্ধু অসূয়াতাড়িত বিদ্যাসাগর? তাঁর ঈর্ষাই কে কেড়ে নিল না মদনমোহনের সর্বস্ব?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *