৩. নাজিরের দপ্তর আর পাঁচকড়ির আমদানি

নাজিরের দপ্তর আর পাঁচকড়ির আমদানি

বেবন্দেজের একটা সুরাহা হল। কিন্তু আমার খোয়াহিশ তো একটা পাক্কা মকান তৈরি আর তার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা জমি জিরাত। প্রথম মওকাতেই আমি ডিপটি সাহেবের দপ্তর থেকে বদলি নিয়ে চলে এলাম নাজিরের কর্মচারীদের দঙ্গলে। নাজির হুজুর হলেন খাস করপরদাজ। তাঁর চাপরাশিরা হল সেই খোসনামের হকদার। এই দপ্তরের যা আমদানি তাতে চাপরাশিদেরও একটা ভাগ থাকে। আমার মতো আজনবির সেখানে কোনও হক ছিল না। এতদিনে আমার দুনিয়াদারির তালিম হয়ে গেছে। বুঝে গেছি কিসমত খুললে তবেই হতে পারি শুনতা ক্যা সিং-এর মতো বুলন্দ আদমি। সাচ্চা খিদমতগারের মতোই আমি নাজির সাহেবের তাঁবেদারি করতে লাগলাম। জোর দিলাম তাঁর ছিলিম তৈরি করায়। সাহেবের জল আনা, তাঁর গাড়ির বা পালকির পিছু পিছু দৌড়-ঝাঁপ করতে করতেই হয়ে গেলাম ভরসামন্দ আদমি। সবাই আমাকে কবুল করে নিল তাঁর খাস আদমি বলে।

সবচেয়ে আসান তরিকায় কী করে আমদানি হতে পারে তা আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। যারা ছোটখাটো খাজনা বাকি রাখে তাদের সমন পাঠিয়ে তলব করেন ডিপটি সাহেব। ফরিয়াদি তখন তলবানা (tullubana) মিটিয়ে দেয়। আমাদের সঙ্গে মুয়ামলা (moamlah) না হলে কিছুতেই কিন্তু ফয়সালা হবে না। কোনও একজন চাপরাশিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এমনই কিছু পরোয়ানার। দেখা যায় তার বেশির ভাগই তার কোমরবন্ধে থেকে গেছে। হাজিরার সময় পার হয়ে গেলে কৈফিয়ত তলব করা হয়, কেন ফরিয়াদি সময়মতো অভিযুক্তের নাম দাখিল করতে পারেনি, তাই আর্জি খারিজ করা হল। এবার ফরিয়াদি হয়তো বলল, কোনও চাপরাশিই তার গ্রামে যায়নি। খবর করা হবে নাজিরকে। তিনি আবার ডেকে পাঠাবেন আমাকে। সওয়াল, পরোয়ানা বিলি হয়েছিল কি হয়নি। পয়গম্বরের নামে কসম খেয়ে আমার জবাব হবে, ফরিয়াদি বিলকুল ঝুঠ বলছে। কমসে কম আমি তিনবার গেছি কিন্তু ফরিয়াদি কোনও নামই বলতে পারেনি। আমার কথায় ভরসা করে সাহেব তখন জারি করবেন পরোয়ানা (warrent of apprehension) আমাকেই দায়িত্ব দেওয়া হবে তার ইস্তেমালের। এর ফলে ফরিয়াদিকে যে শুধু দু-বার করে তলবানা দিতে হবে তাই নয়, আমাকে খুশ না করলে ছাড় মিলবে না গরহাজিরের নালিশ থেকেও। এবার আমদানির আরও একটা ফিকির বলি যা দিয়ে কালেক্টর বা ডিপটিকে বেওকুফ বানানো যায়। বলভদ্র সিং চায় উন্ধাদুন্দ গ্রামে ধুন্দুপন্থ মিশ্রের জমি-জায়গা কিনতে। কিন্তু তার দখল সে কী ভাবে কায়েম করবে তা আমাদের কাছে অজানা। দেওয়ানি আদালত থেকে দখলের কাবালা নিয়ে সে তো সটান হাজির হয়ে গেল গ্রামে। তার চাই জমির কেরায়া। কিন্তু ধুন্দুপন্থের হক ছিল বড়ই কম। পাটোয়ারির দলিল দেখে সে চমকে গেল; কী জমিই না খরিদ করেছে! আর কেউ হলে সেখানেই বেহাল হয়ে পড়ত। কিন্তু বলভদ্র সিং দুসরা কিসমের আদমি। এবার শুরু হল তার নানা ফন্দি-ফিকির। বেছে নিল এমন কয়েকজন আসামিকে যাদের খুব টাকার দরকার আর মওকা বুঝে মিথ্যে বলতেও পিছপা হবে না। সবাইকে পাঁচ টাকা করে কবুল করা হল। কালেক্টর সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের বলতে হবে যে তারা উন্ধাদুন্দ মৌজার কিষান। বাবু বলভদ্র হল তাদের জমিদার। কেরায়া নেওয়াটা তার হক। আপনারা জানতে চাইবেন এসব করে কী হবে। সবুর করুন দেখতে পাবেন কী হতে চলেছে।

বাবু বলভদ্র এবার সরাসরি দপ্তরে একটা দরখাস্ত করল। আর্জি রামদিনুয়া চামার আর দুরশুনুয়া আহিরকে হুকুম করা হোক তারা উদ্ধাদুন্দ গ্রামে পাঁচ বিশোয়া (Biswa) করে যে জমি চাষ করে তার জন্য তাকে দু-টাকা করে কেরায়া দিক। দপ্তর কৈফিয়ত চাইল, বাবু বলভদ্রই সেখানকার জমিদার তো? জবাব মিলল, জরুর। নিলামে সে জমি খরিদ করেছে আর ধুন্দুপন্থ মিশ্রের জায়গায় খাতায় তোলা হয়েছে তার নাম। আইন মোতাবেক রামদিনুয়া আর দুরশুনুয়ার খিলাফ ব্যবস্থা নেওয়া হল। তাদের তো যা পাওয়ার আগেই পেয়ে গেছে। আর কী বলতে হবে সেই তালিমও সারা। এবার তাই হুজুরের সামনে তাদের কবুল করতে কোনও তকলিফই হল না, বকেয়া তারা জরুর মিটিয়ে দেবে। শুধু দয়া করে হজুর যদি তাদের একটু ছাড় দেন। একে বলা হয় ইকবাল দাবা (ekbaldawee)। জারি হল ফরিয়াদির তরফে ডিক্রি।

কয়েক সপ্তাহ পর বাবু বলভদ্র সিং, হাজির হল উন্ধাদুন্দ গ্রামে কেরায়া আদায় করতে। জমিদার তাকে ঠেকাতে গেলে বেধে গেল কাজিয়া। বাবু এবার তাকে জবরদস্তি ঠেকিয়ে রাখার কারণ দেখিয়ে ১৮৪০ সনের IV নম্বর ধারা মোতাবেক ফৌজদারি আদালতে একটা মামলা ঠুকে দিল। এরকম মামলাকে লোকে আকুট চাহাররুম (Akut Chaharoom) বলে জানে। ডিপটি সাহেবের আদালতে যে ফয়েসলা হয়েছিল আর সে যে দেওয়ানি আদালতের হুকুম পেয়েছে কেরায়া আদায় করায় সেই দলিলও জুড়ে দেওয়া হল। সাক্ষী হিসাবে দাখিল করা হল রামদিনুয়া আর দুরশুনুয়াকে। আমাকেও তলব করা হল এটা প্রমাণ করতে যে আসামিদের আদালতের হুকুম জানানোর সময় তারই হাতে ছিল মৌজার দখল। আমরা খুশ ছিলাম বলভদ্রের নজরানায়। তাই তার তরফদারি করায় টালবাহানা ছিল না। আদালত হুকুম দিল, তকরারি জায়দাদ বলভদ্রের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক। এই যে একবার মওকা মিলে গেল, তারপর ধীরে ধীরে পুরো এলাকাটাই চলে এল তার কব্জায়।

একবার নাজির হুকুম পেলেন উন্ধাদুন্দ গ্রামের এক বড় জোতদারকে জমি থেকে উৎখাত করতে হবে। কাজটা শুরুর আগেই জোতদার আমাকে বশ করে ফেলল। একটা কাজ থেকেই আমার আমদানি হয়েছিল পঞ্চাশ টাকা। কেমন করে হয়েছিল সে কথাই বলব। যদি কোনও জমিদার আসামির খিলাফ খাজনা না দেওয়ার ডিক্রি হাসিল করতে পারে, তা হলে সে চাইলে বারো বছরের মধ্যে তাকে উৎখাতের আর্জি জানাতে পারবে। এই রকম মামলায় প্রথমেই খোঁজ পড়ে আসামির। পাশাপাশি চেষ্টা চলে আমাদের খুশ রাখার যাতে হুকুম দাখিলের বদলে আমাদের কৈফিয়ত হয়— আসামিকে ঘরে পাওয়া যায়নি, সে রুপোশ (rooposh)। বেচারা কিষান! তার এই বেয়াদবির দরুন হুকুম জারি হয়, জমি থেকে তাকে উৎখাত করা হল। এবার আমি আর আমার দলবল গিয়ে তার মাঠের ফসল উপড়ে ফেলি। জমিদারের মদতে ফের সেখানেই শুরু হয় চাষ।

জমিদার যদি ভাবে আমাদের কোনও দস্তুরি না দিয়ে সে কালেক্টর সাহেবের হুকুম মোতাবেক চলবে তখন আমরা গিয়ে ভিড়ে যাই উলটো তরফে। ধরা যাক হাল এমনই বেহাল যে আমাদের জমিদারের হক কায়েম করতে হবে। তখন আমরা এমন ভাব করি যে পাকা ফসল বরবাদ করতে আমাদের বুক ফেটে যাচ্ছে। সাহেবের সামনে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে একটা কৈফিয়ত পেশ করা হয়। ডিক্রিদার হল মহাজালিম আর মুফসিদ (moofsidh)। বলভদ্রের খাসিয়ত হুজুরের ভালই মালুম। আমাদের মতো নোকর চাকরেরা সাতকাহন করে কী বলবে তাতে কিছু যায় আসে না। ফলে আসামির হাতেই থেকে যায় জমির হক।

১. করপরদাজ: ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী

২. খোসনাম: সুনাম; সুখ্যাতি

১. খিলাফ: ব্যতিক্রম, অন্যথা আচরণ

১. খাসিয়ত: স্বভাব, প্রবণতা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *