১১. দ্বীপে ওরা
ডাঙায় পৌঁছবার একটু পরেই মশিয়ে দো বাখনিকে হাজির দেখে অবাক হয়ে গেল ক্যাপটেন লীচ। এগিয়ে এসে জানতে চাইল কি ব্যাপার।
তোমার নোংরা সন্দেহের কারণে মাদাম দো বাখনিকে যখন জাহাজ ছাড়তেই হচ্ছে, তখন আমি দেখতে এলাম উপযুক্ত ব্যবস্থা হচ্ছে কি না। ওঁর শরীর ভাল না।
তাহলে ওকে সঙ্গে আনতে গেলে কেন?
অসহিষ্ণু কণ্ঠে জবাব দিল দো বাখনি। ভুলে যাচ্ছ, তোমাকে বলেছি, ওকে গুয়াডিলুপে ওর ভাইয়ের দায়িত্বে রেখে আসব বলে ঠিক করেছিলাম। জামাইকায় ফেলে আসা সম্ভব ছিল না, কারণ স্প্যানিশ সম্পদ ডাকাতির পর কোনদিনই আর ওখানে ফিরতে পারব না। আমি।
যুক্তিটা মনে ধরল লীচের। ওকে লোকজনকে খাটিয়ে যেমন পছন্দ তেমনই ব্যবস্থা করে নেয়ার অনুমতি দিল।
সৈকতের একেবারে দক্ষিণে জঙ্গলের ধারে একটা জায়গা বাছাই করে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে গাছের গুঁড়ি দিয়ে একটা কেবিন তৈরি করাল ও। কাছেপিঠেই মাদামের ভাইয়ের জন্যে আর পিয়েখের জন্যে টাঙানো হলো দুটো তাঁবু। দস্যুদের ক্যাম্প থেকে এতদূরে আশা করা যায় মোটামুটি নিরাপদেই থাকবে মাদাম দো বাখনি।
সূর্যাস্তের আগেই কাজ শেষ করা গেল। গাছ কেটে যে জায়গাটা ফাঁকা করা হয়েছে সেখানেই কেবিনটা তৈরি করায় সরাসরি সামনে না এলে চোখে পড়ে না। জাহাজ থেকে বেশ কিছু আসবাব নিয়ে আসা হয়েছে: খাট, চেয়ার, টেবিল, কার্পেট, বাতি– সব মিলিয়ে চমৎকার বাসযোগ্য মনে হচ্ছে এখন কেবিনটা।
মনে হাজারটা উদ্বেগ, তারপরেও অবাক হলো প্রিসিলা। ওর জন্যে এত কষ্ট করে কেবিনটা সাজানো হয়েছে দেখে বার বার ধন্যবাদ জানাল মশিয়ে দো বাখনিকে। এত সুন্দর একটা কেবিন পারে কল্পনাও করতে পারেনি ও।
প্রিসিলা এসে পৌঁছানোর পর পরই এসে হাজির হলো টম লীচ। ওর আরাম আয়েশের উপযুক্ত ব্যবস্থা হয়েছে কি না নিজ চোখে দেখতে চায়। অতিথিরৎসল গৃহকর্তার ভূমিকা নিয়ে মাদাম বাখনির অসুবিধে হচ্ছে বলে অনেক দুঃখ প্রকাশ করল, এটা-ওটা আনিয়ে দিল ক্যাম্প থেকে। যে-কোনকিছুর প্রয়োজন হলে মাদাম যেন বিনা দ্বিধায় তাকে জানায় ইত্যাদির পর আরও কিছুক্ষণ দো বাখনি ও মেজর স্যান্ডসের সঙ্গে সরস গল্প করার চেষ্টা করে চলে গেল সে নিজের আস্তানায়।
অসম্ভব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে মেজর স্যান্ডস। দুপুরে খাওয়ার সময় পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে সে, তার নিরাপত্তা নির্ভর করছে মশিয়ে দো বাখনির নিরাপত্তার ওপর। তারপর জানতে পেরেছে, লীচের সঙ্গে মোটেও ভাল সম্পর্ক নেই দো বাখনির, লীচ ওকে এক রত্তি বিশ্বাসও করে না। পানিতে পড়েছে যেন ও এখন।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর শুতে যাবার সময় হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মেজর একটা কথা মনে আসায়। আশ্চর্য! এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় তার নজর এড়িয়ে গেল কি করে! মশিয়ে দো বাখনিকে জিজ্ঞেস করল তার শোয়ার ব্যবস্থা কোথায় হয়েছে। জবাব দেয়ার আগে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল ফরাসী লোকটা।
এটা তো সোজা কথা, মেজর। আমার স্ত্রীর সঙ্গেই তো আমার থাকার কথা।
ঘোঁত করে বিদঘুটে একটা শব্দ বেরুলো মেজরের গলা থেকে। ঘুরে দাঁড়াল দো বাখনির দিকে।
যদি কোনভাবে প্রমাণ হয় যে উনি আমার স্ত্রী নন, নিরাপত্তা বলে কিছু থাকবে ওঁর? আপনি নিশ্চয়ই চোখ বুজে ছিলেন না, কী দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকাচ্ছিল টম লীচ দেখেছেন আপনি নাকি দেখেননি?
কিছুক্ষণ দম আটকে রাখল মেজর, তারপর ফেটে পড়ল রাগে, আপনি অথবা টম লীচ, এই তো লতে চাইছেন? দুজনের মধ্যে কি তফাৎ একটু বুঝিয়ে বলবেন?
ঠোঁট গোল করে শ্বাস টানল মশিয়ে দো বাখনি। সাদা দেখাচ্ছে মুখটা। তাহলে এইভাবে নিচ্ছেন আপনি ব্যাপারটা! নিচু গলায় বলল সে। মাথা খেলানোর ক্ষমতা নেই, সিদ্ধান্ত নিয়ে বসছেন যা খুশি। শুকনো হাসি হাসল সে। আপনি যা ভাবছেন আমার উদ্দেশ্য যদি তাই হত, তাহলে, জনাব বর্থোলোমিউ, এতক্ষণে আপনার লাশটা নিয়ে লেগুনের নিচে ভোজে মত্ত থাকত গলদা চিংড়ীর ঝাক। আমার সততা সম্পর্কে যখনই সন্দেহ আসবে তখনই এই কথাটা মনে করার চেষ্টা করবেন। চলি!
খপ করে ওর আস্তীনটা ধরে ফেলল মেজর।
মাফ চাইছি, মশিয়ে দো বাখনি। বিশ্বাস করুন। আপনি চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার আগেই ব্যাপারটা আমার বোঝা উচিত ছিল। আমি মস্ত অন্যায় করেছি আপনার ওপর, স্বীকার করছি।
হয়েছে, থাক! বলে পা বাড়াল দো বাখনি।
দরজা নেই প্রিসিলার কেবিনে। ভারি একটা কম্বলের পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছে ওখানে পিয়েখ.। কাঠের গুঁড়ির ফাঁক-ফোকর গলে আলো আসছে বাইরে। পিয়েখের তাঁবুতে নিজের ডাবলিট খুলে রেখে একটা আলখেল্লা আর একটা বালিশ নিয়ে এগোলো দো বাখনি কেবিনের দিকে।
দরজার ঠিক সামনে এক হাঁটু গেড়ে বসে বালি খুঁড়ে ছোট একটা গর্ত তৈরি করল মশিয়ে দো বাখনি।
কে ওখানে? পর্দার ওপাশ থেকে ভেসে এল প্রিসিলার কণ্ঠ।
আমি, জবাব দিল দো বাখনি। কোনও ভয় নেই, আমি পাহারায় থাকলাম। নিশ্চিন্তে ঘুমান।
ভিতর থেকে আর কোন সাড়া এল না।
আলখেল্লাটা গায়ে জড়িয়ে গর্তে কোমর রেখে আরাম করে শুয়ে পড়ল দো বাখনি বালির উপর।
অনেক দূরে সৈকতের অপর দিকে জলদস্যুদের হৈ-হল্লার শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। আধখানা চাঁদ হাসছে আকাশে, লেগুনের অনেকটা জায়গা ঝিলমিল করছে আলো পড়ে। জোয়ার আসছে, তার মৃদু কলকল শব্দ কানে আসছে। এছাড়া নিঝুম হয়ে গেছে দ্বীপটা।
কিন্তু সবাই ঘুমিয়ে পড়েনি। কুটিরের ভিতর আলো নিভে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। এবার ধীরে, নিঃশব্দে, অতি সাবধানে সরে গেল পর্দার একটা অংশ। নরম চাঁদের আলোয় দেখা দিল প্রিসিলার ফর্সা মুখটা।
মুখটা একটু সামনে বাড়ল, পরমুহূর্তেই চোখ পড়ল ওর পায়ের কাছে শুয়ে থাকা দীর্ঘ দেহটার ওপর। গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে মশিয়ে দো বাখনি।
চট করে সরে গেল না মুখটা পর্দার আড়ালে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে শুনলো মানুষটার নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস। অনুভব করল, তারই নিরাপত্তার জন্যে এখানে এইভাবে শুয়ে আছে এই মহৎ-হৃদয় মানুষটা। তারপর আস্তে করে পর্দাটা নামিয়ে দিয়ে খাটে উঠে শুয়ে পড়ল নিশ্চিন্তে, জানে বিপদের ভয় নেই, এখন ও সম্পূর্ণ নিরাপদ।
ও জানে না, আরও একজন রয়েছে তার পাহারায়। দশ-বারো গজ দূরে নিজের ভাবুর ছায়ায় বাইরে বালির উপর এদিকে মুখ করে শুয়ে দো বাখনির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে মেজর স্যান্ডস। পরপর দুরাত এভাবে জৈগে পাহারা দিল, এবং অসুস্থ হয়ে পড়ল মেজর। হঠাৎ করে গরমও পড়েছে খুব। তাই সিদ্ধান্ত নিল, আর রাত জাগার কোন অর্থ হয় না। আপাতত দো বাখনির কোন বদ মতলব আছে বলে মনে হচ্ছে না। তাছাড়া সামান্য আওয়াজ পেলেই ঘুম ভেঙে যাবে ওর, ছুটে যেতে পারবে প্রিসিলার সাহায্য প্রয়োজন হলে।
ওদিকে কাজে ব্যস্ত জলদস্যরা। লীচ খুব তাড়া লাগাচ্ছে ওদের, কিন্তু কাজ তেমন এগোচ্ছে না। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে ঠিকই, কিন্তু খাওয়ার পর আর কাউকে দিয়ে কিছু করানো যায় না। ঘুমায় ওরা ছায়ায় শুয়ে।
এ ব্যাপারে প্রচ্ছন্ন সায় পায় ওরা দো বাখনির কাছ থেকে। আগের মতই খোলামেলা ভাবে মেলামেশা করে ও সবার সঙ্গে, কথায় কথায় স্প্যানিশ ফ্লীটের কথা তুলে লোভের আগুন জ্বেলে দেয় ওদের মনে। সেইসঙ্গে এটাও জানাতে ভোলে না যে একমাত্র সে-ই ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারে এই বিপুল সম্পদের কাছে। নানান গল্পের ফাঁকে সবাইকে ও বুঝিয়ে দিয়েছে, হাতে প্রচুর সময় আছে, তাড়াহুড়ো করতে যাওয়া অর্থহীন। আগামী তিন সপ্তাহের আগে রওনা হবে না ফ্লীট, আর যখন রওনা হবে, এই অ্যালবুকোয়ার্ক থেকে মাত্র একদিন লাগবে ওটাকে ঠিক জায়গা মত বাগে পেতে।
তারপর সেই সম্পদ হাতে পেয়ে ওরা কি কি মজা লুটতে পারবে তার চিত্র তুলে ধরে জলদস্যুদের বেপরোয়া মনে আগুন জ্বেলে দেয় ও। কল্পনার চোখে সে-সব দেখতে পেয়ে খখ করে হাসে ওরা। এইভাবে ওদের সম্পদের নেশায় আবিষ্ট করে ফেলল সে, সেই সঙ্গে নানান ভাবে ওদের মনে ঢুকিয়ে দিল, এই সম্পদ পেতে হলে তাকে, এবং একমাত্র তাকেই দরকার ওদের।
লীচ যখন জানতে পারল ওর লোকজনকে দিয়ে যে কাজ করানো যাচ্ছে না, তার পেছনে দো বাখনির প্ররোচনা রয়েছে, তখন একদিন খেঁকিয়ে উঠল ওর উপর। ওর কথা গায়ে না মেখে ধীর ও নিশ্চিতভাবে এগোলে কি হয় সে সম্পর্কে প্রবাদ বাক্য আওড়াল দো বাখনি। বলল, হাতে অনেক সময় আছে।
তেলে-বেগুনে ছ্যাঁৎ করে উঠল লীচ। অনেক সময়? কিসের সময় শুনি?
প্লেট ফ্লীট রওনা হওয়ার আগে।
তোমার প্লেট ফ্রীটের নিকুচি করি আমি! চেঁচিয়ে উঠল লীচ। ওই একটাই ফ্লীট আছে নাকি দুনিয়ায়? আর যে-সব চলছে সাগরে এদিক থেকে ওদিক –সেগুলো কিছুই না?
ভয় পেয়ো না, ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল দো বাখনি। তুমি ভাবছ, এখানে ধরা পড়ে যাবে কারও চোখে। দূর! হাসিয়ো না তো! নিশ্চিন্তে থাকো তুমি কোন জাহাজ আসরে না এই গোপন লেগুনে।
হয়তো আসবে না। কিন্তু যদি আসে? তাহলে কি হবে শুনি? ডাঙায় উঠে বসে আছি, অসহায়! অনেক সময় আছে! চুলোয় যাক সময়, আমি যত শীঘ্রি সম্ভব সাগরে নামতে চাই। খবরদার, আমার লোকেদের কানে কোও ফুস্-মন্তর দিতে আসবে না তুমি আর!
ওকে শান্ত করার জন্যে কথা দিল দো বাখনি যে আর এসব কথা কাউকে বলবে না। কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। ওরা এখন জানে, এই গরমে নিজেদের খুন করার কোন অর্থ হয় না, দো বাখনি বলেছে: হাতে সময় আছে প্রচুর।
দশটা দিন কেটে গেল মালদিতা দ্বীপে মোটামুটি শান্তিতেই। আগাছা জ্বালিয়ে দিয়ে ঘষে-মেজে পরিষ্কার করা হয়েছে জাহাজের খোল। এইবার মিস্ত্রী লাগল জোড়াগুলোর ফাঁক-ফোকর বন্ধ করার কাজে। এ-কাজে সবার হাত লাগানোর উপায় নেই। মিস্ত্রীর কাজ শেষ হলে তারপর আবার তলায় আলকাতরা আর গ্রীজ মাখানোর জন্যে দরকার হবে সবাইকে। তাই সবাই মত্ত এখন তাস-পাশা আর গল্প– গুজবে।
গরমে নিষ্কর্মা অবস্থায় বসে থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে মেজর স্যান্ডস। সারাক্ষণ মেজাজ খারাপ হয়ে থাকছে। হতাশা ভর করেছে তার উপর। তর্ক-বিতর্ক আর মশিয়ে দো বাখনির সমালোচনা করেও আর মন ভরছে না।
প্রিসিলা অবশ্য কিছু কাজ বের করে নিয়েছে। রান্নার কাজে পিয়েখকে সাহায্য করছে নিয়মিত। ওর সঙ্গে গিয়ে জঙ্গল থেকে মিষ্টি আলু তুলে আনছে, কাঁচকলা পেড়ে আনছে। সমুদ্রের ধারে দৌড়ঝাঁপ করে কচ্ছপ ধরছে, বালি খুঁড়ে কচ্ছপের ডিম তুলে আনছে, পানিতে ছিপ ফেলে ধরে আনছে মাছ।
মাঝে মাঝে একাই চলে যায় সে জঙ্গলে ঘুরতে। একদিন দ্বীপের মাঝামাঝি জায়গায় লোকচক্ষুর আড়ালে টলটলে পরিষ্কার পানির ছোট্ট একটা পুকুর আবিষ্কার করে দারুণ খুশি হলো সে, যখন ইচ্ছে এসে এই নির্জন পুকুরে সাঁতার কাটা যাবে।
প্রিসিলার সহজ ভঙ্গিতে চলাফেরা, কথাবার্তা আরও রাগ চড়িয়ে দেয় মেজরের। ওর মনে হয় মেয়েটি বোধহয় অনুভূতিশূন্য। নইলে এই বিপদ মাথায় নিয়ে হাসে কি করে? যার বিপদের কথা চিন্তা করে সে নিজে অস্থির হয়ে থাকে অহোরাত্র, সে-ই কি না দিব্যি হেসে-খেলে কাটাচ্ছে সময়। লীচের কথাতেও হেসে উঠতে বাধে না তার।
ইদানীং প্রায়ই আসছে লীচ প্রিসিলার সঙ্গে গল্প করতে। যেখানেই থাকুক, কি করে যেন টের পেয়ে ও পৌঁছবার পরপরই এসে হাজির হয় মশিয়ে দো বাখনি। ফলে মেজর বেঁচে যায় বদমাশটার সঙ্গে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ভদ্র ব্যবহার করার গ্লানি থেকে। বিশেষ করে, খুনে ডাকাতটার টিটকারী ওর একেবারেই সহ্য হয় না। ও কি করে প্রিসিলার ভাই হয়, তাই নিয়ে একদিন মেতে উঠল ব্যাটা। চেহারায় যে সামান্যতম মিল নেই তা সে নিজেও জানে, কিন্তু লীচ যখন প্রিসিলাকে বলল, ভাইয়ের চেহারা পায়নি বলে ওর প্রতিদিন সময় বেঁধে নিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত, তখন একেবারেই অসহ্য লেগে উঠল তার। আর এই কথা শুনে যখন হা-হা করে হেসে উঠল খুনীর দোসর ওই দো বাখনিটা, তখন লাফিয়ে উঠে ছুটে বেরিয়ে গেল সে কেবিন থেকে।
ক্রমেই বাড়ছে লীচের আসা-যাওয়া। হাতে করে এটা-ওটা নিয়ে আসছে ব্ল্যাক সোয়ানের ভাড়ার থেকে। কোনদিন হয়তো দু-বোতল পেরুভিয়ান ওয়াইন, কোনদিনগুয়াভা চীজ, কোনদিন বা চিনির শিরায় চুবিয়ে কড়মড়ে শুকনো করে ভাজা আমন্ড বাদামের প্যাকেট।
দেখেও দেখে না এসব মশিয়ে দো বাখনি। যেন সহজ ভাবে নিয়েছে প্রিসিলার প্রতি লীচের এই মনোযোগ। কিন্তু যখনই মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, শিষ্টতার বেড়া ডিঙিয়ে যেতে চায় লীচ, ঠিক তখনই স্বামী হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় সে প্রাচীর হয়ে।
বাধা পেলেই শ্বদন্ত বেরিয়ে আসে লীচের, চাপা গর্জন আসতে চায় গলা দিয়ে; যেন কুকুরের থাল থেকে হাড় কেড়ে নিয়েছে আর কেউ। কিন্তু সদা প্রস্তুত দীর্ঘদেহী ফ্রেঞ্চম্যানের আধ-বোজা চোখের দৃষ্টির সামনে চেষ্টাকৃত হাসির রূপ নেয় সে গর্জন, এমন ভাব দেখায়, যেন ঠাট্টা করছিল।
.
১২.
ত্রাণকর্তা
মাদাম দো বাখনির প্রতি টম লীচের মনোযোগের আতিশয্য ধরা পড়ল তার ঘনিষ্ঠ অনুচরদের চোখে। প্রথম কিছুদিন হালকা ভাবে নিল ওরা ব্যাপারটা, ঠাট্টা-মস্করা করল এ নিয়ে; কিন্তু বিচক্ষণ বানড্রি যখন বুঝিয়ে দিল কতখানি মারাত্মক হতে পারে এর পরিণতি, তখন চারজন মিলে স্থির করল একদিন ডিনারের পর ধরবে ওরা লীচকে।
উচ্ছৃঙ্খল, বদমেজাজী লীচের সামনে মাথা তুলে কথা বলার ক্ষমতা রাখে একমাত্র আবেগবর্জিত, ভাবলেশহীন বানড্রি, কাজেই ওর ওপরই ভার পড়ল কথাটা তোলার। তুলল সে, এবং পরিষ্কার জানিয়ে দিল ক্যাপটেনের এহেন আচরণ মোটেই সমর্থন করতে পারছে না ওরা।
মুহূর্তে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল লীচ, তর্জন-গর্জন করল, তারপর হুমকি দিল: তার যা খুশি তাই সে করবে, কেউ বাধা দিতে এলে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলবে তাকে।
উওগান, হ্যালিওয়েল আর এলিস কুঁকড়ে গেল এই ধমকের মুখে। কিন্তু ওর দিকে সাপের মত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বানড্রি। তারপর বলল, যা মুখে আসে বলে ফেলো, ক্যাপটেন। এতে গরম কিছুটা বেরিয়ে যাবে ভেতর থেকে। তারপর হয়তো বুঝতে পারবে সহজ যুক্তি কি বলে।
যুক্তি? যুক্তির আমি ইয়ে করি! খোঁড়াই কেয়ার করি আমি…!
পাল নামাও, ক্যাপটেন। যুক্তিকে কেয়ার না করায় অনেককে দেখেছি আমি ধুলোয় মিশে যেতে।
কথাটা হুমকির মত লাগল লীচের কাছে। ব্যাপারটা ভাল করে বোঝার জন্যে বসে পড়ল আবার। কয়েক মুহূর্ত বানড্রির অভিব্যক্তিহীন মুখের উপর অগ্নিবর্ষণ করল ওর চোখ। তারপর বলল, আমার ব্যাপার আমি নিজেই সামলাতে জানি। তোমাদের কারও সাহায্যের দরকার পড়বে না। বোঝা গেছে?
একা তোমার ব্যাপার হলে আমরা নাক গলাতে যেতাম না, টম, শান্ত গলায় বলল বানড্রি। কিন্তু আমরা সবাই জড়িয়ে গেছি এর সঙ্গে। এটা এখন আমাদেরও ব্যাপার। স্প্যানিশ সোনা হাতে পাওয়ার আগে আমরা চাইব না তোমার চারিত্রিক দুর্বলতার কারণে গোটা ব্যাপারটাই ভরাডুবি হোক।
অর্থাৎ তোমাদের কথা মত চলতে হবে আমাকে এখন, এই তো? তোমরা যা করতে দেবে তাই করব, অনুমতি না পেলে করব না, আঁহ? এখনও কেন যে তোমাকে গুলি করে বুঝিয়ে দিচ্ছি না কে এখানে কর্তা! বাকি তিনজনের ওপর চোখ বুলাল সে। বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বলল, তোমাদেরও তো এই একই মত, তাই না?
উত্তর দেয়ার সাহস হলো কেবল হ্যালিওয়েলের। ওর বিশাল বপু ঝুঁকে এল সামনে, টেবিলের উপর থলথলে একটা হাত রেখে বলল, যুক্তির কথা তোমাকে মানতে হবে, ক্যাপটেন। তোমার কি ধারণা আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, টপগ্যাল্যান্ট চার্লি তা দেখতে পাচ্ছে না? তোমার কি ধারণা, ওর চোখে ধুলো দেয়া সম্ভব? তোমার তো অন্তত জানার কথা, টম, ওর ওই শহুরে বোলচাল আর মার্জিত কথাবার্তার আড়ালে ওর মত সদা-সতর্ক, ভয়ঙ্কর, বিপজ্জনক লোক আর হয় না।
আরে, দূর! ভাল সম্পর্ক আমাদের। আমার সঙ্গে তেরিবেরি করার সাহস ওর নেই, কোনদিন হবেও না।
নিজেকে ঠকানোর চেষ্টা কোরো না তো, ক্যাপটেন! এবার কথা বলল উওগান। সবার সঙ্গেই ওর ভাল সম্পর্ক। কিন্তু সবাই জানে, কেউ ওর সঙ্গে বেইমানী করতে গেলে মুহূর্তে ইস্পাতকঠিন হয়ে উঠবে ও।
গাধা তোমরা! ওর একটা কণ্ঠনালী আছে না?
তাতে কি? চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে জানতে চাইল বানড্রি।
আর সবার মতই খুব সহজে দুফাঁক হয়ে যাবে ওটা, যদি আমার সঙ্গে লাগতে আসে।
ঠিক এই জিনিসটাই ঘটতে দিতে চাই না আমরা। বিপুল সম্পদের সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে ও আমাদের কাছে, রহস্যের চাবিকাঠি ওর হাতে। এই অবস্থায় কেউ প্রণয়-পাগল হয়ে সব গুবলেট করে দিতে চাইলে আর সবাই তা মানবে কেন? দয়া করে কথাটা বোঝার চেষ্টা করো, আর ওর মেয়েমানুষের ওপর থেকে নজরটা ফেরাও।
কথাটা ঠিক, ক্যাপটেন, বলল লালচুলো এলিস। সোনাগুলো আমাদের জাহাজে উঠে না আসা পর্যন্ত নিজেকে একটু সামলে রাখতে হবে তোমার, ক্যাপটেন।
তারপর, মৃদু হাসল উওগান, ওই ডানাকাটা পরিকে নিয়ে তুমি যা খুশি তাই করো না কেন, আমরা কেউ তা চেয়েও দেখব না। তোমার কাছে শুধু একটু ধৈর্য দাবি করছি আমরা, ক্যাপটেন, আর কিছু না।
কথাটা বলে জোরে হেসে উঠল উওগান। সে হাসিতে যোগ দিল এলিস ও হ্যালিওয়েল। শীতল ভাবটা দূর করতে চাইছে ওরা হাসি দিয়ে। উদ্দেশ্য সফল হলো ওদের। উত্তরে চাপা শয়তানী হাসি দেখা দিল লীচের ঠোঁটে।
বানড্রি হাসল না। এসব ভাবাবেগের ঊর্ধ্বে সে। যেন মুখোশ পরে আছে। চোখ দুটো স্থির, পলকহীন। যতক্ষণ না রাজি হলো লীচ, একই দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে ওর চোখের দিকে। ওর দৃষ্টি বুঝিয়ে দিল লীচকে, শুধু কথা দিলেই হবে না, কথাটা রক্ষা করা হচ্ছে কি না, লক্ষ রাখা হবে এখন থেকে।
পরপর কয়েকদিন টম লীচ না আসায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন প্রিসিলা। কিন্তু মেজরের সঙ্গে ছোটখাট একটা ঝগড়া বেধে গেল মশিয়ে দো বাখনির। মেজর জানতে চেয়েছিল স্প্যানিশ গোল্ড চুরি করার পর তার ও মিস প্রিসিলার ভাগ্য সম্পর্কে কি ভাবছে সে। এরকম অশালীন প্রশ্ন শুনে কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছে দো বাখনি ওকে। কিন্তু প্রশ্নটার কোন সদুত্তর দেয়নি।
সেই রাতে কুটিরের দরজার সামনে ঘুমন্ত দো বাখনির কাঁধ স্পর্শ করল একটা কোমল হাত। মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠল দো বাখনি, লাফিয়ে উঠে বসে সরিয়ে আলখেল্লার ফাঁক থেকে একটানে বের করল নাঙা তলোয়ার।
দেখল ঠোঁটে আঙুল চেপে রেখেছে প্রিসিলা। চট করে এদিক ওদিক চাইল দো বাখনি, কিন্তু কোথাও কোন বিপদের আভাস পেল না। সৈকতে ঢেউ ভাঙার মৃদু এবং বারো গজ দূরে মেজর স্যান্ডসের নাক ডাকার তীক্ষ্ণ আওয়াজ ছাড়া আর সব নীরব, নিস্তব্ধ।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল সে মৃদু কণ্ঠে। একটা পা ভাঁজ করছে উঠে দাঁড়াবে বলে।
কিছু না, বলল প্রিসিলা। অনুভব করল ওর হাতের তালুর নিচে শিথিল হয়ে গেল ঝাঁপ দেয়ার জন্যে তৈরি পেশীগুলো। আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে, মশিয়ে দো বাখনি।
নিশ্চয়ই, বলুন। একটু নড়ে কেবিনের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসল দো বাখনি। প্রিসিলাও বসল ওর পাশে।
কিছুক্ষণ উসখুস করে বলল, মেজর একটা প্রশ্ন করেছিলেন আজ আপনাকে, আপনি তার উত্তর দেননি। যেভাবে উনি কথাটা বলেছিলেন সেটা আপত্তিজনক বলেই হয়তো আপনি রেগে গিয়ে…
না, না। বোকাসোকা মানুষ, মনের ভাব গোপন রাখতে পারেন না, এই যা– আমি রাগ করিনি।
মেজরের ব্যবহারের জন্যে কৈফিয়ৎ দিতে যাচ্ছিল প্রিসিলা, কিন্তু বাধা দিল দো বাখনি। এ নিয়ে একটুও ভাববেন না আপনি। একটু হয়তো বিরক্তি প্রকাশ করেছি, কিন্তু রাগ আমি সত্যিই করিনি। আমি ধৈর্যশীল মানুষ, হুট করে মেজাজ আমার গরম হয় না।
আমি লক্ষ করেছি সেটা।
এটাও ওর লক্ষ এড়াল না যে, একজন আত্মস্বীকৃত দুর্ধর্ষ জলদস্যু, যে আগামী কিছুদিনের মধ্যেই স্প্যানিশ ফ্লীট আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার মুখে ধৈর্যের কথা শুনতে ওর মোটেও বেমানান লাগছে না। সামান্যতম সন্দেহ বা অবিশ্বাস জাগছে না মনে। একটু চুপ করে থেকে বলল, বার্টের প্রশ্নটার আপনি কিন্তু কোন উত্তর দেননি। প্রশ্নটা ছিল: এদের নিয়ে আপনি যখন ফ্লীট আক্রমণে যাবেন, তখন আমাদের কি ব্যবস্থা হবে। এটা আমারও প্রশ্ন। জবাবটা কি দেবেন আপনি?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল দো বাখনি, সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণে নেই, মিস প্রিসিলা। ঘটনার অপেক্ষায় আছি আমি, অবস্থা কোনদিকে গড়ায় বুঝে আমার ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবু, একটা কিছু পরিকল্পনা তো আছে আপনার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে যখন দেখল প্রিসিলা, অপরপক্ষ থেকে কোন উত্তর আসছে না, তখন আবার বলল, এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ আস্থা আর বিশ্বাস রেখেছি আমি আপনার ওপর। আপনার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেছি বলে, শান্তিতেই ছিলাম।
কিন্তু এখন সেই বিশ্বাস আর নেই।
তা কেন? তা যদি হতো তাহলে তো হতাশায় একবারে ভেঙে পড়তাম। কিন্তু প্রকাশ না করলেও উদ্বেগ তো আর ভুলে থাকার ব্যাপার নয়!
হ্যাঁ, সত্যিই আপনি সাহসী মেয়ে। সত্যিকার সাহসী। দো বাখনির কণ্ঠে অকৃত্রিম প্রশংসা। আপনি ভাবতেও পারবেন না, আপনার সাহস আমাকে কতটা সাহায্য করেছে। এই সাহায্যটা বজায় রাখুন, আপনাকে সাহায্য করতে আমার সুবিধে হবে।
কিন্তু কিছুতেই আনার ইচ্ছে বা পরিকল্পনার কথাটা বলা যাবে না, এই তো? জানতে পারলে হয়তো মনে জোর পেতাম।
আপনাকে তো বলেছি, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিই আমি। তার সঙ্গে এইটুকু যোগ করতে পারি: আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনার কোন ভয় নেই, কোন ক্ষতি হবে না আপনার। কথা দিচ্ছি, যেমন করে পারি আপনাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবই করব। যদি বেঁচে থাকি।
যদি বেঁচে থাকেন!
গলাটা কেঁপে গেল প্রিসিলার। চট করে চাইল দো বাখনি ওর মুখের দিকে। এই কথাটা আমার বলা ঠিক হয়নি। এমনিতেই যথেষ্ট উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটছে আপনার, নতুন একটা শব্দ যোগ করে আপনার ভাগ্য অনিশ্চিত করে তোলা উচিত হয়নি আমার। এরপর দৃঢ়কণ্ঠে বলল, যান, কথা দিচ্ছি, বেঁচে থাকব। কথাটা বিশ্বাস করতে পারেন।
আমার ভাগ্য অনিশ্চিত করে তোলা! আহত বোধ করেছে প্রিসিলা। আমার সম্পর্কে দেখছি আপনার খুব নিচু ধারণা।
নিচু! প্রতিবাদ করল দো বাখনি। কী বলছেন আপনি!
কথাটা আর ব্যাখ্যা করল না প্রিসিলা, ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেল।
স্প্যানিশ ফ্লীট দখল করার পরও এরা শর্ত ভঙ্গ করবে না, একথা আপনি বিশ্বাস করেন?
মৃদুকণ্ঠে হেসে উঠল দো বাখনি। মোটেও না। একসময় শর্তের মর্যাদা ছিল জলদস্যুদের কাছে। কিন্তু এখন এই লীচ লোকটা মানুষ না, পিশাচ। সৌজন্য, দয়া এসবের মতই আত্মসম্মান ওর কাছে আর একটা অর্থহীন শব্দ। না। শর্ত মানার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওদের, এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়।
দম আটকে গেল প্রিসিলার কণ্ঠে এসে। কিন্তু তাহলে? তাহলে কিসের আশায় চলেছেন আপনি? বাঁচবেন কি করে?
মাথা খাটিয়ে। সুযোগ আসবেই। চোখ-কান খোলা রাখলে সুযোগ পাওয়া যায়ই। আমি খোলা রেখেছি ও দুটো। ভাবনা দূর করে দিন মাথা থেকে। দুর্ভাগ্যবশত বড়সড় কোনও বিপর্যয় যদি না ঘটে, আমাকে ওরা পেড়ে ফেলতে পারবে না। আর কোনও ধরনের কোন দুর্ভাগ্য তো আপনাকে স্পর্শই করতে পারবে না।
এর বেশি আর কিছু বলবেন না?
এই মুহূর্তে এর বেশি বলার কিছুই নেই। আবার বলছি, আমার ওপর আস্থা রাখুন, আপনার কোনও ক্ষতি আমি হতে দেব না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রিসিলা। আচ্ছা, চলি। শুভরাত্রি, মশিয়ে দো বাখনি।
প্রিসিলা চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ একই ভাবে বসে রইল দো বাখনি। ভাবছে, কি বলতে চাইল মেয়েটা ওই কথায়? আমার সম্পর্কে দেখছি আপনার খুব নিচু ধারণা। তার মানে কি বোঝাতে চাইল, একা নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছে না ও; সহযাত্রী, সদ্য-পরিচিত মশিয়ে দো বাখনির কথাও ভাবছে?
.
১৩.
একফোঁটা জল
পরদিন সকালে নিজের তাঁবুতে বসে গরমে হাঁপাচ্ছে মেজর স্যান্ডস, এমনি সময়ে প্রবেশপথে দীর্ঘ একটা ছায়া পড়ল। চমকে তাকিয়ে দেখল সে দাঁড়িয়ে আছে মশিয়ে দো বাখনি, খাপে পোরা তলোয়ারটা চেপে রেখেছে বগলের নিচে।
কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, মেজর, অতিরিক্ত চর্বি হয়েছে আপনার, বলে হতভম্ব করে দিল সে মেজরকে। পরমুহূর্তে যোগ করল, একটু নড়াচড়া করা দরকার এখন আপনার, ঘাম ঝরানো দরকার। তাতে মেজাজ কিছুটা শান্ত হবে। আপনার তলোয়ারটা নিয়ে আসুন আমার সঙ্গে।
মেজরের মনে পড়ল, গত কাল কয়েকটা কঠোর শব্দ আদান-প্রদান হয়েছে দুজনের মধ্যে, তাই তার ফয়সালা করার জন্যে ডাকছে ওকে আজ ডাকাতটা। উঠে দাঁড়াল সে, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হয়ে গেছে, উত্তেজনায় লালচে একটা ছোপ পড়েছে মুখে।
আপনি কিন্তু গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাচ্ছেন, মশিয়ে! একবার ভেবে দেখেছেন, আপনাকে যদি মেরে ফেলি প্রিসিলার কি হবে?
অসম্ভব কথা নিয়ে ভাবি না আমি।
খোদা! আপনার বোলচাল সহ্য করা সত্যিই কঠিন। নিজেকে আপনি কী যে ভাবেন! আমাকে খুন করে ফেললেও বলব সত্যিই সহ্য করা মুশকিল। ঠিক আছে, তলোয়ারটা তুলে নিল সে। ফলাফলের জন্যে কিন্তু দায়ী থাকবেন আপনি!
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মশিয়ে দো বাখনি। আমাকে ভুল বোঝা আপনার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, মেজর। আমি বলছি ব্যায়ামের কথা, আর আপনি বলছেন খুনোখুনির কথা।
আপনি যা বলেন। আমার কোনটাতেই আপত্তি নেই।
জঙ্গলের দিকে রওনা হলো দুজন। ফোঁস ফোঁস গরম নিঃশ্বাস ছাড়ছে মেজর, দো বাখনি শান্ত– যেন মজা পাচ্ছে ওর অবস্থা দেখে।
কেউ যেন দেখে না ফেলে সেজন্যে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল দো বাখনি। কিছুদূর এগিয়েই মোড় নিয়ে সৈকতের সমান্তরালে হাঁটতে থাকল। চুপচাপ হাঁটছে দুজন, হঠাৎ পিছনে পায়ের শব্দ শুনে থমকে দাঁড়াল মেজর।
ও কিছু না, বলল দো বাখনি। পিয়েখ আসছে। ও লক্ষ রাখবে যাতে কেউ না এসে পড়ে।
এগিয়ে গেল মেজর। কেমন যেন রহস্যময় ঠেকছে তার কাছে ব্যাপারটা। তবে সে প্রস্তুত। তার সঙ্গে লাগতে এসে পার পাবে না অহঙ্কারী ফরাসী লোকটা, যা থাকে কপালে-কিছুটা শিক্ষা দিয়ে দেবে সে আজ। হাঁপাতে হাঁপাতে খাড়াই বেয়ে উঠল মেজর, তারপর সরু একটা পথ বেয়ে নেমে গেল দো বাখনির পিছু পিছু ছোট একটা সৈকতে। জলদস্যুদের ক্যাম্প থেকে কেউ দেখতে পাবে না ওদের এখানে। উঁচু পাড়ের ওপর এতক্ষণে পিয়েখকে দেখতে পেল মেজর, পাহারায় রয়েছে, কেউ এদিকে এলেই জানান দেবে।
পরচুলা খুলে রেখে তলোয়ার বের করল মশিয়ে দো বাখনি। নীরবে তাকে অনুকরণ করল মেজর। এবার পকেট থেকে ছোট্ট একটা নাশপাতি আকৃতির কাঠের টুকরো বের করল দো বাখনি, তারপর মেজরের ছানাবড়া চোখের সামনে ওটার গায়ের একটা চেরা জায়গায় ঢোকাল তরোয়ালের আগাটা। এবার একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ঠুকে বসাচ্ছে টুকরোটা শক্ত করে।
ব্যাপারটা বোধগম্য না হওয়ায় প্রশ্ন করল মেজর, এর মানে?
একই রকম দেখতে আর একটা কাঠের টুকরো বের করে এগিয়ে দিল দো বাখনি মেজরের দিকে। আপনি কি ভেবেছিলেন রক্তপাতের জন্যে আপনাকে এখানে ডেকে এনেছি আমি? আমি শুধু বলেছি বেশি চর্বি জমে গেছে আপনার গায়ে, একটু নড়াচড়া দরকার, কিছুটা ঘাম ঝরানো দরকার।
এমনিতেই ঘেমে তর-বেতর হয়ে গেছে মেজর। মনে করল তাকে নিয়ে মস্করা করছে দো বাখনি। রেগে কাঁই হয়ে গেল সে।
কী বলছেন আপনি এসব! টিটকারী মারছেন আমাকে?
শান্ত হয়ে ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন, বলল দো বাখনি। আমাদেরকে যে-কোনও মুহূর্তে যুদ্ধে নামতে হতে পারে। অনভ্যাসে মরচে ধরে যায় শরীরে। আপনার না হলেও আমার তা ধরেছে বলে মনে হচ্ছে। ব্যাপার এইটুকুই। আবার এগিয়ে দিল সে কাঠের বলটা।
কিছুটা বুঝে, কিছুটা না বুঝে হাত বাড়িয়ে নিল ওটা মেজর, তারপর লাগিয়ে নিল তলোয়ারের আগায়।
বুঝলাম! এতক্ষণে বোধোদয় হলো মেজরের। প্র্যাকটিসের জন্যে নিয়ে এসেছেন আমাকে। তা একথা আগে বললেই তো হতো।
পোশাক খুলে রাখতে রাখতে বলল দো বাখনি, বলছি তো! প্রথম থেকেই তো এই একই কথা বলছি।
খুশি মনে ফ্রেঞ্চম্যানের দেখাদেখি নিজের পোশাক খুলল মেজর। তলোয়ারবাজ হিসেবে নাম ছিল ওর আর্মিতে। রেজিমেন্টের কেউ কোনদিন পারেনি ওর সঙ্গে। আজ মওকা পাওয়া গেছে, এই লোকটাকে একহাত খেল দেখিয়ে দেবে সে, বুঝিয়ে দেবে, হেলাফেলা করার লোক মেজর বার্থোলোমিউ স্যান্ডস নয়।
মুখোমুখি দাঁড়াল দুজন তলোয়ার নিয়ে। খেল্ দেখিয়ে দেয়ার জন্যে প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সে প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। কিন্তু প্রতিটা আক্রমণ অনায়াসে ঠেকিয়ে দিল ফ্রেঞ্চম্যান, ওর প্রতিরক্ষা ভেদ করতে পারল না মেজর। অথচ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকটা। কিন্তু আক্রমণে না গিয়ে কেবল আত্মরক্ষা করছে বলে মেজরের মনে হলো কাবু হয়ে গেছে লোকটা, তার আক্রমণের জবাব দেয়ার ক্ষমতা নেই।
আরও দ্রুত, মেজর। আরও জোরে হাত চালান, প্লীজ। আপনাকে ঠেকাতে আমার তো কিছুই করতে হচ্ছে না।
টিটকারী দেয়া হচ্ছে মনে করে তুমুল আক্রমণ করল মেজর, কিন্তু কিছুতেই দো বাখনির প্রতিরক্ষা ভেদ করতে পারল না। লোকটার প্রতিটা অঙ্গভঙ্গি যেমন সাবলীল, তেমনি দ্রুত। কিছুতেই তাকে কাবু করতে না পেরে আধঘন্টা পর তলোয়ার নামাল মেজর। ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠেছে। ভুরুর ওপর থেকে ঘাম ঝরিয়ে দো বাখনির দিকে তাকাল সে। ব্যাপার কি! লোকটা মানুষ না পিশাচ? এতো লাফ ঝাঁপ হলো, ঘাম তো নেই-ই, স্বাভাবিক শ্বাস পড়ছে ব্যাটার!
হাসল মশিয়ে দো বাখনি। বুঝতে পারছেন, ব্যায়াম আপনার জন্যে কতখানি দরকার? ঠিকই বলেছিলাম আমি। আমার চেয়েও খারাপ অবস্থা আপনার। অনভ্যাস আপনাকে একেবারে ঢিলে করে দিয়েছে।
কথাটা মেনে নিল মেজর বিমর্ষচিত্তে। কারণ, জানে, কথাটা সত্যি। টের পেয়েছে, যখন প্র্যাকটিস ছিল তখনও এই লোকটার প্রতিরক্ষা ভেদ করা তার পক্ষে সম্ভব হত না। টের পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেছে তার।
মেজর দম ফিরে পেতেই আবার শুরু করল ওরা। এবার দো বাখনির রণকৌশল সম্পূর্ণ বদলে গেছে। মেজরের আক্রমণের প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করেছে এখন দো বাখনি। লাফিয়ে সরে যেতে হচ্ছে মেজরকে আঘাত থেকে বাঁচার জন্যে।
হেসে উঠল দো বাখনি। পালিয়ে বাঁচবেন কি করে? কাছে আসুন, মেজর। কনুইটা শরীরের কাছাকাছি রাখুন। আক্রমণে গেল ফ্রেঞ্চম্যান। মেজরের চেষ্টা বিফল করে দিয়ে ওর তলোয়ার স্পর্শ করল তার পাকস্থলী।
একই সাবলীল ভঙ্গিতে পরপর কয়েকবার স্পর্শ করল দো বাখনি মেজরকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। মেজরকে হতবুদ্ধি করে দিয়ে ওর বুক স্পর্শ করল দো বাখনির তলোয়ার।
ব্যস! বলল সে। কিছুটা দ্রুত হয়েছে দো বাখনির শ্বাস-প্রশ্বাস। একদিনের জন্যে যথেষ্ট, কি বলেন? আমার শরীরে জং ধরে গেছে, তবে যতটা ভেবেছিলাম ততটা নয়। কিন্তু যতটা প্রয়োজন পড়তে পারে তার ধারে কাছেও না। কাল আবার আমরা লড়ব, কেমন? আমাদের দুজনেরই প্র্যাকটিস দরকার। বিশেষ করে আপনার অবস্থা যা দেখলাম, সাধারণ একজন যোদ্ধার সঙ্গেও পারবেন না।
জবাব না দিয়ে বালির ওপর বসে পড়ল মেজর, হাঁপাচ্ছে। কিছুই তার বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু চাপা রাগে কাঁপছে তার বুকের ভিতরটা। বাকি কাপড় যা ছিল সৈকতে খুলে রেখে সাগরে ঝাঁপ দিল দো বাখনি। বেশ অনেকটা জায়গা সাঁতার কেটে ফিরে এল তীরে।
দুপুরে তাবুতে ফিরল ওরা খাওয়ার জন্যে। তেমন কোনও কথাবার্তা হলো না, দো বাখনির ব্যবহারে মাতব্বরির আভাস নেই, কাউকে ছোট করার চেষ্টা নেই, তারপরেও বুকের ভিতরটা পুড়তে থাকল মেজরের। নিজেকে মস্ত এক তলোয়ার-যোদ্ধা মনে করত সে এতদিন, এখন দেখতে পেল এতদিন যা শিখেছে সে-বিদ্যা দো বাখনির ক্ষিপ্রতা ও কৌশলের কাছে কিছুই নয়। কিন্তু ঠিক সেজন্যেই যে ওর এতটা খারাপ লাগছে তা নয়। ওর মনে হচ্ছে, নিজের পারদর্শিতার প্রমাণ দিয়ে লোকটা ওকে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছে, ভদ্র আচরণ না করলে কি ঘটবে তার কপালে। ফলে ওর বিরুদ্ধে চোর, ডাকাত, গুণ্ডা, খুনে, দস্যুর চেয়েও খারাপ খারাপ শব্দ উচ্চারণ করতে থাকল সে মনে মনে।
কিন্তু পরপর তিনদিন যখন তলোয়ার চর্চার জন্যে ডাকল তাকে মশিয়ে দো বাখনি, ভাল খেললে প্রশংসা করল, আক্রমণের গতি কমে গেলে সমালোচনা করল, তখন সে বুঝতে পারল সত্যিই সামনে বিপদ আশঙ্কা করছে লোকটা, এবং কেবল নিজেরই নয়, তার পারদর্শিতারও উন্নতি চায়। ফলে দো বাখনির কাছ থেকে কিছু কিছু কৌশল রপ্ত করে নিতে আর আত্মসম্মানে বাধল না তার। অবশ্য এর ফলে তার প্রতি বিরূপ মনোভাব কমল না একরত্তিও।
মশিয়ে দো বাখনির সঙ্গে প্রিসিলার বন্ধুত্বপূর্ণ মাখামাখিটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না মেজর। যে মেয়েটি আজ বাদে কাল তার স্ত্রী হতে চলেছে, সে যে কেন এই ফরাসী দস্যুটাকে ঘৃণা করতে পারছে না তা কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছে না। না, ঈর্ষা নয়। প্রিসিলা এবং দো বাখনির মত একজন বাজে লোকের সামাজিক অবস্থানে এতই দূরত্ব যে মেজর জানে ওদের দুজনের মধ্যে কোন স্থায়ী সম্পর্ক হতেই পারে না। ঈর্ষা নয়, বিরক্তি বোধ করে মেজর দো বাখনির প্রতি প্রিসিলার নরম আচরণে।
গভীর ঘুমের কারণে টের পায় না, কিন্তু মেজর যদি জানত ইদানীং প্রায় প্রত্যেক রাতেই ভারী কম্বলের পর্দা তুলে তার রক্ষাকর্তার সঙ্গে বসে গল্প করে প্রিসিলা, তাহলে কি ঘটত বলা যায় না। গল্পের বিষয়বস্তু শুনলে অবশ্য পাথর নেমে যেত ওর বুকের ওপর থেকে। কারণ, একটি আপত্তিকর শব্দও উচ্চারিত হয় না কোনও তরফ থেকেই। বেশির ভাগ কথা হয় দিনের ছোটখাট ঘটনা নিয়ে।
চোদ্দ দিনের মাথায় অবশ্য বেশ বড়সড় ঘটনাই ঘটে গেল মালদিতায়। পাশা খেলতে গিয়ে ছুরি মেরে বসল একজন আরেকজনকে। এই নিয়ে দুই দলে ভাগ হয়ে রীতিমত যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়ে গেল ওদের মধ্যে।
লীচ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা প্রথমে কিলঘুসি মেরে দাঙ্গা থামাবার চেষ্টা করল। উভয়পক্ষের ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হলে বিচার করে খুনীর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারত লীচ, কিন্তু সরাসরি মানা করে দিল সে, কারও কোন কথা সে শুনবে না। না। এখন নিজেদের মধ্যে এসব ঝগড়া-ফ্যাসাদ আমি বরদাস্ত করব না। তোমাদের গোস্যা আর ছুরি দুটোই এখন স্প্যানিয়ার্ডদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে জমা করে রাখো। এ নিয়ে এখন আর কোন কথা শুনতে চাই না আমি।
আসলে যে-কোন একপক্ষে রায় দিলে অপরপক্ষের কাছে সে অপ্রিয় হয়ে যাবে, এই ভয়ে বিচার এড়াতে চেয়েছে সে। কিন্তু বেপরোয়া খুনীর দল তা মানতে চাইবে কেন? হৈ-হল্লা বেধে গেল। কখন কোন ফাঁকে ওদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে দো বাখনি টের পায়নি লীচ। দেখল সবাইকে ঠেলে এগিয়ে এসে দাঁড়াল সে। ওর বক্তব্য শোনার জন্যে থেমে গেল গোলমাল।
এড়িয়ে যাচ্ছ কেন, খুব সহজেই তো এর একটা মীমাংসা করে দিতে পার, টম।
তাই নাকি! কিভাবে শুনি? মোটেও খুশি হতে পারেনি সে দো বাখনিকে উপযাচক হয়ে কথা বলতে দেখে।
এর একমাত্র উপযুক্ত বিচারক হতে পারে যারা ঝগড়া ও খুনটা নিজ চোখে দেখেছে।
তারস্বরে চেঁচিয়ে সবাই সমর্থন জানাল ওকে। চিৎকার থামলে আবার বলল ও, এখানেই আছে ওরা, অন্তত এককুড়ি লোক হবে। আর কেউ এর মধ্যে নাক গলাতে পারবে না। ওদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে দাও খুনীকে ফাঁসীতে লটকাবে, না কি বেকসুর খালাস দেবে। বাকি সবাইকে জিজ্ঞেস করো বিচারকদের রায় বিনাবাক্যে মেনে নেবে কিনা। তাহলেই তো হয়ে যায়।
কথাটা লীচের বেশ পছন্দ হলো। এইভাবে নিজে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থেকে বাঁচা সম্ভব। সবাই একবাক্যে জানাল বেশিরভাগ বিচারক যা বলবে, বিনা ওজর আপত্তিতে তা মেনে নেবে।
খুনীর বিরুদ্ধে হাত উঠল বেশি। সঙ্গে সঙ্গে ধরে নিয়ে গিয়ে একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়া হলো তাকে। ব্যস, মামলা খতম, শান্তি ফিরে এল জলদস্যুদের ক্যাম্পে।
গল্পটা শুনে অবাক হয়ে গেল প্রিসিলা। খুনীর পক্ষের লোকেরা এত সহজে ঠাণ্ডা হয়ে গেল?
আসলে জীবন ওদের কাছে খুবই সস্তা। ওর জীবন রক্ষার জন্যে ওরা অস্ত্র ধরতে যাচ্ছিল না। দ্বন্দ্বটা ছিল নিয়ম-নীতির। ভোটাভুটি সবাই বোঝে। সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় মেনে নিতে বাধ্য ওরা, যেহেতু কথা দিয়েছে।
এর পর প্রিসিলার প্রশ্নের জবাবে আইন অমান্যকারী একজন দস্য কেন চুক্তি, শর্ত বা নেহায়েত কথা রাখার জন্য প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে রাজি থাকে সেটা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হয়েছে দো বাখনিকে। নিজের জীবনের নানান ঘটনা এসে পড়েছে কথায় কথায়। মেয়েটির আন্তরিক আগ্রহ টের পেয়ে সে-ও থামতে পারেনি, গড়গড় করে বলে গেছে নিজের বিচিত্র জীবনের অনেক অনেক ঘটনা।
একরাতে, যতদূর সম্ভব মালদিতার সপ্তদশ রাত সেটা, সরাসরি প্রশ্ন করল মেয়েটা ওর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে। এই ভয়ঙ্কর যাযাবর জীবনেই কি থেকে যাবে ও চিরকাল?
আর না! ধরে নিতে পারেন এ-পাট আমি চুকিয়েই দিয়েছি। এখন যে কাজটা হাতে নিয়েছি, এটাই আমার শেষ কাজ। দেশের স্মৃতি টানছে আমাকে। মরগানকেও বলেছি, ফিরে যাব। এখন সাগর ছেড়ে, এমন কি আমার পেশা, ধর্ম সব ছেড়ে, মধুর স্বপ্ন আর স্মৃতি দিয়ে ঘেরা আমার শৈশব-কৈশোরের মাটিতে জলপাই-আঙুরের বাগানে ফিরে যেতে চাই আমি, তুলনের মিষ্টি উচ্চারণ কানে শুনে ধন্য হতে চাই। কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা খুঁজে এল মশিয়ে দো বাখনির।
বুঝতে পারছি, বলল প্রিসিলা নরম গলায়। কিন্তু পেশা-ধর্ম পাল্টাতেও রাজি … দেশের টান খুবই প্রবল মনে হচ্ছে!
একটু চুপ করে থেকে কথাটা নিজের মনে নাড়াচাড়া করে দেখল দো বাখনি, তারপর চাপা কণ্ঠে হেসে উঠল।
শুনতে লাগছে যেন উলঙ্গ এক লোক তার কোট পাল্টাতে চায়। পিছনে যে-সব কীর্তি রেখে এসেছি, যেন ইচ্ছে করলেই মুছে ফেলতে পারি। পারি না বলেই বোধহয় ইচ্ছেটা এত প্রবল ভাবে নাড়া দেয় মনে।
এই প্রথম টের পেল প্রিসিলা, অতীতকে মুছে ফেলার ইচ্ছে রয়েছে মানুষটার অন্তরে। এতদিন মনে হতো, জলদস্যুতাকে খারাপ চোখে দেখে তো না-ই, বরং এজন্যে লজ্জার পরিবর্তে গর্ব অনুভব করে লোকটা।
আপনি এখনও তরুণ, অনেকটা আপন মনেই বলল ও। নতুন করে গড়ার সময় পেরিয়ে যায়নি।
কিন্তু কোন্ মালমশলা দিয়ে গড়ব আমি নতুন জীবন? এ পর্যন্ত কী সঞ্চয় আমার? সবাই তো অতীত থেকে মালমশলা নিয়েই গড়ে তাদের ভবিষ্যৎ– কী আমার অতীত?
কথাটা পুরোপুরি সত্য বলে মেনে নেয়া যায় না। ভাল পথে এগোতে চাইলে চলার পথেই পাওয়া যায় প্রয়োজনীয় সবকিছু। নিজেকে গুছিয়ে নিতে সেসবই হয়তো আপনার জন্যে যথেষ্ট হবে। ধরুন বিয়ে করে একটা পরিবার
বিয়ে? আমি?
কেন নয়?
কৈশোর আর তারুণ্যে আমার মধ্যে যেটুকু কোমলতা ছিল, যেটুকু সৌন্দর্যবোধ আর প্রাণচাঞ্চল্য ছিল, আপনার কি মনে হয় তার সবটা খুইয়ে বসেছি এই বন্য জীবন যাপন করে? হারিয়ে ফেলেছি নিজের বাস্তব অবস্থান জ্ঞানও?
বরং উল্টোটাই মনে হয়।
কি করে বুঝছেন সেটা?
অন্তর থেকে বুঝতে পারছি। আপনাকে জানি আমি। এই কয়েক সপ্তাহে কিছুটা তো নিশ্চয়ই চিনেছি আপনাকে। কিন্তু আমার প্রশ্নের সঙ্গে এই উত্তরের কি সম্পর্ক?
এই। আমার সন্তানদের মা আমি পাব কোথায়?
বুঝলাম না আপনার কথা। যাকে পছন্দ হয় তাকেই তো বিয়ে করতে পারবেন আপনি।
পারব না। আপনার ভুলটা এখানেই। আমার ভাগ্য লেখা হয়ে গেছে। আমার অতীত সেটা লিখে ফেলেছে স্পষ্টাক্ষরে। আমি তো আর। মিথ্যে পরিচয় দিয়ে কারও কাছে প্রেম নিবেদন করতে পারব না। আমার গায়ে ছাপ আছে; আমি খুন করেছি, ডাকাতি করেছি, উচ্চারণ করা যায় না এমন সব কাজ করেছি। এসব করে প্রচুর টাকাও করেছি। জামাইকায় এবং আরও অনেক জায়গায় জমিজমা আছে আমার, খেত খামার আছে। টাকার অভাব নেই। কিন্তু নীতিহীন, হৃদয়হীন, বিবেকহীন না হলে কি কোনও নারীর পক্ষে আমার রোজগারের টাকা স্পর্শ করা সম্ভব? যদি কারও পক্ষে সম্ভব হয়, আমিই কি আমার সন্তানের মা হিসেবে তাকে পছন্দ করতে পারব? আমি খারাপ হয়ে গেছি, কিন্তু অতটা তো এখনও হইনি। আমি বুঝে গেছি, যেমন মেয়ে আমার পছন্দ, তাদের কাছে প্রেম নিবেদন করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। সামান্য হলেও এখনও কিছুটা সততা আছে আমার মধ্যে। এটুকু নষ্ট হয়ে গেলে আর কোনও অবলম্বন, বা আত্মসম্মান বলতে কিছু থাকবে না আমার। না, প্রিসিলা, স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের স্বপ্ন আমি দেখি না।
সদা হাসিখুশি মানুষটা এতই গম্ভীর হতাশা, এতই অতল বিষাদের সঙ্গে বলল কথাগুলো যে বুকের ভিতরটা কেমন যেন নড়ে উঠল প্রিসিলার। পরিস্থিতির শিকার, দুখী লোকটার জন্যে পুড়ছে ওর অন্তর। একেবারে নীরব হয়ে গেল মেয়েটা। চুপচাপ কাটল কিছুক্ষণ, তারপর টুপ করে একফোঁটা জল পড়ল দো বাখনির হাঁটুর উপর রাখা বাম হাতের ওপর।
চমকে উঠল দো বাখনি। ঝট করে চাইল মেয়েটার মুখের দিকে। প্রিসিলা! আপনি কাঁদছেন? গলাটা কেঁপে গেল দো বাখনির।
উঠে পড়ল প্রিসিলা। চলি, বলেই তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিল ও। হারিয়ে গেল ভারী পর্দার আড়ালে।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মৃদু কণ্ঠে বলল দো বাখনি, ধন্যবাদ আপনাকে। একজন বেপথু লোকের কবরে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছেন বলে। চুমু খেল ও সেই ফোঁটার উপর।
অনেক, অনেকক্ষণ পর তারার মোলায়েম আলোয় ভর দিয়ে ঘুম নেমে এল দুধর্ষ ফরাসী দস্যুর চোখে। সকালে উঠে অনুভব করল, মনের গ্লানি অনেকটা ধুয়ে মুছে গেছে সহানুভূতিশীল এক রমণীর চোখের জলে।
.
১৪.
টম লীচের প্রেম
একদিন সকালে নাস্তা খেতে বসে দো বাখনির কাছে নালিশ করল প্রিসিলা, গত দু-তিনদিন যাবৎ নাস্তা তৈরির সময় পিয়েখকে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় যে যায়, কি করে, কোনও সদুত্তর দিতে পারে না।
হয়তো মিষ্টি আলু খুঁজতে যায়, সহজ গলায় বলল দো বাখনি।
তাই যদি হয়, তাহলে ফিরে যখন আসে, একটা আলুও তো দেখি না তার হাতে!
মনে হয় কাছে পিঠে পাওয়া যাচ্ছে না আর ওগুলো। ঠিক আছে, আমি বকে দেব ওকে।
এই উত্তরে সন্তুষ্ট হলো না প্রিসিলা, বরং দো-আঁশলা লোকটার কর্তব্যে অবহেলার ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব না দেয়ায় রেগেই গেল দো বাখনির ওপর।
খানিক পরেই মেজরকে নিয়ে জঙ্গলে চলে গেল দো বাখনি তাদের গোপন তলোয়ার-চর্চায়।
ঠিক সেই সময়েই পায়চারি করছিল ক্যাপটেন লীচ বেলাভূমিতে। কাজ শেষ হচ্ছে না বলে ছটফট করছে লোকটা। জাহাজের তলায় আলকাতরা লাগানো মাত্র শেষ হয়েছে, গ্রীজ লাগানো এখনও বাকি। চার-পাঁচ দিনের আগে আর পানিতে নামানো যাচ্ছে না ব্ল্যাক সোয়ানকে।
হঠাৎ চোখে পড়ল ওর, একটা তাঁবু থেকে বেরিয়ে দুজন লোক জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। আগেও একদিন দেখেছে সে ওদের জঙ্গলে গিয়ে ঢুকতে। থমকে দাঁড়িয়ে চিন্তা করল সে কোথায় যায় ওরা সাত সকালে? একটু পরেই আরও অবাক হয়ে দেখল সে, সবুজ পোশাক পরা প্রিসিলা হ্যারাডিন বেরিয়ে আসছে কেবিন থেকে। কী অপূর্ব চেহারা, কী গড়ন, আর কী তার চলার ভঙ্গি! মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল লীচ মেয়েটার দিকে। ডানদিকে ঘুরে গেল প্রিসিলা। আরে! এদিকে কোথায় যায়? ওর ভাই আর স্বামী যেদিকে গেল সেদিকে না; এ চলেছে আর কোথাও যেন বিশেষ কাজ আছে এমনি ভঙ্গিতে। উঁচু পাড় ধরে বেশ কিছুদূর এগিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেল মেয়েটা।
মেয়েটা কোথায় যায় দেখা দরকার তো, ভাবল লীচ। চার অনুচর ওকে বাধা দেয়ার পর থেকে হৃদয়টা পুড়ছে ওর। যত দিন যাচ্ছে ততই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে সে। কবে স্প্যানিশ ফ্লীট লুঠ হবে, আর কবে ওর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা দূর হবে! অপেক্ষা করতে করতে আর ধৈর্যে কুলাচ্ছে না ওর। ছটফট করছে মনটা। হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে হয় দৌড়ে চলে যায় দূরের ওই কেবিনটায়।
সংযম তার চরিত্রে নেই। চিরকাল সে যখন যা খুশি করেছে, যা মনে ধরেছে তাই নিয়েছে– প্রয়োজনে জোর খাটিয়েছে, খুনোখুনি করে দখল করে নিয়েছে। নিয়ম, শাসন, শৃঙ্খলার ধার কোনদিন ধরেনি। হাতের মুঠোয় যা আছে সেটা তক্ষুণি ভোগ না করে বড় লাভের আশায় ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রাখা, অপেক্ষা করা– এসব ওর জন্যে নরক যন্ত্রণা। গায়ে-গতরে যতই বড় হয়ে উঠুক, ভাবাবেগের দিক থেকে ও রয়ে গেছে ঠিক বারো বছরের একটা বখে যাওয়া, বেপরোয়া, অসংযমী কিশোরের সমান।
কাজেই হঠাৎ করে মেয়েটার পিছু নেয়ার সিদ্ধান্তটাকে কেবলই কৌতূহল বলা যাবে না, সন্দেহ নেই, অনিয়ন্ত্রিত প্রবৃত্তির তাড়নাও ইন্ধন যুগিয়েছে ওকে।
লম্বা পা ফেলে কোনাকুনি এগোল সে বালির উপর দিয়ে। যে পাম গাছগুলোর পাশ দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে অদৃশ্য হয়েছে প্রিসিলা, ঠিক সেই জায়গায় এসে থামল সে। তারপর শিকারী হাউন্ডের মতই ওর ট্রেইল ধরে এগিয়ে উঁচু জমিতে উঠে এল। এখানে শক্ত মাটিতে পৌঁছে হারিয়ে গেছে পায়ের ছাপ। কোথাও কোনও চিহ্ন নেই মেয়েটার। চারপাশে চেয়ে একটা দিকে মনে হলো পায়ের দাগের সামান্য আভাস পাওয়া যায়, সেইদিকেই এগোল লীচ। কিন্তু পাহাড়ের কিনারায় এসে দেখল ভুল পথে এসেছে। খাড়া নেমে গেছে খাদ, এদিকে আসেনি ও। চারদিকে তাকিয়ে টলটলে পানির একটা পুকুর দেখতে পেল ও, পানিটা এতই পরিষ্কার যে এতদূর থেকেও দেখতে পেল সে, গভীর পানিতে সাঁতার কাটছে কয়েকটা বড়সড় মাছ।
ওদিক থেকে ফিরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগোল সে। কিছুদূর এগিয়ে একটা ঢালু মত জায়গায় আবার ঘাস মাড়ানোর চিহ্ন দেখতে পেল। সেই পথে বেশ কিছুটা নেমে আসতেই ঝপাং করে পানিতে ঝাঁপ দেয়ার আওয়াজ এলো কানে। কোমর থেকে বাঁকা হয়ে সামনে ঝুঁকে এগোল সে কয়েক পা, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে চলল। পানিতে ঢেউ দেখে বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা– মেয়েটা নাইতে নেমেছে। আর একটু এগিয়েই দেখতে পেল সে সাঁতার কাটছে দুধ-সাদা রঙের এক জলপরী। ঝোপের আড়ালে লুকাল লীচ যাতে চোখে পড়ে না যায়। আড়াল থেকে যা দেখল, ওর মনে হলো জীবনে দ্বিতীয়বার আর এ-দৃশ্য দেখতে পাবে না কোনদিন।
মেয়েটি ওপার থেকে সাঁতার কেটে ফিরে ক্যানোপি ঝোপের আড়াল হতেই উঠে দাঁড়াল লীচ। হাসি গিয়ে ঠেকেছে দুই কানে। এত দিনে এসেছে সুযোগ!
এই মুহূর্তে ভুলে গেল সে দো বাখনি, স্প্যানিশ ফ্লীট, ওর সহচর আর অনুচরদের কথা। প্লেট ফ্লীট হাতছাড়া হয়ে গেলে সে কি জবাবদিহি করবে নিজের লোকেদের কাছে, সে-চিন্তা ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে গেছে কোথায়! এখন ওর একমাত্র চিন্তা: পাহাড় বেয়ে সড়সড় করে নেমে যাবে, না কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে জঙ্গলের আড়ালে? ওর মনে হলো, ওকে উঠে তো আসতে হবেই, কাজেই ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে আপাতত লুকিয়ে থাকাই ভাল।
মেয়েটা যখন উঠে এল, তখন রীতিমত হাঁপাচ্ছে লীচ; ধুড়প ধাড়প লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা, ঘেমে নেয়ে উঠেছে। কিন্তু কেবিনের দিকে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে কি দেখছে ও বামে তাকিয়ে? কয়েক পা এগিয়েই আবার থামল মেয়েটা। ওর পরিষ্কার সুরেলা গলা শুনতে পেল লীচ।
তুমি হঠাৎ এদিকে কোত্থেকে, পিয়েখ?
রাগের ঠেলায় দো-আঁশলা ব্যাটার উত্তরটা শুনতেই পেল না লীচ। শুধু দেখল, ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে মেয়েটার পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করল পিয়েখ।
ঠিক হিংস্র জানোয়ারের মত একটা চাপা গর্জন ছাড়ল টম লীচ। তারপর নিঃশব্দে অনুসরণ করল ওদের। ক্ষোভে তিক্ত হয়ে গেছে ওর মন, নিরস্ত্র সে। সঙ্গে অস্ত্র থাকলে এক কথা ছিল, কিন্তু পেশীবহুল, দীর্ঘদেহী এই লোকটার ওপর খালিহাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে খুব একটা সুবিধে হবে না, তা ও পরিষ্কার বুঝতে পারছে।
অতএব, কিছুদূর এগিয়ে যেতে দিল সে ওদের, তারপর অনুসরণ করল। ঝট করে ঘাড় কাত করে পিছনে তাকাল একবার পিয়েখ, তারপর চাপা গলায় কিছু বলল প্রিসিলাকে। চলার গতি পরিবর্তন হলো না, যেমন হাঁটছিল তেমনি হাঁটতে থাকল ওরা কেবিনের দিকে। অন্তরে নরক বয়ে নিয়ে পিছন পিছন চলল লীচ।
কেবিনে ঢুকে গেল প্রিসিলা, কয়েক কদম দূরে থেমে নিজের তাঁবুতে ঢুকল পিয়েখ, পরমুহূর্তে একটা খালি বালতি হাতে বেরিয়ে রওনা হয়ে গেল পানি ভরে আনবে বলে।
নতুন আশায় উজ্জীবিত হয়ে উঠল ক্যাপটেন লীচ। ভাগ্যদেবী তাহলে একেবারে ত্যাগ করেনি তাকে!
পিয়েখকে কিছুদূর যাওয়ার সুযোগ দিয়ে সোজা গিয়ে দাঁড়াল সে কেবিনের পর্দা তোলা খোলা দরজায়।
একহাতে চিরুনি, অপর হাতে আয়না– চুল আঁচড়াচ্ছে প্রিসিলা। ক্যাপটেন লীচ কেবিনে ঢুকতেই চমকে তাকাল তার দিকে। দুচোখে রাজ্যের উদ্বেগ।
সবকটা ঝকঝকে দাঁত বের করে মাথা থেকে টুপি খুলল সে।
ঈশ্বর আপনাকে রক্ষা করুন, বলল লীচ প্রিসিলার উদ্দেশে।
প্রিসিলা কোনও উত্তর দেয়ার আগেই বাইরে একটু দূর থেকে মশিয়ে দো বাখনির হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল। স্বস্তির চিহ্ন ফুটল প্রিসিলার মুখে, আর একটু যেন থতমত খেয়ে গেল ক্যাপটেন লীচ। কেবিনে এসে ঢুকল মশিয়ে দো বাখনি, সঙ্গে মেজর স্যান্ডস।
সহজ, আন্তরিক কণ্ঠে অভ্যর্থনা জানাল সে ক্যাপটেনকে, আরে, টম! কি খবর? আমাকে খুঁজছ বুঝি?
তোমাকে খুঁজব…? বাজে কিছু বলে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল লীচ, নিচু গলায় বলল, হ্যাঁ।
কি ব্যাপারে?
না। এই, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই। বেশ কদিন হয়ে গেল তোমাকে দেখিনি আমাদের ওদিকে। কথা বলার একটা লাইন পেয়ে যাওয়ায় এবার গড়গড় করে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করল সে, যতটা চাইছে কাজের ততটা অগ্রগতি হচ্ছে না বলে। এখনও অন্তত চারদিনের কাজ বাকি আছে, পাঁচদিনও লাগতে পারে। জানতে চাইল, হাতে সত্যিই সময় আছে তো?
ওকে আশ্বস্ত করল দো বাখনি। ওদের রওনা হওয়ার তারিখ আসলে তেসরা জুলাই। তার আগে পাল তোলার তো প্রশ্নই ওঠে না, বরং দু-চারদিন দেরি হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। ওটাকে যেখানে আক্রমণ করবে বলে স্থির করেছে, সেখানে পৌঁছতে চব্বিশ ঘণ্টাও লাগবে না লীচের। আগে রওনা হয়ে গেলে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই।
চলে গেল লীচ। ওর গমনপথের দিকে চেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল দো বাখনি। গম্ভীর মুখে ভাবছে কিছু। লীচের ব্যবহারে অদ্ভুত, অস্বস্তিকর, অশুভ কি যেন টের পেয়েছে সে। হঠাৎ প্রিসিলার দিকে ফিরল সে, আমরা আসার আগে কি নিয়ে কথা বলছিল ও?
মাত্র শুরু করতে যাচ্ছিল, ঠিক এমনি সময়ে এসে পড়েছেন আপনারা। ইশশ, কী যে ভয় পেয়েছিলাম! বলেই হেসে উঠল। লীচ বিদায় নেয়ায় হালকা হয়ে গেছে ওর মনটা। একটু থেমে বলল, পিয়েখকে জিজেস করেছিলাম সকালে নাস্তা তৈরির সময় পাওয়া যায় না কেন ওকে। আঁই-ই করে, জবাব দেয় না।
ফিরেছে? জিজ্ঞেস করল দো বাখনি, কোথায় ও এখন?
বলল তো পানি আনতে যাচ্ছে। এখুনি ফিরে আসবে।
পানি আনতে? হঠাৎ ঝিলিক দেয়া আগ্রহটা নিভে গেল দো বাখনির চোখ থেকে। একটু যেন হতাশ। ও, বলে বেরিয়ে গেল তাঁবু থেকে।
কিছুই চোখ এড়াল না প্রিসিলার। কি যেন আছে এর মধ্যে। কিন্তু ঠিক কী তা বুঝতে পারল না। পিয়েখের তাঁবুতে গিয়ে ঢুকেছে দো বাখনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভরা বালতি কাঁধে নিয়ে ফিরে এল পিয়েখ।
প্রিসিলা দেখতে পেল, দ্রুতপায়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে ওর সামনে দাঁড়াল দো বাখনি, চোখে-মুখে উল্কণ্ঠা। জিজ্ঞেস করল, কিছু দেখলে?
বালতিটা মাটিতে নামিয়ে রেখে পিয়েখ বলল, এখনও কিছু না, মশিয়ে।
আহ্! আস্তে! বলেই গলা একেবারে খাদে নামিয়ে ফেলল দো বাখনি। বেশ কিছুক্ষণ আর কিছুই শোনা গেল না। প্রিসিলার একবার মনে হলো, নাস্তা তৈরির সময় ফাঁকি মারছে বলে বোধহয় বকা দিচ্ছে ওকে মশিয়ে দো বাখনি, আবার হাবেভাবে ঠিক তা মনেও হচ্ছে না। হয়তো অন্য কোন প্রসঙ্গে আলাপ করছে ওরা। তারপর আবার ওর গলা শুনতে পেল প্রিসিলা। এখনও হাতে আছে পাঁচদিন। লীবে ধারণা তার আগে সম্ভব নয়। আবহাওয়াও ভাল।
একটু বেশিই ভাল মনে হচ্ছে, মশিয়ে।
আবার কিছুক্ষণ একেবারে খাদে চলে গেল ওদের গলা, তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল দো বাখমি, ধীর পায়ে এসে ঢুকল কৈবিনে, চিন্তিত।
মশিয়ে দো বাখনি যদি ওকে কাজে ফাঁকি দেয়ার জন্যে বকা দিয়েও থাকে, দেখা গেল কোন ফল হয়নি তাতে। পরদিন সকালে পোশাক পরে দরজার ভারী পর্দাটা সরিয়ে পিয়েখকে ডেকে যথারীতি পাওয়া গেল না। বদলে ওর তাবু থেকে বেরিয়ে এল দো বাখনি।
মশিয়ে দো বাখনি, বলল প্রিসিলা। আজকেও গায়েব!
মৃদু হেসে বলল দো বাখনি, ওকে একটা কাজে পাঠিয়েছি, প্রিসিলা। তবে ওর বদলে আমি সাহায্য করব আজ।
কাজে পাঠিয়েছেন? এই দ্বীপে ওর আবার কি কাজ?
খোদা! কৌতূহল কাকে বলে! হাসল সে। কাজে পাঠিয়েছি, এর বেশি যে আর বলতে পারছি না। আসুন, চট করে নাস্তা বানিয়ে ফেলি ওই ক্ষুধার্ত নেকড়ে মেজরটা ঘুম থেকে উঠে হুঙ্কার ছাড়ার আগেই।
.
তক্কেতক্কে ছিল টম লীচ, দূর থেকে খেয়াল রাখল কখন মেজর স্যান্ডসকে নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢেকে দো বাখনি। ও জানে, ইদানীং রোজই ওরা কিজন্যে যেন জঙ্গলে যায়, ফেরে ঘণ্টা দুয়েক পর। কেন যায়, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি সে। এই দ্বীপের বাইরে তো আর যায় না কোথাও, যাক না যেখানে খুশি।
কিছুই আর এসে যায় না এখন টম লীচের। গতকাল স্নানরত প্রিসিলাকে দেখার পর থেকে একেবারে অন্ধ হয়ে গেছে সে। কোনও যুক্তির ধার আর সে ধারবে না। গতকাল বিফল হয়ে মাথার ভিতর আগুন জ্বলছে তার। সারারাত বিছানায় এপাশ ওপাশ ফিরেছে কেবল, ঘুমাতে পারেনি।
কবি কনগ্রিভ বলেছেন: জলাশয়ে নারীর প্রতিচ্ছবি বড়ই মনোরম, যে ঝাঁপ দিলে সে মরলে ডুবে।
কথাটা লীচের জানা নেই। ওর মনে হচ্ছে বাঁচার একমাত্র পথ এখন যেমন করে হোক ওকে দখল করা। কিছুই সে কেয়ার করবে না, এমন কি এই মুহূর্তে স্প্যানিশ গোল্ডও ওর কাছে মূল্যহীন। মেয়েটাকে পেতে হলে দো বাখনিকে খুন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই ওর।
বার্থোলোমিউ স্যান্ডসকে কখনোই গণনার মধ্যে ধরে না সে। দো বাখনিকেও ধরে না, তবে ওর কাছে স্প্যানিশ ফ্লীটের খবর আছে বলেই এতদিন সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে। দলের লোকের সঙ্গে এ নিয়ে বাক্ বিতণ্ডা হবে, কোনও সন্দেহ নেই; কিন্তু ও যদি কারণ দেখায় দো বাখনিই ওকে আক্রমণ করেছিল, আত্মরক্ষার জন্যে ওকে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছে, তাহলে কারও কিছু বলার থাকবে না। মুচকি হাসল সে, ব্যাপারটা সম্ভবত তাই ঘটবে।
অবশ্য ওর নিজের সোনার ভাগটাও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তা যাক, বদলে আরও অনেক বড় ঐশ্বর্য পেতে চলেছে সে। একটু ধৈর্য ধরলে যে দুটো সম্পদই ওর হাতের মুঠোয় চলে আসতে পারত, উওগানের সে-আশ্বাস এ-মুহূর্তে কোনও ছাপই ফেলছে না ওর মনে। ধৈর্য ধরে সুযোগের অপেক্ষা করা ওর কাছে মনে হয় ভীরুতারই নামান্তর।
অতএব, মশিয়ে দো বাখনি ও মেজর অদৃশ্য হওয়ার পরমুহূর্তেই দৃঢ় পদক্ষেপে এগোল সে প্রিসিলার কেবিনের দিকে।
লীচের বাঁকা হাসি আর চোখের চাহনি দেখেই চমকে সোজা হয়ে বসল প্রিসিলা।
আমার স্বামীকে খুঁজছেন, স্যার? উনি এখন নেই।
হাসিটা চওড়া হলো আরও। আমি জানি নেই। ওকে যেতে দেখেছি আমি। কাজেই বুঝতেই পারছেন, ওকে খুঁজছি না।
কথাটা বলে থামল লীচ, চেয়ে রইল ওর দিকে। কারও কাছে প্রেম নিবেদন করতে হলে কি বলতে হয় জানা নেই ওর। যা চায় তা চিরকাল জোর করে ছিনিয়ে নিতেই সে অভ্যস্ত, কিন্তু ওর মন বলছে এখানে অন্য কিছু দরকার, জোর খাটাতে গেলে ভেঙে যাবে। ভদ্র সমাজে ওরা কিভাবে যে বলে কথাগুলো যদি জানা থাকত!
হঠাৎ মনে পড়ল একটা কথা। লাল জামাটার ভিতরের পকেট থেকে বের করে আনল ছোট্ট একটা চামড়ার ব্যাগ। ওটার গলার বাঁধন খুলে এগিয়ে এল সে টেবিলের ধারে।
তোমার জন্যে দেখো কি উপহার এনেছি, বলেই ব্যাগ থেকে হাতে ঢেলে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিল ও দশ-বারোটা বড় আকারের দামী মুক্তা। দারুণ সুন্দর, না? চকচকে চোখে চাইল প্রিসিলার মুখের দিকে।
ওর জানা আছে, এর অর্ধেক মুক্তা পেলেও বর্তে যায় দুনিয়ার সেরা সুন্দরীরা, পা চাটতেও আপত্তি করে না আর। কিন্তু এক্ষেত্রে ফল হলো উল্টো। লোভ তো দূরের কথা, প্রিসিলার চোখে দেখা দিল স্পষ্ট তিরস্কার। উঠে দাঁড়িয়েছে সে চেয়ার ছেড়ে।
আমার স্বামী কারও উপহার নেয়াটা মোটেই ভাল চোখে দেখবেন না, শান্ত, ঠাণ্ডা গলায় কথাটা বলতে পারল প্রিসিলা, যদিও বুকের ভিতর ধুপ-ধাপ লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা প্রচণ্ড ভয়ে।
ও, তাহলে এই ব্যাপার। স্বামীকে ভয় পাচ্ছে মেয়েটা।
আরে, গুলি মারো স্বামী! খাঁটি মুক্তা এগুলো, তোমার গলায় যা মানবে না! একেবারে তোমার মতই সুন্দর!
বরফের মত জমে গেল প্রিসিলা। কোনমতে বলল, আপনার মতামত আমি জানাব আমার স্বামীকে।
অ্যাঁ? হাসিটা দূর হয়ে গেল ওর মুখ থেকে। এক মুহূর্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল মেয়েটার মুখের দিকে। তারপর অস্বস্তি ঢাকার জন্যে খ্যাক খ্যাক করে হাসির মত শব্দ করল। বার বার স্বামী-স্বামী করছ কেন, তোমার ওই চালবাজ স্বামীটাকে কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে থাকা যায় না?
কড়া কথা এসে যাচ্ছিল মুখে, সামলে নিল প্রিসিলা। এখন বুদ্ধি খাটিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে লোকটাকে। আতঙ্কিত হলে চলবে না। শরীরের কাপন আড়াল করবার জন্যে বসে পড়ল সে আবার।
এবার সরাসরি কাজের কথায় চলে এল লীচ। আমি তোমাকে জানাতে এসেছি, সেন্টরে প্রথম যেদিন দেখলাম, সেই দিন থেকেই ঘুম হারাম হয়ে গেছে আমার। তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি আমি, সুন্দরী। এতদিন চিন্তা ভাবনা করে বুঝতে পেরেছি, তোমাকে না পেলে আমার জীবনই বৃথা।
এসব কী বলছেন আপনি! রেগে ওঠার চেষ্টা করল প্রিসিলা।
সত্যি কথাই বলছি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তোমার জন্যে করতে পারি না এমন কাজ নেই।
কথাটা সত্যি? যা বলব তাই করবেন? একটু যেন আশার আলো দেখতে পেল প্রিসিলা।
বলেই দেখো না। দেখো, সত্যি করি কি না!
আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনার মুক্তোগুলো নিয়ে দয়া করে চলে যান, স্যার।
আবার হতভম্ব হয়ে গেল লীচ কয়েক মুহূর্তের জন্যে, তারপর রাগে লাল হয়ে উঠল তার মুখটা। দন্ত বেরিয়ে পড়েছে।
এসব কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে আমাকে তাড়াতে পারবে না, মেয়ে। আমি: টম লীচ। ভিক্ষা যদি না পাই, কেড়ে নেব। যখন যা চেয়েছি তাই আদায় করে নিয়েছি আমি, দুনিয়ার কেউ আজ পর্যন্ত ঠেকাতে পারেনি আমাকে।
একেবারে গায়ের কাছে চলে এসেছে লোকটা। ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল প্রিসিলা, কিন্তু ওকে ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দিল সে আবার। চেপে ধরে আছে ওর কাঁধ।
ছাড়ন আমাকে! ধমক দেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু গলা দিয়ে চি-চি আওয়াজ বেরোল শুধু। জিভ শুকিয়ে কাঠ। গায়ের ওপর থেকে লোকটার হাত সরাবার চেষ্টা করে দেখল সম্ভব নয়। তীক্ষ্ণ এক চিল চিৎকার বেরিয়ে এল ওর গলা দিয়ে বলল, ছাড়ো আমাকে, জানোয়ার কোথাকার!
খিকখিক করে হাসল লীচ। ঠিক ধরেছ, সুন্দরী। আমি এখন ঠিক তাই। জানোয়ার। তোর মত বহুত কুত্তিকে আমি বশ করেছি! শেষ পর্যন্ত আমার পা চাটতে বাধ্য হয়েছে তারা। যত খুশি চিৎকার কর– আশে পাশে দুই মাইলের মধ্যে কেউ নেই। একটানে ওকে নিজের বুকের উপর নিয়ে এল লোকটা।
খোদা! বাঁচাও আমাকে, খোদা! অন্তর থেকে ডাকল প্রিসিলা ঈশ্বরকে। প্রত্যুত্তরও এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
খোলা দরজায় একটা ছায়া পড়ল, পরমুহূর্তে কেবিনে ঢুকল দীর্ঘদেহী মশিয়ে দো বাখনি।
আজকেই কেন যেন তলোয়ার চর্চার সেই ছোট্ট সৈকতে যাবার পথে হঠাৎ দো বাখনির মনে হলো ডাঙায় ভোলা জাহাজটার হাল নিজের চোখে একবার দেখা দরকার। খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে কাজ দেখছিল, এমনি সময় চোখ পড়ল বহুদূরে লাল জামা পরা ক্যাপটেন লীচের উপর– দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে লোকটা প্রিসিলার কেবিনের দিকে, তারপর ঢুকে গেল ভিতরে।
মনে হলো, ফিরে যাওয়া দরকার। যদিও খারাপ কিছু ঘটতে পারে তা ভাবেনি। হঠাৎ ঘুরে হাঁটতে শুরু করল সে নিজেদের ক্যাম্পের দিকে। পিছন পিছন চলেছে মেজর, কিছুই চোখে পড়েনি তার, তাই বার বার জিজ্ঞেস করছে দো বাখনির মত পরিবর্তনের কারণ। অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়েই চলার গতি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল মশিয়ে দো বাখনি, এই গরমে অযথা ক্লান্ত হতে চায় না বলে পিছিয়ে পড়ল মেজর স্যান্ডস।
ক্যাপটেন লীচ টের পায়নি ওর আগমন, তাই কাঁধে থাবা পড়তেই চমকে পিছন ফিরে চাইল। পরমুহূর্তে আশ্চর্য দ্রুতগতিতে লাফিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ওর দিকে। ডান হাত চলে গেছে কোমরের বেল্টের কাছে।
একপা পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে দো বাখনি, মুখটা সাদা হয়ে গেছে, ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসির আভাসটুকু ভয়ঙ্কর হিংস্র দেখাচ্ছে দুচোখের নিষ্ঠুর দৃষ্টির কারণে।
মাদাম দো বাখনিকে যদি পূজা করতে হয়, করো, আমার আপত্তি নেই, বলল সে কঠোর গলায়। তবে দূর থেকে। কথাটা খেয়াল রেখো, লীচ। তাহলে তোমার নিজের জন্যেও মঙ্গল, অন্যেরাও বেঁচে যাবে অঘটন থেকে।
বুড়ো আঙুল দিয়ে বাইরের দিক নির্দেশ করল সে। ওকে বিদায় হতে বলছে।
খোলা দরজা দিয়ে হৃষ্টপুষ্ট মেজরকে দেখা গেল হাঁসফাঁস করে আসছে এদিকে। ঝাঁপ দেয়ার ভঙ্গিতে সামান্য ঝুঁকে আছে লীচ। বাধা পেয়ে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে সে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তোর মুখ থেকে ওই হাসি মুছে দেব আমি, জোকার কোথাকার! জানিস তুই, ক্যাপটেন লীচের সঙ্গে লাগতে গেলে তার কী পরিণতি?
তুমিই বরং নিজের কেবিনে ফিরে ভাবো গিয়ে, কী বাঁচা বেঁচ্ছে; মাদাম দো বাখনির সঙ্গে বেয়াদবি করার ফলে কি হতে পারত তোমার! আবার বুড়ো আঙুল দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করল সে লীচকে।
বাপরে! অনেক বাড় বেড়েছ তুমি দেখতে পাচ্ছি! তবে আর বেড়ো না, চার্লি। তোমার চেয়েও অনেক তুখোড় লোককে পিটিয়ে লাশ করেছি আমি।
মনে রাখব কথাটা, গম্ভীর কণ্ঠে বলল দো বাখনি। তবে আপাতত আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার আগেই দূর হও। হয়তো শুনে থাকবে, অনেক সহ্যক্ষমতা আমার, কিন্তু সেটা অসীম নয়!
হুমকি দিচ্ছ? বেশ, বেশ। এতবড় বুকের পাটা! কপালে দুঃখ আছে তোমার, চার্লি!
বেরিয়ে গেল লীচ কেবিন থেকে বেরিয়েই হুমড়ি খেল ধ্যাড়ধেড়ে শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেজর স্যান্ডসের গায়ে। রাগ ঝাড়ার সুযোগ পেয়ে প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিয়ে মেজরকে সরিয়ে দিল সে সামনে থেকে। কিন্তু ছয় কদম যেতে না যেতেই আবার থামতে হলো ওকে দো বাখনির ডাকে।
কিছু ফেলে রেখে যাচ্ছ মনে হয়?
কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মশিয়ে দো বাখনি, হাতে লীচের মুক্তাগুলো মুঠো করে ধরা। ক্যাপটেন লীচ ঘুরে দাঁড়াতেই ওর দিকে ছুঁড়ে মারল সে ওগুলো। কয়েকটা ওর গায়ে লাগল, বাকিগুলো পড়ল বালিতে।
কয়েক মুহূর্ত থমকে গেল সময়, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে খুঁজতে শুরু করল লীচ ওগুলো, এক-এক করে খুঁটিয়ে তুলছে বালি থেকে। রাগে বেড়ালের মত ফেস-ফোঁস আওয়াজ বেরোচ্ছে ওর মুখ দিয়ে। ব্যাপারটা কতখানি হাস্যকর দেখাচ্ছে টের পেল না সে, কারণ এগুলো ওর জানের জান, একশো পিসেস অভ এইট পেলেও এর একটা বেচবে না সে।
.
১৫.
ছেঁড়া তার
কেবিনের সামনে বালিতে হামাগুড়ি দিয়ে মুক্তা খুঁজছে টম লীচ, অবাক চোখে তাই দেখছে মেজর স্যান্ডস। প্রিসিলার কাছে চলে এল মশিয়ে দো বাখনি।
মশিয়ে দো বাখনির এই রূপ কোনদিন দেখেনি প্রিসিলা। শান্ত, ঠাণ্ডা, সংযমী মানুষটাকে তার বিপদে এতখানি বিচলিত হতে দেখে যেমন অবাক হয়েছে, তেমনি কৃতজ্ঞ বোধ করছে ও এখন। কাঁধে একটা হাত রেখে গাঢ় কণ্ঠে ডাকল লোকটা ওর নাম ধরে। প্রিসিলা লক্ষ করল অতি সামান্য হলেও কাঁপছে হাতটা। বিপদ কেটে যাওয়ায় মস্ত একটা কাঁপা শ্বাস ছেড়ে শিউরে উঠল প্রিসিলা, তারপর দো বাখনির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। একহাতে ওকে জড়িয়ে ধরল, অপর হাতে সান্ত্বনা দিচ্ছে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে। একটু সামলে নিয়ে বলল প্রিসিলা, আপনি না এলে কি যে হতো! খোদাকে হাজার ধন্যবাদ।
হ্যাঁ, ভাগ্যটা ভাল আপনার। ওই কুকুরটার ভাগ্য আরও ভাল। আর একটু দেরি হয়ে গেলে ওকে খুন না করে আমার উপায় থাকত না।
চট করে ওর হাত ধরল প্রিসিলা। আর কিছু করতে যাবেন না, তো? প্লীজ! কথা দিন।
তিক্ত হাসি ফুটল দো বাখনির ঠোঁটে। জীবনে কোনদিন এতটা সংযমের প্রয়োজন হয়নি আমার। আর একটু হলেই এমন কিছু করে বসতাম, যাতে আমাদের সবার জীবন বিপন্ন হতো। কিন্তু খুব কষ্ট হয়েছে নিজেকে সামলাতে। খোদা! আপনার গায়ে হাত দিয়েছে জানোয়ারটা, এটা নিজ চোখে দেখেও কী করে সহ্য করলাম!
কথাগুলো যে ওর অন্তরের অন্তস্তল থেকে বেরিয়ে আসছে বুঝতে অসুবিধে হলো না প্রিসিলার। মৃদু স্বরে বলল, কথা দিন, আমাকে একা রেখে আর কোথাও যাবেন না! অন্তত এখানে যতদিন আছি!
আর যাই কোথাও? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল। এই সুযোগ আর কোনদিন পাবে না ও। নিজের অজান্তেই একটু ঝুঁকে বুকের ওপর রাখা সোনালী মাথাটায় আলতো করে চুমো দিল দো বাখনি।
এতক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে সবকিছু দেখছিল মেজর, এইবার বাধা দেয়া দরকার বুঝে একলাফে চলে এল সামনে। চটে গেছে সে। এক দস্যুর বাহুপাশ থেকে মুক্তি পেয়ে আরেক দস্যুর বাহুপাশে সেঁধিয়ে যাওয়া!– এটা কি রকম? লোকটা আবার চুমোও দিচ্ছে!
এটা কি হচ্ছে, শুনি?
মেজরের বিরক্ত কণ্ঠ শুনে বাস্তবে ফিরে এল দো বাখনি। মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ করল ভাবাবেগ। অসম্ভব তীক্ষ্ণ উপস্থিত বুদ্ধি ফিরে এল তৎক্ষণাৎ। মেয়েটাকে তেমনি জড়িয়ে ধরে রেখেই চাপা গলায় দাঁতের ফাঁক দিয়ে ধমক দিল মেজরকে।
সব গুবলেট করে দেবেন নাকি আপনি গর্দভের মত! ওই যে তাকিয়ে দেখছে লোকটা, ও জানে প্রিসিলা আমার স্ত্রী। স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হচ্ছে আমাকে, স্যার। যান এখান থেকে! আমাকে আমার দায়িত্ব পালন করতে দিন।
শান্ত হলো মেজর। বলল, ভুল হয়েছে, আমি ক্ষমা চাইছি, দো বাখনি। কিন্তু নড়তে পারল না ওখান থেকে। তবে ওর ভাই হিসেবে আমারও তো সান্ত্বনা দেয়া উচিত। কাজেই আমি এগিয়ে এলেও কোন ক্ষতি হয়নি।
প্রিসিলার কেন যেন মনে হচ্ছিল দো বাখনির প্রতিটি কথা তার অন্তর থেকে আসছে, প্রতিটি শব্দ ওর মনে সুরের ঝঙ্কার তুলছিল, কিন্তু এখন অভিনয়ের কথা শুনে চট করে ফিরে এল বাস্তবে। ওর বাহুপাশ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে বসে পড়ল একটা চেয়ারে। আমাকে একটু একা থাকতে দেবেন, প্লীজ?
বেরিয়ে গেল দুজন। সৈকতে পায়চারি করবে বলে এগিয়ে গেল মশিয়ে দো বাখনি। পিছু নিল মেজর। অনর্গল দুষছে সে টম লীচকে জঘন্য আচরণের জন্য, প্রায়ই দো বাখনিকেও লীচের সঙ্গে একই কাতারে ফেলে ঝাল ঝাড়ছে। নিজের চিন্তায় ডুবে আছে ফরাসী লোকটা, মেজরের একটা কথাও খেয়াল করে শুনছে না। বক-বক করেই চলল লোকটা।
শেষে মেজরের একটা কথায় চটকা ভাঙল মশিয়ে দো বাখনির। বলছে, কিছুদিন হলো আপনার ওপর আমার আস্থা আসতে শুরু করেছে। আপনি যদি আপনার খুনে বন্ধুদের দূরে সরিয়ে রাখতে না পারেন তাহলে কিন্তু সে আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।
সেক্ষেত্রে আমার সহানুভূতি থাকবে আপনার জন্যে! কথাটা বলেই হঠাৎ ঘুরে আরেকদিকে হাঁটতে শুরু করল দো বাখনি।
একথার কি অর্থ জিজ্ঞেস করার জন্যে পাশ ফিরেই পিয়েখকে দেখতে পেল মেজর, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওর দিকেই দ্রুতপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে দো বাখনি। গজগজ করতে করতে পিছু পিছু চলল সে।
ফ্রেঞ্চ ভাষায় কী সব বলছে পিয়েখ, বুঝল না মেজর। তবে পরিষ্কার দেখতে পেল, কাঁধ দুটো একটু যেন ঝুলে পড়ল দো বাখনির; চিন্তিত ভঙ্গিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল সে কিছুক্ষণ চুপচাপ, চেহারায় হতাশার ছাপ। আনমনে তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে চিমটি কাটছে ঠোঁটে।
দো বাখনির কনুইয়ের কাছে পৌঁছে শুনতে পেল মেজর কয়েকটা কথা। নিজের মনেই কথা বলছে, নাকি পিয়েখকে বলছে ঠিক বোঝা গেল না, কিন্তু ফ্রেঞ্চ ভাষায় অতি নগণ্য দখল থাকা সত্ত্বেও পরিষ্কার বুঝতে পারল সে ওর বক্তব্য।
যাই হোক, একটা কিছু করা দরকার!
কথাটা বলেই কেবিনের দিকে হাঁটতে শুরু করল দো বাখনি। কিছুদূর গিয়েই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দৃঢ়পায়ে রওনা হলো জলদস্যুদের আস্তানার দিকে।
কাছাকাছি গিয়ে দো বাখনি দেখল দুজন দস্যু কচ্ছপের মাংস সেঁকছে আগুনে। ওকে দেখে বন্ধুত্বের হাসি হাসল ওরা। কিন্তু থামল না দো বাখনি, সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে গেল সামনে।
কেবিনে ডিনার খেতে বসেছে তখন লীচ তার ঘনিষ্ঠ চার অনুচরের সঙ্গে। গম্ভীর, একরোখা চেহারা নিয়ে ঢুকল সেখানে দো বাখনি।
মোটামুটি স্বাভাবিক দেখাচ্ছে লীচকে এখন। দো বাখনিকে আচমকা ঘরে ঢুকতে দেখে একটু যেন ভীতির আভাস ফুটল তার চেহারায়, পরমুহূর্তে তৈরি হয়ে গেল যে-কোনও পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে।
টেবিলের অপর পাশে লীচের মুখোমুখি দাঁড়াল মশিয়ে দো বাখনি। লীচের বাম পাশে বসেছে বানড্রি আর হ্যালিওয়েল, ডান পাশে এলিস আর উওগান। সবাই প্লেট থেকে মুখ তুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দো বাখনির গম্ভীর মুখের দিকে।
শীতল কণ্ঠে সরাসরি বক্তব্য রাখল দো বাখনি।
তুমি জান কেন এসেছি আমি, ক্যাপটেন। তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, লীচ: যদি প্লেট ফ্লীটের কোন মূল্য তোমার কাছে থাকে, আর তুমি যদি চাও আমি পথ দেখিয়ে তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাই, এখন থেকে তোমাকে ভদ্র হয়ে চলতে হবে। আমার কোয়ার্টারে তোমার যাওয়া নিষেধ।
বলে কী, হারাম- উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল লীচ, প্রচণ্ড জোরে ধমকে উঠল দো বাখনি।
থামো! আমার কথা শেষ হয়নি! ওর গলার আওয়াজ আর ভাবভঙ্গি দেখে বসে পড়ল হতভম্ব লীচ। অফিসারদের দিকে ফিরল এবার দো বাখনি। তোমাদেরও বলে যাচ্ছি: যদি আমার মাধ্যমে প্লেট ফ্লীটের কাছে পৌঁছতে চাও, তাহলে তোমরা দেখবে ও যেন আমার নির্দেশ মেনে চলে। আজ সকালে যা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি যদি হয়, আবার যদি টম লীচ আমার কেবিনের বিশ গজের মধ্যে যায়, আমি ধরে নেব আমাদের চুক্তি ভেস্তে গেছে, সোনা তো দূরের কথা, একটা ফুটো পয়সাও জুটবে না তোমাদের কারও কপালে। আমার যদি চুক্তির প্রতি সম্মান দেখাতে হয়, টম লীচকে আমার স্ত্রীর প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, তোমাদেরও দেখতে হবে যেন ও কোনভাবে তাকে অসম্মান করতে না পারে।
ঘৃণা আর বিদ্বেষে জ্বলছে ক্যাপটেনের চোখ। টেবিলের ওপাশে মুখোমুখি দাঁড়ানো দো বাখনির বেপরোয়া, সাহসী চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল সে।
ফ্রেঞ্চম্যানের ঔদ্ধত্য দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছে লীচের অনুচররা। বিড় বিড় করে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। কিন্তু ভাবলেশহীন বানড্রির বিশাল কাঁধটা দো বাখনির দিকে পিছন ফিরল, সরাসরি ক্যাপটেনের দিকে চেয়ে বলল, তার মানে, আমাদের সাবধানবাণী উপেক্ষা করেছ তুমি, ক্যাপটেন!
কথাটা শোনাল শীতল হুমকির মত। মুহূর্তে অনেক কিছুই বুঝে নিল মশিয়ে দো বাখনি। সবাই চেয়ে আছে ক্যাপটেনের দিকে তার উত্তর শুনবে বলে। বানড্রির এ রকম শাসানি হতভম্ব করে দিয়েছে লীচকে, কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারছে না। এদের কারও সমর্থন পাবে তা কল্পনাও করেনি দো বাখনি। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল, এই নীরবতার সুযোগ নিয়ে লীচের ক্ষতটা আরও একটু গভীর করবে।
আমার বাকি কথাটুকুও বলে দিয়ে যাই, টম। মন দিয়ে শুনে নাও, চিন্তা করো, তারপর কিভাবে চলবে স্থির করো। কথাটা হচ্ছে: স্প্যানিয়ার্ডদের সোনা দখল করতে হলে আমাকে দরকার আছে, তোমাকে নেই। তোমাকে ছাড়াও, এদের যে-কোনও একজনের নেতৃত্বে সোনা দখল করা সম্ভব। কিন্তু আমাকে ছাড়া এক কদম আগে বাড়াও সম্ভব নয়। এর বেশি আর কিছু আমি বলতে চাই না। যদি সামান্যতম বিচক্ষণতাও থাকে তোমার মধ্যে, তাহলে যেখান থেকে যতটুকু পার সুরুচি, ভদ্রতা, শ্লীলতা কাচিয়ে এনে নিজের আচরণে যোগ করো। আমার কথা শেষ। ঝগড়ার এখানেই পরিসমাপ্তি হতে পারে-যদি চাও, আবার তা আরও বাড়তে পারে-যদি চাও। সিদ্ধান্তটা তোমার ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি।
লীচকে উত্তর দেয়ার সুযোগ না দিয়ে যেমন এসেছিল, তেমনি আচম্বিতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে বিদায় নিল মশিয়ে দো বাখনি।
উঠে দাঁড়িয়েছে লীচ, ঠোঁট জোড়া কাঁপছে থর-থর করে, ওকে কথা যুগিয়ে দেয়ার জন্যে মুখ খুলল উওগান, কিন্তু বানড্রির শান্ত কণ্ঠ তীক্ষ্ণ চাবুক হানল যেন ওদের দুজনের উপর।
চুপ করো, উগান, বুন্ধু কোথাকার! অবস্থা যথেষ্ট খারাপ হয়েছে, আরও কিছু যোগ করতে যেয়ো না এর সঙ্গে! আর, টম, গোস্যা ছেড়ে মাথাটা খাটাও, সবই শুনেছ তুমি, বুদ্ধি করে চল!
দোজখে যাও তুমি, বানড্রি! কি ভেবেছ? ওই চালিয়াত বাঁদরের বেয়াদবি হজম করতে হবে আমাকে? তুমি কি মনে করেছ…
আমি মনে করছি, তোমার বোঝা উচিত, আমাদের কাছে তোমার চেয়ে অনেক বেশি মূল্য ওই প্লেট ফ্লীটের! এই প্রথম মেজাজ খারাপ করল বানড্রি, ধই করে টেবিলে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে এক লাফে উঠে দাঁড়াল।
স্থির হয়ে গেল সবাই। জবান বন্ধ। তারপর নরম, ধূর্ত কণ্ঠে লীচ বলল, তাই নাকি, বানড্রি? তাই? তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে বানড্রির মুখোশের মত অভিব্যক্তিহীন মুখের দিকে, ডান হাতটা ধীর ভঙ্গিতে বেল্টের উপর দিয়ে এগোচ্ছে অস্ত্রের দিকে।
মনে হলো, মশিয়ে দো বাখনির কথাগুলোর বিষক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে, এখুনি রক্তারক্তি কাণ্ড বেধে যাবে খাবার টেবিলে, ছিঁড়ে ফেলবে একে অন্যের কণ্ঠনালী। কিন্তু হ্যালিওয়েল সামাল দিল ঘটনাটা। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে ঝুঁকে বিশাল দেহটা দিয়ে আড়াল সৃষ্টি করল সে দুজনের মধ্যে।
খোদার দোহাই লাগে, টম, মাথা খারাপ কোরো না তো! ফর্সা এক ছেমরির জন্যে পাগল হয়ে কি ডোবাবে তুমি সবাইকে? সোনাগুলো হাতে এসে গেলেই যখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারছ তুমি, বাধা দেয়ার কেউ থাকছে না-অত অস্থির হওয়ার কি আছে বলো তো?
শুধু বকা নয়, মোটকুর কথায় প্রতিশ্রুতির আভাস আছে। কিছুটা সামলে নিল লীচ নিজেকে, তাকাল একে একে সবার মুখের দিকে। বানড্রির মনোভাব সে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে। এলিস যেভাবে ভুরু কুঁচকে দেখছে ওকে, বোঝা যাচ্ছে গোলমাল বাধলে ও-ও চলে যাবে বিপক্ষে। হ্যালিওয়েলও ওদের সঙ্গে যোগ দেবে, কোনও সন্দেহ নেই। মনে হচ্ছে, একমাত্র উওগানের ওপর কিছুটা ভরসা রাখা যায়, কিন্তু সে-ই বা কতক্ষণ দুর্বল পক্ষে থাকবে বলা মুশকিল।
হিসেব কষে পরাজয় দেখতে পেল ক্যাপটেন। টপগ্যাল্যান্ট চার্লি এমনই চাল দিয়েছে, ঝগড়াটা এখন সরে এসেছে লীচ আর তার অফিসারদের ভিতর। অনেক কষ্টে রাগ সামলে নিল ক্যাপটেন। বলল, ঠিকই বলেছ, নেড। হয়তো বোকামিই করে ফেলেছি। তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু বানড্রির কথায় রয়েছে বিষ! কণ্ঠস্বরে অভিমান আর নালিশের ভাব আনার চেষ্টা করল সে। মুখের ওপর বলে দিল, তোমাদের কাছে আমার চেয়ে অনেক বেশি দামী ওই সোনা! গলার স্বর বুজে এল ওর, যেন প্রিয় অনুচরের কাছ থেকে ব্যথা পেয়ে কান্না চাপছে।
এভাবে বলা তোমার উচিত হয়নি, বানড্রি, বলল উওগান। সত্যিই, আমার কানেও কথাটা খুব খারাপ শুনিয়েছে।
এতই খারাপ, যে সন্তোষজনক উত্তর চাওয়ার অধিকার আছে আমার, বলে বানড্রির মুখোশের দিকে চাইল লীচ।
বানড্রির জানা আছে লীচ কতখানি দুর্দান্ত তলোয়ারবাজ। ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত কলহে রূপ দিতে পারলে আজ ওর কি দশা করে ছাড়তলীচ, তাও ওর জানা। কিন্তু ভয় যদি পেয়েও থাকে, তার কোন আভাস ফুটল না ওর মুখে।
গোটা ব্যাপারটা তোমারই সৃষ্টি, ক্যাপটেন, বলল বানড্রি। তবে তুমি যখন স্বীকার করছ যে কাজটা হয়তো বোকামিই হয়ে গেছে, তখন আমার আর কিছু বলার নেই, আমি আর কথা বাড়াতে চাই না।
লীচ ধরে নিল, ভয় পেয়েছে বানড্রি। যদিও জানে, ওকে আক্রমণ করলে আরেকটা বোকামি হয়ে যাবে। বলল, কথাটা বলা সহজ, বানড্রি। কিন্তু এটা কোনও সন্তোষজনক উত্তর হলো না। বাখনির মত পিচ্ছিল এক পিশাচের কথার কী দাম? ও বলছে প্লেট ফ্লীটের কাছে নিয়ে যাবে আমাদের– কতটুকু ভরসা করা যায় ওর কথায়? গোপন তথ্যটা ও জানে, শুধু এজন্যেই চড় খেয়েও আরেক গাল পেতে দিতে হবে আমাদের দুই পায়ের ফাঁকে লেজ দাবিয়ে রাখতে হবে, ও যতই বেয়াদবি করুক না কেন? টম লীচের পক্ষে তা সম্ভব নয়। তোমাদের জেনে রাখা দরকার, যতক্ষণ পর্যন্ত ও ভদ্রতা বজায় রাখবে, আমি শান্তি ভঙ্গ করব না। কিন্তু তার বেশি কিছু না। প্লেট ফ্লীট দখল হোক বা না হোক পরোয়া করি না আমি। কারও কিছু বলার থাকলে বলে ফেলো, সবার জানা হয়ে যাক কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি।
এ তো অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত কথা, সমর্থন দিল উওগান।
এলিস আর হ্যালিওয়েল মুখে কিছু না বললেও ভাবে ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল লীচের সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে তারা মোটেই আগ্রহী নয়। বানড্রি বুঝতে পারল এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে শক্রতার সৃষ্টি হবে ক্যাপটেন লীচের সঙ্গে, তাই ফণা নামিয়ে ফেলল সে। বলল, এর বেশি কিছু কেউ আশা করছে না, ক্যাপটেন। তবে মনে রেখো, এটুকু অন্তত আশা করব আমরা তোমার কাছে।
বেশ। আমার কথা আমি রক্ষা কুরব।
এইভাবে শান্তি ফিরে এলে আবার খাওয়ায় মন দিল ওরা।
.
১৬.
প্রলোভন
সেই রাতে তারা জ্বলা আকাশের নিচে প্রিসিলার জন্যে মিছেই অপেক্ষা করল মশিয়ে দো বাখনি, কিন্তু পর্দা তুলে পাশে এসে বসল না কেউ। অনেক কথা বলার ছিল ওর, অনেক কিছু ব্যাখ্যা করার ছিল; কিন্তু মনে হলো মেয়েটির তরফ থেকে কোন ব্যাখ্যা শোনার কোন আগ্রহই নেই। রাত বেড়ে চলল, কিন্তু যেমন ছিল তেমনিথাকল পর্ধা।
বহুক্ষণ অপেক্ষার পর অনেক ভেবে বুঝতে পারল মশিয়ে দো বাখনি, কোনভাবে মেয়েটার মনে আঘাত দিয়েছে সে; হয়তো ওর বাহুপাশে যখন ধরা দিয়েছিল প্রিসিলা ওর তরফ থেকে কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে, তাই এই আচরণ। আজকের অনুপস্থিতি অনিচ্ছাকৃত কোন ব্যাপার নয়। এটা বোঝার পর ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন আরও বেশি করে অনুভব করল ফ্রেঞ্চম্যান। আস্তে করে ডাক দিল সে ওকে নাম ধরে।
তৃতীয়বার ডাকার পর নড়ে উঠল পর্দাটা। দো বাখনি বুঝল, জেগেই ছিল ও, ইচ্ছে করেই সাড়া দেয়নি এতক্ষণ।
ডাকছেন আমাকে? জিজ্ঞেস করল মেয়েটা। কিছু হয়েছে?
ঠিক এই কথাটাই জানার জন্যে ডেকেছি। কিছু হয়েছে? বসবেন না আপনি আজ?
কিছু বলবেন?
হাসল দো বাখনি। কত কথাই তো বলছি রোজ! আজ কিন্তু বিশেষ কিছু ছিল।
বসল প্রিসিলা। পাশে বসে দো বাখনি বলল, আজ এলেন না, আমি না ডাকলে আসতেনও না। সত্যি করে বলুন তো, কেন অসন্তুষ্ট হয়েছেন আমার ওপর?
অসন্তুষ্ট? আমি? কি করে তা সম্ভব? বলল বটে, কিন্তু গলার স্বরের আড়ষ্টতা ধরা পড়ল দো বাখনির কানে। কিছু আড়াল করছে মেয়েটা।
আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন। কিছু একটা ঘটেছে যেজন্যে আপনি রেগে গেছেন আমার ওপর। খুব সম্ভব আমাকে ভুল বুঝেছেন আপনি। আজ আমার আচরণে কিছুটা বাড়াবাড়ি ছিল, কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনার প্রতি…
কৈফিয়ৎ দেয়ার কোনও দরকার নেই, মশিয়ে, বাধা দিয়ে বলল প্রিসিলা। আপনাকে ভুল বোঝার প্রশ্নই ওঠে না। মেজর স্যান্ডসকে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, শুনেছি আমি– লীচকে দেখানোর জন্যে কৌতুকাভিনয় করছিলেন আপনি। আমি বুঝতে পেরেছি, এর প্রয়োজন ছিল।
কথাগুলো মনে হলো বহুদূর থেকে ভেসে আসছে, যেন এসব কারও মনের কথা নয়।
তাহলে আপনি এটাকে ক্ষমার চোখে দেখেছেন?
নিশ্চয়ই। চমৎকার অভিনয় করেন আপনি, মশিয়ে দো বাখনি।
অ্যাঁ?
এতই ভাল যে, কিছুক্ষণের জন্যে আমি বোকা হয়ে গিয়েছিলাম। মনে করেছিলাম আপনার রাগ, আমার জন্য দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ একটুও নকল নয় –বুঝি সত্যি।
বিশ্বাস করুন, এতে কোনও খাদ ছিল না, প্রতিবাদ করল দো বাখনি। খোদর কসম, এক বিন্দুও না।
তবে আমি বোকার মত যতটা ধরে নিয়েছিলাম, তার ধারে কাছেও না। এই তো?
কথার ফাঁদে জড়িয়ে গেল সুন্দর মনের দুর্ধর্ষ মানুষটা। মিথ্যে অভিযোগ শুনে চটে গিয়ে বলল, কতটা বিচলিত হয়েছিলাম বলে আপনি ধরে নিয়েছিলেন আমি জানি না, তবে এটুকু জানি আসলের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেনি আপনার ধারণা! কোনদিন পারবে না।
তারপরেও আপনি কৌতুকাভিনয় করলেন লোক দেখানোর জন্যে।
আহ্, মন দিউ! মাতৃভাষায় বলে উঠল দো বাখনি। হৃদয়ের গভীরে নাড়া পড়লে দেশী ভাষা বেরিয়ে যায় ওর মুখ দিয়ে। আপনি কি বলতে চান… চট করে থেমে গেল সে। বলে ফেলতে যাচ্ছিল: হায়, খোদা! আপনি কি বলতে চান আমার আদরটা লোক দেখানো ছিল বলে রেগে গেছেন?
কি বলতে যাচ্ছিলেন? ওকে চুপ হয়ে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।
উচ্চারণ করা যায় না, এমন কিছু।
গলার স্বর কিছুটা নরম হলো প্রিসিলার। আপনি যদি কথাটা বলে ফেলতেন, তাহলে হয়তো আমরা কোনও সত্যের কাছাকাছি পৌঁছতে পারতাম।
কিছু সত্য আছে, যার কাছে না পৌঁছানোই ভাল। এমন সত্য আছে যা কারও কারও কাছে নিষিদ্ধ গন্দম।
এটা তো স্বর্গ নয়, মশিয়ে দো বাখনি।
আমি অত নিশ্চিত হয়ে বলতে পারব না কথাটা। কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে, স্বর্গের এতটা কাছে জীবনে আর কখনও আসিনি।
দুজনকেই থমকে দিল কথাটা। চুপ হয়ে গেল প্রিসিলা। অনেকক্ষণ চুপচাপ কাটল। দো বাখনি ভয় পেল এইবার হয়তো সত্যি সত্যিই রাগিয়ে দিয়েছে মেয়েটাকে। সামনে সৈকত, আকুলিবিকুলি করছে ঢেউ তীরে এসে, তার ওপাশে দুলছে নোঙর ফেলা সেন্টরের ছায়া– সেদিকে চোখ রেখে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল প্রিসিলা, আপনার স্বর্গে কি অভিনয় চলে, মশিয়ে দো বাখনি?
এতক্ষণ সন্দেহের মধ্যে থাকলেও এবার পরিষ্কার বুঝে ফেলল দো বাখনি ঠিক কোন প্রশ্নের খোলাখুলি জবাব চায় মেয়েটা। বুকের ভিতর কাঁপন অনুভব করল ও। কপালে দেখা দিল চিকন ঘাম। অনেকক্ষণ পর কথা বলতে পারল সে।
প্রিসিলা, আমার জন্যে কতটুকু কি শোভা পায়, রূঢ় বাস্তব কতটুকু অনুমোদন করে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে আমার। বামন আমি…
স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথাই ভাববেন?
সম্ভবত এটাই আমার একমাত্র নিঃস্বার্থপরতা।
আবার চুপ। প্রিসিলার নিদারুণ হতাশা আর দো বাখনির চাপা দুঃখ আরও গাঢ় করে তুলেছে যেন আঁধারকে। হঠাৎ কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার সেই আগের প্রশ্নে ফিরে গেল মেয়েটা।
তাহলে আজকের ব্যাপারটা পুরোপুরি অভিনয় ছিল না?
দেখুন, আপনি হচ্ছেন আপনি, আমি হচ্ছি যা আমি। দুজনের বাস দুই ভুবনে। নিয়তির লিখন: আমার সঙ্গে আপনার একমাত্র যোগসূত্র হতে পারে কাল্পনিক সেতুর মাধ্যমে।
নিয়তি হয়তো তাই চেয়েছে, কিন্তু আপনি নিজে? আপনি আপনি কি সেতু গড়ে নিতে পারেন না?
গলাটা ধরে এল মশিয়ে দো বাখনির। আমার ভার সইবার মত সেতু নেই, প্রিসিলা। অনেক দাগ পড়ে গেছে আমার গায়ে।
কিছুটা ভার ফেলে দিতে পারেন না?
অতীতকে তো আর খসানো যায় না! আমার অতীত, আমার স্বভাব, আমার পেশা– এত লজ্জার ভার আমি কোথায় ফেলব?
ধীরে মাথা নাড়ল প্রিসিলা। নিজের অজান্তেই হেলান দিয়েছে দো বাখনির কাঁধে। আপনার স্বভাব সম্পর্কে কথাটা মোটেও খাটে না। আমি চিনি আপনাকে। সে ব্যাপারে সামান্য ত্রুটিও কেউ কোনদিন দেখাতে পারবে না। তবে অতীত … অতীত কি?
আমাদের ইতিহাস।
ওই পাতাটা মুছে ফেলা যায় না?
নিজেরই তৈরি করা ইতিহাস আমি কিভাবে মুছি? আমি মুছে ফেললেই কি ভুলে যাবে মানুষ?
লম্বা করে শ্বাস ফেলল প্রিসিলা। এটা আপনার গোয়ার্তুমি। এই বিনয় আপনার অহঙ্কারের প্রকাশ নয় তো?
অহঙ্কার? কথাটা নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবল দো বাখনি, তারপর বলল, হতে পারে। হয়তো নিজের হৃত সম্মান ফিরে পাওয়ার জন্যে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছি একে। আপনি যে আমাকে নিয়ে সাময়িক হলেও একটু ভেবেছেন, এভাবেই একদিন হয়তো আমি এটুকুর উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারব।
আমার তরফ থেকে ব্যাপারটা যদি সাময়িক না হয়? নরম গলায় জানতে চাইল প্রিসিলা।
হতেই হবে। যেন ভয় পেয়েছে, এমনি ভাবে একটু সরে বসল দো বাখনি। যদি মধুর স্পর্শটুকু ওকে দুর্বল করে তোলে– এই ভয়। শীঘ্রি একদিন নিজের পরিচিত জগতে পরিচিত মানুষের মাঝে ফিরে যাবেন আপনি, যেখানে আপনাকে মানায়, যে জীবনে আপনি অভ্যস্ত। ওখান থেকে যখন আজকের কথা মনে হবে, তখন মস্ত একটা হাঁপ ছাড়বেন, মনে হবে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে ফিরে এসেছেন আনন্দময় বাস্তবে। এখানকার কিছু সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই।
চার্লস! দো বাখনির হাতের ওপর নিজের একটা হাত রাখল প্রিসিলা।
ওর হাতের নিচে ঘুরে গেল পেশীবহুল হাতটা, আঙুলের ফাঁকে আঙুল দিয়ে শক্ত করে ধরল, তারপর উঠে দাঁড়াল, সেই সঙ্গে টেনে তুলল প্রিসিলাকে।
চিরকাল মনে রাখব, প্রিসিলা। যতদিন বাঁচি মনে রাখব তোমাকে। সেইসঙ্গে কথা দিচ্ছি, আমি ভাল হয়ে যাব। তোমার কাছে যা পেলাম সেটাই সাত রাজার ধন হিসেবে বুকের ভেতর নিয়ে বাঁচব আমি। এর বেশি আর কিছু দিতে যেয়ো না তুমি অযোগ্য একটা লোককে।
কিন্তু আমার দিতে ইচ্ছে করলে? ফিসফিস করে জানতে চাইল প্রিসিলা।
আমার অহঙ্কার তোমার সে দান আমাকে নিতে দেবে না। তুমি হচ্ছ তুমি, আমি হচ্ছি আমি। ভেবে দেখো এর কী অর্থ। তুমি কী আর আমি কি। এসো এবার, লক্ষ্মী। ওর হাতটা তুলে ঠোঁট ছোঁয়াল দো বাখনি, তারপর ওটা ছেড়ে দিয়ে পর্দা তুলে ধরল।
মনে কোরো, অপূর্ব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলাম আমরা আজ রাতে। কাল সকালে জেগে উঠে বুঝতে পারব, বাস্তবে এর কোন মূল্য নেই।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দো বাখনির দিকে তাকিয়ে থাকল প্রিসিলা। আবছা দেখাচ্ছে ওর ফর্সা মুখটা, তারার আলো পড়েছে চোখের তারায়, চি-চিক্ করছে। নীরবে ঘুরে দাঁড়াল, মাথাটা সামান্য নিচু করে চলে গেল কেবিনের ভিতর।
পরদিন সকালেও পিয়েখ নেই। প্রিসিলার প্রশ্নের উত্তরে আজ আর দো বাখনি বলতে পারল না কাজে পাঠিয়েছে। বলল, মানুষটা একটু ফাঁকিবাজই, দায়িত্বহীনও বলা যায়; কিছুটা বাচ্চা ছেলেদের মত-বকাঝকা দিয়ে কোন লাভ হয় না।
প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাচ্ছে দো বাখনি, বুঝতে পেরে ও-ও আর চাপাচাপি করল না।
নাস্তার পর আজ আর মেজরের সঙ্গে তলোয়ার অভ্যাসে গেল না দো বাখনি, গত কালকের ঘটনার পর ঠিক হয়েছে, কোনও অবস্থাতেই দুজন একসঙ্গে যাবে না কোথাও; যে কোন একজন ওরা থাকবে কেবিনের ধারে কাছে।
মেজরকে ক্যাম্পে রেখে মশিয়ে দো বাখনি চলল উত্তর দিকে কাজের অগ্রগতির খোঁজ-খবর নিতে। জানা গেল আলকাতরা মাখানো শেষ হবে আজ, আগামীকাল থেকে শুরু হবে গ্রীজ লাগানোর কাজ। লোকজনের সঙ্গে হাসি-তামাশা-গল্প করছে, এমনি সময়ে এসে হাজির হলো ক্যাপটেন লীচ।
ওর চেহারা দেখেই বোঝা গেল মনে মনে কোন দুর্বুদ্ধি এঁটে তারপর এখানে এসেছে। প্রথমেই সে লোকজনের ওপর তর্জন-গর্জন করল কাজ ফেলে গল্প করছে বলে। এমনিতেই অনেক পিছিয়ে গেছে কাজ, ওরা কি চায় বাকি জীবন সে এই মালদিতায় কাটিয়ে দিক? তারপর ঝট করে ফিরল দো বাখনির দিকে, ভুরু কুঁচকে ধমকের সুরে ওকে বলল এখানে কাজের লোককে ডিসটার্ব না করে যেন অন্য কোথাও কোনও কাজ খুঁজে নেয়।
লীচের পরিকল্পিত দুর্ব্যবহার উপেক্ষা করবে বলে স্থির করল দো বাখনি। কোনও উত্তর না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু লীচের আসল উদ্দেশ্য ঝগড়া বাধাবে, তাই সে তেড়ে গেল ওর দিকে।
কাঁধের ঝাঁকি দেখাচ্ছ আমাকে, বাখনি? সবাইকে শুনিয়ে খেঁকিয়ে উঠল সে।
চলার গতি না কমিয়েই ঘাড় ফিরিয়ে উত্তর দিল মশিয়ে দো বাখনি, আর কি করলে পছন্দ হতো তোমার?
আমি চাই, আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা হবে। আমি এখানে ক্যাপটেন, যখন কথা বলব তার জবাবও আশা করব।
আমি তোমার নির্দেশ মেনে নিয়ে চলে যাচ্ছি। এর বেশি আর কি উত্তর চাও তুমি? থেমে ঘুরে দাঁড়াল সে লীচের দিকে। দুজনেই বেশ কিছুদূর সরে এসেছে, ওদের কথা এখন আর কেউ শুনতে পাচ্ছে না, কিন্তু দেখতে পাচ্ছে সবই। সবাই তাকিয়ে আছে এদিকে। ক্যাপটেনের আচরণে ঝগড়ার আভাস টের পেয়ে গেছে ওরা। মারপিট ওদের প্রিয়, বিষয়, আশা করছে লেগে যাক, দেখি কে জেতে। এখন আর কাজের ভানও করছে না কেউ।
বিতৃষ্ণার সঙ্গে চেয়ে আছে লীচ দো বাখনির দিকে।
কাঁধ ঝাঁকানো আমি সহ্য করতে পারি না। আমি যখন হুকুম দিচ্ছি তখন তো একেবারেই না। বিশেষ করে কোনও চালিয়াতি সর্বস্ব ফ্রেঞ্চ কাপুরুষের কাছ থেকে তো নয়ই।
লীচকে খুঁটিয়ে দেখল মশিয়ে দো বাখনি। ও নিজে সশস্ত্র, লীচও আজ তলোয়ার ঝুলিয়েছে কোমরে। ওর চোখে-মুখে প্রত্যাশা।
দেখা যাচ্ছে, একটা ঝগড়া বাধাবার জন্যে মুখিয়ে রয়েছ, বলল সে। কাজটা সবার সামনে করার সাহস নেই, কারণ তাহলে জবাবদিহি করতে হবে ওদের কাছে। কাজেই কিছুটা আড়ালে এনে আমাকে উস্কানি দেয়ার চেষ্টা করছ, যাতে রাগের মাথায় মেরে বসি। আর ওই যে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছ উওগানকে, যেন ও প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সবাইকে জানাতে পারে আমিই শুরু করেছিলাম আগে, আমাকে খুন না করে তোমার উপায় ছিল না। ঠিক ধরেছি ব্যাপারটা, টম?
ক্যাপটেনের চেহারা বলে দিল ওর ধারণাই ঠিক।
আমার ধারণাটাও শুনে রাখো, চার্লি। তুমি একটা কাপুরুষ, বেশ্যার দালাল; আস্ফালন করো তখনই, যখন বোঝো আক্রমণের কোনও ভয় নেই।
ক্যাপটেনকে অবাক করে দিয়ে জোরে হেসে উঠল দো বাখনি। বেহায়ার মত বলল, হয়তো ঠিকই বলেছ। তবে সবকিছুরই একটা নির্ধারিত দিনক্ষণ থাকে, টম। আমার রক্তপানের জন্যে তোমার ভিতরটা হয়তো তড়পাচ্ছে, কিন্তু ভুল সময় বেছে নিয়েছ। আজ ওটা বিষপানের সমান হবে। বানড্রি আর অন্যরা নিশ্চয়ই তোমাকে সতর্ক করেছে? কি, করেনি?
এসব লোকের কথা উল্লেখ করায় পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল লীচের। হাতে না হোক, মুখে হলেও অন্তরের ঘৃণা প্রকাশ করতে দ্বিধা করল না। ব্যাটা চাপাবাজ, কাপুরুষ! থুঃ! দো ঝখনির দিকে থুতু দিল লীচ, তারপর ঘুরে হাঁটতে শুরু করল দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে এদিকে অগ্রসরমান উগানের দিকে। কিন্তু কান খাড়া রেখে প্রস্তুত রয়েছে সে পিছনে সামান্যতম শব্দ হলেই তলোয়ার বের করে রুখে দাঁড়াবে। তার ধারণা এতবড় অপমান সহ্য করা কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়।
কিন্তু তাকে আশাহত করল মশিয়ে দো বাখনি। টু-শব্দ না করে একদৃষ্টে চেয়ে রইল সে লাল জামা পরা ক্যাপটেন লীচের গমন পথের দিকে। ছোট হয়ে গেছে চোখজোড়া, কিন্তু ঠোঁটের কোণে একটুকরো দুর্বোধ্য হাসি। ক্যাপটেন যখন উওগানের কাছে পৌঁছল তখন ঘুরে নিজের ক্যাম্পের দিকে রওনা হয়ে গেল সে।
রেগে গেছে উওগান ক্যাপটেনের বোকামি দেখে, মাথা নাড়ছে অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে।
ওহ্, ক্যাপটেন! আর একটু হলেই লেগে যাবে মনে হচ্ছিল। মেজাজটাকে একটুও সামলাতে পার না! আবার তো দিয়েছিলে সব ভজঘট করে!
ওর মুখের ওপর বাঁকা হাসি হাসল লীচ, কঠোর কণ্ঠে বলল, দেখো, ছোকরা! আমার ব্যাপার আমাকে আমার নিজের মত করে সামলাতে দাও, তোমরা মাতব্বরী মারতে এসো না।
এরই মধ্যে ভুলে গেলে যে এটা একা তোমার ব্যাপার নয়, আমাদের সবার ব্যাপার?
শোধ তুলে নেয়ার পর আবার কথাটা মনে পড়বে আমার।
কিন্তু ওকে যদি মেরে ফেল, তাহলে…
গাধা নাকি? ধমক দিল লীচ। কে মেরে ফেলছে ওকে? শুষ্ক হাসি হাসল লীচ খক্-খক্ করে। ভজঘট পাকাবার মানুষ আমি না, বুঝলে? কতটুকু করতে হবে জানা আছে আমার। গলা নামিয়ে শলা করার ভঙ্গিতে বলল, খালি একটু সুযোগ দিক, আমি ওকে দেখিয়ে দেব-শুধু ওকে না, তোমাদেরও দেখিয়ে দেব, উপযুক্ত লোকের হাতে একটা তলোয়ার কি খেলা দেখায়। কেটে হেঁটে সাইজে নিয়ে আসব ওকে, কিন্তু খুন করব না। চিরতরে ধুলোয় মিশিয়ে দেব হারামজাদার অসহ্য বোলচাল, আস্ফালন আর ফালতু অহঙ্কার। আমার কাজ শেষ হলে দেখবে, লেজ নাড়ার ক্ষমতাও থাকবে না কুকুরটার।
অসংখ্য যুদ্ধে নিজের আশ্চর্য দক্ষতা প্রমাণ করেছে লীচ, কাজেই বিনা প্রশ্নে মেনে নিল উওগান ওর দম্ভোক্তি। সবাই জানে টম লীচ তলোয়ারের জাদুকর।
কিন্তু তারপরেও অস্বস্তি গেল না আইরিশম্যানের। বলল, তা তুমি পার, একশোবার মানি, কিন্তু সে অবস্থাও তো তেমন সুবিধের হবে বলে মনে হচ্ছে না।
তাই বুঝি? ধীরে একটা চোখ বন্ধ করল লীচ। আমার ওপর আস্থা নেই তোমার, না? ওকে ভালমত জখম করে হাত-পা কেটে নেয়ার পর তোমার মনে হচ্ছে ওর কাছ থেকে গোপন তথ্যটা বের করার আর কোনও উপায় থাকবে না আমার হাতে নির্যাতনে হয়তো সত্যিই ওর মুখ খোলানো যাবে না, কিন্তু সেক্ষেত্রে ওর চোখের সামনে ওর ওই জানের জান কুত্তিটাকে কি করা হবে যখন বর্ণনা দেব একে একে, তারপর যখন করে দেখাব, তখন হারামজাদা মুখ না খুলে যাবে কোথায়?
চোখ জোড়া গোল হয়ে গেল উওগানের। তুমি আস্ত একটা পিশাচ, টম! কসম খোদার! ওর কণ্ঠস্বরে ঝরছে অকৃত্রিম প্রশংসা।
পাশাপাশি হেঁটে নিজেদের কেবিনের দিকে চলল দুজন।
মশিয়ে দো বাখনি ফিরে এসে দেখল আর কিছু করার না থাকায় সেলাইয়ে মন দিয়েছে প্রিসিলা। সামনে বসে অনর্গল বক্-বক করছে মেজর স্যান্ডস। ওকে দেখেই উঠে দাঁড়াল মেজর।
চলুন না, মশিয়ে, একটু হেঁটে আসি? প্রস্তাব দিল সে দো বাখনিকে। গা-টা ম্যাজম্যাজ করছে, ব্যায়াম-ট্যায়াম হচ্ছে না তো! কয়েকটা কথাও ছিল আপনার সঙ্গে। কেবিন থেকে বেশি দূরে যাব না।
মেজরের অতি মার্জিত, আন্তরিক ব্যবহারে অবাক হয়ে গেল মশিয়ে দো বাখনি। এতদিন কথায় কথায় বুঝিয়ে দিতে ছাড়েনি ও আর দো বাখনি দুজন দুই জগতের মানুষ। ও একজন ভদ্র বংশীয়, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী আর দো বাখনি একটা অতি জঘন্য, ছোট জাতের খুনে দস্যু– কপালদোষে যার সঙ্গে মেলামেশা করতে, বা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে।
নিশ্চয়ই, চলুন, বলল দো বাখনি।
সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বলে উঠল মেজর, খুবই উল্কণ্ঠার মধ্যে আছি আমি, বিশ্বাস করুন। সত্যি বলছি, দারুণ উৎকণ্ঠায় আছি। দেখা যাচ্ছে আপনার সঙ্গে খটাখটি লেগে গেছে বোম্বেটে লীচ আর তার দলের। ভাবছি, এখন আপনার যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমাদের কি হবে? বিশেষ করে মিস্ প্রিসিলার কি হবে?
আপনার কি মনে হয় ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি না আমি?
ভাবছেন? অনেকটা আশ্বস্ত হচ্ছি কথাটা শুনে। তবে পুরোপুরি নয়। মেজর গম্ভীর। গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না, এর আগেও এ ধরনের প্রশ্ন করে আপনার কাছে সদুত্তর পাইনি। আপনি বেশ বিরক্তও হয়েছিলেন। ওই যে, যেদিন আমি জানতে চেয়েছিলাম স্প্যানিশ জাহাজ আক্রমণ করতে যখন রওনা হবেন, আমাদের কি ব্যবস্থা হবে। এখন সময়টা আরও ঘনিয়ে এসেছে। আপনি নিশ্চয়ই প্রিসিলাকে সঙ্গে নিয়ে ওই রকম ভয়ঙ্কর এক অভিযানে যাওয়ার কথা ভাবছেন না?
এমন হতে পারে, আমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আপনারা হয়তো এখানেই রয়ে গেলেন, বলল মশিয়ে দো বাখনি।
খুশি হয়ে উঠল মেজর। আমিও ভাবছিলাম, এটা হয়তো সম্ভব হতে পারে। কিন্তু… থেমে দাঁড়াল সে হঠাৎ, তারপর ঘুরল সঙ্গীর দিকে, যদি কোনদিন আর না ফেরেন? তাহলে কি হবে, মশিয়ে দো বাখনি?
ঠিক কি বলতে চাইছেন?
বিপদের মধ্যে যাচ্ছেন, তাই না? স্প্যানিয়ার্ডদের তরফ থেকে হতে পারে বিপদ, আবার আপনার বন্ধু-বান্ধবের তরফ থেকেও হতে পারে। আপনাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেছে, আমাকে খুন করে ফেললেও বলব একথা। গতকাল এখানে যা ঘটল, আর ওই বোম্বেটে লীচের সঙ্গে আপনি যা ব্যবহার করলেন, আমার তো মনে হয়…
আপনার কি মনে হয় ওর সঙ্গে শিষ্টাচার করা উচিত ছিল আমার?
না, না। তা কেন? আপনার জায়গায় আমি হলেও এই একই ব্যবহার করতাম। দয়া করে ভুল বুঝবেন না আমাকে। আমি বলছি সম্পর্কের ব্যাপারে– লীচের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্বের ওখানেই পরিসমাপ্তি হয়েছে। এখন যদি বা সে চুপ করে থাকে, স্প্যানিশ গোল্ডের কাছে যখন ওকে পৌঁছে দিচ্ছেন, আপনার গোপন তথ্য যখন জানা হয়ে যাচ্ছে ওর, তখন কি ঘটতে পারে একবার ভেবে দেখেছেন? আস্ত রাখবে ও আপনাকে? কথাটা হয়তো ভেবে দেখেননি আগে?
হাসল মশিয়ে দো বাখনি। বলল, আপনি দেখছি ধরেই নিয়েছেন, এত স্পষ্ট একটা ব্যাপার বোঝার মত বুদ্ধিও নেই আমার মাথায়। ভেবেছেন, কিছু না বুঝে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছি আমি এই এতগুলো বছর, চোখ বুজেই কাটিয়ে দিয়েছি ভয়ঙ্কর একটা বিপজ্জনক জীবন?
বাঁকা কথা পছন্দ হলো না মেজরের। তবে রাগল না। অর্থাৎ, এ চিন্তাটা আপনার মাথাতেও এসেছে?
শুধু একটা সম্ভাবনা হিসেবে নয়। গতকালকের ঘটনার অনেক আগে থেকেই আমি জানি, চুক্তির শর্ত মানার ইচ্ছে লীচের নেই– বিশ্বাস ভঙ্গ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। নিশ্চিন্তে দিন গুনছে ও, সময় এলেই আমার গলাটা দুফাঁক করে দিয়ে কেড়ে নেবে মিস্ প্রিসিলাকে।
অ্যাঁ? হায়, খোদা! আতঙ্কিত হয়ে দিশে হারিয়ে ফেলল সে। তাহলে… তাহলে… আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে সে, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে দো বাখনির মুখের দিকে। কিন্তু তা যদি হয়… আবারও কথা হারিয়ে ফেলল সে। তার মোটা মাথাটা একেবারে গুলিয়ে গেছে। আমাকে খুন করে ফেললেও …
মেজরের অবস্থা দেখে মায়া হলো মশিয়ে দো বাখনির। বলল, কাজেই সতর্ক হতে হয়েছে আমাকেও। টম লীচ যেমন চায়, ঘটনা তেমন ভাবে নাও ঘটতে পারে। সম্পূর্ণ অন্য কিছুও ঘটতে পারে। আমারও তো কিছু পরিকল্পনা থাকতে পারে। ওর ইচ্ছে যেন পূরণ না হয়, তার জন্যে কিছু ব্যবস্থা কি আমিও নিতে পারি না?
হাঁ করে চেয়ে থাকল মেজর। বার দুই ঢোক গিলে বোঝার চেষ্টা করল কী হতে পারে সেই পরিকল্পনা। মনে হচ্ছে, আপনি ভাবছেন ওর অনুচরদের কারও ওপর নির্ভর করা যাবে?
আমি কি ভাবছি, তার কোন দাম নেই। দাম আছে আমি যা জানি, তার। আমি জানি, নিজের ওপর ছাড়া আর কারও ওপর নির্ভর করতে যাওয়া নেহায়েত বোকামি। এ রকম বিপদ এটাই আমার জীবনে প্রথম নয়, মেজর স্যান্ডস।
মশিয়ে দো বাখনির দৃঢ় আত্মবিশ্বাস আর দুর্দমনীয় মনোভাব দেখে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এল তার প্রতি মজরের ঘৃণা। একটু যেন ভালও লাগছে তার এখন জলদস্যুটাকে। মনে হলো, হ্যাঁ, বিপদে এই লোকের ওপর নির্ভর করা যায়।
তাহলে কোন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা হচ্ছে না আপনার, মশিয়ে?
হচ্ছে। জীবনে খুব কম ব্যাপারেই নিশ্চিত হওয়া যায়। যত বুদ্ধি খাটিয়েই পরিকল্পনা করুন না কেন, সেটা কেঁচে যেতে পারে যে কোনও সামান্য কারণে। অতি আত্মবিশ্বাস মানুষকে অসাবধান করে দেয়। তবে একটা ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, মেজর, আমাকে যতই অপছন্দ করুন না কেন, মিস্ প্রিসিলার প্রতি আমার গভীর প্রীতি ও অনুরাগের কারণে যেমন করে পারি আমি তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব। আপনিও তার ফল ভোগ করবেন। কথা বলতে বলতে কেবিনের দিকে চোখ গেল দো বাখনির। এই যে, পিয়েখ এসে পড়েছে, বলেই মেজরকে ফেলে দ্রুতপায়ে এগোল তার দিকে।
মশিয়ে দো বাখনির শেষ কথাটা প্রবল ভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছে মেজর স্যান্ডসকে। আবার রাগ চড়ে যাচ্ছে মাথায়। কটমট করে তাকিয়ে রইল সে লোকটার পিঠের দিকে। বলে কি বদমাইশ! প্রিসিলার প্রতি তার গভীর প্রীতি ও অনুরাগের কারণে ! সত্যি, বড় বেশি বেহায়া আর উদ্ধত এই লোক। সহ্য করা যায় না!
পিয়েখ তাঁবুতে ঢোকার আগেই লম্বা পা ফেলে ওর কাছে পৌঁছে গেল মশিয়ে দো বাখনি। কিন্তু প্রশ্ন করার আগেই মাথা নাড়ল পিয়েখ নিচের ঠোঁট সামনে ঠেলে দিয়ে।
হতাশ হলো দো বাখনি। জ্বজোড়া কুঁচকে বলল, অবস্থা বেশ খারাপের দিকেই চলেছে দেখা যায়!