৩. দুটো স্টেশনের মাঝখানে

তারপর একসময় দুটো স্টেশনের মাঝখানে হঠাৎ হুংকার দিয়ে উঠে দাঁড়াল ওরা পাঁচ জন। রতনের গলাটাই সবচেয়ে বাজখাঁই, সে হুংকার দিয়ে বলে উঠল, খবরদার, কেউ টু শব্দটি করবে না! মধুময়ের হাতে ঝলমল করে উঠল একটা মস্তবড়ো ভোজালি। সে দাঁড়াল দরজা আটকে।

কথা ছিল সাধারণের ঘড়ি, মানিব্যাগ নেওয়া হবে না। কিন্তু কিছু যাত্রী ভয় পেয়ে নিজের থেকে তাদের ঘড়ি আর মানিব্যাগ ছুঁড়ে দিতে লাগল ওদের পায়ের কাছে। একজন ভদ্রমহিলা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে নিজের হাতের চুড়ি খুলতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, আমার ছেলেকে কিছু বোলো না। আমার একমাত্র ছেলে।

ধনাটা লোভীর মতন কুড়িয়ে নিতে লাগল সেই সব ঘড়ি, মানিব্যাগ আর চুড়ি। রতন আর কল্যাণ দু-জন যাত্রীর হাতব্যাগ ধরে টানাটানি করছে। এই সময় একটা যাত্রী হঠাৎ তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে চেন টেনে দিল। আর চিৎকার করতে লাগল তারস্বরে।

বিশু তার বুকের কাছে খেলনা পিস্তল ঠেকিয়ে ধমকাতে লাগল, খবরদার! একদম চুপ! মেরে ফেলব একেবারে!

ট্রেন থেমে এল আস্তে আস্তে, দুটো বাচ্চাছেলে মধুময়ের বগলের ফাঁক দিয়ে গলে লাফিয়ে পড়ল মাটিতে।

মধুময় তাদের আটকাতে পারল না। ভেবেছিল, অত বড়ো ভোজালিটা দেখেই সবাই ভয় পাবে। কিন্তু কেউ ভয় না পেলে তার গায়ে ভোজালির কোপ বসাবার কথা মধুময় চিন্তাই করেনি। ছেলে দুটো মধুময়কে ভয় পেল না কেন? তার মুখ দেখেই কি ওরা বুঝে গিয়েছিল যে, সে কারুকে মারতে পারবে না? সে একজন শৌখিন ডাকাত?

রতন আর কল্যাণ তখনও ব্যাগ দুটো ছিনিয়ে নিতে পারেনি বলে, মধুময় বুঝতে পারছিল না কী করা উচিত।

এদিকে বাচ্চা দুটো মাটিতে নেমে চিৎকার করতে লাগল, ডাকাত! ডাকাত! মেরে ফেলল সবাইকে মেরে ফেলল!

রতন হুকুম দিল, রিট্রিট!

পাশের কামরাগুলো থেকে যাত্রীরা বেরোবার আগেই ওরা দৌড়োল মাঠের মধ্যে দিয়ে। কিছু যাত্রী খানিকটা পথ তাড়া করে এল বটে কিন্তু ওদের কেউ ছুঁতে পারল না।

প্রায় তিন মাইল দূরে একটা বাঁশঝাড়ের পাশে ওরা একটু বিশ্রাম নিতে বসল। তখন দেখা গেল ওদের মধ্যে একজন কম। পাঁচ জনের মধ্যে চার জন এসেছে। বিশু নেই। বিশু কি তাহলে অন্য দিকে পালিয়ে গেল?

ধনা বলল, বিশেটাকে আমি কিন্তু মাইরি ট্রেন থেকে নামতে দেখিনি।

রতন তার কলার চেপে ধরে বলল, শালা, সে-কথা তুই আগে বলিসনি কেন?

 ধনা বলল, বললেই-বা কী হত? তুই কি তাহলে ফিরে যেতিস তাকে আনতে?

বেচারা বিশু, খেলনা পিস্তল নিয়ে ধরা পড়ে গেছে।

রতন বলল, এখানে বসে থাকলে আরও ডেঞ্জার আছে। এক্ষুনি সার্চপার্টি আসতে পারে। চার জন চারদিকে ছড়িয়ে পড়। নিজের বাড়িতে ফিরে যাসনি এখন। বিশুটা প্যাঁদানি খেয়ে নির্ঘাত সবার নাম বলে দেবে।

মধুময়ের গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। সে বলল, বাড়ি ফিরব না? তাহলে আমি যাব কোথায়?

 রতন জিজ্ঞেস করল, তোর কি অন্য কোথাও লুকোবার জায়গা নেই?

 মধুময়ের চকিতে মনে পড়ে গেল স্বপ্নার কথা। নিজেদের বাড়িতে না ফিরে সে স্বপ্নার কাছে গিয়ে বলতে পারে, আমি ট্রেন ডাকাতি করে এসেছি। আমাকে তোমার কাছে লুকিয়ে রাখো।

সে ঘাড় নেড়ে বলল, না, নেই।

এই খেয়েছে। তাহলে কী হবে? বাড়ি ফিরলেই তো ধরা পড়ে যাবি। ঠিক আছে, তুই আয় আমার সঙ্গে।

তক্ষুনি উঠে ওরা ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন দিকে। মধুময়ের বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। এর আগে সে কখনো রাত্রে বাড়ির বাইরে থাকেনি। ব্যাপারটার গুরুত্বও যেন সে বুঝতে পারেনি আগে। ধরা পড়া মানেই তো জানাজানি হয়ে যাওয়া। স্বপ্না জেনে যাবে যে, সে ট্রেনে ডাকাতি করতে গিয়েছিল।

সে রতনকে জিজ্ঞেস করল, কত দিন আমরা বাড়ির বাইরে থাকব? বাড়ির লোকই তো পুলিশে খবর দেবে।

রতন বলল, দু-তিন দিন ঘাপটি মেরে থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘাবড়াসনি।

রতনের সঙ্গে মধুময় বড়োরাস্তায় এসে বাস ধরল। আধ ঘণ্টা বাদে সেই বাস থেকে নেমে আবার ধরল উলটো দিকের একটা বাস। এইরকম ভাবে, প্রায় পাঁচ বার গাড়ি বদল করে সন্ধ্যা নাগাদ তারা এসে পৌঁছোল হাওড়ায়।

ব্রিজ পেরিয়ে ওরা কিন্তু কলকাতায় এল না। একটা ট্যাক্সি নিয়ে হাওড়া শহরের মধ্যেই অনেক গলি ঘুরে ঘুরে থামল এসে একটা বাড়ির সামনে।

একটা খুব পুরোনো আমলের দোতলা বাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার পর রতন চেঁচিয়ে ডাকল, মুক্তো! ও মুক্তো

তিরিশ বত্রিশ বছরের একটি স্ত্রীলোক বেরিয়ে এসে রতনকে বলল, কী ব্যাপার?

রতন একগাল হেসে বলল, তোমার এখানে থাকব আজ, সঙ্গে এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছি।

মুক্তো নামে সেই স্ত্রীলোকটি বলল, থাকবে কী গো! বলা নেই কওয়া নেই হুট করে এসে থাকব বললেই কী হয়? আমার ঘরে আজ লোক আছে।

মধুময় এসব কথার মানে কিছুই বুঝতে পারল না। এটা কি একটা হোটেল?

 রতন বলল, তোমার ঘর আটকা? তাহলে ছাদে সেই যে ছোটো একটা ঘর ছিল?

সেখানে থাকবে? কেন বাপু? মুখ দিয়ে এখনও দুধের গন্ধ যায়নি, বাড়ি যাও না! মা-বাবা চিন্তা করবে না?

আঃ বাজে কথা ছাড়ো, থাকতে দেবে কি-না বল না?

মুক্তো ঘরের ভেতর ঢুকে গিয়ে একটা চাবি নিয়ে এল। সেটা রতনের হাতে দিয়ে বলল, যাও, ঘর খুলে বোসোগে! আমি যাব অখন একসময়।

সিঁড়ি দিয়ে রতন আর মধুময় উঠে এল ছাদে। একটা লম্বাটে ছোট্ট ঘর। চাবি খোলার পর দেখা গেল, সে ঘরের মেঝেতে একটা তেলচিটে মাদুর পাতা আছে শুধু, আর কিছু নেই।

মধুময় জিজ্ঞেস করল, এটা কার বাড়ি রতনদা? ওই মেয়েটি তোমার আত্মীয়?

রতন বলল, সব আস্তে আস্তে টের পাবি। এখন মুখ বুজে থাক, বেশি কথা জিজ্ঞেস করিস না। তুই বাড়িতে না ফিরলে তোর বাড়ির লোক চিন্তা করবে?

তা তো করবেই। আমি অবশ্য বলে এসেছি, তারকেশ্বরে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি …আজ রাত্তিরে না ফিরলে ভাববে হয়তো সেখানে আটকে গেছি, কিন্তু কাল সকালে

এখানে চার-পাঁচ দিন ঘাপটি মেরে থাকা দরকার… সব ব্যাপারটা কেঁচে গেল।

চার-পাঁচ দিন!

এ-লাইনে এলে একটু ঝুঁকি নিতেই হয়।

রতনদা, তুমি আগে বলনি।

আগে কী বলব? তুই কি কচি খোকা? কিছু বুঝিস না?

মধুময় সত্যিই তো কচিখোকা নয়। তার তো জানা উচিত ছিল যে, আগুনে হাত দিলে একবার-না-একবার হাত পুড়ে যেতেই পারে। মধুময় নিজের ডান হাতের পাঞ্জার দিকে তাকাল, সত্যিই যেন, সেখান থেকে পোড়া পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে।

রতন তার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল, আরে, এখনই এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন?

ব্যবসায়ীটির কাছ থেকে হাতব্যাগটা ছিনিয়ে আনতে না পারলেও কোনো এক ফাঁকে রতন ছ-গাছি সোনার চুড়ি, তিনটি মানিব্যাগ আর তিনটে হাতঘড়ি ঠিক হাতিয়ে আনতে পেরেছে।

দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে রতন মানিব্যাগগুলো খুলে মাদুরের ওপর ঝাড়তে লাগল। সব মিলিয়ে তিন-শো বারো টাকা আছে। একটা মানিব্যাগের মধ্যে একটি বাচ্চাছেলের ছবি। সেই ছবিটার দিকে তাকাতেই লজ্জা করল মধুময়ের।

রতন ছবিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলল, আর যা-কাগজপত্র ছিল সবই ছিঁড়ে ফেলে লুকিয়ে রাখল মাদুরের তলায়। ব্যাগগুলো নিয়ে সে কী করবে ভেবে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর বেরিয়ে গেল দরজা খুলে।

ছাদের কোণে একটা গঙ্গাজলের ট্যাঙ্ক। সেই ট্যাঙ্কের ঢাকনা খুলে অনেকখানি মুখ ঝুঁকিয়ে রতন ব্যাগ তিনটেকে গেঁথে রাখল জলের তলায় মাটিতে। তারপর নিশ্চিন্ত মুখ করে ফিরে এল ঘরে।

একটা ঘড়ি সে নিজের হাতে পরে অন্য আর একটা ঘড়ি মধুময়কে দিয়ে বলল, পরে নে।

মধুময় ঘড়িটা ফেরত দিয়ে বলল, আমার দরকার নেই। তুমিই রাখো।

 রতন বলল, আমি এতগুলো ঘড়ি নিয়ে কী করব? একটা রাখ তোর কাছে

ঘড়িটা সে ছুড়ে দিল মধুময়ের কোলের ওপর।

বাকি ঘড়িটা আর সোনার চুড়িগুলো সে নিজের পকেটে রাখল।

টাকাগুলো থেকে গুনে গুনে সে এক-শো টাকা তুলে নিয়ে মধুময়ের হাতে দিয়ে বলল, এই টাকাগুলো তোর পকেটে রাখ। আজ দুপুরের ব্যাপারটা নিয়ে তুই মুক্তোকে কিছু বলবি না। যা, বলার আমি বলব, তোকে আমি সাজাব একটা কয়লাখনির মালিকের ছেলে। আমি ওকে বলব– রতনের তুলনায় মধুময় বেশি পড়াশুনো করেছে, সে খবরও রাখে অনেক বেশি। সে বলল, কয়লাখনির আবার এখন কোনো মালিক আছে নাকি? সব খনি তো গভর্নমেন্ট নিয়ে নিয়েছে।

রতন তাতে একটুও থতমতো খেল না, সে অবহেলার সঙ্গে বলল, তোর ওসব ফ্যাকড়া তুলতে হবে না। মুক্তো ওসব কিছু বোঝে না। আমি বলব, তোকে নিয়ে আমরা এখানে ফুর্তি করতে এসেছি। দেখিস, মুক্তো এইকথা শুনেই বলবে, ফুর্তি করতে এসেছ! এ লাইনে নতুন দেখছি! এই বলেই তোর থুতনিতে হাত দিয়ে একটু আদর করবে। তুই তখন ওই পুরো এক-শো টাকা তুলে দিবি মুক্তোর হাতে। ছ্যাঁচড়ামি করে দু-একটা দশ টাকার নোট লুকিয়ে রাখিস না যেন, পুরোটাই দিবি, তাহলে দেখবি খুব খাতির করবে।

মধুময়ের শরীরে একটা শিহরন লাগল। মুক্তোর জীবিকা কী, এখন তা বুঝতে আর কোনো অসুবিধে নেই। সে কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি যে, কোনোদিন এ-রকম কোনো বাড়িতে এসে সে রাত কাটাবে।

জায়গাটা রতনের বেশ পরিচিত দেখা যাচ্ছে। সে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে ডাকতে লাগল, হরিয়া, এ হরিয়া!

একটু পরে একজন বেশ জোয়ান শক্তসমর্থ চেহারার বুড়োলোক উঠে এল ছাদে।

 রতন তাকে প্রথমে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বলল, রুটি আর তড়কা এনে দাও তো হরিয়া। তারপর আরও একটা দশ টাকার নোট বার করে দিয়ে বলল, মুরগির মাংসও আনবে। আবার দুটো দশ টাকার নোট দিয়ে বলল, আর তিন চার বোতল বিয়ার!

লোকটি চলে যেতেই রতন উপুড় হয়ে মাথা গুঁজে শুয়ে পড়ল, আর একটু বাদেই তার নাক ডাকতে লাগল।

মধুময় বসে রইল গুম হয়ে। এক দিনের মধ্যেই এত কান্ড হয়ে গেল যে, সে খানিকটা দিশাহারা বোধ করছিল। সে কিন্তু ঠিক ভয়ও পায়নি। বরং এইসব নিষিদ্ধ ব্যাপারে খানিকটা রোমাঞ্চই অনুভব করছিল মনে মনে। তিন-চারদিন বাড়ি না ফিরলে, বাড়িতে কী ধরনের হই-চই হবে, কে জানে! সে যাই হোক, ফিরে গিয়ে মধুময় কোনো রকমে সব ঠিক ম্যানেজ করে নেবে। শুধু যেন, স্বপ্নার কানে কোনো কথা না যায়।

কিন্তু সেই সাড়ে তিন হাজার টাকা জোগাড় করা হল না। এ যাত্রায় যদি মধুময় বেঁচেও যায়, আর এরপর এই লাইন, একেবারে যদি ছেড়েও দেয়, তবু সারাজীবন তার মনের মধ্যে একটা গ্লানি থেকে যাবে। রাত্তির বেলার দিকে চৌরঙ্গিতে আবছা অন্ধকারে কোনো ধনী লম্পটের পাশাপাশি কোনো ভীরু লাজুক চেহারার বাঙালি মেয়েকে দেখলেই তার মনে হবে, সেই মেয়েটির দুর্ভাগ্যের জন্য মধুময়ই দায়ী।

হরিয়া খাবার নিয়ে এল প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে। দুটো ভাঁড়ে মাংস আর তড়কা, ঠোঙার মধ্যে রুটি আর পেঁয়াজ কাঁচা লঙ্কা, আর চার বোতল বিয়ার।

রতন প্রথমেই হরিয়াকে দুটো রুটি আর খানিকটা তড়কা আর মাংস তুলে দিয়ে বলল, এই নাও। খাও।

হরিয়া বলল, এ বাবু, হামাকে থোড়াসা বিয়ার পিলান!

 যাও তোমার গেলাস নিয়ে এসো, আর আমাদের জন্যেও দুটো গেলাস এনো।

রতন নিজে খেতে শুরু করে দিল সঙ্গে সঙ্গে। মধুময় ঠিক শুরু করতে পারছে না। হাত টাত ধোওয়া হয়নি। সারা গা ঘামে চিটচিট করছে। ভালো করে জল দিয়ে মুখ হাত না ধুতে পারলে তার খেতে রুচি হচ্ছে না।

রতন বলল, পেট ভরে খেয়ে নে মধু।

মধুময় অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল রতনের দিকে।

 রতন বলল, দেখছিস তো, পেট খালি রাখলেই নানারকম দুশ্চিন্তা আসে। দু-চারদিন আমরা এখানে খাব-দাব, ঘুমোবো, তারপর দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।

মধুময়েরও খুব খিদে পেয়েছিল। আর দেরি না করে সেও একটা রুটি তুলে নিয়ে মাংসের ঝোলে ডোবাল।

হরিয়া তিনটে গেলাস নিয়ে এসেছে। সে দরজার বাইরে বসে নিজের গেলাস থেকে চুক চুক করে বিয়ার খাচ্ছে।

কি–সব বিয়ার শেষ করে ফেললে? দরজা ফাঁক করে দাঁড়াল মুক্তো।

 রতন বলল, না না, তোমার জন্যও রেখেছি। এই হরিয়া, আর একটা গেলাস।

মুক্তো বলল, গেলাস লাগবে না। বলে একটা বোতল তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে ঢালল গলায়। তারপর তৃপ্তির সঙ্গে বলল, আঃ! আজ বড্ড খাটুনি গেছে।

মধুময় কিছুতেই বিস্ময় লুকোতে পারছে না মুক্তোকে দেখে। তার চোখ দুটি বিস্ফারিত। জীবনে এটা তার একটা নতুন অভিজ্ঞতা।

মুক্তো পরে আছে শুধু একটা কালো শায়া আর একটা সাদা ব্রেসিয়ার। তার স্বাস্থ্য বেশ ভরাট, ব্রেসিয়ার উপছে বেরিয়ে আছে দুই স্তন। এইরকম পোশাকে কোনো মেয়ে যে পুরুষদের সামনে আসতে পারে, সিনেমায় নয়, বাস্তবজীবনে, এ-রকম ধারণাই ছিল না মধুময়ের। এজন্য বিন্দুমাত্র সংকোচ নেই মুক্তোর, এমনকী হরিয়ার মতন একজন ভৃত্যশ্রেণির লোক যে বসে আছে, তা-ও সে গ্রাহ্য করছে না।

আজ আবার এ কাকে নিয়ে এসেছ? মুক্তো প্রশ্ন করল রতনকে।

রতন বলল, এ আমার এক বন্ধু, একটা কয়লাখনির মালিকের ছেলে…

মুক্তো খিল খিল করে হেসে উঠল। হাসির সঙ্গে সঙ্গে, তার স্তন দু-টি কাঁপতে থাকে।

নতুন যে আসে, সে-ই তো শুনি কয়লারখনির মালিকের ছেলে! দেশে কত কয়লার খনি আছে গো?

মধুময় ততক্ষণে পকেট থেকে সেই এক-শোটা টাকা বার করে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে মুক্তোর দিকে।

বাপের পকেট মারা হয়েছে বুঝি? আসতে-না-আসতেই টাকা দিচ্ছ যে–

মধুময় এরপর আর কী কথা বলবে বুঝতে পারল না। সে মুক্তোর দিকে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতেও লজ্জা পাচ্ছে। সে চোখ নামিয়ে নিল।

সে মন দিয়ে দেখতে লাগল নিজের ডান হাতের পাঞ্জাটা। তার হাতের রং আগে তো এ রকম ছিল না, ঠিক পোড়াটে কালো রং। সে স্পষ্ট অনুভব করছে চামড়াপোড়া গন্ধ!

মুক্তো বসে পড়ল ওদের গা ঘেঁসে। শায়াটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে সে বলল, যা গরম, এঘরে তোমরা দু-জনে থাকবে কী করে? এই হরিয়া, এখানে বসে বসে বিয়ার গিলছিস, লজ্জা করে না? যা, আমার দোতলার ঘরটা সাফ করে দে তাড়াতাড়ি। এমন একটা টেটিয়া লোক এসেছিল কিছুতেই যেতে চায় না, তার ওপর আবার বমি করে ঘর ভাসিয়েছে!

হরিয়া চলে যেতেই মুক্তো মধুময়কে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী ভাই?

 মধুময় রতনের দিকে তাকাল। এখানে সত্যি নাম বলতে হয় না, বানিয়ে বলতে হয়, তা সে জানে না।

মধুময়ের দ্বিধা দেখে মুক্তো বলল, ঠিক আছে, তোমার নাম বলতে হবে না, আমিই তোমার নাম দিয়ে দিচ্ছি। তোমার নাম দিলাম আমি নাড়ুগোপাল!

বলেই সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল মধুময়ের বুকে। দু-হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, কি-আমাকে পছন্দ নয়?

মধুময়ের এইটুকু জীবনে কোনো নারী তার এত ঘনিষ্ঠ হয়নি। কারও স্তনের স্পর্শ লাগেনি তার বুকে। কেউ তার গলা জড়িয়ে ধরেনি এমনভাবে। স্বপ্না ছাড়া আর কোনো মেয়ের সঙ্গে মেশেনি সে। স্বপ্নার সঙ্গে এ-রকম শারীরিক ঘনিষ্ঠতার কথা কল্পনাই করা যায় না।

উত্তেজনায় তার চোখের কোণ চিবুক ও কানের লতিতে যেন জ্বালা করতে লাগল। সে কোনো কথা বলতে পারল না।

কি-–তোমার বন্ধুটি বোবা নাকি গো?

রতন বলল, প্রথম দিন এসেছে তো, তাই লজ্জা পাচ্ছে।

রতন মুক্তোর কোমরে হাত দিয়ে তাকে আকর্ষণ করল নিজের দিকে। এবার মুক্তো মধুময়কে ছেড়ে অবলীলাক্রমে মাথা রাখল রতনের বুকে। তারপর বলল, একটা সিগারেট দাও-না মাইরি!

রতন মুক্তোর দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিতেই সে বলল, ধরিয়ে দাও।

এক হাতে সিগারেট আর এক হাতে বিয়ারের বোতল নিয়ে সে রতনের বুকে শুয়ে রইল খানিকক্ষণ। বিয়ার ও সিগারেট দুটোই শেষ করার পর সে উঠে বসল আবার। ব্যস্ত হয়ে বলল, অনেক রাত হয়ে গেল। তোমরা তো দিব্যি খেয়ে নিয়েছ। আমায় খেতে হবে না? খিদে পেয়েছে।

নিজের বুকের ওপর থেকে রতনের হাতটা সরিয়ে দিয়ে মুক্তো বলল, তোমরা সারারাত থাকবে তো? নীচে আমার ঘরে তোমাদের মধ্যে একজন চলো, আর একজন এখানেই ঘুমোও। একটা বালিশ পাঠিয়ে দিচ্ছি।

তারপর মধুময়ের দিকে চেয়ে বলল, এই নাড়ুগোপাল তো আজ নতুন এসেছে, ও-ই আমার সঙ্গে চলুক আজ।

রতন বলল, কেন আমরা তিনজনেই তোমার ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকি না?

 মুক্তো বলল, উঁহু। ওসব চলবে না। বললুম না, আজ বড্ড খাটুনি গেছে, আজ আর ওসব পারব না।

রতন বলল, আমি চুপচাপ পাশে শুয়ে থাকব।

তোমাকে আমি চিনি না! তুমি মহা ফেরেব্বাজ।

মুক্তো উঠে দাঁড়িয়ে মধুময়ের হাত ধরে বলল, এসো নাড়ুগোপাল, চলো।

রতন বলল, ঠিক আছে, ও-ই যাক, আমরা কয়েকদিন থাকছি এখানে।

ঘর থেকে বেরোবার সময় মধুময় একবার অসহায়ভাবে তাকাল রতনের দিকে।

রতন হাসতে হাসতে বলল, দেখিস, সাবধান! মুক্তো যেন তোকে কাঁচাই খেয়ে না ফেলে! ও কিন্তু তা পারে।

মুক্তো বলল, মারব ঝ্যাঁটা।

ঠিক একটা বাচ্চাছেলের মতন মধুময়ের হাত ধরে টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল মুক্তো। মধুময় সম্পূর্ণ নির্বাক।

দো-তলার ঘরখানা জিনিসপত্রে ঠাসা। একটা আলমারি, একটা ড্রেসিং টেবিল একটা বড়ো খাট। ড্রেসিং টেবিলের কাঁচটা বাজে, মুখ লম্বা দেখায়।

মুক্তো মধুময়কে খাট দেখিয়ে বলল, একটু বোসো, আমি আসছি।

মধুময় আড়ষ্টভাবে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল ঘরখানা। দেওয়ালে পুরোনো ক্যালেণ্ডারের অনেকগুলো ছবি আঠা দিয়ে সাঁটা। সবই শিব, দুর্গা, কালী–এইসব ঠাকুর দেবতার ছবি। ঘরে কীরকম যেন একটা আঁশটে গন্ধ, দুটো জানলা, দুটোই বন্ধ।

মুক্তো ফিরে এল একটু বাদেই। তারপর খাটের তলা থেকে টেনে বার করল কয়েকটা বাটি আর ডেকচি। সেগুলোর ঢাকা খুলতেই দেখা গেল, তাতে রয়েছে ভাত, ডাল, তরকারি আর মাছ।

মাটিতে বসে পড়ে মুক্তো বলল, ও নাড়ুগোপাল, একটু খাবে কিছু?

মধুময় বলল, না, আমি খেয়েছি। আপনি খান।

মুক্তো একগাল হেসে বলল, ও বাবা, আপনি, আজ্ঞে! শোনো বাবু এখানে ওসব চলে না। আমাকে তুমি বলো। অনেকে তো তুই তোকারি করে। খাবে না আমার সঙ্গে? আমার হাতের ছোঁয়া বুঝি খেতে নেই? তোমরা আর সব পার, শুধু হাতের ছোঁয়া খেলেই তোমাদের জাত যায়।

না, সেজন্য নয়। আমি সকলের ছোঁয়া খাই। কিন্তু একটু আগেই তো অনেক খেলাম।

তাও একটু খেয়ে দেখো, আমি কেমন বেঁধেছি। আমি বাপু নিজে রাঁধি, দোকানের কেনা জিনিস পারতপক্ষে খাই না।

ডাল, আলু-শজনেডাঁটার তরকারি আর পারসে মাছ। ঠিক মধুময়দের বাড়ির রান্নার মতন। ঠিক মাসি-পিসিদের মতনই মুক্তো জোর করে তাকে বলতে লাগল, আর একটু ভাত নাও। আর একটা মাছ দেব?

মুক্তো মধুময়ের চেয়ে অন্তত দশ-বারো বছরের বড়ো।

খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দাতেই বালতিতে রাখা জলে ওরা হাত ধুয়ে নিল।

মুক্তো জিজ্ঞেস করল, তুমি ওই সব পরেই শোবে নাকি? একটা শাড়ি দেব-লুঙির মতন করে জড়িয়ে নেবে।

মধুময় বলল, না না, তার দরকার নেই।

মধুময় পরে আছে প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট। সে জীবনে কখনো লুঙি পরেনি। একটি অচেনা মেয়ের শাড়ি পরে সে শোবে!

এই ধারণাটাই তার কাছে অদ্ভুত লাগে। এতক্ষণ বাদে মধুময় ভয় পাচ্ছে। যেন, এবার একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটে যাবে।

এতক্ষণ তার অনুভূতি যেন সম্পূর্ণ অসাড় হয়েছিল। এখন সে হঠাৎ উপলব্ধি করল যে তাকে নীচে আনা হয়েছে এই মুক্তো নামের মেয়েটির সঙ্গে একঘরে শোয়ার জন্য। তা কি সম্ভব? এই স্ত্রীলোকটিকে সে কয়েক ঘণ্টা আগেও চিনত না!

মুক্তো একটু হাই তুলতে গিয়েও চেপে গেল। তারপর খানিকটা জোর করে হাসি টেনে বলল, এখন গল্প করবে, না শোবে?

মধুময় বলতে চাইল, আমি ওপরে চলে যাই। আমি রতনের পাশে শুয়ে থাকতে পারব। গরমে আমার কষ্ট হবে না। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারল না।

তুমি পান খাও?

না।

আমিও খাব না। একটা সিগারেট দাও বরং।

আমার কাছে তো সিগারেট নেই! ওপর থেকে নিয়ে আসব?

না, থাক। আর আনতে হবে না। এবার তাহলে আলো নিভিয়ে দিই?

 মধুময় হঠাৎ আড়ষ্ট গলায় বলে উঠল, আমি বাইরে শোব।

মুক্তো ভুরু দুটো তুলে জিজ্ঞেস করল, বাইরে শোবে? কেন?

মধুময় বলল, বাইরে শুতেই আমার ভালো লাগবে। বারান্দায় তো অনেক জায়গা আছে।

মুক্তো বলল, বারান্দায় শোবে? তাহলে মাঝরাত্তিরে কী হবে জান? তোমার ভূতে ধরবে। বলেই হি হি করে খুব জোরে হেসে উঠল মুক্তো।

মধুময় তবুও দৃঢ়ভাবে বলল, না, আমি বাইরেই শোব, আমার কিছু হবে না।

 মুক্তো হাসি থামিয়ে বলল, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? রাতদুপুরে তোমায় বারান্দায় দেখলে এ বাড়ির চাকররা ভাববে আমি তোমায় ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। তখন তারা তোমায় চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে রাস্তায় ফেলে দেবে। দুষ্টুমি কোরো না, লক্ষ্মীছেলের মতন শুয়ে পড়ো!

মধুময় অসহায়ভাবে, প্রায় মিনতির সুরে বলল, তাহলে আমি ঘরের মধ্যেই মাটিতে শুচ্ছি। আমায় বিছানা লাগবে না।

মুক্তো এবার মধুময়ের মাথাটা দু-হাতে জড়িয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কেন গো নাড়ুগোপাল? আমায় ভয় পাচ্ছ? আমি কি সত্যি তোমায় খেয়ে ফেলব নাকি? আলো নিভিয়ে দিচ্ছি, আর দেরি করতে পারছি না।

কিন্তু আলো নেভাবার আগেই মুক্তো তার শায়া আর ব্রেসিয়ার খুলে ফেলল চট করে। মধুময় চোখ বুজে ফেলল। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে।

সে আগে অনেক মেয়ের ছবি এঁকেছে। এমনকী নগ্ন মেয়েদের ছবিও এঁকেছে কয়েকখানা। কিন্তু কখনো বাস্তবে দেখেনি। বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবিগুলো দেখে নকল করেছে সে। সেইগুলো আঁকবার সময়ই তার শরীর ঝিম ঝিম করত। বাথরুমে ছুটে গেছে অনেকবার। এখন চোখের সামনে বাস্তব একটি গোটা নগ্ন রমণী দেখে সে যেন ঠিক সহ্য করতে পারল না। ঘরের মধ্যে বড় চড়া আলো। এই আলোটা ঠিক নয়। একটা হালকা নীল আলো জ্বালা থাকলে সে মুক্তোর ছবি আঁকতে পারত।

মুক্তো আলনা থেকে একটা ছাপা শাড়ি টেনে জড়িয়ে নিল গায়ে। তারপর টুপ করে আলো নিভিয়ে খাটে উঠে এসে মধুময়কে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার নাড়ুগোপাল, সত্যিই নাড়ুগোপাল!

মধুময় শুয়ে রইল কাঠ হয়ে। তার শরীর দাউ দাউ করে জ্বলছে। কিন্তু মুক্তোর শরীরটা খুব ঠাণ্ডা। সে যেন স্নেহের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আছে মধুময়কে। এই অবস্থাতেও মধুময় মনে মনে ঠিক যেন জপ করার ভঙ্গিতে বলল, স্বপ্না, আমি কি পাপ করছি? তুমি আমাকে ক্ষমা করো। ক্ষমা করবে না? আমি এতটা বুঝতে পারিনি। বিশ্বাস করো, আমি বুঝতে পারিনি।

মধুময় খুব সন্তর্পণে নিজেকে মুক্তোর আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিল।

মুক্তো বলল, তোমার কিছু ইচ্ছে করছে না বুঝি? তাহলে বাপু আজ লক্ষ্মীছেলের মতন ঘুমিয়ে পড়ো। আমারও বড্ড ঘুম পাচ্ছে। যা খাটুনি গেছে সারাদিন।

একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল মুক্তো।

 মধুময়ের চোখ খরখরে। যেন তার সারারাত ঘুম আসবে না কিছুতেই। শুয়ে শুয়ে সে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। রতনদের সঙ্গে মিশে সে কিছু কিছু নিষিদ্ধ কাজ ও কথাবার্তায় বেশ আনন্দই পেত। কারণ, তাদের বাড়ির আবহাওয়া বড়ো মার্জিত। মধুময় বাড়ির বাইরে এসে, একটা অন্যরকম স্বাদ পেয়েছিল এই প্রথম। ছোটোখাটো বেআইনি কাজেও সে কোনো অন্যায় দেখেনি। কারণ এতদিন বেকার থেকে সে বুঝেছিল, এই সমাজ বেকার তৈরি করে, কিন্তু বেকারদের সম্পর্কে কোনো দায়িত্ব নেয় না। যেকোনো উপায়েই থোক, এই সমাজকে একটা আঘাত দেওয়া দরকার। বাড়ির কড়া শাসনে মধুময় কখনো কোনো রাজনৈতিক দলে ভিড়তে পারেনি। সেইজন্য ও ব্যাপারে তার কোনো স্পষ্ট ধারণাও নেই।

রতনের দুর্দান্তপনা ও দুঃসাহস তার বেশ পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু রতনের এদিকের জীবনটার কথা সে কোনোদিন ঘুণাক্ষরেও জানেনি। এ জীবনে সে আসতে চায়নি কখনো। রতনদের তো স্বপ্না নেই, তার আছে।

মধুময় একবার ভাবল, চুপি চুপি উঠে পড়ে সে এখান থেকে পালিয়ে যায়। এদিককার রাস্তা সে চেনে না, ঘুরতে ঘুরতে কোনোরকমে বাড়ি পৌঁছোতে পারবেই। তারপর সে আর রতনদের সঙ্গে মিশবে না। এই কয়েক মাসের ঘটনা সে তার জীবন থেকে মুছে ফেলবে।

কিন্তু বাড়িতে যদি পুলিশ আসে? পুলিশের নামেই মধুময়ের বুক কেঁপে ওঠে। পুলিশ তাকে মারবে কিংবা জেল খাটাবে, এজন্য সে ভয় পায় না। কিন্তু পুলিশে ধরা পড়া মানেই সব কিছু জানাজানি হয়ে যাওয়া। তাদের দলের একজন ধরা পড়ে গেছে, সে হয়তো অন্যদের নাম বলে দেবে। পুলিশ অমনি ঠিকানা পেয়ে যাবে মধুময়ের। এ ব্যাপারে রতনের অভিজ্ঞতা বেশি। রতনের কথা শুনেই চলা উচিত এখন। ঝোঁকের মাথায় একটা কিছু করতে গেলে মধুময় হয়তো আরও বেশি বিপদে পড়বে।

গঙ্গার ধারে বেড়াতে গিয়ে একদিন মধুময় স্বপ্নাকে নিয়ে অন্ধকার ময়দানে বসেছিল। অন্ধকারে বসার কারণ আর কিছুই নয়, শুধু একটু নিরিবিলি পাওয়া। সেখানে বসে বসে গল্প, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। স্বপ্নার সঙ্গে গল্প করার জন্য কখনো কোনো বিষয়ের কথা চিন্তা করতে হয় না। হঠাৎ সামনে একটি পুলিশ এসে উপস্থিত।

সেই পুলিশটি বিশ্রী গলায় বলেছিল, এখানে বসে অসভ্যতা করা হচ্ছে, অ্যাঁ?

পুলিশ তো আর স্বপ্নাকে চেনে না, সেজন্যই ওরকম কথা বলতে পেরেছিল। স্বপ্নার সঙ্গে অসভ্যতা? মধুময়ের হাজার ইচ্ছে থাকলেও স্বপ্না একবারও তাকে জড়িয়ে ধরতে দেয়নি পর্যন্ত।

পুলিশ দেখে সেদিনও মধুময় বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্বপ্নার মনের মধ্যে তো কোনো অন্যায়বোধ নেই, তাই সে পুলিশকে গ্রাহ্য করেনি। সে বলেছিল, আজেবাজে কথা বলছেন কেন? মাঠের মধ্যে বসা কি অপরাধ?

পুলিশটি বলেছিল, সেকথা থানায় গিয়ে বড়োবাবুকেই জিজ্ঞেস করবেন। এখন চলুন থানায়।

স্বপ্না সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ঠিক আছে চলুন!

মাঠ পেরিয়ে বড়ো রাস্তায় আসবার পর পুলিশটিই বলেছিল, আজ ছেড়ে দিলাম, বাড়ি যান। আর ওরকম করবেন না।

স্বপ্না বলেছিল, ছেড়ে দিলাম মানে? আমরা থানাতেই যেতে চাই। আমরা আপনার বড়োবাবুকেই জিজ্ঞেস করব, মাঠে বসা অপরাধ কিনা।

তখন পুলিশটিই পালিয়ে গিয়েছিল। সে নিশ্চয়ই আশা করেছিল ওদের কাছ থেকে কিছু ঘুস পাবে। নিশ্চয়ই ভেবেছিল থানায় যাওয়ার নাম শুনলেই ওরা ভয় পেয়ে তার কাছে কাকুতি-মিনতি করবে।

কিন্তু এখন তো মধুময় পুলিশ দেখলে জোর দিয়ে বলতে পারবে না, চলুন থানায়, আমি কোনো অন্যায় করিনি।

মুক্তোর মতন একটি বেশ্যার পাশে শুয়ে শুয়ে মধুময় স্বপ্নার কথা ভাবছে? ছি, ছি, এতে তো স্বপ্নাকেই অপমান করা হয়।

অবশ্য মুক্তো মেয়েটি এ-পর্যন্ত তার সঙ্গে কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করেনি। তবু মধুময় ওর স্পর্শ বাঁচিয়ে আরও খানিকটা দূরে সরে গেল।

বহুক্ষণ পর্যন্ত জেগেই রইল মধুময়। শেষরাত্রের তন্দ্রায় সে একটা স্বপ্ন দেখল। মধুময় বাড়ি ফিরে গেছে, খুব হাসছে। মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছেন, কীরে তুই লুকিয়ে লুকিয়ে এম এ পরীক্ষা দিলি কবে? আমরা কিছু জানতে পারিনি! একেবারে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিস! এবার তো তোর চাকরির জন্য চিন্তাই করতে হবে না। গভর্নমেন্ট তোকে ডেকে ডেকে চাকরি দেবে!

পরদিন ঘুম ভেঙেই ধড়ফড় করে উঠে বসল মধুময়। তার সত্যিই ধারণা ছিল, সে তার বাড়ি ফিরে গেছে। কিন্তু না, এটা মুক্তোর ঘর। মুক্তো উঠে গেছে বিছানা থেকে। চুল আঁচড়াচ্ছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, এরই মধ্যে স্নান হয়ে গেছে তার।

একটু পরেই নীচে নেমে এল রতন। পেছন থেকে মুক্তোকে জড়িয়ে ধরে বলল, কাল কেমন জমেছিল, অ্যাঁ? নাড়ুগোপালকে ঠিকমতন হাতেখড়ি দিয়েছ তো?

মুক্তো এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিয়ে রুদ্ধ গলায় বলেছিল, দিলে তো ছুঁয়ে? আবার আমায় চান করতে হবে। জানো না, সকাল বেলা পুজো না করে, আমি কোনো পুরুষমানুষ ছুঁই না!

রতন অপ্রস্তুত হয়ে বলল, মাফ চাইছি ভাই। একটু চা তো খাওয়াবে অন্তত। নাকি সেও পাব পুজোর পরে?

তারপর সবেমাত্র চা খেতে বসেছে ওরা তিন জনে, এমন সময় পুলিশ এল। পুলিশ ওদের মারধোর করেনি। রতনের পকেটে যা জিনিসপত্র পাওয়া গেছে তাইই যথেষ্ট। ওদের এনে পুরে দেওয়া হল লালবাজার লক-আপে।

পরদিন কাগজে বড়ো বড়ো করে ছাপা হল, পাঁচ জন কুখ্যাত ডাকাতের গ্রেফতার কাহিনি। এই দলটি নাকি ইতিমধ্যে সাত বার ট্রেন ডাকাতি করেও সকলের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, এবার ধরা পড়েছে পুলিশের তৎপরতায়।

মধুময়ের বাবা খবর পেয়ে প্রথমে পুলিশকে বলেছিলেন, তাঁর ছেলে এ কাজ করেছে, এটা হতেই পারে না। পৃথিবী উলটে গেলেও তিনি একথা বিশ্বাস করবেন না।

পুলিশ তাঁকে নিয়ে এল আইডেন্টিফিকেশনের জন্য। বাবা মধুময়ের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। একটাও কথা বললেন না। একটু পরে তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। পুলিশকে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমিই যে এ ছেলের জন্ম দিয়েছি, তা অস্বীকার করতে পারি না।

বাবা নাকি তারপর বাড়ি ফিরে বলেছিলেন, ও ছেলের যা শাস্তি হয় হোক, আমি ওকে মন থেকে মুছে ফেলতে চাই। আমি ওকে ছাড়াবার কোনো চেষ্টাই করব না।

কিন্তু মা কান্নাকাটি করতে লাগলেন। মধুময়ের এক মামা বেশ বড়ো উকিল। তিনি এলেন সাহায্য করবার জন্য।

মধুময় জামিন পেল না। কিছুদিন বাদে লালবাজার থেকে সরিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে।

মামলা চলল এগারো মাস। একই মামলার পাঁচজন আসামি হলেও মধুময়ের বড়োমামা লড়তে লাগলেন শুধু একা মধুময়ের হয়ে। তিনি প্রমাণ করবার চেষ্টা করলেন যে, ওই দিন সাঁতরাগাছির কাছে ডাকাতির সময়ে মধুময় ওই ট্রেনে থাকতেই পারে না, কারণ সে তখন একটি মারোয়াড়ি কোম্পানিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল। সেই অনুযায়ী তিনি এগারোজন সাক্ষী হাজির করালেন। প্রত্যেকেই বলল, সেদিন তারা মধুময়কে ইন্টারভিউ দিতে দেখেছে। মধুময়ের নামে একটা ছাপানো ইন্টারভিউয়ের চিঠিও দাখিল করা হল কোর্টে।

বড়োমামা তীব্র ভাষায় বললেন, বাকি যে আরও ছ-টা ডাকাতির অভিযোগ এদের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে, তার মধ্যে তিনটি ডাকাতির সময় মধুময় কলকাতাতেই ছিল না, সে পাটনায় হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করত, তার অকাট্য প্রমাণ আছে। পুলিশ আসল অপরাধীদের ধরতে পারে না, শুধু শুধু নিরীহ ছেলেদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়।

পুলিশ-পক্ষ থেকে সাক্ষী ডাকা হয়েছিল মুক্তোকে।

মুক্তো বলেছিল, কে জানে বাপু, আমার ঘরে প্রতিদিনই দু-তিনজন করে লোকজন আসে, সকলকে চিনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। একে আমি আগে দেখেছি কি না মনে করতে পারছি না।

মধুময়ের তখন একমুখ দাড়ি।

পুলিশ থেকে নানারকম ভয় দেখানো হয়েছিল, তবু মুক্তো কিছুতেই মচকায়নি। শেষপর্যন্ত বেশি জেরার উত্তরে সে দৃঢ়স্বরে বলেছিল, না, আমি একে চিনি না, একে কোনোদিন দেখিনি।

মধুময়ের দাড়ি কামানো আগেকার ছবি দেখানো হল, মুক্তো তখন হাসতে হাসতে বলেছিল, এইটুকু ছেলে? আমার ঘরে? আমার যে এর ডবল বয়েস, হি-হি-হি-হি।

বিচারক ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিলেন তাকে।

জেলে থাকার সময় উৎকটরকম গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল মধুময়। কথা বলত না কারুর সঙ্গে। এমনকী রতন, প্রসাদের সঙ্গেও সে বাক্যালাপ বন্ধ করে দিয়েছিল, সর্বক্ষণ সে ভুরু কুঁচকে চিন্তা করত। সে যাচাই করে দেখত জীবনের ভুলগুলো।

প্রায় এগারো মাস বাদে, যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গেল মধুময়।

 প্রথম দিকে বাবা মধুময়ের আর মুখই দেখতে চাননি কিন্তু তিনি জেলের দরজা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিলেন মধুময়কে। তিনি সস্নেহে বলেছিলেন, যা হয়ে গেছে, ওসব আর মনে রাখিস না। সব ভুলে যা।

তার মা ও বোনেরা মধুময়ের প্রতি অতিরিক্ত খাতির দেখাতে লাগল। কেউ এমন একটা কথাও বলল না, যাতে করে মধুময় দুঃখ পেতে পারে। বরং সকলে তাকে সহানুভূতি দেখাতে লাগল এই বলে যে, এতদিন জেলখানায় থেকে কষ্ট পেয়ে মধুময়ের শরীর অনেক খারাপ হয়ে গেছে।

প্রথম কয়েক দিন মধুময় বাড়ি থেকে বেরোতে পারেনি লজ্জায়! মা বলেছিলেন, তুই কেন লজ্জা পাবি মধু? তোর কি শাস্তি হয়েছে? কোর্ট থেকে তোকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছে! পুলিশ যা-তা একটা বদনাম দিয়ে লোককে ধরে নিয়ে গেলেই কি লোকে তা বিশ্বাস করবে?

আইনের চোখে মধুময় নিরপরাধ ঠিকই। তার কোনো শাস্তি হয়নি। সে, এইকথাটা বুক ফুলিয়ে বলতে পারে। কিন্তু তার বাড়ির সব লোক জানে, মধুময় সত্যিই ট্রেন-ডাকাতি করতে গিয়েছিল। সে ধরা পড়েছিল একটি কুখ্যাত বেশ্যাপল্লির মধ্যে, সকাল বেলা, একটি মেয়ের ঘরে। সে ছাড়া পেয়েছে, শুধু তার বড়ো মামার ওকালতি বুদ্ধির জোরে। স্বপ্নাও জানে।

মধুময় জেল থেকে বেরোবার পর প্রায় এক মাস যায়নি স্বপ্নার সঙ্গে দেখা করতে। তার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল, স্বপ্না নিজে থেকেই বোধ হয় একবার আসবে। প্রায় এক বছর দেখা হয়নি স্বপ্নার সঙ্গে, ওর কি মন কেমন করে না?

স্বপ্না আসেনি, চিঠিও লেখেনি।

তারপর মধুময় নিজেই একদিন বেরিয়ে পড়েছিল। তাকে তো নতুনভাবে জীবন শুরু করতে হবে। দিনের পর দিন বাড়িতে বসে থাকলে তো আর চলবে না।

বড়োমামা একটা ভালো বুদ্ধি দিয়েছেন বাবাকে। মধুময়কে কিছুদিনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হোক মুম্বাইতে। সেখানে আছেন মেজোমামা। তিনি চেষ্টা করলে মধুময়ের জন্য একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে পারবেন। যতদিন চাকরি না জোটে, ততদিন মুম্বাইতে থাকলেও মধুময়ের অনেকটা উপকার হবে। এখানে সে লজ্জায় লোকজনের সঙ্গে মিশতে পারবে না হয়তো। কিন্তু মুম্বাইতে তো সেরকম কোনো অসুবিধে নেই!

মা মধুময়কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুই মুম্বাইতে যাবি?

মধুময় বলেছিল, ভেবে দেখি।

নতুনভাবে জীবন শুরু করার আগে স্বপ্নার ব্যাপারটা ঠিকঠাক করা দরকার। জেলে বসে মধুময় অনেক চিন্তা করে দেখেছে, স্বপ্নাকে বাদ দিয়ে সে জীবন কাটাতে পারবে না। স্বপ্না আঘাত পায়, এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় তার পক্ষে।

স্বপ্না কি তাকে ক্ষমা করবে না? একবার সে ভুলের পথে গিয়েছিল, এখন সে ফিরে আসতে চাইলে স্বপ্না কি মেনে নিতে পারবে না তাকে?

পর পর দু-দিন গিয়ে স্বপ্নার সঙ্গে দেখা হয়নি। দু-দিনই স্বপ্নার দাদার মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল মধুময়। স্বপ্নার দাদা আগে তার সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই কথা বলত, কিন্তু এখন গম্ভীর। অর্থাৎ এও-সব জানে।

স্বপ্নার দাদা বলেছিল, স্বপ্না তো বাড়িতে নেই—

তখনই মধুময়ের সন্দেহ হয়েছিল যে, স্বপ্নার দাদা মিথ্যেকথা বলছে। স্বপ্না বাড়িতে থাকলেও মধুময়ের সঙ্গে দেখা করতে দেবে না।

কিন্তু মধুময়কে তো দেখা করতেই হবে।

কয়েক দিনের মধ্যে দেখা হলও। প্রথমবার স্বপ্না ঠিক মুখের ওপর খারাপ ব্যবহার করতে পারেনি। বলেছিল, তোমার চেহারাটা অন্যরকম হয়ে গেছে। হঠাৎ রাস্তায় দেখা হলে চিনতেই পারতাম না!

মধুময় নিজেই প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেনি। এতদিন পর স্বপ্নাকে দেখামাত্র তার কান্না এসে গিয়েছিল। সে আবার টের পেয়েছিল, স্বপ্না তার ভুবনের কতখানি জুড়ে আছে। এ যেন, শুধু প্রেম ভালোবাসা নয়, স্বপ্নার কাছে গচ্ছিত আছে তার আত্মার একটা টুকরো। এ কথা মধুময় ভুলে গিয়েছিল।

মধুময়কে এড়াবার জন্য স্বপ্না বলেছিল, তুমি আজই এলে? আমায় যে, এক্ষুনি বেরোতে হবে–

প্লেন কিংবা ট্রেন ধরার ব্যাপার থাকলে দেরি করা যায় না। এ ছাড়া আর কোন কারণে এক্ষুনি বেরোতে হবে স্বপ্নাকে? কোনো সিনেমা থিয়েটারে যাওয়ার কথা থাকলে স্বপ্না কি তা সেদিনকার মতন বাতিল করতে পারে না? এমনকী, জরুরি কারুর সঙ্গে দেখা করার কথা থাকলেও মধুময়ের জন্য স্বপ্না কি থেকে যেতে পারে না?

তুমি কোথায় যাবে?

আমার একটা দরকার আছে।

 স্বপ্না এর বেশি আর কিছু বলতে চায়নি।

মধুময়ও জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া তার পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয়। তাই বলেছিল, তুমি আমার চিঠি পেয়েছিলে?

কোন চিঠি?

 জেল থেকে আমি তোমাকে লিখেছিলাম।

না তো!

জেলখানা থেকে চিঠি অনেক সময় সেন্সর করে থাকে। কিন্তু মধুময়ের চিঠিতে তো সেরকম কিছু ছিল না। সবই ব্যক্তিগত কথা।

একটা নয়, তিনখানা চিঠি লিখেছিল মধুময়! শুধু স্বপ্নাকেই। নিজের বাড়িতে সে কোনো চিঠি লেখেনি। সে চিঠি স্বপ্না পায়নি। স্বপ্না তো সহজে মিথ্যেকথা বলে না। তাহলে কি স্বপ্নার বাড়ির লোকেরা সে-চিঠি পেয়ে স্বপ্নাকে দেয়নি। জেলখানা থেকে পাঠানো চিঠি দেখলেই বোঝা যায়।

সেই তিনখানা চিঠিতেই মধুময় লিখেছিল, আমি আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে চাই। একবার ভুল করলে কি মানুষ ফিরতে পারে না?

সেদিন স্বপ্না বেশিক্ষণ থাকেনি, কিন্তু মধুময়কে বলেছিল, তুমি আর একদিন এসো। আর একদিন–বলেনি যে, কালই এসো। তবু মধুময় পর দিনই গিয়েছিল আবার। স্বপ্না সেদিন সত্যিই বাড়ি ছিল না।

স্বপ্না কী করে জানবে যে মধুময় তার পর দিনই আসবে!

আজ স্বপ্না স্পষ্ট মুখের ওপর বলে দিল, তুমি আর এসো না!

স্বপ্না তার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতে চাইছে। দশ-বারো বছরের সম্পর্ক, মধুময় তখনও হাফপ্যান্ট ছাড়েনি। স্বপ্না তখনও ফ্রক পরে, সেই সময় থেকে ওরা পরস্পর বন্ধু থাকার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল।

দেশপ্রিয় পার্কের রেলিং-এ হেলান দিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মধুময়। সে এখন কোন দিকে যাবে? তার সামনে এখন দুটো পথ খোলা আছে।

সে আবার অসামাজিক জীবনে ফিরে যেতে পারে। আগের বারের ভুল থেকে সে শিক্ষা নেবে। দ্বিতীয় বার ট্রেনে ডাকাতি করতে গেলে আর ভুল হবে না। না হয়, ধরা পড়ে দু-এক বছর জেল খাটবে। তবু ওই জীবনে রোমাঞ্চ আছে। ওই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মুক্তোর মতন মেয়েরা।

অথবা সে যেতে পারে নতুন একটা সুন্দর জীবনের দিকে। মুম্বাইতে গিয়ে চাকরি। নতুন ফ্ল্যাট। কিছু টাকা জমিয়ে বিয়ে অথবা বিয়ে না করে ব্যাচেলারের সুখী জীবন, বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, জুয়াখেলা, মদ।

স্বপ্নাকে ছাড়া আর কোনো মেয়েকে বিয়ে করা কি তার পক্ষে সম্ভব? কিংবা বিয়ে করা বা, না করারও প্রশ্ন নয়। স্বপ্না তাকে বাদ দিয়েও জীবন কাটাবার কথা চিন্তা করতে পারে। কিন্তু মধুময়ের পক্ষে তা কি সম্ভব? স্বপ্না জানে না যে, তার কাছে গচ্ছিত আছে মধুময়ের আত্মার খানিকটা অংশ।

এখন সব কিছুই নির্ভর করছে স্বপ্নার ওপরে।

রাত্তিরে খেতে বসার সময় বাবা রোজই জিজ্ঞেস করেন, খোকন কোথায়? বাড়ি ফিরেছে?

মা বলেন, হ্যাঁ, ও তো আজকাল সন্ধ্যের পর বাড়ির বাইরে থাকে না। খুব পড়াশুনো করে দেখি সবসময়। পড়াশুনোয় আবার মন বসেছে মনে হচ্ছে।

বাবা জিজ্ঞেস করেন, খেয়েছে না খায়নি? না খেয়ে থাকলে আমার সঙ্গেই ওর খাবার দিয়ে দাও-না।

ওর খাওয়া হয়ে গেছে কখন।

এক এক দিন মধুময় সত্যিই বাড়ি ফেরে সন্ধ্যের পর। একটা বই খুলে শুয়ে থাকে বিছানায়। অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বলে তার ঘরে।

কিন্তু বইয়ের পাতা বেশি ওলটানো হয় না। খানিকটা পড়তে-না-পড়তেই মধুময় নিজের চিন্তার মধ্যে ডুবে যায়।

মা একদিন সকাল বেলা বললেন, তোর বাবা বলছিলেন—

 চায়ের কাপ থেকে মুখ তুলে মধুময় জিজ্ঞেস করল, কী?

তুই এই সোমবার মুম্বাই যাবি? তোর জন্য টিকিট কাটবে?

 কেন, এই সোমবারই কেন?

 ওঁর এক বন্ধু ফাইজার কোম্পানির মিস্টার মিত্র… উনি যাচ্ছেন সোমবার… তাহলে ওঁর সঙ্গেই যেতে পারিস।

আবার চোখ নামিয়ে মধুময় বলল, কেন, আমি কি শিশু? ওর সঙ্গে যেতে হবে কেন? আমি একা যেতে পারি না?

তা পারবি না কেন? তবু একজন চেনা লোক সঙ্গে থাকলে সুবিধে হয়…

না।

তুই মুম্বাইতে যাবি না?

 আর যেদিনই যাই, এই সোমবার যাব না। যেদিন যাব একাই যাব।

পর দিন সকালে মা আবার বললেন, আগের দিনের চেয়েও নরম গলায়, তোর বাবা জিজ্ঞেস করছিলেন…

আবার চায়ের কাপ থেকে মুখ তুলে মধুময় বলল, কী?

তুই এই সোমবার যদি না যেতে চাস, কবে যাবি, একটা দিন ঠিক কর। শুধু শুধু দেরি করে লাভ কী?

এখন দিন ঠিক করবার একটু মুশকিল আছে। অন্তত মাস দু-এক আমাকে এখানেই থাকতে হবে।

কেন! মাস দু-এক তুই এখানে কী করবি?

মধুময় মায়ের চোখের দিকে সোজা চেয়ে থেকে পরিষ্কার গলায় বলল, মা, এই জীবনটা আমার। এটাকে কীভাবে খরচ করব, সেটা আমাকেই ঠিক করতে হবে। আমি যদি বখে যেতে চাই, গুণ্ডা-বদমাইশ হয়ে যেতে চাই, তোমরা আমাকে আটকাতে পারবে? আমি একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছি, আমার অন্তত দু-মাস সময় চাই। সেই দু-মাস সময় দিতে যদি তোমরা রাজি না থাক, তাহলে আমি এবাড়ি ছেড়ে চলে যেতেও রাজি আছি।

মা চোখ কপালে তুলে বললেন, ও মা, বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা আবার কোথা থেকে আসছে? তোর কি আমাদের ওপর কোনো টান নেই?

মধুময় বলল, মা, আমার বয়সি অনেক ছেলেই চাকরি-বাকরি, পড়াশুনো বা অন্য অনেক কারণে বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকে। তা বলে তাদের টান থাকে না বাবা-মা সম্পর্কে, আমি বেকার বলেই কি আমাকে বাধ্য হয়ে থাকতে হবে এবাড়িতে?

মা হঠাৎ চোখে আঁচল চাপা দিলেন।

মধুময়ের যেন আবেগ, অনুভূতি কিছুই নেই। আগে এ-রকম ছিল না, আগে মায়ের কান্না কিছুতেই সহ্য করতে পারত না সে। ছেলেবেলা থেকে যখন যতই অবাধ্যপনা করুক, মাকে একবার কাঁদতে দেখলেই সেও কাঁদতে শুরু করত। মায়ের গায়ে হাত বুলিয়ে বলত, তুমি কেঁদো না মা। তুমি যা বলবে, আমি সব শুনব। কেঁদো না…

এখন মধুময় টেবিলের ওপাশে বসে থেকে চুপ করে দেখতে লাগল মায়ের কান্না। তার মধ্যেই সে শেষ করে ফেলল তার চা, টোস্ট।

মধুময় টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে যেতে বলল, তুমি শুধু শুধু কাঁদছ মা। মুম্বাইতে যাব না, সে-কথা আমি একবারও বলিনি। আমি শুধু দু-মাস সময় চেয়েছি।

দু-দিন পর মধুময় নিজেই একটা কথা বলে দারুণভাবে চমকে দিল মাকে।

মা, আমার অন্নপ্রাশনের সময়ে আমি সাতটা আংটি আর কয়েকটা রুপোর থালা গেলাস পেয়েছিলাম না?

হ্যাঁ, পেয়েছিলি তো

সেগুলো সব আছে তোমার কাছে?

হ্যাঁ, থাকবে না কেন

চোদ্দো বছর বয়েসে আমার যখন পইতে হয় তখন আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই টাকা দিয়েছিল।

হ্যাঁ, প্রায় সাত-শো টাকা, সে টাকা তোর নামে ব্যাংকে জমা দেওয়া আছে।

সেই টাকাগুলো আমার চাই, আর ওই সোনার আংটিগুলো আর রুপোর থালা গেলাসও আমি বিক্রি করতে চাই।

মা বিস্ময়ে কোনো কথা বলতে পারলেন না।

মধুময় বলল, ওই টাকাগুলো আর ওই জিনিসগুলো যদি আমার বলেই ভেবে থাক তোমরা, তাহলে ওগুলো ইচ্ছেমতন ব্যবহার করার অধিকার আমার থাকবে না? আমার পঁচিশ বছর বয়েস, এখনও যদি আমার জিনিস আমি ইচ্ছেমতন ব্যবহার করতে না পারি, তাহলে আর কবে করব? অথবা বলে দাও, ওগুলো আমার নয়, আমি চাইব না।

কিন্তু ওগুলো বিক্রি করবি কেন?

মুম্বাই যাওয়ার ভাড়াটা আমি ওর থেকে সরিয়ে রাখব। বাকি টাকা আমার হাত-খরচ লাগবে।

হাত-খরচ … আমার কাছে চাইলে কি আমি দিই না?

আমি আর চাইব না। এই দু-মাস অন্তত, আমি বাড়ি থেকে এক পয়সা নেব না, আবার চুরি-ডাকাতিও করতে যাব না।

ফের ওই সব কথা উচ্চারণ করছিস, খোকা?

মা, চুরি-ডাকাতি অনেকেই করে। কোটিপতি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মন্দিরের পুরুতরা পর্যন্ত। সে যাই হোক, তুমি আমার জন্য চিন্তা কোরো না মা। আমার জন্য আর তোমাদের কক্ষনো লজ্জা পেতে হবে না।

মা বললেন, খোকা, তোর কথা শুনলে আমার আজকাল ভয় করে। তুই এত বদলে গেলি কেন রে?

ভাবলেশহীন গম্ভীর গলায় মধুময় বলল, মা, তোমার কোনো ভয় নেই। কিংবা তুমি যদি ভয় পেতে চাও, তাহলে তো প্রত্যেক দিনই ভয় পাওয়ার মতন কিছু-না-কিছু ঘটছে পৃথিবীতে।

এই ঘটনার পর আবার মধুময় অনিয়মিত সময়ে বাড়ি ফিরতে লাগল। কখনো কখনো অনেক রাত হয়ে যায়। মা সেকথা লুকিয়ে রাখে বাবার কাছে, মধুময় বাড়ি না ফিরলেও তিনি তার ঘরের আলো জ্বেলে রাখেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *