৩. দরজার কড়া নড়ছে

১১.

অনেকক্ষণ ধরে দরজার কড়া নড়ছে। সন্ধ্যাবেলা কেউ এলে বজলুর রহমান অত্যন্ত বিরক্ত হন। বেকুব লোকজন বেছে বেছে সন্ধ্যাবেলা মানুষের বাসায় যায়। এদের কানে ধরে ঠাশ করে মাথায় একটা বাড়ি দেয়া উচিত। সভ্য সমাজে বাস করে এই কাজ করা সম্ভব না। বজলুর রহমান দরজা খুললেন। দূজন লোক দাঁড়িয়ে। একজনের চোখে আবার সন্ধ্যাবেলাতেই কাল চশমা।

এটা কি আলতাফ সাহেবের বাসা?

বজলুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, এটা আলতাফের বাসা হবে কেন? এটা আমার বাসা। বাসাও না, এটা হল বাড়ি। আমার নিজের বাড়ি।

আলতাফ সাহেব কি ভাড়াটে?

হ্যাঁ, ভাড়াটে বলা যায়। তবে ওর কাছ থেকে ভাড়া নেই না। আমি ওর মামা। আপনারা কে?

আমরা উনার অফিসেই আছি।

 কলিগ?

জ্বি, কলিগ। আলতাফ সাহেব কি বাসায় আছেন?

না, নেই। কাঁচা বাজারে পাঠিয়েছি। ঘরে দুদিন ধরে বাজার নেই। আপনারা বসুন, এসে পড়বে।

আসতে কি দেরি হবে?

দেরি হবার কথা না। তবে গাধা টাইপের ছেলে তো–হতেও পারে। কিছুই বলা যায় না।

আমরা না হয় কিছুক্ষণ বসি?

 বসুন।

বজলুর রহমান বসার ঘর খুলে দিলেন। ঘর অন্ধকার। বজলুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, অন্ধকারে বসে থাকতে হবে। ইলেকট্রিক লাইনে গণ্ডগোল হয়েছে। বাতি জ্বলে না। গাধাটাকে বলেছি একটা মিস্ত্রি ডেকে আনতে। সেটা মনে থাকে না। আপনারা বসুন, দেখি ঘরে মোম-টোম কিছু আছে কিনা।

মনসুর সাহেব বললেন, আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।

 ব্যস্ত হচ্ছি না। ঘরে মোমবাতি আছে কি না সেটা খোঁজা কোন ব্যস্ততা না। আপনারা চা খাবেন?

ওসমান সাহেব বললেন, অসুবিধা না হলে খেতে পারি।

অসুবিধা তো হবেই। সন্ধ্যাবেলা হল কাজকর্মের সময়, নামাজের সময়। তার উপর ঘরে নেই কাজের লোক। অসুবিধা হবে না তো কি?

তাহলে থাক।

থাকবে কেন? চা খেতে চেয়েছেন, খাবেন। অসুবিধা হলেও ব্যবস্থা হবে।

বজলুর রহমান ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলেন। ওসমান সাহেব নিছু গলায় বললেন, ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। এই পরিবারের একজন সদস্য পোকার সঙ্গে কথা বলবে, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এটাই স্বাভাবিক।

মোমদানে মোমবাতি নিয়ে ঘরে ঢুকল দুলারী। মনসুর সাহেব এবং ড: ওসমান দুজনই চমকে উঠলেন। অসম্ভব রূপবতী একজন তরুণী। মোমবাতি হাতে ধরে ঢুকতেই ঘরের চেহারা পাল্টে গেল। দুলারী বলল, ও এসে পড়বে। আপনারা একটু বসুন। আমি চা দিচ্ছি। বাবা নামাজ পড়ছেন। আপনাদের কিছুক্ষণ একা একা বসতে হবে।

মনসুর সাহেব বললেন, কোন অসুবিধা নেই।

 দুলারী বলল, আপনারা কি ওর অফিস থেকে এসেছেন?

জ্বি।

অফিসে কি কোন ঝামেলা হয়েছে?

না, কোন ঝামেলা হয়নি। আপনার পরিচয় কি জানতে পারি?

 দুলারী লজ্জিত গলায় বলল, আমি ওর স্ত্রী।

তারা দুজন আবারো একটা ধাক্কা খেলেন। বড় ধরনের ধাক্কা। আলতাফ টাইপের লোকদের যেন এ রকম স্ত্রী মানায় না। এরকম স্ত্রী থাকা উচিতও নয়। এদের স্ত্রীরা হবে হাবাগোবা ধরনের। কালো, রোগ মুখে মেছেতার দাগ। ঘরের কাজ সারতে সারতে যাদের নাভিশ্বাস উঠবে। যাদের কোলে সব সময় রোগভোগা একটা শিশু থাকবে। যার একমাত্র লক্ষ্য থাকবে মায়ের বুকের দুধের দিকে।

.

দুলারী চা নিয়ে ঢুকল। শুধু চা। মনসুর সাহেব লক্ষ করলেন, কাপ পরিস্কার, পিরিচে চা জমে নেই। তারচেয়েও বড় কথা–তিনটা কাপ। মেয়েটিও বোধহয় তাঁদের সঙ্গে চা খাবে। এইসব পরিবারে এ ধরনের ভদ্রতা ঠিক আশা করা যায় না। এরা সচরাচর সর-ভাসা ঠাণ্ডা চা কাজের লোক দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। একটা পিরিচে থাকে মিয়ানো টক স্বাদের কিছু বাসি চানাচুর।

মনসুর সাহেব বললেন, সরি, আপনাকে কষ্ট দিলাম।

দুলারী বলল, কষ্ট কিসের? কোন কষ্ট না। বলেই খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ওর অফিসে কোন ঝামেলা হয়নি তো?

মনসুর সাহেব বললেন, না, কোন ঝামেলা হয়নি। আপনি কোন দুশ্চিন্তা করবেন না।

দুলারী বলল, ওকে নিয়ে আমি খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে খাকি।

ওসমান সাহেব কৌতূহলী গলায় বললেন, দুশ্চিন্তা কেন?

এম্নি দুশ্চিন্তা।

ওসমান সাহেব খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, উনার পোকার ব্যাপারটা কি আপনি জানেন?

দুলারী হকচকিয়ে গেল। নিজেকে সে চট করে সামলে নিয়ে বলল, ঐসব কিছু না।

আপনার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয় না?

 মাঝে মধ্যে বলে।

 কি বলে?

 দুলারী শংকিত গলায় বলল, পোকা নিয়ে কি অফিসে কোন সমস্যা হয়েছে?

মনসুর সাহেব বললেন, না, কোন সমস্যা হয়নি। উনি বলছিলেন, পোকাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে। শুনে আমি কৌতূহল বোধ করছি। এরকম তো সাধারণত শোনা যায় না। ব্যাপারটা কি সত্যি?

জানি না।

আপনার সঙ্গে এ নিয়ে কোন আলাপ হয় না?

ও কথাটথা বিশেষ বলে না।

 আপনাদের বিয়ে হয়েছে কতদিন হল?

 অল্পদিন।

আচ্ছা, আলতাফ সাহেবের এক মামাতো বোন আছে–দুলারী। সে কি এ বাড়িতে আছে?

দুলারী চমকে উঠে বলল, আমার নামই দুলারী।

মনসুর সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, আচ্ছা আচ্ছা। আলতাফ সাহেব তার মামাতো বোনের কথা আমাকে বলেছিলেন, কিন্তু তাকেই বিয়ে করেছেন তা বলেননি।

ও নিজ থেকে কিছু বলবে না। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবে। জিজ্ঞেস না করলে চুপ করে থাকবে।

আপনি পোকাদের ব্যাপারে তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি?

 করেছি।

উনি কি বলেন–আসলেই পোকারা তাঁর সঙ্গে কী বলে?

হুঁ।

আপনি তাঁর কথা বিশ্বেস করেন?

হুঁ।

কেন বিশ্বেস করেন? আপনি কি কোন প্রমাণ পেয়েছেন?

না।

তাহলে বিশ্বেস করেন কেন?

ও তো কখনো মিথ্যা কথা বলে না।

আলতাফ এই পর্যায়ে বাজারের ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকল। মনসুর সাহেবেকে দেখে সে মোটেই অবাক হল না। যেন এটাই স্বাভাবিক। অফিসের বড় সাহেবকে সন্ধ্যাবেলা ঘরে বসে থাকতে দেখা যেন খুবই সাধারণ ঘটনা। মনসুর সাহেবই আগ বাড়িয়ে কথা বললেন, আলতাফ সাহেব, ভাল আছেন?

জ্বি স্যার।

 বাজার করে ফিরলেন?

জি স্যার।

আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এসেছি। আমার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। উনি ডঃ ওসমান। মাস্টারি করেন। আপনি বরং হাত-মুখ ধুয়ে আসুন।

জ্বি আচ্ছা, স্যার।

আমরা অসময়ে এসে আপনার অসুবিধা করলাম না তো?

 জ্বি না।

মনসুর সাহেব কৈফিয়ত দেবার মত ভঙ্গিতে বললেন, পোকা-মাকড় হচ্ছে আমার বন্ধুর বিষয়। সে এই বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। তার আগ্রহেই আপনার কাছে আসা।

জ্বি আচ্ছা, স্যার।

যান, আপনি হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।

আলতাফ চলে গেল। আলতাফের সঙ্গে দুলারীও বের হয়ে গেল। তার অনেক কাজ। রান্না চড়াতে হবে। ঘরে মসলা নেই। মসলা পিষতে হবে। বাজারের গুঁড়া মসলা বজলুর রহমান খান না। ঘরে কাজের লোক নেই।

ডঃ ওসমান মনসুর সাহেবের দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, বেকুব ধরনের মানুষ বলে মনে হচ্ছে।

মনসুর কিছু বললেন না। ডঃ ওসমান বললেন, এদের পেছনে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।

চলে যেতে চাও?

এসেছি যখন বসি।

আলতাফ এসে সামনে বসল। তার বসার ভঙ্গিতে কোন রকম দ্বিধা বা সংকোচ দেখা গেল না। ডঃ ওসমান হাসিমুখে বললেন, আলতাফ সাহেব, আপনার পোকাদের বিষয়ে কিছু বলুন।

কি বলব?

যা বলতে চান বলুন।

 কিছু বলতে চাই না, স্যার।

 বলায় সমস্যা আছে?

জ্বি না। ইচ্ছ! করে না।

ওসমান সাহেবের ভ্রু কুঁচকে উঠল। লোকটা যে নির্বোধ এ বিষয়ে তিনি পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হলেন। একমাত্র নির্বোধরাই অফিসের বড় সাহেবের সামনে এমন ভঙ্গিতে কথা বলার সাহস পায়। ওসমান সাহেব কঠিন গলায় বললেন, আমি শুনেছি পোকাদের সঙ্গে আপনার ভাবের আদান-প্রদান হয়।

আলতাফ চুপ করে রইল। ওসমান সাহেব অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, জবাব দিচ্ছেন না কেন? ওদের চিন্তা-ভাবনা আপনি নাকি বুঝতে পারেন?

সবসময় পারি না। ওরা যখন ইচ্ছা করে তখনই শুধু বুঝি। ওরা ইচ্ছা না করলে পারি না।

ওদের কথা বুঝতে হলে তো ওদের বুদ্ধিবৃত্তি আপনার স্তরে আসতে হবে।

ওদের অনেক বুদ্ধি, স্যার।

তাই নাকি?

 জি।

ওদের বুদ্ধির একটা প্রমাণ দিতে পারেন?

আলতাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার বাসায় যে তেলাপোকা আছে সে যে কোন সময় আমেরিকার একটা তেলাপোকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। মানুষ তা পারে না।

ডঃ ওসমান হেসে ফেলতে যাচ্ছিলেন। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, তাহলে তো ইচ্ছা করলে আপনি যে কোন মুহূর্তে একটা খবর তেলাপোকার মাধ্যমে আমেরিকায় পাঠিয়ে দিতে পারেন। আপনি একটা কাজ করুন তো …

কি কাজ?

আমার এক ভাই থাকে ক্যালিফোর্নিয়ার পেনসিলভেনিয়ায়। তার ঠিকানা দিচ্ছি। আপনি তেলাপোকার মাধ্যমে খবর এনে দিন ওদের ছেলেমেয়ে কটি। তাহলে বুঝব আপনার তেলাপোকার ক্ষমতা আছে। পারবেন না?

জি না, স্যার।

 পারবেন না কেন?

আমরা যেমন ঠিকানা বলি–এত নং বাড়ি, এই রাস্তার নাম–সেটা তেলাপোকাদের অজানা। আমি আমেরিকা বললেও কিছু বুঝবে না। তারা জায়গা চিনে গন্ধ দিয়ে। ওদের কাছে এক এক জায়গার এক এক রকম গন্ধ।

ও আচ্ছা, একেক জায়গার একেক রকম গন্ধ।

জ্বি স্যার।

ভাল। নতুন জিনিস জানা গেল।

এরা মানুষের চিন্তা-ভাবনা কাজ-কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে।

এটাও নতুন তত্ত্ব। আপনি বলতে চাচ্ছেন যে, আমরা কি করব না করব তা ঠিক করে দেবে পোকারা?

জ্বি স্যার। এরা খুব সূক্ষভাবে করে। চট করে ধরা যাবে না।

আপনার মত দুই-একজন লোক শুধু ধরতে পারে, তাই না?

জ্বি।

মনসুর সাহেব এতক্ষণ চুপ করেছিলেন। তিনি চুপ করে থাকবেন বলেই ভেবেছিলেন, এখন আর কথা না বলে পারলেন না। বিরক্ত গলায় বললেন, তাহলেতো আলতাফ সাহেব, আমাদের ধরে নিতে হয় যে পোকাদের প্রচণ্ড ক্ষমতা।

ঠিক বলেছেন, স্যার। অসম্ভব ক্ষমতা। একবার পৃথিবী জুড়ে প্লেগ মহামারি হল। কোটির উপর মানুষ মারা গেছে। পোকারাই এটা করেছে।

আমি যতদূর জানি প্লেগ ছড়িয়েছিল ইঁদুর।

 প্লেগের জীবাণু এনে দিয়েছিল তেলাপোকারা। তারা ইঁদুর দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। পোকার মানুষদের যেমন নিয়ন্ত্রণ করে, অন্য জীব-জন্তুদেরও নিয়ন্ত্রণ করে।

ওসমান সাহেব হাসি চাপার জন্য কয়েকবার কাশলেন। আলতাফ বলল, স্যার, এই পৃথিবীটা পোকাদের। ওরা আমাদের থাকতে দিচ্ছে বলেই থাকতে পারছি। অর্থাৎ আমরা ওদের করুণায় বেঁচে আছি।

 ওসমান সাহেব বললেন, আপনার কথা শুনে আনন্দিত হলাম। মজা পাওয়া গেল। শেষ প্রশ্ন–পোকারা এইসব কথা বলার জন্যে আপনাকে খুঁজে বের করল? আরো তো লোক ছিল–না-কি তাদের মতে আপনিই একমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তি? আপনাকে ওদের পছন্দ করার কারণ কি?

ওদের জিজ্ঞেস করিনি।

সময় পেলে জিজ্ঞেস করবেন। আজ উঠি?

জ্বি আচ্ছা, স্যার।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ওসমান সাহেব বললেন, পোকাদের একটা ডেমনস্ট্রেশন হলে মন্দ হত না। আলতাফ সাহেব পোকাদের সঙ্গে কথা বলছেন। আমরা শুনছি এরকম একটা কিছু। পারবেন আলতাফ সাহেব?

আলতাফ বলল, জ্বি না স্যার।

কিছু মনে করবেন না আলতাফ সাহেব। আমার ধারণা, আপনি অন্যদের বোকা বানিয়ে আনন্দ পান। এই কাজটি করবেন না।

আলতাফ কিছু বলল না। ওসমান সাহেব বললেন, আপনার উচিত কোন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলা। মানুষকে ভাওতা দিয়ে বেড়ানো এক ধরনের অসুস্ততা। বুঝতে পারছেন?

পারছি স্যার। কিন্তু আমি সত্যি কথাই বলছি।

সত্যি কথা বললে তো ভালই।

ঠিক তখন উড়তে উড়তে ঘরে একটা তেলাপোকা ঢুকল। পোকাটা বসল ওসমান সাহেবের পায়ের কাছে।

আলতাফ চমকে উঠে বলল, ওকে স্যার মারবেন না।

ওসমান সাহেব পোকাটাকে মারতেন না। পোকা মেরে আনন্দ পাবার বয়স তার নেই। কিন্তু আলতাফের কথা শুনেই সম্ভবত–জুতো দিয়ে পিষে ফেললেন।

পথে নেমেই ওসমান সাহেব বললেন, মনসুর, তোমার প্রথম কাজ হচ্ছে–এই মহা বেকুবকে তুমি অফিস থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে। তোমার দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে–আমার সময় নষ্ট করার জন্য জরিমানা দেবে। বড় ধরনের জরিমানা।

.

১২.

কড় সাহেব জরুরি একটা ফাইল দিয়েছিলেন। সেই ফাইল আলতাফ ড্রয়ারে তালাবন্ধ করে রেখেছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, ফাইলটা নেই! ড্রয়ার ঠিকই তালাবন্ধ। ড্রয়ারের চাবি আলতাফের কাছে।

গনি সাহেব পান চিবুতে চিবুতে কাছে এসে বললেন, সমস্যাটা কি?

আলতাফ বলল, ফাইল পাচ্ছি না।

 তালাবন্ধ ছিল?

হুঁ।

তাহলে তো রিবাট সমস্যা। চিন্তার বিষয়। ভাল করে চিন্তা করে দেখুন–বাসায় নিয়ে যাননি তো?

না।

এ অফিসে তো এরকম কখনো হয়নি। বদরুল সাহেবকে ইনফর্ম করুন।

তাকে ইনফর্ম করব কেন?

গনি সাহেব বিরক্তমুখে বললেন, আপনি তো ভাই বড় প্যাঁচালের লোক। তাকে ইনফর্ম করবেন না কেন? তিনি হচ্ছেন আপনার সেকশনের চার্জে। যে কোন সমস্যা হলে আগে তাকে বলতে হবে। না-কি আপনি ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাবেন? সরাসরি চলে যাবেন বড় সাহেবের কাছে? আপনার নৌকা তো আবার বড় খুঁটিতে বাঁধা।

আলতাফ ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছে না। কেউ কি ড্রয়ার খুলে ফাইল নিয়ে গেছে? কেন নেবে? স্টোর ইন-চার্জের কাছে বার ড্রয়ারেরই চাবি থাকে। তিনি কি কোন কারণে খুলেছেন? অসম্ভব কিছু না। বড় সাহেব হয়ত ফাইল চেয়েছেন। স্টোর-ইন-চার্জ খুলে দিয়েছেন। এ ছাড়া আর কি হতে পারে?

আলতাফ স্টোর-ইন-চার্জ খায়রুল কবিরকে খুঁজে বের করল। খায়রুল কবির আকাশ থেকে পড়লেন।

কি বলছেন আপনি! আমি কেন আপনার ড্রয়ার খুলব? এ ধরনের এলিগেশন সাবধানে দেবেন।

আমি এলিগেশন দিচ্ছি না। জানতে চাচ্ছি।

ব্যাপার একই। বড় সাহেবের সঙ্গে দহরম-মহরম বলে ধরাকে সরা দেখছেন? পেয়েছেন কি আপনি? কী ভাবেন আমাকে?

আপনি শুধু-শুধু রাগ করছেন।

আপনার সঙ্গে কোন কথা বলতে চাচ্ছি না। দয়া করে বিদেয় হোন। আপনার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। আমাকে সরাসরি চোর বললেন–

চোর তো বলিনি –।

 অবশ্যই বলেছেন। ভেবেছেন কি আপনি?

আলতাফ হতভম্ব হয়ে গেল। এই লোকটা এমন করছে কেন? কেন শুধু শুধু রেগে যাচ্ছে? সে নিজের জায়গায় ফিরে এল। কি করবে বুঝতে পারছে না। বড় সাহেবকে জানানো উচিত। সাহসে কুলুচ্ছে না। ভয়-ভয় লাগছে। আলতাফ ড্রয়ার বন্ধ করে ক্যান্টিনের দিকে রওনা হল। ক্যান্টিনে সে কখনো আসে না। এই প্রথম আসা। কোণার দিকে একটা খালি টেবিলে একা একা বসে রইল। ক্যান্টিনের বেয়ারা এক কাপ চা না চাইতেই দিয়ে গেল। অসময়ে চা খাওয়া তার অভ্যাস নেই। তবু সে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না অফিসের মানুষগুলি তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে কেন। সে তো কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না।

এই যে আলতাফ সাহেব। কি করছেন একা একা?

গনি সাহেব চা নিয়ে এগিয়ে এলেন।

আলতাফ সাহেব! বসব আপনার সঙ্গে?

বসুন।

আপনি তো দেখি বিরাট ভেজাল লাগিয়ে ফেলেছেন।

 কি ভেজাল লাগিয়েছি?

স্টোর-ইন-চার্জ খায়রুল কবির সাহেবকে আপনি নকি চোর বলেছেন? উনি তো দারুণ রেগেছেন। আমি ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি। উনি বোধহয় বড় সাহেবের কাছে কমপ্লেইন করতে যাবেন। আমার সে রকম মনে হল।

আলতাফ কিছু বলল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। গনি সাহেব বললেন, আপনার তো চিন্তার কিছু নেই। বড় সাহেব হলেন আপনার খাতিরের লোক। সিগারেট খাবেন নাকি আলতাফ সাহেব?

আমি সিগারেট খাই না।

খেয়ে দেখুন। টেনশানের সময় কাজে লাগে। ব্রেইন পরিষ্কার হয়। এই সময় ব্রেইনটা পরিষ্কার থাকা দরকার। বড় সাহেবকে ফাইলের ব্যাপারে কি বলবেন ভেবে রাখুন। উনি দারুণ রেগেছেন। আপনাকে এক্ষুণি ডেকে পাঠাবেন।

গনি সাহেব সিগারেট ধরিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তৃপ্তি ষোলআনা হচ্ছে না। আলতাফ তেমন ভয় পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। আশ্চর্য মানুষ! ভয়ে অস্থির হয়ে যদি তাকে ধরে পড়ত, কান্নাকাটি করত, সে সামাল দিতে চেষ্টা করত। হারানো ফাইলও তো মাঝে মাঝে পাওয়া যায়। আলতাফ পাথরের মত মুখ করে বসে আছে। ভয়-ভীতির কোন লক্ষণ নেই। চাকরি এখনো কনফার্ম হয়নি। এক কথায় চাকরি চলে যাবে–সেই চিন্তাও মাধ্যায় নেই।

নিন, সিগারেট নিন আলতাফ সাহেব।

আমি সিগারেট খাই না।

 আহ, একটা খেলে কিছু হবে না।

জ্বি-না।

আচ্ছা থাক। খেতে হবে না। আর শুনুন, এত চিন্তা করবেন না। চিন্তা করে লাভ ত কিছু নেই। যা হবার হবেই।

আলতাফ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। গনি সাহেব বললেন, যাচ্ছেন কোথায়? বড় সাহেবের কাছে? নিজ থেকে যাওয়া ঠিক হবে না। বড় সাহেব ডাকুক, তারপর যাবেন। এর মধ্যে ভেবে ভেবে একটা প্ল্যান অব একশান বের করুন।

বড় সাহেবের খাস বেয়ারা মকবুল এসে ঢুকল। গনি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আপনেরে ডাকে।

গনি সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, আমাকে কেন? তুমি বোধহয় ভুল করছ। উনি আলতাফ সাহেবকে ডাকেন।

জে না। আপনেরে ডাকেন। স্পষ্ট কইরা বলছেন–গনি।

.

গনি সাহেব দরজার বাইরে থেকে বললেন, স্যার আসব?

বড় সাহেব বললেন, ইয়েস! কাম ইন প্লীজ।

তিনি ঘরে ঢুকে হাসিমুখে বললেন, কেমন আছেন স্যার?

বড় সাহেব তার উত্তর না দিয়ে বললেন, বসুন।

তিনি বসলেন। বসতে বসতে তাঁর মনে হল–কিছু একটা হয়েছে। দুয়ে দুয়ে চার মিলছে না। ব্যাপারটা কি?

মনসুর সাহেব ফাইলে চোখ বুলাচ্ছিলেন। ফাইল বন্ধ করে তাকালেন। তাঁর চোখ কালো চশমার আড়ালে বলে গনি সাহেব বড় সাহেবের চোখের ভাব ধরতে পারলেন না। তার অস্বস্তি আরো বাড়ল।

গনি সাহেব?

জ্বি স্যার।

 ব্যাপারটা কি বলুন তো?

কি ব্যাপার স্যার? আমি তো কিছু জানি না।

 আমি আলতাফ সাহেবকে একটা জরুরি ফাইল দিয়েছিলাম, সেটা জানেন?

জি-না স্যার। আমি তো কিছুই জানি না। কি ফাইল?

মনসুর আলি জবাব দিলেন না। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। গনি সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলেন, তিনি একটা বড় বোকামি করেছেন। ফাইল সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না তা বলা ঠিক হয়নি। কারণ এর মধ্যে স্টোর-ইন-চার্জ খায়রুল কবির নিশ্চয়ই বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছে। কথা প্রসঙ্গে তার কথা আসতে পারে। আসাটাই স্বাভাবিক।

গনি সাহেব!

জ্বি স্যার।

ফাইল সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না দেখে অবাক হচ্ছি। একটু আগে খায়রুল কবির এসেছিলেন। তিনি বললেন, আপনি এই ফাইল হারানোর ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত।

ও আচ্ছা। আমি স্যার কিছুক্ষণ আগেই জেনেছি। আগে কিছুই জানতাম না। আমি ভেবেছি, আপনি জানতে চাচ্ছেন আগে কিছু জানতাম কি না।

মনসুর সাহেব ড্রয়ার খুলে সিগারেটের কেইস থেকে সিগারেট বের করলেন। গনি সাহেব বললেন, আমি স্যার খুব চিন্তা করছি–এটা হল কি করে? ড্রয়ারে তালাবন্ধ করা ফাইল হাওয়ায় তো উড়ে যেতে পারে না।

আপনার কি মনে হয়? কোথায় গেছে?

বুঝতে পারছি না। তবে আলতাফ সাহেব বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। মাঝে মাঝে তিনি বাসায় ফাইল নিয়ে যান।

তাই নাকি?

জ্বি।

ও আচ্ছা।

স্যার, আমি কি চলে যাব?

একটু বসুন।

মনসুর আলি সিগারেট টানতে লাগলেন। গনি সাহেব এই ঠাণ্ডা ঘরে বসেও ঘামতে লাগলেন।

গনি সাহেব!

 জ্বি স্যার।

ফাইলটা খুব জরুরি। আজ সন্ধ্যার মধ্যে আপনি এটা বের করে দেবেন।

আমি কোত্থেকে বের করব?

আপনি খুব কর্মঠ মানুষ। আপনার বুদ্ধিশুদ্ধিও পরিষ্কার। আপনি কিভাবে বের করবেন তা আপনি জানেন।

স্যার, আপনার কথায় আমি মর্মাহত।

 মর্মাহত হবার কিছু নেই। এখন যান–ফাইলের ব্যাপারে ব্যবস্থা করুন।

গনি সাহেব বের হয়ে এলেন। তাঁর কান ঝা ঝা করছে। বড় সাহেব লোকটি ক্ষমার অযোগ্য একটা কাজ করেছে। সরাসরি চোর বলেছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। কত বড় সাহস! এত সাহস সে পেল কোথায়? খায়রুল কবির কিছু বলেছে নাকি? বলে ফেলতে পারে। বোকা টাইপের লোক। মনে হচ্ছে, বড় সাহেব তাকে প্যাঁচে ফেলে দু-একটা প্রশ্ন করেছেন, আর সে ভর ভর করে পেটের সব কথা বলে ফেলেছে।

গনি সাহেব অতি দ্রুত চিন্তা করছেন। যে ভাবেই হোক বড় সাহেবকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। চোর বলার জন্যে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে হবে। শুধু হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেই হবে না, কাগজে-পত্রেও থাকতে হবে। ইউনিয়ন কি জিনিস এটা বড় সাহেবকে টের পাইয়ে দিতে হবে। কিছু জরুরি টেলিফোন করা দরকার। বড় সাহেবকে ঘেরাও করতে হলে শুধু অফিসের লোক দিয়ে হবে না। বাইরের কিছু লোকজনও দরকার। বড় ধরনের কিছু করতে হলে কয়েকটা জর্দার কৌটা লাগবে। কত ধানে কত চাল তা জানার সময় হয়ে গেছে। গনি সাহেব আলতাফের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। আলতাফ শুকনো মুখে বসে আছে। একে একটা শিক্ষা দিতে হবে। শালা স্পাই! স্পাইগিরি বের করে দিতে হবে। হাত পা ভেঙে হাসপাতালে দাখিল হয়ে গেলে আর স্পাইগিরি করবে না।

.

আলতাফ সাহেব!

জ্বি।

বড় সাহেবের কাছ থেকে আসছি।

ও আচ্ছা।

বড় সাহেবের ধারণা, আপনার ফাইল আমরা চুরি করেছি।

আলতাফ চুপ করে রইল। গনি সাহেব বললেন, আপনি স্যারকে এই কথা বলেছেন। তাই না?

আমি কিছু বলিনি।

 স্পাইগিরি করছেন? পেয়েছেনটা কি?

আলতাফ তাকিয়ে রইল। গনি সাহেব ক্যান্টিনের দিকে রওনা হলেন। মাথা গরম করলে চলবে না। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। বড় ঝামেলার সময় মানুষ মাথা ঠিক রাখতে পারে না বলেই ঝামেলা সামাল দিতে পারে না। তিনি পর পর দুকাপ চা খেয়ে সিগারেট ধরালেন। মাথা এখন খানিকটা শান্ত হয়েছে–ঘেরাও করার পরিকল্পনা এখন আর সুন্দর পরিকল্পনা বলে মনে হচ্ছে না। অন্য চাল চালতে হবে। মারাত্মক কোন চাল। বড় সাহেব সে চাল ধরতে পারবেন না। কি চাল দেয়া যায়? হারানো ফাইল ফেরত দেয়া যায়। বড় সাহেবকে যদি বলা হয় ফাইল পাওয়া গেছে আলতাফের বাসায়–তাহলেই হল। খুব বিনয়ের সঙ্গে বলতে হবে। এতে বড় সাহেবের গালে একটা চড় দেয়া হবে। মোলায়েম চড়।

ফাইল গনি সাহেবের কাছেই আছে। তাঁর ড্রয়ারে তালাবন্ধ অবস্থায় আছে। যা করতে হবে তা হল–ফাইলটা লুকিয়ে নিয়ে চলে যেতে হবে আলতাফের বাসায়। আলতাফকে বলতে হবে–ভাই, আপনার বাসার কাগজপত্রগুলি একটু খুঁজে দেখুন। এমনও তো হতে পারে যে আপনি মনের ভুলে ফাইল নিয়ে বাসায় চলে এসেছেন। হতে পারে না? একটু খুঁজে দেখুন। আমিও আপনার সঙ্গে খুঁজি। দুজন খুঁজতে থাকবে–তখন গনি সাহেব চেঁচিয়ে বলবেন–পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে। এই তো পাওয়া গেছে। আপনার খাটের নিচেই ছিল। যাক, বাঁচা গেল! সবচে ভাল হয়–ফাইলটা যদি আলতাফ সাহেবকে দিয়েই ফেরত পাঠানো হয়।

গনি সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরালেন। পুরো পরিকল্পনাটা আরো ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখতে হবে কোন ভুল-ত্রুটি থেকে গেল কি-না। সামান্য ভুল থাকাও ঠিক হবে না।

ফাইলটা যে এঁর ড্রয়ারে আছে এই খবর অফিসের আর একজনমাত্র মানুষ জানে–স্টোর-ইন-চার্জ খায়রুল কবির। তাঁর নিজের লোক। তা ছাড়া তিনিই চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলেছেন। কাজেই এই খবর বাইরে ছড়াবে না। খায়রুল কবির সাহেব অবশ্যি মাথা গরম লোক। ফট করে মাথা গরম হয়ে যায়। এই জাতীয় লোক মাথা গরম অবস্থায় বেফাস কথা বলে ফেলতে পারে। তাকে সাবধান করে দিতে হবে।

গনি সাহেব উঠলেন। আলতাফের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন।

 আলতাফ সাহেব।

আপনার বাসায় আজ সন্ধ্যায় একটু যাব।

 জ্বি আচ্ছা। বিবাহ করেছেন তো–তাই না?

জ্বি।

ভাবীর হাতে এক কাপ চা খেয়ে আসব।

 জ্বি আচ্ছা।

অধিকাংশ অফিসেই দেখি কর্মচারিদের যুধ্যে কোন সদ্ভাব নেই। এটা ঠিক না। অফিসের বাইরেও আমাদের একটা জীবন আছে। তাই না?

জ্বি।

গনি সাহেব খায়রুল কবির সাহেবের খোঁজে গেলেন। তাকে এখন বেশ হাসি খুশি দেখাচ্ছে। টেনশান অনেকখানি কমে গেছে। তার মাথায় একটাই চিন্তা। ফাইলটা কী করে আলতাফের বাসায় নিয়ে যাবেন। শীতকাল হলে সমস্যা ছিল না ––কোটের ভেতর নিয়ে যেতে পারতেন। গরম কাল হওয়ায় ঝামেলা হয়ে গেছে। বাজারের ব্যাগে করে নিয়ে যাওয়া যায়। তাঁর সঙ্গে বাজারের ব্যাগ আছে। অফিস ফেরত হাতিরপুল কাঁচাবাজার থেকে কিছু শব্জি নিয়ে যাবার কথা। আজ আর নেয়া হবে না।

.

অফিস ছুটি হবার ঠিক আগে আগে মনসুর সাহেবের টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোন করেছেন ডঃ ওসমান। কিন্তু তাঁর গলার স্বর অন্যরকম। মনসুর সাহেব গলা চিনতে পারছেন না। মনে হচ্ছে, অনেক দূর থেকে পাতলা গলায় কে যেন কথা বলছে–মনসুর সাহেব বললেন, হ্যালো, কে? কে কথা বলছেন?

আমি বলছি। আমি!

 কিছু মনে করবেন না। আমিটা কে?

ওসমান।

ও আচ্ছা। তোমার ঠাণ্ডা লেগেছে না-কি? গলার স্বর চিনতে পারছি না।

তোমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমি নিজেও আমার গলার স্বর চিনতে পারছি না।

হয়েছে কি?

ভয়াবহ কিছু হয়নি, তবে যা হয়েছে তাকে ঠিক অগ্রাহ্য করাও ঠিক না।

কি হয়েছে?

 তুমি বাসায় আস, তারপর বলব।

আসছি। এখনি আসছি।

বাই দ্যা ওয়ে, তোমাদের অফিসের কর্মচারি–কি যেন নাম–আলতাফ না? ও কি আছে?

থাকার কথা না–এখন বাজছে পাঁচটা। সে কাটায় কাঁটায় পাঁচটা বাজলে বিদেয় হয়ে যায়। তবু খোঁজ নিচ্ছি। কেন বল তো?

ওকে আমার দরকার। তাকে নিয়ে আসতে পারবে?

দরকার হলে অবশ্যই নিয়ে আসব।

মনসুর সাহেব আলতাফের খোঁজে লোক পাঠালেন। তাকে পাওয়া গেল না। সে ঠিক পাঁচটার সময়ই বের হয়ে গেছে।

আলতাফ অফিস থেকে সরাসরি বাসায় ফেরে। ফেরার সময় বাসে প্রচণ্ড ভিড় হয়। ভিড় কমার জন্যে সে ইদানিং অফিসের পাশে একটা মিউনিসিপ্যালটি পার্কে অপেক্ষা করে। পার্কটি মিউনিসিপ্যালটির কর্মকর্তারা শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি করলেও এটি এখন ভিক্ষুক এবং নেশারুদের দখলে। নেশারুরা আলে সন্ধ্যার পরে। তাদের সঙ্গে আলতাফের দেখা এখনো হয়নি। তবে পার্কের স্থায়ী ভিক্ষুকরা আলতাফকে চেনে। তারা এই লোকটির স্বভাব-চরিত্রও জানে। তারা জানে, এই সাহেব পার্কে ঢোকার মুখে দুটাকার বাদাম কিনবে। পার্কের সবচে উত্তরের বেঞ্চির এক কোণায় চুপচাপ বসে বাদাম খাবে। খাবে খুব ধীরে ধীরে। দুটাকার বাদাম শেষ করতে করতে তার সময় লাগবে এক ঘণ্টার উপর। তখন সে উঠে দাঁড়াবে–যাবে বাসস্ট্যান্ডের দিকে। এই লোকের কাছে ভিক্ষা চেয়ে কোন লাভ হবে না জানে বলেই ভিক্ষুকরা কেউ এখন আর অকে বিরক্ত করে না।

আলতাফ বসে আছে বেঞ্চিতে। তার হাতে বাদামের ঠোঙা এবং খানিকটা ঝাল লবণ। আলতাফ বাদাম ভেঙে মুখে দিচ্ছে। দুটাকার ঠোঙায় বাদাম থাকে ১৮ থেকে ২৫টা। আজ বাদাম বেশি দিয়েছে–আজ বাদাম আছে ত্রিশটা। শেষ করতে অন্য দিনের চেয়ে বেশি সময় লাগবে। লাগুক। তেমন তাড়া নেই। তবে আকাশের অবস্থা ভাল না। মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি হবে। ভাল বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি শুরু হলে ভিজতে হবে। ভিজতে তার খারাপ লাগে না। একটাই শুধু সমস্যা হয়। ভেজা কাপড়ে বাসে উঠতে দেয় না। ভিজে গেলে হেঁটে হেঁটে ফিরতে হবে। আলতাফ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। আজ তার মনটা খারাপ। শুধু যে খারাপ তা না–বেশ খারাপ।

সে বুঝতে পারছে না সবাই মিলে তার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছে কেন? সে তো সবই বুঝতে পারছে। গনি সাহেবের কাছে ফাইলটা বর্তমানে আছে। তিনি এই ফাইল নিয়ে আজ রাতে এক সময় তার বাসায় যাবেন এবং বলবেন, আলতাফ সাহেব, আপনার বাসাটা একটু পরীক্ষা করে দেখব। এমন তো হতে পারে, মনের ভুলে ফাইলটা ফেলে গেছেন।

আলতাফ জানে গনি সাহেবের বাজারের ব্যাগে বর্তমানে ফাইলটা আছে। ফাইলটা নিয়ে তাঁর অনেক কাজকর্ম আছে বলে তিনি আজ বাজারে যেতে পারবেন না। গনি সাহেবের স্ত্রী বলে দিয়েছেন, ঘরে কোন সবজি নেই। সবজি লাগবে। আজও সবজি কেনা হবে না। অথচ এই মহিলা মাছ-মাংস কিছু খেতে পারেন না।

সব তথ্য পোকারা আলতাফকে জানাচ্ছে। কেন জানাচ্ছে সে জানে না। কিভাবে জানাচ্ছে তাও বুঝতে পারে না। জানতে না পারলেই বোধহয় ভাল হত। মনের কষ্ট কম হত। এরা তাকে দেখতে পারছে না কেন? সে কি কোন অন্যায় করেছে?

বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। আলতাফ উঠে দাঁড়াল। হালকা ফোঁটা পড়ছে। বাসস্ট্যান্ডে লোকজন নেই। ইচ্ছা করলে বাসে উঠা যায়। কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করছে না।

হেঁটে হেঁটে যাওয়া যাক। পৌঁছতে সন্ধ্যা পার হয়ে যাবে। তাড়া নেই কিছু। আর বাসায় ফিরতে দেরি হলেই ভাল। ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই গনি সাহেব চলে যাবেন। তার সঙ্গে দেখা হোক তা আলতাফ চাচ্ছে না। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। আলতাফ নির্বিকার ভঙ্গিতে বৃষ্টির ভেতর দিয়ে এগুচ্ছে। লোকজন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। বৃষ্টিতে ভিজে অনেকেই রাস্তায় হাঁটে, তবে তাদের মধ্যে এক ধরনের তাড়া থাকে। কেউ এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে হাঁটে না।

.

১৩.

বজলুর রহমান বললেন, কাকে চান?

গনি সাহেব বললেন, আমি আলতাফ সাহেবের খোঁজে এসেছি।

 ও তো এখনো বাসায় ফিরে নাই।

সে কি! পাঁচটার সময় উনি অফিস থেকে বের হলেন।

বজলুর রহমান বিরক্তমুখে বললেন, এই গাধার কি কিছু ঠিক আছে? কিছু ঠিক নাই। অফিসে কি করে তাই আমি বুঝি না। আসুন, ভেতরে এসে বসুন।

গনি সাহেব অন্ধকার বসার ঘরে ঢুকলেন। বজলুর রহমান বললেন, আপনাকে অন্ধকার ঘরে বসে থাকতে হবে। গাধাটাকে বুলেছিলাম চল্লিশ পাওয়ারের একটা বাল্ব এনে লাগাতে। লাগিয়েছে ঠিকই কিন্তু বা্ল্ব জ্বলছে না। সমস্যাটা কোথায় সে দেখবে না?

গনি সাহেব বললেন, স্যার, আপনি কাইন্ডলি একটা হারিকেন আনুন। আমি দেখে দিচ্ছি। মনে হয় কোথাও লুজ কানেকশন আছে।

না না, আপনি কি দেখবেন?

কোন অসুবিধা নেই, স্যার। আলতাফ সাহেব আমার কলিগ। খুবই বন্ধু মানুষ।

বজলুর রহমান খুশি হলেন। হারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে এলেন। গনি সাহেব কি করলেন কে জানে–বাতি জ্বলে উঠল। বজলুর রহমান হৃষ্টচিত্তে বললেন, বাবা, তুমি আরাম করে বস, চা খাও। ঘরে কিছু আছে কিনা কে জানে? মনে হয় শুধু চা খেতে হবে।

কোন অসুবিধা নেই, স্যার। চা না পেলেও হবে। আমার চায়ের তেমন অভ্যাস নেই। আলতাফ সাহেব কখন ফিরেন?

কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। আগে সকাল সকাল ফিরত। এখন শুনেছি অফিস ছুটির পর কোন এক পার্কে গিয়ে বসে থাকে।

কেন?

 কে বলবে কেন? ওর কি মাথার ঠিক আছে? ব্রেইন ডিফেক্ট।

 চাচাজী, এসব কি বলছেন?

তোমাদের কলিগ, তোমরা জান না? কি করে অফিস চালায় সেটাই তো আমি বুঝি না। কাজকর্ম কিছু পারে?

উনি তো চাচাজী কাজকর্মে খুব ভাল। তবে…

তবে কি?

 রিসেন্টলি একটা সমস্যা হয়েছে।

বজলুর রহমান আগ্রহ নিয়ে বললেন, কি সমস্যা?

থাক স্যার, বলতে চাচ্ছি না।

না না, তুমি বল। কোন অসুবিধা নাই।

অফিসের একটা জরুরি ফাইল হারিয়ে ফেলেছেন। আমাদের বড় সাহেব আবার খুবই রাগী। তিনি ভয়ংকর রেগেছেন। অথচ আলতাফ সাহেবের কোন মাথাব্যথা নেই।

ওর মাথাব্যথা থাকবে কেন? ওর কি মাথা বলে কিছু আছে?

বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করে দু-একটা কথা বললে হত, তাও বলবেন না। এই বাজারে যদি চাকরি চলে যায়, তাহলে অবস্থাটা, চাচাজী, একটু চিন্তা করুন।

চাকরি তো যাবেই। আরো আগেই যাওয়া উচিত ছিল। এখনো কেন যায়নি তাই তো আমি ভেবে পাই না।

বজলুর রহমান অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছেন। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। এটাই তাঁর আনন্দের বিষয়। গনি সাহেব গলা নিচু করে বললেন, আমার ধারণা, উনি ফাইলটা বাসায় নিয়ে এসেছিলেন, তারপর অফিসে নিতে ভুলে গেছেন। আমি এসেছি একটু খুঁজে দেখতে। উনার তো মাথাব্যথা নেই।

বজলুর রহমান দরাজ গলায় বললেন, যাক, গাধাটার চাকরি চলে যাক। তুমি এই নিয়ে চিন্তা করবে না।

তবু স্যার, আমি ভাবছি একটু যদি খুঁজে দেখি, উনি তো খুঁজবেন না।

ও কিছুই করবে না। ও শুধু দরজা বন্ধ করে ঝিম ধরে বসে থাকবে। আর পোকা নিয়ে ভাববে।

গনি সাহেব ইতস্ততঃ করে বললেন, উনি কখন আসেন কে জানে। আমরা কি এই ফাঁকে একটু খুঁজে দেখব?

দেখতে চাও, দেখ। আমি দুলারীকে বলছি, ও তোমাকে তাদের ঘরে নিয়ে যাবে।

দশ মিনিটের মাথায় গনি সাহেব ফাইল হাতে দোতলা থেকে নেমে এলেন। বজলুর রহমানকে দেখে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, পাওয়া গেছে চাচাজী। খাটের নিচে খবরের কাগজের সঙ্গে ছিল।

বজলুর রহমান বললেন, পাওয়া গেছে বলে এত আনন্দিত হয়ো না। আবার হারাবে। কে জানে কাল অফিসে যাওয়ার সময় হয়ত বসে ফেলে রেখে যাবে।

গনি সাহেব বললেন, আপনাকে কি চাচাজী একটা ছোট্ট রিকোয়েস্ট করব? যদি কিছু মনে না করেন।

মনে করাকরির কি আছে? বল কি রিকোয়েস্ট?

ফাইলটা আলতাফ সাহেবের হাতে না দিয়ে আপনি নিজে যদি নিয়ে যান। বড় সাহেবকে একটু বুঝিয়ে বলেন। স্যার তো খুব রেগে আছেন।

কোন অসুবিধা নেই। আমিই বলব।

আমি যে এসেছিলাম এটা যদি না বলেন তাহলে খুব ভাল হয়। বড় সাহেব আমাকে আবার ঠিক পছন্দ করেন না। উনি যদি শুনেন একজন ফাইল হারিয়েছে আর আমি ছোটাছুটি করছি তাহলে আরো রেগে যাবেন।

না না, তুমি নিশ্চিন্ত থাক। তোমার কখা কিছুই বলব না।

গনি চা খেলেন। মুড়ি খেলেন। দুলারীর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করলেন। দুলারীর কাজের মেয়ে নেই শুনে দুঃখিত হলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, কাল সকালের মধ্যে কাজের মেয়ের ব্যবস্থা করবেন।

এই কাজটা তিনি অবশ্যি ভালই পারেন। কাজের মেয়ের সাপ্লাই চ্যানেল তাঁর খুব ভাল। অফিসের অনেকেরই তিনি এই উপকার করেছেন। দুলারীর জন্যেও একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁর নিজের বাসায় এই মুহূর্তে দুজন আছে। তাদের একজনকে দিয়ে যেতে হবে।

.

আলতাফ বাসায় ফিরল রাত নটার কিছু আগে। সে ভিজে চুপসে গেছে। চোখ লাল। দুলারী বলল, আবার বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এসেছ? কতক্ষণ ভিজেছ বৃষ্টিতে?

অনেকক্ষণ।

হাত-পা একদম নীল হয়ে গেছে। চোখ লাল। আজ নির্ঘাৎ তোমার জ্বর আসবে।

হুঁ।

তোমাদের অফিসের একজন কলিগ আজ বাসায় এসেছিলেন। নাম হল গনি সাহেব। কি যেন খোঁজাখুঁজি করলেন।

হুঁ।

খুবই ভাল লোক। আমার কোন কাজের লোক নেই শুনে খুব দুঃখ করলেন। বলেছেন, কাল সকাল দশটার মধ্যে একজনকে দিয়ে যাবেন।

হুঁ।

তুমি তো ঘুমুচ্ছ না, তাহলে এমন হুঁ হুঁ করছ কেন? যাও, বাথরুমে গিয়ে কাপড় ছাড়। ভাত দিয়ে দি। আজ আবার মার শরীরটাও খারাপ। মা শুয়ে আছেন।

হুঁ।

দুলারী টেবিলে ভাত বেড়ে আলতাফকে নিতে এসে দেখে আলতাফ ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। তার গা গরম। আলতাফ বলল, আমার ভাল লাগছে না। আমি কিছু খাব না।

দুধ এনে দেই এককাপ। দুধ খাও?

না। তুমি বাতি নিভিয়ে দাও।

দুলারী বাতি নিভিয়ে দিল। তার খানিকটা মন খারাপ হল। বৃষ্টি হচ্ছে দেখে সে আজ তেহারী রান্না করেছে। এই জিনিসটা আলতাফ খুব পছন্দ করে খায়।

দুলারী!

কি?

আমার মাকে যে পোকা খেয়ে ফেলেছিল তা কি তুমি জান?

এসব কি ধরনের কথা?

 তুমি জান কি-না বল।

জানি, বাবা বলেছিলেন।

 আমার চোখের সামনে তারা মাকে খেয়ে ফেলল।

চুপ কর তো।

 আচ্ছা চুপ করলাম। দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে দাও।

.

১৪.

ওসমান সাহেব থাকেন ধানমণ্ডি আট নম্বরে। চার ইউনিটের নতুন ফ্ল্যাট বাড়িগুলির তিনতলায়। ফ্ল্যাটটি কিনেছেন ওসমান সাহেবের স্ত্রী রেবেকা। ভদ্রমহিলা ডাক্তার এবং পসারওয়ালা বড় ডাক্তার। এদের কোন ছেলেপুলে নেই। স্বামী-স্ত্রী দুজনে বিশাল বাড়িতে বাস করেন। কুকুর, বেড়াল এবং পাখি পুষেন।

মনসুর সাহেব ওসমানদের ফ্ল্যাট বাড়িতে কলিংবেল টিপলেন রাত দশটায়। কলিংবেলে শব্দ হল না। কড়া নাড়তে হল। শব্দ করেই নাড়তে হল। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ইলেকট্রিসিটি নেই। তবে ঘরে আলো আছে। চার্জলাইট জ্বলছে। ওসমান সাহেব দরজা খুলে বললেন, এত দেরি! আমি সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছি।

বৃষ্টি দেখে ভাবছিলাম বৃষ্টি কমলে আসব। মনে হচ্ছে কমবে না, তাই বৃষ্টির মধ্যেই এসেছি।

খেয়ে আসনি তো?

না।

গুড। আমি পূর্বাণী থেকে খাবার আনিয়েছি। আজ রাতে থেকে গেলে অসুবিধা হবে? রেবেকা বাসায় নেই। একা আছি। তুমি থাকলে দুজন মিলে বেচেলারদের মত সারারাত গল্প করব।

বেচেলাররা সারারাত গল্প করে না। এটা নব্য স্বামী-স্ত্রীদের ব্যাপার। রেবেকা কোথায়?

ওর সঙ্গে ভয়াবহ ধরনের ঝগড়া হয়েছে। প্রায় ছাড়াছাড়ি পর্যায়ের ঝগড়া। ও তার বাবার বাসায় চলে গেছে। মনে হচ্ছে আর ফিরবে না।

মনসুর সাহেব কিছু বললেন না। তেমন গুরুত্ব দিলেন না। রেবেকা প্রায়ই প্রচণ্ড রকমের ঝগড়া করে তার বাবার বাসায় চলে যায়, আবার ফিরে আসে। এবারও আসবে। এদের একের অন্যকে ছাড়া গতি নেই।

ওসমান সাহেব বললেন, এসো খেতে বসে যাই। প্যাকেট করা খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলে মুসকিল।

টেবিলভর্তি খাবার। শিভাস রিগেলের পেটমোটা বোতল। এই ব্যাপারটিও পুরানো। ওসমান সাহেব মদ্যপান করেন শুধু যখন রেবেকার সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হয় তখন। মনসুর হাসতে হাসতে বললেন, ঝগড়া মনে হয় গুরুতর পর্যায়ের হয়েছে?

হ্যাঁ।

 কি নিয়ে ঝগড়া?

সেটা বলার জন্যেই ডেকেছি।

আলতাফকেও আনতে বলেছিলে–তাকেও বলতে চাচ্ছিলে?

হ্যাঁ, তাকেও বলতে চাচ্ছিলাম। ঝগড়ার সূত্রপাত তাকে নিয়েই। তুমি খেতে শুরু কর, আমি বলি। খানিকটা হুইস্কি দেই? হুইস্কি থাকলে গল্প শুনে আরাম পাবে।

মনসুর কৌতূহলী হয়ে তাকালেন।

তোমার মনে আছে বোধহয়, আলতাফের বাসায় আমি একটা তেলাপোকা মেরেছিলাম। আলতাফ তাতে দুঃখিত হয়েছিল।

আলতাফ দুঃখিত হয়েছিল কিনা জানি না, তুমি তেলাপোকা মেরেছিলে তা মনে আছে।

বাসায় ফিরলাম, শরীর কেমন ঘিন ঘিন করতে লাগল। সারাক্ষণ মনে হতে লাগল জুতার নিচে তেলাপোকার রক্ত-মাংস লেগে আছে। প্রথমেই কাজের ছেলেটিকে দিয়ে জুতা ধুয়ালাম। আমার মনে হল, সে ঠিকমত ধোয়নি। সাবান দিয়ে নিজে ধুলাম। মনে হল, সর্বনাশ হয়েছে। আমার হাতে রক্ত লেগে গেছে। গোসল করলাম। ভাবটা দূর হল না। শরীর ঘিন ঘিন করতে লাগল।

রাতে ভাত খেতে পারলাম না। রেবেকা ফিরল রাত দশটায়। ততক্ষণে আমার প্রায় মাথা-খারাপের মত হয়ে গেছে। আমার ধারণা হয়ে গেছে, তেলাপোকার রক্ত মাংস সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে। দুজন কাজের লোককেই ঘর মুছতে লাগিয়ে দিয়েছি। বালতি ভর্তি পানিতে ডেটল গুলে ওরা মেঝে ন্যাকড়া দিয়ে মুছছে এবং অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। রেবেকা ঘরে ঢুকে বলল, কি হয়েছে?

আমি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলাম। ব্যাখ্যা করার সময় বুঝলাম, আমি নিতান্ত বোকার মত কথা বলছি। না, বোকা না, পাগলের মত কথা বলছি।

রেবেকা বলল, তুমি নিওরোটিক পেশেন্টের মত আচরণ করছ।

আমি বললাম, আমি মোটেই নিওরোটিক পেশেন্টের মত আচরণ করছি না। আমি যা অনুভব করছি তা বলছি।

রেবেকা কাজের লোক দুটিকে ধোয়াধুয়ি বন্ধ করতে বলল। ঝগড়া শুরু হল এই পর্যায়ে। কুৎসিত ঝগড়া। আমি একেবারে তুই-তোকারির পর্যায়ে চলে গেলাম। চিৎকার করে বলতে লাগলাম–তোর সঙ্গে বাস করে আমি নিওরোটিক পেশেন্ট হয়েছি। বুঝেছিস? তোর ধবধবে শাদা গায়ের রঙের জন্যে তো তোর খুব অহংকার। এই শাদা রঙের জন্যে তোকে দেখায় শাদা তেলাপোকার মত। শাদা তেলাপোকা কখনো দেখেছিস? এরা থাকে কমোডের ভেতরে। তোর গায়েও তেলাপোকার মতই গন্ধ। তার পরেও কিছু বলি না। সহ্য করি।

রেবেকা আমার কথাবার্তা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। এক পর্যায়ে বলল–তোমার ঘুমানো দরকার। আমি পেথিড্রিন ইনজেকশনের একটা এম্পুল রেখে যাচ্ছি। ইসমাইলকে বললেই সে তোমার শরীরে পুশ করে দেবে। আমি চলে যাচ্ছি।

এর উত্তরে আমি আরো সব কুৎসিত কথা বলতে লাগলাম। এমন সব কুৎসিত কথা যে, তুমি শুনলে তিনতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যাবে। উদাহরণ দেব? শুনতে চাও?

না, শুনতে চাই না।

শুনতে না চাওয়াই ভাল।

মনসুর বললেন, তুমি মদ্যপানটা মনে হয় বেশি করছ?

 তা ঠিক, বেশিই করছি। আমার অবস্থায় পড়লে তুমি বাথটাবে মদ ভর্তি করে তার ভেতরে শুয়ে থাকতে। আসল স্টোরিটা শোন। আসল স্টোরিতে এখনো আসিনি।

বল আসল স্টোরি।

রেবেকা রাতেই চলে গেল। আমি কাজের লোক দুটিকে বললাম, তোমরা ননস্টপ ঘর মুছে যাও। আমি না বলা পর্যন্ত থামবে না। তারপর হুইস্কির একটা বোতল নিয়ে বসলাম। তুমি ভাল করেই জান আমি প্রফেশনাল মাতাল নই। বিদেশে পড়াশোনার জন্যে যখন গিয়েছিলাম তখন মাঝে-মধ্যে খেতাম। দেশে এসে ছেড়ে দিয়েছিলাম। ইদানিং কখনো কখনো খাওয়া হয়। তা-ও যখন বন্ধু বান্ধব আসে, তখন। যাই হোক, রাত একটার ভেতর ২৫০ মিলিলিটারের স্কচ হুইস্কির একটা পুরো বোতল শেষ করে ফেললাম। মাতাল হলাম না। শুধু অনুভব করলাম, মাথাটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেও সাবানের বড় একটা ফেনা হয়ে গেছি। বাতাসে ভাসতে শুরু করেছি। হার্ড লিকার চার পেগের বেশি আমি খেতে পারি না। আমার বমি ভাব হয়। পুরো বোতল খেয়েও আমার কিছু হল না। শুধু বাথরুম পেতে লাগল। আমার তখন বাথরুমে যেতেও ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে চেয়ারে বসেই কাজ সেরে ফেলি। মেঝে তো ধোয়া হচ্ছেই। যাই হোক, বাথরুমে গেলাম। এই অংশটা মন দিয়ে শোন। খুব মন দিয়ে শুনবে।

আমি তোমার সব অংশই মন দিয়ে শুনছি।

এই অংশটা অনেক বেশি এটেনশন দিয়ে শুনতে হবে। বাথরুমে ঢুকেছি। বাতি জ্বালিয়ে দরজা বন্ধ করতেই এক ধরনের হামিং সাউন্ড হতে লাগল। যেন লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ খুব নিচু গলায় কথা বলছে। লো ফ্রিকোয়েন্সি সাউড আসছে কমোডের ভেতর থেকে। আমি অবাক হয়ে কমোডের কাছে গিয়ে নিচু হয়ে তাকাতেই গায়ের সমস্ত রক্ত জমে গেল। দেখি, কমোডভর্তি তেলাপোকা। তারপর দেখি শুধু কমোড নয়, বাথরুমের মেঝে থিকথিক করছে পোকায়। অথচ ঘরে ঢোকার সময় ছিল না। কখন এল? কোত্থেকে এল? হঠাৎ দেখি পোকারা আমার গা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। অন্য যে-কেউ হলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেত। আমি বুঝলাম–অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্যে আমার হেলুসিনেশন হচ্ছে। আসলে কোন পোকা নেই কিন্তু আমার মস্তিষ্ক পোকা দেখছে। বাথরুমের দেয়ালগুলি একটু আগেই শাদা দেখেছি–এখন দেখি ব্রাউন রঙ। তেলাপোকায় দেয়াল ডেকে গেছে। আমি তখন এদের কথাও শুনতে পেলাম। পরিস্কার শুনলাম–এরা বলছে …

কি বলছে?

কি বলছে, তা তোমাকে বলতে চাচ্ছি না। কারণ ওরা তো আসলে কিছু বলছে না। যা বলার আমার মস্তিষ্কই আমাকে বলছে। যাই হোক, আমি কি করলাম শোন। বাথরুম থেকে বের হয়ে এলাম। আমার গা ভর্তি তেলাপোকা। এদের নিয়েই বের হয়েছি। কাজের লোক দুটি তখনও মেঝে ঘসে যাচ্ছে। আমি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম–তোমরা কি আমার গায়ে তেলাপোকা দেখতে পাচ্ছ? ওরা ভয়ে ভয়ে বলল, জি না স্যার। আমি বললাম, তাহলে যাও, ইসমাইলকে ডেকে আন। আমাকে পেথিড্রিন ইনজেকশন নিতে হবে। ইসমাইল এসে আমাকে পেথিড্রিন ইনজেকশন দিল। আমার ঘুম ভাঙল পরদিন দুপুর দুটায়। আমি তখন পুরোপুরি সুস্থ। তেলাপোকা ব্যাপারটা আর মাথায় নেই।

এই তোমার গল্প?

হ্যাঁ।

আলতাফকে এই গল্প শুনাতে চাচ্ছিলে কেন?

 ওর কারণে এই ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকে গেছে বলেই ওকে শুনাতে চাচ্ছিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল–ওকে বলব যেন পোকা নিয়ে সে আর কখনো কারো সঙ্গে কোন কথা না বলে। এই হাস্যকর ব্যাপারটা যেন সে আর কারো মাথায় ঢুকিয়ে না দেয়।

মনসুর বললেন, ব্যাপারটা তোমার মাথা থেকে পুরোপুরি দূর হয়েছে?

হঁ, হয়েছে। তবে আমি পোকা নিয়ে খুব ভাবতে শুরু করেছি। অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গিতে এদের দেখার চেষ্টা করছি।

অন্য দৃষ্টিভঙ্গি মানে?

 ওদের প্রতি একটা সিমপেথিটিক এটিচুড তৈরি হয়েছে।

 মনসুর গম্ভীর হয়ে বললেন, সিমপেথিটিক এটিচুডের ব্যাপারটা বুঝলাম না।

ওসমান গলা নিচু করে বললেন, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আলতাফের কথা সত্যি হতেও পারে। পোকাদের কিছু স্ট্রেজ ব্যাপার আছে, যা থেকে ধারণা করা অস্বাভাবিক না যে এদের বুদ্ধি আছে, ভালভাবেই আছে। যেমন ধর, যখন কোন বিশেষ জায়গায় আণবিক বোমার টেস্টিং হয় তখন যে জায়গায় এই টেস্টিং করা হয় তার এক মাইলের ভেতর কোন পোকা-মাকড় বিশেষ করে তেলাপোকা থাকে না। এরা মনে হয় কোন এক অদ্ভুতভাবে খবর পেয়ে যায় যে এখানে নিউক্লিয়ার বোমা টেস্টিং হবে। খবর পেয়ে সরে পড়ে। ইন্টারেস্টিং না?

সত্যি হয়ে থাকলে ইন্টারেস্টিং।

হিরোশিমা এবং নাগাশাকিতে আণবিক বোমা ফাটার পর এর আশেপাশের অঞ্চলগুলি তেলাপোকায় ছেয়ে গিয়েছিল। আমার ধারণা, এরা এসেছে হিরোশিমা ও নাগাশাকি থেকে। এরা বুঝে গিয়েছিল এখানে বোমা ফাটবে, কাজেই সরে গিয়েছিল।

এই খবর পেলে কোথায়?

কোথায় যেন পড়েছিলাম।

সত্যি?

সত্যি তো বটেই। সমুদ্রগামী জাহাজ থেকে হঠাৎ দেখা যায় ইঁদুর আর তেলাপোকা নেমে পড়ছে। তখন বুঝতে হবে জাহাজটা পানিতে ডুবে যাবে বা এই জাতীয় কিছু একটা হবে। এরা খবরটা পায় কিভাবে?

মনসুর বললেন তুমি বলতে ঢাচ্ছ পোকাদের বুদ্ধি আছে। তারা ইন্টেলিজেন্ট।

 নিশ্চিত করে কিছু বলছি না, তবে সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছি না।

 একসময় তুমিই কিন্তু বলেছ ওদের মস্তিষ্ক নেই। কাজেই বুদ্ধি থাকবে না। এখন অন্য কথা বলছ।

তা বলছি। এখন কালেকটিভ ইন্টেলিজেন্সের কথা মাথায় আসছে। অর্থাৎ আলাদা-আলাদাভাবে এক একটা পোকা বুদ্ধিমান নয়–কিন্তু তাদের সবাইকে একত্র করলে তারা বুদ্ধিমান। প্রচণ্ড বুদ্ধিমান। এত বুদ্ধিমান যে এরা মানুষকে ব্যবহার করছে। মানুষ তা-ই বুঝতে পারছে না। মানুষ এদের হাতে খুবই অসহায়।

পোকাদের হাতে মানুষ অসহায়?

হ্যাঁ অসহায়। পঙ্গপালের কথা ভেবে দেখ। পঙ্গপালের আক্রমণ ঠেকানোর কোন বুদ্ধি কি মানুষের আছে? মেশিনগান দিয়ে ঠেকাবে? পৃথিবীতে বিউবোনিক প্লেগ ছড়িয়েছিল ইঁদুর। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১–এই পাঁচ বছরে প্লেগে সারা পৃথিবীতে মানুষ মারা গেছে ৭৫ মিলিয়ন। ঊনবিংশ শতাব্দীতেও বিউবোনিক প্লেগ হল–মানুষ মারা গেল ২০ মিলিয়ন। যেমন হঠাৎ করে অসুখটা এসেছিল তেমনি হঠাৎ করে চলে গিয়েছে। আমার এখন মনে হচ্ছে, এইগুলি পোকাদের সাবধানবাণী। পোকারা মানুষদের সাবধান করে দিচ্ছে। তারা বলছে–হে মানব সম্প্রদায়, সাবধান। আমরা কিন্তু ইচ্ছা করলেই তোমাদের শেষ করে দিতে পারি। তোমাদের অতি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান কোন কাজেই লাগবে না।

মনসুর সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, এদের ক্ষমতা থাকলে মানুষকে এরা শেষ করে দিচ্ছে না কেন? মানুষ তো নানানভাবে এদের বিরক্ত করছে। ইনসেকটিসাইড ছড়াচ্ছে–পোকা-মাকড় মারার কত কায়দা-কৌশল বের করছে। পোকাদের যদি এতই বুদ্ধি তাহলে ওরা চুপ কেন?

ওসমান গলার স্বর নিচু করে বললেন, এই বিষয়েও আমার একটা হাইপোথিসিস আছে। মানুষকে এরা শেষ করছে না, কারণ মানুষকে তাদের প্রয়োজন। মানুষের টেকনোলজি প্রয়োজন। শুধুমাত্র মানুষেরই ক্ষমতা আছে মহাশূন্য জয় করার। মানুষ একদিন সৌরজগতের বাইরেও পা বাড়াবে, কিন্তু পোকাদের এই ক্ষমতা নেই। তারা যদি পৃথিবীর বাইরে ছড়িয়ে পড়তে চায় তাহলে মানুষের সাহায্য তাদের নিতেই হবে।

পৃথিবীর বাইরে ছড়িয়ে পড়ার তাদের দরকার কি?

দরকার আছে। বুদ্ধিমান প্রাণির লক্ষণ হল, সে চেষ্টা করবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে–পোকারা তাই করছে। মানুষ যখন মঙ্গলগ্রহ থেকে যাবে বৃহস্পতির উপগ্রহে, এরাও যাবে মানুষের সঙ্গে। বুঝতে পারছ?

পারছি, কিন্তু তুমি কি এই হাইপোথিসিস বিশ্বাস কর?

বিশ্বাস করি না–আবার অবিশ্বাসও করি না। আলতাফ নামের তোমার ঐ লোকটির সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে।

মনসুর গম্ভীর গলায় বললেন, আলতাফের সঙ্গে তোমার কথা বলতে হবে না। কথা বলার পরিণাম তো দেখতেই পাচ্ছি। তোমার উচিত বিশ্রাম নেয়া এবং মাথা থেকে পোকা-মাকড় পুরোপুরি দূর করা। যেভাবে হুইস্কি খাচ্ছ, মনে হয় একটা কেলেংকারি করবে। যাও, ঘুমুতে যাও।

রাত খুব একটা বেশি হয়নি। দুটা বাজে। দুটা অনেক রাত।

মনসুর উঠে দাঁড়ালেন। এখনো ইলেকট্রিসিটি আসেনি। মনে হয় আজ রাতে আর আসবে না। বৃষ্টি থামেনি। মাঝখানে কিছুটা কমেছিল, এখন আবার মুষলধারে শুরু হয়েছে।

বাথরুম থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ আসছে। কিসের শব্দ? মনসুর কৌতূহলী হয়ে উঁকি দিলেন। অন্ধকার বাথরুম। চার্জলাইটের আলো বাথরুম পর্যন্ত পৌঁছেনি। তিনি পকেট থেকে দেয়াশলাই বের করলেন। দেয়াশলাই জ্বালাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সারা শরীর কেঁপে উঠল–এসব কি? হাজার হাজার কোটি কোটি পোকা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। শুঁড় নাড়ছে। এটা কি এক ধরনের হেলুসিনেশন? অবশ্যই তাই। ওসমানের কথা শুনে তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। আলতাফ প্রভাবিত করেছিল ওসমানকে। তাকে দিয়ে অন্য আরেকজন প্রভাবিত হবে। এক সময় দেখা দেবে মাস হিস্টিরিয়া। দেয়াশলাইয়ের কাঠি নিভে গেছে। তিনি এখন আর কিছুই দেখছেন না, শোঁ শোঁ শব্দ শুনছেন।

শব্দটা কমোডের ভেতর থেকে আসছে। দেয়াশলাইয়ের আরেকটা কাঠি কি জ্বলাবেন? তাঁর সাহস হল না।

.

১৩.

দুলারী অলঅফের মাথার কাছে বসে আছে। জ্বরে মানুষটার গা পুড়ে যাচ্ছে। থার্মোমিটার থাকলে জ্বর দেখা যেত। থার্মোমিটার নেই। জ্বর কমানোর জন্যে কিছু একটা করা দরকার। কি করবে দুলারী বুঝতে পারছে না। দুটা প্যারাসিটামল খাওয়ানো উচিত। ঘরে কোন প্যারাসিটামল নেই। মাথায় পানি ঢালা উচিত। দোতলায় এক ফোঁটা পানি নেই। পানি ঢালতে হলে বালতিতে করে একতলা থেকে নিয়ে আসতে হবে। দুলারী তাও করতো কিন্তু মানুষটা তাকে ছাড়ছে না। তার হাত ধরে বসে আছে। এত শক্ত করে হাত চেপে ধরে আছে যে হাত ব্যথা করছে।

আলতাফ ক্ষীণ স্বরে ডাকল, দুলারী!

দুলারী বলল, কি?

খুব খারাপ লাগছে।

মাকে ডেকে আনব?

না। এখন কটা বাজে দুলারী?

রাত দুটা।

আলতাফ অনেক কষ্টে পাশ ফিরল। দুলারী বলল, বাবাকে ডেকে তুলি। বাবা তোমার জন্যে ডাক্তার নিয়ে আসুক।

তুমি আমার হাতটা ছাড়, আমি তোমার জন্যে পানি নিয়ে আসি। মাথায় পানি ঢালতে হবে।

না।

আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি তোমার জন্যে পানি আনতে যাচ্ছি না। তুমি এত শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরবে না। আমার হাত ব্যথা করছে। আচ্ছা, আমার হাতটা একটু ছাড় তো, বাতি জ্বালাই। অন্ধকারে বসে থাকতে আমার ভয় ভয় লাগছে।

আলতাফ দুলারীর হাত ছাড়ল না। বরং আরো শক্ত করে হাত চেপে ধরল। দুলারীর ভয়-ভয় করছে। তার হঠাৎ করে মনে হচ্ছে, তাদের খাটের নিচটা তেলাপোকায় ভর্তি হয়ে গেছে। পোকার আলতাফকে দেখতে আসছে, আরো আসবে। ঘর ভর্তি হয়ে যাবে পোকায়। কেন তার এরকম মনে হচ্ছে সে জানে না। আলতাফকে জিজ্ঞেস করলে কি কোন লাভ হবে? আলতাফ কি কিছু বলবে?

দুলারী বলল, এই শোন, শোন!

উঁ।

ভয় লাগছে। আমার ভয় লাগছে।

উঁ।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, খাটের নিচটা পোকায় ভর্তি হয়ে গেছে। আমার প্রচণ্ড ভয় লাগছে।

উঁ।

এই দেখ শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। পোকারা কি এরকম শব্দ করে?

উঁ।

এরকম উঁ উঁ করবে না। শুনতে বিশ্রী লাগছে। হাতটা ছাড়, আমি বাতি জ্বালাব।

না।

দুলারী প্রায় জোর করে আলতাফের হাত ছাড়িয়ে দিল। বাতি জ্বাললো। উঁকি দিল খাটের নিচে। সারি সারি তেলাপোকা চুপচাপ অপেক্ষা করছে। একটিও নড়ছে না। দুলারী বলল, যা! যা! এতেও কিছু হল না। আলতাফ ক্লান্ত গলায় বলল, এরা যাবে না। এরা থাকবে। তুমি এদের কিছু বলো না। বাতি নিভিয়ে দাও।

দুলারী বাতি নেভাল। তার কান্না পাচ্ছে। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। এত রাতে বাবা-মাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে ইচ্ছা করছে না।

.

১৪.

ভোরবেলাতেই বজলুর রহমান হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বিধু বাবুর দরজার কড়া নাড়তে লাগলেন। দুলারীর কাছ থেকে খবর পেয়েছেন আলতাফের জ্বর। সারারাতই না-কি জ্বর গেছে। এখন খুব বাড়ছে। ডাক্তার না ডাকলেই নয়।

অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর বিধু বাবু দরজা খুলে হাসিমুখে বললেন, তোমার মাছের কাঁটার অবস্থা কি?

বজলুর রহমান হতভম্ব হয়ে বললেন, কি বলছ তুমি! সে তো বৃটিশ আমলের কথা। আমার গলা থেকে তো কবেই কাটা গেছে, এখন তোমার মাথায় বিঁধে আছে। কাটা বিঁধা মাথা নিয়ে ডাক্তারি কর কিভাবে? যাই হোক, তুমি আস আমার সঙ্গে। আলতাফকে দেখবে।

ওর কি হয়েছে? গলায় কাটা?

গলায় কাঁটার ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর কর। ওর জ্বর।

চল দেখি।

.

বিধু বাবু আলতাফের কপালে হাত দিয়েই প্রায় লাফিয়ে উঠার জোগাড় করলেন–সর্বনাশ! এ তো অনেক জ্বর! রাগে বজলুর রহমানের গা জ্বলে গেল। অনেক জ্বর বলেই তো ডাক্তার ডেকে আনা। কুসুম-কুসুম জ্বর হলে কে আনতো?

বিধু বাবু রোগিকে দেখে টেখে শুকনো গলায় বললেন–অবস্থা তো কেমন কেমন মনে হচ্ছে–ইয়ে। বজলুর রহমান বললেন, ইয়েটা কি?

না মানে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভাল। জ্বর খুব বেশি।

বজলুর রহমানের ইচ্ছা হল, বিধু বাবুকে ধরে একটা আছাড় দেন। এম্নি মুখে বড় বড় কথা–ক্যানসার সারাই, হাঁপানি সারাই, এইডস রোগ সারাই। আর সামান্য একটু জ্বর দেখে মুখ শুকিয়ে আমশি! ধাক্কা দিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে নিচে ফেলা দেয়া উচিত।

তিনি তা করলেন না। নিজেকে সামলালেন। অনেক কাজ আছে। কব্জিগুলি আগে শেষ করা দরকার। যেমন আলতাফের অফিসে ফাইলটা দিয়ে আসতে হবে। প্রতিমাসে ঠিক সময় ইলেকট্রিসিটি বিল দেয়ার পরেও তার ঘরে ইলেকট্রিসিটির লাইন কেন কেটে দিল সেই খোঁজটাও নেয়া দরকার। আলতাফকে হাসপাতালে নিতেই যদি হয়, সন্ধ্যার দিকে নিলেই হবে।

বজলুর রহমান আলতাফের অফিসের ফাইল বগলে নিয়ে প্রথমে আলতাফের কাছে গেলেন। অফিসের ঠিকানাটা দরকার। আলতাফ ঠিকানা বলল, বেশ ভালভাবেই বলল। অফিসটা কোন জায়গায় বুঝিয়ে দিল।

এটা একটা ভাল লক্ষণ। জ্বরে আলতাফের মাথা খারাপ হয়ে যায়নি। বেশি জ্বর উঠলে মাথা খারাপের মত হয়ে যায়।

আলতাফ!

জ্বি।

তোর ফাইলটা দিয়ে আসি।

আচ্ছা।

তোর বড় সাহেবকে বুঝিয়ে বলব যে, বাই মিসটেক তুই ফাইলটা নিয়ে চলে এসেছিলি।

আচ্ছা।

উনাকে রিকোয়েস্ট করব যাতে ভুলটা বড় করে না দেখেন। মানুষমাত্রই ভুল করে। ভুল করাই মানবধর্ম।

জ্বি আচ্ছা।

তুই চিন্তা করিস না। শুয়ে থাক। দুলারী তোর মাথায় পানি ঢালুক।

জ্বি আচ্ছা।

হাসপাতালে যদি নিতেই হয়, সন্ধ্যার দিকে নিয়ে যাব।

জ্বি আচ্ছা।

তুই কি কিছু বলবি?

আলতাফ বিড় বিড় করে বলল, সবাই আসতে শুরু করেছে, মামা।

কি বললি?

পোকারা আসতে শুরু করেছে।

বুঝতে পারছি না–পরিষ্কার করে বল কে আসছে?

পোকারা আসছে।

আসুক না, অসুবিধা কি?

ওরা আমাকে খেয়ে ফেলার জন্যে আসছে মামা।

তোকে খাবে কেন? ওদের কি খাওয়ার অভাব পড়েছে?

আমাকে ওরা পছন্দ করে তো মামা, এই জন্যেই খেয়ে ফেলবে।

পছন্দ করলেই খেয়ে ফেলতে হবে? আমি তোকে পছন্দ না করলেও তুই তো আমাকে পছন্দ করিস। তাই বলে কি তুই আমাকে খেয়ে ফেলেছিস, না খাওয়ার কথা চিন্তা করছিস?

পোকাদের চিন্তাভাবনা তো মানুষের মতো না মামা। ওরা অন্যভাবে চিন্তা

করুক অন্যভাবে চিন্তা। তুই ভাবিস না।

আমার ভয় লাগছে মামা। দূর দূর খেকে পোকার আসতে শুরু করেছে।

বজলুর রহমান সান্ত্বনার স্বরে বললেন, তুই কোন চিন্তা করিস না। তোকে খেয়ে ফেলবে বললেই হল? আমরা আছি কি জন্যে? দরকার হলে ঘরের চারকোণায় DDT পাউডার দেব। DDT পাউডার মারাত্মক জিনিস–পোকার বাবাও আসতে পারবে না। তুই চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকু–মোটেও চিন্তা করবি না।

জ্বি আচ্ছা।

বজলুর রহমান ব্যাপারটাতে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। জ্বর বেশি বাড়লে লোকজন অসংলগ্ন কথা বলে। আলতাফ তাই করছে। বজলুর রহমান ফাইল হাতে অফিসের দিকে রওনা হলেন।

.

১৫.

আমার নাম বজলুর রহমান। আমি আলতাফ হোসেনের মামা।

ও আচ্ছা। বসুন।

আমি স্যার ফাইলটা নিয়ে এসেছি।

মনসুর সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কি ফাইল?

একটা জরুরি ফাইল যে আপনি আলতাফকে দিয়েছিলেন, ফাইলটা হারিয়ে গিয়েছিল–ঐ ফাইল।

মনসুর সাহেব অবাক হয়ে বললেন, সেই ফাইল আপনি কোথায় পেলেন?

গাধাটা বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। তারপর ভুলে গেছে। এ রকম যে হবে জানা কখা।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ফাইলটা হারালে আমাদের খুব ক্ষতি হয়ে যেত।

বজলুর রহমান বললেন, আলতাফের মত লোক যখন আছে তখন ভবিষ্যতে আরো অনেক ক্ষতি হবে। করবেন কি! উপায় তো কিছু নেই।

চা খান।

চা খাব না। চলে যাব। ফাইলটা পৌঁছে দিতে এসেছিলাম। দিলাম। ঐ দিন তো আপনিই আমার বাসায় গিয়েছিলেন?

জ্বি।

আপনি যে বড় সাহেব দেখে মনেই হয় না। আপনাকে একটা জরুরি কথা বলি–আলতাফকে কখনো গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ দেবেন না। এলেবেলে ধরনের কাজ দেবেন। সে সুন্দর করে করবে। গুরুত্বপূর্ণ কাজ দিয়েছেন কি ভজঘট করে ফেলবে। মাখা ঠিক নেই তো!

মাথার ঠিক নেই?

জ্বি-না। ছোটবেলায় তার মাকে পোকায় খেয়ে ফেলল–সেই থেকে মাথাটা খারাপ। সারাক্ষণ পোকা পাকা করে।

উনার মাকে পোকায় খেয়ে ফেলেছিল না-কি?

জ্বি। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য! বলতে গেলে শশার মত কচক করে খেয়ে ফেলেছে। আপনাকে আর বলতে চাই না। বললে হয়ত দুপুরে ভাত খেতে পারবেন না। স্যার, উঠি তাহলে?

উঠবেন?

উপায় নেই স্যার, উঠতেই হবে। আলতাফের জ্বর। ভুল বকছে। বলছে–পোকা আসছে–খেয়ে ফেলবে–এইসব হাবিজাবি। তাকে হাসপাতালে নেয়া দরকার।

জ্বর তাহলে খুব বেশি?

বেশি মানে? বগলের নিচে থার্মোমিটার দিলে–থার্মোমিটারে আগুন ধরে যাবে এমন অবস্থা। স্যার, তাহলে ইজাজত দেন–বিদায় নেই। ঐদিন বাসায় গিয়েছিলেন, চিনতে পারিনি। তেমন সমাদর করতে পারিনি। আরেকবার যদি আসেন–বড় খুশি হব।

আচ্ছা, যাব আরেকবার।

.

মনসুর সাহেব অবাক হয়ে ফাইলটার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভয়ংকর রাগ হওয়া উচিত। লোকটা এরকম একটা কাজ করে কি করে? আর করার পরেও নির্বিকার থাকে কিভাবে? আশ্চর্যের ব্যাপার, আলতাফের উপর তার কোন রাগ লাগছে না। বরং প্রচণ্ড রকম মায়া হচ্ছে। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন–আলতাফ এই ফাইল বাসায় নিয়ে যায়নি। গনি নিয়ে গেছে। গনি যে একটা বাজারের ব্যাগে ভরে। ফাইল নিয়ে গেছে, তা-ও তিনি জানেন। কিভাবে জানেন? কে তাকে বলল? কেউ তো বলেনি। গনি ঐ বাড়িতে কি কি কথা বলেছে তা-ও তিনি জানেন। এটা কিভাবে হয়? সকাল দশটায় ঐ বাড়িতে গনির একটা কাজের মেয়ে দিয়ে আসার কথা। সে কি দিয়ে এসেছে?

মনসুর সাহেব বেল টিপে বেয়ারাকে ডাকলেন, সহজ স্বরে বললেন, গনি সাহেবকে আসতে বল।

গনি আসুক। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

স্লামালিকুম স্যার। আমাকে ডেকেছেন?

বসুন গনি সাহেব। ভাল আছেন?

জ্বি স্যার, ভাল।

বসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

গনি বসলেন। মনসুর সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, চা বা কফি কিছু খাবেন?

চা একটু খেতে পারি স্যার। ঐদিন ঠাণ্ডা লেগে বুকে কফ বসে গেছে। গরম চা। খেলে ভাল লাগবে। দুধ যেন না দেয় স্যার। আমাকে একজন বলেছে–চায়ের মধ্যে দুধ বিষের মত কাজ করে।

মনসুর সাহেব গনির চায়ে দুধ দিতে নিষেধ করলেন। তারপর ঝুঁকে এসে বললেন, ঐদিন আপনি আলতাফের বাসায় গিয়েছিলেন?

গনি হকচকিয়ে গেলেন কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন। সহজভাবে বললেন, জি স্যার?

সঙ্গে একটা বাজারের ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিলেন?

জ্বি স্যার।

ব্যাগে কি ছিল?

কিছু ছিল না স্যার।

আলতাফ সাহেবের বাসায় সকাল দশটার ভেতর একটা কাজের লোক দেয়ার কথা ছিল। কই, দেননি তো!

গনি অস্বস্তি বোধ করছেন। এই লোকটা এত কিছু জানে কোত্থেকে? কে বলেছে?

কি, কথা বলছেন না কেন? সকাল দশটায় একজনকে দেয়ার কথা না?

যাকে দেব বলেছিলাম সে গতরাতে হঠাৎ বরিশাল চলে গেছে। আমার স্ত্রীকে বলেছে–ভাইয়ের অসুখের খবর পেয়ে যাচ্ছে। আসলে ভাওতাবাজি। আমি থাকলে যেতে পারত না।

চা এসে গেছে। মনসুর সাহেব চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, না, ভাওতাবাজি না। ঐ মেয়েটার নাম পারুল। পারুলের ভাইয়ের আসলেই খুব অসুখ।

গনি থতমত গলায় বলল, আপনি কি করে জানেন?

মনসুর সাহেব শীতল গলায় বললেন, আমি সবকিছুই জানি।

এটি পুরোপুরি সত্যি। মনসুর সহেবের শরীর কাঁপছে। গা ঝিম ঝিম করছে। আসলেই তিনি কোথায় কি ঘটছে সব জানেন। এই তো এখন ওসমানকে দেখতে পাচ্ছেন। সে বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে পা দুলাচ্ছে। ওসমানের হাতে একটা বই। বইটার নাম Winter of discontent. ব্যাপারটা সত্যি না মিথ্যা এক্ষুণি বের করা মায়। ওসমানকে টেলিফোন করলেই হয়।

কে তাকে সব জানাচ্ছে? পোকারা জানাচ্ছে? পোকারা কি ঘটছে তা বলে দিচ্ছে?

গনি সাহেব ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, স্যার, আমি একটা ভুল করেছি। আপনার কাছে ক্ষমা চাই স্যার।

যান, ক্ষমা করা হল। চা শেষ না করে চলে যাচ্ছেন কেন? চা শেষ করুন, তারপর যান। গনি সাহেব চুক চুক করে চা খাচ্ছেন। মনসুর সাহেব টেলিফোন করলেন ওসমানকে।

কি করছ ওসমান?

বারান্দায় বসে আছি। কিছু করছি না।

বই পড়ছ না?

বই হাতে নিয়ে বসে আছি, পড়ছি না।

বইটার নাম কি?

Winter of discontent.

সন্ধ্যা সাতটার মত বাজে। অফিসের দারোয়ানরা এবং মনসুর সাহেবের একজন পিওন ছাড়া আর কেউ নেই। মনসুর সাহেব দরজা বন্ধ করে ভেতরে বসে আছেন। তীর ঘর অন্ধকার। তার বেয়ারা কিছুটা ভয় পাচ্ছে। স্যারের কি হয়েছে? এই অন্ধকারের মধ্যে তিনি বাতি নিভিয়ে বসে আছেন কেন?

তিনি করছেন কি? দেখার বা জানার উপায় নেই। কারণ দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়া। এয়ারকুলার চলছে না। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে না। ঘরের ভেতরটা অসহ্য গরম। তবে গরমে মনসুর সাহেবের খারাপ লাগছে না।

মনসুর সাহেবের ঘর নিকষ অন্ধকার। এই অন্ধকারে তিনি চেয়ারে পা তুলে চুপচাপ বসে আছেন। নিজিকে কিছু প্রশ্ন করছেন–এবং প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছেন।

মনসুর : আমি আমার এই অদ্ভুত ক্ষমতা লক্ষ্য করছি। কোথায় কি ঘটছে আমি সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারছি। ছবির মত দেখছি। এর মানে কি?

উত্তর : তোমার চেতনার বিস্তৃতি ঘটেছে। তোমার চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীময়।

মনসুর : এই চেতনার বিস্তৃতি তো আপনা-আপনি ঘটার কথা না। কেন ঘটল?

উত্তর : আমরা সাহায্য করেছি বলে ঘটল।

মনসুর : তোমরা কারা?

উত্তর : আমরা অতি ক্ষুদ্র প্রাণি। তোমরা যাদের পোকা বল, আমরা তাই। আমাদের এককভাবে কোন বুদ্ধি নেই, কিন্তু আমাদের সমষ্টিগত বুদ্ধি সীমাহীন। বুদ্ধি মানেই ক্ষমতা। তোমাকে আমাদের সেই ক্ষমতার কিছুটা দেখালাম। কেমন দেখলে আমাদের ক্ষমতা?

মনসুর : তোমাদের ক্ষমতা যদি থেকে থাকে তাহলে তা অবশ্যই বিস্ময়কর।

উত্তর : এখনো যদি বলছ? এখনো অবিশ্বাস?

মনসুর : হ্যাঁ, অবিশ্বাস। আমার ধারণা, পুরো ব্যাপারটাই আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা।

উত্তর : আমাদের ক্ষমতার আরেকটা নমুনা তোমাকে দেখাই–তাহলে হয়ত তোমার বিশ্বাস হবে।

মনসুর : আমার বিশ্বাসের জন্যে তোমরা এত ব্যস্ত কেন?

উত্তর : আমরা খুবই ব্যস্ত, কারণ তোমাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে। যাদের আমরা পছন্দ করি তাদের আমরা খেয়ে ফেলি। হি হি হি।

মনসুর : আচ্ছা, মানুষ কি তোমাদের শত্রু?

উত্তর : মানুষ আমাদের শত্রুও না, বন্ধুও না। মানুষ এবং পোকা-মাকড় হচ্ছে প্রকৃতির ক্ষুদ্র পরীক্ষার অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ।

মনসুর : সেটা কি রকম?

উত্তর : প্রকৃতি দেখতে চেয়েছিল–কোন প্রাণি শ্রেষ্ঠ? সমষ্টিগত বুদ্ধি যাদের তারা শ্রেষ্ঠ, না একক বুদ্ধির প্রাণি মানুষ শ্রেষ্ঠ।

মনসুর : প্রকৃতি কি দেখল?

উত্তর : আমরা জানি না, কারণ প্রকৃতি প্রশ্নের জবাব দেয় না।

মনসুর : মানুষ একক বুদ্ধির প্রাণি হলেও তার বুদ্ধির একটি সমষ্টিগত দিক আছে। সে অন্যের জ্ঞান গ্রহণ করে।

উত্তর : তা ঠিক, কিন্তু সে একই সঙ্গে সমস্ত জ্ঞান ধারণ করতে পারে না। এটা ভয়াবহ সীমাবদ্ধতা। মানুষ এই সীমা জানে না বলেই সীমাবদ্ধতা জানে না।

মনসুর : পাকারা কি এটা জানে?

উত্তর : জানে এবং পোকারা এমন অনেক কিছু জানে যা মানুষ এখনো কল্পনাও করতে পারে না।

মনসুর : আমাকে কি তা বলা যাবে?

উত্তর : হ্যাঁ, বলা যাবে। কিন্তু তোমার মস্তিষ্ক তা ধারণ করতে পারবে না। মানুষের একক মস্তিষ্কের জন্যে এই জ্ঞান অনেক বেশি ভারী।

মনসুর : আমি জানতে চাই।

উত্তর : কি জানতে চাও?

মনসুর : সবকিছু জানতে চাই।

উত্তর : মূল প্রশ্নের উত্তরটি জানলেই অনেক জানা হবে।

মনসুর : মূল প্রশ্ন কি?

উত্তর : প্রাণ কি? কেন প্রাণ সৃষ্টি হল?

মনসুর : হ্যাঁ বল—আমাকে বল–What is life?

উত্তর : সত্যি জানতে চাও?

মনসুর : চাই। অবশ্যই চাই।

উত্তর : আরো তো প্রশ্ন আছে, সেসবের উত্তর চাও না? যেমন–তুমি কে? তুমি কোত্থেকে এসেছ? তুমি কোথায় যাচ্ছ?

মনসুর : হ্যাঁ চাই, উত্তর জানতে চাই।

উত্তর : সময় কি অ কি জানতে চাও? এই পৃথিবীর সবচে রহস্যময় ব্যাপার হল সময়। সময়টা কি জানতে চাও না?

মনসুর : চাই। উত্তর : আমরা যা জানি সবই তোমাকে জানাব। তোমাকে আমরা আমাদের একজন করে নেব।

মনসুর : তা কিভাবে সম্ভব?

উত্তর : সম্ভব। খুবই সম্ভব। আমরা তোমাকে ছড়িয়ে দেব আমাদের মধ্যে। আগেই তো বলেছি যাকে আমরা পছন্দ করি তাকে আমরা ছড়িয়ে দেই নিজেদের মধ্যে।

মনসুর : তোমরা তাকে মেরে ফেল?

উত্তর : প্রাণ কি তা তোমরা জান না বলেই এই কথা বললে। প্রাণ কি জানা থাকলে বুঝতে যে প্রাণের বিনাশ নেই–রূপান্তর আছে।

মনসুর : মানুষ থেকে আমি পোকা হব?

উত্তর : ক্ষতি কি?

.

মনসুর সাহেব লক্ষ্য করলেন, তাঁর ঘরভর্তি পোকা। একটি-দুটি নয়, হাজারে হাজারে পোকা। লক্ষ কোটি পোকা কিলবিল করছে।

.

তিনি দরজা খুলে বের হতে চাইলেন। দরজা খুঁজে পেলেন না। তেলাপোকা সমস্ত দরজা ঢেকে ফেলেছে। তিনি চিৎকার করে উঠতে চাইলেন–মুখ হা করতেই অসংখ্য পোকা মুখের ভেতর ঢুকে পড়ল।

তাঁর চেতনা পুরোপুরি বিলুপ্ত হবার আগে আলতাফের কথা ভাবলেন। আলতাফকে সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলেন। তাঁর মত আলতাফকেও পোকা ঢেকে ফেলেছে। মাংস ছিঁড়ে খেতে শুরু করেছে। কত দ্রুতই না তারা খাচ্ছে। মনসুর সাহেব চেঁচিয়ে উঠতে গেলেন–এ কি করছ? তোমরা এটা কি করছ? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর হল–ভয় পেও না। ভয়ের কিছু নেই–প্রাণ এক ও অবিনাশী। তোমার প্রাণ এবং এক একটি পাকার প্রাণ আলাদা কিছু না। আমরা এক ও অভিন্ন।

তিনি বারবার নিজেকে বলছেন, এটা ভুল! এটা মায়া! এটা ভ্রান্তি! আসলে কিছুই ঘটছে না। কিছুই ঘটছে না। কিছু না।

তিনি ভয় পেলেন না। কারণ তিনি বুঝতে পারছেন, আসলে কিছুই ঘটছে না। সবই ভ্রান্তি এবং এক ধরনের হেলুসিনেশন। নিজেকে সামলাতে পারলেই হেলুসিনেশনের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। নিজেকে সামলাতে হবে। মনসুর সাহেব চোখ বন্ধ করে বললেন, আমি কিছু দেখছি না। আমি কিছু দেখছি না। তিনি মায়ার ভেতর খিক খিক হাসি শুনলেন। পোকার কি হাসে? এ কেমন হাসি? মাথার ভেতর তাঁকে পোকারা ডাকছে–মনসুর! মনসুর!

বল।

আমরা আছি। আমাদের অগ্রাহ্য করো না।

তোমরা আছ ঠিকই, কিন্তু এখন আমি যা দেখছি সবই ভুল।

না, ভুল নয়। আমাদের ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করো না। তুমি কেন রোদের দিকে তাকাতে পার না? কেন সব সময় চোখে কালো চশমা দিয়ে রাখি তা কি বলব? তাহলে বিশ্বাস করবে?

না, বিশ্বাস করব না।

লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পোকা মনসুর সাহেবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মনসুর জানেন এটা সত্যি নয়। এক ধরনের মায়া, কুহক, ভ্রান্তি। কিন্তু আসলেই কি তাই?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *