৩. তৈয়ব উদ্দিন খাঁ

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ উঠানের মাঝখানে চেয়ারে বসে রয়েছেন। তার পায়ের কাছে বসে আছে এস্কান্দার। এস্কান্দারের হাতে তার সেই পুরনো বন্দুকখানা। সে বন্দুকখানায় তেল মালিশ করছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তিনি ফজু ব্যাপারীর বউ সালেহার বাহুতে ওই গয়নাখানা দেখেছেন। নিজের চোখে না দেখলেও ওই গয়নার কথা যদি কেউ তাকে কেবল বর্ণনাও করত, তাহলেও তার চিনতে অসুবিধা হতো না। বছরের পর বছর ধরে তিনি ওই গয়না নানানভাবে খুঁজেছেন। সকালে সলিমুদ্দি দফাদারের বাড়িখানা দেখার পর থেকেই তার বুকের ভেতর কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করছিল। তারপর আবার ফজু ব্যাপারীর বউয়ের এই ঘটনা।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দৈবে বিশ্বাস করা মানুষ। নানান ঘটনা, ইঙ্গিত তিনি বোঝার চেষ্টা করেন। এ সকল ঘটনায় কোনো ইঙ্গিত রয়েছে কিনা তা বোঝার চেষ্টা কবেন। একইদিনে পরপর এমন দুটো ঘটনা কি তাকে কোনো বিশেষ ইঙ্গিত দিচ্ছে? ফতেহপুরের খা বংশের এই বিশাল শৌর্য-বীর্যের কি তাহলে হাতবদল হতে যাচ্ছে? একসময় এই বিশাল ফতেহপুর অঞ্চল এক নামে শাসন করত ব্যাপারীরা। তারপর অল্প কিছু সময়ের জন্য দফাদাররা। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে খাঁ বংশ। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এই আশি বছরের দীর্ঘ জীবনকালে নানান কিছু দেখেছেন, শুনেছেন। সেইসব থেকেই তিনি জানেন, জগতের কিছু কিছু অদ্ভুত নিয়ম আছে। সেই নিয়ম মানুষ বোঝে না। সকলেই বলে, এ জগতে কোনো কিছুই অবিনশ্বর নয়। এই কথা যে তিনি মানেন না, তা নয়। তবে এই কথার বাইরেও একটা কথা রয়েছে। তা হচ্ছে এই জগতে কোনোকিছু পুরোপুরি নশ্বরও নয়। সকল কিছুই একটা চক্রের মতো। ফলে একই জিনিস ঘুরে-ফিরে নানান বেশে বারবার আসে। আসল বিষয় হচ্ছে সময়। ঘুরে-ফিরে সময়ের ব্যবধানে একই জিনিস বারবার ঘটায়। ফলে কোনো কিছুই পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না।

ফজু ব্যাপারী কি তাহলে তার পূর্বপুরুষের সেই অমূল্য সম্পদের খোঁজ পেয়ে গেছে! নাকি ঘটনাচক্রে এই একখানামাত্র গহনা সালেহার কাছে ছিল। বা অন্য কোনো উপায়ে সে পেয়েছে। একটা বিষয়ে অবশ্য তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দ্বিধাগ্রস্ত। সেটি হচ্ছে যদি পুরো কলসভর্তি সোনা যদি ফজু ব্যাপারী পেয়ে থাকে, তবে সে তা এমন করে জনসম্মুখে বের করবে না। বরং যতটা সম্ভব লুকিয়েই রাখবে। তাহলে সালেহা এমন করে গহনা পরে তার সামনে এলো কেন? ভুল করে নয়তো? অনেক সময় এমন হয়, হুটহাট খুব দামি কিছু পেয়ে গেলে কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়ে শখটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। তাছাড়া সবাই সব সময় নিজেকে সামলাতেও জানে না। কিন্তু আসল ঘটনাখানা জানার জন্য ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ।

তিনি তার স্ত্রী আমোদি বেগমকে ডাকলেন। আমোদি বেগম বাতের ব্যথায় কাতর। তিনি এসে চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে খানিক কুঁজো হয়ে দাঁড়ালেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তোমার শইলের অবস্থা কী?

আমোদি বেগম বললেন, এহন আর শইলের ভালো মন্দ কী!

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, শইলের এহন আর তহন নাই। একশ বছর বয়সেও শইল ভালো থাকলে মনে হয় বয়স হইছে চল্লিশ বছর। আবার চল্লিশ বছর বয়সেও শইল ভালো না থাকলে মনে হয় বয়স হইছে একশ।

আমোদি বেগম বললেন, সবাই তো আর আপনের মতো না। একেকজনের শইল স্বাস্থ্য একেকরকম।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, শইলের নাম মহাশয়, যাহা সহায়, তাহাই সয়। আগে তো সহাই তো জানতে হইব। যাই হোক, এইসব জাইনা তোমার লাভ নাই। স্ত্রীর প্রধান দায়িত্ব স্বামীর খোঁজ-খবর নেওয়া। ভালো মন্দ জানা। সেই দায়িত্বও তো তুমি কোনোদিন পালন করো নাই।

আমোদি বেগম বললেন, আপনে রাহেন দুইন্যার মাইনষের খোঁজ। আপনের খোঁজ কে রাখব?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ খানিক বিরক্ত হলেন। তিনি বললেন, এই বয়সেও যে তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু হইব না, সেইটা আমি ধারণা করি নাই। বয়সের সাথে বুদ্ধি হওনটা জরুরি।

আমোদি বেগম এবার আর জবাব দিলেন না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আমোদি বেগমের আচার আচরণে বিরক্ত। বহুদিন থেকেই তিনি আমোদি বেগমের সংস্পর্শ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। আমোদি বেগমকে বিয়ে করার পর থেকে জৈবিক কারণ ছাড়া নিজের জীবনে আমোদি বেগমের আর কোনো গুরুত্ব কখনোই খুঁজে পাননি তৈয়ব উদ্দিন খাঁ।

তিনি কেঁশে গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, পুরুষ মানুষ হইল বাইর, আর মহিলা মানুষ হইল ঘর। ঘর মানে মহল। মহল থেইকাই মহিলা। পুরুষ মানুষ যতই বাইরের দুইন্যা শাসন করুক, সে ঘরে আসলে তারে দেখনের মতো, শাসন করনের মতো একজন মহিলা থাকতে হয়। এই বুড়া বয়সে এইসব জিনিস তোমারে শিখাই কোনো লাভ নাই। যার হয় তার নয়-তেই হয়, আর যার হয় না তার নব্বইতেও হয় না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ খানিক থামলেন। তারপর আবার বললেন, শোনো, এইসব প্যাচালে কাজ নাই। তোমারে জরুরি কাজে ডাকছি। ফজুর বউরে একদিন কোনো এক ছুঁতায় খবর দিয়া এই বাড়িতে আনন। খেয়াল কইরা দেখবা সে তার গায়ে কী কী গয়না পরছে। বিষয়টা খুব গোপনীয়।

আমোদি বেগম বেশিরভাগ সময়ই তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কথাবার্তা বোঝেন না। এবারও বোঝেননি। তবে বেশ অবাক হয়েছেন, সালেহা শরীরে কী গয়না পরে, তা দিয়ে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কী করবেন? আমোদি বেগম অবশ্য এই প্রশ্ন করলেন না। তিনি এই এত বছরে অন্তত এইটুকু জানেন যে এই বাড়িতে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তার ভূমিকা আসলে কী!

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এখন যাও। আর যত তাড়াতাড়ি পারো, তারে খবর দিয়া আনাও। পারলে আইজকাই।

সালেহাকে খবর দেওয়া হলো সেদিন বিকেলেই। কিন্তু শরীর খারাপের অজুহাতে সে আসলো পরদিন ভোরে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সেদিন আর ফজরের নামাজের পর হাঁটতে বের হলেন না। তিনি তার ঘরে বসে সালেহার আসার অপেক্ষায় রইলেন। সালেহাকে উঠান পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতে তিনি দেখেছেন। কথা ছিল আমোদি বেগমই খেয়াল করে দেখবেন সালেহার শরীরে কোনো গহনা রয়েছে কিনা। কিন্তু আমোদি বেগমের উপর যেন আস্থা রাখতে পারছেন না তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তার খুব অস্থির লাগতে লাগল। এস্কান্দারকে ডেকে তিনি বললেন সালেহা যেন যাওয়ার আগে তার সাথে দেখা করে যায়।

আমোদি বেগমের সাথে দীর্ঘ কথোপকথন হলো সালেহার। কথা শেষ করে সে আসলো তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সাথে দেখা করতে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সালেহার সাথে কথা বললেন। সেদিনের লেবু চিনির শরবত খেয়ে তিনি কী পরিমাণ আনন্দিত হয়েছেন, সে কথা তিনি সালেহাকে বললেন। সালেহার সন্তান-সন্ততি নেই। এই নিয়ে নানান চেষ্টা চরিত্রের কথা গায়ের সকলেই জানে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার চিরাচরিত গাম্ভীর্য ঝেড়ে ফেলে সেই বিষয়েও সালেহার সাথে কথা বললেন। সালেহা চলে যাওয়ার পরও তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। এ কথা সত্যি যে সালেহার শরীরে কোথাও সস্তা কিছু তাবিজ কবজ ছাড়া আর কোনো গহনা তিনি দেখতে পাননি। তার বাহু ঢাকা থাকায় বাজুবন্দ খানা রয়েছে কিনা, সে বিষয়েও নিশ্চিত হতে পারলেন না তৈয়ব উদ্দিন খাঁ।

তিনি ডাকলেন আমোদি বেগমকে। আমোদি বেগমও বললেন তিনি সালেহার শরীরে কোনো গয়না দেখতে পাননি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বিভ্রান্ত বোধ করছেন। তবে তার মন বলছে ঘটনা কিছু একটা ঘটেছে।

তিনি জীবনভর ব্যাপারীদের উপর কম অনাচার করেননি। এই অনাচার করার কারণেই হয়তো সেটি আবার চক্রাকারে ফিরে আসার একটা আশঙ্কাই যেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ভেতরে ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। তার হাতে ঘটনাচক্রে বজলু ব্যাপারী খুন হবার পর তিনি তার ক্ষতিপূরণের চেষ্টার বদলে উপরন্তু তাদের অনেক জমিজমা দখল করেছেন। ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করেছেন। আর তার। পরপরই মূলত ব্যাপারীরা ধীরে ধীরে গ্রাম ছাড়তে শুরু করে। বেশিরভাগই শহরে ছোটখাট কাজ করে। ফজুর আর দুই ভাইও শহরে কাজ করে। তারা আর গায়ে সেরকম আসে না। বাড়িতে আর যে কয়েক গেরস্ত আছে, তাদেরও হতদরিদ্র অবস্থা।

সেদিন রাতেই বড়পুত্র খবির খাঁকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তিনি খবির খাঁকে বললেন, সব মিলাইয়া ফসলি জমিন কয় বিঘা চাষে আছে?

খবির খাঁ বললেন, বন্যার পানি উঠছে বেশিরভাগ ক্ষেতেই। অনেক চাষের জমিনেও এহন আর চাষ নাই। এইজন্য চাষের জমিনের পরিমাণ বলা একটু কঠিন বাজান। বলতে গেলে একটু হিসাব-নিকাশ করন লাগব।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ একটু চুপ করে রইলেন। তারপর চোখ বন্ধ করে এই মুহূর্তে মোট কত বিঘা জমিতে চাষ হচ্ছে, কত বিঘা জমি বন্যার পানিতে ডুবে আছে তার হিসেব দিলেন খবির খাঁকে। তারপর বললেন কোন চরে কত বিঘা জমি অনাবাদি আছে তার হিসাব। বললেন কত বিঘা জমিতে কেবল গাছ লাগানো রয়েছে, কত জমিতে বর্গা চাষ হচ্ছে। কত বিঘা জমি খাজনা করে দেয়া হয়েছে। কোন এলাকায় কোন কোন জমি দেখভাল করার বিনিময়ে কোন কোন পরিবারকে বসত বাড়ি করতে দিয়েছেন। কে কে কতটুকু ফসল ফলিয়ে কতটুকু দিচ্ছে, এইসব হিসেব তিনি একের পর এক দিতে লাগলেন খবির খাঁর। সামনে। সবার শেষে দিলেন তাদের তালিকা, যারা তাদের ঠিকঠাক জমির ফসলের ভাগ সময়মতো বুঝিয়ে দিচ্ছে না, জমি দেখভাল করার বিনিময়ে বসত বাড়ি করাসহ নানা সুবিধা নিয়েও যারা তাদের দায়িত্ব পালন করছে না, তাদের কথাও বললেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ।

একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলে তিনি সামান্য হাঁপিয়ে উঠেছেন। এবার থামলেন। পুরো ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা। খবির খাঁ’র বুকের ভেতরটা কাঁপছে। তা মনে হচ্ছে আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক আগে তিনি তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সামনে বসে যেভাবে ভয়ে থরথর করে কাঁপতেন, যেভাবে তেষ্টায় তার গলা শুকিয়ে আসত, আজ এই বৃদ্ধ বয়সে এসেও তার সেই অনুভূতির সামান্যতমও হেরফের হয়নি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এবার বললেন, মোঘল আমলের কথা কিছু জানস?

হঠাৎ করে বাবার এমন প্রসঙ্গ বদলানোয় খবির খাঁ আরো ভীত বোধ করছেন। তিনি কথা বলতে গিয়েও কিছু বলতে পারলেন না। তার আগেই তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, জমিদারি আমলের কথা তো না জাননের কথা না।

খবির খাঁ ম্রিয়মান গলায় বললেন, জ্বে বাজান।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, মোঘল আমলে মোঘল সম্রাটরা যহন দেখতেন, দূরের কোনো জমিদার ঠিকঠাক মতো খাজনা দেয় না, তহন তারা কী করতেন জানস?

খবির খাঁ কোনো জবাব দিলেন না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, প্রথমে খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করতেন ঘটনা কী? বাহক পাঠাইতেন খাজনা বিষয়ে সতর্ক করতে। তারপরও যদি না পাঠাইতো তহন ফৌজ পাঠাইতো জমিদাররে ধইরা লইয়া যাওনের জন্য। ক্যান জানস?

খবির খাঁ চুপ। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ-ই আবার বললেন, আসল ঘটনা কিন্তু খাজনার অর্থ না। অনেক জায়গার খাজনার মূল্য তেমন আহামরি কিছু আছিল না, তারপরও পাঠাইতেন। পাঠাইতেন যতটা না খাজনা আদায়ের লইগা, তার চাইতে বেশি এইটা বোঝনোর লইগা যে তাদের রাজত্বে থাইকা তাদের ক্ষমতা অগ্রাহ্য করনের মতো দুর্বল তারা এহনও হয় নাই। এই কাজ ইংরেজরাও করছে। বিষয়টা যতটা না খাজনা, তার চাইতেও বেশি এইটা বোঝানো যে আমার শক্তি কিন্তু কমে নাই। একবার যদি জনগণ বুইঝা যায় যে তোর শক্তি কম, তুই কমজোর, দুর্বল, তাইলে কিন্তু আর তাগো সামলানো যাইব না। এইজন্য এই জিনিসগুলান খেয়াল রাখন খুব জরুরি। যহনই দেখবি তোর অধস্ত ন লোকজন তোর কথা মান্য করতেছে না, তোরে ভয় ডর করতেছে না, তহনই বুঝবি, তোর শক্তি নিয়া তাদের সন্দেহ তৈরি হইছে। আমার কথা বুঝছস?

খবির খাঁ ঢোক গিলে বললেন, জ্বে বাজান।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এবার সামান্য গলা চড়িয়ে বললেন, তুই কিছুই বুঝস নাই। আশেপাশে চোউখ কান খোলা রাখস না ক্যান? এই খাঁ বংশ এমনে এমনে এমন বড় বংশ হয় নাই। আর চোউখ কান খোলা না রাখলে এমন থাকবও না। অনেকেই ওঁৎ পাইতা আছে, তারা তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মরনের অপেক্ষায় আছে। আমি যেই চোউখটা বুজব অমনে তারা পিলপিল কইরা পিপড়ার মতো দল বাইন্ধা বাইর হইব। এইটা টের পাস?

খবির খাঁ চুপ।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, চাইরপাশে আমি নানা ফিসফিসানি শুনতেছি। এইটা তোরও শোননের দরকার আছিল। এই ফিসফিসানি শোনন শিখতে হইব।

খবির খাঁ বললেন, আপনেরে কেউ কিছু বলছে বাজান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, হ। বলছে।

খবির খাঁ উৎসুক গলায় বললেন, কেডা কী কইছে বাজান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, বাতাসে বলছে, গাছের পাতায় বলছে। যেই পথ দিয়া প্রত্যেকদিন হাইটা যেই সেই পথও কইছে। এইসকল কিছুরা কথা কয়। আমরা যা দেহি না, এরা তাও দেহে। এইজন্য এদের কথা শুনতে জানন দরকার।

খবির খাঁ এই জীবনে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর বেশিরভাগ কথাই বুঝতে পারেননি। এখনও ঠিকঠাক বুঝতে পারলেন না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, শোন কোন কোন জমিনের ফসলের হিসাব ঠিকঠাক মতো আসে না। কারা কারা কথা দিয়া কথা রাহে না, আইজ দিব, কাইল দিব কইরা ঘুরায়, তাদের সকলের লগে কথা বল। ধমক-ধামক দিতে হইব। কঠিন হইতে হইব। লাগলে দু’-চাইরডা লাশ ফালাইতে হইব।

খবির খাঁ যেন আঁৎকে উঠলেন। তিনি মিনমিন করে বললেন, এহন আর সেই আগের যুগ নাই বাজান। আগে এই এলাকায় দশটা মাডার করলেও সেই খবর থানা-পুলিশ হইত না। হইলেও তারা কেউ পাত্তা দিত না। পুলিশ ডরেও এই দুর্গম অঞ্চলে আইতে চাইত না। আর এহন ওইরম কিছু হইলে লগে লগে থানা পুলিশ হাজির হয় বাজান।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, সবকিছুরই একটা উপায় আছে। মানুষরে ডর দেহাইতে হইব। নিজের কঠিন রূপ না দেহাইলে শাসন করন যায় না। জনগণ দয়ালু শাসক পছন্দ করে না। শাসকের দয়ালু রূপরে তারা ভাবে দুর্বলতা। আর দুর্বল শাসকের অধীনে কেউ থাকতে চায় না। বিদ্রোহ হয়।

খবির খাঁ বুঝতে পারছেন না তিনি কী বলবেন! তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, যুগ যে বদলাইছে, সেইটা তো ভালো বুঝছস, কিন্তু যুগ বদলানোর লগে লগে যে নিজেগোরও বদলাইতে হইব, সেইটা বুঝস না কেন!

খবির খাঁ আবারো মৃদু গলায় বললেন, বাজান, আমারে একটু খুইলা বলবেন, আপনে কী টের পাইছেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কী টের পাইছি এহনও জানি না। তয় তলে তলে কিছু একটা ঘটতেছে। শোন, এই যে এত এত জমিন, এর বেশিরভাগেরই কিন্তু আসল কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ নাই। চর দখল করা হইছিল, কাগজপত্র করা হয় নাই। অনেকের জমি নানাভাবে দখল করা হইছে, মুখে মুখে কেনা হইছে, অদল-বদল হইছে, নানা কিছিমের বিষয়-আশয়। তহন তো গায়ের জোরই আসল জোর। কিন্তু ওই যে কইলি সময় বদলাইছে, এহন এইসব জমিন নিয়া যদি জমিনের পুরোনো কোনো ওয়ারিশ কোনো মামলা মোকদ্দমা করে, তহন কি করবি? তহন ওই কোট-কাছারিতেই কিন্তু যাইতে হইব। এইডা বোঝস?

খবির খাঁ বললেন, বাজান, কেডা আমাগো বিরুদ্ধে মামলা করব? আর মামলা চালাইতেও পয়সা-পাতির ব্যাপার। এই অঞ্চলে তেমন কেডা আছে যে কোটে যাইয়া মামলা-মোকদ্দমা চালাইব দিনের পর দিন? আর এইগুলান করতে হইলে যাইতে হইব মাদারীপুর টাউনে। কার এত হ্যাডম এইসব করনের?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ শান্ত গলায় বললেন, যদি কারো হ্যাডম হয়, তহন তুই কী করবি?

খবির খাঁ খানিক থতমত খেয়ে গেলেন। আসলেই তো, এই কথা তো তিনি ভাবেননি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এহন আর আগের দিন নাই। জমিজমা থেইকা নগদ পয়সাপাতিও তেমন আহে না। বড় বংশ হইলে নানাদিকে নানা খরচাপাতি। দিন শেষে আয়-ব্যয় সমান সমানই থাহে। যেমন আয়, তেমনই ব্যয়। এহন যদি হঠাৎ কইরা বিরাট অঙ্কের নগদ টাকা-পয়সার দরকার হয়, কোনো বিপদ আহে, মামলা-মোকদ্দমা চালাইতে হয়, তহন কী করবি? জমিন বেচবি? জমিন বেইচা জমিনের মামলা চালাইবি? এইরকম জমিন বেইচা বেইচা কয় দিন চলবি? বহুত জমিদার, তালুকদার এমনে কইরা পথের ফইর হইছে। এই জীবনে কম তো আর দেহি নাই।

খবির খাঁ এই সহজ বিষয়গুলো এতদিনেও কখনো চিন্তা করেননি। তার নিজেকে বোকাবোকা লাগছে। একই সাথে ভীতও লাগছে। তার হঠাৎ মনে হচ্ছে এই খা বংশ কোনো বিপদে পড়লে সেই বিপদ থেকে টেনে তোলার সামর্থ্য তার নেই। তার সন্তানদেরও নেই। ঠিক এই মুহূর্তে যদি তার বাবা। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মারা যান, তাহলে তিনি কীভাবে সব সামলাবেন? এতদিন তার মনে হতো বৃদ্ধ তৈয়ব উদ্দিন খাঁর উপস্থিতি তার জন্য এমন কোনো গুরুতর বিষয় না, বরং তিনি নিজে একাই সব কিছু সামলে নিতে পারবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তার মনে হলো, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আসলে আকাশের মতো বিস্তৃত এক বিশাল বটবৃক্ষ। যে মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকলে টের পাওয়া যায় না। মনে হয়, সব কিছুই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ঠিক যেই মুহূর্তে আর থাকবেন না, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে নিজেকে মনে হবে শূন্য, অসহায়। নিজেকে প্রচণ্ড দুর্বল মনে হতে লাগল খবির খাঁর। যেন এক ছোট্ট শিশু। বাবাকে ছাড়া এই কঠিন পৃথিবীতে যে এক মুহূর্তের জন্যও টিকে থাকতে পারবে না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ চিন্তিত গলায় বললেন, খবর পাইছি আব্দুল ফইর দিন কয় আগে মাদারীপুর টাউনে গেছিল। শুনছি সে ভূমি অফিসেও গেছিল।

খবির খাঁ বললেন, আব্দুল ফইর মাদারীপুর টাউনে বা ভূমি অফিসে গেলে আমাগো কি সমস্যা? তার লগে তো আমাগো জমিজমার কোনো সম্পর্ক নাই। তারা সারাজীবন খাইছে ফইরালি কইরা। আর তার বাড়ি রইছে সেই হোসনাবাদ। তাছাড়া ওই বাড়ির জায়গাটুক ছাড়া তার তো আর কোনো জমিনও নাই। আগেও আছিল না। তাইলে কী সমস্যা?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ গম্ভীর গলায় বললেন, যার মাথায় চুল আছে, সে চিরুনি পকেটে লইয়া ঘোরলে সেইটা সমস্যার কিছু না। স্বাভাবিক ঘটনা। সমস্যা হইল যার মাথাজোড়া টাক, সে যদি চিরুনি পকেটে লইয়া ঘোরে তহন। এইটা অস্বাভাবিক ঘটনা। আব্দুল ফইরের জমিন নাই, সে ভূমি অফিসে কী করে!

খবির খাঁ এবার রীতিমত মিইয়ে গেলেন। এই সামান্য বিষয়টাও তার মাথায় ঢুকল না। কিন্তু তিনি একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছেন না আব্দুল ফকিরের ভূমি অফিসে যাওয়ার সাথে তাদের সম্পর্কটা কী! তিনি বিড়বিড় করে বললেন, বাজান, ফইরসাবের লগে আমাগো জমিজমার কি কোনো সম্পর্ক আছে?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সাথে সাথে জবাব দিলেন না। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বললেন, খালি চোখে দেখলে নাই। তয় আমার মন বলতেছে কিছু একটা ঘটতেছে। জিনিসটা ধরতে আমার বেশি সময় লাগব না। তয় তার আগেই এই সব জমিনের কাগজপত্র বাইর কইরা লইয়া বয়। আলতাফ আর গেসুদ্দিন আমিনরে খবর দে। জমিজমার যেইগুলানের কাগজপত্র ঠিক-ঠাক নাই, সেইগুলানের কাগজপত্র বাইর করনের লইগা কী কী ব্যবস্থা নেওন লাগব, তাদের কাছে জিজ্ঞাস কর।

এই প্রথম খবির খাঁর মনে হলো তারা বড় ধরনের কোনো ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছেন। এই ঝামেলার বিরাট অংশই যাবে সঠিক কাগজপত্র না থাকা বিশাল পরিমাণ জমির কাগজপত্র করতে। সমস্যা হচ্ছে যথাযথ আইনগত উপায়ে এবং স্বল্প সময়ে এগুলো করা প্রায় অসম্ভব। সেক্ষেত্রে এগুলো করতে হবে অন্য কোনোভাবে। মাদারীপুর বা ফরিদপুর শহরে তাদের যেতে হবে এই কাগজপত্র করতে। কিন্তু ফতেহবাদে তাদের যত বড় প্রভাবই থাকুক না কেন, ফরিদপুর বা মাদারীপুর শহরে প্রভাব খাঁটিয়ে কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে কীভাবে কী করবে সে?

অনেক ভেবে-চিন্তে অবশেষে ভয়ে ভয়ে কথাগুলো তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে বললেন খবির খাঁ। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কথাগুলো শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, তাও ভালো যে এই জিনিস তোর মাথায় ঢুকছে। তয় সব চাইতে সহজ জিনিসটাই তো ঢোকে নাই। দুইন্যাতে একটা জিনিসের ক্ষমতা সবখানেই আছে। আর সেই জিনিসটা হইল পয়সা। টাকা-পয়সা হাতে থাকলে সব সম্ভব।

খবির খাঁ মিনমিন করে বললেন, কিন্তু বাজান, এ তো অনেক নগদ টাকা পয়সার ব্যাপার। তার ওপর ধরেন, কেউ যদি মামলা-মোকদ্দমা কইরা বহে, তাইলে তো আরো টাকা-পয়সার ব্যাপার। জমিজমা বেচন ছাড়া তো সেই পরিমাণ টাকা-পয়সার ব্যবস্থা আমাগো নাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ খবির খাঁর কথার জবাব দিলেন না। তিনি এস্কান্দারকে ডেকে বললেন মনিরকে খবর দিতে। মনির আসতে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এই মাসে মাদারীপুর গেছিলি?

মনির বলল, না, দাদাজান। আর তিনদিন বাদে যাওনের ডেট।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, মবিন এই মাসে টাকা পাঠায় নাই এহনো?

মনির বলল, পাঠাইছে, তয় ব্যাংকে জমা হইতে সময় লাগব। এই জন্যই তিনদিন বাদে যাওনের ডেট।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তিনদিন বাদে না। কাইল হইতে আগামী তিনদিন প্রত্যেকদিন মাদারীপুর টাউনে যাবি। গিয়া ভূমি অফিস আর কোটে ঘোরাঘুরি করবি। কোনো কাজ-কামের দরকার নাই। খালি ঘুইরা ফিরা দেখবি কে কী করে। কীভাবে কী করে। কেমনে কথা বলে। চোউখ-কান খোলা রাখবি। জয়নুদ্দিন তহশিলদার নামে একজন আছে। আমার পরিচিত, তার কাছে গিয়া আমার কথা বলবি। আর তিনদিন বাদে ব্যাংকের সব টাকার হিসাব আইনা আমারে দিবি। এতদিনে এই নগদ টাকার প্রয়োজন সামনে চইলা আসছে। এরপর তোর আরো অনেক কাজ আছে। আগে এইগুলান শেষ কর।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হঠাৎ এমন আচরণের বিশেষ কিছুই বুঝল না মনির। তবে গুরুতর কিছু একটা যে ঘটছে, সেটি সেও আন্দাজ করতে পেরেছে। তৈয়ব উদ্দিন খ ঠান্ডা গলায় বললেন, এহন যা।

মনির অবাক ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছেন খবির খাঁ। তিনি যে শুধু অবাকই হয়েছেন তাও, বরং বিস্ময়ে হতবুদ্ধ হয়ে গেছেন। এই এতবছর পরে এসে আজ তিনি বুঝতে পারলেন তার বড় ছেলে মবিনকে কেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কুয়েত পাঠিয়েছিলেন! এই নিয়ে বাবার ওপর ভারি একটা অভিমান, রাগ, ক্ষোভও পুষে রেখেছিলেন তিনি। নিজেদের এত ধন-সম্পদ থাকতে তার ছেলে কিনা বিদেশ-বিভূঁই গিয়ে গায়ে গতরে খাটবে! অনেকবারই বাবাকে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা তার হয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি আর সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি। আজ এতবছর পরে মানুষটার সেদিনের সেই সিদ্ধান্তের পেছনের উদ্দেশ্য খবির খাঁর কাছে পরিষ্কার হলো। আজকের এমন পরিস্থিতি যে-কোনো সময় তৈরি হতে পারে ভেবেই তিনি মবিনকে নগদ টাকা উপার্জনের জন্য বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

আরও একটা বিষয়ে অবাক হয়েছিলেন খবির খাঁ। সেটি হচ্ছে, বিদেশ থেকে মবিনের টাকা পাঠানো ও তা রাখার জন্য তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ব্যাংক একাউন্ট খুলতে বললেন মনিরের নামে। এটি নিয়েও তার মনে নানান জিজ্ঞাসা ছিল। কারণ খবির খাঁর সব সময়ই মনে হয়েছে যে তার ছোট পুত্র মনির খানিকটা সহজ সরল প্রকৃতির ছেলে। এই গগ্রাম থেকে নিয়মিত শহরে গিয়ে ব্যাংকের হিসেব-নিকেশ করার মতো জটিল বিষয়গুলো দেখভাল করার জন্য যে পরিমান বুদ্ধি-জ্ঞান প্রয়োজন, তা মনিরের আছে বলে তিনি জানতেন না। কিন্তু খানিক আগে মনিরের সাথে হওয়া তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কথোপকথনেই যেন আরো একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল খবির খাঁর কাছে। সেটি হলো, আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে চিন্তা করেই আজ থেকে বছর কয়েক আগেই তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মনিরকে প্রস্তুত করে রাখতে চেয়েছিলেন। সেইজন্যই তাকে ব্যাংকের কাজের সাথে যুক্ত করে দিয়ে নিয়মিত মাদারীপুর শহরে যাওয়া-আসার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাহলে কি তাদের অবর্তমানে খাঁ বংশ টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নেয়ার জন্য মনিরকেই তৈরি করছেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এবং এই পুরো বিষয়টিই কি তার একটি সুদূরপ্রসারী সুচিন্তিত পরিকল্পনারই অংশ? চোখের সামনে ঘটা এই ঘটনাগুলো দেখেও এই এতদিনেও কিছুই আঁচ করতে পারেননি খবির খাঁ।

এই অবধি ভাবতেই খবির খাঁর সারা শরীর যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। তার মনে হলো, তার সামনে বসা অশীতিপর এই বৃদ্ধ মানুষটির কপালের দৃশ্যমান ওই চোখজোড়া ছাড়াও হয়তো লুকিয়ে থাকা আরো একখানা চোখও কোথাও রয়েছে। যেই চোখে তিনি এমন সকল বিষয় দেখে বেড়ান, অন্যরা সহজে দেখতে পায় না!

*

প্রায় শেষ রাত। এই সময়ে ফতেহপুরের কোনো ঘরেই সামান্যতম আলোর আভাস নেই। সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কেবল ফজু ব্যাপারীর ঘরের কেরোসিনের কুপিখানা চারপাশের অন্ধকারকে আরো খানিক গাঢ় করে দিয়ে মৃদু আলোয় জ্বলছে। উঠানের অন্ধকারও ব্যাপারী বাড়ির আরো তিনখানা ঘরের পুরুষেরা প্রবল সতর্কতায় ঘাপটি মেরে পাহারায় বসে রয়েছে। ফজু ব্যাপারীর ঘরের ভেতর জ্বলা কেরোসিনের কুপির চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে ফজু ব্যাপারী, তার স্ত্রী সালেহা আর আব্দুল ফকির। খানিক আগে নিঃশব্দে আব্দুল ফকিরের নাও ভিড়েছে ফজু ব্যাপারীর খালের ঘাটে। তার সাথে জুলফিকারসহ আরো দুজন যুবকও এসেছে। তারাও বাইরের অন্ধকারে বসে চারপাশে নজর। রাখছে।

আব্দুল ফকিরের সামনে অনেক কাগজপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। তিনি গভীর মনোযোগ নিয়ে সেইসব কাগজপত্র দেখছেন। দেখছে ফজু এবং সালেহাও। তবে তারা এ সকল কাগজপত্রের তেমন কিছুই বোঝে না। ফজু হঠাৎ কাগজ থেকে মুখ তুলে ফিসফিস করে বলল, ফইর কাকু, কী মনে হয়, এই কয়দিনে কাগজপত্র যা দেখলেন, তাতে কি আমাগো কোনো আশা আছে?

আব্দুল ফকির মুখ না তুলেই বললেন, এহনও বেশি কিছু দেখতে পারি নাই। এইসব জমিজমার অফিসে খালি দালাল আর দালাল। আর হইছে পয়সা খাওনের ধান্ধা। তয় আমারে অনেকেই চেনে। এইজন্য আলাদা একটু সুবিধা আছে। আবার অসুবিধাও আছে!

ফজু বলল, অসুবিধা কী?

আব্দুল ফকির বললেন, অসুবিধা হইছে, আমি যে মাদারীপুর ভূমি অফিসে যাই, এই কথা খাঁ-বাড়িতে পৌঁছাইতে কতক্ষণ?

ফজু বলল, আপনে গেলে তাগো সমস্যা কী? আপনের লগে তো তাগো জমিজমার কোনো বিবাদ নাই। আর এর লইগাই তো আপনেরে পাঠাইছি। আমরা গেলে তো আগেই ধইরা ফালাইব।

আব্দুল ফকির বললেন, তোরা যাওনেরতন আমি যাওন ভালো হইছে। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁরে তো চেনোস না! সে…

ফজু যেন হঠাৎ জ্বলে উঠল। সে বলল, তারে আমি চেনতেই চাই। আপনে তো কিছু ভোলেন নাই কাকু। আমিই সব ভুইলা বইসা আছিলাম। আসলে ভুলি নাই কাকু, ভোলার ভান ধইরা আছিলাম। সুযোগের অপেক্ষায় আছিলাম।

আব্দুল ফকির ঠোঁটে আঙুল চেপে চুপ করার ইশারা করলেন ফজুকে। তারপর বললেন, এই এলাকায় যার যা জমিজমা আছিল, তা তো তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আগেই নামমাত্র দামে হয় কিন্যা নিছে, নইলে ডর দেহাইয়া বা অন্য উপায়ে জোর দখল করছিল। তারপরও পরিমাণে অল্প হইলেও শেষমেষ আরো কিছু ভালো জমিন আছিল তোর বাপের। সেই জমিন নিয়াই তোর বাপের লগে ঝামেলা আছিল তৈয়ব উদ্দিন খাঁর। প্রথমে সে কিনতে চাইছিল, তোর বাপও ঘাড়ত্যাড়া। সে জমিন বেচবো না। এরপর কতকিছু যে করল সেই জমিনের লইগা, কিন্তু কিছুই কাজে আইল না। শেষে তো আমার বাড়ির ওই ঘটনা। সেই রাইতেও তোর বাপে আমার কাছে গেছিল এই জমিজমা লইয়া কথা বলতেই। কিন্তু আল্লায় আমার জানের বদলে তার জান নিয়া নিলো।

ফজু অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। তারপর হঠাৎ একখানা কাগজ হাতে নিয়ে আব্দুল ফকিরের সামনে আলোতে ধরে বলল, কাকু, বাপজানের সেই জমিন ছাড়াও নাকি ব্যাপারীগো আরো বহুত জমিন খয়েরা জোর কইরা দখল করছে?

আব্দুল ফকির গম্ভীর গলায় বললেন, হ। অনেক। সব জমিন যদিও না-ও উদ্ধার করতে পারি। অর্ধেক উদ্ধার করতে পারলেও খায়গো বাড়ির গোড়া লইড়া যাইব।

ফজুর চোখজোড়া হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে বলল, আপনে আপনের কাজ করেন কাকু। টাকা-পয়সা নিয়া আপনে চিন্তা করবেন না। মামলা মোকদ্দমা যেইহানে যা করতে যত টাকা লাগে আমরা দিব। আপনে খালি আমাগো জমিনগুলা উদ্ধার কইরা দিবেন।

আব্দুল ফকির গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, আচ্ছা ফজু একখান কথা। হঠাৎ কইরা এই এত বছর পর এই জমিনের পিছে লাগছস ক্যান, আমারে বল তো? আর এত টাকা-পয়সাই বা কই পাইবি? এইসব কাজ মানেই খালি টাকা আর টাকা। কথা বলনের দেরী আছে, পকেটেরতন টাকা খসনের দেরী নাই।

ফজু বলল, আমাগো বংশের যারা যেইহানে আছে, সবাই মিল্যা সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা দিব বলছে। আমার দুই ভাইও আছে এর মধ্যে। আপনে টাকা নিয়া চিন্তা করবেন না।

আব্দুল ফকির বললেন, তুই সত্য কইরা বল তো, আমার কাছে কি কিছু গোপন করতেছস তুই?

ফজু জিভ কেটে বলল, তওবা তওবা। কি কথা কন ফইর কাকু! একখান কথা বিবেচনা কইরা দেহেন, এই সময়ে আমাগো মাথার উপরে আপনে ছাড়া আর কেডা আছে? আপনেরতন যদি কিছু গোপন করি তাইলে উপায় কি? আপনে এহন আমাগো ডাক্তার। আমরা হইলাম রুগী। ডাক্তারের কাছে যদি রুগী কিছু গোপন করে, তাইলে সেই রুগীর রোগ কখনো ভালো হয় ফইর কাকু।

আব্দুল ফকির সামান্য হাসলেন। ফজু ভেবেছিল তার কথায় সে আব্দুল ফকিরকে মুগ্ধ করতে পেরেছে। কিন্তু আব্দুল ফকিরের কথা শুনে তার মনে হলো সে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলেছে। আব্দুল ফকির বললেন, লক্ষণ তো খারাপ ফজলু।

ফজলু অবাক গলায় বলল, কিসের লক্ষণ খারাপ কাকু’?

আব্দুল ফকির বললেন, তোর লক্ষণ। তোরে এই মাসখানেক আগেও দেখছি আলাভোলা একখান পোলা। ঠিকমতো গুছাইয়া কথা বলতে পারস না। বয়স হইছে, বুদ্ধি হয় নাই। আর এহন দেখি মুখে কথার খই ফোটে। খুব হিসাব-নিকাশ কইরা কথা বলতেছস। বুদ্ধিমান মানুষও কহন বলদ হয় জানস? যহন তার পকেটে টাকা না থাকে। আর বলদও বুদ্ধিমান হইয়া যায় যহন তার পকেটে টাকা থাহে। তুই তো মাশাল্লাহ কয়েকদিনেই কি সোন্দর গোছাইয়া কথা বলন শিখ্যা গেছস। ঘটনা কি? মাত্তা মুত্তা পাইছস নাকি?

এ অঞ্চলে মাত্তা বলতে লোকে বোঝে গুপ্তধন। ফজুর বুকের ভেতরটা আবার ধক করে উঠল। সে বলল, মাত্তা পাইলে কি আর এই ঘরে থাহি কাকু! খাইয়া না খাইয়া যে কষ্ট করতেছি, এইটা কোনো মানুষে করে! তাও তো ওই জমিটুকের জন্যই এইসব।

আব্দুল ফকির আর কথা বাড়ালেন না। ফজুর সাথে আরো কিছু বিষয় আলোচনা শেষ করে নৌকায় উঠলেন। আর কিছুক্ষণ বাদেই ফজরের আজান হবে। তার আগেই ফতেহপুরের লোকালয় থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

.

তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে খবরটা দিলেন মসজিদের ইমাম নুরুজ্জমান হুজুর। মসজিদের সাথেই একখানা ঘর। সেই ঘরেই নুরুজ্জামান হুজুর থাকেন। শেষরাতের আগে তিনি উঠেছিলেন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে। খালের ঘাটে ওজু করতে গিয়ে তিনি জুলফিকারকে দেখতে পেলেন। ওজু করতে আব্দুল ফকিরকে যাতে নাওয়ের গলুইয়ে না আসতে হয়, সম্ভবত এই কারণেই তার জন্য ওজুর পানি তুলছিল জুলফিকার। নুরুজ্জামান হুজুরের হাতে ছিল হারিকেন। এত রাতে নৌকার শব্দ পেয়ে তিনি হারিকেনখানা তুলে ধরলেন। তখনই হারিকেনের আবছা আলোয় জুলফিকারকে দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। প্রতিদিনের মতো ফজরের আজানের সাথে সাথেই মসজিদে এসে হাজির হলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তাকে দেখে নির্দোষভাবেই কথাটা বললেন ইমাম সাহেব, আবারো কেউরে সাপে কাটছেনি খাঁ সাব?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হলেন। তিনি বললেন, কই? কারে সাপে কাটছে?

ইমাম সাহেব বললেন, না মানে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়নের লইগা খালঘাটে গেছিলাম অজু করতে। আচুক্কা দেহি একখান নাও। এত রাইতে নাও দেইখা অবাক হইয়া গেছি। হারিকেন তুইলা জিগাইলাম কে যায়? কিন্তু কেউ জবাব দিলো না। তারপর তাকাইয়া দেহি, আব্দুল ফইরের সাগরেদ জুলফিকার। ফইর সাবেও মনে হয় নাওয়ে আছিল। তয় তারে দেহি নাই। তাই ভাবলাম, অত রাইতে ফতেহপুর। আবার কাউরে সাপে কাটে নাই তো!

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বাকিটা সময় আর কোনো কথা বললেন না। তিনি যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষে দীর্ঘ মোনাজাত করলেন। ভয়ঙ্কর রাগে, ক্রোধে তার শরীর ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি সব সময়ই দেখেছেন, কঠিন মুহূর্তে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেয়ে কার্যকরী কিছু আর নেই। তিনি মোনাজাতের মধ্যেও চেষ্টা করলেন তার রাগ কমানোর। কিন্তু রাগ কমলো না। বরং বাড়ল। এই আশঙ্কাটাই তিনি করেছিলেন। এখন তিনি মোটামুটি নিশ্চিত যে ফজু অবশ্যই সেই গয়নার কলসি খুঁজে পেয়েছে। আর খুঁজে পেয়েই সে কাজে নেমে গেছে। সে তার বাপ-দাদার হারানো সম্পদ ফিরে পেতে চাইছে। আর এইজন্য সে জুটিয়েছে আব্দুল ফকিরকে। নানা কারণে আব্দুল ফকিরের প্রতি তৈয়ব উদ্দিন খাঁর অবিশ্বাস্যরকম রাগ। বিভিন্ন সময় আব্দুল ফকিরের সাথে তার নানা অমীমাংসিত ঘটনাও রয়ে গেছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ইচ্ছে করেই সেই সকল ঘটনা আর বাড়াননি। নিজে নিজেই ক্ষ্যান্ত দিয়েছেন। অনেকক্ষেত্রে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মতো মানুষের জন্য এই ক্ষ্যান্ত দেওয়া পরাজয়ের শামিল। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সেই পরাজয় মেনেও নিয়েছেন। তার নিজের কাছে নিজের স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে তিনি আব্দুল ফকিরকে সমীহও করেন। বুদ্ধিমান, ধূর্ত মানুষমাত্রই তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সমীহ করেন, মেপে চলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ধারণা, তার দেখা সবচেয়ে ধূর্ত এবং একইসাথে বুদ্ধিমান মানুষ এই আব্দুল ফকির।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নামাজ শেষ করে এস্কান্দারকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন। হাঁটতে হাঁটতেই তার হঠাৎ মনে হলো এই শেষ বয়সে এসে তিনি একটা কঠিন যুদ্ধের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। ঘটনায় ফজু বা অন্য আর কেউ থাকলেও সমস্যা হতো না। সমস্যা হয়েছে আব্দুল ফকির থাকায়। আব্দুল ফকির কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে খেলতে পছন্দ করেন। কিন্তু তিনি কখনো ধরা দিবেন না যে তিনি খেলছেন। অথচ মুহূর্তের ভুলে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করে ফেলবেন তিনি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ একবার ভাবলেন, তিনি কি আজ আরেকবার ফজু ব্যাপারীর বাড়ি হয়ে আসবেন? যদি নতুন কিছু তার চোখে পড়ে! কিন্তু শেষ অবধি তিনি সিদ্ধান্ত বদলালেন। বাড়ি ফিরে এলেন তার কিছুক্ষণ পরেই।

বাড়ি ঢুকতেই নয়নের সাথে তার মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। ছেলেটাকে দেখে আজকাল আর চট করে চেনা যায় না। গায়ের রঙ ময়লা হয়ে গেছে। শুকিয়েছেও অনেকটা। চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে। হাত-পা কেমন খসখসে মলিন হয়েছে। গত বেশ কিছুদিন ধরে নয়ন তার ঘর থেকে খুব একটা বের হয়নি। তিন বেলার খাবারও তাকে ঘরে পৌঁছে দিতে হয়েছে। তৈয়ব। উদ্দিন খাঁ নয়নকে নিয়েও ভীষণ চিন্তিত। তিনি খুব করে চান যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা ফিরে যাক নয়ন। নানার মুখোমুখি পড়ে থমকে দাঁড়াল নয়ন। তারপর বলল, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে নানাজান।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নরম গলায় বললেন, কথা থাকলে কথা বলবা। এত তাড়াহুরার তো কিছু নাই। বেয়ান হইছে, নাস্তা পানি কিছু খাইছ? আগে নাস্তা পানি কিছু খাও।

নয়ন বলল, আমি সকালের খাবার একটু দেরি করেই খাই নানাজান। বেশিরভাগ সময় খাইও না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হাসলেন। তারপর বললেন, বয়স হইছে দেইখাই কিনা কে জানে, তোমাগো নিয়ম-কানুন দেহি সব উল্টাপাল্টা। তোমরা ডাক্তাররা যদি এমন অনিয়ম করো, তাইলে আমরা কি করব? শোনো, সকালে খাইতে হইব রাজার মতো। দুপুরে খাইতে হইব প্রজার মতো। আর রাইতে খাইতে হইব ফইরের মতো অল্প। এইগুলান সেই ছোটবেলারতন শুইনা আসছি। আর তোমরা যে কী করো!

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর গলায় নয়নের জন্য যে আলাদা খানিক মমতা লেগে থাকে সেটি নয়ন টের পায়। সে ভেবে অবাকও হয়, মানুষটার ভয়ে সবাই থরথর করে কাঁপে। এই খাঁ বংশের সকলেই যার সাথে এক কথার পর দুই কথা বলতে এলে কথা গুলিয়ে ফেলে, সেখানে তিনি নয়নের সাথে কথা বলার সময় আর আট দশজন স্নেহপরায়ণ মানুষের মতোই ঘরের মানুষ হয়ে যান।

*

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সাথে সেই সকালে আর দেখা হলো না নয়নের। কী এক জরুরি কাজে তিনি তড়িঘরি করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। নয়নের সাথে তার দেখা হলো রাতে। কেরোসিনের হারিকেনের আলোয় তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ঘরে তার মুখোমুখি বসল নয়ন। তারপর বলল, নানাজান, অনেক দিন থেকেই ভাবছি, আপনার কাছে কিছু বিষয়ে জানতে চাইব আমি। কিন্তু নানা কারণে হয়ে উঠছিল না। এদিকে আমাকে ঢাকা যেতে হবে জরুরি। তার আগে আপনার সাথে বিষয়গুলো নিয়ে একটু কথা বলতে চাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, কী জানতে চাও বলো?

নয়ন বলল, এগুলো আমার কৌতূহল। কিন্তু বিষয়গুলো আমার জানা দরকার। আপনার যদি মনে হয় এই বিষয়ে আপনি কোনো কথা বলতে চান না, তাহলে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনি নাও দিতে পারেন।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে নয়নের দিকে তাকালেন। নয়ন বলল, এই যে এত বছর হলো মা এ বাড়ি থেকে গেল, তারপর আর কখনো এ বাড়িতে আসে নাই, এমন কি আমাকে বা বাবাকেও কখনো এখানে আসতে দিতে চায় না। কেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এতদিন পর এই প্রশ্ন?

নয়ন বলল, সব প্রশ্ন কি সব সময় গুরুত্বপূর্ণ হয় নানাজান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ একটু চুপ থেকে বললেন, কারণগুলা তো তুমি তোমার মায়রেই জিজ্ঞাস করতে পারতা নানাভাই।

নয়ন বলল, আমি মাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু সে এইসব বিষয় নিয়ে কখনোই কথা বলতে চায় না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এবার গম্ভীর হলেন। বললেন, কেউ যদি কিছু না বলতে চায়, সেই জিনিসটা না জানাই ভালো। যদি জিনিসটা জানা না জানায় তোমার কোনো লাভ ক্ষতি না হয়।

নয়ন বলল, নানাজান, আমার মা খুব একা থাকা এক মানুষ। তাকে আমি কখনো আমার বাবার সাথেও সেভাবে কথা বলতে দেখিনি। হাসতে দেখিনি। এই জগতে তার সবচেয়ে বড় ভালোবাসার মানুষ ছিলেন আপনি। অথচ আপনার সাথেও তার বছরের পর বছর কোনো যোগাযোগ নেই। কী কষ্টকর না বিষয়টা? এখন তার সবচেয়ে কাছের মানুষ আমি। আমার কি উচিত না, তার কী এমন দুঃখ আছে সেটা খুঁজে বের করা?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, জীবনটা তো এত সহজ না নানাভাই যে, তুমি চাইলা আর সব হিসাব মিল্যা গেল। সব সমস্যা সমাধান হইয়া গেল। জীবন বড় কঠিন জায়গা। এইখানে বেশিরভাগ হিসাবই মেলে না।

নয়ন বলল, কিন্তু জানার সুযোগ যেহেতু আছে, আমি জানতে চাই নানাভাই।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, সব সুযোগ নিতে হয় না ভাই। আমরা সব সময় ভাবি, সুযোগ আসামাত্রই সুযোগ নিয়া নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবা, কহনো কহনো সুযোগ না নিয়া ছাইড়া দেওয়াটা আরো বড় বুদ্ধিমানের কাজ।

নয়ন বলল, কিন্তু আপনি তো একজন বাবা। আপনার মেয়ে আপনার কাছ থেকে এই যে এত এত বছর দূরে। আপনার খারাপ লাগে না? আপনার কি উচিত না, তাকে একবারের জন্য হলেও আপনার কাছে নিয়া আসা?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, সবাই কাছে আননের মানুষ না। কেউ কেউ খালি দূরে ঠেইলা দেওনের মানুষ। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দূরে ঠেইলা দেওনের মানুষ।

নয়ন বলল, মা’র জন্য আপনের মায়া হয় না? দেখতে ইচ্ছা হয় না?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মনে আল্লায় মায়া-দয়া দেয়। নাই। সে মায়া-দয়ার মানুষ না।

নয়নের হঠাৎ খুব রাগ হতে লাগল। সে বলল, নানাজান, আপনি জীবনভর বহু সত্য, মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছেন। এই বিষয়টাও আপনাকে কষ্ট দেয় না?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, সত্য লুকাই রাখনের ক্ষমতা আল্লাহপাক কাউরে দেন নাই। সত্যের দায়িত্ব আল্লাহপাকের নিজের। তিনি একদিন না একদিন সত্য বাইর করেনই।

নয়ন বলল, দীর্ঘদিন লুকিয়ে থাকা সত্য বের হয়ে আসলে তা মিথ্যার চেয়েও খারাপ হয় নানাজান।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, দুনিয়ার সব মানুষের খারাপ ভালো বোঝার ধরন কিন্তু এক না। একজনের কাছে যা খারাপ, আরেকজনের কাছে তা ভালো। তো কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ এইটা সকলে বোঝে না।

নয়ন কিছু বলল না। চুপ করে রইল। তবে সামান্য চুপ থেকে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, তুমি এইবার গ্রামে আসছ কেন? আসমার মৃত্যুর বিষয়ে কি কিছু সন্দেহ করো? এইজন্যই গ্রামে আসছ এইবার?

নয়ন সাথে সাথে জবাব দিলো না। খানিক চুপ থেকে বলল, আব্দুল ফকির লোকটা সম্পর্কে আপনার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না নানাজান। কিন্তু আপনি তার সম্পর্কে একটা কথাও আমাকে বলেননি। আপনি কি আব্দুল ফকিরকে ভয় পান? আপনি জানেন, আসমা কেন মারা গেছে?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, জানি।

নয়ন বলল, কীভাবে জানেন? এই কথা তো কেউ জানে না। আসমার মৃত্যুর পর তার লাশ নিয়ে এসেছিলেন বাবা। আমার পরীক্ষার কারণে আমি আসতেও পারিনি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আন্দাজ করেছি।

নয়ন বলল, এত বড় একটা অস্বাভাবিক ঘটনা কি কারো পক্ষে এমনি এমনি আন্দাজ করা সম্ভব নানাজান? আমি এই বিষয়টাই আপনার কাছ থেকে জানতে চাইছি। আব্দুল ফকির নিশ্চয়ই এমন কাজ আরো করেছে এবং সেসব আপনি জানেন। না জানলে এত সহজে আপনার আন্দাজ করতে পারার কথা না। কিন্তু কিসের ভয়ে আপনি আব্দুল ফকিরকে কিছু বলছেন না। কাউকেই কিছু বলছেন না। কেন? আপনি কি তাকে ভয় পান?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মাথার টুপিটা খুলে ভাঁজ করে বিছানার পাশে রাখলেন। তারপর এস্কান্দারকে ডেকে পান খেতে চাইলেন। নয়ন নানার দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটাকে তার এত অদ্ভুত লাগছে! এস্কান্দার পান দিয়ে যেতে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সময় নিয়ে নিজের হাতেই পান বানালেন। তারপর একখানা পান নয়নের দিকে তুলে দিয়ে বললেন, খাইয়া দেহো। মজা পাইবা।

নয়ন পান নিলো না। সে উত্তেজিত গলায় বলল, আপনি কি জানেন নানাজান, আসমার ঘটনায় আমরা কতবড় বিপদ থেকে বেঁচেছি? সে আমাদের বাসায় কাজ করত। নানীজান তারে চার-পাঁচ বছর আগে আমাদের বাসায় কাজের জন্য পাঠিয়েছিলেন। মা প্রথমে রাজি হয়নি। তারপরও নানীজান জোর করে পাঠালেন, কিছু কিছু কাজ করতে মার কষ্ট হয় বলে। সেই মেয়ে কিছুদিন আগে আত্মহত্যা করে মারা গেল। ঢাকায় একজন কাজের মেয়ে আত্মহত্যা করলেই পুলিশ ধরে নেয় এর পেছনে খারাপ কোনো ঘটনা রয়েছে। সেখানে ওই বাড়িতে আমি থাকি, বাবা থাকেন। দুই দুইজন পুরুষ মানুষ। আসমা পনের ষোল বছরের মেয়ে। সে সেই বাড়িতে মারা গেছে ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে। পুলিশ যদি এই ঘটনা জানত, আমরা কতবড় বিপদে পড়তে পারতাম আপনি জানেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নয়নের প্রশ্নের জবাব দিলেন না। নয়ন একটা জিনিস খেয়াল করেছে, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার মা কোহিনূর সম্পর্কে যেমন কোনো প্রশ্ন। করেন না, কিংবা কিছু জানতে চান না। তেমনি, তার বাবা ফখরুল ইসলাম সম্পর্কেও কিছু জানতে চান না। বিশেষ করে শ্বশুরদের মেয়ের চেয়েও জামাইয়ের ভালো-মন্দের প্রতি একটা আলাদা আগ্রহ থাকে। কিন্তু কোনোদিনও তার বাবা সম্পর্কে এই আগ্রহটি তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দেখাননি। এবারও এমন বিপদের আশঙ্কার কথা শুনেও তিনি চুপ করেই রইলেন। নয়ন নানার খানিকটা কাছাকাছি মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার মৃত্যুর সময় মেয়েটা গর্ভবতী ছিল নানাজান! এই কারণেই সে আত্মহত্যা করেছে। আমি যদি আগেভাগেই ঘটনা না জানতাম, তাহলে আমাদের পরিবারের ভেতরই কী ভয়াবহ অবস্থা হতো, আপনি বুঝতে পারছেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ পান চিবুচ্ছেন। তার মুখ নির্বিকার। নয়ন খুব অবাক হচ্ছে তার নানার এমন নির্লিপ্ততা দেখে। সে বলল, আত্মহত্যা করার কিছু দিন আগে মেয়েটা গ্রামে এসেছিল বেড়াতে। তখন তাকে সাপে কেটেছিল। তার সাপের বিষ নামাতে গিয়েছিলেন আব্দুল ফকির। আসমা খুবই দরিদ্র ঘরের মেয়ে। আব্দুল ফকির বললেন তাকে কালি জাত নাকি সাপে যেন কেটেছে। ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ। এই সাপে কাটা রোগী সাধারণত বাঁচে না। কিন্তু তিনি রোগীরে বাঁচিয়ে তুলতে পারবেন। তবে সেক্ষত্রে রোগীকে নিয়ে তাকে টানা তিন দিন তিন রাত আলাদা একটা ঘরে থাকতে হবে। সেই ঘরের চারপাশে কলাগাছ পুঁতে দিতে হবে। ঢোল-বাদ্য বাজাতে হবে। ধুপের ঘন ধোয়া দিতে হবে। এমন আরো অনেক কিছু। একটা ওই অবস্থার মেয়ে, তার মতো একটা মানুষের সাথে তিন দিন তিন রাত আলাদা ঘরে থাকলে কারোই কিছু বলার নাই। আর সকলেই আব্দুল ফকিরকে কী পরিমাণ মানে, ভয় পায়, তা আপনি জানেন। অনেকেই ভাবে, তার অলৌকিক শক্তি অবধি আছে। আমি তো এবার এসে শুনলাম, সে নাকি কুফরি কালাম না কী যেন জানে। আধুনিক মানুষ যাকে ব্ল্যাক ম্যাজিক বলে। তো, এই এলাকার সকলেই আব্দুল ফকিরকে ভয়ও পায়। আপনিও পান। কি পান না?

নয়ন সামান্য হাসল। তার সেই হাসিতে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর প্রতি সুস্পষ্ট বিদ্রূপ। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সেটি গ্রাহ্য করলেন না।

নয়ন বলল, এই তিনদিন বিষ নামানোর কথা বলে আব্দুল ফকির কোনো নেশাদ্রব্য ট্রব্য খাইয়ে মেয়টাকে অচেতন করে নানান সময় ধর্ষণ করেছে। সাপে কাটলে মানুষ যতটা না বিষের কারণে অসুস্থ হয়, তার চেয়ে বেশি অসুস্থ হয় আতঙ্কে। মেয়েটাকে সম্ভবত কোনো বিষধর সাপে কাটেনি। কেটেছে নির্বিষ কোনো সাপেই। কিন্তু সাপের কামড়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল সবাই। আর আব্দুল ফকির যখন বলল, এটা বিষধর সাপের কামড়। রোগী বাঁচানো দুঃসাধ্য। তখন আর যায় কই? মেয়েটা প্রচণ্ড আতঙ্কে পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার পরিবারের অবস্থাও দিশেহারা। আব্দুল ফকিরই তখন একমাত্র ভরসা। এই সুযোগে আব্দুল ফকির মেয়েটাকে অচেতন করে ধর্ষণ করেছে। আব্দুল ফকির নানান জাতের নেশা করা মানুষ। তাকে দেখলে বোঝা যায় না। কিন্তু সেদিন আমি তার চেহারা দেখে, মুখের গন্ধ শুঁকেই টের পেয়েছি। এই সব বিষয়ে সে পুরোপুরি এক্সপার্ট। আর এই কাজ তো তিনি আজ হঠাৎ করে করেননি। আমার ধারণা এই কাজ সে বহু বছর ধরেই করে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোতে। ফলে কেউ জানলেও, বা কোনো কোনো মেয়ে গর্ভবতী হয়ে গেলেও সাহস করে, মান-ইজ্জতের ভয়ে তাকে কেউ কিছু বলে না। কেউ কেউ আবার চুপিচুপি তার কাছেই যায় মেয়ের গর্ভ নষ্ট করার জন্য। কী ভয়ঙ্কর মানুষ সে! কী ভয়ঙ্কর!

নয়ন থামল। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হঠাৎ কথা বলে উঠলেন। বললেন, এত কথা তুমি কীভাবে জানলা? এগুলার কিছুই তো আমিই জানি না।

নয়ন বলল, নানাজান, আপনি সবই জানেন। এই অঞ্চলে এখনও গাছের পাতা পড়লেও সেই সংবাদ সবার আগে আপনার কানে আসে। আর এসব আমি কীভাবে জানলাম? আসমা মেয়েটাকে খুব স্নেহ করতাম আমি। ওকে বাসাতে পড়াতামও। সেবার সাপে কাঁটার ঘটনা শেষে সে ঢাকায় যাবার পর থেকেই তাকে দেখে আমার কেমন সন্দেহ হতে থাকে। আপনি জানেন, আমি ডাক্তার মানুষ। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কী বলব! একদিন জিজ্ঞেস করলাম। প্রথমে সে কিছুই বলল না। তারপর হঠাৎ কেঁদে ফেলল। বলল, ভাইজান আপনে তো ডাক্তার মানুষ, আমারে বাঁচান। আসমা অচেতন থাকলেও সে তো বুঝতেই পেরেছিল কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারেনি। কাউকেই না। আমার তখন ফাইনাল পরীক্ষা। আর হঠাৎ করে একটা মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে এইসব টেস্ট করানোরও নানান সমস্যা। ভাবছিলাম পরীক্ষা শেষ হলেই কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যাব। কিন্তু তার আগেই…

নয়ন কথা শেষ করল না। তার গলার স্বর কেমন ভারি হয়ে উঠল। খানিক থেমে সে বলল, এখনো ওর মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসে নানাজান। আমি ঘুমাতে পারি না। আরেকটা কথা, ওর লাশ গ্রামে আনা কিন্তু সহজ ছিল না। আমি জানতাম ভয়াবহ বিপদে পড়ে যেতাম আমরা। প্রথমত এটা সুইসাইড কেস। পুলিশ জানলে খুব বাজে ট্রিট করত আমাদের। দ্বিতীয়ত তারপর যদি দেখা যেত মেয়েটা প্রেগন্যান্ট! ওহ্ খোদা! কী ভয়াবহ বিপদেই না আমাদের পড়তে হতো!

নয়ন থামলেও তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কোনো কথা বললেন না। নয়নই আবার বলল, নানাজান, বিষয়টা খুবই লজ্জার। এই অঞ্চলের এত বড় একজন মানুষ আপনি। আপনার চোখের সামনে দিনের পর দিন এই মানুষটা এমন ভয়ঙ্কর অন্যায় করে চলছে। কিন্তু আপনি কিছু বলছেন না! কিছু না? কিসের ভয় আপনার? কি দুর্বলতা? আমাকে একটু বলবেন নানাজান, প্লিজ?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ যেন অনড়, জড় এক বস্তু। তিনি যেমন ছিলেন, তেমনই বসে রইলেন। নয়ন বলল, এই আব্দুল ফকির মানুষটা একটা বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ নানাজান। আমি তার বিষয়ে অনেক খোঁজ নিয়েছি। তার সাথে কথাও বলেছি। আমার কী মনে হয়েছে জানেন? আমরা যে নানান বিদেশি সিনেমা দেখি, বই পড়ি, সেইসব বইতে এমন অবিশ্বাস্য বিকৃত সব মানুষের চরিত্র থাকে। আমি এতদিন ভাবতাম, এইসব বিকৃত মানসিকতার মানুষ বোধহয় শুধু গল্প, উপন্যাস বা সিনেমায়ই থাকে। আর বাস্তবে থাকলেও তা ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশে থাকে। সেদেশের নানান পত্র-পত্রিকায় এমন কত খবর যে পড়েছি! কিন্তু বাংলাদেশের এমন একটা গ্রামে, এমন অতি সাধারণ চেহারার একজন মানুষ এমন অবিশ্বাস্যরকম ভয়াবহ হতে পারে, এটা আমার এখনও বিশ্বাস হয় না নানাজান। আমার এখনও মনে হয়, আমি ভুল ভাবছি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এতক্ষণ একটা কথাও বলেননি। এবার বিড়বিড় করে বললেন, জগতের দুইটা রূপ আছে, একটা কালা রূপ, একটা ভালা রূপ। যারা ভালো মানুষ তাগোর ওই কালা রূপটা না দেহনই ভালো। আর দুনিয়ার কতটুকই আমরা জানি! নিজেরেই পুরাপুরি জানি? জানি না। আর তুমি এইসব নিয়া মাথা ঘামাইও না ভাই। তোমার চেহারা শরীলের অবস্থাও ভালো না। তুমি শহরের পোলা শহরে চইল্যা যাও। গ্রাম-গঞ্জে বিপদ-আপদের হাত পাও নাই। আরেকটা কথা তোমারে বইলা রাখি। তোমরা শহরের মানুষ মনে করো, গ্রামের মানুষ অতি সহজ-সরল। কিছু বোঝে না। কথাটা ঠিক না। একদম ঠিক না। গ্রামের মানুষের মতো জটিল কিছু দুইন্যায় নাই। এইজন্যই তোমারে বলি, তুমি যহন-তহন এইহানে সেইহানে ঘুইরা বেড়াইও না। তোমার নানার এহন আর সেই শক্তিটা নাই যে তোমারে দেইখ্যা রাখব। আর ক্ষতি একটা হইয়া গেলে, সেই ক্ষতি আর পোষান যায় না।

নয়ন বলল, এখন না হয় শক্তি নেই। কিন্তু যখন আপনার শক্তি ছিল, তখন আপনি কী করছেন? আর চাইলে এখনও সম্ভব। আপনি কি তাকে ভয় পান? আব্দুল ফকিরের এমন ঘটনা আপনি আগে আর জানতেন না?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর ধীর স্থির ভঙ্গিতে বললেন, তুমি বেশি উত্তেজিত নানাভাই। আমার উত্তেজিত হইলে চলে না। তোমার বয়সের কয়গুন আমার বয়স, সেইটা হিসাব আছে? নাই। শোনো, আমি কিছু করি নাই, কথাটা ঠিক না। আইজ থেইকা প্রায় পঁচিশ বছর আগে উত্তরকান্দির এক মাইয়ার লগে এই একই ঘটনা ঘটছিল। কিন্তু তারাও চায় নাই, ঘটনা জানাজানি হোক। আমি বাতাসের লগে কান পাইতা ঘটনা শুনলাম। মাইয়ার বাপরে ডাকলাম। ডাইকা ঘটনা জিগাইলাম। সে ঘটনা স্বীকার করল। আমি চাইছিলাম, আব্দুল ফইররে তহনই চিরতরে নিকাশ কইরা ফালাইতে। তহন এই দুর্গম এলাকায় থানা-পুলিশের আসনের ঘটনা সহজে ঘটে না। চর। লইয়া দিনে দুপরে মাডার হয়। কেউ গ্রাহ্য করে না। তারপরও, বিনা কারণে আব্দুল ফইররে খুন করলে এই অঞ্চলের লোকজনই খেইপ্যা উঠতে পারে। অনেকের কাছেই সে পীর। দোষ করলেও পীর। এইজন্য তাগো কাছে দেহানোর লইগা একখান কারণ দরকার আছিল। মাইয়ার বাপরে লইয়া গাঙপার বটতলায় বইলাম। এলাকার কয়েকজন গণ্যমান্য লোক রাখলাম লগে। যাতে পরে কোনো ঝামেলা না হয়। মাইয়ার বাপ সকলের সামনে ঘটনা খুইলা বলল। আমার রাস্তা তহন কিলিয়ার। আব্দুল ফইররে যদি খুনও করি, এই গন্যমান্য লোকগুলা তো সবাইরে বলতে পারব, কি কারণে খুন করলাম। সেই রাইতেই দলবল লইয়া গেলাম। লগে আছিল এস্কান্দারের বাপ হায়দার আলী। ঘুটঘইটা আন্ধার রাইত। তার উপর নামল বিষ্টি। হোসনাবাদের একজন খবর দিলো আব্দুল ফইর ঘুমাইছে বাইরের ঘরে। এর চাইতে ভালো সুযোগ আর হয় না।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ থামলেন। নয়ন তাকিয়ে আছে নানার মুখের দিকে। এই প্রথম তার মনে হলো তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মুখে একটা স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। এই ছাপটা সে আগে কখনোই তার নানার মুখে দেখেনি। নয়ন ভারি অবাক হলো।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, আব্দুল ফইর ঘুমাই আছে চৌকির উপর। আমার মনে আছে, আমি স্পষ্ট দেখছি। হায়দার আর তিন চাইর জনরে লইয়া গেল। কেউ পাও চাইপ্যা ধরল, কেউ মুখ চাইপ্যা ধরল। হায়দার এক কোপে কল্লা নামাই দিলো। সেই কল্লা বস্তায় ভইরা নিয়া আসলাম ফতেহপুর। মাইয়ার বাপরে দিব। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কি জিনিস, এইটা মাইনষের জানন দরকার।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর গলা যেন শুকিয়ে আসছে। তিনি বার দুই ঢোক গিললেন। তার চোখে ভয়ের ছায়া। নয়নের প্রচণ্ড অবাক লাগছে। তার সামনের এই মহিরুহ মানুষটি কোনো কারণে এমন ভয়ার্ত হতে পারেন, এটি তার বিশ্বাস হচ্ছে না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কেমন ঘোর লাগা গলায় বললেন, কিন্তু বস্তা থেইকা। কল্লা বাইর কইরা দেহি, কল্লা আব্দুল ফইরের না। কল্লা বজলু ব্যাপারীর। অথচ খুন করনের সময় আমি নিজ চৌক্ষে দেখছি ওইটা আব্দুল ফইর।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মুখ কেমন ভয়ার্ত, ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। নয়ন অবাক হলেও তা প্রকাশ করল না। সে ডান হাত বাড়িয়ে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হাত ধরল। এই শক্ত পাথরের মতো মানুষটার জন্য তার হঠাৎ মায়া লাগতে লাগল। সে বলল, নানাজান, আপনার কি ধারণা, কোনো জাদু মন্ত্রবলে আব্দুল ফকির বজলু ব্যাপারী হয়ে গিয়েছিল? এই কথা আপনি বিশ্বাস করেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ জবাব দিলেন না। নয়ন বলল, শোনেন নানাভাই, ওই রাতে বজলু ব্যাপারী গিয়েছিলেন আব্দুল ফকিরের বাড়ি। তিনিও আব্দুল ফকিরের সাথে রাতে ওই বাইরের ঘরেই ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু মাঝরাতে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় তিনি চলে যান ভেতর ঘরে। আর অন্ধকারে তাড়াহুড়ায় আব্দুল ফকির ভেবে বজলু ব্যাপারীকে খুন করা হয়েছিল। আপনি এত বুদ্ধিমান মানুষ হয়েও কি এইসব জাদু-মন্ত্রে বিশ্বাস করেন?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এই ঘটনা আমি জানি। কিন্তু কিছু ঘটনার আড়ালেও ঘটনা থাহে। বজলু ব্যাপারী ওইদিনই, ওই অতরাইতে ওইহানে কেন যাইব? আর আব্দুল ফইরই বা ঠিক সময় মতো ভেতর বাড়ি চইলা যাইব কেন? বিষয় যত সহজ ভাবো, তত সহজ না। দুইন্যায় চোউক্ষে দেহা যায় না, এমন। বহুত জিনিস আছে। আর আল্লাহপাকের কোরআন তো বিশ্বাস করো। এই কোরআন দিয়া ভালো জিনিস যেমন হয়। উল্টাপাল্টা ব্যবহার কইরা মানুষ খারাপভাবেও ব্যবহার করতে পারে। কুফরি কালামের কথা শোনছ? এই কুফরি কালাম কইরা মানুষ বহু কিছু করতে পারে। আব্দুল ফইর লোক ভালো না। কিছু খারাপ ক্ষমতা তার আছে।

নয়ন মৃদু হাসল। বলল, এই যুগে এসেও এইসব কথা আপনি বিশ্বাস করেন নানাজান। এই জন্য আপনি তাকে ভয় পান? বজলু ব্যাপারীর ঘটনার ব্যাখ্যা তো আছেই। আব্দুল ফকির নিজেও আমাকে বলেছে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, নানাভাই, আমার বয়স কম হয় নাই। কম দেহি নাই। এহনও কম দেহি না। তয় একটা কথা বলি, এইসব জিনিস অবিশ্বাস কইর না। এই জীবনে জাদু টোনা, বাণ মাইরা মানুষ খুন করাও দেখছি।

নয়ন বলল, বাণ মেরে খুন করার বিষয়টা কী?

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, এইগুলার নানান ধরন আছে। ধরো আব্দুল ফইরের মতো এমন কুফরি কালাম, বা জাদু, টোনা জানা কোনো লোকেরতন কেউ অন্য কাউরে ক্ষতি করানের লইগা তার নামে তাবিজ লেইখ্যা আনলা। তারপর সেই তাবিজ কোনো গাছের ডালে ঝুলাইয়া রাখলা। সাতদিনের মইধ্যে সেই গাছ শুকাইয়া মইরা যাইব। লগে সেই মানুষটাও মরব।

নয়ন কি ভাবল, তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ধরেন, আমি যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নামে তাবিজ করে এরকম গাছে ঝুলিয়ে রাখি, সে কি সাতদিনের মধ্যে মারা যাবে? নাকি দেশ দূরে বলে সময় বেশি লাগবে?

নয়নের কথা শুনে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ খানিক আহত হলেন। তিনি বললেন, সকল জিনিস লইয়া তামাশা ভালো না। এই আব্দুল ফইররে যে আমি ওই একবারই মারনের চেষ্টা করছি, তা না। এরপরও আরেকবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারি নাই। তয় সেই চেষ্টা দাগ এহনও তার পায় আছে। পরপর দুইবার নিশ্চিত মরনের হাত থেইকা সে বাঁচছে। আর যে যাই বলুক, এইগুলান কোনো স্বাভাবিক ঘটনা না। আমি ফরিদপুরের বড় পীর সাহেবের ধারেও গেছিলাম। তিনিও আমারে বলছেন, আমি যেন আর আব্দুল ফইরের কোনো ক্ষতি করনের চেষ্টা না করি। সেই থেইকা আমি বাদ দিছি।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ থামলেন। নয়ন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াবে এটি সে ভাবেনি। পাহাড়ের মতো বিশাল মানুষটির এই রূপটি দেখবে বলে সে কখনো ভাবেনি। সে হঠাৎ বলল, নানাজান, আপনি কি আর কোনো কথা আমাকে বলতে চান?

তৈয়ব উদ্দিন খ বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে চোখ তুলে তাকালেন। নয়ন হাসল। তবে সেই হাসিতে কোথাও যেন হাসি ছাড়া অন্য কী রয়েছে! সে বলল, নানাজান, আমি কিন্তু আব্দুল ফকিরকে এত সহজে ছেড়ে দেব না। আমি আবার আসব। আর আপনার কাছে আমার আরো অনেক কিছু জানার আছে।

তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বললেন, দুইন্যার সব জিনিস জানতে হয় না। কিছু জিনিস না জানাই ভালো। যত কম জানবা, তত আনন্দে থাকবা। কম জাননের চেয়ে আনন্দ কিছুতে নাই।

নয়ন কি বলতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেল। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, তৈয়ব উদ্দিনের শেষ কথাটা মিথ্যে না। কম জানা আসলেই আনন্দের।

*

পারুলের সাথে নয়নের দ্বিতীয়বার দেখা হয়ে গেল কাকতালীয়ভাবে। নয়ন ঢাকা ফিরে যাবে। এ অঞ্চল থেকে ঢাকায় যাওয়ার উপায়টা বেশ কঠিন। ট্রলারে কয়েক ঘণ্টার যাত্রা শেষে পৌঁছাতে হয় রায়গঞ্জ বন্দরে। রায়গঞ্জ এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নদী বন্দর। সেই বন্দর থেকে রোজ সন্ধ্যায় বড় দ্বিতল লঞ্চ ছাড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে। সেই লঞ্চে সরাসরি ঢাকা যাওয়া যায়। অন্য উপায়টা আরো কষ্টসাধ্য। বারকয়েক নৌকা, ট্রলার বদলে দীর্ঘ যাত্রা শেষে যেতে হয় মাদারীপুর। শহরে। সেখান থেকে বাসে ঢাকা। নয়ন রায়গঞ্জ থেকে সরাসরি ঢাকায়। যাওয়াটাকেই ভালো মনে করেছিল। কিন্তু লঞ্চ ছাড়ার সঠিক সময়টা সে কোনোভাবেই জানতে পারেনি। তাকে পৌঁছে দিতে তার সাথে এসেছে মনির। তারা দীর্ঘ ট্রলার যাত্রা শেষে যতক্ষণে রায়গঞ্জে পৌঁছাল, ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। তারা তড়িঘড়ি করে লঞ্চঘাট এসে দেখে লঞ্চ ছেড়ে গেছে আরো ঘণ্টাখানেক আগে। এখন উপায়?

মনিরের পরামর্শ আবার ফতেহপুর ফিরে গিয়ে রাতটা কাটিয়ে পরদিন আরো তাড়াতাড়ি চলে আসা। কিন্তু নয়ন তাতে সায় দিলো না। এই এতটা। পথে ট্রলারের ইঞ্জিনের ওই বিদঘুঁটে শব্দ শুনে শুনে কান ঝালাপালা করতে আর ইচ্ছে করছে না। তার চেয়ে রাতটা বরং এখানেই কোথাও থেকে যাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া নতুন জায়গা, একটা আলাদা রোমাঞ্চও কাজ করছিল নয়নের মধ্যে। থাকার জায়গা শেষ অবধি একটা পেলও তারা। কিন্তু সেটি যে বিশেষ সুবিধাজনক হবে না, তা এক পলক দেখেই বুঝে ফেলেছিল নয়ন।

বন্দরে সাধারণত বিক্রয়যোগ্য মালামাল নিয়ে দূর থেকে কৃষকরা আসেন। তারা হঠাৎ হঠাৎ বিপলে পড়লে এখানে থাকেন। ফলে হোটেল বলতে যা বোঝায় তা এখানে নেই। এখানে যা আছে তার নাম বোর্ডিং। লম্বা স্কুল ঘরের মতো ঘর। তাতে পাশাপশি প্রায় আট দশখানা সরু চৌকি বসানো। সেই চৌকি একেকজনের কাছে ভাড়া হয়। ভাড়ায় খুবই সস্তা। নয়ন ভেবেছিল সবগুলো চৌকিই তারা ভাড়া করে দুইজনই সারারাত নির্ঝঞ্ঝাট আরামে থেকে যাবে। কিন্তু বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার তাতে রাজি হলেন না। তার নিয়মিত অতিথিদের বাইরে রেখে কষ্ট করাতে তিনি পারবেন না। ফলে দু’খানাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো নয়ন আর মনিরকে। তবে রাতটা কাটল ছাড়পোকার ভয়াবহ যন্ত্রণাতে।

সকাল বেলা একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়ল নয়ন আর মনির। বাকি দিনটা চারপাশে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে। তাছাড়া এই অঞ্চলে নদীটা চমৎকার। দু’ধারে বড় বড় দোকানপাট হলেও বুড়িগঙ্গার মতো নোংরা নয়। নদীর পানিও দুর্গন্ধযুক্ত কদাকর নয়। শহর নয়, মফস্বল নয়, আবার পুরোপুরি গ্রামও নয়, এমন একটি জয়াগায় ভোর হয় কী করে, সেটি দেখাটাও একটি নতুন। অভিজ্ঞতা। নয়ন চোখ ভরে এই বন্দরের একটি দিনের সূচনা দেখল। হেঁটে হেঁটে মূল বন্দর থেকে অনেকটা দূরে এসেছে তারা। এখানে নদীতে মাছ ধরার কত কত নৌকা। নাও ভর্তি তাজা মাছ চলে আসছে বন্দরের বাজারে। দোকানপাটের ঝাঁপ খুলছে ঝপাঝপ। ভোরের নাস্তার আয়োজন চলছে হোটেলগুলোতে। সেই হোটেলেই খেয়ে নিলো তারা। চারপাশে ক্রমশই জেগে উঠছে অদ্ভুত ব্যস্ততার একটি দিন।

তখন দশটার মতো বাজে। চারপাশে তুমুল কোলাহল। বন্দরে ছোট বড় নানান জলযান এসে ভিড়ছে। তাতে হরেকরকম পণ্য আসছে যাচ্ছে। মুটেরা। মাল মাথায় করে ছুটছে। তিনচাকার ভ্যান গাড়ি ঘটাং ঘটাং শব্দে বেল বাজিয়ে শাই করে চলে যাচ্ছে গা ঘেঁষে। এই মুহূর্তে নয়নকে কেউ ডাকল। একটা মেয়েলি কণ্ঠ রাস্তার উল্টোদিক থেকে চিৎকার করে ডাকছিল, এই, এইই।

নয়ন প্রথম বারদুয়েক খেয়াল করেনি। কারণ মেয়েটা তাকে নাম ধরে ডাকছে না। তৃতীয়বার মেয়েটা রাস্তা পার হয়ে চলে এলো। নয়নের সামনে এসে বলল, আপনে কি কানে কম শোনেন? কতবার ডাকতেছি?

নয়ন চট করে মেয়েটাকে চিনতে পারল না। খানিক সময় লাগল তার। আব্দুল ফকিরের মেয়ে পারুল। সে রেগে উত্তর দিতে গিয়েও হেসে ফেলল। বলল, সরি। আপনি তো আমার নাম ধরে ডাকেননি। এইজন্য শুনতে পাইনি।

পারুল বলল, আপনে এইহানে কী করেন?

নয়ন ঘটনা খুলে বলল। ঘটনা শুনে পারুল হেসে কুটিকুটি। সে বলল, দেইখেন আইজও আবার লঞ্চ মিস কইরেন না।

নয়ন বলল, না। আজ আর সে উপায় নেই।

পারুল বলল, আমরা এইহানে কেন আসছি জানেন?

নয়ন বলল, কেন?

পারুল বলল, আপনে ভুইলা গেলেন? তাবারন খালায় সেই যে গরম তরকারি পইড়া পুড়ল! আপনেই না বললেন, ডাক্তারের কাছে আনতে। অবস্থা তো খারাপ, পোড়া জায়গাটায় ঘা হইছে।

নয়ন বলল, আপনারা জায়গাটা ঠিকমতো পরিষ্কার করেননি। আর আমি কিছু মলম কিনে এনে দিতে বলেছিলাম, দিয়েছিলেন?

পারুল বলল, না। কীভাবে দিব? আব্বায় ছিল না বাড়িতে। জুলফিকার ভাইও না। আর ওইদিকে তো ডাক্তারও নাই, ওষুধের দোকানপাট নাই। কিছু নাই।

নয়ন বলল, তা এখন কী অবস্থা?

পারুল বলল, সেই জন্যই তো এইহানে আনা লাগছে। আব্বায় কী সব। কাজ লইয়া আইজকাল খুব ব্যস্ত। সে যে দেখব, সেই সময়ও পাইতেছে না। অবস্থা খারাপ দেইখা শেষে নিজেই বলল ডাক্তারের কাছে লইয়া আইতে।

নয়ন বলল, কিন্তু এত ভোরে এখানে আসলেন কীভাবে?

পারুল বলল, আইজ তিন দিন হয় আইছি। লগে রতনও আছে। এইহানে আমার এক বান্ধবী আছে লতা। তার নানাবাড়ি এইহানে। সে তার নানাবাড়ি থাইকা কলেজে পড়ে। তার কাছেই উঠছি। ডাক্তার বলছে কয়েকদিন থাকতে। কী সব ওষুধপত্র দিলো। বলল কয়টা দিন থাইকা ভালো-মন্দ দেখাই যান। একবার চইলা গেলে তো আর সহজে আসতে পারবেন না। এইজন্যই থাইকা গেলাম।

পারুলের কথার ধরনে একটা সরলতা আছে। বিষয়টা নয়নকে মুগ্ধ করল। সে বলল, বাহ্, আপনি তো খুব সুন্দর করে কথা বলেন। বাচ্চাদের মতো।

পারুলের চট করে সেদিনের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল। তার ভারি লজ্জা লাগতে লাগল। সে বলল, আমি তো শুদ্ধ কইরা কথা বলতে পারি না। আপনের তো শুদ্ধ কথা পছন্দ।

নয়ন হাসল। বলল, কে বলল আমার শুদ্ধ কথা পছন্দ?

পারুল প্রায় মুখ ফসকে বলেই বলছিল যে সেদিন রাতে পুকুর ঘাটে বসে। যে বললেন! কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে সে নিজেকে সামলে নিলো। আজকাল যে তার কী হয়েছে, সেই রাতের সেই স্বপ্নটা যে স্বপ্ন ছিল, তা সে প্রায়ই ভুলে যায়।

পারুল বলল, না, আপনেরা তো শহরের মানুষ। শহরের মানুষ শুদ্ধ কথাই পছন্দ করবে- এইটাই স্বাভাবিক।

নয়ন বলল, তাহলে গ্রামের মানুষেরও তো তাদের কথাই পছন্দ করাটা স্বাভাবিক হবার কথা, তাই না?

পারুল বলল, অত কিছু বুঝি না। আমার শুদ্ধ কথা বলনের খুব শখ। টাউনে যাওনের খুব শখ।

নয়ন হঠাৎ পারুলকে তুমি করে বলে ফেলল। সে বলল, সময় হলে তুমিও শহরে যাবে পারুল। সমস্যা তো নেই। এখনো অনেক সময় আছে।

পারুল প্রথমে তার কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি। নয়ন তাকে তুমি করে বলেছে। ইশ! তুমি! তুমি ডাকটা যে কী সুন্দর! কী সুন্দর! সেদিন রাতে স্বপ্নের ভেতরও নয়ন তাকে তুমি করে ডেকেছিল। আনন্দে পারুলের মরে যেতে ইচ্ছে করছে। তার চোখে পানি চলে এসেছে। সে কি করবে এখন? আচ্ছা, নয়ন তাকে হুট করে তুমি বলে ফেলল কেন, কোনো কারণ নেই তো? নাকি ভুলে বলে ফেলেছে?

পারুল বলল, আপনে আইজই চইলা যাবেন?

নয়ন বলল, হ্যাঁ।

পারুল বলল, আবার কবে আইবেন?

নয়ন বলল, এখন তো বলতে পারছি না। তবে আসব। এই জায়গাটা আমার ভীষণ ভালো লেগে গেছে। মানুষগুলোও প্রিয়। আমার আসতেই হবে।

নয়ন চলে যাচ্ছে শোনার পর থেকেই বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল তার। মনে হচ্ছিল জগতের সকল কিছু মুহূর্তেই শূন্য হয়ে গেছে। কিন্তু এই যে নয়ন তাকে বলল, এই জায়গাটা ভীষণ প্রিয় তার। মানুষগুলোও প্রিয়, আবার আসতেই হবে তাকে। এই কথাগুলো শুনেই পারুলের বুকের ভেতর আবার কেমন থইথই করে উঠল। পারুল বলল, আপনে কিন্তু আসবেনই। আপনের সাথে আমার অনেক কথা আছে।

নয়ন হাসল, নিশ্চয়ই আসব।

পারুল বলল, আপনেগো লঞ্চ কহন ছাড়ব?

নয়ন লঞ্চের সময়টা জেনে এসেছে আজ। সে সময়টা বলল। পারুল যেমন এসেছিল তেমনই বিদায় নিয়ে চলে গেল। সেইদিনই পারুলের সাথে নয়নের আবার দেখা হয়ে গেল। সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত নয়ন বিকেলের দিকে খানিক আগেভাগেই লঞ্চঘাট পৌঁছাল। পন্টুনে ওঠার সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে পারুল আর তার সাথে এক মেয়ে। মেয়েটা পারুলের বান্ধবী লতা। পারুলের হাতে একগাদা কাগজ। সে নয়নকে দেখেই বলল, আপনের জন্য। সেই কহন থেইকা দাঁড়াই আছি। এতক্ষণে আইলেন।

নয়ন হাসল। পারুল বলল, গ্রাম-গঞ্জের ডাক্তার কী না কী বোঝে, এই জন্য ওষুধপাতি আর কাগজপত্রগুলান লইয়া আইছি। আপনেরে একটু দেখাইয়া নিতে চাই।

নয়ন ওষুধ আর কাগজপত্রগুলো সময় নিয়ে দেখল। তারপর বলল, ঠিকই আছে। উনি ভালো ডাক্তার। আশা করি আর সমস্যা হবে না।

পারুল কী ভেবে খানিক চুপ করে রইল। তারপর লতাকে দেখিয়ে পরিচয়। করিয়ে দিয়ে বলল, আমার বান্ধবীর একজন মানুষ আছে, তার নাম আশিক। সেও কিন্তু ঢাকা থাকে।

নয়ন এবারো মৃদু হেসে বলল, তাই নাকি?

লতা জবাব দিলো না। লজ্জায় আরক্ত হলো। পারুল খানিক প্রগলভ যেন। সে বলল, আশিক ভাই মাঝে-মধ্যেই ঢাকারতন এই লঞ্চে আসে। সারাদিন থাকে। তারপর সইন্ধ্যা বেলা আবার চইল্যা যায়। লতা বলছে তারা নাকি লুকাইয়া আগেই বিয়া কইরা ফালাইব। দুইজন আলাদা থাকতে নাকি কষ্ট।

লতা এবার ভারি লজ্জা পেল। সে তার বাঁ হাতে পারুলকে আলতো আঘাত করল। পারুল বলল, আপনের তো ঢাকা যাইতে যাইতে সারা রাইত লাইগা যাইব। কাইল বেয়ান বেলা পৌঁছাইবেন। রাইতে খাইবেন কি লঞ্চে?

নয়ন এই বিষয়টা ভাবেনি। অবশ্য ভাবনার কিছু নেইও। লঞ্চে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু পেয়ে যাবে সে। তাছাড়া দুয়েক রাত না খেয়ে থাকার অভ্যাস তার আছে। সে বলল, ওটা আমি ম্যানেজ করে নেব।

নয়ন এতক্ষণ খেয়াল করেনি। পারুলের হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগও। পারুল হঠাৎ ব্যাগের ভেতর থেকে একটা টিফিন ক্যারিয়ার বের করে বলল, লঞ্চের খাওন ভালো না। কী না কী দিয়া রান্ধে। শেষে পেট খারাপ হইব। এই বাটির মইধ্যে মুরগির মাংস আর ভাত আছে। এমনিতে সময় আছিল না, তার উপর অন্য মাইনষের বাড়ি। এইজন্য বেশি কিছু করতে পারি নাই। আমি নিজে কিন্তু রানছি। ভালো না হইলেও পরের বার আইসা বলবেন যে ভালো হইছে।

নয়ন এবার ভারি বিব্রত বোধ করছে। সে কিছু বলতে যাবে, কিন্তু তার আগেই পারুল একটা পানির বোতল হাতে ধরিয়ে দিলো মনিরের। তারপর নয়নকে বলল, লঞ্চের পানিও খাইবেন না। ওই পানিতে কত কী যে থাকে, আল্লাপাকই জানে! এই বোতলের পানি একদম টিউবওয়েলের। এইটাই খাইবেন।

নয়নের ভারি অবাক লাগছে। একইসাথে বিব্রতও লাগছে। সে বলল, পারুল। এতসব কেন করতে গেলে তুমি?

পারুল জবাব দিলো না। তবে একটা সহজাত গোপন মেয়েলি লজ্জার আভায় তার মুখখানা রক্তিম হয়ে উঠল। নয়ন বলল, তোমার এই বাটি আমি ফেরত দেব কি করে? তাছাড়া এগুলো বয়ে নিতে আমার বাড়তি কষ্টই হবে।

পারুল চট করে বলল, আপন মানুষের কষ্ট কষ্ট মনে হয় না। আনন্দ মনে হয়। আর বাটি আপনের ফেরত দেওন লাগব না। দিতে চাইলে ঢাকারতন কিছু নিয়া আইসেন।

নয়ন বলল, তোমার সাথে তো আমার দেখা নাও হতে পারে পারুল।

পারুল কী বলতে গিয়ে আচমকা থমকে গেল। তার চোখ ছলছল। সে কি কেঁদে ফেলবে? বিষয়টা নয়নের চোখ এড়াল না। তার সামনে দাঁড়ানো সহজ সরল মেয়েটাকে দেখে তার হঠাৎ ভারি মায়া লেগে গেল। সে সামান্য ঝুঁকে আলতো করে পারুলের মাথায় হাত রেখে বলল, আচ্ছা, আচ্ছা, আমি নিচ্ছি। তুমি ভালো থেকো।

পারুলের মাথায় ওই সামান্যতম স্পর্শ, কিন্তু পারুলের মনে হলো তার পৃথিবী জুড়ে এক মুহূর্তে অজস্র ফুল ফুটল, হাজারটা প্রজাপতি রঙিন ডানা মেলে ছুটে গেল। এই অনুভূতি সে বোঝাতে পারবে না।

নয়ন বলল, সন্ধ্যা হয়ে এলো। যাও, বাড়ি যাও। আর তাবারনের খেয়াল রাখো। আমাদের উঠে যেতে হবে।

পারুল তারপর আরো কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু পারল না। একটা শব্দও আর তার মুখ থেকে বের হলো না। নয়ন মনিরকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চে উঠে গেল। কিন্তু পারুল দাঁড়িয়েই রইল। লতার কি কাজ ছিল সন্ধ্যাবেলা। সে। বারকয়েক তাড়া দিলো পারুলকে। কিন্তু পারুল নড়ল না। সে দাঁড়িয়েই রইল। শেষ অবধি পারুলের সাথে কথা বলেই তাকে রেখে চলে গেল লতা। পন্টুনে ঢোকার পথ থেকে সরে গিয়ে একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে গিয়ে দাঁড়াল পারুল। ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে চারধারে। নয়ন ছোট দেখে একটা কেবিনও পেয়ে গেল। মালামাল কেবিনে রেখে মনিরকে বিদায় দিতে আসলো সে। মনির নেমে যেতেই একা হয়ে গেল নয়ন। লঞ্চের দোতলার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশটা শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে নয়ন। এই সময়টা কেমন অদ্ভুত এক বিষণ্ণতার সময়। আকাশ থেকে ঝুপ করে যেন একটা মন খারাপের চাদর নেমে ঢেকে দেয় পৃথিবী। বহু চেষ্টা করেও সেই চাদরটা আর সরানো যায় না। নয়নের হঠাৎ মনে হলো তার বুকের ভেতরটা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে হু হু করে উঠছে। এই কারণটা হয়তো সে জানে, হয়তো জানে না। কিন্তু মাঝে-মধ্যে তার মনে হয় না জানাই ভালো। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হয়তো ঠিক কথাটাই বলেছিলেন, জগতে সকল কিছু জানতে নেই। যত কম জানা যায়, ততই ভালো। ততই আনন্দময় এই জগৎ।

পুরোপুরি অন্ধকার নামতেই বিকট শব্দে ভেঁপু বাজাল লঞ্চ। ভেঁপুর শব্দে নয়ন হঠাৎ চমকে উঠল। পন্টুনটা বার দুই ঢেউয়ের তালে কাঁপল। তারপর পন্টুন ছেড়ে দিলো লঞ্চের মাথা। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগল। পন্টুনের বা পাশে ল্যাম্পপোস্টটার নিচে চোখ পড়তেই নয়ন রীতিমতো একটা ধাক্কা মতো খেলো। ল্যাম্পপোস্টের নিচে পারুল দাঁড়িয়ে আছে। সে সরাসরি তাকিয়ে আছে। নয়নের দিকে। নয়ন প্রচণ্ড অবাক হয়েছে পারুলকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে।

লঞ্চ দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়ার আগ অবধি পারুল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটার জন্য অদ্ভুত একটা মায়া হতে লাগল নয়নের। কিন্তু নয়নের ধারণা সেই মায়া স্পর্শ করার ক্ষমতা পারুলের নেই।

.

পারুল বাড়ি ফিরল পরদিন। তারপর থেকে সে বড্ড চুপচাপ, একা। কারো সাথে কথা বলে না। ঠিকমতো খায় না। বিষয়টা যে আব্দুল ফকিরের চোখে ধরা পড়েনি, তা না। কিন্তু আজকাল তার ব্যস্ততা বেড়েছে। বাড়িতেও সারাদিন নানান ধরনের লোকজনের আনাগোনা। তাদের কাউকে কাউকে পারুল চেনে, কাউকে কাউকে একদমই চেনে না। অবশ্য এসব নিয়ে সে মাথাও ঘামায় না। পুরোটা সময় সে ডুবে আছে তার ভাবনার জগতে। চিরটাকালই সে প্রবল অস্থিরতায় ভোগা এক মানুষ। ভেবে-চিন্তে কখনোই কিছু সে করেনি। যখন যা ইচ্ছে তাইই করেছে। কিন্তু এই প্রথম যেন সব কিছু নিয়েই সে নতুন করে ভাবছে। না চাইলেও ভাবছে। ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে ভাবনাগুলো যে শুধু ভাবনায়ই সীমাবদ্ধ থাকছে, তাও না। সে আজকাল নানান যুক্তি খুঁজছে। সম্ভাবনা খুঁজছে। সেইসকল যুক্তি, সম্ভাবনাগুলোতেও সে স্থির হতে পারছে না। একটার পরপরই অন্য একটা যুক্তি, অন্য একটা সম্ভাবনা এসে আগের সবগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। আর এ সকলই নয়নকে ঘিরে। বিষয়টা তার নিজের কাছেই খানিকটা অদ্ভুত লাগছে। সেই এক মুহূর্তের দেখা, তারপর থেকেই কী এক অস্থিরতা সে টের পাচ্ছিল তার বুকের ভেতর।

রায়গঞ্জ থেকে লতা এলো তার দিন চারেক বাদে। সে এসেই সন্ধ্যাবেলা পারুলের সাথে দেখা করতে এলো। পারুল বসেছিল পুকুরঘাটে। লতাকে দেখে পারুল কোনো উচ্ছ্বাস দেখাল না। মৃদু হাসল কেবল। পারুলের প্রতিক্রিয়ায় খানিক অবাক হলেও কিছু বলল না লতা। সে পারুলের পাশে গিয়ে বসল। পারুল চুপ করে তাকিয়ে আছে পুকুরের জলে। সেখানে কতগুলো শুকনো পাতা নৌকার মতো ভেসে যাচ্ছে ধীরে। সেই ভেসে যাওয়া পাতায় কী এমন দেখছে। পারুল!

লতা পারুলের পিঠে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল, কীরে, কী হয়েছে তোর?

পারুল জবাব দিলো না। সে যেমন তাকিয়ে ছিল তেমন তাকিয়েই বসে রইল। লতা বলল, এখনও মন খারাপ?

পারুল এবারও জবাব দিলো না। লতা বলল, এমন মন খারাপ করে থেকে কি হবে? চল কিছু একটা করি। তুই না বলছিলি শুদ্ধ করে কথা বলে শিখবি? চল, আমিই তোরে শেখাই?

পারুল ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। তার চোখে মুখে স্পষ্ট আগ্রহ। কিন্তু তার সেই আগ্রহী মুখ দেখেও লতা থমকে গেল। পারুলের গাল ভেজা। চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুর দাগ নেমে গেছে গাল বেয়ে। সে হঠাৎ দু’হাতে পারুলকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোরে আমি দুনিয়ার সব কিছু আইনা দিব পারুল। তাও আমার জন্য একটু এমনে কইরা কান। প্লিজ।

বলেই সে পারুলের মাথাটা বুকে চেপে ধরল। পারুল হঠাৎ কেঁদে উঠল। লতা পারুলকে শক্ত করে বুকের সাথে জাপটে ধরে ফিসফিস করে বলল, অনেক কষ্ট হইতেছে?

পারুল জবাব দিলো না। লতা পারুলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, তোর কেন কষ্ট হয়, আমারে বল তো? সে কি তোরে কিছু বলছে?

পারুল এবারও জবাব দিলো না। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই থাকল। লতাও আর কিছু জিজ্ঞেস করল না পারুলকে। কাঁদুক, কাঁদলে বুকটা হালকা হবে। কষ্টগুলো কান্নার সাথে সাথে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু খানিকবাদেই পারুল উঠে বসল। সে ওড়নায় মুখ মুছল। তারপর লতার দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, প্রথম প্রথম তোরও কি এমন লাগত?

লতা বলল, কেমন?

পারুল বলল, এই যে বুকের মইধ্যে কেমন খাঁ খাঁ করে। সব সময় মনে হয় বুকটা খালি খালি। গলার গোড়ায় কেমন জানি একটা ব্যথা। কিছু খাইতে ইচ্ছা হয় না। ঘুমাইতে ইচ্ছা করে না।

লতা হাসল। বলল, হ। লাগছেই তো।

পারুল বলল, আচ্ছা, সে কি টের পাইতেছে যে তার জইন্য আমার এমন লাগতেছে?

লতা বলল, কত পোলা যে তোর জইন্য তোর বাড়ির সামনে দাঁড়াইয়া কানছে। একটু কথা বলতে চাইছে। এক পলক দেইখাই চইলা যাইতে চাইছে। কেন চাইছে জানস? তোর এখন তার জন্য যেমন লাগতেছে, তাদেরও তোর জন্য এমনই লাগত। তুই কি তখন টের পাইতি?

পারুল মাথা নাড়ল। লতা বলল, এইটাই দুনিয়া।

পারুল আবার চুপ করে রইল। লতাও। সময় চলে যাচ্ছে নিঃশব্দে। পারুল হঠাৎ মাথা তুলে তাকাল, তারপর বলল, তার কিছু মনে হয় না? আমার যে হয়, সেইটাও সে বোঝে না?

লতা বলল, সেইদিন তো দুইজনরেই একসাথে দেখলাম। কিছু তো মনে হইল না।

পারুল বলল, সে যে আমার মাথায় হাত রাখল। সেইটা কি এমনে এমনেই রাখছে?

লতা হঠাৎ ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলল, না, এমনে এমনে মনে হয় নাই। দেইখা স্পেশাল কিছুই মনে হইছে।

পারুলের শূন্য বুকটা যেন আবার ঝলমল করে উঠল। সে লতার শরীরের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো খানিকটা। তারপর উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, বল না, কী এসপেশাল মনে হইছে। বল না?

লতা হঠাৎ হা হা হা করে হেসে উঠল। পারুল অবাক চোখে লতার দিকে তাকাল। লতা দু’হাতে নিজের মুখ চেপে হাসি বন্ধ করতে করতে বলল, মনে হইছে সে তার আপন ছোট বইনের মাথায় হাত বুলাইয়া দোয়া কইরা দিতেছে। বড় ভাই যেমনে ছোট বইনেরে মাথায় হাত দিয়া দোয়া কইরা দেয়, তেমন। হা হা হা।

লতা হাসছে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও সে তার হাসি থামাতে পারছে না। পারুল চট করে উঠে পড়ল। তারপর গমগম করে হেঁটে চলে গেল ভেতর বাড়ির দিকে। তার পিছু পিছু ডাকতে ডাকতে ছুটল লতাও। কিন্তু পারুল আর ফিরেও তাকাল না।

সে দ্রুতগতিতে হেঁটে ঢুকে গেল ঘরে। তাবারন অসুস্থ বলে তখনও ঘরে আলো দেয়া হয়নি। পারুল আলো জ্বেলে তাবারনের ঘরের দিকে গেল, তাকে সন্ধ্যার ঔষুধ দিতে হবে। দরজার কাছে হারিকেনের এক চিলতে আলো পড়তেই পারুলের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ভয়ের শিতল স্রোত নেমে গেল। তাবারনের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন নুরুন্নাহার। নুরুন্নাহারের হাতে বিশাল আকারের একখানা রাম দা। দরজার বাইরের চৌকাঠের ওপরের অংশে শেকল টেনে আংটা দিয়ে বন্ধ করে রেখে গিয়েছিল পারুল। নুরুন্নাহার সেই শেকল খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু অন্ধকার আর উচ্চতার কারণে সে শেকলটা খুলতে পারছে না। পারুল চিৎকার করে ডাকল, মা!

নুরুন্নাহার খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পারুলের দিকে ফিরলেন। তারপর বললেন, সেই তহন থেইকা শিকলখান খোলনের চেষ্টা করতেছি। পারতেছি না। শিকলখান একটু খুইলা দে তো।

পারুল বলল, শিকল খুইলা তুমি কী করবা?

নুরুন্নাহার পারুলের মুখের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসলেন। তারপর বললেন, তাবারনের দুই ঠ্যাংয়ের দুই রানের মাঝখানে এই দাও দিয়া ফারবো। ফইরসাবে যেন আর ওইখানে যাইতে না পারে।

পারুল চিৎকার করে বলল, মা। দাও ফেলাও। এখুনি দাও ফেলাও।

নুরুন্নাহার বললেন, না, ফেলব না। তাবারনের ঠ্যাং ফারবো। তারপর তার বড় বড় ওলানগুলান কাটব। ফইরসাবের মজা শ্যাষ করব।

পারুল বলল, এক্ষুণি ফালাও মা। ফালাইয়া ঘরে যাও। তোমার ঘরের দুয়ার খুলছে কেডা?

নুরুন্নাহারের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা গেল না। তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললেন, রতনের ধারে পানি চাইছিলাম। সে পানি দিতে গেছিল। ওই ফাঁকে তারে ভিতরে আটকাই থুইয়া বাইর হইয়া আইছি।

পারুল আবারো বলল, দাওখান ফেলাও মা। দাওখান ফালাইয়া চুপচাপ তোমার ঘরে যাও।

নুরুন্নাহার বললেন, তোর শরম করে না? তোর বাপ এইরকম একখান কুজাত। তোর শরম করে না? তোর মায়রে পাগল বানাইছে কেডা, তুই জানস না? আগে এই মাগিরে শ্যাষ করব। তারপর দেখব ফইরসাবের কেমন লাগে। তুই চাস না?

পারুল বলল, দাওখান ফেলাও মা। এক্ষণ ফালাও।

নুরুন্নাহার হঠাৎ হি হি হি করে বিকট শব্দে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, তুই কেডা? তোরে তো আমি চিনি না। তোর কথা আমি শুনব কেন? আয়, তুই ধারে আয়। তোরেও একখান কোপ দেই। তুইও দেহি ফইর সাবের পক্ষে কথা কস! ফইর সাবের লগের সকল মানুষ আমার শত্রু। তুইও। আয়, ধারে আয় ছেমড়ি। ধারে আয়।

লতা এসে দাঁড়িয়েছে পারুলের পিছনে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হতভম্ব! পারুল কঠিন গলায় বলল, দাওখান দেও বলতেছি মা। এক্ষণ দেও। না হইলে। কিন্তু…

নুরুন্নাহার হঠাৎ ভয়ানক গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন। সেই চিৎকারে গা হিম হয়ে এলো লতা আর পারুলের। কোনো মানুষের গলা থেকে এমন বীভৎস, এমন লোমহর্ষক চিৎকার বের হতে পারে তা অবিশ্বাস্য। সেই বিকট চিৎকারের ভেতর থেকেই নুরুন্নাহার বললেন, ফেলব না দাও। ফেলব না। দেহি তুই কী করস? আইজ আমি কাজ শ্যাষ না কইরা যাব না।

নুরুন্নাহারের এই রূপ দেখে লতা ভয় পেয়ে গেছে। ভয় পেয়ে গেছে পারুলও। নুরুন্নাহারের এখন যে অবস্থা, তা দেখে মনে হচ্ছে না তিনি পারুল, লতা বা তাবারন কাউকে আলাদা করতে পারবেন। যে কাউকে আঘাত করতে পারেন তিনি। হারিকেনের আবছা আলোয় বিশাল দা হাতে সংহার মূর্তি ধারণ করেছেন নুরুন্নাহার। তিনি আবারো চিৎকার করলেন। তারপর চিৎকার করেই বললেন, দরজাখান খুইলা দে। এক্ষণ খুইলা দে।

বলার সাথে সাথেই তিনি হাতের দা’খানা দিয়ে সজোরে কোপ বসালেন দরজার গায়ে। চৌকাঠসহ পুরো ঘরই সেই আঘাতে কেঁপে উঠল। নুরুন্নাহার টান দিয়ে দাখানা দরজার কাঠ থেকে ছাড়ালেন। পারুল এবার ঠান্ডা স্থির গলায় বলল, মা, এইবার শেষবার বলতেছি, দাওখান ফালাও। ফালাইয়া চুপচাপ তোমার ঘরে যাও। শেষবার বলতেছি।

নুরুন্নাহার সশব্দে দ্বিতীয় কোপখানা বসালেন দরজার গায়ে। তারপর ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন পারুলের দিকে। বললেন, না ফালাইলে কী করবি তুই? কি করবি?

পারুল হঠাৎ তার হাতের হারিকেনখানা কাত করল। তারপর হারিকেনে কেরোসিন ভরবার ছিদ্রের ছোট ঢাকনা খুলে গলগল করে কেরোসিন ঢালতে লাগল তার গায়ে। নুরুন্নাহার হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন। তিনি খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। পারুলের জামার সামনের দিকটা কেরোসিনে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। সে ঠান্ডা চোখে নুরুন্নাহারের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যদি এক্ষণ দাওখান ফালাইয়া তোমার ঘরে না যাও, তাইলে এক্ষণ আমি আমার গায়ে। আগুন দিব। তোমার সামনে পুইড়া মরব।

লতা রুদ্ধশ্বাস আতঙ্ক নিয়ে পারুলের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না তার সামনে এ কী ঘটছে! খানিক বাদে কী ঘটবে, তার কিছুই বুঝতে পারছে না সে। নুরুন্নাহার হঠাৎ দরজার সামনে মাটিতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লেন। কিন্তু দা’খানা হাত থেকে এখনো ছাড়েনি সে। কিন্তু মাটিতে বসে তার ভাঁজ করা হাঁটুর উপর মাথা রেখে হঠাৎ উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন নুরুন্নাহার।

সে রাতে পারুল সারারাত বসে রইল মায়ের ঘরের দরজার সামনে। আব্দুল ফকিরও রাতে বাড়ি ফিরলেন না। ঘরের ভেতরে নুরুন্নাহার একটানা কেঁদে চললেন সারারাত। সেই কান্না শুনতে শুনতে পারুলের হঠাৎ মনে হলো, একটা মানুষ তার চোখের ভেতর কত জল জমা করে রাখতে পারে? কত জল? কত অশ্রু ঝড়ালে পরে তার কান্না শেষ হয়? চোখ হয়ে যেতে পারে অশ্রুবিহীন? পারুল এইসব প্রশ্নের উত্তর পেল না। তবে তার কেন যেন মনে হতে লাগল, শেষ কিছুদিনে সে আর সেই আগের পারুল নেই। হুট করেই হয়ে অচেনা অন্য এক পারুল হয়ে উঠেছে সে। এই পারুলকে সে নিজেই চেনে না। আচ্ছা অন্য কেউ কি চেনে?

পারুলের আচমকা মনে হলো, কে চিনবে তাকে? এই জগতে অমন গভীর করে চেনার মতো কেউ যে নেই তার! কেউ না।

*

মন খারাপ হলে কী করা যায়? হেমার ধারণা মন খারাপ হলে আকাশ দেখা যায়। বাবা-মার বিষয়টা নিয়ে সে আর মন খারাপ করে থাকতে চাচ্ছে না। চারপাশে এত এত সমস্যা যে কোনটা রেখে কোনটাকে সে সামলাবে! তবে মার সাথে কথা বলার একটা উপায় সে খুঁজছে এবং তার ধারণা সেই উপায়টা সে পেয়েও যাবে। সেদিন বাবার কথা শুনে বাবার জন্য স্পষ্টতই তার খারাপ লেগেছে। কিন্তু মার কাছেও সে কথাগুলো শুনতে চায়। আর হেমার কাছে এটিও স্পষ্ট যে হঠাৎ করে নিতে যাওয়া বাবার এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পেছনে অন্য কোনো একটা কারণও নিশ্চয়ই রয়েছে। এই দীর্ঘজীবন তিনি অমন সব ভয়াবহ সমস্যা নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারলেও এই প্রায় শেষ বয়সে এসে হঠাৎ-ই। এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে কারণ কী? হেমার ধারণা, এই সিদ্ধান্তের পেছনে অন্য কোনো অনুঘটক না থেকেই পারে না। সেই ব্যাপারটা জানাটাও জরুরি। কিন্তু হেমার কেন যেন ইচ্ছে করছে না। একদম ইচ্ছে করছে না। বাবার কি অন্য কোনো সম্পর্ক হয়েছে? তার জীবনে কি অন্য কেউ এসেছে? আজকাল এমন অহরহ হচ্ছে। হেমা দেখেছেও। তার খুব কাছের এক বান্ধবীর বাবার গোপন বিয়ের খবর জানাজানি হয়েছে প্রায় ছ’বছর পর। তার সেই গোপন স্ত্রীটিও বয়সে তরুণী। এমন আরো কত ঘটনা যে হেমা দেখেছে, শুনেছে! তখন বিষয়গুলো স্বাভাবিক মনে হলেও নিজের বাবার ক্ষেত্রে বিষয়টি সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না।

হেমা এ ক’দিন অনেক ভেবেছে। ভেবে একটা কথা খুব স্পষ্ট করেই তার মনে হয়েছে, সেটি হলো বাবা-বা মা তার সন্তানদের কাছে কেবল বাবা-মা হয়েই থাকেন। তারা যে আলাদা করে একজন নারী বা পুরুষও, সেটি তাদের সন্তানরা কখনোই ভাবতে চায় না। এইজন্যই অন্যের বাবা-মায়ের ডিভোর্স, আবার বিয়ে, পরকীয়া প্রেম, অস্বাভাবিক বা অনুনোমোদিত কোনো শারীরিক সম্পর্কের ঘটনা শুনেও সেটিকে তারা যত সহজে নিতে পারে, নিজের বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে তা তারা মোটেও নিতে পারে না।

এমন নানা ভাবনা হেমার মাথায় ক’দিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝে মধ্যে এও মনে হচ্ছে যে, সে কি অবচেতনভাবেই নিজেকে যে-কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি করার জন্যই এসব ভেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে চাইছে? কিন্তু আজ সারাটা দিনই তার মন ভার হয়ে আছে। কিছুতেই মন ভালো করতে পারছে না সে। এমন কিছু একটা করতে ইচ্ছা হচ্ছে তার, যার কোনো অর্থ নেই, কোনো যৌক্তিক কারণ নেই, কিন্তু সেই কাজটা তাকে তার আর সকল ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে।

কিন্তু কী করবে সে! হেমা জানে না। তবে এই মুহূর্তে তার খুব আকাশ দেখতে ইচ্ছে করছে। সমস্যা হচ্ছে এখন গভীর রাত। তার ওপর আকাশ জুড়ে মেঘ। যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। সুতরাং এই সময় আকাশে দেখার কিছু নেই। এই আকাশজোড়া মেঘ অবশ্য সেই বিকেল থেকেই। সাথে প্রচণ্ড গরম। কিন্তু বৃষ্টি নামছে না। মাঝে-মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হেমা মন খারাপ ভাব নিয়ে দীর্ঘক্ষণ বিছানায় বসে রইল। মন ভালো হবার মতো নানান কিছু ভাবতে চেষ্টা করল। কিন্তু সব ভাবনাই কেমন এলোমেলো হয়ে আছে! কোনোকিছুই কাজে লাগছে না।

দিন কুড়ি আগে তার বাবা বাসা ছেড়ে গেছেন। তারপর আর ফেরেননি। তার ফোনও বন্ধ। কোথায় আছেন, সে বিষয়েও কোনো খোঁজ নেই। মার সাথে এর মধ্যে বারদুয়েক কথা বলার চেষ্টা করেছিল হেমা। কিন্তু লাভ হয়নি। রেণু তাতে খুব একটা সাড়া দেননি। হেমার আজকাল হঠাৎ হঠাৎ পৃথিবীটা খুব অর্থহীন লাগে। এই যে এত এত কাজ, প্রতিযোগিতা, সম্পর্ক, মায়া- এ সকলই কি শেষ অবধি অর্থহীন নয়? অথচ এই প্রতিটি জিনিসের জন্য কত কত নিষ্ঠুম রাত, কত কত কান্না, জিঘাংসা! অথচ দিন শেষে সকল কিছুর ফলাফলই স্রেফ শূন্য।

শেষ রাতের দিকে হঠাৎ ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। প্রচণ্ড গরমে দরদর করে ঘামছিল হেমা। সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বারান্দার বাইরে ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে ডালপালা ছড়ানো বিশাল এক সজনে গাছ। ঢাকার মতো বৃক্ষহীন শহরে এতবড় সজনে গাছ বিরল। দোতলার বারান্দা অবধি উঠে গিয়ে সবুজ পাতাভর্তি ডালপালা মেলে দিয়েছে গাছটা। হঠাৎ তাকালে চোখে পড়ে কেবল সবুজ আর সবুজ। কিন্তু সেই সবুজ এই অন্ধকারে সামন্যিতমও স্বস্তি দিতে পারল না হেমাকে। গাছের পাতা নড়ছে না। সামান্য হাওয়াও নেই কোথাও। সবকিছু স্থির, স্তব্ধ। হেমা সেই স্থির, স্তব্ধ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইল। সে ঘুমাতে গেল শেষ রাতে। ঘুমের ভেতর এলোমেলো নানান স্বপ্ন দেখল। ঘুম ভাঙল ভোরে। অর্ধেকটা চোখ মেলে তাকিয়েই তার মন ভালো হয়ে গেল। রাতে বারান্দার দরজা, জানালা লাগতে ভুলে গিয়েছিল সে। চোখ মেলতেই সেই বারান্দার দরজা, জানালা গলে দৃষ্টি চলে গেল সজনে গাছের ডালে। সেখানে তুমুল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি সবুজ পাতাগুলোকে আরো সবুজ করে একটানা ঝরে যাচ্ছে।

হেমার বৃষ্টি পছন্দ। তবে মৃদু ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি নয়। আবার খানিক থেমে থেমে ঝরা বৃষ্টিও নয়। তার পছন্দ জগৎ সংসার অন্ধকার করে দিয়ে নামা বিরামহীন তুমুল বর্ষণ। সেই বর্ষণে রাস্তাঘাট শূন্য হয়ে যাবে। লোকজন ঘর থেকে বের হবে না। অফিস-আদালত হবে না। স্কুল-কলেজ খুলবে না। রাস্তায় হাঁটু জল জমে যাবে। সেই জলের ভেতর খইয়ের মতো ফুটতে থাকবে বড় বড় অজস্র বৃষ্টির ফোঁটা। জানালার বাইরে তাকালে মনে হবে আজ বৃষ্টির দিন। কেবলই বৃষ্টির দিন। এই বৃষ্টির দিনে কেবল বৃষ্টির অবিরাম ঝরে যাওয়া ছাড়া আর কারোই কিছু করার থাকবে না। সবাই ঘরের ভেতর বসে বৃষ্টি দেখবে। কেউ কেউ চাইলে ঘর থেকে বেরও হতে পারবে। তবে তা কেবলই বৃষ্টিতে ভেজার জন্য, অন্য কোনো কাজে নয়।

হেমা অনেকক্ষণ আধখোলা চোখে তাকিয়ে রইল। তার হঠাৎ মনে হলো, আজ সেই বৃষ্টির দিন। সেই বিশেষ বৃষ্টির দিন! সে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল। তারপর দৌড়ে চলে গেল বারান্দায়। বারান্দার মেঝেয় পানি জমে আছে। সে খুব আলতো করে, সন্তর্পণে মেঝেতে জমে থাকা পানিতে তার আঙুলের ডগা ছোঁয়াল। গা শিরশরে ঠান্ডা অনুভূতি! সে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়াল। বৃষ্টির ঝাঁপটায় সে ভিজে যাচ্ছে। শীত শীত লাগছে। কিন্তু সে নড়ল না। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়েই রইল। তার যে কী ভালো লাগছে। তার মনে হচ্ছে, ইশ, একজোড়া পাখা যদি তার থাকত! তাহলে এখন সে পাখির মতো ডানা মেলে এই বৃষ্টির ভেতর উড়ে যেতে পারত। সে উড়ে উড়ে চলে যেতে পারত কোনো নদীর কাছে, ভোলা মাঠের কাছে, উঁচু নিঃসঙ্গ পাহাড়ের কাছে, কোনো এক গাঁয়ের শান্ত পুকুর কিংবা ধান ক্ষেতের ভেতর ঝাঁক বেঁধে হেঁটে চলা হাঁসেদের কাছে। সে উড়ে উড়ে এই অদ্ভুত সব বৃষ্টি দেখত। সব রকমের বৃষ্টি। হেমা হঠাৎ আবিষ্কার করল, সে যা যা ভাবছে, ঠিক তাই তাই যেন সে তার বন্ধ চোখের ভেতর সিনেমার দৃশ্যের মতো একের পর এক ভেসে আসছে। সত্যি সত্যি যেন তার দু’খানা পাখনা হয়েছে। সে সেই পাখনা হাওয়ায় ভাসিয়ে ভিজে ভিজে উড়ে যাচ্ছে প্রবল বর্ষণে।

ভীষণ শব্দে বজ্রপাত হলো কোথাও। হেমা আচমকা চোখ মেলে তাকাল। বারান্দার ঠিক নিচেই সরু রাস্তা। রাস্তার মাঝখানে রাহাত দাঁড়িয়ে আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে রাহাত যে একা একা দাঁড়িয়ে আছে তা না। তার সাথে দাঁড়িয়ে আছে একখানা তিন চাকার ভ্যানগাড়িও। তবে ভ্যানগাড়িতে কোনো চালক নেই। সম্ভবত চালক রাহাত নিজে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ভ্যানগাড়ি ভর্তি কদম ফুল। রাহাত সেই কদম ফুলের মাঝখানে বসে তাকিয়ে আছে হেমার দিকে। তার চোখে কালো সানগ্লাস। এই বৃষ্টির মধ্যে সে কালো সানগ্লাস পরে আছে কেন কে জানে! এই ছেলের কাণ্ডকারখানা বোঝা ভারি মুশকিল। কিন্তু এই অদ্ভুত ঘোর লাগা বৃষ্টিতে রাস্তার মাঝখানে ভ্যানভর্তি কদমফুলের মাঝখানে। সানগ্লাস পরা রাহাতকে বসে থাকতে দেখে হেমার কেমন মন খারাপ হয়ে গেল। অবশ্য মন খারাপ ব্যাপারটাকে সে পাত্তা দিলো না। সে জানে, নয়ন কখনোই তার জন্য এমন কিছু করবে না। রাহাতকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে। তার ভাবনায় মুহূর্তের জন্য নয়ন চলে এসেছিল। সে বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর চিৎকার করে বলল, আমার কাছে ক্যামেরা নেই। ক্যামেরা থাকলে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সেরা ছবিটা ভোলা হয়ে যেত।

রাহাত হাসলো কিনা বোঝা গেল না। তবে সেও চিৎকার করে বলল, হতো না। কম্পোজিশনে সামান্য গোলমাল হতো। এই দৃশ্যের সাথে কালো সানগ্লাস পরা কারো ক্যাবলাকান্ত চেহারা যায় না।

হেমা বলল, তুই কি এই সব কদম ফুল নিয়ে এখন বাসায় উঠবি?

রাহাত বলল, না।

হেমা বলল, তাহলে?

রাহাত বলল, তুই নেমে আসবি। তোকে কদমফুলের মাঝখানে বসিয়ে আমি ভ্যান চালিয়ে ঢাকা ঘুরব।

সিদ্ধান্ত নিতে হেমার মুহূর্তকালও লাগল না।

সে বাসা থেকে বেরুল তার ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায়। তার মাথার মধ্যে কোনো একটা গান গুনগুন করছে। কিন্তু গানটা সে ঠিক ঠিক ধরতে পারছে না। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। একই তীব্রতায় অঝর বর্ষণ চলছে। রাস্তায় পানি জমে গেছে হাঁটু অবধি। তবে স্বস্তির কথা লোকজন একদম নেই। আজ শুক্রবার। এমনিতেই ছুটির দিন। তার ওপর এমন বর্ষণ। অতি প্রয়োজন না থাকলে কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। হেমা বসে আছে ভ্যানের মাঝখানে। তার চারপাশে অসংখ্য কদম ফুল। ভ্যান চালাচ্ছে রাহাত। হেমা বলল, তুই সানগ্লাস পরে আছিস কেন?

রাহাত বলল, বৃষ্টির যা ছাট। কতক্ষণ তোর বারান্দার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে পারতাম? তুই যে এত তাড়াতাড়ি বের হবি, তা তো ভাবিনি।

হেমা বলল, বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকতে তোকে কে বলল, তুই ফোন দিলেই পারতি।

রাহাত বলল, তোর ফোন অফ।

হেমার হঠাৎ মনে হলো সে দীর্ঘ সময় ফোন দেখেনি। ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না বলে ফোনে চার্জও দেয়া হয়নি। সম্ভবত এই কারণেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে বলল, কিন্তু এই পাগলামি মাথায় উঠল কখন?

রাহাত বলল, যখন বৃষ্টি শুরু হলো। ভোর রাতের দিকে। বোঝাই যাচ্ছিল এ সহজে থামার বৃষ্টি না।

হেমা বলল, এত কদম ফুল তুই কই পেলি?

রাহাত হাসল। জবাব দিলো না। হেমাও আর কথা বলল না। কখনো কখনো চুপ থাকা দরকার। রাহাতের এই পাগলামি নতুন না। সে হেমার ক্লাসমেট। নয়ন আর হেমার ঘটনাও সে জানে। কিন্তু তারপরও হেমার জন্য তার এমন অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড নিত্য দিনকার ঘটনা। কেউ কিছু বললে সে উদাস গলায় জবাব দেয়, ভালোবাসতে ভালো লাগে বলেই মানুষ ভালোবাসে। আমিও ভালো লাগে বলেই ভালোবাসি। কই, ভালোবাসা পাই না বলে তো খারাপ লাগে না! একটা শূন্যতাবোধ হয়। তবে জীবনে এই শূন্যতাবোধটার দরকার আছে।

রাহাত জানে, হেমার প্রতি তার এই শর্তহীন সমর্পণ নিয়ে প্রকাশ্যে কিংবা আড়ালে মানুষ নানান কথা বলে। হাসাহাসি করে। কিন্তু এসব নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়। চিন্তিত না হেমাও। হেমার কাছে বিষয়টা অবশ্য অন্যরকম। রাহাতকে তার আজকাল আর আলাদা করে কেউ মনে হয় না। তাকে কেমন যেন বাসার সামনের চেনা সজনে গাছটার মতো মনে হয়। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত সে যেন অমন দাঁড়িয়েই থাকবে। কোথাও যাবে না। কিন্তু তাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবার কিছু নেই। রাহাতও তার কাছে তেমন। রাহাতের এই অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ডে যে হেমা খুব একটা মুগ্ধ হয় তাও না। মাঝে-মধ্যে বিরক্তও হয়। তবে সে সেটাও প্রকাশ করে না।

রাহাত অনেকক্ষণ বাদে বলল, আমরা এখন কোথায় যাব?

হেমা হঠাৎ বলল, ক্রিসেন্ট লেকের ধারে চল। ওখানে খানিক বসি।

রাহাত বলল, নয়ন ভাই এখনো আসেনি।

হেমা বলল, না।

রাহাত হাসল। বলল, গ্রামে গিয়ে বিয়ে-টিয়ে করে ফেলেছেন নাকি?

হেমা বলল, দাওয়াত তো পাইনি।

রাহাত বলল, কীভাবে পাবি? ওখান থেকে পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা তো নেই।

হেমা বলল, টেলিপ্যাথি বলে একটা ব্যাপার আছে না? বিয়ে-টিয়ে করলে ঠিকঠাক দাওয়াত পেয়ে যাব।

রাহাত বলল, বাহ! তারপর?

হেমা বলল, একখানা নীল শাড়ি পরে তোকে নিয়ে গিয়ে বিয়ে খেয়ে আসব।

রাহাত বলল, কষ্ট হবে না?

হেমা বলল, হবে তো। বোরহানিতে ঝাল কম হলে কষ্ট হবে। রোষ্টটাতে মিষ্টি বেশি হলে কষ্ট হবে। ওর হবু বউটা আমার চেয়ে বেশি সুন্দরী হলে কষ্ট হবে।

রাহাত হা হা করে হাসল। তারপর বলল, মেয়েরা সব সময় তার চেয়ে একটু সুন্দরী অন্য কোনো মেয়ে দেখলেই এমন জেলাস হয় কেন বল তো?

হেমা বলল, ছেলেরা হয় না?

রাহাত বলল, না।

হেমা বলল, কে বলল তোকে?

রাহাত বলল, বলতে হবে কেন? তোর সামনে তো একটা জলজ্যান্ত প্রমাণ বসে আছে।

হেমা বলল, তুই? তুই আবার জেলাস হবি কেন?

রাহাত বলল, এই যে নয়ন ভাই দেখতে এত সুন্দর। তারপর এই যে এত কিছু করেও তোর একটু কনসান্ট্রেশন আজও পেলাম না। আর কিছু না করেই

সে পুরোপুরি তোকে পেয়ে গেল।

হেমা হঠাৎ চোখ টিপে খানিক দুষ্টুমিমাখা গলায় বলল, কনসান্ট্রেশন না দিলে এই তুমুল বৃষ্টিতে এমন এক কথায় তোর জন্য ঘর ছাড়লাম?

রাহাত হাসল। বলল, ছেড়েছিস বলছিস?

হেমা বলল, এত সন্দেহ থাকলে কি ভালোবাসা যায়রে পাগল? ভালোবাসতে হলে সবার আগে খুনি হতে হয়। সন্দেহ খুনি। নির্দয়ভাবে সন্দেহ খুন করে ফেলতে হয়। সন্দেহদের খুন না করলে ভালোবাসা যায় না রে।

রাহাত বলল, আর কী কী করলে ভালোবাসা যায় না?

হেমা বলল, কষ্ট না হলে।

রাহাত বলল, কষ্ট কেন হয়?

হেমা বলল, স্পর্শ করতে না জানলে।

রাহাত হঠাৎ হাত বাড়িয়ে হেমার হাত স্পর্শ করে বলল, এই যে স্পর্শ করলাম। ভালোবাসা হয়ে গেল?

হেমা হাসল, ভালোবাসার স্পর্শ যদি এতই সহজ হতো। তাহলে ভালোবাসার জন্য মানুষ এমন ব্যাকুল হতো না।

রাহাত বলল, তাহলে সেই স্পর্শটা কেমন, আমায় একটু শেখা, দেখি, যদি তোকে ছোঁয়া যায়।

হেমা আবারো হাসল। বলল, এই ছোঁয়ার কোনো সূত্র নেই যে! এই ছোঁয়াটা অদ্ভুত! ধর কেউ একজন দিনরাত তোকে পাগলের মতো ভালোবাসছে। তোর ভালো লাগে এমন সবকিছু করছে। উন্মুখ হয়ে থাকছে। তোকে একটু খুশি করবার জন্য। তোর ভালোলাগা, মন্দলাগা সকল কিছু জেনে নিয়ে সে সেইসব কিছুই করার চেষ্টা করছে। কিন্তু দেখবি কী, সেসব কিছুর কোনোটাই তোকে স্পর্শ করছে না। অথচ কেউ একজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডান হাতে নাক পরিষ্কার করে প্যান্টে মুছছে, আঙুলে কান খুচছে। ওই দৃশ্য দেখেও তোর হঠাৎ মনে হতে পারে, আহা, কী সুন্দর করেই না নাক ঝাড়ল, কান খুঁচলো মানুষটা! আহাহা। বুকের ভেতর কেমন একটা ভালোলাগার হাহাকার বয়ে যাবে। সেই হাহাকারভর্তি স্পর্শ। এর কী কোনো সূত্র হয় বল?

রাহাত হেমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তার কালো চশমা খুলে ফেলেছে। হঠাৎ করেই মেঘ ডাকছে খুব। মাঝে-মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হেমা আচমকা বলল, কী? অমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেন? নাকি এখনই বলবি, তুই এত সুন্দর করে কথা বলিস কী করে, বলতো হেমা! এইটাই হলো সেই সূত্ররে গাধা। বুঝেছিস? অথচ বোটানির মেয়েটা, কী যেন নাম? শিউলী না? সে যে রাত-দিন তোর পিছে ঘোরে। কী সুন্দর করে প্রোগ্রামগুলোতে কবিতা আবৃত্তি করে, গান গায়, সেগুলোকেও তোর অখাদ্য মনে হয়। তার কিছুই তাকে একটুও স্পর্শ করে না। আর আমি ডান হাতে নাক ঝাড়লেও তোর ভালো লাগে, তাই না? এই হলো সেই সূত্র বুঝলি?

রাহাত হা হা হা করে হাসল। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, তোর কী হয়েছে বলতো?

হেমা বলল, কী হবে আবার?

রাহাত বলল, কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। ইউ আর নট নরমাল।

হেমা বলল, মেয়েদের মন বোঝার চেষ্টা করে লাভ নেই হে বৎস। স্বয়ং ঈশ্বরও নাকি বুঝতে পারেননি।

রাহাত বলল, নয়ন ভাই কি বুঝেছেন?

হেমা বলল, নাহ্। এই চেষ্টাটা সে কখনো করেইনি। বরং আমিই তাকে বোঝার চেষ্টা করেছি।

রাহাত বলল, পেরেছিস?

হেমা বলল, কখনো কখনো মনে হতে পেরেছি। তারপর আবার মনে হতো একদম না। তবে শেষ কিছুদিন পুরোপুরিই অচেনা।

রাহাত বলল, এইজন্যই বলেছি, দ্যাখ, অন্য কারো প্রেমে পড়েছেন কিনা?

হেমা বলল, আমার ঘর ভাঙতে চাইছিস?

রাহাত বলল, নাহ্। সামান্য ফাটল ধরলেও সেটি জুড়ে দিতে চাইছি।

হেমা বলল, কী করে?

রাহাত বলল, চল। নয়ন ভাইকে গিয়ে নিয়ে আসি। গ্রামের নামটা যেন কী বললি? আমরা সেখানে গিয়ে হাজির হবো। তিনি সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখবেন তার মাথার কাছে তুই দাঁড়িয়ে আছিস।

হেমা খুব চেষ্টা করছিল আজ আর সে মন খারাপ করবে না। কিন্তু এই প্রথম সে তার চেষ্টাটা রাখতে পারল না। সে শেষরাতে বিচ্ছিন্ন এলোমেলো স্বপ্ন। দেখছিল। বাবা-মাকে নিয়ে দেখছিল। নয়নকে নিয়ে দেখছিল। নয়নকে নিয়ে দেখা স্বপ্নটা অদ্ভুত। সে দেখেছে গ্রামের একটা উঠোন বিয়ের লাল, নীল, হলুদ রঙের অসংখ্য কাগজে সাজানো। বাড়িভর্তি নানান লোকজন। তাদের কাউকেই হেমা চেনে না। সে গিয়েছে ঢাকা থেকে। বাড়িতে ঢুকে উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে হতভম্ব হয়ে গেল। নয়নের বিয়ে হচ্ছে। যে মেয়েটার পাশে সে বসে আছে, সেই মেয়েটাকে যেন কোথাও দেখেছে হেমা। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে করতে পারছে না সে! মেয়েটা সম্ভবত ওই গ্রামেরই কেউ। সে উঠানে ঢুকতেই নয়ন তাকে দেখল। সে সোজা তাকিয়ে আছে তার দিকে। হেমা কি করবে এখন? সে কি চিৎকার করে কাঁদবে! সবাইকে ডেকে বলবে নয়নের সাথে তার সম্পর্কের কথা? কি করবে? হেমা কিছুই করল না। সে খুব ধীরে ঘুরল। তারপর বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই নয়ন তাকে ডাকল। কিন্তু হেমা ফিরল না। নয়ন হঠাৎ দৌড়ে ছুটে এলো। তারপর হেমার কাঁধ চেপে ধরে বলল, কই যাচ্ছ?

হেমা জবাব দিলো না। নয়নের উপর তার একটুও রাগ হচ্ছে না। যা হচ্ছে তার নাম কষ্ট। মানুষ রেগে গেলে কষ্ট হয়, ঈর্ষান্বিত হলে কষ্ট হয়, হেরে গেলেও কষ্ট হয়। কিন্তু সেই সকল কষ্টের চেয়ে আলাদা যেই কষ্ট, সেই কষ্টের নাম অভিমানের কষ্ট। জগতে অভিমানী মানুষের কষ্টের তুল্য কিছু নেই। হেমার এখন এই মুহূর্তে যেই কষ্ট হচ্ছে, তার নাম সেই অভিমানী মানুষের কষ্ট।

নয়ন বলল, সেই কখন থেকে সবাই অপেক্ষা করছে, তুমি আসলেই বিয়ে পড়ানো হবে। আর তুমি কিনা এসেই চলে যাচ্ছ?

হেমা ঝট করে মুখ তুলে তাকাল। এসব কী বলছে নয়ন!

নয়ন তাকে আরো অবাক করে দিয়ে বলল, এই বিয়ের সাক্ষী তো তুমি! আর তুমি এত দেরি করে এসেই আবার চলে যাচ্ছ?

হেমা কিছু বলল না। সে কেবল নয়নের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। নয়ন হাসছে। হেমার মনে হচ্ছে সেই হাসির ভেতর কোথাও যেন কোনো একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু রহস্যটা সে ধরতে পারছে না। হেমার ধারণা, নয়ন আচমকা এমন কিছু একটা বলবে, যেটি শুনে হেমা চমকে যাবে। তার সামনের এই বিয়ের ঘটনা তখন তার কাছে মনে হবে সবচেয়ে আনন্দময় ব্যাপার। দেখা গেল স্টেজে বসা মেয়েটাকে কনের সাজে সাজিয়ে গুজিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে স্রেফ একটা নাটক করার জন্য। এই নাটকটা করা হয়েছে তাকে চমকে দেয়ার জন্য। আসল ঘটনা হলো, আজ নয়নের সাথে হেমারই বিয়ে। তারা পরিকল্পনা করেই এই অজপাড়া গায়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে হেমাকে চমকে দিতেই এটা করেছে নয়ন।

কিন্তু বাকি ঘটনা হেমার আর দেখা হলো না। ভয়াবহ মানসিক চাপ নিয়ে তার ঘুম ভাঙল। বুকের বাঁ পাশে কেমন চিনচিনে এক ব্যথা। চোখ খুলে বৃষ্টি দেখেই সেই ব্যথাটা যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে ব্যথাটা আবার ফিরে আসছে। হেমার হঠাৎ খুব কান্না পেতে লাগল। সে কী কাঁদবে? এই বৃষ্টিতে কাঁদাই যায়। আচ্ছা রাহাত তার সামনে বসে আছে, কিন্তু এমন ঝরঝর বাদল মুখর দিনে, এমন তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে যদি সে কাঁদে, তবে কী রাহাত তা বুঝতে পারবে? নাকি বৃষ্টির জলে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে তার কান্নার জল?

*

নয়ন বসে আছে বাসার ছাদে। এই সময়ে এই জায়গাটা তার খুব পছন্দের। মোহাম্মদপুর পেরিয়ে আরো অনেকটা ভেতরের দিকে নতুন এই বাড়ি। এখানে এখনো আকাশচুরি হয়নি। চারপাশে মাথা উঁচু ভবনের বালাই নেই। বিকেল হলেই নরম রোদের সাথে ফুরফুরে হাওয়ার সখ্যতা টের পাওয়া যায়। নয়নের সামনে ক’খানা পুরনো ডায়েরি খোলা। ঠিক ডায়েরিও না, রুলটানা খাতা বললেও চলে। খাতার পাতাভর্তি কত কী যে লেখা! তবে লেখাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্পষ্ট নয়। ঝর্না কলমে নিউজপ্রিন্ট কাগজে লেখা হয়েছিল বলে বেশিরভাগ লেখাই লেপ্টে গিয়েছে। যিনি লিখেছেন তার লেখার ধরনটাও কেমন অদ্ভুত! যেন অন্য কারো হাতে পড়ে গেলে সহজে পড়ে ফেলতে না পারে, এইজন্য ইচ্ছে করেই এমন হিজিবিজি করে লেখা। এ যেন কেবলই নিজের জন্য লেখা।

নয়ন নিজে ডাক্তার। লোকে বলে ডাক্তারদের হাতের লেখা ভয়াবহ দুর্বোধ্য হয়। কিন্তু সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না, এই লেখা যিনি লিখেছেন, তিনি কি ইচ্ছে করেই এমনভাবে লিখেছেন? নাকি তার হাতের লেখাটাই এমন?

এই লেখা লিখেছেন নয়নের মা কোহিনূর। খাঁ-বাড়ির প্রথম কন্যা সন্তান হিসেবে কোহিনূরকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। কোহিনূর অষ্টম শ্রেণি অবধি তার নানাবাড়ি থেকে পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু নয়ন কখনো কোনোদিন মাকে কিছু লিখতে দেখেনি। এমনকি বাজারের ফর্দও না। কিন্তু সে জানে, এই খাতাগুলো তার মায়ের। খাতার লেখাগুলোও। খাতাগুলো নয়নের হাতে এসেছে বহু আগে। কিন্তু তখনও বিষয়টি নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখায়নি নয়ন। ছাদের চিলেকোঠার ঘরে কিছু পুরনো বাকসো রাখা ছিল। সেই বাকসে নয়নের পুরনো কিছু বই-খাতাও ছিল। হঠাৎ দরকারে সেগুলো খুঁজতে গিয়েই মায়ের লেখা খাতাগুলো পেয়ে গিয়েছিল নয়ন। প্রথম দেখায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ। কিছু মনে হয়নি। পাতার পর পাতা জুড়ে যেন কেবল দুর্বোধ্য আঁকিবুকি। এমন জটিল করে লেখা হাতের লেখা আগে কখনো দেখেনি নয়ন। প্রথম লেখাটা বুঝতেই তার অনেক সময় লেগে গিয়েছিল এবং তখন অবধিও সে বুঝতে পারেনি লেখাগুলো কার? কোথাও তার মা কোহিনূরের নাম অবধিও লেখা ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে পাতা যত উল্টেছে, ততই বিস্ময়াভিভূত হয়েছে নয়ন। আবিষ্কার করেছে অদ্ভুত সব ঘটনা।

খাতার বেশিরভাগ লেখাই ছোট ছোট গল্প বা কবিতা। নয়ন কবিতা তেমন ভালো বোঝে না, তবে গল্পগুলো যতটুকু সে পড়তে পেরেছিল, তাতে সেগুলোকে গল্প না বলে আত্মকথা বলেই তার মনে হয়েছে। সম্ভবত কারো সাথে তেমন একটা কথাবার্তা বলতেন না বলেই নিজের ভাবনাগুলোকে এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে লিখে রাখতেন কোহিনূর। খাতাগুলো দেখে নয়নের মনে হয়েছে তার মা সেই সকল নিঃসঙ্গ সময়ের প্রায় সকল কথা, সকল ভাবনা তুলে রেখেছিলেন এই খাতাগুলোতে। সম্ভবত ভীষণ অন্তর্মুখী কোহিনূরের কাছে এই খাতাগুলোই ছিল সে সময়ে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, মনের সকল কথা অকপটে বলতে পারা সঙ্গী। সমস্যা হচ্ছে লেখাগুলোতে কোনো দিন, তারিখ, সময় উল্লেখ করা নেই। নয়ন একবার ভেবেছিল মাকে জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু মাকে সে যতটা চেনে, তাতে আর সাহস করেনি।

অনেকগুলো সাপ যেমন একসাথে থাকলে কিলবিল করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকে, খাতার লেখাগুলোও যেন অনেকটাই তেমন। প্রথম প্রথম পড়তে খুব বেগ পেতে হতো নয়নকে। কিন্তু ক্রমশই লেখায় উল্লেখিত বিভিন্ন চরিত্র, স্থানের নাম, গল্পগুলো সে ধরে ফেলতে পারল। ধরে ফেলতে পারল লেখার নানান কথা, বাক্য, শব্দের ধরনও। ফলে বিষয়গুলো ক্রমশই সহজ হয়ে আসতে লাগল। প্রথম দু’দিন শ্রেফ হাতের লেখা বোঝার কৌতূহল থেকেই খাতাগুলো পড়েছিল নয়ন। কিন্তু সেই কৌতূহল ধীরে ধীরে পরিণত হতে লাগল তার মায়ের ছোটবেলার গল্প ও ভাবনা জানার রুদ্ধশ্বাস নেশায়। রোজ ঘুমানোর আগে দরজা জানালা বন্ধ করে সে খাতাগুলো নিয়ে বসত। কিছু কিছু বিষয় পড়ে কখনো কখনো একটা অপরাধবোধ যে তার কাজ করেনি তা নয়, কিন্তু কৌতূহলটাও দমাতে পারেনি নয়ন।

ফতেহপুরের সাথে নয়নদের সম্পর্ক নেই মানে যে এই কুড়ি-পঁচিশ বছরে আর একবারের জন্যও কোনো যোগাযোগ হয়নি, তা নয়। কোহিনূর কখনো না। গেলেও নয়ন বা নয়নের বাবা ফখরুল আলমকে নানান কারণে সামান্য সময়ের জন্য হলেও দুয়েকবার ফতেহপুরে যেতে হয়েছে। তাছাড়া তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এবং খবির খাঁর সাথে কোহিনূরের সরাসরি কোনো যোগাযোগ না থাকলেও মা আমোদি বেগম, ছোট চাচা আইয়ুব উদ্দিন খাঁ আর ফতেহপুর থেকে কালেভদ্রে ঢাকায় আসা কিছু মানুষের সাথে মিহি সুতোর মতো প্রায় অদৃশ্য একটা যোগাযোগ মাঝে-মধ্যে ছিল। তবে মোটা দাগে তা সে ওই না থাকার মতোই। এদের কাছেই নানান সময়ে নয়ন ফতেহপুরের নানান গল্প শুনেছে। শুনেছে তার মায়ের গল্পও। তবে একটা জিনিস নয়ন খেয়াল করেছে, সেটি হলো, সেই সকল গল্পে কোহিনূরের শৈশব সম্পর্কে সব সময়ই যেন একটা রাখঢাকের ব্যাপার ছিল।

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে তার মা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত তথ্য পেয়েছে আসমার কাছ থেকে। আসমা দীর্ঘদিন থেকেই তাদের বাড়িতে কাজ করত। নয়নের সাথে একটা ভালো বোঝাঁপড়াও তার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ফলে নয়নকে সে অনেক কথা অবলীলায় বলে দিত। নয়ন যখন রোজ নিয়ম করে আসমাকে পড়াতে বসাত, তখন প্রায়ই রাজ্যের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসত আসমা। বিশেষ করে তার গ্রামের গল্প, বন্ধুদের গল্প, দারিদ্রের গল্প। তবে সেইসব গল্পের সবচেয়ে বড় জায়গা জুড়ে থাকত ভূতপ্রেতের কাহিনি। আসমার এই ভূতপ্রেতের কাহিনি শুনতে গিয়েই প্রথম আব্দুল ফকিরের নাম শুনেছিল নয়ন। মানুষটার নানান অতিপ্রাকৃত শক্তির কথা আসমা তাকে ভয়ার্ত চোখে বলেছিল। যদিও সেসব কথার বেশিরভাগই হেসে উড়িয়ে দিত নয়ন। বিষয়টা আসমাকে ভারি আহত করত। কিন্তু তাতে তার বিশ্বাস এতটুকুও টলত না। এমন এক গল্প বলার মুহূর্তেই আসমা হঠাৎ মুখ ফসকে নয়নকে বলে ফেলেছিল কোহিনূরের কথা।

নয়ন হাসতে হাসতে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে বলছিল, এ ক’দিনে তোকে এত কিছু বোঝানোর, শেখানোর পরও তুই এখনও এইসব বিশ্বাস করিসরে আসমা? আব্দুল ফকির মরা মানুষ বাঁচাই তুলতে পারে?

আসমা বলেছিল, সাপে কাটা মানুষ তার কাছে নিলেই সুস্থ। সে ঢোলবাদ্য বাজাইয়া বিষ নামায়। একবার একজনরে মরা ভাইবা কবরও দিয়া দিছিল। আব্দুল ফইর গিয়া বলল, লাশ উঠান, মুর্দা এহনও কবরের মইধ্যে জিন্দা আছে। শুইনা সবাই তো অবাক। লাশ উঠানো হইল কবর খুঁইড়া। ওরে আল্লাহ! সে সেই লাশ জিন্দা বানাইল। শুধুই কি লাশ? জ্বিন, পরী, ভূত সব বশ করতে জানে সে। আপনে বিশ্বাস যান না?

নয়ন হাসতে হাসতেই বলেছিল, তুই ভূতে বিশ্বাস করিস আসমা? আচ্ছা, জ্বিন ভূতে ধরলে মানুষ তখন কি করে?

আসমা ঠিক তখনই মুখ ফসকে বলে ফেলল সেই কথাটা। সে হঠাৎ বলল, ক্যান? আপনের মায়রে দেহেন না? শোনেন নাই কিছু তার কথা? তার লগেও তো জ্বিন আছে। গ্রামের সবাই তারে ছোটবেলায় ডরাইতো। এহনো মুরুব্বীরা তার কত কেরছা-কাহিনি বলে! রাইত বিরাইতে আমগাছ, জামগাছে উইঠ্যা নাকি সে বইসা থাকত।

আসমার কথা শুনে আচমকা থমকে গিয়েছিল নয়ন। আর মুখ ফসকে কথাটা বলেই ভয়ে একদম চুপসে গিয়েছিল আসমা। সেইদিন তার মুখ থেকে আর কিছুই বের করা গেল না। বরং কান্নাকাটি করে সে নয়নের হাত-পা ধরে মাফও চাইল, যেন নয়ন এইকথা কোনোভাবেই কোহিনূরকে না জানায়। নয়ন জানালও না। এর দিন কয় বাদে আবার সেই প্রসঙ্গ তুলল নয়ন এবং সেদিন নয়নকে অনেক কথাই বলেছিল আসমা। নয়ন সেদিন আর আসমার কথা হেসে উড়িয়ে দিলো না। সে খুব মনোযোগ দিয়েই আসমার সকল কথা শুনল। আসমার কাছে নয়ন যা শুনল, তার বিচ্ছিন্ন এবং অসম্পূর্ণ কিছু কিছু কথা বিভিন্ন সময়ে নয়নও শুনেছিল। আসমার মুখে শুনে সেইসব বিচ্ছন্ন কথাগুলোকেই যেন খানিক জোড়া লাগাল নয়ন।

তার মা কোহিনূরের ভেতর একটা অন্যরকম ব্যাপার যে রয়েছে, তা নয়ন জানে। তবে তার মতে, সেই অন্যরকম ব্যাপারটা কোনোভাবেই অতিপ্রাকৃত কিছু নয়। বরং খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কোহিনূর খুব গম্ভীর এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। সারাক্ষণ একা একা থাকেন। বাইরে বের হন না। কিন্তু এর সাথে অতিপ্রাকৃত কোনো কিছুরই কোনো সম্পর্ক নয়ন খুঁজে পায়নি। একেকজন মানুষের ব্যাক্তিত্বের ধরন একেকরকম। কোহিনূরের এই আচরণও তার স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্ত্বা।

কিন্তু আসমা কোহিনূরকে নিয়ে একের পর এক এমন এমন সব আজগুবি গল্প নয়নকে শুনিয়েছে যে নয়ন মাঝে-মধ্যে বিভ্রান্তও হয়ে গেছে। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট যে, গ্রামের মানুষ এইসব অতিপ্রাকৃত গল্প শুনতে এবং বলতে ভালোবাসে। ফলে অস্বাভাবিকতার আভাসযুক্ত সামান্য কোনো ঘটনারও যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা না খুঁজে বরং সেটিকেই আরো রসালো এবং রহস্যময় করে প্রচার করতে শুরু করে তারা। এ-কান সে-কান হয়ে সেই কথা ছড়িয়ে পড়তেই তাতে আর আসল ঘটনার লেশমাত্র কিছু থাকে না, হয়ে যায় পুরোপুরি লোমহর্ষক কোনো ভৌতিক কল্পকাহিনি। তার মা’র ব্যাপারেও যে এর ব্যতিক্রম। কিছু হয়নি, সে বিষয়ে নয়ন নিশ্চিত।

কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে নয়ন নিশ্চিত নয়, সেটি হচ্ছে তার মা আর তার নানার সম্পর্কের এই সুদীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কারণ। সকলেই জানে, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার দুই পুত্রসন্তানের পর মাঝ বয়সে এক কন্যাসন্তানের পিতা হয়ে যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলেন এবং কোহিনূরকে তিনি অস্বাভাবিক রকম ভালোও বাসতেন। তাহলে তাদের এই দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা বা সম্পর্কহীনতার কারণ কি?

সেই কারণ কী এই খাতাগুলোয় লেখা রয়েছে? খাতার প্রথম দিকে ছোট ছোট লেখা। সে সকল লেখার বেশিরভাগই এত বিচ্ছিন্ন যে কোনো বিশেষ ঘটনা বোঝা সম্ভব নয়। তবে ধীরে ধীরে লেখায় একটা ধারাবাহিকতা চলে এসেছে। অমল বাবু নামের এক শিক্ষকের কথাও রয়েছে ধারাবাহিকভাবে লেখা সেই ঘটনাগুলোতে। আচরণের মতোই কোহিনূরের লেখার মধ্যেও একটা ভাবগম্ভীর ব্যাপার রয়েছে। শুধু তাইই না, লেখার ধরন দেখে নয়নের মাঝে মধ্যে খুবই অবাক লেগেছে! আজ থেকে বহু বছর আগে এক অজপাড়া গাঁয়ের অস্বাভাবিক গম্ভীর এক কিশোরী মেয়ের এই লেখা অবাক করার মতোই ব্যাপার!

প্রথম পৃষ্ঠায় সেই কিশোরী কোহিনূর লিখেছেন, গাছ পছন্দ। পানি পছন্দ। আর যাহা পছন্দ, তাহা হইল অন্ধকার।

তিনি প্রথম দিকে সাধু ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে তা আর থাকেনি।

এরপর তিনি লিখেছেন, আমার কথা বলতে ভালো লাগে না। লেখতে ভালো লাগে।

প্রথম দিককার নানান লেখায় নানান অসঙ্গতি রয়েছে, তবে দ্রুতই কোহিনূরের লেখা ভালো থেকে আরো ভালো হয়েছে। নয়ন বরং অনেক ক্ষেত্রে। বিস্মিত হয়েছে। তার মনে হয়েছে, লেখালেখির বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে তার মা জন্মেছিলেন। কিন্তু তিনি জন্মেছিলেন ভুল জায়গায়, ভুল পরিবেশ-পরিস্থিতিতে।

এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, রাবেয়া চুরি করছে। সবাই দোষ দিলো আনোয়ারার। স্যার আনোয়ারাকে অনেক মেরেছে। আনোয়ারার কানের সময় রাবেয়া তারে চোখ মারছে। রাবেয়ার চোখ কলম দিয়া ফুটা করতে ইচ্ছা হয়।

নয়ন খেয়াল করল কান্দনের লেখার সময় অনেক কাটাকুটি করেছেন কোহিনূর। অর্থাৎ এই শব্দটি লেখার সময় বেশ দ্বিধান্বিত ছিলেন তিনি। তিনি নিশ্চয়ই তখনও শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন না। আবার তিনি সাধারণত যেভাবে কথা বলতেন, লেখার সময় সেভাবে লিখতেও চাইতেন না। কিন্তু পরিপূর্ণ শুদ্ধ। শব্দ জানা না থাকায় প্রায়ই শব্দ ব্যবহারে দ্বিধায় ভুগেছেন তিনি। ফলে এইসব শব্দ লেখার সময় প্রচুর কাটাকুটি করতে হয়েছে তাকে। যেমন কান্না লিখতে গিয়ে তিনি সম্ভবত সঠিক শব্দটি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ফলে একাধিকবার। কাটাকুটি শেষে লিখেছেন কান্দন। তবে এই সমস্যাগুলো খুব দ্রুতই কেটে গিয়েছিল।

এর পরের পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারায় লেখা, একটুর জন্য রাবেয়ার চোখ ফুটা হয় নাই। গাল ফুটা হয়েছে।

এই অংশটা পড়ে নয়ন ভারি অবাক হয়েছে। আগের অংশটা পড়ে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল যে তার ক্লাসের রাবেয়া নামের কেউ চুরি করে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল আনোয়ারা নামের একজনকে। বিষয়টি কোহিনূর দেখেছিলেন। আনোয়ারাকে চুরির দায়ে যখন শাস্তি দেয়া হচ্ছিল, তখন রাবেয়া তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হেসেছিল। কোহিনূর এই পুরো ঘটনা নিজ চোখে দেখে মনে মনে রাবেয়ার চোখ গেলে দিয়ে শাস্তি দেয়ার পণ করেছিলেন। কিন্তু শাস্তি দিতে গিয়ে তিনি চোখের বদলে রাবেয়ার গালে কলম বিদ্ধ করে ফেলেছিলেন। কী ভয়াবহ! এই অংশটা পড়ে নয়ন শিউড়ে উঠেছিল। তার মায়ের বয়স তখন কত হবে? হয়তো ক্লাস সিক্স সেভেনের ছাত্রী তখন তিনি।

এই ঘটনা পড়ে নয়নের আরো একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। নয়ন শুনেছিল, একদম শিশু বয়সে ঠিক এভাবেই খেজুর কাঁটায় খ-বাড়ির এক গৃহপরিচারিকার চোখ গেলে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন কোহিনূর। বিষয়টি নিয়ে নয়ন বেশ কৌতূহলীও হয়ে উঠেছিল। এই নিয়ে আসমার সাথে কথা বলতে গেলে সে এমন সব আজগুবি ব্যাখ্যা দিত যে সেসব শুনে নয়নের নিজেরই মাঝেমাঝে সবকিছু ভারি গোলমেলে লাগত। তবে বিষয়টা বোঝার জন্য শিশু মনস্তত্ব নিয়ে কিঞ্চিৎ পড়াশোনার চেষ্টা করেছিল নয়ন। তাতেও যে খুব একটা লাভ হয়েছিল তা নয়। তবে সহজ কিছু ব্যাখ্যা সে পেয়েছিল। কোনো কোনো শিশুরা ছোটবেলা থেকে একা থাকতে পছন্দ করে। কোনো কোনো শিশুর আচরণ ছোটবেলা থেকেই অস্বাভাবিক রকমের নিষ্ঠুর হয়? এর পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর কিছু উত্তর সে পেয়েছিল।

জনি ই, জনস্টন এর দ্য হিউম্যান ইকুয়েশন নামের বইয়ের একটা আর্টিকেল নয়নকে এই বিষয়ে সহজ কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছিল। সাথে শিশু মনস্তত্বের ওপর আরো কিছু আর্টিকেল ঘেটে নয়ন কিছু ব্যাখ্যাও দাঁড় করিয়েছে। একটি শিশুর ভেতর নৃশংস আচরণ গড়ে ওঠে প্রথমত গৃহপালিত পশুপাখি এবং গৃহপরিচারকদের ওপর নৃশংসতা দিয়ে। তারা বেড়াল, কুকুর, বা মুরগির বাচ্চার পা ভেঙে দেয়, বা এদের দেখলেই ঢিল ছুঁড়ে মারে, গৃহপরিচারকদের সাথে খারাপ আচরণ করে। এই আচরণগুলো তারা বেশিরভাগই পায় বড়দের কাছ থেকে। বিশেষ করে পরিবারের মধ্য থেকে। বড়রা গৃহপরিচারকদের সাথে খারাপ আচরণ করলে তা থেকে শিশু নৃশংসতা শেখে। কোনো পরিবারে বাবা মায়ের মধ্যে যদি মারমুখী সম্পর্ক হয়, তবে তার প্রভাবও শিশুর মধ্যে পড়ে। শুধু তাই-ই নয়, যদি বাবা-মা সন্তানকে শাসন করতে গিয়ে নিয়মিত শারীরিকভাবে আঘাত করেন, তবে সেক্ষেত্রেও শিশু নানা অস্বাভাবিক আচরণ করে।

তাহলে কি তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আর আমোদি বেগমের মধ্যেও এমন কোনো সম্পর্কই ছিল? যা শিশু কোহিনূরের মনস্তত্বে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল? সমস্যা হচ্ছে এটি নয়নের পক্ষে জানা সম্ভব না। আর নয়ন যতদূর জানে, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার একমাত্র কন্যা কোহিনূরকে অসম্ভব ভালোবাসতেন।

.

খাতায় এরপরও এমন অনেক সংক্ষিপ্ত লেখা রয়েছে। যেমন, স্যার যখন মারলেন, তখন অনেক কষ্ট হয়েছে, কিন্তু কাঁদি নাই।

অর্থাৎ রাবেয়াকে আঘাত করার কারণে শিক্ষক কোহিনূরকে শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কাঁদেননি।

এরপর লেখা, সবাই আমাকে ভয় পায়। আমি একলা বসি। কেউ কাছে বসে না।

সম্ভবত রাবেয়াকে ওভাবে আঘাত করার কারণেই ক্লাসের বাকিরা তাকে ভয় পেতে শুরু করে।

এরপর একটা জায়গায় কোহিনূর লিখেছেন যে তিনি দুই লাইনের একখানা কবিতা লিখেছিলেন এবং সেটি অমল বাবু দেখে খুব প্রশংসা করেছেন। অমল বাবু এত সুন্দর করে তার সাথে কথা বলেছেন যে বিষয়টি তার খুব ভালো লেগেছে।

সম্ভবত এর পরপরই অমল বাবুর সাথে তার নিয়মিত কথাবার্তা শুরু হয়। কারণ, এখান থেকেই তার লেখা খুব গোছানো এবং শুদ্ধ হতে শুরু করে। এরপর তিনি লিখেছেন, কেউ আমার সাথে কথা বলে না। আনোয়ারাও না। আমিও বলি না।

এরপরের লেখাগুলো টানা এবং ধারাবাহিক। এখান থেকেই নিয়মিত কবিতা ও ছড়া লেখা রয়েছে। অমল বাবুকে নিয়ে সুদীর্ঘ ভাবনা এই সকল জায়গা জুড়ে। রয়েছে তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে নিয়েও কিছু কথা। তাতে বাবার বিষয়ে কিছু ক্ষোভই প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু কেন? লেখাগুলো বিশদ কিছু নয় বলে নয়ন ঠিক বুঝতে পারল না। মা আমোদি বেগমকে নিয়েও টুকরো টুকরো দুয়েকটি কথা রয়েছে। তবে সেসবে আমোদি বেগমের প্রতি স্পষ্টতই এক ধরনের করুণা প্রকাশ পেয়েছে। এরপর অমল বাবুর মাধ্যমে লেখালেখির মতো তুমুল আগ্ৰহদায়ী একটা বিষয়ের সাথে সে পরিচিত হতে পেরেছে তা প্রকাশ পেয়েছে।

এই অংশটিতে নয়ন তার এতদিনকার পরিচিত মায়ের ভাবনার একটি নতুন দিক আবিষ্কার করেছে। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, মানুষের সাথে কথা বলার চাইতে, এই খাতায় লিখিয়া রাখা ভালো। ভুল বোঝার সুযোগ থাকে না।

এর বিশদ ব্যাখ্যাও রয়েছে। সেই ব্যাখ্যা জুড়ে দীর্ঘ একটা ঘটনা লেখা। ঘটনাটি এরকম, নানাবাড়িতে একরাতে স্বপ্ন দেখে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কোহিনূরের। তিনি স্বপ্নে দেখেছেন বাড়ির পেছনের শুকনো বিলে ধবধবে সাদা কাশফুল ফুটেছে। সেই কাশফুলের মাঝে প্রবল আনন্দ নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তার কানে ভেসে এলো সদ্যোজাত এক শিশুর। চিৎকার। সেই চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরও শিশু কণ্ঠের চিৎকারটি তার কানে লেগে রইল। তিনি বারকয়েক বিষয়টিকে গ্রাহ্য না করে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু সেটি কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। শেষ অবধি তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা ছোটখালাকে ঘুম থেকে ডেকে উঠিয়ে তিনি তাকে বললেন বাড়ির পেছনের কাশবনে যাওয়ার কথা। সদ্য কাঁচা ঘুম ভাঙা ছোট খালার হঠাৎ কী হলো, তিনি হঠাৎ ভয়ে চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে জড়ো করলেন! তারপর ওই ঘটনাটুকুকেই নানান রঙ মাখিয়ে বললেন। শুধু তাই-ই না, তিনি কোহিনূরের সাথে আর ঘুমাতেই রাজি হলেন না। এরপর থেকে রোজ রাতে একা একা ঘুমাতে হতো কোহিনূরকে। এমনই এক একা। রাতে কোহিনূর আবারও সেই একই স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নটি দেখে ঘুম ভেঙে গেলেও আগের মতোই তার কানে বিধে রইল সেই সদ্যোজাত শিশুর কান্না। শেষ অবধি সহ্য করতে না পেরে সেই রাতে দরজার খুলে একা একা একাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি।

বাড়ির পেছনের বিল শুকিয়ে শুকনো হয়ে আছে। সেখানে সাদা কাশফুল ফুটেছে। আবছা অন্ধকারে শুভ্র কাশফুলগুলোকে দেখে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কোহিনূর। তখন শেষ রাত। ফজরের আজানও হয়ে গিয়েছে। তবে কোহিনূরের তা খেয়াল নেই। পাশের বাড়ির বয়স্ক এক লোক ওযু করতে উঠেছিলেন। তিনি বিলের কাশবনের মাঝখানে একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন। তার চিৎকারে চারপাশের লোকজন জেগে উঠল। সকলেই ধারণা করল কোহিনূরের উপর আবারো জ্বিন ভর করেছে। শুরু হলো ভয়াবহ অবস্থা। ওঝা এনে বীভৎস উপায়ে চিকিৎসা শুরু হলো কোহিনূরের। হাত-পা বেঁধে তাকে ফেলে রাখা হলো উঠানে। তার মুখের কাছে ধূপ জ্বালানো হলো। ধূপের ভেতরে পুড়তে দেয়া হলো শুকনো মরিচ। একখানা ঝাড় নিয়ে ক্রমাগত কোহিনূরকে পেটানো হলো। তার চোখ-মুখ-নাক দিয়ে পানি ঝড়ছে। কিন্তু কেউ তা গ্রাহ্য করছে না। ওঝা বিড়বিড় করে টানা মন্ত্র পড়ে যাচ্ছেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে কোহিনূরের অবস্থা মৃতপ্রায়।

তাকে সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার করলেন তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমল বাবু। খবর পেয়ে তিনি ছুটে এসেছিলেন তাকে দেখতে। অমল বাবু কোহিনূরের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে তাকে উঠান থেকে ঘরে নিয়ে গেলেন। অমল বাবুকে জড়িয়ে ধরে সেই প্রথম কোহিনূর কাঁদল। হাউমাউ করে কাঁদল। অমল বাবুর বড় কষ্ট হতে লাগল। কিন্তু এরপরও টানা একমাস কোহিনূরকে আর ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হলো না। সে স্কুলে গেল প্রায় মাসখানেক পরে। কিন্তু এই ঘটনা ততদিনে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। স্কুলে সে হয়ে গেল পুরোপুরি একা। কিন্তু সে যত অন্যদের থেকে একা হতে শুরু করল, ততই কাছাকাছি হতে শুরু করল অমল বাবুর। এ যেন ঠিক পিতা আর কন্যা।

নয়ন স্পষ্টতই বুঝতে পারছিল যে তার মা গ্রামের আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো ছিলেন না। তিনি খানিকটা ভয়ডরহীন, নির্বিকার স্বভাবের ছিলেন। তার ভাবনাটাও ছিল বেশ অন্যরকম। কিন্তু এই সকল ভাবনা তিনি কাউকে বলতে পারতেন না। বলতে গেলেই সকলে তাকে ভয়ের চোখে, সন্দেহের চোখে দেখত। ফলে তিনি ক্রমশই একা হয়ে যেতে থাকলেন। একটা সময় পুরোপুরি কথা বলা বন্ধ করে দিলেন অন্যদের সাথে। আর তখন ক্রমশই তার। কথা, ভাবনা বিনিময়ের জায়গা হয়ে উঠল এই লেখার খাতা। আর তার এই সকল আচরণের নানা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে শুরু করল আশেপাশের মানুষ। এ অবশ্য নতুন কিছু নয়। জগতে যুগে যুগে ভিন্ন আচরণ, ভিন্ন মত, ভিন্ন ভাবনাকে মানুষ সহজে মেনে নিতে পারেনি।

নয়ন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাতার পর পাতা পড়েছে। বারবার পড়েছে। কোহিনূরের ভাবনার জগত্তাকে একটি চমৎকার সৃষ্টিশীলতার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন অমল বাবু। তারা পরস্পরের অনুভূতিকে গভীর সংবেদনশীলতায় স্পর্শ করতে পারছিলেন। কিন্তু বিষয়টি তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মেনে নিতে পারেননি। কন্যাস্নেহে কাতর তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অমল বাবু আর কোহিনূরের সম্পর্কের এই গভীরতায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। যার ফলে তিনি কোহিনূরের। পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, এর কিছুদিন বাদে তিনি তড়িঘড়ি করে তার কন্যাকে বিয়েও দিয়ে দিলেন। কিন্তু বিয়ের আগের দিন গভীর রাতে অমল বাবুর কাছ থেকে একখানা জরুরি বার্তা এসেছিল ফতেহপুরের খাঁ-বাড়িতে। সেই বার্তায় অমল বাবুর গুরুতর দুর্ঘটনার সংবাদ ছিল। ফরিদপুর শহর থেকে ফেরার পথে তিনি মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তখন মৃত্যুশয্যায়। মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো তিনি একবারের জন্য। হলেও তার প্রাণাধিক প্রিয় কন্যাসম কোহিনূরকে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তাতে সাড়া দেননি। বরং অস্বাভাবিক আড়ম্বরহীনতায়, অত্যন্ত সাদামাটাভাবে পরদিন সকালে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর একমাত্র কন্যা কোহিনূরের বিয়ে হয়ে গেল অচেনা অজানা ফখরুল আলমের সঙ্গে।

ফখরুল আলম ফতেহপুরে ফুপুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি তখন কেবল ছোটখাট একখানা সরকারি চাকরিতে জয়েন করেছেন। আচার আচরণে নিরীহ নির্বিবাদী ধরনের মানুষ ফখরুল আলম। তার বাবা মা নেই, তেমন কোনো বংশ মর্যাদাও নেই। তিনি মানুষ হয়েছেন বড় বোনের কাছে। নিজেকে নিয়ে সব সময় সঙ্কোচে ভোগা ফখরুল আলম কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন না। সেই ফখরুল আলমের সঙ্গে একদিনের মধ্যে নিজের কন্যার বিয়ে দিয়ে দিলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। বিয়ের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোহিনূরকে তিনি ফখরুল আলমের সঙ্গে ঢাকা পাঠানোরও ব্যবস্থা করলেন। সাথে পর্যাপ্ত অর্থকড়ি দিয়ে পাঠালেন তার ছোট ভাই আইযুব উদ্দিন খাঁকে। আইয়ুব উদ্দিন খাঁ ঢাকায় এসে দিন দশেক থাকলেন। এই সময়ে তিনি কোহিনূরের থাকার জন্য ভালো বাসা ভাড়া করে দিলেন। সেই বাসার জন্য প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র কিনে দিলেন। তারপর ফখরুল আলমের কাছে প্রচুর পরিমাণে নগদ অর্থ রেখে গেলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ স্পষ্ট করে তাকে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন যে কোহিনূরের যেন কোনো সমস্যা না হয়। কোহিনূরের কোনো সমস্যা হয়নি। তবে ফতেহপুর থেকে কোহিনূরের সেই শেষ বিদায়। বিদায় তার পিতা তৈয়ব উদ্দিন খাঁর চোখের সামনে থেকেও।

হয়তো কোহিনূরের সাথে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর এই সুদীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার একটা ব্যাখ্যা এই ঘটনাতেই রয়েছে। কিন্তু নয়ন জানে, ঘটনার মধ্যে রয়েছে এর চেয়েও আরো বেশি কিছু। ফতেহপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী তৈয়ব উদ্দিন খাঁ একদিনের মধ্যে তার কন্যাকে অমন আড়ম্বরহীনভাবে বিয়ে দিয়ে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন কী কারণে? কী কারণে একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের শেষ ইচ্ছেটা অবধি তিনি পূরণ করলেন না। সেই কারণটিই সে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিল। কিন্তু নয়ন জানে কারণটি তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তাকে কোনোদিন বলবেন না। হয়তো বলবে না আর কেউই।

কিন্তু সেই কারণটি সে জানে। জানে, কারণ তার হাতে রয়েছে এই মলিন মলাটের, ছেঁড়া পাতার, ঝাপসা হয়ে যাওয়া অক্ষরের খাতাখানা।

*

হেমার ধারণা সে এ পর্যন্ত এক লক্ষ বার হাঁচি দিয়েছে। এখন হাঁচি দেয়ার জন্য যে সে কপাল কুঁচকাবে, সেই শক্তিটুকুও তার অবশিষ্ট নেই। সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার পর থেকেই শরীরটা কেমন করছিল! এই মুহূর্তে বাসায় সে একা। কী এক সেমিনারে তার মা রেণু গিয়েছেন চট্টগ্রামে। বলেছেন ফিরতে তিন-চারদিন লাগবে। বাবারও সেদিনের পর থেকে আর কোনো খবর নেই। বাসায় কাজের বুয়াটা ছিল। কিন্তু মা-বাবা কেউ নেই বলে এই সুযোগে আর আসেনি। শরীর খারাপ হলে হেমা কখনোই কাউকে কিছু বলে না। এবারও বলেনি। কিন্তু আজ মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙার পরই তার কেমন অসহায় লাগতে লাগল। জ্বরে গা। পুড়ে যাচ্ছে। সে থার্মোমিটার খুঁজে জ্বর মাপল। কিন্তু কত বুঝতে পারল না। একবার মনে হলো একশ তিন। আরেকবার হলো একশ চার। সে আসলে চোখে ঝাপসা দেখছে। তার মাথা ঘুরাচ্ছে। আচ্ছা, এই সময়ে কী করতে হয়? মাথায় খানিক পানি ঢালতে পারলে বোধহয় জ্বরটা কমত। হেমা বিছানা থেকে নেমে দেয়াল ধরে ধরে বাথরুমেও চলে এলো। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় পানি ঢালল সে। তারপর আবার বিছানায় ফেরত এলো। বিছানার চাদর তুলে তার একপ্রান্ত দিয়ে মাথা মুছে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর মনে হলো খানিকটা ভালো লাগছে। কিছুক্ষণ আগের ভয়াবহ অবস্থাটা যেন আর নেই।

কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে হেমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে হতে লাগল। সে অভিমানী টাইপ মেয়ে না। বরং অনেকটাই কাঠখোট্টা টাইপের মেয়ে। অথচ গত কিছুদিন ধরে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে সে। এটা হেমা টের পাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টাকে পাত্তা দিতে চাচ্ছে না। এই যে এই মুহূর্তে, সেদিন রাতের সেই অভিমানটাই আবার ফিরে আসছে তার। এই যে ভয়াবহ জ্বর নিয়ে সে একা একটা ঘরে আটকে আছে। এটা কি তার বাবা-মা টের পাচ্ছে? সে শুনেছে, সন্তানের অসুস্থতার কথা নকি সবার আগে টের পায় মা। আসলেই কী তার মা টের পাচ্ছে?

হেমার হঠাৎ মনে হলো, তার এই দীর্ঘ জীবনে তার মা কি কখনো তার সাথে আহ্লাদ করে কথা বলেছেন? সে মনে করতে পারল না। আচ্ছা, এমনও কি কখনো হয়? নাকি বাবা তাকে সব সময় আগলে রাখতেন বলে, মা আর তেমন খেয়াল রাখতেন না। আসলে বাবা তার কাছে বাবা-মা দুটোই হয়ে উঠেছিলেন। আর সে নিজে থেকেও হয়তো মাকে সেই জায়গাটাই কখনো দেয়নি। কে জানে! কিন্তু আজ এই যে একা একা একটা ঘরে এমন ভয়াবহ জ্বরে প্রায় মারা যাচ্ছে সে, তার মা কি তা টের পাচ্ছে! মনে হয় না। মা তো তাকে কখনো চায়নি। সে মার কাছে কখনোই প্রত্যাশিত কেউ ছিলই না। বাবার কাছেও কি ছিল? নাকি কেবল একটা সম্পর্ক জোড়া লাগানোর উদ্দেশ্যেই তাকে তার মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জন্ম দেয়া হয়েছিল!

হেমার গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইছে। কান্না? হেমা কাঁদতে চায় না। একটুও কাঁদতে চায় না। সে এই ঘরে একা মরে পড়ে থাকলেও কাঁদতে চায় না। শীতে গা কাঁপছে। একটা মোটা কাঁথা হলে ভালো হতো। কিন্তু আলমারি অবধি যেতে ইচ্ছে করছে না। হেমা টের পেল, অসুস্থতার চেয়ে এখানেও একটা সূক্ষ্ম অভিমানবোধ কাজ করছে। সে সুস্থ হবার জন্য কিছুই করবে না। বরং যতটা সম্ভব আরো অসুস্থই হয়ে যাবে। প্রয়োজনে মরেই যাবে। পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষের একটা প্রয়োজন থাকে। কিন্তু এই জগতে তার কি কোনো প্রয়োজন আছে? না মায়ের কাছে, না বাবার কাছে, না নয়নের কাছে!

নয়নের কথা মনে পড়তেই হেমার বুকের ভেতরটা আবার কেমন করে উঠল! এই এত এত দিন! নয়নের কি মুহূর্তের জন্যও তার কথা মনে পড়ছে না! এক মুহূর্তের জন্যও না? আচ্ছা, ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মানুষকে কী করতে হয়? কী করে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের কাছে অপরিহার্য হয়ে ওঠে? কী হলে কেউ কাউকে বলে, তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারি না। আমার কষ্ট হয়। গলা শুকিয়ে যায়। কখন? হেমা জানে না। নয়ন কখনোই তাকে এমন কিছু বলেনি। আচ্ছা, সে কি কখনো শুনতে চেয়েছে? হেমা মনে করতে পারল না।

অসুস্থ হলে মানুষ শারীরিকভাবে যেমন দুর্বল হয়ে যায়, তেমনি দুর্বল হয়ে যায় মানসিকভাবেও। এ সময় সে নানান এলোমেলো বিষয় ভাবে। সেও কি এই দুর্বলতার জন্যই এইসব ভাবছে! আগে কখনোই তো সে এমন কিছু ভাবেনি। নাকি তার অবচেতন মন জুড়ে এই তেষ্টাগুলো সব সময়ই ছিল। কিন্তু বাইরে বাইরে সে নিজেকে সব সময়ই অন্য একটা সাদা মানুষ হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। শক্ত, কঠিন, নিরাবেগ একজন মানুষ। যার মায়ের কাছে, বাবার কাছে, প্রেমিকের কাছে, বন্ধুর কাছে, কারো ক ছই কোনো কিছু চাওয়ার নেই, কোনো অভিযোগ নেই, অভিমান নেই। সকল কিছুতেই সে স্বাভাবিক। কিছুতেই কিছু যায় আসে না তার।

আচ্ছা, সে কি মাকে একটা ফোন দিয়ে দেখবে! মার ফোন নিশ্চয়ই ভোলা এখন? কিন্তু এতরাতে ফোন দিয়ে মাকে কী বলবে সে? সে যদি বলে যে তার জ্বর, আর তারপর মা যদি গম্ভীর গলায় বলেন, এত রাতে ফোন দেয়ার মতো তো কিছু হয়নি। দুটো প্যারাসিটামল খেয়ে ঘুমিয়ে থাকো।

মা কি এমন কিছু বলবেন? নাকি বলবেন, আমাকে ফোন দিয়েছ কেন? ডাক্তারকে ফোন দাও। আর তোমার বাবা কই? তাকে কল করো।

ছি! এসব সে কি ভাবছে! মা নিশ্চয়ই এমন কিছুই বলবেন না। কিন্তু কী বলবেন? হেমা তাও জানে না। এর আগে কখনো সে তার কোনো অসুস্থতার কথা মাকে বলেছে বলে তার মনে পড়ে না। বাবাকে ফোন দিয়েও লাভ নেই। বাবার ফোন সেই থেকে বন্ধ। আচ্ছা সে কি নয়নকে একটা ফোন করে দেখবে? কিন্তু লাভ কী? নয়ন তো সেই ফতেহপুর থেকে এখনো ফেরেইনি। সেখানে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই, নেটওয়ার্ক নেই। এক আদিম বিচ্ছিন্ন দ্বীপ যেন। হেমা তারপরও ফোনটা হাতে নিলো। নয়নের নাম্বারটা বের করল। নয়নের বহু আগের একটা ছবি ভেসে উঠেছে তার নম্বরের পাশে। ছবিটার দিকে হেমা। একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইল। বুকের ভেতরটা কেমন করছে তার। এই তিনটে মানুষ। তিনটে মাত্র মানুষ নিয়েই তার পৃথিবী। অথচ তাদের কারো পৃথিবীতেই তার কোনো অস্তিত্ব নেই। অন্তত সে তা খুঁজে পায় না।

হেমা নয়নকে ফোন দেয়নি। কিন্তু কেমন কেমন করে যেন নয়নের নম্বরে ফোন চলে গেল এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে প্রথমবার রিং হতেই নয়ন ফোনটা ধরল। হেমা এত অবাক হয়েছে যে সে হাত থেকে ফোনটা কান অবধি নিতে ভুলে গেল! নয়নের গলা কানে আসছে তার। নয়ন স্বাভাবিকভাবেই হ্যালো হ্যালো বলছে। হেমা বুঝতে পারছে না সে কী করবে! এতটা অবাক সে কখনোই হয়নি। কিন্তু সে কী নয়নের গলা শুনে খুশি হয়েছে? হেমার মনে হলো, সে খুশি হয়নি। বরং তার সেই অভিমানটা আবারো ফিরে আসছে। তার প্রচণ্ড অভিমান হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে। নয়ন ঢাকায়? অথচ তাকে একটা ফোন অবধি দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি? হেমার মনে হলো সে ফোনটা কেটে দিয়ে বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সেটা আরো ছেলেমানুষি হয়ে যাবে। এমন কিছু সে কখনোই করেনি। নিজের অনুভূতিগুলো চেপে রাখতে সে জানে। সে চায়, তার প্রিয় মানুষগুলো তাকে বুঝুক। তার অভিমান, তার কষ্ট, তার ব্যথার জায়গাটা বুঝে আলতো করে গভীর ভালোবাসায় স্পর্শ করুক।

সে ফোনটা কানে নিলো এবং যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল, হ্যালো।

নয়ন বলল, কখন থেকে হ্যালো হ্যালো বলছি, তুমি কথাই বলছ না।

হেমা সত্যি কথাটাই বলল, আসলে চাপ লেগে ফোনটা চলে গেছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি।

নয়ন বলল, কেমন আছ তুমি?

হেমা বলল, হ্যাঁ ভালো। তুমি?

নয়ন বলল, ভালোই।

এ ক’দিনেই কেমন দূরের মানুষের মতো কথা বলছে তারা। হেমা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। তারপর বলল, যখন কেউ ভালোর সাথেই যোগ করে ভালোই বলে, তখন তার মানে হচ্ছে সে ভালো নেই।

নয়ন মৃদু হাসল। তারপর বলল, তুমি তো দিন দিন তাত্ত্বিক হয়ে যাচ্ছ।

হেমা বলল, ভুল কিছু বললাম?

নয়ন বলল, না। তবে তুমি তো জানোই, আমি ভালো নেই।

হেমা বলল, কীভাবে জানব?

নয়ন বলল, আমাকে দেখলেই তো তুমি সব বুঝে যাও।

হেমা বলল, তোমাকে আমি দেখি কই? দেখার সুযোগ কি আছে?

নয়ন কথা বলল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কেবল। হেমার শরীরটা আবার খারাপ লাগছে। অবশ্য সে কোনোভাবেই নয়নকে বুঝতে দিতে চায় না তার শরীর খারাপ। কিন্তু নয়ন কি তার গলা শুনে একবারের জন্যও বুঝতে পারছে না যে তার শরীর খারাপ? তার কথা শুনেও না?

হেমা বলল, কবে ফিরলে?

নয়ন স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল, ক’দিন? তিন… চার…। উমমম… পাঁচদিনও হতে পারে। ঠিক মনে নেই।

হেমার গলার ভেতরের সেই দলা পাকানো জিনিসটা আবার ফিরে আসছে। তার খুব ইচ্ছে করছে সে নয়নকে বলে যে নয়ন তুমি পাঁচদিন হয়ে গেছে ঢাকায় এসেছ, অথচ আমাকে একটু জানাতে ইচ্ছে হয়নি? একটু কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি? দেখা করতে ইচ্ছে হয়নি? এই যে এতক্ষণ ধরে আমি তোমার সাথে কথা বলছি, তুমি কী একবারও টের পাওনি যে আমি ঠিক নেই? আমি সুস্থ নেই? একবারও টের পাওনি? হেমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে এসবের কিছুই জিজ্ঞেস করল না। সে কেবল বলল, এখন কি করবে?

নয়ন বলল, জানি না।

হেমা কী বলবে আর? সে আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। নয়নও না। দুজনই ফোন কানে চেপে ধরে চুপ করে বসে রইল। দীর্ঘ সময় পরে নয়ন কথা বলল। সে বলল, অনেক রাত হয়েছে এখন ঘুমাও, হ্যাঁ?

হেমা সাথে সাথে জবাব দিলো না। খানিক চুপ করে রইল। তারপর বলল, আচ্ছা।

*

নয়ন ফোন কেটে দিলো। হেমা তারপরও দীর্ঘ সময় ফোন কানে চেপে ধরে বসে রইল। সেই কেটে দেয়া ফোনের ভেতর কী এক অবিশ্বাস্য নৈঃশব্দ্য! কী এক অদ্ভুত শূন্যতা। তা হেমা ছাড়া এই জগতে আর কেউ বুঝবে না। কেউ না। সেই নৈঃশব্দ্য, সেই শূন্যতা ক্রমশই ফোনের ভেতর থেকে হেমার বুকের ভেতর ছড়িয়ে যেতে থাকল। হেমার কান্না পাচ্ছে। প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। গলার কাছে দলা পাকানো ব্যথার মতো কষ্টটা জমাট হয়ে আছে। কী যে কষ্ট হচ্ছে! কী যে কষ্ট! সে যদি খানিক চিৎকার করে, হাউমাউ করে কাঁদতে পারত, তাহলে হয়তো ওই জমাট বাধা কষ্টটুকু গলে গলে ঝরে যেত। কিন্তু সে কাঁদল না।

কীভাবে কাঁদবে সে? কান্নার জন্যও কাউকে দরকার হয় মানুষের। কারো বুকে মাথা রেখে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদবার জন্য হলেও কাউকে দরকার হয়। কিন্তু এই জগতে কারো বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবার মতো কি কেউ আছে হেমার? কাউকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদবার মতো কি কেউ আছে তার? নেই।

হেমা হঠাৎ হড়বড় করে বমি করল। প্রথম দমক শেষ হবার আগেই সে আবারো বিছানা ভাসাল। তারপর আবার। বমিতে ভেসে গেল তার শরীর, বিছানা, মেঝে। সে বার দুই সেই বমির ভেতর থেকে সরে আসার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। বরং কাত হয়ে শুয়ে থাকা হেমা বমিতে ভেসে যাওয়া বিছানায় লুটিয়ে পড়ল। সে জ্ঞান হারাল তার আরো কিছুক্ষণ পর।

.

হেমার জ্ঞান ফিরল পরদিন ভোরে। সে শুয়ে আছে কোমল কোনো বিছানায়। অদ্ভুত মায়াময় এক সুবাসে তার সারা শরীর ছেয়ে আছে। তার চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে এমন অদ্ভুত অনুভূতিতে সময় কেটে যাক। সে চোখ মেলে তাকাল। তার চোখের সামনে রেণুর মুখ! হেমা ঝট করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর আবার তাকাল। রেণু তাকিয়ে আছেন তার দিকে। হেমা বলল, মা।

রেণু হঠাৎ দু’হাতে হেমার গাল চেপে ধরলেন। তারপর আবার পরক্ষণেই সচকিত হয়ে উঠলেন। হাত দু’খানা সরিয়ে নিয়ে স্বভাবসূলভ গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার ফোনে টাকা ছিল না?

হেমা জবাব দিলো না। সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। রেণু কঠিন গলায় বললেন, তোমার এই ফোনটা বদলে ফেলোে। একটা পোস্টপেইড সিম কিনে নিও। আর আমি বুয়াকে বলে গেছিলাম রাতেও বাসায় থাকতে। কিন্তু সে যে আর আসেনি সেটি আমাকে জানাবে না?

হেমা জবাব দিলো না। তার মাথাটা রেণুর কোলে। রেণু আস্তে করে মাথাটা নামিয়ে রাখলেন। তার কাছে বাসায় ঢোকার চাবি ছিল। কিন্তু মা এমন দুম করে চলে এলো কেন? হেমা ভেবে পেল না। তার তো আরও পরে আসার কথা ছিল। রেণু বললেন, এই জ্বরে কিছু হয় না। এখন ওঠো। উঠে হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নাও। বলেই রেণু উঠে চলে গেলেন।

হেমার আবারো মন খারাপ হয়ে গেল। সে জানে, তার শরীর কতটা খারাপ। মারও না বোঝার কথা না। অন্তত এই সময়টায় মা একটু ভালো করে কথা বলতে পারত। হেমার খুব ইচ্ছে করছিল, মাকে বলে যে মা আমি আর কিছুক্ষণ তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকি? তুমি একটু আমার মাথায় বিলি কেটে দেবে মা? আমার চুলে একটু হাত বুলিয়ে দেবে?

কিন্তু সে সেসবের কিছুই বলল না। সে শুয়ে আছে মা’র বিছানায়। মা একা কীভাবে ওই ঘর থেকে তাকে নিয়ে এসেছে ভেবে পেল না হেমা। সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করল। প্রথম দু’বার পারল না। মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল। কিন্তু সে উঠবেই। নিজের ঘরে গিয়ে বরং শুয়ে থাকবে। হেমা তৃতীয়বারের চেষ্টায় উঠল। বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে। এলো। কিন্তু নিজের বিছানার কাছে এসে দেখল খাট থেকে সব কিছু নামিয়ে ফেলা হয়েছে। কোনো বিছানা নেই খাটে। নোংরা হয়েছিল বলেই বোধহয় রেণু পরিষ্কার করতে নিয়ে গেছেন। কিন্তু দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। মা আর বাবা বহুদিন থেকেই আলাদা ঘরে ঘুমায়। বাবার ঘরটা মার ঘরের পাশেই। হেমা ভাবল সেখানে গিয়ে খানিক শোবে। সে ধীর পায়ে দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরের দরজা ভেজানো। ধাক্কা দিয়ে খুলতে গিয়ে হেমা থমকে দাঁড়াল। ভেতর থেকে কারো মিহি স্বরে কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সে কিছু সময় স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আলতো হাতে দরজাটা খুলল। এখন সকাল দশটা। চারদিকে চড়চড়িয়ে রোদ উঠে গেছে। কিন্তু ঘরের মেঝেতে একখানা জায়নামাজ বিছানো। সেই জায়নামাজের মাঝখানে রেণু বসে আছেন। তার দুই হাত মোনাজাতের ভঙ্গিতে ধরা। তিনি কাঁদছেন। তার সেই প্রার্থনার পুরোটা জুড়েই ছিল হেমা! কান্নার দমকে দমকে রেণুর শরীর কাঁপছে। হেমা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মায়ের কান্না শুনল। সে হঠাৎ আবিষ্কার করল তার চোখ বেয়েও পানি নামছে। সে এই পানি তার মাকে দেখাতে চায় না। তার মাও হয়তো তাকে তার চোখের পানি দেখাতে চান না। দরকার কি?

জগতে যা না দেখেও দেখা হয়ে যায়, যা না শুনেও শোনা হয়ে যায়, যা না ধরেও স্পর্শ করা যায়, তার চেয়ে গভীর, তার চেয়ে তীব্র, তার চেয়ে শ্বাশত আর কী আছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *