৩. তারুণ্যের প্রজ্বলিত মন
তারুণ্যের শক্তি সুনির্দিষ্টভাবে একটা পরিবর্তন আনবে
.
আজ আমি শেয়ার করতে চাই কীভাবে তরুণদের মন চালিত হলে সমাজ, দেশ ও পৃথিবীর সমৃদ্ধি ঘটবে। আমার কথায় তারুণ্যের মনমানসিকতা প্রজ্বলিত করা ও বড়োসড়ো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার বিষয় উঠে আসবে।
২০০৭ এর এপ্রিলে গ্রিস সফরের মনোরম অভিজ্ঞতা আমি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। আমি এথেন্সের অ্যাক্রোপোলিস পর্বতের শিখরে উঠার জন্য যোগাযোগ করেছিলাম। যাওয়ার পথে ১৫০ জন ছাত্রের একটা দলের দেখা পাই। তারা বন্ধুভাবাপন্ন ছিল। তাদের সঙ্গে শিক্ষকরা ছিলেন। তাঁরা এগিয়ে এসে ছাত্রদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁরা বললেন যে, ভারতের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে তাঁরা খুবই খুশি। ছেলে-মেয়েরা আমার কাছ থেকে কিছু কথা শুনতে চাইল। সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়ল পৃথিবীকে অনেক কিছু দান করা গ্রিসের মহান ব্যক্তিদের মধ্যে সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টোটলের কথা। আমার যুবক বয়সে ছাত্রাবস্থায় প্লেটোর বাণীগুলো আমার মনে ঝঙ্কার তুলত। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য এমন এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যেখানে শুধু একটি মাত্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সুখ থাকবে না বরং সর্বোত্তম সুখশান্তি থাকবে সবার মধ্যে।’ এটা বলা হয়েছিল ২৪০০ বছর আগে। অনুরূপভাবে, কাছাকাছি সময়ে তামিল কবি সেন্ট থিরুভাল্লুভার বলেন, একটি জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে রোগব্যাধি মুক্ত হওয়া, উচ্চ আয় উপার্জন করার যোগ্যতা, উচ্চ উৎপাদনশীলতা, সৌহার্দ্যপূর্ণ বসবাস এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা। প্রত্যেক দেশের নাগরিকেরা কীভাবে এই সমস্ত উপাদানগুলো অর্জন করতে পারে? এ সব চিন্তাভাবনা থেকে আমার মনে হয়েছিল, গ্রীসের ছাত্রছাত্রী ও তরুণদের কাছে কী বলতে হবে। আমি ধীরে ধীরে বারবার লাইনের পর লাইন আবৃত্তি করলাম। এই স্তোত্রটা আমি প্রথম এক ভারতীয় আধ্যাত্মিক কেন্দ্রে শুনেছিলাম।
ন্যায়নিষ্ঠা
হৃদয়ে যখন ন্যায়নিষ্ঠা থাকে
চরিত্রে তখন সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটে।
চরিত্রে যখন সৌন্দর্য থাকে
গৃহে তখন ঐক্যতান সৃষ্টি হয়।
গৃহে যখন ঐক্যতান থাকে
দেশে তখন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়
জাতি যখন শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে
পৃথিবীতে তখন শান্তি সুসংহত হয়।
শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীরাই আমার সঙ্গে বারবার আবৃত্তি করছিল না, ওই সময়ে অ্যাক্রোপোলিসের চারপাশে যে সমস্ত ট্যুরিস্টরা উপস্থিত ছিল তারাও আমার সঙ্গে আবৃত্তি করতে লাগল। আমি উপলব্ধি করলাম, বহুদেশের লোকজন ন্যায়নিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত হয়েছে। ন্যায়নিষ্ঠা প্রত্যেক ব্যক্তি, পরিবার, দেশ ও পৃথিবীতে সুখ সমৃদ্ধির জন্য কতটা প্রয়োজন।
পৃথিবীতে তরুণদের মনমানসিকতাকে প্রজ্বলিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি তারুণ্যের শক্তিতে বলিয়ান। যদি সঠিকভাবে এই শক্তিকে প্রজ্বলিত করা যায়, তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মানবতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। আর তা করতে পারলে সমৃদ্ধি ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবেই।
আসুন আমরা পৃথিবীতে যে দুটো প্রধান সমস্যা নিয়ত আমাদের মোকাবিলা করতে হয় তা নিয়ে আলোচনা করি। একটি হচ্ছে ৭ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করছে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫০ ভাগই নিরাপদ পানি পায় না। বহু সংখ্যক ছেলে-মেয়ে মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। পৃথিবীর তরুণেরা এই সব সমস্যার সমাধান করার জন্য কী অবদান রাখছে? যদি প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষ কমপক্ষে অন্তত পাঁচজনকে স্বাক্ষরতা দান করে তবে পৃথিবী থেকে নিরক্ষরতা দূর হয়ে যাবে। তরুণেরা কি নিরাপদ পানি পান করার বার্তা পৌঁছে দিতে পারে? তরুণেরা কি ‘আউট অব বক্স সলুসনস’ প্রয়োগ করে পানির দুষ্প্রাপ্যতা রোধ করতে পারে?
আমি ‘লিড ইন্ডিয়া ২০২০’ নামে তরুণদের একটি আন্দোলনের প্রস্তাব করেছি। আমি তরুণ ছাত্রছাত্রীদের বলেছি, এই মিশনের ভিত্তি হবে দশ দফা শপথ, যা আমি বিশেষভাবে ডিজাইন করেছি। তরুণদেরকে শপথ করতে হবে এই বলে যে, তারা সাক্ষরতা, পরিবেশ, সামাজিক ন্যায় বিচার, শহর ও গ্রামের পার্থক্য, ও দেশের উন্নয়নের জন্য তারা প্রত্যেকেই লক্ষ্যে পৌছানোর উদ্দেশ্যে কাজ করবে। আমি তাদেরকে জোর দিয়ে বলি জীবনের যৎসামান্য লক্ষ্য থাকাটা একটা অপরাধ। তারুণ্যের উন্নয়নের জন্য থাকতে হবে বহুমাত্রিক দিকদর্শন। তরুণদের অবশ্যই কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করে কর্মজীবনের লক্ষ্যে পৌঁছে, পরিবার, সমাজ ও জাতিকে উন্নত করতে হবে। নারী পুরুষকে পুরোপুরিভাবে মানবিকতাবোধ সম্পন্ন হতে হবে। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের থাকতে হবে প্রশংসাসূচক অভিব্যক্তি। যখন আমি ভালো কাজের কথা আলোচনা করছিলাম, তখন আমি মহাত্মা গান্ধীকে তাঁর মা যে উপদেশ দিয়েছিল সে কথা বললাম। মহাত্মা গান্ধীকে তাঁর মা বলেছিলেন, ‘বাছা, যদি তুমি সারাজীবন কারো জীবনকে সুখময় করার জন্য ব্যয় করতে পার, তবে তোমার জন্মটা হবে মানবিক এবং তাহলেই তোমার জীবন হবে সফল।’ এই উপদেশ গান্ধীজীর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। তাই তিনি সারাজীবন মানবিকতার জন্য কাজ করে গেছেন।
আত্মনির্ভরতা সম্বন্ধে আর একটা উদাহরণ তুলে ধরতে চাই। ২০০৩ সালের প্রাক্কালে আমি অরুণাচল প্রদেশ সফর করছিলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত তাওয়াঙ-এ একটি বৌদ্ধমঠও সেখানে পরিদর্শন করি। প্রায় সারাদিনই আমি মঠটিতে ছিলাম। মঠের ধারে কাছের গ্রামগুলোতেও গিয়েছিলাম। প্রচণ্ড শীত সত্ত্বেও গ্রামগুলোর তরুণ এবং বৃদ্ধদের মনে আমি সুখের সন্ধান পেয়েছিলাম। ৪০০ বছরের পুরনো তাওয়াঙ মঠে বিভিন্ন বয়সী সন্ন্যাসীদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। আমি তাদের মনে প্রশান্তি প্রত্যক্ষ করে মুগ্ধ হই। আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, তাওয়াঙ ও তার চারদিকের গ্রামগুলো কেন এত চমৎকার? গ্রামগুলোর মানুষজন ও সন্ন্যাসীরা কত শান্তিতে বসবাস করছে, নিজেরা পারস্পরিক সৌহার্দ্য স্থাপন করে। আমি প্রধান ভিক্ষুকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি। তিনি হেসে বললেন, ‘আপনি ভারতের রাষ্ট্রপতি, আপনি আমাদের কথা ও পুরো দেশের কথা জানেন।’
আমি তখন তাকে আবার বলি, ‘বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গ্রামবাসীদের মেলবন্ধন সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া আমার প্রয়োজন। অনুগ্রহ করে এ বিষয়ে আপনি আপনার চিন্তাপ্রসূত বিশ্লেষণ আমাকে জানান।’
মঠটিতে মহামতি বুদ্ধের সোনালি রঙের সুন্দর মূর্তি রয়েছে। প্রধান সন্ন্যাসী বিভিন্ন বয়সের প্রায় এক শত ভিক্ষুর সমাবেশ করালেন। আমি তাদের মাঝে বসলাম। সেখানে প্রধান ভিক্ষু একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। তাঁর সেই বক্তব্যের কিছু কথা আমি এখানে প্রকাশ করতে ইচ্ছা করছি। তিনি বললেন, ‘আজকের দিনে পৃথিবীতে আমরা অবিশ্বাস এবং অসুখী সমস্যার মাঝে বসবাস করছি, যা এক সময় সন্ত্রাসের রূপ নিচ্ছে। এই মঠের আমরা সবাই কিন্তু বিশ্বাস করি, মন থেকে “আমি ও আমাকে” কথা দুটো বাদ দিতে পারলেই আপনি অহংভাব ত্যাগ করতে পারবেন। যদি আপনি অহংভাব ত্যাগ করতে পারেন, তবে আপনার মন থেকে আপনার সঙ্গীর প্রতি বিদ্বেষ দূর হয়ে যাবে। যদি মন থেকে ঘৃণা বিদ্বেষ দূর হয়ে যায়, তবে আপনি সন্ত্রাস করার ভাবনা ও সন্ত্রাসী কাজ করা থেকে বিরত হবেন। যদি আমাদের মন থেকে সন্ত্রাসী মনোভাব দূর হয়ে যায়, তবে মানুষের মনে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি হবে।’ আমি উপলব্ধি করলাম শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য এই সুন্দর সমীকরণের অর্থ। একজন ব্যক্তির পক্ষে “আমি” এবং “আমাকে” এই অহংবোধ দূর করা কঠিন। এ জন্য তরুণ বয়স থেকে আমাদের শিক্ষা ও মূল্যবোধ অর্জন করা প্রয়োজন। শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজের অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি আর একটা উত্তর খুঁজে পেয়েছিলাম।
আমি বুলগেরিয়া সফরে গিয়ে একটা প্রাচীন গির্জা পরিদর্শন করেছিলাম। সেখানে আমি বিশেষ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন খৃষ্টসন্তদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করি। আমি তাদের কাছে তাওয়াঙ মঠের অভিজ্ঞতার কথা বললাম। খৃষ্টসন্তরা আমার সঙ্গে একমত পোষণ করে বললেন যে, ক্ষমা হচ্ছে একটা উত্তম জীবনের ভিত্তি।
অনুরূপভাবে, আমি ভারতের তরুণ সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের জন্মস্থানে গিয়ে অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা লাভ করি। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ভাষণে প্রাচ্যপ্রতীচ্য সমাজের শ্রোতৃমণ্ডলীকে মন্ত্রমুগ্ধ করেন জীবনের আধ্যাত্বিকতা ও ব্যবহারিক জ্ঞান দান করে। আমি তাওয়াঙ মঠের অভিজ্ঞতার কথা তাঁদেরকে বলি। তাঁরা আমার সঙ্গে একমত হন। তাঁরা আমাকে বলেন যে, একটা ভালো অভ্যাস উন্নয়নের ইচ্ছা শান্তি ও সুখের দিকে ধাবিত হয়।
আমি আজমীর শরিফ পরিদর্শন কালে শুক্রবারের নামাজে অংশ গ্রহণ করি। সেখানে সুফী সাধকরা আমাকে বলেন যে, এক দিকে সর্বশক্তিমানের সৃষ্টি মানুষ, অন্যদিকে আর একটা শক্তিশালী সৃষ্টি শয়তান। শুধুমাত্র ভালো কাজ উত্তম চিন্তাভাবনায় চালিত হয়, উত্তম চিন্তাভাবনা সর্বশক্তিমানের ভালোবাসায় উদ্ভাসিত আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদদের বার্তা হচ্ছে যে, অনেক অনেক ধ্যান আর আধ্যাত্মিক চিন্তাচেতনা, যা ধর্ম, ভৌগোলিকতা ও সময়কে অতিক্রম করে। যদি আমরা ধর্ম ও জাতির মধ্যে আধ্যাত্মিক সেতুবন্ধন রচনা করতে পারি, তবে অনেক সমস্যা যেমন, গরিব ও ধনীদের ব্যবধান দূর করতে পারব। আমি নিশ্চিত, বিশ্বায়িত তারুণ্য নিরাপদ বিশ্ব গড়তে বিশেষভাবে কাজ করে।
২০১১ এর ২৮ সেপ্টেম্বর হার্ভার্ড ও এমআইটি থেকে আসা একটা সম্মিলিত দলের সামনে ‘লিডারশিপ, ইয়ুথ অ্যান্ড গ্লোবাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিষয়ে বক্তব্য রেখেছিলাম। ইউএসএ ও বিভিন্ন মহাদেশ থেকে আসা ৫০০ ছাত্রছাত্রী আমার বক্তব্য শুনতে অংশ গ্রহণ করে। আমার বক্তব্যের পর ছাত্রছাত্রীরা নয়টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নয় সেট প্রশ্নমালা তৈরি করে। নয় সেট প্রশ্নের মধ্যে তিন সেট প্রশ্ন আসে ইউএসএ টিমের কাছ থেকে। ইউএসএ টিম আমাকে প্রশ্ন করে, আপনি কেন ভারতে মিসাইল এবং অ্যাটোমবোম তৈরি করেছেন? যেখানে আপনার দেশের সব জনগণের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলোর অভাব রয়েছে? তাদের প্রশ্নের জবাবে আমি বলেছিলাম, যদি আপনারা স্টাডি করে দেখেন, তবে দেখবেন ৫,০০০ বছরের ভারতের ইতিহাসে ভারত মাত্র ৬০০ বছর ভারতীয়দের দ্বারা শাসিত হয়েছে। বাকি সময়টা আমরা আক্রান্ত হয়েছি বিভিন্ন দেশ থেকে
আসা বহু রাজ্যের শাসকদের দ্বারা। তারা আমাদের দেশ দখল করে শাসন করেছে। সর্বশেষে ব্রিটিশদের দ্বারা ভারত ৩০০ বছরের বেশি শাসিত হয়েছে। আমরা নব্বই বছরের সংগ্রামের ফলে স্বাধীনতা লাভ করেছি। সুতরাং ইতিহাস আমাদেরকে এই শিক্ষাদান করে যে, আমাদেরকে ন্যূনতম শক্তি অর্জন করতে হবে। পর্যাপ্ত সামরিক সরঞ্জামাদির অধিকারী হয়ে, ভারতের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করে, আমাদের দেশকে সমৃদ্ধি ও শান্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমরা দেখতে পেলাম, আমাদের দেশের চারদিকের দেশগুলো বিপুল পরিমাণের নিউক্লিয়ার অস্ত্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। শুধুমাত্র ন্যূনতম শক্তি অর্জন করা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। অনুরূপ ভূরাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত দেশের জন্য এই নীতি প্রযোজ্য। যাইহোক, আমরা ‘প্রথমে ব্যবহার নয়’ এই নীতিতে বিশ্বাসী। ভারত কিন্তু তার জিডিপি-এর ৩ শতাংশের কম প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে। ভারত অবশ্যই তার কষ্টার্জিত সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বদ্ধপরিকর। শক্তি প্রদর্শনের জন্য এই অঞ্চলের অনেক দেশই বদ্ধপরিকর, এটা কিন্তু সত্য।
পরবর্তী প্রশ্ন আসে এশিয়ান টিমের কাছ থেকে। পাকিস্তান থেকে আসা একজন ছাত্রীর নেতৃত্বে এই টিমটি গঠিত ছিল। ছাত্রীটি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ড. কালাম আপনি কি আমাকে বলবেন, বর্তমান বা ভবিষ্যতের যে-কোনো সময়ে ভারত ও পাকিস্তান তাদের নাগরিকদের সমৃদ্ধি ও শান্তির জন্য একত্রে কাজ করতে পারবে?’ এই প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, ‘মোটের উপর আমরা উভয় দেশ একই অবকাঠামোতে আছি। আমরা দেখেছি, ইউরোপীয়ান দেশগুলো শত শত বছর ধরে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করেছে। তারাই দুটো বিশ্বযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সমৃদ্ধি ও শান্তির জন্য ইউরোপের ২৭টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত ৮০০ সদস্যের একটি পার্লামেন্ট বর্তমানে কাজ করে চলেছে। আমি নিশ্চিত, কয়েক দশকের মধ্যে এশিয়াতে একদিন পুনরায় এই ধারা বহাল হবে। সে সময় ভারত ও পাকিস্তান এক যোগে সমৃদ্ধি ও শান্তির জন্য কাজ করবে। এমনকি এশিয়াতে SARRC রাষ্ট্রগুলো একদিন EU এর মতো সংস্থায় রূপান্তরিত হবে।
তৃতীয় প্রশ্ন আসে MIT এর একজন ছাত্রের কাছ থেকে। ‘ড. কালাম, আমাকে অনুগ্রহ করে বলুন, পরবর্তী বিশ বছরে প্রযুক্তির কী ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে আপনি আশা করেন। আমি স্বীকার করলাম যে, এটা খুব ভালো একটা প্রশ্ন।’ আমি বললাম, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধিত হবে। বায়ো-সায়েন্স, ন্যানো-সায়েন্স, তথ্য প্রযুক্তি এবং পরিবেশগত বিজ্ঞান একই অভিমুখে ধাবিত হবে এবং সমাজের মঙ্গলের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটবে।
অদূর ভবিষ্যতে এখনকার চেয়েও নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্বের প্রয়োজন হবে। এখন আমি আপনাদের সঙ্গে ‘এভরি গ্রেটনেস’ নামে একটা বইয়ের কথা বলতে চাই। মেক্সিকোতে ঘটা একটা অভিজ্ঞতার কথা এই বইয়ে উঠে এসেছে। মেক্সিকোর লা মেসা কারাগারে একটি দাঙ্গা হয়। পঁচিশ শত কয়েদিকে জেলখানার কম্পাউন্ডে রাখা হয়েছিল। জেলখানাটি কিন্তু মাত্র ৬০০ জন কয়েদির জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কয়েদিরা ক্রোধান্বিত হয়ে পুলিশের উপর ভাঙা বোতল ছুড়ে মারতে থাকে। ফলে, পুলিশ তাদের উপর মেশিনগানের গুলি চালায়। তারপর সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা ছোটোখাটো তেষট্টি বছর বয়সের এক বৃদ্ধা মহিলা শান্তভাবে জনতার মাঝে ঢুকে পড়ে এবং দু’হাত প্রসারিত করার ভঙ্গিতে শান্তির জন্য আকুতি জানাতে থাকে। বৃষ্টির মতো বুলেট এসে পড়াকে উপেক্ষা করে, সে সেখানে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে দাঙ্গা থামানোর জন্য আবেদন করে, সবাই শান্ত হয়। সিস্টার আন্তোনিয়া ছাড়া কেউই সেদিন এগিয়ে আসেনি। কেন লোকজন মহিলাটার কথা শুনেছিল? কারণ, পেছনে ফেলে আসা দশকগুলোতে বৃদ্ধা মহিলাটি কয়েদিদেরকে সেবাযত্ন করেছে। সে সারাটা জীবন খুনি, তস্কর এবং মাদক জগতের সম্রাটদেরকে নিজের সন্তানের দৃষ্টিতে দেখে এসেছে। মহিলাটি ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে এসেছে। সে তাদেরকে নানাভাবে যত্নআত্তি করত। বৃদ্ধা মহিলাটির নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় কয়েদিরা তাকে সম্মান করত। আর সে কারণেই সে কয়েদিদেরকে শান্ত করতে পারল। মহিলাটি তাদেরকে যা করতে বলল, তারা তাই করল। মানবিকতার জন্য এটা বড়ো একটা বার্তা! মহিলাটির মধ্যে নেতৃত্বদানের ক্ষমতা থাকায় সে কয়েদিদেরকে শান্ত করতে পেরেছিল। পৃথিবীর মিলিয়ন মিলিয়ন বোবা মানুষের জন্য আমাদেরও কিন্তু অনুরূপ করুণাসিক্ত ভালোবাসা প্রদর্শন করা প্রয়োজন।
দশ বছরের বালক বয়সে অমার প্রত্যক্ষ করা একটি বিষয় তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে ইচ্ছা করি। আমাদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে চমৎকার ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের তিনজন মানুষ মিলিত হতেন। তাঁরা ছিলেন বিখ্যাত রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ও বৈদিকশাস্ত্রে পণ্ডিত পকশী লক্ষ্মমানা শাস্ত্ৰীগাল, রামেশ্বরম দ্বীপে স্থাপিত গির্জার প্রতিষ্ঠাতা রেভারেন্ট ফাদার বোদাল এবং মসজিদের ইমাম আমার বাবা। তাঁরা তিনজন একত্রে মিলিত হয়ে,
দ্বীপের সমস্যা সম্বন্ধে আলোচনা করে, সেগুলোর সমাধান করতেন। তাছাড়াও তাঁরা সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে গঠনমূলক আলাপআলোচনা করতেন। দ্বীপটিতে তাদের পারস্পরিক সম্পৃক্ততা ফুলের সৌরভের মতো চারিদিকে যেন ছড়িয়ে পড়ত। কখনো ধর্মের গুরুত্ব সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা করতে গিয়ে এই তিনজন মানুষের মহামিলনের স্মৃতি মনে পড়ত। ভারতে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের মনে অখণ্ডতার চিত্র আমার মনে ভেসে ওঠে।
সারাবিশ্বে কৃষ্টি, ধর্ম ও সভ্যতা নিয়ে এখন খোলামেলা সংলাপ করা অধিকতর জরুরি। আমরা দেখেছি, রাশিয়ানরা কেমনভাবে স্পুটনিক উৎক্ষেপণ করেছে কিংবা নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে অবতরণ করেছেন। বিশ্বের যুব সমাজ এ সব ঘটনার কথা জেনে বিদ্যুতের মতো চমকিত হয়েছে। মহাকাশ যাত্রার মিশন শেষ করে যখন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহিলা মহাকাশযাত্রী তার সহকর্মীদের সঙ্গে পৃথিবীর মাটিতে ফিরে আসছিল, তখন সারা পৃথিবী তাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রার্থনা জানিয়েছিল। কমনওয়েলথ দেশগুলোতে ক্রিকেট সমাদৃত হয়, আর অন্যদিকে তখন ইউরোপের দেশগুলোতে ফুটবল খেলা চলে উদ্যমের সাথে। তাদের উচ্ছ্বাস দেশের সীমানা পেরিয়ে যায়। অনুরূপভাবে শিল্পকলা ও সঙ্গীত তরুণদের মনে কেমনভাবে রেখাপাত করে তার অনেক দৃষ্টান্ত আমি অবলোকন করেছি।
কয়েক বছর আগে, যখন আমি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মিলিত হই, তখন আমরা তরুণদের জন্য একটা উপগ্রহ তৈরিতে সম্মত হয়েছিলাম, যার সাহায্যে বিভিন্ন দেশের তরুণরা একত্রে কাজ করতে পারে। এ ধরনের সম্মিলিত কর্মের ফলে পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধি করতে সহায়ক হয়। তার ফলে তাদের মধ্যে নতুন পথ আবিষ্কারের দিগন্তও উন্মোচিত হয়। এরূপ সহযোগিতার উদ্দীপন ঘটাতে হবে তরুণদের মধ্যে বিশ্বায়িতভাবে। ইয়ুথ স্যাটেলাইটের ধারণা দেশগুলোর জয়েন্ট ভেনচারের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়। ভারতের স্পেস এজেন্সি ও রাশিয়ার উদ্যোগে ২০১১ এর ২০ এপ্রিল তারিখে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটা থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়। আমি তারপর ইসরো টিমকে পরামর্শ দেই ইয়ুথ স্যাটেলাইটের সিরিজ উৎক্ষেপণ চলমান রাখতে, যাতে তারা একে প্লাটফরম হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।
প্রিয় বন্ধুগণ, যদি আপনারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন গত তিরাশি বছরে আমার জীবন কীভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে, তবে সবাইকে বলতে হয় একটা মেসেজের কথা। মেসেজটি এ ধরনের। যখন আমার বয়স সতেরো বছর তখন আমার বড়ো বড়ো সঙ্গী ছিল। ওই সঙ্গীরা আর কেউ নয়, বিখ্যাত বিখ্যাত বই। বইগুলোই আমার সারাজীবনটাকে সমৃদ্ধ করেছে। আমি সবাইকে নিম্নের বইগুলো পড়ার পরামর্শ ও সুপারিশ করছি:
- ‘লাইট ফ্রম মেনি ল্যাম্পস বাই লিলিয়ান এইচলার
- ‘এম্পার অব দি মাইন্ড বাই ডেনিস ওয়েটলে
- ‘থিরুক্কুরাল’ বাই থিরুভাল্লুভার
- ‘এভরিডে গ্রেটম্যান বাই স্টেভেন আর. কোভে
- ‘দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিয়েন্স উইথ ট্রু বাই মহাত্মা গান্ধী
পৃথিবীকে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট অনেক অনেক বিবাদকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। একজন তরুণ হিসাবে সবাইকে সকল বিবাদ দূরে সরিয়ে রেখে বিশ্বজনীন ঐক্যের জন্য কাজ করতে হবে। আপনারা কি তা করতে প্রস্তুত?
কাজের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের একটি হচ্ছে, এগিয়ে যাওয়া পরিচ্ছন্ন সবুজ এনার্জি এবং একটা পরিচ্ছন্ন পৃথিবী নামক গ্রহের জন্য কাজ করে যাওয়া। এটার অর্থ হচ্ছে, ৭ বিলিয়ন মানুষের সুন্দর জীবনের জন্য একটা মিশন গ্রহণ করা। যদি আপনারা সবাই সুন্দর জীবনের উদ্দেশে এই মিশনের জন্য কাজ করেন, তবে পৃথিবী ফসিল ফুয়েল থেকে মুক্ত হবে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন মারাত্মক জ্বালানিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সোলার পাওয়ার, নিউক্লিয়ার পাওয়ার ও বায়ো ফুয়েল ব্যবহার করে আমরা পরিচ্ছন্ন শক্তিলাভ করতে পারি। অবশ্যই এই মিশন সফল করতে তরুণদেরকে উদ্ভাবনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। আমি আস্থাশীল, তরুণরা নেতৃত্বের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারবে। আজ থেকেই কাজে লেগে পড়তে হবে। আপনারা কি অদম্য কর্মশক্তির মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারবেন?
হ্যাঁ প্রিয় বন্ধুরা, তরুণরাই তাদের শক্তি দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে একটা পরিবর্তন ঘটাতে পারবে—এই পরিবর্তন দেশ ও বিশ্বের সমৃদ্ধি বহন করে আনবে।
(BMICH, কলোম্বোতে ২৬ জুন ২০১৫ এ ছাত্রছাত্রীদের কাছে ভাষণ থেকে।)