তারও আগের দিন
ব্রিস্টলের একটা residential হোটেলের যে ঘরে লোকে খায়, বসে ও স্মোক করে সেই ঘরে সোম বসে পেগির জন্য অপেক্ষা করছিল। পেগি এলে দু-জনে প্রাতরাশ করবে।
ঘরটি লম্বা। একখানি মাত্র টেবিল। সেটিকে ঘিরে প্রায় বিশ জনের আসন। টেবিলের উপর একতাল রুটি। দু-টি কি তিনটি পাত্রে অনেকখানি জ্যাম। বোধহয় হোটেলের নিজের তৈরি। মার্গারিনের মতো দেখতে খানিকটা সস্তা মাখনের অল্পই অবশিষ্ট আছে। কেননা ইতিমধ্যে ব্রেকফাস্ট খাওয়া শেষ হয়ে গেছে এবং দেরি করে যারা উঠেছে তাদের খাওয়া চলেছে।
তাদের প্রত্যেকেই খেতে বসবার আগে একবার সোমকে বলেছে, ‘খাওয়া হয়ে গেছে আপনার?’
সোম বলেছে, ‘না।’
‘আসুন, খেতে বসি।’
‘ধন্যবাদ। আমি একজনের জন্যে অপেক্ষা করছি।’
প্রত্যেকের খাওয়া শেষ হয়ে যায়, আরেকবার সোমের সঙ্গে আলাপ জমাবার ছল খোঁজে। বলে, ‘দিনটা চমৎকার।’
সোম বলে, ‘চমৎকার।’
‘এবারকার মতো ইস্টার আর হয়নি।’
‘শুনতে পাই।’
‘কোথা থেকে আসছেন?’
‘লণ্ডন থেকে।’
‘ওঃ, লণ্ডন। তা হলে আমাদের ব্রিস্টলকে আপনার মনে ধরবে না।’
কেউ বলে, ‘আমি আসছি কার্ডিফ থেকে।’
‘কার্ডিফ? সে কত দূর?’
‘এই তো, চ্যানেলের ওপারে।’
‘ওয়েলস দেখতে ইচ্ছে করে।’
‘দেখেননি? দেখবার মতো। Wye Valley-র নাম শুনেছেন?’
‘না।’
‘সুন্দর।’
‘কার্ডিফের কয়লার খনির কুলিদের ভারি দুর্দশা, না?’
‘হবে না? ব্যাটারা গোঁয়ার। হিতবাক্য শুনবে না। ওদেরই তো দোষ।’
‘এ বিষয়ে একমত হতে পারলুম না।’
ঘরের একাংশে কয়েকখানা গাইড বই ও ডাইরেক্টরি ছিল। সোম পাতা ওলটানোতে মন দিল। খুঁজে বের করতে হবে রামমোহন রায়ের সমাধি-মন্দির শহরের কোন অঞ্চলে। জিজ্ঞাসাও করল দু-একজনকে।
‘বলতে পারেন রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি কোনখানে?’
‘কার বললেন?’
‘রাজা রামমোহন রায়ের। একজন প্রসিদ্ধ ভারতীয়ের।’
(Shrug করে) ‘আমার তো জানা নেই। এই এন্ড্রুজ, জান একজন ইন্ডিয়ান মহারাজার কবর এ শহরের কোনখানে?’
এন্ড্রুজ জানে না। কিন্তু গোরস্থানগুলোর নাম করল। আজ রবিবার, দু-টোর আগে কোনো গোরস্থানে ঢুকতে দেবে না।
ইতিমধ্যে সোমের মন ওয়েলস-এর দিকে রওয়ানা হয়েছিল। কাল রাত্রে ব্রিস্টলের যতটুকু দেখেছে ততটুকু তাকে আকৃষ্ট করেনি। লণ্ডনেরই সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। ভেবেছিল সমুদ্রের উপরে। তাও নয়। লণ্ডনের একটা খেলো সংস্করণ। যে নাটক লণ্ডনে বহুদিন অভিনীত হয়ে আর চলল না সেই নাটক এখানে স্থানান্তরিত হয়েছে। পেগিকে নিয়ে কোনো একটা থিয়েটারে যেত, কিন্তু প্রোগ্রাম দেখে পা সরেনি।
পেগির প্রবেশ।
(চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে) ‘গুড মর্নিং, মিস স্কট।’
(সলজ্জে) ‘গুড মর্নিং, মিস্টার সোম। আমার খুব দেরি হয়ে গেছে?
‘খুব না। মোটে দেড় ঘণ্টা।’
‘মোটে দেড় ঘণ্টা? আমি ভেবেছিলুম আপনার মুখে শুনব দেড় শতাব্দী? নাঃ, আপনি poet-ও না, lover-ও না, ভুল ভেবেছিলুম। যাক, খাওয়া হয়েছে?’
‘আপনার কী মনে হয়?’
‘হয়নি। কিন্তু কেন?’
‘সেটাও অনুমান করুন।’
‘দিন তা হলে আপনার হাত। তাই দেখে বলব। (তা দেখে) হাতে লিখেছে আপনি পেগি স্কট নাম্নী একটি মহিলার আসার পথ চেয়ে বসে কড়িকাঠ গুনছিলেন।’
‘শেষটুকু ভুল। ডাইরেক্টরি ঘাঁটছিলুম। তার মানে কাজ গুছিয়ে রাখছিলুম।’
‘সেই কথাই তো আমিও বলি। আপনি poet-ও না, lover-ও না, আপনি কাজের মানুষ। আমাদের মতো বিছানায় পড়ে পড়ে পাঁচ মিনিট পর পর ভাবেন না যে, থাক আর পাঁচ মিনিট পরে উঠব।’
‘পাঁচ মিনিট আগে উঠলে পাঁচ মিনিট আগে একজনকে দেখতে পাব এমন যদি ভেবে থাকি সে কি আমার অপরাধ?’
‘তা হলে অন্তত দরজায় একটা টোকা মেরে জানিয়ে যেতে হয় যে হুজুর দেখতে চান।’
‘মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে দিলে মানুষ তেড়ে মারতে আসে। অন্তত আমি তেমন মানুষ।’
‘না, না, আর দেরি নয়। আসুন, খেতে বসি। কই, এরা কি কেউ কফি তৈরি করে দিয়ে যাবে না? কে আছে?’ (একজন কফি দিয়ে গেল।) ‘মিস্টার সোমের আজকের প্রোগ্রাম কী?’
‘আপনারটা আগে বলুন।’
‘আমি মাসিমার বাড়ি যাচ্ছি! সেইখানেই থাকব আজ। কালকের ট্রেনে লণ্ডন।’
‘আর আমি যাচ্ছি ওয়েলস। ব্রিস্টলে আমার মন টিঁকছে না।’
‘ও মা, তাই নাকি। আমি ভাবছিলুম কে আমাকে কাল ট্রেনে বসিয়ে দেবে।’
‘ট্রেনে বসিয়ে দিতে কেউ হয়তো রাজি আছে, কিন্তু কার্ডিফ থেকে।’
‘এত চুলো থাকতে কার্ডিফ? আমাদের কাজের মানুষটি কি কয়লার আড়তদার?’
‘কয়লার কুলিদের দুরবস্থাটা একবার চাক্ষুষ দেখবার অভিপ্রায় আছে।’
‘কুৎসিতের মধ্যে আপনাকে আমি যেতে দেব না। সে যে আমার দেশের কলঙ্ক।’
(চমৎকৃত হয়ে) ‘তাহলে সৌন্দর্যের মধ্যে নিয়ে চলুন। Wye Valley-তে?’
‘আজকেই?’
‘কাল তো আপনি লণ্ডনে চললেন?’
‘তবু মাসিমা আটকাবেন।’
‘মাসিমার সঙ্গে দেখা নাই করলেন?’
‘বটে! যে কারণে এতদূর এলুম সেইটেকে বিসর্জন দেব?’
‘বলুন, যে অছিলায় এতদূর এলুম।’ (সোম মুখ টিপে টিপে হাসছিল।)
‘ভাবছেন আপনাকে ছাড়তে না পেরে এখানে এসেছি?’
‘কিংবা আমি ছাড়তে চাইনি বলে এখানে এসেছেন।’
‘কী ধৃষ্টতা!’
‘কী কপট কোপ!’
‘বেশি চটাবেন না। সবটা মাখন খেয়ে শেষ করে ফেলব।’
‘মোটা হবার ভয় নেই।’
‘হলে তো বেঁচে যাই। ‘ছাড়তে চাইনে’—বলে কেউ পিসি-মাসির প্রতি কর্তব্য ভুলিয়ে দেয় না।’
‘কিন্তু মোটা হতে আপনাকে আমি দেব না। সে আমার সৌন্দর্যবোধের উপর অত্যাচার! অতএব দিন ওটুকু মাখন।’
পেগি তার মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। একলাটি যাবে? মিস্টার সোম তাকে পৌঁছে দেবেন না?
সোমের বড়ো সংকোচ বোধ হচ্ছিল। পেগির সঙ্গে তার পথে পরিচয়। মাসিমা যদি জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমাদের পেগির সঙ্গে আপনার খুব বন্ধুতা, না?’ সোম কী বলে উত্তর করবে? বলবে, ‘দু-দিনের পরিচয়ে যতটা হয় তার বেশি নয়?’ কিন্তু সত্যি তার বেশি নয়? সোম নিজের হৃদয়কে প্রশ্ন করল। হৃদয় উত্তর না করে লাজুক বধূর মতো থরথর করে কাঁপতে লাগল।
কিংবা ফুর্তি করে বলবে, ‘এত বন্ধুতা যে সেই জোরে আপনাকে ‘Auntie’ বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে।’ কিন্তু ফুর্তির পরেই হৃদয় নিজ মূর্তি ধরবে। হৃদয়ের কাঁপুনি এত উত্তাল হবে যে কানে বাজবে।
সোম বেঁকে বসল। ব্রিস্টলে তার থাকতে রুচি নেই, সে বারোটার ট্রেনে কার্ডিফ যেতে চায়। পেগির কাছে যদি পেগির মাসিমা-ই হয় বড়ো, পেগির বন্ধু কেউ না হয়—তবে পেগি একাই যাক, একাই থাক। আশা করা যায় মেসোমশাই ট্রেনে তুলে দিতে পারবেন, দুই হাতে করে তুলে দেবেন, ছোটো খুকিটি কি না।
‘বলবেন, Nunkey dear, আমাকে দু-হাতে তুলে ট্রেনে চাপিয়ে দাও না? আমি উঠতে গেলে পড়ে যাব যে। এমনি করে আব্দারের সুরে বলবেন।’ (সোম সুরের নমুনা দিল।)
‘উপদেশটা মাঠে মারা গেল। আমার মাসিমা সুতো কাটেন!’
‘Spinster? তা হলে তো বোনঝিটিকে পেলে লুফে নেবেন। ছেড়ে দেবেন না কালকের আগে। আমাকে খালি হাতে ফিরে আসতে হবে হোটেলে।’
‘একা থাকতে পারবেন না?’
‘একা যদি থাকতেই হয়, ব্রিস্টলে কেন?’
‘বুঝেছি। পথে আরেকটি সঙ্গিনী পাবার আশা রাখেন।’
‘একজন যুবকের পক্ষে কি সেটা অন্যায় আশা, মিস স্কট?’
‘অতি ন্যায়সঙ্গত আশা। কিন্তু আমাকে আপনি ভাববার কারণ দিয়েছিলেন যে আপনি সকলের মতো নন।’
‘কাঁদছেন?’
‘কই, না? হাসছিই তো।’
‘তবে বুঝতে হবে হাসি-কান্না একই জিনিস। অনুমতি দেন তো চোখ মুছে দিই।’
‘ধন্যবাদ। অত গ্যালান্টপনা দেখাতে হবে না। বিদায়।’ (পেগি যাবার জন্য পা বাড়াল।)
‘বিদায়।’
(হঠাৎ সশব্দে হেসে) ‘আসুন না আমার ট্যাক্সিতে? আপনাকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে যাব।’
‘ধন্যবাদ, মিস স্কট। কিন্তু আমার ট্রেনের দেরি আছে। পায়ে হেঁটে শহর দেখতে দেখতে যাব।’
ট্যাক্সি চলে গেল। সোম ভগ্নহৃদয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল। হাতব্যাগটি নিয়ে এখুনি বেরিয়ে যাবে, যেদিকে দুই চোখ যায়। তারপর ট্যাক্সিতে করে স্টেশনে যাবে।
দু-দিনের সান্নিধ্য মিস স্কটের প্রতি তাকে আসক্ত করেছিল। মিস স্কট গেছে, কিন্তু আসক্তি থেকে গেছে। সোম বিছানায় শুয়ে পড়ে খানিকক্ষণ কাঁদবে ভাবছিল, যদি আসক্তিটা জল হয়ে কেটে যায়। স্মৃতির বোঝা বয়ে পথে চলা যায় না। পথিকের পক্ষে একটা হাতব্যাগই যথেষ্ট বোঝা।
কিন্তু বাসি বিছানায় শুতে তার প্রবৃত্তি হয় না। সে ব্যাগটা হাতে করে করিডর দিয়ে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে, এমন সময় হোটেলওয়ালার মেয়ের সঙ্গে দেখা। তার হাতের উপর একটা টিয়া পাখি।
‘আর ফিরে আসছেন না, মিস্টার?’
‘না, মিস।’
‘আবার কখনো এলে এখানেই উঠবেন।’
‘যদি কখনো আসি। কিন্তু ‘যদি’ কথাটা ‘আসি’ কথাটার থেকে অনেক অনেক বড়ো।’
‘কখনো আসবেন না?’
‘আপনার দেশ তো আমার দেশ নয়, মিস। আমার দেশে ফিরে যেতে হবে না?’
‘আপনার মা-বাবা এদেশে নেই?’
‘দেশে দেশে আর সব পাওয়া যায়। টিয়া পাখি পর্যন্ত। কিন্তু মা-বাবা একটু দুষ্প্রাপ্য। না, মিস?’
(সকৌতুক) ‘টিয়া পাখি, আপনার দেশে পাওয়া যায়?’
‘ঝাঁকে ঝাঁকে। ক-টা চান?’
‘তা বলে আমার জিম-এর মতো টিয়ে কখনো পাওয়া যাবে না। যা বলেছেন, একটু দুষ্প্রাপ্য। দেখুন, দেখুন, কেমন দুষ্টু। কামড়াতে চায়। আমি ওর মা, আমাকে ও কামড়াতে চায়। যেন ওর খাদ্য। লক্ষ্মীছাড়া ছেলে।’
সোম একটু আদর করল টিয়াটিকে। আদর করলে কামড়াতে আসে। সোম মনে মনে বলল, ‘মেয়েমানুষের মতো।’ মনে মনে হাসল। উপমাটা ঠিক হয়নি বটে, কিন্তু নিষ্ঠুর হয়েছে। মিস স্কটকে শোনাতে পারলে গায়ের জ্বালা মিটত। কিন্তু মিস স্কট ঠিকানা দিয়ে যায়নি। এতবড়ো জগতে যাকে একদিন অকস্মাৎ পেয়েছিল আজ তাকে অকস্মাৎ হারিয়েছে। মিস স্কট যেন একটা স্বপ্ন।
‘তাহলে বিদায়, মিস।’
‘বিদায়। কিন্তু আসবেন, বুঝলেন? দেশে যাবার আগে একবার আসবেন।’
‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে’। সোম যখনি যেখানে গেছে সেখানে ভালোবেসেছে ভালোবাসিয়েছে। কতজনকে কথা দিয়েছে, ‘হ্যাঁ, আসব বইকী, আবার একদিন আসব।’ কিন্তু পারে না যেতে। ওটা শুধু কথার কথা। উভয় পক্ষের সাময়িক সন্তোষের জন্য।
সোম ট্রাম পেল না। রবিবার সকাল বেলা ট্রাম-চলাচল বন্ধ থাকে ইংল্যাণ্ডের সর্বত্র। পায়ে হেঁটে অলি-গলি ঘুরতে ঘুরতে একটা পার্কে গিয়ে পড়ল। সেখানে পলিটিক্যাল বক্তৃতা শুনল। তারপর নদী দেখতে গেল। ছোটো নদী। নাম Avon, কিন্তু শেকসপিয়রের Avon নয়।
পরিশেষে স্টেশনে পৌঁছোল।
কিনল কার্ডিফের টিকিট। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। মিনিট পনেরা পরে ছাড়বে। সোম একটি জায়গা দখল করে হাতব্যাগটি রাখল। প্ল্যাটফর্মে নেমে পায়চারি করতে থাকল। রবিবারের কাগজ বিক্রি হচ্ছিল। খান দুয়েক কিনল। মিস স্কটের জন্য তার মন-কেমন-করা কমে এসেছে, মন উন্মুখ হয়েছে Severn নদী দেখতে। Severn নদীর তলার সুড়ঙ্গ দিয়ে যেতে কতক্ষণ লাগবে সোম তার হিসাব করছে। Severn নদী যেখানে সমুদ্রে মিশেছে সেখানটা নদীর বহুগুণ চওড়া।
সোমের কামরায় কারা কখন জায়গা নিয়েছে সোম লক্ষ করেনি। সোম ধেয়ানে Severn Tunnel-এর ছবি ও নয়নে রবিবাসরীয় পত্রিকার ছবি দেখছিল। ট্রেন ছাড়বার সংকেত শুনে কাগজ থেকে চোখ না তুলেই কামরায় উঠে বসল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে Sunday Pictorial-এ নিবিষ্ট রইল।
হঠাৎ ভূত দেখলে কেমন বোধ হয় সে অভিজ্ঞতা আমাদের প্রত্যেকেরই আছে। সোম প্রথমটা কাঠ হয়ে গেল। তার হৃদয়স্পন্দন বন্ধ, নিশ্বাস-প্রশ্বাস স্থগিত, দৃষ্টি পক্ষাহত। কয়েক মিনিট—কয়েক ঘণ্টা—কেটে গেলে পর লাফ দিয়ে দাঁড়াল। যেন স্প্রিংযুক্ত কলের পুতুল। সাহস হচ্ছিল না, তবু দুই হাত দিয়ে পেগিকে স্পর্শ করে জিজ্ঞাসা করল, ‘মাফ করবেন আমাকে। আপনি কি পেগি স্কট? না আমার মতিভ্রম?’
কামরায় লোক ঠাসা। একটা কালো মানুষের কান্ড দেখে সকলেরই চক্ষু স্থির। পেগি চট করে সোমের অবস্থাটা আন্দাজ করে নিল। পরম বিস্ময়ের ভান করে বলল, ‘হ্যালো! আপনি এখানে! আমার পাঁচ বছর পরে দেখতে পাওয়া বন্ধু মিস্টার সোম। এতক্ষণ চিনতে পারিনি বলে মাফ করবেন তো?’
এই বলে পেগি তাকে হিড়হিড় করে টেনে কামরার বাইরে করিডরে নিয়ে গেল। সোম তখনো অপ্রকৃতিস্থ। পাঁচ বছর আগে সে তো ভারতবর্ষে ছিল।
পেগি বলল, ‘অন্যমনস্ক মানুষ ঢের দেখেছি, কিন্তু এমনটি এই প্রথম। ছি ছি এক গাড়ি মানুষের সামনে কী রঙ্গই করলেন?’
‘কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি নে, মিস স্কট—’
‘মাসিমাকে মিথ্যে বলে পালিয়ে এসেছি। বলেছি, কার্ডিফে আমার ইয়ংম্যানের সঙ্গে যাচ্ছিলুম, পথে পড়ল ব্রিস্টল, ভাবলুম আপন মাসিমার সঙ্গে দেখা না করে গেলে ঘোর অকৃতজ্ঞতা হবে।’ মাসিমা বললেন, ‘তবে তোকে আটকাব না, পেগ। শেষকালে অভিশাপ দিবি। তোকে স্টেশনে দিয়ে আসব?’ বললুম, ‘ধন্যবাদ, মাসিমা। কিন্তু আজকালকার মেয়ের chaperon দরকার করে না। তাতে করে আমার ইয়ংম্যানকে অপদস্থ করা হয়। যার যা কাজ।’ মাসিমা খুব হাসলেন। বললেন, ‘তাকেও এখানে আনলি নে কেন, ছুঁড়ি! আমি তার কী জবাব দিই বলুন! আপনি কি আমার মুখ রেখেছেন। বললুম, ‘‘তারও এখানে একটি পিসিমা আছে’’।’
সোমের হাসি আর থামে না।
এদিকে Severn নদীর সুড়ঙ্গও আর আসে না। সোম সে-কথা ভুলে গেছিল। কিন্তু তার কামরায় যারা ছিল তারা ওই পথ দিয়ে সকাল সকাল বাড়ি পৌঁছোনোর জন্যে উৎকন্ঠিত। ব্রিস্টল থেকে কার্ডিফে যাবার দুটো রেলরাস্তা। একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে সংক্ষেপে, অন্যটা নদী যেখানে সংকীর্ণ সেইখান অবধি গিয়ে সেতুর উপর দিয়ে।
সোমরা যখন কামরায় ফিরে এল তখন তাদের আচরণ সম্বন্ধে কারুর মুখভাবে কোনো সন্দেহ বা কৌতূহল বা নিন্দা প্রকাশ পেল না, সকলে ভাবছে ট্রেনের আচরণের কথা। সে যে এমন করে দাগা দেবে কেউ প্রত্যাশা করেনি। তারা তাই নিয়ে উত্তেজিত হয়ে তর্ক করছে। সোম ও পেগি তর্কের আসরে ভিড়ে গেল। সুড়ঙ্গটা ফস্কে গেল বলে সোমের আফশোস সকলের আফশোসকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। অন্যদের আফশোস তো এই যে অন্যেরা যথাসময়ে মধ্যাহ্নভোজন করতে পারে না। একটি মেয়ে প্রত্যেকের কাছে একবার করে দুঃখ জানাচ্ছিল এইরকম যে, সুড়ঙ্গের ওপারের স্টেশনে তাকে নেবার জন্যে একজন (অর্থাৎ তার ইয়ংম্যান) এসে নিরাশ হবে। আর এই যে ট্রেনটা এটাও ঘুরে ফিরে সেই স্টেশন দিয়ে কার্ডিফ যাবে। একেবারে ওদিক মাড়াবে না এমন নয়। কিন্তু অন্তত একটি ঘণ্টা দেরি করবে! কী জানি!
সোমের সঙ্গে এক টেকো বুড়োর গল্প চলছিল। বুড়ো, তার বুড়ি ও বন্ধুরা মিলে জ্যামেইকা বেড়াতে গেছিল। এই ফিরছে। সঙ্গে বিস্তর তোড়জোড়। ওরা শুধু হেঁটে বেড়ায়নি, সে তাদের গলফ খেলার বহুল উপকরণ দেখে অনুমান করা যায়।
এও তো ইন্ডিজ, সেও তো ইন্ডিয়া, তবে জ্যামাইকার সঙ্গে ভারতবর্ষের তফাত কী। টেকোর প্রশ্নটা হল এই ভাবের। সোম থতমত খেয়ে বলল, ‘তাই তো।’
সোম ভেবে বলল, ‘ভারতবর্ষে আম হয়।’
টেকো বাঁধানো দাঁত বের করে বলল, ‘জ্যামাইকাতেও আম হয়। আমরা খেয়ে এসেছি, না ডরোথি!’
স্ত্রী বললেন, ‘সঙ্গে করেও কিছু এনেছি।’
কার্ডিফে নেমে সোম ও পেগির প্রথম ভাবনা হল এই অবেলায় কোনো রেস্তোরাঁতে পেট ভরে খেতে পাওয়া যাবে কি যাবে না। কিন্তু পাওয়া গেল। স্টেশনের কাছেই রেস্তোরাঁ। ক্ষুধার পরিমাণ অনুসারে খাদ্যের পরিমাণ স্থির করে ওয়েট্রেসকে বলল, ‘জলদি করো।’
গল্প করবার মতো শক্তি দু-জনের কারুর ছিল না। দু-জনে দু-জনের কথা ভাবছিল। আর মুচকে মুচকে হাসছিল। কেই-বা ভেবেছিল আবার তারা এক সঙ্গে খেতে বসবে? পরস্পরের সান্নিধ্য পাবে? পরস্পরের সাক্ষাৎ পাবে? কেউ কারুর ঠিকানা জানত না। ধরো যদি বারোটার গাড়িতে সোম না আসত, আসত আগে কিংবা পরে, তবে পেগি কি কোনোদিন তার দিশে পেত? সম্ভবত কোনো ভারতীয় ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করত, ‘মিস্টার সোমকে চেনেন?’ কিন্তু ভারতীয় কি লণ্ডনে দশটি-বিশটি আছে? আর মিস্টার সোম যে দশ-বিশ জন নেই তারই বা কোন স্থিরতা? সোমের খ্রিস্টান নামটা পর্যন্ত পেগির জানা নেই। পেগি হয়তো বুদ্ধি খাটিয়ে টাইমস সংবাদ পত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন দিত : Shome, Meet me at Piccadilly Circus on Saturday at 1-30—Peggy। কিন্তু সে বিজ্ঞাপন হয়তো সোমের চোখ এড়িয়ে যেত। আর পেগি যে টাইমস কাগজে বিজ্ঞাপন দিত এমন সম্ভাবনা অল্প। পেগির প্রিয় কাগজ ডেলি মিরার। ওখানা সোমের চোখে পড়ে না। তবু সোম হয়তো মাস খানেক ডেলি মিরার-এর প্রত্যেকটি বিজ্ঞাপন অধ্যয়ন করত।
পরিতোষপূর্বক আহার সমাপন করে দু-জনে চলল কার্ডিফ দেখতে। পরিষ্কার তকতকে শহর। ব্রিস্টলের চাইতে সুখদৃশ্য।
সোম বলল, ‘কই, কুৎসিত নয় তো?’
পেগি বলল, ‘যেদিকটা গরিব লোকেরা থাকে সেদিকটা কুৎসিত। কিন্তু সেদিকটা আপনি দেখতে পাবেন না।’
এই বলে পেগি তাকে পেনার্থ নামক উপকন্ঠে যাবার বাস-এ তুলে দিয়ে নিজেও উঠে বসল।
পেনার্থ সমুদ্রের উপকূলে। তার অনতিদূরে বনানী। দিনটিও সেদিন ছিল রৌদ্রময়ী। সোম মুগ্ধ হয়ে গেল! বলল, ‘আমার যদি দেদার টাকা থাকত আমি সমুদ্রের থেকে ত্রিশ হাত দূরে ওরই একটা হোটেলে সাত দিন থাকতুম। কিন্তু যা আছে তাতে দু-শো হাত দূরের একটা বোর্ডিং হাউসেও কুলোবে না। অতএব আমরা আজ রাত্রিটা পেনার্থে কাটালুম না, মিস স্কট।’
পেনার্থ ত্যাগ করতে তাদের পা সরছিল না। কার্ডিফে ফিরে এল। সেখানে পেগি বলল, ‘ভালো কথা। মাসিমা বলছিল, ‘‘তোর ইয়ং ম্যানকে বলিস পর্থকওল যেতে।’ কার্ডিফ থেকে বেশি দূর নয়। ছোটো গ্রাম, কিন্তু অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর’’।’
সোম বলল, ‘তাই চলুন। হয়তো অল্প খরচে সমুদ্রের ধারে বাসা পাব।’
পর্থকওল-এর বাস-এর অপেক্ষায় আছে এমন সময় চিরকুট পরা একটি রোগা মানুষ তাদের সামনে পাত পাতল। ‘একটি পেনি দিন!’
পেগি বলল, ‘ভাগ। নইলে পুলিশে ধরিয়ে দেব। ভিক্ষা করিস কেন?’
‘রাত্রে মাথা গুঁজবার আশ্রয় চাই যে।’
‘খেটে খাস নে কেন?’
‘হা হা হা। তার উপায় কি আপনারা রেখেছেন? কাজও দেবেন না, ভাতও দেবেন না, দিতে পারেন কেবল পুলিশে।’
সোম বলল, ‘তুমি খনির কুলি?’
‘আমি খনির কুলি!’
পেগি বলল, ‘দেশের শত্রু!’
‘কারা শত্রু তা বোঝা গেছে।’
সোম তাকে দু-জনের হয়ে দুটো পেনি দিয়ে বলল, ‘তোমরা তো দেশের লোকের কাছ থেকে অনেক দান পাচ্ছ, তবু রাত্রে শোবার জায়গা পাও না?’
‘পেলে ভিক্ষা করি সাধে?’
‘কাগজে তো লিখছে—’
‘কাগজওয়ালারা আমাদের শত্রু।’
পেগি বলল, ‘যা, যা, বাজে বকিস নে। দেশসুদ্ধ তোদের শত্রু।’
‘বিশ্বাস করছেন না। আমি অবিবাহিত বলে দানের অংশ আমাকে নামমাত্র দেয়।’
‘তাই বল। কিন্তু সবাইকে শত্রু ঠাওরাসনে।’
লোকটা চলে গেলে সোম বলল, ‘লোকটা কী তেজস্বী!’
পেগি বলল, ‘আমার দেশের সবাই তেজস্বী। তাই আমাদের ঘরোয়া বিবাদ গেল না। দেখ, না ওরা বাড়াবাড়ি করে কী ক্ষতিটাই করাল। অবশ্য আমি খনির মালিকদেরও ক্ষমা করি নে। দু-পক্ষই দেশের শত্রুতা করেছে।’
পর্থকওল-এর বাস যখন এল তখন ছ-টা বেজে গেছে। অল্পক্ষণ পরে গোধূলির আলোটুকুও রইল না। অন্ধকারে বাস চলতে লাগল ছোটো ছোটো গ্রাম ছাড়িয়ে। পেগি ও সোম খুব কাছাকাছি বসেছিল হাতে হাত রেখে। তারা আজ উভয়ে উভয়ের জন্যে অনেক দুঃখ পেয়েছে, বিচ্ছেদের দুঃখ। বিচ্ছেদের পরে মিলিত হয়ে অনেক সুখও পেয়েছে। সুখ দুঃখের অতীত একটি সহজ প্রাপ্তির ভাব তাদের বিভোর করেছিল। তারা সঙ্গী ও সঙ্গিনী। এই সম্পর্কটি অন্য কোনো সম্পর্কের মতো ধরাবাঁধা নয়। পরস্পরের কাছে তাদের কোনোরূপ বাধ্যবাধকতা নেই। প্রেমের মধ্যে দায় আছে—দেবার ও পাবার তাড়না। যারা ভালোবাসে তারা পরস্পরের অধীন। একেবারে ক্রীতদাস। বন্ধুতাও প্রেমধর্মী। সেও একপ্রকার বাঁধন। কিন্তু সাথিত্ব জিনিসটির মধ্যে মুক্তি আছে। ও যেন পদ্মপত্রের সঙ্গে বারিবিন্দুর সম্পর্ক। কিংবা তৃণের সঙ্গে শিশিরবিন্দুর।
কাল আমরা লণ্ডন ফিরব। সেখানে কেউ কারুর কথা ভুলেও ভাবব না, কেউ কারুর নাম মনেও আনব না। আমাদের নিজের নিজের কাজ আছে, দল আছে। আর লণ্ডন শহরটাও একটা গোলকধাঁধা। কে কোন পাড়ায় থাকে ছ-মাসে একবার খবর নেওয়া হয়ে ওঠে না। আমি গেলুম তোমাকে দেখতে Crouch End-এ, তুমি গেছ আর কাউকে দেখতে Golders Green-এ। ফোন করলুম, চিঠি লিখলুম তবু তুমি জরুরি কারণে বাড়ি থাকলে না।
সেই জন্যে লণ্ডনের বাইরে যে দু-টি মানুষ একত্র হওয়ামাত্র এক হয়, লণ্ডনে ফিরে এলেই তারা আবার সেই একাকী। পৌনে এক কোটি লোকের মাঝখানেও একাকী। প্রত্যেকের দল আছে, কিন্তু একাকী একাকিনীর দল। কেউ কারুর সাথি নয়। লণ্ডনে প্রেম হয়, বন্ধুতা হয়, কিন্তু সাথিত্ব হয় না।
অন্ধকার সন্ধ্যায় নির্জন প্রান্তর দিয়ে বাস ছুটেছে। পেগি ও সোম দু-টি দূর দেশের পাখির মতো আকাশের পথে পাশাপাশি ডানা চালাচ্ছে। কাল যখন সন্ধ্যা হবে তখন আজকের সন্ধ্যা জগতেও থাকবে না স্মরণেও থাকবে না। সোম হয়তো পেগির সাথিত্বের লোভে লণ্ডনে ফিরবে, কিংবা আরও পশ্চিমে যাবে—এক ধাক্কায় আয়ারল্যাণ্ডটাও কাভার করে আসবে। আবার যেন এত খরচ করে ওয়েলস দিয়ে আয়ারল্যাণ্ডে না-যেতে হয়। ইকনমি বলে একটা কথা আছে তো।
বাস যখন পর্থকওলে থামল তখন আটটা বেজে গেছে।
পেগি ও সোমের সাথিত্বের ঘোর কাটল। বোধহয় একটু তন্দ্রাও এসেছিল। হঠাৎ এত আলো দু-জনের চোখ ঝলসে দিল। দু-ঘণ্টা এক জায়গায় বসে তাদের পায়ে খিল ধরে গেছল। সোম পেগিকে ধরে নামাল।
পেগি বলল, ‘রোজ রোজ ভালো লাগে না, মিস্টার সোম।’
‘কী ভালো লাগে না, মিস স্কট?’
‘যদি বলি আপনাকে ভালো লাগে না?’
‘তবে বলব মিথ্যা বলছেন।’
‘ইস! কী অহংকার!’
‘কেন, আমি কি সুপুরুষ নই?’
‘আলকাৎরার মতো কালো যে!’
‘বলুন, ওথেলোর মতো।’
‘ও মা, তা হলে যে আমার প্রাণটি যাবে!’
‘আপনার প্রাণের উপর আমার লোভ নেই। আশ্বস্ত হতে পারেন।’
‘তবে কীসের উপর?’
‘এই ধরুন সাথিত্বের উপর। আপনি দু-বেলা আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরবেন। এইটুকুতে ওথেলো খুশি।’
‘কী অসাধারণ দাবি! চাকরের কাছেও এমন দাবি করলে সে জবাব দিয়ে নিষ্কৃতি পায়।’
‘নিষ্কৃতির জন্যে আপনাকে অত কষ্টও করতে হয় না। ট্যাক্সি ডাকান, মাসির বাড়ি হাঁকান। চাকরও তো সাতদিনের নোটিশ না দিয়ে ভাগে না।’
‘ভারি রাগ করেছেন, না?’
‘রাগ করলে ঘরের ভাত বেশি করে খাব। আপনার তাতে লোকসান?’
‘কী সাংঘাতিক লোক। ভেবেছিলুম আপনি সকাল বেলার ঘটনা ভুলেও গেছেন, ক্ষমাও করেছেন। কিন্তু মনে মনে এত!’
সোম বলল, ‘যাক, কী বলছিলেন, বলুন। রোজ রোজ কী ভালো লাগে না?’
‘না মশাই, আর বলব না যে আপনাকে ভালো লাগে না। চার দিনের ছুটিতে বেরিয়েছি, একটু আনন্দ পেতে আর দিতে। কাউকে যদি রাগিয়ে তুলি তবে তো আমার ছুটিটা মাটি।’
‘কী করবেন বলুন। আপনাদের ভাষায় ‘অভিমান’ কথাটার প্রতিশব্দ নেই। তাই বোঝাতেও পারব না আমার হৃদয়ভাব। সম্ভবত ইংরেজদের হৃদয়ে অভিমান বলে কোনো ভাবই নেই। সেই জন্যে আপনারা অমন অবস্থায় ‘cross’ হন, ‘hurt’ হন, আর কিছু হন না।’
পেগি একটা দমকা হাসি হেসে প্রসঙ্গটাকে উড়িয়ে দিল। বলল, ‘বলছিলুম রোজ রোজ রাতের বাসা খুঁজতে ভালো লাগে না, মিস্টার সোম।’
‘তবে আর অ্যাডভেঞ্চার কী হল!’
‘রোজ রোজ একই অ্যাডভেঞ্চার? ভালো লাগে না। আজ মাসির বাড়ি থাকলে পারতুম।’
‘তবে আর দেরি করছেন কেন? মাসির বাড়ি ফিরে যান। দু-টোর আগে পৌঁছোতে পারবেন।’
ঘুরে-ফিরে আবার সেই প্রসঙ্গ। পেগি আরেকটা হাসি দিয়ে আবার তাকে উড়িয়ে দিল। তুলোর মতো উড়ে যায়, উড়ে আসে।
পেগি বলে, ‘দিনান্তে একখানি নির্দিষ্ট বাসা, এক বাটি গরম সুপ, একটি নরম বিছানা। এর বেশি কাম্য কী থাকতে পারে মানুষের?’
‘রাত জেগে নাচতে ভালো লাগে না?’
‘না। মন দেয়া-নেয়া অনেক করেছি। নেচেছি সারাজীবন।’
‘যেন কতকালের বুড়ি! বয়স তো উনিশ কী কুড়ি।’
‘না, না, অত কম নয়, মশাই। ঠিক দুগ্ধপোষ্য নাবালিকা নই।’
সোম কৌতুকের স্বরে বলল, ‘মাচিমার কাছে চোবো। শুলেন না কেন মাসিমার কাছে ছোট্ট একটি বিছানায়? সকাল থেকে ‘tiny tot’টিকে মাসিমা ঠেলাগাড়ি করে বেড়াতে নিয়ে যেতেন।’
ওরা বাসা খুঁজবার আগে একবার সমুদ্রতীরটি দেখে নিল। দীর্ঘ নয়। গুটি কয়েক হোটেল। বাকি সব বোর্ডিং হাউস। রবিবারের রাত্রি—দোকানপাট বন্ধ। সকলে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। কিংবা সিনেমায় গেছে। পর্থকওলের বাইরে থেকে অসংখ্য লোক এসেছে ছুটি কাটাতে।
পেগি ও সোম বোর্ডিং হাউসগুলিতে বেল টিপল। যেখানে যায় সেখানে ওই একই কথা। ‘তিলধারণের স্থান নেই।’…‘একটু আগেও একখানা ঘর ছিল’…‘তিন দিন আগে থেকে প্রত্যেকটি ঘর বুক করা।’ …‘ও পাড়ায় ঘর থাকতে পারে, একবার চেষ্টা করুন না?’
কোনো পাড়াতেই চেষ্টার ত্রুটি হল না! কিন্তু কোনোখানে এক রাত্রের আশ্রয় জুটল না। এদিকে ক্ষুধাও বেশ পেয়েছে। রেস্তোরাঁ খোলা থাকলে তারা আগে খেয়ে নিত, পরে বাসা খুঁজত।
‘কী করা যায়, মিস স্কট?’
‘কী করা যায়, মিস্টার সোম?’
‘বিপদে একটা পরামর্শ দিতে পারেন না। কোনো কাজের নন।’
‘কাজের মানুষ যে আমি নই, আপনি।’
‘আসুন তবে একটা হোটেলে ঢুকে সাপার খাই, তারপর সে হোটেলে না পোষায় অন্য হোটেলে জায়গা খুঁজব।’
কিন্তু সাড়ে ন-টা বেজে গেছিল। কোনো হোটেলে খাবার পাওয়া গেল না। কোথাও সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, কোথাও বাইরের লোককে খাবার ঘরে ঢুকতে দেয় না।
সোম বলল, ‘তা যদি হয় আমরা ভিতরের লোক হতে রাজি আছি। হোটেলে জায়গা খালি আছে?’
‘খালি! স্নানের ঘরগুলো খালি ছিল, শোবার ঘরে পরিণত করা হয়েছে। জায়গা!’
সোম বলল, ‘তবে আসুন, আমরা এদের সবচেয়ে যে বড়ো হোটেল সেই হোটেলে যাই। হয়তো জনপিছু এক পাউণ্ড চেয়ে বসবে, তবু তাই দেব। একটি রাত সমুদ্রের নিকটতম হব।’
পেগি বলল, ‘রাজি।’
কিন্তু ও হরি! সেখানে আরও অনেক স্থানপ্রার্থী দাঁড়িয়ে। কেরানি মেয়েটি বলছে, ‘এখনও ছত্রিশ জনকে জায়গা দিয়ে উঠতে পারা যায়নি। তাদের দাবি সর্বাগ্রে। নাম লিখে নিতে আমার আপত্তি নেই, বলুন আপনাদের নাম।’ সোম ও পেগি নাম লেখাল।
সোম বলল, ‘আমরা লণ্ডন থেকে এসে নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছি, মিস। একটি রাতের মতো জায়গা—’
‘সর্বনাশ! আজ রাতের মতো জায়গা!’
‘হ্যাঁ, তাই তো—’
‘অনর্থক নাম লিখে নিলুম। আমি ভেবেছিলুম কালকের রাত্রের জন্যে স্থান প্রার্থনা করছেন। আজ আর কিছু না হোক এক-শো জনকে ফিরিয়ে দিয়েছি। এই তো একটু আগে একদল লোক এ গ্রামে রাত কাটাবার জায়গা না পেয়ে ব্রিজেণ্ড চলে গেল। বোধ হয় ব্রিজেণ্ডের ট্রেন কিংবা বাসও আর পাবেন না।’
‘তবে কি আমরা না খেয়ে না শুয়ে সারারাত পায়চারি করে বেড়াব?’
‘একটি কাজ করুন। থানায় গিয়ে পুলিশকে ধরুন। ওরা যা হয় একটা বন্দোবস্ত করে দিতে পারবে।’
সোম ও পেগি থানার সন্ধানে চলল। পা আর চলতে চায় না। শূন্য উদরের উপর রাগ করে অসহযোগ করছে।
থানা বলে চেনবার উপায় ছিল না। আধখানা বাড়ি। বাইরে একটা ল্যাম্পপোস্ট-বিহীন ল্যাম্প দেওয়ালের গায়ে। সোম একটা দুয়ারে বেল টিপে ও ধাক্কা দিয়ে সাড়া পেল না। অন্য দুয়ারটাতে সফল হল। এক ঊনবিংশ শতাব্দীর বুড়ি দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘কাকে চান?’
‘পুলিশকে।’
বুড়ির বিরক্তির কারণ ছিল। পুলিশের খোঁজে বুড়ির ঘুম চটিয়ে দেওয়া বোধ হয় এই প্রথম নয়। প্রতিবেশিনী হিসেবে পুলিশের পিন্ডি বুড়ির ঘাড়ে, এইটে বোধহয় পর্থকওলের প্রবাদ।
উষ্মার সঙ্গে বুড়ি বলল, ‘এ দরজা নয়, ও দরজা।’
‘আমরা গেছিলুম ওখানে। সাড়া পাইনি।’
‘জঞ্জাল! বেলটাও ওদের বে-মেরামত। ধাক্কা দিলে ওরা ভাবে কেউ আমার বাড়ি ধাক্কা দিচ্ছে। আচ্ছা আমি ভিতরে গিয়ে খবর দিচ্ছি।’
পুলিশের লোক সোমকে ও পেগিকে ভিতরের ঘরে নিয়ে গেল। ব্যাপারটা কী লিখে নেবার জন্যে একজন কাগজ-কলম নিয়ে বসল। ওঃ, এই ব্যাপার? আচ্ছা আমাদের কর্তাকে ডেকে আনছি।
ইন্সপেক্টার রসিক লোক। সোমকে দেখে বলল, ‘কোন দেশের লোক? Wandering Jew?’
‘ইন্ডিয়ান।’
‘ঠিক, ইন্ডিয়ানদেরই মতো দেখতে। কিন্তু উনি? ওঁকে তো দেখতে ইন্ডিয়ানের মতো নয়?’
পেগি বলল, ‘উনি রেড ইন্ডিয়ান। আর আমি হোয়াইট ইন্ডিয়ান।’
ইন্সপেক্টার এর উত্তরে কী একটা রসিকতা করতে যাচ্ছিল, সোম বলল, ‘কাল করবেন। আমরা সাত ঘণ্টা খাইনি, এত হেঁটেছি যে দাঁড়াতে পারছি নে। হয় আমাদের এইখানে খেতে দিন, নয় কোথাও খাবার বন্দোবস্ত করে দিন আগে।’
ইন্সপেক্টার লজ্জিত হয়ে বলল, ‘সমস্ত বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। ইন্ডিয়ার মানুষ পর্থকওলে এসেছেন, সুখী হয়ে না ফেরেন তো কী বলেছি! অমৃতের মতো হাওয়া এখানকার। সমুদ্রতীরে গেছিলেন?’
সোম বলল, ‘ক-বার করে বলব? এইমাত্র আপনার কনস্টেবলকে পর্থকওলের নাড়ীনক্ষত্রের খবর দিয়েছি।’
ইন্সপেক্টার একজনকে ডেকে বলল, ‘জন?’
‘স্যার।’
তিনটে বোর্ডিং হাউসের নাম দিচ্ছি। আমার নাম করে জায়গা চাইবে। একটাতে না হয় আরেকটাতে। নামগুলো মনে থাকবে তো?’
‘নিশ্চয়ই, স্যার।’
জন সোমকে ও পেগিকে নিয়ে সমুদ্র সন্নিকটবর্তী তিন তিনটে বাড়িতে গেল। কেউ বলে জায়গা হয়তো একজনের হবে, কিন্তু খাবার। কেউ বলে খাবার যৎসামান্য জোগাড় করা যায়, কিন্তু বিছানা!
জনের সঙ্গে ইতিমধ্যে সোমের আলাপ চলছিল। জন নাকি লণ্ডনে ট্রেনিং নিতে গেছিল। লণ্ডনকে তার ভালো লেগেছে। এখানে তার শরীর খুব ভালো থাকছে বটে, কিন্তু বড্ড খাটুনি। অনেকের সঙ্গে বন্ধুতা হয়েছে।
জন বলল, ‘এসেছেন যখন পর্থকওলে স্যার, তখন আপনাদের ফিরে যেতে দেব না। আমার একজনের সঙ্গে জানাশোনা আছে। কিন্তু মাইল খানেক দূরে।’
পেগি সোমের বাহুতে ভর দিয়ে সক্লেশে হাঁটছিল। সোমেরও শরীর ভেঙে পড়ছিল। মাইল খানেক দূরে। সেখানে যদি না হয় তবে? হা ভগবান!
জন বলল, ‘সেখানে জায়গা থাকবেই, স্যার। না থাকলেও তারা যেমন করে হোক দেবেই। তাদের সঙ্গে আমার বিশেষ খাতির।’
পেগি কথা বলছিল না। মহিলার সঙ্গে কথা বলবার সাহসও ছিল না গ্রাম্য কনস্টেবলের।
একটা কাফে। গ্রামের সীমান্তদেশে তার অবস্থিতি। কাফেওয়ালিরা নিদ্রার আয়োজন করছিল। অতিথি পেয়ে আহারের আয়োজনে লেগে গেল। জনকেও ছাড়ল না। জন যে তাদের ঘরের ছেলের মতো। পাশের ঘরে তাকে নিয়ে একজন খেতে বসল। অপর জন পেগি ও সোমকে রুটি ও ডিম পরিবেশন করল। ফল তাদের কাফে সংলগ্ন দোকানে অপর্যাপ্ত ছিল। পরিশেষে কফি।
তখন রাত্রি সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে, বারোটা বাজে। ঘুমে চোখের পাতা জুড়ে আসছে। কাফেওয়ালিরা সোমকে ও পেগিকে নিয়ে সকলের উপরতলায় যে গ্যারেট সেই ঘরে ছেড়ে দিল।
পেগির তখন খেয়াল ছিল না যে ঘরটাতে দুটো বিছানা এবং ঘরটা সোমেরও। কাফেওয়ালি যখন মোমবাতিটা ম্যান্টলপিসের উপর রেখে দিয়ে গুডনাইট জানিয়ে চলে গেল তখন পেগি বলল, ‘আপনার ঘরে যাবেন না?’
সোমও সেই কথা ভাবছিল। কনস্টেবল কি দুটো ঘরের কথা বলেনি, না দুটো ঘর পাওয়া যায়নি? কাফেওয়ালিকে সে-কথা জিজ্ঞাসা করতে সংকোচবোধ হচ্ছিল। কাফেওয়ালি হয়তো ধরে নিয়েছে যে এরা স্বামী-স্ত্রী। তা নইলে এমন একসঙ্গে বেড়ায়? চেহারা ও রং থেকে তো মনে হয় না যে ভাই বোন!’
সোম বলল, ‘আমাকে তো আলাদা ঘর দেয়নি?’
পেগি ধপ করে একটা বিছানায় বসে পড়ে বলল, ‘সর্বনাশ!’ তার মুখে লজ্জা ভয় ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা।
সোম বলল, ‘যাব নীচে নেমে? বলব আর একটা ঘর থাকে তো দিতে?’
‘থাকলে ওরাই দিত। কেননা দুটো ঘর দিলে প্রায় ডবল লাভ করত।’
এই বলে পেগি দুই হাতে মুখ ঢেকে ভাবতে কি কাঁদতে কি হাসতে লাগল তা সোম ঠাহর করতে পারল না। এমন সংকটে সে কখনো পড়েনি। তার জীবনে নারীঘটিত সংকট ঘটেছে অনেক। কখনো ট্রেনে কখনো সরাইতে কখনো তীর্থক্ষেত্রের ভিড়ের মধ্যে। কিন্তু তরুণী নারীর সঙ্গে এক ঘরে রাত্রিযাপন—তাও সম্ভোগের জন্যে নয়, যে জন্যে কলঙ্কভাগী হয়েও সুখ আছে!
ঢং ঢং করে বারোটা বাজল শুনে পেগির ধ্যান ভাঙল।
পেগি বলল, ‘আপনি তো একজন man of honour—কেমন?’
সোম একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে বলল, ‘নিশ্চয়।’
‘তবে আবার ভয় কাকে? কাফেওয়ালি যা খুশি ভাবুক, যা মুখে আসে রটাক। আপনি তো অশ্রদ্ধা করবেন না, প্রচার করে বেড়াবেন না।’
‘নিশ্চিন্ত হতে পারেন, মিস স্কট। আপনি যে কে এবং কোথায় থাকেন কার কন্যা এবং কী করেন তাই এখনও জানলুম না।’
‘হয়তো আমি পেগি স্কটই নই, এলিজাবেথ সিমসন। কিংবা জিনি জোনস।’
‘ভগবান জানেন।’
‘ভগবানকে ধন্যবাদ। মাসিমার ওখানে আপনাকে না নিয়ে গিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ বাঁচিয়েছি। না, না, অবিশ্বাস আপনাকে আমি করি নে, কিন্তু আপনিও তো পুরুষ। বিশ্বাসো নৈব কর্তব্য পুরুষেষু।’
পেগি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘লক্ষ্মীটি একবার ঘরের বাইরে যান যদি তো কাপড় ছেড়ে নিই। দেরি হবে না।’
সোম অভিমান পরিপাক করতে নিঃশব্দে গৃহত্যাগ করল। তার একটুও অভিরুচি ছিল না পেগির সঙ্গে এক ঘরে রাত কাটাতে। এত ঢং কেন? ন্যাকামির বেহদ্দ! সকাল বেলা যাকে ইয়ংম্যান বলে প্রচার করেছে, যার জন্যে মাসিমাকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে এসেছে, যার হাতে হাত রেখে সমস্ত গ্রামটাকে সাত পাক দিয়েছে তার সঙ্গে ঘটনাচক্রে এক ঘরে শুতে হচ্ছে বিভিন্ন বিছানায়। এই নিয়ে এত ফুটানি!
সোম যদি অন্য ঘর পেত নিশ্চয়ই পেগির ঘরে ফিরত না। পেগি সাধলেও না।
ভিতর থেকে পেগির ডাক এল। সোম রাগ করে দু-তিন মিনিট বাইরেই পায়চারি করতে থাকল, ভিতরে গেল না। তখন পেগি দরজা খুলে মুখ বের করে সন্ত্রস্ত স্বরে বলল, ‘মিস্টার সোম।’
সোম গাম্ভীর্যের সঙ্গে মৃদু কন্ঠে বলল, ‘ইয়েস?’
‘আছেন তা হলে। আমি ভেবেছিলুম নীচে চলে গেছেন।’
‘নীচে চলে গেলে নিষ্কণ্টক হন?’
‘ছিঃ ছিঃ। দেখুন এসে, আপনার বিছানা কেমন নতুন করে পেতেছি।’
সোম চমৎকৃত হল।
পেগি বলল, ‘এবার আপনাকে প্রাইভেসি দিয়ে আমি চললুম বাইরে। কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না বলে যাচ্ছি। ক্লান্তিতে আমার পা দু-গাছা ভেঙে পড়ছে মিস্টার সোম।’
সোমের মনে ক্ষোভলেশ রইল না। সে পেগিকে ক্ষমা করল।