ঠিকানা ঠিকই ছিল। বাড়ির নম্বর, রাস্তার নাম, পোস্ট অফিস, জেলা–সব ঠিক ছিল। পিয়ন যথা নিয়মে চিঠি পৌঁছে দেয় নির্দিষ্ট ঠিকানায়। অন্তত আশা করা যায়। কখনো যে ভুল হয় না, তা নয়। ভুল হয় বৈকি। তাই বোধহয় হয়েছিল। তা না হলে আবার ডাক বাক্সে দেবে কেন? এবার পিয়ন একটু সতর্ক হয়েই চিঠি পৌঁছে দিল চিঠিতে লেখা ঠিকানায়। সে চিঠি পরের দিনই আবার ডাক বাক্সে ফিরে এল।
এবার পিয়ন চিঠি বিলি করতে গেলেই গৃহস্বামী বললেন, আরে মশাই, এ বাড়িতে বিকাশ চৌধুরী বলে কেউ থাকে না। এ চিঠি ফেরত নিয়ে যান।
খামের চিঠি। হাতে লেখা ঠিকানা। খামের কোথাও পত্রদাতার নাম-ঠিকানা লেখা নেই। সাধারণতঃ থাকে না। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের চিঠি হলে খামের এক জায়গায় লেখা থাকত If undelive red, please return to…
শেষ পর্যন্ত সে চিঠি এসে হাজির আর-এল-ওতে। শৈলেনদার হাতে এমনি আরও একটা খামের চিঠি এল। চিঠি দুটো হাতে নিয়ে শৈলেনদার একটু খটকা লাগল। দুটি খামের ঠিকানাই কী একই মানুষের লেখা?
না, না, তা কি করে সম্ভব? একটা চিঠি পোস্ট হয়েছে শ্রীরামপুরে অন্যটি গোবরডাঙা। শ্রীরামপুরের চিঠিটা ফেরত এসেছে বেহালা থেকে, অন্যটি উত্তরপাড়া থেকে এই ধরনের চিঠিপত্রকে পত্ৰলেখককেই ফেরত পাঠাতে হয়। অথবা দেবার চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় খামের বাইরে প্রেরকের নাম-ঠিকানা না থাকলেও চিঠির মধ্যে নাম ঠিকানা পাওয়া যায় এবং সে জন্যই শৈলেনদা চিঠি দুটো খুললেন।
এ্যা!
না, না, এ দুটি চিঠি কখনই দুজনের লেখা নয়–একই মানুষের লেখা। নিশ্চয়ই! একশবার! হাজার-হাজার লক্ষ-লক্ষ মানুষের হাতের লেখা দেখতে দেখতে এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে ভুল হতে পারে না। কিন্তু…তবু শৈলেনদার খটকা লাগে। একই মানুষের লেখা। একই দিনে পোস্ট করা কিন্তু কোথায় শ্রীরামপুর আর কোথায় গোবরডাঙা। নাকি ইনি শ্রীরামপুরে বাস করেন ও গোবরডাঙায় চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য করেন? অথবা গোবরডাঙা থেকে শ্রীরামপুরে যাতায়াত করেন?
আপন মনেই মাথা নাড়েন শৈলেনদা। ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
পরের চিঠি পড়তে কিছু কিছু মানুষের আগ্রহ-উৎসাহের সীমা নেই। মেয়েদের হস্টেলের বিগত যৌবনা প্রৌঢ়া সুপারিনটেনডেন্ট ছাত্রীদের চিঠি পড়ার সময় নিজের অতীত জীবন বেমালুম ভুলে যান। সদ্য বিবাহিত-বিবাহিতদের চিঠিপত্র পড়তেও বহুজনের আগ্রহ দেখা যায় কিন্তু আর-এল-ও রিটার্ন লেটার অফিসের কর্মীদের মধ্যে এই ধরনের উৎসাহ বা আগ্রহ নেই। হওয়া সম্ভব নয় পেটের দায়ে, চাকরির খাতিরে বাধ্য হয়ে যাদের নিত্য অন্যের চিঠি পড়তে হয়, তাদের কী এ বিষয়ে উৎসাহ থাকতে পারে?
তাইতো শৈলেনদা চিঠি দুটো টেবিলের উপর রেখে সুকুমারদার ঘরে চা খেতে গেলেন। ফিরে এসেও সিগারেট ধরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাটাবার পর প্রায় অনিচ্ছার সঙ্গেই একটা চিঠি পড়তে শুরু করেন।
দুচার লাইন পড়ার পরই শৈলেনদা সিগারেট ফেলে দিয়ে হঠাৎ খুব মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়লেন। বার বার বেশ কয়েকবার। যতবার পড়েন ততবারই সন্দেহ আরও বাড়ে। মনে হল কি যেন অঘটন ঘটতে যাচ্ছে। তাইতো চিঠিটা আবার আস্তে আস্তে পড়তে শুরু করেন।…
প্রিয় সন্তু, আগামী মাসের তিন তারিখ থেকে আমাদের পাড়ার জগদীশ সরকারের মেয়ে শিউলি আর তার বর ধ্রুব জলদাপাড়া ফরেস্ট বাংলোয় দশ দিন থাকবে। আমি এই মাসে ২৮ তারিখ থেকে মিঃ ও মিসেস বিমল ব্যানার্জী নামে ঐ ফরেস্ট বাংলোয় একটা ঘর এক সপ্তাহের জন্য রিজার্ভ করেছি।
তুই ছোট বৌদিকে নিয়ে ২৭ তারিখে দার্জিলিং মেলে রওনা হবি এবং ২৮-এ অবশ্যই ওখানে পোঁছবি। ৪ তারিখে বিকেলে তোর বাংলো ছাড়বি ও সবাই জানবে তোরা রাত্রের ট্রেনে কলকাতা রওনা হবি। তুই কাছাকাছি কোথাও গা ঢাকা দিয়ে কাটাবার পর রাতে একটা থেকে দেড়টার মধ্যে কাজ শেষ করবি। ঠিক সময় হাতের কাছেই জীপ থাকবে। তারপর আমার দায়িত্ব।
২৫ তারিখে দুপুরে ১২টা ১০ মিনিটে খদ্দরের পায়জামা-পাঞ্জাবি জওহর কোর্ট পরা একটা ছেলে হাওড়া স্টেশনের কফি কর্নারে ঢুকবে। ও যে টেবিলে বসবে তোর লোকও যেন সেই টেবিলে বসে ও ওঠার সময় ব্রীফকেস বদলাবদলি হবে। ঐ ব্রীফকেসে সম্প্রতি গঙ্গায় ধরা খুব ভাল ইলিশমাছ ছাড়াও রেলের টিকিট, ফরেস্ট বাংলো রিজার্ভেশানের কাগজ ও দশ দিস্তা নতুন কাগজ থাকবে।
চিঠি এখানেই শেষ। চিঠির নিচে কোন নাম নেই। শুধু লেখা আছে–ইতি তোর প্রিয় বন্ধু!
শৈলেনদা আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে অন্য চিঠিটা পড়েন…
বিকাশ, গত সপ্তাহে গঙ্গায় যে ইলিশ ধরা পড়েছে, সেটা আর দশ দিস্তা নতুন কাগজ একটা ব্রীফকেসে ভরবে। তারপর ঐ ব্রীফকেস নিয়ে ২৪ তারিখ বিকেল ৩টা ১৫ মিনিটের সময় ইডেনগার্ডেনের ক্লাব হাউসের গেটে আসবে। ওখানে ধুতি-শার্ট পরা এক ভদ্রলোক ইসারা করলে তার পিছন পিছনে যাবে ও সুবিধা মত জায়গায় ব্রীফকেসটি ওকে দিয়ে দেবে।
এ চিঠি এখানেই শেষ কিন্তু এর নিচে নাম আছে–ইতি নন্দ।
দুটি চিঠির কোনটিতেই পত্ৰপ্রেরকের ঠিকানা ছিল না এবং থাকলেও এ চিঠি আর-এল-ও অফিস থেকে পত্রপ্রেরকের কাছে পাঠানো হতো না।
শৈলেনদা আপনমনে কথা বলতে বলতে একটু থামতেই আমি জিজ্ঞেস করি, চিঠি দুটো আপনাদের অফিসে এল কেন?
উনি একটু হেসে বললেন, আসলে সন্তুর নামের নিচে বিকাশের ঠিকানা লেখা ছিল।
আবার বিকাশের নামের নিচে বুঝি সন্তুর ঠিকানা লিখেছিল।
হ্যাঁ।
যাই হোক, তারপর কী হল?
চিঠি দুটো সঙ্গে সঙ্গে আমরা লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগে পাঠিয়ে দিলাম।
শৈলেনদা এবার একটা সিগারেট ধরিয়ে দুএকটা টান দেবার পর বললেন, আর দুটো দিন দেরি হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত।
আসল ব্যাপারটা কী ছিল?
কী আর ব্যাপার? গুণ্ডা-বদমাইসা যা করে আর কি! নাম ঠিকানা ঠিক থাকলে ঐ ধ্রুব বেচারী প্রাণ হারাত আর শিউলিকে নিয়ে নন্দ ব্যাঙ্গালোর চলে যেত।
তাই নাকি?
তবে কী?
ধ্রুব কী অপরাধ করেছিল যে…
আমার কথার মাঝখানেই উনি বলেন, নন্দ বিখ্যাত গুণ্ডা ও বদমাইস ছিল। ও নেপাল থেকে আফিঙ স্মাগলিং করে এনে বিদেশে পাচার করত। এই কাজের জন্য ও একদল মেয়েকে রেখেছিল। শৈলেনদা একটু হেসে বললেন নন্দ এই মেয়েগুলোর সঙ্গে স্ফুর্তিও করত।
কিন্তু ধ্রুব?
বলছি, বলছি।
আমি আর প্রশ্ন করি না! শৈলেনদা আবার বলে যান, আমি চুপ করে শুনি।
নন্দর এইসব কাজ-কারবারের জন্য পাড়ার লোকজন অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করলেও প্রকাশ্যে ওর বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস করতেন না কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সহ্য না করতে পেরে বেচুবাবু একদিন নিজে গিয়ে পুলিশকে খবর দিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করে দিলেন।
তিন বছর প্রেসিডেন্সী জেলে কাটিয়ে আসার কিছুদিন পরই নন্দ হঠাৎ একদিন শিউলিকে দেখেই পাগল হয়ে উঠল। ব্যস! পরদিন ও বেচুবাবুকে গিয়ে বলল আপনার শিউলির সঙ্গে আমার বিয়ে দিন।
ঐ লম্বা চওড়া বেচুবাবু সঙ্গে সঙ্গে ওর গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বললেন, জবাব পেয়েছ?
নন্দ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে কোন মতে সামলে নিয়ে শুধু বলল, সুদে-আসলে এর জবাব দেব।
তোমার মত পুচকে গুণ্ডাকে বেচু সরকার ভয় করে না।
সত্যি বেচু সরকার ওকে ভয় করতেন না। শিউলির বিয়ের দিন নন্দ দুজন সাগরেদকে সঙ্গে নিয়ে হামলা করতে এসে এমন শিক্ষা পেয়েছিল যে তা সে জীবনে ভুলতে পারবে না।
শৈলেনদা এক নিঃশ্বাসে সব বলে যান।
আমি জানতে চাই, নন্দ কি বেচুবাবুর মেয়ে-জামাইকে খুন করার প্লান করেছিল?
মেয়েকে না, শুধু জামাইকে খতম করার প্ল্যান করেছিল। জামাইকে শেষ করে মেয়েকে নিয়ে উধাও হবার মতলব ছিল।
পুলিস ধরে ফেলেছিল নিশ্চয়ই?
ধরেছিল মানে? রাবণের গুষ্টিকে ধরেছিল। তারপর তো কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুল।
তার মানে?
দেখা গেল, নন্দ সন্তুকে দিয়ে আগে আরও দুটো মার্ডার করিয়েছে। তাছাড়া কলকাতা পোর্টে আসার সময় কিছু বিদেশী জাহাজ ডায়মণ্ডহারবারের ওদিকে গঙ্গার জলে বাক্স ভর্তি রিভলবার ফেলে দেয় ও বিকাশ সেসব নিয়ে ব্যবসা করে।
আমি একটু হেসে বললাম, ঐ রিভলবারকেই বুঝি চিঠিতে গঙ্গার ইলিশ বলেছে?
শৈলেনদা একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, আর দশ দিস্তা নতুন কাগজ মানে নতুন দশ হাজার টাকার বাণ্ডিল।
কয়েক বছর ধরে এই মামলা চলেছিল। দায়রা জজের রায়ের বিরুদ্ধে ওর। হাইকোর্টে আপিল করেছিল কিন্তু কিছু লাভ হয়নি। সন্তু অর নন্দ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে এখনও প্রেসিডেন্সী জেলে রয়েছে।
শৈলেনদা এই মামলার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন। দায়রা জজ ও হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতি ওঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। বিচারপতিদের প্রশংসার জন্য কিছু মাইনেও বেড়েছিল!
আর?
শৈলেনদা এখন বেচুবাবুর পরমাত্মীয়। আর শিউলি তো কাকু বলতে অজ্ঞান।
এ সংসারে কখন কোথায় যে অঘটন ঘটবে, তা কেউ জানে না, জানতে পারে না।