৩. টাইমিংটা একেবারে পারফেক্ট

।। ।।

স্কুলের হলঘরটা বিশাল। তার একদিকে পুজোর জায়গা, অন্যদিকে টেবিল-চেয়ার পেতে খাবারের আয়োজন। আমাদের টাইমিংটা একেবারে পারফেক্ট, ভোগ বিতরণটা সবে শুরু হয়েছে। প্রত্যেক পাড়ার পুজোর স্ট্রং পয়েন্ট হল ভোগের নাম করে খাবারের দেদার আয়োজন! গরম গরম পাতলা অতি সুস্বাদু খিচুড়ি। তার সঙ্গে তিন রকমের তরকারি আর ভেজিটেবল চপ। গ্র্যান্ড ফিনালি হল পাঁপড়, চাটনি, দই আর দু’রকমের মিষ্টি দিয়ে। অবশ্য এবারের আয়োজনটা নাকি একটু বেশিই! সেটা শুনলাম ওখানকার এক কর্মকর্তা সুধীর শিকদারের কাছ থেকে। লোকটাকে শ্যামলদার বাড়িতে আগে কয়েকবার দেখেছি। চোখে পিচুটি কুমড়োপটাস টাইপের হাইলি আনহাইজিনিক অ্যান্ড আনহেলদি চেহারা। লোকটা অসম্ভব কথা বলে, তার ওপর মুখ দিয়ে থুতু ছেটায়! বিশ্বশুন্ধু এত লোক থাকতে আমার ওপর হঠাৎ এত কেন সদয় হল, ভগবান জানেন! ঝাড়া পঁচিশ মিনিট হলের কোণে আমাকে কবজা করে অফুরন্ত বকলেন! ভাগ্যিস একেনবাবু এসে সাহানিদের খোঁজ করলেন! সাহানিদের কথা উঠতেই শিকদারমশাই বললেন, “চেনেন নাকি ওঁদের? কী স্যাড ব্যাপার বলুন তো! বাড়ির গেস্ট ডেড, আর আঙ্কল মিসিং!”

আমি বললাম, “আঙ্কল মিসিং মানে? আমি তো শুনেছিলাম মিসিং পার্সন হল গেস্ট ভ ভদ্রলোকের কাজের লোক!”

“ওয়েল,” বলে শিকদারমশাই আমার ঠিক মুখের সামনে একগাদা জার্ম স্প্রে করে নোংরা রুমালে সশব্দে নাকটা ঝাড়লেন।

আমি জার্মগুলো এড়ানোর জন্য দম চেপে দাঁড়িয়ে আছি, সেই ফাঁকে পাশ থেকে একেনবাবু প্রশ্ন করলেন। “কী ‘ওয়েল’ স্যার?”

“আসলে,” শিকদারমশাই চারিদিকে একবার চট করে তাকিয়ে নিয়ে খুব মাই ডিয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “মিসিং ম্যান ঠিক ভৃত্য নন। আই মিন নট অ্যান অর্ডিনারি সার্ভেন্ট। ওঁর আসল পরিচয় হল উনি সাহানিদের এক দূর সম্পর্কের কাকা। সাহানিরা অবশ্য এটা কাউকে বলে না। এনিওয়ে হি ইজ অলসো শ্যাম মিরচন্দানি, মানে যে ভদ্রলোক মারা গেছেন, তাঁর গ্রামেরই লোক এবং মিরচন্দানির বন্ধুও। মিরচন্দানির সঙ্গে সাহানিদের পরিচয় এই কাকার সুত্রেই।”

“দাঁড়ান স্যার, দাঁড়ান। আপনি বলছেন ছেলেবেলার বন্ধু, কিন্তু তাঁকে দিয়ে মিস্টার মিরচন্দানি গৃহ ভৃত্যের কাজ করাচ্ছিলেন!”

“এই তো আপনাদের নিয়ে মুশকিল, আপনার বড় বেশি সেন্টিমেন্টাল। এ জব ইজ এ জব। শ্যাম মিরচন্দানির সাতকূলে কেউ নেই। ভদ্রলোক কিছুদিন আগে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে ফুলটাইম লোক রাখার খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। কিছুদিন প্রাইভেট নার্স রেখেছিলেন। কিন্তু এখানে প্রাইভেট নার্স রাখতে হলে যে কী খরচ সেটা তো

জানেনই। তাই বুদ্ধি করে দেশ থেকে গরীব বন্ধুকে আনিয়ে নিয়েছিলেন। ফ্রেন্ড কাম ফ্রেন্ড, হেল্পার কাম হেল্পার! বন্ধুকে মাইনেপত্র কী দিতেন অবশ্য জানি না, বাট আই বেট, যাই দিতেন না কেন –তাতে ওঁরও লাভ, ওঁর বন্ধুরও লাভ!”

সুধীর শিকদার হাঁড়ির এত খবর পেলেন কোত্থেকে কে জানে! আমরা হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে, শিকদারমশাই বললেন, “যাক, এসব আবার কাউকে বলবেন না যেন! সাহানি ব্রাদার্স হচ্ছেন আমাদের পুজোর একজন বড় পেট্রন। শুধু শুধু চটিয়ে দিলে, বুঝতেই তো পারছেন … কী মিন করছি!”

“তা বেশ পারছি স্যার,” একেনবাবু বললেন, “থাক ওসব কথা। তবে একটা কথা স্যার, অবাঙালিরা সরস্বতী পুজোয় চাঁদা দিচ্ছে, শুনতেও ভালো লাগে!”

“না, তা ওঁরা দেন। মানুষের ভালো পয়েন্ট দেখলে, সেটা না বলার পাত্র এই সুধীর শিকদার নয়। দোষ দেখলে দোষ বলব, গুণ দেখলে গুণ।”

“সেটা হল মহৎ লোকের লক্ষণ স্যার।” বুঝলাম একেনবাবু একটু তেল দিলেন। তারপর বললেন, “ভালো কথা, কে জানি বলছিলেন যে, এখানকার ফুডের ইনচার্জ হলেন আপনি? যাই বলুন স্যার, আপনাদের এখানে ভোগের আয়োজনটা কিন্তু সত্যিই প্রচণ্ড!”

“ভাল লেগেছে?” শিকদারমশাই খুব খুশি হয়ে প্রশ্নটা করলেন।

“যেমন ভ্যারাইটি স্যার, তেমনি রান্নার কোয়ালিটি।” একেনবাবু শিকদারমশাইয়ের আত্মতৃপ্তিটা বলতে গেলে প্রায় চরমে তুলে দিলেন।

“কোয়ালিটির জন্য দায়ী এই শর্মা,” নিজেকে দেখালেন শিকদারমশাই। “বুঝলেন মশাই, সারা বছরে এই একদিনই আমি রাঁধি। কিন্তু যখন রাঁধি, তখন চারশো লোকের জন্য রাঁধি! একটু পানবাহার চলবে নাকি?” পাঞ্জাবির পকেট থেকে টিনের একটা দোমড়ানো কৌটো বার করলেন সুধীর শিকদার।

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ!” একেনবাবু এক টিপ পানবাহার মুখে পুরে বললেন, “এখন একটু স্নাফ পাওয়া গেলেই সোনায় সোহাগা হত!”

“স্নাফ!”

“হ্যাঁ স্যার স্নাফ, মানে নস্যি।”

“অ্যাাঁ, আপনিও নস্যিরসিক!” শিকদারমশাই এমন ভাবে একেনবাবুর দিকে তাকালেন, যেন বহুদিন বাদে ভাগ্যচক্রে হঠাৎ টুইন ব্রাদারকে আবিষ্কার করেছেন! “তাহলে একদিন আসুন না আমাদের বাড়িতে। আনলিমিটেড নস্যি সাপ্লাই একেবারে গ্যারান্টিড! আই কান্ট গিভ ইউ নাউ। গিন্নী নস্যির ডিবে নিয়ে বেরোলেই বড় চ্যাঁচামেচি করে! তাই তো একটু আগে সুট করে বাড়ি গিয়ে একটিপ নিয়ে এলাম।” তারপর আমার মুখের সামনে মুখ এনে বললেন, “আপনিও আসুন না মশাই, শেয়ার দ্য এক্সপিরিয়ান্স!”

কী ডিসগাস্টিং! মনেমনে ভাবলাম। মুখে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম, “না আমি নস্যি নিই না।”

আমার গলার সুরে নিশ্চয় বিরক্তির ভাবটা স্পষ্ট ছিল। শিকদারমশাই তাতে একটু দমে যাচ্ছেন দেখেই বোধহয় একেনবাবু বেশ গদগদ স্বরে আবার বলে উঠলেন, “যাই বলুন। স্যার, প্রতি বছর চারশো লোকের জন্য এত ভ্যারাইটি রান্না, তাও আবার এরকম দারুণ স্বাদ বজায় রাখা! ট্রলি অ্যামেজিং স্যার।”

শিকদারমশাই একেনবাবুর দিকে দারুণ অ্যাপ্রিশিয়েটিভ চোখে তাকালেন। ভাবটা, গুণীকে গুণী না চিনিলে, আর কে চিনিবে! তারপর বললেন, “হ্যাঁ, চারশোটা বরাবরই চারশো। তবে কিনা মিথ্যে বলব না, এত ভ্যারাইটি প্রতি বছর হয় না। এবারেরটা হল কমপ্লিমেন্ট অফ গ্রেট সাহানি ব্রাদার্স। ওরাই…”

শিকদারমশাই আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু একটা কমবয়েসি ছেলে এসে ওঁকে একটু আড়ালে নিয়ে গেল। শিকদারমশাই সামনে থেকে যেতে না যেতেই শুনলাম কেউ চাপা গলায় বলছে, “ফ্রোজেন ফুড!”

পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি প্রমথ। ও যে কখন এসেছে, টেরই পাইনি।

“ফ্রোজেন ফুড! কী বলতে চাচ্ছিস তুই?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“এই পুজোয় সাহানিদের কনট্রিবিউশন! ফ্রিজারে বোধহয় পচছিল, তাই সুযোগ বুঝে ডাম্প করেছে এখানে।”

“আপনি কী করে জানলেন স্যার?”

“কেন মশাই, আপনিই কি একা গোয়েন্দা এখানে! আমাদের চোখ-কান নেই?” তারপর বলল, “কয়েকটা ছেলে বলাবলি করছিল, কানে এল। অবশ্য আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। তরকারিগুলো কেমন যেন জল জল লাগছিল, তাই না?”

জল জল না মুণ্ডু! প্রমথটার ফ্রোজেন জিনিসের প্রতি একটা ভয় আছে। সব সময় বাজার থেকে ফ্রেশ ভেজিটেবল কিনবে। ফ্রেশ না পেলে ক্যানড। কিন্তু ফ্রোজেন কখনোই কিনবে না! লোকে বরং ক্যানড ফুডের ব্যাপারে সাবধান হয় –বচুলিজমের জন্য! কিন্তুকে কাকে বোঝায়!

“এই বাপি বিচ্ছুর মতো ওখানে লুকিয়ে আছিস কেন –এদিকে আয়!” বেন্টুমাসি উদাত্ত গলায় হলের অন্য প্রান্ত থেকে ডাক দিলেন।

.

আমি বিচ্ছু নই, লুকিয়েও নেই। তাছাড়া আমি একা নই, আরও দু’জন –একেনবাবু ও প্রমথ আমার পাশে দাঁড়িয়ে। তবু সম্বোধনটা শুধু আমাকে কেন করা হল বুঝলাম না! তবে কানটা ঝাঁঝাঁ করে উঠল, যখন দেখলাম হলভর্তি লোক বেন্টুমাসির এই বিচ্ছু বোনপোর দিকে তাকিয়ে আছে!

“কী ব্যাপার, চাঁচামেচি করছ কেন?” বেন্টুমাসির সামনে গিয়ে একটু বিরক্ত হয়েই প্রশ্নটা করলাম।

বেন্টুমাসি আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে একেনবাবুকে বললেন, “এই যে একেন, এ হচ্ছে অশোক, আর এ হল অরুণ। এরা তোমার কথা খুব ভালো করে জানে।”

“এঁরা?” অশোক আমাদের দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন।

“ও হ্যাঁ, এবার আমাদের কথা মনে পড়ল বেন্টুমাসির। “এই অকালকুষ্মও হতভাগা হচ্ছে আমার বোনপো বাপি, আর এটা হল ওর যোগ্য সহচর প্রমথ।”

এরকম একটা ইনট্রোডাকশনের পর কার না দিল খুশ হয়!