ঝুমু ও টোপর ও স্বপ্নের ঘোর
‘ঝুমুদি, চলো সব মিলে পুরী ঘুরে আসি।’
‘কবে?’
‘এই শুক্রবার।’
‘আজ বুধবার।’
‘হ্যাঁ। গাড়ি নিয়ে যাই চলো।’
‘কী আশ্চর্য!’
‘কেন?’
‘কাল সমুদ্র স্বপ্ন দেখেছি।’
‘আমিও তো। সমুদ্র আমার কাছে এল। বলল— চলো হে! চাকরির জাঁতাকলে পড়ে গেলে বন্ধ ওড়াউড়ি। বললাম— বেশ। যাও তবে। ঝুমুকে গিয়ে বলো। সে যদি রাজি থাকে। যদি সারস পাখিটি হয়ে, আমাকেও ঠোঁটে তুলে উড়ান লাগায়।’
‘আজ সরসী এসেছিল রে সকালটায়?’
‘হ্যাঁ। তুমি যেমন শিখিয়ে দিয়েছিলে তেমন বলেছি। আমি তো তোমার ভক্ত। ঝুমুদি যা বলে টোপর তা করে।’
‘ঝুমুদি কি ভুল বলে?’
‘না। ঝুমুদি টোপরের জন্য নির্ভুল।’
‘কার জন্য ভুল?’
‘তার নিজের জন্য।’
‘কেন রে, আমি নিজের তো কোনও ক্ষতি করিনি।’
‘চাকরিটায় আবার যোগ দেবে ঝুমুদি? বাবার কথায় ওঁরা তোমাকে নিয়েছিলেন। এখনও বাবার চাকরি আছে, জোর আছে। বললে হয়তো হয়ে যাবে। আরও অন্য সংস্থা আছে।’
‘এই সাতাশ বছর বয়সে কে আমাকে চাকরি দেবে টোপর? ফক্স অ্যান্ড গুপ্তা যখন ছেড়ে আসি, ওঁরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার অসুবিধা ঠিক কী।’
‘হ্যাঁ। আমার মনে আছে। তুমি বলেছিলে বাড়িতে অসুবিধা হচ্ছে। মা নেই তো আমাদের।’
‘হ্যাঁ। তাই বললাম। তখন আমাদের প্রধানত যিনি কাজ শেখাতেন, সুকুমার বাগচি, বললেন— মা, তোমার যখন বিয়ে হয়ে যাবে, বাড়ির লোক কী উপায় করবেন! আমি হাসলাম। উনি শুধু মাথা নেড়েছিলেন।’
‘তুমি তো বলতে পারতে বাবা চায় না, অথচ তুমি বললে, বাড়িতে অসুবিধা হয়। তুমি সত্যিটা বুঝেছিলে, বলেও ফেলেছ। কিন্তু অন্য সত্য গোপন করেছ।’
‘কাল রাতে তোর কথাগুলো ভাবছিলাম। আমার চাকরির সুযোগ, সেটা হারানো। বাবার একটা দিক নতুন করে আবিষ্কার করলাম।’
‘কী?’
‘আচ্ছা, টোপর, তোর তো আজ বেরোন নেই!’
‘নো, ম্যা অ্যা অ্যা মা! আজ আমি কোনও কাজ রাখিনি। সকালে নিজেকে পোড়ালাম!’
‘মানে? ছ্যাঁকা খেয়েছিস? কী করতে চেয়েছিলি?’
‘কুল বেইবি, কুল! আমার কোথাও লাগেনি! খুব সাবধানে থাকা অভ্যাস আমার। অসাবধানতা কি আমার পক্ষে বরদাস্ত করা সম্ভব? এমন হাঁক পাঁক করো!’
‘তবে যে বললি!’
‘ক্যালোরি বার্ন করলাম। সুপ্রিয়দা এসেছিলেন। যেমন আসেন। তাই বললাম নিজেকে পোড়ালাম। আমারই তো ক্যালোরি! তুমিও এবার থেকে খানিক আসন, প্রাণায়াম করো দেখি।’
‘করলেই হয়। স্কুলে অনেক শিখেছিলাম।’
‘ও দিয়ে হবে না। কাল সুপ্রিয়দা এলে তোমায় ডাকব, দেখে নিয়ো।’
‘না না। উনি তোর জন্য আসেন। সময় পরিমিত। টাকাও উনি তোরই জন্য নেন। আমি উপদ্রব জুটলে ওঁর মোটেই ভাল লাগবে না।’
‘মোটা হয়ে যাচ্ছ তুমি। তোমার রোজ শরীরচর্চা করা দরকার। তার জন্য সুপ্রিয়দার চেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি এ তল্লাটে আর পাবে না।’
‘তুই এমন বলিস টোপর! ভাল্লাগে না! মোটা হয়ে যাচ্ছি আমি জানি। আজ থেকে বিকেলবেলায় হাঁটব, হবে তো?’
‘হবে। কিন্তু শুধু হাঁটলেই হয় না। বসো। তোমাকে যোগাসন বিষয়ে খানিক লেকচার দিই।’
‘আমার দরকার নেই। আমি বাবাকে বলতেই পারব না মাসে মাসে টাকা খরচ করে আমার ওজন কমাও, কারণ বাবা কী বলবে আমি জানি।’
‘কী বলবে?’
‘আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাবে। অনেকক্ষণ কিছু বলবে না। তারপর দু’বার গলা খাঁকড়াবে। গেঞ্জি তুলে চশার কাচ মুছবে। অবশেষে লম্বা শ্বাস ফেলে বলবে— ‘এত টাকা কোথায় পাব রে মা? মাসে বারোশো টাকা নেবে, তাও সপ্তাহে তিনদিন, এত বাজে খরচ করা কি আমাদের সাজে? সামনে তোর বিয়ে। কত খরচ হবে বল তো। কোথা থেকে যে করব, ধারকর্জই বোধহয় নিতে হবে।’ সেদিন কী হল শোন! ক’দিন আগে খুব গলদা চিংড়ি খেতে ইচ্ছে করল, বাজারে পেয়েছিলাম, দেখে লোভ হল। কিনে ফেললাম।’
‘মনে আছে। মালাইকারি করে দিলে তো।’
‘মনে আছে তো? বাবা চিংড়ি দেখে বলল, ‘কত করে নিল?’ ‘সাড়ে পাঁচশো।’ ‘সা ড়ে পাঁ চ শো ও! ঝুমু, তোকে সারা সপ্তাহের বাজারের টাকা দিয়েছি, একদিনে শেষ? এভাবে চললে তো পথের ভিখিরি হয়ে যাব মা।’ আমার যে কী লজ্জা করল! আমি তো জানতাম বাবা খুশি হবে না, তবু কেন নিতে গেলাম! সামান্য চিংড়ির লোভ সামলাতে পারলাম না! ঝিরি ঝাঁঝিয়ে উঠল বাবার ওপর, ‘একদিন একটু চিংড়ি খেলে যদি পথের ভিখিরি হয়ে যাই আমরা বাবা, তবে তা হওয়াই উচিত।’ বাবা বলল, ‘এক টাকা বাঁচানো মানে একটাকা উপার্জন। নিজেরা রোজগার করলে বুঝতে পারবি।’ ঝিরি মুখঝামটা মারল, ‘বাজে কথা বোলো না, দিদি রোজগার করতেই গিয়েছিল, তুমি দাওনি! ও চিংড়ি কিনেছে, বেশ করেছে!’ বাবা আর কিছু বলেনি।’
‘আর সেই চিংড়ির মালাইকারি তুমি আমাদের খাইয়েছ।’
‘ভাল পদ কিছু হলে তোকে না দিয়ে খেতে পারি না রে।’
‘তোমার সব রান্নাই তো ভাল পদ ঝুমুদি।’
‘ওই একটাই তো পারি। তবু ভয়ে ভয়ে রান্না করি জানিস। এই বুঝি বেশি তেল দিয়ে দিলাম! তোদের জন্য সন্ধ্যাবেলায় মুখরোচক এটা-ওটা করি, কাজু দিই, কিশমিশ, গোলাপজল, আরও কত কী! বাজারের টাকা থেকে বাঁচিয়ে একটু একটু করে কিনি। বাবাকে দেওয়ার আগে, একটা একটা করে কাজু-কিশমিশ বেছে তুলি। গোপালীমাসি জানে। একবার আমি বেছে দিই, একবার মাসি বাছে। একটাও পেয়ে গেলে এমন করবে! রাগ তো করে না! যেন চোখের জল না ফেলে কাঁদে। তুই, ঝিরি— তোরা তো বাচ্চা, তোদের তো মুখরোচক খেতে ইচ্ছে করবেই। আমারই করে। রোজ চারাপোনার ঝোল, রোজ বাটামাছ, রোজ রুটি সাদা আলুর তরকারি— একঘেয়ে হয়ে যায় না? যদি টের পায়, বাজারের টাকা থেকে বাঁচাই, হয় টাকা আরও কম দেবে, নয়তো নিজেই বাজারে যেতে শুরু করবে। আমি সকাল-সকাল টাটকা বাজারে যেতে চাইলেও আপত্তি, তখন নাকি মাছ, আনাজ— সবকিছুর দাম বেশি থাকে। তোদের বাড়িতে এসে রান্না করতে ভাল লাগে আমার। স্বাধীনভাবে সব দিতে পারি। প্রবীরকাকার তো অত হিসেব রাখার বাতিক নেই। এটা আমার স্বাধীন দেশ।’
‘স্বাধীন দেশ? পাকাপাকি থেকে যাও না ঝুমুদি এ দেশে? দেশটা খারাপ কি? তুমি তো এর প্রতিটি কোনার খবর রাখো। মাকড়শা জাল বুনলে আমাদের আগে তুমি দেখতে পাও। এ দেশের টিকটিকিরা ক’টা পোকা খেল, সে খবরও তোমার অজানা নয়।’
‘দ্বৈত নাগরিকত্ব আমার। এদেশেরও লোক, ওদেশেরও। সেটাই তো ভাল।’
‘না। দেশাত্মবোধ ভাগ করা যায় বলে আমি মানি না। গাছেরও খাব, তলারও কুড়োব— খুব খারাপ স্বভাব। দু’নৌকোয় পা দিয়ে আজ পর্যন্ত চলতে পেরেছে কেউ?’
‘দাঁড়া, প্রবাদ প্রবচনের অভিধান বার করি। তোকে নতুন কিছু সরবরাহ করা দরকার।’
‘দরকার নেই। তুমি বলো দু’দেশের মধ্যে যদি যুদ্ধ বাঁধে, তুমি কোন পক্ষ নেবে?’
‘কূটনেতিক পদক্ষেপ হিসেবে দু’দেশই দ্বৈত নাগরিকত্ব বাতিল করবে। আমি তখন চার আনা দিয়ে টস করব।’
‘চার আনাই কেন? শুনেছ তো সিকি অচল।’
‘আমার চার আনাই সম্বল। চার আনার গুরুত্ব, চার আনার অধিকার, চার আনার স্বাধীনতা। আমার মতো সাধারণ মেয়ের যা থাকে।’
‘ষোলো আনা স্বাধীনতা কি চাও তুমি, ঝুমুদি?’
‘আমি তো স্বাধীনই।’
‘দ্বিচারিণী। মিথ্যাবাদিনী। যে নিজেকে প্রতারণা করে তার দাসত্ব চিরকালের। আমি তোমার আকাশ। আমাকে বলো, বলো তুমি তোমার যন্ত্রণা, বলো অপমান বলো, চিংড়ি পোকার মাথা চিড়ে নেমে আসা লালগোলা যাতনাকাতর, বলো, বলে দাও, পাকশালে তেলের পাত্রের মতো ঝাঁঝালো ব্যথার হাতে নিস্তেজ শুখাল পাতা। আর একটু স্বাধীন যদি হতে তুমি, মশলার কৌটো থেকে বেরিয়ে আসত, পাঁচফোঁড়নের মতো রংদার আলোকরমণী আর সাদা ডানা সফেদ সারস।’
‘সরসী কী বলল রে? তুই যখন বললি?’
‘কী লজ্জা! একটু মাছভাত খাবে, কী লজ্জা! কিছুতে নেব না। বলে, ঝুমুদি আসুক, নেব এখন। বললাম, ঝুমুদি গুছিয়েই রেখে গেছে। নিয়ে গেল।’
‘খেল না? নিয়ে গেল? দাঁড়া ধরব বিকেলে। নিয়ে গেল মানে ছেলেমেয়ে সবাইকে খাওয়াবে। ওর আর কী লাভ হল!’
‘তুমি থাকলে জোর করে খাওয়াতে পারতে।’
‘তাই করতে হবে। আমাকে ডাকবি ও এলে।’
‘তোমার জোর আছে। স্বাধীনতা আছে। তোমার বাড়িতেই পাঠিয়ে দেব ওকে। বলব, খেয়ে এসো।’
‘কীসের শোধ নিচ্ছিস টোপর? বাবার কৃপণতার জন্য গোপালীমাসি আমাদের বাড়িতে এক কাপ চা দিলেও খায় না। তোদের ভাতই সরসীকে খেতে হবে।’
‘তুমি সরসীকে রোজ খাওয়াতে পারো, তুমি সুপ্রিয়দার কাছে শরীরচর্চা করতে পারো, ভাল কোনও জিমে যেতে পারো, নামকরা পার্লারে রূপচর্চা করতে পারো, দামি পোশাক হাতে নিয়ে ছ্যাঁকা লাগার মতো সরিয়ে রেখে বলার দরকার হয় না— সাড়ে তিনশো-চারশো— দু’শো-আড়াই শো, বাটি থেকে কিশমিশ-বাদাম লুকিয়ে তুলতে হয় না ঝুমুদি, চিংড়ির লজ্জিত মালাইকারি দিয়ে মেখে লোভ সংবরণ করতে না পারার গ্লানিসমেত ভাতের মণ্ড মুখে তুলতে হয় না। যদি তুমি নিজে রোজগার করো।’
‘রোজগারেই কি সব অধীনতার মুক্তি?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘রোজগারেই কি সব ইচ্ছাপূরণের চাবিকাঠি?’
‘নিঃসন্দেহে।’
‘কই তোদের এখানে তো আমার রোজগার বিচার করা হচ্ছে না।’
‘আরে তোমাকে আমরা সেভাবে দেখিই না তুমি জানো। আমাদের নারীবিবর্জিত সংসার তো চলে আসলে নারীরই পরিচালনায়। এবাড়ির নাড়িনক্ষত্র তোমার জানা।’
‘তার মানে ‘সেভাবে দেখা’ গুরুত্বপূর্ণ। সরসী তো রোজগার করে। ও কি স্বাধীন?’
‘ও পরিস্থিতির অধীন। হয়তো ও স্বামীর প্রতি অনুরক্ত, সেটাই দুর্বলতা। হয়তো সন্তানদের কথা ভেবে ও স্থিতাবস্থাই নিরাপদ বোধ করে। কোটি কোটি দরিদ্র ভারতবাসীর মতো আশা করে বসে থাকে, দিন ফিরবে। স্বামীর জ্ঞান ফিরবে। ছেলেমেয়ে বড় হলে টাকার মুখ দেখবে।’
‘তার মানে দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি ‘পরিস্থিতি’ শর্তটাও উঠে এল।’
‘আজ তুমি আমাকে যুক্তি তে হারিয়ে দিচ্ছ।’
‘কফি খাবি?’
‘করো। দেখি উত্তেজক পানীয় আমার তর্কবুদ্ধি বাড়ায় কিনা।’
ঝুমু কফির জল চাপাল। কাপে দুধ, চিনি, কফি দিল। ফুটে ওঠা জল ঢালছে। নাড়ছে। বলল, ‘দাম বেশি বলে আমাদের বাড়িতে কফি আসে না। ভাল চা আসে না। দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। আবার এই দেখাটাও নানান রকম।’
ছোট টুলে কফির কাপ দুটি নিয়ে বসল মুখোমুখি। বলতে লাগল, ‘জীবনে এক-একটা উপলব্ধি মনটাকে নতুন করে গড়ে দেয়। আমার মা যেদিন মরে গেল, তুই খুব ছোট্ট, আমি পাঁচ পূর্ণ করেছি, বোন কয়েক মাসের, বাবা আমাকে কোলে নিয়ে বারান্দায়। বড়পিসি এসে বলল, ‘জ্যোতি, তোকে শক্ত হতে হবে। ছোট মেয়েটার জন্য আয়া রাখতে হবে। তোর শ্বশুরবাড়ির কেউ দায় নেবে না। আমার অবস্থা তো জানিস।’ বাবা বলল, ‘আয়া-টায়া রাখা সম্ভব না। চিনু আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে।’ ‘ওইটুকু শিশু, মরে যাবে যত্ন না পেলে। ভাল চাকরি তোর, অত চিন্তা কীসের, সংসারে কত দায়িদায়িত্ব থাকে।’ বাবা বলল, ‘দশ হাজার টাকা! চিনুর জন্য দশ হাজার টাকা চলে গেল। ওর ভাইরা তো একটা নয়া পসা ছোঁয়াল না!’ বড় হলাম। বুঝলাম মায়ের চেয়েও টাকার শোকই সেদিন বেশি ছিল বাবার। সেই বাবা, আমাকে চাকরি করতে দিল না কেন? কারণ, বাবা রক্ষণশীল। আমি যদি স্কুলে পড়াতাম, যদি সরকারি চাকরি করতাম, বাবা শেষ পর্যন্ত মেনে নিত। কিন্তু বাবার অনেক কথায় প্রকাশ পায় রক্ষণশীলতা। মেয়েরা ঘর সামলাবে। মেয়েদের প্রতি অত্যাচার বা নারীস্বাধীনতা নিয়ে কোনও মহিলা টিভিতে বক্তব্য রাখছে দেখলে বাবা টিভি বন্ধ কর দেয়। আমাকে বলে, ‘ওসব গিলিস না।’ বাবার মতে, অভিনয় করলেই মেয়েরা নষ্টচরিত্র। নার্স মানেই ডাক্তারদের সাথে শোয়। বিমানবালারা সবাই পাইলটদের মনোরঞ্জন করে। আমি একদিন বললাম, ‘তা হলে চিকিৎসক ও বিমানচালকরা মহিলা হলে কী হয়!’ তখন উত্তর— মহিলা চিকিৎসকের সঙ্গে নার্সের কোনও তফাত নেই। আর বেসরকারি সংস্থায় কোনও মেয়ে কাজ করে মানেই তার মালিক বা উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিদের হাতে ক্রীড়নক।’
‘আর তুমি তার বিরুদ্ধে যাবে না! তুমি বলবে না, জ্যোতিকাকার ধারণা ভিত্তিহীন!’
‘নিজের লোকের সঙ্গে লড়াই করতে পারি না আমি। ঝিরি পারে। তবু ঝিরি স্কুলে চাকরি পাবার চেষ্টা করছে।’
‘জ্যোতিকাকা একা নয় ঝুমুদি। এইরকম ধারণা, এমনকী বদ্ধমূল সংস্কার আরও অনেক পরিবারে আছে। অনেক লোকের মধ্যে আছে। আমাদের কলেজে যে মেয়েরা একটু খোলামেলা পোশাক পরত, কিংবা ধরো ধূমপানের অভ্যাস আছে, ছেলেরা তাদের সঙ্গ পাবার জন্য ব্যাকুল কিন্তু আড়ালে ‘বিচ’ ছাড়া সম্বোধন করে না। প্রেম-প্রেম ভান করেই শুয়ে পড়ার পরিকল্পনা করে। যদি বা সত্যিই কোনও খোলামেলাকে ভালবাসল কেউ, বলে-কয়ে তো প্রেম হয় না, সবার আগে সে ভালবাসার অধিকারে কোপ মারে প্রেমিকার পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাষা বা সিগারেটের ওপর। স্তনসন্ধি প্রদর্শন করবে না, ওটা শুধু আমার জন্য। হাতকাটা জামা পরবে না—অন্যরা পুরো চাটে।… কথায় কথায় ওসব, ইয়ে, ফাক ইউ টিউ বলো কেন? তোমার মুখে মানায় না। কত বলব। ভালবাসা, না পাকানো দড়ি বোঝা ভার। মেয়েরাও অধিকারপ্রবণ হয়। যেদিক থেকেই শর্তগুলো আসুক না কেন, সম্পর্ক শ্বাসরুদ্ধকর হওয়ার আগেই নিজের পছন্দ-অপছন্দ জানিয়ে দেওয়া দরকার।’
‘বললাম যে, নিজের লোকের সঙ্গে শর্ত নিয়ে দর কষাকষি আমার পক্ষে অসম্ভব।’
‘সম্ভব করতে হবে ঝুমুদি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সম্মান করাই সভ্যতা। ব্যক্তি ও পরিবার, পরিবার ও সমাজ, সমাজ এবং রাষ্ট্র যদি পরস্পরের জগতে সম্মানজনক বোঝাপড়া করে না নেয়, তা হলে ভারসাম্য থাকে না।’
‘টোপর, এইসব কথা তত্ত্ব হিসেবে খুব ভাল, কিন্তু আমার এই ছোট্ট জগতে ওই শব্দগুলো কেমন বেমানান ঠেকে রে। আমার বাবা, তার মত প্রকাশ করছে, আমি তার মেয়ে, আমি কীভাবে বিচার করব আমার স্বাতন্ত্র্য সম্মান পেল কিনা! বাবা আর মেয়ে, এর মধ্যে এসব আসে নাকি?’
‘তুমি ব্যক্তি শব্দটাই ভাবনা থেকে বাদ দিয়ে দিলে ঝুমুদি। পরিবারের ধারণা কত বদলে গিয়েছে দেখো। আস্তে আস্তে সামাজিক সম্পর্ক আরও ব্যাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। রক্তের সম্বন্ধে পরিবার বলে কিছু থাকবে না। ব্যক্তি সরাসরি সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। আজ যে আমরা স্বতন্ত্র ব্যক্তিপরিসর নিয়ে সচেতন হয়ে উঠছি, এরই বিশালতর প্রক্ষেপ হবে ভবিষ্যতের সমাজ। নিশ্চয়, বাবা আর মেয়ের মধ্যে বোঝাপড়া থাকতে হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে একজন নিজস্ব বিশ্বাস ও সিদ্ধান্ত আরেকজনের ওপর চাপিয়ে দেবে। আমি স্নেহ, প্রেম, ভালবাসা ইত্যাদি স্বাধীন হতে বলছি, দাস হতে নয়।’
‘ভবিষ্যতের সমাজ কেমন হবে, সেই ভেবে বর্তমান অস্বীকার করলে চলবে?’
‘তুমি তো বর্তমানে নেই ঝুমুদি, অতীতে আছ। আমাদের চারপাশের বিপুল জনগণ অতীতে আছে। তারাই তোমার মতো আরও অনেককে অতীতে ধরে রাখতে চাইছে নিজের স্বার্থে। নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে। নিজের অহং চরিতার্থ করার স্বার্থে।’
‘আমার ভয়-ভয় করছে রে। টোপর, তুই যেন আমাকে নিষিদ্ধ কিছু করতে বলছিস।’
‘ঝুমুদি, আমি শুধু বলছি, নিজের ইচ্ছের মূল্য দিতে শেখো।’
‘স্বার্থপর হতে বলিস না আমাকে। এই বেশ আছি আমি টোপর। বাবা যেমন আছে থাক, ফেলে তো দিতে পারব না। কী লাভ অশান্তি করে?’
‘পৃথিবীটা শুধু তোমার বাবার নয়। আরও অনেক লোক আসবে যে।’
‘ও। তাই বল। তুই বিয়ের কথা বলছিস! বর কেমন হবে, শ্বশুরবাড়ি কেমন হবে! যা কপালে আছে হবে। ওখানে গিয়ে যদি সমাজ বিবর্তনের তত্ত্ব আওড়াই আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ নিয়ে কথা বলি, বউমা’র মাথা খারাপ বলে ফেরত দিয়ে যাবে। বুঝলি?’
‘আগেই আত্মসমর্পণ করে বসে আছ? এইজন্যই আমাদের দেশে এত বধূ হত্যা হয়। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া।’
‘আমার মতো মেয়ের আর গতি কী!’
‘তোমাকে দেখে আমার মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্য লাগে, জানো?’
‘কেন?’
‘একজন আস্ত মানুষ, সকাল থেকে রাত্রি যে অন্য চারজন লোকের সুবিধা-অসুবিধা দেখে যায়, বিনিময়ে কিছু প্রশংসাবাক্য-টাক্য—আবার সংসার তাকেই ঘাড়ের বোঝা মনে করে অন্য সংসারে চালান করে দিতে চায়, সেও চালান হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে, আনন্দের সঙ্গে নয়, ত্রাসের সঙ্গে। কারণ তার জন্য বাবার টাকা খরচ হবে, শ্বশুরবাড়ি যেমনই হোক, মেনে নিতে হবে। আবার সেখানে গিয়েও সে অন্য আরও কয়েকজন লোকের সুবিধা দেখবে, কাউকে সেবায় তুষ্ট করবে, কাউকে যৌনভাবে, তাতে সে সফল হবেই, কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না।’
‘অত নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে দেখছিস কেন?’
‘আমি বুঝতে পারি না ঝুমুদি, কীভাবে একটি সুস্থ বুদ্ধিমান মেয়ে কেবল যৌনতা ও দাসত্বর জন্য অপেক্ষা করতে পারে। দু’জন নরনারী যৌনক্রিয়া করবে এবং নতুন প্রজন্মের মানুষ পৃথিবীতে আনবে—এই অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বেচাকেনার হাট করে তোলা হয় কেন! তা-ও আমি বুঝতে পারি না। আমি এটাও বুঝি না, এই সম্বন্ধ করা বিয়ে। প্রেমহীন, বাধ্যতামূলক সঙ্গমের পথ বেয়ে ভালবাসার জুয়াখেলা। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই সম্বন্ধ ঘটিয়ে বিবাহ, বিবাহ কেন্দ্র করে যত বাণিজ্য, লেনদেন, সব মিলে আসলে এক বৃহত্তর বেশ্যালয়।’
‘টোপর প্লিজ, লোকে এসব শুনলে বলবে তোর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। এদেশে আজও সম্বন্ধের বিয়ে উচ্চতম সামাজিক সম্মান। গরিব হলে ধার করে এই সম্মান কেনে, মধ্যবিত্ত নিজস্ব পুঁজি বিলিয়ে দেয়, বড়লোকের বিয়ে মানে প্রতিপত্তির প্রমাণ। একে তুই বেশ্যালয় বলছিস!’
‘নিশ্চয়ই। বেশ্যাপল্লিতে দু’জন অচেনা নারী-পুরুষ কী করে? যৌনতা কেন্দ্র করে ব্যবসায় করে তো? সেখানে প্রেম-ভালবাসা-বোঝাপড়া কিচ্ছু নেই। স্রেফ এবং স্রেফ যৌনতা ও বাণিজ্য! একটু বড় মাত্রায় ভাবো। দু’টি অচেনা ছেলে-মেয়ে, যারা পাত্রপাত্রী, তাদের যৌন সম্পর্কে শিলমোহর দিচ্ছে সমাজ। তাদের কেন্দ্র করে বাণিজ্যও বিপুল। পার্থক্য হল, বেশ্যাগমন ব্যক্তি র স্বাধীন নির্বাচন, বিবাহ পাত্রপাত্রীর সামাজিক নির্বাচন, অর্থাৎ সমাজ সেইসব কর্মকাণ্ড সহজে অনুমোদন করতে চায় না যেখানে ব্যক্তি স্বরাট, সমষ্টি গৌণ, এমনকী কখনও কখনও অস্তিত্বহীন! এ বিষয়ে সমাজমানস এমনই গূঢ় এবং বিস্তৃত যে কমিউনিস্টরা সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার—সকলের সৃজনশীলতাকে আক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে! আমাদের দেশে তো কে কী নিয়ে পড়বে, তা-ও পারিবারিক তথা সামাজিক নির্বাচন। বিয়ের ব্যাপারে তো কথাই নেই।’
‘সবার কি প্রেম হয়? সেই প্রেম কি আজীবন থাকে? ভালবাসা কি ফুরোয় না? শরীরের খিদে বলেও তো একটা কথা আছে। বাচ্চা আনাও জরুরি। না হলে তো মানবজাতি বলে কিছু থাকবে না। প্রেম কী জানিস? একটা আসক্তি! টান! হয়তো এর মধ্যে কোনও যৌনরসায়ন আছে! ভালবাসা অনেক বড়। অনেক বেশি মায়াবী আর গভীর। একসঙ্গে থাকলে তবেই ভালবাসা গড়ে ওঠে। প্রেমের জন্য একসঙ্গে থাকা জরুরি নয়। এমনকী চোখে না দেখেও প্রেম হয়। এই দ্যাখ, তোরা যদি আমাদের পাশের বাড়ি না হতি, বাবা আর প্রবীরকাকা যদি দুই বন্ধু না হত, তোর সঙ্গে হয়তো আমার আলাপ-পরিচয় থাকত, কিন্তু এত ভালবাসা আসত কি?’
‘কত ভালবাসা ঝুমুদি?’
‘অনেক, অনেক। জানিস না যেন!’
‘তাও বলো না, কতটা?’
‘ভালবাসা কি মাপা যায়? সে খুব ভালবাসা রে টোপর! ভগবান যদি এসে বলে, ঝুমু, আজ থেকে তোর পা দুটো নিয়ে নিলাম, টোপরের পা ভাল হয়ে যাক-আমি বলব, তাই হোক।’
‘ব্যস! এইটুকু!’
‘প্রাণও দিতে পারি।’
‘সে তো আরও সোজা।’
‘টাকা পয়সা সোনাদানা তো নেই।’
‘সম্পর্ক দিতে পারবে?’
‘সে আবার কী।’
‘আমার জন্য সবাইকে ছাড়তে পারবে?’
‘ছাড়তেই হবে না।’
‘যদি হয়, ছাড়বে?’
‘কাকে? বাবাকে? বোনকে?’
‘যাকে যাকে ছাড়তে হবে। কে, আমি জানি না।’
‘পাগলামো করিস না।’
‘বলো না!’
‘এভাবে বলা যায় না। তবে তুই যেভাবে বিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করছিলি, আমি মানতে পারলাম না। বিয়ের পর ছেলেরাও কি সব সময় প্রার্থিত জীবন পায়? আমার এক মামা আছে, দারুণ গান গায়। গানপাগল একদম। মান্না দে-র গান এমন নিখুঁতভাবে গাইতে পারে যে লোকে অবাক হয়ে যায়। বিয়ের দু-তিন বছরের মধ্যেই মামার গান বন্ধ। মামিমার সন্দেহবাতিক।’
‘ঝুমুদি গো, আমার সোনা ঝুমুদি, বিয়ের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা তুমি বন্ধ করো।’
‘পুরী যাবার কথা কী বলছিলি?’
‘তোমার স্বপ্নের কথা বলো ঝুমুদি। সমুদ্র স্বপ্ন দেখেছ তুমি। বলো।’
‘ওহো কী সুন্দর রে স্বপ্নটা! নীল আকাশ আর নীল জল। কত দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে সমুদ্র। খুব একটা ঢেউ নেই। তুই জলের কিনার ধরে হেঁটে যাচ্ছিস। পেছন থেকে তোকে দেখছি। অনেক লম্বা। অমিতাভ বচ্চনের মতো। পারে আর লোক নেই। একজনও নেই। আমিও না। কিন্তু আমি তোকে দেখছি। ঝলমলে রোদ্দুরে তোর গায়েও নীল শার্ট, ব্লু জিন্স! হাওয়ায় চুল উড়ছে। আমি ভাবছি, টোপর তো বলেনি ও হাঁটতে পারছে!’
‘আর?’
‘আমার খুব ভাল লাগছিল। স্বপ্নের ভেতর ভাল লাগা ঢুকে পড়েছিল। আর দ্যাখ, তুই পুরী যেতে চাস। কী আশ্চর্য না? কিন্তু টোপর, রবিবার যে পাত্রপক্ষ আসবে। শুক্রবার গেলে আমরা রোববার কেমন করে ফিরব?’
জয়ী ও কল্যাণী ও পরিচিত ঋণ
সম্বন্ধ বড়পিসিই এনেছেন। পাত্রের মা তাঁর গুরুভগ্নী। ভগিনীর পুত্র যে ভাগিনেয়, নাম সন্দীপন, আটপৌরে দীপ। সুচাকুরে, দীর্ঘদেহী সুতনু, যদিও মাথায় টাক পড়ে গেছে, বয়স ছত্রিশ মাত্র, বড়পিসির অভিমত্যানুসারে এমন ছেলে লাখে একটা মেলে কারণ ভক্তিমান, শ্রীগুরুর শ্রীচরণে এত দূর মতি যে বিয়ে না করার দুর্মতি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত গুরুভগ্নী কল্যাণী দুর্গতের গতি দীনজনশরণ শ্রীগুরুর পদাপন্ন হয়ে বিপদাপন্নের উদ্ধার প্রার্থনা করলেন। গুরুর আদেশে বাঘেগোরুতে একজোট -দীপ কোন ছাড়!
বাড়ি গড়িয়ায়। লেক গাডের্ন অঞ্চল থেকে কিবা দূর! বড়পিসির মতে, গুরুই এ সম্বন্ধ রচনা করেছেন। এ বিয়ে হবেই, যদি না টাক আছে বলে ঝুমু বাতিল করে দেয়। যদিও, যে মেয়ে চারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে—প্রথমবার সমগোত্র, দ্বিতীয়বার মাস্টার্স ডিগ্রি নেই, তৃতীয়বার শ্যামলা রং বলে এবং চতুর্থবার স্রেফ ব্যাখ্যাহীন অপছন্দে— সে মেয়েকে পঞ্চমপক্ষ যদি পছন্দ করে বসে তো হাতে পাওয়া চাঁদ পাঁপড়ভাজার মতো কুড়মুড় করে খেয়ে ফেলা আশু কর্তব্য! টাক তো কী! চুল ধুয়ে জল খাবে?
যদি উলটোটা হত? ঝুমু সুচাকুরে, ভক্তিমতী, মাথাজোড়া টাক—সন্দীপন রাজি হত?
এহেঃ। যত অবাস্তব কথা! নারীবাদীদের যত অর্থহীন নষ্টামি আর উসকানি, সব উল্টো করে ভাবা চাই। আরে বাবা, প্রতিবিম্ব দেখে চলতে গেলে ডান-বাম জ্ঞান থাকবে না!
‘ঝুমু আমাদের সেইরকম মেয়েই নয়। ওর মতো নম্র, ভদ্র, লজ্জীশীলা একালে পাওয়াই যাবে না। আমরা যা বলব, যেমন বলব, ঝুমু শুনবে।’ বড়পিসি বলেন।
অর্থাৎ, অতি বিরল চরিত্তির সন্দীপন এবং বিরলতম প্রজাতিকা ঝুমুর, ওরফে দীপ বনাম ঝুমু—খেলা লাগল বলে! আম পাকে, জাম পাকে, আর পাকে বেল, তোমায় আমায় শুরু হল খেল্ খেল্ খেল্।
‘বিয়েতে মত হওয়ার পর নাকি ছেলে বলেছে সে মেয়ে দেখতে আসবে না। মা যাকে পছন্দ করবে, তাকেই মেনে নেবে। শুধু মেয়ের যেন কোমর ছাপানো চুল থাকে। আজকাল মেয়েদের যে নানা ছাঁটের চুল, তা তার পছন্দ নয়। পুরুষছাঁটের চুলওয়ালা মেয়ে তো আসলে নারীকুলের ভ্রষ্টাচারিতা! সে নিয়ে তো ভাবনা নেই, ঝুমু-র যা চুল, কেশতৈলের বিজ্ঞাপন করা যায়।’ বড়পিসির গর্ব তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রীর চুলে উৎকুন পোকার মতো সেঁধোয়।
‘আমাদের ঝুমু তো দেখতে-শুনতে খারাপ না। রংটা একটু চাপা। কিন্তু চোখমুখ? একেবারে কাটা কাটা না হলেও খাঁদাবোঁচাও নয়। সংসারে হেন কাজ নেই যে জানে না। আমি তো বললাম কল্যাণীদিকে, এমন কাজের মেয়ে তুমি আর দুটি পাবে না।’
সকলের আগে ওঠে। সবশেষে ঘুমোতে যায়। শাশুড়ির মশারিটি গুঁজে দিয়ে, বাতিটা নেভায়। বউ হয়ে এসেই নিয়ে নিল শ্বশুরের ঔষধ খাওয়াবার ভার। শ্বশুরবাড়িতে নব ননদ-দেওর সকলের রাখে আবদার। বরের খাবার গরম গরম দেয় পাতে। টিফিনের বাক্সে পুরে দেয় কত না ভোজের আয়োজন। খুশি রাখে নাভির তলায় অন্ধকার রাতে। বরকে একলা পেতে চায়? আ ছিছি! সে কথা কি কখনও বলেছি? তার জন্য রয়েছে তো মধুরাত। মধু না থাকলেও থাকে কঠিন আঘাত। যদিও আদর, শুধু যন্ত্রণার সাক্ষী থাকে নীরব চাদর। দিনে দাসী, রাতে সর্বনাশী! অবসরে? বউমানুষের অবসর হল চুনোমাছ কোটা। যদি সব কাজ হয়ে গিয়ে থাকে, অবসরে মেজে ঝকঝকে করে দিক পেতলের শুচিস্মিত লোটা। যত ছ্যাঁতলা পড়েছে কলতলে, কে তুলবে ঘষে, বউ ছাড়া? সবার পতন রোধে একমাত্র গুণবতী সুন্দরী বেচারা। বউ—এ টোটাল প্যাকেজ অব মেকিং এ ড্রিম হোম। যাকে খায় স্বামী, শ্বশুরাল, সমাজ ও যম! খরচ সামান্য। কন্যাদায়ত্রস্ত পিতা যা দেয় থোয় সেটা হল উপরি পাওনা। কাজের মেয়েরা বেতন-টেতন চেয়ে কেবল বাড়ায় দুখভার। বউমা অবৈতনিক! যত খুশি নাচিয়ে নাও না!
সেই বউ, শুক্তো না রেঁধে, পরিত্যক্ত শয্যা গুছিয়ে না তুলে, কাঁধে আলোকচিত্রগ্রাহী যন্তরটি ফেলে কিংবা স্রেফ বই পড়বে শান্তচিত্তে অভিপ্রায়ে যদি গন্তব্যে রওয়ানা হয়, সেটা কি দেশের প্রতি, দশের প্রতি, সমাজ, পরিবার, সর্বোপরি তার স্বামীটির প্রতি অসভ্য বিশ্বাসঘাতকতা নয়? লোক এলে চা দেবে কে? অ্যাঁ?
ছাঁটা চুল! ইয়ার্কি! লম্বা চুল না থাকলে মেয়েদের কমনীয়তা আসে না! মেরি কমের জীবনী চলচ্চিত্রে উত্তেজক, ভারোত্তোলক ভারতী জোয়ারদার আবেগ জোয়ারে আপনার প্রেয়সী হতে চাইলে, ও মশাই, আপনি থলে হাতে ভূতলে গড়াবেন!
‘আমাদের ঝুমুকে নিয়ে কোনও ভয় নেই। তার চুল আছে। পরিচর্যার অতুল প্রমাণ। সে রা-টি কাড়ে না। যা বলি, তা শোনে। বড় ভাল।’
ঝুমু ও টোপর ও অবরুদ্ধ দোর
‘বুঝলি রে টোপর, আমাকে কেউ দেখতে আসুক বা না আসুক, সম্বন্ধ এলেই বড়পিসি আমার গুণকেত্তন শুরু করে আর বাবা খুব মন দিয়ে সেই সব শোনে, যেন আমাকে দেখেইনি কখনও, বড়পিসির বর্ণনা শুনে মনে মনে এঁকে নিচ্ছে।’
‘পুলিশের আঁকিয়েরা ওইরকম। তুমি একজনের বর্ণনা দিলে, ওঁরা চেহারাখানা আঁকলেন, অনেকখানি মিলেও যায়।’
‘বাবা আমাকেও মেলায় বোধহয়। ফাইনাল ব্যালেন্স শিট ধরার আগে বারবার ট্রায়াল ব্যালেন্স চেক করে। তারপর অ্যাসেট লায়াবিলিটির সূক্ষ্ম বিচার।’
‘যে কোনও উৎপাদিত পণ্য যখন তুমি বাজারে ছাড়বে, তার গুণাগুণ সম্পর্কে তোমায় ওয়াকিবহাল থাকতে হবে, তবেই বিজ্ঞাপন জোরদার হবে। বিকিকিনি জমবে ভাল। এক্ষেত্রে জয়ীপিসিমার সঙ্গে আমাদের গড়িয়াহাটের ফুটপাথ জুড়ে বসা দোকানদারের কোনও তফাত নেই। সবে তো বাছাই চলছে ঝুমুদি, এরপর দর কষাকষি শুরু হবে।’
‘পাত্রপক্ষের দাবিদাওয়া? ছেলের নাকি কোনও দাবি নেই।’
‘ছেলের বাবার? মায়ের? সেজপিসিমার? ন’মাইমার? কুট্টিদিদির?’
‘এখনও সেসব বলেনি। আগে তো মেয়ে দেখা।’
‘একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করেছ?’
‘কী?’
‘বিয়ের কথা উঠলেই মানুষের নাম উড়ে যায়? তখন শুধু ছেলে আর মেয়ে। ছেলের বাড়ি, মেয়ের বাড়ি।’
‘তারপর বিয়ে ঠিক হয়ে গেলেই শুদ্ধভাষা। পাত্র আর পাত্রী। পাত্রপক্ষ, কন্যাপক্ষ।’
‘বিয়ের পর আবার চলিত প্রয়োগ। বর-কনে।’
‘কি অদ্ভুত না? কেউ শিখিয়ে-পরিয়ে দিচ্ছে না। প্রত্যেক পরিবারেই আপনা-আপনি ভাষাগুলো এসে যাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটায় একটা, কী বলব, নকশা আছে বা ধাপ আছে।’
‘যেমন?’
‘যখন সম্বন্ধ আসে, অর্থাৎ প্রস্তাব, তখন যে কোনও একটা ছেলের সঙ্গে যে কোনও একজন মেয়েকে জুড়ে দেবার জন্য সুতো টানা হচ্ছে। একটা মেয়ে বা ছেলে, তাকে কেন্দ্র করে সম্বন্ধের অনেক সুতো। এবারে একটা জুটি হল। এবার এল দাঁড়িপাল্লা। দেনা-পাওনা। কৌলীন্য মান-মর্যাদা। ঘটনা ওজনদার। ছেলে আর মেয়েও পাত্রপাত্রী। তারাই তো আধার। সচেতন স্বার্থসম্বন্ধের গুরুগম্ভীর আদানপ্রদান।’
@@@@
‘ঠিক। ঠিক বলেছ। আবার বিয়ের আসরে আনন্দ-উৎসবের মেজাজ মুখের ভাষাও দেয় হালকা করে। টোপর পরা বর আর মুকুট পরা ঝুমু। তখন শুধু মাধুর্য।’
‘ওমনি নিজেকে বরের মাথায় বসিয়ে দিলি!’
‘আচ্ছা, টোপর একটা নাম হল! বলো তুমি! টুপুর-টাপুর, পুটুর-পাটুর, পুটে, টুকাই, টোকন, পটা, পটকা—কতরকম নাম হতে পারত! তুমি রাগ কোরো না ঝুমুদি, তোমার মাথায় মুকুট পরালাম তো।’
‘মাঝে মাঝে বড্ড বাজে বকিস। বাচাল একটা।’
‘ভাগ্যিস বেচাল বলোনি। ভয় হত, এই না বানচাল করে দাও।’
‘কী বানচাল?’
‘তা হলে কাল তোমায় দেখতে আসছে। বেশ। দেখিয়ে এসো।’
‘কী দেখাব?’
‘ওঁরা যা দেখতে চাইবেন।’
‘মারব এক চড়।’
‘সে তুমি মারতেই পারো। কিন্তু ওঁরা তো দেখতেই আসছেন। তুমিও দেখাবার জন্য তৈরি।’
‘আবার তোর একই কথা। রোজই কি তুই এই নিয়ে তর্ক করবি টোপর? আমি কী করব বল তুই?’
‘আমি যা বলব করবে তুমি?’
‘কেন করব না? তুই তো আমায় এমন কিছু বলবি না যা অসম্ভব!’
‘আন্দাজ করো তো, কী বলতে পারি?’
‘তুই বলবি, বিয়েই কোরো না। আমিও তোর কথা মেনে নিতে রাজি। কিন্তু বাড়িতে শুনছে কে! সমস্ত আলাপ আলোচনা, আয়োজন আমার জন্যই নাকি, আমারও একটা ‘জীবন’ আছে, সেটা পাইয়ে দেওয়া, কিন্তু আমায় কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে না। ছেলের চুল নেই। বড়পিসি বলেই ফেলল, আমার এ নিয়ে আপত্তি করার উপায় নেই কারণ এর আগে—’
‘চারটি ছেলের বাড়ি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।’
‘হুঁ। তার জন্য ছেলের টাক থাকলেও মানতে হবে।’
‘বিয়ের পরে টাক পড়লে কী করবে?’
‘হুঁ। ততদিনে পুরনো হয়ে যাবে। তাই বলে—।’
‘ওঃ! পুরনো মানুষের কদর নেই, না?’
‘তা মোটেই বলিনি! তাই বলে ময়রার মতো ভুঁড়ি, জল্লাদের মতো বড় বড় কানের লোম, রামু মাছওয়ালার মতো ফাঁকা ফাঁকা দাঁত—সব আমাকে পছন্দ করতে হবে? না বলার উপায় নেই’!
‘হো হো হো হো হো হো! উঃ হু হু! আঃ হা হা হা! ঝুমুদি, ও ঝুমুদি, ও ঝুমুদি—এত মিষ্টি তুমি—এত মিষ্টি— তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতেই পারব না।’
টোপর হাসতে হাসতে লাল। হাঁপাচ্ছে। জল খেল। ঝুমু-র ডান হাতখানি নিল নিজের হাতে। হাতের ওপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আস্তে-আস্তে, আস্তে-আস্তে। ঘাড় অল্প কাত করা। দৃষ্টি দূরে। গভীর ভাবনায় ডুবে আছে।
‘টোপর!’
জবাব নেই। মুখের শব্দ সব বুকের তলায় বুজকুড়ি কাটে আর রক্তের ফেনা তোলে লুকোন পুকুরে। শীতল মাছেরা সচকিত। কত মাছ! দুখের সুখের! অপমানে জর্জর মাছের গলার ক্ষত এখনও সারেনি। অভিমানে ঘাই মারা ভুলে গিয়ে যে-মাছ অনড়, সেও আজ থরো থরো কাঁপে। পৃথিবী সুখের নয়। জেনে গেছে। ভালবাসা ভীষণ কঠিন। ভালবাসি, ছেড়ে চলে যেয়ো না কোথাও, বলা কি কঠিনতর নয়? তবুও এমন হয়। তবুও তবুও ঠিক এরকমই হয়!
‘টোপর!’
ঝুমু ভয় পাচ্ছে। সেদিনের মতো আবার কি কাঁদবে ছেলেটা? ওই দুটি চোখে জল ঝুমু সইতে পারে না। ওই মুখে বিষাদের ছায়া পড়ে, বড় কষ্ট হয়। ঝুমু তো গভীর ভালবাসে। ভালবাসে ছেলেটাকে।
‘টোপর! কথা বল!’
ঝুমু-র হাতটি ছোঁয়াল গালে।
‘কফি করি? পাঁপড় সেঁকে দেব?’
ঝুমু-র হাতটি ছোঁয়াল দুই চোখে। বার বার। চুমু খেল। কী কাতর চোখমুখ! তবু কী গভীর! যেন মগ্ন হয়ে আছে। বলল, ‘ঝুমুদি।’
‘উঁ?’
‘ওদের না বলে দাও। আর কোনও দিন বোসো না পরীক্ষায়।’
‘উঁ?’
‘তোমার পরীক্ষা নেওয়ার সাধ্য এ জগতে কারও নেই।’
‘তারপর?’
‘ভালবাসি। তুমিও তো ভালবাস। বিয়ে করো। করবে?’
‘ক্কী! কাকে? ক্কী বলছিস?’
‘আমাকে? ঝুমুদি? আমি তো ভালবাসি, তোমাকেই। তুমিও তো, আমাকেই তো! আমরা তো ভালবাসি।’
স্থির। অনন্তকাল। স্থির। বিদ্যুৎপ্রভার মতো ক্ষণিক প্রণীত।
ঝটকায় সরিয়ে নিল হাত!
চড়!
সেই হাতখানি দিয়ে, যে হাতে একটু আগেই চুমু দিয়েছিল প্রতিবন্ধী ছেলে!
চড়! সেই হাতখানি দিয়ে! যে-হাত খানিক আগে দু’গালে ছুঁইয়েছিল অসাড়াঙ্গ যুবক ছেলেটা!
‘এরকম একটা কথা কীভাবে তুই বলতে পারলি আমাকে! ছিঃ!’
ওষ্ঠে অভিমান, অভিমান গ্রীবার ভঙ্গিতে, গালে কে জানে কীসের অঙ্গার আভা। স্ফুরিত নাকের পাটা ক্রোধে। দুই চোখ বাইরে ফেরানো। নগরের ধূসর আকাশ যতটুকু চোখে পড়ে, সেইখানে শূন্যের মতো, অসহায় শূন্যতার মতো, ব্যথিত, কাতর দুটি চোখ, ধীরে ধীরে মেঘ নেমে আসে।
‘ঝুমুদি!’
ঝুমু ঠোঁট কামড়ে ধরল। দু’হাতে শরীরের ভার, যেন ঢলে পড়া থেকে বাঁচতে দু’হাত স্তম্ভ অতিবল।
‘ঝুমুদি! তাকাও আমার দিকে।’
‘তোকে আমি সবচেয়ে বড় বন্ধু ভাবি…’
‘তাকাও ঝুমুদি। আমার দিকে দেখো। সত্যিই তো আমি তোমার সবচেয়ে বড় বন্ধু।’
‘তোকে কত বিশ্বাস করেছিলাম।’
‘আর করো না? করবে না আর? ঝুমুদি? বলো!’
জল পড়ছে চোখ থেকে। টুপ, টাপ, টুপ, টাপ। নৈঃশব্দের শব্দ। জলবিন্দু চোখ থেকে গড়িয়ে নামছে গাল বেয়ে, চিবুকের দু’পাশ ভিজিয়ে, গলায়। কোন পানে ধায় অশ্রুধারা? তারও কি প্রিয় ওই স্তনসন্ধি, গাঢ় ভাঁজ, নরম নরম দুই পর্বতের চূড়া?
‘ঝুমুদি কথা বলো। যা মুখে আসে। যা প্রাণে চায়। বলো। দেখো আমাকে।’
‘আর কি বিশ্বাস করতে পারব তোকে?’
‘আমি কীভাবে তোমার বিশ্বাসে আঘাত দিলাম? বলো। বলো আমাকে।’
‘তোর চেয়ে কত বড় আমি! চারটে বছর! তোকে কোলে নেওয়ার স্মৃতিও আছে আমার। আর তুই এই চোখে দেখে বসলি আমাকে? আমি কি সেইরকম মেয়ে?’
‘দাঁড়াও ঝুমুদি দাঁড়াও। অনেক আলাদা প্রসঙ্গ টেনে আনছ। তুমি আমার চেয়ে বড়, তো? কী এসে যায়? তুমি মাত্র চার বছর আগে পৃথিবীতে পৌঁছেছ বলে আমি তোমায় ভালবাসতে পারি না?’
‘আমি তোর দিদি না? আমাকে ঝুমুদি বলিস তুই। তোকে রাখি পরাই। ফোঁটা দিই। ইশ্ শ্ শ্! ছিছি! কেউ শুনলে কী বলবে।’
‘অন্য কারও কথা পরে। আগে তোমার কথা। রাখির অর্থ কী? রক্ষাবন্ধন। প্রিয়জনের মঙ্গল রক্ষা করার আবেদন। সম্বন্ধ যাই হোক, রাখি পরানো যায় গো ঝুমুদি। আর ভাইফোঁটা? শেষ কবে দিয়েছ আমায়?’
‘সে তুই নিতে চাস না তাই। ছোটবেলায় তো নিতি।’
‘কেন চাই না? ভেবেছ কখনও?’
‘আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ করিস না তাই। কী মনে করছিস তুই টোপর? আমাকে যা খুশি বোঝাবি আর আমি বুঝে যাব?’
‘না। আমি তোমাকে যা খুশি বোঝাব না। তুমিও বুঝবে না। শোনো, আমার কথা তুমি না-ই মানতে পারো। আমি জোর করব না ঝুমুদি। ভালবাসার মধ্যে জোরাজুরি সবচেয়ে হীন কর্ম। কিন্তু আলোচনা হতে তো বাধা নেই। অন্তত আমরা যে বন্ধু, সে বিষয়ে তো তোমার সঙ্গে আমার মতানৈক্য নেই। তুমি আমাকে বিশ্বাসহন্তা বলেছ, আমাকে আমার উপলব্ধি ব্যাখ্যা করতে দাও। তুমি তো আমার আকাশ ঝুমুদি।’
‘আমি তোকে বিশ্বাসঘাতক বলিনি। আমার খারাপ লাগছে। লাগছে। আমি ভাবতেও পারিনি তুই…’
‘শব্দটা উচ্চারণ করোনি। বলেছ, ‘আর কি তোকে বিশ্বাস করতে পারব?’ ঝুমুদি, ছোটবেলায় তুমি, ঝিরি আমাকে ভাইফোঁটা দিয়েছ, তার গুরুত্ব বুঝে দিয়েছ কি? আমিই কি বুঝে নিয়েছি? সমাজ কত কী চাপিয়ে দেয় একেকটি মানবক ধরে দুই কাঁধে। ধর্ম, সংস্কার, রীতি। কাঁধ নিজেই জানে না সে কীসের বাহক। বুঝতে যখন শিখলাম, আর ভাল লাগল না। কেন? প্রথমত, আমার ছোট জগতে এই তো তোমরা ক’জন। তাই প্রত্যেকটি সম্পর্ক আমি গভীর যত্নে লালন করতে শিখেছি। আমার যখন এগারো-বারো, বুঝেছিলাম, তোমাকে ছাড়া আমার চলে না। তুমি একদিনের জন্যও যদি আমতার মামার বাড়িতে যেতে, আমার কান্না পেত। ছাতের এডিনিয়াম গাছগুলোকে বাবা যেমন ছোট্ট একটুখানি চারা থেকে প্যাঁচালো গুঁড়িওয়ালা অপূর্ব দারুশিল্পে নিয়ে গিয়েছে, তেমনই তুমি আমায়। মা যখন চলে গেল, তোমাকে আঁকড়ে আমি মায়ের অনুপস্থিতি ভোলার চেষ্টা করতাম। তুমি আমাকে বুকে চেপে ধরতে। তোমার ছোট্ট বালিকা বুক। কী গভীর ভালবাসা! কী মায়া! মাকে ছাড়া বাবাতে আর তোমাতে আমি ভরে উঠলাম। আমি মায়ের দায় ছিলাম, ওই শৈশবেই বুঝেছি। মা আমাকে যত্ন করত কিন্তু বাবার ওপর শোধ তুলত। আমার ওপরেও তুলত মা’র আবেগহীন হিম যত্নের মধ্যে দিয়ে। বড় হয়ে ছোটবেলা আরও ভাল করে চেনা যায় তো। আমি ছিলাম দায়, মা দায় ফেলে গিয়েছে। বাবা সেই দায় বুকে নিল এমন সহজে, অনায়াসে, তুমি আমাকে তোমার মধ্যে মিশিয়ে নিলে এমন যে আমার আর অভাববোধ রইল না। মায়ের প্রতি স্বাভাবিক টান তো আমার থেকেই গিয়েছিল বলো। যদি মা মরে যেত, সে ছিল একরকম। তোমাদের মতো আমিও মেনে নিতাম। আমার কী হল? মা আছে, আসে না, ফেলে গেছে। আর আমি তোমাকে, মাত্র চার বছরের বড় তোমাকে, মায়ের মতোই জড়িয়ে একটু বেড়ে উঠলাম। এগারো-বারো হল আমার, বয়ঃসন্ধিক্ষণে, তোমার পনেরো-ষোলো, তোমার জন্য আমি আকুল হয়ে গেলাম। একটা ছেলে কোন বয়সে প্রথম ভালবাসে জানো কি? সাত-আট বছরেই গো। কিংবা তারও আগে। তার মধ্যে চেতনা সঞ্চারিত হওয়া মাত্র কোনও না কোনও নারীকে সে ভালবেসে ফেলে। বিশ্বাস করো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভালবাসার আধার বদলে যায়। কিন্তু আমার হল না সেরকম। তোমাকে ছাড়া কাউকে আমার ভালই লাগেনি। কাউকে দেখে মনে হয়নি, কোলে মাথা রেখে শান্তি পাব। বয়সের ধর্মে তোমাকে চুমু খেতে চেয়েছি মনে মনে, বুকে আদর করতে ইচ্ছা হয়েছে, প্রকাশ করতে চেয়েছি কতবার—ভালবাসি—এই কথা বলার মধ্যেও বড় তৃপ্তি—কিন্তু তুমি এত সহজেই আমায় আদর করো, কোলে নাও, কতদিন তোমার বুক আমার গালে কপালে ছুঁয়ে যায়, অনায়াসে চুমু দাও তুমি, ভয় করত, ঠিক আজ তোমার যে প্রতিক্রিয়া, তার জন্য ভয় করত, যদি ছেড়ে যাও, যদি কেউ বুঝে ফেলে আর আলাদা করে দেয় আমাদের, যদি এ বাড়িতে তোমার আসা বন্ধ হয়ে যায়, আমি বাঁচব কী নিয়ে?’
‘তুই যা বলছিস, অসম্ভব! চার বছরের বড় আমি! চা-র!’
‘একটা করে সম্বন্ধ আসে তোমার, দেখতে আসে, আমার সারা রাত ঘুম আসে না। তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে, আমার একই সঙ্গে দুঃখ ও সুখ। সুখের-দুখের কাঁথা গায়ে আমি সারদিনমান কুয়াশা বানাই। সারা রাত তন্ত্রসাধনা করে একে একে নরবলি নারীবলি দিই যজ্ঞের লকলকে আগ্রাসী আগুনে। তারা সব নরকের জীব। পাপের আকার। এই ধরাধামে তোমাকে অবজ্ঞা করে যায়! তোমাকে! নেড়ে চেড়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে পাড়ি দেয় নবজলসায়! অধিকার নেই। হোমকুণ্ডে মরা যত শব আমি ধরে রাখি নতুন নুতন ফোল্ডারে। তারপর নেমে আসে উৎসবরাতি। আমার হৃদয় জুড়ে সুরের বাজনা বেজে ওঠে। হাজার হাজার বাতি জ্বলে। শীতঘুম ভেঙে গভীর গর্ত থেকে সাপ এসে বলে, ঝুমু আছে, ঝুমু আছে, ছেলেপক্ষ পছন্দ করেনি।’
‘সম্ভব নয়। সম্ভব নয় টোপর। পাপ হবে।’
‘কোনও পাপ নেই ঝুমু। ভালবাসা অপাপবিদ্ধ। বিয়েও জরুরি কিছু নয়। ভাইফোঁটা নয়। সম্পর্ক হয়। তার একটা নাম হয়। সেই নাম দেবে মন, পাড়াপড়শি নয়। জন্মের শংসাপত্র মিলিয়ে কি ভালবাসা হয়? তুমি বললে বিশ্বাস ভেঙেছি। ‘ভালবাসি’ বললে বিশ্বাসভাঙা? নাকি ভাল না বাসাই বিশ্বাসে আঘাত? তুমিও তো ভালবাস। আমাকেই। বলো? বাসো না? বলার বাসনা নেই? বোলো না, সে বেশ। বলো যদি, সত্য বোলো, মিথ্যা নয়। মিথ্যা নয়।’
‘পাগলামো কেন করছিস টোপর? তোকে আমি ভালবাসি। একশোবার। হাজারবার। সেটা অন্য ভালবাসা।’
‘এভাবে পরীক্ষায় বসো, অনাদৃত হও, এভাবে অন্যরা তোমাকে দুঃখ দেয়, তোমার জীবন গছিয়ে দেয় তোমাকেই অবহেলা করে, নিজের খেয়াল খুশিমতো। ভাল লাগে? বলো? ভাল লাগে?’
‘অন্য উপায় নেই যে।’
‘ঝুমু, আমি বিয়ে নিয়ে ভাবিনি। না করলেই বা কী। কিন্তু অন্য কোথাও চলে যাবে, তা কি হয়? একটা ভাল চাকরি মানেই তো যোগ্যতা। বিবাহযোগ্যতা। এতদিন সে যোগ্যতা ছিল না, বলিনি কিছু। আজ আমি রাজা। তুমি শুধু রাজি হও। হ্যাঁ বলো। বলো। ভালবাস। আমাকে যে ভালবাস তুমি। আমি টের পাই।’
‘সেটা অন্য।’
‘সেটা কেমন? ঝুমুদি? কীরকম সেটা?’
‘আমি জানি না।’
‘এটাই তোমার সৎ উত্তর। তুমি জানতে পারোনি। সংস্কার পলি ফেলে বোধে। আমি জানি তুমি আমাকেই ভালবাস। আমারই মতো করে। আমার, আমারই জন্য পাগলিনী সেই মেয়ে, চিনি, তাকে চিনি। ঝুমুদি, ঝুমু, তুমি সত্যি আমাকেই ভালবাস, ভেবে দেখতে চাওনি। তুমি মিথ্যে বলতে পারো না, তাই ‘ভাইয়ের মতো’ বলোনি। মনের কোনায় কোথাও এ স্বীকৃতি আছে। ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানে আওড়ানো আকাট ছড়ার নীচে ঢাকা। কোনও অর্থ কি হয়? যমদুয়ারে কাঁটা কি পড়ে? রাখি-বাঁধা, ভাইফোঁটাসিক্ত ভাই-বোন পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে শত্রু কি হয় না? উদাসীন হয়ে যায় না কি পরস্পর? ভাবো ঝুমু, ঢাকনা তুলে দেখো, নিজেরই কাছে স্বপ্রকাশ হও। একবার হ্যাঁ বলো। বাকি পৃথিবীর সঙ্গে আমি লড়ে যাব।’
‘তোর পায়ে পড়ি রে টোপর, কাউকে কিচ্ছু বলিস না। তুই যা বলছিস, হয় না, অসম্ভব, এটা ছেলেমানুষী। মাঝখান থেকে আমাদের দুই বাড়ির মধ্যে এই সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাবে।’
‘সম্পর্ক কি গোদুগ্ধ যে নষ্ট হয়ে যাবে? নাকি মুসুর ডাল? হিম যন্তরে তিনদিন থাকলেই পচা?’
‘সবাই কি তোর মতো করে ভাবে? বাবা কীরকম রক্ষণশীল জানিস না? নিজে আর বিয়ে পর্যন্ত করল না খানিকটা হয়তো রক্ষণশীলতার কারণে। মাঝখান থেকে কেউ আমাদের বিশ্বাস করবে না। ভাববে তলে তলে আরও অনেক কিছুই চলছে।’
‘কী চলছে? শোয়াশুয়ি? একটা প্রতিবন্ধী ছেলে আর বিয়ের বাজারে ফিরি হতে থাকা কালো মেয়ে শুচ্ছে ঘন ঘন?’
‘কাদা ছেটাবে সম্পর্কটায়। ভাল লাগবে?’
‘তাতে কী প্রমাণ হবে জানো?’
‘কী?’
‘মেয়েটা চার বছরের বড় হলেও যৌনসম্পর্ক, প্রেম-ট্রেম সম্ভব, এটা আর সকলেই জানে, মানে, কেবল তুমিই জানো না জানেমন।’
‘আমি বাড়ি যাচ্ছি রে। কাল আর আসব না তোর কাছে।’
‘পরীক্ষায় ফেল কোরো ঝুমুদি। আমার শুভেচ্ছা। আর ভেবো। কী চাও। কী চাও না। আমি তোমাকেই চাই। বার বার মারো, বার বার। আমি সহস্র চাঁদের থেকে জ্যোৎস্না পানীয় করে ভালবাসা বানিয়েছি বুকের ভিতর। মস্তিষ্কে, হাতে, কোষে কোষান্তরে, এমনকী অসাড় পায়েও ছড়িয়ে দিয়েছি অশেষ অসীম প্রাণ। প্রাণ, তুমি প্রাণ, তুমি ভালবাসা, প্রাণের ভিতর প্রাণ হয়ে এসো তুমি। আমি আছি। তোমারই জন্য আমরণ। যতই প্রহার করো, যতই চড়ের বার্তা শরীরে পাঠাও, যতই আঘাত করো, তোমাকেই ভালবেসে যাব। তোমাকেই চেয়ে নেব জগতের কাছে। তোমাকেই বলব ভিক্ষা দাও আঁচল ভরিয়ে। তোমাকে তুমিই ভিক্ষা দাও।’
‘লেগেছে গালে?’
‘হুঁ।’
‘আহা! আয় হাত বুলিয়ে দিই টোপর।’
‘কাছে এসো। আরও কাছে।’
‘আজ নয় টোপর।’
‘একটা চুমু দাও।’
‘আজ আর নয়।’
‘কপালের মাঝখানে। একটা!’
‘না টোপর। পারব না।!
‘রাগ করে চলে যাবে? বিশ্বাস করো না?’
‘না। রাগ নয়। অবিশ্বাসও নয়। আমাকে ভাবতে হবে। বুঝতে হবে, টোপর।’
ঝুমু ও নমিতা ও নরম কিতাব
সকাল সকাল ঝুমু-র চলে মেহেন্দি লাগাতে এল ঝাড়ু নমিতা। ঝিরির আয়োজন। রূপচর্চার প্রাথমিক কিছু কায়দা জানে নমিতা। সুতো দিয়ে ভ্রূ চেঁছে ধনুক-বাঁকা, চুলের প্রসাধন, ফাটা পায়ের মসৃণতা উদ্ধার। এমনই কানাই সামন্ত সরু গলিতে বিয়ে লাগলে ঝাড়ু নমিতার কনে সাজাবার অগ্রাধিকার। সে এ কাজে পারিশ্রমিক নেয় না। স্রেফ শখ।
উত্তরের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছে ঝুমু। গায়ে গামছা। রং-চটা পুরনো ঢিলে ম্যাক্সি। মেহেন্দির রং মাখামাখি হলেও খেদ নেই।
ছোট টুলে মেহেন্দির পাত্র রেখে, দাঁত মাজার পুরনো বুরুশ দিয়ে ঝুমু-র চুলের গোছায় অল্প অল্প করে লাগাচ্ছে নমিতা। ঝিরি সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে। হাতে বই।
ঝুমু বলল, ‘ঠিক যেন একতাল গোবর। বাবাঃ! কী হয় এসব লাগিয়ে?’
ঝাড়ু নমিতা বলল, ‘দেখতে গোবর। কিন্তু গন্ধ? আ আঃ! দারুণ লাগে। খুব গুণ মেহেন্দির। মাথা ঠাণ্ডা করে, চুল ভাল হয়, দেখবে শ্যাম্পু করার পর একদম সিল্কি! চুল পড়াও কমায়।’
‘তুই তো মেহেন্দির বিজ্ঞাপন লাগিয়ে দিলি।’
‘জিজ্ঞেস করো ঝিরিকে। কী রে ঝিরি? বল!’
ঝিরি বলল, ‘মালটা আসলি তো?’
‘দেখেছ ঝুমুদি, কীসব ভাষা বলছে।’
‘মাল কি খারাপ কথা? মালগাড়ি হতে পারে, মাল মাটি, মাল গুদাম, মাল খালাস, মালদার— সবই তা হলে অচল।’
ঝুমু বলল, ‘রকের ভাষায় কথা খুব চলে এখন। ঝিরি স্মার্ট হতে চায়, না ঝিরি?’
‘চাই-ই তো। স্মার্ট, সাকসেসফুল, ইন্ডিপেন্ডেন্ট। কিপ্টে বুড়োর অধীনে আমি থাকছি না, থাকব না। মাল্লু কামাব আর ওড়াব। সেই তো জীবন মামা, মাল নাকি পায়জামা? বেশ দিচ্ছিস তো নমি, আমারও লাগাতে ইচ্ছে করছে।’
নমিতা বলল, ‘আর মেয়েদের যখন ‘মাল’ বলে?’
‘বলে তো বলে। মেয়েদের তো ‘জিনিস’-ও বলে।’
‘আরও কত কী বলে। মাকড়ি, নিমকি, দুদমা।’
‘এতো পুরো মেয়েটাকে বলে। এরপর আছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।’
ঝুমু বলল, ‘হয়েছে। তোরা থাম এবার। আঃ! মাথাটা বেশ ঠাণ্ডা লাগছে।’
“টোপর’ কাকে বলে জানো ঝুমুদি?’
‘হি হি হি হি!’ ঝিরি হাসছে। ‘দিদিকে বলিস না। রেগে যাবে।’
ঝুমু বলল, ‘রেগে যাব কেন? শুনি।’
নমিতা বলল, ‘টুপি, টুপি। কণ্ডোমকে বলে টোপর।’
‘যাচ্ছেতাই। মা গো। গা গুলোচ্ছে।’
‘এতেই? দিদি, তুই আর মানুষ হলি না।’
‘তুই কি বিবস্বানের সামনেও এই ভাষা বলিস?’
‘তো? ওর সামনে কি শুদ্ধভাষা বলব নাকি? ও কি আমার গুরুঠাকুর? না বট্ঠাকুর?’
‘বট্ঠাকুর মানে কী বল তো?’
‘কেন? বটগাছ ঠাকুর! বটগাছতলায় পুজো দেয় দেখিসনি? এ আর জিজ্ঞেস করার কী আছে?’
‘তোর মাথা আর আমার মুণ্ডু। বট্ঠাকুর হল বড়ঠাকুর। ভাসুরকে ভাইয়ের বউরা বট্ঠাকুর বলত।’
‘সত্যি বাবা, ভাশুর শ্বশুর ননদ নন্দাই জা শাশুড়ি— কী অদ্ভুত শব্দ সব! শুনলেই মনে হয় আজব এক দুনিয়া। সবাই খুব নিষ্ঠুর আর সমালোচক টাইপ্স্। কেমন অচেনা লাগে, না রে দিদি? ভয়-ভয় করে।’
‘ভয়-ভয় করে বলে তো মনে হয় না। এক পা বাড়িয়েই আছিস।’
‘দাঁড়া। দিল্লি আভি দূর হ্যায়।’
‘কেন?’
‘কেন আবার। প্রেম করছি ঠিক আছে। বিয়ের ব্যাপারে অনেক ভাবতে হবে।’
‘তার মানে?’
‘আমি বলছি না বিবস্কে বিয়ে করব না। চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে অনেক তফাত। ও কোথায় চাকরি পাবে, আমি কোথায় পাব, একই শহরে পাব কিনা, না পেলে কী করব, দূরে গেলে এই প্রেম টিকবে কিনা…’
‘চোখের সামনে না থাকলেই প্রেম শেষ হয়ে যায় নাকি রে ঝিরি?’
‘যায়-ই তা বলব কী করে? তবে যেতে তো পারেই। রোজকার দেখাসাক্ষাৎ টান বাড়ায় তো।’
‘অদর্শনে টান কমে আসে? বাঃ! বেশ বললি তো! তাই যদি হবে, তবে দাম্পত্যে প্রেমের মরচে পড়ে কেন? একসাথে থাকা, খাওয়া, শোওয়া, অ্যান্টাসিড বা ঘেমো অন্তর্বাসের সহাবস্থানে প্রেম তো সবারই তুঙ্গে থাকা উচিত ছিল।’
ঝাড়ু নমিতা বলল, ‘আমি কিন্তু মানি না ঝুমুদি। টান অনেকরকম হয়। সব গাছের শিকড় কি সমান গভীরে যায়? দূরে গেলেই প্রেম ফিকে হয়ে যায়, এটা মানি না। আমার একটা অদ্ভুত কথা মনে হয়। এই ঝিরি, হাসবি না। রাস্তা ঝাড়ু দিই বলে কি আমি ভাবি না?’
ঝিরির হাসি থামছে না। সারা শরীর কাঁপন ছড়িয়ে হেসে যাচ্ছে। বলল, ‘দিদি, নমি কিন্তু তত্ত্ব আওড়ায়। পথের আবর্জনা পরিষ্কার করতে করতে ওর নাকি মনে হয়, ও দেশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জগন্নাথের রথের রশিতে ওর হাতের শক্তিটুকুও পড়ছে। হি হি হি!’
ঝুমু বলল, ‘ভাবনাটা ভুল কীসে? ও বলছিল একটা কথা, তুই বাধা দিচ্ছিস, বল তো নমি।’
‘না। ঝিরি শুধু হাসে। আমার কাজটাকে আমি সনমান করব না? তো কাজটা আমি করি কেন?’
‘নমি, তুই ভবিষ্যতে সংগঠনের নেতৃত্বভার নিবি। সম্মানকে সনমান বলিস না।’
‘স্যরি!’
‘কী বলছিলি, তাই বল।’
‘ধরো, যারা ফৌজি বা জাহাজি, দিনের পর দিন ঘরে থাকে না, তাদেরও তো প্রেম থাকে! ধরো, মিছিলে স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছি। কিন্তু কমলকে ভাবছি। ওর সঙ্গে তো কথাই হয় না। আমি গিয়ে ওর দোকানের পাশে মঞ্জুমাসির চায়ের ঘরে বেঞ্চে বসে পা দোলাই আর আজেবাজে বকি। পাত্তাও দেয় না। তবু ওকে ভাবি কেন? কারণ ও আমার মাথার মধ্যে আছে। আমার চিন্তায়। যতদিন ওকে ভাবতে থাকব ততদিন ওকে ছাড়া আমার চলবে না। সে ও আমার সঙ্গে আশনাই করুক আর না করুক। তার মানে কী? একটা মানুষকে তুমি কোথায় রাখছ।’
ঝিরি একটু ভাবল। প্রসঙ্গ পালটে বলল, ‘নমি, দিদির আর কতক্ষণ?’ ‘আরও দশ মিনিট। অনেক চুল না? খুব ভাল চুলের জাত। ঝুমুদি, তোমাকে টপনট খুব মানাবে। আজ করে দেব।’
‘না। একদম না। ওই যেমন বিনুনি করি, তেমনি।’
‘ঝিরি তুই মেহেন্দি লাগাবি তো জামা পালটে আয়। যা আছে তোর হয়ে যাবে।’
‘তুই কি ভাল রে নমি। আমি চাকরি পেলে তোকে কী উপহার দেব বল।’
‘তোর বাজেট কত?’
‘বাবাঃ! তুই বাজেট ভাবিস নাকি?’
‘বাজেট তো আমরাই ভাবব ঝিরি। আগে-ভাগে খরচের পরিকল্পনা না করলে সংসার চলবে কী করে? উড়োনর মতো টাকা থাকলেও বাজেট, না থাকলেও। ভারত সরকার বছর বছর বাজেট করছে। আমাদের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী সংগঠনেরও বাজেট করতে হয়। আমাদের এলাকায় সংগঠনের ব্যয় পরিকল্পনা কমিটিতে আমিও আছি এখন।’
‘তুই তো বশ লকলকিয়ে উঠছিস রে নমি!’
‘উঠব না তো কী। ছাইগাদার মধ্যেও লাউ-কুমড়ো-চিচিঙ্গের লতা ফনফনিয়ে ওঠে, দেখিসনি?’
‘বাবাঃ! তোর সঙ্গে কথায় কে পারবে? মুন্নার মা পর্যন্ত তোকে সমঝে চলে। ওসব সংগঠন-টন করে কী হয় রে নমি? টাকা আসে?’
‘দুনিয়ায় সব কাজই কি টাকার জন্য? স্রেফ কাজের আনন্দও তো আছে।’
‘স্রেফ কাজের জন্য কাজ বলে কিস্যু হয় নাকি আবার? এই দ্যাখ, তুই যা বিউটিশিয়ানের কাজ শিখেছিস, একটা কোর্স নিলে অনায়াসে টু পাইস বাড়তি রোজগার করতে পারবি।’
‘যেদিন আমি কনে সাজিয়ে বা ভুরু তুলে টাকা নিতে শুরু করব, সেদিন থেকেই বিচার শুরু হয়ে যাবে, এক ঝাড়ুদারনির জ্ঞানগম্যি আছে কিনা, আদৌ অধিকার আছে কিনা এসবে, যদি থাকে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে এসেছে তো? বিনে পয়সার সার্ভিসে অনেক দোষ মাপ হয়ে যায়।’
‘তা কেন? ঝাড়ুদারনির গায়ে কি ময়লা লেগে থাকে?’
‘না। ময়লা লোকের চোখে। আমরা তো স্নান করলেই সাফ। আর তুই বলছিলি না, সংগঠন করে কী হয়! গরিবের দুঃখ গরিবই বোঝে। তাই একত্রিত হওয়া। ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য একযোগেই লড়তে হয়।’
ঝুমু বলল, ‘শুধু গরিব কেন? সমাজে সবারই ন্যায্য পাওনা অধিকারের প্রশ্ন আছে। ব্যাঙ্ককর্মী সংগঠন আছে। বাবা কিংবা প্রবীরকাকারও আছে। আবার মেয়েদেরও সংগঠন আছে। একজন মানুষকে আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে লড়াই করে নানারকম অধিকার আদায় করতে হয়।’
‘তাই ঝুমুদি?’
‘তাই না? তোকেই দ্যাখ। কমলের সঙ্গে তোর একটা যুদ্ধ চলছে না? ও তোকে চাকরি ছাড়তে বলছে। তোর অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে, তুই প্রতিরোধ করছিস। যাকে পেলে তোর জীবন সুন্দর হয়ে যাবে, সে-ই তোর প্রতিপক্ষ। আবার একজন কর্মী হিসেবে তোর সংগ্রাম আছে। প্রতিদিন আরও কত যুদ্ধ!’
‘ঠিকই বলেছ। শ্বশুরবাড়িতে গেলে আবার কঠিন যুদ্ধ, না?’
‘সবার হয়তো নয়।’
ঝাড়ু নমিতা ঝুমুর মেহেন্দি মাখানো লম্বা চুল গোছা ধরে পেঁচিয়ে মাথার উপর স্তূপ করছে, পুরনো গামছায় বেঁধে দিল।
‘চুপ করে বসে থাকো। দু’ ঘণ্টা।’
‘না না। অত পারব না।’
ঝিরি পোশাক পালটে এসেছে। ঝুমুর মতোই ঢিলে ম্যাক্সি। কাঁধে ফিতে বাঁধা। টানলেই শরীর থেকে খসে পড়ে। বিশুদ্ধ রাতপোশাক। ঝিরি ঝুমুর চেয়ে লম্বা। গায়ের রং ধলোর দিকে। তার বুক কাঁধ দৃশ্যমান।
‘এভাবে বাইরে চলে এলি!’ ঝুমু ধমকে উঠল।
‘বাইরে আবার কী! এদিকে অত দেখা যায় না।’
‘কী করে বুঝলি? যা, গায়ে গামছা দিয়ে আয়।’
‘এটা কী! দেখছিস না? গায়ে গামছা তো দিতেই হবে।’
‘দে তবে। তলায় ব্রা পর্যন্ত পরিসনি। জল চুঁইয়ে সব ফুটে উঠবে না?’
‘ওঃ দিদি! তুই পারিস!’ গায়ে গামছা জড়াল। নমিতা বলল, ‘ঝুমুদি, তুমি চাইলে আর-সব কাজ সেরে নিতে পারো। ঝিরির লাগানো হলে একবার বাড়ি যাব। ফের এসে তোমার চুল ধুয়ে দিয়ে যাব।’
ঝিরি বলল, ‘কোন শাড়ি পরবি? টোপরের দেওয়া লালটা তো?’
‘টোপর তোমাকে শাড়ি দিয়েছে? কেন গো?’
‘কারণ ছাড়া শাড়ি দেওয়া যায় না?’
‘তা কেন যাবে না। টোপর শাড়ি দিয়েছে, তাই বলছি। বিজয়া, পয়লা বৈশাখ, ভাইফোঁটা, ফ্রেন্ডশিপ ডে— কিছুই তো নেই।’
ঝুমু বলল, ‘টোপর চাকরি পেয়েছে, তাই। পলাশ বলেনি বাড়িতে?’
‘পলাশ? একটা কথাও তুমি ওর পেট থেকে বার করতে পারবে না। এমনিই হয়তো কৌতূহলে জানতে চাইলাম, বলে কী জানো? টোপরদা আমাকে বিশ্বাস করে। তোর কিছু জানার থাকলে টোপরদাকে জিজ্ঞেস কর।’
‘এই তো জেনে গেলি। টোপর চাকরি পেয়েছে বলে আমাকে শাড়ি দিয়েছে আর ঝিরিকে ব্যাগ।’
‘কত খেলেছি ওর সঙ্গে, এখন ওকে দেখলে কীরকম ভয় ভয় করে ঝুমুদি।’
ঝুমুর ঝুমুর
গাঢ় লাল শাড়িটা ভাঁজ খুলে বিছানায় ছড়িয়ে দিল ঝিরি। ঝুমুর বুকটা ধ্বক্ করে উঠল। হাতের তালু ঘামছে। কষ্টে ভরে যাচ্ছে মন। কীসের কষ্ট? সে টোপরকে কষ্ট দিচ্ছে, তার ফল ভুগছে। ঝুমুর পক্ষে বরং সোজা ছিল মরে যাওয়া, যদি টোপর বলত, তুমি মরে গেলে আমার ভাল হবে। কিন্তু টোপর ঝুমুর মরণ চায় না। বরং ঝুমুকে সর্বস্ব দিয়ে বাঁচাতে চায়!
অসম্ভব! টোপর উন্মাদ! বদ্ধ পাগল! ও যা চায়— অসম্ভব!
কিন্তু এই শাড়ি পরে সে নিজের প্রদর্শনী করবে? রুপুকাকিমার মতো লাল শাড়ি পরে বিদায়ের আয়োজন করবে ঝুমু? শাড়িটা এত সুন্দর, সবাই যে চায় সে এই শাড়ি পরুক। অন্তরতম সততায় সে অস্বীকার করতে পারছে না, সে নিজেও তাই চায়। তার ভারী বিশ্রী লাগছে এখন।
‘কী সুন্দর শাড়িটা ঝুমুদি!’ চুল বেঁধে দিচ্ছে ঝাড়ু নমিতা আর বলছে। ‘অপূর্ব সুন্দর, না ঝুমুদি?’
‘হুঁ।’
‘গয়না কী পরবি, দিদি? বাবাকে বলেছিলাম, ক’টা গয়না লকার থেকে নিয়ে এসো। এমনভাবে তাকাল যেন আমি বাবার পাঁজরের হাড় চাইছি। বলে, ‘তোর মায়ের জিনিস তোদেরই বিয়েতে দেব ভাগাভাগি করে। একটা হারালেই অপূরণীয় ক্ষতি। সোনার কী দাম জানিস? চারগাছা চুড়ি করতে লাখ টাকা খরচা।’’
‘গয়না লাগবে না ঝিরি।’
‘ঝট্সে সিটি গোল্ড কিনে আনবি নমি? এই শাড়ির সঙ্গে একটু গয়না না হলে বিচ্ছিরি লাগবে।’
‘শাড়িটা তুলে রাখ।’
‘পরবি না?’
‘এবার প্রবীরকাকা দিয়েছিল যে শাড়িটা, পুজোয়, ওইটা দে।’
‘গোলাপি মটকা? গোলাপি তোকে মানায় না দিদি, আরও কালো লাগে।’
নমিতা বলল, ‘এটাতে ফাটাফাটি লাগবে তোমাকে ঝুমুদি। ছেলের বাড়ি একবারে পছন্দ করে যাবে।’
‘আমিও ঠিক একথাই বলেছিলাম।’
‘তা হলে তো ওদের শাড়ির দোকানে পাঠিয়ে দেওয়াই ভাল। ম্যানিকিন কিনে আনবে। বউ করবে।’
‘তার মানে?’
‘শাড়িটাই ওদের পছন্দ হবে। তার তলায় আমার চলনসই চেহারাটা নজরে পড়বে না। পরে যখন বুঝবে, আফশোসের শেষ থাকবে না। ওরকম একটা লালশাড়ি পরাটা কি আদিখ্যেতা হয়ে যাচ্ছে না? যেন কনে সেজেই হাজির হচ্ছি! না না। গোলাপিটাই দে, নয়তো বাবা যে ছানার জল টাঙাইল দিল গতবার, ওইটা দে ঝিরি। ম্যাচিং ব্লাউজ়টা বেশ ফিটিংস হয়। ঝুটো মুক্তোর গয়না পরলেও মানিয়ে যাবে।’
‘তুই যা ভাল বুঝিস।’
‘কপালে থাকলে হবে, নইলে কপাল কুটলেও হবে না। অত ভেবে কী হবে?’
ঝুমু ও নমিতা ও চিরপরাজিতা
‘ঝুমুদি।’
‘উঁ।’
‘ওরা এসে পড়েছে।’
‘বেশ তো, চা বসা। মিষ্টির প্লেট সাজাতে পারবি তো?’
‘গোপালীমাসি করছে ওসব। আমাকে তোমার কাছে পাঠাল।’
‘বোস।’
‘মুখটা প্যাঁচা করে আছ কেন গো? একটু হাসি-হাসি হও না। লাল শাড়িটাও পরলে না।’
‘কোন আনন্দে লাল শাড়ি পরে হাসি-হাসি মুখে বসে থাকব?’
‘তা থাকবে না? বিয়ের দেখা বলে কথা। ছেলের বাবা কাকা কেউ আসেনি গো। শুধু মা, বোন আর মামা বলল।’
‘প্রথমবারের পক্ষে এই কি যথেষ্ট নয়?’
‘ছেলেও আসেনি।’
‘ছেলের বাবা শুনলাম অসুস্থ। একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। আর ছেলে বলেছেন মায়ের পছন্দই তাঁর পছন্দ!’
‘আসবে না? দেখবে না তোমাকে?’
‘আমি কী করে বলব।’
‘সে কী গো ঝুমুদি! আজকাল এমন রামচন্দ্র কেউ হয়? মা যাকে গলায় লটকে দেবে তাকেই? ডাল মে কুছ কালা নেই তো? সারা জীবনের ব্যাপার।’
‘কেন রে? এতে সন্দেহ করার কী আছে! আমায় ধরে যার গলায় লটকানো হচ্ছে, আমি তো বাপু তাকেই মেনে নিয়ে বসে আছি! বার বার দেখা দিচ্ছি, হেঁটে বোঝাচ্ছি হাঁটতে পারি, হেসে বোঝাচ্ছি গোমড়া নই, কথা বলে বোঝাচ্ছি বোবা নই, কিন্তু ছেলে দেখতে তো যাচ্ছি না। এই ভাল। এইটুকু দেখে কী আর বোঝা যায়। সবটাই তো জুয়ার মতো।’
‘আহা! ছেলেকে দেখে তো তার চেহারাটা বুঝতে! শেষে শুভদৃষ্টিতে পানপাতা সরিয়ে দেখলে বর ট্যারা চোখে চেয়ে আছে। তখন?’
‘ট্যারার কপালেই ঢ্যারা দেব। গলায় মালা। তারই দু’হাত ধরে বলব— তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি-ই প্রিয়, এ কি মোর অপরাধ!’
‘যাঃ! হি হি হি! তুমি না পারো! বিয়েটা যেন তোমার হচ্ছে না, তুমি প্রক্সি দিচ্ছ। দেখো, এরা যদি তোমায় পছন্দ করে, ছেলে ঠিক তোমার সঙ্গে বাইরে দেখা করবে।’
‘কেন?’
‘আজকাল সবাই তাই করে। প্রথমে বাড়ির লোক সম্বন্ধ ঠিক করে, তারপর ছেলে-মেয়ে চুটিয়ে প্রেম করে। কারও কিছু বলারও থাকে না।’
‘আমার বুকে যে অত মধু নেই রে! শোন নমি, ছেলে ভাল রোজগার করে বাবা খোঁজ নিয়েছে। ছেলে, ছেলের বাড়ির লোক— সবাইকে বড়পিসি চেনে। আমার আর দেখে কাজ কী। ওতে প্রেম হয় না। ছোলা ভিজিয়ে রাখলে যেমন অঙ্কুর হয়, প্রেম হল সেইরকম। ভিতরে থাকে, তারপর কোনও একসময় প্রকাশ পায়। তোর যেমন পেয়েছে।’
‘আমার কথা বাদ দাও।’
‘কেন?’
‘এক হাতে কি তালি বাজে? সে তো আমাকে চায় না।’
‘তালি না বাজলেও প্রেম মিথ্যে হয়ে যায় না রে। তোর অনুভূতি তো মিথ্যে নয়। কমল তোকে বুঝলে তোর কষ্ট কমত ঠিকই, প্রেম তো প্রেমের জায়গাতেই থাকত।’
‘না গো ঝুমুদি। প্রেম বোধহয় একটু বল্লী টাইপ। আঁকড়ে ধরতে চায়। স্বীকৃতি চায়। নইলে কী হয় জানো?’
‘কী?’
‘লতা নজর করেছ কখনও? আমাদের চানঘরের পাশে একটু মাটি, পলাশ ওখানে একটা জুঁইলতা লাগিয়েছিল। দড়ি দিয়ে পাইখানা ঘরের অ্যাসবেস্টাসে তুলে দিয়েছে। গাছ তো অনেক ডাল ছাড়ছে। মা ওর গোড়ায় মাছ-ধোয়া মাংস-ধোয়া জল দেয়। যত বল্লী উঠছে সব তো দড়ির নাগাল পাচ্ছে না। যে পায়, বেয়ে ওঠে, যে পায় না, ক’দিন শূন্যে সবুজ পাতাগুলো দোলায়, তারপর ডগা শুকোতে থাকে, ডগার পর গলা বুক পেট করতে করতে পুরো বল্লিকাই একটা কাঠি। একটা পাতা নেই। ঝরে গেছে। কালো। শুকনো। কাঠি।’
‘চুপ কর।’
‘কেন?’
‘বকবকানি ভাল লাগছে না।’
‘ভয় করছে?’
‘ওঃ! তোর যেন মুখের পাতা পড়ে না নমি।’
‘ওই তোমার সঙ্গেই তো একটু কথা বলি।’
‘চুপ কর। বিশ্বসুদ্ধু তোর বন্ধু।’
‘না গো। সব কথা কি সবাইকে বলা যায়? নাকি বলা উচিত?’
‘হুঁ।’
‘ঝুমুদি।’
‘উঁ।’
‘তোমার প্রেম হয়নি?’
‘জানি না রে।’
‘সে কি!’
‘সত্যি! এর উত্তর জানা আমার কাছেও খুব জরুরি।’
জয়ী ও কল্যাণী ও নিজ সর্পমণি
‘এই আমার ভাইঝি, কল্যাণীদি। বড়টা। ছোটটাকে তো দেখেছ। সারাক্ষণ চোখেমুখে কথা। এ কিন্তু একদম উলটো। বড্ড চাপা আর শান্ত। আমাদের সবার মা হয়ে বসে আছে।’
‘এসো। বসো আমার পাশে। বোনের নাম ঝিরি। তোমার নাম কী?’
‘ঝুমু। ঝুমুর।’
‘বাঃ! বেশ নাম! আর ঝিরির ভাল নাম?’
‘ঝরোকা।’
‘বাঃ! কে নাম রেখেছে?’
বড়পিসি বললেন, ‘ওদের মা। বই পড়ার নেশা ছিল খুব। ঝুমুও পেয়েছে মায়ের গুণ। ওই পাশের বাড়িতে ওদের এক ভাই আছে, তার নামও ওর মায়ের দেওয়া। টোপর, আর ভাল নাম কী যেন রে ঝুমু?’
‘শতরূপ।’ ঝুমু বলল।
‘বাঃ! সে কোথায়? কি, কাজিন ভাই?’
বড়পিসি বললেন, ‘না না। আপন ভাইয়ের মতোই। রক্ত সম্পর্ক নেই। আসলে ছেলেটা জন্মখোঁড়া। পঙ্গু। তাই এদের খুব টান। ঝুমুর বাবা জ্যোতি আর টোপরের বাবা প্রবীর কলেজকালের বন্ধু। একজনেরও বউ নেই। তার ওপর ওই পঙ্গু ছেলে।’
‘আহা!’
ঝুমু স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। কল্যাণী যেভাবে বাঃ বাঃ করছিলেন সব কথায়, টোপর প্রসঙ্গেও সে আশঙ্কা হচ্ছিল তার। সে ঠোঁট কামড়াল। ভ্রূ কুঁচকে আছে। পঙ্গু শব্দটা সে সহ্য করতে পারে না। সে বলে ফেলল, ‘টোপর ঠিক পঙ্গু নয় কিন্তু। ও নিজের সবকিছু পারে। গাড়ি চালায়। কারও ওপর নির্ভর করে না।’
‘বাঃ! তা হলে তো খুব ভাল!’ কল্যাণী তাঁর দাদা সুনন্দ এবং মেয়ে শাশ্বতীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন। শাশ্বতী হাসল। সে বিবাহিতা। রোগা, লম্বা, ঝিরির মতো রং। মুখখানা ভারী সুন্দর, অনেকটা ঝুমু-র স্কুলের সরস্বতী প্রতিমার মতো। প্রতি বছর এক মুখ। এতটুকু এদিক-ওদিক নেই, শাশ্বতী হাসলে টোল পড়ে। ঠোঁট দুটি একটু ফোলা। চোখ টানে। খুব বেমানানভাবে তার চোখের তলায় গাঢ় কালি। অনেকদিন অসুখে ভুগে উঠলে যেমন হয়। শাশ্বতী ঝুমুকে নিজের পাশে ডেকে নিল।
‘দাদার ছবি দেখবে? মোবাইলে তুলে এনেছি।’
ঝুমু হাসল। তার কোনও আগ্রহ নেই। ‘দেখতে চাই না’ বললে শাশ্বতী আহত হতে পারে ভেবে চুপ করে রইল। তার সামনে এখন সেলফোনের ইঞ্চিখানেক বর্গাকার বা সামান্য আয়তাকার আলোকোজ্জ্বল পর্দা, তাতে এক যুবক। মাথায় অল্প চুল, মোটা গোঁফ। বেশ ফর্সা লাগছে। কল্যাণী ও সুনন্দকে ফর্সাই বলা যায়। যুবক গম্ভীর। চোখমুখ অনেকটা শাশ্বতীর মতো।
কল্যাণী বললেন, ‘আমি তোমার এই ভাইঝিকে কোথাও দেখেছি জয়ী।’
‘দেখেছই তো। আমার সঙ্গে তো যায়। গুরুমা এলে ও-ই তো যায় সঙ্গে। খুব ভক্তিমতী। তোমার খুব সুবিধে হবে।’
বড়পিসি ঝুমুর গুণপনা নিয়ে পড়লেন। এই যে ছাগলটা দেখছেন, এর জাত খুব ভাল। গোরুও ভাবতে পারেন একে। আর এই গোরুটা, হ্যাঁ, ঝুমু, দেখুন, এর দাঁত দেখে নিন সবার আগে, আরে দাঁতই হল গোরুর যৌবনের প্রমাণ। স্বাস্থ্য দেখেছেন? দুধ যা দেবে! ওলান দেখুন, যেমন আঁট তেমনি বাঁট! গা দেখুন গা দেখুন, যেন মসৃণ রেশম, হাঁ, যত্ন করি বটে আমরা, মরশুমের শাকপাতা খাওয়াই, বাজারের সেরা খড়বিচুলি, জাবনা, খায় না বেশি, বরং প্রচুর গোবর দেয়, দুধও তেমনি দেবে, বালতি কিনতে হবে নতুন নতুন। হেঃ হেঃ! যখন বিনা বাক্যে আদেশ মান্য করতে হবে— এ ছাগী হয়ে যাবে। একেবারে নধর বেঙ্গল ব্ল্যাক। আবার গাধাও আপনি একে বানাতে পারেন। যতই ভার চাপান, মেরুদণ্ড রামধনু হয়ে যাবে, তবু মুখ ফুটে বলবে না— আর পারি না, পারি না! তবে হ্যাঁ খবরদার! পায়ে একটা শিকলি দিয়ে রাখবেন। বিশ্বাস? না না। না-বিয়োন পর্যন্ত বিশ্বাস নেই। ছাগলি হোক, গাভী হোক, গোরু হোক— কাউকে পুরোপুরি বিশ্বেস করা যাবে না, বিয়োলেও না, কারণ? মার চকাচক লাগ্ ধকাধক্— জগতে সব মেয়েমানুষের পাখি হওয়ার বাসনা প্রবল। আমি মেয়েছেলে হয়ে দিব্যি গেলে বলছি— পঞ্ছি ছাড়া পেলে আকাশে উড়বেই।
ঝুমু ও টোপর ও আপন-পর
ঝুমু ভেবেছিল, টোপর অন্ধকার ঘরে চুপ করে বসে থাকবে। গিয়ে দেখে সে বসে আছে কম্পিউটার নিয়ে। ভারী ক্লান্ত লাগছিল ঝুমু-র। আজ তাকে দেখতে আসবে বলে গোপালীমাসি সব সামাল দিয়েছেন, সকাল থেকে ঝুমু-র ত্বক, নখ, চুলের ঘষামাজা চলেছে। তাতে তার আরাম হয়েছে। মেহেদি আগে লাগায়নি সে কখনও। তাল তাল গোবর মাখার মতো মেহেদি ধুয়ে শ্যাম্পু করার পর নিজের সম্ভার থেকে শুষ্ককরণ যন্ত্র এনে গরম হাওয়ায় ঝুমুর চুল শুকিয়ে দিয়েছিল ঝাড়ু নমিতা। ‘যা গোছ তোমার চুলে, শুকোতে বিকেল হবে ড্রায়ার না দিলে। দেখো এবার চুলের রং।’
দেখল ঝুমু। তার কালো চুল এখন ঠিক অন্ধকারের আগেকার আকাশের মতো। কালোর ওপর গাঢ় লালের পোচ। যেন অলক্ষ্যে কোনও গোপন আলোকসজ্জা কারিগর গাঢ় সন্ধ্যা রঙের আলো ফেলছে তার মাথায়। ‘কী সুন্দর লাগছে। আমিও করি। চোখে পড়ে না। তোমার এত চুল। খুলে দাও। কী সুন্দর গন্ধ।’
‘না। চুল খুলে যাব না।’
‘মেহেদি করলে কালোদেরও ফর্সা লাগে।’
‘আমাকে লাগছে না তো। সেই কালো সাধারণ মেয়েটাই তো আয়নায়।’
ছেলের বোন শাশ্বতী বলল, ‘চুলটা খোলো না। একটা ছবি নিই। দাদাকে দেখাব।’
ঝুমু হেসেছিল। চুল খোলার কোনও উদ্যোগ নেয়নি। শাশ্বতী জোর করেনি। এমনিই ছবি নিল। ঝিরি বলে উঠল, ‘যার দেখার গরজ নেই তাকে জোর করে দেখাবেন!’
শাশ্বতী হাসল। বলল, ‘না বলা ওর স্বভাব। বিয়ে তো করবে না বলেছিল, এখন রাজি। ওর একটা কুকুর আছে। তার নাম বাঁটুল। বিশাল চেহারা যদিও। তাকে কুকুর বললে দাদা খুব রেগে যায়। সারাক্ষণ বাঁটুলের সঙ্গে ওর যুদ্ধ চলে। বাঁটুল নো। বাঁটুল না। বাঁটুল ডোন্ট! আই’ল কিল ইউ বাঁটুল! ডোন্ট মেক নয়েজ লাইক স্ট্রিট ডগস্! …আমাদের বাড়িতে আমরা সব অস্তিত্বহীন, শুধু দাদাকে আর বাঁটুলকে খুঁজে পাওয়া যায়।’
আজ অপরাহ্নবেলার সন্ধ্যাগামী দুটি ঘণ্টা ছেঁড়া-ছেঁড়া ভাবে ঝুমুর মনে আসছে। এঁরা কি পছন্দ করলেন তাকে? শীঘ্রই জানাবেন বড়পিসি। সে কি খুব উদ্বেগাকুল? পরীক্ষা যাই হোক, রক্তে কতখানি হিমোগ্লোবিন আছে, তারও ফলাফল জানার জন্য মন উচাটন থাকে। সে চুপচাপ টোপরের বিছানায় পা ছড়িয়ে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল।
‘ক্লান্ত?’ কম্পিউটার থেকে চোখ না সরিয়ে জিজ্ঞেস করল টোপর।
‘উঁ।’
আজ সকাল থেকে সে টোপরের কাছে আসেনি। ইচ্ছে করেই। দূরত্ব রচনা করা দরকার। সে ভেবেছে। পেরেছে কি? সারাক্ষণ টোপরকেই ভেবে গেছে।
‘কী ভাবছ?’
‘তোর জরুরি কাজ?’
‘না। তেমন কিছু না। পরে করলেও চলে।’
‘ওদের বাড়িতে কুকুর আছে।’
‘হুঁ।’
‘কুকুরকে ছেলেটা মানুষ ভাবে।’
‘তফাত কী?’
টোপর মুখ ফেরাচ্ছে না। কেন? রাগ করেছে? কেন? সকাল থেকে একবারও আসেনি ঝুমু, তাই?
‘কী মেখেছ? সোঁদা মাটির গন্ধ!’
‘অত দূর থেকে গন্ধ পাচ্ছিস?’
‘কুকুরের ঘ্রাণশক্তি মানুষরাও পেতে পারে।’
‘মেহেদি। চুলে।’
‘তোমার তো দাড়ি নেই। আর কোথায় দেবে!’
‘অসভ্য!’
‘কী অসভ্যতা করলাম রে বাবা!’
স্বাভাবিক হচ্ছে টোপর। আস্তে আস্তে। ঝুমুর ক্লান্তি কেটে যাচ্ছে। কী অদ্ভুত। এ ক্লান্তি কীসের তবে? ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাবার। কোন ইচ্ছে? কোন কোন ইচ্ছে?
‘আমি ক্লান্ত বুঝলি কী করে? ক্লান্তির তো গন্ধ নেই।’
টোপর কোল জোড়া কম্পিউটার টেবিলে রাখল। গড়গড়ি চালিয়ে ঝুমু-র দিকে আসছে। তালবেতাল দেওয়াল দণ্ডায়মান। ব্যবহৃত হতে চায়। বস্তু। সে কেবল ব্যবহৃত হতে চায়। ব্যক্তি। ইচ্ছানুসারে ব্যবহৃত হতে চায়। দুটির পার্থক্য ইচ্ছা নেই, ইচ্ছা আছে। ইচ্ছা। ঝুমু ইচ্ছার ভাসান দেয় আসমুদ্র জুড়ে। কারণ অকারণ বোঝে না। বোঝে না কি? উপলব্ধি ঘিরে আছে ঘা, পুঁজ, রক্ত, থুতু, কফ। ঝুমুর ঝুমুর বিপক্ষে সদাই সরব। হরবোলা পাখি যা শোনে তাই বলে। কেউ কেউ হরকরা। ডাক-হরকরা নয়। যা দেখে তাই করে। হর করা! প্রচলিত শব্দস্রোতে ভেসে যায়। ডুবে যায় নিষেধের পাঁকে। বাঁচার রাস্তা জানে পাঁকাল মাছেরা। মৎসগন্ধারা মরে প্রতিদিন রাতে। সুস্বাদু, নরম, আমরণ খলখল শব্দ করে বাঁচে, হুল দেয় জগতের প্রেমহীন হাতে।
‘ক্লান্তির গন্ধ বাসিপদ্মের মতো।’
‘বাসি পদ্ম?’
‘দেখো। এনে দেখো। বহুদিন থাকে। গন্ধও। একটু সোঁদা, মৃদু অথচ মধুর।’
‘কিন্তু এখন আমার ক্লান্তি কেটে যাচ্ছে।’
‘গন্ধও সতেজ। তবে চুলের নতুন গন্ধে তোমাকে নতুন করে চেনা প্রয়োজন।’
‘আমার অপরাধবোধ হচ্ছে।’
‘কেন?’
‘আমি কি তোকে প্ররোচিত করলাম?’
‘প্ররোচনা দিয়ে যুদ্ধ হয়। ভালবাসা নয়। কামার্ত করা যায়। আদিগন্ত পিপাসার্ত নয়।’
পা দু’টি ভাঁজ করল ঝুমু।
‘আয়। কোলে আয়।’
‘না।’
‘কেন? রাগ যায়নি?’
‘রাগ নেই ঝুমু। তুমি কেন বুঝবে না আমায়!’
‘বুঝি তো।’
‘আজ নয়। আজ তুমি ধ্বস্ত। বুঝবে না। আমি যতদিন নিজেকে প্রকাশ করিনি, সংযম ছিল। তুমি আমার কপালে চুম্বন করেছ, আমি তোমার ঠোঁট চাইনি। তুমি আমার গালে আঙুল রেখেছ, আমি সে আঙুল নিইনি জিহ্বায়, তুমি কোল পেতে নিয়েছ আমাকে, আমি তোমার অতলের গন্ধ সত্ত্বেও জাগাইনি ঘুমন্ত পাহাড়, তোমার ওই দুই আশ্চর্য মসৃণ গোলক— কতবার ছুঁয়ে গেছে, আমি তাকে দুই হাতে ধারণ করিনি। নিজেকে নিষেধ দিয়ে, কড়া প্রহরায় আমি অপ্রলোভন সংযত ছিলাম। আজ মনপাখি খাঁচা খুলে শেকল ছাড়িয়ে তার আকাশে উড়েছে। আর যদি না শোনে কথা? আর যদি শাসন না মানে? ঝুমু, সেই কোল দিও, যেখানে নিষেধ নেই, ভুল-করা জোর-করা অপমান সংস্কার বয়স ভাইফোঁটা নেই। যাব। তোমার কোলেই আমি আমরণ শুয়ে থাকতে চাই।’
দু’ হাঁটু মুড়ে, মুখ রেখে, নিঃশব্দে কাঁদছে ঝুমু, কেন হল? কেন এরকম হল? কেন সে টোপরের কষ্টের নিমিত্ত হল? এ কী জটিলতা, ভগবান!
টোপর ও ঝুমু ও নির্জীব ময়ূর
কথা নেই। বসে আছে চুপচাপ। শুধু বসে আছে। কাঁদছেও না। গান নেই। টিভি স্তব্ধ। কোনও সিনেমাও চলছে না। টিকটিক ঘড়িগুলি প্রবাহিত সময়ের সাক্ষ্য দেয়। বাকি সব অনড় অচল।
ঝুমুর বেদনা, সম্পর্ক স্বাভাবিক রইল না আর। সুন্দর বোঝাপড়া, বিশ্বাস, প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তাদের।
টোপরের যন্ত্রণা সত্যদীপ্ত। সে চায় সম্পর্ক নিবিড় হোক। ব্যাপ্ত বিশাল হোক। সব তাতে ধরে যাক। সে চায়, ঝুমুর সর্বার্থসাধিকা হোক তার। মন যা চায়, তাকে ছাইচাপা দিয়ে মারা স্বাভাবিক নয়। টোপর অন্যায় কোনও কিছু চায়নি। কেন সে লালন করবে না তার প্রভাময়ী ইচ্ছা? তার হারাবার কিছু নেই। ঝুমু ছেড়ে যাবে। যেতে চায়। সে তবু হারাবে না। রেখে দেবে অসংখ্য ঝুমুর তার বুকের তলায়।
টোপর ও প্রবীর ও প্রবিদ্ধ তির
দরজার ঘণ্টি বাজল। টোপরের জন্য এ বাড়িতে দরজার মাথার দিকে ছিটকিনি নেই। দ্বার খুলে দিল ঝুমু। পাকশালে গেল। প্রবীর এসেছেন।
‘চা খাবে তো কাকা?’
‘হ্যাঁ। খাবার আছে কিছু?’
‘ও বাড়িতে যাবে তো, ওখানে তোমার খাবার রাখা আছে।’
‘ও! তোর পরীক্ষা ছিল না আজ? বাঃ! এই সমুদ্ররঙে তোকে জলদেবীর মতো লাগছে রে মা! বেশ বেশ! তাঁরা কি এসেছিলেন?’
‘হ্যাঁ। টোপর, চা খাবি?’
‘বানাও। সবুজ কৃষ্ণপত্র।’
‘কৃষ্ণপত্র সবুজ কী করে হল? ওহো! গ্রিন টি!’
‘টি-এর শুদ্ধ বাংলা কৃষ্ণপত্র।’
রান্নাঘর থেকে ঝুমু-র স্বর ভেসে এল।
‘এত বাসন পড়ে আছে! আজ সরসী আসেনি?’
‘না।’
‘ও আর পারছে না। লোক দেখতে হবে।’
‘তুমি বাসন মাজতে বোসো না। কাল সকালে আসবে।’
‘ক’টা মেজে রাখলে কাল সুবিধা হত না?’
প্রবীর বললেন, ‘থাক, থাক। আজ অনেক গেল তোর ওপর দিয়ে। এসবে মনের ভিতর চাপ পড়ে। কেন আসছে? না দেখতে! অদ্ভুত নিয়ম! তা, ঝুমু মা, তোর কেমন লাগল তাঁদের? কেমন বুঝলি?’
‘কিছুই কি বোঝা যায় প্রবীরকা? তবে তারা কুকুরপ্রেমিক। কুকুরকে কুকুর বললে রেগে যায়।’
‘কী বলে? শ্বা? নিজের পদবি কুকুরের লেজে দেয় না তো?’
‘কুকুরের নাম বাঁটুল। সে প্রায় শামলা শাঁটুল, জানো! পাত্রের বোন বলল বাড়িতে বাঁটুল আর বাঁটুলের মনিব, তার দাদাই সব।’
‘তাই নাকি? তা পাত্র এল না কেন? এই সময়ের ছেলে এসব দেখাদেখির নিয়ম পছন্দ করে কী করে?’
টোপর বলল, ‘নিয়ম নয়। রীতি।’
‘একই ব্যাপার।’
‘না। এক নয়। নিয়মের মধ্যে কঠোরতা বেশি। বাধ্যতামূলক। রীতি অনেক নমনীয়।’
‘রীতি থেকেও নিয়ম হয়ে যায়।’
‘তা হতে পারে। তোমার প্রতিযোগিতা কেমন হল?’
‘দারুণ! বাচ্চারা খুব ভাল খেলছে। আজকাল সব কম্পিউটারের সঙ্গে দাবা খেলে। এরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী।’
‘সেটাই স্বাভাবিক। ছোট থেকে টিভি, কম্পিউটার, সেলফোন ঘাঁটছে।’
‘নব্য প্রযুক্তি নতুন প্রজন্মকে অনেক এগিয়ে নিচ্ছে।’
‘পিছিয়েও দিচ্ছে বাবা।’
‘বাচ্চাদের খেলা দেখে মনে হল না।’
‘ক’টা বাচ্চা দাবায় আগ্রহী? বেশিরভাগ চায় উত্তেজক খেলা। চ্যালেঞ্জ। কাউকে পরাস্ত করবে অথবা স্কোর করবে। অলীক জগতের জয়-পরাজয়, প্রতিযোগীর মনোভাব, নম্বর বাড়াবার নেশা তাদের অহং তৃপ্ত করে। সেই অলীক তৃপ্তি বাস্তবতাবোধ থেকে বিরত রাখে তাদের। খেলতে খেলতে একজন দক্ষ হয়, মাউস চালাবার বা আঙুল স্পর্শ করার ক্ষিপ্রতা অর্জন করে, চিন্তার নয়, হাতের, চোখ নাচানোর।’
‘ওতে বুদ্ধি লাগে না বলছিস?’
‘বুদ্ধির খেলা আছে, তাতে আগ্রহ কম।’
‘খেলা ছাড়াও ছোটরা অন্য জায়গায় চিন্তা ও বুদ্ধি প্রয়োগ করছে।’
‘ন্যূনতম। একটা প্যাটার্ন তাড়িয়ে নিচ্ছে এই প্রজন্মকে। একটা চাবি টিপলেই সব পেয়েছির আসর। সৃষ্টির মজা কুক্ষীগত করছে জনা কয় ব্যক্তি, আবিষ্কারের মজা-বাকি কোটি কোটি মানুষ যান্ত্রিকভাবে যন্ত্রের শরণ নিচ্ছে।’
‘আবিষ্কারের আনন্দ চিরকালই অল্প ক’জন পায়। তাই মানুষের মধ্যে সাধারণ আর অসাধারণের তফাত।’
‘না বাবা। বড় বড় আবিষ্কার ছাড়াও মানুষের জীবনে প্রতিনিয়ত ছোট্ট ছোট্ট আবিষ্কারের মজা থাকে। ধরো, আমি যখন স্টিয়ারিং হুইল ধরে ভার্চুয়াল গাড়ি চালাতাম, আমার আনন্দ-উত্তেজনা একরকম ছিল। কিন্তু সত্যিকারের স্টিয়ারিং ধরে যেদিন রাস্তায় বেরোলাম, ওঃ, সে যে কী অনুভূতি! প্রতি মুহূর্ত, প্রতি বাঁক, প্রত্যেকটি গর্ত, প্রতিটি ঋতুর আলাদা রূপ-রস গাড়ির ভিতর থেকে দেখতে দেখতে, আমার অসাড় পা দিয়ে যন্ত্রগুলোকে কব্জা করতে করতে প্রতি ক্ষণে আমি জীবন আবিষ্কার করেছি। সেটা ওই অলীক গাড়ি চালানোয় ছিল না।’
‘চা হয়ে গেছে।’ ঝুমু কাঠের থালিতে চায়ের পাত্র, পেয়ালা, বিস্কিট সাজিয়ে এনেছে। প্রবীর ব্যবহৃত মোজা ময়লা কাপড়ের ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে এলেন। কাজুবাদামের আদলে গড়া মুচমুচে বিস্কিট মুঠো ভরে মুখে পুরছে টোপর। প্রবীর বললেন, ‘একটু নিমকি ভাজিস তো মা মুড়মুড়ে করে। আর তো ক’দিন। তুই শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে ক’দিন খুব কষ্ট পাব।’
ঝুমু মুখ নিচু করে আছে। টোপর বুড়ো আঙুলের চাপে একটা কাজু বিস্কিট গুঁড়ো করে ফেলল। প্রবীর বলছেন, ‘সবচেয়ে কষ্ট পাবে টোপর। তুই ওকে যেভাবে আগলে রাখতিস, একেবারে মায়ের মতো। তোর নাম হওয়া দরকার মহামায়া। সবার মা হয়ে আছিস। কখনও অন্নপূর্ণা, কখনও কল্যাণেশ্বরী! টোপরকে যেভাবে যত্ন করিস, কোনওদিন মনে হয়নি ও প্রায় তোরই বয়সি।’
‘চার বছরের বড়।’ টোপর বলল।
‘সে আর এমন কী! হ্যাঁ রে ঝুমু, টোপরের দেওয়া শাড়িটা তোর পছন্দ হয়েছে? ভাবি জিজ্ঞেস করব, ভুলে যাই।’
‘হ্যাঁ। সুন্দর শাড়ি। অনেক দাম।’
‘দাম তো কী আছে! টোপরের একটা ইচ্ছে হয়েছে। কেমন পছন্দ করেছে বল। টোপরটাও বড় হয়ে গেল। চাকরি করছে, দিদির জন্য শাড়ি কিনেছে।’
‘তোমার একটা এডিনিয়ামের গুঁড়িতে পচ ধরেছে প্রবীরকা।’
‘সে কী! কোনটা বল তো! কাজের চাপে ক’দিন যেতে পারিনি! আজও সকাল সকাল খেলা দেখতে চলে গেলাম। হারান প্রায় দু’হপ্তা আসেনি।’
‘হারান আসছে না বলে আমি জল দিচ্ছি। বেশি দিয়ে ফেললাম বোধহয়।’
‘এমনিতে বেশি দিলে কিছু হয় না। টবে জল দাঁড়াচ্ছে কোনও কারণে। কোনটা হয়েছে?’
‘ছোট গাছ। মাস দুয়েক আগে একটা আনলে।’
‘এখনও ফুল ধরেনি। নার্সারিতে বলল হলুদ ফুল হবে।’
নীচে কানাই সামন্ত সরু গলিতে শোরগোল। কেউই কান দিল না। ঝগড়া, মাতালের বকাবকি, এর দরজায় লাথি, তার বউয়ের শাপশাপান্ত, মারামারি কখনও বিরক্তিকরও বটে। বিশেষত যদি কেউ থাকে ক্লান্ত, বিষাদে ছাওয়া। ক্লান্তি ও বিষাদ অপনোদনের জন্য এ বাড়িতে চা ছাড়া অন্য কিছু নেই।
‘আ আঃ! চা পেয়ে বড় আরাম হল! যাই, তোদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। শ্বশুরবাড়িতে গেলে রোজ সন্ধ্যা করে এখানে চলে আসবি তো মা। বলবি, বুড়ো কাকা আমার হাতে চা না খেলে ভাল থাকে না।’
টোপর অসহিষ্ণু স্বরে বলল, ‘আজকাল বেশি কথা বলো বাবা।’
‘বয়সের ধর্মই হল এমন। বাল্যে কৌতূহল ও কল্পনা, তারুণ্যে চপলতা ও বন্ধুবাত্সল্য, যৌবনে বিষাদ ও গাম্ভীর্য, বার্ধক্যে বাচালতা ও অহং ক্ষয়।’
‘তুমি কি জ্যোতিকাকার সঙ্গে দাবায় বসবে?’
‘না। আজ বসব না। সারাদিন তো দাবার মধ্যেই গেল। যাই একবার দেখে আসি।’
‘বেশ! কেউ তোমারে আইজ দাবায় রাখতে পারবো না।’
‘হা হা! ভাল পান দিলি তো!’
‘ঠিক আছে ঘুরে এসো।’
‘আচ্ছা। ঝুমু যাবি?’
ঝুমু টোপরের দিকে চাইল। অন্য দিন টোপর স্পষ্ট বলে, ‘না, ঝুমুদি এখন যাবে না।’ আজ সে চুপ। দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। ঝুমু-র থাকতে ইচ্ছে করছে। টোপর কিছু বলছে না, সে বিড়ম্বনা বোধ করল, অন্যের ইচ্ছের সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত সে নড়তেও ভুলে গেছে। বলল, ‘তুমি যাও, আমি একটু পরেই আসছি।’
টোপর তাকাল। দুই চোখে অভিমান পূর্ণ হয়ে আছে। ঝুমু-র ইচ্ছে করল, ওই মুখ বুকে চেপে ধরে। আর তা সম্ভব নয়।
প্রবীরের সিঁড়ি ভাঙার শব্দ আসছে। দরজা বন্ধ করে ঝুমু টোপরের মুখোমুখি দাঁড়াল। ‘তুই কি আমাকে থাকতেও বলবি না?’
‘কোন অধিকারে বলব?’
‘যে অধিকারে গতকাল পর্যন্ত বকবক করেছিস।’
‘ভেবে দেখলাম, জোর করার অর্থ নেই। এটা আমাকে আয়ত্ত করতে হবে। এতদিন অনায়াসে জোর করেছি। এখন আমার জোর তোমার বিপন্নতা হয়ে উঠবে। তোমার যেমনটা ভাল লাগে, তাই কোরো। তোমার ইচ্ছা আমার শিরোধার্য ঝুমু।’
‘টোপর আমার ভাল লাগছে না।’
‘আমারও খুব বিশ্রী লাগছে। তো? জীবনে যে সব কিছু মনের মতো হয় না, আমি জানি।’
ঝুমু টোপরের পায়ের কাছে বসল।
‘তুই যেমন চাস, আমি পারব না টোপর। কেউ মানবে না।’
‘তুমি তোমার কথা বলো।’
‘অসম্ভব! তুই নিরর্থক আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করছিস। আমার মাথায় সারাক্ষণ তোর কথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে তোকে কষ্ট দিচ্ছি। অপরাধ করছি। মনে হচ্ছে তুই অন্যায় আবদার করছিস। কখনও রাগ হচ্ছে, কখনও ভীষণ দুঃখ হচ্ছে। টোপর, আমি যে তোর দাবি মেটাতে অভ্যস্ত। এই দোটানায় আমার মধ্যে তোর কাছে আসার আগ্রহ কমে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। লাল শাড়িটা পর্যন্ত ওদের সামনে পরতে পারলাম না।’
‘সম্পর্ক নষ্ট হতে শুরু করেছে? ঝুমু, আমি আমার ভেতরের সত্য প্রকাশ করেছি। জোর করিনি। আবদার করিনি। নাটুকে আবেগ দেখিয়ে তোমার ওপর বোঝাও চাপিয়ে দিচ্ছি না। তা হলে নষ্ট হল কীসে?’
‘টোপর, আমরা তো ভাল ছিলাম রে। তুই কি আমাকে ঝুমুদি বলে ডাকবি না? নাম ধরছিস, কী বলবে সবাই? অন্যদের সামনে অন্তত দিদি বল।’
‘আমি সতর্ক থাকব যাতে তোমাকে নাম ধরে না ডেকে ফেলি। আজও লক্ষ লক্ষ দম্পতি পরস্পরের নাম না ডেকেই ঠাকুরদা-ঠাকুমা হয়ে পরলোকে যায়। এই যে, এই, শুনছ-কত ডাক! আমিও বলব! এই ঝিরি, তোর দিদিকে ডাক।’
‘আমার ভয় করছে।’
‘কুকুরের? মানে বাঁটুলের ভয়?’
‘না। তোর এই সমস্ত পাগালামি বাবা, প্রবীরকাকা জানতে পারেন যদি! অসম্ভব! ওঁরা ভয়ানক আঘাত পাবেন!’
‘আগে নিজেকে বোঝো ঝুমু। বার বার বলছি।’
‘আমি বুঝেছি। তোর বোঝা দরকার, তোর মনের চিকিৎসা করতে হবে।’
‘এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ো না ঝুমুদি। ভুল করে ফেলবে।’
‘তুই খারাপ হয়ে গেছিস। একদম বাজে। বড় ছোট জ্ঞান নেই। এসব কেমনতর বদমায়েশি।’
‘কী চাও তুমি ঝুমু? আমাকে দিয়ে বলিয়ে নেবে যা করেছি ভুল করেছি? আজ থেকে তোমাকে আমি ভাইয়ের মতো ভালবাসব? আমার নীতি অন্যরকম। বোধ, বিশ্বাস অন্যরকম। আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে ডেকেছি। বয়স বেশি মানেই তাকে চাচি, মামি, পিসিমণি বলতে হবে, আমি মানি না। আর বললেই তারা আমার মাসিমণি হয়ে যাবে না। আমি জানি, তুমি একদিন নিজেকে বুঝবে। যেদিন বুঝবে, ইচ্ছে হলে এসো। আমি তোমার জন্য রইলাম।’
প্রবীর ও টোপর ও নয়ন বিভোর
জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে আড্ডা সেরে প্রবীর ফিরলেন। আজকের অনুপুঙ্খ খবর নিয়েছেন তিনি। যাঁরা সব এসেছিলেন তাঁরা লোক কেমন। কোনও পরিবার সম্পর্কে এই বিষয়টিই তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। প্রস্তাবিত পাত্র কী কাজ করে, তার উপার্জন ইত্যাদি বোঝা জ্যোতির্ময় বা প্রবীরের কাছে কঠিন নয়। কিন্তু মানুষ চেনা সবচেয়ে জরুরি এবং প্রায় অসম্ভব কাজ। ঘরের মেয়েটিকে যে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, তাদের ভালমানুষ হওয়া মুখ্য কাম্য। একটাই ভরসা, জয়ী ওঁদের অনেকদিনের পরিচিত। গুরুভগিনী। নানান সমাবেশে বহুবার সাক্ষাৎ হয়েছে। সন্দীপন নামের ছেলেটি এ কালের ছেলের মতো বহির্মুখী নয়। ঝুমু-র পক্ষে সম্বন্ধটা ভাল।
প্রবীর ভারী সন্তোষে এ দিনের খবরের কাগজগুলি নিয়ে বসলেন। অদূরে, নিজের গড়গড়িতে বসে আছে টোপর। হাতে ভারী বই। মনোযোগ সহকারে পড়ছে। প্রবীর বললেন, ‘বেশ ভাল সম্বন্ধ বুঝলি টোপর। শুনে তো যা মনে হচ্ছে, ঝুমু-র বিয়েটা এবার লেগে যাবে। সময়টা ভাল যাচ্ছে। তোর চাকরি হল, ঝুমু-র বিয়ে লাগছে।’
কোলের উপর বই রেখে টোপর সরাসরি তাকাল প্রবীরের দিকে। বলল, ‘তোমাকে কিছু বলার আছে বাবা!’
‘বলো।’
‘আমি বিয়ে করতে চাই।’
‘বিয়ে! তুমি! মানে আমি বলতে চাইছি সবে চাকরি পেলে, কাজে যোগ দেওয়া পর্যন্ত বাকি, এসময় বিয়ের প্রস্তাব, কোনও বিশেষ কারণ কি আছে?’
‘আছে বাবা।’
‘বলো। শুনি।’
‘আমি ঝুমুকে ভালবাসি। ভেবে দেখলাম, ওর বিয়ে হয়ে গেলে…’
‘কী বলছ তুমি জানো? কী বলছ এসব?’ প্রবীরের চোখমুখ তপতপে। বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে তিনি ঘনঘোর উত্তেজিত।
‘ঝুমুকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।’
‘চুপ! একদম চুপ! ছি ছি ছি! আমি জ্যোতির্ময়ের কাছে মুখ দেখাব কী করে?’
‘এই প্রথম তুমি আমার কথা বোঝার চেষ্টাই করলে না। তুমি তো এরকম করো না।’
‘এতে বোঝার কী আছে টোপর। ঝুমু-ঝিরি আমার মেয়ের মতো। তোমরা একই পরিবারে ভাইবোনের মতো বড় হয়েছে। তার মধ্যে এসব কী! এ তো বিকার!’
‘বাবা, তুমিও আমাকে বোঝার চেষ্টা করবে না?’
‘কতদিন ধরে চলছে এসব টোপর? আমরা তোমাদের বিশ্বাস করেছিলাম।’
‘এখন এ আলোচনা থাক বাবা। তুমি আমার সততা, আমার ভণিতাহীন, সত্যকে মর্যাদা দিলে না। তুমি খুব রক্ষণশীল অনমনীয় প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছ। এভাবেই পৃথিবীতে সন্ত্রাসের জন্ম দিয়ে আনন্দ চলে যায় গোপন কোটরে। এভাবেই হিঁচড়ে টেনে প্রাণময়ী ভালবাসা চিতায় জ্বলতে জ্বলতে রেখে যায় দুঃখিত বিষাক্ত ধোঁয়া। ভালবাসা, আহা ভালবাসা, অমন ভয়াল মৃত্যু কাম্য নয় তার, চলো তাকে ফসলের ক্ষেতে যত ধানের গোড়ায় বুনে বুনে, সাবলীল করে দিই জীবনের সুন্দরের সিক্ত বীজ রোয়া, তাকে বুকের ওপর তুলে আমি যাব তোমাদের চিতার আগুনে।’
প্রবীর উঠে পড়লেন। তিনি হতচকিত। বিভ্রান্ত। অনেক আঘাত তিনি সয়েছেন এ জীবনে। অনেক প্রতিকূল পথ হেঁটেছেন একা। তিনি অস্থির বোধ করছেন। শরীরে গরম ভাপ। হাত-পা কাঁপছে। একদিন জীবনসঙ্গিনীর জন্য নিজে বিদ্রোহ করেছিলেন, আজ ছেলে সেই বিদ্রোহী। এই প্রস্তাব অন্যায় ঠেকছে, অসহনীয়, এমনকী পাপমতিত্ব মনে হচ্ছে। কেন? এই কি স্থবিরতা? জীবন গতানুগতিক হলে, নির্দিষ্ট ছন্দোবদ্ধ হলে কি নব্য ভাবনার গ্রহণযোগ্যতা হারায়? হয়তো এই স্থাণুবৎ অস্তিত্বই দুই প্রজন্মে অনিবার্য দূরত্ব রচনা করে! তিনি স্নানঘরে ছিটকিনি তুলে আয়নায় দাঁড়ালেন মুখোমুখি। স্পষ্টতা। অকপট উন্মোচন। নিরাবরণ অনিচ্ছা-ইচ্ছার স্বাধীন প্রস্তাব! ছেলে ও বাবার মধ্যে আছে। এমনই জগৎ তাঁরা রচনা করেছেন। না হলে পথ চলা দুরূহ হত। অসহায় শিশুটিকে মা ফেলে গেলে লোকে তাকে নির্মমতা বলে। বলে কী করে পারল! বাবা যদি ফেলে যায়, বলে এমনই তো হয়, পুরুষ স্বভাবত স্বার্থপর। পিতা গর্ভে ধারণ করে না, তাই সন্তানের মাহাত্ম্যও জানে না।
আর মায়ের পরিত্যক্ত চিরনির্ভর শিশুটিকে যদি বাপ তুলে নেয় বুকে? সেও ধারণ নয়? গর্ভ থেকে নেমে ভূমিষ্ঠ বিকল শিশু উঠে আসে বক্ষগর্ভে পরম নির্ভয়ে। সে গর্ভ পিতার। সে গর্ভে মাতৃপুষ্প নেই। সে গর্ভে সন্তান ভালবাসা ফুল দিয়ে ঢাকা।
‘বাবা, মা আমার জন্য চলে গেল? হাঁটতে পারি না বলে?’
‘টোপর, যে যাবার, সে চলে যায়। ঝিরি-ঝুমু ওদেরও তো মা নেই।’
‘ওদের মা মরে গেছে। হাসপাতালে। না বাবা?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার মা কোথায় গেল?’
‘জানায়নি।’
‘কোনও দিন আসবে না!’
‘জানি না রে।’
‘আমার কী দোষ বাবা। আমি কি ইচ্ছা করে প্রতিবন্ধী?’
‘কে বলল, তুমি প্রতিবন্ধী?’
‘লোকে বলে। শুনেছি।’
‘যারা এমন বলে, মনে মনে তারাই প্রতিবন্ধী। আধুনিক সভ্যতা বিজ্ঞানমনস্ক। মানবিকতার জয়কারী। অক্ষমের ক্ষমতার জন্যই একালের লড়াই। ক্ষমতাবানের ক্ষমতালোভ সভ্যতার পরিপন্থী। নিকৃষ্ট কদাচার। ক্ষমতার সাম্য রচনা করা হল মানুষের ধর্ম। হেলেন কেলার নামে একজন মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন অন্ধ ও বধির। অথচ তাঁর শিক্ষা, বুদ্ধি, চেতনা, সাহস ও অধ্যবসায় তাঁকে অসাধারণ নারী করে তুলেছিল। তিনি বই লিখেছেন, পড়িয়েছেন, স্বয়ং হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণা। তাঁর জীবনী তোমাকে পড়াব আমি।’
‘মা কি হেলেন কেলারকে চেনে?’
‘হেলেন কেলার ১৯৬৮ সালে মারা গিয়েছেন। তোমার মা অবশ্যই তাঁর নাম জানতেন।’
‘মা নেই। আমাকে কে হাসপাতালে নিয়ে যাবে?’
‘এটা ঠিক, এতকাল তোমার মা-ই তোমাকে সবরকমে আগলে রেখেছিলেন। এবার আমি করব।’
‘মা’র ভাল লাগত না। চলে গেল। তোমারও ভাল লাগবে না। তখন তুমিও চলে যাবে?’
‘না টোপর। আমি তোমাকে ফেলে কোথাও যাব না। তোমার মা তোমাকে আট বছরের করে দিয়ে গেছেন। তোমাকে আমি স্বনির্ভর করে দেব। তুমি যাতে আমারও ভার না হয়ে ওঠো, আমারও তোমাকে বালাই মনে না হয়, তা-ই করব আমি।’
‘আগে কেন করলে না? মা তা হলে থাকত।’
‘সবকিছুই শুরু করার নির্দিষ্ট সময় আছে টোপর। তার আগে হয় না।’
‘আমার কেন এরকম হল বাবা?’
‘তোমার মায়ের একটা অসুখ করেছিল। তুমি মায়ের পেটে ছিলে। ডাক্তাররা বললেন, অসুখটার জন্য বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে। তোমার মা বলল…’
‘মা কী বলল?’
‘বাচ্চা না হওয়াই ভাল।’
‘কেমন করে? আমি তো তখন হয়ে গেছি, না বাবা? মায়ের পেটে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছি।’
‘কেমন করে জানলে?’
‘ছবিতে দেখেছি না? হাসপাতালে ছবি থাকে।’
‘হ্যাঁ। ওই ছবির মতো। যে তুমি হয়ে গিয়েছিলে, তাকে নেই বলা যাবে কী করে?’
‘তা হলে মা কেন বলল?’
‘মা ভেবেছিল, ম্যাজিক, চাইলেই যা আছে তা ভ্যানিশ করে দেওয়া যায়।’
‘তারপর?’
‘মা বলল, ‘আমার ভয় করছে।’ আমি বললাম, ‘ভয় নেই। যা হচ্ছে হোক। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তারপর তুমি এলে। আমার ফুটফুটে জীবন্ত পুতুল। মা-ও পুতুল পেয়ে খুশি। কিন্তু যখন বুঝতে পারল সুন্দর পুতুলটার একটু খুঁত থেকে গেছে…’
‘খুব কাঁদল, না বাবা?’
‘কাঁদল, রাগও করল।’
‘বাচ্চারা কি ম্যাজিক প্লেটের আঁকিবুকি, বাবা?’
‘কেন বলছ?’
‘বোতাম টিপলে মুছে যায়, না? এই আছে, এই নেই। পেটে ছিল, পেটে নেই।’
‘তা সম্ভব। ডাক্তাররা পারেন ওরকমটা।’
‘তখন বাচ্ছারা কোথায় যায়?’
‘মুছে যায়। ওই যে বললে, ম্যাজিক স্লেট।’
‘আমিও যদি মুছে যেতাম, আমি নেই, তাই না?’
‘আমি তো চাইনি তুমি মুছে যাও। তোমার মা-ও চায়নি। শুধু চেয়েছিল নিখুঁত পুতুল। পেল না, ওমনি রাগ। বলে খেলব না। চলে যাব। চলে গেল।’
‘আমিও চলে যাব, বাবা?’
‘কেন যাবে?’
‘মা নেই। কষ্ট।’
‘আমারও তো কষ্ট। তুমি যদি চলে যাও, আমার কী হবে? কে আমার সঙ্গে কথা বলবে? কে ভালবাসবে?’
‘বাবা, কোলে নাও। তোমার কাছে যাব।’
গলা জড়িয়ে ধরত টোপর। মুখ গুঁজে দিত পিঠে। তার ঝুলঝুল করা পা দু’খানি প্রবীর নিজেই বের দিয়ে জড়িয়ে নিতেন। টোপর বড় হচ্ছিল। সেই বিকাশমান কৈশোর তারুণ্যের সমস্ত খবর জানা ছিল প্রবীরের। এই কথাটুকু ছাড়া। ওরা ভালবাসে। টোপর কাউকে ভালবাসে। কবে থেকে? জানায়নি কেন? প্রবীরের অভিমান হল। সেই বোধ অতিমানী হয়ে ঠোক্কর খেতে লাগল। ছেলে বলল না কিছু? তাঁকেও বলল না? ছেলের পৃথক জগৎ তাঁকে পীড়া দিল।
মুখে চোখে শীতল জলের ঝাপট কতক শান্ত করল প্রাণ। চিন্তার গতি ঘুরে ঘুরে পথ করে নিতে পারল স্নেহ অভিমুখে। সে যে পরম স্নেহের ধন। প্রিয়তম। আত্মসত্তার চেয়ে প্রিয় আত্মজ। প্রবীর অবিচল সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন। যাই হোক। ঘটনাপ্রবাহ যেদিকেই যাক। তিনি ছেলেকে কোলে করে রাখবেন। মাটিতে পায়ের চিহ্ন পড়ে না ঈশ্বর। অক্ষম সেই পায়ে সক্ষমতা দাও সংগ্রামে। দাও মনে বল, চরিত্রে দৃঢ়তা, দাও অকপট স্বীকারের অপূর্ব হৃদয়।
বেরিয়ে দেখলেন, টোপর চোখ বন্ধ করে বসে আছে। নিমগ্ন ধ্যানে। বুকের মধ্যে হু হু করে উঠল। কেন ওই প্রতিক্রিয়া? আর নয়। আর কোনও দিন নয়। ভালবেসে সরব হয়েছে। এ কি কোনও অপরাধ? কত নির্ভীক এই ছেলে! কত উদার হৃদয়! নরম করে ডাকলেন, ‘টোপর।’
টোপর তাকাল। ‘বাবা। রাগ করলে?’
‘না বাবা। হঠাৎ শুনলাম। ধাক্কা লেগে গেল। এখন ঠিক আছি। আবার নতুন করে শুনি। শুরু করো।’
‘ঝুমুকে ভালবাসি বাবা। এ কি অপরাধ? আজ নয়। আমি ভালবাসি বরাবর। অত ভেবে দেখিনি তো। ও আছে, থাকবে। আর কিছু ভাবিনি। ওর বিয়ে হবে শুনে খুব ভয় হল বাবা। আমি শুধু প্রার্থনা করে গেছি যেন না হয়। আর কাজ করে গেছি। চাকরি, চাকরি। উপার্জন। আমার অক্ষমতা জানি আমি। বাবা। আমার মেধাময় মস্তিষ্কই একমাত্র সহায়। ও ওইভাবে লোকের কাছে যায়, বসে, ওকে দেখে, কী দেখে বাবা? আলু-পটলের মতো নাড়াচাড়া, গোরু-ছাগলের মতো দর করা-এ কি মানুষের কাজ? দেখে কী বোঝা যায়? নিজেকে এইভাবে সাজিয়ে-গুজিয়ে তুলে ধরা বাবা-এ কি মধ্যযুগ? দাসব্যবসায়? তারপর…অচেনা লোকের সঙ্গে সোজা বিছানায় ঠেলে দেবে। বাবা, ঝুমুকে বাঁচাবে না?’
‘ঝুমু জানে, ওকে তুমি কীভাবে ভালবাসো?’
‘জানত না। সেদিন বলেছি।’
‘কী বলল?’
‘মারল।’
‘তারপর?’
‘কাঁদল। বলল, আমি বিশ্বাস ভেঙেছি।’
‘ওর দোষ নেই। আমরা সবাই সংস্কারে বাঁধা। বড় কঠিন শৃঙ্খল বাবা। ছাড়ানো সহজ নয়।’
‘জানি বাবা। আমি বুঝি। বার বার বলছে-ও আমার চেয়ে চার বছরের বড়। ভাই বলে।’
‘শোনো, তোমাকে কয়েকটা কথা বলি। শুধু বাবা হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবেও বলি। প্রকৃতির কারসাজিতে মেয়েরা তাড়াতাড়ি বড় হয়, বুড়িয়েও যায় তাড়াতাড়ি। যেহেতু বিবাহের অন্যতম উদ্দেশ্য যৌন সম্পর্ক স্থাপন, সেহেতু কন্যা হয় বয়ঃকনিষ্ঠ। আগে এই পার্থক্যে ভারসাম্য ছিল না। রক্ষণশীল অশিক্ষিত সমাজ বারো বছরের মেয়ের সঙ্গে অনায়াসে বাহাত্তর বয়সি পুরুষমানুষের বিয়ে দিত। সেই চূড়ান্ত অবমানকর এবং নিষ্ঠুর ব্যবস্থা আর নেই। মোটামুটিভাবে বয়সের তফাত যা আছে, সমাজ তাতে সন্তুষ্ট। সমবয়সি বিয়েও আর আপত্তিকর নয়। কিন্তু মেয়েটি বয়সে বড় হলে আমরা রক্ষণাত্মক। আমিও ব্যতিক্রম নই। কিন্তু আমি তোমার ইচ্ছায় বাধা হতে চাই না। তবু ভেবে দেখতে বলি, তোমার স্ত্রী তোমার ঢের আগে বুড়িয়ে গেলে তোমার পক্ষে মর্মান্তিক হবে না তো?’
‘বাবা, আমি ঝুমুকে ভালবাসি। ওর রূপ, শরীর, দাঁত, নখ আমার বিচার্য নয়। ও যদি রোগগ্রস্ত হয়, নষ্টযৌবনা হয়, যদি যৌনশৈত্য ওকে গ্রাস করে, তবু তো ঝুমু। ও আমার জীবনের অংশ বাবা।’
‘কবে তুমি এভাবে ভাবতে শুরু করলে আমি জানি না। আমার তো আশ্চর্যই লাগছে। যাই হোক, আমি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসি, তোমার প্রস্তাবে ঝুমু সম্মত নয়, তাই তো?’
‘ও ভয় পাচ্ছে, যদি জ্যোতিকাকার সঙ্গে আমাদের এ নিয়ে মনোমালিন্য হয়?’
‘সে সম্ভাবনা আছে। জ্যোতি অত্যন্ত রক্ষণশীল। বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে ও প্রায় অষ্টাদশ শতকে পড়ে আছে। কিন্তু ঝুমু নিজেও তো বয়সের সংস্কারে আটকে আছে।’
‘তুমি ওকে বুঝিয়ে বলবে, বাবা?’
‘টোপর, যে তোমাকে ভাই ভাবছে, তাকে আমি কীভাবে বোঝাতে পারি তুমি যা চাও!’
‘আমি অনুভূতি দিয়ে বুঝেছি ও আমাকে অসম্ভব ভালবাসে। কিন্তু সংস্কার পেরোতে পারছে না।’
‘সংস্কার নিজেকেই ডিঙিয়ে যেতে হয়। নিজের ভালবাসার রূপ কী, নিজেকে বুঝতে হয়। ঝুমু যতদিন অন্তরে তোমার যথার্থ অবস্থান উপলব্ধি না করবে, তোমায় অপেক্ষা করতে হবে। প্রেমের উন্মেষ উভয়পক্ষীয় না হলে বিনাশের সম্ভাবনা। আর একপক্ষীয় প্রেমের সঙ্গে অচেনা জনের সম্বন্ধ চাপিয়ে দেওয়ার কোনও তফাত নেই।’
‘যদি ও বুঝতে পারে, যদি আসে আমার কাছে, তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে তো বাবা?’
‘টোপর, ঝুমু বড় ভাল মেয়ে। কত ভালবাসা ওর মধ্যে! কত করুণা! আমি যখন থাকব না পৃথিবীতে, তখন, তুমি ঝুমুর তত্ত্বাবধানে থাকো যদি, আমি শান্তি পাব। কিন্তু ওর পরিবার যদি না মানে? ঘরছাড়া হওয়ার যন্ত্রণা, স্বজন পর হয়ে যাবার যন্ত্রণা আমি পেয়েছি। আজ আবার সব ফিরে পেতে ইচ্ছা হয়। তাড়া করে ছোটবেলার স্মৃতি। যার জন্য সবাইকে ছাড়লাম, সে-ও তো আমায় ছেড়ে গেল। ঝুমু কি পারবে, তার বাবার বিরুদ্ধে যেতে?’
‘ভালবাসার একটা শক্তি আছে বাবা। আজ যদি মা তোমার সঙ্গে থাকত, তোমার কি আত্মীয়বিচ্ছেদ বেদনা এত তীব্র হত?’
‘হয়তো নয়। তবুও টোপর, তুমি ঝুমুর সম্মতির অপেক্ষা করো। আর হ্যাঁ, একটা কথা, তুমি যথেষ্ট পরিণত, আত্মবিশ্বাসী, তবু ভেবে দেখতে বলি, তোমার শারীরিক অক্ষমতার জন্য ঝুমু আপত্তি করছে না তো?’
‘না। না বাবা। অসম্ভব। ঝুমুদি আমার জন্য কী না করে বলো।’
‘সে তো বাইরে থেকে করা। দায়িত্ব এসে গেলে বাধ্যবাধকতার প্রশ্নে সে রাজি হবে তো? ছেড়ে যাবে না তো?’
‘না বাবা। ঝুমু এরকম করতেই পারে না।’
‘মেয়েরা বড় দুর্বোধ্য টোপর। একই সঙ্গে তারা নির্মম ও করুণার প্রতিমূর্তি। আমি নারীকে বিশ্বাস করি না।’
‘আমি করি বাবা। নারী ব্যক্তি মাত্র। মানুষ। মানুষকে অবিশ্বাস করব কেন? প্রত্যেকটি মানুষই তো আলাদা।’
ঝুমুর ঝুমুর
আইবুড়ো ভাতের দিন ঝিরি আর ঝাড়ু নমিতা জোর করে টোপরের দেওয়া লাল ঢাকাই শাড়িটি ঝুমুকে পরিয়ে দিল।
ক’দিন তাদের খুব মনখারাপ ছিল। গর্ভবতী সরসীকে তার মাতাল স্বামী পেটে সর্বশক্তি মান লাথি মেরেছিল।
এ পৃথিবীর নষ্ট পুরুষের সহজতম ক্রিয়া কী? যে কোনও স্ত্রীলিঙ্গ ধরো, আট মাস বয়সি থেকে আটানব্বই বত্সর-অপরিণত, অক্ষম, সুন্দর, কুত্সিত, অবোধ, দুর্বল-ধরো আর ফুঁড়ে দাও। ছিন্নভিন্ন করে দাও যোনিপদ্ম।
জগতের কোন কর্ম নষ্টের মহতী পুরুষকার? ধরো, বিদ্ধ করো নারী। গর্ভবতী করে দাও।
বাকি থাকে কিছু? থাকে না কি? মূল ধ্বংস করো। নারীভ্রূণ অর্থহীন। উপড়ে ছিঁড়ে আনো গর্ভ থেকে। তারও চেয়ে উপাদেয় গর্ভে লাথি মারা। গর্ভিণী নারীকে মেরে বড় পদসুখ! বড় তৃপ্তি। দেখ শালি, আমার কী পাঁকাল জাঁকাল পুরুষোচিত বিপুল ক্ষমতা। এক লাথিতে গর্ভ খানখান। স্বর্গ থেকে মর্ত্য থেকে মর্গে টেনে আন।
সরসী মারা যেত যদি না ঝাড়ু নমিতা, জটা নমিতা, মুন্নার মা, গোপালীমাসির দল চিল্লিয়ে পুরুষদের তত্পর না করত।
কানাই সামন্ত সরু গলির প্রায় সব পুরুষমানুষই সন্ধ্যায় চা পান করেই গাঁজায় মদে যার যার রুচি অনুযায়ী নিমজ্জিত হয়। কেউ কেউ চেতনাবলুপ্তির অচির সমাধি লাভ করে। কেউ কেউ ঝিমোয়। ভুল বকে। এন্তার গালিগালাজ করে যাবতীয় অসন্তোষ বিক্ষোভের ঝাল মেটায়। কিন্তু ঝাঁকুনি দিলে জেগে ওঠে। নারীকুলের মুখনাড়া অঙ্গুলিহেলনে এমনকী সামাজিক সচেতনে তত্পর।
তাই মরণ কামড়ে ধরা সরসীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সরসী মরবেই পণ করেছিল, হঠাৎ মনে পড়ল দুটি ছানা, সে না থাকলে ভিখিরির বাচ্চা হয়ে যাবে। কে গায়ে-গতরে খেটে খেতে পরতে দেবে, ইস্কুলে পাঠাবে জোর করে! সরসীর আদরের সন্তানেরা পথে মরে পড়ে থাকা চ্যাপটা ব্যাঙের মতো পায়ে পায়ে ধূলি হয়ে যাবে।
অতএব, বড় করে পেট কেটে সরসীর লাথিভোক্তা মরা ছানাটিকে ফেলে দিয়ে পেটখানা সেলাই করে প্রাণ দেওয়া হতে লাগল। এবারের মতো সরসী বেঁচে গেল।
তার মরণের মুখে যাওয়া আর ফিরে আসার মধ্যবর্তী দিনগুলি মনোরম ছিল না। প্রথম দিকের প্রতিটি দিন লম্বা-চওড়া রাস্তার দু’ধারের মধ্য ও উচ্চবিত্তের গেরস্থালি আগলানো বিজন ভট্টাচার্য গলির ঠিকানায় ঝুমু-র উদ্বেগের অন্ত ছিল না। কানাই সামন্ত সরু গলিতে ঝগড়া বাধাতে ভুলে গিয়েছিল মেয়েরা। পুরুষেরা নেশার আসরে বসে পাপিষ্ঠ স্বামীর কথা বলত আর হতভাগিনী সরসীর কথা।
আর তারই মধ্যে ঝুমুরের বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র ছাপা হতে গেল। তার প্রতিটি সোনালি অক্ষরে মিশে রইল বিষাদের হলুদ।
সরসী কেমন আছে? বাঁচবে তো? এই প্রশ্নে শুরু হত দিন, এই প্রশ্নে শেষ।
ঝুমু একদিন ঝাড়ু নমিতার সঙ্গে হাসপাতালে গেল। ফ্যাকাশে, হাড় কাঁকলাস সরসীর শরীরে বোতলের রক্ত ঢুকছিল। সে ছিল আচ্ছন্ন। ঝুমু তার জন্য কিছু ফল নিয়ে গিয়েছিল। জ্যোতির্ময় ত্রিশ টাকা দিলেন ফল কেনার জন্য, টোপর দিল আড়াইশো। ঝাড়ু নমিতা সব ফলগুলি হাসপাতালে না রেখে কিছু নিয়ে এল সরসীর বাচ্চাদের জন্য। সরু গলির মানুষেরা বিপদে-আপদে একযোগে ভাবনা-চিন্তা করে। প্রতিদিনই তাকে দেখতে যাচ্ছিল কেউ না কেউ। রোজ দু’বেলা কতক চেনা কথা ভাসছিল কানাই সামন্ত সরু গলিতে।
‘কেমন দেখলি আজ?’
‘ওই একইরকম।’
‘কী রে, এবেলা কেমন?’
‘একটু যেন ভাল দেখলাম। কথা বলল।’
‘উঠে বসেছে?’
‘না না। সে টাইম লাগবে। শুধু ছেলেমেয়ের কথা জানতে চায় আর মড়াটার জন্য কাঁদে!’
তারই মধ্যে ঝুমু-র গয়না এল। তাদের মায়ের গয়না ভাগাভাগি করে দুই বোনের। সেসব ঘষামাজার জন্য স্যাঁকরার কাছে দেবার আগে ঝিরি বলল, ‘বাবা, এসব পুরনো ডিজাইন। এগুলো ভেঙে নতুন গয়না গড়িয়ে দাও দিদিকে।’
‘সোনা নষ্ট হবে। অনেক টাকা যাবে। এমনিতেই বিয়ের কত খরচ।’ জ্যোতির্ময় বললেন। ‘তবু যদি ঝুমু চায়।’
‘না। আমি চাই না। গয়না পরার অত ঝোঁক নেই তো আমার। টাকা নষ্ট করার দরকার কী!’
‘ঝিরি বড় খরচ বাড়াতে চায়। আমার ঝুমু হল লক্ষ্মী। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে পথে বসছি, তার ওপর দুই মেয়ে। সঙ্গে ঝিরির নানান বায়নাক্কা।’
‘ও তো ছেলেমানুষ বাবা। তুমি অত ভেবো না। এই গয়নাই বা খারাপ কি!’
সেই গয়নাই কিছু পরানো হয়েছে ঝুমুকে আজ। লাল জড়িকাজ ঢাকাই। ঝুমু আজ রূপবতী।
আজ এক ছুটির দিন। আইবুড়ো ভাতের উদ্যোগ বড়পিসির। বহু আত্মীয় সমাগমে বাড়িটা আজ ছিল সরগরম। ঝিরি বলে বসল, ‘আমাদের এত আত্মীয়, এত হিতাকাঙ্ক্ষী আছে, আগে জানতাম না তো! অমুক মাসি, তুমুক পিসি, রাঙা দিদা, কুট্টি কাকি! বাপস্! গিয়ে বলব, এতদিন কোথায় ছিলেন?’
মৃত্যু এবং উৎসব কেন্দ্র করে আত্মীয়মিলন হয়। এই বাস্তব সত্য ঝুমু মেনে নিয়েছে, ঝিরি নেয়নি। ঝুমুর বিবাহে ছোটপিসির আবির্ভাব হবে। ঝুমু ভারী কৃতজ্ঞ বোধ করছে। কিন্তু ঝিরি রুষ্ট। এমনকী সে একথাও তুলছে-সন্দীপনদা তোর সঙ্গে একবার কথাও বলতে চাইল না?
ঝুমু বলে— সেই ভাল। কথা বলে কী হত?
‘এটা স্বাভাবিক না দিদি। এর থেকে দু’রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। এক. সন্দীপনদা এখনও ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করছে। দুই. ভদ্রলোক সেকেলে। প্রথমটা যদি কারণ হয়, তবে তার থেকে অনেক সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়। এক. ভদ্রলোকের আর কেউ আছে যাকে বউ করা যাচ্ছে না। দুই. শারীরিক বা মানসিক গোলমাল আছে। এর কোনওটাই তোর পক্ষে ভাল নয়।’
‘বাব্বা ঝিরি, তুই তো পাকা গোয়েন্দার মতো কথা বলছিস। আমাদের ব্যোমকেশী বক্সী। অত ভেবে কী হবে? বাজি ধরতেই হবে তো। তবু তো বড়পিসির চেনাজানা।’
‘কতটা চেনা? গলা মিলিয়ে কেওন গাইলেই কি সব জানা হয়ে যায়?’
‘চেনাজানা, প্রেম, বন্ধুত্ব— কোনওটাই সম্পর্কের শেষকথা হতে পারে না ঝিরি। তুই দ্যাখ, আমাদের প্রবীরকা রুপুকাকিমাকে ভালবেসে সব ছেড়েছিলেন। তবু টোপর মা পেল না। টোপরের চাকরি পাবার দিনটা কত আনন্দের, কত সাফল্যের! রুপুকাকিমার পক্ষে সেটা চরম গর্বের দিন হতে পারত! অথচ কেউ একবার তাঁর নাম পর্যন্ত করল না। জীবন বড়ই অনিশ্চিত ঝিরি। যুক্তি দিয়ে যতই সাবধান হওয়া যাক, শেষরক্ষা না-ও হতে পারে।’
‘মা হিসেবে রুপুকাকিমা খুবই ব্যতিক্রমী দিদি। এত নিষ্ঠুর, এমন উদাসীন কেউ হতে পারে? উনি এমন করেছেন মানেই সবাই এমন তো নয়! অদ্ভুত! একবার জানতেও ইচ্ছে করে না, ছেলেটার কী হল?’
‘ছেড়ে গেলে হয়তো পিছুটান না রেখেই যাওয়া উচিত। তোর কথা থেকেই বলি, মানুষের কোনও ছাঁচ হয় না। দেখি কপালে কী আছে! নিজেকে আলু-পটলের মতো হাটে-বাজারে তুলতে তুলতে আমি ক্লান্ত ঝিরি। তবু তো ওঁরা আমাকে পছন্দ করলেন।’
‘তোকে যে কাছ থেকে দেখবে, সে-ই পছন্দ করবে দিদি। আশা করি সন্দীপনদাও করবে।’
ঝাড়ু নমিতা বলে—মজায় আছ, না ঝুমুদি?
‘মজা কীসের?’
‘বিয়ে হলে মজা হয় না?’
‘শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় পাশ করলাম। এই আর কি।’
‘আমাদের ভুলে যাবে না তো?’
‘না। ভুলব কেন? আমি কি সাত সমুদ্র পার হয়ে চলে যাচ্ছি?’
‘ফুলশয্যার রাতে কী হল, সব শুনব।’
‘কিছুই হবে না।’
‘কী করে জানলে?’
‘বিয়ে হলেই কি সব হয়? সময় লাগে।’
‘আজ তোমাকে রাজেন্দ্রাণীর মতো লাগছে। ‘সূর্যকন্যা’ সিনেমায় এই ডায়লগটা ছিল। প্রেমিকার বিয়ে হচ্ছে অন্য লোকের সঙ্গে, প্রেমিক বলছে ‘…তুমি আজ রূপে ঐশ্বর্যে রাজেন্দ্রাণী। আর আমি পথের ভিখিরি!’ খুব কেঁদেছিলাম ঝুমুদি।’
‘আমার জন্যও কাঁদিস। বুঝব তবু আমার দাম আছে।’
‘তোমার জন্য সবাই কাঁদবে। সবচেয়ে বেশি কে কাঁদবে বলো তো?’
‘কে?’
‘টোপরদা।’
টোপর! টোপর! নাম শুনলেই বুকের মধ্যে উথালপাথাল করে। টোপর যেন পুরীর সমুদ্র। গভীর, বিশাল, একাকী। আর কেউ না জানলেও ঝুমু জানে, টোপর প্রকাশ্যে কাঁদবে না।
বিকেল নাগাদ, অতিথি বিদায় নিয়ে গেলে, বড়পিসি বললেন, ‘সময়টা ভাল। গুরুমা এসেছেন। তোর বিয়েতে আনার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মা কাল সকালেই চলে যাবেন আসানসোলে এক ভক্তের বাড়ি। চল, তোকে নিয়ে যাই। আশীর্বাদ করুন।’
ঝুমু গাড়ি নিয়ে বড়পিসির সঙ্গে চলল। জ্যোতির্ময় গাড়ি রাখা বিলাসিতা মনে করেন। ঝুমুদের গাড়ি নেই। এ গাড়ি প্রবীরের। আজ থেকে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তার বাসে-ট্রামে-অটো রিকশায় যাওয়া মানা। কখন কী মানা হয়ে যাচ্ছে, কখন কী চালু হচ্ছে, ঝুমু তাল রাখতে পারছে না। তার দিনগুলো ভারী মধুর ছন্দে বাঁধা ছিল। তার সূর্য ওঠার সব লক্ষণ চেনা ছিল, তার চন্দ্রোদয় ছিল নিরুপদ্রব। গাঁয়ের যে নদীটি আপন খেয়ালে হাঁটুজল নিয়ে বয়ে যায়, হঠাৎ তার অভিমুখে পালটে দেবার চেষ্টা করলে নদী হয় দিশেহারা। ঝুমু-র সেই দশা। চিরকালের আত্মসমর্পিতা, নতুন করে নিজেকে সঁপে দিল নির্দেশের অর্থহীন মাননে।