৩. ঝড় এল

১১.

ঝড় এল।

তখনও বাগানের একপাশ জুড়ে সোনার আঁচলখানি বিছানো ছিল অস্তোন্মুখ সূর্যের। মরশুমের সংক্ষিপ্ত জীবনোত্তীর্ণ সারা বছরের মরশুমি ফুলের গাছগুলি তখনও মুখ ঘষছিল সোনার আঁচলে। একহারা স্বর্ণচাঁপা গাছটি, পাঁচিলের বাইরে কতবেল গাছটি মাখামাখি হয়েছিল রক্তিম রোদে। পশ্চিমের বাড়িগুলির অপ্রশস্ত ফাঁকে ফাঁকে, একটু ছোট বাড়িগুলির শির পেরিয়ে, তখনও যত সুদীর্ঘ ছায়ার মেলা তত সুদীর্ঘ আলোর রেশ কাঁপছিল চিকচিক করে।

তখনও যেন রবিবারের বৈকালিক আনাগোনাটুকু পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি পথে-ঘাটে। সবে তার শুরু হয়েছিল। এ বাড়িরই দু পাশের রাস্তায়, কোথাও চলছে দুহঁ উঁহু। সদলে সপরিবারে কোথাও। প্যারামবুলেটার আর ট্রাইসাইকেলের পিছনে পিছনে ছুটেছে ঝি-আয়ারা।

তখনি এলেন তাপসীর বাবা এ বাড়িতে। রিটায়ার্ড ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিত্র সাহেব। প্যান্টের সঙ্গে হলুদ বর্ণের গলাবন্ধ কোট। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এলেন তখনি। এরকম এসে থাকেন মাঝে মাঝে, বাবার সঙ্গে গল্প করার জন্যে।

সুমিতা তখন বেরিয়েছে বাথরুম থেকে। দেখে নিয়েছে একলহমায়। যা হোক, সঙ্গী একজন জুটে গেছেন বাবার।

আজ সুমিতার মস্ত বড় ডাক রয়েছে বাইরে। কেউ ওকে হাত বাড়িয়ে ডাক দিয়ে যায়নি। বাইরের এক বিশাল সমারোহ যেন আজ কেমন এক বিচিত্র বেশে ডাক দিয়েছে। দক্ষিণ কলকাতায় আজ ছাত্রসমাবেশ। সমাবেশের কোনও একজন ডাক দেয়নি সুমিতাকে হাতছানি দিয়ে। মেজদি বেরিয়ে গেছে কখন, সেই দুপুরে, প্রায় বেলা বারোটার সময়। তখন থেকে ওর বুকের মধ্যে ব্যাকুল বাতাসের ঝড় লেগেছে। ওই সমাবেশের মধ্যে কোথায় একটুখানি যেন জায়গা রয়েছে ওর জন্যে। শুধু সুমিতারই জন্যে সে জায়গাটুকু। আর কেউ সেটুকু পারবে না ভরে দিতে।

কেমন করে যে কেটেছে সারাটি দুপুর। মাঝে মাঝে বুকের ব্যাকুল বাতাসে একটি অনড় নিশ্চল গুমোট আবহাওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। সেটুকু বাবার জন্যে। বাবা একলা থাকবেন, সেই ভাবনা। কিন্তু মনের গভীরে মাঝে মাঝে কেমন যেন একটি দুর্দৈবের আবির্ভাব ঘটে যায়। এ সেই দুর্দৈব। এর গতিপ্রকৃতি সবটাই এমন দুর্বিনীত যে, সে এই একটি বিকেলের জন্যে বাবাকে চাইলে না আমল দিতে। যদি সুমিতা ওর ব্যাকুল বাতাসের উলটোদিকে মুখ করে কেঁদেও উঠত, তবু রেহাই ছিল না, যেতে হবে, যেতে হবে। ওই একটি কথা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব।

আয়নার সামনে দাঁড়াবার আগে, বাগানের রোদটুকু চোখে পড়েছিল সুমিতার। বেণী দুটো নিয়ে কী যে করবে ও। খোঁপা বাঁধল আজ সুমিতা। বাংলা খোঁপা। কাঁটার অভাব ছিল না, যদিও ওর নিজের একটিও নেই। তারপর কাপড় পরতে ঢুকল ছোট কুঠরিতে। মনে পড়ে গেল অনেক দিন আগের একটি কথা। এমনি এক বৈশাখের বিকালে, গিরীনদা বলেছিলেন বড়দিকে, কী পরবে? বাইরে বৈশাখের দাবদাহ, তার মাঝে হয় তুমি অগ্নিরূপিণী কৃষ্ণচূড়া হয়ে আমাদের আরও দগ্ধ করতে পারো। অন্যথায় তাপদগ্ধ ব্যাকগ্রাউন্ডে কাঁচা সবুজের মায়া ছড়িয়ে আমাদের প্রাণ একটু জুড়াতে পারো। দুটোই আমি প্রেফার করছি।

বড়দি বলেছিল, কাব্যি করার লোভে মিছে কথা বললে। যে জুড়োতে চায়, সে জ্বলতে চায় না। যে কোনও একটা। জুড়িয়ে দেওয়াটাই অধর্ম। আমি আগুনের বেশটাই নিলুম।

ছি! কেন যে এ সব কথা মনে পড়ছে সুমিতার। কিন্তু অলক্ষিতের সমস্ত ছাত্রসমাবেশটি যেন ওর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে, অবাক মুগ্ধ চোখে দেখছে। এ ওর অভিসার নয়, তবু ব্যাকুলতার মধ্যে চাপা একটি লজ্জা থেকে থেকে কেমন অবশ করে দিচ্ছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে নানান কথা।

বেছে নিয়ে পরল সুমিতা সবুজ রং-এর শাড়ি। গাঢ় সবুজ ওর দীপ্তাঙ্গে লকলকে অরণ্যের মতো যেন বন্য হয়ে উঠল। কোনও শান্তভাবের ছায়া তো পড়েনি ওকে ঘিরে। কী বিপদ! কেমন করে নিজেকে ও আরও নিষ্প্রভ করে দেবে।

এদিকে সময় যায়। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল ছোট কুঠরি থেকে। ততক্ষণে বায়ু কোণ থেকে স্বয়ং বায়ু তার রথ দিয়েছে চালিয়ে যেন সুমিতার কাপড় ছাড়তে যাওয়ারই অপেক্ষায় কোথায় আত্মগোপন করে ছিল সে। সুযোগ পেয়ে ছুটে এসেছে দিগন্ত অন্ধকার করে।

সংশয়ে দুরু দুরু করে উঠল সুমিতার বুকের মধ্যে। বায়ুকোণের রুদ্র কিম্ভুত রথও দুরু দুরু করে এল ধেয়ে গগনে গগনে হেঁকে। তার চাবুক কষা ঝিলিক হানল বিদ্যুতে বিদ্যুতে। সহসা সারা বাড়ির উন্মুক্ত দরজা-জানালাগুলি দারুণ শব্দে আঘাত করল গরাদে চৌকাটে।

ছুটে এল বিলাস। ঝড় এসেছে।

 সোনার আঁচল গেল কোথায় উড়ে। জঞ্জালে আর ধুলোয় দিল শহরের আকাশ ভরে। দিনের আলো হারিয়ে গেল অন্ধকারে। বাগানের গাছগুলি বুক মুখ চেপে পড়ল মাটিতে।

পথে পথে দৌড়াদৌড়ি, হল্লা-হাঁক, সবকিছুতেই যেন ঝড়-উল্লাসের মাতন।

 সঘন বজ্রপাত চোখ ধাঁধাল পলে পলে। স্বর্ণচাঁপার শিরে বিদ্যুৎ কষার শিহরন। পরদাগুলি ফুলে উঠেছে পালের মতো। বৃষ্টি এল বড় বড় ফোঁটায়।

এই ঘনঘোর অন্ধকারের সমারোহে মিশে গেল সুমিতার ঘন সবুজের সাজ। তুফান লাগল ওর ঘন অরণ্যের সাজে, বিদ্যুতের কষা বুকের খোলা কপাটে। সে কপাট ও দু হাত দিয়ে বন্ধ করতে পারল না। আশাহত বিমূঢ় বিস্মিত ব্যথায় দেখতে লাগল এই প্রলয়ের খেলা। আর ভিতর দুয়ারের খোলা পাল্লা আছড়াতে লাগল আপন-মনে।

ফিরে দেখল, বড়দি স্থির অবিচল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জানালার কাছে। মুখ দেখা যায় না। কিন্তু বাতাসে যেন কাঁপছে ওর সর্বাঙ্গ। এলোখোঁপার চুল উড়ছে, লুটিয়ে পড়ছে কাঁধে।

কিন্তু সুমিতার নিজের বুকে ঝড়। বাইরের প্রলয়টা যেন শুধু ওর জন্যেই। কী মেয়ে! ভাবছে, ছাত্রসমাবেশের সবকিছুই গেল ঘটে, আটকা পড়ে গেল নিজে। প্রলয়টা যে বাইরেও এসেছে, ছাত্রসমাবেশ থেকে এ রবিবারের ছুটির প্রাঙ্গণে, সেটুকু ভাবতেই পারছে না।

সহসা মনে হল, কে যেন আসছে বাইরের গেট ঠেলে। লোহার গেটের ঝনাৎকার শুনতে পেল যেন সুমিতা। ছুটে গেল বাইরের ঘরে।

কেউ আসেনি। মুখোমুখি বসে আছেন দুই বৃদ্ধ। বাইরের ঘরের দরজাটা অনেকখানি বারান্দার টালিশেডের মধ্যে। সেখানে বৃষ্টি আসার কোনও সম্ভাবনা নেই, তাই খোলা রয়েছে। ছেঁড়া পালের মতো আছড়ে উড়ে অস্থির হয়ে উঠেছে নীল পরদাটি।

আবার তাকাল সুমিতা বাইরের দিকে। এ কী অবোধ ঝড় ওর বুকের মধ্যে। ও যেন শুনল, কে আসছে লোহার দরজা ঠেলে, বাইরের ঘরের দরজা খুলে। কাকে আসতে দেখল সুমিতা। কই, কোনও মুখ তো মনে পড়ছে না। কোনও চেনা মুখ, চোখ, চেনা পোশাক, কিছুই দেখেনি, কেবল একটি মূর্তি ছাড়া।

বৃষ্টির ছাঁট পশ্চিমে। পুবের বারান্দায় জল নেই। সেইখানে উঁকি দিয়ে দেখল সুমিতা, প্রচণ্ড বৃষ্টিধারা ঝরছে অসংখ্য সূচের মতো, ছুটে চলেছে রাস্তার উপর দিয়ে। বাতাসের ঝাপটায়, বিদ্যুতের ঝিলিকে, বজ্রের হুংকারে, কে যেন ভয় দেখাচ্ছে সবাইকে, শাসাচ্ছে ক্রুদ্ধস্বরে। দেখল, রাস্তার ওধারে, দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সেই কালো গোরুটি। যাকে প্রতি দিন দেখতে পায় সুমিতা, ওদের বাগানের দরজার কাছে, জিভ বাড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকে বিষণ্ণ চোখে। কত দিন মনে হয়েছে, টুক করে দরজাটি খুলে দিয়ে আসে। কিন্তু ভয়ে পারেনি। সভয় উদ্দীপ্ত চোখে জলের ঝাপটায় ভিজছে এখন জানোয়ারটা।

লোহার গেট বন্ধ। কেন তবে এমন মনে হল সুমিতার। তবে হয়তো কেউ আসবে আজ।

ঝড়ের নিশিতে পেল মেয়েটাকে। কে যেন আসবে এখুনি এ রুদ্র তাণ্ডবকে মাথায় করে। ওর আছাড় খাওয়া কপাটে জমাট বেঁধে উঠতে লাগল অশ্রু। রুদ্ধকান্না ফুলতে লাগল ভিতরে ভিতরে। কে যেন আসবে।

বোধ হয় ওধারের রাস্তার বেলগাছের একটি ডাল ভেঙে পড়ল মড়মড় করে। বুকের ঝাড়ে লাগল সুমিতার প্রলয়ঙ্কর দাপাদাপি। চোখ ফেরাতে পারল না ঝড়ক্ষুব্ধ বৃষ্টিপ্লাবিত রাস্তা থেকে।

দরজার কাছে বারান্দায় রইল দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে কোটি কোটি বৃষ্টিকণা নিয়ে এসে, হাওয়া উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে সবুজ শাড়ি। বৈশাখের দাবদাহে শান্ত সবুজের মায়া ধরেছিল। এখন ঝড়ে উড়ছে। ওর আলুথালু বেশিনী সবুজ দেহলতা বিকশিত হয়ে উঠছে আরও।

বাইরে এত ঝড়, সুমিতার বুকে ঝড়, আর ঘরের মধ্যে মুখোমুখি বসে দুটি মানুষের মনে যে কীসের ঝড় লেগেছে, বুঝতে পারছে না সুমিতা। এ ঘরের সঙ্গে বাইরের কোনও মিল খুঁজে পাচ্ছে না ও। দুজনেই যেন বিস্মিত, বিমর্ষ। কেমন বিক্ষুব্ধ দেখাচ্ছে মাঝে মাঝে মিত্রসাহেবকে আর দুজনেই বিড়বিড় করে কী সব বলছেন।

বাবাকে ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে। যেন, কড়া মাস্টার মশাইয়ের পাল্লায় পড়ে বিব্রত হয়ে পড়েছেন, ভয় পেয়েছেন। ভীরু চোখে তাকিয়ে আছেন মিত্রসাহেবের দিকে। আর মিত্রসাহেবের সেই একই কথা, এ দেশের নোক চাষাভুষো থেকে শুরু করে কেউ ভাল নয়। এদের কিছুই নেই, এদেশে নিজের ছেলেপিলে পর্যন্ত মানুষ করা যায় না। মিত্রসাহেব জানেন, মিত্ৰসাহেব অভিজ্ঞ, তাই মিত্ৰসাহেব ঘৃণা করেন সবকিছুকে, কেবল জপ, আহ্নিক আর তেত্রিশ কোটি দেবতা ছাড়া।

হঠাৎ চোখে পড়ল সামনের বাড়িটার আলসেয় এক ঝলক আলো। রোদ নয়, পশ্চিমের মেঘলা আকাশের ঝিলিক ওটা। তখনও সামান্য বৃষ্টি ঝরছে কিন্তু শুরু হয়েছে লোক চলাচল।

সুমিতার সমস্ত মন ভরে বাজতে লাগল একটি বিষণ্ণ রাগিণী। ঝড় ওর সবটুকু উচ্ছ্বাসকে নিয়ে গেছে উড়িয়ে। সন্ধ্যা নামছে। এবার বাতি জ্বলবে।

একবার সুমিতা ভাবতে চেষ্টা করল সেই সমাবেশের উৎসবের কথা। তারপর, যেন কার উপরে ওর সমস্ত অভিমানে চোখ দুটি দিল ভিজিয়ে। কী দুর্দৈব! কী বিচিত্র বিপর্যয়। কিন্তু যদি বা এল ঝড়, গেলও, তবু কেউ এল না। সবুজ শাড়ি নিয়ে ওকে হারিয়ে যেতে হবে এক বার অন্ধকারে।

বাড়ির মধ্যে গেল ও বড়দির কাছে। এখানেও একটু বিস্মিত ব্যথার চমক ছিল। দেখল, বড়দি দাঁড়িয়ে রয়েছে পশ্চিমের জানালার কাছে। শুধু বাঁ দিকের গাল দেখা যাচ্ছে। চোখের কোণ থেকে গাল ভেসে টলমল করছে চোখের জল। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে পড়ল সুমিতা। ভাবল, ফিরে যাবে। কিন্তু সেখান থেকে ফিরেছে বিমুখ হয়ে। এখন ঘরে থাকতেও পারবে না আর।

এই ন যযৌ ন তস্থে অবস্থায় মুখ ফেরালে বড়দি। বলল, কে, রুমনি?

 সুমিতা বলল, হ্যাঁ বড়দি। ঘরে আসছিলুম।

 বড়দি মুখখানি ফিরিয়ে নিয়ে বলল, আয়।

সুমিতা পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াল বড়দির কাছে। জানালা দিয়ে দেখল, সত্যি বেল গাছের একটি ডাল পড়েছে ভেঙে। সামনের একটি বাড়ির পুরো বারান্দাটির ডালপাতার পরদা গেছে খসে।

সুমিতার ঠোঁট কাঁপছে। বড়দিকে জিজ্ঞেস করতে চাইছে কিছু। তার আগেই বড়দি জিজ্ঞেস করল, বেরুতে পারিসনি বুঝি।

না বড়দি! তুমি বেরুলে না।

–পারলুম না।

 সহসা বড়দির বুকের কাছে ঘেঁষে বলল সুমিতা, বড়দি তুমি কাঁদছিলে। বড় ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করেছে। কিন্তু বড়দি বললে যেন ভেজা গলায়, সুমিতার ঘাড়ে হাত রেখে; এক একসময় কিছুই ঠিক করতে পারিনে, তাই বড় কষ্ট হয়।

সুমিতার ঠোঁটের প্রান্তে ছুটে এল অনেক কথা। কিন্তু বলতে পারল না। একটু একটু করে নামছে অন্ধকার। মনে হল, সারা কলকাতাও যেন নির্বাক হয়ে গেছে এখন।

এমন সময় বাইরের ঘরে শোনা গেল অনেকগুলি গলার স্বর, পায়ের শব্দ।

মেজদির গলা শোনা গেল, বোসো তোমরা, আমি আসছি। বলতে বলতেই উপস্থিত মেজদি। দেখেই বোঝা গেল, পুরো ঝড়টি গেছে মাথার উপর দিয়ে। এলো-কেশ ছড়ানো গালে কপালে। আঁচল টেনে জড়িয়েছে কোমরে। ওদিকে কাঁধের ব্যাগ, কাঁধ থেকে গড়াচ্ছে বেসামাল হয়ে। চোখেমুখে ধুলোর মাঝেও চমকাচ্ছে ভারী খুশির দীপ্তি। সচকিত খুশি গলায় বলল দম টেনে টেনে, তোরা এখানে? ও, বড়দি ভাই, একরাশ এসেছে আজ। রাজেন, মৃণাল, হিরন্ময়–অনেক। সমাবেশ উড়িয়ে নিল ঝড়ে, এখন খিচুড়ি বেঁধে নাকি খাওয়াতে হবে আমাকে।

বড়দি খুশি হল কি না বোঝা গেল না। এগিয়ে এসে বলল, বেশ তো।

সুমিতা ভাবছিল, ঝড় গেছে শান্ত হয়ে, সব গেছে ডুবে কোনও বিষণ্ণতার পাথারে। লোহার গেট কাঁপছে ঝনঝনিয়ে। আশ্চর্য! মনের চাওয়ার সঙ্গে কোনও মিল নেই এ সংসারের।

শুনতে পাচ্ছে সুমিতা, কাদের পদভারে কাঁপছে সারা বাড়িটি। গম গম করছে কাদের কলকণ্ঠে।

সুমিতা যেন সবকিছুই দেখছে এক বেদনাহত বিস্ময়ে। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে জমাট হচ্ছে রাতের কালিমা। বাতাস গেছে, উচ্ছ্বাস গেছে, ঝরে গেছে যা ঝরবার। শুনতে পাচ্ছিল ও, বাগানে তান ধরেছে ঝিঁঝি। মন ভরে উঠেছিল এক আশ্চর্য স্নেহে ও ভালবাসায়–ছোট রুমনির মন। বড়দিকে চাইছিল আদর করতে ছোট মেয়েটির মতো।

সেই সময়ে কেঁপে উঠল সারা বাড়ি।

 কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে উঁচু স্বরে ডাকলে মেজদি, বিলাস!

জবাব এল, যাই মেজদি।

এও যেন জীবনের আর একটি দরজা খুলে গেল ওর সামনে। ঝড়ের সময় কাটে একলা কাল। যতক্ষণ সেই ঘোর-ঘন-ঘটা না যায়, ততক্ষণ আবির্ভাব ঘটে না আসলের। হতাশার ব্যথা তাতে লাগুক যতখানি, সত্য যখন আসে, তখন সে বোধ হয় আসে এমনি নির্বাক বিষণ্ণতার ঘোরে। তবে কি ওর মন ভরে ছিল কৃত্রিম ঝড়ের দোলায়।

.

এদিকে সুগতা পড়েছে যেন মহা ভাবনায়। আজকের দিনটা বিলাসের হাতে রান্নার ভার ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু রাঁধতে গেলেও, সে খাবার মুখে তোলা যাবে কি না, সে বিষয়ে ওর ঘোর সংশয়।

শুধু কি তাই? সুমিতার মেজদি সে। কিন্তু ওর মাপজোক করা গম্ভীর তাল যে কী পরিমাণ বে-তাল হয়ে গেছে, নিজেই কি জানে? দেখছে কি একবারো নিজের চোখ মুখ, ভাব ভঙ্গি? বে-তাল হয়েই সে বড়দির পরামর্শ চাইছে। এমনকী রুমনির পরামর্শও। কী করা যায় রাঁধবার। সেই সরল বাংলা রান্না প্রকরণ বইটা দেখে দেখে তিন বোনে রান্নাটা সারলে কেমন হয়।

বাঁচিয়ে দিলেন এমন সময় বাবা এসে। সেই টাকা আসার ঘটনার পর থেকে বড়দির সঙ্গে প্রায় কোনও কথাই বাবার হয়নি। বাবার চোখেমুখে খুশির আভাস। কিন্তু সেই হেঁকে-ডেকে চলাফেরাটুকু নেই আর তেমন। বরং বাড়ির আজ এই হঠাৎ খুশির মেলায় ওঁকে একটু শান্তই মনে হচ্ছে। তবু মুখ দেখে বুঝতে পারছে সুমিতা, বাবার মনের সব দুশ্চিন্তা, আবিলতা ডুবে গেছে এখন। আজ পড়ে পাওয়া ষোলো আনা পেয়ে গেছেন ঘরে বসে।

বাবা আগে দেখলেন বড়দিকে। বড়দির দিকেই তাকিয়ে বললেন কী বিপদ হল? সব শুনে, বেগতিক দেখলেন বাবাও। একটু চুপ করে থেকে বললেন, ঝুমনো, আমি বলছিলাম, আজকে বিলাসের উপরেই রান্নার দায়িত্বটা ছেড়ে দেওয়া যাক। তোমাদের অতিথিরা বসে থাকবেন একলা একলা, তোমরা থাকবে এদিকে, সেটা ঠিক হবে না। কী বলে?

ঠিক সুমিতার মনের মতো কথাটি যেন বলেছেন বাবা। বোধ হয় সকলেরই। তবু একবার মেজদি বলল, বিলাসের উপর। কিন্তু যদি গণ্ডগোল হয়–

যদিও গণ্ডগোল কখনওই হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত আরও দু-একবার এমনটিই হয়েছে। তবু বললেন বাবা, তা হতে দেবে কেন? বিলাসের উপর খবরদারির ভার তোমাদের তিনজনের। তা ছাড়া খালি তো খিচুড়ি নয়, আনুষঙ্গিক আরও কিছু আছে নিশ্চয়। সেটা তো তোমাদেরই করতে হবে।

মেজদি আজ ওর পুরনো দিনের পিছনে গেছে ফিরে। কূল ভাসানো নিঝরিণী। কোন দিকে গতি, অনুমান করা যাচ্ছে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ভিতরের নিঝর এখন উপচে পড়েছে। কোমরে আঁচল বেঁধে বলল বাবাকে, ঠিক বলেছ।

বাবা একটু অসহায়ের মতো করে বললেন, হ্যাঁ, দেরি করে ফেলো না। আর ওদিকটাও একটু সামলাও। মিত্রসাহেবের সঙ্গে তো রাজেনের এর মধ্যেই হয়ে গেল এক প্রস্থ।

রাজেনের সঙ্গে। তিন বোনই চমকে উঠল! মেজদি বলল, কেন কী হয়েছে?

এমন কিছুই নয়। জানিস তো মিত্তিরসাহেব একটু অন্যরকম লোক। একটু তর্কবিতর্ক হয়েছে রাজনীতি নিয়ে।

মেজদি বলে উঠল, সেই ভাল। শুনে আমার বুকের মধ্যে ধুক ধুক করছে। ভাবলুম, রাজেন বুঝি রেগেমেগে চলেই গেল।

বলে ফেলেও মেজদির কী সংকোচ। চট করে এক বার বড়দিকে আড়চোখে দেখে, বিলাসকে ডেকে নিয়ে গেল শোবার ঘরে।

কিছু চাঞ্চল্য এসেছে বড়দির স্থিরমগ্নতায়। সারাদিনের দলিত শিথিল কাপড়-চোপড় সামলাতে হচ্ছে ওঁকে।

মেজদি পাশের ঘর থেকেই বলল, রুমনি, তুই একটু বাইরের ঘরে যা।

 বুকের মধ্যে ধক করে উঠল সুমিতার। ভয়ার্ত স্বরে বলল, কেন?

বোধ হয় চকিতে এক বার মেজদির ঠোঁটের কোণে বিদ্যুতের ঝিলিক উঠল ঝলকে। সুমিতার নিজের মনেও হানল চকিত বিজলি। মুহূর্তে ও ভীরু চিৎকার করে উঠল, মেজদি, তুমি কিছু বলেছ বুঝি?

কিন্তু মেজদি তখন প্রায় ঘরের বাইরে। দরজার কাছ থেকে বলল, আশ্চর্য! বলব আবার কী। যেতে নেই বুঝি তোকে। দেরি করিসনে যা।

অসহায় সুমিতা। এর উপরে না বলার ক্ষমতা নেই ওর। যদিও বা যেত সহজে, এখন পা দুটি অসাড় হয়ে গেছে। কী করবে ও। সংসারে কত মেয়ে প্রেম করে, তাদের একজন করে প্রেমিক থাকে। সেই মেয়েরা যায় অভিসারে।

সুমিতার প্রেম করা হয়ে ওঠেনি। গোটা কলকাতার যুবকদের আজকে সে তার প্রেমিকের জায়গায় বসিয়ে, অভিসারে যেতে চেয়েছিল সভার মাঝখানে। কিন্তু ঝড় এসে গেল। কী ভয়ংকর ঝড়। তারপর একেবারে স্তব্ধ।

বাইরের ঝড়েই ও থরথর করে কেঁপেছিল, প্রকৃতির স্তব্ধতার সঙ্গে স্তব্ধ হয়েছিল।

 কিন্তু সেটা ভুল। ঝড়ের পরেও ঝড় আসে। বাইরের ঝড় যায়, ঘরের ঝড় আসে। এ-ও যেন সুমিতার সেই অভিসারে যাওয়ার মতোই। তবে সে যাওয়া যে এত কঠিন, কে জানত।

প্রথমে দৌডুল আবার বড়দির ঘরে, কাপড় বদলাতে। মরে গেলেও তো এই কাপড় পরে ওই ঘরে যেতে পারবে না আর কিছুতেই। অথচ আশ্চর্য! এই পরে যাচ্ছিল তখন সমাবেশের মাঝে।

বড়দি বলল, ও কী হচ্ছে? কোথায় যাচ্ছিস?

 বলল, কাপড় বদলাব।

ভ্রূ কুঁচকে বলল বড়দি, কেন? লোকজন এসেছে, কাপড় ছাড়ছিস কেন? ওই পরেই যা।

 নিরুপায় সুমিতা। এ নির্দেশ অমান্য করার রাস্তা নেই ওর। এটা যে আবার সামাজিক রীতিনীতির মধ্যে পড়ে। এক চুল সরবার উপায় নেই।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল খাবার ঘরের দিকে। খাবার ঘরের আলো গিয়ে পড়েছে বাগানে বারান্দায়। বাতাসে ভেসে গেল যেন সুমিতা ওই দিকে। একটু দম নেবে। কেন এরকম হল, ও জানে না।

দাঁড়িয়ে পড়েছিল সুমিতা বারান্দার সিঁড়ির উপরে। ঘরের আলো পড়েছে ওর গায়ে।

হঠাৎ কানে এল, এই, সুমিতা।

চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখল তাপসী ঝুঁকে পড়েছে ওদের দোতলার রান্নাঘরের ছোট্ট বারান্দাটিতে। ফিরতেই বলল, কী করছিস রে ওখানে দাঁড়িয়ে।

সহসা যেন কী ধরা পড়ে গেছে সুমিতার। ঢোক গিলে বলল, কিছু না তো।

সামান্য আলোতেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, তাপসীর চোখ দুটি যেন কীসের লোভে চক চক করছে। একটি বিচিত্র ইশারা ওর ঠোঁটে চোখে হাসিতে। বলল চাপা গলায়, না, কিছু নয়। আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারিসনি। তোদের বাড়িতে অনেক ছেলে এসেছে, না?

অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ।

তাপসী বলল, হিরন্ময় বিনয়, ওরা সবাই এসেছে না?

 প্রায় রুদ্ধশ্বাস হয়ে বলল সুমিতা, হ্যাঁ, তা কী হয়েছে।

তাপসী তেমনি হেসে হেসে বলল, বুঝেছি, বুঝেছি।

তাপসীর বুঝেছি বুঝেছি শুনে সুমিতার নিজের বুকের ভিতরেও দুবার বিদ্যুৎ চমকিত হল। বলল, কী বুঝেছিস?

চাপা গলায় প্রায় ফিসফিস করে বলল তাপসী, বুঝেছি, যা তুই বুঝেছিস। তোর সাজ দেখেই বুঝেছি।

সুমিতা বলল, সাজ কোথায়। এ তো আমি আগেই পরেছি।

চোখ ঘুরিয়ে বলল তাপসী, থাক, আর মিছে কথা বলতে হবে না। কিন্তু কার জন্যে পরেছিস বল তো। বিনয় না হিরন্ময়।

সুমিতার মনে হল, তাপসী যেন ওর ভিতরের কোন সুদুরের দরজাটা সত্যি ভোলা পেয়েছে। এই সাজের মাঝে কোথায় যেন বিনয় হিরন্ময়ও আত্মগোপন করেছিল। কিন্তু থতিয়ে গেল তাপসীর এমন সোজাসুজি জিজ্ঞাসায়। সহসা জবাব দিতে পারলে না।

তাপসী আবার বলল, বুঝেছি বুঝেছি। ওয়ান অব দেম। তুই ভাই বেশ লাকি।

-লাকি?

নয়? আমাদের বাড়িতে ও সব নট অ্যালাউড।

 কী সব?

–ছেলেদের আড্ডা।

 তাপসীর কথার মধ্যে একটি লুব্ধ হতাশার সুর। একটু বেদনার আভাসও যেন অনুরণিত হল তার গলায়। সুমিতা বলল, তুই আসবি আমাদের বাড়িতে?

তাপসী বলল, নট অ্যালাউড।

বলে আবার হেসে উঠল চাপা গলায়। নট অ্যালাউড। তাপসীর জীবনের সঙ্গে কোথায় যেন শিবানীর একটু মিল রয়েছে। অথচ আশ্চর্য দুই পরিবারে কত তফাত। শিবানীর একলা বাইরেও বেরুতে নেই। ও বাড়ির সবাই বলেন, মেয়ে বড় হয়ে গেছে। তাপসীর আছে একলা বাইরে বেরুবার নির্দেশ। নইলে কলেজ যাবে কেমন করে। কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই প্রতি পদক্ষেপে জোড়া জোড়া অদৃশ্য চোখ নিয়ন্ত্রণ করছে ওর গতিবিধি! সে চোখ ওর বাবা মায়ের। ওটা নাকি শাসনের পদ্ধতি। নবেন্দুর বন্ধুরা এলে সে ঘরে যাওয়া নিষেধ তাপসীর। ওটা ওদের বাড়িতে অভাবিত। অথচ ডেপুটি সাহেবের বাড়ি, পুরোপুরি মর্ডান। কলেজে যাওয়া ছাড়া সামাজিক রীতি হিসাবেই তাপসীকে বেরুতে হয় ঠোঁটে মুখে রং মেখে। বাড়িতে বসে আলাপ সম্ভব সেই ছেলের সঙ্গে, যাকে আলাপের জন্য ডেকে আনবেন ওর বাবা মা।

তাপসী বলল, কিন্তু, তুই এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছিস যে?

সুমিতা বলল, বড় লজ্জা করছে।

–আহা, একদিন তো সব লজ্জাই ভেঙে যাবে।

কার কাছে?

 যাকে ভাবছিস মনে মনে।

ছি ছি! সব কথাগুলির মানে উলটে ফেলছে তাপসী। যে ব্যাপারে সুমিতা কাঁটা হয়ে গেছে লজ্জায়, তার সঙ্গে কোনও মিল নেই তাপসীর কথার।

হঠাৎ চমকে উঠল সুমিতা। কার ছায়া পড়ছে ওর পাশে। পিছু ফিরে দেখবার আগেই ঝংকৃত হয়ে উঠল মেজদির গলা, একী রুমনি, তুই এখানে।

এবার বুঝি ধমক আছে অদৃষ্টে। বলল, এই যে যাচ্ছি। তাপসীর সঙ্গে একটু কথা বলছিলুম।

 তাপসী বলে উঠল চাপা গলায়, এই মিথ্যুক! তুই তো পালিয়ে এসেছিস।

ছায়া সরে গেল। সুমিতাও পিছন ফিরে ঘরে ঢুকতে গিয়ে শুনতে পেল তাপসীর কথা, বেশ আছিস তোরা।

বেশ। হয়তো বেশ। তাপসীর মতো বন্দিদশা সুমিতা ভাবতে পারে না। কিছু এখন

এখন আর কিছু ভাববার নেই। নিজেকে ঠেলে নিয়ে দাঁড়াল গিয়ে বাইরের ঘরের দরজায়।

সেখানে তখন ঘোরতর তর্ক উঠেছে জমে। সুমিতাকে দেখে সবাই থামল। প্রথমে ওর দিকে কারুর যেন নজরই পড়ল না। তাতে খানিকটা স্বস্তি পেল বটে, মনটা গেল খারাপ হয়ে। সুমিতাকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার সময় নেই কারুরই।

তর্ক জমেছে আশীষ আর রাজেনের মধ্যে। বিষয় বোঝা না গেলেও আন্দাজ করা যায়। রোজার গারোদি আর লুই আরার্গ-এর সাম্প্রতিক উর্দি না-উর্দি নিয়ে আসর গরম হয়েছে। নিশ্চয় সাহিত্য আর রাজনীতির ফাটাফাটি চলছে।

আসলে, সবাইকে দেখে মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে ওরা একদল ছন্নছাড়া। কোথায় যেন যাত্রা করেছিল এই মানুষগুলি, কোন দুর্গমের পথে। কিন্তু ঝড়ের মারে সবাই ফিরে এসেছে কোটরে।

সুমিতা কী করবে না করবে, ঠিক করার আগেই রবিদা বলে উঠলেন, এ-যে ঘন ঘোর বনানী। এসো রুমনো সাহেবা। আরক্ত হয়ে উঠল সুমিতার মুখ। জানত, রবিদা কিছু একটা বলবেনই।

মৃণাল তার প্যান্ট ছেড়ে আজ এসেছে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সুমিতা তো এখন পুরোপুরি লেডি। দাঁড়িয়ে উঠে অনার জানাতে হয় ওঁকে।

মুখের রক্তাভা আর একটু গাঢ় হল সুমিতার। সবাই তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। বিনয়, আশীষ, হিরন্ময়। বিনয়ের সেই লজ্জামুগ্ধ ব্রীড়াবনত ভাব। হিরন্ময়ের সেই হাতা গোটানো, উশকোখুশকো চুলে ত্রস্ততা। অপলক ছোট চোখের ঢুলঢুলুনিতে কী এক দুর্বোধ্য তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা আশীষের।

.

১২.

এর মধ্যে যাকে সুমিতার সবচেয়ে বেশি চোখে লাগছিল, সে রাজেন। রবিদার চেয়েও চওড়া কপাল রাজেনের। সারা কপালটিতে যেন পিছলে পড়ছে আলো। ঝড়ের বেলায় কালো চুলে পড়েছে ধুলো, পড়েছে অবিন্যস্ত হয়ে বিশাল কপালে। তীক্ষ্ণ জ্বর তলায় টানা টানা চোখ দুটিতে সর্বক্ষণ কী এক বিস্ময় ও কৌতূহলের ঝিকিমিকি। মনে হয়, চোখের ওই বিস্ময়ের বিদ্যুৎ আভাসটুকুই সারা মুখে ধরে রেখেছে যত রুক্ষতা। ওটুকু না থাকলে মনে হত ভাবের বশে মুগ্ধ হয়ে বসে আছে একজন। এ ঘরের সোফা আলমারি শেলফ, রঙিন পরদা আর ফুলদানির মধ্যে যদি বা মানিয়েছিল রবিদা থেকে বিনয়কে পর্যন্ত, মানায়নি রাজেনকে। মোটা আলখাল্লার মতো পাঞ্জাবি, তার ভাঁজ গেছে অনেক দিন। কিংবা ছিল না কোনও কালেই। মালকোঁচা দিয়ে পরা ধুতি, পায়ের কনুয়ের অনেক উপরে। সে যে আর কিছুতেই নামবে না, সেটা বোঝা যাচ্ছে শক্ত দৃঢ় গোড়ালি দেখে।

রবিদা বললেন, বোসো রুমনো সাহেবা।

 রাজেন বলল, দাঁড়াও রবিদা, ওর সঙ্গে আগে আমার বোঝাপড়া হবে।

রবিদা বললেন হেসে, সর্বনাশ। আজ তা হলে ডালপালা সব ভাঙল সবুজ বনানীর। কেটে পড়ো ভাই শিগগির।

সবাই হেসে উঠল। ঝড় উঠল সুমিতার বুকে। ফুলদানির বারোমেসে ক্রিসানথিমামের পাপড়ি ছিঁড়তে ছিঁড়তে, আরক্ত মুখ রাখল নিচু করে।

রাজেন যেন সাক্ষী মেনে বলছে সবাইকে। বলল, আমি ওর সঙ্গে আজ অবধি কটা কথা বলেছি জানিনে, কিন্তু ও আমাকে কী কী বলেছে শোনো। এক নম্বর, বদরাগি–

সুমিতা বলে উঠল ভয়চকিত গলায়, না না—

সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বলল রাজেন, দু নম্বর, গোঁয়ার।

–ওমা! না, কখখনও না।

ভয়ে আর উত্তেজনায় সুমিতার গলা রুদ্ধ প্রায়। ডালপালা সত্যি বুঝি ভাঙল।

রাজেন বলল, দাঁড়াও। আরও মনে করতে হবে। হ্যাঁ, কাটখোট্টা, গোমড়ামুখো…

বুঝতে পারছিল সুমিতা, কথাগুলির সবখানিই আসলের চেয়ে বেনো জলের ঢেউ, কিন্তু ধাক্কাটা লাগল ওর। মেজদির পাশে যাকে কল্পনা করেছে, তাকে কখনও বলেনি এ সব। কল্পনাতেও নয়। বলে উঠল, কখনও নয়। সব মিছে কথা।

এমন সময়ে ঘরে ঢুকল মেজদি। বলল, কী হয়েছে?

সুমিতা দৃপ্ত ভঙ্গিতে ফিরে দাঁড়াল মেজদির দিকে। যা কোনওদিনই করেনি। বলল, কী বলেছ তুমি ওঁকে?

কী বলেছি?

ততক্ষণে হাসিটা ভেঙে পড়েছে সুমিতার রুদ্ধ অভিমানের তটে।

 কিন্তু হাসির মাঝে বেসুর ছিল একটু। রবিদার হাসির মাঝে ছিল একটু আড়ষ্টতা। তাকিয়েছিলেন ভিতর দরজার দিকে। মনে হল, পুরো মনটি নেই এখানে।

রাজেনের মেঘমন্দ্রিত অট্টহাসির মধ্যে উল্লাসের ধ্বনি একটু বেশি। তখন মৃণাল তাকিয়ে ছিল সুগতার দিকে। আর সুগতা বিস্মিত চোখে চকিতে এক বার দেখল রাজেনকে।

আশীষ হাসছিল, কিন্তু নিঃশব্দে। লক্ষ করছিল সবাইকে। শুধু বিনয় আর হিরন্ময় সুমিতার দিকে চেয়ে হাসতে গিয়ে চোখখাচোখি করল পরস্পরে।

সুগতা বলল, কিন্তু যা-ই বলল, তুমি একটু গোঁয়ার আছ রাজেন।

রাজেন বলল, আছিই তো। নইলে ছাত্র আন্দোলন করব কেমন করে?

-কেন?

নইলে কবে তোমরা ভাসিয়ে দিতে আমাকে। এমনিতেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মরতে হয়। ভাগ্যিস একটু গোঁয়ার হয়েছিলুম, তবু কথা শোনে সবাই।

সবাই হেসে উঠল আবার।

মৃণাল বলল, কিন্তু রাজেন, পালিয়েও যায় অনেকে।

বিদ্যুৎ কষার মতো তীক্ষ্ণ হাসি নিঃশব্দে ঝলকে উঠল রাজেনের ঠোঁটে। বলল, জানি। যারা পালাবার, তারা পালাবেই। তাদের ধরে রাখবার মন্ত্র আমার জানা নেই, চাইনেও।

সুগতার ঠোঁটের হাসিটুকু বারে বারে ছড় খেয়ে যেতে লাগল। কে যেন অদৃশ্যে টিপুনি দিচ্ছে ওর হৃৎপিণ্ডে। চমকে চমকে উঠছে ব্যথায়। বাতাসে শিউরে উঠছে কূল ভাসানো নিঝরিণী। বলল, ও, গোঁয়ার্তুমি দেখেই কথা শোনে সবাই। ভালবেসে বুঝি শোনে না?

কথাটার মধ্যে কীসের একটি সুর ছিল। সুগতার ঝড়-এলোমেলো মুখে চাপা অভিমানের বিদ্যুৎ-চকিত আভাস।

রাজেন বলল, তা হলে সে গোঁয়ারকে দেখে কেউ পালায় না বলো।

সুমিতা ঠিক ধরতে পারছিল না, অন্তস্রোতের গতিটা ছুটছে কোনওদিকে। কিন্তু মেজদির চোখে মুখে ক্রমেই যেন রক্ত ফুটছিল অদৃশ্য চাবুক কষায়। বলল, গোঁয়ারকে দেখে পালায় কিনা জানিনে, কিন্তু

সহসা থেমে গেল সুগতা। ওর দুই চোখে নেমে এল অতল গভীরতা। নিঝরিণীই হারিয়ে গেছে যেন কোনও নিস্তরঙ্গ অতল সমুদ্রে।

এতক্ষণে প্রথম মুখ খুলল আশীষ ওর সেই ঢুলুঢুলু চোখে। কেমন একটু বিদ্রুপের আভাস নিয়ে বলল, শেষ পর্যন্ত যে পালাবার সে পালাল।

রাজেনের যেন হঠাৎ খেয়াল হল, আবহাওয়াটা মোেড় নিচ্ছে অন্যদিকে। তাড়াতাড়ি বলল একটু সংকুচিত হয়ে, যে যত খুশি বকো আর রাগো ভাই, খিচুড়ির আসরটা যেন নষ্ট না হয়।

মৃণাল কেমন একটু অস্বস্তি বোধ করছিল। সিগারেট টেনে টেনে আর কূল পাচ্ছিল না। বললে, আমিও সেইটেই চাইছিলুম।

রাজেন বলল, সবাই মিলে যেন আমাকে দোষ দিয়ো না। আমাকে গোঁয়ার বলেছ, তাই আমি বলেছি। সে আমার মাও আমাকে রোজ গোঁয়ার বলেন, আমিও মাকে অনেক কিছু বলি।

আবার একটু হাসির শব্দ শোনা গেল সকলের গলায়।

রাজেন বলল আবার, মাঝখান থেকে যে আমাকে এ সব বলেছে সে বেচারি পড়ে গেছে মহা ফাঁপরে। তুমি বোসো সুমিতা।

সুমিতা বসল বিনয়ের পাশের সোফাটায়। সুমিতার চেয়েও আরক্ত মুখে, কেমন যেন কুঁচকে উঠল বিনয়।

সুগতা উঠল চেয়ার ছেড়ে। কোমরে বাঁধা আঁচলটি গেছে খুলে। সেটি তুলতে গিয়ে চকিতে এক বার চোখাচোখি হল মৃণালের সঙ্গে। বলল, আমাকেও যেন দোষ দিয়ো না তোমরা। শেষ কথা, আমার খিচুড়ির আসর আমি কিছুতেই মাটি হতে দিতে চাইনে। সমাবেশ না জমবার অভিশাপ থাকলেও চাইনে। বলে চলে যেতে গিয়ে আবার ফিরে বলল, রুমনি, তুই কিন্তু আসিস পরে রান্নাঘরে।

চলে গেল সুগতা। সুমিতা দেখল, রবিদাও মেজদির সঙ্গে গেল ভিতরের ঘরে।

রবিদা আর মেজদি চলে যাওয়ার পরেও, কয়েক মুহূর্ত বাইরের ঘরের আবহাওয়া যেন থমকে রইল। একরাশ কৌতূহল ব্যাকুল করে তুলল সুমিতাকে ভিতরে ভিতরে। কেবলি মনে হতে লাগল, মেজদির সঙ্গে রাজেনদার কোথায় একটু কী ঘটে গেছে। যার অতল আবর্তের সামান্য নির্বাক কম্পনটুকু দেখতে পেয়েছে সুমিতা। ও একলা নয়, এ ঘরের সবাই। বিশেষ করে আশীষ। ওর ঠোঁটের কোণের কেন্নোর মতো কুঞ্চনটুকু যেন অন্তঃসলিলের সব আবর্তটাকে ঘূর্ণিপাকে আরও ফাঁপিয়ে তুলছে দুর্বোধ্যভাবে। আর আশ্চর্য! আশীষের সঙ্গে সুমিতার বারেবারেই চোখখাচোখি হচ্ছিল। আশীষ যেন একটু কেমন করে তাকাচ্ছিল ওর দিকে।

নিয়ত বিস্ময় কুঞ্চিত চোখে রাজেনেরও যেন একটি চকিত ছায়ার আভাস দেখা দিল। বলল, মৃণাল, একটা সিগারেট দাও, খাই।

মৃণালও পকেটে হাত দিয়ে একটু শক্ত হয়েই ছিল। সহসা শিথিল হওয়ার অবকাশ পেল যেন। তাড়াতাড়ি সিগারেটের প্যাকেট বার করে বলল, অব কোর্স

আশীষ বলল, এদিকেও দিয়ো মৃণাল।

মৃণাল আবার বলল, অব কোর্স

ধুতি-পাঞ্জাবি পরা অব কোর্সের ভঙ্গিতে বেমানান লাগছিল ওকে। আশীষের ব্যাপারটা একটু আলাদা হয়ে গেছে এখানে। একসময়ে কলেজে পড়েছে রাজেন-মৃণালের সঙ্গেই। সাহিত্য করে অনেক দিন থেকে। সবচেয়ে বড় গুণ যেটা ওর, সেটা হল ওর পড়াশোনার বিস্তৃতি। বিশেষ করে বিদেশি সাহিত্য। সে নিজেও সাহিত্য করে। হঠাৎ এক বার ওর খেয়াল হয়েছিল, নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হবে সাহিত্যে। পালিয়ে গিয়েছিল কয়লাখনি অঞ্চলে। সেখানে কিছু হয়নি বলে, চা বাগানে। তাও খুব একটা মনোমত হয়নি বলে, ট্রেড ইউনিয়ন করতে নেমে পড়েছিল শহরতলির চটকল এলাকায়। এই করে, তিন বছর কাটিয়ে, আবার ওকে ঢুকতে হয়েছে সেই ঘোলা জলে। অর্থাৎ কলেজে। এখন অবশ্য সাহিত্য সম্পর্কে আশীষ অন্য কথা বলে। কিন্তু রাজেন-মৃণালের সঙ্গে রয়ে গেছে সেই পুরনো বন্ধুত্বের জের।

আশীষ সিগারেট নিয়ে রাজেনের দিকে ফিরে বলল, হঠাৎ সিগারেট খাচ্ছ যে?

রাজেন বলল, খাওয়া যাক আজ একটা। সুমিতার দিকে ফিরে বলল, সুমিতার অনারে।

রাজেনের সঙ্গে চোখখাচোখি হল সুমিতার। পরমুহূর্তেই রাজেনের বিস্ময়-বিদ্যুৎ-চকিত চোখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ভাবছ, লোকটা সত্যি গোঁয়ার, না?

সুমিতা লজ্জিত হেসে বলল, মোটেই না।

রাজেন বলল, যাক, বাঁচা গেল। তোমার রেজাল্ট আউট হচ্ছে কবে?

সুমিতা–জুনের গোড়ার দিকেই।

মৃণাল বলে উঠল, তখনও, খিচুড়ি না হোক, অন্য একটা আসর আমাদের বসবে নিশ্চয়ই।

আশীষ বলল, তা হলে এবার আমাদের সেই পুরনো আলোচনাটাই ফিরে আসুক।

.

১৩.

আশ্চর্য সুন্দর কথা বলে আশীষ। জ্ঞানের পরিধিটা ওর বহু দুর ব্যাপ্ত। সেটা জ্ঞান কিনা কে জানে। পড়াশোনা আছে নিশ্চয়ই। অতীতকালের মিশর ব্যাবিলনের ইতিহাস পেরিয়ে, রোম পার হয়ে, ফ্রান্স আর ইংল্যান্ড ঘুরে ওর বক্তব্য যখন ভারতের কূলে এসে দাঁড়ায়, তখনই দেখে সবটা শূন্য। বর্তমান ভারতের সবকিছুর উপরেই তার উদ্যত অঙ্গুলির বিদ্রূপ আর কুটি।

রাজেনের সঙ্গে বিতর্ক তার অষ্টপ্রহর।

কিন্তু সুমিতার মনটা মচকে মচকে উঠছে বার বার। আশীষ যেন কী এক বিচিত্র অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তার দিকে। যেন কী বলছে। সেই নিঃশব্দ বার্তায় লজ্জা করছে সুমিতার। লজ্জা করছে, কিন্তু একটি পুরোপুরি ছেলের এমন চাউনিতে কী একটি গৌরবও যেন আছে। আবার খারাপও লাগে। শরীরের মধ্যে কেঁপে ওঠে কেন চাউনি দেখে। কিন্তু রাজেনের দিকে চোখ পড়লেই থমকে যায় আবার সুমিতা। আর ভাবে, এই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মূর্তির সারা মুখে দৃঢ় অভিব্যক্তির মধ্যে কোথায় একটু বৈরাগ্যের বিচিত্র স্পর্শ রয়েছে লেগে। চোখে তার কী যে আশ্চর্য বিস্ময়! যেন এই বিশ্বের ধূলিকণা থেকে সবকিছুকেই নতুন করে দেখছে বারে বারে। ওই চোখে, অমনি বিস্ময়ে বারে বারে মেজদিকে দেখবে ফিরে, মেজদিকে ফিরে তাকাতে হবে বারে বারে। তার মনের কূলে কূলে নিশ্চয় আচমকা শিহরিত হবে নিস্তরঙ্গ জল। যদি প্রাণ থাকত ধূলিকণার, সেও ভাবত, আমি সামান্য পথের ধুলো। কী দেখছে আমার মধ্যে সে অমন করে। মেজদি নিশ্চয় ধরা পড়েছে ওই চোখে ওর কঠিন দৃপ্ত হৃদয় নিয়ে।

রবি রাজেনকে থামিয়ে বলল, যাক, ডেপুটি সাহেবের কথা শোনা যাক।

শুনলেই তো, উনি বলে গেলেন, অনেক রাজনীতিকের দেখা উনি পেয়েছেন ওঁর এজলাসে। যে দেশকে উনি ওঁর কাঠগড়ায় শুধু দেখেছেন, সে দেশের মানুষকে উনি করুণা করতে পারেন, ভালবাসেন কী করে। শত হলেও উনি হচ্ছেন রাজ-প্রতিনিধি, রাজার অংশ।

মৃণাল বলল, কিন্তু এদেশে তো ডেপুটির স্বদেশ কীর্তিও কিছু কম নেই।

রাজেন বলল হেসে, এ দেশে মেরি কার্পেন্টার আর লং সাহেবের মতো ইংরেজও এসেছিলেন। তাতে ভারতবর্ষে ইংরেজের জাতবদল হয়ে যায়নি। যে ডেপুটিদের স্বদেশ কীর্তির কথা বলছ তুমি, তাঁদের পরিচয়টা ডেপুটি বলে অন্য কিছু। তবে, আমি যে হিরন্ময়কে রাগ করতে বারণ করেছি, তার কারণ, রাগ করে কোনও লাভ নেই। মিত্ৰসাহেবরা যে এত বাড়াবাড়ি করেন, সেটা হল ত্রিশঙ্কুর ক্রোধ। ইজ্জতের দিক থেকে ওঁদের নতুন কিছু পাবার নেই। সেই বিক্ষোভ তো আছেই, তার উপরে বাস করেন যে দেশে, সে দেশের জীবন থেকে রয়েছেন অনেক দূরে। জীবনের এ শূন্যতার জ্বালাও তো কম নয়। যদিও এ জ্বালাটাকে ওঁরা ওঁদের সমাজের তৃপ্তি বলেই জানেন।

সব কথার মানে স্পষ্ট নয় সুমিতার কাছে। ওর চোখের সামনে শুধু মিত্ৰসাহেবের সেই একঘেয়ে কথাগুলি যেন অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।

দেখছে, শুনছে। আর শুনছে সুমিতা, ওর কানের কাছে বিনয় বলছে ফিসফিস করে, পার্কে গিয়ে খুঁজেছিলুম শুধু তোমাকে। না দেখে মনটা এত খারাপ হয়ে যাচ্ছিল! নতুন একটা গান বেঁধে নিয়ে এসেছিলুম আজকে, সভায় গাইব বলে, জানো। ভাবছিলুম তুমি না এলে–

বিরক্ত নয়, ভীষণ লজ্জা করছে সুমিতার। রাজেনের জন্যে নয়। সে মেতে গেছে তার বিষয়ে। লজ্জা করছিল আশীষের দিকে তাকিয়ে। সে তাকাচ্ছে এদিকে বারে বারে সেই দৃষ্টিতে, ঢুলুঢুলু চোখে। আড়চোখে ঠোঁট কুঁচকে। ভাবটা যেন, আমার নজর আছে ওদিকেও।

সুমিতা ভুলে যায়নি, ওকে ডাক দিয়ে গেছে মেজদি। কিন্তু যেতে পারছে না এ ছেড়ে যেতে পারছে না, অথচ উৎসুক মন বারবার উঁকি দিয়ে আসতে চাইছে ভিতরে। কোথায় গেলেন রবিদা, কার কাছে গেলেন আজ এত দিন পরে।

.

রবি এসে দাঁড়াল সুজাতার ঘরের দরজায়।

দরজা রয়েছে খোলা কিন্তু আড়াল রয়েছে পরদার। ওর পাশ দিয়ে সুগতা চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। ভেবে এসেছিল অনেক কিছু, অনেক দিনের অনেক সংকল্প নিয়ে। মহীতোষের অনুরোধ এড়িয়ে যেতে পারেনি রবি। অনেক দিনের বন্ধু। যে বন্ধুত্ব সম্পর্কে বন্ধু ও আত্মীয়মহলে আলোচনার শেষ ছিল না। তাদের বন্ধুত্বের মধ্যে যারা অনেক কিছু দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু আজ কাছে এসে, গাঢ় নীল পরদাটা যেন কী এক দুর্বোধ্য বাধায় দুলতে লাগল চোখের সামনে। হাত দিয়ে পরদা সরাতে, চোখে পড়ল, সুজাতা দাঁড়িয়ে রয়েছে জানালায়, বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে।

রবি ডাকল, ব্যস্ত আছ?

চমকে উঠল সুজাতা। ফিরে দাঁড়িয়েই অসংবৃত আঁচল ঠিক করে এক মুহূর্ত থমকে গেল বিস্ময়ে। বলল, কে? ও, রবি, এসো।

শেষ মুহূর্তের ডাকে অনেকখানি নির্বিকার শোনাল সুজাতার গলা। সহসা ওর রক্তাভ ঠোঁটের কোণে একটু বিদ্রুপের আভাস উঠল ফুটে। তরল টলটল চোখে বিস্ময়ের একটি অস্পষ্ট কাঠিন্য এল ঘিরে। দেখে এখন বোঝবার উপায় নেই, এ মেয়ে সন্ধ্যাবেলা শুধু জীবনের রুদ্ধ দরজাগুলির গায়ে মাথা ঠুকে ঠুকে ফেলছিল চোখের জল। তবু বহু দূরে জলোচ্ছাসের কলকলানি শোনা যাচ্ছে কোথায়। যেন মরণের বান ডাকছে সেখানে। এতক্ষণে কাপড় বদলানো হয়েছিল বটে, কিন্তু অবিন্যস্ত খোলা চুলে কিংবা মুখে হাত পড়েনি এখনও সুজাতার। বলল, বোসো।

রবি বসল একটি চেয়ারে। অনেক দিন পরে, হঠাৎ বড় অচেনা লাগছে এই ঘর। ব্যবধান যেন কত সুদূর। যেন সহসা এক নিষিদ্ধ ঘরে ঢুকে, অসহায় অস্বস্তি বোধ করছে। এ রবিকে দেখলে বোঝা যায় না, তাঁর ব্যক্তিত্বকে সবাই সম্ভ্রম করে বাইরে। ছাত্রমহল থেকে উচ্চ রাজনীতির আসরে যাঁর সসম্মান গতিবিধি রয়েছে।

সুজাতা দাঁড়িয়েছে খাটে হেলান দিয়ে উধ্বাঙ্গে বাঁক নিয়ে। যেন সত্যি আসছে কোনও জলোচ্ছ্বাসের তীব্র ঢেউ। তাকে ও প্রতিরোধ করবে।

রবি তাকাল সুজাতার দিকে। সেই বুদ্ধিদীপ্ত বিষণ্ণ চোখে। কিন্তু পরমুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিল অন্য দিকে। ধিক্কার না থাক, কেমন একটি ঔদ্ধত্য রয়েছে সুজাতার সর্বাঙ্গে।

বিক্ষুব্ধ জনারণ্যে যার ভয় নেই, সে কিনা ভীরু এই ঘরের কোণে। রবি বলল, তোমাকে কয়েকটা কথা বলব সুজাতা।

সুজাতা! এ নামে ডাকবার তো কথা ছিল না। যার সঙ্গে পরিচয় ছিল, সে তো উমনো।

সুজাতা বলল, কী কথা বলো।

এমনি করে কথা বলেনি কোনওদিন দুজনে। বহু খুনসুটি করেছে দুজনে এককালে। জীবনের অনেক মোড় ঘুরে, অনেক স্মৃতির গ্রন্থি পার হয়ে আজ এসে আবার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে এই রূপে। যে ভয়ংকর ফাঁকিটা এত দিন নির্লিপ্ত বেশে দাঁড়িয়ে ছিল দুজনের মাঝখানে, আজ সে ঠোঁট টিপে হাসছে নিষ্ঠুরভাবে।

রবি বলল, কথাটা ঠিক আমার নয়।

সুজাতার ঠোঁটের কোণে বিদ্যুৎ হানল দূর আকাশের। যেন আগের মতোই বলল ঠাট্টার ভঙ্গিতে হেসে, পরের জন্যে তো তুমি লাইফ স্যাক্রিফাইস করেই আছ। পরের কথা-ই তো তোমরা বলল।

অতি অল্প সময়ের মধ্যে এক সর্বগ্রাসী আক্রমণের সমস্ত আয়োজন ঝকমকিয়ে উঠল সুজাতার কথার সুরে ও ভঙ্গিতে। সেইজন্য ও প্রথম থেকেই অগ্রগামিনী। যেন তার দুর্ভাগ্যের জন্যে দায়ি সবার বড় আসামিকে পেয়েছে আজ সামনে।

এক মুহূর্তে রবির মুখও শক্ত গম্ভীর হয়ে উঠল। কিন্তু শান্ত গলায় বলল, কথাটা ঠিক তা নয়। ওঁর ধারণা, আমি তোমাকে বললে বোধ হয় কাজ হবে।

ওঁর অর্থাৎ মহীতোষ। কাকাবাবু বলাটাও ছেড়ে দিয়েছে নাকি রবি। কিন্তু সুজাতার সমস্ত মুখ অকস্মাৎ জ্বলে উঠল দপ করে! রক্তাভ ঠোঁটে ফুটল সুস্পষ্ট ধারালো বিদ্রূপ। তবুও বুকের গভীরে যেন এক সুতীব্র কনকনানি। সেটা যত বাড়ল, রবির এই নির্লিপ্ত শান্ত মুখ ততই কেন যেন অস্থির করে তুলল চাপা ক্ষোভে।

বলল, তুমিও নিশ্চয় কাজ হবার আশা নিয়েই এসেছ আজ বলতে।

রবির বিশাল শরীরে একটি অসহায়তা দেখা দিল। ব্যাকুল গলায় বলল, না, না—

সুজাতা বলল, তবে?

কীসের জন্যে এমন কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করছে সুজাতা। চকিতে এক বার মনে হল রবির, যদি অধিকারের প্রশ্ন হয়, তবে এ মুহূর্তে এ ঘর থেকে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

বাঁক ছেড়ে সোজাসুজি দাঁড়িয়েছে সুজাতা। ঝুটা মসলিনের সাদা জামার অস্পষ্ট সীমানায় কিলবিল করছে সোনার হার।

রবি বলল, থাক ও সব কথা। হয়তো তোমার মন ভাল নেই আজ।

রবি উঠতে গেল। ভ্রূ কুঁচকে উঠল সুজাতার। বলল, থাকবে কেন? এর চেয়ে ভাল মনের আশা নাই বা করলে।

রবির শ্যামল চিকন মুখে রক্ত উঠেছে ফুটে। ঘাম দেখা দিয়েছে কপালে বিন্দু বিন্দু। উঠে দাঁড়াল সুজাতার সারা গায়ে ছায়া ফেলে। বলল, না, আজ থাক সুজাতা।

আবার সুজাতা। বলল, আজ থাক। কিন্তু আমার উপরে তোমার এত রাগের কারণ আমি সত্যি জানিনে।

দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘাড় ফিরিয়ে বললে সুজাতা, রাগ আমি কারো পরেই করিনি। কিন্তু সারা ঘরটি যেন থমথম করছে। আসবাবপত্র থেকে সবকিছু, দেওয়ালের নডটিও রয়েছে যেন উৎকর্ণ হয়ে।

বলতে চায় না সুজাতা, বলতে চায় না আর। কিন্তু কী চতুর আর মিথ্যুক রবি। মনে করেছে, উমনোকে সুজাতা বলে ডাকলেই বুঝি, শুধু বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে বুঝি, এমনি নির্লিপ্তভাবে ফিরে যাওয়া যায়। সুজাতা যে আসলকে ছেড়ে নকলের গলায় মালা দিয়ে এখন পাপের ফল ভোগ করছে, তাতে যেন রবির একটুও আনন্দ হয়নি, এমনি ভাব দেখাতে চাইছে। খুশিতে আর ঘৃণায় এতখানি নির্বিকার হবার ক্ষমতা পেয়েছে রবি, সে কথা জানে সুজাতা। তবে কেন না বলে ছাড়বে। ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমার দুর্ভাগ্যে যে খুশি হয়, তাকেও কি আমার ভাল লাগাতে হবে।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে বলল রবি, তোমার দুর্ভাগ্যে খুশি?

নয়? একটুও নয়?

হৃৎপিণ্ডে ধকধক, দু পায়ে কাঁপুনি লেগেছে সুজাতার।

রবি হাত দিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে ধরেছিল। হাত সরিয়ে স্খলিত চাপা গলায় বলল, কীসে বুঝলে?

নিজেকে সংবরণ করতে চাইছিল সুজাতা। হৃৎপিণ্ডের দ্রুত ওঠানামায় কে যেন কণ্ঠনালীতে হাত চেপে বলছিল ভিতরে ভিতরে, থাক থাক। কিন্তু সামলাতে পারলে না রবির প্রশ্নের মুখে। বললে, যেমন করে অনেক কিছু বোঝা যায়, তেমন করেই।

কয়েক মুহূর্ত আরণ্য স্তব্ধতা গেল। রবি দাঁড়িয়ে চেয়ারের হাতলটি মোচড়াচ্ছিল। তারপর যেন হঠাৎ অনেকখানি শান্ত গম্ভীর গলায় বলল, সুজাতা তোমার মন নিয়ে তুমি যা খুশি তাই ভাবতে পার, বলতে পার। কিন্তু তোমার দুঃখে আমি সুখী, এ কথা তুমি ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে না।

সুজাতা তেমনি মুখ রেখেছে ফিরিয়ে। বললে, করবে না, বাইরের অনেকেই বিশ্বাস করছে।

 চকিতে এক বার রবির মনে পড়ল ওর বাড়ির কথা। সে নিজে ছাড়া সে বাড়িতে সবাই সাহেব। সেই প্রাণান্তকর বাঙালি সাহেব বাড়িতে তাকে মনে হয়, যেন ছেলেপুলেদের গৃহশিক্ষক ছাড়া আর কিছু নয়। সেখানে কথার আড়ালে, সবাই সুজাতার নামটি করে ওর কাছে। ভাবে ভাষায় ইঙ্গিত দিতে চায় দুজনের অন্তরঙ্গতার। এড়িয়ে যাবার ইচ্ছে থাকলেও মনে মনে ক্ষুব্ধ না হয়ে পারে না।

বলল, তোমাদের সেই অনেকে কী বিশ্বাস করে না করে আমি জানিনে। জানতেও চাইনে। তবে এক জনের কথার সঙ্গে তোমার মিল খুঁজে পেলুম, সেটুকু অস্বীকার করতে পারিনে। সে গিরীন।

সুজাতা মুখ ফিরিয়ে সরে গেল এক পা, খাটের কোণে। পিছন থেকে এলিয়ে পড়েছে সর্পিল চুল। বলল, সে তোমার বন্ধু। তোমাকে চেনে বেশি।

প্রতিটি কথার মধ্যে সুজাতার নিষ্ঠুর আয়ুধ। কিন্তু, যত শান্ত হয়ে পড়ছে রবি, ততই যেন আক্রমণ ব্যাহত হচ্ছে। যত ব্যাহত হচ্ছে, ততই দাবানল জ্বলছে হু হু করে। ততই হৃৎপিণ্ডে কীসের নিষ্ঠুর টিপুনি লাগছে।

রবির কণ্ঠস্বর গাঢ় হচ্ছে ক্রমে। কিন্তু আঘাতের চমকটুকু উঠেছে সামলে। বলল, তোমরা দুজনেই আমার বন্ধু। তোমাদের এই চেনাচিনির উপরে আর আমার কথা চলে না। আমি তো জানতুম না, আমাকে তোমার এত চেনা আর এত ঘৃণা।

সুজাতা রুদ্ধশ্বাস, নিষ্কম্প ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল শক্ত হয়ে। আক্রমণের সমস্ত অস্ত্রগুলি এবার যেন ঘুরে দাঁড়িয়েছে ওর দিকেই।

রবি আবার বলল, আমি ভেবেছিলাম নিজের দুর্ভাগ্যে পথ খুঁজে পাচ্ছ না তাই তুমি, আসতে পার না কাছে।

সুজাতার বুকের ভিতরে কে নিঃশব্দে উঠল ফুঁপিয়ে-সত্যি, সত্যি, পথ আমি পাচ্ছিনে খুঁজে। কিন্তু আমার সে দুর্ভাগ্যের দায় কি আমার একলার? রবির কি কোনও জবাবদিহি নেই?

রবি বলল, হয়তো তোমার বন্ধু অমলাদের নাইট ক্লাবেও এ নিয়ে দারুণ ঘৃণায় তোমরা হাসাহাসি করেছ।

বুকের নিগুঢ় তলে নিঃশব্দ চিৎকারে ফেটে পড়ল সুজাতা, না না। কিন্তু মুখে বলল, নাইট ক্লাব?

 রবি-হ্যাঁ, তোমাদের পার্ক স্ট্রিটের নাইট ক্লাবের কথা বলছি।

কিন্তু সেখানে তো কেউ হাসেনি রবিকে নিয়ে। অমলা তার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কখনও তা বাড়তে দেয়নি সুজাতা। কিন্তু রবির মুখে নাইট ক্লাবের কথা শুনে আরও তীব্র হয়ে উঠল ওর গলা, কেউ যদি হেসে থাকে, তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার।

রবির মুখে ক্রোধের আভাস নেই। কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও মুখ থমথমিয়ে উঠেছে। বলল, রাগ কোরো না, তেমন অনুরোধ আর করতে পারিনে। তবু, তোমার বাবা আমাকে বলতে বলেছিলেন গিরীনের দেওয়া মাসোহারাটা তোমাকে অ্যাকসেপ্ট করতে।

আবার ফিরল সুজাতা উদ্যত ফণা নিয়ে। এইবার ও চিৎকার করে উঠতে চায়। কোনওরকমে নিজেকে ধরে রেখে বলল, তুমি কী বলে?

কাকাবাবু আমাকে যা ভেবে বলতে বলেছিলেন, সেটা আসলে আমাদের দুজনেরই ভুল। নইলে কেন এসেছিলুম বলতে। তবু, একটি কথা না বলে পারছিনে সুজাতা। গোড়ায় তোমার গলদ হয়েছে কোথাও।

যথা?

রবি দৃঢ় গম্ভীর স্বরে বলল, দেখ সুজাতা, নিজের অনেক সমস্যা থাকে, তা দিয়ে আর দশজনকে ভোগাবার অধিকার তোমার নেই। তোমার সুখে কেউ বাধা দেয়নি, দুঃখের দায় যদি কেউ নিতে আসে, তাকে অপমান করার অধিকারও তাই তোমার চিরদিন থাকবে। কিন্তু কথা সেখানে নয়। কথা হল, তুমি হয়তো মনে করেছ, মস্ত বড় একটা অসত্যকে আঘাত করে, সত্যকে রক্ষা করেছ। তা কিন্তু আদপেই নয়, তোমার এই অদ্ভুত ব্যবহার তার প্রমাণ। আসলে গিরীনের বিত্তের মূল্যটা তোমার কাছে কম নয়। আমাকে যত খুশি ঘৃণা করতে পার, ভেবে দেখ, সেটা হারিয়ে তোমার দুঃখ বেড়েছে কি না।

তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ করে বলল সুজাতা, কোনও বিত্তহীনকে বিয়ে করলেই বোধ হয় সুখী হতুম?

 রবি তৎক্ষণাৎ বলল, না। বিত্তহীনদেরও হৃদয় আছে, আর তাই আছে তাদের স্বস্তিতে বাঁচবার অধিকার। তোমার পক্ষে সেটা স্থান নয়, তুমি নিজেই সেটা ভাল বোঝ। সেইজন্যই আর একটি কথাও বলব। গিরীনকে যদি ভালবেসে থাক, তবে সবকিছু মিটিয়ে ফেলো এখুনি।

রবি দেখতে পেল না, সুজাতা কাঁপছে সত্যি সত্যি। এলো চুলে, রক্তকুঞ্চিত ঠোঁটে আর দীপ্ত চোখে, ভয়ংকরী দেখাচ্ছিল ওকে। বলল, তোমার কি কোনও সন্দেহ আছে সে ভালবাসায়?

–আমি জানিনে। রবি ফিরে গেল দরজার দিকে। সারা মুখ ভেসে গেছে ঘামে। হঠাৎ একটি অস্ফুট শব্দ শুনে ফিরে তাকাল। শুনতে পেল, সুজাতা বলছে, যাও তুমি।

বেরিয়ে গেল রবি। সুজাতা দাঁড়িয়ে রইল তেমনি। বুকের উপরে দু হাত চাপতে চাপতে তুলে নিয়ে এল গলার কাছে। খাটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনে হল, সেটা যেন সরে যাচ্ছে একটু একটু করে।

ফিরে দাঁড়িয়ে সুজাতা শক্ত করে ধরল খাটের রেলিং। তারপর, শুন্য ধমনীতে একটু একটু করে ফিরে এল রক্ত। যত আসতে লাগল, ততই মনে হল, একটি ভয়ংকর সত্য ওর ধমনীতে আসছে ছুটে। ভালবাসেনি ও গিরীনকে। ভালবাসেনি, তবু প্রাণ ভরে চেয়েছিল গিরীনের বিষয়বৈভব। চেয়েছিল শৈশব থেকে, নিজেকে ভেবেছে চিরদিন বিপুল বিত্তবানের ঘরণী। ওই স্বপ্নটুকুকে ভালবেসেছে সুজাতা, ওই সত্যটাকে লালন করছে সোহাগ দিয়ে। কিন্তু মানুষটির কথা ভেবে দেখেনি। বিত্তকে আলিঙ্গন করতে গিয়ে জীবনের একটি প্রতিপত্তিকে ও হারিয়েছে। সে ওর ভালবাসার প্রতিপত্তি। ওর ভালবাসা, সেখানে আজ শুধু ব্যর্থতা, বিদ্রূপ আর ঘৃণা। সেইজন্যেই সারা প্রাণভরে শুধু ছলনা আর একদিকে। পরকে নয়, ছলনার বেড়িটা আজ ওকেও ঘিরেছে পিলপিল করে। কিন্তু এ কী আশৈশব বিপুল বিত্তসাধন ওর যে, তার আড়ালেও সুজাতা পারলে না ছলনা করতে। ছলনা করতে হচ্ছে আজ নিজেকে নিয়ে।

পরমুহূর্তেই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল আবার রবির মুখ। আর দারুণ অভিমানে চোখের তট ছাপিয়ে এল জল। যে ওকে কখনও কিছুই বলেনি, তার প্রতিই বারে বারে ফুঁসে উঠল, দর্পী, অহঙ্কারী মিথ্যুক আর চতুর বলে। অসত্যকে-ই যদি আঘাত না করে থাকে সুজাতা, তবে বিপুল বৈভবের বাসনাকে দলিত করে এসেছে কেমন করে? মন নয়, মতির ফাঁদে পড়েছিল সেদিন সুজাতা। কিন্তু রবি কী মিথ্যুক, কী মিথ্যুক! জীবনে অসত্যকে আঘাত করার প্রথম পাঠ কার কাছ থেকে পেয়েছিল সুজাতা? রবি নয়?

তবু, সুজাতা যে সত্যকে ফাঁকি দিয়ে অসত্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল, সেই ক্ষোভে রবি ওর সমস্যাটাকেও স্বীকার করতে চায় না। আসলে ওর জীবনের সেই অস্তিত্বের জটিলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সুজাতা। যে ওকে নিয়ত ভেংচি কাটছে। বলছে, ভালবাসাকে ফাঁকি দিয়ে, গণ্ডুষ ভরে পান করতে চেয়েছিলে জীবনখানি। প্রকৃতি তার শোধ নিচ্ছে তোমার উপর। রবি সেই প্রকৃতির বাহন হিসেবেই কথা বলছে।

রবি শুধু প্রকৃতিরই বাহন? আর কিছুনয়? গিরীনকে বিয়ে করতে গিয়ে সে যে রবির সঙ্গে মিথ্যাচার করেছে, সুজাতার সেই জ্বালাটুকুও রবি বোঝে না? সহসা ভয় ফুটে উঠল সুজাতার চোখে। এ পৃথিবীতে ওর ফাঁকির জ্বালাটা বুঝি কেউ কোনওদিন বুঝবে না। বড় একাকী মনে হচ্ছে নিজেকে। এই ভরা বাড়ির নিঃসঙ্গতা থেকে পালাতে ইচ্ছে করছে।

কিন্তু উপায় নেই। সারা বাড়িতে তখন কলরব উঠছে ভোজনের।

.

১৪.

সুজাতার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মনে হল রবির–এত দিনে বোধ হয় সাঙ্গ হল এ বাড়িতে যাওয়া আসার পালা। শুধু সুজাতার জন্যেই আসেনি এত দিন, লোক ছিল এ বাড়িতে আরও। কিন্তু নিজের মনের কাছে তো কোনও ফাঁকি নেই, যত দূরে থাক, আর এক জনের অস্তিত্বকে অনুভব করেছে। সর্বক্ষণ। মনে হল, সেই আর একজনই আজ যেন পিছনে পিছনে এসে দেখিয়ে দিয়েছে বেরিয়ে যাবার দরজাটা।

কিন্তু যাওয়ার উপায় ছিল না। যাদের সঙ্গে এসেছে, তাদের ছেড়ে গেলে অকারণ কিছু কৌতূহল রেখে যেতে হবে। নিজেকে অনেকখানি সামলাবার চেষ্টা করে ঢুকল খাবার ঘরে। সেখানে তখন আসর ভাঙবার সময় হয়েছে।

সুমিতার সঙ্গে প্রথম চোখাচোখি হল রবিদার। ও নিজেও তখন মেতে গেছে গাছকোমর বেঁধে।

এদিকে সেই তর্কটা তলে তলে অনেকখানি বেড়ে উঠেছে রাজেনের সঙ্গে মৃণাল-আশীষের। যত বারই ওই কথাটা উঠতে যাচ্ছে, বাধা দিচ্ছে সুগতা, আবার তোমাদের ওই কথা?

খাবার টেবিলেরই এক পাশে বসেছিলেন মহীতোষ। তিনিও ফিরে তাকালেন রবির দিকে। বললেন, এসো রবি।

খাবার টেবিলের সঙ্গে আর একটি টেবিল জুড়ে দেওয়া হয়েছে। জায়গা রয়েছে অনেকখানি। সুমিতা নিজে একখানি চেয়ার এগিয়ে দিল রবিকে।

সুমিতার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটি কথা মনে পড়ে গেল রবির। কোর্টে দাঁড়িয়ে বলেছিল সুমিতা, গিরীনদা যদি হাত ধরে নিয়ে যান বড়দিকে, তবে বেশ হয়। রবি বলেছিল, ঠিক বলেছ রুমনো, এর চেয়ে ভাল আর কিছু হয় না। মনে তো হয় না, কথাটি নিতান্তই ছলনা করে বলেছিল সুমিতাকে।

ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক শূন্য চোখ ফেরাতে ভুলে গেল সুমিতার উপর থেকে।

 নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল সুমিতা, আমাকে কিছু বলছেন রবিদা?

রবি চমকে উঠে বলল, অ্যাঁ? পরমুহূর্তে ওর সেই স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলল, হ্যাঁ বলছি, আমাকেও খেতে দাও।

এইটুকুই আন্দাজ করেছিল সুমিতা। এমনি একটু সব-ভোলানো হাসি হেসে উঠবেন উনি। এ ছাড়া ওঁর উপায় নেই।

অনেক কথা, অনেক হাসির কলরোলে শেষ হল খাওয়া। বিনয় আর হিরন্ময় এক বারও চোখ ফেরাতে পারেনি সুমিতার উপর থেকে। মাঝে মাঝে আশীষ। আশীষের চাউনিতে সেই কী এক অর্থপূর্ণ অথচ অস্পষ্ট কথা। কী যেন বলছে ওকে আশীষ। যদিও শোনা যায় না, তবু সর্বাঙ্গ কেন যেন শিউরে ওঠে সুমিতার। আর কখনও সখনও বিদ্যুৎ-বিস্মিত চোখ পড়েছে রাজেনের। কিন্তু মৃণাল বারে, বারেই দেখছে কেবলি সুগতাকে। লক্ষ করে দেখেছে সুমিতা, মেজদি মৃণালের দিকে তাকিয়েই চকিত গম্ভীর মুখ ফিরিয়ে একবার দেখে নিচ্ছে রাজেনকে।

সবাই যখন বেরিয়ে পড়েছে, তখন মহীতোষ ডাকলেন রবিদাকে। মেজদি চলে গেল বাথরুমে হাত-মুখ ধুতে। বাইরের ঘর থেকে চলে আসতে গিয়ে সুমিতা দাঁড়িয়ে পড়ল দরজার পাশে।

ঘরের ভিতর মহীতোষ বললেন, কিছু বলেছিলে নাকি?

 রবিদার গলা শুনতে পেল, বলেছিলুম।

মহীতোষরাজি হয়েছে টাকাটা নিতে?

চকিতে ভেসে উঠল সুমিতার চোখে গিরীনদার চেকটা। রবিদা বললেন, ঠিক বুঝতে পারিনি।

পায়ের শব্দে বুঝতে পারল সুমিতা, রবিদা চলে যাচ্ছেন। বললেন, আচ্ছা আমি এখন চলি।

 মহীতোষ অসহায় বিস্ময়ে বললেন, তুমি কি রাগ করেছ রবি?

রবিদা বললেন, না না। তবে আমি বলাতে বোধ হয় উমনো অপমান বোধ করেছে। আমার বলাটা ঠিক হয়নি।

 মহীতোষ–আমিই তোমাকে বলতে বলেছিলুম রবি।

রবিদা–তাতে আপনার দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই কাকাবাবু। আমার নিজের দিক থেকেও একেবারে অনিচ্ছা ছিল না। কিন্তু আমরা দুজনেই বোধ হয় ভুল বুঝেছিলুম, তবে

তবে?

কাকাবাবু, আমার মনে হয় সবটাই ঘটেছে বোধ হয় একটা রেষারেষির বশে। তারই একটা পালটা রিঅ্যাকশন হয়েছে উমনোর। ওর নিজের মনেই হয়তো অনেক সংশয় রয়েছে। জানে না, কী চায়।

মহীতোষ বললেন, এইটাই সবচেয়ে সাংঘাতিক রবি। এই চাওয়া না চাওয়ার ধাঁধা মানুষকে তার অজান্তে বড় বিপদের পথে টেনে নিয়ে যায়।

খানিকক্ষণ চুপচাপ। রবিদা আবার বললেন, চলি আমি।

সরে গেল সুমিতা। রাগ না হোক, কিছু একটা হয়েছে রবিদার। এমন নির্বিকার শুকনো গলায় কোনওদিন বিদায় নেননি।

বড়দির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, ঘর অন্ধকার। শুধু পাখার বাতাসে একটানা যান্ত্রিক শব্দ আবর্তিত হচ্ছে। সুমিতা ডাকল, বড়দি।

–কী।

–খাবে এসো।

জবাব এল, তোরা খা। আমার খিদে নেই।

ঘরের পরদা ধরে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল সুমিতা। কাছে গিয়ে আর কিছু বলতে ভরসা হল না।

বড়দি খাবে না শুনে, এক মুহূর্ত ক্ৰ কুঁচকে নির্বাক হয়ে রইল সুগতা। তারপর খেতে চলে গেল। কিন্তু ঠোঁটের কোণে কেমন একটি কঠিন বিরক্তির দাগ রইল লেগে।

রাত্রে শুয়ে সুমিতার কেবলি মনে হতে লাগল, সন্ধ্যাবেলার সেই ঝড়টা যেন এখনও দাপাদাপি করছে ঘরের বাইরে। এখনও যেন বাড়িময় অনেক, অনেক কোলাহল। তার মধ্যে ও উৎকর্ণ হয়ে রইল। যদি মেজদি কিছু বলে। কিন্তু সুগতার দিক থেকে কোনও সাড়া শব্দ এল না।

 সকালবেলা সুমিতা পায়ে পায়ে নেমে এল বাগানে। অধিকাংশ ফুলগাছগুলি মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটিতে। পাতা ঝরেছে, ডালপালা ভেঙেছে। মহীতোষ বাগানে এসে লেগেছেন গাছের পরিচর্যায়।

সুমিতার সদ্য বিছানা-ছাড়া মূর্তি দেখে মহীতোষ একটু অবাক হলেন। বললেন, কী খবর রুমনো সাহেবা। সকালবেলাই এদিকে যে?

সুমিতা বলল, এমনি।

বলে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল গাছগুলির দুরবস্থা। মহীতোষ কঞ্চি বেঁধে দোমড়ানো গাছ খাড়া করছিলেন। তারপর, সুমিতা যে এমনি আসেনি, সেটা বোঝা গেল, ও যখন ঝপ করে এসে বসে পড়ল মহীতোষের কাছে।

কী হয়েছে রুমনো।

 শুধু লজ্জা নয়, একটু বোধ হয় শঙ্কাও ছিল সুমিতার মনে। তবু বলল, বাবা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

 অবাক হয়ে বললেন মহীতোষ, নিশ্চয়ই করবে! কী কথা বলো তো? সুমিতা বলল, কাল তুমি মিত্ৰসাহেবকে কীসের অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের কথা বলছিলে?

মহীতোষ হঠাৎ অন্যমনস্কের মতো কঞ্চি বাঁধতে বাঁধতে বললেন, ও সে কথা তোমার কানে গেছে ঠিক।

হ্যাঁ। তোমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন উনি মিউনিসিপ্যাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের কাজের কথা।

মহীতোষ তখন একটি গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কোনও জবাব দিলেন না।

সুমিতা ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। আবার ডাকল কিছুটা ভয়ে ভয়ে, বাবা।

 মহীতোষ বললেন, হুঁ।

আবার কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। তারপর বললেন মহীতোষ, রুমনো সাহেবা, এখন তুমি বড় হয়েছ, তোমাকে সব কথাই বলা যায়। আমি একটা চাকরি পেয়েছি।

চাকরি! বাবার দিকে ভাল করে তাকাল সুমিতা। সহসা মনে হল, বাবার মাথার চুলগুলি অনেক বেশি সাদা হয়ে উঠেছে এর মধ্যে। সারা মুখে বার্ধক্যের রেখা পড়েছে আরও ঘিঞ্জি হয়ে। প্রসন্ন ক্লান্তির বদলে অসহায় ত্রস্ততা উঠেছে ফুটে চোখের গভীর পরিখার ওপারে।

সুমিতার বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল বাবার কথা শুনে। বলল, তোমার আবার কীসের চাকরি বাবা? তুমি রিটায়ার্ড ম্যান।

মহীতোষ তখনও চোখ না তুলেই বললেন, রিটায়ার্ড মানুষও চাকরি করতে পারে রুমনো সাহেবা। আমি চেয়েছিলুম এই কাজটা। মিত্রসাহেবও চেষ্টা করেছিলেন আমার জন্যে।

সুমিতা নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে ওর। কিন্তু বাবাকে নিরুৎসুক দেখে, মুখ খুলতে পারছে না। ও জানত, মহীতোষ তাঁর কর্মজীবন শেষ করেছেন। যত দিন বাঁচবেন তত দিন ভোগ করে যাবেন পেনশন।

হঠাৎ মহীতোষ নিজেই ফিরলেন সুমিতার দিকে। ঘরের দিকে এক বার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, রুমনো, তোমার যখন এতই শুনতে ইচ্ছে হয়েছে তখন বলি। এ বাড়িটা ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারিনি। পেনশনের টাকাটা সবই খরচ হয়ে যায় মাসে মাসে। ভেবেছিলুম, তোমাদের বিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে যাব। এভাবেই চলে যাবে আমার জীবন। কিন্তু যা ভাবা যায়, তা হয় না রুমনো সাহেবা। আমাকে আরও কিছু করতে হবে।

সুমিতা বলল, কেন, তুমি যা ভেবেছিলে, তাই তো হচ্ছে।

–কোথায়? কোথায় তা হল? তোমার বড়দির দিকে তাকিয়ে দেখ। তোমার আর ঝুমনোর কী হবে এখনও জানিনে। কিন্তু আমি যদি এই অবস্থায় মরি, তোমার বড়দির কী হবে? তখন তো পেনশনের টাকা থাকবে না।

কথাগুলি শুনতে শুনতে টনটন করে উঠল সুমিতার বুকের মধ্যে। মহীতোষের দিকে সোজাসুজি চোখ তুলে তাকাতে পারল না। বুঝতে পারল, কী নিদারুণ দুশ্চিন্তায় ভুগছেন বাবা। শুধু দুশ্চিন্তা নয়, কণ্ঠস্বরে মনে হল, কোথায় একটি গভীর ক্ষত রয়েছে অভিমানের।

কিছু বলতে পারল না সুমিতা। নরম মাটিতে আঙুল দিয়ে আঁক কাটতে লাগল।

 ইতিমধ্যে রোদ উঠেছে কিছুটা। উঠতে না উঠতেই তাত ফুটেছে রোদে।

সুমিতা বলল, কিন্তু, তুমি আমাদের লেখাপড়া শেখাচ্ছ, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব।

মহীতোষ বললেন, তা হয়তো পারবে। তবু তোমরা আমার মেয়ে। আমি এত সহজে নিশ্চিন্ত হব কেমন করে? ছেলে হলেও নিশ্চিন্ত হতে পারতুম না। আমি চেয়েছিলুম, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তোমরা সসম্মানে থাকবে।

সুমিতার ঠোঁটের আগে ছুটে এল কথা। কিন্তু দ্বিধা হল বলতে। তবু না বলে পারল না, চাকরি করলে কি সমাজে প্রতিষ্ঠা হয় না বাবা?

মহীতোষ চোখ তুলে তাকালেন সুমিতার দিকে। কেমন একটু বিস্মিত অনুসন্ধিৎসা ছিল সেই দৃষ্টিতে। সুমিতা আরক্ত হয়ে উঠল।

মহীতোষ বললেন, হয় বইকী। কিন্তু তাতে আমার তো কোনও সান্ত্বনা নেই। সেইজন্যে আমার সান্ত্বনা আমাকে খুঁজতে হচ্ছে।

অস্পষ্ট হলেও, অনেক কথা মনে হতে লাগল সুমিতার। বলতে ইচ্ছে করল অনেক কথা। কিন্তু এখন সে সব কথা বাবার সামনে বলতে সংকোচ হল ওর। এই সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে তিন মেয়ের কারুরই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি মহীতোষ। করবেন না কোনওদিন। কিন্তু যা বিশ্বাস করেন, তা বলতে দ্বিধা নেই। তা করতেও পেছপা হবেন না। যত বড় বেদনার হোক এটা সুমিতার কাছে, নিজের বিশ্বাস ও সম্মানের জন্যে সে বেদনাই স্বীকার করে নিয়েছেন বাবা নিজে।

তবুও শত দুর্বলতার মধ্যে, সায়াহ্নের সেই একাকী মানুষটির জন্যে সুমিতার বুকে নিঃশব্দে গুমরে উঠল কান্না। বলল, কিন্তু বাবা, আমার বড় ভয় করছে। কী করে তুমি পারবে?

মহীতোষ আবার মনোযোগ দিয়েছেন গাছের দিকে। হেসে বললেন, পারব রে রুমনো সাহেবা, পারব। তুই দেখছি তোর মায়ের স্বভাব পেয়েছিস। সব বিষয়ে তুই ঘেঁকে ধরবি।

সুমিতা বলল, তবে, তুমি বড়দি মেজদির সঙ্গে আগে এ বিষয়ে একটু আলোচনা করে নাও।

মহীতোষ সন্ত্রস্ত হয়ে ফিরে বললেন, না না, এখন ও সব কথা তোমার দিদিদের বলতে যেয়ো না। যখন বলবার, তখন আমিই বলব। আজ আমার জয়েনিং ডেট। বিলাসকে বলে রেখেছিলুম রান্নার কথা। তুমি বরং ওদিকে একবার দেখো। চা একটু তাড়াতাড়ি দিতে বলল।

সুমিতা দিদিদের বলাটাই সবচেয়ে সমীচীন বোধ করছিল। কেননা, যদি বিশেষভাবে বাবাকে বাধা দিতে হয়, তবে তারাই তা পারবে। যদিও, সে বিষয়েও অনেক সংশয় আছে সুমিতার। বলল, আজকেই যেতে হবে?

–হ্যাঁ।

–কোথায় সেটা?

কলকাতার বাইরে, মাইল দশেক। আমাকে ট্রেনে যেতে হবে।

যেতে গিয়ে শঙ্কিত মুখে ফিরে দাঁড়াল সুমিতা। বলল, কলকাতার বাইরে? বালিগঞ্জ স্টেশন দিয়ে যাবে?

–না। শিয়ালদহ দিয়ে।

সুমিতা সভয়ে বলে উঠল, কী বলছ তুমি বাবা? কী করে তুমি পারবে রোজ রোজ যেতে?

গম্ভীরভাবে হাসলেন তেমনি মহীতোষ। ভাঙা ডাল খাড়া করতে করতে বললেন, যেমন করে সব মানুষ পারে। অত ভয় পেয়ো না।

বলে মুখ ফেরালেন। কিন্তু সুমিতার সারা মন জুড়ে এক সভয় কান্না রইল থমকে। বাবার এই স্থির অবিচলতার মধ্যেও যেন এক গূঢ় অশান্তিকে দেখল পিলপিল করে এগিয়ে আসতে। বাবা যখন শান্ত হয়ে কথা বলেন, তখন আর কথা চলে না তার উপরে। মনে হল, বাবার এই অবিচল কাঠিন্যটাই আর এক রূপে দেখেছে বড়দির মধ্যে।

.

১৫.

অকূলে ভাসল সুমিতার মন। তবু কোনও কূলকিনারা পেল না ও ভেবে। মেজদির ভাষায় যাকে বলে ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট, এ বাড়ির সেই দুর্জয় ফ্রন্টে ভাঙন ধরেছে বড় রকমের।

তিন দিন ধরে প্রত্যহ একই সময়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন মহীতোষ। একই সময়ে প্যান্ট কোট পরে, টাই বেঁধে, টুপি মাথায় দিয়ে। বহু দিনের পুরনো একটি অস্পষ্ট ছায়া ভেসে উঠেছিল সুমিতার চোখে। সে ওর শৈশবে-দেখা, জুজু মূর্তি মহীতোষ। টাই-টুপি-পোশাক ছিল ওর চোখে জুজুর বেশ। বাবার সেই চাকুরে জীবনের পুরনো মূর্তিটা, স্পষ্ট করে দেখা হল সুমিতার। বহু দিন এত ফিটফাট হয়ে কেউ বেরুতে দেখেনি ওঁকে। স্পষ্ট করে দেখা হল বটে, কিন্তু শৈশবে দেখা তেমনটি আর নেই। তার একটি ছায়ামাত্র। প্রথম দিন মেজদি বলেছিল অবাক হয়ে, এ কী! কোথায় চলেছ এভাবে?

বাবা বোধ হয় সেই পুরনো দিনের মতো মেয়েকে খুশি করার জন্যে একটু হেসেছিলেন ক্র তুলে। যেন বলতে চেয়েছিলেন, কোথায় বলো তো ঝুমনো? কিন্তু হেসে উঠে মুখ ঘুরিয়ে বলেছিলেন বাবা, আবার ডাক পড়েছে পুরনো জায়গায়। সরকারি নথিপত্রের ব্যাপার তো। হয়তো কোনও গণ্ডগোল হয়েছে, তাই ডেকেছে।

মেজদি একটু অবাক হলেও বোধ হয় বিশ্বাস করেছিল। অবাক হওয়ার কারণটা আর কিছু নয়। কথাটি আগে থাকতে না বলার ব্যতিক্রমটাই বিস্ময়ের। বলেছিল, কই, তুমি তো কিছুই বলোনি।

মহীতোষ মুখ না ফিরিয়েই বলেছিলেন, সময় পেলুম কোথায়? কালকেই তো সংবাদ এল। তবু মেজদির বিস্ময়ের সর্পিল জ্বলতা সরল হল না। কাল না হোক, আজ সকালেও সময় ছিল। এমনিভাবে জিজ্ঞেস না করলে, হয়তো শোনাই হত না ব্যাপারটা।

সুগতা ফিরে তাকিয়েছিল সুমিতার দিকে। এই ভয় করেছিল সুমিতা। হয়তো ওর মুখ থেকেই স্পষ্টাক্ষরে সবটুকু পড়ে নেবে মেজদি। সামান্য অছিলা করে সরে গিয়েছিল ও সামনে থেকে।

কিন্তু আসল লোক মহীতোষ নিজে এত নির্বিকার! সুগতা বিশ্বাস করেছিল মহীতোষকে, কিন্তু ওঁর এই অনাসক্ত ব্যবহারের জন্য মনে মনে দায়ি করেছিল সুজাতাকে।

মহীতোষ বোধ হয় আরও একজনকে আশা করেছিলেন। আর একজন কাছে এসে জিজ্ঞেস করবে, কোথায় চলেছ এভাবে। কিন্তু সুজাতা আসেনি।

ওরা তিন বোন না থাকলে মহীতোষের কাছে যেমন সারা বাড়িটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, ওদের তিন বোনেরও তেমনি, মহীতোষ না থাকলে মনে হয়, বাড়িটার কোথায় কী ঘটে গেছে।

 মহীতোষ বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তিন বোন দাঁড়িয়েছিল তিন জায়গায়। কেউ কাউকে দেখতে পায়নি। কিন্তু মনের তলায় পাক খাচ্ছিল বোধ হয় এক জায়গাতেই। তিনদিন হল, আরও অনেক তিনদিন গেল। সুমিতা দেখল, একটি ছলনার জাল চারদিক থেকে গ্রাস করছে সারাটি বাড়ি। মহীতোষের এ নিয়মিত যাওয়া আসা নিয়ে, কেউ কথা বলতে পারল না মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

শুধু দুজন জিজ্ঞেস করেছে। তাও সুমিতাকে। ঝি অচলা আর বিলাস। বলেছে, ছোট দিদিমণি, সাহেব কি আবার চাকরি করতে যাচ্ছেন?

ঝি-চাকরের এ কৌতূহলটা এ বাড়িতে শোভন নয়। তবু এরা পুরনো মানুষ। ওদের টনক নড়েছে। না জিজ্ঞেস করে পারেনি। সুমিতার কাছেও কোনও অশোভন মনে হয়নি। বলেছে, হ্যাঁ।

চোখখাচোখি করেছে অচলা আর বিলাস। ভাবখানা, কী জানি, বড়লোকের কথাই আলাদা। তবু ঝি অচলা এক বার টেনে বলেছে, এই বয়সে আবার…।

সেই যে গেছেন রবিদা আর আসেননি এ বাড়িতে। মহীতোষ এসে রোজই জিজ্ঞেস করেন, রবি এসেছিল। জবাব দিতে হয় সুমিতাকেই। একই জবাব। ও যেখানেই বেরুক, মহীতোষ আসবার আগে ঠিক উপস্থিত হবে বাড়িতে। কেননা, ঠিক ওই সময়েই বাড়িটা থাকে একেবারে ফাঁকা। বড়দি মেজদি থাকে না। সেই একঘেয়ে মিত্ৰসাহেবের ঘ্যানঘ্যানানি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তি নিয়ে ভীরু বিক্ষোভে প্যানপ্যান করেন; আমি আপনাকে বলে রাখছি মিঃ ব্যানার্জি, এই সালটা একটা ভয়ংকর দুর্ভাগ্যের বৎসর।

 রবিদা আসেন না। বড়দির সম্পর্কে মেজদি এত নিরুৎসুক অনাসক্ত ভাব দেখায়, যেন দুজনে বিদেশ থেকে এসে কোনও হোটেলের ঘরে বাস করছে পাশাপাশি। দুটি কথা, একটু হাসি, খেতে বসে সামান্য বাইরের আলোচনা। কিন্তু এত প্রাণহীন, নিরাসক্ত যে, তার চেয়ে দুজনে চুপ করে থাকলে মানায় অনেক বেশি।

ছলনা, ছলনা, শুধু ছলনা। কাকে যে দায়ি করবে, দোষ দেবে, ভেবে পায় না সুমিতা। কারুর উপরেই রাগ করতে পারছে না। বড়দি, মেজদি, বাবা, কারুর প্রতি রুষ্ট হতে পারছে না। নিজেকে আর সেই ভীরু অশিক্ষিত লতাটির মতো লুকিয়ে রাখতে মন চায় না। ইচ্ছে হয় সোজাসুজি কথা বলে এদের এই অসহজের সহজ গতিটা ভেঙে চুরমার করে। কিন্তু তাতেও ভয়। যদি নতুন কোনও সংকট এসে পড়ে এর ওপরে।

ওর পরীক্ষার ফল বেরুবার দিন আসছে ঘনিয়ে। বাড়ির এ আড়ষ্ট আবহাওয়ার মধ্যে সেই দিনটির প্রতীক্ষা করছে সুমিতা। আর যা-ই হোক, তবু একটা কিছু নিয়ে থাকা যাবে।

এর মধ্যে, মনের এই অকূলে, কখনও কখনও আচমকা ঝড় বইয়ে দিয়ে যায় তাপসী। বিপথগামী করে দিয়ে যায় সব ভাবনাকে। এত স্পষ্ট ইঙ্গিত ছড়ানো তাপসীর কথা! সারা শরীরে, রক্তে রক্তে এক আশ্চর্য দোলা দিয়ে যায়। কখনও কখনও ভয়ংকর অশ্লীল মনে হয়। যখন তাপসী ওর দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলে, তোকে দেখলে মনে হয়, তুই ভাই ডুবে ডুবে জল খাস।

সুমিতা ভীরু বিস্ময়ে চমকে উঠে বলে, কেন?

কোনও তীক্ষ্ণতা নেই তাপসীর। বরং বড় স্থূলভাবে হেসে বলে, তোর ঠোঁট দুটো দেখে মনে হয়, এর মধ্যেই…

পায়ের তলা থেকে একটা তুহিন-ঠাণ্ডা সাপ যেন সুমিতার মাথায় বেয়ে উঠে কিলবিল করে। বুকের মধ্যে বাজে ড্রাম। বলে, মানে?

তাপসী বলে চোখ ঘুরিয়ে, আহা, যেন কিছু বুঝিসনে। তোকে কেউ কখনও

 কথা শেষের আগেই সুমিতা চাপা গলায় ওঠে চিৎকার করে, যাঃ। 

–কেউ নয়? বিনয়, হিরন্ময়, আশীষ…

–ছি ছি, কী যা তা বলছিস!

আরক্ত মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে সুমিতার। তাপসী বলে, রাগ করলি?

–তুই বড় বাজে বকিস, ভাই।

তাপসী বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হবে।

কেমন একটু ঠোঁট কুঁচকে, চোখ পিট পিট করে হেসে ওঠে তাপসী। হাসি পায় সুমিতার। হাসে দুজনেই। তারপর সুমিতার ভিতর থেকে শামুকের গুঁড়ের মতো পিল পিল করে বেরিয়ে আসে বিস্মিত কৌতূহল। বলে, আচ্ছা, তোর…?

তাপসী যেন হাসবার জন্যেই বুকের কাপড় এলো করে হাত তুলে বলে, হান্ড্রেড টাইমস।

সুমিতা বলে বিস্মিত লজ্জায়, যাঃ। কী করে?

তাপসী বলে ঠোঁট উলটে, এর মধ্যে তিন বার প্রেমে পড়েছি জানিস?

–এর মধ্যে তিন বার?

 –হ্যাঁ। বারো বছরে আমার এক মাসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে…

 নিদারুণ লজ্জার মধ্যেও হেসে লুটিয়ে পড়ে সুমিতা। বারো বছরে?

-হ্যাঁ। তারপর ষোলো বছর বয়সে দাদার এক বন্ধুর সঙ্গে। আঠারো বছরে এক দূরসম্পর্কের মামার সঙ্গে। অবশ্য তারা সকলেই খুব কেউকেটা সাহেব মানুষ। এক বছর আর ওসব নেই।

হাসতে গিয়েও কনকনে বরফের মতো বুক জমে ওঠে সুমিতার। কোনও ছেলেকে দেখে হঠাৎ কয়েক মুহূর্ত ভাল লাগার অনুভূতি ছাড়া, এ বিষয়ে কোনও অভিজ্ঞতা নেই ওর জীবনে। ভীত বিস্ময়ে অপলক চেয়ে থাকে তাপসীর দিকে।

তারপর বলে, তোদের বাড়ির লোকে জানে না?

জানলে তো লক আপ।

 এমন বলার ভঙ্গি তাপসীর, বুকের হাজারো ধুকপুকনির মধ্যে পারা যায় না, না-হেসে। বলে, আর

বিয়ে?

–সে তো বাবা মা দেবে। এই তো আজ দেখাদেখি আছে।

কী রকম? তোকে দেখতে আসবে?

–ধুস! আজকাল আবার দেখতে আসাআসি আছে নাকি? তা হলে সমাজে কান পাতা দায় হবে না?

তবে?

-ও সব অনেক ব্যাপার। আমি যাচ্ছি দাদার এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে। যেন আমি কিছুই জানিনে। মা বলে দিয়েছে, এইভাবে যাবে সেজেগুজে, মোটেই বাঁচালতা করবে না। তোমার দাদার বন্ধু নরেশ জানে তুমি কেন যাচ্ছ। নরেশের এক বন্ধু আসবে আজ সেখানে বেড়াতে। ছেলেটি বড় চাকুরে। এখনও অবিশ্যি কিছুই জানে না ছেলেটি। নরেশ তোমাকে আলাপ করিয়ে দেবে। দেখো যেন যা তা কিছু বলে বসো না। ঠিক ঠিক বুঝে আলাপ করবে। তারপর ওখান থেকে সোজা বাড়ি আসবে।

প্রায় ডেপুটি-গিন্নির মতো ক্ৰ কুঁচকে, এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তাপসী সুমিতার দিকে। তারপর চোখের একটি বিচিত্র ভঙ্গি করে বলল, বুঝলে ম্যাডাম। একে বলে দেখাদেখি।

সুমিতা বলল, তারপর?

-তারপর? যদি ও পক্ষের মন মজে, তবে আমার অনুপস্থিতিতে নরেশদাকে নিশ্চয় জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তারপর মাছি মাকড়সার জালে আসবে ধীরে ধীরে।

কিন্তু যদি তোর ভাল না লাগে?

বয়ে গেল। আমাকে ঠিক করে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে, চা এগিয়ে দিতে হবে, বাড়ি থেকে পারমিশন দিলে সিনেমা থিয়েটারেও যেতে হবে। আর তখন সে ঠোঁট কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে জিজ্ঞেস করবে, আমাকে বিয়ে করতে তোমার কোনও আপত্তি নেই তো তাপসী?

শুনতে শুনতে রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠেছিল সুমিতা। সমাজের এ সত্যটা জানাজানি সত্ত্বেও এমন করে কোনওদিন যেন ওকে টুটি চেপে ধরেনি। শিবানীর কথা মনে পড়ে সুমিতার। একই গোত্রের যেন, তবু কত তফাত। প্রায় চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করে, তখন তুই কী বলবি?

–আমি? তাপসী বলে, ওর বাসি রং-মাখা ঠোঁট দুটি বাঁকিয়ে, বলার আগে আমি ভাবব, মা বাবা কী বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, ছেলেটি ভাল, বড় চাকুরে। শুনেছি, ওদের কোম্পানি ওকে বিলেত পাঠাবে। সকলের নজর রয়েছে ওই ছেলের দিকে। ওকে কোনওরকমে হাতছাড়া করা যাবে না। দেখো, দুটো-চারটে বাজে কথা বলে ছেলেটিকে ভাগিও না যেন। তা হলে তোমারই দুর্গতি হবে। ব্যাস। আর তো আমার ভাবাভাবির কিছু নেই। আমি খালি কোনওরকমে এক বার ঘাড় কাত করে দেব। আর সে অমনি হাতটি ধরবে চেপে। এমনি করে।

বলে খপ করে চেপে ধরে সুমিতার হাত। আচমকা ভয়ের বিদ্যুৎচমক লাগে সুমিতার বুকে। তাপসী হাসে খিলখিল করে। এমনভাবে বলে সবটুকু, যেন এ ঘটনা আগেও ঘটে গেছে ওর জীবনে।

সুমিতা ভীরু বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে তাপসীকে। শ্যামাঙ্গিনীও বলা যাবে না তাপসীকে। কালো মেয়ে, চোখ মুখও এমন কিছু বলার মতো নয়। কিন্তু ওর খোঁপায়, চোখে মুখে নিয়ত কীসের এক চাপা হাসি ও অনুসন্ধিৎসা, চলা-ফেরার ভঙ্গিতে, কাপড় পরার ধরনে, সব মিলিয়ে এমন কিছু একটা বয়ে বেড়ায়, সবাই এক বার ভুলেও তাকাবে ওর দিকে। কিন্তু সেটুকু সবই বাইরে থেকে ধরে রেখেছে। তাপসী। নিজের বলতে অতি সাধারণ কালো মেয়ে ছাড়া ও আর কিছু নয়।

 আর যেটুকু আছে, সেটুকু মনে হয়, একটি বিচিত্র জ্বালা। ওর ওই বহিরঙ্গনের ভঙ্গিটার মধ্যে জ্বালাটুকুই যেন বয়ে বেড়াচ্ছে অভিশাপের মতো। যত ভয় থাক, বিস্ময় থাক সুমিতার মনে, ও রাগ করতে পারে না তাপসীর উপর। বরং ওর এই দুর্বিনীত হাসি ও কথার ভিতর দিয়ে কেমন করে যেন মন কাড়ে। মনের কোথায় একটু বাষ্প জমিয়ে দেয় ওর হাসির উত্তাপের মাঝে।

সুমিতা বলে, আর যদি ছেলেটার পছন্দ না হয়?

তা হলে সে কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। বরং নরেশদাকেই ভাবে ভঙ্গিতে তখন আমাদের হয়ে অ্যাপ্রোচ করতে হবে। আর সেই ছেলেটা কাঁড়ি কাঁড়ি মিছে কথা বলে পালিয়ে বাঁচবে! ভাববে বাবা! খুব কড়া ট্র্যাপ থেকে বেঁচে গেছি, একটা কালিন্দী মেয়ে আর একটু হলেই ঘাড়ে চাপছিল আর কী!

বলে চোখ পাকায় তাপসী, তোর অত দুর্ভাবনা কীসের? তুই তো ডজন ডজন ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। পুরো ফ্রিডম।

কিন্তু সুমিতা তখনও ছাড়ে না। বলে, কিন্তু তোর লেখাপড়া?

কম্পার্টমেন্টাল দিয়ে তো ম্যাট্রিক পাশ করেছিলুম, তাও এক বার ফেল করে। এবারও গাব্দুস নির্ঘাৎ। ও সব আমার দ্বারা হবেও না কোনওকালে। যা হবে, তাই করে বেড়াচ্ছি।

 বলে আবার হাসে চোখ টিপে। তারপর আরম্ভ করে ওর প্রেমকাহিনী বলতে। ওর সেই দূর সম্পর্কের মামা, দাদার বন্ধু, আর মাসতুতো ভাই। তারপর সুমিতার গাল টিপে দিয়ে বলে, শুধু তুই ভাজার মাছটি উলটে খেতে জানিসনে। সত্যি, কত ন্যাকামোই যে জানিস।

আরও কত কথা যে বলে তাপসী। যে কথাগুলি, কখনও ভয়ে কখনও ঘৃণায় শিহরন তোলে গায়ের মধ্যে। কিন্তু কখনও কখনও সেই কথা তোলপাড় করে সুমিতার রক্তে। ওর অকুলে হারানো মনের মাঝে কী এক বিচিত্র অর্থহীন ঝড় তুলে দিয়ে যায়।

তখন এই আড়ষ্ট বাড়িটার পরিবেশ ছেড়ে সুমিতা বাসে চেপে ছোটে কলেজ স্ট্রিটের দিকে। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে আসতে আসতেই ঝড় অনেকখানি প্রশমিত হয় আপনা আপনি। বৌবাজারের মোড়ে এসে ওকে নামতে হয় সভয়ে। কোথায় চলেছে ও, কার কাছে চলেছে। মিথ্যে নয়, ওই তল্লাটে, অনেকগুলি আচ্ছা আছে, অনেকে আছে আশেপাশে ছড়িয়ে নানান জায়গায়। যাদের কথা তাপসী বলে বারে বারে। কিন্তু ও এসেছে ছুটে কার কাছে? কোন আসরে! এখানে রেডিয়ো ঘ্যানঘ্যান, ওখানে ট্রামের ঠং ঠং। চৌরাস্তার ভিড়ে, আরক্ত মুখে লুকিয়ে বাঁচে না নিজেকে। তাড়াতাড়ি অন্য ফুটে গিয়ে ধরে উলটোপথের গাড়ি।

 বাড়ি এসে হঠাৎ অর্থহীন বোধ হতে থাকে সমস্তটা। ও যে বাড়ির ছোট মেয়ে রুমনি, তারও সহসা বড়দির মতো মনে হয়, জীবনটার চারদিকে কী এক কষ্টকর বেড়া রয়েছে ঘিরে। যেখানে বারবার প্রশ্ন করেও কোনও জবাব পাওয়া যায় না। এখন বড় ভয় হয় সুমিতার। ভয় হয়, জীবনের কোন এক অনির্দিষ্ট অন্ধকারে নিজেও যাবে হারিয়ে।

ও এখন মেজদির কলেজের পুরনো বইগুলি নিয়ে পড়ে। ওকে অনার্স নিতে হবে, বি এ-তে। লেখাপড়া করতে হবে অনেকখানি।

তারপর বাবা আসেন। ওঁর সান্নিধ্যে এসে, শত বিষণ্ণ আড়ষ্টতার মধ্যেও আবার নিজেকে ফিরে পায়। ভয় করে, আবার না আসে তাপসী। ও এসেই যেন কী একটা কলকাটি দিয়ে যায় নেড়ে। আর অভিমান হয় রবিদার উপর। ভাবে, যাবে এক বার রবিদার বাড়িতে। কিন্তু বাড়ির লোকগুলির কথা মনে হলেই সভয়ে পেছিয়ে আসে মনে মনে। রবিদার সঙ্গে বাড়িটার কী অসম্ভব তফাত!

তবু এল তাপসী, বেলা তিনটের ঝোঁকে। কী যে হুড়ে মেয়ে। এসে গায়ে পড়বে, ধামসাবে।

আজ এসে বলল, পরীক্ষা দিয়ে এসেছি। ফেল না পাশ, বুঝতে পারিনি। নেহাত গোবেচারি। প্রেমের কিছুই বোঝে না।

তারপর এ কথা সে কথার পর হঠাৎ বলল, আর প্রেমের দাম কী বা আছে। চারদিকে দেখতে পাচ্ছি সব একই ব্যাপার।

কী রকম?

–কী রকম আবার। ছেলেটির বাপের টাকা আছে, ছেলেটিও সাতশো টাকা মাইনেয় নাকি চাকরি করে, সসাসাইটিতে ওদের প্রেস্টিজ আছে। আর কী চাই। প্রেম করতে পার যার সঙ্গে খুশি, বিয়ে এখানেই করতে হবে।

–কিন্তু, তারপর?

–তারপর যত খুশি প্রেম। ইচ্ছে না করলেও প্রেম, প্রেম আর প্রেম। তারপরে বুড়ি হয়ে যাব, সব জুড়িয়ে যাবে।

 এ প্রেমের কোনও রূপ খুঁজে পেল না সুমিতা। সেটা কার সঙ্গে, কীসের জন্যে। ওটা তো আসলে ক্রীতদাসীর মতো আত্মসমর্পণ।

 তাপসী বলল, একেবারে যে অবাক হয়ে গেলি? তোদের বাড়িতেই দ্যাখনা। সুজাতাদির ব্যাপারটা কী?

হঠাৎ মনে হল, সুমিতা জমে পাথর হয়ে গেছে।

ভয়-স্খলিত গলায় জিজ্ঞেস করল, কী?

তাপসী বলল, আহা, জেনেশুনে তুই বড় ন্যাকা সাজিস। তোর বড়দি তো বাপু আসলে ভালবাসেনি স্বামীকে। নেহাত বড়লোক দেখেই গিরীনবাবুকে পাকড়ালে। শেষটায়

সুমিতার মনে হল, মাটি সরে যাচ্ছে ওর পায়ের তলা থেকে। তবু সর্বাঙ্গে একটি অসম্ভব ঝাঁকুনি দিয়ে, শক্তি সঞ্চয় করে চাপা গলায় চিৎকার করে উঠল, তাপসী।

তাপসী চমকে বলল, কী রে?

কয়েক মুহূর্ত নির্বাক দুজনেই। তাপসী বলল, রাগ করলি?

সুমিতার বুকের ভিতর থেকে কী একটি বস্তু গলার কাছে ছুটে আসছে ভলকে ভলকে। কোনওরকমে বলল, হ্যাঁ।

তাপসী আরও কয়েক পলক ওর কাজল মাখা চোখে তাকিয়ে রইল তীক্ষ্ণ চোখে। তারপর বলল, কিন্তু তোকে রাগাবার জন্য বলিনি ভাই। যা দেখেছি, তাই বলেছি। তবু সুজাতাদির কত সাহস, ভাল লাগেনি বলে ছেড়ে আসতে পেরেছেন। আমরা? আমরা কী করব? তোকে তো কিছু ভাবতে হয় না, তাই তুই রাগ করতে পারিস। বলতে বলতে তাপসীর গলা যেন ধরে এল। বলল, আচ্ছা, আজ যাচ্ছি।

তাপসী বেরিয়ে গেল। সুমিতার বুক থেকে ভলকে ভলকে ছুটে আসা বস্তুটি অকস্মাৎ নেমে এল চোখের কোল প্লাবিত করে। একটা ভয়ংকর অশ্লীল সত্য, যেটাকে ছলনা করে চলেছে একদিক থেকে আজ সারাটি বাড়ি, সেই কথাটিই যেন চাবুকের মতো ছুঁড়ে দিয়েছে তাপসী। রাগ করুক তাপসী, কাঁদুক, সত্য বলুক, তবু বড়দির এত বড় অপমান ও কেমন করে নেবে গায়ে পেতে।

মন যখন একটু শান্ত হল, তখন ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল রবিদার মুখখানি। যে কথাটিকে নিজের মনেও স্বীকার করতে পারেনি কোনওদিন, আজ হঠাৎ মনে হল, বড়দির এ অপমানের অনেকখানি গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছেন রবিদা।

কার উপরে যে রাগ করবে সুমিতা। সংসারের এই অসহজ বিচিত্র নিয়মগুলির প্রতিই ওর দুর্জয় অভিমান হতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *