জীবন জয়ী হবে
পলিটিকস কোথায় যে টানবে!
৬ নভেম্বর ২০০২
সরদার ফজলুল করিমের সাথে আলাপচারিতা শুরুর আজ প্রথম দিন। এরপর মাসের পর মাস আমাদের আলাপ চলেছে। আসলে আলাপ নয়চেষ্টা করেছি কোন একটা প্রসঙ্গ ধরিয়ে দেয়ার। ঐটুকুই আমাদের কাজ–এর পর দুটো। যন্ত্র যার যার মত করে কাজ করেছে। সরদার ফজলুল করিম নামের মানব যন্ত্রটির গুণে-মানে আমরা বিস্মিত হয়েছি। আশি বছরের পুরোনো যন্ত্র, কিন্তু কি যে ভালো। তাঁর স্মৃতি, শব্দ চয়ন, রসবোধ থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ইতিহাসের পেছনের ইতিহাস ব্যাখ্যার পারঙ্গমতা, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, সর্বোপরি চির সচল এক বর্ণাঢ্য জীবনাভিজ্ঞতা বর্ণনার অসাধারণত্ব পাঠক মাত্রই টের পাবেন–আশা রাখি। আমাদের মধ্যে মৌনভাবে হলেও ফাঁকিবাজির একটা চেষ্টা বোধ হয় ছিলো। আমরা বোধ হয় চেয়েছিলাম, এখান থেকে ওখান থেকে শুরু করে কিছু একটা দাঁড় করাতে-যাতে করে তাঁর জীবনের আকর্ষণীয় অংশগুলোর (আমাদের ধারণায়) একটা বিবরণ দাঁড় করানো যায়। কিন্তু তা হয়নি। তিনি শুরু থেকেই করেছেন। পরে বুঝতে পেরেছি যে, অজান্তেই বড় একটা লাভ হয়েছে। শুরু থেকে শুরু করার ফলে পরের অংশগুলো বুঝতে সুবিধা হয়েছে। প্রথম দিন থেকেই তিনি আমাদের এ কথাটা মনে করিয়ে দিতেন যে, কোন একজন ব্যক্তিকে বা কোন একটা বিষয়কে বিচ্ছিন্নভাবে জানার বা বোঝার চেষ্টাটা ভুল। সেজন্যই প্রথম দিনের আলাপ শুরুর জন্য দ্বিতীয় যন্ত্রটি অর্থাৎ শব্দ ধারন যন্ত্রটি চালু করার আগে আমরা স্যারের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকাহিনী শোনার আকাঙ্খ প্রকাশ করি। তিনি সম্মতি প্রকাশ করেন। এবং কথা শুরু করেন অনেকটা ওস্তাদ সঙ্গীত শিল্পীর ঢংয়ে, অর্থাৎ ঝপ করে কোন একটা জায়গা থেকে–কিন্তু আলাপের শেষে পুরো একটা রাগ শ্রবণের আরাম দেয়। যতদিন আলাপ চলেছে আমরা শুধু শব্দ ধারণ যন্ত্রটি খুলে রেখেছি আর মাঝে-মধ্যে স্যারকে উসকে কথা বের করার চেষ্টা করেছি। কখনো কখনো যুক্তিতে না পেরে বিতর্কে হেরে কুতর্কে জড়িয়েছি। তিনি রাগ করেননি। একটা বিষয় উল্লেখ্য, স্যার যা বলেছেন সেগুলোর একটা লিখিত রূপ দেয়ার চেষ্টা আমরা করেছি। তবে তাঁর কথা শোনার অভিজ্ঞতাটা আলাদা। প্রমিত-আঞ্চলিক বাংলার মাঝে মাঝে ইংরেজি ঢুকিয়ে যে আকর্ষণীয় উপস্থাপনা, যার সাথে আরো যুক্ত হয় শব্দ প্রক্ষেপণের অসাধারণ কুশলতা এবং প্রয়োজন মাফিক কণ্ঠস্বরের উত্থান পতন। এলো সব মিলে সরদার ফজলুল করিম শ্রোতার কান ও মগজ হয়ে মনে ঢুকে পড়েন শ্রোতার অজান্তে। শৈশবে বরিশালের স্কুলে পড়ার সময় সেখান থেকে গ্রামের। বাড়ি যাওয়ার কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে স্যার কথা শুরু করেন।
আমার গ্রামের বাড়ি ছিলো বরিশাল শহর থেকে প্রায় পনেরো-ষোল মাইল তফাতে। রহমতপুর, দোয়ারিকা, শিকারপুর। তিনটা খেয়া পার হয়ে আমাকে যেতে হতো।
সে আমলে আমার বরিশাল থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তায় ছিলো একটা শ্মশানঘাট। মাঝে-মধ্যে আমি শেষরাতে সে পথ ধরে বাড়ির দিকে রওয়ানা হতাম। আমার বড় ভগ্নীপতি, মাস্টার মানুষ খুব কড়া মানুষ, তিনি আমাকে বলতেন, তোর ভয় করে না! শ্মশানঘাটে ভূত আছে তুই জানোস না? আমি আবার বলতাম, আমি ভূতেরে ভয় পাই না, এই বইলা আমি যাত্রা করতাম। শেষে হয়তো সকাল আটটা না বাজতেই বাড়িতে পৌঁছে মা রে ডাক দিতাম মা বইলা। মা সাংঘাতিক অবাক হয়ে বলতেন, পাগল তুই কেমন করে এত সকালে এত দূর থেকে আসলি।
আমরা স্যারের মা-বাবা সহ পরিবারের কথা একটু শুনতে চাইলে তন্ময় হয়ে শুরু করলেন, বাবা ছিলেন খুব নির্বাক মানুষ। কথা বলতেন না। আমার মা তার কোন নাম ছিলো না। সবাই তারে ডাকতো মউজ আলীর মা। মউজ আলী তার বড় ছেলে। এই সেই দিন আমার মেজ বোন যে এখন প্রায় স্মৃতিভ্রষ্ট, তার কাছ থেকে মায়ের নাম জানলাম। সে নাম এখানে বলে লাভ নাই। কারণ তার নাম তো কেউ বলতো না।
মা ছিলো ভীষণ considerate। আমাদের গ্রামের বাড়ির ঘরামী ছিলেন এক হিন্দু শিডিউল কাস্ট। মা তারে নিজের থালে করে ভাত খাওয়াইছেন। তো এইরকম কৃষক ঘরের মেয়ে খুব কম পাওয়া যায়। আমি কখনো কখনো বাবার নাম নিয়েছি-কফিলউদ্দিন সরদার। কিন্তু মায়ের নাম আমি লিখতে পারি না।
-মায়ের নাম প্রসঙ্গে এসে পড়ে মেজবোন মেহেরুন্নেছা প্রসঙ্গ। চাপা কষ্ট থেকে তিনি বললেন :
–তোমরা তো কোন খোঁজ করতে চাও না, কষ্ট করতে চাও না। বরিশালের রহমতপুর হাই স্কুলে আমি আর সে একই ক্লাসে পড়তাম। আমাদের সাথে হিন্দু জমিদারবাড়ির কয়েকটা মেয়েও পড়তো। তারপর তো তার নানা কাহিনী। মেজ বোনটার একটা ট্র্যাজিক লাইফ আর কি। একাত্তরের শহীদের তালিকায় আমার বোনের পরিবারটাকে তোমরা তো খুঁজেও পাও না! আমার মেজবোনটা ছিলো ভীষণ জেদী। শাড়ি পছন্দ না হইলে পুড়াইয়া ফেলার মত ব্যাপার আর কি। তার একটা ডাক নাম ছিলো-ছোট্ট। নামটা আমার বড় ভাই দিয়েছিলেন। এই সেই বড় ভাই যিনি আমাকে মেরেছেন, কাঁধে করে ঘুরিয়েছেন, আমাকে মানুষ করেছেন। আবার পরবর্তীকালে জেলখানায় যেয়ে আমার সাথে দেখা করেছেন। বড় ভাই আমাদের বড় এবং মেজবোনর বিয়ে ঠিক করেছিলেন। আমার বড় বোনের বিয়ে হয়েছিলো স্কুল। শিক্ষক ওফাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের সাথে। তিনি তৎকালে এলাকায় খুব বিখ্যাত লোক ছিলেন। মেজ বোনের বিয়ে দিলেন নিজের সহপাঠি আশরাফ আলী খানের সাথে। সোজা কথা বড় ভাই তার পছন্দ মত মানুষ জোগাড় করে বোনদের বিয়ে দিয়েছিলেন। আশরাফ আলী খানও by nature সাহিত্যিক ধরনের ছিলেন। ইনি কবি আহসান হাবীবের বড় ভাইয়ের মত ছিলেন। আহসান হাবীব তো সেভাবে তেমন পড়ালেখা করেন নি। মেট্রিক পাশ করার পর তিনি বরিশাল এলে আমার মেজো ভগ্নিপতি তাকে আশ্রয় দিলেন। নিজের বাসায় রাখলেন। আমি যখন ক্লাশ ফাইভে সিক্সে পড়ি তখন আহসান হাবীবের সাথে আমার পরিচয়। আশরাফ আলী খানের সাথে আমার বোনের বিয়ের সময় সেই কালের নিয়ম অনুসারে আহসান হাবীব আমার বোনের উদ্দেশ্যে। কবিতাও লিখেছে। সেই কবিতা দেয়ালে বাঁধাই করে আমার মেজবোন অনেক দিন যত্নে রেখেছে। অবশ্য পরে আহসান হাবীব অনেক বড় হয়েছেন। আমার মেজবোন ঢাকায় থাকলেও আহসান হাবীব খুব একটা যোগাযোগ রক্ষা করতেন না। মেজ ভগ্নিপতি পিডডির একজন সিনিয়র ক্লার্ক ছিলেন। অবশ্য পার্টিশানের আগে তিনি ঢাকাতেও কাজ করেছেন।
আমরা চেষ্টা করলাম স্যারকে তার শৈশব-কৈশোরে ফিরিয়ে নিতে। স্যার বলেন :
-হ্যাঁ ঐ সময় বড় ভাই বোনদের বিয়ে দিলেন। পরে যিনি মেজ ভগ্নীপতি হলেন আমি বরিশালে একটা সময় তার সাথে মেসে থেকেছি। বড় ভগ্নীপতিও বরিশালে থাকতেন। উভয়ে আমাকে ভীষণ আদর করতেন। এখন ধরো এই হচ্ছে ব্যাপার। ঐ সময়ের আর কি পাইতে চাও? এটুকু বলা যায়। যে, ঐ সময় একটা মুসলিম মধ্যবিত্ত কিছু পরিমাণে ডেভেলপ করছে। আমার পরিবারের মধ্যেই দেখো, আমার ভগ্নীপতিদের একজন শিক্ষক। আরেকজন সরকারি অফিসের ক্লার্ক। ধরো বরিশালে স্কুলে আমি একজন মুসলমান ছাত্র। আমার মত আরো কিছু মুসলমান ছাত্র ছিলো। বুঝতেই পারছো, হিন্দুদের চেয়ে বেশি নয়।
এ প্রসঙ্গে আমরা একটা প্রশ্ন উত্থাপন করি। রেকর্ডার চালু করার আগে। আপনি বলছিলেন যে, হিন্দু ছাত্ররা পলিটিক্যাল ছিলো কিন্তু দুএকটা ব্যতিক্রম ছাড়া মুসলমান ছাত্ররা নয়। মুসলিম ছাত্রদের পলিটিকসে আকর্ষণ ছিলো না। কেন? এ পর্যায়ে আলোচনা জমে যায়। স্যার বলেন :
পলিটিকস কোথায় যে টানবে! পলিটিকস থাকলে তো টানবে।
কেন তখন তো কংগ্রেস ছিলো, মুসলিম লীগ ছিলো। কংগ্রেসে না যাক মুসলিম লীগে যাবে।
-(দৃঢ় আপত্তি জানিয়ে) না, সমান কইরো না। কংগ্রেস আছে মুসলিম লীগ আছে বললে পরে তো সব সমান হয়ে যায়। তোমরা তো এমনভাবে বলো যেন দুটোই সমান আছে। কংগ্রেসে হইছে সেই কবে এইটিন এইটিস আর মুসলিম লীগ হচ্ছে ১৯০৬ সালে। এটা কি সাধারণ ব্যাপার বলবা। এই সময়ের ব্যাবধানটা?
কিন্তু আপনি দেখেন, আমরা যে সময়ের কথা আলাপ করছি ততদিনে মুসলিম লীগ অনেক পরিণত।
–অনেকটুকু কি matured হইছে ঘোড়ার ডিম! সব তো উপর তলার কতগুলা লোক। যারা প্রকৃত অর্থে মুসলমানদের স্বার্থ দেখেনি। এবং they were communalizing the community. They were using the capital. তুমি দেখো জিন্নাদের অবস্থা দেখো। তুমি দেখো কয়জন মুসলিম লীডার ততদিন পর্যন্ত বরিশালে আসছে। হ্যাঁ, বরিশালেও ভালো ভালো মুসলিম লীডার ছিলেন–হাশেম আলী খান, আজীজ উদ্দীন সাহেব, জমিদার ইসমাইল চৌধুরী, ওহাব খান এরা ছিলেন। এরা সবাই তো মুসলিম লীগই ছিলেন। তাই বলে এটা বলা যাবে না যে বরিশালের মুসলিম লীগও ১৯০৬ সালে হয়েছিলো। ব্যাপারটাকে এভাবেই বুঝতে হবে। তোমাদের এও বুঝতে হবে, যে বরিশালের মুসলিম লীগের নেতারাও কিন্তু মোছলমান পোলাপানদের approach করে নাই। তারা approach করছে আর পাঁচটা উকিলরে। আর পাঁচটা তালুকদাররে। এদের approach করার পেছনে central assembly-তে ভোটের ব্যাপার আছে। joint electorate হলে পরে ভোট পাইতে সুবিধা হবে এসব বিবেচনা ছিলো। এদের সাথে যে আমি যাবো আমার কাছে তো তাদের আসতে হবে। তারা তো ছাত্রদের কাছে যান নাই।
মুসলিম লীগ সংক্রান্ত আলোচনায় সুবিধা করতে না পেরে আমরা তৎকালীন কংগ্রেস প্রসঙ্গে স্যারের অনুভূতি জানতে চাইলাম।
-কংগ্রেস আর কি? ঐ এক সুভাষ বসুরে দেখলাম। কংগ্রেস তো আর আমার কাছে আসে নাই। আরএসপি (রেভুল্যশানারি সোসালিস্ট পার্টি) আসছে। কংগ্রেসের আমার কাছে আসার দরকার পড়ে নাই। কংগ্রেসের তো হিন্দু ক্লায়েন্ট আছে। তার যাওয়ার অনেক জায়গা আছে–লীডার আছে। মাতবর আছে, হেডমাস্টার, স্কুল টিচার সব আছে। নির্দিষ্ট এলাকা আছে, তাহলে সে আমার কাছে কেন আসবে?
তার মানে কি এই যে, মুসলিম লীগ বা কংগ্রেস যারা আগে আসতো আপনি তাদের সাথেই যেতেন!
–আহা! আসলে তো যাবো! ওরা কেউ তো আসে নাই। কেউ ডাকলে আমি না করবো বা হ্যাঁ করবো, এই তো ব্যাপার। আগে আসলেই যে একেবারে তার দিকে ঢলে পড়বো এমন তো না। সে তো আমাকে এমনভাবে ভালোবাসতে হবে যেন আমি তার কাছে যাই। কংগ্রেস বলো, মুসলিম লীগ বলো কেউ তেমনটা করে নাই। তোমাদের মুশকিল হলো তোমরা সবকিছু কেতাবে পড়ো, আর পড়ে এসব কথা বলো, The book cannot give you the time. সেজন্যই একই বিষয়ের উপরে পাঁচটা পাঁচ রকমের বই হয়। আর তোমরা পাঁচটা মিলায়ে একটা কিছু বের করার চেষ্টা করো। এখন তোমরা আদর্শ মনে কর নবাব সলিমুল্লারে। এই নবাব সলিমুল্লাটা কেডা?
প্রথম দিনের আলাপে স্যারের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচারণ শুনতে চাইছিলাম। কিন্তু ঐ যে বলে কথা হলো লতা। স্যার আলাপ অন্যদিকে ভাসিয়েছেন। আমরাও স্যারের কথার স্রোতে ভাসতে থাকলাম। মনে করিয়ে দিলাম যে উনি একটু আগে বলেছিলেন আরএসপি ওনার কাছে এসেছিলো। আরএসপি প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম।
-আমি আরএসপিকে কোন অর্গানাইজেশান হিসাবে দেখতামই না। আমি আমার বন্ধু মোজাম্মেলকে চিনতাম। সে আরএসপির সাথে জড়িত ছিলো। ওরা আমারে কোন মিটিংয়েও নেয় নাই, আরএসপি কারে বলে তাও জানতাম না। তারা কোন পাবলিক মিটিং করতো বলে মনে পড়ে না। RSP was inside the Congress, তখন তো আরএসপি, কম্যুনিস্ট, স্যোসালিস্ট সুক সবই ছিলো ইনসাইড দি কংগ্রেস। পরবর্তীকালে এরা আলাদা হয়। এদের অনেকে আন্দামানেও গেছে। তাহলেও এরা এত বড় ছিলো না যে খুব বড় করে পাবলিকলি আসবে। আসলে তখন আমার কাছে আসল ব্যাপার ছিলো মোজাম্মেল। তার সঙ্গে একটা কৈশোর প্রেম ছিলো বলে আমার মনে পড়ছে। বরিশালে এরকম প্রেম আর কারু সঙ্গে ছিলো বলে মনে পড়ে না। গলাচিপাতে ছিলো। সেখানে সুনীল আর সুশীল কর আমার দুজন বন্ধু ছিলো। মোজাম্মেল নামে ১৯৬৫ সালে এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যায়।
হোস্টেল জীবন প্রসঙ্গে এবার স্মৃতিচারণ করলেন।
-আমাদের হোস্টেলে সুপারিনটেনডেন্টের হুকুমে রাত দশটার সময় ইলেকট্রিক বাতি নিবাইয়ে দিতো। তারপরে আমি কি করব? আমি বইপত্র বগলে করে হোস্টেলের পাশে ডিস্ট্রিক বোর্ডের গ্রীল পার হয়ে বরিশাল স্টীমার ঘাটে চলে যেতাম। খুব সুন্দর ছিলো স্টীমার ঘাটটা। নানান জায়গার জাহাজ চলাচল করতো। আমি যাত্রীদের চলাচলের জন্য যে বোর্ড ছিলো তার গায়ে হেলান দিয়ে লাইটের আলোতে বই পড়তাম। একবার কোন একটা জাহাজের সারেং বা তেমন কিছু হবে–তার নজরে পড়ে যাই। তিনি আমারে স্টীমারের ভেতরে নিয়ে সুন্দর আলোতে পড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
–কি ধরনের বই পড়তেন?
গলাচিপায় থাকতে ডিটেকটিভ বই পড়তাম। বরিশালে এসে লাল ইশতেহার পড়েছি। আর পথের দাবী। আমি তখন ক্রমান্বয়ে শরৎ সাহিত্যের প্রভাবে এসে যাই। তখন বসুমতী সাহিত্য মন্দির সস্তায় শরৎ সাহিত্য তৈরি করতো। আমি পুরো সেট কিনেছিলাম। আমার বড় ভাই লক্ষ্য করলেন যে অন্য ভাইদের তুলনায় আমি একটু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছি। আমার সেই বড়। ভাই আমারে কত আদর করতেন। তার কথা আমি বলতে পারি না। বলতে গেল আবেগ আসে। আবেগ আসলে কথা বলা যায় না। মনে পড়ছে-বড় ভাই তখনও অবিবাহিত। পিরোজপুর সাবডিভিশনে কোন একটা জায়গার সাব রেজিস্ট্রার। একবার বাড়ি আসলে আমি তার সাথে যাওয়ার তাল ধরলাম। কারু নিষেধই শুনলাম না। মিয়াভাই তখন মেনে নিয়ে বললেন, আচ্ছা আমার লগে উজিরপুর পর্যন্ত যাউক। উজিরপুর থেইকা তো ওরা আসবে। ওগো লগে দিয়া দিমু। ওরা মানে আমাদের জ্ঞাতি বা আত্মীয়-স্বজনদের কেউ হয়তো উজিরপুরের দিকে গিয়েছিলো। ওখান থেকে বাড়ির দিকে আসার পথে আমাকে তাদের সাথে ধরিয়ে দেবেন, এই ছিলো মিয়াভাইর প্ল্যান। কিন্তু উজিরপুর যাওয়ার পরও আমাকে ছাড়ানো গেলো না। তখন ভাইয়ের চাপরাশী আমাকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে চললো। তারপর তো এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার। আমার এখনও মনে আছে-হলুদপুরের মাঠ বলে বিশাল এক মাঠে পথ ভুলে সারারাত ঘুরে ঘুরে ভোরবেলা বানারীপাড়া পৌঁছি স্টীমারে চড়লাম। সেই আমার প্রথম স্টীমার চড়া। পরে ভাইয়ের কর্মস্থলে পৌঁছি। তো এসব আলাপ আর কি শুনবা? বরং অন্যকোন সামাজিক বিষয় যদি জানতে চাও জিজ্ঞেস করো। ধরো একটা কৃষক পরিবার। কৃষক পরিবারটার মধ্যে এডুকেশান ঢুকছে। not madrasa education. ঢুকছে ইংলিশ এডুকেশন। ইংলিশ এডুকেশান ঢোকার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই পরিবারের বড় ছেলে তার পরিবারটাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এই বড় ছেলের অর্থাৎ আমার বড় ভাইয়ের ধর্মভীরুতা যেমন একটা বৈশিষ্ট্য ছিলো তেমনি তার অসাম্প্রদায়িকতাও একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিলো। He was very much popular. রহমতপুরে চাকরি করার সময় একটা হিন্দু জমিদার পরিবারের সঙ্গে তার সাংঘাতিক একটা। ঘনিষ্ঠতা ডেভেলাপ করে। এসব কথা আমার সেই সে কাল বইতেও আছে। সেখানে আমি একটা লেখার নাম দিয়েছি মোসলমান ছেলের হিন্দু মা।
তখন আমার চারপাশে সবাই কমুনিস্ট
২০ নভেম্বর ২০০২
আজকের আলাপের একটা বৈশিষ্ট্য হলো স্যার প্রায় সারাদিনই আমাদের সাথে ছিলেন। এবং দীর্ঘ একটা সময়ের উপর আলো ফেলেছেন। গত দিনের আলাপের সূত্র ধরেই আমরা এগুনোর মনস্থ করি। অর্থাৎ শৈশব-কৈশোরের কিছু স্মৃতি চারণ সে সাথে স্যারের বরিশাল জীবন। জেনেছি যে তিনি ১৯৪০ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে মেট্টিকুলেশান সমাপ্ত করেছেন এবং প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে রাজনীতির সাথে তার যোগাযোগের কিছু আভাসও দিয়েছেন। স্বভাবতই এর পরে স্যারের ঢাকা আগমন এবং এতদ্বপ্রসঙ্গে কিছু শুনতে চাওয়াটা আমরা যৌক্তিক মনে করলাম। কেননা ঢাকা আগমনের পূর্বের জীবনের অবদান স্বীকার করে নিলেও বলা যায় বরিশালের সরদার ফজলুল করিম আসলে আজকের সরদার ফজলুল করিম হয়ে উঠতে শুরু করেন ঢাকা আগমনের পর থেকে। আমরা স্যারের কাছে বরিশালের পাট চুকিয়ে ঢাকা আগমন এবং সম্পর্কিত বিষয়াদি জানতে চাইলাম।
এখন তুমি যে বলো ১৯৪১-এ কোথায় ছিলেন? এই কথাটাই আমি মনে ভেবেছিলাম। তুমি বলো, আপনি ৪০ এ মেট্রিক পাশ করলেন। আপনি ৪১ সালে কোথায় ছিলেন। এখন ধরো ৪১ সালে আমি কোথাও ডুব দিয়েছিলাম তা না। আসলে তোমাকে বুঝতে হবে ৪০ সাল ৪১ সাল সবই হচ্ছে কানেকটেড। ৭১-এর আগস্ট সেপ্টেম্বরে আমার রেজাল্ট বেরুলো। তখন একটা প্রসেস চললো। আমার বড় ভাই, তিনি আমার পিতার মত, আমাকে ঢাকা পাঠিয়ে দিলেন। ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য। এই যে প্রসেসটা–আমি কারু সঙ্গে ঢাকা আসলাম। যার সঙ্গে আসলাম, বড় ভাই তাকে অনুরোধ করলেন, তিনি আমাকে ঢাকার একটা রেপুটেড কোন গভর্মেন্ট কলেজে ভর্তি করে দিতে পারেন কি না। তো ধরো এই একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। সব মিলিয়ে। দাঁড়ালো আর ৪০-এ মেট্রিক পাশ করলাম। ৪১-এ ঢাকা গর্ভমেন্ট ইন্টারমেডিয়েট কলেজে ভর্তি হলাম এবং ১৯৪২-এ ফাইনাল পরীক্ষা হলো। তা রেজাল্ট বেরুতে তো সময় লাগে। আজকের দিনের মতই সময় লাগে। আমি অবশ্য রেজাল্টের জন্য ঢাকায় অপেক্ষা করিনি।
এবার আমাদের একটু সুবিধা হলো। আমরা তার ইন্টারমেডিয়েট স্টুডেন্ট লাইফ সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। রাজনীতি, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বড় শহরে আসবার অনুভূতি সম্পর্কে জানবার আগ্রহ হচ্ছিলো। দেখা গেলো, স্যার এ বিষয়ে বলতে আগ্রহী। তিনি শুরু করলেন :
–অফ কোর্স। অফ কোর্স। এগুলো আসবে। অটোমেটিক্যালি আসবে। ধরো আমার যে বুজুম ফ্রেন্ড মোজাম্মেল হকের কথা আগের দিন তোমাদের বলেছি সে কিন্তু ঢাকাতে পড়তে এলো না। ও বরিশালে কি পড়ছে না পড়ছে আমি ভালো জানতাম না। তবে সে রাজনৈতিক ছিলো। ঐ ৪১-৪২ সালেও সে মাঝে-মধ্যে ঢাকায় এসেছে। আমাকে খুঁজে বের করেছে। আলাপ করেছে। আবার ফিরে যাওয়ার সময় আমি মোজাম্মেলকে বাদামতলী ঘাটে সি অফ করেছি। এ সমস্ত প্রেমময় স্মৃতি আছে। এখন ধরো, ৪১-৪২ ব্যাপারটা, আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। তোমাদের তো কোন স্মৃতি নেই। আমার আছে আমি বলছি। তখন ঢাকা গভর্মেন্ট ইন্টারমেডিয়েট কলেজ বাই ইটসেলফ, বিল্ডিং ওয়াইজ ও যদি ধরো একটা হিস্টোরিক্যাল ব্যাপার ছিলো। It continued to be the same building which was made for Curzon. The same building. এখনো আছে, ঐ যে ডিপিআই অফিস তার পাশে দেখবা একটা অদ্ভুত ধরনের গেইট আছে। এই গেইটটা ভাঙে নাই। কিন্তু এইটা কেউ দেখেও না। আর এইটা সম্পর্কে কিছু মনেও রাখে না। এই গেইট দিয়া ভেতরে ঢুকলে বড় ডোমওয়ালা একটা বিল্ডিং এখনো পাবা। এইটা ছিলো বলা চলে একটা সেকেন্ড কপি অফ কোলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। এই বিল্ডিংটা এখন বোধ হয় ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট ব্যবহার করে। কাউকে ঢুকতে দেয় না। এটা জাদুঘরের কোন মাল না এবং এটাতে তোমরাও যাও না। আমিও যেতে পারবো না। ঢুকতে এলাউ করা হবে না। ঐ বিল্ডিংয়ের স্টেয়ার কেইসটা একটা রাজসিক ব্যাপার ছিলো। দোতলাতে একটা ড্যান্সিং হল ছিলো কাঠের। এগুলো আমার স্মৃতিতে আছে। আমাদের ক্লাশরুমগুলোও ছিলো বড় বড়। ঐ বিল্ডিংয়ের দুটো উইং ছিলো এবং দুটো উইংয়ের মধ্যে যাতায়াতের জন্য একটা ব্রীজ ছিলো। ঢাকা কলেজ তখন ছিলো মূলত আর্টস পড়াশোনার জায়গায়। কমার্সও বোধ হয় ছিলো। আমি যখন ভর্তি হই তখন প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন ড. মমতাজ উদ্দীন আহমেদ। তিনি ফিলসফির লোক ছিলেন। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি হন। ঐ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর বড় অবদান আছে। হি ওয়াজ অলমোস্ট ফাউন্ডার। তোমরা জানো এসব?
আমরা আর দশটা প্রশ্নের মত এ প্রশ্নের উত্তরও জানা নেই বলে স্যারকে জানাই। স্যার তখন জানালেন যে মমতাজ উদ্দীন সাহেবের বিষয়ে এতসব তিনিও জানতেন না। কেননা মমতাজ সাহেব সরকারি চাকুরে ছিলেন বিধায় ঢাকা কলেজ থেকে পরে কোথায় গেছেন সেসব খবর রাখা হয়নি। কিন্তু স্যার পরে খবর বের করেছেন। জেনেছেন। সে কথাই তিনি আমাদের জানালেন। আমরা খানিকটা বুঝে নিলাম, স্যার যে বারবার আনআর্থ করার কথা বলেন এই আনআর্থ। করা জিনিসটা কি। সেটা একজন মমতাজ সাহেব হোন বা অন্য কেউ হোন। আমাদের যে বা যা কিছু মহান সেগুলোকে খুঁজে খুঁজে, খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে আনা। স্মৃতির অতলে যেতে না দেয়া। সরদার ফজলুল করিম এ সবের জন্যই রোদন করেন। স্মৃতিকে ধরে রাখার প্রক্রিয়ায় বলে যেতে থাকলেন :
-এই মমতাজ উদ্দীন সাহেব ইংরেজি, হিস্ট্রি এসবই পড়াতেন। আমার সাবজেক্ট কম্বিনেশন ছিলো লজিক, সিভিকস এবং হিস্ট্রি। ঐ সময় আমাদের একজন ইংরেজি প্রফেসর ছিলেন। তিনি হলেন জালাল উদ্দীন সাহেব। ঢাকা কলেজ যখন নিউমার্কেটের ঐ দিকে যায় তখন তিনি প্রিন্সিপ্যাল হয়েছিলেন।
ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় স্যার কোথায় থাকতেন, কিভাবে থাকতেন এগুলোও আমরা জানতে চাই। পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতে স্যার যেন পুরোনো দিনেই বিচরণ করছিলেন :
-তুমি নোট রাখো যে আমি ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজে ভর্তি হলাম। ফজলুল হক হল এবং ঢাকা হল, এখন যেটা শহীদুল্লাহ হল, এই হল দুটোর মাঝখানে একটা পুকুর ছিলো, এখনো আছে। দুপাড়ে দুটো ঘাট ছিলো। আমি থাকতাম পুব সাইডে। তখন নাম ছিলো ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট হোস্টেল। এই হোস্টেলের একটা বৈশিষ্ট্য ছিলো । এখানে রিলিজিয়াস কোন ব্যাপার ছিলো না। ইট ওয়াজ কসমোপলিট্যান। ভাগ ছিলো এটুকুই যে এক সাইডে হিন্দু ছেলেরা অন্য সাইডে মুসলিম ছেলেরা থাকতো। তাদের রান্নাবান্না আলাদা হতো। এই পর্যন্তই। সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন দুজন। একজন হিন্দু আরেকজন মুসলিম। সব মিলিয়ে হলটা আমাদের খুব ভালো লাগতো। আমরা লেখাপড়া করতাম, গল্প করতাম, ঘাটে বসতাম।
আমাদের আগ্রহ ছিলো স্যারের পলিটিক্যাল ইনভলমেন্ট বিষয়ে জানার। আরেকটা দিক, অর্থাৎ তখন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিলো, সে যুদ্ধটাকে স্যার কিভাবে দেখেছিলেন। আমাদের উভয় আগ্রহের জায়গাকে একসাথে বেঁধে নিয়ে স্যার বলতে শুরু করলেন :
–আমি ৪১ সালে ঢাকা আসছি। তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধের ইমপ্যাক্টটা গ্র্যাজুয়েলি ঢাকার উপরে সেভাবে পড়েনি। যুদ্ধের ফ্রন্টটা ছিলো ইস্টে। বার্মা, সিঙ্গাপুর এসব দিকে। জাপান সাংঘাতিক আক্রমণ করছে। তারা এমনকি আমেরিকার পার্ল হারবারেও আক্রমণ চালাচ্ছে। এই যে ভয়ানক যুদ্ধটা চলছে, এর যা আনুষঙ্গিক–অর্থাৎ আহত হয়, নিহত হয়, হাসপাতালে নিতে হয় এসব ব্যাপার তো রয়েছেই। এসবের প্রভাব ঢাকার উপরে পড়েছিলো। তখন সলিমুল্লাহ হলকে মিলিটারী হসপিটালে পরিণত করা হয়। এটা ৪২ সালের দিকের ঘটনা। এছাড়াও এখন যেটা ঢাকা মেডিক্যাল তার একটা অংশও মিলিটারী হসপিটাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তখন অবশ্য এটা মেডিক্যাল কলেজ হয়নি। ঐ পুরো এলাকায় একমাত্র সলিমুল্লাহ হল ছাড়া বাকি সবগুলো স্থাপনাই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরবর্তীতে নতুন রাজধানীর প্রয়োজনে তৈরি হয়েছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পর কালক্রমে। এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে দেয়া হয়। সলিমুল্লাহ হল আলাদা করে তৈরি হয়েছিলো। সেসব যাই হোক। তোমরা যা জানতে চাইছে সেদিকে আসি। আমি কলেজে ভর্তি হলাম। ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজ হোস্টেলে থাকছি। পড়ালেখা করছি। ৪২-এর মাঝামাঝি সময়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলো। ততদিনে আমার বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধব হয়েছে। খুবই ইন্টিমেস্ট বন্ধু বান্ধব। ধরো, নাসির উদ্দীন। নাসির উদ্দীন আমার বুজুম ফ্রেন্ড হয়। ও বোধ হয় হিস্ট্রিতেই ছিলো। তার কোন রাজনীতি ছিলো না। কিন্তু তার একটা এফেকশান ছিলো। আমি তখন ছুটিছাটায় বাড়ি না যেয়ে বন্ধু-বান্ধবের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম। নাসির উদ্দীনের বাবা আব্দুল গফুর সাহেব ছিলেন চাঁদপুরের এসডিও। আমি সেখানেও গেছি। নাসির উদ্দীনের ছোট ভাই বাচ্চু অর্থাৎ ৭১-এ শহীদ ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গিয়াস উদ্দীন তখন মাত্র ক্লাশ এইটের ছাত্র। তার সঙ্গেও আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সে আমাকে খুবই পছন্দ করতো। চিঠি লিখতো। তার পরে ধরো আবদুল মতিন। জেনেভায় বঙ্গবন্ধু বইয়ের লেখক। আমরা চেনানোর জন্য বলি জেনেভায় বঙ্গবন্ধুর মতিন, সেও আমার ভীষণ ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। মতিনের বাবার নাম ছিলো আবদুছ সোবহান। দারুণ অমায়িক মানুষ। আমি মতিনের সাথে নোয়াখালীতে তার বাবার কর্মস্থলে গেছি। তিনি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে কাজ করতেন। তাদের গ্রামের বাড়িও গেছি। মতিন পাঁচ অধ্যায় নামের আত্মজীবনীতে এগুলো লিখেছেও। পলিটিশিয়ান রাজিয়া খান মতিন যিনি একসময় এমপি হয়েছিলেন, সে হলো আবদুল মতিনের ছোট বোন আর মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মতিন চৌধুরী সাহেবের ওয়াইফ। আমার আরো বন্ধু ছিলো। যেমন ধরো নূরুল ইসলাম চৌধুরী। সে পরবর্তী জীবনে এ্যাম্বাসেডার হয়। এখন রিটায়ার্ড। সে তেমন একটা পলিটিক্যাল ছিলো না। পাবনার পাকশীতে নূরুল ইসলামের বাড়ি এবং রাজশাহী চারঘাটে তার মামাবাড়ি। দুজায়গাতেই আমি গিয়েছি। ও এখনো আমার সাথে যোগাযোগ রাখে। এবার নাম বলবো হিস্ট্রির মাযহার উদ্দীনের। ওর বাবা ছিলো মাদারীপুরের উকিল। এই ছেলেটা ছিলো ভীষণ অদ্ভুত। মুসলমান হয়েও অমুসলিম ধার্মিক ছিলো। সে ধ্যান করতো, বেদ পড়তো। আর সাম্প্রদায়িকতা কাকে বলে সে জানতো না। মাযহার উদ্দীন এখন জীবিত নেই। নাসির উদ্দীনও এখন জীবিত নেই। আমার আরেকজন বন্ধু ছিলো আবুল কাসেম। সে এখনো তেঁজগা কলেজে পড়ায়। তার মত নন-কমনাল লোক খুব কম পাইবা। সে ইংলিশ এবং জিওগ্রাফীতে এম.এ। তার কাছে যেয়ে কথা বলো, অনেক কিছু জানতে পারবা। তোমরা তো কোথাও যাইবা না। এখন হাতের কাছে পাইছো আমারে–ধরে খালি টানাটানি করো। আমার আরো বন্ধুর নাম শুনতে চাইলে বলতে পারি। যেমন ধরো, রবিউল ইসলাম চৌধুরী, লুৎফুল করিম। লুৎফুল করিম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলো। এখন রিটায়ার্ড। এর বড় একটা পরিচয় হলো সে হচ্ছে younger brother of নাজমুল করিম। নাম শুনেছো? নাজমুল করিম হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। এই যে রঙ্গলাল সেন, সাদ উদ্দীন, আফসার উদ্দীন, সৈয়দ আহমদ এরা সবাই নাজমুল করিমকে দেখেছেন, তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। নাজমুল করিমদের খুবই শিক্ষিত পরিবার। আরো কিছু বন্ধু-বান্ধবের নাম আসবে পরে। সেটা অনার্স ক্লাশে পড়ার সময়। ইন্টারমেডিয়েট পড়ার সময় তেমন কোন হিন্দু বন্ধুর নাম মনে পড়ছে না। সেটা পাবে পরে–যেমন ধরো রবি গুহ। তার সাথে আমার দারুণ বন্ধুত্ব ছিলো এবং এটা রাজনৈতিক বন্ধুত্বও ছিলো। যাই হোক, ৪২ সালে যে আমি ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা দিলাম সে পরীক্ষায় আশ্চর্যজনকভাবে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি সেকেন্ড স্ট্যান্ড করলাম।
আমরা আবারো সে সময়টাতে স্যারের রাজনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলাম।
–আমার রাজনীতি না। সে সময়ের রাজনীতিটা আগে তোমাকে জানতে হবে। তারপরে আমার কথা জানতে চাও। আমি তো পলিটিকস তৈরি করি নাই। আমি পলিটিকসের সঙ্গে জড়িত হয়েছি। এটা একটু খেয়াল রেখো। otherwise এটা একটা personal ব্যাপার হয়ে যায়। লাহোর প্রস্তাব, ক্রীপস মিশন এগুলো জানতে বই পড়তে যাও। আমি কিছু বলতে পারবো না। কয়েকটা ঘটনার কথা হয়তো বলতে পারবো। যেমন বলছি যে, আমার পড়ার সময়ে ঢাকা কলেজে একটা রাজনৈতিক গণ্ডগোল সংঘঠিত হয়েছিলো। And you get the politics–সেই ৪১ সালের দিকে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে পাকিস্তানবাদ develop করতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে শ্যামা-হক মন্ত্রী সভার বিরোধিতার কথা বলতে পারি। আমার কথা বলতে গেলে, ঢাকা কলেজে আমার কিছু লিবারেল ফ্রেন্ডস দাঁড়িয়ে যায়–নট ডেডিকেটেড কন্যুনাল। যাদের নাম আমি একটু আগেই বলেছি। আমরা বই পড়তাম, ম্যাগাজিন বের করতাম, লাইব্রেরি তৈরি করতাম। আবার মুকুল সিনেমা হলে সারারাত জেগে সিনেমা দেখতাম। আমার একটা লেখার নামই আছে-সিনেমা বিশারদ। এক একটা পার্বন উপলক্ষ্যে, ধরো কালী পূজায়, এক টিকেটে সারারাত তিন-চারটা সিনেমা দেখতাম। একবার সারারাত সিনেমা দেখে ভোরবেলা হোস্টেলে ঢোকার সময় সুপারিষ্টটেনডেন্ট অলিউল্যাহ সাহেবের কাছে ধরা পড়লে বন্ধুরা সব দোষ আমার উপরে চাপিয়ে দেয় আর কি! এ নিয়ে আমাকে শাস্তি পেতে হয়েছিলো। সে যাই হোক, আমাদের একটা লিবারেল গ্রুপ দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো যে গ্রুপটা একটু সাহিত্য চর্চা করতো। এই গ্রুপটাই পরে শ্যামা-হক মন্ত্রী সভার সাপোর্ট এবং অপোজের ব্যাপারে ইনভলভ হয়েছিলো। সে সময় মুসলিম লীগের ছাত্ররা হক সাহেবের ঢাকা সফরের সময় তাঁর বিরুদ্ধে ডেমোনেস্ট্রেশনের সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের গ্রুপটাকে এতে যোগ দিতে বলে। তারা জানতো যে আমরা মুসলিম হলেও মুসলিম লীগার না, সাম্প্রদায়িক না। বরং একটু জাতীয়তাবাদী। আমরা যাবো কি যাবো না সেটা আমাদের ব্যাপার বলে আমরা পাশ কাটানোর চেষ্টা করি। পরে তারা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। মারধর করে। ডাইনিং হলে খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তখন আমি কিছুদিনের জন্য ঢাকা ছেড়ে নলছিটিতে বড় ভাইর কাছে চলে যেতে বাধ্য হই এবং সেখানে বসেই ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকি। পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে হোস্টেলে এসে পরীক্ষায় বসি। ঢাকা কলেজে আমি যে খুব একটা ভালো ছাত্র ছিলাম তা নয়। আমি এবং আমার বন্ধুরা ছিলাম ব্যাক বেঞ্চার। ফাস্ট বেঞ্চে থাকতো সৈয়দ আলী আশরাফ, অজিত দে-এরা ছিলো একেবারে ফরমালি ভালো ছেলে আর কি। আসলে ভালো রেজাল্ট করার জন্য আমার কখনো পড়ালেখা করা হয়নি। আমি বরং বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গটাই এনজয় করতাম। এখনো মনে আছে, আমি কখনো সামনে বসলে বন্ধু কামাল আমাকে টেনে পেছনে নিয়ে আসতো। বলতো, তোর জায়গা আমাদের সাথে পেছনে। তুই আমাদের পড়াবি। এত স্নেহের সম্পর্ক আমাদের ছিলো। আসলে ভালো করার জন্য পড়া হয়নি। এমনকি পরীক্ষার পর বড় ভাইকে বলেছিলাম যে পরীক্ষা হইছে আর কি মোটামুটি। কিন্তু রেজাল্টে দেখা গেলো যে, আমি সেকেন্ড প্লেস করেছি। এটা তো বড় একটা ব্যাপার। ফাস্টে প্লেস করতো বরাবরই জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা যারা মূলত হিন্দু। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হওয়া গেলেও মুসলিম ছাত্ররা ঢাকা কলেজেই বেশি ভর্তি হতো। যেমন আমি। যাই হোক, রেজাল্টের ফলে বড় ভাইর মনোভাব বদলে গেলো। মাঝে তিনি ভেবেছিলেন যে আমি বখে যাচ্ছি।
আমরা আবারো স্যারের রাজনীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম। বরিশালে থাকার সময় আরএসপির সাথে পরোক্ষভাবে যেটুকু সম্পর্ক হয়েছিলো সেটা ঢাকায় এসেও ছিলো কিনা জানতে চাইলাম। তিনি না বোধক উত্তর করেন। অবশ্য এ প্রসঙ্গে সোমেন চন্দের খুন হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। তবে বিস্ত রিত কিছু বললেন না। এছাড়াও জানান যে, ঢাকা কলেজে পড়া অবস্থায়ও সরাসরি রাজনীতির সংস্পর্শে তেমন একটা আসেন নি। সেটা শুরু হয় আরো পরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ফজলুল হক হলে ওঠার পর। এ সময় নাজমুল করিমের সাথে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। এছাড়াও রবি গুহ, হেশাম উদ্দীনের নাম উল্লেখ করেন। নতুন ছাত্র থাকা অবস্থায়ই একটা অনুষ্ঠানকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনাতে সাম্প্রদায়িকতার খানিক মহড়া হয়। ঘটনাটা শুরু হয়েছিলো ঢাকা হলের বসন্ত উৎসব বা এ জাতীয় কোন একটা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। কার্জন হলের অডিটোরিয়ামে মেয়েরা উৎসব উপলক্ষ্যে নাচ-গান করার সময় উপর তলার ফজলুল হক বা সলিমুল্লাহ হলের কিছু ছাত্র হয়তো খানিকটা বখামী করেছিলো। এবং ঢাকা হলের হিন্দু ছাত্ররা অপমানিত বোধ করে মুসলিম ছাত্রদের মারধোর করে। পরদিন ফজলুল হক হলের মুসলিম ছাত্ররা ক্লাশ চলাকালে হিন্দু ছাত্রদের আক্রমণ করে। দুপক্ষের সংঘাতের সময় নাজির আহমেদ নামে একজন ছাত্র ছুরিকাহত হয় পরে মারা যায়। স্যার বলেন, সে সময় কোন কোন হিন্দু ছাত্রের ছুরি চালানো সম্পর্কে কুখ্যাতি ছিলো। এ সংঘর্ষ চলাকালে নাজমুল করিম, রবি গুহ, হেশামউদ্দীনরা হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, সরদার ফজলুল করিম চিকেন পক্সে আক্রান্ত অবস্থায় হাসপাতালে থাকলেও তাঁকে শোকজ করা হয়েছিলো। তখনকার দিনেও এখনকার মত রাজনৈতিক নষ্টামীর খবর শুনে আমরা বিস্ময় প্রকাশ করি। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর অন্য একটা ঘটনায় প্রভাবিত হওয়ার কথা স্যার আমাদের জানালেন। চুয়াল্লিশ সালের দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অনেক বিদেশী সৈন্য বিশেষতঃ আমেরিকান সৈন্য ঢাকায় আসে। যার ফলে ঢাকা হঠাৎ করেই কিছুদিনের জন্য আন্তর্জাতিক শহরে পরিণত হয়ে যায়। স্যার বলেন, প্রগতিশীল কিছু আমেরিকান সৈন্যের সাথে হৃদ্যতা তৈরি হওয়ায় আমরা খানিকটা লাইম লাইটে চলে আসি। হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলে ভারতের কম্যুনিস্টরা অবস্থা পরিবর্তন করে মিত্রশক্তির পক্ষ নেয়। স্বাধীনতার দাবিও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ইংরেজরা তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা না দিতে চাইলেও আমেরিকানরা এর পক্ষ নেয়। সৈন্যদের মধ্যে এসব নিয়ে বিতর্ক হতো। আমরা সেসব বিতর্ক শুনতে যেতাম। এ সময়টাতে হিন্দু ছাত্রদের সাথে সাথে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যেও রাজনীতি সচেতনতা বাড়তে থাকে এবং তারা যুদ্ধ সম্পর্কে নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করে। কম্যুনিস্ট ছাত্ররা এই অবস্থানকে capitalize করতে সচেষ্ট হয়। স্যারের মতে, তখন কমুনিস্ট ছাত্ররা became anti-facist more than anti-imperialist. এ সময় আরএসপি ফরোয়ার্ড ব্লকের মত মিলিট্যান্ট গ্রুপসহ কংগ্রেসের অনেক হিন্দুরাও কম্যুনিস্টদের সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলতে শুরু করে। এমনকি রনেশ দাশগুপ্তকেও তখন ছুরি মারা হয়েছিলো। তখন ঢাকার কম্যুনিস্টরা মুসলমান ছাত্রদের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা চালায়। ৪৪-এর দিকে মুসলিম প্রগতিশীল ছাত্রদের সাথে কম্যুনিস্ট প্রগতি লেখক সংঘের যোগাযোগ বাড়তে থাকে। মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে আগে উল্লেখিত বন্ধুরা ছাড়াও সানাউল হক, আবদুল মতিন, সৈয়দ নূরুদ্দীন, মুনীর চৌধুরী এঁরা ছিলেন। সে সময় প্রগতি লেখক সংঘের মধ্যে ছিলেন রনেশ দাশগুপ্ত, অচ্যুত গোস্বামী, সরলানন্দ সেন, কিরণশংকর সেনগুপ্ত প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। এসব ঘটনার মধ্যে দিয়ে সরদার ফজলুল করিমের কম্যুনিস্ট রাজনীতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায়। এ সময়ই অন্য অনেক বন্ধুর মত প্রো কম্যুনিস্ট না থেকে তিনি এ্যাকটিভ কম্যুনিস্ট কর্মীর ন্যায় কাজকর্মে জড়িয়ে যান। এ সময় আবার সৈয়দ আলী আশরাফদের নেতৃত্বে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ দাঁড়িয়ে যায়। সাহিত্য সংসদ যাতে পুরোপুরি মুসলিম লীগের খপ্পরে চলে যায় সেজন্য কম্যুনিস্টরা এর ভেতরে ঢুকে যায়। সরদার ফজলুল করিমসহ আরো অনেকে সাহিত্য সংসদে আসা যাওয়ার মাধ্যমে একে কৌশলে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে হাসান হাফিজুর রহমানদের মত প্রগতিশীল লোকদের হাতে সাহিত্য সংসদের নেতৃত্ব চলে আসে। এসব প্রসঙ্গে স্যার আমাদেরকে ইতিহাস না জানার অভিযোগে অভিযুক্ত করে বলেন, তোমরা তো জানো না যে কাজী মোতাহার হোসেন, নাসিরুদ্দীন সাহেব, নূরজাহান বেগম বা রোকনুজ্জামানের মত লোকেরা সাহিত্য সংসদে বিভিন্নভাবে জড়িত থাকলেও এরা মূলত ছিলেন। কম্যুনিস্টদের লোক।
এসব আলাপ চলার সময় আমরা জানতে চাইলাম, আপনি কি ততদিনে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছেন?
–আমাকে ওরা খুব ভালোবাসতো। রেগুলার মেম্বার করতে চাইতো। তবে তখন পার্টির মেম্বার হওয়া অনেক শক্ত ছিলো। আর আমার একটা সাইকোলজি কাজ করতো যে, আমি দ্বিতীয় বর্ষে পড়া একটা ছাত্র মাত্র তখনো। পার্টির মেম্বার হওয়ারই উপযুক্ত হই নাই।
কিন্তু আপনার মনের অবস্থা কি ছিলো?
–আমার মন তো ততদিনে কম্যুনিস্ট হয়েই গেছে। অন্য আর কোন ইচ্ছাতো ছিলো না। কোন অলটারনেটিভ ছিলো না। বিশেষতঃ যুদ্ধ নিয়ে আমার যে এক্সপেরিয়েন্স আর অ্যাকশন, তারপর তো আমার জন্য প্যারালাল টু কমুনিস্ট অন্য কিছু ভাবার ব্যাপার ছিলো না। Not that I choose to be communist but that I had to be communist. এক্ষেত্রে একটা বিষয় খেয়াল রেখো, আমাদের যে কম্যুনিস্ট গ্রুপটা ছিলো they were the best students of the university.
উপমহাদেশের রাজনীতিতে তখন যে ভয়ংকর দোলাচল চলছিলো সে ব্যাপারে আপনাদের যুক্ততা বা ভূমিকা কি ছিলো?
–তখনো পর্যন্ত আমি ঢাকা বেইসড রাজনীতি করছি। এমনকি বেঙ্গল বেইসডও নয়। আমাদের কম্যুনিস্ট গ্রুপটার লক্ষ্য ছিলো ঢাকার রাজনীতিটাকে যাতে কেউ communalized না করে ফেলতে পারে। সেজন্য আমরা হিন্দু মুসলিম unity টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছি। কোথাও একটা Killing হলে তার প্রভাবে এখানে যাতে কিছু শুরু না হয়ে যায় সে চেষ্টা করেছি। ধরো একটা শান্তি মিছিল বের করে শহর ঘুরে আসা এরকম অনেক ব্যাপার। শাহ আজিজ, ফরিদ আহমদ যে এক সময় কম্যুনিস্টদের সাথে জড়িত থাকলেও পরে নেজাম-ই-ইসলামে যোগ দেয়, এরকম লোকগুলারে পর্যন্ত আমরা শান্তি। মিছিলে ঢুকিয়ে শহর ঘুরতে বাধ্য করছি। কাজী মোতাহার হোসেন সাহেবকেও ব্যবহার করেছি। আসলে সে সময় আমাদের ভূমিকা অনেকটা জাতীয়তাবাদীর একথা বলতে পারি। তবে আমরা কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলন করি নাই। নাজমুল করিম যদি কিছু করেও থাকেন অতি সামান্য। হেশাম উদ্দীন তো কম্যুনিস্ট লীডারই। তবে স্বীকার করছি যে, main current ছিলাম না। main current ছিলো মুসলিম current সে সময় তারা আমাদের, অর্থাৎ Communist দের আক্রমণ করছে।
পাকিস্তান আন্দোলন সম্পর্কে আপনাদের ভাষ্য কি ছিলো?
–আমাদের ভাষ্য ছিলো national minority প্রশ্নটা আগে solve করতে হবে। যে কথাটা বললাম, আমাদের কম্যুনিস্ট গ্রুপটা তো তেমন বড় গ্রুপ না। তাহলে তো মুসলিম লীগরে শেষ করে দিতে পারতাম। তখন মুসলিম লীগই বড় গ্রুপ। It is becoming bigger and bigger. এটা তখন লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের দিকে এগুচ্ছে। আর আমরা তখন ক্রমশই আমাদের অবস্থান হারিয়ে ফেলছি।
আপনাদের আদৌ কি কোন অবস্থান ছিলো? আমরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্যারকে জিজ্ঞাসা করি। তিনি তেঁতে উঠে বললেন :
-একেবারে ওভাবে বোলো না। মনে করে দেখো সে সময়ের নৌ বিদ্রোহ, আশি দিনের ট্রাম ধর্মঘট এগুলোর কথা। যা দেখে both Congress and the British, they got frightened because of the evolving strength of a third force. অর্থাৎ কম্যুনিস্ট ফোর্স, ওয়াকার্স ফোর্স, পিসেন্ট ফোর্স। তারপরে ভাবো আমাদের তেভাগা আন্দোলনের কথা। জানো তোমরা মুসলিম লীগ কি পরিমাণে oppose করেছিলো? একটা বিষয় তোমাদের বুঝতে হবে যে তখন সর্বভারতীয় হিসাবে ধরলে কম্যুনিস্টরা একটা বড় শক্তি ছিলো। Communist flag was flown. নৌ বিদ্রোহের সময়। জাহাজের মাস্তুলে নাবিকরা তিনটা পতাকা উড়িয়ে ছিলো–কংগ্রেস, মুসলিম লীগের পতাকার সাথে কম্যুনিস্ট পতাকাও সেখানে উড়েছিলো। এগুলো একটা symbolic ব্যাপার আর কি। একটা নতুন force develop করছিলো। যে ফোর্সটাকে গান্ধীজিও উঠতে দিতে চাচ্ছেন না। তবে গান্ধী প্রসঙ্গে আমি বলবো যে গান্ধীজির দুর্বলতা ছিলো। ঐ যে ধর্মের ব্যাপারটা। কিন্তু এখানে এটাও উল্লেখ করবো যে, তিনি ধর্মকে বিক্রি করেন নাই। বলতে পারো ধর্মই তার আদর্শ। এখন ধর্ম বিক্রি হচ্ছে, ব্যবসা করছে। But Gandhi didnt do that এমন নজীরও আছে যে কোরান পড়তে না দেয়ার প্রতিবাদে তিনি সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন। যা হোক, তোমাদের আগ্রহের জায়গাটার সূত্র ধরে। বলি–ঢাকায় আমাদের চেষ্টাটা ছিলো, এখানে যেন কোলকাতার মত communalism-টা develop না করে। এজন্য আমরা জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছি। ঢাকায় জ্ঞান চক্রবর্তী, ফনিহ, অনিল মুখার্জীসহ অনেকে কাজ করেছেন। ঢাকার বাইরেও অনেকে ছিলেন। যেমন বগুড়ায় ডাক্তার কাদের। আবার ওদিকে মনিকৃষ্ণ সিংহ ছিলেন। বর্তমান কম্যুনিস্টদের দুর্বলতা কি জানো? এরা নিজেদের ঐতিহ্যটা সম্পর্কে সচেতন না। এরা যদি কোন চরিত্রাভিধান তৈরি করে থাকতো তাহলে যে কথা তুমি আমার কাছে জানতে চাইছো, আমি বলতে পারতাম যে কম্যুনিস্ট পার্টির চরিত্রাভিধানটা পড়ো।
কথা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা এসে পড়ে। কেমন ছিলো তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ?
–অনেক ভালো ভালো শিক্ষক ছিলো। যেমন ধরো, প্রফেসর রাজ্জাক। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্রফেসর রাজ্জাক became professor Razzaqe because of Rabi Guha, Sarder Fazlul Karim-4g yo 94675 জন্য। আমাকে একবার হল ইলেকশানে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। সেবারই প্রথম ইলেকট্রিক মাইক্রোফোন ব্যবহার করে আমরা সভা করি। একদিন ক্লাশ নেয়া অবস্থায় আমার বক্তৃতা তার কানে ঢুকলে নিজের বক্তৃতা থামিয়ে ছাত্রদের আমার বক্তৃতা শুনতে বলেন। ভাবতে পারো, কি কাণ্ড! যাই হোক কম্যুনিস্ট হওয়ার কারণে আমি নির্বাচনে হেরে যাই। তবে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বীকে গাল না দেয়ার নীতি কঠোরভাবে মেনে চলতাম। হেরে যাওয়ার পর আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে আমাদের প্যান্ডেলে বক্তৃতা দেয়ার জন্য ডেকেছিলাম। আমার সম্পর্কে বিরোধী দল বলতো যে, ওর সঙ্গে কোন argument এ যাওয়া যাবে না। মারবি যখন মারবি। শিক্ষকদের মধ্যে আরো ছিলেন মোজাফফর আহমদ চৌধুরী। He was pro-communist. তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ organ পিপলস ওয়ার, জনযুদ্ধ এসব পত্রিকা পর্যন্ত বিক্রি করতেন। পরে এই পত্রিকার আলোকেই তিনি এবং নৃপেন চক্রবর্তীরা মিলে স্বাধীনতা পত্রিকা প্রকাশ করেন। মুসলমান শিক্ষকদের মধ্যে কম্যুনিস্টদের সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলো এমন আরেকটা নাম শহীদুল্লাহ সাহেব অর্থাৎ ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
তাহলে আপনি কম্যুনিস্ট হয়ে গেলেন? আগের প্রশ্নটা আবারো আমরা উত্থাপন করি।
-এটা তুমি কি বলতে চাও? আমি তো দেখি যে তখন আমার চারদিকে সবাই কম্যুনিস্ট। আমাদের পলিসি ছিলো কাউকে hostile না করে বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলো দখল করে নেয়া। যেমন ধরো, মুসলিম লীগের নেতা আবুল হাশিম-বন্ধু, মান্যবর। আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। তাকেও আমরা ডিল করেছি কমুনিস্টের জায়গা থেকে। পাটি আমাদেরকে হুকুম করছে, তোমরা হাশিম সাহেবের কাছে কাছে থাকবা। যা সাহায্য লাগে করবা। এই রকম ইকুমই করা ছিলো। হুকুমের চোটে আবার ধরো দুই একজন নষ্টও হয়ে গেছে। যেমন ধরো শামসুদ্দীন। আবুল হাশিম সাহেবকে সামলানোর জন্য তাকেও পাঠানো হয়েছিলো। সে এমনি সামলায় যে নিজেই পাকিস্তানপন্থী হয়ে যায়। পরে পাকিস্তানেই চলে যায়। সেখানেই মারা যায়। কথা হলো যে সব প্রচেষ্টাই যে সফল হবে এমন কোন কথা নেই। শামসুদ্দীন নষ্ট হইছে কিন্তু তবু তো আমি আজ পর্যন্ত বেঁচে আছি। তোমরা বাঁচিয়ে রাখছো বলে বেঁচে আছি। আমার নিজের কোন বাহাদুরী নাই। কিন্তু এই বেঁচে থাকাটা I am enjoing and you also should enjoy. আমার একমাত্র রিকোয়েস্ট হচ্ছে যে, যা আমি জানি না তো তোমাদেরকে জানতে হবে। আমার আফসোস হচ্ছে you do not know your noble heritage. মানুষ হিসাবে যে গৌরবজনক ঐতিহ্য তোমার আছে সেটা না জেনে তুমি মানুষ হতে পারবে না। এটাই আজকের দিনের পলিটিকসেরও সমস্যা। শেখ হাসিনা কি এসব জানে? Even her father; তিনিও এসব ব্যাপারে তেমন একটা কেয়ার করেন নাই। Pakistanism কি জিনিস, এটা কি মুজিব যথার্থই বুঝতে পারছিলেন? যেমন। পেরেছিলো কমুনিস্টরা। বুঝতে পারে নাই বলেই মুজিব বাংলাদেশ তৈরি করেছে কিন্তু anti-Pakistanism তৈরি করতে পারে নাই। এটা একটু খেয়াল করতে হবে। এখানেই গৌরব উজ্জ্বল ঐতিহ্য বুঝতে পারার গুরুত্ব। Pakistanism-এর ধারণার বিরুদ্ধে কমুনিস্টদের যে অবস্থান ছিলো সেটাই গুরুত্বের সাথে বোঝার ব্যাপার আছে। Anyway আমাদের তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থানটাকে এভাবে বলতে পারি যে, তখন আমরা কম্যুনিস্টরা। Nill ছিলাম না আবার Full-ও ছিলাম না। Full control-এ থাকতে পারলে তো ইতিহাস অন্যরকম হতো। আমরা দেশভাগও হতে দিতাম না। সেই সময়ে আমাদের ভূমিকা যে একেবারে কম ছিলো না এটা তোমাদের আত্যন্তি কভাবে জানতে হবে। এটা বই পড়ে হবে না। Not by reading books but by unearthing যত তুমি unearth করতে পারবা ততই ভালো। সোমেন চন্দকে জানতে চেষ্টা করো। কমুনিস্ট মেনিফেস্টো বারবার পড়ো। গ্রামশী পড়ো। পিপলকে বোঝার চেষ্টা করো বেশি বেশি আমেরিকা, বিলাত যাওয়া বন্ধ করো।
.
প্রথম জেল জীবন
৩১ জানুয়ারি ২০০৩
দুমাসেরও বেশি বিরতির পর আজ আবার আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা স্যারের সামনে বসেছি। শেষ আলাপের সূত্রটুকু মনে করিয়ে দেয়ার পর আমরা নির্দিষ্ট করে দেশভাগের সময়ে স্যারদের অর্থাৎ কম্যুনিস্টদের অবস্থা কেমন ছিলো জানতে চাইলাম। স্যার কথা বলতে শুরু করেন।
–ঠিক আছে। তোমাকে আমি অনেকদিন মিস্ করেছিলাম। আমার কাছের লোক না থাকলে আমি বড় অসহায় বোধ করি। তোমাদের যেহেতু আগ্রহ আছে সেহেতু আমার স্মৃতি তোমাদেরকে একটু দেয়ার দরকার আছে। আমি পুরো দেশ নিয়ে নয়, এমনকি ঢাকা জেলা নিয়ে নয় বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ঢাকা শহরে আমাদের অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা বলতে পারি। সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব বড় রকমের না হলেও কমুনিস্ট কর্মীদের একটা ভালো অবস্থান ছিলো। তোমাদের সাথে আলাপের একটা সমস্যা হলো যে সে সময়টা তোমাদের পক্ষে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। কারণ হচ্ছে সময় তো একটা স্রোতস্বিনী নদীর মত। সময় তো প্রবাহিত হয়ে যায়। যে সময় অতীত হয়ে গেছে সে সময় বর্তমানের কাছে তুলে ধরা খুব ডিফিকাল্ট। আরেকটা ব্যাপার হলো সবকিছু তো আমার স্মৃতিতেও এখন আর নেই। কাজেই আমরা নির্দিষ্ট সময়ের উপর কিছু পাঠ করে, কিছু শুনে, ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে একটু জোড়াতালি দিয়ে সময়টা ধরার চেষ্টা করতে পারি মাত্র। তোমাদের প্রশ্নে ফিরে আসি। সে সময়ে আমরা কম্যুনিস্টরা অন্য একাধিক প্রবল আদর্শের সাথে একটা দ্বন্দ্বমান আদর্শ হিসাবে কাজ করেছি। সে সময়ে মূল আদর্শ হচ্ছে ধর্মের ভিত্তিতে, অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানের ভিত্তিতে দেশটা ভাগ হবে। একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, হিন্দু এবং মুসলমানের ভিত্তিতে যারা ভাগ করছে তারা কিন্তু জাতিগত বিশ্বাসগত বা সাংস্কৃতিক মাইনরটির ব্যাপারটা হিসাবে ধরছে না। একমাত্র কন্যুনিস্ট পার্টির ভেতরেই এই চিন্তাটা ছিলো। আবার পাকিস্তান আন্দোলনকে কিভাবে দেখা হবে এ বিষয়ে কমুনিস্টদের একটা সমস্যা দাঁড়ায়। কেননা তত্ত্বগতভাবে পাকিস্তানবাদ স্বীকার না করলেও এর বাস্তব দিকটা অস্বীকার করা যাচ্ছিলো না। এর মধ্যে একটা element of truth আছে। তা হলো question of national minorities হ্যাঁ ঠিক আছে, মুসলিম লীগ এটাকে ধর্মের ভিত্তিতে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু এই যে পাকিস্ত নিজমের চিন্তাটা, এটা যেহেতু মূল স্রোত একে hostile করে কি হবে? এটা হলো এক ধরনের চিন্তার কাঠামো। এখন এই চিন্তার যে ভ্রান্তি তাকে তো জোর করে কথার মাধ্যমে শেষ করে ফেলা যাবে না। আমাকে তার কাছে যেতে হবে, তাকে ম্যানেজ করে ফেলতে হবে এ প্রসঙ্গে হাশিম সাহেবের প্রসঙ্গ চলে আসে। মনে রাখবে জাতীয়তাবাদী পরিবারগুলো অন্যতম একটি পরিবার থেকে হাশিম সাহেব এসেছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলনকে তিনি নিজের আন্দোলনই মনে করেছেন। কিন্তু তাহলে পরেও বুঝতে হবে যে, খাজা নাজিমুদ্দীন বা অন্যান্য সামন্তবাদী নেতা পাকিস্তান আন্দোলনকে যেভাবে দেখাতে চান তিনি সেভাবে দেখাতে চান না। এখানে এইটাই বড় কথা যে, খাজা নাজিমুদ্দীন আর আবুল হাশিম সাহেব এক না। এমনকি সোহরাওয়ার্দীও এক না। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সে সময়ে আমাদের গ্রুপটা বেশ সক্রিয় ছিলো এবং এটা পরিচালিত হতো under the guidence of the communist organizations, communist party. 145 বিভিন্নভাবে কাজ করতাম। যেমন ধরো, প্রগতি লেখক সংঘ ছিলো। এছাড়াও জনযুদ্ধ, স্বাধীনতা, পিপলস ওয়ারের মত প্রো-কম্যুনিস্ট পত্রিকাগুলোকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকদের মধ্যে পুশ সেল করতাম। তুমি এখন শুনলে আশ্চর্য হবে, বুঝবে যে আমাদের দৌড়টা কদ্দূর পর্যন্ত ছিলো। এই যে মরহুম মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী যিনি স্বাধীনতার পর ভিসি হয়েছিলেন, তিনি তখন টীচার নাকি সিনিয়র স্টুডেন্ট ছিলেন এখন মনে নাই, সেই মোজাফফর আহমদ চৌধুরীও আমাদের সাথে পত্রিকা বিক্রির স্কোয়াডে থাকতেন। এসব বলে আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে, দেশভাগের সময় কম্যুনিস্টরা একটা কারেন্ট ছিলো। হয়তো প্রধান কারেন্ট না। তবে মুসলিম লীগ এটা কাউন্ট করতো। প্রমাণ হিসাবে বলতে পারি, ৪৭ বা ৪৮ সালের দিকে দেশের পরিস্থিতি আলোচনার জন্য কম্যুনিস্ট পার্টির নির্দেশে আমি, মুনীর চৌধুরীসহ কয়েকজন যখন সদরঘাটে লেডিজ পার্কে একটা সভার আয়োজন করি। সে সভা আক্রমণের শিকার হয়। সুলতান যে পরবর্তীতে বিচারপতি হয়, শাহ আজিজ এদের যে গ্রুপটা ছিলো তারা আমাদের আক্রমণ করে এবং সভা পণ্ড করে দেয়। এগুলো প্রমাণ করে যে, কম্যুনিস্ট গ্রুপটাকে মুসলিম জঙ্গীরা পছন্দ করছে না। তারা এই গ্রুপটাকে কথা বলতে দিতে চায় না। আমাদের পজিশনটা ছিলো আক্রান্ত হওয়ার পজিশন। আক্রান্ত কে হয়? যে আক্রান্ত হওয়ার গুরুত্ব রাখে সে। আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস আরো আছে। পার্টিশানের পরপরই কমরেড মোজাফফর আহমদর রথখোলার National Book Agency আক্রমণ করে তছনছ করে ফেলা হয়। এগুলো কোনটাই কিন্তু কম্যুনিস্টদের দুর্বলতার পরিচয় নয় বরং সবলতার পরিচয়। ঐ রকম কাছাকাছি সময়েই সলিমুল্লাহ হলে মুনীর চৌধুরীর কক্ষ আক্রমণ করা হয়।
আলাপের এ পর্যায়ে এসে ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯র মধ্যবর্তী সময়ের উল্লেখযোগ্য ব্যাপার সম্পর্কে জানতে চাই। এরকমভাবে সময় বিভাজনের কারণ হলো ১৯৪৯ সাল থেকে সরদার ফজলুল করিমের জেলজীবন শুরু হয়। এবং স্যারের জেলজীবন সম্পর্কে ব্যাপক কৌতূহলের কারণে বিষয়টা সম্পর্কে আলাদাভাবে আলাপের মনস্থ করি। সেজন্যই এর আগের বিষয়াবলী স্পষ্ট হওয়াটা একটু প্রয়োজনীয় বলে মনে হলো।
–এখন ধরো আমি ৪৬ সালে এমএ পাশ করলাম। তারপর কিছুদিন ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টে টীচার হিসাবে জড়িত ছিলাম। আরেকটা বিষয় মনে রাখো যে, এসময় আমার কম্যুনিস্ট এসোশিয়েসনটা ক্রমান্বয়ে গম্ভীর হচ্ছিলো। একটা সময়ে এসে under the order of the party আমি টীচারশীপ থেকে রিজাইন করি। সে সময়ে একটা crisis period চলছিলো। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে হিন্দু কমরেডরা চলে যাচ্ছিলেন। তখন আমি সহ আরো কয়েকজন পুলিশ এবং ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের কাছে বেশি লক্ষযোগ্য হয়ে পড়ি। এসব আমি বলছি ৪৮ সালের শেষ দিককার কথা। তুমি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে পুরোনো ফাইল ঘেঁটে বের করতে পারো, অবশ্য যদি এখনো সংরক্ষিত থাকে, তাহলে দেখবা যে আমার নামেও একটা ফাইল আছে। সেখানে দেখবা যে হোম ডিপার্টমেন্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে এই মর্মে চিঠি দেয়া হয়েছে যে, explain-why Sarder Fazlul Karim has resigned and where is his where abouts? U15 আস্তানা কোথায়-এসব আর কি? আমার ব্যাপারটা ছিলো এরকম যে, আমার। কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলো না, resign দিলে কি হবে এসব ভাবনায় আসে নি। কোন পারিবারিক দায়িত্বও ছিলো না। ফ্যামিলি যখন খবরটা শুনলো একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেলো–কি ব্যাপার? এর আগে কমনওয়েলথ বৃত্তির অধীনে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ বাদ দেয়ার ব্যাপারটা ছিলো।
আর পার্টি? প্রশ্ন রাখি।
রিজাইন করার পর পার্টি আমাকে আন্ডার গ্রাউন্ডে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ঢাকায় সে সময় গোপন আশ্রয় লাভের জায়গাগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। এমন অবস্থায় পার্টি আমাকে ঢাকা জেলার চালাকচর বলে একটা জায়গায় পাঠিয়ে দেয়। সেখানে আন্দামান ফেরত অন্নদা পাল, প্রাইমারী শিক্ষক ও পার্টি সদস্য আখতারুজ্জামান সহ শরীফপুর, পীরপুর অঞ্চলের কয়েকজন পান চাষী আমাকে আশ্রয় দেন। বেশ কয় মাস পরে একটা গোপন মিটিংয়ে যোগদানের জন্য ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়। সন্তোষ গুপ্তের বাড়িতে মিটিং করার সময় আমরা গ্রেপ্তার হই। তারিখটা খুব সম্ভব ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৯।
এবারে আমরা সরদার ফজলুল করিমের প্রথম জেল জীবনের কাহিনী শোনার প্রস্তুতি নেই। জেলখানার জীবন, সহযোদ্ধাদের সাথে স্মৃতিগুলো, বিশেষ কোন ঘটনা, সে সময়ের চিন্তাভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে বলার জন্য আমরা স্যারকে অনুরোধ করি।
ঠিক আছে। কিন্তু তুমি যেভাবে বললে অর্থাৎ আপনার জেলজীবন সম্পর্কে কিছু বলেন তাতে করে মনে হয় যে আমি একটা ব্যক্তি, এই ব্যক্তি জেলে গেলাম এবং এই জেলটা আমার এবং এই জেলে ঘটে যাওয়া সব কিছুই আমি কেন্দ্রিক। তা কিন্তু না। তোমরা যারা নতুন প্রজন্ম তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে এই জেলের ব্যাপারটা সামগ্রিকতার মধ্যে ধরে বিচার না করলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধীনতা যাই বলো না কেন, এসব ব্যাপারগুলো স্পষ্ট হবে না। সে সময় আমি, সন্তোষ এরাই যে শুধু এ্যরেস্ট হলাম তা নয়। তখন একজন দুজন নয় hundreds of communists were arrested and put into jail. দেশের সব জেলে। কে কোন জেলে ছিলো তা খুঁজে বের করো। তোমাদেরই তো রাষ্ট্র, জেলখানা। কর্তৃপক্ষের কাছে যাও তাদের পুরোনো ফাইলপত্র দেখাতে বলো। এটা করতে না পারলে একটা পুরো চিত্র তুমি পাবে না। আমার কিছু কথাই শুধু জানতে পারবে। যা হোক, আমাদের যখন ঢাকা জেলে ঢোকানো হয় সেখানে তখন allready একশ কি দুইশ কম্যুনিস্ট বন্দী আগে থেকেই আছেন। এবং বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে জেলের ভেতরে হাঙ্গার স্ট্রাইক চলছে। হাঙ্গার স্ট্রাইক ছাড়া তখন আর কোন উপায় ছিলো না। রাজবন্দীদের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা ব্রিটিশ আমল থেকে চালু ছিলো পাকিস্তানী এ্যাডমিনিস্ট্রেশান সেগুলো সব কেটে দিলো। আর জেলের ভেতরে সাধারণ কয়েদীদের লেলিয়ে দিলো এই বলে যে, এই যে সব কম্যুনিস্টগুলো এরা সব পাকিস্তানের শত্রু, এদের যেভাবে পারো শেষ করো। সে যাই হোক, এখন সুযোগ-সুবিধা কেটে দিলো বললে তো সব কিছু বোঝায় না। জেলখানায় না গেলে তো তুমি বুঝবা না কেটে দেয়ার মানেটা কি? আমাদের নতুন প্রজন্মের অসুবিধা হলো, এরা জেল শব্দটাই শুনেছে জেলের ভেতরে তো ঢোকে নাই। আর এখন যারা ঢোকে তারা কিভাবে ঢোকে, কেন ঢোকে সেগুলো আলাদা রিসার্চের ব্যাপার আর কি। যা হোক যা বলছিলাম, ঐ হাঙ্গার স্ট্রাইকটা যতদূর মনে পড়ে আটান্ন দিন চলে। এটা তো খেলার কথা না। আমার মত দুর্বল মানুষও এতে যোগ দিয়েছিলাম। আমরা শুধু লবণ মেশানো পানি খেতাম। ওরা খাবার দিয়ে যেতো আমরা খেতাম না। ছয়দিনের মাথায়। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কারা কর্তৃপক্ষ এ পর্যায়ে force feeding শুরু করে। অর্থাৎ জোর করে খাওয়ানো। তারা অনশনরত কয়েদীদের জোর করে ধরে শুইয়ে ফেলে নাকের ভেতরে রবারের নল ঢুকিয়ে তরল দুধ খাওয়াতো। এরকম অত্যাচারে কুষ্টিয়ার কটন মিলের একজন নেতা শিবেন রায় শ্বাসনালীতে তরল ঢুকে মারা যায়। আটান্ন দিনের মাথায় সরকারের তরফ থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর অঙ্গীকার করা হয়। তখন ঢাকা কম্যুনিস্ট পার্টির সেক্রেটারী ফনি শুহের নেতৃত্বে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা শেষে কম্যুনিস্টরা অনশন ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। কেননা আর বেশি দিন চললে সেটা হতো আত্মহত্যার শামিল। কিন্তু আমরা আত্মহত্যার জন্য সেখানে যাই নাই। দুঃখের ব্যাপার কি জানো–এখনকার কম্যুনিস্টরা ফনি গুহের নাম জানেও না বলেও না।
আপনি আমরা বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন? শুধু কম্যুনিস্টদের?
-মেজর অংশ তো কমুনিস্টরাই ছিলো। শতাধিক। এর বাইরে ধরো, কংগ্রেসের প্রগতিশীলদের একটা অংশ কম্যুনিস্টদের সাথে ছিলো। তারা কে কে ছিলেন কতজন ছিলেন এসব আমি বলতে পারবো না। ৫০র গোড়ার দিকে কর্তৃপক্ষ করলো কি যারা অনশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদেরকে একসাথে রাখা বিপজ্জনক মনে করে বিভিন্ন জেলে পাঠিয়ে দিতে শুরু করলো। আমাকে পাঠানো হলো সিলেট জেলে। জেলের ভেতরে থেকেই খাপড়া ওয়ার্ডের হত্যাকাণ্ডের খবর শুনি। সিলেট জেলেও অনশন হয়েছিলো। সেটা বোধ হয় আমি যাবার আগে। সেখানে বন্দীদের উপর নিদারুণ নির্যাতন হয়েছে। সিলেট জেলে অজয় ভট্টাচার্য ছিলেন। নানকার বিদ্রোহ নামে তার বিখ্যাত গ্রন্থ আছে। তিনি অবশ্য পরবর্তীতে কোন কম্যুনিস্ট গ্রুপের সাথে থাকেননি। কিন্তু আজীবন কমুনিস্ট ছিলেন। ৫০ সালের শেষের দিকে আমাকে রাজশাহী জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এবং ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আমি সেখানেই ছিলাম। রাজশাহী জেল থেকেই ভাষা আন্দোলনের খবর জানতে পারি। কিভাবে আমাদের জন্য বরাদ্দ সংবাদপত্রের সেন্সরশীপের মাত্রা ক্রমশই বাড়তে থাকার সাথে ভাষা আন্দোলনের সফলতার যোগসূত্র আবিষ্কার করি সে কাহিনী বোধ হয় তুমি জানো। এ বিষয়ে আমি বিভিন্ন সময়ে লিখেছি।
-’৫৩ সালে আমাকে পাঠানো হয় কুমিল্লা জেলে। কতদিন ছিলাম মনে নেই।
’৫৪ সালের বিভিন্ন জেলে যাদের সাথে ছিলেন তাদের নামগুলো শুনতে চাইলাম। কিন্তু স্যার রাজী হন নি। কেননা এসব মহৎ নামগুলো খুঁজে বের করাটা আমাদের দায়িত্ব হিসাবে উল্লেখ করলেন। নাম শোনার আশা বাদ দিয়ে আমরা প্রাদেশিক নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চাই। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের সময়ও তিনি কুমিল্লা জেলে। বেশ কয়েক মাস পর, সেপ্টেম্বর মাসে পঁচিশ তারিখে কথায় কথায় কিছু নাম জেনে নিই যারা স্যারের সাথে বিন্নি জেলে। ছিলেন। যাদের নাম তিনি মনে করতে পেরেছেন তাঁরা হলেন : সিলেট জেল শফিউদ্দীন, গোপেশ মালাকার, বিজয় পুরকায়স্থ, সত্যব্রত দাশ, অজয় ভট্টাচার্য, লালা শরদিন্দু দে, বরুন রায়। রাজশাহী জেল-বগুড়ার নেতা আবু (মাজহারুল ইসলাম), প্রিয়ব্রত দাশ। কুমিল্লা জেল-অজয় ভট্টাচার্য, সত্যেন সেন।
ঐ নির্বাচনে তো আপনি জয়লাভ করেছিলেন। সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
-কি বলবো? তোমরা শুধু এটুকুই জানো যে ঐ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ হেরে ছিলো আর যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করেছিলো। কিন্তু ঐ যুক্তফ্রন্ট কাদের প্রচেষ্টার ফসল? সাধারণভাবে মনে হবে আওয়ামী লীগের কিন্তু আওয়ামী লীগের ভেতরে থেকে কারা কাজটা করেছিলো? এ কাজটা করেছিলো আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা কম্যুনিস্টরা। তখনকার ইস্ট পাকিস্তান এ্যাসেম্বলিতে ত্রিশ জনেরও বেশি কমুনিস্ট ছিলেন। এরাই প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের জন্যে যুক্তফ্রন্টের ব্যাপারটা সংগঠিত করে। নির্বাচনের পরে ৫৫ সালে আমি মুক্তি পাই। সেটাই স্বাভাবিক ছিলো। কেননা রাজবন্দীদের মুক্তিদান যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ওয়াদা ছিলো।
আমরা দেখতে পাচ্ছি যে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রটির শুরুর দিক থেকেই আপনাকে জেলে থাকতে হচ্ছে। এবং পরবর্তী কয়েক বছরে সংগঠিত অনেকগুলো বড় বড় রাজনৈতিক ইভেন্টে আপনি প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। কিন্তু যেটুকু শুনেছি তা হলো জেলখানার ভেতরেও আপনাদের রাজনীতি চর্চা থেমে থাকেনি। জেলখানার ভেতরে রাজনীতি চর্চা, পারস্পরিক সম্পর্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবহার এসব নিয়ে কিছু বলুন।
–এক কথায় তো এসব বলা যাবে না। এটুকু বলা যায় যে জেলের ভেতরেও কম্যুনিস্টরা একটা organized life lead করার চেষ্টা করছে। সবাইকে তো এক জায়গায় রাখা হতো না। ধরো কিছু বন্দীকে রাখা হতো ওয়ার্ডে আবার যাদেরকে বিপজ্জনক মনে করতো তাদেরকে রাখতে সেলে। তথাপি যেখানে যে কয়জন থাকতো তারা অর্গানাইজড থাকার চেষ্টা করতো। জেলের ভেতরেই তারা নানা রকমের কমিটি তৈরি করতো। এমনকি প্রশাসনের সাথে দেনদরবার করার জন্য কমিটি গঠনেরও নজীর আছে। এই ব্যাপারটাকে সাধারণত একটা টেকনিক্যাল টার্ম ব্যবহারের মাধ্যমে বোঝানো হতো। টার্মটা হচ্ছে Communist cosolidation, কম্যুনিস্ট বন্দীরা এসেছিলো সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে। কেউ কৃষক শ্রেণী থেকে, কেউ তেভাগা আন্দোলনের কর্মী, কেউ হাইস্কুলের ছাত্র, শ্রমিক শ্রেণী থেকেও কেউ কেউ এসেছে। অর্থাৎ একটা মিক্সড আপ। সবাই তো আর এ রকম না। জেলের ভেতরে আমাদের লক্ষ্য ছিলো সবার মনোবলটা ঠিক রাখা। এলক্ষ্যে আমরা বিভিন্ন কিছু করতাম। যেমন কাটা-ছেঁড়া করা সংবাদপত্র যা আমরা পেতাম সেটা থেকে লেখা তৈরির জন্য কোন একজন কমরেডকে দায়িত্ব দেয়া হতো। এটা আবার নির্দিষ্ট দিনে সবার সামনে উপস্থাপন করা হতো। এছাড়াও সেন্সর হওয়া সংবাদপত্র খুঁজে যেটুকু খবর পেতাম তা থেকেই সবাই বুঝ পাওয়ার চেষ্টা করতাম যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অবস্থা পাল্টে যাচ্ছে। আন্ত র্জাতিক পরিমণ্ডলে সে আভাষ দেখা যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ পিছু হটছে। এসব আমরা করতাম। তারপর আবার মাঝে-মধ্যে সবাই একটু ভালো খাওয়া দাওয়ার চেষ্টা করেছি। খেলাধুলা করেছি। অর্থাৎ এসবই আমরা করতাম। কম্যুনিস্টদের মনোবল অটুট রাখার জন্য।
স্যার জেলখানার ভেতরে তো আপনারা তথ্য ঘাটতিতে থাকতেন। তাহলে এই যে একটু আগে বললেন মনোবল অটুট রাখার জন্য আপনারা অবস্থা পাল্টে যাচ্ছে বলে একে অপরকে ধারণা দিতেন, এটা কিসের ভিত্তিতে করতেন?
দুইভাবে। কাটা-ছেঁড়া যাই হোক কিছু সংবাদপত্র আমরা পেতাম। আর আমাদের চেষ্টা থাকতো এমন একটা সিমপ্যাথেটিক সেপাই জোগাড় করা যে আমাদের একটা স্লিপ বাইরে নিয়ে যাবে। জায়গামত পৌঁছে দেবে এবং কিছু খবরাখবর নিয়ে আসবে। এই পদ্ধতিতে পার্টি আমাদের কাছে অনেক গোপন তথ্য, ডকুমেন্ট, নির্দেশ পাঠিয়েছে। সেগুলো আবার হাতে নকল করে জেলখানার ভেতরে বিভিন্ন অংশে বন্দীদের দেয়া হতো। এগুলো নিয়ে আলোচনা হতো। যত সহজ মনে করছো অত সহজ বিষয় এগুলো ছিলো না। ভীষণ ডেঞ্জারাস আর কি। নির্যাতনের ভয় ছিলো। কোন সেপাই ধরা পড়লে চাকরি চলে যেতো। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করবো। আমরা কিন্তু জেলে সিমপ্যাথেটিক লোক ঠিকই পেয়ে যেতাম। সেপাইরা আমাদের ভালোবাসতো। কম্যুনিস্টদের মত লোক তো সমাজে কম যে কিনা একজন সেপাইকেও কাছে টেনে মমতা ভরে তার বাড়ি ঘরের খবর জিজ্ঞাসা করতে পারে।
জেলখানায় থাকাকালীন সময়ে আপনার পরিবারের সাথে কি যোগাযোগ ছিলো? তারা ব্যাপারটাকে কিভাবে নিয়েছিলেন?
–আমার বড় ভাই সরকারি চাকুরে হওয়া সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে জেলে আমাকে দেখতে এসেছিলেন। সঙ্গতভাবেই তিনি রাগ করেছিলেন। খুব রাগ করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি এসব কি আরম্ভ করেছ? কার জন্য করছ? এই সব আর কি। কারা কর্তৃপক্ষ ভাইকে পরামর্শ দিয়েছিলেন আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বণ্ড দিয়ে বের করে নেয়ার জন্য। যাই হোক সেগুলো হয়নি। আমি আছি। আছি আর কি। বড় ভাই রাগ করে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বলে। গেলেন আরো একটা ভালো ছেলেও এরকম নষ্ট হয়ে গেছে-সে হলো আবদুস শহীদ। এই শহীদকে তোমরা চেনো না। কেউ হয়তো পরে কখনো তাকে রাস্তাঘাটে ঘুরে ঘুরে বই বেঁচতে দেখেছে। কিন্তু তার আসল কাহিনী কয়জন জানে? শহীদ একটা রিলিজিয়াস ফ্যামিলির ছেলে। সে হলো শর্ষিণার পীরের পরিবারের লোক। অথচ এই শহীদ কম্যুনিস্ট লাইনে আসে। খাপড়া ওয়ার্ডের ঘটনার সময় শহীদ সেখানে ছিলো। পরে জেল থেকে বেরিয়ে সে আবার আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। আমি জেলে থাকার সময়ে বড় ভাই ছাড়া বাবা-মা কারু সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি। তারা গ্রামে থাকতেন। বড় ভাই মাঝে-মধ্যেই রাগ করে চিঠি-টিঠি লিখতেন এই বলে যে, তোমার জন্য কি আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে যাবে নাকি?
এবারে আপনার নিজের অনুভূতির কথা কিছু বলুন। কম সময় তো নয়। প্রথমবারেই আপনি প্রায় অর্ধযুগ জেলখানায়।
–কি রকম আর মনে হবে। তোমাদের ভাষা ধার করে বলতে পারি যে, আমি তখন একটু ভাবুক টাইপের ছিলাম। এরকম না হলে তো জেলখানায় নিজেকে ম্যানেজ করাটা সমস্যা হতো, বুঝতেই পার।
জেলজীবন সংক্রান্ত আলোচনার রেশ আমরা আরেকটু ধরে রাখতে চাইলাম। এ কারণেই জেলখানায় থাকাকালীন স্যারের ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা আবারো জানতে চাইলাম।
–তেমন আর কি বলবো। একটা ব্যাপার ধরো যে, আমি খুব বেশি কান্নাকাটি করি নাই। যদিও কান্নাকাটি করাটাই স্বাভাবিক। একটা লোক জেলে আসছে, তার কারণে একটা পরিবার ডুবতে বসছে–এসব যে কি মর্মান্তিক ব্যাপার তা তোমরা বুঝতে পারবা না। আমার ব্যাপার হলো এই যে
আমি তো পরিবারের কোন কাজে আসি নি। পরিবারের কথা ভাবি নি। স্বাভাবিক যে পরিবার আমার উপরে প্রীত ছিলো না। কিন্তু জেলখানায় আমি এত প্রীতি এত ভালবাসা পেয়েছি যা বলবার মত নয়। এগুলো আমার। জীবনের অক্ষয় সম্পদ। জেলখানার ভেতরে আমার চমৎকার একটা জগৎ ছিলো। জেলের ভেতরে বন্ধুরা ভালোবেসে আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে তা পালনের চেষ্টা করেছি। সাধারণ ঘর থেকে আসা কমুনিস্ট বন্দীদের মনোবল টিকিয়ে রাখার জন্য জেলখানায় আমরা কি করতাম সে সবের কিছু বর্ণনা আমি গত দিন তোমাকে দিয়েছি। একবার আমার উপর এক হাজার পৃষ্ঠার এক বই কমরেডদের পড়ে শোনানোর দায়িত্ব পড়লো। যদূর মনে পড়ছে বইটার নাম ছিলো Diplomat আর লেখক জেমস অ্যালড্রিজ। কুর্দীদের একটা দল স্ট্যালিনের সাথে দেখা করবে এবং কুর্দীদের সাহায্য করার ব্যাপারে তাকে রাজী করাবে-এই হচ্ছে কাহিনীটা। সে এক অসাধারণ ব্যাপার। প্রতিদিন দুপুরে কমরেডরা আমাকে ডেকে নিতো এই বলে, এই বাহে আপনি ঘুমান ক্যানে? আপনি আমাদের পড়ে শুনাবেন না? তোমাকে এসব কথা বলতেও আমার ভীষণ আবেগ এসে যাচ্ছে। আমি সেই বই খানিকটা ইংরেজিতে পড়ে সে অংশটাই আবার অনুবাদ করে শোনাতাম। এসব কাজ পরবর্তীতে অনেক ফল দিয়েছিলো। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর এই লোকগুলো কমিউনিস্ট পার্টিকে গড়ে তোলা, যুক্তফ্রন্ট গঠন করা এসব ব্যাপারে দারুণ ভূমিকা রেখেছিলো। এই যে নেজামী ইসলামী, ভাসানী, ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী এরা একসাথে এসেছিলো–এই কৃতিত্ব কার? আমি বলছি। এই কৃতিত্ব কম্যুনিস্টদের। তোমরা তো এসব কিছুই জানো না। গতদিনও আমি বোধ হয় এ বিষয়ে কিছুটা বলেছি।
জেলখানায় বসে কি আপনার কখনো দোদুল্যমানতা এসেছিলো? কখনো কি মনে হয়েছিলো যে এটা কি করলাম! এত ব্রাইট রেজাল্ট, ক্যারিয়ার এইসব
Repentance for the loss of career বলতে যা বোঝায় এটা আমার কখনো আসে নি। আমার অমুক ছিলো তমুক ছিলো অমুক হইতে পারতাম। এই রকম ভাবনা আমার আসে নাই। আমার একটা লেখায়ও বলেছি যে আমি হলাম Imost non-ambitious person. ছোটবেলায় বড় ভাই একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, বড় হয়ে তুই কি হবি? আমি কুলী হতে চেয়েছিলাম। আমার স্মৃতিতে ছিলো বরিশাল লঞ্চঘাট। সেখানে কুলীরা কি সুন্দর কাজ করছে। অন্যের মাল তুলছে। এসব তখন আমার কাছে সাংঘাতিক আকর্ষণীয় ব্যাপার। পরবর্তীতেও আমার কোন ambition develop করেনি। চাকরি করা, ফরেন যাওয়া, মাস্টারী করা কোনটা নিয়েই তেমন কোন ambition কাজ করেনি। মাস্টারী তো পেয়েছিলাম। তা আবার ছেড়েও দিয়েছিলাম। এভাবে তোমাকে বুঝতে হবে যে, এটা হয়। সব লোক তো এক রকম না। তোমার প্রশ্নের উত্তরে আবারো বলছি, জেলখানায় বসে কখনো আমার মনে হয়নি যে একটা ভুল করলাম। আমি নিজের সম্পর্কে বলি যে, আমার জীবনে ভুল বলে কোন কথা নাই। আমার জীবনে লোকসান বলে কিছু নাই। যে কাজ করতে আমি বাধ্য ছিলাম তাকে আমি ভুল বলি কেমন করে? অনুশোচনা, আফশোস, লজ্জা এগুলো আমার আসে নি। কেন আসে নি বলতে পারবো না। তবে একটা ব্যাপার, আমার এই সব কর্মকাণ্ডের জন্য আমার পরিবার রাগ করেছে বটে কিন্তু আমাকে পরিত্যাগ করেনি। আমার উপর থেকে ভালোবাসা withdraw করেনি। এটা একটা পারিবারিক দান। তারা আমাকে ভালোবেসেছে। আমি তাদেরকে তা ফিরিয়ে দিতে পারি নি। কিন্তু তাদের ভালোবাসা দিয়ে আমি অপরের ভালোবাসা জয় করার চেষ্টা করেছি। তো আমি হলাম এই রকম। আমি কি করতে পারি! One cannot be other than what he is.
প্লেটো এবং মার্কসে দ্বন্দ্ব নেই
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৩
গত আলোচনাগুলোর ক্ষেত্রে আমরা সময়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলার চেষ্টা করেছিলাম। আজ আলোচনার শুরুতেই স্যারকে সে কথা মনে করিয়ে দিলাম। এবং প্রশ্ন উত্থাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। কিন্তু এই সময়ের ধারাবাহিকতার প্রসঙ্গটাই স্যার টেনে নিলেন। আনুষ্ঠানিক কোন প্রশ্ন উত্থাপনের আগেই স্যার কথা বলতে শুরু করলেন।
এই যে তোমরা আমাকে রিসিভ করো আমাকে খাওয়াও, এসব দেখে প্রত্যেকদিন ফিরে যাওয়ার সময় নিজেকে বলি আমারই বরং খাওয়ানো দরকার। যাই হোক। এই যে তোমরা আমাকে পাঁচটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করো-আপনি কবে কি করলেন, কেন করলেন এসবই হচ্ছে historical details. every man is history. অথচ আমরা প্রায় সময়ই এ সত্যটা মিস্ করি। প্রায়ই দেখা যায় যে কোন একজন বড় ব্যক্তিই আমাদের কাছে ইতিহাস হয়ে ওঠে। এরকম হওয়াটা উচিৎ নয়। এজন্যই দেখা যাচ্ছে যে, আমরা আমাদের ইতিহাসকে রক্ষা করতে জানি না। এবং সেজন্যই আমরা আমাদের প্রো-পিপল ইতিহাস লিখতে পারি না।
এ প্রসঙ্গে স্যার অ্যালেক্স হ্যাঁলির দ্য রুটস এর কথা উল্লেখ করলেন। ইতিহাস কিভাবে খুঁড়ে বের করতে হয় তার একটা অনন্য নজীর হিসাবে রুটস উপন্যাসের কথা বললেন। উপন্যাসটি নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছার কথা জানালেন। আমাদের দেশে ইতিহাস চর্চার সংকট প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতেই জানালেন যে, মূলে না যাওয়ার প্রবণতাই হলো প্রধান সমস্যা। মূলে প্রবেশ না করে ইতিহাস এবং চলমানতাকে ব্যাখ্যা করার ফলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে কোন ঘটনার উপরিতলটুকুই শুধু ব্যাখ্যা হয়। যার দরুণ অনেক বড় বড় ঘটনা বা। বাস্তবতা থেকেও আমরা অনুপ্রেরণা লাভে ব্যর্থ হই। স্যার দীর্ঘক্ষণ ধরে এই ব্যাপারগুলোই আমাদের মাথায় ঢোকাতে চাচ্ছেন বলে মনে হলো। অনুপ্রেরণাহীনতার ফলে কি হয় সে ব্যাপারেও কিছু মন্তব্য করলেন।
-এর ফলে হয় কি, তোমাদের মত পোলাপানদের মুখে কেবল একটা কথাই শুনি। তোমরা খালি বলতে থাক, স্যার কি খারাপ অবস্থা। সংকট, সংকট, এইসব। আমাদের মত বুড়া দুএকজন যা আছে তাদের কাছে তোমরা এ সবের একটা রেডিমেড জবাব চাও। কিন্তু এসবের তো কোন রেডিমেড জবাব নাই। সেজন্যই তোমাদের জিজ্ঞেস করি, এত সংকট ভাবনা মাথায় নিয়ে তোমরা মানসিকভাবে কতদিন বাঁচো?
আমরা বলি, তরুণ প্রজন্মের সংকট-ম্যানিয়া নিয়ে আপনি যাই বলুন না কেন, আপনার কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে চলমান সংকটকে আপনিও স্বীকার করে নিচ্ছেন। আমরা তো সংকটকে সংকটই বলছি। সংকটকে সম্ভাবনা বলতে যাবো কেন?
–এটা তো ঠিকই যে সংকট বাদে জীবন হয় না। কিন্তু আসল বিষয় হলো আমি কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংকটকে দেখি। এটাই তোমার সাথে আমার পার্থক্য। ক্রাইসিস, প্রবলেম এসব সম্পর্কে আমার সাথে তোমার দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য রয়েছে। তুমি একভাবে দেখ আমি আরেকভাবে দেখি। আমাকে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, আদর্শের রাজনীতি কি শেষ হয়ে গেলো? আরে এরকম হতাশ প্রশ্নের মানে কি? হতাশার নিবাস কোথায়? কোথায় হতাশা! হতাশা যদি কোথাও থাকে সেটা তোমার মনের মধ্যে। তুমি তো ভয় পাচ্ছো। যেমন ধরো বুশকে, এই ধ্বংসকারীকে ভয় পাচ্ছে। যারা জীবনের ধ্বংসকারী যারা আদর্শহীন তাদেরকে ভয় পাচ্ছে। এই ভয় থেকেই তোমার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে হতাশা। আমি মানবতার দর্শনে বিশ্বাস করি। সেজন্য আমার ভয় নাই হতাশা নাই।
আপনার সাথে আলোচনার একটা সমস্যা হলো আপনি পুরো জিনিসটা দার্শনিক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন।
–তাই তো। দার্শনিকতাই আসল। কিন্তু তোমরা তো সেদিকে যাবা না। তোমার কথার মধ্যে ইঙ্গিত আছে যে আপনি ঐ দিকে যাইয়েন না। আপনি বাস্তবে থাকেন।
আমরা সাধারণ মানুষরা বাস্তবে থাকতে চাইবো এটাই তো স্বাভাবিক। একটা দার্শনিক স্তরে পৌঁছে তারপর সংকট বোঝার ক্ষমতা সবার নাও থাকতে পারে। আপনি আমাদের বলেন, এ মুহূর্তের সংকটগুলো কি? এগুলো চিহ্নিত করাটাকে কি আপনি জরুরি মনে করেন না?
–সাধারণ মানুষ আমরা, এসব শব্দ ব্যবহার আপাতত বাদ দেও। তুমি সংকট বলতে কি বোঝা তাই আমারে বোঝাও। তোমার সংকটটা কি? তুমি বইপত্র পড়া লোক। তোমার কাছেও ছাত্র-ছাত্রীরা আসে। তুমি নিশ্চয় তাদেরকে কিছু না কিছু বোঝাও। কিন্তু তুমি আমাকে বোঝাও, তোমার লাইফ-ফোর্সটা কি?
এ ব্যাপারে কখনো গভীরভাবে ভাবা হয়নি বলতেই স্যার রেগে গেলেন। আমরা যে দুই-আড়াই বছরের শিশু না একথাও মনে করিয়ে দিলেন। তার মত হলো, সংকট আদিতে ছিলো, এখন আছে, অন্তেও থাকবে। এবং এ ব্যাপারেও একমত হলেন যে, সংকটগুলো চিহ্নিত করা জরুরি। স্যার মনে করেন, আমাদের প্রধান সংকট হচ্ছে জীবন বোধের সংকট, সাংস্কৃতিক সংকট। অথচ এক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা হলো আমরা ভয় পাচ্ছি। ভয়ের চোটে মনে করছি। যে আমাদের কোন সংস্কৃতি নাই। ছুটাছুটি করছি এখানে সেখানে।
আমরা জিজ্ঞেস করি, ধরুন বর্তমান দুনিয়ার প্রেক্ষাপটে যদি ভাবি তাহলে আমেরিকানিজমকে কি আপনি সংকট মনে করেন?
-এই যে আমেরিকানিজমকে সংকট বলছো এটাও বলছো ভয়ের চোখে। তোমরা যদি ভয় না পেয়ে আমেরিকানিজমকে একটা মেকানিজম হিসাবে বিবেচনা করতে শিখতে, তাহলে ভালো হতো। আমেরিকানিজম জিনিসটা আসলে কি? এটা তো মানবিকতার সংকট। এই সংকট চলবে। কিন্তু তাই বলে মানুষকে কি মেরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে? আরে সামান্য পিঁপড়ার কথা ভাবো। এত মেরেও কি এদের তুমি নিশ্চিহ্ন করতে পারছ?
এতো আপনি বলছেন একটা প্রজাতির বিনাশের কথা। কিন্তু একজন মানুষ বা একটি পিঁপড়ার মৃত্যুকেই বা তুচ্ছ ব্যাপার মনে করবেন কেন? আর এভাবে দেখতে থাকলে তো পুরো ব্যাপারটাই বিমূর্ত হয়ে যায়।
-এটা তুচ্ছ মনে করা না করার ব্যাপার না। ধরো আমার বাবা একজন ব্যক্তি। তিনি আজকে নাই। মারা গেছেন। কিন্তু তার জন্য আমি দুঃখ পাই না। আমি ব্যক্তি মানুষকে মনুষ্য প্রজাতির অংশমাত্র মনে করি। আমার বাপ ও দুঃখ পায় নাই। সে তার পোলারে জ্যাতা রাইখা গেছে। পোলার জন্য তালগাছ লাগাইয়া দিয়া গেছে। তোমাকে তো স্বীকার করতে হবে যে জীবনের জন্ম হয় মৃত্যুর জন্য। ব্যক্তির কথা ভুলে যাও। তুমি মাথায় রাখবে প্রজাতির কথা। এভাবে যদি দেখতে পারো তখন আসবে জীবন বনাম মৃত্যুর দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্ব হলো প্রজাতির জীবন এবং মৃত্যুর দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে জীবনই জয়ী হয়। আর এই যে বললে বিমূর্ত হয়ে যায়–এর মানে কি! মূর্ত থেকেই বিমূর্ত তৈরি হয়। পাঁচটা মূর্ত মানুষ দেখার পরই একটা সাধারণীকরণ করা যায়। বলা যায় যে আসলে মানুষ হচ্ছে এরকম।
কথা হচ্ছে যে, আপনার মত বুদ্ধিবৃত্তির উঁচু স্তরে যারা অবস্থান করে তাদের সাথে সাধারণ মানুষের ভাবনার পার্থক্যটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। যেমন এই মুহূর্তে আমাদের ভাবনার সাথে আপনার ভাবনার মিল খুঁজে পাচ্ছি না–মন্তব্য করি।
-এখন তুমি যদি নিজে একটা গ্যাপ তৈরি করো কিংবা গ্যাপ থাকলে সেটা অতিক্রম করতে না চাও তাহলে বলার কিছু নাই। তোমাকে শুধু একথাই বলতে পারি যে, জীবনটাকে আশার দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা কর। এই যে এখন তোমরা আমেরিকার কার্যকলাপে হতাশ হয়ে পড়ে যাচ্ছো এর তো কোন অর্থ নেই। আমেরিকা তো অখণ্ড কোন বিষয় নয়। সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব মার্কিন সৈন্যদের সাথে ঢাকা শহরে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছিলো তারাও তো আমেরিকা। এখন যে লক্ষ লক্ষ আমেরিকান সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে ইরাক আগ্রাসনের নিন্দা জানাচ্ছে এটাও তো আমেরিকা। সেজন্যই বলছিলাম যে, জীবনটাকে একটা আশার দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করো। কেন হতাশা হতাশা বলে চিৎকার করবে? তোমাদের এখন পশুশক্তি আমেরিকাকে হত্যা করবো বলে শ্লোগান দেয়ার কথা। তা না করে তোমরা মৃদু ভাষায় অমুক অমুক কিসব বলে পাশ কাটাচ্ছো। তুমি মানসিকভাবেই আমেরিকাকে তোমার চাইতে বড় মনে করছে। যদি আমেরিকাকে নেগেটিভ ফোর্স মনে কর আর নিজেদের পজেটিভ ফোর্স মনে কর তাহলে নেগেটিভ ফোর্সকে কেন পজেটিভ ফোর্সের চেয়ে বড় ভাবছো! নেগেটিভকে নেগেটিভভাবেই দেখো। এই দুয়ের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। মানুষ এই দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই আজকের অবস্থানে এসেছে।
সরদার স্যার হতাশা নামক ব্যাধিকে এভাবেই নাশ করতে চান। তাঁর আরাধ্য দেবতা মানুষ। তিনি মানুষকে মহাকালের সাথে লড়াই-সংগ্রামে বিজয়ী এক গৌরবান্বিত প্রজাতি হিসাবে দেখেন। সেই কোন কাল থেকে মানুষ মরে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে, হেরে যাচ্ছে। এই মানুষই আবার ভেসে উঠছে, টিকে থাকছে, জিতে যাচ্ছে। মানুষের এই অনিঃশেষ জীবনীশক্তি সরদার ফজলুল করিমকে অভিভূত করে। সেজন্যই তিনি জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে ফেলে ইতিবাচক হয়ে ওঠার জন্য নিরন্তর পরামর্শ ফেরি করে চলছেন। আর এর জন্য চাই সাহস। সাহসী মানুষের বড় বেশি প্রয়োজন আজ। যে মানুষ আমেরিকার একচ্ছত্র ঔদ্ধত্য দেখে ভয়ে মুহ্যমান হয়ে যাবে না। প্রতিরোধ-প্রস্তুতি বাদ দিয়ে হতাশাকে আঁকড়ে ধরবে না। সরদার ফজলুল করিম এই জাতেরই মানুষ যিনি বুঝতে পারেন না পশুরা যদি যুথবদ্ধ থাকতে পারে তাহলে মানুষ কেন সমাজবদ্ধ থাকতে পারবে না? মানুষ কেন সংঘবদ্ধভাবে পশু শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না? বুঝতে পারেন না। বলেই তাঁর অনেক বাক্যই নির্মিত হয় প্রশ্নবোধক আকারে। তিনি বুঝতে পারেন না, কেন আজকের তরুণ প্রজন্ম প্রজাতি মানুষের পরিবর্তে ব্যক্তি মানুষের ধারণায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে?
এ প্রসঙ্গে আমরা এই মর্মে প্রশ্ন করি, তাহলে কি একজন ব্যক্তি মানুষের পরাজয় বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কোনই গুরুত্ব নেই?
–আরে এটা বোঝার চেষ্টা করো যে কিছুই তো নিশ্চিহ্ন হয় না। আমার বাপও তো নিশ্চিহ্ন হয় নাই। আমি তাকে যে কবরে শোওয়াইয়া রাখছি সে কবরের মাটিকে তো সে সরস করে দিয়েছে।
এটা কি আপনি স্বীকার করেন যে মৃত্যু হচ্ছে সকল সম্ভাবনার বিনাশ?
-ধ্বংস, নিশ্চিহ্ন এগুলা ডিকশনারির শব্দ। এগুলা তোমরা বাদ দেও। বিনাশ বলতে তুমি কি বোঝাতে চাও? মৃত্যু মানে তো একটা বস্তুর মৃত্যু। যে মরে সে কি একটা বস্তু না?
কিন্তু মানুষ তো আর দশটা বস্তুর মত না। তার মধ্যে তো অনুভূতি বলে একটা ব্যাপার আছে।
-সেটা পরের কথা। আগে এটা স্বীকার কর মানুষ বস্তু কিনা? যদি বস্তু বলে স্বীকার কর তাহলে বস্তুর ধর্ম কি তা বোঝার চেষ্টা কর। বস্তুর রূপান্তর ঘটে কিন্তু বস্তুর অস্তিত্বহীনতা ঘটে না। আসলে সমস্যা হলো আমরা সসীম। মানুষ অসীম জ্ঞান লাভ করতে পারি না। এটা সম্ভব না। তুমি যে আমার কথাগুলো ধরতে পারছো না একমত হতে পারছে না এটা তোমার একার সমস্যা নয় আমারও সমস্যা। আমি কি সবকিছু বুঝতে পারি? তাতো নয়। তবে ব্যাপার হলো, যে কথাগুলো তোমাকে এতক্ষণ বললাম আমি ঠিক সেভাবেই ফিল করি। একটা মৌলিক ব্যাপার বুঝতে পারি যে every life wants to live. সে লাইফ মানুষ হোক আর অন্য কিছু হোক। যে জীবন বাঁচতে চায় না সে জীবন কোন জীবন না। আমি এটা বুঝতে পারি না, তোমরা হতাশ-হতাশ বলে এত চিৎকার করতে পার কিন্তু আশা-আশা বলে চিৎকার করতে কেন পার না! হতাশাকে তো অন্বেষণ করতে হয় না।
স্যারকে একটু থামিয়ে আমরা বললাম, এই যে আপনি বললেন সকল প্রাণই বাঁচতে চায় এর সাথে আমরা একমত। কিন্তু চারদিকে যেসব হতাশ প্রাণের আর্তনাদ দেখে আপনি সব গেলো গেলো বলে শোর তুলছেন তার সাথে একমত হতে পারছি না। এমনও তো হতে পারে, যে সব প্রাণ আজ হতাশার গভীরে নিমজ্জিত বলে আপনার কাছে মনে হচ্ছে তারা আসলে গভীর বিচারে ভয়ংকর আশাবাদী। তারা জীবনের কাছে অনেক অনেক বেশি কিছু আশা করে বলেই চারদিকের বিশৃঙ্খলায় হতাশ।
ধরে নিলাম তোমার কথা ঠিক। কিন্তু ঐ সব প্রাণগুলোকে প্রথমতঃ বস্তু হিসাবে দেখা শিখতে হবে। বস্তুর উপরে আমাদের চিন্তাটাই হচ্ছে ভাব। আর এই ভাবটা তো কোথাও এক জায়গায় বসে নেই। আমি একটা বস্তু অথচ আমার মধ্যে বাঁচার ইচ্ছা থাকবে না তবুও আমি বাঁচার বস্তু হবে এটা কেমন করে হয় আমি জানি না। আমি এটা কল্পনা করতে পারি না। আরে তোমরা সবাই তো একেকজন আশার বাহক। কি অধিকার তোমাদের আছে এ কথা বলার যে আমরা হতাশায় মরে যাচ্ছি। তোমারে হতাশায় মরে যাওয়ার জন্য তোমার বাপ-মা জন্ম দিয়েছে?
অতঃপর বর্তমান তরুণ প্রজন্মের হতাশা ব্যাধিকে সরদার ফজলুল করিম জন্ম-ঋণ শোধ প্রচেষ্টার অস্বীকার হিসাবে বর্ণনা করেন। তাঁর মতে, আমরা অমুক-তমুক কবি, বই পড়ি-লিখি, ডক্টরেট করি কিন্তু আসল কাজটাই করি না। একবারও ভাবি না যে বাবা-মা যদি আমাদের জন্ম না দিতো তাহলে কোথায় থাকতো এসব হতাশ হওয়া-টওয়া। এখানেই হচ্ছে জীবনবোধের ব্যাপার। জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়াটা একান্তই জরুরি। তা না হলে পরে অপরজন কিভাবে আমার কাছ থেকে উদ্বুদ্ধ হবে? মানুষ পরস্পর একসাথে বাস করে অপরের কাছ থেকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আশায়। হাট থেকে বাড়ি ফেরার সময় মানুষ যখন অন্ধকারকে ভয় পায় তখন পাঁচজনা মানুষ মিলে একসঙ্গে যায়। এটাই তো আসল ব্যাপার। এই মানুষগুলো পরস্পরের কাছে আশা চায়। সমাজ জীবনের সব ক্ষেত্রেই একই ব্যাপার। মানুষ মানুষের কাছে আশা চায়। এভাবেই স্যার খণ্ডন করলেন আমাদের উত্থাপিত যুক্তি। তিনি যেন একটাই বোঝাতে চাইলেন যে আশাবাদী থাকাটা শুধু ব্যক্তির জন্যই জরুরি তা নয়, বরং সমাজ-দেহে বাস করার নিমিত্তে তার উপর আরোপিত শর্তও বটে।
–মানুষের মত অসহায় প্রাণী আর নেই। মানুষ পিঁপড়ার চেয়েও অসহায়। খেয়াল করে দেখো, মানুষ মানুষকে যেমন করে মারে পিপড়া পিঁপড়াকে, হাতি হাতিকে তেমন করে মেরে ফেলে না। খেয়ে ফেলে না। আমি বুঝে উঠতে পারি না, কেন আমরা পোলাপানরা বাপরেও বলতে পারবে না যে চিন্তা কোরো না আমি তো আছি। আমি এটাও বুঝতে পারি না, কেন তোমরা একথা বুঝতে চাও না যে বুশ-ক্লিনটনরা তোমাদের ভয় পায় বলেই এখানে আসে। তাহলে তোমরা কেন তাদের রেড-কার্পেট দাও? তোমরা দাসস্য-দাস বলেই নিজেদেরকে চূড়ান্ত অপমান করে তাদের রেড়-কার্পেট দাও। ভুল করে ভয় পাও বলেই রেড-কার্পেট দাও। এই ভুল ভাবনাটাই এখনকার প্রধান সংকট। মানুষকে তো মানুষ করে তুলতে হবে। অথচ কি হচ্ছে? একদিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি-টুন্নতি করে মানুষরে মরতে দিবা না আবার বাঁচতেও দিবা না। তারে তোমরা খাইতেও দিবা না আবার মরতেও দিবা না। একটা এ্যাবসার্ড সিচুয়েশান। এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে আমরা এরকম অবস্থা থেকে উত্তরণের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেটা টিকে নাই। কিন্তু তবুও আমি স্বপ্ন দেখি। কেন আমি স্বপ্ন দেখবো না?
কথা শুনতে শুনতে আমাদের মনে হয়েছিলো–সত্যই তো তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন না দেখে পারে না বলেই স্বপ্ন দেখে। অনেক স্বপ্নই পূরণ হবে না জেনেও স্বপ্ন দেখে। আসলে স্বপ্ন পূরণের স্বপ্নই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। স্যার এরকম কিছু একটাই বোঝাতে চান বলে মনে হলো। ঘোর সংকটের কাল চলছে বটে কিন্তু সংকট অতিক্রমের স্বপ্ন তো দেখতে হবে। সাঁতার না জানা জলে পড়া মানুষ হাত-পা ছেড়ে কেন? স্বপ্ন দেখে বলেই ছোঁড়ে। বাঁচার স্বপ্ন। স্যার বক্তব্য এগিয়ে নিয়ে চলেন।
-আমি বুঝি যে এখন ঘোর কলিকাল। কত হাজার বছরে এই সংকট কাল শেষ হবে আমি জানি না। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে জীবন জয়ী হবে এবং মৃত্যু পরাজিত হবে। তবে এটা হবে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে। জীবন লড়াই করবে মৃত্যুর সাথে। এবং মৃত্যু পরাজিত হবে। এবং জীবন প্রবহমান থাকবে। জীবন বেঁচে থাকবে এবং মৃত্যুর মৃত্যু ঘটবে–এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকাটা একান্ত আবশ্যকীয়। আমি তোমাদের কেমন করে বোঝাবো? তোমরা তো প্লেটো পড় না।
প্লেটোর নাম উচ্চারণের সাথে সাথেই আমরা একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের একটা জিজ্ঞাসা ছিলো। বিভিন্ন সময়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছি। তিনি কখনোই বিস্তারিতভাবে বলতে চাননি। আজকে আলোচনার ধারাবাহিকতায় কিছু কথা বেরিয়ে আসতে পারে বলে আশা করলাম। আমাদের প্রশ্নটা ছিলো এরকমের-আপনার প্লেটোপ্রীতি সর্বজনবিদিত। সেই ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকে দেখে আসছি, মাসের পর মাস আপনি প্লেটো বোঝানোর পেছনে ব্যয় করেছেন। তার তত্ত্বের মহত্ত্ব তুলে ধরেছেন। প্লেটোর রিপাবলিকের তুলনাহীন অনুবাদও আপনার হাত দিয়েই সম্পন্ন হয়েছে। সে অনুবাদের যে ভূমিকা আপনি লিখেছেন তা বাংলা ভাষাভাষীদের অমূল্য সম্পদ বলেই আমরা মনে করি। কিন্তু আপনার সারা জীবনের রাজনীতি অর্থাৎ কম্যুনিস্ট রাজনীতির সাথে এই প্রগাঢ় প্লেটোপ্রীতি কি মেলানো যায়? প্লেটো যেখানে সামাজিক বিভক্তি টিকিয়ে রাখতে চান মার্কস সেখানে বিভক্তির দেয়াল তুলে ফেলে শ্ৰেণীহীন শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেন। এ দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শকে আপনি কিভাবে নিজের ভেতরে লালন করেন? এটা কিভাবে সম্ভব?
এত দীর্ঘ নিজস্ব বক্তব্য আগে কখনো স্যারের সামনে নিয়ে আসা হয় নি। কিন্তু ব্যাপারটা বোঝার জন্য অনেকের মধ্যেই কৌতূহল আছে জানি বলেই একটু বিস্তারিতভাবে প্রসঙ্গটি স্যারের সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করলাম। অনেকটা সওয়াল-জবাব ধাঁচে। তিনি আবারো আগের মতই এ প্রসঙ্গ বাদ দিতে চাইলেন। এবং তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, তাঁর কমিটমেন্ট এসব বিষয়কে একেবারেই মূল্যহীন বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু আমরা তারপরেও কিছু বক্তব্য শুনতে চাইলে স্যার বললেন :
প্লেটোর এত সরল পাঠ করেছো দেখে আমি অবাক হচ্ছি। বর্বরকে আমি কেমন করে প্লেটো বোঝাবো? কেমন করে জ্ঞানদান করবো? তুমি বরং প্লেটো বোঝাটা তোমার জীবনের লক্ষ্য হিসাবে নিতে পারো।
অসুবিধার কিছুই নাই। বর্বরকে আপনিই জ্ঞানদান করুন। এবং বলুন প্লেটোর সাথে মার্কসের সংযোগটা আপনি কিভাবে করেন?
এখন তুমি আমারে এমন শিক্ষক বানাইলা যে আমি কথায় কথায় ধমকাতে পারি। তোমাকে এই সংযোগ বিষয়ে কিছু বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার শুরুর দিক থেকেই আমার মধ্যে কিছু প্রশ্ন জন্ম নিতে শুরু করে : সত্য। কি মিথ্যা কি, জীবনের সাথে দর্শনের সম্পর্ক কি–এসব। এক পর্যায়ে আমি অনার্স বিষয় পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেই। এবং ইংরেজি বিভাগ থেকে দর্শন বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য হরিদাস ভট্টাচার্যের শরণাপন্ন হই। তিনি খানিক ধমক-টমক দিয়ে রাজী হলেন। আসলে আমি জীবনে কি হবো না হবো এসব নিয়ে কখনোই সিরিয়াসলি ভাবিনি। ব্যাপারটা হচ্ছে যে, সবাই তো একরকম হয় না। সে যাই হোক। দর্শন পড়তে এসে আমি সত্য-মিথ্যার রাজ্যে এলাম। দর্শন বিভাগে তখন এসব বিষয়ে মৌলিক আলোচনা হতো। সত্য-মিথ্যার জগতে এসে আমার দারুণ লাভ হয়। দর্শন না পড়লে এটা বুঝতে পারতাম না যে nothing is unrelated with anything else. এটা মার্কসীয় দর্শনের ব্যাপার কি। এছাড়াও মহান শিক্ষকদের হাত ধরে ইলশান এন্ড রিয়েলিটি, নলেজ, সাইকেলিজি, কনশাস, আনকনশাস, সাবকনশাস ইত্যাদি বিষয়গুলো বুঝতে চেষ্টা করি। আগে থেকেও অভ্যাসটা ছিলো এ পর্যায়ে এসে বই পড়াটা আরো ব্যাপকভাবে আমার অভ্যাসে পরিণত হয়। এখন প্লেটো প্রসঙ্গে বলি। দর্শন বিভাগে ভর্তি, পাঠাভ্যাস, রাজনীতি-এই সবগুলোই কিন্তু আমাকে প্লেটোর মধ্যে ঢুকিয়েছে। সক্রেটিসের মধ্যে ঢুকিয়েছে। পরে বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ করার সময় এ বিষয়গুলো নিয়ে কিছু কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
আমি মনে করি যে, প্লেটো এবং মার্কসের মধ্যে কোন কন্ট্রাডিকশান নেই। একটা সাধারণ কন্ট্রাডিকশান আছে। তা হলো প্লেটো হচ্ছেন। আইডিয়ালিস্ট আর মার্ক হচ্ছেন রিয়ালিস্ট। কিন্তু গভীরে ঢুকলে উভয়ের সাদৃশ্যই পরিস্ফুট হয়। মার্কস প্লেটোকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আইডিয়ালিস্ট ফিলোসফার মনে করেন। শব্দ ধরে ধরে এ দুজনের মধ্যে পার্থক্য তুলে বের করার দরকার নেই। দুজনের মধ্যে সময়গত ব্যবধানটা খেয়াল রেখো। সক্রেটিসের জবানীতে প্লেটো যখন বলেন যে আমি জানি যে আমি জানি না, ওরা জানে না যে ওরা জানে না। কিংবা প্লেটো যখন বলেন যে, যার যা করা উচিৎ তা করাই হচ্ছে জাস্টিস–এগুলো তো মহা অমূল্য কথা। এগুলো আর কোথায় পাবা! মার্কসীয় দর্শনে আকৃষ্ট একজন লোক হয়েও এগুলোকে ধারণ করায় আমার কোন অসুবিধা হয় না। কমুনিস্ট মেনিফেস্টোটা না পড়লে পড়। পড়ে থাকলে আবার পড়। কাজে দেবে। একটি বিষয়কে অন্যটি থেকে। বিচ্ছিন্ন করে দেখাটা মার্কসিজম আমাকে শেখায় নাই। মার্কসবাদে প্লেটোকে গ্রেটেস্ট আইডিয়ালিস্ট বলা হয়েছে গ্রেটেস্ট রাফিয়ান বলা হয় নাই। ফাইটটা হচ্ছে আইডিয়ালিজম এবং মেটেরিয়ালিজমের মধ্যে। প্লেটোর পরে অ্যারিস্টটলে এসে একটু অগ্রসরমানতা পাই। অ্যারিস্টটল এ দুয়ের মধ্যে একটা মিক্স-আপ করার চেষ্টা করছেন।
অনেকক্ষণ পরে এসে আমরা একটু কথা বললাম। আমরা বললাম যে আপনি বৈপরীত্য খুঁজে পান না ভালো কথা। কিন্তু প্লেটো এবং মার্কসের মধ্যে কার পক্ষাবলম্বন করেন?
–এভাবে জানতে চেয়ে কোন লাভ হবে না। এরা একজন আরেকজন থেকে বাদ না। প্লেটোর মধ্যে ও রিয়ালিজম আছে। বাস্তবতাবোধ থেকেই প্লেটো নিজের মত করে দার্শনিক রাজা বা আদর্শ রাষ্ট্রের আইডিয়ালিস্ট ধারণা দাঁড় করান। সবকিছুই তো রিলেটিভ। প্লেটো এবং মার্কসকে সরাসরি বিপরীত অবস্থানে দাঁড় করানো ঠিক না। একটা কথা হলো, ভাব বা আইডিয়ার ব্যাপারটা বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ম্যাটারের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আইডিয়া। ম্যাটার সংক্রান্ত যে চিন্তাটা সেটাই আইডিয়া। আইডিয়া বলে বস্তুর বাইরে কিছু নাই। মার্কসের মহত্ত্ব হচ্ছে এই যে সে এক ঝটকায় কোন কিছুর অস্তিত্ব বা অকার্যকারিতা ঘোষণা করে নাই। সে সবকিছুকে দ্বান্দ্বিকভাবে বিশ্লেষণ করেছে। মার্কসের নাম যখন বলি তখন এঙ্গেলসকেও স্মরণ রাখবে।
আজকের আলোচনা এভাবে শেষ হয়েছিলো। পরবর্তী এক আলোচনায়, অর্থাৎ ৮ এপ্রিল ২০০৩ তারিখে, মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কথোপকথনের এক পর্যায়ে এসে আমরা কমুনিস্ট, কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে একজন ব্যক্তি ক্যুনিস্টের সম্পর্কের ধরন কেমন হতে পারে এসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করি। এ প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ সরদার ফজলুল করিম স্বয়ং। সাধারণ্যে তাঁর পরিচিতি একজন আজীবন কমুনিস্টের। আবার কোন কমুনিস্ট পার্টির সাথে তিনি জড়িত আছেন এরকম আমাদের জানা নেই। ব্যাপারটা আমাদের জন্য কৌতূহলের। লেখার সময় পাঠের সুবিধার্থে ৮ এপ্রিলের আলোচনার একটি অংশ আজকের আলোচনার শেষে যুক্ত করা হয়েছে।
–কম্যুনিস্ট, কম্যুনিস্ট পার্টি সম্পর্কে আমার বক্তব্য এ রকমের : আমি তো কম্যুনিস্ট পার্টির কেউ ছিলাম না। I was a communist by myself. Iwas not a communist by membership. এখানে একটা পার্থক্য আছে। আমি মনে করি আগে কম্যুনিস্ট হওয়ার ব্যাপার তারপরে আসবে কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগদানের প্রসঙ্গ। কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েও কম্যুনিস্ট হওয়ার গ্যারান্টি নাই। আগে conception about humanity, conception about man এগুলো। পার্টি কর্তৃক চেতনা জাগ্রত করার কথা তুমি বলেছে। আসলে ব্যাপারটা তা নয়। পার্টি যেটা পারে তা হলো ব্যক্তির মধ্যেকার যে conception সেটাকে প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করা। সুতরাং পার্টির ব্যাপারটা আসবে conceptionর পরে। যখন মার্কস কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো লেখার জন্য এত পরিশ্রম করে তখন কি তিনি পার্টির মেম্বার। ছিলেন? যারা বিত্তহীন, অসহায় তাদের জন্য মার্কসের যে বোধ সেটাই আগের কথা। বোধ স্পষ্ট না থাকলে পরে একটা সংগঠন যদি ভেঙে যায়, তখন সংগঠনের সদস্য মনে করে যে তার আদর্শই ভেঙে গেছে! কতগুলো পার্টি গড়ে উঠলো বা ভেঙে পড়লো তার সাথে কম্যুনিস্ট থাকা না থাকার ব্যাপারটা জড়িত থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। একজন কম্যুনিস্ট তার বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতেই কম্যুনিস্ট। এটা মনের ব্যাপার, কিভাবে জগতটাকে দেখি সেটা হচ্ছে ব্যাপার। অর্গানাইজেশান নিশ্চয় সাহায্য করে। যাদের মধ্যে খানিক আগ্রহ আছে, পার্টি তাদেরকেই আরো বেশি করে আগ্রহী করে তুলতে পারে। উৎসাহ যদি একেবারেই না থাকে, ইচ্ছা যদি একেবারেই না থাকে, নিজেকে নৈতিক প্রাণী মনে করার বোধই যদি না থাকে তাহলে পার্টি কি করতে পারে? একজন ডাকাতে আর ডাক্তারে তফাৎ কি? ডাকাত জীবন নেয় আর ডাক্তার জীবন রক্ষা করে। ডাক্তার ব্যর্থ হতে পারে তাই বলে তাকে ফাঁসি দেয়া হয় না। কিন্তু ডাকাতকে ফাঁসি দেয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে আমি নিজেকে কোন ভাবে ভাবি? ডাক্তার নাকি ডাকাত?
ব্যক্তির হতাশা থেকে হতাশার মহামারি হয়
৫ মার্চ ২০০৩
সারা বিশ্ব আতঙ্কিত প্রহর শুনছে। যে কোন দিন, যে কোন মুহূর্তে ইরাক আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। সারা দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষ, জাতিসংঘসহ সব জায়গা থেকেই রব উঠছে যুদ্ধ নয়। কিন্তু ক্ষমতা মদমত্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং তার দোসর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কোন যুক্তি-তর্কের ধার ধারতেই রাজী নয়। সাদ্দাম একনায়ক হোক যাই হোক, তাকে অপসারণের দায়িত্ব ইঙ্গ মার্কিন বাহিনীর নয়। সে দায়িত্ব ইরাকী জনগণের। একনায়ক সরিয়ে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা প্রচলনে সাহায্য করতে পারে একমাত্র জাতিসংঘ। এক্ষেত্রে গায়ের জোরে অন্য কারো হস্তক্ষেপ অবশ্যই অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। এই সরল কথাগুলোই মানতে রাজী নয় আমেরিকা। আসল কথা হলো সন্ত্রাস, জীবাণু অস্ত্র, একনায়কত্ব ইত্যাদি অভিযোগ সামনে খাড়া রেখে দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল ভান্ডারটি লুটেপুটে নেয়া। কিন্তু মানুষ যুদ্ধ চায় না। প্রাণহানি চায় না। সম্পদ বিনাশ চায় না। তাই তারা আজ সোচ্চার। এমনকি ধনী দেশেরও লক্ষ লক্ষ মানুষ নেমে এসেছে রাজপথে। যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? সামরিক শক্তিতে বলিয়ান পক্ষ যুদ্ধকে অমোঘ করে তুলেছে। শান্তিকামী মানুষ কি পারছে যুদ্ধের দামামা স্তব্ধ করতে? কয়েক সপ্তাহ আগে পৃথিবীর ছয়শটি শহরে একযোগে যুদ্ধ বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। কোটি মানুষ কণ্ঠ মিলিয়ে বলেছে-যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। ঢাকায় আজ বিকেলে, প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহলের উদ্যোগে বড় আকারের যুদ্ধ বিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। টেপ রেকর্ডার চালু করার আগে থেকেই বিদ্যমান বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে স্যারের মধ্যে ক্ষোভ এবং উদ্বেগ লক্ষ্য করা গেলো। স্যার আমাদের জানালেন যে, তিনি এই সমাবেশে যোগ দিতে ইচ্ছুক। বিকেলের সমাবেশে যোগদানের কয়েক ঘন্টা আগে আমরা তার কাছে প্রশ্ন রাখলাম : শান্তিকামী মানুষের ক্ষমতা কতটুকু? আদৌ কি তারা পারবে বর্বর যুদ্ধবাজের উন্মাদনা থামাতে? এমতাবস্থায় যদি আমরা হতাশায় আক্রান্ত হই তা কি অস্বাভাবিক? নিন্দা-বিক্ষোভ প্রদর্শনে কিছু কি এসে যায়? শান্তির কোন সম্ভাবনা কি আছে?
বুঝতেই পারছো এই ব্যাপারগুলো দিন-রাত্র আমাকে নাড়া দেয়। তবে কথা হলো আমরা এ ধরনের ব্যাপারগুলোকে সামগ্রিকভাবে অর্থাৎ গ্লোব ওয়াইজ ভাবতে ব্যর্থ হচ্ছি। এটা আমাদের সীমাবদ্ধতা। আমরা অমুক জিন্দাবাদ তমুক মুর্দাবাদের ঘেরাটোপে আটকে আছি। এ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারার ফলেই অনুধাবনের সমস্যা হচ্ছে। আমাদেরকে এভাবে ভাবতে হবে যে, আমি যেমন গ্লোবের মধ্যে আছি গ্লোবও তেমনি আমার মধ্যে আছে। আমার সমস্ত অসহায়তা নিয়েই বলতে চাই যে, without me there is no globe. এভাবে ভাবতে পারলে একটু সাহস পাওয়া যায়। তুমি হয়তো ব্যঙ্গ করতে পার এই বলে যে, ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সরদার! হোক না। আমার ঢাল-তলোয়ার না থাকুক তথাপি আমি নিধিরাম সরদার। সরদার তো। আমি বুড়া মানুষটা এভাবে ভাবতে পারি অথচ আমার তরুণ প্রজন্ম সারাক্ষণই গেলামরে, গেলামরে করছে। তারা খালি বলে, আমরা কি করতে পারি? আমাদের কি শক্তি আছে! দুইটা বোমা মারলেই তো আমরা শ্যাষ হয়ে যাবো। সোভিয়েত ইউনিয়নরে খাইছে, ইরাকরে খাওয়া আর কিইবা এমন ব্যাপার। তাদের কাছে গ্লোবালাইজেশান মানে হলো মনো পাওয়ার। আমেরিকা ছাড়া আর কিছু নাই। আমার চারিদিকে হতাশার সর্বগ্রাসী একটা ব্যাপার দেখি। হতাশাবোধ হচ্ছে এক সংক্রামক ব্যাধি। ব্যক্তির হতাশা থেকে হতাশার মহামারি হয়। জীবনের মধ্যে হতাশাকে অন্বেষণ করতে হয় না। জীবনের মধ্যে আশার বীজ অন্বেষণ করতে হয়। জীবনপথের স্বর্ণখণ্ডকে চিনতে না পারলে এবং চিনে তাকে হাতে তুলে না নিলে স্বর্ণখও নিজে এসে তোমাকে বলবে না যে, এই দ্যাখো আমি তোমার জীবনের স্বর্ণখণ্ড। আমি তোমাকে একথাটা বলতে চাই যে হতাশার বিবরে আবদ্ধ হয়ে থাকলে চলবে না। অনেককে বলেছি আবারও বলছি : কোথায় মৃত্যু দেখলে? আমি তো জীবন ছাড়া আর কিছু দেখি না। গোর্কির কথাই আমাদের জীবন-দর্শন হোক–মানুষ ছাড়া কোন দেবতা নাই। এই আমি যখন মানুষকে দেখি, আমি দেখি যে, কত লক্ষ-হাজার বছর ধরে মানুষ লাইন ধরে জীবনের পথে এগিয়ে চলেছে। সে এগুচ্ছে আর এগুচ্ছে জীবনের সড়কে। প্রতি মুহূর্তে তারা জীবনের খাদে-খন্দে পড়ছে আর মরছে। আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। আবার চলছে। এই দৃশ্য আমাকে মৃত্যুঞ্জয়ী সুধায় অভিসিক্ত করে। আমাকেও অমর শক্তিতে পরিণত করে। আদর্শ বা বিশ্বাস যাই বলি, তার সংকট আমাদের। বাইরে নয়। আমাদের ভেতরে। আদর্শ ব্যক্তির অবশ্যই কোন বিকল্প নাই। আদর্শ ব্যক্তি হওয়ার আকাঙ্খার এবং আশার মধ্য দিয়েই ব্যক্তি আদর্শ হয়ে ওঠে। জীবনের মৃত্যুঞ্জয়ী শিখার বাহক হয়ে ওঠে। জীবনের প্রতীকে পরিণত হয়-ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন হয়ে দেখা দেয়। শেক মুজিব জীবনের সংগ্রামের ডাক দিতে দিতে জীবনকে দান করে। জীবনকে যদি এভাবে দেখি, তাহলে হতাশা কোথায়? বর্তমান বিশ্ব সংকট নিরসনে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সরকার, অসরকার, বেসরকার, নাসরকার যা খুশি বল সবার সামনেই একটা সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ। আমাদের এখানে যারা নিজেদের শান্তির স্বপক্ষ শক্তি মনে করে তারা যদি এই সুযোগটা। কাজে লাগাতে না পারে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এই সুযোগ আজ সারা পৃথিবীর সকল শান্তিকামী মানুষের সামনে এসে হাজির হয়েছে। এই সুযোগ শত্রুর বিরুদ্ধে শেষ যুদ্ধর সুযোগ। আজ বিকেল বেলা শহীদ মিনারে ইরাক আক্রমণ-বিরোধী গণপ্রতিবাদে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমি সেখানে যাবো। জনগণের উদ্দেশে যে কথাগুলো আমি বলবো বলে ঠিক করেছি সেগুলো এখন একবার বলছি। আমি সমাগত জনতাকে বলবো যে, জর্জ বুশের আসল নাম আপনারা জানেন না। বুশের আসল নাম হচ্ছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। আরো বলবো যে, শেষ যুদ্ধ শুরু আজ কমরেড এসো মোরা। মিলি একসাথ।
সরদার ফজলুল করিম বারবার একটা কথাই যেন আমাদের বুঝিয়ে চললেন যে, সবাই মিলে একসাথে দাঁড়ানোর যে সুযোগ বিশ্ব সভ্যতার সামনে এসেছে তা যেন ধরে রাখা যায়। যেন তিনি আরো বলতে চাইলেন এই কথাটি যে, বিশ্ব মানবতার সম্মিলিত প্রতিরোধ-প্রতিবাদের মুখে পশু শক্তির পরাজয় অনিবার্য। এখন হতাশায় আক্রান্ত হয়ে থাকার সময় নয়। এখন প্রবল সাহসী হয়ে রুখে দাঁড়ানোর সময়। তিনি আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নিচের কথাগুলো বললেন :
আরে মরছি তো আমরা মরছি। আমরা তো রোজই মরছি। কিন্তু বুশ একথাটা বুঝতে চাচ্ছে না যে, আমাদেরকে মেরে শেষ করতে পারবে না। ব্যক্তি মানুষকে মারতে পারে। কিন্তু প্রজাতি মানুষকে কি মেরে শেষ করতে পারবে? এই সত্য যখন বিরাজমান তখন হতাশার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? আমাদেরকে মহৎ মানুষ হিসেবে তৈরি হতে হবে। কোন দায়িত্ব নেবো না, কেবল আমি ভোগই করবো, সারাক্ষণ খালি অন্যকে দোষী করবো এবং চারিদিকে আশা ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও হতাশায় ভেসে যাবো এটা হয় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি আত্মবিরোধী এবং আত্মহত্যামূলক দৃষ্টিভঙ্গি। বুশ ডলার কোথায় পায়? আমার রক্ত দিয়ে বুশ ডলার বানায়। বুশের ডলার খাই বলেই একেবারে বুশের দাসস্য দাস হয়ে যাবো? আমার মত পুরোনো আমলের লোকের কাছে এরকম দৃষ্টিভঙ্গি অচিন্ত্যনীয়। বুশকে ধন্যবাদ এজন্য যে সে সারা পৃথিবীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে একটা তার ভাগ একটা আমার ভাগ। আমি নিশ্চিত যে তার ভাগের তুলনায় আমার ভাগ অনেক বেশি শক্তিশালী। এই মূর্খতা বুঝতে পারছে বলেই ভয় পাচ্ছে। এটা বুশের একার কৃতিত্ব নয়। বুশেরও বাপ ছিলো, তারও বাপ ছিলো। এই বাপেরা ১৯২০ সাল থেকে এই বু-প্রিন্টটা শুরু করেছে। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের তাৎপর্য ছিলো নতুন মানুষ নতুন সমাজ তৈরি করা। প্যারি কমিউনকে প্রথম ধরলে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব হলো দ্বিতীয় প্যারি কমিউন। এটা ধ্বংস হয়েছে। ধ্বংসের জন্য তারা ক্রুশেভ, গর্বাচেভ, ইয়েলেৎসিন এসব তৈরি করেছে। যেহেতু যে কোন সমাজই প্রতিষ্ঠিত হয় অপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সেহেতু এই ধ্বংসকে বিপর্যয় কেন বলছো? এটা তো ন্যাচারাল ব্যাপার। আমি নতুন প্যারি কমিউনের আবির্ভাব দেখতে পাচ্ছি। একটা সময় দুর্বল কণ্ঠে আমরা যুদ্ধ নয় শান্তি শ্লোগান দিয়েছি। অথচ আজ কত ব্যাপক-সর্বগ্রাসী শ্লোগানে উচ্চারিত হচ্ছে যুদ্ধ নয়। শান্তি। যুদ্ধ নয় শান্তি। আর কি চাই আমাদের!
আজকের আলোচনার নির্যাসটুকু বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে আবারো ভাবনা শুরু করতে আমাদের বাধ্য করায়। আমাদের এ প্রশ্নটি ভাবতে বাধ্য করে যে কেন এই স্থবিরতা? যে অংশটি সমাজকে নেতৃত্ব দেবে, মুক্তি দেবে সে অংশটি কেন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক? ইরাকের উপর আক্রমণ কি আমাদের উপর আক্রমণ নয়? তাহলে কোথায় সে রকম প্রতিরোধ পর্ব? সমাজের অগ্রসর অংশটি কেন ব্যক্তি স্বার্থের চিন্তায় এত ব্যতিব্যস্ত থাকছে? পল্টন মোড় আর শহীদ মিনারের বক্তৃতা, পত্রিকার পাতায় গরম গরম কলাম লেখা আর টিভি পর্দার সামনে বসে যুদ্ধ-বিনোদন উপভোগেই কি দায়িত্ব শেষ? সরদার ফজলুল করিমের বচন শুনে মনে হয় এগুলো সে অর্থে দায়িত্ব পালন নয়। দায়িত্ব পালনের ছল করে নিজেকে স্তোক দেয়া। তবে একই সাথে আমরা এও মনে রাখলাম যে, যতই সীমাবদ্ধতা থাক, স্বার্থ চিন্তা থাক তবুও সারা পৃথিবীর মত বাংলাদেশেও লক্ষ-কোটি কণ্ঠস্বরে আওয়াজ উঠছে, যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। কিন্তু আমাদের সন্দেহ সে আওয়াজ কি মার্কিন যুদ্ধবাজদের আদৌ সংযত করতে পারছে? তাহলে এই যুদ্ধবাজী ঠেকানোর কার্যকর কোন উপায় আদৌ আছে কি–আমরা প্রশ্ন রাখি।
মৃত্যু দিয়ে মৃত্যুকে ঠেকাবা। আবার কি! আর কোন নাজা রাস্তা কেন। খোঁজ? তুমি বাঁচতে চাইলে একটা গর্ত খুঁড়ে ঢুকে পড়। ইতিহাস খুঁজে দেখো পালিয়ে থেকে নয় নির্যাতিত মানুষ নির্যাতিত হতে হতে মরতে মরতে সভ্যতাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
অর্থাৎ আপনি বলতে চান যে সহায়হীন নিরস্ত্র মানুষ মরতে মরতে দুষ্টের বিবেকবোধ জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষা করবে? আমাদের প্রশ্ন।
–কে সহায়হীন! কে নিরস্ত্র! আরে আমার বুকের আশাটাই তো বড় অস্ত্র। অস্ত্র বলতে খালি ক্ষেপণাস্ত্র, স্টেনগান বোঝ কেন? যে আশার মধ্যে তুমি বেঁচে আছ মোকাবেলা করছ সেটাকে কেন অস্ত্র ভাবতে পার না? এটা বোঝা চাই যে মৃত্যু জীবনকে খায়। কিন্তু জীবন মৃত্যুকে প্রতিরোধ করে দ্বান্দ্বিক ব্যাপার।
এত ব্যাখ্যা শোনার পরও আলোচনার শেষ প্রান্তে এসে আবার প্রশ্ন করি : করণীয় কি? শান্তিকামী মানুষের করণীয় কি?
যারা শান্তি বিনষ্ট করার তারা শান্তি বিনষ্ট করবেই। কিন্তু বাড়িতে ডাকাত পড়লে লাঠি-সোটা যাই থাকুক তাই দিয়ে প্রতিরোধে নামতে হবে। শান্তিবাদী মানুষ মরেও অমর হবে এই বোধে আস্থা রেখে সে যেটুকু সামর্থ্য আছে তাই নিয়ে প্রতিরোধে নামাটাই বিধেয়। যে বাঁচার চেষ্টায় নেমে মরছে সেই হচ্ছে জীবন। আর যে মারতে নেমেছে সে মেরেও মৃত্যুর বাড়া। তোমরা এসব কিছু বোঝ না বা বুঝতে চাও না। তোমরা ইংল্যান্ড আমেরিকা যাও কিসব শিখে আস কে জানে! এখানে মাস্টারি কর অথচ একজন ছাত্রছাত্রীকেও এভাবে ভাবতে উৎসাহিত করা না তোমাদের কোন কমিটমেন্ট নাই, স্যাক্রিফাইস নাই সেজন্যই অন্যকে উৎসাহিত করার নৈতিক অবস্থানও নাই। আর শাসক শ্রেণীর কথা কি বলবো? এরা তো বুশের সার্টিফিকেট আর মন্ত্রী হওয়া ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাও করতে পারে না। আসলে কথা হচ্ছে দার্শনিকবোধ সম্পন্ন হতে হবে, কম্যুনিস্ট হতে হবে। কম্যুনিস্ট হওয়া বলতে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়া বোঝাচ্ছি না। একজন কম্যুনিস্ট কোন একটা কম্যুনিস্ট পার্টির মেম্বার নাও হতে পারে। আবার কম্যুনিস্ট পার্টির একজন মেম্বার প্রকৃত বিচারে কম্যুনিস্ট নাও হতে পারে। এই দ্বান্দ্বিকতা বুঝতে হবে। আমরা আজ যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি সেটাকে সরলভাবে দেখো না। অনেক দ্বান্দ্বিকতা পেরিয়ে এখানে এসেছি। এটা বিনা চিন্তা, বিনা আকাঙ্খ, বিনা স্বপ্নে, বিনা আশায় ঘটেনি। সোজা কথা। তাহলে করণীয় কি এমন প্রশ্ন করার আর কি থাকে? সব চাইতে বড় মীমাংসা তো এই যে তুমি আছো। আমি আছি। এটাইতে বড় সত্য। জীবনকে ভোগ কর। সচেতনভাবে ভোগ কর। জীবনকে বোঝাই হলো জীবনকে ভোগ করা।
দ্বিতীয় জেল জীবন এবং বন্ডদানে মুক্তি
২ এপ্রিল ২০০৩
মাঝখানে কয়েক সপ্তাহ স্যারের কথা শোনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। যদিও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় কোন ছেদ পড়েনি। আমরা শুরু থেকে যেভাবে সময় ধরে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, ইরাক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কারণে আমাদের আলোচনার। ধারাবাহিকতায় একটু ছেদ পড়েছিলো স্বাভাবিকভাবেই। আজ আবার পূর্বের ধারাবাহিকতায় ফিরে আসতে চাইলাম। একারণেই প্রথম এবং দ্বিতীয় জেল জীবনের মাঝখানের সময়টুকু সম্পর্কে জানতে চেয়ে আজকের আলোচনার সূত্রপাত করতে চাইলাম।
১৯৪৯ সালের শেষে জেলখানায় ঢুকে ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে আমি মুক্তি পেলাম। আমি নয় আমরা মুক্তি পেলাম। অর্থাৎ অন্যদের সাথে আমিও মুক্তি পেলাম। মুক্তির পাওয়ার কারণ হলো ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে বিজয়ীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলো কম্যুনিস্ট অথবা কম্যুনিস্ট মাইন্ডেন্ড। যদিও মুসলমান পরিবার থেকে আসা কম্যুনিস্ট নিজেদের কম্যুনিস্ট হিসাবে উল্লেখ করতো না। সমস্যা ছিলো কম্যুনিস্টদের প্রধান সংযোগ ছিলো আওয়ামী লীগের সাথে। ঐ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের প্রধান ভিত্তি ছিলো কম্যুনিস্ট কর্মীরা। কেন যেন ১৯৫৪ পরবর্তী প্রজন্মের যে সব লোক কমুনিজম করে তারা এ কথাটা বলার উৎসাহ রাখে না যদিও তৎকালে কম্যুনিস্টরা আওয়ামী লীগকে জয়ী করার জন্য শ্রম-মেধা ব্যয় করেছে তবুও অন্তত ত্রিশজন গোপন কম্যুনিস্টকে তুমি পাবে যারা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। এরা কমুনিস্ট পরিচয় গোপন রাখতেন কিন্তু শেখ মুজিব এদেরকে জানতেন। তো সে সময় সম্পর্কে কি বলবো? সে সময় অনেকগুলো ঘটনা দ্রুতই ঘটেছিলো। যুক্তফ্রন্টের বিজয়, সরকার গঠন, আবার সরকার ভেঙে দেয়া এবং ১৯৫৮ সারে এসে সামরিক শাসনের সূচনা।
যাদেরকে গোপন কম্যুনিস্ট বলছেন তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
-কেমন করে বলবো, সব নাম তো এখন আর মনে নাই। তুমি যদি ঐ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট থেকে বিজয়ী সদস্যদের একটা তালিকা আমাকে দাও তাহলে আমি নামের পাশে টিক দিয়ে বলতে পারবো এইটা একটা কম্যুনিস্ট ওইটা একটা কম্যুনিস্ট। এ মুহূর্তে দুএক জনের নাম মনে পড়ছে। যেমন চাটগার চৌধুরী হারুনুর রশীদ, সিলেটের পীর হাবিবুর রহমান, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, পাবনার সেলিনা বেগম ও তার স্বামী। আর আমার নিজের ব্যাপারটা হলো এরকম যে তখনও আমি সব সময়ের মতই যতটা না অর্গানাইজার তার চেয়ে বেশি অবজারভার ছিলাম। এ কারণেই বোধ হয়। আমার উপরে তেমন কোন গুরুতর দায়িত্ব আসে নি।
এ প্রশ্নটা কি করতে পারি যে দায়িত্ব দেয়া হয়নি নাকি দায়িত্ব নিতে চান নি?
–আমি তো বলছিই যে আমি পর্যবেক্ষণকারী হিসেবেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তবুও কখনো কখনো দায়িত্ব পেয়েছি। যেমন বরিশালের নলিন দাস আমাকে বক্তৃতা করার জন্য নিয়েছিলেন। এ ছাড়াও মুসলিম কমরেডরা বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতো। আসলে I was very much beloved boy of the Communist Party. সত্যেন সেন, রনেশ দাশগুপ্ত, জ্ঞান চক্রবর্তী, ফনি গুহ কতজনের ভালোবাসার কথা আমি বলবো। আমার অপার ভাগ্য যে আমি তাদের পেয়েছিলাম। সেজন্যই আমি শাহ আজিজুর রহমান না হয়ে সরদার ফজলুল করিম হয়েছি।
আপনার পজিশন যদি এতই নির্বিষ হয় যেমনটা আপনি বলছেন, অর্থাৎ আপনার ভূমিকা হলো পর্যবেক্ষকের তাহলে পুলিশ ঘুরেফিরে আপনারে ধরে কেন?
ঘুরে ঘুরে তো শুধু আমাকে ধরছে না। যারা ধরে তাদেরতো একটা বড় লিস্ট থাকে। সেই লিস্ট অনুযায়ী, যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়ার পরের কথা বলছি, তারা যখন জাল ফেললো তখন একসাথে সব ধরা পড়ে গেলো। এমনকি আশি বছরের বুড়া কবিয়াল রমেশ শীলও ধরা পড়লো। আমারে ধরে ঠিক আছে ধরে। কিন্তু প্রশ্ন করো যে রমেশ শীলকে কেন ধরে? আসলে যারা ধরে বা ধরার ক্ষমতা রাখে তারা কার মধ্যে কতখানি বীজ লুকিয়ে আছে সেটা আগে থেকে আঁচ করে নেয়। এটাকেই বলে সিস্টেম। ঐ সিস্টেম মনে করেছে আমাকে ধরা উচিৎ, তাই ধরেছে। ওরা ভেবেছে, এই ব্যাটারে ঊনপঞ্চাশ সালেও একবার জেলে ঢুকানো হইছিলো। তার মানে এই লোকের নিশ্চয় কোন গড়বড় আছে। সে সময়ের ব্যাপারে আরো কিছু জানতে চাইলে আমি বলবো যে, ১৯৫৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠান করাটা মুসলিম লীগের একটা অবদান। তারা এটা নাও করতে পারতো। গুণ্ডা লাগিয়ে দিতে পারতো। তারা তা করে নাই। নির্বাচন হয়েছে এবং নির্বাচনে মুসলিম লীগ সংখ্যালঘু রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। অন্য কেউ না বললেও আমি মুসলিম লীগের এই অবদান স্বীকার করতে চাই। কেননা আমি পুরো ব্যাপারটাকে দ্বান্দ্বিকভাবে দেখতে চাই। কোন নেগেটিভকেই পুরোপুরি নেগেটিভ মনে করা যায় না। কোন পজেটিভকেই পুরোপুরি পজেটিভ মনে করা যায় না। নেগেটিভেরও পজেটিভ থাকে আবার পজেটিভেরও নেগেটিভ থাকে। মুসলিম লীগ যে চুয়ান্ন সালেই মার্শাল ল জারী করানোর মত অবস্থা তৈরি করলো না–এটা একটা বড় ব্যাপার। মার্শাল ল আসলো আটান্ন সালে। মাঝখানের সময়টাতে অবশ্য মুসলিম লীগ মার্শাল লর কথা বলতো। আমি কনস্টিটুয়েন্ট এ্যাসেম্বলিতে যেয়েও শুনছি। তখন ভাবতাম ব্যাটারা হুমকি দিচ্ছে। ওরা বোঝে নাই যে হুমকিটা যতক্ষণ হুমকি থাকে ততক্ষণই হচ্ছে কাজের। হুমকিটা যখন রিয়ালিটি হয়ে যায় তখন তো তার হাতে আর কিছু অবশেষে রইলো না। যেমন ধরো সে সময়ের একটা চলতি হুমকি ছিলো-বাঙালিরা যদি ওয়ান ইউনিট না মানে তাহলে মার্শাল ল হয়ে যাবে। সোহরাওয়ার্দী সাহেবও এই অস্ত্রের ভয়ই বাঙালিদের দেখাতেন।
স্যার এখন আপনি আমাদের বলেন সামরিক শাসন আসার পরে কি পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করলেন? তখন তো আপনার দ্বিতীয় জেল জীবনের শুরু।
সামরিক শাসন আসলো এবং আমাদের গ্রেফতার করা হলো। আটান্নর শেষ দিক থেকে বাষট্টির ডিসেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত আমি জেলের ভেতরে। সামরিক শাসন সম্পর্ক আমার মন্তব্য শুনে কি হবে? যারা বাইরে ছিলো তাদের জিজ্ঞেস কর। আমি নিজের ব্যাপারে বলতে পারি। বাষট্টির ডিসেম্বরে আমি ছাড়া পাই। এ ব্যাপারে আমার পরিবারের ভূমিকা ছিলো। আরেকটা ব্যাপার হলো জেলে ঢোকানোর আগে সাতান্ন সালে আমি সংসার পেতেছি। নতুন সংসার জীবনের মাথায় জেলে চলে গেলাম। জেলে বসে আমি নিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনি। কম্যুনিস্ট সংগঠনের কোন দায়িত্বে না থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
এ পর্যায়ে এসে দ্বিতীয় পর্যায়ের জেলজীবন সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি হলো। প্রথম জেলজীবনের স্মৃতিচারণের সময় জেলের ভেতরকার পরিবেশ, দৈনন্দিন জীবনের বর্ণনাই শুধু নয় সহবন্দীদের মানসিকভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা, পাঠচক্র, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে বন্দীদের চিন্তাভাবনা ইত্যাদি কিছু মিলিয়ে যে ঋণ পরিবেশনা পেয়েছিলাম তাই আমরা পেতে চাইলাম দ্বিতীয় জেলজীবনের কাহিনীটা শোনার সময়।
–প্রথম বারের জেলজীবন সম্পর্কে যা বলেছি এখানেও তাই, অর্থাৎ Communist elements wanted to remain political inside the jail also. কম্যুনিস্টদের বড় গুণটা ছিলো এই যে ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ সভ্যতা, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে তার যে বোধ, যে বিশ্বাস, তা কখনোই মন্ত্রী হওয়া না হওয়ার সাথে মিশিয়ে ফেলেনি। জেলখানার ভেতরে বসেও কম্যুনিস্ট পার্টির ক্যাডাররা এই বোধের চর্চা অব্যাহত রাখতো।
জেলখানার ভেতরে দীর্ঘ সময় থাকার পরে কম্যুনিস্ট ক্যাডারদের মধ্যে কি ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?
এখানেই আসলে চর্চার ব্যাপার আর কি। বোধগুলো লালন করার ব্যাপার আর কি। আমি তোমাকে বলতে পারি যে, জেলখানার ভেতরে যেহেতু কম্যুনিস্টদের মধ্যে কম্যুনিস্ট থাকার চেষ্টা অব্যাহত থাকতো সেহেতু গণহারে নন-কম্যুনিস্ট বা এ্যান্টিকম্যুনিস্ট হয়ে যাওয়ার নজীর পাওয়া যায় না–যেটা পরবর্তীকালে হয়েছে।
সরদার ফজলুল করিমের জীবনের একটা অস্পষ্ট অংশে আলোচনাটা হাজির হয়েছে বলে মনে হলো। বাষট্টির শেষে এসে তিনি যেভাবে জেল থেকে বেরিয়ে আসলেন এবং রাজনৈতিক সংগঠন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করলেন তা নিয়ে কথাবার্তা হওয়া প্রয়োজন আমরা অনুমান করি। এ বিষয়টি নিয়ে কারু কারু মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা রয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যারা সরদার ফজলুল করিম বিষয়ে আগ্রহী তাদের মধ্যে রয়েছে প্রশ্ন : কেন তিনি এমন করলেন? আমরা স্যারকে জানালাম যে বিষয়টা নিয়ে তিনি কথা বললে অস্পষ্টতার নিরসন ঘটতে পারে। তিনি রাজী হলেন। উদ্দেশ্য মোতাবেক আমরা এগুতে থাকলাম। শুরুতে দ্বিতীয় জেলজীবনের কাহিনী শুনতে চাইলাম।
–তেমন কোন কাহিনী নাই। প্রথমবারের মতই জেলের ভেতরে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পরস্পরকে সাহায্য করেছি। যতদূর মনে পড়ে ঢাকা, রাজশাহী এবং কুমিল্লা জেলে ছিলাম। এখানে একটা কথা উল্লেখ করবো যে, প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বার জেলজীবনে একটু হিউম্যান কন্ডিশনে ছিলাম। জেলখানার ভেতরের পরিবেশ আগের চেয়ে খানিকটা ভালো পেয়েছিলাম। চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হওয়ায় এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিলো। যদিও সামরিক শাসনামলে আমরা জেলে ছিলাম। এবং অনেক আগেই যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়া হয়েছে তথাপি সামরিক সরকার যুক্তফ্রন্টের অভিজ্ঞতা মাথায় রাখতে বাধ্য ছিলো। উনপঞ্চাশ সালের যে রকম। বিপুল হারে কম্যুনিস্টদের জেলখানায় ঢোকানো হয়েছিলো এবার ততটা হয়নি। তবে প্রধান টার্গেট কম্যুনিস্টরাই ছিলো।
আমরা প্রশ্ন রাখলাম, ততদিনে তো আওয়ামী লীগ বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। তাহলে তাদেরকে টার্গেট না করে কম্যুনিস্টদের প্রধান টার্গেট করতে যাবে কেন?
আওয়ামী লীগ বড় রাজনৈতিক দল কিন্তু সরকার না। সরকার আওয়ামী লীগের ভেতরে যারা আসল অর্থাৎ কম্যুনিস্ট ইলিমেন্টগুলোকে প্রধান টার্গেট করেছিলো। পার্টিগতভাবে দেখলে কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর আগের রমরমাটা কমে যাচ্ছিলো। এটা একান্তই আমার অভিমত।
এবারে আমরা আসল জায়গাটা ধরতে চাইলাম। অর্থাৎ কেন তিনি সংগঠন থেকে দূরে চলে যেতে থাকলেন? কেন তিনি বন্ড দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসলেন? এগুলোকে যদি কেউ নেতিবাচক মনে করে থাকে তাহলে তাঁর বক্তব্য কি?
তুমি যা বললা এর মধ্যে কোন মিথ্যা নাই। ধর আমি হচ্ছি এককালের কম্যুনিস্ট। বাষট্টির ডিসেম্বরে আমি পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় জেল থেকে বেরিয়ে আসি। গভর্মেন্ট বলছে ওরে বাইর করতে হইলে আন্ডারটেকিং দিতে হবে। তখনকার আমলে আন্ডারটেকিংকে বলতো বন্ড। বন্ড শব্দটা খারাপ শব্দ। যে বন্ড দেয় সে সরকারের দালাল ছাড়া আর কি! জেলের ভেতরে থাকার সময় থেকেই কম্যুনিস্ট সহবন্দীরা আমার পরিবর্তনটা টের পাচ্ছিলেন। তারা টের পাচ্ছিলেন যে সরদার যেন একটু গা-ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আগের মত অত ইন্টিম্যাটলি পাওয়া যাচ্ছে না। ওদের অনুমানে ভুল ছিলো না। তখন আমি নিজের সম্পর্কে একটা রিয়েলাইজেশান ডেভেলপ করছিলাম। আমি সাতান্ন সালে পরিবার গঠন করি। জেলে আসার সময় ছয় মাস বয়সের একটা বাচ্চা রেখে এসেছি। আমার ওয়াইফ একজন শিক্ষক। তার কান্নাকাটি আমাকে স্পর্শ করে। এমন একটা অবস্থায়, আমার মধ্যে যে বোধটা বেড়ে ওঠে তা হলো আমার পরিবারের পাশে দাঁড়ানো উচিৎ। এই বোধ থেকেই আমি বন্ড দিয়ে বেরিয়ে আসতে রাজী হই। তা না হলে কারু পক্ষে আমাকে বন্ড দিয়ে বেরিয়ে আসায় রাজী করানো সম্ভব ছিলো না। বলতে পার, এটা আমার একটা নীতিগত পরিবর্তন যা শুরু হয়েছে জেলের ভেতর থেকেই। সুতরাং ব্যাপারটা দাঁড়ালো এরকম যে, জেল থেকে বেরিয়ে আমি আর রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত থাকলাম না। আবার একেবারে যে নিষ্ক্রিয় থাকলাম তাও নয়। আমি পর্যবেক্ষকের ভূমিকা নিলাম। কিন্তু তাই বলে আমাকে যারা ভালোবাসতেন, যারা আমার আদর্শ ছিলেন তারা আমার উপর থেকে ভালোবাসা প্রত্যাহার করে নিলেন না। আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন না। শত্রু মনে করলেন না। আমি তখন পরিবারটিকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে এমনকি লকলেজে ভর্তি হলাম। পরে তেষট্টির ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমিতে যোগদান করলাম।
তখন কিন্তু এ অঞ্চলে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে। সামরিক শাসনের প্রাথমিক ভীতি কাটিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন জোরদার হওয়া শুরু হচ্ছে। দীর্ঘ সময় কমুনিস্ট আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকলেন। জীবনের অনেক প্রলোভন উপেক্ষা করলেন। নির্যাতন ভোগ করলেন। অতপর যখন আপনার মত একজনকে ভীষণ প্রয়োজন তখন আপনি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেন। এই যে পরিবর্তনটা এটা অন্যদের সমালোচনার কথা বাদ থাক আপনার নিজের মধ্যে কি কোন অনুশোচনা জন্ম দেয় নি?
–অনুশোচনা বা কন্ট্রাডিকশন কোনটাই জন্ম নেয় নি। আমি হয়তো মুভমেন্টে যোগ দিচ্ছি না, মুভ করছি না। কিন্তু কম্যুনিজম সম্পর্কে আমরা যে ভাবনা, মানুষকে যেভাবে দেখি, সমাজকে যেভাবে দেখি সেগুলোর সাথে তো কন্ট্রাডিক্ট করি নি বা সেগুলো রিফিউজ করার দরকার পড়েনি।
কিন্তু এক সময়ে এই জনপদের আন্দোলন সংগ্রামে শরীক ছিলেন এবং আত্যন্তি কভাবেই ছিলেন–একথা আপনি নিজেই আমাদের বলেছেন। অথচ এখন থাকছেন না এই ব্যাপারটা সহজভাবে বুঝতে পারছি না। আপনাদের প্রজন্মের কেউ কেউ বোধ হয় আপনার এই অবস্থান পরিবর্তনকে এ্যাপ্রিশিয়েট করেন না। বিব্রতকর হলেও স্যারকে এ কথাটা বললাম।
কথা হচ্ছে, আমার যেটা ক্ষমতা নাই সেটা আমি কেমন করে করবো? এক সময় আমি জেল খেটেছি, আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলাম সবই ঠিক আছে। কিন্তু যখনকার কথা বলছো তখন তো এগুলো আমার পক্ষে আর সম্ভব না। আমার বাচ্চা আছে, পরিবার আছে। যাদের ফেলে আমি যেতে চাই না। এটা হলো সচেতনভাবেই চলমান প্রক্রিয়ার বাইরে থাকা। আমার নীতি, আদর্শ, দর্শন কিছুই কিন্তু আমি বাদ দেই নি। কিন্তু একটা লোক সব কাজ নাও করতে পারে। সে অর্গানাইজার নাও হতে পারে। এবার আসি এ্যাপ্রিশিয়েট করা না করার ব্যাপারটায়। খুবই স্বাভাবিক। তুমি একজনকে যে কাঙ্খিত অবস্থানে দেখতে চাও সেখানে যদি না দেখতে পাও তাহলে তো ঐ লোকের প্রতি তোমার ভালোবাসা একটু কমবেই। অনেক আগে যখন আমি গণপরিষদের সদস্য ছিলাম একটা ঘটনা হয়েছিলো। ফরেন পলিসি সংক্রান্ত একটা ব্যাপারে যখন আমি আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দেই তখন কম্যুনিস্ট পার্টি আমাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি শুভাকাঙ্খী মারফত খবরটা জেনে বলেছিলাম, পার্টি ঠিক কাজ করেছে। কেননা আমি পার্টির ইচ্ছা-বিরুদ্ধে কাজ করেছিলাম। একইভাবে বাষট্টি সালের পর আমার পরিবর্তিত অবস্থানে যারা খুশি হতে পারেন নি তারা তাদের জায়গা থেকে ঠিক কাজই করেছেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে তেষট্টি সাল থেকে আপনি বাংলা একাডেমির চাকুরি করছেন। এবং পারিবারিক জীবন-যাপন করছেন। এবং পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করছেন। আপনার এই পর্যবেক্ষণ কাদের কাজে লাগছিলো?
-হ্যাঁ। পারিবারিক জীবন-যাপন করছিলাম এবং রাজনীতির পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করছিলাম। কারু কাজে লাগুক না লাগুক আমার কাজে লাগছিলো। আমি দেখছিলাম যে সমাজটা পাল্টাচ্ছে। পাল্টানোর ফলে কোথায় যাবে আমি জানি না। কিন্তু আমি তো দেখছি। ভূমিকা পাল্টানোর ব্যাপারে তোমার প্রশ্ন? মুনির চৌধুরীর কথা ধরো–যে আমার ভীষণ ঘনিষ্ঠ। সে রাজনীতির সংগঠন বাদ দিয়ে শিক্ষকতার ভূমিকা নিলো। আমি বাংলা একাডেমির চাকুরির রোল নিলাম–ক্ষতি কি? এখানে মুনিরের কথা একটু বলি। আমি যতখানি গভীরভাবে রাজনীতি পর্যবেক্ষক ছিলাম মুনীর ততটা নয়। মুনীর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতিতে যুক্ত হয়। প্রফেসর আবদুল হাই সাহেবের সাথে যুক্ত হয়। এক সময় দেখতে পেলাম যে, আমার ব্যাপারে ওর একটা অপছন্দ ডেভেলপ করে। বলেনি কখনো। কিন্তু-ভাবে-ভঙ্গিতে বোঝা যায়।
এসব আলাপ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, যিনি সরদার স্যারের যে কোন আলাপে অবধারিতভাবে স্থান পেয়ে থাকেন, তাঁর কথা এসে পড়ে। আপাতভাবে কিছুটা বিষয় বহির্ভূতভাবেই স্যার বলতে থাকলেন :
–আমার ব্যাপারে মুনীরের এক ধরনের জড়তা তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু প্রফেসর রাজ্জাকের মধ্যে তেমনি কিছু হয় নি। সেই যে বিয়াল্লিশ সাল থেকে আমারে ধরছেন আর ছাড়েন নি। বাংলা একাডেমিতে কাজ করার সময়ও তিনি কোন কাজে ওদিকে গেলে আমাকে না দেখে আসেন নি। ছাত্রজীবনের পরবর্তী সময়ে রাজ্জাক সাহেবের সাথে আমার সম্পর্ক কেমন ছিলো এ প্রশ্ন তুমি এক সময় করেছে। উত্তরে বলি, যোগাযোগ ছিলো। তবে যেমন ধরো, বাংলা একাডেমীতে যোগদানের ব্যাপারে ওনার তেমন কোন ভূমিকা ছিলো না। আমার বড় একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীন। এখানে একটা কথা বলি-মুনীর চৌধুরী আমার পক্ষে কোন কথা বলেছেন এমন খবর আমি পাই নি। অবশ্য আমার পক্ষ নেয়া অতটা নিরাপদ ছিলো না। আমার ব্যাপারে তার আড়ষ্টতার প্রমাণটা আমি পেয়েছি। কারণ একটা এমনও হতে পারে যে আমার স্ত্রীর তুলনায় ওর স্ত্রী অনেক বেশি অ্যান্টি-পলিটিক্যাল ছিলেন। আমার কারণে আমার স্ত্রীকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে কিন্তু কখনো সে অ্যান্টি-পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড নেয় নি।
আমরা স্যারকে মূল বিষয়ে টেনে আনতে চাইলাম। বললাম, ধরুন আপনার যে কাহিনী সেটা অন্য একজন ব্যক্তির কাহিনী। যে ব্যক্তি সুদীর্ঘ সময় ধরে আত্মত্যাগ করেছে, আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, মানুষের মুক্তির রাজনীতিতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। তারপর একটা সময়ে এসে বলেছেন যে আমি আর একেবারেই রাজনীতির সাথে নাই। আমি এখন পর্যবেক্ষক। আপনাকে যদি ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলি আপনি কি মন্তব্য করবেন?
একেবারেই রাজনীতির সাথে নাই এমনভাবে বললে হবে না। বলো যে ততটা থাকছেন না। একেবারে খারিজ করে দিলে তো হবে না। ঠিক আছে, তোমার লাইন ধরেই যাই–একজন বন্ধু যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে যে তুমি এই কারবারটা কি করলা? সারাজীবন এত কিছু করে শেষে আইসা সব ছাইড়া দিলা! এই তো প্রশ্ন? এর একটা উত্তর হলো : One man does not remain one man throughout his life. আমরা এটা সহজে চিন্তা করতে পারি না। একটা মানুষকে নানান ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তার নানান পরিবর্তন সংগঠিত হয়। তুমি দেখতে চাচ্ছো তার যেন পরিবর্তন না হয়। তুমি চাচ্ছো তাকে দশ বছর আগে যে রকম কমুনিস্ট দেখেছো সে রকম কমুনিস্ট হিসাবে দেখতে। একটু অবজেকটিভলি একটু সায়েন্টিফিক্যালি যদি দেখো তাহলে বুঝতে পারবা যে কেউই অপরিবর্তনীয় থাকে না। এই পরিবর্তনকে ভালো বা খারাপ বা কম ভালো বা কম খারাপ বলতে পারো। কিন্তু পরিবর্তনশীলতাকে তোমার স্বীকার করতেই হবে।
তাহলে আপনার ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা ঘটেছিলো তাকে আপনি কি বলবেন? আপনার কম্যুনিস্ট বন্ধুরা যদি আপনাকে নেতিবাচকভাবে দেখেন তাহলে কি আপনি মাইন্ড করবেন?
–আমি বলবো যে আমি পরিবর্তন করলাম। আমি অর্গানাইজেশানের জন্য খুব একটা হেলফফুল থাকলাম না। আর বন্ধুরা নেতিবাচকভাবে দেখলে আপত্তি করবো কেন? তারা তা সঠিকভাবেই করবেন। তবে কতটা নেগেটিভলি করবেন সেটা হচ্ছে কথা (উচ্চ হাসি হাসলেন, আমরাও যোগ দিলাম)। কিন্তু একটা কথা বলছি যে, সবাই কিন্তু আমাকে নেতিবাচকভাবে নেয় নি। যেমন ধরো, অনিল মুখার্জী। চেনো তাকে? নাম জানো? তার বই পড়েছো? পড়লে আবার পড়। ভীষণ নীতিবোধসম্পন্ন লোক। এই লোক আমার নন-ইনভলমেন্টর ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি আমার উপর থেকে তাঁর যে স্নেহ-ভালোবাসা তা প্রত্যাহার করলেন না। এবং তিনি একটা কাজ করেছিলেন সচেতনভাবে। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত পার্টির কোন সমস্যা নিয়ে আমার সাথে কথা বলেন নি। আর আমিও তাকে এ বিষয়ে কখনো কোন প্রশ্ন করিনি। তিনি আমার বাসায় আসতেন। পুরো পরিবারকে ভীষণ আদর করতেন।
বারবার একই প্রশ্ন করে হয়তো আপনার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাচ্ছি। তবু শেষ একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। কত ঘটনাই তো আপনার চোখের সামনে ঘটছিলো। ছয়দফা। গণঅভ্যুত্থান। নির্বাচন। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ। একজন রাজনৈতিক কর্মী না হোক একজন রাজনীতির পর্যবেক্ষক হিসাবে আপনি তখন কি ভাবছিলেন?
এখন এসব বিষয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে কথা বলা ছাড়া তো উপায় নাই। পেছনের দিকে তাকিয়ে বললেও বলবো, ভাবছিলাম এই কথাই যে দেশ পরিবর্তিত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, আমরা যে স্বপ্ন দেখতাম সে স্বপ্নের মধ্যে এ্যান্টি-হিউম্যান অর্থে এ্যান্টি-পাকিস্তানী হওয়ার ব্যাপার ছিলো না। Pakistan was also a land of people. আমরা সেজন্য পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টি তৈরি করেছি। আমরা পাকিস্তানের গণতন্ত্রায়ন চেয়েছি। এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রক্রিয়াটার মধ্যে ডেমোক্রেটিক ইলিমেন্টগুলোকে যুক্ত করতে চেয়েছি। এসব নিয়ে অনেক কথা আছে। যেমন ধরো, মুজিব মণি সিংহকে বলছে, দাদা এবার লাগাইয়া দেই? মণি সিংহ বলেছেন, একটু ধৈর্য ধর। অস্থির হয়ো না। আসলে কম্যুনিস্টরা লং-টার্মে চিন্তা করে। তারা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার টার্মে চিন্তা করেনি। সেসব যাই হোক, আমি একটা সময়ে এসে এটাই ভাবছিলাম যে যা হওয়া উচিত তাই হচ্ছে। পিপল মুভ করছে। দেশ গণঅভ্যুত্থানের পর্যায়ে যাচ্ছে। আসাদকে হত্যার ঘটনা যেদিন ঘটে সেদিন আমি সাংঘাতিকভাবে আলোড়িত হয়েছিলাম।
এবারে আপনার কাছে একটু তাত্ত্বিক জবাব আশা করি। জাতীয়তাবাদের রাজনীতির কাছে কম্যুনিস্ট রাজনীতি কেন পিছিয়ে পড়েছিলো? আপনি হয়তো বলবেন যে আওয়ামী লীগের ভেতরে কমুনিস্টরা ছিলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো রাজনৈতিক দল হিসাবে কম্যুনিস্ট পার্টি কেন আওয়ামী লীগের তুলনায় পিছিয়ে থাকলো? কিংবা ব্যক্তি হিসাবে ধরলে শেখ মুজিবের তুলনায় পিছিয়ে থাকলো? কিংবা ব্যক্তি হিসাবে ধরলে শেখ মুজিবের তুলনায় মাওলানা ভাসানী কেন ঝাপসা হয়ে গেলেন?
–কিভাবে এক কথায় উত্তর দেই! এটা একটা দ্বান্দ্বিক ব্যাপার, হেগেলিয়ান ব্যাপার। হয়তো বলতে পারি যে যা হওয়ার তাই হইছে। তবে। আসল কথা হচ্ছে যে ব্যাপারটা এত সোজা না। কম্যুনিস্ট নামটা অত সহজে সামনে আসতে পারে না। এর জন্য ইতিহাসের পর্ব অতিক্রম করে আসতে হয়। তোমার প্রশ্নের উত্তরে, বলতে পারি যে এটাকে আমি কমুনিস্টদের ব্যর্থতা মনে করি না। কম্যুনিস্টদের অত শক্তি কোথায় যে ব্যর্থতার প্রশ্ন। আসে! একটা ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টকে ডেমোক্রেটিক রাখার চেষ্টা করেছে। এটাই তো বড় কথা। আরেকটা ব্যাপার হলো কম্যুনিস্টরা হঠকারিতাকে প্রশয় দিতে পারে না। হঠকারিতার ফল ভালো হয় না। খাপড়া ওয়ার্ডের ঘটনাটার কথা বলি। অনেকে হয়তো একমত হবে না কিন্তু আমার দৃষ্টিতে খাপড়া। ওয়ার্ডের ঘটনায় আবদুল হকদের হঠকারিতা ছিলো। ফল কি হলো? কতগুলো অমূল্য জীবন ঝরে পড়লো আর কম্যুনিস্টদের সাফল্য-ব্যর্থতা প্রসঙ্গে বলি, কম্যুনিস্টরা কিভাবে মানুষকে মুক্তি দেবে? যার মুক্তি তাকেই অর্জন করতে হয়। এটা সক্রেটিসের কথা। কমুনিস্টরা যা পারে তা হচ্ছে মুক্তির অর্জনের ব্যাপারে সাহায্য করা। আরেকটা ব্যাপার হলো, কম্যুনিস্টরা একটা সমন্বিত সমাজ, মানুষের সমাজ তৈরি করতে চেয়েছে। কিন্তু বিপক্ষ শক্তি যারা তারা। তো বোকা নয়, দুর্বল নয়। তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে কম্যুনিস্টদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে এবং করবে। পাকিস্তান আমলেও কম্যুনিস্টদের এসব বাধা-বিঘ্নের ভেতরেই কাজ করতে হয়েছে। সুতরাং কম্যুনিস্টরা ব্যর্থ হয়েছে এটা আমি মনে করি না।
১৯৭১ : দস্তখত দিলাম তবু গ্রেফতার হলাম
৮ এপ্রিল ২০০৩
আজকের বিষয়বস্তু ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। শুধু মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস নয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গোড়া থেকেই শুরু হওয়া রাজনৈতিক ঘটনাবলী, মুক্তিযুদ্ধের সূচনা এবং পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়টা–এসবই আজকের আলোচনার উপজীব্য। একজন পর্যবেক্ষক অর্থাৎ সরদার ফজলুল করিম ঘটনাগুলোকে কিভাবে দেখছিলেন? এছাড়াও তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থা, ভাবনা চিন্তা, সর্বোপরি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ব্যাপারে তাঁর মধ্যে কি ধরনের চিন্তা তৈরি হচ্ছিলো সেগুলো জানার আগ্রহও আমাদের থাকলো।
–এসব কথা বলার আগে আমি অনুরোধ করবো তোমরা ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এসব বিষয়গুলো মাথায়। রাখো। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এটা প্রয়োজন। অনেক ঘটনাই মনে পড়ছে। যেমন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে ক্যান্টনমেন্টে হত্যার ঘটনা। তারপর শেখ মুজিব যেদিন ছাড়া পেলেন সেদিনের ঘটনা। মুজিব ছাড়া পেয়েছেন এটা আমার কাছে অনেক বড় ঘটনা ছিলো। হাজার হাজার মানুষের মত আমিও তার ধানমন্ডির বাড়ির দিকে দৌড়ে গেলাম। কিন্তু জনতার এত ভীড় ছিলো যে, আমি খুব বেশি অগ্রসর হতে পারি নি। বাড়ি ফিরে আমি ডায়েরীতে লিখলাম যে, শেখ মুজিব মানে হচ্ছে জনতা সুতরাং আমি জনতাকে দেখে আসলাম। এসব কথা বলছি ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্য। কালের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য।
’৭১-এর কথা যদি জানতে চাও আমি শুরু করবো ৭ মার্চ থেকে। আমি ৭ মার্চ দেখেছি। আমি দেখেছি যে জনগণের মধ্যে পাকিস্তান সম্পর্কে একটা বড় রকমের দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন চলে এসেছে। তখন আবার পশ্চিম পাকিস্তানীরা। আলোচনা বা আলোচনার ধাপ্পাবাজী শুরু করেছে। আসলে ইয়াহিয়া খান। যেদিন পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দেন অর্থাৎ মার্চের ১ তারিখে সেদিন থেকে পুরো দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। অধিবেশন বসার কথা ছিলো ৩ তারিখে। ১ তারিখে শেখ মুজিব বাংলা একাডেমিতে একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। তাঁর বক্তৃতার মাঝখানেই ইয়াহিয়ার ঘোষণা জানাজানি হয়ে গেলো। মুজিব তাড়াতাড়ি বাংলা একাডেমি ত্যাগ করে চলে গেলেন। তখন থেকেই টেনশান ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলো। আমাদের বাংলা একাডেমির পরিবেশটাও বেশ পাল্টে গেলো। সেখানে দুএকজন ছিলো যারা চলমান। ঘটনাবলী পছন্দ করছিলেন না। এদেরকে এজেন্ট বলা যেতে পারে। পরবর্তীতে এদের মাধ্যমেই রেডিও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একটা বিবৃতি তৈরি করে দস্তখত কালেকশান করার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিলো। তখন কবির চৌধুরী সাহেবও বাংলা একাডেমীতে ছিলেন। তিনি দস্তখত দেন নি। আমি দিয়েছিলাম।
এটা কি ধরনের বিবৃতি ছিলো যে কবির চৌধুরী সাহেব দস্তখত দেননি এবং আপনি দিয়েছিলেন? আমরা জানতে চাইলাম।
Situation at Dhaka is nomal-এ বক্তব্যটা গভর্মেন্ট প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলো। রেডিও পাকিস্তানের হেমায়েত নামের এক লোকের মাধ্যমে এ বক্তব্যের সপক্ষে বিভিন্ন জায়গা থেকে দস্তখত সংগ্রহ করা হয়। ঐ সময়ের হলিডে পত্রিকা দেখলে তুমি এগুলো ভালোভাবে জানতে পারবে। মার্চের শেষ দিকে এবং এপ্রিলের প্রথম দিকে সরকার এ উদ্যোগটা নিয়েছিলো। কারণ তখন গণহত্যা, ধ্বংসলীলা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভীষণ আলোড়ন চলছিলো। সুতরাং ঢাকার অবস্থা স্বাভাবিক আছে এ রকম একটা ব্যাপার প্রতিষ্ঠা করা সরকারের পক্ষে ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছিলো।
কিন্তু ঢাকার পরিস্থিতি তখন স্বাভাবিক ছিলো না। এটা সবাই জানে। কিন্তু আপনি সরকারের পক্ষে দস্তখত দিলেন। কেন এই মিথ্যাচারের পক্ষে আপনি দস্তখত দিলেন?
আমার ব্যক্তিগত রূপান্তরের কথা তোমাকে আগের আলোচনায় বলেছি। দস্তখত প্রসঙ্গে বলি, হেমায়েত আমাকে বললো যে স্যার দস্তখত না দিলে কি হবে এটা আপনি তো বোঝেন। কাজেই ডিশিসানটা আপনাকে নিতে হবে। সুতরাং ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই যে, আমি যদি কথামত কাজ না করি তাহলে তারা রিপোর্ট করবে যে Sardar Fazlul Karim has refused to sign the statement. ফল হবে এই যে, আমার বাসা আক্রমণ হবে, আমাকে হয়তো আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যেতে হবে। আর ঢাকায় থাকতে হলে আমাকে দস্তখতটা করতে হবে।
এই ভীতিটা তো কবির চৌধুরী সাহেবের জন্যও প্রযোজ্য ছিলো? আমাদের প্রশ্ন।
না, কবির চৌধুরী সাহেব এবং সরদার ফজলুল করিম এক না। এটা তোমাকে বুঝতে হবে। তোমরা ইয়াংম্যানরা বুঝতে চাও না। কবীর চৌধুরী সাহেবের অনেক যোগাযোগ ছিলো। আর্মিতে তাদের কাছের লোকজন অফিসার পদেও ছিলেন। কাজেই তিনি যা করতে পারেন আমি সরদার ফজলুল করিম সে কাজ করতে পারি না। এটা হচ্ছে আমার নিজস্ব কৈফিয়ৎ। দস্তখত না দেওয়াটা সরদার ফজলুল করিমের সাহসে কুলায় নাই।
আপনি পারিবারিক কারণ দেখাচ্ছেন, কানেকশান না থাকার কথা। বলছেন। অথচ সে সময়ই অসংখ্য মানুষ জানবাজি রেখে লড়াই করছে। এখন আপনি নিজেই নিজের সম্পর্কে মন্তব্য করুন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থেই এটা জরুরি বলে মনে হচ্ছে।
–আমার নিজের সম্পর্কে মন্তব্য হচ্ছে I have to remain by the side of my family. এই বিবেচনা থেকেই আমি সব কিছু করেছি। আরো জেনে রাখো যে, ২৭ মার্চ থেকে শুরু করে ৭ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ গ্রেফতার হওয়ার দিন পর্যন্ত নিয়মিত অফিস করেছি এবং অফিস থেকে বাসার দিকে গেছি।
জাতি কি আপনার কাছে এরকম প্রত্যাশা করেছিলো? আপনি একটা সিম্বল। আন্দোলন, সংগ্রাম, গ্রেফতার বরণের মধ্যে দিয়ে একটা সময়ে আপনার যে অবস্থান তার সাথে কি এসব ব্যাপার মেলানো যায়?
-সিম্বল মানে কি? একটু দ্বান্দ্বিক ভাবো যদি তুমি বুঝতে না চাও তাহলে তো অসুবিধা। আমি তো আগেও বলেছি যে, আমার এক সময়কার যে রাজনৈতিক যুক্ততা পরবর্তীকালে ঠিক সে রকমভাবে আমি আর থাকি নি। একটা ব্যক্তি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটা ব্যক্তি না। আর জাতির প্রত্যাশা বলতে কি বোঝাচ্ছে এটা বুঝতে পারছি না। পুরো জাতি বলে যে শব্দটা ব্যবহার হয় সেটা একটু বাড়াবাড়ি। পুরো জাতি বলে কোন ব্যাপার কারু সামনে থাকে না। তার সামনে থাকে তার জীবনটা।
তাহলে কিছু লোক যে বলে, আমার জীবন বাঁচানোর তাগিদে রাজাকার বা শান্তিবাহিনীর মেম্বার হইছি তাদেরকেই বা কি বলার আছে?
-তাদের সাথে কিভাবে তর্ক করবা সেটা তোমার ব্যাপার। আমি শুধু বলতে পারি যে, একটা ব্যক্তি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক না। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয় বা নিতে বাধ্য হয়। আমিও নিয়েছি। তুমি বা অন্য একজন যে কোন উপসংহারে আসতে পারে। আমাকে সংশোধনবাদী, কাওয়ার্ড বলতে পারে আবার নাও বলতে পারে। জাতি, জাতির প্রতীক এগুলো বিমূর্ত ব্যাপার। কংক্রীট ব্যাপার হলো এই যে, সরদার ফজলুল করিম মনোযোগ দিয়ে বাংলা একাডেমীতে চাকুরি করে এবং সরকারের কথামত দস্ত খত দিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারে নি। সেপ্টেম্বরে সে গ্রেফতার হলো। যারা আমার দস্তখত দেয়া, চাকুরি করা ব্যাপারগুলো পছন্দ করেনি তারা আমাকে কোলাবোরেটর বলেছে। তাদের যা মনে হয়েছে তা বলেছে। আমি কি করতে পারি! তারা অতি সহজে বলতে পেরেছে যে সরদারের দস্তখত না দেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু না দেয়ার যে ফল তা থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য কেউ ছিলো না। সত্যি যে আমার সীমাবদ্ধতা ছিলো। আমি পিছু হঠেছি। সিগনেচার দিয়েছি। কিন্তু তবুও আমাকে গ্রেফতার করা হলো। এটা কেন হলো? আমার সীমাবদ্ধতা নিয়ে তুমি কথা বলছো কিন্তু কেন গ্রেফতার করা হলো সে ব্যাপারে। কেন কিছু বলছে না। আমার অনুরোধ একজন ব্যক্তিকে দেখবে তার পজিটিভে-নেগেটিভে, তার সাহসে-অসাহসে। সব জায়গাগুলো ধরার চেষ্টা করতে হবে। আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আমি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মত সাহসী হতে পারি নি। তার আত্মীয়-স্বজন সমস্ত ব্যবস্থা করেছে। কুমিল্লা থেকে আগরতলা যাওয়া কোন ব্যাপার ছিলো না। কিন্তু তিনি যান নি। তিনি যা পেরেছেন আমি তা পারিনি। সাধারণ মানুষের মতই আমার মধ্যে সাহস এবং ভীরুতা উভয়ই আছে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গীতার বাণী উদ্ধৃত করেছিলেন। বলেছিলেন, নিজের কর্তব্য সম্পন্ন করার জন্য যে ব্যক্তি নিজের জীবন দান করে সেটা দান নয়–গ্রহণ। সেখানেই তার সম্পূর্ণতা। এই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের খবর তোমরা রাখো না। তিনি জানতেন যে ঘাতকরা আসবে। তিনি স্বজনদের আহাজারি করতে বারণ করেছিলেন। ঘাতকরা ঠিকই এসেছিলো। এবং তাঁকে হত্যা করেছিলো। এই একটা লোক যিনি নিজেকে দেখেছেন মানুষের সমাজের সাথে নিজেকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে। এই লোকটা একটা সম্মিলিত সমাজ তৈরি করতে চেয়েছিলো। এমন সমাজ যেখানে মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে। মানুষ মানুষের সাথে থাকবে। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আমার নমস্য। আবার ধরো অগ্নিযুগের বিপ্লবী চট্টগ্রামের পূর্ণেন্দু দস্তিদার। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থান ত্যাগ করেছেন। জীবন বাঁচাতে। চেয়েছেন। পারেন নি। পথে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু জীবন বাঁচাতে চেয়েছিলেন। বাঁচতে চাওয়াটা কোন পাপের ব্যাপার না। একটা আঘাতের সামনে জীবন রক্ষা করা একজন ব্যক্তির জন্য কোন পাপের ব্যাপার নয়। সে জীবনটা কিভাবে ব্যবহার করলো সেখানে হচ্ছে বিচারের প্রশ্ন।
তাহলে সাহসিকতা, আদর্শ, আদর্শের জন্য জীবন বিসর্জন দেয়া এসব কি শুধুই কথার কথা?
–কথার কথা কেন হবে? শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে দেখো। কথার কথা হচ্ছে, যারা কথার কথা বলে অথচ কাজ করে না। একটা লোক সিগনেচার। দেয় আবার জেলেও যায়–এভাবে সম্পূর্ণভাবে একটা ব্যক্তিকে তোমার বুঝতে হবে। সে শুধুই সিগনেচার দেয় না জেলেও যায়। লোকটাকে যদি মূল্যায়ন করতে চাও তাহলে তার দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করাই বড় কথা না। তাকে ভালোবাসা যায় এমন পয়েন্টগুলোও খুঁজে বের করতে হবে। তার মধ্যে যদি অনুপ্রেরণাদায়ী কিছু থাকে সেগুলো খুঁজে বের করাই বড় কথা।
বেশ কিছু সময় সরদার ফজলুল করিমকে কাঁটা-ছেঁড়া করার চেষ্টার পর আমরা পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আলাপ যখন পদ্ধতিগতভাবে ক্যাসেট বন্দী হচ্ছিলো তখন নিবিড়ভাবে স্যারের কথাগুলোর তাৎপর্য বোঝা সম্ভব হয় নি। পরবর্তীতে যখন ক্যাসেট থেকে তাঁর কথাগুলো তুলে এনে সাদা পৃষ্ঠায় লিখতে বসেছি তখন মনে হচ্ছিলো, আমরা যে পদ্ধতিতে তাঁকে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছিলাম, অর্থাৎ আপনি কেন এরকম করলেন অথচ ওরকম করলেন না। অথবা আপনার কাছে প্রত্যাশা ছিলো এরকম অথচ আপনি ওরকম করলেন–এটা একজন ব্যক্তিকে মূল্যায়নের সঠিক পদ্ধতি নয়। বরং মানুষ বলেই মানুষের মধ্যে যে সব সীমাবদ্ধতা থাকে সেগুলোকে সক্রিয় বিবেচনায় রেখেই মূল্যায়নের চেষ্টা করা উচিত। আজকের আলোচনার এক পর্যায়ে এসে স্যার পাকিস্তান-বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। তাঁর ভাষায়, আমরা যারা পাকিস্তান ভাঙছি তারা পাকিস্তানত্ব বাদ দেই নাই। পাকিস্তান ভেঙে ফেললেও একটা সম্মিলিত সমাজের আকাঙ্খ আমাদের মধ্যে নাই। কামরুদ্দীন আহমেদ, তাজউদ্দীন আহমেদের মত লোকেরা যারা পাকিস্ত নি আমলে ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের বেস ছিলেন তাদের লক্ষ্য পূরণ হয় নাই। অতপর আমরা আবারো প্রথম প্রশ্নটি উত্থাপন করলাম। প্রশ্নটি ছিলো এরকমের : একজন পর্যবেক্ষক হিসাবে আপনি আমাদের বলুন, যুদ্ধের দিনগুলোতে আপনার কি মনে হচ্ছিলো? দেশ স্বাধীন হওয়ার দিকে এগুচ্ছিলো এমনটা কি মনে হচ্ছিলো, না কি আপনার মনে হচ্ছিলো যে যুদ্ধ প্রলম্বিত হবে? অথবা এমনটা কি কখনো মনে হয়েছে যে স্বাধীনতা আদৌ সম্ভব নয়?
–তোমরা পোলাপান মানুষ তোমাদের কি করে বোঝাই! তোমাদের সাথে আসলে আলোচনা করা উচিত না। কারণ তোমরা সময়টাকে সেভাবে ধরতে পারবা না। আরে আমরা অফিস করেছি। তা অফিসের মধ্যে আমরা কি করেছি সেটা তুমি কেমন করে জানবা! আমরা অফিসের মধ্যে প্ল্যানচেট করেছি। প্ল্যানচেট করে জিন্নাহ, এ. কে ফজলুল হক সাহেবের কাছ থেকে স্বাধীনতা সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। এগুলোর হয়তো কোন মানে নেই। এগুলো করেছি মনের আকুতি থেকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কানের কাছে ধরে রেখেছি, রাতে শহরে কোথাও বোমা ফাটার শব্দে ভীত নয় সুখী হয়েছি। আবার বাড়ির সামনে দিয়ে মিলিটারীর গাড়ি আসলে ভয়ে কম্পিত হয়েছি। ভয় এবং সাহস উডয়ই একজন ব্যক্তির মধ্যে যুগপৎ অবস্থান করে। পর্যবেক্ষণ কি ছিলো এ প্রশ্নের উত্তরে আমার আর কি বলার থাকতে পারে। আমি তোমাদের মত অত পয়েন্ট ধরে ধরে কথা বলতে পারবো না। যা বোঝার তোমাকেই বুঝে নিতে হবে। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যে এই উপমহাদেশে একটা বিশাল ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা হয়েছে। রমনার কালী মন্দির গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমীতে গোলা ফেলা হয়েছে। আমার বড় ভাইয়ের ছেলে যুদ্ধে গেলো আর এলো না, বোনের ছেলে লঞ্চে বাড়ি থেকে আসার পথে বিমান আক্রমণের শিকার হলো এবং মারা গেলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দিচ্ছে, ইন্দিরা গান্ধী আমাদের পক্ষে সারা বিশ্বে কূটনীতি চালাচ্ছেন। এসব দেখার পর আমার ভাবনাটা কি দাঁড়াতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
আজকের অর্থাৎ ৮ এপ্রিল ২০০৩ তারিখের আলোচনার ইতি ঘটলো। স্যারের নিমোক্ত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে :
-একাত্তর সালের বড় ঘটনাই হচ্ছে একাত্তর সাল। কথাটা এজন্যই আসে যখন কেউ প্রশ্ন করে যে মুক্তিযুদ্ধ করে কি লাভ হয়েছে? আমি বলি যে মুক্তিযুদ্ধটাই তো লাভ করলাম। এই যে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, এটাই তো লাভ। যেমন ধরো, খন্দকার মুশতাকের অন্তবর্তীকালীন সরকারে অন্ত ভুক্তি, তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা–এসবই তো অভিজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধের পরে যা ঘটেছে এখনো যা ঘটছে সবই তো মুক্তিযুদ্ধের ফল। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এদের সবারই নিহত হওয়ার কারণও মুক্তিযুদ্ধ। ইলেকশানে কারো জেতা না জেতা, কারসাজী, বুশের দালালী বা আমেরিকানিজম সব কিছুর মূলে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ। এই ব্যাপারগুলো অনেক সময় বোধের অগম্য মনে হলেও মিথ্যা নয়।
তোমরা কি পাকিস্তানিজম পরিত্যাগ করেছো!
১২ এপ্রিল ২০০৩
একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়। যা ছিলো দীর্ঘ দুযুগের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী সংগ্রামের সফল রাজনৈতিক পরিণতি। স্বাধীন রাষ্ট্রটির জনগণের মধ্যে এই প্রত্যাশা জন্ম নেয় যে, রাজনৈতিক স্বাধীনতার হাত ধরাধরি করে মুক্তি সংগ্রামের অন্য লক্ষ্যটিও, অর্থাৎ অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নও এবার পূর্ণ হবে। জাতির সে প্রত্যাশা, সে স্বপ্ন তৎকালীন সিভিল শাসকরা অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পূর্ব পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিলেন, কতটা পূরণ করতে পেরেছেন–এই ছিলো আজকের আলোচনার জন্য স্যারের প্রতি মোটাদাগে প্রথম প্রশ্ন।
তুমি যে প্রত্যাশার কথা বলো, মানুষগুলোর প্রত্যাশার কথা বললা–এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নাই। এই মানুষগুলার ভেতরে একজন সরদার। ফজলুল করিমও ছিলো। আমি শুধু সরদার ফজলুল করিমের বিষয়েই কিছু কথা বলতে পারি। বটেই আমার কিছু প্রত্যাশা ছিলো। তবে একথাও বলবো যে, তেমন সাংঘাতিক কোন প্রত্যাশা ছিলো না। আমি তোমাকে আগেও বলেছি যে আমি তেমন কোন সাংঘাতিক ব্যক্তি বা রাজনৈতিক কর্মী ছিলাম না। প্রত্যাশা থাকবে তাদের যারা পুরো ব্যাপারটাকে সফল রূপ দিয়েছিলেন। ধরো শেখ মুজিবের। ধরো তাজউদ্দিনের। প্রত্যাশা থাকবে তাদের দলের। এখন প্রত্যাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এসব বিষয়ে তোমাকে একটা ব্যাপার বুঝতে হবে। সন্দেহ নেই যে শেখ মুজিব সবচেয়ে বড় ব্যক্তি ছিলেন। এখন মুজিব বলে কথা নয় সব বড় ব্যক্তিরই পোলাপান থাকে বউ থাকে আত্মীয়-পরিজন বন্ধু থাকে। তাদের আদর-আবদার থাকে। রুশোর ঐ বাক্যটা যদি তুমি মুখস্থ রাখ তাহলে ভালো হবে-man is bom free and every where he is in chain অর্থাৎ মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং সে সর্বত্র শৃঙ্খলে আবদ্ধ। খেয়াল করো, শো এবং শব্দটা ব্যবহার করছেন কিন্তু শব্দ নয়। কথাটা বললাম এই জন্য যে, শেখ মুজিবের তো সীমাবদ্ধতা আছে। তাঁরও শৃঙ্খল আছে। কোন একজন ব্যক্তির পক্ষে, যত শৃঙ্খলে সে আবদ্ধ সবগুলো ভেঙে ফেলা সম্ভব নয়। মুজিবের পক্ষেও সম্ভব নয়। সুতরাং আমি যখন আমার প্রত্যাশা তৈরি করি তখন আমাকে মনে রাখতে হবে যে, যারা আমার প্রত্যাশা পূরণ করবে তাদেরও শৃঙ্খল আছে। আমি এভাবেই দেখি।
এ পর্যায়ে এসে স্যারের কাছে জানতে চাওয়া হলো : স্বাভাবিক যে, মানুষ যে মাত্রায় প্রত্যাশা পূরণ চেয়েছিলো সেভাবে হবার নয়। প্রত্যাশা পূরণকারীদের সীমাবদ্ধতার কথাটা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমরা জানতে চাই প্রত্যাশা পুরণের দায়িত্ব যে কর্তৃপক্ষের তাদের ঝোঁকটা কোনদিকে ছিলো? একাত্তর সালে একটা ট্রেন্ড-সেট হয়েছিলো। ট্রেন্ডটা হলো পাকিস্তানতন্ত্রের বিপরীত একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। যে রাষ্ট্র নিজ জনগণের আশা-আকাঙ্খা পূরণে সদা-সচেষ্ট থাকবে। সে ঝোঁকটা কতটা বেগবান হয়েছিলো সে সম্পর্কে আপনি আমাদের বলুন।
প্রশ্ন শুনে স্যার অনেকটাই রেগে উঠলেন এবং বললেন :
-কি বলো এসব কথাবার্তা! তোমরা কি পাকিস্তানিজম রিজেক্ট করেছে! Do you understand what is Pakistanism? মোটা দাগে বুঝলে হবে না। সূক্ষ্মভাবে বুঝতে হবে। পাকিস্তানিজমের যে আঘাতটা সেটা ইনকুডিং শেখ মুজিব বেশিরভাগই বুঝতে পারে নাই। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন এর মধ্যে খারাপ কিছু নাই। অধিকাংশ লোক ভোট দিয়েছে, তাহলে কেন তিনি এই ন্যায্য দাবিটা করবেন না! সেটা ঠিকই আছে। কিন্তু তোমাকে বুঝতে হবে যে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়া হবে কি হবে না, শুধু এটুকুর মধ্যেই পাকিস্তানিজম ব্যাপারটা সীমিত নয়। এটা সুদীর্ঘকালের পরিকল্পনা প্রসূত। ব্লু-প্রিন্ট। ভারতীয় উপমহাদেশে যাতে করে একটা মানবিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে না পারে, যাতে মানুষ কখনো মানুষ হতে না পারে, যাতে মানুষ মানুষকে মারে-এসব লক্ষ্য থেকেই পাকিস্তানিজম তৈরি হয়েছে। এটা একদিনে হয়নি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করার পর তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এই বলে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন যে entire East Bengal has gone red.
আপনার এসব কথার সাথে দ্বিমত নেই। কিন্তু এটাও সত্য যে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। আপনি কি মনে করেন না যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্ত নতন্ত্র নামক ধারণাটা পরিশোধিত হয়েছিলো বা পরিত্যাজ্য হয়েছিলো-স্যারের সামনে প্রশ্ন রাখা হলো।
–পরিশোধন হয় নাই তো। পরিশোধনটা তো আপনা-আপনি হয় না। কাউকে করতে হয়। এই উপমহাদেশকে ঘিরে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের যে নীল-নকশা, সেটা মুক্তিযুদ্ধের ফলেও শেষ হয়নি। ব্রিটিশ আমলে এবং পাকিস্ত নি আমলে বেছে বেছে সেই লোকগুলোকেই নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছে যারা মানুষে মানুষে সৌহার্দ্র চায়, সম্প্রীতি চায়। যারা একটা মানবিক সমাজ চায়। পাকিস্তান হওয়ার পর যখন ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চের হিন্দু অফিসাররা চলে যাচ্ছিলো তখন সরকার আরো কিছুদিন থেকে যাওয়ার জন্য তাদেরকে রিকোয়েস্ট করেছিলো। কি কারণে এমন অনুরোধ করেছিলো? উদ্দেশ্য ছিলো মুসলমানদের ভেতরের প্রগতিশীল ইলিমেন্টগুলোকে চিনে নেয়া। তারপরে ধরো পার্টিশানের সময়ের কথা, তখন আমি কে? আমি তো কেউ না। টার্গেট হওয়ার মত কিছু না। কিন্তু ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ মনে করেছে যে ঢাকা ইউনিভার্সিটির এই লোকটার মধ্যে কিছু একটা আছে। অতএব তারা আমাকে ধরেছে। এর অনেক পরে অর্থাৎ স্বাধীনতার আগে আগে যখন আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফিরে আসার চেষ্টা করছি তখন প্রভাবশালী একজন আমাকে বলেছিলো, আপনি তো কম্যুনিস্ট। আমি জানালাম যে আমি কোন রাজনীতি করি না। ঐ লোকের ভাষ্য ছিলো, আমি তা মনে করি না। যে বীজ আপনার মধ্যে ঢুকেছে, সে বীজ কোনদিন বেরুবে না। আবার ধরো, পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কেউ একজন আমাকে বলেছে, আপনি ইসলামের উপর একটা আর্টিকেল লেখেন। আমি বলেছি, আমি যা পারি তাই তো লিখবো! ইসলামের উপর আমাকে লিখতে বলছেন ঠিক আছে। ইসলাম তো খারাপ কিছু না। কিন্তু আমাকে তো সময় দিতে হবে–আমি এভাবে উত্তর দিয়েছি। জিসি দেবের কাছে অনুরোধ করে বলেছি যে স্যার আমি একটু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে চাই। তিনি বলেছেন, দ্যাখো আমার আপত্তি নাই। কিন্তু আমি তো হিন্দু লোক। তুমি যদি মন্ত্রী সাহেবকে একটু বলতে পার তাহলে আমার সুবিধা হয়। আমি তখন বলেছি, মন্ত্রীর কাছেই যদি যাবো তাহলে আপনার কাছে কেন এসেছি! এত কথা বলছি পাকিস্তানিজমের প্রগাঢ়তা বোঝানোর জন্য।
তাহলে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে স্বাধীনতার পরও সেই ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে?
রয়ে গেছে মানে? সাংঘাতিকভাবে রয়ে গেছে। এজন্যই একটু আগেই বলেছি যে পাকিস্তানিজম জিনিসটা কত ভয়ংকর সেটা বড়-বড় সব লোকেরাও বুঝতে পারেনি। তাহলে কিভাবে আশা করবো যে স্বাধীনতার তিন-চার বছরের মধ্যেই সব একেবারে পাল্টে যাবে! এ হয় না। একটা সমাজকে পরিবর্তন করাটা কত বড় একটা ব্যাপার তা অনেকেই বুঝতে পারে না। পাকিস্তানিজম ঠিকমত বুঝতে না পারার কারণে শেখ মুজিব এমনকি নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থাটাও সেভাবে করেন নি। অবশ্য ঠিকঠাক নিরাপত্তা নিলেই মুজিব বেঁচে যেতেন তা নয়। নানান ফোর্স সর্বক্ষণই কাজ করে।
এরকমই যদি হয় তাহলে পাকিস্তান পর্ব থেকে বাংলাদেশ পর্ব কিভাবে আলাদা?
–সন্দেহ নেই যে একটা অতি বড় ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু স্পষ্ট করে জেনে রাখো যে সে সময় যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকতো তাহলে তোমার সাধের বাংলাদেশ আসতো না। প্রায় এক লাখ সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানীরা সারেন্ডার করবে? অ্যাবসার্ড! আরেকটা ব্যাপার ইন্দিরা গান্ধীর সাপোর্ট। পাকিস্তানিজম ব্যাপারটা ঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলো কম্যুনিস্ট পার্টি। সেজন্যই এক সময় তারা আবুল হাশিমের পাশে থেকেছে। পরে মুজিবের পাশে এসেছে। কিন্তু মুজিবের কি ঘটেছিলো? স্বাধীনতার পরে তো শেখ মুজিব ধর্মপ্রাণ হতে থাকলেন। কম্যুনিস্ট পার্টি কি করবে? তাদের তো অত শক্তি নাই। যে মুজিবকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে। এত শক্তি নাই যে ক্ষমতা দখল করে একটা সরকার গঠন করতে পারে। এত শক্তি নাই যে লেনিনের মত বলতে পারে, now or ever. এত শক্তি নাই যে সমস্ত বিভাজনের দেয়াল তুলে দিয়ে বলতে পারে যে, হিন্দু-মুসলমান এসব কোন প্রশ্ন নাই। একমাত্র ব্যাপার হচ্ছে মানুষ। মানুষের বাংলাদেশ। সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মবাদ তো কোন তুচ্ছ ব্যাপার না। তাদের শক্তি আছে। ব্যাপক শক্তি। আমার কথা হচ্ছে, শিকড়ে পৌঁছার চেষ্টা না করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে শর্ট-কাট পথে বুঝতে পারবে না।
কিন্তু আপোষ করেও মুজিব বাঁচতে পারলেন না। আপনি কি মনে করেন যে তার ব্যর্থতার মধ্যেই পরবর্তী সমস্যাগুলোর বীজ নিহিত?
–আপোষ না করে কি করবে! যা করা উচিত সেটা মুজিব করেন নি বা। করার কথাও নয়। কিন্তু আপোষ করলে বাঁচতে পারবেন এমন কোন কথা নেই। বাংলাদেশটাকে মানুষের বাংলাদেশ বানানোর প্রচেষ্টা সাম্রাজ্যবাদ মেনে নিতে পারে না। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে–এমন তো কোন সামাজিক শক্তি ছিলো না যারা মানুষের বাংলাদেশ বানানোর ব্যাপারে মুজিবকে বাধ্য করতে পারে।
আজকের আলোচনা শেষে মূল প্রশ্নটির ব্যাপারে স্যারের মূল্যায়নকে আমরা বুঝে নিলাম এভাবে : মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সরকারের জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-সাধ পূরণের ব্যাপারটা অত সহজ ব্যাপার ছিলো না। এক্ষেত্রে সামর্থের অভাববোধের অভাব ইচ্ছার অভাব সবকিছুই কাজ করেছে।
আমার শেখ মুজিবকে মেরে ফেলা হয়েছে
৭ মে ২০০৩
স্যারকে জন্মদিনের বিলম্বিত শুভেচ্ছা জানিয়ে আজকের আলোচনা শুরু করা হয়। ১ মে স্যারের উনআশিতম জন্মদিন উপলক্ষে শুভানুধ্যায়ীরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষজনের উপস্থিতিতে সেদিন তিনি প্রায় দুঘণ্টা বক্তৃতা করেছিলেন–মানুষ, মানুষের সমাজ, বর্তমান বাংলাদেশ পরিস্থিতিসহ সভ্যতার উপরে সাম্রাজ্যবাদের চলমান আগ্রাসন সম্পর্কে। শ্রোতা হিসাবে সেদিন আমরাও উপস্থিত ছিলাম। আজকের আলোচনার ক্ষেত্রেও আমরা অন্যান্য দিনের মতই পূর্ববর্তী আলোচনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে চাইলাম। গতদিন স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম গণতান্ত্রিক শাসনামল সম্পর্কে স্যার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু মূল্যায়ন হাজির করেছিলেন। আজকে আমরা প্রথম গণতান্ত্রিক শাসনামলের যে রক্তাক্ত অবসান ঘটেছিলো এই বাংলাদেশে সে সম্পর্কে কিছু শোনার আকাঙ্খা করি। আমাদের প্রথম প্রশ্নটি ছিলো : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটা আপনি যখন প্রথম শুনলেন সে মুহূর্তে আপনার কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো?
এই প্রশ্নটা করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। কারণ সেদিনের ঘটনার অনুভূতি আমার মনের মধ্যে আছে। এবং এ কথাগুলো বলা দরকার কেননা আমি মরে গেলে পরে তো আর কাউকে জানাতে পারবো না। কোন সন্দেহ নেই যে সেদিনের ঘটনাটা সাংঘাতিক। সে সাথে একথাও বলছি যে ঘটনার সংবাদটা যখন আমার কাছে এলো, তোমাকে মনে রাখতে হবে যে সংবাদটা কোন অসচেতন লোকের কাছে এলো না। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্সের টীচার। কয়েক বছর আগে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন আমার গুরু অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী। বুঝতে পারছি যে, তোমরা এসব পূর্বকথনে বিরক্ত হচ্ছে। তোমরা এত মেকানিক্যাল যে যা চাও টু দি পয়েন্ট তাই দিতে হবে। কিন্তু আমার তো উপায় নাই। আগের কথাগুলো না বলে তোমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। যা হোক। আমাকে জয়েন করানোর সিদ্ধান্ত হলো কিন্তু প্রফেসর মুজাফফর আহমদ চৌধুরী এটাও ভাবলেন যে একটু ক্লিয়ারেন্স নিয়ে আসাটা দরকার। অর্থাৎ শেখ মুজিবের ক্লিয়ারেন্স। তিনি আমাকে সাথে করে মুজিবের কাছে নিয়ে গেলেন। আমার খবর পেয়েই তিনি আসলেন এবং নিজস্ব ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, এই সরদার আপনি কই আছেন? আমিও নিজস্ব ভঙ্গিতে উত্তর দিলাম, আমি তো রাস্তায় আছি। তিনি বললেন, রাস্তায় ক্যান! আপনি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে থাকবেন। কথাটা শুনে মুজাফফর চৌধুরী নিশ্চিত হলেন। আমি জয়েন করলাম। আর বিস্তারিত না বলি। কিন্তু পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত মুজিবের সাথে আমার আরো স্মৃতি আছে। এখন ১৫ আগস্টের কথায় আসি। এর কয়েক দিন আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে সম্বর্ধনা দেয়ার জোর প্রস্তুতি চলছে। আমি তখন বিশ্ববদ্যিালয়ের ফুলার রোডের আবাসিক এলাকায় এক্কেবারে রাস্তার ধারের একটা ফ্ল্যাটের নিচতলায় থাকি। বেডরুম থেকে পুরো রাস্তাটা দেখা যায়। ভোর বেলায় আমি মাইকের আওয়াজ শুনলাম। মাইক লাগানো একটা গাড়ি থেকে আমি একটা আওয়াজই শুনতে পেলাম: খুনী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘোষণা দিতে দিতে গাড়িটা চলে গেলো। আমি সে সময়ে অন্য যে কোন কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকলেও এরকম ঘোষণা শোনার জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। বঙ্গবন্ধু সকালবেলা কখন ক্যাম্পাসে আসবেন কখন যাবেন–এসব নিউজের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়েছে, এ নিউজের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। সেই সকালেরই আরো একটা ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে আছে। ঘোষণা শোনার কিছু পরেই দেখলাম যে মার্কিন পতাকা ওড়ানো একটা গাড়ি নিউ মার্কেটের ওদিক থেকে এসে কলাভবনের পাশ ঘেঁষে ইন্টারন্যাশনাল হলের দিকে গেলো। কিছু সময় পরেই আবার আগের রাস্তা ধরে ফিরে গেলো। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমার কাছে। এগুলো সবই মুজিব হত্যার প্ল্যানিংয়ের অংশ। বিনা প্ল্যানিংয়ে তো কিছু হয় না। এই পর্যন্তই আমি বলতে পারি। এটুকুই আমার মনে আছে।
আপনি এসব দেখলেন, মুজিব হত্যার ঘোষণাও শুনলেন। তখন আপনার প্রতিক্রিয়াটা কেমন হয়েছিলো?
-আরে সাংঘাতিক! এর পরেও পোলা তুমি আমার অনুভূতির কথা জানতে চাও! আমার শেখ মুজিবকে মেরে ফেলা হয়েছে একথা জানার পরও তুমি কি মনে কর যে আমার খুব আনন্দের অনুভূতি হয়েছিলো! তুমি কি এরকম অনুভূতির কথা শুনতে চাও! মাইকের ঘোষণায় কারা ছিলো, গাড়ি করে কে এসেছিলো সেসব আমি জানি না। তবে কথা হলো, আমি যেহেতু রাজনীতি করা লোক, আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অনুভূতি হয় নাই। আকাশ তো ভেঙে পড়েছে তার পরিবারের মাথায়। পরিবারই বা কোথায়? তাদেরকেও তো হত্যা করা হয়েছে। ওয়াইফ, বাচ্চা, আত্মীয় সবাইকে। শেখ মুজিব তো কাউকে ভয় পায় নাই জীবনে। ঘাতকদের উদ্দেশ্যে তাঁর শেষ কথা ছিলো, তোরা কি করছিস! ঘাতকের ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার আগে সে শুধু বিস্ময়ের সাথে বলেছে, তোরা কি করছিস! গান্ধীজি যেমন বলেছিলেন, হে রাম। আর কি বলবো? বলতে পারি যে মুজিবকে হত্যার মধ্যেই ঘটনা শেষ হয়ে যায় নি। পরবর্তী ঘটনাগুলোর সাথে এই হত্যার যোগসূত্র আছে। যেমন ধরো খন্দকার মোশতাক আসলো। সে রাজত্ব শুরু করলো। আওয়ামী লীগের অনেকে তার সাথে যোগ দিলো বা দিতে বাধ্য হলো। কেন এমন হলো আমি জানি না।
পঁচাত্তরের পরবর্তীতে যে ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করলো সে সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি? একাত্তরের পরে যেটুকু গণতন্ত্র পাওয়া গেলো সেটুকু নাই হয়ে গেলো–আমাদের এরকমই মনে হয়। আপনার কি মনে হয়?
–আমার কিছুই মনে হয় না। কি আবার মনে হবে? দেশে সামরিক শাসন আসছে তাতে কি হইছে? আমি আমার পরিবার নিয়ে থাকছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াইছি। বাংলাদেশে সামরিক শাসন আসছে দেখে আমার মন কাঁদছে। তাতে কি হইছে? এগুলো বলার কিছু আছে নাকি? মুজিবকে শেষ করে ফেলার পর কখন কার ভাগ্যে কি ঘটবে তা কেউ জানতো না। মুজিবকেই যদি এই বাংলাদেশের মাটিতে শেষ করে ফেলা যায় তাহলে অন্যরা নিজের সম্পর্কে আর কিইবা ভাবতে পারে? এই বাস্তবতার মধ্যে আমাকেও বাঁচতে হয়েছে। ভয়ে এসব প্রসঙ্গ আলোচনা করিনি পর্যন্ত। ক্লাশে সক্রেটিস, প্লেটো, মুভমেন্ট অফ সোসাইটি পড়িয়েছি। বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে সমাজ কখনো অপরিবর্তিত থাকে না। ছেলেমেয়েদেরকে এভাবে জেনারেল টার্মে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছি। তাদের বলেছি যে, you have to enjoy your won death. কেউ একা তার জীবনটাকে পাল্টে ফেলতে পারে না। এটা সম্ভব না। আবার জীবন অপরিবর্তিত থাকে না এটাও সত্য। তাহলে মানুষ যা করতে পারে তাহলো পরিবর্তনটাকে বোঝার চেষ্টা করা। এটা একটু হেগেলিয়ান ব্যাপার। এই মতে মানুষ ইতিহাসের অসহায় দর্শক মাত্র।
আপনিও কি একই মত পোষণ করেন?
-না। আমি আবার একটু মার্কসবাদে বিশ্বাসী।
তাহলে হেগেলকে সাক্ষী মানছেন কেন?
–দেখো, মার্কসও হেগেলকে ফেরে দেন নি। মার্কস হচ্ছেন নিউ হেগেলিয়ান। মার্কস একমত যে একজন ব্যক্তি একজন শ্রমজীবী মানুষ ইতিহাসকে বদলে দিতে পারে না। কিন্তু ইতিহাস বলে যদি একটা ব্যাপার থাকে এবং তার যদি একটা মুভমেন্ট থাকে তাহলে এই মুভমেন্টের পেছনে একটা ফোর্সও থাকে। এই ফোর্স হচ্ছে মেহনতী মানুষ, নির্যাতিত মানুষ।
আমরা দেখলাম যে স্যার পুরো বিষয়টাকে দার্শনিকভাবে দেখতে সমর্থ। সেজন্যই তিনি ১৫ আগস্টের পরের জেল হত্যা, খালেদ মোশাররফ, কর্ণেল তাহের ইত্যাদি প্রসঙ্গে আলাদা করে কিছু বলতে চাইলেন না। ঐ সমস্ত ঘটনার তথ্য-প্রদায়ক হিসাবে তিনি কিছু বলতে অপারগতা জানালেন। কারণ হিসাবে এটুকুই উল্লেখ করলেন যে তিনি ঐ ঘটনাগুলোর ভেতরটা ভালো জানেন না। আমাদেরও মনে হলো যে সরদার ফজলুল করিমের কাছ থেকে নিছক ঘটনার বর্ণনা শুনতে চেয়ে লাভ নেই। বরং পুরো একটা প্রক্রিয়ার ব্যাপারে তাঁর পর্যবেক্ষণমূলক মন্তব্যগুলোই গুরুত্বপূর্ণ। তেমন লাভ নেই জেনেও আমরা দিনের শেষ প্রশ্ন উত্থাপন করলাম : আপনি ঘটনাবলীকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সমগ্রের আলোকে দেখেছেন এটুকু বুঝতে পারছি। তবু আপনি বলুন লক্ষ প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যে জাতি স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে সামরিক শাসন কেন তাদের জীবনে আবারো ফিরে এলো?
–এসব মাস্টারি প্রশ্ন করে লাভ নেই। যে লোক নিজেকে বাংলাদেশ মনে করার মত মন ছিলো, যে লোক নিজের প্রটেকশানের ব্যবস্থাও সেভাবে নেয় নাই সেই শেখ মুজিব পর্যন্ত খুন হয়ে যায়–এরকম ঘটনাকে তুমি জাতি, লক্ষ প্রাণ, সামরিক শাসন এরকম শব্দ ব্যবহার করে বুঝতে পারবা না। সমগ্রের মধ্যেই কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। আর একটা কথা, তুমি বললে যে বাঙালি জাতি দীর্ঘ দিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে তারা কেন। আবার সামরিক শাসনের যাতাকলে পড়বে। এ কথার অর্থ আমি বুঝলাম না। তোমাদের মত লোকের কাছে পনের বছরের সামরিক শাসন অনেক ভয়ংকর ব্যাপার হতে পারে, আমার কাছে তেমন কিছু না। মানুষের সমাজে উপনীত হওয়ার সংগ্রাম শেষ হতে পঞ্চাশ হাজার বা এক লক্ষ বা একশ লক্ষ বছরও লাগতে পারে। তাতে কি? ব্যক্তি যতক্ষণ না জনতায় পরিণত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কিছুই ঘটে না। সেদিক থেকে দেখলে বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে মাত্র পনেরো বছরেই জনতার সংগ্রাম তৈরি হয়েছিলো। এবং সামরিক শাসনের পতন ঘটেছিলো।
এই কারবার আরো কতবার ঘটবে
২১ মে ২০০৩
আজকের আলোচনার শুরুতে স্যারকে জানানো হলো যে, গতদিনের আলোচনার দ্বিতীয়াংশে এসে তিনি যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলোতে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। কেননা বাংলাদেশে সামরিক শাসনের সূচনা এবং এর অভিঘাত সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় নি। আমরা এও বললাম যে কিছু কথাবার্তা আমাদের মাথার উপর দিয়ে গেছে। স্যার এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আজও কথা বলতে রাজী হলেন। আমরা অনুরোধ করলাম। যে, শুধু সামরিক শাসনের সূচনা এবং অভিঘাত নয় বরং অবসান পর্ব সম্পর্কেও কিছু বলুন। কেননা ৯০ সালের ঘটনা যাকে আমরা গণঅভ্যুত্থান বলতে অভ্যস্ত অথবা স্যারের ভাষা অনুসরণে বলতে পারি ব্যক্তির জনতায় রূপান্তর পর্ব–সে সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন জানাটা জরুরি।
-তুমি চাচ্ছ মূল্যায়ন। মূল্যায়ন কিইবা করি। যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো প্রার্থিত নয়। তবু ঘটেছে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় চাকুরি জীবনের শেষপ্রান্তে। তুমি বোধ হয় ঠিক সে সময়েরই ছাত্র হবে–ঠিক মনে করতে পারছি না। যাই হোক, তখন ছাত্ররা বোমা ফাটাচ্ছে। বোমার কারণে ক্লাশে কথা বলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বোমা বন্ধ হলে আবার ক্লাশ শুরু হচ্ছে। ছাত্ররা মাঠে শুয়ে পড়ে একদল আরেক দলের সাথে বন্দুক যুদ্ধ করছে। এসব ঘটনার কোনটিই উত্তম ব্যাপার নয়। একথা সবাই বলবে। তথাপি কেন ঘটেছে এ প্রশ্নের জবাব দেয়া সহজ না। তবে এগুলো জীবনেরই অংশ। মানুষের খুনাখুনি, মারামারি ছিলো না এমন কোন কাল পাওয়া যায় না। তাহলে কি হবসের কথাই সত্য? হবস বলেছেন যে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই এরকম, সে অন্যকে মারতে চায় সে সন্দেহপরায়ণ, ঈর্ষাকাতর ইত্যাদি। হবস একেবারে অসত্য বলেন নি। প্রাচীনকালেও মানুষ এরকম ছিলো। পরবর্তীতে এসব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষই আবার পরম্পর চুক্তি করলো। সামাজিক চুক্তি–যা রাষ্ট্র উদ্ভবের শর্ত। চুক্তি হলো এই মর্মে যে তারা পরস্পর মারামারি করবে না। চুক্তি হলে কি হবে? ব্যাপারটা কি এতই সোজা!
কিন্তু মার্কসীয় ব্যাখ্যায় দেখা যায় যে আদিম সাম্যবাদী সমাজে হানাহানি, মারামারির ব্যাপার ছিলো না।
-মনে রাখতে হবে যে তখন রাষ্ট্রের মত নিপীড়নকারী কোন সংগঠন বিকশিত হয়নি। আজকের অর্থে ধর্মও বিস্তার লাভ করেনি। অর্থাৎ হানাহানি, মারামারির মূল কারণগুলো বিকশিত হয়নি। অবশ্য এরকম ভাবাটা পুরোপুরি সঠিক হবে না যে আদিম মানুষ শুধুই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে জীবন যাপন করতো। তাদের মধ্যে কোনই দ্বন্দ্ব ছিলো না–এরকম ভাবাটা ঠিক হবে না। তবে ইতিহাসের পর্ব হিসাবে ভাগ করে, আজকের সময়ের সাথে তুলনা করে বলা যায় যে, আদিম মানব সমাজে বিরোধিতার ধরনটা ছিলো আপোষমূলক বিরোধিতা। আর বর্তমান মানব সমাজের বিরোধিতার ধরনটা হচ্ছে অনাপোষমূলক বিরোধিতা। এখনকার বিরোধিতায় কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। আদিম মানুষের যৌথ জীবন-যাপন করার বিকল্পও ছিলো না।
বর্তমান যুগে মানুষে মানুষে সংঘাতের কারণ সম্পর্কে স্যারের দার্শনিক ব্যাখ্যা শোনার পরে আমরা ৯০ সালে ফিরে আসতে চাইলাম। প্রশ্ন করলাম। ৯০ সালে বাংলাদেশে যে ঘটনা ঘটেছিলো, তাকে সচরাচর গণঅভ্যুত্থান বলা হয়ে থাকে। আপনি কি ঐ সময়ের ঘটনাবলীকে গণঅভ্যুত্থান হিসাবে আখ্যায়িত করতে চান?
–এসব শব্দ ব্যবহারে সুবিধা আছে আবার অসুবিধা আছে। ৯০ সালের আগেও ঘটনা ঘটেছে। জিয়াউর রহমানকে যে মারা হলো সেটাও একটা বড় ঘটনাযার মাধ্যমে এরশাদ ক্ষমতা দখল করে। তারপরেও অনেক ঘটনা। নূর হোসেনকে মারা হলো ইত্যাদি নানা ঘটনা। অর্থাৎ ৯০-র সামরিক শাসনের পতনটা একবারের চেষ্টায় হয়নি। এখানে একটা কথা বলি, এরশাদ অত্যন্ত চালাক লোক। এবং সে একটা পলিটিক্যাল লোক। এরকম পলিটিক্যাল লোক কম পাওয়া যায়। ক্ষমতায় থাকার জন্য সে কত রকমের ফন্দী-ফিকির করলো! সে বিদায় নেবে অথচ নিচ্ছে না। বিভিন্ন কৌশল করছে। বলছে কার কাছে রিজাইন দেবো? তারপরে আবার একটা ভাইস প্রেসিডেন্ট বানালো। ইত্যাদি অনেক কিছু সে করেছে। অত্যন্ত চালাক লোক। তবু শেষমেশ তার পতন হলো। এই ঘটনাটা ঘটার কারণ হলো মানুষের মোর্চা। মানুষের মোর্চা ক্রমান্বয়ে ছোট থেকে বড় হয়েছে। মানুষ এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন হয়ে অসংখ্য মানুষের মোর্চা যখন গড়ে উঠেছে তখনই ৯০র ঘটনাটা ঘটেছে। এটাকে অভ্যুত্থান বলতে চাইলে বলতে পার। গণঅভ্যুত্থান আমি ৬৯ সালেও দেখেছি। সে সময় একদিন আমি শহীদ। মিনারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি একদল লোক জেলখানা থেকে থেকে বেরিয়ে লাঠি-সোটা হাতে চলে আসছে। সেই দলটার সামনে একটা লোককে আমি দেখতে পেলাম। তিনি আমার সত্যেন সেন। সত্যেন সেনও একটা লাঠি কাঁধে করে জেলখানা থেকে চলে আসছেন। এটা একটা সিম্বলিক ব্যাপার। তাঁর মত একটা লোকও লাঠি কাঁধে করে চলে আসছেন! এই হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থান। নব্বইতেও একই রকম ব্যাপার। গণঅভ্যুত্থান যাকে বলছো তার মধ্যে কিন্তু গোলেমালে হরিবোল বলে একটা ব্যাপার থাকে। এর কোন ছকবাঁধা থাকে না। ঐ অবস্থাটার সুযোগ যে যেমন নিতে চায় এবং যে যেমন নিতে পারে সেটাই পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ৯০ সালের ঘটনার সময়। আমিও প্রেস ক্লাবের সামনে এসেছি। এরশাদ পতনের পর বন্ধুদের সাথে হাত। মিলিয়েছি। পরস্পরকে বলেছি, দেখছেন কত বড় কারবার! আবার এ কথাও বলেছি, এই কারবার আরো কতবার ঘটবে তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে?
আমরা একটু কথা বললাম। বললাম যে, ঐ কারবার অর্থাৎ ৯০-র। ঘটনার পর এক যুগেরও বেশি সময় কেটে গেছে। বলা হয় যে এটা হলো গণতন্ত্রে পুনঃপ্রবর্তনের কাল। আপনার কি মনে হয় ৯০-র ঘটনা থেকে। লাভের লাভ কিছু কি হয়েছে?
প্রথম কথা হলো, একটা পরিবর্তন তো আসছে। এক ধরনের সরকার ছিলো। তার পরিবর্তে আরেক ধরনের সরকার এলো। যারা সরকার বানালো। তারা বললো, এটা ভালো। তুমি হয়তো বলো যে না পুরা ভালো না। ঠিকই আছে। পর্যবেক্ষণ করলে দেখবে, যে পরিবর্তনই হোক না কেন তার পজিটিভ নেগেটিভ উভয় দিকই থাকবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই। পজেটিভ দিক অনেকই আছে। পরপর দুইজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী–এরকম আর কোথায় পাইবা আদৌ কিছু লাভ হইছে কিনা এরকম প্রশ্ন তোলা সোজা। কিন্তু একটা নষ্ট সিস্টেমের মধ্যেও ভালো পয়েন্টগুলো খুঁজে বের করে সামনে তুলে ধরাটা জরুরি। কোন একটা সিস্টেম একেবারে নষ্ট এটা বলা সোজা। কিন্তু ঐ নষ্টের। মধ্যেও আলো খুঁজে বের করার কঠিন কাজটা করতে হবে। এ্যাবসলিউট নষ্ট বলে কোন ব্যাপার নাই।
তাহলে তো সামরিক শাসনকেও নষ্ট বলার কোন কারণ নাই–আমাদের মন্তব্য।
–এভাবে দেখো না। খালি সামরিক শাসনকে দোষ দিয়েই পার পাওয়া যাবে না। অন্যদের মধ্যে কি ক্ষমতার বাসনা নেই? তবে এভাবে বলা যায় যে, বেসামরিক শাসন তুলনামূলকভাবে সামরিক শাসন অপেক্ষা ভালো। কেননা সামরিক শাসনে বহুসংখ্যক লোকের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না। কিন্তু বেসামরিক শাসনেও যে জনগণের আশা-ভঙ্গ হয় সে ব্যাপারটা ভালোভাবে মাথায় রাখতে হবে। শেষ বাক্যটিকে ধরে আমরা পরবর্তী প্রশ্ন উত্থাপন করি : আমরা যাদের কাছ থেকে শাসনের বিভিন্ন পদ্ধতি ধার করেছি, যাদের মত করে গণতন্ত্র বা ইত্যকার বিষয়গুলোর মডেল খাড়া করেছি, তারা কিন্তু আমাদের মত শাসন পদ্ধতির ঝামেলায় ভুগছে না। আর যাই হোক, সেসব দেশগুলোতে স্বৈরাচারী শাসনের কথা চিন্তা করা যায় না। আপনি কি বলেন?
–আমি বলি যে সবাইকেই পর্যায়গুলো অতিক্রম করে আসতে হয়। আজ আমাদের এখানে যে সমস্যাগুলো দেখছো সে রকম সমস্যা সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডে ও পাওয়া যাবে। রাজা বনাম পার্লামেন্ট দ্বন্দ্ব, একজন আরেকজনের মাথা কেটে ফেলা–এসবই পাওয়া যাবে। আমেরিকায় কি কালো মানুষদের হত্যা করা হয়নি? এসব পর্যায় তাদের অতিক্রম করতে হয়েছে। তবুও কি সব সমস্যার অবসান হয়েছে। বুশ প্রশাসনকে কোন চোখে দেখবো? এটা কি গণতান্ত্রিক না স্বৈরাচারী? নির্ভর করছে তোমার বলার উপর। আমি তো মনে করি যে বুশ প্রশাসন স্বৈরাচারেরও স্বৈরাচার। তুমি কি মনে কর সেটা তোমার ব্যাপার। আসল ব্যাপার হলো গন্তব্য নির্দিষ্ট করা, কোথায় যেতে চাই তা ঠিক করা। গন্তব্য নির্দিষ্ট করার অর্থই হলো বর্তমানের সমস্যাগুলোকে যে তুমি অতিক্রম করতে চাও সে ব্যাপারটা স্পষ্ট হওয়া। চলতি অর্থে গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায় সে গণতন্ত্রের ব্যাপারে আমার অনেকখানি উদাসীনতা আছে। গণতন্ত্র অর্থ যদি নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হয় সে গণতন্ত্র কতটুকুই বা কল্যাণকর হতে পারে? আদর্শটা যদি কল্যাণমূলক না হয়, ভালো কিছু করার যদি স্পৃহা না থাকে তাহলে এ ধরনের গণতন্ত্র আসলেই বা কি হয়? এত কথা বলার পরে আমি আবারো বলবো যে সমাজটা কিন্তু ধীরে হলেও এগিয়ে যাচ্ছে। প্রক্রিয়াটার ভেতরে আছ বলে বুঝতে পারছে না। এজন্য দূর থেকে দেখার একটা ব্যাপার আছে। বইয়ের ভেতর দিয়ে যাওয়া কোন যাওয়া না। আমি দেখি যে ১৯২৫ সাল থেকে, যখন আমার জন্ম, ধরলে সমাজ অনেকটাই পাল্টেছে। সামরিক শাসনের কথা বললে। সামরিক শাসন এসেছে কি হয়েছে? বরং লাভ হয়েছে। সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা থাকার ফলেই ভবিষ্যতে বলতে পারা যাবে যে আমরা সামরিক শাসন চাই না।
কথাগুলো শোনার পরও আমরা মন্তব্য করি : আমাদের কাছে মনে হয় যে আমাদের সমাজ ক্রমশই পিছিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র, ক্ষুধা, বৈষম্য, প্রান্তিকীকরণ, হিংসা-হানাহানি, হত্যা সবই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মানুষের শরীরী টিকে থাকার সম্ভাবনাও যেন উবে যাচ্ছে। সরদার ফজলুল করিম আমাদের মন্তব্য উড়িয়ে দিলেন না। তবে জানতে চাইলেন, পৃথিবীতে এমন কোন দেশ আছে কিনা সেখানে এই সমস্যাগুলো একেবারেই নেই। অবশ্য মেনে নিলেন যে মাত্রাগত পার্থক্যের ব্যাপারটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য সমস্যাগুলোকে অন্যদের সাথে তুলনা করে রিলেটেভলি দেখার পরামর্শ দিলেন। যে সাথে এটাও যুক্ত করলেন যে, প্রত্যেকটি বর্তমানের ক্ষেত্রেই existance is stake. প্রত্যেকটা বর্তমানেরই সমস্যা থাকে এবং প্রত্যেকটা বর্তমানই সে সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে চায়। এর বিকল্প নেই। বিদ্যমান সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মানুষের মহৎ ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হওয়া একান্ত দরকারি। সমস্যার উপাদানগুলো কেন টিকে থাকছে–এ প্রশ্নের উত্তরে স্যার বলেন :
মানুষের জীবনের কোন উপাদানই একেবারে outdated হয়ে যায় না যতক্ষণ পর্যন্ত সে উপাদানের একটা বস্তুগত ভিত্তি থাকে। শোষক শ্ৰেণী, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, সামরিকতন্ত্র যাই হোক না কেন, যতদিন পর্যন্ত এসবের একটা বস্তুগত ভিত্তি আছে এতদিন পর্যন্ত এগুলো outdated হবে না। এমনকি কোন একটা পর্যায়ে এসে অন্য কোন ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলেও বস্তুগত ভিত্তির কারণে দীর্ঘদিন পূর্ববর্তী ব্যবস্থার রেশ থেকে যেতে পারে।
-তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা কি বুঝবো? মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন হয়েছে তবু প্রার্থিত অবস্থা তৈরি হয়নি। তবে কি এরকম বলা যায়, যে সব শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ বা ৯০-র গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে সে সব শক্তির বস্তুগত ভিত্তি এখনো রয়ে গেছে? উত্তর যদি হ্যাঁ বোধক হয় তাহলে করণীয় কি? সরদার ফজলুল করিম মনে করেন, অমুক মুর্দাবাদ-তমুক মুর্দাবাদে কাজ হবে না। মনে রাখতে হবে যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোও একটা ডিমান্ডকেই সার্ভ করে। এক্ষেত্রে প্রগতিশীল শক্তির করণীয় হচ্ছে সমাজ দেহে প্রতিক্রিয়াশীলতার যে চাহিদা সে চাহিদাকে নষ্ট করে দেয়া। আপনার এসব ব্যাখ্যাকে যদি কেউ যান্ত্রিক বলতে চায় তাহলে কেমন হবে? একদিকে লক্ষ-কোটি মানুষ নিয়তই নিপীড়িত হচ্ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে অন্যদিকে আপনি বলতেও পারছেন না কবে এসবের অবসান ঘটবে? অথবা আদৌ ঘটবে কি না? নিপীড়নের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করাটাই কি মূল ব্যাপার? তাহলে তো নিত্য-নতুন নিপীড়ক বা নিপীড়ন পদ্ধতি আসতে থাকবে আর আমাদেরকে সে সবের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ (!) হওয়া ছাড়া আর কিছু বাকি থাকলো না। আমাদের মন্তব্য।
তুমি পারলে এর চেয়ে ভালো কোন নিদান দাও। আমার আপত্তি নেই। চলমান যে নিপীড়ন প্রক্রিয়া তার শিকার আমি নিজেও। তথাপি আমি কোন সংক্ষিপ্ত রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। যদি পেতাম তাহলে অবশ্যই জানাতাম। তোমাকে খুশি করতে পারতাম। আমি যেভাবে দেখি সেভাবেই দেখে যেতে চাই। আমার কাছে কত হাজার বছর লাগলো সেটা বড় ব্যাপার না। time is timeless. তুমি অন্যভাবে দেখতে পার। তুমি হয়ত বলবে, না স্যার আমি অত বছর বাঁচতে পারবো না। আমার যা হওয়ার এই দশ বছরের মধ্যে হতে হবে। আমার এর চেয়ে বেশি ধৈৰ্য্য নাই। এরকম বলতে চাইলে কোন মানা নেই এটা তোমার দৃষ্টিভঙ্গি।
আমি ভয়ার্ত
২ জুলাই ২০০৩
আজকের আলোচনাসহ পরবর্তী আলোচনাগুলোর ক্ষেত্রে সময়ের ধারবাহিকতা রক্ষার চেষ্টা করা হয়নি। কেননা দীর্ঘদিন আলোচনা থেকে আমাদের মনে হয়েছে যে, সরদার ফজলুল করিম ব্যক্তিগত অথবা সমাজ জীবনের উত্থান পতন, কিংবা বাঁক পরিবর্তনকে এক বছর দুবছরের ফ্রেমে ধরতে চান না। সে। জন্যই এখন থেকে সাল-বছর ধরে মন্তব্য শোনার পরিবর্তে বিষয়ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ শোনানোর জন্য স্যারের বরাবরে প্রস্তাব রাখি।
কেন আপনাকে কনসটিটুয়েন্ট এ্যাসেম্বলীতে পাঠানো হয়েছিলো?
-এটা এখনো আমার কাছে একটা ধাঁধা। এখনো একটা রহস্য। কম্যুনিস্ট পার্টি কেন তখন আমাকে পছন্দ করেছিলো এটা আমি আজো বুঝে উঠতে পারিনি। তখন তো আমি জেলখানায় খুব সম্ভবত ন্যাপের মোজাফফর আহমেদ জেলখানায় এসে আমার সাথে দেখা করে স্বভাব-সিদ্ধভাবে ধমক টমক মেরে নমিনেশন পেপার সাইন করিয়ে নিয়ে যায়। আমাকে মনোনীত করার পেছনে নিশ্চয় পার্টির কোন টেকনিক্যাল কারণ থাকতে পারে যা আমি জানি না। কিন্তু এ ব্যাপারটা আমাকে এখনো ভাবায়। বিস্তারিত জানবার ইচ্ছা থেকেই আমি কিছুদিন আগে সৌভিক রেজাকে মোজাফফর আহমেদের কাছে পাঠিয়েছিলাম। চেয়েছিলাম সৌভিক পারলে কিছু তথ্য বের করে আনুক। খুব একটা কাজ হয়নি। তার কাছ থেকে কথা বের করা অত সহজ না। এই একটা মানুষ এত মহৎ এত উদার। সৌভিকের প্রশ্ন শুনে বলেছে, তোমরা চ্যাংড়া মানুষ সরদাররে চিনতে পার নাই। সেজন্যই এমন প্রশ্ন নিয়ে আমার কাছে আসছ। সরদার কি পাশ জানো? সৌভিক বলেছে, এমএ পাশ। উত্তরে মোজাফফর আহমেদ বলেছেন, সরদার এমএ না সে হচ্ছে বিএ পাশ। বিএ মানে হচ্ছে বিনয়ের অবতার। শুধু এটুকু বলেছেন যে, আমরা সরদাররে পাঠাবো না তো কি মোজাফফররে পাঠাবোয় নিজের নাম উল্লেখ করেই বলেছেন। এই হচ্ছে অধ্যাপক মোজাফফর। সে যাই হোক। কেন আমাকে কনসটিটুয়েন্ট এ্যাসেম্বলীতে পাঠানো হয়েছিলো তা এখনো আমার জানা নাই। মনে হয় তারা আমার সম্পর্কে এরকম ভেবেছিলেন যে সরদার একটা ভালো। পোলা, জেল খাটতেছে, পড়ালেখাও খানিকটা জানে। এসব হতে পারে। নয়তো আর কি কারণ থাকতে পারে। তবে একটা কথা বলতে পারি যে আমি সরদার ফজলুল করিম নিজেকে যত ছোট মনে করি না কেন ব্যাপারটার কিন্তু বড় ধরনের গুরুত্ব ছিলো। ব্যাপারটা প্রমাণ করে যে তখন কমুনিস্টদের বড় ধরনের প্রভাব ছিলো। আমি তোমাদের অনুরোধ করবো যে, মোজাফফর আহমেদের মত যে দুএকজন ব্যক্তিত্ব এখনো আছেন তাদের কাছে যাও। তাঁদের কথা ধরে রাখার চেষ্টা কর। এ মুহূতে এরকম কয়েকজনের নাম মনে হচ্ছে–আহমেদুল কবির (২০ নভেম্বর ২০০৩-এ প্রয়াত), কেজি মুস্তাফা, সন্তোষ গুপ্ত, প্রাণেশ সমাদ্দার, ফয়েজ আহমদ আরো নাম এখন মনে করতে পারছি না। এদের কাছে যাও। অনেক ইতিহাস জানতে পারবে। হয়তো সহজে কথা বলতে চাইবে না। তবু চেষ্টা কর।
সেক্যুলারিজমের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে
আজকের আলোচনা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার আগেই কলাভবনের শিক্ষক লাউঞ্জে আরো কয়েকজন সহকর্মীর উপস্থিতিতে স্যারের সঙ্গে উপমহাদেশে সেকুলারিজমের ভবিষ্যত প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছিলো। কয়েকদিন আগে জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ হোসেনূর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় সেকুলারিজম প্রসঙ্গটি এসে পড়ে। সাক্ষাৎকারটিতে হোসেনূর রহমান ভারতীয় উপমহাদেশে সেকুলারজিমের আদর্শ দুর্বল হয়ে পড়া, সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদর রাজনীতির রমরমা অবস্থার কারণ ইত্যাদি প্রসঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো এই যে, ভারতবর্ষে সেকুল্যার ফোর্স ক্ষমতার ভেতর বা বাইরে যেখানেই থাক না কেন অন্যরা একে সমঝে চলতে হয়। কিন্তু ভারতবর্ষের তুলনায় বাংলাদেশের সেকুলার ফোর্স অতটা শক্তিশালী নয় বলেই হোসেনুর মনে করেন। সাক্ষাৎকারটি স্যারেরও চোখে পড়েছে বলে জানালেন। আমাদের সুবিধা হলো আমরা তাঁর মন্তব্য শুনতে চাইলাম।
–হোসেনূর রহমানকে আমি চিনি না। কিন্তু তার বক্তব্য পড়ে আমার কোন সন্দেহ নেই যে he is a thoughful personality. তার এই সাক্ষাৎকারটি আলোচনার দাবি রাখে। তোমরা সেমিনার আয়োজন কর। আমি অংশগ্রহণ করবো। হোসেনূরের সাথে আমি একটা বিষয়ে একমত যে, ভারতের মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের মনোবল টিকে থাকার অন্তত একটা জায়গা আছে। এই জায়গাটা হলো ভারতের সেকুলার সংবিধান। কাজ হোক না হোক, এই সংবিধানকে ধরে সে কথা বলতে পারে, মামলা করতে পারে, বলতে পারে যে সংখ্যালঘুরা সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থাটা কি? এখানে সংবিধানকে বারবার পদদলিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়েছে। এখানকার হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি সংখ্যালঘুরা কোথায় fallback করবে? আমি বলবো না যে ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ কোন সমস্যা নয়। অবশ্যই সমস্যা। কিন্তু বাংলাদেশে কি হচ্ছে? ইন্ডিয়াতে মুসলিম নিপীড়নের অজুহাত দেখিয়ে এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। আর কিছুদিন এভাবে চলতে থাকলে এই শক্তিটি পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশান করার দাবি তুলবে। এদেশের নাম হবে বঙ্গ-পাকিস্তান।
-সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির এজেন্ডাটা স্পষ্ট। তারা ভারতে হোক বাংলাদেশে হোক ধর্মবাদ কায়েম করতে চায়। কিন্তু নিছক ভোটবাজির জন্য যে সব সেকুলার পার্টি মৌলবাদের আস্ফালনকে বাধা না দিয়ে বরং নীরব থাকার পলিসি নেয় তাদের সম্পর্কে কি বলবেন? ভারতবর্ষে বাবরী মসজিদ যখন ভাঙ্গা হয় তখন ক্ষমতায় ছিলো একটি সেকুলার পার্টি। আমরা স্যারকে মনে করিয়ে দিলাম।
বাদ দাও তোমার সেকুলার পার্টি। কে সেকুলার? সেকুলারিজম কি জিনিস আমরা আদৌ কি এখনো বুঝতে পারছি। তুমি প্রশ্ন তুলেছ সেকুলার। পার্টির ভূমিকা নিয়ে আর আমি প্রশ্ন তুলছি কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর ভূমিকা। নিয়ে। সেকুলারিজমই যদি আমরা বুঝতাম তা হলে একটা পত্রিকা কি করে এই মর্মে শিরোনাম করে যে আমেরিকা মুসলমানদের আক্রমণ করছে। কম্যুনিস্ট পার্টির পত্রিকার যদি এই দশা হয় তাহলে বাকিদের কথা আর কিইবা বলা যায়। বিজেপি-শিবসেনা-জামাতের সাথে যদি ফাইট করতে হয় সেটা কি ভাবে করতে হবে? আমরা কি মৌলবাদ রোখার জন্য নিজেরাই মৌলবাদের ভেক ধরবোর আপোস করবো? এভাবে কখনো সাফল্য আসবে না। বুঝতে হবে সারা পৃথিবীকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার একটা ব্লু-প্রিন্ট চলছে। সেকুলার পার্টি বলো আর কম্যুনিস্ট পার্টি বললো-এরা বুঝতেই পারছে না সামনের বিপদটা কত ভয়াবহ হবে। এরা মুখে অনেক কিছু বলে কিন্তু সামনে এগিয়ে এসে ফেস করছে না। স্যাক্রিফাইস না করলে তো। মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিপদ ঠেকানো যাবে না। এই যে বাংলাদেশে তথা পুরো উপমহাদেশে মৌলবাদীরা যথেচ্ছভাবে সংখ্যালঘু নিপীড়ন করছে তার বিরুদ্ধে তথাকথিত সেকুলার ফোর্স কোন সংগঠিত প্রতিরোধ তৈরি করছে না।
কেন প্রতিরোধ করছে না? আমাদের প্রশ্ন।
–কিভাবে করবে? এটাই তো বোধের ব্যাপার। সেকুলারিজম ধারনাটাকে যদি তারা নিছক রাজনৈতিক টার্ম মনে না করে অন্তর অন্তঃস্থলে স্থান দিতে পারতো তাহলে কাজ হতো। সেটা হয় নি। উপমহাদেশজুড়ে হিন্দু মুসলিম-খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে আর সেকুলাররা তাকিয়ে দেখছে। বৃক্ততা, মিছিল, মানববন্ধন করেই দায়িত্ব শেষ করছে। জীবন বাজি রেখে রুখে না দাঁড়ালে মৌলবাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। আমাদের সময়ে একটা সেন্টিমেন্ট ছিলো। একটা যৌথ সমাজ দাঁড় করাবার সেন্টিমেন্ট। আমি যখন একজন হিন্দু কমরেডের নাম নিয়ে বলি সে আমার ভাই, কিংবা যখন বলি সন্তোষের (সন্তোষ গুপ্ত) মা আমার মাসিমা তখন আমার মধ্যে ইউনাইটেড হিউম্যান কমিউনিটির বোধটা কাজ করে। এখনকার সময়ে এসে দেখছি যে, চামড়ায় একটু আঁচড় কাটলে ধর্মগত পরিচয়টা ফুটে বেরিয়ে আসে। এটা খুবই দুঃখজনক। তবে এটাও ঠিক যে, হতাশা, ব্যর্থতা, বিফলতার অভিজ্ঞতা ছাড়া সমাজ রূপান্তর সম্ভব নয়।
আমাদের শেষ প্রশ্ন : সেকুলারিজমের কোন ভবিষ্যৎ কি আছে? দশ লক্ষ বছর লাগতে পারে এরকম না বলে দয়া করে অন্যভাবে বলুন।
–তোমাদের ইয়াং জেনারেশনের ভাষা আমি বুঝতে পারি না। তোমাদের ভাষা তো আমাদের ভাষা না। আমি জানি না, সেকুলারিজমের বিকল্প কি হতে পারে। আমি এটুকু জানি যে, রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের সম্পর্ক। থাকবে না। মানুষ হওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া আর কি করা যায় আমি জানি না। পাশের ঘরে অন্য ধর্মাবলম্বী কন্যাটি যখন ধর্ষিত হয় তখন তার পাশে না দাঁড়ানো কিভাবে সম্ভব? এর কোন বিকল্প নাই। আজকে অবস্থা এমন স্তরে পৌঁছে গেছে যে নিজের মনের কথা নিজের কাছে বলতে ভয় নাই। কেবলই মনে হয় দেয়ালেরও কান আছে। আমি ভয়ার্ত। না হয়ে উপায়ও নেই। কেননা আমি দেখছি যে আমার তরুণ প্রজন্ম ভয়ে গুটিয়ে আছে। তাহলে আমি ভীত না হয়ে কি করবো। বর্তমান প্রজন্ম আর কিছু না করে শুধুই পূর্ববর্তী প্রজন্মকে দোষারোপ করেই পার পেতে চাচ্ছে। তবে এটাই কিন্তু আমার শেষ করা নয়। আমি দেখতে পাচ্ছি যে এত হতাশার মধ্যেও একটা তরুণ প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে যারা আশার ভিত্তিতে বাঁচতে চায়। সেজন্যই যতই চিৎকার করি না কেন শেষ বিচারে আমি হতাশাবাদী নই। আশাবাদী।
বুশ অপরাজেয় নয়
১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৩
বেশ কিছুদিন বিরতির পর আজ আবার স্যারের কথা শোনার সুযোগ হলো। মাঝখানে বিভিন্ন কারণে স্যারের সাথে বসা হয়ে ওঠেনি। আজ সুযোগ মিলে গেলো অকস্মাৎ। সকালে ফোন আলাপের সময়ই উনি ক্যাম্পাসে আসার প্রয়োজন উল্লেখ করেন। সুযোগটা নিয়ে নেই এবং ঘণ্টা দুয়েক পরে রেজিস্টার বিল্ডিংস্থ সোনালী ব্যাংক থেকে স্যারকে কলাভবন লাউঞ্জে নিয়ে আসি। এক পর্যায়ে চতুর্থ বর্ষ সম্মান শ্রেণীর ক্লাশে স্যারকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করলে তিনি সম্মতি দেন। ভাবছিলাম যে স্যারকে ক্লাশে হাজির করতে পারলে শিক্ষার্থীরা উৎসাহিত ও উপকৃত হবে। পরে দেখা গেলো, ক্লাশের ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজন গুণগ্রাহী হাজির হয়েছেন। চতুর্থ বর্ষের সিলেবাসে নির্ধারিত জাতিকতা, ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত কোর্সটি পড়ানোর জন্য আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসাবে আগের দুটো ক্লাশ থেকেই আমরা হান্টিংটনের clash of civlizations তত্ত্বটি আলোচনা করছিলাম। আজকের ক্লাশে তত্ত্বটির পর্যালোচনা-সমালোচনা উপস্থাপনা করার কথা ছিলো। আমরা ভাবলাম স্যার যদি এই তত্ত্বটির সম্পর্কে মন্তব্য করেন তাহলে এর চেয়ে ভালো কিছু হয় না। এই লক্ষ্য থেকেই আমরা স্যারকে প্রশ্ন করলাম, এই যে হান্টিংটনরা বলছেন, আগামী দিনগুলোতে ধর্মই হবে সংস্কৃতির প্রধান উপাদান বা মানুষের প্রধান স্মারক এবং ধর্মের ভিত্তিতেই কয়েকটি সভ্যতার তৈরি হয়ে একটি আরেকটির বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়াবে-এ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি? প্রশ্ন শুনেই স্যার প্রায় উত্তেজিত হয়ে উঠলেন এবং পরের এক ঘণ্টা বৃক্ততা করলেন। সারসংক্ষেপ এরকম :
হান্টিংটন কে আমি জানি না। আমারে চেনাও। তোমরা এ সমস্ত জিনিসপত্র হাজির করে পোলাপানের মাথা খাওয়ার জোগাড় করছ। তোমরা Knowledge impose করতেছ। ছাত্র-ছাত্রীদের মনের ভেতর কি আছে। সেসব তোমরা শুনতেই চাও না। শুনলেও পাত্তা দেও না। খালি ভারী ভারী। শব্দ ব্যবহার করে সবকিছু জটিল করে তোল। এই যে তুমি কতগুলো শব্দ ব্যবহার করলা এর জন্য তো আজকে আমারে বাসায় ফিরে ডিকশনারী ব্যবহার করতে হবে। পারলে বিকল্প সিলেবাস তৈরি কর। নিজেদের ইতিহাস না জেনে তোমরা খালি বাইরের জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাও। আমি বুঝি ১৯০৫ সাল। বঙ্গভঙ্গ। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। মধ্যবিত্তের ভূমিকা। আমি বুঝবার চেষ্টা করি হিন্দু মধ্যবিত্ত, মুসলিম মধ্যবিত্ত এই অঞ্চলে ধর্ম নিয়ে কে কি করেছে সেসব জিনিস। আর তুমি আমারে আমার পোলপানদের সামনে খাড়া করাইয়া দিছ হান্টিংটন না কে তার এক শয়তানীরা তত্ত্ব সে সব নিয়ে কথা বলার জন্য।
এসব বলার পর স্যার কিছু সময় ব্যয় করেন তাঁর প্রিয় আলাপের বিষয় অর্থাৎ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সংক্রান্ত আলোচনায়। একটা পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা স্যারকে মৌলবাদ কি বঙ্গভঙ্গের কারণ এবং এর জন্য কোন সম্প্রদায়ের কতখানি ভূমিকা, এ ধরনের বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। স্যার কোন প্রশ্নেরই চটজলদি উত্তর দেন নি। শুধু মনে করিয়ে দিলেন যে এসব বিষয়ে ভালোভাবে জানার জন্য বেশি বেশি করে বই পড়ার দরকার। কেননা এসব বিষয়ে দারুণ মতভেদ রয়েছে। যত বেশি পড়া হবে ততই চিন্তার স্বচ্ছতা আসবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে বই পড়া হয় না সে বই কোন বই নয়। সেটা একটা বস্তু মাত্র। ক্লাশ শেষেও দীর্ঘ সময় ধরে বারান্দায় সবাই স্যারকে ঘিরে রেখে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে। বিকেলের দিকে ফাঁকা লাউঞ্জে বসে আলাপকালে তিনি বলেন :
–তোমাদের প্রজন্মের কেউই মূল সমস্যাটা ধরতে পারছে না। অথবা ইচ্ছে করেই ধরছো না। যদি কোন বিপদে পড়ে যাও এই ভয়ে। যদি ক্যারিয়ারের ক্ষতি হয়। কিন্তু ভুলেও মনে কোরো না যে এভাবে করে শেষরক্ষা পাবে। সারা পৃথিবীটা একটা ঘোরতর বিপদের মধ্যে আছে। একমেরু বিশিষ্ট একটা বৈশ্বিক ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। আর এ ব্যবস্থায়, একজন ব্যক্তি অর্থাৎ বুশ সাহেবের কথা মতই সবকিছু হচ্ছে। এগুলো কিভাবে মেনে নাও তোমরা! আমি এই বুড়ো মানুষটা তো একথা মানতে পারি না যে সে একলা যা বলে তাই ঠিক আর সবাই ভুল। তোমরা নিজেরা বুঝবার চেষ্টা কর এবং অন্যদেরকেও বোঝাও, আমেরিকা এখন যে অরাজকতা চালাচ্ছে তা কখনোই চিরকালের ব্যাপারে হতে পারে না। শুধু শক্তি ধারণ করার চেষ্টা কর এই ভেবে যে বুশ অপরাজেয় না। সম্মিলিত প্রয়াসে বুশকে অর্থাৎ আমেরিকার এসব অনাচার হঠিয়ে দেয়া সম্ভব। তোমরা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কিছু করে বেড়াও। এটা ভালো। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে তো কিছু হবে না। আর যাদের জন্য করছ তারা যদি সাধারণ মানুষজন হয়, তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সেই সব লোকগুলোর মধ্যে বিশ্বজনীনতার বোধ তৈরি করা। এই বোধ তৈরি করা না গেলে কোন লাভ হবে না।
শুধু বাপের ঋণ শোধ করতে চাই
৭ নভেম্বর ২০০৩
আজকের আলোচনাটি এক অর্থে ব্যতিক্রমী। ২০০১ সালের শেষের দিকে প্রান্তি ক-সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে স্যারের সেই সে কাল গ্রন্থের উপর আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে আশি জনের মত ছাত্র-ছাত্রী মাসখানেক আগে থেকে বাজার থেকে বইটি সংগ্রহ করে অনুষ্ঠানের দিন স্যারকে প্রশ্ন করার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত আলোচনা অনুষ্ঠানটি মূলতঃ একটি প্রশ্নোত্তর পর্বে পরিণত হয়। বইটির পাঠ সমাপ্তকারীরা ছাড়াও উপস্থিত অন্যান্য শ্রোতারা মিলে সরদার ফজলুল করিমের বরাবরে কয়েক ডজন প্রশ্ন লিখিত আকারে উপস্থাপন করে। বলাই বাহুল্য যে, সেদিনের আলোচনায় স্যার সবগুলো প্রশ্নের মীমাংসার হাজির করেন নি। তবে তিনি প্রশ্নগুলো সযত্নে রক্ষা করেছিলেন। দুবছরের বেশি সময় পরে আজ কিছু প্রশ্ন বাছাই করে স্যারের সামনে নিয়ে আসি। প্রথম প্রশ্নটি এরকমের-আপনাদের এত ত্যাগ তিতিক্ষার পরে ও আমাদের দেশে বাম রাজনীতি ব্যর্থ কেন? এই রাজনীতি কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হলো? উল্লেখ্য যে, বেশ কয়েকজন প্রশ্নকারীই এই প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিলেন।
–তোমাদের এবং নিজেকেও বলছি যে জীবনের কোন সমস্যারই সহজ জবাব নাই। অথচ মানুষের প্রবৃত্তি হচ্ছে সে সহজ জবাব চায়। খেয়াল করলে দেখবে যে বাগানের চারপাশ দিয়ে না হেঁটে মানুষ বাগান মাড়িয়ে কোনাকুনি হাঁটে। উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তরে বলছি যে সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হলো কোথায়? সমাজতন্ত্র সবে সফল হতে শুরু করেছে। অথচ তোমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলে যে সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবকে আমি বলি দ্বিতীয় প্যারি কমিউন। পুঁজিবাদ শুরু থেকেই এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে এবং যেহেতু তাদের শক্তি বেশি সেহেতু ১৯৯০ সালে এসে দ্বিতীয় প্যারি কমিউনের রাজনৈতিক পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য তারা ক্রুশ্চেভ, গর্বাচেভ ইত্যাদি তৈরি করেছে। তথাপি সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছে বলে আমি মনে করি না। আজ সারা বিশ্বব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রতিবাদের মধ্যে আমি নতুন এক প্যারি কমিউনের আবির্ভাব দেখতে পাচ্ছি। সমাজতন্ত্রের সুদিন দেখতে পাচ্ছি।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি উত্থাপন করলাম তবে প্রথম প্রশ্নের উত্তরের সাথে যুক্ত করে। তাহলে আপনি মনে করছেন যে পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় বাম রাজনীতির ভবিষ্যৎ আছে?
নিশ্চয় আমার কাছে জানতে চাইছে না যে বাম রাজনীতি সফল হতে কয় বছর লাগবে? এত অধৈর্য তোমরা! অমানুষের সমাজ মানুষের সমাজে রূপান্তরিত হওয়া কি চট করে সম্ভব? আমি এটুকু বুঝি যে মানুষকে অবশ্যই মানুষ হতে হবে, এর কোন গত্যন্তর নাই। এবং মানুষ হতে চাইলে বাম রাজনীতির বিকল্প নাই।
তৃতীয় প্রশ্ন : আপনার বিভিন্ন লেখালেখিতে বিপ্লব সম্পর্কে দুধরনের মন্তব্য পাওয়া যায়। প্রথম মন্তব্যটি আত্মজিজ্ঞাসামূলক-বিপ্লব কি আসবে? দ্বিতীয় মন্ত ব্যটি একটি বোধের পরিচায়ক-আমরা বিপ্লবের মধ্যে বাস করছি। কোনটি সত্য? আজকে আপনার সামনে বসে এ প্রশ্ন উত্থাপন করছি। দেখতেই পাচ্ছেন যে আপনার সামনে বিছিয়ে রাখা সেদিনের অনেকগুলো প্রশ্নের মধ্যে শ্রোতাদের এ প্রশ্নটিও রয়েছে।
–তরুণরা আমাকে প্রশ্ন করছে এই বলে যে আপনার ঘোড়ার ডিমের বিপ্লব কবে আসবে? এই কথাটা জিজ্ঞেস করাই তো একটা বিপ্লবাত্মক ব্যাপার। একদিন দেখলাম এক মেয়ে এক ছেলেকে চড় মেরেছে। আমার চোখে এটা বিশাল এক বিপ্লব। তুমি জিজ্ঞেস করছ এর আদৌ কোন রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে কি না। আমি বলবো অবশ্যই আছে। বিশাল রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। বাম রাজনীতির লোকেরা যদি এটা বুঝতে না পারে তাহলে বলার কিছু নাই।
তাহলে আপনি কেন আহাজারি করেন, বিপ্লব কি আসবে? বিপ্লব কি আসবে? আপনি তাহলে প্রতিক্রিয়াশীলতার আস্ফালনে ভড়কে যেয়ে বিপ্লবকে ডাকছেন।
–বিপ্লবকে যথাযথ বোঝা অত সোজা না। মেয়ে ছেলেকে চড় মেরেছে। এটা বললাম আবার আমাদের মেয়েরাই আত্মহত্যা করছে। এর মধ্যে বিপ্লবাত্মক উপাদান নয় এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার শক্তি প্রদর্শন রয়েছে। এজন্যই বোধ হয় আমি বিপ্লব সম্পর্কে দুধরনের কথা বলি।
চতুর্থ প্রশ্ন : এখনকার প্রশ্নটি নিয়ে আপনার সাথে দীর্ঘ আলাপ করতে হয়েছে। দেখতে পাচ্ছি যে অনুষ্ঠানের শ্রোতারাও একই বিষয়ে আপনার ভাষ্য শুনতে আগ্রহী ছিলেন। প্রশ্নটা হচ্ছে এক সময় ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী কিন্তু এখন সে পরিচয় লুপ্ত। এখন আপনার পরিচয় বুদ্ধিজীবী। কেন আপনাকে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে পাওয়া গেলো না?
-আমার পরিচয় আমি তৈরি করি নাই। রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী এসব পরিচয় আমার দেয়া নয়। আমি কৃষকের পোলা। আমি শুধু বাপের ঋণ শোধ করতে চাই।
আলোচনার এ অংশটি বেশ দীর্ঘ হয়েছিলো। পূর্বের একটি আলোচনাতেও স্যার বিস্তারিতভাবে তার ব্যক্তিগত অবস্থান ব্যাখ্যা করেছিলেন। আশা করা যায় পাঠকবৃন্দ এবং প্রশ্ন উত্থাপনকারীরা সে আলোচনা থেকে উত্থাপিত প্রশ্নের কিছু জবাব পেয়ে যাবেন। শেষের দিকে শুধু জানতে চাওয়া হয়েছিলো, আপনি সবসময় বিকাশ, বিবর্তনের কথা বলেন। আপনার কি এরকম মনে হয় যে যদি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থাকতেন তাহলে বিকাশ এবং বিবর্তনের পক্ষের শক্তিকে আরো বেগবান করতে পারতেন? স্যার এ প্রশ্নের উত্তরে শুধু এটুকু বললেন যে, যদি দিয়ে কোন বাক্য তৈরি নিরর্থক। বলা বাহুল্য যে এ ধরনের উত্তরে আমরা তৃপ্ত হতে পারিনি। মনে হয়েছে যে সরদার ফজলুল। করিমও কখনো কখনো মানুষী সীমাবদ্ধতায় আটক হতে পারেন। এটা ভালো লাগার কারণও বটে। স্যার কখনো নিজের উপর দেবত্ব আরোপ করেন না।
একটি মজার প্রশ্ন উত্থাপনের মধ্য দিয়ে আজকের আলোচনার ইতি হয়। একজন শ্রোতা সরদার ফজলুল করিমের কাছেই প্রশ্ন রেখেছেন এই মর্মে যে সরদার ফজলুল করিমকে কি কম্যুনিস্ট মৌলবাদী বলা যায়?
-শব্দগতভাবে দেখলে মৌলবাদী খারাপ কিছু না। মূলে যাওয়ার চেষ্টাই তো মৌলবাদ। তবে কথা হলো কম্যুনিস্ট মৌলবাদী হওয়া সহজ না। বুকে একটা কম্যুনিস্ট প্ল্যাকার্ড ঝোলালেই কমুনিস্ট হওয়া যায় না। মার্কসবাদের মূলে যাওয়া সহজ না।
আমি মৃত্যুর জিকির করি না
১৫ জানুয়ারি ২০০৪
শেষদিনের সংক্ষিপ্ত আলোচনাটি ছিলো নিম্নরূপ :
জীবন সম্পর্কে আপনার দর্শন কি?
–তুমি কি আমাকে চেনো? কিভাবে? আমার জীবন-দর্শন জানার আগে তোমাদের জানতে হবে কেন আমি আড়াই হাজার বছরের পুরোনো বই অনুবাদ করলাম। তোমাদের জানতে হবে একথাটা যে, আমি জানি যে তোমরা আমাকে ভালোবাসো। নিজগুণেই ভালোবাসো। কিন্তু আমাকে বলো, কেন তোমরা আমাকে ভালোবাসো? লাইফকে শব্দগতভাবে বুঝতে চাইলে আর কতটুকুই বা বোঝা যায়। জীবনকে বোঝার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে জীবন বাঁচিয়ে রাখা, জীবন যাপন করা। জন্ম কখনোই আজন্ম পাপ হতে পারে না। দাউদ হায়দার ভালো ছেলে। ওর কবিতার লাইনটাকে মন দিয়ে বুঝতে হবে। সোজা মানে করলে হবে না। ওর কবিতার প্রতীকী অর্থ বুঝতে হবে। তবে কথা হলো আমার জীবন দর্শন কি বলবো? এতদিন কথা বলে যা বোঝার বুঝে নাও। শুধু বলবো যে Unless you enjoy your death you cannot enjoy your life.
কিন্তু একটু আগেই আপনি বললেন যে জীবনকে বোঝার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে জীবন বাঁচিয়ে রাখা।
জীবন এবং মৃত্যু এ দুটো related word. সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডের ক্ষণপূর্বে যখন তাকে বন্ধনমুক্ত করা হয় তখন তিনি শিষ্যদের বলেছিলেন বন্ধন না থাকলে আমি বন্ধন মুক্তির আনন্দ বুঝতে পারতাম না। জীবনকে বুঝতে হলে মৃত্যুকেও বোঝার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
গত কিছুদিন থেকে আপনি বারবারই মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছেন, বলছেন যে আপনি অপেক্ষা করছেন। কেন বলছেন? নিয়তই জীবনকে উপভোগ করার পরামর্শ আপনি দিয়ে থাকেন। আপনার ক্ষেত্রে এমন কি ঘটছে? বারবার মৃত্যুর আলোচনা হাজির করার কারণ কি এই যে আপনি জীবনকে উপভোগ করছেন না?
–আমি সর্বদা গোর্কীকে স্মরণে রাখি। জীবন কখনো মরে না। সময়হীন সময় ধরে জীবন অগ্রসর হচ্ছে। life is endless. মৃত্যুভাবনা নিয়ে কথা বলছি জীবনের আনন্দ উপভোগ অব্যাহত রাখার জন্য। একটা জীবন যখন মৃত্যুর হাত থেকে উঠে আসে সে আনন্দ ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। আমার সে অভিজ্ঞতা আছে। তোমাদের নাই। আমার মত করে জীবনকে তোমরা বুঝতে পারবে না। আগে অভিজ্ঞতা নাও। এ সমস্ত প্রশ্ন না করে পারলে আমার মত এগারো বছর জেলখানায় থেকে আস। তারপর বুঝতে পারবা প্রতিটা অভিজ্ঞতা কতই না মূল্যবান। জীবন কতই না মূল্যবান। আমি ব্যক্তিগত মৃত্যুর প্রসঙ্গটিকে ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না। আমি কোন একলা আমি নই। আমার পরিবার, বন্ধুজনা, পারিপার্শ্বিক, তোমরা সব মিলিয়ে আমি। আমি হচ্ছি সমাজের আমি। আমি শুধু মানুষের সমাজের স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি।
আমরা এ পর্যায়ে এসে তাঁর বক্তব্যগুলো আরেকটু ভালোভাবে বুঝে নিতে চাইলাম। তার উচ্চারিত লাইনগুলোই আবার তাঁকে শোনাতে চাইলাম। তিনি রাজি হলেন না। বরং বলেন :
যেভাবে খুশি ছাপো আমার কিছু আসে যায় না। তোমরা এখন শেখ মুজিবের মুখে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বসাইছো তাতে শেখ মুজিবের কি আসে যায়। আমার কথাও তুমি যেমনে খুশি লিখতে পার আমার কিছু যায় আসে না। এখন cannibalism চলছে I man is eating man.
আপনি বলছেন যে cannibalism চলছে, মানুষ মানুষকে খাচ্ছে। তবুও কি আপনি জীবনের সম্ভাবনায় বিশ্বাস করেন?
–জীবনের অর্থই জীবন। জীবন জীবিত থাকে আর মৃত্যু মারা যায়। বাচ্চা মারা গেলে মা কাঁদে এটা একটা বায়োলজিক্যাল ব্যাপার। তথাপি এই বাচ্চা মারা যাওয়াটা একজন ব্যক্তির extinction, এটা মানুষের extinction নয়। এরকম ভাবনা নিয়েই আমি বেঁচে আছি। আমি মৃত্যুর জিকির করি না। এত অস্ত্র নাকি বানানো হয়েছে যা দিয়ে পৃথিবীকে হাজার বার ধ্বংস করা যায়, এখন টুইন টাওয়ার ভেঙ্গে ফেলার কাল চলছে, এখন বাগদাদের লাইব্রেরি পোড়ানোর সময় চলছে-এখন বিশ্বজুড়ে অমানুষের রাজত্ব চলছে। তাই বলে কি আমি স্বপ্ন দেখবো না?
২০০২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর স্যারের সাথে আনুষ্ঠানিক আলাপ শুরু হয়েছিলো। আজ এক বছর তিন মাসের মাথায় এসে আনুষ্ঠানিক আলাপ পর্বের আপাতত সমাপ্তি হচ্ছে। আপাতত সমাপ্ত বলা হচ্ছে এই কারণে যে, সরদার ফজলুল করিম পাঠ এত সহজে শেষ হবার নয়। চেষ্টা ছিলো যতটা সম্ভব সময়ানুক্রম ধরে রেখে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অতীত-বর্তমান ভবিষ্যতকে উপজীব্য করে মানুষ-সমাজ-সভ্যতা, সমাজ পরিবর্তনের দ্বান্দ্বিকতা, মানুষী সমাজ প্রতিষ্ঠার বিঘ্ন ও সম্ভাবনাসহ নানাবিধ বিষয় সম্পর্কে সরদার ফজলুল করিমের মন্তব্যগুলোকে ধরে রাখা। বলাই বাহুল্য যে বাংলাদেশকে মূল উপজীব্য ধরা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্যারের মন্তব্য পর্যবেক্ষণগুলো দেশ কালের গণ্ডীতে আটকে না থেকে সব সমাজের সব কালের হয়ে উঠেছে। আরো একটি লক্ষ্য ছিলো: আমাদের মহত্তম ঐতিহ্যের অগ্রগণ্য স্মারক সরদার ফজলুল করিমের জীবন সম্পর্কে সাধারণের কৌতূহল নিবৃত্তি। সুখী এই কারণে যে তিনি নিজের উপরে দেবত্ব আরোপের কোন প্রকার চেষ্টা না করে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন মানুষ হিসেবে। তাই অবলীলায় বলতে পেরেছেন নিজের সীমাবদ্ধতার কথা যা মানুষের জন্য স্বাভাবিক। দীর্ঘদিনের আলাপের অংশজুড়ে অনেকটা রয়েছে ব্যক্তি সরদার ফজলুল করিমের সীমাবদ্ধতার কৈফিয়ৎ। কারু সন্তুষ্টি বিধানের জন্য নয়। নিজের কাছে স্পষ্ট থাকার জন্য-এমনটাই মনে। হয়েছে শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত। প্রতিটি আলোচনা পর্বে বারবার এ কথাটিই মনে হয়েছে যে, সরদার ফজলুল করিম হতাশার পূজারী নন–আশার কাণ্ডারী। আশা ফেরিওয়ালা।