আর জাহান বুজার্ডকে নিয়ে খোলা বাহনে চড়ে জাঞ্জিবার-এর রাস্তায় বের হলো, যেন সারা পৃথিবীর মানুষ এই মুখোশ পরা দানবটাকে দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়। একটা পুরো অশ্বারোহী সৈন্যদল তাদের বাহনটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, পাশাপাশি আরেকটা অশ্বারোহী সৈন্যদল তাদের পেছনে পাহারা দিয়ে যাচ্ছিল যেন কেউ কোনোরকম সমস্যা তৈরি করতে না পারে। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে এক হাতওয়ালা দানবটাকে দেখছে। যারা সেই ছোট বালকটার অবস্থা দেখেছে তারা কেউই বুজার্ডকে অপমান করার কথা চিন্তাও করতে পারছে না। অনেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে যেন তাদেরকে এই অমানুষ প্রাণীটাকে দেখতে না হয়। তারা ওকে শয়তানের সৃষ্টি জিন বলেই মনে করে।
মাত্র একঘণ্টা আগে জাহান বুজার্ডকে পুরনো একটা মন্দির ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। এর সমাধিস্থান আর আনুবিস এর ছবি দেখিয়েছে। আনুবিস হচ্ছে মিসরীয় শেয়ালের মাথাওয়ালা আন্ডারওয়ার্ল্ডের লর্ড। “এ হচ্ছে মৃত্যুর দেবতা” এটা বলার পর বুজার্ড মাথা ঘুরিয়ে এক চোখ দিয়ে ভালভাবে তাকিয়ে দেখল। “তাকিয়ে দেখ এর নাকটা দেখতে অনেকটা তোমার চামড়ার নাকের মতো। তুমি নিজেকে আনুবিস ভাবতে পার-মৃত্যুর দৃত, যে কি-না মানুষের আত্মাকে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে নিয়ে যায়।”
“যেটা বলতে চাচ্ছিলাম। তুমি তোমার মুখে ময়লা ছুঁড়ে দেয়া ছেলেটাকে যেভাবে হত্যা করেছে এতে আমি খুবই সন্তুষ্ট হয়েছি। এতে আমি আশ্বস্ত হয়েছি যে তোমার মানুষ হত্যা করার দক্ষতা বাড়বে। তুমি এক বাহু আর এক হাত নিয়ে আগের চেয়েও অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছ। তোমাকে আরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সকাল থেকেই এই প্রশিক্ষণ শুরু করা হবে।”
এখন বুজার্ডকে তার ট্রেইনিং-এর প্রথম সেশনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু শুধু সে এবং জাহান এই ভ্রমণে যাচ্ছে না। তাদের খোলা বাহনের পেছনে একটি বদ্ধ বাহনও রয়েছে। তাদের ভোলা বাহনের জানালার শাটারগুলো ফেলে দেয়া হয়েছে। এর ফলে ভেতরে কে আছে তা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। এর ভেতরের মানুষও বাইরের কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কোচ তার জায়গায় বসে আছে এবং রওনা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। খানিক বাদে বুজার্ডকে বহনকারী বাহন আর তার চারপাশের প্রহরীরা বড় একটা গেট-এর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে চতুষ্কোণ একটা জায়গার মাঝামাঝি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। জাহান এবং বুজার্ডকে বাহনটা থেকে নামার পর প্রিজন গর্ভনর তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়, এরপর বুজার্ডের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় লোকটা। এরপর সে দুই হাতে তালি বাজানোর পর তিনজন প্রিজন গার্ড তাদের হিংস্র চেহারা নিয়ে সামনে এগিয়ে আসে। একজনের হাতে লম্বা একটা লোহার চেইন। বাকি দুইজন তার দুইপাশ দিয়ে এগিয়ে আসছে। তাদের হাত কোমড়ে ঝুলানো তলোয়ার-এর বাট-এর ওপর।
বুজার্ড দেখতে পায় শেকলটার একপাশে একটা তালা লাগানো। সবকিছুর অর্থ বুজার্ড একমুহূর্তে বুঝে ফেলে। তার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে যদি সে কোনো কিছুতে বাধা দেয়। তাই সে মূর্তির মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার গলায় লাগানো চামড়ার কলারের সামনের হুক-এ শেকলটা আটকানো হয়। এরপর জেলের ভেতর থাকা লোকগুলোর চোখের সামনে দিয়ে তাকে পশুর মতো টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে বিশাল বড় এক উঠোনের মাঝখানে নিয়ে দাঁড় করানো হয় যেটার চারপাশে বড় বড় উঁচু দেয়াল তোলা। দাঁড়ানোর পর বুজার্ড তার মাথাটা যতদূর সম্ভব ঘুরিয়ে একচোখ দিয়ে চারপাশটা দেখতে থাকে। চারপাশে লাল রঙ্গা উঁচু দেয়াল। দেয়ালের পেছনে দর্শকদের বসার জন্য এক ধরনের গ্যালারিও রয়েছে। সেই গ্যালারি থেকে দর্শকদের উল্লাস ধ্বনি ভেসে আসছে। চিৎকার দিয়ে কেউ একজন বলে উঠে, “জঘন্য লোকটাকে দেখতে পাচ্ছি আমি!” কণ্ঠটা তার কাছে অনেক পরিচিত মনে হয়। জাহানের প্রিয় উপপত্নী এলিনা। উত্তর-পূর্ব উপকুলে সারকাশিয়ান জাতির মেয়ে সে। ওখানকার রমণীরা যেমন তাদের সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল তেমনি পুরুষের চাহিদা মেটানোর দক্ষতার জন্যও কম বিখ্যাত ছিল না। কন্সট্যান্টিনোপাল-এ ওটোম্যান সুলতানের হারেমে সবচেয়ে বেশি ছিল সারকাশিয়ান রমণী। এদের মধ্যে যারা সবচেয়ে সুন্দরী তারা দিল্লীর লাল কেল্লায় গ্রেট মোগল-এর চাহিদা মেটাত।
এলিনা জাহানের নারীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী নয়। এমনকি তার সঠিক মাপের চিকন ফিগারের শরীরও নয়। কিন্তু তার ঠোঁটে এক ধরনের কামুক ভাব খেলা করত। তার চোখে, তার শরীরের প্রতিটি ভজে এবং তার প্রতিটি চলাফেরায় সে যে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতো তাতে বলা যায় সে জাহানকে যে শুধু আনন্দই দিতে জানত, তা নয়, আনন্দ কিভাবে নিংড়ে নিতে হয় সেটাও জানত। সে অবশ্য কিছুদিন আগে বুজার্ডকে দেখে মোহিত হয়েছিল-যখন বুজার্ড প্রথমবারের মতো হারেমে গিয়েছিল, সাথে ছিল শক্ত পেশিবহুল দুজন হারেম-গার্ড, যাদের উচ্চতা আর মাংসল শরীর দেখে বোঝার কোনো উপায়ই ছিল না যে তারা নপুংসক। যেখানে অন্যান্য উপপত্নী ভয়ে দূরে সরে যাচ্ছিল সেখানে এলিনা স্বইচ্ছায় অদ্ভুত মুখোশ পরা বুজার্ডের দিকে এগিয়ে আসে। সে বুজার্ডের এত কাছে চলে আসে যে বুজার্ড তার শরীর থেকে আসা সুগন্ধ খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারছিল। তার নিজের নকশা করা মুখোশ, তার অর্ধনগ্ন শরীর বুজার্ডের শরীরের সাথে প্রায় লেগে ছিল।
“এই প্রাণীটা কী স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলে, মাই লর্ড?” সে নারীসুলভ ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে জাহানকে জিজ্ঞেস করেছিল।
“না”, প্রিন্স জবাব দেয়। কিন্তু তোমার কথা ও বুঝতে পারবে।” বুজার্ড বুঝতে পারে এলিনা তার শরীরে। চাপ দিচ্ছে। বুজার্ড বুঝতে পারে তার ভেতরটা আস্তে আস্তে জেগে উঠছে। যে রক্তের প্রবাহের কারণে একজন পুরুষ মানুষ পুরুষ হয়ে উঠে সেই প্রবাহ স্বাভাবিক থাকার পরও তার কিছুই করার নেই। পুড়ে যাওয়া ক্ষত জায়গা থেকে সে শুধু মশার কামড়ের মতো এক ধরনের চুলকানি অনুভব করছে। এরপর উপপত্নীটা বুজার্ডের দিকে তাকিয়ে বলে, “মাই লর্ড কী ঠিক বলেছে? তুমি কী বুঝতে পারছ আমি কী বলতে চাচ্ছি?”
বুজার্ড কি বলবে বুঝতে পারছে না। যেন মৃত্যুযন্ত্রণা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। দুই পায়ের সন্ধিস্থল থেকে এক ধরনের অসহ্য যন্ত্রণা তার মস্তিষ্কে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। এমনকি হাত দিয়ে সেখানে চুলকানোরও অনুমতি নেই। সে অস্পষ্টভাবে শুনতে পায় জাহান বলছে, “তুমি মাথা নাড়াতে পার।” কিন্তু তার মনে হচ্ছিল জাহান-এর কণ্ঠ যেন অন্য কোনো দুনিয়া থেকে আসছে।
বুজার্ড মাথা নাড়ায়, সেই সাথে তার কোমর এদিক সেদিক নাড়া দেয়। “ওহ”, এলিনা বেশ চিন্তাশীলভাবে বলে উঠে, “এ তো দেখি অনেক কিছুই বুঝতে পারে। কিন্তু কীভাবে?”
সে তার পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ায়। এরপর বুজার্ডের মুখোশের কাছাকাছি এসে বলে, “একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক, কুৎসিৎ মানব, যদি তুমি বাঁচতে চাও। তার চেয়ে বড় কথা তুমি তোমার হাত নাড়ানোর চেষ্টা করবে না। যদি তুমি আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা কর তবে তোমার মৃত্যু অনিবার্য। মাথা নেড়ে সম্মতি জানাও তাহলে আমি তোমাকে এবারের মতো ছেড়ে দেব।”
বুজার্ড খুব দ্রুত দুই বার মাথা নাড়ায়, যা দেখে এলিনা পেছনে সরে গিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। “তোমার এই অদ্ভুত ঠোঁট সাবধানে রাখ, জঘন্য জানোয়ার! নয়ত তোমার ওই সুচালো ঠোঁট আমাকেও তোমার মতো একচোখওয়ালা দানবে পরিণত করে দেবে। আমার প্রিন্স কোনোভাবেই সেটা মেনে নিবে না, মাথায় রেখে কথাটা।”
এলিনা আবারও বুজার্ডের দিকে এগিয়ে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে। বুজার্ড যে জেল্লাব পরে আছে সেটার একপাশে আস্তে আস্তে হাত দিয়ে উপরে তুলতে থাকে। তাহলে তুমি এটার নিচে কী লুকিয়ে রেখেছ?” এলিনা জিজ্ঞেস করে, এরপর সে বুজার্ডের পা, উরু নগ্ন করতে থাকে। একপর্যায়ে সে চিৎকার দিয়ে সরে আসে। তার চোখ মুখ বিরক্তিতে কুচকে আসে। এর চামড়া তো পুড়ে গিয়ে ক্ষত হয়ে আছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ওখান থেকে।”
হারেম-এর মেয়েরা ভয়ে আর্তচিৎকার দিয়ে উঠে। তবে ভয়কে ছাপিয়ে তাদের কৌতূহলটাই বড় হয়ে উঠে একটু পর। ব্যাপারটা ভাল করে দেখার জন্য তারা সামনে এগিয়ে আসে। মুখোশের পেছনে বুজার্ড লজ্জায় অপমানে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। এই অপমানের জ্বালা তার ক্ষত থেকে আসা ব্যথার চেয়েও বেশি তীব্র। তার হার্ট দ্রুত পাম্প করতে শুরু করেছে, নিঃশ্বাস এত হোট হয়ে আসছে যে সে ভয় পাচ্ছে; হয়তো সে যথেষ্ট পরিমাণ বাতাস ফুসফুসে নিতে পারছে না।
এরপর আরো একবার তীক্ষ্ণ হাহাকার শোনা যায় যখন এলিনা বুজার্ড-এর কাপড়টা একেবারে উপরে উঠিয়ে ফেলে; ক্ষতটা একেবারেই উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল তখন। “দেখ,” সে অন্যান্য মেয়েকে দেখিয়ে বলে। “এই ঘৃণ্য জীবটা নারীও নয় আবার পুরুষও নয়।” এরপর সে বুজার্ড-এর পায়ের মাঝে লেগে থাকা ছোট্ট মাংসটুকুতে আঙুল দিয়ে বলল, “এটা দেখতে গোলাপের কুড়ির মতো, যেটা আমাদের এত আনন্দ দেয়, তাই না?” কিন্তু “এই ক্ষুদ্র জিনিসটা এই কুৎসিৎ লোকটাকে আনন্দ দিতে পারে কি-না, আমার সন্দেহ আছে।”
বুজার্ডের ইচ্ছে হচ্ছিল মেয়েটার ওপর প্রতিশোধ নিতে কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। সে মেয়েটাকে শক্ত বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছে কিন্তু তার শুধু একটি বাহু আছে। আর সে যদি এই বাহুটা দিয়েও কিছু করতে চায় তবে তার মৃত্যু অনিবার্য।
সে এখন যেটা করতে পারে সেটা হচ্ছে : দু’পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। তবে পা দুটোও মনে হচ্ছে যে-কোনো মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবে।
বুজার্ড তার একচোখ দিয়ে সবাইকে ভালভাবে দেখতে পাচ্ছে না, তাই পাখির মতো মাথা নাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করা তার জন্য স্বাভাবিক। তার এক চোখ দিয়ে সে কখনো কোনো সুন্দর মুখ, কোনো সুন্দর ঠোঁট বা চোখ, কখনো বা কারও শরীরের ভাজ দেখতে পাচ্ছে। সে কখনো একসাথে এতগুলো সুন্দরী রমণী দেখেনি। যদি সে কয়েকমাস আগেও এমন সুযোগ পেত তাহলে হয়ত নারীজাতির কাছে নিজের পৌরুষ প্রমাণের একটা সুযোগ পেত।
এখন যদিও নিজের হীনতা নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া বুজার্ডের আর কিছুই করার নেই। এলিনা কিছুক্ষণ তার দিকে খুব কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এরপর উচ্চস্বরে বলতে থাকে, “আমি ভাবছি, এটা দিয়ে কী কোনো স্বাভাবিক নারী-পুরুষের মতো আনন্দ করা সম্ভব।” এরপর সে জাহানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলতে থাকে, “আমি কী এটা নিয়ে খেলা করতে পারি, স্যার?”
মহারাজা উচ্চস্বরে হেসে উঠেন। “না, তুমি পার না। আমি চাই তুমি আমার সঙ্গে খেলা কর। এদিকে এস। তাহলে তুমি বুঝতে পারবে যে একজন প্রকৃত পুরুষ কেমন হয়।” সে গার্ডদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “একে নিয়ে যাও।” বুজার্ডকে তার নোংরা বন্দিখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর থেকে আজকের আগ পর্যন্ত জাহানের সাথে বুজার্ডের আর দেখা হয়নি। এমনকি হারেমে যাওয়ার অনুমতিও বুজার্ডের ছিলনা। এখন এলিনার কণ্ঠ তাকে আবার সেই পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। তার দুই পায়ের সন্ধিস্থল থেকে সেই তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করে সে।
“এদিকে তাকাও”, কুৎসিৎ মানব এলিনা চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে। “তোমার জন্য আমার কাছে কিছু একটা আছে।”
বুজার্ড এদিক সেদিক তাকিয়ে কণ্ঠের উৎস খুঁজতে থাকে। তার উপরের দিকে দোতলা সমান উঁচু খোলা একটা গ্যালারি রয়েছে। সেটাতে শুধু এলিনা আর জাহান বসে আছে। এলিনার মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা, যেন তার মনিব ব্যতীত বাইরের কেউ তাকে দেখতে না পায়। হারেম-এর বাইরে গেলে তাকে এইভাবেই থাকতে হয়।
“দেখ”, সে ডাক দিয়ে বলে। তার দুই হাত সামনে বাড়ানো। বুজার্ড দেখতে পায় তার হাতে লম্বা, বাঁকানো একটা তলোয়ার। এটার সঠিক ব্যবহার। কর। “তাহলে পুনরায় আমাদের দেখা হবে।”
এলিনা সামনের দিকে ঝুঁকে হাত দুটো নিচু করে তলোয়ারটা তার দিকে ছুঁড়ে দেয়। বুজার্ড সেটা তুলে নেয়। এরপর জাহান তার উদ্দেশ্যে কথা বলে উঠে।
“যাও, পিছিয়ে গিয়ে মাঠের মাঝখানে দাঁড়াও। তুমি যে গেটটা দিয়ে ঢুকেছে সেটার দিকে তাকিয়ে দেখ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা খুলে যাবে আর সেখান থেকে একজন মানুষ প্রবেশ করবে। সে হচ্ছে মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামী। তোমার তাকে হত্যা করতে হবে।”
“তাকে হত্যা কর।” এলিনার কণ্ঠও প্রতিধ্বনিত হয়।
বুজার্ড তার দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু এতবেশি ছড়ায়নি যাতে তার ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হয়। গত এক মাসের মধ্যে সে এই প্রথম এতটা শক্তিশালী অনুভব করল। কোনো সুন্দরী রমণীর সামনে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পেল। তাকে দেখানোর সুযোগ পেল যে সবকিছু সত্ত্বেও সে এখনো একজন পুরুষ।
কয়েক সেকেন্ড পরে গেট খুলে যায়। একজোড়া অপরিচিত হাত একজন বন্দিকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়। রোগা চর্মসার, ছোট খাট একজন মানুষ ভেতরে প্রবেশ করে। লজ্জা নিবারণের জন্য তার কোমড়ে জড়ানো ছিল শুধু এক টুকরো কাপড়। তার রুক্ষ সোনালি চুলের ওপর একটা কাপড় বাঁধা ছিল। মাঠ পাড়ি দিয়ে তার যে চোখ বুজার্ডের দিকে তাকিয়ে ছিল সে চোখে কোনো ভয় ছিল না। ছিল বিদ্বেষ।
বুজার্ড ভালভাবে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করতে লাগল এবং নিজের দুর্বলতাগুলো খুঁজতে লাগল। সেগুলো খুঁজে পাওয়া অবশ্য কঠিন কিছু নয়। তার বাম হাত নেই। বাম চোখ নেই। তার লম্বা ঠোঁট তার দৃষ্টির এক অংশ প্রায় ঢেকে রেখেছে। তাই তার শরীরের অন্যপাশ প্রতিপক্ষের জন্য অনেক দুর্বল অংশ। বুজার্ড নিশ্চিত যে বৃদ্ধ লোকটি তার বর্শা দিয়ে বুজার্ড-এর বাম পাশে আঘাত করার চেষ্টা করবে। তাই বুজার্ড লোকটির গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু লোকটি আস্তে আস্তে পেছনে সরে যাচ্ছে।
“তোমার পেছনে,” এলিনা আর্তনাদ করে উঠে।
“ঘুরে দাঁড়াও,” জাহান বলে উঠে।
বুজার্ড অতি দ্রুত বাম দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। বৃদ্ধ লোকটির অল্প একটু অংশ ছায়ার মতো তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। গ্যালারি থেকে তীব্র চিৎকার শোনা যাচ্ছে এখন। সাথে-সাথে বুজার্ডের ভেতর নিজের যুদ্ধের স্পৃহা ফিরে আসল। সে ভুল পথে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার ডানদিকে ঘুরা উচিত যেদিকে তার একটি হাত আর একটি চোখ ভাল আছে। তলোয়ার ধরা হাতটা সামনের দিকে দিয়ে সে ঘুরতে থাকে যাতে সামনে যা-ই পড়বে সব কেটে যাবে।
হাত ছড়িয়ে দিয়ে ঘুরতে থাকার ফলে তার ভারসাম্য রক্ষা করতে সহজ হয়। এক পর্যায়ে সে বুঝতে পারে তার তলোয়ারটা শক্ত কিছুর ওপর আঘাত করেছে। এরপরই সে ব্যথাতুর চিৎকার শুনতে পায়। বুজার্ড স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। দেখতে পায় বৃদ্ধ লোকটি তার ডান হাতটি বামহাত দিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর বুজার্ডের চোখ যায় মাটিতে। দেখতে পায় দুটো কাটা আঙুল মাটিতে নড়াচড়া করছে। এরপর সে মাথা তুলে দেখতে পায় বৃদ্ধ লোকটি পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যথার কারণে সে আর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারছে না।
পিছিয়ে যেতে যেতে বৃদ্ধ লোকটি দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল। সাথে-সাথে বুঝতে পারে সে ফাঁদে আটকা পড়েছে। লোকটা বুজার্ডের দিকে তাকিয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইলো। কয়েক মুহূর্ত পুজার্ড ইতস্তত করতে থাকে যে কি করবে। এরপরই সে জাহানের কণ্ঠ শুনতে পায়। “ও একজন খুনী। ওকে হত্যা কর।” আবেগহীন রুক্ষ কণ্ঠে জাহান আদেশ করে উঠল। এরপরই এলিনা চিৎকার দিয়ে উঠে। “ওকে হত্যা কর কুৎসিৎ মানব।”
এরপর আর কোনো চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন ছিল না। তার কাজ সে চালিয়ে যায়। নিজের তলোয়ারটা লোকটির পেটে ঢুকিয়ে দেয় সে। এরপর লোকটি যখন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে তখন তার উন্মুক্ত গলায় বুজার্ড তলোয়ার বসিয়ে দেয়। লোকটিকে হত্যা করার পর বুজার্ডের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। জাহানের হারেমে তাকে যে অপমানের শিকার হতে হয়েছে তাতে সে গত কয়েকদিন যাবত কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না। এখন কিছুটা হলেও সেটা কমেছে। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে আনন্দিত হওয়ার সময় নেই কারণ জাহান এরই মধ্যে তার নাম ধরে ডেকেছে। “গেট! গেট-এর দিকে তাকাও।”
বুজার্ড মাথাটা ঘুরিয়ে গেট-এর দিকে তাকিয়ে দেখে আরেকজন লোক প্রবেশ করছে। তার বয়স আগের লোকটির চেয়েও কম এবং তাকে বেশ শক্তিশালী মনে হচ্ছে। কিন্তু লোকটির পায়ে একধরনের অসংগতি আছে। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছে। বুজার্ড বুঝতে পারে তার মাথাটা সবসময় নড়াচড়ার ওপর রাখতে হবে যেন তার দৃষ্টি লক্ষ বস্তুর ওপর থেকে সরে না যায়। শুধু যে তাকে মাথা নাড়াতে হচ্ছে তা-ই না। মাথার গতিবিধির সাথে তাল মিলিয়ে শরীরকেও নাড়াতে হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে যে অস্ত্র হাতে ধেয়ে আসতে থাকা শত্রুর সামনে সে যদি একদিন য় দাঁড়িয়ে থাকে তবে তার মৃত্য অনিবার্য।
যদিও বুজার্ডের যুদ্ধ কৌশল আয়ত্তে আনতে একটু সময় লাগে তবুও শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় মানুষটিকেও শায়িত করে ফেলে সে। তলোয়ার দিয়ে তার পেট চিরে ফেলে বুজার্ড। রক্তে ভেসে থাকা খাদ্যনালী এবং পেটের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ উন্মুক্ত হয়ে যায়।
এরইমধ্যে মাঠে তৃতীয় যোদ্ধার প্রবেশ ঘটে। বুজার্ড তার নিজস্ব গতিতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাকে কুপোকাত করে ফেলে।
“যথেষ্ট হয়েছে,” এলিনা বিরক্তির স্বরে বলে উঠে। “গুড”, জাহান উত্তর দেয়। আমরা একে নিয়ে আরও ভাল কিছু করতে পারি।”
এরপর তারা দুজন বুজার্ড-এর দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে উঠে চলে যায়। স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে বুজার্ড তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এলিনার উদাসীনতায় বুজার্ড স্কুলপড়ুয়া বালকের মতো দুঃখ পেল। ওরা চলে যাওয়ার পরপরই গ্যালারি থেকে মোটা কণ্ঠের একজনের চিৎকারে সে সম্বিত ফিরে পায়
“হে মুখোশ মানব!” বুজার্ড দেখতে পায় বেশ লম্বা মোটাসোটা একজন লোক কথা বলছে। তার মাথার চুল ফেলে দেয়া, খালি গা, বাহুর প্রস্থ একজন সাধারণ মানুষের উরুর চাইতেও বেশি।
“আমার নাম আলী। আমি তোমার প্রশিক্ষক। তোমার আরো কাজ আছে। মহারাজার আদেশ অনুযায়ী তোমাকে একজন ভাল যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যা আমি অবশ্যই করব। তাই বলছি, সতর্ক থাকো, সেই সাথে চারপাশে নজর রাখো। যতগুলো শক্র সামনে আসবে তাদের বধ করতে হবে তোমাকে-যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি থামতে বলব। এটা আমার আদেশ এবং …একই সাথে উপদেশ। তুমি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?”
বুজার্ড মাথা নাড়ায়।
“গুড”, আলী বলতে থাকে। “এখন তোমার যাদের সাথে দেখা হবে তারা আরও তরুণ এবং শক্তিশালী, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারো-যদি তুমি তাদেরকে হত্যা না কর তাহলে তারা তোমাকেই হত্যা করবে।”
প্রশিক্ষক ঠিকই বলেছিল। পরবর্তী যে দুজন বন্দিকে তার দিকে ঠেলে দেয়া হয় তারা তাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে সেখান থেকে যথেষ্ট কৌশলে তাকে সরে আসতে হয়েছে। তাদের প্রতিহত করে একদম প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। ছয় নাম্বার লোকটি বুজার্ডকে আঘাত করতে সক্ষম হয়। বুজার্ড যদি শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করতে না পারত তাহলে হয়ত সে-ই বুজার্ডকে হত্যা করত। সাত নাম্বার লোকটি বুজার্ডকে কয়েকটা ঘুষি মেরে বসে। কিন্তু মাঠের এখানে সেখানে পড়ে থাকা মৃত মানুষগুলোর দিকে নজর পড়ার পর তার সাহস আর আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছিল। নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে দুটো গুণ অনেক প্রয়োজন ছিল। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে তলোয়ার-এর এক আঘাতে নিজের শেষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধ্বংস করে দেয় সে। এর পরপরই হাঁটুগেড়ে মাঠের ওপর বসে পড়ে বুজার্ড। এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে তলোয়ার ধরে রাখা আঙুলগুলো অনুভবই করতে পারছিল না।
.
ক্ষুধার্ত এবং ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় বুজার্ড তার কোয়াটার-এ ফিরে আসে। আফ্রিকান চাকরটা যখন নল ঢুকিয়ে তাকে পানি খেতে দেয় সে একবারে সমস্ত পাত্র খালি করে ফেলে। তার জেল্লাবা খুলে দেয়া হয়, এরপর তাকে গরম পানিতে গোসল করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে তাকে গরম তেল মালিশ করে দেয়া হয়-পেশিগুলোকে শিথিল করার জন্য। গোসল শেষে তাকে দেয়া হয় শুকনো কাপড়। খেতে দেয়া হয় চিকপিস, শাকসবজি, এবং মিনস মিট-তার জন্য আজ বরাদ্দকৃত খাবার ওইগুলোই ছিল।
কিছুক্ষণ পর বুজার্ড যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন জাহান তার কক্ষে আসে। “তুমি আজ যথেষ্ট ভাল করেছ।” সে বলতে থাকে। “এখন থেকে আলী তোমাকে প্রতিদিন প্রশিক্ষণ দিবে। মাঝে মাঝে সে আর তুমি একা কাজ করবে। অন্যসময় তোমাকে বন্দিশালায় নিয়ে যাওয়া হবে-তুমি কী শিখেছো সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য। সেখানে তোমাকে বন্দিদের সাথে যুদ্ধ করতে দেয়া হবে।”
জাহান বুজার্ডের দিকে এগিয়ে তার কাঁধে হাত রাখে এবং সরাসরি তার চোখের দিকে তাকায়। “এলিনা খুবই অসাধারণ এক রমণী। তাই না?” সে এমনভাবে বলে যেন দুই বন্ধু মিলে গল্প করছে।
“হ্যা”, বুজার্ড উত্তর দেয়।
“মাঝে মাঝে আমি বুঝতে পারি না, সে ডাইনি, নাকি পরী, নাকি দেবী…অথবা সে সবই। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, সে যেভাবে মানুষকে আনন্দ দিতে পারে-এমনকি তোমার মতো কাউকেও”-তার তুলনাই হয় না। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে জাহান। “সে তোমার অনুভূতি জাগিয়ে দিয়েছিল। তাই না? মানে যতটা জেগে উঠা তোমার পক্ষে সম্ভব ছিল আরকি।”
“হ্যা”, বুজার্ড অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দেয়। তার কণ্ঠে কেমন যে দোটনা ভাব চলে এসেছিল।
“তুমিও চাও সে তোমাকে আনন্দ দিক, তাই না?”
“হা…হা…অবশ্যই”, খুব দ্রুত জবাব দেয় বুজার্ড।
জাহান বুজার্ডের দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দেয়। আমি এটা নিয়ে চিন্তা করেছি। কিন্তু এলিনা অথবা আমার অন্যকোনো উপপত্নীর সাথে স্বর্গসুখ উপভোগ করতে চাইলে তোমাকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে যতদিন পর্যন্ত না তুমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে। হেনরি কার্টনিকে হত্যা করতে পারবে।”
“কিন্তু এরপর…?” বুজার্ড জিজ্ঞেস করে।
জাহান হেসে জবাব দেয়, “যদি তুমি কার্টনিকে হত্যা কর, সে আমাদেরকে যেভাবে অসম্মান করেছে, তোমাকে যেভাবে অপমান করেছে, আমাদের লোকদের ক্ষতি করেছে, সেগুলো তাকে কড়ায় কণ্ডায় হিসেব বুঝিয়ে দিতে পারো, তবেই তুমি আমার হারেমের কোনো এক রত্নকে পাবে। সেটা এলিনাও হতে পারে-যদি আমি ততদিনে তাকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি আরকি। আমার উপহার হিসেবে তুমি তাকে রেখে দিতে পারবে অথবা যা খুশি করতে পারবে।”
*
উইলিয়াম পেট অনেকটা খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষ, সেই সাথে সক বেশ অদ্ভুত। হাল তাকে নিজের অলিভ ওয়েল আর বেরিলা অ্যাসেস সোপ ব্যবহার করতে দিয়েছে। সাগর থেকে বালতি ভর্তি পানি তুলে গোসল করে লোকটা। ডেফট-এর বন্দিশালায় বন্দি থাকা অবস্থায় তার শরীরে যে ময়লা ও ধুলাবালি জমেছিল সেগুলো সে পরিষ্কার করে খুব ভালভাবে। শুধু শারীরিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষার জন্যই যে সে তা করে তা-ই নয়। বরং সবার মাঝে নিজেকে যেন আকর্ষণীয় মনে হয় সেদিকেও লক্ষ রাখে সে।
ক্যাপ্টেন-এর টেবিলের চারদিকে খেতে বসা সবার চেহারা যেখানে অপরিষ্কার বা অগোছালো থাকে সেখানে পেট-এর চেহারা উচ্চ গোত্রীয় ইউরোপীয়ানদের মতো চকচক করতে থাকে। যেভাবেই হোক সে বোম্বে (মুম্বাই) ভ্রমণ করে এসেছে, সেই সাথে আর্ল অব কাম্বার ল্যান্ডে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে এসেছে। কিন্তু তাতে তার চেহারার উজ্জ্বলতা খুব একটা মলিন হয়ে যায়নি। বন্দিদশা তার ধূসর রঙটাকে শুধু একটু বাড়িয়ে দিয়েছে।
হাল আর তার নাবিকেরা উঠে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তরতাজা খাবারের স্বাদ নিচ্ছিল। জুডিথ জাহাজের রাঁধুনীকে কিভাবে আরও ভাল রান্না করা যায় সে ব্যাপারে উপদেশ দিচ্ছিল একনাগাড়ে।
হাল তার গল্প বলার পর দুই রাত পার হয়েছে। এরই মাঝে সে একবার তার নাবিকদের মাঝে কয়েকজনকে জন লোভেল-এর নেতৃত্বে ডেট-এ পাঠিয়েছে। দুটি জাহাজই এখন অ্যাস্টার্ন লাইন-এর ওপর দিয়ে যাচ্ছে যদিও প্রতিকূল বাতাসের কারণে তারা খুব একটা দ্রুত এগুতে পারছে না। আটক করা ওলন্দাজ নাবিকদের এখনো বন্দি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু তাদেরকে শেকলে বাঁধা হয়নি। জাহাজের অন্যান্য নাবিকের মতো তাদেরকেও একই খাবার এবং পানীয় দেয়া হচ্ছে। দিনে দুইবার তাদেরকে ডেক-এর ওপর যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে যেন তারা সূর্যের আলো পেতে পারে, নির্মল বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারে। সেই সাথে পরাজিত নাবিকদের ব্যাপারে তার পিতা যে কৌশল অবলম্বন করতেন ট্রাম্প-এর ব্যাপারেও সে একই কৌশল অবলম্বন করেছে কার্টনি। তাকে প্রতিদিন রাতে ক্যাপ্টেন-এর খাবার টেবিলে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
জুডিথ-এর পরামর্শ অনুযায়ী তৈরি করা আজকের মার্টনকারি বেশ সুস্বাদু হয়েছে বলা যায়। টেবিলে বসা প্রায় সবাই প্রাণভরে খেয়েছে শুধু পেট বাদে। পেট-এর খাবারের থালা প্রায় একইরকম রয়ে গিয়েছে। প্লেটের খাবার প্লেটেই গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার এই খামখেয়ালিপনা হয়ত উপস্থিত লোকদের কাছে বিরক্তির কারণ হতে পারে কিন্তু পেট এরকম পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার মতো দক্ষতা তৈরি করে নিয়েছে নিজের ভেতর। তার উপস্থিতি অন্যদের কাছে যেন উপভোগ্য হয় সেটা নিশ্চিত করতে সে ভালই পারে।
হাল হাসতে হাসতে তার ওয়াইন-এর বোতল সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “আপনার পালা ঘনিয়ে আসছে মি. পেট। গত দুইদিন আগে আপনি আমাকে গল্প বলতে বাধ্য করেছিলেন। এবার আপনি আপনার গল্প বলবেন। কোন ভাগ্যের প্যাঁচে পড়ে আপনি সাগরের এখানে এসে পৌঁছেছেন যে ট্রোম্প-এর মতো লোকের আপনাকে দয়া দেখিয়ে উদ্ধার করতে হয়েছিল।” আর “আমি একইসাথে আপনাকেও জানিয়ে রাখছি মি. ট্রাম্প। এরপর আপনার ভ্রমণকাহিনী শুনব আমরা।”
ওলন্দাজ নাবিকটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দেয়, “দুই-একটা ঘটনা শুনে আপনারা মজা পেলেও পেতে পারেন।
একগ্লাস ওয়াইন পান করার পরও খালি গ্লাসে চুমুক দিতে থাকে পেট। এরপর সে গলা পরিষ্কার করে বলতে থাকে। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, আমি আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এ চড়ে বোম্বে (মুম্বাই) থেকে যাত্রা শুরু করি। আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে কিছু ব্যবসায়িক চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য গিয়েছিলাম। যখন আলোচনা শেষ হয় তখন গভর্নর-এর বাসস্থানে ক্যাপ্টেন গোডিংস-এর সাথে পরিচয় হয়। সে খুব খুশি মনে আমাকে আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এ জায়গা দিতে রাজি হয়েছিল। জাহাজটা তখন খনিজ পদার্থ বোঝাই করে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল মাত্র।”
উইল স্ট্যানলি আর বিগ ডেনিয়েল-এর দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যায়। “আমার তো মনে হয় এরকম জাহাজে চড়া অর্ধেকটা মৃত্যুর সমতুল্য। যেকোনো মুহূর্তে আগুন লেগে বিস্ফোরিত হতে পারে ওটা।”
“আপনার ভয়ের যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে,” পেট বলতে শুরু করে। “যখন আমরা যাত্রা শুরু করি তখন সবই ছিল গুজব। ক্যাপ্টন গোডিংস ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক একজন মানুষ। সেই সাথে সে বেশ মজাদার মানুষও বটে।
আমার যতদূর মনে পড়ে তার জাহাজের নাবিকেরা তার নাম দিয়েছিল। সসেজ।”
চারপাশে মৃদু একটা হাসির রোল শোনা গেল। জুডিথ বলে উঠে, “মাফ করবেন মি. পেট। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এই নামের মধ্যে হাসির কী। আছে?”
“ম্যাডাম, ব্যাপারটাকে এত জটিলভাবে নেয়ার দরকার নেই। আমারও সঠিক ধারণা নেই যে এই নাম কিভাবে রটেছে। ক্যাপ্টেন গোডিংস-এর কাছ থেকে যতটুকু ধারণা পেয়েছি, ব্যাপারটা মাংস আর কসাইখানার সাথে সম্পর্কিত। সম্ভবত আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এর লোকেরা বিশেষ পদ্ধতিতে সসেজ রান্না করতে পারে। এর বেশি কিছু আমি জানি না।”
“তাহলে আমাদের সসেস সম্পর্কে বলুন। অথবা ঐ জাহাজ সম্পর্কে নেড টেইলর অনেকটা অধৈর্য হয়ে বলে উঠল। “জাহাজটা কী যথেষ্ট বড় ছিল?”
পেট মাথা নাড়ায়। “আমি তাই বলব। কারণ মি, গোডিংস আমাকে এটার গঠন সম্পর্কে বলেছিলেন যা শুনে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। এমনকি ওটার ভেতর মজুদ করা ধন-সম্পদের কথা বলেও তিনি আমাকে মুগ্ধ করেছেন। তিনি আমাকে জানিয়েছেন এটার ভেতর দুইশরও বেশি রকমের গাছ রয়েছে। পাইন গাছের কাঠ রাখা হয়েছে জাহাজটার মাস্তুলের জন্য। স্পার কাঠ আনা হয়েছে বিভিন্ন কলোনী থেকে সংগ্রহ করে। এছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা তা হল ইংলিশ ওক কাঠ আনা হয়েছে ফরেস্ট অব ডীন থেকে-কিংবা অন্য কোনো বন থেকে যেটা আমার মনে নেই। কিন্তু মি. টেইলর আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, এটার মাস্তুল, এটার পাল, আর এটার বন্দুক সবই ছিল অত্যন্ত গুণগত মানসম্পন্ন। কোম্পানির আদেশ অনুযায়ী অনেক উন্নতভাবে সাজানো হয়েছিল এটাকে। জাহাজটার লাভ নির্ভর করত এর কার্গোগুলো কতটা নিরাপদে পৌঁছাতে পারে সেটার ওপর।
“ক্যাপ্টেন গোডিংস নামটা আমার কাছে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে।” হাল বলে উঠে। “আমি নিশ্চিত যে আমার পিতা তাকে চিনতেন। ওহ, হ্যাঁ মনে পড়েছে। তারা দুজন একসাথে স্কেভেনিংজেন-এর যুদ্ধে লড়েছিলেন। আমার বাবা বলেছিলেন, “জাহাজের যুদ্ধে তাকে নিজের পক্ষে পাওয়াটা অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।”
“আহ, স্কেভেনিংজেন”, নেড টেইলর তার ধূসর মাথাটা নাড়িয়ে বলতে থাকে। অনেক মানুষ সেদিন সাগরের তলায় হারিয়ে গিয়েছিল। সে তার বুকের শুকিয়ে যাওয়া রুপালি রঙের ক্ষতটাতে হাত লাগিয়ে বহুবছরের পুরনো স্মৃতিটার কথা মনে করতে থাকে। তার আগের রাতের ঝড়ো বাতাসটা ছিল আসলে ঈশ্বরের ক্রোধ। সবার বোঝা উচিত ছিল যে ঈশ্বর আমাদেরকে কিছু একটার ইঙ্গিত দিচ্ছেন।”
“তোমার পুরনো গল্প বাদ দাও তো, টেইলর”, হাল বলতে শুরু করে, “নয়ত আমরা কখনোই পেট-এর গল্পের শেষটা শুনতে পারব না।”
“আরে, বলতে দাও তো। টেইলর বলতে শুরু করে।” “একবার কি হয়েছে শোন। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত, শুনে অবাক হবে। আমি তখন প্লাইমাউথ-এর এক সরাইখানা থেকে বের হয়ে আসছিলাম, এমন সময় লালচুলো এক সুন্দরী আমাদের মাল্লাদের সর্দারের কাছে এসে নিজে থেকেই তার সেবা দিতে চাচ্ছিল-সে কোনো কথা বলার পূর্বেই।”
“আরও কিছু বলার আছে?” অ্যাবোলী জোর গলায় বলে উঠল। এরপর জুডিথ-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ওর হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।”
“সেটার কোনো প্রয়োজন নেই,” জুডিথ হেসে জানাল। “আমি বহুবছর পুরুষ সৈন্যদলের মাঝে একমাত্র নারী ছিলাম। আমি এর চেয়েও বেশি কিছু শুনে অভ্যস্ত।”
“আমাকে ক্ষমা করবেন মি. টেইলর, কিন্তু মাঝি-মাল্লার সর্দারদের সাথে এসব নারীদের ঘটনা উল্লেখের কী কোনো সম্পর্ক আছে?”
“নেড বিশ্বাস করে যে এসব লাল চুলো রমণীদের আগমন জাহাজের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনে, হাল তাকে ব্যাখ্যা করে বোঝায়।
“ওহ, আচ্ছা”, পেট বলে উঠে। “কিন্তু সেই ঘটনার পর সেই যুবকটির কী হয়েছিল?”
“সে জাহাজ থেকে নামার সময় কাঠের পাটাতন উল্টে পাথরের মতো সমুদ্রে ডুবে যায়”, নেড জানায়।
“আমি আর কল্পনাও করতে পারছি না, মি. টেইলর, পেট বলে উঠে। “আমি প্রথমে সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখি, দ্বিতীয়ত, রাখি আমার নিজের ওপর। এবং সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা আমার বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করেছে। এই যে দেখুন না, এতদিন বন্দি হয়ে কাটানোর পরেও আমি আপনাদের সাথে এখন চমৎকার খাবার উপভোগ করছি। ওদিকে ক্যাপ্টেন গোডিংস আর তার লোকেরা পুড়ে ছাই হয়ে সাগরের নিচে ডুবে গিয়েছে।”
টেবিলের চারপাশ থেকে এক ধরনের আক্ষেপ ধ্বনি শোনা যায়। যারা সবসময় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, শত্রুর আশেপাশে বাস করে তাদের আর্তনাদ যেন কেবিন জুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়। নেড টেইলর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হাল তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যে সে মুখ বন্ধ করে ফেলতে বাধ্য হয়।
“এরপর আর কোনো বাধা আসবে না, আমি আপনাকে নিশ্চিত করছি, মি পেট”, হাল বলে উঠে, “এখন দয়া করে, আপনি আপনার গল্প শেষ করুন।”
“অবশ্যই, ক্যাপ্টেন। তো যা বলছিলাম। ক্যাপ্টেন গোডিংস জাহাজে করে খনিজপদার্থ নিয়ে লন্ডনে ফিরছিল। মি স্ট্যানলি এরই মধ্যে লক্ষ করেছেন যে কাজটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আপনি নিশ্চয়ই আমাকে ভীরু ভাববেন না যদি আমি বলি যে আমি ইচ্ছে করে আর্ল অব কামব্ৰায় উঠিনি। আমার ইংল্যান্ডে ফেরা প্রয়োজন ছিল-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তাই এরপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। জাহাজে আগুন লেগে গিয়েছিল।”
সে তার চোখের দৃষ্টি টেবিলের চারদিকে বসা সবার দিকে একবার ঘুরিয়ে আনে। “আপনারা সবাই আমার মতো একজন নির্বোধ ব্যক্তির জন্য আফসোস করতে পারেন। কেননা আপনারা সবাই জানেন যে সমুদ্রে আগুন লাগা কতটা বিপজ্জনক ব্যাপার। যদিও গতকাল রাতে ক্যাপ্টেন কার্টনির গল্প এরকমই একটা ঘটনার মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। তবুও অন্তত আপনারা সেই অগ্নিকাণ্ডের কারণটা জানতেন যেটাতে বুজার্ড নামের সেই লোকটা মারা গিয়েছে। কিন্তু আমি এখনো জানি না যে আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এ কেন আগুন লেগেছিল। আমি শুধু বলতে পারি যে আমি ক্যাপ্টেন গোডিংস-এর সাথে তার কোয়াটারে এক মনোরম আলোচনায় মগ্ন ছিলাম। তখন আমরা সতর্কধ্বনি আর চিৎকার শুনতে পাই। এরপর একজন নাবিক চোখ বড় বড় করে আগুন আগুন বলে চিৎকার করতে করতে এসে বলে, “তাড়াতাড়ি আসুন ক্যাপ্টেন, জাহাজে আগুন লেগেছে।”
“তারপর সেই সাহসী ক্যাপ্টেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। প্রথমে আমিও তার পিছু পিছু ডেক পর্যন্ত যাই। মানুষজন এখান থেকে সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছিল। এদিকে অন্ধকারে আগুনের শিখা বেড়েই চলেছে। শিখা উঁচু হতে হতে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। প্রধান মাস্তুলের অনেক উপরে উঠে পড়েছে সেই ধোয়া।”
“তো, আপনি সেখান থেকে কীভাবে মুক্ত হলেন?” ট্রোম্প জিজ্ঞেস করে “আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি খুব একটা সাহসী নন।”
“কথাটা উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করছি আমি. পেট আপত্তি জানায়।
“তাহলে হয়তো আমি ভুল বুঝেছিলাম,” ট্রোম্প বলতে থাকে। আমি ভেবেছি আপনি খনিজ পদার্থ ভর্তি জাহাজে উঠতে চাননি কারণ আপনার সাহসের অভাব ছিল। সে টেবিলে বসা সবার দিকে তাকিয়ে সমর্থন লাভের আশায় বলে, “আমি কী ভুল বলেছি?”
ব্যাপারটা নিয়ে সবার মাঝেই একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে শুরু করে। হাল বুঝতে পারে এবার ব্যাপারটাতে তার মধ্যস্থতা করে দেয়া উচিত। “তুমি হয়ত পেট-এর কথাটা বুঝতে ভুল করেছে। সে আগেই বলে নিয়েছে যে আমরা যেন তাকে ভীরু না ভাবি। কিন্তু এটা সত্য যে খনিজপদার্থ ভর্তি একটা জাহাজে চড়া খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়, সেই সাথে অনেক বিপদজনকও বটে।” “আমি নিশ্চিত যে আমার ব্যাখ্যার পর কেউই মি. পেটকে আর কাপুরুষ ভাববেন না অথবা তার সেন্টিমেন্ট-এ আঘাত করবেন না।”
ট্রোম্প তার মুখে একটা অলস হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে, “উপস, আমি সম্ভবত আপনার ইংরেজি ভাষায় অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। এই অজ্ঞতার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। চিজহেড শব্দটা হয়ত বা আমার মতো ওলন্দাজ-এর জন্যই সঠিক।”
“আপনাকে ক্ষমা করব? পেট বলতে শুরু করে। এই ভুল বোঝাবুঝির জন্য আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু কোনো অপরাধ না করেও আমাকে যে বন্দি থাকতে হয়েছে…সেটা নিয়ে ক্ষমা পাওয়া অনেক দূরের ব্যাপার, অনেক দূরের।”
“আমি আপনাকে অনেক বার বলেছি কথাটা, এটা আমি আপনার নিজের জীবনের নিরাপত্তার জন্য করেছি।”
যথেষ্ট হয়েছে ভদ্রমহোদয়গণ। আমার টেবিলে আমি এ ধরনের তর্ক বিতর্ক হতে দেব না। মি. পেট আপনি দয়া করে আরেকটা তথ্য দিয়ে আপনার গল্প শেষ করুন।” “এত লোকের মাঝে আপনি একা কিভাবে আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড থেকে মুক্তি পেলেন?”
পেট কয়েক মুহূর্তের জন্য কিছুই বলল না। তার শীতল দৃষ্টি এখনো সে মি. ট্রোম্প-এর ওপর স্থির করে রেখেছে। এরপর স্বপ্ন দেখার পর মানুষ যেভাবে হঠাৎ বাস্তবে ফিরে আসে সেও সেভাবে চেতনা ফিরে পেয়ে বলতে শুরু করে। “আমি আগেই বলেছি যে আমি দুটো জিনিসের ওপর আস্থা রাখি : সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা এবং আমার পদক্ষেপ। আমি যদি নাবিকদের সাথে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতাম তাহলে হয়ত কোনো লাভই হতনা। যদি আমি তা করতাম তাহলে হয়ত আমার অবস্থাও তাদের মতো হত। এটা নিয়ে আমি উভয় সংকটের মধ্যে ছিলাম। আমার কী জাহাজে থাকা উচিত, তার সাথে সাথে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি নেয়া উচিত? নাকি আমি এই রাতের অন্ধকারে মাঝসমুদ্রে লাফ দিয়ে নিজেকে সম্ভাব্য মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিব?”
“এ সময় আমি সৃষ্টিকর্তার পথ প্রদর্শনের ওপর নির্ভর করতে থাকি। এবং আমাকে তিনি নিরাশা করেন নি। আমি তার উপস্থিতি বুঝতে পারি। তার কণ্ঠ আমার মাথায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। তিনি আমাকে সেখান থেকে নিজেকে মুক্ত করতে বলেন। আমিও সেই অনুযায়ী কাজ করি। কিন্তু সেটা করার জন্য আমাকে ক্যাপ্টেন-এর বিছানাটা ব্যবহার করতে হয়েছিল যেটা অনেকটা ক্যাপ্টেন কার্টনির বিছানার মতো দেখতে, তবে অনেকটা সরু।”
সবার মুখে একটা উজ্জ্বলতা ফুটে উঠে কেননা সবাই বুঝতে পারে কেন ক্যাপ্টেন কার্টনির বিছানাটা চওড়া, পেট ব্যাপারটার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ না করে আবার বলতে শুরু করে। “আমি জানতাম যে আমাকে কী করতে হবে। আমি প্রথমে জাহাজের জানালাটা চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলি। এরপর আমি বিছানাটা সাগরের বুকে ছুঁড়ে দেই এবং এর পরপরই আমি নিজে লাফ দেই। কারণ আমি সাঁতার কাটতে জানি না…”
সবার হাসির উজ্জ্বলতা একটা বিস্ময়ে রূপ নেয়। কিন্তু কীভাবে…?” বিগ ডেনিয়ে বলে।
“আমি জানি। আমি নিজেকেও একই প্রশ্ন করেছি। আমি কিভাবে সাগরের বুকে এই বিছানা খুঁজে পাব, সেই সাথে নিজের পথ করে নিব? সত্যি বলতে, আমার কোনো পূর্বধারণাই ছিল না…”
এইটুকু অন্তত নির্ভেজাল সত্য, পেট মনে মনে চিন্তা করল। এরপর আবার বলতে শুরু করে দিল। আমি যেটুকু বলতে পারি তা হচ্ছে, “লাফ দেয়ার পর আমি নিজেকে ভাসমান বিছানার ওপর দেখতে পাই। এর কিছু সময় পর উজ্জ্বল আলো দেখতে পাই আমি। এতটাই উজ্জ্বল যে মনে হচ্ছিল সূর্য থেকে সরাসরি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আমার চোখ প্রায় পুড়ে যাবার অবস্থা। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই খনিজপদার্থ বিস্ফোরণের তীব্র শব্দ পেয়েছিলাম। এত তীব্র যে আমার প্রায় বধির হয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়েছিল আরকি। কিন্তু সময় যত যেতে থাকে শব্দের তীব্রতা ততই কমতে থাকে। একসময় সব চুপচাপ হয়ে গেল। অদ্ভুত রকমের শান্ত, নীরবতা চারদিকটাকে ঘিরে ফেলে। জাহাজ এবং জাহাজের সমস্ত মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাদের কোনো চিহ্নই আর সাগরের বুকে থাকে না।”
পেট-এর এরূপ ভয়াবহ বর্ণনা শুনে টেবিলের চারপাশে বসা সবার মাঝেও ভয়াবহ নীরবতা নেমে আসে। এরপর পেট তার গল্পের উপসংহারে চলে আসে। “বাতাস আর তরঙ্গের স্রোতে ভাসতে থাকি আমি-ডেফট-এর লোকদের চোখে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত। তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কাছে আমি কৃতজ্ঞ।”
“আচ্ছা আমরা সবাই জানি যে এরপর কি ঘটেছিল।” হাল গল্পের সমাপ্তি টানতে চায় যেন আবার সবার মাঝে কোনোরকম তর্ক-বির্তক শুরু না হয়। “এখন আমরা সবাই এখান থেকে যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছি…।”
“এক্সকিউজ মি, ক্যাপ্টেন”, ট্রোম্প বাধা দেয়।
“বলুন?”
“আপনি আমাকে নিজের গল্প বলতে বলেছিলেন।”
“হা, কিন্তু সেটার জন্য আমাদেরকে আগামীকাল রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”
“আমার গল্প খুবই ছোট্ট, ক্যাপ্টেন।”
“ক্যাপ্টেন তাকে এখনই সুযোগ দিন”, নেড টেইলর বলে উঠে।
“যদি বেশি ছোট হয়, তাহলে আমরা নিজেরাই তার সাথে কিছু যোগ করে বড় করে নেব।” বিগ ডেনিয়েল বলল।
“যেহেতু ক্যাপ্টেন ট্রাম্প-এর গল্প খুবই ছোট তাহলে বরং আমরা এখনই তা শুনে ফেলি। সবাই মনে হচ্ছে এখনই শুনতে চাচ্ছে। শুরু করুন ট্রোম্প,” হাল ট্রোম্প-এর উদ্দেশ্যে বলে উঠল।
ট্রোম্প টেবিলের সবার দিকে একবার করে তাকায়। এরপর গলা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করে। “বাতাবিয়ায় একটা মেয়ের সাথে একটা ঘটনা ঘটেছিল। তার নাম ছিল ক্রিস্টিনা। সে ছিল এডমিরাল-এর কন্যা।”
টেবিলের অন্যান্যের মতোই হাল-এর কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছিল। বাউ-এর নাবিকেরা তাদের নিঃশ্বাসের সাথে নানা রকম আওয়াজ করেই চলছিল। জুডিথ যদিও সেদিকে কান দিচ্ছিল না কিন্তু তার ঠোঠে হাসি খেলা করছিল।
“বলতে থাকুন”, হাল বলল।
ট্রোম্প আবার বলতে থাকে, “আমার পুরনো ভালবাসার গল্প। আমরা কখনো নাচতাম, কখনো বা হাসতাম, পরক্ষণেই আবার ভালবাসায় মেতে উঠতাম…সে তার এক চোখের ভ্রু উঁচু করে বলল। এরপর সে একদিন আমাকে বলে যে তার গর্ভে আমার সন্তান আছে। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো সে এটা তার বাবাকেও বলে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম তার বাবা পাউডার ভর্তি শট ফিউজ-এর মতো ফেটে পড়বে। তিনি আমাকে জাহাজের একজন অফিসার হিসেবে পছন্দ করতেন। কিন্তু নিশ্চয়ই এমন একজন হিসেবে নয় যে তার মেয়ের গর্ভে বীজ বপন করবে।”
“তো, সে কি ওভাবেই ফেটে পড়েছিল?” হাল জিজ্ঞেস করে।
ট্রোম্প মাথা নাড়ায়। “না, তার চেয়েও খারাপ। তিনি বলেছিলেন যে আমাকে পরিবারের সদস্য হিসেবে মেনে নেয়ার কোনো ইচ্ছেই তার নেই। কিন্তু এখন তার হাতে অন্য কোনো উপায় নেই। আমাকে এক সপ্তাহের মধ্যে সেই মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।”
“তারপর আপনি পালিয়ে আসেন।”
“আমি ক্রিস্টিনাকে ভালবাসতাম না, আর ক্রিস্টিনাও আমাকে ভালবাসত না। আর তাই আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। প্রথমে আমি এডমিরাল-এর কাছে গেলাম। গিয়ে তাকে বললাম যে, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করব। কিন্তু সেটা সঠিক নিয়মে কোনো চার্চে গিয়ে। উৎসব হবে, খাওয়া-দাওয়া হবে। যেন লোকজন এটাকে সত্যিকার ভালবাসা মনে করে। আর এর জন্য অন্তত আমাদের দুটি সপ্তাহের প্রয়োজন হবে। সে প্রথমে রাজি হতে চাচ্ছিল না। কিন্তু পরে ভেবে দেখল যে আমার কথায় যুক্তি আছে। এটা তার এবং তার পরিবারের সম্মান বাঁচাবে।” এরপর আমি বাতাবিয়ার এক কারিগর-এর কাছে গিয়ে বললাম, “আমাকে এই নকশাগুলো বানিয়ে দিন। অন্তত প্রত্যেক রকমের ছয়টা করে। তারপর দশ দিনের মধ্যে আমি যে জাহাজে চাকরি করতাম সেখানে গেলাম। সেখানকার সব নাবিককেই আমি চিনতাম। তাদেরকে বললাম যে আমার একটা পরিকল্পনা আছে। আমার সাথে কাজ কর তাহলে ধনী হয়ে যেতে পারবে।”
“তারা তোমার কথা বিশ্বাস করল”, হাল বিস্ময়াবিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“ওহ, তারা সেটাই বিশ্বাস করে যেটা তারা চায়। তারা সবাই ইস্ট ইন্ডিস-এ পচে গলে মরতে চাচ্ছিল না। তারা সবাই বাড়ি ফিরতে চাচ্ছিল। আমি তাদেরকে বলেছি যে আমি তোমাদেরকে হল্যান্ড-এ ফিরিয়ে নিয়ে যাব। অনেক সোনাদানা টাকা-পয়সা এবং মেয়ে মানুষ তোমাদের হাতে থাকবে।”
ট্রোম্প এমনভাবে কথা বলছিল যেন সবকিছু তার চোখের সামনে ভাসছে। হাল ধারণা করার চেষ্টা করছিল সেই নাবিকের দল কী পরিমাণ অশিক্ষিত ও মূর্খ ছিল, যাদেরকে ধনী করার আশ্বাস দিয়ে এভাবে ভোলানো সম্ভব।
“তারা সবাই কী ডেফট-এর নাবিক ছিল?” হাল জিজ্ঞেস করে।
“অবশ্যই”, ট্রোম্প উত্তর দেয়। “তো সেই দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল। আমার দুশ্চিন্তা বেড়েই চলল। আমি মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম নেটিভটা যদি সময়মত ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ-এর প্রতিলিপিগুলো তৈরি করতে না পারে তাহলে আমি এখানে ক্রিস্টিনা ও তার বাবার কাছে ধরা পড়ে যাব। কিন্তু বিয়ের দুইদিন পূর্বে সেগুলো প্রস্তুত হয়ে যায়। আমি সেগুলো বক্সে ভরে জাহাজে উঠানোর জন্য প্রস্তুত করে রাখি। ডেট আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। জাহাজে উঠার পর যখন জাহাজ ছেড়ে দেয় তখন আমরা মুক্ত, ট্রোম্প টেবিলের চারদিকে সবার দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে। সবাই একটু একটু করে ঝুঁকে বসে যাতে তারা গল্পের প্রতি আরও বেশি করে মনোযোগ দিতে পারে। “ডেট একটা বিশেষ ধরনের জাহাজ ছিল। ওটা নেভী জাহাজও ছিল না আবার ইস্ট ইন্ডিয়ার জাহাজও ছিল না। সেটা ছিল এডমিরাল-এর জাহাজ, ত্রিস্টিনার বাবার অত্যন্ত পছন্দের জাহাজ।”
ট্রোম্প সবার মনে যে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল সেটা হাসিতে রূপ নেয়। টেবিলের চারদিক থেকে অট্টহাসির আওয়াজ শোনা যায়। “আমি তোমাকে স্যালুট করলাম, ক্যাপ্টেন,” অ্যাবোলি তার কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে থাকে। “তুমি প্রথমে তার কন্যাকে হাত করলে। তার কুমারিত্ব নষ্ট করলে। এরপর তুমি…”
“আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই,” ট্রোম্প বলতে শুরু করে, “কেননা প্রথম দিকে সে যে ধরনের আচরণ করছিল তাতে আমার মনে হয়নি সে কুমারী।”
“তুমি তার পেটে তোমার বীজ বপন করেছ, এরপর তাকে অসম্মান করেছে তার মা-বাবা এবং তার সমগ্র জাতির সামনে। তারপর তুমি পালিয়ে এসেছ তার বাবার জাহাজ নিয়ে। তোমার তো মরে যাওয়া উচিত ছিল। যদি তুমি এটা আমাদের উপজাতির প্রধান মনোমাতাপার সাথে করতে তবে সে তোমার পেছনে তার সবচেয়ে শক্তিশালী যোদ্ধাকে পাঠাত। তারা তোমাকে খুঁজে বের করে হত্যা করত এবং…” অ্যাবোলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। “তারা তোমাকে আস্তে আস্তে মৃত্যু যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করত-যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার প্রাণবায়ু বের হয়ে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত।”
“বিশ্বাস করুন, ক্যাপ্টেন ট্রাম্প বলল। “ক্রিস্টিনার বাবাও ঠিক এমনটাই ভেবেছিল। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি তিনি বাতাবিয়ার প্রত্যেকটা জাহাজকে বলেছেন আমাকে খুঁজে বের করার জন্য। তিনি আমার মাথার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন। তাই এখন এটা আপনাদের বিবেচনার বিষয় ক্যাপ্টেন। যদি আপনি আমাদেরকে ওলন্দাজদের হাতে সমর্পণ করেন তবে মৃত্যু অনিবার্য। এদিকে আপনাদের জাহাজ বেশ কয়েক মাস যাবত যুদ্ধ করেছে। আপনারা অনেক মানুষ হারিয়েছেন। যে কারণে আপনারা জাহাজটা চালিয়ে নিতে পারছেন তা হলো আপনারা আফ্রিকান যোদ্ধাদেরকে নাবিক হিসেবে নিয়েছেন। কিন্তু তারা এখানকার অধিবাসী। আপনারা শিঘ্রই কেপ এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। এরপরই রয়েছে আটলান্টিক। সেখান থেকে আপনারা ইংল্যান্ড এবং হল্যান্ড-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন হয়তো বা। “আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে বলব, আপনারা নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরতে চান ক্যাপ্টেন কার্টনি। আপনার নিশ্চয়ই এমন নাবিক প্রয়োজন যে কি-না উত্তরের ঠাণ্ডা পানি সম্পর্কে জানে। সেক্ষেত্রে আপনারা আমাকে এবং আমার নাবিকদের নিতে পারেন…যদি আপনারা আমাদেরকে নেন তাহলে আমরা আপনাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দেব।”
*
পেট সেই কণ্ঠ শুনতে পায়। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ওগুলো। সকখনো কখনো তারা একত্রে কথা বলে উঠে। আবার কখনো কত পার্লামেন্ট-এর মতো একের পর এক কথা বলতে থাকে। এসব কণ্ঠের চেয়েও তার মনে যে তীব্র বাসনা কাজ করছে তা হল কাউকে খুন করার বাসনা। যদিও দৈববাণীর উপস্থিতি এটার একটা অংশ। না, এর চেয়ে বেশি কিছু তার অনুভব করার প্রয়োজন নেই। এটা তার রক্তে মিশে আছে। তার হাড়ে গেঁথে আছে।
সে জানে না যে ঠিক কোন জিনিসটা তার মধ্যে এই অনুভূতি নিয়ে আসে। কিন্তু এটা তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে। “এত শীঘ্রই কেন?” সে নিজেকে প্রশ্ন করে। কিন্তু কোনো উত্তর পায় না শুধু মেনে নেয়া ছাড়া।
মাত্র কিছুদিন আগে ডেট-এ সে তার সাথে থাকা বন্দি লোকটাকে শ্বাসরোধ করে মেরেছে। এ ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ পূর্বে গোডিংস তার হাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। আস্তে আস্তে ঘটনাগুলোর মধ্যবর্তী সময় কমে যাচ্ছে। সে যতই হত্যা করছে প্রতিটা মৃত্যু নিয়েই ততই অতৃপ্তি তার মধ্যে কাজ করছে। এখন আবার তার সেই ইচ্ছাশক্তি, তার মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা স্পৃহা, তাকে সেই ঘটনা ঘটানোর দিকে ধাবিত করছে। সেটা এতই তীব্র যে একসাথে দুটি খুন করারও হয়তো প্রয়োজন পড়তে পারে। কেবল তাহলেই হয়ত সেটা কিছুদিন লুকিয়ে থাকবে। তার সেই শিকার দুটি তার কেবিন থেকে অল্প কিছু দূরে পাশাপাশি শুয়ে আছে। ক্যাপ্টেন কার্টনি আর নাজেতকে একত্রে হত্যা করা অবশ্যই একটা বড় ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যাবে। প্রথমত, তারা দুজনেই খুব ভাল যোদ্ধা। নিজদেরকে রক্ষা করার ক্ষমতা আছে তাদের। এছাড়াও, তাদের তলোয়ার চালানোর দক্ষতা হয়ত পেট-এর দক্ষতাকে ছাড়িয়ে যাবে। এরপর আসে আরেকটা ব্যাপার। ক্যাপ্টেন গোডিংস কিন্তু আগুনে পুড়ে মারা যায় নি। মারা গিয়েছিল তারই ছুরির আঘাতে। সেই ছুরির ব্যবস্থা তাকে সেই জাহাজের লোকদের কাছ থেকেই করতে হয়েছিল। এই ক্যাপ্টেন এবং তার লেডি জাহাজের নাবিকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাই সেই ব্যবস্থা করা এখানে খুব একটা সহজ হবে না।
অবশ্য পেটকে এসব ভাবলে চলবে না। তাকে যেভাবেই হোক এই কাজ করতে হবে। সেই দৈব বাণী যদিও এখন পর্যন্ত তার মস্তিষ্কে যে আওয়াজগুলো তুলছে সেগুলো বেশ অস্পষ্ট, কিন্তু সে জানে যে এটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই গভীর ইচ্ছাটা সে কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারে না। আর এই কাজ করা যে সম্ভব, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। সে এই কাজ সম্পন্ন করবে নীরবে এবং অত্যন্ত দ্রুততার সাথে। সে ভাবছে যে গতবারের মতো একইরকমভাবে ক্যাপ্টেন-এর বিছানাটাকে সাগরের বুকে নিজের অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করবে। গত কয়েকদিন ধরে সে আফ্রিকার উপকূল প্রত্যক্ষ করেছে। সে নিশ্চিত যে সে খুব সহজেই সেখানে পৌঁছাতে পারবে। ওটায় চড়ে ভাসতে ভাসতে সাগরের এক পাশে চলে যাবে। ক্যাপ্টেন কার্টনির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পূর্বেই উপকূলে পৌঁছে যাবে সে।
কিন্তু একজন নারীকে হত্যা করাটা…এ ব্যাপারে সে একটু দুশ্চিন্তায় রয়েছে কারণ সে এর আগে কখনোই এই কাজ করেনি। সে নিজেকে একজন সভ্য মানুষ হিসেবে দাবি করে, এ নিয়ে গর্বও করে। পেট-এর মতে নারী জাতি অত্যন্ত কোমল এবং নমনীয় তাই তাদেরকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে মানায় না। সাথে-সাথে একটা কণ্ঠ তার সাথে তর্কে লিপ্ত হলো। “এই নারী মোটেও কোমল এবং নমনীয় নয়। সে তার নিজের ইচ্ছায় যুদ্ধে গিয়েছে। সে পুরুষের পাশাপাশি কুচকাওয়াজ-এ অংশ নিয়েছে, যুদ্ধ করেছে। যদি সে এগুলো করতে পারে তবে তার সাথে খেলা ভালই জামবে।”
মেয়েটা হয়ত ভাবছে যে সে তার ঈশ্বরের ইচ্ছায় তার দেশ, তার পবিত্র ভূমির জন্য লড়াই করতে এসেছে। কিন্তু পেট যেটা করছে সেটাও তার কাছে পবিত্র কাজ। আরও অনেকে আছে যারা মানুষ হত্যা করে। সে জানে এটা। কিন্তু তারা কেউই কাজটা তার মতো ভালভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। সে তার কাজ নিয়ে গর্ববোধ করে। যখন অন্যান্য বাচ্চা পিন হেড বা অন্যকিছু নিয়ে খেলা করত সে তখন তলোয়ার চালনা বা স্টীল-এর স্লিং নিয়ে খেলা করত। ঐ বয়সে বিভিন্ন বিষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে খেলা করত সে। দক্ষ হাতে কিভাবে বিভিন্নভাবে মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া যায় সেটা নিয়ে পড়াশোনা করত। ক্যাপ্টেন কাটনি আর জেনারেল নাজেত-এর জীবন কেড়ে নেয়া হচ্ছে তার কাছে অন্যরকম একটা পরীক্ষা।
এবং এখনও পর্যন্ত পেট কোনোটাতেই অকতকার্য হয়নি। এ কাজের জন্য সে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে মার্লিনস্পাইক নামক লম্বা স্টীলের পাত-এর মতো একটা জিনিস যেটা জাহাজের নাবিকেরা রশি বাঁধতে ব্যবহার করে। গোল্ডেন বাউ-এ আসার পরপরই সে এটা চুরি করেছে। প্রতিনিয়ত সে এটায় শান দেয়- যখনই সে একা থাকে। এটাকে এতটাই ধারালো করতে হবে যেন এটা খুব সহজেই মানুষের চামড়া এবং পেশি ভেদ করে কোনো অঙ্গের ভেতর ঢুকে যায়।
পেট এটাকে তার জামার ডান হাতার নিচে লুকিয়ে রাখে। এমনভাবে রাখে যেন একেবারে বাহুর সাথে লেগে থাকে। এছাড়া তার কাছে আরেকটা ছোট্ট অস্ত্র আছে-জাহাজের পেরেক, যেটা সে তার দুই ঠোঁটের মাঝে রেখে দিতে পারে। সে এখনই ক্যাপ্টেন-এর কোয়ার্টার-এর দিকে এগুতে চাচ্ছে না। ধীরে-সুস্থে ভেবে-চিন্তে তারপর এগুতে চায় সে। আগে জেনে নিতে চায় যে জাহাজের ওপর এমন কিছু বা এমন কেউ আছে কি-না যে তার কাজের জন্য হুমকিস্বরূপ।
তারা ভরা রাতে পেট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের কাজের পরিকল্পনা করছে। জ্যোৎস্না রাতের মৃদু আলোতে সে যখন কোয়ার্টার ডেক-এ দাঁড়িয়ে ছিল তখন একটু দূর থেকে ফিসফিস করে কথা বলা কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পায় সে। পেট সাথে-সাথেই চিনতে পারে-এটা অ্যাবোলি নামে সেই আফ্রিকান লোকটার কণ্ঠ। প্রধান মাস্তুলের নিচে দাঁড়িয়ে আফ্রিকান লোকটা অন্যান্য অ্যামাডোডা সৈন্যদের গল্প বলছে। দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো কথা বলা সিংহ সম্পর্কে গল্প করছে। বাহুদুটো ছড়িয়ে দিয়ে হাত দুটোকে থাবার মতো করে রেখেছে লোকটা।
এমন সময় সে কারও এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পায়। তার পেশি শক্ত হয়ে যায়। নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যায় সে। কেউ একজন এগিয়ে আসছে। সম্ভবত উইল স্ট্যানলি তার রাতের ভ্রমণ শেষ করছে। পেট কোয়ার্টার ডেক এর মই-এর পেছনে লুকিয়ে পড়ে। ভয়ে জমতে থাকে ও। সে চায় না স্ট্যানলি এখন তাকে জিজ্ঞেস করুক যে এই মধ্যরাতে সে এখানে কি করছে।
স্ট্যানলি তাকে লক্ষ না করে রেলিং-এর দিকে এগিয়ে যায়। পেছন দিকে হাত দুটো রেখে সে কিছুক্ষণ সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক কদম এগিয়ে গেলেই পেট তার কাছে চলে যেতে পারে। তার লম্বা স্পাইকটা লোকটার কিডনির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে মৃতদেহটা তার নিজের কেবিনে লুকিয়ে রাখতে পারে।
কিন্তু কোনোভাবে যদি স্ট্যানলি হাত থেকে ফসকে যায় আর সবাই সজাগ হয়ে উঠে, তবে কী হবে? তখন সে কার্টনি আর জুডিথকেও হত্যা করতে পারবে না।
স্ট্যানলি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে জাহাজের সম্মুখভাগের দিকে তাকায়। তার কপাল কুঁচকানো বিস্ময় ভাবটা অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পেট জানে না যে স্ট্যানলি আসলে কী দেখেছে বা কী দেখতে পায় নি। তার চেয়ে বড় ব্যাপার স্ট্যানলি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। একটু পর ডেক-এর নিচে নেমে গেল সে। পুরোটা সময় পেট তার নিঃশ্বাস আটকে রেখেছিল।
“এখনই সময়…” সেই সিদ্ধপুরুষ কণ্ঠটির প্রতিধ্বনি পেট অবশেষে শুনতে পায়। তার পথপ্রদর্শক এবং তার রক্ষাকর্তা তার সাথেই আছে। তাই সবকিছুই ভাল ভাবে সম্পন্ন হবে।
সিঁড়ির পেছন থেকে বেরিয়ে আসে উইলিয়াম পেট, এরপর আস্তে আস্তে ক্যাপ্টেন কার্টনির কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। ডান বাহু উঁচু করে ধরে লম্বা পাতের মতো অস্ত্রটা তার জামার হাতার নিচে রেখে দেয় পেট। এরপর আঙুল দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝ থেকে মোটা পিনটা বের করে আনে, তারপর সেটাকে আস্তে আস্তে তালার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। খুট শব্দ করে তালা খুলে যায়।
সাথে-সাথে তার মনে একটা ভাবনার উদয় হয়। যখন ডেফট-এর নাবিকরা তাকে সাগর থেকে টেনে তুলেছিল তখন থেকেই কি তার রাস্তা পরিষ্কার ছিল না? আর যুবক কার্টনি কী সবার জন্য ভুরিভোজ-এর আয়োজন করেনি?
“তুমি কী মনে কর যে আমরা সবকিছু করি শুধু তোমার জন্যই?” কণ্ঠটি জিজ্ঞেস করল।
এরপর পেট খুবই ধীরে ধীরে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা ভেতরের দিকে খুলে ফেলল। ভুল ক্রমেও সে হাতল ধরে ধাক্কা দিল না। কারণ কোনরকম শব্দে যদি কার্টনির ঘুম ভেঙ্গে যায় তাহলেই সব নিঃশেষ হয়ে যাবে।
ভেতরে ঢুকে সে দেখতে পায় কার্টনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়ে সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে। কোনো সন্দেহ নেই যে ক্যাপ্টেন কার্টনিও তার বাবার মতোই লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প। তার স্ত্রী তার পাশেই ঘুমিয়ে আছে। তার মুখ কার্টনির গলার বিপরীতে রাখা আছে। তার গায়ে থাকা সাদা রঙের পোশাক তার পা এবং বাহুতে একটা রঙের শেড তৈরি করেছে। পেট কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, তারপর আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে যায়।
তার পায়ের নিচ থেকে কাঠের মড়মড় আওয়াজ হয়। সাথে-সাথে সে ঝুঁকে পড়ে স্থির হয়ে যায়।
জুডিথ নড়াচড়া করে উঠে, এরপর আরাম করে শোয়। কিন্তু সে জেগে উঠে না। এরকম পরিস্থিতিতে কোনো অনভিজ্ঞ লোক হয়ত দুশ্চিন্তায় পড়ে যেত। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে যেত। কিন্তু পেট-এর শ্বাসপ্রশ্বাস এখনো স্বাভাবিক আছে। বিছানার চারদিকে ঘুরতে-ঘুরতে কার্টনির মাথার পাশে এসে দাঁড়ায় পেট। কার্টনি তখন চিৎ হয়ে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে শুয়ে ছিল।
পেট তার পেটের পেশি শিথিল করে নিঃশব্দে একটা গাঢ় শ্বাস নেয়। যেন রক্তে অক্সিজেন ঢুকিয়ে পরিপূর্ণ শক্তি পায়। সেইসাথে কাউকে খুন করার আগে যে দুশ্চিন্তা আসে সেটা দূর করার চেষ্টা করে।
কার্টনির শ্বাস-প্রশ্বাস আরও গম্ভীর হতে থাকে। এদিকে পেট তার জামার হাতার নিচ থেকে স্টীলের মারলিনস্পাইকটা বের করে। সেটাকে শক্ত করে ডান হাত দিয়ে ধরে আঘাত করার জন্য হাতটা পেছনে নেয়। যদিও মারলিনস্পাইকটা আঘাত করার জন্য বেশ উপযুক্ত কিন্তু এর তীক্ষ্ণতা কাউকে কাটার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই পেটকে যথেষ্ট শক্তি দিয়ে কাজটা করতে হবে। বিছানার ওপর ঝুঁকে পড়ে বাম হাত দিয়ে কার্টনির মুখ বন্ধ করে ডান হাত দিয়ে খুঁতনির হাড়ের নিচে তীব্রভাবে আঘাত করতে হবে। কানের একটু নিচ দিয়ে যেন সরাসরি ক্যারোটিও আর্টারিকে ভেদ করে চলে যায় পাইকটা। তখন হয়ত তার শরীর, বিছানার চাদর, এমনকি পেট-এর শরীরও রক্তে ভেসে যাবে। তার পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটিও হয়ত রাতে দুঃস্বপ্ন দেখার মতো করে ভয়ে জেগে উঠবে। তখন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তাকেও একের পর এক আঘাত করতে হবে যেন সে চিৎকার করার সময়ও না পায়।
ঠিক তখনই এক চিলতে চাঁদের আলো কেবিন-এর ভেতরে প্রবেশ করল। পেট জাহাজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। একটা মেঘ খণ্ড হয়ে দুদিকে সরে গিয়ে কিছু তারাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে, রুপালি চাঁদের আলো ক্যাপ্টেন এর কোয়ার্টার-এ প্রবেশ করেছে যার প্রভাবে পেট-এর শিরায় প্রবাহিত রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তখনই পেট কার্টনির বিছানার পাশে টেবিলের ওপর সোনালি কভার-এ মোড়ানো একটা বাইবেল দেখতে পায়।
আর সাথে-সাথেই পেট-এর মনে একধরনের তছনছ শুরু হয়। সেই সাথে তার মন ভেসে যায় সেই সময়ে যখন সে জ্বলন্ত আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড থেকে সাগরে লাফ দিয়েছিল। এটা কী সেই দৈববাণী থেকে কোনোরকম ইঙ্গিত? এভাবেই কী ঈশ্বর হেনরি কার্টনিকে ছেড়ে দেয়ার কোনো ইশারা করছেন? অবশ্যই না। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো সেই দৈব কণ্ঠ এখনো পর্যন্ত চুপচাপ রয়েছে। সাধারণত এই সময়ে তার পরিষ্কার কণ্ঠ শোনা যায়।
পেট দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, এরপর পা দিয়ে মেঝেতে মৃদু আঘাত করতে থাকে। একটু একটু করে ঘামতে থাকে সে। কপাল চুঁইয়ে সেই ঘামের পানি পড়তে থাকে মেঝেতে।
“কিছু একটা ইঙ্গিত করুন, যাতে আমি বুঝতে পারি যে আপনি কার্টনির হত্যার ব্যাপারে সায় দিচ্ছেন,” পেট মনে মনে বলে উঠল।
মেঘ খণ্ড দুটো আবারও জোড়া লেগে গিয়ে হাল-এর কেবিনকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিল। কিন্তু পেট যা দেখেছে তা এখনো ভুলতে পারছে না। এরকম মুহূর্তে খ্রিস্টের ক্রস যেভাবে আলোকিত হয়ে উঠেছে সেটা যে কোনো স্বর্গীয় ইঙ্গিত ছিল, সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কী কাউকে হত্যা করার জন্য নাকি কাউকে বাঁচানোর জন্য?
কিন্তু সে খুবই কাছাকাছি চলে এসেছে। যেকোনো মুহূর্তে কাজটা করে ফেলা সম্ভব। মাংস ভেদ করে দুটো তীক্ষ্ণ আঘাত করতে পারলেই তার কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু তার কাছে কিছু একটা ভুল মনে হচ্ছে। জীবনে সে বহুবার খুন করেছে। কিন্তু এই প্রথমবার তার মনে এমন সন্দেহ হচ্ছে। যদি ঈশ্বরের এমন কোনো ইচ্ছে থাকে যে তিনি এই লোকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাচ্ছেন, তবে তাকে অবশ্যই থামতে হবে। কিন্তু সে যদি এখন খুন না করে তবে তার মনে কতটা গোলমাল দেখা দিবে কে জানে!
আস্তে আস্তে পেট তার মনকে শান্ত করতে থাকে। সে তার স্টিলের পাতটা আবারও জামার হাতার নিচে রেখে দেয়, এরপর প্রেমিক যুগলের বিছানার কাছ থেকে আস্তে আস্তে সরে আসে। সে প্রায় দরজার কাছাকাছি চলে এসেছে। দরজা খুলে এখনই বের হয়ে আসবে।
দরজার বাইরে পা রাখার ঠিক আগ মুহূর্তে কাঠের মেঝেতে একটা শব্দ করে ফেলে সে। আওয়াজটা খুব একটা জোরে হয়নি। কিন্তু হালকে জাগিয়ে ভোলার জন্য ঐ শব্দটুকুই যথেষ্ট ছিল। সে দ্রুত বিছানায় উঠে বসে, এরপর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে সামনে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে। এরপর ভয়ের পরিবর্তে ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে। “পেট? আপনি এত রাতে আমার কেবিনে কী করছেন?”
এরপর জুডিথও আস্তে আস্তে জেগে উঠে, তারপর মৃদুস্বরে বলতে থাকে, “তোমার কী হয়েছে হেনরি?”।
জুডিথ-এর উপস্থিতির কথা মনে পড়ায় কার্টনি রাগে ফেটে পড়ে। “আপনার এত বড় সাহস? এই মধ্যরাতে আপনি আমার কেবিনে প্রবেশ করেছেন যেখানে একজন নারী উপস্থিত আছে এই কেবিনে? ব্যাখ্যা করুন কেন করলেন এটা?”
পেট একেবারে হতভম্ব হয়ে যায়। জীবনে এই প্রথমবারের মতো তার উপস্থিত বুদ্ধি ব্যর্থ হয়। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। তখনই দৈব বাণীটি তাকে বলতে থাকে, “ট্রোম্প, ট্রোম্প-এর কথা ভাব।”
পেট যেন হঠাৎ করেই তার জ্ঞান ফিরে পায়। “এই অনধিকার প্রবেশের জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন ক্যাপ্টেন। আমি এখানে এসেছিলাম…কারণ… কারণ আমি কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলাম না। আমার মাথায় একটা জিনিস ঘুরপাক খাচ্ছিল যেটা আপনাকে বলা খুবই প্রয়োজন ছিল। জাহাজের অন্যান্য সদস্যদের আড়ালে।”
“তাই বলে এই মধ্যরাতে? আপনি কী পাগল নাকি?” কার্টনি তার দিকে তাকিয়ে ক্রু কুঁচকে বলল, “আপনি নিশ্চয়ই অতিরিক্ত মদ্যপান করেন নি, তাই না?”
“না, ক্যাপ্টেন, এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। আমার কাজের সাথে মদ্যপান ব্যাপারটা যায় না। এটা শুধু…পেট তার চেহারায় এমন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে যেন সে তীব্র যন্ত্রণায় রয়েছে। …আমার মনের মধ্যে অসহ্যকর যন্ত্রণা কাজ করছে। আমি… আমাকে খুব তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে অপবাদের বোঝা মাথায় নিতে হয়েছে। স্যার! যেটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।”
“কী অপবাদ দেয়া হয়েছে?”
“সেই ওলন্দাজ ক্যাপ্টেন, ট্রোম্প। ওহ, আমি জানি যে সে সবার সামনে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য আমার কথার অর্থ ভুল বোঝার ভান করেছে এবং ইচ্ছেকৃতভাবে আমার সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু এই লোকটাকে আমি চিনি। তার দক্ষতা এবং প্রকৃতি সম্পর্কে জানি। এরকম একজন লোকের কথা কিভাবে বিশ্বাস করা যায় যে কিনা ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ তৈরি করার আদেশ দেয়।”
কার্টনি এবং জুডিথ দুজনেই চুপচাপ শুনতে থাকে। এতে পেট-এর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায় এবং সে বলতে থাকে। “কাউকে তার সমকক্ষ সভাসদ-এর সামনে কাপুরুষ বলাটা এক ধরনের অপরাধ। সেই সাথে এই লোকটি আমাকে সাধারণ অপরাধীর মতো কি অবস্থায় বন্দি করে রেখেছিল তা আপনি নিজের চোখে দেখেছেন। আপনি দেখছেন যে একজন মৃত ব্যক্তির সঙ্গে আমাকে থাকতে হয়েছে। একজন ভদ্রলোক সেটা কিভাবে এতবড় অসম্মান মেনে নিতে পারে।”
কার্টনি তার চোখ থেকে ঘুমটুকু মুছে ফেলে বলল, “আপনি যথেষ্ট ভাল যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন মি. পেট।”
“আমি স্বীকার করছি আপনার খারাপ লাগার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এসব কারণে কেন আপনাকে এই মাঝরাতে আমার কেবিনে প্রবেশ করতে হবে?”
“কারণ হচ্ছে স্যার, আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করতে এসেছি যেটা অন্যান্য নাবিক বা বন্দিদের সামনে করা যেত না। যে করেই হোক আপনি ক্যাপ্টেন ট্রোম্প-এর সাথে মুষ্টিযুদ্ধ লড়াই-এর ব্যবস্থা করে দিবেন। আমি তার সাথে এই প্রতিযোগিতায় নামতে চাই।”
“মুষ্টিযুদ্ধ।” কার্টনি বিস্ময়াবিভূত হয়ে বলল।
“মি পেট, আপনি ঠিক আছেন তো?” জুডিথ জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, ম্যাডাম অবশ্যই। আমি কোনোভাবেই আমার এ ইচ্ছে থেকে এদিক সেদিক হব না। আমার সম্মান কোনোভাবেই এটা মেনে নিবে না।”
“কিন্তু মি. পেট”, কার্টনি বলতে থাকে। “আমি আপনাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে বলছি যে আপনি কোনো মিলিটারি নন,..এরপর হাল কয়েক সেকেন্ড থেমে পেটকে তার কথাটা ভেবে দেখার সময় দেয়। তাই নয় কী মি. পেট?”
“না, স্যার, আমি একজন ব্যবসায়ী।”
“তাহলে আপনি জিনিস কেনা-বেচা বা হিসেব-নিকেশ এসব ক্ষেত্রে বেশ দক্ষ। কিন্তু ক্যাপ্টেন ট্রাম্প একজন নেভাল অফিসার। সে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে অভ্যস্ত। তার কথার নৈতিকতা যাই থাকুক না কেন আমি বুঝতে পারছি তার আচরণ আপনার সম্মানে লেগেছে। কিন্তু প্রতিপক্ষ হিসেবে আমি তার যুদ্ধ দেখেছি। মি. পেট আমি যদি আপনার এই অনুরোধ মেনে নিই তবে এটা অবশ্যই আপনার মৃত্যুকে মেনে নেয়ার সমান হবে।”
“সেটা অবশ্যই একটা যুক্তিযুক্ত আশঙ্কা ক্যাপ্টেন। কিন্তু আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে আমার ব্যাপার নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। এক্ষেত্রে আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে যে ঈশ্বর আমার পাশে আছেন।”
“আমি সেরকম সৈন্যবাহিনীকেও পরাজিত করেছি যারা শুধু ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস করে বিজয় ছিনিয়ে নিতে এসেছিল মি পেট,” জুডিথ বলে উঠল। সে এক রহস্যময় পথে হাঁটছে। আমরা জানি না সে আমাদের জন্য কি পরিকল্পনা করে রেখেছে। “আমি বলছি না যে আপনার দৃঢ় বিশ্বাস-এর ওপর আমি সন্দেহ পোষণ করছি। আমি শুধু আপনাকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।”
“ধন্যবাদ,” ম্যাডাম। কিন্তু তার আগে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করছি। যখন আপনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে যান এবং কোনো তীর্থস্থান বা পবিত্রস্থান-এর জন্য যুদ্ধ করেন তখন আপনার মনে হয়না যে অদৃশ্য স্বর্গীয় সৈন্যরা আপনার পাশে আপনার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করছে?”
“হ্যাঁ, তা মনে হয়।” জুডিথ বলল।
“এবং সেটা নিশ্চয়ই আপনার বিজিত হওয়ার দৃঢ়বিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়?”
“হ্যা!”
“তাহলে সেক্ষেত্রে যদি আপনার বিশ্বাস থাকে তবে আমার বিশ্বাস নিয়ে আমাকে থাকতে দিন। যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা হয় আমার অকাল মৃত্যু তবে আমি সেটাই মেনে নিব। কিন্তু নিজের নামের শেষে কাপুরুষ শব্দ নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই আমার কাছে শ্রেয়। আমি যদিও ব্যবসায়ী তবুও আমি একজন মানুষ। প্রয়োজনমতো যে কোনো সময় আমিও যুদ্ধ করতে পারি।”
“ভাল বলেছেন, মি. পেট”, হাল বলল।
“আমার প্রার্থনা থাকবে আপনার বা ক্যাপ্টেন ট্রোম্প কারও ক্ষতি না হয়ে ব্যাপারটা মীমাংসা হয়ে থাকে। অনেক মুষ্টিযুদ্ধ দেখেছি সেটাতে দুপক্ষের কারোরই রক্ত না ঝরে ব্যাপারটা মীমাংসা হয়ে যায়। আমি আশা করব এটাও সেরকমই কিছু একটা হবে। আমি এখনও প্রত্যাশা করছি ব্যাপারটা অন্যকোনো উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা হয়ে যাক। তবে সেটা যদি সম্ভব না হয় তবে অবশ্যই আপনি মুষ্টিযুদ্ধ করতে পারবেন।”
“তুমি কী নিশ্চিত, মাই লাভ? আমাদের তাহলে আরও ক্ষতি, আরও মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হবে হবে।”
“আমার সেটা মনে হয় না, মাই লাভ। এটা হচ্ছে সম্মানের ব্যাপার। আর সম্মানের ব্যাপার নিয়ে অবশ্যই পরিতপ্ত থাকা উচিত।”
পেট দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল যে এই রমণী হয়ত তার ব্যাপারটা মেনে নিবে না। কিন্তু সে তার যুক্তিগুলো দেখানোর পর আর কোনো তর্ক করেনি। সে সেই নারী যে কিনা হাজার হাজার পুরুষকে আদেশ করে অথচ এই পুরুষের কথা এক কথায় মেনে নেয়। পেট মনে মনে হাল-এর প্রশংসা করতে লাগল। সেই সাথে সে অদৃশ্য সিদ্ধপুরুষকে কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগল। কারণ তার কারণেই সে এবারের মতো রেহাই পেয়েছে। এর চাইতে ভাল কোনো উপায় বের করা সম্ভব হত না। সবশেষে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন।”
*
পেটকে মুষ্টিযুদ্ধের আশ্বাস দেয়ার পর বার ঘণ্টার মতো পার হয়ে = গিয়েছে। হাল আর চাচ্ছে না ব্যাপারটাকে অমীমাংসিতভাবে ঝুলিয়ে রাখতে। তাই সকালের সূর্য উঠার সাথে সাথেই ওটার আয়োজন করা হয়েছে। দুজন মানুষ বিশ গজ দূরত্বে জাহাজের ডেক-এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। পেট তার পেছন দিকটা জানালার দিকে দিয়ে রেখেছে, আর ক্যাপ্টেন ট্রোম্প ঠিক তার বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিকেরা সবাই চারপাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে উৎসাহ নিয়ে। আটজন ওলন্দাজ বন্দিকে উপরে উঠিয়ে আনা হয়েছে দেখার জন্য। এছাড়াও যে সব নাবিককে বাউ জাহাজটি নোঙর করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারাও। দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে আজকের আয়োজন দেখার জন্য। অ্যামাডোডা সৈন্যরা যারা সবসময় জাহাজটার ওপর নজরদারি করে বেড়ায় তারাও আনন্দে উল্লাসধ্বনি করছে।
“তুমি চাইলে এখনও এটা বন্ধ করতে পার।” জুডিথ হালকে উদ্দেশ্য করে বলে। সে হাল-এর পেছনে জাহাজের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তারা দুজনেই আয়োজনের মধ্যমণি লোকদুটির দিকে তাকিয়ে আছে। যারা এই মুহূর্তে নিজেদের পিস্তল ঠিক জায়গামতো আছে কি-না দেখে নিচ্ছিল। সেই সাথে চোখ দিয়ে আশেপাশের প্রতিটা দূরত্ব মেপে নেয়ার চেষ্টা করছিল।
হাল মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে প্রথমে সে যতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল জুডিথ-এর কথায় সেটা অনেকটাই উবে গিয়েছে। এখন সে দোটানার মধ্যে পড়ে গিয়েছে। পরামর্শের আশায় অ্যাবোলির দিকে তাকাল সে।
“তাদেরকে যুদ্ধ করতে দাও, গান্ডওয়েন”, অ্যাবোলি বলতে থাকে। মি. পেট যেহেতু তার আত্মসম্মান ফিরে পাওয়ার লড়াই করতে চাচ্ছে, তাকে তা করতে দিন। বিষ ছড়িয়ে পড়ার আগে ক্ষতটা কেটে পরিষ্কার করে ফেলাটা অনেক ভাল। নয়ত এই বিষ অন্যান্য নাবিকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে অনেক ক্ষতি করে ফেলবে। ডেনিয়েল এরই মধ্যে একজন ওলন্দাজ সৈন্যকে আধামরা অবস্থায় বাঁচিয়েছে, যাকে আমাদের দুজন নাবিক ইচ্ছেমতো পেটাচ্ছিল।
“কিন্তু যদি ট্রোম্প মি. পেটকে হত্যা করে তখন কী হবে?” তখন কী ব্যাপারটা আরও খারাপ হবে না? আমাদের লোকেরা কী সেটা মেনে নিবে?
অ্যাবোলি কাঁধ ঝাঁকায়। “তোমার কি মনে হয় ব্যাপারটা নিয়ে তারা মাথা। ঘামাবে? পেট একজন ইংরেজ হতে পারে বটে কিন্তু সে আমাদের জাহাজের কোনো নাবিক নয়। কেউ তার জন্য কাঁদবে না। ওদেরকে যুদ্ধ করতে দাও।”
হাল অ্যাবোলির কথাগুলো ভেবে দেখল; যুক্তিগুলো মেনে নেয়ার মতোই। একটা অমীমাংসিত ব্যাপার-এর বিষ ছড়িয়ে পড়ার চাইতে সামনা সামনি যুদ্ধ হয়ে ব্যাপারটা মীমাংসা হয়ে যাওয়া ভাল। তাই মি. পেট-এর উচিত ট্রোম্পকে সামনা সামনি প্রতিহত করা।
ওলন্দাজ লোকটা কোনোরকম বিশৃঙ্খলা না করেই ব্যাপারটা মীমাংসা করতে চেয়েছিল।
“আমার নিশ্চয়ই এরকম প্রতিপক্ষের বিপক্ষে যুদ্ধ করা ঠিক হবে না যার জেতার কোনো সম্ভাবনাই নেই?” সে এই কথাটা অনেকবার বলেছে। কিন্তু অনেকবার বলার পর যখন দেখেছে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করাটা ওর কাপুরুষতা হিসেবেই দেখছে সবাই, তখন সেও এটা মেনে নিয়েছে।
ট্রোম্পকে অবাক করে দিয়ে অস্ত্র পছন্দের ভারটা তার ওপরই ছেড়ে দেয় পেট। “আমার পিস্তল হলেই চলবে।” ট্রাম্প জানালো।
“আমি তোমার সিদ্ধান্ত নেয়া দেখে অবাক হয়েছি।” অবাক হয়ে বলল হাল। “আমি তোমার তলোয়ার যুদ্ধ দেখেছি। ওটাতে তুমি বেশ ভাল। কিন্তু যেহেতু তুমি বন্দুক বেছে নিয়েছ সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা তোমার জন্য একটু কঠিন হয়ে গেল।”
“ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি জানি যে আমি তলোয়ার যুদ্ধে বেশ ভাল। সেক্ষেত্রে একটা সমস্যা আছে। আমি যদি তলোয়ার নিয়ে সামনা সামনি যুদ্ধ করি তবে মাথা মোটা পেটকে হত্যা না করে থাকাটা আমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু অস্ত্র হিসেবে পিস্তল খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয়। সমতল ভূমিতে যে কোনো দূরত্বে পিস্তল দিয়ে লক্ষ্যভেদ করা তুলনামূলক সহজ। কিন্তু সাগরের ওপর দোদুল্যমান জাহাজে লক্ষ্যবস্তুর খুব কাছ থেকে গুলি করে টার্গেটে লাগাতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। যদি পেট আমাকে হত্যা করেই ফেলে তবে অবশ্যই মানতে হবে যে ঈশ্বর ওর পক্ষে ছিল। কে জানে, আমার সেসব ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ নিয়ে হয়তো বা তিনি মোটেই সন্তুষ্ট নন।”
হাল হাসতে লাগল। সমস্ত বদমায়েশী কাণ্ডকারখানার পরও হাল-এর কাছে ট্রোম্প ঠাণ্ডা, পাণ্ডুবর্ণ ও রক্তহীন পেট-এর চাইতে অধিক পছন্দের মানুষ। তবে পেট-এর অনুভূতি যেরূপই হোক না কেন তাকে অন্তত কাপুরুষ বলা যায় না। পিস্তল হাতে ডেক-এর ওপর যেভাবে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে তাতেই বোঝা যায় যে তার তেজ বা সংকল্পে কোনো ভীরুতা নেই।
ক্যাপ্টেন ট্রাম্প-এর নিজের লোকেরা স্টারবোর্ড-এর রেলিং-এর পাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গোড়ালিতে শেকল পরানো আছে। ট্রোম্প তার নিজের লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল যে, “সে যদি এই ইংরেজটার খুলিকে ফুটো করতে পারে তবে সে তাদের হারানো সম্মান ফিরিয়ে আনতে পারবে। এই কথা শোনার পর ট্রোম্প-এর কিছু লোক চিৎকার করে উঠে, বাকিরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
“এই লোক তো এখনই ঘামছে!” র্যালফ বিগ নামে একজন অভিজ্ঞ সৈনিক ট্রোম্পকে উদ্দেশ্য করে বিদ্রূপ করে উঠে।
“আরে তাই তো! ওর শরীর ঘামে ভিজে একদম একাকার হয়ে গিয়েছে।” পাশ থেকে আরেক নাবিক বলে উঠে। এরপর সবাই মিলে হাসতে থাকে একযোগে।
“কিন্তু মি. পেট-এর দিকে তাকিয়ে দেখ, আরেকজন নাবিক বলল। “একফোঁটা ঘামও নেই। বাধ দেয়া পুকুরের মতই শান্তশিষ্ট।”
প্রতিযোগী দুইজন কেবল একটাই জামা পরে আছে। তাদের পায়ে বা মাথায় অন্যকোনো কাপড় নেই। যেখানে সূর্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য জাহাজের প্রায় সবাই মাথায় কোনো না কোনো কাপড় পরে আছে। হাল তার মাথা থেকে বড় ছাউনিওয়ালা টুপিটা খুলে হাতের রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে থাকে। এমনকি আফ্রিকার গরমের ভেতর বেড়ে ওঠা জুডিথও ঘামছিল প্রচণ্ডভাবে।
“আসলেই অনেক গরম পড়েছে। আর এই কারণেই ট্রোম্প ঘামছে, ভয়ের কারণে নয়।” হাল বলে উঠল।
আর ওদিকে ট্রাম্প ভেবে পাচ্ছিল না যে মি. পেট-এর মতো একজন ব্যবসায়ী মানুষ কিভাবে অস্ত্র পছন্দের ভার তার ওপর ছেড়ে দিতে পারল! এবং এখনও পর্যন্ত এতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে কিভাবে লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার নখের ময়লা পরিষ্কার করছে যেখানে ট্রোম্প করার মতো কিছুই পাচ্ছে না।
“তোমরা কী তৈরি?” বিগ ডেনিয়েল জিজ্ঞেস করল। সে ডেক থেকে ছয় ফিট দুরে প্রধান মাস্তুলের রশি ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
দুজন প্রতিদ্বন্দ্বীই তাদের জায়গামত দাঁড়িয়েছে।
“আমি ফায়ার শব্দটা উচ্চারণ করার আগ পর্যন্ত তোমরা কোনো গুলি ছুড়বে না”, ডেনিয়েল বলতে থাকে। তারপর তোমরা তোমাদের ইচ্ছেমত যখন খুশি গুলি ছুড়বে। যেই মুহূর্তে কেউ একজন গুরুত্বর আহত হবে, গুলি করতে অক্ষম হয়ে পড়বে, তখন এই খেলা বন্ধ করতে হবে। বুঝতে পেরেছ তোমরা?
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমাদেরকে এবার শুরু করতে দিন।” ট্রোম্প জবাব দিল। পেট শুধু তার মাথাটা একটু নাড়াল।
হাল উঠে দাঁড়িয়ে জুডিথ-এর সামনে চলে আসলো। কারো পিস্তল থেকে ছুটে আসা গুলি কোন দিকে যাবে বলা তো যায়না। হয়ত তারা নিশানা ঠিক করেই গুলি ছুড়বে, তারপরও হাল কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চায় না।
সাগরের মতো করেই সময় বয়ে যেতে লাগল। এরই মাঝে আশেপাশে কেউ একজন শব্দ করে বায়ু ছাড়ল-সশব্দে হেসে উঠল সবাই। দুর্গন্ধটা পুরোপুরি মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করিয়ে রাখল বিগ ডেনিয়েল। রঙ্গমঞ্চে প্রস্তুত দুজনই তাদের হাত সামনে টানটান করে রেখে পিস্তল ধরে আছে। ট্রাম্প-এর হাতের পিস্তলটা ইতোমধ্যেই কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।
“ফায়ার”, বিগ ডেনিয়েল তীব্র গর্জন করে উঠে। কয়েক সেকেন্ড পর ট্রোম্প-এর পিস্তল থেকে এক ঝলক আগুন এবং ধোঁয়া পেট-এর দিকে ধেয়ে গেল। পেট-এর বাম কাঁধটা ঝাঁকুনি খেয়ে পেছনে সরে আসলো। কিন্তু তার পা স্থির হয়ে আছে এখনো। ভিড়ের মাঝ থেকে একটা গুঞ্জন ধ্বনি শোনা গেল। পেট-এর শার্টে রক্তের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। হাল ভাবল যে দুটো পিস্তল থেকেই হয়ত গুলি ছোঁড়া হয়েছে, কিন্তু পেট তার গুলিটা ট্রোম্প-এর গায়ে লাগাতে পারেনি। কিন্তু পরমুহূর্তেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। পেট এখন পর্যন্ত গুলিই ছোড়েনি। সে এখনও একইরকমভাবে পিস্তলটা ধরে রেখেছে।
পেট তার ক্ষতস্থানের ব্যথা খুব একটা অনুভব করতে পারছিল না। কারণ সে তার সুযোগের অপেক্ষায় বসে ছিল। তার লক্ষ্যবস্তুর নিশানা ঠিক করছিল। এতটুকু দূরত্ব থেকে কখনোই তার লক্ষ্যবস্তু ব্যর্থ হয়নি। তার সমস্ত মনোযোগ তার হাতে ধরা পিস্তল এবং তার সামনে দাঁড়ানো ট্রোম্প-এর দিকে যে কিনা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ট্রোম্প বুঝতে পেরেছে যে সে বোকার মতো কাজ করেছে যেটার ফলাফল তাকে এখন ভোগ করতে হবে। এমনকি তার আশেপাশে যে সবাই পিনপতন নীরবতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এটাও সে খেয়াল করছে না।
যখন পেট ট্রিগার-এ চাপ দিল তার পরপরই ট্রাম্প-এর বাম কাঁধ থেকে অল্প একটু মাংস ছিটকে পড়তে দেখা গেল। সেই সাথে পিছিয়ে পড়ল ট্রোম্প।
“জেসাস ক্রিস্ট”, সে বিড়বিড় করে বলে উঠে।
ক্রুদ্ধ চোখে নিজের পিস্তল-এর দিকে তাকিয়ে ছিল পেট যেন এটা তার সাথে বেইমানী করেছে।
“তলোয়ার হলেই ভাল হত লগওয়ার্ড নামে একজন নাবিক চিৎকার দিয়ে উঠে”, যদিও যুদ্ধের ফলাফলে হাল-এর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। যদিও হাল জানে যে একটা সাধারণ দাগই একজন মানুষকে হত্যার জন্য যথেষ্ট-যদি সেটাতে পচন ধরে। যদি এরকম কিছু ঘটেও যায়, তবে তখন সেটার ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এখন ব্যাপারটা নিয়ে না ভাবলেও চলবে।
“ইটস ওভার,” বিগ ডেনিয়েল বলে উঠে। দুজনই একে অপরের দিকে তাকিয়ে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এটা পরিষ্কার যে দুজনের কেউই মারাত্মকভাবে আহত হয়নি। যদিও তাদেরকে দেখে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে তারা একজন আরেকজনকে বেঁচে থাকতে দেখে স্বস্তি পেয়েছে নাকি আরেকবার চেষ্টা চালানোর ইচ্ছে পোেষণ করছে।
“আপনি কি সম্ভষ্ট, মি. পেট?” ট্রোম্প জিজ্ঞেস করল। যদিও সে জিজ্ঞেস করার সময় ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল।
পেট তার পিস্তলটা ডেনিয়েল-এর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি সন্তুষ্ট, ট্রাম্প।” কিন্তু তার শান্ত, অনুভূতিহীন চেহারা দেখে বোঝা গেল না যে তার মস্তিষ্কে কী খেলা করছে।
“অ্যাবোলি, আমার কেবিনে যাও। ওখান থেকে ফ্রেঞ্চ ব্রান্ডি খুঁজে বের করে নিয়ে এসো”, হাল অ্যাবোলির উদ্দেশ্যে বলে।
“আমরা কী আজকের ঘটনাটা উদ্যাপন করতে যাচ্ছি ক্যাপ্টেন?” উইল স্ট্যানলি জিজ্ঞেস করে উঠল।
“গাধা! লোকদুটোর ক্ষতস্থান ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য আনা হচ্ছে ওটা,” নেড টেইলর জবাব দিল।
“আমি সেই ব্রান্ডিতে হিসি করে দিলে অনেকটা ব্রান্ডি বেঁচে যাবে,” অ্যাবোলি এত জোরে বলল যে কথাটা সবার কানেই গেল। তার বিশ্বাস যে মানুষের মূত্র ক্ষতস্থানের ইনফেকশান রোধ করার জন্য খুবই কার্যকরী মহৌষধ-অ্যাবোলির এই বিশ্বাস সম্পর্কে জাহাজের সমস্ত নাবিকই জানে। এবং তাদের কেউ কেউ এই ব্যাপারটা মেনে নিতে বাধ্যও হয়েছে-ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কারণেই।
বাউ-এর নাবিকদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল হাল। তার মনে হলো, এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। যদিও কিছুটা রক্তপাত হয়েছে কিন্তু কেউ মারা যায় নি।”
“এটা শেষ হওয়ায় আমিও খুব খুশি হয়েছি,” জুডিথ তার দৃঢ়, শান্ত কণ্ঠে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠল। “পুরুষ লোকগুলোর গৌরব নিয়ে কি আর বলব।”
হাল-এর চোখ জুডিথ-এর স্নিগ্ধ কোমল চেহারা, মায়াময় চোখ, এবং বাঁকানো ঠোঁটের ওপর ঘুরতে থাকে।
“ক্যাথলিকদের মতে গর্ব হচ্ছে এক ধরনের পাপ”, হাল বলতে থাকে। কিন্তু আমি সেজন্য মি. পেটকে দোষারোপ করছি না। আমি জানি আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বেঁচে থাকাটা পশুর সমান। এইটুকু বলেই হঠাৎ করে নিশ্চুপ হয়ে গেল সে, কারণ ‘গাল অব মুরেতে সেইসব দিনের কথা তার মনে পড়ে যাচ্ছে যখন তাকে দাসদের মতো করে জীবন যাপন করতে হত। এরপর সে জুডিথকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, “মাঝে মাঝে এই গর্বটুকুই আমাদের শেষ সম্বল হয়।”
হাল ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রধান মাস্তুলের কাছে দাঁড়ানো মি. পেট-এর কাছে যেতে থাকে। পেট তার গায়ের জামা খুলছে ক্ষতটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য।
“শুধু একটু আচড় লেগেছে, ক্যাপ্টেন,” সে বলল।
হাল মাথা নাড়ায়। “আপনারা দুজনেই খুব ভাগ্যবান। আপনারা দুজন যেভাবে স্থির হাতে গুলি চালিয়েছেন তা দেখে আমি খুবই খুশি হয়েছি। আমি আমার নাবিকদের কাছ থেকেও হয়ত এর চাইতে বেশি কিছু প্রত্যাশা করতাম না। তবে তারা অনেক যুদ্ধ দেখেছে। আপনি সেরকম কিছু দেখেন নি।”
“চুয়াল্লিশ সালে নেসবি-তে চেরিটন-এর যুদ্ধে আমার বাবা যুদ্ধ করেছেন।” পেট জবাব দিল। আশেপাশে যারা এই যুদ্ধের নাম শুনতে পেল তারা সাথে সাথে রাগে দুঃখে আর হতাশায় ফেটে পড়ল। কারণ তাদের কারও না কারও মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব এই যুদ্ধে মারা গিয়েছেন। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে বন্দুক চালনা করতে হয়। যখন ওলন্দাজটা পিস্তল বেছে নেয় তখন আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হয়নি। তলোয়ার বেছে নিলে আমি হয়ত খুব বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারতাম না।”
হাল হেসে জবাব দেয়, তাহলে বলা যায় আপনার ভাগ্য এখনো আপনার পক্ষে আছে, মি. পেট।” এরপর হাল ট্রোম্প-এর দিকে তাকিয়ে দেখে সে বিগ ডেনিয়েলকে দিয়ে তার ক্ষত পরীক্ষা করাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, আপনার ক্ষতটাতে ফ্রেঞ্চ ব্রান্ডি দিলে অনেক উপকারে আসবে। তবে আপনি অ্যাবোলির দেয়া ওষুধটিও কাজে লাগাতে পারেন।”
“আমি কখনো সেটা ব্যবহার করিনি ক্যাপ্টেন কার্টনি, মি. পেট অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলে। “কার্যকরী ওষুধ হয়তো বা, আমি জানি না।”
“গুড”, হাল মাথা নাড়ায়। তাহলে আপনি থাকুন, আমি এই রাসকেল গুলোকে কাজে পাঠিয়ে দিয়ে আসি। বাতাস আবার এদিকে আসছে, মি. পেট”, পাল-এর ওপর দিয়ে আকাশের রঙ-এর বদলে যাওয়া দেখতে দেখতে বলে হাল। “আরও উপরে নোঙর করুন”, “মি. টেইলার। মি, মুন, মি. স্ট্যানলি! আপনারা বদমাশগুলোকে কাজে পাঠান, পাল ঠিক করতে বলুন।” কয়েক মুহূর্তের মধ্যে গোল্ডেন বাউ ব্যস্ত ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়ে যায়। অ্যামাডোডারাও কাজে নেমে পড়ে। তরঙ্গাকারে পাল তুলে দেয়া হয়। জাহাজটাও মৃদুতালে দুলতে থাকে।
অ্যাবোলি মি. পেট-এর ক্ষতটাতে ফ্রেঞ্চ ব্যাক্তি ঢেলে দিচ্ছে। আর মি. পেট হাল-এর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর ভাবছে সেই দৈববাণী তার জন্য কী পরিকল্পনা করে রেখেছে।
ক্যাপ্টেন ট্রাম্পকে হাতের নাগালে পেয়েও মারতে পারেনি সে; এত কাছ থেকে ঠিক কী কারণে তার লক্ষ্যবস্তু ব্যর্থ হয়েছে, সেটাই বুঝে উঠতে পারছে নাপেট। যদিও, তার মন বলছে, পুরো ব্যাপারটায় সেই অদৃশ্য সাধুর হাত রয়েছে।
পেট-এর দুইজন শিকার এখনো বেঁচে আছে, যাদেরকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছিল সে। এর আগে তার সাথে কখনোই এ ধরনের কিছু ঘটেনি। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো না কোনো কারণ আছে। সে নিশ্চিত-খুব শীঘ্রই এর কারণ খুঁজে বের করে ফেলতে পারবে সে।
*
মি. পেট এবং ট্রোম্প-এর দ্বন্দ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দুই দিন পার হয়েছে। সমস্ত শত্রুতাকে নিঃশেষ করে দিয়ে বাউ আনন্দচিত্তে, স্নিগ্ধ বাতাসে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করেছে। তাই ট্রোম্প-এর মনে হচ্ছে এই সময়টাই হাল-এর সামনে গিয়ে কথা বলার জন্য উপযুক্ত সময়।
“আমি কী আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি, ক্যাপ্টেন?”
“একটু নয়, পুরোপুরিই বলুন।” হাল জবাব দেয়। সে এই জাহাজের মালিক। তার পেছনে সূর্য এবং সামনে বাতাস রয়েছে। তার ভালবাসার নারী তার পাশেই আছে। তার মনে হচ্ছে সমস্ত পৃথিবীটাই তার কাছে আছে।
“আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে আমি এবং আমার নাবিকদের আপনার জাহাজে যোগদানের ব্যাপারে বলেছিলাম। অবশ্য অন্য কোনো ব্যাপারে ব্যস্ত থাকার কারণে আপনি এদিকে মন দেয়ার সময়ই পাননি।” ট্রোম্প একটা শুষ্ক হাসি দিয়ে রেলিং-এ দাঁড়ানো পেটের দিকে তাকায়। “তাই নয় কি, মি. পেট?” এরপর আবার হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার কী এ ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখার সময় হবে?”
হাল হেসে ফেলল। “শয়তানও অস্বীকার করতে পারবে না যে তুমি তার চেয়ে কোনো অংশে কম। প্রথমে তুমি আমাদেরকে হত্যা করতে চেয়েছিলে। আর এখন তুমি আমাদের সাথেই যোগ দিতে চাচ্ছ।”
“আমি কখনোই আপনাদেরকে হত্যা করতে চাইনি।” ট্রোম্প বাধা দিয়ে বলল। “এই জাহাজটা আর তার খাবারগুলোর দিকেই শুধু চোখ ছিল আমার।”
অ্যাবোলি এগিয়ে এসে আলোচনায় যোগ দেয়। “আর সেটার জন্য তাকে ঠিক দোষারোপও করা যায় না।”
“আমাকে আপনার নাবিক হিসেবে যোগদানের সুযোগ দিন।” ট্রোম্প বলতে থাকে। “আমি একজন অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন। কিন্তু আপনি এই জাহাজের মালিক। আমি জানি অ্যাবোলি আপনার ফাস্ট মেট, তো আমাকে আপনার সেকেন্ড মেট হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিন। আমি এখানকার জলরাশি সম্পর্কে ভাল করেই জানি। উত্তরে বহুদূর পর্যন্ত আমার চেনা-জানা আছে এবং দক্ষিণের কেপ-এর চারপাশটাও আমার পরিচিত। এই পথ দিয়ে আমি বহুবছর যাবত ব্যবসায়িক যোগাযোগ স্থাপন করেছি। আমার অনেক বন্ধুও আছে ক্যাপ্টেন।”
“সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক”, হাল বলতে থাকে। কারণ তোমার যে পরিমাণ শত্রু আছে বলে আমার মনে হচ্ছে, সে পরিমাণ শত্রুর হাত থেকে বেঁচে থাকতে হলে অনেক বন্ধু থাকতেই হবে।”
ট্রোম্প ভাবগম্ভীর দৃষ্টিতে হাল-এর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল যে সে কেন এই কথা বলছে। এরপর আবার বলতে শুরু করল, “আপনি সবসময় নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য স্থির রেখে চলতে পছন্দ করেন, ক্যাপ্টেন কার্টনি। সেই সাথে সবসময় সময়ের সদ ব্যবহার করেন। আপনার মতো একজন মানুষের সাথে কাজ করতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব।”
অ্যাবোলি আর নেড টেইলর জাহাজের হুইলের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিটি কথা শুনছিল এবং তাদের ক্যাপ্টেন-এর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। ট্রোম্প-এর কথা শুনে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যাবে। এখন ক্যাপ্টেন কার্টনি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায় সেটাই হচ্ছে দেখার বিষয়।
হাল কিছু একটা চিন্তা করতে করতে ট্রাম্প-এর কথার উত্তরে কী বলবে সেটা ভুলেই গিয়েছিল।
এরপর জুডিথ কথা বলে সেই নীরবতা ভেঙে দেয়। “হেনরি, তুমি একবার বলেছিলে যে তোমার নাবিকের ঘাটতি আছে তাই না।”
“হ্যাঁ বলেছিলাম।”
“তাহলে কেন তুমি এরকম একজন অভিজ্ঞ লোককে নাবিক হিসেবে স্বাগত জানাচ্ছ না, সে জিজ্ঞেস করে।
ট্রোম্প জুডিথ-এর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। যার জীবন এক সময় সে বিপন্ন করতে চেয়েছিল এখন সে-ই তার পক্ষ হয়ে কথা বলছে।
“তুমি সত্যিই অবিশ্বাস্য, মাই ডিয়ার”, হাল জুডিথকে উদ্দেশ্য করে বলে।
“আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি।” জুডিথ ট্রোম্প-এর দিক থেকে হাল-এর দিকে তাকিয়ে আবারো বলতে থাকে। এই লোকটি এবং তার নাবিকদের জীবন রক্ষা করা যদি তোমার সাধ্যের মধ্যে হয়ে থাকে তবে অবশ্যই তোমার তা করা উচিত।”
“ধন্যবাদ ম্যাডাম,” ট্রোম্প জুডিথকে উদ্দেশ্য করে বলল। জুডিথ নীরবে মাথা নেড়ে তার কৃতজ্ঞতার জবাব দেয়।
“কিন্তু আমি কিভাবে নিশ্চিত হব যে তুমি প্রথম সুযোগেই আবার জাহাজটা দখল করতে চাইবে না।” হাল জিজ্ঞেস করে। “তোমাকে দেখে মনে হয়েছে কর্তৃপক্ষের প্রতি তোমার শ্রদ্ধাবোধ কম। তাহলে তুমি কীভাবে আমার নাবিক হিসেবে কাজ করবে?”
ট্রোম্প হেসে ফেলে, যে হাসি তার চোখে প্রতিফলিত হয়। “আমি আমার জীবনের জন্য আপনার কাছে ঋণী। আপনি চাইলে আমাদের প্রথম সাক্ষাতের সময়েই আমাকে হাঙরের মুখে নিক্ষেপ করতে পারতেন।” এরপর সে হাল এর চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে। “সত্যি বলতে কী আপনার সাথে জাহাজ চালাতে পারলে নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে করব।”
ট্রোম্প-এর কথাগুলো হাল অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনল। বাস্তবতা হচ্ছে, ট্রোম্প যদি তার দেয়া কথা নাও রাখে তবুও বাউ-এর নাবিকদের কাছ থেকে জাহাজ কেড়ে নেয়া এই ওলন্দাজ লোকটার পক্ষে অসম্ভব। এছাড়াও তার জাহাজে এখন নাবিকের সংকট রয়েছে। তাই এমন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক নিলে খুব একটা মন্দ হয় না।
“আপনি কী মনে করেন মি. পেট? মি. ট্রাম্প এবং তার নাবিকদের কী আমার জাহাজে নাবিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া উচিত?”
পেট শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “এটা আমার মতামত দেয়ার বিষয় নয়। ক্যাপ্টেন।” এরপর সে চোখের জোড়া উপরের দিকে তুলে বলে। “কিন্তু আপনাদের নাবিকদের মধ্যে অনেক কুসংস্কারও রয়েছে। আপনি যদি এরকম ভাগ্যবান ব্যক্তিকে নিয়োগ দেন তাহলে সেটা হয়ত জাহাজের জন্য ভাল বয়ে আনতে পারে।”
“ভাগ্যবান? কিন্তু কীভাবে মি. পেট?” হাল জিজ্ঞেস করে।
“অবশ্যই, ভাগ্যবান”, পেট তার কথায় জোর দিয়ে বলে। প্রথমত, সে আমাকে বিশ গজ দূর থেকে আঘাত করেছিল। আমরা দুজনেই চলন্ত ডেক এর ওপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। দ্বিতীয়ত, আমার গুলিটা এভাবে ব্যর্থ হওয়ার কথা। ছিল না। আমি সাধারণত এ ধরনের ব্যর্থতায় অভ্যস্ত নই।”
“একজন ব্যবসায়ীর তুলনায় কথাগুলো বেশ অদ্ভুত, মি. পেট, হাল পেটকে উদ্দেশ্য করে বলল।
“আমি তো আপনাদেরকে বলেছিলামই যে, আমার বাবা আমাকে বন্দুক চালনা শিখয়েছিলেন। তিনি খুব ভাল প্রশিক্ষক ছিলেন এবং আমাকে বেশ ভালভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আমাকে ব্যর্থ হতে দেখলে তিনি নিশ্চয়ই খুশি হতেন না।”
“ও আচ্ছা, হাল পেট-এর দিকে তাকিয়ে বলল। এই লোকটার মাঝে এমন কিছু আছে যেটার কারণে হাল খুব বিরক্ত হচ্ছিল। শুধু যে সে-ই খুব বিরক্ত হচ্ছে তাই না। সে তার নাবিকদেরও পেট-এর ব্যাপারে আলোচনা। করতে শুনেছে। গুলি করার সময়ও সে ইচ্ছেকৃতভাবে সময় নিয়েছিল প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। যুদ্ধবিদ্যা সম্পর্কে ধারণা না থাকা একজন ব্যবসায়ীর বন্দুকের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় এইরকম স্থিরচিত্ত মনোভাব একদমই মানায় না। স্বাভাবিকভাবেই হাল চায় না যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক মিনিটও লোকটা এই জাহাজে থাকুক।
“আচ্ছা ঠিক আছে মি. ট্রোম্প, আমি প্রস্তাবে রাজি,” হাল বলতে থাকে। “আমি তোমাকে আমার সেকেন্ড মেট হিসেবে নিয়োগ দিতে রাজি আছি। আমি খুব খুশি হব যদি তুমি তোমার লোকদের একটা তালিকা তৈরি করে তাদের বিশেষ দক্ষতা সম্পর্কে লিখে আমাকে দাও।”
ট্রোম্প-এর চেহারায় হাসি ফুটে ওঠে। “আপনি আপনার সিদ্বান্তের জন্য অনুতাপ করবেন না। ক্যাপ্টেন কার্টনি।”
হালও হেসে ফেলে, “তবে তার কথায় কোনো কৌতুক ছিল না। তুমি আশা করতে পার, আমি সেটা করব না। আমি তোমার ওপর বিশ্বাস রেখেছি। তবে তুমি যদি আমার বিশ্বাস ভঙ্গ কর তবে মনে রেখ সেটার জন্য তোমাকে অনুতাপ করতে হবে।”
“আমার নজর সবসময় তোমার ওপর থাকবে, ডাচম্যান,” অ্যাবোলি বিড়বিড় করে বলতে থাকে।
“গুড, তাহলে অন্তত আপনি দুয়েকটা জিনিস শিখতে পারবেন।” ট্রোম্প অনেকটা বিদ্রুপাত্মক স্বরে বলল। এরপর যেতে যেতে অ্যাবোলির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল।
“সাবধানে কথা বল মি. ট্রাম্প,” হাল সতর্ক করে দিল সাথে-সাথে। “একটা ঝামেলা মাত্র শেষ হয়েছে। আমি চাচ্ছি না যে তোমার কারণে আরেকটা ঝামেলা হোক।”
“হা-হা ক্যাপ্টেন, ট্রোম্প দ্রুত জবাব দিল।
.
হাল-এর জন্য স্বস্তির ব্যাপার এই যে মি. ট্রোম্প নিজের যোগ্যতা বেশ ভালভাবেই প্রমাণ করছে। তারা দুজনে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে চার্ট দেখছে। ওলন্দাজ লোকটি উপকূল সম্পর্কে তার সমস্ত অভিজ্ঞতা হাল-এর সাথে শেয়ার করেছে যেন তাদের দুজনের একত্রিত জ্ঞান ভবিষ্যতের জন্য অমূল্য কিছু বয়ে আনতে পারে।
তবে খুব শীঘ্রই ট্রোম্পকে এলিফ্যান্ট লেগুন এবং এর গুপ্তধন সম্পর্কে বলার ইচ্ছে নেই হাল-এর। কিন্তু তারা যে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে, সেটা তাকে না বললেও সূর্যের দিকে একবার তাকিয়েই সে ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে। সে জাঞ্জিবার এবং কেপ-এর মাঝে নিরাপদ কিছু জায়গা চিনে যেখানে তারা নিরাপদে নোঙর ফেলতে পারবে। সেখানে ওমানি আরব সৈন্য বা মাদাগাস্কান দস্যুদের আক্রমণের কোনো ভয় থাকবে না।
ডেফট-এর নাবিকেরাও বেশ কাজ করছে। এমনকি নেড টেইলর-এর মতো অভিজ্ঞ নাবিকও বিরক্তির সাথে খেয়াল করল যে এই লোকগুলো আসলেই অনেক বেশি কর্মঠ। তারা সারা দিন কাজ করে; প্রধান মাস্তুলের ওপর উঠা-নামা করে, এরপর জাহাজ-এর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়ায় কাজের খোঁজে, এরপর আবার নিচের ডেকে চলে যায় নতুন কাজ করার জন্য। যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের শরীর বেয়ে ঘামের পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে, তাদের শরীর সোজা করেই দাঁড় করাতে কষ্ট হয়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা থামে না।
“এদেরকে দিয়ে হবে, মি. টেইলর,” হাল বেশ সন্তুষ্ট হয়ে বলে। “আমাদের লোকেরা কী ওদের ভালভাবে গ্রহণ করেছে? সেটাই এখন দেখার বিষয়।”
“ওদের নিয়ে অবশ্য কিছুটা হাসি ঠাট্টার ব্যাপার ঘটে। তবে সেটাও একদিক থেকে ভাল। তাই না ক্যাপ্টেন।”
কথার মধ্যে যদিও উৎফুল্লতা ছিল কিন্তু হাল-এর কেন জানি মনে হাল-এমন কিছু একটা আছে যেটা নেড টেইলর তাকে বলতে চাচ্ছে না।
“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা নিয়ে সমস্যায় আছ। সেটা কী আমাকে বল।”
“ওহ, তেমন কিছু না। ক্যাপ্টেন।”
“সেটা আমি বিচার করব। আমাকে বল।”
টেইলর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এরপর লম্বা টান দিয়ে পাইপ থেকে বুকভর্তি করে তামাকের ধোয়া টেনে নেয়। এরপর আস্তে আস্তে সেই ধোয়া ছাড়তে থাকে। হাল তাকে ভাবার সময় দেয়। অবশেষে নেড টেইলর বলতে থাকে, “ব্যাপারটা মি. পেটকে নিয়ে। আমি তাকে অসম্মান করছি না। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে নাবিকরা মি. পেটকে মেনে নিতে পারছে না। একদমই না।”
হালকে তার পিতা এমনভাবে বড় করেছেন যেন সে তার লোকদের ভাল করে দেখাশোনা করতে পারে। “ধরো, তুমি ঝড়ো বাতাসের সময় তোমার লোকদের টপগ্যালান্ট-এ উঠতে বললে কিংবা কামানের গুলির মাঝে শত্রুর জাহাজ আক্রমণ করতে বললে”, স্যার ফ্রান্সিস কার্টনি সবসময় এভাবে বলতেন, “যদি তোমার প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা না থাকে, তাহলেও তারা এই কাজগুলো করবে-কিন্তু তীব্র অনীহার সাথে। কিন্তু তুমি যদি তাদের পাশে থাকো, তাদের প্রয়োজন ঠিকমতো মেটাতে পারো, তাদের মতামতের গুরুত্ব দাও, তবে এই কাজগুলো করার সময় তারা একদম মন থেকেই করবে।”
অতএব, স্বাভাবিকভাবেই হাল টেইলার-এর কথাগুলোকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। “এমন বিশেষ কিছু কী আছে যেটা তারা পছন্দ করছে না?”
“প্রথমত তারা মনে করে যে পেট-এর মাথায় সমস্যা আছে। ডিনারের সময় বা লোকজনের সামনে থাকার সময় সে যথেষ্ট ভুদ্র থাকে, কারো সাথে কোনো কথা বলে না। কিন্তু সে যখন একা থাকে তখন সে আপন মনে বিড়বিড় করে, দেখে মনে হয়, সে অদৃশ্য কারও সাথে কথা বলছে। সেই অদৃশ্য কারো সাথে সৃষ্টিকর্তা, ফেরেশতা এই জাতীয় ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলে সে।”
“ক্রিশ্চয়ান ধর্মে অনুরাগী কারও এভাবে কথা বলাতে আমি অন্যায়ের কিছু দেখছি না।”
“হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন, সেটা হয়ত সত্য।” “কিন্তু মি. পেট-এর ব্যাপারটা সেরকম না। এটা একেবারেই অন্যরকম…” টেইলর যেন সঠিক শব্দটা খুঁজে পাচ্ছে না “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না,” টেইলর শুধু মন্তব্য করে। তবে তাকে ঠিক স্বাভাবিক বলা যায় না। বেশ অদ্ভুত বলতে পারেন।”
হাল কিছু একটা বলার জন্য মুখ খোলার চেষ্টা করে কিন্তু নেড তার কথা কেড়ে নিয়ে বলে। তারপর তাদের দুজনের সেই মারামারির ব্যাপারটাও স্বাভাবিক ছিল না। ট্রাম্প যখন তাকে গুলি করছিল সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেন সে কিছুই অনুভব করতে পারছে না। আবার সে যখন ট্রাম্পকে গুলি করছিল তার চেহারা একেবারেই অভিব্যক্তিহীন ছিল যেন কোনোকিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। সে যে একজন মানুষকে গুলি করতে যাচ্ছে এটা তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে কোনো ইঁদুর বা অন্য কোনো ঘৃণ্য প্রাণীকে গুলি করছে। আর যখন সে দেখল যে তার গুলি মিস হয়েছে…
“তাকে খুব হতাশ দেখাচ্ছিল…হ্যাঁ, ব্যাপারটা আমিও খেয়াল করেছি।” হাল বলতে শুরু করে। “আমি বুঝতে পারছি নাবিকরা তাকে পছন্দ না করার পেছনে কারণ আছে। আমিও লোকটার মাঝে অদ্ভুত কিছু একটা দেখেছি। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না বুঝতে পারছি যে ব্যাপারটা ঠিক কী, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি, এই আরকি।” হাল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল।
“তো…আমরা এরপর কোথায় যাচ্ছি, ক্যাপ্টেন?”
“জাঞ্জিবার। সমস্ত জায়গাটা ওমানি আরব লোকদের দ্বারা চালিত হয়। যাদের কিছু লোকের জাহাজ আমরা আনন্দের সাথে লাল সাগরে ডুবিয়েছি। তাই ওখানকার উপকূলে যাওয়ার পর পরিবেশটা আমাদের জন্য বন্ধুসুলভ নাও হতে পারে। কিন্তু তারপরও…”
হাল কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, “নেড, তুমি কী দয়া করে মি. অ্যাবোলি, মি. ট্রাম্প এবং মাস্টার ফিশারকে বলবে আজকে দুপুরে তারা যেন আমার কোয়ার্টারে এসে আমার সাথে দেখা করে। তুমিও সাথে থাকবে।”
যখন তারা সবাই একসাথে এলো, তখন জুডিথও সেখানে উপস্থিত ছিল। হাল বলতে শুরু করল, “ব্যাপারটা আমার নজরে এসেছে যে মি. পেট কোনো না কোনোভাবে নাবিকদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হোক সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে, হোক সেটা অনিচ্ছাকৃতভাবে। একারণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে জাঞ্জিবার-এ গিয়ে আমি মি. পেটকে সেখানকার মাননীয় রাষ্ট্রদূত-এর কাছে সমর্পণ করব, যেন তিনি সহজ রাস্তায় মি. পেটকে ইংল্যান্ড-এ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেন।এতে করে মি. পেট এরও সুবিধা হবে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরও লাভ হবে। সে যদি সুয়েজ-এর উত্তর দিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় যায় এবং সেখান থেকে লন্ডন-এ পৌঁছায়, তবে তার যাত্রা আরও দ্রুত হবে, এবং তাকে গোল্ডেন বাউ-এর সাথে কেপ-এ যেতে হবে না। আমি সবাইকে ডেকে এনেছি এই কারণে যে এতে কারও কোনো আপত্তি আছে কি-না। তাছাড়া মি. পেট চলে গেলে ট্রোম্প-এর সাথে তার চলমান তিক্ত সম্পর্কেরও অবসান হবে।”
“আমার দিক থেকে তাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। এটা আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি ক্যাপ্টেন, ট্রোম্প বলল।
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। তাছাড়া আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করেছি। পেটকে উদ্ধার করেছি। তাকে ভাল খাবার দিয়েছি। কিন্তু আমাদের এখন তাকে বাড়ি ফেরানোর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে হবে। যদিও আমার ইংল্যান্ড-এ পাঠানোর মতো অনেক চিঠিপত্র ছিল, কিন্তু সেসব থাক।”
“আমরা কী বাউকে জাঞ্জিবার-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছি?” অ্যাবোলি জিজ্ঞেস করে। সেখানে নিশ্চয়ই অনেকেই আছে যাদের জাহাজ আমরা ধ্বংস করেছি। তারা নিশ্চয়ই সেগুলোর সাক্ষী দেবে, আমাদের জাহাজের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।”
“আমিও সেটা নিয়ে ভেবেছি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাউকে জাঞ্জিবার এর উপকূল থেকে এক দিনের দূরত্বে রেখে নোঙর করব। এরপর ডেফট জাহাজটাকে উপকূলের কাছাকাছি নিয়ে যাব। ট্রোম্প, কিছু সময়ের জন্য হলেও তুমি তোমার নেতৃত্ব ফিরে পেতে পার। তুমি যদি মনে কর যে তোমার জাহাজকে আমরা বিপদের সম্মুখীন করতে যাচ্ছি তবে বলব যে এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। কারণ সেখানে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে তোমার জাহাজকে ইস্ট ইন্ডিস-এর পানিতে দেখেছে। তাছাড়া, আমরা তোমার জাহাজের নাম বদলে ফেলব। ডেফট-এর নাম রাখব ক্রিস্টিনা। কারণ, আমি জানি এই নাম তোমার অনেক পছন্দের।”
সমবেত সবাই হেসে উঠে। তারা জানে যে এটা সেই অ্যাডমিরাল-এর কন্যার নাম যার সাথে ট্রোম্প প্রথমে প্রণয় গড়ে তুলে পরে বেইমানি করে পালিয়ে আসে। সবার সাথে সাথে ট্রোম্পও হেসে উঠে। “যখন বাতাভিয়া ছেড়ে এসেছিলাম, তখন ভেবেছিলাম যে অবশেষে ক্রিস্টিনার কাছ থেকে পালাতে পেরেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, পুরোপুরি পারিনি।”
“বাউ-এর ভাল ভাল নাবিকেরা তোমার সাথে থাকবে,” হাল বলতে থাকে। “এর দুটো কারণ আছে। কারণ প্রথমত, এরা তোমার ওপর নজর রাখতে পারবে। দ্বিতীয়ত, আমি যখন উপকূলে থাকব সেখানে হয়ত আমি অস্ত্র নিয়ে যেতে পারব না। কিন্তু আমার প্রয়োজন হলে সময়মত যেন ওরা চলে আসতে পারে, সেই জন্যই তাদেরকে নেয়া। রাষ্ট্রদূত গ্রে হয়ত আমাকে একবার দেখলেই চিনতে পারবে। আর সে নিশ্চয়ই এখনো আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আছে।”
“তুমি তার সাথে প্রতারণা করেছিলে, গান্ডওয়েন, অ্যাবোলি বলতে থাকে। “যদি কোনো লোক আমার সাথে এরকম করত তবে আমিও তাকে ক্ষমা করতাম না।”
“আমি তার সাথে সরাসরি প্রতারণা করি নি।” হাল যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। “আমি ওর মাধ্যমে একটা আদেশপত্র নিয়েছিলাম-আরব সৈন্যদের সাথে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করার ব্যাপারে। আর সেকারণে আমি তাকে যথেষ্ট পরিমাণ টাকাও দিয়েছিলাম। তবে এটা আমি নিশ্চিত বলতে পারি যে আমি মুসলিমদের হয়ে কখনো ক্রিশ্চিয়ানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতাম না। আর আমি বিশ্বাস করি না যে সে ব্যাপারটা জানত না। আমি এ ব্যাপারেও নিশ্চিত যে আমার কাজের জন্য তাকে কখনোই দায়ী করা হয়নি। আর যদি করা হয়ও, তাহলে তার সম্পর্কে একটা কথা তোমাদের জানিয়ে দেই। কনসাল গ্রে হচ্ছে এমন একজন মানুষ যার কাছে টাকা-পয়সা হচ্ছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে আমি তার কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করব।”
অ্যাবোলিকে দেখে মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা এখনো তার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু সে কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে ছিল। সে জাহাজের অন্যান্য কর্মকর্তার সামনে কখনো হাল-এর কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন করতে চায় না। তারা যতই বিশ্বাসী এবং সিনিয়র কর্মকর্তা হোক না কেন।
পরিকল্পনা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হলো। জুডিথ এবং হালকে রেখে সবাই আস্তে আস্তে বের হয়ে গেল।
“আমি কী তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি?” জুডিথ জিজ্ঞেস করল।
“অবশ্যই, মাই লাভ”, হাল জবাব দেয়। এরপর সে জুডিথ-এর দিকে ভ্রু কুঁচকে অকিয়ে বলে, “তোমার কী শরীর ভাল না?”
সে হেসে হাল-এর কপালে হাত রাখে। “আমি ভাল আছি। কিন্তু আমার পেটে সন্তান। যতই দিন যাচ্ছে আমি আস্তে আস্তে দুর্বল এবং কাহিল হয়ে পড়ছি। আর কিছুদিন পর যখন সময় আসবে তখন হয়ত আমাকে তীব্র ব্যথার সম্মুখীন হতে হবে।”
“না, আমি সেটা হতে দিব না,” হাল জোর দিয়ে বলে উঠে।
জুডিথ হেসে ফেলে, “এমন অনেক কিছু আছে যেটা তোমার আদেশের বাইরে। এমনকি সেটা যদি তোমার জাহাজে ঘটে তবুও।” জুডিথ বলতে থাকে। “সন্তান জন্ম দেয়া হচ্ছে অত্যন্ত কঠিন এবং বেদনাদায়ক কাজ। এ কারণেই এটাকে বলা হয় লেবার। আমার মনে হয়, আমাকে সাহায্য করার জন্য জাহাজে আরেকজন নারী থাকলে ভাল হত। অন্তত যখন সময় আসবে তখন যেন আমরা উপকূলে গিয়ে একজন ধাত্রী খুঁজে বের করতে পারি।”
“আফ্রিকায় এমন কাউকে খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, ডালিং।”
“সেটা হত না যদি আমি বাড়িতে থাকতাম। সেখানে আমার বাড়ির সব মহিলা থাকত, চাকরবাকর থাকত। কিন্তু আমাদের এখন কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু ঔষধি গাছ এবং লতাপাতা আছে যেগুলো দিয়ে মিশ্রণ প্রস্তুত করে খেলে আমার কষ্ট অনেকটা লাঘব হবে। আমার মনে হয় জাঞ্জিবার-এ কোনো না কোনো কবিরাজ পাওয়া যাবে যার কাছে এসব পাওয়া যাবে।”
“অবশ্যই, আমি বুঝতে পেরেছি”, হাল মাথা নাড়ায়। এখন শুধু তুমি আমাকে সেগুলোর নাম বল। আমি যেখান থেকে পারি সেগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।”
“না হেনরী, মাই লাভ, তুমি পারবে না।” জুডিথ যদিও অনেক নমনীয় স্বরে বলে কিন্তু হাল বুঝতে পারছে জুডিথ তাকে বাধা দিচ্ছে। “তোমার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। তুমি একজন পুরুষমানুষ। আমি যদি তোমাকে বলি তুমি সবকিছু বুঝতে পারবে না। এছাড়া তুমি একজন ইংরেজ। জাঞ্জিবার এর সবাই অ্যারাবিক কিংবা সওহিলি ভাষায় কথা বলে। তুমি তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না।”
“কিন্তু তুমি জাঞ্জিবার-এর লোকদের কাছে নিষ্ঠুর জেনারেল নাজেত হিসেবে পরিচিত যে কি-না দুটো মুসলমান সৈন্য বাহিনীকে পরাজিত করেছে। জাঞ্জিবার-এর প্রত্যেকে তোমাকে ঘৃণা করে।”
“তারা জেনারেলকে ঘৃণা করে এটা সত্য, জুডিথ উত্তর দেয়। তারা মনে করে জেনারেল নাজেত হচ্ছে একটা দানব। শয়তানের বউ, যে কি-না মানুষরূপে পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু আমি যদি একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্র রমণী রূপে রাস্তায় বের হই, কবিরাজ-এর কাছে যাই তাহলে তারা কী আমাকে চিনতে পারবে? আমার মুখ ঢাকা থাকবে কাপড়ের নিচে। তারা হয়ত ভাববে আমি প্রতিদিনকার কাজকর্ম সারতে যাচ্ছি।” তখন কেউ কী আমার দিকে তাকিয়ে বলবে, “ওই দেখ জেনারেল নাজেত যাচ্ছে?”
হাল-একটা হাসি দিয়ে বলল, “খুব ভাল।” “আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমার কথা মেনে নিচ্ছি। জেনারেল নাজেত-এর যুক্তির কাছে আমি হেরে গেছি।” “আমরা একসাথেই যাব। কিন্তু এটুকুই প্রার্থনা আমরা যেন একত্রে ফিরতে পারি।”